রোদে পিঠটা চিনচিন করছে অনেকক্ষণ থেকে, হঠাৎ যেন হু-হু করে জ্বলে উঠল। ওঃ, বকুলগাছের ছায়াটা দাওয়া থেকে সরে গেছে! বেলা তা হলে কম হয় নি! বিপদে পড়লেন মোক্ষদা, দু হাত জোড়া, অথচ পিঠের কাপড়টা সরে গিয়ে সরাসরি রোদটা পিঠের চামড়ায় লাগছে। নিজে দেখতে পাচ্ছেন না মোক্ষদা, আর কেউ কাছে থাকলে দেখতে পেত মোক্ষদার হত্তেল-রঙা পিঠটার কতকাংশ ফোস্কাপড়ার মত লাল হয়ে উঠেছে।
নাঃ, তসর থানখানা না পরে ভিজে থানখানা পরে আমতেল মাখতে বসলেই হত। ভিজে কাপড়ে যেন দেহের দাহ অনেকটা নিবারণ হয়। কানাউঁচু ভারী ভারী পাথরের খোরা দুখানা খানিকটা টেনে নিয়ে গিয়ে সরে দাওয়ার খুঁটির ছায়াটুকুতে পৃষ্ঠরক্ষা করতে গেলেন মোক্ষদা।
সমুদ্রে তৃণখণ্ড। তাছাড়া রোদ এখন দৌড়চ্ছে, এখুনি খুটির ছায়া সরবে।
হঠাৎ মোক্ষদা একটা সত্য আবিষ্কার করে বসলেন। সারা বছরটাই রোদে পুড়ে পুড়ে মরেন তিনি। এই তো কচি আমের আমতেল, এর পরই বাখড়া বাধা আমের গুড়-আম, মসলা-আম, তার পরেই পড়ে যাবে আমসত্ত্বর মরসুম। আর সে মরসুমকে সামলে তোলা তো সোজা নয়। আমসত্ত্বর পালা চুকতে চুকতেই অবশ্য বর্ষা নামে, সেই দু-তিনটে মাসই শুধু রোদে পোড়ার ছুটি, বর্ষা শেষ হতেই দুর্গোৎসবের সুর ওঠে। দুর্গোৎসবের আগে সারা ভাড়ারটাতেই তো ঝাড়া বাছা রোদে দেওয়ার ধুম চলে, তারপর পড়ে তিলের নাড়ুর ধূম।
বদ্যি চাটুয্যের বাড়ির দুর্গোৎসবের তিলের নাড়ু একটা বিখ্যাত ব্যাপার, হাতে বাগিয়ে ধরে কামড় দিতে পারা যায় না। এত বড় নাড়ু! পক্কান্ন আনন্দ নাড়ু মুড়কির মোয়া সবই কবরেজ-বাড়ির বিখ্যাত, কিন্তু সে সব তো তবু পাঁচহাতের ব্যাপার, নিতান্ত প্ৰতিমার ভোগের উপর্যুক্ত সেরকতক জিনিস গঙ্গাজলে ভোগের ঘরে তৈরী হলেও বিরাট অংশটায় অনেকে হাত লাগায়। কিন্তু তিলের নাড়ুটি সম্পূর্ণ মোক্ষদার ডিপার্টমেন্ট। কারণ তিলের নাড়ুর অমন হাত নাকি —শুধু এ গ্রামে কেন—এ তল্লাটে নেই। তা সেই নাম কি আর আমনি হয়েছে, আগাগোড়া নিজের হাতে রাখেন বলেই না এদিক ওদিক হতে পায় না! বস্তা বস্তা তিল তো এসে হাজির হল, তার পর? সেই তিল ঝাড়া-বাছা, নিখুঁত করে ধুয়ে নিপাট করে রোদে শুকিয়ে ঝুনো করা, ঢেকিতে কোটা, প্ৰকাণ্ড পেতলের সরা চড়িয়ে গুড় জ্বাল দিয়ে দিয়ে নিটুট নিশ্চিছদির ধামায় সেই তিলচুর মেখে মেখে তাড়াতাড়ি গরম থাকতে থাকতে নাড়ু পাকিয়ে ফেলা, এর কোনটা নিজের হাতে না করলে চলে? একবার বুঝি তিলটা কুটেছিল। সেজবৌতে আর বড়বৌমাতে, সেবার তো নাড়ু দিয়ে মজল। আগাগোড়া খোসায় ভর্তি। রঙও হল তেমনি কেলে-কিষ্টি। রামকালী নাড়ু দেখে হেসেছিলেন, প্রশ্ন করেছিলেন, এ নাড়ু কার তৈরী?
সেই থেকে সাবধান হয়ে গেছেন মোক্ষদা। টেকির গড়ের কাছে কাউকে একটু বসানো ছাড়া আর সব একা করেন।
দুর্গাপূজোর রোদে পোড়া তো শুধুই তিলের নাড়ু নয়, বাড়ি বাড়ি নেমন্তন্নর কথা বলতে যাওয়া, গুরুপুরুতের বাড়ি সিধে দিতে যাওয়া সে সবও তো মোক্ষদার ডিউটির মধ্যেই। কারণ তিনি ঝিউড়ি মেয়ে। কাশীশ্বরীও কতকটা করেছেন আগে আগে, কিন্তু ইদানীং তিনি রোগে কেমন জবুথবু হয়ে গেছেন। মাঠঘাট ভেঙে রোদে রোদে ঘুরে কাজ উদ্ধার করার সামর্থ্য নেই। মোক্ষদাই সব করেন, আর দিনে অন্তত বার চোদ্দ-পনেরো স্নান করেন।
কেন কে জানে, আজ রোদের কথাটাই বার বার মনে পড়ছে মোক্ষদার। মনে হল পূজোর ঝঞ্ঝাট কাটতে না-কাটতেই তো বড়ির মরসুম। বছরে বারো-চোদ্দ মণ বড়ি লাগে। আশা-নিরামিষ দুদিকের প্রয়োজনের দায়টা পোহানো হয় এই দিকেই, কারণ বড়িও তো আম-কাসুন্দির মতই শুদ্ধাচারের বস্তু। আর শুদ্ধাচারের ব্যাপারে কাকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হবেন মোক্ষদা নিজেকে ছাড়া?
বড়ি দিতে দিতে মোক্ষদার হত্তেল রঙ কালসিটে মেরে যায়। তবে জিনিস যা হয় তাক লাগাবার মত। ডাকসাইটের হাত। সাবধানীও খুব মোক্ষদা, কাউকে ছুতেই দেন না। সাধ্যপক্ষে, বড় বড় তিজেলে ভরে সরাচাপা দিয়ে সাঙায় তুলে রাখেন, সময়মত বার করে দেন। কত তার স্বাদ। কুমড়ো বড়ি, খাস্তা বড়ি, পোস্ত বড়ি, তিলের বড়ি, জিরের বড়ি, ঝালমশলার বড়ি, টকে-সুক্তয় দিতে মটর-খেসারির বড়ি—ব্যবহার অনেক।
ওরই মধ্যে মূলোর বড়িটা আবার আলাদা রাখতে হয়, মাঘ মাসে পাছে ভুলে খাওয়া হয়ে যায়। মাঘ মাসে মূলো খাওয়া আর গোমাংস খাওয়ায় তো তফাৎ কিছু নেই। … খুঁটির রোদটা সরে গেছে, পিঠটা আবার চিনচিন করছে। মনটাও যেন চিনচিন করছে।
বড়িপর্ব সারা হতেই আসে কুল, আসে তেঁতুল।
কবে তবে রোদে পোড়ার ছুটি?
সারা বছর ধরে এই রোদে পোড়ার দায়িত্ব মোক্ষদাকে দিয়েছে কে, এ কথা কে বলবে? তবে মোক্ষদা জানেন এটা তাঁরই দায়িত্ব।
আমতেল মাখা একটা সময়সাপেক্ষ কাজ। চটকে চটকে তেলে-আমে। মিশোতে হবে তো? হয়েছে এতক্ষণে, এবার রাইসরষের মিহিগুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে ক্ৰমাগত রোদ খাওয়ানো।
কোমরটা টান করে উঠে পড়লেন মোক্ষদা, পিঠের জ্বালা-কয়ার জায়গাটা নড়াচড়া পেয়ে আর একবার হু-হু করে উঠলো। কিন্তু কী আশ্চর্য, সরষে গুঁড়োবার জন্যে রান্নাঘরে এসে ঢুকতেই মনটা হুঁ-হুঁ করে উঠলো কেন?
ঘরে ঢুকেই হঠাৎ কেমন বোকার মত দাঁড়িয়ে পড়লেন মোক্ষদা। ঘরটা আজ এত বড় দেখাচ্ছে কেন? কই, এমন তো কোন দিন দেখায় না! বরং ভাত বাড়ার সময় পরস্পরের গা বাঁচিয়ে ব্যবধান রেখে ঠাঁই করতে তো জায়গার অকুলানই লাগে।
ঘরের মধ্যে তো রোদ নেই, তবু এই ছায়াশীতল প্ৰকাণ্ড লম্বা ঘরখানা যেন ওই রোদে খা খাঁ প্ৰকাণ্ড উঠোনটার মতই বা ঝা খা খা করছে। আর সেই খা খা করা ঘরের এক প্রান্তে বড় বড় দুটো উনুন তাদের মাজাঘষা নিকোনো চুকোনো চেহারা নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে বহু অকথিত শূন্যতার প্রতীকের মত।
উনুন দুটোকে আজ আগুনের দাহ সহ্য করতে হবে না। ওরা হয়তো এই নিরালা ঘরে স্তব্ধ হয়ে বসে নিজেদের শূন্যতার পরিমাপ করবার অবকাশ পাবে।
আজ ওদের ছুটি। আজ এদের একাদশী।
মোক্ষদার ছুটি নেই কেন?
ঘরের নর্দমার কাছবরাবর একটা জলভর্তি ঘড়া বসানো থাকে-নেহাৎ সময়-অসময়ের জন্যে। মোক্ষাদাই শেষবারের মানের পর এনে রেখে দেন।
তেল-তেল হাতটা ঘড়া কাত করে ধুয়ে নিয়ে মোক্ষদা। হঠাৎ আছড়া আছড়া জল নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে লাগলেন, পিঠের রোদে চিনচিনে জায়গাটার জুলুনি একটু ঠাণ্ডা হোক। দূর ছাই, হাত ধুয়ে পুকুরে গেলেই হত, তবু একবার গা-মাথা ভিজিয়ে আসা যেত। গায়ের চামড়াটা খানিক ভিজলেও যেন ভেতরের তেষ্টাটা খানিক কমে।
একাদশীর দিন তেষ্টা কথাটা মনে আনাও পাপ। এ কি আর জানেন না মোক্ষদা? তায় আবার তার মত বয়স-ভাটিয়ে-যাওয়া শক্তিপোক্ত মজবুত বিধবার! কিন্তু মনে করব না বললেও মনে যদি এসে যায়, সে পাপকে তাড়ানো যায় কোন অস্ত্ৰে?
রোদ লাগলে বোশেখ-জষ্টির দুপুরে তেষ্টাটা জানান দেয় বেশী। কিন্তু উপায় কি? আজকেই যে যত রাজ্যের বাড়তি কাজ করবার পরম দিন। আজকের মতন এমন অখণ্ড অবসর আর কদিন জোটে।
রাইসরষের সন্ধানে কুলুঙ্গীতে তুলে রাখা রঙিন ফুলকাটা ছোট ছোট ছোবা হাঁড়ির একটা পাড়লেন মোক্ষদা। সব হাঁড়িতে একেবারে সম্বৎসরের মশলা ঝেড়ে বেছে তুলে রাখা হয়, আর নিত্য প্রয়োজনে দুটি দুটি বার করে কাঁচা ন্যাকড়ার কোণে কোণে পুঁটুলি বেঁধে রাখা হয। শুধু এরকম অনিত্য প্রয়োজনেই মূল ভাঁড়ারে হাত পড়ে।
একটা পাথরবাটিতে আন্দাজমত সরষে ঢেলে নিয়ে শিল পেতে বসতে যাচ্ছিলেন মোক্ষদা, হঠাৎ দরজার কাছে শিবজায়ার গলা বেজে উঠল, কালে কালে কি হল গো, এ যে কলির চারপো পুরল দেখছি! আমাদের ধিঙ্গ অবতার মেয়ের আস্পদ্দার কথাটা শুনেছ ছোটঠাকুরঝি?
ধিঙ্গী অবতার মেয়ের আস্পদ্দার ইতিহাস শোনার আগেই ভাজের আসপদ্দায় রে-রে করে ওঠেন। মোক্ষদা, উঠোনের পায়ে তুমি দাওয়ায় উঠলে সেজবৌ? আর ওইখানেই আমার আচারের খোরা! বলি তোমরা সুদ্ধ যদি এরকম যবন হও—
শিবজায়া ঈষৎ রুষ্টভাবে বললেন, তোমার এক কথা ছোটঠাকুরবি, উঠোনের পায়ে দাওয়ায় উঠে আসব আমি অমনি আমনি! এই দেখা পায়ে গোবর লেগে। হাতে করে একনাদ এনে পৈঠের নীচেয় ফেলে সেই গোবর দুপায়ে মাড়িয়ে তবেই না উঠেছি!
নিতান্তপক্ষে পুকুরে নেমে পা ধুয়ে আসা যদি অসম্ভব হয়, তা হলে অনুকল্প হিসেবে এই ব্যবস্থা দিয়ে রেখেছেন মোক্ষদা। তবু সেজবৌয়ের আশ্বাসবাণীতে তেমন নিশ্চিন্ত হলেন না। সন্দিগ্ধ সুরে বললেন, বলি গোবরটা নিজেদের তো? নাকি আর কারুদের ঘরের এটোকাটা খাওয়া গরুর?
শোন কথা— জেরা থামানোর চেষ্টায় বলে ওঠেন শিবজায়া, তোমাদের উঠোনে আবার অপরের গরুর গোবর আসবে কোথা থেকে?
কিন্তু থামাতে চাইলেই কি সব জিনিস থামে? মোক্ষদার জেরাও থামল না। তিনি একটু কটুহাস্যে বলে উঠলেন, ও মা লো! আমাদের উঠোনে অন্যের গরুর গোবর আসবে কোথা থেকে? তোমার কথা শুনে মাঝে মাঝে মনে হয়। সেজবৌ, তুমি যেন এইমাত্তর মায়ের পেট থেকে পড়লে!
শিবজায়া ননদকে খুব ভয় করলেও, তবু ছোট ননদ। তাই বিরক্ত সুরে বলে ফেলেন, নাও বাবা, তোমার কাছে আসাই দেখছি ঝকমারি! গোবিন্দবাড়ি থেকে ফিরতে পথে আমাদের কীর্তিমান মেয়ের কীর্তির কথা শুনে হা হয়ে গেলাম, তাই, থাক গে—
মোক্ষদা এতক্ষণে একটু নরম হন। প্রায় সন্ধির সুরেই বলেন, কেন, কী আবার করল কে? সত্য বুঝি?
তবে আবার কে! শিবজায়া ঔদাসীন্য ত্যাগ করে। মহোৎসাহে পুরনো সুর ধরেন, সত্য ছাড়া আর কার এত বুকের পাটা হবে? হারামজাদী নাকি জটার নামে ছড়া বেঁধে পাড়ার গুষ্টিসুদ্ধ ছেলেমেয়েকে শিখিয়ে দিয়েছে, আর গাসুদ্ধ ছেলেপিলে জটাকে কি জটার মাকে দেখলেই ঝোপেবাড়ের আড়াল থেকে শুনিয়ে শুনিয়ে তাই আওড়াচ্ছে। জটার মা তো রেগে গাল দিয়ে শাপশাপান্ত করে একাকার!
শেষ পর্যন্ত সবটুকু শোনবার জন্যে ধৈর্য ধরে চুপ করে তাকিয়েছিলেন মোক্ষদা, এবার ভুরু কুঁচকে তীক্ষ্ণস্বরে বলে ওঠেন, ছড়া বেঁধেছে মানে কি?
মানে কি, তাই কি আমিই আগে বুঝতে পেরেছিলাম? মেয়েমানুষ যে আবার ছড়া বাধে বাপের জন্মেও শুনি নি। তাপর পথে আসতে আসতে দেখি একপাল ছোঁড়া হি হি করে হাসতে হাসতে বলছে, জটা মোটা পা গোদা— ভেঙচি কেটে আরও সব কত কি পয়ার ছন্দ বলতে বলতে যাচ্ছে!
মোক্ষদা আরও ভুরু কুঁচকে বলেন, ছড়া বেঁধেছে সত্য?
তবে আর বলছি কি!
ওই মেয়ে হতেই এ বংশের মুখে চুনকালি পড়বে— মোক্ষদা এবার শিলটা পাততে পাততে বলেন, রামকালী চন্দর এখন বুঝছেন না, এর পর টের পাবেন, যখন শ্বশুরঘর থেকে ফেরত দিয়ে যাবে। ভেঙচি-কাটা ছড়া বোধ হয়। জটা বৌ ঠেঙিয়েছিল বলে!
তবে না তো কি? বলি পরিবারকে আবার না মারে কোন মন্দ? ঢলানি বৌ আমনি তিলকে তাল করে দাঁতকপাটি লাগিয়ে পাড়ায় লোক-জানাজানি করে ছাড়লেন। জটার মা বলছে, ছোঁড়াগুলোর জুলায় নাকি জটা বেচারা ঘরের বার হতে পারছে না, কি গেরো বল দেখি!
মোক্ষদা ঘাস ঘাস করে শিলে সরষে রাগড়াতে রাগড়াতে বলেন, হাতের কাজটা মিটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমি বৌমার কাছে। ভাল করে সমঝে দিয়ে আসছি। মায়ের আসকারা না থাকলে মেয়ে কখনও এত বড় বেয়াড়া হয়? পাড়ার ছোঁড়াদের সঙ্গেই বা রাতদিন এত মস্করা কিসের? একটা কলঙ্ক রটে গেলে তখন রামকালীর মুখটা থাকবে কোথায়? পয়সাওলা বলে তো সমাজ রেয়াৎ করবে না!
শিবজায়ার কাজ কিছুটা সিদ্ধ হল।
বড় জায়ের নাতনীর বিরুদ্ধে ছোট ননদকে কিছুটা তাতাতে পেরেছেন। শেষবেশ বলেন, তুমি যাই আছ ছোট ঠাকুরঝি, তাই এখনও সংসারে একটা হক কথা হয়, নইলে আমরা তো ভয়ে কাটা!
ভয় আবার কিসের?
মোক্ষদা দুম করে শিলটা তুলে ফেলে বলেন, ভয় করব ভূতকে, ভয় করব। ভগবানকে। মানুষকে ভয় করতে যাব কেন? বিধবা পিসিকে ভাত দিয়ে পুষিছে বলে যে হক কথা শুনতে হবে না রামকালীকে, এ তুমি ভেবো না। সেজবৌ! সে যাক, জটার বোর প্রাচিত্তিরের কিছু ব্যবস্থা হয়েছে?
ওমা, তুমি শোন নি সে কথা? প্ৰচিত্তির তো করবে না!
করবে না?
না। রামকালী নাকি ভটাচাৰ্যকে শাসিয়েছে, প্ৰচিত্তিরের বিধান দিলে তাকে গাঁ-ছাড়া করবে!
তার মানে? আকাশ থেকে পড়লেন মোক্ষদা।
মানে বোঝ! অহমিকা আর কি! আমি গায়ের মাথা, আমি যা খুশি তাই করব!
হুঁ।
মোক্ষদা সরষে-গুঁড়ো-ছড়ানো আচারের খোরা দুটো দুম করে ঘরে তুলে ঘরের কপাটটা টেনে : তুলে দিয়ে বলেন, যাচ্ছি, দেখছি পয়সার বাড় কত বেড়েছে রামকালীর! সত্য আছে বাড়ি?
বাড়ি! দুপুরবেলা বাড়ি থার্কবারই মেয়ে বটে সে! কোথায় আগানে-বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে! বেওলা মেয়ের এত বুকের পাটা, এতখানি বয়সে দেখি নি কখনও।
তসরখানা গুছিয়ে পরে উঠোন পার হয়ে খরা খর পায়ে বেড়ার দরজা খুলে পথে পড়লেন মোক্ষদা। ফিরে তো স্নান করতেই হবে, একবার কেন—কতবার, কিন্তু এসবের একটা হেস্তনেস্ত দরকার।
জগতের কোথাও কোনও অনাচার ঘটবে, এ মোক্ষদা বরদাস্ত করতে পারবেন না।
কিন্তু ও কী?
একটু এগোতেই থমকে দাঁড়াতে হল।
বজ্রাহতের মতই থমকানি।
দেখলেন একখানা তেপেড়ে শাড়িতে গাছকোমর বেঁধে, একরাশ রুক্ষ চুল উড়িয়ে একহাঁটু ধুলো মেখে একদল ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমবাগানের মাঝখান দিয়ে চলেছে সত্য হি-হি করতে করতে আর সমস্বরে কি যেন একটা ছড়ার মতই আওড়াতে আওড়াতে।
দাঁতে দাঁত চেপে আরও একটু এগিয়ে গেলেন। মোক্ষদা, দলের পিছন দিকে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটা শুনতে চেষ্টা করলেন। হি-হি হাসির চোটে সব শোনা যায় ছাই! তবু বালককণ্ঠের শানানো সুর, আর বার বার উচ্চারণ করছে, কাজেই ক্রমশ সবটাই কর্ণগোচর থেকে মৰ্মগোচর হয়ে যায়।
শুনতে পেলেন খাজে খাজে। হাসি ছড়ানো সেই ছড়া—
জটাদাদা পা গোদা
যেন ভোঁদা হাতী,
বৌ-ঠেঙানো, দাদার পিঠে
ব্যাঙে মারে লাথি।
জটা জটা পেট মোটা–
দেখিব মজা কেমন সাজা
যাও না শ্বশুরবাড়ি।
বলতে বলতে চলে গেল ওরা।
মোক্ষদা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
না, ভাইপোর মেয়ের কবিত্বশক্তির পরিচয়ে অভিভূত হয়ে নয়, স্তম্ভিত হলেন এ মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে। একে তিনি শাসন করতে এসেছেন! এর পরে আর একে শাসন করে শায়েস্তা করবার সাধ তাঁর নেই; শুধু এইটে মনে মনে অনুধাবন করলেন—একে নিয়ে চিরকাল জ্বলে-পুড়ে মরতে হবে তাদেরই, কারণ শ্বশুরবাড়ি থেকে তো মারতে মারতে খেঁদিয়ে দেবেই!
কাগজের চিলতেয় মোড়া গোটাকতক ওষুধে বড়ি আঁচলের গিট থেকে খুলতে খুলতে সত্য তার শানানো গলাটাকে কিঞ্চিৎ নামিয়ে বলল, এই নাও বৌ, কি যেন বটিকা! বাবা বলে দিলেন সকাল সন্ধ্যে একটা করে বটিকা পানের রস দিয়ে খেতে, গায়ে বল পাবে।
আর গায়ে বল!
মনের বল তো সমুদ্রের তলায়। ভয়ে বুক কেঁপে থর-থর। জটার বৌ কাতর করুণ কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, হেই ঠাকুরঝি, তোমার পায়ে ধরি, ওষুধ তুমি নিয়ে যাও। ওষুধ খাচ্ছি। দেখলে ঠাকরুণ। আর আমাকে আস্ত রাখবেন না!
সত্য গিনির মত গালে হাত দিয়ে বলে, ওমা, শোনো বিত্তান্ত! দেহ দুব্বল হয়েছে, মিনিমাগনায় ওষুধ পাচ্ছ, খেলে শাউড়ী তোমায় মেরে ফেলবে? তুমি যে তাজ্জব করলে গা!
দোহাই গো ঠাকুরঝি, একটু আস্তে— প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে বলে জটার বৌ, তোমার দুটি পায়ে পড়ছি, ঠাকরুণের কানে গেলে পুকুরে ড়ুবে মরা ছাড়া আর গতি থাকবে না। আমার।
সত্য এবার একটু গুছিয়ে বসে, বসে অবাক গলায় আস্তে আস্তে বলে, কী শুনলে গো?
ওই যে মেরে ফেলার কথা বললে! জানো তো ভাই সমস্ত? মামাঠাকুর ওষুধ পাঠিয়ে দিয়েছেন, আর সেই ওষুধ আমি খাচ্ছি! ওরে ব্যাপারে! এই দেখা ঠাকুরঝি, আমার বুকের ভেতর কেমনতর ঢেঁকির পাড় পড়ছে!
জটার বৌয়ের ওই ব্যাধের তাড়া খাওয়া হরিণের চোখের মত চোখ আর ঘুটের ছাইয়ের মত। পাশুট-রঙা মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ কেমন চিন্তাশীল দেখায় সত্যবতীকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ওষুধগুলো ফের আঁচলে বাঁধতে বাধতে বলে, আচ্ছা তা হলে ফেরত নে যাই।
ফেরত!
মামা ঠাকুরের কাছে!
আর এক ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে জটার বৌয়ের। আর এবার আর কাঁদো কাঁদো নয়, ভ্যাক করে কেঁদেই ফেলে। ও সত্য ঠাকুরঝি, তোমার পা-ধোওয়া জল খাই, তোমার কেনা গোলাম হয়ে থাকি, ও বড়ি মামাঠাকুরকে ফেরত দিতে যেও না!
ফেরত দিতে যেও না!
হঠাৎ সত্য তার নিজের স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে ওঠে, এই সেরেছে! ব্যায়রামে পড়ে দেখছি তোমার ভীমরতি ধরেছে বৌ! শাউড়ীর ভয়ে ওষুধ খাবে না, আবার ফেরতও দেবে না, তবে বড়িগুলো কি আমি খেয়ে নেব? দাও, তা হলে একখোরা পানের রস করে দাও, সবগুলো একসঙ্গে গুলে গিলে ফেলি।
জটার বৌ এবার মনের কথা খুলে বলে। শাশুড়ীর অসাক্ষাতে ওষুধ খাবার সাহস তার নেই, বলে কয়ে সাক্ষাতে খাবার তো আরোই নেই, অতএব–
অতএব পুকুরের জলে!
পুকুরে?
সত্যর চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। বাবার দেওয়া বড়ি স্বয়ং ধন্বন্তরী, তা জান? এ বাড়ির অপমান করলে, ধন্বন্তরীর অপমান তা জান?
তবে আমি কী করি?
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে জটার বৌ।
সত্য ওর অবস্থা দেখে কাতর না হয়ে পারে না, একটু ভেবেচিন্তে বলে, তা হলে নয় এক কাজ করি, পিসীকেই দিয়ে যাই, বলি বাবা পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাবা অবিশ্যি বলেছিলেন পিসীকে দিস না, তা হলে খেতে দেবে না, ফেলে দেবে। তুতিয়েপাতিয়ে কাকুতি-মিনতি করে বলে যাই।
উঠে দাঁড়ায় সত্য, আর সঙ্গে সঙ্গে ওর কাপড়ের একটা খুঁট ধরে হুমড়ে প্রায় ওর পায়ে পড়ে জটার বৌ, ও ঠাকুরঝি, তার চাইতে তুমি আমার গলায় পা দিয়ে মেরে রেখে যাও, আঁশবিটি দে কেটে রেখে যাও আমায়।
সত্য আবার বসে পড়ে।
একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, আচ্ছা বৌ, তোমাদের এত ভয় কিসের বলতে পার?