১৮. উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার প্রসঙ্গে বিবিধ সূত্র

অষ্টাদশ অধ্যায় — উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার প্রসঙ্গে বিবিধ সূত্র

আমরা দেখেছি, উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার প্রকাশিত হয় নিম্নলিখিত সূত্ৰসমূহের দ্বারা :

উদ্বৃত্ত-মূল্য/অস্থির মূলধ – উদ্বৃত্ত-মূল্য/ শ্রমশক্তির মূল্য = উদ্বৃত্ত- শ্রম/ আবশ্যিক শ্রম

এই সূত্রগুলির মধ্যে প্রথম দুটি যা প্রকাশ করে বিবিধ মূল্যের অনুপাত হিসাবে, তৃতীয়টি তাই-প্রকাশ করে বিবিধ সময়ের অনুপাত হিসাবে, যে যে সময়ে এই মূল্যগুলি উৎপাদিত হয়। পরস্পরের পরিপূরক এই সূত্রগুলি কঠোরভাবে সুনির্দিষ্ট ও সঠিক। সুতরাং আমরা এগুলিকে চিরায়ত রাষ্ট্রিক অর্থতত্ত্বেও পাই মূলতঃ নির্ণয়ীকৃত আকারে, যদিও তা সচেতন ভাবে করা হয়নি। সেখানে আমরা উল্লিখিত সূত্রগুলি থেকে উপনীত নিম্নোধৃত সূত্রসমূহও পাই :

(১) উদ্বৃত্ত- শ্রম/ শ্রম-দিবস = উদ্বৃত্ত-মূল্য/ উৎপন্ন ফলের মূল্য = উৎপন্ন দ্রব্য/ মোট উৎপন্ন ফল

একই অনুপাত এখানে প্রকাশিত হয়েছে বিবিধ শ্রম-সময়ের অনুপাত হিসাবে, যে যে মূল্যে এই বিবিধ শ্রম-সময় মূর্ত হয়, সেই সেই সময়ের অনুপাত হিসাবে এবং যে যে উৎপন্ন দ্রব্যে ঐ বিবিধ মূল্য বিদ্যমান থাকে, সেই সেই দ্রব্যের অনুপাত হিসাবে। এটা অবশ্য স্পষ্ট যে, ‘উৎপন্ন ফলের মূল্য বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে একটি শ্রম-দিবসে কেবল নোতুন সৃষ্ট মূল্যটিকে—উক্ত উৎপন্ন ফলের মূল্যের স্থির অংশটিকে বাদ দিয়ে।

(২) এর অন্তর্ভূক্ত সব কটি সুত্রেই শ্রম-শোষণের আসল মাত্রাটি, অথবা উদ্ধত্ত মূল্যের হারটি মিথ্যাভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। ধরা যাক, একটি ১২ ঘণ্টার শ্রম-দিবস। তা হলে, আগেকার দৃষ্টান্তগুলিতে আমরা যা যা ধরে নিয়েছি, সেইগুলি এ ক্ষেত্রেও ধরে নিলে শ্রম-শোষণের আসল মাত্রাটি প্রকাশ পাবে এই এই অনুপাতে।

৬ ঘণ্টা উদ্বৃত্ত-সময়/ ৬ ঘণ্টা আবশ্যিক সময় = ৩ শিলিং উদ্বৃত্ত-মূল্য/ ৩ শিলিং অস্থির মূলধন

=১০০%

কিন্তু (২ নম্বরের সূত্রগুলি থেকে আমরা যা পাই তা সম্পূর্ণ ভিন্ন; আমরা পাইঃ

৬ ঘণ্টা উদ্বৃত্ত-শ্রম/ ১২ ঘণ্টা শ্রম-দিবস =  ৩ শিলিং উদ্বৃত্ত-মূল্য/ ৬ শিলিং সৃষ্ট মূল্য।

= ৫০%

আসলে এই (২) নম্বরের অন্তর্ভুক্ত সূত্রগুলি কেবল সেই অনুপাতটিকেই প্রকাশ করে, যে-অনুপাতে শ্রম-দিবসটি, কিংবা তার উৎপাদিত মূল্যটি ধনিক এবং শ্রমিকের মধ্যে বিভক্ত হয়। যদি তাদের গণ্য করা হয় মূলধনের আত্ম-সম্প্রসারণের মাত্রার প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তি হিসাবে, তা হলে নিম্নোক্ত ভ্রান্ত নিয়মটি সঠিক বলে ধারণা হবে : উদ্বৃত্ত-শ্রম বা উদ্বৃত্ত-মূল্য কখনো শতকরা ১০০ ভাগে পৌছাতে পারে না।[১] যেহেতু উদ্বৃত্ত-শ্রম হচ্ছে সৃষ্ট মূল্যেরই একাংশ, সেহেতু উদ্বৃত্ত-শ্রম, অবশ্যই সব সময়ে হবে শ্রম-দিবসের চেয়ে অল্পতর কিংবা উদ্বৃত্ত-মূল্য অবশ্যই সব সময়ে হবে সৃষ্ট মূল্যের চেয়ে অল্পতর। কিন্তু ১০০:১০০ অনুপাতে পৌছাতে তারা অবশ্যই হবে সমান সমান। যাতে করে উদ্ব-ম গোটা শ্রম-দিবসটিকেই (অর্থাৎ যেকোন সপ্তাহের বা বছরের একটি গত দিবসকে) আত্মসাৎ করতে পারে, আবশ্যিক এমকে অবশ্যই পর্যবসিত হতে হবে শূন্যে। কিন্তু যদি আবশ্যিক শ্ৰম অন্তর্হিত হয় তা হলে উদ্বৃত্ত-শ্রমও হয় অন্তর্হিত; কেননা দ্বিতীয়টি প্রথমটিরই একটি ক্রিয়া।

শ্রম-দিবসকে আয়তনে স্থির হিসাবে গণ্য করার প্রিয় পদ্ধতিটি, (২)-নম্বরভুক্ত সূত্রাবলীর ব্যবহারের মাধ্যমে একটি সুস্থিত প্রথায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল, কেননা ঐ সূত্রগুলিতে উদ্বৃত্ত-শ্রমকে সব সময়ে তুলনা করা হয় একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের শ্রম-দিবসের সঙ্গে। একই ব্যাপার প্রযোজ্য হয় যখন উৎপাদিত মূল্যের পুনর্বণ্টনকেই একান্তভাবে নজরে রাখা হয়।

উদ্বৃত্ত-মূল্যকে এবং শ্রমশক্তির মূল্যকে সৃষ্ট মূল্যের ভগ্নাংশ হিসাবে গণ্য করার অভ্যাস—এমন একটি অভ্যাস যার উৎপত্তি ঘটে স্বয়ং ধনতান্ত্রিক-উৎপাদন-পদ্ধতি থেকেই, এবং যার তাৎপর্য এর পরে আলোচনা করা হবে-এই অভ্যাস সেই খোদ, লেন-দেনের ব্যাপারটাকেই লুকিয়ে রাখে, যা মূলধনের বৈশিষ্ট্য, যথা, জীবন্ত শ্রমশক্তির। জন্য অস্থির মূলধনের বিনিময় এবং, তার পরিণামে, উৎপন্ন ফল থেকে শ্রমিকের বঞ্চনা। আসল ঘটনার পরিবর্তে আমরা পাই এমন একটি সম্মিলনের একটি মিথ্যা প্রতিরূপ যাতে শ্রমিক এবং ধনিক উক্ত ফলটির উৎপাদনে তাদের নিজ নিজ উপাদান সমূহের অবদান অনুপাতে সেটিকে ভাগ করে নেয়।[২]

তা ছাড়া, (২)নং সূত্রাবলীকে যে-কোনো সময়ে (১)-নং সূত্রাবলীতে রূপান্তরিত করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ, যদি আমাদের থাকে

৬ ঘণ্টা উদ্বৃত্ত-শ্রম/ ১২ ঘণ্টা কর্ম-দিবস, তাহলে যেহেতু আবশ্যিক শ্রম-সময় হল ১২ ঘণ্টা বিয়োগ ৬ ঘণ্টা উদ্বৃত্ত-শ্রম, সেহেতু আমরা পাই নিয়োক্ত ফলটি :

৬ ঘণ্টা উদ্বৃত্ত-শ্রম/৬ ঘণ্টা আবশ্যিক শ্রম = ১০০/১০০

 আরো একটি তৃতীয় সূত্র আছে, যার আভাস আমি ইতিপূর্বে মাঝে মাঝে দিয়েছি। সে সূত্রটি এই :

উদ্বৃত্ত-মূল্য / শ্রমশক্তির মূল্য = উদ্বৃত্ত-শ্রম/ আবশ্যিক শ্রম = মজুরি-প্রদত্ত শ্রম /মজুরি-বঞ্চিত শ্রম

উপরে আমরা যে বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছি, তার পরে আর

মজুরি-প্রদত্ত শ্রম/ মজুরি-বঞ্চিত শ্রম

এই সূত্রের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে যেতে পারি না যে ধনিক শ্রম শক্তির জন্য মূল্য দেয় না, মূল্য দেয় শ্রমের জন্য। এই সূত্রটি কেবল –

উদ্বৃত্ত-শ্রম/ আবশ্যিক শ্রম

সূত্রটিই জনরঞ্জন সংস্করণ। ধনিক মূল্য দেয় যতটা পর্যন্ত শ্রমশক্তির দাম তার মূল্যের সঙ্গে অনুরূপ হয় এবং বিনিময়ে স্বয়ং জীবন্ত শ্রমের ভোগ-ব্যবহারের উপরে অধিকার প্রাপ্ত হয়। তার ভোগ-স্বত্ব দুটি সময়ের উপরে বিস্তৃত থাকে। একটি সময় যখন শ্রমিক এমন একটি মূল্য উৎপাদন করে যা কেবল তার শ্রমশক্তির মূল্যের সমান হয়, সে তার একটি তুল্যমূল্য সামগ্রী উৎপাদন করে এইভাবে ধনিক শ্রমশক্তির দাম বাবদে যা অগ্রিম দিয়ে থাকে, প্রতিদানে তার একই দামের উৎপন্ন দ্রব্য পায়। ব্যাপারটা যেন এইরকম যে সে উক্ত দ্রব্যটি রেডিমেড আকারেই বাজার থেকে কিনেছে। বাকি সময়টিতে, উদ্ব-শ্রমের সময়টিতে, উক্ত শ্রমশক্তির উপরে ধনিকের ভোগ-স্বত্ব তার (ধনিকের জন্য এমন একটি মূল্য সৃষ্টি করে যার জন্য তাকে কোনো প্রতিদান দিতে হয় না।[৩] শ্রমশক্তির এই ব্যয় সে পেয়ে যায় মুফতে। এই অর্থেই উদ্বৃত্ত-শ্রমকে মজুরি-বঞ্চিত শ্রম বলা যায়।

সুতরাং, মূলধন কেবল, অ্যাডাম স্মিথ যা বলেছেন, শ্রমের উপরে আধিপত্য, তাই নয়। মূলধন মূলতঃ মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের উপরে আধিপত্য। সমস্ত উদ্বৃত্ত-মূল্য, তা পরবর্তী কালে যে-বিশেষ রূপটিতেই (মুনাফা, সুদ বা খাজনা) তা স্ফটিকায়িত হোক না কেন, তা মর্মগত ভাবে মজুরি-বঞ্চিত শ্রমেরই বাস্তবায়ন। মূলধনের আত্ম সম্প্রসারণের গুপ্ত রহস্যটি আত্মপ্রকাশ করে অন্য লোকের মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের উপরে ভোগ-স্বত্ব হিসাবে।

———–

১. “Dritter Brief an V. kirchmann von Rodbertus, Widerlegung der Ricardo’s chen Lehre von der Grundrente und Begrundung einer neuen Rententheorie” দ্রষ্টব্য। এই চিঠিটিতে আমি পরে আবার ফিরে আসব। খাজনা সম্পর্কে এর ভূল তত্ত্ব সত্ত্বেও, এ ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রকৃতি দেখতে সক্ষম হয়েছে। (তৃতীয় জার্মান সংস্করণে সংযোজিত : এ থেকে বোঝা যায় মার্কস কতটা সহৃদয়তার সঙ্গে তার পূর্বগামীদের বিচার করতেন—যখনি তিনি তাদের মধ্যে খুঁজে পেতেন সত্যকার অগ্রগতি কিংবা নোতুন ও সুষ্ঠু, ভাবনা। পরবর্তী কালে রুড মেয়রের কাছে লেখা রবার্টাসের এই চিঠিগুলি প্রকাশিত হয় এবং তা থেকে দেখা যায় যে মার্কসের উল্লিখিত স্বীকৃতির কিছুতা সীমিতকরণ দরকার। ঐ চিঠিগুলিতে এই অনুচ্ছেদটি রয়েছে, মূলধনকে কেবল শ্রমের কাছ থেকে রক্ষা করলেই চলবে না, তার নিজের কাছ থেকেও রক্ষা করতে হবে এবং সেটা সবচেয়ে ভাল ভাবে করা যাবে, যদি শিল্প-ধনিকের কাজ-কর্মকে আমরা গণ্য করি এমন অর্থ নৈতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ড হিসাবে যার দায়িত্ব মূলধনের দায়িত্বের সঙ্গে তার উপর ন্যস্ত করা হয়েছে, এবং তঁার মুনাফাকে গণ্য করি এক প্রকারের বেতন হিসাবে, কেননা আমরা এখনো অন্য কোনো সামাজিক সংগঠনকে জানিনা। কিন্তু বেতনকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে, এমনকি কমানোও যেতে পারে, যদি বেতন মজুরি থেকে খুব বেশি নিয়ে নেয়। সমাজের মধ্যে মার্কসের সবলে প্রবেশ, আমি তার বইখানাকে তাই বলেই মনে করি, অবশ্যই প্রতিহত করতে…সব মিলিয়ে মার্কসের বইটি যে পরিমাণে মূলধন সম্পর্কে তত্ত্বানুসন্ধান, তার চেয়ে ঢের বেশি পরিমাণে মূলধনের বর্তমান রূপের বিরুদ্ধে, যে-রূপটিকে তিনি গুলিয়ে ফেলেছেন মূলধনের খোদ ধারণাটারই সঙ্গে, তার বিরুদ্ধে আক্রমণ।” তাঁর “সামাজিক চিঠিপত্রে’ রবার্টাস যে নির্ভীক আক্রমণ চালিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা পর্যবসিত হয় এই মতাদর্শমত জগাখিচুড়িতে।এফ. এঙ্গেলস।]

২. ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সমস্ত সু-পরিণত রূপই হল সহযোগের বিভিন্ন রূপ; তাই তাদের স্ববিরোধী চরিত্র থেকে একটা অমূর্ত তত্ত্বে উপনীত হওয়া এবং সেই রূপগুলিকে এক কথায় কোন-না-কোন ধরনের স্বাধীন সম্মিলনে রূপান্তরিত করার তুলনায় সহজতর আর কিছু নেই, যা করেছেন এ দ্য লাবোর্দে তার “De P Esprit d. Association dans tous les interets de la communaute”-a ( প্যারিস, ১৮১৮)। এইচ, ক্যারি নামক সেই ইয়াংকিটিও মাঝে মাঝে সমান সাফল্যের সঙ্গে এই ধরনের ছলাকলা পরিদর্শন করেন—এমনকি ক্রীতদাসত্ব থেকে উদ্ভূত সম্পর্ক সমূহের ক্ষেত্রেও।

৩. ‘ফিজিওক্র্যাটরা যদিও উদ্বৃত্ত-মূল্যের রহস্য ভেদ করতে পারেন নি, তবু এই পর্যন্ত তাদের কাছে পরিষ্কার ছিল যে, “une richesse independante et disponible qu’il ( the possessor) n’a point achetec et qu’il vend., (Turgot : Reflexions sur la Formation et la Distribution des Richesses.” P. 11).

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *