১৯. শ্রমশক্তির মূল্যের (এবং যথাক্রমে দামের) মজুরিতে রূপান্তর

ষষ্ঠ বিভাগ মজুরি

ঊনবিংশ অধ্যায় শ্রমশক্তির মূল্যের (এবং যথাক্রমে দামের) মজুরিতে রূপান্তর

বুর্জোয়া সমাজের উপরিতলে শ্রমিকের মজুরি প্রতিভাত হয় শ্রমের দাম হিসাবে, একটি বিশেষ পরিমাণ শ্রমের জন্য ব্যয়িত একটি বিশেষ পরিমাণ অর্থ। এই জন্যই লোকে শ্রমের মূল্যের কথা বলে এবং অর্থের অঙ্কে তার অভিব্যক্তিকে তার আবশ্যিক বা স্বাভাবিক দাম বলে অভিহিত করে। এবং এই মূল্যের পরিমাণকে আমরা কি ভাবে পরিমাপ করি? তার মধ্যে বিধৃত শ্রমের পরিমাণ দিয়ে। তা হলে, ধরা যাক, ১২ ঘণ্টার একটি শ্রমদিবসের মূল্য কি ভাবে নিরূপিত হয়? ১২ ঘণ্টার একটি শ্রম দিবসের মধ্যে বিধৃত ১২ ঘণ্টা দ্বারা; এটা একই কথার একটি আজগুবি পুনরাবৃত্তি।[১]

বাজারে পণ্য হিসাবে বিক্রীত হতে হলে, বিক্রয়ের আগে শ্রমের অস্তিত্ব সর্ব ক্ষেত্রেই আবশ্যিক। কিন্তু শ্রমিক যদি তাকে একটি স্বতন্ত্র বাস্তব অস্তিত্ব দান করতে পারত, তা হলে সে একটি পণ্যই বিক্রয় করত, শ্রম বিক্রয় করত না।[২]

এই সমস্ত স্ববিরোধ ছাড়াও, জীবন্ত শ্রমের সঙ্গে অর্থের, তথা রূপায়িত শ্রমের প্রত্যক্ষ বিনিময় হয়, মূল্যের নিয়মটির-যে নিয়মটি ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ভিত্তিতে সবেমাত্র নিজেকে অবাধে বিকশিত করতে শুরু করে, সেই নিয়মটির—অবসান ঘটাবে, আর নয়তে, মজুরি-শ্রমের উপরে প্রত্যক্ষত প্রতিষ্ঠিত খোদ ধনতান্ত্রিক উৎপাদনেরই অবসান ঘটাবে। ১২ ঘণ্টার একটি শ্রম-দিবস নিজেকে মূর্ত করে একটি অর্থ-মূল্যে, ধরা যাক, ৬ শিলিংয়ে। হয়, দুটি তুল্যমূল্যের মধ্যে বিনিময় ঘটে এবং তখন শ্রমিক তার ১২ ঘণ্টার শ্রমের জন্য ৬ শিলিং প্রাপ্ত হয়; তার শ্রমের দাম তার উৎপন্ন দ্রব্যের দামের সমান হয়। এই ক্ষেত্রে সে তার শ্রমের ক্রেতার জন্য কোনো উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করে না, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ভিত্তিটাই অন্তর্হিত হয়ে যায়। কিন্তু ঠিক এই ভিওিটির উপরেই সে তার শ্রম বিক্রি করে এবং তার শ্রম হচ্ছে মজুরি-শ্রম। আর নয়তো, সে তার ১২ ঘণ্টার শ্রমের জন্য পায় ৬ শিলিংয়ের কম অর্থাৎ ১২ ঘণ্টার শ্রমের চেয়ে কম। ১২ ঘণ্টার শ্রমের সঙ্গে বিনিময় ঘটে ১৩, ৬ ইত্যাদি ঘণ্টার শ্রম। অসম দুটি পরিমাণের সমতা-বিধান কেবল একটি আত্ম-বিধ্বংসী স্ববিরোধ এমন কি কোন ভাবেই একটি নিয়ম হিসাবেও বিধৃত বা সূত্রায়িত করা যায় না।

রূপায়িত শ্রম এবং জীবন্ত শ্রম-এই রূপগত পার্থক্যের মধ্যে বেশি শ্রমের সঙ্গে অল্প শ্রমের বিনিময়ের কোন সুত্র বার করা নিরর্থক।[৩] এটা আরও আজগুবি, কেননা একটি পণ্যের মূল্য তার মধ্যে সত্য সত্যই রূপায়িত হয়েছে এমন শ্রমের পরিমাণ দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় তার উৎপাদনের জন্য আবশ্যক জীবন্ত শ্রমের পরিমাণ দ্বারা। ধরা যাক, একটি পণ্য ৬টি শ্রম ঘণ্টার প্রতিনিধিত্ব করে। যদি এমন একটা আবিষ্কার ঘটে যার দ্বারা ঐ পণ্যটি ৩ ঘণ্টাতেই করা যায়, তা হলে তার মূল্য, এমন কি যেটি আবিষ্কারের আগেই উৎপন্ন হয়েছে, তারও মূল্য অর্ধেক হয়ে যায়। আগে যে। পণ্যটি প্রতিনিধিত্ব করত ৬ ঘণ্টা আবশ্যিক শ্রমের, এখন তা প্রতিনিধিত্ব করে ৩ ঘণ্টা সামাজিক শ্রমের। এটা হচ্ছে ঐ পণ্যটি উৎপাদন করতে যতটা শ্ৰম লাগে, তার পরিমাণ, তার রূপায়িত আকার নয়, যার দ্বারা একটি পণ্যের মূল্যের পরিমাণ নিরূপিত হয়।

বাস্তবিক পক্ষে, বাজারে টাকার মালিকের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যার মুখোমুখি হয়, তা শ্রম নয় শ্রমিক। সে যা বিক্রি করে, তা হল তার শ্রম শক্তি। যে মুহূর্ত থেকে তার শ্রম কার্যতঃ আরম্ভ হয়, সেই মুহূর্ত থেকে সে আর তার শ্রমের মালিক থাকে না, সুতরাং তখন সে আর তা বিক্রি করতে পারে না। শ্রম হচ্ছে মূল্যের অন্তর্বস্তু, তার অন্তনিহিত পরিমাপ, কিন্তু শ্রমের নিজের কোনো মূল্য নেই।[৪]

“শ্রমের মূল্য” কথাটির মধ্যে মূল্যের ধারণাটি কেবল যে মুছে যায়, তা-ই নয়, বস্তুত উলটে যায়। “পৃথিবীর মূল্য” কথাটির মত “শ্রমের মূল্য” কথাটিও কাল্পনিক। অবশ্য, উৎপাদনের সম্পর্কসমূহ থেকেই এই ধরনের কাল্পনিক কথার উদ্ভব ঘটে। এগুলি হল মর্মগত সম্পর্কসমূহের জন্য বাহ্য রূপগুলির বিবিধ অভিধা মাত্র। অনেক সময়েই যে, জিনিসের বাহ রূপ নিজেকে উপস্থিত করে উলটো ভাবে, এই ঘটনা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ছাড়া প্রত্যেকটি বিজ্ঞানেরই সুপরিজ্ঞাত।[৫]

 “শ্রমের দাম”—এই অভিধাটি চিরায়ত রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব বিনা সমালোচনাতেই দৈনন্দিন জীবন থেকে ধার করে নিল এবং তার পরে সরলভাবে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করল, কিভাবে এই দামটি নিরূপিত হয়? চিরায়ত অর্থতত্ত্ব অচিরেই বুঝতে পারল যে, চাহিদা ও যোগানের সম্পর্কে কোন পরিবর্তন, বাকি সমস্ত পণ্যের দামের ক্ষেত্রেও যেমন, শ্রমের দামের ক্ষেত্রেও তেমন, তার পরিবর্তনগুলি ছাড়া, অর্থাৎ একটি বিশেষ মানের উর্ধ্বে বা নীচে বাজার দরের ওঠা-নামাগুলি ছাড়া, আর কিছুই ব্যাখ্যা করে না। বাকি সমস্ত কিছু অপরিবর্তিত থেকে, যদি চাহিদা ও যোগান সমান হয়, তাহলে দামের ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে চাহিদা ও যোগানও কিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারে না। যখন চাহিদা ও যোগান সাম্যাবস্থায় থাকে, তখনকার শ্রমের দাম হচ্ছে তার স্বাভাবিক দাম—যা নির্ধারিত হয় চাহিদা ও যোগান থেকে নিরপেক্ষ ভাবে। কিন্তু এই দামটি কিভাবে নির্ধারিত হয়, ঠিক সেইটাই তো প্রশ্ন। অথবা, ওঠা-নামার একটি দীর্ঘতর সময়কে, ধরা যাক, একটি গোটা বছরকে, নেওয়া হল এবং দেখা গেল যে ওঠা নামাগুলি পরস্পরকে খারিজ করে দিল, যার ফলে থেকে গেল একটি গড়পড়তা পরিমাণ, একটি আপেক্ষিক ভাবে স্থির আয়তন। স্বভাবতই তাকে নির্ধারণ করতে হলে তার নিজের পরস্পর-পরিপূরক পরিবর্তনগুলির সাহায্যে ছাড়া, অন্য কিছুর সাহায্যে তা করতে হবে। এই যে দামটি, যা সর্বদাই শেষ পর্যন্ত শ্রমের আকস্মিক বাজার-দামগুলির উপরে আধিপত্য করে এবং সেগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে, এই “আবশ্যিক দামটি” (ফিজিও ক্র্যাটদের মতে, এই “স্বাভাবিক দামটি” (অ্যাডাম স্মিথের মতে, যেমন অন্যান্য সমস্ত পণ্যের ক্ষেত্রে, তেমন এ ক্ষেত্রেও অর্থের অঙ্কে অভিব্যক্ত তার মূল্য ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। এই ভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ব আশা করল শ্রমের আকস্মিক দাম গুলির মধ্যে, শ্রমের মূল্যের মধ্যে, তির্যকভাবে প্রবেশ করতে। যেমন অন্যান্য ক্ষেত্রে তেমন এই ক্ষেত্রেও এই মূল্য নির্ধারিত হল উৎপাদন-ব্যয়ের দ্বারা। কিন্তু শ্রমিকের উংপাদন-ব্যয়—অর্থাৎ স্বয়ং শ্রমিকের উৎপাদন বা পুনরুৎপাদনের ব্যয় কি? রাষ্ট্রীয় অর্থতত্বে এই প্রশ্নটি অচেতন ভাবে মূল প্রশ্নটির স্থান গ্রহণ করল; কেননা শ্রমের উৎপাদন-ব্যয়ের সন্ধানে অন্বেষণ চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকল এবং কখনো বিদায় নিল না। সুতরাং অর্থতত্ত্ববিদেরা যাকে বলেন শ্রমের মূল্য, তা আসলে শ্রমশক্তির মূল্য, যে-ভাবে সেই শক্তি থাকে শ্রমিকের ব্যক্তিত্বের মধ্যে যা তার কাজ থেকে অর্থাৎ শ্রম থেকে ততটা ভিন্ন, যতটা ভিন্ন একটি মেশিন তার করণীয় কাজ থেকে। শ্রমের বাজার দাম ও তার তথাকথিত মূল্যের মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে, মুনাফ-হারের সঙ্গে এবং শ্রম ইত্যাদির সাহায্যে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীর মূল্য সমূহের সঙ্গে এই মূল্যের সম্পর্ক নিয়ে, ব্যস্ত থাকায় তারা কখনো আবিষ্কার করলো না যে, আলোচনার ধারাটি কেবল শ্রমের বাজার দাম থেকে তার পরিগৃহীত মূল্যের দিকে চলে যায়নি, সেই সঙ্গে চলে গিয়েছে শ্রমশক্তির মূল্যের মধ্যে স্বয়ং শ্রমের এই মূল্যেরই পর্যবসানে! চিরায়ত অর্থতত্ত্ব কখনো নিজের বিশ্লেষণের ফলাফলের সচেতনায় উপনীত হতে পারেনি। বিনা সমালোচনায় তা “শ্রমের মূল্য “শ্রমের স্বাভাবিক দাম” ইত্যাদির মত অভিথাগুলিকে চূড়ান্ত বলে এবং আলোচনাধীন মূল্য-সম্পর্কের সঠিক পরিচায়ক বলে গ্রহণ করেছিল, এবং এর ফলে চালিত হয়েছিল অমোচনীয় বিভ্রান্তি ও দ্বন্দ্ব বিরোধে (যে বিষয়টি আমরা পরে দেখব ); সেই সঙ্গে হাতুড়ে অর্থনীতিবিদদের জন্য উপহার দিয়েছিল তাদের অগভীরতা অনুশীলনের জন্য নিরাপদ ভিত্তি, যা নীতিগত ভাবেই পূজা করে কেবল বাহরূপ।

এর পরে আসুন আমরা দেখি কিভাবে এই রূপান্তরিত অবস্থায় শ্রমশক্তির মূল্য ( এবং মজুরি) তাদের নিজেদেরকে উপস্থিত করে।

আমরা জানি যে, শ্রমশক্তির দৈনিক মূল্য হিসাব করা হয় শ্রমিকের জীবনের একটি বিশেষ দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে, যার সঙ্গে আবার সাযুজ্যপ্রাপ্ত হয় শ্রম-দিবসের একটি বিশেষ দৈর্ঘ্য। ধরা যাক, একটি প্রচলিত শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য হল ১২ ঘণ্টা এবং শ্রমশক্তি দৈনিক মূল্য হল ৩ শিলিং-৬ ঘণ্টার এমকে বিস্তৃত করে এমন একটি মূল্যের আর্থিক অভিব্যক্তি। যদি শ্রমিক পায় ৩ শিলিং, তা হলে সে তার শ্রমশক্তির মূল্য পায়, যা কাজ করে ১২ ঘণ্টা ধরে। এখন, যদি এক দিনের শ্রমশক্তির এই মূলকে খোদ এক দিনের শ্রমের মূল্য হিসাবে প্রকাশ করা হয়, তা হলে আমরা এই সূত্রটিতে উপনীত হই : ১২ ঘণ্টার শ্রমের মূল্য ৩ শিলিং। শ্রমশক্তির মূল্য এই ভাবে নির্ধারিত করে শ্রমের মূল্যকে অথবা আর্থিক অঙ্কে প্রকাশ করলে, শ্রমের আবশ্যিক দামকে। অন্যদিকে, যদি শ্রমশক্তির দাম তার মূল্য থেকে পৃথক করা হয়, তা হলে, অনুরূপ ভাবে শ্রমের দামও তার তথাকথিত মূল্য থেকে পৃথক হয়।

যেহেতু শ্রমের মূল্য শ্রমশক্তির মূল বোঝাবার পক্ষে কেবল একটি অযৌক্তিক ভাষা, এটা অবশ্যই অনুসরণ করে যে শ্রমের মূল্য সব সময়েই হবে তার উৎপাদিত মূল্যের তুলনায় কম, কেননা শ্রমশক্তির আপন মূল্য পুনরুৎপাদন করতে যতটা সময় লাগে ধনিক তাকে সব সময়েই দীর্ঘতর সময় কাজ করতে বাধ্য করে। উল্লিখিত দৃষ্টান্তটিতে, ১২ ঘণ্টা ধরে কাজ করে যে শ্রমশক্তি তার মূল্য হল ৩ শিলিং—এমন একটি মূল্য যা পুনরুৎপাদনের জন্য লাগে ৩ ঘণ্টা। অন্য দিকে, উক্ত শ্রমশক্তি যে-মূল্য উৎপাদন করে, তার মূল্য হল ৬ শিলিং, কারণ বস্তুতঃ পক্ষে তা কাজ করে ১২ ঘণ্টা ধরে, এবং তা যে-মূল্য উৎপাদন করে, সেই মূল্য তার নিজের মূল্যের উপরে নির্ভর করে না, নির্ভর করে তা যত সময় কাজ করে তার দৈর্ঘ্যের উপরে। তা হলে আমরা এমন একটি ফল পাই যা প্রথম দৃষ্টিতে অসম্ভব বলে মনে হয় : যে, শ্রম সৃষ্টি করে ৬ শিলিং মূল্য, তার নিজের মূল্য ৩ শিলিং।[৬]

আমরা আরো দেখতে পাই : ৩ শিলিং মূল্য, যার দ্বারা দিবসটির মাত্র একটি অংশের মূল্য দেওয়া হয়, তা প্রতিভাত হয়, সমগ্র ১২ ঘণ্টার শ্রম-দিবসটির মূল্য বা দাম হিসাবে–যে ১২ ঘণ্টায় অন্তর্ভুক্ত আছে এমন ৬টি ঘণ্টা যার জন্য মূল্য দেওয়া হয়নি। এই ভাবে মজুরি-রূপ শ্রম-দিবসের আবশ্যিক ও উদ্বত্ত-শ্রমে, মূল্য-প্রদত্ত ও মূল্য বঞ্চিত শ্রমে বিভাজনের সকল চিহ্নকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। সমস্ত শ্রমই প্রতিভাত হয় মূল্য-প্রদত্ত শ্রম হিসাবে। বেগরি প্রথায়, শ্রমিকের নিজের জন্য শ্রম হিসাবে। বেগার প্রথায়, শ্রমিকের নিজের জন্য শ্রম এবং তার প্রভুর জন্য তার বাধ্যতামূলক শ্রম এই দুয়ের মধ্যে স্থান ও কালের দিক থেকে পার্থক্য যথাসম্ভব স্পষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ করে। দাস-এমে এমনকি এমদিবসের যে অংশে দাস কেবল তার নিজের জীবন ধারণের উপকরণাদি প্রতিস্থাপন করে, অতএব, যে অংশে, সে কেবল তার নিজের জন্যই কাজ করে, সেই অংশটিও প্রতিভাত হয় মালিকের জন্য তার কাজ হিসাবে। দাসের সমস্ত এমই প্রতিভাত হয় মূল্য-বঞ্চিত শ্রম হিসাবে।[৭] মজুরি-শ্রমে, বিপরীত, এমন কি উদ্বৃত্ত-শ্রমও, কিংবা মূল্য-বঞ্চিত শ্রমও প্রতিভাত হয় মূল্য-প্রদত্ত শ্রম হিসাবে। ওখানে সম্পত্তি-সম্পর্ক দাসের নিজের জন্য কৃত শ্রমকে লুকিয়ে রাখে; এখানে অর্থ-সম্পর্ক মজুরি শ্রমিকের প্রতিদান-বঞ্চিত এমকে লুকিয়ে রাখে।

সুতরাং মজুরির রূপে, যা খোদ শ্রমের মূল্য ও দামের রূপে ম-শক্তির রূপান্তরণের চূড়ান্ত গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারি। এই যে বাহ রূপ, যা আসল সম্পর্কটিকে অদৃশ্য করে রাখে এবং বাস্তবিক পক্ষে, সেই সম্পর্কের প্রত্যক্ষ বিপরীতটিকেই প্রদর্শন করে থাকে-এই বাহরূপটিই শ্রমিক এবং ধনিক উভয়েরই সমস্ত আইনগত ধারণার, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রণালীর সমস্ত রহস্যময়তার, স্বাধীনতা সম্পর্কে তার সমস্ত বিভ্রমের, হাতুড়ে অর্থতাত্ত্বিকদের সমস্ত ক্রটিস্বীকারসূচক বক্তব্য-পরিবর্তনের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে।

ইতিহাস যদি মজুরির মূলদেশে উপনীত হতে দীর্ঘ সময় নিয়ে থাকে, তা হলে, অন্য দিকে, এই মজুরি-রূপটির আবশ্যিকতা, অস্তিত্বের আবশ্যিক প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করার তুলনায় সহজতর আর কিছুই নেই।

মূলধন এবং শ্রমের মধ্যে বিনিময় প্রথমে আমাদের মনের কাছে হাজির হয় অন্যান্য পণ্যদ্রব্যাদির ক্রয়-বিক্রয়ের মত একই চেহারায়। ক্রেতা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেয়, বিক্রেতা দেয় অর্থ থেকে প্রকৃতিগতভাবে আলাদা একটি জিনিষ। আইনবিদের চেতনা এখানে উপলব্ধি করে বড় জোর একটি বস্তুগত পার্থক্য, যা অভিব্যক্ত হয়েছে আইনগতভাবে সমরূপ এই সূত্রটির মধ্যে। “Do ut des, do ut facias, facio ut des, facio ut facias”

অধিকন্তু, বিনিময়মূল্য ও ব্যবহার-মূল্য হল অপরিমেয় রাশি; তাই শ্রমের মূল্য, শ্রমের দাম” এই কথাগুলি “তুলোর মূল্য” “তুলোর দাম কথাগুলির তুলনায় বেশি যুক্তিহীন নয়। তা ছাড়া, শ্রমিককে তার প্রাপ্য দেওয়া হয় সে শ্রম দিয়ে দেবার পরে। মূল্য দানের উপায় হিসাবে অর্থের যে ভূমিকা, সেই ভূমিকা অনুযায়ী, অর্থ পরে সরবরাহ কৃত জিনিসটির মূল্য বা দামটি এই বিশেষ ক্ষেত্রে সরবরাহকৃত শ্রমের মূল্য বা দামটি -বাস্তবায়িত করে। সর্বশেষে, শ্রমিক ধনিককে যে ব্যবহার-মূল্য সরবরাহ করে তা আসলে তার শ্রমশক্তি নয়, তা হচ্ছে শ্রমশক্তির কাজ, কোন নির্দিষ্ট প্রয়োজন-পূর্বক শ্রম, দর্জির কাজ, জুতো তৈরি, সুতো কাটা ইত্যাদি। এই একই শ্রম যে আবার বিশ্বজনীন মূল্যসৃজনী উপাদান, এবং সেই কারণে এমন একটি গুণ যা তাকে বাকি সমস্ত পণ্য থেকে স্বতন্ত্রতা দান করে, তা মামুলি বুদ্ধির ধারণার বাইরে।

আসুন, আমরা নিজেদেরকে এমন একজন শ্রমিকের জায়গায় বসাই, যে ১২ ঘণ্টা শ্রমের বিনিময়ে পায়, ধরুন, ৬ ঘণ্টা শ্রমের মূল্য, ধরুন, ৩ শিলিং। বস্তুতঃ পক্ষে, তার দিক থেকে, তার এই ১২ ঘণ্টার শ্রম হচ্ছে তার ৩ শিলিং কেনার উপায়। তার জীবন ধারণের মামুলি উপকরণাদির মূল্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার শ্রমশক্তির মূল্যও পরিবর্তিত হতে পারে, ৩ শিলিং থেকে ৪ শিলিং-এ, বা ৩ শিলিং থেকে ২ শিলিং-এ; অথবা যদি তার শ্রমশক্তির মূল্য স্থির থাকে, তাহলে চাহিদা ও যোগানের সম্পর্কে পরিবর্তন অনুযায়ী তার দাম বেড়ে গিয়ে, ৪ শিলিং হতে পারে বা কমে গিয়ে ২ শিলি; হতে পারে। সে কিন্তু সব সময়ই দিচ্ছে ১২ ঘণ্টা শ্রম। এই ঘটনাটি অ্যাডাম স্মিথকে, যিনি শ্রম-দিবসকে গণ্য করতেন একটি স্থির রাশি[৮] হিসাবে, এই ভুল সিদ্ধান্তে ঠেলে দিয়েছিল যে শ্রমের মূল্য স্থির থাকে, যদিও জীবনধারণের উপায়-উপকরণের মূল্য পরিবর্তিত হতে পারে, এবং, সেই কারণে, একই শ্রম-দিবস শ্রমিকের কাছে নিজেকে উপস্থিত করতে পারে বেশি বা কম টাকা হিসাবে।।

অন্য দিকে আসুন ধনিকের অবস্থাটা বিবেচনা করে দেখি। সে চায় যত কম টাকা দিয়ে যত বেশি শ্রম পাওয়া যায়, তাই পেতে। সুতরাং কার্যক্ষেত্রে একমাত্র যে জিনিসটিতে তার আগ্রহ থাকে, সেটি হল শ্রমশক্তির দাম এবং যে-মূল্য ঐ শ্রম শক্তির কাজের দ্বারা সৃষ্ট হয় সেই মূল্যের মধ্যেকার পার্থক্যটি। কিন্তু, সেখানে সে চায় যত সস্তায় সম্ভব সব জিনিস ক্রয় করতে এবং সময়ই তার মুনাফার কারণ হিসাবে দেখায় তার প্রতারণামূলক লেন-দেনকে—মূল্যের তুলনায় কমে ক্রয় করে মূল্যের তুলনায় বেশিতে বিক্রয় করার ব্যাপারটিকে। সুতরাং সে কখনো দেখতে পায় না, শ্রমের মূল্যের মত কোন একটা কিছু যদি সত্যই থাকত, এবং সে এই মূল্য দিয়ে দিত, তা হলে কোনো মূলধন থাকত না, তার অর্থ মূলধনে রূপান্তরিত হত না।

অধিকন্তু, মজুরির আসল গতিবিধি এমন সব বাহরূপ উপস্থিত করে, যা যেন প্রমাণ করে যে শ্রমশক্তির মূল্য বাবদে কিছু দেওয়া হয় না, দেওয়া হয় তার কাজের মূল্য বাবদে, স্বয়ং শ্রমের মূল্য বাবদে। এই সব বাহ্য-রূপকে আমরা দুটি বড় বড় শ্রেণীতে বিভক্ত করতে পারি : (১) শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্যের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মজুরির পরিবর্তন। কেউ অনুরূপ ভাবে এই সিদ্ধান্তেও আসতে পারেন যে, একটি মেশিনের মূল্য দেওয়া হয় না, দেওয়া হয় তার কাজের মূল্য, কেননা এক দিনের জন্য একটি মেশিনকে ভাড়া করতে যা খরচ হয়, এক সপ্তাহের জন্য সেটাকে ভাড়া করলে তার চেয়ে বেশি খরচ হয়। (২) একই ধরনের কাজ করে এমন বিভিন্ন শ্রমিকের মজুরিতে। ব্যক্তিগত পার্থক্য। ক্রীতদাসপ্রথায়, যেখানে কোনো কথার মারপ্যাচ না করে, খোলাখুলি ও অবাধে খোদ শ্রমশক্তিই বিক্রি হয়, সেখানে আমরা এই পার্থক্য প্রত্যক্ষ করি, কিন্তু তার দ্বারা প্রতারিত হই না। একমাত্র ক্রীতদাসপ্রথাতেই গড়ের তুলনায় উচ্চতর একটি শ্রমশক্তির সুবিধা এবং গড়ের তুলনায় নিম্নতর একটি শ্রমশক্তির অসুবিধা দাস-মালিককে প্রভাবিত করে; মজুরি-শ্রম প্রথায় তা স্বয়ং শ্রমিককে প্রভাবিত করে, কেননা এক ক্ষেত্রে সে নিজেই তার শ্রমশক্তি বিক্রি করে, অন্য ক্ষেত্রে তৃতীয় এক ব্যক্তি তা বিক্রি করে।

বাহ্য-রূপ প্রসঙ্গে “শ্রমের মূল্য ও দাম” কিংবা “মজুরি” বাকি বিষয়ের ক্ষেত্রে তন্মধ্যে প্রকাশিত মর্মগত সম্পর্কের প্রতি তুলনায়, অর্থাৎ শ্রম-শক্তিমূল্য ওদামের প্রতি তুলনায়, সেই পার্থক্য বলবৎ থাকে, যা বলবৎ থাকে সমস্ত বাহ্য-রূপ এবং তাদের প্রচ্ছন্ন অন্তর্বর মধ্যে। প্রথমটি প্রত্যক্ষ ও স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে প্রতিভাত হয় প্রচলিত চিন্তাধারা হিসাবে; দ্বিতীয়টিকে প্রথমত আবিষ্কৃত হতে হয় বিজ্ঞানের দ্বারা। চিরায়ত অর্থতত্ত্ব জিনিসগুলির সত্যকার সম্পর্কের কিনারা প্রায় স্পর্শ করেছিল, যদিও সচেতনভাবে তাকে সূত্রায়িত করতে পারে নি। যতক্ষণ পর্যন্ত বুর্জোয়া চামড়া তার গায়ে লেগে থাকবে, ততক্ষণ সে তা করতেও পারবে না।

————

১. ‘মিঃ রিকার্ডো যথেষ্ট কৌশল সহকারে একটা সমস্যা পরিহার করেন, যে-সমস্যাটা, প্রথম দৃষ্টিতে, তার এই মতবাদকে . আচ্ছন্ন করে ফেলার আশংকা সৃষ্টি করেছিল : মূল্য নির্ভর করে উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমের উপরে। যদি এই নীতির প্রতি কঠোর ভাবে নিষ্ঠাবান হতে হয়, তা হলে এই সিদ্ধান্ত টানতে হয় যে, শ্রমের মূল্য নির্ভর করে তার উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমের উপরে- যা স্পষ্টতই অসম্ভব। সুতরাং একটা সুকৌশলী মোচড় মেরে মিঃ রিকার্ডো শ্রমের মূল্যকে নির্ভরশীল করে তোলেন মজুরি উৎপাদন করতে যে-পরিমাণ শ্রম লাগে, তার উপরে; কিংবা তাঁকে যদি নিজের ভাষাতেই বলার সুবিধা দেওয়া যায়, তিনি পোষণ করেন যে, শ্রমের মূল্য হিসাবে করতে হবে মজুরি উৎপাদন করতে যে পরিমাণ শ্রমের দরকার হয় তার দ্বারা; যার দ্বারা তিনি বোঝাতে চান শ্রমিককে প্রদত্ত অর্থ বা পণ্য উৎপাদন করতে যে-পরিমাণ শ্রমের দরকার হয় তাই। ওকথা বলার মানেও যেমন, একথা বলার মানেও তেমন যে, কাপড়ের মূল্যের হিসাব করা হয় তার উৎপাদনে যে-পরিমাণ শ্রম অর্পিত হয়, তার দ্বারা নয়; হিসাব করা হয় ঐ কাপড়ের বিনিময়ে যে রুপো পাওয়া যায়, সেই রুপো উৎপাদনে কতটা শ্রম অর্পিত হয়েছে তার দ্বারা। (এ ক্রিটিক্যাল ডিলারটেশন অন দি নেচর অব ভ্যালু, পৃঃ ৫৩, ৫১)।

২. আপনি যদি শ্রমকে একটি পণ্য বলেন যা প্রথমে উৎপন্ন হয় বিনিময় করার জন্য, এবং পরে নিয়ে আসা হয় বাজারে, যেখানে তা অবশ্যই বিনিমিত হবে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ পরিমাণ অনুযায়ী যে পরিমাণ তখন বাজারে থাকতে পারে; শ্রম সৃষ্ট হয় তখনি, যে-মুহূর্তে তাকে বাজারে আনা হয়। এমনকি তাকে বাজারে আনা হয় তার সৃষ্টি হবার আগেই। (“অবজার্ভেশন অন সার্টেন ভার্বাল ডিসপিউটস,” পৃঃ ৭৫, ৭৬)।

৩. ‘Il a fallu convenir ( a new edition of the contrat social 1) que toutes les fois qu’il echangerait due travail fait contre du lavail a faire; le dernier (le capitaliste) aurait une valeur superieure au premier’ ( le travailleur ). Simonde (i.e. Sismondi), “De la Richesse Commerciale,” Geneve, 1803, t. 1. 9: 37.

৪, শ্রম মূল্যের একান্ত মান…সমস্ত ধনের স্রষ্টা, কোনো পণ্য নয়। টমাস হজস্কিন, পপুলার পলিটিক্যাল ইকনমি, পৃঃ ১৮৬।

৫. অন্য দিকে, এই ধরনের বাচনভঙ্গিকে নিছক ‘কবিশোভন স্বাধিকার বলে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা কেবল ঐ বিশ্লেষণের নিস্ফলই প্রমাণ করে। এই কারণেই প্রুধোঁর যে উক্তি: “Le travail est dit valoir, non pas en tant que marchandise lui-meme, mais en vue des valeurs qu’on suppose renfermees puissanciellement en lui. La valeur du travail est une expression figuree,” সেই উক্তির উত্তরে আমি মন্তব্য করেছি, “Dans le travail-marchandise qui est d’une realite effrayante il ( Proudhon ) ne voit qu’une ellipse grammaticale. Donc, toute la societe actuelle fondee sur le travail-marchandise, est desormais fondee sur une license poetique, sur une expression figuree. La societe veut-elle ‘eliminer tous les inconvenients,’ qui la travaillent, ch bien; qu’elle elimine les termes malsonnants, qu’elle change de langage, et pour cela elle n’a qu’a s’adresser a l’Academie pour lui demander une nouvelle edition de son dictionnaire.” ( Karl Marx, “Misere de la Philosophie, pp. 34, 35 ). স্বভাবতই মূল্যের দ্বারা কিছুই না বোঝ আরো সহজ। সেক্ষেত্রে যে কেউ অনায়াসেই এই শিরোনামের অধীনে সব কিছুই ধরে নিতে পারেন। যেমন, জে বি সে প্রশ্ন করেন, valeur’ কি? উত্তর : C’est ce qu’une chose vaut। এবং “prix” কি? উত্তর : ‘La valeur d’une chose exprimee en monnaie.’ 493 cpap ‘le travail de la terre…une valeur? Parce qu’on y met un prix., সুতরাং একটি জিনিসের মূল্য হচ্ছে তাই, যা তার মূল্য এবং জমির মূল্য আছে, কেননা তার মূল্য প্রকাশিত হয় টাকার অঙ্কে। যাই হোক, কোন কিছুর হেতু ও উৎস বোঝাবার পক্ষে এটা বড় সরল উপায় !

৬. দ্রষ্টব্য : zur Kritik der Politischen Dekonomie, পৃঃ ৪০, যেখানে আমি বলেছি যে, মূলধন-সংক্রান্ত গ্রন্থের সংশ্লিষ্ট অংশে এই সমস্যাটি আলোচিত হবে। কেবল শ্রম-সময়ের দ্বারা নির্ধারিত বিনিময়মূল্যের ভিত্তিতে কেমন করে উৎপাদন এই ফলে উপনীত হয় যে, শ্রমের বিনিময়মূল্য তার উৎপন্ন ফলের বিনিময় মূল্যের চেয়ে কম?

৭. দি মনিং স্টার, লণ্ডন থেকে প্রকাশিত অবাধ বাণিজ্যের একটি মুখপত্র, এত সরল যে প্রায় বোকা, আমেরিকার গৃহযুদ্ধ চলাকালে, মানুষের যতটা নৈতিক ক্রোধ থাকতে পারে সেই সমগ্র ক্রোধ সহ, মুখপত্রটির উচিত ছিল লণ্ডনের ইন্ট-এন্ড-এর একজন স্বাধীন শ্রমিকের দৈনিক ব্যয়ের সঙ্গে এমন একজন নিগ্রোর দৈনিক ব্যয় তুলনা করে দেখা।

৮. ‘পিস-গুয়েজ’-এর (জিনিস পিছু মজুরির কথা বলতে গিয়ে অ্যাডাম স্মিথ কেবল হঠাৎ শ্রম-দিবসের হ্রাস-বৃদ্ধির কথা বলে ফেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *