ভূমিকা
বহির্বিশ্বের ভাঙাগড়ার কাহিনী নিয়ে রচিত হয় বিগত কালের ইতিহাস। আলো আর অন্ধকারের পৃষ্ঠপটে উচ্চকিত সেই ধ্বনিমুখর ইতিহাস পরবর্তীকালের জন্য সঞ্চিত রাখে প্রেরণা, উন্মাদনা, রোমাঞ্চ। কিন্তু স্তিমিত অন্তঃপুরের অন্তরালেও কি চলে না ভাঙাগড়ার কাজ? যেখান থেকে রং বদল হয় সমাজের, যুগের, সমাজ মানুষের মানসিকতার। চোখ ফেললে দেখা যায়। সেখানেও অনেক সঞ্চয়। তবু রচিত ইতিহাসগুলি চিরদিনই এই অন্তঃপুরের ভাঙাগড়ার প্রতি উদাসীন। অন্তঃপুর চিরদিনই অবহেলিত। বাংলাদেশের সেই অবজ্ঞাত অন্তঃপুরের নিভৃতে প্রথম যাঁরা বহন করে এনেছেন প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর, এ গ্রন্থ সেই অনামী মেয়েদের একজনের কাহিনী।
তুচ্ছ দৈনন্দিনের পৃষ্ঠপট আঁকা এই ছবি যদি বহন করে রাখতে পেরে থাকে বিগত কালের সামান্যতম একটি টুকরোকে, সেইটুকুই হবে আমার শ্রমের সার্থকতা।
–লেখিকা
॥ এ গ্রন্থে বর্ণিত চরিত্রগুলির পরিচয় ॥
মূল চরিত্র – সত্যবতী
রামকলী – সত্যবতীর বাবা
জয়কালী – ঠাকুর্দা
কুঞ্জ – জ্যাঠামশাই
জটা—পিসির ছেলে
নবকুমার—স্বামী
নীলাম্বর বাঁড়ুয্যে—শ্বশুর
সাধন—ছোট ছেলে
সরল—ছোট ছেলে
ফেলু বাঁড়ুয্যে—রামকালীর শ্বশুর
রাসবিহারী—কুঞ্জর বড় ছেলে
নেড়ু—কুঞ্জর ছোট ছেলে
ভবতোষ—নবকুমারের শিক্ষক
নিতাই—নবকুমারের বন্ধু
লক্ষ্মীকান্ত বাড়ুয্যে—পাটমহলের জমিদার
শ্যামাকান্ত—ঐ জমিদার-পুত্র
রাখহরি ঘোষাল—ঐ প্রতিবেশী
দয়াল মুখুয্যে
নগেন—কাটোয়র যুবক
বিদ্যারত্ন—রামকালীর ভক্তিভাজন পণ্ডিত
গোবিন্দ গুপ্ত—আশ্রয়দাতা
পটলী ঘোষাল
বিপিল লাহিড়ী—প্রতিবেশী
মুকুন্দ মুখুয্যে—সৌদামিনির স্বামী
তুষ্ট—গোয়ালা
রঘু—তুষ্টুর নাতি
বিন্দে—ওঝা
গোপেন–রাখাল
সরল–চ্ছোট
ভুবনেশ্বরী–সত্যবতীর মা
দীনতারিনী — ঠাকুমা
কাশীশ্বরী
মোক্ষদা– পিসঠাকুর
শিবজায়া
নন্দরানী – জ্ঞাতিঠাকুমা
নিভাননী
সুকুমারী – মামী
এলোকেশী–সত্যবতীর শাশুড়ী
পুণ্যি— সত্যবতীর সমবয়সী পিসি
খেঁদি–বাল্যবান্ধবী
সুবৰ্ণ – মেয়ে
সেজ পিসি – জটার মা
শশীতারা–কুঞ্জর বোন
অভয়া–স্ত্রী
সারদা–রাসুর বৌ
পটলী–রাসুর দ্বিতীয় স্ত্রী
শঙ্করী (কাটোয়ার বৌ)– কাশীশ্বরীর নাতবৌ
বেহুলা–শ্যামাকান্তের স্ত্রী
ভাবিনী–নিতাইয়ের স্ত্রী
মুক্তকেশী–এলোকেশীর সইয়ের মেয়ে
সৌদামিনী–এলোকেশীর ভাগ্নী
সুহাস–শঙ্করীর মেয়ে
সাবিপিসি, রাখুর মা, নাপিত-বৌ, দত্তগিন্নী ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণ ইত্যাদি।
০১.
সত্যবতীর গল্প আমার লেখা নয়। এ গল্প বকুলের খাতা থেকে নেওয়া। বকুল বলেছিল, একে গল্প বলতে চাও গল্প, সত্যি বলতে চাও সত্যি।
বকুলকে আমি ছেলেবেলা থেকে দেখছি। এখনও দেখছি। বরাবরই বলি, বকুল, তোমাকে নিয়ে গল্প লেখা যায়। বকুল হাসে। অবিশ্বাস আর কৌতুকের হাসি। না, বকুল নিজে কোনদিন ভাবে না—তাকে নিয়েও গল্প লেখা যায়। নিজের সম্বন্ধে কোন মূল্যবোধ নেই বকুলের, কোন চেতনাই নেই।
বকুলও যে সত্যিই পৃথিবীর একজন এ কথা মানতেই পারে না। বকুল। সে শুধু জানে, সে কিছুই নয়, কেউই নয়। অতি সাধারণের একজন, একেবারে সাধারণ–যাদের নিয়ে গল্প লিখতে গেলে কিছুই লেখবার থাকে না।
বকুলের এ ধারণা গড়ে ওঠার মূলে হয়তো ওর জীবনের বনেদের তুচ্ছতা। হয়তো এখন অনেক পেয়েও শৈশবের সেই অনেক কিছু না পাওয়ার ক্ষোভটা আজও রয়ে গেছে তার মনে। সেই ক্ষোভই স্তিমিত করে রেখেছে তার মনকে। কুণ্ঠিত করে রেখেছে তার সত্তাকে।
বকুল সুবৰ্ণলতার অনেকগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে একজন। সুবৰ্ণলতার শেষদিকের মেয়ে।
সুবৰ্ণলতার সংসারে বকুলের ভূমিকা ছিল অপরাধীর।
অজানা কোন এক অপরাধে সব সময় সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হবে বকুলকে, এ যেন বিধি-নির্দেশিত বিধান।
বকুলের শৈশব-মন গঠিত হয়েছিল তাই অদ্ভুত এক আলোছায়ার পরিমণ্ডলে। যার কতকাংশ শুধু ভয় সন্দেহ আতঙ্ক ঘৃণা, আর কতকাংশ জ্যোতির্ময় রহস্যপুরীর উজ্জ্বল চেতনায় উদ্ভাসিত। তবু মানুষকে ভাল না বেসে পারে না বকুল। মানুষকে ভালবাসে বলেই তো—
কিন্তু থাক, এটা তো বকুলের গল্প নয়। বকুল বলেছে, আমার গল্প যদি লিখতেই হয় তো সে আজ নয়। পরে। জীবনের দীর্ঘ পথ পার হয়ে এসে বুঝতে শিখেছে বকুল, পিতামহী প্রপিতামহীর ঋণশোধ না করে নিজের কথা বলতে নেই।
নিভৃত গ্রামের ছায়ান্ধকার পুষ্করিণীই ভরা বর্ষায় উপচে উঠে নদীতে গিয়ে মিশে স্রোত হয়ে ছোটে। সেই ধারাই ছুটে ছুটে একদিন সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। সেই ছায়ান্ধকারের প্রথম ধারাকে স্বীকৃতি দিতে হবে বৈকি।
আজকের বাংলাদেশের অজস্র বকুল-পারুলদের পিছনে রয়েছে অনেক বছরের সংগ্রামের ইতিহাস। বকুল-পারুলদের মা দিদিমা পিতামহী আর প্রপিতামহীদের সংগ্রামের ইতিহাস। তারা ংখ্যায় অজস্র ছিল না, তারা অনেকের মধ্যে মাত্র এক-একজন। তারা একলা এগিয়েছে। এগিয়েছে খানা ডোবা ডিঙিয়ে পাথর ভেঙে কাটাঝোঁপ উপড়ে। পথ কাটতে কাটতে হয়তো দিশেহারা হয়েছে, বসে পড়েছে নিজেরই কাটা-পথের পথ জুড়ে। আবার এসেছে আর একজন; তার আরব্ধ। কর্মভার তুলে নিয়েছে নিজের হাতে। এমনি করেই তো তৈরী হল রাস্তা। যেখান দিয়ে বকুল-পারুলরা এগিয়ে চলেছে। বকুলরাও খাটছে বৈকি। না খাটলে চলবে কেন? শুধু তো পায়ে চলার পথ হলেই কাজ শেষ হল না।
রথ চলার পথ চাই যে!
সে পথ কে কাটবে কে জানে? সে রথ কারা চালাবে কে জানে?
যারা চালাবে তারা হয়তো অলস কৌতূহলে অতীত ইতিহাসের পাতা উলটে দেখতে দেখতে সত্যবতীকে দেখে হেসে উঠবে।
নাকে নোলক, আর পায়ে মাল পরা আট বছরের সত্যবতীকে।
বকুলও একসময় হাসত।
এখন হাসে না। অনেকটা পায় পার হয়ে বকুল পথের মর্মকথা বুঝতে শিখেছে। তাই যে সত্যবতীকে বকুল কোনোদিন চোখেও দেখে নি, তাকে দেখতে পেয়েছে স্বপ্নে আর কল্পনায়, মমতায় আর শ্রদ্ধায়।
তাই তো বকুলের খাতায় সত্যবতীর এমন স্পষ্ট চেহারা আঁকা রয়েছে।
নাকে নোলক, কানে সার মাকড়ি, পায়ে ঝাঁঝর মিল, বৃন্দাবনী-ছাপের আটহাতি শাড়িপরা আট বছরের সত্যবতী। বিয়ে হয়ে গেছে। বছরখানেক আগে—এখনও ঘরবসতি হয় নি। অপ্রতিহত প্ৰতাপে পাড়াসুদ্ধ ছেলেমেয়ের দলনেত্রী হয়ে যথেচ্ছ খেলে বেড়ায়। সত্যবতীর মা ঠাকুমা জেঠী পিসী ঐটে উঠতে পারে না ওকে।
পারে না হয়তো সত্যবতীর যথেচ্ছাচারের ওপর ওর বাপের কিছু প্রশ্ৰয় আছে বলে।
সত্যবতীর বাপ রামকালী চাটুয্যে, চাটুয্যে বামুনের ঘরের ছেলে হলেও ব্রাহ্মণ-জনোচিত পেশা তাঁর নয়। অন্য শাস্ত্ৰপালা বেদ-বেদান্ত বাদ দিয়ে তিনি বেছে নিয়েছেন আয়ুৰ্বেদ। ব্ৰাহ্মণের ছেলে হয়েও কবিরাজী করেন রামকালী। তাই গ্রামে ওঁর নাম নাড়ীটেপা বামুন। ওঁর বাড়ির নাম নাড়ীটেপা বাড়ি।
রামকালীর প্রথম জীবনটা ওঁর অন্য সব ভাই আর অন্যান্য জ্ঞাতিগোত্রের চাইতে ভিন্ন। কিছুটা হয়তো বিচিত্ৰও। নইলে ওই আধাবয়সী লোকটার ওইটুকু মেয়ে কেন? সত্যবতী তো রামকালীর প্রথম সন্তান। সে যুগের হিসেবে বিয়ের বয়স একেবারে পার করে ফেলে তবে বিয়ে করেছিলেন রামকালী। সত্যবতী সেই পার হয়ে যাওয়া বয়সের ফল।
শোনা যায় নিতান্ত কিশোর বয়সে বাপের ওপর অভিমান করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন রামকালী। কারণটা যদিও খুব একটা ঘোরালো নয়, কিন্তু কিশোর রামকালীর মনে বোধ করি সেটাই বেশ জোরালো ছাপ মেরেছিল।
কি একটা অসুবিধেয় পড়ে রামকালীর বাবা জয়কালী একদিনের জন্যে সদ্য উপবীতধারী পুত্ৰ রামকালীর উপর ভার দিয়েছিলেন গৃহদেবতা জনাৰ্দনের পূজা-আরতির। মহোৎসাহে সে ভার নিয়েছিল রামকালী। তার আরতির ঘণ্টাধ্বনিতে সেদিন বাড়িসুদ্ধ লোক ত্ৰাহি জনাৰ্দন ডাক ছেড়েছিল। কিন্তু উৎসাহের চোটে ভয়ঙ্কর একটা ভুল ঘটে গেল। মারাত্মক ভুল।
রামকালীর ঠাকুমা ঠাকুরঘর মার্জনা করতে এসে টের পেলেন সে ভুল। টের পেয়ে ন্যাড়া মাথার উপর কদমছাট চুল সজারুর কাটার মত খাড়া হয়ে উঠল তার ৷ ছুটে গিয়ে ভাইপোর অর্থাৎ রামকালীর বাবা জয়কালীর কাছে প্ৰায় আছড়ে পড়লেন।
সর্বনাশ হয়েছে জয়!
জয়কালী চমকে উঠলেন কি হয়েছে পিসী?
ছেলেপুলেকে দিয়ে ঠাকুরসেবা করালে যা হয় তাই হয়েছে। সেবা-অপরাধ ঘটেছে। রেমো জনাৰ্দনকে ফল-বাতাসা দিয়েচে, জল দেয় নি।
চড়াৎ করে সমস্ত শরীরের রক্ত মাথায় গিয়ে উঠল জয়কালীর। অ্যাঁ করে একটা আর্তনাদধ্বনি তুললেন তিনি।
পিসী একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে সেই সুরেই সুর মিলিয়ে বললেন, হ্যাঁ! জানি না এখন কার কি অদৃষ্ট আছে! ফুল তুলসীর ভুল নয়, একেবারে তেষ্টার জল!
সহসা জয়কালী পায়ের খড়মটা খুলে নিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, রেমো! রেমো!
চিৎকারে রামকালী প্রথমটায় বিশেষ আতঙ্কিত হয় নি, কারণ পুত্র-পরিজনদের প্রতি স্নেহসম্ভাষণও জয়কালীর এর চাইতে খুব বেশী নিম্নগ্রামের নয়। অতএব সে বেলের আঠার হাতটা মাথায় মুছতে মুছতে পিতৃসকাশে এসে দাঁড়াল।
কিন্তু এ কী! জয়কালীর হাতে খড়ম!
রামকালীর চোখের সামনে কতকগুলো হলুদ রঙের ফুল ভিড় করে দাঁড়াল।
ভগবানকে স্মরণ করা রেমো, জয়কালী ভীষণ মুখে বললেন, তোর কপালে মৃত্যু আছে!
রামকালীর চোখের সামনে থেকে হলুদ রঙের ফুলগুলোও লুপ্ত হয়ে গেল, রইল। শুধু নিরন্ধ অন্ধকার। সেই অন্ধকার হাতড়ে একবার খুঁজতে চেষ্টা করল রামকালী কোন অপরাধে বিধাতা আজ তার কপালে মৃত্যুদণ্ড লিখেছেন। খুঁজে পেল না, খোঁজবার সামর্থ্যও রইল না। সেই অন্ধকারটা ক্রমশ রামকালীর চৈতন্যর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
জনার্দনের ঘরে আজ পূজো করেছিলি তুই না?
রামকালী নীরব।
পূজার ঘরেই তা হলে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু কই? কি? যথারীতি হাত-পা ধুয়ে তার পৈতেয় পাওয়া চেলির জোড়টা পরেই তো ঘরে ঢুকেছিল রামকালী। তারপর? আসন। তারপর? আচমন। তারপর? আরতি। তারপর—ঠাঁই করে মাথায় একটা ধাক্কা লাগল।
জল দিয়েছিলি ভোগের সময়?
এই প্রশ্নটি পুত্ৰকে করছেন জয়কালী খড়মের মাধ্যমে।
দিশেহারা রামকালী আরও দু-দশটা ধাক্কার ভয়ে বলে বসল—হ্যাঁ, দিয়েছি তো!
দিয়েছিলি?? জল দিয়েছিলি? জয়কালীর পিসী যশোদা একেবারে নামের বিপরীত ভঙ্গীতে বলে উঠলেন, দিয়েছিলি তো সে জল গেল কোথায় রে হতভাগা? গেলাস একেবারে শুকনো?
প্ৰশ্নকর্ত্রী ঠাকুমা।
বুকের গুরু-গুরু ভাবটা কিঞ্চিত হালকা মনে হল, রামকালী ক্ষীণস্বরে বলে বসিল, ঠাকুর খেয়ে নিয়েছে বোধ হয়!
কী? কী বললি? আর একবার ঠিক করে একটা শব্দ, আর চোখে অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আরও গভীরতম অনুভূতি।
লক্ষ্মীছাড়া, শুয়োর বনবরা! ঠাকুর জল খেয়ে নিয়েছে? শুধু ভূত হও নি তুমি, শয়তানও হয়েছ। ভয় নেই প্ৰাণে তোমার? ঠাকুরের নামে মিছে কথা?
অর্থাৎ মিথ্যা কথাটা যত না অপরাধ হোক, ঠাকুরের নামের সঙ্গে জড়িত হয়ে ভীষণ অপরাধে পরিণত হয়েছে। রামকালী ভয়ের বশে আবারও মিছে কথা বলে বসে, হ্যাঁ, সত্যি বলছি। ঠাকুরের নামে দিব্যি। দিয়েছিলাম জল।
বটে। রে হারামজাদা! বামুনের ঘরে চাঁড়াল! ঠাকুরের নামে দিব্যি? জল দিয়েছিস তুই? ঠাকুর জল খেয়ে ফেলেছে? ঠাকুর জল খায়?
মাথার মধ্যে জ্বলছে।
রামকালী মাথার জুলায় অস্থির হয়ে সমস্ত ভয়-ডর ভুলে বলে বসল, খায় না জানো তো দাও কেন?
ও, আবার মুখে মুখে চোপা! জয়কালী আর একবার শেষবেশ খড়মটার সদ্ব্যবহার করলেন। করে বললেন, যা দূর হ, বামুনের ঘরের গরু! দূর হয়ে যা আমার সুমুখ থেকে!
এই।
এর বেশী আর কিছুই করেন নি জয়কালী। আর এরকম ব্যবহার তো তিনি সর্বদাই সকলের সঙ্গে করে থাকেন। কিন্তু কিসে যে কি হয়!
রামকালীর চোখের সামনে থেকে যেন একটা পর্দা খসে গেল।
চিরদিন জেনে আসছে জনাৰ্দন বেশ একটু দয়ালু ব্যক্তি, কারণে-অকারণে উঠতে বসতে বাড়ির সকলেই বলে, জনাৰ্দন, দয়া করো। কিন্তু কোথায় সে দয়ার কণিকামাত্ৰ!
রামকালী যে মনে মনে প্ৰাণ ফাটিয়ে চিৎকার করে প্রার্থনা করল, ঠাকুর এই অবিশ্বাসীদের সামনে একবার নিজমূর্তি প্রকাশ করো, একবার অলক্ষ্য থেকে দৈববাণী করো, ওরে জয়কালী, বৃথা ওকে উৎপীড়ন করছিস। জল আমি সত্যই খেয়ে ফেলেছি। একমুঠো বাতাসা খেয়ে ফেলে বড্ড তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল।
নাঃ, দৈববাণীর ছায়ামাত্র নেই।
সেই মুহূর্তে আবিষ্কার করল রামকালী, ঠাকুর মিথ্যে, দেবতা মিথ্যে, পূজোপাঠ প্রার্থনা–সবই মিথ্যে, অমোঘ সত্য শুধু খড়ম।
পৈতের সময় তারও একজোড়া খড়ম হয়েছে। তার উপর্যুক্ত ব্যবহার কবে করতে পারবে রামকালী কে জানে!
অথচ এই দণ্ডে সমস্ত পৃথিবীর উপরই সে ব্যবহারটা করতে ইচ্ছে করছে।
পৃথিবীতে আর থাকব না আমি।
প্ৰথমে সংকল্প করল রামকালী।
তারপর ক্রমশ পৃথিবীটা ছেড়ে চলে যাবার কোনো উপায় আবিষ্কার করতে না পেরে মনের সঙ্গে রিফা করল।
পৃথিবীটা আপাতত হাতে থাক, ওটা তো যখন ইচ্ছেই ছাড়া যাবে। ছাড়বার মত আরও একটা জিনিস রয়েছে, পৃথিবীরই প্রতীক যেটা।
বাড়ি।
বাড়িই ছাড়বে রামকালী।
জন্মে আর কখনও জনার্দনের পূজো যাতে না করতে হয়।
তখন নাড়ীটেপার বাড়ি নাম হয় নি, আদি ও অকৃত্রিম চাটুয্যে বাড়িই ছিল। সকলের শ্রদ্ধাসুমী ও সাধার ছিল। কাজেই বেশ কিছুদিন গ্রামে সাড়া পড়ে রইল, চাটুয্যেদেরর ছেলে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে।
গ্রামের সমস্ত পুকুরে জাল ফেলা হল। গ্রামের সকল দেবদেবীর কাছে মানসিক মানা হল। রামকালীর মা রোজ নিয়ম করে ছেলের নামে ঘাটে প্ৰদীপ ভাসাতে লাগল, জয়কালী নিয়ম করে জনার্দনের ঘরে তুলসী চড়াতে লাগলেন, কিছুই হল না।
ক্রমশ সকলে যখন প্ৰায় ভুলে গেল। চাটুয্যেদের রামকালী বলে একটা ছেলে ছিল, তখন গ্রামের কোনো একটি যুবক একদিন ঘোষণা করল, রামকালী আছে। সে মুকণ্ডদাবাদে গিয়েছিল, সেখানে নিজের চোখে দেখে এসেছে রামকালী নবাব বাড়ির কবরেজ গোবিন্দ গুপ্তর বাড়িতে রয়েছে, তার সাকরেদি করে কবরেজি শিখছে।
শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন জয়কালী। ছেলের বেঁচে থাকার খবর, আর ছেলের জাত যাওয়ার খবর, যুগপৎ উল্টোপাল্টা দুটো খবরে তিনি ভুলে গেলেন, আনন্দে হৈহৈকার করতে হবে কি শোকে হাহাকার করতে হবে!
ছেলে বদ্যিবাড়ির ভাত খাচ্ছে, বদ্যিবাড়ির আশ্রয় গ্ৰহণ করেছে, এ তো মৃত্যুসংবাদেরই সামিল।
অথচ রামকালী এযাবৎ মরে নি, একথা জেনে প্ৰাণের মধ্যে কী যেন ঠেলে উঠছে। কী সে? আনন্দ? আবেগ? অনুতাপের যন্ত্রণা-মুক্তির সুখ?
গ্রামের সকলের সঙ্গে পরামর্শ করতে লাগলেন জয়কালী। অবশেষে রায় বেরোল, জয়কালীর নিজের একবার যাওয়া দরকার। সরেজমিনে তদন্ত করে দেখে আসুন প্রকৃত অবস্থাটা কি! তা ছাড়া সেই লোক প্রকৃতই রামকালী। কিনা— তাই বা কে জানে! যে দেখেছে সে তো নিকট-আত্মীয় নয়, চোখের ভ্রম হতে কতক্ষণ?
কিন্তু পরামর্শ শুনে জয়কালী আকাশ থেকে পড়লেন, আমি যাব? আমি কি করে যাব? জনার্দনের সেবা ফেলে আমার কি নড়বার জোর আছে?
রামকালীর মা, জয়কালীর দ্বিতীয় পক্ষ দীনতারিণী শুনে কেঁদে ভাসাল। মুখে এসেছিল, বলে, জনাৰ্দনই তোমার এত বড় হল?
বলতে পারল না। সাহস করে, শুধু চোখের জল ফেলতে লাগল।
অবশেষে অনেক পরিকল্পনান্তে স্থির হল, জয়কালীর এক ভাগ্নে যাবে, বয়স্থ ভাগ্নে। তার সঙ্গে জয়কালীর প্রথম পক্ষের বড় ছেলে কুঞ্জকালী যাবে।
কিন্তু এই গন্ডগ্রিাম থেকে মুকণ্ডদাবাদে যাওয়া তো সোজা নয়! গরুর গাড়ি করে গঞ্জে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে কবে নৌকা যাবে মুকগুদাবাদ। তারপর আবার চাল চিড়ে বেঁধে নিয়ে গরুর গাড়িতে তিন ক্রোশ রাস্তা ভেঙে নৌকোর কিনারে গিয়ে ধর্না পাড়া।
খরচও কম নয়।
জয়কালী ভাবলেন, খরচের খাতায় বসানো সংখ্যা আবার জমার খাতায় বসাতে গেলে ঝঞ্ঝাট বড় কম নয়। এত ঝঞাটের দরকারই বা কি ছিল? রাগ হল সেই ফাজিল ছোঁকরাটার ওপর; যে এসে খবর দিয়েছে। যে এত ঝঞাট বাধানোর নায়ক।
রামকালী তো খবচ হয়েই গিয়েছিল। ওই ফাজিলটা এসে খবর না দিলে আর—
কিন্তু দরকার ছিল রামকালীর মার দিক থেকে, তাই সব ঝঞাট পুইয়ে ভাগ্নেকে আর ছেলেকে পাঠালেন জয়কালী। আর কদিন পরে তারা এসে জানাল খবর ঠিক। রামকালী নিঃসন্তান গোবিন্দ বন্দির পুষ্যি হয়ে রাজার হালে আছে, এর পর নাকি পাটনা যাবে। এদের কাছে বলেছে একেবারে রাজবদ্যি হয়ে টাকার মোট নিয়ে দেশে যাবে, তার আগে নয়।
শুনে যাদের বেশী ঈর্ষা হল, তারা বলল, এমন কুলাঙ্গার ছেলের মুখদর্শন করতে নেই। তা ছাড়া ও তো জাতিচ্যুত।
যাদের একটু কম ঈর্ষা হল, তারা বলল, তবু বলতে হবে উদ্যোগী পুরুষ! আর জাতিচু্যতই বা হবে কেন? কুঞ্জ তো বলছে নাকি জেনে এসেছে গোবিন্দ গুপ্ত রামকালী চাটুয্যের জন্যে কোন এক বামুনবাড়িতে ভাতের ব্যবস্থা করে রেখেছে।
গ্রামে আবার কিছুদিন এই নিয়ে আলোচনা চলল। এবং যখন এসব আলোচনা ঝিমিয়ে গিয়ে ক্রমশ আবার সবাই রামকালীর নাম ভুলতে বসল, তখন একদিন রামকালী সশরীরে হাজির হল টাকার বস্তা নিয়ে।
গোবিন্দ গুপ্ত পরামর্শ দিয়েছেন, তোমার আর রাজবদ্যি হয়ে কাজ নেই বাপু, রাজ্যে এখন ভেতরে ভেতরে ঘুণ ধরতে বসেছে, নবাবের নবাবী তো শিকেয় উঠেছে। আমার এই দীর্ঘকালের সঞ্চিত অৰ্থরাশি নিয়ে দেশে পালিয়ে গিয়ে নিজে নবাবী করো গে। আমরা স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে কাশীবাসে মনঃস্থির করেছি!
অগত্যা চলে এসেছে রামকালী।
গঞ্জের ঘাট থেকে নিজের পালকি করে।
গোবিন্দ গুপ্তের পালকিটাও পেয়েছে রামকালী। নৌকায় চাপিয়ে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু তখন জয়কালী মারা গেছেন এই এক মস্ত আপসোস।
বাবাকে একবার দেখাতে পারল না। রামকালী, সেই তাড়িয়ে দেওয়া ছেলেটা মানুষ হয়ে ফিরল।
feeling loved to read the book