১৭. শ্রমশক্তির দামে এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যে আয়তনের পরিবর্তন

সপ্তদশ অধ্যায় — শ্রমশক্তির দামে এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যে আয়তনের পরির্তন

শ্রম-শক্তির মূল্য নির্ধারিত হয় জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যক সেই সব দ্রব্য সামগ্রীর মূল্যের দ্বারা, যেগুলি একজন গড় শ্রমিকের অভ্যাসগত ভাবে প্রয়োজন হয়। একটি নির্দিষ্ট সমাজের একটি নির্দিষ্ট যুগে এই অত্যাবশ্যক দুব্য-সামগ্রীর পরিমাণ কি তা পরিজ্ঞাত, এবং সেইজন্য তাকে একটি স্থির রাশি বলে গণ্য করা যায়। যা পরিবর্তিত হয়, তা হচ্ছে এই পরিমাণটির মূল্য। তা ছাড়া, আরো দুটি উপাদান আছে, যারা শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারণে অংশ নেয়। এক, সেই শক্তিকে বিকশিত করার জন্য ব্যয়, যে-ব্যয় পরিবর্তিত হয় উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে; অন্যটি, তার প্রকৃতিগত বিভিন্নতা—পুরুষ এবং নারী, শিশু এবং বয়স্কের শ্রম-শক্তির মধ্যে বিভিন্নতা। এই ধরনের শ্রমশক্তির নিয়োগ, যা আবার আবশ্যক হয় উৎপাদন পদ্ধতির প্রয়োজনে, তা শ্রমিকের পরিবার-পোষণের খরচে এবং বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকের শ্রম-শক্তি মূল্যে বিরাট পার্থক্য ঘটায়। কিন্তু এই দুটি উৎপাদনকেই নিম্নলিখিত পর্যালোচনা থেকে বাদ রাখা হচ্ছে।[১]

আমি ধরে নিচ্ছি, (১) পণ্য-দ্রব্যাদি বিক্রয় হয় তাদের নিজ নিজ মূল্যে; এবং (২) শ্রমশক্তির দাম মাঝে মাঝে তার মূল্যের চেয়ে উপরে ওঠে কিন্তু কখনো তার নীচে নামে না।

এটা ধরে নিয়ে আমরা দেখেছি যে উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়তন নির্ধারিত হয় তিনটি বিষয়ের দ্বারা : (১) শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য কিংবা শ্রমে বিস্তৃত আয়তন, (২) শ্রমের স্বাভাবিক তীব্রতা কিংবা তার নিবিড় আয়তন, যার দ্বারা একটি নির্দিষ্ট পৰিমাণ শ্রম একটি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যয়িত হয়; (৩) শ্রমের উৎপাদনশীলতা, যার দ্বারা একই পরিমাণ এম একটি নির্দিষ্ট সময়ে অপেক্ষাকৃত বেশি বা অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ উৎপাদন—যা নির্ভর করে উৎপাদনের অবস্থাবলী কতটা বিকাশ লাভ করেছে তার উপরে। এটা পরিষ্কার যে, অত্যন্ত বিভিন্ন ধরনের নানা সন্নিবেশ ঘটতে পারে, যেমন, তিনটি বিষয়ের মধ্যে একটি স্থির ও দুটি অ-স্থির কিংবা দুটি স্থির ও একটি অস্থির কিংবা তিনটিই যুগপৎ অস্থির। এবং এই সন্নিবেশ সমূহের সংখ্যা এই ঘটনার ফলে বধিত হয় যে, যখন এই তিনটি বিষয়ই যুগপৎ পরিবর্তিত হয়, তখন তাদের নিজ নিজ পরিবর্তনগুলির পরিমাণ ও গতিমুখ বিভিন্ন হতে পারে। নীচে আমরা কেবল প্রধান প্রধান সন্নিবেশগুলি নিয়েই আলোচনা করব।

১. শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য শ্রমের তীব্রতা স্থির ঃ শ্রমের উৎপাদনশীলতা অস্থির

এইগুলি ধরে নিলে, শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারিত হয় তিনটি নিয়মের দ্বারা :

(১) নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের একটি শ্রম-দিবস সব সময়ে একই পরিমাণ মূল্য সৃষ্টি করে। শ্রমের উৎপাদনশীলতা এবং, তার সঙ্গে, উৎপন্ন দ্রব্যের সমষ্টি এবং, প্রত্যেকটি একক পণ্যের দাম কিভাবে পরিবর্তিত হয়, তাতে কিছু যায় আসে না।

যদি ১২ ঘণ্টার একটি শ্রম-দিবসে উৎপাদিত মূল্য হয়, ধরা যাক, ৬ শিলিং, তা হলে যদিও উৎপন্ন দ্রব্যের সমষ্টি শ্রমের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে পরিবর্তিত হয়, তা হলে একমাত্র ফল হয় এই যে, ছয় শিলিং-এ প্রতিফলিত মূল্যটি একটি বেশিসংখ্যক বা অল্পসংখ্যক দ্রব্যে বিস্তৃতি লাভ করে।

(২) উদ্বৃত্ত-মূল্য এবং শ্রমশক্তির মূল্য বিপরীত দিকে পরিবর্তিত হয়। শ্রমের উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তন, তার বৃদ্ধি বা হ্রাস, শ্রমশক্তির মূল্যে বিপরীত দিকে, এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যে একই দিকে পরিবর্তন ঘটায়।

১২ ঘণ্টার একটি শ্রম-দিবস যে মূল্য সৃষ্টি করে তা একটি স্থির রাশি, ধরুন, ছয় শিলিং। এই স্থির রাশিটি দুটি মূল্যেরউদ্বৃত্ত-মূল্য এবং শ্রমশক্তির মূল্যের যোগফল; এই দ্বিতীয়টিকে অর্থাৎ শ্রমশক্তির মূল্যটিকে শ্রমিক তুল্যমূল্য দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে। এটা স্বতঃস্পষ্ট যে যদি একটি স্থির রাশি দুটি অংশ দিয়ে গঠিত হয়, তা হলে একটিকে না কমিয়ে অন্যটি বাড়তে পারে না। ধরা যাক, শুরুতে দুটি অংশই সমান : শ্রমশক্তি ৩ শিলিং এবং উদ্বৃত্ত মূল্য ৩ শিলিং। তা হলে, এম শক্তির মূল্য ৩ শিলিং থেকে বেড়ে ৪ শিলিং হতে পারে না, যদি উদ্বৃত্ত-মূল্য ৩ শিলিং থেকে কমে ২ শিলি না হয়; এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যও ৩ শিলিং থেকে বেড়ে ৪ শিলিং হতে পারে না, যদি শ্রম শক্তির মূল্য ৩ শিলিং থেকে কমে ২ শিলিং না হয়। অতএব, এই পরিস্থিতিতে উদ্বৃত্ত-মূল্যে কিংবা শ্রমশক্তির মূল্যের কোনটিরই অনাপেক্ষিক আয়তনে কোনো পরিবর্তন ঘটতে পারে না, যদি তাদের আপেক্ষিক আয়তনে অর্থাৎ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কে আপেক্ষিকভাবে একটি যুগপৎ পরিবর্তন না ঘটে।

অধিকন্তু, শ্রমশক্তির মূল্য কমতে পারে না এবং, অতএব, উদ্বৃত্ত-মূল্য বাড়তে পারে না যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতায় বৃদ্ধি না ঘটে। যেমন, উল্লিখিত ক্ষেত্রে, শ্রমশক্তির মূল্য নি শিলিং থেকে দুই শিলিং-এ কমে যেতে পারে না যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতায় একটি বৃদ্ধি ঘটার ফলে আগে যে-পরিমাণ অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করতে লাগত ৬ ঘণ্টা সেই একই পরিমাণ অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী এখানে ৪ ঘণ্টার মধ্যে উৎপাদন করা সম্ভব না হয়। অন্য দিকে, শ্রমশক্তির মূল্য তিন শিলিং থেকে বেড়ে চার শিলিং হতে পারে না, যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতায় একটি হ্রাস না ঘটে, যার ফলে—আগে যে-পরিমাণ অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি উৎপাদন করতে ছয় ঘণ্টাই ছিল যথেষ্ট -সেই একই পরিমাণ অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি উৎপাদন করতে এখন লাগে আট ঘণ্টা। এ থেকে যে ব্যাপারটা বেরিয়ে আসে, তা এই যে, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলে শ্রম-শক্তির মূল্য হ্রাস পায় এবং, অতএব, উদ্বৃত্ত-মূল্য বৃদ্ধি পায়; অন্য দিকে; এই উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেলে শ্রমশক্তির মূল্য বৃদ্ধি পায়, এবং উদ্বৃত্ত-মূল্য হ্রাস পায়।

এই নিয়মটি সূত্রায়িত করতে গিয়ে রিকার্ডো একটি ঘটনা উপেক্ষা করেছিলেন; যদিও উদ্বৃত্ত-মূল্যের বা উত্ত-শ্রমের আয়তনে একটি পরিবর্তন শ্রমশক্তির মূল্যে কিংবা আবশ্যিক শ্রমের পরিমাণে বিপরীত দিকে একটি পরিবর্তন ঘটায়, তা থেকে এটা কোনক্রমেই এই সিদ্ধান্ত করা যায় না যে তারা একই অনুপাতে পরিবর্তিত হয়। তারা অবশ্যই একই পরিমাণে বৃদ্ধি বা হ্রাস পায়। কিন্তু তাদের আনুপাতিক বৃদ্ধি বা হ্রাস নির্ভর করে, শ্রমের উৎপাদনশীলতায় বৃদ্ধি ঘটার পূর্বে তাদের যে মূল আয়তন ছিল, সেই আয়তনের উপরে। যদি শ্রমশক্তির মূল্য হয় ৪ শিলিং, কিংবা আবশ্যিক শ্রম সময় হয় ৮ ঘণ্টা, এবং উদ্বৃত্ত-মূল্য হয় ২ শিলিং কিংবা উদ্বৃত্ত-শ্রম হয় ৪ ঘণ্টা, এবং যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতায় বৃদ্ধি ঘটার ফলে শ্রমশক্তির মূল্য কমে দাঁড়ায় ৩ শিলিং কিংবা আবশিক শ্রম কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৬ ঘণ্টা, তা হলে, উদ্বৃত্ত মূল্য বেড়ে যাবে ৩ শিলিং-এ কিংবা উত্তম বেড়ে যাবে ৬ ঘণ্টায়। একই পরিমাণ, ১ শিলিং বা ২ ঘণ্টা, এক ক্ষেত্রে যোজিত হয় এবং অন্য ক্ষেত্রে বিয়োজিত হয়। কিন্তু প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আয়তনের আনুপাতিক পরিবর্তন বিভিন্ন। যখন শ্রমশক্তির মূল্য হ্রাস পায় ৪ শিলিং থেকে ৩ শিলিংএ অর্থাৎ ৪ বা ২৫ ভাগ, তখন উদ্বৃত্ত মূল্য বৃদ্ধি পায় ২ শিলিং থেকে ৩ শিলিংএ বা শতকরা ৫০ ভাগ। সুতরাং এ থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, শ্রমের উৎপাদনশীলতায় একটি নির্দিষ্ট পরিবর্তনের দরুণ উদ্বৃত্ত-মূল্যে যে অনুপাতিক বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটে নির্ভর করে শ্রম-দিবসের সেই অংশের আয়তনের উপরে, যা নিজেকে প্রমূর্ত করে উদ্ধত্ত-মূল্যের মধ্যে; সেই অংশটি যত বেশি হয়, আনুপাতিক পরিবর্তন তত কম হয়।

(৩) উদ্বৃত্ত-মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস সব সময়েই শ্রম-শক্তির মূল্যে আনুষঙ্গিক হ্রাস বা বুদ্ধির অনুবর্তী, কখনো তা তার কারণ নয়।[২]

যেহেতু শ্রম-দিবসের আয়তন স্থির এবং প্রতিরূপায়িত হয় একটি স্থির আয়তনের মূল্যের দ্বারা, যেহেতু উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়তনে প্রত্যেকটি পরিবর্তনের সঙ্গে আনুষঙ্গিক ভাবে সংঘটিত হয় শ্রমশক্তির মূল্যে একটি বিপরীতমুখী পরিবর্তন এবং যেহেতু এম শক্তির মূল্য শ্রমের উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তন না ঘটলে পরিবর্তিত হতে পারে না, সেহেতু এই পরিস্থিতিতে এ থেকে পরিষ্কার ভাবে বেরিয়ে আসে যে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়তনে প্রত্যেকটি পরিবর্তনের উদ্ভব ঘটে শ্রমশক্তির মূল্যে আয়তনের বিপরীতমুখী পরিবর্তন থেকে। তা হলে, যা আমরা আগেই দেখেছি, যদি শ্রমশক্তির মূল্যের এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যের আপেক্ষিক আয়তনে পরিবর্তন ছাড়া তাদের অনুপেক্ষিক আয়তনে কোনো পরিবর্তন না ঘটতে পারে, তা হলে এখন এটা বেরিয়ে আসে যে, শ্রমশক্তির মূল্যের অনাপেক্ষিক আয়তনে আগে পরিবর্তন না ঘটলে তাদের আপেক্ষিক আয়তনে পরিবর্তন ঘটতে পারে না।

এই তৃতীয় নিয়মটি অনুসারে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়তনে কোন পরবর্তনের পূর্বশর্ত হল শ্রমশক্তির মূল্যে পরিবর্তন, যে পরিবর্তন সাধিত হয় শ্রমের উৎপাদনশক্তিতে পরিবর্তনের দ্বারা। এই পরিবর্তনের মাত্রা নির্দিষ্ট হয় শ্রমশক্তির পরিবর্তিত মূল্যের দ্বারা। যাই হোক, এমনকি যখন অবস্থাবলীর এমন যে নিয়মটি কাজ করতে পারে, তখন অনুপূরক পরিবর্তন ঘটতে পারে! দৃষ্টান্তস্বরূপ, যদি শ্রমের বর্ধিত উৎপাদন শীলতার ফলে, শ্রমশক্তির মূল্য ও শিলিং থেকে ৩ শিলি-এ পড়ে যায় কিংবা আবশ্যিক শ্রম-সময় ৮ ঘণ্টা থেকে ৬ ঘণ্টায় পড়ে যায়, তা হলে শ্রমশক্তির মূল্য সম্ভবতঃ ৩ শি ৮পে, ওশি ৬পে বা ৩শি ২ পেন্সের নীচে নামতে পারে না এবং, কাজে কাজেই উদ্ধত মূল্য :শি পে, ৩শি ৬পে বা ৩শি ১. পেন্সের উপরে উঠতে পারে না। এই পড়ে যাওয়ার পরিমাণ-যার সর্বনিম্ন সীমা হল ৩ শিলিং (শ্রম-শক্তির নোতুন মূল্য ) নির্ভর করে আপেক্ষিক ওজনের উপরে, যা একদিকে মূলধনের চাপ এবং অন্য দিকে শ্রমিকের প্রতিরোধ তুলাদণ্ডের উপরে স্থাপন করে।

শ্রম-শক্তির মূল্য নির্ধারিত হয় একটি নির্দিষ্ট-পরিমাণ অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যের দ্বারা। শ্রমের উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তনের সঙ্গে এই অত্যাবশ্যক দ্রব্য সামগ্রীর পরিমাণে পরিবর্তন ঘটে না, ঘটে তার মূল্যে। অবশ্য, এটা সম্ভব যে, উৎপাদনশীলতায় বৃদ্ধির দরুন, শ্রমিক এবং ধনিক একই সময়ে সক্ষম হতে পারে এই এব্য-সামগ্রীর বৃহত্তর পরিমাণ আত্মকৃত করতে শ্রম-শক্তির দামে বা উভ-মূল্যে কোনো রকম পরিবর্তন ছাড়াই। যদি শ্রমশক্তির মূল্য হয় ৩ শিলিং এবং আবশ্যিক শ্রম-সময়ের পরিমাণ হয় ৬ ঘণ্টা, যদি অনুরূপ ভাবে উদ্বৃত্ত-মূল্য হয় ৩ শিলিং উত্তম ৬ ঘণ্টা, তাহলেউহুভশ্রমের সঙ্গে আবশ্যিক শ্রমের অনুপাতে কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতাকে দ্বি-গুণিত করা যায়, তবে উদ্বৃত্ত-মূল্যে এবং শ্রমশক্তির দামে আয়তনের কোন পরিবর্তন ঘটবে না। একমাত্র ফল দাড়াবে এই যে তাদের প্রত্যেকেই পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ ব্যবহারমূল্যের প্রতিনিধিত্ব করবে; এই ব্যবহার মূল্যগুলি পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ সস্তা হবে। যদি শ্রমশক্তি দামের দিক থেকে থাকে অপরিবর্তিত, তা হলে, তা হবে তার মূল্যের ঊর্ধ্বে। কিন্তু যদি শ্রম-শক্তির দাম পড়ে যেত—তার নোতুন মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যথাসম্ভব নিম্নতম বিন্দুটিতে নয়, ১ শিলিং ৬ পেন্সে নয়—পড়ে যেত ২শি ১০ পেন্সে বা ২ শিলিং ৬ পেন্সে, তা হলেও এই নিম্নতর দামটি প্রতিনিধিত্ব করত অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর একটি বর্ধিত পরিমাণের। এইভাবে এটা সম্ভব যে, শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা যখন বেড়ে চলেছে, শ্রম-শক্তির দাম তখন কমে চলেছে, এবং তবু এই কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের জীবন-ধান্বণের উপকরণসমূহের পরিমাণ অবিরত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এই ধরনের ক্ষেত্রেও, শ্রম-শক্তির মূল্যহ্রাসের ফলে উদ্বৃত্ত মূল্যের আনুষঙ্গিক বৃদ্ধি ঘটবে; এবং শ্রমিকের অবস্থান ও ধনিকের অবস্থানের মধ্যেকার ব্যবধান আরো প্রশস্ত হতে থাকবে।[৩]

রিকার্ডোই সর্বপ্রথম উল্লিখিত তিনটি নিয়মকে সঠিক ভাবে সূত্রায়িত করেছিলেন। কিন্তু তিনি কয়েকটি ভুল করে ফেলেন, যেগুলি নীচে উল্লেখ করা হল (১) যে বিশেষ অবস্থাবলীতে এই নিয়মগুলি কার্যকরী হয়, তিনি সেগুলিকে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের নির্বিশেষ ও একমাত্র অবস্থাবলী বলে ধরে নেন। তিনি কোনো পরিবর্তনকেই জানেন না–না শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য, না শ্রমের-তীব্রতায়; সুতরাং তার চোখে কেবল একটিই পরিবর্তনীয় উপাদান থাকতে পারে; সেটি হল শ্রমের উৎপাদনশীলতা; (২) এবং এই ভুলটি (১) নং ভুলটির তুলনায় তার বিশ্লেষণকে বেশি বিভ্রান্ত করে দেয়; অন্যান্য অর্থনীতিবিদেরা যেমন উদ্বৃত্ত-মূল্যকে বিচ্ছিন্ন ভাবে অর্থাৎ মুনাফা, খাজনা ইত্যাদির মত বিশেষ বিশেষ রূপ থেকে স্বতন্ত্র ভাবে অনুসন্ধান করেছেন, তিনিও তাদের চেয়ে বেশি কিছু করেন নি। সুতরাং তিনি উদ্বৃত্ত-মূল্যের হারের নিয়মগুলির সঙ্গে মুনাফার হারের নিয়মগুলিকে গুলিয়ে ফেলেন। আমরা আগেই দেখেছি, মুনাফার হার হল অগ্রিম-প্রদত্ত মোট মূলধনের সঙ্গে উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার; উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার হল মূলধনের পরিবর্তনীয় অংশের সঙ্গে উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার। ধরা যাক, ঐ ৫০০ পাউণ্ড। পরিমাণ একটি মূলধন (খ) গঠিত হয় ৪০০ পাউণ্ড পরিমাণ কাঁচামাল, শ্রম-উপকরণ ইত্যাদি ) এবং ১০০ পাউণ্ড পরিমাণ মজুরি (ম) নিয়ে; আরো ধরা যাক, উদ্বৃত্ত-মূল্য (উ)=১০০ পাউণ্ড। তা হলে আমরা দেখি, উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার উ =১০০%। কিন্তু মুনাফার হার -১::= ২০%। তা ছাড়া এটা পরিষ্কার যে, মুনাফার হার এমন সমস্ত ঘটনার উপরে নির্ভর করতে পারে যেগুলি কোনক্রমেই উদ্বৃত্ত-মূল্যের হারকে প্রভাবিত করে না। তৃতীয় গ্রন্থে আমি দেখাব যে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের একটি মাত্র হার নির্দিষ্ট থাকলেও, আমরা পেতে পারি যে-কোনো সংখ্যক মুনাফার হার; আরো দেখাব যে, উদ্ধত্ত-মূল্যের বিভিন্ন হার নির্দিষ্ট অবস্থায়, একটি অভিন্ন হারে নিজেদের প্রকাশ করে।

. শ্রম-দিবস স্থির : শ্রমের উৎপাদনশীলতা স্থির : শ্রমের তীব্রতা অস্থির

শ্রমের বর্ধিত তীব্রতার অর্থ হল একটি নির্দিষ্ট সময়ে শ্রমের বর্ধিত ব্যয়। সুতরাং অধিকতর তীব্রতার একটি কর্মদিবস অল্পতর তীব্রতার একটি কর্মদিবসের তুলনায় অধিকতর সংখ্যক দ্রব্যোৎপাদনের প্রতিমূর্তি। একথা সত্য যে শ্রমের বর্ধিত উৎপাদনশীলতাও একটি নির্দিষ্ট কর্ম-দিবসে অধিকতর সংখ্যক দ্রব্য উৎপাদন করবে। কিন্তু এই পরবর্তী ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পায়, কেননা তাতে আগের তুলনায় অল্পতর শ্রম-ব্যয় হয়; পূর্ববর্তী ক্ষেত্রে, ঐ মূল্য থাকে অপরিবর্তিত, কেননা প্রত্যেকটি উৎপন্ন দ্রব্য ব্যয়িত হয় আগের মত একই পরিমাণ শ্রম। এখানে তাদের একক-প্রতি মূল্যহ্রাস ছাড়াই আমরা অধিকতর সংখ্যক দ্রব্য পেয়ে থাকি; যেমন তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, তেমন তাদের দামের যোগফলও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বর্ধিত উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে, একটি নির্দিষ্ট মূল্য অধিকতর সংখ্যক উৎপন্ন দ্রব্যে বিস্তৃত হয়। সুতরাং কর্মদিবসের দৈর্ঘ্য যদিও স্থির থাকে, তা হলে বর্ধিত তীব্রতার একটি দিবস বিস্তৃত হবে একটি বর্ধিত মূল্যে; এবং টাকার মূল্য অপরিবর্তিত থাকলে, অধিকতর সংখ্যক টাকায়। সৃষ্ট মূল্য সেই মাত্রায় পরিবর্তিত হয়, যে-মাত্রায় শ্রমের তীব্রতা তার সাধারণ তীব্রতা থেকে বিচ্যুত হয়। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট কর্ম-দিবস আর একটি স্থির মূল্য সৃষ্টি করে না সৃষ্টি করে একটি পরিবর্তনীয় মূল্য; ১২ ঘণ্টার মামুলি তীব্রতার -একটি দিনে সৃষ্ট মূল্যের পরিমাণ, ধরা যাক, ৬ শিলিং কিন্তু বর্ধিত তীব্রতার সঙ্গে তা বেড়ে দাড়াতে পারে ৭, ৮ বা তারও বেশি শিলিং-এ। এটা পরিষ্কার যে যদি এক দিনের শ্রমের দ্বারা সৃষ্ট মূল্য, ধরুন, ৬ শিলিং থেকে বেড়ে ৮ শিলিং হয়, তা হলে যে দুটি অংশে-শ্রমশক্তির দাম এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যে—এই মূল্য বিভক্ত, সেই দুটিই যুগপৎ বৃদ্ধি পেতে পারে, এবং বৃদ্ধি পেতে পারে হয় সমভাবে আর, নয়তো, অসমভাবে। দুটি মূল্যই একই সঙ্গে ৩ শিলিং থেকে বেড়ে ৪ শিলিং করে হতে পারে। এখানে শ্রমশক্তির মূল্য-বৃদ্ধি আবশ্যিক ভাবেই সূচিত করে না যে দামটি শ্রমশক্তির মূল্যের চেয়ে উপরে উঠেছে। বরং বিপরীত, দামে বৃদ্ধি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যে-হ্রাস ঘটতে পারে। যখনি শ্রমশক্তির দামে যে বৃদ্ধি ঘটে, তা তার বর্ধিত ক্ষয়-ক্ষতি পুষিয়ে না দেয়, তখনি এটা ঘটে।

আমরা জানি যে, কয়েকটি স্বল্পকালীন ব্যতিক্রম ছাড়া, শ্রমের উৎপাদনশীলতায় কোন পরিবর্তন শ্রমশক্তির মূল্যে কোনো পরিবর্তন ঘটায় না, অতএব, উদ্ধত্ত-মূল্যের আয়তনের কোনো পরিবর্তন ঘটার না-যদি না তন্দ্বারা প্রভাবিত শিল্পগুলির উৎপন্ন দ্রব্যগুলি শ্রমিকদের অভ্যাসগত ভাবে আবশ্যিক পরিভোগর বিষয় হয়। বর্তমান ক্ষেত্রে এই শর্তটি আর প্রযোজ্য নয়। কারণ যখন পরিবর্তনাট ঘটে শ্রমের দীর্ঘতায় বা তীব্রতায়, তখন সর্বদাই সৃষ্ট মূল্যের আয়তনে ঘটে আনুষঙ্গিক পরিবর্তন এবং এটা ঘটে জিনিসটিকে উক্ত মূল্যটি মূর্তি ধারণ করে, তা নির্বিশেষে।

যদি শ্রমের তীব্রতা একই সঙ্গে ও একই মাত্রায় শিল্পের সকল শাখায় বৃদ্ধি পেত, তা হলে নোতুন ও উচ্ছতর তীব্রতাই হয়ে উঠত সমাজের পক্ষে স্বাভাবিক মাত্রা, এবং সেই জন্য তাকে আর হিসাবেও ধরা হত না। কিন্তু তবু, কখনন, শ্রমের তীব্রতা ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন হবে এবং মূল্যের নিয়মটির আন্তর্জাতিক প্রয়োগকে তদনুয়ায়ী প্রভাবিত করত। এক দেশের অধিকতর তীব্র শ্রমের একটি কর্মদিবস আরেক দেশে অল্পতর তীব্র শ্রমের একটি কর্মদিবসের তুলনায় একটি বৃহত্তর পরিমাণ অর্থের প্রতিনিধিত্ব করত।[৪]

৩. শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও তীব্রতা স্থির : কর্মদিবসের দৈর্ঘ্য অস্থির

একটি কর্ম-দিবস দুভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। আমাদের হাতে যে-তথ্য আছে এবং ইতিপূর্বে আমরা যা যা ধরে নিয়েছি, সেই ভিত্তিতে আমরা নিম্নলিখিত নিয়মগুলিতে উপনীত হই।

 (১) কর্ম-দিক তার দৈর্ঘ্য অনুপাতে বেশি বা কম পরিমাণ মূল্য সৃষ্টি করে সুজাং একটি স্থির-পরিমাণ মূল্য সৃষ্টি করে না, সৃষ্টি করে একটি অস্থির পরিমাণ মূল্য।

(২) উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়তন এবং শ্রমশক্তির মূল্যের আয়তনের মধ্যেকার সম্পর্কে সংঘটিত প্রত্যেকটি পরিবর্তন উদ্ভূত হয় উত্ত-খমের, অতএব উদ্বৃত্ত-মূল্যের, অনাপেক্ষিক আয়তনে কোন পরিবর্তন থেকে।

 (৩) শ্রম শক্তির ক্ষয়-ক্ষতির উপরে উদ্বৃত্ত-শ্রমের দীর্ঘায়ন যে প্রতিক্রিয়া ঘটায়, কেবল তারই ফলে শ্রমশক্তির অপেক্ষিক মূল্য পরিবর্তিত হতে পারে। অতএব, এই অনাপেক্ষিক মূল্যে প্রত্যেকটি পরিবর্তনই উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়তনে একটি পরিবর্তনের ফল, কিন্তু কখনো তার হেতু নয়।

আমরা এমন একটি ক্ষেত্র দিয়ে আরম্ভ করি, যেখানে-কর্ম-দিবসকে হ্রস করা হয়েছে।

(১) উল্লিখিত অবস্থাবলীতে কর্মদিবসের হ্রস্বতাসাধন শ্রমশক্তির মূল্যকে এবং, সেই সঙ্গে, আবশ্যিক শ্রম-সময়কে অপরিবর্তিতই রাখে। তা উত্তম ও উদ্বৃত্ত-মূল্যের হ্রাস সাধন করে। শেষোক্তটির আয়তনের সঙ্গে, তার আপেক্ষিক

আয়তনও হ্রাস পায় অর্থাৎ শ্রমশক্তির মূল্যের—যার আয়তন থাকে অপরিবর্তিত তার সঙ্গে আপেক্ষিকভাবে তার আয়তনও হ্রাস পায়। একমাত্র শ্রমশক্তির দামকে তার মূল্যের নীচে নামিয়ে এনেই ধনিক পারে অক্ষত অবস্থায় আত্মরক্ষা করতে।

কর্ম-দিবসকে হ্রস্বতর করার বিরুদ্ধে সচরাচর যে সমস্ত যুক্তি দেওয়া হয়, সেগুলিতে ধরে নেওয়া হয় যে, এই হ্রস্বতা-সাধন ঘটে থাকে এমন অবস্থাবলীর অধীনে যেগুলি বিদ্যমান আছে বলে আমরা এখানে ধরে নিয়েছি, কিন্তু বাস্তবে ঠিক তার বিপরীতটাই হয়; শ্রমের উৎপাদনশীলতায় বা তীব্রতায় কোন পরিবর্তন কর্মদিবসের হ্রস্বতাসাধনের আগে বা অব্যবহিত পরে ঘটে।[৫]

(২) কর্ম-দিবসের দীর্ঘ সাধন। ধরা যাক, আবশ্যিক শ্রম-সময় হচ্ছে ৬ ঘণ্টা, কিংবা শ্রমশক্তির মূল্য হচ্ছে ৩ শিলিং; আরো ধরা যাক যে উত্তম হচ্ছে ৬ ঘণ্টা কিংবা উদ্বৃত্ত-মূল্য হচ্ছে ৩ শিলিং। তা হলে, গোটা কর্মদিবসের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ ঘণ্টায় এবং তা রূপান্তরিত হয় ৬ শিলিং পরিমাণ মূল্যে। এখন, যদি কর্ম-দিবসকে আরো ২ ঘন্টা দীর্ঘতর করা হয় এবং শ্রমশক্তির দাম অপরিবর্তিত থাকে, তা হলে উদ্বৃত্ত-মূল্য বৃদ্ধি পায়-আপেক্ষিক ভাবে ও অনাপেক্ষিক ভাবে উভয়ত। যদিও এম শক্তির মূল্যে কোনো অনাপেক্ষিক পরিবর্তন হয় না, তবু এর আপেক্ষিক হ্রাস ঘটে। (১)-এ যে অবস্থাবলী ধরে নেওয়া হয়েছে, শ্রম-শক্তির অপেক্ষিক মূল্যে কোনো পরিবর্তন না ঘটলে তার মূল্যে আপেক্ষিক আয়তনের পরিবর্তন ঘটতে পারে না। এখানে, বরং বিপরীত, শ্রমশক্তির মূল্যে আপেক্ষিক আয়তনের পরিবর্তন হচ্ছে উদ্বৃত্ত-মূল্যে অনাপেক্ষিক আয়তনের পরিবর্তনের ফল।

যেহেতু যে-মূল্যটির মধ্যে এক দিনের শ্রম রূপায়িত আছে, তা ঐ দিনটির দৈর্ঘ্যের সঙ্গে বৃদ্ধি পায়, সেহেতু এটা স্পষ্ট যে, উদ্বৃত্ত-মূল্য এবং শ্রমশক্তির দাম যুগপৎ বৃদ্ধি পেতে পারে—হয়, সম-পরিমাণে আর, নয়তো অসম পরিমাণে। এই যুগপৎ বৃদ্ধি, অতএব সম্ভব হয় দুটি ক্ষেত্রে, এক, কর্মদিবসের সত্যসত্যই দীর্ঘতা-সাধন : অন্যটি, এই দীর্ঘতা-সাধন ব্যতিরেকে শ্রমের তীব্রতায় বৃদ্ধি-সাধন।

কর্ম-দিবসকে যখন দীর্ঘায়িত করা হয়, তখন শ্রমশক্তির দাম তার মূল্য থেকে পড়ে যেতে পারে, যদিও সেই দাম নামে অপরিবর্তিত থাকতে পারে, এমনকি বেড়েও যেতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, একটি কর্ম-দিবসের শ্রম শক্তির মূল্য পরিমাপ করা হয় তার স্বাভাবিক গড়পড়তা স্থায়িত্বকাল হতে কিংবা শ্রমিকদের মধ্যে জীবনের স্বাভাবিক স্থায়িত্বকাল হতে, এবং মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি অনুযায়ী সংগঠিত শারীরিক বস্তুর গতিতে আনুষঙ্গিক ও স্বাভাবিক রূপান্তরণ হতে।[৬] একটি বিন্দু পর্যন্ত, শ্রম-দিবসের দীর্ঘায়ন-জনিত শ্রমশক্তির ক্ষয়-ক্ষতি উচ্চতর মজুরি দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেই বিন্দুটি পার হয়ে গেলেই ক্ষয়-ক্ষতি বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে এবং শ্রমশক্তির স্বাভাবিক পুনরুৎপাদন ও কাজকর্ম ব্যাহত হয়। শ্রমশক্তির দাম এবং তার শোষণের মাত্রা আর সম-পরিমাণ থাকে না।

৪. শ্রমের স্থায়িত্বকাল, উৎপাদনশীলতা ও তীব্রতায় যুগপৎ পরিবর্তন

এটা স্পষ্ট যে, এক্ষেত্রে বহুসংখ্যক সন্নিবেশ সম্ভব। তিনটি বিষয়ের মধ্যে যে কোনো দুটির পরিবর্তন ঘটতে পারে এবং বাকিটি স্থির থাকতে পারে, কিংবা তিনটির সব কটিরই একই সঙ্গে পরিবর্তন ঘটতে পারে। তারা একই দিকে বা ভিন্ন ভিন্ন দিকে পরিবর্তিত হতে পারে; একই বা বিপরীত দিকে পরিবর্তিত হতে পারে; ফল হয় এই যে পরিবর্তনগুলি একটি অপরটির বিরুদ্ধে ক্রিয়া করে এবং পরস্পরকে সমগ্র ভাবে বা আংশিক ভাবে বিফল করে দেয়। যাইহোক, [১], [২] এবং [৩]-এ প্রদত্ত ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে, সম্ভাব্য প্রত্যেকটি সন্নিবেশের বিশ্লেষণ সহজেই করা যায়। সম্ভাব্য প্রত্যেকটি সন্নিবেশের ফল পাওয়া যেতে পারে—যদি পালাক্রমে সেই মুহূর্তে প্রত্যেকটি বিষয়কে অস্থির এবং বাকি দুটি বিষয়কে স্থির বলে গণ্য করা হয়। সুতরাং আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র পরীক্ষা করে দেখব—তাও খুবই সংক্ষেপে।

(১) কর্মদিবসের দীর্ঘতা সাধনের সঙ্গে যুগপৎ শ্রমের হ্রাসমান উৎপাদনশীলতা

শ্রমের হ্রাসমান উৎপাদনশীলতার কথা বলতে গিয়ে, আমরা এখানে সেইসব শিল্পে হ্রাসপ্রাপ্তির ঘটনা উল্লেখ করব, যেগুলির উৎপন্ন দ্রব্য শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারণ করে, এই ধরনের হ্রাসপ্রাপ্তি যা ঘটে, ধরা যাক, মাটির হ্রাসমান উর্বতী এবং উৎপন্ন দ্রব্যের তজ্জনিত মহার্ঘতার ফল হিসাবে। ধরুন, কর্ম-দিবসের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১২ ঘণ্টা এবং তার দ্বারা সৃষ্ট মূল্য হচ্ছে ৬ শিলিং, যার মধ্যে অর্ধেক শ্রমশক্তির মূল্য প্রতিস্থাপিত করে এবং বাকি অর্ধেক গঠন করে উদ্বৃত্ত-মূল্য। ধরুন, মটির উৎপন্ন দ্রব্যে বর্ধিত মহার্ঘতার ফলে, শ্রমশক্তির মূল্য ৩ শিলিং থেকে বেড়ে হয় ৪ শিলিং এবং অতএব, আবশ্যিক শ্রম-সময় ৬ ঘণ্টা থেকে বেড়ে হয় ৮ ঘণ্টা। যদি কর্মদিবসের দৈর্ঘ্যে কোনো পরিবর্তন না ঘটে, তা হলে উদ্বৃত্ত-শ্রম ৬ ঘণ্টা থেকে কমে – যাবে ৪ ঘণ্টায়, উদ্বৃত্ত-মূল্য ৩ শিলিং থেকে ২ শিলিং-এ। যদি কর্মদিবসের দৈর্ঘ্য ২ ঘন্টা বাড়িয়ে দেওয়া যায় অর্থাৎ ১২ ঘণ্টা থেকে ১৪ ঘন্টা করা যায়, তা হলে উও-শ্রম ৬ ঘণ্টাই থেকে যায় এবং উদ্বৃত্ত-মূল্য থেকে যায় ৬ শিলিং; কিন্তু আবশ্যিক শ্রম-সময়ের হিসাবে পরিমাপ করলে দেখা যায় যে, শ্রমশক্তির মূল্যের তুলনায় উদ্বৃত্ত-মূল্য কমে যায়। যদি কর্ম দিবসটিকে ৪ ঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়া যায় অর্থাৎ ১২ ঘণ্টা থেকে ১৬ ঘণ্টা করা যায়, তা হলে উদ্বৃত্ত-মূল্য এবং শ্রমশক্তির মূল্যের, উদ্ধত্ত-শ্রম এবং আবশ্যিক শ্রমের আনুপাতিক আয়তনগুলি অপরিবর্তিতই থেকে যায়, কিন্তু উদ্বৃত্ত-মূল্যের অপেক্ষিক আয়তন ৩ শিলিং থেকে বেড়ে হয় ৪ শিলিং, উদ্ধত্ত-শ্রমের অনুপেক্ষিক আয়তন ৬ ঘণ্টা থেকে বেড়ে হয় ৮ ঘণ্টা—শতকরা ৩৩ ভাগ বৃদ্ধি। সুতরাং শ্রমের হ্রাসমান উৎপাদনশীলতার সঙ্গে এবং যুগপৎ শ্রম-দিবসের দীর্ঘতা সাধনের সঙ্গে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের অনাপেক্ষিক আয়তন অপরিবর্তিত থেকে যেতে পারে—যে সময়ে তার আপেক্ষিক আয়তন হ্রাস পায়; তার আপেক্ষিক আয়তন অপরিবর্তিত থেকে যেতে পারে-যে সময়ে তার অনাপেক্ষিক আয়তন বৃদ্ধি পায়; এবং যদি শ্রম-দিবসটির দৈর্ঘ্য যথেষ্ট হয়, তা হলে উভয়েই বৃদ্ধি পেতে পারে। ১৭৯৯ থেকে ১৮১৫ সালের মধ্যবর্তী কালে ইংল্যাণ্ডে খাদ্য-দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান দামের ফলে আর্থিক মজুরি বৃদ্ধি ঘটেছিল যদিও আসল মজুরি—অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদির আকারে প্রকাশিত মজুরি হ্রাস পেয়েছিল। এই ঘটনা থেকে ওয়েস্ট এবং রিকার্ডো এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, কষি-শ্রমের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবার ফলে উদ্বৃত্ত মূল্যের হারে হ্রাস ঘটেছে, এবং তারা এমন একটি ঘটনাকে ধরে নিয়েছিলেন যার অস্তিত্ব ছিল কেবল তাদের কল্পনায়—মজুরি, মুনাফা ও খাজনা সম্পর্কিত অনুসন্ধান কার্যের সূচনা স্থল। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে, শ্রমের তীব্রতা-বৃদ্ধি এবং শ্রম-দিবসের দীর্ঘতা বৃদ্ধির কল্যাণে সেই সময়ে উদ্বৃত্ত-মূল্য উভয়তই বৃদ্ধি পেয়েছিল -অনাপেক্ষিক আয়তনে এবং আপেক্ষিক আয়তনে। এটাই ছিল সেই সময়, যখন দোর্দণ্ড মাত্রায় শ্রমের ঘণ্টা বাড়াবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল;[৭] যে সময়ের বিশেষ চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ছিল, এক দিকে, মূলধনের ত্বরান্বিত সঞ্চয়ন এবং অন্য দিকে, নিঃস্বতার সম্প্রসারণ।[৮]

(২) শ্রমদিবসের হ্রস্বতা-গানের সঙ্গে যুগপৎ শ্রমের তীব্রতা ও উৎপাদনশীলতায় বৃদ্ধি সাধন

শ্রমের বর্ধিত উৎপাদনশীলতা এবং অধিকতর তীব্রতার ফলাফল একই রকম। তারা উভয়েই একটি নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদিত দ্রব্যসম্ভারের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। সুতরাং উভয়েই শ্রম-দিবসের সেই অংশটির হ্রস্বতা সাধন করে, যে-অংশটি শ্রমিকের প্রয়োজন তার জীবনধারণের উপকরণ-সামগ্রী বা সেগুলির তুল্যমূল্য কিছু উৎপাদন করার জন্য। শ্রম-দিবসের নূ্যনতম দৈর্ঘ্য নির্ধারিত হয় তার এই আবশ্যিক অথচ চুক্তি সাপেক্ষ অংশের দ্বারা। যদি গোটা দিবসটিকে সংকুচিত করে আনা যেত ঐ অংশটির দৈর্ঘ্যের মধ্যে, তা হলে উদ্বৃত্ত-মূল্যে অন্তর্হিত হয়ে যেত—সেটা এমন একটা পরিণতি, মূলধনের রাজত্বে যা কোনক্রমেই ঘটতে পারে না। একমাত্র ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির অবসান ঘটিয়েই শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য আবশ্যিক শ্রম-সময়ে কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও আবশ্যিক শ্রম-সময় তার মাত্রার সম্প্রসারণ ঘটাবে। এক দিকে, কারণ তখন “জীবনধারণের উপকরণ-সামগ্রীর” ধারণাটির অর্থ সম্প্রসারিত হবে এবং শ্রমিক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক জীবন-মান দাবি করবে। অন্য দিকে, কারণ তখন আজকের দিনে যা উদ্বৃত্ত-মূল্য, তার একটা অংশ গণ্য হবে আবশ্যিক শ্রম হিসাবে। আমি বোঝাতে চাইছি ( ভবিষ্যৎ উৎপাদনের প্রয়োজনে) সংরক্ষণ ও সঞ্চয়নের একটি ভাণ্ডার গড়ে তোলার জন্য।

শ্রমের উৎপাদনশীলতা যত বেশি বৃদ্ধি পায়, শ্রম-দিবসকে তত বেশি হ্রাস করা যায়; এবং শ্রম-দিবসকে যত বেশি হ্রাস করা যায়, শ্রমের তীব্রতাকে তত বেশি বৃদ্ধি করা যায়। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে, শ্রমের সাশ্রয়ের সঙ্গে একই হারে উৎপাদন শীলতা বৃদ্ধি পায়, শ্রমের সাশ্রয় আবার তার বেলায় কেবল উৎপাদন উপকরণের ব্যয় সংকোচই বোঝায় না, সেই সঙ্গে বোঝয় অপ্রয়োজনীয় শ্রমের পরিহারও। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি, একদিকে, যখন প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র কারবারের ক্ষেত্রে ব্যয়-সংকোচ সংঘটিত করে, অন্য দিকে, তখন তা তার প্রতিযোগিতার নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির দ্বারা শ্রমশক্তির ও উৎপাদনের সামাজিক উপকরণ সমূহের সবচেয়ে বেপরোয়া অপব্যয়ের জন্ম দেয়আপাততঃ অপরিহার্য কিন্তু কার্যতঃ অপ্রয়োজনীয় এক বিশালসংখ্যক কর্ম সৃষ্টির কথা নয় বাদই দিলাম।

শ্রমের তীব্রতা ও উৎপাদনশীলতা যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে সমাজ বৈষয়িক উৎপাদনে যে-পরিমাণ সময় নিয়োগ করতে বাধ্য তা হ্রাস পায়, এবং ব্যক্তির অবাধ মানসিক ও সামাজিক বিকাশের জন্য সমাজ তার হাতে বিপুলতর সময় পায়—যে অনুপাতে সমগ্র কাজ সমাজের সকল সক্ষম-দেহী সদস্যদের মধ্যে সমভাবে বন্টিত হয় এবং যে-অনুপাতে একটি বিশেষ শ্রেণী শ্রমের স্বাভাবিক ভারকে নিজেদের কাধ থেকে অপসারিত করে সমাজের অন্য এক স্তরের কাধে তা চাপিয়ে দেবার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়, সেই অনুপাতে। এই দিক থেকে, শ্রম-দিবসের হ্রস্বতা-সাধন শেষ পর্যন্ত শ্রমের সাধারণীকরণের মধ্যে একটা সীমাপ্রাপ্ত হয়। ধনতান্ত্রিক সমাজে একটি শ্রেণীর জন্য অবকাশ অর্জন করা হয় জনগণের সমগ্র জীবন-কালকে শ্ৰম-সময়ে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে।

————

১. তৃতীয় জার্মান সংস্করণে প্রদত্ত টাকা-৫-৮ পৃষ্ঠায় বাংলা সংস্করণ (ইংরেজি সংস্করণ ৩০০-৩২ পৃষ্ঠায়) আলোচিত বিষয়টি অবশ্য এখানে বাদ দেওয়া হয়েছে। এফই.

২. এই তৃতীয় নিয়মটির সঙ্গে ম্যাককুলক যা যা যোগ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে এই আজগুবি সংযোজনটি যে, শ্রমশক্তির মূল্য-হ্রাস ব্যতিরেকে উদ্বৃত্ত মূল্যের বৃদ্ধি ঘটতে পারে যদি ধনিক কর্তৃক দেয় করগুলিকে লোপ করে দেওয়া হয়। শ্রমিকের কাছ থেকে ধনিকে প্রত্যক্ষভাবে যে উদ্বৃত্ত-মূল্য আদায় করে নেয়, তার পরিমাণে করের অবলুপ্তি কোনো পরিবর্তনই ঘটাতে পারে না। তা কেবল তার এবং তৃতীয় ব্যক্তিদের মধ্যে কোন্ অনুপাতে উদ্বও মূল্যের বণ্টন ঘটবে, সেই অনুপাতটির পরিবর্তন ঘটায়। সুতরাং তা উদ্বৃত্ত-মূল্য এবং শ্রমশক্তির মূল্যের মধ্যেকার সম্পর্কটিতে কোনো পরিবর্তনই ঘটায় না। অতএব, ম্যাককুলকের ব্যতিক্রম কেবল ঐ নিয়মটির অনুধাবনে তার অক্ষমতাই প্রমাণ করে। রিকার্ডোর অপব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন দুর্ভাগ্য তার প্রায়ই হয়েছে, যেমন হয়েছে বি সে’র অ্যাডাম স্মিথের অপব্যাখ্যা করতে গিয়ে।

৩. “যখন শিল্পের উৎপাদনশীলতায় কোনো পরিবর্তন ঘটে এবং একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম ও মূলধনের দ্বারা বেশি কিংবা কম উৎপন্ন হয় তখন মজুরির অনুপাত স্পষ্টতই পরিবর্তিত হতে পারে—যখন ঐ অনুপাতটি যে পরিমাণটির প্রতিনিধিত্ব করে সেটা, একই থাকে কিংবা পরিমাণটি পরিবর্তিত হয় অথচ অনুপাতটি একই থাকে। (“আউটলাইনস অব পলিটিক্যাল ইকনমি”, ইত্যাদি পৃ: ৬৭)

৪. “সব কিছু সমান থাকলে একজন বিদেশী ম্যানুফ্যাকচারের চেয়ে একজন ইংরেজ ম্যানুফ্যাকচারার একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনেক বেশি কাজ আদায় করতে পারে, এত বেশি যে, অন্য জায়গার ৭২-৮০ ঘণ্টার সপ্তাহ এবং এখানকার ৬০ ঘণ্টার সপ্তাহ সমান হয়ে যায়।” (“রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ”, ৩১ অক্টোবর ১৮৫৫, পৃঃ ৬৫)।

ইংরেজ এবং মহাদেশীয় শ্রম-ঘণ্টার মধ্যে এই গুণগত পার্থক্য হ্রাস করার সবচেয়ে অভ্রান্ত উপায় হল আইন করে মহাদেশীয় কারখানাগুলিতে শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য পরিমাণগত ভাবে কমিয়ে দেওয়া।

৫. দশ ঘণ্টা আইনের প্রচলনের ফলে প্রকাশ পেয়েছে যে অনেক ক্ষতিপূরণকারী ব্যাপার রয়েছে।” (“রিপোর্টস ….. ফ্যাক্টরিজ”, ৩১ অক্টোবর ১৮৪৮, পৃঃ ৭)।

৬. “২৪ ঘণ্টা কি পরিমাণ শ্ৰম একজন মানুষ করেছে তা মোটামুটি হিসাব করা যায় যদি তার দেহে যে-সব রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটেছে, সেগুলিকে পরীক্ষা করা যায়। বস্তুর রূপগত পরিবর্তন নির্দেশ করে সক্রিয় শক্তির পূর্বকৃত অনুশীলন।” (গ্রোভ: “অন দি কো-রিলেশন অব ফিজিক্যাল ফোর্সেস।” )।

৭. শস্য এবং শ্রম কদাচিৎ সমান তালে চলে; কিন্তু একটা পরিষ্কার মাত্রা আছে, যার বাইরে তাদের বিচ্ছিন্ন করা যায় না। মহার্ঘতার সময়ে, যখন মজুরির হ্রাস ঘটে, যেটা সাক্ষ্য থেকে দেখা যায় (পার্লামেন্টের তদন্ত কমিটির সামনে প্রদত্ত সাক্ষ্য, ২৮১৪-১৫), তখন শ্রমজীবী শ্রেণীগুলিকে যে অস্বাভাবিক পরিশ্রম করতে হয়, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সর্বশ্রেষ্ট কৃতিত্বের পরিচায়ক এবং নিশ্চয়ই মূলধন বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক। কিন্তু মানবজাতির কোনো একজনও এটা চাইতে পারে না যে ঐ পরিশ্রম হোক চিরস্থায়ী, থাক অপ্রশমিত। সাময়িক পরিত্রাণ হিসাবে তা প্রশংসনীয়, কিন্তু তা যদি নিরন্তর চালু থাকে, তা হলে তা থেকে ঘটবে একই ফলাফল যা ঘটে থাকে কোন দেশের জনসংখ্যাকে খাদ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত ঠেলে দিলে।” (ম্যালথাস, “ইনকুইরি ইনটু দি নেচর অ্যাণ্ডি প্রাগ্রেস অব রেন্ট।” লণ্ডন ১৮১৫, পৃঃ ৪৮ টীকা)। ম্যালথাসকে শ্রদ্ধা জানাই, তিনি শ্রম-ঘণ্টার দীর্ঘতসাধনের উপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন, একটা ঘটনা যার প্রতি তার পুস্তিকায় তিনি অন্যত্রও মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন, অন্য দিকে বিকার্ডো এবং অন্যান্যরা, সবচেয়ে কলংকজনক ঘটনাবলী সত্বেও, শ্রম-দিবসের দীর্ঘতার অপরিবর্তনীয়তাকে তাদের যাবতীয় অনুসন্ধানের ভিত্তিম্বরূপে পরিণত করেছেন। কিন্তু যে সংরক্ষণশীল স্বার্থগুলিকে ম্যালথাস সেবা করতেন, তা তাকে দেখতে দেয়নি যে, শ্রম-দিবসের মাত্রাহীন দীর্ঘতসাধন এবং সেই সঙ্গে মেশিনারির অসাধারণ অগ্রগমন এবং নারী ও শিশুদের শোষণ শ্রমিক শ্রেণীর একটা বৃহৎ অংশকে নিশ্চয়ই পর্যবসিত করবে ‘সংখ্যাতিরিক্ত বাহুল্যে”—বিশেষ করে, তখন যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে এবং বিশ্বের বাজারগুলিতে ইংল্যাণ্ডের একচেটিয়া অধিকারেরও অবসান ঘটবে। অবশ্য ম্যালথাস যাদের পূজা করতেন, যথার্থ পুরোহিত হিসাবে সেই শাসক শ্রেণীগুলির কাছে এই “জনবহুল্য”কে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ঐতিহাসিক নিয়মাবলীর সাহায্যে ব্যাখ্যা করার তুলনায় প্রকৃতির শাশ্বত নিয়মাবলীর সাহায্যে ব্যাখ্যা করা ঢের বেশি সুবিধাজনক ও স্বার্থসঙ্গত।

৮. যুদ্ধ চলাকালে মূলধন বৃদ্ধির একটা প্রধান কারণ হল শ্রমজীবী শ্রেণীগুলির আরো বেশি পরিশ্রম এবং সম্ভবতঃ আরো বেশি বঞ্চনা-প্রত্যেক সমাজেই যারা সবচেয়ে সংখ্যাধিক। অভাবের তাড়নায় আরো মহিলা, আরো শিশু বাধ্য হয়েছিল। শ্রমসাধ্য বৃত্তিগুলিতে যোগ দিতে এবং আগেকার শ্রমিকেরা ঐ একই কারণে বাধ্য হয়েছিল তাদের বেশির ভাগ সময়টা উৎপাদন-বৃদ্ধির কাজে নিয়োগ করতে ( এসেজ অন পলিটিক্যাল ইকনমি ইন হুইচ আর ইলাস্ট্রেটেড দি প্রিন্সিপাল কজেস অব দি প্রেজেন্ট ন্যাশনাল ডিসট্রেস’ ১৮৩৩, পৃঃ ২৪৮।)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *