৩২. ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের ঐতিহাসিক প্রবণতা

দ্বাত্রিংশ অধ্যায়–ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের ঐতিহাসিক প্রবণতা

মূলধনের আদিম সঞ্চয়ন অর্থাৎ তার ঐতিহাসিক উৎপত্তি নিজেকে কিসে পর্যবসিত করে? যতদূর পর্যন্ত তা ক্রীতদাস ও ভূমিদাসদের মজুরি-শ্রমিকে প্রত্যক্ষ রূপান্তরণ নয় এবং সেই কারণে নিছক রূপগত পরিবর্তন মাত্র, ততদূর পর্যন্ত তার অর্থ দাড়ায় উৎপাদনকারীদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বিচ্যুতিকরণ অর্থাৎ মালিকের নিজের শ্রমের উপরে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবলুপ্তি সাধন। সামাজিক তথা সামূহিক সম্পত্তির বিপরীত হিসাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিদ্যমান থাকে কেবল সেখানেই, যেখানে শ্রমের উপায়সমূহ এবং শ্রমের বাহিক অবস্থাবলী ব্যক্তির মালিকানা-ভুক্ত। কিন্তু এই ব্যক্তি শ্রমিক কি শ্রমিক নয়, তদনুযায়ী সম্পত্তির চরিত্রও বিভিন্ন হয়। অসংখ্য ধরন-ধারণ, যেগুলি প্রথমে চোখের সামনে হাজির হয়, সেগুলি এই দুটি চরম রূপের মধ্যবর্তী বিভিন্ন পর্যায়। নিজের উৎপাদনের উপায়সমূহের শ্রমিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তিই হল ক্ষুদ্র শিল্পের ভিত্তি, তা সে কৃষিগই হোক বা ম্যানুফ্যাকচারগতই হোক বা উভয়গতই হোক; আবার এই ক্ষুদ্র শিল্পই হল সামাজিক উৎপাদনের বিকাশ এবং স্বয়ং শ্রমিকের স্বাধীন ব্যক্তিত্বের বিকাশের অত্যাবশ্যক শর্ত। অবশ্য, এই ক্ষুদ্র উৎপাদন পদ্ধতি ক্রীতদাসত্ব ভূমিদাসত্ব ও অন্যান্য ধরনের অধীনত্বের অবস্থাতেও বিরাজ করে। কিন্তু তা বিকাশিত হয়, তার সমগ্র শক্তিকে মুক্ত করে দেয়, তার চিরায়ত রূপে উপনীত হয় কেবল সেখানেই, যেখানে শ্রমিক নিজেই তার শ্রমের উপায়সমূহের ব্যক্তিগত মালিক এবং যেখানে সে নিজেই সেগুলিকে গতি-সচল রাখে। জমির চাষী যে নিজেই জমিটি চাষ করে, হাতিয়ারের কারিগর যে নিজেই তা ব্যবহার করে বিশেষজ্ঞ হিসাবে। এই উৎপাদন-পদ্ধতির পূর্বশর্ত হল এই যে জমি থাকবে ভাগে ভাগে এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপায়গুলি থাকবে ছড়িয়ে। এক দিকে যেমন তা এই সমস্ত উৎপাদন-উপায়সমূহের কেন্দ্রীভবনকে ঠাই দেয় না, অন্য দিকে তেমন তা শাবার সহযোগ, উৎপাদনের প্রত্যেকটি প্রক্রিয়ার মধ্যে শ্রম-বিভাজন, সমাজ কর্তৃক প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের উৎপাদনশীল প্রয়োগ ও সেগুলির উপরে নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক উৎপাদিকা ক্ষমতার অবাধ বিকাশ ইত্যাদিকেও ঠাই দেয় না। তা কেবলি এমনি একটা উৎপাদন-ব্যবস্থার সঙ্গে তথা সমাজের সঙ্গে, সঙ্গতিপূর্ণ, যা সংকীর্ণ এবং মোটামুটি আদিম চৌহদ্দির মধ্যেই নড়াচড়া করে। অকে চিরস্থায়ী করার মানে দাঁড়াবে, যে-কথা পেকুয়র সঠিক ভাবেই বলেছেন, “সর্বজনীন সাধারণত্বের বিধান জারি করা।”

ধনতান্ত্রিক সংঘনের ঐতিহাসিক প্রবণতা বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে তা তার নিজের অবসান ঘটানোর বাস্তব শক্তিগুলিকে জন্ম দেয় সেই মুহূর্ত থেকে সমাজের বক্ষতলে উগত হয় নোতুন নোতুন শক্তি, নোতুন নোতুন আবেগ; কিন্তু পুরনো সামাজিক সংগঠন তাদের শৃংখলিত ও অবদমিত করে রাখে। কিন্তু ধ্বংস সে হবেই—এবং ধ্বংস হয়ও। তার ধ্বংস ব্যক্তিভিত্তিক ও বিক্ষিপ্ত বিবিধ উৎপাদন উপায়ের সামাজিক ভাবে সংকেন্দ্রীভূত উপায়সম্ভারে এবং বহু লোকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্পত্তির মুষ্টিমেয় লোকের বিরাট বিরাট সম্পত্তিতে রূপান্তরণ; জমি থেকে, জীবনধারণের উপায় থেকে এবং শ্রমের উপায় থেকে জনসংখ্যার বিপুল সমষ্টির উৎসাদন—এই ভয়াবহ ও যন্ত্রণাকর বহু-ব্যাপক উৎসাদনই রচনা করে মূলধনের ইতিহাসের ভূমিকা। উৎসাদনের এই প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয় জোর জবরদস্তিমূলক নানাবিধ পদ্ধতির মাধ্যমে; যেগুলির মধ্যে আমরা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছি কেবল সেই সব পদ্ধতি, যেগুলি মূলধনের আদিম সঞ্চয়নের পদ্ধতি হিসাবে যুগান্তকারী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। প্রত্যক্ষ উৎপাদনকারীদের উৎসাদন সাধিত হয় নির্মম দানবিকতার সঙ্গে এবং সবচেয়ে জঘন্য, সবচেয়ে কদর্য, সবচেয়ে নীচ, সবচেয়ে কুৎসিৎ সব আবেগের উন্মাদনায়। ঘোপার্জিত ব্যক্তিগত সম্পত্তি, যার ভিত্তি হল, বলা যায়, বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র, শ্রমকারী-ব্যক্তির সঙ্গে তার শ্রমের অবস্থাবলীর সংমিশ্রণ তা গ্রহণ করল ধনতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তি যার ভিত্তি হল অপরের নামেমাত্র স্বাধীন শ্রমের শোষণ অর্থাৎ মজুরি-শ্রম।[১]

যত শীঘ্র রূপান্তরণের এই প্রক্রিয়া পুৰ্বনো সমাজের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত যথেষ্ট রকম ভাঙন ধরায়, যত শীঘ্র শ্রমিকেরা সর্বহারায় পরিণত হয়, যত শীঘ্র ধনতান্ত্রিক উৎপাদন তার নিজের পায়ে দাঁড়ায়, তত শীঘ্র শ্রমের আরো সমাজীকরণ এবং জমি ও অন্যান্য উৎপাদন-উপায়ের সামাজিক ভাবে ব্যবহৃত তথা সাধারণীকৃত, উৎপাদন-উপায়ে আরো রূপান্তরণ, এবং সেই সঙ্গে, ব্যক্তিগত স্বত্বাধিকারীদের আরো উৎসাদন একটি নোতন রূপ ধারণ করে। এখন যাকে উৎসাদিত করতে হবে সে আর নিজের জন্য কর্মরত শ্রমিক নয়, সে হল বহুসংখ্যক শ্রমিককে শোষণরত ধনিক। এই উৎপাদন সাধিত হয় স্বয়ং ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের অন্তনিহিত নিয়মাবলীর ক্রিয়াশীলতার দ্বারা, মূলধনের কেন্দ্রীভবনের দ্বারা। একজন ধনিক সব সময়েই অনেক ধনিককে হত্যা করে। মূলধনের এই কেন্দ্রীভবনের সঙ্গে কিংবা মুষ্টিমেয় ধনিকের দ্বারা বহুসংখ্যক ধনিকের উৎসাদনের সঙ্গে এক যোগে বিকাশ লাভ করে ক্রমবর্ধমান আয়তনে—শ্রম প্রক্রিয়ার সহযোগমূলক রূপ, বিজ্ঞানের সচেতন কৃৎকৌশলগত প্রয়োগ, জমির সুশৃংখল কৰ্ষণকার্য এমে উপকরণসমূহ যাতে করে কেবল সমবেত ভাবে ব্যবহার উৎপাদন উপায়ে পরিণত হয় সেই ভাবে তাদের রূপান্তরণ সম্মিলিত সমাজীকৃত প্রমের উৎপাদন উপায় হিসাবে ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্ত উৎপাদন-উপায়ের সাম-বিধান, বিশ্ববাজারের জালে সমস্ত জাতিসমূহের আবন্ধন এবং সেই সঙ্গে ধনতান্ত্রিক রাজত্বের আন্তর্জাতিক চরিত্র-অর্জন যারা এই রূপান্ত-প্রক্রিয়ার যাবতীয় সুবিধা আত্মসাৎ এবং একচেটিয়া ভাবে দখল করে, মূলধনের সেই মহামালিকদের নিরন্তর সংখ্যা-হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় দুর্দশা, উৎপীড়ন, দাসত্ব, অধঃপতন, শোষণের গুরুভার; কিন্তু সেই সঙ্গেই আবার বৃদ্ধি পায় শ্রমিকশ্রেণীর বিদ্রোহ-যে-শ্রেণী সব সময়ে বৃদ্ধিশীল এবং স্বয়ং ধনতান্ত্রিক উৎপাদনেরই প্রক্রিয়া ও প্রণালীর দ্বারা শৃংখলাবদ্ধ, একতাবদ্ধ ও সংগঠনবদ্ধ —সেই শ্রেণীর বিদ্রোহ। মূলধনের একচেটিয়া অধিকার পরিণত হয় উৎপাদন-পদ্ধতির উপরে একটি শৃংখলে—যে উৎপাদন-পদ্ধতি গড়ে উঠেছে এবং বেড়ে উঠেছে তারই সঙ্গে এবং তারই অধীনে। উৎপাদন-উপায়সমূহের কেন্দ্রীভবন এবং শ্রমের সমাজীভবন অবশেষে এমন একটা বিন্দুতে উপনীত হয়, যেখানে সেগুলি ধনতান্ত্রিক নির্মোকের সঙ্গে হয়ে ওঠে অসঙ্গতিপূর্ণ। নির্মোকটি ভেঙে চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যায়। ধনতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তির অন্তিম ঘণ্টা বেজে ওঠে। উচ্ছেদকারীরা হয় উচ্ছিন্ন।

ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির ফলস্বরূপ ধনতান্ত্রিক আত্মীকরণের পদ্ধতি উৎপাদন করে ধনতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তি। স্বত্বাধিকারীর শ্রমের উপরে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি বিশেষের ব্যক্তিগত সম্পত্তির এটাই হল প্রথম নিরাকরণ। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের অনিবার্যতার সঙ্গে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন জন্মদান করে তার নিজেরই নিরাকরণ। এটা হল নিরাকরণের নিরাকরণ। তা উৎপাদনকারীর জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেনা কিন্তু তাকে দেয় ধনতান্ত্রিক যুগের বিবিধ আহরণের উপরে, অর্থাৎ সহযোগ এবং জমি ও উৎপাদন-উপায়সমূহের যৌথ অধিকারের উপরে, প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি-বিশেষক সম্পত্তি।

ব্যক্তিবিশেষের শ্রম থেকে উদ্ভূত বিক্ষিপ্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধনতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তর স্বভাবতই ধনতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তির—যা ইতিমধ্যেই কার্যত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে সমাজীকৃত উৎপাদনের উপরে—তার সমাজীকৃত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হবার তুলনায় বহুগুণ বেশি দীর্ঘস্থায়ী প্রচণ্ড ও কঠিন। প্রথম ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই কয়েকজন জবর-দখলকারীর দ্বারা বিপুল জনসমষ্টির উচ্ছেদ-সাধন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই বিপুল জনসমষ্টির দ্বারা কয়েকজন জবর-দখলকারীর উচ্ছেদ সাধন।[২]

————

১. “Nous sommes dans une condition tout-a-faiit nouvelle de la societe…nous tendons a separer toute espece de propriete d’avec toute espece de travail. (Sismondi : “Nouveaux Principes d’Econ. Polit.” t. II, p. 434)

২. শিল্পের অগ্রগতি, যার অনিচ্ছাকৃত উদ্বোধক হল বুর্জোয়া শ্রেণী, তা শ্রমিকদের প্রতিযোগিতাজনিত বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে প্রতিস্থাপিত করল তাদের সন্মিলনজনিত বৈপ্লবিক সহযোগিতা। সুতরাং আধুনিক শিল্পের বিকাশ তার পায়ের তলা থেকে সেই ভিত্তিটিকেই কেটে দিল, যার উপরে দাড়িয়ে বুর্জোয়াশ্রেণী উৎপন্নসম্ভার উৎপাদন ও আত্মীকরণ করে। সুতরাং বুজোয়াশ্রেণী যা উৎপাদন করে, তা হল, সর্বোপরি, তার নিজেরই কবরখননকারী। তার পতন এবং সর্বহারা-শ্রেণীর বিজয় সমান ভাবে অবশ্যম্ভাবী। যে শ্রেণীগুলি আজ বুর্জোয়াশ্রেণীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তাদের মধ্যে একমাত্র সর্বহারা শ্ৰেণীই হল যথার্থ বিপ্লবী শ্রেণী। আধুনিক শিল্পের সম্মুখে বাকি শ্রেণীগুলি ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে যায়; সর্বহারা শ্ৰেণীই হল তার বিশেষ এবং আবশ্যিক সৃষ্টি নিম্নতর মধ্য শ্রেণীসমূহ, ক্ষুদ্র শিল্পোৎপাদনকারী, দোকানদার, কারিগর, চাষী—এরা সকলে বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অবলুপ্তির গ্রাস থেকে মধ্য-শ্রেণীর ভগ্নাংশ হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে। তারা প্রতিক্রিয়াশীল, কেননা তারা ইতিহাসের চাকা পিছন দিকে ঘুরিয়ে দিতে চায়। কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতাহার। লণ্ডন, ১৮৪৮, পৃঃ ৯, ১১।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *