৩৩. উপনিবেশ-বিস্তারের নোতুন তত্ত্ব

ত্রয়স্ত্রিংশ অধ্যায়– উপনিবেশ-বিস্তারের নোতুন তত্ত্ব [১]

রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব নীতির দিক থেকে দুটি অত্যন্ত ভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে গুলিয়ে ফেলে, যে-দুটির মধ্যে একটির ভিত্তি হল উৎপাদনকারীদের নিজেদের প্রম, অন্যটির ভিত্তি হল অপরের শ্রমের নিয়োগ। তা ভুলে যায় যে, দ্বিতীয়টি কেবল প্রথমটির প্রত্যক্ষ বিপরীতই নয়, তা একান্ত ভাবে উন্মেষিত হয় প্রথমটির সমাধির উপরে। রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের জন্মভূমি পশ্চিম ইউরোপে আদিম সঞ্চয়নের প্রক্রিয়া মোটা মুটি সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। এখানে ধনতান্ত্রিক রাজত্ব হয় জাতীয় উৎপাদনের সমগ্র রাজ্যকে জয় করে নিয়েছে, নয়তে, যেখানে অর্থনৈতিক সম্পর্কসমূহ অপেক্ষাকৃত কম পরিণত, সেখানে তা অন্তত সমাজের সেই স্তরগুলিকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, যেগুলি যদিও সেকেলে উৎপাদন-পদ্ধতির অন্তর্গত, তা হলেও পাশাপাশি ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় টিকে আছে। প্রস্তুত অবস্থায় উপস্থিত মূলধনের এই জগতের উপরে রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিক প্রয়োগ করেন প্রাকৃ-ধনতান্ত্রিক জগৎ থেকে উত্তরাধিকার-সূত্রে প্রাপ্ত আইন সম্পর্কিত ও সম্পত্তি-সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণাগুলি; যতই ঘটনাবলী তার ভাবাদর্শের মুখের পরে সোচ্চারে বিরোধিতা করে, ততই তিনি আরো ব্যগ্র আগ্রহে, আরো বাকৃচাতুর্য সহকারে সেই ধ্যান-ধারণাগুলি প্রয়োগ করেন। উপনিবেশগুলিতে পরিস্থিতি অন্য রকম। সেখানে ধনতান্ত্রিক রাজত্ব সর্বত্রই উৎপাদনকারীর সঙ্গে সংঘর্ষে আসে, যে, তার নিজের শ্রমের অবস্থাবলীর মালিক হিসাবে, সেই শ্রম নিয়োগ করে নিজেকে ধনী করবার জন্য, ধনিককে ধনী করবার জন্য নয়। এই দুটি সম্পূর্ণ পরস্পর-বিরুদ্ধে ব্যবস্থার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এখানে কার্যতঃ আত্মপ্রকাশ করে তাদের দুয়ের মধ্যে এক সংগ্রামে। যেখানে ধনিকের পিছনে থাকে তার স্বদেশের পরাক্রম, সেখানে সে চেষ্টা করে, বলপ্রয়োগের সাহায্যে, উৎপাদনকারীর স্বতন্ত্র শ্রমের উপরে প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন ও আত্মীকরণের পদ্ধতিগুলিকে তার পথ থেকে সরিয়ে দিতে। সেই একই স্বার্থ যা মূলধনের তাবেদারকে-রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিককে স্বদেশে বাধ্য করে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতিকে তার বিপরীত পদ্ধতির সঙ্গে তগত ভাবে অভিন্ন বলে ঘোষণা করতে, সেই একই স্বার্থ তাকে উপনিবেশগুলিতে বাধ্য করে তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে এবং সরবে ঘোষণ করতে যে, দুটি উৎপাদন-পদ্ধতি পরস্পরের বিরুদ্ধবাদী। এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রমাণ করেন কিভাবে শ্রমের সামাজিক উৎপাদন, ক্ষমতা, সহযোগ, শ্রম-বিভাগ, ব্যাপক আয়তনে মেশিনারির ব্যবহার ইত্যাদির বিকাশ শ্রমিকদের সম্পত্তি থেকে উৎপাদন এবং সেই সঙ্গে তাদের উৎপাদন-উপায়সমূহের মূলধনে রূপান্তরণ ব্যতিরেকে অসম্ভব। তথাকথিত জাতীয় সম্পদের স্বার্থে, তিনি জনগণের দারিদ্র্যকে সুনিশ্চিত করার জন্য কৃত্রিম উপায় খুঁজে বেড়ান। এক্ষেত্রে তাঁর আত্মরক্ষামূলক বর্মখানি পচা-গলা কাঠের মত টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে। ই জি ওয়েকফিডের বিরাট কৃতিত্ব হল উপনিবেশের ব্যাপারে[২] নোতুন কিছু আবিষ্কার করা নয়, কিন্তু মূল-দেশের ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ব্যবস্থার ব্যাপারে উপনিবেশগুলিতে সত্য আবিষ্কার করা। যেহেতু সংরক্ষণ-ব্যবস্থা তার সূচনায়[৩] চেষ্টা করেছিল মূলদেশে কৃত্রিম উপায়ে ধনিক ম্যানুফ্যাকচার’ করতে, সেই হেতু ওয়েকফিডের উপনিবেশবিস্তারের ভক্ত। যা ইংল্যাণ্ড কিছু কালের জন্য পার্লামেন্টের আইনের সাহায্যে চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছিল, সেই তত্ত্বটি চেষ্টা করেছিল উপনিবেশগুলিতে মজুরি-শ্রমিক ‘ম্যানুফ্যাকচার করতে। একে তিনি বলেন, “প্রণালীবদ্ধ উপনিবেশ-বিস্তার।”

প্রথমত, ওয়েকফিল্ড আবিষ্কার করেন যে, উপনিবেশগুলিতে টাকা-পয়সা, জীবন ধারণের উপায়, মেশিন-পত্র এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপায়ের আকারে সম্পত্তির মালিকানা এখন পর্যন্ত কোন লোককে ‘ধনিক হিসাবে চিহ্নিত করে দেয় না, যদি সেখানে বাকি সহ সম্বন্ধীটি-মজুরি-শ্রমিকটি, যে তার নিজেকে নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় বিক্রি করতে বাধ্য সেই মানুষটি-না থাকে। তিনি আবিষ্কার করেন, মূলধন একটা জিনিস নয়, এটা একাধিক ব্যক্তির মধ্যেকার একটা সামাজিক সম্পর্ক, যা প্রতিষ্ঠিত হয় জিনিসের মাধ্যমে।[৪] তিনি দুঃখ করে বলেন, মিঃ পীল তার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, ইংল্যাণ্ড থেকে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায়, সোয়ান রিভারে ৫০,০০০ পাউণ্ড মূল্যের জীবন ধারণ ও উৎপাদনের উপায়-উপকরণ। তা ছাড়া, মিঃ পীলের দূরদৃষ্টি ছিল তার সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর পুরুষ, নারী, ও শিশু মিলিয়ে মোট ৩,০০০ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে যাবার একবার তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাবার পরে, “মিঃ পীলের বিছানা করার মত বা নদী থেকে জল আনবার মত কেউ রইল না।”[৫] অসুখী মিঃ পীল, যিনি সব কিছু ব্যবস্থা করেছিলেন একমাত্র ইংরেজ উৎপাদন-পদ্ধতিতে সোয়ান লেকে রপ্তানি করা ছাড়া!

ওয়েকফিলডের নিম্নোক্ত আবিষ্কারগুলি অনুধাবনের জন্য দুটি প্রাথমিক মন্তব্য: আমরা জানি যে, উৎপাদন ও জীবনধারণের উপায়সমূহ যখন থাকে প্রত্যক্ষ উৎপাদন কারীর সম্পত্তি, তখন তারা মূলধন নয়। তারা মূলধনে পরিণত হয় কেবল সেই অবস্থায়, যখন তারা একই সময়ে শ্রমিকের শোষণ ও বশ্যতাসাধনের উপায় হিসাবে কাজ করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিকের মাথার মধ্যে তাদের এই ধনতান্ত্রিক আত্মা তাদের বস্তুগত উপাদানের সঙ্গে এমন অন্তরঙ্গ ভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছে যে, তিনি সমস্ত অবস্থাতেই তাদের মূলধন বলে অভিহিত করেন—এমনকি যখন তারা তার ঠিক বিপরীত, তখনো। এই হল ওয়েকফিডের ধারণা। অধিকন্তু, নিজের নিজের উদ্যোগে কর্মরত বহুসংখ্যক স্বাধীন শ্রমিকের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে উৎপাদন-উপায় সমূহের বিভক্তিকরণকে তিনি অভিহিত করেন মূলধনের সমবিভাজন হিসাবে। এটা যেমন রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিকের ক্ষেত্রে, তেমন সামন্ততান্ত্রিক আইন-বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্রে। এই আইন-বিশেষজ্ঞেরা সামন্ততান্ত্রিক আইনের কাছ থেকে প্রাপ্ত লেবেলগুলিকেই এটে দিলেন বিশুদ্ধ মুদ্রাকার সম্পর্কের উপরে।

ওয়েকফি বলেন, “যদি ধরে নেওয়া হয় সমাজের সমস্ত সদস্যরা মূলধনের সমান সমান অংশের অধিকারী:…তা হলে কোনো মানুষেরই প্রবৃত্তি হবে না, সে নিজের হাতে যতটা মূলধন ব্যবহার করতে পারে, তার চেয়ে বেশি মূলধন সঞ্চয়ন করার। নোতুন মার্কিন উপনিবেশগুলিতে অবস্থা অনেকটা এইরকম, যেখানে জমির মালিক হবার উন্মাদনা এত প্রবল যে তা শ্রমিকদের এমন একটি শ্রেণী গড়ে উঠতে দেয় না, যারা ভাড়া খাটবে।”[৬] সুতরাং, যত কাল শ্রমিক নিজের জন্য সঞ্চয়ন করতে পারে–এবং তা সে পারে যত কাল সে থাকে তার উৎপাদন-উপায়ের মালিক, ততকাল ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়ন ও ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি অসম্ভব। এই সবের জন্য যে মজুরি শ্রমিক-শ্রেণী অত্যাবশ্যক, তা অনুপস্থিত। তা হলে, কেমন করে পুরনো ইউরোপে তার শ্রমের অবস্থাবলী থেকে শ্রমিকের উৎসাদন অর্থাৎ মূলধন এবং মজুরি-শ্রমের সহাবস্থান সংঘটিত হয়েছিল? বেশ মৌলিক ধরনের একটা সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে। “মানবজাতি গ্রহণ করেছে: মূলধনের সঞ্চনকে অনুপ্রেরিত করার জন্য একটি সরল কৌশল—মূলধন সঞ্চয়ন, যা অ্যাডাম স্মিথের কাল থেকে ভেসে বেড়িয়েছে তাদের কল্পনায় তাদের অস্তিত্বের একমাত্র ও ও চুড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে তারা নিজেদেরকে ভাগ করে নিয়েছে মূলধনের মালিক এবং শ্রমের মালিকে। এই বিভাগ ছিল সামঞ্জস্য ও সম্মিলনের ফল।”[৭] এক কথায় : “মূলধন সঞ্চয়ন”-এর সম্মানে মানব-সমাজের সুবিপুল জনসমষ্টি নিজেদেরকে সম্পত্তির অধিকার থেকে উৎসাদিত করল। এখন, একজন মনে করবে যে, আত্মবঞ্চনার এই উন্মাদনা নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে জ্যামুক্ত করে দেবে বিশেষ ভাবে উপনিবেশগুলিতে, একমাত্র যেখানে থাকে এমন মানুষজন এবং আয়োজন, যা সামাজিক চুক্তিকে পরিণত করতে পারে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে। কিন্তু তা হলে কেন “প্রণালীবদ্ধ উপনিবেশবিস্তার”-কে ডেকে আনা হবে তার বিপরীত, স্বতঃস্ফুর্ত, অনিয়মিত উপনিবেশ বিস্তারকে প্রতিস্থাপিত করার জন্য? কিন্তু কিন্তু-“আমেরিকান ইউনিয়নের উত্তর দিককার অঙ্গ রাষ্ট্রগুলিতে জনসংখ্যা এমনকি এক-দশমাংশের মতও ভাড়াটে শ্রমিকের পংত্তির মধ্যে পড়ে কিনা সন্দেহ। ইংল্যাণ্ডে …শ্রমজীবী শ্ৰেণীই গঠন করে জনসংখ্যার বিপুল সমষ্টি।[৮] এমনকি, শ্রমজীবী মানবসমাজের পক্ষে মূলধনের মহিমার জন্য আত্ম-উচ্ছেদনের এই প্রবৃত্তি এত সামাই থাকে যে, স্বয়ং ওয়েকফিতের মতেও, ক্রীতদাসত্বই ঔপনিবেশিক ঐশ্বর্যের স্বাভাবিক ভিত্তি। তাঁর প্রণালীবদ্ধ উপনিবেশবিস্তার হল কেবল একটা pis aller ( ‘অগতির গতি ), যেহেতু দুর্ভাগ্যক্রমে তাকে কাজ চালাতে হয়, ক্রীতদাসদের দিয়ে নয়, স্বাধীন মানুষদের নিয়ে। “সেন্ট ভোমিনিগোতে প্রথম স্পেনীয় উপনিবেশ স্থাপনকারীরা স্পেন থেকে শ্রমিক পায়নি। কিন্তু শ্রমিক ছাড়া, তাদের মূলধন নিশ্চয়ই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কিংবা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে সেই ক্ষুদ্র পরিমাণটিতে পর্যবসিত হয়েছিল, যতটা প্রত্যেকটি ব্যক্তি তার নিজের হাতে কাজে লাগাতে পারে। এটা সত্য সত্যই ঘটেছিল ইংরেজদের দ্বারা স্থাপিত সর্বশেষ উপনিবেশটিতে-সোয়ান লেক-এ, যেখানে এক বিপুল পরিমাণ মূলধনবীজ, উপকরণ ও গবাদি পশু-ধ্বংস হয়ে গিয়েছে সেগুলি ব্যবহার করার মত শ্রমিক ছিলনা এবং যেখানে কোনো বসতি স্থাপন কারী নিজের হাতে—যতটা মূলধনকে কাজে লাগাতে পারে তার চেয়ে বেশি মূলধন রক্ষা করেনি।”[৯]

আমরা দেখেছি, জমি থেকে জনসমষ্টির উৎসাদনই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির ভিত্তি রচনা করে। অন্য দিকে, একটি স্বাধীন উপনিবেশের মর্মবস্তু হচ্ছে এই যে, জমির বেশির ভাগটাই এখনো সাধারণের সম্পত্তি, এবং সেই হেতু, তার উপরে বসতি স্থাপনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই সেই সাধারণ জমির একটা অংশকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও নিজস্ব উৎপাদন-উপায়ে রূপান্তরিত করে নিতে পারে; তাতে পরবর্তী বসতি স্থাপনকারীদের পক্ষে অনুরূপ কাজ করার পথে কোনো বাধা সৃষ্টি হয় না।[১০] এটাই হল দুটি ব্যাপারেরই গুপ্ত কথা-উপনিবেশগুলির সমৃদ্ধির এবং তাদের বদ্ধমূল বদভ্যাসের অর্থাৎ মূলধন-প্রতিষ্ঠার প্রতি বিরোধিতার। যেখানে জমি খুব সুলভ এবং সমস্ত মানুষ স্বাধীন, যেখানে যে চায় সে-ই অনায়াসে পেতে পারে এক খণ্ড জমি, সেখানে শ্রম যে কেবল মহার্ঘ, তাই নয়, উৎপন্ন ফসলে শ্রমিকের অংশ প্রসঙ্গে, যে কোনো দামে সম্মিলিত শ্রম সংগ্রহ করাও দুঃসাধ্য।”[১১]

যেহেতু উপনিবেশগুলিতে, শ্রমের অবস্থাবলী থেকে এবং তাদের মূল যে জমি তা থেকে শ্রমিকের বিচ্ছেদ এখনো ঘটেনি, কিংবা, ঘটলেও ঘটেছে কেবল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ভাবে কিংবা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ আয়তনে, সেই হেতু শিল্প থেকে কৃষির বিচ্ছেদও যেমন ঘটেনি, তেমন চাষী সমাজের ঘরোয়া শিল্পেরও বিনাশ ঘটেনি। তা হলে, মূলধনের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার কোথা আসবে? আমেরিকার জনসংখ্যার কোনো অংশই একান্তভাবে কৃষিগত নয়, কেবল ক্রীতদাস এবং তাদের নিয়োগকর্তারা ছাড়া, যারা বিশেষ বিশেষ কাজে মূলধন এবং শ্রম সম্মিলিত করে, স্বাধীন আমেরিকানরা, যারা জমি চাষ করে, তারা আরো পাঁচটা পেশা অনুসরণ করে। যেসব আসবাব ও হাতিয়ারপত্র তারা ব্যবহার করে, তার কিছু অংশ তারা নিজেরাই সাধারণতঃ তৈরি করে। তারা প্রায়শই তাদের নিজেদের বাড়ি-ঘর বানিয়ে নেয় এবং তাদের নিজেদের শিল্পোৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রী নিজেরাই বাজারে বয়ে নিয়ে যায়-তা সে যত দূরেই হোক না কেন। তারা সুতো কাটে, কাপড় বোনে, তারা সাবান ও মোম তৈরি করে, অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যবহারের জুতো-জামাও তৈরি করে। আমেরিকায় জমি চাষ প্রায়ই কর্মকার, ঘানি-ওয়ালা বা দোকানদারের অতিরিক্ত পেশা। [১২] যেখানে এই ধরনের অদ্ভুত লোকজনের বসতি, সেখানে ধনিকদের জন্য “ভোগ-সংবরণের ক্ষেত্ৰ” কোথায়?

ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের মহৎ সৌন্দর্য এইখানে যে, তা কেবল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে মজুরি-শ্রমিককে মজুরি শ্রমিক হিসাবে পুনরুৎপাদন করে না, সেই সঙ্গে সব সময়েই উৎপাদন করে, মূলধনের সঞ্চয়নের অনুপাতে, মজুরি-শ্রমিকদের একটি আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যা। এইভাবে শ্রমের যোগান ও চাহিদাকে ধরে রাখা হয় সঠিক চাপে, মজুরির ওঠা-নামাকে বেঁধে রাখা হয় ধনতান্ত্রিক শোষণের পক্ষে সন্তোষজনক মানার মধ্যে, এবং, সর্বশেষে, ধনিকের উপরে শ্রমিকের সামাজিক নির্ভরতাকে, সেই অপরিহার্য প্রয়োজনকে সুসম্পন্ন করা হয়; নির্ভরতার এক অভ্রান্ত সম্পর্ক, থাকে আত্মতুষ্ঠ রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিক মূল-দেশে তথা স্বদেশে যাদুবলে রূপান্তরিত করতে পারে ক্রেতা, ও বিক্রেতার মধ্যে, সমান ভাবে স্বাধীন দুজন পণ্য-মালিকের মধ্যে-মূলধনরূপ পণ্যের মালিক এবং শ্রমরূপ পণ্যের মালিকের মধ্যে একটি স্বাধীন চুক্তিগত সম্পর্কে। কিন্তু উপনিবেশগুলিতে এই মনোরম কল্পনা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মূল-দেশটির তুলনায় এখানে অনাপেক্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় অনেক বেশি তাড়াতাড়ি, কেননা অনেক এমিক জগতে প্রবেশ করেই আজন্ম-যুবক হিসাবে, এবং তবু শ্রমের বাজারে সব সময়েই ঘাটতি। শ্রমের যোগান ও চাহিদার নিয়ম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এক দিকে, শোষণ ও “ভোগ সংবরণের তৃষ্ণায় অধীর” পুরনো জগৎ অবিরাম মুলধন ছুড়ে দিচ্ছে; অন্য দিকে, মজুরিশ্রমিক হিসাবে মজুরি-শ্রমিকের নিয়মিত পুনরুৎপাদন সংঘাতে আসছে সবচেয়ে বেয়াড়া এবং অংশতঃ দুর্ভেদ্য সব প্রতিবন্ধকের সঙ্গে। মূলধনের সঞ্চয়নের অনুপাতে সংখ্যাতিরিক্ত মজুরি-শ্রমিকদের উৎপাদনের কি হয়? আজকের মরিশ্রমিক কালকের স্বাধীন চাষী বা কারিগর, যে কাজ করে নিজের জন্য। শ্রমের বাজার থেকে সে উধাও হয়ে যায়। মজুরি-শ্রমিকদের স্বাধীন উৎপাদনকারীতে এই নিরন্তর রূপান্তর, যারা মূলধনের জন্য কাজ করে না, করে নিজেদের জন্য, এবং ধনিক ভদ্রলোকদের সমৃদ্ধ করেনা, করে নিজেদের, এই রূপান্তরণ আবার শ্রমবাজারের পরিস্থিতির উপরে খুব বিকৃত ভাবে প্রতিক্রিয়া করে। মজুরি শ্রমিকদের শোষণের মাত্রা যে কেবল লজ্জাজনক ভাবে নিচু থাকে, তাই নয়। তার উপরে, মজুরিশ্রমিক হারায়, নির্ভরতার সম্পর্ক সমেত, ভোগসংবৃত ধনিকের উপরে তার নির্ভরতার মানসিকতাও। এই কারণেই দেখা দেয় সেইসব অসুবিধা যেগুলিকে আমাদের ই জি ওয়েকফিল্ড চিত্রিত করেছেন এত বলিষ্ঠ ভাবে, এত সোচ্চার ভাবে, এত করুণ ভাবে।

তার নালিশ: মজুরি শ্রমের সরবরাহ স্থিরও নয়, নিয়মিতও নয়, পর্যাপ্তও নয়। “শ্রমের সরবরাহ কেবল অল্পই নয়, অনিশ্চিত।[১৩] যদিও ধনিক এবং শ্রমিকের মধ্যে বিভক্ত উৎপন্ন ফল বেশিও হয়, তা হলেও শ্রমিক এত বড় একটা অংশ নিয়ে নেয় যে, সে অচিরেই একজন ধনিক হয়ে ওঠে। এমনকি যাদের আয়ু খুব দীর্ঘ, তাদের খুব সামান্য কয়েকজনই বিপুল পরিমাণ বিত্ত সঞ্চয় করতে পারে।[১৪] তাদের শ্রমের বৃহত্তর অংশের দাম তাদের দিয়ে দেওয়া থেকে সে নিজের সংবরণ করুক, ধনিককে এই অনুমতি দিতে শ্রমিকেরা অতি স্পষ্ট কণ্ঠে অস্বীকার করে। যদি সে বুদ্ধি করে, তার নিজের মূলধন দিয়ে ইউরোপ থেকে তার নিজের মজুরি-শ্রমিক আমদানি করে, তা হলেও তার কোনো লাভ হয় না। অচিরেই তারা আর ভাড়া-খাটা মজুর থাকে না; যদি শ্রমের বাজারে তাদের প্রাক্তন মনিবদের প্রতিদ্বন্দ্বী না-ও হয়, তারা হয়ে ওঠে স্বাধীন জমিদার[১৫] কী ভয়ংকর ব্যাপার, একবার ভাবুন ত! মহাশয় বনিক ব্যক্তিটি, তার নিজের পকেটের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে, ইউরোপ থেকে শারীরিক ভাবে তুলে এনেছে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের ! দুনিয়ার ইন্তেকালের আর বাকি কি! উপনিবেশ গুলির মজুরি-শ্রমিকদের মধ্য থেকে সমস্ত নির্ভরতা উধাও হয়ে গিয়েছে, এমনকি নির্ভরতার মনোভার পর্যন্ত উধাও হয়ে গিয়েছে-এতে ওয়েকফিল্ড যদি কান্নাকাটি করেন, তা হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। তাঁর শিষ মেরিভেল বলেন, উপনিবেশগুলিতে রয়েছে, “আরো সন্তা, আরো বাধ্য মজুরদের জন্য জরুরী দাবি—এমন একটি শ্রেণীর জন্য জরুরী দাবি যাদের হুকুম মানতে ধনিক বাধ্য হবে না, যারা নিজেরাই বাধ্য হবে ধনিকের হুকুম মানতে। প্রাচীন কালের সভ্য দেশগুলিতে শ্রমিক, যদিও স্বাধীন তবু প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা ধনিকদের উপরে নির্ভরশীল ছিল; উপনিবেশগুলিতে এই নির্ভরতা সৃষ্টি করতে হবে কৃত্রিম উপায়ে।[১৬]

তা হলে ওয়েকফিলডের মত অনুসারে, উপনিবেশগুলিতে এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির ফলাফল কি? উৎপাদনকারীদের এবং জাতীয় সম্পদদের ছড়িয়ে দেবার এক বর্বরতা বিস্তারী প্রবণতা।[১৭] নিজ নিজ উদ্যোগে কর্মরত, এমন অগণিত মালিকের মধ্যে উৎপাদনের উপায়সমূহ ভাগাভাগি কেবল মূলধনের কেন্দ্রীভবনকেই ধ্বংস করে দেয়না, সম্মিলিত প্রমের সমস্ত ভিত্তিকেও ধ্বংস করে দেয়। প্রত্যেকটি দীর্ঘকালসাপেক্ষ উদ্যোগ যার জন্য লাগে কয়েক বছর এবং চাই স্থির মূলধনের বিনিয়োগ, এমন সমস্ত উদ্যোগই বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইউরোপে মূলধনের বিনিয়োগে ক্ষণিকের দ্বিধাও দেখা দেয় না, কেননা সেখানে শ্রমিক শ্রেণী তার উপাঙ্গ—সব সময়েই বাড়তি এবং সব সময়েই হাতের কাছে মজুদ। কিন্তু উপনিবেশগুলিতে? ওয়েকফিঙ এক অতি বেদনাময় কাহিনীর বলেন। তিনি কথা বলছিলেন ক্যানাভা এবং নিউ ইয়র্ক অঙ্গ-রাষ্ট্রের কয়েকজন খনিকের সঙ্গে, যেখানে অভিবাসনের ঢেউ মাঝে মাঝে রুদ্ধ হয়ে যায় এবং জমা হয় সংখ্যাতিৰিক্ত শ্রমিকের কিছু তলানি। এই নাটকটির একটি চরিত্র বলেন, “আমাদের মূলধন তৈরি ছিল এমন অনেক কর্মকাণ্ডের জন্য, যেগুলি সম্পূর্ণ করতে লাগে বেশ কিছু সময়, কিন্তু এই সমস্ত কর্মকাণ্ড আমরা এমন শ্রমিকদের দিয়ে আরম্ভ করতে পারি না, যারা, আমরা জানি, শীঘ্রই ছেড়ে চলে যাবে। আমরা যদি এমন অভিবাসীদের গুম করে রাখা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারতাম তা হলে আমরা খুশি মনে তাদের নিযুক্ত করতাম এবং উচু মজুরি দিতাম; এমনকি যদি আমরা এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারতাম যে তারা ছেড়ে চলে যাবে কিন্তু সেই সঙ্গে, সর্বত্র আমাদের প্রয়োজনমত, শ্রমের নোতুন সরবরাহ পাঞ্জা যাবে, তা হলেও তাদের আমরা নিযুক্ত করতাম।[১৮]

আমেরিকান চাষীদের বিক্ষিপ্ত কৃষির সঙ্গে ইংরেজ ধনতান্ত্রিক কৃষি ও তার “সন্মিলিত” শ্রমের প্রতি তুলনা করার পরে, ওয়েকফিল, অসতর্ক মুহূর্তে মেডেলের উলটো পিঠটি আমাদের এক পলকে দেখে নেবার সুযোগ দিয়েছেন। তিনি আমেরিকার জনসাধারণের বিপুল সমষ্টিকে চিত্রিত করেছেন সচ্ছল, স্বাধীন, কর্মঠ এবং অপেক্ষাকৃত কৃষ্টিসম্পন্ন বলে, যেখানে ইংরেজ কৃষিশ্রমিক হল একটা শোচনীয় বেচারা, একটা ভিক্ষাজীবী। উত্তর আমেরিকা এবং কয়েকটি নতুন উপনিবেশে ছাড়া আর কোথায় কৃষিকর্মে নিযুক্ত স্বাধীন শ্রমের মজুরি শ্রমিকের নিছক জীবনধারণের মাত্রা বেশি ছাড়িয়ে যায়? নিঃসন্দেহে, ইংল্যাণ্ডে খামার-ঘোড়াগুলি যেহেতু মূল্যবান সম্পত্তি, সেহেতু ইংরেজ চাষীদের তুলনায় ভাল খোরাক পায়।[১৯] কিন্তু তাতে কি এসে যায়, জাতীয় সম্পদ স্বভাবতই জনগণের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে অভিন্ন, সেটাই আরেকবার প্রমাণ হয়।

তা হলে উপনিবেশগুলির ধনতন্ত্র-বিরোধী ক্যান্সারকে কি করে নিরাময় করা যায়? মানুষ যদি এক ধাক্কায় সমস্ত সাধারণ জমিকে ব্যক্তিগত জমিতে পরিণত করতে সম্মত হত, তা হলে তারা নিশ্চয়ই এই পাপের মূলকে ধ্বংস করে দিত, কিন্তু সেই সঙ্গে উপনিবেশগুলিকেও। কৌশলটা হল কিভাবে একই সঙ্গে দুটি পাখিকে খতম করা যায়। যোগান ও চাহিদার নিয়মের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে, সরকার এই কুমারী মাটির একটা কৃত্রিম দাম ধার্য করে দিক, এমন একটা দাম যা অভিবাসীকে বাধ্য করে মজুরির বিনিময়ে দীর্ঘকাল ধরে কাজ করতে যার আগে সে জমি কেনার মত এবং নিজেকে একজন স্বাধীন চাষীতে পরিণত করার মত যথেষ্ট টাকা উপার্জন করতে সক্ষম হবে না। [২০] মজুরি-শ্রমিকদের কাছে অপেক্ষাকৃত নিষেধমূলক দামে জমি বিক্রয় থেকে যে-তহবিল তৈরি হবে, যোগান ও চাহিদার পবিত্র নিয়মটি লংঘন করে শ্রমের মজুরি থেকে আদায়ের সাহায্যে যে তহবিল তৈরি হবে, সেই তহবিলটি সরকার ব্যয় করবে ইউরোপ থেকে উপনিবেশগুলিতে সর্বস্বহারাদের আমদানি করতে। এই অবস্থায় tout sera pour be miux dans be meilleur des mondes possibles। এটাই হল প্রণালীবদ্ধ উপনিবেশ-বিস্তার”-এর মহান গুপ্ত-রহস্য। বিজয়োল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠেন ওয়েকফিঙ, এই পরিকল্পনার মাধ্যমে “শ্রমের সরবরাহ অবশ্যই হবে নিরন্তর ও নিয়মিত কারণ, প্রথমত, যেহেতু মজুরির জন্য কাজ না করলে কোনো শ্রমিকই জমি সংগ্রহ করতে পারবে না, সেইহেতু সমস্ত অভিবাসী শ্রমিক কিছুকাল মজুরির বিনিময়ে এবং সম্মিলিত ভাবে কাজ করে আরো শ্রমিক নিয়োগের জন্য মূলধন উৎপাদন করবে; দ্বিতীয়ত, যারা মজুরির বিনিময়ে কাজ করা ছেড়ে দিয়ে জমির মালিক হবে তারা প্রত্যেকেই জমি কিনতে গিয়ে উপনিবেশে নোতুন শ্রম আমদানির জন্য একটা তহবিলের সংস্থান করবে।”[২১] রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত জমির দাম অবশ্যই হতে হবে একটা পর্যাপ্ত দাম”, অর্থাৎ হতে হবে এত উচু যাতে করে যত কাল না অন্যরা তাদের স্থান পূরণের জন্য এগিয়ে না আসে, ততকাল শ্রমিকেরা স্বাধীন জমির মালিক না হতে পারে।[২২] এই “জমির জন্য পর্যাপ্ত দাম” নরম ভাষায় ঘুরিয়ে বলা ‘মুক্তিপণ ছাড়া আর কিছু নয়, যা শ্রমিককে তুলে দিতে হয় ধানকের হাতে-জুরি-শ্রমের বাজার থেকে ছুটি নিয়ে জমিতে অবসর গ্রহণের জন্য। প্রথমত, তাকে ধনিকের জন্য সৃষ্টি করতে হবে মূলধন, যার সাহায্যে ধনিক আরো শ্রমিক শোষণ করতে পারে। তার পরে, তার নিজের খরচে শ্রমের বাজারে স্থাপন করতে হবে একজন সহকারী (locuon tencs’ ) যাকে সরকার সাগর পার করে পাঠিয়ে দেবে তার প্রাক্তন মনিবেরধানকের উপকারের জন্য।

এটা খুবই বৈশিষ্ট্যসূচক যে, খোলাখুলি ভাবেই উপনিবেশগুলির ব্যবহারের জন্য ওয়েকফিল্ড কর্তৃক নির্দেশিত “আদিম সঞ্চয়নের” পদ্ধতিটি ইংরেজ সরকার বছরের পর বছর অনুসরণ করে এসেছে। অবশ্য তামাসাটা স্যার রবার্ট পীল-এর ব্যাংক আইনের মতই সার্থক হয়েছিল। প্ৰবাসনের স্রোত কেবল ইংরেজ উপনিবেশগুলি থেকে সরে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধাবিত হয়েছিল। ইতিমধ্যে ইউরোপে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের অগ্রগতি এবং তৎসংশ্লিষ্ট ক্রমবর্ধমান সরকারি অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যে পরিণত করেছে। এক দিকে প্রবাসনের পশ্চিম-মুখী ঢেউ যত দ্রুত বেগে তা ধুয়ে নিতে পাৰে, তার চেয়ে দ্রুত বেগে অভিবাসনের ঢেউ শ্রমের বাজারে লোক ছুড়ে দেবার দরুন বছরের পর বছর আমেরিকার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষের বিপুল ও বিরামহীন প্রবাহ পেছনে রেখে গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব দিকে একটি নিশ্চল তলানি।

অন্য দিকে, মার্কিন গৃহযুদ্ধ তার পিছনে পিছনে নিয়ে এল এক বিশাল জাতীয় ঋণ এবং তার সঙ্গে করের চাপ, জঘন্যতম আর্থিক অভিজাততন্ত্রের প্রাদুর্ভাব, রেলপথ, খনি ইত্যাদি চালু করার জন্য কোম্পানিগুলির উপরে সাধারণ জমির একটি বিরাট অংশের অপচয়, এক কথায়, মূলধনের সবচেয়ে দ্রুতগতি কেন্দ্রীভবন। সুতরাং, মহান প্রজাতন্ত্র আর প্রবাসী শ্রমিকদের কাছে স্বপ্নরাজ্য বইল না। এমনকি, যদিও মজুরির স্বল্পতা এবং মজুরি-শ্রমিকের নির্ভরতা ইউরোপের স্বাভাবিক মাত্রায় নামিয়ে আনা থেকে তখনন অনেক দূরে, তবু ধনতান্ত্রিক উৎপাদন এগিয়ে যায় দানবীয় পদক্ষেপে। সরকার কর্তৃক দাজ হাতে নিলজ্জ ভাবে অভিজাত ও ধনিকদের মধ্যে, অকর্ষিত জমি-বিলির অমিত ব্যয়ী দাক্ষিণ্য, যাকে এমনকি ওয়েকফিল্ড-ও এত সরবে নিন্দা করেছিলেন, তা সোনার খনি-খণনের কাজ যাদের টেনে আনে, সেই জন-প্রবাহের সহযোগিতায় এবং ইংরেজ পণ্যসামগ্রীর আমদানি, যা এমনকি ক্ষুদ্রতম কুটির শিল্পের সঙ্গে পাল্লা দেয়, তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায়-উৎপাদন করে প্রচুর আপেক্ষিক ‘উদ্বৃত্ত শ্রমজীবী জনসংখ্যা”, যার ফলে প্রত্যেকটি ডাক মেইল’) বয়ে নিয়ে আসে “অস্ট্রেলিয়ার শ্রমের বাজারে অত্যধিক শ্রম-সরবরাহের” আপাত-সুখকর সংবাদ; এবং কোন কোন জায়গায় বারবণিতা-বৃত্তি জাঁকিয়ে ওঠে লণ্ডন ‘হে মার্কেট’-এর মত বেপরোয়া ভাবে। [২৩]

যাই হোক, এখানে আমরা উপনিবেশগুলির অবস্থা নিয়ে ব্যস্ত নই। একমাত্র যে-জিনিসটির প্রতি আমাদের আগ্রহ, তা হল, পুরনো জগতের রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ব কর্তৃক আবিষ্কৃত এবং গৃহশীর্ষ থেকে বিঘোষিত নোতুন জগতের গোপন রহস্য; যে-রহস্যটি হল এই যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ও সঞ্চয়ন পদ্ধতির, এবং, স্বভাবতই, ধনতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তির মৌল শর্ত হল স্বোপার্জিত ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধ্বংসসাধন। ভাষান্তরে শ্রমিকের উৎসাদন।

————

১. (শিরোনাম ) আমরা এখানে আলোচনা করছি প্রকৃত ‘উপনিবেশ ( কলোনি) নিয়ে—সেইসব কুমারী ভূমি নিয়ে, অভিবাসনকারীরা যেখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, অর্থ নৈতিক ভাবে এখনো ইউরোপের একটি উপনিবেশ মাত্র। তা ছাড়া, এই পংক্তির মধ্যে সেই ধরনের পুরনো অভিবসতিগুলিও পড়ে, যেগুলিতে ক্রীতদাসকের অবলুপ্তি আগেকার অবস্থাবলীর আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে।

২. আধুনিক উপনিবেশ স্থাপনের বিষয়ে ওয়েকফিডের যে-সামান্য কিছু আলোচনা রয়েছে, ‘ফিজিওক্র্যাট মিরাবব পেয়ার আগেই তার পুরোপুরি আভাস দিয়েছিলেন এবং তারও অনেক আগে দিয়েছিলেন ইংরেজ অর্থনীতিবিদেরা।

৩. পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক সংগ্রামে এটা পরিণত হল একটি সাময়িক আবশ্যকতায়। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই হোক, ফলাফল একই থাকে।

৪. একজন নিগ্রো নিগ্রোই’। বিশেষ বিশেষ অবস্থায় সে হয় গোলাম। একটা ‘মিউল’ হল সুতো কাটার জন্য একটা মেশিন। কেবল বিশেষ বিশেষ অবস্থাইে তা হয় মূলধন। এই অবস্থাবলীর বাইরে সোনা যেমন স্বতঃই টাকা কিংবা চিনি, যেমন চিনির দাম, তার চেয়ে বেশি ভাবে তা কোনমতেই মূলধন নয়। মূলধন হল উৎপাদনের একটি সামাজিক সম্পর্ক। এ হল উৎপাদনের একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক। ( pro syf, ‘Lohnarbeit und Kapital. N. Rh. Zeitung, No. 266, April 1, 1849 )।

৫. ই. জি ওয়েকফিঙ : ইংল্যান্ড অ্যাণ্ড আমেরিকা” দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ৩৩।

৬. ঐ, পৃঃ ১৭।

৭. ঐ, পৃ: ১৮।

৮. ঐ, পৃঃ ৪২, ৪৩, ৪৪।

৯. ঐ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ৫।

১০. ঐ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ১২৫। উপনিবেশে রূপান্তরণের অন্যতম উপাদান হতে হলে, জমি কেবল ‘পতিত থাকলেই হবে না, তা হতে হবে সাধারণ সম্পত্তি, যাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিবর্তিত করা যায়। ঐ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১২৫।

১১. ঐ, প্রথম খণ্ড, পৃ ২৪৭।

১২. ঐ, পৃঃ ২১, ২২।

১৩. ঐ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ১১৬।

১৪. ঐ, প্রথম খণ্ড, পৃ ১৩১।

১৫. ঐ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ।

১৬. মেরিভেল, লেকচার্স অন কলোনাইজেশন অ্যাণ্ড কলোনি, বিতীয় খণ্ড পৃ ২৫৩, ২৫৪। এমনকি শান্ত, অবাধ বাণিজ্যবাদী, হাতুড়ে অর্থতাত্ত্বিক মলিনারি 978607a”Dans les colonies ou l’esclavage a ete aboli sans que le travail force se trouvait remplace par uue quantite equivalente de travail libre, on a vu s’operer la contre-partie du fait qui se realise tous les jours sous nos yeux. On a vu les simples travailleurs exploiter a leur tour les entrepreneurs d’industrie, exiger d’eux des salaires hors de toute proportion avec la part legitime qui leur revenait dans le produit. Les planteurs, ne pouvant obtenir de leurs sucres un prix suffisant pour couvrir la bausse de salaire, ont ete obliges de fournir l’excedant, d’abord sur leurs profits, ensuite sur leurs capitaux memes. Une foule de planteurs ont ete ruines de la sorte, d’autres ont ferme leurs ateliers pour echapper a une ruine imminente… Sans doute, il vaut mieux voir perir des accumulations capitaux que des generations d’hommes [ how generous of Mr. Molinari ! ]: mais ne vaudrait-il pas mieux que ni les autres perissent?(Molinari,’ ‘Etudes Economibues’, pp. 51, 52 ). Fall মলিনারি ! মিঃ মলিনারি ! তা হলে, মোজেস এবং তার পয়গম্বরদের দশটি অনুজ্ঞার মোগান ও চাহিদার নিয়মের কি হবে, যদি ইউরোপে আঁত্রেপ্রেন্যার’ শ্রমিকের ন্যায্য অংশ কাটতে পারে, এবং ওয়েস্ট-ইণ্ডিজ শ্রমিক পারে ‘আঁত্রেপ্রেন্যার শ্রমিকের ন্যায্য অংশ কাটতে? এবং যদি দয়া করে বলেন, কি এই ন্যায্য অংশ, যা আপনার নিজেরই স্বীকৃতি অনুসারে ইউরোপে ধনিক নিত্য দিতে ভুল করে? ওখানে ঐ উপনিবেশ গুলিতে, যেখানে শ্রমিকেরা এত সরল যে তারা ধনিককে শোষণ করে। যোগান ও চাহিদার নিয়মটি, যা অন্যত্র কাজ করে আপনা-আপনি, সেটিকে পুলিশের সহায়তায়, সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য মিঃ মলিনারি একটু কমন বোধ করেন।

১৭. ওয়েকফিল, ঐ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ৫২।

১৮, ঐ, পৃ ১৯১, ১৯২।

১৯. ঐ, প্রথম খণ্ড, পৃ ৪৭, ২৪৬।

২০ “C’est, ajoutez-vous, grace a l’appropriation du sol et des capicaux que l’homme qui n’a que ses bras, trouve de l’occupation. et se fait un revenu…c’est au contraire, grace a l’appropriation individuelle du sol qu’il se trouve des hommes n’ayant que leurs bry… Quand vous mettez un homme dans lc vide, vous vous ciparez de l’atmosphere. Ainsi faites-vous, quand vous emparez du sol… C’est le mettre dans le vide de richesses, pour ne le laisser vivre qu’a votre volonte.” (Colias, l. c., t. III., pp. 268-271, passim.)

২১. ওয়েকফিল, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ১৯২

২২. ঐ, পৃ ৪৫।

২৩. যে মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া তার নিজের আইনপ্রণেতা হয়ে উঠল, সে স্বভাবতই এমন সব আইন প্রনয়ণ করল যেগুলি বসতিস্থাপনকারীদের পক্ষে অনুকুল, কিন্তু ইংরেজ সরকার কর্তৃক ইতিপূর্বেই সম্পাদিত জমির অপচয় বাধা হয়ে দাড়াল। ১৮৬২ সালের নোতুন ভূমি-আইনটির প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হল লোকজনের বসতি স্থাপনের বর্ধিত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা।’ (‘দি ল্যাণ্ড ল অব ভিক্টোরিয়া, মাননীয় সি. জি. ডাকি, সাধারণ জমির ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী, লণ্ডল, ১৮৬২।)।

[ক্যাপিট্যাল ইংরেজী প্রথম খণ্ড তথা বাংলা দ্বিতীয় খণ্ডের সমাপ্তি।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *