বেলা না পড়তেই আবার রামকালীর পালকি ফিরতি মুখ ধরেছে, একা রামকালীকে নিয়েই। এখন পালকির খোলা দরজা দিয়ে পড়ন্ত সূর্যের স্বর্ণাভা উঁকি মারছে, শেষ ফাল্গুনের উড়ু উড়ু বাতাস যেন দুষ্ট শিশুর মত মাঝে মাঝে ঝুপ করে ঢুকে পড়ে একটা টু দিয়ে যাচ্ছে।
আকাশে বাতাসে পাতায় সর্বত্রই একটা আলো-ঝলসানো আনন্দের আবেশ। কিন্তু প্রকৃতির এই মধুর রূপে মন দেবার মত মন এখন নেই রামকালীর। কি এক দুরন্ত ক্ষোভে মনটা যেন হাহাকার করছে। মনে হচ্ছে কোথায় যেন মস্ত একটা হার হয়ে গেছে তার।
ভদ্রতাবোধহীন নীলাম্বর বাঁড়ুয্যের কাছে কি পরাজয় ঘটেছে রামকালীর? মেয়েকে নিয়ে আসতে পারেন নি এই ক্ষোভেই মন এমন অস্থির।
কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তো তা নয়। নীলাম্বর তো ভদ্রতার চূড়ান্ত দেখিয়েছেন।
মেয়ে নিতে এসেছেন এ প্রস্তাব তোলামাত্রই নীলাম্বর অমায়িক হাস্যে বলেছেন, বিলক্ষণ, এ তো অতি উত্তম কথা! আপনার কন্যা আপনি নিয়ে যাবেন, যত দিন ইচ্ছে রাখবেন, এতে আমার কি বলবার আছে। ওরে কে আছিস, পঞ্জিকাটা একবার নিয়ে আয় তো।
রামকালী বলেছিলেন, পঞ্জিকা আমি দেখেই এসেছি। আগামী কাল সর্বশুদ্ধা ত্রয়োদশী। বারও ভাল। কালই নিয়ে যাব। রাত্রিবাস না করে উপায় থাকছে না। কাজেই গ্রামে কোনও ব্রাহ্মণবাড়িতে শয়নের একটু ব্যবস্থা করে দিন। কিন্তু অনুগ্রহ করে কোনও আহারাদির আয়োজন করতে যাবেন না। বেহারাদের জলপানির ব্যবস্থা ওদের সঙ্গে আছে।
নীলাম্বর মেয়েদের ভঙ্গীতে গালে হাত দিয়ে বলে উঠেছিলেন, বলেন কি বেহাই মশাই! আমার এত বড় বাড়ি, এত বড় ঘরদালান থাকতে আপনি অন্যত্র–
রামকালী গম্ভীর হাস্যে থামিয়ে দিয়েছিলেন, বেহাইমশাই কি হিন্দু বাঙালীর লোকাচার বিস্মৃত হচ্ছেন? জামাতৃ-গৃহে রাত্রিবাস কি লোকাচারসম্মত?
নীলাম্বর হাসির সঙ্গে একটি হ্যা হ্যা শব্দ করে বলেছিলেন, তা অবশ্য, তা অবশ্য। কিন্তু আপনার কন্যার সন্তান-জন্মের পর তো আর এ জেদ রাখতে পারবেন না?
রামকালী আরও গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, সন্তান নয়, পুত্রসন্তান। কিন্তু সুদূর ভবিষ্যতের আলোচনায় বৃথা সময় অপচয়ে দরকার কি? এখন কন্যার সঙ্গে একবার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করুন।
বিলক্ষণ, এর আবার ব্যবস্থা কি? ওরে সদু, তোদের বৌকে একবার মাঝের ঘরে নিয়ে আয়, বেহাইমশাই একবার দেখবেন।
তবে? নীলাম্বরের ব্যবহারে খুঁত কোথায়?
এর চাইতে ভদ্র ব্যবহার আর কি আশা করা যায়? কত বাড়িতে তো বৌয়ের বাপ-ভাই এলে বাইরে থেকেই জল-পান খাইয়ে বিদায় দেওয়া হয়, মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় না। তা ছাড়া অনেক বাড়িতে বহু সাধ্য-সাধনায় যদি বা মেয়ের দর্শন মেলে, সঙ্গে একজন পাহারা থাকে। সে জায়গায় কিনা চাওয়া মাত্রই পাওয়া? রামকালীর তো কৃতার্থ হয়ে যাওয়া উচিত।
কিন্তু আশ্চর্য মানুষের মন! রামকালীর মনে হল নীলাম্বরের ওই “সদু” না কাকে ডেকে হুকুম দেওয়া, ওটা যেন তাচ্ছিল্য প্রকাশের একটা চরম অভিব্যক্তি। ও সুরটার মধ্যে এই কথাগুলোই ঠিক খাপ খেত– ওরে কে আছিস, একমুঠো ভিক্ষে দিয়ে যা তো, ভিখিরিটা চেঁচাচ্ছে!
নিজেকে গ্লানিযুক্ত আর সমস্ত পরিবেশটা অশুচি মনে হল রামকালীর। কিন্তু উপায় কী? জামাইয়ের বন্ধু সেই ছেলেটা উঠোনে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখা যাচ্ছে, নিজে সে গেল কোন দিকে?
এদিক ওদিক তাকালেন, হদিস পেলেন না।
সদু কে? ছেলে না মেয়ে? কর্তার তো শুনেছি মেয়ে নেই!
একঝাক ভাবনার মাঝখানে হঠাৎ বোধ করি সেই মাঝের ঘরেরই দরজার শিকলটা নড়ে উঠল।
নীলাম্বর কোমরের কসি খুঁজতে খুঁজতে উঠলেন। ভিতরে ঢুকে কি বললেন কি করলেন ঈশ্বর জানেন, তার পর বেরিয়ে এসে ডাক দিলেন, আসুন বেহাই মশাই!
রামকালী ভিতরে ঢুকলেন।
দেখলেন একটা অন্ধকার–অন্ধকার ঘরের মধ্যে একটা চৌকির ধারে একগলা ঘোমটা টাকা একটি বালিকা-মূর্তি। পরনের শাড়িখানা জমকালো; বোধ করি পিতৃ-সন্নিধানে আসার উপলক্ষে তাকে খানিকটা সাজিয়ে ফেলা হয়েছে।
ঘরের বাইরে একটি কমবয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে, মাথায় ঘোমটা কম। রামকালী এসে ঢুকতেই মেয়েটি তাড়াতাড়ি তার পায়ের ধুলো নিয়ে খাটো গলায় বলল, ওই যে, কথাবার্তা কন। তারপরে আরও খাটো গলায় হঠাৎ ‘মেয়ে নিয়ে যাবেন’ বলেই টুক করে পাশের একটা দরজা দিয়ে কোথায় ঢুকে গেল। কিন্তু ওর ওই অস্ফুট কথাটা পরিপাক করবার আগেই আর একটা চাপা অথচ তীব্র কথা কানে এল তাঁর, বৌকে একলা রেখে চলে এলি যে বড়!
বাঃ, আমি আবার সঙের পুতুলের মত কি দাঁড়িয়ে থাকব, লজ্জা করে না? উত্তরের এই কথাটুকুও কানে এল। তারপর আবার সেই তীব্র স্বর, ওরে আমার লজ্জাউলি লজ্জাবতী! একলা হয়ে এখন বাপের কাছে সাতখানা করে লাগাক!
এর উত্তর আর কানে এল না রামকালীর, কিন্তু ইতিপূর্বের তিক্ত মন কী এক রকম বিকল হয়ে বিস্বাদ হয়ে গেল, কন্যা-সন্দর্শনের প্রথম আনন্দটাই শিথিল হয়ে গেল।
সেই অবকাশে গুণ্ঠনবতী সত্য নিতান্ত নীরবে বাপকে একটি প্রণাম করল। প্রণাম করে যথারীতি পায়ের ধুলো মাথায় বুলোতে ভুলে গেল না।
কিন্তু রামকালী সহসা স্তম্ভিত হলেন কেন?
সত্যর এই আচরণে বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠল তার কেন? যে হাহাকার এখনো থামাতে পারছেন না এই স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষটাও রামকালী কি আশা করেছিলেন তার সেই সত্য অবিকল তেমনি আছে? বাপকে দেখেই ছুটে এসে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে গিন্নীদের মত বলে উঠবে, কি বাবা, এতদিনে মেয়েটাকে মনে পড়ল? ধন্যি বলি বাপের প্রাণ, এতদিনে একবার দেখতে আসতে ইচ্ছে হল না মেয়েটা মরল কি বাচল? যাই ভাগ্যিস পুণ্যিপিসির বিয়েটা লেগেছিল, তাই না—
অথবা এইটাই কি মনে করেছিলেন, সত্য আর আগের সত্য নেই, একেবারে বদলে গেছে। তাই প্রত্যাশিত হৃদয়ে অপেক্ষা করছিলেন, দেখামাত্রই ঝাঁপিয়ে এসে পিতৃবক্ষে আশ্রয় নিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে ভাসাবে সে! আর তার সেই অবিরল অশ্রুধারায় রামকালীর জ্বালা করা বুকটা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে!
কিন্তু এই ইচ্ছে তো রামকালীর হবার কথা নয়। আবেগপ্রবণতা তো রামকালীর সম্পূর্ণ রুচিবিরুদ্ধ। মন-কেমন করা বা অনেক দিন পরে দেখা হওয়া ইত্যাদি উপলক্ষ করে বউ কাঁদছে কাটছে দেখলে ভুরু কুঁচকে ওঠে তার। স্বয়ং রামকালী-দুহিতাই যদি সেই খেলা আর সস্তা পদ্ধতিতে আবেগ প্রকাশ করে বসে, রামকালী অসন্তুষ্ট হতেন না কি?
বহু বিচিত্র উপাদানে গড়া মানব-মন কখন কি চায় বলা বড় শক্ত। কি চায় নিজেই বুঝতে পারে না, শুধু এক-এক সময় একান্ত বেদনায় বলে, এ কী হল! এ তো আমি চাই নি!
তাই চির-অবিচলিত রামকালী হঠাৎ আজ নিজের মেয়ের এই শান্ত সভ্য বধূমূর্তি দেখে বিচলিত হয়ে ভাবলেন, এ কী হল!
কথা যোগায় না রামকালীর। মৃদু গম্ভীর কণ্ঠ থেকে শুধু একটু কুশল প্রশ্ন উচ্চারিত হয়েছিল, ভালো আছো তো?
সত্য তেমনি মাথা নিচু করে বলেছিল, হ্যাঁ বাবা। বাড়ির সব খবর মঙ্গল?
ঠাকুমা পিঠাকুমার দল থেকে শুরু করে বান্দী ঝিটা পর্যন্ত বাড়ির প্রত্যেকটি সদস্যের নাম করে কে কেমন আছে জিজ্ঞেস করল না সত্য, শুধু জিজ্ঞেস করল বাড়ির সব মঙ্গল?
আশ্চর্য! আশ্চর্য! শ্বশুরঘরে এলে কি এমনি করেই মেয়েরা তাদের আজন্মের আশ্রয়কে– তাদের ধুলোমাটির গড়া খেলাঘরের মতই ভেঙে ফেলে? মন থেকে মুছে ফেলে? তাই শকুন্তলাকে আর কোন দিন কণ্ব মুনির আশ্রমে দেখা যায় নি, জনক রাজার ঘরে সীতাকে? মহাকবিদের মহৎ লেখনীও এই অমোঘ নিয়মকে সহজ সত্য বলেই মেনে নিয়েছিল, তাই সে লেখনী নির্মম ঔদাসীন্যে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে, পিছু ফিরে তাকায় নি?
নারী আর নদী, এরা তবে এক ধাতুতে গড়া!
কিন্তু গিরিরাজ-দুহিতা উমা?
না, উমা তো ইতিহাসের নয়, পুরাণের নয়, মহাকবিদের অমর লেখনীর অনবদ্য সৃষ্টি নয়, সে যে শুধু ঘরোয়া মানুষের মনের মাধুরী দিয়ে গড়া অমিয় ছবি। মানুষের প্রত্যাশা আর কল্পনা, আশা আর আকাক্ষা দিয়ে গড়া ভালবাসার মূর্তি!
রামকালীর মনের মধ্যে অনেক ভাব-তরঙ্গের একটা আলোড়ন উঠেছিল, যেমনটা তাঁর সচরাচর হয় না। ভাবলেন তবে কি সত্য সম্পর্কে এতদিন যে মূল্যবোধ তার মনের মধ্যে ছিল, সত্য তার উপযুক্ত নয়? সত্য সেই সাধারণ মেয়ে, যারা সহজেই বদলে যায়? ভাবলেন তবে কি মার খাওয়ার কথাটাই সত্যি, আর সত্য একেবারে নেহাত একটা ভীরু মেয়ে মাত্র? যে মেয়েরা পড়ে মার খায়, আর মার খেয়ে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে, নিজেকে প্রকাশ করতে সাহস পায় না?
সত্যর সম্পর্কে এত হতাশ হয়েই বুঝি রামকালীর মধ্যে এত আলোড়ন।
তবু সে আলোড়নকে সংহত রেখে রামকালী বলেছিলেন, হা, সব সংবাদ মঙ্গল। পুণ্যির বিয়ে যোলই বোশেখ, তাই তোমাকে নিয়ে যাবার সংকল্প করে এসেছি।
হ্যাঁ, ঠিক এই কথাটা উচ্চারণের পরই বুকের মধ্যে যেন একটা হাতুড়ির ঘা খেলেন রামকালী।
বাবা গো, তুমি কি ভাল! বলে আহ্লাদে চেঁচিয়ে উঠল না সত্য, তার বদলে বলল, বোশেখের মাঝামাঝি বিয়ে, আর এখন তো সবে ফাগুনের শেষ, এত আগে থেকে নিয়ে যেতে চাইলে এরা কিছু মনে করতে পারে বাবা।
রামকালী সুগভীর একটা নিঃশ্বাস গোপন করে বলেছিলেন, ওঁরা অমত করেন নি।
করে নি সে ওদের ভদ্রতাই, কিন্তু বাবা আমাদেরও তো একটা বিবেচনা করা দরকার। এদের অসুবিধেয় ফেলে–
তোমার তাহলে এখন যাওয়ার মত নেই?
আর একটা নিঃশ্বাস গোপন করতে হয় রামকালীকে।
সত্য এবার মুখ তুলে তাকায়। সোজাসুজি একেবারে বাপের চোখের দিকেই। বাহারে শাড়ির ঘোমটাটা খসে পিঠের ওপর পড়ে যায়, তাই সত্যর সে বাগ-না-মানা কোঁকড়া চুলে ঘেরা মুখটার সবটাই স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়, আর চোখের দৃষ্টিটা তার বেশ একটু সময় নিয়েই বাপের মুখের দিকে নিবদ্ধ থাকে!
তার পর চোখ নামিয়ে নিয়ে বসে পড়া আঁচলটা মাথায় তুলতে তুলতে উত্তর দেয় সত্য, তা কার্যক্ষেত্রে মত নেই-ই বলতে হয় বৈকি। ঠাকরুণের শরীর-স্বাস্থ্য ভাল নয়, একা ননদের ঘাড়ে সমগ্র সংসার
রামকালী ঈষৎ বিস্মিত প্রশ্নে বলেন, ননদ! নবকুমারের ভগিনী আছেন নাকি?
সহোদর বোন নন, তবে সহোদরের বাড়া বাবা। পিসতুতো ননদ-ওই যে যিনি তোমাকে এ ঘরে এনে পৌঁছে দিলেন।
ও! ননদ-প্রসঙ্গে ইতি টেনে রামকালী বলেন, যাবার যখন উপায় নেই, তখন আর কি করবার আছে! অতএব রাত্রে আমার আর এ গ্রামে অবস্থান করারও প্রয়োজন দেখি না। এখনি রওনা দেব। তার আগে একটা প্রশ্ন তোমায় করছি, তুমি তো লেখাপড়া কিছু শিখেছিলে, পত্রাদিও পড়তে পার মনে হয়, এই চিঠিটা পড়ে মানে বুঝতে পারবে? জামার পকেট থেকে চিঠিটা বার করেন রামকালী।
চিঠিখানা কিন্তু সত্য তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে নেয় না। মৃদুস্বরে বলে, কার পত্তর?
সেটাই তো আমার জানা নেই। তুমি হয়তো জানতে পারবে।
অতঃপর চিঠিটা হাতে নিয়ে কয়েক ছত্র পড়ে সত্য, ঈশ্বর জানেন ঘোমটার মধ্যে তার মুখের চেহারা কেমন হয়ে ওঠে, কিন্তু গলাটা তো ঠিকই থাকে। ঠিকঠাক শান্ত গলায় বলে ওঠে সে, এত বড় একটা জ্ঞানবান বিচক্ষণ ব্যক্তি হয়ে বুঝতে পারলে না বাবা, এ কোনো শত্ত্বরের কাজ!
এমন কে শত্রু আছে তোমাদের?
তা কে জানে বাবা! অনেক শত্রুর তো ওপরে ভালমানুষ সেজেও থাকে। চিঠিটা সব না পড়েই বাবার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল সত্য।
রামকালী সেটা ফের পকেটে পুরে, দীর্ঘনিঃশ্বাস গোপন না করেই বলেছিলেন, তাহলে এখানে তোমার কষ্টের কোন কারণ নেই। তোমার সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা করবারও কিছু নেই আমার। ঈশ্বর মঙ্গল করলেন। তাহলে এই কথাই বলে সান্ত্বনা দিতে পারব তোমার মাকে।
মা! সত্য একটু চমকে বলে, এ পত্তরের বিষয় মা জানেন?
না। তিনি অবশ্য জানেন না কিছু, রামকালী ঈষৎ হাসির মত করে বলেন, তবে মেয়ে মেয়ে করে একটু উতলা হয়েছেন তো। যাক, তোমার প্রতি যে কোন দুর্ব্যবহার হয় না এটাই শান্তির বিষয়। আর বিশ্বাস করব তুমি ঠিক কথাই বলছ।
সত্য আর একবার তেমনি মুখ তুলে তাকায়। এবার যেন ভয়ঙ্কর একটা অভিমানের ছায়া ভর্ৎসনার মত ফুটে ওঠে সে-চোখে। তারপর চোখ নামে। মৃদু আর দৃঢ়কণ্ঠে বলে সত্য, পেতল কাঁসার ঘটিটা-বাটিটাও একত্রে থাকলে মধ্যে মধ্যে ঠোকাঠুকি লাগে বাবা, আর এ তো জলজ্যান্ত মানুষ! একেবারে ঠোকাঠুকি লাগে না, লাগবে না, এ কথা কি জোর করে বলা যায়? তবে এটুকু বিশ্বেস মেয়ের প্রতি রেখো বাবা, কোনও অন্যায় সে করবেও না, সইবেও না।
তারপর রামকালী চলে এসেছিলেন।
সত্য আর এক দফা প্রণাম করেছিল।
.
কিন্তু এখানেই তো ইতি নয়।
মেয়েকে না নিয়েই যে চললেন বেহাইমশাই? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিল রামকালীকে। আর মিথ্যা কথা বানিয়ে বলতে না পারার জন্যে বিদ্রূপ-হাস্যরঞ্জিত বিস্ময়-প্রশ্নও শুনতে হয়েছিল।
সত্যর শ্বশুর সেই তার মেয়েলী ভঙ্গীতে গালে হাত দিয়ে বলেছিলেন বলেন কি বেহাই মশাই, মেয়ে বাপের ঘর যেতে চায় না! এ যে বড় তাজ্জব কথা শোনালেন দেখছি!
নিজের জন্যও ততটা নয়, রামকালীর মনে হয়েছিল, কুকুরের কামড় হাঁটুর নিচে কিন্তু সত্যর শ্বশুর সম্পর্কে যে তাঁর ওই প্রবাদটা সহজেই মনে আসতে পারল, এটাও তো কম গ্লানির কথা নয়।
আশ্চর্য, ওদের ব্যবহারে বিনয় আর সৌজন্য প্রকাশের ঘটা তো কম ছিল না, তবু কেন রামকালীর ওদের স্থূল অমার্জিত মনে হয়েছিল? জামাইটা অবশ্য নেহাৎ বোকা-বোকা, প্রকৃতি কেমন কে জানে। তা সেই তো মাত্র একবার দেখা দিয়েই উধাও হয়ে গেল।
বন্ধুটাকে তবু আবার দেখলেন, কিন্তু জামাইকে নয়।
বন্ধুটা যে সত্যর শ্বশুর-শাশুড়ীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
শ্রদ্ধার যোগ্যই নয় ওরা।
তবু আর একবার বুকটা কেমন মুচড়ে উঠল রামকালীর, তবু সেই শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে দিব্যি মিশে গেছে সত্য। এমন মিশে গেছে যে শাশুড়ীর শরীর-স্বাস্থ্যের অজুহাতে বাপের বাড়ি যাওয়ার প্রলোভন ত্যাগ করল।
সুযোগ পেয়েও বাপের বাড়ি যেতে চাইল না, এ রকম মেয়ে রামকালী কি তাঁর এতখানি জীবনে এর আগে কখনো দেখেছেন? অথচ ঠিক বোঝাও যাচ্ছে না তাকে।
হয়তো তাকে আর কোন দিনই বোঝা যাবে না। রামকালীর মেয়ে রামকালীর কাছ থেকেই অনেক দূরে চলে গেছে, হয়তো আরও অনেক অনেক দূরে চলে যাবে। সেই সত্যকে আর কোনদিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
চির নিঃসঙ্গ রামকালীর অন্তরের একটিমাত্র ছোট্ট সঙ্গী, রামকালীর আকাশের আলো-ঝিকঝিকে ছোট্ট একটি তারকা চিরদিনের মত হারিয়ে গেল।
হঠাৎ চিন্তায় ছেদ পড়ল।
.
চোখে পড়ল পালকির পাশ দিয়ে বেহারাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর একটা মানুষও দৌড়চ্ছে।
কখন থেকে দৌড়চ্ছে?
হঠাৎ কোথা থেকেই বা এল? কিছু বলতে চায় নাকি?
রামকালী বেহারাদের আদেশ দিলেন থামতে।
আর তারপরই নজরে পড়ল, এ সেই নিতাই, তার জামাইয়ের বন্ধু।
কি খবর?
কিসের একটা প্রত্যাশায় রামকালীর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
কি ভাবলেন তিনি? তার সত্যবতীই কী আবার বাপকে ফিরিয়ে আনতে ডাক দিয়েছে? এখন কেঁদে ফেলে বলবে, মেয়ের মুখের কথাটা তুমি দেখলে বাবা, তার অভিমানটাকে দেখলে না? একবার না করেছি তো রাগ দেখিয়ে চলে গেলে?
অনেকগুলো কথা মনের মধ্যে হুড়োহুড়ি করে উঠল, তবু সংযত কণ্ঠেই প্রশ্ন করলেন রামকালী, কী খবর?
নিতাই হাঁপাচ্ছিল।
একটু জিরিয়ে নিয়ে বলে, বাচালতা মার্জনা করবেন তালুই মশাই, বলতে এসেছি– এ কী করলেন? মেয়ে নিতে এসে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন? বাঁড়ুয্যে মশাইয়ের কাছে হেরে গেলেন?
রামকালীর মুখ লাল হয়ে ওঠে।
কষ্টে আত্মসংবরণ করে বলেন, বাচালতা মার্জনা করা শক্ত হচ্ছে!
বুঝেছি। কিন্তু বড় আশায় হতাশ্বাস হয়েই ছুটে এসেছি। আপনার কন্যাকে নিয়ে গেলেন না বটে, কিন্তু এর পর আর হয়তো মেয়েকে জীবিত দেখতে পাবেন না। হয়তো আত্মঘাতী হয়ে– মেয়ে তো আপনার ভাঙে তো মচকায় না!
সহসা রামকালী চাপা ভারী গলায় প্রবল একটা ধমক দিয়ে ওঠেন, দেখতে তো বেশ ভদ্ৰসন্তান বলে মনে হচ্ছে, প্রকৃতি এমন ইতরের মত কেন?
ইতরের মত!
নিতাই বিহ্বল ভাবে তাকিয়ে থাকে।
রামকালী স্বভাবগম্ভীর স্বরে বলেন, অপর গৃহের কুলবধূ সম্পর্কে কোন আলোচনা ইতরতারই নামান্তর।
বেশ। নিতাই অভিমান-ক্ষুব্ধ মুখ নিচু করে বিদায়-প্রণাম করে বলে, আর কি বলব বলুন! তবে একা আমিই আসপর্দা করি নি। আপনার জামাই নবকুমারই, ঢোক গিলে বলে নিতাই, সে বলছিল চোখের সামনে স্ত্রীহত্যে দেখব, প্রতিকার করব না? তাই আমি–
নিতাই আস্তে আস্তে চলে যায়।
রামকালী স্তব্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন।
আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে রামকালী কি ওকে ফিরে ডাকবেন?
কিন্তু ডেকে তারপর?
আদ্যোপান্ত ঘটনা জেনে নিয়ে ফের আবার ছুটবেন জামাইবাড়ি?
তারপর?
আবার তাদের বলবেন, না, আমার ভুল হয়েছে, মেয়ে বালিকা, খামখেয়ালের বশে কি বলেছে। সে-কথা কথাই নয়, ওকে নিয়ে যাব?
আচ্ছা তার পর?
যদি সত্য আবার বলে, সে কি বাবা, আবার ফিরে এলে কি বলে? আমি তো বলেছি এখন যাওয়া হবে না?
তখন?
তখন কি করবেন রামকালী? সত্যর ওই কথার পর? বলবেন, পাগলী মেয়ে, পাগলামি রাখ, তোর মা তোকে না দেখে কেঁদে দিন কাটাচ্ছে! বলবেন, তোকে না নিয়ে একা ফিরতে আমার প্রাণটা হাহাকার করছে! বলবেন–
না, তা হয় না, আত্মমর্যাদাকে আর কত বিসর্জন দেবেন রামকালী?
তোল পালকি!
বেহারাদের হুকুম দেন রামকালী।
তারা যথারীতি গৃহাভিমুখেই চলতে থাকে।
আর রামকালী বিস্ময়ে মূক হয়ে বসে থাকেন সেই একক পালকিতে।
ধীরে ধীরে বিস্ময়ের ধূসরতা ফিকে হয়ে আসে।
কার্যকারণের চেহারাটা চোখে ভেসে ওঠে।
নীলাম্বর বড়য্যের কাছে হেরে যান নি রামকালী, হেরে গেছেন আপন আত্মজার কাছে। বুদ্ধির খেলায় রামকালীকে পরাজিত করেছে সত্য। বাপের কাছে প্রতিপন্ন করেছে, শ্বশুরবাড়িতে সুখে আছে সে, সন্তোষে আছে। তাই শ্বশুরবাড়ির কর্তব্যের কাছে বাপেরবাড়ির তীব্রমধুর আকর্ষণও তুচ্ছ করতে পারা অসম্ভব হল না তার।
জীবনের বিনিময়েও বাপের শান্তি বজায় রাখবে সত্য।
আর রামকালী? রামকালী সত্যর সেই কৌশলে বিভ্রান্ত হলেন, অভিমানে অন্ধ হলেন, আপন অহঙ্কার নিয়ে ফিরে এলেন।
আর এখন ফিরে যাওয়া যাবে না।
.
অপেক্ষা করতে হবে ন্যায্য সময়ের জন্য। পুণ্যির বিয়ের তারিখ ঘেঁষে কুটুম্বের মত আসবে সত্য। আসবে যদি ততদিন বেঁচে থাকে।
চোখ দুটো হঠাৎ লঙ্কার ঝাল লাগার মত জ্বলে উঠল। স্বভাব-বহির্ভূত তীব্রতায় পালকি থেকে মুখ বাড়িয়ে বেহারাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন রামকালী, কচ্ছপের মত সমস্ত মাটি মাড়িয়ে হাঁটছিস যে তোরা, পায়ে জোর নেই?
চিঠিখানা যে “শত্তুরের রটনা”, এ কথাটা নেহাৎ ভুল নয়। বৌকে এলোকেশী নিত্যপ্রহারে জর্জরিত করেন, এ বললে এলোকেশীর প্রতি অন্যায় অবিচার করা হয়। মেরেছিলেন সেই একদিনই। বৌয়ের চুল বাঁধতে বসে। অবিশ্যি একটু আশ মিটিয়েই মারবেন বলে উঠোনের রোদে মেলে দেওয়া জ্বালানি কাঠ থেকে একখানা তুলে এনেছিলেন, কিন্তু সে কাঠ আর বৌয়ের পিঠে ভাঙবার সুখ তাঁর হয় নি। সর্বনেশে সৃষ্টিছাড়া বৌ হঠাৎ ঝট করে কাঠখানা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বেশ মজবুত গলায় বলে উঠেছিল, দেখ গুরুজন আছো গুরুজনের মতন থাক, শিরোধার্যে রাখব। নচেৎ তোমার ললাটে দুঃখু আছে। আমাকে তুমি চেনো না, তাই ভেবেছো আমার ওপর যা খুশি করবে। সে বাসনা ছাড়ো।
কথা শেষ না হতেই এলোকেশী হঠাৎ মড়াকান্না কেঁদে উঠে পাড়ার লোক জড়ো করেছিলেন।
তারপর তো সে এক হৈ-চৈ কাণ্ড, রৈরৈ ব্যাপার!
কিন্তু সত্যকে আর সে রঙ্গমঞ্চে দেখা যায় নি।
পাড়ার পাঁচজনের বিস্ময়োক্তিকে সদু থামিয়েছিল, নতুন ফাগুনের গরমে মামীমার মাথাটা গরম হয়ে উঠেছে বলে। বলেছিল অবশ্য নেপথ্যে ডেকে নিয়ে গিয়ে চুপিচুপি জনে জনে বলেছিল।
তারপর মামীকে চুপিচুপি বলেছিল, সাপের ন্যাজে পা দিতে যেও না মামী, বৌটি তোমার যেমন তেমন নয়!
এলোকেশী সদুকে ন-ভূতো ন-ভবিষ্যতি গালমন্দ করে চিৎকার করে জানিয়েছিলেন–আচ্ছা, ওই বৌকে তিনি মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গাঁয়ের বার করে দিতে পারেন কিনা দেখবে গাঁসুদ্ধু সবাই।
কিন্তু আশ্চর্য, কার্যক্ষেত্রে আর তা করে উঠতে পারলেন না। এই কথার পিঠে বৌ সদুকে উদ্দেশ করে বেশ স্পষ্ট গলায় বলে দিয়েছিল, ঘরের বৌকে মাথায় ঘোল ঢেলে গাঁয়ের বার করে দিলে যদি গায়ের কাছে তোমাদের মুখোজ্জ্বল হয় তো তা করতে বল ঠাকুরঝি তোমার মামীকে। তবে বিবেচনা করে দেখতে বলল, তা করলে কার গায়ে ধুলো দেবে লোকে!
এলোকেশী তেড়ে এসে বলেছিলেন, তবে আয়, তোকে আজ কেটে রক্তগঙ্গা করে নিজে ফাঁসি যাই! উঃ, বৌমানুষের এত কথা!
সত্য নিঃশব্দে রান্নাঘরের দাওয়া থেকে মাছ কাটবার বড় বঁটিটা তুলে এনে এলোকেশীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, তাই তবে কর, তখন তো আর আমি দেখতে আসব না, কার মুখটা পুড়ল!
আশ্চর্য, এই ঘটনার পরই এলোকেশী কেমন নিথর হয়ে গিয়েছিলেন। আর একটিও বাক সরে নি তার মুখ থেকে। কিছুক্ষণ সেই বঁটিখানার চকচকে ফলাটার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে সরে গিয়েছিলেন।
আর তদবধি
তর্জন-গর্জনের পথ থেকে সরে এসে বাক্যালাপ বন্ধর পথ ধরে চলেছিলেন এলোকেশী। এবং তলে তলে ক্রমাগত নীলাম্বরকে মন্ত্রণা দিচ্ছিলেন, বৌয়ের গহনাগাটি সব কেড়ে নিয়ে কোন ছলে ছুতোয় বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। একবার পাঠিয়ে দিতে পারলে জীবনেও আর ওই সর্বনেশে জাহাবাজ মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে আসছেন না।
কিন্তু ছলছুতো খুঁজতে খুঁজতে দিন গড়িয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ এমনি সময় রামকালীর আবির্ভাব।
হাতে চাঁদ পেয়েছিলেন এলোকেশী। এবং নিশ্চিত ঠিক করে ফেলেছিলেন, এই সূত্রে বৌকে জন্মের শোধ বিদায় দেবেন। কারণ ইত্যবসরে আর একটি মেয়ে এলোকেশীর দেখা হয়ে গেছে, বয়স সাত-আট, ধরন-ধারণ খুব নিরীহ, সর্বোপরি তার বাপ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীনে-সোনার গহনায় মেয়ের সর্বাঙ্গ মুড়ে দেবে।
ঐ মহামন্ত্রটি স্বামীকে অনবরত জপিয়েছেন এলোকেশী।
অতএব এক কথায় রাজী হয়েছিলেন নীলাম্বর বৌ পাঠাতে। স্বপ্নেও ধারণা করতে পারেন নি, বৌ নিজে বেঁকে বসবে।
রামকালী চলে যেতে এলোকেশী পতির প্রতি জ্বলন্ত কটাক্ষ করে বলেন, বুঝলে কত বড় জাহাবাজ ধড়িবাজ মেয়ে? বলে নি তোমায় আমি, ও মেয়ের হাড়ে ভেলকি খেলে!
নীলাম্বর বলেন, দেখছি বটে।
তা হলে বল, ওই বৌ নিয়ে ঘর করতে হবে আমায়? একে তো ওই লক্ষ্মীছড়ি সদিকে নিয়ে হাড়ে হাড়ে জ্বলছি, তার সঙ্গে আবার ওই বৌ! আর দুটিতে মিল কত! আরও ওই জন্যেই বৌকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করতে চাই। আর–আরও একটা কথা, চুপি চুপি বলেছিলেন এলোকেশী, এখনো ঘরে দিই নি তাই, ওই ছক্কা-পাঞ্জা বৌ যেই সোয়ামীকে হাতে পাবে, সেই তো একেবারে জয় করে নেবে! আর কি আমার নবু আমার থাকবে? তার থেকে আমার বকুলফুলের ওই দ্যাওর-ঝিটা হাবাগোবা মতন আছে–
কিন্তু বেয়াই যখন চলে গেলেন তখন কিন্তু আর নীলাম্বর এ কথা বলতে পারলেন না, ভাল চান তো মেয়ে নিয়ে যান মশাই, নইলে কুলোর বাতাস দিয়ে বার করে দেবো!
নীলাম্বরের একটা ত্রুটি আছে। বুকের পাটাটা তার যতই থাক, মুখের জোরটা কম।
এলোকেশী গালে-মুখে চড়িয়ে বললেন, কী বলব, ব্যাই বেটাছেলে, তার সঙ্গে তো আমার কথা কওয়া সাজে না, নইলে একবার দেখে নিতাম সে বা কত বড় ঘুঘু আর ওই বাপ-সোহাগী বেটিই বা কত বড় হারামজাদী!
বৌয়ের সঙ্গে কথা বন্ধ ছিল, সে পণ আর রাখতে পারলেন না এলোকেশী। সত্য যেখানে বসে পান সাজছিল, সেখানে তেড়ে গিয়ে বললেন, বাপ নিতে এসেছিল, গেলি না যে বড়?
সত্য একবার চোখ তুলে চোখ নামিয়ে পান মোড়ায় মন দিল।
কী, কথার উতুর দিলি না যে বড়? গেলি না কেন বাপের সঙ্গে পিসির বিয়েতে?
সত্য মৃদু গম্ভীর ভাবে বলে, বিয়ের তো এখনও দেরি।
তা বাপ তো আদিখ্যেতা করে নিতে এসেছিল!
বাবার কথায় ও-রকম অচ্ছেদ্দা করে কথা কইবে না। বলে মোড়া পানগুলো ডাবরে ভরে ভিজে ন্যাকড়া ঢাকা দিয়ে ধীর মন্থর গতিতে উঠে কুলুঙ্গীতে তুলে রাখে সত্য।
এলোকেশী রাগে দিশেহারা হয়ে বোধ করি আর কোন কথা খুঁজে না পেয়েই বলেন, সর্বনাশী লক্ষ্মীছাড়ি, কি ভেবেছিস তুই? বাপের ঘরে যাবি না, চিরকাল আমার বুকে বসে দাড়ি ওপড়াবি?
সত্য একবার ফিরে তাকিয়ে শাশুড়ীর দিকে একটি অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, সর্বনাশীকে যখন কুলো-ডালা দিয়ে বরণ করে ঘরে এনেছ, তখন চিরকাল তার বোঝা বইতে হবে বৈকি।
.
নবকুমার খবরটা পেল ভগ্নদূতের কাছে।
নিতাই বলে গেছে, তোর শ্বশুর আমাকে শুধু ভস্ম করতে বাকী রেখেছে!
কিন্তু নিতাইয়ের কথাগুলো নবকুমার গায়ে মাখল না।
নির্যাতিতা ধর্মপত্নীকে নির্যাতন থেকে উদ্ধার করবার সাধু সংকল্প নিয়ে নবকুমার অসমসাহসিক কাজ করেছিল, কিন্তু রামকালী ফিরে যাবার পর হঠাৎ নিজের মনের দিকে তাকিয়ে আবার বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল নবকুমার। আশ্চর্য, সত্যবতীর যাওয়া হল না দেখে তার মনের মধ্যে যেন একটা পুলকের ঢেউ উথলে উঠছে।
নবকুমার এ রহস্যের কিনারা করতে পারল না।
কিন্তু নবকুমারের জন্যে যে আরও কী অদ্ভুত রহস্য তোলা ছিল, তা কি সে দণ্ডখানেক আগেও ভেবেছিল?
রাত খুব বেশী নয়, সন্ধ্যেরাত্তির।
এলোকেশী যথারীতি বিছানায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আর নীলাম্বর যথারীতি রাতসফরে বেরিয়েছেন, সদু রান্নাঘরে কাঠের ‘দেলকো’র উপর মাটির প্রদীপ বসিয়ে রান্না করছে। নবকুমার বাড়ি ফিরে সন্তর্পণে অন্ধকার দালানটা পার হচ্ছিল, হঠাৎ পাশের ঘরের দরজার কাছ থেকে একটা চাপা মৃদু অথচ দৃঢ় গলায় কে বলে ওঠে, একটু দাঁড়াতে হবে!
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না নবকুমার এবং দাঁড়িয়ে যে পড়ে সেটা আদেশ পালনার্থে নয়, চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলে বলেই পড়ে।
এ কণ্ঠস্বর তার বাপের নয়, মা’র নয়, সদুর নয়।
অতএব?
বাড়িতে আর কে আছে? নবকুমারের স্বপ্নলোকবাসিনী ছাড়া?
অন্ধকারে কেউ কাউকে স্পষ্ট দেখতে পায় না– শুধু গলাটাই শোনা যায়, নিত্যেনন্দপুরে চিঠি পাঠিয়েছিল কে? আমার দুঃখ-কাহিনীর ব্যাখ্যা না করে?
বলাবাহুল্য নবকুমার দারুমূর্তিতে পরিণত। আর দারুমূর্তির কথা কইবার ক্ষমতা থাকা সম্ভব নয়।
উত্তর নেই যে?
নবকুমার একবার অস্ফুটে বলে, কি বলব?
স্পষ্ট উত্তর দেবে। আমার বাবাকে চিঠি দিয়েছিল কে?
এ কণ্ঠের প্রশ্নে নিরুত্তর থাকা নবকুমারের সাধ্যাতীত। কষ্টে বলে, আমার সঙ্গে কথা কইছ, কে কমনে দেখে ফেলবে!
আচ্ছা সে চিন্তে আমার। কথাটার উত্তুর ফাঁকি না দিয়ে হক জবাবটা দাও।
নবকুমার ঢোক গিলে, ঘাড় চুলকে, ঘেমে-টেমে বলে, আমি চিঠির কথা কি করে জানব? কিসের চিঠি?
দ্যাখো, মিথ্যে কথা কয়ো না, নরকে ঠাই হবে না। সত্যবতী রুদ্ধকণ্ঠে বলে, আমার নিয্যস জ্ঞান, এ তোমার কাজ!
সহসা নবকুমারের স্বামীত্ব এবং পৌরষ ধিক্কার দিয়ে ওঠে তাকে। তাই সেও সহসা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে, যদি দিয়েই থাকি, দোষটা কি হয়েছে? নিজেই তো মরছিলে!
অন্ধকার থেকে মৃদু তীক্ষ্ণ স্বর দ্রুত কথা কয়, মরছিলাম সেটা ঢাক পিটিয়ে বলে বেড়াবার, কুটুমের কানে তোলার মতন কথা নয়। যারা নিজের মায়ের গালে চুনকালি দেয়, তাদের আবার বিদ্যে-বুদ্ধির বড়াই! ঘরশত্রুর বিভীষণকে ত্রিজগতের লোকে ছিছিক্কার করছে বৈ ধন্যি-ধন্যি করে নি। এই বুঝে কাজ করো।
ঘরের অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে যায় দরজায় দাঁড়ানো মূর্তিটার আভাস।
কণ্ঠস্বরের অনুরণনটুকুও বাতাসে মিলিয়ে যায়, অথচ নবকুমার না যযৌ ন তস্থৌ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রথম পত্নী-সম্ভাষণের যে বহুবিধ রোমাঞ্চময় এবং আবেগময় মধুর কল্পনা নবকুমারের লাজুক হৃদয় এতদিন ধরে লালন করে আসছিল, তার উপর কে যেন একটা কালির দোয়াত উপুড় করে দিয়ে গেছে। স্ত্রীর সঙ্গে জীবনের প্রথম বাক্যবিনিময় এইভাবেই শেষ হয় নবকুমারের।