এলোকেশী দাওয়ায় পাটি পেতে বসে বৌয়ের চুল বেঁধে দিচ্ছেন। দিচ্ছেন অনেকক্ষণ থেকেই। সেই দুপুরবেলা বসেছিলেন– এখন বেলা প্রায় গড়িয়ে এল।
এলোকেশী যেন পণ করেছেন আজ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি দেখিয়ে ছাড়বেন। বৌকে সামনে রেখে তার পিছনে হাঁটু গেড়ে উঁচু হয়ে বসেছেন তিনি, মুখের ভাব কঠিন কঠোর।
ওদিকে টানের চোটে সত্যবতীর রগের শির ফুলে উঠেছে, চুলের গোড়াগুলো মাথার চামড়া থেকে উঠে আসতে চাইছে, ঘাড় অনেকক্ষণ আগে থেকেই টনটন করতে শুরু করেছে, এখন মেরুদণ্ডের মধ্যেও একটা অস্বস্তি শুরু হচ্ছে।
অথচ তার কেশকলাপ নিয়ে যে অপূর্ব শিল্প-রচনার চেষ্টা চলেছে, আশা হচ্ছে না সহজে তার সমাপ্তি ঘটবে।
কিন্তু কেবলমাত্র এলোকেশীর অক্ষমতাকেই দায়ী করলে অবিবেচনার কাজ হবে, দায়ী অপরপক্ষ। সত্যবতীর চুলগুলো যেন বেয়াড়া ঘোড়া, কোনমতেই তাকে বাগ মানিয়ে বশে আনা যাচ্ছে না।
ঝুলে খাটো আর আড়ে ভারী চাপ চাপ কোঁকড়া কোঁকড়া চুলগুলো খোলা থাকলে যতই সুন্দর দেখাক, তাকে বেণীর বন্ধনে বেঁধে কবরীর আকৃতি দিতে গেলেই মুশকিলের একশেষ। গোড়া বাধতে গেলে ফসফস করে এলিয়ে খুলে পড়ে, কোনরকমে যদিবা তিনগুছির ফেরে ফেলা যায়, পাঁচগুছি নগুছির দিকেও যাওয়া চলে না।
কিন্তু এলোকেশী আজ বদ্ধপরিকর, সাতগুছির বাঁধনে বেঁধে ‘কল্কা খোঁপা’ করে দেবেন, তাই বারতিনেক অসাফল্যের পর একগোছা মোটা মোটা কালো ঘুনসি দিয়ে চুলের গোরা নিয়ে টেনে ব্রহ্মতালুতে জড় করে এনে প্রাণপণ বিটকেলে বেঁধে ফেলেছেন, এবং সাতগুছির সাত ভাগকে করতে চেষ্টা করছেন।
দীর্ঘস্থায়ী এই চেষ্টায় সত্যবতীর অবস্থা উপরোক্ত। অনেকক্ষণ বাবু হয়ে বসে থাকার পর এবার হাঁটু দুটো মুড়ে বুকের কাছে জড়ো করে বসেছে সত্যবতী, কারণ পায়ে ঝিঝি ধরেছিল। মুখটা সত্যবতীর আকাশমুখো আর সেই মুখের ওপর পরনের নীলাম্বর শাড়িখানার আঁচলটুকু চাপা দেওয়া।
মুখে আঁচল চাপা না দিয়ে উপায় নেই, কারণ চুল বাঁধবার সময় ঘোমটা দেওয়া চলে না। অথচ জলজ্যান্ত আস্ত মুখোনা খুলে বসে থাকলেও তো চলে না। না-ই বা ধারেকাছে কেউ থাকল আর হলই বা শাশুড়ী পিছনে বসে, তবু নতুন বৌ বলে কথা। তাই আঁচলটা তুলে মুখে চাপা দিয়েছে সত্যবতী। মানে দিতে বাধ্য হয়েছে। ঘোমটা খসবার আগেই এলোকেশী নির্দেশ দিয়েছেন, আঁচলটা মুখে ঢাকা দাও দিকি বাছা! তোমার তো আর বোধ-বুদ্ধির বালাই নেই, অগত্যে সবই স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে আমায়।
.
দিনটা কি তবে সত্যবতীর শ্বশুরবাড়ি বাসের প্রথম দিন?
না তা নয়, এসেছে সত্যবতী প্রায় মাসখানেক হয়ে গেল, কিন্তু মাথাটা ওর এ পর্যন্ত শাশুড়ীর হাতে পড়ে নি। সৌদামিনীই চুল বেঁধে সরময়দা মাখিয়ে আলতা পরিয়ে নতুন বৌয়ের প্রসাধন আর যত্নসাধন করছিল কদিন! হঠাৎ আজ এলোকেশীর নজরে পড়ল বৌয়ের চুল বেড়াবিনুনি করে বাঁধা।
দেখে রাগে জ্বলে উঠলেন এলোকেশী। তবু নিশ্চিন্ত হবার জন্যে ভুরু কুচকে ডাক দিলেন, এদিকে এস দিকি বৌমা!
শাশুড়ীর সামনে কথা বলাও নিষেধ, মুখ খোলাও নিষেধ, সত্যবতী নীরবে কাছে এসে দাঁড়াল।
ঘোমটা অবশ্য বজায় থাকলই, এলোকেশী হ্যাঁচকা একটা টানে পুত্রবধূর পিঠের কাপড়টা তুলে খোঁপাটা দেখে নিলেন। ঠিক বটে, বেড়াবিনুনিই বটে।
তেলে-বেগুনে জ্বলে ডাক দিলেন, সদু! সদি!
যাকে বলে ত্রস্তেব্যস্তে সেইভাবে ছুটে এল সৌদামিনী। দেখল নতুন বৌ বুকে মাথায় এক হয়ে ঘাড় হেঁট করে দাঁড়িয়ে, আর মামী তার পিঠের কাপড় উঁচু করে তুলে ধরে দণ্ডায়মান। মামীর নয়নে অগ্নিশিখা; কপালে কুটিলরেখা।
কি বলছ এ প্রশ্ন উচ্চারণ করল না সৌদামিনী, শুধু শঙ্কিত দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইল।
কি হল বৌয়ের পিঠে?
কোন জড়ল চিহ্ন, না কোন চর্মরোগের আভাস, নাকি বা কোন পুরনো ক্ষতের দাগ! অর্থাৎ নতুন বৌ কি ‘দাগী’! আর মামীর শ্যেনদৃষ্টির সামনে ধরা পড়ে গেছে সেটা!
অবশ্য ভুল ধারণা নিয়ে বেশীক্ষণ থাকতে হল না সৌদামিনীকে, এলোকেশী প্রবল স্বরে বলে উঠলেন, বলি সদি, এমন ব্যাপার ঠেলার কাজ কি না করলেই নয়?
বুক থেকে পাথর নামে সৌদামিনীর।
যাক বাচা গেল।
নতুন কিছু নয়। সেই আদি ও অকৃত্রিম লক্ষ্য।
অতএব সাহসে ভর করে বলল, কি হল?
কি হল! বলি শুধোতে লজ্জা করল না? ধম্মের ষাঁড়ের মতন আঁকাড়া গতর নিয়ে দুবেলা ভাতের পাথর মারছিস, আর গতরে হাওয়া দিয়ে বেড়াচ্ছিস, একটু হায়া আসে না প্রাণে? দশটা নয় বিশটা নয় একটা ভাই-বৌ, তার চুলটা বেঁধে দিয়েছিস এত অচ্ছেদ্দা করে! বলি কেন? কেন? এত
হলটা কি তা বলবে তো?
সহজ গলায় বলে সৌদামিনী। আর সত্যবতী ঘোমটার মধ্যে থেকে অবাক হয়ে প্রায় থরথর করে কাঁপতে থাকে। না, এলোকেশীর কটু-ভাষণে নয়, গিন্নীদের মুখে এরকম বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি কথা শোনার অভ্যাস পাড়াবেড়ানি সত্যর আছে। রামকালী চাটুয্যের বাড়ির কথাবার্তাগুলো কথঞ্চিত সত্য, নইলে তারই সেজপিসি সাবিপিসির বাড়ি সর্বদা এই ধরনের কথার চাষ। সেজন্যে না। এলোকেশীর কটুভাষণে না অবাক হয় সৌদামিনীর সহ্যশক্তি দেখে। এত অপমানের পর ওই রকম সহজভাবে কথা বলল ঠাকুরঝি!
এটা সত্যবতীর অদেখা।
কটু কথার পরিবর্তে হয় কটু কথা, নয় ক্রন্দন, এই দেখতেই অভ্যস্ত সে! আর ঠাকুরঝি কিনা! বলছে হলটা কি তা বলবে তো?
এলোকেশী অবশ্য অবাক হন না, কারণ সৌদামিনীর এই সহ্যশক্তি তার পরিচিত। তবে তিনি তো আর প্রশংসায় উদ্বেল হন না, বরং এটা তার মামীর প্রতি অগ্রাহ্য ভাব বলেই রেগে জ্বলে যান।
এখনো তাই বললেন, হলটা কি তা বলে তবে বোঝাতে হবে? মনে মনে জানছ না? চোখে দেখতে পাচ্ছ না? এ কী ছিরির চুল বাধা হয়েছে? বৌয়ের মাথায় বেড়া-বিনুনি! ছি ছি, এতখানি বয়েস হল, কখনো শ্বশুরবাড়ির বৌয়ের মাথায় বেড়া-বিনুনি দেখি নি! গলায় দড়ি তোর সদু, গলায় দড়ি যে একটা মাত্তর মাথা, তাও একখানা বাহারি খোঁপা বেঁধে দিতে পারিস না!
সদু হেসে ওঠে, বৌয়ের চুল যা বাহারি, ওতে আর বাহারি খোঁপা হয় না। বাগ মানানোই যায়।
বাগ মানানো যায় না! এলোকেশী ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন, আচ্ছা, দেখব কেমন না যায়। এই বড়য্যে-গিন্নীর কাছে জব্দ হয় না এমন কোন বস্তু জগতে আছে দেখি! ত্রিজগতের মধ্যে বাগ মানাতে পারলাম না শুধু এই তোমাকে।
বেশ তো মামী, তুমি নিজে হাতেই বৌকে সাজিও না, তোমার একটা মাত্তর বেটার বৌ! বলে সৌদামিনী।
আর এলোকেশী আরও ধেই ধেই করে ওঠেন, কি বললি সদি? এ্যা! এত আসপদ্দা! মুখে মুখে জবাব! এত অহঙ্কার তোর কবে চূর্ণ হবে, কবে তোর দুঃখে শ্যালকুকুর কাঁদবে, সেই আশায় আছি আমি। এই তোকে দিব্যি দিলাম সদি, যদি আর কোনদিন তুই আমার বো’র চুলে হাত দিবি!
গুরুজনের দিব্যি গায়ে লাগে না– এ মানলে কি চলে গা? সদু অম্লানবদনে বলে, তোমার হল গে মন-মর্জি, কোনদিন দেবে, কোনদিন বা ভুলে যাবে–
কী বললি! কী বললি লক্ষ্মীছাড়ি! আমার একটা বেটার বৌয়ের কথা আমি ভুলে যাব?
তা তাতে আর আশ্চয্যি কি মামী! সদু নিতান্ত অমায়িক মুখে বলে, তোমার সে গুণে কি ঘাট আছে? আপনার খিদের খাওয়া, তাই তো অর্ধেক দিন ভুলে যাও, ডেকে খাওয়াতে হয়।
এলোকেশী সহসা থতমত খান এটা ঠিক কোন ধরনের কথা ধরতে পারেন না অভিযোগ না প্রশস্তি?
তাই ভারীমুখে বলেন, হ্যাঁ, আমি ভুলে থাকছি আর রোজ তুমি আমায় ডেকে তুলে ঝিনুকে করে গিলিয়ে দিচ্ছ।
আহা তা না দিই, তোমার কি খেয়াল থাকে?
না থাকে না থাক। বৌয়ের চুল আজ থেকে আমি বাঁধব এই বলে রাখছি। ওর চুলের দড়ি কাটা সব আমার ঘরে রেখে যাবি। পাখী-কাঁটাগুলো দিতে ভুলবি না।
দেব, দিয়ে যাব। তা বৌয়ের বাবা যে সোনার চিরুনি, সাপকাটা, বাগান ফুল ইত্যাদি করে একরাশ মাথার গহনা দিয়েছেন, সেগুলোই বা বাক্সয় পুরে রাখছ কেন? সব বার করে বাহার করে দিও!
সে আমি কি করব না করব তোমার কাছে পরামর্শ নিতে আসব না! অনবরত খালি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা! ভগবান যে কেন কঠিন রোগ দিয়ে তোর বাকশক্তি হরণ করে নেন না তাই বি। তুই জনোর শোধ বোবা হয়ে বসে থাক, আমি নিসিংহতলা’য় ভোগ চড়াই।
দোহাই মামী, ওসব মানত-টানত করতে যেও না। দেব-দেবীরা এক শুনতে আর এক শুনে বসে থাকে, হয়ত বোবার বদলে ঠুটো করে দেবে, তখন মরবে তুমি লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে।
কী বললি! তুই ঠুটো হয়ে বসে থাকলে আমার সংসার অচল হয়ে যাবে? সাধে বলি অহঙ্কারে পাঁচ-পা তোর। আমার সংসার আমি চালাতে পারি নে ভেবেছিস? বা হাতের কড়ে আঙুলে পারি। কিন্তু সে আঙুলই বা আমি নাড়ব কেন? ভাতকাপড় দিয়ে তোকে পুষছি যখন!
আহা, আমিও তো তাই বলছি গো। ঠুটো হলেও তো ভাত-কাপড়টা দিতেই হবে।
হবে! দায় পড়েছে। ঠ্যাং ধরে টেনে পগারে ফেলে দেব।
সর্বনাশ মামী, ও বুদ্ধি করতে যেও না, পাড়াপড়শী তাই সেই পণে শাক তুলে এনে তোমাদের গালে মুখে মাখাবে। বলে হাসতে হাসতে চলে যায় সৌদামিনী সত্যবতীকে স্তম্ভিত করে রেখে।
বড় সংসারের মেয়ে সত্যবতী, তার এতটুকু জীবনে অনেক চরিত্র দেখেছে, এরকম আর দেখেনি।
.
যাক, সকালের সেই ঘটনার পরিণামে আজ দুপুরের এই মল্লযুদ্ধ।
সত্যিই বড় ভারী চুলের গোড়া সত্যর, অথচ এদিকে ঝুলে খাটো! এক গোছা কালো ঘুসি দিয়ে কষে বেঁধে আর গোছা গোছা ঘুনসির ভেজাল মিশিয়ে বেণী দুটো যদিবা লম্বা করলেন এলোকেশী, তাদের প্রজাপতি ছাদে পাক খাওয়াতে গিয়েই গোড়াসুদ্ধ ঢিলে হয়ে নেমে এল। সত্যবতীর কপালের ফের, ঠিক সেই মুহূর্তেই সত্যবতী বোধ করি পিঠের খিল আর পায়ের ঝিঝি ধরা কমাতে একটু নড়েচড়ে বসল।
ব্যাপারটা হল পাত্ৰাধার তৈল কি তৈলাধার পাত্রের মতই। বন্ধনটা ঢিলে হয়ে পড়ার জন্যেই মুক্তির সুখে নড়েচড়ে বসল সত্যবতী, না নড়েচড়ে বসার জন্যেই বেণী বন্ধনমুক্ত হয়ে গেল সেটা বোঝা গেল না। এলোকেশী দেখলেন বৌ নড়ল, চুল খুলল।
এলোকেশী পাথরের দেবী নন, রক্তমাংসের মানুষ, এরপরও যদি তাকে ঠাণ্ডা মাথায় সহজভাবে বসে থাকতে দেখবার আশা করা যায়, সে আশাটা পাগলের আশা। পাগলের আশা পূরণ হয় না, হবার নয়।
এতক্ষণের পরিশ্রম পণ্ড হওয়ার রাগে, আর সৌদামিনীকে নিজের শিল্পপ্রতিভা দেখিয়ে দেবার আশাভঙ্গে, দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য এলোকেশী সহসা একটা অভাবিত কাজ করে বসলেন। বৌয়ের। সেই খিল-ছড়ানো সিদে পিঠটার ওপর গুম করে একটা গোলগাল কিল বসিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, হল তো! গেল তো গোল্লায়! এক দণ্ড যদি সুস্থির
কিন্তু কথা এলোকেশীকে শেষ করতে হল না, মুহূর্তের মধ্যে আর এক প্রলয় ঘটে গেল। শাশুড়ীর হাত থেকে চুলের ভার এক হ্যাঁচকায় টেনে নিয়ে সত্যবতী ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠল, আর শাশুড়ীর সঙ্গে যে কথা কওয়া নিষেধ সে কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে দৃপ্তস্বরে বলে উঠল, তুমি আমায় মারলে যে!
কিলটা বসিয়ে চকিতে হয়তো একটু অনুতপ্ত হয়েছিলেন এলোকেশী, কিন্তু সে অনুতাপের অনুভূতি দানা বাঁধবার আগেই এই আকস্মিক বিদ্যুতাঘাতে এলোকেশী প্রথমটা যেন পাথর হয়ে গেলেন। বৌয়ের কণ্ঠস্বর কেমন সেটা জানবার সুযোগ এ পর্যন্ত হয় নি এলোকেশীর, কেননা তার সঙ্গে তো বটেই, তাঁর সামনেও কোনদিন বৌ কথা কয় নি। কইবার রেওয়াজও নেই। কোনও প্রশ্ন করলে শুধু ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ-না জানিয়েছে। কথা যা সে সদুর সঙ্গে। কিন্তু সেও তো নিভৃতে। রাত্রে সৌদামিনীর কাছেই শোয় বৌ, কারণ ডাগরটি না হলে তার ঘর-বরের প্রশ্ন ওঠে না।
না, কোন ছলেই সত্যর কণ্ঠস্বর এলোকেশীর কানে আসে নি, সহসা আজ সেই স্বর বাজের মত এসে কানে বাজল।
এ কী জোরালো গলা বৌ-মানুষের!
এতটুকু একটা মানুষের।
অনুতাপের বাষ্প ধুলো হয়ে উড়ে গেল।
এলোকেশীও দাঁড়িয়ে উঠলেন। চেঁচিয়ে তেড়ে উঠলেন, মেরেছি বেশ করেছি। করবি কি শুনি? তুইও উল্টে মারবি নাকি?
সত্য তখন এলোকেশীর অনেক পরিশ্রমে গড়া সাতগুছির বেণী দুটোর মধ্যে আঙুল চালিয়ে চালিয়ে জোরে জোরে খুলে ফেলতে শুরু করেছে। মাথায় কাপড় নেই, মুখের আঁচল খসেছে, সেই মুখে আগুনের আভা।
এলোকেশীর কথায় একবার সেই আগুনভরা মুখটা ফিরিয়ে অবজ্ঞাভরে উচ্চারণ করল সত্য, আমি অমন ছোটলোক নই। তবে মনে রেখো আর কোনদিন যেন–
কী বললি? আর কোনদিন যেন? গলা টিপলে দুধ বেরোয় এক ফোঁটা মেয়ে, তার এত বড় কথা! মেরে তোকে তুলো ধুনতে পারি তা জানিস?… সদি লক্ষ্মীছাড়ি, আন দিকি একখানা চ্যালাকাঠ, কেমন করে বৌ ঢিট করতে হয় দেখাই ত্রিজগৎকে। চ্যালাকাঠ পিঠে পড়লেই তেজ বেরিয়ে যাবে।
মারো না দেখি, তোমার কত চ্যালাকাঠ আছে!
বলে দৃপ্তভঙ্গিতে সোজা শাশুড়ীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে সত্যবতী নির্ভীক দুই চোখ মেলে।
জীবনে অনেকবার রেগে জ্ঞানহারা হয়েছেন এলোকেশী, অনেকবার বুক চাপড়েছেন শাপমন্যি দিয়েছেন দাপাদাপি করেছেন, কিন্তু আজকের মত অবস্থা বোধ হয় তার জীবনে আসে নি।
এ অবস্থা যে তার কল্পনার বাইরে, স্বপ্নের বাইরে। তাই সহসা যেন নিথর হয়ে গেলেন তিনি, সাপের মত ঠাণ্ডা চোখে শুধু তাকিয়ে রইলেন সেই দুঃসাহসের প্রতিমূর্তির দিকে।
ঠিক এই অবস্থায় থাকলে কতক্ষণে কি হত বলা শক্ত, কিন্তু ভাগ্যের কৌতুকে আর এক অঘটন ঘটে গেল।
এই নাটকীয় মুহূর্তে উঠোনের বেড়ার দরজা ঠেলে বাড়িতে এসে ঢুকল নবকুমার। ঢুকেই যেন বজ্রাহত হয়ে গেল।
এ কী পরিস্থিতি।
সহস্র সাপের ফণার মত একরাশ চুলের ফণায় ঘেরা সম্পূর্ণ খোলামুখে এলোকেশীর মুখোমুখি অগ্নিবর্ষী দুই চোখে সোজা তাকিয়ে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে রয়েছে, কে ও?
নবকুমারের বৌ নাকি?
কিন্তু তাই কি সম্ভব?
আকাশ থেকে বাজ পড়ছে না, পৃথিবীর মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে না, এমন কি প্রলয়ঙ্কর একটা ঝড়ও উঠছে না, অথচ নবকুমারের বৌ নবকুমারের মার সামনে অমনি করে দাঁড়িয়ে আছে?
আর নবকুমার ঢুকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়া সত্ত্বেও দৃকপাতমাত্র করছে না?
অসম্ভব! অসম্ভব!
এ অন্য আর কেউ!
নবকুমারের অজানিত পড়শীবাড়ির মেয়ে। হয়তো ভয়ঙ্কর কোন একটা কিছু ঘটেছে ওদের সঙ্গে।
নবকুমার গলাখাকারি দিতে ভুলে যায়, সরে যেতে ভুলে যায়, স্তম্ভিত বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। বিপদ যে ঘোরতর! অসম্ভব বলে একেবারে নিশ্চিন্ত হতেই বা পারছে কই?
বৌয়ের মুখটা দেখবার সৌভাগ্য কোনদিন না হলেও এই মাসখানেকের মধ্যে কোন না বিশ পঁচিশবার আভাসে ছায়ায় বৌকে দেখতে পেয়েছে সে। যদিও পাছে কেউ দেখে ফেলে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে আছে নবকুমার, তাই সেই তাকানোটা পলকস্থায়ী হয়েছে মাত্র।
তবুও ক্যামেরার লেনস্ পলকের মধ্যেই চিরকালের মত ছবি ধরে রাখে।
মুখ না দেখুক, সর্ব অবয়বের একটা ভঙ্গি তো দেখেছে।
আর দেখেছে ওই নীলাম্বরীর আঁচলখানা।
অতএব মনকে চোখ ঠেরে লাভ নেই। চোখ বুজে সূর্যকে অস্বীকার করতে যাওয়া হাস্যকর।
পড়শীবাড়ির কেউ নয়, ওই দৃপ্ত মূর্তি নবকুমারের বৌয়েরই।
যে বৌয়ের উদ্দেশে নবকুমার স্বপ্নে জাগরণে নিঃশব্দ উচ্চারণে ক্রমাগত গেয়েছে, গাইছে, কও কথা মুখে তুলে বৌ, দেখ না চেয়ে চোখ খুলে।
কিন্তু সে কী এই চোখ!
নবকুমার যেমন নিঃশব্দে এসেছিল, যদি পরিস্থিতি দেখে তেমনি নিঃশব্দে সরে পড়ত, তাহলে হয়তো নাটকের এই নাট্য-মুহূর্তটা এমন চূড়ান্তে উঠত না, হয়তো সত্যবতী নির্ভীকভাবে সেখান থেকে সরে যেত, আর এলোকেশী জীবনে যত গালি-গালাজ শিখেছেন, সবগুলো উচ্চারণ করতেন বসে বসে। আর স্বামী-পুত্র বাড়ি ফিরলে বৌয়ের এই মারাত্মক দুঃসাহস আর ভয়ঙ্কর দুর্বিনয়ের কাহিনী বিস্তারিত বর্ণনায় পেশ করতেন। তারপর গড়িয়ে যেত ব্যাপারটা।
কিন্তু নির্বোধ নবকুমার সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইল হাঁ করে।
আর এক সময়ে এলোকেশীর চোখ গিয়ে পড়ল তার ওপর। দাওয়ার উপর তিনি, নিচে উঠোনে ছেলে।
নবকুমারকে এভাবে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এলোকেশীও একবার হাঁ হয়ে গেলেন, তারপর সহসা সেই এতক্ষণের স্তব্ধ হয়ে থাকা হাঁ থেকে ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার উঠল, ওরে লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা মেনিমুখো ছোঁড়া, পায়ে কি তোর জুতো নেই? জুতিয়ে জুতিয়ে ওর মুখটা যদি জন্মের শোধ ছেঁচে শেষ করে দিতে পারিস, তবে বলি বাপের বেটা বাহাদুর!
কিন্তু নবকুমার নিশ্চল।
পরক্ষণেই সুরফেৰ্তা ধরলেন এলোকেশী, ওগো মাগো, কোথায় আছি দেখ গো, বেতা বেটা-বৌ দুজনে মিলে কী অপমান্যিটা করছে আমায়! ওরে নবা, বামুনের গরু, ছোটলোকের মেয়ে বিয়ে করে তুইও কি ছোটলোক হয়ে গেলি? দু পায়ে খাড়া দাঁড়িয়ে মায়ের অপমানটা দেখছিস? তবে মার মার, ঝাটা আমাকেই মার। ঝাটা খাওয়াই উপযুক্ত শাস্তি আমার। নইলে এখনো ওই বৌকে ভিটের বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দিই? মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিই না? ওগো মাগো, বৌ আমায় ধরে মারে আর তাই আমার ছেলে দাঁড়িয়ে দেখে!
এতক্ষণে নবকুমার বোধ করি চেতনা ফিরে পায়, আর ফিরে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোঁ চোঁ দেড় মারে সেই খোলা দরজাটা দিয়ে।
.
খিড়কির ঘাটে বাসন মাজছিল সদু, ঘাটের পাশ দিয়ে নবকুমারকে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োতে দেখে দাঁড়িয়ে উঠে ছাইমাখা হাতটাই নেড়ে ডাক দেয়, নবু, কি হল রে? অ নবু, অমন করে ছুটছিস কেন?
নবকুমার প্রথমটা ভাবল পিছুডাকে সাড়া দেবে না, ছুটে একেবারেই নিতাইয়ের বাড়ি গিয়ে পড়বে, তারপর বলবে, জল দে এক ঘটি।
কারণ নিতাই হচ্ছে তার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু। বিচলিত অবস্থায় তার কাছেই যাওয়া চলে।
কিন্তু সৌদামিনীর উত্তরোত্তর ডাকে কি ভেবে থমকে দাঁড়াল, ফিরল, তারপর গুটি গুটি এসে ঘাটের পাশে একটা ঝড়ে-পড়া তালগাছের গুঁড়ির ওপর বসে পড়ে রুদ্ধকণ্ঠে বলল, আমি আর বাড়ি ফিরব না সদুদি।
কথার ছিরি শোন ছেলের! হল কি তাই বল?
সর্বনাশ হয়েছে সদুদি!
আরে গেল যা! সর্বনাশের কথা বলতে আছে নাকি?
হলে বলতে আছে বৈকি।
সদু নবকুমারের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত, তাই বেশি ভয় না পেয়ে বলে, কেন, তোর মা হঠাৎ চড়ি ওল্টালো নাকি?
মা নয় সদুদি, মা নয় আমিই। জানি না, ঠিক বলতে পারছি না, আমি সত্যি বেঁচে আছি কিনা!
গায়ে চিমটি কেটে দেখ। বলে পুকুরের জলে হাত ডুবিয়ে ডুবিয়ে ছাই মাটি ধুতে ধুতে বলে সদু, মামী বুঝি রণচণ্ডী হয়ে তেড়ে এসেছিল?
জানি না।
জানিস না? ন্যাকামি রাখ দিকি নবু, হয় কি হয়েছে তাই বল, নয় যে দিকে যাচ্ছিলি সেই দিকে যা। বেটাছেলে না মেয়েমানুষ তুই?
সদুদি, যে দৃশ্য দেখে এসেছি, তা দেখলে অতি বড় বীর বেটাছেলেরও পেটের ভেতরে হাত পা সেঁধিয়ে যায়।
নাঃ, তোর দেখছি আর গৌরচন্দ্রিকে শেষ হয় না। বলবি তো বল, না বলবি তো যা। ভূত দেখেছিস, না ডাকাত পড়া দেখেছিস তাও তো জানি না।
নবকুমার বুকে বল করে কণ্ঠে শব্দ আনে, ঝপ করে বলে ওঠে, মাতে আর তোমাদের বৌতে মারামারি করছে!
কি করছে মাতে আর বৌতে? চমকে উঠে বলে সৌদামিনী।
বললাম তো, মারামারি করছে!
সৌদামিনী এক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে তারপর বলে, মারামারি কথাটা বলছিস কেন, মামী বৌকে ধরে ঠেঙাচ্ছে, তাই বল! আর সেই দৃশ্য দেখে তুই মদ্দ পুরুষ কাছা-কোঁচা খুলে ছুট মারছিস! কেন তুই মেয়েমানুষ হয়ে জন্মাস নি নবু তাই ভাবি। যাই দেখি ইতিমধ্যে কি এমন ঘটল। এই তো খানিক আগে বাসনের পাঁজা নিয়ে বেরিয়ে এলাম দেখলাম মামী বেটার বৌয়ের চুল বাঁধছে, ইতিমধ্যে হলটা কি?
আমি তো এই ঢুকলাম বাড়িতে। তুমি শীগগির যাও সদুদি।
যাই। বাবা পলকে প্রলয়, তিল থেকে তিলভাণ্ডেশ্বর! কি হল এক্ষুনি?
সৌদামিনী তাড়াতাড়ি বাসনগুলো ধুয়ে নিতে থাকে।
আমি আজ নিতাইদের বাড়িতেই থাকব সদুদি। এই চললাম।
সৌদামিনী ভুরু কুঁচকে বলে, কদিন পরের বাড়িতে থাকবি?
যতদিন চলে।
তার মানে নিজে গা বাঁচিয়ে কেটে পড়বি, আর পরের মেয়েটা, দুধের মেয়েটা তোর মার হাতে পড়ে মার খাবে!
পরের মেয়ে এবং দুধের মেয়ে শব্দটায় নবকুমারের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে, চোখে জল এসে যায়। কষ্ট গোপন করে বলে, তা আমি আর কি করব!
সৌদামিনী আড়চোখে একবার ওর মুখচ্ছবি দেখে নিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেন, দৃশ্য দেখে চলে এলে পারতিস, তুই দেখছিস জানলে যতই হোক নিজেকে একটু সামলে নিত মামী, একেবারে শেষ করে ফেলত না। যাই দেখি ছুঁড়ি বাঁচল কি মরল!
নবকুমার লজ্জা ত্যাগ করে সহসা বলে ওঠে, যাই বল সদুদি, যা দেখলাম ও তোমাদের বৌটি পড়ে মার খাবার মেয়ে নয়।
আমারও তাই মনে হয়, বলে সদু সকৌতুকে একটু হেসে বলে, মারামারি না করুক, পড়ে মার খাবে না। তাই তুই তো বলতেই পারলি না হয়েছেটা কি?
গোড়া থেকে কি কিছু জানি ছাই। বাড়ি ঢুকেই দেখি দাওয়ায় দু প্রাণী সুমুখোমুখি দাঁড়িয়ে। একজন সাপিনীর মত ফুঁসছে, আর একজন বাঘিনীর মতন গজরাচ্ছে।
সৌদামিনী হেসে উঠে বলে, বা রে, তুই তো অনেক নাটুকে কথা শিখেছিস দেখছি! যাক কালে-ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। তোর বৌও খুব পণ্ডিত।
বৌয়ের গল্প কান ভরে শুনতে ইচ্ছে করে নবকুমারের, ভুলে যায় এইমাত্র তাকে বাঘিনীর সঙ্গে তুলনা করেছে সে নিজেই। কিন্তু গল্প বাড়বে কি উপায়ে? নবকুমার তো আর কথা ফেলে বাড়াতে পারে না?
শুধু ভাবে, কালে-ভবিষ্যতে!
সে কত কাল?
কোন ভবিষ্যৎ?
বাঘিনীর মুখটা বার বার মনে ধাক্কা দিচ্ছে। ভয়ঙ্কর, কিন্তু সুন্দর! কী বড় বড় চোখ, কী চমৎকার জোড়া ভুরু!
কিন্তু বৌও মায়ের মত রাগী হবে হয়তো। লজ্জায় কুণ্ঠায় বিগলিত বৌটি মাত্র থাকবে না। নবকুমারের কল্পনার সঙ্গে ঠিক খাপ খাচ্ছে কি?
ঠিক যেন কি একটা লোকসানের দুঃখে বুকটা টনটন করে ওঠে নবকুমারের।
কাদার পুতুলের মত একটি নিরীহ ভালমানুষ বৌ নবকুমারের ভাগ্যে জুটলে কি এসে যেত ভগবানের! কত লোকেরই তো তেমন বৌ হয়!
কিন্তু সাপের ফণার মত চুলের ফণায় ঘেরা ওই মুখখানি।
ওতে যেন আগুনের আকর্ষণ।
নবকুমার পতঙ্গ মাত্র।
সৌদামিনী বলে, বিবাগী হয়ে যাচ্ছিলি তো যা, মেলা রাত করিস নে হাঁড়ি আগলে বসে থাকতে পারব না।
হাঁড়ি!
রান্না!
ভাত!
এসব শব্দগুলো কাজে লাগবে আজ! নবকুমারের যেন বিশ্বাস হয় না। ভয়ে ভয়ে বলে, আছি এখানটায় আমি– তুমি, তুমি একবার দেখে এসে খবরটা আমায় দিতে পার না সদুদি? নিশ্চিন্দি হয়ে তা হলে আমাদের তাসের আড্ডায় যেতে পারি।
ওরে আমার কে রে, উনি বাবু বসে থাকবেন, আর আমি ওঁর জন্যে খবরের থালা বয়ে আনব!
বলে থালা-বাসনের গোছাটা বাগিয়ে কাঁধের ওপর তুলে নেয় সদু। হাতে গামছার পুঁটুলিতে ঘটিবাটি। চলে যেতে যেতে ছোট ভাইকে আর একবার অভয় দেয় সে, বৌয়ের চিন্তে করে মনখারাপ করিস নে, নেহাৎ যদি মামী খুন করে ফাঁসির দায়ে না পড়ে তো ওই বৌয়ের দ্বারাই শায়েস্তা হবে। বৌ তোর যেমন তেমন মেয়ে নয়।
যদি খুন না করে!
যদিটা নবকুমারের বুকের মধ্যে কাঁটার মত খচখচিয়ে ওঠে, কিন্তু প্রশ্ন তুলতে পারে না, শুধু ম্রিয়মাণ হয়ে বসে থাকে।
সন্ধ্যে হয়ে আসছে, এখেনে আর বসে থাকতে হবে না, যা কোথায় যাচ্ছিলি ঘুরে আয়।
সদু লম্বা লম্বা পা পেলে বাঁশবাগানের খানিকটা অতিক্রম করে। কিন্তু নবকুমার আবার পিছু নিয়েছে। উদ্ভ্রান্ত মুখ, ছলছল চোখ।
সদুদি, তোমার সঙ্গে আমি যাব?
সদু মৃদু হেসে পা চালাতে চালাতেই বলে, কেন, এই যে বললি আর কখনো বাড়ি ফিরবি না?
মনটা কি রকম যেন করছে সদুদি! বলে সঙ্গে সঙ্গে এগোতে এগোতে নবকুমার হঠাৎ সুর বদলায়, বৌ যদি মাকে অপমান করে থাকে, তারও শাস্তি করা দরকার।
গায়ে পড়ে কাউকে অপমান করবার মেয়ে সে নয় নবু, সেদিকে তুই নিশ্চিন্দি থাক। তবে কেউ যদি গা পেতে অপমান নিতে যায় সে আলাদা কথা। আসল কথা কি জানিস, বৌ হল উঁচু ঘরের মেয়ে, শিক্ষাদীক্ষা উঁচু, লেখাপড়া জানে, বড় বড় বই পড়ে ফেলে, নিজে পয়ার বাঁধে।
অ্যাঁ!
স্থানকাল ভুলে নবকুমার প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, মস্করা করছ আমার সঙ্গে?
কি দরকার আমার? আকাশ থেকে কথা পেড়ে বলতেই বা যাব কি করে? আর ওসব আমি বুঝিই বা কি? বৌ আমার কাছে মনটা খোলে তাই টের পেয়েছি।
সদুর কাছে মনটা খোলে!
হায়, কবে সেই আকাক্সিক্ষত স্বর্গসুখ আসছে নবকুমারের ভাগ্যে, যেদিন নবকুমারের সামনে বৌ মন খুলবে!
সদু আবার মুখ চালায়, তোদের এ বাড়িতে বিয়ে হওয়া ওর উচিত হয় নি, এই বলে দিলাম স্পষ্ট কথা! তুই রাগ করিস আর যাই করিস, এ বাড়ি ওর যুগ্যি নয়! মামীর পয়সাই আছে, নজর বলতে আছে কিছু? আর বৌয়ের ছোট নজর দেখার অভ্যেসই নেই। এই তো সেদিন মামী পাড়ার লোকের গয়না বাধা রেখে টাকা ধার দিয়ে সূদ নেয় শুনে যেন হিমাঙ্গ হয়ে গেল বৌ!
নবকুমার বিরক্ত স্বরে বলে, তা ওসব কথা বলতে যাবারই বা দরকার কি?
বলতে আমি যাই নি রে বাপু তোর বৌয়ের কান ধরে। ওর সামনেই ঘোষগিন্নী একজোড়া বাজু বন্দুক নিয়ে দৈ-দস্তুর করতে লাগল। সে বলে টাকায় এক পয়সা, মামী বলে টাকায় দেড় পয়সা, এই আধপয়সা নিয়ে ধস্তাধস্তি। শেষ অবধি
শেষ অবধি কি হল তা আর শোনা হল না নবকুমারের, সহসা বাড়ির মধ্যে থেকে ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার-রোল ভেসে এল।
সর্বনাশ করেছে
সদুর নিষেধবাণী ভুলে নবকুমার সর্বনাশ শব্দটাই আবারও ব্যবহার করল, নিশ্চয় হয়ে গেল একটা কিছু!
সদু ততক্ষণে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
আর নবকুমার?
সে চলৎশক্তি হারিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিজেদেরই বাড়িখানার দিকে তাকিয়ে।
তীক্ষ্ণ তীব্র সানুনাসিক এই স্বরটা কার?
এ তো এলোকেশীর!
তবে হলটা কি?
কিন্তু যাই ঘটুক, সব কিছু ছাপিয়ে নবকুমারের প্রাণটা হাহাকারে ভরে উঠল এই ভেবে– এই অ-সাধারণ বৌ নিয়ে ঘর করা হল না নবকুমারের অদৃষ্টে!
মা হয় বৌকে মড়িপোড়ার ঘাটে পাঠাবে, নয় জন্মের শোধ বাপের বাড়ি বিদেয় করে দেবে।
মার চিৎকার উত্তরোত্তর আকাশে উঠছে।
আর দলে দলে পড়শীরা নবকুমারের বাড়ির দিকে দৌড়চ্ছে।
নবকুমার যাত্রাগানের দর্শকের মত পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে সেই দৃশ্য!