২৫. ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের সাধারণ নিয়ম

পঞ্চবিংশ অধ্যায় — ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের সাধারণ নিয়ম

প্রথম পরিচ্ছেদ– মূলধনের গঠন অপরিবর্তিত থেকে, সঞ্চয়নের সহগামী শ্রমশক্তির জন্য বর্ধিত চাহিদা

এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব শ্রমিক শ্রেণীর ভাগ্যের উপরে মূলধনের বিকাশ ও বৃদ্ধির প্রভাব। এই আলোচনায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মূলধনের গঠন এবং সঞ্চয়নের প্রক্রিয়ায় যেসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই গঠন অতিক্রান্ত হয়, সেই পরিবর্তনসমূহ।

মূলধনের গঠনকে বুঝতে হবে দ্বিবিধ অর্থে। মূল্যের দিক থেকে, তা নির্ধারিত হয় যে-অনুপাতে তা বিভক্ত হয় স্থির মূলধন বা উৎপাদন-উপায়সমূহের মূল্য এবং অস্থির মূলধন বা শ্রমশক্তির মূল্য তথা মোট মজুরির মধ্যে, সেই অনুপাতের দ্বারা। বস্তুগত দিক থেকে তা যখন কাজ করে উৎপাদন-প্রক্রিয়ায়, সমস্ত মূলধন তখন বিভক্ত থাকে উৎপাদনের উপায়ে এবং জীবন্ত শ্রমশক্তিতে। এই পরবর্তী গঠনটি নির্ধারিত হয় এক দিকে নিয়োজিত উৎপাদন-উপায়সমূহের পরিমাণ এবং, অন্য দিকে সেগুলির নিয়োজনের জন্য আবশ্যক শ্রমের পরিমাণের মধ্যেকার সম্পর্কের দ্বারা। প্রথমটিকে আমি অভিহিত কৰি মূল্যগত গঠন’ বলে, এবং দ্বিতীয়টিকে প্রযুক্তিগত গঠন’ বলে। দুটির মধ্যে আছে একটি গোপন আন্তঃসম্পর্ক। এই সম্পর্কটি প্রকাশ করতে আমি মূলধনের মূল্যগত গঠনকে যেহেতু তা নির্ধারিত হয় তার প্রযুক্তিগত গঠনের দ্বারা এবং প্রতিবিম্বিত করে প্রযুক্তিগত গঠনের বিবিধ পরিবর্তন, সেই হেতু তাকে আমি অভিহিত করি মূলধনের ‘আঙ্গিক গঠন’ বলে। যখনি আমি আর কোনো বর্ণনা ছাড়া মূলধনের গঠনের কথা উল্লেখ করব, তখনি ধরে নিতে হবে যে, আমি তার আঙ্গিক গঠনের কথাই বলছি।

একটি বিশেষ শিল্প-শাখায় বিনিয়োজিত অনেক আলাদা আলাদা মূলধনের পরস্পর থেকে ভিন্ন ভিন্ন গঠন থাকে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন গঠনের গড় থেকে পাওয়া যায় সেই শিল্প-শাখায় বিনিয়োজিত মোট মূলধনের গঠন। সর্বশেষে, উৎপাদনের সমস্ত শাখার গড়গুলির গড় থেকে আবার পাওয়া যায় একটি দেশের মোট সামাজিক মূলধনের গঠন এবং, শেষ পর্যন্ত, একমাত্র এই বিষয়টি নিয়েই আমাদের নিম্নলিখিত অনুসন্ধান।

মূলধনের বৃদ্ধি মানে তার অস্থির উপাদানেরও অর্থাৎ শ্রমশণিতে বিনিয়োজিত অংশটিরও বৃদ্ধি। অতিরিক্ত মূলধনে রূপান্তরিত উদ্বৃত্ত-মূল্যের একটি অংশকে অবশ্যই সব সময়ে অস্থির মূলধনে কিংবা অতিরিক্ত শ্রম-ভাণ্ডারে পুনঃরূপান্তরিত হতে হবে। আমরা যদি ধরে নিই যে, বাকি সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে, মূলধনের গঠনও অপরিবর্তিত থাকে (যার মানে এই যে, উৎপাদনের উপায়-উপকরণের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণকে গতিশীল করার জন্য সব সময়ে একই পরিমাণ শ্রমশক্তি ঘাবশ্যক হয়, তা হলে, মূলধনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রম ও শ্রমিকদের জন্য অত্যাবশ্যক সামগ্রী-ভাণ্ডারের চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে এবং মূলধন তত দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়। যেহেতু মূলধন বাৎসরিক একটি উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করে, যার একটা অংশ বাৎসরিক প্রারম্ভিক মূলধনের সঙ্গে সংযোজিত হয়; যেহেতু আগে থেকে কর্মরত মূলধনের বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এই সংযোজিত অংশ নিজেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়; সর্বশেষে, যেহেতু, নোতুন নোতুন অভাবের উদ্ভব হবার দরুন নতুন নোতুন বাজার, কিংবা মূলধন বিনিয়োগের নোতুন নোতুন ক্ষেত্র খুলে যাবার মত ঐশ্বর্য সংগ্রহের নোতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হবার দরুন, মূলধনে ও আয়ে উদ্বৃত্ত-মূল্যের বিভাজনে কেবলমাত্র একটি পরিবর্তন ঘটিয়েই, সঞ্চয়নের আয়তনকে অকস্মাৎ বৃদ্ধি করা যায়, সেই হেতু মূলধন সঞ্চয়ের প্রয়োজনগুলি শ্রমশক্তির বা শ্রম সংখ্যার বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে; শ্রমিকের চাহিদা শ্রমিকের সরবরাহ ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং, স্বভাবতই, মজুরি বেড়ে যেতে পারে। বস্তুতঃ পক্ষে, উপরে যে অবস্থাগুলি ধরে নেওয়া হয়েছে সেগুলি যদি চলতে থাকে, তা হলে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত তাই দাঁড়াবে। কারণ যেহেতু প্রতি বছরই তার আগেকার বছর থেকে বেশি সংখ্যক শ্রমিক নিযুক্ত হয়, সেই হেতু, আগে হোক পরে হোক, এমন একটা সময় আসবে, যখন সঞ্চয়নের প্রয়োজন শ্রমের চলতি সরবরাহকে ছাড়িয়ে যাবে এবং তার ফলে মজুরি বৃদ্ধি পাবে। এই ব্যাপার ইংল্যাণ্ডে গোটা পঞ্চদশ শতক এবং অষ্টাদশ শতকের প্রথম অর্ধাংশ জুড়ে একটা বিলাপ শোনা যেত। যে মোটামুটি অনুকূল অবস্থায় মজুরিশ্রমিক-শ্রেণী নিজের ভরণপোষণ ও সংখ্যাবর্ধন করে, তা কোনক্রমেই ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের মৌল চরিত্রে পরিবর্তন ঘটায় না। যেমন সরল পুনরুৎপাদন নিরন্তর স্বয়ং মূলধন-সম্পর্কটিকেই, অর্থাৎ একদিকে ধনিক এবং অন্যদিকে মজুরি-শ্রমিকের মধ্যকার সম্পর্কটিকেই, পুনরুৎপাদিত করে, তেমন ক্রমবর্ধমান হারে পুনরুৎপাদনও অর্থাৎ সঞ্চয়নও, ক্রমবর্ধমান হারে মূলধন-সম্পর্কটিকে পুনরুৎপাদিত করে—এই প্রান্তে বিপুল সংখ্যক বা বৃহত্তর, ধনিক অন্য প্রান্তে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক। একটি বিশেষ পরিমাণ শ্রম শক্তির পুনরুৎপাদন, যা অবশ্যই নিজেকে মূলধনের সঙ্গে সংবদ্ধ করবে ঐ মূলধনটিরই আত্ম-প্রসারণের জন্য, যা মূলধন থেকে মুক্তি পেতে পারে না এবং মূলধনের কাছে যার ক্রীতদাসত্ব প্রচ্ছন্ন থাকে, যাদের কাছে সে আত্ম-বিক্রয় করে, কেবল সেই ব্যক্তিগত ধনিকদের বিভিন্নতার দ্বারা, শ্রমশক্তির এই পুনরুৎপাদন আসলে কিন্তু স্বয়ং মূলধনেরই পুনরুৎপাদনের একটি অত্যাবশ্যক উপাদান রচনা করে। অতএব, মূলধনের সঞ্চয়ন মানেই হল সর্বহারা-শ্রেণীর (প্রোলেটারিয়েট’-এর) আয়তন বৃদ্ধি।[১]

চিরায়ত অৰ্থত এই ঘটনাটিকে এমন সর্বাঙ্গীণ ভাবে ধরতে পেরেছিল যে, অ্যাডাম স্মিথ, রিকার্ডো প্রমুখ অর্থতাত্ত্বিকেরা, যে-কথা আমরা আগেই বলেছি, উদ্ভ-উৎপন্ন সামগ্রীর সমগ্র মূলধনীকৃত অংশটিকেও উৎপাদনশীল শ্রমিকের পরিভোগর সঙ্গে, কিংবা অতিরিক্ত শ্ৰমিকসংখ্যায় তার রূপান্তরণের সঙ্গে ভুল ভাবে একাকার করে ফেলেছিলেন। সেই ১৯৬ সালেই জনা বেলার্স বলেন, কারো যদি ১,০০০ একর জমি এবং তত হাজার পাউণ্ড টাকা থাকে এবং তত হাজার গবাদি পশু থাকে, কিন্তু কোনো শ্রমিক না থাকে, তা হলে সেই ধনী ব্যক্তিটি শ্রমিক না হয়ে আর কি হবে? এবং যেহেতু শ্রমিকেরাই লোকদের ধনী করে, সেই হেত শ্রমিকের সংখ্যা যত বেশি হবে, ধনীর সংখ্যাও তত বাড়বে গরদের শ্রমই হল ধনকদের ধনের খনি।”[২] অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে বার্ণা দ্য দেভিল-ও একই রকম কথা বলেছিলেন, “যেখানে সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চয়ীকৃত, সেখানে গরিব-ছাড় বাস করার তুলনায় টাকা-ছাড বাস করা সহজতর। কেননা, কাজ করবে কে? যেহেতু গরিবদের অনশন থেকে বাঁচাতে হবে, সেহেতু সঞ্চয় করার মত তারা কিছু পাবে না। যদি এখানে সেখানে সবচেয়ে নীচ শ্রেণীর কোন কেউ অসাধারণ পরিশ্রমের জোরে এবং আধপেটা খেয়ে, সে যে-অবস্থার মধ্যে বড় হয়েছে, সেই অবস্থা থেকে উপরে উঠে আসতে পারে, তা হলে তাকে কারো বাধা দেওয়া হবে না; বরং সমাজে প্রত্যেকটি লোকের পক্ষে, প্রত্যেকটি পরিবারের পক্ষে মিতাহারী হওয়াটাই হল সবচেয়ে বিচক্ষণ পন্থা; কিন্তু সমস্ত ধনী জাতিগুলিরই স্বার্থ এই যে, গরিবদের বিপুলতম অংশ যেন প্রায় কোন সময়েই অলস হয়ে পড়ে না থাকে, এবং যা তারা পায় তাই তারা অনবরত খরচ করে দেয়। যারা তাদের দৈনিক শ্রমের সাহায্যে জীবিকা অর্জন করে, অভাবের তাড়না ছাড়া যাদের কাজে প্রবৃত্ত করার মত আর কিছু নেই, তাদের অভিসম্পাত না করে, তাদের অভাবের উপশমে সাহায্য করাই সুবিবেচনার কাজ; না করাটা হবে নির্বুদ্ধিতা, একমাত্র যে-জিনিসটি শ্রমিককে পরিশ্রমী করে তুলতে পারে, তা হল এমন-পরিমাণ টাকা, যা খুব কমও নয়, আবার খুব বেশিও নয়, কেননা প্রথম ক্ষেত্রে, তার মেজাজ অনুযায়ী সে হয়ে পড়বে নিরুম বা বেপরোয়া, এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সে হয়ে উঠবে উদ্ধত বা আলস্য-পরায়ণ : যা বলা হয়েছে, তা থেকে এটা পরিষ্কার যে, একটা মুক্তজাতিতে-যেখানে ক্রীতদাস-প্রথা অবৈধ, সেখানে—শ্রমশীল গরিব জনসংখ্যার বাহুল্যই হল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সম্পদ। কেননা, তারা কেবল নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর লালনাগারই নয়, তাদের ছাড়া কোনো ভোগ-বিলাসই সম্ভব নয়, এবং কোন দেশের কোনো উৎপন্ন সামগ্রীই হতে পারে না মূল্যবান। “সমাজকে (অর্থাৎ অ-শ্রমিক জনসংখ্যাকে সুখী করার জন্য এবং সবচেয়ে হীন অবস্থার মধ্যেও সাধারণের জীবনকে সুসহ করার জন্য, এটা জরুরি যে তাদের বেশির ভাগই হয় অজ্ঞ ও দরিদ্র; জ্ঞান আমাদের অভাব-বোধের বৃদ্ধি ও বৈচিত্র্য সাধন করে এবং মানুষের লিগা যত কম থাকে তত সহজে তা মেটানো সম্ভব হয়।”[৩] মদেভিল একজন সৎ ও পরিচ্ছন্ন-মস্তিষ্ক ব্যক্তি; কিন্তু তিনি যেটা দেখতে পাননি, সেটা এই যে, সঞ্চয়নের যান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি নিজেই যেমন মূলধনের বৃদ্ধি ঘটায়, তেমন আবার “শ্রমশীল গরিব জনসংখ্যার”-ও বৃদ্ধি ঘটায়—অর্থাৎ বৃদ্ধি ঘটায় তাদের সংখ্যার, যারা তাদের শ্রম শক্তিকে পরিণত করে ক্রমবর্ধিষ্ণু মূলধনের আত্ম-প্রসারণের একটি ক্রমবর্ধমান শক্তিতে, এবং তা করার পরেও, ধনিকের ব্যক্তিরূপে রূপায়িত তাদের নিজেদেরই উৎপন্ন ফলের উপরে, নিজেদের নির্ভরতার সম্পর্ককে বাধ্য হয় চিরস্থায়ী করতে। এই নির্ভরতার সম্পর্ক প্রসঙ্গে, স্যার এফ. এম. ইডেন তার “গরিবদের অবস্থা, ইংল্যাণ্ডে শ্রমজীবী শ্রেণীসমূহের ইতিবৃত্ত” নামক গ্রন্থে বলেন, “আমাদের মৃত্তিকার প্রাকৃতিক ফসল নিশ্চয়ই আমাদের জীবনধারণের পক্ষে যথেষ্ট নয়; পূর্ববর্তী কিছু শ্রমের অবদান ছাড়া আমরা না পারি আমাদের পরিধেয় ও আবাসনের ব্যবস্থা করতে, না পারি খাদ্যদ্রব্যের সংস্থান করতে। সমাজের অন্ততঃ একটি অংশকে কাজ করতে হবে অবিশ্রান্ত ভাবে।…… অন্যান্যরাও আছে, যারা খাটুনিও খাটেনা, সুতোও কাটে না, অথচ নিয়ন্ত্রণ করে শিল্পোৎপন্ন সামগ্রীসম্ভারকে, যারা অব্যাহতি ভোগ করে কেবলমাত্র সভ্যতা ও শৃংখলার প্রাসাদে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাসমূহের তারা বিশেষ জাতীয় সৃষ্টি[৪], যে-সংস্থাগুলি স্বীকার করে নিয়েছে যে, শ্রম না করেও অন্যান্য নানা উপায়ে ব্যক্তি পারে সম্পত্তি অর্জন করতে। স্বতন্ত্র ঐশ্বর্যের অধিকারী ব্যক্তিরা : কোনক্রমেই তাদের উন্নততর ক্ষমতার বলে। উন্নততর সুযোগ-সুবিধার অধিকার ভোগ করে না, তারা তা ভোগ করে প্রায় সমগ্র ভাবেই অপরের পরিশ্রমের ফলে। সমাজের শ্রমজীবী অংশ থেকে ঐশ্বর্যবান ব্যক্তিদের যা বিশিষ্টতা দান করে, তা জমি কিংবা টাকার উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ নয়, তা হল শ্রমের উপরে নিয়ন্ত্রণ। (ইডেনের অনুমোদিত) এই পরিকল্পনা, তাদের জন্য যারা কাজ করে, তাদের উপরে সম্পত্তিবান লোকদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ প্রভাব ও প্রতিপত্তি অর্পণ করবে এবং, সেই সঙ্গে, তা শ্রমিকদের এক নিতান্ত হীন ও দাস-সুলভ অবস্থায় অধঃপাতিত না করে, তাদের স্থাপন করবে এমন এক সহজ ও উদার নির্ভরতার অবস্থানে, যাকে মানব-প্রকৃতি সম্পর্কে ও মানব ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত সমস্ত মানুষই শ্রমিকদের নিজেদের আরামের জন্য আবশ্যক বলে স্বীকার করবেন।[৫] প্রসঙ্গত উল্লেখ যোগ্য যে, স্যার এফ. এম. ইডেন-ই হচ্ছেন অষ্টাদশ শতকে অ্যাডাম স্মিথের একমাত্র শিষ্য যিনি কিঞ্চিৎ গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ রচনা করেন।[৬]

এই পর্যন্ত সঞ্চয়নের যে-অবস্থাবলী ধরে নেওয়া হয়েছে, যেগুলি শ্রমিকদের পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল, তাতে মূলধনের উপরে তাদের নির্ভরতা একটি সহনীয় আকার, বা ইডেন-এর ভাষায়, একটি “সহজ ও উদার আকার ধারণ করে। মূলধনের অগ্রগতির সঙ্গে অধিক নিবিড়তর না হয়ে, এই নির্ভরতার সম্পর্ক হয় অধিক ব্যাপকতর, অর্থাৎ, নিজের আয়তন ও প্রজাদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে মূলধনের শোষণ ও শাসনের সীমানা আরো বিস্তার লাভ করে। তাদের নিজেদের উৎপন্ন সামগ্রীর একটি বৃহত্তর অংশ, সর্বদা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ও নিরন্তর অতিরিক্ত মূলধনে রূপান্তরিত হয়ে, তাদের কাছেই ফিরে আসে পাওনা-পরিশোধের উপায়ের আকারে, যাতে করে তারা পারে তাদের ভোগর পরিধির প্রসার সাধন করতে, তাদের পোষাক-আশাক, আসবাবপত্র ইত্যাদির পরিভোগ-ভাণ্ডারে কিছু সংযোজন করতে এবং তার পরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুরক্ষিত অর্থভাণ্ডার (রিজার্ভ মানিফাণ্ড’) গড়ে তুলতে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ভাল খাওয়া, পরা ও ব্যবহার এবং অপেক্ষাকৃত বেশি ব্যক্তিগত সম্পত্তি যেমন ক্রীতদাসের শোষণের সামান্যই অবলুপ্তি ঘটাতে পারে, ঠিক তেমনি সেগুলি মজুরি-শ্রমিকের শোষণেরও সামান্যই অপনয়ন ঘটাতে পারে। মূলধনের সঞ্চয়নের ফলে শ্রমের দাম বৃদ্ধি পাবার মানে, বাস্তবিক পক্ষে, কেবল এই যে, শ্রমিক নিজের জন্য যে সোনার শিকল তৈরি করেছে, তার দৈর্ঘ্য ও ওজন-জনিত চাপের কিছুটা উপশম। এই বিষয়টি সম্পর্কে যেসব তর্কবিতর্ক চলেছে, তাতে প্রধান যে জিনিসটি সাধারণ ভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে, সেটি হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের নিজস্ব পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্য (differentia specifica’)। শ্রমশক্তি আজ বিক্রয় হয় তার সেবা বা উৎপন্ন দ্রব্যের দ্বারা ক্রেতার ব্যক্তিগত অভাব পূরণের উদ্দেশ্যে নয়। তার উদ্দেশ্য হল তার মূলধনের বৃদ্ধিসাধন, সে যতটা শ্রমের মূল্য দিয়েছে তার চেয়ে বেশি মূল্য ধারণ করে অর্থাৎ যার জন্য তার কিছু মূল্য দিতে হয়নি এমন কিছু শ্ৰম ধারণ করে—এমন পণ্য-সম্ভার উৎপাদন; অথচ যখন সে ঐ পণ্যসামঞ্জ বিক্রয় করে, তখন ঐ মূল্যকে সে নগদে রূপায়িত করে নেয়। এই উৎপাদন-পদ্ধতির সার্বভৌম নিয়ম হল উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন। শ্রমশক্তি যে-মাত্রায় উৎপাদনের উপায়-উপকরণকে তাদের মূলধনের ভূমিকায় সংরক্ষিত করে, তার নিজের মূল্যকে মূলধন হিসাবে পুনরুৎপাদিত করে এবং মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের আকারে অতিরিক্ত মূলধনের একটি উৎসের সংস্থান করে, সেই মাত্রায়ই তা বিক্রয়যোগ্য হয়।[৭] অতএব শ্রমশক্তি বিক্রয়ের শর্তাবলী শ্রমিকের পক্ষে, বেশি বা কম অনুকূল হোক, সেই শর্তাবলীর মধ্যে অন্তভূক্ত থাকে তার নিরন্তর পুনঃবিক্রয়ের এবং মূলধনের আকারে সমস্ত সম্পদের সম্প্রসারিত পুনরুৎপাদনের আবশ্যিক। আমরা আগেই দেখেছি, স্বভাবগতভাবে মজুরি সর্বদাই সূচিত করে শ্রমিক কর্তৃক কিছু পরিমাণ মজুরি-বঞ্চিত শ্রম-সম্পদান। মোটের উপরে, শ্রমের দাম হ্রাস পাবার সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি ঘটনা-নির্বিশেষে, এই ধরনের বৃদ্ধিপ্রাপ্তি বড় জোর বোঝায় যে, মজুরকে যে-পরিমাণ মজুরি-বঞ্চিত শ্রম দিতে হবে, তা হ্রাস পেয়েছে। মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের এই হ্রাসপ্রাপ্তি কখনো এমন এক মাত্রায় পৌছাতে পারে না, যা গোটা ব্যবস্থাটাকেই বিপন্ন করে। মজুরির হার নিয়ে প্রচণ্ড সংঘ ছাড়া, (এবং অ্যাডাম স্মিথ আগেই দেখিয়েছেন, এই ধরনের সংঘর্ষে, গোটাগুটি ভাবে দেখলে মালিক সব সময়েই মালিক) মূলধনের সঞ্চয়নের ফল হিসাবে শ্রমের দামে কোন বৃদ্ধিপ্রাপ্তির ঘটনা সূচনা করে নিম্নলিখিত বিকল্পটি :

হয়, শ্রমের দাম বৃদ্ধি পেতে থাকে, কারণ এই বৃদ্ধি সঞ্চয়নের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে না। এ ব্যাপারে আশ্চর্যজনক কিছু নেই, কেননা, যে কথা অ্যাডাম স্মিথ বলেন, “এইগুলি (মুনাফাগুলি ) হ্রাস পাবার পরে, ‘স্টক কেবল বৃদ্ধি পেতেই পারে না, বৃদ্ধি পেতে পারে পূর্বের তুলনায় দ্রুততর হারে। বৃহৎ মুনাফা সহ ক্ষুদ্র স্টকের তুলনায় ক্ষুদ্র মুনাফা সহ বৃহৎ স্টক দ্রুততর হারে বৃদ্ধি পায়” (ঐ, পৃঃ ১৮)। এ ক্ষেত্রে এটা পরিষ্কার যে, মজুরি-বঞ্চিত শ্রম হ্রাস পেলে তা কোনক্রমেই মূলধনের রাজ্য-বিস্তারের পথে বাধা সৃষ্টি করে না। নয়তো, অন্য দিকে, শ্রমের দাম বৃদ্ধির ফলে সঞ্চয়ন শ্লথ হয়ে যায়, কারণ লাভের প্রেরণা ভোতা হয়ে যায়। সঞ্চয়নের হার হ্রাস পায়; কিন্তু তা হ্রাস পাবার সঙ্গে, সেই হ্রাসপ্রাপ্তির প্রাথমিক কারণটি, অর্থাৎ মূলধন এবং শোষণযোগ্য শ্রমের মধ্যেকার অনুপাত-বৈষম্যটি, অন্তর্হিত হয়ে যায়। যে প্রতিবন্ধকগুলিকে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রক্রিয়ার যান্ত্রিক প্রণালীটি সাময়িক ভাবে সৃষ্টি করে, সেইগুলিকেই তা আবার অপসারিত করে। শ্রমের দাম আবার মূলধনের আত্মপ্রসারণের প্রয়োজন অনুযায়ী মানে হ্রাস পায়—তা সেই মান মজুরি বৃদ্ধির আগে যে স্বাভাবিক মান চালু ছিল, তা থেকে কমই হোক, বা তার সমানই হোক, বা তার থেকে বেশিই হোক। অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি : প্রথম ক্ষেত্রে, শ্রম শক্তিতে বা শ্রমজীবী জনসংখ্যায় অনাপেক্ষিক বা আনুপাতিক বৃদ্ধির হারে হ্রাস প্রাপ্তির ফলে মূলধনের বাহুল্য ঘটে না; বরং উল্টো, মূলধনের বাহুল্যের ফলেই শোষণযোগ্য শ্রমশক্তির অপ্রতুলতা ঘটে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে, শ্রমশক্তিতে বা শ্রম জীবী জনসংখ্যায় অনাপেক্ষিক বা আনুপাতিক বৃদ্ধির হারে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির ফলে মূলধনের অপ্রতুলতা ঘটে না; বরং উল্টো, মূলধনের আপেক্ষিক হ্রাসপ্রাপ্তির ফলেই শোষণযোগ্য শ্রমশক্তি তথা তার দামের, বাহুল্য ঘটে। মূলধনের সঞ্চয়নের এই অনাপেক্ষিক গতি-ক্রিয়াসমূহই শোষণযোগ্য শ্রমশক্তির পরিমাণের আপেক্ষিক গতি-ক্রিয়া হিসাবে প্রতিফলিত হয়। গাণিতিক ভাবে প্রকাশ করলে ব্যাপারটা এইরকম দাড়ায়। সঞ্চয়নের হার সাপেক্ষ পরিবর্ত’ ( variable) নয়, অ-সাপেক্ষ পরিবর্ত’; মজুরির হার অ-সাপেক্ষ পরিবর্ত্য নয়, সাপেক্ষ পরিবর্ত্য। অতএব, শিল্প-চক্র যখন সংকটের পর্যায়ে; তখন পণদ্রব্যাদির দামে সাধারণ অধোগতি প্রকাশ পায় টাকার মূল্যে উর্ধ্বগতির আকারে; আবার সমৃদ্ধির পর্যায়ে পণ্যদ্রব্যাদির দামে সাধারণ উর্ধ্বগতি প্রকাশ পায় টাকার মূলে অধোগতির আকারে। এই থেকে তথাকথিত ‘কারেন্সি স্কুল’ ( ‘মুদ্রা-মতবাদী গোষ্ঠী এই সিদ্ধান্ত করেন যে, বেশি দামের সঙ্গে অত্যল্প*[* এম এস প্রথম ক্ষেত্রেই বলেন “স্বল্প” এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বলেন “অধিক”; যথাযথ ফরাসী অনুবাদ মত সংশোধনী সংযুক্ত হয়েছে-রুশ সংস্করণে ইনষ্টিটিউট অব মার্কসিজম-লেনিনিজম-প্রদত্ত টীকা। ] এবং ক. দামের সঙ্গে অত্যধিক টাকা সঞ্চলনে থাকে। ঘটনা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও সম্পূর্ণ ভুল ধারণার[৮] ক্ষেত্রে এদের সুযোগ্য জুড়ি হল সেই অর্থতাত্ত্বিকেরা, যারা সঞ্চয়নের উল্লিখিত ব্যাপারগুলিকে ব্যাখ্যা করেন এই বলে যে, মজুরি-শ্রমিকদের সংখ্যা এখন অতিরিক্ত কমে গিয়েছে এবং তখন অতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছে।

ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের নিয়মটি, যেটি রয়েছে “জনসংখ্যার প্রাকৃতিক নিয়ম” বলে উপস্থাপিত দাবিটির মূলে, সেটি পর্যবসিত হয় কেবল এই বক্তব্যটিতে মূলধনে রূপান্তরিত মজুরি-বঞ্চিত শ্রম এবং এই অতিরিক্ত মূলধনকে গতিশীল করার জন্য। প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত মজুরি-প্রদত্ত শ্রম—এই দুয়ের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক ছাড়া মূলধনের সঞ্চয়ন এবং মজুরির হার—এই দুটির মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক অন্য কিছু নয়। সুতরাং তা কোনক্রমেই পরস্পর-নিরপেক্ষ দুটি আয়তনের মধ্যে সম্পর্ক নয় : একদিকে, মূলধনের আয়তন, অন্যদিকে শ্রমজীবী জনসংখ্যার আয়তন; এবং মূলতঃ তা একই শ্রমজীবী জনসংখ্যার মজুরি-বঞ্চিত এবং মজুরি-প্রদত্ত শ্রমের মধ্যেকার সম্পর্ক। যদি শ্রমিক শ্রেণী কর্তৃক সরবরাহকৃত এবং ধনিক শ্রেণী কর্তৃক সঞ্চয়-কৃত মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের পরিমাণ এত দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি লাভ করে যে, তাকে মূলধনে রূপান্তরিত করতে অতিরিক্ত পরিমাণ মজুরি-প্রদত্ত শ্রমের আবশ্যক হয়, তাহলে, মজুরি বৃদ্ধি পায় এব, বাকি সমস্ত অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, মজুরি-বঞ্চিত শ্রম আনুপাতিক ভাবে হ্রাস পায়। কিন্তু -মুহর্তে এই হ্রাসপ্রাপ্তি সেই বিন্দুতে উপনীত হয়, যে-বিন্দুতে যে উদ্বত্ত-শ্রম মূলধনকে পুষ্ট করে তা আর স্বাভাবিক পরিমাণে সরবরাহ হয় না, সেই মুহূর্তে শুরু হয় একটি প্রতিক্রিয়া : আয়ের মূলধনীকৃত অংশ হতে থাকে অল্পতর, সঞ্চয়ন পড়ে থাকে পিছনে এবং মজুরি-বৃদ্ধির গতি-প্রবণতা হয় প্রতিরগ্ধ। সুতরাং মজুরি বৃদ্ধি সেই মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা কেবল মূলধনের ভিত্তিকেই অটুট রাখে না, সেই সঙ্গে তার ক্রমবর্ধমান হারে পুনরুৎপাদনকেই নিরাপদ রাখে। ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের নিয়মটি, যাকে অর্থতাত্ত্বিকেরা রূপান্তরিত করেছে তথাকথিত একটি প্রাকৃতিক নিয়মে, তা আসলে যা বলে তা কেবল এই যে, সঞ্চয়নের প্রকৃতিই এমন যে, তা শ্রম-শোষণের মাত্রায় প্রতিটি হ্রাস-প্রাপ্তি এবং শ্রমের দামে প্রতিটি বৃদ্ধিপ্রাপ্তি যা ধনতান্ত্রিক সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান আয়তনে ক্রমাগত পুনরুৎপাদনের পথে বিপদ সৃষ্টি করতে পারে, তাকে নাকচ করে দেয়। যে ব্যবস্থায় বস্তুগত সম্পদের অস্তিত্ব শ্রমিকের বিকাশ সাধনের প্রয়োজন পূরণের জন্য নয়, বরং উটো, শ্রমিকের আস্তত্বই হল উপস্থিত মূল্যসম্ভারের আত্ম-প্রসারণের প্রয়োজন পূরণের জন্য, সেই ব্যবস্থায় অন্য কিছু হতে পারে না। যেমন, ধর্মের ক্ষেত্রে মানুষ তার নিজেরই মস্তিষ্কজাত ধ্যান-ধারণার দ্বারা শাসিত হয়, ঠিক তেমনি ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থায় সে শাসিত হয় তার নিজের হাতে তৈরি দ্রব্যসামগ্রীর দ্বারা।[৯]

————

১. কার্লমার্কস: “A egalite d’oppression des masses, plus un pis a de pouletaires et plus il est riche.” (Colins, “L’Economie Politiqu Source des Revolutions et des Utopies pretendues Socia. listes. Pari১, 1857, t. 1, p. 331.) আমাদের প্রালেতারিয়ান (সর্বহারা’। অর্থনৈতিক দিক থেকে মজুরি-শ্রমিক ছাড়া আর কেউ নয়, যে মূলধন উৎপাদনও বৃদ্ধি করে এবং যে-মুহূর্তে, পেজুয়র যার নাম দিয়েছেন ‘মশিয়ে ক্যাপিট্যাল ( ‘মাননীয় মূলধন’ ), তার আত্মসম্প্রসারণের প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত হয়ে পড়ে, সেই মুহর্তে যাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। আদিম অরণ্যের কৃশকায় সর্বহারা হল রশ্চারের একটি সুন্দর কল্পনা। আদিম বনচারী হল আদিম বনের মালিক, এবং ওরাংওটাং-এর মত স্বাধীনতা নিয়ে সে বনকে ব্যবহার করে তার সম্পত্তি হিসাবে। সুতরাং, সে মোটেই সর্বহারা নয়। যদি ঘটনাটা এমন হত যে সে আদিম বনকে শোষণ করছে না, বরং বনই তাকে শোষণ করছে, কেবল তখনি সে ‘সর্বহারা হত। তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে বলা যায় যে, এমন একজন লোক যে কেবল তুলনায় আধুনিক সর্বহারার চেয়ে ভাল হবে, তাই নয়, ‘সিফিলিস’ (উপদংশ) ও ‘ফুল।’ (গণ্ডমালা) ব্যাধিগ্রস্ত উচ্চতর শ্রেণীগুলির চেয়েও ভালই হবে।

২. জন বেলার্স : ‘প্রপোজান্স ফর রেইজিং এ কলেজ অব ইণ্ডাষ্ট্র অব অল ইউজফুল ট্রেড অ্যাণ্ড হাজব্যাণ্ডী, লণ্ডন, ১৬৯৬, পৃঃ ২।

৩. বার্নাদ দ্য মাদেভিল : ‘মৌমাছির উপাখ্যান’, পঞ্চম সংস্করণ, লণ্ডন ১৭২৮। মন্তব্য: পৃঃ ২১২, ২১৩, ৩২৮। “পরিমিত জীবনযাত্রা এবং নিরন্তর কর্মব্যস্ততাই হল গরিবদের পক্ষে যুক্তিসিদ্ধ সুখের” ( যার দ্বারা তিনি সম্ভবত বোঝতে চান দীর্ঘ কর্ম দিবস এবং জীবনধারণের সামান্য উপকরণ) এবং রাষ্ট্রের ঐশ্বর্য ও শক্তির (অর্থাৎ জমিদার, ধনিক এবং তাদের রাজনৈতিক মাতব্বর ও আড়কাঠিদের সরাসরি পথ। (অ্যান এসে অন ট্রেড অ্যান্ড কমার্স’, লণ্ডন, ১৭৭৩, পৃঃ ৫৪)।

৪. ইডেন-এর জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল, তা হলে রাষ্ট্রীয় সংস্থানগুলি’ কার সৃষ্টি? আইন সম্পর্কে এই মোহের দরুন, তিনি আইনকে উৎপাদনের বাস্তব সম্পর্ক সমূহের ফল বলে গণ্য না করে, উলটো বাস্তব সম্পর্কসমূহকেই আইনের ফল বলে গণ্য করেন। মতাস্কুর বিভ্রমমূলক ‘আইনের মর্মবস্তু’-কে লিগুয়েৎ এক কথায় ‘আইনের মর্মবস্তু তথা সম্পত্তি-সম্পর্ক’ বলে উড়িয়ে দেন। Esprit des lois” with one word : “L’esprit des lois, c’est la propriete.”

৫. ইডেন, ঐ, প্রথম খণ্ড, প্রথম অধ্যায়, প্রথম পরিচ্ছেদ, পৃঃ ১, ২ এবং পূর্বাভাষ পৃঃ ২০।

৬. পাঠক যদি ম্যালথাসের কথা তোলেন, যার এসে অন পপুলেশন’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৯৮ সালে, তা হলে আমি বলব যে এই পুস্তিকাটি তার প্রথম আকারে ডি ফো, স্যার জেমস স্টুয়ার্ট, টাউনসেণ্ড, ফ্র্যাংকলিন, ওয়ালেস প্রমুখের কাছ থেকে ইস্কুলের বালকের মত, ভাসা-ভাসা চৌর্যবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়; তাতে এমন একটা কথাও নেই যা তার নিজের মাথা থেকে বেরিয়েছে। এই পুস্তিকাটি যে বিপুল চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে তা স্রেফ দলীয় স্বার্থের কারণে। ফরাসী বিপ্লব যুক্তরাজ্যে পেয়েছিল আবেগো দীপ্ত সমর্থকবৃন্দ; “জনসংখ্যার নীতিটি,” যা অষ্টাদশ শতকে আস্তে আস্তে বিকাশ লাভ করে এবং পরে এক প্রচণ্ড সামাজিক সংকটের মধ্যে ঢাক-ঢোল সহকারে প্রচারিত হয়, কঁদরসেত-এর শিক্ষার অভ্রান্ত প্রতিষেধক হিসাবে, তাকেই ইংরেজ অভিজাত-চক্র সোল্লাসে অভিনন্দিত করল মানবিক অগ্রগতির প্রতি সমস্ত আকাঙ্ক্ষার মহান ধ্বংসকর্তা বলে। নিজের সাফল্যে বিপুল বিস্ময়ে ম্যালথাস তার বইয়ে ঠাসতে লাগলেন ভাসাভাসা ভাবে জড় করা মালমশলা এবং নোতুন নোতুন সামগ্রী, যার কিছুই তার আবিষ্কৃত নয়, সবটাই আত্মীকৃত। আব লক্ষণীয় যে, যদিও ম্যালথাস ছিলেন ইংলিশ স্টেট চার্চ’ এর একজন যাজক, তিনি গ্রহণ করেছিলেন কৌমার্যব্রতের সন্ন্যাসীসুলভ সংকল্প প্রোটেস্ট্যান্ট কেজি ইউনিভার্সিটির ফেলোশিপ’ অজনের অন্যতম শর্ত : “Socios collegiorum maritos esse non permittimus, sed statim postquam quis uxorem duxerit socius collegii desinat esse.” (Fatma wa কেম্বিজ ইউনিভার্সিটি কমিশন,” পৃঃ ১৭২। এই ঘটনা অন্যান্য প্রোটেস্ট্যান্ট যাজকদের তুলনায় ম্যালথাসকে অনুকূল বিশিষ্টতা দান করে; বাকি প্রোটেস্ট্যান্টরা যাজকত্বের কৌমার্যব্রত ঝেড়ে ফেলে দিয়ে গ্রহণ করেছে ফলবান হও এবং বংশ বৃদ্ধি কর”—বাইবেল-ব্যবস্থিত এই ব্রতটিকে এমন এক মাত্রায় যে, একদিকে যখন তারা শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার করছে “জনসংখ্যার নীতি”, অন্যদিকে জনসংখ্যাবৃদ্ধিতে নিজেরা অবদান রাখছে সত্য সত্যই অস্বাভাবিক মাত্রায়। এটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে, মানুষের অর্থ নৈতিক পল, আদমের সেই আপেল, সেই সুতীব্র ক্ষুধা, “সেইসব নিয়ন্ত্রণ যা কামদেবতার শরগুলিকে ভোতা করে দেয়”-যে-ভাবে যাজক টাউনসেণ্ড পরিহাসভরে কথাটা রেখেছেন-এই সকু প্রশ্নটিকে ‘প্রোটেস্ট্যান্ট থিয়োলজি’র বিশেষ করে, প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ’-এর ‘রেভারেণ্ড মহোদয়েরা অতীতেও নিজস্ব একচেটিয়া ব্যাপার করে রেখেছিলেন, এখনো রেখেছেন। ভেনিসের ‘মংক’ ( সন্ন্যাসী অর্টেস, যিনি ছিলেন একজন মৌল ও বুদ্ধিমান লেখক, তিনি ছাড়া অধিকাংশ জনসংখ্যা-নীতিবিষয়ক শিক্ষকেরাই ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট যাজক। যেমন, কনার, “Theorie du systeme animal,” Leyde, 1767, যাতে আধুনিক জনসংখ্যাতত্ত্বের সব কিছু নিঃশেষে আলোচিত হয়েছে এবং যাতে কেনে এবং তাঁর শিষ্য, বড় মিরাববার মধ্যে প্রসঙ্গক্রমিক বিরোখ একই বিষয় সম্পর্কে বিবিধ ভা যুগিয়েছে, তারপরে যাজক ওয়ালেস, যাজক টাউনসেও, যাজক ম্যালথাস এবং তার শিষ্য যাজক টমাস চ্যামার্স এবং আরো একগাদা কলম-চালক। গোড়ার দিকে, রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব অধ্যয়ন করতেন হবস, লক, হিউম-এর মত দার্শনিকেরা, টমাস মোর, টেম্পল, সাল্লি, ডি উইট,নর্থল, ভ্যাণ্ডেরলিন্ট, ক্যান্টিন, ফ্যাংকলিন-এর মত ব্যবসায়ী ও রাষ্ট্রনীতিবিদেরা, এবং বিশেষ ভাবে বিশেষ সাফল্য সহকারে পেটি, কার্বন, ম্যাণ্ডেভিল, ক্যেনের মত চিকিৎসাবিদেরা। এমনকি ১৮ দশকের মাঝামাঝিও রেভারেণ্ড মিঃ টাকার, তার কালের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, কুবেরের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে, এবং, সত্যি কথা বলতে কি, এই “জনসংখ্যা নীতির সঙ্গে সঙ্গে ঘণ্টা বেজে উঠল প্রোটেস্ট্যান্ট যাজকদের মঞ্চে প্রবেশের। পেটি, যিনি জনসংখ্যাকে গণ্য করলে। সম্পদের উৎস হিসাবে এবং ছিলেন, অ্যাডাম স্মিথের মতই, যাজকদের শত্রু, বলেন যেন তিনি আগেভাগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন তাদের তালগোল-পাকানো নাক গলানোর—“ধর্মের সর্বোত্তম প্রতিষ্ঠা তখনি ঘটে, যখন পুরোহিতরা হন সর্বাপেক্ষা অনুতপ্ত, যেমন আগে বলা হত আইনের ক্ষেত্রে আইনের সর্বোত্তম প্রতিষ্ঠা তখনি ঘটে, যখন আইনজীবীদের করণীয় কাজ থাকে সর্বাপেক্ষা ন্যূনতম।” তিনি প্রোটেস্ট্যান্ট পুরোহিতদের উপদেশ দেন, যদি তারা চিরকালের জন্য অ্যাপস্টল পলকে অনুসরণ না করেন এবং কৌমার্যব্রত পালন করে অনুতাপ প্রকাশ না করেন তবে যেন তারা আজকের দিনে যাজক-পদগুলিতে যতসংখ্যক যাজক নিযুক্ত রয়েছেন, তার চেয়ে বেশি সংখ্যক যাজকের জন্ম না দেন, অর্থাৎ আজ যদি ইংল্যান্ড ও ওয়েলস-এ বারো হাজার যাজক থাকেন, তা হলে তারা যেন ২৪,০০০ যাজকের জন্ম না দেন, কেননা তা হলে যে বারো হাজার জন কোনো পদ পাবে না তারা জীবিকা সন্ধানের চেষ্টা করবে, যা করতে গিয়ে তারা জনগণকে না বুঝিয়ে পারবে না যে এই বারো হাজার গলগ্রহ তাদের আত্মাকে বিষাক্ত করছে বা উপবাসী রাখছে এবং তাদের স্বর্গের পথে ভুল দিক নির্দেশ করছে।” (পেটি, এ ট্রিটিজ অব ট্যাক্সেস অ্যাণ্ড কন্টিবিউশন”, লণ্ডন ১৬৬৭, পৃঃ ৫৭ )। প্রোটেস্ট্যান্ট পুরোহিত-তন্ত্রের প্রতি অ্যাডাম স্মিথের কি মনোভাব ছিল, তা নিচের ব্যাপার থেকে বোঝা যায়। এ লেটার টু এ স্মিথ এল. এল. ডি. অন দি লাইফ, তেম অ্যাণ্ড ফিলজফি অব হিজ ফ্রেণ্ড, ডেভিড হিউম। বাই ওয়ান অব দি পিপল কলঙ্ক ক্রিশ্চিয়ানস” ৪র্থ সংস্করণ অক্সফোর্ড ১৭৮৪ (খ্রষ্টান নামে অভিহিত জনসংখ্যার মধ্যে একজনের দ্বারা অ্যাডাম স্মিথকে লিখিত একটি পত্র : ডেভিড হিউমের জীবন ও মৃত্যু প্রসঙ্গে) নামক লেখাটিতে নরুইচের বিশপ ডঃ হর্ণ অ্যাডাম স্মিথকে ভৎসনা করেন, কেননা মিঃ স্ট্রাহান-এর কাছে লেখা এক প্রকাশিত পত্রে তিনি তাঁর বন্ধু ডেভিড হিউমকে সুবাসিত করেছেন, কেননা তিনি বিশ্বকে বলেছেন কেমন করে হিউম তাঁর মৃত্যুশয্যায় লুসিয়ান এবং হুইস্টকে নিয়ে মজা করতেন, এমনকি হিউম সম্পর্কে তিনি একথা লেখার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন, তিনি যখন জীবিত ছিলেন তখনন এবং তিনি মারা যাবার পরে আমি তাকে সব সময়েই মান্য করেছি একজন পরিপূর্ণ প্রজ্ঞাবান ও ধর্মাত্মা ব্যক্তির আদর্শের সমীপবর্তী বলে।” বিশপ রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে প্রশ্ন করেন, “স্যার, যে-ব্যক্তি ধর্ম বলতে যা কিছু বোঝায়, তার সবকিছুর বিরুদ্ধেই পোষণ করেন অনারোগ্য বিরাগ, তার চরিত্র ও আচরণকে পরিপূর্ণ। প্রজ্ঞাবান ও ধর্মাত্মা’ বলে বর্ণনা করা কি আপনার পক্ষে শোভন হয়েছে? কিন্তু সত্য-প্রেমিকদের নিরুৎসাহ হবার কারণ নেই। নাস্তিকতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।’ (তর নৈতিক বোধের তত্ত্ব দিয়ে সমগ্র দেশে নাস্তিকতা প্রচারের অমার্জনীয় দুর্মতি’ অ্যাডাম স্মিথের হয়েছে। (পৃঃ ১৭) মোটের উপর, ডক্টর, আপনার বক্তব্যটা ভালই; কিন্তু আমার ধারণা, এবারে আপনি সফল হবেন না। ডেভিড হিউমের দৃষ্টান্ত দিয়ে আপনি আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করবেন যে, নাস্তিকতাই অবসাদগ্রস্ত আত্মাদের একমাত্র সঞ্জীবনী এবং মৃত্যুভয়ের যথার্থ প্রতিষেধক। আপনি ব্যাবিলনের ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে হাসতে পারেন এবং লোহিত সাগরে নিক্ষিপ্ত সুকঠিন ফারাওকে ধন্যবাদ জানাতে পারেন। (ঐ, পৃঃ ২১, ২২)। অ্যাডাম স্মিথের একজন কলেজের বন্ধু, একজন সনাতনপন্থী ব্যক্তি, তাঁর মৃত্যুর পরে লেখেন, ‘হিউমের প্রতি তার সৎ-পাত্রে ন্যস্ত ভালবাসা তার খ্ৰীষ্টান হবার পথে বাধা দেয়। সৎ লোকদের তিনি পছন্দ করতেন এবং তাদের সঙ্গে যখন দেখা হত, তারা যাই বলতেন, তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি যদি সুযোগ্য সুকৌশলী হরক্স-এর বন্ধু হতেন, তিনি হয়তো বিশ্বাস করতেন যে, মেঘ না থাকলেও চাদ মাঝে মাঝে নির্মল আকাশে অদৃশ্য হয়ে যায়। রাজনৈতিক ধ্যানধারণার দিক থেকে তিনি ছিলেন ‘রিপ্লাবিকানিজম’-এর সমর্থক। (দি বী’, জেমস এণ্ডার্সন, ১৮ খণ্ড, তৃতীয় খণ্ডে, পৃঃ ১৬৬, ১৬৫, এডিনবরা, ১৭৯১-৯৩). যাজক টমাস চ্যামার্স সন্দেহ করেন, ঈশ্বরের আঙুর-বাগানে তাদের পূত-পবিত্র কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও অ্যাডাম স্মিথ হয়ত একমাত্র প্রোটেস্ট্যান্ট যাজকদের বোঝাবার জন্যই ‘অৎপাদক শ্রমিক অভিধাটি উদ্ভাবন করেছেন।

৭. “যাই হোক, কর্মী এবং শ্রমিক উভয়েরই নিয়োগের ক্ষেত্রে সীমা সেই একই তাদের পরিশ্রমের ফল থেকে নিয়োগকর্তার একটা মুনাফা অর্জনের সম্ভাব্যতা। যদি মজুরির হার এমন হয় যাতে মনিবের লাভ মূলধনের গড় মুনাফার চেয়ে কমে যায়, তা হলে সে নিয়োগ করা বন্ধ করে দেবে, কিংবা কেবল এই শর্তে নিয়োগ করবে যে তারা মজুরি-হ্রাসে রাজি থাকবে।” (জন ওয়েড, “হিস্টরি অব দি মিডল অ্যাণ্ড ওয়ার্কিং ক্লাসেস’, ইত্যাদি, তৃতীয় সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮৩৫, পৃঃ ২৪১)।

৮. কার্ল মার্কস, এ কন্টিবিউশন টু পলিটিক্যাল ইকনমি পৃঃ ১৬৬ (”zur Kritik der Politischen Oekonomie.”)

৯. “আমরা যদি এখন আমাদের প্রথম অনুসন্ধানটির দিকে ফিরে তাকাই, যেখানে দেখানো হয়েছিল যে স্বয়ং মূলধনই হল মনুষ্য-শ্রমের ফল” এটা সম্পূর্ণ অবোধ্য বলে মনে হয় যে মানুষ তার নিজেরই সৃষ্টির, তথা মূলধনের, আধিপত্যের অধীনস্থ হতে পারে, তার কাছে বশ্যতা মানতে পারে; এবং যেহেতু বাস্তবে এটা একটা তর্কাতীত ঘটনা, সেহেতু প্রশ্ন ওঠে : কিভাবে শ্রমিক মূলধনের স্রষ্টা হিসাবে তার মালিকের অবস্থান থেকে তার গোলামের অবস্থানে অধঃপাতিত হল?” (Von Thunen, “Der isolierte Staat”, Part ii, Section ii Rostock, 1863 pp. 5,6 ) 061 থুনেন-এর গুণ যে তিনি প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করেছেন। তাঁর উত্তরটা কিন্তু একেবারেই বালখিল্যসুলভ।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ–সঞ্চয়ন ও তার সহগামী সংকেন্দ্রীভনের অগ্রগতির সঙ্গে যুগপৎ মূলধনের অস্থির অংশের আপেক্ষিক হ্রাসপ্রাপ্তি

অর্থবিকদের নিজেদেরই মত অনুসারে, সামাজিক সম্পদের বাস্তব পরিমাণ বা কর্মরত মূলধনের আয়তন মজুরি বৃদ্ধি ঘটায় না, কিন্তু কেবল সঞ্চয়নের নিরন্তর অগ্রগতি এবং সেই অগ্রগতির দ্রুততার হারই তা ঘটিয়ে থাকে। (অ্যাডাম স্মিথ, প্রথম খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ)। এই পর্যন্ত আমরা কেবল এই প্রক্রিয়ার একটি বিশেষ পর্যায় সম্বন্ধেই আলোচনা করেছিযে-পর্যায়টিতে মূলধনের বৃদ্ধি ঘটে মূলধনের একটি প্রযুক্তিগত গঠন অপরিবর্তিত থাকার অবস্থায়। কিন্তু প্রক্রিয়াটি উক্ত পর্যায়কে ছাড়িয়ে যায়।

ধনতান্ত্রিক ব্যবহারের সাধারণ ভিত্তিটি যদি একবার প্রতিষ্ঠা পায়, তা হলে সঞ্চয়নের প্রক্রিয়ায় এমন একটা সময় আসে যখন সামাজিক শ্রমের উৎপাদনশীলতার বিকাশই হয়ে ওঠে সঞ্চয়নের সবচেয়ে শক্তিশালী অনুপ্রেরক। অ্যাডাম স্মিথ বলেন, “সেই একই কারণটি, শ্রমে মজুরি বাড়ায়, ‘স্টক’ বৃদ্ধি করে, তাই আবার শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং অল্প পরিমাণ শ্রমকে দিয়ে অধিক পরিমাণ কাজ উৎপাদনের পক্ষে সহায়তা করে।”

ভূমির উর্বরতার মত প্রাকৃতিক অবস্থাবলী এবং স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন উৎপাদন কারীদের কুশলতা ছাড়াও (উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণের তুলনায় যা প্রকাশ পায়। বরং তার গুণগত উৎকৃষ্টতায়, একটি নির্দিষ্ট সমাজে শ্রমের উৎপাদনশীলতার মাত্রা অভিব্যক্ত হয় উৎপাদন-উপায়সমূহের সেই আপেক্ষিক পরিমাণে, যে-পরিমাণটিকে একজন শ্রমিক একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, একই মাত্রায় শ্রমশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রূপান্তরিত করে উৎপন্ন দ্রব্যে। যে-পরিমাণ উৎপাদন-উপায়সমূহকে সে এই ভাবে, রূপান্তরিত করে, তা তার শ্রমের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ঐ উৎপাদন-উপায়গুলি দ্বৈত ভূমিকা গ্রহণ করে। কতকগুলি উপায়ের বৃদ্ধিপ্রাপ্তি হল

শ্রমের বর্ধিষ্ণু উৎপাদনশীলতার ফল এবং বাকিগুলির বৃদ্ধিপ্রাপ্তি হল তার অন্যতম শর্ত। দৃষ্টান্ত ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাগের সঙ্গে এবং মেশিনারি ব্যবহারের সঙ্গে, একই সময়ের মধ্যে অধিকতর পরিমাণ কাঁচামাল সংসাধিত হয় এবং সেই কারণে বৃহত্তর পরিমাণ কাঁচামাল ও সহায়ক সামগ্ৰী শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। এটা হল শ্রমের বর্ধিষ্ণু উৎপাদনশীলতার ফল। অন্য দিকে, মেশিনারি, ভারবাহী পশু, খনিজ সার, ড্রেন-পাইপ ইত্যাদির সমষ্টি হল শ্রমের বর্ধিষ্ণু উৎপাদনশীলতার একটি শর্ত। বাড়ি-ঘর, ফানেস, পরিবহন ইত্যাদিতে সংকেন্দ্রীভূত মূলধনও এই একই শ্রেণীতে পড়ে। কিন্তু শর্তই হোক আর ফলই হোক, উৎপাদন-উপায়সমূহের সঙ্গে সংবদ্ধ শ্রমের তুলনায়, সেই উপায়সমূহের ক্রমবর্ধমান আয়তনই হচ্ছে শ্রমের ক্রমবর্ধমান উৎপাদন শীলতার অন্যতম অভিব্যক্তি। সুতরাং শ্রমের উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি আত্মপ্রকাশ করে, তা যে পরিমাণ উৎপাদন-উপায়কে গতিশীল করে, তার অনুপাতে শ্রমের পরিমাণে হ্রাসপ্রাপ্তির মধ্যে কিংবা বিষয়গত উৎপাদনের তুলনায় বিষয়ীগত উপাদানে হ্রাসপ্রাপ্তির মধ্যে।

মূলধনের প্রযুক্তিগত গঠনে এই পরিবর্তন, যে শ্রমশক্তি উৎপাদনের উপায়সমূহের সমষ্টিকে জীবন্ত করে তোলে তার তুলনায় সেই উপায়-সমষ্টি, তা আবার প্রতিফলিত হয় তার মূল্যগঠনে-তার অস্থির উপাদানের বিনিময়ে তার স্থির উপাদানটির বৃদ্ধি সাধন করে। উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক, শুরুতে একটি মূলধনের শতকরা ৫০ ভাগ বিনিয়োগ করা হল উংপাদন-উপায়ের বাবদে এবং বাকি ৫০ ভাগ শ্রমশক্তির বাবদে; পরবর্তী কালে, শ্রমের উৎপাদনশীলতার বিকাশের সঙ্গে উৎপাদন-উপায় বাবদে বিনিয়োজিত হল শতকরা ৮০ ভাগ এবং শ্রমশক্তি বাদে ২০ ভাগ; এবং এই ভাবেই চলতে থাকল। অস্থির মূলধনের অনুপাতে স্থির মূলধনের ক্রম-বর্ধিত হারে বৃদ্ধি প্রাপ্তির এই নিয়মটি পণ্যদ্রব্যাদির দামের তুলনামূলক বিশ্লেষণের দ্বারা প্রতি পদক্ষেপে প্রমাণিত হয় ( যা আগেই দেখানো হয়েছে তা আমরা বিভিন্ন অর্থ নৈতিক যুগের মধ্যেই তুলনা করি কিংবা একটি যুগে বিভিন্ন দেশের মধ্যেই তুলনা করি না কেন। দামের দুটি উপাদানের মধ্যে একটি উপাদান কেবল উৎপাদন-উপায়সমূহের মূল্যের, তথা পৰিভুক্ত মূলধনের স্থির অংশটির মূল্যের, প্রতিনিধিত্ব করে এবং অন্যটি শ্রমের মজুরি প্রদান করে ( মূলধনের অস্থির অংশ); সঞ্চয়নের অগ্রগতির সঙ্গে প্রথম উপাদানের আপেক্ষিক আয়তনটি যেখানে প্রত্যক্ষ অনুপাতে সম্পর্কিত, অপর উপাদানটির আপেক্ষিক আয়তনটি সেখানে বিপরীত অনুপাতে সম্পর্কিত।

যাই হোক, মূলধনের স্থির অংশটির তুলনায় অস্থির অংশটির এই হ্রাসপ্রাপ্তি, কিংবা মূলধনের এই পরিবর্তিত মূল্য-গঠন তার বস্তুগত উপাদানগুলির গঠনে যে-পরিব ঘটে, কেবল তাই প্রকাশ করে। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, সুতাকলে বিনিয়োজিত মূলধন-মূল্য যদি আজ হয় ৭/৮ স্থির ও ১/৮ অস্থির, তা হলে আঠারো শতকের গোড়ার দিকে, তা ছিল ১/২ স্থির ও ১/২অস্থির; অন্য দিকে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুতাকল শ্রম আজ যে-পরিমাণ কাঁচামাল, শ্রম-উপকরণ ইত্যাদিকে উৎপাদনশীল ভাবে পরিভোগ করে ত আঠারো দশকের গোড়ার দিককার তুলনায় বহু শত গুণ বেশি। এর সহজ কারণটি এই যে, শ্রমের ক্রমবর্ধমান উৎপাদনশীলতার সঙ্গে, কেবল যে তার দ্বারা পরিভুক্ত উংপাদন-উপায়গুলির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, তাই নয়, সেই সঙ্গে সেগুলির পরিমাণের সঙ্গে তুলনায় সেগুলির মূল্যও হ্রাস পায়। সুতরাং সেগুলির মূল্য বৃদ্ধি পায় পেক্ষিক ভাবে, কিন্তু পরিমাণের সঙ্গে আনুপাতিক ভাবে নয়। অতএব, স্থির মূলধন এবং অস্থির মূলধনের মধ্যকার ব্যবধানে যে-বৃদ্ধি ঘটে, তা স্থির মূলধনে রূপান্তরিত উংপাদন-উপায়-সমূহের পরিমাণ এবং অস্থির মূলধনে পান্তরিত শ্রম শক্তির পরিমাণের মধ্যকার ব্যবধানের তুলনায় অনেক কম ‘ ববর্তী ব্যবধানটি পরবর্তীটির সঙ্গে বৃদ্ধি পায়, তবে অল্পতর মাত্রায়।

কিন্তু সঞ্চয়নের অগ্রগতি যদি মূলধনের অস্থির অংশের আপেক্ষিক আয়তনে হ্রাস ঘটায়, তা করতে গিয়ে, তা কোনমতেই তার অনুপেক্ষিক আয়তনে বৃদ্ধিপ্রাপ্তিকে বাতিল করে দেয় না। ধরা যাক, একটি মূলধন-মূল্যকে প্রথমে ভাগ করা হল ৫০ শতাংশ স্থির মূলধনে এবং ৫০ শতাংশ অস্থির মূলধনে; পরে ৮০ শতাংশ স্থির মূলধনে এবং ২০ শতাংশ অস্থির মূলধনে। যদি ইতিমধ্যে প্রারম্ভিক মূলধন, ধরা যাক, £ ৬, ০০০ বেড়ে দাঁড়ায় ১০,০০০, তা হলে, তার অস্থির অংশও বেড়ে যায়। সেট। ছিল £ ৩,০০০, এখন দাড়াল £ ৩,৬০০। কিন্তু, আগে যেখানে মূলধণের ২০ শতাংশ বৃদ্ধি শ্রমের চাহিদার ২০ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটাবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল, এখন শ্রমের চাহিদার এই ২০ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটাতে লাগে গোছাকার মূলধনের তিন গুণ।

চতুর্থ বিভাগে দেখানো হয়েছিল, কিভাবে সামাজিক শ্রমের ক’শের পূর্বশত হল হেদায়তনে সহযোগের অস্তিত্ব, কিভাবে এই পূর্বশরে গাছে ‘ভত্তিতে স গঠিত হয় শ্রমের বিভাজন ও স যোজ এবং বিরাট অয়নে সকে করণের ভিত্তিতে সংসাধিত হয় উৎপাদন-উপায়সমূহের ব্যয়স কোচণা; কিভবে শ্রমে সেই নব উপকরণ যেগুলি প্রকৃতিগত ভাবেই যেথ ব্যবহারের উপযোর্গী, যেন মেশিনারি-ব্যবস্থা, সেগুলির অধিব ঘটে; কি ভাবে বিপুল প্রাকৃতিক শক্তিসমূহকে কাজে লাগানো যায়; এবং কি ভাবে উৎপাদনের প্রঞিাকে বিজ্ঞানের একটি প্রয়োগবিদ্যাগত অনুশীলনে রূপান্তবিত করা যায়। উৎপাদনের উপায়সমূহ যেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং, যেখানে কারিগর অন্যান্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র ভাবে পণ্য উৎপাদন করে। কিংবা, স্বতন্ত্র ভাবে শিল্প পরিচালনার মত সঙ্গতি নেই বলে, নিজের শ্রমশক্তিকে পণ্য হিসাবে বিক্রয় করে, সেখানে বৃহদায়তন সহযোগ নিজেকে বাস্তবায়িত করতে পারে কেবল ব্যক্তিগত মূলধন-সমূহের বর্ধিত পরিমাণে-রূপায়িত করতে পারে কেবল সেই অনুপাতে, যে অনুপাতে সামাজিক উৎপাদনের উপায়সমূহ এবং জীবনধারণের উপকরণ সমূহ ধনিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়। পণ্যোৎপাদনের ভিত্তি একমাত্র ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই বৃহদায়তন উৎপাদনকে ধারণ করতে পারে। সুতরাং ব্যক্তিগত পণ্যোৎপাদনকারীদের হাতে কিছু পরিমাণ মূলধনের সঞ্চয়ন যথাযথ ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির আবশ্যিক পূর্বশর্ত। অতএব, আমাদের ধরে নিতে হয়েছিল যে, এই সঞ্চয়ন সংঘটিত হয় হস্তশিল্প থেকে ধনতান্ত্রিক শিল্পে অতিক্রমণের কালে। একে বলা যেতে পারে আদিম সঞ্চয়ন, কেননা এটা যথাযথ ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ঐতিহাসিক পরিণতি নয়, ঐতিহাসিক ভিত্তি। স্বয়ং এই আদিম সঞ্চয়নের উৎপত্তি কিভাবে ঘটেছিল, তা আমাদের এখনি অনুসন্ধান করার প্রয়োজন নেই। আপাতত এইটুকুই যথেষ্ট যে, এটাই হল সূচনা-বিন্দু। কিন্তু সামাজিক উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এই ভিত্তির উপরে বিকশিত সমন্ত কয়টি পদ্ধতিই আবার একই সময়ে উদ্বৃত্ত-মূল্যের বা উদ্ব দ্রব্যের বর্ধিত উৎপাদনের পদ্ধতি, যা আবার সঞ্চয়নের সংগঠনী উপাদান। সুতরাং সেগুলি একই সঙ্গে মূলধন কর্তৃক মূলধনের উৎপাদন, অথবা তার স্বরান্বিত সঞ্চয়নের পদ্ধতি। উদ্বৃত্ত-মূল্যের ক্রমাগত মূলধনে পুনঃ-রূপান্তরণ এখন আত্মপ্রকাশ করে সেই মূলধনটির ক্রমবর্ধমান আয়তনের আকারে, যেটি প্রবেশ করে উৎপাদনের প্রক্রিয়াটির মধ্যে। এটাই আবার হয় উৎপাদনের সম্প্রসারিত আয়তনের সংশ্লিষ্ট শ্রমের উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধি-সাধনের এক উদ্বৃত্ত-মূল্যের ত্বরান্বিত উৎপাদনের ভিত্তি। অতএব, মূলধনের কিয়ৎ মাত্রায় সঞ্চয়ন যদি যথাযথ ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির একটি শর্ত হিসাবে দেখা দেয়, তা হলে এই দ্বিতীয়টি আবার বিপরীত ভাবে ঘটায় মূলধনের ত্বরান্বিত সঞ্চয়ন। সুতরাং, মূলধনের সঞ্চয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ লাভ করে যথাযথ ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি এবং ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে বিকাশ লাভ করে মূলধনের সঞ্চয়ন। এই দুটি অর্থনৈতিক উপাদান, পরস্পর পরস্পরকে যে প্রেরণা সঞ্চার করে সেই প্রেরণার মিশ্র অনুপাতে, সংঘটিত করে মূলধনের গঠনে সেই প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, যার ফলে স্থির অংশটির সঙ্গে তুলনায় অস্থির অংশটি ক্রমেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়।

প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত মূলধনই হল উৎপাদন-উপায়সমূহের একটি বৃহত্তর বা ক্ষুদ্রতর কেন্দ্রীভবন, যার আধিপত্যে রয়েছে তদনুযায়ী বৃহত্তর বা ক্ষুদ্রতর শ্রমবাহিনী। প্রত্যেকটি সঞ্চয়নই কাজ করে নোতুন সঞ্চয়নের উপায় হিসাবে। মূলধন হিসাবে কাজ করে এমন সম্পদের পরিমাণ-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, সঞ্চয়ন ব্যক্তিগত ধনিকদের হাতে সেই সম্পদের কেন্দ্রীভবনের বৃদ্ধি ঘটায় এবং এই ভাবে বৃহদায়তনে উৎপাদনের এবং ধনতান্ত্রিক বিশেষ পদ্ধতিগুলির ভিত্তিটিকে প্রসারিত করে। বহুসংখ্যক ব্যক্তিগত মূলধনের সংবৃদ্ধির দ্বারা সামাজিক মূলধনের সংবৃদ্ধি সাধিত হয়। বাকি সব কিছু যদি অপরিবর্তিত থাকে, তা হলে ব্যক্তিগত মূলধনসমূহ, এবং তাদের সঙ্গে উৎপাদনের উপায়সমূহের কেন্দ্রীভবন, এমন অনুপাতে বৃদ্ধি পায় যে-অনুপাতে তারা মোট সামাজিক মূলধনের অঙ্গীভূত অংশ রচনা করে। একই সময়ে প্রারম্ভিক মূলধন সমূহের কিছু কিছু অংশ নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে নেয় এবং নোতুন নোতুন স্বতন্ত্র মূলধন হিসাবে কাজ করে। অন্যান্য কারণ ছাড়াও, ধনিক-পরিবারগুলির মধ্যে সম্পত্তি-বিভাজনও এই ব্যাপারে একটি বৃহৎ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। সুতরাং মূলধনের সংবৃদ্ধির সঙ্গে ধনিকদের সংখ্যাও অধিকতর বা অল্পতর মাত্রায় বৃদ্ধি লাভ করে। সঞ্চয়ন থেকে প্রত্যক্ষ ভাবে উদ্ভূত, কিংবা বরং, সঞ্চয়নের সঙ্গে অভিন্ন, এই জাতীয় কেন্দ্রীভবন দুটি বিশেষত্ব দ্বারা চিহ্নিত। প্রথমত, বাকি সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে, ব্যক্তিগত ধনিকদের হাতে সামাজিক উৎপাদন-উপায়সমূহের ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভবন সামাজিক সম্পদের বৃদ্ধির মাত্রা দ্বারা সীমাবদ্ধ। দ্বিতীয়ত, উৎপাদনের প্রত্যেকটি বিশেষ ক্ষেত্রে নিবাসিত সামাজিক মূলধনের অংশটি অনেক খনিকের মধ্যে বিভক্ত, যারা পরস্পর-প্রতিযোগ স্বতন্ত্র পণ্যোৎপাদনকারী হিসাবে পরস্পরের মুখোমুখি হয়। সুতরাং সঞ্চয়ন এবং তার সহগামী কেন্দ্রীভবন কেবল বিভিন্ন বিন্দুতেই বিক্ষিপ্ত নয়, উপরন্তু প্রত্যেকটি কর্মরত মূলধনই আবার ব্যাহত হয় নোতুন নোতুন মূলধন গঠন এবং পুরানো মূলধনগুলির উপ-বিভাজনের দ্বারা। সুতরাং, সঞ্চয়ন নিজেকে উপস্থিত করে, এক দিকে, উৎপাদনের উপায়সমূহের, এবং শ্রমের উপরে আধপত্যের, ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভবন হিসাবে; অন্য দিকে, বহু ব্যক্তিগত মূলধনের পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্নভবন হিসাবে।

বহুসংখ্যক ব্যক্তিগত মূলধনে মোট সামাজিক মূলধনের এই বিভাজন কিংবা তার ভগ্নাংশগুলির পরস্পর থেকে বিকর্ষণ প্রতিহত হয় তাদের আকর্ষণের দ্বারা। এই সর্বশেষটি উৎপাদনের উপায়সমূহের এবং শ্রমের উপরে কর্তৃত্বের সেই সরল কেন্দ্রী ভবনটিকে বোঝয় না, যা সঞ্চলনের সঙ্গে অভিন্ন। এটা ইতিপূর্বেই গঠিত মূলধনগুলির কেন্দ্রীভবন, সেগুলির ব্যক্তিগত স্বতন্ত্রতার বিনাশ-সাধন, ধনিক কর্তৃক ধনিকের বে-দখলীকরণ, বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মূলধনের স্বল্পসংখ্যক বৃহৎ মূলধনে রূপান্তরণ। এই প্রক্রিয়াটি পূর্বতন প্রক্রিয়াটি থেকে এইখানে পৃথক যে, এ কেবল ধরে নেয় হস্ত-স্থিত ও কর্মরত এমন মূলধনেরই বণ্টনে পরিবর্তন : সুতরাং এর কর্মক্ষেত্র সামাজিক সম্পদের অনাপেক্ষিক সংবৃদ্ধির দ্বারা, সঞ্চয়নের অনাপেক্ষিক মাত্রার দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। এক জায়গায় একজনের হাতে মূলধন বেড়ে যায় বিপুল পরিমাণে, কেননা অন্য জায়গায়। বহুজন তা হারিয়েছে। এ হচ্ছে যথাযথ কেন্দ্রীভবন, যা সঞ্চয়ন ও সংকেন্দ্রীভবন থেকে বিশিষ্ট।

মূলধনসমূহের এই কেন্দ্রীভবনের, কিংবা মূলধন কর্তৃক মূলধনের আকর্ষণের, নিয়মাবলী বিশ্লেষণের অবকাশ এখানে নেই। কয়েকটি তথ্যের সংক্ষিপ্ত উল্লেখই যথেষ্ট হওয়া উচিত। প্রতিযোগিতার যুদ্ধ যোঝ হয় পণ্যদ্রব্যের দাম সস্তা করে। পণ্যদ্রব্যের দাম সস্তা করার ব্যাপারটি আবার নির্ভর করে, caeteris paribus, শ্রমের উৎপাদনশীলতার উপরে, এবং সেটা আবার নির্ভর করে উৎপাদনের আয়তনের উপরে। সুতরাং বড় বড় মূলধনের হাতে ছোট ঘোট মূলধন মার খায়। আরো মনে রাখা দরকার যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যবসা-পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত মূলধনের ন্যূনতম পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং ছোট ঘোট মূলধনগুলি সেই সব উৎপাদন-ক্ষেত্রে ভিড় করে, যেগুলিতে আধুনিক শিল্প কেবল বিক্ষিপ্ত ভাবে বা অসম্পূর্ণ ভাবে অধিকার বিস্তার করেছে। এখানে প্রতিযোগিতা, বিরোধী মূলধনগুলির সংখ্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ অনুপাতে এবং সেগুলির আয়তনের সঙ্গে বিপরীত অনুপাতে, আত্মপ্রকাশ করে। এই প্রতিযোগিতা সব সময়েই শেষ হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধনীর সর্বনাশে, যাদের মূলধন অংশত চলে যায় তাদের বিজেতাদের হাতে, অংশত অন্তর্হিত হয়ে যায়। এ ছাড়াও, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সঙ্গে একটি সম্পূর্ণ অভিনব শক্তির-ঋণ-ব্যবস্থার (ক্রেডিট-সিস্টেম’-এর )* [* এখানে ( “যা তার প্রথম দিককার পর্যায়গুলি” থেকে ৫৭৯ পৃষ্ঠায়“অনাপেক্ষিক হ্রাস-প্রাপ্তির পরিমাণ বৃহত্তর হবে পর্যন্ত) ইংরেজী পাঠ্যাংশটিকে চতুর্থ জার্মান সংস্করণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বদল করা হয়েছে।ইং সং সম্পাদক।]—আবির্ভাব ঘটে, যা তার প্রথম দিককার পর্যায়গুলিতে চোরের মত চুপিসাড়ে প্রবেশ করে সঞ্চয়নের একজন সামান্য সহকারী হিসাবে এবং ব্যক্তিগত বা সমিতিবদ্ধ ধনিকদের হাতে অদৃশ্য সূত্রের সাহায্যে টেনে এনে দেয় গোটা সমাজ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট বা বড় পরিমাণের অর্থ-সম্পদকে; কিন্তু প্রতিযোগিতার যুদ্ধে তা অচিরেই হয়ে ওঠে এক নোতুন ও সাংঘাতিক হাতিয়ার এবং শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত হয় মূলধন কেন্দ্রীকরণের একটি বিশাল সামাজিক যন্ত্রে।

ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ও সঞ্চয়নের বিকাশের সঙ্গে সম-অনুপাতে বিকশিত হয় কেন্দ্রীভবনের দুটি সবচেয়ে শক্তিশালী অনুপ্রেরক-প্রতিযোগিতা ও ঋণ-ব্যবস্থা (ক্রেডিট)। একই সময়ে সঞ্চয়নের অগ্রগতি কেন্দ্রীভবনের প্রতি প্রবণতাসম্পন্ন সামগ্রীকে অর্থাৎ ব্যক্তিগত মূলধন সমূহকে বৃদ্ধি করে, যখন ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সম্প্রসারণ এক দিকে সৃষ্টি করে সামাজিক অভাব এবং অন্য দিকে সৃষ্টি করে সেই সব বিরাট বিরাট শিল্পোদ্যোগের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত উপায়, যে শিল্পোদ্যোগগুলির কর্মসম্পাদনের জন্য আবশ্যক হয় মূলধনের পূর্বতন কেন্দ্রীভবন। সুতরাং আজ আকর্ষণের শক্তি, ব্যক্তিগত মূলধনগুলিকে এক জায়গায় টেনে আনার শক্তি এবং কেন্দ্রীভবনের প্রবণতা যে-কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। কিন্তু কেন্দ্রীভবনের অভিমুখে গতিশীলতার আপেক্ষিক প্রসার ও প্রবলতা যদি কিছু মাত্রায় নির্ধারিত হয় ধনতান্ত্রিক সম্পদের আয়তন এবং ইতিমধ্যে অধিগত অর্থ নৈতিক ব্যবস্থার উৎকর্ষের দ্বারা, তা হলে কেন্দ্রীভবনে অগ্রগতি কোনক্রমেই সামাজিক মূলধনের একটি সদর্থক সংবৃদ্ধির উপরে নির্ভর করে না। এবং এটাই হয় কেন্দ্রীভবন এবং সংকেন্দ্রীভবনের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য; সংকেন্দ্রীভবন হল সম্প্রসারিত আয়তনে পুনরুৎপাদনেরই নামান্তর মাত্র। সম্মুখে উপস্থিত মূলধনগুলি বণ্টনে কেবলমাত্র পরিবর্তন থেকেই, সামাজিক মূলধনের গঠনকারী অংশসমূহের পরিমাণগত সন্নিবেশে নিছক রদবদল থেকেই কেন্দ্রীভবনের উদ্ভব ঘটতে পারে। এখানে একটি মাত্র হাতে মূলধন বিরাট বিরাট সমষ্টিতে পুঞ্জীভূত হতে পারে, কেননা ওখানে তা স্থানচ্যুত হয়েছে অনেক অনেক হাত থেকে। যে কোন নির্দিষ্ট শিল্প-শাখায়, কেন্দ্রীভবন তার চরম মাত্রায় পৌছাবে, যদি তাতে বিনিয়োজিত সমস্ত ব্যক্তিগত মূলধনগুলি একটিমাত্র মূলধনে পর্যবসিত হয়।[১] একটি নির্দিষ্ট সমাজে এই মাত্রাটিতে উপনীত হওয়া যায় কেবল তখনি, যখন সমগ্র সামাজিক মূলধন একীভূত হয় একজনমাত্ৰ ধনিকের হাত কিংবা একটিমাত্র ধনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের হাতে।।

শিল্প-ধনিকদের তাদের কর্মপরিধি বিগর সাধনে সক্ষম করে, কেন্দ্রীভবন সঞ্চয়নের কাজটিকে সম্পূর্ণ করে। কর্ম-পরিধির এই বিস্তার-সাধন সঞ্চয়নের বা কেন্দ্রীভবনের পরিণতি হোক বা না হোক, কেন্দ্রীভবন বলপূর্বক অধিকার বিস্তারের প্রচণ্ড প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্পাদিত হোক-সে ক্ষেত্রে কয়েকটি মূলধন অন্যান্য মূলধনের পক্ষে এমন আকর্ষণের অধি-কেন্দ্র হয়ে ওঠে যে, তারা বাকি মূলধনগুলি নিজ নিজ সংহতিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সেই খণ্ড খণ্ড অংশগুলিকে নিজেদের মধ্যে আকর্ষণ করে নেয়কি-বা ইতিমধ্যে গঠিত বা গঠন-প্রক্রিয়ায় নিরত কতকগুলি মূলধনের একত্রী ভবন যৌথ মূলধনী প্রতিষ্টান সংগঠনের স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্পাদিত হোক— অথ নৈতিক ফলশ্রুতি কিন্তু হয় একই প্রকার। সবত্রই শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহের বর্ধিত আয়তন হল-সামাজিক ভাবে সংযোজিত ও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে সুবিন্যস্ত বিবিধ উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় বহুসংখ্যক শিল্প-সংস্থার যৌথ কাজের আরো ব্যাপক সংগঠনের জন্য, তাদের বস্তুগত সঞ্চলন শক্তিসমূহের আরো ব্যাপক বিকাশ সাধনের জন্য ভাষান্তরে, চিরাচরিত প্রথা-পদ্ধতিতে পরিচালিত বিচ্ছিন্ন উৎপাদন-প্রক্রিয়াগুলির ক্রমবর্ধমান হারে রূপান্তর সাধনের জন্য-সূচনা-বিন্দু।

কিন্তু সঞ্চয়ন, বৃত্তাকায় (সার্কুলার’) রূপ থেকে ঘূর্ণাকার (‘স্পাইরাল’) রূপে অতিক্রমণের কালে পুনরুৎপাদনের দ্বারা মূলধনের ‘মিক বর্ধন, স্পষ্টতই কেন্দ্রীভবনের তুলনায় খুবই মন্তর প্রক্রিয়া; কেন্দ্রীভবনকে যা করতে হয়, তা হল কেবল সামাজিক মূলধনের গঠনকারী অংশসমূহের পরিমাণগত সন্নিবেশসমূহের পরিবর্তন সাধন। পৃথিবীতে অাজও রেলপথ হত না, যদি তাকে প্রতীক্ষা করতে হত কবে কয়েকটি ব্যক্তিগত মূলধন একটি রেলপথ নির্মাণের পক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণে উপনীত হবে, সেই দিনটির জয়। কেন্দ্রীভবন কিন্তু যৌথমূলধনী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এক নিমেষেই তা করে ফেলল। এবং কেন্দ্রীভবন যখন এইভাবে সঞ্চয়নের ফলাফলকে ঘনীভূত ও ত্বরান্বিত করে, তা আবার সেই সঙ্গে মূলধনের যুক্তিগত গঠন-বিন্যাসে সেই সব বিপ্লবকে ও সারিত ও ত্বরান্বিত করে, যেগুলি তার অস্থির অংশের বিনিময়ে স্থির অংশের বৃদ্ধি সাধন করে এবং এই ভাবে শ্রমের অপেক্ষিক চাহিদার হ্রাস সাধন করে।

কেন্দ্রীভবনের কল্যাণে রাতারাতি একীভূত তাল তাল মূলধন অন্যান্য মূলধনের মতই পুনরুৎপাদন ও পরিবর্ধন করে, কিন্তু তা করে আরো ক্ষিপ্র বেগে এবং এই ভাবে পরিণত হয় সামাজিক সঞ্চয়নের ক্ষেত্রে আরো শক্তিশালী অনুপ্রেরকে। সুতরাং, আজকের দিনে যখন আমরা সামাজিক সঞ্চয়নের কথা বলি, তখন আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে তার মধ্যে ধরে নিই কেন্দ্রীভবনের ফুলগুলিকেও।

সঞ্চয়নের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গঠিত অতিরিক্ত মূলধনসমূহ। চতুর্দশ অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য) কাজ করে বিশেষ ভাবে নোতুন নোতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কার এবং সাধারণ ভাবে শিল্পোন্নয়নের সুযোগ গ্রহণের উপায় হিসাবে। কিন্তু যথাসময়ে পুরানো মূলধনও আপাদমস্তক পুননবীকরণের মুহূর্তটিতে পৌছে যায়, যখন তা তার জীর্ণ চর্ম পরিহার করে অন্যান্যের মত নোতুন জন্ম পরিগ্রহ করে সুসংস্কৃত প্রযুক্তিগত আকারে-যে-আকারে শ্রমের একটি ক্ষুদ্রতর পরিমাণই সক্ষম হবে মেশিনারি কাচা মালের একটি বৃহত্তর পরিমাণকে ক্রিয়াশীল করে তুলতে। এই পুননবীকরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্ৰমণশীল মূলধনসমূহ কেন্দ্রীভবনের কল্যাণে যত উচ্চতর মাত্রায় একত্রে পুঞ্জীভূত হবে, ততই শ্রমের চাহিদায় এক অনাপেক্ষিক হ্রাস প্রাপির পরিমাণ বৃহত্তর হবে।

অতএব, এক দিকে, সঞ্চয়নের গতিপথে গঠিত অতিরিক্ত মূলধন তার আয়তনের অনুপাতে আরে, আরো অল্পসংখ্যক শ্রমিককে আকর্ষণ করে। অন্য দিকে, গঠন-বিন্যাসে পরিবর্তন-সহ পর্যায়ক্রমিক ভাবে পুনরুৎপাদিত পুরানো মূলধন তার পূর্ব-নিযু ও শ্রমিকদের আরো আরো অধিক সংখ্যায় প্রতিসারণ করে।

————

১. [৪র্থ সংস্করণে জার্মান টীকা: শিল্পের কোন বিশেষ শাখায় অন্তত পক্ষে সব কয়টি বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানকে কার্যত একচেটিয়া সুবিধাভোগী একটি অতিকায় যৌথমূলধনী কোম্পানীতে ঐক্যবদ্ধ করে সর্ব-সাম্প্রতিক ইংরেজ ও মার্কিন “ট্রাস্টগুলি ইতিমধ্যেই এই লক্ষ্যসাধনে সচেষ্ট হয়েছে।-এফ, এঙ্গেলস। ]

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ ॥ একটি আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার, বা সংরক্ষিত শিল্পকর্মীবাহিনীর ক্রম-বর্ধিষ্ণু উৎপাদন।

আমরা দেখেছি, মূলধনের সঞ্চয়ন, যদিও তা শুরুতে প্রতিভাত হয় কেবল তার পরিমাণগত সম্প্রসারণ বলে, তবু তা সংঘটিত হয় তার গঠনবিন্যাসে ক্রমবর্ধমান গুণমান গত পরিবর্তনের প্রভাবে, তার অস্থির উপাদানের বিনিময়ে স্থির উপাদানের নিরন্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্তির প্রভাবে।[১]

উৎপাদনের সুনির্দিষ্ট ধনতান্ত্রিক পদ্ধতি, শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতার তদনুযায়ী বিকাশ এবং মূলধনের আঙ্গিক গঠনে তজ্জনিত পরিবর্তন কেবল সঞ্চয়নের অগ্রগতির সঙ্গেই, বা সামাজিক সম্পদের সংবৃদ্ধির সঙ্গেই সঙ্গতি রক্ষা করে না। সেগুলি বিকশিত হয় ঢের বেশি দ্রুততর হারে, কেননা কেবল সঞ্চয়ন, তথা সামাজিক মূলধনের অপেক্ষিক স’ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চলে ব্যক্তিগত মূলধনসমূহের কেন্দ্রীভবন, যা দিয়ে গঠিত হয় মোট মূলধনটি; এবং কেননা অতিরিক্ত মূলধনের প্রযুক্তিগত গঠনে পরিবর্তনের সঙ্গে হাতে হাত দিয়ে চলে প্রারম্ভিক মূলধনের প্রযুক্তিগঠনে অনুরূপ পরিবর্তন। সুতরাং সঞ্চয়নের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অস্থির মূলধনের সঙ্গে স্থির মূলধনের অনুপাত পরিবর্তিত হয়। যদি তা গোড়ায় থাকে ১: ১, তা হলে তা পরপর পরিণত হয় ২: ১, ৩: ১, ৪: ১, ৫: ১, ৭: ১ ইত্যাদিতে, যাতে করে, মূলধন যখন বৃদ্ধি পায়, তখন তার মোট মূল্যের অর্ধেকের পরিবতে, কেবল ১/৩, ১/৪, ১/৫, ১/৬, ১/৮ ইত্যাদি রূপান্তরিত হয় শ্রমশক্তিতে, এবং অন্য দিকে ২/৩, ৩/৪, ৪/৫, ৫/৬, ৭/৮ রূপান্তরিত হয় উৎপাদনের উপায়ে। যেহেতু শ্রমের চাহিদা মূলধনের সমগ্র পরিমাণের দ্বারা নির্ধারিত হয়না, নির্ধারিত হয় কেবল তার অস্থির অংশটির দ্বার, সেই হেতু সেই চাহিদা মোট মূলধন বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে, সেই অনুপাতে বৃদ্ধি পাবার পরিবতে, আগে যা ধরে নেওয়া হয়েছিল, ক্রমবর্ধমান হারে হ্রাস পায়। মোট মূলধনের আয়তন বাড়ার সঙ্গে, এই চাহিদা সেই আয়তনের অনুপাতে আপেক্ষিক ভাবে কমে যায়-এবং কমে যায় ত্বরান্বিত হারে। মোট মূলধনের বৃদ্ধি ঘটলে তার অস্থির অংশেরও বা তার মধ্যে বিধৃত শ্রমেরও বৃদ্ধি ঘটে—কিন্তু সেই বৃদ্ধি ঘটে নিরন্তর হ্রাসমান হারে। মধ্যবর্তী বিরতিগুলি, যখন সঞ্চন কাজ করে একটি নির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত ভিত্তির উপরে উৎপাদনের সরল সম্প্রসারণ হিসাবে—সেই বিরতিল হয় সংক্ষেপিত। এটা কেবল এই নয় যে, মোট মূলধনের ত্বরান্বিত সঞ্চয়ন-নিরন্তর ক্রমবর্ধমান হারে ত্বরান্বিত সঞ্চয়ন–আবশ্যক হয় অতিরিক্ত সংখ্যক শ্রমিকদের নিয়োগের জন্য কিংবা, এমন কি, পুরানো মূলধনের নিরন্তর রূপান্ত-সাধনের প্রয়োজনে উপস্থিত কর্মরত শ্রমিকদেরকে কাজে বহাল রাখার জন্য। এই শ্রম-বর্ধমান সঞ্চয়ন ও কেন্দ্রীভবনই আবার পরিণত হয় মূলধনের গঠন-বিন্যাসে নতুন নোতুন পরিবর্তনের, মূলধনের স্থির অংশের তুলনায় অস্থির অংশের আরো ত্বরান্বিত হ্রস্বতা-প্রাপ্তির উৎস স্বরূপ। মূলধনের অস্থির অংশের এই ত্বরান্বিত আপেক্ষিক হ্রাস-প্রাপ্তি, যা ঘটে থাকে মোট মূলধনের ত্বরান্বিত বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে এবং ঘটে থাকে এই বৃদ্ধি প্রাপ্তির চেয়ে একটি অনাপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার ক্রমবর্ধিষ্ণু উৎপাদন ৩৬১ দ্রুততর গতিতে, তা অন্য মেরুতে ধারণ করে একটি বিপরীত রূপ-শ্রমজীবী জন সংখ্যার বাহ্যতঃ একটি অনাপেক্ষিক বৃদ্ধিপ্রাপ্তির রূপ, এমন একটি বৃদ্ধি যা সব সময়েই ঘটে অস্থির মূলধনের বা, কর্ম-নিযুক্তির উপায়সমূহের বৃদ্ধির চেয়ে দ্রুততর গতিতে। কিন্তু বস্তুত পক্ষে, ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়ন নিজেই নিরন্তর উৎপাদন করে তার নিজের শক্তি ও মাত্রার প্রত্যক্ষ অনুপাতে-একটি আপেক্ষিক ভাবে অপ্রয়োজনীয় শ্রমিক জনসংখ্যা, অর্থাৎ, মূলধনের আত্মপ্রসারণের গড় প্রয়োজন সাধনের জন্য যে-জনসংখ্যা আবশ্যক, তার চেয়ে বিপুলতর জনসংখ্যা, অতএব, একটি উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা।

সামাজিক মূলধনকে তার সমগ্রতায় বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, তার সঞ্চয়নের গতিশীলতা এখন ঘটায় সময়ক্রমিক পরিবর্তন—বা তাকে প্রভাবিত করে সমগ্র ভাবে, এখন ছড়িয়ে দেয় একই সময়ে তার বিবিধ পর্যায় উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উপরে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরল কেন্দ্রীভবনের ফুল হিসাবে মূলধনের গঠনে পরিবর্তন ঘটে তার অনাপেক্ষিক আয়তনে কোন বৃদ্ধি ব্যতিরেকেই; কিছু কিছু ক্ষেত্রে মূলধনের অপেক্ষিক বৃদ্ধি সংযুক্ত থাকে তার অস্থির উপাদানের অনুপেক্ষিক বা, তার মধ্যে বিধৃত শ্রম শওির, হ্রাসের সঙ্গে; আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মূলধন তার নির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত ভিত্তির উপরে কিছুকালের জন্য বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সেই বৃদ্ধির অনুপাতে শ্রমশক্তিকে আকর্ষণ করতে থাকে, যখন অন্যান্য সময়ে তা আঙ্গিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, এবং তার অস্থির উপাদানটির হ্রাস সাধন করে; সমস্ত ক্ষেত্রেই মূলধনের অস্থির অংশটির বৃদ্ধি এবং, স্বভাবতই, তার দ্বারা কর্ম-নিযুক্ত শ্রমিক-সংখ্যার বৃদ্ধি সব সময়েই সংযুক্ত থাকে প্রচণ্ড উঠতি-পড় তি ও উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার স্বল্পস্থায়ী উৎপাদনের সঙ্গে—তা সে কর্মনিযুক্ত শ্রমিকদের প্রতিসারণের অধিকতর প্রকট রূপই ধারণ করুক, কিংবা বিভিন্ন গতানুগতিক পদ্ধতির মাধ্যমে অতিরিক্ত শ্রমিক-জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের অল্পতর প্রকট রূপই ধারণ করুক; এই রূপটি অপেক্ষাকৃত কষ্টসাধ্য, তবে অবাস্তব নয়।[২]

উপস্থিত কর্মত সামাজিক মূলধনের আয়তন এবং তার বৃদ্ধিপ্রাপ্তির মাত্রার সঙ্গে, উৎপাদনের আয়তনের সম্প্রসারণ এবং শ্রমিক সমষ্টিতে গতি-সঞ্চারের সঙ্গে, তাদের শ্রমের উৎপাদনশীলতার বিকশের সঙ্গে, সম্পদের সমস্ত উৎসের বৃহত্তর প্রসার ও পূর্ণতার সঙ্গে, যে-আয়তনে মূলধন-কর্তৃক শ্রমিকদের বৃহত্তর আকর্ষণ তাদের বৃহত্তর বিকর্ষণের দ্বার’ অনুসারিত হয়, সেই আয়তনেরও সম্প্রসারণ ঘটে; মূলধনের আঙ্গিক গঠনে, ও তার যুক্তিগত রূপে পরিবর্তনের ক্ষিপ্রতা বৃদ্ধি পায়; এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রসমূহ ক্র-বর্ধমান সংখ্যায় এই পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে—কখনো যুগপৎ, কখনো বা পর্যায়ক্রমে। সুতরাং শ্রমিক জনসংখ্যা নিজের উৎপাদিত মূলধনের সঞ্চয়নের সঙ্গে, সেই উপায়-উপকরণগুলিও উৎপাদন করে, যেগুলি তাকেই পরিণত করে আপেক্ষিক ভাবে অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যে, পরিণত করে একটি আপেক্ষিক উত্ত-জন সংখ্যায়—এবং এটা করে সব সময়েই একটা ক্রমবর্ধমান মাত্রায়।[৩] এটাই হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির স্ববিশেষ জনসংখ্যা সংক্রান্ত নিয়ম; এবং বাস্তবিক পক্ষে প্রত্যেকটি বিশেষ ঐতিহাসিক উৎপাদন-পদ্ধতিরই স্ববিশেষ জনসংখ্যা সংক্রান্ত নিয়ম, যা কেবল সংশ্লিষ্ট পদ্ধতিটির সীমার মধ্যেই কার্যকর জনসংখ্যা সংক্রান্ত কোন অমূত নিয়ম, কার্যকর আছে কেবল উদ ও পশুদের মধ্যে—যেহেতু মানুষ সেখানে হস্তক্ষেপ করেনি।।

কিন্তু যদি একটি উদ্বৃত্ত শ্রমজীবী জনসংখ্যা হয় ধনতান্ত্রিক ভিত্তিতে সঞ্চয়নের কিংব সম্পদ সৃষ্টির একটি আবশ্যিক ফল, তা হলে এই উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা, বিপরীত ভাবে, পরিণত হয় ধনতাকি সঞ্চয়নের অনুথেকে, এমনকি, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি অতিতের একটি শতে। এট। গড়ে তোলে একটি ব্যবহারযোগ্য সংরক্ষিত শিল্প-কর্মী বাহিনী, য এমন ভাবে মূলধনের অধিকারে থাকে, যেন মূলধনই তাকে নিজের খরচে লালন-পালন করেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বাস্তব মাত্র নির্বিশেষে, এই উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা মূলধনের আত্ম-প্রসারণের পরিবর্তনশীল প্রয়োজন পূরণের জন্য, সৃষ্টি করে এমন এক মানবিক সামগ্রী-সম্ভার, যাকে সব সময়েই শোষণের জন্য প্রস্তুত অবস্থায় পাওয়া যায়। সঞ্চয়ন, এবং তার সহগামী শ্রমের উৎপাদনশীলতার বিকাশের সঙ্গে, মূলধনের আকস্মিক সম্প্রসারণের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়; এট। বৃদ্ধি পায় কেবল এই কারণে নয় যে কর্মরত মূলধনে স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায়; কেবল এই কারণে নয় যে মূলধন যার একটি স্থিতিস্থাপক অংশ মাত্র, সমাজের সেই অনাপেক্ষিক সম্পদ বৃদ্ধি পায়; কেবল এই কারণে নয় যে সর্বপ্রকার বিশেষ প্রেরণার প্রভাবে ক্রেডিট এই সম্পদের একটি বিরাট অংশ অতিরিক্ত মূলধনের আকারে এক সঙ্গে তুলে দেয় উৎপাদনের প্রয়োজন-সাধনে। এটা এই কারণেও বৃদ্ধি পায় যে, উৎপাদন-প্রক্রিয়ার কারিগরি অবস্থাগুলি-মেশিনারি, পরিবহন ইত্যাদি নিজেরাই এখন উদ্বৃত্ত-উৎপন্নসামগ্রী-সম্ভারের ক্ষিপ্রতম গতিতে উৎপাদনের উপায়-উপকরণে রূপান্তরণ সম্ভব করে তোলে। সঞ্চয়নের অগ্রগতির কল্যাণে সুবিপুল ভাবে বর্ধিত এবং অতিরিক্ত মূলধনে রূপান্তরযোগ্য সামাজিক সম্পদ সম্ভার উদ্ভ্রান্ত ভাবে নিজেকে সতেজে ঠেলে দেয় উৎপাদনের পুরাগত শাখাগুলির মধ্যে যেগুলির বাজার সহসা প্রসার লাভ করে, কিংবা নব-গঠিত শাখাগুলির মধ্যে, যেমন রেলপথ ইত্যাদিতে—যেগুলির প্রয়োজন উদ্ভূত হয় পুরাগত শাখাগুলির অগ্রগতি থেকেই। অন্যান্য ক্ষেত্রের কোন ক্ষতি না করে, এই ধরনের সমস্ত ক্ষেত্রে যাতে সহসা বিরাট বিরাট জনসমষ্টিকে বিশেষ বিশেষ চূড়ান্ত অবস্থানে নিক্ষেপ করা যায়, তার সম্ভাব্য ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। অতিরিক্ত জনসংখ্য। এই সমস্ত জনসমষ্টি সরবরাহ করে। আধুনিক শিল্পের স্বভাবসিদ্ধ গতিপথ হল—গড় কর্মতৎপরতা, উচ্চ মাত্রায় উৎপাদন, সংকট ও অচলাবস্থার পর্যায়ক্রমিক দশ-বৎসরান্তিক চক্রপথ (যা মাঝে মাঝে ব্যাহত হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্দোলনের দ্বারা; এই-গতিক্রমটি নির্ভর করে সংরক্ষিত শিল্প-কর্মী বাহিনীর তথা উদ্মও-জনসমষ্টির নিরন্তর গঠন, বৃহত্তর বা ক্ষুদ্রতর অংশের কর্ম-নিয়োজন, এবং ঐ বাহিনীর পুনর্গঠনের উপরে। শিল্প-চক্রের বিভিন্ন পর্যায় আবার সংগ্রহ করে উদ্বও জনসমষ্টি এবং এই ভাবে কাজ করে তার পুনরুৎপাদনের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সংগঠক হিসাবে। আধুনিক শিল্পের এই বিশেষ গতিক্রমটি মানব-ইতিহাসের কোনো পূর্ববর্তী পর্যায়ে ঘটেনা, এমনকি, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের শৈশবেও তা ছিল অসম্ভব। মূলধনের গঠন-বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটত, কিন্তু খুবই মন্থর গতিতে। সুতরাং তার সঞ্চয়নের সঙ্গে তদনুযায়ী শ্রমের চাহিদাও মোটামুটি সঙ্গতি রেখে বৃদ্ধি পেত। যেহেতু আরো আধুনিক যুগের তুলনায় সঞ্চয়নের অগ্রগতি ছিল মন্থর, সেহেতু তা শোষণযোগ্য শ্রমজীবী জনসংখ্যার স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতা দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হত, যে-সীমাবদ্ধতা থেকে কেবল বল প্রয়োগের পথেই নিষ্কৃতি পাওয়া যেত, যার কথা আমরা পরে উল্লেখ করব। উৎপাদন-আয়তনের দমকে দমকে সম্প্রসারণ তার একই রকম আকস্মিক সংকোচনের পূর্বাভাস; সংকোচন আবার সম্প্রসারণের সূচনা করে, কিন্তু ব্যবহারযোগ্য মানবিক সামগ্রী ছাড়া, জনসংখ্যার অনাপেক্ষিক বৃদ্ধির উপরে নির্ভর না করে শ্রমিক-সংখ্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ছাড়া, এই সম্প্রসারণ অসম্ভব। যে-সরল প্রক্রিয়াটি শ্রমিকের একটা অংশকে নিরন্তর “মুক্তি দেয়, সেই প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে, যে-সব পদ্ধতি বর্ধিত উৎপাদনের অনুপাতে নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা হ্রাস করে সেই সব পদ্ধতির মাধ্যমে, এই শ্রমিক সংখ্যায় এই বৃদ্ধি ঘটানো হয়। সুতরাং আধুনিক শিল্পের গতিশীলতার সমগ্র রূপটি নির্ভর করে শ্রমজীবী জনসংখ্যার একটি অংশকে নিরন্তর বেকার বা আধা-বেকারে পর্যবসিত করার উপরে। রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের অন্তঃসারশূন্যতা এই ঘটনায় বেরিয়ে পড়ে যে, ক্রেডিটের সম্প্রসারণ ও সংকোচন-যা শিল্প-চক্রের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের একটি লক্ষণ

একটি অনাপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার ক্রমবর্ধিষ্ণু উৎপাদন ৩৬৫ মাত্ৰ-তাকেই তা গণ্য করে তার কারণ বলে। যেমন আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি একবার এক নির্দিষ্ট গতিপথে নিক্ষিপ্ত হয়ে সব সময়েই সেটির পুনরাবৃত্তি করে চলে, ঠিক তেমনি সামাজিক উৎপাদনও একবার সম্প্রসারণ ও সংকোচনের পর্যায়ক্রমিক গতিপথে নিক্ষিপ্ত হয়ে তার পুনরাবৃত্তি করে চলে। ফল আবার পরিণত হয় কারণে এবং সমগ্র প্রক্রিয়াটির—যা সর্বদাই তার নিজের অবস্থাবলী পুনরুৎপাদন করে—সেই প্রক্রিয়াটির পরিবর্তনশীল আপতিক ঘটনাগুলি পর্যায়ক্রমিকতার রূপ ধারণ করে। যখন এই পর্যায় ক্রমিকতা একবার সংহত হয়ে যায়, তখন এমনকি রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বও দেখতে পায় যে, একটি আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার উৎপাদন, অর্থাৎ মূলধনের আত্ম-প্রসারণের গড় প্রয়োজনসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে উত্ত, এমন একটি জনসংখ্যার উৎপাদন, আধুনিক শিল্পের একটি আবশ্যিক শত।

এইচ মেরিভেল, যিনি প্রথমে ছিলেন অক্সফোর্ডে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের অধ্যাপক এবং পরে নিযুক্ত হন কলোনিয়াল অফিস’-এ ( ‘ঔপনিবেশিক কার্যালয়ে’) বলেন, “ধরুন, ধরুন যে, এই ধরনের কোন কোন সংকট উপলক্ষ্যে শত-সহস্র বাড়তি শ্রমিককে দেশান্তরে পাঠিয়ে নিষ্কৃতি পাবার প্রচেষ্টায় জাতিকে তৎপর হতে হত, তার ফলে তার পরিণতি কী হত? পরিণতি হত এই যে, শ্রমের চাহিদা ফিরে আসার শুরুতেই দেখা দিত ঘাটতি। পুনরুৎপাদন যত দ্রুতই হোক না কেন, বয়স্ক শ্রমিকের স্থান পূরণে সব সময়েই এক প্রজন্মের প্রয়োজন হয়। এখন, আমাদের কারখানা-মালিকদের মুনাফা নির্ভর করে সমৃদ্ধির এই মুহূর্তটির সদ্ব্যবহারের ক্ষমতার উপরে, যখন চাহিদা হয় তেজী; এবং এই ভাবে যখন তা মন্দা ছিল, সেই অন্তর্বর্তী কালের ক্ষতিটা পুষিয়ে দেয়। মেশিনারি ও দৈহিক শ্রমের উপরে তাদের কর্তৃত্ব থেকেই তাদের হাতে আসে এই ক্ষমতা। তাদের হাতের কাছে প্রস্তুত থাকতে হবে পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মী, তাদের সামর্থ্য থাকতে হবে বাজারের অবস্থা অনুযায়ী তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করার বা হ্রাস করার, অন্যথা তারা পারবেন না প্রতিযোগিতার দৌড়ে তাদের প্রাধান্য বজায় রাখতে, যার উপরে গড়ে ওঠে জাতির সম্পদ।”[৪] এমনকি, ম্যালথাস পর্যন্ত জনবাহুল্যকে স্বীকার করেন আধুনিক শিল্পের আবশ্যিক প্রয়োজন হিসাবে, যদিও তার সংকীর্ণ ভঙ্গিতে তিনি তার ব্যাখ্যা দেন শ্রমজীবী জনসংখ্যার অনাপেক্ষিক অতি-বৃদ্ধি বলে, নির্দিষ্ট প্রয়োজনের তুলনায় আপেক্ষিক সংখ্যাধিক্য বলে নয়। শিল্প ও বাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল কোন দেশের শ্রমজীবী শ্রেণীর মধ্যে বিবাহ সম্পর্কে “বাস্তববুদ্ধিজাত অভ্যাস-আচরণ যদি বেশি দূর পর্যন্ত অনুসৃত হয়, তা হলে তা সেই দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে। : জনসংখ্যার প্রকৃতিই এই রকম যে, একটি বিশেষ চাহিদা পূরণের প্রয়োজনে বাজারে শ্রমিকসংখ্যা বাড়ানো যায় না, যে পর্যন্ত ১৬ থেকে ১৮ বছর পার না হয়; এবং সঞ্চয়ের মাধ্যমে আয়ের মূলধনে রূপান্তর-পরিগ্রহ তার অনেক আগেই ঘটতে পারে; কোন দেশে জন সংখ্যা যে গতিতে বৃদ্ধি পায় তার থেকে টের দ্রুততর গতিতে বৃদ্ধি পেতে পারে শ্রমের ভরণ পোষণের জন্য অর্থ-ভাণ্ডারের পরিমাণ।”[৫] ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের পক্ষে একটি আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার নিরন্তর উৎপাদন যে একটি আবশ্যিক প্রয়োজন, সেটা প্রমাণ করার পরে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি এক বয়স্কা আইবুড়ো মহিলার ভঙ্গিতে তার মনের মানুষের মুখে-ধনিকের মুখে—এই কথা কটি বসিয়ে দিল, যা বলা হল তাদের নিজেদেরই সৃষ্ট অতিরিক্ত মূলধনের দ্বারা পথে ছুড়ে-ফেলা শ্রমিকদের লক্ষ্য করে। “আমরা কারখানা-মালিকেরা তোমাদের জন্য যা করা যায়, তা সবই করছি; যে-মূলধন দিয়ে তোমাদের খাওয়া-পরা চলে, তা বাড়াচ্ছি; এখন তোমাদের দায়িত্ব খাওয়া-পরার যে-সংস্থান করা হচ্ছে, তার সঙ্গে তোমাদের সংখ্যাকে মানিয়ে নেওয়া।”[৬]

জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি থেকে যে-পরিমাণ ব্যবহারযোগ্য শ্রম পাওয়া যায়, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন কখনো সেই পরিমাণটি নিয়ে তৃপ্ত থাকতে পারে না। তার খুশিমত ব্যবহারের জন্য সে চায় এই সব স্বাভাবিক মাত্রা থেকে মুক্ত এক সংক্ষিত শিল্প কর্মীবাহিনী।

এই পর্যন্ত আমরা ধরে নিয়েছি যে, অস্থির মূলধনে বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটে নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যায় বৃদ্ধি বা হ্রাসের সঙ্গে সঠিক সঙ্গতি অনুসারে।

অস্থির মূলধন বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও কিন্তু মূলধনের কর্তৃত্বাধীন শ্রমিকদের সংখ্যা একই থাকতে পারে, এমনকি কমেও যেতে পারে। এটা ঘটে যখন ব্যক্তিগত শ্রমিক অধিকতর পরিমাণ শ্রম দেয় এবং স্বভাবতই, তার মজুরিও বৃদ্ধি পায়; এবং এটা ঘটে যদিও শ্রমের দাম একই থাকে বা এমনকি কমেও যায়–কমে যায় কেবল শ্রমের পরিমাণ যে-গতিতে বৃদ্ধি পায়, তার তুলনায় মন্থরতর গতিতে। এ ক্ষেত্রে অস্থির মূলধনের বৃদ্ধি এখানে অধিক পরিমাণ শ্রমের সূচক কিন্তু অধিকসংখ্যক শ্রমিকের সূচক নয়। খরচ যদি প্রায় সমানই পড়ে, তা হলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম বেশি সংখ্যক শ্রমিকের কাছ থেকে আদায় না করে বরং কম সংখ্যক শ্রমিকের কাছ থেকে আদায় করাই হল ধনিকের পরম স্বার্থ। প্রথম ক্ষেত্রে কর্ম-নিযুক্ত শ্রমের পরিমাণের অনুপাতে স্থির মূলধনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, এই বৃদ্ধি অনেক কম। উৎপাদনের আয়তন যত

একটি অনাপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার ক্রমবর্ধিষ্ণু উৎপাদন সম্প্রসারিত হয়, এই উদ্দেশ্য আরো প্রবল হয়ে ওঠে। মূলধনের সঞ্চয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবলতা আরো বৃদ্ধি পায়।

আমরা দেখেছি, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি এবং শ্রমের উৎপাদন-ক্ষমতার বিকাশ একই সঙ্গে যা সঞ্চয়নের হেতু ও ফল-ধনিককে সক্ষম করে একই পরিমাণ অস্থির মূলধনের বিনিয়োগের সাহায্যে, কিন্তু প্রত্যেকটি ব্যাক্তিগত শ্রম-শক্তির আরো ( ব্যাপক ও নিবিড়) শোষণের মাধ্যমে, আরো বেশি পরিমাণ শ্রমকে কর্ম-প্রযুক্ত করতে। আমরা আরো দেখেছি, ধনেক যতই বেশি বেশি করে দক্ষ শ্রমিকের বদলে অদক্ষ শ্রমিককে, পরিণত শ্রমশক্তির বদলে অপরিণত শ্রমশক্তিকে, পুরুষ শ্রমের বদলে নারী শ্রমকে, বয়স্কদের শ্রমের বদলে কিশোর ও শিশুদের শ্রমকে নিয়োগ করতে থাকে, ততই ধনিক একই মূলধনের সাহায্যে বৃহত্তর পরিমাণ শ্রমশক্তি ক্রয় করে।

সুতরাং, এক দিনে, সঞ্চয়নের অগ্রগতির সঙ্গে, একটি বৃহত্তর পরিমাণ অস্থির মূলধন, নোতুশ শ্রমিক নিয়োগ না করেও, অধিকতর শ্রমকে কর্ম-প্রযুক্ত করে; অন্য দিকে, একই আয়তনের অস্থির মূলধন একই পরিমাণ শ্রমশক্তির সাহায্যে অধিকতর শ্রমকে কর্ম-প্ৰযুক্ত করে; এবং, শেষ পর্যন্ত, উচ্চতর মানের শ্রমশক্তিকে নিম্নতর মানের শ্রমশক্তির দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে। সুতরাং, যে কৃৎকৌশলগত বিপ্লব সঞ্চয়নের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সংঘটিত হয় এবং তার দ্বারা ত্বরান্বিত হ:, তার তুলনায়, এবং মূলধনের স্থর শেঃ অনুপাতে তার অস্থির অশে হ্রাসপ্রাপ্তির তুলনায়, একটি আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার উৎপাদন বা শ্রমিকদের মুক্তি দান আরো বেশি দ্রুত বেগে অগ্রসর হতে থাকে। উৎপাদনের উপায়সমূহ য মাত্রায় ও কার্যকরী ক্ষমতায় বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে অল্পতম মাত্রায় শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের উপর হয়ে ওঠে, তা হলে আবার সেই পরিস্থিতিটি সংশোধিত হয় এই ঘটনার দ্বা: যে, শ্রমের উৎপাদনশীলতা যে-অনুপাতে বৃদ্ধি পায়, মূলধন তার শ্রমিকদের জন্য চাহিদার তুলনায় তার শ্রমের সরবরাহকে অায়ে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি করে। শ্রমিকশ্রেণীর কর্ম নিযুক্ত অংশটির অতিরিক্ত কাজের ফলে সংরক্ষিত বাহিনীর অয়জ আরো স্ফীত হয়, অন্য দিকে, আবার, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই সংর ক্ষত বাহিনী কর্ম-নিযুক্ত শ্রমিকদের উপরে যে বৃহত্তর চাপ সৃষ্টি করে, তা তাদের বাধ্য রে অতিরিক্ত কাজ এবং মূলধনের কর্তৃত্ব ও হুকুমকে স্বীকার করে নিতে। শ্রমক-শ্রেণীর এক শের অতিরিক্ত কাজের দরুন। অপরাংশের এই বাধ্যতামূলক কর্মহীনতার যন্ত্রণাযোগ এবং এদের এই যন্ত্রণাভোগের দরুন আবার ওদের ঐ অতিরিক্ত কাজের বোঝা–এটাই ওঠে ব্যক্তিগত ধনিকদের আরো ধনবান হবার একটি উপায়[৭] এবং এটাই আবার সেই সঙ্গে স্বরান্বিত করে সামাজিক সঞ্চয়নের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংরক্ষিত বাহিনীর সম্প্রসারণ। আপেক্ষিক উত্তজনসংখ্যা গড়ে তোলায় এই উপাদানটি কত গুরুত্বপুর্ণ, ইংল্যাণ্ডের দৃষ্টান্ত থেকেই তা বোঝা যায়। শ্রম বাঁচাবার জন্য তার কারিগরি উপায়-উপকরণ সুবিপুল। তা সত্ত্বেও, যদি কাল সকালে এমকে একটি যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে কমিয়ে আনা যেত এবং বয়স ও নারী-পুরুষ হিসাবে শ্রমিক-শ্রেণীর বিভিন্ন অংশে আনুপাতিক ভাগ করে দেওয়া যেত, তা হলে দেখা যেত যে, বর্তমানে যে আয়তনে উৎপাদন চলছে, সে আয়তনে উৎপাদন চালানোর পক্ষে ইংল্যাণ্ডের শ্রমজীবী জনসংখ্যা অনেক কম। আজ যে-শ্রমিকদের অনুৎপাদনশীল” বলে গণ্য করা হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই তখন “উৎপাদনশীল” শ্ৰমিকে পরিণত হবে।

সমগ্র ভাবে দেখলে মজুরির সাধারণ গতি-প্রকৃতি একান্তভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় সংরক্ষিত শিল্প-কর্মীবাহিনীর সম্প্রসারণ ও সংকোচনের দ্বারা এবং তা আবার ঘটে শিল্প-চক্রের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন অনুসারে। সুতরাং মজুরির গতি-প্রকৃতি শ্রমজীবী জনগণের অনাপেক্ষিক সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধির দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় শ্রমিক শ্রেণী কোন্ কোন্ অনুপাতে সক্রিয় ও সংরক্ষিত কর্মীবাহিনীতে বিভক্ত, সেই সেই অনুপাতের দ্বারা, উভ-জনসংখ্যার আপেক্ষিক পরিমাণের হ্রাস বা বৃদ্ধির দ্বারা যে-মাত্রায় এই জনসংখ্যা এখন কর্ম-নিযুক্ত হয়, তখন কর্ম-বিমুক্ত হয় সেই মাত্রার দ্বারা। আধুনিক শিল্পের পক্ষে-যার বৈশিষ্ট্য হল দশ-বাৎসরিক চক্র ও সময়ক্রমিক পর্যায় সমূহ, সঞ্চনের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে যেগুলি পর পর আরো দ্রুত গতিতে ও অনিয়মিত ভাবে সংঘটিত দোলন-বিদোলনের দরুন আরো জটিল হয়ে ওঠে —সেই আধুনিক শিল্পের পক্ষে, সেটি হত একটি সুন্দর নিয়ম, যে-নিয়মটি মূলধনের পর্যায়ক্রমিক সম্প্রসারণ ও সংকোচনের দ্বারা শ্রমের চাহিদা ও সরবরাহকে নিয়ন্ত্রণ করার পরিবর্তে-যার ফলে শ্রমের বাজার কখনো হয় আপেক্ষিক ভাবে ‘উন-পূৰ্ণ ( ‘আণ্ডার-ফুল’ }, কেননা মূলধন সম্প্রসারিত হচ্ছে; কখনো হয় ‘অতি-পূর্ণ’ (ওভার ফুল’ ), কেননা মূলধন সংকুচিত হচ্ছে—দাবি করে যে, মূলধনের কাজ নির্ভর করে জনসংখ্যার অনাপেক্ষিক পরিবর্তনের উপরে। অথচ এটাই হল অথতাত্ত্বিকদের বদ্ধমূল ধারণা। তাঁদের মতে, মজুরি বৃদ্ধি পায় মূলধনের সঞ্চয়নের ফলে। উচ্চতর মজুরি শ্রমজীবী জনসংখ্যাকে আরো দ্রুত বংশবৃদ্ধিতে প্রণােদিত করে, এবং তা চলতে থাকে যে-পর্যন্ত না শ্রমজীবীর বাজার অতিরিক্ত পূর্ণ হয়ে যায়, এবং, সেই কারণে, শ্রমের সরবরাহের তুলনায় আপেক্ষিক ভাবে মূলধন অপ্রতুল হয়ে পড়ে। মজুরি যখন হ্রাস পায়, তখন আমরা মেতেলের উটো দিকটি প্রত্যক্ষ করি। মজুরি হ্রাসের ফলে

শ্রমজীবী জনসংখ্যার আস্তে আস্তে বংশদ্বাস হয় এবং মূলধন আবার তাদের তুলনায় আপেক্ষিকভাবে অত্যধিক হয়ে পড়ে, অথবা অন্যরা ব্যাপারটিকে যেমনভাবে ব্যাখ্যা করেন, পড়তি মজুরি এবং সেই সঙ্গে শ্রমের বাড়তি শোষণ আবার সঞ্চয়নকে ত্বরান্বিত করে, যখন, একই সময়ে অল্পতর মজুরি শ্রমিক-শ্রেণীর সংখ্যাবৃদ্ধিকে দমিয়ে রাখে। তারপরে, আবার একটি সময় আসে, যখন শ্রমের যোগান চাহিদার তুলনায় কম পড়ে এবং মজুরি বৃদ্ধি ঘটে, এবং এইভাবে চলতে থাকে। বিকশিত ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের পক্ষে এটা গতিশীলতার একটি সুন্দর পদ্ধতি! মজুরি বৃদ্ধির দরুন, কাজের জন্য সত্য সত্যই উপযুক্ত এমন জনসংখ্যার কোনো সদর্থক বৃদ্ধি ঘটার আগে, তেমন। সময় বারংবার অতিক্রান্ত হত যার মধ্যে শিল্প-অভিযান অবশ্যই সম্পূর্ণায়িত হত, যুদ্ধ যোঝ ও জয় করা হত।

১৮৪৯ থেকে ১৮৫৯ সালের মধ্যে ইংল্যাণ্ডের কৃষিপ্রধান জেলাগুলিতে, একটা মজুরি বৃদ্ধি ঘটেছিল; যদিও তার সঙ্গে ফসলের দামও কমেছিল, তবু এই মজুরি-বৃদ্ধি ছিল কার্যত নগণ্য। যেমন, উইল্টশায়ারে মজুরি বেড়েছিল ৭ শিলিং থেকে ৮ শিলিং-এ; ডর্সেটশায়ারে ৭ বা ৮ শিলিং থেকে ৯ শিলিং-এ ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা ছিল উদ্বৃত্ত-কৃষি জনসংখ্যার দলে দলে গ্রাম ত্যাগের এক অস্বাভাবিক হিড়িকের ফল যার কারণ ছিল যুদ্ধের চাহিদা, রেলপথ, কারখানা, খনি ইত্যাদির বিস্তার। মজুরি যত কম থাকে, যে-অনুপাতে এত নগণ্য একটা মজুরি-বৃদ্ধি নিজেকে প্রকাশ করে তা তত বেশি হয়। যদি সাপ্তাহিক মজুরি হয়, ধরা যাক, ২. শিলিং এবং তা বেড়ে হয় ২২ শিলিং, তার মানে দাড়ায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি, যা শুনতে বেশ ভাল লাগে। প্রত্যেক জায়গায় জোত-মালিকেরা সোচ্চারে বিলাপ করছে, এবং এই উপোস-করানো মজুরি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লণ্ডনের ইকনমিস্ট’ (অর্থতাত্ত্বিক) বেশ গুরুত্ব দিয়েই একে “একটি সার্বিক ও সুপ্রচুর অগ্রগতি”[৮] বলে প্রলাপ বকছে। এই চোখ-ধাঁধানো মজুরির ফল হিসাবে যে-পর্যন্ত না কৃষি-শ্রমিকেরা এমন ভাবে বেড়েছে ও বংশবৃদ্ধি করেছে যে, তাদের মজুরি আবার কমে গিয়েছে; তারা কি, অচল-মস্তিষ্ক অর্থত্তিকদের ব্যবস্থাপত্র অনুসরণ করে, সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল? তারা প্রবর্তন করেছিল আরো আরো মেশিনারি এবং শ্রমিকেরা এক মুহূর্তে পরিণত হয়েছিল অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যে আর এমন কি জোত-মালিকেরা যা চেয়েছিল, খুশি মনে তাই পেয়েছিল। তখন সেখানে কৃষিতে আগের তুলনায় বেশি মূলধন”-এর বিনিয়োগ ঘটল এবং বেশি উৎপাদনশীল ভাবে। তার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমের চাহিদা কেবল আপেক্ষিক ভাবেই কমে গেল না, কমে গেল অনাপেক্ষিক ভাবেও।

উল্লিখিত অর্থ নৈতিক গল্পকথাটি, যে-নিয়মগুলি মজুরির হ্রাস বৃদ্ধিকে কিংবা, এক দিকে, শ্রমিক-শ্রেণী তথা মোট শ্রমশক্তি এবং অন্য দিকে মোট সামাজিক মূলধনের মধ্যেকার অনুপাতকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই নিয়মগুলির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে সেই নিয়মগুলিকে, যেগুলি উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে শ্রমজীবী জনসংখ্যাকে বণ্টন। করে দেয়। ধরা যাক, যদি অনুকূল পরিস্থিতিতে, উৎপাদনের কোন বিশেষ ক্ষেত্রে সঞ্চয়ন বিশেষ ভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে, এবং তাতে মুনাফা, গড় মুনাফার তুলনায় বেশি হবার দরুন, অতিরিক্ত শ্ৰম আকর্ষণ করে, তা হলে, অবশ্যই শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এবং মজুরিও বৃদ্ধি পায়। উচ্চতর মজুরি-শ্রমজীবী জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশকে অধিকতর সুবিধাভোগী ক্ষেত্রটিতে টেনে নেয়, যে-পর্যন্ত না সেই ক্ষেত্রটি শ্রমশক্তিতে পরিপ্লাবিত হয়ে যায়, এবং মজুরি আবার তার গড় মানে কিংবা, চাপ খুব বেশি হলে, তারও নিচুতে নেমে না যায়। তখন, সেই শিল্প-শাখাটিতে কেবল যে নোহন শ্রমিকের প্রবেশ বন্ধ হয়, তাই নয়, সেখান থেকে পুরনো শ্রমিকের প্রস্থানও শুরু হয়ে যায়। এখানে রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিক মনে করেন, তিনি শ্রমিক-সংখ্যার অনাপেক্ষিক বৃদ্ধি ও সেই সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধির, এবং শ্রমিক-সংখ্যার অনাপেক্ষিক হ্রাস ও সেই সঙ্গে মজুরি-হ্রাসের তাবৎ কারণ দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু আসলে তিনি যা দেখতে পাচ্ছেন, তা হল উংপাদনের একটি বিশেষ ক্ষেত্রে শ্রমবাজারের ওঠা-নামা—তিনি দেখতে পাচ্ছেন কেবল মূলধন-বিনিয়োগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তনশীল প্রয়োজন অনুসারে শ্রমজীবী জনসংখ্যার বণ্টনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনাটি।

নিশ্চলাবস্থা ও গড় সমৃদ্ধির সময়কালে শিল্পের সংরক্ষিত বাহিনী সক্রিয় বাহিনীকে দাবিয়ে রাখে; অতি-উৎপাদন ও দমকা বৃদ্ধির সময়ে, সে তার দাবি-দাওয়াকে সংযত রাখে। অতএব, আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্য, হচ্ছে সেই কেন্দ্রাবলম্ব, যার উপরে শ্রমের চাহিদা ও যোগানের নিয়মটি কাজ করে। তা এই নিয়মটির কার্যক্ষেত্রকে এমন মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে, যা শোষণকার্যের পক্ষে ও মূলধনের আধিপত্যের পক্ষে পরম সুবিধাজনক।

এই জায়গায় অর্থত্তিক দালালির মহান সাফল্যগুলির মধ্যে একটি সাফল্যের প্রতি ফিরে তাকানো উচিত। স্মাণ করা দরকার যে, যদি নোতুন মেশিনারির প্রবর্তন বা পুরানো মেশিনারির প্রসারণের মাধ্যমে, অস্থির মূলধনের একটি অংশ স্থির মূলধনে রূপান্তরিত হয়, তা হলে এই কর্মকাণ্ডটিকে—যা মূলধনকে “স্থিত করে এবং ঠিক সেই কাজের দ্বারাই শ্রমিকদের “মুক্তিদান করে”—সেই কর্মকাণ্ডটিকে অর্থতাত্ত্বিক দালালটি ব্যাখ্যা করেন ঠিক বিপরীত ভাবে; তিনি দাবি করেন যেন তা শ্রমিকদের জন্য মূলধনকে মুক্ত করে দিচ্ছে। কেবল এখনি কেউ বুঝতে পারবেন এই দালালদের ধৃষ্টতা ! যাকে মুক্ত করা হচ্ছে, তা কেবল মেশিনের দ্বারা তৎক্ষণাৎ বহিস্কৃত শ্রমিক সমষ্টি নয়, সেই সঙ্গে যারা ভবিষ্যতে তাদের স্থান গ্রহণের জন্য পরবর্তী প্রজন্মে বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে, তাদেরকেও; এমন কি পুরানো ভিত্তিতেই ব্যবসার মামুলি সম্প্রসারণের সঙ্গে যে-অতিরিক্ত বাহিনীর নিয়মিত ভাবে কর্ম-নিযুক্ত হবার কথা, তাদেরকেও। তারা এখন সকলেই “মুক্তি-প্রদত্ত”, এবং বিনিয়োগ-সন্ধানী মূলধনের প্রত্যেকটি টুকরো তাদের ব্যবহার করতে পারে। এই মূলধন তাদেরই আকর্ষণ করুক বা অন্যদের আকর্ষণ করুক, সাধারণ শ্রম-চাহিদার উপরে তার ফল হবে শূন্য-যদি মেশিন যত সংখ্যক শ্রমিককে বাজারে ছুড়ে দিয়েছিল, এই মূলধন তত সংখ্যক শ্রমিককে বাজার থেকে তুলে নিতে পারে। যদি তা তার চেয়ে অল্পতর সংখ্যক শ্রমিক নিযুক্ত করে, তাহলে, অনাবশ্যক শ্রমিক-সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যদি তা তার চেয়ে বৃহত্তর সংখ্যক শ্রমিক নিযুক্ত করে, তা হলে মুক্তিপ্রদত্ত সংখ্যার অতিরিক্ত যত শ্রমিক নিযুক্ত হবে, কেবল তত পরিমাণেই শ্রমের সাধারণ চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং বিনিয়োগ সন্ধানী মূলধন অন্যথা শ্রমের জন্য সাধারণ চাহিদাকে যে-প্রেরণা সঞ্চার করত, তা প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই মেশিনের দ্বারা কর্মচ্যুত শ্রমিক-সংখ্যার আয়তন অনুযায়ী নিরাকৃত হয়ে যায়। তার মানে এই যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রণালী এমন ভাবে সব কিছুর ব্যবস্থাপনা করে যে, মূলধনের অপেক্ষিক বৃদ্ধির সঙ্গে শ্রমের চাহিদায় অনুরূপ কোনো বৃদ্ধি ঘটে না। এবং অতিক্রান্তির কালে যে-শ্রমিকেরা সংরক্ষিত বাহিনীতে নিক্ষিপ্ত হয়, সেই কর্মচ্যুত শ্রমিকদের দুর্দশা, দুর্ভোগ ও সম্ভাব্য মৃত্যুর এটাই নাকি ক্ষতিপূরণ -দালালেরা তাই বলেন। শ্রমের চাহিদা মূলধনের বৃদ্ধির সঙ্গে অভিন্ন নয়; শ্রমের সরবরাহ শ্ৰমিক-শ্রেণীর বৃদ্ধির সঙ্গে অভিন্ন নয়। এটা দুটি স্বতন্ত্র শক্তির পরস্পরের উপরে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যাপার নয়। Les des sont pipes মূলধন একই সময়ে উভয় দিকে কাজ করে। যদি তার সঞ্চয়ন, একদিকে শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি করে, অন্য দিকে, তা তাদের “মুক্তিদান করে শ্রমিকদের যোগানেরও বৃদ্ধি সাধন করে; যখন একই সময়ে কর্মচ্যুত শ্রমিকদের চাপ কৰ্ম-নিযুক্ত শ্রমিকদের বাধ্য করে আরো বেশি করে শ্রম করতে এবং এই ভাবে, শ্রমের যোগানকে শ্রমিকদের যোগান থেকে কিছু মাত্রায় স্বতন্ত্র করে দিতে। শ্রমের যোগান ও চাহিদার নিয়মটির এই ভিত্তিতে কাজ করার ফলে মূলধনের স্বৈরতন্ত্র সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। সুতরাং, যে-মুহূর্তে শ্রমিকেরা এই গোপন কথাটি জেনে যায় যে, কেমন করে এটা ঘটে যে, যে-মাত্রায় তারা আরো বেশি কাজ করে, অপরের জন্য আরো বেশী সম্পদ উৎপাদন করে, এবং তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ঠিক সেই মাত্রায় এমন কি মূলধনের আয়ু-প্রসারণের উপায় হিসাবেও তাদের কাজ তাদের পক্ষে আরো আরো অনিশ্চিত হয়ে ওঠে; যে-মুহূর্তে তারা আবিষ্কার করে যে, তাদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতার তীব্রতার মাত্রা পুরোপুরি নির্ভর করে আপেক্ষিক উদ্বও জনসংখ্যার চাপের উপরে, যে-মুহূর্তে তারা তাদের শ্ৰেণীর উপরে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের এই স্বভাবসিদ্ধ নিয়মটির সর্বনাশা ফলাফলকে ধ্বংস বা খর্ব করার জন্য ট্রেড-ইউনিয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে কর্মরত ও কর্মহীনদের মধ্যে একটি নিয়মিত সহযোগিতা সংগঠিত করতে সচেষ্ট হয়, সেই মুহূর্তে মূলধন ও তার স্তুতিকার ‘রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ব’ যোগান ও চাহিদার এই “শাশ্বত” ও “পবিত্র” নিয়মটিকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে চিৎকার শুরু করে। কর্মরত ও কর্মহীনদের যে-কোনো সম্মিলন এই নিয়মটির “সুসামঞ্জস্যপূর্ণ” কর্মধাকে ব্যাহত করে। কিন্তু অন্য দিকে, যে-মুহূর্তে (যেমন, উপনিবেশগুলিতে) প্রতিকূল ঘটনাবলী সংরক্ষিত শিল্প-কর্মী-বাহিনী সৃষ্টির পথে, এবং সেই সঙ্গে ধনিক শ্রেণীর উপরে শ্রমিক-শ্রেণীর চরম নির্ভশীলতার পথে প্রতিবন্ধকতা করে, সেই মুহূর্তে মূলধন ও তার চির-পুরাতন সাঞ্চো পাঞ্জা যোগান ও চাহিদার “পবিত্র” নিয়মটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং তার অসুবিধাজনক কর্মধারাকে জোর-জবরদস্তি করে ও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের সাহায্যে প্রতিহত করতে সচেষ্ট হয়।

————

১. তৃতীয় জার্মান সংস্করণে টীকা : মার্কসের কপিতে এখানে পৃষ্ঠা-পাশে ‘মার্জিন’-এ) এই টীকাটি রয়েছে। পরে বিশদ আলোচনার জন্য এখানে ‘নোট’ করুন। যদি এই সম্প্রসারণ হয় কেবল পরিমাণগত, তা হলে একই শিল্পশাখায় বৃহত্তর বা ক্ষুদ্রতর মূলধনের জন্য মুনাফা হয় অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের আয়তনের অনুযায়ী। যদি পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তন সংঘটিত করে, তা হলে একটি বৃহত্তর মূলধনের উপরে মুনাফার হার যুগপৎ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।”—এফ. এঙ্গেলস

২. ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলস-এর আদমসুমারি থেকে জানা যায় : কৃষিতে নিযুক্ত মোট লোকসংখ্যা! ( জমিদার, কৃষি-মালিক, মালি, রাখাল ইত্যাদি সমেত): ১৮৫১– ২০,১১,৪৮৭; ১৮৬১-১৯,২৪,১১। হ্রাস ৮৭,৩৩৭। উল উৎপাদন : ১৮৫১– ১,২,৭১৪; ব্যক্তি : ১৮৬১-৭৯,২৪২। সিল্ক বয়ন : ১৮৫১-১,১১,৯৪০; ১৮৬১ ১,১,৬৭৮। ক্যালিকো ছাপাই : ১৮৫১-১২,০৯৮; ১৮৬১–১২,৫৫৬। সামান্য বৃদ্ধি এবং এই শিল্পের বিপুল বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে নিযুক্ত শ্ৰমিকসংখ্যায় আনুপাতিক ভাবে দারুণ হ্রাস। টুপি-তৈরি : ১৮৫১-১৫,৯৫৭; ১৮৬১-১৩,৮১৪; খড়ের টুপি ও শিরোভূষণ : ১৮৫১-২৭,৩৯৩; ১৮৬১-১৮,১৭৬; সারা-সুরা তৈরি : ১৮৫১-১০,৫৬৬; ১৮৬১-১৩,৬৭৭। মোমবাতি—১৮৫১-৪,৯৪৯; ১৮৬১ -৪,৬৮৬। এই হ্রাসের প্রধান কারণ গ্যাসের বাতি। চিরুনি তৈরি : ১৮৫১– ২,৩৮; ১৮৬১–১,৪৭৮। করাতী : ১৮৫১-৩০,৫৫২; ১৮৬১-৩১,৬৪৭। করাতকল বৃদ্ধি পাবার জন্য সামান্য বৃদ্ধি। পেরেক তৈরি ১৮৫১-২৬,৯৪ .; ১৮৬১ -২৬,১৩০। মেশিনারির তিযোগিতার ফলে হ্রাস। টিন ও ধাতু খনন : ১৮৫১ -৩১,৩৬, ১৮৬১৩১, ০৪১। অন্য দিকে তুলোর সুতো ও কাপড় বোনা: :৮৫১-৩, ৭১.৭৭৭; ১৮ ৬১-৪,৫৬,৬৪৬। কয়লা খনন : ১৮৫১-১,৮৩,৩৮, ১৮৬১-২, ৬,৬১৩। ১৮৫১ সালের পর থেকে সাধারণত শ্রমিক-সংখ্যা সেখানেই সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, যেখানে মেশিনার সেই পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে প্রযুক্ত হয়নি। (ইংল্যাণ্ড ও ওয়ালেসের আদমসুমারি, :৮৬১, তৃতীয় খণ্ড, লণ্ডন ১৮৬৩, পৃঃ ৩৬)।

৩. [ ঢতুর্থ জাৰ্মাণ সংস্করণে সংযোজন। অস্থির মূলধনের আপেক্ষিক আয়তনের ক্রমবর্ধমান হারে হ্রাসপ্রাপ্তির নিয়ম এবং মজুরি-শ্রমিকদের অবস্থার উপরে ওর ফল বিশিষ্ট চিরায়ত অর্থ কিকদের মধ্যে কেউ কেউ অনুধাবন না করলেও অনুন করেছিলেন এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় তদান ছিল জন বার্টন-এর যদিও তিনি অন্যান্যদের মতই স্থির ও স্থিতিশীল মূলধনকে, অস্থির ও আবর্তনশীল মূলধনকে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি বলেন : শ্রমের চাহিদা নির্ভর করে আবর্তনশীল মূলধনের বৃদ্ধির উপরে, স্থিতিশীল মূলধনের বৃদ্ধির উপরে নয়। যদি এটা সত্য হত যে, এই দু ধরনের মূলধনের মধ্যেকার অনুপাত সর্ব সময়ে এবং সর্ব অবস্থায় একই থাকবে, তা হলে, বাস্তবিক পক্ষে, এটাই ঘটবে যে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা হবে তাষ্ট্রের সম্পদের সঙ্গে আনুপাতিক। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতির সম্ভাব্যতার কোনো ছায়াও নেই। যতই শিল্প অনুশীলিত ও সভ্যতা প্রসারিত হয়, ততই স্থিতিশীল মূলধন আবর্তনশীল মূলধনের সঙ্গে আরো বেশি বেশি অনুপাতে সম্পর্কিত হয়। এক টুকরো ব্রিটিশ মসলিন উৎপন্ন করতে যে পরিমাণ স্থিতিশীল মূলধন নিয়জিত হয়, তা এক টুকরে? অনুরূপ ভারতীয় মসলিন উৎপন্ন করতে নিয়োজিত স্থিতিশীল মূলধনের একশ’ গুণ, সম্ভবত, এক হাজার গুণ বৃহ। এবং আবর্তনশীল মূলধনের অনুপাত একশ বা হাজার গুণ কম। সমগ্র বাংরিক সঞ্চয়, স্থিতিশীল মূলধনের সঙ্গে সংযোজিত হয়েও, শ্রমের চাহিদার কোনো বৃদ্ধি ঘটাবে না। ( জন বার্টন, “অবজার্ভেশন অন দি সারকামাসটেন্সেস তুইচ ইনফুলেন্স দি ক্যানডিশন অব। দি লেবরিং ক্লাসেস অব সোসাইটি, লণ্ডন ১৮১৭, পৃঃ ১৬ ১৭’। “একই কারণ, যা দেশের নীট আয় বৃদ্ধি করতে পারে, তাই আবার একই সময়ে জনসংখ্যাকে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলতে এবং শ্রমিকের অবস্থাতে অবনতি ঘটাতে পারে। ( রিকার্ডো, ঐ, পৃ: ৪৬৯। মূলধনের বুদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে : শ্রমের জন্য চাহিদা হবে ক্রমহ্রাসমান হারে। ঐ, পৃঃ ৮৮০ টীক’ ‘। শ্রমের পরিপোষণের জন্য নিয়োজিত মূলধনের পরিমাণ মূলধনের সমগ্র পরিমাণে পরিবর্তন থেকে নিরপেক্ষ ভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। মূলধন নিজেই যত প্রচুর হয়, ততই কর্মসংস্থানের পরিমাণে বিপুল ওঠা-নাম। এবং সেই সঙ্গে বিপুল দুর্দশা আর ঘন ঘন ঘটতে পারে।” ( চিডং জোন্স, “ইন্টেডাক্টরি লেকচার অন পলিটিকাল ইকনমি!’ ল ১৮৩৩, পৃঃ ১৩’। [শ্রমের জন্য চাহিদা বৃদ্ধি পাবে : সাধারণ মূলধনের সঞ্চয়নের অনুপাতে নয়। পুনরুৎপাদনের জন্য নির্দেশিত জাতীয় মূলধনে প্রতিটি বৃদ্ধি সমাজের অগ্রগতির পথে শ্রমিকের অবস্থার উপরে ক্রমেই আরো কম কম প্রভাব বিস্তার করে। ( র‍্যামসে, ঐ পৃঃ ৯০-৯১)

৪. এইচ মেরিভেল, লেকচার্স অন কলোনিজেসন অ্যান্ড কলোনিজ, ১৮৪১ খণ্ড ১, পৃঃ ১৪৬।

৫. ম্যালথাস, ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিকাল ইকনমি’, পৃঃ ২১৫, ৩১৯, ৩২। এই গ্রন্থে ম্যালথাস, সিম দির সহায়তায়, চুড়ান্ত ভাবে আবিষ্কার করেন ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সেই সুন্দর ত্রিনীতি: অতি-উৎপাদন, অতি-জনসংখ্যা, অতি-পরিভোগ সত্যিই তিনটি অতি সুত দানব। তুলনীয় : “Umrisse Zu einer kritik der Nationalokonomie”. 1. c. p. 107 et. seq. F. Engles.

৬. হারিয়েট মার্টিনো, এ ম্যাঞ্চেস্টার স্ট্রাইক। ১৮৩২, পৃঃ ১০১।

৭. এমনকি ১৮৬৩ সালের তুলে।-দুর্ভিক্ষের সময় আমরা ব্ল্যাকবানের কর্মরত তুলোকাটুনিদের একটি পুস্তিকায় দেখতে পাই উপরি-খাটুনির তীব্র নিন্দা, যা কারখানা-আইনের দরুন কেবল বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকদেরকেই পীড়িত করত “এই মিলের বয়স্ক কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রত্যহ ১২ থেকে ১৩ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতে, যখন এমন শত শত লোক রয়েছে, যারা তাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা করার জন্য এবং অতিরিক্ত কাজের চাপে পিষ্ট শ্রমিক-ভাইদের অকালমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য স্বেচ্ছায় আংশিক কাজ করতেও রাজি, তাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কর্মহীনতা।” ঐ পুস্তিকায় আরো বলা হয়েছে, “আমরা জিজ্ঞাসা করতে চাই কিছু সংখ্যক কর্মীকে দিয়ে এই উপরি-খাটানোর রীতি কি প্রভু ও ভৃত্যের মধ্যে ভালো মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে? যাদের উপরে জোর করে আলস্য চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের মত, যাদের উপরি-খাটানা হচ্ছে, তারাও সমান ভাবে অন্যায়টা অনুভব করে। অঞ্চলে যা কাজ আছে, তা সকলের মধ্যে ন্যায্য ভাবে ভাগ করে দিলে প্রায় সকলের জন্যই আংশিক কাজের ব্যবস্থা হয়ে যায়। আমরা কেবল মালিকদের কাছে আবেদন করছি যা করা উচিত, তাই করার জন্য, কিছু লোককে উপরি-খাটুনি খাটিয়ে বাকিদের জন্য কাজের অভাব সৃষ্টি করে তাদের খয়রাতের উপরে নির্ভর করতে বাধ্য না করে অল্প ঘণ্টা কাজের রীতি চালু করবার জন্য, বিশেষ করে যে-পর্যন্ত না আমাদের সুদিনের উদয় হচ্ছে।”(“রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর ১৮৬৩”,পৃঃ ৮)। “এসে অন ট্রেড অ্যান্ড কমার্স”-এর লেখক তার অভ্যস্ত অভ্রান্ত বুর্জোয়া প্রবৃত্তির সাহায্যে কর্ম-নিযুক্ত শ্রমিকদের উপরে আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার ফল উপলব্ধি করতে পারে। “এই রাজ্যে অলসতার আরেকটি কারণ হল যথেষ্ট সংখ্যক শ্রমিকের অভাব। যখনি উৎপন্ন দ্রব্যের অস্বাভাবিক চাহিদার দরুন শ্রম দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে, শ্রমিকেরা তাদের নিজেদের পরিণাম বুঝতে পারে এবং তাদের মালিকদেরও অনুরূপ ভাবে তা বুঝতে বাধ্য করে—একটা গোটা দিন আলসেমি করে কাটিয়ে দেয়।” (“এসে ইত্যাদি, পৃঃ ২৭-২৮)। আসলে বেচারারা মজুরি-বৃদ্ধির পিছনে ছুটছিল।

৮. “ইকনমিস্ট”, জানুয়ারি ২১, ১৮৬০।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ– আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার বিভিন্ন রূপ। ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের সাধারণ নিয়ম।

আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যা থাকে সকল সম্ভাব্য রূপে। যে-সময় জুড়ে সে আংশিক ভাবে বা সম্পূর্ণ ভাবে বেকার থাকে, তখন প্রত্যেকটি মিকই এই সংখ্যার মধ্যে পড়ে। শিল্প-চক্রের পরিবর্তনশীল পর্যায় সমুহের সময়ক্রমিক পৌনঃপুনিক রূপগুলি এই জন সংখ্যার উপরে যে-ছাপ রেখে যায়, সেগুলিকে হিসাবে না ধরলেও এখন সংকটের সময়ে একটা তীক্ষ্ণ রূপ, তখন মন্থরতার সময়ে একটা একটানা রূপ এগুলিকে হিসাবে না ধরলেও—এর সব সময়েই তিনটি রূপ থাকে, ভাসমান, প্রচ্ছন্ন, নিশ্চল।

আধুনিক শিল্পের কেন্দ্রগুলিতে-ফ্যাক্টরি, ম্যানুফ্যাকচার, লোহা-কারখানা, খনি ইত্যাদিতে-শ্রমিকদের কখনো তাড়িয়ে দেওয়া হয়, কখনো আবার আরো বেশি সংখ্যায় টেনে নেওয়া হয়, যার ফলে নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা মোটের উপরে বৃদ্ধি পায় যদিও সেই বৃদ্ধিটা ঘটে উৎপাদনের আয়তনের তুলনায় নিরন্তর হ্রাসমান অনুপাতে। এখানে উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার রূপটি ভাসমান।

স্বয়ংক্রিয় ফ্যাক্টরিগুলিতে, যেমন সব বৃহদাকার কর্মশালাগুলিতে, যেখানে মেশিনারি একটি উপাদান হিসাবে প্রবেশ করে, কিংবা যেখানে কেবল আধুনিক শ্রম বিভাজনই কার্যকর করা হয়, বিপুলসংখ্যক বালককে সাবালক না হওয়া পর্যন্ত কাজে রাখা হয়। যখন তারা সাবালকত্বে পৌছে যায়, তখন তাদের মধ্যে কেবল একটি ছোট সংখ্যাই সেই শিল্প-শাখাগুলিতে কাজ পায়, আর বেশির ভাগই নিয়মিত ভাবে কর্মচ্যুত হয়। কর্মচ্যুত এই গরিষ্ঠ অংশ ভাসমান উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার একটি উপাদানে পরিণত হয়, শিল্পের এই শাখাগুলি যত বিস্তার লাভ করে, এদের সংখ্যাও তত বৃদ্ধি লাভ করে। তাদের মধ্যে একটা অংশ দেশান্তরে চলে যায়, বাস্তবিক পক্ষে, মূলধনের দেশান্তর-গমনকে অনুসরণ করেই। তার একটা ফল হয় এই যে, পুরুষ-জনসংখ্যার তুলনায় নারী-জনসংখ্যা বেড়ে যায়, যেমন ঘটেছে ইংল্যাণ্ডে। শ্রমিকদের স্বাভাবিক সংখ্যা বৃদ্ধি যে সঞ্চয়নের প্রয়োজন পূরণ করে না, এবং তবু সব সময়েই সেই প্রয়োজনের তুলনায় উদ্বৃত্ত থাকে, সেটা স্বয়ং মূলধনেরই গতি-প্রকৃতির মধ্যে নিহিত একটি স্ববিরোধ। তা চায় অধিকতর সংখ্যক তারুণ্যপূর্ণ শ্রমিক আর অল্পতর সংখ্যক বয়স্ক শ্রমিক। এই স্ববিরোধটি অন্য স্ববিরোধের তুলনায় বেশি জাজ্বল্যমান নয়, যে স্ববিরোধটি হল এই যে, যখন হাজার হাজার শ্রমিক কর্মহীন, তখন নালিশ শোনা যায় যে, যথেষ্ট সংখ্যক শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ শ্রম-বিভাগ তাদের বেঁধে রাখে এক একটি বিশেষ শিল্প-শাখায়।[১]

তা ছাড়া, মূলধনের দ্বারা শ্রমশক্তির পরিভোগ এত দ্রুতগতিতে সম্পাদিত হয় যে, শ্রমিক তার জীবনের আধাআধি পথ যেতে না যেতেই নিজেকে প্রায় সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে ফেলে। সে তখন অন্তর্ভূক্ত হয় বাড়তি শ্রমিক-সংখ্যার একজন হিসাবে, কিংবা অবনমিত হয় নিম্নতর ধাপে। আধুনিক শিল্পের ঠিক এই শ্রমজীবী জনসংখ্যার মধ্যেই আমরা লক্ষ্য করি স্বল্পতম আয়ুষ্কাল। ম্যাঞ্চেস্টারের স্বাস্থ্য-বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ লী বলেন, “ম্যাঞ্চেস্টারের উচ্চতর মধ্য-শ্রেণীতে মৃত্যুর গড় বয়স ৩৮ বছর, যেখানে শ্রমিক-শ্রেণীতে মৃত্যুর গড় বয়স ১৭ বছর; লিভারপুলে এই গড় বয়স দুটি যথাক্রমে ৩৫ বছর এবং ১৫ বছর। এ থেকে দেখা যায় যে, বিত্তবান শ্রেণীগুলির জীবনকাল কম ভাগ্যবান নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ জীবনকালের দ্বিগুণেরও বেশি।”[২] এই পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হলে, শ্রমজীবী শ্রেণীর (প্রোলেটারিয়েট’ এর) এই অংশের অনাপেক্ষিক বৃদ্ধি ঘটাতে হবে এমন অবস্থায় যা তাদের সংখ্যাকে স্ফীতকায় করবে যদিও ব্যক্তিগত উপাদানগুলি হয়ে যাবে দ্রুত কর্মজীর্ণ। এইজন্যই চাই শ্রমিক-প্রজন্মগুলির দ্রুত নবীকরণ। (এই নিয়মটি অবশ্য জনসমষ্টির অন্যান্য অংশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়)। এই সামাজিক প্রয়োজনটি সাধিত হয় অল্প বয়সে বিবাহের দ্বারা (যা আধুনিক শ্রমিকেরা যে-অবস্থার মধ্যে জীবন কাটায়, তার একটি আবশ্যিক পরিণতি), এবং, শিশুদের শোষণ তাদের উৎপাদনের উপরে যে পরিপ্রাপ্তি প্রদান করে, তার দ্বারা।

যখনি ধনতান্ত্রিক উৎপাদন কৃষিকর্মের দখল নেয়, এবং যে-মাত্রায় তা এটা করে সেই অনুপাতে, তখনি শ্রমের চাহিদা দারুণ ভাবে পড়ে যায়। অন্যদিকে, কৃষিতে বিনিয়োজিত মূলধনের সঞ্চয়নের অগ্রগতি ঘটে, কিন্তু অ-কৃষিক্ষেত্রে যেমন এই প্রতিসারণ অধিকতর আকর্ষণের দ্বারা পরিপূরিত হয়, এখানে তা হয় না। সুতরাং, কৃষিগত জনসংখ্যার একটা অংশ সব সময়েই শহুরে বা কারখানা-শ্রমিকে রূপান্তরিত হবার মুখে থাকে এবং এই রূপান্তরণের অনুকূল অবস্থার জন্য অপেক্ষা করে। (কারখানা কথাটি এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে সমস্ত অ-কৃষিগত শিল্পসমূহ বোঝতে।)[৩] অতএব, আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার এই উৎসটি সব সময়েই থাকে ভাসমান। তবে শহরমুখী এই নিরন্তর প্রবাহের পূর্বশর্ত হল খোদ গ্রামাঞ্চলে একটি উত্ত-জনসংখ্যার নিরন্তর প্রচ্ছন্ন অস্তিত্ব, যার আয়তন কেবল তখনি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন তার প্রবাহের পথগুলি অসাধারণ বিস্তার লাভ করে। সুতরাং কৃষি-শ্রমিকদের মজুরি পর্যবসিত করা হয় ন্যূনতম পরিমাণে এবং তাদের একটি পা সব সময়েই থাকে দুঃস্থতার পঙ্কে।

আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার তৃতীয় বর্গটি, নিশ্চল বৰ্গটি, সক্রিয় শ্রম-বাহিনীরই একটি অংশ কিন্তু তার কর্ম-নিয়োগ ঘটে চরম অনিয়মিত ভাবে। সুতরাং এই অংশটি মূলধনকে যোগায় ব্যবহার্য শ্রমশক্তির এক অফুরন্ত ভাণ্ডার। এর জীবনধারণের অবস্থা শ্ৰমিক-শ্রেণীর গড়পড়ত। জীবনধারণের অবস্থার অনেক নীচে নেমে যায়; এর ফলে তা সঙ্গে সঙ্গেই ধনতান্ত্রিক শোষণের বিশেষ বিশেষ শাখার প্রশস্ত ভিত্তিতে পরিণত হয়। কাজের সময় সবচেয়ে বেশি, মজুরি সবচেয়ে কম-এই হল এর বিশেষত্ব। এর প্রধান রূপটিকে আমরা জানতে শিখেছি লাল কালিতে লেখা “ঘরোয়া শিল্প”—এই শিরোনামায়। এ নিরন্তর এর কর্মী সংগ্রহ করে আধুনিক শিল্প ও কৃষির বাড়তি বাহিনীগুলি থেকে, বিশেষ করে সেই সব ক্ষয়িষ্ণু শিল্পশাখা থেকে, যেখানে হস্তশিল্প স্থান ছেড়ে দিচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারকে, ম্যানুফ্যাকচার স্থান ছেড়ে দিচ্ছে মেশিনারিকে। সঞ্চয়নের প্রসার ও প্রবলতার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার সৃষ্টি যেমন এগিয়ে যায়, এর প্রসারও তেমন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অন্যান্য উপাদানের তুলনায়। শ্ৰমিক-শ্রেণীর বুদ্ধিসাধনে অনুপাতিক ভাবে বৃহত্তর অংশ গ্রহণ করায়, এটি একই সময়ে গঠন করে সেই শ্রেণীর একটি আত্ম পুনরুৎপাদনশীল ও আত্ম-বিস্তাৱশীল উপাদান। বস্তুতঃপক্ষে, কেবল জন্ম ও মৃত্যুর সংখ্যাই নয়, পরন্তু পরিবারগুলির অনাপেক্ষিক আকারও মজুরির উচ্চতার এবং, সেই কারণেই, শ্রমিকদের বিভিন্ন বর্গ যে-পরিমাণ প্রাণ-ধারণের উপকরণাদি পৰিভোগ করে, সেই পরিমাণের সঙ্গে বিপরীত ভাবে সম্পর্কিত। ধনতান্ত্রিক সমাজের এই নিয়মটি কেবল অসভ্য মানুষদের কাছেই নয়, সভ্যতাপ্রাপ্ত উপনিবেশবাসীদের কাছেও অদ্ভুত শোনাবে। এটা মনে করিয়ে দেয় জন্তু-জানোয়ারের সীমাহীন পুনরুৎপাদনের কথা, যেগুলি একক ভাবে দুর্বল এবং স্বভাবতই নিরন্তর শিকারের বলি।[৪]

আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার সবচেয়ে নিচুকার তলানি শেষ পর্যন্ত অবস্থান করে দুঃস্থতার চতুঃসীমায়। ভবঘুরে দুবৃত্ত ও বারনারীদের, এক কথায় বিপজ্জনক শ্রেণীগুলি”-কে বাদ দিলে, এই স্তরটি তিন ধরনের লোক নিয়ে গঠিত। প্রথমত, যারা কাজ করতে সক্ষম। প্রত্যেকটি সংকটেই যে দুঃস্থদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং প্রত্যেকটি পুনরুত্থানেই যে তাদের সংখ্যা হ্রাস পায়, সেটা দেখতে হলে ইংল্যাণ্ডে দুঃস্থতার পরিসংখ্যানের উপরে কেবল একবার ভাসাভাসা ভাবে চোখ বুলিয়ে যাওয়াই যথেষ্ট। দ্বিতীয়তঃ, অনাথ ও দুঃস্থ শিশুর দল। এরা হল সংরক্ষিত শিল্প-কর্মীবাহিনীর সম্ভাব্য সদস্য এবং, বিপুল সমৃদ্ধির সময়ে, যেমন ১৮৬০ সালে, এরা দ্রুত বেগে ও বিরাট সংখ্যায় সংগৃহীত হয় সক্রিয় শ্রমিক-বাহিনীতে। তৃতীয়ত, যারা অধঃপতিত ও ‘অনাচারগ্রস্ত এবং যারা কাজ করতে অক্ষম-প্রধানতঃ তারা যারা শ্রম-বিভাজনের সঙ্গে অভিযোজনে অযোগ্য বলে প্রতিপন্ন; যেসব লোক শ্রমিকের স্বাভাবিক বয়ঃসীমা অতিক্রান্ত করেছে; যেসব লোক শিল্পব্যবস্থার বলি, বিপজ্জনক মেশিনারি, খনি, রাসায়নিক কারখানা ইত্যাদির বৃদ্ধির সঙ্গে যাদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে বিকলাঙ্গ, রোগগ্রস্ত, বিধবা ইত্যাদি। দুঃস্থতা হল সক্রিয় শ্রমিক-বাহিনীর হাসপাতাল আর সংরক্ষিত শ্রমিক-বাহিনীর জগদ্দল পাষাণ। এর উৎপাদন আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত জন সংখ্যার অন্তর্ভূক্ত, এর প্রয়োজন তাদেরও প্রয়োজন; উত্তজনসংখ্যা যেমন ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের, তথা ধনতান্ত্রিক সম্পদ-সৃষ্টির একটি অবস্থা, দুঃস্থতাও তেমন তাই। তা ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ‘faux frais-এ প্রবেশ করে; কিন্তু মূলধন জানে কেমন করে তাদের বৃহত্তম অংশকে নিজের কাঁধ থেকে শ্রমিক-শ্রেণী ও নিম্নতর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কঁাধে ছুড়ে দিতে হয়।

সামাজিক সম্পদ, কর্মরত মূলধন, তার সংবৃদ্ধির মাত্রা ও শক্তি, এবং অতএব, শ্ৰমিক-শ্রেণীর ও তার শ্রমের উৎপাদনশীলতারও অনাপেক্ষিক পরিমাণ যত বৃদ্ধি পায়, শিল্পের সংরক্ষিত বাহিনীও তত বৃদ্ধি পায়। যে-কারণগুলি মূলধনের সম্প্রসারণমূলক ক্ষমতার বিকাশ ঘটায়, সেইগুলিই আবার তার অধীনস্থ শ্রম শক্তির বিকাশ ঘটায়। কিন্তু সক্রিয় শ্রমিক-বাহিনীর অনুপাতে এই সংরক্ষিত শ্রমিক বাহিনীর যত বৃহত্তর হবে, মোট উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার সমষ্টিও তত বৃহত্তর হবে, যাদের দুর্দশা, যাতনা এবং শ্রম বিপরীত অনুপাতে সম্পর্কিত। সর্বশেষে রুগ্ন-আতুর শ্রমিক শ্রেণীর, এবং এই সংরক্ষিত বাহিনীর, স্তরগুলি যত বিস্তার লাভ করে সরকারি দুঃস্থ-দাক্ষিণ্যও তত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের এটাই হল অনাপেক্ষিক সাধারণ নিয়ম। অন্যান্য সমস্ত নিয়মের মত এই নিয়মটিও তার ক্রম-প্রক্রিয়ায় নানা ঘটনার দ্বারা উপযোজিত হয়, যার বিশ্লেষণ এখানে আমাদের দরকার নেই।

যে অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা শ্রমিকদের উপদেশ দেয় তাদের সংখ্যাকে মূলধনের প্রয়োজনের সঙ্গে সমন্বয় করিয়ে নেবার জন্য, তার মূঢ়তা এখন প্রকট। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ও সঞ্চয়নের প্রণালী নিজেই নিরন্তর এই সমন্বয় সাধন করে। এই সমন্বয়নের প্রথম কথাটি হল আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার বা শিল্পগত সংরক্ষিত কর্মী-বাহিনীর সৃষ্টি। আর তার শেষ কথাটি হল সক্রিয় শ্রম-বাহিনীর নিরন্তর প্রসারণশীল সুরসমূহের দুঃখ-দুর্দশা, এবং দুঃস্থতার জগদ্দল পাষাণ।

যে নিয়মের বলে, সামাজিক শ্রমের উৎপাদনশীলতার অগ্রগতির কল্যাণে, উৎপাদন-উপায়সমূহের নিরন্তর বর্ধমান পরিমাণকে মনুষ্য-শ্রমের ক্রমবর্ধিত হাৱে হ্রাসমান ব্যয়ের দ্বারা গতিশীল করা যায়, সেই নিয়মটি ধনতান্ত্রিক সমাজে—যেখানে শ্রমিক উৎপাদনের উপায়কে খাটায় না, উৎপাদনের উপায়ই শ্রমিক খাটায়—একটি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, এবং এই ভাবে অভিব্যক্ত হয় : শ্রমের উৎপাদনশীলতা যত বৃদ্ধি পায়, কর্মে নিয়োগের উপায়গুলির উপরে শ্রমিকদের চাপও তত বৃদ্ধি পায়; সুতরাং তাদের অস্তিত্বের অবস্থা হয়ে ওঠে আরো অনিশ্চিত, অর্থাৎ আরেকজনের সম্পদ বাড়াবার জন্য, মূলধনের আত্মবিস্তারের জন্য তাদের নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রয়ের ব্যাপারটা হয়ে ওঠে আরো অনিশ্চিত। সুতরাং উৎপাদনের উপায়সমূহ ও শ্রমের উৎপাদনশীলতা, যে উৎপাদনশীল জনসংখ্যার তুলনায় দ্রুততর গতিতে বৃদ্ধি পায়, এই ঘটনা ধনতান্ত্রিক ভাবে নিজেকে প্রকাশ করে এই বিপরীত রূপে যে যে-অবস্থাবলীতে মূলধন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শ্রমজীবী জনসংখ্যাকে তার নিজের আত্ম-প্রসারণের জন্য কাজে লাগাতে পারে, সেই অবস্থাবলীর বিকাশলাভের তুলনায় শ্রমজীবী জনসংখ্যা দ্রুততর গতিতে বৃদ্ধি পায়।

চতুর্থ বিভাগে, আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে আমরা দেখেছিলাম : ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমের সামাজিক উৎপাদনশীলতা উন্নীত করার সব কটি পদ্ধতিই সংঘটিত হয় ব্যক্তিগত শ্রমিকের স্বার্থের বিনিময়ে; উৎপাদন উন্নয়নের সব কটি উপায়ই নিজেদেরকে রূপান্তরিত করে উৎপাদনকারীদের উপরে আধিপত্য বিস্তারের এবং তাদের শোষণ করার উপায়ে; তার শ্রমিককে বিকলাঙ্গ করে তাকে পর্যবসিত করে মানুষের একটি ভগ্নাংশে; তাকে অধঃপাতিত করে যন্ত্রের একটি উপাঙ্গে, তার কাজের সমস্ত আকর্ষণকে ধ্বংস করে দিয়ে কাজকে পরিণত করে ঘৃণ্য উবৃত্তিতে; যে-মাত্রায় শ্রম-প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানকে স্থান করে দেওয়া হয় একটি স্বতন্ত্র শক্তি হিসাবে, সেই মাত্রায় তারা শ্রমিককে বিচ্ছিন্ন করে তার বুদ্ধিবৃত্তিগত সম্ভাবনাগুলি থেকে; তারা তার কাজের অবস্থাবলীকে বিকৃত করে, শ্রম-প্রক্রিয়া চলাকালে তাকে বশীভূত করে এমন এক স্বৈরতন্ত্রের কাছে, যা তার নীচতার জন্য আরো জঘন্য; তারা তার জী-কালকে পরিণত করে নিছক কর্ম-কালে এবং তার স্ত্রী ও সন্তানকে টেনে নিয়ে যায় মূলধনরূপী জগন্নাথের রথের চাকার তলায়।[৫] কিন্তু উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের সব কটি পদ্ধতিই আবার একই সঙ্গে সঞ্চয়নেরও পদ্ধতি; এবং সঞ্চয়নেরও প্রত্যেকটি সম্প্রসারণই আবার পরিণত হয় ঐ পদ্ধতিগুলিরই বিকাশ-সাধনের উপায়। এ থেকে বেরিয়ে আসে যে, মূলধন যে-অনুপাতে সঞ্চয়িত হয়, শ্রমিকের ভাগ্য সেই অনুপাতে আরো খারাপ হয় তার মজুরি বেশিই হোক বা কমই হোক। সর্বশেষে, এই যে নিয়ম যা সব সময়ে আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যাকে, কিংবা শিল্পের সংরক্ষিত বাহিনীকে সঞ্চয়নের প্রসার ও প্রবলতার সঙ্গে সমতা-সঙ্গত করে, এই নিয়মটি ভাকানের গোঁজগুলি প্রমিথিউসকে যতটা দৃঢ়ভাবে পাথরের সঙ্গে এটে দিয়েছিল, তার চেয়েও দৃঢ়ভাবে শ্রমিককে মূলধনের সঙ্গে এটে দেয়। মূলধনের সঞ্চয়নের সঙ্গে সঙ্গে তা দুঃখ-দৈন্যের সঞ্চয়নও সংঘটিত করে। সুতরাং, এক মেরুতে সম্পদের সঞ্চয়নের সঙ্গে একই সময়ে বিপরীত মেরুতে, অর্থাৎ, যে-শ্রেণীটি মূলধনের আকারে নিজের উৎপন্ন সামগ্রী উৎপাদন করে, সেই শ্ৰেণীটির প্রান্তে, ঘটায় দুঃখ-দুর্দশার সঞ্চয়ন, উঞ্ছবৃত্তি, দাসত্ব, অজ্ঞতা, পাশবিকতা, মানসিক অধঃপতনের যণ।। রাষ্ট্ৰীয় অর্থতাকের ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের এই স্ববিরোধী চরিত্র নানা ভাবে বিবৃত করেছেন; যদিও তারা তাকে গুলিয়ে ফেলেছেন এমন সব ব্যাপারের সঙ্গে, যেগুলি নিশ্চয়ই কিছু পরিমাণে অনুরূপ, কিন্তু তা হলেও মূলত আলাদা, এবং প্রাকৃ-ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতিসমূহের অন্তর্গত।

আঠারো শতকের বিরাট অর্থনৈতিক লেখকদের অন্যতম, ভেনিসীয় সন্ন্যাসী অর্টেস ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বিরোধিতাকে গণ করেন সামাজিক সম্পদের সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়ম হিসাবে। একটি জাতির অর্থনীতিতে সুবিধা ও অসুবিধাগুলি সবসময়ে পরস্পরের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে {©il bcne ed il male economico in una nazione sempre all, intessa misura”): pape GTCAI RIGU সম্পদের প্রাচুর্য সব সময়ে বাকি লোকদের হাতে সম্পদের অভাবের সমান হয় (la copia dei beni in alcuni sempre eguale alla mancanza di essi in altri): অল্পসংখ্যক লোকের হাতে বিপুল ঐশ্বর্য সব সময়ে বাকি অনেকের জন্য প্রাণ-ধারণের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলির চরম অভাবের সঙ্গে যায়। কোন জাতির সম্পদ হয় তার জনসংখ্যার সঙ্গে আনুপাতিক এবং তার দুর্দশা হয় তার সম্পদের সঙ্গে আনুপাতিক। কিছু লোকের মধ্যে শ্রমশীলতা অন্যদের মধ্যে বাধ্যতামূলক অলসতা সৃষ্টি করে। দরিদ্র ও অলসেরা ধনী ও পরিশ্রমীদের আবশ্যিক পরিণতি।”[৬] অর্টেস এর প্রায় দশ বছর পরে সম্পূর্ণ পাশবিক ভাবে, ইংল্যাণ্ডের গীর্জার ভারপ্রাপ্ত যাজক টাউনসেণ্ড দারিদ্রের যাতনার মহিমা কীর্তন করেন সম্পদের আবশ্যিক শর্ত হিসাবে। “শ্রমের উপরে) আইনগত নিয়ন্ত্রণ অতিরিক্ত ঝামেলা, হিংসা ও গোলমাল সঙ্গে নিয়ে আসে, অন্য দিকে, ক্ষুধা কেবল শান্তিপূর্ণ, নিঃশব্দ, অবিরাম চাপই নয়, পরন্তু শ্রম ও মেহনতের সবচেয়ে স্বাভাবিক তাড়না হিসাবে তা উদ্ব,দ্ধ করে সবচেয়ে প্রবল কর্ম তৎপরতা।” সুতরাং, সব কিছুই নির্ভর করে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে ক্ষুধাকে চিরস্থায়ী করার উপরে, এবং টাউনসেণ্ড-এর মতে, জনসংখ্যার নীতি—যা বিশেষ করে, দরিদ্রদের মধ্যে সক্রিয় সেই নীতি তার জন্য যথোচিত সংস্থান রাখে। “মনে হয় এটা প্রকৃতিরই একটি নিয়ম যে, দরিদ্ররা হবে কিছু মাত্রায় অদূরদশী (এত অদূরদশী যে মুখে রুপোর চামচে ছাড়াই তার ভূমিষ্ঠ হয়। যাতে করে সব সময়েই এমন কিছু লোক পাওয়া যায় যারা সমাজের সবচেয়ে হীন, সবচেয়ে নীচ ও সবচেয়ে ইতর করবে। এর দ্বারা মানুষের সুখের ভাণ্ডার বর্ধিত হবে এবং যারা অধিকতর নম্র-স্বভাব তারা কেবল কর্ম যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতিই পাবে না: … পরন্তু বিনা বাধায় তাদের নিজ নিজ প্রবৃত্তি অনুসারে বৃত্তি অনুসরণের স্বাধীনতা পাবে।…..সুষমা ও সৌন্দর্য, সমন্বয় ও শৃংখলার যে ব্যবস্থা ঈশ্বর ও প্রকৃতি এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেছেন, গরিব আইন’ তা ধ্বংস করতে উন্মুখ হবে।”[৭] যা দুঃখ-দুর্দশাকে করে চিরন্তন, সেই অবধারিত ভবিতব্যের মধ্যে যদি ভেনেসীয় সন্ন্যাসীটি আবিষ্কার করে থাকেন খ্ৰীষ্টীয় করুণা, কৌমার্য, মঠ ও মন্দিরের আদি কারণ, তা হলে বৃত্তি-ভোগী প্রোটেস্ট্যান্ট যাজক-সম্প্রদায় তার মধ্যে খুঁজে পান সেই সব আইনকে নিন্দা করার একটা অছিলা, যেসব আইনের বলে গরিবেরা পেয়েছিল শোচনীয় পরিমাণ সরকারি ত্রাণ-সাহায্যের অধিকার।

স্টর্চ বলেন, “সামাজিক সম্পদে অগ্রগতি জন্ম দেয় সমাজের পক্ষে উপকারী এই শ্ৰেণীটিকে ….. যে-শ্রেণীটি সম্পাদন করে সবচেয়ে ক্লান্তিকর, সবচেয়ে জঘন্য, সবচেয়ে বিরক্তিকর কার্যগুলি; এক কথায়, যে-শ্রেণীটি তার কাঁধে তুলে নেয় জীবনে যা কিছু অসহনীয় ও অবমাননাকর; এবং, এই ভাবে, অন্যান্য শ্রেণীর জন্য ব্যবস্থা করে দেয় অবকাশ, মানসিক প্রশান্তি এবং চিরাচরিত (c’est bon!) চারিত্রিক সন্ত্রম।”[৮] টর্চ নিজেকে প্রশ্ন করেন, তা হলে বর্বর যুগের তুলনায়, যে ধনতান্ত্রিক সভ্যতার জনগণের এত দুর্গতি, এত অধঃপতন, তার অগ্রগতিটা কোথায়? তিনি কেবল একটি উত্তরই খুজে পান : নিরাপত্তায় !

সিসম দি বলেন, শিল্প ও “বিজ্ঞানের অগ্রগতির কল্যাণে প্রত্যেক শ্রমিকই পারে তার নিজের পরিভোগর জন্য যা প্রয়োজন তার চেয়ে ঢের বেশি উৎপাদন করতে। কিন্তু একই সময়ে, যখন তার শ্রম-সম্পদ উৎপাদন করে, তখন যদি তাকে ডাকা হত সেই সম্পদ নিজেই পরিভোগ করতে, তা হলে তা শ্রমের জন্য তার যে-উপযুক্ততা, তা কমিয়ে দিত।” তার মতে, “মানুষ” (অর্থাৎ অ-শ্রমিক। “সম্ভবতঃ সমস্ত শিল্পকলাগত উৎকর্ষ এবং, উৎপাদনকারীরা আমাদের জন্য যেসব ভোগ্য সামগ্রীর সরবরাহ করে, সেগুলিকে ছাড়াই জীবন কাটাত, যদি সেই সব কিছু শ্রমিকের মত নিরন্তর পরিশ্রম করে, তাদের ক্রয় করতে হত।….. পরিশ্রম আজ তার প্রতিমূল্য থেকে বিচ্ছিন্ন; ঘটনা এই নয় যে, যে আগে কাজ করে, সেই পরে বিশ্রাম ভোগ করে; ঘটনা এই যে, একজন কাজ করে আর অন্য একজন বিশ্রাম ভোগ করে। সুতরাং শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতার অনির্দিষ্ট পরিবৃদ্ধির একমাত্র ফল হতে পারে কেবল অলস ধনীদের বিলাস ও সম্ভোগ বৃদ্ধি।”[৯]

সর্বশেষে, দেস্তুত দ্য ত্রাসি নামে সেই মেছে রক্তের বুর্জোয়া তত্ত্ববাগীশদের নির্লজ্জ হঠোক্তি : “দরিদ্র দেশগুলিতে লোকেরা থাকে আরামে, ধনীদেশগুলিতে তারা সাধারণতঃ দরিদ্র।”[১০]

————

১. যখন ১৮৬৬ সালের শেষের ছ’মাস লণ্ডনে ৮ থেকে ১০ হাজার শ্রমজীবী মানুষ কৰ্মচ্যুত হয়, তখন সেই একই সময়ের ফ্যাক্টরি রিপোর্টে বলা হয়, এটা সম্পূর্ণ সত্য বলে মনে হয় না যে, চাহিদা সব সময়েই, যে-মুহূর্তে সরবরাহের দরকার হবে, সেই মুহূর্তেই তা উৎপাদন করবে। শ্রমের ক্ষেত্রে চাহিদা তা করেনি, কেননা গত বছর শ্রমিকের অভাবে অনেক মেশিনারি অলস পড়েছিল।” (“রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৬ পৃঃ ৮১।

২. বার্মিংহামে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সম্মেলনে শহরের মেয়র জে. চেম্বারলেন, এখন (১৮৮৩) ব্যবসা-পর্ষদ-এর সভাপতি—এর উদ্বোধনী ভাষণ, ১৫ই জানুয়ারী, ১৮৭৫।

৩. ইংল্যাণ্ড ওয়েলসের ১৮৬১ সালের আদমসুমারিতে প্রদত্ত ৭৮১টি শহর, “ধারণ করত ১০,৯৬০,৯৯৮ জন অধিবাসী, যেখানে গ্রাম ও মফস্বলের প্যারিশগুলি ধারণ করত ৯,১০৫,২২৬ জন। ১৮৫১ সালে ৫৮টি শহর চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং সেগুলিতে আর সেগুলির চার পাশে মফস্বল এলাকাগুলির জনসংখ্যা ছিল প্রায় সমান সমান। কিন্তু যেখানে যেখানে পরবর্তী-দশ বছরে গ্রামে ও মফস্বলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেল ৫ লক্ষ, সেখানে শহরে তা বৃদ্ধি পেল ১৫ লক্ষ (১,৫৫৪, ৬৭)। মফস্বলের প্যারিশগুলির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৬৫ শতাংশ, শহরগুলির ১৭৩ শতাংশ। বৃদ্ধির হারের এই পার্থক্যের কারণ গ্রাম থেকে শহরে গমন। মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির ও ভাগ ঘটেছে শহরে। (“আদমসুমারি” ইত্যাদি, পৃঃ ১১, ১২)।

৪. “মনে হয় দারিদ্র্য প্রজননের পক্ষে অনুকূল”, (অ্যাডাম স্মিথ )। বীর ও বুদ্ধিমান আব্বে গ্যালিয়ানির মতে, এটা ঈশ্বরের এক বিশেষ ভাবে প্রাজ্ঞ ব্যবস্থা। «Iddio af che girl uominiche esercitano mestieri di primautilita nascono abbondantemente” (গ্যালিয়ানি ঐ, পৃঃ ৭৮)। “দুর্ভিক্ষ ওমহামারীর চরম অবস্থায় পর্যন্ত দুর্দশা জনসংখ্যাকে না কমিয়ে বরং বাড়ায়।” (এস লেইংগ। “ন্যাশনাল ডিস্ট্রেস”, ১৮৪৪, পৃঃ ৬৯)। পরিসংখ্যানের সাহায্যে এটা প্রমাণের পরে লেইংগ বলেন, “সকল মানুষ যদি স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থাকতে পারত, তা হলে পৃথিবী জনহীন হয়ে যেত।”

৫. “De jour en jour il devient donc plus clair que les rapports de production dans lesquels se meut la bourgeoisie n’ont pas un caractere un, un caractere simple, mais un caractere de duplicite que dans les memes rapports dans lesquels se produit la richesse, la misere se produit aussi; que dans les memes rapports dans lesquels il y a developpement des forces productives, il y a une force productive de repression; que ces rapports de produisent la richesse bourgeoise, c’est-a-dire la richesse de la classe bourgeoise, qu’en ancantissant continuellement la richesse des membres integrants de cette classe et en produisant un proletariat toujours croissant.” (Karl Marx : “Misere de la Philosophie,” p. 116.)

৬. জি অর্টেস, “Della Economia Nazionale libri sei, 1777. in Custodi, Parte Moderna, t. xxi. pp. 6, 9, 22, 25, etc. অর্টেস বলেন : “In luoco di progettar sistemi inutili per la felicita de’popoli, mi limitero a investigare la ragione della loro infelicita.”

৭. “এ ডিসার্টেশন অন দি পুয়োর লজ, বাই এ ওয়েলউইশার অব ম্যানই’ (রেভাঃজে টাউনসেণ্ড), ১৭৮৬, পুনর্মুদ্রিত, লণ্ডন ১৮১৭পৃঃ ১৫,৩৯,৪১। এই সুকোমল যাজকটির লেখা থেকে ম্যালথাস প্রায়ই পাতার পরে পাতা টুকে দিয়েছেন; যাজকটি নিজে কিন্তু তার মতবাদের বেশির ভাগটাই ধার করেছেন জেমস স্টুয়ার্ট মিল থেকে। অবশ্য ধার করার সময় কিছুটা অদল-বদলও করেছেন। যেমন, স্টুয়ার্ট বলেন, “এখানে এই ক্রীতদাস-প্রথার মধ্যে ছিল মানুষকে জোর করে পরিশ্রমী করার একটা ব্যবস্থা,” [ অ-শ্রমিকদের জন্য ] ‘মানুষ তখন বাধ্য হত কাজ করতে [ অর্থাৎ মুফতে অন্যের জন্য খাটতে ], কারণ তারা তখন ছিল অন্যের ক্রীতদাস; মানুষ এখন বাধ্য হয় কাজ করতে [ অর্থাৎ অ-শ্রমিকদের জন্য মুফতে কাজ করতে ], কারণ তারা তাদের প্রয়োজনের ক্রীতদাস, তা থেকে তিনি গীর্জার ঐ স্থূলকায় পদাধিকারীর মত এই সিদ্ধান্ত করেন না যে, মজুরি-শ্রমিককে অবশ্যই উপোস করে থাকতে হবে। বরং তিনি চান তাদের অভাব বৃদ্ধি করতে এবং তাদের অভাবের এই বর্ধিত সংখ্যাকে “অধিকৃতর সুকোমল” ব্যক্তি-বনের জন্য শ্রম-সাধনায় উদ্বোধিত করতে।

৮. স্টর্চ: H. Fr, cours d’Economie politique…nation. 28 ৩য় খণ্ড, প্যারিস ১৮২৩, পৃঃ ২২৩।

৯. সিসম দি : Nouveax priacipes d’Economie politique, vol—11 Paris, 1819. পৃঃ ৭৯, ৮৩, ৮৫।

১০. Deslutt de Tracy, 1.c., p. 231; “Les nations pauvres, c’est la ou le peuple est a son aise; et les nations riches, c’est la ou il est ordinairement pauvre.”

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ–ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের সাধারণ নিয়মের বিবিধ উদাহরণ।

(ক) ইংল্যাণ্ড : ১৮৪৬-১৮৬৬

ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়ন অনুধাবন করার পক্ষে গত ২০ বছরের সময়কাল যত অনুকূল, আধুনিক সমাজের আর কোনো কাল ততটা নয়। মনে হয় যেন এই কালটা ফরচুন্যাটাস এর ভাণ্ডার পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সমস্ত দেশের মধ্যে ইংল্যাণ্ডই হল আবার একমাত্র চিরায়ত উদাহরণ, কেননা বিশ্বের বাজারে তার স্থান সর্বাগ্রে, কেননা একমাত্র এখানেই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পূর্ণ ভাবে বিকশিত, এবং সর্বশেষে, কেননা ১৮৪৬ সাল থেকে অবাধ বাণিজ্যের স্বর্ণযুগের প্রবর্তন মামুলি অর্থনীতির শেষ আশ্রয়টি ভেঙে দিয়েছে। উৎপাদনে যে সুবিপুল অগ্রগতি ঘটে-২০ বছরের পরবর্তী ১০ বছরের অগ্রগতি আবার পূর্ববর্তী ১০ বছরের অগ্রগতিকেও ছাড়িয়ে যায়—তার কথা চতুর্থ বিভাগেই বিশদ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

যদিও গত অর্ধ-শতাব্দীতে ইংল্যাণ্ডের জনসংখ্যার অনাপেক্ষিক বৃদ্ধি ছিল খুবই বিরাট, তবু আপেক্ষিক বৃদ্ধি কিংবা সংবৃদ্ধির হার নিরন্তর কমে গিয়েছিল।

ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলস-এর জনসংখ্যার বাৎসরিক শতকরা বৃদ্ধির হার দশমিক সংখ্যায় :

১৮১১-১৮২১   শতকরা   ১.৫৩৩

১৮২১-১৮৩১   শতকরা   ১.৪৪৬

১৮৩১-১৮৪১   শতকরা   ১.৩২৬

১৮৪১-১৮৫১   শতকরা   ১.২১৬

১৮৫১-১৮৬১  শতকরা    ১.১৪১

অন্য দিকে, এবারে বিবেচনা করা যাক সম্পদ বৃদ্ধির কথা। এখানে, আয়করের আওতায় আসে এমন মুনাফা, জমির খাজনা ইত্যাদিই হল সবচেয়ে নিশ্চিত ভিত্তি। ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৪ সালের মধ্যে আয়করের আওতাভুক্ত মুনাফার বৃদ্ধি (জোত-মালিক ও আরো কিছু বৰ্গকে বাদ দিয়ে) দাড়িয়েছিল ৫০.৪৭ শতাংশ কিংবা বাৎসরিক গড় হিসাবে ৪.৫৮[১] শতাংশ, সেক্ষেত্রে ঐ একই সময়কালে জনসংখ্যার বৃদ্ধি বাৎসরিক গড় হিসাবে দাড়িয়েছিল প্রায় ১২ শতাংশ। ১৮৫৩ থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত করের আওতা ভুক্ত জমির খাজনার (বাড়ি-ঘর, রেলপথ, খনি, মৎস্যক্ষেত্র ইত্যাদি ধরে ) বৃদ্ধি ঘটেছিল ৩৮ শতাংশ কিংবা বাৎসরিক ৩.৬২ শতাংশ। এই শিরোনামায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলিতে ঘটেছিল বৃহত্তম বৃদ্ধি :

১৮৫৩ সালের বাৎসরিক আয়ের তুলনায় ১৮৬৪ সালের বাৎসরিক আয়ের আধিক্যঃ

বাড়িঘর : ৩৮৬০ শতাংশ             বাৎসরিক বৃদ্ধি   ৩.৫০ শতাংশ

পাথর-খাত : ৮৪৭৬ শতাংশ         বাৎসরিক বৃদ্ধি   ৭৭০   শতাংশ

খনি :  ৬৮.৮৫ শতাংশ               বাৎসরিক বৃদ্ধি    ৬.২৬  শতাংশ

লোহা-কারখানা : ৩৯.৯২ শতাংশ    বাৎসরিক বৃদ্ধি   ৩.৬৩  শতাংশ

 মাছচাষ : ৫৭.৩৭, শতাংশ          বাৎসরিক বৃদ্ধি   ৫.২১   শতাংশ

গ্যাস-কারখানা : ১২৬.০২, শতাংশ  বাৎসরিক বৃদ্ধি   ১১.৪৫  শতাংশ

রেলপথ : ৮৩.২৯ শতাংশ            বাৎসরিক বৃদ্ধি   ৭.৫৭   শতাংশ [২]

 ১৮৫৩ থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত যদি আমরা চারটি করে পর-পর বছরের তিনটি প্রন্তে ভাগ করে, সেই প্রস্তগুলিকে তুলনা করি, আমরা দেখতে পাই যে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির হার নিরন্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন, ১৮৫৩ এবং ১৮৫৭ সালের মধ্যে এই বৃদ্ধিপ্রাপ্তির হার হল বাৎসরিক ১.৭৩ শতাংশ; ১৮৫৭ এবং ১৮৬১ সালের মধ্যে ২.৭৪ শতাংশ এবং ১৮৬১ এবং ১৮৬৪ সালের মধ্যে ৯৩০ শতাংশ। যুক্তরাজ্যের আয়কর-যোগ্য আয়সমূহের যোগফল ১৮৫৬ সালে ছিল £ ৩০,৭০,৬৮,৮১৮, ১৮৫৯ সালে £ ৪ ৩২,৮১,২৭,৪১৬; ১৮৬২ সালে £ ৩৫,১৭,৪৫,২৪১; ১৮৬৩ সালে £ ৩৫,৯১,৪২,৮৯৭; ১৮৬৪ সালে £ ৫ ৩৬,২৪,৬২,২৭৯; ১৮৬৫ সালে £ ৩৮,৫৫,৩০,৩২০। [৩]

ঐ একই সময়ে মূলধনের সঙ্গে একত্রে চলেছিল সংকেন্দ্রীভবন ও কেন্দ্রীভবন। যদিও ইংল্যাণ্ডের বেলায় কৃষিক্ষেত্রের কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই (আয়ার্ল্যাণ্ডের আছে), ১০টি কাউন্টিতে তা স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছিল। এই সব পরিসংখ্যান থেকে যে ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল, তাতে দেখা যায়, ১৮৫১ থেকে ১৮৬১ সাল অবধি ১০০ একরের কম আয়তনের জোতের সংখ্যা ৩১,৫৮৩ থেকে কমে দাঁড়িয়েছিল ২৬,৫৯৭টি যার মানে, ৫,১৬টি জোত কয়েকটি করে একত্রে নিক্ষিপ্ত হয়ে বড় বড় জোতে পরিণত হয়েছিল।[৪] ১৮১৫ থেকে ১৮২৫ সাল অবধি ১৩,০০,০০০ বেশি মূল্যের কোনো ব্যক্তিগত ভূ-সম্পত্তি (এস্টেট) উত্তরাধিকার করের অধীনে আসেনি। ১৮২৫ থেকে ১৮৫৫ সাল অবধি কিন্তু এমন আটটি এসেছিল, এবং ১৮৫৬ থেকে ১৮৫৯ সালের জুন মাস অবধি, অর্থাৎ ৪.৫ বছরে এসেছিল ৪টি।[৫] অবশ্য, কেন্দ্রীভবনের তথ্য সবচেয়ে ভাল ভাবে পাওয়া যায় ১৮৬৪ এবং ১৮৬৫ সালের ‘আয়কর তপশিল’ ‘খ’-এর একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ থেকে ( মুনাফা-জোত ইত্যাদির মুনাফা বাদ দিয়ে)। আগে ভাগেই বলে রাখি যে, এই উৎস থেকে প্রাপ্ত আরগুলি ৬০ পাউণ্ডের উপরে সব কিছু বাদে কর দেয়। ইংল্যাণ্ড, ওয়েলস্ ও স্কটল্যাণ্ডে করের আওতাভুক্ত এই আয়সমূহের পরিমাণ ১৮৬৪ সালে হয়েছিল £ ৯,৫৮,৪৪,২৩২; ১৮৬৫ সালে £ ১০,৫৪,৫৩,৫৭৯। [৬] ১৮৬৪ সালে মোট ২,৮,৯১,৭০৯ জনসংখ্যার মধ্যে কর-আরোপিত ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল ৩,৭৮,৪১৬ জন; ১৮৬৫ সালে মোট ২,৪১,২৭, ০৩ জনসংখ্যার মধ্যে কর-আবোপিত ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল ৩,৩২,৪৩১ জন। নিম্ন-প্রদত্ত সারণীটিতে এই দুই বছরে এই সব আয়ের বন্টন দেখানো হল।

ছবি। পেজ ৩৮৪

১৮৫৫ সালে যুক্তরাজ্যে উৎপাদিত হয়েছিল ৬,১৪,৫৩, ৭৯ টন কয়লা, যার মূল্য ছিল ১,৬১,১৩,১৬৭ পাউণ্ড; ১৮৬৪ সালে ৯,২৭,৮৭,৮৭৩ টন, মূল্য ২,৩১,৯৭,৯৬, পাউণ্ড; ১৮৫৫ সালে ৩২,১৮,১৫৭ টন লৌহপিণ্ড, মূল্য ৮০,৪৫,৩৮৫ পাউণ্ড; ১৮৬৪ সালে ৪৭,৬৭,৯৫১ টন, মূল্য ১,১৯,১৯,৮৭৭ পাউণ্ড। ১৮৫৪ সালে যুক্তরাজ্যে চালু রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল ৮০,৪৫৪ মাইল, আদায়ীকৃত মূলধন ছিল ২৮,৬৩,৬৮,৭৯৪ পাউণ্ড; ১৮৬৪ সালে রেলপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়াল ১২,৭৮৯ মাইল, আদায়ীকৃত মূলধন ৪২,৫৭,১৯, ৬১৩ পাউণ্ড। ১৮৫৪ সালে যুক্তরাজ্যের মোট রপ্তানি ও আমদানি ছিল ২৬,৮২, ৩,১৪৫ পাউণ্ড; ১৯৬৫ সালে ৪৮,৯৯,২৩,২৮৫ পাউণ্ড। নিমোর্ধত সারণীটি থেকে রপ্তানির গতি জানা যায়ঃ

১৮৪৬        £ ৫,৮৮,৪১,৩৭৭

১৮৪৯          ৬,৩৫,৯৬,০৫২

১৮৫৬          ১১,৫৮,২৬,৯৪৮

১৮৬০          ১৩,৫৮,৪২,৮১৭

১৮৬৫          ১৬,৫৮,৮২,৪৩২

১৮৬৬          ১৮,৮৯,১৭,৫৬৩

এই সময়ে ১৮৬৭ সালের মার্চ মাসে ভারত ও চীনের বাজার আবার ব্রিটিশ তুলাজাত পণ্যের রপ্তানিতে সরবরাহের বাহুল্য ঘটেছে। ১৮৬৬ সালে তুলা-শ্রমিকদের উল্লিখিত উদাহরণগুলির পরে রেজিস্ট্রার-জেনারেল’-এর ব্রিটিশ জাতির বিজয় ঘোণা সহজেই বোঝা যায় : “যদিও জনসংখ্যা দ্রুত গতিতেই বৃদ্ধি পেয়েছে, তা হলেও তা শিল্প ও সম্পদের অগ্রগতির সঙ্গে পা মিলিয়ে এগোতে পারেনি।” [৭]

 এখন এই শিল্পের প্রত্যক্ষ সংঘটকদের, তথা এই সম্পদের উৎপাদকদের দিকে শ্রমিক-শ্রেণীর দিকে নজর দেওয়া যাক। গ্ল্যাডস্টোনের কথায়, “এই দেশের সামাজিক। অবস্থার সর্বাপেক্ষা বিষাদজনক বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, যখন জনগণের পরিভোগ-ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং যখন শ্রমিক-শ্রেণী ও কর্মীদের অভাব ও দুর্গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন এখানে ঘটছে উচ্চতর শ্রেণীগুলির হাতে সম্পদের নিরন্তর সঞ্চয়ন এবং সম্পদের নিরন্তর বৃদ্ধি।”[৮]—এতৎ উবাচ এই মহামতি মন্ত্রী-মহোদয়, ১৮৪৩ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি, কমন্স সভায় তাঁর ভাষণে। ২০ বছর পরে, ১৮৬৩ সালের ১৬ই এপ্রিল, যে-বক্তৃতা দিয়ে তিনি বাজেট উত্থাপন করেন, তাতে তিনি বলেন, “১৮৪২ থেকে ১৮৫২ সাল অবধি দেশের কর-যোগ্য আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ শতাংশ। … ১৮৫৩ থেকে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত আট বছরে, ১৮৫৩ সালকে ভিত্তি হিসাবে ধরে, এই আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২০ শতাংশ। এই ঘটনা এত আশ্চর্যজনক যে প্রায় অবিশ্বাস্য সম্পদ ও শক্তি এই উন্মাদনাকর সংবৃদ্ধি : যা সমগ্র ভাবে সম্পত্তিবান শ্রেণীগুলির মধ্যে সংবদ্ধ…. নিশ্চয়ই শ্রমজীবী জনগণের পক্ষে প্রত্যক্ষ ভাবে মঙ্গলজনক হবে, কেননা তা সাধারণ। ভোগের পণ্যদ্রব্যাদিকে সস্তা করে দেয়। যখন ধনীরা আরো বেশি ধনী হচ্ছে, তখন দরিদ্র হচ্ছে আরো কম দরিদ্র। যাই হোক, দারিদ্র্যের চরম দশা হ্রাস পেয়েছে কিনা, তা আমি বিনা বিচারে বলতে পারি না।[৯] কী অক্ষম ভাবান্তর-গ্রহণ! শ্ৰমিক-শ্রেণী যদি “দরিদ্র”-ই থেকে গিয়েছে, কেবল যে-অনুপাতে তারা বিত্তবান শ্রেণীগুলির জন্য “সম্পদ ও শক্তির, উন্মাদনাকর বৃদ্ধি ঘটিয়েছে সেই অনুপাতে কম দরিদ্র হয়েছে, তা হলে তারা আপেক্ষিক ভাবে আগের মতই দরিদ্র থেকে গিয়েছে। দারিদ্র্যের চরম দশা যদি না হ্রাস পেয়ে থাকে, তা হলে তা বৃদ্ধি পেয়েছে, কেননা সম্পদের চরম বৃদ্ধি ঘটেছে। জীবনধারণের উপায়-উপকরণ সস্তা হয়ে যাওয়া সম্পর্কে সরকারি পরিসংখ্যানে, তথা লণ্ডন অফ্যান অ্যাসাইলাম-এর (লণ্ডন অনাথ আশ্রম’-এর) হিসাবে দেখা যায় যে, ১৮৫১-১৮৫৩ সালের তিন বছরের গড়ের তুলনায় ১৮৬০-১৮৬২ সালের তিন বছরের গড় দাম ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরবর্তী তিন বছরে ১৮৬৩-১৮৬৫মাংস, মাখন, দুধ, চিনি, নুন, কয়লা, এবং জীবনধারণের অন্যান্য অনেকগুলি দ্রব্যসামগ্রীর দাম ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে।[১০] ১৮৬৪ সালের ৭ই এপ্রিল তারিখে প্রদত্ত গ্লাডস্টোনের পরবর্তী বাজেট বক্তৃতাটি তোত উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃজনের অগ্রগতি ও দরিদ্র’-শোষিত জনগণের সুখ সম্বন্ধে পিণ্ডার-রচিত বন্দনা-সঙ্গীতের মত। তিনি তার বক্তৃতায় দুঃস্থতার “প্রান্তবর্তী” জনগণের কথা, যে-সব শিল্প-শাখায় মজুরি বৃদ্ধি পায়নি”, সে-সবের কথা বলেন এবং, সর্বশেষে, এক কথায়, শ্ৰমিক-শ্রেণীর সুখের কথা বিবৃত করেন, “মানব-জীবন, প্রতি দশটি ক্ষেত্রের মধ্যে নয়টিতেই কেবল অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম।”[১১] অধ্যাপক ফসেট গ্ল্যান্ড স্টোনের মত সরকারি বিচার-বিবেচনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন; তিনি সোজা-সুজিই ঘোষণা করেন, “আমি অবশ্য অস্বীকার করি না যে, (গত দশ বছরে) মূলধনের এই সংবৃদ্ধির ফলে আর্থিক মজুরিও বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এই বাহ্যিক সুবিধা অনেক পরিমাণেই হয়েছে বিনষ্ট, কারণ জীবনধারণের জন্য আবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী হয়েছে আরো মহার্ঘ” (তার বিশ্বাস মূল্যবান ধাতুসমূহের মূল্যহ্রাসের দরুন — ধনী দ্রুত গতিতে আবো ধনবান হয়, অথচ শিল্পে নিযুক্ত শ্রেণীগুলির সচ্ছলতা-ভোগের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয় না। তারা (শ্রমিকেরা। ব্যবসায়ীদের প্রায় ক্রীতদাসে পরিণত হয়, কেননা তারা তাদের কাছে ঋণী।”[১২]

শ্রম-দিবস” এবং “মেশিনারি” সংক্রান্ত অধ্যায়গুলিতে পাঠক দেখেছেন কোন্ কোন্ অবস্থায় ব্রিটেনের শ্রমিক-শ্রেণী সম্পত্তিবান শ্রেণীগুলির জন্য সম্পদ ও শক্তির উন্মাদনাকর সংবৃদ্ধি” ঘটিয়েছিল। সেখানে আমরা প্রধানতঃ ব্যাপৃত ছিলাম শ্রমিকের সামাজিক কর্ম-সম্পাদনের সঙ্গে। কিন্তু সঞ্চয়নের নিয়মটির পূর্ণ ব্যাখ্যার জন্য, কর্মশালার বাইরেও তার অবস্থার দিকে নজর দেয়া দরকার—খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যাপারে তার যে অবস্থা, তার দিকে। এই গ্রন্থের যা চৌহদ্দি, তা আমাদের বাধ্য করে প্রধানতঃ শিল্প-সর্বহারা শ্রেণীর ( ‘ইণ্ডাস্ট্রিয়াল প্রোলেটারিয়েট’ )-এর সবচেয়ে কম মজুরি-প্রাপ্ত অংশের এবং কৃষি শ্রমিকদের বিষয়ে মনোযোগ দিতে; শিল্প-সর্বহারা-শ্রেণীর সবচেয়ে কম মজুরি-প্রাপ্ত অংশ এবং কৃষি-শ্রমিকেরাই হল একত্রে শ্রমিক-শ্রেণীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।

কিন্তু, প্রথমে, সরকারি দুঃস্থতা প্রসঙ্গে, কিংবা শ্রমিকশ্রেণীর যে অংশ তার অস্তিত্ব ধারণের শর্তটিকে (শ্রমশক্তি বিক্রয়ের শর্তটিকে হারিয়েছে, এবং কোন রকমে বেঁচে আছে সরকারি খয়রাতের উপরে, সেই অংশটি প্রসঙ্গে একটি কথা। ইংল্যাণ্ডে দুঃস্থের সরকারি তালিকায়[১৩] সংখ্যা ছিল ৮,৫১,৩৬৯ জন; ১৮৫৬ সালে ৮,৭৭,৭৬৭ জন; ১৮৬৫ সালে ৯,৭১,৪৩৩ জন। তুলা-দুর্ভিক্ষের দরুন এই সংখ্যা ১৮৬৩ ও ১৮৬৪ সালে যথাক্রমে ১৭,৭৯,৩৮২ ও ১৩,১৪,৯৭৮ জন। ১৮৬৬ সালের সংকট, যা সবচেয়ে প্রচণ্ড ভাবে আঘাত করেছিল লণ্ডনকে, তা স্কটল্যাণ্ড-রাজ্যের বেশি জনবহুল এই বিশ্ববাজারের কেন্দ্রটিতে ১৮৬৬ সালে দুঃস্থ-সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল ১৮৬৫ সালের তুলনায় ১৯৫ শতাংশ এবং সালের তুলনায় ২৪°৪ শতাংশ, এবং ১৯৬৬ সালের তুলনায় ১৯৬৭ সালের প্রথম কয় মাস আরো বৃহত্তর শতাংশ। দুঃস্থ তালিকার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ থেকে দুটি জিনিস লক্ষ্য করতে হবে। এক দিকে, দুঃস্থদের সংখ্যায় উপরে-নীচে ওঠা-নামা প্রতিফলিত করে শিল্প-চক্রের পর্যায়ক্রমিক উত্থান-পতন। অন্যদিকে, মূলধনের সঞ্চয়নের সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণী-সংগ্রাম এবং, সেই কারণে, শ্ৰমিক-শ্রেণী শ্রেণী-সচেতন যে-অনুপাতে বিকাশ লাভ করে, সেই অনুপাতে দুঃস্থতা সম্পর্কিত সরকারি পরিসংখ্যানও বেশি। বেশি করে বিভ্রান্তিকর হয়। দৃষ্টান্ত : দুঃস্থদের প্রতি আচরণে যে-বর্বরতা প্রদর্শন করা হয়, যার সম্পর্কে ব্রিটেনের পত্র-পত্রিকাগুলি (দি টাইমস, পল মল গেজেট) গত দুবছর তারস্বরে চীৎকার করেছে, তা প্রাচীন কালকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৮৪৪ সালে এফ, এঙ্গেলস ঠিক একই রকম ভয়ঙ্কর ঘটনা, ঠিক একই রকম “রোমাঞ্চ-সাহিত্য” সুলভ সাময়িক মামুলি হৈ চৈ-এর উদাহরণ দিয়ে ছিলেন। কিন্তু গত দশ বছর লণ্ডনে অনশনজনিত মৃত্যুর ভয়াবহ বৃদ্ধি নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে যে, যে-আতংকের মধ্যে শ্রমজীবী জনগণকে কর্মশালার গোলামি তথা দুর্দশার জন্য দণ্ড ভোগ করতে হয়, তা বেড়েই চলেছে।[১৪]

(খ) ব্রিটেনের শিল্প-শ্রমিক-শ্রেণীর অতি নিম্ন মজুরি-প্রান্ত বিভিন্ন স্তর

১৮৬২ সালের তুলা-দুর্ভিক্ষের কালে প্রিভি কাউন্সিল ডাঃ স্মিথকে দায়িত্ব দিয়েছিল ল্যাংকাশায়ার ও চেশায়ারের দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিকদের পুষ্টির অবস্থাদি সম্বন্ধে তদন্ত করতে। পূর্ববতী অনেক বছরের পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, “অনশনজনিত আধি-ব্যাধি নিবারণের জন্য একজন সাধারণ নারীর দৈনিক আহারে ১৮০ গ্রেন নাইট্রোজেনসহ অন্ততঃ ৩,৯০০ গ্রেন কার্বন থাকা দরকার। একজন সাধারণ পুরুষের ২০০ গ্রেন নাইট্রোজেনসহ অন্তত ৪,৩০০ গ্রেন কার্বন; নারীদের জন্য ২ পাউণ্ড ভাল গমের রুটিতে যে-পরিমাণ পুষ্টিকর উপাদান থাকে ততটা পুরুষদের জন্য আরো ২ ভাগ; বয়স্ক নারী ও পুরুষের জন্য সাপ্তাহিক গড় অন্ততঃ পক্ষে ২৮,৬০০ গ্রেন কার্বন এবং ১,৩৩০ গ্রেন নাইট্রোজেন। পুষ্টিকর খাদ্যের যে-শোচনীয় পরিমাণ তুলা-শ্রমিকেরা অভাবের চাপে খেতে বাধ্য হচ্ছিল, ডাঃ স্মিথের হিসাব আশ্চর্যজনক ভাবে তার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। ১৮৬২ সালের ডিসেম্বর মাসে পরিমাণ ছিল সপ্তাহে ২৯,২১১ গ্রেন কার্বন এবং ১,২৯৫ গ্রেন নাইট্রোজেন।

১৮৬৩ সালে প্রিভি কাউন্সিল ইংল্যাণ্ডের শ্রমিক-শ্রেণীর সবচেয়ে অপুষ্টি-পীড়িত অংশের দুর্দশা সম্পর্কে একটি তদন্তের আদেশ দেয়। প্রিভি কাউন্সিলের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ সাইমন এই কাজের জন্য মনোনীত করেন উক্ত ডাঃ স্মিথকে। তার তদন্তের পরিধিভুক্ত ছিল একদিকে কৃষি-শ্রমিকেরা এবং, অন্য দিকে রেশম-বয়নকারী, সূচী-কর্মে নিযুক্ত মহিলারা, দস্তানা-প্রস্তুতকারীরা মোজা-বয়নকারীরা ও পাদুকা প্রস্তুতকারীরা। তদন্তকার্য পরিচালনায় নিয়ম করে দেওয়া হয়েছিল যে, প্রত্যেকটি বর্গে সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান পরিবারগুলিকে এবং তুলনামূলক ভাবে যারা সর্বাপেক্ষা ভাল অবস্থায় আছে, তাদের অবস্থাই তদন্ত করা হবে।

সাধারণ ভাবে দেখা গিয়েছিল, অন্দরে কাজ করে এমন শ্রমিকদের যে-সব শ্রেণীকে পরীক্ষা করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে কেবল একটি শ্রেণীর ক্ষেত্রেই নাইট্রোজেনের গড় সরবরাহ ন্যূনতম পর্যাপ্ততার নির্ধারিত মাত্রা যৎসামান্য অতিক্রম করেছে এবং আরেকটি শ্রেণীর ক্ষেত্রে সেই মাত্রা প্রায় উপনীত হওয়া গিয়েছে [ এখানে পর্যাপ্ত মানে হল অনশন-জনিত আধি ব্যাধি নিবারণের পক্ষে পর্যাপ্ত ]; এবং দুটি শ্রেণীর ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে গিয়েছে। একটিতে বিরাট ঘাটতি-নাইট্রোজেন ও কার্বন, উভয়েরই। তা ছাড়া, কৃষি-জনসংখ্যার সমীক্ষাভুক্ত পরিবারগুলির ক্ষেত্রে দেখা গেল, তাদের মধ্য এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি পায় কার্বনযুক্ত খাদ্যের নির্ধারিত মাত্রার কম, এক তৃতীয়াংশেরও বেশি পায় নাইট্রোজেনযুক্ত খাদ্যের নির্ধারিত মাত্রার কম এবং তিনটি কাউন্টিতে (বার্কশায়ার, অক্সফোর্ডশায়ার এবং সমারসেটশায়ার-এ) নইেট্রোজেন খাদ্যের অপ্রতুলতাই হল স্থানীয় আহার্যের গড় বৈশিষ্ট্য।[১৫] কৃষি-শ্রমিকদের মধ্যে, যুক্তরাজ্যের সর্বাপেক্ষা বিত্তশালী অংশ যে ইংল্যাণ্ড, সেই ইংল্যাণ্ডেবই কৃষি-শ্রমিকেরা হল সবচেয়ে স্বল্পভুক্ত।[১৬] কৃষি-শ্রমিকদের মধ্যে খাদ্যের এই অনটনের দুর্ভোগ প্রধানতঃ সহ্য করতে হয় নারী ও শিশুদের, কেননা যাতে সে কাজ করতে পারে, তার জন্য পুরুষ মানুষকে অবশ্যই খেতে হবে।” এ থেকেও আরো বেশি অভাব-অনটন বিধ্বস্ত করে দিচ্ছিল শহরের শ্রমিকদের। তারা এত স্বল্পভুক্ত যে নিশ্চিত ভাবেই তাদের মধ্যে রয়েছে কঠোর ও ক্ষতিকর কচ্ছ-সাধনের অনেক দৃষ্টান্ত।[১৭] (এই সবই তো ধনিকে কৃচ্ছসাধন। অর্থাৎ তার “হাতগুলি”-কে কেবল সজীব রাখার জন্য নিছক প্রাণধারণের যে-নূ্যনতম উপকরণসমূহ পরম প্রয়োজন, সেগুলি জন্য তদুপযোগী ব্যয়-সংস্থান থেকে “আত্ম সংবরণ”)।

বিশুদ্ধ শহরবাসী শ্রমজীবী জনগণের উল্লিখিত বর্গগুলির পুষ্টিকর খাদ্য-গ্রহণের পরিস্থিতি নিম্ন-প্রদত্ত সারণী থেকে পাওয়া যায়; ডাঃ স্মিথ যে-ন্যনতম পুষ্টিকর খাদ্য পরিমাণের কথা বলেছেন, এবং সর্বাধিক দুর্দশার সময়ে তুলা-কল-কর্মীদের যে খাদ্য ভাতা দেওয়া হয়েছিল, তার সঙ্গে এটা তুলনীয়।

ছবি। পেজ ৩৯০

সমীক্ষাভুক্ত শিল্প-শ্রমিক বর্গগুলির অর্ধেক বা ৬৫/১২৫ ভাগের ক্ষেত্রে কোন ‘বিয়ার ছিল না, ২৮ শতাংশের ক্ষেত্রে ছিল না কোনো দুধ। পরিবারগুলিতে তরলজাতীয় পুষ্টিকর পদার্থের সাপ্তাহিক গড় সূচী-কর্মে নিযুক্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে ৭ আউন্স থেকে মোজা তৈরির কাজে নিযুক্ত কর্মীদের ২৪.৭৫ আউন্স পর্যন্ত কম-বেশি হয়। যার দুধ পেত না, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই হল লণ্ডনের সূচী-কর্মী মহিলারা। রুটির পরিমাণ কম-বেশি হয় সূচী-কর্মী মহিলাদের বেলায় ৭.৭৫ পাউণ্ড থেকে জুতো-প্রস্তুতকারীদের বেলায় ১১.৫ পাউণ্ড পর্যন্ত, বয়স্ক লোকদের মাথাপিছু সাপ্তাহিক গড় দাড়ায় ৯.৯ পাউণ্ড। চিনি ( ঝোলা গুড়, ইত্যাদি) দস্তানা-প্রস্তুতকারকদের জন্য সপ্তাহে ৪ আউন্স থেকে মোজা প্রস্তুতকারকদের জন্যে ১১ আউন্স পর্যন্ত কম-বেশি হয়; সকল বর্গের বয়স্ক শ্রমিকদের জন্য মোট সাপ্তাহিক গড় মাথাপিছু পরিমাণ ৮ আউন্স। বয়স্কদের জন্য মাখনের (চর্বি ইত্যাদির মাথাপিছু সাপ্তাহিক গড় ৫ আউন্স। মাংসের (শূকর ইত্যাদির ) সাপ্তাহিক গড়ে পার্থক্য হত রেশম-বয়নকারীদের ক্ষেত্রে ৭.২৫ আউন্স থেকে দস্তানা-প্রস্তুতকারকদের জন্য ১৮.২৫ আউন্স; বিভিন্ন বর্গের জন্য মোট গড় ১৩.৬ আউন্স। বয়স্ক লোক-পিছু খাদ্যের জন্য সাপ্তাহিক ব্যয়ের গড় পরিমাণ এই রকম : রেশম-বয়নকারী ২ শি. ২২ পে, সূচী-কর্মী মহিলা শি. ৭ পে, দস্তানা-প্রস্তুতকারক ২ শি. ৯.৫ পে, জুতা-প্রস্তুতকারক ২ শি. ৭.৭৫ পে, মোজা-প্রস্তুতকারক ২ শি. ৬.২৫ পে। ম্যাকৃফিডের রেশম-বয়নকারীদের ক্ষেত্রে এই গড় মাত্র ১ শি ৮.৫ পে। সবচেয়ে খারাপ দশা ছিল সূচী-কর্মী মহিলা, রেশম-বয়নকারী এবং দস্তানা-প্রস্তুতকারীদের।[১৯] এই সব তথ্য প্রসঙ্গে ভাঃ সাইমন তার সাধারণ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিবেদন’-এ লিখেছেন,  “ব্যাধির কারণ বা তার বৃদ্ধির কারণ যে ত্রুটিযুক্ত খাদ্য, তা যে-কেউ যিনি গরিব আইনের তালিকাভুক্ত ডাক্তারদের চিকিৎসা সম্পর্কে কিংবা হাসপাতালগুলির অন্দরেরও বাইরের রোগীদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত, তিনিই তা সমর্থন করবেন। ….. তবু এই প্রসঙ্গে, আমার মতে, একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পটভূমিকা সংযোজন করতে হবে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, খাদ্য সম্পর্কে কৃচ্ছতা মানুষ বিষম ক্ষোভের সঙ্গে সহ করে, এবং সাধারণ নিয়ম এই যে, খাদ্য সম্পর্কে বিষম কৃচ্ছতা মানুষ ভোগ করে কেবল অন্যান্য বিষয়ে কৃচ্ছতা ভোগের পরেই। খাদ্যের স্বল্পতা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা হিসাবে দেখা দেবার অনেক আগেই, জীবন ও অনশনের মধ্যস্থলে অবস্থানকারী নাইট্রোজেন ও কার্বনের গ্রেনগুলি গুনে দেখার প্রয়োজন শরীর-বিদ্যাবিদের মাথায় দেখা দেবার অনেক আগেই, নিশ্চয়ই পরিবারটি সব রকমের বৈষয়িক সচ্ছলতা থেকে সম্পূর্ণ রিক্ত হয়ে গিয়েছেন; কাপড়-চোপড় ও জ্বালানি নিশ্চয়ই খাবারের তুলনায় আরো বিরল হয়ে পড়েছে আবহাওয়ার প্রতিকূলতা থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়েছে, থাকবার জায়গা নিশ্চয়ই এতটা সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে যে ঠাসাঠাসি করে থাকার ফলে রোগের প্রাদুর্ভাব বা প্রকোপ ঘটেছে; সংসারের দৈনন্দিন ব্যবহারের বাসন-কোসন ও আসবাব-পত্র সম্ভবত আর অবশিষ্ট নাই—এমনকি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার ব্যয়ও হয়ে পড়েছে সাধ্যাতীত বা কষ্টসাধ্য, এবং যদি তা রক্ষার জন্য আত্ম মর্যাদাকর কোনো প্রচেষ্টা করা হয়, তা হলে এমন প্রত্যেকটি প্রচেষ্টার সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে ক্ষুধার যন্ত্রণা। বাড়ি হবে সেখানেই, যেখানে আশ্রয় পাওয়া যায় সবচেয়ে সস্তায় -এমন সব পল্লীতে যেখানে স্বাস্থ্য-বিভাগের তদারকির পরিচয় মেলে সবচেয়ে কম, নর্দমা ইত্যাদির ব্যবস্থা সবচেয়ে কম, মেথরের কাজ সবচেয়ে কম, আবর্জনা-সাফাই সবচেয়ে কম, জল সরবরাহ সবচেয়ে কম বা সবচেয়ে খারাপ এবং, যদি শহরাঞ্চলে হয়, তা হলে আলো-হাওয়াও সবচেয়ে কম। যেখানে অভাব এই মাত্রায় উপনীত যে খাদ্যের পর্যন্ত অভাব ঘটেছে, সেখানে দারিদ্র্য প্রায় অবধারিত ভাবেই এই সব বিপদে আক্রান্ত। এবং যখন সেগুলির মোট যোগফল জীবনের বিরুদ্ধে ভয়ংকর আকার ধারণ করে, তখন কেবল খাদ্যের স্বল্পতা পর্যবসিত হয় একটি গুরুতর ব্যাপারে।……এই পরিস্থিতি ভাবতেও কষ্ট হয়, যখন মনে করা যায় যে, এই দারিদ্র্য যা তারা ভোগ করে, তা তাদের আলস্যজনিত যথাপ্রাপ্য দারিদ্র্য নয়। সমস্ত ক্ষেত্রেই এই দারিদ্র্য হল অমরত জন সংখ্যার দারিদ্র্য। বস্তুত পক্ষে, কর্মশালার অন্দরকর্মীরা যে-কাজের বিনিময়ে তাদের সামান্য খাদ্যের খয়রাত পায়, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অত্যধিক মাত্রায় দীর্ঘায়িত করা হয়। তবু এটা সুস্পষ্ট যে, কেবল সীমাবদ্ধ অর্থেই এই কাজকে স্বয়ম্ভর বলে গণ্য করা যায়। এবং এই নামমাত্র স্বয়ম্ভরতা এক অতি বৃহৎ আয়তনে কেবল দুস্থতায় উপনীত হবার পথ-পরিক্রমা মাও হতে পারে কখনো তা হ্রস্ব, কখনো দীর্ঘ। [২০]

এক দিকে, শ্রমিক শ্রেণীর সর্বাপেক্ষা পরিশ্রমী স্তরগুলির ক্ষুধার যন্ত্রণা এবং অন্য দিকে, বিত্তবানদের অপরিমেয় পরিভোগ, শালীন ও অশালীন পরিভোগ, যার ভিত্তি হচ্ছে ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়ন—এই দুযের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান, তা নিজেকে প্রকাশ করে কেবল তখনি, যখন অর্থনৈতিক নিয়মগুলি আমাদের জানা হয়ে যায়। “গরিবদের আবাসন”-এর ব্যাপারটা অন্য রকম। প্রত্যেক নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক দেখতে পান যে, উৎপাদনের উপায়সমূহ যত বেশি কেন্দ্রীভূত হয়, তদনুযায়ী ততই একটি নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে শ্রমিকেরা পীকৃত হয়; সুতরাং, ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়ন যত বেশি দ্রুত হয়, শ্রমিকদের বাসস্থানগুলিও হয় তত বেশি শোচনীয়। শহর-“উন্নয়ন”-এর সঙ্গে সঙ্গে চলে বাজে ভাবে তৈরি করা ‘কোয়াটার্স’-গুলি ভেঙে দিয়ে ব্যাংক, গুদাম ইত্যাদির জন্য প্রাসাদ নির্মাণ, ব্যবসায়িক পণ্য-পরিবহন, বিলাসবহুল শকট চলাচল এবং ট্রামগাড়ি প্রবর্তনের জন্য রাস্তাঘাটের প্রশস্তকরণ ইত্যাদি আর তার ফলে শ্রমিকেরা বিতাড়িত হয় আরো খারাপ, আরো ঘিঞ্জি সব আস্তানায়। অপর পক্ষে, প্রত্যেকেই এটা জানেন যে, বাসস্থানের দুষ্প্রাপ্যতা এবং তার উৎকৃষ্টতা বিপরীত অনুপাতে চলে এবং বাড়ি ঘরের ফটকাবাজরা এই দুঃখের খনিগুলিকে এমনকি পটোসির খনিগুলির চেয়েও আরো বেশি মুনাফায় বা আরো কম খরচে শোষণ করে। ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের এবং, স্বভাবতই, সাধারণ ভাবে ধনতান্ত্রিক সম্পত্তি সম্পর্ক-সমূহের স্ব-বিরোধী চরিত্র[২১] এক্ষেত্রে এত প্রকট যে, এমনকি এই বিষয়-সম্বন্ধে ইংল্যাণ্ডের সরকারি রিপোর্টগুলি পর্যন্ত নিজেদের রীতি নীতি ভেঙ্গে সম্পত্তি ও তার অধিকার”-এর উপরে আক্রমণে প্রবৃত্ত হয়েছে। শিল্পের বিকাশ-লাভের সঙ্গে সঙ্গে, মূলধনের সঞ্চয়নের সঙ্গে সঙ্গে, শহর-“উন্নয়নের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে, এই পাপটি এমন বিস্তার লাভ করল যে, সংক্রামক ব্যাধি-যা “মাননীয়তা কেও মান্য করে না তার নিছক ভয়ই ১৮৪৭ থেকে ১৮৬৪ সালের মধ্যে সংসদীয় স্বাস্থ্য-সংরক্ষণ সম্পর্কে অন্তত দশ দশটি আইনের জন্ম দিল; এবং লিভারপুল, গ্লাসগো-র মত কয়েকটি শহরের ভীত-সন্ত্রস্ত বুর্জোয়ারা তাদের পৌর সংস্থানগুলির মাধ্যমে বিবিধ আয়াসসাধ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করল। যাই হোক, ডাঃ সাইমন তার ১৮৬৫ সালের রিপোর্টে লিখলেন, “সাধারণ ভাবে বলা যায়, এই পাপ এখন ইংল্যাণ্ডে অনিয়ন্ত্রিত।” প্রিভি কাউন্সিলের নির্দেশ ১৮৬৪ সালে কৃষি-শ্রমিকদের আবাসনের অবস্থা সম্পর্কে এক তদন্ত হয়, ১৮৬৫ সালে হয় শহরের দরিদ্রতর শ্রেণীগুলির আবাসনের অবস্থা সম্পর্কে। ডাঃ জুলিয়ান হান্টারের প্রশংসনীয় কাজের ফলাফল জন-স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সপ্তম (১৮৬৫) এবং অষ্টম (১৮৬৬) রিপোর্ট দুটিতে পাওয়া যায়। কৃষি-শ্রমিকদের বিষয়ে আমি পরে আসব। শহরের বাসস্থানগুলি সম্পর্কে আমি ডাঃ সাইমনের একটি সাধারণ মন্তব্যকে ভূমিকা হিসাবে উদ্ধত করব। তিনি বলেন, “যদিও আমার সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি একান্ত ভাবেই দেহগত, তবু সাধারণ মানবিকতা দাবি করে যে এর অন্য দিকটিও উপেক্ষা করা উচিত হবে না। বেশি ভিড় করে থাকার প্রায় অবধারিত ফলই হল সমস্ত শ্লীলতার এমন অবলুপ্তি, দেহ ও দৈহিক কাজকর্মের এমন উচ্ছঙ্খলা, জৈব ও যৌন নগ্নতার এমন উলঙ্গ প্রকাশ যে তাকে মানবিক না বলে পাশবিক বলাই উচিত। ঐসব প্রভাবের অধীনে অবস্থান এমনি একটা অধঃপতন, যা যাদের উপরে সেইগুলি কাজ করকে থাকে, তাদের আরো আবো নীচে নামিয়ে দেয়। এর অভিশাপের ছায়ায় যে-শিশুরা জন্মায়, তাদের কাছে এটা হয় কলংকিত জীবন-যাপনে দীক্ষাস্বরূপ। এবং এই পরিস্থিতিতে যারা বাস করে, তারা কোনো কালে অন্য কোনো দিকে সভ্যতার পরিবেশের জন্য যার মর্মবস্তুই হল দৈহিক ও নৈতিক পরিচ্ছন্নতার জন্য আকাঙ্খ পোষণ করবে, এমন একটা আশা সর্বতোভাবেই দুরাশা।” [২২]

মানুষের পক্ষে একেবারে অনুপযুক্ত ঠাসাঠাসি বাসা-বসতির ব্যাপারে লণ্ডনের স্থান সবার আগে। ডাঃ হান্টার বলেন, “দুটি ব্যাপারে তার উপলব্ধি পরিষ্কার; প্রথমত, লণ্ডনে এমন ২০টি বিরাট কলোনি’ (‘বসতি’) আছে, যেগুলির প্রত্যেকটিতে থাকে ১০,০০০ করে মানুষ এবং যেগুলির শোচনীয় অবস্থা ইংল্যাণ্ডের অন্য যে-কোনো অঞ্চলে তাঁর দেখা দুরবস্থাকে ছাড়িয়ে যায় এবং যে-অবস্থার জন্য সম্পূর্ণ ভাবেই দায়ী এখানকার নিকৃষ্ট আবাসন-ব্যবস্থা; এবং দ্বিতীয়তঃ, এই কলোনি’-গুলির বাড়ি-ঘরগুলির ভিড়ে ভরা ও ভাঙ্গাচোর। অবস্থা ২০ বছর আগেকার অবস্থা থেকেও ঢের খারাপ।[২৩] একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, লণ্ডনের কোন কোন অংশে জীবন নারকীয়। [২৪]

অধিকন্তু, যে-অনুপাতে “উন্নয়ন” এবং তার সঙ্গে পুরনো রাস্তা ও বাড়ি-ভাঙ্গার কাজ অগ্রসর হয়, মহানগরে কল-কারখানা ও জন-প্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং জমির খাজনা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়িভাড়াও বৃদ্ধি পায়, সেই অনুপাতে ছোট দোকানদার ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন অংশ এই জঘন্য অভিশাপের অধীনে আনীত হয়। ভাড়া এত বেড়ে গিয়েছে যে, খুবই নগণ্য সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ একটি ঘরের বেশি ভাড়া বহন করতে পারে।[২৫] লণ্ডনে এমন কোনো বাড়ি নেই, যা এক গাদা দালালের দ্বারা ভারাক্রান্ত নয়। যেহেতু লণ্ডনে জমির দাম তার বার্ষিক আয়ের তুলনায় সব সময়েই অনেক বেশি, সেই হেতু প্রত্যেক ক্রেতাই আবার জুরি-নির্দিষ্ট দামে (জুরির সদস্যদের দ্বারা নির্ধারিত স্বত্বান্তর-মূল্য অনুসারে ) তা থেকে অব্যাহতি পাবার, কিংবা কোন বিরাট প্রতিষ্ঠানের নিকটবর্তী অবস্থানের দরুন অস্বাভাবিক ভাবে বর্ধিত মূল্য হস্তগত করার, ফটকাবাজিতে লিপ্ত থাকে। এর ফলে সেখানে সব সময়েই লীজ-এর অন্তপর্ব” ক্রয়ের ব্যাপারে নিয়মিত একটা ব্যবসা চলে। “এই ব্যবসায়ে লিপ্ত ভদ্রলোকেরা, তাদের কাছ থেকে ন্যায্যতঃ যা আশা করা যায়, তাই করেন—ভাড়াটেদের যখন হাতে পান, তখন তাদের কাছ থেকে যত বেশি পারেন, আদায় করে নেন এবং তাদের উত্তরাগতদের জন্য যত কম পারেন, রেখে যান।”[২৬]

ভাড়া দেওয়া হয় সাপ্তাহিক ভিত্তিতে, এবং এই ভদ্রলোকেরা কোনো ঝুকিই নেন না। মহানগরে রেলপথ নির্মাণের ফলে, “ইস্ট-লণ্ডনে সম্প্রতি একটা দৃশ্য দেখা গিয়েছে —দুঃস্থ-নিবাস ছাড়া আর কোনো আশ্রয় না থাকায়, তাদের সামান্য যা কিছু পার্থিব সম্পত্তি আছে, তাই পিঠে নিয়ে কিছু সংখ্যক পরিবার শনিবার রাতে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।[২৭] দুঃস্থ-নিবাসগুলি ইতিমধ্যেই অতিরিক্ত ভিড়ে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। এবং পার্লামেন্ট যে-“উন্নয়ন পরিকল্পনা মঞ্জুর করেছে, তার কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। তাদের পুরনো ঘর-বাড়িগুলি ভেঙে দেবার ফলে শ্রমিকের বিতাড়িত হলেও তারা তাদের যাজক-পল্লী ছেড়ে যায় না, বড় জোর, তারা তার সীমানায় বসতি স্থাপন করে—যত কাছে পারে, তত কাছে। “অবশ্য, তারা তাদের কারখানার যথাসম্ভব সন্নিকটে থাকতে চেষ্টা করে। অধিবাসীরা একই যাজক-পল্লীর কিংবা পরবর্তী যাজক-পল্লীর বাইরে যায় না তাদের দু-ঘরের ভাড়া-বাসাগুলিকে একটি করে ঘরে ভাগ করে নিতে হলেও, এমনকি সেগুলিতে গাদাগাদি করে থাকতে হলেও। …….এমনকি বেশি ভাড়াতেও, স্থানচ্যুত মানুষেরা তাদের ছেড়ে-আসা সামান্য আয়টির মত ভাল আশ্রয় পাবে না।…….স্ট্রা-এর অর্ধেক শ্রমিক দু-মাইল হেঁটে তাদের কাজে যায়।[২৮] এই যে স্ট্রাণ্ড, একটি প্রধান রাজপথ, যা আগন্তুকদের কাছে তুলে ধরে লণ্ডনের ঐশ্বর্যের এক মনোমুগ্ধকর চিত্র, তাই আবার সেই শহরের মানুষদের গাদাগাদি করে থাকার একটা নমুনা হিসাবে কাজ করতে পারে। হেথ, অফিসারের হিসাবে দেখা যায়, যাজক-পল্লীগুলির একটিতে একর পিছু ৫৮১ জন লোক বাস করে, যদিও টেমস নদের প্রস্থের অর্ধেকটা হিসাবে ধরা হয়েছে। এটা আপনা-আপনিই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত প্রত্যেকটি ব্যবস্থা, বাসের অযোগ্য বাড়িগুলিকে ভেঙে দিয়ে, কেবল শ্রমিকদের এক কোয়ার্টার থেকে তাড়িয়ে নিয়ে আরেক কোয়ার্টারে আরো গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য করে, যেমন লণ্ডনে হয়েছে। ডাঃ হান্টার বলেন, “হয়, এই সমস্ত কার্যক্রম একটা অসম্ভব ব্যাপার হিসাবে বন্ধ হয়ে যাবে, আর, নয়তে, সর্বজনিক অনুকম্পাকে এমন এক কর্তব্য সাধনে—যাকে ‘জাতীয়’ বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না-তেমন এক সাধনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যাতে, যারা তাদের মূলধন নেই বলে নিজেদের মাথার উপরে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে পারেনা, কিন্তু দফায় দফায় টাকা দিয়ে তার দাম শোধ করে দিতে পারে, তাদের জন্য আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করা হয়।”[২৯] ধনতান্ত্রিক ন্যায়-বিচারকে প্রশংসা করুন। রেলপথ, নোতুন নোতুন রাস্তা নির্মাণ, ইত্যাদি “উন্নয়ন”-কার্যের দ্বারা যখন জমির মালিক বাড়ির মালিক বা ব্যবসায়ী উৎখাত হয়, তখন সে কেবল পুরো ক্ষতিপূরণই পায়না। এই বাধ্যতামূলক ভোগ-সংবরণের দরুন সে মানবিক ও ঐশ্বরিক বিধানের বলে পাবে সেই ক্ষতিপূরণের উপরেও একটা অতিকায় মুনাফা। অন্য দিকে, শ্রমিক তার স্ত্রী ও সন্তান ও জিনিসপত্র সহ নিক্ষিপ্ত হয় রায় আর যদি সে বিপুল সংখ্যায় ভিড় করে শহরের সেই কোয়ার্টারগুলির দিকে, যেখানে কর্মচারীরা শালীনতা বজায় রাখার জন্য তৎপর থাকে, তা হলে স্বাস্থ্যবিধি সংরক্ষণের নামে অভিযুক্ত করা হয় !

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে লণ্ডন ছাড়া ইংল্যাণ্ডে আর এমন একটিও শহর ছিল না, যার জনসংখ্যা ১০,০০০-এর বেশি; কেবল পাঁচটি শহর ছিল, যাদের জনসংখ্যা ছিল ৫০,০০০-এর বেশি। এখন ৫০, ০০-এর বেশি জনসংখ্যার বাস, এমন শহরের সংখ্যা ২৮টি। এই পরিবর্তনের ফল কেবল এই নয় যে শহরবাসী লোকের শ্রেণী বিপুল ভাবে বৃদ্ধি পেল, উপরন্তু পুরনো ঘন-সংবদ্ধ ছোট ঘোট শহরগুলি পরিণত হল এমন সব কেন্দ্রে, যাদের সব দিকে ঘিরে গড়ে উঠল ইমারত, কোনো দিক খোলা রইল না হাওয়ার জন্য, এবং যেগুলি ধনীদের কাছে আর আরামপ্রদ না থাকায় তারা সেগুলিকে পরিত্যাগ করে সরে গেল মনোরম উপকণ্ঠে। এই সব ধনী ব্যক্তির পরে যারা এল, তারা বড় বড় বাড়িগুলিতে দখল পেল কামরা-পিছু একটি করে পরিবার হিসাবে […এবং দুজন বা তিনজন করে আবাসিকের স্থান-সংস্থান করল…]; এবং এইভাবে সৃষ্টি হল এমন একটি জনসমষ্টি, যাদের জন্য ঐ বাড়িগুলি তৈরিও হয়নি এবং যেগুলি তাদের জন্য আদৌ উপযুক্তও নয়, আর যেগুলিকে ঘিরে গড়ে উঠল এমন একটি পরিবেশ, বয়স্কদের পক্ষে যা চরিত্রহানিকর এবং শিশুদের পক্ষে যা সর্বনাশা।[৩০] মূলধন যত দ্রুত গতিতে একটি শিল্প-শহরে বা বানিজ্য শহরে সঞ্চয়ীকৃত হয়, শোষণ যোগ্য মানবিক সামগ্রীর স্রোত তত দ্রুত গতিতে প্রবাহিত হয়, শ্রমিকদের তাৎক্ষণিক প্রস্তুত আস্তানাগুলি তত শোচনীয় হয়।

কয়লা ও লোহার ক্রমবর্ধমান উৎপাদনশীলতা-সমন্বিত একটি জিলার কেন্দ্রস্বরূপ নিউক্যাস-অনটাইন-এর স্থান আবাসন-ব্যবস্থার নারকীয়তার বিচারে লণ্ডনের ঠিক পরেই। একটি করে কামরায় বাস করে এমন লোকের সংখ্যা সেখানে ৩৪,০০০-এর কম নয়। সমাজের পক্ষে সাংঘাতিক বিপজ্জনক বলে গণ্য হওয়া সম্প্রতি নিউক্যাল ও গেটসহেড-এ বিপুল সংখ্যায় বাড়ি-ঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, ১৮৬৫ সালে শহরটি এমন জনাকীর্ণ ছিল যা আর কখনো হয়নি। নিউক্যাসল্ ফিভার হসপিটাল’-এর ডাঃ এম্বেলটন বলেন, “এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে ‘টাইফাস’ অরের অব্যাহত প্রকোপ ও প্রসারের বিরাট কারণটি হল মানুষের অত্যধিক ভিড় এবং বাসস্থানের অপরিচ্ছন্নতা। যে-সব কামরায় শ্রমিকের বাস করে, অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলি রুদ্ধ ও ক্ষতিকর চত্বরে বা অঙ্গনে অবস্থিত এবং আলো, হাওয়া পরিসর ও পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে অপ্রতুলতা ও অস্বাস্থ্যকরতার আদর্শ এবং যে-কোনো সভ্য সমাজের পক্ষে কলংকস্বরূপ; লোকগুলি সম্পর্কে বলা যায়, দিনের শিফট-এর পিছে আসে রাতের শিফট আর রাতের শিফটের পিছে দিনের শিফট-এই ভাবে অবিচ্ছিন্ন ভাবে চলে বেশ কিছু কাল, বিছানাগুলো ঠাণ্ডা হবার পর্যন্ত সময় পায়না; গোটা বাড়ির জলের ব্যবস্থা খুবই খারাপ, পায়খানার ব্যবস্থা আরো খারাপ-ননাংরা, আলো বাতাসহীন, ন্যক্কারজনক।[৩১] এই ধরনের আস্তানার সপ্তাহ-পিছু ভাড়া হল ৮ পেন্স থেকে ৩ শিলিং পর্যন্ত। ডাঃ হান্টার বলেন, “নিউক্যাস-অন-টাইন শহরটিতে রয়েছে আমাদেরই দেশবাসী একটি চমৎকার উপজাতি-বাসা ও রাস্তার মত বাহ ঘটনাগুলি যাদের ডুবিয়ে রেখেছে প্রায় বর্বরতার অধঃপাতিত অবস্থায়।” [৩২]

মূলধন ও শ্রমের জোয়ার-ভাটার দরুন কোন শিল্প-শহরের আবাসন-পরিস্থিতি আজকে অসহনীয়, কালকে সহনীয় হতে পারে। কিংবা শহরের প্রশাসক কর্তৃপক্ষ এইসব সাংঘাতিক অব্যবস্থাগুলি অপসারণের জন্য তৎপরতা দেখাতে পারে। কালকেই। আবার পঙ্গপালের মত দলে দলে ধেয়ে আসবে ছিন্ন-বস্তু-পরিহিত আইরিশ বা জীর্ণ শীর্ণ-দেহ ইংরেজ কৃষি-শ্রমিকেরা। তাদের গুদামজাত করা হবে মাটির তলার কুঠরি বা মাথার উপরের খুপরিগুলিতে, কিংবা এতকাল যা ছিল শ্রমিকদের চলনসই বাসা বাড়ি, তাকেই রূপান্তরিত করা হয় সাময়িক অবস্থানের ভাড়াটে আস্তানায়, যে আস্তানাগুলির লোজনের তিরিশ বছরের যুদ্ধের ছাউনিগুলির সৈন্যদের চেয়েও তাড়াতাড়ি বদল হয়ে যায়। নমুনা: ব্রাডফোর্ড (ইয়র্কশায়ার)। সেখানকার পৌর ফিলিস্তিনটি কেবল ব্যস্ত থাকত শুধুমাত্র শহরের উন্নয়ন নিয়ে। তা ছাড়া, ব্রাডফোর্ডে ১৮৬১ সালেও ছিল ১,৭৫১টি এমন বাড়ি, যেগুলিতে কোনো বাসিন্দা ছিল না। কিন্তু এখন এল শিল্প-বাণিজ্যের সেই পুনর্জাগরণ যা নিয়ে সম্প্রতি এত মধুর ভাবে চেঁচামেচি করলেন নিগ্রো বন্ধু, বিনম্র উদারনীতিকে (লিবারল) মিঃ ফস্টার। শিল্প-বাণিজ্যের পুনর্জাগরণের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই এল চির-হ্রাস-বৃদ্ধিশীল সংরক্ষিত বাহিনী”-র বা “আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার ঢেউ থেকে উপচে পড়া জন-প্লাবন। একটি বীমা কোম্পানির এজেন্টের কাছ থেকে ডাঃ হান্টার পুঞ্জীভূত কুঠরি-আশ্রয়ের যে-তালিকা পেয়েছিলেন, সেগুলির অধিবাসী ছিল ভাল-আয়ের শ্রমিকেরা। তারা ঘোষণা করেছিল যে, যদি ভাল বাসস্থান পাওয়া যায়, তা হলে তারা বেশি ভাড়া দিতে রাজি আছে। ইতিমধ্যে তাদের অবনতি ঘটল, তারা একে একে সকলে অসুখে পড়ল এবং অন্য দিকে, আমাদের বিনম্র উদার নীতিক, সংসদ-সদস্য মিঃ ফস্টার অবাধ বাণিজ্যের আশীর্বাদ এবং উলের কারবারে লিও ব্রাডফোর্ডের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মুনাফার উপরে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। ১৮৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের রিপোর্টে ব্রাডফোর্ডের গরিব আইন’-এর ডাক্তারদের মধ্যে একজন, ডাঃ বেল তার জরাক্রান্ত রোগীদের ভয়াবহ মৃত্যু-হারের কারণ হিসাবে নির্দেশ করেন বাসস্থানের অবস্থাকে। ১৫০০ কিউবিক ফুটের একটি ছোট ভূগর্ভস্থ কুঠরিতে বাস করে দশ জন ব্যক্তি। ভিমেন্ট স্ট্রিট, গ্রীন এয়ার প্লেস এবং লেইজ-এ রয়েছে ২২৩টি বাড়ি, যাদের অধিবাসী-সংখ্যা ১,৪৫৩, বিছানা ৪৩৫ এবং পায়খানা ৩৬টি। বিছানা বলতে আমি এখানে ধরছি নোরা ন্যাকড়ার যে-কোনো পুটলি বা সামান্য কিছু চোকলা, এমন এক-একটি বিছানাপিছু রয়েছে গড়ে ৩৩ জন করে লোক; কিছু সংখ্যক বিছানা-পিছু আছে ৫ ৬ জন; এবং আমি শুনলাম, কিছু লোকের বিছানা বলতে একেবারে কিছুই নেই। তারা শোয় তাদের মামুলি পোশাকে খালি তক্তার উপরে—যুবক-যুবতী, বিবাহিত-অবিবাহিত, সকলে একসঙ্গে। বলা বাহুল্য, এই কুঠরিগুলির বেশির ভাগই অন্ধকার, স্যাতসেতে, কদর্য, দুর্গন্ধপূর্ণ কূপ বিশেষ—মানুষের বাসের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযোগী; ঠিক এই কেন্দ্রগুলি থেকেই জন্ম নেয় রোগ ও মৃত্যু, যা ছড়িয়ে পড়ে তাদের মধ্যে যারা আছে উন্নততর অবস্থানে এবং এদেরকে এই ভাবে পচতে দিয়েছে আমাদের মধ্যে। [৩৩]

 বাসস্থানের শোচনীয় দুরবস্থায় ব্রিস্টলের স্থান লণ্ডনের পরে তৃতীয়। “ব্রিস্টল যেখানে প্রত্যক্ষ হয় ইউরোপের সমৃদ্ধতম শহরের চরম দারিদ্র্য ও পারিবারিক দুর্দশার বিপুল বিস্তার।” [৩৪]

(গ) যাযাবর জনসংখ্যা

আমরা এখন এমন এক শ্রেণীর মানুষের দিকে মনোযোগ দেব যারা মূলতঃ ছিল কৃষিজীবী কিন্তু যাদের পেশা এখন বহুলাংশে শিল্পগত। তারা হচ্ছে মূলধনের লঘুভার পদাতিক-বাহিনী, মূলধনের প্রয়োজনমত যাদের নিক্ষেপ করা হয় কখনো এখানে, কখনো সেখানে। যখন তারা চলমান নয়, তখন তারা “তাবু খাটায়”। যাযাবর এমকে নিয়োগ করা হয় বাড়ি নির্মাণ, জল-নিস্কাশন, ইট-তৈরি, চুন-পোড়ানো, রেলপথ বানানো ইত্যাদি নানা কাজে। মহামারীর একটি চলন্ত বাহিনী, এই যাযাবর শ্রম যেখানেই বয়ে নিয়ে যায় বসন্ত, টাইফাস, কলেরা, সংক্রামক অর ইত্যাদি।[৩৫] রেলপথের মত যে-সব উদ্যোগে বিপুল পরিমাণ মূলধন নিয়োগের প্রয়োজন হয়, সেখানে ঠিকাদার নিজেই তার বাহিনীর জন্য কাঠের কুঁড়েঘর ইত্যাদির ব্যবস্থা করে এবং এইভাবে স্থানীর পর্ষদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গজিয়ে ওঠে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ব্যবস্থাবলীর কোনো সংস্থান ছাড়াই গ্রাম আর গ্রাম, যেগুলি ঠিকাদারের পক্ষে হয় খুবই মুনাফাজনক, কারণ সে শ্রমিক শোষণ করতে থাকে দুভাবে প্রথমত, শিল্পের সৈনিক হিসাবে এবং, দ্বিতীয়ত, ভাড়াটে হিসাবে। কাঠের কুঁড়েঘর গুলির যেটায় যতসংখ্যক খুপরি, ১, ২, বা ৩, সেটার ভাড়াও তেমনি সাপ্তাহিক ১, ৩ বা ৪ শিলিং।[৩৬] একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। ১৮৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভাঃ সাইমন রিপোর্ট করেন, সেভেনোক নামক ‘প্যারিশ’-এর (যাজক পল্লী’র আবর্জনা অপসারণ কমিটির সভাপতি স্বরাষ্ট্রসচিব স্যার জর্জ গ্রের কাছে নিম্নলিখিত নিন্দাপত্র পাঠিয়েছেন, “প্রায় বারো মাস আগে পর্যন্ত এই প্যারিশে বসন্ত বগের কথা খুবই কদাচিৎ শোনা যেত। তার কিছুকাল আগে লিউইস থেকে টানব্রিজ পর্যন্ত একটি রেলপথের কাজকর্ম এখানে আরম্ভ হয়, এবং প্রধান কর্মশালাটি এই শহরের একেবারে গায়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছাড়াও, এখানে স্থাপন করা হয় এই গোটা কর্মকাণ্ডটির মাল-গুদাম, যার ফলে স্বভাবতই এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এখানে কর্মনিযুক্ত হয়। যেহেতু কটেজগুলিতে সকলের জন্য আবাসনের সংস্থান করা যায়নি, সেইহেতু কর্মস্থলের লাইন বরাবর জায়গায় মিঃ জে এই কাজের জন্য কুঁড়েঘর তৈরি করে নেন। এই কুঁড়েগুলিতে না আছে কোনো আলো-হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা, না আছে কোনো নর্দমা; তা ছাড়া, এগুলি ছিল স্বভাবতই অতিরিক্ত জনাকীর্ণ, কেননা প্রত্যেক ভোগদখলকারীকে আবার ঠাই দিতে হয় আবাসিকদের, তা তার নিজের পরিবারে সদস্যসংখ্যা যাই হোক না কেন;-যদিও এক একটি কুঁড়েঘরে আছে মাত্র দুখানা করে কামরা। আমরা যে-মেডিক্যাল রিপোর্ট পেয়েছি, তাতে দেখা যায় যে, এর পরিণামে রাতের বেলায় জানালার ঠিক নিচেই জমে থাকা নোংরা জল ও পায়খানা থেকে যে-দুর্গন্ধ বের হয়, তা এড়াতে গিয়ে এই গরিব বেচারাদের সহ্য করতে হয় শ্বাসরুদ্ধ অবস্থার সমস্ত বিভীষিকা। এই কুঁড়েঘরগুলি দেখার উপলক্ষ্য ঘটেছিল এমন একজন ডাক্তার ভদ্রলোক এই সম্পর্কে বিস্তারিত নালিশ জানিয়েছিলেন। তিনি কঠোরতম ভাষায় তাদের থাকার অবস্থার কথা বিবৃত করেছিলেন এবং এই আশংকা ব্যক্ত করেছিলেন যে, যদি স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয় তা হলে অত্যন্ত গুরুতর কিছু পরিণতি ঘটাতে পারে। এক বছর আগে মিঃ জে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি একটি কুটির আলাদা করে রাখবেন, যে-কুটিরে তার অধীনস্থ লোকদের মধ্যে যারা সংক্রামক রোগাক্রান্ত, তাদের সকলকে অবিলম্বে স্থানান্তরিত করা হবে গত ২৩শে জুলাই তিনি ঐ একই প্রতিজ্ঞার পুনরাবৃত্তি করেন, কিন্তু যদিও তার পর থেকে তার কুঁড়েগুলিতে বেশ কয়েকটি বসন্ত রোগের ঘটনা ঘটেছে এবং দুজন মারা গিয়েছে, তবু তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে তিনি কোন কিছুই করেননি। সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে সার্জন ( শল্যচিকিৎসক) মিঃ কেলসন আমার কাছে রিপোর্ট করেন, ঐ কুঁড়েগুলিতে আরো কয়েক জন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং তিনি তাদের অবস্থা চরম কলংকজনক বলে বর্ণনা করেন। আপনার (স্বরাষ্ট্রসচিবের) জ্ঞাতার্থে আমি আরো জুড়ে দিতে চাই যে, এই প্যারিশের অধিবাসীদের মধ্যে যারা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারে, তাদের জন্য রোগী-নিবাস’ বলে যে বাড়িটি আলাদা করা আছে, সেটি গত কয়েক মাস ধরে এই জাতীয় রোগীদের দ্বারা ক্রমাগত ভর্তিই থাকছে, এবং এখনো ভর্তিই আছে; একটি পরিবারে পাঁচ পাচটি শিশুই বসন্ত ও জ্বরে মারা গিয়েছে। এই বছরে ১লা এপ্রিল থেকে ১লা সেপ্টেম্বর—এই পাঁচ মাসে এই প্যারিশে বসন্ত রোগে মারা গিয়েছে অন্তত দশ জন, যাদের মধ্যে চারজন ছিল ঐ কুঁড়েগুলির বাসিন্দা; কত লোক ঐ রোগের কবলে পড়েছে, তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব নয়, কেননা সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলি তা যথাসাধ্য গোপন রাখতে চেষ্টা করে; তবে অনেক মানুষই যে কবলিত হয়েছে, তা জানা গিয়েছে। [৩৭]

কয়লা ও অন্যান্য খনির শ্রমিকেরা ব্রিটিশ সর্বহারা (প্রোলেটারিয়েট’ ) শ্রেণীর সবচেয়ে ভাল মজুরি-প্রাপ্ত বর্গগুলির অন্তর্গত। যে-দাম দিয়ে তারা তাদের মজুরি ক্রয় করে, তা পূর্ববর্তী এক পৃষ্ঠায় দেখানো হয়েছে। এখানে আমি কেবল তাদের বাসস্থানের অবস্থার উপর দিয়ে দ্রুত চোখ বুলিয়ে যাবে। প্রচলিত রীতি এই যে, খনির খনিজ-আহরক, তা সে মালিকই হোক বা ইজারাদারই হোক, তার কর্মীদের জন্য কতকগুলি কুটির তৈরি করে। তারা কুটির আর কয়লা পায় “মাগনা”-অর্থাৎ এগুলি তাদের মজুরিরই অংশ, যা দেওয়া হচ্ছে দ্রব্যসামগ্রীর আকারে। যারা এই কুটির পায়না, তাদের বাৎসরিক ও পাউণ্ড হিসাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। খনি অঞ্চলগুলি দ্রুতবেগে জনসংখ্যা আকর্ষণ করে, যার মধ্যে খোদ খনি-শ্রমিকেরা ছাড়াও থাকে, কারিগর দোকানদার প্রভৃতি, যারা তাদের ঘিরে সমবেত হয়। জমির খাজনা উচু; যেখানে জনবসতি ঘন, সেখানে তাই হয়। সুতরাং, মানব চেষ্টা করে খনি খাদের কাছাকাছি যথাসম্ভব স্বল্প-পরিসর জায়গার মধ্যে ঠিক তত সংখ্যক কুটির তৈরি করে নিতে, যা তাদের কর্মীদের সপরিবারে ঘেঁষাঘেঁষি বাস করার পক্ষে যথেষ্ট হবে। যদি ধারে-কাছে নোতুন খনি খোলা হয়, কিংবা পুরানো খনি আবার চালু করা হয়, তা হলে চাপ বেড়ে যায়। কুটিগুলির নির্মাণের ব্যাপারে কেবল একটি দৃষ্টিভঙ্গিই গুরুত্ব পায়; তা হল এই যে, যে-ব্যয় কোনক্রমেই পরিহার করা যায় না, তা ছাড়া বাকি সমস্ত ব্যয় থেকে “আত্ম-সংবরণ। ডাঃ জুলিয়ান হান্টার বলেন, নাম্বারল্যাণ্ড ও ডারহাম-এর কয়লাক্ষেত্রগুলির সঙ্গে সংযুক্ত ‘পিট-ম্যান’-রা (খনি-খাদের মজুরেরা। এবং অন্যান্য শ্রমিকেরা যে বাসস্থান পায়, তা সম্ভবতঃ মোটের উপরে, ইংল্যাণ্ডের এই ধরনের বড় আকারের নমুনাগুলির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ এবং সবচেয়ে দুমূল্য—একমাত্র মনমাউথ-শায়ারের ‘প্যারিশগুলির অনুরূপ নমুনাগুলি বাদে। . এগুলি যে কত চরম খারাপ তা লক্ষ্য করা যায় একটি মাত্র কামরায় ভিড় করা মানুষের অতিরিক্ত সংখ্যায়, একটি ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ডে বহুসংখ্যক বাড়ির ঘন-সন্নিবেশে, জলের অভাবে, পায়খানার অনুপস্থিতিতে এবং প্রায়শই একটি বাড়ির মাথায় আরেকটি বাড়ি চাপিয়ে দেওয়ার, অথবা ফ্ল্যাট’ হিসাবে ভাগ করে দেওয়ায় জমির ইজারাদার এমন ভাবে কাজ করে যেন গোটা কলোনি’টা নিছক একটা ছাউনি, কোনো বাসস্থান নয়। [৩৮]

ডাঃ স্টিভেন্স বলেন, “আমার প্রতি প্রদত্ত নির্দেশ অনুসারে আমি ডারহাম ইউনিয়নের অধিকাংশ বড় বড় ‘কোলিয়ারি’ গ্রামই পরিদর্শন করেছি।….. অতি সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাকি সবগুলির ক্ষেত্রেই ঢালাও ভাবে একথা বললে সত্যই বলা হবে যে, অধিবাসীদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। সমস্ত কয়লা-খাদের শ্রমিকই খনির ইজারাদার বা মালিকের কাছে বাধা থাকে ( বাধা থাক” কথাটা “বন্ধন-দশা” কথাটার মত ভূমি-দাস প্রথার আমলের মতই প্রাচীন) বারো মাসের জন্য। যদি তারা অসন্তোষ প্রকাশ করে কিংবা কোনো ভাবে তদারক কারীর বিরক্তি উৎপাদন করে, তা হলে তাদের নামের পাশে একটি স্মারক-চিহ্ন একে দেওয়া হয়, এবং বাৎসরিক বন্ধনমুক্তি”-র সময়ে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আমার মনে হয়, এই ঘনবসতিপূর্ণ জেলাগুলিতে ‘ট্রাক-সিস্টেম’-এর। মজুরি-সংশ্লিষ্ট বাধ্য বাধকতার ব্যবস্থার যে অংশই, প্রচলিত রয়েছে, তার চেয়ে খারাপ আর কোনো অংশই হতে পারে না। নিজেকে ভাড়া দেবার শর্ত হিসাবে তাকে নিতে হবে নানাবিধ দুষ্ট সংক্রামক প্রভাবের দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি বাসা; সে নিজেকে এ থেকে বাঁচাতে পারে না। এবং যে তার মালিক ছাড়া আর কেউ তাকে এ ব্যাপারে বাঁচাতে পারে কিনা, তাতে সন্দেহ আছে ( যে-কোনো দিক দেখলে সে একজন ভূমি-দাস, এবং তার মালিক প্রথম বিচার করবে তার আয়-ব্যয়ের হিসাব, এবং তার ফল কি হবে, তা প্রায় নিশ্চিত। মালিক অনেক সময়ে খনি-শ্রমিককে জলও সরবরাহ করে এব, সে জল ভাল হোক, মন্দ হোক, তার জন্য তাকে দাম দিতে হয় কিংবা, বরং এল! উচিত, সেটা তার মজুরি থেকে কেটে রাখা হয়। [৩৯]

“জনমত”-এর, এমনকি হেথ, অফিসারদের বিরোধিতার মুখেও, মূলধন অংশতঃ বিপজ্জনক ও অংশতঃ চরিত্ৰনাশক এই শর্তাবলীকে, যেগুলি দিয়ে সে শ্রমিক এবং তার পরিবারকে বেঁধে রাখে, সেগুলিকে সমর্থন করতে কোনো অসুবিধাই বোধ করে না; সে যুক্তি দেয় যে, মুনাফার স্বার্থে এগুলি অপরিহার্য যখন কারখানায় বিপজ্জনক যন্ত্রপাতির বিরুদ্ধে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন খনিতে আলো-হাওয়; চলাচলের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি থেকে সে “আত্ম-সংবরণ” করে, তখন ঠিক এই যুণ্ডিই সে দেয়। খনি-শ্রমিকদের আবাসনের ক্ষেত্রেও সেই একই যু9ি। প্রিভি কাউন্সিলের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ সাইমন তার সরকারি রিপোর্টে বলেন ‘বাসস্থানের শোচনীয় অবস্থার কৈফিয়ৎ হিসাবে বলা হয়, খনিগুলি সাধারণতঃ ইজারায় খাটে; ইজারাদারের স্বার্থের মেয়াদ ২ কোলিয়ারিতে সচরাচর ২১ বছর ততটা দীর্ঘস্থায়ী নয় যে সে তার শ্রমিকদের জন্য, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য লোকজন যাদের সে টেনে এনেছে তাদের জন্য সুষ্ঠ, আবাসনের বন্দোবস্ত করা লাভজনক বলে। মনে করতে পারে; এমনকি সে যদি এ ব্যাপারে উদার মনোভাব নিয়ে কিছু করতে চেষ্টাও করে, তা হলেও সেই চেষ্টা সাধারণতঃ ব্যাহত হবে জমির মালিকের প্রবণতার দ্বারা; মাটির তলাকার সম্পত্তিতে কর্ম-নিযুক্ত শ্রমিকদের জন্য মাটির উপরে রুচিসম্পন্ন ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ গ্রাম গড়ে তোলার বিশেষ অধিকারলাভের জন্য জমির মালিক তার উপরে জমির খাজনা বাবদে চাপিয়ে দেবে অতি উচ্ছ-হারে একটি অতিরিক্ত চার্জ এবং সেই নিষেধাজ্ঞা-মূলক দাম (যদি তা সরাসরি নিষেধাজ্ঞা না-ও হয়। অন্যান্য যারা এমন গ্রাম গড়ে তোলার ইচ্ছা পোষণ করতে পারে, তাদেরও দুর্নিবারণ করবে। উল্লিখিত কৈফিয়তের গুণাগুণ বিচার করা রিপোর্টের পরিধিভুক্ত নয়। এমন কি, এখানে এটাও বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই যে, যদি সুষ্ঠ, আবাসনের ব্যবস্থা করা যেত, তা হলে খবরটা শেষ পর্যন্ত কার উপরে, বর্তাত-জমির মালিকের উপরে, ইজারাদারের উপরে, না কি সমাজের উপরে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট রিপোর্টগুলিতে ( ডাঃ হান্টার, ডাঃ স্টিভেন্স প্রভৃতির রিপোর্টগুলিতে) যে লজ্জাকর তথ্যসমূহ প্রতিপন্ন হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই প্রতিকার দাবি করা যায়। জমিদারিত্বের দাবি ইত্যাদিকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিরাট সামাজিক অহিত-সাধনের কাজে। খনির মালিক হিসাবে জমিদার একটি শিল্প শ্রমিকবাহিনীকে আমন্ত্রণ করে তার জমিদারিতে কাজ করতে এবং তার পরে ভূমি পৃষ্ঠের মালিক হিসাবে সে যে-শ্রমিকদের সমবেত করল তাদের পক্ষে বাসস্থান সংগ্রহ করার ব্যাপারটা অসম্ভব করে তুলল। এদিকে ইজারাদারের (ধনতান্ত্রিক শোষণ কারীর) কোনো আর্থিক উদ্দেশ্য থাকে না এই দেনা-পাওনার ভাগাভাগিতে বাধা দেবার; সে বেশ ভাল ভাবেই জানে যে, শেষোক্ত শর্তাবলী যদি অত্যন্ত চড়াও হয়, তা হলেও তার ফলাফল তার উপরে বর্তাবে, বর্তাবে তার শ্রমিকদের উপরে যাদের এমন কোন শিক্ষা নাই যাতে তারা তাদের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত অধিকারগুলির মূল্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারে; জানে যে, সবচেয়ে জঘন্য বাস-ব্যবস্থা বা সবচেয়ে দূষিত পানীয় জল-কোনোটাই তাদের ধর্মঘট করার মত যথেষ্ট প্রণোদনা হিসাবে কাজ করবে না।” [৪০]

(ঘ) শ্ৰমিক-শ্রেণীর সর্বোত্তম মজুরি-প্রাপক অংশের উপরে সংকটের ফলাফলঃ

নিয়মিত কৃষি-শ্রমিকদের বিষয়ে আলোচনা শুরু করার আগে আমি আপনাদের অনুমতি চাই, কিভাবে শিল্পগত ঝড়ঝাপ্টা শ্রমিক শ্রেণীর এমনকি সর্বোচ্চ মজুরি প্রাপক অংশকে ( অভিজাত বর্গকে) পর্যন্ত আঘাত করে; আমি কেবল একটি দৃষ্টান্তই দেব। স্মরণীয় যে ১৮৫৭ সালটি নিয়ে এসেছিল অন্যতম বৃহত্তম সংকটকে, যা সূচনা করে শিল্প-চক্রের পর্যায়ক্রমের পরিসমাপ্তি। পরবর্তী সংকট-বিরতির কাল ছিল ১৮৬৬। নিয়মিত কারখানা-জেলাগুলিতে তুলা-দুর্ভিক্ষের দরুন ইতিমধ্যে হ্রাসপ্রাপ্ত যে-দুর্ভিক্ষ বহুল পরিমাণ মূলধনকে তার চিরাভ্যস্ত ক্ষেত্র থেকে তাকে ছুড়ে দিল টাকার বাজারের বিরাট বিরাট কেন্দ্রে—সেই সংকট ধারণ করল বিশেষ ভাবে একটি আর্থিক চরিত্র। এই সংকটের সংকেত পাওয়া গিয়েছিল একটি অতিকায় লণ্ডন ব্যাংকের ‘ফেল পড়া থেকে, যার পিছু পিছু ভেঙে পড়ল অসংখ্য প্রতারক কোম্পানি। এই বিপর্যয়ের সঙ্গে জড়িত লণ্ডনের বিরাট বিরাট শিল্প-শাখার মধ্যে একটি হল লোহার জাহাজ নির্মাণ। তেজীর মরশুমে এই শিল্পশাখার দিকপালেরা যে কেবল সমস্ত মাত্রাছাড়া অতি-উৎপাদনে মেতে উঠেছিল, তাই নয়, দরকার-মত ক্রেডিট পাওয়া যাবে এই ফাটকাবাজির ভিত্তিতে তারা বিরাট বিরাট চুক্তিতেও লিপ্ত হয়েছিল। এখন, এক ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া শুরু হল; এমনকি এত দিন পরে আজও পর্যন্ত (১৮৬৭ সালের মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত। সেই প্রতিক্রিয়া লণ্ডনের এই শিল্পে ও অন্যান্য শিল্পে চলে আসছে।[৪১] শ্রমিকদের অবস্থা, কি ছিল, তা দেখাবার জন্য আমি মর্নিং স্টার পত্রিকার এক সাংবাদিকদের একটি তথ্যবহুল রিপোর্ট এখানে তুলে ধরছি, যিনি ১৮৬৬ সালের শেষে এবং ১৮৬৭ সালের শুরুতে দুর্দশার কেন্দ্রগুলি ঘুরে দেখেছিলেন, “পপুলার, মিলওয়াল, গ্রীনউইচ, ডেপ, টফোর্ড লাইমহাউজ, ক্যানিং টাউন প্রভৃতি ইস্ট-ইণ্ড অঞ্চলগুলিতে অন্তত পক্ষে ২০ হাজার কর্মী ও তাদের পরিবারবর্গ চরম দুঃস্থতার অবস্থায় ছিল এবং ৩০০০ কুশলী মেকানিক (আধ বছরেরও বেশি কালব্যাপী দুর্দশার পরে) দুঃস্থনিবাসের উঠোনে শান-বাঁধানো পাথর ভাঙছিল। ঐ দুঃস্থ নিবাসের ফটক পর্যন্ত যেতে আমার দারুণ কষ্ট হয়েছিল, কেননা এক ক্ষুধাত জনতা তাকে অবরোধ করে রেখেছিল। তারা তাদের টিকিটের জন্য প্রতীক্ষা করেছিল যদিও টিকিট বিতরণের সময় তখনো আসেনি। উঠোনটা ছিল একটা মন্ত চৌক, যার চার দিক ঘিরেছিল একটা খোল। শেড’ (ছাউনি, এবং মধ্যিখানটা চেকে রেখেছিল কয়েকটি বড় বড় বরফের স্তুপ। তা ছাড়া, মধ্যিখানে ভেড়ার খোঁয়াড়ের মত ডালপালার বেড়া দেওয়া ছোট ছোট জায়গাও ছিল; কিন্তু আমি যেদিন সেখানে দেখতে গিয়েছিলাম, সেগুলি বরফে এত টাকা ছিল যে কারো পক্ষে সেখানে বসা সম্ভব ছিল না। সেদিন যাই হোক, সেই খোল শেডে লোকজন শান বাধানো পাথর ভেঙে খোয়া তৈরিতে ব্যস্ত ছিল। প্রত্যেকের বসার জন্য ছিল একটি করে বড় শানবাঁধানো পাথর; সে একটা বড় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে চলছিল কঠিন বরফে ঢাক। একটা গ্রনিট পাথরের উপরে, যতক্ষণ না সেট। টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল এবং ভাবুন? এই ভাবে তাকে ভরতে হবে পাঁচ পাঁচটি বুশেল; তা হলেই শেষ হবে তার এক রোজের কাজ এবং সে পাবে তার রোজের মজুরি-তিন পেন্স আর বরাদ্দ খাদ্য। উঠোনের অন্য প্রান্তে ছিল একটা ভগ্ন খায় কাঠের বাড়ি, এবং আমরা যখন তার দুয়োর খুললাম, আমরা দেখতে পেলাম সেটা একেবারে ভতি –লোকেরা গাদাগাদি করে বসে আছে পরস্পরের গায়ের ও প্রশ্বাসের গরমটুকুর জন্য। তারা হাতে ফেঁসে। তৈরি করছিল আর মুখে তর্ক করছিল একই পরিমাণ খাবার খেয়ে কে সবচেয়ে বেশি সময় কাজ করতে পারে—কার কতটা সহশক্তি সেটাই ছিল এখানে মর্যাদার বিষয়। এই দুঃস্থ-নিবাসটিতে : সাত হাজার পাচ্ছিল ত্রাণ-সাহায্য দেখা গেল, তাদের মধ্যে অনেকে ছয় থেকে আট মাস আগে পর্যন্ত উপার্জন করত কারিগরদের জন্য বরাদ্দ সবচেয়ে উচু মজুরি। এদের সংখ্যা হত দ্বিগুণেরও বেশি যদি, যারা সব সঞ্চয় খরচ হয়ে যাবার পরেও প্যারিশে আবেদন করতে অস্বীকার করছে, কেননা বন্ধক রাখার মত তখনো কিছু অবশিষ্ট ছিল, তাদেরও যদি হিসাবে গোনা হত। দুঃস্থ নিবাসটি ছেড়ে আমি পপলারের আশেপাশে রাস্তা ধরে এক-তলা ছোট ছোট বাড়িগুলির মধ্য দিয়ে একটু হাঁটলাম; এমন বাড়ি সেই অঞ্চলে প্রচুর। আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন বেকার-কমিটির একজন সদস্য। আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটল একজন লোহা-শ্রমিকের সঙ্গে, সাতাশ সপ্তাহ ধরে যে কর্মহীন। আমি তাকে আর তার পরিবারকে পেলাম পিছন দিককার একটি ঘরে। ঘরটি একেবারে আসবাব পত্ৰ-হীন ছিল না, একটা আগুন জ্বলছিল দিনটা ছিল দারুণ ঠাণ্ডা এবং আগুনটার দরকার ছিল যাতে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ের খালি পাগুলি হিমে অসাড় হয়ে না যায়। আগুনটার সামনে একটা কাঠের থালায় ছিল কিছু পরিমাণ ফেসে, প্যারিশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের বিনিময়ে যা ঐ বেকার শ্রমিকের স্ত্রী ও সন্তানেরা তৈরি করে দিচ্ছিল। লোকটি কাজ করছিল দুঃস্থ-নিবাসের পাথরের উঠোনে দৈনিক একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবারের বরাদ্দ (ব্যাশন’) ও তিন পেন্স-এর জন্য। একটু বিষ হাসি হেসে সে আমাকে বলল, তখন সে বাসায় এসেছিল ভোজনের জন্য। ছিল খুবই ক্ষুধার্ত; আর খাবার ছিল দু-তিন টুকরো রুটি, একটু চর্বি এবং এক পেয়ালা দুধ-ছাড়া চা! . দ্বিতীয় যে-বাড়ির দরজায় আমরা টোকা দিলাম, সেটা খুলে দিলেন একজন মধ্যবয়সী মহিলা। তিনি কোনো কথা না বলে আমাদের নিয়ে গেলেন পিছন দিককার একটি বৈঠকখানায়, সেখানে বসেছিল তার গোটা পরিবারে; নীরব এবং সকলেরই দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল নিবুনিবু, আগুনটার উপরে। লোকগুলিকে এবং তাদের ছোট্ট ঘরটিকে ঘিরে ছিল এমন এক শূন্যতা ও নৈরাশ্য, যা আমি দ্বিতীয় বারের মত দেখতে চাইনা। তার ছেলেদের দিকে আঙুল দেখিয়ে মহিলাটি বললেন, “গত এক-কুড়ি ছ-হপ্তা ধরে কোনো কিছুই ওরা করেনি। আমাদের সব টাকা ফুরিয়ে গেছে; সময় যখন ভাল ছিল তখন বাবা আর আমি মিলে যে-কুড়ি পাউণ্ড জমিয়ে ছিলাম, যখন কাজ থাকবেনা, তখন কিছু সাহায্য হবে—সবি ফুরিয়ে গেছে। একটা ব্যাংকের বই নিয়ে এসে তিক্ত কণ্ঠে বললেন, “দেখুন, এটা দেখুন !” যাতে আমরা দেখতে পারি, কবে কত টাকা জম! দিয়েছিলেন, কবে কত তুলেছিলেন; কি ভাবে শুরুতে পাঁচ শিলিং জমা দেবার পরে আসে আস্তে গড়ে উঠেছিল সেই ছোট পুঁজি; কি ভাবে তা আবার পাউণ্ড থেকে শিলি”-এ, শিলি’ থেকে সে শত্যে পরিণত হয়ে বইট। হয়ে পছে একটা ফাকা কাগজের মত মূল্যহীন। এই পরিবারটি প্যারিশ থেকে ত্রাণ-সাহায্য পাচ্ছিল এবং তাতে তাদের দিনে একবার করে সামান্য খাবারের সংস্থান হচ্ছিল। … তার পরে আমরা গেলাম এক লোহা-শ্রমিকের স্ত্রীর কাছে, যার স্বামী কাজ করতেন শিপইয়ার্ডে। আমরা তাকে দেখতে পেলাম খাদ্যের অভাবজনিত পীড় – গ্রস্ত অবস্থায়, জামা-কাপড় পড়ে শুয়ে আছেন একটা জাজিমের উপরে, যার উপ. বিছানো ছিল কেবল একটা গালিচা, কারণ বাকি সবই বন্ধকে চলে গিয়েছিল। দুটি বেচারা শিশুসন্তান তার শুশ্রুষা করছিল, যাদের নিজেদেরই তাদের মায়ের মতই শুশ্রষার দরকার। উনিশ সপ্তাহের চাপিয়ে-দেওয়া কর্মহীনতার দরুন তাদের এই দুর্গতি, আর যখন তাদের মা এই তিক্ত অতীতের কথা বলছিলেন, তখন এমন ভাবে হা-হুতাশ করছিলেন যেন ভবিষ্যতের উপরে তার সমস্ত বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছে এমন ভবিষ্যৎ আর কখনো আসবেনা, যা এই দুর্গতির জন্য প্রায়শ্চিত্ত করবে … বাইরে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে এক যুবা-বয়স্ক ব্যক্তি আমাদের পিছে পিছে ছুটে এল এবং আমাদের অনুরোধ করল তার ঘরে পদার্পণ করতে, যদি আমরা তাদের জন্য কিছু করতে পারি। তার দেখাবার মত যা ছিল তা হল সব মিলিয়ে তার তরুণী বধু, দুটি সুন্দর শিশু, এক গোছ বন্ধকী টিকিট এবং একটি খালি ঘর।”

১৮৬৬ সালের সংকটের পরবর্তী দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে একটি টোরি পত্রিকা থেকে নিয়োত একটি অনুচ্ছেদ। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, এখানে বলা হচ্ছে লণ্ডনের ‘ইস্ট-এণ্ড’-এর কথা, যা কেবল লৌহ-জাহাজ নির্মাণেরই কেন্দ্র নয়, সেই সঙ্গে স্বল্প-মজুরি-প্রদত্ত একটি তথাকথিত গৃহ-শিল্পেরও কেন্দ। “মহানগরের একটি অংশে গতকাল দেখা গিয়েছিল একটি ভয়ংকর দৃশ্য। যদিও ইস্ট এণ্ডের হাজার হাজার বেকা: সকলেই দল বেঁধে কালো পতাকা হাতে মিছিল করেনি, তবু সেই জন প্রবাহ ছিল খুবই শক্তিব্যঞ্জক। এরা কী যন্ত্রণা ভোগ করছে, তা মনে করে দেখুন। এরা মারা যাচ্ছে ক্ষুধার তাড়নায়। এটাই হল সরল অথচ নিষ্ঠুর সত্য। এরা আছে ৪০,০০। আমাদের চোখের সামনে, এই মহাশ্চর্য মহানগরের এক অংশে পৃথিবী কখনো যেমন দেখেনি, তেমন বিপুল ঐশ্বর্যের সর্বোচ্চ সঞ্চয়ের ঠিক পাশের দরজার গায়ে-গায়ে ধুকছে ৪০ হাজার অসহায়, অনাহার-ক্লিষ্ট মানুষ। এই হাজার হাজার মানুষ এখন আছড়ে পড়ছে মহানগরের অন্যান্য অংশে; সব সময়েই অর্ধভুক্ত, এই দুর্ভাগার। আমাদের কানের কাছে চেঁচিয়ে বলছে তাদের দুর্গতির কথা তার। চেঁচিয়ে বলেছে ভগবানের উদ্দেশ্যে, তাদের শোচনীয় কুঁড়েঘরগুলি থেকে তারা আমাদের বলছে, তাদের পক্ষে কাজ পাওয়া অসম্ভব, ভিক্ষা করা অনর্থক। স্থানীয় কর-দাতারা নিজেরাই যাজকতন্ত্রের নানাবিধ দক্ষিণ। মেটাতে গিয়ে দুঃস্থর কিনারায় গিয়ে পৌঁছেছে।”; ‘স্ট্যাণ্ডার্ড’, ৫ই এপ্রিল, ১৮৬৭)।

যেহেতু ইংরেজ ধনিকদের মধ্যে একটা রেওয়াজ হয়ে দাড়িয়েছে শ্রমিকের ভূস্বর্গ সাবে বেলজিয়ামকে উল্লেখ করা কারণ সেখানে “শ্রমের স্বাধীন ভাষান্তরে। “মূলধনের স্বাধীনতা” ট্রেড ইউনিয়নের যথেচ্ছাচার বা কারখানা-আইনের দ্বারা সীমিত নয়, সেহেতু বেলজিয়ান শ্রমিকের “খ” সম্পর্কে দু-একটি কথা বলে নেব। নিশ্চয়ই প্রয়াত শ্রম ডাকপিটিয়, যিনি ছিলেন বেলজিয়ান কারাগার ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান সমূহের ইনপেক্টর জেনারেল ( ‘মহা-পরিদর্শক’) এবং বেলজিয়ান পরিসংখ্যানের কেন্দ্রীয় কমিশনের সদস্য, তার চেয়ে আর কেউ এই সুখের রহস্য সম্পর্কে অবহিত নন। তার বইখানাই নেওয়া যাক : “Budgets economiques des classes ouvriercs de la Belgique,” ব্রুকসেলেস, ১৮৫৫। এখানে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আমরা পাই একটি সাধারণ বেলজিয়ান পরিবারের চিত্র, যার বাৎসরিক আয় ও ব্যয় তিনি হিসাব করেছেন যথার্থ তথ্যের ভিত্তিতে এবং তার পরে তার পুষ্টি গ্রহণের মানকে তুলনা করেছেন সৈনিক, নাবিক এবং বন্দীর পুষ্টি গ্রহণের সঙ্গে। পরিবার গঠিত হয় পিতা, মাতা ও চারটি সন্তানকে নিয়ে।” এই ছ-জনের মধ্যে চারজন গোটা বছর ধরেই প্রয়োজনপূর্ণ কাজে নিযুক্ত থাকতে পারে।” ধরে নেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যে এমন একজনও নেই, যে অসুস্থ বা কর্মে অশক্ত; আরো ধরে নেওয়া হচ্ছে, গীর্জার আসনের জন্য নামমাত্র ব্যয় ছাড়া ধর্মীয়, নৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক কারণে তাদের কোনো ব্যয় নাই, কিংবা সঞ্চয়ব্যাংকে বা কল্যাণ সংস্থায় কোনো কিছু দেয় নাই, কিংবা “বিলাস বা অমিতাচারজনিত কোনো ব্যয় নাই।” অবশ্য, পিতা ও পুত্র নিজেদের জন্য “তামাকু সেবনের অবকাশ রাখে এবং রবিবার-রবিবার ‘ক্যাবারে’-তে যায়, যার জন্য সপ্তাহে মোট ৮৬ সঁতিম ধরে রাখা হয়। বিভিন্ন শিল্পে শ্রমিকদের যে মজুরি দেওয়া হয় তার একটা সার্বিক সংকলন থেকে বেরিয়ে আসে যে দৈনিক মজুরির উচ্চতম গড় হল পুরুষদের জন্য ১ ফ্র। ৫৬ সঁতি, মহিলাদের জন্য ৮৯ সঁতিম, বালকদের ৫৬ সঁতিম এবং বালিকাদের ৫৫ সঁতিম। এই ভিত্তিতে হিসাব করলে পরিবারটির বার্ষিক অর্থসঙ্গতির পরিমাণ দাঁড়াবে সবচেয়ে বেশি হলে ১,০৬৮ ফ্রাঁ। …প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা হিসাবে নেওয়া এই পরিবারটিতে আমরা হিসাবে ধরেছি সমস্ত সম্ভাব্য অর্থাগম। কিন্তু মায়ের ক্ষেত্রে মজুরি আরোপ করতে গিয়ে আমরা উত্থাপন করি গৃহস্থালী পরিচালনার প্রশ্নটি, তার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি কিভাবে পরিপোষিত হবে? শিশু-সন্তানদের কে দেখাশোনা করবে? কে খাবার প্রস্তুত করবে? ধোয়া-মোছা, সেলাই-ফোড়াইয়ের কাজ কে করবে? শ্রমিকেরা সবসময়েই এই উভয়-সংকটের মুখোমুখি হয়।”

এই অনুসারে উক্ত পরিবারটির বাৎসরিক বাজেট এই :

পিতা : ৩০০ কর্ম-দিবস ১.৫৬ ফ্রাঁ হারে ৪৬৮ ফ্রাঁ
 মাতা :  ,,       ,,          ৮৯  ,,  ,,  ২৬৭ ফ্রাঁ
পুত্র :     ,,      ,,          ৫৬  ,,   ,,  ১৬৮ ফ্রাঁ
কন্যা :   ,,      ,,           ৫৫  ,,   ,,  ১৬৫ ফ্রাঁ
———————————————
মোট ১,০৬৮  ফ্রাঁ

যদি ধরে নেওয়া যায় যে, শ্রমিকের খাদ্য নাবিক, সৈনিক বা বন্দীর খাদ্যের অনুরূপ, তা হলে পরিবারটির বাৎসরিক ব্যয়ে ঘাটতির পরিমাণ ঈবে যথাক্রমে নিম্নরূপ :

নাবিকের অনুরূপ খাদ্য-গ্রহণের ক্ষেত্রে : ১,৮২৮ ফ্রাঁ   ঘাটতি : ৭৬০ ফ্রাঁ

সৈনিকের    ,,      ,,     ,,       ,,      ১,৪৭৩  ,,      ,,      ৪০৫ ,,

বন্দীর        ,,      ,,     ,,       ,,      ১,১১২  ,,      ,,      ৪৪   ,,

নাবিক বা সৈনিকের খাবারের গড়ে পৌছানো তো দূরের কথা, এমন কি বন্দীর গড়ে পৌছানোও খুব নগণ্য-সংখ্যক শ্রমিক-পরিবারের পক্ষেই সম্ভব হয়। (১৮৪৭ থেকে ১৮৪৯ পর্যন্ত বিভিন্ন কারাগারে প্রত্যেক বন্দীর খরচের) সাধারণ গড় সমস্ত কারাগারের ক্ষেত্রে গড়েছে ৬৩ সঁতিম। এই খরচের সঙ্গে শ্রমিকের দৈনিক খোরপোষের খরচের তুলনা করলে ১৩ সঁতিম-এর পার্থক্য দেখা যায়। বলা দরকার যে, বন্দীদের ক্ষেত্রে যেমন প্রশাসন ও প্রহরার খরচ হিসাবের মধ্যে ধরতে হয়, তেমন আবার তাদের বাসা-ভাড়া দিতে হয়না; তা ছাড়া, ক্যান্টিন থেকে তারা যে কেনাকাটা করে, তা তাদের খোরপোষের খরচের মধ্যে পড়েনা; তার উপরে, বহুসংখ্যক বন্দী একই সঙ্গে থাকে বলে এবং তাদের খাদ্য ও ভোগ-ব্যবহারের অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী পাইকারি হারে চুক্তি বা ক্রয়ের মারফতে সংগ্রহ করা হয় বলে, এই ব্যয়পত্রও অনেক কমে যায়।…এটা কেমন করে ঘটে যে, শ্রমিকদের একটা বৃহৎ অংশ, বলতে পারি, সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অন্যান্যদের তুলনায় অধিকতর মিত্যব্যয়ী ভাবে জীবন-যাপন করে? এটা তারা করে এমন সব কৌশল অবলম্বন করে, যার রহস্য কেবল শ্রমিকেরাই জানে; এটা তারা করে তাদের দৈনিক আহারের পরিমাণ কমিয়ে, গমের রুটির বদলে ‘ই’-এর রুটি খেয়ে, মাংস একেবারে বাদ দিয়ে বা প্রায় বাদ দিয়ে এবং মাখন ইত্যাদির ক্ষেত্রেও একই কৌশল অবলম্বন করে; একটি বা দুটি রুমের মধ্যেই গোটা পরিবারটি গাদাগাদি করে থেকে, ছেলে-মেয়ের। পাশাপাশি একই খড়ের তোষকে নিদ্রাসুখ উপভোগ করে; জামা-কাপড়, পরিচ্ছন্নতা ও শালীনতার ক্ষেত্রে সাশ্রয় ঘটিয়ে; রবিবারের আমোদ-প্রমোদ বিদায় দিয়ে; এক কথায় বলা যায়, সবচেয়ে যন্ত্রণাকর বঞ্চনার মধ্যে আত্মসমর্পন করে। একবার এই চরম সীমায় নেমে যাবার পরে, খাদ্যের দামে সামান্য বৃদ্ধি, কাজের ছেদ, অসুখ-বিসুখ শ্রমিকের অবস্থাকে অসহ্য করে তোলে এবং তাকে ধ্বংস করে দেয়। ধারের বোঝা জমতে থাকে, পরে ধারও পাওয়া যায় না, সবচেয়ে দরকারি জামা-কাপড় ও আসবাবও বন্ধক দিতে হয়; এবং শেষ পর্যন্ত পরিবারটি আবেদন করে দুঃস্থ-তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবার জন্য।” (ডাকপিটিয়ক্স, ঐ, পৃঃ ১৫১, ১৫৭, ১৫৫)। বস্তুতঃ পক্ষে, ধনিকদের এই ভূস্বর্গে জীবনধারণের পক্ষে অত্যধিক আবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর দামে সামান্যতম পরিবর্তন ঘটলেই মৃত্যু ও অপরাধের সংখ্যাতেও পরিবর্তন ঘটে ! ( দ্রষ্টব্য : ‘মাশাপ্লিজ-এর ইশতাহার’ : “De Vlamingen Vooruit!” সেলস, ১৮৬০, পৃঃ ১৫, ১৬)। সমগ্র বেলজিয়ামে আছে ৯;৩০,০০০ পরিবার, যাদের মধ্যে সরকারি হিসাবমতে ৯০,০০০ বিত্তবান এবং ভোটার তালিকায় আছে ৪,৫০,০০০ ব্যক্তি; শহর ও গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্য। ৩,৯০,০০০ যাদের মধ্যে বৃহত্তর অংশ ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছে ‘প্রোলেটারিয়েট’-এর স্তরে : সংখ্যা ১৯,৫০,০০০ ব্যক্তি। সর্বশেষে, ৪,৫০,০০০ শ্রমিক শ্রেণীর পরিবার= ২২,৫০,০০০ ব্যক্তি, যাদের মধ্যে যারা আদর্শস্বরূপ, তারা ভোগ করে ডাকপিটিয়ক্স বর্ণিত স্বর্গসুখ। ৪,৫০,০০০ শ্রমিক-পরিবারের মধ্যে, ২, ৩,০০০-এর বেশি রয়েছে দুঃস্থের তালিকায়।

(ঙ) ব্রিটেনের কৃষি-সর্বহারা

ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ও সঞ্চয়নের স্ব-বিরোধী চরিত্র ইংল্যাণ্ডে কৃষিকর্মের (গো প্রজনন সহ) অগ্রগতি এবং কৃষি-কর্মীর পশ্চাৰ্গতিতে যেমন ভাবে আত্ম-প্রতিষ্ঠা করে, তেমন পাশবিক ভাবে আর কোথাও করে না। তার বর্তমান পরিস্থিতির আলোচনার আগে আমি একবার তার অতীতের উপর দিয়ে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিতে চাই। ইংল্যাণ্ডে আধুনিক কৃষিকর্মের সূচনা হয় আঠারো শতকের মধ্যভাগে, যদিও যাকে ভিত্তি করে এই পরিবর্তিত উৎপাদন-পদ্ধতির শুরু, ভূমিগত সম্পত্তিতে সেই বিপ্লবের সূচনা হয় আরো অনেক আগে।

আর্থার ইয়ং, যিনি চিন্তার ক্ষেত্রে অগভীর হলেও পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে ছিলেন যত্নবান, ১৭৭১ সালে কৃষি-শ্রমিকের অবস্থা সম্পর্কে তাঁর বিবৃতিগুলিকে যদি আমরা গ্রহণ করি, তা হলে আমরা দেখতে পাই যে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ দিকে তার পূর্ববর্তী কৃষি-শ্রমিকের তুলনায় তার অবস্থা ছিল অতীব শোচনীয়; “তখন শ্রমিক : ভোগ। করতে পারত প্রাচুর্য এবং সঞ্চয় করতে পারত ঐশ্বর্য”[৪২], ‘শহর ও গ্রামের শ্রমিকের পক্ষে স্বর্ণযুগ” যে-পঞ্চদশ শতাব্দী, তার কথা নাইবা তুললাম। যাই হোক, আমাদের অতদূর যাবার দরকার নেই। ১৭৭৭ সালের অনেক বেশি তথ্যপূর্ণ অন্য একটি বইয়ে আমরা পাই : “বৃহৎ কৃষক প্রায় তার (‘ভদ্রলোকের’) সমপর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। অন্য দিকে বেচারা কৃষি-শ্রমিক প্রায় মাটিতে অধঃপাতিত হয়েছে। যদি মাত্র চল্লিশ বছর অবস্থার সঙ্গে এখানকার অবস্থা তুলনা করা যায়, তা হলেই তার দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জমিদার আর তার প্রজা দুজনেই হাতে হাত মিলিয়ে শ্রমিককে দাবিয়ে রেখেছে।[৪৩] তারপরে ঐ বইটিতে সবিস্তারে দেখানো হয়েছে যে, ১৭৩৭ থেকে ১৭৭৭ সাল অবধি কৃষি-মজুরি প্রায় ৪ ভাগ বা ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ডঃ রিচার্ড প্রাইস-ও বলেন, “আধুনিক কর্মনীতি, বাস্তবিক পক্ষে, উচ্চতর শ্রেণীগুলির পক্ষেই অনুকূল; এবং এর পরিণতি এমন পর্যন্ত দাড়াতে পারে যে গোটা রাজ্যটাই পর্যবসিত হবে ‘ভদ্রলোক’ আর ভিখারীতে, কিংবা অভিজাত আর ক্রীতদাসে।”[৪৪]

যাই হোক, কি আহার ও বাসস্থান, কি আত্মসম ও আমোদ-প্রমোদকোনো ব্যাপারেই ইংল্যাণ্ডের কৃষি শ্রমিক ১৭৭০ থেকে ১৮০ সালে যে-অবস্থায় ছিল, ওর পরে আর কোনো সময়েই সেই আদর্শে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি। ১৭৭০-৭১ সালে গমের পাইন্টের হিসাবে তার গড় মজুরি ছিল ৯০ পাইণ্ট, এডেন-এর সময়ে ( ১৭৯৭) কেবল ৬৫, ১৮০৮ সালে মাত্র ৬০। [৪৫]

জ্যাকোবিন-বিরোধী যুদ্ধের শেষে, যখন জমিদার, জোতদার, কারখানা-মালিক, সওদাগর, ব্যাংক-ব্যবসায়ী, শেয়ার-দালাল, সেনাবাহিনীর ঠিকাদার ইত্যাদির অসাধারণ-পরিমাণ বিত্ত গুছিয়ে নিয়েছিল, তখন কৃষি-শ্রমিকদের অবস্থা কী ছিল, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অংশতঃ ব্যাংক-নোটের অবমূল্যায়নের দরুন, অংশতঃ ঐ অবমূল্যায়ন-ব্যতিরেকেই জীবনধারণের প্রাথমিক দ্রব্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির দরুন আর্থিক মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু আসল মজুরিতে কতটা-কি অদল-বদল ঘটেছিল, তা অপ্রয়োজনীয় বিবরণের মধ্যে না গিয়েও একটি সহজ উপায়ে বোঝা যায়। ‘গরিব আইন’ ১৭৯৫ সালেও যা ছিল, ১৮১৪ সালেও তাই ছিল। এই আইন গ্রামাঞ্চলে কিভাবে কার্যকরী করা হয়েছিল, সেট। স্মরণে রাখা দরকার : শ্রমিকের নিছক প্রাণ-ধারণের জন্য যে-সামান্য পরিমাণ অর্থ দরকার, তার আর্থিক মজুরির সঙ্গে সামান্য অর্থ যোগ করে প্যারিশ সেই পরিমাণ-টুকু তাকে পুষিয়ে দিত—ভিক্ষা হিসাবে। কৃষক তাকে যে মজুরি দিত এবং প্যারিশ তাকে তার মজুরি-ঘাটতি পুষিয়ে দেবার জন্য যা দিত এই দুটির মধ্যেকার পার্থক্যটি থেকে দুটি বিকাশ প্রকাশ পায়। প্রথমতঃ প্রকাশ পায় ন্যূনতম মজুরি থেকেও প্রদত্ত মজুরি কতটা নেমে গিয়েছিল, তার মাত্রা, এবং দ্বিতীয়ত, কৃষি-শ্রমিক কতটা ছিল দুঃস্থ অর্থাৎ কতটা সে পরিণত হয়েছিল প্যারিশের ভুমি-দাসে (সাফ’-এ, তার মাত্রা। সমস্ত কাউন্টিগুলি গড়পড়তা অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে, এমন একটা কাউন্টির কথা বিবেচনা করা যাক। নর্দাম্পটনশায়ারে, ১৭৯৫ সালে, গড় সাপ্তাহিক মজুরি ছিল ৭ শি ৬ পে; ৬ জনের একটি পরিবারের বার্ষিক ব্যয় ছিল ৩৬ পা ১২ শি ৫ পে; তাদের মোট আয় ছিল £ ২৯ পা ১৮ শি; প্যারিশ কর্তৃক ঘাটতি-পূরণের পরিমাণ ছিল ৬ পা ১৪ শি ৫ পে। ১৮১৪ সালে, ঐ একই কাউন্টিতে সাপ্তাহিক মজুরি ছিল ১২ শি ২ পে; ৫ জনের একটি পরিবারের মোট বাৎসরিক ব্যয় ছিল ৪ ৫৪ পা ১৮ শি ৪ পে; তাদের মোট আয় ৪ ৩৬ পা ২ শি; প্যারিশ কর্তৃক ঘাটতি-পূরণের পরিমাণ ১৮ পা ৬ শি ৪ পে।[৪৬] ১৭৯৫ সালে ঘাটতি ছিল ৪ ভাগের কম, ১৮১৪ সালে অর্ধেকের বেশি। এটা সুস্পষ্ট যে, এই পরিস্থিতিতে, কৃষি-শ্রমিকের কুটিরে ইডেন যে-সামান্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তখনো প্রত্যক্ষ করেছিলেন, ১৮১৯ সালের মধ্যে তা উধাও হয়ে গিয়েছে।[৪৭] যতগুলি জীব জন্তুকে কৃষক রাখত, সেগুলির মধ্যে তখন থেকে শ্রমিকই, কথা-বল। যন্তরটি’-ই, হল সবচেয়ে অত্যাচারিত, সবচেয়ে অপুষ্টি-পীড়িত, সবচেয়ে পাশবিক আচরণ-প্রাপ্ত প্রাণী।

এই একই পরিস্থিতি নির্বিঘ্নে চলে যাচ্ছিল যে-পর্যন্ত না “১৮৩০ সালে, সুইংগ-এর দাঙ্গা-হাঙ্গামা জলন্ত ফসল-গোলার আগুনে আমাদের ( অর্থাৎ শাসক-শ্রেণীগুলির ) কাছে প্রকাশ করে দিল সেই দুঃখ-দুর্দশা ও বিদ্রোহ-উন্মুখ অসন্তোষকে যা ভয়ংকর ভাবে ধূমায়িত হচ্ছিল যেমন কৃষি-প্রধান ইংল্যাণ্ডের, তেমনি শিল্প-প্রধান ইংল্যাণ্ডের উভয়েরই অন্তস্থলে।[৪৮] এই সময়ে কমন্স সভায় স্যাডলার কৃষি-শ্রমিকদের অভিহিত করেন “শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস” বলে এবং লর্ড সভায় একজন বিশপ এই অভিধানটির প্রতিধ্বনিত করেন। সে আমলের সর্বাপেক্ষা খ্যাতনামা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিবিদ ই জি ওয়েকফিল্ড বলেন, “দক্ষিণ ইংল্যাণ্ডের কৃষি-মজুর মুক্ত-মানুষ নয়, আবার গোলামও নয়; সে দুঃস্থ।” [৪৯]

শস্য আইন প্রত্যাহারের ঠিক আগেকার সময়টা কৃষি-শ্রমিকদের অবস্থার উপরে নোতুন আলোক সম্পাত করে। এক দিকে, শস্য আইনগুলি সত্য সত্যই যারা উৎপাদনকারী তাদের স্বার্থ কত সামান্য ভাগ রক্ষা করে, সেটা দেখানো ছিল মধ্য শ্রেণীর আন্দোলনকারীদের স্বার্থের পক্ষে অনুকূল। অন্য দিকে, কারখানা-ব্যবস্থার। প্রতি ভূম্যধিকারী অভিজাত-বর্গের ধিক্কারে এবং কারখানা-কর্মীদের প্রতি ঐ চরম দুর্নীতিগ্রস্ত, হৃদয়হীন ও কেতাদুরস্ত নিষ্কর্মাদের কপট সহানুভূতিতে এবং কারখানা আইনের জন্য তাদের “কূটনৈতিক আগ্রহে” শিল্প-বুর্জোয়ারা চাপা আক্রোশে ফুসত। ইংরেজিতে একটা পুরানো প্রবাদ আছে যে, “যখন চোরদের মধ্যে ঝগড়া হয়, তখন সাধু লোক কারা তা আপনা-আপনি বেরিয়ে আসে”, এবং, বাস্তবিক পক্ষে, শাসক দুটি গোষ্ঠর মধ্যে কোন্ গোষ্ঠীটি শ্রমিকদের অধিকতর নির্লজ্জ ভাবে শোষণ শ্রেণীর করেছিল—এই নিয়ে যখন তাদের মধ্যে জোর গলায় উত্তেজনাপূর্ণ ঝগড়া হয়, তখন সেই পারস্পরিক ঝগড়াই হয় সত্য-প্রসবের ধাত্রী। আল শ্যাফটসবেরি, তদানীন্তন লর্ড অ্যাশলি ছিলেন অভিজাততান্ত্রিক, লোকহিতৈষী, কারখানা-বিরোধী অভিযানের প্রধান সেনানায়ক। সুতরা”, ১৮৪৫ সালে ‘মর্নিং ক্রনিক্স পত্রিকায় যেসব তথ্য উদঘাটিত হয়, তিনি ছিলেন তাতে একটি প্রিয় বিষয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই উদারনৈতিক মুখপত্রটি কৃষিপ্রধান জেলাগুলিতে কয়েকজন বিশেষ কমিশনার প্রেরণ করেছিল, যারা কেবল সাধারণ বর্ণনা ও পরিসংখ্যান নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন না, যে-সমস্ত শ্রমজীবী পরিবারকে পরীক্ষা করেছিলেন তাদের নাম এবং সেই তাদের জমিদারদেরও নাম প্রকাশ করেছিলেন। নিম্ন-প্রদত্ত তালিকাটিতে ব্ল্যানফোর্ড, উইমবোর্ন এবং পুল-এর নিকটবর্তী তিনটি গ্রামে যে মজুরি দেওয়া হয়, তা দেখানো হয়েছে। এই তিনটি গ্রাম হল মিঃ জি ব্যাংক এবং শ্যাফট্‌সবেরি আল-এর সম্পত্তি। লক্ষ্যণীয় যে, ব্যাংকস-এর মত এই “নিম্ন গীর্জার পোপ”, এই ইংরেজ পুরোহিত-প্রধানও বাড়িভাড়ার নাম করে শ্রমিকদের শোচনীয় মজুরির একটা বড় অংশ পকেটস্থ করে। (৪১৩ পৃঃ সারণী দ্রষ্টব্য)

ছবি। পেজ ৪১৩

শস্য আইন প্রত্যাহারের ফলে ইংল্যাণ্ডের কৃষিকর্মে একটা প্রেরণা সঞ্চারিত হল।[৫০] সবচেয়ে ব্যাপক আকারে জল-নিকাশের ব্যবস্থা, গোশালায় খাওয়াবার নোতুন পদ্ধতি, সবুজ ফসলের কৃত্রিম চাষের নোতুন পদ্ধতি, যান্ত্রিক সার-প্ৰয়োগ ব্যবস্থার প্রবর্তন, মাটি তৈরির নোতুন প্রণালী, খনিজ সাবের বর্ধিত ব্যবহার, বাম্প-ইঞ্জিনের এবং নানান ধরনের নোতুন মেশিনারির প্রচলন, সাধারণ ভাবে আরো নিবিড় কৰ্ষণ-এই সবই হল এই যুগের বৈশিষ্ট্য। রাজকীয় কৃষি সংস্থার সভাপতি মিঃ পুসে ঘোষণা করেন, নোতুন মেশিনারি প্রবর্তনের কল্যাণে চাষের ( আপেক্ষিক) ব্যয় প্রায় অর্ধেক হ্রাস পেয়েছে। অন্য দিকে, মৃত্তিকার প্রতিদান বস্তুতই বৃদ্ধি পেয়েছে। একরপ্রতি অধিকতর মূলধনের নিয়োজন এবং, তার ফলে, জোতসমূহের দ্রুততর সংকেন্দ্রীভবন এই হল নোতুন কৃষি-পদ্ধতির আবশ্যিক শর্ত।[৫১] একই সময়ে ১৮৪৬ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ ৪,৬৪,১১৯ একরেরও বেশি বৃদ্ধি পেল; তা ছাড়াও, পূর্বাঞ্চলের কাউন্টিগুলিতে যে-বিরাট এলাকা পড়েছিল, সেগুলিকে খড়গোসের বাসভূমি ও নিকৃষ্ট চারণক্ষেত্র থেকে রূপান্তরিত করা হল চমৎকার শস্যক্ষেত্রে। আগেই দেখানো হয়েছে, ঐ একই সময়ে কৃষিকর্মে নিযুক্ত মোট ব্যক্তির সংখ্যা হ্রাস পেল। নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সকল বয়সের শ্রমিকের সংখ্যা ১৮৫১ সালে যেখানে ছিল ১২,১১,৩৯৬, ১৮৬১ সালে তা কমে গিয়ে দাড়াল ১১,৬৩,২১৭।[৫২] সুতরাং ইংরেজ রেজিস্ট্রার-জেনারেল সঠিক ভাবেই যে-মন্তব্য করেন, “১৮০১ সাল থেকে কৃষক ও কৃষি-শ্রমিকদের যে-বৃদ্ধি ঘটে, তা : কৃষিজাত দ্রব্যাদির বৃদ্ধির সঙ্গে কোনো অনুপাত রক্ষা করেনি,[৫৩] সেই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, অনুপাত-বৈষম্য অনেক বেশি মাত্রায় ঘটে সর্বশেষ পর্যায়ে, যখন আরো নিবিড় কর্ষণ, মুক্তিকায় বিনিয়োজিতও তার উৎপাদন-কার্যে প্রযুক্ত মূলধনের অভূতপূর্ব অগ্রগতি এবং মাটির ফলনের পরিমাণে ইতিহাসে তুলনাবিহীন বৃদ্ধি, জমিদারদের ঘর-ভাড়ার উচ্চহার এবং ধনতান্ত্রিক কৃষকদের বর্ধিষ্ণু ধনসম্পদের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিকর্মে নিযুক্ত জনসমষ্টির চরম সংখ্যা হ্রাস। যদি আমরা দ্রুত ও অবিরাম গতিতে বাজারের তথা শহরের বিস্তার ও অবাধ বাণিজ্যের রাজত্বের সঙ্গে এই জিনিসটিকে এক সঙ্গে করে দেখি, তা হলে তো কৃষি-শ্রমিককে দেখতে পাব শেষ পর্যন্ত post tot discrimina rerum, এমন এক অবস্থায় যাতে তার হওয়া উচিত, ১ecundum artem, মুখের মদে মাতাল।।

অথচ অধ্যাপক রজার্স সিদ্ধান্ত করেছেন যে, আজকের ইংরেজ কৃষি-শ্রমিকের ভাগ্য তার চতুর্দশ শতকের শেষার্ধের বা পঞ্চদশ শতকের পূর্বপুরুষের সঙ্গে তো দূরের কথা, কেবল ১৭৭৩ থেকে ১৭৭০ সালের পূর্বপুরুষের ভাগ্যের সঙ্গে তুলনাতেও অস্বাভাবিক মাত্রায় আরো খারাপের দিকে গিয়েছে, “কৃষি-শ্রমিক আবার পরিণত হয়েছে ভূমিদাসে। এমন একজন ভূমিদামে যার খাওয়া-পরা হয়েছে আরো শোচনীয়।[৫৪] ডাঃ হান্টার কবি-শ্রমিকের আবাসন সম্পর্কে তাঁর যুগান্তকারী রিপোর্টে বলেছেন, “খেতি-র (কৃষি শ্রমিক, ভূমিদাস-প্রথার আমল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নাম } খরচ ধার্য হয় তার বেঁচে থাকার মত যথাসম্ভব নিম্নতর পরিমাণে তাকে খাটিয়ে যে-মুনাফা কামানো হয়, তার সঙ্গে তাকে যে-মজুরি ও আস্তানা দেওয়া হয়, তার কোনো সম্পর্ক নেই। চাষের কাজের খরচের হিসাবে সে একটা শূন্য।[৫৫] প্রাণ-ধারণের দ্রব্য-সামগ্রীকে সব সময়েই ধরা হয় একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বলে।[৫৬] তার আয় আরো কমলে সে বলতে পারে, inihil habeo nilhil curo, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার কোনো ভয় নেই, কেননা কেবল টিকে থাকার জন্য যতটুকু চাই, ততটুকুই এখন সে পায়। সে এখন পৌছে গিয়েছে শূন্যে, যেখান থেকে শুরু হয় তার নিয়োগকারী কৃষকের গোনাগুনি। যাই আসুক না কেন, সম্পদেও যেমন তার কোনো ভাগ নেই, বিপদেও তেমন তার কোনো ভাগ নেই।” [৫৭]

১৮৬৩ সালে, দ্বীপান্তর ও সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের পুষ্টি ও শ্রম সম্পর্কে একটি সরকারি তদন্ত পরিচালিত হয়। এই তদন্তের ফলাফল দুটি বৃহদাকার “রু-বুকে লিপিবদ্ধ করা হয়। অন্যান্য বিষয় ছাড়াও এতে বলা হয়েছে, “ইংল্যাণ্ডে কয়েদখানার কয়েদীদের আহার এবং ঐ একই দেশে দুঃস্থ নিবাসের দুঃস্থদের ও মুক্ত শ্রমিকদের আহারের মধ্যে বিস্তারিত তুলনা করলে, এটা নিশ্চিত ভাবেই দেখা যায়। যে, কয়েদীদের আহার বাকি দুটি শ্রেণীর আহার থেকে অনেক ভাল,[৫৮] অথচ সশ্রম কারাদণ্ডভোগী কয়েদীকে যে-পরিমাণ শ্রম করতে হয়, তা একজন মামুলি দিন-মজুরের শ্রমের অর্ধেক।”[৫৯] সাক্ষীদের সাক্ষ্যের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যসূচক দৃষ্টান্ত : এডিনবরা। কারাগারের কারাপাল জন স্মিথ-এর সাক্ষ্য : নং ৫৫ ৫৬। “ইংল্যাণ্ডে মামুলি মজুরদের খাবারের তুলনায় সেখানকার কারাগারের কয়েদীদের খাবার উৎকৃষ্টতর।” নং ৫০। “এটা ঘটনা যে, স্কটল্যাণ্ডের সাধারণ কৃষি মজুরেরা খুব কদাচিৎ আদৌ কোনো মাংস পায়। উত্তর নং ৩০ ৪৭। “সাধারণ শ্রমিকদের তুলনায় তাদের অনেক বেশি ভাল খাবার খাওয়াবার আবশ্যকতার কোনো কারণ আপনি দেখাতে পারেন কি? নিশ্চয়ই না।” নং ৩০ ৪৮। সরকারি পূর্ত কর্মে নিযুক্ত বন্দীদের জন্য মুক্ত শ্রমিকদের খাদ্যতালিকার প্রায় অনুরূপ একটি খাদ্যতালিকা নির্ধারণ করার জন্য আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো কর্তব্য বলে কি আপনি মনে করেন না?”[৬০]…“সে। (কৃষি-শ্রমিক। বলতে পারে, “আমি কঠোর পরিশ্রম করি, কিন্তু আমি যথেষ্ট খাবার পাই না; অথচ আমি যখন জেলে ছিলাম, আমি কঠোর পরিশ্রম করতাম না কিন্তু প্রচুর খাবার পেতাম; সুতরাং এখানে থাকার চেয়ে আমার জেলে যাওয়াই ভাল।”[৬১] উক্ত বিপোর্টের প্রথম খণ্ডটির সঙ্গে প্রদত্ত সংযোজনীটির সারণীগুলির থেকে আমি নিচেকার তুলনামূলক সার-সংক্ষেপটি সংকলন করেছি।

সবচেয়ে কম-ভুক্ত শ্রেণীগুলির খাদ্য সম্পর্কে ১৮৬৩ সালে মেডিক্যাল কমিশন যে তদন্ত করেছিল, তার সাধারণ ফল পাঠকের কাছে পরিজ্ঞাত। তার নিশ্চয়ই স্মরণে

 ছবি। পেজ ৪১৭

আছে যে “অনাহার-মৃত্যু রোধ করার জন্য যে-ন্যূনতম খাদ্যের প্রয়োজন, কৃষি শ্রমিকদের পরিবারগুলির বেশির ভাগেরই আহার তার চেয়ে কম। কর্ণওয়াল ডেভন, সমারটেস, উইলস, স্ট্যাফোর্ড, অক্সফোর্ড, বার্কস্ এবং হের্টস্-এর মত সমস্ত বিশুদ্ধ গ্রামীণ জেলাগুলির পক্ষেই অবস্থাটা বিশেষভাবে এই রকম। ডাঃ স্মিথ বলেন, “গড় পরিমাণ থেকে যা বোঝা যায়, শ্রমিক নিজের জন্য তার চেয়ে বেশি পুষ্টি পেয়ে থাকে, কেননা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের তুলনায় সে তার কাজ করার ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য- বেশি অংশটা খায়; দরিদ্রতর জেলাগুলিতে সমস্ত মাংস ও বেকনটাই সে খায়। তার স্ত্রী ও তার শিশুরাও দ্রুত বৃদ্ধির কালে যে-পরিমাণ খাদ্য পায়, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এবং প্রায় সব কাউন্টিতেই স্বল্প, বিশেষ করে নাইট্রোজেনে অপ্রতুল।[৬২] কৃষকদের নিজেদের সঙ্গে যে পুরুষ ও নারী দাস-দাসীর। থাকে, তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি পায়। ১৮২১ সালে তাদের সংখ্যা ছিল ২,৮০,২৭৭ জন; ১৮৬১ সালে তা কমে গিয়ে দাড়ায় ২,৪,৬২। ডাঃ স্মিথ বলেন, “ক্ষেতে নারীদের শ্রমের যতই অসুবিধা থাক না। কেন: আজকের পরিস্থিতিতে তা পরিবারের পক্ষে বিরাট সুবিধাজনক, কেননা তা সেই পরিমাণ মজুরি যোগ করে যা জুতো ও পোষাক-আশাকের খরচ এবং বাড়ি ভাড়ার যোগান দেয় এবং এইভাবে পরিবারটির জন্য ভালো খাবারের সংস্থান করে।”[৬৩] উক্ত তদন্তের একটি লক্ষণীয় ফল হল এই যে, “যুক্তফ্রাজ্যের অন্যান্য অংশের মধ্যে ইংল্যাণ্ডের কৃষি-শ্রমিকই “বিশেষভাবে সবচেয়ে স্বল্পভুক্ত, নিচের সাণীটি থেকে যা দেখা যাবে :

একজন গড়পড়তা কৃষি-শ্রমিক কর্তৃক সপ্তাহ-প্রতি পরিভুক্ত কার্বন ও নাইট্রোজেনের পরিমাণঃ

ইংল্যান্ড — কার্বন-গ্রেন   ৪৬,৬৭৩ — নাইট্রোজেন-গ্রেন ইংল্যান্ড   ১,৫৯৪
ওয়েলস —     ,,          ৪৮,৩৫৪ —        ,,                      ২,০৩১
স্কটল্যান্ড —    ,,          ৭৮,৯৮০             ,,                      ২,৩৪৮
আয়ারল্যাণ্ড — ,,          ৪৩,৩৬৬ —        ,,                      ২,৪৩৪

ডাঃ সাইমন তার সরকারি রিপোর্টে বলেন, “আমাদের কৃষি-শ্রমিকেরা সাধারণ ভাবে যে-বাসস্থান প্রাপ্ত হয়, তার সীমাবদ্ধ পরিমাণ ও শোচনীয় গুণমান সম্পর্কে ডাঃ হান্টারের রিপোর্টটির প্রত্যেকটি পাতাই একটি করে প্রমাণপত্র। এবং, অনেক বছর ধরে, ক্রমে ক্রমে, এইদিক থেকে শ্রমিকদের অবস্থা আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে। ঘর খুজে পাওয়াই এখন তার পক্ষে হয়ে উঠেছে আরো দারুন একটা কঠিন ব্যাপার, আর যদি খুজে পেতে একটা পাওয়াও যায়, তা এমন অনুপযুক্ত যে সম্ভবতঃ কয়েক শতাব্দীর মধ্যে তেমন আর হয়নি। বিশেষ করে, গত কুড়ি থেকে তিরিশ বছরের মধ্যে এই দুর্ঘটনা দ্রুত বেড়েই চলেছে এবং শ্রমিকের ঘর-সংসারের অবস্থা এখন হয়ে উঠেছে চরম মাত্রায় শোচনীয়। যে পর্যন্ত তারা, যারা তার শ্রমের দৌলতে সমৃদ্ধ হয়, তার প্রতি কিছুটা সদয় প্রশ্রয়ের সঙ্গে আচরণ করে, ততটুকু পর্যন্ত ছাড়া এ ব্যাপারে সে অত্যন্ত অদ্ভুত ভাবে অসহায়। যে-জমি চাষের কাজে সে অংশ নেয়, সেই জমিটার এক কোণায় সে একখানা ঘর পাবে কিনা, যদি পায় তা হলে সেই ঘরটা শুয়োরের খোঁয়াড় না হয়ে মানুষের থাকার উপযুক্ত হবে কিনা, ঘরের সঙ্গে, একটা ছোট্ট বাগান করার মত জায়গা—যা তার দারিদ্র্যের চাপ বহুল পরিমাণ লাঘব করতে পারে-থাকবে কিনা, এই সব তার প্রয়োজন মত ভদ্র বাসস্থান পাবার জন্য যুক্তিসঙ্গত ভাড়া দেবার ইচ্ছা ও সঙ্গতির উপরে নির্ভর করেনা, নির্ভর করে অন্যান্য যারা ঘর পেয়েছে তাদের নিজের জিনিস ইচ্ছামত ব্যবহারের অধিকারের সঙ্গে ব্যাপারটা সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে বলে তারা মনে করে কিনা, তার উপরে। একটা জোত যত বিরাটই হোক না কেন, এমন কোনো আইন নেই যে তার ওপরে কিছু সংখ্যক শ্রমিকের থাকার ঘরের ব্যবস্থা (ভদ্র ব্যবস্থার তো কথাই ওঠেনা) করতে হবে; এমনকি এমন কোনো আইনও নেই যা, যে-জমির পক্ষে তার শ্রম রৌদ্র ও বৃষ্টির মতই অবশ্য-প্রয়োজন, সেই জমিতে তার জন্য এতটুকুও অধিকারও সংরক্ষিত করে না। একটি বাইরের ব্যাপার প্রবল ভাবে তার বিরুদ্ধে কাজ করে : গরিব আইনের আবাসন ও আর্থিক দায় সংক্রান্ত সংস্থানগুলির প্রভাব।[৬৪] এই সংস্থানগুলির দরুন প্রত্যেকটি প্যারিশ চায় তার আবাসিক শ্রমিকদের সংখ্যা যথাসম্ভব ন্যূনতম মাত্রায় হ্রাস করতে কেননা তাতে তার আর্থিক স্বার্থ থাকে; তার কারণ এই যে, কঠোর পরিশ্রমী শ্রমিক ও তার পরিবারের জন্য নিরাপদ ও নিত্যস্থায়ী স্বনির্ভরতার নির্দেশক না হয়ে কৃষি-শ্রম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্দেশ করে দুঃস্থতায় উপনীত হবার দীর্ঘ বা হ্রস্ব পথ-পরিক্রমা—এমনি এক দুঃস্থতা যা পরিক্রমার সমগ্র পথটি ধরেই থাকে তার এত কাছে যে, যে-কোনো অসুখ বা সাময়িক কর্ম বিরতি তাকে বাধ্য করে ত্রাণ-সাহায্যের জন্য প্যারিশের দ্বারস্থ হতে;-অতএব, কোন প্যারিশে কৃষি-জনসংখ্যার গোটা বসতিটার ফল দাড়ায় তার গরিব-করের পরিমাণে বিপুল বৃদ্ধি। বড় বড় জমিদারের[৬৫] সিদ্ধান্ত করে তাদের জমিদারিতে শ্রমিকদের জন্য কোনো বাসস্থান হবে না, এবং সেক্ষেত্রে তাদের জমিদারি গরিবদের দায়-দায়িত্ব থেকে কার্যত আধাআধি মুক্ত থাকবে। ইংরেজদের সংবিধানে ও বিধানে এটা কতদূর পর্যন্ত অভিপ্রেত হয়েছে যে, জমিতে এই ধরনের নিঃশর্ত সম্পত্তি আয়ত্ত করা যাবে এবং জমিদার তার নিজের জিনিস ইচ্ছামত ব্যবহারের অধিকারের বলে এই দেশেরই চাষীদের সঙ্গে আচরণ করবে পর-দেশীদের মত, যাদের সে তাড়িয়ে দিতে পারে তার জমির সীমানা থেকে—এটা এমন একটা প্রশ্ন, যা নিয়ে এখানে আমি আলোচনা করার দাবি করছি না। কেননা জমি থেকে উচ্ছেদের সেই ক্ষমতা। কেবল তত্ত্বের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই। কার্যক্ষেত্রেও ব্যাপক আকারে তা বিদ্যমান রয়েছে বিদ্যমান হয়েছে কৃষি-শ্রমিকের গার্হস্থ্য ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান নিয়ামক শর্ত হিসাবে। . এই অনাচারের ব্যাপকত। সম্পর্কে ডাঃ হান্টার গত আদমশুমারিতে যে তথ্য প্রমাণ সংকলিত করেছিলেন, তার উল্লেখ করাই যথেষ্ট : ঘর-বাড়ির জন্য স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও গত দশ ‘ছর ধরে ই’লণ্ডের ৮২১টি আলাদ। আলাদা প্যারিশে বা টাউনশিপে। উপ-নগরে। ক্রমাগত বাড়ি-ঘর ধ্বংস করা হচ্ছে, যার ফলে যে-সমস্ত আবাসিক অনাবাসিকে পরিণত হতে বাধ্য হয়েছে (অর্থাৎ প্যারিশগুলিতে যেখানে তারা কাজ করত। তাদের হিসাবে না ধরেও, এই সব প্যারিশ ও টাউনশিপগুলি ১৮৫১ সালে যে-পরিমাণ বাসস্থান যত সংখ্যক লোক ধারণ করত, ১৮৬১ সালে তার তুলনায় শতকরা ৪ কম পরিমাণ বাসস্থানে শতকরা ৫৪ বেশি সংখ্যক লোককে ধারণ করছে। ডাঃ হান্টার বলেন, যখন জনসংখ্যার-উচ্ছেদনের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হল, তখন তার ফলে তৈরি হল এক একটি প্রদর্শনী পল্লী, যেখানে কুটিরগুলিকে পর্যবসিত করা হয়েছে অল্পমাত্র সংখ্যায় এবং যেখানে মেষপালক, উদ্যান মালী, শিকার-রক্ষী ইত্যাদির মত জমিদারের নিজস্ব প্রয়োজনের লোকজন ছাড়া আর কেউ রইল না–অর্থাৎ রইল কেবল নিয়মিত দাস-দাসী যারা তাদের শ্রেণী অনুযায়ী ভাল ব্যবহার পায়।[৬৬] কিন্তু জমির জন্য চাষ, এবং দেখা যায় যে তার জন্য নিযুক্ত শ্রমিকেরা আর জমির মালিকের ভাড়াটে নয়, তারা আসে কাছাকাছি কোনো মুক্ত গ্রাম থেকে, হয়ত তা তিন মাইল দূরে, তাদের কুটিগুলি ধ্বংস করে দেবার পরে যে-গ্রামের ছোট ছোট বাড়ি-মালিকেরা তাদের ভাড়াটে হিসাবে গ্রহণ করেছে। যখন পরিস্থিতি এই পরিণতির দিকে এগোয়, তখন যে-কটি কুটির তখনো সংস্কার বিহীন ভগ্নপ্রায় দশায় দাড়িয়ে থাকে, তারা নির্দেশ করে তাদের আসন্ন অবলুপ্তির ভবিষ্যতের দিকে। তাদের দেখা যায় স্বাভাবিক অবক্ষয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে। যতদিন পর্যন্ত কাঠামোটা কোনক্রমে দাড়িয়ে থাকে, ততদিন শ্রমিককে ওটা ভাড়ায় দেওয়া হয় এবং, এমনকি একটা ভালো বাসার সমান ভাড়া দিয়েও শ্রমিক খুশি হয়ে সেটা ভাড়া নেয়। কিন্তু তাতে না করা হয় আর কোনো রকম উন্নয়ন, না কোনো রকম মেরামতির কাজ; তবে কেবল সেইটুকু হয়, যতটুকু তার কপর্দকহীন ভাড়াটেরা নিজের করে নিতে পারে। এবং তার পরে যখন তা হয়ে পড়ে একেবারে বাসের অযোগ্য এমনকি সামান্যাম ভূমি-দাসেরও বাসের অযোগ্য, তখন ধ্বংসস্তুপের তালিকায় আরো একটি সংযোজন ঘটে, এবং ভবিষ্যৎ গরিব-করের বোঝ কিছুট। লাঘব হয়। এক দিকে যখন বড় বড় মালিকেরা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন জমিগুলিকে এই ভাবে জনবসতি-শূন্য করে গরিব-কর এড়িয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে তখ। নিকটতম শহর বা মুক্ত গ্রামে উচ্ছিন্ন মানুষেরা গিয়ে দলে দলে ভিড় করছে; আমি বলছি বটে “নিকটতম” কিন্তু এই “নিকটতম”-র মানে হচ্ছে শ্রমিক যে কৃষি-জোতে দৈনিক খাটে ত’ থেকে তিন-চার মাইল দূরে। তখন সেই দৈনিক খাটুনির সঙ্গে যুক্ত হয় রুটি রোজগারের জন্য ছয় বা আট মাইল হাঁটবার দৈনিক প্রয়োজন, যেন সেটা কিছুই নয়। এবং যেন তার স্ত্রী বা সন্তানেরা কৃষি-জোতে যে-কাজই করুক না কেন, তাদেরকেও সহ্য করতে হয় ঐ অসুবিধা। এই দূরত্বজনিত যে বাড়তি খাটুনি, সেটাও সবখানি নয়। মুক্ত গ্রামটিতে বাড়ির ফটকাবাজের। ছোট ছোট জমির টুকরো কিনে নেয়, যেগুলি তারা যথাসম্ভব সস্তা কুঁড়েঘরে গায়ে গায়ে ছেয়ে ফেলে। আর সেই শোচনীয় আস্তান। গুলির মধ্যে (যেগুলি যদিও অবস্থিত মুক্ত গ্রামে, তবু কলংকিত শহরের সবচেয়ে কদর্য বৈশিষ্ট্যগুলির দ্বারা ভিড় করে ইংলণ্ডের কৃষি শ্রমিকেরা।[৬৭] অন্য দিকে ভাবলে ভুল হবে যে, যে-শ্রমিক তার চাষের জমিতেই থাকার ঘর পায়, সেখানে তার বাসস্থানের ব্যবস্থা সাধারণত এমন যে, তা তার উৎপাদনশীল শ্রমের জীবনের পক্ষে উপযুক্ত। এমনকি রাজকীয় জমিদারিতে পর্যন্ত তার কুটিরটি হতে পারে অতি জঘন্য ধরনের এমন সব জমিদার আছে, যারা মনে করে যে-কোনো খোয়াড়ই শ্রমিক আর তার পরিবারের থাকার পক্ষে যথেষ্ট এবং তবু তার লজ্জা হয় না ভাড়া নিয়ে বচেয়ে কঠোর দরকষাকষি করতে।[৬৮] হয়তো সেই সর্বনাশা কুঁড়েটায় আছে একটা মাত্র শোবার ঘর, যার না আছে কোনো আগুনের ঝাঁঝরি, না কোনো পায়খানা, না কোন খোলা জানাল, ডােবা ছাড়া না আছে কোনো জলের ব্যবস্থা, না কোনো বাগান—কিন্তু এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে শ্রমিক অসহায়। আইনসমূহ . আর আবর্জনা অপসারণ হল কেবল বাজে কাগজের টুকরো যার ব্যবহার নিন্দ্র করে এমন সব কুটির মালিকের উপর যাদের একজনের কাছ থেকে সে তার কুঁড়েঘরটা ভাড়া পেয়েছে ন্যায়নীতি স্বার্থে এটা অত্যাবশ্যক যে, আলো-ঝলমল অতি-বিরল স্থানগুলি থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে এনে তা নিবদ্ধ করা উচিত এই ব্যাপ্ত ঘটনাবলীর উপরে, যা ইংল্যাণ্ডের সভ্যতার পক্ষে একটা ধিক্কার-স্বরূপ। বস্তুত পক্ষে এটা একটা শোচনীয় পরিস্থিতি যে, বর্তমান আবাসন-পরিস্থিতির গুণগত অপকর্ষ এত প্রকট হওয়া সত্ত্বেও, উপযুক্ত পর্যবেক্ষকদের অভিন্ন সিদ্ধান্ত এই যে, বাসস্থানগুলির সাধারণ অপকৃষ্ট অবস্থার তুলনাতেও ঢের বেশি জরুরি সমস্যা হল সেগুলির স’খ্যাগত অপ্রতুলতা। অনেক বছর ধরেই গ্রামীণ শ্রমিকদের অতি-জনাকীর্ণ বাসস্থানগুলি কেবল ” সাস্থ্য-সংক্রান্ত কল্যাণের বিষয় ভাবেন কেবল তাদের কাছেই নয়, সেই সঙ্গে স্বর। ভদ . নৈতিক সম্বন্ধে ভাবেন, তাদের কাছেও গভীর উদ্বেগের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। গ্রাঞ্চলে মহামাৰি-ব্যাধিগুলির বিস্তার সঙ্গে প্রতিবেদকে বারংবার এমন অভিন্ন ভাষায় এই অতি-জনাবীর্ণতার উপরে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে মনে হয় যেন তারা একই গৎ-বঁধ! বুলি আউডে চলেছেন; তারা এই অতি জনাকীর্ণতার উপরে চরম গুরুত্ব দিয়েছেন এই কারণে যে, এটা এমনি একটা ঘটনা যা সংক্রমণ রোধের প্রত্যেকটি প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে দেয়। এবং বারংবার এই দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে যে, পল্লী-পরিবেশে বহু স্বাস্থ্যকর উপাদান থাকা সত্ত্বেও, এই অতি জনাকীর্ণতা, যা সংক্রামক ব্যাধি বিস্তারের পক্ষে এত অনুকূল, এমন সব ব্যাধিরও জন্ম দেয়, যা সংক্রামক নয়। এবং যারা আমাদের গ্রামীণ জনসংখ্যার এই ভিড-আক্রান্ত পরিস্থিতিকে নিন্দা করেছেন, তার তার। আরো একটি ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে নীরব থাকেন নি। যদিও তাদের পর্যবেক্ষণের প্রাথমিক বিষয় ছিল স্বাস্থ্যের পক্ষে অনিষ্টকর দিকগুলি, অনেক সময়ই তারা বাধ্য হয়েছেন উল্লিখিত বিষয়টির অন্যান্য দিকগুলি সম্পর্বেও উল্লেখ করতে। বয়স্ক নারী-পুরুষের, বিবাহিত ও অবিবাহিতরা : প্রায়শই একটি ছোট্ট শোবার ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয়, তা দেখাতে গিয়ে, তাদের রিপোর্টগুলিতে দৃঢ় ভাবে এই কথা বলা হয়েছে যে, উল্লিখিত অবস্থায় শালীনতা বিনষ্ট হতে বাধ্য। এবং নৈতিকতাও স্বভাবতই ক্ষগ না হয়ে পারে না।[৬৯] যেমন দৃষ্টান্ত হিসাবে, আমার গত শরৎকালীন রিপোর্টের পরিশিষ্টে বাকিংহাম শায়ারে উইং-এ জ্বরের আক্রমণ। সম্পর্কে রিপোর্ট করতে গিয়ে ডাঃ অর্ড বলেন, কেমন করে একজন যুবক উইনগ্রেভ থেকে জ্বর নিয়ে সেখানে এসেছিল, “তার অসুখের প্রথম ক’দিন একই রুমে আরো ন’জনের সঙ্গে ঘুমোত। এক পক্ষকালের মধ্যে তাদের আরো ক’জন জ্বরে আক্রান্ত হল এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ন’জনের মধ্যে পাঁচজনই শয্যাগত হল, এবং একজন মারা গেল। সেন্ট জর্জ হাসপাতালের ডাঃ হার্ভে, যিনি ঐ মহামারীর সময়ে ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক কারণে উইং-এ গিয়েছিলেন, তার কাছ থেকে ঠিক এই মর্মে একটি রিপোর্ট আমি পেয়েছিলাম :: “একটি জ্বরাক্রান্ত তরুণী একই ঘরে রাতে তার বাবা ও মা, তার জারজ সন্তান, দুজন তরুণ (তার দু ভাই) এবং তার দু বোন ও তাদের প্রত্যেকের একটি করে জারজ সন্তানকে নিয়ে-মোট ১০ জন একসঙ্গে ঘুমোত। কয়েক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত সেখানে ঘুমোত ১৩ জন।[৭০]

ডাঃ হান্টার কৃষি-শ্রমিকদের ৫,৩৭৫টি কুটিরে সমীক্ষা চালান—কেবল নিছক কৃষি-জেলাগুলিতেই নয়, ই’ল্যাণ্ডের সমস্ত কাউন্টিতেই। এই কুটিরগুলির মধ্যে ২,১৯৫ টির ছিল মাত্র একটি করে শোবার ঘর (প্রায়ই যা ব্যবহৃত হত বসার ঘর হিসাবেও ), ২,৯৩০টির ছিল কেবল দুটি করে, এবং ২৫০টির দুটির বেশি করে। ডজনখানেক কাউন্টি থেকে সংগৃহীত কয়েকটি নমুনা আমি এখানে উপস্থিত করব।

(১) বেডফোর্ডশায়ার

রেসলিংওয়ার্থঃ শোবার ঘর, দৈর্ঘ্যে প্রায় ১২ ফুট এবং প্রস্থে ১০ ফুট, যদিও অনেকগুলি এর চেয়ে ছোট। ঘোট একতলা কুটির, প্রায়ই ‘পার্টিশন’ দিয়ে দুটি শোবার ঘরে বিভক্ত, একটি বিছানা অনেক ক্ষেত্রেই রান্নাঘরে, উচ্চতায় ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। খাজনা বাৎসরিক ৩ পাউণ্ড। ভাড়াটেদেরই নিজেদের পায়খানা তৈরি করে নিতে হয়, জমিদার কেবল একটা গর্ত খুড়ে দেয়। যখনি কেউ একটা পায়খানা তৈরি করে নেয়, তখন থেকেই কাছাকাছি গোটা তল্লাটের মানুষ সেটা ব্যবহার করতে শুরু করে। রিচার্ডসন নামে এক পরিবারের একটি বাড়ি ছিল সৌন্দর্যে অনুপম। তার প্লাস্টার দেওয়ালগুলি ছিল নতজানু মহিলার পরিচ্ছদের মত পরিস্ফীত। ছাদের এক প্রান্তের কোণটি ছিল উত্তল অন্য প্রান্তের অবতল। এবং, দুর্ভাগ্যক্রমে, চিমনিটি দাড়িয়েছিল এই দ্বিতীয়টির উপরে মাটি ও কাঠের তৈরি একটি বাঁকানো নল, যেন একটি হাতির শু। একটি লম্বা লাঠি দিয়ে চিমনিটিকে ঠেকা দিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে না পড়ে য.য়। দরজা ও জানালা ছিল হীরকাকার।” যে ১৭টি বাড়ি আমরা দেখেছি, তাদের মধ্যে ৪টির ছিল একটির বেশি শয়ন-ঘর, আর ঐ চারটি ছিল অতিরিক্ত ভিড়ে ঠাসাঠাসি। এক শোর-ঘর-বিশিষ্ট কুটিরগুলিতে থাকত ৩ জন করে বয়স্ক ব্যক্তি ও ৩টি করে শিশু একটি বিবাহিত দম্পতি ও ৬টি শিশু ইত্যাদি।

ডান্টনঃ উচু ভাড়া, ৪ পাউণ্ড থেকে ৫ পাউণ্ড, মানুষটির সাপ্তাহিক মজুৰ্বি ১. শিলিং। খডের দড়ি পাকিয়ে পরিবারটি ভাড়া দেবার আশা পোষণ করে। ভাড়া যত উচু হয়, ততই তা দেবার জন্য আরো বেশি সংখ্যক লোকের একসঙ্গে কাজ করার দরকার হয়। এটি শিশু সহ ৬ জন বয়স্ক ব্যক্তি একটি শয়নঘরে বাস করে, ভাড়া দেয় ৩ পাউণ্ড ১০ শিলিং। ডাণ্টনের সবচেয়ে সস্তা বাড়ি, বাইরে থেকে ১০ ফুট লম্বা, ১০ ফুট চওডা; ভাড়া ৩ পাউণ্ড। যে-বাড়িগুলি পরিদর্শন করা হয়েছে, সেগুলির মধ্যে ১টি মাত্র দুটি শয়নকক্ষ-বিশিষ্ট। গ্রামটির একটু বাইরে “ভাড়াটেরা বাড়ির পাশে মলত্যাগ কত”, দরজার নিচের ৯ ইঞ্চি পচে-গলে গিয়েছে; দরজার প্রবেশ পথ মানে মাত্র একটা ফাক, রাতে যা বন্ধ করে দেওয়া হয় কয়েকটা ইটের সাহায্যে; বন্ধ করে দেবার পরে সুকৌশলে একটু উপরে ঠেলে দেওয়া হয় এবং একটি মাদুর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। জানালার অর্ধেকট। তার পাল্লা ও সার্শি সমেত মহাপ্রয়াণে গিয়েছে। আসবার-শূন্য এই ঘরটিতে গাদাগাদি করে থাকত ৫টি শিশু-সন্তান সহ ৩ জন বয়স্ক লোক। বিগত্সওয়েড ইউনিয়নের বাকি অংশের তুলনায় ডাণ্টনের অবস্থা খারাপ ছিল না।

(২) বার্কশায়ার

বীনহাম ঃ ১৮৬৪ সালের জুন মাসে একটি লোক তার স্ত্রী ও চার সন্তান সহ একটি কট’-এ ( একতলা টিরে বাস করত। এক কন্যা কাজ থেকে বাড়ি ফিরল ‘স্কার্লেট’ জর নিয়ে। সে মারা গেল। একটি শিশু আক্রান্ত হল, সে-ও মারা গেল। যখন ডাঃ হান্টারকে ডাকা হল, তিনি দেখলেন একটি ম-ও একটি শিশু টাইফাসে শয্যাগত। বাবা এবং বাকি শিশুটি বাইরে শুত, কিন্তু বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখা এখানে একটা সমস্যা হয়ে দাড়াল, কারণ এই শোচনীয় গ্রামটির ভিড়ে-ঠাসা বাজারে পোয়র জন্য পড়ে থাকত ঐ জ্বরাক্রান্ত পরিবারটির কাপড়-চোপড়। ২-এর বাড়ির ভাড়া ছিল সপ্তাহে ১ শিলিং; স্বামী স্ত্রী ও দুটি সন্তানের জন্য একটি শোবার ঘর। একটি বাড়ির ভাড়া ছিল সপ্তাহে ৮ পেন্স, লম্বায় ১৪ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং চওড়ায় ৭ ফুট; রান্না-ঘর উচ্চতায় ৬ ফুট; শোবার ঘরটিতে কোনো জানালা, আগুনের ঝাঁঝরি, দরজা বা ফাক ছিলনা, একমাত্র বারান্দায় বেরোবার পথটি ছাড়া, কোনো বাগান ছিল না। একটি লোক এখানে কিছু কাল ছিল দুটি বড় বড় মেয়ে ও একটি বড় ছেলেকে নিয়ে, বাবা ও ছেলে ঘুমোত বিছানায়, মেয়ে দুটো যাতায়াতের পথে। ওরা যখন এখানে থাকত তখন দুটি মেয়েরই একটা করে বাচ্চা, ছিল, কিন্তু একজন দুঃস্থ-নিবাসে আঁতুড়ে গিয়েছিল। পরে ফিরে আসে।

 (৩) বাকিংহামশায়ার

১,০০০ একর জমির উপরে উপরে ৩ টি কুটির, ১৩০-১৪৫ জন লোকের বাস। ব্রাডেনহাম প্যারিশ-এ অন্তর্ভূক্ত ১,০০০ একর, ১৮৫১ সালে বাড়ির সংখ্যা ছিল ৩৬, জনসংখ্যা ছিল ৮৪ জন পুরুষ ৫৪ জন নারী। ১৮৬১ সালে নারী-পুরুষের এই বৈষম্যের আংশিক প্রতিকার হয়, তখন পুরুষ ও নারীর সংখ্যা যথাক্রমে দাঁড়ায় ৯৮ ও ৮৭ জন; ১০ বছরে পুরুষ ও নার্বীর যথাক্রমিক বৃদ্ধি ১৭ ও ৩৩ জন। ইতিমধ্যে, বাড়ির সংখ্যা কিন্তু একটি কমে গিয়েছে।

উইনস্লো : এর বড় অংশ সুন্দর শৈলীতে নোতুন করে নির্মিত; বাড়ির জন্য চাহিদা খুব প্রকট; অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থার কুঁড়েগুলিও ভাড়া দেওয়া হয় সাপ্তাহিক ১ শিলিং থেকে ১শিলিং ৩ পেন্স হারে।

ওয়াটারইটন : ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে জমিদারেরা শতকরা ২০ ভাগ বাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে। একজন দরিদ্র শ্রমিক যাকে প্রায় ৪ মাইল ডিঙ্গিয়ে কর্মস্থলে যেতে হয়, তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল : সে কি কাছে পিঠে একটা কুঁড়েঘর যোগাড় করে নিতে পারে না? উত্তরে সে বলল, “না আমার মত একটা বড় পরিবারকে ঠাই না দিয়ে কি করতে হয়, তারা তা ভাল জানে।”

টিংকার্স এণ্ড : উইনস্লোর কাছেই অবস্থিত। একটি শোবার ঘর, যাতে ছিল ৭ জন বয়স্ক ব্যক্তি ও ৪টি শিশু; লম্বায় ১১ ফুট চওড়ায় ৯ ফুট এবং যেখানটা সবচেয়ে উঁচু সেখানটা উচ্চতায় ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি; আরেকটি লম্বায় ১১ ফুট ৩ ইঞ্চি, চওড়া ৯ ফুট ও উচু ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি; বাস করত ৬ জন। একজন কয়েদির পক্ষে যতটা জায়গা। তাবশ্যক বলে বিবেচনা করা হয়, এদের প্রত্যেকেই থাকত তার চেয়ে কম জায়গায়। কোন বাড়ির একটার বেশি শোবার ঘর ছিল না, কোনোটারই খিড়কির দরজা ছিল ন জল ছিল অতি দুষ্প্রাপ্য; সাপ্তাহিক বাড়ি ভাড়া ১ শি ৪ পে থেকে ২ শি অবধি। যেসব বাডি প্রদর্শন করা হয়, তাদের মধ্যে ১৬টিতে, এমন লোক ছিল মাত্র একজন, যে উপার্জন করত সপ্তাহে ১০ শিলিং। উপরে বর্ণিত অবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে-পরিমাণ হাওয়া পাওয়া যেত তা যদি তাকে গোটা রাত সব দিক থেকে মাপে ৪ ফুট এমন একটি বাক্সে আটকে রাখা হত, তবে সে যে-পরিমাণ হাওয়া পেত, তার সমান। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রাচীন গুহাগুলিতেও তো কিছু পরিমাণ অ-পরিকল্পিত হাওয়া-চলাচলের সংস্থান ছিল।

(৪) কেম্ব্রিজশায়ার

গ্যাম্বলিংগের মালিক কয়েকজন জমিদার। এতে রয়েছে এমন জঘন্যতম সব কুঁড়েঘর যা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। খড়ের দড়ি পাকানোর হিড়িক। “একটা মারাত্মক অবসাদ, অপরিচ্ছন্নতার কাছে এক হতাশ আত্মসমর্পণ গ্যাম্বলিংগেতে রাজত্ব করে। যার কেন্দ্রস্থলে অবহেলা, তার উত্তর দক্ষিণ দুই প্রান্ত পরিণত হয় অত্যাচারে, যেখানে বাড়ি-ঘরগুলি জীর্ণ হয়ে চূর্ণ হয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে। ‘প্রবাসী’ অনুপস্থিত জমিদারে এই গরিব বস্তিবাসীদের রক্ত মোক্ষণ করে অবাধে। ভাড়া অত্যন্ত চড়া; ৮-৯ জন করে লোককে ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয় একটা শোবার ঘরে; দুটি ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে প্রত্যেকের ১টি বা ২টি বাচ্চা আছে এমন ৬ জন করে তোক একটি মাত্র শোবার ঘরে বাস করে।

(৫) এসেক্স

এই কাউন্টিতে অনেক প্যারিশে জনসংখ্যায় এবং গৃহসংখ্যায় হ্রাসপ্রাপ্তি হাতে হাত দিয়ে যায়। কিন্তু অন্ততপক্ষে ২২টি প্যারিশে বাড়ি-ঘরের ধ্বংসকাণ্ডে জনসংখ্যার অগ্রগতিকে নিবারণ করতে পারেনি কিংবা “শহরে আবাসন”-এর নামে যে নির্বাসন সাধারণত ঘটে, তা ঘটাতে পারেনি। ফিনগ্রিনহো-তে ৩,৭৪৩ একরের এক প্যারিশে ১৮৫১ সালে ছিল ১৪৫টি বাড়ি। ১৮৬১ সালে তা দাঁড়াল মাত্র ১১টিতে। কিন্তু লোকেরা চলে যেতে রাজি হলনা এবং এই পরিস্থিতির মধ্যেও নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হল ১৮৫১ সালে ২৫২ জন ব্যক্তি বাস করত ৬১টি বাড়িতে কিন্তু ১৮৬১ সালে ২৬২ জন ব্যক্তি গাদাগাদি করে আশ্রয় নিল ৪৯টি বাড়িতে। ব্যাসিলডেনে ১৮৫ সালে ১৫৭ জন ব্যক্তি বাস করত ১,৮২৭ একর জমির উপরে ৩৫টি বাড়িতে; দশ বছরের শেষে সেখানে দেখি ১৮০ জন ব্যক্তিকে ২৭টি বাড়িতে। ফিনগ্রিনহে, সাউথ-ফার্ণব্রিজ, উইডফোর্ড, ব্যাসিলডেন এবং ব্যাডেন ক্র্যাগ-এর প্যারিশগুলিতে ১৮৫১ সালে যেখানে ৮,৪৪৯ একরের উপরে ৩১৬টি বাড়িতে বাস করত ১,৩৯২ জন মানুষ, সেখানে ১৮৬১ সালে ঐ একই এলাকায় ২৪৯টি বাড়িতে বাস করে ১,৪৭৩ জন মানুষ।

(৬) হেয়ারফোর্ডশায়ার

ইংল্যাণ্ডে যে-কোনো কাউন্টির তুলনায় এই ছোট্ট কাউন্টিকে “উচ্ছেদের তাড়নায়” বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। ন্যাডবিতে ভিড়েঠাসা সাধারণতঃ দু-রুমের কুটির– গুলির বেশির ভাগেরই মালিক ছিল জোত-মালিকেরা। তারা অনায়াসেই সেগুলি বাৎসরিক £৩ বা ৫s হারে ভাড়া দিয়ে দিত আর মজুরি দিত সাপ্তাহিক ৯ শিলিং হারে।

(৭) হণ্টিংডন

 হাটফোর্ড: ১৮৫১ সালে বাড়ি ছিল ৮৭টি; কিছু কাল পরেই ১,৭২০ একরের এই ছোট প্যারিশটির ১৯টি কুটির ধ্বংস করে দেওয়া হয়; জনসংখ্যা ছিল ১৮৫১ সালে, ৪৫২; ১৮৫২ সালে, ৮৩২; এবং ১৮৬১ সালে, ৩৪১। পরিদর্শন করা হয় প্রতিটি ১ রুম-বিশিষ্ট ১৪টি বাড়ি, একটিতে থাকত এক বিবাহিত দম্পতি, ৩টি বড় ছেলে, ১টি বড় মেয়ে, ৪টি শিশু-সন্তান-মোট ১০ জন; আরেকটিতে, ৩ জন বয়স্ক ব্যক্তি, ৬টি শিশু। একটি রুমে ঘুমোত ৮ জন লোক, রুমটির দৈর্ঘ্য ছিল ১১ ফুট ১০ ইঞ্চি, প্ৰস্ত ১২ ফুট ২ ইঞ্চি, উচ্চতা ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি; রুমটির ভিতর দিকে প্রসারিত অংশগুলি বাদ না দিয়ে মাথাপিছু পরিসর ছিল গড়ে প্রায় ১৩০ কিউবিক ফুট। ১৪টি শোবার ঘরে থাকত ৩৪ জন বয়স্ক ব্যক্তি এবং ৩৩টি শিশু। খুব বিরল ক্ষেত্রেই এই কুটিরগুলির সঙ্গে বাগানের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু অধিবাসীদের অনেকেই ‘রুড’-পিছু। ১২১ বর্গগজ পিছু) ১০ থেকে ১২ শিলিং হারে ছোট ছোট প্লট’ চাষ করতে সক্ষম ছিল, এই ‘প্লটগুলি ছিল বাড়ি থেকে বেশ দূরে; বাড়িগুলিতে কোনো পায়খানা ছিল না। তাদের বিষ্ঠা ইত্যাদি ফেলবার জন্য তাদের ঐ প্লটে যেতে হত, কিংবা, এখানে যা ছিল রেওয়াজ, বোজ ওখানে না গিয়ে, “একটা ঘেরা জায়গায় একটা অনেক দেরাজওয়ালা আলমারির মধ্যে ফিট-করা একটা দেরাজে তা জমিয়ে রাখা সপ্তাহে এক দিন করে সেটা বের করে ঐ জমিতে যেখানে দরকার সেখানে ফেলে আসা।” জাপানেও জীবনযাত্রা এর তুলনায় ভদ্রভাবে নির্বাহিত হয়।

 (৮) লিংকনশায়ার

 ল্যাংটফট রাইট-এর বাড়িতে এখানে একজন লোক থাকে; সঙ্গে তার স্ত্রী, মা ও ৫টি সন্তান; বাড়িটিতে সামনের দিকে আছে একটি রান্নাঘর, ধোলাই ঘর এবং ঐ রান্না-ঘরটিরই উপরে শোবার ঘর; রান্না ও শোবার ঘর দৈর্ঘ্যে ও প্রস্তে ১২ ফুট ২ ইঞ্চি এবং ৯ ফুট ৫ ইঞ্চি। শোবার ঘরটি হল মাথার উপরে একটি খুপরি; দেয়ালগুলি পাশাপাশি ছাদে গিয়ে লেগেছে একটা মিছরির মঠের মত; সামনের দিকে একটা ঝাঁপ-তোলা জানালা। “সে সেখানে কেন থাকত? বাগানটার জন্য? না, সেটা খুবই ছোট। ভাড়া? চড়া, সপ্তাহ-পিছু ১ শি. ৩ পে। তার কাজের জায়গা থেকে কাছে? না, ৬ মাইল দূরে, তাকে রোজ হাঁটতে হয় যাতায়াতের ১১ মাইল। সে সেখানে থাকত কারণ সেটাই ছিল ভাড়া পাবার মত একমাত্র ‘কট” এবং সে চেয়েছিল যে-কোনো জায়গায়, যে কোনো দামে, যে কোনো অবস্থায় সম্পূর্ণ নিজের জন্য একটা কট। ল্যাংটফটে ১২টি শোবার ঘর, ৩৮ জন বয়স্ক লোক এবং ১৩৬টি শিশু সমেত ১২টি বাড়ির পরিসংখ্যান নীচে দেওয়া হল :

ল্যাংটফটে বারোটি বাড়ি

 ছবি। পেজ ৪৩০

(৯) কেন্ট

কেনিংটনঃ ১৮৫৯ সাল, অতিরিক্ত জনাকীর্ণ, ডিপথেরিয়ার প্রাদুর্ভাব, প্যারিশের ডাক্তার কর্তৃক গরিব শ্রেণীগুলির অবস্থা সম্পর্কে তদন্ত-পরিচালনা। তিনি দেখতে পেলেন, ঐ জায়গায়, যেখানে শ্রম খাটানো হয়, সেখানে অনেক কুটির ভেঙে ফেলা হয়েছে অথচ কোনো নোতুন কুটির তৈরি করা হয়নি। একটা জেলায় চারটি বাড়ি ছিল, যেগুলিকে বলা হত পাখির খাচা; প্রত্যেকটিতে ছিল চারটি করে রুম, প্রত্যেক রুমের মাপ ছিল এই রকম :

রান্নাঘর :   দৈর্ঘ্য ৯ ফু ৫ ই— প্রস্থ  ৮ ফু ১১ ই— উচ্চতা ৬ ফু ৬ ই
ধোলাই ঘর : ,,   ৮ ফু ৬ ই— ,,   ৪ ফু ৬ ই —   ,,     ৬ ফু ৬ ই
শোবার ঘর : ,,   ৮ ফু ৫ ই—  ,,  ৫ ফু ১০ ই—   ,,     ৬ ফু ৩ ই
শোবার ঘর : ,,   ৮ ফু ৩ ই—  ,, ৮ ফু ৪ ই—   ,,     ৬ ফু ৩ ই

(১০) নর্দাম্পটনশায়ার

ব্রিনওয়র্থ, পিকফোর্ড এবং ফ্লুরঃ এই গ্রাম তিনটিতে কাজের অভাবে ২১-৩০ জন লোক পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কৃষকেরা সব সময়ে শস্য ও শালগমের জমিগুলি যথেষ্ট-ভাষে চাষ করে না এবং জমিদার দেখেছে যে তার সব জোতগুলিকে এক করে ২-৩টি জোতে পরিণত করাই সবচেয়ে ভাল। সুতরাং কাজের অভাব। দেওয়ালের এক দিকে যখন জমি হাতছানি দিচ্ছে শ্রমিককে, অপর দিকে তখন প্রবঞ্চিত শ্রমিকেরা তার দিকে তাকিয়ে আছে সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে। গ্রীষ্মকালে হাড়-ভাঙ্গা খাটুনি আর শীতকালে আধ-পেটা খাওয়া; লোকগুলো যদি তাদের অদ্ভুত গ্রাম্য কথায় বলে, ‘পাদ্রী আর ভদ্দরলোকেরা আমাদের মারি ফেতি চায়, তা হলে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই।

ফ্লুর-এর কয়েকটি নমুনা : ক্ষুদ্রতম আকারের একটি শোবার ঘরে ৪, ৫, ৬টি শিশু সহ দম্পতি; ৫টি শিশু সহ ৩ জন বয়স্ক ব্যক্তি; ঠাকুর্দা ও স্কালেট জরে শয্যাগত ৬টি শিশু সহ একটি দম্পতি; দুটি শোবার ঘর বিশিষ্ট দুটি বাড়িতে দুটি পরিবার, বাস করে যথাক্রমে ৮ ও ৯ জন বয়স্ক লোক।

(১১) উইল্টশায়ার

স্ট্রাটনঃ ৩১টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয়; ৮টিতে কেবল একটা করে শোবার ঘর। একই প্যারিশের অন্তর্গত পেন্টিল : একটা কুঁড়েতে থাকে ৪ জন বয়স্ক লোক sটি শিশু; ভাড়া দিতে হয় সপ্তাহে . শিলিং ৩ পেন্স; এবড়োখেবড়ো পাথরের টুয়োর মেঝে থেকে, জরাজী খড়ের ছাদ পর্যন্ত খাড়া পাচিলগুলো ছাড়া ভাল বলতে আর কিছু নেই।

(১২) ওয়রসেস্টশায়ার

 এখানে বাড়িঘর ধ্বংসের পরিমাণ খুব মাত্রাতিরিক্ত নয়,; তবু বাড়ি-প্রতি বাসিন্দার সংখ্যা, ১৮৫ থেকে ১৮৬১ সাল অবধি, গড়ে বেড়ে দাড়িয়েছে ৪২ থেকে ৪৬।

ব্যাডসিঃ কুটির অনেক, বাগান প্রায় নেই। কোন কোন জোতমালিক বলে যে, কুটিরগুলি “এখানে একটা বিরাট আবর্জনা-বিশেষ, কারণ সেগুলি গরিবদের ডেকে আনে।” জনৈক ভদ্রলোকের বিবৃতি অনুযায়ী : “এর জন্য গরিবদের অবস্থার আদৌ কোনো সুরাহা হয় না। যদি আপনি ৫ … কুটির তৈরি করেন, তা হলে তারা চটপট সেগুলিকে ভাড়া নিয়ে নেবে। বস্তুতঃ পক্ষে, আপনি যত তৈরি করবেন, তারা তত চাইবে।” (তাঁর মতে কুটিরগুলিই বাসিন্দারের জন্ম দেয়, যারা তার পরে প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে “আবাসনের অবলম্বনের জন্য চাপ সৃষ্টি করে)। ডাঃ হান্টার মন্তব্য করেন, “এই গরিব লোকগুলি নিশ্চয়ই কোথাও-না কোথা থেকে এসে থাকবে, এবং যেহেতু এখানে, ব্যাডসিতে খয়রাত ইত্যাদির মত কোনো আকর্ষণ নেই, সেহেতু নিশ্চয়ই অন্য কোনো অনুপযুক্ত জায়গার বিকর্ষণ তাদের এখানে ঠেলে পাঠিয়েছে। যদি প্রত্যেকে তার কর্মস্থলের কাছে একটা করে প্লট পেত, তা হলে সে ব্যাডসিকে বেছে নিত না, যেখানে তাকে তার থাকার জায়গার জন্য দিতে হয়, তাকে জোতমালিক যা দেয়, তার দ্বিগুণ।”

গ্রাম থেকে শহরে ক্রমাগত জন-প্রবাহ, জোতের সংকেন্দ্রীভবনের দরুন গ্রামাঞ্চলে উত্ত-জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্তি, আবাদী জমির চারণভূমিতে রূপান্তর, মেশিনারি ইত্যাদি এবং কুটিরগুলিকে ধ্বংস করে কৃষি-জনসংখ্যার ক্রমাগত উচ্ছেদ-সাধন হাতে হাত দিয়ে চলে। অঞ্চলটি যতই জনশূন্য হয়, “আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যা ততই বৃদ্ধি পায়, ততই কর্মসংস্থানের উপায়ের উরে তাদের চাপ প্রবলতর হয়, ততই আবাসনের অবলম্বনের তুলনায় কৃষি-জনসংখ্যার অনাপেক্ষিক আধিক্য বিপুলতর হয়; সুতরাং, গ্রামগুলিতে স্থানীয় উদ্যত্ত লোকসংখ্যার এবং মারাত্মক ঠাসাঠাসি জমায়েত ‘আরে বৃহদাকার ধারণ করে। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট গ্রামগুলিতে ও ক্ষুদ্র মফঃস্বলের শহরগুলিতে ‘গুচ্ছ গুচ্ছ মানুষের এই গাদাগাদি-ভিড় এবং সেই সঙ্গে ভূমিপৃষ্ঠ থেকে মানুষের সবলে নিষ্কাশন একযোগে চলে। কৃষি-শ্রমিকদের হ্রাসমান সংখ্যা এবং তাদের উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর বর্ধমান সম্ভার সত্ত্বেও, তাদের নিরন্তর প্রতিস্থাপনের ফলে তাদের মধ্যে দুঃস্থতার প্রাদুর্ভাব ঘটে। শেষ পর্যন্ত এই দুঃস্থতা তাদের উচ্ছেদে হেতু এবং শোচ•ীয় বাস-ব্যবস্থার প্রধান উৎস হিসাবে কাজ করে, যা তাদের শেষ প্রতিরোধ ক্ষমতাটুকুও অবসান ঘটায় এবং তাদের পরিণত করে জমির মালিক ও কৃষকদের নিছক গোলামে।[৭১] এই ভাবে ন্যূনতম মজুরি তাদের কাছে হয়ে ওঠে প্রকৃতির নিয়ম স্বরূপ। অন্য দিকে, তার নিৱন্তর “আপেক্ষিক উভ-জনসংখ্যা সত্বেও জমি একই সময়ে হয় সংখ্যার জন-অধ্যুষিত ( ‘আণ্ডার-পপুলেটেড)। যেসব জায়গা থেকে শহর, খনি, রেলপথ-নির্মাণ ইত্যাদিতে জনপ্রবাহ ঘটেছে, কেবল সেই সব জায়গাতেই যে এই পরিস্থিতি চোখে পড়ে তা নয়। এটা চোখে পড়ে সর্বত্র-যেমন ফসল কাটার সময়ে, তেমন বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে, সেই নিয়মিত ব্যবধানে আবর্তনশীল মরশুমগুলিতে যখন ইংল্যাণ্ডের এত সতর্ক ও সংহত কৃষিকর্মের আবশ্যক হয় অতিরিক্ত কর্মী। জমি-চাষের সাধারণ প্রয়োজন-পূরণের পক্ষে সেখানে কর্মীসংখ্যা সব সময়েই অতিরিক্ত রকম বেশি এবং অসাধারণ ও সাময়িক প্রয়োজনপূরণের পক্ষে সব সময়েই অতিরিক্ত রকম কম।[৭২] এইজন্যই সরকারি দলিলপত্রে আমরা দেখতে পাই, একই সব জায়গা থেকে একই সঙ্গে ঘাটতি ও বাড়তির নালিশ। শ্রমের সাময়িক বা স্থানীয় অভাবের দরুন মজুরিতে কোনো বৃদ্ধি ঘটে না; যা ঘটে তা হল নারী ও শিশুদের ক্ষেতের কাজে যেতে বাধ্য করা এবং শিশুদের শোষণ করার বয়স ক্রমশঃ হ্রাস করা। যখনই নারী ও শিশুদের শোষণ ব্যাপক আয়তনে শুরু হয়, তখনি তা হয়ে ওঠে পুরুষ কৃষি-শ্রমিকদের উত্ত-জনসংখ্যায় পরিণত করার এবং তাদের মজুরি দাবিয়ে রাখার একটা হাতিয়ারে। ইংল্যাণ্ডের পূর্বাঞ্চলে এই পাপ-চক্রের একটি সুন্দর ফুলের বাড় বাড়ন্ত ঘটে, যাকে বলা হয় ‘গ্যাং-প্রথা, যে-সম্পর্কে আমি এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করব।[৭৩]

 ‘গ্যাং-প্রথা’ প্রায় একান্ত ভাবে বিদ্যমান লিংকন, হান্টিংডন, কেম্বিজ, নরফোক, সাফোক, নটিংহাম প্রভৃতি কাউন্টিতে এবং এখানে সেখানে আশেপাশের নর্দাম্পটন, বেডফোর্ড ও বাটল্যাণ্ড প্রভৃতি কাউন্টিতে। লিংকনশায়ার আমাদের কাছে একটা দৃষ্টান্ত হিসাবে কাজ করবে। এই কাউন্টির একটা বড় অংশই আগে ছিল জলাভূমি, কিংবা, এমনকি সদ্য-উল্লিখিত পূর্বাঞ্চলের কাউন্টিগুলির বড় বড় অংশের মত, সম্প্রতি সমুদ্র থেকে জয় করে নেওয়া হয়েছে। জল-নিষ্কাশনের ব্যাপারে স্টিম-ইঞ্জিন বিস্ময়কর সব কাজ করেছে। এক সময় যা ছিল বিল আর বালিয়াড়ি, এখন তা রূপান্তরিত হয়েছে শস্য-তরঙ্গায়িত এক উচ্ছল সাগরে এবং উচ্চতম খাজনার উৎসে। একই কথা প্রযোজ্য মানবিক প্রয়াসে বিজিত পাললিক ভূখণ্ডসমূহ সম্বন্ধে যেমন অ্যাক্সেহোম দ্বীপে এবং ট্রেন্ট নদের তীরবর্তী প্যারিশগুলিতে। নোতুন নোতুন কৃষিক্ষেত্রের উদ্ভবের সঙ্গে, সেই অনুপাতে নোতুন কুটির নির্মাণ তো দূরের কথা, এমনকি পুরনো কুটিরগুলিও ভেঙ্গে ফেলা হত, ফলে শ্রমিকদের কাজে আসতে হত দূর-দূরান্তের মুক্ত গ্রামগুলি থেকে মাইলের পর মাইল পাহাড়ের গা বেয়ে একে-বেঁকে-চলা সুদীর্ঘ পথ পার হয়ে। শীতকালের অবিরাম বন্যা থেকে একমাত্র ঐ গ্রামগুলিতেই তারা আগে আশ্রয় সংগ্রহ করতে পেরেছিল। যে সমস্ত শ্রমিক বাস করে ৪০০-১,০০০ একরের জোতগুলিতে ( যাদের বলা হয় “আটক মজুর), তাদের একান্ত ভাবে নিযুক্ত করা হয় এমন সব ধরনের কৃষিকর্মে, যা স্থায়ী, কঠিন এবং সম্পন্ন করা হয় ঘোড়ার সাহায্যে। প্রতি ১০০ একরের জন্য গড়ে একটি কুটিরও আছে কিনা সন্দেহ। যেমন, একজন জলা কৃষক তদন্ত কমিশনের সমক্ষে তার সাক্ষ্যে বলেছিল, “আমি আবাদ করি ৩২০ একর গোটাটাই আবাদী জমি। সেই জমিতে একটাও কুটির নেই। আমার খামারে এখন আছে মাত্র একজন মজুর। আমার আছে চারজন ঘোড়-সওয়ার, যারা আশেপাশে কোথাও থাকে। হাল্কা কাজ আমরা ‘গ্যাং’ দিয়ে করাই।”[৭৪] জমিতে বেশ কিছু হালকা খেতি-কাজ করতে হয়, যেমন, আগাছা বাছাই, নিড়ানি, সার দেওয়া, ঢিল-চেলা সরানো ইত্যাদি। এই কাজগুলি করানো হয় গ্যাং’-এর সাহায্যে, অর্থাৎ, ছোট ছোট সংগঠিত মজুর-দলের সাহায্যে, যারা বাস করে মুক্ত গ্রামগুলিতে।

এক একটা গ্যাং-এ থাকে ১০ থেকে ৪০ অথবা ৫০ জন করে লোক—নারী, তরুণ-বয়স্ক ছেলে-মেয়ে (১৩ থেকে ১৮ বছর, যদি ছেলেমেয়েদের অধিকাংশকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয় ১৩ বছর বয়সে), এবং শিশু (৬-১৩ বছর)। মাথায় থাকে একজন ‘গ্যাং-মাস্টার’ (সর্দার’)—একজন মামুলি মজুর যাকে সাধারণতঃ বলা হয় বদমাশ, বেপরোয়া, মতিচ্ছন্ন, মাতাল, কিন্তু সব সময়েই একটা কিছু করার মত উদ্যম এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতার অধিকারী। সেই হচ্ছে দলটির রিক্রুটিং সার্জেন্ট (সমাহর্তা-দল নায়ক’) এবং সেটি কাজ করে তারই অধীনে, খামার মালিকের অধীনে নয়। সেই দলের জন্য ঠিকা-কাজের ব্যবস্থা করে; তার আয়, যা সচরাচর একজন সাধারণ কৃষি-মজুরের তুলনায় খুব বেশি নয়, সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে কত দক্ষতার সঙ্গে কত অল্পসময়ের মধ্যে সে তার দলের কাছ থেকে কত বেশি কাজ আদায় করে নিতে পারে, তার উপরে।[৭৫] খামার-মালিকেরা দেখেছে যে, নারী-শ্রমিকেরা কেবল পুরুষদের অধীনেই নিষ্ঠাভরে কাজ করে, কিন্তু নারী ও শিশুদের যদি একবার কাজে চালু করে দেওয়া যায়, তা হলে তারা বেপরোয়া ভাবে তাদের প্রাণশক্তি ঢেলে দেয়, যেকথা ফুরিয়ার জানতেন, আর তখন সুচতুর পুরুষ শ্রমিক তার শ্রম যথাসম্ভব কমিয়ে আনে। গ্যাং’ সর্দার এক খামার থেকে আরেক খামারে যায় এবং এই ভাবে তার দলটিকে বছরে ৬ থেকে ৮ মাস কাজে নিযুক্ত রাখে। সুতরাং, ব্যক্তিগত খামার-মালিকের দ্বারা কর্মে নিয়োগের তুলনায় মেহনতি পরিবারগুলির পক্ষে গ্যাং-সর্দারের দ্বারা কর্ম-নিয়োগ ঢের বেশি লাভজনক ও ঢের বেশি নিশ্চিত হয়; খামার-মালিকেরা অনেক সময় কেবল শিশুদেরই নিয়োগ করে। এই ঘটনা তার মুক্ত গ্রামগুলিতে তার প্রভাবকে এমন ভাবে প্রতিষ্ঠা করে যে, কেবল তার মাধ্যমেই কেবল শিশুদের ভাড়া করা যায়। ‘গ্যাং’-কে বাদ দিয়েও শিশুদের এই ভাবে ভাড়া খাটানো তার দ্বিতীয় আয়ের উপায়।

এই ব্যবস্থার “দোষ-ত্রুটি” হল শিশু ও তরুণ-তরুণীদের, মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম, ৫, ৬ এমনকি ৭ মাইল দূরবর্তী ক্ষেতগুলিতে যাতায়াতের প্রাত্যহিক দীর্ঘ পদযাত্রা, এবং, সর্বশেষে গোটা দলটার নৈতিক অধঃপতন। যদিও গ্যাং-সর্দার, যাকে কোন কোন অঞ্চলে বলা হয় “গাড়োয়ান”, সব সময়েই হাতে রাখে একটা লম্বা লাঠি, সেটা সে কদাচিৎ ব্যবহার করে এবং তার বিরুদ্ধে নৃশংস আচরণের অভিযোগ খুবই বিরল। সে একজন গণতান্ত্রিক শাহানশাহ, কিংবা এক ধরনের সেই ‘হ্যামেলিনের রঙচঙে বাঁশীওয়ালা’। সুতরাং তাকে তার প্রজাদের কাছে জনপ্রিয় হতে হয়, এবং তাদেরকে তার অধীনে বেঁধে রাখে যাযাবর জীবনের নানা যাদু দিয়ে। উচ্ছংখল স্বাধীনতা, উদ্দাম উন্মাদনা, অশ্লীল বেহায়াপনা দঙ্গলটাকে যোগায় নানা আকর্ষণ। সচরাচর গ্যাং-সর্দার তাদের সরাইখানার বিল মিটিয়ে দেয় এবং, তার পরে, এক মিছিলের মাথায়, এক জাদরেল মানার হাত-ধরা অবস্থায়, ডাইনে-বাঁয়ে টলতে টলতে বাড়ির পথে ফেরে—হৈ-হুল্লোড় করতে করতে, অশ্লীল-অশ্রাব্য গান গাইতে গাইতে পিছে পিছে যায় বাচ্চা আর তরুণ-তরুণীরা। ফেরার পথে, ফুরিয়ার যাকে বলেন “পাগ সংযোগ”, তা একটা চলতি রেওয়াজ। ১৩-১৪ বছর বয়সের বালিকাদের পক্ষে সমবয়সী সঙ্গীদের সঙ্গ-ফলে সন্তান কোলে আসা মামুলি ব্যাপার। যে-সব মুক্ত গ্রাম এই সমস্ত ‘গ্যাং’-এর যোগান দেয়, সেগুলি হয় সোডোম’ আর ‘গোমোররা এবং সেগুলিতে অবৈধ জন্মের হার রাজ্যের বাকি অংশের তুলনায় দ্বিগুণ।[৭৬] এই ধরনের ইস্কুলে যাদের শিক্ষা, সেই মেয়েদের নৈতিক চরিত্র কিরকম হয় উপরে তা দেখানো হয়েছে। তাদের বাচ্চাগুলি যদি আফিমের চোটেও শেষ না হয়ে যায়, তা হলে জন্ম থেকেই এই সব ‘গ্যাং’-এর ‘রং-রুট’ হিসাবে বড় হয়।

উপরে যে বনেদি ধরনের ‘গ্যাং-টির বর্ণনা দেওয়া হল, সেটিকে বলা হয় সাধারণ, সার্বজনিক বা ভ্রাম্যমান ‘গ্যাং’। কেননা ব্যক্তিগত ‘গ্যাং’-ও আবার আছে। সাধারণ ‘গ্যাং’-এর মতই সেগুলি তৈরি হয়, তবে সেগুলির সদস্যসংখ্যা কম এবং তারা কাজ করে গ্যাং”-সর্দারের অধীনে নয়, খামারের কোন বৃদ্ধ ভৃত্যের অধীনে, যাকে খামার মালিক আরো ভালভাবে কি করে ব্যবহার করা যায়, তা জানে না। যাযাবর জীবনের মজা এখানে উধাও এবং সমস্ত সাক্ষীরাই এ ব্যাপারে একমত যে, শিশুদের যা দেওয়া হয় এবং যে ব্যবহার করা হয় তা আরো খারাপ।

গত কয়েক বছর ধরে ‘গ্যাং’-প্রথা আরো বিস্তার লাভ[৭৭] করেছে। কেবল যে গ্যাং সর্দারের স্বার্থে তা চালু আছে তা নয়, চালু আছে বৃহৎ কৃষকদের[৭৮], এবং পরোক্ষভাবে জমিদারদের[৭৯] ধন-বৃদ্ধির স্বার্থে। নিজের শ্রমিকদের স্বাভাবিক মানের বেশ কিছুটা নীচে রাখা এবং তৎসত্ত্বেও সব সময়েই বাড়তি কাজের জন্য বাড়তি হাতের যোগান ঠিক রাখার অথবা যথাসম্ভব কম পরিমাণ টাকায়[৮০] যথাসম্ভব বেশি পরিমাণ শ্রম নিঙড়ে নেবার এবং বয়স্ক পুরুষ শ্রমিককে “অপ্রয়োজনীয়” করে দেবার এমন সুকৌশল ব্যবস্থা আর নেই। ইতিমধ্যে যে-ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় কেন, এক দিকে, কৃষি-শ্রমিকের কম বা বেশি পরিমাণ কর্মাভাবের কথা স্বীকার করা হয়, অন্য দিকে, আবার একই সময়ে, বয়স্ক পুরুষ শ্রমের অভাব এবং তার শহরে অভিপ্রয়ারেন[৮১] কারণে ‘গ্যাং’-প্রথাকে “প্রয়োজনীয়” বলে ঘোষণা করা হয়। লিংকনশায়ারে আগাছা মুক্ত পরিচ্ছন্ন জমি এবং অপরিচ্ছন্ন মানবিক আগাছা-এই দুটি হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের মেরু এবং প্রতি-মেরু। [৮২]

(চ) আয়র্ল্যাণ্ড

এই পরিচ্ছেদ শেষ করার আগে আমরা কিছুক্ষণের জন্য আয়ার্ল্যাণ্ডে যাব। প্রথমে, পরিস্থিতির প্রধান প্রধান তথ্যসমূহ।

আয়ার্ল্যাণ্ডের জনসংখ্যা ১৮৪১ সালে পৌছেছিল ৮২,২২,৬৬৪-তে; ১৮৫১ সালে নেমে যায় ৬৬,২৩,৯৮৫-তে; ১৮৬১ সালে ৫৮,৫৩,৩০৯-এ; ১৮৬৬ সালে ৫২ মিলিয়ন এ-১৮০১ সালে যা ছিল প্রায় সেই মানে। এই সংখ্যা-হ্রাস শুরু হয় দুর্ভিক্ষের বছরে, ১৮৪৬ সালে, যার ফলে কুড়ি বছরেরও কম সময়ে আয়লাও হারাল তার জনসংখ্যার ৫ ভাগেরও বেশি লোককে।[৮৩] ১৮৫১ সালের মে মাস থেকে ১৮৬৫ সালের জুলাই মাস অবধি আয়ল্যাণ্ড থেকে যারা দেশান্তরে চলে যায় তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৫৯১, ৪৮৭ জন; ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ অবধি এই সংখ্যা পাঁচ লক্ষেরও বেশি। লোকজন বাস

ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের সাধারণ নিয়মের বিবিধ উদাহরণ ৪৩৯ করত এমন বাড়ির সংখ্যা ১৮৫১ থেকে ১৮৬১ সালের মধ্যে কমে যায় ২,৯৯টি। ১৮৫১ থেকে ১৮৬১ সালের মধ্যে ১৫ থেকে ৩০ একর আয়তন জোতের সংখ্যা বেড়ে যায় ৬১,০০টি; ৩০ একরের বেশি আয়তনের ১৯,০০০টি; অন্য দিকে, জোতের মোট সংখ্যা কমে যায় ১২৩,০০০টি এই কমে যাবার একমাত্র কারণ হল ১৫ একরের কম আয়তনের জোতগুলির বিলুপ্তি সাধন অর্থাৎ সেগুলির কেন্দ্রীকরণ।

সারণী (ক) — পশু-সম্পত্তি

ছবি। পেজ ৪৩৯

জনসংখ্যার হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবতই তাদের উৎপাদনসম্ভারেও হ্রাস ঘটেছিল। আমাদের যা প্রয়োজন, তাতে ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ পর্যন্ত এই ৫ বছর বিবেচনা করাই যথেষ্ট—যে ক’বছরে পাঁচ লক্ষেরও বেশি লোক দেশান্তরে চলে যায় এবং অনাপেক্ষিক জনসংখ্যা ১ মিলিয়নের-এরও বেশি কমে যায়।

উল্লিখিত সারণী থেকে যে ফলাফল পাওয়া যায়, তা এই :

 ছবি। পেজ ৪৪০

এবারে কৃষিকর্মের দিকে নজর দেওয়া যাক, যা থেকে মানুষ এবং গবাদি পশু পায় তাদের প্রাণ-ধারণের উপায়। নিচেকার সারণীটিতে দেওয়া হল আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেকটি বছরের হ্রাস বা বৃদ্ধির হিসাব–ঠিক তার আগেকার বছরের তুলনায়। দানা-শস্যের মধ্যে ধরা হয়েছে গম, জই, যব, রাই, সিম ও শুটি; সবজি শস্যের মধ্যে ধরা হয়েছে আলু, শালগম, বিট, গাজর, মূলো, কপি, কলাই ইত্যাদি।

[* আমরা যদি আরো একটু পিছন দিকে যেতাম, তা হলে ফল হত আরো প্রতিকূল। যেমন, ১৮৬৫-তে ভেড়া ৩,৬৮৮৭৪২, কিন্তু ১৮৫৬-তে ৩,৬৯৪,২৯৪; শুয়োর ১৮৬৫-তে ১,২৯৯,৮৯৩ কিন্তু ১৮৫৮-তে ১,৪০৯,৮৮৩]

ছবি। পেজ ৪৪১

১৮৬৫ সালে “খাস জমি”-র শিরোনামের অধীনে এল অতিরিক্ত ১,২৭,৪৭০ একর। এর প্রধান কারণ এই যে, “অনাবাদি জলা ও পতিত জমি”-র আয়তন ১০১,৫৪৩ একর কমে যায়। আমরা যদি ১৮৬৫-কে ১৮৬৪-র সঙ্গে তুলনা করি, আমরা দেখতে পাই যে, ২৪৬,৬৬৭ কোয়ার্টার দানা শস্য কমে গিয়েছে, যার মধ্যে ৪৮,৯৯৯ গম; ১৬৩,৬০৫ জই; ২৯,৮৯২ যব ইত্যাদি। আলু কমে যায় ৪৪৬,৩৯৮ টন, যদিও ১৮৬৫ সালে আলুর চাষের জমি বেড়ে গিয়েছিল।

ছবি। পেজ ৪৪২

* এই তথ্যগুলি সংগ্রহ করা হয়েছে “কৃষি-পরিসংখ্যান, আয়লা, সাধারণ তথ্য-সার, ডাবলিন”, ১৮৭৬ ইত্যাদি, এবং কৃষি-পরিসংখ্যান, আয়াণ্ড, থেকে। অনুমতি গড় উৎপন্নের সারণী, ডাবলিন, ১৮৬৬। এই পরিসংখ্যান-সমূহ সরকারি এবং পালামেন্টে বাৎসরিক উপস্থাপিত। [ দ্বিতীয় সংস্করণে টাকা। ১৮৭২ সালের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় ১৮৭১ সালের তুলনায় কৰ্ষিত এলাকার ১৩৪,৯১৫ একর হ্রাস। কাঁচা সব জির চাষ বৃদ্ধি; গমের জমি ১৬,০০০ একর, ওটের জমি ১৪,০০, বার্লি ও রাইয়ের ৪…, আলুর ৬৬,৬৩২, শন ৩৪,৬৭, ঘাস, রেপসিড ইত্যাদির ৩০,০০০ একর হ্রাস। গত পাঁচ বছরে গমের জমির হ্রাস লক্ষ্য করা যায় নিম্ন লিখিত পর্যায়ক্রমে : ১৮৬৮, ২৮৫,০০০ একর; ১৮৬৯, ২৮০,০০০; ১৮৭৩, ২৫৯,০০; ১৮৭১, ২৪৪,০০; ১৮৭২, ২২৮,০০০। ১৮৭২ সালে আমরা দেখি ঘোড়া বেড়ে গিয়েছে ২৬০ টি, শৃঙ্গী গবাদি পশু ৮,০০ ৩টি, ভেড়া ৬৮,৬০৯টি কিন্তু শুয়োর কমে গিয়েছে, ২৩৬,…টি ]

ছবি। পেজ ৪৪৪

আয়র্ল্যাণ্ডের জনসংখ্যা ও কৃষি-উৎপন্নের গতি-প্রকৃতির বিষয় থেকে এবারে আমরা মনোযোগ সরিয়ে নেব তার জমিদার, বৃহৎ কৃষক ও শিল্প-ধনিকদের টাকার থলির গতি প্রকৃতির দিকে। এটা প্রতিফলিত হয় আয়করের হ্রাস-বৃদ্ধিতে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তালিকা (ঘ) (কৃষকদের মুনাফা বাদ দিয়ে অন্যান্যদের মুনাফার তালিকা )-র মধ্যে ধরা হয়েছে তথাকথিত “বৃত্তিজীবী”-দেরও মুনাফা অর্থাৎ আইনজীবী, চিকিৎসক ইত্যাদিরও আয়; এবং তালিকা (গ) ও (ঙ), যে-দুটির মধ্যে কোনো বিশেষ বিবরণ দেওয়া হয়নি, তাতে ধরা হয়েছে কর্মচারী, অফিসার, সরকারী পদ-শোভী (সাইনেকিউয়্যারিস্ট), সরকারি ঋণপত্ৰ-অধিকারীদের।

(খ)-তালিকার অন্তর্ভূক্ত, ১৮৫৩ থেকে ১৮৬৪ পর্যন্ত, আয়ের গড়পড়তা বাৎসরিক বৃদ্ধি ঘটেছিল মাত্র ৩৯৩; অন্য দিকে ঐ একই সময়ে গ্রেট ব্রিটেনে ঘটেছিল ৪৫৮। নিচের সারণীতে দেখানো হল ১৮৬৪ ও ১৮৬৫ সালের মুনাফা-বণ্টন (কৃষকদের মুনাফা বাদ দিয়ে)।

সারণী (ঙ)ঃ  তালিকা (ঘ) আয়র্ল্যাণ্ডে মুনাফা (£ ৬০-এর উপরে) থেকে আয়

ছবি। পেজ ৪৪৫

*এই সারণীতে (ঘ) তালিকার অধীনে মোট বাৎসরিক আয় পূর্ববর্তী সারণীগুলির উক্ত তালিকার অধীনস্থ মোট বাৎসরিক আয় থেকে ভিন্ন, তার কারণ আইন-অনুমদিত কয়েকটি বাদ।

ইংল্যাণ্ড হল একটি পূর্ণ-বিকশিত ধনতান্ত্রিক দেশ এবং প্রধানত শিল্পায়ত; আয়ার্ল্যাণ্ডের মত যদি সেখানে জনসংখ্যার এমন নিষ্কাশন ঘটত, তা হলে ইংল্যাণ্ডে রক্তমোক্ষণে সাদা হয়ে যেত। কিন্তু অয়্যাণ্ড এখন হচ্ছে ইংল্যাণ্ডের একটা কৃষি অঞ্চল মাত্র, যে-দেশটিকে সে যোগায় শস্য, পশম, গবাদি পশু এবং শিল্প ও সামরিক ‘রংরুট’, সেই দেশটি থেকে একটি প্রশস্ত প্রণালী দ্বারা বিচ্ছিন্ন।

আয়ার্ল্যাণ্ডের এই জনসংখ্যা-হ্রাসের দরুন তার বেশির ভাগ জমি চাষের বাইরে চলে গেল এবং তার জমির উৎপন্ন দারুণ ভাবে কমে গেল,[৮৪] এবং গবাদি পশু প্রজননের জন্য বৃহত্তর এলাকা নিয়োজিত করা সত্ত্বেও কয়েকটি শাখায় ঘটল চরম অবনতি আর বাকি কয়েকটি ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটলেও তা এত সামান্য যে অনুল্লেখ্য এবং বারংবার পশ্চাৎ গতির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত। যাই হোক, জনসংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে, খাজনা ও কৃষকের মুনাফা বৃদ্ধি পেল, যদিও দ্বিতীয়টি প্রথমটির মত অমন অবিচল গতিতে বৃদ্ধি পেল না। এর কারণ সহজেই বোধগম্য। এক দিকে ঘোট ঘোট জোতগুলি বড় বড় পরিণত হওয়ায় এবং আবাদি জমি চারণ-জমিতে পরিবর্তিত হওয়ায়, সমগ্র উৎপন্ন ফসলের একটা বৃহৎ অংশ উদ্বৃত্ত উৎপন্নে রূপান্তরিত হল। উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন বৃদ্ধি পেল, যদিও যে-মোট উৎপন্নের তা একটি ভগ্নাংশ মাত্র, তা হ্রাস পেল। অন্য দিকে, গত ২০ বছরে, বিশেষ করে, গত ১০ বছরে ইংল্যাণ্ডের বাজারে মাংস, পশম ইত্যাদির দাম বেড়ে যাবার ফলে, এই উত্ত-উৎপন্নের পরিমাণ যত তাড়াতাড়ি বেড়েছিল, তার চেয়ে বেশি তাড়াতাড়ি বেড়েছিল তার আর্থিক মূল্য।

উৎপাদনের বিক্ষিপ্ত উপায়গুলি, যেগুলি অপরের শ্রম আঙ্গীকৃত করে তাদের নিজেদের মূল্যের সম্প্রসারণ না ঘটিয়ে, নিজেরাই উৎপাদনকারীদের কাজ করে কর্ম সংস্থান ও জীবনধারণের উপায় হিসাবে, সেগুলি, স্বয়ং উৎপাদনকারীর নিজের দ্বারা পরিভুক্ত উৎপন্ন দ্রব্য যতটা মাত্রায় পণ্য, তার চেয়ে বেশি মাত্রায় মূলধন নয়। যদি জনসমষ্টির সঙ্গে কৃষিতে নিয়োজিত উৎপাদন-উপায়সমূহের পরিমাণ হ্রাস পেত তা হলে কৃষিতে নিয়োজিত মূলধনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেত, কেননা উৎপাদন-উপায়সমূহের একটা অংশ, যা আগে ছিল বিকেন্দ্রীভূত, তা হত সংকেন্দ্রীভূত এবং রূপান্তরিত হত মূলধনে।

কৃষির বাইরে, শিল্পে ও ব্যবসায়ে বিনিয়োজিত, আয়ার্ল্যাণ্ডের মোট মূলধন গত। দুই দশক ধরে সঞ্চয়ীকৃত হয়—এবং সঞ্চয়ীকৃত হয় বিপুল ও বারংবার ওঠা-নামার মাধ্যমেসেই সঙ্গে আরো দ্রুত গতিতে তার আলাদা আলাদা সংগঠনী উৎপাদন গুলির সংকেন্দ্রীভবনও বিকাশ লাভ করে। এবং তার অনপেক্ষিক বৃদ্ধি যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, ক্ষীয়মান জনসংখ্যার অনুপাতে তা বৃহৎ।

তা হলে এখানে আমাদের চোখের সামনে এবং বৃহৎ আয়তনে উদঘাটিত হয় এমন একটি প্রক্রিয়া, যার তুলনায় চমৎকার আর কোনো কিছু নিষ্ঠাবান অথত তার এই আপ্তবাক্যটির সমর্থনে খুঁজে পাবে না: দুর্দশার উদ্ভব হয় অনাপেক্ষিক উত্তজন সংখ্যা থেকে এবং ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় জনসংখ্যা-হ্রাসের দ্বারা। চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগের যে প্লেগ সম্পর্কে ম্যাঙ্কসপন্থীরা এত পঞ্চমুখ, তার চেয়ে এটা একটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার। আরো দ্রষ্টব্য : যদি কোন ইস্কুল মাস্টারের সরলতা, উনিশ শতকের উৎপাদন ও জনসংখ্যার পরিস্থিতিতে, চতুর্দশ শতকের মানটিকে প্রয়োগ করতে পারত, তাহলে সেই সরলতা, তদুপরি, এই ঘটনাটিকে উপেক্ষা করত যে, সেই প্লেগ তার অনুষঙ্গী গণ-মড়কের ফলে ঘটেছিল ‘চ্যানেল’-এর এপারে, ইংল্যাণ্ডে কৃষি-জনসংখ্যার ভোটাধিকার ও সমৃদ্ধি লাভ, এবং ওপারে, ফ্রান্সে আরো বেশি দাসত্ব, আরো বেশি দুর্দশা।[৮৫]

১৮০৬-এর আইরিশ দুর্ভিক্ষ ১০,০০,০০০ মানুষের প্রাণ হরণ করেছিল, কিন্তু প্রাণ হারিয়েছিল কেবল গরিব পাপাত্মারাই। দেশের সম্পদকে তা এতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। পরবর্তী ২০ বছরের গণ- নিষ্ক্রমণ যা আজও ক্রমবর্ধিত হারে অব্যাহত ভাবে চলছে, তা মানুষের সংখ্যা হ্রাস ঘটলেও সেই সঙ্গে তাদের উৎপাদনের উপায় উপকরণের সংখ্যা হ্রাস ঘটায়নি, যেমন ঘটিয়েছিল ‘ত্রিংশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধ। দুর্দশার স্থান থেকে একটি দরিদ্র জাতিকে হাজার হাজার মাইল দূরে উধাও করে দেবার সম্পূর্ণ নোতুন এক পন্থা আবিষ্কার করল আইরিশ প্রতিভা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত এই লোকগুলি প্রতি বছর তাদের বাড়িতে টাকা পাঠাত, যাদের তারা ফেলে গিয়েছিল, তাদের যাবার খরচ হিসাবে। এক বছর যে-দল যেত, পরের বছর সেই দল আরেকটি দলের যাবার ব্যবস্থা করে দিত। এইভাবে গণ-নিমণ আয়ার্ল্যাণ্ডের পক্ষে কোনো ব্যয়ের কারণ তো হলই না, বরং তা হয়ে উঠল তার একটি সবচেয়ে লাভজনক রপ্তানি-বাণিজ্য। সর্বশেষে, এটা এমন একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা কেবল জন সংখ্যায় একটা সাময়িক শূন্যস্থানই সৃষ্টি করেনা, অধিকন্তু প্রতি বৎসর, সেই স্থান পূরণে যত মানুষের জন্ম হয়, তা থেকে অধিকতর সংখ্যক মানুষকে তা নিষ্ক্রান্ত করে দেয়; ফলে, বছরের পর বছর জনসংখ্যার অনাপেক্ষিকমান হ্রাস পায়। [৮৬]

যারা পিছনে পড়ে রইল এবং উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যা থেকে মুক্তি পেল, আয়ার্ল্যাণ্ডের সেই সব শ্রমিকদের অবস্থা কি হল? অবস্থা হল এই যে, আপেক্ষিক উত্তজনসংখ্যা ১৮৪৬ সালেও যা ছিল, এখনো তাই রয়ে গেল; মজুরি তেমন নিচুই থেকে গেল; শ্রমিকদের উপরে অত্যাচার বেড়ে গেল; দুঃখ-দুর্দশা দেশকে নোতুন এক সংকটের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল। ঘটনাগুলি খুবই সরল। কৃষিতে বিপ্লব দেশত্যাগের সঙ্গে সমান তালে চলেছে। আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যা অনাপেক্ষিক জনসংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে কেবল সম-তালেই চলেনি, তার তুলনায় এগিয়ে গিয়েছে। ‘গ’ সাণীটির দিকে দৃষ্টিপাত করলেই দেখা যায় আবাদি জমি থেকে চারণ-জমিতে পরিবর্তন ইংল্যাণ্ডের তুলনায় আয়ার্ল্যাণ্ডে অবশ্যই আরো তীক্ষভাবে কাজ করবে। ইংল্যাণ্ডে গবাদি পশু প্রজননের সঙ্গে সব জি শস্যের চাষও বৃদ্ধি পায়; আয়ার্ল্যাণ্ডে তা হ্রাস পায়। যখন, আগে যেগুলি চাষ হত এমন অনেক অনেক একর জমি এখন হয় পতিত পড়ে আছে বা স্থায়ীভাবে ঘাস-জমিতে পরিবর্তিত হয়েছে, তখন আগে যা কখনো কাজে লাগানো হয়নি, এমন অনেক পতিত জমি ও শুনো বিল এখন কাজে লাগানও হল গো পালনের জন্য। ছোট ও মাঝারি কৃষকেরা—যাদের মধ্যে আমি ধরছি তাদের যারা ১০০ একরের বেশি চাষ করেনা—এখনে! গঠন করে মোট সংখ্যার ৮/১০ ভাগ।[৮৭] একের পর এক এবং এমন এক বলের প্রকোপে যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি, তারা ধ্বংস হতে থাকে মূলধনের পরিচালনাধীন কৃষিকর্মের প্রতিযোগিতায়; আর এইভাবে তারা। নিরন্তর যুগিয়ে চলে মজুরি শ্রমিকদের শ্রেণীতে নোতুন নোতুন রুট। আয়ার্ল্যাণ্ডের একমাত্র বৃহৎ শিল্প হল শন-কাপড়ে ( লিনেন) শিল্প; কিন্তু তাতে বয়স্ক পুরুষ লাগে অপেক্ষাকৃত অল্প সংখ্যায় এবং, ১৮৬১-১৮৬৬-তে তুলোর দাম বেড়ে যাবার দরুন তা এই শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটা সত্ত্বেও, যত লোককে নিযুক্ত করে তা ইংল্যাণ্ডের জনসংখ্যার একটি নগণ্য অংশ। অন্যান্য বৃহৎ আধুনিক শিল্পের মত, তা অবিরাম ওঠা-নামার মাধ্যমে, নিরন্তর সৃষ্টি করে তার নিজের পরিধির মধ্যে একটি আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জন সংখ্যা—এমনকি তার দ্বারা কর্ম-নিযুক্ত জনসমষ্টির অনাপেক্ষিক বৃদ্ধি প্রাপ্তি সত্ত্বেও। কৃষি-জনসংখ্যার এই দুঃখ-দুর্দশাই রচনা করে বিরাট বিরাট শার্ট-ফ্যাক্টরির বনিয়াদ, যেগুলির শ্রমিক-বাহিনী বাহিনী ছড়িয়ে থাকে গোটা দেশ জুড়ে। এখানে আমরা আবার মুখোমুখি হই উপরে বর্ণিত ঘরোয়া শিল্পের সঙ্গে, যা তার মাত্রল্প মজুরি আর মাত্রাধিক কাজের ব্যবস্থার মধ্যে পেয়ে যাই তার সংরক্ষিত কর্মী-বাহিনী সৃজনের প্রয়াজনীয় উপায়। সর্বশেষে, যদি জনসংখ্যার এই হ্রাস একটি পূর্ণ-বিকশিত ধনতান্ত্রিক দেশে যে-ধ্বংসাত্মক পরিণতি ঘটাত, এখানে তা ঘটায় না, তা স্বদেশের বাজারে নিরন্তর প্রতিক্রিয়া না ঘটিয়ে পারে না। দেশত্যাগের ফলে এখানে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা কেবল শ্রমের জন্য স্থানীয় চাহিদাকেই সীমাবদ্ধ করেনা, তা ঘোট ঘোট দোকানদার, কারিগর, সাধারণ ভাবে ব্যবসায়ীদের আয়ও সীমাবদ্ধ করে। এই কারণেই ‘ঙ’ সারণীতে ৬০ পাউণ্ড এবং ১০০ পাউণ্ডের মধ্যবর্তী আয়ের এই হ্রাস প্রাপ্তি।

আয়ার্ল্যাণ্ডের কৃষি-শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায় আইরিশ ‘গরিব আইন পরিদর্শকদের প্রতিবেদনে (১৮৭০)।[৮৮] যে সরকারকে টিকিয়ে রাখা হয় কেবল সঙ্গীন ও, কখনো প্রচ্ছন্ন কখনো প্রকাশ্য, অবরোধ-আরোপের সাহায্যে, সেই সরকারের কর্মচারীদের স্বভাবতই তাদের ভাষা সম্পর্কে যাবতীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে, যা করতে তাদের ইংল্যাণ্ডের সহকর্মীরা ঘৃণা বোধ করতেন। অবশ্য, তা সত্ত্বেও তারা তাদের সরকারকে মোহের মায়ায় মুগ্ধ থাকতে দেননি। তাদের মতে, মজুরির হার, যদিও এখনো খুবই কম, তা হলেও তা গত ২০ বছরে শতকরা ৫০-৬০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং এখন তা গড়ে দাড়িয়েছে সপ্তাহে ৬ শিলিং থেকে ৯ শিলিং। কিন্তু এই আপাত বৃদ্ধির নেপথ্যে লুকিয়ে আছে আসল হ্রাস, কেননা ইতিমধ্যে জীবন ধারণের দ্রব্যসামগ্রীর যে-দাম বৃদ্ধি হয়েছে মজুরি বৃদ্ধি তার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করেনি। প্রমাণ হিসাবে একটি আইরিশ দুঃস্থ-নিবাসের সরকারি হিসাব থেকে একটি অনুচ্ছেদ নিচের সারণীতে উদ্ধৃত করা হল :

মাথাপিছু সাপ্তাহিক গড় ব্যয়

ছবি। পেজ ৪৪৯

দেখা যাচ্ছে, জীবনধারণের উপায়-উপকরণের দাম ২০ বছর আগে যা ছিল, তার চেয়ে পুরোপুরি দুগু, এবং পোষাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে সঠিক দ্বিগুণ।

এমনকি এই অনুপাত-বৈষম্য ছাড়া, সোনার অঙ্কে প্রকাশিত মজুরি-হারের তুলনা থেকে এমন একটা ফল পাওয়া যাবে যা সঠিক থেকে অনেক দূর। দুর্ভিক্ষের আগে মজুরির বেশির ভাগটাই দেওয়া হত জিনিষ-পত্রে কেবল একটা সামান্য অংশ দেওয়া হত অর্থে; আজকাল অর্থের আকারে মজুরি দেওয়াটাই রেওয়াজ। এ থেকে যা আসে তা এই যে আসল মজুরির পরিমাণ যাই হোক, তার অর্থের হার অবশ্যই উচ্চতর হতে হবে। “দুর্ভিক্ষের আগে শ্ৰমিক ভোগ করত তার কামরা: এক রুড, আধ-একর বা এক একর জমি এবং এক ফলন আলুর:…..”সুবিধা সমেত। সে তাতে শুয়োর-মুৰ্গী পালন করতে পারত ……এখন তাদের কিনতে হয় রুটি; থাকেনা এমন কোনো আবর্জনা যা থেকে চলতে পারে শুয়োর মুর্গীর খোরাক; সুতরাং তারা এখন পায়না শুয়োর, মুর্গী বা ডিমের কোনো সুবিধা।”[৮৯] বাস্তবিক পক্ষে, আগে, কৃষি শ্রমিকেরা ছিল ছোট কৃষকদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট কৃষক এবং গঠন করত তারা যে মাঝারি ও ছোট খামারগুলিতে কাজ করত, সেগুলিরই শেষের সারি। কেবল ১৮৪৬-এর মহাবিপর্যয়ের পরেই তারা পরিণত হতে লাগল নিছক মজুরি-শ্রমিকের একটি শ্ৰেণীতে—এমন একটি বিশেষ শ্রেণীতে যা তাদের মজুরি-মনিবদের সঙ্গে কেবল আর্থিক সম্পর্কেই সম্পর্কিত।

আমরা জানি, ১৮৪৬ সালে তাদের বাসস্থানের কি অবস্থা ছিল। তারপর থেকে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। কৃষি-শ্রমিকদের একটা অংশযে-অংশটা অবশ্য দিন-দিনই কমে যাচ্ছে-এখনো বাস করে কৃষকদের খামারে ভিড়ে-ঠাসা কুঁড়েগুলিতে, যার জঘন্যতা ইংল্যাণ্ডের কৃষি-শ্রমিকদের এই ধরনের কুঁড়েগুলির জঘন্যতাকে অনেক ছাপিয়ে যায়। এবং এই মন্তব্য আলস্টারের কয়েকটা অংশ বাদে সর্বত্রই প্রযোজ্য : দক্ষিণে কর্ক, লিমারিক, কিলকেন্নি ইত্যাদি কাউন্টিগুলিতে; পূর্বে উইকৃলল, ওয়েক্স ফোর্ড ইত্যাদিতে; আয়ার্ল্যাণ্ডের কেন্দ্রস্থলে, রাজ-রানীর কাউন্টি, ডাবলিন ইত্যাদিতে, পশ্চিমে গিগা, বসকমন, মেয়ো, গ্যালোয়ে ইত্যাদিতে। জনৈক পরিদর্শক সোচ্চারে বলেন, “কৃষি-শ্রমিকদের কুঁড়েগুলি এই দেশের খ্ৰীষ্টধর্ম ও সভ্যতার পক্ষে কলংক স্বরূপ।”[৯০] শ্রমিকদের এই কোটরগুলির আকর্ষণ বাড়াবার জন্য স্মরণাতীত কাল থেকে সেগুলির সঙ্গে সংলগ্ন ভূমিখণ্ডগুলিকে ধারাবাহিক ভাবে বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। “জমিদার ও তার দালালদের এই জাতীয় নিষেধাজ্ঞার অধীনে তারা রয়েছে—নিছক এই বোধ…শ্রমিকদের মনে সেই লোকগুলির প্রতি বৈরিতা ও বিক্ষোভের জন্ম দেয়, যারা তাদের এই ভাবে নিজেদেরকে ভাবতে বাধ্য করেছে যে তারা একটা নিষিদ্ধ জাতি।[৯১]

কৃষি-বিপ্লবের প্রথম কাজ হল শ্রমের ক্ষেত্রে অবস্থিত কুঁড়েগুলিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া। এটা করা হয়েছিল বৃহত্তম আয়তনে এবং করা হয়েছিল যেন উপরের কারো নির্দেশের প্রতি আনুগত্য অনুসারে। এই ভাবে অনেক শ্রমিক বাধ্য হয়েছিল গ্রামে ও শহরে আশ্রয়ের সন্ধান করতে। সেখানে তারা আবর্জনার মত নিক্ষিপ্ত হয়েছিল ছাদের উপরে চিলেকোঠায়, মাটির তলায় কোটরে, খুপরিতে আনাচে কানাচে, সবচেয়ে নোংরা ঘিঞ্জি এলাকায়। আইরিশদের বিরুদ্ধে জাতিগত সংস্কারে আচ্ছন্ন যে ইংৰ্বেজ, তাদেরও সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে হাজার হাজার আইরিশ পরিবার—ঘর-সংসারের প্রতি অসাধারণ আকর্ষণের জন্য, আনন্দোচ্ছলতা ও পারিবারিক জীবনের বিশুদ্ধতার জন্য যারা সুখ্যাত-হঠাৎ তারা নিজেদের দেখতে পেল আপন পরিবেশ থেকে উৎপাটিত এবং পাপের পঙ্কে নিক্ষিপ্ত অবস্থায়। মানুষগুলি বাধ্য হল নিকটবর্তী কৃষকদের কাছে কাজের খোঁজ করত; তাদের ভাড়া হত কেবল এক দিনের ভিত্তিতে এবং স্বভাবতই, অত্যন্ত অনিশ্চিত মজুরিতে। সুতরাং, “কাজের জন্য যেতে আসতে অনেক সময়ে তাদের হাঁটতে হত অনেক দূর, প্রায়ই ভিজে যেত, সহ্য করতে দারুণ দুর্ভোগ—অনেক সময়েই যা শেষ হত অসুখে, ব্যাধিতে ও অভাবে।”[৯২]

“পল্লী-অঞ্চলে যে জনসংখ্যা উদ্বও বলে পরিগণিত হত, বছরের পর বছর সেই জনসংখ্যা শহরকে গ্রহণ করতে হত;”[৯৩] এবং তার পরেও মানুষ সবিস্ময়ে দেখত যে, “তখনো শহর ও পল্লীগ্রামে উদ্বও শ্রম থেকে গিয়েছে অথচ একই সময়ে কতগুলি পল্লী অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে হয় শ্রমের স্বল্পতা বা স্বল্পতার আশংকা।”[৯৪] সত্য ঘটনা এই যে, এই স্বল্পতা প্রকট হয়ে উঠত “ফসল কাটার মরশুমে, বসন্ত কালে, কিংবা এমন এমন সময়ে, যখন কৃষিকর্মে তৎপরতা বৃদ্ধি পায়; বছরের বাকি সময়ে অনেক হাতই বেকার থাকে; [৯৫] প্রধান ফসল যে- আলু, অক্টোবর মাসে তা খুড়ে ভোলার কাজ শেষ হয়ে যায় এবং তখন থেকে পরবর্তী বসন্তকাল পর্যন্ত তাদের কোনো রুজি-রোজগার থাকে না;[৯৬] আর তা ছাড়া, যখন কাজের সাড়া পড়ে যায়, তখনো তাদের অনেক ভাঙা-রোজ -ও আরো হরেক রকম ব্যাঘাত ও বিরতির দুর্ভোগ পোহাতে হয়।”[৯৭]

কৃষি-বিপ্লবের এই ফলাফল, যথা, চাষের জমিতে চারণ-জমি পরিবর্তন, মেশিনারির প্রচলন, শ্রমের ব্যবহারে কঠোরতম ব্যয়-সংকোচন ইত্যাদি আদর্শ জমিদারদের কাজে আরো বেগ ও ব্যাপ্তি লাভ করে, যারা তাদের খাজনা অন্য দেশে ব্যয় করার বদলে নিজেদের খাসমহলে ব্যয় করতে খুশি হন। যোগান ও চাহিদার নিয়মটি যাতে লজ্জিত না হয়, সেই জন্য এই ভদ্রলোকের সংগ্রহ করে তাদের শ্রমের যোগান: : প্রধানতঃ তাদের ছোট প্রজাদের মধ্য থেকে, যারা জমিদারদের দরকার মত বাধ্য হয় তাদের কাজ করে দিতে-সাধারণ শ্রমিকদের যে-মজুরি দেওয়া হয়, তার চেয়ে অনেক কম মজুরিতে এবং বীজ-বোনা ও ফসল-তোলার মত জরুরি সময়ে নিজেদের কাজের ক্ষতি করেও জমিদারদের কাজ করে দিতে।[৯৮]

কর্মসংস্থানের এই অনিশ্চয়তা, শ্রমের বাজার বারংবার ও দীর্ঘস্থায়ী এই জনবাহুল্য, আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার এই সমস্ত উপসর্গ গরিব আইন প্রশাসন’-এর প্রতিবেদন গুলিতে প্রকাশিত হয় কৃষি-সর্বহারা। প্রোলেটারিয়েট’। শ্রেণীর নানা রকমের দুর্ভোগ হিসাবে। প্রসঙ্গতঃ স্মরণীয় যে, ইংল্যাণ্ডের কৃষি-সর্বহারা শ্রেণীর ক্ষেত্রেও আমরা একই দৃশ্য দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু পার্থক্য এই যে, যেখানে শিল্প-প্রধান দেশ ইংল্যাণ্ডে তার সংরক্ষিত শিল্পকর্মী-বাহিনী সংগৃহীত হয় তার গ্রামাঞ্চল থেকে সেখানে কৃষিপ্রধান দেশ আয়ার্ল্যাণ্ডে সংরক্ষিত কৃষি-কর্মী বাহিনী সংগৃহীত হয় শহরাঞ্চল থেকে বহিষ্কৃত কৃষি-শ্রমিকেরা যেখানে আশ্রয় নেয়। প্রথম ক্ষেত্রে কৃষির সংখ্যাতিরিক্ত অংশ রূপান্তরিত হয় কারখানা-শ্রমিকে; দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে, যাদের জোর করে শহরে ঠেলে দেওয়া হয়, তারা শহরের মজুরির উপরে চাপ সৃষ্টি করলেও, কৃষি শ্রমিকই থেকে যায় এবং সব সময়েই কাজের সন্ধানে গ্রামে ফিরে যায়।

সরকারি প্রশিক্ষকেরা কৃষি-শ্রমিকের বৈষয়িক অবস্থা সংক্ষেপে এই ভাবে বিবৃত করেছেন : “যদিও সে বাস করে কঠোরতম মিতব্যয়িতার সঙ্গে, তবু তার মজুরি একটি সাধারণ পরিবারের খাদ্য-যোগাবার পক্ষে এবং বাড়িভাড়া দেবার পক্ষে যথেষ্ট হয় না, এবং তার নিজের, তার স্ত্রী ও সন্তানদের জামা-কাপড়ের জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় আয়ের অন্যান্য উৎসের উপরে। এই কুঠরিগুলির আবহাওয়া এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য যেসব অভাব-অনটন তাদের সহ করতে হয় তা এই শ্ৰেণীটিকে একটা ঘুষঘুষে জ্বর ও ফুসফুস-সংক্রান্ত ক্ষয়রোগের পক্ষে বিশেষ ভাবে প্রবণ করে তোলে।”[৯৯] এর পরে, এতে আর আশ্চর্যের কি আছে, যে-কথা সমস্ত পরিদর্শকই এক বাক্যে। সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, এই শ্রেণীর মধ্যে একটা বিষন্ন অসন্তোষের ধারা সব সময়েই প্রবাহিত হয়, তারা অতীত দিনে ফিরে আসার জন্য আকুলতা বোধ করে, বর্তমান কালকে ঘৃণা করে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশা পোষণ করে, “আন্দোলনকারীদের দুই প্রভাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং একটি মাত্র নির্দিষ্ট কামনা মনে মনে লালন করে—তা হল আমেরিকায় চলে যাওয়া। এই হল সেই কোকেইন-ল্যাণ্ড ( অলস বিলাসের কল্প-দেশ)—জনসংখ্যা হ্রাসের ম্যালথুসীয়া সর্বরোগহর ব্যবস্থাপত্র সবুজ এরিনকে (আয়ল্যাণ্ডকে ) যে-দেশে রূপান্তরিত করেছে।

আয়ার্ল্যাণ্ডের কারখানা-কর্মীরা কী সুখী জীবন ভোগ করে, একটি দৃষ্টান্ত দিলেই তা প্রকাশ পেয়ে যাবে : ইংল্যাণ্ডের কারখানা-পরিদর্শক রবার্ট বেকার বলেন, “তার শিশুদের লেখাপড়া শেখাবার জন্য একজন আইরিশ দক্ষ শ্রমিক কত চেষ্টা করেছিল, তার এই সাক্ষাৎটি সম্প্রতি উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ডে সফর কালে আমার গোচরে আসে এবং আমি মুখ থেকে এই সাক্ষ্য যেমন শুনেছি, ঠিক তেমনটিই লিপিবদ্ধ করছি। সে ছিল একজন দক্ষ কারখানা-শ্রমিক—এই কথাটার মানে তখন বোঝা যাবে, যখন আমি বলি যে সে নিযুক্ত ছিল ম্যাঞ্চেস্টার-বাজারের জন্য মাল-ফিনিশের কাজে। জনসন–আমি একজন ‘বিটলার’ (বিটল’ মেশিনের কর্মী, কাপড় পরিপাটি ও চকচকে করা যে-মেশিনের কাজ ); সোমবার থেকে শুক্রবার আমি প্রতিদিন কাজ করি সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। শনিবার আমি ছাড়া পাই সন্ধ্যা ৬টায়, এবং তার পরে তিন ঘণ্টা পাই ভোজন ও বিশ্রামের জন্য। আমার সবসুদ্ধ পাঁচটি সন্তান আছে। এই কাজের জন্য আমি সাপ্তাহিক ১০ শি ৬ পে পাই। আমার স্ত্রীও এখানে কাজ করে, সে পায় সাপ্তাহিক ৫ শি। সবচেয়ে বড় মেয়েটি, বয়স ১২ বছর, সংসারের কাজকর্ম করে। সেই আমাদের রাধুনি ও চাকরানি—সবই। সে ছোটদের ইস্কুলে যাবার জন্য তৈরি করে দেয়। একটি মেয়ে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যায়, সে আমাকে ভোর সাড়ে পাঁচটায় জাগিয়ে দেয়। আমার স্ত্রীও উঠে পড়ে এবং আমার সঙ্গে চলে। কাজে আসবার আগে আমরা কোনো খাবার খেতে পাইনা। ঐ ১২ বছরের শিশুটি সারাদিন বাকি শিশুদের যত্ন-আত্তি করে, এবং বেলা আটটায় প্রাতরাশের আগে পর্যন্ত আমাদের কিছুই জোটেনা। আটটার সময়ে আমরা বাড়ি যাই। সপ্তাহে একদিন আমরা চা পাই, অন্যান্য সময়ে আমরা পাই ‘পরিজ’-কখনো জইয়ের, কখনো ভারতীয় চাল-ডালের, যখন যেমন মেলে। শীতকালে ভারতীয় খাবারের সঙ্গে একটু চিনি ও জল পাই। গরম কালে পাই কিছু আলু যা এক টুকরো জমিতে আমরাই ফলাই; এবং যখন তা ফুরিয়ে যায় আবার ফিরে যাই পরিজে। কখনো-সখনো আমাদের একটু দুধও জুটে যায়। এই ভাবেই কাটে আমাদের প্রতি দিন, রবিবারই হোক আর কাজের দিনই হোক—সারা বছর একই ভাবে। রাতে কাজ শেষ করার পরে আমি ক্লান্ত বোধ করি। কখনো-সখনো আমাদের এক টুকরো মাংসও মিলে যায় তবে খুবই কালেভদ্রে। আমাদের শিশুদের মধ্যে তিনটি ইস্কুলে যায়, তাদের জন্য আমাদের মাথাপিছু দিতে হয় প্রতি সপ্তাহে ১ পেন্স করে। আমাদের বাড়ি ভাড়া সপ্তাহে ৯ পেন্স। আলানীর জন্য আমাদের দুসপ্তাহে ব্যয় হয় অন্তত ১ শি ৬ পে।”[১০০] এই হল আইরিশ মজুরি এই হল আইরিশ জীবন!

বস্তুতঃ পক্ষে আয়ার্ল্যাণ্ডের দুঃখ-দুর্দশা ইংল্যাণ্ডে আবার আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ১৮৬৬-র শেষে ও ১৮৬৭-র শুরুতে আয়ার্ল্যাণ্ডের জনৈক বৃহৎ জমিদার লর্ড-ডাফরিন ‘টাইমস’ পত্রিকায় এই সমস্যার সমাধানে তার প্রস্তাব প্রকাশ করেছিলেন। “Wie menschlich von solch grossem Herrn !”

(ঙ) সারণীতে আমরা দেখেছিলাম যে, ১৮৬৪ সালে £ ৪,৩৬৮,৬১০ মোট মুনাফার মধ্যে তিন জন মালিক উদ্বৃত্ত-মূল্য পকেটস্থ করেছিল মাত্র ৫ ২৬২,৮১৯ পাউণ্ড, কিন্তু ১৮৬৫ সালে ৫৪৬৬,৯৭৯ মোট মুনাফার মধ্যে “ভোগ-সংবরণ”-এর ঐ তিন পয়গম্বরই পকেটস্থ করেছিল ২৭৪,৫২৮ পাউণ্ড; ১৮৬৪ সালে ২৬ জন উদ্বৃত্ত মূল্য মালিক পৌছেছিলে ৬৪৬,৩৭৭ পাউণ্ডে; ১৮৬৫ সালে ২৮ জন উদ্বৃত্ত-মূল্য মালিক ৭,৩৬,৪৪৮ পাউণ্ডে; ১৮৬৪ সালে ১২১ জন, ১০,৭৬,৯১২ পাউণ্ডে; ১৮৬৫ সালে ১৫০ জন উদ্বৃত্ত-মূল্য মালিক ১৩,২৩,৯০৬ পাউণ্ডে; ১৮৬৪ সালে ১,১৩১ জন উদ্বৃত্ত-মূল্য মালিক ২,১৫,৮১৮ পাউণ্ডে, মোট বাৎসরিক মুনাফার প্রায় অর্ধেকে; ১৮৬৫ সালে ১,১৯৪ জন উদ্বৃত্ত-মূল্য মালিক, ২,৪১৮,৮৩৩ পাউণ্ডে, মোট বাৎসরিক মুনাফার অর্ধেকেরও উপরে। কিন্তু বাৎসরিক জাতীয় খাজনার এমন সিংহভাগ ইংল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড ও আয়ার্ল্যাণ্ডের এত অবিশ্বাস্য রকমের স্বল্পসংখ্যক সুবৃহৎ জমিদার গ্রাস করে যে ইংল্যাণ্ড রাষ্ট্রের প্রজ্ঞাবান কর্তৃপক্ষ মুনাফা বণ্টনের পরিসংখ্যান প্রকাশ করলেও খাজনা-বণ্টন সম্পর্কে অনুরূপ পরিসংখ্যান প্রকাশ করা সমীচীন মনে করেননি। লর্ড ডাফরিন ঐ সুবৃহৎ জমিদারদের মধ্যে একজন। খাজনা ও মুনাফা যে কখনো অত্যধিক” হতে পারে কিংবা খাজনা ও মুনাফার প্রাচুর্য যে কোন রকমে জনগণের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, এমন একটা ধারণা যেমন “দুষ্ট” তেমন “ভ্রান্ত”। তিনি তথ্যের প্রতি নিষ্ঠাবান। তথ্য এই যে যখন আয়ার্ল্যাণ্ডের জনসংখ্যা হ্রাস পায়, তখন আয়ার্ল্যাণ্ডের খাজনা বৃদ্ধি পায়; জনসংখ্যা-হ্রাস জমিদারকে উপকার করে, অতএব, জমিরও উপকার করে এবং স্বভাবতই, যারা জমির অনুষঙ্গমাত্র সেই মানুষদেরও উপকার করে। সুতরাং তিনি ঘোষণা করেন, আয়াণ্ড এখনো অতিরিক্ত জনাকীর্ণ এবং দেশান্তর-যাত্রার প্রবাহ এখনো মন্থর। সর্বাঙ্গীণ সুখী হতে হলে, আয়াণ্ডকে অবশ্যই শ্রমজীবী জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ থেকে নিষ্কৃতি পেতে হবে। কেউ যেন মনে না করেন যে, এই প্রভুটি, উপরন্তু যিনি আবার কবিও, সাংগ্রাতো-র অনুসারী কোন ডাক্তার, যিনি যখনি দেখলে রোগীর উন্নতি ঘটছে না, তখনি নির্দেশ দিতেন রক্ত-মোক্ষণের (বিটমি’-র) এবং আরো রক্ত-মোক্ষণের যতক্ষণ না বোগী তার রোগ ও রক্ত থেকে একই সঙ্গে মুক্তি পায়। লর্ড ডাফরিন নোতুন করে মাত্র সাড়ে তিন লক্ষের মত লোকের রক্ত-মোক্ষণ দাবি করেছেন, ২০ লক্ষের মত লোকের দাবি করেননি; বস্তুতঃ পক্ষে এদের হাত নিষ্কৃতি না পেলে এরিনে (আয়ার্ল্যাণ্ডে) সত্যযুগ (মিলেনিয়াম) আসতে পারে না। প্রমাণটা খুবই সহজে দেওয়া যায়।

১৮৬৪ সালে আয়ার্ল্যাণ্ডে জোতের সংখ্যা ও আয়তন

ছবি। পেজ ৪৫৫

১৮৫১ থেকে ১৮৬১ সালের মধ্যে কেন্দ্রীভবনের ফলে ধ্বংস হয় প্রধানতঃ প্রথম। তিন ধরনের জোত-১ একরের কম এবং ১৫ একরের অনধিক। এই সবগুলিকেই অন্তর্হিত হতে হবে। তা হলে পাই “সংখ্যাতিরিক্ত” কৃষক এবং পরিবার প্রতি গড়ে কম করে ৪ জন ধরে নিলে, লোকসংখ্যা পাওয়া যায় ১২,২৮,২৩২ জন। যদি একটু বাড়িয়ে ধরে নেওয়া যায় যে, কৃষি-বিপ্লব সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পরে এদের ৪ ভাগ কর্ম-নিযুক্ত হবে, তা হলে দেশান্তর-গমনের জন্য থাকে ৯,২১,১৭৪ জন। ১৫ একরের অধিক ১০০ একরের অনধিক (৪) (৫) (৬) বৰ্গভুক্ত জোতগুলি ধনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শস্যোৎপাদন ও মেষ-পালনের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং, যেমন ইংল্যাণ্ডে ঘটেছে, তেমন এখানেও দ্রুত বিলীয়মান সংখ্যায় পরিণত হচ্ছে। আবার যদি উপরের মত ধরে নিই যে, দেশান্তর গমনের জন্য রয়েছে আরো ৭,৮,৭৬১ জন লোক, তা হলে মোট দাড়ায় ১৭,৯,৫৩২ জন। এবং যেমন Papetit vient en mangeant’, রেনট্রল-এর চোখ অচিরেই আবিষ্কার করবে, ৬৫ লক্ষ মানুষ নিয়েও আয়ার্ল্যাণ্ডের অবস্থা আগের মতই শোচনীয়, এবং শোচনীয় এই কারণে যে, সে অতিরিক্ত জনাকীর্ণ। সুতরাং তার নির্জনীকরণকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, যাতে করে সে পারে তার সত্যকার ভবিতব্যতা সাধন করতে, ইংল্যাণ্ডের মেষ ও গবাদি পশুর চারণক্ষেত্রে পরিণত হতে।[১০১]

* মোট এলাকার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ধাপা, ভোবা, পোড় জমি।

এই মন্দ জগতের সমস্ত ভাল জিনিসের মত, এই মুনাফাজনক পদ্ধতিটিরও আছে কিছু অসুবিধা। আয়ার্ল্যাণ্ডে খাজনার পুঞ্জীভবনের সঙ্গে আমেরিকায় আইরিশদের পুঞ্জীভবনও সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলে। ভেড়া ও ষাড়ের দ্বারা নির্বাসিত আইরিশম্যান ‘ফেনিয়ান (ইংরেজ সরকার বিরোধী আইরিশ বিপ্লবী সংস্থার সদস্য) হিসাবে পুনরাবির্ভূত হয় সমুদ্রের পরপারে; এবং সাত-সাগরের বয়োবৃদ্ধা মহারানীর মুখোমুখি অভূদিত হয় এক তরুণ পরাক্রান্ত প্রজাতন্ত্র :

Acerba fata Romanos agunt
Scelusque fraternae necis

————

১. ইংরেজ সরকারের ‘টেস্থ রিপোর্ট, ইনল্যাণ্ড রেভিনিউ, লণ্ডন, ১৮৬৬, পৃঃ ৩৮।

২. ঐ

৩. এই পরিসংখ্যানগুলি তুলনার পক্ষে যথেষ্ট, কিন্তু, অনাপেক্ষিক ভাবে দেখলে, মিথ্যা, কেননা সম্ভবতঃ ১৩,০০,০০,০০০ আয় বাৎসরিক অঘোষিত থেকে যায়। ইনল্যাণ্ড রেভিনিউ কমিশনারদের কাছ থেকে ধারাবাহিক প্রতারণার অভিযোগ, বিশেষ করে, বাণিজ্য ও শিল্পগত শ্রেণীগুলির দ্বারা অনুষ্ঠিত প্রতারণার অভিযোগ, হামেশাই শোনা যায়। যেমন, “একটা যৌথ মূলধনী কোম্পানি বিবরণ দাখিল করল যে তার কযোগ্য মুনাফা হল £৬,৩০০, কর-নিৰ্ণায়ক অফিসার তা বাড়িয়ে করলেন ৫৮৮,০০০, এবং শেষ পর্যন্ত এই পরিমাণটির উপরে কর দেওয়া হয়। আরেকটি কোম্পানি দেখিয়েছিল তার কর-যোগ্য মুনাফা £১,৯০,০০০; শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তার মুনাফা £২,৫০,০০০। (ঐ, পৃঃ ৪২)।

৪. ‘আদমসুমারি ইত্যাদি, ঐ, পৃঃ ২৯। জন ব্রাইটের ঘোষণা যে, ১৫০ জন জমিদার অর্ধেক ইংল্যাণ্ডের এবং ১২ জন অর্ধেক স্কটল্যাণ্ডের মালিক, কখনো খণ্ডিত হয়নি।

৫. চতুর্থ রিপোর্ট ইত্যাদি, ইনল্যাণ্ড রেভিনিউ কমিশন, লণ্ডন, ১৮৬৩, পৃঃ ১৭।

 ৬. কয়েকটি আইন-অনুমোদিত বাদ বিয়োগের পরে এগুলিই হল নীট আয়। মজুরিতে ৫ শতাংশ হ্রাস ঘটেছিল। ১৮৬৭ সালে অনুরূপ ঘটনার প্রতিবাদে প্রেস্টনে ২০,০০০ শ্রমিকের ধর্মঘট হয়। (চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংযোজন : অব্যবহিত পরেই যে-সংকট ফেটে পড়ে, এই ঘটনা তারই পূর্বাভাস। এফ. এঙ্গেলস)

৭. “আদমসুমারি, ঐ, পৃঃ ১১।

৮. ১৮৪৩, ১৩ ফেব্রুয়ারি, কমন্স সভায় গ্ল্যাডস্টোনের বক্তৃতা টাইমস ১৮৪৩, ১৪ই ফেব্রুয়ারী—“এই দেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে এটা একটা শোচনীয় দিক যে আমরা অনস্বীকার্য ভাবে দেখতে পাচ্ছি, এই মুহূর্তে যখন জনগণের পরিভোগ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, অভাব ও দুর্দশার চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তে উচ্চতর শ্ৰেণীগুলিরমধ্যে ঘটছে সম্পদের নিরন্তর সঞ্চয়ন, ঘটছে তাদের অভ্যাসগত বিলাস ও ভোগসম্ভারের বৃদ্ধি।” (স্কানসা’, ১৩ ফেব্রুয়ারি)।

৯. ১৮৬৩, ১৬ই এপ্রিল কমন্স সভায় গ্লাভস্টোনের বক্তৃতা। মনিস্টার ১৭ই এপ্রিল।

১০. ‘ব্লু বুক’ এ সরকারি বিবরণ দ্রষ্টব্য : ‘মিসেলানিয়াস স্ট্যাটিষ্টিকস অব দি ইউনাইটেড কিংডম, ৪র্থ বিভাগ, লণ্ডন ১৮৬৬, পৃঃ ২৬০-২৭৩। অনাথ আশ্রমের পরিসংখ্যানের পরিবর্তে, ‘মিনিস্টিরিয়াল জানাল-এ রাজবংশের শিশুদের জন্য যৌতুক সুপারিশের সালংকার বক্তব্যগুলি পড়লেও চলবে। সেখানে জীবনধারণের দ্রব্যসামগ্রীর দুমূল্যতার কথা কখনো ভুলে যাওয়া হয় না!

১১. গ্লাভস্টোন কমন্স-সভা, ৭ই এপ্রিল, ১৮৬৪: হান্সার্ড-এর বর্ণনা এইরূপআর, আরো বৃহত্তর ক্ষেত্রে—কী এই মানব-জীবন! বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অস্তিত্বের সংগ্রাম। গ্ল্যাডস্টোনের ১৮৬৩ ও ১৮৬৪ সালের বাজেট-বক্তৃতাগুলিতে নিরন্তর স্ববিরোধ একজন ইংরেজ লেখক বইলো-র নিম্নোদ্ধত কবিতাংশের সাহায্যে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেনঃ

Voila, l’homme en effet. It va du blanc au noir
 Il condamne au matin ses sentiments du soir.
Importun a tout autre, a soi-meme incommode.
Il change a tout moment d’esprit comme de mode.

(‘থিয়োরি অব এক্সচেঞ্জেস ইত্যাদি, লন, ১৮৬৪, পৃঃ ১৩৫।)

১২. এইচ ফসেট, ঐ, পৃঃ ৬৭-৮২। খুচরো দোকানীদের উপরে শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার কারণ হল তাদের চাকরির ঘন ঘন ছেদ ও অনিশ্চিত অবস্থা।

১৩. এখানে ওয়েলসকে সব সময়েই ইংল্যাণ্ডের মধ্যে ধরা হয়েছে।

১৪. অ্যাডাম স্মিথের আমল থেকে যে-অগ্রগতি ঘটেছে, এই ঘটনা তার উপরে এক বিশেষ রকমের আলোক সম্পাত করে যে “কর্ম-নিবাস” (“দুঃস্থ-নিবাস’ ) কথাটা এখনো মাঝে মাঝে “ম্যানুফ্যাক্টরি” (শ্রম-কারখানা) কথাটার সঙ্গে একই অর্থে ব্যবহৃত হয়; যেমন, তার শ্রম-বিভাগ সংক্রান্ত অধ্যায়টি এই বলে শুরু হয়েছে “কাজের প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা শাখায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রায়ই সমবেত করা হয় একই কর্ম নিবাসে”।

১৫. “জন-স্বাস্থ্য। ষষ্ঠ রিপোর্ট, .৮৬৪, পৃঃ ১৩।

১৬. ঐ, পৃ: ১৭।

 ১৭, ঐ, পৃঃ ১৩।

১৮. ঐ, সংযোজনী, পৃ ২৩২

১৯. ঐ, পৃ ২৩২, ২৩৩।

২০. ঐ, পৃ ১৪, ১৫।

২১. “শ্রমিক শ্রেণীর আবাসনের ক্ষেত্রের মত আর কোনো ক্ষেত্রেই ব্যক্তির অধিকার এমন সরবে ও নিলজ্জ ভাবে বলি-প্রদত্ত হয়নি যেমন হয়েছে সম্পত্তির অধিকারের বেদিতে। প্রত্যেকটি বড় শহরকেই গণ্য করা যেতে পারে একটি নরবলির পীঠ হিসাবে, একটি মশান হিসাবে যেখানে অর্থগৃঃ,তার পিশাচীর কাছে প্রতি বছর বলি দেওয়া হয় হাজারে হাজারে।” এস. লেইং, ঐ, পৃঃ ১৫০।

২২. “জন-স্বাস্থ্য, অষ্টম রিপোর্ট, ১৮৬৫, পৃঃ ১৪ টাকা।

২৩ ঐ, পৃঃ ৮৯। এই কলোনি’গুলির শিশুদের সম্বন্ধে ডাঃ হান্টার বলেন, গরিবদের এই ঘন সন্নিবেশ শুরু হবার আগেকার আমলে শিশুদের কেমন করে বড় করা হত, তা বলার জন্য কেউ বেঁচে নেই, এবং যে-ব্যক্তি আমাদের বলবে এই শিশু-প্রজাতির —যারা এখানে শিক্ষা সম্পূর্ণ করছে তাদের ভবিষ্যৎ জীবিকার জন্য এবং বিপজ্জনক শ্ৰেণীহিসাবে অর্ধেক রাত কাটিয়ে দিচ্ছে সব বয়সের অর্ধ-নগ্ন, পানোন্মত্ত, কদাচারী ও কলহপরায়ণ লোকদের সঙ্গে এমন অবস্থার মধ্যে যা সম্ভবত এই দেশে আর কখনো ঘটেনি-সেই শিশু-প্রজাতির ভবিষ্যৎ আচার-ব্যবহার কি হবে, সে নিশ্চয়ই নিজেকে প্রতিপন্ন করবে একজন হঠকারী ভবিষ্যদ্বক্তা হিসাবে। (ঐ, পৃঃ ৫৬।

২৪. ঐ, পৃঃ ৬২।

২৫. “রিপোর্ট অব দি অফিসার হেলথ অব সেন্ট মার্টিনস-ইন-দি ফিঙ স”, ১৮৬৫।

 ২৬. “জনস্বাস্থ্য, অষ্টম রিপোর্ট ১৮৬৬, পৃঃ ১।

 ২৭. ঐ পৃঃ ৮৮।

২৮. ঐ, পৃঃ ৮৮।

২৯. ঐ, পৃঃ ৮৯।

৩০. ঐ পৃঃ ৫৫ এবং ৫৮।

৩১. ঐ, পৃঃ ১৪৯।

৩২. ঐ, পৃঃ ৫০।

৩৩. ঐ, পৃঃ ১১৪।

৩৪. ঐ, পৃঃ ৫০।

৩৫. “জন-স্বাস্থ্য, সপ্তম রিপোর্ট, ১৮৬৫” পৃ: ১৮।

৩৬. ঐ পৃঃ ১৬৫।

৩৭. ঐ, পৃঃ ১৮ টাকা। চ্যাপেল-এন-লে-ফ্রিথ ইউনিয়নের রিলিভিং অফিসার রেজিস্ট্রার-জেনারেল-এর কাছে রিপোর্ট করেন : “ডাভটেলস-এ চুনের এক বড় ছাই পাহাড়ে ( চুন-ভাটির আবর্জনা ভূপেছোট ছোট গত খোড়া হয়েছে; সেগুলি বাসস্থান হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে; ঐ অঞ্চলে যে-রেলপথ তৈরি হচ্ছে, তার মজুরেরা এবং অন্যান্যর। সেখানে থাকে। গর্তগুলো ছোট ও সঁাৎসেতে, কাছাকাছি কোনো নর্দমা বা পায়খানা নেই; মাথার উপরে ধোয়া বেরোবার জন্য যে গর্ত আছে, তা ছাড়া হাওয়া চলাচলের কোনো পথ নেই। এই ত্রুটির জন্য কিছুকাল ধরে বসন্ত রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে, এবং তার ফলে ( ঐ গুহাবাসীদের মধ্যে) কিছু মৃত্যু ঘটেছে। (ঐ, টীকা ২)।

৩৭. চতুর্থ বিভাগের শেষে যে বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তা বিশেষত কয়লাখনি শ্রমিকদের। ধাতু খনিগুলির অবস্থা আরো খারাপ। ১৮৬৪ সালের রয়্যাল কমিশনের অত্যন্ত সহৃদয় রিপোর্টটি দ্রষ্টব্য।

৩৮. ঐ, পৃঃ ১৮০-১৮২। ক্যাপিট্যাল (২য়)-২৬

৩৯. ঐ, পৃঃ ৫১৫, ৫১৭।

৪০. ঐ, পৃঃ ১৬।

৪১. “লণ্ডনের গরিবদের পাইকারী অনশন . গত কয়েক দিনের মধ্যে লণ্ডনের দেওয়ালগুলি বড় বড় পোস্টারে ছেড়ে গিয়েছে। তাতে রয়েছে এই উল্লেখযোগ্য ঘোষণা : “মোটা ষাড়ের! অনাহারী মানুষেরা! মোটা ষাড়েরা তাদের কঁচের প্রাসাদ থেকে ধনীদের খাওয়াতে গিয়েছে তাদের বিলাসী বাসভবনে, যখন অনাহারী মানুষগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাদের শোচনীয় আস্তানাগুলোতে শুকিয়ে শুকিয়ে মরতে।” এই অমঙ্গলসূচক কথাগুলো বুকে নিয়ে পোস্টারগুলো কিছু সময় বাদে বাদে আত্মপ্রকাশ করে। যে-মুহূর্তে এক প্রস্ত পোস্টার ছিড়ে বা ঢেকে দেওয়া হয়, সেই মুহূর্ত সেই একই জায়গায় বা অন্য কোনো একই রকমের প্রকাশ্য স্থানে আরেক প্রস্ত লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা আমাকে মনে পড়িয়ে দেয় সেই সব গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের কথা, যারা ফরাসী দেশের জনগণকে প্রস্তুত করেছিল ১৭৮৯ সালের জন্য। এই মুহূর্তে যখন ইংল্যাণ্ডের শ্রমজীবী মানুষেরা তাদের স্ত্রী ও শিশুদের নিয়ে শীতে ও অনাহারে মারা যাচ্ছে, তখন ইংল্যাণ্ডেরই শ্রমের সৃষ্টি কোটি কোটি ইংরেজ স্বর্ণমুদ্রা বিনিয়োজিত হচ্ছে রুশ, স্পেনীয়, ইতালীয় ও অন্যান্য বিদেশী প্রতিষ্ঠানে।’-‘রেন নিউজপেপার, ২৩শে জানুয়ারি, ১৮৬৭।

৪২. জেমস ই. থরল্ড রজার্স ( অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থতত্তের অধ্যাপক’, এ হিস্টরি অব এগ্রিকালচারাল প্রাইসেস ইন ইংল্যাণ্ড, ১৮৬৩, পৃঃ ৬৯০। ধৈর্যশীল নিষ্ঠাশীল শ্রমের ফল এই গ্রন্থখান! এতাবৎ প্রকাশিত খণ্ডদুটিতে বিধৃত রয়েছে মাত্র ১২৫ ৯ থেকে ১৪০০ পর্যন্ত সময়কাল, দ্বিতীয় খণ্ডটিতে আছে কেবল পরিসংখ্যান। আমাদের গোচরে এটাই হল প্রথম প্রামাণ্য ‘অর্থমূল্যের ইতিহাস।

৪৩. ‘রিজনস ফর দি লেট ইনক্রিজ অন দি পুয়োর রেটস : “অর এ কমপারিটিভ ভিউ অব দি প্রাইস অব লেবার অ্যাণ্ড প্রভিসন, লণ্ডন, ১৭৭৭, পৃঃ ৫, ১১।

৪৪. ডঃ রিচার্ড প্রাইস : ‘অবজার্ভেশনস অন রিভার্শনরি পেমেন্টস’, ডবলিউ. মর্গান সম্পাদিত .৮০৩, খণ্ড ২, পৃঃ ১৫, ১৫৯। ১৫৯ পৃষ্ঠায় মূল্য সম্পর্কে লেখক মন্তব্য করেছেন, ১৫১৪ সালে যা ছিল তার চেয়ে আজ দিনমজুরের আর্থিক মজুরি ৪ গুণ, নড় জোর ৫ গুণের বেশি নয়। কিন্তু ফসলের দাম ৭ গুণ, মাংস এবং পরিচ্ছদের দাম প্রায় ১৫ গুণ। সুতরাং, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে মজুরি-বৃদ্ধির অনুপাত সমান হওয়া দূরে থাক, তার অর্ধেকও হয়নি।

৪৫. বার্টন, ঐ, পৃঃ ২৬। অষ্টাদশ শতকের শেষের জন্য ইডেন ঐ দ্রষ্টব্য

 ৪৬. প্যারি, ঐ, পৃঃ ৮৬।

৪৭. ঐ, পৃঃ ২১৩।

৪৮. এস. লেইংগ, ঐ, পৃঃ ৬২।

৪৯. ইংল্যান্ড অ্যাণ্ড আমেরিকা, ১৮৩৩, খণ্ড ১, পৃঃ ৪৭

৫০. এই উদ্দেশ্যে ভূম্যধিকারী অভিজাতবৃন্দ রাষ্ট্রের ভাণ্ডার থেকে অত্যন্ত নিচু সুদে নিজেদের আগাম দিল, অবশ্যই পার্লামেন্টের অনুমোদন অনুসারে, বিপুল অর্থ, যা কৃষি-মালিকদের পুষিয়ে দিতে হয়েছিল অনেক উচু হারে।

৫১. মধ্য-শ্রেণী কৃষি-মালিকদের সংখ্যা-হ্রাস আদম-সুমারির বর্গ-ভুক্তি থেকেও বোঝা যায় : ‘কৃষি-মালিকের পুত্র, প্রপৌত্র, ভগিনী, ভাগিনেয়ী, এক কথায়, তার নিজের পরিবারের সদস্যবৃন্দ, যাদের সে নিজেই কাজে নিযুক্ত করেছে। ১৮৫১ সালে এই বর্গের অন্তভুক্ত লোকস”খ্যা ছিল ২১৬,৮৫১ জন, ১৮৬১ সালে মাত্র ১,৭৬, ১৫১ জন। ১৮৫১ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত ২০ একরের কম আয়তনের জোতের সংখ্যা ৯০০ কমে গেল; ৫০ থেকে ৭৫ একরেয় মধ্যস্থিত জোতের সংখ্যা ৮,২৫৩ থেকে কমে দাড়াল ৬,৩৭০; ১৫০ একরের কম আয়তনের জোতগুলির সব ক্ষেত্রেই এই একই অবস্থা ঘটল। অন্য দিকে, এই একই ২০ বছরের মধ্যে, বড় বড় জোতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল; ৩০০-৫০০ একর আয়তন-বিশিষ্ট জোত ৭,৭৭১ থেকে ৮,৪১; ৫০০ একরের বেশি আয়তনবিশিষ্ট ২,৩৫৫ থেকে ৩,৯১৪; ১০০০-এর বেশি আয়তনবিশিষ্ট ৪৯২ থেকে ৫৮২।

৫২. মেষপালকের সংখ্যা ১২,৫১৭ থেকে বেড়ে দাঁড়াল ২৫,৫৫৯ জন।

৫৩. ‘আদমসুমারি’, ঐ, পৃঃ ৩৬।

৫৪. রজার্স, ঐ, পৃঃ ৬৯৩, পৃঃ ১০। রজার্স উদারনৈতিক দলের অন্তভুক্ত; কবডেন এবং ব্রাইট-এর ব্যক্তিগত বন্ধু; সুতরাং বিগতকালের গায়ক নন।

৫৫. ‘জন-স্বাস্থ্য, ৭ম রিপোর্ট’, ১৮৬৫, পৃঃ ২৪২। সুতরাং যখনি কানে আসে যে কোন মজুরের আয় একটু বেড়েছে, তখন জমিদারের পক্ষেও তার ঘরভাড়া বাড়ানো বিরল ঘটনা নয় কিংবা কৃষি-মালিকের পক্ষেও তার মজুরি কমানো বিরল ঘটনা নয়। “কেননা তার স্ত্রী একটা কাজ পেয়েছে ঐ।

৫৬. ঐ, পৃঃ ১৩৫।

৫৭. ঐ, পৃঃ ১৩৪।

৫৮. রিপোর্ট অব কমিশনার্স রিলেটিং টু ট্রান্সপোরেশন অ্যাও পেনাল সার্ভিটুড” লণ্ডন, ১৮৬৩, পৃঃ ৪২, ৫০।

৫৯. ঐ, পৃঃ ৭৭, ‘মেমোণ্ডাম বাই দি লর্ড চিফ জাস্টিস।

 ৬০. ঐ, খণ্ড ২, ‘মিনিটস অব এভিডেন্স।

৬১. ঐ, খণ্ড ১, সংযোজনী পৃ: ২৮।

৬২. “জন-স্বাস্থ্য, ষষ্ঠ রিপোর্ট”, ১৮৬৪, পৃঃ ২৩৮, ২৪৯, ২৬১, ২৬২

৬৩. ঐ, পৃঃ ২৬২।

৬৪. ১৮৬৫ সালে আইনটির কিছুটা উন্নতি সাধিত হয়। অচিরেই অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে এ ধরনের টুকটাক মেরামতিতে কোনো কাজ হয় না।

৬৫. পরে যা বলা হয়েছে তা বুঝতে হলে, মনে রাখা দরকার “রুদ্ধ গ্রাম” মানে সেই সব গ্রাম যাদের মালিক একজন বা দু জন বৃহৎ জমিদার। “মুক্ত গ্রাম” মানে সেই সব গ্রাম, যাদের মাটির মালিক অনেক ছোট ছোট জমিদার। এই শেষোক্ত গ্রামগুলিতে বাড়ির ফটকা-ব্যবসায়ীরা কুটির এবং লজিং হাউজ’ ( খাবার ব্যবস্থা ছাড়া, থাকার ঘর ) নির্মাণ করে।

৬৬. এই ধরনের একটি প্রদর্শনী-পল্লী দেখায় খুব সুন্দর, কিন্তু দ্বিতীয় ক্যাথারিন ক্রিমিয়া যাবার পথে, যে-পল্লীগুলি দেখেছিলেন, সেগুলির মতই অবাস্তব। সম্প্রতি এমনকি মেষ পালকদেরও এই ধরনের গ্রামগুলি থেকে নির্ধারিত করা হয়েছে। যেমন, মার্কেট হর্বরো’-র কাছে ৫০০ একর জমির এক ভেড়া-খামার আছে, যেখানে নিযুক্ত করা হয় কেবল একজন লোকের শ্রম। লাইসেস্টার এবং নর্দাম্পটনের সুন্দর চারণ ভূমির সেই দূর-বিস্তৃত সমতলের উপর দিয়ে দীর্ঘ পদযাত্রাকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য, মেষ পালক খামারের চৌহদ্দির মধ্যেই একটা কুটির পেত। এখন সে পায় সপ্তাহে ১৩ শিলিং—দূরবর্তী কোন মুক্ত গ্রামে মাথা-গোঁজার ঠাঁই ঠিক করে নেবার জন্য।

৬৭. “শ্রমিকদের বাড়িগুলি মুক্ত গ্রামগুলিতে, যেগুলি অবশ্য সব সময়েই জনাকীর্ণ ‘ সাধারণতঃ তৈরি করা হয় সারি সারি ভাবে; মালিকের নিজস্ব জমির শেষ কিনারায় থাকে সেগুলির পিছন দিকটা; এবং সেই কারণে একমাত্র সামনের দিকে ছাড়া কোনো জানালার ব্যবস্থা অনুমোদন করা হয়না।” (ডাঃ হান্টারের নিপোর্ট, পৃঃ ১৩৫) অনেক সময়ে গ্রামের বীয়ার-বিক্রেতা বা মুদিই আবার এই সব বাড়ির ভাড়া প্রদানকারী। সেক্ষেত্রে কৃষি-মজুর কৃষি-মালিকের পরে তার মধ্যে আবিষ্কার করে দ্বিতীয় মালিক। তাকে একই সময়ে হতে হবে তার খরিদ্দাব এবং ভাড়াটে। বস্তুত পক্ষে, এই মুক্ত-গ্রামগুলি হল ইংল্যাণ্ডের কৃষি-সর্বহারাদের “দণ্ড পল্লী”। বেশির ভাগ। কুটিরই হল কেবল রাত্রিবাসের জায়গা, যেখানে ভিড় করে এলাকার যত উচ্ছংখল। লোকেরা। গ্রামের শ্রমিক এবং তার পত্নী, যারা কদর্যতম পরিবেশের মধ্যেও সত্য সত্যই বিস্ময়কর ভাবে রক্ষা করে তাদের চরিত্রের পূর্ণতা ও পবিত্রতা, তারা নিক্ষিপ্ত হয় এই নরকে এবং হয় অধঃপতিত। অবশ্য অভিজাত “শাইলক”-দের মধ্যে একটা ফ্যাশন হচ্ছে বাড়ির ফটকা-ব্যবসায়ী, ছোট জমিদার এবং মুক্ত-গ্রামগুলির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা। তারা অবশ্য ভাল ভাবেই জানে যে তাদের “রুদ্ধ গ্রাম” এবং “প্রদর্শনী গাম’-ই হল ‘মুক্ত-গ্রাম”-এর জন্মভূমি; ওগুলি ছাড়া এগুলি জন্মাতে পারত না। ‘ছোট ঘোট মালিকেরা যদি না থাকত, তা হলে শ্রমিকদের অধিকাংশকেই রাত কাটাতে হত তার যে খামারে কাজ করে তার গাছতলায়।’ ! ঐ, পৃঃ ১৩৫ এই “মুক্ত” এবং “রুদ্ধ” গ্রামের ব্যবস্থা সমস্ত মিডল্যাণ্ড কাউন্টিতে এবং ইংল্যাণ্ডের পূর্বাঞ্চলে চালু আছে।

৬৮. সপ্তাহে ১০ শিলিং মজুরিতে নিযুক্ত একজন লোকের কাছ থেকে নিয়োগকর্তা বস্তুতঃ পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে একটা মুনাফা সংগ্রহ করে নিচ্ছে এবং যে বাড়ির মূল্য খোলা বাজারে ২০ পাউণ্ডের বেশি হত না তার জন্য বেচারা খামার-মজুরকে ভাড়া দিতে হচ্ছে বছরে ৪-৫ পাউণ্ড করে। এই কৃত্রিম হার মালিক বজায় রাখতে পারছে, কেননা তার একথা বলার ক্ষমতা আছে, হয় আমার বাড়িতে থাকে। আর নয়তো ‘ত্র ভাড়া খোজো।” : যদি কোন লোক নিজের অবস্থা ভাল করতে চায়, রেল ওয়েতে ‘প্লেট-লেয়ার হিসাবে কাজ করতে চায়, কিংবা খনি-মজুরের কাজে যেতে চায়, সেই একই ক্ষমতা তাকে বলার জন্য তৈরী, ‘আমার জা এই সামান্য মজুরিতে কাজ করো, কিংবা এক সপ্তাহের নোটিশে কেটে পড়ো; সঙ্গে নিয়ে যাও তোমার শুয়োর এবং বাগানে যে-আলু লাগিয়েছ তার জন্য যা পাও নিয়ে নেও। আর যদি সে বোঝে যে এতে তার বেশি লাভ হবে তা হলে মালিক তাকে ঘরে থাকতে দিয়ে বেশি ভাড়া দাবি করবে—তার কাজ ছেড়ে দেবার শাস্তি হিসাবে। ডঃ হান্টার, পৃঃ ১৩২)

৬৯. ‘নোতুন বিবাহিত দম্পতিরা বয়ঃপ্রাপ্ত ভাই ও বোনদের পর্যবেক্ষণের পক্ষে খুব কল্যাণকর বিষয় নয়; এবং যদিও দৃষ্টান্ত দেবার দরকার নেই, এমন মন্তব্য করার পক্ষে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে যে, অনাচারের অপরাধের মেয়ে অংশীদারটির ভাগ্যে জোটে তীব্র মনোকষ্ট এমনকি, কখনো কখনো মৃত্যু। ( ডাঃ হান্টার, পৃঃ ১৩৭)। একজন গ্রামীণ পুলিশ, তিনি দীর্ঘকাল ধরে লণ্ডনের নিকৃষ্ট মহল্লাগুলিতে গোয়েন্দার কাজ করেছেন, তিনি তার গ্রামের বালিকাদের সম্পর্কে বলেন, লণ্ডনের সবচেয়ে খারাপ অঞ্চলগুলিতে আমার গোয়েন্দা-জীবনের কয়েক বছরে আমি তাদের সাহস ও নির্লজ্জতার তুলনা পাইনি। তারা বাস করে শুয়োরের মত, বড় বড় ছেলে আর মেয়েরা, মায়েরা আর বাবারা—অনেক সময়ে সকলেই একই রুমে। (শিশু নিয়োগ কমিশন, ষষ্ঠ রিপোর্ট, ১৮৬৭, পৃঃ ৭৭ sq. ১৫৫:)।

৭০. জনস্বাস্থ্য, সপ্তম রিপোর্ট, ১৮৬৫, পৃঃ ৯, ১৪।

৭১. খামার-বাসী এই কৃষি-মজুরের কাজ তত ঈশ্বরের দান; এই কাজ তাকে মর্যাদা দান করে। সে গোলাম নয়, শান্তির সৈনিক, এবং জমিদারের দেয়। বিবাহিত লোকদের ‘কোয়ার্টাস’-এ সে স্থান পায়; সৈন্যের কাছ থেকে দেশ যেমন সেবা দাবি করে, তেমন জমিদারও তার উপরে জোর করে কাজের ভার চাপানোর ক্ষমতা ভোগ করে। সৈনিক যেমন বাজারের হারে মজুরি পায় না, সেও তেমন পায় না। সৈন্যের মত তাকেও বাচ্চা বয়সে ধরা হয়, যখন সে একমাত্র তার কাজ ও নিজের অঞ্চল ছাড়া বাকি সব কিছু সম্পর্কে থাকে অজ্ঞ। যেমন করে ‘বিদ্রোহ আইন’ সৈন্যকে নিয়ন্ত্রিত করে, তেমন করে বাল-বিবাহ এবং বসতি-সংক্রান্ত নানাবিধ আইন-কানুন তাকে নিয়ন্ত্রিত করে। (ডাঃ হান্টার, ঐ পৃঃ ১৩২)। কখনো কখনো এক-আধ জন অত্যন্ত কোমল-হৃদয় জমিদার নিজেরই তৈরি করা নির্জনতার জন্য অনুশোচনা করেন। ‘হুকহাম সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পরে অভিনন্দনের উত্তরে লড লেইসেস্টার বলেন, নিজের দেশে একা থাকাটা বিষাদজনক। আমি চারদিকে তাকাই এবং দেখি আমার ছাড়া আর কারো কোনো বাড়ি নেই। এই দৈত্যপুরীর আমি দৈত্য, আমার সব প্রতিবেশীকে আমি খেয়ে ফেলেছি।

৭২. গত দশ বছর ধরে ফ্রান্সেও এই একই ঘটনা-প্রবাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যে-অনুপাতে সেখানে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন কৃষিতে আত্মবিস্তার করছে, সেই অনুপাতে ‘গ উত্ত’-কৃষি জনসংখ্যাকে শহরে ঠেলে পাঠাচ্ছে। এখানেও আমরা উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার মূলে দেখি আবাসন ও অন্যান্য অবস্থার অবনতি। জমির এই বিলি ব্যবস্থার ফলে যে বিশেষ ‘proletariat foncier-এর উদ্ভব ঘটেছে সেই সম্পর্কে কলিন্স-এর পূর্বোদ্ধত গ্রন্থ এবং মার্কসের এইটিন্থ মেয়ার অব লুই বোনাপাত দ্রষ্টব্য। ২য় সংস্করণ, হামবুর্গ, ১৮৬৯, পৃঃ ৫৬ ইত্যাদি ১৮৪৬ সালে ফ্রান্সে শহরবাসীর সংখ্যা ছিল ২৪°৪২ এবং গ্রামবাসীর ৭৫৫৮; ১৮৬১ সালে তা দাড়ায় যথাক্রমে ২৮°৪৬ এবং ৭১১৪। গত ৫ বছরে গ্রামবাসী জনসংখ্যার শতকরা হ্রাস আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। সেই ১৮৪৬ সালেই পিয়ারে দুপে গেয়েছিলেন,

“Mal vetus, loges des trous,
Sous les combles, dans les decombres,
 Nous vivons avec les hiboux
 Et les larrons, amis des mobres.

৭৩. “শিশু নিয়োগ কমিশন-এর ষষ্ঠ ও সর্বশেষ রিপোর্ট,” ১৮৬৭ সালের মার্চ মাসের শেষে প্রকাশিত। এর একমাত্র আলোচ্য বিষয় কষিগত ‘গ্যাং-প্রথা।

৭৪. “শিশু নিয়োগ কমিশন, ৬ষ্ঠ রিপোর্ট”, সাক্ষ্য ১৭৩, পৃঃ ৩৭।

৭৫. কিছু কিছু ‘গ্যাং-সর্দার’ নিজেদেরকে করে তুলেছে ৫০০ একর পর্যন্ত জমির কৃষি-মালিক কিংবা সারি সারি বাড়ির সত্বাধিকারী।

৭৬. লুডফোর্ড-এর অর্ধেক তরুণী (‘গ্যাং’-এ) বেরিয়ে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ঐ, পৃঃ ৬।

৭৭. “হালের বছরগুলিতে তাদের ( ‘গ্যাং’-এর) সংখ্যা আরো বেড়েছে। কিছু জায়গায় এই প্রথা নোতুন চালু হয়েছে। যেখানে যেখানে এই প্রথা কয়েক বছর ধরে চালু রয়েছে, সেখানে সেখানে আরো বেশি সংখ্যায় এবং আরো কম বয়সের বাচ্চারা নিযুক্ত হচ্ছে।” (ঐ, পৃঃ ৭৯)।

৭৮. “ছোট কৃষকেরা কখনো ‘গ্যাং’ নিয়োগ করে না।” “গরিব জমিতে নয়, যে জমি ৪০-৫. শিলিং খাজনা দেবার ক্ষমতা রাখে, সেই জমিতেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় নারী ও শিশুরা নিযুক্ত হয়।” (ঐ, পৃঃ ১৭, ১৪)।

৭৯. এই সব ভদ্রলোকদের একজনের কাছে তার ভাড়ার স্বাদ এত রুচিকর যে, সে তদন্ত কমিশনের কাছে ক্ষেপে গিয়ে ঘোষণা করে, এই গোটা হৈ-চৈটা কেবল এই প্রথার নামটার জন্য। যদি একে “গ্যাং” না বলে “গ্রামীন শিশুদের বৃত্তিগত স্বাবলম্বন সমিতি” বলে ডাকা হত, তা হলে সব কিছুই ঠিক হয়ে যেত।

৮০. “গ্যাং-প্রথায় কাজ অন্য কাজের চেয়ে সন্তা; এই কারণেই তাদের নিযুক্ত করা। হয়,” একথা একজন প্রাক্তন গ্যাং-সর্দারের (ঐ, পৃঃ ১৭, ১৪)। একজন কৃষি-মালিকের। মতে, “গ্যাং-প্রথা নিশ্চিত ভাবেই কৃষি-কতার পক্ষে সবচেয়ে সস্তা, এবং নিশ্চিতভাবেই শিশুদের পক্ষে সবচেয়ে খারাপ।। ঐ, পৃঃ ১৬, ৩)।

৮১. “শিশুরা গ্যাং-প্রথায় যে-কাজ করে, নিঃসন্দেহে তার বেশিটাই আগে করত পুরুষ ও নারীরা। যেখানে এখন বেশি সংখ্যক সংখ্যক নারী ও শিশুকে নিযুক্ত করা হয়, সেখানে আগের চেয়ে বেশি পুরুষ বেকার থাকে।” (ঐ, পৃঃ ৪৩, নোট ২০২) অন্ত দিকে, কতকগুলি কৃষিপ্রধান জেলায়, বিশেষ করে আবাদি এলাকায়, শ্রম-সমস্যা, দেশান্তর-গমন এবং বড় বড় শহরে যাবার জন্য রেলের সুবিধার দরুন, এমন গুরুতর আকার ধারণ করেছে যে আমি (অর্থাৎ একজন বড় জমিদারের কর্মকর্তা) মনে করি যে শিশুদের কাজ অপরিহার্য। (ঐ, পৃঃ ৮৩, নোট ১৮৩) কেননা বাকি সভ্য জগৎ থেকে আলাদা ভাবে ইংল্যাণ্ডের কৃষি-জেলার শ্রম-সমস্যা আসলে হচ্ছে জমিদার ও কৃষি-মালিকের সমস্যা, যথা কৃষিকর্মে নিযুক্ত জনসংখ্যার নিরন্তর বর্ধমান দেশান্তর-গমন সত্ত্বেও, দেশের মধ্যে আপেক্ষিক ভাবে একটি যথেষ্ট উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যা বৃক্ষা করা এবং তার সাহায্যে কৃষি-শ্রমিকের মজুরি ন্যনতম হারে বেঁধে রাখা কি করে সম্ভব?

৮২. ‘জন-স্বাস্থ্য রিপোর্ট’-এ, যেখানে শিশু-মৃত্যুর কথা আলোচিত হয়, সেখানে ‘গ্যাং’ প্রথার কথা কেবল প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা হয়; সেই কারণে পত্র-পত্রিকায় এবং ইংরেজ জনসাধারণের কাছে তা অজ্ঞতাই রয়ে যায়। অন্য দিকে, ‘শিশু নিয়োগ কমিশন’-এর শেষ রিপোর্টটি যখন সংবাদপত্রের হাতে আসে তখন সাড়া পড়ে যায়। ‘লিবারল’ পত্র-পত্রিকারা প্রশ্ন তুলল কি করে ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলারা এবং সরকারি গীর্জার উচ্চ-বেতনভোগী যাজকেরা তাদের জমিদারিতে তাদেরই নাকের ডগায় এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দিলেন, তখন তাঁরা দক্ষিণ সাগরের দ্বীপবাসীদের নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য বিপরীত মেরু পর্যন্ত দ্রুত ‘মিশন’ প্রেরণ করেন এবং সুসংস্কৃত পত্র-পত্রিকাগুলি তখন এই চিন্তায় মগ্ন হয় কী করে কৃষি-জনসংখ্যার এমন নিদারুণ অধঃপতন ঘটল যে তারা নিজেদের শিশুদের এমন গোলামিতে বেচে দিতে পারে। যে-অভিশপ্ত অবস্থার মধ্যে এই সুকোমল ব্যক্তিবর্গ কৃষিশ্রমিককে নিক্ষেপ করেন, তাতে তারা যদি তাদের সন্তানদের খেয়েও ফেলে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। যা আশ্চর্যজনক তা হল এই যে অবস্থার মধ্যেও চরিত্রের কী বলিষ্ঠ সুস্থতা সে বজায় রেখেছে। সরকারি রিপোর্টগুলিই প্রমাণ করে মাতাপিতার। এই ‘গ্যাং’-প্রথাকে কত যুণা করে। এমন টের সাক্ষ্য প্রমাণ আছে যা থেকে বোঝা যায় যে অনেক ক্ষেত্রেই বাপ-মায়েরা তাদের উপরে যে চাপ ও প্রলোভন সৃষ্টি করা হয় তা প্রতিরোধ করবার। জন্য আইনগত বাধ্যবাধকতার সাহায্য পেলে তারা খুশি হত। কখনো প্যারিশ অফিসারেরা কখনো নিয়োগকর্তারা তাদের চাপ দেয়, এমনকি তাদের নিজেদের চাকরি খোয়াবার ভয় দেখিয়ে, যাতে যে-বয়সে তাদের শিশুদের ইস্কুলে পাঠালে স্পষ্টতই ভাল হত, সেই বয়সেই তাদের কাজে লাগিয়ে দেয়। সময় ও শক্তির এই সার্বিক অপচয়; শ্রমিক ও তার শিশুদের উপরে আরোপিত এই অতিরিক্ত ও অলাভজনক ক্লান্তিজনিত ক্লেশভোগ; ঘরের গাদাগাদি ভিড় এবং গ্যাং’-এর সংক্রামক প্রভাব থেকে তার শিশুদের সুকুমার বৃত্তিগুলির অবলুপ্ত ও তাদের নৈতিক সর্বনাশের প্রত্যেকটি দৃষ্টান্ত তার মনে কী অনুভূতি সৃষ্টি করে তা সহজেই বোঝা যায়। তাদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে যে তাদের দৈহিক ও মানসিক ক্লেশের অনেকটাই আসে সেইসব কারণ থেকে, যার জন্য তারা দায়ী নয়; তাদের যদি ক্ষমতা থাকত, তা হলে তারা তা কখনো মেনে নিত না; এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ক্ষমতা তাদের নেই। (ঐ, পৃঃ ২, ৮২, ৩, নং ৯৬)।

৮৩. আয়াণ্ডের জনসংখ্যা ১৮৩১ সালে ৫,৩১৯,৮৬৭ জন ব্যক্তি; ১৮১১-তে ৬,৮৪,৯৯৬; ১৮২১-এ ৬,৮৬৯,৫৪৪; ১৮৩১-এ ৭,৮২৮,৩৪৭; ১৮৪১-এ ৮,২২২,৬৬৪।

৮৪. যদি ফসলও একরপ্রতি হ্রাস পায়, তা হলে ভুলে গেলে চলবে না যে দেড় শতাব্দী ধরে ইংল্যাণ্ড, আয়ল্যাণ্ডের মৃত্তিকার নিঃশেষিত উপাদানগুলি প্রতিস্থাপন করার মত উপায়াদি তার কৃষকদের না দিয়ে, পরোক্ষ ভাবে দেই দেশের মৃত্তিকা রপ্তানি করেছে।

৮৫. যেহেতু আয়লাকে গণ্য করা হয় “জনসংখ্যা-নীতির” প্রতিশ্রুত দেশ বলে, টমাস স্যাডলরে তার জনসংখ্যা সম্পর্কিত বইখানা প্রকাশিত হবার আগে প্রকাশ করেন। তার সেই বিখ্যাত গ্রন্থ, “আয়লা, তার সমস্যা এবং প্রতিকার।” ২য় সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮২৯। এখানে তিনি এক-একটি প্রদেশের এবং প্রত্যেকটি প্রদেশের এক-একটি কাউন্টির। পরিসংখ্যান তুলনা করে, প্রমাণ করে দেন যে, সেখানে, ম্যালথাস যা বলেন, তা নয়; দুর্দশা জনসংখ্যার অনুপাতে বৃদ্ধি পায় না, বরং বৃদ্ধি পায় তার বিপরীত হারে।

৮৬. ১৮৫১ থেকে ১৮৭৪-এর মধ্যে মোট প্রবাসগামীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩,২৫,৯২২ জন।

৮৭. মার্কির ‘আয়লা ইণ্ডাষ্ট্রিয়াল, পলিটিক্যাল অ্যান্ড সোস্যাল’, ১৮৭৩, অনুযায়ী ৯৪৬ ভাগ জোত ১০০ একর পর্যন্ত পৌঁছায় না, ৫’৪ ভাগ ১০০ একর ছাড়িয়ে যায়।

৮৮. ‘রিপোর্টস ফ্রম দি পুয়োর ল ইনস্পেক্টরস অন দি ওয়েজেস অব এগ্রিকালচারাল লেবারার্স ইন ডাবলিন; আরো দেখুন ‘এগ্রিকালচারাল লেবারার্স (আয়া), রিটার্ণ,’ ইত্যাদি, ৮ মার্চ, ১৮৬১, লণ্ডন, ১৮৬২।

৮৯. ঐ, পৃঃ ২৯।

৯০. ঐ, পৃ ১২।

৯১. ঐ, পৃঃ ১২।

৯২. ঐ, পৃঃ ২৫।

৯৩. পৃঃ ২৭।

৯৪. ঐ, পৃঃ ২৫।

 ৯৫. ঐ, পৃঃ ১।

৯৬. ঐ, পৃঃ ৩১, ৩২।

৯৭. ঐ, পৃঃ ২৫।

৯৮. ঐ, পৃঃ ৩০।

৯৯. ঐ, পৃঃ ২১, ১৩।

১০০. “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৬, পৃঃ ৯৬।

১০১. কি করে ব্যক্তিগত জমিদারেরা এবং ইংরেজ আইনসভা জোর করে কৃষি বিপ্লব ঘটাতে এবং আয়ার্ল্যাণ্ডের জনসংখ্যা হ্রাস করে তাদের পক্ষে সন্তোষজনক সংখ্যায় নামিয়ে আনতে দুর্ভিক্ষ ও তার ফলাফলকে কাজে লাগিয়েছিল, তা আমি তৃতীয় খণ্ডে (ইং সং ) ভূমিগত সম্পত্তির পরিচ্ছেদে দেখাব। সেখানেও আমি ছোট কৃষি-মালিক এবং কৃষি-মজুরের অবস্থা আবার আলোচনা করব। আপাতত কেবল একটি প্রশ্ন : নাসাউ ডবল সিনিয়র তার মরণোত্তর প্রকাশিত গ্রন্থখানিতে (জানলিস, কনভার্সেশনস অ্যাণ্ড এসে রিলেটিং টু আয়লা’, খণ্ড ২, পৃঃ ২৮২) বলেন, ডাঃ জি বলেন, আমরা আমাদের গরিব আইন পেয়েছি, এবং এটা জমিদারদের বিজয়-লাভের পক্ষে একটা মস্ত বড় হাতিয়ার কিন্তু তার চেয়েও শক্তিশালী হাতিয়ার হল প্রবাসন। আয়ার্ল্যাণ্ডের কোনো বন্ধু চাইবেন না যে, (জমিদার এবং ছোট ছোট কেলটিক কৃষি-মালিকদের মধ্যে) এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হোক; আরো বেশি চাইবেন না যে এই যুদ্ধে প্রজারা বিজয়ী হোক। যত তাড়াতাড়ি এটা শেষ হয়ে যায়, পশু-চারণের উপযোগী যে স্বল্প জনসংখ্যা দরকার হয়, সেই জনসংখ্যা সমেত যত তাড়াতাড়ি আয়লাকে একটি পশু-চারণে পরিণত করা যায়, ততই সর্বশ্রেণীর পক্ষে ভাল হয়। ১৮১৫ সালের ইংরেজ শস্য আইন গ্রেট ব্রিটেনে অবাধ শস্য-আমদানির একচেটিয়া অধিকার আয়ার্ল্যাণ্ডের জন্য জয় করে নিল। সুতরাং এই আইন শস্য-চাষকে কৃত্রিম ভাবে সাহায্য করল। ১৮৪৬ সালে শস্য-আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে এই একচেটিয়া অধিকারের অকস্মাৎ অবসান ঘটল। অন্যান্য ঘটনা ছাড়াও, এই একটি ঘটনাই আয়ার্ল্যাণ্ডের কৃষি-জমিকে গো-চরে পরিণত করার পক্ষে, জমি কেন্দ্রীকরণের পক্ষে এবং ছোট চাষীদের উচ্ছেদ সাধনের পক্ষে দারুণ প্রেরণা সঞ্চার করল। ১৮১৫ থেকে ১৮৪৬ পর্যন্ত আইরিশ-জমির ফলপ্রসূতার প্রশংসা করা এবং গম উৎপাদনের জন্য প্রকৃতি নির্দিষ্ট বলে ঘোষণা করার পরে, ইংরেজ কৃষিবিদ, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদেরা আবিষ্কার করলেন যে, তা পশুখাদ্য ছাড়া আর কিছু উৎপাদনের উপযুক্ত নয়। মশিয়ে লিয়সে দ্য লাভার্গে চ্যানেলের ওপারে চটপট তার পুনরাবৃত্তি করলেন। লাভার্গের মত গম্ভীর প্রকৃতির মানুষও শেষ পর্যন্ত এমন ছেলেমানুষিতে ধরা পড়লেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *