১৪. পালকি থেকে মুখ বাড়িয়ে

ওরে বাবা-সকল, একটু চোটপায়ে চল, তাগাদা আছে।

পালকি থেকে মুখ বাড়িয়ে আর একবার তাগাদা দিলেন রামকালী। মধ্যাহ্নের মধ্যে গিয়ে পৌঁছাতে না পারলে বিদ্যারত্ন মশাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে না। প্রাতঃসন্ধ্যা সেরে গঙ্গাস্নানে বেরিয়ে পড়েন বিদ্যারত্ন, যেটা বিদ্যারতের আবাসস্থান থেকে অন্তত তিন ক্রোশ দূরে। যাতায়াতের এই ছ ক্রোশ পাড়ি দিয়ে নিত্যাস্নানপর্ব সমাধা করে পুনরায় ঠাকুরঘরে ঢুকে পড়েন তিনি গৃহবিগ্রহের ভোগ দিতে। তৎপরে প্রসাদ গ্রহণ, তার পর আবার সামান্য সময় বিশ্রাম, এই মধ্যবর্তী সময়টা কারও সঙ্গে দেখা করেন না বিদ্যারত্ন। কাজেই তার কাছে যেতে হলে ওই গঙ্গাস্নান সেরে ফেলার মুহূর্তে, নয় অপরাহ্নে।

কিন্তু অপরাহ্ন পর্যন্ত সময় কোথা রামকালীর প্রয়োজন যে বড় জরুরী!

জীবনে যখনই কোন সমস্যা সমাধানের জরুরী প্রয়োজন পড়ে, তখন রামকালী বিদ্যারত্নের দরবারে এসে হাজির দেন।

অবশ্য সে রকম প্রয়োজন জীবনে দৈবাৎই এসেছে।

সেই একবার এসেছিল নিবারণ চৌধুরীর মায়ের গঙ্গাযাত্রার ব্যাপারে। তিরানব্বই বছরের বুড়ী সজ্ঞানে গঙ্গাযাত্রা করলেন, আর সে নির্দেশ রামকালীই দিয়েছিলেন। কিন্তু বুড়ী যেন রামকালীর বিদ্যা-বুদ্ধিকে পরিহাস করে পাঁচ দিন গঙ্গাতীরের হাওয়া খেয়ে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল। তারপর তার বায়না আমায় তোরা বাড়ি নে চল! শরীরে শক্তি আছে, বয়সে মন অবুঝ হয়ে গেছে। নিবারণ চৌধুরী রামকালীকে এসে ধরে পড়লেন, বলুন কি বিহিত?

সেই সময় চিন্তায় পড়েছিলেন রামকালী।

গঙ্গাযাত্রীর মড়া ফের ভিটেয় ফেরত নিয়ে গেলে সংসারের মহা অকল্যাণ, সদ্য ভিটেটায় তো তোলাই যাবে না তাকে। পেঁকিঘরে কি গোয়ালে বড় জোর রাখা যায়, কিন্তু নিবারণ চৌধুরীর মনোভাব দেখে মনে হয়েছিল, সেটুকুতেও তিনি নারাজ। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করেন তিনি সংসারে এত বড় অকল্যাণ ঘটাতে বুক কাঁপছে। বার বার তাই কবরেজ মশাইয়ের কাছে বিধিবিধান চেয়েছিলেন।

সেই সময় এসেছিলেন রামকালী বিদ্যারত্নের কাছে। এসে প্রশ্ন করেছিলেন, বিদ্যারত্ন মশাই, বলুন শাস্ত্র বড় না মাতৃমর্যাদা বড়?

আজ এসেছেন আর এক প্রশ্ন নিয়ে।

অবশ্য আপাতত প্রশ্ন তাড়াতাড়ি পৌঁছবার। একখানা গ্রাম পার হয়ে তবে দেবীপুর। বিদ্যারত্নের গ্রাম।

পালকি থেকে আর একবার মুখ বাড়িয়ে দেখে বেহারাদার তাগাদা দিতে গিয়ে থেমে গেলেন রামকালী, থাক, এত বিচলিত হবার দরকার নেই, পোঁছে ওরা দেবেই ঠিক।

বিচলিত হওয়াকে ঘৃণা করেন রামকালী। তবু মনে মনে অস্বীকার করে লাভ নেই, আজ একটু বিচলিত হয়েছেন। কোথায় যেন হেরে গেছেন রামকালী, তারই একটা সূক্ষ্ম অপমানের জ্বালা মনকে বিধছে।

কিন্তু রামকালীর মধ্যে এই পরাজয়ের গ্লানি কেন? সংসারের একটা বুদ্ধিহীন মেয়ে যদি একটা অঘটন ঘটিয়ে বসে থাকেই, তাতে রামকালীর পরাজয় কেন?

.

ঘোড়ায় এলে এতক্ষণে পৌঁছে যেতেন, কিন্তু কোন বয়োজ্যেষ্ঠ বা গুরুস্থানীয়ের সামনাসামনি সাধ্যপক্ষে ঘোড়ায় চড়েন না রামকালী। তাই পালকিতেই বেরিয়েছেন। বেরিয়ে এসেছেন একটু সঙ্গোপনেই। জেলেদের জাল ফেলার ব্যাপারটা সামান্য তদারক করেই। বাড়তি কিছু মাছ উঠলে উঠুক। খাদ্যবস্তু কখনো বাড়তি হয় না। ওরা এখন যেভাবে কাজ করছে করুক, রামকালীর অনুপস্থিতি টের না পেলেই মঙ্গল। টের পেলেই কাজে ঢিলে দেবে।

কারুর ওপর কি ভরসা করার জো আছে?

কাকা আছেন, সেজকাকা। কিন্তু তাকে কোন কাজকর্মের ভার দেওয়াও বিপদ। কারণ তাঁর মতে ডাকহক চেঁচামেচি এবং নির্বিচারে সকলকে ধমকাতে পারাই পুরুষের প্রধান গুণ। আর বয়েস হয়ে গেলে পৌরুষের পরিমাণটা যে তার একতিলও কমে নি, সর্বদা সেটা প্রমাণ করতেও রীতিমত তৎপর সেজকাকা। তাই তাকে ডেকেডুকে কর্তৃত্বের ভার দেওয়া মানে বিপদ বাধানো।

আর কুঞ্জ? কুঞ্জর কথা কি বলারই যোগ্য?

মিষ্টির ভিয়েনের কানাচে হাতে মুখে রসমাখা আর মুখভর্তি ছানাবড়া ঠাসা কুঞ্জর তৎকালীন চেহারাটা একবার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তখন যখন দেখেছিলেন, মনটা বিরক্তিতে ভরে গিয়েছিল, এখন হঠাৎ একটা মমতা-মিশ্রিত অনুকম্পার ভাব মনে এল।

যে মানুষ লুকিয়ে-চুরিয়ে নিজের ছেলের বিয়ের ভোজের মিষ্টান্ন খেতে বসে, তার উপর অনুকম্পা ছাড়া হৃদয়ের আর কোন্ ভাববৃত্তি বিকশিত হবে?

এরা কি রাগেরই যোগ্য?

আশ্চর্য! রাসুটা হচ্ছে ঠিক বাপের মতই অপদার্থ। ভবিষ্যতের দিকে তাকালে খুব একটা আশার আলো চোখে পড়ে না। কিন্তু তার জন্য হতাশা আনেন না রামকালী–আপন শক্তিতে বিশ্বাসী, আপন কেন্দ্রে অটুট অবিচল তিনি।

ওদের কথাকে চিন্তার জগতে ঠাই দেন না রামকালী, কিন্তু সত্যটা মাঝে মাঝে তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। শুধু সেই একটা ভয়ঙ্কর সরল মুখ থেকে উচ্চারিত ভয়ঙ্কর জটিল প্রশ্নগুলোই চিন্তিত করে তোলে রামকালীকে তা নয়, চিন্তিত করে তোলে সত্যর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে।

সংসার কি সত্যবতীকে বুঝবে?

পালকি থেকে নেমে পড়লেন রামকালী।

বিদ্যারত্নের মাটির কুটির থেকে একটু দূরে। সেটাই সভ্যতা, সেটাই গুরুজনের সম্ভ্রম রক্ষা। গুরুজনের চোখের সামনে গাড়ি পালকি থেকে নামা অবিনয়।

মাটির ঘর দালান দাওয়া, দাওয়ার নিচের উঠোনে আঁকা ছবির মত বেড়া ঘেরা ছোট্ট ফুলবাগানটি। বিদ্যারত্নের নিজের হাতের বাগান, নিজের হাতের দেওয়া বেড়া। টগর দোপাটি গাঁদা বেল মল্লিকা রক্তজবা করৰী সন্ধ্যামণি, নানান গাছে সারা বছরই ফুলের সমারোহ। এছাড়া বেড়ার ধারে আছে তুলসী কেয়ারি। গঙ্গাস্নানের পর পূজোর আগে একবার গাছগাছড়াগুলির তদারক করে যাওয়ার অভ্যাস বিদ্যারত্নের। পায়ে খড়ম, পরনে নিজের হাতে কাটা সুতোর ধুতি ও উত্তরীয়– পিতলের ঝারায় জল নিয়ে গাছের গোড়ায় গোড়ায় ঢালছিলেন বিদ্যারত্ন, রৌদ্রে, রামকালীর ছায়া পড়তেই মুখ তুলে তাকালেন।

হৈ হৈ করে সম্ভাষণ করে উঠলেন না বিদ্যারত্ন। হঠাৎ আবির্ভাবের জন্য বিস্ময় প্রকাশও করলেন, শুধু রামকালীর প্রণাম শেষ হলে তাঁর মাথায় হাত রেখে বললেন, এস, দীর্ঘায়ু হও।

শান্ত, সৌম্য মুখ, শ্যামবর্ণ ছোটখাটো চেহারা, মাথার চুলগুলি ধবধবে পাকা, কিন্তু দৃঢ়নিবদ্ধ মুখের চামড়ায় বলিরেখার আভাসমাত্র নেই। সহজে বিশ্বাস করা শক্তবিদ্যারত্ন মশাইয়ের বয়স আশী ছোঁয়-ছোঁয়। চকচকে সাজানো দাঁতের পাটির শুভ্র হাসিটুকুও বিশ্বাস করতে প্রতিবন্ধকতা করে।

দাওয়ার উপর খান দুই-তিন জলচৌকি, কাছের পৈঠেয় ঘটিতে জল। পা ধুয়ে দাওয়ায় উঠে জলচৌকিতে বসলেন রামকালী, বিনত হাস্যে বললেন, আপনার তো আহ্নিকের বেলা হল!

তা হল। বিদ্যারত্ন প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন, বলবে কিছু–যদি বলবার থাকে?

বলবার কিছু আছেই, নচেৎ এমন অসময়ে ব্যস্ত হয়ে আসার কারণ কি?

রামকালী আর গৌরচন্দ্রিকা করলেন না, মুখ তুলে পরিষ্কার কণ্ঠে বললেন, পণ্ডিতমশাই, আজ আবার এক প্রশ্ন নিয়ে আপনার দরবারে এসে দাঁড়িয়েছি। বলুন মানুষ বড়, না বংশমর্যাদার অহঙ্কার বড়?

.

ঠিক এই একই সময় একটা ছোট মেয়ে ওই একই ধরনের প্রশ্ন করছিল, অন্য কাউকে নয়, নিজের মনকেই। আচ্ছা এও বলব, মানুষ বড়, না তোমাদের রাগটাই বড়?

কী আশ্চয্যি, কী আশ্চয্যি! জলজ্যান্ত একটা মানুষ হারিয়ে গেল তবু গিন্নীরা কিনা সত্যর ওপর চোখ রাঙাচ্ছেন, খবরদার দুটি ঠোঁট ফাঁক করবি না, কারুর যদি কানে যায় তো তোদের সব কটার হাড়মাস দু ঠাই করব।

বেশ বাবা, তোমাদের জেদই থাক, রাগ নিয়ে ধুয়ে জল খাও তোমরা।

ওদিকে বিদ্যারত্ন রামকালীকে বলছিলেন, কালের সমুদ্রে একটা মানুষের জীবনমরণ সুখদুঃখ কিছুই নয় রামকালী, সমুদ্রে বুদ্বুদ মাত্র। কুলত্যাগিনী বধূকে সন্ধান করবার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু সমাজকে তো একটা জবাব দিতে হবে?

যা সত্য তা বলবে সাহসের সঙ্গে। সত্যকে স্পষ্ট করে বলতে পারা চাই। সেটাই ধর্ম। সেই বিপদগামিনীকে তুমি তো আর ঘরে নিচ্ছ না? ভেবে নাও তার মৃত্যু হয়েছে।

কিন্তু পণ্ডিতমশাই, এ আমি ভাবতেই পারছি না। আমার ঘরের কথা নিয়ে অপরে আলোচনা করবে।

রামকালী, তোমার দেহে একট দুষ্টু রোগ হওয়া অসম্ভব নয়, তা যদি হয় কি করবে তুমি? বিধাতার বিধান মেনে নিতেই হবে। তা ছাড়া হয়তো এরকম একটা কিছু প্রয়োজনও ছিল। হয়তো তোমার ভিতর কোনখানে একটু অহমিকা এসেছিল।

অহমিকা! পণ্ডিতমশাই, আমি’র প্রতি মর্যাদাবোধ থাকাটা কি ভুল? অন্যায়?

এই একটা জায়গা বড় গোলমেলে রামকালী, আত্মমর্যাদাবোধ আর অহমিকা-বোধ, এ দুটোর চেহারা যমজ ভাইয়ের মত, প্রায় এক, সূক্ষ্ম আত্মবিচারের দ্বারা এদের তফাৎ বোঝা যায়। তা ছাড়া তুমি ব্রাহ্মণ! রজোগুণ তোমার জন্য নয়। কিন্তু আজ তোমার চিত্ত চঞ্চল, তুমি এখন বিশেষ ব্যস্তও, কাজেই আজ এস। আলোচনা থাক।

রামকালী কয়েক মুহূর্ত মাথা নিচু করে ভূমিসংলগ্ন দৃষ্টিতে কি যেন ভাবলেন, তারপর সহসা মাথা তুলে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, আচ্ছা, আপনার নির্দেশ শিরোধার্য করলাম।

আর একবার বিদ্যারত্নের পদধূলি নিয়ে বেরিয়ে এসে পালকিতে চড়লেন রামকালী। ফেরার মুখে আর বেহারাদের তাড়া দেবার কথা মনে এল না। বিদ্যারত্নের একটা কথা তাকে বিশেষ ধাক্কা দিয়েছে। বিদ্যারত্ন বললেন, তুমি ব্রাহ্মণ, রজোগুণ তোমার জন্য নয়।

কিন্তু তাই কি সত্য? ব্রাহ্মণের মধ্যে তেজ থাকবে না? থাকবে কেবলমাত্র রজোগুণ-শূন্য স্তিমিত শান্তি?

.

ফিরে দেখলেন বাড়ি লোকে লোকারণ্য। নিমন্ত্রিতেরা প্রায় সকলেই এসে গেছে। রান্নাও প্রস্তুত। শুধু রামকালীর অনুপস্থিতিতে ভোজে বসিয়ে দেবার ব্যবস্থাটা ঠিকমত হচ্ছে না, সকলে মিলে শুধু গুলতানি চলছে।

এই চনচনে সময়ে দূর থেকে পরিচিত পালকি-বেহারাদের হুম হুম্ আওয়াজ কানে এল। আশায় অধীর হয়ে উঠল সবাই এসে গেছেন, এসে গেছেন রবে গম্ গম্ করে উঠল জনতা। সকলেই অবশ্য ধরে নিয়েছিল আচমকা কোন রোগীর মরণ-বাচন সংবাদ পেয়ে বাধ্য হয়ে বেরিয়ে যেতে হয়েছে রামকালীকে। কুঞ্জও সেই কথাই বলে রেখেছিলেন।

অন্দরমহলে মেয়েদের মধ্যে শঙ্করী সম্পর্কে কানাঘুষো শুরু হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু বারমহল সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত।

রামকালী এসে দাঁড়াতেই বয়োজ্যেষ্ঠ অতিথি-অভ্যাসগতের দল হৈ হৈ করে এগিয়ে এলেন, ব্যারামটা কার রামকালী? কোন্ গায়ে? কে যেন দেবীপুরের দিকে পাকি যেতে দেখল, এইখানেই কারও—

না, কারও ব্যায়রাম শুনে আমি যাই নি– রামকালী একবার লোক-ভর্তি আটচালার সমস্তটায় চোখ বুলিয়ে নিলেন, তার পর একটু থেমে বললেন, আমি বেরিয়েছিলাম অন্য প্রয়োজনে, সে প্রয়োজেনের কথা আপনাদের সকলকেই জানাব। যদিও আপনারা এখনো অভুক্ত ও ক্ষুধার্ত, আমার কথা শুনে ঠিক কি মনোভাব আপনাদের হবে তাও সম্পূর্ণ বুঝতে পারছি না, তবু আহারাদির পূর্বেই কথাটা ব্যক্ত করা উচিত মনে করছি আমি। বলতে আপনারা সকলে অনুমতি করুন আমাকে।

নিঃশব্দ জনতার মাঝখানে রামকালীর ভরাট কণ্ঠস্বর গম্ গম্ করে উঠল, অনেকেরই বুক কেঁপে উঠল একটা অজানা আশঙ্কায়।

কুঞ্জ হঠাৎ পিছনদিকে হঠে গিয়ে ধুলোর উপর বসে পড়লেন, রাসু ভিড়ের একেবারে পিছনেই ছিল সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল কাকার আরক্ত গৌরমুখের দিকে। সমাগতেরা অনুধাবন করতে পারছেন না ব্যাপারটা কি। আহার্য বস্তুতে কি কোনও অনাচার স্পর্শ ঘটেছে? কিন্তু তাই বা কি করে বলা যায়? রামকালীর আচমকা বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নটাও যে রয়েছে।

তবে কি সহসা রামকালীর কোন জ্ঞাতির মৃত্যু ঘটেছে? এই বিরাট ভোজের রান্না সব অশৌচান। হয়ে গেছে? সেই সংবাদ পেয়েই রামকালী…। রামকালী কি এমন অর্বাচীন যে এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে সেই তথ্য এসে প্রকাশ করবেন? মৃত্যুসংবাদ কানে না শুনলে তো অশৌচ হয় না, উনি নিজে গা ঢাকা দিয়ে বেড়ালে তো আর এখানের অন্নগুলো অশৌচান্ন হয়ে যেত না? বলে এমন ক্ষেত্রে ঘরের মরা কাঁথা কাথা চাপা দিয়ে রেখে লোকে দিন উদ্ধার করে নেয়।

তবে?

রামকালী যে তার বক্তব্য জ্ঞাপন করতে অনুমতি চেয়েছিলেন, এ কথা কারও মনে ছিল না, ফের চেয়ে সে কথা মনে করিয়ে দিলেন রামকালী।

তা হলে আপনারা আমায় অনুমতি দিচ্ছেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্য অবশ্য। তোর যা বলবার আছে বল।

তা হলে শুনুন, গতরাত্রে আমার পরিবারভুক্ত একটি বিধবা বধূ গৃহত্যাগ করেছে।

আঁ! অ্যাঁ! আঁ!

সহসা ভয়ঙ্কর একটা ঝড় উঠল। কালবৈশাখির দুমদাম এলোমেলো ঝড় নয়, যেন একটা বুনো অরণ্যের চাপাশ্বাস গোঁ গোঁ করে উঠল। সেই শ্বাস শুধু সমবেত কণ্ঠের ওই আহত বিস্ময়ের প্রচণ্ড ধ্বনি।

রামকালী কি এই বজ্রটাকেই প্রস্তুত করছিলেন এতক্ষণ ধরে তাঁর অভুক্ত ক্ষুধার্ত নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্যে?

তুমুল ঝড়ের ধ্বনিতে রামকালীর কথার শেষ অংশ চাপা পড়ে গিয়েছিল, আর একবার সে স্বর গমগম করে উঠল চাপা মেঘমন্দ্রের মত।

এখন আপনারা স্থির করুন, এই অপরাধে আমাকে ত্যাগ করবেন কিনা?

যেন বক্তৃতা-মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন রামকালী, এমন ধীর-স্থির সমুন্নত সেই মূর্তি!

একে ত্যাগ!

সম্ভব!

কিন্তু তাও হওয়া সম্ভব বৈকি। সমাজ বলে কথা!

নিবারণ চৌধুরীর মামা বেঁটেখাটো বিপিন লাহিড়ী একটা জলচৌকি টেনে এনে তার উপর দাঁড়িয়ে উঠে বিয়ে চিবিয়ে বললেন, ত্যাগ করাকরির কথা নয়, ভবিষ্যতে যা বিচার তা হবে। কিন্তু বর্তমানে আজ তো আর আমাদের এখানে খাওয়া হয় না রামকালী।

রামকালী দুই হাত জোড় করে শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমি কাউকে অনুরোধের দ্বারা পীড়ন করতে চাই না, তবে এইটুকুই শুধু জানাচ্ছি, আমি সেই মতিভ্রষ্টা মেয়েকে মৃত বলেই গণ্য করব। মানুষের সমাজ থেকে তার মৃত্যু হয়েছে। আহারের পূর্বে এ কথাটি নিবেদন করতে যারপরনরাই দুঃখ বোধ করছি আমি, কিন্তু আমার বিবেকের কাছে এইটাই কর্তব্য বলে মনে হল আমার।

বিপিন লাহিড়ী মনে মনে খুব ভেঙচান, আগে বলাই কর্তব্য ভাবলাম! ওরে আমার যুধিষ্ঠির! এই যজ্ঞির খাওয়াটা পণ্ড করলি? ভাল হবে–তোর ভাল হবে?

চোখে জল এসে যাচ্ছিল বিপিন লাহিড়ীর। তবু কথা বলেন তিনি, আমার মনে হয়, খবরটা তোমার এখন গোপন রাখাই উচিত ছিল রামকালী।

সে আমি ভেবেছিলাম। রামকালী আবার একবার সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, কিন্তু পরে মনকে ঠিক করে নিলাম। আমার এত বড় কলঙ্ক সত্ত্বেও যদি আপনারা আমাকে ত্যাগ না করেন, তাহলে পরম ভাগ্য বলে মানব। আর যদি তা করেন, সে শাস্তি মাথা পেতে নেব।

এবার আর ঝড় নয়, গুঞ্জনধ্বনি!

সে ধ্বনি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল। তা এতে তোমার আর কলঙ্ক কি?

আছে বৈকি! আমার অন্তঃপুর উচিত মত রক্ষা করবার অক্ষমতাই আমার কলঙ্ক, আমার অপরাধ। মার্জনা আমি চাইব না, এই অপরাধের মার্জনা নেই, শুধু আমার প্রতি আপনাদের স্নেহ ভালবাসার কাছে হাত জোড় করে প্রার্থনা করছি, আপনারা পরে আমার প্রতি যে শাস্তির আদেশ দেন মাথা পেতে নেব, শুধু আজ আপনারা দয়া করে আহার করুন।

আর একবার ঝড় উঠল।

অসন্তোষের? না উল্লাসের?

বোধ করি বা উল্লাসেরই, তবে জলচৌকির উপর দাঁড়িয়ে থাকা বেঁটে-খাটো বিপিন লাহিড়ীর গলাটায় শুধু শোনা গেল, আচ্ছা, আজকের মত তোমার অনুরোধ রক্ষা করাই আমরা স্থির করছি।

রামকালী ধীরে ধীরে সরে গেলেন। মাথা সোজা করেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *