২৩. সরল পুনরুৎপাদন

সপ্তম বিভাগ মূলধনের সঞ্চয়ন

মুল্যের যে-পরিমাণটি মূলধন হিসাবে কাজ করতে যাচ্ছে, তা যে-প্রথম পদক্ষেপটি নেয়, সেটি হল একটি টাকার অঙ্ককে উৎপাদনের উপায়-উপকরণে এবং শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিতকরণ। এই রূপান্তরণ ঘটে বাজারে, সঞ্চলনের পরিধির মধ্যে। দ্বিতীয় পদক্ষেপটি সম্পূর্ণ হয় তখনি, যখন উৎপাদনের উপায় উপকরণগুলি এমন পণ্যদ্রব্যাদিতে রূপান্তরিত হয়েছে, যার মূল্য সেই দ্রব্যাদির গঠনকারী অংশগুলির মূল্যকে ছাড়িয়ে বেশি হয়, এবং সেই কারণে বিধৃত করে প্রারম্ভে অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনটিকে একটি উদ্বৃত্ত-মূল্যকে। এই পণ্যদ্রব্যগুলিকে তখন অবশ্যই সঞ্চলনে ছুড়ে দিতে হবে, সেগুলিকে বিক্রি করতে হবে, সেগুলির মূল্যকে টাকার অঙ্কে রূপায়িত করতে হবে, এই টাকাকে আবার নোতুন করে মূলধনে রূপান্তরিত করতে হবে—এবং এই ভাবেই চলতে থাকবে বারংবার।

সঞ্চয়নের প্রথম শর্ত এই যে, ধনিক নিশ্চয়ই তার পণ্যদ্রব্যাদি বিক্রয়ের এবং এই ভাবে প্রাপ্ত টাকার বৃহত্তর অংশকে মূলধন পুনঃরূপান্তরিত করার বন্দোবস্ত করেছে। পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলিতে আমরা ধরে নেব যে, মূলধন তার স্বাভাবিক পথে সঞ্চলন করছে। দ্বিতীয় গ্রন্থে এই প্রক্রিয়াটির বিস্তারিত বিশ্লেষণ দেওয়া হবে।

যে-ধনিক উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করে, অর্থাৎ যে ধনিক শ্রমিকদের কাছ থেকে সরাসরি মজুরি-বঞ্চিত শ্রম আদায় করে এবং তাকে পণ্যদ্রব্যের মধ্যে স্থাপন করে, সে বস্তুতই এই উদ্বৃত্ত-মূল্যের প্রথম অধিকারকারী, কিন্তু কোন মতেই শেষ স্বত্বাধিকারী নয়। তাকে তা ভাগ করে নিতে হয় ধনিকদের সঙ্গে ভূস্বামী ইত্যাদিদের সঙ্গে, যারা সামাজিক জটিল বিন্যাসের মধ্যে অন্যান্য কাজ সম্পাদন করে। সুতরাং, উদ্বৃত্ত মূল্য নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তার অংশগুলি বিভিন্ন বর্গের ব্যক্তিদের ভাগে পড়ে এবং পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র বিবিধ আকার ধারণ করে, যেমন মুনাফা সুদ, ধনিকের মুনাফা, খাজনা ইত্যাদি। কেবল তৃতীয় গ্রন্থে গিয়েই আমরা উদ্বৃত্ত-মূল্যের এই সব উপযোজিত রূপ নিয়ে আলোচনার অবকাশ পাব।

তা হলে, এক দিকে সঞ্চলনের পরিধির মধ্যে থাকাকালে মূলধন যেসব নোতুন নোতুন রূপ পরিগ্রহ করে কিংবা এই সব রূপের অন্তরালে যে বাস্তব অবস্থাগুলি থাকে, সেগুলি সম্পর্কে মাথা না ঘামিয়ে, আমরা ধরে নিচ্ছি যে, ধনিক যে পণ্যভ্রব্যাদি উৎপাদন করে, সে সেগুলিকে তাদের স্ব-মূল্যেই বিক্রি করে। অন্য দিকে আমরা ‘নিক উৎপাদনকারীটিকে গণ্য করছি সমগ্র উদ্বৃত্ত-মূল্যের স্বত্বাধিকারী হিসাবে, বরং বলা ভাল, লুঠের মালে তার সঙ্গে বখরা নেয় এমন তামাম বখরাদারের প্রতিনিধি হিসাবে। সুতরাং, আমরা সর্বপ্রথমে মূলধন সঞ্চয়নকে আলোচনা করব একটি অমূর্ত দৃষ্টিকোণ থেকে—অর্থাৎ উৎপাদনের বাস্তব প্রক্রিয়ায় নিছক একটি পর্যায় হিসাবে।

যখন সঞ্চয়ন সংঘটিত হয়, তখন ধনিক নিশ্চয়ই সফল হয়েছে তার পণ্যদ্রব্যাদি বিক্রি করে দিতে, এবং সেই বিক্রয়লব্ধ টাকাকে মূলধনে পুনঃরূপান্তরিত করতে। অধিকন্তু, উদ্বৃত্ত-মূল্যের এই নানা খণ্ডে ভাগ হয়ে যাবার ঘটনাটি তার প্রকৃতিতেও কোনো পরিবর্তন ঘটায় না কিংবা যে অবস্থাবলীর মধ্যে তা সঞ্চয়নের একটি উপাদান হয়ে ওঠে, সেই অবস্থাবলীতেও কোন পরিবর্তন ঘটায় না। শিল্প-ধনিক নিজের জন্য যতটা রাখে কিংবা অন্যান্যদের জন্য যতটা ছাড়ে, তার অনুপাতে যাই হোক না কেন, সেই হচ্ছে একমাত্র ব্যক্তি, যে প্রথম পর্যায়ে তা দখল করে নেয়। সুতরাং, যা কার্যত ঘটে, তার চেয়ে বেশি কিছুই আমরা ধরে নিচ্ছি না। অন্য দিকে, সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার সরল মৌল রূপটি ঢাকা পড়ে যায় সঞ্চলনের ঘটনাটি দ্বারা যা সেটিকে ঘটায়, এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যের ভাগাভাগি দ্বারা। অতএব এই প্রক্রিয়াটির একটি যথাযথ বিশ্লেষণ দাবি করে যে, আমরা আপাতত উপেক্ষা করব সেই যাবতীয় ব্যাপারকে, যা তার ভিতরকার আমি ব্যবস্থাটির ক্রিয়াকর্মকে আড়াল করে রাখে।

.

ত্রয়োবিংশ অধ্যায় — সরল পুনরুৎপাদন

সমাজে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার রূপ যাই হোক না কেন, তাকে অবশ্যই হতে হবে একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া, কিছু সময় অন্তর অন্তর যেতে হবে একই পর্যায়ক্রমের মধ্য দিয়ে। যেমন কোন সমাজ তার পরিভোগ-ক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে পারে না, তেমন সে তার উৎপাদন-ক্রিয়া থেকেও বিরত থাকতে পারে না। সুতরাং, যখন তাকে দেখা যায় একটি পরম্পর-সংযুক্ত সমগ্র হিসাবে, অবিরত পুনন বীভবনের প্রবাহ হিসাবে, তখন প্রত্যেকটি সামাজিক প্রক্রিয়াই আবার একই সময়ে পুনরুৎপাদনেরও প্রক্রিয়া।

উৎপাদনের শর্তাবলীই আবার পুনরুৎপাদনেরও শর্তাবলী। কোন সমাজ উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারে না, ভাষান্তরে পুনরুৎপাদন করতে পারে না যদি সে তার উৎপন্ন ফলের একটি অংশকে উৎপাদনের উপায় উপকরণে, তথা নোতুন উৎপন্ন ফলের উপাদানে, পুনঃরূপান্তরিত না করে। বাকি সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে, একটি মাত্র পদ্ধতি যার দ্বারা সে তার সম্পদ পুনরুৎপাদন করতে পারে, তা হল উৎপাদনের উপায়-উপকরণের পরিবর্তে, অর্থাৎ শ্রমের হাতিয়ার, কাঁচামাল এবং সারা বছর ধরে পরিভুক্ত সহায়ক সামগ্রীর পরিবতে একই রকমের সব জিনিসের একই পরিমাণে প্রতি স্থাপন; বাৎসরিক উৎপন্ন দ্রব্যসম্ভার থেকে এই জিনিসগুলিকে অবশ্যই আলাদা করতে হবে এবং উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় নোতুন করে নিক্ষেপ করতে হবে। সুতরাং প্রত্যেক বছরের উৎপন্ন দ্রব্যসম্ভারের একটি নির্দিষ্ট অংশ উৎপাদনেরই এখতিয়ারভুক্ত। শুরু থেকেই উৎপাদনশীল পরিভোগের জন্য পূর্ব-নির্দিষ্ট এই অংশটি, প্রধানতঃ এমন সব জিনিসের আকারে থাকে, যা ব্যক্তিগত পরিভোগের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত।

উৎপাদনের রূপ যদি হয় ধনতান্ত্রিক, তা হলে পুনরুৎপাদনের রূপও হবে ধনতান্ত্রিক। যেমন প্রথম ক্ষেত্রে শ্রম-প্রক্রিয়ার ভূমিকা হল মূলধনের আত্ম-সম্প্রসারণের উদে সাধন একটি উপায়মাত্র হিসাবে, ঠিক তেমনি এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতেও তার ভূমিকা হল মূলধনের পুনরুৎপাদনের উপায় হিসাবে—অর্থাৎ আত্ম-সম্প্রসারণশীল মূল্য হিসাবে –অগ্রিম প্রদত্ত মূল্য হিসাবে। যেহেতু তার টাকা সব সময়েই কাজ করে মূলধন হিসাবে সেই হেতুই ধনিকের অর্থ নৈতিক পোশাকটি ব্যক্তিবিশেষের গায়ে লেগে যায়। যেমন, যদি এ বছর ১০০ পাউণ্ড পরিমাণ টাকা মূলধনে রূপান্তরিত হয়, এবং ২০ পাউণ্ড পরিমাণ উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করে, তা হলে পরবর্তী বছরে এবং তার পরের বছরগুলিতেও, তা ঐ একই পুনরাবৃত্তি চালিয়ে যেতে থাকবে। অগ্রিম প্রদত্ত মূলধনের সময়ক্রমিক বৃদ্ধি হিসাবে কিংবা প্রক্রিয়াশীল মূলধনের সময়ক্রমিক ফল হিসাবে, উদ্বৃত্ত-মূল্য মূলধন থেকে উৎসারিত একটি আয়ের আকার ধারণ করে। [১]

এই আয়টি যদি কেবল সংশ্লিষ্ট ধনিকের পরিভোগ সংস্থানের জন্য একটি তহবিল হিসাবে কাজ করে এবং, যেমন সময়ক্রমিক ভাবে পাওয়া যায়, তেমন ভাবেই ব্যয় হয়ে যায়, তা হলে, caeteris paribus, সরল পুনরুৎপাদন সংঘটিত হয়। এবং যদিও এই পুনরুৎপাদন কেবল পুরনো আয়তনে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি মাত্র, তবু কেবল এই পুনরাবৃত্তিই কিংবা নিরবচ্ছিন্নতাই প্রক্রিয়াটিকে একটি নোতুন চরিত্র দান করে, কিংবা, বরং বলা যায়, কয়েকটি আপাত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ধান ঘটায়—যে-বৈশিষ্ট্যগুলি তার অন্তর্ভুক্ত ছিল একটি পৃথক বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া হিসাবে।

একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য শ্রমশক্তি ক্রয় হল উৎপাদন-প্রক্রিয়ার প্রস্তাবনা; এবং যখনি চুক্তি-নির্ধারিত মেয়াদ পার হয়ে যায়, যখনি সপ্তাহ, মাস ইত্যাদির মত উৎপাদনের একটি নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যায়, তখনি এই প্রস্তাবনার নিরন্তর পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত শ্রমিক তার শ্রম-শক্তি ব্যয় না করছে এবং সেই শ্রমশক্তি কেবল মূল্যকেই নয়, তার উদ্বৃত্ত-মূল্যকেও পণ্য-সামগ্রীতে রূপায়িত না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মজুরি দেওয়া হয় না। সুতরাং, সে তার আগে কেবল উদ্বৃত্ত-মূল্যই উৎপাদন করেনি, যাকে আমরা আপাতত গণ্য করছি উক্ত খনিকের ব্যক্তিগত পরিভোগর তহবিল হিসাবে, তা ছাড়াও উৎপাদন করেছে তার কাছে মজুরির আকারে ফিরে যাবার আগে, সেই তহবিলটিকে, অস্থির মূলধনটিকে, যা থেকে তাকেও দেওয়া হয় তার মজুরি; এবং তার কাজ কেবল ততকাল পর্যন্তই থাকে, যতকাল পর্যন্ত সে এই তহবিল পুনরুৎপাদন করতে পারে। এই থেকেই এসেছে অর্থনীতিবিদদের সেই সূত্রটি যা মজুরিকে বর্ণনা করে উৎপন্ন ফলেরই একটি অংশ হিসাবে; অষ্টাদশ অধ্যায়ে আগেই এই সূত্রটির উল্লেখ করা হয়েছে।[২] মজুরির আকারে যা শ্রমিকের কাছে ফিরে যায়, তা তার দ্বারা নিরন্তর পুনরুৎপাদিত উৎপন্ন ফলেরই একটা অংশ। সত্য বটে যে, ধনিক তাকে মজুরি দেয় টাকার অঙ্কে, কিন্তু এই টাকা তার মোৎপন্ন ফলেরই পরিবর্তিত রূপ। যখন সে উৎপাদনের উপায়-উপকরণের একটা অংশকে উৎপন্ন দ্রব্যে রূপান্তরিত করছে, তখন তার পূর্বোৎপন্ন দ্রব্যের একটা অংশ টাকায় রূপান্তরিত হচ্ছে। তার গত সপ্তাহের বা গত মাসের শ্রমই তার এই সপ্তাহের বা এই বছরের মজুরি যুগিয়ে থাকে। টাকার অন্তবর্তী ভূমিকার দরুন যে বিভ্রমের সৃষ্টি হয়, সেই মুহূর্তে তা অন্তর্হিত হয়ে যায়, যে মুহূর্তে একজন ধনিক বা একজন শ্রমিক হিসাবে বিবেচনা না করে, আমরা বিবেচনা করি সমগ্র ভাবে ধনিক শ্রেণী এবং সমগ্র ভাবে শ্রমিক শ্রেণী হিসাবে। ধনিক শ্রেণী সব সময়েই শ্রমিক শ্রেণীকে দিচ্ছে টাকার আকারে ‘অর্ডার নোট’—দিচ্ছে সেই দ্রব্যসম্ভারের একটি অংশের বাবদে, যে দ্রব্যসম্ভার উৎপাদন করে শ্রমিক-শ্রেণী, কিন্তু আত্মসাৎ করে ধনিক শ্ৰেণী। ঠিক অনুরূপ নিরন্তর ভাবেই শ্রমিকেরা সেই অর্ডার-নোটগুলিকে ফিরিয়ে দেয়। ধনিক শ্রেণীর হাতে, এবং এই ভাবে তাদের নিজেদের উৎপন্ন ফলে পায় তাদের অংশ। উৎপন্ন ফলের পণ্য-রূপ এবং পণ্যের মুদ্রা-রূপ এই আদান-প্রদানকে অবগুণ্ঠিত করে রাখে।

সুতরাং অস্থির মূলধন হল জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যসামগ্রী সংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের কিংবা শ্রমিকের নিজের ও তার পরিবারে ভরণ-পোষণের জন্য যে শ্রম-তহবিলের প্রয়োজন হয় এবং, সামাজিক উৎপাদনের প্রণালী যাই হোক না কেন, যে তহবিলটি তাকে নিজেকেই অবশ্যই উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করতে হবে, তারই চেহারার একটি বিশেষ ঐতিহাসিক রূপ মাত্র। শ্রম-তহবিল যদি নিরন্তর তার দিকে বয়ে আসে টাকার আকারে, যা তাকে দেয় তার শ্রমের পারিশ্রমিক, তা হলে তার কারণ এই যে, সে যে-উৎপন্ন দ্রব্য তৈরি করেছে তা নিরন্তর তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে মূলধনের আকারে। কিন্তু এই সবকিছু সত্ত্বেও এই ঘটনাটি বদলে যায় না যে, এটা শ্রমিকেরই নিজস্ব শ্রম, যা রূপায়িত হয় উৎপন্ন দ্রব্য, এবং যা ধনিক তাকে দেয় অগ্রিম হিসাবে।[৩] একজন চাষীর কথা ধরা যাক, যাকে তার প্রভুর জন্য বাধ্যতামূলক ভাবে কাজ করতে হয়। সে তার নিজের উৎপাদন-উপকরণাদি নিয়ে নিজের জমিতে চাষ করে, ধরা যাক, সপ্তাহে ৩ দিন। বাকি ৩ দিন তাকে বেগার খাটতে হয় তার প্রভুর জমিদারিতে। সে নিরন্তর তার নিজের শ্রম-তহবিল পুরুৎপাদন করে, যা, তার ক্ষেত্রে, কখনো তার শ্রমের অন্য কারো দ্বারা অগ্রিম প্রদত্ত আর্থিক মরির রূপ গ্রহণ করে না। কিন্তু প্রতিদানে, তার প্রভুর জন্য তার মজুরি-বঞ্চিত বাধ্যতামলক শ্রমও আবার কখনো স্বেচ্ছামূলক মজুরি-প্রদত্ত শ্রমের চরিত্র অর্জন করে না। এক সুন্দর প্রভাতে প্রভুটি তার জমি গবাদিপশু বীজ, এক কথায়, এই চাষীর উৎপাদনের উপায়-উপকরণ আত্মসাৎ করে নেয়; তখন থেকে ঐ চাষী তার শ্রমশক্তি তার প্রভুর কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। সে। cacteris paribus, আগের মতই সপ্তাহে ৬ দিন করে কাজ করতে থাকবে, ৩ দিন। নিজের জন্য এবং বাকি ৩ দিন প্রভুর জন্য, যে তখন পরিণত হয় মজুরি-দাতা ধনিকে। আগের মতই সে উৎপাদনের উপায়-উপকরণাদি উৎপাদনের উপায়-উপকরণ হিসাণেই ব্যবহার করবে এবং তাদের মূল্যকে উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত করবে। আগের মতই উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর একটা নির্দিষ্ট অংশ পুনরুৎপাদনে নিয়োজিত হবে। কিন্তু যে-মুহূর্ত থেকে বাধ্যতামূলক শ্রম পরিবর্তিত হয় মজুরি-শ্রমে, সেই মুহূর্তটি থেকে শ্রম তহবিল, যা সে আগের মতই উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করতে থাকে, তা মনিবের দ্বারা অগ্রিম প্রদত্ত মজুরির আকারে মূলধনের রূপ ধারণ করে। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ কোন জিনিসের বাহ্যিক রূপ থেকে সেই জিনিসটিকে আলাদা করে দেখতে অক্ষম বলে, এই ঘটনার দিকে চোখ বুজে থাকে যে, পৃথিবীর বুকে এখনো কেবল এখানে-সেখানে। আজও পর্যন্ত শ্রম-তহবিল উদ্ভূত হয় মূলধনের আকারে।[৪]

এটা ঠিক যে, যখন আমরা ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে দেখি তার নিরন্তর পুনর্নবীভবনের প্রবাহ-ধারায়, তখনি কেবল অস্থির মূলধন ধনিকের তহবিল[৫] থেকে দেওয়া অগ্রিম প্রদত্ত মূল্যের চরিত্র হারায়। কিন্তু ঐ প্রক্রিয়াটির নিশ্চয়ই কোন রকমে আগে থেকে সূত্রপাত হয়েছে। সুতরাং আমাদের বর্তমান অবস্থান থেকে এটা সম্ভাব্য বলে মনে হয় যে, একদা এই ধনিক, অন্যান্যদের মজুরি-বঞ্চিত শ্রম থেকে নিরপেক্ষ ভাবে, কিছু সঞ্চয়নের মাধ্যমে, টাকার মালিক হয়ে উঠল এবং এই কারণে এই ভাবেই সে সক্ষম হল শ্রমশক্তির ক্রেতা হিসাবে বাজারে যেতে। যাই হোক, এটাও হতে পারে যে, সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটির নিছক নিরবচ্ছিন্নতা, সরল পুনরুৎপাদন, নিয়ে আসে অন্যান্য কয়েকটি বিস্ময়কর পরিবর্তন, যা কেবল অস্থির মূলধনকেই নয়, মোট মূলধনকেই প্রভাবিত করে।

যদি ১০০০ পাউণ্ড পরিমাণ মূলধন বার্ষিক ২০০ পাউণ্ড পরিমাণ উদ্বৃত্ত মূল্যের জন্ম দেয়, এবং এই উদ্বৃত্ত-মূল্য যদি প্রতি-বৎসর পরিভুক্ত হয়, তা হলে এটা পরিষ্কার যে, ৫ বছরের শেষে পরিভুক্ত উদ্বৃত্ত-মূল্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫X২০০ পাউণ্ড=১০০০ পাউণ্ড, যা গোড়ায় আগাম হিসাবে দেওয়া হয়েছিল। যদি একটি মাত্র অংশ, ধরা যাক অর্ধেক, পরিভুক্ত হত, তা হলে ১০ বছরের শেষে একই ফল ফলত যেহেতু ১০ x১০০ পাউণ্ড= ১,০০০ পাউণ্ড। সাধারণ সূত্র : অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের মূল্যকে বাৎসরিক পরিভুক্ত উদ্বৃত্ত-মূল্য দিয়ে ভাগ করলে সেই বৎসর সংখ্যা বা পুনরুৎপাদনসময়কাল সংখ্যা পাওয়া যায়, যার পরিসমাপ্তি ঘটলে ধনিক কর্তৃক অগ্রিম-প্রদত্ত প্রারম্ভিক মূলধন পরিভুক্ত ও অন্তর্হিত হয়ে যায়। ধনিক মনে করে, সে অন্যান্যের মজুরি বঞ্চিত শ্রমের ফল অর্থাৎ উদ্বৃত্ত-মূল্য পরিভোগ করছে এবং মূল মূলধনটি অক্ষুন। রাখছে; কিন্তু সে যা ভাবে ভাবুক না কেন, তা ঘটনাসমূহকে বদলে দিতে পারে না। একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক বছর অতিবাহিত হয়ে গেলে, সে তখন যে-পরিমাণ মূলধন-মূল্যের অধিকারী থাকে, তা সেই বছরগুলিতে যে-পরিমাণ মোট উদ্বৃত্ত-মূল্য আত্মসাৎ করছে তার সমান, এবং যে-মোট মূল্য সে পরিভোগ করেছে, তা তার প্রান্তিক মূলধনের সমান। এটা সত্য যে, তার হাতে যে মূলধন আছে, তার পরিমাণ বদলায়নি, এবং যার একটি অংশ, যেমন বিভিং, মেশিনারি ইত্যাদি যখন সে তার ব্যবসায়িক কাজ শুরু করে, তখন ছিল। কিন্তু এখানে যা নিয়ে আমাদের কাজ, তা মূলধনের বস্তুগত উপাদানগুলি নয়, তার মূল্য। যখন কোন ব্যক্তি তার সম্পত্তির মুল্যের সমপরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে, তার সমস্ত সম্পত্তিকে শেষ করে দেয়, তখন এটা পরিষ্কার যে তার সম্পত্তি তার সমস্ত ঋণের মোট পরিমাণটি ছাড়া আর কিছুই প্রতিনিধিত্ব করে না। এবং ধনিকের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই; যখন সে তার প্রারম্ভিক মূলধনের সমপরিমাণ মূল্য পরিভোগ করে ফেলেছে, তখন তার উপস্থিত মূলধনের মূল্য সে মজুরি না দিয়েই যে মোট পরিমাণ উদ্বৃত্ত-মূল্য আত্মসাৎ করেছে, তা ছাড়া আর কিছুরই প্রতিনিধিত্ব করে না। তার পুরানো মূলধনের একটি মাত্র অণুও অবশিষ্ট থাকে না।

তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, সমস্ত সঞ্চয়ন ছাড়াও, কেবল উৎপাদন-প্রক্রিয়ার নিরবচ্ছিন্নতাই, ভাষান্তরে, সরল পুনরুৎপাদনই, আজ হোক বা কাল হক, আবশ্যিক ভাবেই প্রত্যেক মূলধনকে সঞ্চয়ীকৃত মূলধনে কিংবা মূলধনায়িত উদ্বৃত্ত-মূল্যে রূপান্তরিত করে। এমনকি যদি সেই মূলধন শুরুতে তার নিয়োগকর্তার ব্যক্তিগত শ্রমের দ্বারাও অর্জিত হয়ে থাকে, তা আজ বা কাল পরিণত হয় আত্মীকৃত মূল্যে, যার জন্য কোনো পরিবর্ত মূল্য দেওয়া হয়নি, অর্থাৎ পরিণত হয় অপরের মজুরি-বঞ্চিত এমে, যা রূপায়িত হয়েছে টাকার অঙ্কে বা অন্য কোন বস্তুর আকারে। চতুর্থ অধ্যায় থেকে ষষ্ঠ অধ্যায় পর্যন্ত আমরা দেখেছি যে, টাকাকে মূলধনে রূপায়িত করতে হলে পণ্যের উৎপাদন ও সঞ্চলন ছাড়াও আরো কিছুর প্রয়োজন হয়। আমরা দেখেছি যে, এক দিকে, মূল্য বা টাকার মালিক এবং অন্য দিকে, মূল্য-সৃজনকারী বস্তুটির মালিক, এক দিকে, উৎপাদন ও জীবন-ধারণের উপায়-উপকরণের মালিক এবং অন্য দিকে, শ্রমশক্তি ছাড়া আর কিছুরই মালিক নয়—এই দুই পক্ষ অবশ্যই পরস্পরের মুখোমুখি হয় ক্রেতা এবং বিক্রেতা হিসাবে। সুতরাং নিজের উৎপন্ন দ্রব্য থেকে শ্রমের বিচ্ছেদ তথা শ্রমের বিষয়গত অবস্থাবলী থেকে বিষয়ীগত শ্রমশক্তির বিচ্ছেদ হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ঘটনাগত আসল ভিত্তি এবং সূচনা-বিন্দু।

কিন্তু যা প্রথমে ছিল একটি সুচনা-বিন্দু, তা কেবল প্রক্রিয়াটির নিবচ্ছিন্নতার কারণেই, সরল পুনরুৎপাদনের কারণেই, হয়ে ওঠে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের স্ব-বিশেষ, নিরন্তর নবীকৃত ও নিত্য স্থায়ীকৃত ফল। এক দিকে, উৎপাদনের প্রক্রিয়া বস্তুগত সম্পদকে অবিরত মূলধনে, ধনিকের জন্য আরো সম্পদ উৎপাদনের উপায়ে, উপভোগের উপকরণে রূপান্তরিত করতে থাকে। অন্য দিকে, শ্রমিক উক্ত প্রক্রিয়া পরিত্যাগ করার পরে, যা সে ছিল ঐ প্রক্রিয়ায় প্রবেশের সময়ে, তাই থেকে যায়, অর্থাৎ সম্পদের অন্যতম উৎসই থেকে যায়, কিন্তু সেই সম্পদকে নিজস্ব করে নেবার সমস্ত উপায় থেকে বঞ্চিত। যেহেতু ঐ প্রক্রিয়ায় প্রবেশের আগে তার নিজের শ্রম ইতিমধ্যেই বিক্রয়ের মাধ্যমে, শ্রমিকের নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে, খনিকের দ্বারা আত্মীকৃত ও মূলধনের সঙ্গে সুসংবদ্ধ হয়ে গিয়েছে, সেহেতু উক্ত প্রক্রিয়া চলাকালে সেই শ্রম অবধারিত ভাবেই এমন একটি উৎপন্ন দ্রব্যে রূপায়িত হবে, যার মালিক আর সে নয়। যেহেতু উৎপাদনের প্রক্রিয়া আবার ধনিক কর্তৃক শ্রমশক্তি পৰিভোগ করারও প্রক্রিয়া, সেহেতু শ্রমিকের উৎপন্ন ফল অবিরত রূপান্তরিত হয় কেবল পণ্যদ্রব্যেই নয়, সেই সঙ্গে মূলধনেও, সেই মূল্যেও, যা শুষে খায় মূল্য-সৃজনকারী ক্ষমতাকে, উৎপাদনের সেই উপায়-উপকরণকেও, যা নিয়ন্ত্রণ করে উৎপাদনকারীদের।[৬] সুতরাং শ্রমিক প্রতিনিয়ত এমন এক বিজাতীয় শক্তির অধীনে বস্তুগত, বিষয়গত সম্পদ উৎপাদন করে, যা মূলধনের আকারে, তার উপরে আধিপত্য করে, তাকে শোষণ করে। এবং ধনিকও তেমনি প্রতিনিয়ত উৎপাদন করে শ্রমশক্তি, কিন্তু, কেবল সম্পদের একটি বিষয়ীগত উৎস হিসাবে একমাত্র যার মধ্যে এবং যার দ্বারা তা রূপায়িত হতে পারে সেই বিষয়সমূহ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে, এক কথায়, সে শ্রমিককে উৎপাদন করে, কিন্তু কেবল মজুরি-শ্রমিক হিসাবে।[৭] এই বিরতিবিহীন পুনরুৎপাদন, শ্রমিকের এই নিত্যস্থায়ীকরণ—এটাই হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের আবশ্যিক শর্ত (sine qua non)।

শ্রমিক পরিভোগ করে দ্বিবিধ উপায়ে। যখন উৎপাদন করে, তখন সে তার শ্রমের সাহায্যে উৎপাদনের উপায়-উপকরণকে পরিভোগ করে এবং সেগুলিকে রূপান্তরিত করে অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের মূল্যের চেয়ে উচ্চতর মূল্যসম্পন্ন উৎপন্ন দ্রব্যে। এটা হল তার উৎপাদনশীল পরিভোগ। এটা আবার সেই সঙ্গে ধনিক কর্তৃক তার শ্রমশক্তির পরিভোগও বটে, যে তা ক্রয় করেছে। অন্য দিকে, শ্রমিক তার শ্রম-শক্তির জন্য টাকাকে পরিবর্তিত করে জীবনধারণের উপকরণে; এটা হল তার ব্যক্তিগত পরিভোগ। সুতরাং, শ্রমিকের উৎপাদনশীল পরিভোগ এবং তার ব্যক্তিগত পরিভোগ দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রথম ক্ষেত্রে, সে কাজ করে মূলধনের সঞ্চলক শক্তি (মোটিভ পাওয়ার) হিসাবে এবং সে ধনিকের মালিকানাধীন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, সে নিজেই নিজের মালিক এবং তার প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যক কাজগুলি সম্পাদন করে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার বাইরে। একটার ফলে ধনিক বেঁচে থাকে, অন্যটার ফলে বেঁচে থাকে শ্রমিক।

শ্রম-দিবস সম্পর্কে আলোচনাকালে, আমরা দেখেছিলাম, শ্রমিককে প্রায়ই বাধ্য করা হয় তার ব্যক্তিগত পরিভোগকে উৎপাদনের কেবল একটা অনুষঙ্গ মাত্রে পরিণত করতে। এমন ক্ষেত্রে, সে নিজেকে যোগায় অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী, যাতে করে সে তার শ্রম-শত্তিকে রক্ষা করতে পারে, ঠিক যেমন স্কিম-ইঞ্জিনে যোগানো হয় জল এবং চাকায় তেল। সে ক্ষেত্রে তার পরিভোগের উপকরণ হল একটি উৎপাদন উপায়েরই প্রয়োজনীয় পরিভোগের উপকরণ; তার ব্যক্তিগত পরিভোগ সরাসরিই উৎপাদনশীল পরিভোগ। এটা, অবশ্য, প্রতীয়মান হয় একটি অনাচার হিসাবে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সঙ্গে যা মর্মগতভাবে সম্পর্কিত নয়।[৮]

বিষয়টি একটি সম্পূর্ণ অন্য চেহারা ধারণ করে, যখন আমরা একক ধনিক ও একক শ্রমিকের কথা বিবেচনা না করে, বিবেচনা করি ধনিক শ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণীর কথা; উৎপাদনের একটি বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়াকে বিবেচনা না করে, বিবেচনা করি ধনতান্ত্রিক উৎপাদনকে তার পূর্ণ মাত্রায় এবং যথার্থ সামাজিক আয়তনে। তার মূলধনের অংশ বিশেষকে শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত করে, ধনিক তার সমগ্র মূলধনের মূল্যকে বর্ধিত করে। এক ঢিলে সে দুটি পাখি মারে। শ্রমিকের কাছ থেকে যা সে পায় কেবল তা থেকেই নয়, শ্রমিককে যা সে দেয় তা থেকেও মুনাফা করে। শ্রমশক্তির বিনিময়ে যেমূলধন দেওয়া হয়, তা রূপান্তরিত হয় অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীতে, যা পরিভোগ করে বর্তমান শ্রমিকের পেশী, স্নায়ু, অস্থি, মস্তিষ্ক, পুনরুৎপাদিত হয় এবং নোতুন শ্রমিকদের জন্ম হয়। অতএব, যা কঠোরভাবে আবশ্যক তার মাত্রার মধ্যে, শ্ৰমিক-শ্রেণীর ব্যক্তিগত পরিভোগ হচ্ছে, শ্রমশক্তির বিনিময়ে মূলধনের দ্বারা প্রদত্ত জীবনধারণের উপকরণ সমূহের শোষণের উদ্দেশ্যে ধনিকের ইচ্ছানুসারে ব্যবহারের জন্য, নোতুন শ্রমশক্তিতে পুনঃরূপান্তর-সাধন। ধনিকের কাছে এত অপরিহার্য যে-উৎপাদনের উপায়টির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন, সেই উৎপাদনের উপায়টি হল স্বয়ং শ্রমিক। শ্রমিকের ব্যক্তিগত পরিভোগ, তা কর্মশালার ভিতরেই চলুক বা বাইরেই চলুক, তা উৎপাদন-প্রক্রিয়ার অংশ হোক বা না হোক, সেটা মূলধন উৎপাদনের ও পুনরুৎপাদনের একটি উপাদান রচনা করে, ঠিক যেমন ‘ক্লিনিং মেশিনারি করে থাকে, তা মেশিনারিটি যখন চালু আছে তখনি করুক, কিংবা যখন সেটি দাড়িয়ে আছে তখনি করুক। শ্রমিক তার জীবনধারণের উপায়-উপকরণ পরিভোগ করে ধনিকের মনোরঞ্জনের জন্য নয়, নিজের প্রয়োজন-সাধনের জন্য—এই ঘটনায় কোন প্রভাব ব্যাপারটির উপরে পড়ে না। যেহেতু পশু যা খায়, তা সে উপভোগ করে; তৎসত্ত্বেও একটি ভারবাহী পশু কর্তৃক খাদ্যের পরিভোগ উৎপাদন-প্রক্রিয়ার একটি প্রয়োজনীয় বিষয়ই থেকে যায়। শ্রমিক শ্রেণীর ভরণ-পোষণ ও পুনরুৎপাদন মূলধনের পুনরুৎপাদনের জন্য এখনো আছে একটি আবশ্যক শর্ত এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু ধনিক তা নির্ভাবনায় শ্রমিকদের আত্ম সংরক্ষণের ও প্রজননের প্রবৃত্তির উপরে ছেড়ে দিতে পারে। ধনিক যার জন্য মাথা ঘামায় তা হল শ্রমিকের ব্যক্তিগত পরিভোগকে নিতান্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির যথাসম্ভব নূ্যনতম মাত্রায় নামিয়ে আনা, এবং যে পাশবিক দক্ষিণ আমেরিকাবাসীরা তাদের এমিকদের অপুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের তুলনায় বরং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে বাধ্য করে, তাদের চেয়ে সে অনেক দূরে থাকে।[৯]

অতএব, ধনিক এবং তার ভাবাদর্শগত প্রতিনিধি তথা অর্থনীতিক উভয়েই শ্রমিকের ব্যক্তিগত পরিভোগের সেই অংশকে উৎপাদনশীল বলে গণ্য করে, যা সেই শ্রেণীর নিত্য স্থায়িত্বের জন্য আবশ্যক, এবং যা অবশ্যই সুনিশ্চিত করতে হবে যাতে করে ধনিক তার পরিভোগর জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তি পেতে পারে; সেই অংশের বাইরে শ্রমিক নিজের আনন্দের জন্য যা পরিভোগ করে, তাই অনুৎপাদনশীল পরিভোগ।[১০] যদি মূলধনের সঞ্চয়নের ফলে মূলধন কর্তৃক শ্রমশক্তির পরিভোগ বৃদ্ধি না পেয়ে, মজুরিতে বৃদ্ধি এবং শ্রমিকের পরিভোগ বৃদ্ধি ঘটত, তা হলে অতিরিক্ত মূলধনটি পরিভুক্ত হত অনুৎপাদনশীল ভাবে।[১১] বস্তুত শ্রমিকের ব্যক্তিগত পরিভোগ তার পক্ষে অনুৎপাদন শীল, কেননা তা অভাবী ব্যক্তিটিকে ছাড়া আর কিছুই পুনরুৎপাদন করে না; এটা ধনিকের পক্ষে এবং রাষ্ট্রের পক্ষে উৎপাদনশীল, কেননা তাদের সম্পদ উৎপাদন করে যে-শক্তি, এটা সেই শক্তিকেই উৎপাদন করে। [১২]

সুতরাং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে, শ্রমিক-শ্রেণী, এমনকি যখন সে শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ভাবে নিযুক্ত না-ও থাকে, তখনো সে শ্রমের মামুলি উপকরণগুলির মতই মূলধনের একটি স্বরূপ। এমনকি তার ব্যক্তিগত পরিভোগও, কয়েকটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে, উৎপাদন-প্রক্রিয়ার একটি উপাদান মাত্র। সেই প্রক্রিয়াটি অবশ্য বিশেষ দৃষ্টি রাখে যাতে করে এই আত্ম-সচেতন উপকরণগুলি তাকে পথে না বসায়, কারণ তা তাদের উৎপন্ন দ্রব্য তৈরি হবার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে তাদের মেরু থেকে একেবারে বিপরীত মেরুতে, মূলধনের মেরুতে অপসারিত করে। এক দিকে, ব্যক্তিগত পরিভোগ তাদের ভরণ-পোষণ ও পুনরুৎপাদনের সংস্থান করে; অন্য দিকে তা জীবন-ধারণের অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর বিনাশ ঘটিয়ে শ্রমের বাজারে শ্রমিকের ক্রমাগত পুনরাবির্ভাবকে নিশ্চয়ীকৃত করে। রোমে ক্রীতদাসকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত; মজুরি-শ্রমিক

তার মালিকের সঙ্গে বাঁধা থাকে অদৃশ্য সুতোয়। স্বাধীনতার একটা বাহ্যিক রূপ সব। সময়েই সামনে বজায় রাখা হয় নিয়োগকর্তাদের নিরন্তর পরিবর্তনের মাধ্যমে এবং একটি চুক্তির আইনগত ছলনার মাধ্যমে।

অতীত কালে, যখনি দরকার পড়ত, তখনি মূলধন স্বাধীন শ্রমিকের উপৰে তার স্বত্বাধিকার বলবৎ করার জন্য আইনের আশ্রয় নিত। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ১৮১৫ সাল পর্যন্ত, ইংল্যাণ্ডে মেশিন-তৈরির কারখানায় নিযুক্ত মেকানিকদের দেশান্তরে গমন নিষিদ্ধ ছিল; নিষেধ ভাঙলে কঠোর দুর্ভোগ ও শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।।

শ্রমিক শ্রেণীর পুনরুৎপাদনের সঙ্গে যায় সঞ্চিত দক্ষতা, যা হস্তান্তরিত হয় এক প্রজন্ম থেকে অন্য এক প্রজন্মে।[১৩] উৎপাদনের উপাদানগুলির মধ্যে এই দক্ষতাসম্পন্ন শ্রেণীর অস্তিত্বকে গণ্য করা হবে, তা একান্ত ভাবেই তার অধিকারভুক্ত; এবং কতটা মাত্রায় সে তাকে কার্যত গণ্য করে তার অস্থির মূলধনের সার-সত্তা হিসাবে, তা বোঝ যায় তখনি, যখন কোন সংকট-মুহূর্তে তাকে হারাবার আশংকা দেখা দেয়। এটা সুপরিজ্ঞাত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের ফলে এবং তজ্জনিত তুলা-দুর্ভিক্ষের দরুন, ল্যাংকাশায়ারের বেশির ভাগ তুল-কল-কমী কর্মচ্যুত হয়েছিল। যেমন স্বয়ং শ্রমিক শ্রেণী থেকে তেমন সমাজের অন্যান্য স্তর থেকেও দাবি উঠল রাষ্ট্রীয় সাহায্য বা স্বেচ্ছা মূলক জাতীয় চাঁদা-সংগ্রহের জন্য, যাতে করে বাড়তি কর্মীরা বিভিন্ন উপনিবেশে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে সক্ষম হয়। তার পরে, ১৮৬৩ সালের ২৪শে মার্চ “টাইমস পত্রিকা এডমণ্ড পটার নামে ম্যাঞ্চেস্টার বণিক সমিতির এক প্রাক্তন সভাপতির একটি চিঠি প্রকাশ করে। এই চিঠিটিকে কমন্স সভায় সঠিক ভাবেই কল-মালিকদের ইশতাহার[১৪] বলে অভিহিত করা হয়েছিল। আমরা এখানে ঐ চিঠিটি থেকে কয়েকটি নমুনা-সূচক অনুচ্ছেদ উপহার দিচ্ছি, যেগুলিতে শ্রমশক্তির উপরে মূলধনের স্বত্বা ধিকারকে নিলজ্জ ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে।

“তাকে ( কর্মচ্যুত লোকটিকে): এ কথা বলা যেতে পারে যে, তুলো-শ্রমিকদের সরবরাহ অতিরিক্ত বেশি এবং অবশ্যই : বস্তুত পক্ষে, এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস করা দরকার, এবং তা হলেই, সম্ভবত বাকি দুই-তৃতীয়াংশের জন্য একটা সুস্থ চাহিদার সৃষ্টি হবে। : জনমত : দাবি তুলেছে দেশান্তরের সমর্থনে মালিক কখনো স্বেচ্ছায় চাইবো। যে তার শ্রমের সরবরাহ স্থানান্তরিত হোক; তিনি ভাবতে পারেন, এবং সম্ভবত ন্যায় সঙ্গত ভাবেই ভাবতে পারেন যে, এটা ভুল এবং মন্দ উভয়ই। কিন্তু যদি সরকারি অর্থ ব্যয় করা হয় দেশান্তরকে সাহায্য করতে, তা হলে তার কথা শোনানোর এবং, সম্ভবত প্রতিবাদ জানানোরও অধিকার আছে।” মিঃ পটার তার পরে দেখান তুলা শিল্প কত উপকারী, কি ভাবে এই শিল্প টেনে এনেছে আয়াল্যাণ্ড এবং কৃষি-প্রধান জেলাগুলি থেকে উদ্বও জনসংখ্যা”, কত বিপুল এর বিস্তার, কিভাবে ১৮৬০ সালে তা ইংল্যাণ্ডের মোট রপ্তানির ৫/১৩ ভাগের যোগান দিয়েছিল, এবং কি ভাবে কয়েক বছর পরেই বাজারের বিশেষ করে, ভারতের বাজারের সম্প্রসারণের ফলে এবং পাউণ্ড প্রতি ৬ পেলে তুলোর প্রচুর সরবরাহের দৌলতে এই শিল্পের আবার প্রসার ঘটবে। তিনি বলে চলেন, “কিছু দিন গেলে এক, দুই বা তিন বছর পরে এমনও হতে পারে যে তা উক্ত পরিমাণটাই উৎপাদন করবে। তা হলে, যে প্রশ্নটি আমি রাখব, তা এই শিল্পটিকে কি টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে? মেশিনাৰিটাকে (তিনি বোঝাচ্ছেন জীবন্ত শ্রম-যন্ত্রটিকে) সঠিক অবস্থায় রাখার কি কোন মূল্য আছে, ওটাকে বিদায় দেওয়া কি সবচেয়ে প্রকাণ্ড বোকামো হবে না? আমি মনে করি, হবে। আমি মানি যে, শ্রমিকেরা সম্পত্তি নয়, ল্যাংকাশায়ার আর তার মালিকদের সম্পত্তি নয়, কিন্তু তারা দুয়েরই শক্তি, তারা হল এমন মানসিক ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শক্তি যাকে এক প্রজন্মের জন্যও প্রতিস্থাপিত করা যায় য়া; যে-মেশিনারি দিয়ে তারা কাজ করে, তার বেশির ভাগটাই সুবিধাজনক ভাবে বানো মাসের মধ্যেই প্রতিস্থাপিত করা যায়, উন্নীত করা যায়। [১৫] শ্রমকারী শক্তিকে দেশান্তরে যেতে উৎসাহ দিন বা অনুমতি দিন (!), কিন্তু ধনিকের কি হবে? শ্রমিকের সেরা অংশকে নিয়ে নিন, এবং স্থিতিশীল মূলধনের দারুণ মাত্রায় অপচয় হবে; পরিবর্তনশীল মূলধন অপকৃষ্ট শ্রমের অপ্রতুল সরবরাহের সঙ্গে সংগ্রামে নিজেকে নিয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে। আমাদের বলা হয়, শ্রমিকেরা এটা (দেশান্তরে যাওয়াটা) চায়। খুবই স্বাভাবিক যে, তারা তা চাইবে।”তার শ্রমকারী শক্তিকে সরিয়ে নিয়ে এবং তাদের মজুরি-ব্যয় কমিয়ে দিয়ে, ধরা যাক, ৫ ভাগ বা ৫০ লক্ষ করে দিয়ে তুলো-শিল্পকে কমিয়ে আনুন, চেপে ছোট করুন, এবং দেখুন, উপরের শ্ৰেণীটির, ঘোট দোকানীদের কি হয়; এবং খাজনা, বাসা-ভাড়ার কি হয়। আরো উপরের দিকে ছোট কৃষক, ভাল গৃহস্থ এবং জমি-মালিক পর্যন্ত ফলাফলগুলি অনুসরণ করুন, এবং তারপরে, বলুন যে, তার উপাদানকারী জনসংখ্যার সবচেয়ে সেরা অংশকে রপ্তানি করে দিয়ে এবং তার সর্বাপেক্ষা উৎপাদনশীল মূলধন ও বৃদ্ধি-সাধনের মূল্যকে ধ্বংস করে দিয়ে জাতিকে পঙ্গু করে দেবার জন্য এর চেয়ে বেশি আত্মঘাতী আর কোনো সুপারিশ হতে পারে কি? আমি সুপারিশ করি একটি ঋণ (৫০ বা ৬০ লক্ষ স্টালিং এর মত)—দুই বা তিন বছরের মেয়াদে বিস্তৃত—অন্ততঃ ঋণগ্রহীতাদের নৈতিক মান উন্নত রাখার উদ্দেশ্য বিশেষ আইন-প্রণয়নের দ্বারা তাদের উপরে বাধ্যতামূলক ভাবে কোন বৃত্তি বা শ্রমের আরেপ, তুলা-প্রধান জেলাগুলির ‘গার্ডিয়ান-বোর্ড’গুলির সঙ্গে সংযুক্ত স্পেশাল কমিশনারদের উপরে সমগ্র ব্যবস্থাটির প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ। একটা সমগ্র প্রদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রমিকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করা এবং সংখ্যা-সংকোচন মূলক দেশান্তর-গমনে উৎসাহ দান, মূলধন ও মূল্যের হ্রাস-সাধন ইত্যাদির দ্বারা বাকিদের মধ্যে অনাস্থা ও নৈরাশ্য সৃষ্টি করার তুলনায় জমি-মালিক ও কল-মালিকদের পক্ষে অধিকতর ক্ষতিকারক আর কি হতে পারে?

কারখানা মালিকদের মনোনীত মুখপাত্র পটার দু ধরনের “মেশিনারি”-র মধ্যে পার্থক্য করেন, যে-দুটির প্রত্যেকটিরই মালিক হচ্ছে ধনিক এবং যাদের মধ্যে একটি থাকে কারখানায় এবং অন্যটি রাতের বেলায় ও রবিবারে থাকে কারখানার বাইরে কুঁড়ে ঘরে। একটি নির্জীব, অন্যটি সজীব। নির্জীব মেশিনারিটি দিনের পর দিন কেবল ক্ষয় প্রাপ্ত ও অবচিতই হয় না, নিরন্তর কারিগরি অগ্রগতির দরুন তার একটা বড় অংশ এত অথব হয়ে পড়ে যে, তাকে কয়েকমাস পরে অবসর দিয়ে তার বদলে নোতুন মেশিনারি বসানো ভাল। অপর পক্ষে সজীব মেশিনারিটি কিন্তু যত দিন যায় তত আরো ভাল হয়, এবং সেই অনুপাতে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে হস্তান্তরিত করার দক্ষতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এই তুলো-নবাবের জবাবে ‘টাইমস পত্রিকা যা বলে তা এই :

“তুলো-মালিকদের অসাধারণ ও অদ্বিতীয় গুরুত্ব সম্পর্কে মিঃ পটার এত আস্থাবান যে, এই শ্রেণীটিকে রক্ষা করতে এবং তাদের বৃত্তিটিকে নিত্যস্থায়ী করতে তিনি চান শ্রমিক শ্রেণীর পাঁচ লক্ষ লোককে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি নৈতিক কর্ম-নিবাসে আবদ্ধ করে রাখতে। মিঃ পটার প্রশ্ন করেন শিল্পটিকে কি টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে? উত্তরে আমরা বলি, “নিশ্চয়ই আছে, সমস্ত সাধু উপায়ে। তিনি আবার প্রশ্ন করেন, ‘মেশিনারিটিকে সঠিক অবস্থায় রাখার কি কোন মূল্য আছে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাদের দ্বিধা আছে। মেশিনারি বলতে মিঃ পটার বোঝাচ্ছেন মনুষ্যরূপ মেশিনারিটিকে, কেননা তার পরেই তিনি বলেছেন যে, তিনি তাদের সর্বতোভাবে সম্পত্তি হিসাবে, ব্যবহার করতে চান না। আমরা স্বীকার করছি, মনুষ্য-রূপ মেশিনারিটিকে সঠিক অবস্থায় রাখার অর্থাৎ যত দিন তার প্রয়োজন না হয়, তত দিন তাকে বন্ধ করে রাখার ও তেল দেবার কোন মূল্য আছে’ বলে, বা তা করা সম্ভব বলে, আমরা মনে করিনা। কর্মহীন অবস্থায় থাকলে মনুষ্য-রূপ মেশিনারি অবশ্যই মরচে ধরবে, যতই তাকে তেল দিন আর মাজাঘষা করুন না কেন। তা ছাড়া, মনুষ্য-মেশিনারি, যেমন আমরা সদ্য সদ্য দেখেছি, আপনা-আপনিই বাম্পায়িত হয়ে উঠবে, এবং হয়, ফেটে পড়বে বা আমাদের বড় বড় শহরগুলিকে তছনছ করে দেবে। যে কথা মিঃ পটার বলেন, শ্রমিকদের পুনরুৎপাদন করতে কিছু সময় লাগতে পারে, কিছু হাতের কাছে মেশিন-বিদ ও ধনিক সুপ্রাপ্য হওয়ায়, আমরা সব সময়েই এমন সমস্ত মিতব্যয়ী, সংকল্পবদ্ধ ও পরিশ্রমী ব্যক্তিকে পেতে পারি, যাদের সাহায্যে আমরা চিরকালের প্রয়োজনের চেয়েও বেশিসংখ্যক কারখানা মালিক চটপট তৈরি করে নিতে পারি। মিঃ পটার এক, দুই বা তিন বছরের মধ্যে শিল্প-পুনর্জাগরণের কথা বলেন এবং তিনি আমাদের অনুরোধ করেন যেন আমরা শ্রমকারী শক্তিকে দেশান্তর গমনে উৎসাহ বা অনুমতি না দিই। তিনি বলেন, এটা খুবই স্বাভাবিক যে শ্রমিকেরা দেশান্তরে যেতে চাইবে; কিন্তু তিনি মনে করেন যে, তাদের ইচ্ছা সত্বেও জাতির কর্তব্য হবে এই ৫ লক্ষ কর্মীকে তাদের ৭ লক্ষ পোয় সহ তুলে-প্রধান জেলাগুলিতে আটক করে রাখা এবং তার পরিণাম হিসাবে, তিনি। নিশ্চয়ই মনে করেন যে, জাতীয় কর্তব্য হবে বল প্রয়োগ করে তাদের বিক্ষোভকে দমন করা এবং ভিক্ষা দিয়ে তাদের জীইয়ে রাখা—কেননা দৈবক্রমে একদিন তুলো-মালিকরা তাদের চাইতে পারে। সময় হয়ে গিয়েছে, যখন এই দ্বীপপুঞ্জের জনমতের সক্রিয় হওয়া। উচিত এই শ্রমকারী শক্তিকে ওদের হাত থেকে বাঁচাবার, যারা এই শক্তির সঙ্গে এমন ভাবে ব্যবহার করতে চায়, যেমন তারা করে থাকে লোহা আর কয়লা আর তুলোর সঙ্গে।”

‘টাইমস’ পত্রিকার নিবন্ধটি কেবল একটি jeu desprit’। বস্তুত পক্ষে, বিপুল জনমত ছিল মিঃ পটার-এর এই মতের সমর্থক যে, কারখানা-কর্মীরা হল কারখানার অস্থাবর উপকরণাদির অংশবিশেষ। সুতরাং তাদের দেশান্তর-গমন নিবারণ করা হল।[১৬] তুলো-প্রধান জেলাগুলিতে “নৈতিক কর্মভবনে তালাবদ্ধ করা হল, এবং, আগের মত, এখনো তারা থেকে গেল ল্যাংকাশায়ারের তুলো-কলমালিকদের “শক্তি”-স্বরূপ।

অতএব, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন নিজ থেকেই শ্রমশক্তি এবং শ্রম-উপকরণের মধ্যে বিচ্ছেদের পুনরুৎপাদন করে। এইভাবে তা শ্ৰমিক-শোষণের অবস্থাটির পুনরুৎপাদন ও নিত্যসাধন করে। তা শ্রমিককে অবিরাম বাধ্য করে বেঁচে থাকবার জন্য তার শ্রম শক্তিকে বিক্রি করতে এবং ধনিককে সক্ষম করে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলবার জন্য সেই শ্রম-শক্তি ক্রয় করতে। [১৭]ধনিক এবং শ্রমিক যে বাজারে পরস্পরের মুখোমুখি হয়, সেটা একটা আপতিক ঘটনা নয়। স্বয়ং প্রক্রিয়াটিই শ্রমিককে তার শ্রমশক্তির ফেরিওয়ালা হিসাবে অবিরাম বাজারে ছুড়ে দেয় এবং তার নিজের উৎপন্ন ফলকে এমন একটি উপায়ে রূপান্তরিত করে, যার দ্বারা আর একজন ব্যক্তি তাকে ক্রয় করতে পারে। তার অর্থ নৈতিক দাসত্বের কারণ,[১৮] নিজেকে পালাক্রমে বেচে দেওয়া তার মালিকের অদল বদল হয়া, এবং শ্রমশক্তির বাজার-দরে ওঠা-নামার এই ঘটনাগুলি এবং আবার তা ঢেকে রাখারও আবরণ।[১৯]

অতএব, একটি অবিচ্ছিন্ন সুসংবদ্ধ প্রক্রিয়ার, পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়ার আকৃতিতে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন কেবল পণ্য সামগ্রীই উৎপাদন করে না; তা সেই সঙ্গে ধনতান্ত্রিক সম্পর্কও উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে। এক দিকে ধনিক এবং অন্য দিকে শ্রমিক।[২০]

————

১. Mais ces riches, qui consomment les produits du travail des autres, ne peuvent les obtenir que par des echanges [ purchases of commodities ). S’ils donnent cependant leur richesse acquise et accumulee en retour contre ces produits nouveaux qui sont l’objet de leur fantaisie, ils semblent exposes a epuiser bientot leur fonds de reserve; ils ne travaillent point, avor s-nous dit, et ils ne peuvent meme travailler; on croirait donc que chaque jour doit voir dimi nuer leurs vieilles richesses, et que lorsqu’il ne leur en restera plus, rien ne sera offert en echange aux ouvriers qui travaillent exclusi vement pour eux … Mais dans l’ordre social, la richesse a acquis la propriete de se reproduire par le travail d’autrui, et sans que son proprietaire y concoure. La richesse, comme le travail, et par le travail, donne un fruit annuel qui peut etre detruit chaque annee sans que le riche en devienne plus pauvre. Ce fruit est le revenu qui nait du capital.” (Sismondi : “Nouv. Princ. d’Econ. Pol.” Paris, 1819, t. I, pp. 81.82. )

২. ‘মজুরি এবং মুনাফা—এই দুটি প্রত্যেকটিকেই বিবেচনা করতে হবে তৈরি উৎপন্ন সামগ্রীর সত্য সত্যই একটি করে অংশ হিসাবে।’ (ব্যামসে, ঐ, পৃঃ ১৪২)। “উৎপন্ন সামগ্রীর যে অংশ শ্রমিকের কাছে আসে মজুরির আকারে। (জে. মিল, এলিমেন্টস’, ইত্যাদি, প্যারিশট কর্তৃক অনূদিত, প্যারিস, ১৮২৩, পৃঃ ৩৪।

৩. যখন মূলধন নি:গ করা হয় শ্রমিককে তরি মজুরি আগাম দেবার জন্য, তখন তা শ্রমের ভরণ-পোষণের ভারে কিছুই যোগ করে না। (কাজেনে”ভ, ম্যালথাসের ‘ডেফিনিশনস ইন পলিটিক্যাল ইকনমি”-র তৎকৃত সংস্করণে নোট, লণ্ডন, ১৮৫৩, পৃঃ ২২)।

৪. পৃথিবীর শ্ৰমিকসংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরও কম ক্ষেত্রে ধনিকেরা শ্রমিকদের মজুরি আগাম দেয়। (রিচ জোন্স, টেক্সটবুক অব লেকচার্স অন দি পলিটিক্যাল ইকনমি অব নেশনস। হার্টফোর্ড, ১৮৫২, পৃঃ ৩৬)।

৫. “যদিও উৎপাদনকারীকে” (শ্রমিককে) মালিক “তার মজুরি আগাম দেয়, কিন্তু আসলে এতে মালিকের কোনো খরচ হয় না, কারণ একটা মুনাফা-সমেত এই মজুরির মূল্য সাধারণতঃ যে বিষয়টির উপরে শ্রম-অর্পিত হয়, তার উন্নীত মূল্যের মধ্যে সংরক্ষিত থাকে।” (অ্যাডাম স্মিথ, ঐ দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় অধ্যায়, পৃঃ ৩১১)।

৬. “উৎপাদনশীল শ্রমের এটা একটা উল্লেখযোগ্য স্ব-বিশেষ গুণ। যা কিছু উৎপাদনশীল ভাবে পরিভুক্ত হয়, তাই মূলধন, এবং তা পরিভোগর মাধ্যমে মূলধনে পরিণত হয়।” (জেমস মিল, ঐ, পৃঃ ২৪২)। যাই হোক, জেমস মিল, কখনো এই ‘উল্লেখযোগ্য স্ব-বিশেষ গুণটিকে অনুধাবন করতে পারেননি।

৭. এটা সত্য যে, একটা ম্যানুফ্যাকচার শুরু করতে গিয়ে প্রথম জন (ধনিক) অনেক দরিদ্রকে নিযুক্ত করে, কিন্তু তারা দরিদ্রই থেকে যায় এবং ঐ ম্যানুফ্যাকচারের চালু থাকা কালে তা আরো অনেক দরিদ্র সৃষ্টি করে। (রিজ ফর এ লিমিটেড এক্সপোর্টেশন অব উল’, লঙ্গ ১৬৭৭, পৃঃ ১৯)। কৃষি-মালিক এখন অদ্ভুত ভাবে দাবি করে যে, সে দরিদ্রদের রাখছে। বস্তুত পক্ষে তাদের রাখা হচ্ছে দুর্দশার মধ্যে। { ‘রিজনস ফর দি লেট ইনক্রিজ অব দি পুওর রেটস অল্প এ কম্প্যাটিভ ভিউ অব দি প্রাইসেস অব লেবর অ্যাণ্ড প্রভিশনস। লন, ১৭৭৩, পৃঃ ৩১)।

৮. সি এর বিরুদ্ধে এত সজোরে বাগাড়ম্বর করতেন না, যদি তিনি সত্যসত্যই ‘উৎপাদনশীল পৰিভোগ’-এর রহস্যের অন্তরে প্রবেশ করতেন।

৯. “দক্ষিণ আমেরিকার খনি-শ্রমিকদের দৈনিক কাজ (সম্ভবতঃ জগতে সবচেয়ে ভারি) হল ৪৫০ ফুট গভীর থেকে কাঁধে করে ১৮০ থেকে ২০০ পাউণ্ড ওজনের ধাতুর বোঝা মাটির ওপরে তুলে আনা; বেঁচে থাকে রুটি আর বিন খেয়ে; তারা আহার্য হিসাবে একমাত্র রুটিই পছন্দ করে, কিন্তু মালিকেরা দেখতে পেল শুধু রুটি খেয়ে লোকগুলি অত কঠোর পরিশ্রম করতে পারে না, তাই তাদেরকে ঘোড়। হিসাবে গণ্য করে বাধ্য করে বিন খেতে; রুটির চেয়ে বিন ফসফেট-অব-লাইমে বেশি সমৃদ্ধ।” (লাইবিগ, ঐ, খণ্ড ১, পৃঃ ১৯৪, টীকা)

১০. জেমস মিল, ঐ, পৃঃ ২৩৮।

১১. যদি শ্রমের দাম এত উচুতে ওঠে যে, মূলধনের বৃদ্ধি সত্ত্বেও, আর বেশি নিযুক্ত করা যায় না, তা হলে আমি বলব যে, মূলধনে এই বৃদ্ধি তখনো অনুৎপাদনশীল ভাবে পরিভুক্ত হবে। ( রিকার্ডো, ঐ, পৃঃ ১৬৩)।

১২. যথাযথ অর্থে উৎপাদনশীল পরিভোগ হল পুনরুৎপাদনের উদ্দেশ্যে ধনিকদের দ্বারা সম্পদের পরিভোগ বা ধ্বংস সাধন।” যথাযথভাবে বললে শ্রমিক তার নিজের কাছে উৎপাদনশীল পরিভোক্তা নয়; যে ব্যক্তি তাকে নিয়োগ করে, তার কাছে এবং রাষ্ট্রের কাছে উৎপাদনশীল পরিভোক্তা। (ম্যালথাস, ডেফিনিশনস’, পৃঃ ৩০)

১৩. একমাত্র জিনিস, যে-সম্পর্কে কেউ বলতে পারেন যে আগে থেকেই সঞ্চিত ও প্রস্তুত আছে, তা হল শ্রমিকের দক্ষতা। বিপুল শ্রমিক সমষ্টির ক্ষেত্রে, দক্ষ শ্রমের সংগ্রহ ও সঞ্চয়-স্বরূপ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডটি সম্পাদিত হয় একেবারে কোন মূলধন ব্যতিরেকেই। (টমাস হজস্কিন, ‘লেবর ডিফেণ্ডেত ইত্যাদি, পৃ ১৩)।

১৪, পত্রটিকে গণ্য করা যায় কল-মালিকেদের ইশতাহার হিসাবে। (ফেরাও, ‘মোশন অন দি কটন ফেমিন, H.o.c. ২৭ এপ্রিল, ১৮৬৩)।

১৫. এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, এই একই মূলধন, সাধারণ অবস্থায়, যখন মজুরি-দ্বাসের প্রশ্ন থাকে, তখন গান করে সম্পূর্ণ ভিন্ন গান। তখন সব মালিকেরা সমন্বরে চিৎকার করে, কারখানা-কর্মীদের এ তথ্যটা ভালভাবে মনে রাখা উচিত যে তাদের শ্রম বাস্তবিক পক্ষেই একটা নিচু জাতের দক্ষ শ্রম, এর চেয়ে বেশি সহজে আয়ত্ত করা যায়, মান-অনুযায়ী এর চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পায় কিংবা সবচেয়ে স্বয় বিশেষজ্ঞের প্রশিক্ষণে এর চেয়ে বেশি তাড়াতাড়ি এবং বহুল পরিমাণে অর্জন করা যায়, এমন আর কোনো শ্রম নেই।‘মালিকের মেশিনারি’ ( যা আমরা জানি ১২ মাসের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা যায় ) বস্তুতঃ পক্ষে কর্মীর (যাকে আমরা এখন জানি, ৩০ বছরের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা যায় না) শ্রম ও দক্ষতার তুলনায় উৎপাদনের কাজে গ্রহণ করে টের বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা; কর্মীর দক্ষতা তো ছ মাসের মধ্যেই শিখে নেওয়া যায় এবং একজন মামুলি শ্রমিকই তা শিখে নিতে পারে। (এই বইয়ের পূ ৯৬, টাকা ১০ দ্রষ্টব্য)।

১৬. দেশান্তর-গমনের সাহায্যার্থে পার্লামেন্ট এক কপর্দকও অনুমোদন করেনি, পরন্তু কয়েকটি আইন পাশ করে পৌর নিয়মগুলিকে ক্ষমতা দান করল কর্মীদের অর্ধাহারে রাখতে অর্থাৎ চতি মজুরিরও কম মজুরিতে তাদের শোষণ করতে। অন্য দিকে, যখন তিন বছর পরে, গবাদি পশুর ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটল, পার্লামেন্টে চলতি রীতিনীতি বেপরোয়া ভাবে ভাঙচুর করে কোটিপতি জমিদারদের ক্ষতিপূরণের জন্য সরাসরি কোটি কোটি পাউণ্ড মঞ্জুর করল, যাদের জোত-মালিকেরা অবশ্য মাংসের দাম বেড়ে যাবার দৌলতে বিনা লোকমানেই বেরিয়ে এসেছিল। ১৮৬৬ সালে পার্লামেন্টের উদ্বোধনে জমির মালিকদের বৃষসুলভ হারবে বোঝা গেল হিন্দু না হয়েও কেউ গাভী ‘সবলা’-কে পূজা করতে পারে এবং জুপিটার না হয়েও কেউ নিজেকে ষাঁড়ে রূপান্তরিত করতে পারে।

১৭. “L’ouvrier demandait de la subsistence pour vivre, le chef demandait du travail pour gagner.” (Sismondi, 1.c. p. 91).

১৮. এই দাসত্ব-বন্ধনের একটা কদর্য নোংরা রূপ দেখা যায় ডারহাম-কাউন্টিতে। অল্প যেকটি কাউন্টিতে উপস্থিত অবস্থাবলীর দরুন কৃষি-মালিক এখনো এখনো কৃষি এমিকের উপরে অবিসংবাদিত স্বত্বাধিকার অর্জন করতে পারেনি, এই কাউন্টি তাদের মধ্যে একটি। খনি-শিল্পের অস্তিত্বের কল্যাণে শ্রমিকদের এখনো কিছু বাছ-বিচারের সুযোগ আছে। এই কাউন্টিটিতে, কৃষি-মালিক, অন্যত্র যে-রীতি চালু আছে তা থেকে বিপরীত ভাবে, এমন কৃষি-জোতের বন্দোবস্ত নেয়, যেগুলিতে শ্রমিকদের কুটির আছে। কুটিরের ভাড়া মজুরির একটা অংশ। এই কুটিরগুলিকে বলা হয় মজুরঘর।

এগুলি শ্রমিকদের ভাড়া দেওয়া হয় বণ্ডেজ’ নামে এক চুক্তির (দাসখৎ’-এর অধীনে–কিছু সামন্ততান্ত্রিক সেবা-সুবিধার বিবেচনায়; এই চুক্তির অন্যান্য শর্তের মধ্যে একটি শত শ্রমিককে বেঁধে রাখে এই বাধ্যবাধকতায় যে সে যখন অন্যত্র কাজে যাবে, তখন সে তার বদলে কাউকে, যেমন মেয়েকে রেখে যাবে তার জায়গা পূরণ করতে। খোদ শ্রমিকটিকে বলা হয় বণ্ড সম্যান’ (খৎবাঁধা মজুর)। এখানে যে-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতে প্রকাশ পায় কিভাবে শ্রমিকের দ্বারা ব্যক্তিগত পরিভোগ পরিণত হয় মূলধনের পক্ষ থেকে পরিভোগ—কিংবা উৎপাদনশীল পরিভোগ, সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিকোণ থেকে : “এটা খুবই অদ্ভুত যে, এই খৎবাঁধা মজুরদের বিষ্ঠা পর্যন্ত হিসেবী প্রভুটির পাওনা এবং প্রভুটি একমাত্র নিজেরটি ছাড়া আর কোনো পায়খানা ত্রিসীমানায় করতে দেয় না; বরং এখানে সেখানে কোন বাগানের জন্য একটু-আধটু সার দেবে কিন্তু তার সামন্ততান্ত্রিক অধিকারের কোনো অংশ ছেড়ে দেবে না।” (জনস্বাস্থ্য, সপ্তম রিপোর্ট, ১৮৬৪, পৃঃ :৮৮)।

১৯. এটা ভুললে চলবে না যে, শিশুদের শ্রমের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছামূলক বিক্রয়ের আনুষ্ঠানিক রূপটি পর্যন্ত উধাও হয়ে যায়।

২০. মূলধন ধরে নেয় মজুরিশ্রমের অস্তিত্ব এবং মজুরি-শম ধরে নেয় মূলধনের অস্তিত্ব। একটি অপরটির অস্তিত্বের আবশ্যিক শর্ত; তারা পরস্পরকে ডেকে আনে সহাবস্থানে। তুলো-কারখানার শ্রমিক কি তুলো-জাত দ্রব্যাদি ছাড়া আর কিছুই উৎপাদন করে না? না, সে উৎপাদন করে মূলধন। সে উৎপাদন করে মূল্যসম্ভার, যা তার শ্রমের উপরে দেয় নতুন কর্তৃত্ব এবং যা এই কর্তৃত্বের মাধ্যমে সৃষ্টি করে নোতুন মূল্যসম্ভার।” (কার্ল মার্কস : “Lohnarbeit und Kapital” : “Neue Rheinische Zeitung, No 266, ৭ই এপ্রিল, 1894) উক্ত পত্রিকায় উল্লিখিত শিবোনামায় যে-প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলি ১৮৪৭ সালে জার্মান Arbeiter. Verein’-এ প্রদত্ত কয়েকটি বক্ততার অংশ; ফেব্রুয়ারি-বিপ্লবের জন্য ঐ বক্তৃতাগুলির প্রকাশনা বাধাপ্রাপ্ত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *