২৬. আদিম সঞ্চয়নের গুপ্তকথা

অষ্টম বিভাগ–তথাকথিত আদিম সঞ্চয়ন

ষষ্ঠবিংশ অধ্যায়–আদিম সঞ্চয়নের গুপ্তকথা

আমরা দেখেছি অর্থ কিভাবে মূলধনে পরিবর্তিত হয়; মূলধনের মাধ্যমে কিভাবে উদ্বৃত্ত-মূল্য গঠিত হয় এবং উদ্বৃত্ত-মূল্য থেকে গঠিত হয় আরো মূলধন। কিন্তু মূলধনের সঞ্চয়নের পূর্বশর্ত হল উদ্বৃত্ত-মূল্য; উদ্বৃত্ত-মূল্যের পূর্বশর্ত হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদন এবং ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের পূর্বশর্ত হল পণ্যোৎপাদনকারীদের হাতে প্রভূত পরিমাণ মূলধন ও শ্রমশক্তির অস্তিত্ব। সুতরাং, মনে হয় যেন সমগ্র প্রক্রিয়াটাই আবর্তিত হয় একটি পাপচক্রে, যা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি যদি ধরে নিই যে ধনপন্ত্রিক সঞ্চয়নের আগেই একটি আদিম সঞ্চয়নের অস্তিত্ব ছিল (অ্যাডাম স্মিথ-কথিত পূর্ববর্তী সঞ্চয়ন) যে সঞ্চয়ন ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির ফল নয়, তার সূচনা-বিন্দু।

ধর্মতত্ত্বে ‘আদি পাপ’ যে-ভূমিকা গ্রহণ করে, রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বে ‘আদিম সঞ্চয়ন’ সেই একই ভূমিকা গ্রহণ করে। অ্যাডাম আপেলটিতে কামড় দিয়েছিল এবং তার পরে মানব জাতির উপরে পাপ নেমে এসেছিল। যেহেতু কথাটাকে হাজির করা হয় অতীতের একটি কাহিনী হিসাবে, সেহেতু ধরে নেওয়া হয় যে, তার উৎপত্তির ব্যাখ্যাটা পাওয়া গেল। সেই সুদূর অতীতে দু’রকমের লোক ছিল; এক রকমের, যারা ছিল পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান এবং, সর্বোপরি, মিতাচারী সম্রান্ত; এবং অন্য রকমের, যারা ছিল কুড়ে, পাজি, উড়নচণ্ডে, এবং তদুপরি, উচ্ছংখল জীবনে অমিতব্যয়ী। আদি পাপের সেই পুরা-কাহিনীটা আমাদের সুনিশ্চিত ভাবে বলে দেয় কেমন করে মানুষ অভিশপ্ত হল তার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পেটের খোরাক জোগাড় করতে; কিন্তু অর্থ নৈতিক আদি পাপের ইতিবৃত্ত আমাদের কাছে প্রকাশ করে যে এমন সব লোকও আছে যাদের পক্ষে এটা মোটেই অপরিহার্য নয়। কুছ পরোয়া নেই। এই ভাবে পরিণামে যা ঘটল, তা এই যে, প্রথম ধরনের লোকদের হাতে সঞ্চিত হল ঐশ্বর্য এবং দ্বিতীয় ধরনের হাতে রইল না নিজেদের চামড়া ছাড়া বিক্রি করার মত আর কিছুই। আর এই আদি পাপ থেকেই এক দিকে শুরু হল সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের দারিদ্র সমস্ত পরিশ্রম সত্ত্বেও যাদের নিজেদেরকে ছাড়া বিক্রি করার মত আর কিছু নেই; অন্য দিকে শুরু হল অত্যল্প সংখ্যক লোকের নিরন্তর ঐশ্বর্য বৃদ্ধি—যদিও বহুকাল আগে থেকেই তারা কাজ করা ছেড়ে দিয়েছে। এমন নিরেট ছেলেমানুষি আমাদের কাছে দিন-রাত প্রচার করা হয় সম্পত্তির সমর্থনে। যেমন, মিঃ তিয়র্স; রাষ্ট্রবিদসুলভ গাম্ভীর্য সহকারে ফরাসী জনগণের কাছে—একদা যারা ছিল এত ‘আধ্যাত্মিক’, সেই ফরাসী জনগণের কাছে তিনি একথা পুনরাবৃত্তি করার মত সাহস দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সম্পত্তির প্রশ্ন যখনি এসে পড়ে, তখনি শিশুদের মানসিক খাদ্যই যে সব বয়সের, বিকাশের সব পর্যায়ের মানুষের পক্ষে উপযুক্ত খাদ্য, সেটা ঘোষণা করা একটা পবিত্র কর্তব্য হিসাবে দেখা দেয়। বাস্তব ইতিহাসে কিন্তু এই কুকীর্তি সুবিদিত যে, যুদ্ধজয়, ক্রীতদাসত্ব, লুণ্ঠন ও হত্যা—এক কথায়, বল-প্ৰয়োগই গ্রহণ করেছে প্রধান ভূমিকা। রাষ্ট্রীয় অর্থতঙ্কের মনোরম কথাকাহিনীতে স্মরণাতীত। কাল থেকে বিরাজ করছে অনাবিল শান্তি-সুষমা। আবহমান কাল ধরেই ন্যায় ও “শ্রম” কাজ করে এসেছে সমৃদ্ধির একমাত্র উৎস হিসাবে;-অবশ্য, বর্তমান বছরটিকে বাদ দিয়ে। আসলে কিন্তু আদিম সঞ্চয়নের পদ্ধতিগুলি আর যাই হোক, কখনন শান্তি সুষমায় উচ্ছল ছিল না।

অর্থ ও পণ্য নিজেরা উৎপাদন ও জীন ধারণের উপায়-উপকরণের চেয়ে বেশি মূলধন নয়। তারা চায় মূলধনে রূপান্তরিত হতে। কিন্তু এই রূপান্তরণ ঘটতে পারে কেবল কয়েকটি বিশেষ অবস্থায়, যার কেন্দ্রে রয়েছে এই ঘটনা যে, দুটি অত্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পণ্যের অধিকারী পরস্পরের মুখোমুখি হবে এবং আসবে পরস্পরের সংস্পর্শে; এক দিকে, অর্থের, উৎপাদনের উপায়সমূহের, জীবনধারণের উপকরণসমূহের অধিকারীরা যারা চায় অন্য লোকের শ্রমশক্তি ক্রয় করে তাদের অধিকারভুক্ত মূল্যসম্ভারের বৃদ্ধি সাধন করতে; অন্য দিকে, মুক্ত শ্রমিকেরা, তাদের নিজেদের শ্রমশক্তির বিক্রয়কারীরা এবং স্বভাবতই, শ্রমের বিক্রয়কারীরা। তারা মুক্ত শ্রমিক দুটি অর্থে : তারা নিজেরা ক্রীতদাস, খৎ-বন্দী মজুর ইত্যাদির মত উৎপাদনের উপায়সমূহের অঙ্গও নয়, আবার কৃষক-মালিকদের উৎপাদনের উপায়সমূহের মালিকও নয়। সুতরাং, তারা তাদের নিজেদের বলতে কোনো উৎপাদন-উপায়ের মালিকানা থেকে মুক্ত, নির্ভার। পণ্য দ্রব্যাদির বাজারের এই মেরু-বিভাজনের সঙ্গে, আমরা পাই ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের মৌল অবস্থাগুলিকে। ধনতান্ত্রিক প্রণালীর পূর্বশর্ত হল, যে-সমস্ত উপায়ের মাধ্যমে শ্রমিকেরা তাদের শ্রমকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে, সেই সব উপায়ের উপরে যাবতীয় সম্পত্তি গত অধিকার থেকে তাদের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ। একবার যদি ধনতান্ত্রিক উৎপাদন তার পায়ের উপরে দাড়িয়ে যায়, তা হলে তা সেই বিচ্ছেদকে কেবল রক্ষাই করেনা, উপরন্তু তা তাকে ক্রমাগত আরো বিস্তারশীল আয়তনে পুনরুৎপাদন করে। সুতরাং, যে-প্রক্রিয়া ধনতান্ত্রিক প্রণালীর পথ পরিষ্কার করে দেয়, তা, শ্রমিকের কাছ থেকে উৎপাদন উপায়ের উপরে তার অধিকারকে কেড়ে নেবার প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছু হতে পারে না; এমন একটি প্রক্রিয়া যা, এক দিকে, জীবন-ধারণ ও উৎপাদনের উপায়সমূহকে মূলধনে রূপান্তরিত করে, এবং, অন্য দিকে, প্রত্যক্ষ উৎপাদনকারীদের রূপান্তরিত করে মজুরি শ্রমিকে। সুতরাং, তথাকথিত আদিম সঞ্চয়ন উৎপাদনের উপায়সমূহ থেকে উৎপাদন কারীকে বিচ্ছিন্ন করার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটি ছাড়া অন্য কিছু নয়। প্রক্রিয়াটা প্রতিভাত হয় আদিম বলে, কেননা সেটা হল মূলধন ও তার আনুষঙ্গিক উৎপাদন পদ্ধতির প্রাগৈতিহাসিক পর্যায়।

ধনতান্ত্রিক অর্থ নৈতিক কাঠামোর উদ্ভব ঘটেছে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের অর্থ নৈতিক কাঠামো থেকে। দ্বিতীয়টির ভাঙন প্রথমটির উপাদানসমূহকে মুক্ত করে দিল।

জমির সঙ্গে সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পরে, ক্রীতদাস, ভূমিদাস ও খন্দী মজুর হওয়া থেকে বিরত হবার পরে, প্রত্যক্ষ উৎপাদনকারী তথা শ্রমিক পারে কেবল তার নিজেকে হস্তান্তরিত করতে। যেখানেই সে বাজার পায় সেখানেই তার পণ্যকে বয়ে নিয়ে যেতে শ্রমশক্তির মূল বিক্রেতায় পরিণত হতে, তাকে অবশ্যই গিল্ড-এর রাজত্ব থেকে, শিক্ষানবিশ ও ঠিকা-মজুর সম্পর্কে তার নিয়ম-কানুন থেকে এবং তার শ্রম সংক্রান্ত বিধি-নিষেধের বাধা-বিঘ্ন থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। সুতরাং, যে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া উৎপাদনকারীদের পরিবর্তিত করে মজুরি-শ্রমিকে, তা, এক দিকে, প্রতিভাত হয় ভূমি-দাসত্ব থেকে, গিডের শৃংখল থেকে, তাদের মুক্তি বলে,—আর এই দিকটাই কেবল নজরে পড়ে আমাদের বুর্জোয়া ঐতিহাসিকদের। কিন্তু, অন্য দিকে, এই নোতুন মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষগুলি লুষ্ঠিত হয় তাদের নিজেদের যাবতীয় উৎপাদনের উপায় থেকে এবং পুরানো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে প্রাপ্ত অস্তিত্বরক্ষার সমস্ত নিশ্চয়তা থেকে আর তার পরে পরিণত হয় নিজেদেরই বিক্রয়কারী হিসাবে। এবং তাদের এই উচ্ছেদনের ইতিহাস মানবজাতির কালপঞ্জীতে লেখা আছে রক্ত ও আগুনের অক্ষরে।

এই শিল্প-ধনিকদের, এই নোতুন ক্ষমতা-পতিদের, আবার নিজেদের বেলায় কেবল হস্তশিল্পের গিল্ড-মাস্টারদেরই স্থানচ্যুত করতে হয়নি, স্থানচ্যুত করতে হয়েছে সামন্ত প্রভুদেরও, যারা তখন ছিল সম্পদের সকল উৎসের অধিকারী। এই দিক থেকে তাদের সামাজিক শক্তির উপরে আধিপত্য অর্জন প্রতিভাত হয় একই সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক প্রভুত্ব ও তার বিক্ষোভজনক প্রাধিকারগুলির বিরুদ্ধে এবং গিলড ও উৎপাদনের অবাধ বিকাশ ও মানুষের উপরে মানুষের অবাধ শোষণের উপরে তার দ্বারা আরোপিত শৃংখলের বিরুদ্ধে, বিজয়ী সংগ্রামের ফল হিসাবে। অবশ্য, শিল্পের এই বীর-পুরুষেরা তরবারিধারী বীর-পুরুষদের উৎখাত করে সেই স্থান অধিকার করতে পেরেছিল এমন। কতকগুলি ঘটনার সুযোগ নিয়ে, যেগুলি ঘটাবার ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকাই ছিল না। একদা রোমের মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাস যেমন জঘন্য পন্থায় ‘প্যাট্রোনাস’-এর প্রভু হয়েছিল, তেমনি জঘন্য পন্থায় তারা উপরে উঠেছিল।

বিকাশের যে সুচনা-বিন্দু মজুরি-শ্রমিক এবং ধনিক উভয়কেই জন্ম দিয়েছিল, তা হল শ্রমিকের দাসত্ব। দাসত্বের রূপে যে-পরিবর্তন ঘটল, সামন্ততান্ত্রিক শোষণ থেকে ধনতান্ত্রিক শোষণে যে-রূপান্তর ঘটল, সেটাই হল অগ্রগতি। তার অভিযান অনুধাবন করার জন্য আমাদেরকে খুব দূর অতীতে ফিরে যেতে হবে না। যদিও ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রথম সূচনা আমরা প্রত্যক্ষ করি সেই চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতেই ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী কয়েকটি শহরে ইতস্তত ভাবে, ধনতান্ত্রিক যুগের তারিখ হল ষোড়শ শতাব্দী। যেখানেই তা আবিভূত হয়, সেখানেই ভূমি-দাসত্বের অবসান অনেক আগেই সংঘটিত হয়ে গিয়েছে এবং মধ্যযুগের বিকাশের পরম পরিণতি যে সার্বভৌম শহরগুলি, অনেক আগেই সেগুলির অবক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছে।

আদিম সঞ্চয়নের ইতিহাসে, সমস্ত বিপ্লবই যুগান্তকারী, যারা কাজ করে ধনতান্ত্রিক শ্ৰেণীটির গড়ে ওঠার পথে অনুপ্রেরক হিসাবে; কিন্তু, সর্বোপরি যুগান্তকারী হল সেই মুহূর্তগুলি যখন বিশাল বিশাল জনসমষ্টি সহসা ও সবলে উৎপাটিত তাদের জীবনধারণের উপায়-উপকরণ থেকে এবং শ্রমের বাজারে নিক্ষিপ্ত হয় মুক্ত ও অসংখ্য “অ সংযুক্ত, সর্বহারা হিসাবে। জমি থেকে কৃষি-উৎপাদকের, কর্ষকের উৎপাটন–এটাই হল সমগ্র প্রক্রিয়াটির ভিত্তি। উৎপাটনের এই ইতিহাস বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে এবং বিভিন্ন পরম্পরায় এবং বিভিন্ন সময়ে তার পর্যায়গুলির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে। একমাত্র ইংল্যাণ্ডেই তা ধারণ করে তার চিরায়ত রূপ, এবং তাকেই আমরা গ্রহণ করি আমাদের দৃষ্টান্ত হিসাবে।[১]

————

১. ইতালি, যেখানে সবচেয়ে আগে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের উন্মেষ ঘটেছিল, সেখানে ভূমিদাস প্রথার অবসানও সবচেয়ে আগে ঘটেছিল। জমিতে কোনো স্বত্বমূলক অধিকার পাবার আগেই সেখানে ভূমিদাস মুক্তি পেয়ে গিয়েছিল। তার মুক্তি সঙ্গে সঙ্গেই তাকে একজন স্বাধীন সর্বহারায় পরিণত করল, তা ছাড়া, সে সঙ্গে সঙ্গেই শহরে তার মনিবকে প্রস্তুত অবস্থায় পেয়ে গেল। যখন বিশ্ববাজারের বিপ্লব পঞ্চদশ শতকের শেষাশেষি উত্তর ইতালির বাণিজ্যিক আধিপতাকে ধ্বংস করে দিল, তখন উলটোমুখী একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। শহরের শ্রমিকেরা দলে দলে গ্রামে বিতাড়িত হল এবং উদ্যানরচনার মত সুকুমার সংস্কৃতি’-কে প্রেরণা যোগাল, যে-সংস্কৃতি আগে কখনো দেখা যায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *