৩০. এ তল্লাটে এ ইতিহাস এই প্রথম

এ তল্লাটে এ ইতিহাস এই প্রথম।

সায়েব ডাক্তার ডাকার ইতিহাস।

ভবতোষ মাস্টার, নিতাইচরণ আর নীলাম্বর বড়য্যের কুলমজানি পুতবৌ, এই তেরোস্পর্শের যোগে এ ইতিহাসের সৃষ্টি। খবর শুনে যে যেখানে ছিল সে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল, যে যে বয়সে ছিল সে সেই বয়সেই রয়ে গেল।

বাঁড়ুয্যের লক্ষ্মীছাড়া রণচণ্ডী বৌয়ের গুণপনা জানতে কারও বাকী ছিল না, শুধু ভেবে পেত না বৌকে ওরা এখনো ঠাই কেন দিচ্ছে। গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে কেন দিচ্ছে না!

বলাবলি করছে সবাই, ভেতরে কোনও রহস্য আছে…..বাপের এক মেয়ে তো! আর বড় মানুষ বাপ! নির্ঘাত বাপ কোন কড়ার করে বিয়ে দিয়েছে!… বৌকে বাপের বাড়ি খেদিয়ে দিলে বোধ করি সেই বামুন বদ্যির বিষয়সম্পত্তিগুলো নবা পাবে না। তা নয় তো, সমস্যা সমাধানের সব চেয়ে সোজা উপায়টা ত্যাগ করে বাড়ূয্যে-গিন্নী গালাগালি শূলোশূলি বুক-চাপড়াচাপড়ির ঘুরপথ ধরে মনের ঝাল মেটায় কেন!

বৌ বিদেয় করে দেওয়ার নাটকটা বার বার ঠিক জমে ওঠার মূহুর্তেই ভেস্তে গিয়ে গিয়ে ইদানীং সবাই হতাশ হয়ে গিয়েছিল। এবং নিত্য নতুন একটা ঢেউয়ের যোগানদার হিসাবে সত্যকে বেশ এক রকমের পছন্দই করতে শুরু করেছিল।

আলোচনার একটা বড় খোরাক, আপন আপন ঘরের বৌ-ঝিকে সুশিক্ষা দেবার সুবিধার্থে একটা কুদৃষ্টান্ত, এটাও একটা লাভের অঙ্ক বৈকি।

কিন্তু নবুর জ্বরবিকারে পড়া অবধি নবুর বৌয়ের সমালোচনায় উপযুক্ত ভাষাও খুঁজে পাচ্ছিল না কেউ। বেদে পুরাণে, যাত্রা নাটকে এমন জাহাবাজ মেয়েমানুষ কেউ কখনো দেখে নি, শোনে নি।

কাজেই ভাষাও সৃষ্টি হয় নি ওর জন্যে।

তবু এতদূর বুঝি কেউ দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করে নি। বৌ নাকি নবুর বন্ধু নিতাইয়ের সঙ্গে আড়ালে দেখাসাক্ষাৎ করে গলার দশভরির হারগাছা বিক্রী করিয়ে, ভবতোষ মাস্টারকে দিয়ে ব্যবস্থা করে কলকাতা থেকে সায়েব ডাক্তার আনিয়েছে।

আবার ভবতোষ মাস্টারের সঙ্গেও কথা কয়েছে?

সাহেব ডাক্তারের চিকিৎসায় নবু বাঁচুক আর মরুক সেটা এখন চিন্তনীয় বিষয় নয়, চিন্তনীয় হচ্ছে–বাঁড়ুয্যে সম্পর্কে অতঃপর কিংকর্তব্য।

ব্যাপারটা তো আর এখন গিন্নীদের এলাকায় নিবদ্ধ নেই, সমাজের মাথার মণি পুরুষদের মাথা টলিয়েছে। নবুর বৌ শাশুড়ীর সঙ্গে গলা তুলে কোদল করে, শ্বশুরের সামনে কথা কয়ে বসে, অথবা দজ্জালজনোচিত আরও বহুবিধ অকাণ্ড করে, এ তাঁরা এযাবৎ গৃহিণী মারফৎ শুনে এসেছেন, কিন্তু তাতে বৌটা সম্পর্কে বিরক্ত হওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।

কিন্তু এখন আর “মেয়েলী কাণ্ড” বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। এখন জাত যাওয়ার প্রশ্ন উঠেছে। হতে পারে বড় য্যে কর্তা সমাজের মাথা, কিন্তু মাথা বলেই তো আর সবাইয়ের মাথা হাতে কাটবার আবদার চলে না?

বাগদিনীর ছোঁয়াচটা হাসা-হাসির মধ্যে দিয়ে একরকম মেনে নেওয়া হয়েছে, আর ওটা এমন সৃষ্টিছাড়া নতুনও কিছু কথা নয়, কিন্তু ঘরে দোরে যদি সাহেব ঢোকে, ঘরের বৌ যদি পরপুরুষের সঙ্গে কথা কয়, সেটা মেনে নেবে সমাজ এত নখদন্তহীন হয়ে যায় নি।

চণ্ডীমণ্ডপে বৈঠক বসে এবং পাঁচ মাথা এক হয়ে এই স্থিরীকৃত হয়, প্রথমে নীলাম্বর বড়য্যেকে চাপ দেওয়া হবে পুতবৌকে ত্যাগ করবার জন্যে, তারপর যদি সে তাতে রাজী না হয়, বা না পেরে ওঠে, অবশ্যই পতিত করতে হবে নীলাম্বরকে।

সমাজে বাস করা তো আর ছেলেখেলা নয়। ওই মুমূর্ষ রোগীটা সত্যিই যদি সাহেব ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে বাঁচে, বাঁচাতেও পারে, ওই লালমুখোদের ওষুধে ভেলকি খেলে শোনা যায়, ঈশ্বর করুন বাঁচুকই, ওকে একটা অঙ্গ-প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে মহাপ্রসাদ খাওয়াতেই হবে।

আর ওই ভবতোষ মাস্টারটা!

ওটাকে জলবিছুটি দিয়ে গ্রামের থেকে বার করে দেবার কথা, কিন্তু শয়তানটা ডাক্তারের সঙ্গেই। গট গট করে গাড়িতে গিয়ে উঠে কলকাতায় লম্বা দিল।

ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে এসেছে ডাক্তারের সঙ্গে!

তা ওর আর বাস ওঠাবার প্রশ্ন কোথায়, নিজেই তো প্রায় বাস উঠিয়ে কলকাতায় গিয়ে বাসা বেঁধেছে। পিসিটা আছে, তাই কালেকস্মিনে আসে!

আসামী বলতে হাজির শুধু নিতাইটা।

তা আপাতত ওকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাহেব ডাক্তাররূপী আগুনটি ল্যাজে বেঁধে এনে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে সরে পড়েছে।

এখন আগুনের কাজ আগুন করছে।

.

আগে ঘুণাক্ষরে কেউ টের পায় নি।

কোন ফাঁকে যে এসব যোগাযোগ করেছে সত্য, ঈশ্বর জানেন! গ্রামের এত জোড়া চোখের ওপর দিয়ে ভানুমতীর খেল দেখিয়ে দিল!

লোকে দেখল গ্রামের পথে ঘোড়ার গাড়ি।

নীলাম্বর দেখলেন সে গাড়ি তার দরজায় থামল। আর তা থেকে নামল এক বাঘা সাহেব।

বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল নীলাম্বরের। সন্দেহ নেই এ গাড়ি কালেক্টরে বা ম্যাজিস্টারের, নিশ্চয় কোন শত্রু নীলাম্বরের নামে কিছু লাগিয়ে-ভাঙিয়ে এসেছে, আর সেই বাবদ হাতকড়া এসেছে নীলাম্বরের জন্যে।

কেন আসবে, কি সূত্রে আসা সম্ভব, এসব কথা ভাববার ক্ষমতা থাকে না নীলাম্বরের, খেয়াল থাকে না সঙ্গে সঙ্গে কে নামছে দেখবার! হাউমাউ করে গিয়ে প্রায় আছড়ে পড়েন তিনি সাহেবের সামনে।

ওদিকে পাড়ায় ঘরে ঘরে বেতার-বার্তা। নীলাম্বরের দরজায় ঘোড়ার গাড়ি থেকে সাহেব।

আইন-আদালত ছাড়া চট করে কারুর মগজে কিছু আসে না এবং সকলে একবার করে জানলা একটু ফাঁক করে আর বলাবলি করতে থাকে, একেই বলে বিপদ একা আসে না! ওদিকে ছেলে শুষছে, এদিকে এই কাণ্ড!

নীলাম্বরের বাড়িতেও উঁকিঝুঁকি চলতে থাকে।

কিন্তু সহসা একজনের চোখে পড়ল সাহেবের গলায় নল ঝুলছে।

ডাক্তার….ডাক্তারী নল ঝুলছে গলায়! একটা চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।

ডাক্তার! সাহেব ডাক্তার এনেছে নবুর জন্যে! তলে তলে এই চালাকি খেলেছে নীলাম্বর, অথচ কারুর সঙ্গে কোন পরামর্শ নেই?

এ যেন প্রতিবেশীর গালে আচমকা একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেওয়া! আবার সাহেবের পায়ে ধরে কাঁদতে বসেছে।

হ্যাঁ, প্রায় পায়েই পড়েছিলেন নীলাম্বর, ও সাহেব, আমি কিছু জানি না, আমি কোনও দোষে দোষী নয়। ঘরে আমার ছেলে মরছে।

সাহেব যে ভারী গলায় আশ্বাস দিল, ভয় না আছে। রোগী ভাল হইয়া যাবে– তাও তাঁর কানে ঢুকল না।

কানে ঢুকল ভবতোষ মাস্টারের কথা।

এ কী, এ রকম করছেন কেন? কলকাতা থেকে ডাক্তার এসেছেন নবকুমারের চিকিৎসার জন্য!

নীলাম্বর তাকিয়ে দেখলেন।

নিতাইকেও দেখলেন।

মুহূর্তে অনুভব করলেন, কোথাও একটা কিছু ষড়যন্ত্র ঘটেছে। তার সঙ্গে সঙ্গেই সেই ষড়যন্ত্রের নায়িকা হিসাবে সত্যর চেহারাটাই চোখের উপর ভেসে উঠল।

কিন্তু কি করে কী হল?

তা সে যাই হোক, এখন টু শব্দ চলবে না। বলির পাঁঠার মত কাঁপতে কাঁপতে ভবতোষ মাস্টারের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঘরে চোরের মত ঢুকলেন নীলাম্বর।

সত্য নিশ্চল প্রস্তর-প্রতিমার মত দাঁড়িয়েছিল সেই রুগীর মাথার কাছে বাগানের দিকের জানলায়। কপাটটা এমন ভাবে আড় করে রেখেছিল, যাতে সে নিজে ঘরের মানুষদের দেখতে পায়, ঘরের মানুষরা তাকে দেখতে পায় না।

ভবতোষ মাস্টারের সঙ্গে সঙ্গে যখন তার চাইতে প্রায় হাতখানেক লম্বা দশাসই গড়ন লাল টকটকে মানুষটা ঘরে ঢুকল, কেন কে জানে বুকটা কেঁপে উঠল সত্যবতীর। তার পর হঠাৎ দু চোখ ভরে জল উপচে এল।

দৃশ্যত হাতজোড় করল না, মনে মনে প্রণামে বলল, বাবা, তোমার আস্পদ্দাওলা অবাধ্য মেয়েটাকে মাপ করো। দূরে থেকে আশীর্বাদ করো যেন তার হাতের নোয়া, সিঁথির সিঁদুর বজায় থাকে।… বুঝেছি তোমার বুকে দাগা দিয়েছি, কিন্তু আমি তো তোমারই মেয়ে। তেজ বল, অহঙ্কার বল, তোমার স্বভাব থেকেই তোমার মেয়েতে বর্তেছে।

তারপর মা’র মুখখানা মনে করতে চেষ্টা করল। বলল, মা, তোমার নামে দিব্যি গেলে বাবার ওষুধ ফেরত দিয়েছি, তোমার নামে যেন কলঙ্ক না পড়ে।

কালী দুর্গা চণ্ডী শিব, এত সব জানে না সত্য, জীবনের সাক্ষাৎ দেবতার কাছেই বার বার আশীর্বাদ প্রার্থনা করে।

সাহেব ডাক্তারের ওষুধ ধন্বন্তরী হোক!

আবার তার চির-কৌতূহলী চিত্ত ওই ভয়ঙ্কর গম্ভীর মুহূর্তেও হঠাৎ অজানতে কখন নেহাৎ ছেলেমানুষের মত কৌতূহলী হয়ে ওঠে। বিস্মিত পুলকে দৃষ্টি বিস্ফারিত করে দেখে, ডাক্তার কিভাবে রোগীর বুকে পিঠে নল বসাচ্ছে আর সেই নলের দুটো মুখ নিজের কানে ঢুকিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছে।

একটু পরে শুনতে পেল, ভারী ভারী একটা গলা উচ্চারণ করছে, ভয় না আছে। ভাল হয়ে যাবে।

স্লেচ্ছকে দেবতা ভাবলে কি পাপ হয়?

তার পর রঙ্গমঞ্চের সমারোহ মিটল।

যারা ডাক্তারকে নিয়ে এসেছিল, তারা তার সঙ্গেই সরে পড়ল। আর উদ্যত বজ্র হাতে নিয়ে দু দুটো মানুষ নিশ্চেতনের মত নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে রইলেন।

বাঁড়ুয্যে আর বাঁড়ুয্যে গিন্নী।

মাটির পুতুলের মত বসে আছেন দুজনে। বুঝতে পারছেন না, এই অবস্থায় ঠিক কোন পথে চলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

না, বজ্ৰ বোধ করি ওঁদের মাথায় পড়েছে!

নবুর কথা ভুলে গেছেন ওঁরা।

অপেক্ষাকৃত সচেতন ছিল সদু।

সে চলে যাবার আগে নিতাইকে হাতছানি দিয়ে ডেকে, ডাক্তার কি কি নির্দেশ দিয়ে গেল তা ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে যেতে বলেছিল। এবং সেই ফাঁকেই ঝপ করে বলে বসেছিল, টাকা কে দিল রে? মাস্টার?

নিতাই মাথা চুলকে বলে, না, মানে ইয়ে–ব্যাপারটা কি জান সদুদি, বৌঠান হঠাৎ সেদিন ঘাটের পথে ডেকে কেঁদে পড়ে

সদু থামিয়ে দেয়, ঈষৎ কঠিন সুরে বলে, বৌ যার-তার কাছে কেঁদে পড়বার মেয়ে নয়। ভণিতা রেখে সত্যি কথাটা বল! ঝপ করে বল!

নিতাই অতএব সত্যি কথাই বলে।

ঘাটের পথে নিতাইয়ের হাতে গলার হার খুলে দিয়ে বলেছে সত্য, আমার যেমন স্বামী তোমারও তেমনি বন্ধু। সেই বুঝে কাজ করবে। কলকাতায় গিয়ে এই হার বিক্কিরি করে সাহেব ডাক্তার নিয়ে এস। ওপর হাতের তাগা-জোড়াটাও খুলে দিতে চাইছিল, নিতাই নিবৃত্ত করেছে।

.

রোগীর ঘরে কেউ নেই।

সত্য আস্তে আস্তে এসে বিছানার কাছে দাঁড়িয়েছিল, সদু ঢুকতে এসে ফিরে গেল। মনে মনে বলল, বাঁচে যদি তো তোর পুণ্যেই বাঁচবে বৌ। বেহুলা মরা স্বামী নিয়ে স্বর্গ পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল, সাবিত্রী যমরাজের পেছনে ছুটেছিল। যুগে যুগে তারা সকলের পূজো পাচ্ছে।

একটু পরে আবার যেতে গিয়ে শুনতে পেল বৌ শাশুড়ীর কাছে এসে নরম গলায় বলছে, সাহেব ডাক্তারের ওষুধে তো তোমরা সর্বদা ছুঁতে পারবে না, রুগীর ভারটাই বরং আমাকে দিয়ে রান্নাঘরটা তুমি।

এলোকেশী নড়েচড়ে শুকনো গলায় বলে ওঠেন, তা এখন তুমি যা বলবে তাই শিরোধায্য করতে হবে! মহারাণী ভিক্টোরিয়ার নিচেই তুমি! তা রান্নাঘরের ভার না হয় বাদী নিল, তোমার ছেলেদের ভার কে নেবে?

সত্য আরও নম্র গলায় বলে, ঠাকুরঝির কাছেই তো বেশী থাকে ওরা।

থাকে বলে গলায় চাপাতে হবে?

জগতে সবই সম্ভব। সদুর দিকে টেনেও কথা বলেন এলোকেশী! সদু পরবর্তী কথা শোনার জন্যে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার শুনতে পায় বৌয়ের আরও নরম গলা, ঠাকুরঝি তো ওদের প্রাণতুল্য দেখেন। গলায় চাপা ভাববেন কেন মা?

কিন্তু সত্যের এই নরম গলাটা কেন সদুর চোখে জল এনে দেয়! কেন যেন মনে হয় সত্যর গলায় এই নরম সুর একেবারে মানায় না। ওর সেই জোরালো গলাটাই ভাল। অনেক ভাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *