সকালবেলা নেড়ুকে হাতের লেখা মক্শ করতে হয়। পুবের উঠোনের রোদ যতক্ষণ না পেয়ারাতলার ঠিক নিচেটায় এসে পড়বে ততক্ষণ পর্যন্ত নেড়ুকে সেই দুরূহ কর্তব্যটি করেই চলতে হবে, এই নির্দেশ আছে তার উপর। ঋতুভেদে সীমানার কিছু ভেদ হয়, আপাতত ওই পেয়ারাতলা।
অবশ্য তার প্রতি আরও নির্দেশ আছে।
সেটা হচ্ছে তালপাতার গোছাগুলি ও দোয়াত-কলম নিয়ে বসার সময় এবং মকশ’র পর সেগুলি তুলে রাখার সময় ভক্তিভরে মা সরস্বতীকে প্রণাম করা। প্রণাম-মন্ত্রের সঙ্গে প্রার্থনা-মন্ত্রও যুক্ত করা আছে।
দেবীর প্রসন্নতা লাভের উপায় স্বরূপ বিদ্যা অনুশীলনের চাইতে স্তবস্ততি প্রণাম প্রার্থনার উপরই নেড়ুর আস্থা বেশী। কাজেই শব্দবোধের পাতা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি মুড়ে ফেলে, নিঃশব্দ স্তুতিতেই সময় বেশি যায় তার। চোখটা বুজে রেখেও তেরছা কটাক্ষের কৌশলে পেয়ারাতলার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে পরম ভক্তিভরে মন্ত্রোচ্চারণ করছিল সে পাততাড়িটি কপালে ঠেকিয়ে
ত্বং ত্বং দেবী শুভ্রবর্ণে,
রত্নশোভিত কুণ্ডলকর্ণে।
কণ্ঠে লম্বিত গজমোতিহারে,
দেবী সরস্বতী বর দাও আমারে।
লাগ লাগ বাণী কণ্ঠে লাগ–
যাবজ্জীবন তাবৎ থাক্।
দুষ্ট সরস্বতী দূরে যাক।
আমি থাকি গুরুর বশে,
ত্রিভুবন পূরিত আমার যশে।
দেবী-স্তবের কালে কিন্তু নেড়ু ভাবছিল দেবের কথা। সূর্যদেব।
আশ্চর্য! নিষ্ঠুর সূর্যদেবতাকে এত আন্তরিকভাবে মাতুল সম্বোধন করেও ভাগ্নের প্রতি তার মমতার কোনও প্রকাশ দেখতে পায় না নেড়ু। পেয়ারাতলার নিচেটায় আসার যেন কোনও গরজই নেই তার। অথচ তিনি সামান্য একটু কৃপা-দৃষ্টিপাত করলেই, করা মাত্রই, নেড়ুর আজকের মত যন্ত্রণা শেষ হয়। বার বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একই স্তবস্তুতি কতক্ষণ ধরেই বা করা যায়?
তবু কপাল থেকে কলম তালপাতা নড়ায় না নেড়ু, ঠেকিয়েই থাকে, এইমাত্র ঠেকানোর ভঙ্গীতে।
খুব যে বিদ্যে হচ্ছে! আহা মরে যাই, ছেলের কী ভক্তি রে!
সত্যবতীর শানানো গলা বেজে ওঠে।
বুকটা কেঁপে ওঠে নেড়ুর।
উঃ, যা মেয়ে ও! আর যা জেরা! তথাপি বাইরের প্রকাশে সত্যকে কোন স্বীকৃতি দেয় না নেড়ু,–একই ভাবে চোখ বুজে বিড়বিড় করতে থাকে।
সত্যবতী হি-হি করে হেসে ওকে একটা ঠেলা দিয়ে বলে, এখন যে বড় চোখ বোজা হচ্ছে? এতক্ষণ কি করছিলি? হুঁ বাবা, খালি চোখ পিটপিট আর পেয়ারাতলার দিকে তাকাসনি!
আঃ সত্য! নেড়ু এবার পাতা কলম কপাল থেকে নামিয়ে সযত্নে জলচৌকির উপর স্থাপিত করে বিরক্তি-ব্যঞ্জক গম্ভীর স্বরে বলে, নমস্কারের সময় গোলমাল করছিস কেন?
নমস্কার তো তুই সকাল থেকেই করছিস! এক পোর বেলা হয়ে গেল সেই এস্তক নমস্কারই হচ্ছে! দেখি নি যেন!
ইঃ, দেখেছিস তুই! নেড়ু উঠোনের দিকে তাকিয়ে দেখে। মনে হচ্ছে যেন মাতুল সূর্যদেব এতক্ষণে সদয় হয়েছেন, পেয়ারাতলার ঠিক নিচেটাতে কৃপাকটাক্ষ করছেন। অতএব বুকের বল বাড়ে তার। দৃপ্তকণ্ঠে বলে, কত মক্শ করলাম তখন থেকে!
কই দেখি কত! বলেই সত্য একটা কাজ করে বসে। হাতটা একবার মাথায় মুছে নিয়ে চট করে মা সরস্বতীর উদ্দেশে একটা প্রণাম নিবেদন করে নেড়ুর এইমাত্র রক্ষিত তালপাতার গোছায় এক টান মারে।
অ্যাই অ্যাই, ও কী হচ্ছে! শিহরিত নেড়ু ভয়ঙ্কর একটা ভয়ের সুরে বলে ওঠে, সত্য? তুই তালপাতায় হাত দিলি?
দিলাম তা কি! নির্ভীক স্বর সত্যর, আমি তো মা সরস্বতীকে পেন্নাম করে হাত দিয়েছি।
পেন্নাম করলেই সব হল? তুই না মেয়েমানুষ? মেয়েমানুষের তালপাতায় হাত ঠেকলে কি . জানিস না?
সত্য ইতিমধ্যে নেড়ুর সারা সকালের শ্রমফল নিরীক্ষণ শুরু করে দিয়েছে। বলা বাহুল্য খানি মাত্র পাতা কালি-কলঙ্কিত, বাকী সবগুলিই নিষ্কলুষ নিষ্কলঙ্ক। কাজেই আর একবার হি হি-র পালা।
খুব যে বলছিলি অনেক মকুশ করেছিস? কই কোথায়? দোয়াতে বুঝি কালির বদলি জল ভরেছিস? তাই চোখে ঠাহর হচ্ছে না?
সত্যর বিদ্রপের ভঙ্গী বড় তীক্ষ্ণ, কারণ উক্ত মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে চোখের তারা পাতার যতটা সম্ভব কাছে নিয়ে এসেছে সে, মুখে কৌতুকের আলোর ঝলমলানি।
এটা সহ্য করা শক্ত।
নেড়ু এক হ্যাঁচকায় নিজ সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে, বেশ থাক্। আমার বিদ্যে না হোক তোর কি? নিজের কি হয় দেখ। বলে দিচ্ছি গিয়ে সবাইকে, তালপাতে হাত দিয়েছিস তুই।
আর কেউ হলে সবাইকে বলে দেওয়ার ভীত-প্রদর্শনেই কাবু হয়ে পড়ে এবং আপসের সুরে আচ্ছা বেশ ভাই দেখলাম! ইত্যাদি অভিমানসূচক বাণী উচ্চারণ করে শত্রুপক্ষের মন নরম করে থাকে। কিন্তু সত্যর মনোভাব আপসহীন। তাই ভিতরে যাই হোক, বাইরে বিন্দুমাত্র বিচলিত ভাব দেখায় না সে, সমান জোরের সঙ্গেই বলে, বলে দিবি তো দিবি, সবাই আমার কি করবে শুনি? শূলে দেব?
দেয় কিনা দেখিস! চালাকি নয়!
কেন, মেয়েমানুষ তালপাতে হাত দিলে কি হয়? কলকেতায় তো কত মেয়েমানুষ লেখাপড়া করে।
তোকে বলেছে করে! পড়লে চোখ কানা হয়ে যায় তা জানিস?
কক্ষনো না, মিছে কথা! বড্ডই তুই জানিস! যারা পড়ছে তারা সব অমনি কানা হয়ে যাচ্ছে।
কলকেতা নামক অ-দৃষ্ট সেই দেশটায়, কদাচ কখনও যেখানের নাম কানে আসে, সেখানে সত্যিই কোনও মেয়েমানুষ লেখাপড়া করে কিনা এবং করলে তাদের চক্ষুযুগলকে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন রাখতে পারে কিনা, এ সম্পর্কে নেড়ুর স্পষ্ট কিছু জানা নেই, তবু নিজের অভিমতকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রাণপণ চেষ্টা করে সে, এখন না যাক–আসছে জন্মে যাবে। অমনি না!
আসছে জন্মে। হি-হি-হি! তাদের আসছে জন্মটা তুই দেখে এসেছিস বুঝি? আমি এই তোকে বলে দিচ্ছি নেড়ু, ওসব কিছু হয় না। বিদ্যে তো ভাল কাজ, করলে কখনও পাপ হতে পারে?
হ্যাঁ, বলেছে ভগবান তোর কান ধরে! ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে সত্য, ভগবান কখনো অমন একচোখা নয়। ওসব বেটাছেলেরাই ছিষ্টি করেছে।
বচসার শব্দ খুব মৃদু হচ্ছিল না, শব্দে আকৃষ্ট হয়ে পুণ্যি এসে দাঁড়ায় এবং সকৌতূহলে প্রশ্ন করে, কি ছিষ্টি করেছে রে বেটাছেলেরা?
সত্য মুহূর্তে অনুত্তেজিত ভাব পরিগ্রহ করে বলে, কিছু না, শাস্তরের কথা হচ্ছে।
শাস্তর!
পুণ্যি হালে পানি পায় না।
সহসা এখানে শাস্ত্রালোচনা শুরু হল কী বাবদ, সেটা অনুধাবন করতে চেষ্টা করে। ইত্যবসরে নেড়ু সেই বলে দেওয়ার সুরে বলে ওঠে, সত্যর সাহসখানা শুনবি পুণ্যিপিসী? তালপাতে হাত দিয়েছে, আবার বলছে দিয়েছি তো হয়েছে কি!
তালপাতে হাত!
এটা আবার আর এক আকস্মিকতা। তালপাতাটা কি জাতীয় সহসা সেটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে পুণ্যবতী।
তালপাতা কি রে? প্রশ্ন করে সত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে।
তাকে হাঁ করে দিয়ে সত্য হেসে উঠে দেওয়ালে পোঁতা পেরেক গোঁজা একখানা তালপাতার হাতপাখা পেড়ে নিয়ে বলে ওঠে, এই যে এই! দেখ, এখন হাতে পোকা পড়ল কিনা আমার!
সত্য! নেড়ু চোখ পাকিয়ে বলে, মা সরস্বতীকে নিয়ে তামাশা করছিস তুই?
প্রত্যেক সময় প্রত্যেক ব্যাপারেই সত্য জিতে যায়, নেড়ু হারে। নেড়ুর মজ্জায় অবস্থিত পৌরুষবোধ এতে যথেষ্টই আহত হয়, আজ সহসা সত্যকে শাসন করবার একটা ছুতো পেয়ে নেড়ুর আর উল্লাসের সীমা নেই। তাই সহসা করতলগত সেই শক্তিটাকে অবহেলায় বাজে খরচ করে ফেলতে পারছে না, রীতিমত করে ভাঙিয়ে খেতে চাইছে চেখে চেখে।
এবার আর হাসে না সত্য, বিরক্তি প্রকাশ করে, সেই ওর অভ্যস্ত ভঙ্গীতে জোড়াভুরু কুঁচকে, হাঁদার মতন কথা কস নে নেড়ু। তামাশা আমি মা সরস্বতীকে করছি না, করছি তোকে। তালপাতে একটু হাত দিয়েছি তো কী কাণ্ডই করছি। যেন সগৃগো মত্য রসাতলে গেছে! শুধু হাত দেওয়া কেন, আমি তো লিখতেও পারি।
লিখতেও পারিস!
যুগপৎ নারী-পুরুষ দুই কণ্ঠে উচ্চারিত হয় এই সর্পাহত-কণ্ঠবৎ শব্দ। আড়ষ্ট হয়ে গেছে পুণ্যি আর নেড়ু।
কিন্তু নিষ্ঠুর সত্য ওদের এই আঘাতপ্রাপ্ত চিত্তেই আরও আঘাত হেনে বসে, পারিই তো, এই দেখ।
ঝপ করে আলোচ্য তালপত্রখণ্ডের একখানা টেনে নিয়ে দোয়াতে কলম ডুবিয়ে পরিপাটি করে লিখে ফেলে সত্য, কর খল ঘট। লিখে অদৃশ্যের উদ্দেশ্যে আর একটা প্রণাম ঠুকে বলে, আরও কত লিখতে পারি?
বিস্ময়ের ঘোর কাটতে কিছুক্ষণ লাগে। পুণ্যির চাইতে নেড়ুই বেশী বিস্ময়াহত। যে দুরূহ কর্মের চেষ্টায় তার ঘাম ছুটে যায়, এত অনায়াসলীলায় সেটা করে ফেলে সত্য!
তাছাড়া কেমন করে?
মা সরস্বতী কি সহসা ওর উপর ভর করেছেন? যেমন নাকি শুনতে পাওয়া যায় কবি কালিদাসের উপর করেছিলেন?
লেখা শব্দ কটির উপর চোখ রেখে ঝিম হয়ে তাকিয়ে থাকে নেড়ু। আর পুণ্যি স্পর্শ বাচিয়ে তালপাতাখানার উপর ঝুঁকে পড়ে বিস্ফারিত নেত্রে বলে, কোথ থেকে শিখলি রে সত্য? কে শেখালে?
শেখাতে আবার কার দায় পড়েছে, আমি নিজে নিজেই শিখেছি! দেখে দেখে!
নিজে নিজেই শিখেছিস? দেখে দেখে?
না তো কি?
দো’ত কলম পেলি কোথা?
দো’ত কলম কে দিচ্ছে! সত্য ঝোঁকের মাথায় তার গোপন কথাটি প্রকাশ করে বসে, বটপাতার ঠুলি গড়ে, তার মধ্যে পুঁইমেটুলির রস গুলে কালির মতন করি।
তাজ্জব বনে যাওয়া দুটি প্রাণী ক্ষীণকণ্ঠে বলে, আর পাত কলম?
তোরা আর হাঁ-করা কথা কস নে বাপু। পৃথিবীর তালগাছ কি কেউ সিঁদুকে বন্ধ করে খেছে, না আকিঞ্চন করে খুঁজলে একটা শরকাঠি মেলে না?
গিন্নীর মতন মুখ করে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে সত্য।
এতক্ষণে বুঝি হদিস পায় পুণ্যি। তা সেও গিন্নীদের মত গালে হাত দিয়ে বলে, তাহলে তুই শুকিয়ে মশ করিস? উঃ ধন্যি বাবা! কাউকে টেরই পেতে দিস না? কখন হাত পাকাস?
সত্য রহস্যের হাসিতে মুখ রঞ্জিত করে বলে, যখন তোরা থাকিস না।
কিন্তু সত্য! পুণ্যি চিন্তিত স্বরে বলে, খেয়াল করে তো করছিস, দেখে আহ্লাদও হচ্ছে, কিন্তু হাজার হোক মেয়েমানুষ, এতে তোর পাপ হবে না?
কেন, পাপ হবে কেন? সত্য সহসা উদ্দীপ্ত তেজের সঙ্গে বলে ওঠে, মেয়েমানুষরা যে রাতদিন ঝগড়া কেদল করছে, যাকে তাকে গালমন্দ শাপমন্যি করছে, তাতে পাপ হয় না, আর বিদ্যে শিখলে পাপ হবে? বলি স্বয়ং মা সরস্বতী নিজে মেয়েমানুষ নয়? সকল শাস্তরের সার শাস্তর চার বেদ মা সরস্বতীর হাতে থাকে না?
নেড়ুর আর বাক্যস্ফুর্তি নেই।
এত বড় অকাট্য যুক্তির সামনে পড়ে গিয়ে যেন বিরাট একটা দৃষ্টির দরজা খুলে যায় তার চোখের সামনে।
সত্যিই তো বটে, মা সরস্বতীটি স্বয়ং নিজেই তো মেয়েমানুষ।
এতবড় স্পষ্ট সত্য কি করে এত দিন তার দৃষ্টির বাইরে ছিল? আর এই সত্যবতীটাই বা কেমন করে উদঘাটন করে ফেলেছে সেই সবাইয়ের ভুলে থাকা, অথচ পরম স্পষ্ট কথাটাকে।
নে পুণ্যি, ঘাটে যাই চ।
আলোচনায় ইতি টেনে দিয়ে উঠে পড়ে সত্যবতী, আর দেরি করলে গিন্নীরা ভাত গেলবার জন্যে হাক পাড়বে, ভাল করে চানই হবে না।
কথাটা মিথ্যা নয়, জলে পড়লে সহজে আশ মিটতে চায় না এদের। সাঁতার দিতে দিতে হাঁপিয়ে না পড়া পর্যন্ত ভাল করে চান হয় না।
চ, বলে উঠে পড়ে পুণ্যি, কিন্তু নেড়ুর সঙ্গে চোখে চোখে একটা ইশারা হয়ে যায় তার।
কিন্তু না, অসদভিপ্রায় ছিল না তাদের, বলে দেওয়ার মনোভাবও ছিল না আর। সত্যর কিন্তু প্রকাশ করে সকলকে চমৎকৃত করে দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল।
সত্য যে তাদেরই একজন।
সত্যর মহিমায় তো তাদেরই মহিমা!
.
কিন্তু সদভিপায়ের ফল কি সব সময় সুস্বাদু হয়?
হয় না।
হয় না, সেটাই আর একবার প্রমাণিত হয়ে গেল নেড়ুর সত্যোদঘাটনে।
হুলুস্থুল পড়ে গেল অন্দর-বাড়িতে।
প্রচ্ছন্নে বইতে লাগল রামকালীর মেয়েকে আশকারা দেওয়ার সমালোচনা আর প্রত্যক্ষে ছিছিক্কার পড়তে লাগল সত্যর বুকের পাটার!
ও কি ভেবেছে শ্বশুরঘর করতে হবে না ওকে?
করতে হবেও না, শিবজায়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলেন, শ্বশুররা টের পেলে উদ্দিশে হাতজোড় করে ত্যাগ করবে ও বৌকে।
মোক্ষদা বলেন, হারামজাদী যখনই জটার নামে ছড়া বেঁধেছিল, তখনই সন্দ হয়েছিল আমার। এখন বুঝছি।
রাসুর মা কোনদিনই কোন কথায় বড় থাকে না, কাজের পাহাড় নিয়েই কাটায় সারা দিন, কিন্তু আজকের অপরাধের আবিষ্কর্তা নাকি স্বয়ং তারই পুত্ররত্ন, তাই বোধ করি কিছুটা দাবি অনুভব করে কথা বলার।
আস্তে আস্তে বলে, একে তো ঘরের একটা বৌ, যা নয় তাই কেলেঙ্কারি করে গালে-মুখে চুনকালি দিয়ে জন্মের শোধ লোকের কাছে হেয় করে রেখে গেল, আবার ঘরের মেয়েরাও যদি যা ইচ্ছে তাই করতে থাকে-
কথা শেষ করে না রাসুর মা, শুধু দুটো পাতকই যে একই গর্হিতের পর্যায়ে পড়ে সেইটুকুরই ইশারা দেয়।
কাঠ হয়ে তাকিয়ে থাকে ভবনেশ্বরী।
শুধু কাশীশ্বরীই নীরব। তাঁর আর মুখ নেই।
সমালোচনার উদ্দমতা কিছুটা স্তিমিত হলে দীনতারিণী প্রায় মিনতির ভঙ্গীতে বলেন, যাক গে বাবা, এই নিয়ে আর বেশী কথাকথিতে কাজ নেই সেজঠাকুরঝি। প্রবাদে বলে, কথা কানে হাঁটে। কোন্ সূত্রে কার দ্বারা চালিত হয়ে কুটুমবাড়ির কানে উঠবে, হয়ত সেই নিয়ে কি বিপত্তি বাধবে কে বলতে পারে! একে তো
দীনতারিণীও কথায় একটা অকল্পিত সম্ভাবনা উহ্য রেখে টেনে ছেড়ে দেন। কাশীশ্বরীর সামনে আর শঙ্করীর কথা স্পষ্ট করে তোলেন না।
তবু মোক্ষদা উচ্চ চীৎকারে ভবিষ্যদ্বাণী করতে ছাড়েন না, সে তুমি যতই সাবধান হও বড়বৌ, আমি এই আগবাড়িয়ে বলে দিচ্ছি, ও মেয়ের কপালে অশেষ দুঃখ আছে। আজ নয় তুমি আমি চেপে গেলাম, কিন্তু ওকে নিয়ে যারা ঘর করবে, তাদের কি আর গুণ বুঝতে বাকী থাকবে? হবে না তো কি, বাপে শাসন না করলে কি আর বেয়াড়া মেয়ে-ছেলে শায়েস্তা হয়?
দীনতারিণী অকূলের কূল হিসেবে মিয়মাণভাবে বলেন, তা তুমি না হয় রামকালীকে বুঝিয়ে বলো?
রক্ষে করো বড়বৌ। আমি আর হেয় হতে চাই না। আমি লাগাতে যাব, আর তিনি মেয়েকে শাসন তো দূরের কথা, উলটে আরও আশকারা দেবেন।
অগত্যাই দিশেহারা দীনতারিণী ভুবনেশ্বরীর প্রতিই দৃষ্টিক্ষেপণ করেন, তা তুমিও তো সময়ান্তরে যখন তার মনমেজাজ ঠাণ্ডা দেখবে, একটু বুঝিয়ে বলতে পার মেজবৌমা? সত্যি যে মেয়ে তোমার স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। পরের ঘরে পাঠাতে তো হবে?
ভুবনেশ্বরী অবশ্য এ কথার কোন উত্তর দেয় না। দেওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। যদিও তার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তবু গুরুজনের সমক্ষে স্বামী সম্পর্কে উল্লেখই যে যারপরনাই লজ্জাজনক। ভুবনেশ্বরী যে রামকালীর সঙ্গে কথা কয়, এত বড় লজ্জার কথাটা শাশুড়ী এই লোকসমাজে প্রকাশই বা করে বসলেন কেন? ছি ছি!
লজ্জা প্রতিকারের আর কিছু না দেখে মাথার ঘোমটাটাই আর খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে মাথা হেঁট করে ভুবনেশ্বরী।
তা মাথাটা আর ভুবনেশ্বরী উঁচু করতে পায় কখন?
স্বামীকেও যে তার বড় ভয়।
তবু বড়ই চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছে সে মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে। অহরহ সকলেই যে বলছে–ও মেয়ে শ্বশুরঘর করতে পারবে না।
.
আসামী এক, বিচারকও এক, শুধু কাঠগড়া আর অভিযোক্তা আলাদা।
তবে আসামীকে প্রথমেই হাজির করে না ভুবনেশ্বরী, তাকে শাসিয়ে রেখে এসে, অনেক কৌশলে ভয়ানক একটা দুঃসাহসিক চেষ্টায় দিনের বেলা একবার স্বামীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে ফেলে সে। রামকালী যখন মধ্যাহ্ন-বিশ্রাম করছেন, সে সময় কাছে এসে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়ায়।
রামকালী ঈষৎ আশ্চর্য হয়ে বলেন, কিছু বলবে?
স্বামীর স্নেহকোমল সুরে সহসা চোখে জল এসে যায় ভুবনেশ্বরীর, উত্তর দিতে পারে না, শুধু ঘোমটাটা একটু কমায়।
কি হল? রামকালী মৃদু কৌতুকে বলেন, বাপের বাড়ি যেতে ইচ্ছে হচ্ছে?
না। ভুবনেশ্বরী মাথা নেড়ে বাষ্পরুদ্ধ স্বরে বলে, বলছি সত্যর কথা।
সত্যর কথা! কেন? আর একটু হাসেন রামকালী, আবার কি মহা অপরাধ করে বসল সে?
করছে তো সব সময়। অভিমানের আবেগে কথায় জোর আসে ভুবনেশ্বরীর, তুমি তো সবই হেসে ওড়াও। কথা শুনতে হয় আমাকেই।
বাজে কথা গায়ে মাখতে নেই মেজবৌ।
বাজে? মেয়ে কি করেছে শুনলে আর
কি করেছে?
লিখেছে।
লিখেছে! লিখেছে কি?
তা জানি না। নেড়ুর তালপাতে কি সব বইয়ের কথা লিখেছে। আবার নাকি আস্পদ্দা করে বলেছে, আরও অনেক লিখতে পারে। বুকের পাটা কত, বাগান থেকে তালপাতা কুড়িয়ে শরকাঠি যোগাড় করে পুইমেটুলির রস দিয়ে লেখা শিখেছে!
এর পর রামকালী চমকৃত না হয়ে পারেন না। বলেন, তাই নাকি? গুরুমশাইটি কে? নেড়ুই নাকি?
নেড়ু? নেড়ু বলেছে সাতজন্ম চেষ্টা করলেও নাকি অমন হরফ সে লিখতে পারবে না!
বটে! কই তাকে একবার ডাক তো দেখি? আসামী পাশের ঘরেই অবস্থান করছে, ভুবনেশ্বরী তাকে চোখ রাঙিয়ে বসিয়ে রেখে এসেছে।
স্বামীকে যে খুব বেশী দুশ্চিন্তিত করতে পেরেছে ভুবনেশ্বরীর এমন ভরসা হয় না, শাস্তির মাত্রা কি আর তেমন গুরু হবে? অথচ লঘু শাস্তিতে কাজ হবে বলে মনে হয় না, কারণ সত্যর ভাব যথারীতি অনমনীয়। তাই স্বামীকে একটু তাতিয়ে তোলবার আশায় বলে, ডাকছি, বেশ ভাল করে শাসন করে দিও। শুধু যে আস্পদ্দার কাজ করেছ তাও তো নয়, আলাত পালাত কত সব তক্ক রেছে। কলকাতায় নাকি অনেক মেয়েমানুষ আজকাল লেখাপড়া শিখছে, তাদের তো কই চোখ না হচ্ছে না, বিদ্যের দেবী মা সরস্বতীই তো নিজে মেয়েমানুষ, এই সব বাচালতা। তুমি একটু উচিত শিক্ষা দিয়ে বকবে মেয়েকে, বুঝলে?
শেষাংশে মিনতি ঝরে পড়ে ভুবনেশ্বরীর কণ্ঠে।
সরে গিয়ে পাশের ঘর থেকে ইশারায় ডাকে মেয়েকে। স্বামীর সামনে তো আর গলা খুলতে পারে না।
.
সত্য এসে হেঁটমুণ্ডে দাঁড়ায়।
কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াবার সময় এটাই পদ্ধতি সত্যর। উত্তরদানকালে মুখ তোলে।
রামকালী প্রথমটায় একটুও অন্তত ধমকে দেবেন এ আশা ছিল ভুবনেশ্বরীর, কিন্তু তিনি তাকে হতাশ করলেন। ভাবলেশশূন্য কণ্ঠে সহজভাবে বললেন, তুমি নাকি লিখতে শিখেছ?
মুখটা অবশ্য একটু পাংশু হল সত্যবতীর।
কই, কি লিখেছ দেখি?
অস্ফুটে যা উত্তর দেয় সত্য তার অর্থ এই–অপরাধের পর আর সেই অপরাধের চিহ্ন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। নেড়ু জানে।
আচ্ছা ঠিক আছে। আবার লিখতে পার?
সত্যবতী মুখ তুলে তাকায়।
কই বাপের চোখে তো রুদ্ররোষের চিহ্ন নেই। তবে বোধ হয় তেমন রাগ করেন নি। তাই জবাবে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে সত্য।
আচ্ছা কই, লেখো দিকি।
হাত বাড়িয়ে চৌকির পাশে অবস্থিত জলচৌকিতে রক্ষিত দোয়াত কলম ও খসখসে একখানা বালির কাগজ টেনে নেন রামকালী, বলেন, লেখো–যা শিখেছ লেখো।
এ কী! এ যে হিতে বিপরীত!
ধমক চুলোয় যাক, মেয়ের হাতে আবার কাগজ কলম তুলে দিচ্ছেন রামকালী! নাটকের শেষ দৃশ্যের জন্যে?
অবশ্য এমনও হতে পারে, যাচাই করে দেখছেন নেড়ুর কথার সত্যতা।
সত্যি, আগাগোড়া ব্যাপারে নেড়ুর চালাকি হতে পারে।
কিন্তু তাই কি? হতচ্ছাড়া মেয়ে তো অস্বীকারও করছে না।
ততক্ষণে সত্য ঘাড় গুঁজে দু-তিনটি শব্দ লিখে ফেলেছে। অবশ্য তালপাতার নিয়মে অধিক জোর প্রয়োগে কাগজগাত্রে সামান্য সামান্য ক্ষতের সৃষ্ট হল, কিন্তু লেখা হল।
রামকালী সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারকয়েক দেখে কোনও মন্তব্য না করে শান্তভাবে বলেন, কলকাতায় অনেক মেয়ে লেখাপড়া করছে, এ কথা তোমায় কে বললে?
ছোটমামী।
তাই নাকি? তিনি কোথা থেকে–ও তিনি যে কলকাতারই মেয়ে! তাই না?
এ উদ্দেশটা ভুবনেশ্বরীকে। কিন্তু ভুবনেশ্বরী তো আর কত বড় মেয়ের সামনে গলা খুলে কথা বলতে পারে না, ঘাড় কাত করে সায় দেয়।
তা তিনি জানেন লেখাপড়া? তোমার মামী?
একটু একটু জানেন। বেশি করে কবে আর শিখতে পেল বেচারা? শুধু বলছিল, একজন মেম নাকি দেশী ইস্কুল খুলেছে, আর একজন সায়েব বিলিতী ইস্কুল খুলে দিয়েছে, কলকাতার মেয়েরা আর মুখ্যু থাকবে না।
মেয়েদের লেখাপড়া শিখে লাভ কি? তারা কি নায়েব গোমস্তা হবে? সকৌতুক হাস্যে মেয়েকে প্রশ্ন করেন রামকালী।
এবার সত্যবতীর তেজের পালা। সব সইতে পারে সে, সইতে পারে না ব্যঙ্গ।
নায়েব গোমস্তা হতে যাবে কেন? লেখাপড়া শিখে নিজে নিজে রামায়ণ মহাভারত পুরাণ বই টই পড়তে পারে তো? কবে কথকঠাকুর কোথায় পড়বেন বলে অপিক্ষে করে থাকতে হয় না।
মেয়ের এই ক্রুদ্ধমূর্তি আর সগর্ব উক্তি কি রামকালীর খুশির খোরাক হয়? তাই আরও একটু উত্তপ্ত করতে চান তাকে?
তা মেয়েমানুষের এত বেদপুরাণ জানবার দরকারই বা কি?
এবার সত্যবতী স্থান পাত্র বিস্মৃত হয়ে নিজ মূর্তি ধরে, এত যদি না দরকারের কথা তো মেয়েমানুষের জন্মাবারই বা দরকার কি, তাই বল তো বাবা শুনি একবার?
মেয়ের এই দুঃসাহসে ভুবনেশ্বরীর বুক থরথর করে, অত বড় মানুষটার মুখে মুখে এতখানি চোপা!
হবে না, হবে না–এ মেয়ের ককখনো শ্বশুরবাড়ি ঘর করা হবে না।
কিন্তু ভুবনেশ্বরীকে চমকে দিয়ে সহসা হেসে ওঠেন রামকালী, বেশ সশব্দেই।
তার পর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি লেখাপড়া শিখতে চাও?
চাই তো, পাচ্ছি কোথায়?
ধরো যদি পাও?
তা হলে রাতদিন লেখাপড়া করব।
অতটা করতে হবে না। নিয়ম করে কিছুক্ষণ পড়লেই হবে। কাল থেকে দুপুরবেলা এই সময় আমার কাছে পড়বে।
পড়বে!
ভুবনেশ্বরী আর কথা না বলে পারে না।
হ্যাঁ, পড়বে লিখবে! পুঁইমেটুলির কালি দিয়ে নয়, সত্যিকার দোয়াত কলমই দেব ওকে।
বাবা!
সত্যর মুখ দিয়ে মাত্র এই দুটি অক্ষর সম্বলিত শব্দটা বেরোয়। আর ভুবনেশ্বরীর দু চোখে শ্রাবণ নামে।