দ্বিতীয় বিভাগ — অর্থের মূলধনে রূপান্তর
চতুর্থ অধ্যায় — মূলধনের জন্য সাধারণ সূত্র
মূলধনের যাত্রা শুরু হয় পণ্যদ্রব্যাদির সঞ্চলন থেকে। পণ্যের উৎপাদন, তাদের সঞ্চলন এবং বাণিজ্য নামে অভিহিত তাদের সঙ্কলনের অধিকতর বিকশিত রূপ এই ঘটনাগুলিই মূলধন উদ্ভবের ঐতিহাসিক ভিত্তিভূমি রচনা করে দেয়। যোড়শ শতকে যে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও বিশ্বব্যাপী বাজারের সৃষ্টি হয়, তখন থেকেই মূলধনের আধুনিক ইতিহাসের সূচনা।
পণ্য-সঞ্চলনের বস্তু-সত্ত্ব থেকে তথা বহুবিধ ব্যবহার মূল্যের বিনিময় থেকে যদি আমরা নিষ্কর্ষিত করে নিই এবং কেবল সঙ্কলনের এই প্রক্রিয়া থেকে উৎপন্ন রূপগুলিকেই বিবেচনার মধ্যে ধরি, আমরা তার চূড়ান্ত ফলশ্রুতি হিসেবে যা পাই তা হচ্ছে ‘অথ’ : পণ্য-সঞ্চলের এই যে চুড়ান্ত রূপ, এই রূপেই ঘটে মূলধনের প্রথম আবির্ভাব।
ইতিহাসের বিচারে, ভূ-সম্পত্তির পাল্টা হিসেবে মূলধন অনিবার্য ভাবেই ধারণ করে অর্থের রূপ; বণিক এবং কুসীদজীবীর মূলধন হিসেবে তা দেখা দেয় অর্থরূপী ধন হিসেবে।[১] কিন্তু মূলধনের প্রথম আবির্ভাব যে অর্থ-রূপেই হয়েছিল তা প্রমাণ করবার জন্য মূলধনের উৎস পর্যন্ত যাবার দরকার পড়ে না। প্রত্যহই আমরা আমাদের চোখের উপরেই দেখি যে অর্থ-রূপেই মূলধনের প্রথম আবির্ভাব ঘটে। এমনকি আমাদের দিনেও সমস্ত নতুন মূলধন রঙ্গমঞ্চে, তথা বাজারে—তা সে পণ্যের বাজার, শ্রমের বাজার বা টাকার বাজার যা-ই হোক না কেন সব বাজারেই সর্বপ্রথমে আবির্ভূত হয় অর্থের আকারেই, যা ক্রমে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় রূপায়িত হল মূলধনে।
নিছক অর্থ হিসেবেই যে অর্থ এবং মূলধন হিসেবে যে অর্থ এই দুয়ের মধ্যে প্রথমে যে পার্থক্যটি আমাদের চোখে পড়ে, তা তাদের সঞ্চলনের রূপে পার্থক্য ছাড়া আর কিছুই নন।
পণ্য সঞ্চলনের সরলতম রূপ হচ্ছে প অ প, পণ্যের অর্থে রূপান্তর, এবং পুনরায় অর্থের পণ্যে পরিবর্তন, অর্থাৎ ক্রয়ের জন্য বিক্রয়। কিন্তু এই রূপটির পাশাপাশিই আমরা প্রত্যক্ষ করি স্পষ্ট ভাবেই ভিন্নতর আরেকটি রূপ : অপ অ; অর্থের পণ্যে রূপান্তর, এবং পুনরায় পণ্যের অর্থে পরিবর্তন; তথা বিক্রয়ের জন্য ক্রয়। এই শেষোক্ত প্রণালী, যে-অর্থ সঞ্চলন করে তাই হচ্ছে সম্ভাব্য মূলধন এবং পরিণত হয় মূলধনে।।
এখন, অ প অ আবর্তটিকে আরো একটু ঘনিষ্ঠ ভাবে পরীক্ষা করে দেখা যাক। অন্য আবর্তটির মত এটিও দুটি বিপরীতমুখী পর্যায়ের সমষ্টি। প্রথম পর্যায়টিতে, অপ, তথা ক্রয়-এর পর্যায়টিতে, অর্থ পরিবর্তিত হয় পণ্যে। দ্বিতীয় পর্যায়টিতে, প—অ, তথা বিক্রয়-এর পর্যায়টিতে পণ্য পুনরায় পরিবর্তিত হয় অর্থে। এই দুটি পর্যায় সম্মিলিত হয়ে রচনা করে একটি এক গতিক্রম, যার প্রক্রিয়ায় অর্থের বিনিময় ঘটে পণ্যের সঙ্গে ঐ একই পণ্যের পুনরায় বিনিময় ঘটে অর্থের সঙ্গে; যার প্রক্রিয়ায় একটি পণ্যকে ক্রয় করা হয় আবার তাকে বিক্রয় করার জন্য কিংবা, ক্রয় ও বিক্রয়ের রূপটিকে যদি উপেক্ষা করি, তা হলে বলা যায় যে, একটি পণ্যকে ক্রয় করা হয় অর্থের সাহায্যে এবং তারপরে অর্থকে ক্রয় করা হয় পণ্যের সাহায্যে।[২] এই যে ফলশ্রুতি, যার মধ্য থেকে সংশ্লিষ্ট অখণ্ড প্রক্রিয়াটির খণ্ড খণ্ড পর্যায় দুটি অন্তর্হিত হয়ে যায়, তার-রূপ দাড়ায় অর্থের পরিবর্তে অর্থের বিনিময় : অ-অ। আমি যদি ৪১০০ পাউণ্ড দিয়ে ২০০০ পাউণ্ড তুলা ক্রয় করি এবং তার পরে ঐ ২০০০ পাউণ্ড তুলাকে আবার £১১ পাউণ্ড পেয়ে বিক্রয় করি, তা হলে আমি কাৰ্ষত যা করে থাকি, তা হল ১০০ পাউণ্ডের সঙ্গে £১১০ পাউণ্ডের বিনিময়, অর্থের সঙ্গে অর্থের বিনিময়।
এখন এটা সুস্পষ্ট যে অ-প-অ আবর্তটি হয়ে পড়ত অসম্ভব এবং অর্থহীন, যদি এই আবর্তটির সাহায্যে কেবল দুটি সমান অঙ্কের অর্থকেই £১০০ পাউণ্ডের সঙ্গে ১০০ পাউণ্ডেরই, বিনিময় ঘটানোর উদ্দেশ্য থাকত। কৃপণের পরিকল্পনা হত ঢের বেশী সরল ও সুনিশ্চিত; সঞ্চলনের ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে সে তার £১০০ পাউণ্ডকেই আঁকড়ে থাকত। এবং তথাপি যে-ব্যবসায়ী তার তুলোর জন্য £১০০ পাউণ্ড দিয়েছে, সে তার সেই তুলোকে £১১০ পাউণ্ডের জন্য বিক্রয় করে দেয়, এমন কি £১… কিংবা £৫ . পাউণ্ডের জন্যও বিক্রয় করে দেয়, তা হলেও সমস্ত ক্ষেত্রেই তার অর্থ এমন একটি বিশিষ্ট ও মৌলিক গতিক্রমের মধ্য দিয়ে পার হয়, যা, যে কৃষক ফসল বিক্রয় করে এবং এইভাবে হস্তগত অর্থের সাহায্যে কাপড়-চোপড় ক্রয় করে তার হাত দিয়ে অর্থ যে-গতিক্রমের মধ্য দিয়ে পার হয়, তা থেকে চরিত্রগত ভাবেই ভিন্নতর। সুতরাং আমাদের শুরুতেই পরীক্ষা করে দেখতে হবে অপ-অ এবং প—অ প—এই দুটি আবর্তের পার্থক্য সূচক বৈশিষ্ট্যগুলিকে এবং তা করলেই নিছক রূপগত পার্থক্যের অন্তরালে যে আসল পার্থক্যটি আছে সেটি প্রকাশ হয়ে পড়বে।
প্রথমে দেখা যাক, দুটি রূপের মধ্যে অভিন্ন কি কি আছে।
দুই আবর্তকেই দুটি অভিন্ন বিপরীতমুখী পর্যায়ে পর্যবসিত করা যায় : প—অ এবং অ-প, যথাক্রমে বিক্রয় এবং ক্রয়। এই দুটি পর্যায়ের প্রত্যেকটি পর্যায়েই একই বস্তুগত উপাদানসমূহ যেমন পণ্য এবং অর্থ এবং একই নাটকীয় চরিত্রসমূহ, যেমন ক্রেতা এবং বিক্রেতা, পরস্পরের মুখোমুখি হয়। প্রত্যেকটি আবর্তই দুটি একই বিপরীত মুখী পর্যায়ের ঐক্য, এবং প্রত্যেকটি পর্যায়েই এই ঐক্য সংঘটিত হয় তিনটি চুক্তিবদ্ধ পক্ষের হস্তক্ষেপের ফলে, যাদের মধ্যে একটি পক্ষ কেবল বিক্রয় করে, আরেকটি কেবল ক্রয় করে, আর বাকি পক্ষটি বিক্রয় এবং ক্রয় দুই-ই করে।
কিন্তু প-অ—প এবং অপ-অ এই দুটি আবর্তের মধ্যে প্রথম ও প্রধান যে বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্যণীয়, তা হচ্ছে দুটি পর্যায়ের বিপরীত পরম্পরা। সরল পণ্য সঞ্চলন শুরু হয় বিক্রয় দিয়ে, শেষ হয় ক্রয়ে আর, অন্য দিকে, মূলধন হিসেবে অর্থের সঞ্চলন শুরু হয় ক্রয় দিয়ে, শেষ হয় বিক্রয়ে। একটি ক্ষেত্রে যাত্রাবিন্দু এবং গন্তব্য বিন্দু দুই-ই হচ্ছে পণ্য, অন্য ক্ষেত্রটিতে, অর্থ। প্রথম রূপটিতে গতিক্রম সংঘটিত হয় অর্থের হস্তক্ষেপে, দ্বিতীয়টিতে পণ্যের।
প—অ-প সঞ্চলনে, অর্থ শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত হয় পণ্যে, যা কাজ করে ব্যবহার মূল্য হিসেবে। পক্ষান্তরে অপ-অ—এই বিপরীত রূপটিতে ক্রেতা অর্থ বিনিয়োগ করে যাতে করে বিক্রেতা হিসেবে সে আবার অর্থ ফেরৎ পায়। তার পণ্য ক্রয়ের দ্বারা সে অর্থ ছুড়ে দেয় সঞ্চলনে, যাতে করে আবার ঐ একই পণ্যের বিক্রয়ের দ্বারা সে সেই অর্থ তুলে নিতে পারে। সে অর্থকে হাতছাড়া করে কেবল এই ধূর্ত অভিসন্ধি নিয়েই যে ঐ অর্থ আবার তারই হাতে ঘুরে আসবে। সুতরাং যথার্থ ভাবে বললে, এ ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় করা হয়না, কেবল মাত্র আগাম দেওয়া হয়।[৩]
প—অপ—এই আবর্তে একই অর্থখণ্ড দুবার তার স্থান পরিবর্তন করে। বিক্রেতা অর্থখশুটি পায় ক্রেতার কাছ থেকে এবং দিয়ে দেয় আরেকজন বিক্রেতার কাছে। সম্পূর্ণ সঞ্চলনটি যার শুরু হয় পণ্যের জন্য অর্থের আদানে আর শেষ হয় তার প্রদানে অ—প-অ আবর্তটিতে কিন্তু যা ঘটে তা ঠিক এর বিপরীত। এখানে অর্থখণ্ডটি দুবার স্থান পরিবর্তন করে না, এখানে দুবার স্থান পরিবর্তন করে পণ্যটি। ক্রেতা পণাটিকে নেয় বিক্রেতার হাত থেকে এবং চালিয়ে দেয় আরেকজন ক্রেতার হাতে। ঠিক যেমন পণ্যের সরল সঞ্চলন একই অর্থখণ্ডের দুবার স্থান পরিবর্তনের ফলে সংঘটিত হয় তার এক হাতে অন্য হাতে স্থানান্তরণ ঠিক তেমনি এখানে। একই পণ্যের দুবার স্থান পরিবর্তনের ফলে সংঘটিত হয় অর্থের যাত্রা বিন্দতে। প্রত্যাবর্তন।
যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে পণ্যটি ক্রয় করা হয়েছিল, তা থেকে বেশী পরিমাণ অর্থে তার বিক্রয়ের উপরে এই প্রত্যাবর্তন নিভরশীল নয়। এই ঘটনা কেবল যে-পরিমাণ অর্থ ফিরে আসে, সেটাকেই প্রভাবিত করে। যে মুহূর্তে ক্রীত পণ্যটি পুনরায় বিক্রিত হয়, অর্থাৎ, যে-মুহূর্তে অ—প-অ আবর্তটি সম্পূৰ্ণায়িত হয়, সেই মুহূর্তেই প্রত্যাবর্তন ঘটে যায়। অতএব, এখানেই আমরা মূলধন হিসেবে অর্থের সঞ্চলন এবং নিছক অর্থ হিসেবে অর্থের সঞ্চলন—এই দুয়ের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করি।
যে-মুহূর্তে একটি পণ্যের বিক্রয়লব্ধ অর্থকে আবার আরেকটি পণ্যের বিক্রয়ের দ্বারা নির্শিত করা হয়, সেই মুহূর্তেই প-অপ আবর্তটির সমাপ্তি ঘটে।
যা-ই হোক, যদি তার যাত্রা বিন্দুতেই অর্থের প্রত্যাবর্তন ঘটে থাকে, তা হলে সেটা ঘটে থাকতে পারে কেবল প্রক্রিয়াটির পুনর্ঘটন বা পুনরাবৃত্তির ফলেই। যদি আমি এক কোয়ার্টার শস্য ৫৩ পাউণ্ডের বিনিময় বিক্রয় করি এবং এই £ পাউণ্ডের সাহায্যে কাপড়-চোপড় ক্রয় করি, তা হলে, আমার সঙ্গে যতটা সম্পর্ক, অর্থটা ব্যয় হয়ে গেল, কাজ চুকে গেল। অর্থ টির মালিক হল কাপড় ব্যবসায়ী। এখন যদি আমি দ্বিতীয় আর এক কোয়ার্টার শস্য বিক্রয় করি, তা হলে বাস্তবিকই অর্থ আমার কাছে ফিরে আসে, কিন্তু তা যে আসে সেটা প্রথম লেন-দেনের জের হিসেবে নয়, আসে তার পুনর্ঘটনের দরুন। যে-মুহূর্তে আমি একটি নতুন ক্রয়ের দ্বারা দ্বিতীয় লেনদেন-প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণায়িত করি, অর্থ আবার তখনি আমাকে ছেড়ে চলে যায়। সুতরাং প-অ—প আবর্তটিতে, অর্থের ব্যয়ের সঙ্গে তার প্রত্যাবর্তনের কোনো সম্পর্ক নেই। পক্ষান্তরে অপ-অ আবর্তটিতে, অর্থের প্রত্যাবর্তন তার ব্যয়ের পদ্ধতিটির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। এই প্রত্যাবর্তন ছাড়া, প্রক্রিয়াটি তার পরিপূরক পর্যায়টিকে তথা বিক্রয়ের ঘটনাটিকে ঘটাতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে যায় কিংবা তা ব্যাহত হয়, অসম্পূর্ণ থাকে।
প-অ—প আবর্তটি শুরু হয় একটি পণ্য দিয়ে এবং শেষ হয় আরেকটি পণ্য দিয়ে –যা সঞ্চলন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পরিভোগর কাজে লাগে। পরিভোগই অভাবের পরিতৃপ্তি, এক কথায়, ব্যবহার-মূল্যই তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে অপ-অ আবর্তটি শুরু হয় অর্থ দিয়ে, শেষও হয় অর্থ দিয়ে। এর প্রধান উদ্দেশ্য—এবং যে লক্ষ্যটি একে আকৃষ্ট করে, তা হচ্ছে কেবল বিনিময় মূল্য।
সরল পণ্য সঞ্চলনে, আবর্তটির দুটি চরম বিন্দুরই থাকে অর্থনৈতিক রূপ তারা উভয়ই হচ্ছে পণ্য-এবং একই মূল্যের পণ্য। কিন্তু তারা আবার ব্যবহার মূল্যও বটে—তবে ভিন্ন ভিন্ন গুণসম্পন্ন, যেমন শস্য এবং কাপড়চোপড়। সমাজের শ্রম যে-যে সামগ্রীতে মূর্ত তাদের মধ্যে বিনিময় তথা উৎপন্ন দ্রব্যাদির বিনিময়ই এখানে রচনা করে গতিক্রমটির ভিত্তি। কিন্তু অপ—অ আবর্তটিতে ব্যাপারটি ভিন্ন ধরনের; আপাত দৃষ্টিতে অপ—অ মনে হয় যেন নিরর্থক, কেননা দ্বিরুক্তিবাচক। দুটি চরম বিন্দুরই থাকে একই অর্থনৈতিক রূপ। দুটিই হচ্ছে অর্থ; সুতরাং তার গুণগত ভাবে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার মূল্য নয়। কেননা অর্থ হচ্ছে পণ্যসমূহেরই রূপান্তরিত রূপ, যে-রূপে তাদের বিশেষ বিশেষ ব্যবহার মূল্যগুলি অন্তর্হিত হয়ে যায়। তুলোর জন্য £১০০ পাউণ্ড বিনিময় করা এবং তারপর আবার £১ . ৫ পাউণ্ডের জন্য সেই তুলোকে বিনিময় করা হচ্ছে কেবল অর্থের জন্য অর্থকে একই দ্রব্যের জন্য একই দ্রব্যকে বিনিময়ের ঘোরানো পদ্ধতি মাত্র; মনে হয় যেন গোটা ব্যাপারটাই যেমন নিরর্থক, তেমনি আজগুবি।[৪] একটা টাকার অঙ্কের সঙ্গে আরেকটা টাকার অঙ্কের পার্থক্য কেবল পরিমাণে। সুতরাং‘অপ—অ প্রক্রিয়াটির প্রকৃতি ও প্রবণতা তার চরম বিন্দুটির মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য থেকে উদ্ভূত নয়, কারণ দুই-ই হচ্ছে অর্থ; পার্থক্যটা পুরোপুরি তাদের পরিমাণগত ভিন্নতা থেকে উদ্ভূত। শুরুতে যে-পরিমাণ অর্থ সঞ্চলনে ছোড়া হয়েছিল, শেষে তার চেয়ে বেশী পরিমাণ অর্থ তুলে নেওয়া হয়। যে-তুলো কেনা হয়েছিল £১ ০ ০ পাউণ্ডের বিনিময়ে, সেটা আবার বেচে দেওয়া হল হয়তো £১০০+৪১ ০ = £১১০ পাউণ্ডের বিনিময়ে। এই প্রক্রিয়াটির যথাযথ রূপ দাড়ায় অ—প—অ’, যেখানে অ অ+ / অ=গোড়ায় আগাম দেওয়া অঙ্ক+বর্ধিত অংশ। এই বর্ধিত অংশ অর্থাৎ গোড়ায় আগাম দেওয়া মূল্যটির সঙ্গে যে বাড়তিটুকু যোগ হল, তাকে আমি বলছি*উদ্বত মূল্য”। অতএব, সঞ্চলনের প্রক্রিয়ার গোড়ায় আগাম দেওয়া মূল্যটি যে কেবল অটুটই থাকে, তাই নয়, তা নিজেকে বর্ধিত করে তথা নিজের সঙ্গে উদ্ধৃত্ত মূল্য যুক্ত করে। এই গতিক্রমই তাকে মূলধনে রূপান্তরিত করে।
অবশ্য, এটাও সম্ভব যে প—অ—প আবর্তে দুটি চরম বিন্দু প—প, ধরা যাক শস্য এবং কাপড়, ভিন্ন ভিন্ন অঙ্কের মূল্যেরও প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। কৃষক তার শস্য মূল্যের চেয়ে বেশিতে বিক্রয় করতে পারে কিংবা কাপড় ক্রয় করতে পারে মূল্যের চেয়ে কমে। আবার কাপড় ব্যবসায়ীর হাতে সে “চোট”-ও খেতে পারে। কিন্তু উপস্থিত আমরা সঞ্চলনের যে-রূপটি নিয়ে আলোচনা করছি, মূল্য এই ধরনের পার্থক্য একেবারেই আপতিক। শস্য এবং কাপড় যে সমার্থ, তাতে এই প্রক্রিয়াটি নিরর্থক হয়ে যায় না, যেমন হয়ে যায় অপঅ আবর্তটির ক্ষেত্রে। বরং তাদের মূল্যের সমার্ঘতাই হচ্ছে তার স্বাভাবিক গতিক্রমের একটি আবশ্যিক শর্ত।
ক্রয়ের উদ্দেশ্য বিক্রয়ের পুনর্ঘটন বা পুনরাবৃত্তি স্বরূপ যে ক্রিয়া তা তার যে উদ্দেশ্যে তার দ্বারাই সীমাবদ্ধ থাকে; সে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে পরিভোগ যা নির্দিষ্ট অভাবের পরিতৃপ্তি সাধন-এননি একটি উদ্দেশ্য যা পুরোপুরিই সঞ্চলনের পরিধির বহিভূত। কিন্তু, পক্ষান্তরে, আমরা যখন বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রয় করি, আমরা যে-জিনিস দিয়ে শুরু করি সেই জিনিসেই শেষ করি সেটি হচ্ছে অর্থ বা বিনিময় মূল্য; আর তার ফলে গতিক্রমটি হয় সীমাহীন। সন্দেহ নেই যে, অ হয়ে ওঠে অ+ অ, £১০০ হয়ে ওঠে £১১০ পাউণ্ড। কিন্তু যখন একমাত্র গুণগত দিক থেকেই তাদের দেখা হয় তখন £১০০ পাউণ্ড আর £১১০ পাউণ্ড তা একই অর্থাৎ অর্থ; আর যদি পরিমাণগত ভাবে দেখা হয়, তা হলে £১০০ পাউণ্ড ৪১ ০ ০ পাউণ্ডের মতোই একটি নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ অঙ্কের মূল্য। এখন যদি £১১০ পাউণ্ডকে অর্থ হিসাবে ব্যয় করা হয়, তা হলে তা আর তার ভূমিকা পালন করতে পারে না। তা আর মূলধন নয়। সঞ্চলন থেকে প্রত্যাহৃত হয়, তা শিলীভূত হয় মওজুদের আকার আর যদি শেষ বিচারের দিন পর্যন্তও তা সেখানে থাকে, তা হলেও একটি ফার্দিংও তার সঙ্গে যুক্ত হবে না। তা হলে, মূল্যের সম্প্রসারণই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে £১ ০ ০ পাউণ্ডের মূল্য বিবর্ধনে ও যা প্রেরণা হিসাবে কাজ করে, £১১০ পাউণ্ডের বেলায়ও তা-ই, কেননা উভয়ই হচ্ছে বিনিময়মূল্যের সীমাবদ্ধ অভিব্যক্তি মাত্র; সুতরাং উভয়েই সংবর্ধনার পথ একই—পরিমাণগত বুদ্ধির মাধ্যমে পরমতম ধনবৃদ্ধির নিকটতম হওয়া। গোড়ায় আগাম দেওয়া মূল্যটি থেকে ১০০ পাউণ্ড থেকে সঞ্চলন-প্রক্রিয়ায় তার সঙ্গে যে উদ্ধৃত্ত মূল্য ৪১ ০ পাউণ্ড সংবৃত্ত হল, সেই উদ্বৃত্ত মূল্যটিকে কেবল স্বল্পকালে জন্যই পার্থক্য করা যায়; অতি অল্প কালের মধ্যেই এই পার্থক্য অন্তর্হিত হয়ে যায়। প্রক্রিয়াটির প্রান্তে উপনীত হয়ে এমনটি ঘটতে যে আমরা একহাতে পেলাম মূল £১০০ পাউণ্ড আর আরেক হাতে উদ্বৃত্ত £১০ পাউণ্ড। আমরা পাই কেবল £১১০ পাউণ্ডের একটি মূল্য, অবস্থার দিক থেকে এবং যোগ্যতার দিক থেকে সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া শুরু করার ব্যাপারে মূল্য ১০০ পাউণ্ডেরও যে অবস্থা ও ঘোগ্যতা ছিল, এই £১১০ পাউণ্ডেরও তা আছে। অর্থ গতিক্রমের সুচনা করে কেবল তাকে আবার সমাপ্ত করার জন্যই।[৫] অতএব প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র আবর্তের এমন একটি আবর্ত যাতে একটি ক্রয় ও তদনুসারী একটি বিক্রয় সম্পূর্ণায়িত হয়েছে তেমন একটি আবতনের চূড়ান্ত ফল তার নিজের মধ্যে থেকেই গড়ে দেয় নতুন আরেকটি আবর্তের বীজ। বিক্রয়ের জন্য ক্রয়-এই যে সরল পণ্য-সঞ্চলন, এটা হচ্ছে এমন একটি উদ্দেশ্য সাধনের উপায়, সঞ্চলনের সঙ্গে যার সংযোগ নেই, যথা ব্যবহার মূল্যের পরিভোগ, অভাবের পরিতৃপ্তি। পক্ষান্তরে, মুলধন হিসেবে অর্থের যে সঞ্চলন তা ইচ্ছে নিজেই নিজের উদ্দেশ্য, কেননা কেবল নিরন্তর পুনর্ঘটিত গতিক্রমের মধ্যেই ঘটতে পারে মূল্যের সম্প্রসারণ। সুতরাং মূলধনের সঞ্চলনের কোন সীমা নেই।[৬]
এই গতিক্রমের সচেতন প্রতিনিধি হিসেবে অর্থের মালিক পরিণত হয় মূলধনিকে (পুজিবাদীর-অনুঃ) তাঁর দেহ, বরং বলা উচিত তার পকেট, পরিণত হয় সেই বিন্দুতে যেখান থেকে শুরু হয় অর্থের যাত্রা এবং যেখানে সারা হয় অর্থের প্রত্যাবর্তন। অপ-অ সঞ্চলনের বিষয়গত ভিত্তি তথা উৎসমুখ হচ্ছে মূল্যের সম্প্রসারণ; আর এই মূল্যের সম্প্রসারণই হয়ে ওঠে পুজিপতির বিষয়ীগত লক্ষ্য; এবং যে-মাত্রায় তার কাজ কারবারের একমাত্র লক্ষ্য থাকে নিষ্কর্ষিত আকার আরো এবং আরো ধনের আয়ত্তীকরণ, সেই মাত্রায় তার ভূমিকা হচ্ছে পুঁজিবাদীর ভূমিকা তথা, চেতনা ও ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরূপে রূপায়িত মূলধনের ভূমিকা। সুতরাং ব্যবহার মূল্যকে কখনো পুজিবাদীর আসল লক্ষ্য বলে গণ্য করলে চলবেনা।[৭] কোন একটি মাত্র লেনদেন থেকে পাওয়া মুনাফাকেও না। যা তার লক্ষ্য তা হচ্ছে মুনাফা সংগ্রহের এক বিরামহীন বিরতিহীন প্রক্রিয়া।[৮] ঐশ্বর্যের প্রতি এই সীমাহীন লোলুপতা, বিনিময়মূল্যের আসক্তিতে এই উন্মাদনাপূর্ণ পশ্চাদ্ধাবন[৯]—এটা পুজিবাদী এবং কৃপণ উভয়ের মধ্যেই লক্ষণীয় কিন্তু যেখানে কৃপণ ব্যক্তি হচ্ছে পাগল হয়ে যাওয়া পুজিবাদী সেখানে পুজিবাদী ব্যক্তিটি হচ্ছে বুদ্ধি-বিবেচনা-সম্পন্ন কৃপণ। সঞ্চলন থেকে নিজের অর্থকে তুলে নিয়ে বিনিময়মূল্যের সীমাহীন সংবর্ধনই হচ্ছে কৃপণের একমাত্র উদ্দেশ্য কিন্তু পুঁজিবাদী[১০] সেই একই উদ্দেশ্য সাধন করে বারংবার তার অর্থকে সঞ্চলনের মধ্যে ছুড়ে দিয়ে।[১১]
সরল সঞ্চলনের ক্ষেত্রে পণ্যদ্রব্যাদির মূল্য যে স্বতন্ত্র রূপ—অর্থরূপ—পরিগ্রহ করে, তা কেবল একটি উদ্দেশ্যেই কাজ করে; সে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে তাদের বিনিময়; গতিক্রমের চুড়ান্ত পরিণতিতে তা অন্তর্হিত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে অ—প-অ সঞ্চলনে, অর্থ এবং পণ্য দুই-ই খোদ মূল্যেরই অস্তিত্ব ধারণের বিভিন্ন পদ্ধতির, সাধারণ রূপে অর্থের এবং প্রচ্ছন্ন রূপে পণ্যের প্রতিনিধিত্ব করে।[১২] তা নিরন্তর একরূপ থেকে অন্যরূপে রূপান্তরিত হয় কিন্তু হারিয়ে যায় না, এবং এই ভাবে তা আপনা আপনিই সক্রিয় চরিত্র ধারণ করে। নিজের জীবনক্রমে স্বয়ংসম্প্রসারণশীল মূল্য পরস্পরাগত ভাবে যে দুটি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে, সেগুলিকে যদি আমরা পালাক্রমে আলোচনা করি, তা হলে আমরা এই দুটি প্রবক্তব্যে উপনীত হই : মূলধন হচ্ছে অর্থ : মূলধন হচ্ছে পণ্য।[১৩] আসলে কিন্তু, মূল্য হচ্ছে এখানে এমন একটি প্রক্রিয়ার একটি সক্রিয় উপাদান, যে প্রক্রিয়াটিতে তা, পালাক্রমে ক্রমাগত অর্থ এবং পণ্যের রূপ পরিগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে যুগপৎ আয়তনের দিক থেকে পরিবর্তিত হয়, নিজের মধ্য থেকে উদ্ধৃত মূল্যকে উৎক্ষিপ্ত করে নিজেকে পৃথগায়িত করে; ভাষান্তরে বলা যায়, মূল মূল্যটি স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে নিজেকে সম্প্রসারিত করে। কেননা যে গতিক্রমের পথে সে উদ্ধও মূল্য সংযুক্ত করে তা তার নিজেরই গতিক্রম। সুতরাং তার সম্প্রসারণ হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় সম্প্রসারণ। যেহেতু সে হচ্ছে মূল্য, সেহেতু নিজের সঙ্গে মূল্য সংযুক্ত করার গূঢ় গুণটি সে আয়ত্ত করে নিয়েছে। সে জন্ম দেয় জীবন্ত সন্তান, কিংবা অন্ততঃ প্রসব করে সুবর্ণ ডিম্ব।
যেহেতু এই প্রক্রিয়ার সক্রিয় উপাদানটি হচ্ছে মূল্য এবং সে একসময়ে ধারণ করে অর্থের রূপ, অন্য সময়ে পণ্যের, কিন্তু সব সময়ে সংরক্ষিত ও সম্প্রসারিত করে নিজেকে, সেহেতু তার আবশ্যক হয় একটি স্বতন্ত্র রূপের—যার সাহায্যে যে কোনো সময়ে তার স্বপরিচয় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এবং এই যে রূপ, সেটি সে ধারণ করে কেবল অর্থের আকারেই। অর্থ রূপের অধীনেই মূল্যের প্রত্যেকটি স্বয়ংক্রিয় প্রজনন ক্রিয়ার শুরু এবং শেষ—এবং আবার শুরু। তার শুরু হয়েছিল £১০০ পাউণ্ড হিসেবে, এখন তা হয়েছে £১১০ পাউণ্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু অর্থ নিজে হচ্ছে মূল্যের দুটি রূপের একটি মাত্র। যদি তা কোন পণ্যের রূপ ধারণ না করে, তা হলে তা মূলধন হয়ে ওঠে না। মওজুদের ক্ষেত্রে যেমন অর্থ এবং পণ্যের মধ্যে বিরোধ থাকে, এক্ষেত্রে অবশ্য তেমন কোন বিরোধ নেই। পুঁজিবাদী জানে যে সমস্ত পণ্যই—তা তাদের চেহারা যত কুৎসিৎই হোক না কেন কিংবা তাদের গন্ধ যতই উৎকটই হোক না কেন, তা হচ্ছে মনপ্রাণে অর্থ তথা ভিতরে ভিতরে সুন্নৎ করা ইহুদী এবং তার চেয়েও বেশী, একটা বিস্ময়কর উপায় যার সাহায্যে অর্থ থেকে আরো বেশী অৰ্থ তৈরী করা যায়।
প—অ—প সরল সঞ্চলনে পণ্যমূল্য বড় জোর উপনীত হয় পণ্যের ব্যবহার মূল্য থেকে নিরপেক্ষ একটি রূপে — তথা অর্থ রূপে, কিন্তু সেই একই মূল। এখন অ—প-অ সঞ্চলনে তথা মূলধন সঞ্চলনে, অকস্মাৎ নিজেকে উপস্থাপিত করে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে—এমন একটি স্বতন্ত্র সত্তা যার আছে নিজস্ব গতিবেগ, যা অতিক্রান্ত হয় নিজস্ব এমন একটি জীবন বৃত্তের মধ্য দিয়ে যাতে অর্থ এবং মুদ্রার ভূমিকা কেবল দুটি রূপ হিসেবে, যে-রূপ দুটি সে পালাক্রমে পরিগ্রহ করে এবং পরিত্যাগ করে। না, তার চেয়েও বেশি : কেবলমাত্র পণ্যদ্রব্যাদির সম্পর্ক সমূহর প্রতিনিধিত্ব করার পরিবর্তে, সে এখন প্রবেশ করে নিজের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক সমূহের মধ্যে উত্ত মূল্য হিসেবে। নিজের মধ্যেই সে পৃথগায়িত করে মূল মূল্য রূপে এবং উদ্ধৃত্ত মূল্য রূপে, যেমন জনক নিজেকে পৃথগায়িত করে তার জাতক থেকে—যদিও উভয়ই একবয়সী বা সমবয়সী; কেননা কেবলমাত্র £১০ পাউণ্ডের উদ্বৃত্ত মূল্যের দ্বারাই গোড়ায় আগাম দেওয়া £১ ০ ০ পাউণ্ড মূলধন হয়ে ওঠে এবং যে মুহূর্তে এটা ঘটে যায় সেই মুহূর্তেই জাতকের, এবং জাতকের মাধ্যমে জনকের, জন্ম ঘটে এবং তাদের পার্থক্যও হয় তিরোহিত এবং তারা পরিণত হয় £ ১০ পাউণ্ডে।
এইভাবে মূল্য এখন পরিণত হয় প্রক্রিয়াশীল মূল্যে, প্রক্রিয়াশীল অর্থে তথা মূলধনে। তা সঞ্চলন থেকে বেরিয়ে আসে। আবার ঢুকে যায় তারই মধ্যে, তার আবর্তের মধ্যে নিজেকে রক্ষা ও বৃদ্ধি করে, সম্প্রসারিত আয়তন নিয়ে তা থেকে বেরিয়ে ফিরে আসে, এবং আবার নতুন করে একই পরিক্রমণ শুরু করে।[১৪]
অ—অ অর্থ ই অর্থের জন্ম দেয়, এটাই হচ্ছে মূলধন’-এর বর্ণনা যা আমরা পেয়েছি তার প্রথম ভাষ্যকারদের কাছ থেকে, বাণিজ্যবাদীদের কাজ থেকে।
বিক্রয়ের জন্য ক্রয়, কিংবা ঠিক ভাবে বললে মহার্ঘতর বিনিময়ে বিক্রয়ের জন্য ক্রয়, অপ—অ’ নিশ্চিত ভাবে দেখা দেয় এমন একটি রূপে যা কেবল এক ধরনের মূলধনেরই বৈশিষ্ট্য—বাণিজ্য-মূলধনের। কিন্তু শিল্প-মূলধনও হচ্ছে অর্থ, যা পরিবর্তিত হয় পণ্যদ্রব্যাদিতে এবং সেই পণ্যদ্রব্যাদির বিক্রয়ের মাধ্যমে পুনঃরূপান্তরিত হয় অধিকতর পরিমাণ অর্থে। বিক্রয় এবং ক্রয়ের অন্তর্বতী অবকাশ, সঞ্চলনের বাইরে যেসব ঘটনা ঘটে, তা তার গতিক্রমকে ক্ষুন্ন করে না। সর্বশেষে, সুদ-প্ৰজনক মূলধনের ক্ষেত্রে, অপ-অসঞ্চলনটি সংক্ষেপিত বলে প্রতীয়মান হয়। মধ্যবর্তী স্তরটি ডিঙিয়েই তার ফলশ্রুতি আমরা পেয়ে যাই অ-অ-এর রূপে “en style lapidaire, অথ যা বেশী অর্থের সমান, মূল্য বা নিজের চেয়ে বেশী।
সুতরাং, বাস্তবিক পক্ষে,—অপ-অ—হচ্ছে মূলধনের সাধারণ সুত্র, সঞ্চলনের পরিধিতে যা স্বতঃসিদ্ধ ভাবে দেখা দেয়।
————
১. কর্তৃত্ব ও দাসত্বের ব্যক্তিক সম্পর্কের উপরের প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতা আসে ভূমি সম্পত্তি থেকে; নৈর্ব্যক্তিক ক্ষমতা আসে অর্থের অধিকার থেকে। এই দু’ধরনের ক্ষমতার মধ্যে প্রতিতুলনা দুটি ফরাসী প্ৰচলনে সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, “Nulle terre sans seigneur,” uge “L’argent n’a pas de maitre”
২. «Avec de l’argent on achete des marchandises et avec des marchandises on achete de l’argent.” (Mercier dela Riviere :: *L’ordre naturel et essentiel des societes politiques”. p. 543),
৩. “যখন কোন জিনিস আবার বিক্রীত হবার উদ্দেশ্যে ক্রীত হয়, তখন যে অর্থ নিযুক্ত করা হয় তাকে বলা হয় আগাম; যখন বিক্রীত হবার উদ্দেশ্যে ক্রীত হয় না, সেই অর্থকে ধরা যায় ব্যয় বলে। (James Steuart: Works, &c Edited by Gen. Sir James Steuart, bis-son. London 1805, V.I.P. 274)
৪. “On n’echange pas de l’argent contre de l’argent”, atfate বাদীদের উদ্দেশ্য করে বলেন Mercier de la Riviere (i. c. p. 486)। ‘বাণিজ্য’ ও ‘ফটকা নিয়ে আলোচনা বলে বর্ণিত একটি বই-এ এই অনুচ্ছেদটি রয়েছে : সমস্ত বাণিজ্যই হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের দ্রব্যাদির মধ্যে বিনিময় এবং এই বিভিন্নতা থেকেই সুবিধার উদ্ভব ঘটে (বণিকেরই কাছে?)। এক পাউণ্ড রুটির সঙ্গে এক পাউণ্ড রুটির বিনিময় হলে কোনো সুবিধারই উদ্ভব ঘটত না। এই কারণেই বাণিজ্যকে সঠিক ভাবে জুয়ার সঙ্গে পার্থক্য করা হয়, যা হচ্ছে কেবল অর্থের সঙ্গে অর্থের বিনিময়। (Th. corbet, “An Inquiry into the Causes and Modes of the wealth of Individuals; or the principles of Trade and speculation Explained,” London, 1841, p. 5), afe Pett দেখতে পান না যে অ-অ অর্থাৎ অর্থের সঙ্গে অর্থের বিনিময় কেবল বণিক-মূলধনেই নয়, সমস্ত মূলধনেরই চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, তবু তিনি স্বীকার করেন যে এই রূপটি জুয়ার সঙ্গে এবং এক ধরনের বাণিজ্যের—ফকার—সঙ্গে অভিন্ন; কিন্তু তার পরেই আসেন ম্যাক-কুলক এবং আবিষ্কার করেন যে বিক্রয় করার জন্য ক্রয় করাও হচ্ছে ফটকাবাজি এবং এইভাবে বাণিজ্য এবং ফটকাবাজির মধ্যে পার্থক্যটা অন্তর্হিত হয়ে যায় : “এমন প্রত্যেকটি লেন-দেন যাতে কোন ব্যক্তি উৎপন্ন দ্রব্য ক্রয় করে আবার তা বিক্রি করার জন্য, তাই হল ফটকা” (Mac Culloch : A Dictionary Practical &c of Commerce, London, 1847, p. 1009)। আরে সরলতা সহকারে আমস্টার্ডাম স্টক-এক্সচেঞ্জ-এর পাণ্ডা পিঞ্চো বলেন, “Le commerce est un jeu (taken from Locke ) et ce n’est pas avec des gueux qu’on peut gagner. Si l’on gagnait longsemps en tout avec tous, il faudrait rendre de bon accord les plus grandes parties du profit pour recommencer le jeu.” ( Pinto, Traite de la Circulation et du credit,” Amsterdam, 1171, p. 231 )
৫. মূলধন বিভাজ্য, মূল অংশে এবং মুনাফা বা মূলধনে সংযোজিত অংশে….. কার্যত কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই পরিণত হয় মূলধনে এবং গতিশীল হয় মূল মূলধনের সঙ্গে।” ( F. Engels “Umrisse zu einer Kritik der National-okonomie, in Deutsch-Franzosische Jahrbucher, herausgegeben von Arnold Ruge und Karl Marx”, Paris, 1844, p. 99 )
৬. অ্যারিস্ততল ক্রেমাটিষ্টিক-এর পাল্টা হিসেবে স্থাপন করেন ‘ইকনমিক’-কে। তিনি শুরু করেন ইকনমিক’ থেকে। যতক্ষণ পর্যন্ত এটা হচ্ছে জীবিকা অর্জনের উপায়, ততক্ষণ তা কেবল সেই সব দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে যেগুলি জীবনধারণের পক্ষে অপরিহার্য এবং গার্হস্থ্য কিংবা রাষ্ট্রকার্যের জন্য প্রয়োজনীয়। “এই ধরনের ব্যবহার-মূল্যগুলিই হল যথার্থ ধন; কেননা জীবনকে সুখকর করতে পারে এই ধরনের বিষয়-সম্পদের পরিমাণ সীমাহীন নয়। কিন্তু দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ আরো একটি উপায় আছে, যে উপায়টিকে আমরা পছন্দমত ও সঠিক ভাবে ক্রেমাটিস্টিক’ বলে অভিহিত করতে পারি এবং এ ক্ষেত্রে ধন-দৌলত ও বিষয়-সম্পদের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। বাণিজ্য ( আক্ষরিক অর্থে খুচরে। বাণিজ্য এবং অ্যারিস্ততল এটাই ধরেছেন কেননা একে ব্যবহার-মূল্যেরই প্রাধান্য) ক্রেমাটিষ্টিক’-এর অন্তর্গত নয় কারণ এখানে বিনিময় কেবল তাদের নিজেদের (ক্রেতা ও বিক্রেতার) পক্ষে যা যা প্রয়োজনীয়, তার সঙ্গেই সম্পর্কিত। অতএব, যা তিনি দেখিয়েছেন, বাণিজ্যের মূল রূপ ছিল ব্য-বিনিময়, কিন্তু দ্রব্য বিনিময়ের বিস্তার লাভের সঙ্গে সঙ্গে অর্থের আবশ্যকতা দেখা দিল। অর্থের আবিষ্কারের পরে দ্রব্য-বিনিময় স্বতঃই বিকাশ লাভ করল পণ্য নিয়ে বাণিজ্যে এবং তা আবার মূল প্রবণতার পরিপন্থী ক্রেমাটিস্টিক’-এ, অর্থ অর্জনের উপায়ে, পরিণত হল। এখন, ‘ইকনমিক’ থেকে ‘মোটিস্টিক’-কে এই ভাবে পার্থক্য করা যায় যে, “ক্রেমাটিষ্টিক’-এর ক্ষেত্রে সঞ্চলনই হচ্ছে ঐশ্বৰ্ষর উৎস। এবং তা প্রতিভাত হয় একটা অর্থ কেন্দ্রিক ব্যাপারে, হিসাবে, কারণ অর্থ ই হচ্ছে এই বিনিময়ের শুরু এবং শেষে। সুতরাং, যে ঐশ্বর্যের জন্য ক্রেমাটিষ্টিক চেষ্টা করে, সেই ঐশ্বর্যও সীমাহীন। ঠিক যেমন প্রত্যেকটি উপায়, যা কোনো উপলক্ষ্য নয়, নিজেই একটি লক্ষ্যস্বরূপ। তার উদ্দেশ্যের কোনো মাত্রা নেই, কেননা তা সব সময়েই সেই সব উপায় যেগুলি লক্ষ্যের দিকে উদ্দিষ্ট, সেগুলি সীমাহীন নয় কেননা নির্দিষ্ট লক্ষ্যটিই কতকগুলি সীমা আরোপ করে দেয়, ঠিক তেমন ক্ৰেমাটিস্টিক-এর ক্ষেত্রেও তার লক্ষ্যের কোনো মাত্রা নেই, সেই লক্ষ্য হল চূড়ান্ত ধন-সম্পদ; ইকনমিকের সীমা আছে, ক্রেমাটিষ্টিকের নেই। … ইকনমিকের লক্ষ্য অর্থ ছাড়া অন্য কিছু, ক্রেটিষ্টিকের লক্ষ্য অর্থের বৃদ্ধি সাধন।……”এই দুটিকে গুলিয়ে ফেলে কিছু লোক সীমাহীন ভাবে অর্থের সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি সাধনকেই ইকনমিকের লক্ষ্য হিসাবে দেখে থাকেন।” (Aristotle, “De Rep.” edit. Bekker. lib. l.c. 8,9 Passim.)।
৭. পণ্যদ্রব্যাদি (এখানে ব্যবহৃত হয়েছে ব্যবহার মূল্য হিসাবে ) কখনো ব্যবসায়ী-পুজিপতির শেষ বিষয় নয়, তার শেষ বিষয় হচ্ছে অর্থ’ (Th. Chalmers ‘On pol. Econ, 2nd Edn. Glasgow 1832, p. 165, 166).
৮. “Il mercante non conta quasi per niente il lucro fatto, ma mira sempre al futuro.’ (A. Genovesi, Lezioni di Economia Civile 1765 custodi’s edit of Italian Economists parte Moderna t VIII P. 139.)।
৯. ‘লাভের লালসায় এক অনির্বাপনীয় উন্মাদনা সর্বদাই প জিপতিদের তাড়া P68 GTEICS I (Mac Culloch. ‘Principles of Polit. Econ. Lond 1830 P.179 ). অবশ্য যখন ম্যাক-কুলক এবং তাঁর ধাতের ললাকেরা অতি-উৎপাদনের প্রশ্ন ইত্যাদির মততগত অসুবিধার পড়েন, তখন এই মত তাদের নিরস্ত করেন। এই একই পুঁজিপতিকে এমন একজন নীতিবাস নাগরিকে রূপান্তরিত করতে, যার একমাত্র আগ্রহ হচ্ছে ব্যবহার মূল্যের প্রতি এবং যে এমনকি জুতো, টুপি, ডিম, ক্যালিকো এবং অন্যান্য অত্যন্ত পরিচিত ধরনের ব্যবহার-মূল্যগুলির জন্যও তৃপ্তিহীন ক্ষুধা অনুভব করে।
১০. মওজুদের জন্য গ্রীক বর্ণনার একটি চরিত্র। তেমনি ইংরেজদেরও সঞ্চয়ের দুটি অর্থ : Sauver ও epargner.
১১. “Questo infinito che le cose non hanno in progresso, hanno in giro” (Galiani ).
১২. “Ce n’est pas la matiere qui fait le capital, mais la valeur de ces matieres.’ (J. B. Say: “Traite d’Econ. polit.” 3 eme ed Paris 1817 tii P 429).
১৩. দ্রব্যাদি উৎপাদনে নিয়োজিত ‘কারেন্সি’-কে (!) বলা হয় মূলধন’। (ম্যাকলিয়ড, থিয়োরি অ্যাও প্রাকৃটিস অফ ব্যাংকিং লণ্ডন ১৮৫৫ পৃ: ৫৫)। ‘মূলধন হচ্ছে পণ্যদ্রব্য। (জেমস্ মিল, ‘এলিমেন্টস অব পল ইকন’ লণ্ডন ১৮২১, পৃঃ ৭৪)।
১৪. Capital : ‘protion fructifiante de la richesse accumulee…… valeur permanente, multipliante (Sismondi Nouveaux “Principes d Econ-Polit, p. ৪৪, ৪9).