ভরা দুপুর।
নৌকো মাঝগঙ্গায়।
দাঁড়টানার একটানা একটা শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। শুধু খানিক খানিক সময় অন্তর দাড়ি-মাঝিদের এক-একটা দুর্বোধ্য হুঙ্কার স্তব্ধ প্রকৃতিকে যেন চমকে চমকে দিচ্ছে।
নৌকোর আশেপাশে দাঁড়ের ধাক্কায় ভেঙে পড়া জলের বৃত্তরেখা, দূরে ঢেউ-খেলানো জলের রেশম চিকন গায়ে বাতাসের মৃদু কাঁপন।
সেই ঢেউ-খেলানো ঘি রঙ্গ রেশমী ওড়নার গায়ে হীরেকচি রোদের উজ্জ্বল সমারোহ।
রামকালী সেই সমারোহের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন।
ভরদুপুরের অচঞ্চল গঙ্গা, নৌকার গতি, মৃদু-মন্থর, তাই ভিতরে আলোড়ন নেই।
কিন্তু মনের ভিতরে?
যে মন ওই স্তব্ধ দেহদুর্গের মধ্যে চিরদিন সমাহিত থেকেছে?
না, আলোড়ন নয়, শুধু যেন সেই চিরসমাহিত মনটাকে আজ একটু মুক্তি দিয়ে ফেলেছেন রামকালী। ছেড়ে দিয়েছেন ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াবার জন্যে।
এই আটষট্টি বছর ধরে যে দীর্ঘ প্রান্তরটা পার হয়ে এলেন রামকালী, সেই প্রান্তরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে সেই হঠাৎ ছাড়া পাওয়া মনটা।
এর আগে কোন দিন এমন করে স্মৃতি-রোমন্থন করেন নি রামকালী। আজ করছেন। হয়ত বা অজ্ঞাতসারেই করছেন।
আজ সংসারের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন রামকালী, পিঠ ফিরিয়েছেন তার দিকে। কিন্তু বিদায় গ্রহণের প্রাক্কালে কত ব্যবস্থা, কত হিসেবনিকেশ, কত নির্দেশ, কত বন্দোবস্ত।
গ্রামে যে টোলটি স্থাপন করেছেন, যে দুঃস্থ বিদ্যার্থী কজনের প্রতিপালনের ভার গ্রহণ করেছেন, একজন কবিরাজ বসিয়ে যে দাঁতব্য কবিরাজখানাটি প্রতিষ্ঠা করেছেন, গ্রীষ্মের দিনের জন্যে যে জলসত্রটি খুলেছেন, সেগুলি যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, তার জন্য উচিতমত নিষ্কর জমি দানপত্র করে দিয়ে আসতে হল। যে কজন দুঃস্থ পণ্ডিত বৃত্তি পেয়ে আসছিলেন, তাঁদের বৃত্তি বজায় রাখার জন্যও জমির ব্যবস্থা করতে হল। তাছাড়া বরাবর গ্রামের কন্যাদায়গ্রস্থ দরিদ্র পিতা, অবীরা অসহায় বিধবা, রুগ্ণ অপটু পুরুষের অথবা মাতৃপিতৃহীন শিশুর একরকম আশ্রয়স্থল ছিলেন রামকালী।
দূর দূর জায়গা থেকেও লোক এসে হাত পেতেছে রামকালীর কাছে।
এসব লোক যাতে একেবারে না বঞ্চিত হয়, একেবারে না বিতাড়িত হয়, তার জন্যও রাসুকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে একখানা বড় তালুকের মাধ্যমে।
অবশ্য রাসু যদি নিয়ম বজায় না রাখে, রাসু যদি সে তালুকের উপস্বত্ব আত্মম্মাৎ করে, করবার কিছু নেই। কারণ এটা একটা অনিয়মিত ব্যাপার।
তবু রাসুকেই ভার দিয়ে আসতে হল। রাসু ছাড়া আর কে মানুষ হল? নেড়ুটায় তো উদ্দেশই পাওয়া গেল না প্রায়। ঠিকানা না জানিয়ে দু’একটা চিঠি দিয়েছিল কবে কবে যেন। তাতেই জানা আছে, মরে নি বেঁচে আছে। রাসুর আর ভাইগুলো তো অমনিষ্যি। সেজকাকার দুই ছেলে কুচুটের রাজা। রাসুর বড় ছেলেটা বাবুর শিরোমণি হয়ে উঠেছে। হচ্ছে সারদার দোষেই কতকটা।
সারদা যেন স্বামীর সঙ্গে রেষারেষি করে ছেলেকে বাবু’ করে তুলতে বদ্ধপরিকর। সব কথায় বলে, ও পারবে না।
ওই একটা মেয়ে। অদ্ভুত উল্টোপাল্টা।
রামকালী নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, ওর বিধাতা কি ওকে কতকগুলো উল্টোফাল্টা জিনিস দিয়েই তৈরী করেছিলেন, নাকি জীবনটা ওর উল্টো স্রোতের মুখে পড়ল বলেই?
রামকালী ওর হদিস পান না।
কখনো ওর ভারসহ কর্মনিষ্ঠা, ওর অসাধারণ নৈপুণ্য, ওর অগাধ সহিষ্ণুতা দেখে তাক লেগে যায়, কখনো ওর বিস্ময়কর নির্লিপ্ততা, দৃষ্টিকটু ঔদাসীন্য দেখে স্তব্ধ হতে হয়।
দুর্গোৎসবের সমস্ত ভার সারদা একা মাথায় তুলে নিতে ভয় পায় না, দিয়েও নিশ্চিন্ত হন রামকালী। কিন্তু এবারে হঠাৎ সারদা শান্ত ঘোষণায় জানিয়ে দিল, খুড়োঠাকুর যেন এ ভার আর কারো উপর ন্যস্ত করেন।
কেন?
কেনর কিছু নেই।
বাড়িতে তো আরো লোক আছে।
গ্রামের কজন বয়স্ক ব্রাহ্মণ-কন্যাকে ডেকে রামকালী জানিয়েছিলেন বড় বৌমার শরীর অসুস্থ, অতএব তারা যদি
তা তাঁরা এসেছিলেন, তুলেও দিয়েছিলেন পূজো।
কিন্তু অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।
পুরোহিত পূজোয় বসে হাতের কাছে উপকরণগুলি ঠিকমত না পেয়ে রেগে আগুন।
তবু রামকালী যেন সারদার উপর রাগ করতে পারেন না। পারেন না অগ্রাহ্য করতে। অনুভব করেন সারদার মধ্যে বস্তু ছিল, কিন্তু ভাগ্যের প্রতিকূলতায় সেটা খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে।
ভাগ্যের প্রতিকূলতায়?
এইখানেই কোথায় যেন একটা খোচ। অনেকবার ভেবেছেন রামকালী, ভাগ্য ছাড়া আর কি? মানুষ তো নিমিত্ত মাত্র, কিন্তু সে বিশ্বাসে অটুট থাকতে পারেন নি।
যাক, তবু সকলের যথাসাধ্য সুব্যবস্থা করে এসেছেন রামকালী, এখন যার যা নিয়তি। তথাপি অনেকগুলো মুখ যেন হতাশ দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছে রামকালীর দিকে। যেন বলছে…ফেলে চলে গেলে আমাদের?… সত্যি!… কই যাবে এ কথা তো বল নি কোনদিন? আমরা যে বড় নিশ্চিন্ত ছিলাম।
এই মুখগুলোর মধ্যে সারদার মুখটা বড় স্পষ্ট, সারদার চোখটা বড় তীব্র। হতাশা নয়, যেন সে দৃষ্টিতে অভিযোগ।
কিন্তু অনেক বছর আগে আর একবার যখন সংসার ত্যাগ করেছিলেন রামকালী?
তখন কি একবারও পিছনপানে তাকিয়েছিলেন? নাঃ, কী হালকা বন্ধনহীন মন নিয়ে সেই যাওয়া!
বৈরাগ্যের কারণটা নিতান্তই স্থল ছিল সত্যি, বাপের খড়ম থেকে সে বৈরাগ্যের উদ্ভব। রাগ দুঃখ অভিমান ক্ষোভ সব মিলিয়ে তীব্র একটা অনুভূতি যেন ঠেলে ঘরের বার করে দিয়েছিল সেই কিশোর বালককে, যাকে এখন যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন রামকালী।
ছেলেটা একখানা নৌকোর পাটাতনের মধ্যে ঢুকে বসে রইল সারটা দিন, কেউ তেমন লক্ষ্য করল না, একসময় ছেড়ে দিল নৌকো। ছেলেটা রইল ঘাপটি মেরে।
তারপর অনেকক্ষণের পর ধরা পড়ল।
তখন নৌকো অনেক এগিয়েছে।
রামকালী দেখছেন, মাঝি-মাল্লারা জেরা করছে ছেলেটাকে। ছেলেটা স্বচ্ছন্দে উত্তর দিচ্ছে–তার কেউ কোথাও নেই, গরীব ব্রাহ্মণসন্তান, ভাড়া-টাকা দিতে পারবে না, নৌকো যেখানে যাবে, সেখানে পর্যন্ত যদি তাকে দয়া করে নিয়ে যায় তারা।
অবস্থা বুঝেই মমতাবশতই হোক অথবা দেবকান্তি রূপ দেখেই হোক ছেলেটাকে তারা সমাদর করে নিয়ে গিয়েছিল মুকসুদাবাদ অবধি।
সেখানে মিলে গেল গোবিন্দ গুপ্তের আশ্রয়।
সে যেন ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ আশীর্বাদের মত।
সেই নিতান্তই কিশোর ছেলেটার মনে হয়েছিল পৃথিবীটা এত বড়! ভগবান এত দয়ালু। অথবা ইনিই ভগবান? পুরাণ উপপুরাণের গল্পের মত ছদ্মবেশ ধরে রামকালীকে কৃপা করতে এসেছেন।
গঙ্গার ঘাটেই বসেছিল ছেলেটা।
কবিরাজ স্নানে এসেছিলেন।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, চিনছি না তো তোমাকে? কাদের ছেলে বাবা?
এখন ভেবে হাসি পাচ্ছে, রামকালী স্বচ্ছন্দে বলেছিলেন, তোমার সে খোঁজে দরকার কি?
দরকার কিছু আছে বৈকি! গোবিন্দ গুপ্ত একটু হেসে বলেছিলেন, কাদের ছেলে, কেন একা ঘুরে বেড়াচ্ছ, রীত-চরিত্তিরই বা কেমন এসব না জানলে চলবে কেন?
চলবে না?
না। ভিনগাঁয়ের ছেলেকে বিশ্বাস কি?
পরে জেনেছিলেন রামকালী, ওটা একটা চালাকি। রাগিয়ে দিয়ে পরিচয় আদায়ের চেষ্টা। কিন্তু সেদিন সেই ছেলেটার কথা বোঝবার ক্ষমতা ছিল না। সে তার ক্রুদ্ধ গলায় বলে উঠেছিল, বিশ্বাস করতে কে পায়ে ধরছে তোমায়? আমার ইচ্ছে আমি বসে আছি। ঘাট কি তোমার কেনা?
সেই সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় ছেলেটার কথায় বেশ কৌতুক অনুভব করেছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। এবং ইচ্ছে করেই খানিকক্ষণ ধরে বাদবিতণ্ডা চালিয়েছিলেন মজা উপভোগ করতে।
তারপর কেমন করেই যেন সন্ধি হয়ে গেল। আর কেমন করেই যেন ছেলেটা আশ্রয় পেয়ে গেল তার কাছে।
কিন্তু শুধুই কি আশ্রয়?
নিঃসন্তান দম্পত্তির হৃদয় উজাড় করা ভালবাসার অধিকারী হয় নি সেই মুখর ছেলেটা?
আস্তে আস্তে সেই মুখরতা চপলতা সব অন্তর্হিত হয়ে স্থির শান্ত মেধাবী একটি ছাত্রে পরিণত হল সে। আর শুধু স্নেহেরই নয়, তাঁদের যথাসর্বম্বের উত্তরাধিকারী হয়ে উঠল।
আশ্চর্য! তবু এক দিনের জন্য নিজে হাতে রেঁধে খাওয়ান নি কবিরাজগৃহিণী। অন্য এক ব্রাহ্মণবাড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
সমস্ত দৃশ্যগুলো যেন হঠাৎ চোখের উপর জ্বলজ্বলিয়ে উঠছে।
রামকালী আবদার করেছেন, জেদ করেছেন, আমি তো তোমাদের জাতেরই হয়ে গেছি বলে যুক্তি খাড়া করেছেন, কবিরাজ-গৃহিণী হাসিভরা মুখ আর চোখভরা জল নিয়ে বলেছেন, পাগলা ছেলে, তাই কখনো হয়?
তোমাদের তো পৈতে আছে বলেছিলেন রামকালী।
গোবিন্দ গুপ্ত হেসেছিলেন, আছে, তা সত্যি। তবে কি জানিস? সবেরই তো জাত থাকে? কেউটে গোখরো আর ঢোড়া বোড়া যেমন এক নয়, তেমনি তোর পৈতে আর আমার পৈতে এক নয়। তোকে তো আমার দত্তক নিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু নিই না। কখন কি অপরাধ ঘটে কে জানে!
সেহের সঙ্গে শ্রদ্ধার এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ!
রামকালী প্রথমে বলেছিলেন, আমার কেউ কোথাও নেই।
তারপর ধীরে ধীরে সবই প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল।
গোবিন্দ গুপ্ত বলতেন, দেখ, তোর মা-বাপকে খবর না দেওয়া আমার পক্ষে মহাপাপ হচ্ছে, তুই নিষেধ করিস না, আমি কোন প্রকারে খবর দিই।
রামকালী বলতেন, কেন? আমি বুঝি তোমার চক্ষুশূল হচ্ছি এবার? বেশ, পুণ্যির ভরা করে খবর দাও তুমি, দেখবে আবার পাখী ফুড়ুৎ!
কবিরাজ-গৃহিণী ষাট ষাট করে শিউরে উঠতেন। বলতেন, তুমিই বা পাপ-পাপ করে ব্যস্ত হচ্ছে কেন বাপু? ওর মা-বাপ, বুঝবে। ছেলের প্রাণ যদি মা বলে না কাঁদে, বুঝতে হবে মায়ের প্রাণে কোথাও ঘাটতি আছে।
মায়ের প্রাণে কি ঘাটতি থাকে বড়বৌ?
কবিরাজ বলতেন সহাস্যে।
রামকালী চড়ে উঠতেন। বলতেন, আচ্ছে। খুব আছে। আমাকে মা দু-চক্ষে দেখতে পারে না। নইলে পিসি যখন শাসন করে, তখন ইচ্ছে করে আমার নামে আরো লাগায়?
সে বোধহয় ননদের ভয়ে।
ইঃ, ভারী আমায় ভয়! মায়ার চেয়ে ভয় বড় হল?
পরে অনেক সময় ভেবেছেন রামকালী, সত্যি মার জন্যে তো একটুও মন কেমন করত না। তাঁর। বরং কবিরাজ-গৃহিণী যখন অসুখে পড়তেন আর শেষে যখন মারা পড়লেন, লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদে কেঁদে শিরঃপীড়া জন্মে গিয়েছিল।
কেন এমন হয়েছিল?
রামকালী নিষ্ঠুর?
তার মা-বাপই স্নেহহীন?
বাপের সম্পর্কে এক কথায় রায় দিয়ে দিলেও মায়ের সম্পর্কে সে রায় দিতে একটু বাধতে। হয়তো বিবেকেই বাধতো।
কিন্তু জীবনের এই শেষপ্রান্তে এসে যখন জীবনটাকে ওই ফেলে আসা গঙ্গার স্রোতের মতই সম্পূর্ণ আর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, তখন রামকালী নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, ভালবাসা জীবনে সেই একবারই লাভ করেছিলেন।
সেই এক প্রৌঢ়া দম্পত্তির কাছে।
সারা জীবনের অনেক পেয়েছেন রামকালী, শ্রদ্ধা সমীহ ভয় ভক্তি, ভালবাসা পান নি। সবাই তাকে দূরে রেখেছে, দূরে থেকে প্রণাম জানিয়েছেন।
রামকালীর নিজেরই দোষ।
দূরত্বের গণ্ডি নিজেই রচনা করেছেন তিনি। ইচ্ছে করে নয়, স্বভাবে।
কোনদিন কি ভাবতে পেরেছেন তিনি, গ্রামের কোনো কাজকর্মে তিনি ব্রাহ্মণভোজনের সারিতে পাত পেতে বসেছেন? ভাবতে পেরেছেন তিনি কোথাও দান নিচ্ছেন? ….কারো চণ্ডীমণ্ডপে বসে গালগল্প করছেন? তাস-পাশা খেলছেন?
ভাবলে হাসি পাবে কি, ভাবতেই পারেন নি।
অথচ গ্রামের অনেক কুলীন সন্তানই এমনি সাধারণের ভূমিকায় জীবন কাটাচ্ছেন।
কৌলীন্যটার সত্যকার বাস তবে কোথায়?
কিন্তু আজ সংসারকে পরিত্যাগ করে যাবার সময় হঠাৎ মনে হচ্ছে রামকালীর, সারা জীবন বিজয়ীর ভূমিকা নিয়ে কাটালাম, কিন্তু সত্যি কি বিজয়ী হতে পেরেছি?
তা হলে কেন মনে হচ্ছে, ভয়ানক একটা লোকসানকে টেনে এনেছেন তিনি সারাজীবন ধরে?
লোকসানটা কী? পরাভবটা কোথায়?
লোকসানের কথা ভাবতে অপ্রাসঙ্গিক একটা কথা মনে এল রামকালীর। কিংবা অপ্রাসঙ্গিক নয়।
সত্য বড় আক্ষেপ করে বলেছিল, এই খেদ রয়ে গেল বাবা, তোমায় একদিন বেঁধে খাওয়াতে পারলুম না!
আচ্ছা কতটুকু ক্ষতি হত রামকালীর, যদি সত্যর এই খেদটুকু না রাখতেন? নিয়মের সেই সামান্যতম হানির লোকসানটাই কী মস্ত একটা লোকসান হত?
রামকালী তাঁর জীবনে যে বস্তুকে পরম মূল্য দিয়ে এসেছেন, সত্যিই কি সেটাই মূল্যের শেষ কথা?
যদি তাই হয়, তবে কেন বার বার ভুবনেশ্বরী অদ্ভুত এক বিজয়িনীর হাসি হেসে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়?
কেন বলে, জীবনে তো অনেক পেলে, পাওয়ার গৌরবে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখ নি, কিন্তু আসল ঘরটাই যে ফাঁকা পড়ে রইল তোমার, সে হিসেব কছে কোন দিন? কর্তব্যই করলে চিরকাল, ভালবাসতে পারলে কাউকে?
মনের মধ্যে ডুব দিয়েছেন রামকালী।
ভালবাসা? কার জন্যে সঞ্চিত থেকেছে?
সত্যর মুখ ছাড়া আর কোনও মুখ-চোখ ভেসে উঠছে না।
আর সব যেন জীবে’র প্রতি করুণা।
সত্য আছে হৃদয়ের নিভৃতে অনেকখানি জায়গা দখল করে। কিন্তু সেটুকু কি সত্যকে কোনদিন জানতে দিয়েছেন রামকালী? জানানো দুর্বলতা ভেবে অনবরত বালি চাপা দিয়ে আসেন নি কি?
হঠাৎ দুর্গা দুর্গা করে উঠলেন রামকালী। ছেড়ে দেওয়া মনকে যেন বেঁধে ফেললেন। বললেন, ওহে, মুঙ্গের পৌঁছবে কখন নাগাদ?
মাঝি বলল, আজ্ঞে কর্তা, এই তো এসে পড়লাম বলে—
আচ্ছা ভাল। কষ্টহারিণীর ঘাটে নৌকো বাধবে।