৩০. শিল্পের উপরে কৃষি বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া

ত্রিংশ অধ্যায় — শিল্পের উপরে কৃষি বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া

শিল্পমূলধনের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজারের সৃষ্টি

আমরা আগেই দেখেছি যে, কৃষি-জনসংখ্যার উচ্ছেদ ও বহিষ্কারের প্রক্রিয়ায় মাঝে মাঝে বিরতি ঘটলেও, তা আবার বারে বারে নোতুন করে শুরু হত, এবং শহরের শিল্প গুলিতে যোগাত এমন সর্বহারা জনসমষ্টি, যা ছিল যৌথ গিন্ডগুলির সঙ্গে সংযোগ-শূন্য এবং তাদের শৃংখল থেকে মুক্ত; এটা এমনি একটা অনুকূল ঘটনা যে, বৃদ্ধ এ এণ্ডারসন ( জেমস এণ্ডারসনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে) তাঁর “বাণিজ্যের ইতিহাস” নামক গ্রন্থে এমন একটা বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন, যেন এটা বিধাতার এক প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের ফলস্বরূপ। আমরা কিন্তু তবু আদিম সঞ্চয়নের এই উপাদানটি বিবেচনার জন্য এখানে একটু দাড়াব। স্বাধীন ও স্বাবলম্বী চাষীদের এই পাতলা হয়ে যাবার ফলে শিল্প সর্বহারাদের ঘটল সংখ্যাবৃদ্ধি ও ঘন-সন্নিবদ্ধ সমাবেশ—যেভাবে জিওফ্র সেন্ট হিলেয়ার এক জায়গায় মহাজাগতিক বস্তুর কেন্দ্রীভবনের ব্যাখ্যা করেছেন অন্য জায়গায় তার ভবনের সাহায্যে, ঠিক সেই ভাবে।[১] কৰ্ষকদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও, জমি আগেও যে ফসল দিত, এখনো সেই পরিমাণ বা তার বেশি ফসল দেয়; তার কারণ এই যে ভূ-সম্পত্তির অবস্থাবলীতে বিপ্লবের সঙ্গে সংঘটিত হয়েছিল কৰ্ষণ-পদ্ধতির উন্নয়ন, সহযোগের সম্প্রসারণ, উৎপাদনের উপায়সমূহের কেন্দ্রীভবন ইত্যাদি। তার কারণ এই যে, কৃষিক্ষেত্রের মজুরি-শ্রমিকদের উপরে কেবল নিবিড়তর চাপ সৃষ্টিই করা হয়নি,[২] তার উপরে, যে-উৎপাদনের জমিতে তারা নিজেদের জন্য কাজ করত, সেই জমি আরো আরো সংকুচিত করা হয়েছিল। সুতরাং, কৃষি-জনসংখ্যার একটি অংশকে মুক্তি দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুষ্টি লাভের পূর্বতন উপায়গুলিকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। সেগুলি তখন রূপান্তরিত হল অস্থির মূলধনের বাস্তব উপাদানে। জমি থেকে উচ্ছিন্ন ও উৎক্ষিপ্ত চাষীকে এখন ক্রয় করতে হবে মজুরির আকারে তাদের মূল্য—তার নোতুন মনিবের তথা শিল্প-ধনিকের কাছ থেকে। জীবনধারণের উপায়ের ক্ষেত্রে যা সত্য, স্বদেশের কৃষির উপরে নির্ভরশীল শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রেও তা সত্য। সেগুলিও রূপান্তরিত হল অস্থির মূলধনের একটি উপাদানে। দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক, ওয়েস্ট ফ্যালিয়ার চাষীদের একটা অংশ, যারা দ্বিতীয় ফ্রেডরিক-এর আমলে সকলেই শণ বুনত, জমি থেকে সবলে উৎখাত ও বিতাড়িত হল; এবং বাকি যে-অংশ থেকে গেল, তারা পরিবর্তিত হল বড় বড় কৃষি-মালিকের দিনমজুরে। সেই একই সময়ে উদ্ভূত হল শণ কাটা ও বোনার বড় বড় প্রতিষ্ঠান, যেগুলিতে সম্প্রতি “মুক্তি-প্রদত্ত মানুষগুলি মজুরির জন্য কাজ করে। শণ আগেও যেমন দেখাত, এখনো ঠিক তেমনি দেখায়। তার একটা তন্তুরও কোন বদল ঘটেনি, কিন্তু তার দেহের মধ্যে এক নোতুন সামাজিক আত্মা ঢুকে পড়েছে। এখন তা রচনা করে ম্যানুফ্যাকচারকারী মালিকের স্থির মূলধনের একটা অংশ। অতীতে যা বিভক্ত ছিল বহুসংখ্যক ছোট ছোট উৎপাদনকারীর মধ্যে, যারা নিজেরাই যা চাষ করত এবং তাদের পরিবারবর্গের সাহায্যে খুচরো কায়দায় বয়ন করত, এখন তা কেন্দ্রীভূত হয়েছে একজন মাত্র ধনিকের হাতে, যে অন্যান্যদের নিযুক্ত করে তার জন্য তা বয়ন করতে। শণ-বয়নে ব্যয়িত অতিরিক্ত শ্রম পূর্বে নিজেকে রূপায়িত করত অসংখ্য চাষী-পরিবারের অতিরিক্ত আয়ে কিংবা, হতে পারে, দ্বিতীয় ফ্রেডরিকের আমলে, ট্যাক্সের আকারে-taxes pour le roi de Prusse। এখন তা নিজেকে রূপায়িত করে কয়েকজন ধনিকের জন্য মুনাফায়। টাকু এবং তঁত, যেগুলি আগে ছড়িয়ে ছিল সারা দেশ জুড়ে, এখন সেগুলি জমায়েৎ করা হয়েছে, শ্রমিক এবং কাঁচামাল সমেত, কয়েকটি বড় বড় শ্রমিক-ব্যারাকে। আর টাকু, তাঁত, কাচামাল এখন রূপান্তরিত হয়েছে কাটুনী ও তাঁতীদের স্বাধীন অস্তিত্বের উপায় থেকে তাদের উপরে কর্তৃত্ব চালাবার এবং তাদের থেকে মজুরি-বঞ্চিত শ্রম চুষে নেবার উপায়ে।[৩] বড় বড় ম্যানুফ্যাক্টরি (শ্রম-কারখানা) ও খামার (ফার্ম)-এর দিকে তাকিয়ে কেউ বুঝতে পারে না যে, সেগুলির উৎপত্তি ঘটেছে অনেকগুলি ঘোট ঘোট উৎপাদন কেন্দ্রকে একটিমাত্র কেন্দ্রে পর্যবসিত করে এবং গড়ে তোলা হয়েছে অনেক ঘোট ঘোট স্বাধীন উৎপাদনকারীকে উৎখাত করে। যাই হোক, জনসাধারণের স্বাভাবিক বোধশক্তি কিন্তু ভুল করেনি। বিপ্লবের সিংহ-পুরুষ মিরাবোর সময়ে, বড় বড় ম্যানুফ্যাক্টরিগুলিকে তখনো বলা হত ‘ম্যানুফ্যাকচার্স রিইউনিস (manufactures reunies’), অনেকগুলি কর্মশালা একটা মাত্রে পর্যবসিত, যেমন আমরা বলি, অনেকগুলি তে একটামাত্ৰ ক্ষেত্রে পর্যবসিত। মিরাবো বলেন, “আমরা কেবল বিরাট ম্যানুফ্যাক্টরিগুলির দিকেই নজর দিচ্ছি, যেগুলিতে শত শত লোক কাজ করে একজন পরিচালকের অধীনে এবং। যেগুলিকে সাধারণত বলা হয় ম্যানুফ্যাকচার্স রিইউনিস। যেগুলিতে একটি বৃহৎ সংখ্যক শ্রমিক কাজ করে, প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা ভাবে এবং স্বতন্ত্র ভাবে, সেগুলির কথা খুব কমই বিবেচনা করা হয়; সেগুলিকে অন্যগুলির তুলনায় স্থাপন করা হয় সীমাহীন দূরত্বে। এটা একটা বিরাট ভুল, কেননা এগুলিই জাতীয় সমৃদ্ধির সত্য সত্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিরাট কর্মশালাটি (ম্যানুফ্যাকচার রিইউনিস’ বিপুলভাবে বিত্তশালী করে তুলবে দু-একজন শিল্পোদ্যোক্তাকে, কিন্তু শ্রমিকেরা থেকে যাবে কম বেশি মজুরি পাওয়া সেই দিন মজুর; প্রতিষ্ঠানের সাফল্যে তাদের থাকবে না কোনো অংশ। উলটো দিকে, ক্ষুদ্রাকার বিচ্ছিন্ন কর্মশালায় ম্যানুফ্যাকচার সেপারী) কেউই বিত্তশালী হবে না, কিন্তু বহুসংখ্যক শ্রমিক হবে সচ্ছল; যারা সঞ্চয়ী ও পরিশ্রমী, তারা সামান্য মূলধন জমাতে সক্ষম হবেনোতুন কোন শিশু-জন্মের জন্য কিংবা নিজেদের বা পরিবারবর্গের অসুখ-বিসুখের জন্য কিছু সরিয়ে রাখতে। সঞ্চয়ী ও পরিশ্রমী শ্রমিকদের। সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, কারণ তারা সদাচার ও কর্মনিষ্ঠার মধ্যে দেখতে পাবে তাদের অবস্থার যথার্থ উন্নতি সাধনের উপায়-সামান্য মজুরি-বৃদ্ধির মত যা তাদের ভবিষ্যতের পক্ষে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ হবে না, এবং যার একমাত্র ফল হবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে কিছুটা উন্নত করা, তা নয়।’: বিরাট কর্মশালাগুলি-কয়েকজন ব্যক্তিগত মালিকের প্রতিষ্ঠান, যেগুলি তাদের নিজস্ব লাভের জন্য শ্রমিকদের খাটিয়ে নিয়ে তাদের দৈনন্দিন মজুরি দিয়ে থাকে—সেগুলি এই ব্যক্তিগত মালিকদের স্বাচ্ছন্দ্য ঘটাতে পারে, কিন্তু সেগুলি কখনো সরকারের মনোযোগ আকর্ষণের মত যোগ্য হবে না। ক্ষুদ্রাকার বিচ্ছিন্ন কর্মশালাগুলিই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেগুলি কৃষি-কর্মের সঙ্গে সংযোজিত থাকে; সেগুলিই হল কেবল স্বাধীন কর্মশালা।[৪] কৃষি-জনসংখ্যার একটা অংশের উচ্ছেদ ও উৎপাদন শিল্পমূলধনের জন্য কেবল শ্রমিকদেরকে, তাদের জীন-ধারণের উপকরণাদিকে এবং শ্রমের সামঞ্জসভারকেই মুক্ত করে দিল না, তা সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারেরও সৃষ্টি করল।

বস্তুতঃ পক্ষে, যে-ঘটনাবলী ছোট চাষীকে রূপান্তৰিত করল মজুরি-শ্রমিকে এবং তাদের জীবনধারণের উপকরণাদিকে রূপান্তরিত করল মূলধনের বস্তুগত উপাদানে, তা যুগপৎ মূলধনের জন্য একটি অভ্যন্তরীণ বাজারও সৃষ্টি করল। আগে, চাষী-পরিবার জীবন-ধারণের উপকরণ ও কাঁচামাল উৎপাদন করত যার বেশির ভাগটা তারা নিজেরাই পরিভোগ করত। এই কাঁচামাল ও জীবনধারণের উপকরণ সমূহই এখন পরিণত হয়েছে পণ্যদ্রব্যে, বৃহৎ কৃষি-মালিক সেগুলিকে বিক্রি করে, কর্মশালাগুলিতে সে পায় তার বাজার। সুতো, শণের কাপড়, পশমের আটপৌরে জিনিসপত্র—যেসব দ্রব্যসামগ্রী আগে ছিল প্রত্যেক চাষী-পরিবারের নাগালের মধ্যে, যেগুলি আগে সে নিজেই বুনত তার নিজের ব্যবহারের জন্য—সেগুলি রূপান্তরিত হল ম্যানুফ্যাকচারের দ্রব্যসামগ্রীতে, যেগুলি সঙ্গে সঙ্গে মফস্বলের জেলাগুলিতে পেয়ে গেল তৈরি বাজার। বিক্ষিপ্ত কারিগরেরা এতাবৎকাল আপন-আপন মনে কর্মরত অগণিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীদের মধ্যে যে-ইতস্ততঃ অবস্থিত ক্রেতাদের পেত, এখন সেই উৎপাদন কারীরা কেন্দ্রীভূত হয় শিল্প-মূলধনের দ্বারা সৃষ্ট একটি বিশাল বাজারে।[৫] এইভাবে স্বাবলম্বী চাষীদের উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে, নিজেদের উৎপাদনের উপায়-উপকরণ থেকে বিচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে একযোগে সংঘটিত হয় গ্রামীণ ঘরোয়া শিল্প, ম্যানুফ্যাকচার এবং কৃষিকর্মের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদের প্রক্রিয়া। এবং গ্রামীণ ঘরোয়া শিল্পের সর্বনাশই কেবল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ঘটাতে পারে সেই সম্প্রসারণ, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির পক্ষে যা একান্ত প্রয়োজন। তবু যথাযথ ভাবে যাকে ম্যানুফ্যাকচার-আমল বলা যায়, সেই আমল সফল হয়নি এই রূপান্তরকে আমূল ভাবে ও সম্পূর্ণ ভাবে সম্পাদন

শিল্পের উপরে কৃষি-বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া করতে। স্মরণীয় যে, যথাযথ ভাবে যাকে ম্যানুফ্যাকচার বলা যায়, তা জাতীয় উৎপাদনের কেবল একটি অংশকেই জয় করে এবং, নিজের শেষ ভিত্তি হিসাবে সর্বদাই নির্ভর করে শহরের হস্তশিল্প এবং গ্রামাঞ্চলের ঘরোয়া শিল্পগুলির উপরে। যদি বিশেষ বিশেষ শাখায় কোন কোন ক্ষেত্রে তা সেগুলিকে ধ্বংস করে এক আকারে, তা হলে অন্যত্র তা সেগুলির উদ্ভব ঘটায় অন্য আকারে, কারণ একটা পর্যায় পর্যন্ত তার সেগুলিকে লাগে কাঁচামাল প্রস্তুতির জন্য। সুতরাং, তা ছোট গ্রামবাসীদের নোতুন এক শ্রেণী গড়ে তোলে, যার সহায়ক বৃত্তি হিসাবে চাষের কাজ করলেও, তাদের প্রধান বৃত্তি খুজে পায় শিল্প-শ্রমের মধ্যে, যার উৎপাদিত দ্রব্যসম্ভার তারা ম্যানুফ্যাকচারকারীদের কাছে বিক্রি করে হয়, সরাসরি আর নয়তো বণিকদের মাধ্যমে। ইংরেজ ইতিহাসের ছাত্রকে ধাঁধায় ফেলে দেয়, এট। তেমনি একটা ঘটনার অন্যতম কারণ, যদিও প্রধান কারণ নয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর তৃতীয় ভাগ থেকে মফস্বলের অঞ্চলগুলিতে ধনতান্ত্রিক কৃষিকর্মের অনধিকার প্রবেশ এবং চাষী-সম্প্রদায়ের উত্তরোত্তর ধ্বংসসাধন সম্পর্কে অভিযোগ ক্রমাগত তার নজরে আসে—তাতে ছেদ পড়ে কেবল মাঝে মাঝে। অন্য দিকে সে এই চাষী সম্প্রদায়কে দেখে পুনর্বার উপস্থিত হতে, যদিও অল্পতর সংখ্যায় এবং আরো খারাপ অবস্থায়।[৬] প্রধান কারণ এই : ইংল্যাণ্ডে, পর্যায়ক্রমে, এক সময়ে প্রধানতঃ শস্য-কৰ্ষক এবং অন্য সময়ে প্রধানতঃ গবাদি পশু-পালক; এবং এই দুই পর্যায় অনুযায়ী চাষীর চাষের পরিধিরও ঘটে বৃদ্ধি বা হ্রাস। আধুনিক শিল্পই একক ভাবে এবং চূড়ান্তভাবে মেশিনারির আকারে সরবরাহ করে ধনতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার চিরস্থায়ী ভিত্তি, সমূলে উৎপাটিত করে সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষি জনসমষ্টি এবং সুসম্পূর্ণ করে কৃষি ও গ্রামীণ ঘরোয়া শিল্পের মধ্যে বিচ্ছেদ, যার শিকড়কে—সুতো কাটা ও কাপড় বোনাকে—তা ছিন্নভিন্ন করে দেয়।[৭] এই ভাবে তা, প্রথমবারের মত, সমগ্র অভ্যন্তরীণ বাজারকে জয় করে দেয় শিল্পমূলধনের জন্য।[৮]

————

১. তাঁর “নোশনস দ্য ফিলসফি ন্যাচুরেল”-এ, প্যারিস, ১৮৩৮।

২. একটি পয়েন্ট’ যার উপরে জেম্স স্টুয়ার্ট গুরুত্ব দিয়েছেন।

৩. “Je permettrai” xf2 269,”que vous ayez l’honneur de me servir, a condition que vous me donnez le peu qui vous reste pour la peine que je prends de vous commander.” (J. J, Rousseau : *Discours sur l’Ecouomie Politique.’ )

৪. মিরাবো মনে করেন বিচ্ছিন্ন কর্মশালাগুলি সংযোজিত কর্মশালাগুলি থেকে বেশি মিতব্যয়ী এবং উৎপাদনশীল এবং সংযোজিত কর্মশালাগুলির মধ্যে দেখতে পান সরকারি কৃষির অধীনে কেবল কৃত্রিম বিদেশিয়ানা; ইউরোপীয় ভূখণ্ডের ম্যানুফ্যাকচার গুলির একটা বড় অংশের তখন যা অবস্থা ছিল, তা থেকেই মিরাববার এই ধারণার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

৫. অন্য কাজের অবকাশে ২০ পাউণ্ড উলকে অনায়াসে নিজেদের শ্রমের সাহায্যে একটি শ্রমিকের পরিবারের বাৎসরিক পরিচ্ছদে রূপান্তরণ-তাতে কোনো দর্শনীয় ব্যাপার হয় না; কিন্তু সেটা বাজারে আন, কারখানায় পাঠান, সেখান থেকে দালালকে, তারপরে কারবারকে এবং আপনি প্রত্যক্ষ করবেন বড় বড় বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড, এবং তার মূল্যের ২০ গুণ পরিমাণ আর্থিক মূলধনের বিনিয়োগ। এই ভাবে শ্রমিক শ্রেণী বাধ্য হয় এক লক্ষ্মীছাড়া কারখানা-জনসংখ্যাকে পোষণ করতে–একটা পরগাছা দোকানদার শ্রেণী এবং একটা অলীক বাণিজ্যিক, আর্থিক ও মুদ্রাগত ব্যবস্থা। ডেভিড আকুহ, ঐ, পৃ ১২।

৬. ক্রমওয়েল-এর আমল একটা ব্যতিক্রম। যতদিন প্রজাতন্ত্র টিকে ছিল, ততদিন সমস্ত স্তরের ইংরেজ জনগণ টিউডরদের অধীনে তারা যে অধঃপতনে তলিয়ে গিয়েছিল, তা থেকে আবার উঠে দাঁড়িয়েছিল।

৭. টাকেট এ ব্যাপারে অবহিত যে, আধুনিক উল শিল্পের উন্মেষ ঘটেছে মেশিনারি প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত ম্যানুফ্যাকচার থেকে—এবং গ্রামীণ ও ঘবোয়া শিল্পগুলির ধ্বংসপ্রাপ্ত থেকে। লাঙল এবং জোয়াল হল দেবতাদের উদ্ভাবন এবং বীরদের বৃত্তি; তাঁত, টাকু, কাটিমের বংশপরিচয় অতটা উচু নয়। আপনি কাটিম আর লাঙল, মাকু আর জোয়ালকে বিচ্ছিন্ন করে দিন। তা হলে পাবেন কারখানা, আর দুঃস্থ-নিবাস, ক্রেডিট আর আতঙ্ক, দুটি শত্রুভাবাপন্ন জাতি—একটি কৃষিজীবী, অন্যটি বাণিজ্য-জীবী।” (ডেভিড আহার্ট, ঐ পৃ ১২২)। কিন্তু এখন ক্যারি এলেন, এবং ধিক্কার জানালেন ইংল্যাগুকে, অবশ্য অযৌক্তিক ভাবে নয়, যে সে চেষ্টা করছে বাকি প্রত্যেকটি দেশকে কেবল কৃষিজীবী দেশে পরিণত করতে, যার শিল্লোৎপাদক হবে ইংল্যান্ড। তিনি দাবি করেন, এই ভাবেই ধ্বংস হয়েছে তুরস্ক, কেননা ইংল্যাণ্ড তার অধিকারী ও অধিবাসীদের কখনো সুযোগ দেয়নি লাঙল ও অঁতের মধ্যে, হাতুড়ি ও মইয়ের মধ্যে স্বাভাবিক মৈত্রীর প্রতিষ্ঠা করে নিজেদেরকে শক্তিশালী করতে।’ (দি স্লেভ ট্রেড, পৃঃ ১২৫। তাঁর মতে, আকু হার্ট নিজেই হচ্ছেন তুরস্কের ধ্বংস-সাধনের প্রধান প্রযোজক, যেখানে তিনি ইংল্যাণ্ডের স্বার্থে পরিচালনা করেছেন অবাধ বাণিজ্যের প্রচারকার্য। সবচেয়ে সেরা ব্যাপার এই যে, ক্যারি, যিনি প্রসঙ্গত একজন রুশ-প্রেমিক, উল্লিখিত বিচ্ছেদের প্রক্রিয়াটিকে নিবারণ করতে চান ঠিক সেই সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থার সাহায্যে, যা তাকে ত্বরান্বিত করে।

৮. মিল, রজার্স, গোল্ডইন স্মিথ, ফসেট প্রমুখ মানবহিতৈষী এবং জন ব্রাইট অ্যাণ্ড কোম্পানির মত উদারনৈতিক ম্যানুফ্যাকচারকারীরা ইংরেজ ভূমি-মালিকদের জিজ্ঞাসা করছেন, যেমন ভগবান জিজ্ঞাসা করেছিলেন অ্যাবেল-এর পরে কেইনকে, ‘আমাদের সেই হাজার হাজার স্বাধীন স্বত্বভোগীরা কোথায় গেল? তারপর, তোমরাই বা কোথা থেকে এলে? এল ঐ স্বাধীন স্বত্বভোগীদের ধ্বংস করে দিয়ে। কেন আপনি আরো জিজ্ঞাসা করেন না, কোথায় গেল সেই স্বাধীন তাঁতীরা, সুতো কাটুনিরা এক কুটিরশিল্পীরা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *