চতুর্দশ অধ্যায় — শ্রম বিভাগ ও ম্যানুফ্যাকচার
প্রথম পরিচ্ছেদ — ম্যানুফ্যাকচারের দ্বিবিধ উৎপত্তি
শ্রম-বিভাগের উপরে যে সহযোগের ভিত্তি, ম্যানুফ্যাকচারে তার প্রতিভূ-রূপ ধারণ করে এবং ম্যানুফ্যাকচারের যুগ’ বলতে সঠিক ভাবে যে যুগটিকে অভিহিত করা যায়, সেটা গোটা যুগটি জুড়ে তা থাকে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রক্রিয়ার চরিত্র-রূপ। মোটামুটি ভাবে বলা যায়, যোড়শ শতকের মধ্য ভাগ থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতকের শেষ তৃতীয় ভাগ পর্যন্ত এইযুগের বিস্তৃতি।
ম্যানুফ্যাকচারের উদ্ভব ঘটে দুভাবে : (১) একটি মাত্র কর্মশালায় একজন মাত্র ধনিকের নিয়ন্ত্রণে নানাবিধ আলাদা আলাদা হস্তশিল্পের অন্তর্গত কারিগরদের সমাবেশ সম্পূর্ণ হতে হলে কোন জিনিসকে অবশ্যই এই কারিগরদের হাত দিয়ে পার হতে হবে। যেমন, একটি শকট অতীতে ছিল বহুসংখ্যক আলাদা আলাদা কারিগরের শ্রমের ফল, যথা হইলরাইট’ (যারা চাকা বানায়), হারনেস-মেকার’ ( যারা পশুটির সাজ-সরঞ্জাম তৈরি করে), টেইলর (যারা দর্জির কাজ করে ), লক-স্মিথ (যারা তালা-চাবি ইত্যাদি বানায় ), আপহলস্টার (যারা ভিতরের গদি-সাজসজ্জা ইত্যাদি তৈরি করে), “টার্নার (যারা কুঁদ বা খরাদের কাজ করে ), ‘ফ্রিঞ্জ-মেকার (যারা ঝালর বানায়, ‘গেডিয়ার (যারা কঁচ বসায় ), ‘পেইন্টার (যারা রঙের কাজ করে ), ‘পলিশার (যারা পালিশের কাজ করে ), গিভার (যারা গিলটি করে) ইত্যাদি ইত্যাদি। শকট-ম্যানুফ্যাকচারের কাজে কিন্তু এই সমস্ত কারিগর একই বাড়িতে সমবেত হয়। যেখানে তারা পরস্পরের হাত থেকে হাতে কাজ করে। এটা ঠিক যে, একটি শকট তৈরি হয়ে যাবার আগে সেটাকে গিটি করা যায় না। তবে একসঙ্গে যদি অনেকগুলি শকট তৈরি করা হয়, তা হলে কয়েকটি যখন গিটিকারদের হাতে, তখন কয়েকটি ‘আবার পূর্ববর্তী কোন এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পার হচ্ছে। এতদূর পর্যন্ত আমরা এখনো রয়েছি সরল সহযোগের পর্যায়ে, যে পর্যায়ে মাল-মশলাগুলি মানুষ ও জিনিসের আকারে হাতের কাছেই প্রস্তুত থাকে। কিন্তু অচিরেই ঘটে যায় এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। দরজি, তালা-মিস্ত্রি প্রভৃতিরা একমাত্র শকটের কাজেই একান্ত ভাবে নিযুক্ত, থাকায় তাদের প্রত্যেকেই অভ্যাসের অভাবে নিজ নিজ পুরনো হস্তশিল্পটি পুরোপুরি ভাবে সম্পাদন করার সামর্থ্য ক্রমে ক্রমে হারিয়ে ফেলে। কিন্তু অন্যদিকে, এখন তার কাজকর্ম একটি ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়ায়, তা ধারণ করে এমন একটি রূপ যা এই সংকীর্ণ কর্মপরিধির সঙ্গে সবচেয়ে বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ। ধাপে ধাপে শকট তৈরির কাজটি তার বিভিন্ন প্ৰত্যংশ-প্রক্রিয়ায় বিভক্ত হয়ে যায়, তাদের প্রত্যেকটি আবার পরিণতি লাভ করে এক-একজন বিশেষ কারিগরের একান্ত কাজ হিসাবে, সমগ্র ভাবে ম্যানুফ্যাকচারটি সম্পাদিত হয় সম্মিলিত ভাবে বহু লোকের দ্বারা। এই একই ভাবে একজন মাত্র ধনিকের নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন হস্তশিল্পের সংযোজনের মাধ্যমেই কাপড় তৈরির মত আরো একগাদা জিনিসের ম্যানুফ্যাকচারের উদ্ভব ঘটে।[১]
(২) উল্লিখিত প্রক্রিয়ার ঠিক বিপরীত প্রক্রিয়াতেও ম্যানুফ্যাকচারের উদ্ভব ঘটে, যেমন, কাগজ, হরফ বা সুচ তৈরির মত একই কাজ বা একই ধরনের কাজ করে, এমন বহুসংখ্যক কারিগরকে একই কারখানায় একজন মাত্র ধনিকের দ্বারা নিয়োগের প্রক্রিয়ায়। এটা হচ্ছে সবচেয়ে সরল ধরনের সহযোগ। এই কারিগরদের প্রত্যেকে (সম্ভবত দু-একজন শিক্ষানবিশের সাহায্য নিয়ে গোটা জিনিসটিকে তৈরি করে এবং স্বভাবতই সেই জিনিসটি উৎপাদন করতে যেসব প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়, সেগুলি সে একাই পরপর সম্পাদন করে। সে কাজ করে তার পুরনো হস্তশিল্পেরই কায়দায়। কিন্তু অতি শীগ্রই বাইরের ঘটনাবলী একই জায়গায় বহুসংখ্যক কর্মীর এই সমাবেশকে এবং তাদের কাজের এই যুগপৎ সম্পাদনকে অন্য একটি কাজে ব্যবহার করতে বাধ্য করে। হয়তো একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য জিনিসটির একটি বাড়তি পরিমাণ যোগাতে হবে। সুতরাং কাজটির পুনর্বণ্টন করা হয়। প্রত্যেকটি লোককে পরপর সব কটি প্রক্রিয়া না করতে দিয়ে, এই প্রক্রিয়াগুলিকে বিচ্ছিন্ন খণ্ড খণ্ড প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত করা হয় যেগুলি সম্পাদিত হবে পাশাপাশি; এক একটি খণ্ড প্রক্রিয়ার ভার দেওয়া হয় এক-একজন কর্মীকে এবং গোটা কাজটি যুগপং সম্পাদিত হয় পরস্পর-সহযোগী কর্মীদের দ্বারা। এই আপতিক পুনর্বণ্টন পুনরাবর্তিত হয়; নোতুন সুবিধার উদ্ভব ঘটায় এবং কালক্রমে সুব্যবস্থিত শ্ৰম-বিভাগে দৃঢ় রূপে পর্যবসিত হয়। পণ্যটি আর কোন একজন স্বতন্ত্র কারিগরের ব্যক্তিগত ম-ফল না থেকে, একটি কারিগর-সমষ্টির সামাজিক ম-ফলে পরিণত হয়, ঐ কারিগরদের এক-একজন যার এক-একটি আংশিক প্রক্রিয়া সম্পাদন। করছে। যেখানে একটি জার্মান গিল্ড-এর একজন কাগজ-নির্মাতার ক্ষেত্রে যে-প্রক্রিয়াগুলি একজন কারিগরের পরপর-করণীয় কাজ হিসাবে পরস্পরের মধ্যে মিলে যেত, সেই প্রক্রিয়াগুলিই আবার একটি ওলন্দাজ কাগজ-ম্যানুফ্যাকচারে সম্পাদিত হত বহুসংখ্যক কারিগরের দ্বারা পাশাপাশি-সম্পাদিত অনেকগুলি আংশিক প্রক্রিয়া হিসাবে। নুরেমবার্গ গিল্ড-এর সুচ নির্মাতা ছিল ভিত্তিপ্রস্তর, যার উপরে নির্মিত হয়েছিল ইংরেজ সুচ ম্যানুফ্যাকচারের সৌধ। কিন্তু সেখানে নুরেমবার্গে একজন মাত্র কারিগর সম্পাদন করত পরপর সম্ভবতঃ ২০টি প্রক্রিয়া, সেখানে ইংল্যাণ্ডে, বেশি দিন আগে নয়, ২০ জন সুচ-নির্মাতা পাশাপাশি প্রত্যেকে সম্পাদন করত ঐ ২০টি প্রক্রিয়ার মধ্যে মাত্র। একটি প্রক্রিয়া; এবং আরো অভিজ্ঞতার কল্যাণে এই ২০টি প্রক্রিয়ার প্রত্যেকেটিই আবার হল খণ্ডিত ও বিভক্ত এবং ন্যস্ত হল এক একজন আলাদা আলাদা কারিগরের একান্ত দায়িত্বে।
অতএব, যে পদ্ধতিতে ম্যানুফ্যাকচারের উদ্ভব হয়, হস্তশিল্প থেকে এর জন্ম ও বৃদ্ধি, তা দ্বিন্ধি। এক দিকে, এ উদ্ভূত হয় বিভিন্ন স্বতন্ত্র হস্তশিল্পের সম্মিলন থেকে, যে-হস্তশিল্পগুলি তাদের স্বাতন্ত্র থেকে বঞ্চিত হয় এবং এত দূর পর্যন্ত বিশেষীকৃত হয়। যে, তারা পর্যবসিত হয় একটি বিশেষ পণ্য উৎপাদনের বিবিধ পরিপূরক আংশিক প্রক্রিয়ায়। অন্য দিকে, এ উদ্ভূত হয় একটি হস্তশিল্পের কারিগরবৃন্দের সহযোগ থেকে; সেই বিশেষ হস্তশিল্পটিকে এ বিভক্ত করে বিভিন্ন প্রত্যংশ কর্মকাণ্ডে এবং তা করতে গিয়ে সেই কর্মকাণ্ডগুলিকে পরস্পর থেকে এত দূর পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র করে দেয় মে। প্রত্যেকটিই আবার হয়ে ওঠে এক একজন বিশেষ কারিগরের একান্ত কার্য। সুতরাং এক দিক থেকে, ম্যানুফ্যাকচার, হয়, একটি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রম-বিভাজন প্রবর্তন করে আর, নয়তো, শ্রম বিভাজনকে আরো বিকশিত করে; অন্য দিকে, যে সমস্ত হস্তশিল্প ইতোপূর্বে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল, সেগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে। কিন্তু এর সুচনা-বিন্দু যাই হোক না কেন, এর চুড়ান্ত রূপ অবশ্যই এক ও অভিন্ন—এমন একটি উৎপাদন-যন্ত্র যার বিভিন্ন অংশ হচ্ছে মানুষেরা।
ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাজন সম্পর্কে সঠিক ধারণা করার জন্য, নিম্নলিখিত বিষয়গুলি সম্পর্কে সুস্পষ্ট উপলব্ধি থাকা অত্যাবশ্যক। প্রথমত, পরস্পরাগত বিভিন্ন পর্যায়ে একটি উৎপাদন-প্রক্রিয়ার বিভাজন এখানে একটি হস্তশিল্পের পরম্পরাগত বিভিন্ন শারীরিক কর্মপ্রক্রিয়ার পৃথগীভবনের সঙ্গে যুগপৎ সংঘটিত হয়। জটিলই হোক আর সরলই হোক, প্রত্যেকটি কর্মপ্রক্রিয়া হাত দিয়ে করতে হবে, প্রত্যেকটিই বজায় রাখে হস্তশিল্পের চরিত্র, কাজে কাজেই প্রত্যেকটিই নির্ভর করে ব্যক্তিগত কর্মী কতটা শক্তি, দক্ষতা, ক্ষিপ্রতা ও প্রত্যয়ের সঙ্গে তার হাতিয়ারগুলি ব্যবহার করে, তার উপরে। হস্তশিল্পই কাজ করতে থাকে ভিত্তি হিসাবে। শিল্প উৎপাদনের কোন একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার সত্যকার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এই সংকীর্ণ কৃৎকৌশলগত ভিত্তির দরুণ বাঙ্গ পড়ে যায়, কেননা এটা এখনো একটা শর্ত যে, উৎপন্ন দ্রব্যটি যে সমস্ত প্রত্যংশ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পার হয়, সেগুলির প্রত্যেকটি প্রক্রিয়াকেই অবশ্যই এমন হতে হবে যে, তাকে হাতের সাহায্য সম্পাদন করা যায় এবং একটি আলাদা হস্তশিল্প হিসাবে গঠন করা যায়। এই কারণেই যেহেতু, হস্তশিল্প-সুলভ দক্ষতা এই ভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়ার ভিত্তি হিসাবে চালু থাকে, ঠিক সেই হেতুই প্রত্যেকটি কর্মীকে এক-একটি আংশিক কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তার বাকি জীবনের জন্য তার শ্রমশক্তি এই খণ্ড কাজটির উপায়মাত্রে পরিণত হয়।
দ্বিতীয়ত, এই শ্রম বিভাগ হচ্ছে এক ধরনের সহযোগ এবং এর অসুবিধাগুলির অনেকটাই উদ্ভূত হয় সহযোগের সাধারণ চরিত্র থেকে, তার এই বিশেষ রূপটি থেকে নয়।
————
১. একটি আরো আধুনিক দৃষ্টান্ত : লায়ন্স ও নাইমূস-এর রেশম সুতোকাটা ও Catati “est toute patriarcale; elle emploie beaucoup de femmes et d’enfants, mais sans les epuiser ni les corrompre; elle les laisse dans leur belles vallees de la Drome, du Var, de l’Isere, de Vaucluse, pour y elever des vers et devider leurs cocos; jamais elle p’entre dans une veritable fabrique. Pour etre aussi bien observe… le principe de la division du travail s’y revet d’un caractere special Ily a biendes devideuses des moulineurs, des teinturiers, des encolleurs, puis des tisserands; mais ils ne sont pas reunis dans un meme etablissement. ne dependent pas d’un meme maitre tous ils sontindependants.” (A. Blanqui :“Cours d’Econ. Industrielle.” Recueilli-Para. Blais. Paris, 1838-39, p. 79 )। কি একথা লেখার পর থেকে বিভিন্ন ধরনের স্বতন্ত্র শ্রমিক, কিছু মাত্রায়, বিবিধ কারখানায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। [ এবং মার্কস উল্লিখিত কথা লেখার পর থেকে, শক্তিচালিত তাঁত এই সব কারখানা আক্রমণ করেছে, এবং, এখন—১৮৬৬ সালেহস্তচালিত তাঁতকে দ্রুতবেগে স্থানচ্যুত করছে। (চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংযোজিত। এ ব্যাপারে কেড়ে রেশম শিল্পেরও কিছু বলা আছে)-এফ এঙ্গেলস ]
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ — প্রত্যংশ শ্রমিক[১] ও তার উপকরণাদি
আমরা যদি এখন আরো একটু বিশদ আলোচনায় যাই, তা হলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, একজন শ্রমিক যদি তার সাৱা জীবন একই অভিন্ন সরল সহযোগে নিযুক্ত থাকে, তা হলে তার সমগ্র দেহটি সেই কর্মপ্রক্রিয়ার একটি স্বয়ংক্রিয়, বিশেষীকৃত যকে রূপান্তরিত হয়ে যায়। কাজে কাজেই, যে কারিগরকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি গোটা প্রণালীর সব কটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়, তার চেয়ে ঐ কাজটি করতে তার অল্পতর সময় লাগে। কিন্তু যে যৌথ শ্রমিকটি হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারের জীবন্ত যন্ত্র, সে সম্পূর্ণ ভাবেই এই ধরনের বিশেষীকৃত প্রত্যাশ ( ‘ডিটেল’) শ্রমিকদের দ্বারাই গঠিত। সুতরাং স্বতন্ত্র হস্তশিল্পের তুলনায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদনের পরিমাণ হয় অধিকতর কিংবা শ্রমিকের উৎপাদিকা শক্তি হয় বর্ধিত।[২] অধিকন্তু, যখন এই ভগ্নাংশিক কাজ প্রতিষ্ঠিত হয় একজন ব্যক্তির একান্ত কার্য হিসাবে, তখন প্রযুক্ত পদ্ধতিগুলিরও উৎকর্ষ সাধিত হয়। একই সরল কাজের অবিরত পুনরাবৃত্তি এবং তার উপরে তার একান্ত মনোনিবেশ শ্রমিককে তার অভিজ্ঞতা দিয়ে শেখায় কত কম খাটুনির সাহায্যে ঈগিত ফল লাভ করা যায়। কিন্তু যেহেতু সব সময়েই কয়েক প্রজন্মের শ্রমিক একই সময়ে বাস করে এবং একটি নির্দিষ্ট দ্রব্য ম্যানুফ্যাকচারে একত্রে কাজ করে, সেইহেতু এই ভাবে অর্জিত উক্ত বৃত্তিটির কারিগরি কলাকৌশল প্রচলন লাভ করে এবং সঞ্চিত হতে হতে উত্তরাগতদের হাতে হস্তান্তরিত হয়।[৩] বাস্তবিক পক্ষে, ব্যাপক জনসমাজ হাতের কাছে প্রচলিত অবস্থায় পাওয়া, স্বাভাবিক ভাবে বিকশিত বৃত্তি-বিভাজনকে কর্মশালার অভ্যন্তরে পুনরুৎপাদিত ও ধারাবাহিক ভাবে চূড়ান্ত মাত্রায় বিকশিত করে ম্যানুফ্যাকচার প্রত্যংশ ( ‘ডিটেল’ ) শ্রমিকের দক্ষতা উৎপাদন করে। অপর পক্ষে, একজন মানুষের ভগ্নাংশিক কাজের এই আজীবন জীবিকায় রূপান্তরণে এমন একটা প্রবণতা আত্মপ্রকাশ করে, যা পূর্ববর্তী সমাজ-সমুহে বিভিন্ন বৃত্তিকে বংশানুক্রমিক করে, হয়, সেগুলিকে বিভিন্ন জাতি-বর্ণে শিলীভূত রূপদান করে আর, নয়ত, যেখানে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিস্থিতির ফলে ব্যক্তিমানসে এমন একটি প্রবণতার জন্ম হয়, যা তাকে জাতি-বর্ণের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিহীন মানসিকতায় পরিবর্তিত করে, সেখানে সেগুলিকে প্রস্তরীভৃত আকার দান করে। যে প্রাকৃতিক নিয়মটি উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বিভিন্ন প্রজাতি ও প্রকারে পৃথগীভূত হবার ঘটনাটিকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই একই নিয়মটির কার্যকারিতার ফলে জাতি ও গিল্ড-এর উদ্ভব ঘটে, তবে একটি ক্ষেত্রে ছাড়া বিকাশের একটি বিশেষ মাত্রায় উপনীত হবার পরে জাতির বংশানুক্রমিতা ও গিলতে এক-পৰ্বত নির্দেশিত, হয় সমাজের নিয়ম হিসাবে। [৪] “সূক্ষ্মতার দিক থেকে ঢাকার মসলিন, উজ্জ্বল ও অস্থায়ী, বর্ণাঢ্যতার দিক থেকে করমণ্ডলের ক্যালিকো ও অন্যান্য সামঞ্জসম্ভার আজও অনতিক্রান্ত। অথচ মূলধন, যন্ত্রপাতি, এমবিভাগ এক যেসব উপায় ইউরোপের ম্যানুফ্যাকচারকারী স্বার্থকে এত সুবিধা দিয়ে থাকে, সেসবের কোনো কিছুর সুযোগ ছাড়াই ঐ মসলিন,ক্যালিকো ইত্যাদি উৎপাদিত হয়। যে তন্তুবায় তা করে, সে একজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিমাত্ৰ; কোন ক্রেতার কাছ থেকে ফরমায়েস পেলেই কেবল সে কোনক্রমে জোড়াতালি-দেওয়া কয়েকটি ডাল বা কাঠের টুকরো দিয়ে স্কুলত ভাবে তৈরি তার তাঁতের সাহায্যে সে বোনে সেই উর্ণজাল। এমনকি টানা সুতো গুটিয়ে রাখবার মত সাজ-সরঞ্জামও নেই; তাঁতটিকে প্রসারিত করে রাখতে হয় তার পুরো দৈর্ঘ্যে; ফলে তা এমন বেয়াড়া ধরণের বড় হয়ে যায় যে, সেটি প্রস্তুতকারকের কুটিরের মধ্যে ধরে না; তাই সে তখন বাধ্য হয় খোলা জায়গায় তার কাজ চালাতে, যার ফলে আবহাওয়ার প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে তা ব্যাহত হয়।[৫] বংশপরম্পরায় সঞ্চিত এবং পিতা থেকে পুত্রের হাতে সঞ্চারিত বিশেষ কুশলতাই কেবল ভারতীয়কে দিয়ে থাকে এই নৈপুণ্য, যেমন দিয়ে থাকে মাকড়সাকে। কিন্তু তবু একজন ম্যানুফ্যাকচার-শ্রমিকের তুলনায় একজন হিন্দু (ভারতীয়) তাঁতীর কাজ ঢের বেশি জটিল।
একজন কারিগর, যে একটি তৈরি জিনিসের উৎপাদনে বিভিন্ন ভগ্নাংশিক কাজগুলি পরপর সম্পন্ন করে, তাকে এক সময়ে বদলাতে হয় তার স্থান, অন্য সময়ে বদলাতে হয় তার হাতিয়ার। এক কাজ থেকে পরবর্তী কাজে যেতে তার প্রমের প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং, বলা যায়, তার শ্রমদিবসে মাঝে মাঝে ছেদ পড়ে। এই ছেদগুলি তখনি ছোট হয়ে আসে, যখনি সে একই কাজে সারা দিন বাঁধা থাকে; তার কাজের প্রক্রিয়ার পরিবর্তন যত কমে যায়, ততই এই ছেদগুলি অন্তর্হিত হয়ে যায়। এর ফলে উৎপাদিকা শক্তির যে-বৃদ্ধি ঘটে তার কারণ, হয়, শ্রমের বর্ধিত নিয়োগ অর্থাৎ শ্রমের বর্ধিত নিবিড়তা, নয়তো অনুৎপাদক ভাবে ব্যবহৃত শ্রমশক্তির হ্রাস। বিরতি থেকে গতিতে যেতে শ্রমের বাড়তি ব্যয় পোষানো হয় স্বাভাবিক গতিবেগের স্থিতিকালকে দীর্ঘায়িত করে, যখন তা একবার অর্জিত হয়ে যায়। অপর পক্ষে, এক ও অভিন্ন ধরণের নিরন্তর শ্রম মানুষের জৈব কর্মশক্তির প্রবাহ ও নিবিড়তাকে ক্ষুন্ন করে, যে কর্মশক্তি নিছক পরিবর্তনেই স্মৃতি ও আনন্দ পায়।
শ্রমের উৎপাদনশীলতা কেবল শ্রমিকের নৈপুণ্যের উপরেই নির্ভর করে না, তার হাতিয়ারগুলির উন্নয়নের উপরেও নির্ভর করে। একই ধরনের সব হাতিয়ার, যেমন, ছুরি, তুরপুন, ক্ষুদে তুরপুন,হাতুড়ি ইত্যাদি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হতে পারে এবং একই হাতিয়ার একই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে। কিন্তু যখনি একটি শ্রম-প্রক্রিয়ার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে পরস্পর থেকে বিযুক্ত করে দেওয়া হয় এবং প্রত্যেকটি ভগ্নাংশিক পর্যায় এক একজন প্রত্যংশ শ্রমিকের হাতে একটি যথোপযুক্ত ও বিশিষ্ট রূপ ধারণ করে, তখনি যে-সমস্ত হাতিয়ার পূর্বে একাধিক উদ্দেশ্য সাধন করত, সেগুলিতে পরিবর্তন সাধনের দরকার হয়। সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির অপরিবর্তিত রূপটিতে কি কি অসুবিধা হচ্ছিল, তাই দিয়েই নির্ধারিত হয় পরিবর্তন কোন্ দিকে ঘটবে। ম্যানুফ্যাকচারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উপকরণসমূহে বিশেষীভবন—এমন বিশেষীভবন যার দ্বারা এক এক ধরনের হাতিয়ার এক এক বিশেষ প্রয়োগের সঙ্গে উপযোজিত হয়ে নির্দিষ্ট আকারপ্রাপ্ত হয় এবং ঐসব হাতিয়ারের বিশেষীভবন যার ফলে প্রত্যেকটি বিশেষ হাতিয়ার কেবল একজন নির্দিষ্ট প্রত্যংশ শ্রমিকের হাতেই পূর্ণভাবে খেলতে পারে। একমাত্র বার্মিংহামেই উৎপাদিত হয় ৫০০ রকমের হাতুড়ি এবং তাদের এক-একটি রকম যে কেবল এক-একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার সঙ্গেই উপযোজিত তা নয়, প্রায়শঃই এমন ঘটে যে, কয়েকটি ধরন একান্ত ভাবে একই অভিন্ন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন সাধন করে। প্রত্যেক প্রত্যংশ শ্রমিকের একান্ত স্ববিশেষ কাজগুলির শ্রমের হাতিয়ারসমূহের অভিযোজন ঘটিয়ে ম্যানুফ্যাকচারের যুগ সেগুলিকে সরলীকৃত, উন্নীত ও বহুগুণিত করে।[৬] এইভাবে তা মেশিনারির অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তব অবস্থানগুলির মধ্যে একটি অবস্থার সৃষ্টি করে; মেশিনারি হল কয়েকটি সরল হাতিয়ারের সংযোজিত রূপ।
. প্রত্যংশ শ্রমিক এবং তার হাতিয়ারগুলিই হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারের সরলতম উপাদান। এখন আমরা সমগ্র ভাবে এই দিকটি উপরে মনোনিবেশ করব।
————
১. প্রত্যংশ শ্রমিক : “ডিটেইল লেবারার”
২. “অধিক বৈচিত্র্যপূর্ণ কোন ম্যানুফ্যাকচার যত বেশি বন্টিত হবে এবং বিভিন্ন শিল্পীকে বরাদ্দ করা হবে, সেটি অবশ্যই আরো ভাল ভাবে তৈরি হবে আরো বেশি দ্রুত গতিতে, আবো কম সময়ে ও শ্রমে।” (“দি অ্যাডভান্টেজেন অব দি ইস্ট ইঞ্জি ট্রেড,” ১৭২০, পৃঃ ৭১)।
৩. “সহজ এম হল হস্তান্তরিত দক্ষতা।” (মস হজস্কিন : “পপুলার পলিটিক্যাল ইকনমি” পৃ: ৪৮)
৪. “কারুশিল্পও…….মিশরে পৌছেছিল উৎকর্ষের শিখরে। কেননা এটাই একমাত্র দেশ যেখানে কারুশিল্পীরা আরেক শ্রেণীর নাগরিকদের কাজে মাথা গলাত না; লেগে থাকত কেবল সেই একটি মাত্র বৃত্তিতে যেটি তাদের গোষ্ঠীতে আইন। অনুসারে উত্তরাধিকার সূত্রে চলে আসছিল। অন্য দেশে দেখা যায় যে, কারুশিল্পীরা নানান বিষয়ে মনোনিবেশ করত। এক সময়ে তারা মন দিত কৃষিতে, অন্য সময়ে তারা শুরু করত বাণিজ্য, আরেক সময়ে তারা আবার একই সঙ্গে ধরত একাধিক পেশা। স্বাধীন দেশগুলিতে তারা প্রায়ই হানা দিত জন-পরিষদসমূহে। অন্য দিকে মিশরে প্রত্যেক কারুশিল্পীকে কঠোর ভাবে দণ্ড দেওয়া হত যদি সে মাথা গলাতে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে, কিংবা লিপ্ত হত একাধিক পেশায়। সুতরাং তাদের বৃত্তিতে ব্যাঘাত ঘটাবার মত কিছুই ছিল না। অধিকন্তু, যেহেতু তারা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেত অসংখ্য রীতি-পদ্ধতি, সেই হেতু তারা আগ্রহী হত নোতুন। নোতুন সুবিধা আবিষ্কার করতে।” { ডিওডারাস : সিকিউলাস : Historische Bibliothek vols l. 111 Stuttgart. 1828, 74),
৫. “হিস্টরিক্যাল অ্যাণ্ড ডেস্ক্রিপটিভ অ্যাকাউন্ট অব ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া ইত্যাদি”, হিউ মারে এবং জেমস উইলসন, এডিনবরা ১৮৩২, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪৪৯। ভারতীয় তাঁত থাকে খাড়া অর্থাৎ টানা সুতো থাকে খাড়াখাড়ি।
৬. প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে তার যুগান্তকারী গ্রন্থে ডারউইন উদ্ভিদ ও জীবদের প্রাকৃতিক অঙ্গসমূহ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত একটি অভিন্ন অঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের কার্য সম্পাদন করতে হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তার পরিবর্মীয়তার একটি ভিত্তি সম্ভবতঃ এই ব্যাপারটিতে পাওয়া যায় যে, যদি সেই অঙ্গটি কেবল একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নির্দিষ্ট থাকত তা হলে, তার তুলনায় অল্পতর যত্নভরে প্রাকৃতিক নির্বাচন রূপগত প্রত্যেকটি পরিবর্তনকে রক্ষা করত বা দমন করত। যেমন, যে সব ছুরি সব রকমের জিনিস কাটবার সঙ্গে অভিযোজিত, সেগুলি মোটামুটি ভাবে একই আকারের হতে পারে; কিন্তু একটি যন্ত্র, যা কেবল একভাবেই ব্যবহৃত হবার জন্য নির্দিষ্ট, তার আকার হবে প্রত্যেকটি বিভিন্ন ব্যবহারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন।”
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ — ম্যানুফ্যাকচারের দুটি মৌলরূপঃ বিমিশ্র ম্যানুফ্যাকচার ও ক্রমিক ম্যানুফ্যাকচার
ম্যানুফ্যাকচার-সংগঠনের দুটি মৌল রূপ আছে, যে দুটি রূপ কখনন কখনোপরস্পরের সঙ্গে মিশে গেলেও মূলতঃ ভিন্ন প্রকারের এবং, তা ছাড়াও, পরবর্তীকালে ম্যানুফ্যাক ‘চারের মেশিনারি-পরিচালিত আধুনিক শিল্পে রূপান্তরণে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা গ্রহণ করে। এই দ্বৈত চরিত্রের উদ্ভব ঘটে উৎপাদিত জিনিসটির প্রকৃতি থেকে। হয়, সেই জিনিসটি স্বতন্ত্র ভাবে উৎপাদিত বিভিন্ন আংশিক দ্রব্যের নিছক যান্ত্রিক সংযোজনের ফল আর, নয়তো, তার পূর্ণায়ত আকারটি এক প্রস্ত পরস্পর সংযুক্ত-প্রক্রিয়ার পরিণতি।
নমুনা হিসাবে বলা যায়, একটি লোকোমোটিত গঠিত হয় … স্বতন্ত্র অংশের সংযোজনের ফলে। কিন্তু এটাকে প্রথম ধরনের বিশুদ্ধ ম্যানুফ্যাকচারের নমুনা হিসাবে নেওয়া যায়না, কেননা, তার অবয়বটি আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পের দ্বারা গঠিত। তবে একটি ঘড়িকে তেমন নমুনা হিসাবে নেয়া যায়; এবং উইলিয়ম পেটি এটাকে ব্যবহার করতেন শ্রম-বিভাজনের দৃষ্টান্ত দেবার জন্য। আগে রেমবার্গের ঘড়ি ছিল একজন কারিগরের ব্যক্তিগত কাজ, পরে তা রূপান্তরিত হয় বিরাট-সংখ্যক প্ৰত্যংশ শ্রমিকের একটি সামাজিক উৎপাদনে, যেমন মেইন শ্রিং মেকার’, ‘ডায়াল মেকার, স্পাইরাল স্ক্রি মেকার’, ‘জুয়েল্ড হোল মেকার’, ‘রুবি লেভার মেকার’, ‘হ্যাণ্ড মেকার’, ‘কেসমেকার, কে, মেকার’, ‘গিলডার’—এবং সেই সঙ্গে আরো অসংখ্য উপ-বিভাগ যেমন হুইল-মেকার (পিতল ও ইস্পাতের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ), পিন-মেকার’, ‘মুভমেন্ট-মেকার’, ‘আশেভ দ্য পিগন (অ্যাক্সেল-এর উপরে হুইল বা চাকা লাগায় ), পিভট-মেকার’, ‘প্লাত্য দ্য ফিনিসাজ’ (হুইল ও স্প্রিং ওয়ার্কস-এর মধ্যে স্থাপন করে, ‘র্যাকোয়েট-মেকার ( ঘড়িটি রেগুলেট করার যন্ত্র), ‘প্লাত দ্য এশকাপমেন্ট (এসকেপমেন্ট-মেকার ); তারপরে আছে ‘রিপাশুর দ্য ব্যারিলেট’ (স্প্রিং-এর বক্সটি তৈরি করে ), ‘স্টিল পলিশার’, ‘হুইল পলিশার’, ‘, পলিশার’, ‘ফিগার-পেণ্টার’, ‘ডায়াল-এনামেলার (তামার উপরে কলাই করে), ফ্যাব্রিকঁাত দ্য পেদা (কেসটি ঝুলিয়ে রাখার আংটিটি তৈরি করে ), ‘ফিনিশু দ্য শার্নিয়ের’ (কভারের মধ্যে পিতলের কাটা স্থাপন করে, ‘গ্রাভর, ফেইসু্যর দ্য সিক্রেট কেসটি যে স্প্রিংটি দিয়ে ভোলা হয়, সেটি পরায়) ‘সিসের’, ‘পলির দ্য বয়েতে’ ইত্যাদি ইত্যাদি এবং, সর্বশেষে, রিপার’, যে গোটা ঘড়িটাকে ফিট করে এবং চালু অবস্থায় তা হাতে তুলে দেয়। ঘড়িটির কয়েকটি মাত্র অংশ বিভিন্ন হাতের মধ্য দিয়ে যায়। এবং এই সমস্ত “মেম্ব ডিসজেক্টা” প্রথম বারের মত সমবেত হয় সেই ব্যক্তিটির হাতে, যে তাদের এক সঙ্গে সন্নিবিষ্ট করে একটি যান্ত্রিক সমগ্রতায় রূপ দেয়। তৈরি সামগ্রীটি এবং তার বিবিধ বিচিত্র উপাদানগুলি, যা দিয়ে তা তৈরি হয়, সেগুলির মধ্যে এই যে বাহ সম্পর্ক, তা যেমন এই ক্ষেত্রে তেমনি অনুরূপ সমস্ত ক্ষেত্রেই, এই ব্যাপারটিকে একটি দৈবাৎ ঘটনায় পরিণত করে যে, প্রত্যংশ শ্রমিকদের একই কর্মশালায় সমবেত করা হল কিনা। প্রত্যংশ কাজগুলি আবার কতকগুলি স্বতন্ত্র ক্রিয়াকাণ্ড হিসাবেও চালানো যায়, যেমন করা হয় ভাউড ও চ্যাটেল-এর ক্যান্টনগুলিতে; অন্য দিকে, জেনেভায় আছে বড় বড় ঘড়ি ম্যানুফ্যাক্টরি (এম-কারখানা) যেখানে প্রত্যংশ শ্রমিকেরা প্রত্যক্ষ ভাবে একজন ধনিকের নিয়ন্ত্রণাধীনে কাজ করে। এবং এই পরবর্তী ক্ষেত্রেও ‘ডায়াল’, ‘ম্পিং’ ও ‘কেল’ কদাচিৎ ঐ কারখানাতেই তৈরি হয়। ঘড়ির ব্যবসায়ে শ্রমিকদের এক জায়গায় জড় করে তাকে ম্যানুফ্যাকচার হিসাবে পরিচালনা করা কেবল বিরল ক্ষেত্রেই লাভজনক হয়, কেননা যে সব শ্রমিক বাড়িতে সে কাজ করতে চায়, তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকে তীব্রতর এবং কেননা কতকগুলি ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাজের বিভাজনের ফলে যৌথ ভাবে ব্যবহার্য শ্রম-উপকরণসমূহের ব্যবহারের সুযোগ ঘটে কদাচিৎ; এবং সেই কারণে ধনিক শ্রমিকদের ছড়িয়ে দিয়ে কর্মশালা ইত্যাদির উপরে তার বিনিয়োগের সাশ্রয় করে ইত্যাদি।[১] সে যাইহোক, যে কারিগর তার খরিদ্দারের জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করে, তার তুলনায় এই যে প্রত্যংশ শ্রমিক, সে যদিও কাজ করে তার বাড়িতে বসে কিন্তু কাজ করে খনিকেরই জন্য, তার অবস্থান একেবারেই ভিন্ন।[২]
দ্বিতীয় ধরনের ম্যানুফ্যাকচার, তার উন্নতকৃত রূপ, এমন সব জিনিস তৈরি করে, সেগুলি পরস্পর-সংযুক্ত বিবিধ বিকাশ পর্যায়ের মধ্য দিয়ে, এক প্রস্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, ধাপে ধাপে অতিক্রম করে, যেমন সুচ ম্যানুফ্যাকচারে সুচের তার অতিক্রম করে ৭২ জন, এমন কি, কখনো কখনো ৯২ জন ভিন্ন ভিন্ন শ্রমিকের হাতের মধ্য দিয়ে।
যখন প্রথম শুরু করা হয়, তখন এমন একটি ম্যানুফ্যাকচার বিক্ষিপ্ত হস্তশিল্পগুলিকে যতটা মাত্রায় সংযোজিত করতে পারে, ততটা মাত্রায় তা উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায় যে-ব্যবধান দ্বারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, সেই ব্যবধানকে কমিয়ে আনে। এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে অতিক্রান্তির সময়কালও হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, যেমন হ্রাসপ্রাপ্ত হয় সেই শ্রম, যে শ্রম এই অতিক্রান্তি ঘটিয়ে থাকে।[৩] হস্তশিল্পের তুলনায় অধিক উৎপাদন শক্তি লব্ধ হয়, এবং এই লাভ উদ্ভূত হয় ম্যানুফ্যাকচারের সাধারণ চরিত্র থেকে। অপর পক্ষে, এম-বিভাজন, যা ম্যানুফ্যাকচারের একটি বৈশিষ্ট্যসূচক নীতি, তা দাবি করে উৎপাদনের বিবিধ পর্যায়ের বিচ্ছিন্নতা এবং তাদের পারস্পরিক স্বতন্ত্রতা। বিচ্ছিন্ন কাজগুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপন ও সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন হয় এক হাত থেকে অন্য হাতে, এক প্রক্রিয়া থেকে অন্য প্রক্রিয়ায় নিরন্তর স্থানান্তর। আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই প্রয়োজনটি প্রতিভাত হয় একটি চরিত্রগত ও ব্যয়বহুল অসুবিধা হিসাবে এবং এমন একটি অসুবিধা হিসাবে, যা ম্যানুফ্যাকচারের নীতির মধ্যেই নিহিত। [৪]
যদি আমরা আমাদের মনোযোগ কোন বিশেষ ধরনের কাঁচামালের উপরে নিবদ্ধ করি, যেমন কাগজ ম্যানুফ্যাকচারের ক্ষেত্রে ছেড়া ন্যাকড়া কিংবা সুচ ম্যানুফ্যাকচারের ক্ষেত্রে তারের উপরে, আমরা লক্ষ্য করি যে, তা সম্পূর্ণ না হওয়া অবধি বিভিন্ন প্ৰত্যংশ শ্রমিকের হাতে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে পালাক্রমে পার হয়। অপর পক্ষে, আমরা যদি সমগ্র ভাবে কর্মশালাটির উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, আমরা একই সময়ে কাঁচামালটিকে তার বিভিন্ন পর্যায়ে দেখতে পাই। যৌথ শ্রমিক তার অনেক হাতের মধ্যে এক ধরনের হাতিয়ারে সুসজ্জিত একপ্রস্ত হাত দিয়ে তার টানে, আরেক ধরনের হাতিয়ারে সুসজ্জিত আরেক প্রস্ত হাত দিয়ে একই সময়ে তারটিকে সোজা করে এবং আরো এক ধরনের হাতিয়ারে সুসজ্জিত আরো এক প্রন্ত হাত দিয়ে তারটিকে সুচলো করে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিভিন্ন প্ৰত্যংশ প্রক্রিয়াগুলি, যা ছিল কালের দিক থেকে পর্যায়ক্রমিক, তাই হয়ে উঠল স্থানের দিক থেকে যুগপৎ। এই কারণেই একটি নির্দিষ্ট সময়ে উৎপন্ন হল একটি বৃহত্তর পরিমাণ তৈরি পণ্যসম্ভার। [৫] এ কথা ঠিক যে, এই যুগপত্তার হেতু হচ্ছে সমগ্র ভাবে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটির সহযোগমূলক রূপটি; কিন্তু ম্যানুফ্যাকচার কেবল সহযোগের অবস্থানগুলিকে তৈরি-অবস্থায় পায়না, হস্তশিল্প-শ্রমের আরো বিভাজন ঘটিয়ে সে নিজেও সেগুলি কিছুটা পরিমাণে তৈরি করে নেয়। অপর পক্ষে, প্রত্যেক শ্রমিককে কেবল একটি করে ভগ্নাংশিক কাজে নিবন্ধ রেখে ম্যানুফ্যাকচার এই সামাজিক সংগঠনটিকে সম্পূর্ণ করে।
যেহেতু প্রত্যেক প্রত্যংশ শ্রমিকের উৎপাদিত ভয়াংশিক দ্রব্যটি একই সঙ্গে আবার এক ও অভিন্ন তৈরি জিনিসের একটি বিশেষ পর্যায় মাত্র, সেহেতু প্রত্যেকটি শ্রমিক বা শ্রমিকগোষ্ঠী যা করে, তা হচ্ছে অন্য একজন শ্রমিক বা শ্ৰমিক-গোষ্ঠীর জন্য কাঁচামাল প্রস্তুত করে দেওয়া। একের শ্রমের ফল আর একের শ্রমের সূচনাবিন্দু। সুতরাং একজন শ্রমিক প্রত্যক্ষ ভাবেই আরেকজনকে কাজ দিচ্ছে। ঈপ্সিত ফল লাভের জন্য প্রত্যেকটি আংশিক প্রক্রিয়ায় যে শ্রম-সময়ের প্রয়োজন, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তা শেখা হয়ে যায়; এবং সমগ্রভাবে ম্যানুফ্যাকচারের যান্ত্রিক প্রণালীটি এই পূর্ব-সিদ্ধান্তের উপরে দাড়িয়ে আছে যে, একটি নির্দিষ্ট ফল একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লাভ করা যায়। কেবল এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই বিবিধ অনুপূরক শ্ৰম-প্রক্রিয়া অব্যাহত ভাবে, যুগপৎ পাশাপাশি অগ্রসর হতে পারে। এটা স্পষ্ট যে, বিবিধ কর্মের, এবং, সেই কারণেই, বিভিন্ন শ্রমিকের, পরস্পরের উপরে এই প্রত্যক্ষ নির্ভরশীলতা তাদের প্রত্যেককে বাধ্য করে তার কাজের জন্য কেবল ঠিক ততটা শ্রম-সময় ব্যয় করতে যতটা আবশ্যিক শ্রম-সময়ের অনধিক এবং এই ভাবে এমন একটি অনবচ্ছিন্নতা, অভিন্নতা, নিয়মিকতা, শৃংখলা[৬] এবং এমনকি শ্ৰম-তীব্রতার জন্ম হয়, যা একটি স্বাধীন হস্তশিল্পে, এমনকি সরল সহযোগে। যা দৃষ্ট হয়, তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। কোন পণ্যের উপরে ক্যয়িত শ্রম-সময়ের পরিমাপ তার উৎপাদনের জন্য সামাজিক ভাবে আবশ্যিক শ্রম-সময়কে ছাড়িয়ে যাওয়া অনুচিত—এই যে নীতি, এটা সাধারণ ভাবে পণ্যোৎপাদনে কেবল প্রতিযোগিতার ফলশ্রুতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে প্রতিভাত হয়; যেহেতু ভাসা ভাসা ভাবে বলতে গেলে, প্রত্যেক ব্যক্তিগত উৎপাদনকারী তার পণ্য তার বাজারদরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ম্যানুফ্যাকচারে কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোন দ্রব্যের নির্দিষ্ট পরিমাপের উৎপাদন স্বয়ং উৎপাদন-প্রক্রিয়ারই একটি কৃৎকৌশলগত নিয়ম।[৭]
অবশ্য, বিভিন্ন কাজ বিভিন্ন সময় লাগায় এবং সেই কারণে, সম-পরিমাণ সময় অসম। পরিমাণ ভগ্নাংশিক দ্রব্য যোগায়। সুতরাং যদি একই শ্রমিককে দিনের পর দিন একই কাজ করতে হয়, তা হলে এক-একটি কাজের জন্য অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক শ্রমিক লাগে, যেমন টাইপ ম্যানুফ্যাকচারে চারজন ‘ফাউণ্ডার’ ও দুজন ‘ব্রেকার পিছু থাকে একজন রাবার; ফাউণ্ডার প্রতি ঘণ্টায় ছাচ ঢালাই করে ২০০০ টাইপ, বেকার ভাতে ৪০০০ এবং বাবার পালিশ করে ৮০°। এখানে আবার আমরা সহযোগের নীতিটিকে পাই তার সরলতম রূপে। একটি কাজের জন্য যুগপৎ অনেক শ্রমিকের নিয়োগ কেৱল এখানে এই নীতিটি হচ্ছে একটি অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের অভিব্যক্তি। ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাজন যেভাবে পরিচালিত হয়, তাতে যে কেবল সামাজিক যৌথ-শ্রমিকের গুণগত ভাবে বিভিন্ন অংশগুলি সরলীকৃত ও পরিবর্তিত হয়, তাই নয়, সেই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট গাণিতিক সম্পর্ক বা অনুপাতের সৃষ্টি হয়, যা ঐ অংশগুলির পরিমাণগত মাত্রাটিকে নিয়ন্ত্রিত করে যথা, প্রত্যেকটি প্রত্যংশ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিকের আপেক্ষিক সংখ্যা কিংবা শ্রমিক-গোষ্ঠীর আপেক্ষিক আকার। সামাজিক শ্রম-প্রক্রিয়ার গুণগত উপ-বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থা ঐ প্রক্রিয়ার জন্য একটি পরিমাণগত নীতি ও আনুপাতিকতার বিকাশ ঘটায়।
একবার যদি একটি নির্দিষ্ট আয়তনে উৎপাদনরত বিবিধ শ্রমিক-গোষ্ঠীগুলিতে প্রত্যংশ শ্রমিকদের বিবিধ সংখ্যার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত অনুপাতটি পরীক্ষামূলক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তা হলে কেবল প্রত্যেকটি বিশেষ শ্রমিক-গোষ্ঠীর একটি গুণিতককে কর্ম-নিযুক্ত করেই সেই আয়তনটির বিস্তার সাধন করা যায়।[৮] অধিকন্তু, কয়েক ধরনের কাজ একই ব্যক্তি বৃহদায়তনেও যতটা ভাল ভাবে করতে পারে, ক্ষুদ্রায়তনেও ঠিক ততটা ভাল ভাবেই করতে পারে, যেমন, তত্ত্বাবধানের শ্রম, এক পর্যায় থেকে পরবর্তী পর্যায়ে ভগ্নাংশিক দ্রব্যটির পরিবহণ। এই ধরনের কাজগুলির মধ্যে বিচ্ছেদ সাধন, একটি বিশেষ শ্রমিকের উপরে সেগুলির দায়িত্ব অর্পণ কখনো সুবিধাজনক হয় না, যে পর্যন্ত না নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে গিয়েছে, তবে এই সংখ্যাবৃদ্ধি প্রত্যেকটি প্রমিক-গোষ্ঠীতেই আনুপাতিক ভাবে ঘটাতে হবে।
যার উপরে কোন বিশেষ প্রত্যংশ কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়, এমন একটি বিচ্ছিন্ন শ্ৰমিক-গোষ্ঠী গঠিত হয় সমজাতীয় উপাদানসমূহের দ্বারা এবং এই শ্রমিক-গোষ্ঠী হবে সমগ্র ব্যবস্থাটির একটি অঙ্গগত অংশ। অবশ্য অনেক ম্যানুফ্যাকচারে এই শ্রমিক গোষ্ঠী নিজেই একটি শ্রম-সংগঠন-সমগ্র ব্যবস্থাটি হচ্ছে এই প্রাথমিক গঠনগুলির পুনরাবর্তন। দৃষ্টান্ত হিসাবে, কাচের বোতল ম্যানুফ্যাকচারের বিষয়টি নেওয়া যাক। ব্যাপারটিকে সিটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম যখন কাদের উপকরণগুলি প্রস্তুত করা হয়, বালি ও চুন ইত্যাদি মেশানো হয় এক সেগুলিকে গলিয়ে কাচে তরল আকারে পরিণত করা হয়।[৯] বিভিন্ন প্ৰত্যংশ শ্রমিক এই পর্যায়ে নিযুক্ত হয়, যেমন তারা নিযুক্ত হয় চুড়ান্ত পায়েও, যখন বোতলগুলিকে শুকিয়ে নেবার চুল্লী থেকে সরিয়ে নিতে হয়, বাছাই করে সাজাতে হয়, প্যাক করতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। মধ্য পর্যায়ে, অর্থাৎ প্রারম্ভিক ও চূড়ান্ত—এই দুই পর্যায়ের মধ্যবর্তী পর্যায়ে, আসে সঠিক কঁচ বিগলন, তরল আকারের কাচের উপযোজন। চুল্লীর প্রত্যেকটি মুখে কাজ করে একটি করে শ্রমিক-গোষ্ঠী, যাকে বলা হয় “হোল” (কোটর”) যা গঠিত হয় একজন “ফিনিশার” (বোতল-নির্মাতা), একজন “ব্লোয়ার” (হাপরদার ), একজন “গ্যাদারার” (সংগ্রাহক), একজন “পুটার-আপ” বা “হোয়েটার ইন” (শানদার) এবং একজন “টেকারইন” (উত্তোলক)-এর দ্বারা। এই পাঁচজন প্রত্যংশ কর্মী একটি একক কর্মযন্ত্রের পাঁচটি অঙ্গ, যে কর্মযন্ত্রটি কেবল একটি সমগ্র হিসাবেই কাজ করে এবং স্বভাবতই ক্রিয়াশীল হতে পারে কেবল সমগ্র পাঁচটির সহযোগে। যদি এই পাঁচটির মধ্যে কোন একটির অভাব ঘটে, তা হলে গোটা দেহটাই অসাড় হয়ে পড়বে। কিন্তু একটা কাচের চুল্লীর থাকে কয়েকটা করে মুখ (ইংল্যাণ্ডে ৪ থেকে ৬টি), প্রত্যেকটিতে থাকে তরল কাচে পরিপূর্ণ একটি মাটির ঘড়া এবং কাজ করে অনুরূপ একটি কর্মী-গোষ্ঠী। প্রত্যেকটি গোষ্ঠীর সংগঠনের ভিত্তি হল শ্রম-বিভাজন, তবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে থাকে সহযোগের বন্ধন, যা উৎপাদনের অন্যতম উপায়কে অর্থাৎ চুল্লীটিকে সম্মিলিত ভাবে ব্যবহার করার ফলে তার বাবদে ঘটায় আরো ব্যয়-সংকোচন। এমন একটি চুল্লী তার ৪ থেকে ৩টি কর্মী-গোষ্ঠী নিয়ে গঠন করে একটি কাচঘর এবং এক-একটি কঁচ-কারখানা (ম্যানুফ্যাক্টরি) গঠিত হয় এইরকম কয়েকটি কঁাচ-ঘর এবং সেই সঙ্গে প্রারম্ভিক ও চুড়ান্ত পর্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম ও শ্রমিকদের নিয়ে।
সর্বশেষে, ঠিক যেমন ম্যানুফ্যাকচারের উদ্ভব ঘটে, অংশতঃ, বিভিন্ন হস্তশিল্পের সংযোজন থেকে, ঠিক তেমনি সেও আবার বিকাশ ঘটায় বিবিধ ম্যানুফ্যাকচারের। নমুনা হিসাবে, ইংল্যাণ্ডের বড় বড় কাঁচ-ম্যানুফ্যাকচারকারীরা নিজেরাই তাদের মাটির বিগলন-পাত্রগুলি গড়ে নেয়, কেননা সেগুলির উপরে বহুল পরিমাণে নির্ভর করে প্রক্রিয়াটির সাফল্য বা ব্যর্থতা। উৎপাদন-উপায়সমূহের একটি ম্যানুফ্যাকচার এক্ষেত্রে উৎপাদনীয় জিনিসটির উৎপাদনের সঙ্গে সংযোজিত হয়ে গিয়েছে। অপর পক্ষে, জিনিসটির ম্যানুফ্যাকচার অন্যান্য ম্যানুফ্যাকচারের সঙ্গে সংযোজিত হতে পারে এমন ম্যানুফ্যাকচারের সঙ্গে যার কাঁচামাল হল এই জিনিসটি; অথবা উৎপাদনের বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে খোদ এই জিনিসটিই পরবর্তীকালে মিশ্রিত হতে পারে। যেমন আমরা দেখতে পাই চকমকি কঁচের ম্যানুফ্যাকচারের সঙ্গে কঁচ-কাটা ও পিতল ঢালাইয়ের সংযোজন—যার প্রয়োজন হয় কাচের তৈরি বিভিন্ন জিনিস সেট করবার কাজে। এইভাবে সংযোজিত বিবিধ ম্যানুফ্যাকচার পরিণত হয় একটি বৃহত্তর ম্যানুফ্যাকচারের মোটামুটি আলাদা আলাদা বিভাগে, কিন্তু সেই সঙ্গে প্রত্যেকটিই আবার একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া, যার প্রত্যেকটিতেই থাকে তার নিজস্ব শ্রম-বিভাজন। বিবিধ ম্যানুফ্যাকচারের এই সংযোজন নানাবিধ সুবিধার অধিকারী হলেও, তা কখনো তার নিজস্ব তিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত একটি পূর্ণাঙ্গ কারিগরি প্রণালীতে বিকাশ লাভ করেনা। সেটা ঘটে কেবল তখনি, যখন তা রূপান্তরিত হয় মেশিনারি-চালিত একটি শিল্পে।
ম্যানুফ্যাকচার-যুগের গোড়ার দিকে, পণ্যোৎপাদনে আবশ্যিক শ্রম-সময়ের হ্রাস সাধনের নীতি[১০] গৃহীত ও সুত্রায়িত হত; এবং মেশিনের ব্যবহার এখানে সেখানে আত্মপ্রকাশ করত, বিশেষ করে, কয়েকটি সরল প্রাথমিক প্রক্রিয়ার জন্য, যেগুলিকে পরিচালিত করতে হত খুবই বৃহদায়তনে এবং বিপুল শক্তি-প্রয়োগে। যেমন প্রথম যুগে কাগজ ম্যানুফ্যাকচারে ন্যাকড়া-ছেড়ার কাজটি করা হত কাগজ-কলের দ্বারা ধাতু কারখানার আকর চূর্ণ করা হত পেষাইকলে।[১১] জলচক্রের (ওয়াটার-হুইল’-এর ) যাবতীয় মেশিনারির প্রাথমিক রূপটি রোম-সাম্রাজ্য দিয়ে গিয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। [১২]
হস্তশিল্পের কাছ থেকে আমরা উত্তরাধিকার হিসাবে পেয়েছি কম্পাস’ ( দিক দর্শক যন্ত্র। গান পাউডার’ (বারুদ’, ‘টাইপ প্রিন্টিং’ (হরফ-মুদ্রণ) ও স্বয়ংক্রিয় ঘড়ির মত বড় বড় সব উদ্ভাবন। কিন্তু সমগ্র ভাবে দেখলে, শ্রম-বিভাজনের তুলনায় মেশিনারির স্থান তখন ছিল গৌণ, যে স্থানটি অ্যাডাম স্মিথ ন্যস্ত করেছিলেন তার উপরে।[১৩] সপ্তদশ শতাব্দীতে মেশিনারির বিক্ষিপ্ত ব্যবহারের ঘটনাটি চরম গুরুত্বপূর্ণ, কেননা সে যুগের মহান গণিতজ্ঞদের তা যুগিয়েছিল, বলবিজ্ঞান (মেকানিক্স’ -সৃষ্টির বাস্তব ভিত্তি ও প্রেরণা।
বিবিধ প্রত্যংশ-শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত যৌথ শ্রমিকটিই হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারযুগের বৈশিষ্ট্যসূচক মেশিনারি। নানাবিধ কর্মকাণ্ড, যেগুলি একজন পণ্যের উৎপাদক পালাক্রমে সম্পাদন করে এবং যেগুলি উৎপাদনের অগ্রগমনের পথে পরস্পরের সঙ্গে মিলে যায়, সেগুলি তার উপরে নানা ভাবে দাবি হাজির করত। একটি কর্মকাণ্ডে
তাকে দিতে হবে অধিকতর দৈহিক শক্তি, আর একটিতে অধিকতর অভিনিবেশ এবং একই ব্যক্তি এই সমস্ত কয়টি গুণ সমান ভাবে ধারণ করে না। একবার যখন ম্যানুফ্যাকচার বিবিধ প্রক্রিয়াগুলিকে বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র করে দিয়েছে, তখন শ্রমিকেরাও তাদের নিজ নিজ প্রধান গুণ অনুসারে বিভক্ত, শ্রেণীবিন্যস্ত ও গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে যায়। একদিকে তাদের প্রকৃতি-প্রদত্ত গুণাবলী হয় শ্রম-বিভাজনের ভিত্তি এবং অন্য দিক ম্যানুফ্যাকচার একবার প্রবর্তিত হলে তাদের মধ্যে ঘটায় নোতুন নোতুন ক্ষমতার বিকাশ—যে ক্ষমতাগুলি স্বভাবতই সীমিত ও বিশেষ কাজের জন্যই উপযোগ। তখন যৌথ শ্রমিকটি, সমমাত্রার উৎকর্ষে, উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কয়টি গুণেরই অধিকারী হয় এবং বিশেষ বিশেষ শ্রমিকেরা বা শ্ৰমিক-গোষ্ঠীর দ্বারা গঠিত তার সব কয়টি অঙ্গকে একান্ত ভাবেই তাদের স্ব স্ব বিশেষ কাজে নিযুক্ত করে সে সেই গুণগুলিকে প্রয়োগ করে সর্বাপেক্ষা মিতব্যয়ী ভাবে।[১৩] প্রত্যংশ শ্রমিকের একপেশেমি ও খুৎগুলি তখন হয়ে ওঠে সর্বাঙ্গীণ ও নিখুৎ, কেননা তখন সে যৌথ প্রমিকটির একটি অঙ্গ।[১৪] একটি মাত্র কাজ করবার অভ্যাস তাকে পরিণত করে একটি অব্যর্থ উপকণে, আর অন্য দিকে গোটা সংগঠনটির সঙ্গে তার সংযোগ তাকে বাধ্য করে একটি মেশিনের অংশ-সুলভ নিয়মিকতার সঙ্গে কাজ করতে।[১৫]
যেহেতু যৌথ শ্রমিকটির সরল ও জটিল, উচু ও নিচু—দু রকমেরই কাজ আছে, সেই হেতু তার সদস্যদের অর্থাৎ ব্যক্তি-শ্রমিকদের প্রয়োজন হয় বিভিন্ন মাত্রার প্রশিক্ষণের এক সেই কারণে তাদের মূল্যও হয় বিভিন্ন। সুতরাং ম্যানুফ্যাকচার গড়ে তোলে শ্রমশক্তিসমূহের একটি ক্রমোচ্চ-রতন্ত্র, যার এক-একটি স্তরের জন্য নির্দিষ্ট হয় এক-এক রকম মজুরির হার। এক দিকে, যখন ব্যক্তি-শ্রমিকেরা সারা জীবনের জন্য একটি সীমিত কাজে নিযুক্ত ও আবদ্ধ থাকে, অন্য দিকে তখন ঐ ভতন্ত্রের নানাবিধ কাজগুলি শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয় তাদের নিজ নিজ স্বাভাবিক ও অর্জিত গুণাবলী অনুসারে।[১৬] অবশ্য, প্রত্যেকটি উৎপাদন-প্রক্রিয়াতেই এমন কিছু প্রকৌশল-ক্ষমতার দরকার হয় যা প্রত্যেক মানুষেরই ক্ষমতার মধ্যে। কর্মতৎপরতার অধিকতর পূর্ণ-গর্ভ মুহূর্তের সঙ্গে এই প্রকৌশলগুলির সংযোগ থেকেও এখন এগুলির বিচ্ছেদ ঘটানো হয় এবং এগুলিকে শিলীভূত রূপ দেওয়া হয় বিশেষ ভাৰে নিযুক্ত শ্রমিকদের একান্ত কার্যে। অতএব, ম্যানুফ্যাকচার যে হস্তশিল্পেই হাত বাড়াক না কেন, সেখানেই তা সৃষ্টি করে তথাকথিত অদক্ষ শ্রমিকদের একটি শ্রেণী এমন একটি শ্রেণী যার কোনো স্থান নেই হস্তশিল্পে। ম্যানুফ্যাকচার ষছি এমন মানুষের সমগ্র কর্মক্ষমতার বিনিময়ে একটি একপেশে বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটায়, তবে তা আবার সমস্ত বিকাশের অভাবকেও একটি বৈশিষ্ট্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা-দানের সূচনা করে। একটি ক্রমোচ্চ-স্ততন্ত্র প্রবর্তনের পাশাপাশি আলে দক্ষ ও অক্ষ শ্রমিকদের একটি সহজ সরল শ্রেণীভাগ। অদক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষানবিশি ব্যয় হয় অন্তর্হিত; দক্ষদের জন্য এই ব্যয় হস্তশিল্পীদের তুলনায় হ্রাস পায়, কেননা কাজগুলি তখন সরল হয়ে যায়। উভয় ক্ষেত্রেই শ্রমের মূল্য পড়ে যায়।[১৭] এই নিয়মটি একটি ব্যতিক্রম ঘটে কেবল তখনি, যখন শ্ৰম-প্রক্রিয়ার ভাঙনের ফলে নোতুন ও বিস্তারিত কাজের জন্ম হয়—এমন সব কাজ যার, হয়, হস্তশিল্পে কোনো স্থান ছিলনা; নয়তে, থাকলেও তা ছিল সামান্য। শিক্ষানবিশির বাবদে ব্যয়ের এই অবলুপ্তি হ্রাসপ্রাপ্তির অর্থ দাঁড়ায় মূলধনের সেবায় উত্তমূল্যের সরাসরি বৃদ্ধিপ্রাপ্তি, কেননা তা আবশ্যক শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় আবশ্যিক শ্রম-সময়ের হ্রাস ঘটায়, তাই উত্ত-শ্রমের পরিধিরও বিস্তার ঘটায়।
————
১. ১৮৫৪ সালে জেনেভা উৎপাদন করেছিল ৮০,০০০ ঘড়ি, যা নিউফচ্যাটেল-এর ক্যান্টনে যা উৎপাদিত হয় তার এক-পঞ্চমাংশও নয়। যাকে আমরা একটা বিশাল ঘড়ি ম্যানুফ্যাক্টরি বলে গণ্য করতে পারি, সেই লা দ্য-দ্য-ফদ একা বছরে উৎপাদন করত জেনেভার দ্বিগুণ। ১৮৫০ থেকে ১৮৬১ পর্যন্ত জেনেভা উৎপাদন করে ৭,২০,০০০ ঘড়ি। “জেনেভা থেকে ঘড়ি-ব্যবসা প্রসঙ্গে প্রতিবেদন,” “ম্যানুফ্যাকচার, কমার্স ইত্যাদি প্রসঙ্গে এমব্যাসি ও লিগেশন-এর রাজকীয় সেক্রেটারিদের রিপোর্ট, নং ৬, ১৮৬৩” দ্রষ্টব্য। যে-সমস্ত প্রক্রিয়ায়, সেই সমস্ত জিনিস—যেগুলি কেবল একসঙ্গে ফিট-করা বিভিন্ন অংশ—সেগুলির উৎপাদন বিভক্ত, সেই সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে সংযোগের অভাব এই ধরনের একটি ম্যানুফ্যাকচারকে মেশিনারি-চালিত আধুনিক শিল্পের একটি শাখায় রূপান্তর-সাধনকে খুবই কঠিন করে তোলে। কিন্তু ঘড়ির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আরো দুটি প্রতিবন্ধক আছে তার বিভিন্ন অংশের ক্ষুদ্রতা ও সুক্ষ্মতা এবং বিলাসদ্রব্য হিসাবে তার চরিত্র। এই কারণেই তার এত বৈচিত্র, যা এত বিবিধ যে এমনকি লণ্ডনের সেরা ঘড়ি-ঘরগুলি পর্যন্ত এক বছরে একই রকমের এক ডজন ঘড়িও তৈরি করে কিনা সন্দেহ। মেসার্স ভ্যাচিরন অ্যাণ্ড কনস্ট্যানটিন’ এর ঘড়ি-কারখানা, যেখানে সাফল্যের সঙ্গে মেশিনারি প্রতিবর্তিত হয়েছে, সেখানে বড় জোর তিন-চার রকমের আকার ও রূপের ঘড়ি তৈরি হয়।
২. বহু-বিমিশ্র ম্যানুফ্যাকচারের চিরায়ত দৃষ্টান্ত এই ঘড়ি নির্মাণে আমরা, হস্ত শিল্পের উপ-বিভাজনের দ্বারা সংঘটিত, শ্রম-উপকরণগুলির উল্লিখিত পৃথগীভবন ও বিশেষীতবন, খুব সঠিকভাবে অধ্যয়ন করতে পারি।
৩. “জনগণের এত ঘনসন্নিবিষ্ট বসবাসে শকটের প্রয়োজন অবশ্যই হবে সীমিত।” (“দি অ্যাডভান্টেজেস অব দি ইস্ট ইণ্ডিয়া ট্রেড, পৃঃ ১০৬)।
৪. “দৈহিক শ্রম নিয়োগের ফলশ্রুতি হিসাবে ম্যানুফ্যাকচারের বিভিন্ন পর্যায়ের বিচ্ছেদন উৎপাদন ব্যয় দারুণ ভাবে বৃদ্ধি করে; ক্ষতির উদ্ভব ঘটে প্রধানতঃ প্রক্রিয়া থেকে প্রক্রিয়ান্তরে অপসারণের দরুণ।” (“দি ইণ্ডাষ্ট্রি অব নেশনস”, লণ্ডন ১৮৮৫, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২০৬)।
৫. এটা (এম-বিভাগ) একটি কাজকে বিভিন্ন শাখায় ভাগ করে, যেগুলি সবই একই সময়ে করা যায়। এইভাবে তা সময়ের সাশ্রয় ঘটায়। সব কয়টি বিভিন্ন প্রক্রিয়া একই সঙ্গে সম্পাদন করে, যেগুলি একজন ব্যক্তিকে করতে হত আলাদা আলাদা ভাবে, এটা সম্ভব হয় একটা ‘পিন’-কে কাটতে বা ছুচালো করতে যতটা সময় লাগে, সেই সময়ের মধ্যে এক গাদা,পিন’-কে পূর্ণ আকারে উৎপাদন করা।” (ভুগাল্ড স্টুয়ার্ট, “লেকচার্স অন পলিটিক্যাল ইকনমি,” পৃঃ ৩১৯)
৬. “প্রত্যেকটি ম্যানুফ্যাকচারে যত বিভিন্ন রকমের কারিগর: প্রত্যেকটি কাজে তত বেশি শৃংখলা ও নিয়মিত; সেটি সম্পন্ন হয় আরো কম সময়ে, আরো কম শ্রমে।” (“দি অ্যাডভানটেজেস” ইত্যাদি, পৃঃ ৬৮) .
৭. সে যাই হক, অনেক শিল্প-শাখায় ম্যানুফ্যাকচার-প্রণালী এই ফলে উপনীত হয় অসম্পূর্ণ ভাবে, কেননা তা জানেনা কিভাবে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার রাসায়নিক ও ভৌত অবস্থাবলী নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
৮. “যখন প্রত্যেক ম্যানুফ্যাক্টরির উৎপন্ন দ্রব্যের স্ব-বৈশিষ্ট্যের দরুণ) কতগুলি প্রক্রিয়ায় তাকে বিভক্ত করলে হবে সবচেয়ে সুবিধাজনক, সেই সংখ্যাটি এবং, সেই সঙ্গে কত জন লোককে নিযুক্ত করতে হবে সেই সংখ্যাটি নির্ধারিত হয়ে যায়, তখন বাকি যেসব ম্যানুফ্যাক্টরি এই সংখ্যার গুণিতককে নিয়োগ না করে তারা জিনিসটি উৎপাদন করে বেশি খরচে। এই কারণেই উদ্ভূত হয় বৃহৎ প্রতিষ্ঠান স্থাপনের একটা বড় কারণ।” (সি ব্যাবেজ : “অন দি ইকনমি অব মেশিনারি”, প্রথম সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮৩২, পরিচ্ছেদ ২১, পৃঃ ১৮২-১৮৩)
৯. ইংল্যাণ্ডে যেখানে গ্লাস নিপুণ ভাবে ব্যবহৃত হয় সেখানে মেলটিং-ফার্নেস এবং মাস-ফার্নেস’ আলাদা। বেলজিয়ামে একই ফার্নেস দুটি কাজই করে।
১০. এটা দেখা যেতে পারে ডবলু পেটি, জন বেলা, অ্যাণ্ডউ ইয়ারান্টন, “দি অ্যাডভানটেজেস অব দি ইস্ট ইণ্ডিয়। ট্রেড”, এবং জে ভ্যাণ্ডারলিন্ট থেকে, অন্যান্যদের লেখাতেও এর উল্লেখ নেই।
১১. ঘোড়শ শতকের শেষ দিকেও ফ্রান্সে আকর চূর্ণ ও পরিষ্কার করার জন্য হামন দিস্তা ও ছাকনি ব্যবহার করা হত।
১২ মেশিনারির বিকাশের গোটা ইতিহাস ময়দা-কলের ইতিহাস থেকেই পাওয়া যায়। ইংল্যাণ্ডে “ফ্যাক্টরি” তখনো পর্যন্ত “মিল”। জার্মান কৃৎবিজ্ঞান সম্পর্কিত বইপত্রে এই শতকের প্রথম দশক অবধি “মুহল” কথাটি ব্যবহৃত হত কেবল প্রাকৃতিক শক্তিচালিত মেশিনারি বোঝাতেই নয়, ব্যবহৃত হত এমন সমস্ত ম্যানুফ্যাকচার বোঝাতে যেখানে মেশিনারি’ জাতীয় অ্যাপারেটাস” ব্যবহার করা হত।
১২. চতুর্থ খণ্ডে সবিস্তারে দেখানো হবে যে, শ্রম-বিভাগ সম্পর্কে অ্যাডাম স্মিথ নোতুন কোনো বক্তব্যই প্রতিষ্ঠা করেননি। কিন্তু যে-কারণে তাকে ম্যানুফ্যাকচার যুগের বিশিষ্ট অর্থতাত্ত্বিক বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তা হল শ্রম-বিভাগের উপরে তার বিশেষ গুরুত্ব আরোপ। মেশিনারিকে তিনি যে গৌণ স্থান দিয়েছিলেন তা আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পের প্রথম পর্যায়ে লডারডেল-এর, পরবর্তী পর্যায়ে, উরে-র বিতর্কের সূচনা করে। অ্যাডাম স্মিথ শ্রমের হাতিয়ারগুলিকে পৃথগীভবনের সঙ্গে-যে-ব্যাপারে প্রত্যংশ শ্রমিকেরা নিজেরাই নিয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা—মেশিনারির উদ্ভাবনকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন; এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ম্যানুফ্যাক্টরির কর্মীরা নয়, পণ্ডিত ব্যক্তিরা, হন্ত শিল্পীরা এমনকি ক্ষুদ্র-কৃষকেরাও (ব্রিণ্ডলি) একটা ভূমিকা নিয়েছিল।
১৩. “মালিক-ম্যানুফ্যাকচারার বিভিন্ন মাত্রার দক্ষতা ও বলের প্রয়োজন হয় এমন বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাজটিকে ভাগ করে দেয়; সে জানে কোন কোন প্রক্রিয়ার জন্য কোন কোন্ পরিমাণে দুটিকে ক্রয় করতে হবে; অন্য দিকে, যদি গোটা কাজটাই একজন মাত্র কর্মীর দ্বারা সম্পাদিত হত, তা হলে তাকে সবচেয়ে কঠিন কাজটি করার মত যথেষ্ট দক্ষতা এবং সবচেয়ে শ্রমসাধ্য কাজটি করার মত যথেষ্ট শক্তির অধিকারী হতে হত।” (চার্লস ব্যাবেজ, “অনদি ইকনমি অফ মেশিনারী এ্যাও ম্যানুফ্যাকচার্স,” লন ১৮৩২, অধ্যায় ১৯)।
১৪. যেমন, কোন পেশীর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, কোন অস্থির বক্রতা ইত্যাদি।
১৫. জনৈক তদন্ত কমিশনার প্রশ্ন করেছিলেন, কেমন করে ছোট ছেলে-মেয়েদের কাজে ধরে রাখা হয়? তার উত্তরে এক কঁচ-কারখানার ম্যানেজার মিঃ মার্শাল সঠিক ভাবেই বলেছিলেন, তারা তাদের কাজ উপেক্ষা করতে পারে না, একবার কাজ শুরু করলে তা শেষ করতেই হবে; তারা ঠিক মেশিনের বিভিন্ন অংশের মত।” (“শিশু নিয়োগ-কমিশন, চতুর্থ রিপোর্ট, ১৮৬৫, পৃঃ ২৪৭)।
১৬. ড উরে তার আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পের মহিমা কীর্তনে ব্যাবেজ-এর মত পুর্বতন অর্থতাত্ত্বিকদের তুলনায় আরো তীক্ষ্ণভাবে ম্যানুফ্যাকচারের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশ করেন; ব্যাবেজ গণিতজ্ঞ ও যন্ত্র-বিশেষজ্ঞ হিসাবে ছিলেন উরে-র চেয়ে ঢের উচুতে, কিন্তু তিনি যান্ত্রিক শিল্পকে দেখেছিলেন একমাত্র ম্যানুফ্যাকচারকারীর দৃষ্টিতে। উরে বলেন, “প্রত্যেকের জন্য এই কাজের বিলি-বণ্টন, উপযুক্ত মূল্য ও ব্যয়ের এক একজন কর্মীকে বরাদ্দকরণ-এটাই হল শ্রম-বিভাগের আসল মর্ম।” অন্য দিকে, তিনি এম-বিভাজনকে বর্ণনা করেন বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন প্রতিভার সঙ্গে শ্রমের অভিযোজন” বলে এবং সর্বশেষে সমগ্র ম্যানুফ্যাকচার-প্রণালীকে “শ্রমের-বিভাজন ও পর্যায়ীকরণের এক প্রণালী” হিসাবে, “দক্ষতার মাত্রা অনুযায়ী শ্রমের বিভাজন” হিসাবে। (উরে, “দি ফিলসফি অব ম্যানুফ্যাকচার্স”, ফরাসী অনুবাদ, পৃঃ ১৯-২৩)।
১৭. “প্রত্যেক হস্তশিল্পীকে একটি বিন্দুতে অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে নিখুৎ করে তুলতে দেওয়া হয় বলে, সে হয়ে উঠত একজন অপেক্ষাকৃত সস্তা মজুর।” (উরে, “দি ফিলসফি অব ম্যানুফ্যাকচার্স”, পৃঃ ১৯)।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ — ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাগ এবং সমাজে এম-বিভাগ
আমরা প্রথমে বিবেচনা করেছিলাম ম্যানুফ্যাকচারের উৎপত্তি, তার পরে তার বিবিধ সরল উপাদান, তারপর প্রত্যংশ শ্রমিক ও তার বিভিন্ন উপকরণ এবং সর্বশেষে সমগ্র ভাবে এই ব্যবস্থাটি। এখন আমরা দৃষ্টি দেব ম্যানুফ্যাকচারগত এম-বিভাজন এবং সামাজিক শ্রম-বিভাজনের উপরে, যা সমস্ত পণ্যোৎপাদনের ভিত্তিস্থানীয়।
আমরা যদি একমাত্র শ্রমকেই আমাদের নজরে রাখি, তা হলে আমরা প্রধান প্রধান বিভাগে তথা গণজাতিতে—যেমন কৃষি, শিল্প ইত্যাদিতে তার পৃথগভবনকে অভিহিত করতে পারি সাধারণ শ্রম-বিভাজন হিসাবে এবং এক-একটি গণজাতির প্রজাতি ও উপ-প্রজাতিতে বিভাজনকে বিশেষ শ্রম-বিভাজন হিসাবে এবং কর্মশালার অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাজনকে একক বা প্ৰত্যংশ শ্রম-বিভাজন হিসাবে।[১]
সমাজে এম-বিভাজন এবং সেই সঙ্গে একটি বিশেষ পেশায় ব্যক্তি-মানুষদের বাধা পড়ার ব্যাপারটি বিকাশ লাভ করে বিপরীত সূচনা-বিন্দু থেকে, ঠিক যেমন ম্যানুফ্যাকচারেও ঘটে থাকে। একটি পরিবারের মধ্যে[২] এবং আরো অগ্রগতির পরে একটি গোষ্ঠীর মধ্যে, স্বাভাবিক ভাবেই, উদ্ভূত হয় এক ধরনের শ্রম-বিভাগ, যার কারণ নারী-পুরুষের পার্থক্য, অতএব, শারীরবৃত্তগত পার্থক্য—যে শ্রম-বিভাগ তার উপাদানসমূহের বৃদ্ধিসাধন করে জনসমাজের বৃদ্ধিসাধনের মাধ্যমে এবং বিশেষ করে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ এবং এক গোষ্ঠীর উপরে অন্য গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে। অপর পক্ষে, যে কথা আমি আগেই বলেছি, দ্রব্য-বিনিময়ের উদ্ভব ঘটে, সেই সব ক্ষেত্রে যেখানে বিভিন্ন পরিবার, গোষ্ঠী, জনসমাজ পরস্পরের সংস্পর্শে আসে; কারণ সভ্যতার প্রারম্ভে বিভিন্ন পরিবার, গোষ্ঠী ইত্যাদির স্বাধীন মর্যাদার ভিত্তিতে মিলিত হয়, ব্যক্তিবিশেষরা নয়। বিভিন্ন জনসমাজ তাদের আপন আপন প্রাকৃতিক পরিবেশে উৎপাদনের ভিন্ন ভিন্ন উপায় ও প্রাণধারণের ভিন্ন ভিন্ন উপকরণের সন্ধান পায়। সুতরাং তাদের উৎপাদন-পদ্ধতি, জীবনধারণের পদ্ধতি এবং তাদের উৎপন্ন দ্রব্যাদিও হয় ভিন্ন ভিন্ন। যখন বিভিন্ন জনসমাজ পরস্পরের সংস্পর্শে আসে, তখন স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে বিকশিত এই বিভিন্নতাই পারস্পরিক দ্রব্য-বিনিময়ের প্রয়োজন ঘটায়। বিনিময় উৎপাদনের-ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে বিভিন্নতা সৃষ্টি করে না, বরং যেগুলি আগে থেকেই বিভিন্ন, সেগুলির মধ্যে সম্পর্ক ঘটায় এবং যেগুলিকে রূপান্তরিত করে একটি সম্প্রসারিত সমাজের সমষ্টিগত উৎপাদনের মোটামুটি পরস্পর-নির্ভর শাখা হিসাবে। এই শেষোক্ত ক্ষেত্রে সামাজিক শ্রম-বিভাগের উদ্ভব ঘটে উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে বিনিময় থেকে, যেগুলি পরস্পর থেকে মূলতঃ আলাদা ও স্বতন্ত্র। পূর্বোক্ত ক্ষেত্রে, যেখানে শারীরবৃত্তগত শ্রম-বিভাগই হচ্ছে সূচনা-বিন্দু, সেখানে একটি সুসংবদ্ধ সমগ্রের প্রধান প্রধান অঙ্গগুলি ঢিলেটালা হয়ে যায় প্রধানতঃ বিদেশী জনসমাজগুলির সঙ্গে বিনিময়ের কারণে, এবং তারপর নিজেদেরকে এতদূর পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে যে, শেষ পর্যন্ত বিবিধ প্রকারের কাজকে যা যুক্ত করে রাখে, তা হল পণ্য হিসাবে এই উৎপন্নগুলির বিনিময়। এক ক্ষেত্রে, যা ছিল স্বনির্ভর, তাকে করা হল পরনির্ভর এবং অন্য ক্ষেত্রে, যা ছিল পরনির্ভর, তাকে করা হল স্বনির্ভর।
সুবিকশিত ও পণ্য বিনিময়ের দ্বারা সংঘটিত প্রত্যেক শ্রম-বিভাগের ভিত্তি হল শহর ও গ্রামের মধ্যে বিচ্ছেদ।[৩] এটা বলা যেতে পারে যে, সমাজের সমগ্র অর্থ নৈতিক ইতিহাস এই বৈপরীত্যের গতি-প্রক্রিয়ার মধ্যেই ক্ষুদ্রাকারে বিধৃত। সে যাক, আপাততঃ আমরা ব্যাপারটিকে ডিঙিয়ে যাচ্ছি।
যেমন যুগপৎ নিযুক্ত কিছু সংখ্যক শ্রমিক হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাজনের বাস্তব পূর্বশর্ত, ঠিক তেমনি জনসংখ্যার আয়তন ও ঘনত্ব, যা এখানে বোঝায় একটি কর্মশালায় সন্নিবিষ্ট জনসংখ্যা, ভাই হল সমাজে শ্রম-বিভাজনের আবশ্যিক ভিত্তি।[৪]
যাই হোক, এই ঘনত্ব কমবেশি আপেক্ষিক। মোগাযোগের সুব্যবস্থা রয়েছে এমন একটি আপেক্ষিক ভাবে জনবিরল দেশ যোগাযোগের সুব্যবস্থা নাই এমন একটি অধিকতর জনবহুল দেশের তুলনায় ঘনতর জনবসতির অধিকারী; এবং এই অর্থে, দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায় যে, ভারতের তুলনায় আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলের জনবসতি ঘনতর।[৫]
যেহেতু পণ্যের উৎপাদন ও সঞ্চলন হচ্ছে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির পূর্বশর্ত, সেহেতু ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাজন পূর্বাহ্নেই একটি বিশেষ মাত্রায় বিকশিত হয়ে গিয়েছে। বিপরীত ভাবে বলা যায়, পূর্ববর্তী শ্রম-বিভাজন পরবর্তী শ্রম-বিভাজনের বিকাশ ও বৃদ্ধি ঘটায়। সেই একই সময়ে, শ্রম-উপকরণসমূহের সঙ্গে সঙ্গে, যেসব শিল্প এইসব উপকরণ উৎপাদন করে সেগুলিও আরো বেশি করে পৃথগীভূত হয়।[৬] ম্যানুফ্যাকচার যদি এমন কোন শিল্পের উপরে আধিপত্য বিস্তার করে, যে-শিল্প পূর্বে প্রধান বা অধীন হিসাবে অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে সংযোগে এবং একজন উৎপাদনকারকের পরিচালনায় পরিচালিত হত, তা হলে এই শিল্পগুলি তৎক্ষণাৎ তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নেয় এবং স্বতন্ত্র হয়ে যায়। ম্যানুফ্যাকচার যদি কোন পণ্যের উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় কোন একটি পর্যায়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা করে, তা হলে তার অন্যান্য পর্যায়গুলি ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র শিল্পে রূপান্তরিত হয়ে যায়। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, যেখানে পূর্ণ-প্রস্তুত জিনিসটি কেবল একত্র-সংযোজিত কয়েকটি অংশ মাত্র, সেখানে প্রত্যংশ কর্মকাণ্ডগুলি নিজেদেরকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে বিবিধ, বিচ্ছিন্ন, বিশুদ্ধ হস্তশিল্প হিসাবে। ম্যানুফ্যাকচারে এম-বিভাজনকে আরো নিখুৎ ভাবে কার্যকরী করে তোলার জন্য, উৎপাদনের একটি একক শাখা তার কাচামালের বিভিন্নতা অনুযায়ী কিংবা একই কাঁচামাল যে-সমস্ত বিভিন্ন আকার ধারণ করতে পারে, তদনুযায়ী অসংখ্য, এবং কিছুটা মাত্রায় সম্পূর্ণ নোতুন ম্যানুফ্যাকচারে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। তদনুযায়ী, আঠারো শতকের প্রথমার্ধে একমাত্র ফ্রান্সেই ১০০ বিভিন্ন ধরনের রেশম-সামগ্রী বোনা হত এবং অ্যাভিগননে আইন ছিল যে, প্রত্যেক শিক্ষানবিশ আত্মনিয়োগ করবে কেবল একধরনের কারিগরি কাজে এবং সে কোনমতেই একাধিক ধরনের সামগ্রী প্রস্তুত করার কাজ শিখবে না। শ্রমের আঞ্চলিক বিভাজন উৎপাদনের বিশেষ বিশেষ শাখাকে একটি দেশের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে নিবদ্ধ করে এবং এই কাজে ম্যানুফ্যাকচার থেকে প্রেরণা লাভ করে, যার কাজই হল সব রকমের বিশেষ সুবিধার সুযোগ গ্রহণ।[৭] ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ও বিশ্বের বাজারসমূহের উন্মোচন যেদুটি ব্যাপারই ম্যানুফ্যাকচার-যুগের অস্তিত্বের সাধারণ শর্তাবলীর অন্তভুক্ত-সমাজে শ্রম-বিভাজনের বিকাশ ঘটানোর পক্ষে সমৃদ্ধ উপাদান যোগায়। শ্রম-বিভাজন কিভাবে কেবল অর্থ নৈতিক ক্ষেত্রটিই নয়, পরন্তু বাকি সমস্ত সামাজিক ক্ষেত্রেও আত্মবিস্তার করে এবং সর্বত্রই ভিত্তি স্থাপন করে মানুষের বিশেষীকরণ ও বিন্যাস-সাধনের সর্বব্যাপক ব্যবস্থাটির যা মানুষের সমস্ত কর্মশক্তির বিনিময়ে কেবল একটি মাত্র শক্তির বিকাশ ঘটায়, যে সম্পর্কে অ্যাডাম স্মিথের প্রভু এ ফার্গুসন এই বলে চেঁচিয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছিলেন, “আমরা গড়ে তুলছি হেলটদের একটি জাতি; আমাদের এখানে নেই কোনো স্বাধীন নাগরিক”—সেই ব্যবস্থাটি সম্পর্কে আলোচনা চালিয়ে যাবার অবকাশ এখানে নেই।[৮]
কিন্তু তাদের মধ্যে অসংখ্য সাদৃশ্য ও সংযোগ থাকা সত্ত্বেও সমাজের অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাগ কেবল মাত্রাগত ভাবেই নয়, প্রকারগত ভাবেও পরস্পর থেকে ভিন্ন। যেখানে সংশ্লিষ্ট শিল্পটির বিভিন্ন শাখাকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি অদৃশ্য বন্ধন বিদ্যমান থাকে, কেবল সেখানেই সাদৃশ্যটি সবচেয়ে তর্কাতীত ভাবে প্রতিভাত হয়। যেমন, গো-পালক কাচা চামড়া উৎপাদন করে, চর্মকার সেই চামড়াকে পাকা চামড়ায় পরিণত করে, পাদুকাকার তা দিয়ে জুতো তৈরি করে। এখানে তারা প্রত্যেকে যে যা করছে, তাই হল চূড়ান্ত রূপটির দিকে একটি করে পদক্ষেপ, যা হবে তাদের সকলের সংযোজিত শ্রমের ফল। তা ছাড়া রয়েছে বিবিধ শিল্প যা গো-পালককে, চর্মকারকে, পাদুকাকারকে সরবরাহ করে উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণ। এখন অ্যাডাম স্মিথের সঙ্গে আমরাও কল্পনা করতে পারি যে, উল্লিখিত সামাজিক শ্রম-বিভাগ এবং ম্যানুফ্যাকচার-গত শ্রম-বিভাগের মধ্যে পার্থক্যটি নিছক বিষয়ীগত, যার অস্তিত্ব কেবল পর্যবেক্ষকের চোখে, যে একটি ম্যানুফ্যাকচারে এক নজরে দেখতে পায় সমস্ত কয়টি কর্মকাণ্ডকে ঘটনাস্থলে সম্পাদিত হতে, অন্য দিকে, উপরে বর্ণিত দষ্টান্তটিতে সংশ্লিষ্ট কাজটি বিরাট বিরাট এলাকায় ছড়িয়ে থাকায় এবং প্রত্যেকটি শ্রমশাখায় বহুসংখ্যক লোক নিযুক্ত থাকায় ব্যাপারটা থেকে যায় অন্তরালে।[৯] কিন্তু কী সেই ব্যাপার, যা গো-পালক চর্মকার ও পাদুকাকারের ভিন্ন ভিন্ন শ্রমের মধ্যে বন্ধন হিসাবে কাজ করে? সেই ঘটনাটি হচ্ছে এই যে তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ উৎপন্ন সামগ্রীই হল পণ্য। অন্যদিকে ম্যানুফ্যাকচার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য কি? সেই বৈশিষ্ট্যটি হল এই ঘটনা যে, প্রত্যংশ শ্রমিক কোন পণ্যই উৎপাদন করে না।[১০] সমস্ত প্রত্যংশ শ্রমিকের যৌথ উৎপন্ন ফলটিই হচ্ছে কেবল পণ্য।[১১] সমাজে এম-বিভাগ সংঘটিত হয় শিল্পের বিভিন্ন শাখায় উৎপন্ন দ্রব্যাদির বিক্রয় ও ক্রয়ের দ্বারা; অন্য দিকে, একটি কর্মশালায় প্রত্যংশ কর্মকাণ্ডগুলির মধ্যে যোগটির হেতু হচ্ছে একই ধনিকের কাছে অনেক শ্রমিকের শ্রমশক্তি বিক্রয়ের ঘটনাটি, যে-ধনিক সেই শক্তিকে প্রয়োগ করে। সংযোজিত শ্রমশক্তি হিসাবে। কর্মশালায় শ্রম-বিভাগের তাৎপর্য হচ্ছে একজন খনিকের হাতে উৎপাদনের উপায়সমূহের কেন্দ্রীভবন; অন্য দিকে, সমাজে এম-বিভাগের তাৎপর্য হচ্ছে বহুসংখ্যক স্বতন্ত্র পণ্যোৎপাদনকারীর মধ্যে তাদের বিক্ষিপ্ত বিকেন্দ্রীভূত অবস্থান। কর্মশালার ভিতরে যখন আনুপাতিকতার লৌহ বিধান নির্দিষ্টসংখ্যক শ্রমিককে নির্দিষ্ট কাজেকর্মে আবদ্ধ রাখে, তখন কর্মশালার বাইরেকার সমাজে শিল্পের বিভিন্ন শাখার মধ্যে উৎপাদনকারীদের ও তাদের উৎপাদনের উপায়সমূহের বিলিবণ্টনে আকস্মিকতা ও খেয়ালখুশি অবাধে কাজ করে। এটা ঠিক যে, উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্র নিরন্তর একটা ভারসাম্যের দিকে যাবার প্রবণতা দেখায়, কেননা যখন, একদিকে, একটি পণ্যের প্রত্যেকটি উৎপাদনকারী একটি বিশেষ সামাজিক অভাব পূরণের জন্য একটি ব্যবহার-মূল্য উৎপাদন করতে বাধ্য এবং যখন ঐ সমস্ত অভাবের পরিমাপ মাত্রাগত ভাবে বিভিন্ন, তখন সেখানে থাকে এমন একটি অন্তলীন সম্পর্ক, যা তাদের অনুপাতকে একটি নিয়মিত প্রণালীর মধ্যে স্থিত করে দেয়। অন্য দিকে, পণ্যের মূল্য-নিয়মটি শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত করে দেয় তার কতটা নিয়োগ-যোগ্য এম-সময়কে সমাজ প্রত্যেকটি বিশেষ শ্রেণীর পণ্যের জন্য ব্যয় করতে পারে। কিন্তু উৎপাদনের এই বিবিধ ক্ষেত্রের ভারসাম্যের দিকে যাবার প্রবণতা অভিব্যক্ত হয় কেবল এই ভারসাম্যের নিরন্তর বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার আকারেই। যে-এমবিভাগ অবরোহমূলক প্রণালীর ভিত্তিতে কর্মশালার অভ্যন্তরে নিয়মিত সম্পাদিত হয়, তাই আবার সমাজের অভ্যন্তরে পরিণত হয় আরোহমূলক প্রণালী-সঞ্জাত প্রকৃতি-প্ৰতিত আবশ্যিক প্রয়োজন হিসাবে, যা নিয়ন্ত্রণ করে উৎপাদনকারীদের উচ্ছল খেয়ালখুশিকে এবং আত্মপ্রকাশ করে বাজার দরের তাপমান-যন্ত্রসুলভ উত্থান-পতনে। কর্মশালার অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাগের নিহিতার্থ হচ্ছে মানুষজনের উপরে ধনিকের তর্কাতীত প্রাধান্য-মানুষজন হচ্ছে কেবল একটা যন্ত্রের বিভিন্ন অংশস্বরূপ, যে যন্ত্রটির মালিক হল ঐ ধনিক। সমাজের অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাগ স্বতন্ত্র উৎপাদনকারীদের নিয়ে আসে পারস্পরিক সংস্পর্শে, যারা প্রতিযোগিতা-ব্যতিরেকে, পারস্পরিক স্বার্থ-সংঘাতজনিত জবরদস্তি ব্যতিরেকে অন্য কোনো কর্তৃত্বকে স্বীকার করেনা ঠিক যেমন পশুরাজ্যে bellum omnium contra omnes প্রত্যেকটি প্রজাতির অস্তিত্বকে রক্ষা করে।
সেই একই বুর্জোয়া মানস, যা কর্মশালায় শ্রম-বিভাগের একটি আংশিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আজীবন সংযোজনের এবং মূলধনের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের গুণকীর্তন করে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সংগঠন হিসাবে, হঁ্যা, ঠিক সেই একই বুর্জোয়া মানসই আবার উৎপাদন-প্রক্রিয়ার সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মনের জন্য প্রত্যেকটি পচেষ্টাকে সমান তেজে ধিক্কার জানায় সম্পত্তির অধিকার এবং ব্যক্তিগত ধনিকের প্রবৃত্তির স্বাধীনতা ও অবাধ বিকাশের মত পবিত্র অধিকারগুলির উপরে অন্যায় অনুপ্রবেশ হিসাবে। এটা খুবই বৈশিষ্ট্যসূচক যে, সমাজের শ্রমের একটি সাধারণ সংগঠন গড়ে তুললে তা সমগ্র সমাজকে পর্যবসিত করবে একটি বিশাল কারখানায়-এর চেয়ে বেশি সাংঘাতিক কোন যুক্তি ছাড়া, উক্ত শ্রম-সংগঠনের বিরুদ্ধে কারখানা-ব্যবস্থার উৎসাহী উকিলদের আর কিছুই বলার নেই।
ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা-সমন্বিত কোন সমাজে সামাজিক শ্রম-বিভাজনে অরাজকতা এবং কর্মশালার অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাজনে অরাজকতা যেমন একটি অপরটির পারস্পরিক শত, তেমন সমাজের সেই প্রারম্ভিক পর্যায়গুলিতেযখন বৃত্তি-বিভাজন প্রথমে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উদ্ভূত, পরে স্ফটিকায়িত এবং শেষ পর্যন্ত আইন-প্রণয়নের মাধ্যমে স্থায়ীকৃত হচ্ছিল, তখন আমরা দেখি, একদিকে, একটি অনুমোদিত, কর্তৃত্বসমন্বিত পরিকল্পনা-অনুযায়ী শ্রম-সংগঠনের নমুনা এবং অন্য দিকে কর্মশালার মধ্যে শ্রম-বিভাজনের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি কিংবা, খুব বেশি হলে, তার এক বামনাকৃতি বা বিক্ষিপ্ত আপতিক বিকাশ। [১২]
ঐ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ও অতি প্রাচীন ভারতীয় জনসমাজগুলি যাদের মধ্যে কতকগুলি টিকে আছে আজও পর্যন্ত–সেগুলির ভিত্তি হল জমির উপরে যৌথ অধিকার, কৃষি ও হস্তশিল্পের সংমিশ্রণ ও অপরিবর্তনীয় এক শ্রম-বিভাজনযে শ্রম-বিভাজন যখনি এক নোতুন জনসমাজের সূচনা হত, তখনি কাজ করত হাতের কাছে প্রস্তুত একটি দৃঢ়বদ্ধ পরিকল্পনা ও ছক হিসাবে। ১০০ থেকে কয়েক সহস্র একর জমির অধিকারী এই জাতীয় প্রত্যেকটি জনসমাজ হল এক-একটি অখণ্ড সমগ্র, যা তার প্রয়োজনীয় সব কিছুই উৎপাদন করে। উৎপাদিত পণ্যসম্ভারের প্রধান অংশটাই স্বয়ং এই জনসমাজটিরই প্রত্যক্ষ ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট। সুতরাং এখানে উৎপাদন, পণ্য-বিনিময়ের দ্বারা সমগ্র ভাবে ভারতীয় সমাজে যে শ্রম-বিভাজন সংঘটিত হয়েছে, তা থেকে নিরপেক্ষ। কেবল উত্তটাই এখানে পণ্য হয়ে ওঠে এবং এমনকি তারও একটা অংশ যে পর্যন্ত তা রাষ্ট্রের হাতে না পৌছাচ্ছে, সে পর্যন্ত নয়—যার হাতে স্মরণাতীত কাল থেকে এই উৎপন্ন দ্রব্যাদির একটি অংশ খাজনার আকারে গিয়ে জমা পড়ে আসছে। এই সমস্ত জনসমাজের গড়ন ভারতের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকমের। সরলতম রূপের জনসমাজ গুলির জমির চাষ হয় যৌথ ভাবে এবং তার উৎপন্ন ফসল বন্টিত হয় সদস্যদের মধ্যে। একই সময়ে প্রত্যেকটি পরিবারেই সুতো কাটা ও কাপড় বোনা চলে গৌণ শিল্প হিসাবে। এক ও অভিন্ন কাজে ব্যাপৃত জনসমষ্টির পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই “মুখ্য অধিবাসী”-কে যে একাধারে বিচারক, সান্ত্রী ও তহশিলদার, দেখতে পাই। হিসাবরক্ষককে যে কৃষিকাজের হিসাব রাখে এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাবৎ বিষয় লিপিবদ্ধ করে, অন্য একজন কর্মচারীকে যে অপরাধীদের অভিযুক্ত করে, ঐ গ্রাম অতিক্রমকারী বহিরাগতদের রক্ষা করে এবং পরবর্তী গ্রাম পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দিয়ে আসে, সীমানা-প্রহরী যে প্রতিবেশী জনসমাজগুলির বিরুদ্ধে সীমানা পাহারা দেয়; জল-বণ্টনকারী যে সেচের কাজের জন্য যৌথ জলাশয় থেকে জল বেঁটে দেয়; ব্রাহ্মণ যে ধর্মানুষ্ঠানগুলি পরিচালনা করে; শিক্ষক যে বালির উপরে ছেলেদের লিখতে পড়তে শেখায়; পঞ্জিকাকার বা গণৎকার যে বীজ বোনা ও ফসল কাটার শুভাশুভ দিনগুলি জানিয়ে দেয়; একজন কর্মকার ও একজন সূত্রধর যারা কৃষি-উপকরণগুলি তৈরি ও মেরামত করে, কুম্ভকার যে গ্রামের প্রয়োজনীয় হাঁড়ি-কলসি ইত্যাদি তৈরি করে, একজন রৌপ্যকার কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে রৌপ্যকারের বদলে একজন কবি; কোন কোন জনসমাজে বিদ্যালয়-শিক্ষক। এই এক ডজন লোকের ভরণ-পোষণ চলে গোটা জন সমাজটির খরচে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খালি জমিতে পুরনো ধাঁচেই একটি নোতুন জনসমাজের সূত্রপাত হয়। সমগ্র ব্যবস্থাটিতেই প্রকাশ পায় একটি শ্রম-বিভাগ কিন্তু ম্যানুফ্যাকচারে যে ধরনের শ্রম-বিভাগ থাকে, এখানে তা অসম্ভব, যেহেতু কর্মকার, সূত্রধর এখানে পায় একটি অপরিবর্তনশীল বাজার এবং, বড় জোর, গ্রামগুলির আয়তন অনুসারে সেখানে দেখা দেয় একজনের বদলে প্রত্যেক ধরণের দু-তিন জন করে।[১৩] যে আইন জনসমাজ শ্রম-বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা প্রকৃতির নিয়মের মতই অপ্রতি রোধ্য কতৃত্ব নিয়ে কাজ করে; একই সময়ে প্রত্যেক ব্যক্তিগত কারিগর, কর্মকার, বা সূত্রধর ইত্যাদি তার কর্মশালায় তার হস্তশিল্পের সব কটি কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে চিরাচরিত প্রথায় কোনো উপরওয়ালা কতৃপক্ষকে না মান্য করেই। এই সমস্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ জনসমাজ, যেগুলি নিরন্তর নিজেদেরকে একই আকারে পুনরুৎপাদন করে চলে এবং যদি কখনো কোন দুর্ঘটনায় কোনটি ধ্বংস হয়ে যায়, তা হলে আবার ঐ একই জায়গায় একই নামে যাদের উদ্ভব ঘটে।[১৪] এই জনসমাজগুলির উৎপাদন-সংগঠনের সরলতা এশীয় সমাজ-সমূহের অপরিবর্তনীয়তার চাবিকাঠি যোগায়—যে অপরিবর্তনশীলতা এশীয় রাষ্ট্রগুলির নিরন্তর ভাঙন ও পুনর্গঠনের এবং বংশানুক্রমের অবিচ্ছিন্ন পবির্তন প্রবাহের তুলনায় এত জাল মান। রাজনৈতিক আকাশে ঝড়-ঝকা সত্ত্বেও সমাজের অর্থনৈতিক উপাদানগুলি থাকে অনাহত।
যে কথা আমি আগেই বলেছি, একজন মালিক কতসংখ্যক শিক্ষানবিশ ও ঠিকা মজুর নিয়োগ করতে পারবে গিভের নিয়মকানুন তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া গিন্ড মাস্টার ধনিক হয়ে উঠতে পারেনি। তা ছাড়া, সে নিজে যে হস্তশিল্পের মালিক, সেখানে ছাড়া অন্যত্র সে তার ঠিকা-মজুরদের নিযুক্ত করতে পারত না। বণিকের মূলধনের প্রত্যেকটি অনুপ্রবেশকে গিল্ড প্রবল উদ্যমে প্রতিহত করত এবং কেবল এই ধরনের স্বাধীন মূলধনেরই সংস্পর্শে তারা আসত। বণিক প্রত্যেক ধরনের পণ্যই ক্রয় করতে পারত। কিন্তু শ্রমকে পণ্য হিসাবে ক্রয় করতে সে পারত না। কেবল হস্তশিল্প জাত দ্রব্যাদির কারবারি হিসাবেই তার অস্তিত্বকে মেনে নেওয়া হত। যদি ঘটনাক্রমে অধিকতর শ্রম-বিভাজনের প্রয়োজন দেখা দিত, তা হলে উপস্থিত গিম্ভগুলিই নিজেদেরকে বিভক্ত করে বিভিন্ন গিলডে পরিণত করত কিংবা পুরনন গিন্ডগুলির পাশাপাশি নোতুন গিল্ড প্রতিষ্ঠা করত; কিন্তু এসবই করা হত একটিমাত্র কর্মশালায় বিবিধ হস্তশিল্পে কেন্দ্রীভূত না করে। অতএব গিল্ড-সংগঠন হস্তশিল্পগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে, স্বতন্ত্র করে ও পূর্ণাঙ্গ করে ম্যানুফ্যাকচারের অস্তিত্বের উপযোগী অবস্থাবলী সৃষ্টি করতে যত সাহায্যই করে থাক না কেন, তা কর্মশালা থেকে শ্রম-বিভাগকে বাদ দিয়ে রাখত। মোটামুটি ভাবে, শামুক যেমন তার খোলসটির সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত থাকে, তেমনি শ্রমিকও তার উৎপাদন-উপকরণের সঙ্গে যুক্ত থাকত এবং এই কারণেই ম্যানুফ্যাকচারের প্রধান ভিত্তিটি ছিল ‘অনুপস্থিত-যে ভিত্তিটি হচ্ছে উৎপাদনের উপায় উপকরণ থেকে শ্রমিকদের বিচ্ছেদ এবং এই উপায়-উপকরণের মূলধনে রূপান্তরণ।
যেখানে ব্যাপক সমাজে শ্রম-বিভাগ তা সে পণ্য-বিনিময়ের দ্বারাই সংঘটিত হোক বা অন্য কোন ভাবেই সংঘটিত হোক—সমাজের সবচেয়ে বিভিন্ন অর্থনৈতিক গঠনে অভিন্ন ভাবে উপস্থিত, সেখানে ম্যানুফ্যাকচার-প্রবর্তিত শ্রম-বিভাগ একমাত্র ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতিরই-সৃষ্টি।
————
১. শ্রম-বিভাজন অগ্রসর হয় সেই বিভাজন থেকে বহুল পরিমাণে ভিন্নতর বৃত্তি বিভাজন থেকে, যেখানে কয়েকজন শ্রমিক নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় একটি অভিন্ন দ্রব্যের উৎপাদন, যেমন ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থায়। (স্টর্চ : “কোর্স অব পলিটিক্যাল ইকনমি”, ফরাসী সংস্করণ, পৃঃ ১৭৩)। “Nous rencontrons chez les peuples parvenus a un certain degre de civilisation trois genres de divisions d’industrie : la premiere, que nous nommerons generale, amene la distinction des producteurs en agriculteurs, manufacturiers et comm ercants, elle se rapporte aux trois principales branches d’industrie nationale; la seconde, qu’on pourrait appeler speciale, est la division de chaque genre d’industrie en especes… la troisieme division d’industrie, celle enfin qu’on devrait qualifier de division de la besogne ou de travail proprement dit, est celle qui s’etablit dans les arts et les metiers separes… qui ‘soetablit dans la plupart des manufactures et des ateliers.” (Skarbek, Theorie des richesses sociales vol. I 2nd, edition. Paris, 1839. pp. 84, 85.)
২. তৃতীয় সংস্করণের টীকা-পরবর্তীকালে মানুষের আদিম অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধানের ফলে গ্রন্থকার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পরিবার প্রথমে গোষ্ঠীতে বিকাশ লাভ করেনি, বরং গোষ্ঠীই হল মানবিক সংগঠনের রক্ত-সম্পর্কের উপরে প্রতিষ্ঠিত, আদিম ও স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে বিকশিত রূপ, এবং গোষ্ঠীগত বন্ধনের প্রাথমিক ক্রমবর্ধমান শিথিলতা থেকেই পরবর্তী কালে পরিবারের বহু এবং বিবিধ রূপের বিকাশ ঘটে।-এফ, এঙ্গেলস।
৩. স্যার জেমস স্টুয়ার্ট হলেন সেই অর্থনীতিবিদ, যিনি সবচেয়ে ভালভাবে এই বিষয়টি আলোচনা করেছেন। “ওয়েথ, অব নেশনস থেকে দশ বছর আগে প্রকাশিত হলেও, তার বইটি আজও পর্যন্ত কত কম পরিচিত, তা বোঝা যায় এই ঘটনাটি থেকে যে ম্যালথাসের ভক্তরা পর্যন্ত জানেন না যে, তার বইয়ের প্রথম সংস্করণটিতে, একমাত্র বাক্যালংকার ছাড়া এমন আর কিছু নেই যা প্রধানতঃ স্টুয়ার্ট থেকে এবং কিছু পরিমাণে ওয়ালেস এবং টাউনসে ণ্ড থেকে উদ্ধত অনুচ্ছেদ নয়।
৪. জনসংখ্যার এমন একটা বিশেষ মাত্রার ঘনত্ব আছে, যা সামাজিক আদান প্রদান এবং সেই শক্তি-সম্মিলন, যার দ্বারা শ্রমের উৎপন্ন বৃদ্ধি পায়—উভয়ের পক্ষে সুবিধাজনক। জেমস মিল, “এলিমেন্টস অব পলিটিক্যাল ইকনমি”, পৃঃ ৫০)। “শ্রমিকদের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পায়, সমাজের উৎপাদন ক্ষমতা তত বর্ধিত হয় সেই বৃদ্ধি সশ্রম-বিভাগের ফলসমূহের চক্রবৃদ্ধি হারে।” (থমাস হজস্কিন : “লেবর ডিফেন্ডেড এগেইনস্ট দি ক্লেইমস অব ক্যাপিট্যাল”, পৃঃ ১২৫, ১২৬)।
৫. ১৮৬১ সালের পরে তুলার বিপুল চাহিদার ফলে, ভারতের কয়েকটি ঘন বসতিপূর্ণ অঞ্চলে চালের চাষ কমিয়ে তুলার চাষ বাড়ানো হয়েছিল। পরিণামে সেখানে স্থানীয় ভাবে দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব ঘটল; যোগাযোগের অব্যবস্থার দরুণ অন্য অঞ্চল থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে চাল পাঠানো সম্ভব হয়নি।
৬. এই ভাবে, সেই সপ্তদশ শতকেই হল্যাণ্ডে মাকু-তৈরি পরিণত হল শিজের একটি বিশেষ শাখায়।
৭. ইংল্যাণ্ডের পশম-জাত দ্রব্যাদির ম্যানুফ্যাকচার কয়েকটি অংশে বা শাখায় বিভক্ত হয়ে, যেসব জায়গায় সেগুলি একান্তভাবে বা বিশেষভাবে উৎপন্ন হয়, সেসব জায়গায় আত্মীকৃত হয়েছে কি হয়নি, কিন্তু মিহি কাপড় সমারসেটশায়ারে, মোটা কাপড় ইয়র্কশায়ারে, লং-এল এক্সেটারে, ক্রেপ’ নকইচে, কম্বল হুইটিনিতে নিবদ্ধ হয়েছে। (ব্রেকলি : “দি কুইরিস্ট” ১৭৫১-৫২০ )
৮. এ ফার্গুসন, “হিস্ট্রি অব সিভিল সোসাইটি” এডিনবরা ১৭৬৭, ৪র্থ অধ্যায়, ২য় অনুচ্ছেদ, পৃঃ ২৮৫।
৯. তিনি বলেন, সঠিক ম্যানুফ্যাকচারে, এম-বিভাগ বেশি হয় বলে মনে হয়, কারণ উপস্থিত কাজটির ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যেকটি শাখায় যারা নিযুক্ত হয়, তাদের প্রায়ই একই কর্ম-নিবাসে সমবেত করা যায় এবং একই সঙ্গে দর্শকের চোখের সামনে স্থাপন করা যায়। অন্য দিকে ঐ সব বৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারে—যেগুলি বিপুল জনসংখ্যার বিপুল প্রয়োজন মেটাবে, সেগুলিতে প্রত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন শাখায় এত বিরাট সংখ্যক লোক নিযুক্ত হয় যে তাদের সকলকে একই কর্ম-নিবাসে সমবেত করা অসম্ভব।” (অ্যাডাম স্মিথ, “ওয়েলথ অব নেশনস”, প্রথম খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ)। ঐ একই পরিচ্ছেদের সেই বিখ্যাত অনুচ্ছেদটি, যার শুরু এই কথাকটি দিয়ে, “একটি সভ্য ও সমৃদ্ধ দেশে একজন দিনমজুর বা কারিগরের থাকার জায়গাটা দেখুন”, তা প্রায় অক্ষরে অক্ষরে টুকে দেওয়া হয়েছে বি, ডি ম্যাণ্ডেভিল-এর, “মৌমাছির উপাখ্যান বা ব্যক্তিগত অনাচার। এবং সার্বজনিক সুবিধার”-র মন্তব্য থেকে। প্রথম সংস্করণ, মন্তব্য ছাড়া ১৭০৬; মন্তব্য সহ, ১৭১৪)।
১০. “এখন আর তেমন কিছু নেই যাকে আমরা বলতে পারি ব্যক্তিগত শ্রমের স্বাভাবিক পুরস্কার। প্রত্যেক শ্রমিক উৎপাদন করে একটা গোটা জিনিসের একটা অংশমাত্র এবং যেহেতু সেই অংশটির আলাদা ভাবে নিজের কোন মূল্য নেই, সেইহেতু সে কোনো কিছুর উপরে হাত দিয়ে বলতে পারে না, এটা আমার উৎপন্ন; আমি এটাকে আমার কাছে রেখে দেব।” (“লেবর ডিফেডে” এগেনস্ট দি ক্লেমস অব ক্যাপিট্যক লণ্ডন ১৮২৫ পৃঃ ২৫)। এই আকর্ষণীয় গ্রন্থটির প্রণেতা হলেন হজস্কিন, আমি আগেই উল্লেখ করেছি।
১১. সমাজে এবং ম্যনুফ্যাকচার ব্যবস্থার মধ্যে এই পার্থক্য ইয়াকীদের কাছে হাতে-কলমে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গৃহযুদ্ধের আমলে প্রবর্তিত ট্যাক্সগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে সমস্ত শিল্পজাত দ্রব্যের উপরে ৬% কর। প্রশ্ন : শিল্পজাত দ্রব্য বলতে কি বোঝায়? আইনসভার উত্তর : একটি জিনিস উৎপাদিত হয় তখন, যখন সেটি তৈরি হয়, এবং সেটি তৈরি হয় তখন, যখন সেটি বিক্রির জন্য প্রস্তুত। নিউইয়র্ক এবং ফিলাডেলফিয়ার ম্যানুফ্যাকচারকারীদের আগে অভ্যাস ছিল তাদের সর্বস্ব দিয়ে ছাতা তৈরি করা। কিন্তু যেহেতু একটি ছাতা হল অত্যন্ত বিভিন্ন অংশের একটি মিশ্র সামগ্রী, সেই হেতু এই অংশগুলি ক্রমে ক্রমে পরিণত হল বিভিন্ন আলাদা আলাদা শিল্পের উৎপন্ন দ্রব্য, যে শিল্পগুলি স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হত ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। তারা ছাতা কারখানায় প্রবেশ করত আলাদা আলাদা পণ্য হিসাবে। এইভাবে একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে তৈরি জিনিসগুলিকে ইয়াংকীরা নাম দিয়েছিল “সন্নিবিষ্ট সামগ্রী, যে নামটি ছিল তাদের পক্ষে উপযুক্ত, কেননা তারা ছিল কতকগুলি ট্যাক্সের সন্নিবেশ। এইভাবে একটি ছাতা একত্রে “সন্নিবেশ করত” তার উপাদানগুলির দামের উপরে ৬% এবং আবার তার মোট দামের উপরে ৬%।
১২. “On peut……etablir en regle generale, que moins l’autorite preside a la division du travail dans l’interieur de la societe, plus la division du travail se developpe dans l’interieur de l’atelier, et plus elle y est soumise a l’autorite d’un seul. Ainsi l’autorite dans l’atelier et celle dans la societe, par rapport a la division du travail. sont en raison inverse l’une de i’autre.” (Karl Marx, “Misere”, &c. pp. 139.131. )
১৩. লেঃ কর্নেল মার্ক উইস, “হিস্টরিকাল স্কেচেজ অব দি সাউথ অব ইণ্ডিয়া”, ১৮১০-১৭, পৃঃ ১১৮-২০। ভারতীয় জনসমাজগুলির একটি সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। জর্জ ক্যাম্পবেল-এর “মর্ডান ইণ্ডিয়া” নামক বইটিতে, ১৮৫২।
১৪. এই সরল ব্যবস্থার অধীনে দেশের অধিবাসীরা বাস করেছে স্মরণাতীত কাল ধরে। গ্রামগুলির সীমানা পরিবর্তিত হয়েছে কদাচিৎ; এবং যদিও গ্রামগুলি নিজেরা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমন কি জন-পরিত্যক্তও হয়েছে, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এবং ব্যাধির প্রকোপে, তা হলেও একই নাম, একই সীমানা, এবং এমনকি একই পরিবার সমূহ চলে এসেছে যুগ যুগ ধরে। রাজ্যের ভাগাভাগি বা ভাঙাগড়া নিয়ে মানুষ কখনো মাথা ঘামায় নি; গ্রাম যদি থাকে অভগ্ন, তা হলে কোন্ রাজশক্তির অধীনে তারা স্থানান্তরিত হল কিংবা কোন সার্বভৌমের অধিকারে গ্রামটি গেল, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না; তার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি থাকে অপরিবর্তিত। (টমাস স্ট্যামফোর্ড, জাভার ভূতপূর্ব শাসনকর্তা : “দি হিস্ট্রি অব জাভা,” লণ্ডন, ১৮১৭, খণ্ড ১, পৃ ২৮৫)।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ — ম্যানুফ্যাকচারের গনতান্ত্রিক চরিত্র।
যেমন সাধারণ ভাবে সহযোগের, তেমনি বিশেষ ভাবে ম্যানুফ্যাকচারের, স্বাভাবিক সূচনা-বিন্দু হচ্ছে একজন ধনিকের নিয়ন্ত্রণাধীনে বর্ধিত-সংখ্যক শ্রমিকের অবস্থান। কিন্তু ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাগ শ্রমিকদের এই সংখ্যাবৃদ্ধিকে পরিণত করে একটি কৃৎকৌশল গত প্রয়োজনে। কোন এক নির্দিষ্ট ধনিক ন্যূনতম কতসংখ্যক শ্রমিককে নিয়োগ করতে বাধ্য, তা এখানে পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত শ্রম-বিভাজনের দ্বারা নির্ধারিত। অন্য দিকে, আরো শ্রম-বিভাজনের সুবিধা পাওয়া যায় কেবল শ্রমিকদের আরো সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটিয়ে এবং তা করা যেতে পারে কেবল বিভিন্ন প্ৰত্যংশ শ্রমিক-গোষ্ঠীর বিবিধ গুণিতক যোগ দিয়ে। কিন্তু বিনিয়োজিত মূলধনের অস্থির অংশের বৃদ্ধি করলে তার স্থির অংশেরও বৃদ্ধিসাধন জরুরি হয়ে পড়ে—যেমন, কর্মশালা, উপকরণ ইত্যাদিতে এবং বিশেষ করে, কাচামালে, যার দরকার পড়ে শ্রমিকদের সংখ্যার চেয়েও তাড়াতাড়ি। একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের দ্বারা ব্যবহৃত কঁচামালের পরিমাণ একই অনুপাতে বাড়ে-যে অনুপাতে বাড়ে শ্রম-বিভাজনের ফলে ঐ শ্রমের উৎপাদন-ক্ষমতা। সুতরাং ম্যানুফ্যাকচারের নিজস্ব প্রকৃতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত এটা একটা নিয়ম যে, প্রত্যেক ধনিকের হাতে যে ন্যূনতম পরিমাণ মূলধন থাকতে বাধ্য, তা অবশ্যই বেড়ে যেতে থাকবে। অন্য ভাবে বলা যায়, উৎপাদনের ও জীবনধারণের সামাজিক উপায়সমূহের মূলধনে রূপান্তরণ অবশ্যই সম্প্রসারিত হতে থাকবে।[১]
যেমন সরল সহযোগে তেমন ম্যানুফ্যাকচারেও যৌথ কর্মব্যবস্থাটি মূলধনের অস্তিত্বের একটি রূপ। বহুসংখ্যক প্রত্যংশ শ্রমিক নিয়ে গঠিত ব্যবস্থার মালিক হচ্ছে ধনিক। সুতরাং শ্রমিকদের সংযোজন থেকে যে উৎপাদন-ক্ষমতার উদ্ভব হয়, তা প্রতিভাত হয় মূলধনের উৎপাদিত ক্ষমতা বলে। সঠিক ম্যানুফ্যাকচার যে কেবল প্রাক্তন স্বাধীন শ্রমিককে মূলধনের শাসন ও হুকুমতের অধীনস্থ করে, তাই নয়, উপরন্তু তা শ্রমিকদের নিজেদের মধ্যেই একটি ক্রমোচ্চ-স্বরতন্ত্র প্রবর্তন করে। যেখানে সরল সহযোগ ব্যক্তির কর্মপদ্ধতিকে প্রধানতঃ অপরিবর্তিত রাখে, ম্যানুফ্যাকচার তার কর্মপদ্ধতিতে আদ্যন্ত বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয় এবং শ্রমশক্তিকে একেবারে তার মূল ধরে টান দেয়। সুবিপুলসংখ্যক উৎপাদন শক্তি ও প্রবৃত্তি বিনষ্ট করে তার উপরে এক প্রত্যংশ-কর্মপটুতা সবলে চাপিয়ে দিয়ে শ্রমিককে তা পর্যবসিত করে একটি বিকলাঙ্গ কিম্ভুত সত্তায়, ঠিক যেমন লা প্লাটা যুক্তরাষ্ট্রের লোকেরা কেবল তার চামড়া বা চর্বির জন্য একটা গোটা পশুকেই হত্যা করে। প্রত্যংশ কাজটি যে কেবল বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়, কেবল তাই নয়, স্বয়ং সেই ব্যক্তিটিকেই পরিণত করা হয় একটি ভগ্নাংশিক কাজের স্বয়ংক্রিয় মোটরে[২] এবং, মেনিনিয়াস অ্যাগ্রিপ্পার সেই আজগুবি গল্পটি, যাতে মানুষকে পরিণত করা হয়েছে তারই দেহের একটি অংশ বিশেষে, সেটি বাস্তবে রূপ পরিগ্রহ করে।[৩] যদি, প্রথমে শ্রমিক তার শ্রমশক্তির মূলধনের কাছে বিক্রয় করে কারণ। পণ্য-উৎপাদনের বাস্তব উপায়সমূহ তার হাতে নেই, তবে এখন তার হাতে নেই, তবে এখন তার নিজেরই শ্রমশক্তি কাজ করতে অস্বীকার করে, যদি না তা মূলধনের কাছে বিক্রীত হয়। বিক্রয়ের পরে সেই শ্রমশক্তি এখন কার্যকরী করা যায় এমন একটি পরিবেশে, যা কেবল ধনিকের কারখানাতেই বিদ্যমান। প্রকৃতিগত ভাবেই কোন কিছু স্বাধীন ভাবে করার অনুপযুক্ত, ম্যানুফ্যাকচারের অন্তর্গত শ্রমিক উৎপাদনশীল তৎপরতার বিকাশ ঘটাতে পারে কেবল ধনিকের কর্মশালার একটি উপাঙ্গ হিসাবে।[৪] যেমন মনোনীত ব্যক্তিবর্গ তাদের অবয়বে জিহোবর স্বাক্ষর বহন করে, তেমনি শ্রম-বিভাগ ম্যানুফ্যাকচারে কর্মনিযুক্ত শ্রমিককে চিহ্নিত করে দেয় মূলধনের-সম্পত্তি বলে।
যেমন করে বন্য মানুষ সমগ্র যুদ্ধকৌশলকে পরিণত করে তার ব্যক্তিগত চাতুর্য প্রদর্শনের ক্রিয়াকাণ্ডে, ঠিক তেমন করেই ক্ষুদ্র চাষী ও হস্তশিল্পী, তা যত সামান্য মাত্রায়ই হোক না কেন, প্রয়োগ করে তার জ্ঞান বিবেচনা ও ইচ্ছাশক্তি—এখন সেই গুণগুলির প্রয়োজন হয় কেবল সমগ্রভাবে কর্মশালাটির জন্য। উৎপাদনে বুদ্ধিমত্তার বিস্তার ঘটে একদিকে, কেননা তার বিনাশ ঘটে বাকি সকল দিকে। প্ৰত্যংশ শ্রমিকেরা যা হারায়, তা গিয়ে পুঞ্জীভূত হয় মূলধনে, যে তাদের নিয়োগ করে।[৫] ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম বিভাজনের একটা ফল এই যে, শ্রমিককে এনে দাড় করিয়ে দেওয়া হয় অপর একজনের সম্পত্তি-স্বরূপ এবং একটি কর্তৃত্বশীল ক্ষমতা-স্বরূপ বাস্তব উৎপাদন প্রক্রিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক শজিসমূহের মুখোমুখি। এই বিচ্ছেদ শুরু হয় সরল সহযোগ থেকে, যেখানে ধনিক, একক শ্রমিকের কাছে সম্মিলিত শ্রমের একত্ব ও ইচ্ছাশক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। এর বিকাশ ঘটে ম্যানুফ্যাকচারে, যা শ্রমিককে কেটে পরিণত করে একজন প্রত্যংশ শ্রমিকে। এটা সম্পূর্ণতা পায় আধুনিক শিল্পে, যা বিজ্ঞানকে করে তোলে শ্রম থেকে স্বতন্ত্র একটি উৎপাদনশীল শক্তি এবং তাকে নিয়োগ করে মূলধনের সেবায়।
ম্যানুফ্যাকচারে যৌথ শ্রমিক তৈরি করার জন্য এবং তার মাধ্যমে সামাজিক শক্তিতে সমৃদ্ধ মূলধন তৈরি করার জন্য, প্রত্যেক শ্রমিককে অবশ্যই পরিণত করতে হবে ব্যগিত উৎপাদিকা শক্তিতে দরিদ্র। “অজ্ঞতা যেমন শিল্পের জননী, তেমন। বুসংস্ক বেরও জননী। মনন ও কল্পনা বিভ্রমসাপেক্ষ কিন্তু একটি হাত বা পা নাড়াবার অভ্যাস এই উভয়েরই নিরপেক্ষ। স্বভাবতই ম্যানুফ্যাকচার সবচেয়ে বেশি ঋদ্ধি লাভ করতে পারে সেখানে, যেখানে মনের সঙ্গে পরামর্শ করা হয় সবচেয়ে কম এবং যেখানে কর্মশালাকে বিবেচনা করা যায় একটি ইঞ্জিন হিসাবে, মানুষেরা যার বিভিন্ন প্রত্যংশ”।[৬] বাস্তবিক পক্ষে, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি কয়েকজন ম্যানুফ্যাকচার-কারক বিশেষ কয়েকটি কাজের জন্য বাছাই করে নিয়োগ করত আধ-হাবলা লোকদের সেই কাজগুলি ছিল তাদের ব্যবসাগত গুপ্ত রহস্য।[৭]
অ্যাডাম স্মিথ বলেন, “অধিকাংশ মানুষেরই উপলব্ধিগুলি আবশ্যিক ভাবে গঠিত হয় তাদের মামুলি কৰ্মনিযুক্তির দ্বারা। যে মানুষটির সারাজীবন কেটে যায় কয়েকটি সরল কর্মকাণ্ড সম্পাদনে তার কোনো সুযোগই হয় না তার বোধশক্তি প্রয়োগের। একটি মানবিক জীবের পক্ষে যতটা সম্ভব নির্বোধ ও অজ্ঞ হওয়া সম্ভব, সে সাধারণতঃ তাই নয়। একজন প্রত্যংশ শ্রমিকের নিবুদ্ধিতার বিবরণ দিয়ে তিনি আরো বলেন, “তার অনড় জীবনের একঘেয়েমি স্বভাবতই তার মনের সাহসকে বিকৃত করে দেয়; যে কাজটিতে বাঁধা থেকে সে বড় হয়েছে, সে কাজটি ছাড়া আর কোনো কাজে উৎসাহ ও অধ্যবসায় সহকারে শক্তি প্রয়োগে তা তাকে অক্ষম করে দেয়। এইভাবে তার নিজের কাজে তাকে কুশলতা অর্জন করতে হয় তার বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, সামরিক গুণগুলির বিনিময়ে। কিন্তু প্রত্যেকটি উন্নত ও সভ্য সমাজে এই হচ্ছে অবস্থা, যাতে শ্রমজীবী দরিদ্ররা অর্থাৎ জনগণের বিপুলতর অংশ হয় অধঃপতিত।”[৮] শ্রম-বিভাজনের দ্বারা যাতে বিপুল জনসমষ্টি সম্পূর্ণ ভাবে অধঃপাতিত না হয়, সেইজন্য অ্যাডাম স্মিথ রাষ্ট্র কতৃক জনগণেকে শিক্ষাদানের সুপারিশ করেন, কিন্তু সে শিক্ষা দিতে হবে বিবেচনা সহকারে এবং হোমিপ্যাথিক ডোজের আকারে। তার ফরাসী অনুবাদক ও টীকাকার জি গার্ণিয়ার, যিনি প্রথম ফরাসী সাম্রাজ্যের অধীনে খুব স্বাভাবিক ভাবেই অভূদিত হয়েছিলেন সিনেটর হিসাবে, তিনি ঠিক ততটা স্বাভাবিক ভাবেই তাকে এই বিষয়ে বিরোধিতা করেন। তিনি যুক্তি দেন, জনগণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার শ্রম-বিভাজনের মূল নিয়মটিকেই লংঘন করে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গোটা ব্যবস্থাটাই তার বৈধতা হারিয়ে ফেলে।” তিনি বলেন, “অন্যান্য সর্বপ্রকার শ্রম-বিভাজনের মত, সমাজ যতই আরো ধনী হয় তিনি সঠিক ভাবেই ‘সমাজ’ কথাটি ব্যবহার করছেন মূলধন, ভূ-সম্পত্তি ও তাদের রাষ্ট্রকে বোঝতে, হাতের শ্রম ও মাথার শ্রমের মধ্যে এম বিভাজন[৯] আরো প্রকট হয়ে উঠে। অন্যান্য প্রত্যেক শ্রম-বিভাজনের মত এই শ্রম বিভাজনও অতীতের ফল ও ভবিষ্যতের হেতু। তা হলে সরকারের পক্ষে কি উচিত হবে এই শ্রম-বিভাগের বিরুদ্ধে কাজ করা এবং তার স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করা? তার পক্ষে কি উচিত হবে বিভাজন ও পৃথগীভবনের জন্য উন্মুখ এমন দুই শ্রেণীর এমকে গুলিয়ে ফেলা ও মিলিয়ে দেবার কাজ সরাসরি অর্থের একটি অংশকে ব্যয় করা?[১০]
এমন কি সমগ্রভাবে সমাজগত এম-বিভাজন থেকেও দেহ ও মনের কিছুটা পঙ্গুতা অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু যেহেতু ম্যানুফ্যাকচার শ্রমের বিভিন্ন শাখার এই পৃথগীভবনকে আরো অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যায় এবং তার উপরে আবার, তার অদ্ভুত বিভাজনের দ্বারা ব্যক্তিকে তার জীবনের একেবারে মূলে আক্রমণ করে, সেহেতু ম্যানুফ্যাকচারই সর্বপ্রথম শিল্পগত ব্যাধি-বিজ্ঞানের জন্য মালমশলার যোগান দেয় এবং তার সূচনা করে।[১১]
কোন মানুষকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করার অর্থ হচ্ছে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করা, যদি সেই দণ্ড তার প্রাপ্য হয়; আর তাকে হত্যা করা যদি সেই দণ্ড তার প্রাপ্য না হয়।…… শ্রমের বিভাগীকরণের অর্থ হল একটি জনসমষ্টির হত্যাকাণ্ড।[১২]
শ্রম-বিভাগের উপরে ভিত্তিশীল সহযোগিতার, ভাষান্তরে ম্যানুফ্যাকচারের, সূচনা হয় স্ততঃস্ফূর্ত সংগঠন হিসাবে। যখন তা কিছুটা সঙ্গতি ও বিস্তৃতি লাভ করে, তখনি তা হয়ে ওঠে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের নিয়মিত প্রণালীবদ্ধ রূপ। সঠিক ভাবে যাকে ম্যানুফ্যাকচার বলে অভিহিত করা যায়, সেই ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসূচক শ্রম-বিভাগ কিভাবে প্রথমে প্রথমে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, যেন অভিনেতাদের নেপথ্যে, সর্বশ্রেষ্ঠ উপযোজিত রূপটি অর্জন করে এবং পরে, গিডের অন্তর্গত হস্তশিল্পগুলির মত, এই নবলব্ধ রূপটিকে আঁকড়ে রাখবার চেষ্টা করে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী তা ধরে রাখতে ইতস্ততঃ সাফল্য লাভ করে, ইতিহাস তা তুলে ধরে। খুটিনাটি ব্যাপার ছাড়া, এই রূপটিতে কোনো পরিবর্তন সম্পূর্ণ ভাবেই ঘটে থাকে শ্রমের উপকরণে কোন বিপ্লবের ফলে। যেখনেই আধুনিক ম্যানুফ্যাকচারের উদ্ভব ঘটে—আমি এখানে মেশিনারি ভিত্তিক আধুনিক শিল্পের কথা বলছিনা-সেখানেই তা disjecta member poetae-কে প্রস্তুত অবস্থায় হাতের কাছে পায়, কেবল যেন তারা একত্রে সন্নিবিষ্ট হবার জন্যই অপেক্ষা করছে, যেমন বড় বড় শহরগুলিতে বস্ত্র-ম্যানুফ্যাকচারের ক্ষেত্রে; আর নয়তো, কোন হস্তশিল্পের (যেমন, বই-বাঁধাইয়ের) বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব একান্ত ভাবেই বিশেষ বিশেষ মানুষের উপরে সরলভাবে ন্যস্ত করে সহজেই শ্রম বিভাজনের নীতিকে প্রয়োগ করতে পারে। এই ধরনের ক্ষেত্রগুলিতে বিভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক সংখ্যাগুলির মধ্যকার অনুপাত নির্ধারণ করার জন্য এক সপ্তাহের অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট।[১৩]
হস্তশিল্পের ভাঙনের দ্বারা, শ্রম-উপকরণসমূহের বিশেষীকরণের দ্বারা, প্রত্যংশ শ্রমিকদের উদ্ভব ঘটিয়ে তাদেরকে একটিমাত্র ব্যবস্থার মধ্যে যূথবন্ধন ও সম্মিলনের দ্বারা, ম্যানুফ্যাকচার-প্রণালীতে শ্রম-বিভাগ উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি করে একটি গুণগত স্তরভেদ ও পরিমাণগত অনুপাত এবং তারা একই সময়ে গড়ে তোলে সমাজে নোতুন নোতুন উৎপাদিকা শক্তি। তার নির্দিষ্ট ধনতান্ত্রিক রূপে এবং নির্দিষ্ট অবস্থার অধীনে তার পক্ষে এই ধনতান্ত্রিক রূপ ছাড়া অন্য কোনো রূপ গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না—ম্যানুফ্যাকচার হল কেবল আপেক্ষিক উত্তমূল্য প্রজননের অথবা শ্রমিকের স্বার্থের বিনিময়ে মূলধনের আত্মপ্রসারণের একটি পদ্ধতি—যাকে সাধারণ ভাবে বলা হয় সামাজিক সম্পদ’, ‘ওয়েলথ অব নেশনস ইত্যাদি। তা কেবল শ্রমিকের স্বার্থের বিনিময়ে ধনিকের স্বার্থ সাধনের জন্যই শ্রমিকের সামাজিক উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধিই করে না, তা সেটা করে শ্রমিকদের পঙ্গু করে দিয়ে। শ্রমের উপরে মূলধনের প্রভুত্বের জন্য তা নোতুন অবস্থার সৃষ্টি করে। অতএব, এ যদি নিজেকে ঐতিহাসিক ভাবে উপস্থাপিত করে একটি অগ্রগামী পদক্ষেপ হিসাবে এবং, সমাজের বিকাশ পথে একটি আবশ্যিক পর্যায় হিসাবে, তা হলে অন্য দিকে সেটা হল শোষণের একটি সুসংস্কৃত ও সুসভ্যকৃত পদ্ধতি।
রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব, একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসাবে যার উদ্ভব হয় ম্যানুফ্যাকচারের আমলে, তা শ্রম-বিভাজনকে দেখে কেবল ম্যানুফ্যাকচারের দৃষ্টিকোণ থেকে।[১৪] এবং তার মধ্যে দেখে কেবল একটি উপায়-একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের সাহায্যে আরো বেশি পণ্যোৎপাদনের এবং তার ফলে পণ্যের মূল্য-হাসের ও দ্রুতবেগে মূলধন-সঞ্চয়ের একটি উপায় হিসাবে। পরিমাণ ও বিনিময় মূল্য বৃদ্ধির প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে জাজ্বল্যমান প্রতিতুলনা হচ্ছে চিরায়ত পুরা-বৃত্ত লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি, যাদের চোখ একান্ত ভাবেই নিবদ্ধ গুণমান ও ব্যবহার-মূল্যের উপরে।[১৫] উৎপাদনের সামাজিক শাখাগুলির পৃথগীভবনের ফলে পণ্য আরো ভাল ভাবে তৈরি হয়, মানুষের বিভিন্ন প্রবণতা ও প্রতিভা উপযুক্ত ক্ষেত্র বেছে নেয়[১৬]; এবং কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোথাও গুরুত্বপূর্ণ ফল পাওয়া যায় না।[১৭] অতএব, উৎপাদনের সামাজিক শাখাসমূহের এই পৃথগীভবনের ফলে উৎপাদন ও উৎপাদক উভয়েরই উৎকর্ষ ঘটে। যদি উৎপন্ন পরিমাণের বৃদ্ধিপ্রাপ্তির দিকটাই প্রায়শঃ উল্লিখিত হয়ে থাকে, তা হলে তা করা হয় কেবল ব্যবহার-মূল্যের অধিকতর প্রাচুর্যের পরিপ্রেক্ষিতে। একমাত্র ব্যবহার মূল্যের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখার এই দিকটি প্লেটোও গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এম বিভাজনকে দেখেছিলেন একটি ভিত্তি হিসাবে, যার উপরে গড়ে ওঠে বিভিন্ন শ্রেণীতে সমাজের বিভাজন, যেমন দেখেছেন জেনোফোন, যিনি তার চরিত্রগত বুর্জোয়া প্রবৃত্তি থেকেই কর্মশালার অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাজনের আরো কাছে গিয়েছেন।[১৮] রাষ্ট্রের গঠনমূলক নীতি হিসাবে শ্রম-বিভাজন সম্পর্কে যে-আলোচনা প্লেটোর রিপাবলিক’এ আছে, তা হচ্ছে কেবল মিশরীয় জাতিভেদ প্রথার আথেন্সীয় আদর্শায়িত রূপ; মিশর তার সমসাময়িক অনেকের কাজেই শিল্পায়িত দেশের অনুকরণীয় নমুনা হিসাবে কাজ করত, যেমন ইসক্রেটিস-এর কাছে[১৯] এবং রোম-সাম্রাজ্যের অন্তর্গত গ্রীকদের কাছেও মিশরের এই মর্যাদা ছিল অব্যাহত।[২০]
যথার্থ ম্যানুফ্যাকচারের আমলে, যখন ম্যানুফ্যাকচারের ছিল ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রধান রূপ, তখন ম্যানুফ্যাকচারের স্ব-বিশেষ প্রবণতাগুলির পূর্ণ বিকাশের পথে ছিল অনেকগুলি প্রতিবন্ধক। যদিও ম্যানুফ্যাকচার সৃষ্টি করে, যেমন আমরা দেখেছি, দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে একটি সরল বিভাজন এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণীতে তাদের একটি স্তরতান্ত্রিক বিন্যাস, তবু দক্ষ শ্রমিকদের বিপুলতর প্রভাবের দরুণ অদক্ষ শ্রমিকদের সংখ্যা থাকে খুবই সীমাবদ্ধ। যদিও তা শ্রমের জীবন্ত উপকরণগুলির পরিপক্কতা, শক্তি ও বিকাশের বিভিন্ন মাত্রার সঙ্গে প্রত্যংশ শ্রমিকদের অভিযোজিত করে দেয় এবং এই ভাবে নারী ও শিশুদের শোষণের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়, তা হলেও সমগ্র ভাবে এই প্রবণতা পুরুষ শ্রমিকদের অভ্যাস ও প্রতিরোধের সর্বনাশ ঘটায়। যদিও হস্তশিল্পগুলির পৃথগীভবন শ্রমিককে গড়ে তোলার খরচ কমিয়ে দেয় এবং, ফলত, তার মূল্যও কমিয়ে দেয়, তবু, অধিকতর দুরূহ প্রত্যংশ-কাজের জন্য দরকার হয় দীর্ঘতর শিক্ষানবিশি এবং, এমন কি, যেখানে তা বাহুল্য মাত্র, সেখানেও শ্রমিকেরা তার জন্য সন্দেহবশতঃ পীড়াপীড়ি করে। যেমন ইংল্যাণ্ডে আমরা দেখতে পাই সাত বছরের শিক্ষানবিশি সমেত শিক্ষানবিশির আইনগুলি ম্যানুফ্যাকচার-আমলের শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি বলবৎ ছিল এবং আধুনিক শিল্পের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত সেগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। যেহেতু হস্তশিল্পে কৌশলই হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারের বনিয়াদ এবং যেহেতু সমগ্র ভাবে ম্যানুফ্যাকচার-প্রণালী স্বয়ং শ্রমিকদের ছাড়া আর কোন কাঠামোর অধিকারী নয়, সেহেতু মূলধন নিরন্তর বাধ্য হয় শ্রমিকের অবাধ্যতার সঙ্গে লড়াই করতে। বন্ধু উরে বলেন, “মানব-প্রকৃতির দুর্বলতার দরুন এমন ব্যাপার ঘটে যে, শ্রমিক যতই দক্ষ হয়, ততই সে খেয়ালি ও বেয়াড়া হয় এবং স্বভাবতই হয়ে ওঠে একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ হবার অনুপযুক্ত—এমন একটি ব্যবস্থা, যার সে সমগ্র ভাবেই দারুণ ক্ষতি করতে পারে। [২১] সুতরাং গোটা ম্যানুফ্যাকচার-আমলটি জুড়েই শ্রমিকদের মধ্যে শৃংখলাহীনতার অভিযোগটি শোনা যায়। এবং আমাদের কাছে যদি সমকালীন লেখকদের সাক্ষ্য নাও থাকত, তা হলেও এই কটি সহজ ঘটনা যে, ষোড়শ শতক থেকে আধুনিক শিল্প-যুগের মধ্যবর্তী সময়কাল জুড়ে মূলধন ম্যানুফ্যাকচার-শ্রমিকদের মোট ব্যবহারযোগ্য কাজের সময়ের উপরে প্রভুত্ব অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে, ম্যানুফ্যাকচার হচ্ছে স্বল্পকালস্থায়ী এবং তা শ্রমিকদের আগমন-নির্গমনের সঙ্গে সঙ্গে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থান পরিবর্তন করে—এই কটি ঘটনা থেকেই অনেক কিছু প্রকাশ পায়। যে কোনো ভাবেই হোক, শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করতেই হবে”, ১৭৭০ সালে এই কথা সোস্কারে যোষণা করেছিলেন ব্যবসা ও বাণিজ্য প্রসঙ্গে নিবন্ধ (“এসে অন ট্রেড অ্যাণ্ড কমার্স” )-এর বহু-উদ্ধত গ্রন্থকার। ৬৬ বছর পরে ডঃ অ্যান্ড্রু উরে তার প্রতিধ্বনি করে বলেন, “এম-বিভাজনের পণ্ডিতি সুত্রের উপরে প্রতিষ্ঠিত ম্যানুফ্যাকচারে শৃঙ্খলা ছিল না এবং শৃংখলা সৃষ্টি করেছিলেন আর্কাইট।”
অধিকন্তু, ম্যানুফ্যাকচার, হয়, সমাজের উৎপাদনের পূর্ণমাত্রা পর্যন্ত আত্মবিস্তার করতে আর, নয়ত, সেই উৎপাদনের মর্ম পর্যন্ত বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছিল। শহরের হস্তশিল্প ও গ্রামের ঘরোয়া শিল্পের বনিয়াদের উপরে একটি কলা-কৃতি হিসাবে তা মাথা তুলে দাড়িয়েছিল, যে সংকীর্ণ কারিগরি ভিত্তির উপরে ম্যানুফ্যাকচার দাড়িয়েছিল বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে তা উৎপাদনের প্রয়োজন গুলির সঙ্গে সংঘাতে এল—যে প্রয়োজনগুলি আবার ম্যানুফ্যাকচারেরই সৃষ্টি।
তার সর্বাপেক্ষা সম্পূর্ণায়িত সৃষ্টিসমূহের অন্যতম হচ্ছে স্বয়ং শ্রম-উপকরণাদি উৎপাদনের কর্মশালাটি, যে উপকরণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল তখনকার দিনে নিযুক্ত সবচেয়ে জটিল যান্ত্রিক অ্যাপারেটাস’-টি। উরে বলেন, একটি মেশিন-ফ্যাক্টরি শ্রম বিভাজনকে প্রদর্শন করত বহুবিধ পর্যায়ক্রমে—ফাইল’, ‘ড্রিল’ ‘লেদ’—যাদের প্রত্যেকেরই ছিল দক্ষতা অনুসারে এক একজন করে শ্রমিক।” (পৃ: ২১)। শ্রম-বিভাজনের অবদান এই কর্মশালাটি আবার পালাক্রমে উৎপাদন করত—‘মেশিন। এই মেশিনগুলিই ঝেটিয়ে বিদায় করল সামাজিক উৎপাদনের নিয়ামক নীতি হিসাবে হস্তশিল্পের কাজকে। এই ভাবে একদিকে অপসারিত হল একটি প্রত্যংশ কাজের সঙ্গে একজন শ্রমিকের আজীবন সংযুক্তির কারিগরি যুক্তিটি, অন্যদিকে, যে-শৃংখল এই একই নীতি আরোপ করেছিল মূলধনের রাজ্য-বিস্তারের উপরে, সেই শৃংখলও ভেঙে লুটিয়ে পড়ল।
————
১. এটাই যথেষ্ট নয় যে, হস্তশিল্পের উপ-বিভাজনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন” (লেখকের বলা উচিত ছিল জীবনধারণ ও উৎপাদনের উপায়) “সমাজে প্রস্তুত অবস্থায় থাকবে; নিয়োগকর্তাদের হাতে তাকে থাকতে হবে প্রচুর পরিমাণে, যাতে করে তারা তাদের কাজ বৃহদায়তনে পরিচালিত করতে পারে। যতই বিভাজন বৃদ্ধি পায়, ততই একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রমিককে নিরন্তর কাজে রাখতে হলে যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ইত্যাদিতে বেশি পরিমাণ মূলধনের বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়।” ( স্টর্চ, Coursd Econ. Polit” paris Ed, পৃঃ ২৫০-২৫১) “La concentration des instruments de production et la divisioj du travail sont aussi inseparables l’une de l’autre que le sont, dans le regime politique, la concentration des pouvoirs publics et la division des interets prives.” (Karl Marx,l. c., p. 134.)
২. ভূগাল্ড স্টুয়ার্ট ম্যানুফ্যাকচারকারী শ্রমিকদের অভিহিত করেন “কাজের বিভিন্ন অংশে নিযুক্ত . জীবন্ত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বলে।” (ঐ, পৃঃ ৩১৮)।
৩. প্রবালপুঞ্জে প্রত্যেকটি একক কীট সমগ্র পুঞ্জটির পাকস্থলী হিসাবে কাজ করে, কিন্তু রোমের প্যাট্রিসিয়ানদের মত পুষ্টি কেড়ে না নিয়ে, তা গোটা পুঞ্জটিকে পুষ্টি যোগায়।
8. “L’ouvrier qui porte dans ses bras tout un metier, peut aller partout exercer son industrie et trouver des moyens desubsister : l’autre ( the manufacturing labourer ) n’est qu’un accessoire qui, separe de ses confreres, n’a plus ni capacite, ni independance, et qui se trouve force d’acceptei la loi qu’on juge a propos de lui imposer.” (Storch, 1. c., Petersb. edit., 1815, t.1, p. 204)
৫. এ ফার্গুসন, ঐ পৃঃ ২১৮: “দ্বিতীয়টি যা হারিয়েছে, প্রথমটি হয়ত তা লাভ করেছে।”
৬. জ্ঞানসম্পন্ন লোক এবং উৎপাদনশীল শ্রমিক পরস্পর থেকে ব্যাপক ভাবে ভিন্ন হয়ে যায়; এবং জ্ঞান আর শ্রমিকের হাতে তার উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শ্রমের হাতিয়ার হিসাবে না থেকে প্রায় সর্বত্রই শ্রমের বিরুদ্ধে নিজেকে সমবেত করেছে ধারাবাহিক ভাবে তাদের বিভ্রান্ত করছে এবং বিপথে চালিত করছে, যাতে করে তাদের পেশীগত শক্তিসমূহ সম্পূর্ণ যান্ত্রিক ও বাধ্য হয়ে পড়ে” (ডবল টম্পসন: “অ্যান ইনকুইরি ইনটু দি প্রিন্সিপলস অব ডিষ্ট্রিবিউশন অব ওয়েলথ”, ১৮২৪ পৃঃ ২৭৪)।
৭. এ ফার্গুসন, ঐ, পৃঃ ২৮০
৮. অ্যাডাম স্মিথ, “ওয়েলথ, অব নেশনস”, খণ্ড ৫, পরিচ্ছেদ ১, অনুচ্ছেদ ২। ফার্গুসন দেখিয়ে ছিলেন শ্রম-বিভাজনের অসুবিধাজনক ফলাফলগুলি; তাঁর ছাত্র অ্যাডাম স্মিথ ছিলেন এ বিষয়ে খুবই পরিষ্কার। তার গ্রন্থের ভূমিকায় যেখানে তিনি শ্রম-বিভাগের প্রশংসা করেন, সেখানে তিনি কেবল প্রসঙ্গক্রমে বলেন যে, তা সামাজিক বৈষম্যের উৎস। আমার ‘ফিলসফি অব পভাটি’-তে আমি শ্রম-বিভাগের সমালোচনার ব্যাপারে ফার্গুসন, স্মিথ, লেমটিয়ে এবং সে-র মধ্যে ঐতিহাসিক যোগাযোগটা দেখিয়েছি এবং, প্রথমবারের মত প্রমাণ করেছি যে, ম্যানুফ্যাকচারে যেমন ভাবে প্রযুক্ত হয় সেইভাবে শ্রম-বিভাগ ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির একটি বিশিষ্ট রূপ।
৯. ফার্গুসন ইতিপূর্বেই বলেছেন (ঐ, পৃঃ ২৮১, “এবং এই বিভাজনের যুগে চিন্তা করাটাই হয়ে উঠতে পারে একটা বিশেষ ধরনের দক্ষতা।
১০. জি গার্নিয়ার, অ্যাডাম স্মিথের অনুবাদ, খণ্ড ৫, পৃঃ ৪-৫।
১১. রামাজিনি, পাডুয়াতে, প্র্যাকটিক্যাল মেডিসিন’-এর অধ্যাপক, তাঁর গ্রন্থ “দ্য মৰ্বিস আর্তিফিকাম” প্রকাশ করেন ১৭১৩। আধুনিক যান্ত্রিক শিল্প অবশ্য শ্রমিকদের রোগের নালিকাকে আরো দীর্ঘ করেছে।
১২. আকু হার্ট : “ফ্যামিলিয়ার ওয়র্ডস”, ১৮৫৫। শ্রম-বিভাগ সম্পর্কে হেগেল এর মতামত ছিল অতি অদ্ভুত। তিনি তাঁর “রেখটসফিলসফি”-তে বলেন, “সুশিক্ষিত লোক বলতে আমরা প্রথমত বুঝি, যিনি, অন্যান্যরা যা করতে পারেন, তা সবই করতে পারেন।”
১৩. শ্রম-বিভাগের ধনতান্ত্রিক চরিত্র উদ্ঘাটন করতে অ্যাডাম স্মিথ যতটা করেছেন তার চেয়ে ঢের বেশি করেছেন প্রাচীনতর লেখকেরা-উইলিয়ম পেটী এবং “অ্যাডভান্টেজেস অব ইস্ট ইণ্ডিয়া ট্রেড”-এর অনামী লেখক প্রমুখ।
১৪. আধুনিকদের মধ্য থেকে বাদ দেওয়া যায় আঠারো শতকের বেকারিয়া এবং জেমস হ্যারিস-এর মত কয়েকজন লেখককে। জেমস হ্যারিস, পরবর্তীকালে আর্ল অব ম্যাসবেরি, তাঁর “ডায়ালগ কনসার্নিং হাপিনেস”-এর মন্তব্যে লেখেন, “ কর্ম-বিভাগের দ্বারা) সমাজকে স্বাভাবিক প্রমাণ করার গোটা যুক্তিটাই গৃহীত হয়েছে প্লেটোর ‘রিপাব্লিক’-এর দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে।”
১৫. যেমন ‘অডিসি’-তে এবং ‘সেক্সটাস এস্পিরিক স’-এ।
১৬. পণ্যোৎপাদনকারী হিসাবে প্রত্যেক অথেনিয়ান নিজেকে একজন স্পার্টানের তুলনায় শ্রেয় মনে করে, কেনন। যুদ্ধের সময় স্পার্টানের হাতে যথেষ্ঠ লোকবল থাকা সত্ত্বেও সে পারেনি অর্থবল সমবেত করতে।
১৭. প্লেটোর মতে, প্রয়োজনের বহুমুখিতা এবং ব্যক্তির সীমাবদ্ধ সক্ষমতা থেকেই সমাজে শ্রম-বিভাগের উদ্ভব। তার কাছে প্রধান বিষয়টি হচ্ছে এই যে, শ্রমিক নিজেকে খাপ খাওয়াবে কাজের সঙ্গে, কাজ নিজেকে খাপ খাওয়াবে না শ্রমিকের সঙ্গে, দ্বিতীয়টি তখনি হয় অপরিহার্য, যদি সে কয়েকটি বৃত্তি একসঙ্গে করে এবং তাদের কোন কোনটিকে গৌণ স্থান দেয়।
১৮. তিনি ( বুসিরিস তাদের সকলকে বিভক্ত করেছিলেন বিভিন্ন জাতিতে ( ‘কাস্ট’-এ :: : নিয়ম করে দিয়েছিলেন যে, একই লোক সব সময়ে একই কাজে নিযুক্ত থাকবে, কারণ তিনি জানতেন যে, যারা তাদের বৃত্তি পরিবর্তন করে, তারা কোনো বৃত্তিতেই কুশলী হয় না, কিন্তু যারা একই বৃত্তিতে লেগে থাকে, তারা তাদের কুশলতাকে সর্বাঙ্গীণ করে তোলে। (ইসক্রেটিস’, বুসিরিস, ৮)।
১৯. ডিওডোরাস সিকিউলাস দ্রষ্টব্য।
২০. উরে, ঐ, পৃঃ ২০। ২১. ফ্রান্সের তুলনায় এটা ইংল্যাণ্ডে বেশি এবং হল্যাণ্ডের তুলনায় ফ্রান্সে বেশি।