পঞ্চদশ অধ্যায় — মেশিন ও আধুনিক শিল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ — মেশিনের বিকাশ।
জন স্টুয়ার্ট মিল তার “রাষ্ট্রীয় অর্থতন্ত্রের নীতিনিচয়” (“প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি” ) নামক গ্রন্থে বলেন, “আজ পর্যন্ত যাবতীয় যান্ত্রিক উদ্ভাবন কোন মানুষের দৈনিক শ্রমের লাঘব ঘটিয়েছে কিনা তা তর্কসাপেক্ষ।”[১] অবশ্য যন্ত্রপাতির ধনতান্ত্রিক প্রয়োগের উদ্দেশ্যও কোনমতেই তা নয়। শ্রমের উৎপাদনশীলতায় অন্য প্রত্যেকটি বৃদ্ধির মত, মেশিনারি প্রবর্তনেরও উদ্দেশ্য পণ্য সস্তা করা এবং শ্রমিক শ্রম-দিবসের যে-অংশটিতে নিজের জন্য কাজ করে, সেই অংশটিকে হ্রস্বতর করা এবং যে-অংশটি সে বিনা প্রতিমূল্যে ধনিককে দান করে, সেই অংশটিকে দীর্ঘতর করা। সংক্ষেপে, এটা হল উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনের একটি উপায়।
ম্যানুফ্যাকচারের উৎপাদন-পদ্ধতিতে বিপ্লব শুরু হয় শ্রমশক্তিকে দিয়ে, আধুনিক শিল্পে তা শুরু হয় শ্রম-উপকরণ দিয়ে। সুতরাং আমাদের জিজ্ঞাসার প্রথম বিষয় হল, কেমন করে উৎপাদনের উপকরণগুলি হাতিয়ার। টুল) থেকে যন্ত্রে (মেশিন-এ রূপান্তরিত হল অথবা হস্তশিল্পের হাতিয়ারগুলি সঙ্গে একটি যন্ত্রের পার্থক্য কি কি? এখানে আমাদের আগ্রহ কেবল সুপ্রকট ও সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে, কেননা ভূতাত্ত্বিক যুগগুলির তুলনায় সমাজ-ইতিহাসের যুগগুলি অধিকতর স্পষ্ট ভেদরেখা দ্বারা চিহ্নিত নয়।
গণিতজ্ঞ ও বলবিদ্যাবিদা (মেকানিসিয়ানস’) এবং তাঁদের অনুকরণে কয়েকজন ইংরেজ অর্থতাত্ত্বিকও হাতিয়ার’ (টুল )-কে অভিহিত করেন সরল যন্ত্র (সিম্পল মেশিন) বলে এবং যন্ত্রকে অভিহিত করেন একটি জটিল হাতিয়ার বলে। তাঁরা দুটির মধ্যে কোনো মর্মগত পার্থক্য দেখতে পান না এবং লেভার’, ‘ইনক্লাইড প্লেন’, ‘’, ‘ওয়েজ ইত্যাদির মত সরল যান্ত্রিক সরঞ্জামগুলিকেও (মেকানিক্যাল পাওয়াস’-কেও। তাঁরা মেশিন’ নাম দিয়ে থাকেন।[২] বাস্তবিক পক্ষে, প্রত্যেকটি মেশিনই হচ্ছে ঐ সরল ‘পাওয়ার’গুলির এক একটি সংযোজন, তা সেগুলি যেভাবেই আত্মগোপন করে থাক না কেন। অর্থ নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ব্যাখ্যাটি লক্ষ্য করা কর্তব্য, কেননা ঐতিহাসিক উপাদানটি এখানে অনুপস্থিত। হাতিয়ার ও মেশিনারির মধ্যে আর একটি পার্থক্য এই যে, হাতিয়ারের ক্ষেত্রে মানুষ হচ্ছে চালক-শক্তি কিন্তু মেশিনের ক্ষেত্রে চালক-শক্তি মানুষ ছাড়া অন্য কিছু, যেমন, পশু, জল, বাতাস ইত্যাদি।[৩] এতদনুসারে বলদে-টানা লাঙল, যা এমন একটি কারিকুরি যেটা একেবারে ভিন্ন ভিন্ন যুগে অভিন্ন ব্যাপার, তা-ও হবে একটা মেশিন। যেখানে সে-এর ঘোরানো ত—যা একজন মাত্র শ্রমিকের দ্বারা চালিত হয়, প্রতি মিনিটে বোনে ৯৬,০০০ ‘পিক’ত হবে একটি হাতিয়ার মাত্র। কেবল তাই নয়, এই হাতিয়ারটি, যা হাতে চালিত হলে একটি হাতিয়ার, তাই আবার বাষ্পে চালিত হলে হয় মেশিন; এবং যেহেতু পশুশক্তির প্রয়োগে মানুষের প্রথমতম উদ্ভাবনগুলির মধ্যে এটা একটি, সেই হেতু হস্তশিল্পের দ্বারা উৎপাদনেরও আগে অবশ্যই এসেছিল মেশিনের দ্বারা উৎপাদন। ১৭৩৫ খ্রীষ্টাব্দে জন ওয়াট তাঁর সুতো কাটার মেশিন বার করলেন এবং আঠারো শতকেই শিল্প বিপ্লবের সূচনা করলেন, তিনি একটিবারও বললেন না মানুষের বদলে গাধা দিয়ে সেটা চালাবার কথা। যদিও এই অংশটা পড়ল গাধারই ভাগে। তিনি এটাকে বর্ণনা করলেন “আল-ছাড়া সুতা কাটার” মেশিন বলে।[৪]
সমস্ত পূর্ণ-বিকশিত মেশিনারির থাকে তিনটি অংশ, ‘মোটর-মেকানিজম’, ‘ট্রান্সমিটিং-মেকানিজম এবং, সর্বশেষ, ‘টুল’ বা ‘কর্মর্যন্ত্র। মোটর মেকানিজম গোটা মেশিনারিটিতে গতি সঞ্চার করে। হয়, এই মেকানিজমটি তার নিজের সঞ্চলক শক্তি প্রজনন করে, যেমন টিম ইঞ্জিন, ক্যালোরিক ইঞ্জিন, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইঞ্জিন ইত্যাদি আর, নয়তো, পূর্বস্থিত কোন প্রাকৃতিক শক্তি থেকে সে তার সঞ্চলক শক্তি পেয়ে যায়, যেমন জল-চক্র তার শক্তি পায় কোন জল-মুখ-থেকে, বায়ু-যন্ত পায় বাতাস থেকে। ফ্লাই-হুইল, শ্যাফটিং, দাত-ওয়ালা হুইল, পুলি, স্ট্র্যাপ, রোপ, ব্যাণ্ড, পিনিয়ন এবং অত্যন্ত বিবিধ প্রকারের গিয়ারিং ইত্যাদি নিয়ে গঠিত ট্রান্সমিটিং-মেকানিজম মেশিনারিটির গতি নিয়ন্ত্রণ করে, প্রয়োজনমত তার রূপ পরিবর্তন করে, যেমন রেখা-রূপ থেকে চক্রাকার রূপে এবং সেই গতিকে কর্মযন্ত্র-গুলির মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দেয়। সমগ্ৰ মেকানিজমটির এই প্রথম দুটি অংশের একমাত্র কাজ হচ্ছে কর্মযন্ত্রগুলির গতিশীল রাখা—যেগতির সাহায্যে শ্রমকে প্রয়োজনমত নিয়োজিত ও উপযোজিত করা যায়। ‘টুল’ বা কর্মযন্ত্রটি হচ্ছে মেশিনারিটির সেই অংশটি যা দিয়ে ১৮ শতকের বিপ্লব শুরু হয়। এবং আজও পর্যন্ত যখনি কোন হস্তশিল্প বা ম্যানুফ্যাকচার মেশিনারি কর্তৃক চালিত শিল্পে রূপান্তরিত হয়, সে নিরন্তর এবং বিবিধ সুচনা-বিন্দু হিসাবেই কাজ করে চলছে।
কর্মযন্ত্রটিকে আরো ভাল করে পরীক্ষা করলে আমরা তার মধ্যে সাধারণত দেখতে পাই-যদিও নিঃসন্দেহে প্রায়শই অত্যন্ত পরিবর্তিত আকারে-হস্তশিল্পী বা মা ফ্যাকচার-শ্রমিকের দ্বারা ব্যবহৃত সেই ‘অ্যাপারেটাস’ ও ‘টুলগুলি; পার্থক্য এই যে, অতীতে এগুলি ছিল মানুষের হাতিয়ার আর এখন এগুলি মেকানিজম-এর সরঞ্জাম অথবা মেকানিকের সরঞ্জাম। হয়, গোটা মেশিনটাই পুরনো হস্তশিল্পগত টুলের কম বেশি পরিবর্তিত মেকানিক্যাল সংস্করণ, যেমন, পাওয়ারলুম,[৫] নয়তো মেশিনের কাঠামোয় ফিট-করা বিভিন্ন কাজের উপকরণগুলি আমাদের পূর্ব-পরিচিত, যেমন মিউল মেশিনে মাকু, স্টকিং লুমে সুচ, করাতকলে করাত, মপিং মেশিনে ছুরি। এইসব ‘টুল’ এবং ঐ মেশিনটির মূল দেহের সঙ্গে জন্ম থেকেই পার্থক্য থাকে এবং পরবর্তী কালে মেশিনটির দেহে এগুলি সংযোজিত হয়—যে মেশিনটি মেশিনারিরই উৎপাদন।[৬] সুতরাং সঠিক অর্থে মেশিন হচ্ছে একটি মেকানিজম, যা গতি সঞ্চারিত হবার পরে, টুলগুলির সাহায্যে সেই একই সব কাজ করে, যেগুলি অতীতে শ্রমিক ঐ টুলগুলির সাহায্যে করত। এই সঞ্চলক শক্তি মানুষ থেকেই আসুক বা অন্য কোন মেশিন থেকেই আসুক, এব্যাপারে তাতে কোন তারতম্য হয়না। যে মুহূর্তে মানুষের হাত থেকে একটি টুল তুলে নিয়ে সেটাকে একটি মেকানিজমে ফিট করা হয়, সেই মুহূর্ত থেকে একটি নিছক হাতিয়ারের স্থান নেয় একটি মেশিন। পার্থক্যটা সঙ্গে সঙ্গেই নজরে পড়ে—এমনকি, যেখানে মানুষই থেকে যায় প্রধান সঞ্চলক হিসাবে। কত সংখ্যক হাতিয়ার সে নিজে যুগপং করতে পারে, তা সীমায়িত হয় তার নিজের প্রাকৃতিক উৎপাদন-উপকরণগুলির দ্বারা, তার শারীরিক উপাদানগুলির দ্বারা। জার্মানিতে প্রথমে চেষ্টা হয়েছিল একজন ‘স্পিনার দিয়ে দুটো স্পিনিং হুইল’ চালানোর, অর্থাৎ একই সঙ্গে দুহাত ও দুপা দিয়ে কাজ করানোর। কাজটা ছিল দুঃসাধ্য। পরবর্তী কালে দুটি টাকু-সমন্বিত একটি ট্রেডল স্পিনিং হুইল উদ্ভাবিত হল। কিন্তু একই সঙ্গে দুটো সুতো কাটতে পারে এমন কুশলী শ্রমিকের সংখ্যা দু-মাথালা মানুষের মতই বিরল। অন্য দিকে, জন্ম থেকেই ‘জেনি’ ১২-১৮টি টাকু দিয়ে সুতো কাটতে পারত আর স্টকিং লুম তো একসঙ্গে কয়েক হাজার কটা দিয়ে একই সঙ্গে বুনতে পারত। একজন হস্তশিল্পী কত টুল ব্যবহার করতে পারে, তা তার দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারাই সীমায়িত; মেশিন একই সঙ্গে কত সংখ্যক ‘টুল দিয়ে কাজ করতে পারে, তা গোড়া থেকেই এই সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত।
. অনেক হস্তচালিত হাতিয়ারে নিছক সঞ্চলক শক্তি হিসাবে মানুষ এবং সঠিক ভাবে যাকে শ্রমিক বা ‘অপারেটর বলা যায় সেই হিসাবে মানুষ—এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে প্রকট। যেমন পায়ের পাতা হচ্ছে স্পিনিং হুইলের প্রধান সঞ্চলক মাত্র কিন্তু স্পিনিং-এর আসল কাজটি করে হাত, যে টাকু চালায়, সুতো টানে এবং ঘোরায়। হস্তশিল্পীর এই সর্বশেষ কাজটিই সর্বপ্রথম শিল্প-বিপ্লবের আয়ত্তে আসে আর শ্রমিকের জন্য পড়ে থাকে চোখ দিয়ে মেশিনটির উপরে নজর রাখা এবং, হাত দিয়ে ভুলচুকগুলি শুধরে দেবার নোতুন কাজটি ছাড়াও, কেবল সঞ্চলক শক্তি হিসাবে কাজ করার যান্ত্রিক অংশটি। অন্যদিকে, সেই সমস্ত উপকরণ যেগুলির ক্ষেত্রে মানুষ সবসময়েই কাজ করেছে সঞ্চলক শক্তি হিসাবে, যেমন মিলের ‘র্যাংক’ ঘোরানো, পাম্প চালানো, হাপরের হাত উপর-নীচ করা, হামনদিস্তার সাহায্যে গুড়ো করা ইত্যাদি এমন সব উপকরণ যাতে অচিরেই সঞ্চলক শক্তি হিসাবে চালু হয়ে যায় পশু, জল[৭] ও বাতাস। ম্যানুফ্যাকচার আমলের অনেক আগে এবং, কিয়ৎ পরিমাণে, সেই আমল থাকা কালেই, এই হাতিয়ার গুলি এখানে-সেখানে মেশিনে রূপান্তরিত হয়ে যায় অথচ উৎপাদন-পদ্ধতিতে কোন বিপ্লব ঘটায় না। আধুনিক শিল্প-যুগে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এই উপকরণগুলি এমনকি সেগুলির হস্তচালিত আকারেই মেশিন হয়ে যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ‘৮৩৬-৩৭ সালে যে পাম্পগুলি দিয়ে ওলন্দাজরা হালেম-এর লেকটিকে খালি করেছিল, সেগুলি তৈরি হয়েছিল মামুলি পাম্পেরই নীতিতে; একমাত্র পার্থক্য ছিল এই যে, সেগুলির পিস্টন চালাতে মানুষ ব্যবহার না করে, ব্যবহার করা হয়েছিল সাইক্লোপিয়ান টিম ইঞ্জিন। ইংল্যাণ্ডে কর্মকারেরা যে মামুলি ও অত্যন্ত কাঁচা ধরনের হাপর ব্যবহার করে, অনেক সময়ে সেগুলির হাতলকেই স্টিম ইঞ্জিনের সঙ্গে যুক্ত করে সেগুলিকেই রূপান্তরিত করা হত ব্লোয়িং ইঞ্জিনে। খোদ স্টিম ইঞ্জিনের কথাই ধরা যাক; ১৭ শতকের শেষ দিকে ম্যানুফ্যাকচার-আমলে তার উদ্ভাবনের কাল থেকে ১৭৮০ সাল পর্যন্ত তা যে-আকারে ছিল, তাতে কোন শিল্প-বিপ্লবের উত্তর ঘটেনি। পরন্তু, মেশিনের উদ্ভাবন নিন ইঞ্জিনের আকারে বিপ্লব ঘটানোকে অনিবার্য করে তুলল। যে মুহূর্তে মানুষ তার প্রশ্নের বিষয়ের উপরে হাতিয়ারের সাহায্যে কাজ করার বদলে, একটি হাতিয়ার-মেশিনের নিছক সঞ্চলক শক্তি হিসাবে কাজ করে, এটা হয়ে পড়ে একটি আপতিক ঘটনা যে, সঞ্চলক শক্তি মানুষের পেশীশক্তির রূপ পরিগ্রহ করে; এবং তা সমান সার্থক ভাবেই বাতাস, জল বা বাষ্পের রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। অবশ্য, যে-মেকানিজমটি গোড়ায় তৈরি হয়েছিল কেবল মানুষের দ্বারা চালিত হবার জন্যই, উল্লিখিত রূপ-পরিবর্তন সেই মেকানিজমটিতে বড় বড় রদবদল না ঘটিয়ে পারেনা। আজকাল সেলাইয়ের মেশিন, রুটি তৈরির মেশিনের মত যেসব মেশিন চালু হয়, সেগুলি, হয়, তাদের প্রকৃতিবশতই ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদনের কাজ থেকে বাদ পড়ে যায় আর, নয়তো, এমন ভাবে নির্মিত হয় যে, মানুষের শ্রম এবং বিশুদ্ধ যান্ত্রিক সঞ্চলক শক্তি—উভয়ের দ্বারাই সেগুলিকে চালানো যায়।
কারিগর কাজ করে একটি টুল দিয়ে, মেশিন তার জায়গায় বসায় এমন এক মেকানিজম, যা কাজ করে অনুরূপ অনেকগুলি টুল দিয়ে এবং একটি মাত্র সঞ্চলক শক্তি দ্বারা গতিশীল হয়ে—তা সেই সঞ্চলক শক্তির রূপ যাই হোক না কেন।[৮] এখানে আমরা মেশিনকে পাই, কিন্তু পাই কেবল মেশিনারি দ্বারা চালিত উৎপাদনের একটি প্রাথমিক উপাদান হিসাবে।
মেশিনের আকারে ও তার কাজের ‘টুলগুলির সংখ্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হয় তাকে চালানোর জন্য একটি আরো অতিকায় মেকানিজম-এর এবং এই মেকানিজমটির আবার তার প্রতিবন্ধ অতিক্রম করার জন্য দরকার হয় মানুষের তুলনায় বিপুলতর ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সঞ্চলক শক্তির; তা ছাড়া, আরো একটি ঘটনা এই যে, অবিরাম সমভাবে অব্যাহত গতি-সঞ্চারের হাতিয়ার হিসাবে মানুষ একেবারেই অনুপযুক্ত। কিন্তু যদি ধরে নেওয়া হয় যে, সে কাজ করছে কেবল একটি মোটর হিসাবে এবং একটি মেশিন তার টুলের স্থান গ্রহণ করেছে, এটা স্পষ্ট যে তাহলে, প্রাকৃতিক শক্তিসমূহ তার জায়গা গ্রহণ করতে পারে। ম্যানুফ্যাকচার-আমল থেকে উত্তরাধিকার হিসাবে যেসব বড় বড় মোটর আমরা পেয়েছি, অশ্বশক্তি হচ্ছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ, অংশতঃ এই কারণে যে অশ্বের নিজস্ব একটি মাথা আছে এবং অংশতঃ এই কারণে যে অশ্ব অতি ব্যয়বহুল এবং যে-মাত্রায় তাকে কারখানায় প্রয়োগ করা যায়, তা বড়ই সীমাবদ্ধ। [৯] যাই হোক, আধুনিক শিল্পের শৈশবকালে অশ্ব ব্যবহৃত হত ব্যাপকভাবে। এটা, একদিকে যেমন প্রমাণিত হয় সম-সাময়িক কৃষিবিদদের অভিযোগ থেকে, অন্য দিকে, তেমন প্রমাণিত হয় “অশ্বশক্তি” কথাটি থেকে, যা যান্ত্রিক শক্তির অভিধা হিসাবে আজও পর্যন্ত টিকে আছে।
বাতাস বড় অনিয়মিত ও অনিয়ন্ত্রণযোগ্য এবং তা ছাড়া, আধুনিক শিল্পের স্থান যে ইংল্যাণ্ডে সেই ইংল্যাণ্ডে এমনকি ম্যানুফ্যাকচার-আমলেও জলশক্তিরই ছিল প্রাধান্য। ১৭ শতকেই চেষ্টা হয়েছিল দু’জোড়া মিল-স্টোনকে একটি মাত্র জল-চক্রের সাহায্যে চালানোর। কিন্তু গিয়ারিং’-এর পরিবর্ধিত আকারটি জল-শক্তির তুলনায় হয়ে পড়ল অত্যধিক, যে জল-শক্তি আবার হয়ে উঠেছে অপ্রতুল এবং যেসব কারণের অন্য সংঘর্ষণের নিয়মাবলী’ (‘লজ অব ফ্রিকশন’ ) নিয়ে আরো যথাযথ অনুসন্ধান শুরু হল, এই ঘটনা সেগুলির মধ্যে একটি। একই ভাবে একটি লেভার’-কে ঠেলে ও টেনে মিলকে গতিশীল করার ব্যবস্থার দরুন সঞ্চলক শক্তিতে অনিয়মকতার কারণে কালক্রমে এল ফ্লাইং হুইলের তত্ত্ব ও প্রয়োগ, যা পরবর্তী কালে আধুনিক শিল্পে অধিকার করল এত গুরুত্বপূর্ণ স্থান।[১০] এই ভাবেই ম্যানুফ্যাকচারের আমলে বিকাশ লাভ করল আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পের প্রথম বৈজ্ঞানিক ও কৃৎকৌশলগত উপাদানসমূহ। আর্কাইট এর থশ -স্পিনিং মিল শুরু থেকেই চালিত হত জলের দ্বারা। কিন্তু এসব সত্ত্বেও, প্রধান সঞ্চলুক শক্তি হিসাবে জলের ব্যবহার ছিল নানা সমস্যায় আকীর্ণ। তাকে ইচ্ছামত বাড়ানো যেত না, বছরের কোন কোন ঋতুতে হয়ে পড়ত অকেজো, এবং সবচেয়ে যেটা বড় সমস্যা, তা হল এই যে এটা মূলতঃ স্থান-নিবদ্ধ।[১১] ওয়াট-এর দ্বিতীয় এবং তথাকথিত ‘ডবল অ্যাক্টিং স্টিম ইঞ্জিন’-টি উদ্ভাবিত হবার পূর্ব পর্যন্ত এমন একটি ‘প্রাইভ-মুভার (অভি-সঞ্চলক’ }-এর সন্ধান মেলেনি, যা কয়লা ও জলকে কাজে লাগিয়ে নিজের শক্তি নিজেই জন্মাতে সক্ষম, যা নিজে সচল এবং তদুপরি সচলতার উপায়, যার শক্তি সমগ্র ভাবেই মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন, যা জল-চক্রের মত গ্রামগত নয় বরং শহরগত, যা উৎপাদনকে জলচক্রের মত গ্রামে গ্রামান্তরে বিক্ষিপ্ত না করে দিয়ে শহরে কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ সৃষ্টি করে, যা বিশ্বজনীন ভাবে কারিগরি প্রয়োগের উপযুক্ত এবং, আপেক্ষিক ভাবে বলা যায়, স্থানীয় ঘটনাবলী দ্বারা যার অবস্থান নির্বাচনের ব্যাপারটি কদাচিং ব্যাহত হয়। ১৭৮৪ সালের এপ্রিল মাসে ওয়াট যে পেটেন্ট বার করেন তার ‘স্পেসিফিকেশন’ থেকেই তাঁর প্রতিভা প্রতিভাত হয়। এই স্পেসিফিকেশনে তার স্টিম ইঞ্জিনের বিবরণ এমন ভাবে দেওয়া হয়নি যে সেটি একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উদ্ভাবিত যন্ত্র মাত্র, পরন্তু যান্ত্রিক শিল্পে বিশ্বজনীন ব্যবহারের একটি এজেন্ট। এই অভিজ্ঞান-পত্রে তিনি এমন সব প্রয়োগের উল্লেখ করেন, যাদের অনেকগুলিই, যেমন ‘ক্টিম হামার’, পরবর্তী অর্ধ-শতাব্দীর আগে প্রবর্তিত হয়নি। অবশ্য নৌ-চলাচলের ক্ষেত্রে স্টিম ইঞ্জিনের ব্যবহার সম্পর্কে তিনি সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তার দুই উত্তরসাধক, বলটন এবং ওয়াট, ১৮৭১ সালের প্রদর্শনীতে সাগরগামী স্টিমারের জন্য বিশাল আকারের স্টিম ইঞ্জিন প্রেরণ করেন।
যে মুহূর্তে বিভিন্ন টুল’ রূপান্তরিত হল মানুষের হস্তচালিত হাতিয়ার থেকে একটি মেশিনের মেকানিক্যাল অ্যাপারেটাসের উপকরণে, সেই মুহূর্তে সঞ্চলক মেকানিজমটিও অর্জন করল একটি স্বতন্ত্র রূপ, যা মনুষ্য-শক্তির সীমাবদ্ধতা থেকে সম্পূর্ণ বিমুক্ত। তারপরে, সেই একক মেশিনটি, যার কথা আমরা এতক্ষণ বিবেচনা করেছি, পর্যবসিত হল মেশিনারি দ্বারা উৎপাদনের একটি উপাদানে মাত্র। একটি সঞ্চলক মেকানিজম সক্ষম হল একই সঙ্গে অনেকগুলি মেশিন চালু করতে। যুগপৎ চলে এমন মেশিনের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পায়, সঞ্চলক মেকানিজমটিও তত বৃদ্ধি পায় এবং সঞ্চারক (ট্রান্সমিটিং) মেকানিজমটিও হয় একটা ব্যাপক বিস্তারশীল অ্যাপারেটাস।
এখন আমরা মেশিনারি-রূপ জটিল প্রণালী এবং বহুসংখ্যক মেশিনের মধ্যে পার্থক্য কি তা নিয়ে আলোচনায় অগ্রসর হব।
. এক ক্ষেত্রে উৎপন্ন দ্রব্যটি সমগ্র ভাবে তৈরি হয় একটি মাত্র মেশিনের দ্বারা, যে মেশিনটি একজন হস্তশিল্পী আগে তার টুলের সাহায্যে, যেমন একজন তাঁতী তার তাঁতের সাহায্যে, কিংবা কয়েকজন হস্তশিল্পী, বিচ্ছিন্ন ভাবে বা একটি ম্যানুফ্যাকচারের সদস্য হিসাবে পূর্বে পর্যায়ক্রমে যেসব কর্মকাণ্ড করত, সেই সবই করে।[১২] দৃষ্টান্ত হিসাবে, লেফাফা-ম্যানুফ্যাকচারে একজন মানুষ ফোল্ডারের সাহায্যে কাগজটিকে জ করত, আরেকজন আঠা লাগাত, তৃতীয় একজন আলগা কাগজটি সেঁটে দিত এবং চতুর্থ আর একজন তার উপরে নক্সাটি ছাপ দিত—এবং এই প্রত্যেকটি পর্যায়ের জন্য লেফাফাটির হাতে হাতে ঘুরতে হত। এখন একটি মাত্র লেফাফা-মেশিন এই সমস্ত কাজগুলি একসঙ্গে করে এবং ঘণ্টায় ৩ হাজারেরও বেশি লেফাফা তৈরি করে। ১৮৬২ সালে লণ্ডন প্রদর্শনীতে কাগজ-কর্ণেট তৈরি করার একটি আমেরিকান মেশিন দেখানো হয়েছিল। এতে একই সঙ্গে কাগজ কাটা, আঠা লাগানো, ভঁজ করা এবং ৩০ ৩টি কর্ণেট এক মিনিটে তৈরি হয়ে যেত। যখন ম্যানুফ্যাকচার হিসাবে সম্পাদিত হত, তখন যে-গোটা প্রক্রিয়াটি বিভক্ত ও পরিচালিত হত কয়েকটি পর্যায়ে, তা এখন সম্পাদিত হচ্ছে একটি মেশিনের দ্বারা, যে-মেশিনটি কাজ করাচ্ছে কয়েকটি টুলকে সংযোজিত ভাবে। এখন এই ধরনের একটি মেশিন কেবল একটি জটিল হস্তশিল্পগত উপকরণই হোক কিংবা ম্যানুফ্যাকচার দ্বারা বিশেষীকৃত বিবিধ সরল উপকরণের একটি সংযোজনই হোক, উভয় ক্ষেত্রেই ফ্যাক্টরিতে, অর্থাৎ যেখানে কেবল মেশিনারিই ব্যবহৃত হয় সেই কর্মশালাতে, আমাদের আবার সাক্ষাৎ ঘটে সরল সহযোগের সঙ্গে; আপাততঃ যদি আমরা কাজের লোকটিকে বিবেচনার বাইরে রাখি, তা হলে এই সহযোগ আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়, প্রথমতঃ, একই জায়গায় একই রকমের ও একই সঙ্গে কার্যরত কতকগুলি মেশিনের সমাবেশ হিসাবে। যেমন, একটি বয়ন ফ্যাক্টরি গঠিত হয় পাশাপাশি কার্যরত কতকগুলি পাওয়ারলুমের দ্বারা, একটি সেলাই ফ্যাক্টরি গঠিত হয় একই বাড়িতে অবস্থিত কতকগুলি সেলাইয়ের কলের দ্বারা। কিন্তু এখানে রয়েছে। গোটা প্রণালীটির মধ্যে একটি কারিগরি একত্ব, কেননা সব কটি মোশনই তাদের গতিবেগ পাচ্ছে একই সঙ্গে এবং একই মাত্রায় একই ট্রান্সমিটিং মেশিনের দ্বারা পরিবাহিত এবই প্রাইভ-মুভারের স্পন্দন থেকে; তা ছাড়া, এই মেকানিজটিও তাদের সব লের কিছু মাত্রায় অভিন্ন, কেননা এর থেকে উদগত বিভিন্ন শাখা-প্রশাখাই প্রত্যেকটি মেশিনর সঙ্গে সংলগ্ন হয়। যেমন কয়েকটি টুল একটি মেশিনের অব্দ গঠন করে, ঠিক তেমনি একই জাতীয় কতকগুলি মেশিন সঞ্চালক মেকানিজমটির বিভিন্ন অঙ্গ গড়ে তোলে।
যাই হোক, একটি যথার্থ মেশিনারি-প্রণালী কিন্তু এই স্বতন্ত্র মেশিনগুলির স্থান গ্রহণ করতে পারে না, যে পর্যন্ত শ্রমের বিষয়টি বিবিধ প্রত্যংশ প্রক্রিয়ার একটি সুসংবদ্ধ পর্যায়ক্রমের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত না হয়, যে-পর্যায়গুলি আবার পরম্পর-পরিপূরক এক সারি নানান জাতের মেশিনের দ্বারা ক্রমিক ভাবে সম্পাদিত হয়। এখানে আবার আমরা ম্যানুফ্যাকচার কর্তৃক বিশেষিত শ্রম-বিভাজন-জনিত সহযোগের সাক্ষাৎ পাই। পার্থক্য কেবল এই যে এখন তা বিবিধ প্রত্যংশ মেশিনের একটি সংযোজন। পশম শিল্পে ‘বিটার’, ‘কুর’, ‘স্পিনার প্রভৃতির মত বিবিধ প্রত্যংশ শ্রমিকদের বিশেষ বিশেষ টুলগুলি এখন রূপান্তরিত হয় বিশেষায়িত মেশিনগুলির বিভিন্ন টুলে, সংশ্লিষ্ট প্রণালীতে প্রত্যেকটি মেশিন এক-একটি বিশেষ কাজের জন্য এক-একটি বিশেষ অঙ্গ। যেসব শিল্প-শাখায় মেশিনার প্রথমে প্রবর্তিত হয়, স্বয়ং ম্যানুফ্যাকচারই সাধারণভাবে সেখানে যোগায় উৎপাদন-প্রক্রিয়া-বিভাজনের ও তজ্জনিত সংগঠনের স্বাভাবিক বনিয়াদ।[১৩] যাই হোক, একটা মর্মগত পার্থক্য সঙ্গে সঙ্গেই আত্মপ্রকাশ করে। ম্যানু ফ্যাকচার-প্রণালীতে কর্মীদেরই তাদের হস্তশিল্পগত উপকরণসমূহ নিয়ে একক ভাবে বা গোষ্ঠী হিসাবে প্রত্যেকটি প্রত্যংশ সম্পাদন করতে হয়। একদিকে, যেখানে কর্মীটি প্রক্রিয়ার সঙ্গে উপযোজিত হয়ে যায়, অন্য দিকে, সেখানে প্রক্রিয়াটিকে তার পক্ষে উপযুক্ত করে নেওয়া হয়। মেশিনারি দ্বারা পরিচালিত উৎপাদনব্যবস্থায় শ্রম বিভাজনের বিষয়ীগত নীতিটি আর বিদ্যমান থাকে না। এখানে সমগ্র ভাবে প্রক্রিয়াটিকেই বিষয়গত ভাবে পরীক্ষা করা হয় স্বয়ংগত অবস্থায়, অর্থাৎ মনুষ্য-হস্ত দ্বার। সম্পাদনের প্রশ্নটির দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে, তাকে বিশ্লিষ্ট করা হয় তার বিভিন্ন সংগঠনী পর্যায়ে এবং কিভাবে প্রত্যেকটি প্রত্যংশ পর্যায় সম্পাদন করতে হবে এবং সেগুলিকে সংবদ্ধ করতে হবে একটি সামগ্রিক আকারে, সেই সমস্যাটির সমাধান করা হয় মেশিন, কেমিষ্ট্রি ইত্যাদির সহায়তায়।[১৪] তবে অবশ্যই এক্ষেত্রেও তত্ত্বকে সর্বাঙ্গীন করে তুলতে হবে বিপুলাকারে সঞ্চয়ীকৃত অভিজ্ঞতার দ্বারা। প্রত্যেকটি প্রত্যংশ মেশিন পর্যায়ক্রমে পরবর্তী মেশিনটির জন্য কাঁচামাল যোগায় এবং যেহেতু তারা সকলেই কাজ করে একই সঙ্গে, সেই হেতু উৎপাদ্য দ্রব্যটিকে সব সময়েই তার বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে পার হতে হচ্ছে; এবং তা নিরন্তর থাকছে অতিক্রান্তির এক অবস্থায়—এক পর্যায় থেকে অন্য এক পর্যায়ে। যেমন, ম্যানুফ্যাকচারে প্রত্যংশ শ্রমিকদের প্রত্যক্ষ সহযোগ বিভিন্ন বিশেষ গোষ্ঠীগুলির মধ্যে একটি সংখ্যাগত অনুপাত প্রতিষ্ঠা করে, ঠিক তেমনি মেশিনারির একটি সংগঠিত প্রণালীতে, যেখানে একটি প্রত্যংশ মেশিন আর একটি প্রত্যংশ মেশিনকে কর্মব্যস্ত রাখে, সেখানে তাদের সংখ্যা, তাদের আয়তন ও তাদের গতিবেগের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই যৌথ মেশিনটি তখন নানান ধরনের একক মেশিনের কিংবা একক মেশিনসমষ্টির একটি সুসংগঠিত প্রণালী; যতই প্রক্রিয়াটি হয়ে ওঠে অনবচ্ছিন্ন অর্থাৎ যতই প্রথম পর্যায়টি থেকে শেষ পর্যায়টিতে যেতে কাঁচামালটির পথে ব্যাঘাত ঘটে আরো আবো কম, ততই এই যৌথ মেশিনটি হয়ে ওঠে আবো আরো নিখুত; অন্য ভাবে বলা যায়, যতই এক পর্যায় থেকে অন্য এক পর্যায়ে কাঁচামালটির অতিক্রান্তি সাধিত হয় মানুষের হাতের বদলে মেশিনের দ্বারা, ততই যৌথ মেশিনটি হয়ে ওঠে আরো নিখুত। ম্যানুফ্যাকচারের প্রত্যেকটি প্রত্যংশ প্রক্রিয়ার পৃথগীভবন হচ্ছে শ্রম-বিভাজনের প্রকৃতির দ্বারা আরোপিত একটি অবস্থা কিন্তু একটি পূর্ণ বিকশিত ফ্যাক্টরিতে এই প্রক্রিয়াগুলির অনবচ্ছিন্নতা হচ্ছে বরং আবশ্যিক।
একটি মেশিনারী-প্রণালী, তা সে একই রকমের কয়েকটি মেশিনের নিছক সহযোগের উপরেই ভিত্তিশীল হোক, যেমন বয়নকার্যে, অথবা নানান রকমের মেশিনের একটি সংযোজনের উপরেই ভিত্তিশীল হোক, যেমন, সুতো কাটার কাজে, নিজের মধ্যেই গড়ে তোলে একটি বিশাল অটোমেশন, যখন তা চালিত হয় একটি স্বয়ংক্রিয় প্রাইমমুভারের দ্বারা। কিন্তু যদিও ফ্যাক্টরিটি সমগ্র ভাবে চালিত হয় স্টিম ইঞ্জিনের দ্বারা, তবু, হয়, কয়েকটি একক মেশিনের কয়েকটি গতিক্রিয়ার জন্য তাদের লাগতে পারে শ্রমিকের সাহায্য। (স্বয়ংক্রিয়) মিউলের আবিক্রিয়ার আগে মিউল ক্যারেজ চালানোর জন্য এইরকম সাহায্যের দরকার হত, এবং এখনো সূক্ষ্ম সুতো কাটার মিলে তার দরকার হয়, আর, নয়তো, একটি মেশিন যাতে তার কাজ করতে সক্ষম হয়, তার জন্য এই মেশিনের কয়েকটি অংশের প্রয়োজন হতে পারে শ্রমিকের হাতের তৎপরতার, যেমন, একটি হস্তচালিত “টুল’, ‘সাইড-রেস্ট’-এর ‘সেলফ-অ্যাক্টর’-এ রূপান্তরিত হবার পূর্ব পর্যন্ত মেশিন-মেকারদের কর্মশালাগুলিতে এই অবস্থাই ছিল। যে মুহূর্তে মানুষের সাহায্য ছাড়াই কেবল তার তত্ত্বাবধানেই একটি মেশিন একটি কাঁচামালের রূপায়ণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পর্যায়গুলি সম্পাদন করতে পারে, সেই মুহূর্তেই আমরা পাই একটি স্বয়ংক্রিয় মেশিনারি-প্রণালী—এবং এমন একটি প্রণালী যার বিভিন্ন প্ৰত্যংশ নিরন্তর উন্নয়নের সম্ভাবনাযুক্ত। একটি ‘সিলভার ভেঙে যাবার সঙ্গে সঙ্গে টানা-কাঠামোটিকে বন্ধ করে দেয়, এমন ‘অ্যাপারেটাস এবং মাকুর ‘ববিন’টি পড়ে’ (ওয়েফট) থেকে বেরিয়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ারলুমটিকে বন্ধ করে দেয়, এমন স্বয়ংক্রিয় ‘স্টপ’—এগুলি বেশ আধুনিক আবিষ্কার—উৎপাদনের নিরবচ্ছিন্নতা এবং স্বয়ংক্রিয় নীতির ক্রিয়াশীলতা—এই উভয়েরই একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা একটি আধুনিক কাগজ-কলকে নিতে পারি। সাধারণ ভাবে কাগজ-শিল্পে আমরা যে কেবল বিভিন্ন উৎপাদন-উপায়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন উৎপাদন-পদ্ধতির মধ্যেকার পার্থক্যগুলি সবিস্তারে সুবিধাজনক ভাবে অনুধাবন করতে পারি, তাই নয়, সেই সঙ্গে ঐ পদ্ধতি গুলির সঙ্গে সামাজিক সংযোগটি অনুরূপ ভাবে অনুধাবন করতে পারি, কেননা পুরনো জার্মান কাগজ-তৈরির পদ্ধতিটি আমাদের যোগায় হস্তশিল্পের একটি নমুনা; ১৭ শতকের ওলন্দাজ ও ১৮ শতকের ফরাসী কাগজ-তৈরির পদ্ধতি আমাদের যোগায় ঐ জিনিসটির স্বয়ংক্রিয় উৎপাদনের নমুনা। তা ছাড়া, ভারতে ও চীনে এখনো চালু আছে ঐ শিল্পটির দুটি স্বতন্ত্র প্রাচীন এশীয় রূপ।
বিবিধ মেশিনের একটি সংগঠিত প্রণালী, যাতে একটি ট্রান্সমিটিং মেকানিজমের দ্বারা গতি সঞ্চারিত হয় একটি কেন্দ্রীয় অটোমেশন থেকে—এটাই হচ্ছে মেশিনারি-পরিচালিত উৎপাদনের সবচেয়ে বিকশিত রূপ। একটি একক মেশিনের জায়গায় এখানে আমরা পাই একটি যান্ত্রিক দানব, যার দেহটা জুড়ে থাকে গোটা গোটা কারখানা, এবং যার দানবীয় শক্তি গোড়ার দিকে তার দানবোচিত প্রত্যঙ্গসমূহে অবগুণ্ঠিত থাকে মন্থর ও পরিমিত খণ্ড খণ্ড গতি-প্রক্রিয়ার মধ্যে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেটে পড়ে তার অগণিত অঙ্গের ক্ষিপ্র ও প্রচণ্ড ঘূর্ণীতে।
যাদের একমাত্র পেশা হল মিউল ও ক্টিম ইঞ্জিন তৈরি করা, এমন শ্রমিকদের আগেও মিউল ও স্টিম ইঞ্জিন ছিল; ঠিক যেমন দর্জির আবির্ভাবের আগেও মানুষ জামা-কাপড় পরত। কিন্তু ভকানসন, আর্কাইট, ওয়াট ও অন্যান্যদের নানাবিধ উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছিল, কেননা এই উদ্ভাবকেরা হাতের কাছে প্রস্তুত অবস্থায় পেয়েছিলেন ম্যানুফ্যাকচারের যুগের তৈরি বহুসংখ্যক কুশলী কারিগর। এদের মধ্যে কিছু অংশ বিভিন্ন ব্যবসায়ের স্বাধীন হস্তশিল্পী, কিছু ছিল ম্যানুফ্যাকচারের মধ্যে সংঘবদ্ধ, যে কথা আগেই বলা হয়েছে, যে-ম্যানুফ্যাকচারগুলিতে কঠোর ভাবে শ্রম-বিভাগ সংঘটিত হয়েছিল। উদ্ভাবনের সংখ্যা যতই বাড়তে লাগল, তই মেশিন নির্মাণ শিল্পটি বিভক্ত হতে লাগল আরো আরো বহুসংখ্যক শাখায়; এবং এই সমস্ত ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম বিভাগও আরো আরো বিকাশ লাভ করতে লাগল। এই ভাবে এখানেই আমরা পেয়ে যাই আধুনিক শিল্পের প্রত্যক্ষ বনিয়াদ। ম্যানুফ্যাকচার উৎপাদন করল মেশিনারি আর এই মেশিনারি দিয়েই আধুনিক শিল্প, যেসব উৎপাদন-ক্ষেত্রে তা আগে আত্মবিস্তার করল, সে সব ক্ষেত্র থেকে হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচারকে নির্বাসিত কর। সুতরাং ঘটনাপ্রবাহের স্বাভাবিক ধারাতেই ফ্যাক্টরি-ব্যবস্থা গঠিত হল এক অনুপযোগী ভিত্তির উপরে। যখন এই ব্যবস্থা উন্নীত হল বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে, তখন তাকে উপড়ে ফেলতে হল এই তৈরি-হওয়া ভিত্তিটি, যেটি ইতিমধ্যেই বিস্তার লাভ করেছিল পুরনো ধাঁচে; এবং সেই ভিত্তিটির জায়গায় তাকে গড়ে তুলতে হল এমন একটি ভিত্তি, যা হবে তার উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যত কাল পর্যন্ত মনুষ্য-শক্তিতে পরিচালিত হয়, তত কাল পর্যন্ত যেমন একটি একক মেশিন তার বামন-আকৃতি রক্ষা করে, ঠিক তেমনি যত দিন পর্যন্ত জন্তু, বাতাস, এমনকি জলের মত পূর্বত সঞ্চলক শক্তিসমূহের স্থান গ্রহণে টিম ইঞ্জিন সক্ষম হয়নি, তত দিন পর্যন্ত কোন মেশিনারি-প্রণালী সঠিক অর্থে বিকাশ লাভ করতে পারেনি, ঠিক তেমনি আধুনিক শিল্পের বৈশিষ্ট্যসূচক উৎপাদন-উপকরণের যে মেশিন, তা যত দিন পর্যন্ত তার অস্তিত্বের জন্য দায়ী ছিল ব্যক্তিগত বল ও ব্যক্তিগত দক্ষতার কাছে এবং নির্ভর করত প্রত্যংশ কর্মীরা ও হস্তশিল্প কারিগরেরা যে পেশীগত বল, দৃষ্টিগত তীক্ষ্ণতা ও হস্তগত দক্ষতার সাহায্যে তাদের ছোট ছোট হাতিয়ারগুলিকে ব্যবহার করত, সেই বল, দৃষ্টি ও দক্ষতার উপরে, তত দিন পর্যন্ত আধুনিক শিল্প তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশে ছিল অশক্ত। সুতরাং এই ভাবে নির্মিত মেশিনের মহার্ঘতা ছাড়াও-যে ঘটনাটি সর্বদাই ধনিকের মনে জাগরূক থাকে, সে ঘটনাটি ছাড়াও—মেশিন-পরিচালিত শিল্পসমূহের সম্প্রসারণ এবং নোতুন উৎপাদনশাখায় তার আক্রমণ নির্ভর করে এক শ্রেণীর কর্মীর উপরে, যারা তাদের নিয়োগের প্রায় শিল্পকলা সুলভ প্রকৃতির দরুন, নিজেদের সংখ্যা লাফে লাফে বাড়াতে পারেনা, পারে কেবল ক্রমে ক্রমে। কিন্তু তা ছাড়াও বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে আধুনিক শিল্প হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচার দ্বারা রচিত ভিত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন হয়ে ওঠে। প্রাইমমুভার, ট্রান্সমিটিং মেকানিজম এবং খোদ মেশিনগুলির ক্রমবর্ধমান আকার শারীরিক শ্রম শুরুতে এগুলিকে যেভাবে তৈরি করেছিল সেই মূল রূপটি থেকে ক্রমাগত সরে যাবার দরুন মেশিনের অংশগুলির জটিলতা, বিভিন্নতার ও নিয়মিকতার বৃদ্ধিপ্রাপ্তি কাজের অবস্থা জনিত নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বাকি সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এমন একটি, রূপ অর্জন।[১৫] স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মোয়ন এবং কাঠের পরিবর্তে লোহার ব্যবহারের মত আরো দুর্বল সামী ব্যবহারের দৈনিক বর্ধমান অপ্রতিরোধ্য চাপ-ঘটনাপ্রবাহের প্রকোপে উদ্ভূত এই সমস্ত সমস্যার সমাধান সর্বত্রই বাধাপ্রাপ্ত হল ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা-রূপ প্রতিবন্ধকের দ্বারা যে সীমাবদ্ধতা এমনকি ম্যানুফ্যাকচার-যুগের যৌথ শ্রমিকও সীমিত মাত্রায় ছাড়া ভেদ করতে পারত না। আধুনিক হাইড্রলিক প্রেস, আধুনিক পাওয়ার লুম এবং আধুনিক কার্ডিং ইঞ্জিনের মত মেশিন কখনো ম্যানুফ্যাকচারের দ্বারা উৎপাদিত হতে পারত না।
উৎপাদনের এক ক্ষেত্রে কোন আমূল পরিবর্তন ঘটলে অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন আবশ্যক হয়। এটা ঘটে প্রথমতঃ শিল্পের সেই সমস্ত শাখায়, যেগুলি একই প্রক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন পর্যায় হিসাবে সংলগ্ন হয়েও সামাজিক শ্রম-বিভাজন দ্বারা এমন ভাবে বিচ্ছিন্ন যে, তাদের প্রত্যেকটিই তৈরি করে এক-একটি আলাদা আলাদা পণ্য। যেমন, মেশিনারি দিয়ে সুতো কাটা মেশিনারি দিয়ে কাপড় বোনার প্রয়োজন ঘটাল এবং উভয়ে মিলিত ভাবে আবশ্যিক করে তুলল একটি যান্ত্রিক ও রাসায়নিক বিপ্লব ঘটল ‘ব্লিচিং’, ‘প্রিন্টিং’ ও ‘ডাইং’-এ। অন্য দিকে, অনুরূপ ভাবে সুতো কাটায় বিপ্লব ঘটার জন্য তুলাবীজ থেকে তুলা-তন্তুকে আলাদা করার জন্য ঘটল ‘জিন’-এর উদ্ভাবন; কেবল এই উদ্ভাবনটির কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে বিপুল আয়তনে তুলার উৎপাদন করে। বর্তমানের প্রয়োজন মিটানো।[১৬] কিন্তু আরো বিশেষ ভাবে, শিল্প ও কৃষির উৎপাদন পদ্ধতিতে বিপ্লব অনিবার্য করে তুলল সাধারণ ভাবে উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ যোগাযোগ ও পরিবহণ-ব্যবস্থায় বিপ্লব। এমন একটি সমাজ, ফুরিয়ার-এর ভাষায়, যার চক্ৰনাভি ছিল ক্ষুদ্রায়তন কৃষিকর্ম এবং তৎসহ তার আনুসঙ্গিক ঘরোয়া শিল্প ও শহুরে হস্তশিল্প-এমন একটি সমাজে যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা ছিল ম্যানুফ্যকচার-আমলের উৎপাদন-প্রয়োজনসমূহের তুলনায় এত অনুপযোগী-যে-ম্যানু ফ্যাকচার-আমলের অনুষঙ্গ ছিল সম্প্রসারিত শ্রম-বিভাজন, উৎপাদন-উপকরণ ও শ্রমিকদের কেন্দ্রীভবন এবং ঔপনিবেশিক বাজার—সেই ম্যানুফ্যাকচার-আমলের উৎপাদন-প্রয়োজনসমূহের তুলনায় এত অনুপযোগ যে, কার্যত সেগুলিরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেল। একই ভাবে ম্যানুফ্যাকচার-আমল থেকে উত্তরাগত যোগাযোগ ও পরিবহণের উপায়গুলি আধুনিক শিল্পের পক্ষে হয়ে উঠল অসহ প্রতিবন্ধক রূপ আধুনিক শিল্প যার উৎপাদনের গতি প্রচণ্ড ক্ষিপ্র, যার বিস্তৃতি বিপুল, উৎপাদনের এক ক্ষেত্র থেকে অন্য ক্ষেত্রে যার মূলধন ও শ্রমের নিক্ষেপণ নিরন্তর এবং বিশ্ববারের সঙ্গে যার ঘটছে নোতুন সংযোগ। সুতরাং পাল-তোল। জাহাজের নির্মাণকার্যে আমূল পরিবর্তন ছাড়াও স্টিমার, রেলওয়ে, সাগরগামী ষ্টিমার প্রভৃতির ব্যবস্থার দ্বারা যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা ক্রমশই যান্ত্রিক শিল্পের নানাবিধ উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে উপযোজিত হল। কিন্তু বিশাল বিশাল লৌহপিণ্ড, যা এখন ঢালাই-পেটাই করতে হবে, কাটাই ছেদাই করতে হবে, ভিন্ন ভিন্ন আকারে রূপ দিতে হবে, তার জন্য আবার প্রয়োজন দেখা দিল সাইক্লোপিয়ান মেশিনের, যেগুলি তৈরি করার পক্ষে ম্যানুফ্যাকচার-আমলের পদ্ধতিগুলি ছিল একেবারেই অনুপযোগী।
অতএব, আধুনিক শিল্পকে হাতে তুলে নিতে হল মেশিনকে তথা তার উৎপাদন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসূচক উপকরণটিকে এবং নির্মাণ করতে হল মেশিনের সাহায্যেই আরো সব মেশিনকে। যত দিন পর্যন্ত সে এই কাজ করে উঠতে পারেনি, তত দিন পর্যন্ত তার পক্ষে নিজের জন্য উপযুক্ত একটি কারিগরি বনিয়াদ তৈরি করা ও তার উপরে দাড়ানোও সম্ভব হয়নি। নিজের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মেশিনারিও এই শতকের প্রথম কয়েক দশকে ধাপে ধাপে আসল মেশিন নির্মাণের কাজটিকে আত্মস্থ করে ফেলল। কিন্তু কেবল ১৮৬৬ দশকের আগের দশকেই মাত্র বিপুল আয়তনে রেলওয়ে ও সাগরগামী জাহাজ নির্মাণের তাগিদেই বিবিধ সাইক্লোপিয়ান মেশিনের আবির্ভাব ঘটল, যা এখন নিয়োজিত হচ্ছে প্রাইভ-মুভার নির্মাণের কাজে।
মেশিন দিয়ে মেশিন তৈরির জন্য সবচেয়ে আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে একটি প্রাইভ-মুভার, যা যেকোন পরিমাণ বল প্রয়োগ করতে পারবে অথচ থাকবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এই শতটি স্টিম ইঞ্জিন ইতিপূর্বেই পূরণ করে দিয়েছিল। কিন্তু একই সময়ে চাই জ্যামিতিক ভাবে যথাযথ ‘সরল রেখা’, ‘তল’, ‘বৃত্ত’, ‘স্তম্ভক’ (সিলিণ্ডার’ ), শঙ্কু (কোন’) ও ‘গোলক’ (ম্পিহার’ )—যেগুলির প্রয়োজন হয় মেশিনের বিস্তারিত অংশগুলিতে। স্নাইড রেস্ট’ উদ্ভাবন করে এই শতকের প্রথম দশকে হেনরি মডন্সি এই সমস্যার সমাধান করে দেন; অচিরেই সেটিকে স্বয়ংক্রিয় করে দেওয়া হয় এবং কিছুটা পরিবর্তিত আকারে তা ‘লেদ ছাড়াও অন্যান্য নির্মাণমূলক মেশিনে প্রযুক্ত হয়, যদিও তা মূলত তৈরি হয়েছিল লেদ-এর জন্যই। এই যান্ত্রিক ‘অ্যাপ্লায়ান্স’-টি কেবল কোন একটি ‘টুল’-এরই স্থান দখল করেনা, স্বয়ং হাতের স্থানই দখল করে নেয়—যা লোহা বা অন্য কোন জিনিস-বরাবর কাটিং টুলটিকে প্রয়োগ ও পরিচালনা করে একটি বিশেষ আকার উৎপাদন করে। এই ভাবে সম্ভব হল কোন মেশিনারির ভিন্ন ভিন্ন অংশগুলির বিভিন্ন আকার “এতটা সহজ ও সঠিক ভাবে এবং এতটা দ্রুত গতিতে উৎপাদন করা, যা সবচেয়ে দক্ষ কারিগরের দীর্ঘ অভিজ্ঞ হাতও করতে পারে না”।[১৮]
এখন যদি আমরা মেশিনারির সেই অংশটির উপরে মনঃসংযোগ করি, যেটি তার ‘অপারেটিং টুল’, তা হলে আমরা দেখতে পাই যে হস্তচালিত হাতিয়ারগুলিই আবার আবির্ভূত হচ্ছে, কিন্তু তা হচ্ছে সাইক্লোপিয়ান আয়তনে। একটি বোরিং মেশিনের অপারেটিং অংশটি হচ্ছে একটি বৃহদাকার ড্রিল, যা চালিত হয় একটি ঠিম ইঞ্জিনের দ্বারা; অন্য দিকে আবার, এই মেশিনটি ছাড়া বড় বড় স্টিম ইঞ্জিন ও হাইড্রলিক প্রেস-এর সিলিণ্ডারগুলি তৈরি করা সম্ভব হত না। মেকানিক্যাল লেদ হচ্ছে মামুলি ফুট লেদেরই সাইক্লোপিয়ান সংস্করণ; যা সেই একই সব টুল দিয়ে লোহার উপরে কাজ করে, যেগুলি দিয়ে মানুষ-সূত্রধর কাজ করে কাঠের উপরে; লণ্ডনের জাহাজঘাটাগুলিতে যে হাতিয়ারটি তক্তা কাটে, তা হচ্ছে একটি বিরাট ক্ষুর; যে কাটাই ( ‘শিয়ারিং) মেশিন দর্জির কঁচি যেমন অনায়াসে কাপড় কাটে তেমনি অনায়াসে লোহা কাটে, সেটি একজোড়া অতিকায় কঁচিমাত্র; এবং একটি বাষ্প-হাতুড়ি (স্টিম হামার’ . কাজ করে একটি মামুলি হাতুড়ির মাথা দিয়ে কিন্তু তার ওজন এত বেশি যে স্বয়ং থর-ও সেটা নাড়াতে পারত না।[১৯] এই স্টিম হামারগুলি ন্যাস্মিথ-এর আবিষ্কার এবং সেগুলির মধ্যে এমন একটি হ্যামার আছে, যার ওজন ছয় টনেরও বেশি, যা আঘাত করে সাত ফিট উচু থেকে খাড়া-খাড়ি ভাবে নেমে এসে—এবং আঘাত করে এমন একটি নেহাইয়ের উপরে যার ওজন ৩৬ টন। গ্র্যানিট পাথরকে ভেঙে গুড়ো-গুড়ো করা এর পক্ষে নিছক ছেলেখেলা, তবু আস্তে আস্তে আঘাত করে একটি পেরেককে একটুকরো নরম কাঠের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে এ কম সক্ষম নয়।
শ্রমের নানাবিধ উপকরণ যখন মেশিনারির আকার প্রাপ্ত হয়, তখন আবশ্যক হয় মনুষ্য-শক্তির পরিবর্তে প্রাকৃতিক শক্তির প্রবর্তন হয় হাতুড়ে কায়দার বদলে বিজ্ঞানের সচের প্রয়োগ। ম্যানুফ্যাকচারে সামাজিক শ্রম-প্রক্রিয়ার সংগঠন নেহাই বিষয়ীগত; সেটা হচ্ছে প্ৰত্যংশ শ্রমিকদের সংযোজন; অন্য দিকে, মেশিনারিব্যবস্থায় আধুনিক শিল্প এমন একটি উৎপাদনী সংগঠনের অধিকারী, যা যথার্থ ভাবেই বিষয়গত—যেন সংগঠনটিতে শ্রমিক উৎপাদনের এক পূর্বাগত বাস্তব অবস্থার উপাঙ্গ মাত্র। সরল সহযোগে, এবং, এমনকি, শ্রম-বিভাজনের উপরে প্রতিষ্ঠিত সহযোগেও, বিচ্ছিন্ন কারিগরের উপরে যৌথ কারিগরের দমনকার্য আত্মপ্রকাশ করে কমবেশি দৈবাৎ। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া, সেগুলির উল্লেখ পরে করা হবে, শ্রম-প্রক্রিয়ার সহযোগমূলক চরিত্র হচ্ছে একটি কারিগরি প্রয়োজন-স্বয়ং শ্রম-উপকরণের তাগিদেই যার প্রচলন।
————
১. মিল-এর বলা উচিত ছিল, “অন্যের শ্রমের দ্বারা পরিপোষিত নয়, এমন কোন মানুষের দৈনিক শ্রমের লাঘব ঘটিয়েছে কিনা” কেননা মেশিনারি যে বিত্তমান অলস ব্যক্তিদের সংখ্যা অনেক বাড়িয়েছে, তাতে সংশয় নেই।
২. দৃষ্টান্ত হিসাবে হাটুনের কোর্স অব ম্যাথমেটিকস” দ্রষ্টব্য।
৩. এই দিক থেকে একটি ‘টুল’ আর একটি মেশিন’-এর মধ্যে আমরা একটা স্পষ্ট পার্থক্য করতে পারি। কোদাল, হাতুড়ি ইত্যাদি যা কিছুর চালক-শক্তি মানুষ, তা হল ‘টুল; কিন্তু একটা লাঙল যার চালক-শক্তি পশু, বা উইণ্ড-মিল ইত্যাদি হল ‘মেশিন’ (উইলহেলম শুলৎস, Die Bewegung der produktion”, ১৮৪৩,
৪. তার সময়ের আগেই সুতো কাটার যন্ত্র বেরিয়ে গিয়েছে, যদিও খুবই স্কুল ধরনের। প্রথম আবির্ভাবের স্থান সম্ভবত ইতালি। কৃৎবিজ্ঞানের ইতিহাস খুঁটিয়ে পড়লে জানা যায় আঠারো শতকের উদ্ভাবনগুলির প্রায় কোনটাই একক ব্যক্তির উদ্ভাবন নয়। এখন পর্যন্ত তেমন কানন বই নেই। ডারউইন আমাদের আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন প্রকৃতির কৃৎবিজ্ঞানে অর্থাৎ উদ্ভিদ ও জীবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠনে, যেগুলি জীবনকে পোষণ করার উৎপাদন-উপকরণ হিসাবে কাজ করে। মানুষের উৎপাদনশীল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি—যেগুলি হচ্ছে সমস্ত সামাজিক সংগঠনের বস্তুগত ভিত্তি—সেগুলি কি একই মনোযোগ দাবি করেনা? এবং এমন একটি ইতিহাস সংকলন করা কি সহজ হবে না, কেননা, যেকথা ভিলে বলেছেন, মানবিক ইতিহাসের সঙ্গে প্রাকৃতিক ইতিহাসের পার্থক্য এইখানে যে, আমরা প্রথমটি তৈরি করেছি কিন্তু দ্বিতীয়টি নয়? কৃৎবিজ্ঞান প্রকাশ করে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ক্রিয়া কলাপ-উৎপাদনের প্রক্রিয়া যার দ্বারা সে জীবনকে পোষণ করে, এবং তারা উদ্ঘাটিত করে তার সামাজিক সম্পর্কসমূহের গঠন-প্রণালী এবং, সেই সঙ্গে, তা থেকে গড়ে ওঠা মানসিক ধ্যান-ধারণাসমূহ। ধর্মের প্রত্যেকটি ইতিহাসই, যা এই বস্তুগত ভিত্তিটিকে হিসাবের মধ্যে ধরে না, তা ভাসাভাসা। বস্তুতঃ পক্ষে, জীবনের বাস্তব সম্পর্কসমূহের ভিত্তি থেকে ঐ সমস্ত সম্পর্কের আনুষঙ্গিক ধর্মগত রূপ গড়ে তোলর তুলনায় বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধর্মের সেই কুয়াশাবৃত সৃষ্টিগুলির পার্থিব মর্মবস্তু আবিষ্কার করা অনেক সহজতর। এই পদ্ধতিটিই হল একমাত্র বস্তুবাদী, অতএব, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। প্রকৃতি বিজ্ঞানের অমৃত বস্তুবাদের—যা ইতিহাস এবং তার প্রক্রিয়াকে বাদ দেয়, সেই বস্তুবাদের দুর্বলতাগুলি তার মুখপাত্রদের অমূর্ত ও ভাবাদর্শগত ধ্যান-ধারণা থেকে তখনি প্রকট হয়ে ওঠে, যখনি তারা তাদের বিশেষ পরিধির বাইরে পা বাড়ান।
৫. বিশেষ করে শক্তিচালিত তাঁতের (পাওয়ার লুম’-এর) মূল রূপটির মধ্যে আমরা প্রথম দৃষ্টিতেই চিনতে পারি প্রাচীন আঁতটিকে। শক্তিচালিত তাঁতের আধুনিক আকারে অনেক অদল-বদল ঘটেছে।
৬. কেবল গত ১৫ বছর ধরে ( অর্থাৎ প্রায় ১৮৫০ সাল থেকে), এই মেশিন-টুল গুলির একটি নিরন্তর বর্তমান অংশ ইংল্যাণ্ডে তৈরি হচ্ছে মেশিনারির সাহায্যে এবং তৈরি হচ্ছে সেই ম্যানুফ্যাকচারকারীদের দ্বারা, যারা মেশিন তৈরি করে না। এই সব মেকানিক্যাল টুল তৈরি করার মেশিনের দৃষ্টান্ত স্বয়ংক্রিয় ববিন-মেকিং ইঞ্জিন, ‘কার্ড-সেটিং ইঞ্জিন’, ‘শাটল-মেকিং ইঞ্জিন’ ইত্যাদি।
৭. মোজস বলেন, “যে-বলদ তোমার শস্য মাড়িয়ে দেয়, তুমি তার মুখ বেঁধে দিও না। অন্য দিকে, জার্মানির খ্রীস্টান লোক-হিতৈষীগণ ভূমিদাসের গলা বেড় দিয়ে একটা কাঠের ফলক বেঁধে দিত, যাদের তারা ব্যবহার করত ময়দা-পেষার সঞ্চলক শক্তি হিসাবে; এটা তারা করত যাতে ওরা ওদের হাত দিয়ে মুখের মধ্যে পুরে না দিতে পারে।
৮. একটি মাত্র মোটরের দ্বারা পরিচালিত এই সমস্ত সরল উপকরণের একটি সমষ্টিকে বলা হয় একটি মেশিন। (ব্যাবেজ, ঐ।
৯. ১৮৬১ সালের জানুয়ারি মাসে জন সি মর্টন ‘সোসাইটি অব আর্টস’-এ একটি নিবন্ধ পাঠ করেন, বিষয় ছিল কৃষিকর্মে নিয়োজিত শক্তিসমূহ। সেখানে তিনি বলেন, জমির সমরূপতা বৃদ্ধি করে, এখন প্রত্যেকটি উন্নয়ন বিশুদ্ধ যান্ত্রিক শক্তি উৎপাদনে স্টিম ইঞ্জিনের প্রয়োগ আরো আরো বৃদ্ধি করে। অশ্বশক্তির প্রয়োজন হয় সেখানে, যেখানে এলোমেলো বেড়া ও অন্যান্য বাধা সমরূপতার কর্মকাণ্ডের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এই সমস্ত বাধা দিনে দিনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যথার্থ শক্তির তুলনায় যেখানে ইচ্ছা শক্তির প্রয়োজনই প্রধান সেখানে চাই এমন শক্তি, যাকে প্রতি মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের মন—অর্থাৎ চাই মনুষ্য-শক্তি। তার পরে, মর্টন বাম্প-শক্তি, অশ্ব-শক্তি ও মনুষ্য-শক্তিকে পর্যবসিত করেন ঠিম-ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে প্রচলিত ‘ইউনিট’-এ এবং এই ভাবে হিসাব করে দেখান যে স্কিম-ইঞ্জিন থেকে প্রাপ্ত এক ইউনিট অশ্ব-শক্তি। অশ্ব থেকে প্রাপ্ত এক ইউনিট অশ্বশক্তির তুলনায় সা। তা ছাড়া, যদি একটা ঘোড়ার স্বাস্থ্য অক্ষুন্ন রাখতে হয়, তা হলে তাকে দিয়ে দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যায় না। জমি-চাষের কাজ থেকে প্রতি ৭টি ঘোড়াব মধ্যে অন্তত ৩টিকে বিদায় দিয়ে; সেখানে বাম্প-শক্তি প্রয়োগ করলে ঐ ঘোড়ার জন্য ৩-৪ মাসে যা খরচ হয়, তার সমানই খরচ হবে, আর ৩-৪ মাসের বেশি একটা ঘোড়াকে ফলপ্রসূ ভাবে কাজ করানোও যায় না। সর্বশেষে, যে-সব কৃষিগত কাজকর্মে বাষ্প-শক্তিকে ব্যবহার করা যায়, সেখানে অশ্বশক্তির তুলনায় কাজের গুনমান উন্নততর হয়। একটা সিম-ইঞ্জিনের কাজ করতে লাগবে ঘণ্টা-পিছু ১৬ শিলিং মোট ব্যয়ে ৬৬ জন মানুষ, আর একটা ঘোড়র কাজ করতে লাগবে ঘণ্টা-পিছু ৮ শিলিং মোট ব্যয়ে ৩২ জন মানুষ।
১০. ফাউলহাবার, ডে কজ, ১৬৮।
১১. আধুনিক টার্বাইন জল-শক্তিকে পুরনো অনেক বন্ধন থেকে মুক্ত করেছে
১২. কাপড়ের কলের গোড়ার দিকে কারখানার স্থান নির্ভর করত, কাছেই একটা নদী আছে কিনা এবং তাতে একটা জল-চক্র চালাবার মত গতি আছে কিনা, তার উপরে; এবং যদিও জল-কলের স্থাপনা ম্যানুফ্যাকচায়ের ঘরোয়া পদ্ধতির ভাঙন সুচনা করে; কিন্তু তবু আবশ্যিক ভাবেই নদীর তীরে এবং সাধারণত পরস্পর থেকে দূরে দূরে অবস্থিত এই মিলগুলি সবমিলিয়ে একটা গ্রামীণ পরিবেশই সৃষ্টি করত, শহুরে পরিবেশ নয়; এবং যে পর্যন্ত না বাষ্প-শক্তি নদীর স্থান গ্রহণ করল, সে পর্যন্ত শহরে এবং যেসব জায়গায় বাষ্প উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কয়লা ও জল আছে, সেই সব জায়গায় কারখানার সমাবেশ ঘটল না।” (এ রেভ গ্রেভ, “রিপোর্নস অব দি ইন্ধপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ”, ১৮৬০ পৃ: ৩৬)।
১৩. যান্ত্রিক শিল্পের আগে উল ম্যানুফ্যাকচারই ছিল ইংল্যাণ্ডে প্রধান ম্যানুফ্যাকচার। এই কারণেই ১৮ শতকের প্রথমার্ধে এই শিল্পেই অনুষ্ঠিত হয় সর্বাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। উল থেকে যে অভিজ্ঞতা পাওয়া গেল, তার সুযোগ ভোগ করল তুললা; পরবর্তীকালে। আবার মেশিনারির সাহায্যে তুলো থেকে সুতো কাটা ও কাপড় বোনার কারখানার অনুকরণে গড়ে উঠল ঠিক আগের দশ বছরে উল-ম্যানুফ্যাকচারের বিভিন্ন কাজ, যেমন উল-আঁচড়ানো ইত্যাদি, কারখানা-ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল। “উল-আঁচড়ানো কাজে ‘ম্বিং মেশিন’ প্রবর্তনের ফলে নিঃসন্দেহে অনেক লোক কর্মচ্যুত হল। আগে উল-আঁচজানো হত হাতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্মীর নিজের বাড়িতে। এখন তা সাধারণতঃ আঁচড়ানো হয় কারখানাতেই এবং যে কয়েকটি ক্ষেত্রে হাতের কাজ এখনো উৎকৃষ্ট বলে বেছে নেয়া হয়, সে-ক্ষেত্রগুলি ছাড়া, বাকি জায়গায় মেশিন বসানো হয়েছে। কিছু কিছু হাতে-আঁচড়ানো কর্মী কারখানায় কাজ পেলেও, বেশির ভাগই কাজ হারিয়েছে।” “রিপোর্ট অব ইনিসপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ”, ১৮ ৫৬, পৃঃ ১৬)
১৪. “তা হলে, কারখানা-ব্যবস্থার নীতি হল কারিগরদিগের মধ্যে শ্রম-বিভাজন বা পর্যায়ীকরণের পরিবর্তে একটা প্রক্রিয়াকে তার প্রধান প্রধান অংশে বিভাগীকরণ। (অ্যাণ্ড, উরে “দি ফিলসফি অব ম্যানুফ্যাকচার্স”, ১৮৩৫, পৃঃ ২০।)
১৫. পাওয়ার লুম গোড়ায় তৈরি হত কাঠ দিয়ে, এখন তৈরি হয় লোহা দিয়ে। উৎপাদন-উপকরণগুলির পুরনো আকার তাদের নোতুন আকারকে কটা প্রভাবিত করেছে, তা বোঝা যায় বর্তমান পাওয়ারলুমকে আগেকার পাওয়ারলুমের সঙ্গে, আধুনিক ব্লাস্ট ফানেস-এর হাপরকে পুরনো হাপরের সঙ্গে, এবং আরো জাজ্বল্যমান ভাবে, বর্তমান লোকোমোটিভকে আগেকার লোকোমোটিভ তৈরির প্রচেষ্টার সঙ্গে তুলনা করলে; আগেকার সেই লোকোমোটিভের ছিল দুটি পা, যা ঘোড়ার ভঙ্গিতে পরপর মাটি থেকে উঠত এবং মাটিতে নামত। বল-বিজ্ঞানের প্রভূত অগ্রগতি এবং দীর্ঘ সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ফলেই কেবল শেষ পর্যন্ত একটি মেশিনের আকার স্থিরীকৃত হল বল-বিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে এবং তা মুক্তি পেল তার চিরাচরিত আকারটি থেকে, যা থেকে ঘটেছিল তার উদ্ভব।
১৬. আঠারো শতকের যে-কোনো মেশিনের তুলনায় এলি হুইটনির কটন জেনি’-তে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল সবচেয়ে কম। কেবল গত দশকে (১৮৫৬-র পরে) আরেকজন আমেরিকান, মিঃ এমেরি ( আলবানি, নিউইয়র্ক) একটা সরল অথচ সফল উন্নয়নের মাধ্যমে হুইটনির ‘জেনি’-কে সেকেলে করে দিয়েছেন।
১৭. “দি ইণ্ডাষ্ট্রি অব নেশনস”, ১৮৫৫, পৃঃ ২৩৯; এই বইখানিও মন্তব্য করে : “সরল ও বাইরে থেকে গুরুত্বহীন বলে মনে হলেও, একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে লেদ-এর এই উপাঙ্গটি মেশিনারির উন্নতি ও প্রসার সাধনে যে-প্রভাব বিস্তার করেছে। তা ওয়াট-এর ঠিম-ইঞ্জিনের উৎকর্ষ সাধনের তুলনায় কম নয়। এর প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মেশিনারি নিখুত হয়ে উঠল, সসা হল এবং উদ্ভান ও উন্নয়নের দিকে প্রেরণা সঞ্চারিত হল।
১৮. এই মেশিনগুলির মধ্যে একটি মেশিন ব্যবহৃত হয় ‘প্যাডল-হুইল শ্যাফট ‘পেটাই করার জন্য, নাম “র”। একজন কামার যেমন অনায়াসে একটা ঘোড়ার নাল ‘পেটাই করে, তেমনি অনায়াসেই এই মেশিনটি একটি ১৬৫ টন ‘শ্যাফট’-কে পেটাই করে।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ — মেশিনারি কর্তৃক উৎপন্নদ্রব্যে স্থানান্তরিত মূল্য।
আমরা দেখেছি সহযোগ ও শ্রম-বিভাগ থেকে সঞ্জাত উৎপাদিকা শক্তির জন্য মূলধনের কিছুই ব্যয় হয়না। এইসব শক্তি সামাজিক শ্রমের স্বাভাবিক শক্তি। তেমনি, বাষ্প, জল ইত্যাদির মত প্রাকৃতিক শ%ি গুলি যখন উৎপাদন-প্রক্রিয়াসমূহে প্রযুক্ত হয়, সেগুলির জন্যও কিছু ব্যয় হয়না। কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য মানুষের যেন ফুসফুস প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনি প্রাকৃতিক শওি গুলিকে উৎপাদনশীল ভাবে ব্যবহার করতে হলে তার প্রয়োজন হয় এমন কিছু, যা মানুষের হাতের কাজ। জলের শওি কে কাজে লাগাতে হলে চাই একটি জল-চ, বাষ্পের শক্তিকে কাজে লাগাতে হলে চাই একটি বাম্প-ইঞ্জিন। একবার আবিষ্কৃত হবার পরে, ইলেকট্রিক কারেন্টের ক্ষেত্রে চৌম্বক সুচের বিচ্যুতির নিয়ম, কিংবা যাকে ঘিরে ইলেকট্রিক কারেন্ট আবর্তিত হয়, সেই লৌহের চুম্বকায়নের নিয়ম বাবদে কখনো এক কড়িও ব্যয় হয়না।[১] কিন্তু টেলিগ্রাফ ইত্যাদির কাজে এই নিয়মগুলিকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন হয় একটি ব্যয়বহুল ও সুবিস্তৃত অ্যাপারেটাস। আমরা দেখেছি, মেশিন টুলকে উৎখাত করে না। মানবদেহের একটি ক্ষুদ্রাকৃতি উপকরণ থেকে পরিবর্ধিত ও বহুগুণিত হয়ে টুল মানুষের তৈরি কোন মেকানিজমে পরিণতি লাভ করে। তখন মূলধন শ্রমিককে নিয়োজিত করে একটি হস্তচালিত টুলের সাহায্যে কাজ করবার জন্য নয়, একটি মেশিনের সাহায্যে কাজ করবার জন্য যে মেশিন নিজেই কাজ করায় টুলগুলিকে। অতএব, যদিও এটা প্রথম দৃষ্টিতেই পরিষ্কার যে, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিপুল প্রাকৃতিক শক্তি ও প্রকৃতি-বিজ্ঞানসমূহকে সংযোজিত করে, আধুনিক শিল্প শ্রমের উৎপাদনশীলতাকে অসাধারণ এক মাত্রায় উন্নীত করে, তবু এটা কিন্তু কোন মতেই পরিষ্কার নয় যে, এই বর্ধিত উৎপাদিকা শক্তি ক্রয় করতে লাগে শ্রমের বর্ধিত ব্যয়। যেমন স্থির মূলধনের অন্যান্য প্রত্যেকটি উপাদান, তেমনি মুলধনও নোতুন কোনো মূল্য সৃষ্টি করে না; তা কেবল তার নিজের মূল্যই সেই উৎপন্ন-দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত করে, যে দ্রব্যটির উৎপাদনে তা অংশ গ্রহণ করে। যেহেতু মেশিনের মূল্য আছে এবং, কাজে কাজেই, তা মূল্য স্থানান্তরিত করে উৎপন্ন দ্রব্যে, সেই হেতু উক্ত উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যে মেশিনও হচ্ছে একটি উপাদান। সস্তা হবার বদলে, মেশিনের মূল্য অনুপাতে উৎপন্ন দ্রব্যটি হয় আরো মহার্ঘ। এবং এটা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার যে, হস্তশিল্পে ও ম্যানুফ্যাকচারে ব্যবহৃত উপকরণসমূহের তুলনায় আধুনিক শিল্পের যা বৈশিষ্ট্য সেই মেশিন ও মেশিনারি-রূপ শ্রম-উপকরণসমূহে বিধৃত মূল্য অপরিমেয় ভাবে বেশি।
প্রথমত, এটা লক্ষ্য করতে হবে যে, শ্রম-প্রক্রিয়ায় সব সময়ে অখণ্ড ভাবে। প্রবেশ করলেও কিন্তু মেশিনারি মূল্য-প্রজনন প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে কেবল খণ্ড খণ্ড ভাবে। গড়ে ক্ষয়ক্ষতি বাবদে যে মূল্য সে হারায়, তার চেয়ে বেশি মূল্য সে কখনন যোগ করেনা। সুতরাং একটি মেশিনের মূল্য এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেই মেশিনটি উৎপন্ন দ্রব্যে যে মূল্য স্থানান্তরিত করে—এই দুয়ের মধ্যে থাকে বিশাল পার্থক্য। মেশিনটির আয়ু যত দীর্ঘতর হয়, এই পার্থক্য হয় তত বিরাটতর। এতে কোনো সনেই নেই, যা আমরা আগেই দেখেছি, যে প্রত্যেকটি শ্রম-যন্ত্র শ্রম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে সমগ্র ভাবে, কিন্তু মূল্য-প্রজনন প্রক্রিয়ায় তা প্রবেশ করে কেবলমাত্র টুকরো টুকরো ভাবে দৈনিক ক্ষয়-ক্ষতির গড়পড়তা অনুপাতের হারে। কিন্তু একটা সমগ্র শ্রম-যন্ত্র এবং তার দৈনিক ক্ষয়-ক্ষতির মধ্যে যে পার্থক্য, তা একটি টুল-এর ক্ষেত্রে যতটা, তার থেকে একটি মেশিনের ক্ষেত্রে অনেক অনেক বেশি, কেননা একটি মেশিন তৈরি হয় আরো টেকসই দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে এবং তাই তার আয়ুও হয় আবো দীর্ঘ; কেননা তার নিয়োগ নিয়মিত হয় কঠোর বৈজ্ঞানিক নিয়মাবলীর দ্বারা এবং তাই তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ও তার ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীতে অনেক বেশি মিতব্যয় ঘটে; এবং, কেননা একটি টুলের তুলনায় তার উৎপাদন-ক্ষেত্র বহুগুণ বৃহত্তর। মেশিন ও টুল উভয় ক্ষেত্রেই প্রাত্যহিক খরচের অর্থাৎ দৈনিক গড় ক্ষয়-ক্ষতির দ্বারা যেমূল্য তারা অদের উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত করে, তার জন্য এবং, সেই সঙ্গে তেল, কয়লা ইত্যাদির মত যেসব সহায়ক বস্তু তারা ব্যবহার করে, তার জন্য সংস্থান করার পরে, তারা কাজ করে বিনামূল্যে—ঠিক যেমন করে মানুষের সাহায্য ব্যতিরেকেই প্রকৃতি-প্রদত্ত শক্তিসমূহ। টুলের তুলনায় মেশিনারির উৎপাদনক্ষমতা যত বেশি হয়, ততই টুলের তুলনায় তার বিনামূল্যে কাজের মাত্রাও বেশি হয়। আধুনিক শিল্পেই মানুষ সর্বপ্রথম সক্ষম হল তার অতীত শ্রমের উৎপন্ন ফলকে বিনা মূল্যে বৃহদায়তনে কাজ করাতে, প্রকৃতির শক্তিসমূহেরই মত।[২]
সহযোগ ও ম্যানুফ্যাকচার সম্পর্কে আলোচনাকালে দেখানো হয়েছিল যে, বিচ্ছিন্ন শ্রমিকের বিক্ষিপ্ত উৎপাদন-উপায়সমূহের তুলনায় বাড়ি-ঘরের মত উৎপাদনের কয়েকটি সাধারণ উপকরণ যৌথ-ব্যবহার-জনিত মিতব্যয়ের ফলে সস্তা হয়ে যায়। মেশিনারি-ব্যবস্থায়, কেবল মেশিনটির কাঠামোটিই যে অপারেটিং উপকরণসমুহের দ্বারা যৌথ ভাবে ব্যবহৃত হয়, তাই নয়, সেই সঙ্গে ট্রান্সমিটিং মেকানিজম-এর একটা অংশ সমেত খোদ প্রাইমমুভারটিও যৌথ ভাবে ব্যবহৃত হয় বহুসংখ্যক অপারেটিভ মেশিনের দ্বারা।
মেশিনারির মূল্য এবং একদিনে ঐ মেশিনারি তার উৎপন্ন দ্রব্যে যে মূল্য স্থানান্তরিত করে, সেই মূল্য-এই দুটি মূল্যের মধ্যে পার্থক্য নির্দিষ্ট থাকলে, এই শেষোক্ত মূল্যটি উক্ত উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যে কতটা বৃদ্ধি ঘটায়, তা নির্ভর করে প্রথমত, উৎপন্ন দ্রব্যটির আকারের উপরে, বলা যায়, তার আয়তনের উপরে। ম্যাকর্ণের মিঃ বেনেস ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত তাঁর এক বক্তৃতায় হিসাব দিয়েছেন যে প্রত্যেকটি যথার্থ অশ্বশক্তি চালিত করবে প্রস্তুতি-সমেত ৪৫০টি স্বয়ংক্রিয় ‘মিউল স্পিন্ডল’, কিংবা ২০ টি খুশল শিগুল’, কিংবা ‘ওয়ার্নিং’ ও ‘সাইজিং’-এর ‘অ্যাপ্লায়েন্স ইত্যাদি সমেত ৪. ইঞ্চি কাপড়ের ৬৫টি আঁত।” প্রথম ক্ষেত্রে এটা হল ৪৫টি মিউল ম্পিগুলের সারা দিনের উৎপাদন, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ২০ টি খুশল স্পিগুলের, তৃতীয় ক্ষেত্রে ১৫টি পাওয়ারলুমের-যেগুলির উপরে বিস্তৃত হয় একটি অশ্বশক্তির এবং সেই শক্তি-চালিত মেশিনারির ক্ষয়-ক্ষতির দৈনিক খরচ; সুতরাং এক পাউণ্ড সুতোয় বা এক গজ কাপড়ে এই ক্ষয়-ক্ষতির দ্বারা স্থানান্তরিত হয় অতি ক্ষুদ্র-পরিমাণ মূল্য। উপরে বর্ণিত ষ্টিম-হামার সম্পর্কেও এই একই ঘটনা। যেহেতু সেটির দৈনিক ক্ষয় ক্ষতি, কয়লা-খরচ ইত্যাদি বিস্তৃত হয় গোটা দিনে সেটি যে বিরাট বিরাট লৌহপিণ্ড পেটায়, সবগুলির উপরে; সেই হেতু এক হব লোহা পিছু যুক্ত হয় খুবই সামান্য পরিমাণ মূল্য, কিন্তু ঐ সাইক্লোপিয়ান যন্ত্রটিকে যদি পেরেক ঢোকানোৱ কাজে ব্যবহার করা হয়, তা হলে মূল্য হত খুবই বিরাট।
যদি একটি মেশিনের কাজের সক্ষমতা অর্থাৎ তার অপারেটিং টুলগুলির সংখ্যা, অথবা যখন এটা বলের প্রশ্ন, তখন যদি সেগুলির ‘ভর নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে তার উৎপন্নের পরিমাণ নির্ভর করবে তার কর্মসাধক অংশগুলির উপরে, যেমন শিগুলগুলির বেগের উপর, কিংবা এক মিনিটে হ্যামার কতগুলি আঘাত হানতে পারে তার উপরে। এই অতিকায় হাতুড়িগুলির মধ্যে এমন অনেক কটি আছে, যেগুলি প্রতি মিনিটে ৭০ বার আঘাত হানতে পারে, এবং ঘোট ঘোট হাতুড়ি দিয়ে স্পিণ্ডল তৈরির জন্য রাইডারের পেটেন্ট-করা মেশিনটি প্রতি মিনিটে হানতে পারে ৭০০ আঘাত।
যে হারে মেশিনারি তার মূল্য উৎপন্ন দ্রব্য স্থানান্তরিত করে, সেই হারটি যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে এইভাবে স্থানান্তরিত মূল্যের পরিমাণ নির্ভর করে মেশিনারিটির মোট মূল্যের উপরে। [৪] তা যত কম মূল্য ধারণ করে, উৎপন্ন দ্রব্যে তত কম মূল্য তা সঞ্চারিত করে। যত কম মূল্য তা পরিত্যাগ করে, ততই তা অধিকতর উৎপাদনশীল হয় এবং ততই তার অবদান প্রাকৃতিক শক্তিগুলির অবদানের অনুরূপতা লাভ করে। কিন্তু মেশিনারির দ্বারা মেশিনারির উৎপাদন তার সম্প্রসারণ ও ফল
প্রসবের সঙ্গে তুলনামূলক ভাবে তার মূল্যের হ্রাস ঘটায়।
হস্তশিল্প বা ম্যানুফ্যাকচারের দ্বারা উৎপাদিত পণ্যসমূহের দাম এবং মেশিনারি দ্বারা উৎপাদিত সেই একই পণ্যসমূহের দাম যদি বিশ্লেষণ ও তুলনা করা যায়, তা হলে সাধারণত দেখা যায় যে, মেশিনারি-দ্বারা উৎপাদিত পণ্যদ্রব্যে শ্রমের উপকরণ জনিত মূল্য আপেক্ষিত ভাবে বৃদ্ধি পায়, কিন্তু অপেক্ষিক ভাবে হ্রাস পায়। অন্য ভাবে বলা যায় যে, তার অনাপেক্ষিক পরিমাণ হ্রাস পায়, কিন্তু উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর, যথা এক পাউণ্ড সুতোর, মোট মূল্যের সঙ্গে আপেক্ষিক ভাবে তার সামগ্রীর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।[৫]
এটা স্পষ্ট যে, একটি মেশিন তৈরি করতে যে-পরিমাণ শ্রম ব্যয় হয়, ঐ মেশিনটি নিয়োগ করলে যদি সেই পরিমাণ এমই বাঁচে, তা হলে কেবল শ্রমের অবস্থান বিনিময়ই ঘটে; কাজে কাজেই, একটি পণ্য উৎপাদনে যে-মোট শ্রম দরকার হয়, তার হ্রাস ঘটেনা অথবা শ্রমের উৎপাদনশীলতারও বৃদ্ধি ঘটে না। যাই হোক, এটা পরিষ্কার যে, একটি মেশিন যে-পরিমাণ শ্রম লাগায় এবং যে-পরিমাণ শ্রম বাঁচায় —এই দুয়ের মধ্যেকার পার্থক্য, অর্থাৎ তার নিজের উৎপাদনশীলতা তার নিজের মূল্য এবং যে-উপকণের স্থান সে গ্রহণ করে তার মূল্য—এই দুয়ের পার্থক্যের উপরে নির্ভর করেনা। যে পর্যন্ত একটি মেশিনের উপরে ব্যয়িত শ্রম অর্থাৎ উৎপন্ন দ্রব্যের সঙ্গে সংঘোজিত মূল্যাংশ শ্রমিক তার টুলের সাহায্যে উৎপন্ন দ্রাব্য যে-মূল্য সংযোজিত করে, তার তুলনায় অল্পতর থাকে, সে পর্যন্ত সব সময়েই মেশিনারির অনুকূলে কিছু পরিমাণ বেঁচে-যাওয়া শ্রমের পার্থক্য থেকে যায়। সুতরাং কত পরিমাণ মানবিক শ্রমশক্তির স্থান একটি মেশিন গ্রহণ করে তার দ্বারাই মাপা হয় একটি মেশিনের উৎপাদনশীলতা। মিঃ বেনেস-এর হিসাব অনুসারে, প্রস্তুতিমূলক মেশিনারি সমেত[৬] একটি অশ্বশক্তিচালিত ৪৫টি মিউল-ম্পিগুলের জন্য লাগে ২৪ জন শ্রমিক; ফশ ঘণ্টা কাজ করে প্রত্যেকটি স্বয়ংক্রিয় মিউল-স্পিণ্ডল ১৩ আউন্স সুতো (খুলত্বে গড় সংখ্যা ফলত, ২৫ জন শ্রমিক সপ্তাহে উৎপাদন করে ৩৬৫৪ পাউণ্ড সুলতা। সুতরাং ঝরতি-পড়তি বাদ দিয়ে ৩৬৬ পাউণ্ড তুলো সুতোয় রূপান্তরিত হবার সময়ে কেবল ১৫০ ঘণ্টার শ্রম বা বোজ দশ ঘণ্টা হিসাবে ১৫ দিনের শ্রম আত্মসাৎ করে। কিন্তু এক ‘স্পিনিং হুইল দিয়ে একজন হাতে সুতোকটুনি ষাট ঘণ্টায় ১৩ আউন্স সুতো কাটলে, ঐ একই পরিমাণ তুলো আত্মসাৎ করবে ১০ ঘণ্টা বোজ হিসাবে ২,৮০০ দিনের শ্রম বা ২৭,০০০ ঘণ্টার শ্রম। [৭] যেখানে হাত দিয়ে ক্যালিকো ছাপানোর পুরনো পদ্ধতির, ব্লক-প্রিন্টিং পদ্ধতির স্থান নিয়েছে মেশিন-প্রিন্টিং, সেখানে একজন লোকের বা বালকের সাহায্যে একটি মাত্র মেশিন ছাপায় এক ঘণ্টার চার রঙের ততটা পরিমাণ ক্যালিকো, যতটা ছাপাতে আগে লাগত ২০০ জন মানুষ।[৮] ১৭৯৩ সালে এলি হুইটনি কটন জিন’ উদ্ভাবন করার পূর্বে এক পাউণ্ড তুলো থেকে তুলাবীজ আলাদা করতে লাগত একটি গল্প দিনের শ্রম। তার উদ্ভাবনের সাহায্যে একটি নিগ্রো-মজুরানি পরিষ্কার করতে পারত প্রতিদিন ১০০ পাউণ্ড করে; এবং তার পর থেকে ‘জিন’-এর আরো ঢের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। এক পাউণ্ড তুলো-পশম আগে উৎপাদন করতে খরচ হত ৫ সেন্ট; ঐ মেশিন উদ্ভাবনের পরে তা অন্তর্ভূক্ত করে অধিকতর পরিমাণ মজুরি-বঞ্চিত শ্রম এবং স্বভাবতই বিক্রি হয় অধিকতর মুনাফায়, ১ সেন্টে। ভারতে লোকেরা পশম বীজ আলাদা করার জন্য একটি যন্ত্র ব্যবহার করে, নাম ‘চরকা’, যা অর্ধেক মেশিন;অর্ধেক টুল; এই চরকার সাহায্যে একজন পুরুষ ও একজন নারী দৈনিক ছাড়াতে পারে ২৮ পাউণ্ড পশম। কয়েক বছর আগে ডঃ ফরবেস কর্তৃক আবিষ্কৃত চরকার সাহায্যে একজন মানুষ ও একটি বালক এখন প্রত্যহ উৎপাদন করতে পারে ২৫০ পাউণ্ড করে। যদি সেটি চালাবার জন্য ষাড়, বাষ্প বা জল ব্যবহার করা হয়, তা হলে কেবল কয়েকটি বালক-বালিকার দরকার হয় যোগানদার হিসাবে। আগে ৭৫০ জন মানুষ দিনে গড়ে যে-পরিমাণ কাজ করত, এখন এই ধরনের ষণ্ডালিত ১৬টি মেশিন সেই কাজ করে।[৯]
যে কথা আগেই বলা হয়েছে, ১৫ শিলিং খরচে ৬৬ জন লোক যে কাজ করত, এখন তিন পেনি খরচে একটি বাষ্পচালিত লাঙল সেই একই কাজ করে। একটি ভ্রান্ত ধাধণা পরিষ্কার করার জন্য আমি আর এই দৃষ্টান্তটিতে ফিরে আসছি। ৩৬ জন লোক একঘণ্টায় যে মোট শ্রম ব্যয় করে, এই ১৫ শিলিং কোনমতেই সেই সমগ্র শ্রমের অর্থগত (টাকার অঙ্কে ) অভিব্যক্তি নয়। যদি আবশ্যিক শ্রমের সঙ্গে উদ্বৃত্ত শ্রমের অনুপাত হয় ১০০%, তবে এই ৬৬ জন লোক এক ঘণ্টায় উৎপাদন করবে ৩০ শিলিং পরিমাণ মূল্য, যদিও তাদের মজুরি হিসাবে প্রাপ্ত ১৫ শিলিং প্রতিনিধিত্ব করে মাত্র তাদের অর্থ ঘণ্টার শ্রমের। তা হলে ধরুন, একটি মেশিন ১৫০ জন লোকের স্থান গ্রহণ করে এবং তার মূল্য পড়ে এই ১৫ জন লোকের এক বছরে যা মজুরি তার সমান, ধরা যাক ৩০০ পাউণ্ড; মেশিনটি প্রবর্তনের পূর্বে ১৫০ জন লোক, সংশ্লিষ্ট সামগ্রীতে যে-পরিমাণ শ্রম সংযোজিত করত, এই ৩০০০ পাউণ্ড কিন্তু কোন মতেই তার সমগ্রটার অর্থগত অভিব্যক্তি নয়, কেবল সেই অংশের অর্থগত অভিব্যক্তি, যে অংশটি তারা ব্যয় করে নিজেদের জন্য এবং প্রকাশ পায় তাদের মজুরি হিসাবে। অপর পক্ষে, ঐ ৩০০০ পাউণ্ড, যা হল ঐ মেশিনটির অর্থমূল্য তা কিন্তু প্রতিনিধিত্ব করে তার উৎপাদনে ব্যয়িত শ্রমের সমগ্র“এই শ্রম কোন্ অনুপাতে শ্রমিকের জন্য মজুরি এবং ধনিকের জন্য উদ্ধত মূল্যের সংস্থান করে, তাতে কিছু এসে যায় না। অতএব যদিও যতটা শ্রমশক্তিকে একটি মেশিন স্থানচ্যুত করে তার বাবদে ব্যয় এবং মেশিনটির বাবদে ব্যয় সমান, তা হলেও যে-পরিমাণ জীবন্ত শ্রমের স্থান সে গ্রহণ করে তার তুলনায় তার মধ্যে বাস্তবায়িত শ্রম অনেক অনেক কম। [১০]
একমাত্র উৎপন্ন দ্রব্যকে সস্তা করার জন্যই মেশিনারির ব্যবহার এইভাবে সীমাবদ্ধ : ঐ মেশিনারি নিয়োগের ফলে যে-পরিমাণ শ্রম স্থানচ্যুত হয়, এটি তৈরি করতে তার তুলনায় কম পরিমাণ শ্রম ব্যয় করতে হবে। ধনিকের ক্ষেত্রে, অবশ্য, মেশিনের ব্যবহার আরো সীমাবদ্ধ। শ্রমের জন্য মূল্য না নিয়ে, সে কেবল দিয়ে থাকে নিয়োজিত শ্রম শক্তির মূল্য; সুতরাং মেশিন ব্যবহারে তার সীমা নির্দিষ্ট হয় মেশিনটির মূল্য এবং তার দ্বারা স্থানচ্যুত শ্রমশক্তির মূল্য—এই দুয়ের পার্থক্যের দ্বারা। যেহেতু আবশ্যিক ও উদ্বৃত্ত শ্রমে দৈনিক কাজের ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন রকমের, এবং এমনকি একই দেশে ভিন্ন ভিন্ন শিল্প-শাখায় ভিন্ন ভিন্ন রকমের এবং যেহেতু শ্রমিকের সত্যকার মজুরি এক সময়ে তার শ্রমশক্তির নীচে নেমে যায়, অন্য সময়ে তার উপরে উঠে যায়, সেহেতু মেশিনারির নাম এবং মেশিনারি দ্বারা স্থানচ্যুত শ্রমশক্তির দামের মধ্যকার পার্থক্যে বড় রকমের হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে, যদিও উক্ত মেশিনটি তৈরি করতে প্রয়োজনীয় শ্রমের পরিমাণ এবং তার দ্বারা স্থানচ্যুত মোট পরিমাণের মধ্যকার পার্থক্য স্থিরই থাকে।[১১] কিন্তু ধনিকের কাছে একমাত্র পূর্ববর্তী পার্থক্যটিই একটি পণ্য উৎপাদনের খরচ নির্ধারণ করে দেয় এবং প্রতিযোগিতার চাপের মাধ্যমে, তার কাজকে প্রভাবিত করে। এই কারণেই আজকাল মেশিনের আবিষ্কার হয় ইংল্যাণ্ডে, যার নিয়োগ হয় একমাত্র উত্তর আমেরিকায়; ঠিক যেমন ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে একমাত্র হল্যাণ্ডে ব্যবহৃত হবার জন্যই মেশিনের আবিষ্কার হত জার্মানিতে এবং ঠিক যেমন অষ্টাদশ শতকে অনেকগুলি ফরাসী আবিষ্কারই প্রয়োগ করা হত একমাত্র ইংল্যাণ্ডে। প্রবীণতর দেশগুলিতে বিভিন্ন শিল্প-শাখায় নিযুক্ত হয়ে মেশিনারি বাকি শিল্প শাখাগুলিতে এমন শ্রম-বাহুল্যের সৃষ্টি করে যে, সেগুলিতে মজুরি পড়ে যায় শ্রমশক্তির মূল্যেরও নীচে এবং ব্যাহত করে মেশিনারির প্রবর্তন; ধনিকের মুনাফা আসে নিয়োজিত শ্রমের হ্রাস-প্রাপ্তি থেকে নয়, আসে মজুরি-প্রদত্ত শ্রম থেকে; তার পক্ষে, মেশিনারির প্রচলন হয়ে ওঠে অনাবশ্যক, এমনকি, অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভবও। ইংল্যাণ্ডে কতকগুলি উল-ম্যানুফ্যাকচারে শিশুদের নিয়োগ সাম্প্রতিক কালে বেশ কমে গিয়েছে, এবং কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে। কেন? কারণ কারখানা-আইন দু-প্রন্ত শিশুর নিয়োগ আবশ্যক করে তুলেছে—এক প্ৰস্ত কাজ করবে ছয়-ঘণ্টা, অন্য প্রস্ত চার ঘণ্টা অথবা দুটি প্রান্তের প্রতিটিই পাঁচ ঘণ্টা। কিন্তু ফুলটাইমারদের তুলনায় “হাফ-টাইমার”-দের সস্তায় বেচে দিতে বাপ-মায়েরা অস্বীকার করে। এই কারণেই “হাফ-টাইমার”-দের বদলে মেশিনারির প্রবর্তন।[১২] নারী ও দশ বছরের কম বয়স্ক শিশুদের খনিতে নিয়োগ নিষিদ্ধ হবার আগে ধনিকেরা নগ্ন নারী ও বালিকাদের, অনেক সময়ে পুরুষদের সঙ্গে, কর্ম-নিয়োগকে তাদের নীতিবোধের পক্ষে, এবং, বিশেষ করে, হিসাব খাতার পক্ষে এত অনুকূল মনে করত যে, কেবল উল্লিখিত আইনটি পাশ হবার পরেই তারা মেশিনারির শরণ নিতে বাধ্য হয়। ইয়াঙ্কির একটি পাথর-ভাঙা মেশিন উদ্ভাবন করেছে। ইংরেজরা সেটা ব্যবহার করে না, কেননা যে “বেচারা”[১৩] এই কাজটা করে, সে তার শ্রমের এত সামান্য অংশের জন্য পয়সা পায় যে তার বদলে মেশিনারি লাগালে ধনিকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। [১৪] ইংল্যাণ্ডে এখনো মাঝে মাঝেই ঘোড়ার বদলে মেয়েদের ব্যবহার করা হয়, খাল দিয়ে নৌকা টেনে নেবার জন্য[১৫], কেননা ঘোড়া বা মেশিন উৎপাদন করতে যে শ্রমের দরকার হয়, তা একটি সুপরিজ্ঞাত রাশি, কিন্তু উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার মেয়েদের খোরপোষের জন্য যা দরকার হয় তা গণনার মধ্যেও আসে না। এই কারণেই, সবচেয়ে জঘন্য উদ্দেশ্যে মানুষের শ্রমশক্তিকে অপচয় করার এমন ন্যক্কারজনক পরিস্থিতি আমরা আর কোথাও দেখিনা, যেমন দেখি ইংল্যাণ্ড-মেশিনারির দেশ এই ইংল্যাণ্ডে।
————
১. সাধারণ ভাবে বলা যায়, বিজ্ঞানের জন্য ধনিককে কিছু খরচ করতে হয় না, কিন্তু তাই বলে বিজ্ঞানকে শোষণ করতে তার আদৌ বাধে না। অন্যের শ্রমের মত অন্যের বিজ্ঞানও সে দখল করে নেয়। বিজ্ঞানেরই হোক বা বৈষয়িক সম্পদেরই হোক-ধনতান্ত্রিক আত্মীকরণ এবং ব্যক্তি হিসাবে আত্মীকরণ কিন্তু দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। মিঃ উরে নিজেই তার প্রিয় মেশিনারি-নিয়োগকারী ম্যানুফ্যাকচারদের মধ্যে যান্ত্রিক বিজ্ঞান সম্পর্কে নিরেট অজ্ঞতার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আর ইংরেজ কেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারারদের মধ্যে কেমিস্ট্রি সম্পর্কে আশ্চর্যজনক অজ্ঞতা সম্পর্কে লাইবিগ তো একটা কাহিনীই বলতে পারেন।
২. মেশিনারির এই ফলটির উপরে রিকার্ডো এখানে এত গুরুত্ব আরোপ করেন যে, মেশিনের দ্বারা উৎপন্ন দ্রব্যে যে-মূল্য অপিত হয়, সেটার প্রতি নজর দিতে তিনি প্রায়ই ভুলে যান এবং এই ভাবে মেশিনকে প্রাকৃতিক শক্তিগুলির মত একই স্থান দান করেন। প্রাকৃতিক শক্তিসমূহ এবং মেশিনারি আমাদের জন্য যে কাজ দেয়, অ্যাডাম স্মিথ কখনো তার মূল্য ছোট করে দেখাননি, কিন্তু তারা পণ্য-সামগ্রীতে যে মূল্য। সংযোজন করে, তার প্রকৃতি তিনি খুব সঙ্গত ভাবেই বিশেষিত করেন”যেহেতু তারা তাদের কাজ করে মুফতে, সেই হেতু তাদের প্রদত্ত সাহায্য বিনিময়ে মুল্যের সঙ্গে কিছুই যুক্ত করে না। রিকার্ডো, “প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি অ্যাণ্ড ট্যাক্সেশন” পৃঃ ৩৩৬, ৩৩৭। রিকার্ভোর এই মন্তব্য অবশ্যই সেই পর্যন্ত সঠিক, যে পর্যন্ত তা জে বি সে’র বিরুদ্ধে পরিচালিত, যিনি ভাবেন যে, মেশিন সেই মূল্য সৃজনের কাজ দেয়, “মুনাফার অংশবিশেষ।
৩. একটি অশ্বশক্তি প্রতি মিনিটে ৩,০০০ ফুট-পাউণ্ডের শক্তির সমান, কিংবা রে শক্তি এক মিনিটে ৩৩,০০০ পাউণ্ড এক ফুট উত্তোলন করে অথবা এক পাউণ্ড ৩৩,০০০. ফুট তার সমান। এই গ্রন্থে এই অর্থেই অশ্বশক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। চলতি ভাষায়, এবং এই গ্রন্থেও. এখানে সেখানে উদ্ধৃতির মধ্যে একই ইঞ্জিনের নামীয়” এবং “বাণিজ্যিক কিংবা “নির্দেশিত” অশ্বশক্তির মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। পুরনো বা নামীয় অশ্বশক্তি গণনা করা হয় একান্ত ভাবেই পিস্টন-স্ট্রোকের দৈর্ঘ্য, এবং সিলিণ্ডারের ব্যাস থেকে, এবং বাষ্পের চাপ এবং পিস্টনের বেগকে বাইরে রাখে। কার্যত তা বোঝায় এই এই ইঞ্জিনটি হবে ৫০ অশ্বশক্তিসম্পন্ন, যদি তা বুলটন এবং ওয়াট-এর দিনের মত সেই একই নিয় বাষ্প-চাপে ও একই মন্থর পিস্টন-বেগে চালানো হয়। কিন্তু এই চাপ ও বেগ পরবর্তী কালে অনেক বেড়ে গিয়েছে। একটি ইঞ্জিন যে-যান্ত্রিক শক্তি আজ খাটায়, তাকে মাপবার জন্য একটি নির্দেশক” উদ্ভাবিত হয়েছে, যা সিলিণ্ডারের গায়ে চাপ নির্দেশ করে। পিস্টনের বেগ তত সহজেই জানা যায়। এই ভাবে একটি ইঞ্জিনের নির্দেশিত” বা “বাণিজ্যিক” অশ্বশক্তি প্রকাশিত হয় একটি বাণিজ্যিক ‘ফমূলা’র দ্বারা, যার মধ্যে যুগপৎ অন্তর্ভূক্ত সিলিণ্ডারের ব্যাস, স্ট্রোকের দৈর্ঘ্য, পিস্টনের বেগ, বাম্পের চাপ এবং তা প্রকাশ করে ৩৩,০০০ পাউণ্ডের কত গুণিতক ইঞ্জিনটির দ্বারা এক মিনিটে উভোলিত হয়। সুতরাং একটি নামীয়” অশ্বশক্তি খাটাতে পারে তিন, চার, বা এমনকি, পাঁচটি নির্দেশিত” বা “বাস্তব” অশ্বশক্তি। পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলিতে যা যা বলা হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করার জন্য এই ব্যাখ্যাটি যোগ করা হল। এফ, এঙ্গেলস।
৪. যে-পাঠক ধনতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার দ্বারা আচ্ছন্ন, তিনি এখানে স্বভাবতই “সু”-এর অভাব লক্ষ্য করবেন—যা মেশিন, তার মূলধন-মূল্যের অনুপাতে, উৎপন্ন সামগ্রীতে সংযোজিত করে। কিন্তু এটা সহজেই বোঝা যায় যে, যেহেতু মেশিন স্থির মূলধনের অন্য কোন অংশ ছাড়া, কোন নোতুন মূল্য সৃষ্টি করে না, সেই হেতু “সুদ” নামে কোনো মূল্য তা সংযোজিত করতে পারে না। এটাও স্পষ্ট যে, যেখানে আমরা। উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন নিয়ে আলোচনা করছি, সেখানে আমরা আগে ভাগেই সুদ” এই নামের অধীনে মূল্যের কোনো অংশের অস্তিত্বকে ধরে নিতে পারি না। ধনতান্ত্রিক গণনা-পদ্ধতি, যা আপাত দৃষ্টিতেই আজগুবি এবং মূল্য-সৃষ্টির নিয়মের পরিপন্থী বলে মনে হয়, তা পরবর্তী খণ্ডে ব্যাখ্যা করা হবে।
৫. মূল্যের এই যে অংশ, যা মেশিনারির দ্বারা সংযোজিত হয়, তা অনাপেক্ষিক এবং আপেক্ষিক উভয় ভাবে হ্রাস পায়, যখন মেশিনারি ঘোড়া ও অন্যান্য পশুকে বিদায় করে দেয়—যারা কেবল সঞ্চলনের শক্তি হিসাবেই কাজ করে, বস্তুর রূপ-পরিবর্তন ঘটাবার জন্য মেশিন হিসাবে কাজ করে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দেকার্তে যখন পশুকে বর্ণনা করেন কেবল মেশিন হিসাবে, তখন তিনি দেখেছিলেন ম্যানুফ্যাকচারিং যুগের চোখ দিয়ে, অন্য দিকে, মধ্যযুগের চোখে পণ্ড হল মানুষের সহকারী। দেকার্তে যে বেকনের মত, পরিবর্তিত চিন্তা-পদ্ধতির ফলে, উৎপাদনের রূপে একটি পরিবর্তন এবং প্রকৃতির উপরে মানুষের কার্যতঃ প্রাধান্য-স্থাপনের কথা আগে থেকেই দেখতে পেয়েছিলেন, তা তার “Discours de la Methode থেকেই পরিষ্কার। সেখানে তিনি বলেছেন, “l est possible (by the methods he introduced in philosophy ) de parvenir a des connaissances fort utiles a la vie, et qu’au lieu de cette philosophie speculative qu’on enseigne dans les ecoles, on en peut trouver une pratique par laquelle, connaissant la force et les actions du feu, de l’eau, de l’air, des astres, et de tous les autres corps qui nous environnent, aussi distinctement que nous connaissons les divers metiers de nos artisans, nous les pourrions employer en meme facon a tous les usages auxquels ils sont propres, et ainsi nous rendre comme maitres et possesseurs de la nature and thus “contrubuer au perfectionnement de la vie huniaine”. স্যার ডাডলি নর্থ-এর “ক্সিকোর্সেস আপন ট্রেড” (১৬৯১)-এর ভূমিকায় বলা হয়েছে, দেকার্তের পদ্ধতি স্বর্ণ, বাণিজ্য ইত্যাদি সম্পর্কে পুরনো গল্পকথা ও কুসংস্কার থেকে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বকে মুক্ত করতে শুরু করেছিল। মোটামুটি ভাবে কিন্তু প্রথম দিককার ইংরেজ অর্থতাত্ত্বিকেরা তাঁদের দার্শনিক হিসাবে বেকন এবং হবস-এর পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, যদিও পরবর্তী কালে ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স ও ইতালিতে অর্থতত্ত্বের মুখ্য দার্শনিক হয়েছিলেন লক।
৬. এসেন বণিক সমিতির বাৎসরিক রিপোর্ট ( ১৮৬৩) অনুসারে ১৮৬২ সালে, ১৬১টি ফানেস, ৩২টি টিম-ইঞ্জিন ( ১৮০০ সালে ম্যাঞ্চেস্টারে কর্মরত সমস্ত কিম-ইঞ্জিন গুলির সংখ্যার প্রায় সমান ), ১৪টি স্টিম-হ্যামার। মোট ১,২৩৬ অশ্বশক্তি প্রতিস্থাপন), ৪৯টি কামারশালা, ২০৩টি টুল-মেশিন এবং প্রায় ২,৪০০ শ্রমিক সমন্বিত কূপ-এর কাস্ট আয়রণ কারখানায় উৎপন্ন হয়েছিল ১ কোটি ৩০ লক্ষ পাউণ্ড কাস্ট-আয়রণ। এখানে প্রত্যেকটি অশ্বশক্তি-পিছু দুজন করে শ্রমিক নয়।
৭. ব্যাবেজ-এর হিসাব অনুযায়ী সুতোকাটুনি মই একক ভাবে তুলোর মূল্যে সংযোজিত করে শতকরা ১১৭ ভাগ। একই সময়ে (১৮৩২), মিহি সুতো কাটার শিল্পে মেশিনারি ও শ্রমের দ্বারা তুলোয় সংযোজিত মোট মূল্য ছিল শতকরা ৩৩ ভাগ। (“অন দি ইকনমি অব মেশিনারি, পৃ ১৬৫, ১৬৬)।
৮. মেশিনে মুদ্রণের ফলে রঙেরও সাশ্রয় ঘটে।
৯. ‘সোসাইটি অব আর্টস’-এর সমক্ষে ভারত সরকারের রিপোটার ও ওয়াটসন কর্তৃক পঠিত প্রতিবেদন, ১৭ই এপ্রিল, ১৮৬০।
১০. এই সকল নীরব প্রতিনিধিরা (মেশিনসমূহ) যত সংখ্যক শ্রমিককে স্থানচ্যুত করে তার চেয়ে কম স’খ্যক শ্রমিকের দ্বারা সর্বসময়ে প্রস্তুত হয়, এমনকি যখন তাদের অর্থ-মূল্য একই থাকে। (রিকার্ডো প্রিন্সিপ লস অফ পলিটিক্যাল ইকনমি, সি পৃঃ ৪০)
১১. সুতরাং একটি বুর্জোয়া সমাজে মেশিনারি নিয়োগের যে অবকাশ ঘটে, তা থেকে একটি কমিউনিস্ট সমাজে তার অবকাশ ঘটবে খুবই ভিন্ন প্রকারের।
১২. “শ্রমের নিয়োগকর্তারা অযথা ১৩ বছরের কম বয়সী দু প্রন্ত শিশুকে বহাল রাখবেন না। বস্তুতঃ পক্ষে এক শ্রেণীর ম্যানুফ্যাকচারার এখন কদাচিৎ ১৩ বছরের কম-বয়সী শিশুদের অর্থাৎ হাফ-টাইমারদের নিয়োগ করে। তারা নানান ধরনের উন্নত প্রকারের মেশিন প্রবর্তন করেছে, যার ফলে শিশু-নিয়োগ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। (১৩ বছরের কম বয়সী) নমুনা হিসাবে আমি শিশুসংখ্যা-হ্রাসের একটি প্রক্রিয়ার কথা বলব, যে-প্রক্রিয়ায় একটি মাত্র মেশিন-পিসিং মেশিন’—চার থেকে ছ’জন হাফ-টাইমারের কাজ একজন তরুণ ( ১০ বছরের বেশি বয়সী) করতে পারে। ‘হাফ-টাইম’ ব্যবস্থা ‘পিসিং মেশিন’-এর উদ্ভাবনে “প্রেরণা যুগিয়েছে”। (রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর ১৮৫৫)
১৩. “বেচারা” (“রেচ”) কথাটা ইংরেজ রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বে কৃষি-মজুরকে বোঝতে ব্যবহৃত একটি স্বীকৃত শব্দ।
১৪. “শ্রম ( তিনি বোঝাতে চাইছেন মজুরি) না বাড়া পর্যন্ত মেশিনারি ঘন ঘন খাটানো যায় না।” ( রিকার্ডো, প্রিন্সিপল অব পলিটিক্যাল ইকনমি, পৃঃ ৪৭৯)।
১৫. “রিপোর্ট অব দি সোশ্যাল সাইন্স কংগ্রেস, এবি, ১৮৬৩” দ্রষ্টব্য।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ — শ্রমিকের উপরে মেশিনারির প্রত্যক্ষ ফলাফল।
আমরা দেখেছি, আধুনিক শিল্পের সূচনা-বিন্দু হচ্ছে শ্রমের উপকরণে বিপ্লব, এবং এই বিপ্লব তার সর্বোচ্চ বিকশিত রূপ অর্জন করে একটি কারখানায় মেশিনারির সংগঠিত ব্যবস্থায়। কেমন করে মানবিক সামগ্রী এই বাস্তব সংগঠনটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়, সে সম্পর্কে অন্বেষণের পূর্বে আমরা বিবেচনা করব স্বয়ং শ্রমিকের উপরে এই বিপ্লবের কয়েকটি সাধারণ ফলাফল।
ক মূলধন কর্তৃক পরিপূরক শ্রমশক্তির ব্যবহার নারী ও শিশুদের কর্মে নিয়োগ।
যতদূর পর্যন্ত মেশিনারি পেশী-শক্তিকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলে, ততদূর পর্যন্ত তা ক্ষীণবল পেশী-শক্তিসম্পন্ন শ্রমিকদের এবং দৈহিক বিকাশের দিক থেকে অসম্পূর্ণ, এবং সেই কারণেই যাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আরো নমনীয়, তাদের কর্ম সংস্থানের একটি উপায় হয়ে ওঠে। সুতরাং মেশিনারি-ব্যবহারকারী ধনিকদের প্রথম নজর পড়ে নারী ও শিশুদের শ্রমের উপরে। শ্রম ও শ্রমিকদের সেই প্রবল বিকল্পটি সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে গেল নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে শ্রমিক-পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যকে মূলধনের প্রত্যক্ষ কর্তৃত্বের অধীনে ভর্তি করে নিয়ে মজুরি-শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার একটি উপায়ে। ধনিকের জন্য বাধ্যতামূলক কাজ কেবল শিশুদের খেলা-ধুলোর স্থানই দখল করে নিলনা, সেই সঙ্গে দখল করে নিল মোটামুটি মাত্রার মধ্যে পরিবার-প্রতিপালনের জন্য বাড়িতে স্বাধীন শ্রমের যে স্থান, সেই স্থানটিকেও।[১]
শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারিত হত কেবল একক বয়স্ক শ্রমিকটির ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজনীহ শ্রম-সময়ের দ্বারাই নয়, নির্ধারিত হত তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের দ্বারাও। পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যকে শ্রমের বানরে ছুড়ে দিয়ে, মেশিনারি মানুষটির শ্রমশক্তির মূল্যকে ছড়িয়ে দেয় তার গোটা পরিবারের উপরে। এই ভাবে মেশিনারি তার শ্রমশক্তির অবমূল্যায়ন ঘটায়। হয়তে, পরিবারের কর্তাব্যক্তিটির শ্রমশক্তি ক্রয় করতে আগে যে খরচ পড়ত, তার তুলনায় চারজন কাজের লোকের একটি পরিবারের শ্রমশক্তি ক্রয় করতে খরচ হয় বেশি, কিন্তু, প্রতিদানে, চার দিনের শ্রম নেয় এক দিনের জায়গা এবং একজনের উদ্বৃত্ত মূলের উপরে চারজনের উদ্বৃত্ত-মূল্যের অতিরিক্ত অংশের অনুপাতে তাদের দামও পড়ে যায়। পরিবারটি যাতে বাঁচতে পারে, তার জন্য চারজন মানুষের কেবল শ্রম করলেই চলবেনা, ধনিকের জন্য উদ্বৃত্ত-শ্রমও ব্যয় করতে হবে। অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূলধনের শোষণ-ক্ষমতার প্রধান বিষয় যে মানবিক সামগ্রী,[২] মেশিনারি তার বৃদ্ধি সাধনের সঙ্গে সঙ্গে, শোষণের মাত্রাও বৃদ্ধি করে।
শ্রমিক ও খনিকের মধ্যে যে চুক্তি আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্দিষ্ট করে দেয়, মেশিনারি সম্পূর্ণ ভাবে সেই চুক্তিটিতেও বৈপ্লবিক পৰিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। পণ্য-বিনিময়কে আমাদের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে, আমরা প্রথমে ধরে নিয়েছিলাম যে, ধনিক এবং শ্রমিক পরস্পরের মুখোমুখি হয় স্বাধীন ব্যক্তি হিসাবে, পণ্যের স্বাধীন মালিক হিসাবে; একজনের মালিকানায় আছে টাকা ও উৎপাদনের উপায়, অন্য জনের মালিকানায় শ্রমশক্তি। কিন্তু এখন ধনিক কিনে নেয় শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্ক তরুণ ছেলেমেয়েদের। পূর্বে শ্রমিক বিক্রি করত তার নিজের শ্রমশক্তি, যা সে দিত তথাকথিত স্বাধীন ব্যক্তি হিসাবে। এখন সে বেচে দেয় তার স্ত্রী ও সন্তান। সে পরিণত হয় এক দাস-ব্যবসায়ীতে।[৩] শিশু-শ্রমের জন্য চাহিদা প্রায়শই রূপগত ভাবে মিলে যায় নিগ্রো ক্রীতদাসদের জন্য অনুসন্ধানের সঙ্গে, যা চোখে পড়ে আমেরিকার পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের আকারে। জনৈক ইংরেজ কারখানা-পরিদর্শক বলেন, “আমার জিলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যানুফ্যাকচারকারী শহরগুলির মধ্যে একটি শহরের স্থানীয় পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপনের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। নীচে বিজ্ঞাপনটির একটি প্রতিলিপি দেওয়া হয় : “কর্মখালি : চাই ১২ থেকে ২০ জন তরুণ ব্যক্তি; ১৩ বছর বয়স বলে চালিয়ে দেওয়া যায় তার চেয়ে তরুণ হলে চলবে না; মজুরি সপ্তাহে ৪ শিলিং; আবেদন কর ইত্যাদি ইত্যাদি[৪] “১৩ বছর বয়স বলে চালিয়ে দেয়া যায় এই অংশটির প্রাসঙ্গিকতা এই যে, কারখানা-আইন অনুযায়ী ১৩ বছরের কম বয়সের শিশুদের কেবল দিনে ছয় ঘণ্টা করে কাজ করানো চলে। সরকারি ভাবে নিযুক্ত একজন ডাক্তারকে তাদের বয়স সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিতে হবে। সুতরাং ম্যানুফ্যাকচারকারীরা এমন সব শিশুদের চায় যাদের ১৩ বছর বয়স হয়েছে বলে মনে হয়। কারখানাগুলিতে ১৩ বছরের অনূর্ধ্ব-বয়স্ক শিশুদের সংখ্যা কমে যাওয়ার অনেক সময়ে দারুণ ভাবে কমে যাওয়ার ঘটনা যা আশ্চর্যজনক ভাবে প্রকাশ পেয়েছে ইংল্যাণ্ডের গত ২০ বছরের পরিসংখ্যানে-তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সার্টিফিকেট প্রদানকারী ডাক্তারদের কাজ, যারা ধনিকের শোষণ-লোলুপতাকে এবং মাতা-পিতার এই হীন কারবারি তাগিদকে তুষ্ট করতে গিয়ে শিশুদের বয়স বাড়িয়ে লিখেছিল—এই সাক্ষ্য দিয়েছেন কারখানা-পরিদর্শকেরা নিজেরাই। বেথনীল গ্রীন’ নামক কুখ্যাত জিলাটিতে প্রতি সোমবার ও মঙ্গলবার সকালে একটি খোলা বাজার বসে, যেখানে ৯ বছর বয়স থেকে শুরু করে সব বয়সের ছেলে ও মেয়ে শিশুরা সিল্ফ ম্যানুফ্যাকচার কারীদের কাছে নিজেদেরকে ভাড়া দিয়ে দেয়। সচরাচর শর্ত হয় এই সপ্তাহে ১ শিলিং ৮ পেন্স (যা পাবে বাবা-মা) এবং ২ পেন্স ও চা, যা পাব আমি। এই চুক্তি বলবৎ থাকবে মাত্র এক সপ্তাহ। বাজার যখন চালু থাকে, তখন সেখানকার দৃশ্য ও ভাষা খুবই কলংকজনক।”[৫] ইংল্যাণ্ডে এটাও দেখা যায়, নারী নিয়ে এসেছে “কর্মশালা থেকে শিশুদের এবং তাদের যে কাউকে বাইরে নিয়ে এসেছে সপ্তাহে ২ শিলিং ৬ পেন্সের জন্য”, [৬]আইন প্রণয়ন সত্ত্বেও গ্রেট ব্রিটেনে চিমনি-সাফাইয়ের জীবন্ত মেশিন হিসাবে (যদিও সে কাজ করার জন্য প্রচুর মেশিন রয়েছে, তবু) ২০০০ এরও বেশি ছেলেকে তাদের বাপ-মায়েরা বেচে দেয়।[৭] শ্রমশক্তির ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে আইনগত সম্পর্কে মেশিনারি যে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে, তার ফলে এই লেনদেনের ব্যাপারটা স্বাধীন ব্যক্তিদের মধ্যে একটি চুক্তি হিসাবে যে চেহারা তার ছিল, তা হারিয়ে ফেলে; এটাই আইনগত নীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ পার্লামেন্টের কাছে একটা কৈফিয়ৎ হয়ে দেখা দিল কারখানার ব্যাপারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের পক্ষে। যখনি আইন শিশুদের শ্রম ৬ ঘণ্টায় বেঁধে দেয় (আগে এই হস্তক্ষেপ ছিল না), তখনি ম্যানুফ্যাকচার কারীরা আবার নোতুন করে তাদের নালিশ জানায়। তারা অভিযোগ জানায় যে, এই আইনের আওতায় পড়ে, এমন সব শিল্প থেকে বাপ-মায়েরা দলে দলে তাদের ছেলে মেয়েদের তুলে নিয়ে যায়, যাতে করে যেখানে “শ্রমের স্বাধীনতা” এখনো বজায় আছে, অর্থাৎ যেখানে ১৩ বছরের কমবয়সী শিশুদের বেশি-বয়সী মানুষদের সমান কাজ করতে বাধ্য করা যায় এবং উচ্চতর দামের বিনিময়ে তাদের দায় থেকে রেহাই পাওয়া যায়, সেখানে বিক্রি করে দেবার জন্য। কিন্তু যেহেতু মূলধন নিজেই স্বভাবগত ভাবে এক সমতা-বিধায়ক, যেহেতু শ্রমের শোষণের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সে শর্তাদির সমতা আদায় করে ছাড়ে, সেই হেতু একটি শিল্প-শাখায় শিশু-শ্রমের উপরে আইন-আরোপিত সীমাবদ্ধতা, অন্যান্য শিল্প-শাখাতেও অনুরূপ সীমাবদ্ধতা-আবরাপের হেতু হিসাবে কাজ
প্রথমে, মেশিনারির ভিত্তিতে গজিয়ে-ওঠা কারখানাগুলিতে প্রত্যক্ষ ভাবে এবং, তার পরে, শিল্পের বাকি সব শাখায় অপ্রত্যক্ষভাবে, মেশিনারি যাদেরকে মূলধনের শোষণের শিকারে পরিণত করে, সেই শিশু ও তরুণ-তরুণীদের, সেই সঙ্গে নারীদেরও, শারীরিক অবনতির কথা আমরা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি। অতএব এখানে আমরা কেবল একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব-শ্রমিকদের শিশুদের মধ্যে জীবনের প্রথম কয়েক বছরে মৃত্যুহারের বিপুলতার বিষয়টি নিয়ে। যে-সমস্ত রেজিষ্ট্রি-জেলায় ইংল্যাণ্ড, বিভক্ত সেই জেলাগুলির ঘষালটিতে এক বছরের কমবয়সী এমন প্রতি ১,০০,০০০ শিশুর মধ্যে এক বছরে গড়ে মারা যায় ৯০ ০ ০টি (একটি জেলায় মাত্র ৭, ০৪৭); ২৪টি জেলায় ১৩,০০০-এর বেশি কিন্তু ১১০০০-এর কম; ৩৯টি জেলায় ১১,০০০-এর বেশি কিন্তু ১২,০০০-এর কম; ৪৮টি জেলায় ১২০০০-এর বেশি কিন্তু ১৩০ ৬০-এর কম; ২২টি জেলায় ২০,০০০-এর বেশি; ২৫টি জেলায় ২১,০০০-এর বেশি; ১৭টিতে ২২০০০-এর বেশি; ১১টিতে ২৩,০০০-এর বেশি; হু, উলভারহ্যাম্পটন, অ্যাশটন-আণ্ডার-লাইন এক প্রেস্টনে ২৪,৩০০-এর বৈশি; নটিংহাম, স্টকপোর্ট এবং ব্রাডফোর্ডে ২৫,০০০-এর বেশি। উইসবিচে ২৬,৩০-এর বেশি এবং ম্যাঞ্চেস্টারে ২৬,১২৫।[৯] ১৮৬১ সালে একটি মেডিক্যাল সমীক্ষায় এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছিল যে, স্থানীয় বিভিন্ন কারণ ছাড়া, এই উচ্চ মৃত্যু-হারের প্রধান কারণ হল বাড়ি থেকে দুরে মায়েদের চাকরি এবং তাদের অনুপস্থিতির ফলে অবহেলা ও অযত্ন; দৃষ্টান্ত হিসাবে অনেক কিছুর মধ্যে উল্লেখ করা যায়, অপ্রতুল পুষ্টি, অনুপযোগী খাদ্য ও ঘুমপাড়ানি মাদক সেবন; এছাড়াও মা ও শিশুর মধ্যে ঘটে এক অস্বাভাবিক বিচ্ছেদ এবং তার ফলে শিশুদের ইচ্ছাকৃত ভাবে উপোস করিয়ে রাখা, বিষ-খাওয়ান।[৯] সেই সব কৃষি-প্রধান, জেলা, “যেগুলিতে ন্যূনতম সংখ্যায় নারী কর্ম-নিযুক্ত, (শিশু) মৃত্যুর হার কিন্তু খুবই নিচু ”[১০] অবশ্য, ১৮০১ তদন্ত কমিশন একটি অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তে উপনীত হল; তা এই যে উত্তর সাগরের তীরে অবস্থিত কৃষিপ্রধান জেলাগুলিতে এক বছরের অনূর্ধ্ব-বয়স্ক শিশুদের মৃত্যুহার সর্বাপেক্ষা খারাপ কারখানা-জেলাগুলির মৃত্যু-হারের প্রায় সমান। সুতরাং ডাঃ জুলিয়ান হান্টারকে দায়িত্ব দেওয়া হল ব্যাপারটি সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতে। “জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত ষষ্ঠ প্রতিবেদন”[১১]-এর সঙ্গে তাঁর প্রতিবেদনটিও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ততদিন পর্যন্ত ধরে নেওয়া হত যে, নিচু ও জলা-জায়গায় ভরা জেলা গুলির বিশেষত্ব যে ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য নানাবিধ রোগ, সেগুলির প্রকোপেই প্রতি দশ জনে একটি শিশুর মৃত্যু হয়। কিন্তু তদন্তে যা প্রকাশ পেল, তা ঠিক বিপরীত; প্রকাশ পেল যে, যে-কারণটি ম্যালেরিয়াকে তাড়িয়ে দিল, সেই কারণটিই-শীতকালে জলাভূমি থেকে এবং গ্রীষ্মকালে তৃণবিরল চারণভূমি থেকে জমির সুফলা শস্য ক্ষেত্রে রূপান্তরণের ঘটনাটিই—আবার অস্বাভাবিক হারে শিশুমৃত্যুর সূচনা করল।[১২] চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে-সত্তর জন ব্যক্তিকে নিয়ে ডাঃ হান্টার ঐ জেলায় অনুসন্ধান চালান, তাঁরা সকলেই এই বিষয়ে আশ্চর্যজনক ভাবে একমত।” বাস্তবিক পক্ষে কৃষি-পদ্ধতিতে বিল্পবের ফলে শিল্প-ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটেছিল। চুক্তি-নির্ধারিত একটি টাকার অংকের জন্য বিবাহিত নারীরা কাজ করে বালক-বালিকাদের সঙ্গে দল বেঁধে; ‘আণ্ডারটেকাররা (ঠিকাদার’) নামে এক ব্যক্তি, যে গোটা দলটির হয়ে চুক্তি করে, সে এই গোটা দলটিকে স্থাপন করে একজন জোত-মালিকের অধীনে। অনেক সময়ে এই ধরনের দলগুলিকে তাদের নিজেদের গ্রাম ছেড়ে যেতে হয় অনেক অনেক মাইল দূরে; পথে পথে তাদের দেখা যায় পরনে খাটো পেটিকোট, মানানসই কোট ও বুট এবং কখনো কখনো ট্রাউজার; তাদের দেখায় আশ্চর্য রকম সবলা ও স্বাস্থ্যবতী কিন্তু অত্যন্ত অসচ্চরিত্রতার দ্বারা কলংকিতা; তাদের হতভাগ্য সন্তানগুলি, যারা বাড়িতে আকুল ভাবে প্রতীক্ষা করছে, তাদের উপরে নিজেদের এই ব্যস্ত ও স্বাধীন জীবন কী মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে, সে বিষয়ে তাদের নেই কোনো ভ্রুক্ষেপ।[১৩] কারখানা-জেলাগুলির প্রত্যেকটি ঘটনার এখানে পুনঃপ্রাদুর্ভাব ঘটে –সেই অ-প্রচ্ছন্ন শিশুহত্যা, আফিমে অভ্যস্ত করা সমেত প্রত্যেকটি ঘটনা, তবে আরো বর্ধিত হারে।[১৪] প্রিভি কাউন্সিলের মেডিক্যাল অফিসার ও জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিবেদনসমূহের প্রধান সম্পাদক ডঃ সাইমন বলেন, “যে-গভীর আশংকার সঙ্গে আমি কোন শিল্পক্ষেত্রে বয়স্কা নারীদের বৃহৎসংখ্যায় কর্ম-নিয়োগকে দেখে থাকি, এই সমস্ত খারাপ ব্যাপারের জ্ঞান আমার সেই আশংকার কৈফিয়ৎ হিসাবে কাজ করতে পারে।[১৫] কারখানা-পরিদর্শক মি বেকার তাঁর সরকারি প্রতিবেদনে চিৎকার করে ওঠেন, “ইংল্যাণ্ডের কারখানা-জেলাগুলির পক্ষে বাস্তবিকই সেটা হবে একটা সুখের ব্যাপার, যখন পরিবার আছে এমন প্রত্যেকটি বিবাহিতা নারীর পক্ষে কোনো কাপড়ের কলে কাজ করা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হবে।[১৬]
ধনতান্ত্রিক শোষণ নারী ও শিশুদের যে নৈতিক অধঃপতন ঘটায় তার ছবি এফ এঙ্গেলস তার Lage dec Arbeitenden klasse Englands”-এ এমন সামগ্রিক ভাবে চিত্রিত করেছেন যে এখানে বিষয়টির উল্লেখ করাই হবে যথেষ্ট। কিন্তু অপরিণত মানব-সন্তানদের কেবল উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের যন্ত্রে রূপান্তরিত করে কৃত্রিম ভাবে সৃষ্টি করা হয় যে মানসিক উষ -মনের এমন একটা অবস্থা যা স্বাভাবিক অজ্ঞতার অবস্থা থেকে ভিন্ন, কেননা স্বাভাবিক অজ্ঞতা মনকে অনাবাদী ফেলে রাখে কিন্তু তার বিকাশ-ক্ষমতাকে তার স্বাভাবিক উর্বরতাকে ধ্বংস করে দেয়না—এই মানসিক উষরতা শেষ পর্যন্ত এমনকি ইংরেজ পার্লামেন্টকেও বাধ্য করল কারখানা আইনের পরিধিভুক্ত প্রত্যেকটি শিল্পে ১৪ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুদের “উৎপাদনশীল কর্ম-নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাকে একটি আবশ্যিক শর্ত হিসাবে আইন প্রণয়ন করতে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের মর্মবস্তুটি প্রকট হয়ে পড়ে কারখানা আইনের তথাকথিত শিক্ষাসংক্রান্ত ধারাগুলির হাস্যকর শব্দ-বিন্যাসে, প্রশাসনিক যন্ত্রের অনুপস্থিতিতে-মে অনুপস্থিতির দরুন বাধ্যবাধকতাটা হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ অলীক, এই শিক্ষা-সংক্রান্ত ধারাগুলির প্রতি স্বয়ং মালিকদের বিরোধিতায় এবং এগুলিকে এড়িয়ে যাবার জন্য তারা যেসব ছলাকলা অবলম্বন করে সেইসব ছলাকলায়। এই জন্য কেবল আইনসভাকেই দোষ দিতে হয় কেননা সে এমন একটা লোক-ঠকানো আইন পাশ করল, যাতে মনে হয় যেন কারখানায় সে শিশুরা কাজ করবে তাদের আবশ্যিক শিক্ষাদানের একটা ব্যবস্থা হল অথচ এমন কোন আইন করা হল না যার বলে ঐ ঘোষিত উদ্দেশ্য সাধনকে সুনিশ্চিত করা যায়। সপ্তাহের কয়েকটি দিন রোজ কয়েক (তিন ঘণ্টা করে শিশুরা পাঠশালা নামক একটি স্থানে চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে এবং নিয়োগা প্রতি সপ্তাহে একজন ব্যক্তির কাছ থেকে—চাদা-দাতারা যার নাম দিয়েছে শিক্ষক’ বা ‘শিক্ষিকাতার কাছ থেকে সেই মর্মে একটি স্বাক্ষরিত সাটিফিকেট পাবে।”[১৭] ১৮৪৪ সালে সংশোধিত কারখানা-আইন পাশ হবার আগে প্রায়শই এটা ঘটত যে শিক্ষক বা শিক্ষিকা ঐ সার্টিফিকেট স্বাক্ষর করেছে কেবল একটি ‘ল’ (x) চিহ্ন দিয়ে, কেননা সে নিজেই লিখতে পড়তে জানত না। একবার ‘পাঠশালা’ নামে অভিহিত একটি স্থান পরিদর্শন করে, যেখান থেকে পাঠশালায় উপনিত ধাকার সার্টিফিকেট দেওয়া হয় এমন একটি স্থান পরিদর্শন করে, আমি মাস্টারটির অজ্ঞতা দেখে এমন স্তম্ভিত হয়ে যাই যে, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, “মার্জনা করবেন, মহাশয়, আপনি কি পড়তে জানেন? সে উত্তর দিল,” “ঐ কিছুমিছু।” তার পরে যোগ করল, “যা হোক, আমি তো আমার ছাত্রদের চেয়ে আগে আছি।” ১৮৪৪ সালে যখন ঐ আইনের খসড়া প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন পাঠশালা নামে অভিহিত এই স্থানগুলি, যেগুলির কাছ থেকে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট আইন-অনুসারে তাদের মেনে নিতে হয়, সেগুলি যে কী কলঙ্কজনক অবস্থায় রয়েছে, পরিদর্শকেরা সে সম্পর্কে তাঁদের বক্তব্য জানাতে অক্ষমতা দেখাননি, কিন্তু তারা মাত্র এইটুকু করাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ১৮৪৪ সালের আইন পাশ হবার পর থেকে শিক্ষককে নিজের হাতেই সার্টিফিকেটগুলি পূরণ করতে হবে এবং খ্রীস্টান নাম ও পদবী পুরোপুরি স্বাক্ষর করতে হবে।”[১৮] স্কটল্যাণ্ডের কারখানা-পরিদর্শক স্যার জন কিনকেইডও অনুরূপ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, “যে পাঠশালাটি আমরা প্রথম পরিদর্শন করি, সেটি ছিল জনৈক শ্ৰীমতী অ্যান কিলিনের দায়িত্বে। তাকে তার নিজের নামের বানান জিজ্ঞাসা করতেই সে চটপট একটি ভুল বানান বলল, সে ‘কিলিন (Killin) বানান শুরু করল “C” অক্ষরটি দিয়ে, তার পরে সঙ্গে সঙ্গেই তা শুধরে নিয়ে বলল, “K”। কিন্তু সাটিফিকেট বইগুলিতে আমি লক্ষ্য করলাম, সে তার নামের বানান লিখেছে নানান ভাবে এবং তার হাতের লেখা দেখে আমার সন্দেহ রইলনা যে শিক্ষাদান সে একেবারেই অযোগ্য। সে নিজেও স্বীকার করল, সে রেজিস্টার রাখতে পারে না ………দ্বিতীয় পাঠশালাটিতে আমি দেখলাম ঘরটি ১৫ ফুট লম্বা এবং ১০ ফুট চওড়া এবং তাতে রয়েছে ৭৫টি শিশু; তারা কি যেন বিড়বিড় করছিল—একেবারেই অবোধ্য।[১৯] কিন্তু উল্লিখিত শোচনীয় স্থানগুলি থেকেই যে কেবল শিশুরা কিছু না শিখেই পাঠশালায় হাজিরার সার্টিফিকেট পায়—হ্যা, কিছু না শিখেই, কারণ যেখানে যোগ্য শিক্ষক বা শিক্ষিকা আছে, সেখানেও তিন বছর থেকে শুরু করে উপরের দিকে সব বয়সের ছেলে-মেয়েদের বেয়াড়া ভিড়ে তার চেষ্টা ফলপ্রসূ হতে পারে না; তার জীবিকার উপায়, যখন সবচেয়ে ভাল, তখনো শোচনীয়, কেননা তাকে নির্ভর করতে হয় যত বেশি সংখ্যক শিশুকে সে ঐ জায়গাটুকুতে ধরাতে পারে, তত সংখ্যক শিশুর কাছ থেকে প্রাপ্ত পেনির উপরে। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে আসবাবের খাতা, বইপত্র ও অন্যান্য শিক্ষা সামগ্রীর অভাব এবং একটি বদ্ধ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশহতভাগ্য শিশুগুলির উপরে যার প্রভাব খুব নৈরাশ্যজনক। আমি এমন বহু পাঠশালা দেখেছি যেখানে সারি সারি শিশু একেবারেই কিছু করেনা অথচ এই অবস্থাকেই সাটিফিকেট দেওয়া হয় পাঠশালায় হাজিরা বলে এবং পরিসংখ্যানগত বিবরণীতে এই শিশুদেরই দেখান হয় শিক্ষা পাচ্ছে বলে।”[২০] স্কটল্যাণ্ডে কারখানা-মালিকরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করে যাতে যে-সব শিশুরা পাঠশালায় যেতে বাধিত হয়, তাদের বাদ দিয়েই কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। এটা প্রমাণ করতে বড় বেশি যুক্তির প্রয়োজন হয় না যে, যখন কারখানা-আইনের শিক্ষা-সংক্রান্ত ধারাগুলি মিল-মালিকরা এত অপছন্দ করে, তখন তারা বহুল পরিমাণে সচেষ্ট হয় ঐ শ্রেণীর শিশুদের কর্ম-নিয়োগ থেকে এবং উক্ত আইনে অভিপ্রেত সুবিধা থেকে সমভাবে বঞ্চিত করতে।”[২১] ভয়ানক কদর্য আকারে এটা আত্মপ্রকাশ করে মুদ্রণ কারখানায়, যেগুলি নিয়ন্ত্রিত হয় একটি বিশেষ আইনের দ্বারা।
উক্ত আইন অনুসারে, একটি মুদ্রণ কাজে নিযুক্ত হবার আগে এই ধরনের কর্ম নিযুক্তির প্রথম দিনটির ঠিক পূর্ববর্তী ছয় মাসের মধ্যে প্রত্যেকটি শিশুকে অন্তত ৩০ দিন কিংবা অন্তত ১৫০ ঘণ্টা অবশ্যই পাঠশালায় হাজিরা দিতে হবে এবং সেই মুদ্রণ কারখানায় কাজে থাকা কালে পর পর প্রতি ছয় মাসে তাকে অনুরূপ ৩০ দিন বা ১৫০ ঘণ্টা করে পাঠশালায় হাজির থাকতে হবে…….. পাঠশালায় এই হাজিরা অবশ্যই হতে হবে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে। কোন একটি দিনে ২ ১/২ ঘণ্টার কম বা ৫ ঘণ্টার বেশি হাজিরা দিলে, তা ঐ ১৫০ ঘণ্টার মধ্যে গণ্য করা হবে না। সাধারণ অবস্থায় শিশুরা পাঠশালায় যায় সকালে ও বিকালে ৩০ দিনের জন্য, প্রতিদিন ৫ ঘণ্টা করে এবং ৩০ দিন পার হলে আইন-নির্ধারিত ১৫০ ঘণ্টা উত্তীর্ণ হলে, তাদের ভাষায়, বইয়ের পাঠ শেষ হলে, তারা কারখানায় ফিরে যায়, যেখানে তারা আরো ছয় মাস কাজ চালিয়ে যায়, যখন আর এক দফা পাঠশালায় হাজিরার দিন এসে যায় এবং তারা আর একবার পাঠশালায় যায় এবং আর একবার বইয়ের পাঠ শেষ করে।……… অনেক ছেলের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, পাঠশালায় হাজিরার নির্ধারিত ঘণ্টা-সংখ্যা সমাপ্ত করে যখন তারা কারখানায় ফিরে গিয়ে ছমাস কাজ করার পরে আবার পাঠশালায় যায়, তখন তারা প্রথম যেদিন ‘প্রিন্ট-বয়’ হিসাবে যোগ দিয়েছিল, সেদিন যে-অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই রয়েছে। দেখা যায় যে, প্রথম পাঠশালায় হাজিরা থেকে যতটুকুই বা তারা শিখেছিল, তার সবটুকুই তারা ইতিমধ্যে ভুলে গিয়েছে।
অন্যান্য মুদ্রণ-কারখানায় শিশুদের পাঠশালায় হাজিরা পুরোপুরি নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানটির কাজের প্রয়োজনের উপরে। প্রতি মাসে নির্ধারিত ঘণ্টার সংখ্যা পুষিয়ে দেওয়া হয়, বলা যায়, গোটা ছ-মাস জুড়েই এককালীন তিন ঘণ্টা থেকে পাঁচ ঘণ্টার দফাওয়ারি ভাবে। …… যেমন, একদিন হয়ত হাজিরা পড়ে সকাল ৮টা থেকে ১১টা, অন্যদিন আবার বেলা ১টা থেকে ৪টা; তার পরে হয়তো কয়েক দিন ধরে শিশুটির আর পাঠশালায় দেখাই তার মেলেনা; যখন অবোর দেখা মিল, তখন তার হাজিরা পড়ল বিকাল ৩টা থেকে ৬টা; হয়তো কখনো সে হাজিরা দিল পরপর ৩৪ দিন, এমনকি এক সপ্তাহ, তার পরে গরহাজির রইল আবার ৩ সপ্তাহ বা এক মাস। তারপরে আবার হাজির হল কোন বেয়াড়া দিনে বেয়াড়া সময়ে-যখন তার নিয়োগকর্তা তাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে। এই ভাবে শিশুটিকে নিয়ে যেন ঘুষোঘুষি চলে কারখানা থেকে পাঠশালায় এবং পাঠশালা থেকে কারখানায় এবং এইভাবে চলে, যে-পর্যন্ত-না শেষ হয় ১৫০ ঘণ্টার কাহিনীটি।” [২২]
শ্রমিকের সারিতে নারী ও শিশুদের অতিরিক্ত সংখ্যায় ভর্তি করে নিয়ে মেশিনারি শেষ পর্যন্ত ভেঙে ফেলল পুরুষ কর্মীদের সেই প্রতিরোধ, তারা ম্যানুফ্যাকচারের আমলে খাড়া করে রেখেছিল মূলধনের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে।[২৩]
(খ) শ্রম-দিবসের দীর্ঘায়ন
মেশিনারি যদি হয় শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি করার অর্থাৎ একটি পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাজের সময়ের হ্রস্বতা সাধনের সবচেয়ে বলিষ্ঠ উপায়, তা হলে মূলধনের হাতে তা পরিণত হয়, যেসব শিল্প সে প্রথম আক্রমণ করে সেই সব শিল্পে, মানব-প্রকৃতির দ্বারা আরোপিত সব সীমারেখার বাইরে শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করার সবচেয়ে বলিষ্ঠ উপায়ে। এক দিকে তা সৃষ্টি করে এমন নোতুন সব অবস্থা যার দ্বারা মূলধন সক্ষম হয় শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করার দিকে তার যে নিরন্তর প্রবণতা তাকে অবাধ সুযোগ দিতে, এবং অন্য দিকে, তা সৃষ্টি করে এমন সব প্রণোদনা যার দ্বারা অপরের শ্রম শোষণ করবার জন্য মূলধনের যে ক্ষুধা হয়। আরো তীব্র।
প্রথমতঃ মেশিনারির আকারে শ্রমের উপকরণসমূহ হয় স্বয়ংক্রিয়; শ্রমিককে ছাড়াই কাজকর্ম চলে এবং সব কিছু সচল থাকে। তখন থেকে সেগুলি পরিণত হয় একটি শিল্পগত ‘পার্পেটাম মোবাইল (perpetuum mobile )-এ, যা চিরকাল উৎপাদন করে চলবে, যদি না মেশিনারিটি তার মানবিক পার্শ্বচরদের দুর্বল দেহ ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি-জনিত কতকগুলি প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত না হয়। মূলধনের আকারে এবং যেহেতু তা মূলধন সেই কারণেই, অটোমেশন (স্বয়ংকরণ) খনিকের ব্যক্তিকে ভূষিত হয় বুদ্ধিবৃত্তি ও ইচ্ছাশক্তির দ্বারা; সুতরাং সেই বিয়কর অথচ নমনীয় প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকের তথা মানুষের দ্বারা উপস্থাপিত প্রতিরোধকে ন্যূনতম মাত্রায় পর্যবসিত করবার কামনায় তা হয়ে ওঠে উজ্জীবিত।[২৪] অধিকন্তু, মেশিনের কাজের বাহিক লঘুতা এবং কর্ম-নিযুক্ত নারী শিশুদের অপেক্ষাকৃত নমনীয় ও বশ্যতাপ্রবণ স্বভাব এই প্রতিরোধের শক্তিকে হ্রাস করে দেয়।[২৫]
আমরা আগেই দেখেছি, মেশিনারির উৎপাদনশীলতা সে যে-মূল্য উৎপন্ন-দ্রব্যে স্থানান্তরিত করে, তার সঙ্গে বিপরীত ভাবে আনুপাতিক। মেশিনের আয়ু যত দীর্ঘ হয়, ততই যত সংখ্যক উৎপন্ন দ্রব্যে মেশিনটি কর্তৃক সঞ্চারিত মূল্য বিস্তৃতি লাভ করে, তার সামূহিক পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং ততই সেই মূল্যের আরো কম কম অংশ প্রত্যেকটি একক উৎপন্ন-দ্রব্যে সংযুক্ত হয়। যাই হোক, একটি মেশিনের সক্রিয় আয়ুষ্কাল স্পষ্টতই নির্ভর করে শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্যের উপরে কিংবা প্রাত্যহিক শ্রম-প্রক্রিয়ার স্থায়িত্বকাল x সেই প্রক্রিয়াটি কতদিন ধরে সম্পাদিত হয়েছে তার সংখ্যার উপরে।
একটি মেশিনের ক্ষয়-ক্ষতি তার কাজের সময়ের সঙ্গে সঠিকভাবে আনুপাতিক নয়। আর যদি তা হত, তা হলে ৭ বছর ধরে দৈনিক ১৬ ঘণ্টা হিসাবে কাজ করে সেই একই কর্মকাল জুড়ে কাজ করত, যা সে করত ১৫ বছর ধরে দৈনিক মাত্র ৮ ঘণ্টা হিসাবে কাজ করে এবং প্রথম ক্ষেত্রে মোট উৎপন্ন দ্রব্যে সে যে মূল্য স্থানান্তরিত করত, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তা থেকে বেশি করত না। কিন্তু প্রথম কোটিতে দ্বিতীয় ক্ষেত্রটির তুলনায় দ্বিগুণ তাড়াতাড়ি মেশিনটির মূল্য পুনরুৎপাদিত হত এবং প্রথম ক্ষেত্রে মালিক মেশিনটিকে এই ভাবে ব্যবহার করে ৭ বছরে আত্মসাৎ করত সেই পরিমাণ উদ্বৃত্ত মূল্য, যা সে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আত্মসাৎ করত ১৫ বছরে।
কোন একটি মেশিনের বস্তুগত ক্ষয়-ক্ষতি দুই প্রকারের। এক প্রকারের ক্ষয় ক্ষতি ঘটে ব্যবহারের ফলে, যেমন মুদ্রায় বেলায় ঘটে হাতে হাতে ঘোরার ফলে এবং অন্য প্রকারের ক্ষয়-ক্ষতি ঘটে অ-ব্যবহারের ফলে, যেমন একটি তলোয়ারকে যদি তার খাপে রেখে দেওয়া হয়, তাহলে তাতে মরচে ধরে যায়। দ্বিতীয় প্রকারের ক্ষয়-ক্ষতির কারণ প্রাকৃতিক শক্তিসমূহ। মেশিনের ব্যবহারের সঙ্গে কম বেশি প্রত্যক্ষভাবে আনুপাতিক কিন্তু দ্বিতীয়টি কিছু মাত্রায় বিপরীত ভাবে আনুপাতিক।[২৬]
কিন্তু বস্তুগত ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াও, একটি মেশিনের ঘটে থাকে, যাকে বলা যায়, নৈতিক অবমূল্যায়ন। সে হারায় তার বিনিময়মূল্য হয়, তার মত একই ধরনের মেশিন তার চেয়ে সস্তায় উৎপাদিত হবার ফলে, আর নয়তো, তার চেয়ে ভাল মেশিন তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আসার ফলে।[২৭] উভয় ক্ষেত্রেই, মেশিনটি যতই তারুণ্য ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর হোক না কেন, তার মূল্য আর তার মধ্যে সত্য সত্যই বাস্তবায়িত শ্রমের দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় তাকে বা উন্নততর মেশিনটিকে পুনরুৎপাদন করতে যে-শ্ৰম সময় আবশ্যক হয়, তার দ্বারা; সুতরাং, তা কম বা বেশি মূল্য হারিয়েছে। তার মোট মূল্য পুনরুৎপাদন করতে সময় যত কম লাগে, নৈতিক অবমূল্যায়নের বিপদও তত কম হয়; এবং কাজের দিনটি যত দীর্ঘ হয়, ঐ সময়টাও তত কম লাগে। যখন মেশিনারি প্রথম শিল্পে প্রবর্তিত হয়, তখন থেকে তাকে আরো সস্তায় পুনরুৎপাদনের পদ্ধতি একটার পরে একটা আঘাতের পর আঘাতের মত আসতে থাকে,[২৮] এবং উন্নতিও ঘটে একটার পরে একটা, যা কেবল তার ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গে ও প্রতাতেই পরিবর্তন ঘটায় না, গোটা কাঠামোটাতেই পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে। অতএব, মেশিনারির জীবনের শুরুর দিকেই কর্ম-দিককে দীর্ঘতর করা এই বিশেষ প্রেরণাটি সব চেয়ে তীব্র ভাবে আত্মপ্রকাশ করে।[২৯]
কর্মদিবসের দৈর্ঘ্য যদি নির্দিষ্ট থাকে, অন্যান্য সব কিছু যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে দ্বিগুণ সংখ্যক শ্রমিকের শোষণের জন্য প্রয়োজন হবে স্থির মূলধনের যে অংশটি মেশিনারি ও বাড়িঘরে বিনিয়োজিত হয়, কেবল সেই সঙ্গে সেই অংশেরও দ্বিগুণীকরণ, যা খাটানো হয় কাঁচামাল ও সহায়ক দ্রব্যসামগ্রীতে। অন্য দিকে, কর্ম-দিবসের দীর্ঘতা সাধনের ফলে মেশিনারি ও বাড়ি-ঘরের উপরে মূলধনের পরিমাণে পরিবর্তন না ঘটিয়ে, উৎপাদনের আয়তন বৃদ্ধি করা যায়।[৩০] সুতরাং, কেবল যে উদ্বৃত্ত-মূল্যের বৃদ্ধিপ্রাপ্তিই ঘটে, তাই নয়, তা পাবার জন্য যে-বিনিয়োগের প্রয়োজন তার হ্রাস প্রাপ্তিও ঘটে। এটা ঠিক যে, কর্ম-দিবস যত বার বাড়ানো যায়, ততবারই এটা ঘটে থাকে, কিন্তু আলোচ্য ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন আরো বেশি প্রকট, কেননা উপকরণে রূপান্তরিত মূলধন আরো বৃহত্তর মাত্রায় গুরুত্ব লাভ করে।[৩১] কারখানা ব্যবস্থার অগ্রগতির ফলে মূলধনের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ এমন একটি আকারে স্থাপিত হয়, যে-আকারে তার মূল্য একদিকে, ক্রমাগত আত্মপ্রকাশের সক্ষমতা লাভ করে এক অন্যদিকে, সে যখনই জীবন্ত শ্রমের সঙ্গে হারায় তার সংস্পর্শ তখনি হারায় ব্যবহার মূল্য ও বিনিময়মূল্য—উভয় মূল্যই। বিরাট তুলো-ব্যবসায়ী মিঃ অশয়ার্থ অধ্যাপক নাসাউ ডবল সিনিয়রকে বলেন, “যখন একজন শ্রমিক তার কোদালটি নামিয়ে রাখে, সে তখনকার মত আঠারো পেনি মূল্যের একটি মূলধনকে অকেজো করে দেয়। যখন আমাদের লোকজনদের কেউ একজন মিল ছেড়ে যায়, সে অকেজো করে দেয় এমন একটি মূলধন যাতে ব্যয় হয়েছে ১,০০,০০০ পাউণ্ড।”[৩২] একবার কল্পনা করুন! একটি মূলধন যাতে খরচ পড়েছে ১,০০,০০০ পাউণ্ড, তাকে এক মুহূর্তের জন্য অকেজো করে রাখা। সত্যিই এটা একটা দানবীয় ব্যাপার যে, আমাদের লোকজনদের কেউ একজনও কারখানা ছেড়ে যাবে ! অ্যাশওয়ার্থের কাছ থেকে আলোকপ্রাপ্ত হয়ে মিঃ সিনিয়র যে-জিনিসটি পরিষ্কার দেখতে পেলেন তা এই যে, মেশিনারির বর্ধিত ব্যবহার কর্মদিবসের নিরন্তর বর্ধমান দীর্ঘায়নকে করে তোল “বাঞ্ছনীয়”। [৩৩]
মেশিনারি উৎপাদন করে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য; কেবল, প্রত্যক্ষভাবে, শ্রম শক্তির মূল্যহ্রাস ঘটিয়েই, এবং, পরোক্ষভাবে, যেসব পণ্য তার পুনরুৎপাদনে অংশ নেয় তাদের সস্তা করেই যে সে এটা করে, তাই নয়, সেই সঙ্গে যখন সে বিক্ষিপ্তভাবে প্রথম শিল্পে প্রবর্তিত হয় তখন সে তা করে থাকে করে থাকে মেশিনারি-মালিকের দ্বারা নিযুক্ত শ্রমকে উচ্চতর মাত্রাসম্পন্ন ও অধিকতর ফলপ্রসূ শ্রমে রূপান্তরিত করে, উৎপন্ন দ্রব্যটির সামাজিক মূল্যকে তার ব্যক্তিগত মূল্যের উপরে উন্নীত করে, এবং, এইভাবে একদিনের শ্রমশক্তির মূল্যের পরিবর্তে এক দিনের উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের একটি ক্ষুদ্রতর অংশকে স্থলাভিষিক্ত করার কাজে মালিককে সক্ষম করে। এই অতিক্রান্তির কালে, যখন মেশিনারির ব্যবহার মোটামুটি একটি একচেটিয়া ব্যাপার, তখন স্বভাবতই মুনাফা হয় অসাধারণ এবং মালিকও চেষ্টা করে কর্ম-দিবসকে যথাসাধ্য দীর্ঘায়িত করে তার প্রথম প্রেমের অরুণাললাকিত প্রহরটির পরিপূর্ণ অযোগ গ্রহণ করতে। মুনাফার আয়ন তার অনো মুনাফার লোলুপতাকে আরো শাণিত করে তোলে।
একটি বিশেষ শিল্পে মেশিনারির ব্যবহার যখন আর ব্যাপকতা লাভ করে, তখন উৎপন্ন দ্রব্যটির সামাজিক মূল্য তার ব্যক্তিগত মূল্য নেমে যায় এবং সেই যে নিয়ম, যা বলে যে, মেশিনারি যে-শ্রমশক্তির স্থান নিয়েছে, সেই শ্রমশক্তি থেকে, মুনাফার উদ্ভব হয় না, মুনাফার উদ্ভব হয় সেই শ্রমশক্তি থেকে, বস্তুতই যা মেশিনারির সঙ্গে কাজ করার জন্যই নিযুক্ত হয়, সেই নিয়মটি কার্যকরী হয়। উদ্বৃত্ত-মূল্যের উদ্ভব ঘটে কেবল অস্থির মূলধন থেকেই, এবং আমরা দেখেছি যে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের পরিমাণ নির্ভর করে দুটি উপাদানের উপরে, যথা, উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার এবং যুগপৎ নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা। কর্মদিবসের দৈর্ঘ্য যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার নির্ধারিত হয় এক দিনে আবশ্যিক শ্রমের স্থায়িত্ব-কালএবং উদ্বত্ত-শ্রমের স্থায়িত্ব কালের দ্বারা। এদিকে, যুগপৎ নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা নির্ভর করে স্থির মূলধনের সঙ্গে অ স্থির মূলধনের আনুপাতিক হার দ্বারা। এখন, মের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে আবশ্যিক শ্রমের বিনিময়ে মেশিনারির ব্যবহার উত্তমকে যত বেশিই বৃদ্ধি করুক না কেন, এটা পরিষ্কার যে তা এই ফল লাভ করে কেবল একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন কর্তৃক কর্ম-নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যায় হ্রাস সাধন করেই। দৃষ্টান্ত হিসাবে, ২৪ জন শ্রমিকের কাছ থেকে যতটা উদ্বৃত্ত-মূল্য নিঙড়ে নেওয়া যায়, ২ জনের কাছ থেকে ততটা যায় না। যদি এই ২৪ জন লোকের প্রত্যেকে ১২ ঘণ্টায় কেবল ১ ঘণ্টা করে উত্তম দেয়, তা হলে ২৪ জন মানুষ সম্মিলিত ভাবে দেয় ২৪ ঘণ্টা উত্তম, যেখানে ২ জন লোকের মোট শ্রমই হল ২৪ ঘণ্টা। অতএব, উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনে মেশিনারির প্রয়োগ এমন একটি দ্বন্দ্ব সূচিত করে যা তার মধ্যে অন্তনিহিত, কেননা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন দ্বারা সৃষ্ট উদ্বৃত্ত-মূল্যের দুটি উপাদানের মধ্যে একটিকে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের হারটিকে বাড়ানো যায় না যদি না, অন্যটিকে, শ্রমিকদের সংখ্যাটিকে কমানোনা হয়। যে মুহূর্তে একটি বিশেষ শিল্পে, মেশিনারির সাধারণ নিয়োগের দ্বারা, মেশিন উৎপাদিত পণ্যটির মূল্য একই ধরনের সমস্ত পণ্যের মূল্যকে নিয়ন্ত্রিত করে, সেই মুহূর্তেই এই দ্বন্দ্বটির[৩৪] বহিঃপ্রকাশ ঘটে; এবং এই দ্বন্দ্বটিই যা আবার তখন ধনিককে তার নিজের উপলব্ধির আগেই তাড়িত করে কর্মদিবসের মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘতা সাধনে, যাতে করে শোষিত শ্রমিকদের আপেক্ষিক সংখ্যায় যে হ্রাস ঘটেছে, সে তার তার ক্ষতিপূরণ করতে পারে কেবল আপেক্ষিক উত্তমেই নয়, সেই সঙ্গে অনাপেক্ষিক উত্তমের বৃদ্ধি সাধন করে।
তাহলে, একদিকে যখন মেশিনারির ধনতান্ত্রিক ব্যবহার কর্ম-দিবসে মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘতাসাধনের দিকে শক্তিশালী প্রেরণা যুগিয়ে থাকে এবং যেমন প্রমের পদ্ধতিসমূহে, তেমনি সামাজিক কর্ম-সংগঠনের চরিত্রেও এমন ভাবে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে যে, দীর্ঘতাসাধনের এই প্রবণতার পথে সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে; অন্য দিকে তখন তা—অংশতঃ শ্রমিক শ্রেণীর নোতুন নোতুন স্তর, যারা ছিল পূর্বে খনিকের কাছে অনধিগম্য, তাদেরকে তার কাছে উন্মুক্ত করে দিয়ে এবং অংশত, যে-শ্রমিকদের তা উচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তাদেরকে মুক্তি দিয়ে সৃষ্টি করে এক উদ্ধত শ্রমিক জনসংখ্যা[৩৫], যে জনসংখ্যা বাধ্য হয় মূলধনের নির্দেশের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে। এই জন্যই আধুনিক শিল্পের ইতিহাসে প্রত্যক্ষ হয় এই অসাধারণ ঘটনা-মেশিনারি ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয় কর্ম-দিবসের দৈর্ঘ্যের উপরে প্রতিটি নৈতিক ও প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ। এই জন্যই প্রত্যক্ষ হয় অর্থনৈতিক দিক থেকে এই আপাত-বিরোধী ঘটনা —শ্রম-সময়ের হ্রস্বতাসাধনের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হাতিয়ারটিই পরিণত হয় শ্রমিক ও তার পরিবারের সমগ্র সময়ের প্রত্যেকটি মুহূর্ত ধনিকের আয়ত্তে আনবার অব্যর্থ উপায়, যাতে করে সে বাড়াতে পারে তার মূলধনের মূল্য। পুরাকালের মহত্তম চিন্তাবিদ আরিস্তোতল স্বপ্ন দেখেছিলেন, যদি প্রত্যেকটি ‘টুল’ নির্দেশমত অথবা, এমনকি, স্বেচ্ছামত তার উপযোগী কাজ করতে পারত, পারত, ঠিক যেমন দেদেলাস এর সৃষ্টিগুলি নিজেরাই চলাফেরা করত কংবা হেফিস্তোস-এর তেপায়াগুলি নিজে থেকেই যেত তাদের পবিত্র কর্মানুষ্ঠানে, যদি তাঁতীদের মাকুগুকি আপনা-আপনিই কাপড় বুনত, তা হলে মালিক-কারিগরের লাগত না কোনো শিক্ষানবিশ কিংবা প্রভুদের লাগত না কোনো ক্রীতদাস।[৩৬] এবং সিসেরোর আমলের একজন বড় কবি আন্তিপাস শস্য-পেষাইয়ের জন্য জল চক্রের উদ্ভাবনটি সমন্ত মেশিনারি প্রাথমিক রূপ, তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন ক্রীতদাসীদের মুক্তিদাতা বলে এবং স্বর্ণযুগের প্রত্যাবর্তক বলে।[৩৭] হায়রে! হিদেনের (বিধর্মীর) দল! ওঁরা অর্থতত্ত্ব বা খ্রীস্টতত্ত্বের কিই বুঝতে পারেননি যা প্রাজ্ঞ বাষ্টিয়াট এবং তারও আগে প্রাজ্ঞতর ম্যাককুলক আবিষ্কার করেছেন। যেমন তারা বুঝতে পারেননি যে মেশিনারি হচ্ছে কর্ম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করার সবচেয়ে নিশ্চিত উপায়। ওঁরা বোধহয় একজনের ক্রীতদাসত্বকে মাফ করেছিলেন এই কারণে যে তার ফলে আরেকজনের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। কিন্তু যাতে করে কয়েকজন অমার্জিত অর্ধ-শিক্ষিত ভুইফোড় ব্যক্তি হয়ে ১৬তে পারে “বিশিষ্ট সুতো কলমালিক” “বৃহৎ সসেজ-প্রস্তুতকারক” ও “প্রভাবশালী জুতোর কালির কারবারি। সেজন্য জনসমষ্টির ক্রীতদাসত্ব প্রচার করার মত ফ্রস্টধর্মের শব্দঝংকার পদের ছিলনা।
(গ) শ্রমের তীব্রতা-সাধন
মূলধনের কতলগত মেশিনারি কর্ম-দিবসের যে মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘতা-বিধান করে, তা সমাজের উপরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, কেননা তার ফলে সমাজের প্রাণশক্তির উৎসগুলি পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়ে এবং তা থেকেই আসে স্বাভাবিক কর্ম-দিবস নির্মাণের জন্য আইন-প্রণয়ন। সেই থেকে, শ্রমের তীব্রতা-বর্ধনের যে ব্যাপারটির সঙ্গে আমরা ইতিপূর্বেই পরিচিত হয়েছি, তা সবিশেষ গুরুত্ব ধারণ করে। অনাপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য সংক্রান্ত আমাদের বিশ্লেষণ আমরা করেছিলাম প্রধানতঃ শ্রমের কার্যকালের। দৈর্ঘ্য বা বিস্তৃতির প্রসঙ্গে। তখন আমরা শ্রমের তীব্রতাকে ধরে নিয়েছিলাম স্থির বলে। এখন আমরা আলোচনা করব দীর্ঘতর শ্রমের পরিবর্তে তীব্রতর শ্রমের স্থান গ্রহণের বিষয় এবং এই শ্রম-তীব্রতার মাত্রা সম্পর্কে।
এটা স্বতঃস্পষ্ট যে, মেশিনারির ব্যবহার যত বিস্তার লাভ করে এবং মেশিনারিতে অভ্যস্ত একটি বিশেষ শ্রেণীর শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা যত পুষ্টি লাভ করে, ততই তার স্বাভাবিক ফলশ্রুতি হিসাবে শ্রমের ক্ষিপ্রতা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। যেমন ইংল্যাণ্ডে, অর্ধ-শতাব্দীকাল ধরে, কর্মদিবসের দীর্ঘতাবৃদ্ধি এবং কারখানা শ্রমের তীব্রতাবৃদ্ধি হাতে হাত দিয়ে চলেছে। যাই হোক, পাঠক পরিস্কার দেখতে পাবেন যে, যেখানে শ্রম আক্ষেপে-বিক্ষেপে সম্পাদিত হয় না, অভিন্ন অপরিবর্তিত ধারাবাহিকতায় পুনরাবর্তিত হয় দিনের পর দিন, সেখানে এমন একটা পর্যায় অনিবার্য ভাবেই আসবে, যে-পর্যায়ে কর্মদিবসের বিস্তৃতি এবং তীব্রতা এমন ভাবে পরস্পর-ব্যতিরেকী হবে যে, কর্ম-দিবসের দীর্ঘতা-বিস্তার কেবল শ্রমের তীব্রতা-লাঘবের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এবং উচ্চ মাত্রার তীব্রতা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে কেবল কর্ম-দিবসের হ্রস্বতা-সাধনের সঙ্গে। যে মুহূর্তে শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহের মুখে পার্লামেন্ট বাধ্য হল বাধ্যতামূলক ভাবে শ্রমের ঘণ্টা হ্রাস করতে এবং নিময়-মাফিক কারখানাগুলির উপরে একটি স্বাভাবিক কর্ম-দিবস চাপিয়ে দিতে, যে মুহূর্তে তার ফলে কর্ম-দিবসকে দীর্ঘতর করে বর্ধিত উদ্ব-মূল্য, উৎপাদনের পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেল, সেই মুহূর্ত থেকে মূলধন তার সর্বশক্তি প্রয়োগে করল যথাশীঘ্র সম্ভব মেশিনারির আরো উন্নতি সাধন করে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের প্রচেষ্টায়। সেই সঙ্গে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের প্রকৃতিতে ঘটল এক পরিবক্স। সাধারণ ভাবে বলা যায়, আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের পদ্ধতি হচ্ছে শ্রমিকের উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধিসাধন, যাতে করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একই পরিমাণ শ্রম ব্যয় করে সে আরো বেশি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। মোট উৎপন্ন দ্রব্যে শ্রম-সময় আগের মত একই মূল্য সঞ্চারিত করে থাকে, কিন্তু বিনিময় মূল্যের এই অপরিবতিত পরিমাণ বিস্তৃতি লাভ করে অধিকতর ব্যবহারশূল্যের উপরে। সুতরাং প্রত্যেকটি একক পণ্যের মূল্য পড়ে যায়। অন্যথা, অবশ্য, যখন শ্রমের ঘন্টা বাধ্যতামূলক ভাবে হ্রাস করা হয়, তখনি এটা ঘটে। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ এবং উৎপাদনের উপায়-উপকরণের সাশ্রয়-শাধনে তা যে বিপুল গতিবেগ সঞ্চার করে, সেই বেগ শ্রমিকের উপরে চাপিয়ে দেয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শ্রমের বর্ধিত ব্যয়, শ্রমশক্তির বর্ধিত প্রেষণ (টেসন) এবং কর্মদিবসের রন্ধ্রগুলি বন্ধ করণ কিংবা এমন মাত্রায় শ্রমের ঘনত্বসাধন, যা সাধ্যায়ত্ত হতে পারে কেবল স্বীকৃত কর্মদিবসের সীমার মধ্যে। একটি বৃহত্তর পরিমাণ শ্রমের একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই যে ঘনীভবন, তা তখন থেকে গণ্য হতে থাকে, সত্য সত্যই তা ঠিক যা, সেই হিসাবেই, অর্থাৎ বৃহত্তর পরিমাণ শ্রম হিসাবে। আরো কিছুটা বিস্তৃতি তথা স্থায়িত্বকাল ছাড়াও, শ্রম এখন অর্জন করে আরো কিছুটা তীব্রতা, আরো কিছুটা নিবিড়তা বা ঘনত্ব।[৩৮] দশ ঘণ্টার কর্মদিবসের একটি রন্ধ-বিরল ঘণ্টা একটি বানো ঘণ্টার কর্মদিবসের রন্ধবহুল ঘণ্টার তুলনায় অধিকতর শ্রম অর্থাৎ ব্যয়িত শ্রমশক্তি ধারণ করে। সুতরাং পূর্বোক্ত ১ ঘণ্টার উৎপন্ন দ্রব্য শেষোক্ত ১ ১/৫ ঘণ্টার উৎপন্ন দ্রব্যের সমান বা তা থেকে বেশি মূল্য ধারণ করে। শ্রমের বর্ধিত উৎপাদনক্ষমতার মাধ্যমে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের বর্ধিত অবদান ছাড়াও, সেই একই পরিমাণ মূল্য এখন ধনিকের জন্য উৎপাদিত হয়, ধরুন, ৩ ১/৩ ঘণ্টার উদ্বৃত্ত-মূল্য ও ৬ ২/৩ আবশ্যিক মুল্যের দ্বারা, যা পূর্বে উৎপাদিত হত ৪ ঘণ্টার উত্তম ও ৮ ঘণ্টার আবশ্যিক শ্রমের দ্বারা।
এখন আমরা যে-প্রশ্নটিতে আসি, তা এই: শ্রমের তীব্রতা বৃদ্ধি কিভাবে সাধিত হয়।
কর্ম-দিবসকে হ্রস্ব করার প্রথম ফলটি উদ্ভূত হয় এই স্বতঃস্পষ্ট নিয়মটি থেকে যে, শ্রম-শক্তির নৈপুণ্য তার ব্যয়িত পরিমাণের সঙ্গে বিপরীত অনুপাতে সম্পর্কিত। অধিকন্তু, শ্রমিক যে বাস্তবিকই অধিকতর শ্রম শক্তি ব্যয় করে, তা নিশ্চয়ীকৃত হয় ধনিক কি পদ্ধতিতে তাকে পারিশ্রমিক দেয়, তার উপরে।[৩৯] কুম্ভকার-শিল্পের মত যে সব শিল্পে মেশিনারি সামান্যই অংশ গ্রহণ করে কিংবা একেবারেই করে না, সেখানে কারখানা আইনের প্রবর্তনের ফলে জাজ্বল্যমান ভাবে দেখা গিয়েছে যে, কর্ম-দিবসকে কেবল হ্রস্ব করলেই শ্রমের নিয়মিকতা, অভিন্নতা, শৃংখলা-নিষ্ঠা, ধারাবাহিকতা ও উদ্যমশীলতা আশ্চর্যজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়।[৪০] অবশ্য, এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে যে, সঠিকভাবে যাকে কারখানা বলা যায়, যেখানে মেশিনারির অভিন্ন ও অনবচ্ছিন্ন গতির উপরে নির্ভরশীলতা ইতিমধ্যেই কঠোরতম নিয়মানুবর্তিতা প্রতিষ্ঠা করেছে, সেখানে এই ফল ঘটবে কিনা। সুতরাং ১৮৪৪ সালে যখন কাজের দিনকে ১২ ঘণ্টার নীচে নামিয়ে আনার তর্ক চলছিল, তখন মালিকেরা সমস্বরে ঘোষণা করেছিল যে, বিভিন্ন ধরে তাদের তদারককারীরা সযত্নে লক্ষ্য রাখে যাতে কর্মীরা কোন সময় না হারায়, শ্রমিকের দিক থেকে সতর্কতা মনোযোগ আর খুব সামান্যই বাড়ানো সম্ভব”, এবং, সেই কারণেই, মেশিনারির গতি ও অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, “একটি সুপরিচালিত কারখানায় শ্রমিকের বর্ধিত মনোযোগ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফল লাভের প্রত্যাশা করা একটা অবাস্তব ব্যাপার[৪১] এই উক্তি অবশ্য পরীক্ষার ফলে ভুল বলে প্রতিপন্ন হল। ১৮৪৪ সালের ২০শে এপ্রিল তারিখে ও তার পর থেকে রবার্ট গার্ডনার প্রেক্টনে অবস্থিত তার দুটি বড় বড় কারখানায় কাজের সময় ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ১১ ঘন্টা করেন। প্রায় এক বছর এই ভাবে চলার ফল হিসাবে দেখা গেল যে, একই খরচে একই পরিমাণ উৎপাদন পাওয়া গিয়েছে এবং সমগ্রভাবে শ্রমিকেরা আগে ১২ ঘণ্টা করে কাজ করে যে মজুরি পেত, এখন সেই একই পরিমাণ মজুরি পাচ্ছে ১১ ঘন্টা করে কাজ করে।”[৪২] ‘স্পিনিং’ ও ‘কার্ডিং বিভাগ ছেড়ে আমি ‘উইভিং বিভাগে যাচ্ছি, কারণ ঐ দুটি বিভাগে মেশিনের গতি ২ শতাংশ করে বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু ‘উইভিং’-এর ঘরে, যেখানে নানান ধরনের সৌখীন সামগ্রী বোনা হয়, সেখানে কাজের অবস্থায় সামান্যতম পরিবর্তনও করা হয়নি। ফল এই : “১৮৪৪ সালের ৬ই জানুয়ারী থেকে ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত, যখন ১২ঘন্টার দিন চালু হয়েছিল, তখন প্রত্যেক কর্মীর সপ্তাহপ্রতি গড় মজুরি হল ১০ শিলিং ১ ১/২ পেন্স। ১৮৪৪-এর ২০শে এপ্রিল থেকে ২৯শে জুন পর্যন্ত, যখন চালু হল ১১ ঘন্টার দিন, তখন সপ্তাহপ্রতি গড় মজুরি হল ১. শিলিং ৩ ১/২ পেন্স।”[৪৩] আমরা এখানে আগে ১২ ঘণ্টার যা উৎপাদন করেছি, ১১ ঘণ্টায় তা থেকে বেশি উৎপাদন করলাম এবং এটা সমগ্রভাবে সম্ভব হল শ্রমিকদের দ্বারা অধিকতর মনঃসংযোগ ও সময়-সাশ্রয়ের কল্যাণে। যদিও তারা পেল একই মজুরি এবং এক ঘণ্টার বাড়তি সময়, তবু ধনিক কিন্তু পেল একই পরিমাণ উৎপাদন এবং বাচালো এক ঘণ্টার কয়লা, গ্যাস ও অন্যান্য জিনিস। মেসার্স হয় অ্যাণ্ড জ্যাকসন’-এর মিলগুলিতে চালানো হয় একই পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পাওয়া একই সাফল্য।[৪৪]
প্রথমত, শ্রমের সময়-হ্রাস এমিককে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অধিকতর শক্তি প্রয়োগে সক্ষম করে এবং এইভাবে শ্রমের ঘনত্ব-রিধানের বিষয়ীগত অবস্থা সৃষ্টি করে। যে-মুহূর্তে এই সময় হ্রাস বাধ্যতামূলক হয়ে যায়, সেই মুহূর্ত থেকে ধনিকের হাত মেশিনারি হয়ে ওঠে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আরো শ্রম নিঙড়ে নেবার জন্য নিয়মিতভাবে নিযুক্ত বিষয়গত উপায়। এটা কার্যকরী করা হয় দুভাবে : মেশিনারি গতি বৃদ্ধি করে এবং শ্রমিককে আরো মেশিনারি দিয়ে। আরো উন্নত ধরনের মেশিনারি নির্মাণের প্রয়োজন হয়—অংশত এই কারণে যে, তা ছাড়া শ্রমিকের উপরে অধিকতর চাপ সৃষ্টি করা যায় না এবং অংশত এই কারণে যে, শ্রম-সময়ের হ্রাস-সাধনের ফলে ধনিক বাধ্য হয় উৎপাদন-ব্যয়ের উপরে তীক্ষ্ণতম নজর রাখতে। স্টিম-ইঞ্জিনে উন্নতি সাধনের ফলে পিস্টন-বেগ বেড়ে গিয়েছে এবং সেই সঙ্গে সম্ভব হয়েছে আরো কম শক্তি ব্যয়ে, একই পরিমাণ বা আরো কম পরিমাণ কয়লা খরচ করে একই ইঞ্জিনের সাহায্যে আরো বেশি মেশিনারি চালনা করা। ট্রান্সমিটিং কারিগরির উন্নতি সাধনের ফলে সংঘর্ষণ কমে গিয়েছে এবং, যে-ব্যাপারটি পূর্বতন মেশিনারি ও আধুনিক মেশিনারির মধ্যে এত পার্থক্য সৃষ্টি করেছে-এই উন্নতিগুলি ‘শ্যাফটিং’-এর ব্যাস ও ওজনকে একটি নিরন্তর হ্রাসমান ন্যূনতম পরিমাপে পর্যবসিত করেছে। সর্বশেষে অপারেটিভ মেশিনগুলিতে উন্নতি সাধনের ফলে একদিকে যেমন সেগুলি আকারে আকারে ক্ষুদ্রতর হয়েছে, অন্যদিকে তেমন বেগে ও নৈপুণ্যে ক্ষিপ্রতর হয়েছে, যথা আধনিক পাওয়ারলুম; অথবা তাদের কাঠামো সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলির কর্ম-সম্পাদনী অঙ্গগুলিরও মাত্রা ও সংখ্যার সম্প্রসারণ ঘটেছে, যথা স্পিনিং মিউল; অথবা এই কর্মসম্পাদনী অঙ্গগুলিতে যৎসামান্য অদল-বদল ঘটানোয় এগুলির গতিবেগ বৃদ্ধি পেয়েছে—যেমন দশ বছর আগে স্বয়ংক্রিয় মিউল-এ স্পিণ্ডলগুলির গতি বৃদ্ধি পেয়েছিল এক-পঞ্চমাংশ হারে।
কাজের দিনকে ১২ ঘণ্টায় কমিয়ে আনার ঘটনা ইংল্যাণ্ডে ঘটেছিল ১৮৩২ সালে। ১৮৩৩ সালে এক কারখানা-মালিক বিবৃতি দেন, “ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেকার তুলনায় … এখন কারখানাগুলিতে যে শ্রম করতে হয়, তা ঢের বেশি মেশিনারিতে এখন যে বিপুলভাবে বর্ধিত বেশ সঞ্চার করা হয় তাতে আবশ্যক হয় অনেক বেশি মনঃসংযোগ ও ও কর্মতৎপরতা।[৪৫] ১৮৪৪ সালে লর্ড অ্যাশলি, এখন লর্ড শ্যাফটসবেরি, কমন্স সভায় দলিলপত্রের সাক্ষ্যপ্রমাণসহ নিম্নলিখিত বিবৃতি দেন, “ম্যানুফ্যাকচারের বিবিধ প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত কর্মীরা যে-ম সম্পাদন করে, তার পরিমাণ এই ধরনের কর্মকাণ্ডের শুরুতে যে-শ্রম প্রয়োজন হত, তার তিন গুণ।
যে কাজ দাবি করত লক্ষ লক্ষ মানুষের দৈহিক শক্তি, সে কাজ যে মেশিনারি করে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু যারা তার আবহ গতিবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাদের শ্রম সে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে দানবীর ভাবে।………. ১৮১৫ সালে, যখন কাজের ঘণ্টা ছিল দৈনিক ১২ ঘণ্টা, তখন ৪০ নম্বর সুতো কাটায় নিযুক্ত এক জোড়া ‘মিউলকে অনুসরণ করতে দরকার হত, ৮ মাইল হটবার শ্রম। ১৭৩২ সালে ঐ একই নম্বরের সুতা কাটতে নিযুক্ত এক জোড়া “মিউল’ যে দূরত্ব পার হত, তা অনুসরণ করতে লাগত ২০ মাইল, অনেক সময় তার চেয়েও বেশি। ১৮৩৫ সালে (প্রশ্ন : ১৮১৫ বা ১৮২৫?) সুতোকাটুনি প্রত্যেকটি মিউলের উপরে প্রত্যহ চাপাত ৮২০টি স্ট্রেচ’; সুতরাং গোটা দিনে মোট ১,৬৪টি ‘স্ট্রে; ১৮৩৫ সালে সুতোকাটুনি প্রত্যেকটি মিউলের উপরে চাপাত ২,২০ টি স্ট্রেচ’, মোট হতে ৪,৪০০টি। ১৮৪৪ সালে, ২,৪০০টি করে, মোট দাঁড়াত ৪,৮০০টি; এবং কোন কোন ক্ষেত্রে দরকার পড়ত আরো বেশি পরিমাণ শ্রম। আমার হাতে আরো একটি দলিল আছে যা আমাকে পাঠানো হয়েছে ১৮৪২ সালে, যাতে বলা হয়েছে যে শ্রম ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে—বেড়ে চলেছে এই কারণে নয় যে, যে-দূরত্ব এখন অতিক্রম করতে হচ্ছে তা দীর্ঘতর, কিন্তু এই কারণে যে যখন আগের তুলনায় কর্মীর সংখ্যা কম, তখন উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণ বহুলভাবে বেশি; তার উপরে আবার এখন সুতো কাটা হয় এক নিকৃষ্ট জাতের তুলে দিয়ে, যা নিয়ে কাজ করা আরো কঠিন। ‘কাডিং’ বিভাগেও শ্রম অনেক বেড়ে গিয়েছে। আগে দুজনে যে-কাজ করত, এখন তা করে একজনে। বয়ন বিভাগে নিযুক্ত হয় বিরাট সংখ্যক কর্মী, প্রধানতঃ নারী। সেখানেও সুতো কাটার মেশিনারিতে বর্ধিত গতিবেগ সঞ্চারের দরুণ গত কয়েক বছরে শ্রম বেড়ে গিয়েছে পুরো ১০ শতাংশ। ১৮৩৮ সালে যেখানে প্রতি সপ্তাহে কাটা হত ১৮,০০০ ফেটি সুতে’, সেখানে ১৮৪৩ সালে তার পরিমাণ দাঁড়াল ২১,০… ফেটি। ১৮১৯ সালে যেখানে পাওয়ারলুম বয়নে মিনিট-পিছু ‘পিক’-এর সংখ্যা ছিল ৬০, ১৮৪২ সালে তা দাড়াল ১৪০—যাতে দেখা যায় শ্রম কী বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছে।[৪৬]
শ্রমের এই যে আশ্চর্যজনক তীব্রতাবৃদ্ধি ১৮৪৪ সালের ১২ ঘণ্টা আইনের অধীনে যা আগেই সাধিত হয়ে গিয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় যে তৎকালীন ইংরেজ কারখানা মালিকেরা যে উক্তি করেছিল তাতে কিছুটা যৌক্তিকতা ছিল। তারা বলেছিল, এই দিকে আর অগ্রগতি অসম্ভব; সুতরাং শ্রমের ঘণ্টায় প্রতিটি হ্রাস-সাধনের অর্থ হল হ্রাস-প্রাপ্ত উৎপাদন। তাদের যুক্তির আপাত সঠিকতা সবচেয়ে প্রকৃষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় তাদের সর্বক্ষণের সতর্ক সমীক্ষক, কারখানা-পরিদর্শক লিয়না হার-এর এই সমসাময়িক বিরতিটি থেকে।
এখন যেহেতু উৎপন্নের পরিমাণ প্রধানতঃ নিয়ন্ত্রিত হয় মেশিনারির গতিবেগের দ্বারা, সেই হেতু মিলমালিকের স্বার্থ হবে নিম্নলিখিত শর্তসাপেক্ষ মেশিনারিকে যথাসাধ্য উচ্চতম গতিবেগে চালনা করা; শর্তগুলি এই মেশিনারিটি দ্রুত অবনতি থেকে তাকে রক্ষা করা, উৎপন্ন দ্রব্যটির গুণমান অক্ষুন্ন রাখা, এবং যে পরিমাণ দৈহিক চাপ সয়ে সে একটানা কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম তার চেয়ে বেশি চাপ যাতে শ্রমিকের উপরে না পড়ে গতিবেগকে সেই মাত্রায় রাখা। সুতরাং যে-সমস্ত সবচেয়ে গুপর্ণ সমস্যা কারখানা-মালিককে সমাধান করতে হয়, তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, উল্লিখিত শর্তগুলিকে রক্ষা করে কত উচ্চতম গতিবেগে সে মেশিনারি চালাতে পারে। এমন প্রায়ই ঘটে সে যে দেখতে পায় যে, সে মাত্রাতিরিক্ত গতিবেগে চালিয়ে ফেলেছে। দেখতে পায় যে, ভাঙচুর ও নিম্নমানের কাজ বর্ধিত গতিবেগের প্রত্যাশিত ফলকে নাকচ করে দেয় এবং যখন একজন তৎপর ও বুদ্ধিমান মালিক নিরাপদ উচ্চতম মাত্রা আবিষ্কার করে, তখন তার পক্ষে ১২ ঘণ্টায় যে পরিমাণ উৎপাদন করা সম্ভব হত, ১১ ঘণ্টায় সেই পরিমাণ উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। আমি আরো ধরে নিয়েছিলাম যে, কত একক দ্রব্য উৎপাদন করেছে, সেই ভিত্তিতে যখন কর্মীকে তার মজুরি দেওয়া হয়, তখন সে যে-সর্বোচ্চ হারে একটানা খেটে যেতে পারে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যথাসাধ্য খাটুনি খাটে।”[৪৭] অতএব, হনরি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, কাজের ঘণ্টা যদি ১২ ঘণ্টার নীচে নামানো হয়, তা হলে উৎপাদনের পরিমাণও কমে যেতে বাধ্য।[৪৮] দশ বছর পরে তিনি নিজেই তার ১৮৪৫ সালের মতটি উদ্ধৃত করেন এটা প্রমাণ করতে যে, ঐ বছর তিনি মেশিনারির স্থিতিস্থাপকতাকে এবং মানুষের এ শক্তির স্থিতিস্থাপকতাকে-কর্ম দিবসের বাধ্যতামূলক হ্রস্বীকরণের দ্বারা যাদের উভয়কেই যুগপৎ বিস্তৃত করা হয় চরম মাত্রায়—সেই উভয়কেই তিনি কত ছোট করে দেখে ছিলেন।
এখন আমরা ১৮৪৭ সালে ইংল্যাণ্ডে তুলল, পশম, রেশম ও শণ শিল্পে দশ ঘণ্টা আইন প্রবর্তনের পরে যে-সময় এল, সেই সময়ের আলোচনায় যাচ্ছি।
“স্পিণ্ডলের গতিবেগ বেড়েছে প্রতি মিনিটে খুশল-এর উপরে ৫০০ ও মিউলের উপরে ১০০০ আবর্তন; তারে মানে যে থুশল-স্পিণ্ডলের বেগ ছিল ১৮৩৯ সালে প্রতি মিনিটে ৪,৫০০ বার, তা এখন (১৮৬২ সালে) হয়েছে প্রতি মিনিটে ৫০০০ এবং যে মিউলে ছিল ৫০০০ তা এখন হয়েছে ৬০০০, প্রথম ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বৃদ্ধির পরিমাণ এক-দশমাংশ এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে এক, পঞ্চমাংশ।[৪৯] ম্যানচেষ্টারের নিকটবর্তী প্যাট্রিক্রফটের খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ার জেমস ন্যাসমিথ ১৮৫২ সালে লিয়নার্দ হর্নারের কাছে এক পত্রে ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে স্টিম ইঞ্জিনে যেসব উন্নতি ঘটেছে সেগুলি ব্যাখ্যা করেন। ১৯২৮ সালের অনুরূপ ইঞ্জিন গুলির শক্তি অনুসারে সব সময়েই সরকারি বিবরণে স্টিম ইঞ্জিনগুলির অশ্বশক্তির যে হিসা দেয়া হয়, তা কেবল নামীয়, এবং তা কেবল তাদের আসল শক্তির সূচক হিসাবেই কাজ করতে পারে[৫০] এই মন্তব্যের পরে ন্যাসমিথ বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে, টিম ইঞ্জিন মেশিনারির একই ওজন থেকে আমরা এখন লাভ করছি গড়ে ত আরো ৫০ শতাংশ কর্তব্য বা কাজ, এ অনেক ক্ষেত্রে অনুরূপ মি-ইনি, যেগুলি প্রতি মিনিটে ২২০ ফুটের সীমাবদ্ধ গতিবেগে উৎপাদন করত ৫০ অশ্বশক্তি, সেগুলি এখন উৎপাদন করছে ১… অতি বেশি।…….১০০ অশ্বশক্তির ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক টিম ইঞ্জিন আগেকার তুলনায় বৃহত্তর বেগে কাজ করতে সক্ষম; তার নিয়ে নির্মাণকার্যে উৎকর্য, বয়লারের নির্মাণকারে ও ক্ষমতায় উৎকর্য ইত্যাদি থেকেই এই অতিরিক্ত বেগের উদ্ভব।…দিও অপশক্তির অনুপাতে আগেকার সময়ের মত সেই একই সংখ্যক কর্মী নিযুক্ত হয়, মেশিনারি অনুপাতে কিন্তু নিযুক্ত হয় অল্পতর কর্মী।[৫১] ১৮৫০ সালে, যুক্তরাজ্যের কারখানাগুলি নিযুক্ত করত ১,৩৪,২১৭ নামীয় শক্তি ২৫,৬৩৮,৭১৬টি শিশুকে এবং ১,০০টি আঁতকে গতি দান করতে। ১৮৫৬ সালে স্পিণ্ড ল ও তঁতের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩,৩৫,৩৫৮০ এবং ৩,৬৯, ২০৫টি এবং যদি ধরে নেওয়া যায় যে প্রয়োজনীয় অশ্বশক্তির গে ১৮৫০ সালে যে পরিমাণ ছিল সেই বেগের অনুরূপ হতে হবে, তা হলে দরকার হবে, ১৭৫,০০০ অশ্বের শক্তি, কিন্তু ১৮৫৬ সালের বিবরণে প্রদত্ত আসল শক্তির পরিমাণ ছিল ১৬১,৪৩৫-১৮৫০ সালের বিবরণের ভিত্তিতে হিসাব করলে ১৮৫৬ সালে যতটা অশ্বশক্তি লাগা উচিত, তা থেকে ১০,০০০ অশ্ব কম।[৫২] (১৮৫৬ সালের) বিবরণীতে যে ব্য দাখিল করা হয়েছে, তাতে বেরিয়ে আসে যে কারখানা ব্যবহার যত সম্প্রসারণ ঘটছে; যদিও আগেকার সময়ে অপশক্তির অনুপাতে যত সংখ্যক কর্মী নিযুক্ত করা হত, এখনো তত সংখ্যক কর্মীই নিযুক্ত করা হচ্ছে, তবু মেশিনারি অনুপাতে নিযুক্ত করা হচ্ছে আতর সংখ্যক শক্তির সাশ্রয় জটিল ও অন্যান্য উপায়ে টিম ইঞ্জিনকে সক্ষম করে তোলা হচ্ছে বর্ধিত পরিমাণ ওজনে মেশিনারি চালনা করতে এবং মেশিনারিতে ম্যানুফ্যাকচারের পদ্ধতিতে উন্নতি ঘটিয়ে মেশিনারির গতিবেগ বাড়িয়ে ও আরো বহুবিধ উপায়ে অধিকতর পরিমাণ কাজ করিয়ে নেওয়া যায়।[৫৩]
“সব রকমের মেশিনে প্রভূত উৎকর্ষ সাধনের ফলে তাদের উৎপাদনশক্তি বিপুল ভাবে বর্ধিত হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে কাজের ঘণ্টা কমানোর দরুনই …….এই সব উৎকর্ষ সাধনের তাড়না সৃষ্টি হয়েছে। মেশিনের এই উৎকর্ষের সঙ্গে শ্রমিকের উপরে আরো তীব্র চাপ মিলে এই ফল ঘটেছে যে, আগে দীর্ঘতর কাজের দিনে যতটা উৎপন্ন হত, তখন দুম্বতর কাজের দিনেও (দু-ঘণ্টা বা এক যষ্ঠমাংশ ২তর) অন্তত ততটা উৎপন্ন হচ্ছে।[৫৪]
শ্রম-শক্তির তীব্রতর শোষণের সঙ্গে সঙ্গে কারখানা মালিকদের ঐশ্বর্য কী বিপুল ভাবে বেড়েছে, একটি মাত্র ঘটনা তুলে ধরাই তা প্রমাণ করার পক্ষে যথেষ্ট। ১৮৩৮ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত, ইংল্যাণ্ডের তুলল ও অন্যান্য কারখানায় গড় আনুপাতিক বুর্কি ঘটেছিল ৩২ শতাংশ, যেখানে ১৮৫ থেকে ১৮৫৬ পর্যন্ত এই বৃদ্ধি ঘটে ৮৬ শতাংশ।
কিন্তু দশ ঘণ্টার কাজের দিনের প্রভাবের অধীনে ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ পর্যন্ত ৮ বছরে ইংল্যাণ্ডের শিল্পে যত বিরাট অগ্রগতিই ঘটুক না কেন, ১৮৫৬ থেকে ১৮৬২ পর্যন্ত পরবর্তী ৬ বছরের অগ্রগতি তাকে অনেক ছাপিয়ে যায়। দৃষ্টান্ত হিসাবে রেশম কারখানাগুলির কথা ধরা যাক; ১৮৫৬ সালে স্পিণ্ডল-এর সংখ্যা ছিল ১৩,৯৩,৭৯৯; ১৮৬২ সালে তা বেড়ে দাঁড়াল ১৩,৮৮,৫৪৪; ১৮৫৬ সালে তাঁতের সংখ্যা ছিল ৯,২৬৬, ১৮৬২ সালে তা বেড়ে দাড়াল ১০,৭০৯। কিন্তু কর্মীর সংখ্যা ১৮৫৬ সালে যেখানে ছিল ৫৬,১৩১, ১৮৬২ সালে সেখানে নেমে দাড়াল ৫২,৪২৯। সুতরাং; যেখানে স্পিণ্ডল বৃদ্ধি পেল ২৬৯ শতাংশ, তত বৃদ্ধি পেল ১৫৬ শতাংশ, সেখানে কর্মী সংখ্যা হ্রাস পেল ৭ শতাংশ। ১৮৫০ সালে পশম মিলগুলিতে কাজে ছিল ৮৭.৮৩. স্পিণ্ডল, ১৮৫৬ সালে ১৩,২৪,৫৪৯ (বৃদ্ধি ১২ শতাংশ) এবং ১৮৬২ সালে ১২,৮৯,১৭২ (হ্রাস ২৭ শতাংশ)। কিন্তু ১৮৫৬ সালের সংখ্যায় যেগুলি স্থান পেয়েছে, অথচ ১৮৬২ সালের সংখ্যায় পায়নি, সেই ডাবলিং স্পিলগুলিকে আমরা যদি বাদ দেই, তা হলে আমরা দেখতে পাব যে ১৮৫৬ সালের পরে স্পিণ্ডল-এর সংখ্যা প্রায় স্থিরই ছিল। অপর পক্ষে, ১৮৫০ সালের পরে স্পিণ্ডল ও তাদের সংখ্যা অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। পশম মিলগুলিতে পাওয়ারলুমের সংখ্যা ১৮৫০ সালে ছিল ৩২,৬১৭; ১৮৫৬ সালে ৩৮,৯৫৬; ১৮৬২ সালে ৪৩, ৪৮। কর্মীর সংখ্যা ছিল ১৮৫০-এ ৭৯,৭৩৭; ১৮৫৬-তে ৮৭,৭৯৪; ১৮৬২-তে ৬,৬৩; অবখ, এই সংখ্যাগুলির মধ্যে ধরা আছে ১৪ বছরের অমূর্ব-বয়সী শিশুদের সংখ্যা, যা ১৮৫০এ ছিল ১,৯৫৬; ১৮৫৬-তে ১১,২২৮; ১৮৬২-তে ১৩,১৭৮। অতএব দেখা যাচ্ছে যে ১৮৫৬ সালের তুলনায় ১৮৬২ সালে তাঁতের সংখ্যা দারুণ ভাবে বৃদ্ধি পেলেও, নিযুক্ত কাজের লোকের মোট সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল, এবং শোষিত শিশুদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল।[৫৫]
১৮৬৩ সালের ২৭শে এপ্রিল মিঃ ফেরাও কমন্স সভায় বলেন, এখানে আমি যাদের মুখপাত্র সেই ল্যাংকাশায়ার ও চেশায়ার-এর ১৬টি জেলার প্রতিনিধিরা আমাকে জানিয়েছেন যে মেশিনারির উৎকর্ষ সাধনের দরুন কল-কারখানায় কাজ ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে। পূর্বে যেমন একজন ব্যক্তি দুজন সহায়কের সাহায্যে দুটি তাতকে চালু রাখত, এখন একজন ব্যক্তি কোনো সহায়ক ছাড়াই চালু রাখে তিনটি তত; এমনকি একজন ব্যক্তি চারটি তাঁত চালু রাখছে এমন দৃশ্যও বিরল নয়। উল্লিখিত তথ্যগুলি থেকে বোঝা যায় যে ১২ ঘণ্টার কাজকে এমন ঠেলে দেয়া হয় ১০ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে। সুতরাং এটা এখন সুস্পষ্ট, গত ১০ বছরে একজন কারখানা-কর্মীর কাজ কত বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।”[৫৬]
সুতরাং, যদিও কারখানা-পরিদর্শকেরা অবিরাম ভাবে ও যৌক্তিকতা সহকারেই ১৮৪৪ ও ১৮৫০ সালের কারখানা-আইন দুটির সুফলসমুহের সুপারিশ করে থাকেন, তবু তারা স্বীকার করেন যে কাজের ঘণ্টার হ্রাস সাধনের দরুন এমন মাত্রায় শ্রমের তীব্রতা বৃদ্ধি করা হয়েছে যে, তা শ্রমিকের স্বাস্থ্যের পক্ষে এক তার কর্মক্ষমতার পক্ষে ক্ষতিকারক। অধিকাংশ তুলল, পশম ও রেশম কারখানাগুলিতে মেশিনারির গতিবেগ গত কয়েক বছরে এত বিপুল ভাবে বর্ধিত করা হয়েছে যে সেগুলির প্রতি সখেজনক ভাবে মনোনিবেশ করতে হলে যে-উত্তেজনাকর অবস্থার মধ্যে নিয়ে কাজ করতে হয়, আমার মনে হয় ভাঃ খ্রীনহাউ তার সাম্প্রতিক রিপোর্টে যোসের ব্যাধি-জনিত অতিরিক্ত প্রাণহানির কথা বলেছেন, এটা তার অন্যতম কারণ।[৫৭] এ বিষয়ে সামান্যতম সংশয় নেই যে, যে-মুহূর্তে কাজের দিনের দীর্ঘতা-সাধন চিরতরে নিষিদ্ধ হয়ে গেল, সেই মুহূর্ত থেকে মূলধনের মধ্যে এমন একটা প্রবণতার সৃষ্টি হয়। তাকে তাড়িত করছে শ্রমের তীব্রতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করতে এবং মেশিনারির প্রত্যেকটি উন্নয়নকে এমন একটি উপায়ে রূপান্তরিত করতে থাকে শ্রমিককে উজাড় করে নেওয়া যায়। এই প্রবণতা অচিরেই এমন একটা পরিস্থিলি দিকে নিয়ে যাবে যাতে কাজের ঘণ্টার আবার হ্রাস-সাধন অনিবার্য হয়ে উঠবে। অপর পক্ষে, ১০ ঘণ্টার কাজের দিনের প্রভাবে ১৮৪৮ সাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের শিল্পে এতটা অগ্রগতি ঘটেছে যা ১২ ঘণ্টার কাজের দিনের যুগে ১৮ থেকে ১৮৪৭-এর অগ্রগতি কারখানা-ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরে প্রথম অর্ধশতাব্দী অগ্রগতিকে—যখন কাজের দিনের কোনো সীমাবদ্ধতা ছিলনা, তখনকার অগ্রগতিকে যতটা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। [৫৮]
————
১. আমেরিকার গৃহযুদ্ধ-জনিত তুলো-সংকটের সময় ইংরেজ সরকার ডঃ এভোয়ার্ড স্মিথকে পাঠায় ল্যাংকাশায়ার, চেশায়ার এবং অন্যান্য জায়গায়তুলো-শ্রমিকদের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট করার জন্য। তিনি রিপোর্ট করেন, স্বাস্থ্য-বিষয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, কারখানার আবহাওয়া থেকে শ্রমিকদের নির্বাসন ঘটানো ছাড়াও, সংকটের ফলে কয়েকটা সুবিধা ঘটে। “গডফ্রের কর্ডিয়াল” নামক বিষ না খাইয়ে, শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াবার যথেষ্ট অবসর মায়েরা এখন পায়। রান্নাবান্ন। শেখার সময়ও এখন তাদের আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই বিদ্যাটা তারা এমন সময়েই শিখল, যখন তাদের রান্না করার মত কিছু নেই। কিন্তু এ থেকে আমরা বুঝতে পারি কি ভাবে মূলধন তার আত্ম-প্রসারের স্বার্থে পরিবারের সাংসারিক প্রয়োজনের শ্রমকে জবর-দখল করে নিয়েছে। এই সংকটকে শ্রমিকদের কন্যার ব্যবহার করেছিল সেলাইয়ের ইস্কুলে সেলাই শেখার কাজে। একটি আমেরিকান বিপ্লব এবং একটি বিশ্বজনীন সংকট যাতে করে শ্রমিক মেয়েরা, যারা গোটা দুনিয়ার জন্য সুতো কাটে, তারা শিখতে পারে কেমন করে সেলাই করতে হয়।
২. “পুরুষ-শ্রমের জায়গায় নারী-শ্রম এবং বয়স্ক-শ্রমের জায়গায় শিশু-শ্রমের নিয়োগের মাধ্যমে শ্রমিকদের বিপুল সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে। সপ্তাহে ৬ শিলিং থেকে ৮ শিলিং পায় এমন ৩ জন করে বালিকা সপ্তাহে ১৮ শিলিং থেকে ৪৫ শিলিং পায় এমন ১ জন পরিণত বয়স্ক শ্রমিকের স্থান গ্রহণ করেছে।” (থমাস ভি কুইন্সি, “দি লজিক অব পলিটিক্যাল ইকনমি,” লণ্ডন ১৮৪৪, টীকা, পৃঃ ১৪৭)। যেহেতু শিশুদের পরিচর্যা করা, স্তন্যদান করা ইত্যাদির মত কয়েকটি পারিবারিক কাজকে নাকচ করে দেওয়া যায় না, সেহেতু মূলধনের দ্বারা বাজেয়াপ্ত কৃত মায়েরা কিছু কিছু বিকল্প ব্যবস্থার চেষ্টা করে। সেলাই, রিফু করার মত গার্হস্থ্য কাজের বদলে চালু করে তৈরি জামা-কাপড় কেনার রেওয়াজ। এই ভাবে ঘরের কাজে কম-পরিমাণ শ্রম-ব্যয়ের সঙ্গে চলে বেশি-পরিমাণ অর্থ-ব্যয়। পরিবারের পোষণের ব্যয় বেড়ে যায় এবং বর্ধিত আয়ের দাবি করে। অধিকন্তু, জীবন ধারণের দ্রব্যসামগ্রীর প্রস্তুতি ও ব্যবহারে মিতব্যয় ও বিচার-বিবেচনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই সব তথ্য সম্পর্কে প্রচুর সামগ্রী, যা সরকারি অর্থনীতি লুকিয়ে রাখে, পাওয়া যায় কারখানা-পরিদর্শকদের, শিশু-নিয়োগ কমিশনের এবং, বিশেষ করে, জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্টগুলিতে।
৩. ইংরেজ কল-কারখানাগুলিতে নারী ও শিশুদের কাজের ঘণ্টা কমাবার দাবি মূলধনের হাত থেকে আদায় করে নিয়েছিল পুরুষ-শ্রমিকেরা—এই মহতী ঘটনার বিপরীত-তুলনায়, আমরা শিশু-নিয়োগ কমিশনের সর্বসাম্প্রতিক বিপোর্টগুলির মধ্যে লক্ষ্য করি শিশুদের দিয়ে ব্যবসা করাবার দিকে শ্রমিক মাতা-পিতাদের এমন কিছু প্রবণতা, যা সত্যসত্যই ধিক্কারজনক এবং পুরোপুরি দাস-ব্যবসার অনুরূপ। কিন্তু ধনিক নামধেয় ঐ বিড়াল-তপস্বী এই পাশবিকতার নিন্দা করে, অথচ সে-ই একে সৃষ্টি করে, বাঁচিয়ে রাখে এবং শোষণ করে আর সেই সঙ্গে একে আশীর্বাদ করে “মের স্বাধীনতা” বলে। “শিশু-শ্রমকে সাহায্যের জন্য ডাকা হয়েছে এমনকি তাদের দৈনিক রুটি রোজগার করার জন্য। এই মাত্রাহীন পরিশ্রম সহ করার মত শক্তি ছাড়া, তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে পরিচালনা করার মত শিক্ষা ছাড়া, তাদের ছুড়ে দেওয়া হয়েছে এমন এক পরিস্থিতিতে, যা দৈহিক ও মানসিক উভয় ভাবেই দূষিত। টাইটাস কর্তৃক জেরুজালেম-এর পত্ন ঘটাবার ঘটনা সম্পর্কে ইহুদী ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন, এতে কোনো আশ্চর্যের কারণ নেই যে তা ধ্বংস হবে, যখন এক অমানবিক মাতা তার নিজের সন্তানকে বলি দেয় তীব্র ক্ষুধার তাড়না তৃপ্ত করার জন্য (“পাবলিক ইকনমি কনসেন্টে টেড, কালি, ১৮৩৩, পৃঃ ৬৬)।
৪. এ. রেডগ্রেভ, “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ,” ৩১ অক্টোবর, ১৮৫৮, পৃঃ ৪০, ৪১।
৫. “শিশু-নিয়োগ কৃমিশন, পঞ্চম বিপোর্ট”, লণ্ডন ১৮৬৬, পৃঃ ৮১।
[ ৪র্থ জার্মান সংস্করণে সংযোজিতবেথনীল গ্রীন সিল্ক ইনডাস্ট্রি এখন প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে—এফ এঙ্গেলস ]। *
৬. “শিশু-নিয়োগ কমিশন, তৃতীয় রিপোর্ট”, লণ্ডন ১৮৬৪, পৃঃ ৫৩। .
৭. শিশুনিয়োগ কমিশন পঞ্চম রিপোর্ট, পৃঃ ২২।
৮. “জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত ষষ্ঠ রিপোর্ট”, ১৮৬৪, পৃঃ ৩৪
৯. “এই রিপোর্ট (১৮৬১) দেখায় যে, যখন উল্লিখিত অবস্থার মধ্যে অবহেলা ও অব্যবস্থায়—যা তাদের মায়েদের কাজের প্রকৃতি-সঞ্জাত শিশুরা মারা যায়, তখন মায়েরা শিশুদের প্রতি এক শোচনীয় ভাবে অস্বাভাবিক মানসিকতা-গ্রস্ত হয়ে ওঠে শিশুদের মৃত্যুতে তারা কোনো উদ্বেগ পোষণ তো করেই না: অনেক সময় মৃত্যু ঘটানোর ব্যাপারেও তাদের হাত থাকে।” (জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট।
১০. ঐ, পৃঃ ৪৫৪।
১১. ঐ, পৃঃ ৪৫৪-৪৬৩: “ইংল্যাণ্ডের কয়েকটি গ্রামীণ অঞ্চলে শিশু-মৃত্যুর অত্যধিক :হার সম্পর্কে ডঃ হেনরি জুলিয়ান হান্টারের রিপোর্ট।”
১২. জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট পৃঃ ৩৫ এবং ৪৫৫, ৪৫।
১৩. জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট, পৃঃ ৪৫৬।
১৪. কৃষি-অঞ্চলে এবং শিল্পাঞ্চলে পুরুষ ও নারী নির্বিশেষে বয়ঃপ্রাপ্ত শ্রমিকদের মধ্যে অহিফেন-সেবন প্রত্যহ বিস্তার লাভ করছে। “কিছু পাইকারি ব্যবসায়ীর মহৎ লক্ষ্য হল আফিমের বিক্রি আরো বৃদ্ধি করা।” (“জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট”, পৃঃ ৪৫৯)। শিশুরা, যারা আফিম খায়, তারা “ক্ষুদ্রাকার বৃদ্ধ লোকের মত কুঁচকে যায় কিংবা “ছোট ঘোট বানরের মত শুকিয়ে যায়।” (“জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট” পৃ: ৪৬)। আমরা এখানে দেখতে পাই কিভাবে ভারত এবং চীন ইংল্যাণ্ডের উপরে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।
১৫. ঐ পৃ: ৩৭।
১৬. “রিপোর্ট অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ”, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ৫৯, মি. বেকার একজন প্রাক্তন ভাক্তার ছিলেন।
১৭. এল হর্ণার : “রিপোর্ট অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ”, ৩ জুন ১৮৫৭, পৃঃ ১৭ দ্রষ্টব্য।
১৮. এল হর্ণার : “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর ১৮৫৫, পৃ ১৮, ১৯ দ্রষ্টব্য।
১৯. স্যার জন কিনকেইউ : “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ”, ৩১ অক্টোবর ১৮৫৮, পৃঃ ৩১, ৩২।
২০. এল. হর্ণার : “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ”, ৩১ অক্টোবর ১৮৫৭, পৃ ১৭, ১৮ দ্রষ্টব্য।
২১. আর জন কিনকেই বিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ, ১৮৫৬, পৃঃ ৬৬।
২২. এ. রেডগ্রেভ, “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ”, ১৮৫৭, পৃঃ ৪১-৪২। যেসব শিল্পে আসল কারখানা-আইন (মূল গ্রন্থে উল্লেখিত ছাপাখানা আইন নয়) চালু আছে,সেখানে শিক্ষাগত ধারাগুলি সম্পর্কে বাধাসমূহ সাম্প্রতিককালে অপসারিত হয়েছে। এই আইনের আওতায় পড়ে, এই সমস্ত শিল্পে মিঃ জে গেছেস নামক জনৈক কাঁচ ম্যানুফ্যাকচারকারীর কথা আজও প্রযোজ্য। তিনি একজন অনুসন্ধানকারী কমিশনার মি. হোয়াইট-কে জনিয়েছেন “আমি যতটা বুঝি, শ্রমিক শ্রেণীর একটা অংশ যে শিক্ষা অতীতে পেয়েছে, তার বেশির ভাগটাই অমঙ্গলজনক। এটা বিপজ্জনক কারণ শিক্ষা তাদের স্বাধীন করে তোলে।” (“শিশু-নিয়োগ কমিশন, চতুর্থ বিপোট”, ১৮৬৫, লণ্ডন পৃঃ ২৫৩)।
২৩. মিঃ ই. একজন ম্যানুফ্যাকচারার, আমাকে জানালেন তিনি তাঁর পাওয়ার লুমগুলিতে একান্তভাবে মহিলাদের নিযুক্ত করেন, বিশেষ করে তাদের যারা বিবাহিত, যাদের বাড়িতে পরিবার পোষণ করতে হয়, তারা অবিবাহিত মহিলাদের চেয়ে বেশি মনোযোগী, বেশি অনুগত এবং জীবনের আবশ্যিক সামগ্রী ইত্যাদি সংগ্রহের জন্য তারা বাধ্য হয় যথাসাধ্য খাটতে। এই গুণগুলি—যা নারী-চরিত্রের নিজস্ব গুণ —সেগুলি বিকৃত করলে তাদেরই ক্ষতি হয়। এই ভাবে নারীর প্রকৃতিতেযা কমনীয়তা, যা কর্তব্যনিষ্ঠা, তার সব কিছুকেই ব্যবহার করা হয় তার উপরে বন্ধন ও দুর্দশা চাপিয়ে দেবার উপায় হিসাবে।” (দশ ঘণ্টার কারখানা আইনের প্রস্তাব, লর্ড অ্যাশলির ভাষণ, ১৫ই মার্চ, লণ্ডন, ১৮৪৪, পৃঃ ২০।
২৪. মেশিনারির সার্বিক প্রবর্তনের পর থেকে মানব-প্রকৃতিতে জোর করে তার গড়-শক্তির অনেক বাই সম্প্রসারিত করা হয়েছে।” (রবার্ট ওয়েন : “অবজার্ভেশনস অন দি এফেক্টস অব দি ম্যানুফ্যাকচারিং সিস্টেম” ২য় সংস্করণ লণ্ডন ১৮১৭)।
২৫. ইংরেজদের একটা প্রবণতা আছে, কোনো জিনিসের আবির্ভাবের প্রথম রূপটিকে তার অস্তিত্বের কারণ বলে গণ্য করার; কারখানা-ব্যবস্থার শৈশবে ধনিকেরা। দুঃস্থ-নিবাস ও অনাথ-ভবনগুলি থেকে পাইকারি ভাবে শিশু-হরণ করত; এই লুণ্ঠন কার্যের মাধ্যমে তারা সংগ্রহ করত শোষণের প্রতিরোধহীন সামগ্রী; কারখানায় কাজের দীর্ঘসময়ের কারণ হিসাবে ইংরেজরা নির্দেশ করে এই শিশু-লুণ্ঠনের রেওয়াজকে। যেমন ফিলডেন, যিনি নিজেই একজন ম্যানুফ্যাকচারার বলেন, “দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে যোগানো হত এত বিপুল সংখ্যক দুঃস্থ শিশু যে মালিকেরা তাদের কর্মীদের আর পবোয়া করতেন না-এই ঘটনাই কাজের দীর্ঘ সময়ের জন্য দায়ী; এই শোচনীয় সামগ্রী গুলির উপরে একবার একটা রীতি চালু করে দিলে, পরে প্রতিবেশীদের উপরে তা চালু করে দেওয়া যায় আরো অনায়াসে।” (জে ফিলডেন, “দি কার্স অব দি ফ্যাক্টরি সিস্টেম”, লণ্ডন ১৮৩৬, পৃঃ ১১)। নারী-শ্রম সম্পর্কে কারখানা-পরিদর্শক সণ্ডার্স তার ১৮৪৪ সালের রিপোর্টে বলেন, “নারীশ্রমিকদের মধ্যেএমন কিছুনারী আছে যারা,সামান্য কয়েক দিন বাদে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ সকাল ৬টা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত কাজ করে, খাবার জন্য পায় দু’ঘণ্টারও কম; ফলে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ দিন করে তারা বাড়ি যাতায়াতের জন্য এবং বিছানায় বিশ্রাম নেবার জন্য পায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র ৬ ঘণ্টা।
২৬. “নিষ্ক্রিয়তার দ্বারা ধাতব যন্ত্রটির সুক্ষ্ম সচল অংশগুলির ক্ষতি সাধন করে।” (উলে, “শিশু-নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ২৮১)।
২৭. ‘ম্যাঞ্চেস্টার স্পিনার (টাইমস”, ২৬শে নভেম্বর ১৮৭২) এই প্রসঙ্গে বলে, এটার মেশিনারির ক্ষয়-ক্ষতির জন্য প্রদত্ত সুবিধার) উদ্দেশ্য হচ্ছে পুরনো মেশিন জীর্ণ হয়ে যাবার আগেই তার বদলে নোতুন ও আরো ভাল মেশিন বসাবার যে-নিরন্তর লোকসান তা পুষিয়ে নেওয়া।
২৮. “হিসেব করে দেখা গিয়েছে যে, একটি নোতুন উদ্ভাবিত মেশিনের প্রথমটি তৈরি করতে দ্বিতীয়টির তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি খরচ হয়।” (ব্যাবেজ, “শিশু-নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ৩৪৯)
২৯, “‘পেটেন্টনেট’ তৈরি করার জন্য যে-ফ্রেম’, তাতে কিছুকাল আগে যে-উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে, তা এত বিপুল যে একটি মেশিন, যা কয়েক বছর আগে কেনা হয়েছিল ৪১,২০০ পাউণ্ডে, তাই ভাল অবস্থায় বিক্রি করতে হল £৬০ পাউণ্ডে। একটার পরে একটা উন্নয়ন এমন দ্রুত গতিতে ঘটতে লাগল যে প্রস্তুত কারককে তার হাতের মেশিন শেষ হবার আগেই সেটাকে ছেড়ে দিয়ে আরেকটা ধরতে হল।” কারণ নব উন্নয়ন তার ব্যবহার উপযোগকে রুদ্ধ করে দিচ্ছিল (ব্যাবেজ, “শিশু-নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ২৩৩)। এই ঝড়ের মত অগ্রগতির সময়ে টুলে’ (সূক্ষ্ম রেশমি কাপড় ) প্রস্তুতকারকেরা অচিরেই দুই প্রান্ত কর্মী নিয়োগ করে, কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে নিল ৮ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টায়।
৩০. “এটা স্পষ্ট যে, বাজারের জোয়ার-ভাটা এবং চাহিদার তেজি-মন্দার মধ্যে এমন অবস্থা বারংবার দেখা দেবে যে, ম্যানুফ্যাকচারার অতিরিক্ত স্থির মূলধন নিয়োগ না করে অতিরিক্ত অস্থির মূলধন নিয়োগ করবে: যদি বাড়িঘর ও মেশিনারি বাদে অতিরিক্ত খরচ না করে অতিরিক্ত পরিমাণ কাঁচামালকে তৈরি মালে পরিণত করা যায়।” (আর টরেন্স, “অন ওয়েজেস অ্যান্ড কম্বিনেশন”, লণ্ডন ১৮৩৪, পৃঃ ৬৪)।
৩১. এই ঘটনাটা এখানে উল্লেখ করা হল সম্পূর্ণতার স্বার্থে, কারণ আমি মুনাফার হার অর্থাৎ অগ্রিম প্রদত্ত মোট মূলধনের সঙ্গে উদ্বৃত্ত-মূল্যের অনুপাত তৃতীয় গ্রন্থে যাবার আগে আলোচনা করব না।
৩২. সিনিয়র, “লেটার্স অন দি ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট”, লণ্ডন, ১৮৩৭, পৃঃ ১৩, ১৪।
৩৩. “আবর্তনশীল মূলধনের শেষে স্থিতিশীল মূলধনের বিরাট অনুপাত: দীর্ঘ কাজের সময়কে বাঞ্ছনীয় করে তোলে।” মেশিনারি ইত্যাদির বর্ধিত ব্যবহারের সঙ্গে, “দীর্ঘতর কাজের সময়ের দিকে প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে, কেননা সেটাই হবে স্থিতিশীল মূলধনের বিরাট অনুপাতকে মুনাফাজনক করার একমাত্র উপায়।” “লেটার্স অন দি ফ্যাক্টরি আকু”, পৃঃ ১১-১৩। “মিলের এমন কিছু খরচ আছে, যা, মিলে পুরো সময় চালু থাক আর কম সময় চালু থাক, একই অনুপাতে বহন করতে হয়, যেমন, খাজনা। ভাড়া, শুল্ক, কর, অগ্নি-বীমা, কিছু স্থায়ী কর্মচারীর মজুরি, মেশিনের ক্ষয়-ক্ষতি এবং ম্যানুফ্যাকচারকারী প্রতিষ্ঠানের দেয় আরো কিছু মাশুল, উৎপাদন হ্রাস পাবার সঙ্গে সঙ্গে যাদের অনুপাত বৃদ্ধি পায়।” (রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর ১৮৬২,পৃঃ ১৯)।
৩৪, কেন যে ধনিক এবং সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিকেরাও, যারা তার মতামতে অনুরঞ্জিত, এই অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বটি সম্পর্কে অবহিত, তা তৃতীয় খণ্ডের (ইং সং) প্রথম অংশ থেকে বোঝা যাবে। (বাংলা সংস্করণ ৫ম খণ্ড)
৩৫. এটা রিকার্ডোর সবচেয়ে বড় কৃতিত্বগুলির মধ্যে একটি যে, তিনি মেশিনারির মধ্যে কেবল পণ্য উৎপাদনের উপায়ই দেখতে পাননি, একটি “অপ্রয়োজনীয় জনসংখ্যা সৃষ্টির উপায়ও দেখতে পেয়েছিলেন।
৩৬. F. Biese : “Die Philosophie des Aristotles”, Vol. 2, Barlin, 1842, p. 408.
৩৭. আমি নীচে এই কবিতাটির স্টোলবার্গ-কৃত অনুবাদটি দিচ্ছি, কেননা শ্রম বিভাজন সম্পর্কিত উদ্ধৃতিগুলির মর্ম অনুযায়ী, এই কবিতাটি ফুটিয়ে তুলেছে প্রাচীন ও আধুনিকদের মধ্যেকার মত-বৈপরীত্য : “Spare the hand that grinds the corn, Oh, miller girls, and softly sleep. Let Chanticleer announce the morn in vain! Deo has commanded the work of the girls to be done by the Nymphs, and now they skip lightly over the wheels, so that the shaken axles revolve with their spokes and pull round the load of the revolving stones. Let us live the life of our fathers, and let us rest from work and enjoy the gifts that the Goddess sends us.”
“ময়দা-কলের মেয়েরা সব শান্ত ভাবে ঘুমাও; যে-হাত দিয়ে ময়দা পেষে সে হাত-দুটি থামাও। মোরগগুলো যাক না ডেকে, সকাল হল, জাগো ! ‘দেও’ দিয়েছেন হুকুম, শোনোতোমরা সবাই ভাগো এখন থেকে করবে কাজ জল-পরীরা সব; হাল্কা পায়ে চাকার পরে মেতেছে উৎসব। চাকাগুলো ঘুরছে যেমন, ঘুরছে তেমন শিল; আমরা সবাই বাঁচব এবার খুশি-ভরা দিল। বাপ-দাদারা ঢের খেটেছে, আমরা চাই ছুটি; ভগবানের দেওয়া দান দুহাত দিয়ে লুটি।” [অনুবাদ এই গ্রন্থের অনুবাদকের ]
(Gedichte aus dem Griechischen ubersetzt von Christian Graf zu Stolberg, Hamburg, 1782.)
৩৮. অবশ্য, বিভিন্ন শিল্পে সব সময়েই শ্রম-তীব্রতায় পার্থক্য হয়, কিন্তু এইসব পার্থক্য যেমন অ্যাডাম স্মিথ দেখিয়েছেন, প্রত্যেক ধরনের শ্রমের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যজনিত সামান্য সামান্য ঘটনার দ্বারা কিছু পরিমাণে পরিপোষিত হয়ে যায়। মূল্যের পরিমাপ হিসাবে এমসময় কিন্তু এখানে ক্ষুন্ন হয় না—একমাত্র ততটা পরিমাণ ছাড়া, যতটা পরিমাণে শ্রমের স্থায়িত্বকাল, এবং তার তীব্রতার মাত্রা একই অভিন্ন পরিমাণ শ্রমের দুটি পরস্পর ব্যতিরেকী অভিব্যক্তি।
৩৯. বিশেষ করে, ‘সংখ্যা-পিছু ( ‘পিস-ওয়ার্ক) মজুরির ক্ষেত্রে, যে-রূপটি সম্পর্কে আমরা এই বইয়ের ষষ্ঠ বিভাগে আলোচনা করব।
৪০. “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ১৮৬৫”,দ্রষ্টব্য।
৪১. “রিপোর্ট অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ১৮৪৫”, ৩০শে এপ্রিল শেষ হওয়া সপ্তাহ ১৮৪৫ পৃঃ ২০-২১।
৪২. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ”, পৃঃ ১৯। যেহেতু জিনিস-পিছু মজুরি ছিল অপরিবর্তিত সেই হেতু সাপ্তাহিক মজুরি নির্ভর করত উৎপন্ন পরিমাণের উপরে।
৪৩. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ”, পৃঃ ২০।
৪৪. উল্লিখিত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নৈতিক উপাদান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়েছিল। “আমরা আবো তেজের সঙ্গে কাজ করি, আমানের সামনে থাকে রাত্রে তাড়াতাড়ি ছাড়া পাবার পুরস্কার এবং একটা আনন্দময় মনোভাব গোটা মিলটিতে ব্যাপ্ত করে রাখে সবচেয়ে অল্পবয়সী ‘পিস’-কর্মী থেকে সবচেয়ে বেশী-বয়সী কর্মীকে পর্যন্ত। আমরা বিপুল ভাবে পরস্পরকে সাহায্য করতে পারি।” (“রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ”, পৃ ২১)।
৪৫. জন ফিলজেন, “দি কার্স অব দি ফ্যাক্টরি সিষ্টেম, পৃঃ ৩২।
৪৬. “টেন আওয়ার্স ফ্যাক্টরি বিল : লর্ড অ্যাশলির ভাষণ”, ১৮৪৪, পৃঃ ৩৭৯-৮০।
৪৭. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ১৮৪৪”, ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া সপ্তাহ এবং ১লা অক্টোবর ১৮৪৪ থেকে ৩০ এপ্রিল ১৮৪৫, পৃঃ ২০।
৪৮. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরীজ, পৃঃ ২২।
৪৯. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরীজ, ৩১শে অক্টোবর ১৮৬২, পৃঃ ৬২।’
৫০. ১৮৬২ সালের পার্লামেন্টারি রিটার্ণও এটা পরিবর্তন করা হয়েছিল। নামীয় অশ্বশক্তির পরিবর্তে আধুনিক চিম-ইঞ্জিন ও জল-চক্রের আসল অশ্বশক্তি দেয়া হয়। ডাবলিং স্পিণ্ডল’-এলিকেও আর ‘স্পিনিং ম্পিগুল’-গুলির মধ্যে ধরা হয়না (১৮৩৯, ১৮৫ এবং ১৮৫৬ সালের রিটার্নে ধরা হয়েছিল)। উলের মিল’-এর ক্ষেত্রে ‘জিগ যোগ করা হয়। পাট এবং শণ মিলগুলির মধ্যে পার্থক্য করা হয় এবং মোজা বোনাকে এই প্রথম অংক কয়।
৫১. “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্ট অ্যাক্টরি, ৩১ অক্টোবর ১৮৫৬, পৃঃ ১৩, ১৪, ২ এ ১৮৫২ পৃ ২৩।
৫২. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরি, ১০, ১৫।
৫৩. “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরি, পৃঃ ২০।
৫৪. “রিপোর্টস ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৮, পৃ ৯-১০ তুলনীয় রিপোর্ট ইত্যাদি ৩০ এপ্রিল, ১৮৬০ পৃ: ৩।
৫৫. “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ”, ৩১ অক্টোবর ১৮৬২, পৃঃ ১০০, এবং ১৩।
৫৬. দুটি আধুনিক পাওয়ারলুমে একজন তাতী এখন ৬০ ঘণ্টার এক সপ্তাহে করে নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গুণমানের ২৬ পিস; পুরনো পাওয়ারলুমে সে এইরকম ৪ পিসের বেশি করতে পারত না। এই ধরনের কাপড় বোনার খরচ ১৮৫০ সালের পরে ২ শিলিং ৯ পেন্স থেকে কমে দাঁড়ায় ৫ ১/৮পেন্স।
“ত্রিশ বছর আগে (১৮৪১) তিন জন ‘পিস’-কর্মী সহ একজন সুতোকাটুনিকে ৩০০ ৩২৪টি টাকুসমন্বিত এক-জোড়ায় বেশি মিউলের দায়িত্ব নিতে হত না। আজকে (১৮৭১) ৫জন ‘পিস’-কর্মী সহ তাকে দেখতে হয় ২,২০০ টাকু এবং উৎপাদন করতে হয় ১৮৪১ সালের তুলনায় অন্তত সাত গুণ।” (জার্নাল অব আর্টস-এ কারখানা পরিদর্শক ও রেগ্রেভ, ৫ই জানুয়ারি, ১৮৭২)।
৫৭. “রিপোর্ট অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬১, পৃঃ ২৫, ২৬।
৫৮. পরপৃষ্ঠার পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাবে ১৮৪৮ থেকে স্কুলে কারখানা কত বৃদ্ধি পেয়েছিল।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ — কারখানা
এই অধ্যায়ের শুরুতে আমরা যা নিয়ে আলোচনা করেছি, তাকে আমরা বলতে পারি কারখানার শরীর অর্থাৎ একটি প্রণালী হিসাবে সংগঠিত মেশিনারী। সেখান আমরা দেখেছি কিভাবে নারী ও শিশুদের শ্রম করায়ত্ত করে মেশিনারি মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে-যে মানুষেরাই হল ধনতান্ত্রিক শোষণের সামগ্রী; দেখেছি কিভাৰে শ্রমের ঘণ্টা মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বাড়িয়ে, মেশিনারি শ্রমিকের খাটাবার মত শ্রমের সবটাই বাজেয়াপ্ত করে নেয়; এবং দেখেছি কিভাবে শেষ পর্যন্ত তার অগ্রগতি যা সম্ভব করে তোলে আরো আরো অল্প সময়ে আরো আরো বিপুল পরিমাণ উৎপাদন– সেই অগ্রগতি কাজ করে অল্প সময়ের মধ্যে অধিকতর উৎপাদন আদায়ের কিংবা শক্তিকে আরো তীব্র ভাবে শোষণের হাতিয়ার হিসাবে। এখন আমরা আলোচনা করব সমগ্র ভাবে কারখানাটিকে নিয়ে এবং তা তার সবচেয়ে নিতে আকারটিকে নিয়ে।
স্বয়ংক্রিয় কারখানার পিওর (মহাকবি) ড. উরে তাকে বর্ণনা করেন, এক দিকে একটি কেন্দ্রীয় শক্তি দ্বারা নিরন্তর-প্রণাদিত বহু উৎপাদনশীল মেশিনের একটি সংগঠিত প্রণালীকে যত্নধ্য দক্ষতা সহকারে সেবা করার জন্য বিবিধ বর্গের তরুণ বয়স্ক শ্রমিকদের সম্মিলিত সহযোগিতা” (প্রধান চালক) হিসাবে অন্য দিকে, একটি স্বয়ং-নিয়ন্ত্রিত চালক শক্তির অধীনস্থ, একটি অভিন্ন সামগ্রী উৎপাদনের জন্য অব্যাহত সময়ে কর্মরত, বহুবিধ যান্ত্রিক ও বৌদ্ধিক অবয়বের দ্বারা গঠিত একটি বিশাল অটোমেশন” হিসাবে। এই দুটি বর্ণনায় বিস্তর প্রভেদ আছে। একটি বর্ণনায়, যৌথ শ্রমিকটি অথবা মের সামাজিক সংগঠনটি প্রতিভাত হয় আধিপত্যশল কর্তা হিসাবে এবং যান্ত্রিক অটোমেশন তার কর্ম হিসাবে; অন্যটিতে, অটোমেশন নিজেই হচ্ছে কর্তা এবং প্রমিক হচ্ছে কেবল অটোমেশনের অচেতন অবয়বগুলির সঙ্গে সতিসম্পন্ন সচেতন অবয়ব এবং এই অচেতন অবয়গুলির সঙ্গে একযোগে কেন্দ্রীয় চালক শক্তির বশীভূত। প্রথম বর্ণনাটি মেশিনারির প্রত্যেকটি সম্ভাব্য বৃহদায়তন নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; দ্বিতীয় বর্ণনাটি মূলধনের দ্বারা তার ব্যবহারের, এবং সেই কারণেই আধুনিক কারখানাখ্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসূচক। সুতরাং উলে, রে মেশিনটি থেকে গতির সঞ্চার হয়, সেই মেশিনটি কেবল ‘অটোমেশন বলে বর্ণনা করতে চান না, বর্ণনা করতে চান অটোক্র্যাট (স্বৈরন্ত্রী) বলে। এই প্রশ কগুলিতে বাপের মহিয় ক্ষমতা তার, চতুদিকে সমবেত করে অগণিত স্বেচ্ছা প্রণোদিত দাস। [১]
টুল-টির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক যে-দক্ষতা সহকারে টুলটিকে ব্যবহার করে সেই দক্ষতাটাও মেশিনের অীভূত হয়ে যায়। মানুষের শ্রম-শক্তি থেকে যে সীমাবদ্ধতাগুলি অবিচ্ছেদ্য সেগুলি থেকেও মুক্তি পায় টুল-এর কর্মক্ষমত। তার ফলে ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থা যে-কারিগৰি বনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত, সেই বনিয়া ভেসে যায়। সুতরাং ম্যানুফ্যাকচারের বৈশিষ্ট্যসূচক, বিশেষায়িত শ্রমিকদের ক্রমোত কারভেদ ব্যবস্থার জায়গায় স্বয়ংক্রির কারখানায় পদক্ষেপ করে এমন একটা প্রবণতা, যা ঐসব মেশিনের অনুষী শ্রমিকদের প্রত্যেক বকমের কাজকে একটি অভিন্ন সমান মানে পর্যবসিত করে।[২] প্রত্যংশ শ্রমিকদের কৃত্রিম পার্থক্য বিধানের পরিবর্তে প্রচলন লাভ করে বয়স ও নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক পার্থক্য।
যতটা পর্যন্ত শ্রম-বিভাজনের পুনরাবির্ভাব ঘটে, তা হল প্রধানত বিশেষাষিত মেশিনসমূহের মধ্যে শ্রমিকদের বিলিবণ্টন; মিকদের বিভিন্ন ভাগে—অবশ্য, গোষ্ট হিসাবে সংগঠিত নয়, এমন বিভিন্ন ভাগে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বিলিবণ্টন, যে বিভাগগুলিতে প্রত্যেককেই কাজ করতে হয় পাশাপাশি সন্নিবিষ্ট একই রকমের অনেকগুলি মেশিনে; সুতরাং তাদের সহযোগ হল নিছক সরল সহযোগ। ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হল শ্রমিকদের সংগঠিত গোষ্ঠী। এখানে তার মন গ্রহণ করে হেডমিস্ত্রি এবং তার কয়েকজন সহকারীর মধ্যে সংযোগ। মূল বিভাজন হল এক দিকে যারা মেশিনে কাজ করে, সেই সমস্ত শ্রমিক (যাদের মধ্যে এমন কয়েকজন থাকে যারা ইঞ্জিনটির তদারক করে) এবং অন্যদিকে এই সব শ্রমিকের পার্শ্বচর হিসাবে যারা কাজ করে, তারা—এই দুয়ের মধ্যেকার বিভাজন, এই শেষোক্তরা প্রায় সকলেই শিশু। এইসব পার্শ্বচরদের মধ্যে ধরা হয় কমবেশি সমস্ত যোগানদারদের, যারা মেশিনগুলিকে যোগায় যা দিয়ে সেগুলি কাজ করে সেই দ্রব্যসামগ্রী। এই দুটি প্রধান শ্রেণী ছাড়াও, আরো থাকে স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তির একটি শ্রেণী, যাদের কাজ হল গোটা মেশিনারিটি তদারক করা এবং দরকামত মেরামত করা, যেমন ইঞ্জিনিয়ার, মেকানিক, অয়েনার ইত্যাদি। এর এক উৎকৃষ্টতর শ্রেণীর শ্রমিক, যাদের মধ্যে কয়েকজন বৈজ্ঞানিকভাবে শিক্ষিত, অন্যান্যরা একটি বিশেষ কাজে প্রশিক্ষিত; কারখানার কর্ম-শ্রেণী থেকে এৱা স্বতন্ত্র এবং আরে লয়ে অধুমাত্র সংযুক্ত।[৩] এই শ্রম-বিতন নিছক নামমাত্র বিভাজন।
কোন মেশিনে কাজ করতে হলে, এমিককে শেখাতে হবে তার শিশুকাল থেকে, যাতে করে সে অটোমেশনের অভিন্ন ও অবিরাম গতির সঙ্গে তার নিজের নড়াচড়াকে খাপ খাইয়ে নিতে শিখতে পারে। যখন সমগ্র ভাবে মেশিনারিটি হল যুগপৎ ও সাম্য পূর্ণ ভাবে কর্মরত নানাবিধ মেশিনের একটি সমন্বিত প্রণালী, তখন তার উপরে প্রতিষ্ঠিত যে সহযোগ, তাতে প্রয়োজন হয় বিভিন্ন ধরনের মেশিনের মধ্যে বিভিন্ন শ্রমিক গোষ্ঠীকে বণ্টন করে দেওয়া। কিন্তু ম্যানুফ্যাকচার-প্রণালীতে যেমন একটি বিশেষ কাজে একজন শ্রমিককে নিরন্তর বেঁধে রেখে এই বণ্টনকে স্ফটিকায়িত করার কাৰক হয়, মেশিনারির প্রবর্তন সেই আবশ্যকতার অবসান ঘটায়।[৪] যেহেতু গোটা প্রণালীটির গতিবেগ মানুষ থেকে আসে না, আসে মেশিনারির থেকে, সেই হেতু কালে কোন রকমের ব্যাঘাত না ঘটিয়েই, ব্যক্তির অদলবদল ঘটানো যায়। এর সবচেয়ে জাজ্বল্যমান প্রমাণ হচ্ছে ‘দৌড় প্রখা’ (রিলে সিস্টেম )-১৮৪৮-৫০এর বিদ্রোহের কাল থেকে কারখানা মালিকেরা যে প্রথার প্রবর্তন করেছে। সর্বশেষে কচি বয়সের ছেলেমেয়েরা যেমন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে মেশিনের কাজ শিখে ফেলে, তাতে একাভাবে মেশিনারির কাজের জন্য একটি বিশেষ শ্রেণীর কর্মীদের গড়ে তোলার আবশ্যকতা থাকে না।[৫] নিছক পার্শ্বচরদের কাজ সম্পর্কে বলা যায় যে কারখানায় কিছু পরিমানে ঐকাজের জন্য মানুষের বদলে মেশিন বসানো যায়,[৬] এবং তার চর সরলতার তা এই একঘেয়ে কাজের ভারাক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্রুত নিয়মিত পরিবর্তনের ব্যবস্থা করতে পারে।
যদিও তখন, সাধারণ ভাবে বলতে গেলে, মেশিনারি পুরনো অম-বিভাজন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছে, তবু তা কারখানায় টিকে থাকে ম্যানুফ্যাকচার যুগের উত্তগত চিরাচরিত প্রথা হিসাবে এবং পরবর্তীকালে মূলধনের দ্বারা ধারাবাহিক ভাবে পুনঃগঠিত ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় আরো কদর্য আকারে-এ-শক্তিকে শোষণের হাতিয়ার হিসাৰে। একই টুলকে আজীন সেবা করার বিশেষত্বটি এখন রূপান্তরিত হয় একই অতির মেশিনকে সেবা করার আজীবন বিশেষত্বে। শিশুকাল হতেই শ্রমিককে একটি প্রত্যংশ মেশিনের অংশে রূপান্তরিত করার উদ্দেশ্যে মেশিনারিকে লাগানো হয় ভুল কাজে।[৭] এইভাবে কেবল যে তার পুনরুৎপাদনের খরচই উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পায় তাই নয়, সেই সনে একই সমন্ধে সমগ্রভাবে কারখানার উপরে অর্থাৎ এনিকের উপরে তার অসহায় নির্ভরশীলতাও সম্পূর্ণতা লাভ করে। যেমন সর্বত্র, তেমন এখানেও, আমরা একদিকে উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়ার কারণে বুদ্ধিপ্রাপ্ত উৎপাদনক্ষমতা এবং অঙ্গ দিকে সেই প্রক্রিয়াটির ধনতান্ত্রিক শোষণের কারণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত উৎপাদনক্ষমতার মধ্যে আমরা অবশ্যই পার্থক্য করব। হস্তশিল্পে ও ম্যানুফ্যাকচারে এমিক টুল ব্যবহার করে, কারখানায় মেশিন ব্যবহার করে থাকে। সেখানে শ্রম-উপকরণের গতিবেগ উৎসারিত হয় শ্রমিক থেকে, এখানে শ্রমিককেই অনুসরণ করতে হয় মেশিনের গতিকে। ম্যানুফ্যাকচারে শ্রমিকেরা একটি জীবন্ত সংগঠনের বিভিন্ন অংশ। কারখানায় আমরা পাই শ্রমিক থেকে স্বতন্ত্র এক প্রাণহীন সংগঠনকে, শ্রমিক যার কেবল দীবন্ত উপাঙ্গমাত্র। “অন্তহীন একঘেয়েমি ও খাটুনির এই যে শোচনীয় রুটিন যার ভিতর দিয়ে একই যান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্পাদন করতে হয় বারংবার, তা যেন। সিসিফাসের পরিশ্রম। প্রস্তরপিণ্ডের মত অমের বোবা ক্লান্ত শ্রমিকের উপরে ফিরে ফিরে এসে পড়ে।[৮] সেই সঙ্গে কারখানার কার আয়ুতন্ত্রকে সম্পূর্ণ ভাবে নিঃশেষিত করে দেয়; তা পেশীর বহুমুখী ফুরণের অবসান ঘটায় এবং দেহ ও মনের উভয়েরই কাজকর্মের স্বাধীনতার প্রত্যেকটি পরমাণু বাজেয়াপ্ত করে দেয়।[৯] শ্রমকে হালকা করার মানেও গিয়ে দাড়ায় এক ধরনের অত্যাচার, কেননা মেশিন শ্রমিককে কাল থেকে মুক্তি দেয় না, কিন্তু তার কাজকে বঞ্চিত করে সর্বপ্রকার আকর্ষণ থেকে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন, যা কেবল একটি শ্রম-প্রক্রিয়াই নয়, সেই সঙ্গে উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদকেরও একটি প্রক্রিয়া—সেই ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রত্যেকটি ধরনের মধ্যেই একটি জিনিস অভিন্ন; তা এই যে এখানে শ্রমিক মোপকরণকে খাটায় না, শ্রমোপকরণই শ্রমিককে খাটায়।. কি কেবল কারখানা-ব্যবস্থাতেই সর্বপ্রথম এই একান-বিপর্যয় একটি প্রকৌশলগত ও প্রত্যক্ষ-গোচর বাস্তব আকার লাভ করে। অটোমেশনে রূপান্তরিত হয়ে এমেৱ উপকরণ প্রক্রিয়া চলাকালে শ্রমিকের মুখোমুখি হয় মূলধনের আকারে, মৃত মের আকারে যা জীবন্ত শ্রমশক্তির উপরে আধিপত্য করে এবং তাকে নিঙড়ে শুষ্ক করে দেয়। দৈহিক শক্তি থেকে উৎপাদনের মানসিক শক্তিসমূহেৱ বিচ্ছে এবং শ্রমের উপরে মূলধনের পরাক্রম হিসাবে ঐ শক্তিসমুহের রূপান্তরণ চুড়ান্ত ভাবে সম্পন্ন হয় মেশিনারির বনিয়াদের উপরে প্রতিষ্ঠিত আধুনিক শিল্পের দ্বারা, যা আমরা আগেই দেখিয়েছি। কারখানা ব্যবস্থার মধ্যে মুক্তি পেয়েছে যে বিজ্ঞান, প্রচণ্ড শারীরিক বল ও পুঞ্জীভূত শ্রম, তার সামনে প্রত্যেকটি তুচ্ছ ব্যক্তিগত কারখানা-কর্মীর বিশেষ দক্ষতা একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রাশি হিসাবে অন্তহিত হয়ে যায় এবং উক্ত ব্যবস্থাটির মনে একযোগে “মনিব”-এর শক্তিতে পরিণত হয়। সুতরাং এই মনিব, যার মাথায় মেশিনারিটি এবং তার উপরে তার একচেটিয়া অধিকার অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছে, সে যখনি তার “হাতগুলি”-র সরে বিরোধে আসে, তখনি তাচ্ছিল্যভরে তাদেরকে বলে, কারখানা কর্মীদের এটা সর্বসময়ে স্মরণে রাখতে হবে যে, সত্য সত্যই তাদের দক্ষ-শ্রম হচ্ছে নিকৃষ্ট জাতের; এবং এমন আর কিছু নেই যা আরো সহজে আয়ত্ত করা যায়; কিংবা তার যা গুণমান তাতে আরো বেশি পারিশ্রমিক দেওয়া যায়; কিংবা যা সামান্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সবচেয়ে কম কুশলী কমী আবো তাড়াতাড়ি আরো প্রচুর ভাবে অর্জন করতে পারে।……… কমার শ্রম ও দক্ষতা তত দু’মাসের প্রশিক্ষণেই শেখা যায় এবং একজন মামুলি শ্রমিক তা শিখে নিতে পারে; তার শ্রমের তুলনায় মনিবের মেশিনারি উৎপাদনকার্যে গ্রহণ করে সত্য সত্যই টের বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।[১০] শ্রম-উপকরণসমূহের একটানা অভিন্ন গতিবেগের কাছে শ্রমিকের প্রযুক্তিগত বশ্যতা এবং কর্মনিযুক্ত জনসমষ্টির অদ্ভুত গঠন, যার মধ্যে আছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সের ব্যক্তি—এই উভয়ে মিলে সৃষ্টি করে এক ব্যারাকসুলভ শৃংখলা, যা কারখানায় বিস্তার লাভ করে একটি পূর্ণায়ত প্রণালীতে এবং যা পরিপূর্ণ ভাবে বিকশিত করে পুর্বোক্ত তদারকির কাজটিকে এবং তা কর্ম-নিযুক্ত জনসমষ্টিকে ভাগ করে দেয় দুটি ভাগে-কর্মী ও তদারককারীতে, শিল্প সেনাবাহিনীর সৈন্য ও সার্জেন্ট। স্বয়ংক্রিয় কারখানায় প্রধান সমস্যা দেখা দেয় এলোমলো কাজের অভ্যাসগুলি পরিত্যাগে শ্রমিকদের শিক্ষিত করে তুলতে এবং জটিল অটোমেশনের অপরিবর্মীয় নিয়মিকতার সঙ্গে তাদের একাত্ম করে তুলতে। কারখানাগত প্ৰম-প্রণালীর প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি সফল শৃঙ্খলা-বিধিত প্রণয়ন ও প্রয়োগই হচ্ছে আাইটের হার্কিউলিয়াস-লত উদ্যমশীলতায় মহৎ সাফল্য। এমন কি আজও পর্যন্ত, যখন সমগ্র ব্যবস্থাটি নিখুত ভাবে সংগঠিত এবং শ্রম যথাসম্ভব লঘুত, তখনো সাবালকত্ব-অতিক্রান্ত ব্যক্তিদের উপযুক্ত কারখানা-কমীতে রূপান্তরিত করা অসম্ভব বলে প্রতিভাত হয়।[১১] অন্যান্য ক্ষেত্রে বুর্জোয়া শ্রেণী যে দায়িত্ব-বিভাজনকে এত সমর্থন জানায়, প্রতিনিধিত্বমুলক ব্যবস্থার প্রতি আরো বেশি সমর্থন জানায়, সেই দায়িত্ব-বিভাজন ও প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থাকে দূরে সরিয়ে রেখে মূলধন এখানে কাজ করে একজন বেসরকারি বিধায়ক হিসাবে এবং তার স্বেচ্ছা অনুসারে প্রণয়ন করে এমন কারখানা-বিধি যাতে সে বিধিবদ্ধ করে তার স্বৈরতন্ত্র; বৃহদায়তন সহযোগে এবং শ্রম-উপকরণসমূহের বিশেষ করে, মেশিনারির, যৌথ ব্যবহারে যে-সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন দেখা দেয়, এই শৃংখলা-বিধি তার একটি ব্যরূপ। দাস চালকদের চাবুকের জায়গা নেয় তদারককারির পেনাল্টি-বুক” সাজার খাতা”। সমস্ত সাজা বা শাস্তিই পর্যবসিত হয় জরিমানায় বা মজুরি-কাটায় এবং কারখানার বিধান-দাতা লাইকারগাস এমন ভাবে সব কিছুর ব্যবস্থা করে যে তার আইন মানলে তার যে লাভ হয়, ভাঙলে লাভ হয় তার চেয়ে বেশি।[১২]
যে বাস্তব অবস্থার মধ্যে কারখানায় কাজ করতে হয়, এখানে আমরা কেবল ভাৱ আস দেব। ধনপন্নিবিষ্ট মেশিনারির ভীড়ে জীবন ও অঙ্গহানির বিপদ তো আছেই, ঋতু-ক্রমিক নিয়মিত অনুসারে শিল্পমুদ্ধে নিহত ও আহত সৈনিকদের তালিকা প্রকাশ তো আছেই, তা ছাড়া প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয় সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃত্রিমভাবে বর্ধিত তাপমাত্রার দ্বারা, ধুলি-ভারাক্রান্ত আবহাওয়ার দ্বারা।[১৩] উৎপাদনের সামাজিক উপায়-উপকরণের মিথ্যয়, কারখানা-ব্যবস্থাঁর গরম ঘরে পরিণত ও প্রকোপিত হয়ে, মূলধনের হাতে রূপান্তরিত হয় কর্মরত শ্রমিকের জীবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার ধারাবাহিক লুণ্ঠনে-লুণ্ঠন স্থান, আলো ও বাতাসের, লুণ্ঠন উৎপাদন-প্রক্রিয়া-সংশ্লিষ্ট কতকগুলি বিপজ্জনক ও ক্ষতিকারক অনুষদের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত সুরক্ষার; প্রমিকের আরামের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহের লুণ্ঠনের কথা নাইবা উলেখ করলাম।[১৪] রিয়ার যখন কারখানাকে অভিহিত করেন “উত্তপ্ত কারাগার” বলে, তখন কি তিনি ভুল করেন?[১৫]
————
১. উরে, “রিপোর্ট অব ফ্যাক্টরি, পৃঃ ১৮।
২. উরে, “রিপোর্ট অব ফ্যাক্টরি, পৃঃ ৩১। দ্রষ্টব্য কার্ল মার্ক, পভাটি অব ফিলসফি”, পৃ ১৪০-১৪১।
৩. মনে হয় ইচ্ছা করেই পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে (অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই ধরনের বিভ্রান্তি-সৃষ্টির বিস্তারিত প্রমাণ দেওয়া সম্ভব ), যখন ইংল্যাণ্ডের কারখানা আইন তার পরিধি থেকে শেষোক্ত শ্রেণীকে বাইরে রেখেছে, তখন পার্লা মেন্টারি রিটার্ণ কারখানা-কর্মীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে কেবল ইঞ্জিনীয়ার ও মেকানিকদেরই নয়-সেই সঙ্গে ম্যানেজার, সেলসম্যান, মেসেঞ্জার, ওয়ারহাউজ-ম্যান, প্যাকার ইত্যাদিকেও—এক কথায়, স্বয়ং কারখানা-মালিককে ছাড়া বাকি সবাইকেই।
৪. উরে এটাকে মেনে নেন। বলেন, “প্রয়োজনের সময়ে”, ম্যানেজারের ইচ্ছামত আমিকদের এক মেশিন থেকে অন্য মেশিন সরিয়ে নেওয়া যায়, এবং তিনি বিজয়ীর মত ঘোষণা করেন, “পুরনো যে-রুটিন প্রমকে বিভক্ত করে এবং একজন শ্রমিককে কাজ দেয় অচের মাথা তৈরি করার, আরেকজনকে চুচলো করার, সেই রুটিনের সঙ্গে এই ধরনের অদল-বদল সম্পূর্ণ পরিপন্থী।” তার পক্ষে ঢের ভাল হত যদি তিনি নিজেকে প্রশ্ন করতেন, কেন এই “পুরনো রুটিন” অটোমেটিক কারখানা থেকে প্রস্থান করে কেবল প্রয়োজনের সময়ে”?
৫. যখন দুর্দশা খুবই বেশি হয়, যেমন আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়ে, তখন কারখানা-কমীকে ‘বুর্জোয়া এখন-তখন রাস্তা তৈরির মত অত্যন্ত বেয়াড়া কাজেও নিয়োগ করে। দুঃস্থ তুলো-শ্রমিকদের সাহায্যের জন্য স্থাপিত ১৮৬২ ও তার পরবর্তী বছরগুলির ইংরেজ জাতীয় কর্মকাণ্ড এবং ১৮৪৮ সালের ফাসী ‘জাতীয় কর্মকাণ্ড মধ্যে পার্থক্য কেবল এই যে, দ্বিতীয়টিতে রাষ্ট্রের খরচে শ্রমিকদে করতে হত অনুৎপাদনশীল কাজকর্ম আর প্রথমটিতে তাদের করতে হত বুর্জোয়াদের স্বার্থে পৌর কর্ম এবং তা-ও আবার করতে হত নিয়মিত কমার তুলনায় সস্তায় এবং এইভাবে তাদের ঠেলে দেওয়া হত নিয়মিত কর্মীদের তুলনায় প্রতিযোগিতায়। “তুলো শ্রমিকদের দৈহিক চেহারা নিঃসন্দেহে উন্নত হয়েছে। আমি এটা আবোপ কৰি… কারখানার বাইরে পূর্ত-কাজে নিযুক্ত থাকার উপরে।” (“রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর’ ১৮৬৩, পৃঃ ৫৯)। লেখক এখানে উল্লেখ করছেন প্রেস্টন ফ্যাক্টরি শ্রমিকদের কথা, যাদের নিযুক্ত করা হয়েছিল প্রস্টন মুর’-এ।
৬. একটি দৃষ্টান্ত : ১৮৪৪ সালের আইনের পর থেকে এমকে স্থানচ্যুত করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের যান্ত্রিক অ্যাপারেটাস’-এর প্রবর্তন। “মেশিনারির মধ্যে, সম্ভবত, স্বয়ংক্রিয় ‘মিউল’-ই অন্য যে-কোনো ধরনের মেশিনারির মতই বিপজ্জনক। এখানে বেশির ভাগ দুর্ঘটনাই ঘটে ঘোট ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে, যখন ‘মিউল চালু থাকা কালে তাদের হামা দিয়ে তার নিচে যেতে হয় মেঝে ঝাড় দেবার জন্য। এই অপরাধের জন্য বেশ কয়েকজন তদারককারীকে জরিমানা করা হয়েছে, কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো ফল হয়নি। যদি মেশিন-প্রস্তুতকারকেরা কেবল একটা স্বয়ংক্রিয় সম্মার্জনী (সেলফ, সুইপার) উদ্ভাবন করতে পারেন, যার ফলে শিশুদের আর মেশিনের নীচে যাওয়ার দরকার হবে না, তা হলে সেটা হবে আমাদের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাগুলিতে একটি সুখকর সংযোজন। রিপোটল অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮, পৃঃ ৬৩)।
৭. তা হলে, এই হল প্রধোর আশ্চর্য ভাবনা। তিনি একটি মেশিনারিকে উপস্থাপিত করেন শ্রমের উপকরণসমূহের সমন্বয় হিসাবে নয়, স্বয়ং শ্রমিকেরই সুবিধার জন্য প্রত্যংশ প্রক্রিয়াসমূহের সমন্বয় হিসাবে।
৮. এফ. এঙ্গেলস, “Die Lage der arbeitenden classe in England.” p. 217. এমন কি মি. মলিনারির মত একজন সাধারণ ও আশাবাদী ব্যবসায়ী পর্যন্ত T679, “Un homme s’use plus vite en surveillant, quinze heures par jour, l’evolution uniforme d’un mecanisme, qu’en exercant, dans le meme espace de temps, sa force physique. Ce travail de survei llance qui servirait peut-etre d’utile gymnastique a l’intelligence, s’il d’etait pas trop prolonge, detruit a la longue, par son exces, et l’intelligence, et le corps meme.” (G. de Molinari : “Etudes Economiques.” Paris, 1846.)
৯. এফ. এঙ্গেলস, ঐ, পৃঃ২১৬।
১০. “দি মাস্টার স্পিনার্স অ্যাও ম্যানুফ্যাকচারার্স ডিফেন্স-ফাণ্ড। রিপোর্ট অব দি কমিটি। ম্যাঞ্চেস্টার, ১৮৫৪, পৃঃ ১৭। এর পরে আমরা দেখব, ‘মাস্টারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা গানও গাইতে পারে, যখন তার সামনে দেখা দেয় তার জীবন্ত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটি হাৱাবার আশংকা।
১১. উৱে ‘দি ফিলসফি অব ম্যনুফ্যাকচারার্স পৃঃ ১৫। যিনিই আর্কাইটের জীবন-ইতিহাস জানেন, তিনি কখনো এই পরামানিক প্রতিভাকে “মহৎ” বলে অভিহিত করবেন না। আঠারো শতকের সমস্ত বিরাট উদ্ভাবকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যান্য লোকের উদ্ভাবনগুলি চুরি করার ব্যাপারে সবচেয়ে বিরাট চোর এবং সবচেয়ে জঘন্য ব্যক্তি।
১২. বুর্জোয়া শ্রেণী যে-ক্রীতদাসত্বে প্রটোরিয়্যাট শ্রেণীকে বেঁধেছে, তা কারখানা ব্যবস্থায় যেমন দিনের আলোয় খোলাখুলি বেরিয়ে আসে আর কোথাও তেমন ভাবে আসে না। এই ব্যবস্থায় সমস্ত স্বাধীনতার ইতি ঘটে—কার্যত ও আইনতঃ। শ্রমিক অবশ্যই কারখানায় হাজির হবে সাড়ে পাঁচটায়। যদি তার আসতে কয়েক মিনিট দেরি হয়, তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। যদি ১০ মিনিট দেরি হয়, তাকে প্রাতরাশের আগে ঢুকতে দেওয়া হবে না এবং এই ভাবে সে হারাবে ৪ দিনের মজুরি। তাকে খেতে, পরতে, ঘুমোত হবে মুখের হুকুমে।’ স্বৈরতন্ত্রের ঘণ্টা তাকে ডেকে তোলে তাকে খাবার টেবিল থেকে। এবং ‘মিলে অবস্থা কি? সেখানে মালিকের কথাই নিরঙ্কুশ আইন। সে যেমন খুশি, তেমন আইন তৈরি করে; সে তার মর্জিমত তার অদল-বদল, ও যোগ-বিয়োগ করে, এবং সে যদি আজগুবি অর্থহীন কোন কিছুকে আইনের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়, তা হলে আদালত শ্রমিককে বলবে যেহেতু তুমি স্বেচ্ছায় এই চুক্তিতে প্রবেশ করেছ, সেই হেতু তোমাকে তা মেনে চলতে হবে। তাদের নয় বছর বয়স থেকে তাদের মৃত্যু পর্যন্ত শ্রমিকে কুণ্ডিত হয় এই মানসিক ও দৈহিক নির্যাতনে। (এফ এজেলস, Die lage der arbeitenden kalasse in Eagland, Leipzing, 1845, পৃ ১১৭)। আদালত কি বলে, দুটি পৃষ্ঠা সাহায্যে আমি তা হাজির করব। একটা ঘটে শেফিতে ১৮৬৬ সালের শেষে। ঐ শহরে একজন শ্রমিক একটা ইস্পাত-কারখানায় দু বছরের জন্য নিজেকে কাজে লাগায়। নিয়োগকর্তার সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় সে ঐ কারখানা ছেড়ে যায় এবং যোব করে, কোনো অবস্থাতেই সে আর ঐ মালিকের অধীনে কাজ করবে না। চুক্তিকে দায়ে সে অভিযুক্ত হয় এবং দু মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। (মালিক যদি চুক্তি ও করে, তা হলে তার বিরুদ্ধে কেবল দেওয়ানি মামলা করা যায় এবং আর্থিক ক্ষতি-পূর্ব ছাড়া আর কোনো কিছুরই ঝকিই তার উপরে কর্তায় না। দু মাস কারাদণ্ড ভোগের পরে ঐ শ্রমিক যখন বেরিয়ে এল, মালিক তাকে তার চুক্তি অনুসারে আবার কাছে যোগ দেবার জন্য আহ্বান করল। শ্রমিক বলল, না, সে ইতিমধ্যেই চুক্তিভজে এ দণ্ড ভোগ করেছে। মালিক তার বিরুদ্ধে আবার নালিশ করে, আদালত বা তাকে দণ্ডিত করে, যদিও মিঃ শী নামে একজন বিচারক একে আইনের দানীয় বিকৃতি বলে প্রকাশ্যেই নিন্দা করেন-এটা এমন একটা বিকৃতি যার ফলে একই অপরাধের জন্য একজনকে পর্যায়ক্রমিক ভাবে আজীবন দণ্ডিত করা যায়। এই রায় কোনো মফস্বলের গবুচন্দ্রের রায় নয়, লণ্ডনের অন্যতম সর্বোচ্চ আদালতের রায়। [ চতু জার্মান সংস্করণে সংযোজিত এখন এর অবসান ঘটানো হয়েছে। সেখানে সাধারণ গাস-ওয়ার্কস জড়িত, এমন সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া, চুক্তিভরে ক্ষেত্রে এখন ইংল্যাণ্ডে শ্রমিক এবং মালিকের একই অবস্থান এবং উভয়ের বিরুদে কেবল দেওয়ানি ভাবেই মামলা করা যায়।-এফ এঙ্গেলস। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে উইলয়ারে, ১৮৬৩ সালে নভেম্বরের শেষ দিকে। ওয়েস্টবেরি লেইতে অবস্থিত লিওয়ের মিলে হারাপ নামে এক কাপড়-কল-মালিকের অধীনে কর্মরত প্রায় ৩০ জন পাওয়ারলুম-ততী ধর্মঘট করে, কারণ মালিকের একটা অমায়িক অভ্যাস ছিল সকালে আসতে দেরী হবার জন্য শ্রমিকদের মজুরি কেটে নেয়া। ২ মিনিটের জন্য ৬ পেন্স, ৩ মিনিটের জন্য ১ শিলিং, ১০ মিনিটের জন্য ১ শিলিং পেল। এটা ছিল ঘণ্টা-পিছু ৯ শিলিং এবং দিন-পিছু ৫ ৪ ১. শিলিং হারে; যেখানে একজন শ্রমিকের সাপ্তাহিক মজুরি এক বছরের গড়পড়তা ভিত্তিতে কখনো ১০ থেকে ১২ শিলিং-এর বেশি হত না। কাজ শুরুর সময় ঘোণ করার জন্য যারা এখন বালককে নিযুক্ত করেছিল। সে বা বাজিয়ে তা ঘোয়ল করত এক প্রায়ই তা বড় সকালে টানার আগেই। ঐ সময়ের মধ্যে যদি সমস্ত কী সেখানে হাজির না হতে পারত, দরজা বন্ধ করে দেওয়া হত, আর যারা বাইরে পড়ে থাকত, তাদের জরিমানা দিতে হত; এবং যেহেতু সেখানে কোন ঘড়ি ছিল না, সেই হেতু বেচারা শ্রমিকদের নির্ভর করতে হত হারাপের প্রেরণায় অনুপ্রেরিত বাচ্চা-বয়সী সময়-ক্ষটির উপরে। ধর্মঘটি কর্মীরা-মায়েরা ও মেয়েরা-প্রস্তাব দিল যে তারা কাজে যোগ দেবে, যদি সময়-রক্ষী বাচ্চাটার বদলে একটা ঘড়ির ব্যবস্থা করা হয় এবং জরিমানার কিছুটা যুক্তিসঙ্গত হয়। চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে হারাপ ১৯ জন মহিলা ও বালিকাকে ম্যাজিস্ট্রেট-এর কাছে সমন করল। উপস্থিত সকলের ক্রোধ উৎপাদন করে ম্যাজিস্ট্রেট প্রত্যেকের উপরে ৬ পেন্স করে জরিমানা এবং ২ শিলিং ৬ পেন্স করে মামলার খরচ বাবদ চাপিয়ে দিল।মালিকদের একটা মনোমত কাজ হল শ্রমের উপকরণেও সামগ্রিক ত্রুটির জন্য শ্রমিকদের মজুরি কেটে নিয়ে তাদের শাস্তি দেওয়া। এই পদ্ধতির ফলে ১৮৬৬ সালে মৃৎশিল্পে এক সাধারণ ধর্মঘটের উদ্ভব হয়। শিশু-নিয়োগ কমিশন’ (১৮৬৩-৬৬) যেসব বিপোর্ট দিয়েছে, তাতে এমন বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ আছে, যেখানে শ্রমিক কোনো মজুরি তো পায়ই না, উটে, তার শ্রমের বাবদে এবং শাস্তিমূলক বিবিধ ব্যবস্থার বাবদে তার সুযোগ্য মালিকের দেনাদারে পরিণত হয়। মজরি থেকে কেটে নেবার ব্যাপারে কারখানার স্বৈরপতিরা যে প্রাজ্ঞতার প্রদর্শন করে, তার মহান দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় সর্বশেষ তুলো-সংকটের সময়ে আর বেকার নামে কারখানা-পরিদর্শক বলেন, এই দুঃসহ যন্ত্রণাকর সময়ে তার অধীনে কর্মরত কয়েকজন অল্পবয়সী কর্মীর মজুরি থেকে মাথা পিছু ১০ পেন্স করে কেটে নেবার জন্য সম্প্রতি আমি নিজে একজন তুলোকল মালিকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করার নির্দেশ দিয়েছি। এদের মজুরি কেটে নেওয়া হয় সার্জনের সার্টিফিকেটের জন্য, (যে-বাবদে মালিক নিজে দিয়েছে মাত্র ৬ পেন্স); এর জন্য আইনতঃ ৩ পেন্স কেটে নেওয়া যায় কিন্তু কিছুই কেটে নেবার রীতি নেই। এবং আমাকে আরেকজনের কথা জানানো হয়েছে যে, আইনের বাইরে থেকে একই লক্ষ্য সাধনের জন্য তার অধীনস্থ গরিব শিশুদের কাছ থেকে তাদের তোকাটার শিল্পকলা ও রহস্য শেখানোর নাম করে ১ শিলিং করে আদায় করে; যে মহতে সার্জন তাদের ঐ পেশার জন্য যোগ্য ও সঠিক ব্যক্তি বলে ঘোষণা করে, সেই মহুর্তেই মালিক এই টাকাটা আদায় করে নেয়। সুতরাং, ধর্মঘটের মত অস্বাভাবিক প্রদর্শনীর নেপথ্য কারণ অবশ্যই থাকতে পারে—কেবল সেখানেই নয়, যেখানে তা আত্মপ্রকাশ করে, কিন্তু বিশেষ করে আজকের মত সময়ে ব্যাখ্যা না করলে এই নেপথ্য কারণ জনসাধারণের কাছে অবোধ্যই থেকে যায়। তিনি এখানে উল্লেখ করছেন ১৮৬৩ সালের জুন মাসে ভারওয়েনে পাওয়ারলুম তাদের ধর্মঘটটির কথা। (“রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরি, ৩০ এপ্রিল ১৮৬৩, পৃঃ ৫০-৫১)। এ রিপোর্টগুলি সব সময়ই তাদের সরকারী তারিখকে ছাড়িয়ে যেত।
১৩. বিপজ্জনক মেশিনারির বিরুদ্ধে কারখানা-আইনগুলি যে-নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে, তার একটা কল্যাণকর ফল ফলেছে। কিন্তু ২০ বছর আগে যেগুলি ছিল না, এখন বিপদের নানাবিধ নোতুন উৎস দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, একটি মেশিনারির বর্ধিত গতিবেগ। চাকা, বোলার, টাকু এবং মাকু এখন চালিত হয় বর্ধিত ও বর্ধমান গতিবেগ; ছিড়ে যাওয়া সুতো তুলে নেবার জন্য আঙুলগুলিকে হতে হয় আরো ক্ষিপ্র, আরো দক্ষ; যদি কোনো রকমে দ্বিধা বা অসতর্কতা ঘটে যায়, তা হলে সেগুলি চলে যাবে।’বহু সংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটে শ্রমিকদের তাড়াতাড়ি কাজ সেয়ে ফেলার ব্যগ্রতায়। মনে রাখতে হবে যে, মালিকের সবচেয়ে বড় স্বার্থই হল মেশিনকে গতিশীল রাখা অর্থাৎ সুতো ও জিনিসপত্র তৈরি করে যাওয়া। প্রত্যেকটি মিনিটের ছেদ মানে কেবল শক্তিরই অপচয় নয়, উৎপাদনেরও ক্ষতি; এবং এটা শ্রমিকদের কম বড় স্বার্থ নয়—দের মজুরি দেওয়া হয় উৎপন্ন দ্রব্যের ওজন বা সংখ্যা হিসাবে, তাদের পক্ষে-যে, মেশিন সচল থাক। কাজে কাজেই যদিও মেশিন চালু থাকা কালে, তা পরিষ্কার করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ, তবু কার্যক্ষেত্রে মেশিন চালু থাকা কালেই তা পরিষ্কার করা রেওয়াজে দাড়িয়ে গিয়েছে। যেহেতু পরিস্কার করার জন্যে কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না, শ্রমিকেরা চায় যত তাড়াতাড়ি পারা যায় এই কাজটা সেরে ফেলা। এই কারণেই শুক্রবার ও শনিবার অন্যান্য বারের তুলনায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটে। শুক্রবার আগের চার দিনের তুলনায় দুর্ঘটনা ঘটে ১২ শতাংশ বেশি এবং শনিবার আগের পাঁচ দিনের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। কিংবা যদি শনিবারগুলির কাজের ঘন্টা হিসাবে ধরা হয়—অন্যান্য দিনের ১ ঘণ্টার তুলনায় শনিবারের ৭ ঘণ্টা-তাহলে বাকি পাঁচদিনের গড়ের তুলনায় শনিবারগুলিতে বাড়তি থাকে ৬৫ শতাংশ।” (“রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরি ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৬, ৯, ১৫, ১৬, ১৭)।
১৪. তৃতীয় খণ্ডে প্রথম বিভাগে আমি ইংরেজ ম্যানুফ্যাকচারারদের একটি সাকি অভিযানের বিবরণ দেব; কারখানা-আইনের যে-সমস্ত ধারায় বিপনক মেশিনারির বিরুদ্ধে “হাতগুলির নিরাপত্তামূলক সংস্থান আছে। এই অভিমান সেই সমস্ত ধারার বিরুদ্ধে। আপাততঃ লেজার্ড হর্ণারের সরকারি রিপোর্ট থেকে একটি উদ্ধৃতি দেওয়াই যথেষ্ট : “কিছু মিল-মালিকের মুখে আমি শুনেছি কয়েকটি দুর্ঘটনা সম্পর্কে এমন লম্বু ভাবে কথা বলতে যে তা অমার্জনীয়, যেমন, একটা আঙুল হারান একটা তুচ্ছ ব্যাথরি। একজন শ্রমিকের জীবিকা ও ভবিষ্যৎ আঙুলের উপরে এত নির্ভরশীল, যে তার কোনো ক্ষয়-ক্ষতি তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন এই ধরনের বিবেচনাহীন কথা আমি শুনেছি, আমি প্রশ্ন কৱেছি, মনে করুন, আপনার আনো একজন খমিক চাই, এবং দুজন আপনার কাছে আবেদন করল; দুজনই বাকি সব বিষয়ে সমান সম্পন্ন, কিন্তু একজনের একটি বৃদ্ধা বা তর্জনী নেই; আপনি কাকে নিযুক্ত করবেন? উত্তর সম্পর্কে আমি কখনো দ্বিধা দেখিনি। (“রিপোর্টস ক্যাক্টরি, ৩১ অটোবর, ১৮৫৫”)। এই মালিকেরা চালাক লোক এবং তারা যে গোলা মালিকদের বিদ্রোহের ব্যাপারে উৎসাহী, তা অকারণ নয়।
১৫ যেসব কারখানা সবচেয়ে দীর্ঘকাল ধরে কারখানা-আইনসমূহ এবং তাদের বাতাৰুক সময়সীমার আওতায় রয়েছে, সেগুলিতে অনেক পুরানো অনাচারের অবসান ঘটেছে। মেশিনারির উন্নয়নই কিছু পরিমাণে দাবি করে উন্নত ধরনের বানি নির্মাণ এক তা হয় শ্রমিকদের পক্ষে সুবিধাজনক। (কারখানা পরিদর্শকের বিপ: ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৩, পৃঃ ১৩৯ ব্রষ্টব্য।)।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ — শ্রমিক এবং মেশিনের মধ্যে বিরোধ
যখন থেকে মূলধনের জন্ম, তখন থেকেই চলেছে ধনিক এবং মজুরি-শ্রমিকের মধ্যে বিৰে। এই বিরোধ চলেছে গোটা ম্যানুফ্যাকচার-আমল জুড়ে। কিন্তু কেবল মেশিনারি প্রবর্তনের কাল থেকেই শ্রমিক লড়াই করছে স্বয়ং শ্রম-উপকরণটিই বিরুদ্ধে-মূলধনের বস্তুগত মূর্তরূপ হিসাবে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির মত ভিত্তি হিসাবে উৎপাদনউপায়ের এই বিশেষ রূপটির বিরুদ্ধেই তার বিদ্রোহ।
সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রায় সমগ্র ইউরোপ প্রত্যক্ষ করেছে এমিক-জনগণের অনেক বিদ্রোহ-‘রিবন ও ‘ট্রমিং বোনার মেশিন ‘রিন-লুম’-এর বিরুদ্ধে, জার্মানিতে যে-মেশিনকে বলা হয় ব্যামিউল, গুরমিউল’ ও ‘মিউলেনস্টল’। এই মেশিন উদ্ভাবিত হয়েছিল জার্মানিতে। ১৫৭৯ সালে লেখা কিন্তু ১৬৩৬ সালে ভেনিসে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে আব্বে ল্যানসেলোর বলেন, “প্রায় ৫০ বছর আগে ভ্যানজিগের অ্যানি স্যুলার শহরে একটি অতি সুকৌশল মেশিন দেখেছিলেন, যেটি একসঙ্গে চার থেকে ছটি করে ‘পিস বোনে। কিন্তু মেয়র আশংকা করলেন যে এর ফলে বহুসংখ্যক শ্রমিককে রাস্তায় বাড়াতে হতে পারে। তাই তিনি সংগোপনে মেশিনটির উদ্ভাবকে মৃত্যু ঘটালেন—হয় গলা টিপে, নয়তো, জলে ডুবিয়ে। লেইডেনে এই মেশিনটি ১৬২৯-এর আগে পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়নি; এবং সেখানে শেষ পর্যন্ত রিবন-য়নকারীদের দাঙ্গা-হাঙ্গামার ফলে পুরসভা মেশিনটি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হন। লেইতেনে এই মেনিটি প্রবর্তন প্রসঙ্গে বক্সহর্ণ (ইনস্ট, পল, ১৬৬৩) বলেন, “In hac urbe, ante hos viginti circiter annos instrumentum quidam invenerunt textorium, quo solus plus panni et facilius conficere poterat, quan plures aequali tempore. Hinc turbae ortae et querulae textorum, tandemque usus bujus instrumenti a magistratu prohibitus est.” ১৬৩২, ১৬৩৯ ইত্যাদি সালে এই ‘লুম-টির কম-বেশি নিষেধাত্মক বিভিন্ন আইন জারির পরে হল্যাণ্ডের স্টেটস জেনারেল শেষ পর্যন্ত ১৫ই ডিসেম্বর ১৬৬১ সালের বিধান-বলে শর্তসাপে ভাবে এই মেশিন ব্যবহারের অনুমতি দান করেন। ১৯৭৬ সালে যখন এই মেশিনটির প্রবর্তনের ফলে ইংল্যাণ্ডে শ্রমিকদের মধ্যে বিক্ষোভ চলছিল, তখন কোলোনেও এটি নিষিদ্ধ বলে মোৰিত হয়। ১৮৮৫ সালে ১৯শে ফেব্রুয়ারি সম্রাটের এক হুকুমনামা সমগ্র জার্মানিতে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেয়। হামবুর্গে সিনেট-এর আদেশে এটিকে সর্বসমক্ষে দাহ করা হয়। ১৭১৯ সালে ১ই ফেব্রুয়ারি সম্রাট ঠ চাল। ১৬৮৫ সালের হুকুমনামাটি আবার জারি করেন, এবং ১৭৬৫ সালের আগে নির ইলেক্টোরেটে এটিকে প্রকাশ্যে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই মেশিন, ইউরোপের ভিৎ পর্যন্ত কাপিয়ে দিয়েছিল এবং এটিই হল মিউল ও পাওয়ারলুমের এই অষ্টাদশ শতকের শিয়-বিপ্লবের-পুর্বসুরী। এই মেশিনটির সাহায্যে একটি অনভিজ্ঞ বালকও পারত কেবলমাত্র একটি রডকে আগে-পিছে চালনা করে একটি গোটা তাকে তার সবকটি মাকু (শাটল) সমেত চালু করতে; এবং এর উন্নত সংস্করণটির সাহায্যে একই সঙ্গে ৪০ থেকে ৫০টি ‘পিস’ বোনা যেত।
১৬৩০-এর নাগাদ, লণ্ডনের অদূরে একজন ওলন্দাজ কর্তৃক স্থাপিত, একটি বায়ুতাড়িত করাতকল জনতার বাড়াবাড়ির ফলে বন্ধ করে দিতে হয়। এমনকি আঠারো শতকের সুচনাকাল পর্যন্ত জল-তাড়িত করাতকলগুলি খুবই কষ্টে জনতার বিরাধিতা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল, কেননা সেই বিরোধিতার পেছনে ছিল পার্লামেন্টের সমর্থন। ১৭৫৮ সালে এভারেট সর্বপ্রথম জলশক্তি-তাড়িত পশম-কাটা কল স্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গেই ১,৩,০০০ কর্মচ্যুত লোক তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পশম পাট, করে যারা জীবিকা নির্বাহ করত এমন ৫০,০০০ মানুষ আর্কাইট-এর ক্রিবলিং মিল ও কার্ডিং ইঞ্জিনের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের কাছে আবেদন জানায়। প্রধানতঃ পাওয়ারলুম প্রচলনের কারণে এই শতাব্দীর প্রথম ১৫ বছরে মেশিনারি থবংসের যে বিরাট অভিযান চলে, লুভাইট আন্দোলন নামে যা পরিচিত, সেই এনিই সিডমাউথ, ক্যালরিখ-এর মত জ্যাকোবিন-বিরোধী সরকারগুলির পক্ষে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ও পীড়নমূলক আইন প্রণয়নের অজুহাত হয়ে উঠল। মেশিনারি এবং মূলধন কর্তৃক তার নিয়োগ—এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে, এবং উৎপাদনের বস্তুগত উপায় উপকরণের বিরুদ্ধে নয়, যে-পদ্ধতিতে সেগুলি ব্যবহৃত হয়, তার বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ পরিচালনা করতে, শ্রমিক জনগণের অনেক সময় ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়েছিল।[১]
ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থায় মজুরি নিয়ে লড়াই ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থা না থাকলে হয়না এবং কোনো অর্থে ই তা ঐ ব্যবস্থার অস্তিত্বের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় না। নোতুন নোতুন ম্যানুফ্যাকচার স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শ্রমিক-জনগণের কাছ থেকে আসেনা, আসে গিড় ও প্রাধিকার-ভোগী শহরগুলির কাছ থেকে। সুতরাং ম্যানুফ্যাকচার-আমলের লেখকগণ শ্রম-বিভাজনের আলোচনা করেছিলেন প্রধানতঃ শ্রমিকদের ঘাটতি পূরণের একটি উপায় হিসাবেই, যারা কাজে আছে তাদের স্থানচ্যুত করার উপায় হিসাবে নয়। এই পার্থক্যটি স্বতস্পষ্ট। যদি একথা বলা হয় যে, আজ ইংল্যাণ্ডে মিউলের সাহায্যে ৫,৩৩,০০০ লোক যত সুতো কাটে, পুরনো চরকা দিয়ে তত সুতা কাটতে লাগত ১০ কোটি লোক, তার মানে এই নয় যে, মিউলগুলি ঐ কোটি কোটি লোকের স্থান নিয়েছে, যাদের কোন কালে কোনো অস্তিত্বই ছিলনা। তার মানে দাঁড়ায় এই যে, সুতো কাটার মেশিনের জায়গা নিতে হলে লাগবে কয়েক কোটি লোক। অপর পক্ষে যদি বলা হয় যে, ইংল্যাণ্ডে পাওয়ারলুম ৮,০০,০০০ তন্তুবায়কে পথে ছুড়ে দিয়েছিল, তা হলে আমরা বর্তমান মেশিনারির কথা বলছিনা যার পরিবর্তে নিয়োগ করতে হবে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ; বলছি এমন এক শ্ৰমিকসংখ্যার কথা, যারা সত্য সত্যই বিদ্যমান ছিল এবং যারা সত্য সত্যই পাওয়ার লুমের দ্বারা স্থানচ্যুত বা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ম্যানুফ্যাকচার-আমলে, শ্রম বিভাজনের যারা পরিবর্তিত হলেও, হস্তশিল্পের অমই তখনো ছিল ভিত্তিস্বরূপ। মধ্যযুগ থেকে উত্তরাগত অপেক্ষাকৃত সংখ্যক শহরে কমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা নোতুন নোতুন ঔপনিবেশিক বাজারগুলির চাহিদা মেটানো। এবং তাই নিয়মিত ম্যানুফ্যাকচার গ্রামীণ জনগণের সামনে খুলে দিল নোতুন নোতুন উৎপাদন-ক্ষেত্র সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসানের ফলে যারা ভূমি থেকে তাড়িত হয়েছিল। সুতরাং সেই সময়ে কর্মশালাগুলিতে শ্রম-বিভাগ ও সহযোগকে দেখা হত প্রধানতঃ এই ইতিবাচক দিক থেকে যে তারা শ্রমিক-জনগণকে করে তোলে আনো উৎপাদনশীল[২]। যেখানে যেখানে এইসব পদ্ধতি কৃষি-কর্মে, প্রযুক্ত হয়েছিল, এমন বহুসংখ্যক দেশে, আধুনিক শিল্পের অনেক আগে সহযোগ এবং কয়েক জনের হাতে শ্রম-উপকরণের কেন্দ্রীভবন উৎপাদন পদ্ধতিতে, এবং সেই কারণেই, অস্তিত্বের অবস্থায় ও গ্রামীণ জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের উপায়ে ঘটিয়ে দিয়েছিল বিরাট, আকস্মিক ও সবল বিপ্লব। কিন্তু এই লড়াই মূলধন এবং মজুরিশ্রমের মধ্যে ঘটবার আগে ঘটে বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র ভূমি-মালিকদের মধ্যে; অপর পক্ষে, যখন শ্রমিকেরা স্থানচ্যুত হয় শ্রম-উপকরণের দ্বারা, ভেড়-ঘোড় ইত্যাদির দ্বারা, খন, শিল্প-বিপ্লবের ভূমিকা হিসাবে প্রথমেই বলপ্রয়োগের আশ্রয় নেয়া হয়। প্রথমে শ্রমিকদের বিতাড়িত করা হয় জমি থেকে, তার পরে আসে ভেড়ার পাল। বৃহদায়তনে কৃষিকর্ম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্ৰ-প্ৰতির হয় প্রথম পদক্ষেপ হল বৃহদায়তনে জমি-দখল, যেমন ঘটেছিল ইংল্যাণ্ডে।[৩] সূতত্ত্বা কৃষিকর্মের এই বিপর্যয়সাধন প্রথমে আসে রাজনৈতিক বিপ্লবের চেহারায়।
শ্রমের উপকৱণ যখনি ধারণ করে মেশিনের রূপ, তখন সে হয়ে ওঠে বং শ্রমিকেরই প্রতিযোগী।[৪] তখন থেকে মেশিনারির সাহায্যে মূলধনের আত্ম-সম্প্রসারণ এ যাদের জীবিকা মেশিনারি ধ্বংস করে দিয়েছে, সেই শ্রমিক জনসংখ্যা হয় প্রত্যক্ষ গৰে আনুপাতিক। সমগ্ৰ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিই এই যে, শ্রমিক তার শ্রম শক্তিকে বিক্রয় করে পণ্য হিসাবে। একটি বিশেষ ‘টুল’ ব্যবহার দক্ষ করে তুলে শ্রম বিভাগ এই শ্রমশক্তিকে বিশেষায়িত করে তোলে। যখন থেকে এই টুলটির ব্যবহার একটি মেশিনের কাজ হয়ে ওঠে, তখন থেকেই শ্রমিকের শ্রমশক্তির ব্যবহার-মূল্যের সঙ্গে তার বিনিময়মূল্যও অন্তর্হিত হয়ে যায়; কাগজের নোট যেমন আইন প্রণয়নের ফলে অচল হয়ে যায়, তেমনি শ্রমিকও হয়ে যায় অবিক্রয়যোগ্য। শ্ৰমিক-শ্রেণীর যে-অংশ এই ভাবে মেশিনারির দ্বারা বাহুল্যে পর্যবসিত হয়, অর্থাৎ মূলধনের আত্ম প্রসারণের জন্য আর আশু আবশ্যক হয়না সেই অংশ, হয়, মেশিনারির সঙ্গে পুরনো হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচারের অসম দ্বন্দ্বে কোণঠাসা হয়ে পড়ে, আর, নয়তো, আরো অনায়াসে অধিগম্য শিল্প-শাখাগুলিকে প্লাবিত করে দেয়, শ্রমেরবাজারকে ভাসিয়ে দেয় এবং শ্রম-শক্তির দামকে তার মূল্যের নীচে ডুবিয়ে দেয়। শ্রমজীবী জনগণের মনে বিরাট সাল্কা হিসাবে প্রথমতঃ এই ধারণা সৃষ্টি করা হয় যে, তাদের দুর্দশা কেবল সাময়িক ( অস্থায়ী অসুবিধা ) দ্বিতীয়ত, মেশিনারি একটি উৎপাদন ক্ষেত্রের সমগ্র বিস্তৃতি জুড়ে তার কর্তৃত্ব বিস্তার করে কেবল ধাপে ধাপে যার ফলে তার ধ্বংসাত্মক ফলের ব্যাপকতা ও তীব্রতা কমে যায়। প্রথম সান্ত্বনাটি দ্বিতীয়টিকে অক্রিয় করে দেয়। যখন মেশিনারি একটি শিল্পের উপরে ধাপে ধাপে তার কর্তৃত্ব ৰিস্তার করে, তখন তা কর্মীদের মধ্যে যারা তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে-তাদের মধ্যে স্থায়ী দুর্দশা সৃষ্টি করে। যখন এই অতিক্রান্তি হয় দ্রুতগতি, তখন তার প্রতিক্রি। হয় তীক্ষ্ণ এবং তা ভোগ করে বিপুল জনসমষ্টি। ইংল্যাণ্ডের হস্তচালিত তাঁতের ক্রমিক অবলুপ্তির তুলনায় অধিকতর করুন কোনো কাহিনী ইতিহাসে পায়া যায় না। কয়েক দশক ধরে চলেছিল এই অবলুপ্তির প্রক্রিয়া এবং চুড়ান্ত ভাবে সমাপ্ত হয়েছিল ১৮৩৮ সালে। তাদের মধ্যে অনেকের মৃত্যু ঘটেছিল অনশনে, অনেকে সপরিবারে দীর্ঘকাল কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে ছিল দৈনিক ২৫ পেনির উপরে।[৫] অন্য দিকে, ইল্যাণ্ডের তুলা-কল ভারতে সৃষ্টি করল সাংঘাতিক ফুল। ১৮৩৪-৩৫ সালে ভারতের বড়লাট বিপোর্ট করেন, “বাণিজ্যের ইতিহাসে এই দুর্দশায় কোনো তুলনা নেই। সুতি-বন্ত্রের তন্তুবায়দের হাতে ভারতের সমতল সাদা হয়ে যাচ্ছে। সন্দেহ নেই যে, এই “অনিত্য” সংসার থেকে তাদের বের করে দেবার জন্য মেশিনারি তাদের “অস্থায়ী অসুবিধা” ছাড়া বেশি কিছু করেনি। বাকিদের জন্য, যেহেতু মেশিনারি ক্রমাগত নোতুন নোতুন উৎপাদন-ক্ষেত্রে তার কর্তৃত্ব বিস্তার করছে, সেহেতু তার অস্থায়ী ফলটা বস্তুত পক্ষে চিরস্থায়ী। সুতরাং শ্রমিকের সঙ্গে সম্পর্কে পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্রভাবে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি শ্রম-উপকরণকে ও উৎপন্ন দ্রব্যকে যে স্বতন্ত্রতা ও বিচ্ছিন্নতা দান করে তার চরিত্র মেশিনারির মাধ্যমে বিকশিত হয় নী বৈরিতায়।[৬] অতএব, মেশিনারির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই শ্রমিক সর্বপ্রথম শ্রম-উপকরণের বিরুদ্ধে পাশবিক ভাবে বিদ্রোহ করে।
শ্রমের উপকরণ এমিককে দাবিয়ে রাখে। পুরাগত হস্তশিল্প বা ম্যানুফ্যাকচারের সহে নব-প্রবর্তিত মেশিন যখন প্রতিযোগিতা করে, তখন শ্রম-উপকরণ এবং শ্রমিকের মধ্যে এই প্রত্যক্ষ বৈরিতা সবচেয়ে প্রবলভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। কিন্তু এমন কি আধুনিক শিল্পেও মেশিন্মরির ক্রমাগত উৎকর্ষ এবং স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার বিকাশেরও ফল হয় অনুরূপ। “মেশিনারির উৎকর্ষসাধনের উদ্দেশ্য হয় দৈহিক শ্রমের লাঘব করা এবং কোন কিছু উৎপাদনে মনুষ্য-যন্ত্রের পরিবর্তে লৌহ-যন্ত্রের মাধ্যমে কোন প্রক্রিয়া সম্পাদন করা অথবা কোন সংযোগের সংস্থান করা।”[৭] “এতাবৎকাল যা ছিল হস্তচালিত, সেই মেশিনারির সঙ্গে শক্তির উপযোজন প্রায় একটি প্রাত্যহিক ঘটনা: মেশিনারিতে ছোট-খাট উন্নয়ন যার উদ্দেশ্য থাকে শক্তির সাশ্রয়সাধন, উন্নততর কাজের উৎপাদন, একই সময়ের মধ্যে অধিকতর কাজ সম্পাদন কিংবা একটি শিত বা নারী বা লোকের স্থান পূরণ, তেমন উন্নয়ন চলতেই থাকে এবং যদি কখনো কখনো বাহ্যতঃ তা খুব গুরুত্বপূর্ণ না-ও হয়, কার্যত বেশ কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ ফলপ্রসূ।”[৮] যখনি কোন প্রক্রিয়ার দরকার হয় হাতের বিশেষ ধরনের কুশলতা ও অবিচলতা, তখনি যথাসম্ভব শীঘ্র তা তুলে নেওয়া হয় কৌশলী শ্রমিকের কাছ থেকে, কেননা তার নানা রকমের অনিয়মিকতা ঘটতে পারে; সেই প্রক্রিয়াটি তখন তুলে দেওয়া হয় একটি বিশেষ ধরনের যন্ত্রের দায়িত্ব, যা এমন ভাবে স্বয়ং-নিয়ামক যে একটি শিশু পর্যন্ত তার তদারকি করতে পারে।[৯] স্বয়ংক্রিয় পরিকল্পনায় কুশলী শ্ৰম ক্রমবর্ধমান হারে স্থানচ্যুত হয়।[১০] একটি নির্দিষ্ট ফল উৎপাদন করা হয় কেবল আগেকার মত একই পরিমাণ বয়স্ক শ্রম নিয়োগের আবশ্যকতাকে অতিক্রম করার জন্যই নয়, সেই সলে এক ধরনের মনুষ-শ্রমের পরিবর্তে অন্য ধরনের মের, বয়স্ক মের পরিবর্তে শি শ্রমের, পুরুষ-শ্রমের পরিবর্তে নারী শ্রমের, অধিকতর কুশলী এষের পরিবর্তে অল্পতর কুশলী শ্রমের নানাবিধ নিয়োগের জন্যও মজুরির হারে নানাবিধ ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।[১১] সাধারণ মিউলের জায়গায় স্বয়ংক্রিয় মিউলের প্রবর্তনের ফল দাড়িয়ে ছিল অধিকাংশ পুরুষ সুতাকল শ্রমিককে ছাঁটাই করে দিয়ে, কিশোর ও শিশু শ্রমকে বহাল রাখা।[১২] হাতে-কলমে কাজের পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতার দরুন, হাতের কাছে উপস্থিত যান্ত্রিক উপায়ের দরুন এবং নিরন্তর কারিগরি উৎকর্ষ-বৃব্ধির দরুন কারখানা ব্যবস্থার আত্ম-বিস্তারের ক্ষমতা যে কত অসাধারণ, তা আমাদের কাছে প্রতিপন্ন হয়েছিল কর্ম-দিবস হ্রাসের চাপের অধীনে ঐ ব্যবস্থা যে বিরাট বিরাট পদক্ষেপ নিয়েছিল, তার দ্বারা। কিন্তু ইংল্যাণ্ডের তুলা শিল্পের চূড়ান্ত বছরে, ১৮৬০ সালে, কে স্বপ্ন দেখেছিল যে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের প্রেরণায় পরবর্তী তিন বছরে মেশিনারিতে এমন জোর-কদম অগ্রগতি ঘটবে এবং তার ফলে এমিক জনসংখ্যার এমন কর্মচ্যুতি ঘটবে? কারখানা-পরিদর্শকদের বিপোর্ট থেকে দু-একটি দৃষ্টান্ত দেওয়াই এ ব্যাপারে যথেষ্ট। ম্যাঞ্চেস্টারের এক কল-মালিক বলেন, আগে আমাদের ছিল ৭৫টি কার্ডি ইঞ্জিন, এখন সেই জায়গায় আছে ১২টি, কিন্তু কাজ করছে সেই একই পরিমাণ।……আমরা ১৪ জন কম লোক নিয়ে কাজ করছি। এতে মজুরি বাবদ প্রতি সপ্তাহে আমাদের বেঁচে যাচ্ছে ১০ পাউণ্ড। ব্যবহৃত তুলোর পরিমাণে ঝরতি-পড়তি খাতে আমাদের বেঁচে যাচ্ছে প্রায় ১০ শতাংশ। ম্যাঞ্চেস্টারে সূ সুতাকলে, আমাকে জানানো হয় যে, গতিবেগ বৃদ্ধি করে এবং কয়েকটি স্বয়ংক্রি প্রক্রিয়া প্রবর্তন করে সংখ্যা হ্রাস ঘটানো গিয়েছে। এক বিভাগে এক-চতুর্থাংশ এবং আরেক বিভাগে অর্ধেকেরও বেশি এবং দ্বিতীয় বার ‘পাট করার বদলে আঁচড়াবার কল (কুম্বিং মেশিন) চালু করার ফলে কার্ডিং’ ঘরে আগের তুলনায় কর্মীসংখ্যা বিশেষ ভাবে হ্রাস করা গিয়েছে। আরেকটি সুতাকলে শ্রমের সাশ্রয় ঘটেছে শতকরা ১০ ভাগ। মঞ্চেস্টারের সুতাকল-মালিক মেসার্স গিলমৌর বলে আমাদের হিসাবে, আমাদের ব্লোয়িং রুম’ বিভাগে নোতুন মেশিনারি নিয়ে মজুরি ও কর্মীসংখ্যায় সাশ্রয় ঘটেছে পুরো এক-তৃতীয়াংশ।……জ্যাক ফ্রেম ও ড্রয়িং ফ্রেম রুমে ব্যয়-খাতে সায় এক-তৃতীয়াংশ এবং কর্মীবাবদেও তাই। ‘স্পিনিং রুম’-এ ব্যয় খাতে সাশ্রয় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। কিন্তু এটাই সব নয়; যখন আমাদের সুতো ম্যানুফ্যাকচারকারীদের হাতে যায়, তখন মেশিনারি প্রবর্তনের কল্যাণে তার উৎকর্ষ এত বেশি হবার দরুন তারা আরো বেশি পরিমাণে কাপড় উৎপাদন করবে এবং পুরনো মেশিনারিতে উৎপন্ন সুতো থেকে তৈরি কাপড়ের তুলনায় সস্তায় তারা করবে।[১৩] ঐ একই রিপোর্টে মিঃ রেডগ্রেভ আরো মন্তব্য করেন, উৎপাদন-বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কর্মী-সংখ্যার হ্রাস, বাস্তবিক পক্ষে, সব সময়েই ঘটছে। পশম মিলগুলিতে কিছু দিন আগে এই কর্মী-ছাঁটাই শুরু হয়েছে এবং এখনো তা চলহে; তার কয়েক দিন পরে রকলে-এর নিকটবর্তী এক ইস্কুলের মাস্টার আমাকে বলেন, বালিকা বিদ্যালয়ে ছাত্রী-সংখ্যা দারুণ ভাবে কমে যাবার কারণ কেবল দুর্দশা নয়, তার আরো কারণ হচ্ছে পশম-মিলগুলিতে মেশিনারিতে অদল-বদল, যার ফলে ৭ জন অল্পসময়ের ছাত্রী (শর্ট-টাইমার) কমে গিয়েছে।[১৪]
১৮৬১ থেকে ১৮৬৮-র মধ্যে ৩৩৮টি তুলল কারখানার অবলুপ্তি ঘটল; অন্য ভাবে বলা যায়, অল্পতর সংখ্যক বনিকের হাতে আরো বৃহৎ আয়তনে অধিকতর উৎপাদক মেশিনারি কেন্দ্রীভূত হল। পাওয়ারলুমের সংখ্যা ২০,৬৬৩টি কমে গেল, কিন্তু সেই সঙ্গে যেহেতু তাদের উৎপন্ন বেড়ে গেল, সেইহেতু এই উন্নততর সুম নিশ্চয় পুরনো লুমের তুলনায় বেশি পরিমাণ উৎপাদন করেছিল। সর্বশেষে, টাবুর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল ১৬,১২,৪১টি, অথচ কর্মীর সংখ্যা কমে গিয়েছিল ৫৩,৫৫ জন। তুলো-সংকট-কর্তৃক শ্রমজীবী মানুষদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া অস্থায়ী অসুবিধা” মেশিনারি ক্ষত ও ক্রমাগত অগ্রগতির ফলে তীব্রতর হল, অস্থায়ী থেকে চিরস্থায়ী হল।
কিন্তু মেশিনারি কেবল শ্রমিকের এমন একটি প্রতিযোগী হিসাবেই কাজ করে না যে তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়, সেই সঙ্গে তাকে সব সময়েই বাহুল্যে পরিণত হবার আশংকায় ঝুলিয়ে রাখে। মেশিনারি এমন একটি শক্তি, যা তার পক্ষে ক্ষতিকারক এক এই কারণেই মূলধন সোস্টারে তার গুণকীর্তন করে এবং তাকে ব্যবহার করে। মূলধনের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শ্রমিক-শ্রেণী মাঝে মাঝে যে বিদ্রোহ করে-যাকে বলা হয় ধর্মঘট, তা দমন করার পক্ষে মেশিনারি হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।[১৫] গ্যাসকেল-এর মতে, শুরু থেকেই ঠিম-ইঞ্জিন ছিল মনুষ্য-শক্তির বৈরী-এমন এক বৈরী যা ধনিককে সক্ষম করেছিল শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান দাবিদাওয়াকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে দিতে, যারা নবজাত কারখানা ব্যবস্থার সামনে সৃষ্টি করেছিল এক সংকটের আশংকা।[১৬] ১৮৩ সাল থেকে একমাত্র শ্রমিক-শ্রেণীর বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যেই ধনিকের হাতে অস্ত্র তুলে দেবার জন্য যে-সমস্ত উদ্ভাবন সংঘটিত হয়েছিল, তা নিয়ে রীতিমত একটা ইতিহাস বচনা করা সম্ভব। এই সমস্ত উদ্ভাবনের শীর্ষে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় মিউল, কেননা তা খুলে দিয়েছিল স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় এক নোতুন যুগ।[১৭]
১৮৫১ সালে বহুবিস্তৃত ও দীর্ঘস্থায়ী ধর্মঘটগুলির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মেশিনারিতে যেসমস্ত উৎকর্ষ সাধন করেন এবং সেগুলিকে প্রবর্তন করেন, সে সম্পর্কে ট্রেড ইউনিয়ন কমিশনের সামনে ‘মি-হামার’-এর উদ্ভাবক ন্যাসমিথ যে সাক্ষ্য দেন, তা এই : আমাদের আধুনিক যান্ত্রিক উন্নয়নগুলির অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হল স্বয়ংক্রিয় টুল-মেশিনারির প্রবর্তন। এখন যা একজন মেকানিক-কর্মীকে করতে হয়, এবং যা প্রত্যেক বালকই করতে পারে, তা এই যে, নিজে কোনো কাজ না করে কেবল মেশিনের মনোরম শ্রম তত্ত্বাবধান করা। যারা তাদের দক্ষতার উপরে দাড়িয়েছিল, সেই মিকদের গোটা শ্ৰেণীটাকেই উচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। অতীতে আমি প্রত্যেক মেকানিক-পিছু চারজন করে বালক নিযুক্ত করতাম। এই নোতুন যান্ত্রিক সংযোজনগুলির কল্যাণে, আমি বয়স্ক লোকদের সংখ্যা ১,৫০০ থেকে কমিয়ে ৭৫ করেছি। তার ফলে আমাদেৱ মুনাফা প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ক্যালিকো ছাপাবার কাজে ব্যবহৃত একটি মেশিন প্রসলে উয়ে বলেন, শেষ পর্যন্ত খনিকেরা এই অসহ্ন বন্ধন থেকে মুক্তির (অর্থাৎ, তাদের ভাষায়, শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তির দুর্বহ শর্তগুলি থেকে অব্যাহতির) সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানের অবদানের মাধ্যমে; এবং অচিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেন তাদের বিধিসম্মত কর্তৃত্বের আসনে-অধস্তন সদস্যদের উপরে কর্তাব্যক্তির যে কর্তৃত্ব, সেই আসনে। কাঠিমে সুতো পাকাবার জন্ত একটি আবিক্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, তার পরে সেই সমবেত বিক্ষোভকারীরা, যারা নিজেদের কল্পনা করে নিয়েছিল পুরনো শ্রম-বিভাগের প্রতিরক্ষাগণ্ডীর পশ্চাতে – দুর্ভেদ্যভাবে সংরক্ষিত বলে, তারা দেখতে পেল নোতুন যান্ত্রিক রণকৌশলের মুখে তাদের সেই প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা অকার্যকারী হয়ে পড়েছে এবং তারা বাধিত হল স্বেচ্ছায় আত্ম সমর্পণ করতে।” স্বয়ংক্রিয় মিউলের উদ্ভাবন সম্পর্কে তিনি বলেন, এমন একটি সৃষ্টি বা শ্রমজীবী শ্রেণীগুলির মধ্যে শৃংখলা ফিরিয়ে আনবার জন্য পূর্ব-নির্দিষ্ট।”এই উদ্ভাবন সেই মহান তত্ত্বটিকেই সপ্রমাণ করে, যা ঘোষণা করে, যখন মূলধন বিজ্ঞানকে তার সেবায় নিয়োজিত করে, তখন শ্রমের অবাধ্য হাত বিনয়ী হতে শিক্ষা পায়।[১৮] যদিও উল্লিখিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ৩০ বছর আগে, এমন এক সময়ে যখন কারখানা ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছিল তুলনামূলকভাবে খুব সামান্যই, তবু তা আজও কেবল তার অনাবৃত উন্নাসিকতাকেই নয়, সেই সঙ্গে বনিকমস্তিষ্কের নিরেট বগুলি তুলে ধরার নিবুদ্ধিতাতেও প্রকাশ করে কারখানা-ব্যবস্থার মর্মব। যেমন, মূলধন তার বেন ভোগী বিজ্ঞানের সহায়তায় সব সময়েই অবাধ্য শ্রমের হাতকে বিনয়ী করে তোলে। উল্লিখিত এই তত্ত্বটি উপস্থিত করার পরে, তিনি তার ক্রোধ প্রকাশ করেন এই কারণে যে, একে ( ফিজিওমেকানিক্যাল বিজ্ঞানকে) অভিযুক্ত করা হয়েছে শ্রমিককে হয়রান করার কাজে ধনিকের কাছে নিজেকে বিক্রি করার জন্য। মেশিনারির দ্রুত অগ্রগমন শ্রমিকদের স্বার্থে কত সুবিধাজনক, সে সম্পর্কে এক দীর্ঘ বাণী প্রচারের পরে তিনি তাদের হুশিয়ারি দিয়ে বলেন যে নিজেদের একগুয়েমি ও ধর্মঘটের দ্বারা তারাই মেশিনের অগ্রগমন ত্বরান্বিত করছে। তিনি বলেন, এই ধরনের প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া স্বল্পদর্শী ‘ব্যক্তিকে প্রকাশ কৱে আত্ম-নিপীড়কের ঘণাহ চরিত্রে। কয়েক পৃষ্ঠা আগেই তিনি কিন্তু বিপরীত কথা বলেছেন, কারখানা-কর্মীদের মধ্যে যেসব ভ্রান্ত ধারণা চালু আছে, তার ফলে প্রচণ্ড সংঘর্ষ ও ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়; তা যদি না হত, তা হলে কারখানা-ব্যবস্থা আরো দ্রুত বেগে এবং সংশ্লিষ্ট সকলের পক্ষে আরো কল্যাণকভাবে বিকশিত করা যেত। তার পরে তিনি আবার চেঁচিয়ে ওঠেন, “গ্রেট ব্রিটেনের তুলা-প্রধান জেলা গুলির সামাজিক অবস্থার পক্ষে এটা সৌভাগ্য যে, মেশিনারির উন্নতি ঘটেছে ক্রমাণ্বয়ে। ‘শোনা যায়, বয়স্ক শ্রমিকদের একাংশকে স্থানচ্যুত করে এবং এইভাবে চাহিদার তুলনায় তাদের সংখ্যার অতি-প্রাচুর্য ঘটিয়ে মেশিনারির উন্নতি তাদের উপার্জনের হার কমিয়ে দেয়। কিন্তু তা নিশ্চিতভাবেই শিশুশ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি করে এবং শিশু-শ্রমিকদের মজুরির হারও বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে আবার, এই সান্ত্বনা-বণ্টনকারী ব্যক্তিটিই কিন্তু মজুরির নিচু হার শিশুদের মাতা-পিতাকে বিরত করে তাদেরকে অতি অল্প বয়সে কারখানায় পাঠানো থেকে—এই যুক্তিতে মজুরির নিচু হারকে সমর্থন করেন। তাঁর গোটা বইটাই হচ্ছে বিধি-নিষেধহীন কর্ম-দিবসের সপক্ষে কৈফিয়ৎ; পার্লামেন্ট যে ১৩ বছরের শিশুদের ১২ ঘণ্টার কর্মদিবসের দ্বারা নিঃশেষিত করে দেবার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তাতে তার মনে পড়ে যায় মধ্য যুগের অন্ধকার দিনগুলির কথা। তাতে অবশ্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদজ্ঞাপনের জন্য কারখানা-শ্রমিকদের আহ্বান জানাতে তার পক্ষে কোনো বাধার সৃষ্টি হয় না, কেননা মেশিনারির মাধ্যমে তিনিই তাদের দিয়েছেন তাদের অবিনশ্বর স্বার্থসমূহ সম্পর্কে চিন্তা করবার অবকাশ।[১৯]
————
১. পুরানো-ধরনের ম্যানুফ্যাকচারগুলিতে মেশিনারির বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের বিদ্রোহ, আজও পর্যন্ত ধারণ করে বর্বর আকার, যেমন করেছিল ১৮৬৫ সালে শেফিল্ডে কাটারদের বিদ্রোহ।
২. স্যার জেমস স্টুয়ার্ট-ও মেশিনারিকে সম্পূর্ণ এই অর্থেই বোঝেন। “Je considere donc les machines comme des moyens d’augmenter (virtue llement) le nombre des gens industrieux qu’on n’est pas oblige de nourrier… En quoi l’effet d’une machine differe-t-il de celui de nouveaux habitants que (French trans. t. I., II., ch. XIX. ) safat সরল হচ্ছেন পেটা, যিনি বলেন, এ বহু বিবাহের স্থান গ্রহণ করে। এই মতটি বড় জোর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঞ্চল সম্পর্কে গ্রাহ। অন্য দিকে, “কোন ব্যক্তির এমকে সংক্ষিপ্ত করার পক্ষে খুব কদাচিৎ মেশিনারিকে ব্যবহার করা যায়। তার প্রয়োজনে যে সময়টা বেঁচে যায়, তার নির্মাণে তার চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়। এটা তখনি উপকারী হয়ে ওঠে যখন এটা বিপুল জনসমষ্টি নিয়ে কাজ করে, যখন একটি মাত্র মেশিন হাজার হাজার লোককে সাহায্য করে। সেই কারণেই সবচেয়ে জনবহুল দেশে, যেখানে থাকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মহীন লোক, সেখানে এর সর্বাধিক প্ৰাচুর্য।” (পিয়ার্সি র্যাভেনটোন, খল অন দি ফাউণ্ডিং সিস্টেম, ১৮২৪, পৃঃ ৪৫)।
৩. চতুর্থ জার্মান সংস্করণে টীকা—এটা জার্মানির পক্ষেও প্রযোজ্য। আমাদের দেশে যেখানেই বৃহদায় কৃষির অস্তিত্ব, সেখানেই তা সম্ভব হয়েছে জমিদারিগুলি পরিস্করণের ফলে, যা ব্যাপ্তি লাভ করে বোড়শ শতকে, বিশেষ করে, ১৮৪৮ সালের পর থেকে।—এফ. এঙ্গেলস।]
৪, “মেশিনারি এবং শ্রম নিরন্তর প্রতিযোগী।” রিকার্ডো, ‘অন দি প্রিন্সিপস অৰ পলিটিক্যাল ইকনমি অ্যাণ্ড ট্যাকসেসন’, ৩য় সংস্করণ, লণ্ডন ১৮২১।
৫. ১৯৩৩ সালে গরিব আইন পাশ হবার আগে হস্তচালিত তাঁত এবং শক্তি চালিত তাঁতের মধ্যে প্রতিযোগিতাকে দীর্ঘায়িত করা হয়েছিল প্যারিস থেকে প্রদত্ত মজুরি-পরিপোষণ সাহায্যের দ্বার; মজুরি তখন পড়ে গিয়েছিল ন্যূনতম মজুরির অনেক নীচে। ১৮২৭ সালে রেতঃ মিঃ টার্ণার ছিলেন চেশায়ারে অবস্থিত। উইলমশ্লো-র রেকটর। দেশত্যাগ-সংক্রান্ত কমিটি এবং মিঃ টার্ণারএর মধ্যে যে প্রশ্নোত্তর চলে তা থেকে জানা যায়, মেশিনারির বিরুদ্ধে মনুষ্য-শ্রমের প্রতিযোগিতাকে কেমন করে টিকিয়ে রাখা হয়। প্রশ্ন: পাওয়ারলুমের ব্যবহার কি হস্তচালিত তঁতের স্থান দখল করে নেয়নি? উত্তর : নিঃসন্দেহে; যা দখল করে নিয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি নিত, যদি হস্তচালিত তাঁতের তাঁতী মজুরি ছাঁটাইয়ের রাজি না হত। প্রশ্ন : কিন্তু তাতে রাজি হয়ে, সে কি এমন মজুরি মেনে নিয়েছে, যাতে তার ভরণপোষণ চলে না? উত্তর : হ্যা, আসলে পাওয়ারলুম আর হলুমের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাঁচিয়ে রাখা হয় গরিব-ত্রাণের মাধ্যমে। এইভাবে, অবমাননাকর দুস্থতা বা দেশ থেকে বহিষ্করণ—এই সৌভাগ্যই জোটে পরিশ্রমীদের ভাগ্যে, মেশিনারি প্রবর্তনের ফলে। এটাকে ওঁরা বলেন ‘অস্থায়ী অসুবিধা। (এ প্রাইস এসে অন দি কম্প্যাটিভ মেরিটস অব কম্পিটিশন অ্যান্ড কো-অপারেশন” ১৮৩৪, পৃ ২৯)।
৬. যে কারণ দেশের আয় বাড়ায় (আয় বলতে রিকার্ডো ঐ একই অনুচ্ছেদ বুঝিয়েছেন জমিদার ও ধনিকদের আয়, অর্থনৈতিক দিক থেকে, যে-আয়ই হল জাতির সম্পদ’ ), সেই একই কারণ জনসংখ্যাকে করে তুলতে পারে অপ্রয়োজনীয় এবং শ্রমিকের অবস্থাকে আরো অধঃপতিত।” রিকার্ডো, ঐ, পৃ: ৪৬৯। “মেশিনারীতে প্রত্যেকটি উন্নয়নের নিশ্চিত লক্ষ্য ও প্রবণতা হচ্ছে আসলে মনুষ্য-শ্রমকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেওয়া কিংবা বয়স্ক মানুষদের পরিবর্তে নারী ও শিশুদের শ্রম অথবা দক্ষ শ্রমিকের বদলে অদক্ষ শ্রমিককে নিয়োগ করে তার দাম কমিয়ে দেওয়া।” উরে, ঐ, পৃঃ ৩৫)।
৭. “রিপোর্ট ফ্যাক্টরিজ, ১৮৫৮, পৃ: ৪৩।
৮. রিপোর্ট ফ্যাক্টরিজ, ১৮৫৬, পৃঃ ১৫।
৯. উরে, ঐ, ১৯ : “ইট তৈরির কাজে মেশিনারি নিয়োগের বড় অসুবিধা এই যে, নিয়োগকর্তা কুশলী শ্রমিকদের উপরে নির্ভরতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে যায়।” (“শিশু নিয়োগ কমিশন পঞ্চম রিপোর্ট লণ্ডন, ১৮৬৬ পৃঃ ১৩, টাকা ৪৬।) লোমোটিভ, ইত্যাদি নির্মাণ প্রসঙ্গে গ্রেট নর্দান রেলওয়েজ এর সুপারিন্টেডেন্ট মিঃ এ স্টক বলেন, প্রতিদিনই ব্যয়বহুল ইংরেজ শ্রমের ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইংল্যাণ্ডের কারখানাগুলির উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে উন্নত যন্ত্রপাতির সাহায্যে এবং এই যন্ত্রপাতিগুলিকে কাজ করানো হচ্ছে নিম্ন মানের শ্রমিকের দ্বারা। আগে তাদের দক্ষ শ্রমিকেরাই উৎপাদন করত ইঞ্জিনের সমস্ত অংশ। এখন ইঞ্জিনের সেই অংশগুলি উৎপাদিত হচ্ছে কম দক্ষ শ্রমিক কিন্তু উন্নত যন্ত্রপাতির সাহায্যে। যন্ত্রপাতি বলতে আমি এখানে বোঝাচ্ছি ইঞ্জিনিয়ারের মেশিনারি, লে প্লেনিং মেশিন, ড্রিল ইত্যাদি। ( রয়্যাল কমিশন অন রেলওয়েজ নল, ১৮৬৭, সিনিটস অব এভিভেন্স, মোট ১৭,৮৬২ এবং ১৭,৮৬২ এবং ১৭,৬১)।
১০. উলে, ‘দি ফিলসফি অব ম্যানুফ্যাকচার্স ২য় সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮৩৫, পৃঃ
১১। ২ উরে, “দি ফিলসফি অব ম্যানুফ্যাকচারার্স ২য় সংস্করণ, লওন, ১৮৩৫ পৃ ৩২১।
১২. উৱে, ঐ, পৃঃ ২৩।
১৩. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ১৮৬৩, পৃঃ ১০৮।
১৪, সংকটের সময়ে মেশিনারির দ্রুত উৎকর্ষ সাধন ইংরেজ-ম্যনুফ্যাকচারারকে সক্ষম করল, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, বিশ্বের বাজারকে আবার ভাসিয়ে দিতে। ১৮৬৬ সালের পরের ছয় মাস কাপড় প্রায় অবিক্রয়যোগ্য হয়ে পড়ল। তার পরে শুরু হল ভারত ও চীনে রপ্তানি; তার ফলে পণ্য-প্লাবন আরো প্রবল হয়ে উঠল। ১৮৬৭ সালে মালিকেরা তাদের সমস্যা-পরিহারের চিরাচরিত পথটি অবলম্বন করল অর্থাৎ মজুরি ৫ শতাংশ ছাঁটাই করল। শ্রমিকের প্রতিরোধ করল এবং বলল, একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে কাজের সময় কমানো, ৪ দিনে সপ্তাহ চালু করা; এবং তাদের পুত্রই ছিল ঠিক। কিছু কাল ঠেকিয়ে রাখার পরে শিল্পের স্ব-নির্বাচিত কাণ্ডারীরা শেষ পর্যন্ত কাজের সময় কমানোর সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হল, কোথাও কোথাও মজুরিও কমানো হল, কোথাও কোথাও তা করা হল না।
১৫. “ফিন্ট (চকমকি) কাচের বোতলের ব্যবসায়ের মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যেকার সম্পর্ক হল একটানা ধর্মঘটের সম্পর্ক। এই জন্যই প্রেসঙ’ কঁাচ ম্যানু ফ্যাকচারে এত উৎসাহ; এখানে বেশির ভাগ কাজটাই হয় মেশিনারিতে। নিউক্যাসলের একটি ফার্ম আগে উৎপাদন করত ৩৫০,০০০ পাউণ্ড ব্লেন-ফিন্ট কঁাচ; এখন সেটা উৎপাদন করে ৩,০০০, ৫০০ পাউণ্ড প্রেসভ কাচ। শিশু-নিয়োগ কমিশন, ৪ রিপোর্ট, পৃঃ ২৬২, ২৬৩।
১৬. গ্যাসকেল : “দি ম্যানুফ্যাকচারিং পপুলেশন অব ইংল্যাণ্ড, দণ্ডন ১৮৩৩, পৃ ৩, ৪। ৩
১৭. জব ফেয়ারবেইন তার নিজের কারখানায় ধর্মঘট হবার দরুন মেশিন নির্মাণের ক্ষেত্রে মেশিনারি প্রয়োগের কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আবিষ্কার করেছিলেন।
১৮. উরে, ‘দি ফিলসফি অব ম্যানুফ্যাকচারার্স’ পৃ ৩৬৮-৩৭০।
১৯. উরে, ঐ, পৃ ৩৬৮, ৩৭০, ২৮০, ২৮১, ৩২১, ৩৭০, ৪৭৫।
.
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ — মেশিনারির যারা কর্মচ্যুত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের তত্ত্ব
জেমস মিল, ম্যাক কুলক, টরেন্স সিনিয়র, জন স্টুয়ার্ট মিল এবং আরো এক গাদা বুর্জোয়া অর্থতাত্ত্বিক দাবি করেন যে, সমস্ত মেশিনারি, যা শ্রমজীবী মানুষদের কর্মচ্যুত করে, তা সেই সঙ্গে আবশ্যিক ভাবেই এমন পরিমাণ মূলধনকে মুক্ত করে দেয়, যা সেই একই সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থানের পক্ষে যথেষ্ট।
ধরুন, একটি কার্পেট-কারখানায় বছরে মাথাপিছু ৩০ পাউণ্ড ব্যয়ে একজন ধনিক ১০০ জন শ্রমিককে নিযুক্ত করে। অতএব, বাৎসরিক অস্থির মূলধনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩,০০০ পাউণ্ড। আরো ধরুন, ঐ ঘনিক ৫০ জন এমিককে ছাঁটাই করে দিয়ে বাকি ৫০ জনকে মেশিনারিসহ নিযুক্ত করল, যে মেশিনারির জন্য তার খরচ পড়ল ১,৫০০ পাউণ্ড। ব্যাপারটাকে সহজ করার জন্য আমরা বাড়ি, কয়লা ইত্যাদি হিসাবের মধ্যে ধরছি না। আরো ধরা যাক, এই পরিবর্তনের আগে এবং পরে—উভয় সময়েই প্রতি বছরে ব্যবহৃত কাঁচামালের জন্য ব্যয় করা হয় ৩,০০০ পাউণ্ড।[২] এই অদল-বদলের ফলে কোনো মূলধন মুক্ত হয় কি? পরিবর্তনের আগে মোট অংকটার অর্থাৎ ৬,০০০ পাউণ্ডের অর্ধেকটা ছিল স্থির মূলধন এবং বাকি অর্ধেকটা অস্থির মূলধন। পরিবর্তনের পরে, স্থির মূলধনের পরিমাণ দাঁড়াল ৪,৫০০ পাউণ্ড (কাচামাল ৩০০০ পাউণ্ড এবং মেশিনারি ১,৫০০ পাউণ্ড) আর অস্থির মূলধনের পরিমাণ দাঁড়াল ১,৫০০ পাউণ্ড। মোট মূলধনের অর্ধেক না হয়ে অস্থির মূলধন হল মাত্র এক-চতুর্থাংশ। মুক্ত হবার বদলে, মূলধনের একটা অংশ এখানে এমন ভাবে অবরুদ্ধ হল যে শ্রমশক্তির সঙ্গে, আৰু : বিনিময়ের পথ রুদ্ধ হয়ে গেল; অস্থির মূলধন পরিবর্তিত হল স্থির মূলধনে। অন্যান্য সব কিছু যদি অপরিবর্তিত থাকে, তা হলে ৬,০০০ পাউণ্ড মূলধন ভবিষ্যতে ৫০ জনের বেশি লোককে কর্ম-নিযুক্ত করতে পারে না। মেশিনারির প্রতিটি উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তা আরো কম কম লোকের কর্মসংস্থান করবে। নব-প্রবর্তিত মেশিনারিটি যদি তার দ্বারা কর্মচ্যুত শ্রমশক্তি ও উপকরণ পিছু যত ব্যয় হত, তার তুলনায় কম ব্যয়সাধ্য হত, যেমন, যদি ১,৫০০ পাউণ্ড ব্যয়ের পরিবর্তে তা ১,০০০ পাউণ্ড ব্যয় করাত, তা হলে ১,০০০ পাউও অস্থির মূলধন রূপান্তরিত হত স্থির মূলধনে এবং অবরুদ্ধ হত; এবং ৫০০ পাউণ্ড পরিমাণ মূলধন মুক্তি পেত। মজুরি অপরিবর্তিত থাকবে ধরে নিলে এই শেষোক্ত টাকাটা যে তহবিল গঠন করবে, তা কর্মচ্যুত ৫০ জন লোকের মধ্যে মাত্র ১৬ জনকে কাজে নিযুক্ত করতে সক্ষম হবে; কেননা মূলধন হিসাবে নিযুক্ত হতে হলে, এই ৫৫. পাউণ্ডের মধ্যে একটা অংশকে হতে হবে স্থির মূলধন এবং তার ফলে শক্তি বাবদে নিয়োজিত হতে পারবে মাত্র বাকি অংশটি।
কিন্তু, আর ধরুন নোতুন মেশিনারিটির নির্মাণকার্যে অধিকতর শংখ্যক মেকানিকের কর্মসংস্থান হতে পারে, তা হলেও কি মেকানিকদের বলা যাৰে কার্পেট কর্মীদের জন্য ক্ষতিপূরণ—ঐ মেশিনারিটি যাদের ছুড়ে ফেলে দিয়েছে পথের ধুলোয়। খুব বেশি হলেও, মেশিনারিটির নিয়োগ যতসংখ্যক লোককে বেকার করবে, তার নির্মাণকার্য তার তুলনায় কমসংখ্যক লোককে কাজ দেবে। ১,৫০০ পাউন্ড অটি আগে প্রতিনিধিত্ব করত কর্মচ্যুত-কার্পেট-কর্মীদের মজুরির পরিমাণ, এখন তা প্রতিনিধিত্ব করে মেশিনারির আকারে :-(১) উক্ত মেশিনারিটির নির্মাণকাৰে ব্যবহৃত উৎপাদনের উপায়-উপকরণের মূল্য, (২) ঐ নির্মাণকার্যে নিযুক্ত মেকানিকদের মজুরি, এবং (৩) তাদের “মনিবের” ভাগের অন্তর্ভূক্ত উদ্বৃত্ত-মূল্য। অধিকন্তু, যে পর্যন্ত না মেশিনারিটির জীর্ণ হয়ে অকেজো হয়ে যায়, সে পর্যন্ত তার নবীকরণে দরকার পড়ে না। সুতরাং, উক্ত বর্ধিত-সংখ্যক মেকানিককে নিরন্তর কাজে রাখবার অন্য একজনের পরে আরেকজন কার্পেট-ম্যানুফ্যাকচারকারী শ্রমিকের পরিবর্তে মেশিন নিয়োগ করবে।
বাস্তবিক পক্ষে, এই কৈফিয়ৎদাতারা এই ধরনের মুক্তি দানের কথা বোঝান না। তাদের মনে আছে মুক্তিপ্রদত্ত শ্রমিকদের জীবনধারণের উপায়ের কথা। উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলিতে এটা অস্বীকার কথা যায় না যে, মেশিনারি কেবল ৫০ জন মানুষকে মুক্তিই দেয় না এবং এইভাবে তাদেরকে অন্যান্যের হাতে ছেড়েই দেয় না, সেই সঙ্গে সে তাদের গ্রাস থেকে তুলে নেয় এবং মুক্ত করে দেয় ১,৫০০ পাউণ্ড অল্যের জীবনধারণের দ্রব্যসামগ্রী। অতএব, মেশিনারি শ্রমিকদের বিচ্ছিন্ন করে দেয় তাদের জীন-ধারণের উপায় থেকে—এই সরল ঘটনাটি, যদিও তা কোন নোতুন ঘটনা নয়, যা বোঝায়, অর্থনৈতিক পরিভাষায় তা দাড়ায় এই যে, মেশিনারি শ্রমিকের জন্য জীবনধারণের উপায়সমূহকে মুক্ত করে দেয় অথবা তার কর্মসংস্থানের জন্য সেই উপায়সমূহকে মূলধনে রূপান্তরিত করে। তা হলে দেখতে পাচ্ছেন, প্রকাশ-ভজিটাই সবকিছু। “Nominibus mollire licet mala”
এই তত্ত্বের নিহিতার্থ এই যে, ১,৫০০ পাউণ্ড মূল্যের জীবনধারণের উপায় ছিল মূলধন, যা কৰ্মচ্যুত ৫০ জন মানুষের শ্রমের দ্বারা সম্প্রসারিত হচ্ছিল। অতএব, যে মুহূর্ত থেকে এই মানুষগুলি তাদের উপরে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ছুটি ভোগ করতে শুরু করে, সেই মুহূর্ত থেকেই এই মূলধন নিয়োগের বাইরে পড়ে যায় এবং যে-পর্যন্ত না তা কোনো নোতুন বিনিয়োগ খুজে পায়, যেখানে আবার তা এই ৫০ জন মানুষের বারাই উৎপাদনশীল ভাবে পরিভুক্ত হচ্ছে, সে পর্যন্ত তার বিরাম থাকে না। সুতরাং আজ হোক, কাল হোক, মূলধন এবং শ্রম পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হবেই। সুতরাং মেশিনারি দ্বারা কর্মচ্যুত শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা এই জগতের ধন-সম্পদের মতই-অনিত্য।
কর্মচ্যুত শ্রমিকদের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ ১,৫০০ পাউণ্ড মূল্যের জীবনধারণের উপায়গুলি কখনো মূলধন ছিলনা। যা মূলধন হিসাবে তাদের মুখোমুখি হল, তা হল পরবর্তী কালে মেশিনারিতে নিয়োজিত ঐ ১,৫০০ পাউণ্ডে। আরো একট নিবিড় ভাবে দেখলে দেখা যাবে যে, ঐ ১,৫০০ পাউণ্ড প্রতিনিধিত্ব করত ১৫০ জন কর্মচ্যুত শ্রমিক এক বছরে যে কার্পেট উৎপাদন করত, তারই একটা অংশ, যে অংশটি তারা তাদের নিয়োগকর্তার কাছ থেকে জিনিসপত্রের অঙ্কে না পেয়ে পেত নগদ টাকায় তাদের মজুরি হিসাবে। টাকার অঙ্কে কার্পেটের বিনিময়ে তারা কিনত ১৫০ পাউণ্ড মূল্যের জীবনধারণের উপায়। সুতরাং এই উপায়সমূহ তাদের কাছে মুলধন ছিল না, ছিল পণ্য এবং এই পণ্যগুলির ক্ষেত্রে তারা মজুরিশ্রমিক ছিলনা, ছিল ক্রেতা। তারা যে মেশিনারি থেকে, ক্রয়ের উপায় থেকে মুক্ত হয়েছিল, এই ঘটনা তাদেরকে পরিবর্তিত করেছিল ক্রেতা থেকে অক্ৰেতায়। এই কারণেই ঐ পণ্য গুলির চাহিদাও হ্রাস পেয়েছিল-“voila tout”। যদি এই হ্রাসপ্রাপ্তি জনিত ক্ষতি অন্য কোন মহল থেকে চাহিদা-বৃদ্ধির দ্বারা পূরণ না হয়, তা হলে পণ্যগুলির বাসায় ফর পড়ে যায়। যদি এই পরিস্থিতি কিছুকাল পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং দীর্ঘায়িত হয়, তা হলে আসে এই পণ্যসামগ্রী উৎপাদনে নিযুক্ত শ্রমিকদের কর্মচ্যুতি। জীবন ধরণের আবশ্যিক উপায়-উপকরণ উৎপাদনে পূর্বে যেমূলধন নিয়োজিত হত, এখন তার কিছু অংশ অন্য আকারে পুনরুৎপাদিত হতে হবে। যখন দাম পড়ে যায় এবং মূলধনের স্থানচ্যুতি ঘটছে, তখন জীবনধারণের উপায়-উপকরণের উৎপাদনে নিযুক্ত শ্রমিকেরা আবার তাদের বেলায় তাদের মজুরির একটা অংশ থেকে বঞ্চিত হয়। অতএব, যখন মেশিনারি শ্রমিককে তার জীবনধারণের উপায় থেকে মুক্ত করে, তখন তা সেই সঙ্গে তার ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের জন্য এই উপায়গুলিকে মূলধনে রূপান্তরিত করে এই বক্তব্য প্রমাণ করার পরিবর্তে আমাদের কৈফিয়ৎদাতারা তাদের চাহিদা ও যোগানের পূর্বপ্রস্তুত নিয়মটির সাহায্যে বরং উল্টো এটাই প্রমাণ করেন যে, উৎপাদনের যে-শাখায় মেশিনারি প্রবর্তিত হয়, কেবল সেই শাখাতেই নয়, যে-সব শাখাতে হয় না, সেইসব শাখাতেও তা শ্রমিকদের পথে ছুড়ে দেয়।
আসল যে ঘটনা যা অর্থতাত্ত্বিকদের আশাবাদের প্রেরণায় হাস্যকর ভাবে উপস্থাপিত হয়, তা এই: যখন শ্রমিকেরা মেশিনারির দ্বারা কর্মশালা থেকে বিতাড়িত হয়, তখন তারা নিক্ষিপ্ত হয় শ্রমের বাজারে; এবং সেখানে বনিকের ইচ্ছামত ব্যবহারের জন্য যে-শ্রমিকেরা ভিড় করে আছে, তারা সেই ভিড়কে আরো ফীত করে। এই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে দেখা যাবে যে, মেশিনারির এই ফল, যা আমরা আগেই দেখেছি, দেখানো হয় এমিক-শ্রেণীর পক্ষে ক্ষতিপুরণ স্বরূপ, অথচ তা বরং উলটো। একটা ভয়াবহ অভিশাপ। আপাততঃ আমি কেবল এই কথাই বলব : শিল্পের কোন এক শাখা থেকে উৎখাত শ্রমিকেরা নিঃসন্দেহে অন্য কোন শাখায় কাজ খোয়। করতে পারে। যদি তারা তা পায় এবং এইভাবে তাদের নিজেদের এবং জীবন ধারণের উপায়সমূহের মধ্যেকার বন্ধন নোতুন করে স্থাপন করতে পারে, তা হলে সেটা অসম্ভব হয় কেবল এক নোতুন ও অতিরিক্ত মূলধনের মধ্যস্থতায়, যে মূলধন বিনিয়োগের সন্ধান করছিল কোন ক্রমেই সেই মূলধনের মধ্যস্থতায় নয়, যে তাদের পূর্বে নিয়োগ করেছিল এবং পরে মেশিনারিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। এবং যদি তারা কাজ পেয়েও থাকে, তা হলেও কী হতভাগ্য তাদের চেহারা! যেহেতু তারা শ্রম বিভাগের দ্বারা পঙ্গু, সেহেতু এই বেচারা শয়তানগুলোর মূল্য তাদের পুরনো কাজের বাইরে এত নগণ্য, যে তারা কয়েকটি অপকৃষ্ট ধরনের শিল্প ছাড়া—যেগুলি ইতিপুর্বেই স্বল্প মজুরির শ্রমিকদের দ্বারা জনাকীর্ণ’—সেগুলি ছাড়া, অন্য কোথাও প্রবেশাধিকার পায় না।[৩] অধিকন্তু, প্রত্যেক শিল্প প্রতি বছর আকর্ষণ করে একটি করে নোতুন শ্রম-শ্রোত, যা থেকে পূরণ করে নিতে হয় শূন্য স্থানগুলি এবং সংগ্রহ করে নিতে হয় সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ। যে মুহূর্তে মেশিনারি একটি নির্দিষ্ট শিল্প শাখায় নিযুক্ত শ্রমিকদের মুক্ত করে দেয়, সেই মুহূর্তে এই প্রতীম্মান কর্মপ্রার্থী মানুষগুলি ছড়িয়ে পড়ে কর্মসংস্থানের নোতুন নোতুন প্রবাহে এবং অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায় অন্যান্য শাখায়; ইতোমধ্যে, এই অতিক্রমণের কালে যে-শ্রমিকেরা গোড়ায় বলি হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই উপোস করে থাকতে থাকতে শেষ হয়ে যায়।
এটা একটা সন্দেহাতীত ঘটনা যে, মেশিনারি নিয়ে শ্রমিকদের তাদের জীবন ধারণের উপায়-উপকরণ থেকে মুক্ত করে দেবার জন্য দায়ী নয়। যেখানেই মেশিনারি আত্মবিস্তার করে, উৎপাদনের সেই শাখাতেই সে উৎপাদনকে সস্তা করে এবং বৃদ্ধি করে, এবং অপরাপর শাখায় উৎপাদিত জীবনধারণের উপায়-উপকরণের পরিমাণে গোড়ার দিকে কোনো পরিবর্তন ঘটায় না। অতএব, মেশিনারি প্রবর্তনের পরে কর্মচ্যুত শ্রমিকদের জন্য সমাজ পায়, আগেকার তুলনায় বেশি না হলেও, অন্তত সম-পরিমাণ জীবনধারণের সামগ্রী; এবং সেটা অ-শ্রমিকদের দ্বারা প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ উৎপন্ন সম্ভার অপচয়িত হয়, তা বাদ দিয়েই। এবং এই পয়েন্ট’-টির উপরেই আমাদের কৈফিয়ৎদাতারা দাড়িয়ে আছেন ! মেশিনারির গনতান্ত্রিক নিয়োগের সঙ্গে যেসব দ্বন্দ্ব ও বৈরিতা অবিচ্ছেদ্য, এরা বলেন, সেগুলির নাকি কোনো অস্তিত্ব থাকেনা, কেননা সেগুলির উদ্ভব স্বয়ং মেশিনারি থেকে নয়, মেশিনারির ধনতান্ত্রিক নিয়োগ থেকে ! সুতরাং যেহেতু মেশিনারিকে যদি আলাদা করে একক ভাবে বিবেচনা করা যায়, তা হলে সে শ্রমের ঘণ্টা কমিয়ে দেয়, কিন্তু যখন সে মূলধনের সেবায় নিয়োজিত থাকে তখন সে শ্রমের ঘণ্টা বাড়িয়ে দেয়, যেহেতু এককভাবে সে শ্রমের তীব্রতাকে হ্রাস করে এবং যখন সে নিযুক্ত থাকে মূলধনের অধীনে তখন তা বৃদ্ধি করে; যেহেতু একক ভাবে সে প্রকৃতির শক্তিসমূহের উপরে মানুষের জয়লাভের সূচক কিন্তু মূলধনের হাতে পড়ে পরিণত হয় ঐ শক্তিসমূহের ক্রীতদাসে; যেহেতু একক ভাবে সে উৎপাদনকারীদের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করে কিন্তু মূলধনের হাতে সে তাদের করে দেয় সর্বস্বান্ত—এই সমস্ত কারণে এবং আরো অন্যান্য কারণে, বুর্জোয়া অর্থবিকেরা বেশি হৈ চৈ না করেই বলে থাকেন যে, এটা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার যে এই সব দ্বন্দ্ব-বিরোখ কেবল বাস্তবের আপাত-দৃশ্য রূপ মাত্র আসলে, এদের না আছে কোনো বস্তুগত অস্তিত্ব না আছে কোনো তগত অস্তিত্ব। এইভাবে ওঁর মন্তিকের অধিকতর বিভ্রান্তি থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে থাকেন; আরো বড় কথা, ওঁরা ইঙ্গিতে বলে থাকেন যে তাদের বিরোধিরা এত বোকা যে মেশিনারির ধনপন্ত্রিক নিয়োগের বিরুদ্ধে না দাড়িয়ে, তাঁরা পঁড়ান খোদ মেশিনারিরই বিরুদ্ধে।
সন্দেহ নেই, মেশিনারির গনতান্ত্রিক ব্যবহার থেকে যে কিছু সাময়িক অসুবিধা ঘটতে পারে, ওঁরা তা মোটেই অস্বীকার করেন না। কিন্তু এমন ‘মেছাল কোথায় আছে, যার এক পিঠ আছে, অন্য পিঠ নেই ! মূলধনের দ্বারা ছাড়া অন্য কোনো ভাবে তার নিয়োগ একটা অসম্ভব ব্যাপার। সুতরাং ওঁদের কাছে মেশিনের দ্বারা শ্রমিকের শোষণ এবং শ্রমিকের দ্বারা মেশিনের শোষণ অভিন্ন। অতএব, মেশিনারির ধনতান্ত্রিক নিয়োগে আসল অবস্থা কি দাঁড়ায় যিনিই সেটা উদঘাটিত করুন না কেন, তিনিই তার যে-কোনো ভাবে নিয়োগেরই বিরোধী; এবং সামাজিক প্রগতিরও শত্রু।[৪] প্রখ্যাত বিল স্কাইজ যে যুক্তি দিয়েছিলেন, অবিকল সেই যুক্তি। “জুরির ভদ্রমহোদয়গণ, কোনো সন্দেহ নেই যে এই বাণিজ্যিক সফরকারীর গলা কাটা হয়েছে। কিন্তু সেটা আমার দোষ নয়, সেটা ছুরিটার দোষ। এমন সাময়িক অসুবিধার জন্য কি আমাদের ছুরির ব্যবহারকে নির্বাসন দিতে হবে? কেবল ভেবে দেখুন, চুরির ব্যবহার বাদ দিলে কৃষি ও শিল্প কোথায় গিয়ে দাড়াবে? অঙ্গ-সংস্থানের ক্ষেত্রে যেমন সে উপকারক, অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেও সে তেমন উপকারক নয় কি? অধিকন্তু, ভোজের টেবিলেও কি তা একটি স্বেচ্ছামূলক সহায়ক নয়? যদি আপনারা ছুরিকে নির্বাসনে পাঠান, তা হলে আপনারা ফের আমাদের বর্বরযুগের গভীরে ছুড়ে দেবেন।”[৫]
যদিও যেসব শিল্পে মেশিনারি প্রবর্তিত হয়, সেখানে অবধারিত ভাবেই মানুষকে কর্মচ্যুত হতে হয়, কিন্তু তৎসত্বেও তা অন্যান্য শিল্পে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ঘটালেও ঘটাতে পারে। অবশ্য, এই ফলের সঙ্গে তথাকথিত ক্ষতিপূরণ তত্বের কোন মিল নেই। যেহেতু হাতে তৈরি প্রত্যেকটি জিনিসের তুলনায় মেশিনে তৈরি প্রত্যেকটি জিনিস সন্ত হয়, সেই হেতু আমরা নিম্নলিখিত অভ্রান্ত নিয়মটি নির্ণয় করতে পারি : যদি মেশিনারি দ্বারা উৎপাদিত জিনিসটির মোট পরিমাণ পূর্বে হস্তশিল্প বা ম্যানুফ্যাকচারের দ্বারা উৎপাদিত, এবং এখন মেশিনারি দ্বারা তৈরি, জিনিসটির মোট পরিমাণের সমান হয়, তা হলে মোট ব্যয়িত শ্রম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। শ্রমের উপকরণসমূহের উপরে, মেশিনারির উপরে, কয়লা ইত্যাদির উপরে নোতুন যে-শ্রম ব্যয়িত হয় তা অবশ্যই মেশিনারি দ্বারা কর্মচ্যুত শ্রমের তুলনায় কম হবে; অন্যথায় মেশিনারির দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্য দৈহিক শ্রমের-দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্যের সমান মহার্ঘ বা অধিকতর মহার্ঘ হত। কিন্তু, কার্যত, অল্পতর সংখ্যক শ্রমিকের সাহায্যে মেশিনারি জিনিসটির যে-মোট পরিমাণ উৎপন্ন করে তা হাতে-তৈরি জিনিসটির মোট পরিমাণের সমান থাকেনা, তাকে টের ছাড়িয়ে যায় হাতে-তৈরি জিনিসটির যে পরিমাণটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ধরা যাক, যতসংখ্যক তাতী হাত দিয়ে ১,০০,০০০ গজ কাপড় তৈরি করতে পারত, তার চেয়ে কম সংখ্যক তাঁতী পাওয়ারলুম দিয়ে ৪,৭০,৭৪০ গজ কাপড় তৈরি করেছে। চতুগুণিত উৎপন্ন সম্ভারে চারগুণ কাচামালের দরকার হয়েছে। কিন্তু শ্রমের উপকরণ সমূহের বেলায়, বাড়ি-ঘর, কয়লা, মেশিনারি ইত্যাদির বেলায় ব্যাপারটা অন্য রকম; সেগুলির উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনমত অতিরিক্ত শ্রম যে-মাত্রা পর্যন্ত বর্ধিত করা যায়, তা মেশিনে তৈরি জিনিসের পরিমাণ এবং সেই একই সংখ্যক লোক একই জিনিসের যে-পরিমাণ হাতে তৈরি করতে পারত—এই দুয়ের মধ্যেকার পার্থক্যের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।
অতএব, যখন মেশিনারির ব্যবহার একটি নির্দিষ্ট শিল্পে প্রসার লাভ করে, তার আশু ফল হয় অন্যান্য শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি, যে-শিল্পগুলি প্রথমোক্ত শিল্পটিকে উৎপাদনের উপকরণসমূহ সরবরাহ করে। তার দ্বারা কত সংখ্যক বাড়তি লোকের জন্য কর্মসংস্থান হয় তা নির্ভর করে, কাজের দিনের দৈর্ঘ্য ও শ্রমের তীব্রতা যদি নির্দিষ্ট থাকে তা হলে, বিনিয়োজিত মূলধনের গঠন-বিন্যাসের উপরে অর্থাৎ অ-স্থির উপাদানের সঙ্গে স্থির-উপাদানের অনুপাতের উপরে। এই অনুপাত আবার তার বেলায় প্রভূত ভাবে পরিবর্তিত হয় যে-মাত্রায় মেশিনারি ইতিমধ্যেই সেই ব্যবসাগুলি দখল করে নিয়েছে কিংবা তখনো দখল করে নিচ্ছে, সেই মাটির উপরে। ইংল্যাণ্ডে কারখানা ব্যবস্থার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে কয়লা ও তামার খনির কাজে অভিশপ্ত লোকদের সংখ্যা বিপুল ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, কিন্তু খনির কাজে নোতুন মেশিনারি প্রবর্তিত হবার দরুন গত কয়েক দশক ধরে এই বৃদ্ধি কম দ্রুত গতিতে ঘটেছে।[৬] মেশিনের সঙ্গে সঙ্গে নোতুন এক ধরনের শ্রমিকের জন্ম হয়—মেশিনের নির্মাণকারী। আমরা ইতিপূর্বেই জেনেছি, এমন কি উৎপাদনের এই শাখাটিকে মেশিন এমন আয়তনে অধিকার করে নিয়েছে যে আয়তন প্রতিদিনই বৃদ্ধি পায়।[৭] কাচামালের ক্ষেত্রে[৮] এবিষয়ে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই যে, সুতো কাটার প্রবল পদক্ষেপে অগ্রগতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেবল তুলে উৎপাদনে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রাচুর্য এবং আফ্রোদেশীয় দাস ব্যবসাতেই প্রেরণা সৃষ্টি করেনি, সেই সঙ্গে, তা সীমান্তের দাস-রাষ্ট্রগুলিতে দাস প্রজননকে প্রধান ব্যবসাতে পরিণত করল। যখন, ১৭৯০ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দাসদের প্রথম আদমসুমারি তৈরি হয়েছিল, তখন তাদের সংখ্যা ছিল ৩,৯৭,০০০; ১৮৬১ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাড়ায় প্রায় ৪০ লক্ষে। অপর পক্ষে, এটাও কম নিশ্চিত নয় যে, ইংল্যাণ্ডে উল-কারখানাগুলির উদ্ভব এবং সেই সঙ্গে আবাদি জমির মেষ-চারণ ভূমিতে রূপান্তর কৃষি-শ্রমিকদের সংখ্যায় ঘটাল মাত্রাতিরিক্ত বাহুল্য এবং দলে দলে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল শহরগুলিতে। আয়াল্যাণ্ড গত কুড়ি বছরে তার জনসংখ্যাকে নামিয়ে এনেছে অর্ধেকে এবং এখন তার অধিবাসী-সংখ্যাকে আরো কমিয়ে আনছে, যাতে করে তা তার জমিদারদের এবং ইংল্যাণ্ডের উল-ম্যানুফ্যাকচারকারীদের প্রয়োজনের সঙ্গে সঠিক ভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
শ্রমের বিষয়কে সম্পূর্ণতা লাভের জন্য যে সমস্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে পার হতে হয়, তাদের যে কোনো একটি পর্যায়ে যদি মেশিনারি প্রবর্তিত হয়, তা হলে সেই সমস্ত পর্যায়ে দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং সেই একই সঙ্গে হস্তশিল্পে ও ম্যানুফ্যাকচারে শ্রমের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়—সেই সব হস্তশিল্পে ও ম্যানুফ্যাকচারে যেগুলি তাদের সরবরাহ পায় মেশিন-জনিত উৎপন্নসভায় থেকে। যেমন, মেশিনারি দিয়ে সুতো কাটার দরুন সুতোর সরবরাহ এত সস্তা ও প্রচুর হল যে হাতে তঁত-চালকেরা প্রথমে সক্ষম হল বিনিয়োগ না বাড়িয়েও পুরো সময় কাজ করতে। সেই অনুসারে তাদের আয়ও বৃদ্ধি পেল।[৯] তার ফলে চলল তুলা-বয়ন শিরে জনতার স্রোত, যে পর্যন্ত না অবশেষে পাওয়ারলুম এসে ঠেলে ফেলে দিল সেই ৮,০০,০০০ মানুষকে যাদের স্থান করে দিয়েছিল ‘জেনি’, ‘খুশ-এবং ‘মিউল। ঠিক সেই ভাবে, মেশিনারি দ্বারা উৎপাদনের ফলে কাপড়ের দ্রব্যসামগ্রীর এত প্রাচুর্য দেখা দিল যে দর্জি, সেলাই ও সুচের কাজে নিযুক্ত মেয়েদের সংখ্যা বেড়েই যেতে থাকল, যে পর্যন্ত না সেলাই কলের আবির্ভাব ঘটল।
যে অনুপাতে মেশিনারি, অপেক্ষাকৃত অল্প লোকের সাহায্যে, কাঁচামাল, মধ্যবর্তী সামগ্রী, শ্রমের উপকরণ ইত্যাদির পরিমাণ বৃদ্ধি করে, সেই অনুপাতে এইসব কাচামাল ও মধ্যবর্তী সামগ্রীর প্রস্তুতি-প্রক্রিয়াও অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় ভাগ হয়ে যায়। সামাজিক উৎপাদনে বৃদ্ধি পায় বৈচিত্র্য। ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থা শ্রম বিভাজনকে যতদূর পর্যন্ত নিয়ে যায়, কারখানা-ব্যবস্থা তাকে নিয়ে যায় বহু বহু গুন দূরে; কারণ যে-সব শিল্প সে করায়ত্ত করে, তাদের উৎপাদশীলতাকে সে বাড়িয়ে দেয় অনেক উচু মাত্রায়।
মেশিনারির আশু ফল হল উদ্বৃত্ত-মূল্যের বৃদ্ধি এবং সেইসব দ্রব্যসম্ভারের উৎপাদন বৃদ্ধি, যার মধ্যে উদ্বৃত্ত-মূল্য বিধৃত থাকে। এবং ধনিক ও তাদের পরিবার-পরিজন যেসব দ্রব্যসামগ্রী পরিভোগ করে, সেগুলির প্রাচুর্য যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি বুদ্ধি পায় সে সবের জন্য সমাজের ফরমাশ। একদিকে, তাদের ঐশ্বর্যের বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যাদি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক-সংখ্যায় হ্রাসের ফলে সৃষ্টি হয় বিবিধ নতুন ও বিলাসী অভাব এবং সেই সঙ্গে সেই অভাব-পুর্তির উপকরণ। সমাজের উৎপন্ন সম্ভারের একটা বৃহত্তর অংশ পরিবর্তিত হয় উদ্বৃত্ত উৎপয়ে এবং এই উদ্বৃত্ত-উৎপন্নের একটি বৃহৎ অংশ পরিভোগর জন্য সরবরাহ করা হ বহুবিধ সুসংস্কৃত আবারে। অন্যভাবে বলা যায়, বিলাসদ্রব্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।[১০] বিশ্বের বাজারের সঙ্গে নোতুন নোতুন সম্পর্কের উদ্বোধনও উৎপন্ন-দ্রব্যাদির এই সংস্কৃত ও বিচিত্র রূপের জন্য দায়ী, আধুনিক শিল্প এই নোতুন সম্পন্দহের স্রষ্টা। কেবল যে স্বদেশে তৈরি দ্রব্যাদির সঙ্গে বিদেশে তৈরি বিলাস-ব্যাদির বিনিময় ঘটে, তাই নয়, সেই সঙ্গে বিদেশী কাঁচামাল, উপাদান, মধ্যবর্তী উৎপন্ন সামগ্রীও বিপুল পরিমাণে স্বদেশী শিল্পগুলিতে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের বাজারের সঙ্গে এই সম্পর্কসূত্রের সুবাদে, পরিবহণ-ব্যবস্থাগুলিতে শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং এই ব্যবসাগুলি অসংখ্য প্রকারে বিভক্ত হয়।[১১]
শ্রমিক-সংখ্যায় আপেক্ষিক হ্রাসের সঙ্গে উৎপাদন ওজীবনধারণের উপায়-সমূহের এই বৃদ্ধির ফলে খাল, ‘ডক (জাহাজঘাটা), টানেল’ (সুড়ঙ্গপথ ), সেতু ইত্যাদি তৈরি করার জন্য শ্রমিকেরা চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এই সব নির্মাণকার্য কেবল সুদূর ভবিষ্যতেই ফল করতে পারে। হয় মেনািরির, নয়ত, তজ্জনিত সাধারণ শিল্পগত পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল হিসাব সম্পূর্ণ নোতুন নোতুন উৎপাদন-শাখার উদ্ভব ঘটে এবং তার ফলে মের নোতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। কিন্তু এমনকি সবচেয়ে বিকশিত দেশগুলিতেও সামগ্রিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই উৎপাদনশাখাগুলির স্থান আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেগুলিতে কত সংখ্যক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়, তা ঐসব শিল্প কত পরিমাণ স্থূলতম প্রকারের দৈহিক শ্রমের চাহিদা সৃষ্টি করে, তার সঙ্গে আনুপাতিক। বর্তমানে এই ধরনের প্রধান শিল্প হচ্ছে গ্যাস-কারখানা, টেলিগ্রাফি, বাষ্পীয় নৌ-চলাচল এবং রেলওয়ে। ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলস-এর ১৮৬১ সালের আদমশুমারি অনুসারে আমরা দেখতে পাই যে গ্যাস শিল্পে (গ্যাস-কারখানা, মেকানিক্যাল অ্যাপারেটাসের উৎপাদন, গ্যাস-কোম্পানিগুলির কর্মীবৃন্দ ইত্যাদি) ছিল ১৫,২১১ জন ব্যক্তি, টেলিগ্রাফিতে ২,৩৯৯ জন, ফটোগ্রাফিতে ২,৩৬৬ জন। বাষ্পীয় নৌ-চলাচলে ৩,৫৭৩ জন এবং রেলওয়েতে ১,৫৯৯ জন, যাদের মধ্যে কম-বেশি স্থায়ীভাবে নিযুক্ত অদক্ষ “আনাড়িদের” এবং সমগ্র প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক স্টাফের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ২৮,০০০ জন। সুতরাং এই পাঁচটি শিলে মোট নিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা হল ৯৪,১৪৫ জন। সর্বশেষে, উৎপাদনের সমস্ত ক্ষেত্রে শ্রম-শক্তির আরো ব্যাপক ও আরো তীব্র শোষণের সঙ্গে সংযুক্ত আধুনিক শিল্পের অসাধারণ উৎপাদনশীলতা সুযোগ করে শ্রমিক-শ্রেণীর এক ক্ৰম-বৃহত্তর অংশের অনুৎপাদক কর্মসংস্থানের এবং নিরন্তরবর্ধমান আয়তনে প্রাচীন ঘরোয়া ক্রীতদাসের পুনরুৎপাদনের পরিচারক-শ্রেণী নামের আড়ালে এই ক্রীতদাস-শ্রেণীর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত থাকে পুরুষ-পরিচারক, নারী-পরিচারিকা, পার্শ্বচর-ভৃত্য ইত্যাদি। ১৮৬১ সালের আদম-সুমারি অনুযায়ী, ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলসের জনসংখ্যা ছিল ২,০০,৬৬, ২৪৪; এদের মধ্যে পুরুষ ৯৭, ৬,২৫৯ এবং নারী ১,২,৮৯,৯৬৫। এই জনসংখ্যা থেকে যদি আমরা বাদ দিই এমন সকলকে যারা কাজের পক্ষে অতি বৃদ্ধ বা অতি কচি তাদেরকে, সমস্ত অনুৎপাদনশীল নারী, তরুণ ও শিশুদেরকে, সরকারী কর্মচারী, পুরোহিত, আইনজীবী ও সৈনিক ইত্যাদির মত “ভাবাদর্শগত” শ্ৰেণীসমূহকে এবং সেই সঙ্গে, এমন সকলকে যাদের খাজনা, সুদ ইত্যাদির আকারে অন্যের শ্রম পরিভোগ করা ছাড়া আর কোন পেশা নেই এবং সর্বশেষে, নিঃস্ব, ভবঘুরে ও দুবৃত্তদেরকে, তা হলে থাকে পুরো সংখ্যায় সব বয়সের নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে ৮০ লক্ষ মানুষ, যাদের মধ্যে ধরা হয়েছে এমন প্রত্যেকটি ধনিককে, যে কোন-না-কোন ভাবে শিল্প, বাণিজ্য বা ফিন্যান্স (অর্থসংস্থান )-এর কাজে লিপ্ত। এই ৮০ লক্ষের মধ্যে আছে।
কৃষি শ্রমিক (মেষপালক, খামার-কর্মী, কৃষকের বাড়িতে কর্ম নিযুক্ত ঝি সমেত) —১,৯৮,২৬১ জন
তুলো, উল, পশম, শণ রেশম ও পাট কলে এবং মেশিনারি সহযোগে মোজা ও লেম তৈরিতে নিযুক্ত এমন এমন সকলে –৬৪২,৬০৭[১২] জন
কয়লা ও ধাতুর খনিতে নিযুক্ত এমন সকলে— ৫৬৫,৮৩৫ জন
ধাতুর কারখানায় (ব্লাস্ট ফার্নেস, রোলিং মিল ইত্যাদি) এবং প্রত্যেক ধরনের মেটাল-ম্যানুফ্যাকচারে নিযুক্ত এমন সকলে— ৩৯৬,৯৯৮[১৩] জন
ভৃত্য-শ্রেণী—১,২৮,৬৪৮৩[১৪] জন।
কাপড়-কলে ও খনিতে নিযুক্ত এবং সকলকে ধরে সংখ্যা দাঁড়ায় ১,২০৮,৪৪২; কাপড় কলে ও ধাতু শিল্পে নিযুক্ত এমন সকলকে ধরে সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৩৯,৬০৫; উভয় ক্ষেত্রেই সংখ্যাটি আধুনিক ঘরোয়া ক্রীতদাসদের সংখ্যার চেয়ে কম; মেশিনারির ধনতান্ত্রিক শোষণের কী চমৎকার ফল।
————
১. রিকার্ডোও গোড়ার দিকে এই মত পোষণ করতেন কিন্তু পরে তাঁর স্বভাবসুলভ বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতা ও সত্যানুরাগের জন্য তিনি খোলাখুলি ভাবেই তা পরিহার করেন। (ঐ, “অন মেশিনারি”)।
২. দ্রষ্টব্যঃ আমার উদাহরণগুলি সম্পূর্ণ ভাবেই উল্লিখিত অর্থনীতিকদের প্রদত্ত নকশার অনুরূপ।
৩. জে বি সে-র মামুলিপনার জবাবে রিকার্ডোর এক শিষ্য বলেন, শ্রম-বিভাজন যেখানে বিকশিত, সেখানে শ্রমিকের দক্ষতা কেবল সেই শাখাতেই সুপ্রাপ্য, যে শাখাতে তা অর্জিত হয়েছে; সে নিজেই এক ধরনের মেশিন। সুতরাং, কেবল তোতা পাখির মত এই একই বুলি আউড়ে যাওয়া যে, জিনিসের স্বভাবই হচ্ছে নিজের মন খুজে নেওয়া—এতে কোনো সুরাহা হয় না। আমাদের চারদিকে তাকিয়ে আমরা এটা না দেখে পারি না যে সে তার মান অনেক কাল পর্যন্ত খুঁজে পায় না; এবং যখন তা পায় তখন সেই মানটি উক্ত প্রক্রিয়ার শুরুতে যা ছিল, তার চেয়ে নিচু।” (নিকুইরি ইনটু প্রিন্সিপলস নেচার অব ডিম্যাও,” লণ্ডন, ১৮২১, পৃ: ৭২)।
৪. অন্যান্যদের মধ্যে ম্যাককুলক-ও এই ধরনের হাবাগোবার ভান করতে একজন বাহাদুর ব্যক্তি। ৮ বছরের শিশুর কৃত্রিম সরলতার ভান দেখিয়ে তিনি বলেন, “যদি, শ্রমিকের দক্ষতার আরো বিকাশ সাধন করা সুবিধাজনক হয়, যাতে করে সে একই পরিমাণ বা অল্পতর পরিমাণ শ্রমের সাহায্যে নিরন্তরবর্ধিত পরিমাণে পণ্য উৎপাদন করতে পারে, তা হলে এটাও সুবিধাজনক হবে যে, সে এমন মেশিনারিরও সাহায্য গ্রহণ করবে যা তাকে এই ফল অর্জন করতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে।” (ম্যাককুলক: “প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি,” লণ্ডন, ১৮৩৩, পৃঃ ১৬৬)।
৫. “সুতোকাটার যন্ত্র (চরকা) ভারতকে ধবংস করে দিয়েছে। অবশ্য এটা এমন একটা ঘটনা, যাতে সামান্যই যায় আসে।”—এম. তিয়েস: “দ্য লা এপিয়েতে”। তিয়েস এখানে সুতোকাটার যন্ত্রকে তাতের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন, যেটা “এমন একটা ঘটনা, যাতে আমাদের সামাই যায় আসে।”
৬. ১৮৬১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, (২য় খণ্ড, লণ্ডন ১৮৬৩) ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলস-এ কয়লা খনিতে নিযুক্ত লোকসংখ্যা ছিল ২,৪৬৬১৩ জন, যাদের মধ্যে ৭৩,৫৪৫ জন ছিল ২০ বছরের নীচে এবং ১,৭৩,৬৭ জন ছিল, উপরে। ২০ বছরের নীচে যারা ছিল, তাদের মধ্যে ২০,৮৩৫ জন ছিল ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে, ৩০,৭১ জন ছিল ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে, ৪২,১০ জন ছিল ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। লোহা, তামা, সীসা, টিন এবং অন্যান্য খনিতে নিযুক্তদের সংখ্যা ছিল ৩,১৯,২২২ জন।
৭. ১৮৬১ সালে ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলস-এ মেশিনারি তৈরিতে নিযুক্ত ছিল ৬০,৮০৭ জন। মালিক, করণিক, দালাল, শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধরে কিন্তু সেলাই-কল ইত্যাদির মত ছোট মেশিনের নির্মাতাদের বাদ দিয়ে) সিভিল ইঞ্জিনিয়র, মোট সংখ্যা ৩,৩২৯ জন।
৮. যেহেতু লোহা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাচামালগুলির মধ্যে একটি সেই হেতু আমি বলতে চাই যে ১৮৬১ সালে ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলসে ছিল ১২৫,৭৭১ চাল লোহা লোহা-চালাইকার, যাদের মধ্যে ১২৩,৪৩০ জন ছিল পুরুষ, ২৩৪১ জন নারী। পুরুষদের মধ্যে ৩৮২ জন ২০ বছর বয়সের নীচে, ২৬২ জন তার উপরে।
৯. চার জন বয়স্ক লোকের একটি পরিবার, গুটি পাকানোর জন্য দুজন শিশু সহ, গত শতকের শেষে এবং এই শতকের শুরুতে, দৈনিক দশ ঘণ্টা শ্রম করে, উপার্জন করত সপ্তাহে ৪ পাউণ্ড। যদি কাজটা খুব জরুরি হত, তা হলে বেশি উপার্জন করতে পারত। তার আগে পর্যন্ত সুতোর সরবরাহে সব সময়েই ছিল ঘাটতির দুর্ভোগ। (গ্যাসকেল দি ম্যানুফ্যাকচারিক পপুলেশন অব ইংল্যাণ্ড পৃঃ ২৫-২৭)।
১০. এফ. এসে তাঁর “Lag…Klasse in England-এ দেখিয়েছেন এসব বিলাস-দ্রব্যাদি উৎপাদনে যারা কাজ করে, তাদের বিপুল অংশের কী শোচনীয় অবস্থা। “শিশু-নিয়োগ কমিশন”এর রিপোর্টগুলিতেও অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
১১. ১৯৬১ সালে ইংল্যাণ্ড ও ওয়ালেসে মার্চেন্ট সার্ভিসে ছিল ৯৪,৬৬৫ জন নাবিক।
১২. এদের মধ্যে মাত্র ১৭৭, ৫৯৬ জন পুরুষ, যাদের বয়স ১৩ বছরের উপরে।
১৩. এদের মধ্যে ৩৭,৫০১ জন নারী।
১৪. এদের মধ্যে ১৩৭,৪৪৭ জন পুরুষ। ব্যক্তিগত বাড়িতে কাজ করে না এমন একজনকেও এদের মধ্যে ধরা হয় নি। ১৮৬১ এবং ১৮৭০ সালের মধ্যে পুরুষ ভৃত্যের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। তা বেড়ে দাড়ায় ২৬৭,৬৭১। ১৮৪৭ সালে (জমিদারদের পশু-জননক্ষেত্রের জন্য) ছিল ২,৬৯৪ জন পশু-পালক, ১৮৬৯ সালে ছিল ৪,৯২১ জন। লণ্ডনের নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাড়িতে নিযুক্ত অল্পবয়সী কাজের মেয়েদের সাধারণ ভাবে বলা হয় বাদী।
.
সপ্তম পরিচ্ছেদ — কারখানা-ব্যবস্থার দ্বারা মেহনতি মানুষের বিকর্ষণ ও আকর্ষণ। তুলো ব্যবসায়ে সংকট
যে কোনো মানের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিবিদেরা স্বীকার করেন যে, নতুন মেশিনারি প্রবর্তন পুরনো হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচারে শ্রমিকদের উপরে সর্বনাশা ফল সৃষ্টি করে -এই হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচারের সঙ্গেই নোতুন মেশিনারি প্রথম প্রতিযোগিতা করে। তারা প্রায় সকলেই কারখানা-শ্রমিকের ক্রীতদাসত্বে শোক প্রকাশ করেন। এবং তাদের হাতে সেই মস্ত তুরুপের তাসটি কি, যেটি তারা খেলেন? সেটি হল এই যে, প্রথম প্রবর্তন ও বিকাশের যুগের বিভীষিকাগুলি প্রশমিত হবার পরে, মেশিনারি শ্রমের ক্রীতদাসদের সংখ্যা না কমিয়ে বরং বাড়িয়ে দেয় ! হ্যা, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি এই বীভৎস তত্ত্বটিতে—ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের চিরন্তন প্রকৃতি-নির্দিষ্ট ভবিতবতায় বিশ্বাসী প্রত্যেকটি “লোক-হিতৈষী ব্যক্তির কাছেই যা বীভৎস, সেই তত্ত্বটিতে—উল্লাস প্রকাশ করেন যে, অগ্রগতি ও অতিক্রান্তির একটা যুগের পরে, এমন কি তার চুড়ান্ত সাফল্যের পরে, কারখানা-ব্যবস্থা তার প্রথম প্রবর্তনের কালে যত শ্রমিককে পথে ছুড়ে দেয়, তার চেয়ে বেশি সংখ্যক শ্রমিককে পেষণ করে।[১]
এটা ঠিক যে কিছু ক্ষেত্রে, যেমন আমরা জেনেছি ইংল্যাণ্ডের পশম ও রেশম কারখানাগুলিতে, কারখানা-ব্যবস্থার অসাধারণ সম্প্রসারণ, তার বিকাশের বিশেষ এক পর্যায়ে, ঘটাতে পারে কর্ম-নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যায় কেবল আপেক্ষিক হ্রাসই নয়, অপেক্ষিক হ্রাসও। ১৮৬০ সালে, যখন পার্লামেন্টের নির্দেশে যুক্তরাজ্যের সমস্ত কারখানার একটি বিশেষ সুমারি তৈরি করা হয়, তখন কারখানা-পরিদর্শক মি বেকার-এর জেলায় অন্তর্ভুক্ত ল্যাংকাশায়ার, চেশায়ার ও ইয়র্কশায়ারের অংশগুলিতে কারখানার সংখ্যা ছিল ৬৫২টি; এদের মধ্যে ৫৭টিতে ছিল ৮৫,৬২২টি পাওয়ার লুম ৬৮,১৯, ১৪৬টি স্পিণ্ডল (ডাবলিং স্পিণ্ডল বাদে); এরা নিয়োগ করত ২৭,৪৩৯ অশ্বশক্তি ( বাম্প) ও ১৩৯০ অশ্বশক্তি (জল) এবং ৯৪, ১১৯ জন ব্যক্তি ১৮৬৫ সালে ঐ একই কারখানাগুলিতে লুমের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫,১৬৩ স্পিণ্ড-এর ৭৩২৫ ৩১; বাপ-শক্তির পরিমাণ দাড়াল ২৮,৯২৫ অশ্ব এবং জলশক্তির ১৪,৪৫ অশ্ব; এবং কর্ম নিযুক্ত লোকের সংখ্যা দাড়াল ৮৮,৯১৩। অতএব, ১৮৬০ থেকে ১৮৩৫ এই পাঁচ বছরের মধ্যে লুমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল ১১ শতাংশ, স্পিণ্ডল-এর ৩ শতাংশ, ইঞ্জিন-শক্তির পরিমাণ ৩ শতাংশ, কিন্তু কর্মনিযুক্ত লোকের সংখ্যা কমে গেল ৫২ শতাংশ। ১৮৫২ থেকে ১৮৬২ সালের মধ্যে ইংল্যাণ্ডের উল ম্যানুফ্যাকচার প্রভৃতি প্রসার ঘটে অথচ তাতে কর্মনিযুক্ত লোকের সংখ্যা থাকে প্রায় স্থির। এ থেকে বোঝা যায়, নোতুন নোতুন মেশিনের প্রবর্তন পূর্বতন কালের কত সংখ্যক শ্রমিকের স্থান দখল করছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে, নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি কেবল আপাত-দৃশ্য; অর্থাৎ ইতিপূর্বেই প্রতিষ্ঠিত কারখানাগুলির প্রসারণের দরুন এই বৃদ্ধি ঘটেনি, ঘটেছে সংষ্টি অন্যান্য ব্যবসাগুলিকে অজীভূত করে নেবার দরুন; যেমন, ১৮৩৮ থেকে ১৮৫৬-র মধ্যে তুলা-শিল্পে পাওয়ার লুমের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে কেবল এই শিল্পেরই প্রসারলাভের কারণে; কিন্তু অন্যান্য শিল্পে তা ঘটে কার্পেট-লুমে, রিবন-লুমে এবং লিনেন-লুমে বাম্পশক্তি প্রয়োগের কারণে; পূর্বে এগুলি চালিত হত মনুষ্য-শক্তির দ্বারা।[৪] সুতরাং; এই শেষোক্ত শিল্পগুলিতে কর্মী সংখ্যায় বুদ্ধি হচ্ছে কেবল মোট সংখ্যায় হ্রাসপ্রাপ্তিতে লক্ষণমাত্র। সর্বশেষে, আমরা এই সমগ্র প্রশ্নটিকে আলোচনা করেছি একটি ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে; সেই ঘটনাটি এই যে, ধাতব শিল্পগুলি ব্যতিরেকে সর্বত্রই অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা (যারা আঠারো বছরের কমবয়সী, তারা) এবং নারী ও শিশুরাই গঠন করে কারখানা কর্মীদের অধিপ্রধান অংশ।
যাই হোক, বিপুল কর্মীসংখ্যা কৰ্মচ্যুত ও কার্যত মেশিনের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়া সত্ত্বেও, আমরা বুঝতে পারি যে, একটি নির্দিষ্ট শিল্পে আরো কল-কারখানা নির্মাণ এবং পুরনো কল-কারখানাগুলির সম্প্রসারণের মাধ্যমে, কারখানা-শ্রমিকের সংখ্যা ম্যানুফ্যাকচার ও হস্তশিল্প থেকে কর্মচ্যুত শ্রমিক-সংখ্যা থেকে আরো বহুলতা লাভ করতে পারে। দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক, পুরনন উৎপাদন-পদ্ধতিতে, প্রতি সপ্তাহে ৫০০ পাউণ্ড করে বিনিয়োগ করা হয়, যার দুই-পঞ্চমাংশ স্থির মূলধন এবং বাকি তিন-পঞ্চমাংশ অস্থির মূলধন অর্থাৎ ২০০ পাউণ্ড খাটানো হচ্ছে উৎপাদনের উপায়ে এবং ৩০০ পাউণ্ড, ধরুন, মাথাপিছু ১ পাউণ্ড হিসাবে, শ্রমশক্তিতে। মেশিনারি প্রবর্তনের সঙ্গে, এই সঙ্গে এই অনুপাতটি পরিবর্তিত হয়ে যায়। আমরা ধরে নেব যে তখন চার-পঞ্চমাংশ হবে স্থি মূলধন এবং এক-পঞ্চমাংশ অস্থির মূলধন, যার মানে এখন মাত্র ১০০ পাউণ্ড লাগানো হয় শ্রম-শক্তির বাদে। কাজে কাজেই দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিক সংখ্যার কর্মচ্যুতি ঘটে। এখন যদি ব্যবসা বিস্তার লাভ করে এবং বিনিয়োজিত মূলধন বেড়ে দাড়ায় ১,৫০০ পাউণ্ড, অথচ অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে, তা হলে নিযুক্ত শ্রমিক সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়াবে ৩০০-মেশিনারি প্রবর্তনের আগে যা ছিল ঠিক সেই সংখ্যায়। যদি মূলধন আরো বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২,০০ পাউণ্ড, তা হলে নিযুক্ত শ্রমিক-সংখ্যা হবে ৪ ০ ০ অর্থাৎ আগেকার ব্যবস্থায় যা ছিল, তার চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ বেশি। তথ্যের দিক থেকে, তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেবল আপেক্ষিক ভাবে; অর্থাৎ আগাম-খাটানো মূলধনের হিসাবে তাদের সংখ্যা ৮০০ জন হ্রাস পেয়েছে, কেননা আগেকার অবস্থা বজায় থাকলে ২০০০ পাউণ্ড মূলধন নিযুক্ত করত ৪০০ জনের জায়গায় ১২০০ জন। অতএব, শ্রমিকসংখ্যায় আপেক্ষিক হ্রাস এবং বাস্তবিক বৃদ্ধি পরস্পরের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। উপরে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, যখন মোট মূলধন বাড়ে, তখন তার গঠন-বিন্যাস একই থাকে, কেননা উৎপাদনের অবস্থাবলী অপরিবর্তিত থাকে। কিন্তু আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, মেশিনারির ব্যবহারে প্রতিটি অগ্রগতির সঙ্গে মূলধনের স্থির উপাদানটি যে অংশটি গঠিত হয় মেশিনারি, কাচামাল ইত্যাদি দিয়ে, সেই অংশটি—বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়; অন্য দিকে, অস্থির উপাদানটি—যে অংশটি ব্যয়িত হয় শ্রমশক্তি বাবদে, সেই অংশটি হ্রাস-প্রাপ্ত হয়। আমরা আরো জানি, কারখানা ব্যবস্থার মত অন্য কোন উৎপাদন ব্যবস্থায় উন্নয়ন এত নিরবচ্ছিন্ন নয় এবং বিনিয়োজিত মূলধনের গঠন-বিন্যাসও এত নিরন্তর পরিবর্তনশীল নয়। অবশ্য, এই পরিবর্তনগুলি কিছুকাল অন্তর-অন্তর বাধাপ্রাপ্ত হয় সাময়িক বিশ্রামের দ্বারা, যখন উপস্থিত কৃৎকৌশলগত ভিত্তির উপরেই কারখানা গুলির কেবল মাত্রাগত সম্প্রসারণই ঘটে। এই ধরনের সময়কালে শ্রমিকদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে। যেমন, ১৮৩৫ সালে যুক্তরাজ্যে তুলল, উল, পশম, শণ ও রেশম কারখানাগুলিতে মোট শ্রমিক-সংখ্যা ছিল মাত্র ৪,৪৪,৬৮৪, যেখানে ১৮৩১ সালে একমাত্র পাওয়ারলুম তন্তুবায়দের নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে ও আট বছর থেকে উপরের দিকে সব বয়সের কর্মী-সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২,৪০,৬৫৪। নিশ্চয়ই, এই বৃদ্ধির গুরুত্ব কমে যায় যখন আমরা মনে করি যে, ১৮৩৮ সালে তখনো হস্তচালিত তাঁতে নিযুক্ত তন্তুবায়দের সপরিবারে সংখ্যা ছিল ৮,০০,০০০;[৫] এশিয়ায় ও ইউরোপীয় ভূখণ্ডে যাদের কাজ থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে, তাদের কথা নাইবা উল্লেখ করলাম।
এই প্রসঙ্গে আমার যে-সামান্য কটি মন্তব্য এখনো বাকি আছে, সেগুলিতে আমি সত্য সত্যই বর্তমান আছে এমন কয়েকটি সম্পর্কের উল্লেখ করব—যে সম্পর্ক-সমূহের অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত আমাদের অনুসন্ধানে প্রকাশ পায়নি।
যতকাল পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট শিল্প-শাখায়, কারখানা-ব্যবস্থা আত্ম-বিস্তার করে পুরনো হস্তশিল্প বা ম্যানুফ্যাকচারের বিনিময়ে, ততকাল পর্যন্ত তার ফল হয় একদিকে বন্দুক-কামানসজ্জিত সেনাবাহিনী এবং অন্যদিকে তীর-ধনুকে সজ্জিত সেন বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষেরই অনুরূপ। এই প্রথম যুগটি, যখন মেশিনারি তার কর্মক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে—এই যুগটি চুড়ান্ত গুরুত্বপুর্ণ, কেননা তা অসাধারণ পরিমাণে মুনাফা অর্জনে সাহায্য করে। এই মুনাফা যে কেবল দ্রুতগতি সঞ্চয়নের উৎস গড়ে তোলে, তাই নয়, সেই সঙ্গে, নিরন্তর সৃষ্টি হচ্ছে যে সামাজিক মূলধন এবং যা খুজে বেরোচ্ছে নতুন নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্র, তার বৃহত্তর অংশটিকে আকর্ষণ করে নিয়ে আসে উৎপাদনের অনুকূল ক্ষেত্রে। প্রথম যুগের এই ক্ষিপ্র ও প্রচণ্ড তৎপরতার বিশেষ সুবিধাগুলি অনুভূত হয় মেশিনারি কর্তৃক আক্রান্ত প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে। যখন কারখানা-ব্যবস্থা দাড়াবার মত প্রশস্ত ভিত্তি পেয়ে গিয়েছে এবং একটা নির্দিষ্ট মাত্রার পরিপক্কতা লাভ করেছে, বিশেষ করে, যখন তার নিজের কারিগরি ভিত্তি যে মেশিনারি, সেই মেশিনারি নিজেই উৎপাদিত হচ্ছে মেশিনারির দ্বারা, যখন কয়লা খনন ও লৌহ খননে, ধাতব শিল্পসমূহ এবং পরিবহণ-ব্যবস্থায় ঘটে গিয়েছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন; সংক্ষেপে, যখন আধুনিক শিল্পের দ্বারা উৎপাদনের জন্য আবশ্যক অবস্থাগুলি তৈরি হয়ে গিয়েছে, তখনি এই উৎপাদন পদ্ধতি এমন একটা প্রসারণশীলতা, লাফে লাফে আচমকা বিস্তারলাভের এমন একটা ক্ষমতা অর্জন করে যে, তার পথে কাঁচামালের সরবরাহে এবং উৎপন্ন সম্ভারের বিক্রি-বন্দেজ ছাড়া আর কোনো ব্যাপারে কোনো বাধা থাকে না। একদিকে মেশিনারির আশু ফল হয় কাঁচামালের সরবরাহ বৃদ্ধি করা, যেমন কটন জিন বৃদ্ধি করেছিল কটনের উৎপাদন।[৬] অপরদিকে মেশিনারির দ্বারা উৎপাদিত জিনিসের সস্তায় সুলভতা এবং পরিবহণ ও যোগাযোগের উপায়সমূহের উন্নতি যোগায় বিদেশী বাজার জয় করার হাতিয়ার। অন্যান্য দেশের হস্তশিল্প-উৎপাদনকে ধ্বংস করে দিয়ে, মেশিনারি তাদের বলপূর্বক রূপান্তরিত করে কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে। এই ভাবেই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বাধ্য হয়েছিল গ্রেট ব্রিটেনের জন্য তুলা, পশম, শণ, পাটি ও নীল উৎপাদন করতে।[৭] যেসব দেশে আধুনিক শিল্প শিকড় গেড়েছে, সেসব দেশে কর্মীসংখ্যার একাংশকে তা চিরকাল “অনুপুরক” হিসাবে দেশান্তরী হতে এবং বিদেশের ভূখণ্ডগুলিতে উপনিবেশ স্থাপন করতে প্রেরণা যোগায়, যে-ভূখণ্ডগুলি তার ফলে রূপান্তরিত হয় মূলদেশটির জন্য কাঁচামাল উৎপাদনের উপনিবেশে, ঠিক যেমন, নমুনা হিসাবে, অস্ট্রেলিয়া রূপান্তরিত হয়েছিল উল উৎপাদনের উপনিবেশে।[৮] একটি নোতুন ও আন্তর্জাতিক শ্রম-বিভাগের, আধুনিক শিল্পের প্রধান কেন্দ্রের প্রয়োজন সমূহের পক্ষে উপযোগ এমন এক শ্রম-বিভাগের, উদ্ভব ঘটে এবং ভূমণ্ডলের একটি অংশকে রূপান্তরিত করে প্রধানত কৃষি-উৎপাদনের ক্ষেত্রে যার কাজ হবে ভূমণ্ডলের অন্য অংশটিকে—যা থেকে যায় শিল্প-প্রধান, সেই অংশটিকে কাঁচামালের মোগান দেওয়া। এই বিল্পব যুক্ত হয় কৃষিতে আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে, যে সম্পর্কে এখানে আমরা আর অনুসন্ধান চালাব না।[৯]
মিঃ গ্যাভস্টোনের প্রস্তাব অনুযায়ী কমন্স সভা, ১৮৬৭ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি, নির্দেশ দেয় যে ১৮৩১ ও ১৮৬৬-র মধ্যে যুক্তরাজ্যে আমদানিকৃত এবং যুক্তরাজ্য থেকে রপ্তানিত সমস্ত রকমের খাদ্যশস্য ও আটা-ময়দার বিবরণী (রিটার্ণ) দাখিল করতে হবে। নিয়ে আমি উক্ত ফলাফলের একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন দিলাম। আটা-ময়দার হিসাব দেওয়া হয়েছে শস্যের কোয়ার্টারের হিসাব।
দমকে দমকে সম্প্রসারণের যে বিপুল শক্তি কারখানা-ব্যবস্থায় অন্তর্নিহিত এবং বিশ্বের বাজারের উপরে তার যে নির্ভরতা, তা অনিবার্যভাবেই প্রচণ্ড উৎপাদনের সূচনা করে, যার ফলে বাজারগুলি মাত্ৰাধিক দ্রব্যসামগ্রীতে ছাপিয়ে যায় এবং তখন শুরু হয় বাজারে সংকোচন এবং উৎপাদনের পঙ্গুতাসাধন। আধুনিক শিল্পের জীবন হয়ে ওঠে পরিমিত তৎপরতা, সমৃদ্ধি, অতি-উৎপাদন, সংকট ও অচলাবস্থার একটি পরম্পরা। শ্রমিকদের কর্মনিয়োগে এবং স্বভাবতই অস্তিত্বের অবস্থায়, মেশিনারি যে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে তা শিল্পচক্রের এই পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের ফলে হয়ে ওঠে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। একমাত্র সমৃদ্ধির পর্যায় ছাড়া, অন্যান্য পর্যায়ে ধনিকদের পরস্পরের মধ্যে প্রচণ্ড ভাবে চলে বাজারে প্রত্যেকের ভাগ পাবার জন্য সবচেয়ে সাংঘাতিক লড়াই। উৎপন্ন দ্রব্যটি কত সস্তা করা যায়, এই লড়াই তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে আনুপাতিক। এই লড়াই শ্রমশক্তির জায়গায় উন্নত মেশিনারি ও নোতুন উৎপাদন-পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দেয়, তা ছাড়াও প্রত্যেক শিল্প-চক্র এমন একটা পর্যায় আসে যখন পণ্যসামগ্রীকে আরো সস্তা করা জন্য শ্রমশক্তির মূল্যের নীচে মজুরি কমিয়ে আনার চেষ্টা হয়।[১০]
সুতরাং কারখানা-কর্মীর সংখ্যাবৃদ্ধির একটি আবশ্যিক শর্ত হল, কল-কারখানায় বিনিয়োজিত মূলধনের পরিমাণে অনুপাতের তুলনায় অধিকতর বেগে বৃদ্ধিসাধন। অবশ্য, এই বৃদ্ধি শিল্পচক্রের জোয়ার-ভাটা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। তা ছাড়া, তা কৃৎকৌশলগত অগ্রগতির দ্বারা নিরন্তর বাধাপ্রাপ্ত হয়যে অগ্রগতি এক সময়ে নোতুন। শ্রমিকের স্থান করে দেয়, অন্য সময়ে সত্য সত্যই পুরনো এমিকেরও স্থান কেড়ে নেয়। যান্ত্রিক শিল্পে এই গুণগত পরিবর্তনের ফলে কারখানা থেকে ক্রমাগত শ্রমিক ছাটাই হয় কিংবা নোতুন নিয়োগের স্রোতের মুখে কারখানার দরজা বন্ধ হয়ে যায়। যেখানে বিশুদ্ধ মাত্রাগত সম্প্রসারণের ফলে কেবল কর্মচ্যুত লোকগুলির পুনর্নিয়োগেই হয় না, দলে দলে নোতুন শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হয়। এইভাবে শ্রমিকেরা ক্রমাগত আহুত ও বিতাড়িত হয়, একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে তাড়া খায় এবং সেই সময়েই চলতে থাক নোতুন নিয়োগে নারী-পুরুষে, বয়সে ও দক্ষতায় অনবরত অদল-বদল।
কারখানা-কর্মীদের ভাগ্য সবচেয়ে ভালো ভাবে আঁকা যায় যদি আমরা ইংল্যাণ্ডের তুলা শিল্পের একটি দ্রুত সমীক্ষা করে ফেলি।
১৭৭০ সালের ১৮১৫ সাল পর্যন্ত এই শিল্পটি মন্দায় আক্রান্ত হয়েছিল বা অচলাবস্থায় নিপতিত হয়েছিল মাত্র ৫ বছরের জন্য। এই ৪৫ বছর কাল ইংরেজ শিল্পপতিরা ভোগ করত মেশিনারির উপরের এবং বিশ্বের বাজারগুলির উপরে একচেটিয়া অধিকার। ১৮১৫ থেকে ১৮২১ মন্দা; ১৮২২ এবং ‘২৩ তেজি; ১৮২৪ ট্রেড ইউনিয়ন-বিরোধী আইনের অবলুপ্তি, সর্বত্র কল-কারখানার বিরাট প্রসার; ১৮২৫ সংকট; ১৮২৬ কারখানা-শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক দুর্দশা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা; ১৮২৭ অবস্থার সামান্য উন্নতি; ১৮২৮ পাওয়ারলুমের এবং রপ্তানি-পরিমাণের বিরাট বৃদ্ধি; ১৮২৯ রপ্তানি, বিশেষ করে ভারতে রপ্তানি, ছাড়িয়ে যায় পূর্ববর্তী সমস্ত বছরকে; ১৮৩০ পরিপ্লাবিত বাজার, দারুণ দুর্গতি; ১৮৩১ থেকে ১৮৩৩ একটানা মন্দা, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চালাবার একটি অধিকার প্রত্যাহার; ১৮৩৪ কারখানা ও মেশিনারির বিপুল বৃদ্ধি, শ্রমিক-স্বল্পতা। নোতুন গরিব আইন’-এর ফলে কৃষি-শ্রমিকদের কারখানায় অভিপ্রয়াণ আরো বৃদ্ধি। মফস্বলের অঞ্চলগুলি থেকে শিশু উধাও। শ্বেতাঙ্গ দাস-ব্যবসা; ১৮৩৫ দারুণ সমৃদ্ধি একই সময়ে হাতে-চালানো তাঁতের তাঁতীদের অনাহার; ১৮৩৬ দারুণ সমৃদ্ধি, ১৮৩৭ ও ১৮৩৮ মন্দা ও সংকট; ১৮৩৯ পুনর্জাগরণ; ১৮৪৭ দারুণ মন্দা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সৈন্য তলব; ১৮৪১ ও ৪২ কারখানা-শ্রমিকদের মধ্যে ভয়াবহ দুর্গতি; ১৮৩৩ শত আইন’-এর প্রত্যাহার সকলে কার্যকরী করার জন্য কল-কারখানায় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে তালা বন্ধ (লক-আউট’ )। ল্যাংকাশায়ার ও ইয়র্কশায়ার শহর হাজার হাজার শ্রমিকদের প্রবাহ সামরিক বাহিনীর দ্বারা প্রতিহত এবং তাদের নেতৃবৃন্দকে ল্যাংকাশায়ায়ারে বিচারের জন্য উপস্থাপিত; ১৮৪৩ দারুণ দুর্দশা; ১৮৪৪ পুনর্জাগরণ; ১৮৪৫ বিপুল সমৃদ্ধি; ১৮৪৬ গোড়ার দিকে ক্রমাগত উন্নতি, তারপরে প্রতিক্রিয়া। শস্য আইন প্রত্যাহার; ১৮৪৭ ‘বড়া খানা’-র প্রতি সম্মানার্থে শতকরা দশ বা ততোধিক হারে মজুরি ছাটাই, ১৮৪৮ ক্রমাগত মা; সামরিক প্রহরাধীনে ম্যাঞ্চেস্টার; ১৮৪৯ পুনর্জাগরণ; ১৮৫ . সমৃদ্ধি, ১৮৫১ পড়তি দাম, কমতি মজুরি, ঘন ঘন ধর্মঘট; ১৮৫২ উন্নতির সূচনা, ধর্মঘট অব্যাহত, মালিকদের দ্বারা বিদেশী মজুর আমদানির হুমকি; ১৮৫৩ রপ্তানি বৃদ্ধি। ৮ মাস ধর্মঘট, প্রেস্টনে দারুণ দুর্গতি; ১৮৫৪ বিপুল সমৃদ্ধি, পরিপ্লাবিত বাজার; ১৮৫৫ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও প্রাচ্যের বাজারগুলি থেকে ক্রমাগত ব্যর্থতার সংবাদ; ১৮৫৬ বিপুল সমৃদ্ধি; ১৮৫৭ সংকট; ১৮৫৮ উন্নতি; ১৮৫৯ বিপুল সমৃদ্ধি কল-কারখানায় অগ্রগতি; ১৮৬০ ইংল্যাণ্ডের তুলো শিল্পে উন্নতির চুড়ান্ত, ভারত অস্টেলিয়া ও অন্যান্য বাজার এমন পণ্য-প্লাবিত যে ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত তা সব পরিভুক্ত হয়নি; ফরাসী বানিজ্য চুক্তি কারখানা ও মেশিনারির বিরাট বাড় বাড়ন্ত; ১৮৬১ কিছু কাল পর্যন্ত সমৃদ্ধি, তারপরে প্রতিক্রিয়া, আমেরিকার গৃহযুদ্ধ; তুলা-দুর্ভিক্ষ; ১৮৬২ থেকে ১৮৬৩ সম্পূর্ণ বিপর্যয়।
তুলা দুর্ভিক্ষের ইতিহাস এত বৈশিষ্ট্য-সুচক যে একটু আলোচনা না করে ছেড়ে দেওয়া যায় না। ১৮৬০ ও ১৮৬১ সালে বিশ্বের বাজারগুলির অবস্থা সম্পর্কে যেসব ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তা থেকে আমরা দেখি যে সেই দুর্ভিক্ষটি এসেছিল কল-মালিকদের পক্ষে ঠিক সময়মত এবং কিছু পরিমাণে হয়েছিল তাদের পক্ষে সুবিধাজনক—একটা ঘটনা যা স্বীকৃত হয়েছিল ম্যাঞ্চেস্টার চেম্বার অব কমার্স-এর রিপোর্টে, পামারস্টোন এবং ডার্বি কর্তৃক ঘোষিত হয়েছিল পার্লামেন্টে এবং সমর্থিত হয়েছিল ঘটনাবলীর দ্বারা।[১১] কোনো সন্দেহ নেই যে, ১৮৬১ সালে যুক্তরাজ্যে ২৮৮৭টি তুলা কলের মধ্যে অনেকগুলি ছিল ছোট আকারে। মিঃ রেডগ্রেড-এর রিপোর্ট অনুসারে তাঁর জেলার অন্তর্ভূক্ত ২,১০৯টি মিলের মধ্যে ৩৯২টি অর্থাৎ শতকরা ১৯টি প্রত্যেকে নিয়োগ করত ১০ অশ্বশক্তিরও কম; ৩৪৫টি অর্থাৎ শতকরা ১৬টি প্রত্যেকে ২০ অশেরও কম; এবং ১৩৭২টি প্রত্যেকে ২০ অশ্ব থেকে বেশি।[১২] ছোট মিলগুলির অধিকাংশই ছিল কাপড় বোনার শেভ; নির্মিত হয়েছিল ১৮৫৮ সালের পরে সমৃদ্ধির সময়ে; নির্মাতারা বেশির ভাগই ছিল ফাটকাবাজ, যাদের মধ্যে কেউ যোগাত সুতো, কেউ মেশিনারি, কেউবা বাড়িঘর; এগুলি চালাত তত্ত্বাবধায়কেরা বা অন্যান্য স্বল্প বিত্তের লোকজনেরা। এই সব ছোট ছোট উৎপাদনকারীরা বেশির ভাগই কোণঠাসা হয়ে গেল। একই অদৃষ্ট তাদের বাণিজ্যিক সংকটে পর্যুদস্ত করত, যদি তুলা-দুর্ভিক্ষ তা প্রতিহত না করত। যদিও তারা ছিল, উৎপাদনকারীদের মোট সংখ্যার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ, তবু তাদের মিলগুলিতেও বিনিয়োজিত ছিল তুলা-শিল্পের মোট মূলধনের একটি আরো অল্পতর অংশ। কত মিল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার প্রামাণ্য হিসাবে দেখা যায়, ১৮৬২ সালে ৬৩ শতাংশ শিওল, ৫৮ শতাংশ লুম কর্মরত ছিল। এটা হল সমগ্রভাবে তুলা-শিল্পের পরিসংখ্যান, বিশেষ বিশেষ জেলায় যার কিছুটা অদল-বদল করে নিতে হয়। কেবল খুব স্বল্পসংখ্যক মিলই পুরো সময় (সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টা কাজ করেছে, বাকি সব কাজ করেছে মাঝে মাঝে। এমনকি সেই স্বল্পসংখ্যক মিল, যেগুলি পুরো সময় কাজ করেছে এবং প্রথানুসারে একক-পিস হারে ( পিস-রেটে) মজুরি দিয়েছে, সেগুলিতেও শ্রমিকদের মজুরিখারাপ তুলো ভালো তুলোর জায়গা নেবার দরুন, মিশরীয় তুলো সি-আইল্যাণ্ডের তুলোর জায়গা (সূক্ষ্ম সুতো কাটার মিলগুলিতে), সুরাটের তুলো মার্কিন ও মিশরীয় তুলোর জায়গা এবং ফালতু ও সুরাটি মেশাল তুলে খাঁটি তুলোর জায়গা নেবার দরুন কমে গিয়েছিল। সুরাটি তুলোর ক্ষুদ্রতর তত্ত্ব এবং তার অপরিচ্ছন্ন অবস্থা, সুতোর অধিকতর ভঙ্গুরতা এবং টানা সুতোয় আঠা মাখাবার জন্য ময়দার বদলে যাবতীয় ভারি উপাদানের ব্যবহার—এই সবকিছু মেশিনারির গতিবেগ, কিংবা একজন তাঁতী যতগুলি তঁত তদারক করতে পারে তার সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছিল, মেশিনারির ত্রুটিজনিত শ্ৰম বেড়ে গিয়েছিল এবং উৎপাদনের মোট পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে একক-পিছু মজুরিও কমিয়ে দিয়েছিল। যখন সুটের তুলো ব্যবহার করা হত, তখন যে-শ্রমিক পুরো সময় কাজ করত, তার ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াত ২০,৩০ কিংবা তারও বেশি শতাংশ। কিন্তু এ ছাড়াও, অধিকাংশ মিল-মালিক একক-পিছু মজুরির হারে ৫,, এবং ১০ শতাংশ ছাটাই করত। সুতরাং, যে সমস্ত শ্রমিক সপ্তাহে মাত্র ৩, ৩ বা ৪ দিনের জন্য অথবা দিনে ৬ ঘণ্টার জন্য নিযুক্ত হত, তাদের অবস্থা যে কী ছিল, তা আমরা ধারণা করে নিতে পারি। এমনকি ১৮৬৩ সালে, তুলনামূলক ভাবে অবস্থার উন্নতি শুরু হবার পরেও সুতো কাটুনি ও তাঁতীদের মজুরি ছিল ৩শি ৪পে, ৩শি ১০পে, ৪ শি ৬ পে এবং এশি ১ পে।[১৩] অবশ্য, এই শোচনীয় পরিস্থিতিতেও মনিবদের উদ্ভাবনী উদ্দীপনা স্তিমিত হয়ে যায়নি; তা সক্রিয় ছিল মজুরি থেকে কিছু কিছু ছাট-কাট করার প্রচেষ্টায়। এই ছাটকাট কিছু পরিমাণে করা হত তৈরি মালে ত্রুটি থাকার দণ্ড হিসাবে, যে-ত্রুটির আসল কারণ কিন্তু খারাপ তুলা বা অনুপযুক্ত মেশিনারি। অধিকন্তু, যেখানে মিলমালিক নিজেই শ্রমিকদের কুঁড়েঘরগুলির মালিক, সেখানে সে তাদের শোচনীয় মজুরি থেকে ভাড়া কেটে রেখে নিজেকেই তা দিত। মিঃ রেডগ্রেভ আমাদের এমন স্বয়ংক্রিয় তদারককারীদের (একজোড়া স্বয়ংক্রিয় মিউল যারা তদারক করে, তাদের কথা বলেছেন, যারা এক পক্ষ কালের পুরো কাজের শেষে আয় করত ৮শি ১১পে, যা থেকে আবার মিল-মালিক কেটে নিত তার ঘর-তাড়া; অবশ্য, এই কেটে নেওয়া ঘর-ভাড়ার অর্ধেকটা আবার সে ফিরিয়ে দিত দান হিসাবে। তদারককারীরা পেত ৬শি ১১পে। ১৮৬২ সালের পরবর্তী অংশে অনেক জায়গায় স্বয়ংক্রিয় তদারককারীরা মজুরি পেত সপ্তাহে ৫শি থেকে ৯শি এবং তাঁতীরা পেত ২শি থেকে ৬শি।[১৪] এমনকি যখন কারখানাগুলি আংশিক সময় কাজ করত, তখনো বাড়িভাড়া শ্রমিকদের মজুরি থেকে কেটে নেওয়া হত।[১৫] ব্যাংকাশায়ারের কোন কোন অঞ্চলে যে কোন রকমের দুর্ভিক্ষ হয়নি, তাতে বিস্ময়ের কোন কারণ নেই। কিন্তু এসব থেকেও বৈশিষ্ট্যসূচক ব্যাপারটি এই যে উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় এই যে, বিপ্লব ঘটল, তা ঘটল শ্রমিকদের বিনিময়ে। Experimenta in corpore vili, ব্যাঙের উপরে অ্যানাটমিস্ট ( অঙ্গ-ব্যবচ্ছেদকারীরা) যেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়, আনুষ্ঠানিক ভাবে তেমনই চালানো হত। মিঃ রেডগ্রেভ বলেন, যদিও আমি কয়েকটি মিলের শ্রমিকদের সত্যকার আয়ের হিসাব দিয়েছি, তা থেকে এই সিদ্ধান্ত করা যায় না যে তারা সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ঐ একই পরিমাণ আয় করে থাকে। কল-মালিকদের নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরুন শ্রমিকদের দারুণ ঠা-নামার মধ্যে থাকতে হয়।……… বিভিন্ন জাতের তুলোর মেশালের গুণমানের দরুনও মজুরির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে, কখনো এই হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে পূর্বতন আয়ের ১৫ শতাংশের মধ্যে এবং তার পরে এক সপ্তাহের মধ্যে তা নেমে যায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশে।[১৬] কেবল শ্রমিকের জীবন ধণর উপায়-উপকরণের বিনিময়েই এই সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হত না। ও পাঁচটি ইন্দ্রিয়কেও দণ্ড ভোগ করতে হত। “সুরাটি তুলে নিয়ে কাজ করার :- যাদের নিযুক্ত করা হত তাদের অভিযোগ ছিল অনেক। তারা আমাকে জানায় যে, তুলোর গাঁট খোলার সঙ্গে সঙ্গে এক অসহ দুর্গন্ধ বেলোয়, যাতে গা গুলিয়ে ওঠে। ……….‘মিক্সিং’, ‘বিলিং’; ও কার্ভিং ঘরগুলিতে যে ধুলো-ময়লা ছাড়ানো হয়, তা বায়ু চলাচলের পথে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, কাশির উদ্রেক করে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস কষ্টকর করে তোলে। সুরাটি তুলোয় এমন এক রকম ময়লা থাকে যা এক ধরনের চর্মরোগ ঘটায়।……….তন্তু এত ছোট যে জান্তব ও উভয় প্রকারের আঠাই বিপুল পরিমাণে লাগাতে হয়।…….. ধুলোর জন্য ব্রংকাইটিসের প্রকোপ ঘটে। একই কারণে গলায় প্রদাহ ও ক্ষত খুব ব্যাপক। মাকুর ছিদ্র দিয়ে তাতী যখন পড়েন চুষে নেয়, তখন পড়েনটি বারবার ভেঙে যাবার দরুণ অসুস্থতা ও অজীর্ণতা দেখা দেয়। অন্য দিকে, ময়দার বিকল্পগুলি ছিল মিল-মালিকের কাছে একটি ‘ফচুনেটাস’ এর মানিব্যাগ-স্বরূপ-সেগুলি বাড়িয়ে দিয়েছিল সুতোর ওজন। সেগুলির দৌলতে ১৫ পাউণ্ড কাচামালের ওজন বোনার পরে দাড়াতে ২৬ পাউণ্ড।[১৭] ১৮৬৪ সালের ৩০শে এপ্রিলের জন্য কারখানা-পরিদর্শকের বিপোর্টে আমরা পাই : “এই উপকরণটি শিল্প এখন এমন এক মাত্রা পর্যন্ত কাজে লাগাচ্ছে, যা এমনকি কলংকজনক। আমি খুব নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এমন একটি কাপড়ের কথা শুনেছি যার ৮ পাউণ্ড ওজন তৈরি হয়েছিল ৫৪ পাউণ্ড তুলল আর ২ পাউণ্ড আঠা দিয়ে; এবং আরো একটি কাপড়ের কথা শুনেছি যার ৫৪ পাউণ্ড ওজনের মধ্যে ২ পাউণ্ডই আঠা। কাপড় ছিল রপ্তানির জন্য মামুলি শার্টের কাপড়। অন্যান্য প্রকারের কাপড়ে কখনো কখনো ৫০ শতাংশ পর্যন্ত আঠা যোগ করা হত; যার ফলে মিল-মালিক বড়াই করে বলতে পারত, এবং সত্য সত্য বলত যে, যে-সুতো দিয়ে সেই কাপড় বোনা হয়েছে, সেই সুতোর জন্য সে যা খরচ করেছে, তা থেকেও পাউণ্ড-পিছু কম টাকায় সে তা বিক্রি করে ধনী হচ্ছে।[১৮] কিন্তু কেবল ভিতরে মিল-মালিকের এবং বাইরে মিউনিসিপ্যালিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে, কেবল মজুরি হ্রাস ও কাজের অভাব থেকে, অনটন থেকে এবং বদান্যতা থেকে এবং লর্ড সভা ও কমন্স সভার প্রশস্তিবাচক বক্তৃতাগুলি থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় না। “তুলা দুর্ভিক্ষের দরুন গোড়াতেই যে দুর্ভাগা নারী-শ্রমিকেরা কর্মচ্যুত, তারা কিন্তু আজও যখন শিল্পে ঘটেছে পুনর্জাগরণ, কাজ রয়েছে প্রচুর, তখন তারা থেকে যায় সেই দুর্ভাগা শ্রেণীরই অন্তর্ভূক্ত, এবং থেকেও যাবে তাই। ‘বরো’-তে এখন এত যৌবনবতী বারবনিতা আছে, গত ২৫ বছরে যা আমি জানিনি।”[১৯]
তা হলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইংল্যাণ্ডের তুলো-শিল্পের প্রথম ৪৫ বছৱে, ১৭০০ সাল থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত, মাত্র পাঁচটি বছর ছিল সংকট ও অচলাবস্থার বছর; কিন্তু এটা ছিল একচেটিয়া অধিকারের কাল। দ্বিতীয় যুগে, ১৮১৫ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত ৪৮ বছরে, ছিল ২৮ বছরের মন্দা ও অচলাবস্থার পাল্টা মাত্র ২০ বছরের পুনর্জাগরণ ও সমৃদ্ধি। ১৮১৫ থেকে ১৮৩০-এর মধ্যে ইউরোপ মহাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। ১৮৩৩-এর পরে এশিয়ার বাজারের বিস্তৃতি সংঘটিত হয় “মানবজাতির ধ্বংস-সাধনের মাধ্যমে” (ভারতীয় হস্তচালিত তাঁতের তন্তুবায় শ্রেণীর সামগ্রিক-অবলুপ্তির মাধ্যমে)। শস্য আইন প্রত্যাহারের পরে ১৮৪৬ থেকে ১৮৬৩ বছর পর্যন্ত ১৭ বছরে মধ্যে ৮ বছর বলে মাঝারি রকমের তৎপরতা ও সমৃদ্ধি এবং ৯ বছর চলে মন্দা ও অস্থিরতা। এমনকি সমৃদ্ধির বছরগুলিতেও বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষ শ্রমিকদের অবস্থা কি ছিল, তা এই সঙ্গে প্রদত্ত ‘নোট’টি থেকে বিচার করা যায়।
————
১. বিপরীত দিকে, গ্যানিল মনে করেন, কারখানা-ব্যবস্থার চূড়ান্ত ফল হল কর্মীসংখ্যায় অনাপেক্ষিক হ্রাস, আর তাদের বিনিময়ে বেঁচে থাকে এক বর্ধিত সংখ্যক “gens honnectes” এবং গড়ে তোল তাদের সুপরিচিত “perfectibilite perfec tible”। যেহেতু তিনি উৎপাদনের গতি খুব সামান্যই বোঝেন, তিনি অন্তত মনে করেন যে, মেশিনারিকে অবশ্যই হতে হবে একটা মাত্মক প্রতিষ্ঠান, যদি তার প্রজ কর্মব্যস্ত শ্রমিকদের পরিবর্তিত করে দুঃস্থ, এবং তার অগ্রগতি সে যতসংখ্যক ক্রীতদাসত্বের অবসান ঘটিয়েছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক ক্রীতদাসত্বের প্রাদুর্ভাব ঘটায়। তার নিজের কথাতেই ছাড়া, তার এই বক্তব্যের ভাড়ামি আর কোনো ভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয় : “Les classes condamnees a produire et a consommer diminuent, et les classes qui dirigent le travail, qui soulagent, conso lent, et eclairent toute la population, se multiplient…et s’approprient tous les bienfaits qui resultant de la diminution des frais du travail, de l’abondance des productions, et du bon marche des consomma tions. Dans cette direction, l’espece humaine s’eleve aux plus hautes conceptions du genie, penetre dans les profondeurs mysterieuses de la religion, etablit les principes salutaires de la morale ( which consists in ‘s’approprier tous les bienfaits,’ &c.), les lois tutelaires de la liberte (liberty of ‘les classes condamnees a produire?”) et du pouvoir, de l’obeissance et de la justice, du devoir et de l’humanite.” For this twaddle see “Des systemes d’Economie Politique, &c., Par M. Ch. Ganilh.”’ 2cme ed., Paris, 1821, t. I. p. 224, and see p. 212.
২. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর ১৮৬৫, পৃঃ ৫৮। যাই হোক, একই সময়ে, বর্ধিত সংখ্যক কর্মীর জন্য কর্মসংস্থানের উপায় ১১০টি নোতুন মিল-এ প্রস্তুত ছিল, যেগুলিতে ছিল ১১,৬২৫টি তঁত; ৬,২৮,৫৭৬টি টাকু এবং বাষ্প ও জলের মোট ২,৬৯৫ অশ্বশক্তি। (ঐ)।
৩. “রিপোর্টস ইত্যাদি, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ৭৯। ১৮৭১ সালের শেষে, মিঃ এ. রেডগ্রেভ, কারখানা-পরিদর্শক, ব্রেডফোডে ‘নিউ মেকানিক্স ইনষ্টিটিউশনে’ এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, “কিছুকাল ধরে যেটা আমার নজরে পড়ছে, সেটা হল উল ফ্যাক্টরিগুলির পরিবর্তিত চেহারা। আগে এগুলি ভর্তি ছিল মহিলা আর শিশুতে; এখন মনে হয়, মেশিনারিই সব কাজ করে। এর কারণ জিজ্ঞেস করায় একজন ম্যানুফ্যাকচারার আমাকে বলল, পুরনো ব্যবস্থায় আমি নিয়োগ করতাম ৬৩ জন ব্যক্তি, উন্নত ধরনের মেশিনারি প্রয়োগের পরে আমি তাদের সংখ্যা কমিয়ে করেছিলাম ৩৩ জন, সম্প্রতি আরো নোতুন ও বিস্তারিত অদল-বদলের পরে আমি সেই সংখ্যা নামিয়ে আনতে পেরেছি ১৩-তে।
৪. রিপোর্টস ইত্যাদি, ৩১ অক্টোবর, ১৮৫৬, পৃঃ ১৬ দ্রষ্টব্য।
৫. হস্তচালিত তাঁতের উঁতীদের দুঃখ-দুর্দশা একটি রয়্যাল কমিশন’-এর তদন্তের বিষয় হয়েছিল, যদিও তা স্বীকৃত হয়েছিল এবং তার জন্য বিলাপ করা হয়েছিল, কিন্তু তাদের অবস্থা সুরাহা করার ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল দৈব ও কালগত পরিবর্তনের উপরে; আশা করা যায় (২০ বছর পরে !) এখন সেই দুঃখ-দুর্দশা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে সম্ভবতঃ পাওয়ারলুমের বর্তমান ব্যাপক বিস্তারের কল্যাণে। (রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ১৮৫৬, পৃঃ ১৫)।
৬. অন্যান্য যে-সব উপায়ে মেশিনারি কাঁচামালের উৎপাদনকে প্রভাবিত করে, তা তৃতীয় গ্রন্থে উল্লেখ করা হবে।
৭. ভারত থেকে গ্রেট ব্রিটেনে তুলা রানির পরিমাণ (পাউণ্ড)
১৮৪৬–৩,৪৫,৪০,১৪৩ / ১৮৬০–২০,৪১,৪১,১৬৮/ ১৮৬৫–৪৪,৫৯,৪৭,৬০০
ভারত থেকে গ্রেট ব্রিটেনে উল রানির পরিমাণ (পাউণ্ড)
১৮৪৬–৪৫,৭৩,৫৮১/ ১৮৬০–২,৩২,১৪,১৭৩/ ১৮৬৫–-২,৬,৭৯,১১১
৮. কেপ থেকে গ্রেট ব্রিটেনে উল-রপ্তানির পরিমাণ : ১৮৪৬–২,৯৫৮,৪৫৭ পাউণ্ড, ১৮৬০–১৬,৫৭৪,৩৪৫ পাউণ্ড, ১৮৬৫–২৯,৯২,৬২৩ পাউণ্ড।
অস্ট্রেলিয়া থেকে গ্রেট ব্রিটেনে উল-রপ্তানির পরিমাণ : ১৮৪৬–-২,১৭,৮৯,৩৪৬ পাউণ্ড, ১৮৬০–৫,৯১,৬৬,৬১৬ পাউণ্ড, ১৮৬৫–১৩,৯৭,৩৪,২৬১ পাউণ্ড।
৯. স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ নৈতিক বিকাশও ইউরোপের, বিশেষ করে, ইংল্যাণ্ডের আধুনিক শিল্পের অবদান। তাদের বর্তমান রূপে ঐ রাষ্ট্রগুলিকে এখন (১৮৬৬) ইউরোপের উপনিবেশ বলেই গণ্য করা উচিত। [ চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংযোজিত-“তারপর থেকে তারা বিকশিত হয়েছে এমন একটি দেশে যার শিল্প এখন দখল করেছে দ্বিতীয় স্থান। অবশ্য তার জন্য তাদের ঔপনিবেশিক চরিত্র এখন সম্পূর্ণ ভাবে লোপ পায়নি।” এফ, এঙ্গেলস ]
১০. ‘লক-আউট’-এর ফলে কর্মচ্যুত লাইসেস্টার-এর জুতো-প্রস্তুতকারীরা ১৮৬৬ সালের জুলাই মাসে ইংল্যাণ্ডের ‘ট্রেড সোসাইটিজ’-এর কাছে এক আবেদনে বলা হয়ঃ ২০ বছর আগে সেলাইয়ের বদলে ‘রিবেট’-এর প্রবর্তন করে লাইসেস্টারের জুত শিল্পে বিপ্লব ঘটানো হয়। সেই সময়ে ভাল মজুরি আয় করা যেত। বিভিন্ন ফার্মের মধ্যে বিরাট প্রতিযোগিতা চলতকে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন জিনিস তৈরি করবে। কিন্তু অল্পকাল পরেই এক খারাপ ধরনের প্রতিযোগিতার প্রাদুর্ভাব ঘটে—কে কত কম দামে জিনিস বেচে অন্যকে কোণঠাসা করতে পারবে। এর ক্ষতিকর ফল শীঘ্রই আত্মপ্রকাশ করল মজুরি ছাটাইয়ের আকারে, এবং মজুরি এত দ্রুত এত দারুণ কমে গেল যে অনেক ফার্ম এখন দেয় আগেকার মজুরির অর্ধেক। কিন্তু মজুরি যতই কমে যাচ্ছে, প্রত্যেকটি কমতির সঙ্গে সঙ্গে মুনাফা বেড়েই যাচ্ছে। এমনকি অত্যন্ত দুঃসময়কেও মালিকেরা কাজে লাগায় শ্রমিকের মজুরি দারুণ ভাবে ছাঁটাই করে অর্থাৎ তার জীবন ধারণের দ্রব্য-সামগ্রীকে সরাসরি লুঠ করে তার মুনাফা অসাধারণ ভাবে বাড়িয়ে নিতে। একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট হবে (এটা ইঙ্গিত দেয় ‘কভেন্টি সিক-উইভিং’-এ সংকটের)। “মালিক এবং শ্রমিক উভয় পক্ষ থেকেই আমি যেসব খবর পেয়েছি তাতে কোন সন্দেহ নেই যে, মজুরি যে-হারে ছাঁটাই করা হয়েছে তা বিদেশী মালিকদের পঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য যতটা দরকার অথবা অন্যান্য ঘটনার দরুণ যতটা দরকার, তার চেয়ে বেশি বেশির ভাগ শ্রমিককে কাজ করতে হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম মজুরিতে। এক পিস রিবন, যা তৈরি করে তন্তুবায় পাঁচ বছর আগে পেত ৬ পা ৭ শিলিং, এখন পায় ৩ শিলিং ৬ পেন্স অথবা ৩ শিলিং ৬ পেন্স; অন্য ধরনের যে কাজের দাম আগে ছিল ৪ শিলিং বা ৪ শিলিং ও পেন্স, তার দাম এখন হয়েছে ২ শিলিং বা ২ শিলিং ৩ পেন্স। চাহিদা বাড়াবার জন্য মজুরি যতটা কমানো দরকার, তার চেয়ে বেশি কমানো হয়েছে বলে মনে হয়। বস্তুত পক্ষে, অনেক ধরনের রিবনের বুনন-খরচ কমানো হলেও, তৈরি জিনিসগুলির বিক্রির দাম কিন্তু কমানো হয়নি।” (মিঃ এফ. ভি. লঙএর রিপোর্ট, ‘শিশু নিয়োগ কমিশন’, ৫ম রিপোর্ট, ১৮৬৬, পৃঃ ১১৪)।
১১. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ৩০।
১২. ঐ, পৃঃ ১৯। ক্যাপিট্যাল (২য়)—১১
১৩. রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ ৩১ অক্টোবর ১৮৬৩ পূঃ ৪১-৪৫
১৪. ঐ, পৃঃ ৪১-৪২।
১৫. ঐ, পৃ: ৫৭।
১৬. ঐ, পৃঃ৫০-৫১।
১৭. ঐ, পৃঃ ৬২-৬৩।
১৮. রিপোর্টস ইত্যাদি, ৩১ এপ্রিল, ১৮৬৪, পৃঃ ২৭।
১৯. রিপোর্টস ইত্যাদি ৩১ অক্টোবর ১৮৬৫, পৃঃ ৬১-৬২, মিঃ হারিস চিহ্ন কনস্টেবল অব বোলটন-এর চিঠি থেকে উদ্ধৃত।
সংগঠিত ভাবে দেশান্তর-গমনের জন্য একটি সমিতি গঠনের উদ্দেশ্যে ল্যাংকাশায়ারের কারখানা-কর্মীদের এক আবেদনে (তাং ১৮৬৩) আমরা দেখতে পাই : “একথা খুব কম লোকই অস্বীকার করবেন যে কারখানা-কর্মীদের বর্তমান ভূপাতিত অবস্থা থেকে তুলতে হলে, তাদের বিরাট সংখ্যায় দেশান্তরে চলে যাওয়া অত্যাবশ্যক, কিন্তু দেশান্তর অভিমুখে একটা অবিরাম প্রবাহ প্রয়োজন এবং তা ছাড়া সাধারণ সময়েও যে তারা তাদের অবস্থা বজায় রাখতে পারে না, তা দেখানোর জন্যই আমরা সবিনয়ে এই তথ্যগুলি আমরা এখানে একত্রে উপস্থিত করছি : ১৮১৪ সালে রপ্তানিকৃত তুলাজাত দ্রব্যাদির সরকারী মূল্য ছিল £ ১,৭৬,৬৫-৩৭৮, যেখানে সত্যকার বিপননযোগ্য মূল্য ছিল ২,৩,৭,৮২৪। ১৮৫৮ সালে রপ্তানিকৃত তুলাজাত দ্রব্যাদির সরকারী মূল্য ছিল ৫ ১৮,২২,২১,৬৮১, প্রকৃত বিপনন যোগ্য মূল্য ছিল এবং ৪,৩০,৩১,৩২২; প্রায় ১০ গুণ জিনিস বিক্রি হয়েছে আগেকার দামে দ্বিগুণের চেয়ে বেশিতে। সাধারণ ভাবে দেশের পক্ষে এবং বিশেষ ভাবে শ্রমিকদের পক্ষে এত হানিকর ফলাফল উৎপন্ন করতে কয়েকটি কারণ এক সঙ্গে কাজ করছে, যা অবস্থা অনুকূল হলে, আমরা বিশদভাবে আপনার নজরে আনতাম; আপাতত এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে যে এই সব কারণের মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট কারণ হল শমের নিরন্তর বাহুল্য, যা না থাকলে এমন একটা শিল্প, যার ফল হল এমন সর্বনাশা, তা চালু থাকতে পারত না এবং ধ্বংসের হাত থেকে যাকে বাঁচাতে হলে চাই একটি নিরন্তর প্রসারণশীল বাজার। আমাদের তুলা-কলগুলি পর্যায়ক্রমিক শিল্প-মন্দার জন্য অচল হয়ে যেতে পারে; বর্তমান অবস্থায় যা মৃত্যুর মত অবশ্যম্ভাবী; কিন্তু মানুষে মন সর্বদাই কাজ করে চলেছে এবং যদিও আমার মনে হয় যে যখন আমরা বলি যে গত ২৫ বছরে ৬০ লক্ষ মানুষ এই তীর ছেড়ে চলে গিয়েছে, তখন আমরা কম করেই বলি, তবু জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি থেকে এবং উৎপাদন সস্তা করার জন্য শ্রমের স্থান চ্যুতি থেকে, সব চেয়ে সমৃদ্ধির সময়েও বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকদের একটা বৃহৎ শতাংশের পক্ষে যে-কোনো শতে কাজ পাওয়া অসম্ভব।” (“রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ,৩০ এপ্রিল ১৮৬৩, পৃঃ ৫১-৫২)। একটি পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখব কিভাবে আমাদের বন্ধুরা, ম্যানুফ্যাক চারকারীরা, তুলো-শিল্পের বিপর্যয়ের সময়ে, চেষ্টা করেছিলেন যে কোনো উপায়ে, এমনকি, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের মাধ্যমেও, শ্রমিকদের দেশান্তরগমনের পথে বাধা সৃষ্টি করতে।
.
অষ্টম পরিচ্ছেদ–ম্যানুফ্যাকচার, হস্তশিল্প, ও গৃহ-শিল্পে আধুনিক শিল্প কর্তৃক সংঘটিত বিপ্লব
ক. হস্তশিল্প ও শ্রম-বিভাগের উপরে ভিতিশীল সহযোগের অবসান।
হস্তশিল্পের উপরে ভিত্তিশীল সহযোগের এবং হস্তশিল্প-শ্রমের বিভাজনের উপরে ভিত্তিশীল ম্যানুফ্যাকচারের অবসান মেশিনারি কিভাবে ঘটায় আমরা তা দেখছি। প্রথম ধরনের একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ফসলকাটাই যন্ত্র (মোইং মেশিন’ ); ফসল-কাটা কর্মীদের মধ্যে যে সহযোগ, এই যন্ত্র তার স্থান দখল করে নেয়। দ্বিতীয় ধরনের একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হচ্ছে সুচ তৈরির যন্ত্র (নিডল-মেকিং মেশিন’)। অ্যাডাম স্মিথের তথ্যানুসারে, তার সময়কালে ১০ জন মানুষ সহযোগের ভিত্তিতে তৈরি করত দিনে ৪৮,০০০-এরও বেশি সুচ। অন্য দিকে, একটি মাত্র সুচ তৈরির মেশিন ১১ ঘণ্টার একটি কাজের দিনে তৈরি করে ১,৪৫,০০০-এরও বেশি সুচ। একজন মহিলা বা একজন বালিকা তদারক করে এইরকম চারটি মেশিন; সুতরাং দিনে উৎপাদন করে প্রায় ৬,০০,০০০ সুচ এবং সপ্তাহে ৩০,০০,০০০-এরও বেশি।[১] যখন তা সহযোগের বা ম্যানুফাকচারের স্থান দখল করে, তখন একটি একক মেশিন নিজেই হতে পারে একটি হস্তশিল্প-জাতীয় শিল্পের ভিত্তি। কিন্তু হস্তশিল্পে এই ধরনের প্রত্যাবর্তন কারখানা-ব্যবস্থায় অতিক্রমণ ছাড়া কিছুই নয়, যার আবির্ভাব ঘটে তখনি যখন মেশিন চালানোর জন্য মানুষের পেশির স্থলাভিষিক্ত হয় বাষ্প বা জলের মত কোন যান্ত্রিক শক্তি। এখানে সেখানে, কিন্তু কেবল কিছুকালের জন্যই, একটি শিল্প ক্ষুদ্র আয়তনে, যান্ত্রিক শক্তির সাহায্যে চালিত হতে পারে। এটা সংঘটিত হয় বাম্পশক্তি ভাড়া করার মাধ্যমে, যেমন করা হয় বার্মিংহামের শিল্পগুলিতে কিংবা ছোট ঘোট ক্যাকেরিক ইঞ্জিনের মাধ্যমে, যেমন করা হয় বয়নের (উইভিং-এর) কয়েকটি শাখায়।[২] কভেন্টি, রেশম-বয়ন শিল্পে “কুটির কারখানা”র পরীক্ষা যাচাই করা হয়েছিল। সারি সারি কুটির-বেষ্টিত একটি চত্বরের কেন্দ্রস্থলে একটি ইঞ্জিন-ঘর তৈরি করা হয়েছিল এবং ঐ কুটিগুলির মধ্যে অবস্থিত ‘লুম’গুলির সঙ্গে ‘শ্যাফট’-এর সাহায্যে সেগুলিকে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ‘লুম’-পিছু একটা টাকা দিয়ে ভাড়া করা হয়েছিল। লুম কাজ করুক আর নাই করুক ভাড়া দিতে হত প্রতি সপ্তাহে। প্রত্যেকটি কুটিরে ছিল ২-৬টা করে লুম; কতকগুলির মালিক ছিল তাঁতীরা নিজেরাই, কতকগুলি আনা হয়েছিল ধারে এবং কতকগুলি আনা হয়েছিল ভাড়ার ভিত্তিতে। এই কুটির-কারখানাগুলির সঙ্গে নিয়মিত কারখানাগুলির সংগ্রাম চলে ১২ বছর ধরে। এর পরিণতি ঘটে ৩…টি কুটির-কারখানারই সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্তিতে।[৩] যেখানে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটির প্রকৃতিতে বৃহদায়তন উৎপাদনের আবশ্যিকতা ছিলনা, সেখানে গত কয়েক দশকে নোতুন যেসব শিল্প গড়ে উঠেছে, যেমন লেফাফা-তৈরি, ইস্পাতের কলম তৈরি ইত্যাদি, সেখানেই, সাধারণ নিয়ম অনুসারে, তা প্রথম পার হয়েছে হস্তশিল্পের পর্যায়ের মধ্য দিয়ে এবং পরে ম্যানুফ্যাকচারের পর্যায়ের মধ্য দিয়ে কারখানা-পর্যায়ে অতিক্রমণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অধ্যায় হিসাবে। যেখানে ম্যানুফ্যাকচারের দ্বারা জিনিসটির উৎপাদন কেবল এক প্রস্ত ক্রমান্বয়ী প্রক্রিয়া দিয়ে গঠিত নয়, বহুসংখ্যক সংলগ্ন প্রক্রিয়া দিয়ে গঠিত, সেখানে এই অতিক্রমণ খুবই দুরূহ। ইস্পাত-কলম তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার পথে এই ঘটনাটা বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়িয়ে ছিল। যাইহোক, প্রায় ১৫ বছর আগে একটি মেশিন আবিষ্কৃত হয় যা একই সঙ্গে ছটি বিচ্ছিন্ন কর্ম-প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয় ভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। প্রথম ইস্পাত-কলমটিকে সরবরাহ করেছিল হস্তশিল্প-ব্যবস্থা, ১৮২০ সালে, প্রতি গ্রস। পাউণ্ড ৪ শিলিং দামে; তারপরে সেগুলিকে সরবরাহ করে ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থা প্রতি গ্রস’ ৮ শিলিংএ; আর আজ কারখানা-ব্যবস্থা সেগুলিকে সরবরাহ করে প্রতি গ্রস ২ শিলিং ৬ পেলে।[৪]
.
খ. ম্যানুফ্যাকচার ও গৃহ-শিজের উপরে কারখানাখ্যার প্রতিক্রিয়া
কারখানা-ব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে এবং তার সহগামী কৃষি-ব্যবস্থায় বিপ্লবের সঙ্গে, শিল্পের অন্যান্য শাখায় উৎপাদন কেবল বিস্তার লাভই করেনা, তার চরিত্রও বদলে দেয়। কারখানা-ব্যবস্থায় অনুসৃত নীতিই হচ্ছে উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে তার সংগঠনী পর্যায়সমূহে বিশ্লেষণ করা এবং এই ভাবে উপস্থাপিত সমস্যাগুলিকে ‘মেকানিক্স, ‘কেমিস্ত্রি এবং তাবৎ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রয়োগের দ্বারা সমাধান করা; এই নীতিটিই হয়ে ওঠে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ামক নীতি। অতএব, মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারকারী শিল্পে নিজেকে সবলে অনুপ্রবিষ্ট করায় প্রথমে একটি প্রত্যংশ (ডিটেল) প্রক্রিয়ার জন্য, পরে আরেকটির জন্য। এই ভাবে, পুরান শ্রম বিভাজনের ভিত্তিতে গঠিত তাদের সংগঠন-রূপ অখণ্ড স্ফটিকটি খণ্ড হয়ে যায় এবং নিরন্তর পরিবর্তনের পথ করে দেয়। এ থেকে স্বতন্ত্র ভাবেও, যৌথ শ্রমিকটির গঠনবিন্যাসে একটি আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় সম্মিলিত ভাবে কর্মরত ব্যক্তিদের পরিবর্তন। ম্যানুফ্যাকচার-আমলের সঙ্গে প্রতি-তুলনায়, থেকে শ্রম-বিভাজন গড়ে ভোলা হয়, যেখানেই সম্ভব সেখানেই, মহিলাদের, সব বয়সের শিশুদের ও অদক্ষ শ্রমিকদের নিয়োগের ভিত্তিতে, এক কথায়, সস্তা শ্রমের ভিত্তিতে ইংল্যাণ্ডের যে যে ভাষায় একে বৈশিষ্ট্য-সূচক ভাবে অভিহিত করা হয়। মেশিনারি নিয়োগ করুক আর নাই করুক, সমস্ত বৃহদায়তন উৎপাদনের ক্ষেত্রেই যে এটা চলছে, কেবল তাই নয়, তথাকথিত গৃহ-শিল্পের ক্ষেত্রেও এটা চলছে, তা শ্রমিকের নিজের ঘরেই চালু থাক বা ছোট ছোট কর্মশালাতেই চালু থাক। আধুনিক গৃহ-শিল্পের নামটি ছাড়া আর কিছুই পুরানো প্রথার গৃহ-শিল্পের সঙ্গে অভিন্ন নেই—পুরানো প্রথার গৃহ-শিল্পের অস্তিত্বের পূর্বশর্ত ছিল স্বতন্ত্র শহুরে হস্তশিল্প, স্বতন্ত্র কৃষক-খামার, এবং সর্বোপরি, শ্রমিক ও তার পরিবারের বাসের জন্য একটি বাসা-বাটি। পুরানো প্রথার শিল্প এখন রূপান্তরিত হয়েছে কারখানার একটি বহির্বিভাগে ম্যানুফ্যাক্টরিতে (শ্রম কারখানায়) বা ওয়্যারহাউজে (গুদোম-ঘরে)। কারখানা-শ্রমিক, ম্যানুফ্যাকচার শ্রমিক এবং হস্তশিল্প-শ্রমিক—যাদেরকে সে দলে দলে একই জায়গায় কেন্দ্রীভূত করে এবং প্রত্যক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, তাদেরকে ছাড়াও, মূলধন অদৃশ্য সূত্রের মাধ্যমে আরো একটি সেনাবাহিনীকে গতিশীল করে; সেই বাহিনীটি হল ঘরোয়া শিল্পগুলির কর্মীবৃন্দ, যারা বাস করে বড় বড় শহরে এবং ছড়িয়ে থাকে সারা দেশ জুড়ে। একটি দৃষ্টান্ত : লণ্ডনভেরিতে অবস্থিত মেসার্স টিল্লির শার্ট-কারখানা : কারখানাটি নিজের ভিতরেই খাটায় ১,০০০ শ্রমিক; ছাড়াও খাটায় আরো ৯০০০ মানুষ, যারা ছড়িয়ে আছে দেশের সর্বত্র এবং কাজ করেছে নিজ নিজ বাড়িতে।[৫]
নিয়মিত কারখানার তুলনায় আধুনিক ম্যানুফ্যাকচারে সস্তা ও অপরিণত শ্রম শক্তিকে শোষণ করা হয় আরো নির্লজ্জ ভাবে। এর কারণ এই যে, কারখানা ব্যবস্থার কারিগরি ভিত্তি অর্থাৎ পেশিশক্তির জায়গায় মেশিনের প্রচলন, এবং শ্রমের লঘু চরিত্র ম্যানুফ্যাকচারে সম্পূর্ণ ভাবে অনুপস্থিত এবং সেই সঙ্গে আবার নারী ও অতি-কম-বয়সী শিশুদের নির্মম ভাবে অভ্যস্ত করা হয় বিষাক্ত ও ক্ষতিকারক সব পদার্থের প্রভাবে। ম্যানুফ্যাকচারের তুলনায় তথাকথিত ঘরোয়া শিল্পে আবার এই শোষণ আরো বেশি নির্লজ্জ; কারণ শ্রমিকেরা যত ছড়িয়ে থাকে, তত তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয়; কারণ লুঠের পরগাছাদের একটা গোটা বাহিনী নিজেদের স্থান করে নেয় নিয়োগকর্তা এবং কর্মীদের মাঝখানে; কারণ ঘরোয়া শিল্পকে সব সময়েই প্রতিযোগিতা করতে হয় একই উৎপাদন-শাখায় কারখানা-ব্যবস্থা ও ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থার সঙ্গে; কারণ শ্রমিকের পক্ষে সবচেয়ে জরুরি যে-সব জীবন-যাপনের ব্যবস্থা-জায়গা, আলো, হাওয়া-দারিদ্র্য তার কাছ থেকে সেগুলিকে কেড়ে নেয়; কারণ কর্ম-প্রাপ্তি ক্রমেই হয়ে ওঠে আরো আরো অনিয়মিত; এবং, সর্বশেষে, আধুনিক শিল্প ও কৃষি যাদের পরিণত করেছে “অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যে, সেই বিপুল জনসমষ্টির এই শেষ আশ্রয়গুলিতেও কাজের জন্য প্রতিযোগিতা ওঠে চরমে। উৎপাদনের উপায়-উপকরণে ব্যয়সংকোচন, যা প্রথমে ধারাবাহিক ভাবে কার্যকরী করা হয়। কারখানা-ব্যবস্থায় এবং সেখানে যা শুরু থেকেই সংঘটিত হয় শ্রমশক্তির বেপরোয়া অপচয়ের সঙ্গে এবং, তৎসহ, শ্রমের পক্ষে স্বাভাবিক ভাবে প্রয়োজনীয় যেসব অবস্থা তা থেকে তার বঞ্চনার সঙ্গে—এই ব্যয়-সংকোচন এখন আরো বেশি করে আত্মপ্রকাশ করে তার বৈরিতাপূর্ণ ও মারণাত্মক রূপে; সেই শিল্প-শাখায় তা তত বেশি করে আত্মপ্রকাশ করে, যেখানে শ্রমের সামাজিক উৎপাদন ক্ষমতা এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সংযোজনের কারিগরি ভিত্তি যত কম বিকশিত।
.
গ. আধুনিক ম্যানুফ্যাকচার
উপরে যে নীতিগুলি উপস্থাপিত হয়েছে, আমি এখন সেগুলিকে দৃষ্টান্তের সাহায্যে বোঝাতে অগ্রসর হব। বাস্তবিক পক্ষে, শ্রম-দিবসের অধ্যায়ে প্রদত্ত বহুসংখ্যক দৃষ্টান্তের সঙ্গে ইতিপূর্বেই পাঠকের পরিচয় ঘটেছে। বার্মিংহামের হার্ডওয়্যার (লোহা, তামা ইত্যাদি) ম্যানুফ্যাকচারগুলিতে এবং তার আশেপাশের এলাকায়, প্রধান খুবই ভারি কাজে নিযুক্ত ছিল ১০,০০০ মহিলা ছাড়াও, ৩০,০০০ শিশু ও তরুণ ব্যক্তি। সেখানে তাদের দেখা যেত অস্বাস্থ্যকর পেতল-ঢালাইয়ের ঘরে (ব্রাস ফ্রাউণ্ডি’-তে ), বোম কারখানায়, কলাই (এনামেলিং’) রাংঝালাই। (গ্যালভানাইজিং) ও বার্নিশ ( ‘ল্যাকারিং) করার বিভাগগুলিতে।[৬] প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক উভয় ধরনের শ্রমিকদের মাত্রাধিক খাটুনির জন্য লণ্ডনের যেসব ভবনে সংবাদপত্র ও বই ইত্যাদি ছাপা হয়, সেগুলিকে অভিহিত করা হয় “কশাইখানা” এই অশুভ নামে।[৭] একই ধরনের মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করানো হয় বই-বাঁধাইয়ের কারখানাগুলিতে, যেখানে বলি হয় প্রধানতঃ মহিলারা, বালিকারা ও শিশুরা; অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের ভারি কাজ করতে হয় দড়ি-পাকানোর কারখানায় এবং নৈশ কাজ করতে হয় মুনের খনি, মোম তৈরির কারখানা ও রাসায়নিক কারখানায়; রেশম-বোনায় তঁাত ঘোরানোর কাজ যখন মেশিনারি দিয়ে করানো হয় না, তখন বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের দিয়ে সেই কাজ করাতে করাতে তাদের প্রাণান্ত করা হয়।[৮] সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক, সবচেয়ে বেশি নোরা, সবচেয়ে কম মজুরি-দেওয়া কাজগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে ন্যাকড়া-বাছাইয়েয় কাজ; আর এই কাজে বেছে বেছে নিয়োগ করা হয় মহিলাদের ও তরুণী বালিকাদের। এটা সুপরিচিত যে, গ্রেট ব্রিটেনের নিজের বিপুল পরিমাণ ন্যাকড়ার যোগান থাকলেও, সে কাজ করে গোটা বিশ্বের ন্যাকড়া বাণিজ্যের বড় বাজার হিসাবে। ন্যাকড়ার চালান আসে জাপান থেকে, দক্ষিণ আমেরিকার দূর দূর রাষ্ট্র থেকে এবং ক্যানারি আইল্যাণ্ডস থেকে। কিন্তু ন্যাকড়া সরবরাহের প্রধান প্রধান উৎস হচ্ছে জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইতালি, মিশর, তুরস্ক, বেলজিয়াম ও হল্যাণ্ড। ন্যাকড়া ব্যবহার হয় সারের জন্য, বিছানার জাজিমের জন্য, ফেসোর জন্য এবং কাজ করে কাগজের কাঁচামাল হিসাবে। ন্যাকড়ার ভাণ্ডারগুলি হচ্ছে বসন্ত ও অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির বাহন এবং তারা নিজেরাই হয় সেই সব ব্যাধির প্রথম শিকার।[৯] অতিরিক্ত কাজ, কঠিন ও অনুচিত শ্রমের, এবং শিশুকাল থেকেই শ্রমিকের উপরে তার পাশবিক প্রভাবের একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত কেবল যে কয়লা খননকারীদের মধ্যে এবং সাধারণ ভাবে সমস্ত খননকারীদের মধ্যেই পাওয়া যায় তা নয়, সেই সঙ্গে পাওয়া যায় টালি তৈরি ও ইট-তৈরির কাজে লিপ্ত কর্মীদের মধ্যেওযে শিল্পটিতে সাম্প্রতিক কালে উদ্ভাবিত মেশিনটি ইংল্যাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে কেবল বিক্ষিপ্ত ভাবে। মে এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিদিন কাজ চলে সকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা অবধি এবং, যেখানে খোলা হাওয়ায় কোনো হয়, সেখানে সকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা অবধি। সকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কাজকে ধরা হয় মাত্রানি” ও “পরিমিত কাজ বলে। ৬, এমনকি, ৪ বছরের ছেলে ও মেয়েদের পর্যন্ত নিয়োগ করা হয়। তারা বয়স্কদের সমান ঘণ্টা, এমনকি, অনেক সময়েই তাদের চেয়ে বেশি ঘণ্টা কাজ করে। কাজটা খুবই কঠিন এবং গ্রীষ্মের তাপ অবসাদ আরো বাড়িয়ে দেয়। মোসলে-তে একটা টালি খোলায় ২৪ বছর বয়সের এক যুবতী নারী ২টি ছোট ছোট বালিকার সাহায্যে দৈনিক নিয়মিত ভাবে ২০০০ করে টালি তৈরি করত; মেয়ে দুটি তার জন্য মাটি বয়ে আনত ও টালিগুলিকে সাজিয়ে রাখত। তাদের প্রতিদিন ১০ টন মাটি ৩০ ফুট গভীর মাটির খাদ থেকে খাদের পিছল গা বেয়ে উপরে নিয়ে আসতে হত এবং তার পরে আরো ২১০ ফুট দূরে বয়ে নিয়ে যেতে হত। “নিদারুণ নৈতিক অধঃপতন ছাড়া কোন শিশুর পক্ষে টালি খোলার সংশোধনাগারের ভিতর দিয়ে পার হওয়া অসম্ভব।……..”যে অশ্লীল ভাষা শুনতে তারা তাদের কোমলতম বয়স থেকে অভ্যস্ত হয়, যে নোংরা কদর্য ও ন্যাক্কারজনক অভ্যাসের পরিবেশে তারা অজানিত ও অর্ধ-বন্য ভাবে বড় হয়, তা পরবর্তী জীবনে তাদেরকে করে তোলে উচ্ছংখল, উড়নচণ্ডে ও দুশ্চরিত্র। জীবন-যাপনের পদ্ধতিটাই হচ্ছে নৈতিক অধঃপতনের একটি ভয়াবহ উৎস। প্রত্যেক ঢালাইকার (মোল্ডার’ ), যে সব সময়েই একজন দক্ষ শ্রমিক এবং একটি গ্রুপের প্রধান, তাকে তার কুটিরে তার অধীন ৭ জন কর্মীকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হয়। তারা তার পরিবারের সদস্য হোক বা না হোক, সকলকে পুরুষ, বালক, বালিকা সকলকে—শুতে হয় ঐ একই কুটিরে, যাতে থাকে সাধারণতঃ দুটি ঘর, বিরল ক্ষেত্রে তিনটি ঘর এবং যে ঘরগুলি সবই একতলার এবং প্রায় আলো-হাওয়া শূন্য। সারা দিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরে এই লোকগুলি হয়ে পড়ে এত অবসন্ন যে স্বাস্থ্যের বা পরিচ্ছন্নতার বা। শালীনতার কোনো বিধি-নিয়ম তারা এতটুকুও মানতে পারে না। এই ধরনের অধিকাংশ কুটিরই অপরিচ্ছন্নতা, অশ্লীলতা ও ধুলো-ময়লার তোশাখানা।………এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় পাপ এই যে, এতে নিযুক্ত করা হয় তরুণী মেয়েদের এবং শিশুকাল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাদের দৃঢ় ভাবে বেঁধে রাখা হয় সবচেয়ে লম্পট এক দঙ্গলের সঙ্গে। তারা যে মেয়ে, প্রকৃতি তাদের তা শেখাবার আগেই, তারা হয়ে ওঠে একদল বেয়াড়া ‘ছেলে’, যাদের মুখে সব সময়েই লেগে আছে খারাপ কথা। পরনে কয়েক টুকরো ন্যাকড়া, হাঁটুর উপর পা অনেকটাই নগ্ন, চুল ও মুখ ময়লায়। মাখা—এই মেয়েরা শালীনতা ও সংকোচের সমস্ত অনুভূতিকে অবজ্ঞাভরে ঝেড়ে ফেলে। খাবার সময়ে তারা তারা মাঠের মধ্যে সটান শুয়ে পড়ে, বা কাছের কোন খালে ছেলেদের স্নান করার দৃশ্য দেখে। সারা দিনের ভারি কাজের শেষে অপেক্ষাকৃত ভাল জামা-কাপড় পরে পুরুষদের সঙ্গ ধরে সরাইখানায় যায়। এই সমগ্ৰ শ্ৰেণীটির মধ্যে যে শিশুকাল থেকে শুরু করে বাকি জীবন-ভর মাত্রাহীন অমিতাচারের প্রকোপ দেখা যাবে, তা তো স্বাভাবিক। সবচেয়ে খারাপ জিনিস এই যে, ইট প্রস্তুতকারীরা নিজেরাই নিজেদের সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে একটু ভাল এমন একজন সাউদলফিল্ড-এর এক যাজককে বলেছিল, মহাশয়, ইট-ওয়ালার মত শয়তানকে উপরে টেনে তোলার, ভাল কবার চেষ্টা করুন।”[১০]
আধুনিক ম্যানুফ্যাকচারব্যবস্থায় (যার মধ্যে আমি ধরি নিয়মিত কারখানা বাদে বড় আকারের সব কর্মশালা) মূলধন কিভাবে ব্যয়-সংকোচন ঘটায়, সে সম্পর্কে সরকারি ও সুপ্রচুর তথ্য পাওয়া যায় পাবলিক হেলথ, রিপোর্ট (৪) এবং পাবলিক হেথ, রিপোর্ট (৬)’-এ (১৮৬৪)। কর্মশালাগুলির বর্ণনা, বিশেষ করে, লণ্ডনের মুদ্রাকর ও দরজিদের কর্মশালাগুলির বর্ণনা আমাদের খেয়ালী গল্প-লেখকদের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক উদ্ভট কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপরে এর প্রতিক্রিয়া স্বতঃস্পষ্ট। প্রিভি-কাউন্সিলের চীফ মেডিক্যাল অফিসার এবং পাবলিক হেস্থ, বিপোর্ট’-এর সরকারি সম্পাদক ডাঃ সাইমন বলেন, “আমার চতুর্থ রিপোর্টে (১৮৬৩) আমি দেখিয়েছিলাম, যেটি তাদের প্রথম স্বাস্থ্য-বিষয়ক অধিকার সেটি নিয়ে পীড়াপীড়ি করাও শ্রমিকদের পক্ষে বাস্তবে কত অসম্ভব; সেই অধিকারটি হল এই যে, কোন্ কাজের জন্য নিয়োগকর্তা তাদের এক জায়গায় জড়ো করেছেন, তাতে কিছু যায় আসে না, কিন্তু সমস্ত পরিহার্য অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে শ্রমকে মুক্ত করতে হবে যতদূর পর্যন্ত নিয়োগকর্তার উপরে তা নির্ভর করে। আমি দেখিয়েছিলাম, যেখানে শ্রমিকেরা নিজেদের স্বাস্থ্যের স্বার্থে এই ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ে কার্যত অক্ষম থাকবে, সেখানে তারা স্বাস্থ্যরক্ষী পুলিশের বেতনভোগী প্রশাসন থেকে কোনো ফলপ্রসূ সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হবে না।……..হাজার হাজার শ্রমিকের জীবন এখন নিরর্থক নির্যাতিত হয় এবং দীর্ঘায়ু থেকে বঞ্চিত হয় কেবল তাদের পেশাগত অবস্থা সঞ্জাত অন্তহীন শারীরিক ক্লেশ থেকে।”[১১] কিভাবে কাজের ঘরগুলি স্বাস্থ্যের অবস্থাকে প্রভাবিত করে, তা বোঝাবার জন্য ডাঃ সাইমন নিমোত সারণীটি উপস্থিত করেছেন।[১২]
ছবি— পৃষ্ঠা ১৭২
.
ঘ. আধুনিক গৃহ-শিল্প
আমি এখন আসছি তথাকথিত গৃহ-শিল্পের ক্ষেত্রে। এই ক্ষেত্রে, যেখানে মূলধন তার শোষণকার্য চালায় আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পের পটভূমিকায়—এই ক্ষেত্রে বিভীষিকাগুলি সম্পর্কে একটা ধারণা করতে হলে যেতে হবে বাহত খুবই নিরীহ দর্শন পেরেক-তৈরির শিল্পে,[১৩] যা পরিচালিত হয় ইংল্যাণ্ডের দূর দূর গ্রামে। অবশ্য, এখানে লেস-বোনাওখড়ের বিনুনি বানানোর শিল্প দুটির যেসব শাখা এখনো মেশিনারির সাহায্যে চালানো হয় না এবং কারখানায় বা ম্যানুফ্যাকচারে চালিত শাখাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না, সেইসব শাখা থেকে গুটিকয়েক নমুনা দেওয়াই যথেষ্ট।
ইংল্যাণ্ডে লেস-উৎপাদনে নিযুক্ত ১,৫০,০০০ ব্যক্তির মধ্যে, ১০,০০০ জন ১৮৬১ সালের কারখানা-আইনের পরিধির মধ্যে পড়ে। বাকি ১,৪০,০০০ জনের মধ্যে প্রায় সকলেই মহিলা, তরুণ-তরুণী এবং ছেলে ও মেয়ে ছিল—অবশ্য, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্ষেত্র দুটিতে ছেলেদের সংখ্যা খুবই কম। শোষণের এই সন্তা-সুলভ সামগ্রীর স্বাস্থ্যের অবস্থাটি নিচেকার সারণীটি থেকেই পরিষ্কার হয়ে যাবে; এটি তৈরি করেছেন তা ট্রম্যান, নটিংহাম জেনারেল ডিসপেন্সারির চিকিৎসক। ৬৮টি রোগিণীর মধ্যে, যাদের সকলেই লেস বোনে এবং যাদের অধিকাংশই ১৭ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে বয়স, ক্ষয়রোগাক্রান্তের সংখ্যা নিম্নরূপ :
১৮৫২-৪৫ জনে ১
১৮৫৩-২৮ জনে ১
১৮৫৪-১৭ জনে ১
১৮৫৫-১৮ জনে ১
১৮৫৬-১৫ জনে ১
১৮৫৭-১৩ জনে ১
১৮৫৮-১৫ জনে ১
১৮৫৯- ৯ জনে ১
১৮৬০- ৮ জনে ১
১৮৬১- ৮ জনে ১[১৪]
ক্ষয়রোগের এই অগ্রগতি সর্বাপেক্ষ। অশাবাদী প্রগতিবাদীদের পক্ষে এবং জার্মানির স্বাধীন বাণিজ্যের ধ্বজাধারীদের মধ্যে যে ব্যক্তিটি মিথ্যা প্রচারের সবচেয়ে বড় ফেরিওয়ালা তার পক্ষেও যথেষ্ট হবে বলে মনে হয়।
১৮৬১ সালের কারখানা-আইনটি মেশিনারি পরিচালিত লেস উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রন করে এবং ইংল্যাণ্ডে সেটা চালু আছে। এখানে আমরা সেই শাখাগুলির পর্যালোচনা করছি যেখানে শ্রমিকের কাজ করে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে-ম্যানুফ্যাক্টরি (শ্রম-কারখানা) বা গুদামঘরে নয়। এরা পড়ে দুটি ভাগে : (১) ফিনিশিং এবং (২) মেনডি’। প্রথম ভাগে যারা কাজ করে, তারা মেশিনে তৈরি লেসকে ‘ফিনিশিং টাচ’ দেয় এবং নানা উপভাগে ভাগ হয়ে কাজ করে।
লেস ফিনিশিং-এর কাজটা করা হয়, যাকে বলা হয় “মনিবানীর বাড়ি”, তাতে, অথবা মহিলাদের দ্বারা তাদের নিজ নিজ বাড়িতে কখনো তাদের বাচ্চাদের সাহায্য নিয়ে, কখনো তা না নিয়ে। মনিবানীরা বায়না নেয় ম্যানুফ্যাকচারকারীদের কাছ থেকে বা গুদাম-ঘর-মালিকদের কাছ থেকে এবং তারপরে ঘরের আয়তন ও চাহিদার ওঠানামা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক মহিলা, বালিকা ও অল্পবয়সী বাচ্চাদের কাজে নিয়োগ করে। নিযুক্ত মহিলাদের সংখ্যা কোথাও হয় ২০ থেকে ৪০ অবধি এবং কোথাও ১০ থেকে ২০ অবধি। যে-বয়সে এই বাচ্চারা কাজ শুরু করে, তা গড়ে দাড়ায় ৬ বছর, কোন কোন ক্ষেত্রে ৫ বছরের কম। সাধারণ ভাবে কাজের ঘণ্টা সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত, খাবার জন্য ১২ ঘণ্টা সমেত; অবশ্য, খাবার খেতে হয় এক-এক দিন এক-এক সময়ে এবং প্রায়ই সেই অপরিচ্ছন্ন কাজের ঘরের মধ্যেই।
যখন কাজ থাকে প্রচুর, তখন অনেক সময়েই কাজ করতে হয় সকাল ৮টা, এমন কি ৬টা থেকে রাত ১০টা, ১১টা, এমন কি ১২টা পর্যন্ত। ইংল্যাণ্ডের ব্যারাকগুলিতে সৈন্যদের মাথাপিছু জায়গা আইনতঃ বরাদ্দ করতে হয় ৫০০/৬০০ কিউবিক ফুট এবং সামরিক হাসপাতালগুলিতে মাথাপিছু ১,২০০ ফুট, কিন্তু ঐ ‘ফিনিশিং কর্মক্ষেত্রগুলিতে মাথাপিছু জায়গা ৬৭ থেকে ১০০ কিউবিক ফুটের বেশি হয় না। সেই সঙ্গে বাতাসের অম্লজান (অক্সিজেন) আবার নিঃশেষিত হয় ঘরের গ্যাস-বাতিগুলির দ্বারা। লেস যাতে পরিষ্কার থাকে সেইজন্য এমনকি শীতকালেও বাচ্চাগুলিকে পর্যন্ত বাধ্য করা হয় পায়ের জুতো খুলে ফেলতে-যদিও মেঝে টালি বা পাথরের ফলকে বাঁধানো থাকে। নটিংহামে এটা কোন বিরল দৃশ্য নয় যে, ছোট্ট একটা ঘরে, সম্ভবত ১২ বর্গফুট জায়গায়, ১৪ থেকে ২০ জন বাচ্চাকে ঠাসাঠাসি করে কাজ করানো হচ্ছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৫ ঘণ্টা—এমন কাজ, যা কেবল সম্ভাব্য সব রকমের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যেই পরিচালিত হয় না, সেই সঙ্গে যার ক্লান্তি ও একঘেয়েমি তাদের নিঃশেষ করে দেয়।……….এমন কি সবচেয়ে ঘোট যে বাচ্চাগুলি তাদেরও কাজ করতে হয় এমন অত্যধিক মনোযোগ ও ক্ষিপ্রতা সহকারে যে অবাক হয়ে যেতে হয়। তাদের আঙুল পায় না কোনো বিশ্রাম, গতি হয় না কখনো শ্লথ। যদি তাদের কোনো প্রশ্ন করা হয়, তারা কখনো তাদের মাথা তোলে না-পাছে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট হয়। যতই কাজের ঘন্টা আরো লম্বা করা হয়, ততই মনিবানীর লম্বা লাঠিটা আরো বেশি বেশি করে ব্যবহৃত হয় উদ্দীপক-অংকুশ হিসাবে। “শিশুগুলি ক্রমে ক্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘকাল ধরে একটা একঘেয়ে চোখ-আলাকারী কাজে আটকে থাকার দরুন এবং একই অনড় ভঙ্গিতে কাজ করে যাবার অবসাদেব দরুন দিনের শেষ দিকে তারা পাখির মত ছটফট করতে থাকে। তাদের কাজ ক্রীতদাসত্বের মত।”[১৫] যখন মহিলা ও শিশুরা বাড়িতে থেকে কাজ করে বাড়িতে মানে ভাড়া-করা একখানা ঘরে, প্রায়ই একটা চিলেকোঠায়, তখন পরিস্থিতি হয় সম্ভবতঃ আরো খারাপ। নটিংহামের চারদিকে ৪০ মাইলের বৃত্তের মধ্যে এই ধরনের কাজ দেওয়া হয়। রাত ৯টা বা ১০টার সময়ে কাজের বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় তাদেরকে প্রায়ই দিয়ে দেয়া হয় এক বাণ্ডিল লেস যাতে তারা নিজেদের কাজটি শেষ করে ফেলতে পারে। বাণ্ডিলটা দিয়ে দেবার সময়ে অবশ্য মালিকের এক চাকর ফ্যারিসি’-র মত ভণ্ডামির সঙ্গে বলে দেয়, “এ কাজটা মায়ের জন্য”, যদিও সে জানে যে বেচারা শিশুদেরই রাত জেগে ঐ কাজটি শেষ করতে সাহায্য করতে হবে।[১৬]
ইংল্যাণ্ডে বালিশের জন্য লেস তৈরির কাজ চলে প্রধানতঃ দুটি জেলায়। একটি হল হলিটন লেস ডিস্ট্রিক্ট, ডেভনশায়ারের দক্ষিণ তীর বরাবর যা ছড়িয়ে আছে ২০ থেকে ৩০ মাইল পর্যন্ত; তা ছাড়া, নর্থ ডেভনের কয়েকটি স্থানও পড়েছে যার মধ্যে; আর অন্য জেলাটি গঠিত হয়েছে বাকিংহাম, বেডফোর্ড ও নর্দাম্পটনকে এবং, সেই সঙ্গে, অক্সফোর্ড শয়ার ও হান্টিংনশায়ারের সংলগ্ন অংশগুলিকে নিয়ে। কাজটি পরিচালিত হয় প্রধানত কৃষি-শ্রমিকদের কুটিগুলিতে। এমন অনেক ম্যানুফ্যাকচারকারী আছে যারা ৩০০০ এরও বেশি এই ধরনের লেস-তৈরিকারকে নিয়োগ করে। এরা প্রধানত শিশু এবং একান্তভাবেই মেয়ে—কিশোরবয়সী। লেস-ফিনিশিং-এর কাজের আনুষঙ্গিক যে সব অবস্থার কথা আগে বলা হয়েছে, এখানে তার সবই আছে—পার্থক্য কেবল এই যে, এখানে “মনিবানীর বাড়ি বদলে পাই “লেস-স্কুল”, যেগুলি গরিব মহিলারা পরিচালনা করে নিজেদের কুটিরে। শিশুরা তাদের পঞ্চম বছর বয়স থেকে, অনেক সময়ে তারও আগে থেকে, দ্বাদশ বা পঞ্চদশ বর্ষ বয়স পর্যন্ত এই স্কুলগুলিতে কাজ করে। প্রথম বছরে খুবই অল্পবয়সী শিশুরা কাজ করে চার থেকে আট ঘণ্টা অবধি এবং, পরবর্তী কালে, সকাল ছটা থেকে রাত দশটা অবধি। “ঘরগুলি সাধারণত ছোট ঘোট কুটিরের মামুলি প্ৰাকার ঘর; দমকা হাওয়া বাইরে রাখার জন্য চিমনি রাখা হয় বন্ধু এবং ঘরের বাসিন্দারা নিজেদের গরম রাখে কেবল গায়ের উত্তাপের সাহায্যে; শীতকালেও প্রায় এই একই ঘটনা ঘটে। অন্যান্য ক্ষেত্রে, এই তথাকথিত স্কুলগুলি হল ফায়ারপ্লেস’-ছাড়া ভাড়ার ঘরের মত।……এই কুঠরিগুলিতে ভিড়ের ঠাসাঠাসি এবং তারই ফলে বায়ু দূষণের বাড়াবাড়ি প্রায়ই চরম। এর উপরে আবার আছে নর্দমা, পায়খানা এবং এই ধরনের ঘোট ঘোট কুটির-সংলগ্ন আস্তাকুড়ে পচা জিনিস ও আবর্জনার ক্ষতিকর ফলাফল। জায়গার পরিসর সম্পর্কে : “একটা লেস-স্কুলে আঠারজন বালিকা ও একজন মনিবানী, মাথাপিছু ৩৫ কিউবিক ফুট, অন্য একটিতে, যেখানে দুর্গন্ধ ছিল অসহ, ১৮ জন, মাথাপিছু ২৪.৫ কিউবিক ফুট। এই শিল্পে কর্ম-নিযুক্তদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় ২ ও ২.২৫ বছরের শিশুদের পর্যন্ত।”[১৭]
বাকিংহাম ও বেডফোর্ডের কাউন্টিগুলিতে যখন লেস-বোনার কাজ শেষ হয়, তখন শুরু হয় খড়ের বিনুনি বানানোর কাজ এবং এই রেওয়াজ চালু আছে হার্টফোর্ডশায়ারের একটি বড় অংশে এবং ইসেক্স-এর পশ্চিম ও উত্তরাংশে। ১৮৬১ সালে খড়ের বিনুনি ও টুপি তৈরির কাজে নিযুক্ত ছিল ৪৩,০৪৩ জন ব্যক্তি। এদের মধ্যে সব বয়সের পুরুষ ছিল ৩,৮১৫ জন এবং বাকিরা ছিল নারী যাদের মধ্যে ৭০০০ শিশুকে ধরে ২০ বছরের কমবয়সী মেয়েদের সংখ্যা ছিল ১৪,৯১৩। লেস-স্কুলের বদলে আমরা এখানে দেখি খড়ের বিনুনি বানানোর স্কুল। শিশুরা খড়-বিহুনিতে হাতে খড়ি দেয় সাধারণত তাদের ৪ বছরে, প্রায়ই ৩ আর ৪ বছরের মাঝামাঝি সময়ে। অবশ্য, শিক্ষা তারা। কিছুই পায় না। শিশুরা নিজেরাই এক রক্তচোষা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে পার্থক্য বোঝাবার জন্য প্রাথমিক স্কুলগুলিকে বলে “স্বাভাবিক স্কুল”; এই রক্তচোষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাদের কাজে রাখা হয় একমাত্র তাদের টাস্ক করিয়ে নেবার জন্য, যা হচ্ছে সাধারণত ৩০ গজ এবং এটা ঠিক করে দেয় তাদেরই অর্ধাশক্লিষ্ট মায়েরা। এই একই মায়েরাই আবার স্কুলের পরে তাদের বাড়িতে কাজ করায় রাত ১০, ১১, এমনকি ১২টা অবধি। অনবরত মুখে দিয়ে খড় ভিজিয়ে নেয় বলে তাদের মুখ কেটে যায়; খড়ে তাদের আঙুলও কেটে যায়। ডাঃ ব্যালার্ড লণ্ডনের সমস্ত মেডিক্যাল অফিসার্বদের বক্তব্য হিসাবে বলেন যে, শোবার ঘরে বা কাজের ঘরে প্রত্যেক ব্যক্তির ন্যূনতম প্রয়োজন হল ৩০০ কিউবিক ফুট, কিন্তু খড় বিনুনির স্কুলগুলিতে লেস-বোনার স্কুলগুলির চেয়েও মাথাপিছু কম জায়গা বরাদ্দ করা হয়-“প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ১২.৬৭, ১৭, ১৮.৫ কিউবিক ফুট এবং ২২-এর কম কিউবিক ফুট।” কমিশনারদের মধ্যে একজন, মিঃ হোয়াইট বলেন, সব দিকে ৩ ফুট করে এমন একটি বাক্সের মধ্যে যদি একটি শিশুকে ঠেসে দেওয়া হয়, তাহলে সে যতটা জায়গা জুড়ে থাকবে, এই সংখ্যাগুলির মধ্যে ক্ষুদ্রতর সংখ্যাটি তার অর্ধেকেরও কম। ১২ বা ১৪ বছর অবধি শিশুরা এই রকম একটা জীবনই উপভোগ করে। হতভাগ্য, অর্ধভুক্ত মা-বাবার আর কিছুই ভাবনা নেই—একমাত্র বাচ্চাগুলিকে নিঙড়ে যতটা আদায় করে নেওয়া যায়, তা ছাড়া বাচ্চাগুলিও আবার যখন বড় হয়, তখন তারা মা-বাবার জন্য এক কড়িও পরোয়া করে না, মা-বাবাকে ছেড়ে চলে যায় এবং সেটাই স্বাভাবিক। “এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে এইভাবে যারা বড় হয়, তাদের মধ্যে অজ্ঞতা ও দুষ্পবৃত্তির প্রাবল্য দেখা যায়। তাদের নৈতিকতা থাকে সবচেয়ে নিচু স্তরে। মহিলাদের একটা বড় সংখ্যাই থাকে অবৈধ সন্তান এবং সেটা এমন একটা অপরিণত বয়সে যে, অপরাধ-পরিসংখ্যানের সঙ্গে যাদের সম্যক পরিচয় আছে, তারা পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে যান।”[১৮] আর এইসব আদর্শ পরিবারের জন্মভূমি হল ইউরোপের সামনে আদর্শস্থানীয় খ্ৰীষ্টান দেশ; একথা বলেছেন, কাউন্ট মন্টালেমবার্ট, যিনি নিশ্চয়ই খ্ৰীষ্টধর্মের উপরে একজন সুযোগ্য কর্তৃত্ব !
উল্লিখিত শিল্পগুলিতে একেই তো মজুরি শোচনীয় (খড়-বিনুনির স্কুলগুলিতে খুব বিরল ক্ষেত্রেই তা ৩ শিলিং পর্যন্ত ওঠে), তা-ও আবার টাকার বদলে জিনিসে মজুরি দেওয়ার দরুন তার আর্থিক পরিমাণ আরো কমিয়ে দেওয়া হয়; এই জিনিস মজুরি দেবার প্রথা সর্বত্রই বিদ্যমান, বিশেষ করে, লেস-উৎপাদনকারী জেলাগুলিতে।[১৯]
————
১. ‘শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-৩, ১৮৬৪, টীকা ৪৪৭ পৃঃ ১০৮।
২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ভাবে মেশিনারির উপরে ভিত্তিশীল হস্তশিল্পের পুনরুদ্ধার একটি চলতি ঘটনা; সুতরাং যখনি ফ্যক্টরি-ব্যবস্থায় অবশ্যম্ভাবী অতিক্রমণ সংঘটিত হয়, তখনি তজ্জনিত কেন্দ্রীভবন, ইউরোপ, এমনকি, ইংল্যাণ্ডেরও তুলনায় পদক্ষেপে এগিয়ে যায়।
৩. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর ১৮৬৫, পৃঃ ৬৪।
৪. মিঃ গিল্পট বার্মিংহামে প্রথম বড় আকারে ইস্পাত-কলম কারখানা স্থাপন করেন। সেই ১৮৫১ সালেই তা উৎপাদন করত বছরে ১৮,০০,০০,০০০ কলম এবং ব্যবহার করত ১২০ টন ইস্পাত। যুক্তরাজ্যে এই শিল্পের একচেটিয়া অধিকার ছিল। বার্মিংহামের হাতে, বর্তমানে তা উৎপাদন করে হাজার হাজার মিলিয়ম ইস্পাত কলম। ১৮৬১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, এই শিল্পে নিযুক্ত কর্মীসংখ্যা ছিল ১,৪২৮ জন, যাদের মধ্যে ছিল ১,২৬৮ জন নারী-৫ বছর বয়স থেকে শুরু করে বেশি বয়স্ক।
৫. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-২”, ১৮৬৪ টীকা ৪১৫ পৃঃ ৬৮।
৬. এবং, সত্য কথা বলতে কি, শিশুরা এখন শেফিডে নিযুক্ত করা হয় ফাইল কাটিং-এ।
৭. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-৫”, ১৮৬৬ পৃঃ ৩ টীকা ২৪ পৃঃ ৬, টীকা ৫৫, ৫৬, পৃঃ ৭, টীকা ৫৯-৬০।
৮. ঐ, পৃঃ ১১৪, ১১৫ টীকা ৬, ৭। কমিশনার সঠিক ভাবেই মন্তব্য করেছেন, যদিও সাধারণত মেশিন মানুষের স্থান গ্রহণ করে, কিন্তু এখানে আক্ষরিক ভাবেই অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরা মেশিনের স্থান গ্রহণ করেছে।
৯. কম্বল ব্যবসা এবং জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিবিধ বিষয়, দ্রষ্টব্য অষ্টম রিপোর্ট৮৬৩, পৃ ১৯৬২০৮।
১০. “শিশু-নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-৫, ১৮৬৬, পৃঃ ১৬-১৮ টীকা ৮৬-৯৭ এবং পৃঃ ১৩০-১৩৩ টাকা ৩৯-৭১ এবং ৩য় রিপোর্ট ১৮৬৪ পৃঃ ৪৮, ৫৬ দ্রষ্টব্য।
১১. “জনস্বাস্থ্য, ষষ্ঠ রিপোর্ট”, লণ্ডন ১৮৬৪, পৃঃ ২৯, ৩১।।
১২. ঐ, পৃঃ ৩০। ডাঃ সাইমন মন্তব্য করেন, লণ্ডনের ২৫ বছর থেকে ৩৫ বছর বয়সী দর্জি এবং মুদ্রণ-কর্মীর মধ্যে মৃত্যুহার বেশি। এর কারণ নিয়োগ কর্তারা মফস্বল থেকে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত অনেক অল্পবয়সীদের সংগ্রহ করে আনে শিক্ষানবিশ এবং প্রশিক্ষার্থী হিসাবে, যারা আসে ঐ শিল্পে দক্ষতা অর্জনের জন্য। এদের বেশির ভাগই আবার ফিরে যায় কঠিন রোগাক্রান্ত হয়। (ঐ) এই সংখ্যা লণ্ডনের অদমশুমারীতে উল্লেখ আছে—ঐ জায়গার মৃত্যুহার হিসাবে না ধরে লণ্ডন-মৃত্যু হার গণনা করা হয়েছে। তাদের অধিকাংশই প্রকৃত পক্ষে দেশে ফিরে আসে, বিশেষতঃ রোগের প্রকোপের সময়।
১৩. আমি এখানে বলেছি হাতুড়িপেটা পেরেকের কথা, কেটে বা মেশিনে তৈরি পেরেকের কথা নয়। দ্রষ্টব্য : “শিশু নিয়োগ কমিশন, তৃতীয় রিপোর্ট”, পৃঃ ১১-১৯ টীকা ১২৫-১৩০, পৃঃ ৫২, টীকা ১১, পৃঃ ১১৪, টীকা ৪৮৭ পৃঃ ১৩৭, টাকা ৬৭৪।
১৪. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-২, পৃঃ ২২, টীকা ১৬৬।
১৫. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-২”, ১৮৬৪, পৃঃ ১৯, ২০, ২১। .
১৬. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ২১, ২২।
১৭. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট, পৃ ১৯, ৩০।
১৮. শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ৪০, ৪১।
১৯. শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-১”, ১৮৬৩, পৃঃ ১৮৫।
.
ঙ. আধুনিক ম্যানুফ্যাকচার ও গৃহশিল্পের আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পে অতিক্রমণ। ঐসব শিল্পে কারখানা-আইনের প্রয়োগে এই বিপ্লবের ত্বরিতায়ন।
নারী ও শিশুদের শ্রমের নিছক অপব্যবহারের মাধ্যমে, কাজ করা ও বেঁচে থাকার জন্য যে সমস্ত অবস্থা প্রয়োজন তার প্রত্যেকটির নিছক লুণ্ঠনের মাধ্যমে এবং অতি-শ্রম ও নৈশশ্রমের মাধ্যমে শ্রম-শক্তিকে সস্তা করার এই প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত বাধাপ্রাপ্ত হয় অনতিক্রম্য স্বাভাবিক প্রতিবন্ধকের দ্বারা। ঠিক একই ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় এই পদ্ধতিগুলির উপরে প্রতিষ্ঠিত সাধারণ ভাবে পণ্যসামগ্রীকে সস্তা করার এবং ধনতান্ত্রিক শোষণ-কার্যের প্রক্রিয়া। যখনি এই বিন্দুটিতে উপনীত হওয়া যায়-যদিও তাতে লাগে অনেক বছর—তখনি ঘণ্টা বেজে ওঠে মেশিনারি প্রবর্তনের এবং সেই সঙ্গে বিক্ষিপ্ত গৃহ-শিল্পগুলির ও ম্যানুফ্যাকচারগুলি কারখানা-শিল্পে দ্রুতগতি রূপান্তরণের।
এই আলোড়নের এক বিরাট আয়তনের দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায় পরিধেয় পোশাক উৎপাদনের ক্ষেত্রে। শিশু-নিয়োগ কমিশন’-এর শ্রেণীবিন্যাস অনুসারে এই শিল্পের মধ্যে পড়ে খড়ের টুপি প্রস্তুতকারক, মেয়েদের টুপি-প্রস্তুতকারক, ক্যাপ-প্রস্তুতকারক, দজি মেয়েদের মাথার সাজ ও পোশাক-আশাক প্রস্তুতকারক, শার্ট-প্রস্তুতকারক; কঁচুলি প্রস্তুতকারক, দস্তানা-প্রস্তুতকারক, জুতো-প্রস্তুতকারক এবং, তা ছাড়াও, আরো অনেক শাখা যেমন গলাবন্ধ, কলার ইত্যাদি। ১৮৬১ সালে ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলসে এই শিল্পগুলিতে নিযুক্ত নারীদের সংখ্যা ছিল ৫,৮৬, ২৯৯; এদের মধ্যে অন্ততঃ ১১৫, ২৪২ জন ছিল ২০ বছর বয়সের নীচে এবং ১৬,৬৫ জন ১৫ বছর বয়সের নীচে। ১৮৬১ সালে যুক্তরাজ্যে নারী-শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল ৭,৫৩,৩৩৪ জন। টুপি তৈরি, জুতো তৈরি, দস্তানা তৈরি ও দর্জির কাজে নিযুক্ত পুরুষ শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল ৪,৩৭,৯৬৯; এদের মধ্যে ১৪,৯৬৪ জন ছিল ১৫ বছর বয়সের নীচে, ৮৯,২৮৫ জন ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সের মধ্যে এবং ৩,৩৩,১১৭ জন ২০ বছর। বয়সের উপরে। এই পরিসংখ্যানের মধ্যে অনেকগুলি ক্ষুদ্রতর শাখা-প্রশাখাকে ধরা হয়নি। কিন্তু যেভাবে আছে, সেই ভাবেই সংখ্যাগুলিকে ধরা যাক; তা হলে ১৮৬১ সালের আদমশুমারি অনুসারে একমাত্র ইংল্যান্ড ও ওয়েসেই আমরা পাই ১৩,২৪,২৭৭ জন, কৃষি ও গো-পালনে যত লোক নিযুক্ত রয়েছে তার প্রায় সমান। মেশিনারির যাদু-দ্বারা উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ পণ্য-সম্ভারের এবং ঐ মেশিনারির দ্বারা মুক্তি প্রদত্ত বিরাট শ্রমিক-জনতার কি অবস্থা হয়, তা আমরা উপলব্ধি করতে শুরু করি।
পরনের পোশাক-আশাকের উৎপাদন অংশতঃ সম্পাদিত হয় ম্যানুফ্যাক্টরিগুলিতে, যেখানে কর্মশালাসমূহে আমরা পাই সেই শ্রম-বিভাজনেরই পুনরুৎপাদন, যার ‘মেমব্রা ডিসজেক্টা প্রস্তুত অবস্থাতেই পাওয়া যায় হাতের কাছেই; আর অংশতঃ সম্পাদিত হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মালিক-হস্তশিল্পীদের দ্বারা; এরা অবশ্য আগে যেমন ব্যক্তিগত পরিভোকাদের জন্য কাজ করত, এখন তা করেনা, এখন কাজ করে ম্যানুফ্যাক্টরি ও গুদামঘরের জন্য এবং কাজ করে এমন মাত্রায় যে প্রায়ই গোটা শহর বা গোটা অঞ্চল একটি স্থানীয় বিশেষত্ব হিসাবে নিযুক্ত থাকে বিশেষ বিশেষ শাখায়, যেমন জুতো তৈরি; এবং সর্বশেষে, এক বিপুল আয়তনে সম্পাদিত হয় তথাকথিত গৃহশিল্প শ্রমিকদের দ্বারা, যারা পরিণত হয় ম্যানুফ্যাক্টরিগুলির বহিবস্থিত বিভাগে, এমনকি, ক্ষুদ্রতর মালিকদের কর্মশালায়।[১]
কাঁচামাল ইত্যাদির যোগান আসে যান্ত্রিক শিল্প থেকে, সস্তা মানবিক মালের সমষ্টি গঠিত হয় (Tailable a merci et misericorde) যান্ত্রিক শিল্পের দ্বারা এবং উন্নতকৃত কৃষি কর্মের দ্বারা “মুক্ত-কৃত ব্যক্তিদের দিয়ে। চাহিদার বৃদ্ধি ঘটলে তার প্রয়োজন মেটাতে ধনিকদের চাই হাতের কাছে প্রস্তুত একটি সুসজ্জিত বাহিনী-ধনিকদের এই প্রয়োজন থেকেই উল্লিখিত শ্রেণীর ম্যানুফ্যাকচারের উৎপত্তি।[২] যাই হক, এইসব ম্যানুফ্যাকচার কিন্তু একটি সুবিস্তৃত ভিত্তি হিসাবে এই বিক্ষিপ্ত হস্তশিল্প ও গৃহ-শিল্পগুলিকে বেঁচে থেকে কাজ চালিয়ে যেতে সুযোগ দেয়। শ্রমের এই শাখাগুলিতে উদাত্ত মূল্যের বিপুল উৎপাদন এবং তাদের উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর ক্রমবর্ধমান হারে মূল্যহ্রাসের কারণ হচ্ছে প্রধানতঃ শ্রমিকদেরকে প্রদত্ত মজুরির পরিমাণ, যা এত সামান্য যে তা দিয়ে কেবল কায়রেশে প্রাণ বাঁচানোই যায় এবং সেই সঙ্গে, কাজের সময়ের যথাসম্ভব সম্প্রসারণ, যা এত সাংঘাতিক যে মানবদেহের সহ্যের শেষ সীমা ছাড়িয়ে যায়। বাস্তবিক পক্ষে, মানুষের যে ঘর্ম ও রক্ত রূপান্তরিত হয় পণ্যসামগ্রীতে, সেই ঘর্ম ও রক্তকে সস্তা করেই অতীতে বাজারগুলিকে নিরন্তর আরো বিস্তৃত করা হয়েছে এবং আজও প্রত্যহ করা হচ্ছে; এই ঘটনা আরো বিশেষভাবে লক্ষণীয় ইংল্যাণ্ডের ঔপনিবেশিক বাজারগুলি সম্বন্ধে, যেখানে, তা ছাড়াও, ইংরেজ রুচি ও অভ্যাসগুলি প্রাধান্য লাভ করে। শেষ পর্যন্ত সেই সংকট-বিন্দুটিতে উপনীত হতে হল। পুৰ্বনো পদ্ধতির ভিত্তিটি–শ্রমিক-জনগণের পাশবিক শোষণ এবং সেই সঙ্গে মোটামুটি প্রণালীবদ্ধ শ্রম-বিভাজন আর ক্রমবর্ধমান বাজারগুলির পক্ষে এবং ধনিকদের মধ্যে আরো দ্রুত-বর্ধমান প্রতিযোগিতার পক্ষে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হলনা। মেশিনারির আবির্ভাবের ঘণ্টা বেজে উঠল। চুড়ান্ত ভাবে বৈপ্লবিক যে মেশিন, যা সমভাবে আক্রমণ চালাল এই উৎপাদন-ক্ষেত্রটির সংখ্যাহীন শাখায় উপরে-পোশাক তৈরি, দর্জির কাজ, জুতো তৈরি, সেলাই-ফেঁাড়াই, টুপি-তৈরি এবং আরো অনেক কিছুর সামগ্রিক ব্যবস্থার উপরে, সেটি আর কিছু নয়—সিউয়িং মেশিন’, ‘সেলাই-কল’।
শ্রমিক-জনসংখ্যার উপরে তার আশু প্রতিক্রিয়া অন্যান্য সব মেশিনারির মতই, আধুনিক শিল্পের উদ্ভব থেকে যে মেশিনারি শিল্পের নোতুন শাখায় আত্ম-প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। অতি কচি বয়সের শিশুরা ভেসে যায়। মেশিন-কর্মীদের মজুরি গৃহ কর্মীদের মজুরির তুলনায় বৃদ্ধি পায়; এই গৃহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই গরিবদের মধ্যেও সবচেয়ে গরিব। অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে অবস্থিত হস্তশিল্পীদের সঙ্গে মেশিনারি প্রতিযোগিতা করে, ফলে তাদের মজুরি দারুণ নেমে যায়। এই নোতুন মেশিন-কর্মীরা একান্ত ভাবেই বালিকা ও যুবতী নারী। যান্ত্রিক শক্তির সাহায্যে তারা, ভারি কাজের উপরে পুরুষ শ্রমিকদের যে-একচেটিয়া অধিকার এতকাল ছিল, সেই অধিকারকে ভেঙ্গে দেয় এবং অপেক্ষাকৃত হাল্কা কাজ থেকে বৃদ্ধ নারী ও অতি কচি শিশুদের দলে দলে উৎখাত করে দেয়। প্রবল প্রতিযোগিতা দৈহিক শ্রমিকদের মধ্যে যারা দুর্বলতম তাদের চূর্ণ করে দেয়। গত ১০ বছরে লণ্ডনে অনাহার-মৃত্যুর ভয়াবহ বৃদ্ধি এবং মেশিনে-সেলাইয়ের বিস্তার পাশাপাশি অগ্রসর হয়েছে।[৩] নোতুন মেয়ে-শ্রমিকেরা মেশিনের বিশেষ গড়ন, ওজন ও আকার অনুযায়ী হাতে ও পায়ে কিংবা কেবল হাতে মেশিন চালায়-কখনো বসে, কখনো দাড়িয়ে এবং যথেষ্ট পরিমাণ শ্রমশক্তি ব্যয় করে। যদিও পুরনো ব্যবস্থায় কাজের ঘণ্টা যত দীর্ঘ ছিল, এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা থেকে কম, তবু কাজের ঘণ্টার এই দৈর্ঘ্যের জন্যই এই মেয়ে শ্রমিকদের কাজ হয়ে পড়ে অস্বাস্থ্যকর। যেখানেই একটি সেলাই-কলকে স্থাপন করা হয় সংকীর্ণ ও ইতিপূবেই জনাকীর্ণ কোন কাজের ঘরের মধ্যে, তা অস্বাস্থ্যকর প্রভাবগুলিকে বাড়িয়ে তোলে। মিঃ লর্ড বলেন, “নিচু ছাদ-ওয়ালা কাজের ঘর, যার মধ্যে কাজ করছে ৩০৪০ জন মেশিন-কমী—এমন একটি ঘরে প্রবেশ করার প্রথম প্রতিক্রিয়াই অসহনীয়।……ঘরের অভ্যন্তরস্থ উত্তাপ ভয়ংকর; অংশত যার কারণ হচ্ছে ইস্তিরি গরম করার জন্য ব্যবহৃত গ্যাস স্টোভ; এমনকি যখন কাজের ঘণ্টা পরিমিত, সকাল ৮টা থেকে সন্ধা ৬টা পর্যন্ত, তখনো এই সব জায়গায় প্রতিদিন ৩৪ জন করে কর্মী অজ্ঞান হয়ে যায়।[৪]
উৎপাদনের উপকরণে বিপ্লবের অবশ্যিক ফল হল শিল্প-পদ্ধতিতে বিপ্লব, যা সংঘটিত হয় বিবিধ অতিক্রান্তিকালীন রূপের বিচিত্র এক সংমিশ্রণের দ্বারা। শিল্পের কোন-না কোন শাখায় যে-হারে সেলাই-কলের প্রচলন ঘটেছে, যে-সময় জুড়ে তা কাজ করে এসেছে, শ্রমিক-জনগণের পূর্ববর্তী অবস্থা যা ছিল, ম্যানুফ্যাকচার বা হস্তশিল্প বা গৃহ-শিল্পের কার কতটা প্রাধান্য, কাজের ঘরের ভাড়া কত ইত্যাদি অনুযায়ী এই রূপগুলিরও পরিবর্তন ঘটে।[৫] দৃষ্টান্ত হিসাবে, পোশাক-আশাকে তৈরির ক্ষেত্রে, যেখানে শ্রম প্রায় সর্বত্র সংগঠিত প্রধানতঃ সরল সহযোগের ভিত্তিতে, সেখানে সেলাই-কল গোড়ার দিকে সেই ম্যানুফ্যাকচার-শিল্পে দেখা দিত কেবল একটা নোতুন উপাদান হিসাবে। দর্জির কাজে, শার্ট তৈরিতে, জুতো তৈরি ইত্যাদিতে সব কটি রূপই পরস্পর-মিশ্রিত। এখানে নিয়মিত ফ্যাক্টরি-ব্যবস্থা। সেখানে মধ্যবর্তী লোকেরা ধনিকের কাছ থেকে সরাসরি কাঁচামাল পায় এবং ১০ থেকে ৫০ জন বা তারও বেশি মেয়ে-কর্মীকে তাদের সেলাই-কলগুলিকে আলাদা আলাদা গ্রুপে—“কামরা” বা “চিলেকোঠায় ভাগ করে দেয়। সর্বশেষে, যেখানে মেশিনারি প্রণালী হিসাবে সংগঠিত নয় এবং যেখানে তাকে খর্বাকার অনুপাতেও ব্যবহার করা যায়, সেখানে, সর্বত্রই যা ঘটে থাকে, হস্তশিল্পী ও গৃহকর্মীরা তাদের পরিবারবর্গের সহায়তায় কিংবা বাইরে থেকে কিছুটা অতিরিক্ত শ্রমের সাহায্যে, তাদের নিজেদের সেলাই কলগুলিকেই কাজে লাগিয়ে থাকে।[৬] যে-ব্যবস্থাটা ইংল্যাণ্ডে বাস্তবে চালু আছে, তা এই যে, ধনিক তার মোকামে বহুসংখ্যক মেশিন কেন্দ্রীভূত করে এবং তার পরে ঐসব মেশিনে উৎপন্ন জিনিসগুলিতে বাকি কাজের জন্য সেগুলি বিলি করে দেওয়া হয় গৃহকর্মীদের মধ্যে।[৭] ক্রান্তিকালীন এই রূপগুলির বিচিত্র বিভিন্নতা কিন্তু নিয়মিত কারখানা ব্যবস্থায় রূপান্তরণের প্রবণতাকে প্রচ্ছন্ন রাখেনা। সেলাই মেশিনের যা প্রকৃতি, তাতে এই প্রবণতা আরো পরিপুষ্ট হর; আগে তার যে-বহুবিধ ব্যবহার সম্পাদিত হত একটি শিল্পের বিভিন্ন শাখায়, এখন সেগুলি সম্পাদিত হয় একই ছাদের নীচে, একই পরিচালনার অধীনে। এই প্রবণতা আরো উৎসাহ পায় এই ঘটনা থেকে যে, প্রাথমিক সুচের কাজ ও আরো কিছু ক্রিয়াকর্ম সবচেয়ে সুবিধাজনক ভাবে করা যায় সেই জায়গায়, যেখানে মেশিনটি কাজ করছে। সেই সঙ্গে যার হাতে সেলাই করে এবং যারা নিজেদের মেশিনে সেলাই করে, সেই গৃহকর্মীদের অবশ্যম্ভাবী উদ্বাসনও এই প্রবণতাকে উৎসাহ দেয়। এই ভবিতব্য ইতিমধ্যেই তাদের অংশত কবলিত করেছে। সেলাই-কলে[৮] বিনিয়োজিত মূলধনের নিরন্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্তির ফলে মেশিনেতৈরি জিনিসপত্রের উৎপাদনে প্রেরণা সঞ্চার করে এবং তা দিয়ে বাজারকে ভাসিয়ে দেয় আর এই ভাবে গৃহ-কর্মীদের নিশানা দেয় তাদের মেশিনগুলিকে বিক্রি করে দেবার জন্য। খোদ সেলাই-মেশিনেরই অতি উৎপাদন তাদের উৎপাদন কারীদের বাধ্য করে, সেগুলিকে বিক্রি করতে না পেরে, কিছু পরিমাণ টাকার বদলে সাপ্তাহিক হিসাবে ভাড়া দিতে এবং এই ভাবে মারাত্মক প্রতিযোগিতার দ্বারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেশিন-মালিককে ধ্বংস করে দিত।[৯] মেশিনগুলির গঠনে নিরন্তর পরিবর্তন এবং সেগুলির ক্রমবর্ধমান মূল্যহ্রাস পুরনো মেশিনগুলির দিন দিন অবমূল্যায়ন ঘটায় এবং অসম্ভব সস্তা দামে সেগুলিকে বড় বড় ধনিকদের কাছে বিক্রি করে দেবার ব্যবস্থা করে, একমাত্র যারা সেগুলিকে লাভজনক ভাবে কাজে লাগাতে পারে। সর্বশেষে, মানুষের জায়গায় স্টিম ইঞ্জিনের প্রবর্তন, যেমন অনুরূপ সব বিপ্লবে, তেমন এই বিপ্লবেও হানে শেষ আঘাত। প্রথমে বাম্প-শক্তির ব্যবহার কিছু নিছক কারিগরি সমস্যার সম্মুখীন হয়, যেমন মেশিনগুলির মধ্যে অনিয়মিক, সেগুলির গতিবেগ নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা, হালকা মেশিনগুলিতে অতিরিক্ত ক্ষয়-ক্ষতি ইত্যাদি; অচিরেই অভিজ্ঞতার কল্যাণে এই সমস্যাগুলি অতিক্রম করা সম্ভব হয়।[১০] যদি, এক দিকে বড় বড় ম্যানুফ্যাক্টরিতে অনেক মেশিনের কেন্দ্রীভবনের ফলে বাম্প-শক্তির প্রয়োগ সম্ভব হয়, অন্য দিকে তখন মানুষের পেশির সঙ্গে বাষ্পের প্রতিযোগিতার ফলে বড় বড় কারখানায় শ্রমিক ও মেশিনের কেন্দ্রীভবন ত্বরান্বিত হয়। যেমন বর্তমান ইংল্যাণ্ড, যেখানে আধুনিক শিল্পের প্রভাবে সম্পূর্ণ ভাবে পরিবর্তিত বিপর্যস্ত ম্যানুফ্যাকচার, হস্তশিল্প ও গৃহ-শিল্পের মত উৎপাদনের প্রত্যেকটি রূপই অনেক কাল আগেই কারখানা ব্যবস্থার বিভীষিকাগুলি পুনরুৎপাদন করেছে, এমনকি মাত্রাতিরিক্ত ভাবেই করেছে, অথচ সেই ব্যবস্থার আনুষঙ্গিক সামাজিক প্রগতির কোনো উপাদানে অংশ গ্রহণ করেনি, সেই ইংল্যাণ্ড আজ প্রত্যক্ষ করছে ম্যানুফাকচার, হস্তশিল্প, গৃহশিল্প, প্রভৃতি প্রত্যেকটি উৎপাদন-রূপের কারখানা-ব্যবস্থায় রূপান্তরণ—কেবল পোশাক তৈরির শিল্পের মত বিশাল শিল্পেই নয়, উল্লিখিত অন্যান্য শিল্পগুলিরও অধিকাংশ ক্ষেত্রে।[১১]
যে সমস্ত শিল্পে নারী, তরুণ-তরুণী ও শিশুরা নিযুক্ত হয়, সেই সমস্ত শিল্পে কারখানা আইনের বিস্তার সাধন শিল্প বিপ্লবকে কৃত্রিম ভাবে সাহায্য করে, যদিও শিল্প-বিপ্লব ঘটে থাকে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে। কাজের দিনের দৈর্ঘ্য, ছেদ, শুরু ও শেষ সম্পর্কিত বাধ্যতামূলক নিয়ন্ত্রণ, শিশুদের দৌড়-প্রথা, নির্দিষ্ট বয়সের কমবয়সী সমস্ত শিশুদের নিয়োগ নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদির কারণে, এক দিকে যেমন দরকার হয় আরো মেশিনারি,[১২] অন্য দিকে তেমন দরকার হয় সঞ্চলক শক্তি হিসাবে পেশিশক্তির বদলে বাষ্প-শক্তির প্রয়োগ।[১৩] অপর পক্ষে, সময়ের ক্ষতিকে পুষিয়ে দেবার জন্য যৌথ ভাবে ব্যবহার্য উৎপাদন-উপায় উপকরণের ফার্ণেস-এর ও বাড়ি-ঘরের সম্প্রসারণ ঘটে; এক কথায়, উৎপাদনের উপায় উপকরণের বৃহত্তর কেন্দ্রীভবন এবং সেই সঙ্গে শ্রমিক-জনসংখ্যার বৃহত্তর সমাবেশ। কারখানা-আইনের দ্বারা আহত প্রত্যেকটি ম্যানুফ্যাকচারকারী বারংবার আবেগভরে যে প্রধান আপত্তিটি উত্থাপন করে, তা আসলে এই যে, পুরাতন আয়তনে উৎপাদন চালিয়ে যেতে হলে বৃহত্তর পরিমান মূলধনের প্রয়োজন হবে। কিন্তু তথাকথিত গৃহ শিল্পগুলিতে এবং গৃহ-শিল্প ও ম্যানুফ্যাকচারের মধ্যবর্তী রূপগুলিতে শ্রমের বেলায়, যখনি কাজের দিন ও শিশুদের নিয়োগের উপরে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়, তখনি ঐ শিল্পগুলি কোণঠাসা হয়ে যায়। সস্তা শ্রমের সীমাহীন শোষণই হচ্ছে তাদের প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতার একমাত্র ভিত্তি।
বিশেষ করে, কাজের দিনের দৈর্ঘ্য যখন নির্দিষ্ট, তখন কারখানা-ব্যবস্থার অস্তিত্বের একটি অত্যাবশ্যক শর্ত হচ্ছে ফল সম্পর্কে নিশ্চয়তা অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্যদ্রব্যের কিংবা একটি প্রয়োজনীয় পরিমাণের উৎপাদন সম্পর্কে নিশ্চয়তা। একটি শ্রম-দিবসে আইন-অনুসারে কয়েকটি ছেদ দিতে হয়। এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয় যে, মাঝে মাঝে ও আকস্মিক এই যে কর্ম-বিরতি, তা উৎপাদন-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রমণশীল জিনিসটির কোনো ক্ষতি করেনা। ফলের ব্যাপারে এই নিশ্চয়তা এবং কাজে বিরতি ঘটাবার এই সম্ভাব্যতা বিশুদ্ধ যান্ত্রিক শিল্পগুলিতে যত সহজে আয়ত্ত করা যায়, রাসায়নিক ও ভৌত প্রক্রিয়াসমূহ যেসব শিল্পে অংশ গ্রহণ করে সেখানে তত সহজে করা যায়না। যেমন দৃষ্টান্তস্বরূপ, মৃৎপাত্র শিল্পে, ‘ব্লিচিং’, ‘ডাইং’, ‘বেকিং’ এবং অধিকাংশ ধাতব শিল্পে, যেখানেই এমন শ্রম-দিবস রয়েছে যার দৈর্ঘ্যের উপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যেখানেই নৈশ কাজ ও মনুষ্য-জীবনের সীমাহীন অপচয় চালু আছে, সেখানেই কাজটির প্রকৃতিই যদি ভালোর দিকে পরিবর্তনের পথে সামান্যতম বাধাও সৃষ্টি করে, তা হলে অচিরেই সেই বাধাকে দেখা হয় প্রকৃতি কর্তৃক আরোপিত চিরস্থায়ী প্রতিবন্ধক হিসাবে। কারখানা-আইন যতটা নিশ্চিত ভাবে এই সব প্রতিবন্ধক অপসারণ করে, কোনো বিষয়ই তার চেয়ে বেশি নিশ্চিত ভাবে কীট-পতঙ্গের মৃত্যু ঘটায় না। “অসম্ভাব্যতা সম্পর্কে আমাদের বন্ধুরা, মৃৎপাত্র-প্রস্তুতকারকেরা যত হৈ-চৈ করেছিল তার চেয়ে বেশি আর কেউ করেনি। যাই হোক, ১৮৪৬ সালে তাদের এই আইনের আওতায় আনা হয়, এবং ষোল মাসের মধ্যেই সমস্ত “অসম্ভাব্যতা” অন্তহিত হয়ে যায়। বাষ্পীকরণের পরিবর্তে চাপের সাহায্যে স্লিপ তৈরির যে উন্নত পদ্ধতি এই আইনের ফলে সংঘটিত হল, মৃৎপাত্রকে তার কাঁচা অবস্থায় শুকিয়ে নেবার জন্য যে নোতুন স্টোভ আবিষ্কৃত হল —এই সবই মৃৎ-শিল্পকলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং এইগুলি এমন এক অগ্রগতির পরিচায়ক, যার সমকক্ষ পূর্ববর্তী শতাব্দীতে ছিলনা।….. এই উন্নত পদ্ধতি এমনকি স্টোভগুলির তাপও বহুল পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছে এবং জ্বালানির সাশ্রয় ঘটিয়েছে; পাত্রের উপরে যাতে চটপট ক্রিয়া করে তারও ব্যবস্থা করেছে।[১৪] সব রকমের ভবিষ্যদ্বাণী সত্ত্বেও, মাটির জিনিসের উৎপাদন-ব্যয় বৃদ্ধি পায়নি অথচ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে—এবং বৃদ্ধি পেয়েছে এমন মাত্রায় যে ১৮৬৫ সালের ডিসেম্বরে যে বারো মাস শেষ হল, সেই এক বছরে পূর্ববর্তী তিন বছরের গড়কে ছাড়িয়ে রপ্তানির পরিমাণ মূল্য হিসাবে বেড়ে গেল ১,৩৮,৬২৮ পাউণ্ড। দিয়াশলাই ম্যানুফ্যাকচারে এটাকে ধরে নেওয়া হত একটা অপরিহার্য প্রয়োজন বলে যে, বালকেরা যখন নাকে-মুখে তাদের খাবার গিলবে, তখন কাঠির মাথাগুলিকে গলানো ফসফোরামের মধ্যে ডুবিয়ে যাবে, আর ফসফোরাসের বিষাক্ত বাম্প তাদের মুখে গিয়ে লাগবে। (১৮৬৪) সালের কারখানা-আইন সময়ের সংকোচন-সাধনকে আবশ্যিক ব্যাপারে পরিণত করল এবং একটি ডোবানো যন্ত্রের (ডিপিং মেশিন-এর) আবিষ্কার ঘটাল, যার বাষ্প আর কর্মীদের গায়ে এসে লাগতে পারেনা।[১৫] অনুরূপ ভাবে, বর্তমানে লেস-ম্যানুফ্যাকচারের যেসব শাখাকে এখন পর্যন্ত কারখানা-আইনের আওতায় আনা হয়নি, সেই সব শাখায় এই খ্রীতি অনুসরণ করা হয় যে খাবারের জন্য কোনো নিয়মিত সময় নির্দিষ্ট করা যায়না, কেননা বিভিন্ন রকমের লেস শুকোবার জন্য বিভিন্ন সময়কালের দরকার হয়, যা কখনো হতে পারে তিন মিনিট, কখনো বা এক ঘণ্টা বা তারও বেশি। এর জবাবে শিশু নিয়োগ কমিশনের কমিশনার বলেন, এই ক্ষেত্রের অবস্থাবলী ঠিক কাগজ-রঞ্জকদের অবস্থাবলীর মত, যার কথা আমরা প্রথম রিপোর্টে আলোচনা করেছি। এই শিল্পের প্রধান কয়েকজন ম্যানুফ্যাকচারকারী বলেন, যেসব মাল-মশলা ব্যবহার করা হয় সেগুলির প্রকৃতি এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার দরুন, তাদের পক্ষে গুরুতর লোকসান ছাড়া একটি নির্দিষ্ট সময়কে খাবার খাওয়ার জন্য স্থির রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে দেখা গেল যে, একটু নজর দিলে এবং আগে থেকে ব্যবস্থা করলে, আশংকিত অসুবিধাকে অতিক্রম করা যায় এবং তদনুযায়ী পার্লামেন্টের চলতি অধিবেশনে গৃহীত কারখানা সম্প্রসারণ আইন’-এর ৬ ধারার ৬ উপধারা বলে কারখানা আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট খাবারের সময় চালু করার জন্য তাদেরকে আঠারো মাস সময় দেওয়া হল।”[১৬] এই আইনটি পাশ হতে না হতেই আমাদের ম্যানুফ্যাকচারকারী বন্ধুরা আবিষ্কার করে ফেলল, “আমাদের উৎপাদন-শাখায় কারখানা-আইনের সম্প্রসারণের ফলে যে সমস্ত অসুবিধা ঘটবে বলে আশংকা করেছিলাম, আমি আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই, সেগুলি ঘটেনি। উৎপাদনে আদৌ কোনো ব্যাঘাত ঘটেছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি না, বস্তুত এখন তারা একই সময়ে বেশি উৎপাদন করছি।[১৭] এটা সুস্পষ্ট যে ইংল্যাণ্ডের পার্লামেন্ট—যার বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই কেউ এই অপবাদ দিতে পারবেন না যে সেখানে প্রতিভার খুব আধিক্য রয়েছে, সেই পার্লামেন্ট–অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, কাজের ঘণ্টা কমানো ও নিয়মিত করার পালটা হিসাবে সংশ্লিষ্ট উৎপাদন-প্রক্রিয়ার প্রকৃতি যে-সমস্ত প্রতিবন্ধক খাড়া করেছে, সেগুলিকে একটা সাদাসিধে বাধ্যতামূলক আইন প্রণয়নের সাহায্যেই ভাসিয়ে দেওয়া যায়। অতএব, একটি নির্দিষ্ট শিল্পে কারখানা আইন চালু করার পরে ছয় থেকে আঠারো মাস সময় দেওয়া হচ্ছে যার মধ্যে উক্ত আইনটি কার্যকরী করার পক্ষে যেসব প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধক আছে, সেগুলিকে অপসারিত করা হবে ম্যানুফ্যাকচার কারীদের পক্ষে বাধ্যতামূলক। “Impossible! ne me dites jamais ce bete de mot !”—মিরাবোর এই উক্তিটি বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য আধুনিক প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের (টেকনোলজি’-র) ক্ষেত্রে। কিন্তু যদিও ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থাকে ফ্যাক্টরি-ব্যবস্থায় রূপান্তরণের জন্য, প্রয়োজনীয় বৈষয়িক উপাদানগুলিকে কারখানা-আইনসমূহ এইভাবে কৃত্রিম ভাবে পরিপক্ক করে তোলে, তবু কিন্তু সেই সময়ে বৃহত্তর পরিমাণ মূলধন নিয়োগের আবশ্যকতা ঘটিয়ে সেই আইনসমূহ ক্ষুদ্র মালিকদের অবক্ষয় এবং মূলধনের কেন্দ্রীভবনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।[১৮]
নিছক প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকসমূহ ছাড়াও—যেগুলি প্রযুক্তিগত উপায়ের মাধ্যমে অপসারণ করা যায়, সেগুলি ছাড়াও, শ্রমিক-জনগণের বিবিধ অনিয়মিত আচার অভ্যাসও শ্রমের সময় নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি করে। যেখানে একক-পিছু মজুরি ( ‘পিস ওয়েজ) প্রথার প্রাধান্য থাকে কিংবা যেখানে দিনের বা সপ্তাহের একাংশের নষ্ট সময় অন্য অংশে উপরি-সময় খেটে বা নৈশকাজের মাধ্যমে-যে-নৈশ কাজের রেওয়াজ বয়স্ক শ্রমিককে পাশবিক করে তোলে এবং তার স্ত্রী ও শিশুদের সর্বনাশ ঘটায় সেই কাজের মাধ্যমে, পুষিয়ে নেওয়া যায়, বিশেষ করে সেখানে শ্রমিকের এই অনিয়মিত আচার অভ্যাসই মূলতঃ প্রাতবন্ধক হয়ে দাড়ায়।[১৯] যদিও শ্রমশক্তি-ব্যয়ের এই অনিয়মিকতা একঘেয়ে উঞ্ছবৃত্তির ক্লান্তিকরতার বিরুদ্ধে একটি স্বাভাবিক ও রূঢ় প্রতিক্রিয়া, তা হলেও এর উৎপত্তি প্রধানতঃ ঘটে উৎপাদনক্ষেত্রে নৈরাজ্য থেকে—যে নৈরাজ্যের আবার কারণ হল ধনিকের দ্বারা শ্রমশক্তির বগাহীন শোষণ। শিল্পচক্রের সাধারণ পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন এবং বাজারের বিশেষ ওঠা-নামা, যা প্রত্যেকটি শিল্পকে শাসন করে, সেগুলি ছাড়াও, আমরা মরশুম”-কে বিবেচনার মধ্যে ধরতে পারি, যা নির্ভর করে নৌ-চলা চলের পক্ষে অনুকূল ঋতুগুলির উপরে কিংবা ফ্যাশন এবং, যথাসম্ভব স্বল্পকালের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে, এমন আকস্মিক বিরাট বায়নার উপরে। রেলওয়ে এবং টেলিগ্রাফের সম্প্রসারণের সুবাদে এই ধরনের বায়না দেবার রেওয়াজ ঘন ঘন ঘটে। “সারা দেশ জুড়ে রেলওয়ে-ব্যবস্থার প্রসার স্বল্পকালীন নোটিশ দেবার প্রবণতাকে খুবই। উৎসাহ যুগিয়েছে। এখন, আমরা যেসব পণ্যাগারে সরবরাহ যোগাই, গ্লাসগো, ম্যাঞ্চেস্টার। ও এডিনবরা থেকে ক্রেতারা সেখানে আসে; আগে যেমন তারা উপস্থিত স্টক থেকেই জিনিস কিনত, এখন তা না করে তারা ঘোট ঘোট বায়না দেয়, যেগুলিকে অবিলম্বে সরবরাহ করতে হয়। কয়েক বছর আগে আমরা আলগা সময়ে কাজ করতে পারতাম, যাতে করে পরের মরশুমের চাহিদা মেটাতে পারি, কিন্তু এখন কেউই আগে থেকে বলতে পারে না তখন চাহিদা কতটা হবে।[২০]
এখনো কারখানা-আইনের আওতায় আসেনি, এমন সব ফ্যাক্টরি ও ম্যানু ফ্যাক্টরিতে সবচেয়ে ভয়ানক অতিরিক্ত কাজ (ওভার-ওয়ার্ক”) কিছুকাল অন্তর অন্তর দেখা যায়, যাকে বলা হয় মরশুম’, সেই সময়ে, যা ঘটে থাকে আকস্মিক বায়না পেয়ে যাবার ফলে। ফ্যাক্টরি, ম্যানুফ্যাক্টরি ও ওয়্যার-হাউজ (পণ্যাগার )-এর বহিরবস্থিত বিভাগে, তথাকথিত গৃহকর্মীরা, যাদের কর্ম-নিয়োগ খুব ভাল হলে অনিয়মিত, তারা তাদের কাঁচামালের জন্য সম্পূর্ণ নির্ভর করে ধনিকের বায়না বা খেয়ালের উপরে, যে এই শিল্পে তার বাড়িঘর বা যন্ত্রপাতির অবমূল্যায়নের ভাবনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় এবং কাজ বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকের নিজের চামড়ার ঝুকি ছাড়া আর কোনো কিছুরই ঝুঁকি গ্রহণ করে না। এখানে তাই সে নিজেকে নিয়োজিত করে একটি মজুদ শিল্প-বাহিনী গড়ে তুলতে, যে-বাহিনী এক মুহূর্তের নোটিশে তৈরি হয়ে যাবে, বছরের একটি অংশে যে সবচেয়ে অমানুষিক পরিশ্রমের দ্বারা এই বাহিনীর প্রতি দশজনের একজনকে মৃত্যুর কবলে ঠেলে দেয় এবং আরেকটি অংশে কাজের অভাবে অনাহারে থাকতে বাধ্য করে। “যখন এক ধাক্কায় কোনো বাড়তি কাজ করিয়ে নিতে হয়, তখন নিয়োগকর্তারা শ্রমিকের এই অভ্যাসগত অনিয়মিকতার সুযোগ নেয়, যার ফলে কাজ চলে রাত ১১টা, ১২টা, কিম্বা ২টা পর্যন্ত অথবা, চলতি কথায় যাকে বলা হয়, “চব্বিশ ঘণ্টা” এবং যেসব অঞ্চলে দুর্গন্ধে তোমার দম আটকে আসে, তুমি দরজার দিকে হঠে যাও, হয়তো খুলে ফেলল, কিন্তু তার পরে আর এক পা বাড়াতে গিয়ে কেঁপে ওঠে।”[২১] মনিবদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে একজন সাক্ষী, পাদুকাকার, বলেন, “এরা অদ্ভুত লোক; এরা ভাবে একটা ছেলেকে যদি বছরের ছমাস হাড়-ভাঙ্গা খাটুনি খাটানো হয় এবং বাকি ছমাস প্রায় অলস বসিয়ে রাখা হয় তা হলে ছেলেটার কোনো ক্ষতি হয় না।”[২২]
যে-ভাবে প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকগুলিকে, ঠিক তেমনি “যেসব রীতি গড়ে উঠেছে। শিল্পের গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই রীতিগুলিকে, স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ধনিকেরা আগেও যেমন ঘোষণা করত কাজের প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত প্রতিবন্ধক বলে, আজও তেমন করে। যখন তারা প্রথম কারখানা-আইনের শংকায় শংকিত হল, তখন এটা ছিল তুলাকল-মালিকদের পছন্দসই আওয়াজ। যদিও অন্য যে-কোনো শিল্পের তুলনায় তাদের শিল্প নৌ-চলাচলের উপরে বেশি নির্ভরশীল, তথাপি অভিজ্ঞতা তাদের মিথ্যাবাদী বলে প্রতিপন্ন করেছে। সেই থেকে, ব্যবসার পথে, ইচ্ছাকৃত যে-কোনো প্রতিবন্ধককে কারখানা-পরিদর্শকেরা গণ্য করেছেন নিছক ধাপ্পা বলে।[২৩] শিশু নিয়োগ কমিশনের সম্পূর্ণত নীতি-নিষ্ঠ সমীক্ষা প্রমাণ করে যে, শ্রমের ঘণ্টা নিয়ন্ত্রণের ফলে কয়েকটি শিল্পে পূর্ব-নিযুক্ত-শ্রম-সমষ্টি সারা বছর জুড়ে অধিকতর সমভাবে বিস্তার লাভ করেছে;[২৪] প্রমাণ করে যে, এই নিয়মই হচ্ছে প্রচলিত প্রথার মারণাত্মক, নিরর্থক যথেচ্ছাচারের উপরে প্রথম যুক্তিবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ,-যথেচ্ছাচার যা আধুনিক শিল্পের সঙ্গে এত খারাপভাবে লগ্ন হয়ে থাকে;[২৫] প্রমাণ করে যে, সমুদ্রগামী নৌ-পরিবহন ও সাধারণভাবে যোগাযোগব্যবস্থার অগ্রগতি মরশুমি কাজের প্রযুক্তিগত ভিত্তিটিকে তথা অবলম্বনটিকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে;[২৬] এবং প্রমাণ করে দিয়েছে যে, আরো বড় বড় বাড়ি, আবো মেশিনারি, নিযুক্ত শ্ৰমিকসংখ্যায় আরো অগ্রগতি[২৭] এবং পাইকারি ব্যবসা পরিচালনায় এই সবের জন্য সংঘটিত রদবদলের মুখে অন্যান্য সর্বপ্রকারের তথাকথিত দুর্জয় সমস্যাগুলি অন্তর্হিত হয়ে যায়।[২৮] কিন্তু তথাপি মূলধন কখনো এই সব পরিবর্তন এবং তার প্রতিনিধিরাই বারংবার সেটা স্বীকার করেছেন—যতদিন না শ্রমের ঘন্টা বাধ্যতামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে “পার্লামেন্টের সার্বিক আইন তার উপরে তা চাপিয়ে দেয়।]২৯]
————
১. ইংল্যাণ্ডে মেয়েদের টুপি তৈরি ও পোশাক-আশাক তৈরির কাজ প্রধানত নিয়োগ-কর্তার জায়গাতেই করা হয়; কিছু করে যারা সেখানে থাকে সেই মহিলারা আর কিছু করে যারা বাইরে থেকে আসে তারা।
২. মিঃ হোয়াইট নামে জনৈক কমিশনার একটি সামরিক পোশাক তৈরির ম্যানুফ্যাক্টরি পরিদর্শন করেন, যেখানে কাজ করত ১,০০০ থেকে ১,২০০ ব্যক্তি, প্রায় সকলেই মহিলা। তিনি একটি জুতো তৈরির কারখানা পরিদর্শন করেছিলেন, যেখানে কাজ করত ১,৩০০ জন, যাদের মধ্যে অর্ধেকই ছিল শিশু ও অল্পবয়সী ছেলে-মেয়ে।
৩. একটি দৃষ্টান্ত : রেজিস্ট্রার জেনারেল-এর সাপ্তাহিক মৃত্যু-তালিকায়, ২৬শে ফেব্রুয়ারী, ১৮৬৪, অনশনজনিত ৫টি মৃত্যুর উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐ একই দিনে ‘টাইমস পত্রিকায় আরো একটি মৃত্যুর খবর বের হয়। এক সপ্তাহে ৬টি অনশন-মৃত্যু।
৪. “শিশু নিয়োগ কমিশন, দ্বিতীয় বিপোর্ট, ১৮৬৪, পৃঃ ৬৭; নং ৪৬-৯, পৃঃ ৮৪; নং ১২৪, পৃঃ ৭৩; নং ৪৪১, পৃঃ ৬৮, নং ৬, পৃঃ ৮০; নং ১২৬, পৃঃ ৭৮; নং ৮৫, পৃ ৭৬ নং ৬৯, পৃঃ ৭২, নং ৪৮৩।
৫. “কাজের ঘরের জায়গাগুলির খাজনাই সম্ভবতঃ সেই উপাদান, যা শেষ পর্যন্ত বিষয়টিকে নির্ধারণ করে এবং তার ফলে প্রধান শহরেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিয়োগকর্তাকে ও পরিবারকে কাজ দেবার পুরানো প্রথাটি সবচেয়ে বেশি কাল বজায় ছিল এবং সবচেয়ে আগে আবার চালু করা হয়েছে।” (“শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ৮৩, নোট : ১২৩) এই উদ্ধৃতির শেষ অংশটিতে কেবল জুতো তৈরির শিল্পের কথাই বলা হয়েছে।
৬. দস্তানা তৈরি ও অন্যান্য শিল্পে, যেখানে কর্মীদের অবস্থা দুঃস্থদের তুলনায় কোনো মতে ভাল নয়, সেখানে এটা ঘটেনা।
৭. ঐ পৃঃ ৮৩, টীকা ১২২।
৮. একমাত্র লাইসেস্টারেই পাইকারি বুট ও জুতো শিল্পে ১৮৬৪ সালে ব্যবহারে ছিল ৮০ টি সেলাই-কল।
৯. “শিশু নিয়োগ কমিশন, দ্বিতীয় বিপোর্ট, ৩৮৬৪, পৃঃ ৮৪, নং ১২৪।
১০. দৃষ্টান্ত : লণ্ডনে পিমলিকোয় ‘আর্মি ক্লোদিং ডিপো; লণ্ডনডেরিতে টিল্পি ও হেণ্ডার্সনে সার্ট ফ্যাক্টরি; লিমারিকে মেসার্স টেইট-এর ফ্যাক্টরিতে, যেখানে কাজ করে ১,২০০ কর্মী।
১১. “কারখানা-ব্যবস্থার দিকে প্রবণতা” (ঐ, পৃঃ ৬৭)। “গোটা কর্ম-নিয়োগের ব্যাপারটা তখন পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এবং লেস’ শিল্পে, বয়নকার্যে যে পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে, সেই দিকে যাচ্ছে” (ঐ, নং ৪০৫)। “একটি সম্পূর্ণ বিপ্লব” (ঐ, পৃঃ ৪৬, নং ৩১৮)। ১৮৪০ সালে শিশু নিয়োগ কমিশনের সময়ে মোজা-তৈরি তখনো হত দৈহিক শ্রমের সাহায্যে। ১৮৪৬ সাল থেকে নানা ধরনের মেশিন প্রবর্তিত হয়, যেগুলি চলত বাষ্পে। মোজা-তৈরিতে নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে ৩ বছর বয়স থেকে শুরু করে সব বয়সের কর্মীর সংখ্যা ১৮৬২ সালে ছিল প্রায় ১,২৯,৩০০। এদের মধ্যে ৪,৬৩ জন কাজ করত কারখানা-আইনের অধীনে, ১৮৬২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি মাসের ‘পার্লামেন্টারি রিটান” দ্রষ্টব্য।
১২ যেমন মৃৎ-সামগ্রী শিল্পে গ্লাসগোর ‘ব্রিটেন পটারি’-র মেসার্স করেন রিপোর্ট করেন :“আমাদের পরিমাণ ঠিক রাখবার জন্য আমরা ব্যাপক ভাবে মেশিন চালু করছি, যেগুলি চালায় অদক্ষ শ্রমিকেরা; প্রতি দিনই আমরা আরো নিশ্চিত হচ্ছি যে পুরনো ব্যবস্থার তুলনায় আমরা বেশি পরিমাণ উৎপন্ন করতে পারি (“রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ১৩)। “কারখানা আইনের একটা ফল হল জোর করে মেশিনারি প্রবর্তন করা।” (ঐ, পৃঃ ১৩-১৪)।
১৩. যেমন, মৃৎশিল্পে (পটারিজ’-এ) কারখানা-আইনের বিস্তার-সাধনের পরে, হস্ত-চালিত ‘জিগার’-এর বদলে শক্তি-চালিত ‘জিগার’-এর ব্যবহারে বিপুল বৃদ্ধি।
১৪. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ৯৬ এবং ১২৭।
১৫. দিয়াশলাই তৈরি ক্ষেত্রে এই এবং অন্যান্য মেশিনারি প্রবর্তনের ফলে কেবল একটি বিভাগেই ২৩০ জন যুবক-যুবতীর পরিবর্তে ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সের ৩২ জন বালক-বালিকা নিয়োগ করা যয়। শ্রমের এই সাশ্রয় আরো বেশি করে সাধিত হয় ১৮৬৫ সালে বাম্প-শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে।
১৬. “শিশু নিয়োগ কমিশন, দ্বিতীয় রিপোর্ট, ১৮৬৪”, পৃঃ ১, নং ৫০।
১৭. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ২২।
১৮. “কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, এই সমস্ত উন্নয়ন যদিও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পুরোপুরি প্রযুক্ত হয়েছে, তা হলেও সেগুলি কোনক্রমেই ব্যাপক নয় এবং অনেক পুরনো ম্যানুফ্যাক্টরিতেই নোতুন মূলধন নিয়োগ না করে সেগুলিকে নিয়োগ করা যায় না অথচ এই মূলধন নিয়োগ বর্তমান অধিকারীদের অনেকেরই সাধ্যের বাইরে।” উপ পরিদর্শক মে লিখেছেন, “আমি আনন্দ না করে পারিনা যে, এমন একটা ব্যবস্থা ( যেমন কারখানা-আইন প্রসারণ আইন’) প্রবর্তন ফলে সাময়িক বিশৃংখলা হলেও এবং বস্তুতঃ পক্ষে যে-সমস্ত খারাপ জিনিস তা দূর করতে চায় সরাসরি তার নির্দেশক হলেও…” ইত্যাদি ইত্যাদি (“রিপোর্টস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫)।
১৯. যেমন ব্লাস্ট ফার্নেস-এর ক্ষেত্রে, “সপ্তাহের শেষ দিকে কাজের সময় সাধারণত বেড়ে যায়, কেননা মানুষের অভ্যাসই হল সোমবারটা, এমনকি মঙ্গলবারটাও আলসেমি করে কাটিয়ে দেওয়া।” (“শিশু নিয়োগ কমিশন, তৃতীয় রিপোর্ট”, পৃঃ ৬)। “ছোট মালিকদের কাজের সময় খুব অনিয়মিত। তারা ২/৩ দিন করে হারায় এবং তার পরে সেই ক্ষতিটা পূরণ করার জন্য সারা রাত ধরে কাজ করে। তারা সব সময়েই তাদের নিজেদের শিশুদেরকে নিযুক্ত করে, অবশ্য যদি থাকে।” (ঐ, পঃ ৭) “কাজে আসতে এই নিয়মিকতার অভাব উৎসাহিত হয় অতিরিক্ত সময় কাজ করে ক্ষতি পূরণের এই সম্ভাব্যতার দ্বারা। (ঐ, পৃঃ ২৮) “বার্মিংহামে বিপুল পরিমাণ সময় নষ্ট হয় কিছুটা সময় আলসেমি করে কাটিয়ে, বাকি সময়টা গোলামি করতে হয়।” (ঐ, পৃঃ ১১)।
২০. (“শিশু নিয়োগ কমিশন, চতুর্থ রিপোর্ট”, পৃঃ ৩২)। “বলা হয় যে, রেল ব্যবস্থার সম্প্রসারণের দরুন এই আকস্মিক ‘অর্ডার’ এবং তজ্জনিত তাড়াহুড়ো, খাবার সময়ের বেনিয়ম, কর্মীদের বেশি সময় ধরে কাজ ইত্যাদির রেওয়াজ বিপুল ভাবে বেড়ে গিয়েছে।” (ঐ পৃঃ ৩১)
২১. “শিশু নিয়োগ কমিশন, চতুর্থ রিপোর্ট”, পৃঃ ৩৫ নং ২৩৫, ২৩৭।
২২. “শিশু নিয়োগ কমিশন, চতুর্থ রিপোর্ট”, পৃঃ ১২৭, নং ৫৬।
২৩. “১৮৩২-৩৩ সালে ‘শিপিং-অর্ডার’ যথাসময়ে পুরণ না করার জন্য লোকসানের যুক্তিটি কারখানা মালিকদের ছিল একটা প্রিয় যুক্তি। এই বিষয়ে এখন যে যুক্তিই দেওয়া হোক না কেন, তখন তার যা গুরুত্ব হত, এখন তা হতে পারে না: তখন মানে, যখন বাষ্পের দরুন সমস্ত দূরত্ব অর্ধেক হয়ে গিয়েছে এবং পরিবহনের নোতুন নিয়ম-কানুন প্রবর্তিত হয়েছে, তার আগে। যতবার পরীক্ষা করা গিয়েছে, তত বারই যুক্তিটি অসার বলে বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। আমি নিশ্চিত এখনো পরীক্ষা করলে, তাই হবে।” (“রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ৫৪, ৫৫)।
২৪. “শিশু নিয়োগ কমিশন, চতুর্থ রিপোর্ট”, পৃঃ ১৮, নং ১১৮।
২৫. সেই ১৬৯৯ সালে জন বেলার্স মন্তব্য করেছিলেন : ফ্যাশনের অনিশ্চয়তার দরুন অভাবী দরিদ্রের সংখ্যা বেড়ে যায়। এর দুটি ক্ষতিকর দিক আছে। প্রথমত, শীতকালে। কাজের অভাবে ঠিক-মজুরদের অবস্থা হয় শোচনীয়; বস্ত্র ব্যবসায়ী ও তঁত মালিকেরা বসন্ত কাল আসার আগে তাদের কর্মসংস্থানের জন্য পুজি খাটাতে সাহস করে না; এবং তারা জানে বসন্ত কাল এলে তখন তাদের মজুদ প্রকাশ করার সাহস পায় না বসন্তকাল আসবার আগে কেউ তাদের নিয়োগ করে না; তখন বোঝা যায় কি ফ্যাশন আসবে। দ্বিতীয়তঃ, বসন্তকালে ঠিক-মজুরদের সংখ্যা অপ্রতুল, কিন্তু তঁত-মালিকদের কহুসংখ্যক শিক্ষানবিশ অবশ্যই সংগ্রহ করতে হয়, কারণ ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে তাদের যোগাতে হয় গোটা রাজ্যের প্রয়োজন; সুতরাং, দেশ উজাড় করে, লাঙল থেকে হাত লুটে এনে কাজ করাতে হয়; এরাই আবার শীতকালে পরিণত হয় ভিখারীতে কিংবা ভিক্ষা করতে লজ্জা বোধ করলে মারা যায় অনাহারে।” “এসেজ অ্যাবাউট দি পুয়োর”, পৃঃ ৯।
২৬. “শিশু নিয়োগ কমিশন, চতুর্থ রিপোর্ট”, পৃঃ ১৭১, নোট ৩৪।
২৭. ব্রাডফোর্ডের কিছু ব্ৰপ্তানি-প্রতিষ্ঠানের সাক্ষ্য নিম্নরূপ : “এই অবস্থায় এটা পরিষ্কার যে কোনো বালককে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা বা ৭টা ৩০-এর বেশি খাটাবার দরকার নেই। এটা কেবল বাড়তি হাত আর বাড়তি বিনিয়োগের ব্যাপার। যদি কিছু মালিক এত লোভী না হত, তা হলে বালকদের এত দেরি পর্যন্ত কাজ করতে হত না; একটা বাড়তি মেশিনের খরচ মাত্র ১৬ বা £১৮; এখন যে অতিরিক্ত সময় খাটানো হয়, তার বেশির ভাগটারই কারণ হল যন্ত্রপাতি আর জায়গার অভাব।” (“শিশু নিয়োগ কমিশন, পঞ্চম বিপোর্ট”, পৃঃ ১৭১, নং ৩৫, ৩৬, ৩৮)।
২৮. ঐ, লণ্ডনের এক ম্যানুফ্যাকচারার, যিনি অন্যান্য ব্যাপারে কাজের ঘণ্টার বাধ্যতা মূলক নিয়ন্ত্রণকে দেখে থাকেন ম্যানুফ্যাকচারারদের বিরুদ্ধে কাজের লোকদের এবং পাইকারী ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে স্বয়ং ম্যানুফ্যাকচারারদের সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা হিসাবে বলেন, “আমাদের ব্যবসার উপরে চাপ সৃষ্টি করে জাহাজ-মালিকেরা; তারা এমন সময়ে জাহাজে পাল তুলে দিতে চায়, যাতে করে গন্তব্য স্থলে একটা নির্দিষ্ট ঋতুতে পৌঁছে গিয়ে মাল বেচতে পারে, এবং সেই সঙ্গে আবার পাল-তোলা জাহাজ আর বাম্প-চালিত জাহাজের মধ্যে মাল-ভাড়ার পার্থক্যটাও পকেটস্থ করতে পারে, কিংবা যারা দুটি বাষ্প-চালিত জাহাজের মধ্যে আগেরটা ধরতে চায়, যাতে করে তাদের প্রতিযোগীদের চেয়ে আগে গিয়ে বিদেশী বাজারে পৌছাতে পারে।”
২৯. একজন ম্যানুফ্যাকচারকারীর মতে এটাকে অতিক্রম করা যেত পার্লামেন্টের একটি সার্বিক আইনের চাপের অধীনে কারখানার প্রসার-সাধনের বিনিময়ে।” ঐ পৃঃ ১৩, নোট : ৩৮।
.
নবম পরিচ্ছেদ– কারখানা-আইনঃ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা-সংক্রান্ত বিবিধ অনুচ্ছেদঃ
ইংল্যাণ্ডে সেই আইনের সাধারণ সম্প্রসারণ
কারখানা সংক্রান্ত আইন-প্রণয়ন হল উৎপাদন-প্রক্রিয়ার স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিকশিত রূপের বিরুদ্ধে সমাজের প্রথম সচেতন ও সুশৃংখল প্রতিক্রিয়া; আমরা আগেই দেখেছি, তুলোর সুতো, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, বৈদ্যুতিক তারবার্তা যেমন আধুনিকশিল্পের আবশ্যিক অবদান, কারখানা-আইনও তেমন তাই। ইংল্যাণ্ডে সেই আইনের সম্প্রসারণ সম্পর্কে আলোচনায় যাবার আগে আমরা কারখানা-আইনগুলির কয়েকটি অনুচ্ছেদের দিকে সংক্ষেপে নজর দেব, এমন কয়েকটি অনুচ্ছেদ যেগুলির সঙ্গে কাজের ঘণ্টার সম্পর্ক নাই।
স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলির শব্দ-বিন্যাসই এমন যাকে ধনিকদের পক্ষে সেগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়; এই শব্দ-বিন্যাস ছাড়া ঐ অনুচ্ছেদগুলিতে আর যা আছে, তা একেবারেই নগণ্য; বস্তুতপক্ষে, সেগুলি দেয়ালে চুনকাম, অন্যান্য কিছু ব্যাপারে পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা, আলো-বাতাস চলাচলের বন্দোবস্ত এবং বিপজ্জনক মেশিনারির বিরুদ্ধে সুরক্ষা-সংক্রান্ত সংস্থানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তৃতীয় গ্রন্থটিতে আমরা সেই অনুচ্ছেদগুলির সম্পর্কে মালিকদের উন্মত্ত বিরোধিতার বিষয়ে ফিরে আসব, যে অনুচ্ছেদগুলি তাদেরই শ্রমিকদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুরক্ষার জন্য কয়েকটি উপকরণ বাবদ তাদের উপরে সামান্য অর্থব্যয় চাপিয়ে দিয়েছিল। তাদের সেই বিরোধিতা স্বাধীন বাণিজ্যের মন্ত্রটির উপরে করে নতুন ও প্রাজ্জ্বল আলোকসম্পাত, যে মন্ত্রটি বলে যে, যে-সমাজে রয়েছে স্বার্থে স্বার্থে সংঘাত, সেই সমাজে প্রত্যেকটি ব্যক্তিই এগিয়ে নিয়ে যায় সকলের অভিন্ন স্বার্থ“আর কিছু করে নয়, কেবল তার নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ সাধন করেই! একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। পাঠক জানেন যে, গত ২০ বছরে শন শিল্প বিপুলভাবে বিস্তার লাভ করেছে এবং সেই বিস্তার লাভের সঙ্গে আয়ার্ল্যাণ্ডে শন-পাটিকরণের কল (স্কাচিং মিল’)-ও বিস্তার লাভ করেছে। ১৮৬৪ সালে এই দেশে এই ধরনের মিলের সংখ্যা ছিল ১,৮০০টি। নিয়মিত ভাবে শরৎকালে ও শীতকালে নারী ও তরুণ-বয়স্ক ব্যক্তিদের”, নিকটবর্তী ক্ষুদ্র কৃষক-ঘরের স্ত্রী পুত্র ও কন্যাদের—এমন একটি শ্রেণীর মানুষ যাৱা মেশিনারির ব্যাপারে সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত, তাদের তাদের ক্ষেতের কাজ থেকে তুলে নেওয়া হয় স্কাচিং মিল’—গুলির বোলারে শন যোগাবার কাজে। যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, তা সংখ্যা ও প্রকৃতি উভয় দিক থেকেই ইতিহাসে তুলনারহিত। কর্ক-এর অদূরে কিডিনানে একটি স্কাচিং মিলে ১৮৫২ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে ছটি প্রাণনাশা দুর্ঘটনা এবং ষাটটি অঙ্গহানি ঘটে, যে দুর্ঘটনাগুলির প্রত্যেকটি নিবারণ করা যেত, যদি কয়েক শিলিং মাত্র খরচ করে কয়েকটি সহজ উপকরণের ব্যবস্থা করা হত। ডাউনপ্যাট্রিকের কারখানাসমূহের সার্টিফাইং সার্জন ডাঃ ডবলু হোয়াইট তাঁর ১৫ই ডিসেম্বর, ১৮৩৫ তারিখের সরকারি বিপোর্টে বলেন, “স্কাচিং মিলগুলিতে যে সব গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটে, সেগুলি সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ প্রকৃতির। অনেক ক্ষেত্রেই দেহের চার ভাগের এক ভাগ ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ফলে হয় মৃত্যু আর নয়তে অক্ষমতা ও যন্ত্রণাভোগের এক করুণ ভবিষ্যৎ। দেশে মিলের সংখ্যাবৃদ্ধি অবশ্যই এই ভয়ংকর পরিণামের আরো বিস্তার ঘটাবে, এবং যদি সেগুলিকে আইন-সভার অধীনে আনা হয়, তা হয়ে সেটা হবে একটা বিরাট আশীর্বাদ। আমি নিশ্চিত, যদি স্কাচিং মিলগুলির যথাযথ তদারকির ব্যবস্থা করা করা হয়, তা হলে জীবন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি নিবারণ করা যায়।”[১]
পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য সংরক্ষণের জন্য কয়েকটি সহজতম উপকরণের ব্যবস্থা করতেও যে পার্লামেন্টের আইন-প্রণয়নের সাহায্যে বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেবার আবশ্যকতা রয়েছে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির চরিত্র প্রদর্শনে এর তুলনায় আরো ভালো দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে? মৃৎশিল্প-কারখানাগুলিতে (পটারি) দীর্ঘকাল ধরে, কোন কোন ক্ষেত্রে ২০ বছর, আবার কোনটিতে আজন্মকাল পরিষ্কার করার কাজ থেকে নিবৃত্ত থাকার পরে” (এটাই বুঝি ধনিকদের ‘ভোগ-নিবৃত্তির’ তত্ত্ব। ১৮৩৪ সালের কারখানা-আইন সেগুলিকে করায় চুনকাম ও পরিষ্কার”, এই কারখানাগুলিতে কাজ করত ২৭,৮০০ শ্রমিক, যাদের এতকাল সারাদিন ও প্রায়শঃই সারা রাতভর কাজের সময়ে শ্বাস নিতে হত একটা পুতিগন্ধপূর্ণ আবহাওয়ায়, অন্য দিক থেকে ক্ষতিকারক না হলেও এই আবহাওয়ার দরুন এই পেশাটি হয়ে ওঠে রোগ ও মৃত্যুতে আকীর্ণ। এই আইনের ফলে আলো-হাওয়া চলাচলের অনেকটা উন্নতি ঘটে।”[২] একই সঙ্গে এই আইনটির এই অংশটি জাজ্বল্যমান ভাবে দেখিয়ে দেয় যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি, তার নিজস্ব প্রকৃতির দরুণই, একটা নির্দিষ্ট মাত্রার পরে যাবতীয় যুক্তিসঙ্গত উন্নয়নের কাজকে পরিহার করে। একথা বারংবার বলা হয়েছে যে, ইংরেজ ডাক্তাররা এবিষয়ে একমত যে, যেখানে কাজ চলে একটানা সেখানে সবচেয়ে কম করে হলেও প্রত্যেকটি ব্যক্তির জন্য প্রয়োজন ৫০০ ফুট জায়গা। এখন, যদি কারখানা আইনগুলি তাদের বাধ্যতামূলক সংস্থানগুলির মাধ্যমে ছোট ঘোট কর্মশালাগুলির বড় বড় কারখানায় রূপান্তরিত হবার প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করে এবং এইভাবে পরোক্ষঃ ছোট ছোট ধনিকদের স্বত্বাধিকারকে আক্রমণ করে এবং বড় বড় ধনিকদের একচেটিয়া অধিকার স্থাপনকে সুনিশ্চিত করে, তা হলে প্রত্যেক কর্মশালায় প্রত্যেকটি কর্মীর জন্য উপযুক্ত স্থান সংকুলানের সংস্থানটিকে যদি বাধ্যতামূলক করা হয়, তার ফল দাড়াবে এই যে এক ধাক্কায় হাজার হাজার ছোট খনিক প্রত্যক্ষভাবে উচ্ছিন্ন হয়ে। যাবে ! ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির যেটি শিকড় তথা শ্রমশক্তির “অবাধ” ক্রয় ও ব্যবহারের মাধ্যমে ছোট বড় সমস্ত মূলধনের আত্মপ্রসারণ—সেই শিকই হবে আক্রান্ত। সুতরাং শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় এই ৫০০ ফুট জায়গার সামনে এসেই কারখানা-আইন প্রণয়নের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায়। স্যানিটারি (স্বাস্থ বিভাগীর) অফিসার, শিল্প-তদন্ত কমিশনার, কারখানা-ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) সকলেই ঐ ৫০০ কিউবিক ফুটের আবশ্যকতার কথা এবং মূলধনের কাছ থেকে তা আদায় করে নেবার অসম্ভাব্যতার কথা বারংবার পুনরাবৃত্তি করেছেন। বস্তুতঃপক্ষে, তারা এইভাবে এটাই ঘোষণা করেছেন যে, শ্রমিক-জনসংখ্যার মধ্যে ক্ষয়-রোগ ও ফুসফুসের অন্যান্য রোগের অস্তিত্ব মূলধনের পক্ষে অত্যাবশ্যক পূর্বশর্ত।[৩]
কারখানা-আইনের শিক্ষা-সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলি নগণ্য বলে প্রতিভাত হলেও, তা প্রাথমিক শিক্ষাকে শিশুদের কর্ম-নিয়োগের অপরিহার্য শর্ত বলে ঘোষণা করেছে।[৪] এই অনুচ্ছেদগুলির সাফল্য প্রথম বারের মত প্রমাণ করে দিল দৈহিক শ্রমের সঙ্গে শিক্ষা ও ব্যায়ামের মিলন ঘটাবার সম্ভাব্যতা।[৫] স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করে কারখানা-পরিদর্শকেরা অচিরেই আবিষ্কার করলেন যে, কারখানার শিশুরা যদিও নিয়মিত ডে-স্কুলগুলির শিক্ষার্থীরা যতটা শিক্ষালাভ করে তার অর্ধেকটা পায়, তা হলেও অন্যান্য বিষয়ে তাদের তুলনায় সমান বা তার বেশই শেখে। এর কারণ এই সহজ সত্যটি যে, মাত্র অর্ধেক সময় স্কুলে থাকে বলে তারা সব প্রাণবন্ত সময়েই এবং শিক্ষা গ্রহণে প্রায় সব সময়েই আগ্রহী। যে-প্রণালীতে তারা কাজ করে—অর্ধেক দৈহিক শ্রম, অর্ধেক শিক্ষা, তাতে এই দুটির মধ্যে একটিতে নিযুক্তি অন্যটিকে দেয় বিশ্রাম ও মুক্তি; কাজে কাজেই, একমাত্র একটিতে নিরন্তর নিযুক্ত থাকার চেয়ে দুটিতে নিযুক্ত থাকা শিশুদের পক্ষে টের বেশি অনুকূল। এটা খুবই স্পষ্ট যে, একটি বালক যে গোটা সকালটাই স্কুলে ব্যস্ত থাকে, সে, যে-বালকটি তার কাজ থেকে উজ্জীবিত ও উৎফুল্ল হয়ে ফিরল, তার সঙ্গে পেরে ওঠে না (বিশেষ করে, গরম আবহাওয়ায়)।[৬] এই সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণের জন্য ১৮৬৩ সালে এডিনবরায় অনুষ্ঠিত সামাজিক বিজ্ঞান সম্মেলনে সোশ্যাল সাইন্স কংগ্রেস’-এ প্রদত্ত সিনিয়রের ভাষণ দ্রষ্টব্য। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, স্কুলের উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর শিশুদের একঘেয়ে ও অনর্থক দীর্ঘায়িত স্কুলষটাগুলি কেমন করে কেবল শিক্ষকদের কাজের ভারকেই অনর্থক ভাবে বাড়িয়ে তোলে, “যখন তিনি কেবল নিষ্ফলভাবেই নয়, সেই সঙ্গে চুড়ান্ত ভাবেও নষ্ট করেন শিশুদের সময়, স্বাস্থ্য ও শক্তি”।[৭] যে-কথা রবার্ট ওয়েন আমাদের সবিস্তারে বলেছেন, কারখানা-ব্যবস্থা থেকে কুসুমিত হয় ভবিষ্যতের শিক্ষার বীজ-যে-শিক্ষ। কেবল একটা নির্দিষ্ট বয়সের বেশ-বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে উৎপাদন-নৈপুণ্য বারাবার পদ্ধতি হিসাবেই শিক্ষা ও ব্যায়ামের সঙ্গে উৎপাদনশীল শ্রমের মিলন ঘটাবে না, সেই সঙ্গে হয়ে উঠবে পূর্ব বিকশিত মানুষ গড়ে তোলার একমাত্র পদ্ধতি।
আমরা দেখেছি, আধুনিক শিল্প প্রযুক্তিগত উপায়ের মাধ্যমে ম্যানুফ্যাকচার ব্যবস্থার শ্রম-বিভাগকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, যার অধীনে প্রত্যেকটি মানুষ একটিমাত্র প্রত্যশ কাজে আজীবন হাত-পা বাঁধ; অবস্থায় আটক থাকত। একই সময়ে আবার, অাধুনিক শিল্পের ধনতাধিক রূপটি সে একই শ্রম-বিভাগের পুনরাবির্ভাব ঘটায় আরো দানবীয় আকারে-কারখানার ভিতরে, শ্রমিককে মেশিনের একটি জীবন্ত উপাঙ্গে পর্যবসিত করে এবং কারখানার বাইরে সর্বত্র অংশত মেশিনারি ও মেশিন কর্মীদেরকেই[৮] বিক্ষিপ্ত ভাবে ব্যবহার করে এবং অংশত নারী ও শিশুদের শ্রম এবং সস্তা অদক্ষ শ্রমের ব্যাপক পতনের মাধ্যমে শ্রম বিভাগকে নোতুনতর ভিত্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে।
ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থার শ্রম-বিভাগ এবং আধুনিক শিল্পের পদ্ধতিসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সজোরে আত্মপ্রকাশ করে। অন্যান্য ভাবে ছাড়াও এই দ্বন্দ্ব আত্মপ্রকাশ করে এই ভয়াবহ ঘটনায় যে আধুনিক শিল্পে ও আধুনিক ম্যানুফ্যাকচারে শিশুদের একটি বৃহৎ অংশই তাদের অতি কচি নল থেকে আটকে থাকে সবচেয়ে সরল কয়েকটা ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় এবং শোষিত হয় ছরের পর বছর অথচ তাদের শেখানো হয়না এমন একটি কাজও যার দৌলতে সে পরবর্তী জীবনে ফ্যাক্টরিতে বা ম্যানুফ্যাক্টরিতে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে। নমুন। হিসাবে উল্লেখ করা যায়, ইল্যাণ্ডের ছাপাখানায় আগে পুরনো ম্যানুফ্যাকচ ও হস্তশিল্পের অনুরূপ একটা ব্যবস্থা ছিল, যাতে শিক্ষানবিশদের উন্নীত করা সহজ কাজ থেকে কঠিন এবং আরো কঠিন কাজে। তারা একটা ক্ষিধ্যে দিয়ে যেত, যত দিন তার উপযুক্ত মুকিয় হয়ে না উঠছে। পড়তে এবং লিখতে সক্ষম হওয়া ছিল তাদের কাজের আবশ্যক শর্ত। এই সব কিছুই বদলে গেল মুদ্রণ-যন্ত্র প্রবর্তনের ফলে। এই যন্ত্র নিযুক্ত করে ধরনের শ্রমিক-এক পনের ‘বয়স্ক’, টণ্টার’, অন্য ধরনের বালক, ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী, যাদের একমাত্র কাজ হল মেশিনের নীচে কাগজের ‘শিট বিছিয়ে দেওয়া কিংবা সেখান থেকে মুদ্রিত ‘শিট সরিয়ে নেওয়া। এই ক্লান্তিকর কাজ তাদের করতে হয়, বিশেষ করে লণ্ডনে, সপ্তাহে কয়েক দিন একটানা ১৪, ১৫ এমনকি ১৬ ঘণ্টা, অনেক সময়ে ৩৬ ঘণ্টা, যার মধ্যে তারা খাওয়া ও ঘুমের জন্য বিশ্রামের সময় পায় মাত্র ২ ঘণ্টা।[৯] তাদের অধিকাংশই পড়তে পারে না এবং, সাধারণ ভাবে, চরম বর্বর এবং অত্যন্ত অস্বাভাবিক জীব। “যে-কাজ তাদের করতে হয়, তার উপযুক্ততা অর্জনের জন্য তাদের কোন মেধাগত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়না; এ কাজে দক্ষতার দরকার আছে সামান্যই এবং বিচার-বুদ্ধির দরকার নেই আদৌ; তাদের মজুরি বালকদের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি হলেও, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আনুপাতিক ভাবে বাড়েনা এবং তাদের অধিকাংশই আশা করতে পারেনা যে তারা ভবিষ্যতে মেশিন-চালকের দায়িত্বশীল পদে উন্নীত হবে ও বেশি মজুরি পাবে, কেননা যেখানে মেশিন-প্রতি বালক কাজ করে চার জন, সেখানে চালক লাগে একজন।[১০] যখন তারা এই কাজের তুলনায় বেশি বয়সী হয়ে পড়ে অর্থাৎ ১৭ বছরে প; দেয়, তখনি তাদের ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। তারা তখন নানাবিধ অপরাধের কাজের নবিশ হয়। তাদের অন্যত্র কর্মসংস্থানের একাধিক প্রচেষ্টা তাদের অজ্ঞতা, অমানুষিকতা এবং মানসিকতা ও শারীরিক অধঃপতনের দরুন ব্যর্থতায় পর্যবসিত
যেমন ম্যানুফ্যাকচারকারী কর্মশালার অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাগের ক্ষেত্রে, তেমনি। সমাজের অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাগের ক্ষেত্রে। যতকাল হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচার রচনা করে সামাজিক উৎপাদনের সাধারণ ভিত্তিভূমি, তত কাল পর্যন্ত একটি শাখার কাছে উংপাদকের একান্ত বশ্যতা তথ। তার কর্মসংস্থানের বহুমুখিতার সমাপ্তি[১১] বিকাশের পথে একটি আবশ্যক শর্ত। ঐ ভিত্তিভূমির উপরে উৎপাদনের প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র শাখা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন করে সেই আকার যা কৃৎকৌশলগত ভাবে তার পক্ষে উপযোগী, তার পরে আস্তে আস্তে তা সেটিকে নিখুত করে তোলে এবং সেই আকারটিকে দ্রুত স্ফটিকায়িত করে। বাণিজ্যের মারফৎ প্রাপ্ত নোতুন কাঁচামাল ছাড়া আর একটি মাত্র জিনিস যা পরিবর্তন ঘটায় তা হল শ্রম উপকরণসমূহের ক্রমিক পরিবর্তন। কিন্তু সেগুলিরও রূপও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একবার নির্দিষ্ট হয়ে গেলে তা-ও হয়ে যায় শিলীভূত-হাজার বছর ধরে সেগুলি যে একই রূপে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়, এটাই তার প্রমাণ। একটি বৈশিষ্ট্য সূচক নিদর্শন হচ্ছে এই যে, এমনকি এই অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্তও বিভিন্ন শিল্পকে অভিহিত করা হত “রহস্য” ( ‘মিষ্ট্রি’) বলে। যার গুপ্ত তথ্যে কেবল যথাবিহিত ভাবে দীক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করতে পারত না।[১২] তাদের নিজেদেরই সামাজিক উৎপাদনকে মানুষদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখত যে অবগুণ্ঠন, এবং স্বতঃস্ফত বিভিন্ন ভাবে আধুনিক শিল্প সেই অবগুণ্ঠনটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিল বিভক্ত উৎপাদন শাখাকে, কেবল বাইরের লোকদের কাছেই নয়, ভিতরের লোকদের কাছেও পরিণত করত কতগুলি ধাধায় সেগুলি মানুষের হাতের সাহায্যে সম্পাদন করা সম্ভব কিনা সে দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করেই প্রত্যেকটি প্রক্রিয়াকে তার উপাদানগত কতকগুলি গতিক্রিয়ায় বিভক্ত করার যে নীতি আধুনিক শিল্প অনুসরণ কয়ে, তাই সৃষ্টি করল প্রযুক্তিতরে (টেকনোলজি’-র) আধুনিক বিজ্ঞানকে। শিল্প প্রক্রিয়াসমূহের বিভিন্ন-বিচিত্র, বাহত অসংলগ্ন, শিলীভূত রূপগুলি এখন নিজেদেরকে পর্যবসতি করল নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য-সাধনে প্রকৃতি-বিজ্ঞানের কতকগুলি সচেতন ও সুশৃংখল প্রয়োগে। প্রযুক্তি বিজ্ঞান আরো আবিষ্কার করল গতির প্রধান প্রধান মৌল রূপ-কটিকে, ব্যবহৃত হাতিয়ারগুলির বিচিত্র বিভিন্নতা সত্ত্বেও গতির যে-রূপগুলিকে মানবদেহের প্রত্যেকটি উৎপাদনমুখী ক্রিয়া আবশ্যিক ভাবেই ধারণ করে থাকে; ঠিক যেমন বলৰিক্ত ন (মেকানিক্স’) সবচেয়ে জটিল মেশিনারির মধ্যেও দেখতে পায় কেবল কতকল সরল যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি—তা ছাড়া, আর কিছুই নয়।
আধুনিক শিল্প কখনো কোনো প্রক্রিয়ার উপস্থিত রূপটিকে চূড়ান্ত বলে গ্রহণ। করে না, বা সেভাবে তাকে ব্যবহারও করে না। সুতরাং, যেখানে উৎপাদনের পূর্ববর্তী সব কটি রূপই ছিল মূলতঃ স’রক্ষণশীল, সেখানে আধুনিক শিল্পের কৃৎ-কৌশলগত ভিত্তি হচ্ছে বৈপ্লবিক।[১৩] মেশিনারি, বিবিধ রাসায়নিক প্রক্রিয়া ও অন্যান্য পদ্ধতিসমূহের সাহায্যে, তা নিরন্তর পরিবর্তন সংঘটিত করছে—কেবল উৎপাদনের কৃৎকৌশলগত ভিত্তিতেই নয়, সেই সঙ্গে শ্রমিকের কার্যাবলীতে এবং শ্রম প্রক্রিয়ার সামাজিক সংযোজনসমূহেও। একই সময়ে, তা এইভাবে সমাজের অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাগকেও বিপ্লবায়িত করে এবং উৎপাদনের এক শাখা থেকে অন্য শাখায় মূলধন ও শ্রমিক-জনসমষ্টির অবিরাম স্থানান্তর ঘটায়। কিন্তু একদিকে যখন আধুনিক শিল্প তার নিজস্ব প্রকৃতিবশতই শ্রমের পরিবর্তন, কাজের সাবলীলতা, শ্রমিকের বিশ্বব্যাপী সচলতা দাবি করে, অন্যদিকে তা তখন তার ধনতান্ত্রিক রূপটিতে পুরনো শ্রম-বিভাজনকে তার শিলীভূত বিশেষত্বসমূহসহ পুনরুৎপাদন করে। আমরা দেখেছি কিভাবে আধুনিক শিল্পের কৃৎকৌশলগত প্রয়োজনসমূহ এবং ধনতান্ত্রিক রূপটির মধ্যে নিহিত সামাজিক চরিত্রের মধ্যেকার চুড়ান্ত দ্বন্দ্ব শ্রমিকের অবস্থিতিতে যাবতীয় নির্দিষ্টতা ও নিরাপত্তার অবলুপ্তি ঘটায়; কিভাবে তা সমস্ত শ্রম-উপকরণকে অধিগত করে তার হাত থেকে তার প্রাণ-ধারণের উপায়গুলিকে ছিনিয়ে নেয়[১৪] এবং তার প্রত্যংশ কাজকে দাবিয়ে দিয়ে তাকে অবান্তর করে তোলে। আমরা আরো দেখছি, এই দ্বন্দ্ব কিভাবে তার রেষিকে অভিব্যক্ত করে সেই কিভূত কাণ্ডের সৃষ্টিকর্যে, যাকে বলা হয় “মজদ বাহিনী এবং রাখা হয় দুঃখ দুর্দশার মধ্যে, যাতে করে তা সব সময়েই থাকে মূলধনের হাতের তলায়; অভিব্যক্ত করে শ্রমিক-শ্রেণীর মধ্য থেকে
অবিশ্রাম নর-বলির মধ্যে, শ্রমশক্তির সবচেয়ে বেপরোয়া অপচয়ের মধ্যে এবং সামাজিক নৈরাজ্য-ঘটিত ধ্বংসকাণ্ডের মধ্যে-যে-বিপর্যয় প্রত্যেকটি অর্থ নৈতিক অগ্রগতিকে পর্যবসিত করে একটি জাতীয় বিপত্তিতে। এটা হচ্ছে নেতিবাচক দিক। কিন্তু, একদিকে যখন কাজের পরিবর্তন বর্তমানে নিজেকে চাপিয়ে দেয় একটি প্রবল পরাক্রান্ত প্রাকৃতিক নিয়ম হিসাবে এবং চাপিয়ে দেয় এমন একটি প্রাকৃতিক নিয়মের অন্ধ বিপৎসী সক্রিয়তাসহ,[১৫] যাকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয় সমস্ত বিন্দুতে, তা হলে আধুনিক শিল্প চাপিয়ে দেয়, তার বিপর্যয়গুলির মাধ্যমে, কাজের পরিবর্তন সাধন, অতএব বিভিন্ন কাজের জন্য শ্রমিকের যোগ্যতা বিধান, অতএব তার বিভিন্ন প্রবণতার সর্বাধিক সম্ভব বিকাশ-সাধন ইত্যাদিতে উৎপাদনের একটি মৌল নিয়ম হিসাবে উপলব্ধি করার আবশ্যকতা। এই নিয়মটির স্বাভাবিক সক্রিয়তার সঙ্গে উৎপাদনের পদ্ধতিটিকে অভিযোজিত করার প্রয়োজনটি তখন সমাজের পক্ষে হয়ে ওঠে একটি জীবন-মরণ প্রশ্ন। বাস্তবিক পক্ষে, অন্যথা করলে মৃত্যুদণ্ড, এই শর্তে আধুনিক শিল্প সমাজকে বাধ্য করে, আজীবন অভিন্ন একটি তুচ্ছ কাজের পুনরাবৃত্তির দ্বারা পঙ্গুকৃত এবং এইভাবে একটি মানুষের ভগ্নাংশমাতে পর্যবসিত, আজকের প্রত্যংশ শ্রমিকের পরিবর্তে একজন পূর্ণ-বিকশিত ব্যক্তিকে প্রতিস্থাপিত করতে-এমন এক ব্যক্তি যে বিভিন্ন ধরনের শ্রমের পক্ষে উপযুক্ত উৎপাদনের যে-কোনো পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত এবং যার কাছে যে-সমস্ত সামাজিক কার্য সে সম্পাদন করে, সেই কাজগুলি তার নিজের প্রকৃতিগত ও উপার্জিত শক্তিসমূহকে অবাধ সুযোগ দানের কতকগুলি পদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই বিপ্লব ঘটানোর দিকে একটি পদক্ষেপ যা ইতিমধ্যেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেওয়া হয়েছে, তা হল কারিগরি ও কৃষি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা এবং “ecoles d’eneigne ment professionnel”-এর প্রতিষ্ঠা, যে প্রতিষ্ঠানগুলিতে শ্রমজীবী মানুষদের শিশু সন্তানের প্রযুক্তি-বিদ্যায় এবং শ্রমের বিভিন্ন হাতিয়ার হাতে-কলমে ব্যবহারে কিঞ্চিৎ শিক্ষা লাভ করে। যদিও কারখানা-আইনের আকারে মূলধনের হাত থেকে সর্বপ্রথম ও সামান্য-পরিমাণ যে সুবিধা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তা কানায় কাজের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষাকে সংযোজিত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তবু এ ব্যপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, যখন শ্ৰমিক-শ্রেণী ক্ষমতায় আসে, যা তার! তনবার্গ ভবেই আসবে, তখন তত্বগত ও কার্যগত উভয় ধরনের কারিগরি শিক্ষাই শ্রমিক শ্রেণীর বিদ্যালয় গুলিতে যথাচিত স্থান পাবে। এ ব্যাপারেও সন্দেহে অবকাশ নেই যে, এই ধরনের বৈপ্লবিক আলোড়ন, যার চূড়ান্ত পরিণাম হল পুরনে’ শ্রম-বিভাগের অবসান, তা ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-রূপ এবং সেই রূপ অনুযায়ী শ্রমিকের যে অর্থনৈতিক অবস্থা, তার সম্পূর্ণ বিরোধী। কিন্তু কোন একটি নির্দিষ্ট কপের মধ্যে হত দ্বন্দগুশির ঐতিহাসিক বিকাশই হল একমাত্র পথ, যে পথে উৎপাদনে সেই পটিকে ভেঙে দেওয়া যায় এবং তার জায়গায় নোতুন একটি রূপ প্রতিষ্ঠা কর” যায়। “Ne sutor ultra crepidan” – হশিল্প সম্পর্কে জ্ঞানের এই “nec plus ultra” সেই মুহূর্ত থেকেই হয়ে পড়ল অথহীন, যে-মুহত থেকে ঘড়ি নির্মাণকারী ওয়েট উদ্ভাবন করলেন ‘ষ্টিম-ইঞ্জিন’, ক্ষৌরকার অর্কিরাইট করলেন ‘থশ এ কমরত জহুরী ফুলটন করলেন ‘স্টিমশিপ।[১৬]
যতদিন কারখানা-আইন সীমাবদ্ধ থাকে ফ্যাক্টরি, ফ্যাক্টরি ইত্যাদিতে কাজের ঘন্ট! নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে, ততদিন তাকে গণ্য করা হয় মূলধনের শোষণ করার অধিকারের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ বলে। কিন্তু যখন ত! বিস্তার লাভ ক?-তথাকথিত “ঘরোয়া শ্রম”[১৭] নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে, তখনি তা পরিগণিত হয় “patria potestas, মাতা-পিতার কর্তৃত্বের উপরে প্রত্যক্ষ আক্রমণ বলে, কোমল-হৃদয় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দীর্ঘকাল এই পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত ছিল। অবশ্য, ঘটনার চাপে সে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হল স্বীকার করতে যে আধুনিক শিল্প চিরাচরিত পারিবারিক শ্রম যার উপরে প্রতিষ্ঠিত সেই অর্থনৈতিক বনিয়াদকে চুরমার করে দিচ্ছে এবং তার সঙ্গে জড়িত পারিবারিক শ্রমও ইতিপূর্বেই সমস্ত চিরাচরিত পারিবারিক বন্ধনকে শিথিল করে দিয়েছে। শিশুদের অধিকারসমূহ ঘোষণা করতে হয়েছিল। ১৮৩৬ সালে শিশু-নিয়োগ কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্টে বলা হয়, সমগ্র সাক্ষ্যের ভিতর দিয়ে এটা দুঃখজনক ও যন্ত্রণাদায়কভাবে স্পষ্ট হয়ে হয়ে ওঠে যে, তাদের মাতা-পিতার হাত থেকে ছেলে-মেয়ে-নির্বিশেষে সমস্ত শিশুর যতটা সুরক্ষা দরকার আর কোনো তিন হাত থেকে ততটা নয়।” সাধারণভাবে শিশুশ্রমের এবং বিশেষভাবে তথাকথিত ঘরোয়া শ্রমের সমাহীন শোষণের এই যে ব্যবস্থা তা চালু থাকতে পারে একমাত্র এই কারণে যে, মাতা-পিতার। এদের কচিকাচা সন্তানদের উপরে তাদের স্বেচ্ছাচারী ও ক্ষতিকারক কর্তৃত্বকে কোনো নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই প্রয়োগ করতে সক্ষম। … তাদের শিশুদের কেবল “এতটা পরিমাণ সাপ্তাহিক মজুরি অর্জনের মেশিন” হিসাবে ব্যবহার করার কর্তৃত্ব নাতা-পিতাদের হাতে অবশ্যই থাকা উচিত নয়।
. সুতরাং এইরকম সকল পরিস্থিতিতে আইনসভার কাছে স্বাভাবিক অধিকার। হিসেবেই যৌক্তিকভাবে দাবি করতে পারে যে, যা তাদের অপরিণত বয়সেই শারীরিক শক্তিকে ধ্বংস করে এবং বুদ্ধিমান ও নীতিবান জীবের মাদণ্ডে নিচের স্তরে নামিয়ে দেয়, তার কবল থেকে তাদের পরিত্রাণের একটা ব্যবস্থা করা উচিত।”[১৮] অবশ্য, মাতা-পিতার কর্তৃত্বই যে শিশু-শ্রমের ধনতান্ত্রিক শোষণের প্রত্যক্ষই বা পরোক্ষই হোক—সৃষ্টি করেছে, তা নয়; বরং বিপরীত,–ধনতান্ত্রিক শোষণই মাতা পিতার কর্তৃত্বের ভিত্তিটিকে ভাসিয়ে দিয়ে তাকে অধঃপাত করল ক্ষমতার দুষ্ট অপব্যবহারে। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুরনো পারিবারিক বন্ধনসমূহের ভাঙন যতই ভয়ংকর হোক না কেন, তবু আধুনিক শিল্প পারিবারিক পরিধির বাইরে নারী, তরুণ-তরুণী ও ছেলে-মেয়ে-নির্বিশেষে শিশুদেরকে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দান করায় পরিবার ও শারী-পুরুষের সম্পর্কের এক উচ্চতর রপের ভিত্তি সৃষ্টি করেছে। অবশ্য, পরিবারের টিউটনি খ্ৰীষ্টান রূপটিকেই পরম রূপ বলে ধরে নেওয়া হবে এক আজগুবি ব্যাপার, যেন আজগুবি ব্যাপার হত যদি প্রাচীন রোমে, প্রাচীন গ্রীক বা প্রাচ্য-দেশীয় পরিবারের উপরে ঐ অভিধানটি প্রয়োগ করা; আসলে একসঙ্গে করে দেখলে এই রূপগুলি হচ্ছে ঐতিহাসিক বিবর্তনের একটি পর্যায়ক্রম। অধিকন্তু, এটা স্পষ্ট যে যৌথ কী-গোষ্ঠী নারী ও পুরুষ এবং সব বয়সের মানুষদের নিয়ে গঠিত হওয়ায় তা অবশ্যই হয়ে উঠবে মানবিক বিকাশের একটি উৎসম্বরূপ, যদিও তার স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে গড়ে ওঠা, পাশবিক, ধনতান্ত্রিক রূপটি যেখানে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার জন্যই শ্রমিকের অস্তিত্ব, শ্রমিকের জন্য উৎপাদন-প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব নয়-সেখানে ঐ ঘটনাটি হল দুর্নীতি ও দাসত্বের জীবাণু-সংক্রামক উৎসবিশেষ।[১৯]
কারখানা আইনগুলির সার্বিকীকরণের আবশ্যকতা, কেবল মেশিনে সুতো কাটা ও কাপড় বোনর ক্ষেত্রে—মেশিনারির প্রথমতম দুটি সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ব্যতিক্রমস্বরূপ আইন থেকে সামগ্রিক ভাবে সামাজিক উৎপাদন সংক্রান্ত আইনে রূপান্তরিত করার আবশ্যকতা দেখা দিল আধুনিক শিল্প যে-পদ্ধতিতে ঐতিহাসিক ভাবে বিকশিত হয়েছিল, সেই পদ্ধতিটি থেকে, এটা আমরা আগেই দেখেছি। সেই শিল্পের পিছু পিছু ম্যানুফ্যাকচার, হস্ত শিল্প ও গৃহ-শিল্পের চিরাচরিত রূপটিও বিপ্লবায়িত হয়ে যায়; ম্যানুফ্যাকচার নিরন্তর পরিণতি লাভ করে ফ্যাক্টরি-ব্যবস্থায় এবং হস্তশিল্প ম্যানুফ্যাকচারে; এবং সর্বশেষে হস্ত ও গৃহ-শিল্পের পরিধি, তুলনামূলক বিচারে আশ্চর্যজনক স্বল্প সময়ে, পরিণত হয় যন্ত্রণার নরককুণ্ডে, যেখানে ধনতান্ত্রিক শোষণ পায় তার জঘন্যতম অত্যাচারের অবারিত অবকাশ। দুটি ঘটনা শেষ পর্যন্ত অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয় : প্রধমত, এই পৌনঃপুনিক অভিজ্ঞতা যে, মূলধন যখনি এক ক্ষেত্রে আইনের অধীনে পড়ে যায়, খনি সে অন্যান্য ক্ষেত্রে আরো বেপরোয়া হয়ে সেটা পুষিয়ে নেয়;[২০] দ্বিতীয়ত, ধনিকদের এই সোচ্চার দাবি যে, প্রতিযোগিতার অবস্থা গুলিতে সমতা-বিধান করা হোক অর্থাৎ শ্রমের সকল রকম শোষণের উপরে সমান নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হোক।[২১] এই প্রসঙ্গে, আসুন আমরা দুটি হৃদয়বিদারক চিৎকারে কর্ণপাত করি। ব্রিস্টলের পেরেক ও শিকল প্রস্তুতকারক মেসার্স কুকক্সি স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই তাদের কারখানায় কারখানা-াইনের নিয়ম-কানুনগুলি প্রবর্তন করল। “যেহেতু পুরনো অনিয়মিত ব্যবস্থাটা নিকটবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলিতে চালু আছে, যেহেতু মেসার্স কুকল্পি এক অসুবিধায় পড়ল, তারা দেখতে পেল যে তাদের ছেলেদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে অন্যত্র সন্ধ্যা ৬টার পরেও কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। তারা স্বভাবতই বলল, “এটা আমাদের প্রতি একটি অন্যায় এবং আমাদের পক্ষে একটা লোকসান, যেহেতু এর ফলে ছেলেদের শক্তি-সামর্থ্যের একটা অংশ ফুরিয়ে যায়, যে-অংশটির সুযোগ আমরা নিতে পারতাম।[২২] লণ্ডনের কাগজ বাক্স ও থলি প্রস্তুতকারক মিঃ জে সিম্পসন শিশু নিয়োগ কমিশনাদের সামনে বক্তব্যে বলেন যে, “এ জন্য (আইন-সভার হস্তক্ষেপের জন্য) তিনি যে-কোনো দরখাস্তে সই দিতে প্রস্তুত।” “বাস্তবিক পক্ষে, রাতের বেলায় তিনি সব সময়েই খুব অস্বস্তিতে কাটনি, পাছে তিনি যখন তার কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন, তখন অন্যরা তাদের কাজ চালু রাখেন এবং পার পেয়ে যান।”[২৩] সংক্ষিপ্ত করে শিশু নিয়োগ কমিশন বলে, বড় বড় নিয়োগকদের প্রতি এটা হবে একটা অবিচার যদি তাদের কারখানাগুলিকে কাজ করতে দেওয়া হয় ঘণ্টার পরে ঘণ্ট। বিনা-নিয়ন্ত্রণে। এবং কাজের ঘণ্টার ক্ষেত্রে ছোট ছোট কারখানাগুলির উপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করায় প্রতিযোগিতার এই যে অসম অবস্থা তার দরুন যে-অৰচান ঘটে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়। বড় বড় মালিকদের পক্ষে আরো একটি অসুবিধা-তারা দেখতে পায় যে তাদের। নাবালক ও নারী শ্রমকে টেনে নেওয়া হচ্ছে সেই সব প্রতিষ্টানে, যেগুলি আইনগত নিয়ন্ত্রণ থেকে মু! অধিকন্তু, এর ফলে ছোট ছোট প্রতিরুন স্থাপনের দিকে প্রেরণা সৃষ্টি হয়, যেগুলি জনগণের স্বাস্থ্য, স্বাচ্ছন্দ্য, শিক্ষা ও সাধারণ উন্নয়নের পক্ষে। অবশ্যভাবীরূপেই সবচেয়ে কম অনুকূল।”[২৪]
কমিশন তা চূড়ান্ত রিপোর্টে প্রস্তাব করেছে যে ১৪,০০,০০০ শিশু কিশোর কিশোরীও মহিলাকে কারখানা আইনের আওতায় আনা হোক; এদের মধ্যে অর্ধেকই শোষিত হয় ছোট কারখ নাগুলতে এবং ঘরোয়া কাজের মাধ্যমে;[২৫] কমিশন বলেছে, কিন্তু পার্লামেন্ট যদি এই সম সংখ্যক শিশু, কিশোর-কিশোরী ও মহিলাকেই উল্লিখিত আইনের আশ্রয়ে নিয়ে আমাকে সঠিক বলে বিবেচনা করে …… তা হলে নিঃসন্দেহে সেই আইনের কল্যাণকর ফল কেবল তার আশু লক্ষ্যস্থানীয় অল্প বয়সী ও ক্ষীণবল ব্যক্তিদের উপরেই পড়বে না, প্রাপ্তবয়স্ক কর্মীদের উপরেও পড়বে যারা এই সব কর্ম-প্রতিষ্ঠানে অবলম্বে এর প্রভাবে আসবে। এই আইন তাদের জন্য নিয়মিত ও পরিমিত কাজের ঘণ্টা বাধ্যতামূলক করবে; এই এই আইন তাদের কাজের জায়গা গুলিতে স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার ব্যবস্থা কবে, এই আইন স্বভাবতই সেই শারীরিক শক্তি-সঞ্চয় কৃষ্টি ও পুষ্টি ঘটৰে যার উপরে তার নিজের এবং তার দেশের মঙ্গল এতটা নির্ভর ক; এই আইন উদীয়মান শিশু-প্রজন্মকে রক্ষা করবে কচি বয়সের অত্যধিক খানি চুপ থেকে, যা তাদের শরীরকে ভেঙে দেয় এবং অসময়ে অপটু করে দেয়। সর্বশেসে, এই আইন তাদের জন্য আন্তঃ ১৩ বছর পর্যন্ত-নিশ্চিত করবে প্রাথমিক শিক্ষ, লভে: সুযোগ এবং অবসান ঘটবে সেই চরম অজ্ঞতার। যার অতি বিশ্ব বরণ উপস্থিত কর। হয়েছে আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারদের রিপোর্টে, যা পড়া যায়না গভীরতম বেদনা এবং জাতীয় অধঃপতনের এক প্রগাঢ় অনুভূতি ছাড়া।[২৬]
১৮৬৫ সালের ৫ই ফেব্রুঃ রি রাজকীয় ভাষণের মধ্যমে টোকি মন্ত্রিসভা ঘোষণা করে যে, তারা শিল্প-কমিশনের প্রস্তাবগুলিকে “বিল”-এর আকার দিয়েছেন।[২৭] ঐ পর্যন্ত উপনীত হতে তাদের লেগেছে আরো ২ বছরের এক্সপেরিমেন্টাম ইন কর্পোর ভিলি। সেই ১৮৯০ সালেই শিশুশ্রম সম্পর্কে একটি পার্লামেন্টির কমিশন নিয়োগ করা হয়েছিল। ১৮৪২ সালে প্রকাশিত এই কমিশনের রিপোর্টে উদঘাটিত হয়, নাসাউ ডবলু সিনিয়র-এর ভাষায়, একদিকে মনিব ও মাতা-পিতার অর্থ-গৃপ্নতা, স্বার্থপরতা ও নিষ্ঠুরতার এবং অন্যদিকে, কিশোর ও শিশু-বয়সী ছেলে-মেয়েদের দুর্দশা, অধঃপতন ও সাশের এক সবচেয়ে ভয়ংকর চিত্র। ধরা যেতে পারে যে এটা একটা অতীত যুগের চিত্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যায় যে, এই বিভীষিকাগুলি অতীতেও যেন ছিল, আজও তেমন আছে। প্রায় ২ বছর আগে হার্ডউইক কর্তৃক প্রকাশিত এক পুস্তিকায় বলা হয়েছে যে ১৮৪২ সালে যেসব অনাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, আজও সেগুলি পূ-প্রস্ফুটিত আকারে রয়ে গিয়েছে। শ্ৰমিক-শ্রেণীর শিশুদের নীতি ও স্বাস্থ্যের প্রতি সাধারণ অবহেলার এটা একটা অদ্ভুত দৃষ্টান্ত যে গত ২০ বছর ধরে এই রিপোর্টটির প্রতি কোনো দৃষ্টি দেওয়া হয়নি, যে। দীর্ঘ সময় ধরে নীতি’ কথাটির মানে কি সে সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা ছাড়াই বড় হয়ে উঠেছে যে শিশুরা, যাদের না ছিল কোনো জ্ঞান, ধর্মবোধ বা স্বাভাবিক স্নেহ-মমতা, তারাই আজ হয়েছে বর্তমান যুগের মাতা-পিতা।”[২৮]
যেহেতু সামাজিক ব্যবস্থা পালটে গিয়েছে, সেই হেতু পার্লামেন্টের আজ সাহস হয়নি ১৮৬২ সালের কমিশনের দাবিগুলিকে তাকবন্দী করে রাখবার যেমন সে রেখেছিল ১৮৪২ সালের কমিশনের দাবিগুলিকে। অতএব, ১৮৬৪ সালে যখন কমিশন তার রিপোর্টের চার ভাগের এক ভাগও প্রকাশ করে উঠতে পারেনি, তখনি মৃৎ শিল্প (কুম্ভকার-শিশু সমেত) কাগজের ঝালর, দিয়াশলাই, কার্টিজ ও ক্যাপ প্রস্তুতকারক এবং ফুশ্চিয়ান-কাটারদের নিয়ে আসা হয়, বস্ত্র-শিল্পে যে-আইনটি চালু ছিল, সেই আইনটির আওতায়। ১৮৬৭ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারির রাজকীয় ভাষণের মাধ্যমে। তৎকালীন টোরি মন্ত্রিসভা উক্ত শিল্প-কমিশনের সুপারিশগুলির ভিত্তিতে “বিল” উত্থাপনের কথা ঘোষণা করে; কমিশন অবশ্য তার কাজ শেষ করেছিল ১৮৬৬ সালেই।
১৮৬৭ সালের ১৫ই আগস্ট এবং ২১শে আগস্ট কারখানা আইন সম্প্রসারণ আইন এবং কর্মশালা নিয়ন্ত্রণ আইন যথাক্রমে রাজকীয় অনুমোদন লাভ করে। প্রথম আইনটি বড় বড় শিল্পের ক্ষেত্রে এবং দ্বিতীয় আইনটি ছোট ছোট শিল্পের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
প্রথমটি প্রযোজ্য ব্লাস্ট ফানেস, লোহ ও তামা কল, ঢালাই কারখানা, মেশিন শণ, তামা ম্যানুফ্যাক্টরি, গাট্টা-পার্চা কারখানা, কাগজ কল, কাচ কারখানা, তামাক ম্যানুফ্যাক্টরি, ছাপাখানা (সংবাদপত্র সমেত), বই-বাধাই, সংক্ষেপে উল্লিখিত ধরনের সমস্ত শিল্প-প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, যেখানে ৫০ বা তদূর্ধ্ব সখ্যক শ্রমিক যুগপৎ এবং বছরে অন্তত ১০০ দিন কাজ করে।
কর্মশালা নিয়ন্ত্রণ আইনটির কর্ম-পরিধি কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, সেই সম্পর্কে একটা ধারণা দেবার জন্য আমরা তার ব্যাখ্যামূলক অনুচ্ছেদ থেকে নিচেকার অংশগুলি উদ্ধত করছি।
“হস্তশিল্প” বলতে বোঝাবে যে-কোন দৈহিক শ্রম, যা বৃত্তিগত ভাবে প্রয়োগ করা হয় কোন একটি জিনিস বা তার কোন একটি অংশ তৈরি করে কিংবা বিক্রয়ের জন্য কোন একটি জিনিসের পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন, অলংকরণ ও সম্পূর্ণতা বিধান অথবা অন্য ভাবে তার অভিযোজন ঘটিয়ে লাভ করার উদ্দেশ্য।”
“কর্মশালা বলতে বোঝাবে যে-কোন ঘর বা জায়গা, তার উপরে কোন হাত থাক বা না থাক, যেখানে কোন হস্তশিল্প সম্পাদিত হয় কোন শিশু, কিশোর-কিশোরী বা মহিলার দ্বারা এবং এই শিশু, কিশোর-কিশোরী বা মহিলাদের নিয়োগ করে যে-ব্যক্তি তার যে ঘরে বা জায়গায় প্রবেশের অধিকার আছে এবং যার উপরে তার নিয়ন্ত্রণ আছে।”
“কর্ম-নিযুক্ত বলতে বোঝাবে মনিবের কিংবা মাতা-পিতার যে-কোন একজনের অধীনে কোন হস্তশিল্পে মজুরির বিনিময়ে বা বিনা-মজুরিতে নিযুক্ত থাক।।”
“মাতা-পিতার যে-কোন একজন বলতে বোঝাবে হয় মাত, নয় পিতা কিংবা অভিভাবক কিবা এমন কোন লোক, যার হেফাজতে বা নিয়ন্ত্রণে আছে কোন …… শিশু, তরুণ-বয়স্ক ব্যক্তি বা মহিল।।”
“শিশু, তরুণ-বয়স্ক ব্যক্তি বা মহিলার চাকরির ব্যাপারে আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে ৭ম অনুচ্ছেদে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে কেবল কর্মশালার অধিকারীকেই নয়, তা সে মাতা বা পিতাই হোক বা অন্য কেউ হেকি, তাকেই যে কেবল জরিমানা দিতে হবে, তাই নয়, “শিশু, তরুণ-তরুণী বা মহিলার মাতা বা পিতা কিংবা অন্য কোন ব্যক্তি যে তার শ্রম থেকে সুবিধা ভোগ করে বা তার উপরে নিয়ন্ত্রণ ভোগ করে, তাকেও জরিমানা দিতে হবে।”
‘কারখানা আইন সম্প্রসারণ আইন, যা বৃহৎ শিল্পগুলির ক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য, তা এক গাদা ব্যতিক্রম ও মালিকের সঙ্গে কাপুরুষোচিত আপস-রফার ফলে কারখানা আইন’-এর তুলনায় শিথিলতা-প্রাপ্ত হল।
‘কর্মশালা নিয়ন্ত্রণ আইন’, য. ছিল সর্বাংশে শোচনীয়, তাও পৌর ও স্থানীয় কতৃপক্ষের হাতে পড়ে অকেজো হয়ে গেল, অথচ এদের উপরেই ভয় ছিল এই আইন কার্যকরী করার। ১৮৭১ সালে পার্লামেন্ট যখন তাদের হাত থেকে এই ক্ষমতা তুলে নিয়ে কারখানা-পরিদর্শকদের হাতে ন্যস্ত করল এবং এই ভাবে এক কলমের খোঁচায় পপিদর্শকদের দায়িত্বে আরো একশ-হাজার কর্মশালা এবং তিনশ ইট-কারখানা স্থাপন করল, তখন খুব সতর্কভাবেই ব্যবস্থা করা হল, যাতে তাদের স্টাফে আর আট জনের বেশি লোক যুক্ত করা না হয় অথচ এই অতিরিক্ত দায়িত্ব-দানের আগে থেকেই এই স্টাফে লোক ছিল প্রয়োজনের তুলনায় কম।[২৯]
তা হলে ইংল্যাণ্ডের ১৮৬৭ সালের আইনে যেটা আমাদের নজরে পড়ে সেটা হল, একদিকে ধনতান্ত্রিক শোষণের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে খুবই ব্যাপক ও অসাধারণ সব ব্যবস্থা গ্রহণে শাসক শ্রেণীগুলির পার্লামেন্ট নীতিগত ভাবে বাধ্য হয়; অন্য দিকে, সেই ব্যবস্থাগুলিকে কার্যে পরিণত করতে সে দ্বিধা, বিরুদ্ধতা ও বিশ্বাসঘাতকতা করে।
১৮৬২ সালের তদন্ত কমিশন খনি-শিল্পের জন্যও একটি নোতুন আইনের প্রস্তাব করে ছিল; অন্যান্য শিল্পের তুলনায় এই শিল্পের একান্ত বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানে ভুস্বামী ও ধনিকের স্বার্থ হাতে হাত মিলায়। এই দুটি স্বার্থের পারস্পরিক বৈরিত কারখানা আইন প্রণয়নের পক্ষে সহায়ক হয়েছে; অন্য দিকে, এই বৈরিতার অনুপস্থিতি খনি আইন প্রণয়নে বিলম্ব ও প্রতারণার যথেষ্ট কারণ হিসাবে কাজ করেছে।
১৮৪০ সালের তদন্ত কমিশন এত ভয়ানক, এত শোচনীয় সব ব্যাপার ফাস করে দিয়েছিল এবং তার ফলে গোটা ইউরোপ জুড়ে এমন নিনি পড়ে গিয়েছিল যে নিজের বিবেককে রক্ষা করার জন্য ১৮৮২ সালে খনি আইন পাশ করতে হয়, যে, আইনে সে কেবল ১০ বছরের কমবয়সী শিশুদের এবং নারীদের খনিগর্ভে কাজ করার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে।।
তারপরে, আর একটি মাইন, ১৮৬০ খনি-পরিদর্শন আইন, পাশ হয় এবং তাতে সংস্থান রাখা হয় যে, বিশেষ ভাবে এই কাজের জন্যই মনোনীত সরকারি কর্মচারীরা খনিগুলি পরিদর্শন করবে এবং যদি তারা স্কুল থেকে?প্ত প্রয়োজনীয় টফিকেট না দেখাতে পারে বা স্কুলে একটি নির্দিষ্ট সখ্যক ঘটা হাজিব? না দেয়, এ হলে ১০ এবং ১২ বছরের মধ্যবর্তী নমস্ক ছেলের খনির কাজে নিযু ও হবে না। স্কুল-পরিদর্শকদের হাস্যকর ভাবে স্বল্প সংখ্যা, তাদের ক্ষমতার যৎসামান্যত এবং অন্যান্য করণের দরুন এই আইনটি সম্পূর্ণ অকেজে!-ই থেকে যায়; যতই ‘আম! এগো ততই এই অন্যান্য কারণগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
খনি প্রসঙ্গে প্রকাশিত সাম্প্রতিকতম ‘র, বুক-গুলির মধ্যে একটি হল “খনি সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট এবং তৎসহ সাক্ষ্যপ্রমাণ ইত্যাদি, ১৩শে জুলাই, ১৮৬৬।” এই কমিটি গঠিত হয় কমন্স সভা থেকে নাছাই-কর সদস্যদের নিয়ে এবং এর অধিকার ছিল সাক্ষীদের তলব ও জেরা করবার, উক্ত রিপোর্টটি এই কমিটিরই কাজ। রিপোর্টটি একটি মোট আকারের ‘ফোলিও’ ই; যার মধ্যে খোদ রিপোর্টটি হচ্ছে মাত্র পাঁচ লাইনের এই বকুব্যটি : কমিটির বলার মত কিছু নেই; অরে।। সাক্ষীকে জেরা করা দরকার !
সাক্ষীদের যে-পদ্ধতিতে জেরা করা হয়, ত ই ল্যাণ্ডের আদালতগুলিতে যে-পদ্ধতিতে জো করা হয়, তাকেই মনে পড়িয়ে দেয়, যেখানে উকিল চেষ্টা করেন ধৃষ্ট, অপ্রত্যাশিত, দ্ব্যর্থবোধক ও জটিলতাপূর্ণ ও প্রসঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য প্রশ্নের সাহায্যে সাক্ষীকে ভয় দেখাতে, চমকে দিত এবং বিভ্রান্ত করে দিতে এবং তার পরে তার কাছ থেকে আদায় করা উত্তরগুলির উপরে নিজের ব্যাখ্যা চাপিয়ে দিতে। এই তদন্তে কমিটির সদস্যরা নিজেরাই জেরা করেন, এবং তাদের মধ্যে থাকেন খনির ভূস্বামী ও খনিজ-আহরণকারী ধনিক উভয়েই; সাক্ষীরা প্রায় সকলেই হল খনি-শ্রমিক। গোটা প্রহসনটা মূলধনের মর্ম-প্রকৃতির এত বৈশিষ্ট্যসূচক যে তা থেকে কয়েকটি অনুচ্ছেদ এখানে উদ্ধৃত না করে পারা যায় না। সংক্ষেপে উপস্থিত করার উদ্দেশ্যে আমি। সেগুলিকে বিভিন্ন শিরোনামায় ভাগ করেছি। এই সঙ্গে বলে রাখছি যে, প্রত্যেকটি প্রশ্ন ও তার উত্তর ইংল্যাণ্ডের ব্লু-বুকগুলিতে নম্বর দ্বারা চিহ্নিত আছে।
১. খনিতে ১০ বছর ও তদুর্ধ বছর বয়স্ক বালকদের নিয়োগ :
খনিতে যাতায়াতের সময় হিসাবে নিয়ে কাজের সময় সচরাচর ১৪ বা ১৫ ঘণ্টা; সকাল ৩, ৪ ও ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৫ ও ৬টা অবধি (নং ৬,৪৫২,৮৩)। বয়ঃপ্রাপ্তরা কাজ করে দুই শিফটে, প্রত্যেকটি শিফট ৮ ঘন্টা করে, কিন্তু খরচের দরুন, বালকদের বেলায় কোন অদল-বদল করা হয় না (নং ৮,২০৩,২০৪)। প্রধানত কমবয়সী বালকদের নিযুক্ত করা হয় খণর বিভিন্ন অংশে হাওয়া চলাচলের দরজা খোলা ও বন্ধ করার কাজে; অপেক্ষাকৃত বেশিবাসীদের নিযুক্ত করা হয় কয়ল, বনের এত ভাই কাজে (নং ১২২,৭৩৯,১৭৪৭); এই দীর্য ঘটা ধরে তারা খনিগতে কাজ করে ১৮ ব৷ ১২ বছর বয়স পর্যন্ত, যখন তাদের লাগানো হয় নিয়মিত খনিখননের কাজে (নং ১৬১)। যে-কোনো পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় শিশু ও কিশোর-কিশোীদের প্রতি এখন আরো খারাপ আচরণ করা হয়, আরো কঠোর কাজ করানো হয় (নং ১৬৬৩–১৬৬৭ )। খনি-ধনিকরা প্রায় সর্বসম্মতভাবে দ করে যে পার্লামেন্ট ১৪ বছরের কমবয়সী শিশুদের খনির কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করে একটা আইন পাশ করুক। এবং এখন হুসি ভিভিয়ান, যিনি নিজেই একজন খনি-ধনিক, প্রশ্ন করছেন, “শ্রমিকের পরিবারে দারিদ্রের উপরেই কি নির্ভর করে ন শ্ৰ’মকের মতামত?” মিঃ ব্রুস : “আপনি কি মনে করেন, যেখানে মাতা বা পিতা কেউ আহত, রোগগ্রস্থ, কিংবা যেখানে পিতা মৃত এবং কেবল মাতাই জীবিত, সেখানে ১২/১৪ বছরের একটি শিশু যদি পরিবারের জন্য দিনে ১ শি ৭ পেন্স আয় করে, তা হলে খুব কঠিন ব্যাপার হবে?”… আপনাকে নিশ্চয়ই একটা সাধারণ নিয়ম বেঁধে দিতে হবে? আপনি কি এমন একটি আইন প্রণয়নের সুপারিশ করতে প্রস্তুত যা ১২/১৪ বছরের কমবয়সী শিশুদের কাজে নিয়োগ ঢালাওভাবে বন্ধ করে দেবে, তা তাদের মাতা-পিতার অবস্থা যা-ই হোক না কেন? “হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত।” (নং ১০৭-১১০ )। ভিভিয়ান : “যদি ধরে নেওয়া যায় যে, ১৪ বছরের কমবয়সী শিশুদের কর্ম-নিয়োগ নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাশ করা হল, তা হলে, তাদের মাতা-পিতার অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের জন্য কাজের খোঁজ করবে, যেমন ম্যানুফ্যাকচারে।” “সাধারণভাবে সেটা হবে না বলেই আমার ধারণা।” (নং ১৭৪)। কিশ্লেয়ার্ড : “কিছু বালক দারোয়ানের কাজ করে?” “হ্যাঁ।” “যতবার আপনি দরজা খোলেন বা বন্ধ করেন সাধারণত ততবারই কি একটা প্রবল দমকা বাতাসের সৃষ্টি হয় না?” এটা শুনতে বেশ সহজ বলেই মনে হয় কিন্তু আসলে এটা একটা কষ্টকর ব্যাপার?” “সেখানে সে আটকে থাকে ঠিক যেন জেলখানার সেলের মধ্যে কয়েদীর মত।” বুর্জোয় ভিভিয়ান : “যখনি একটি বালকের হাতে একটা ল্যাম্প দেওয়া হয়, সে কি পড়তে পারে না?” ! সে পারে, যদি তাকে মোম দেওয়া হয়। তবে আমার ধারণা, তাকে যদি বই পড়তে দেখা যায়, তা হলে সেট। তার দোষ বলে ধরা হবে। সেখানে তাকে তার কাজ করতে হয়; তার করণীয় একটা কর্তব্য রয়েছে এবং তাকে সবচেয়ে আগে সেদিকেই মন দিতে হবে; আমি মনে করিনা, খনির গর্তে তাকে বই পড়তে দেওয়া হবে।” (নং ১৩৯, ১৪১, ১২৩, ১৫৮, ১৬)।
২. শিক্ষাঃ
খনি-শ্রমিকের। চায় কারখানার ক্ষেত্রে যেমন আছে, খনির ক্ষেত্রেও তেমন তাদের শিশুদের বাধ্যতামূলক শিক্ষার জন্য একটি আইন পাশ করা হোক। তারা বলে যে, ১০ এবং ১২ বছরের শিশুদের কর্মে নিয়োগের পূর্বশর্ত হিসাবে স্কুল-সার্টিফিকেট দেখানোর যে নিয়ম আছে, সেটা একটা ফাকি। এই বিষয়ে সাক্ষীদের পরীক্ষা করার ব্যাপারট। সত্য সত্যই ভঁড়ামে’। “এই আইনটি কার বিরুদ্ধে প্রয়োজন—শিক্ষক না মাতা পিতার বিরুদ্ধে?” “আমার মনে হয়, উভয়েরই বিরুদ্ধে।” “আপনি কি বলতে পারেন না কার বিরুদ্ধে বেশ :” “না, আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না।” ( নং ১১৫, ১১৬) “শিশুর যতে স্কুলে যাবার জন্য কয়েক ঘণ্টা করে ছাড়া পায়, এমন কোনো ইচ্ছা নিয়োগকতদের মধ্যে দেখা যায় কি?” “না, তার জন্য কাজের ঘণ্টা কখনো কমানে হয় না।” { নং ১৩৭)। মিঃ কিন্নেয়ার্ড, “আপনি কি বলতে পারেন, যে সাধারণভাবে খনি-মজুরের। তাদের শিক্ষার উৎকর্ষ সাধন করে? আপনার কি এমন দৃষ্টান্ত জানা আছে যে, কাজ শুরু করার সময়ে তার যতটা শিক্ষা ছিল, পরে তা থেকে তার শিক্ষ। খুব বেশি একটা উন্নত হয়েছে? বরং যখন তারা ফিরে যায়, তখন তার আগে যতটাও বা আয়ত্ত করেছিল, তাও হারিয়ে ফেলে?” “সাধারণতঃ তাদের আরো অবনতি ঘটে, তাদের উন্নতি হয় না। তারা বিভিন্ন বদঅভ্যাস আয়ত্ত করে; তার মদে ও জুয়ায় এবং অনুরূপ সব ব্যাপারে মেতে ওঠে এবং সম্পূর্ণ সর্বনাশের গহ্বরে তলিয়ে যায়।” (নং ২১১) “শিক্ষাদানের জন্য তারা কি নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনের মত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয়?” “সামান্য কয়েকটা কোলিয়ারি আছে যেখানে নৈশ স্কুল চালু আছে, এবং সম্ভবতঃ সেইসব স্কুলে কিছুসংখ্যক ছেলে যায়। কিন্তু শারীরিক ভাবে তারা এমন শান্ত থাকে যে স্কুলে গিয়ে কাজের কাজ কিছুই হয় না।” (নং ৪৫৪)। “তা হলে আপনি শিক্ষার বিরুদ্ধে?”—সিদ্ধান্ত করেন বুর্জোয়া ব্যক্তিটি। “নিশ্চয়ই নয়, কিন্তু :(নং ৪৪৩)। “কিন্তু নিয়োগ কর্তারা কি স্কুল-সাটিফিকেট দাবি করতে বাধ্য নন?” “আইনত তারা বাধ্য; কিন্তু তারা যে তা করেন, সে ব্যাপারে আমি অবহিত নই।” “তা হলে এটাই আপনার মত যে সার্টিফিকেট দাবি করার এই যে ধারাটি তা কোলিয়ারিগুলিতে সাধারণত মেনে চলা হয় না।” (নং ৪৪৩, ৪৪৪)। “লোকেরা কি এই শিক্ষার প্রশ্নে বিশেষ আগ্রহ দেখায়? বেশির ভাগ লোকই দেখায়।” (নং ৭১৭) তারা কি এ ব্যাপারে ব্যগ্র যে আইনটি কার্যকরী করা হোক?” “বেশির ভাগই ব্যগ্র। { নং ৭১৮) “আপনি কি মনে করেন, এই দেশে আপনি যদি কোন আইন পাশ করেন, তা হলে জনগণ নিজেরাই যদি সেই আইন কার্যকরী করতে এগিয়ে না আসে, সেই আইন ফলপ্রসূ হতে পারে?” এমন অনেকেই আছেন যারা বালকের নিয়োগে আপত্তি করতে চান, কিন্তু তা করলে তারা সম্ভবত চিহ্নিত হয়ে যাবেন?” (নং ৭২০ ) “কাদের দ্বারা চিহ্নিত?” “তাদের নিয়োগকর্তাদের দ্বারা।” (নং ৭২১)। “আপনি কি মনে করেন কোন লোক আইন মেনে কাজ করলে, নিয়োগকর্তা তার পিছনে লাগবেন?” “আমার বিশ্বাস, হঁ্যা, লাগবেন।” (নং ৭২২)। “লেখাপড়া জানে না এমন ১০-১২ বছর-বয়সী কোন বালকের নিয়োগে কোন শ্রমিককে আপত্তি তুলতে আপনি শুনেছেন কি?” “এটা মানুষের ইচ্ছার উপরে ছেড়ে দেওয়া হয়নি।” (নং ১২৩) “আপনি কি পার্লামেন্টের হস্তক্ষেপ দাবি করেন?” “আমি মনে করি, খনি-শ্রমিকদের শিক্ষার জন্য ফলপ্রসূ কিছু করতে হলে তা অবশ্যই পার্লামেন্টের আইনের দ্বারা বাধ্যতামূলক করতে হবে।” (নং ১৬৩৪)। “আপনি কি বাধ্যবাধকতাটা কেবল কয়লাখনি-শ্রমিকদের পক্ষেই আরোপ করতে চান, গ্রেট ব্রিটেনের সমস্ত শ্রমজীবী জনগণের পক্ষেই আরোপ করতে চান?” “আমি এখানে এসেছি কয়লা-শ্রমিকদের হয়ে কথা বলতে।” (নং ১৬৩৬)। আপনি অন্যান্য বালকদের থেকে ওদের আলাদা করে দেখছেন কেন?” “কারণ আমি মনে করি, ওরা সাধারণ নিয়মের একটি ব্যতিক্রম।” (নং ১৬৩৮)। “কোন দিক থেকে?” “শারীরিক দিক থেকে।” (নং ১৬৩৯)। “অন্যান্য শ্রেণীর ছেলেদের তুলনায় ওদের ক্ষেত্রে শিক্ষা বেশি মূল্যবান হবে কেন?” “আমি জানি না যে তা বেশি মূল্যবান; কিন্তু খনির কাজে অতিরিক্ত খাটুনি খেটে তাদের পক্ষে সাণ্ডে স্কুলে বা ডে-স্কুলে লেখাপড়া শিখবার সুযোগ ঢের কম।” (নং ১৬৪০)। “এই ধরনের একটি প্রশ্নকে সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র করে দেখা অসম্ভব।” (নং ১৬৪৪)। “স্কুলের সংখ্যা কি যথেষ্ট প্রচুর?”-“না।” (নং ১৬৪৬)। “যদি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিয়ম করে দেওয়া হয় যে প্রত্যেকটি শিশুকে স্কুলে যেতে হবে, তা হলে প্রত্যেকের যাবার মত অত স্কুল কোথায় হবে?” “না, হবে না, কিন্তু আমি মনে করি, তেমন অবস্থা উদ্ভূত হয় তা হলে স্কুলেরও উদ্ভব ঘটবে।” (নং ১৬৪৭)। আমার ধারণা, তাদের (ছেলেদের কেউ লিখতে পড়তে জানে না।” “বেশির ভাগই জানে না। বয়স্কদের মধ্যেও বেশির ভাগ জানেন না।” (নং ৭৫, ৭২৫)।
৩. নারীদের কর্মে নিয়োগ
১৮৪২ সাল থেকে নারীদের আর মাটির তলায় কাজ করতে হয় না; এখন তারা নিযুক্ত হয় মাটির উপরকার নানা কাজে, যেমন, কয়লা বোঝাই করা, টবগুলিকে খাল বা ওয়াগন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া, বাছাই করা ইত্যাদি। গত তিন চার বছরে তাদের সংখ্যা প্রভূত ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। (নং ১৭২৭)। তাদের মধ্যে অধিকাংশই খনি-মজুরদের স্ত্রী, কন্যা বা বিধবা পত্নী; বয়স ১২ থেকে ৫ বা ৬০। ( নং ৬৪৫, ১৭৭৯)। “নারীদের এই কর্মনিযুক্তিতে কর্মরত খনি-মজুরদের মনোভাব কি?” “আমার মনে হয়, তারা সাধারণ ভাবে একে নিন্দা করে।” (ং ৬৪) “আপনি এর মধ্যে আপত্তিজনক কি দেখতে পান?” “আমার মতে এটা নারীর পক্ষে অবমাননাকর” (নং ৬৪৪) “পোশাকে কোন বৈশিষ্ট্য আছে?” “হ্যা, এটা এট, বরং পুরুষের পোশাক এবং কিছু ক্ষেত্রে সব রকমের শালীনতার পরিপন্থী “নয়ে। বিচ ধূমপান করে?” “কেউ কেউ করে।” “অার অামার মনে হয় কাজটা বড় নোও।” “খুবই নোর। “তারা কালিঝুলিতে কদাকার হয়ে যায় !” “মাটির তলায় যারা কাজ করে, তাদের মতই কালিময় হয়ে যায়। আমার বিশ্বাস যে-মহিলাদের শিশু-সন্তান আছে এবং খাদের কিনারায় অনেকেরই আছে, তারা তাদের প্রতি কর্তব্য করতে পারে না” (নং ৬৫০-৬৪৫, ৭০:।। “আপনি কি মনে করেন ঐ বিধবারা অন্য কোথাও কাজ করলে এখানে যে জুরি পায় (সপ্তাহে ৮শ থেকে শি, সেই মজুরি পেত?” “সে সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারি না।” (নং ৭০৯)। এই ভাবে জীবিক; অর্জন থেকে তাদের বাধা দিতে আপনি এখনো প্রস্তুত?” হায়রে, নির্মম-নির্দয় ব্যক্তি! “আমি প্রস্তুত।” (নং ৭১০) মেয়েদের কর্ম-নিয়োগ সম্পর্কে অঞ্চলে সাধারণ মনোভাব কি?” “মনোভাব কি?” “মনোভাব হচ্ছে এই যে এই কাজটা অবমাননাকর এবং খনি-শ্রমিক হিসাবে আমরা মনে করি যে, খাদের কিনারায় তাদের দেখতে পাওয়া ছাড়া অন্য কোন অধিকতর সম্মানের জায়গায় নদের দেখতে পাওয়া ভাল। … কাজের কোন কোন অংশ দারুণ কষ্টকর; এই ব্যালকাদের মধ্যে অনেকে দিনে ১০ টন পর্যন্ত মাল তোলে।” (নং ১৭১৫, ১৭১৭)। আপনি কি মনে করেন ফ্যাক্টরিতে যে-মেয়েরা কাজ করে তাদের চেয়ে কোলিয়ারিতে যে-মেয়েরা কাজ করে, তাদের নৈতিকতা নিচু মানের?” “……. ফ্যাক্টরিতে কাজ-করা মেয়েদের তুলনায় খারাপের শতকরা ভাগ কিছুটা বেশি হতে পারে।” (নং ১২৩৭),‘কিন্তু ফ্যাক্টরির নৈতিক মান সম্পর্কেও তো আপনি খুব খুশি নন?” “না, আমি খুশি নই।” (নং ১৭৩৩) “আপনি কি ফ্যাক্টরিতেও মেয়েদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে চান?” “না, আমি চাইনা।” (নং ১৭৩৪) “কেন চান না?” “আমি মনে করি মিল-ফ্যাক্টরিতে কাজ করা তাদের পক্ষে বেশি সম্মানজনক।” ( নং ১৭৩৫) “তবু, আপনি মনে করেন, এ কাজ তাদের নৈতিকতার পক্ষে হানিকর?“খাদের পারে কাজ করা যতটা হানিকর, ততটা নয়।” কিন্তু আমি ব্যাপারটা দেখছি সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে; আমি কেবল নৈতিক অবস্থানের দিক থেকেই দেখছি না। বালিকাদের উপরে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার দিক থেকে এই অধঃপতন চরম শোচনীয়। যখন এই ৪০০ বা ৫০০ বালিকা খনি-শ্রমিকদের স্ত্রী হয়, তখন তাদের স্বামীরা এই অধঃপতনের দরুন দারুন কষ্ট ভোগ করে। এর ফলে তারা বাড়ি-ঘর ছেড়ে যায় এবং পানাসক্ত হয়।” (নং ১৭৩৬), “যদি আপনি কয়লা খনিতে মেয়েদের নিয়োগ বন্ধ করতে চান, তা হলে তোত আপনি লোহা কারখানাতেও তাদের নিয়োগ বন্ধ করতে চাইবেন; কি, তাই না?” “অন্য কোন ক্ষেত্রের কথা আমি বলতে পারিনা।” (নং ১৭৩৭)। লোহা-কারখানায় নিযুক্ত মেয়েদের পরিস্থিতি এবং কয়লাখনিতে মাটির উপরে নিযুক্ত মেয়েদের পরিস্থিতি—এ দুয়ের মধ্যে আপনি কি কোনো পার্থক্য দেখতে পান?” “এ সম্পর্কে আমি এখনো যাচাই করে দেখিনি” (নং ১৭৪০ )। “আপনি কি এমন কিছু দেখতে পান যা দুটি শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য-সূচক?” “আমি তা যাচাই করে দেখিনি, কিন্তু বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমি যা দেখেছি তা থেকে আমি জানি যে আমাদের অঞ্চলে অবস্থাটা অতি শোচনীয়।” : নং ১৭৪১)। “যেখানেই মেয়েদের নিয়োগ অধঃপতন ঘটায়, এমন প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই কি হস্তক্ষেপ করবেন?” আমি মনে করি, এদিক থেকে এটা ক্ষতিকারক হবে : ইংরেজদের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুভূতিগুলি তার লাভ করেছে তাদের মায়েদের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা থেকে।” (নং ১৭৫ . ) “সেটা তো কৃষিক্ষেত্রে নিয়োগের বেলাতেও সমান ভাবে প্রযোজ্য; নয় কি?” “হ্যা, কিন্তু সেট। কেবল দুটি ঋতুর জন্য, আর এখানে আমাদের কাজ রয়েছে চারটি ঋতুর সব কটি ঋতু জুড়েই। নং ১৭৫১) “তারা প্রায়ই কাজ করে দিন এবং রাত; গা ভিজে যায়; তাদের শরীর নষ্ট হয় এবং স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।” “আপনি সম্ভবত ব্যাপারটি সম্পর্কে খোঁজ খবর করেন। নি?” “আমি যেতে যেতে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছি, কিন্তু খাদের পাড়ে কাজের যে ফলাফল মেয়েদের উপরে ঘটে, আর কোনোখানেই তার তুলনা দেখিনি। এটা হল পুরুষের কাজ, বলিষ্ঠ পুরুষের কাজ।”। ১৭৫৩, ১৭৯৩, ১৭৯৪)। আপনার অনুভূতিটি এই রকম যে, উন্নততর শ্রেণীর খনি-শ্রমিকেরা, যারা নিজেদের আরো উন্নীত করতে চায়, মনুষ্যত্ব বিকশিত করতে চায়, তারা তাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পায় না। বরং তাদের স্ত্রীরা তাদেরকে আরে, নীচে টেনে আনে।” “হ্যা।” i নং ১৮০৮)। এই বুর্জোয়াদের কাছ থেকে আরো কিছু ফুটিল প্রশ্নের পরে, অবশেষে, বিধবাদের জন্য, দরিদ্র পরিবারগুলির জন্য তাদের সহানুভূতি’র গোপন রহস্যটি বেরিয়ে পড়ে। “কয়লা-মালিক কয়েকজন ভদ্রলোককে নিয়োগ করেন কাজকর্ম জারক করার জন্য এবং তার অনুমোদন পাবার জন্য। এরা যে পলিসিটি অনুসরণ করে তা হল যথাসাধ্য স্বল্প ব্যয়ের ভিত্তিতে সবকিছু পরিচালনা করা, আর এই বালিকাদের নিযুক্ত করে দৈনিক ১ শিলিং থেকে ১ শিলিং ৬ পেন্স মজুরির হারে, যেখানে একজন পুরুষ মানুষকে নিযুক্ত করতে লাগত দৈনিক ২ শিলিং ৬ পেন্স করে।” (নং ১৮১৬)।
৪. ‘করোনার’-এর (মৃত্যু সম্পর্কে তদন্তকারীর) তদন্ত কার্যঃ
“করোনার’-এর তদন্ত প্রসঙ্গে, দুর্ঘটনা ঘটার পরে যে তদন্তকার্য চালানো হয়, তাতে আপনার জেলার শ্রমিকদের আস্থা কি?” “না; তাদের আস্থা নেই। (নং ৩৬০ )। “কেন নেই?” “প্রধানত এই কারণে আস্থা থাকে না যে, স্বাদের এই কাজের জন্য সাধারণত মনোনীত করা হয়, খনি বা এ-জাতীয় কোনো কিছু সম্পর্কে তার কিছুই জানেন না।” “শ্রমিকদের কি জুরিতে ডাকা হয় না?” আমি যতদূর জানি, কখনো সাক্ষী হিসাবে ডাকা হয় না।” “সাধারণতঃ কাদের এই সব জুরিতে ডাকা হয়?” “ডাকা হয় সাধারণতঃ এলাকার ব্যবসায়ীদের তাদের যা অবস্থান তাতে অনেক সময়েই তারা নিয়োগ কর্তাদের ……. কর্মশালা-মালিকদের ……. প্রভাধীনে কাজ করতে বাধ্য হয়। তারা সাধারণত এমন ধরনের মানুষ, যাদের কোনো জ্ঞান নেই, এবং তাদের সামনে যেসব সাক্ষীদের হাজির করা হয় তাদের কথা বার্তা কিংবা যেসব শব্দ তারা ব্যবহার করে তা তারা কদাচিৎ বুঝতে পারে।” “আপনারা কি চান যে জুরি এমন লোক নিয়ে গঠিত হোক যারা খনির কাজে নিযুক্ত চিলেন?” “হ্যা, অংশত তাই চাই।… শ্রমিকেরা মনে করে যে সাক্ষ্য-প্রমাণ যা হাজির করা হয়, বোনারের সাধারণত তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না।” (নং ৩৬১, ৩৬৪, ৩৬৬, ৩৬৮, ৩৭১, ৩৭৫)। “জুরি ডাকবার একটা মহৎ উদ্দেশ্যই হচ্ছে যে তা হবে নিরপেক্ষ; নয় কি?” “হ্যা, সেটাই হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।” “আপনি কি মনে করেন যে প্রধানত শ্রমিকদের দিয়েই যদি জুরি গঠিত হত, তা হলে তা হত পক্ষপাতশূন্য?“আমি এমন কোনো উদ্দেশ্য দেখিনা যার বশে শ্রমিকের পক্ষপাতী হয়ে কাজ করত। …একটা খনির কাজকর্ম কিভাবে চলে, সে সম্পর্কে স্বভাবতই তাদের ভাল জ্ঞান থাকে।” “আপনি মনে করেন না যে, শ্রমিকদের পক্ষে একটা প্রবণতা থাকবে অন্যায় ভাবে কঠোর রায় দেবার?” “না, আমি মনে করি ন।” (নং ৩৭৮, ৩৭৯, ৩৮০ )।
৫. মিথ্যা ওজন ও পরিমাপঃ
শ্রমিকেরা দাবি করে যে, তাদের মজুরি পাক্ষিক হিসাবে না দিয়ে সাপ্তাহিক হিসাবে দেয়া হোক এবং টবগুলির ভিতরকার জিনিসের ঘন ক্ষেত্র অনুসারে না দিয়ে ওজন অনুসারে দেওয়া হোক; তারা জাল বাটখারা দিয়ে মিথ্যা ওজনের বিরুদ্ধেও প্রতিবিধানমূলক ব্যবস্থা দাবি করে। (নং ১০৭১) “যদি টবগুলি জুয়াচুরি করে বাড়ানো হয়, তা হলে ১৪ দিনের নোটিশ দিয়েই তো কেউ কাজ বন্ধ করে দিতে পারে?” “কিন্তু সে যেখানেই যাবে, সেখানে দেখবে সেই একই জুয়াচুরি।” (নং ১০৭১), “কিন্তু যেখানে ঐ অন্যায় করা হচ্ছে, তো সে ছেড়ে যেতে পারে?” “এটা সর্বব্যাপক, যেখানেই সে যাক, সেখানেই তাকে এটা মেনে নিতে হবে। (নং ১০৭২), “১৪ দিনের নোটিশ দিয়েই কি কেউ ছেড়ে যেতে পারে? “হঁ্যা, পারে।” (নং ১০৭৩)। এবং তবু তারা খুশি নয় !
৬. খনি পরিদর্শনঃ
বিস্ফোরণের ফলে হতাহত হওয়াই শ্রমিকের একমাত্র দুর্ভোগ নয়। (নং ২৩৪ ) “আমাদের লোকেরা কোলিয়ারিগুলির হাওয়া-চলাচল ব্যবস্থার দুরবস্থা সম্পকেও তীব্র অভিযোগ জানায়। হাওয়া চলাচল ব্যবস্থা এত খারাপ যে শ্বাস-প্রশ্বাসও কষ্টকর বোধ হয়; তাদের কাজের সঙ্গে কিছু কাল যুক্ত থাকার পরে তারা যে-কোনো রকমের কর্ম-নিয়োগের পক্ষে অচল হয়ে পড়ে; বাস্তবিক পক্ষে, খনির যে-অংশে আমি কাজ করছি, ঠিক সেই অংশটিতেই, লোকের বাধ্য সেই কারণেই তাদের কাজ ছেড়ে দিতে। সেখানে কোনো বিস্ফোরক গ্যাস না থাকা সত্বেও কেবল হাওয়া-চলাচলের অব্যবস্থার জন্য তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জন কয়েক সপ্তাহ ধরে বেকার অবস্থায় হয়েছে। প্রধান প্রধান যাতায়াত-পথে সাধারণত প্রচুর পরিমাণ বাতাস থাকে কিন্তু যেখানে মানুষদের কাজ করতে হয় সেখানে তা নিয়ে যাবার জন্য কোনো চেষ্টাই কম হয় না।” “আপনার পরিদর্শকের কাছে আবেদন করেন না কেন?” “সত্য কথা বলতে কি, এমন অনেকেই আছে যারা এ ব্যাপারে ভয় পায়; পরিদর্শকের কাছে দরখাস্ত করার ফলে বলি হয়েছে এবং চাকরী থেকে বরখাস্ত হয়েছে, এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে।” “কেন, অভিযোগ জানানোর জন্য সে কি দাগী হয়ে যায়? সে কি অন্য খনিতে কাজ পেতে অসুবিধা বোধ “হ্যা। আপনি কি মনে করেন যে আইনের সংস্থানগুলি মানা হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করার জন্য আপনার অঞ্চলের খনিগুলি পরিদর্শনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে?” “না, পরিদর্শন আদৌ কখনো হয় না:…..৭ বছর আগে একবার একজন পরিদর্শক খনিগর্ভে নেমেছিলেন; এবং তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এইভাবেই চলছে। ……আমি যে জেলায় কাজ করি, সেখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক পরিদর্শকও নেই। আমাদের আছেন একজন বৃদ্ধ পরিদর্শক, যার বয়স ৭০ বছরের উপরে এবং যার পরিদর্শন করার কথা ১৩০টিরও বেশি খনি।” “আপনারা কি চান যে উপ-পরিদর্শকদের একটা শ্রেণীও থাকে?” “হ্যা।” (নং ২৩৪, ২৪১, ২০১, ২৫৪, ২৭৪, ২৭৫, ৫৫ ৪, ২৭৬, ১৯৩)। “কিন্তু আপনি কি মনে করেন সরকারের পক্ষে এমন এক পরিদর্শকবাহিনী পোষণ কর সব যারা আপনার যা যা চান, তার সব কিছুই করবেন অথচ লোকেরা তাঁদের কোন তথ্য যোগাবে না?” “না, আমার মনে হয়, সেটা হবে প্রায় অসম্ভব। এটা বাঞ্ছনীয় যে, পরিদর্শকেরা একটু ঘন ঘন আসুন।’ “হ্যাঁ, এবং ডেকে পাঠাবার আগেই।” (নং ২৮০, ২৭৭)। “আপনি কি মনে করেন যে পরিদর্শকদের এত ঘন ঘন পরিদর্শনের ফলে বায়ু-চলাচলের সুব্যবস্থার দায়িত্ব।। কোলিয়ারি-মালিকদের কাধ থেকে সরে গিয়ে বর্তাবে সরকারি কর্মচারীদের কাঁধে?” “না, আমি তা মনে করিনা; আমি মনে করি, ইতিপূর্বেই যেসব আইন তৈরি হয়ে আছে সেগুলিকেই কার্যকরী করা তারা তাদের কর্তব্য হিসাবে গ্রহণ করবেন।। নং ২৮৫)। যখন আপনি উপ-পরিদর্শক নিয়োগের কথা বলেন, তখন কি আপনি বোঝাতে চান যে তাঁদের বেতন হবে কম এবং তারা হবেন অপকৃষ্ট মাপের কর্মচারী?” আপনি যদি উৎকৃষ্ট লোক পান, তা হলে আমি অপকৃষ্ট লোক চাইব কেন?” নং ২৫৪ )। “আপনি কি কেবল আরো পরিদর্শক চান, নাকি চান পরিদর্শক হিসাবে নিচু মানের লোক?” “আমি চাই এমন লোক, যিনি কোলিয়ারিগুলিতে কড়া নেড়ে নেড়ে ঘুরবেন এবং দেখবেন সব কিছু ঠিক চলছে কিনা; চাই এমন মানুষ যে নিজের ভয়ে ভীত নয়।” (নং ১৯৫) “নিচু মানের পরিদর্শক নিয়োগের জন্য আপনার যে অভিলাষ, তা যদি পূরণ করা হয়, তা হলে আপনি কি মনে করবেন না যে কুশলতার অভাব ঘটবে?” “আমি তা মনে করি না, আমি মনে করি, সরকার সেদিকে নজর দেবে এবং যোগ্য লোককে সেই পদে নিয়োগ করবে।” (নং ২৯৭)। এই ধরনের পরীক্ষা শেষ পর্যন্ত কমিটির চেয়ারম্যানের কাছেও বাড়াবাডি বলে মনে হয় এবং তিনি বাধা দিয়ে মন্তব্য করেন, “আপনি এমন এক ক্লাস মানুষ চান, যারা খানর সমস্ত খুটিনাটি ব্যাপার দেখাশোনা করবেন এবং প্রতি কোণে ও রন্ধ্রে প্রবেশ করবেন এবং আসল তথ্য সম্পর্কে অবহিত হবেন। তাঁর প্রধান পরিদর্শকের কাছে রিপোর্ট করবেন, যিনি তার বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে প্রয়োগ করবেন তাদের দ্বারা উপস্থাপিত তথ্যগুলি অনুধাবনে?” (নং ২৯৮, ২৯৯ ! “খনির এইসব পুরনো কর্মক্ষেত্রগুলিতেও যদি বায়ু-চলাচলের সুব্যবস্থা করতে হয়, তা হলে কি বিপুল পরিমাণ ব্যয়ের প্রয়োজন হবে না?” “হ্যা, ব্যয় হয়তো হবে, কিন্তু তাতে জীবনও রক্ষা পাবে।” (নং ৫৩১ ) ১৮৬৫ সালে আইনের ১৭তম অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে জনৈক কর্মরত খশ্রমিক বলেন, “এখন যদি পরিদর্শক কোন খনির একটি অংশকে কাজের জন্য অনুপযুক্ত বলে দেখেন, তা হলে তাকে খনি-মালিক ও স্বরাষ্ট্রসচিবকে রিপোর্ট করতে হয়। তা করার পরে, মালিককে ২০ দিনের সময় দেওয়া হয় ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য; ২০ দিন পার হয়ে গেলে তার অধিকার থাকে খনিতে কোনো পরিবর্তন সাধনে অস্বীকার করার; কিন্তু যখন সে অস্বীকার করে, তখন তা তাকে লিখতে হয় স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে এবং সেই সঙ্গে পাঠাতে হয় তার মনোনীত পাঁচজন ইঞ্জিনিয়ারের নাম, যাদের মধ্য থেকে স্বরাষ্ট্রসচিব নিযুক্ত করেন একজনকে, আমার মনে হয় সালিশ হিসাবে কিংবা নিযুক্ত করেন একাধিক সালিশকে, সুতরাং সে ক্ষেত্রে আমরা মনে করি যে খনির মালিক কার্যত নিজেই তার সালিশদের নিয়োগ করে।” ( নং ৫৮১)। বুর্জোয়া পরীক্ষক, যিনি নিজেও একজন খনি-মালিক। “কিন্তু এটা কি নিছক অনুমান-ভিত্তিক আপত্তি নয়।” (নং ৫৮৬) “তাহলে, খনি ইঞ্জিনিয়ায়ারদের সততা সম্পর্কে আপনার ধারণা খুবই দুর্ভাগ্যজনক?” “এটনিশ্চিত ভাবেই চরম অন্যায় ও সংস্কারদুষ্ট।” নং ৫৮৮। “খন-ইঞ্জিনিয়ারদের কি জনসমক্ষে একটা লোকমান্য চরিত্র নেই? এবং আপনি কি মনে করেন না যে, আপনি যেমন আশংকা করছেন তেমন পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত করা থেকে দঅনেক উর্ধে?” “আমি ঐ ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে এই ধনের প্রশ্নের জবাব দিতে চাই না। আমার বিশ্বাস, অনেক ক্ষেত্রেই তারা স্বতই পক্ষপাতদুষ্ট কাজ করবে এবং যেখানে মানুষের বন বিপ:, সেখানে তা করার ক্ষমতা তাদের হাতে থাকা উচিৎ নয়।” ( নং ৫৮৯) এই একই বুর্জোয়া ব্যক্তিটি কিন্তু এই প্রশ্নটি করতে লজ্জা বোধ করেন না! “আপনি কি মনে করেন যে একটা বিস্ফোরণ ঘটলে খনি-মালিকেরও ক্ষতি সহ করতে হয়। সর্বশেষে, “সরকারকে ডেকে না এনে আপনারা, ল্যাংকাশায়ারের শ্রমিকের, আপনার কি পারেন না আপনাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষ, করতে?” “না”। (নং ১০৪২)
১৮৬৫ সালে ইংল্যাণ্ডে কয়লাখনি ছিল ৩,২১৭টি এবং পরিদর্শক ছিলেন ১২ জন। ইয়র্কশায়ারের জনৈক খনি-মালিক নিজেই হিসাব করেছেন ( ‘টাইমস’, ২৬শে জানুয়ারি, ১৮৬৭), এক দিকে তাদের অফিসের কাজ করে, যা তাদের গোটা সময় টাকেই নিয়ে নেয়, একজন পরিদর্শকের পক্ষে প্রতি দশ বছরে একবার করে একটি খান পরিদর্শন করা সম্ভব হয়। গত দশ বছরে যে সংখ্যায় ও ব্যাপকতায় ( অনেক ক্ষেত্রে ২০০-৩০০ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে ‘ উভয়তই বিস্ফোরণ ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেছে, তাতে আশ্চর্যের কারণ নেই। এইগুলিই হচ্ছে “অবাধ ধন উৎপাদনের সৌন্দর্য।* [* এই বাক্যটি ৪র্থ জার্মান সংস্করণের সশে মিলিয়ে যুক্ত করা হয়েছে –সম্পাদক ইং সংস্করণ।]
১৮৭২ সালে প্রণীত অত্যন্ত টিপূর্ণ আইনটিই সর্বপ্রথম খনিতে নিযুক্ত শিশুদের কাজের ঘণ্ট, নয়ন্ত্রণ করে এবং তথাকথিত দুর্ঘটনার জন্য খনিজ-আহণকারী ধনকে এবং খানর স্বত্বাধিকারী ভূস্বামীকে, কিছুটা পরিমাণে দায়ী বলে ঘোষণা করে।
শিশু, কিশোর-কিশোরী ও মহিলাদের কৃষিকর্মে নিয়োগ সম্পর্গে ১৮৬৭ সালে নিযুক্ত রাজকীয় কমিশন খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কৃষিকর্মের ক্ষেত্রে কারখানা আইন, কিছুটা সংশোধিত আকারে, প্রয়োগের চেষ্টা কয়েকবার হয়েছে কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। যে ব্যাপারটির দিকে আমি এখানে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই, তা হল ঐ নীতিসমূহের সর্বব্যাপক প্রয়োগের অনুকূলে একটি অপ্রতিরোধ্য প্রবণতার অস্তিত্ব।
যখন শ্রমিক শ্রেণীর মানসিক ও শারীরিক উভয়বিধ নিরাপত্তা বিধানের প্রয়োজনে সমস্ত বৃত্তিতে কারখানা-আইনের সম্প্রসারণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে, তখন অন্যদিকে, যেমন আমরা আগেই দেখেছি, ঐ সম্প্রসারণই আবার বহুসংখ্যক বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র শিল্পের বৃহদায়তনে পরিচালিত স্বল্পসংখ্যক সংযোজিত শিল্পে রূপান্তরণের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। এইভাবে তা মূলধনের কেন্দ্রীভবন ও কাখোনা-ব্যবস্থা, একান্ত প্রাধান্য অর্জনকে ত্বরিতয়িত করে। তা পুরাতন ও অতিক্রান্তিকালীন উভয় ধরনের রূপকেই ধ্বংস করে দেয়, যার নেপথ্যে মূলধনের রাজত্ব এখনো অশত প্রচ্ছন্ন; এবং তার স্থলে অভিষিক্ত করে মূলধনের প্রত্যক্ষ আধিপত্যকে; কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তা আবার নিজের আধিপত্যের পথে বিরোধিতাকে সর্বব্যাপক করে তোলে। যখন তা, প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা কর্মশালায় অভিন্নতা, নিয়মিত, শৃংখল ও মিতব্যয়িতা বলবং করে, তখন তা, শ্রম-দিনের দৈর্ঘ্যের আরোপিত সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনে যে প্রেরণা সঞ্চার করে, সেই প্রেরণাকে আরো প্রল ভাবে উদ্দীপিত করে এবং সমগ্রভাবে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের নৈরাজা, শ্রমের ব্রতী, শ্রমিকের সঙ্গে মেশিনারির ও তিযোগিতার বৃদ্ধিসাধন করে। ক্ষুদে ও ঘরোয়া শিল্পগুলকে ধ্বংস করে দিয়ে, তা “বাড়তি জনসংখ্যা”-র শেষ আশ্রয়গুলিকেও ধ্বংস করে দেয় এবং তারই সঙ্গে ধ্বংস করে দেয় গোটা সমাজ-ব্যবস্থার সর্বশেষ নিরাপত্তা-ব্যবস্থাটিকে, সেফটি ভালব’-টিকে।। উৎপাদন-প্রক্রিয়াগুলির অস্থাবলীকে পণত করে তুলে এবং সংযোজন সাধন করে, তা ধণতান্ত্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব ও বৈরিতগুলিকেও আরো পরিণত করে তোলে এবং এইভ বে, নোতুন এক সমাজ গঠনের উপাদানসমূহসহ, পুরান ব্যবস্থাকে চুরমার করে দেবার প্রয়োজনীয় শক্তির সংস্থান করে।[৩০]
১. “শিশু নিমোগ কমিশন, পঞ্চম বিপোট”, পৃ ১৫, নং ৭২ ইত্যাদি
২. “রিপোর্ট ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ১২৭।
৩. পরীক্ষা করে পাওয়া গিয়েছে, একজন স্বাস্থ্যবান সাধারণ ব্যক্তির প্রত্যেকটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে প্রায় ২০ কিউবিক ইঞ্চি বায়ু পরিভুক্ত হয়। এভাবে ২৫ কিউবিক ইঞ্চি বায়ু ব্যবহার করে। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তি ২৪ ঘণ্টায় যে বায়ু টেনে নেয় তার পরিমাণ হচ্ছে ৭,২০,০০০ কিউবিক ইঞ্চি বা ৪১৬ কিউবিক ফুট। কিন্তু এটা পরিষ্কার, যে বায়ু একবার টেনে নেওয়া হয়েছে, তা প্রকৃতির বিপুল কর্মশালায় শোধিত হবার আগে আর একই উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে না। ভ্যালেন্টিন এবং ব্ৰনার-এর পরীক্ষা থেকে দেখা যায় যে, একজন স্বাস্থ্যবান মানুষ প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১,৩০০ কিউবিক ইঞ্চি কার্বনিক অ্যাসিড পরিত্যাগ করে; ২৪ ঘন্টায় ফুসফুস প্রায় ৮ আউন্স সলিড কার্বন নিঃসরণ করে। প্রত্যেকটি মানুষের চাই অন্তত ৮০০ কিউবিক ফুট।” (হাক্সলি)।
৪. ইংরেজ কারখানা আইন অনুসারে, মাতা-পিতা তাদের ১৪ বছরের কমবয়সী শিশুদের কারখানা-আইনের অন্তর্গত কারখানায় পাঠাতে পারে না, যদি সেই সময়ে তারা তাদের প্রাথমিক শিক্ষা নিতে অনুমতি না দেয়। ম্যানুফ্যাকচারারের দায়িত্ব এই আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাজ করা। কারখানা-শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং তা শ্রমের একটি শর্ত।” (“রিপোর্ট অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ১১১।)
৫. কারখানার শিশু ও নিঃস্ব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক শিক্ষার সঙ্গে দৈহিক ব্যায়াম (এবং বালকদের বেলায় ড্রিল) সংযুক্ত করার অতি সুবিধাজনক ফল সমূহ প্রসঙ্গে দেখুন “ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রােমোশন অব সোশ্যাল সাইন্স”-এর সপ্তম বার্ষিক কংগ্রেসে এন. ডবলু সিনিয়র-এর বক্তৃতা : “রিপোর্ট অব প্রসিডিংস ইত্যাদি”, লণ্ডন, ১৮৬৩, পৃঃ ৬৩, ৬৪ এবং সেই সঙ্গে কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ১১৮, ১১৯, ১২০, ১২৬ ইত্যাদি।
৬. “রিপোর্ট ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ১১৮। একজন সিলক-ম্যানুফ্যাকচারার সরল ভাবে শিশু নিয়োগ কমিশনার’-দের বলেন, আমি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, নৈপুণ্যসম্পন্ন কর্মী তৈরি করার সত্যিকার গুপ্তকথা হল শিশুকালে শিক্ষ। ও শ্রমের মধ্যে ঐক্যসাধন। অবশ্য, শ্রম যেন বেশি কঠোর, বিরক্তিকর বা অস্বাস্থ্যকর না হয়। এই ঐক্যসাধনের সুবিধা সম্পর্কে আমার কোনো সংশয় নেই। আমি চাই আমার নিজের সন্তানের। যদি তাদের লেখাপড়ায় বৈচিত্র্য সঞ্চারের জন্য কিছু কাজ ও কিছু খেলার সুযোগ পেত।” “শিশু নিয়োগ কমিশন, পঞ্চম রিপোর্ট, পৃঃ ৮২, নং ৩৬।)
৭. সিনিয়র, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দি প্রমেশন অব সোশ্যাল সাইন্স” এর সপ্তম বাৎসরিক কংগ্রেসে প্রদত্ত বক্তৃত, পৃঃ ৬৬। কেমন করে আধুনিক শিল্প, যখন তা একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌছেছে, তখন উৎপাদনের পদ্ধতিতে এবং উৎপাদনের সামাজিক অবস্থায় তা যে বিপ্লব ঘটায়, তার দ্বারা মানুষের মনকেও বিপ্লবায়িত করে, তা সুস্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় যদি ১৮৬৩ সালে প্রদত্ত সিনিয়র-এর বক্তৃতাটির সঙ্গে ১৮৩৩ সালের কারখানা আইনের বিরুদ্ধে তার শ্লেষাত্মক আক্রমণের তুলনা করা যায় কিংবা যদি উল্লিখিত কংগ্রেসের মতামতসমূহের সঙ্গে এই ঘটনাটির তুলনা করা য; যে, ইংল্যাণ্ডের কয়েকটি মফস্বল অঞ্চলে গরিব মাতা-পিতার তাদের শিশুদের শিক্ষ: দিতে চাইলে তাদের ওপরে নেমে আসে অনাহারে মৃত্যুবরণের দণ্ড। যেন, মিঃ স্মেল সমারসেটশায়ারে এটাকে একটা মামুলি ঘটনা বলে বর্ণনা করেছেন যে, যখন একজন গরিব মানুষ প্যারিশ থেকে ত্রাণসামগ্ৰী চায়, তখন তাকে তার শিশুদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনতে হয়। মিঃ উলারটন নামে ফেলটহাম-এর ধর্মযাজকও এমন সব দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছেন, যে কয়েকটি পরিবারকে সম সাহয্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, “কেননা তাদের শিশুদের স্কুলে পাঠাবেই।”
৮. যেখানেই মনুষ্য-চালিত হশিল্প-যন্ত্র যান্ত্রিক শক্তি-চালিত যন্ত্রের সঙ্গে প্রতি যেগিত করে, সেখানেই যে-শ্রমিক তাকে চালায় তার ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়। প্রথমে ২.-চালিত ইঞ্জি, তার স্থান নেয়, পরে সে অবশ্যই বাম্প-চালিত ইঞ্জিনটির স্থান নেবে। কাজে কাজেই, উদ্বেগ এবং ব্যয়িত শ্রমের পরিমাণ হয় দানবিক, এবং বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে যায়। এই নির্যাতনের বলি হয়। যেমন কমিশনারদের মধ্যে একজন ১৫ লজ, কভেন্টি, এব, তার আশেপাশে বিন-লুম চালনায় নিযুক্ত ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী বালকদের দেখেছিলেন—ছোট ছোট মেশিন চালনায় নিযুক্ত অরে। অল্পবয়সী শিশুদের কথা না হয় নাই উল্লেখ করা হল : “এটা একটা অসাধারণ ব্লজনক কাজ। বালকটি কেবল বাষ্প-শক্তির বিকল্প মাত্র।” (“শিশু নিয়োগ কমিশন, পঞ্চ রিপোট, ১৮৬৬, পৃঃ ১১৪, নোট ৬)। সরকারি রিপোর্ট যাকে বলা হয়েছে “গোলামী ব্যবস্থা” তার মারাত্মক ফলগুলি সম্পর্কে দেখুন : ঐ, পৃঃ ১১৪ ইত্যদি।
৯. “শিশু নিয়োগ কমিশন, পঞ্চম রিপোর্ট”, পৃঃ ৩, নং ২৪।
১০. “শিশু নিয়োগ কমিশন, পঞ্চম রিপোর্ট”, পৃঃ ৭, নং ৬০।।
১১. বেশি বছর আগে নয়, স্কটল্যাণ্ডের হাইল্যাণ্ডস-এর কিছু অংশে, প্রত্যেক চাষী তার নিজের ‘ট্যান’-করা চামড়া দিয়ে নিজের জুতো তৈরি করে নিত। অনেক খামার কুটিরবাসী মেষপালক তাদের স্ত্রী ও শিশুদের নিয়ে এমন জামাকাপড় পরে গাজায় যেত যা তৈরি করতে তাদের নিজেদের ছাড়া আর কারো হাতের ছোঁয়া লাগেনি। এই সব তৈরি করতে কেবল সুচ, অঙ্গুষ্ঠান এবং কয়েকটি লোহার সরঞ্জাম ছাড়া আর কিছুই প্রায় তারা ক্রয় করত না। এমন কি রঙও মেয়েরা নিষ্কর্ষণ করে অনত গাছপালা, ঝোপঝাড় থেকে (ডুগান্ড স্টুয়ার্ট : “ওয়ার্কস”, হামিলটন সংস্করণ, অষ্টম খণ্ড, পৃঃ ৩২৭-৩২৮)।
১২. এতিয়েনে বইলো-র “Livre des meticrs” নামক বিখ্যাত গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই যে, একজন ঠিক-মজুর মালিকদের মধ্যে গৃহীত হলে তাকে শপথ করতে হত ভাইয়ের মত ভালবাসা দিয়ে তাকে সম-ব্যবসায়ীদের ভালবাসতে, তাদের নিজ নিজ ব্যবসায়ে তাদের সাহায্য করতে, ব্যবসায়ের গুপ্ততথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ না করতে এবং, তা ছাড়া অন্যান্য ব্যবসায়ীদের পণ্যসামগ্রীতে এটি দেখিয়ে ক্রেতাদের মনোযোগ নিজের সামগ্রীর প্রতি আকৃষ্ট না করতে।
১৩. উৎপাদনের হাতিয়ারসমূহে এবং সেই সঙ্গে, উৎপাদনের সম্পর্ক এবং সমস্ত সামাজিক সম্পর্কসমূহে ক্রমাগত বিপ্লব না ঘটিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণী অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না। বিপরীত পক্ষে, পূর্ববর্তী সময় শিল্প-শ্রেণীর অস্তিত্ব রক্ষার প্রথম শর্তই ছিল উৎপাদনের পুরনো পদ্ধতিগুলিকে অপরিবর্তিতভাবে সংরক্ষিত করা। উৎপাদনে নিরন্তর বিপ্লব সাধন, সমস্ত সামাজিক অবস্থায় অব্যাহত অস্থিতিশীলতা, চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা বুর্জোয়া যুগকে পূর্ববর্তী সকল যুগ থেকে বিশিষ্টতা দান করে, সমস্ত স্থানু, শিলীভূত সম্পর্কসমূহ তাদের প্রাচীন ও পবিত্র সংস্কারগুলিসহ ভেসে যায়; নবগঠিত সম্পর্কসমূহ সংযত হবার আগেই সেকেলে হয়ে যায়। যা কিছু দৃঢ়, বাতাসে উবে যায়; যা কিছু শুচি, অশুচি হয়ে যায় এবং মানুষ, সর্বশেষে, সুস্থিত বিচার-বুদ্ধি নিয়ে তার জীবনের বাস্তব অবস্থাবলীও তার স্বজাতির সঙ্গে তার সম্পন্সমূহের মুখোমুখি হতে পারে।”; ‘ম্যানিফেস্টো অব দি কমিউনিস্ট পার্টি’-এফ, এঙ্গেলস-এর কার্ল মার্ক, ১৮৪৮, পৃঃ ৫}।
১৪. “তুমি কেড়ে লও আমার জীবন,
যখন তুমি কেড়ে লও সেই সব উপায়,
যা দিয়ে আমি করি জীবন-ধারণ।”—শেক্সপিয়ার
১৫. স্যান ফ্রান্সিকো থেকে ফিরে একজন ফরাসী শ্রমিক লেখেন : “আমি কখনো বিশ্বাস করতে পারতাম না যে ক্যালিফোর্নিয়ায় আমাকে যত রকম কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল, তত রকম কাজ আমি করতে সক্ষম। আমার দৃঢ় ধারণা ছিল ছাপার কাজ ছাড়া আমি আর কোনো কাজের নই। একবার এই ভাগ্যান্বেষীদের জগতে গিয়ে, যার। তাদের সার্টের মতই ঝটপট পেশা বদল করে, আমিও তাদের মত হয়ে গেলাম। খনির কাজে মজুরি তেমন ভাল না হওয়ায়, আমি খনি ছেড়ে শহরে গেলাম। সেখানে গিয়ে আমি পর-পর টাইপোগ্রাফার, স্লেটার, প্লাম্বার ইত্যাদি হলাম। এই ভাবে যখন দেখলাম আমি সব কাজেরই মোগ্য, তখন আমি আর একটা জড়পিণ্ড রইলাম না, আমি নিজেকে বোধ করলাম মানুষ হিসাবে। (এ কর্বন : “De Penseignement professionnel”, 2eme ed. p. 50. )
১৬. রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের ইতিহাসে সত্যই একটি বিস্ময় জন বেলা তর রাষ্ট্রীয় অর্থ তত্তের ইতিহাস নামক গ্রন্থে সতেরো শতকের শেষে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে দেখিয়েছিলেন। শিক্ষা ও শ্রম-বিভাগের বর্তমান ব্যবস্থার অবসান ঘটানে। কত প্রয়োজন যার ফলে সমাজের একদিকে দেখা দেয় অস্বাভাবিক স্ফীতি, অন্যদিকে অস্বাভাবিক ক্ষয়। অন্যান্য কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন : অলস শিক্ষা অলসতার শিক্ষার চেয়ে ভাল নয় দৈহিক শ্রম হল বিধাতার স্বাভাবিক আদিম প্রতিষ্টান খাদ্য যেমন দেহের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন, শ্রম তেমন তাকে সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজন কেননা, মানুষ আরামে যা সঞ্চয় করে, ব্যারামে তা হারায় জীবনের প্রদীপে শ্রম তেল যোগায়, চিন্ত। তাকে প্রজ্জ্বলিত করে : একটা বালখিল্যসুলভ বুদ্ধিহীন ব্যস্ততা”। “বেসডাউ’-দের এবং তাদের আধুনিক অনুকারীদের প্রতি আগে থেকেই হুশিয়ারি) “শিশুদের মনকে করে রাখে বুদ্ধিহীন।” (“প্রপোজালস ফর রেইজিং এ কলেজ অব ইণ্ডাষ্ট্রি অব অল ইউজফুল ট্রেডস অ্যাণ্ড হ’জব্যাণ্ডি, ১৬৯৬, পৃঃ ১২, ১৪, ১৮।
১৭. এই ধরনের শ্রম প্রধানতঃ চলে ছোট ছোট কর্মশালায়, যেমন আর দেখেছি লেস-তৈরি ও খড়ের বিনুনি বঁধার শিল্পে, শেফিল্ড, বার্মিংহাম ইত্যাদি জায়গার ধাতু-শিল্প-গুলিতে আরো বিস্তারিতভাবে দেখানো যায়।
১৮. “শিশু নিয়োগ কমিশ, পঞ্চম রিপোর্ট”, পৃঃ ২৫, নং ১৬২ এবং দ্বিতীয় রিপোর্ট পৃ: ৩৮, নং ১৮৫, ২৮৯ পৃঃ ২৫, ১৫, নং ১৯১।
১৯. “কারখানা-শ্রম ঘরোয়া শ্রমের মতই বিশুদ্ধ ও সরল হতে পারে।” (“রিপোর্টস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ১২৯)।
২০. “রিপোর্টস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ২৭-৩২।
২১. “রিপোর্ট : ফ্যাক্টরিজ”-এ অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে।
২২. “শ নিয়োগ কমিশন, পঞ্চম রিপোর্ট”, পৃঃ ১৩, নং ৩৫।
২৩. ঐ পৃঃ ১, নং ২৮।
২৪. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ২৫, নং ১৬৫-১৬৭, ক্ষুদ্রায়তন শিল্পের তুলনায় বৃহদায়তন শিল্পের সুবিধা সম্পর্কে ‘শিশু নিয়োগ কমিশন, তৃতীয় রিপোর্ট’, পৃঃ ১৩, নং ১৭১, পৃঃ ২৫, নং ১২১, পৃঃ ২৬, নং ১২৫, পৃঃ ২৭, নং ১৪০ দ্রষ্টব্য।
২৫. উক্ত আইনের অধীনে আনবার জন্য যেসব শিল্পের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে : লেস তৈরি, মোজ-বোনা, খড়-বিনুনি, বিভিন্ন প্রকারের পরিধেয় প্রস্তুত, কৃত্রিম ফুল তৈরি, জুতো তৈরি, টুপি তৈরি, দানা বানানো, দজির কাজ, ব্লাস্ট ফানেল থেকে সুচ পর্যন্ত সমস্ত ধাতুর কাজ, ইত্যাদি, কাগজ-কল, গ্লাস-তৈরী, তামাক কারখানা ভারতীয় রবার তৈরী, বিনুনী কাজ (কাপড় বোনার জন্য ) হাতে গালিচা বোনা, ছাতা তৈরি, প্যারাসল তৈরি, টফু ও নাটাই তৈরি, টাইপ-প্রেসে মুদ্রণ, বই বাঁধানো, মণিহারি দ্রব্যাদি তৈরি, কাগজের থলে, কাড, রঙ্গিন কাগজ ইত্যাদি সহ ) দডি তৈরি, অলংকার নির্মাণ, ইট তৈরি, হাতে রেশম উৎপাদন, মোমের ঝাড়লণ্ঠন তৈরি, লবণ তৈরি, সিমেন্ট কারখানা, চিনি শোধনাগার, বিস্কুট বানানো, কাঠের বিভিন্ন শিল্প ইত্যাদি।
২৬. “শিশু নিয়োগ কমিশন, পঞ্চম বিপোর্ট’, পৃঃ ২৫, নং ১৬৯।
২৭. কারখানা আইন বিস’র আইন পাশ হয় ১৮৬৭ সালের ১২ই আগস্ট-এর আওতায় আসে সমস্ত ঢালাই কারখানা, কামর-শালা, ধাতু-ম্যানুফ্যাক্টরি, কাচ কারখানা, কাগজ মিল, রাবার কারখানা, তমা ম্যানুফ্যাক্টরি, ছাপাখানা, বই-বাই শালা এবং ৫ জনের বেশি লোক নিয়োগ করে এমন সমস্ত কাশাল; এই আইনগুলির ব্যাপারে পরবর্তী খণ্ডে আমি আবার ফিরে আসব।
২৮. সিনিয়র, ‘সোশ্যাল সাইন্স কংগ্রেস’, পৃঃ ৫৫-৫৮।
২৯. এই স্টাফের “কর্মীবৃন্দের মধ্যে পড়ে ২ জন পরিদর্শক, ২ জন সহকারী পরিদর্শক এবং ৪১ জন উপ-পরিদর্শক। ১৮৭১ সালে নিযুক্ত হয়েছিল ৮ জন অতিরিক্ত উপ-পরিদর্শক, ১৮৭১-৭২ সালে ইংল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড ও আয়ার্ল্যাণ্ডে এই আইন প্রয়োগ করতে মোট খরচ হয়েছিল £২৫৩৫৭-এরও বেশি, যার মধ্যে দোষী মালিকদের বিরুদ্ধে মামলার খরচও ধরা হয়েছে।
৩০. সমবায় ফ্যাক্টরি এবং স্টোর-এর প্রতিষ্টাতা রবার্ট ওয়েন রূপান্তর সাধনের এই বিক্ষিপ্ত উপাদানগুলির প্রভাব সম্পর্কে তাঁর অনুগামীদের ভ্রান্ত ধারণাসমূহের শরিক ছিলেন ন্য-এ কথা আগেই বলা হয়েছে; তিনি কারখান:-ব্যবস্থাকে কেবল কার্যক্ষেত্রেই তার পরীক্ষ:-নিরক্ষার একমাত্র ভিত্তি হিসাবেই গ্রহণ করেন নি, সেই সঙ্গে তত্ত্ব ক্ষেত্রেও এই ব্যবস্থাকে ঘোষণা করেছিলেন সমাজ-বিপ্লবের সূচনা-স্থল হিসাবে। লিডেন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হের ভিসারিং-এর এ বিষয়ে সংশয় আছে বলে মনে হয়, যখন তিনি তার “Handbook van Praktiscle Staatshuishoudkunde, 1860-62”-তে, যাতে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে হাতুড়ে অর্থনীতির সমস্ত মামুলি উক্তি গুলির, তাতে তিনি কারখানা-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হস্তশিল্পকে প্রবল ভাবে সমর্থন করেন। (চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংযোজিত ) : “পরস্পর-বিরোধী কারখানা-আইন, কারখানা-আইন সম্প্রসারণ আইন এবং কর্মশালা আইনের মাধ্যমে ইংরেজ আইন প্রণেতারা পরস্পর-পরিপন্থী বিধি-বিধানের যে অদ্ভুত জট পাকিয়েছেন, সেগুলি শেষ পর্যন্ত অসহ্য হয়ে উঠল, এবং এই ভাবেই এই বিষয়টি সংক্রান্ত যাবতীয় আইন ১৮৭৮ সালের কারখানা ও কর্মশালা আইনে বিধিবদ্ধ কর; হল। অবশ্য, ইংল্যাণ্ডের এই শিল্প বি.ধর কোনো বিশদ সমালোচনা এখানে উপস্থিত করা যাবে না। নিচের মন্তব্য গুলকেই যথেষ্ট বলে ধরতে হবে। এই আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে :
১) কাপড়-কল : এখানে যা ছিল, প্রায় তাই আছে; ১০ বছরের বেশি বয়সের শিশুর দৈনিক ৫.৫ ঘণ্টা কিংবা, শনিবার ছুটি নিলে, দৈনিক ৬ ঘণ্টা কাজ করতে পারে; তরুণ-তরুণীর ৫ দিন ১৫ ঘণ্টা এবং শনিবা সর্বাধিক ৬.৫ ঘণ্টা কাজ করতে পারে।
(২) কাপড় কল ছাড়া অন্যান্য কারখানা। এখানে নিয়ম-কানুনগুলিকে আগের চেয়ে ১ নম্বরের নিয়ম-কানুনগুলির আরো কাছাকাছি আনা হয়েছে; কিন্তু এখনো এমন কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে, যেগুলি ধনিকদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে এবং যেগুলিকে কোন কোন ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র সচিবের বিশেষ অনুমতি-বলে সম্প্রসারিত করা যায়।
(৩) কর্মশালাগুলির সংজ্ঞা আগেকার আইনের মতই প্রায় রাখা হয়েছে। সেখানে নিযুক্ত শিশু, তরুণ এবং নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কর্মশালাগুলি কাপড়-কল ছাড়া অন্যান্য কারখানার অনুরূপ কিন্তু খুটিনাটির বেলায় শতগুলি শিথিল।
(৪) যেসব কর্মশালায় কোনো শিশু বা তরুণকে নিযুক্ত করা হয় না; কেবল ১৮ বছর বয়সের বেশি বয়সী পুরুষ ও নারীকেই নিযুক্ত কর হয়; এর। কিছুটা সহজতর শর্ত ভোগ করে।
(৫) ঘরোয়া কর্মশালা, যেখানে পারিবারিক বাসস্থানে কেবল পরিবারের সদস্যরাই নিযুক্ত থাকে : আরো বেশি নমনীয় নিয়ম-কানুন এবং সেই সঙ্গে এই নিয়ন্ত্রণ যে, মন্ত্রিসভার বিশেষ অনুমতি ছাড়, পরিদর্শক কেবল সেই ঘরগুলিতেই প্রবেশ করতে পারে, যেগুলি উপরন্তু নাসোর জন্যও ব্যবহার করা হয় না, এবং সর্বশেষে খড়-পাকানন, লেস ও দস্তানা বানানোর জন্য পরিবারের লোকদের অবাধ স্বাধীনতা। ১৮৭৭ সলের ২৩শে মার্চ তারিখে সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় কারখানা আইনটি সমেত এই আইনটি, এর সমস্ত দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও, এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঢের ভাল আইন। উক্ত সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনটির সঙ্গে এর একটি তুলনা বিশেষ কৌতূহল-উদ্দীপক, কারণ তাতে পরিষ্কার প্রকাশ পায় দুটি আইনগত পদ্ধতির গুণাগুণ –ইংল্যাণ্ডের ঐতিহাসিক” পদ্ধতি, অবস্থা-বিশেষে যার প্রয়োগ ঘটে, এবং ইউরোপ-ভূখণ্ডের পদ্ধতি, যার প্রতিষ্ঠা ফরাসী বিপ্লবের ঐতিহ্যের উপরে এবং যা তাকে করে আরো ব্যাপক। দুর্ভাগ্যক্রমে, উপযুক্ত সংখ্যক পরিদর্শন কর্মীর অভাবে, ইংল্যাণ্ডের বিধিটি কর্মশালায় প্রয়োগের ক্ষেত্রে এখন একটি কাগুজে দলিল মাত্র।
.
দশম পরিচ্ছেদ — আধুনিক শিল্প এবং কৃষিকার্য
কৃষিকর্মে এবং কৃষি-উৎপাদনকারীদের সামাজিক সম্পর্কসমূহে আধুনিক শিল্প যে বিপ্লব ঘটিয়েছে, তা নিয়ে পরে অনুসন্ধান করা হবে। এখানে আমরা কেবল পূর্বানুগমন হিসাবে কয়েকটি ফলাফল সম্পর্কে আভাস দেব। যদিও কারখানা-কর্মীদের উপরে মেশিনের ব্যবহার যে হানিকর শারীরিক প্রতিক্রিয়া ঘটায়, তার তুলনায় কৃষিতে মেশিনের ব্যবহার বহুলাংশে মুক্ত, তা হলেও কৃষি-শ্রমিকদের উৎখাত করে তাদের সেই স্থান দখলে তার তৎপরতা টের বেশি তীব্র অথচ তা পায় চের কম প্রতিবোধ, যা আমর। পরে সবিস্তারে আলোচনা করব। যেমন, কেজি ও সাফোক কাউন্টি-দুটিতে গত ২০ বছরে (১৮৬৮ সাল পর্যন্ত) কর্ষিত ভূমির এলাকা দারুণ ভাবে বেড়ে গিয়েছে, অথচ সেই একই সময়ে গ্রামীণ জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে-কেবল আপেক্ষিক ভাবেই নয়, অনাপপক্ষিক ভাবেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো পর্যন্ত কেবল দৃশ্যতই কৃষি-মেশিন শ্রমিকের স্থান গ্রহণ করে; অই ভাবে বলা যায়, এই মেশিন জোত-মালিককে সক্ষম করে একটি বৃহৎ এনাকে কষণ করতে, কিন্তু কার্যত নিযুক্ত শ্রমিকদের নির্বাসিত করে ন’। ১৮৬১ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে কৃষি-মেশিন ম্যানুফ্যাকচারের কাজে নযুক্ত ছল ১,৩-৪ জন শ্রমিক, যখন কৃষি-মেশিন ও বাম্প-ইঞ্জিন ব্যবহারে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা ১,২০৫ জনের বেশি ছিল না।
অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক শিল্পের ফল অধিকতর বৈপ্লবক, কেননা তা চাষীকে অর্থাৎ পুরোনো সমাজের দুর্গপ্রাচীর ধ্বংস করে দেয় এবং তার জায়গায় স্থাপন করে ম:ি-শ্রমককে! এইভাবে তা সামাজিক পরিবনের জন্য আগ্রহকে গ্রামে ও শহরে একই মাত্রায় নিয়ে আসে। কৃষির অবৈজ্ঞানিক ও প্রাচীন পন্থী পদ্ধতিগুলির পরিবর্তে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রবর্তন করে। কৃষি ও শিল্পের ম্যানুফ্যাকচারের মধ্যে শৈশবে যে-বন্ধন ছিল, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন তাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কিন্তু একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এক উচ্চতর সমন্বয়ের জন্য তা বাস্তব অবস্থাবলী তৈরি করে দেয় অর্থাৎ তাদের সাময়িক বিচ্ছেদের কালে তারা উভয়েই যে উৎকর্ষিত রূপ অর্জন করেছে সেই নবতর রূপের ভিত্তিতে উচ্চতর সমন্বয়। বিরাট বিরাট কেন্দ্রে জনসংখ্যাকে সমবেত করে এবং শহরবাসী জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন একদিকে সমাজের ঐতিহাসিক সঞ্চলক শক্তিকে (মোটিভ পাওয়ার’-কে) কেন্দ্রীভূত করে; অন্য দিকে, তা মানুষ ও মৃত্তিকার মধ্যে বস্তুর সঞ্চলনকে ব্যাহত করে অর্থাৎ মৃত্তিকার যেসব উপাদান মানুষ খাদ্য ও পরিধেয় হিসাবে পরিভোগ করে সেগুলিকে আর মৃত্তিকায় ফিরে আসতে দেয় না। সুতরাং তা মাটির চিরন্তন উর্বরতার আবশ্যিক শর্তগুলিকে লন করেএই একই কাজের দ্বারা, আধুনিক শিল্প একই সঙ্গে শহরের শ্রমিকের স্বাস্থ্য এবং গ্রামের শ্রমিকের বুদ্ধিজীবী। জীবনকে ধ্বংস করে।[১] কিন্তু সেই বস্তু-সঞ্চলনের জন্য প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা শর্তাবলীকে বিপর্যস্ত করে দেবার সঙ্গে সঙ্গে, তা আবার ঔদ্ধত্যভরে একটি প্রণালী হিসাবে তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায় সামাজিক উৎপাদনের একটি নিয়ামক বিধান হিসাবে এব” মানবজাতির পরিপূর্ণ বিকাশের পক্ষে উপযোগী এক রূপ হিসাবে। যেমন ম্যানুফ্যাকচা, তেমন কৃষিকর্মে, মূলধনের প্রাধানের অধীনে উৎপাদনের কপাষণের একই সঙ্গে অর্থ দাঁড়ায় উৎপাদনকারীর শহিদ-শোভন মৃত্যু; শ্রমের উপকরণ পরিণত হয় শ্রমিককে গোলাম করার, শোষণ করে এবং সর্বস্বান্ত করার হাতিয়ারে; শ্রম-প্রক্রিয়াসমূহের সামাজিক স’যোজন ও সংগঠন পরিণত হয় শ্রমিকের ব্যক্তিগত প্রাণশক্তি, স্বাধিকার ও স্বাধীনতাকে সবলে নিঃশেষিত করার একটি সংগঠিত ব্যবস্থায় ! বিরাট বিরাট এলাকায় বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবার দরুন গ্রামীণ শ্রমিকদের প্রতিবোধ ভেঙ্গে যায়, অন্য দিকে শহরের শ্রমিকদের কেন্দ্রীভবন বৃদ্ধি পায়। যেমন শহরের শিল্পগুলতে, তেমন আধুনিক কৃষিকর্মে শ্রমের যে বর্ধিত উৎপাদন শক্তি ও পরিমাণকে গতিমুক্ত করে দেওয়া হয়, তা ক্রয় করা হয় স্বয়ং শ্রমশক্তিকেই অনুর্বর ফেলে রাখা ও রোগে-ভোগে জীর্ণ করার বিনিময়ে। অধিকন্তু, ধনতান্ত্রিক কৃষিকর্মে সমস্ত অগ্রগতির মানেই হল কেবল শ্রমিককেই নয়, সেই সঙ্গে মৃত্তিকাকেও লুণ্ঠন করার কলা কৌশলের অগ্রগতি; একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মৃত্তিকার উর্বরতা বৃদ্ধিতে অগ্রগতির মানেই হল সেই উর্বতার চিরস্থায়ী উৎস সমূহের বিনাশ-সাধনের অগ্রগতি। মার্কিন যুক্তাষ্ট্রের মত যতই একটা দেশ আধুনিক শিল্পের বনিয়াদের উপরে বেশি বেশি করে তার বিকাশ-কাণ্ড শুরু করে, ততই তার সর্বনাশের প্রক্রিয়া আরো আরো দ্রুতগতি হয়।[২] অতএব, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন যে প্রযুক্তি বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটায় এবং বিবিধ প্রক্রিয়ার সংযোজনের মাধ্যমে একটি সামাজিক সমগ্রতা গড়ে তোলে, তা কেবল সম্পদের মূল উৎস দুটিকে নিঃশেষিত করার মাধ্যমেই সম্পাদন করে। সেই উৎস দুটি হল-মৃত্তিকা ও শ্রমিক।
————
১. আপনি জনসংখ্যাকে দুটি বিরোধী শিবিরে বিভক্ত করে দেন—অমার্জিত বর্বর এবং নপুংশক বামন। হায় ভগবান কৃষি ও বাণিজ্যিক স্বার্থে বিভক্ত একটি জাতি নিজেকে মনে করে সুস্থ-স্কি বলে ! কেবল তাই নয়, নিজেকে আখ্যাত করে আলোকদীপ্ত ও সুসভ্য বলে ! আর তকরে এই দানবীয় ও অস্বাভাবিক বিভাগ সত্ত্বেও নয়, তার কারণেই। ( ডেভিড আর্কুহার্ট, ফ্যামিলিয়ার ওয়ার্ডস”, ১৮৫৫, পৃঃ ১১৯)। এই অনুচ্ছেদটিতে একই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে সেই ধরনের সমালোচনার শক্তি ও দুর্বলতা, যা জানে কিভাবে বর্তমানকে নিন্দা করতে হয়, কিন্তু জানে না কিভাবে তাকে অনুধাবন করতে হয়।
২. দ্রষ্টব্য : লাইবিগ : “Die chemie in ihrer Anwendung auf Agri cultur und Physiologie”, 1862, GP Racon PCS “Einleitung in die Naturgesetze des Feldbaus, প্রথম খণ্ড। লাইবিগ-এর অন্যতম অবিনশ্বর কীতি হল প্রকৃতি বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক কৃষিকর্মের নঙর্থক অর্থাৎ ধ্বংসাত্মক দিকটিকে বিকশিত করা। কৃষিকর্মের ইতিহাসের তার সংক্ষিপ্ত বিবরণী, যদিও গুরুতর ভুলভ্রান্তি থেকে মুক্ত নয়, তবু তাতে আছে এখানে সেখানে আলোর ঝলক। এট। অবশ্য দুঃখজনক যে কিছু কিছু এলোমেলে। বক্তব্য তাঁর কাছ থেকে এসেছে, যেমন এই বক্তব্যটি : “আরো বেশি গুড়ো গুড়ো করে এবং আরো ঘন ঘন করে সচ্ছিদ্র মৃত্তিকার অন্তর্ভাগে বায়ু-চলাচল বৃদ্ধি করা যায় এবং আবহাওয়ার ক্রিয়াশীলতার দিকে উন্মুক্ত মৃত্তিকাপৃষ্ঠকে বর্ধিত ও নবীকৃত করা যায়। কিন্তু সহজেই চোখে পড়ে যে জমির বর্ধিত ফলন কখনো সেই জমিতে ব্যয়িত শ্রমের সঙ্গে আনুপাতিক হয়না; কিন্তু ত বৃদ্ধি পায় অনেক অল্পতর অনুপাতে। এই নিয়মটি, লাইবিগ বলেন, “প্রথম উপস্থাপিত করেন জন স্টুয়ার্ট মিল তার প্রিন্সিপল অব পলিটিক্যাল ইকনমি’ নামক গ্রন্থে ( প্রথম খণ্ড, পৃঃ ১৭।; তার উপস্থাপনা ছিল এইরকম : ‘নিযুক্ত শ্রমিক-সংখ্যার বৃদ্ধির অনুপাতে জমির ফলন বৃদ্ধি পায় হ্রাসমান হারে { রিকার্ডোর মতাবলম্বীদের দ্বারা প্রণীত একটি নিয়মকে মিল এখানে একটি ভ্রান্ত রূপে উপস্থিত করেছেন, কেননা যেহেতু নিযুক্ত শ্ৰমিকসংখ্যার হ্রাস’ ইংল্যাণ্ডে কৃষিকর্মের অগ্রগতির সঙ্গে সমান তাল রক্ষা করেছিল, সেই হেতু ইংল্যাণ্ডে আবিষ্কৃত ও প্রযুক্ত নিয়মটির সেই দেশে, সর্বক্ষেত্রে,
যোজ্য হতে পারেন। এটা হল কৃষি-শিল্পের সর্বজনীন নিয়ম। এট। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, কেননা মিল এই নিয়মের কারণটি সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন।” (লাইবিগ, ঐ, পৃঃ ১৪৩ ও ‘নোট’)। শ্রম’ কথাটি রাষ্ট্রীয় অর্থতবে যে-অর্থে ব্যবহৃত হয়, লাইবিগ সে অর্থ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস বুঝেছেন; ‘শ্রম’ কথাটির এই ভুল ব্যাখ্যা ছাড়াও, এটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, যে-তত্ত্বটি অ্যাডাম স্মিথের আমলে জেমস এণ্ডাসন প্রথম প্রকাশ করেছিলেন এবং যেটি উনিশ শতকের সূচনাকাল পর্যন্ত নানা রচনায় বারবার পুনরুল্লিখিত হয়, যে-তত্ত্বটি লেখা-চুরিতে ওস্তাদ সেই ম্যালথাস নামে ব্যক্তিটি ১৮১৫ সালে আত্মসাৎ করে ফেলেন, যে তত্ত্বটি ওয়েস্ট বিকশিত করেছিলেন এণ্ডার্সন থেকে স্বতন্ত্র ভাবে এবং একই সময়ে; যে তত্ত্বটিকে ১৮১৭ সালে রিকার্ডো সংযোজিত করেছিলেন মূল্যের সাধারণ তকটির বিকৃতি সাধন করেছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিলের জনক জেমস মিল এবং যে বহুল-প্রচলিত এবং এমনকি স্কুলের ছাত্রদের কাছেও পরিজ্ঞাত তত্ত্বটিকে সর্বশেষে জন স্টুয়ার্ট মিল ও অন্যান্যরা পুনরুৎপাদিত করেন একটা বদ্ধ মতবাদ হিসাবে-সেই তত্ত্বটির প্রথম প্রণেতা হিসাবে লাইবিগ নাম করবেন জন স্টুয়ার্ট মিলের! এটা অস্বীকার করা যায়না যে, জন স্টুয়ার্ট মিল সর্বক্ষেত্রে, তার উল্লেখযোগ্য কর্তৃত্বের জন্য প্রায় সমগ্র ভাবেই ঋণী এই ধরনের পারস্পরিক পৃষ্ঠ-কণ্ডুয়নের কাছে।