০৬. শ্রমশক্তির ক্রয়-বিক্রয়

ষষ্ঠ অধ্যায় শ্রমশক্তির ক্রয়বিক্রয়

মূলধনে রূপান্তরণের জন্য উদ্দিষ্ট অর্থরে ক্ষেত্রে মূল্যের যে পরিবর্তন ঘটে, সেই পরিবর্তন অর্থের নিজের মধ্যে ঘটতে পারে না, কেননা, ক্রয় ও প্রদানের উপায় হিসেবে তার যে ভূমিকা, তা তার সাহায্যে ক্রীত পণ্যটির দামকে বাস্তবায়িত করার বেশি কিছু করে না; এবং নগদ টাকা হিসেবে তা হচ্ছে শিলীভূত মূল্য, যা কখনো পরিবর্তন শীল নয়।[১] সঞ্চলনের দ্বিতীয় ক্রিয়াটিতেও, উক্ত পণ্যটির পুনঃবিক্রয়ের ক্রিয়াটিতেও, তা কিছুর উদ্ভব ঘটাতে পারে না, কেননা এক্ষেত্রেও তা পণ্যটির দেহগত রূপটিকে পুনরায় তার অর্থরূপে রূপায়িত করা ছাড়া আর কিছু করে না। সুতরাং পরিবর্তন যা ঘটে, তা অবশ্যই ঘটে পণ্যটির মধ্যে এবং তা ঘটে প্রথম ক্রিয়াটিতে, অ-প পর্যায়টিতে; কিন্তু তার মূল্যে কোনো পরিবর্তন ঘটে না, কেননা বিনিময় ঘটে সমান সমানের মধ্যে এবং পণ্যটির পূর্ণ মূল্যই তার জন্য যা দেয় তা দেওয়া হয়। অতএব, আমরা এই সিদ্ধান্ত করতে বাধ্য হই যে পরিবর্তনের সূচনা হয় পণ্যটির ব্যবহার মূল্যের মধ্যে অর্থাৎ তার পরিভোগর মধ্যে। কোন পণ্যের পরিভোগ থেকে মূল্য নিষ্কর্ষিত করতে হলে, আমাদের বন্ধু শীটাকাভর থলিওয়ালা’কে এমন ভাগ্য করতে হবে যে, সঞ্চলনের পরিধির মধ্যেই তথা, বাজারেই, তাকে খুঁজে পেতে হবে একটি পণ্য, যার ব্যবহার-মূল্যের রয়েছে এই স্ববিশিষ্ট ক্ষমতা যে তা হবে মূল্যের একটি উৎসম্বরূপ, যে পণ্যটির পরিভোগ-ক্রিয়াটি নিজেই হচ্ছে শ্রমের একটি ঘূর্তরূপ এবং, সেই কারণেই মূল্যের সৃষ্টি। অর্থের অধিকারী ব্যক্তিটি অবশ্য বাজারে শ্রমক্ষমতা বা শ্রম শক্তির মধ্যে এমন একটি বিশিষ্ট পণ্যের সাক্ষাৎ পায়।

শ্রমশক্তি বা এমক্ষমতা বলতে বুঝতে হবে কোন মানুষের মধ্যে যে সব মানসিক ও শারীরিক ক্ষমতা থাকে, যে ক্ষমতাসমূহকে সে যে-কোন ধরনের ব্যবহার-মূল্য উৎপাদন করতে গেলেই প্রয়োগ করে—সেই সব ক্ষমতার মোট সমষ্টিকে।

কিন্তু যাতে করে আমাদের টাকাওয়ালা ব্যক্তিটি পণ্য হিসাবে বিক্রয়ের জন্য উপস্থাপিত শ্রমের সাক্ষাৎ পায়, সেজন্য চাই নানাবিধ শর্তের পরিপূরণ। পণ্য বিনিময়ের নিজের প্রকৃতি থেকে যে-সব পরাপেক্ষিতার সম্পর্কের উদ্ভব ঘটে, সেই সম্পর্কসমূহ ব্যতীত অন্য কোনো সম্পর্কই স্বয়ং পণ্য-বিনিময় আভাসিত করে না।

যদি এটা ধরে নেওয়া হয় তা হলে বাজারের শ্রমশক্তি পণ্য হিসেবে কেবল তখনি এবং ততটা পরিমাণেই আবিভূত হতে পারে, যখন এবং যতটা পরিমাণে তার অধিকারী অর্থাৎ সেই ব্যক্তিটি যে সেই শ্রমশক্তির ধারক তার সেই শক্তিকে বিক্রয়ের জন্য তথা পণ্য হিসেবে উপস্থাপিত করে। যাতে করে সে তা করতে পারে সেইজন্য তাকে হতে হবে তার নিজের শ্রমক্ষমতার তথা নিজের ব্যক্তিসত্তার নিঃশত মালিক।[২] সে এবং টাকাওয়ালা ব্যক্তিটি পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাজারে এবং পরস্পরের সঙ্গে সমান অধিকারের ভিত্তিতে; পার্থক্য থাকে কেবল এই যে একজন হচ্ছে ক্রেতা এবং অন্যজন বিক্রেতা; আইনের চোখে দুজনেই সমান। এই যে সম্পর্ক, তার ধারাবাহিক . দাবি করে যে শ্রমশক্তির মালিক তার শ্রমশক্তি বিক্রয় করবে কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই, কারণ সে যদি তা বিক্রয় করে দেয় সব কিছু সমেত সর্বকালের জন্য, তা হলে সে তো নিজেকেই বিক্রয় করে দেবে এবং স্বাধীন মানুষ থেকে পর্যবসিত হবে ক্রীতদাসে, পণ্যের মালিক থেকে নিছক একটা পণ্যে। তাকে নিরন্তর তার শ্রমশক্তিকে গণ্য করতে হবে তার সম্পত্তি হিসেবে, পণ্য হিসেবে এবং তা সে কেবল তখনি পারবে যখনি সে তার শ্রমশক্তিকে ক্রেতার অধীনে রাখে। কেবল সাময়িক ভাবেই, একটা নির্দিষ্ট সময়কালের শর্তেই। কেবল এই ভাবেই সে পারে তার শ্রমশক্তির উপরে তার যে অধিকার, সেই অধিকার। পরিত্যাগের ঘটনাকে পরিহার করতে।[৩]

টাকাওয়ালা ব্যক্তিটি যাতে বাজারে শ্রমশক্তির সাক্ষাৎ পায় তার জন্য দ্বিতীয় অপরিহার্য শর্তটি হচ্ছে এই : যে পণ্যসামগ্রীতে তার শ্রম বিধৃত সেই পণ্যসামগ্রী সে নিজেই বিক্রয় করবে, এমন অবস্থানে না থেকে শ্রমিককে থাকতে হবে এমন এক অবস্থানে যে সে তার শ্রমশক্তিকেই পণ্য হিসেবে বিক্রয় করে দিতে বাধ্য হয়—যে শ্রম শক্তির অস্তিত্ব তার জীবন্ত সত্তায়।।

যাতে করে কোন লোক শ্রমশক্তি ছাড়া অন্যান্য পণ্য বিক্রয় করতে পারে তার জন্য তার অবশ্যই থাকা চাই কাচামাল, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি উৎপাদনের উপায় ও উপকরণ। চামড়া ছাড়া জুতো তৈরী করা যায় না। তা ছাড়া, তার থাকা চাই প্রাণধারণের উপায়-উপকরণ। কোনো লোকই—এমনকি ‘ভাবত্যের গীতিকারও বেঁচে থাকতে পারে না ভবিষ্যতের উৎপন্ন দ্রব্যাদি পরিভোগ করে অর্থাৎ অম্পূর্ণায়িত অবস্থার ব্যবহার-মূল্যাদি পরিভোগ করে; এবং বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে তার সেই প্রথম আবির্ভাব থেকে মানুষ সব সমযেই হয়ে এসেছে এবং সব সময়েই থাকবে পরভোগকারী-উৎপাদনে ব্রতী হবার আগেও এবং উৎপাদন যখন চলতে থাকে তখনও। এমন এক সমাজে যেখানে সমস্ত উৎপন্ন দ্রব্যই ধারণ করে পণ্যরূপ, সেখানে উৎপাদিত হবার পরে পণ্যগুলিকে বিক্রয় করতেই হবে। বিয়ের পরেই কেবল তারা। পারে তাদের উৎপাদনকারীর প্রয়োজন মিটাতে। তাদের উৎপাদনের জন্য যে সময়ের প্রয়োজন হয় তার সঙ্গে উপরি-যুক্ত হয় তাদের বিক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সময়।

অতএব, তার অর্থকে মূলধনে রূপান্তরিত করার জন্য অর্থের মালিককে সাক্ষাৎ করতে হবে বাজারস্থিত মুক্ত শ্রমিকের সঙ্গে, মুক্ত দুটি অর্থে -মুক্ত এই হিসেবে যে সে তার শ্রমশক্তিকে বিক্রয় করতে পারে তার পণ্য হিসেবে, এবং পক্ষান্তরে মুক্ত এই হিসেবে যে বিক্রয় করার মতো আর কোনো পণ্যই তার নেই; সংক্ষেপে, তার শ্রমশক্তিকে বাস্তবায়িত করার জন্য যা কিছু আবশ্যক সেই সব কিছুর মালিকানা থেকেই সে মুক্ত।

এই স্বাধীন শ্রমিকটি কেন বাজারে তার মুখোমুখি হয়—সে প্রশ্নে অর্থ-মালিকের কোনো আগ্রহ নেই; তার কাছে শ্রমের বাজার সাধারণ পণ্য বাজারেরই অংশবিশেষ। আর এই মুহূর্তে এই প্রশ্নটিতে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। আমরা ঘটনাটির সঙ্গে লেগে থাকি তত্ত্বগতভাবে, যেমন সে লেগে থাকে কার্যগত ভাবে। যাই হোক, একটা জিনিস পরিষ্কার-প্রকৃতি এক পাশে অর্থ কিংবা পণ্য সামগ্রী এবং আরেক পাশে, নিজেদের শ্রমশক্তি ছাড়া যাদের আর কিছুই নেই, এমন মানুষদের উৎপাদন করে না। এই সম্পর্কটির কোনো প্রাকৃতিক ভিত্তি নেই। এমনকি সমস্ত ঐতিহাসিক যুগেই অভিন্ন এমন কোনো সামাজিক ভিত্তিও তার নেই। স্পষ্টতই এটা হচ্ছে অতীতকালের ঐতিহাসিক বিকাশের ফলশ্রুতি, অনেক অর্থনৈতিক বিপ্লবের তথা সামাজিক উৎপাদনের প্রাচীনতর রূপান্তরের একটি সমগ্ৰ ধারাক্রমের অবলুপ্তির পরিণতি।।

যে সমস্ত অর্থনৈতিক বর্গগুলি সম্বন্ধে আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। সেগুলিও বহন করে ইতিহাসের ছাপ। একটি উৎপন্ন দ্রব্য যাতে পণ্য হয়ে উঠতে পারে, সেজন্য চাই বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক অবস্থার উপস্থিতি। উৎপাদনকারীর প্রত্যক্ষ ভোগের জন্য কোন দ্রব্য উৎপাদিত হবে; তা পণ্য হবে না। আমরা যদি আরো কিছুটা এগিয়ে যেতাম এবং জানতে চাইতাম কোন কোন অবস্থায় যাবতীয় উৎপন্ন দ্রব্য কিংবা এমনকি তাদের মধ্যে বেশির ভাগ দ্রব্য পণ্যের রূপ ধারণ করে, তা হলে আমরা দেখতে পারি যে কেবল একটা নির্দিষ্ট ধরনের উৎপাদনের অবস্থাতেই অথচ পুজিবাদী উৎপাদনের অবস্থাতেই তা ঘটতে পারে।

পণ্যের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অবশ্য এমন অনুসন্ধিৎসা হত এক অনভ্যন্ত ব্যাপার। যদিও তাদের উৎপাদনকারীদের প্রত্যক্ষ প্রয়োজন পরিপূরণের জন্যই সুবিপুল সামগ্ৰীসম্ভার উৎপাদিত ও উদ্দিষ্ট হয় বলে সেগুলি পণ্যে পরিবর্তিত হয় না এবং সেই কারণে সামাজিক উৎপাদন তখনো পর্যন্ত কালগত দৈর্ঘ ও বিস্তারগত ব্যপকতার বিচারে বিনিময়-মূল্যের দ্বারা খুব বেশী অধিপ্রভাবিত নয়, তবু কিন্তু পণ্য-দ্রব্যাদির উৎপাদন এবং সঞ্চলন স’ঘটিত হতে পারে। উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর পণ্যরূপে আবির্ভাবের পূর্বশত হল শ্রমের সামাজিক বিভাগের এমন মাত্রায় বিকাশলাভ, যাতে ব্যবহারমূল্য আর বিনিময়মূল্যের মধ্যে বিচ্ছেদ—দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থাতেই ঘটেছিল যার সূচনা, সেই বিচ্ছেদ—ইতিমধ্যেই সুসম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিকাশের এমন একটি মাত্রা এমন অনেক সামাজিক রূপের মধ্যেই অভিন্ন চেহারায় লক্ষ্য করা যায়, এগুলি অন্যান্য দিক থেকে সবচেয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট সমৃদ্ধ। পক্ষান্তরে, আমরা যদি অর্থের বিষয় বিবেচনা করি, তা হলে দেখতে পাই যে পণ্যবিময়ের একটি সুনির্দিষ্ট পর্যায়েই তার অস্তিত্ব সম্ভব। পণ্যের সমার্থ সামগ্রী হিসেবেই হোক, কিংবা সঞ্চলনের উপায় হিসেবেই হোক, কিংবা মজুদ হিসেবেই হোক কিংবা বিশ্বজনিক অর্থ হিসেবেই হোক, অর্থ যে সমস্ত বিশেষ বিশেষ কাজ করে থাকে, সে সমস্ত কাজের এক একটি প্রাধান্য সামাজিক উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়কে সৃচিত করে। অথচ আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে আপেক্ষিকভাবে আদিম এক পা-সঞ্চলন ব্যবস্থাই এই বহুবিধ রূপের উদ্ভব ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট। মূলধনের বেলায় ব্যাপারটি ভিন্নতর। মূলধনের অস্তিত্বের জন্য যে সব ঐতিহাসিক অবস্থার প্রয়োজন, সেগুলি কিন্তু কেবল অর্থ এবং পণ্য সামগ্রীর সঞ্চলনের সঙ্গে কোনক্রমেই সহগামী নয়। যখন উৎপাদন-উপায়ের এবং জীবনধারণের উপকরণের মালিক বাজারে নিজস্ব শ্রমশক্তির বিক্রয়কারী স্বাধীন শ্রমিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, কেবল তখনি তার প্রাণ সঞ্চার ঘটে। আর এই একটিমাত্র ঐতিহাসিক শর্ত একটা গোটা দুনিয়ার ইতিহাসকে জুড়ে আছে। অতএব, নিজের প্রথম আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই মূলধন ঘোষণা করে সামাজিক উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় নৃতন এক যুগের সূচনা।[৪]

আমরা এখন আরো ঘনিষ্টভাবে শ্রমশক্তি, নামধেয় এই পণ্যটিকে পরীক্ষা করে দেখব। বাকি সকল পণ্যের মতো শ্রমশক্তিরও আছে মূল্য।[৫] এই মূল্য কিভাবে নির্ধারিত হয়।

অন্যান্য প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্যের মতো শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারিত হয় এই বিশেষ সামগ্রীটির উৎপাদনের জন্য এবং স্বভাবতই পুনঃউৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের দ্বারা। শ্রমশক্তির যখন মূল্য আছে, তখন সমাজের গড় শ্রমের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ যা সেই পরিমাণের মধ্যে অন্তভূক্ত আছে, তার বেশি হতে পারে না। শ্রমশক্তির অস্তিত্ব কেবল জীবিত ব্যক্তির ক্ষমতা বা শক্তি হিসেবেই শ্রমশক্তির উৎপাদনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হচ্ছে জীবিত শ্রমিকের অস্তিত্ব। ব্যক্তিটি যদি থাকে, তা হলে শ্রমশক্তির উৎপাদন মানে দাঁড়ায় তার নিজস্ব অস্তিতের পুনরুৎপাদন বা তার নিজের ভরণপোষণ। তার ভরণপোষণের জন্য তার চাই জীবনধারণের উপকরণসম্ভারের একটি নির্দিষ্ট পরিমান। সুতরাং শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম-সময় পর্যবসিত হয় ঐ পরিমাণ জীবনধারণের উপকরণাদি উৎপাদনে যে শ্রম-সময়ের প্রয়োজন হয়, তা-ই। অন্যভাবে বলা যায় যে শ্রমশক্তির মূল্য হচ্ছে শ্রমিকের ভরণশোষণের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপায়-উপকরণের মূল্য। শ্রমশক্তি অবশ্য বাস্তব হয়ে ওঠে কেবল তার সক্রিয়তার দ্বারা, কেবল কাজের মাধ্যমেই তা নিজেকে গতিশীল করে। তোলে। কিন্তু তার ফলে মানুষের পেশী, স্নায়ু, মস্তিষ্ক ইত্যাদির একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, সুতরাং এই ক্ষয়ের পরিপূরণ করতে হবে। এই বর্ধিত ব্যয়ের জন্য চাই বর্ধিত আয়।[৬] শ্রমশক্তির মালিক যদি আজকে কাজ করে, তা হলে স্বাস্থ্য ও বলের একই অবস্থায় থেকে কালকে আবার তাকে সেই একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করতে হবে। সুতরাং তার জীবনধারণের উপায়-উপকরণকে এমন যথেষ্ট হতে হবে যাতে করে শ্রমকারী ব্যক্তি হিসাবে সে তার স্বাভাবিক স্বাস্থ্যে ও বলে অটুট থাকে। খাদ্য, বস্ত্ৰ ইন্ধন ও বাসস্থানের মতো স্বাভাবিক অভাবগুলি তার দেশের আবহাওয়া ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে বিভিন্ন হয়। পক্ষান্তরে, তথাকথিত আবশ্যিক অভাবসমূহের এবং সেই সঙ্গে সেগুলি পরিতৃপ্ত করার ধরণধারণগুলির সংখ্যা ও মাত্রা নিজেরাই হচ্ছে ঐতিহাসিক বিকাশধারার ফলশ্রুতি এবং সেই কারণেই দেশের সভ্যতার মাত্রার উপরে অনেকটা নির্ভরশীল, বিশেষ করে নিভরশীল সেই অবস্থাবলীর উপরে যার মধ্যে স্বাধীন শ্রমিকদের শ্রেণীটি গড়ে উঠেছে এবং সেই কারণেই যেসকল অভ্যাস ও আরামে অভ্যস্ত হয়েছে।[৭] সুতরাং অন্যান্য পণ্যসাগ্রীর শ্রেণী থেকে শ্রমশক্তি নামধেয় পণ্যটির যেটা পার্থক্য, তা এই যে শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারণের মধ্যে প্রবেশলাভ করে একটি ঐতিহাসিক ও নৈতিক উপাদান। যাই হোক, একটি নির্দিষ্ট দেশে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে শ্রমিকের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপায় উপকরণের গড় পরিমাণ কার্যত সুপরিজ্ঞাত।

শ্রমশক্তির মালিক মরণশীল। সুতরাং বাজারে তার আবিভাবকে যদি অবিচ্ছিন্ন খেতে হয়—এবং অর্থের মূলধনে অবিচ্ছিন্ন রূপান্তরণের পূর্বশর্তও তাই—তা হলে শ্রমশক্তির বিক্রেতাকে অবশ্যই নিজেকে করতে হবে চিরন্তন, “যেভাবে প্রত্যেকটি জীবন্ত ব্যক্তি নিজেকে চিরন্তন, করে, তেমনিভাব অর্থাৎ বংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে।[৮] ক্ষয়ে যাওয়া, জীর্ণ হয়ে যাওয়া, মরে যাওয়া ইত্যাদির ফলে যে শ্রমশক্তি বাজার থেকে অপসারিত হয়, তার শূন্য স্থান পূর্ণ করার জন্য অন্তত পক্ষে সেই পরিমাণ শ্রমশক্তি ক্রমাগত বাজারে হাজির করতে হবে। সুতরাং যারা শ্রমিকের স্থান গ্রহণ করবে তাদের অর্থাৎ তার সন্তানদের ভরণপোষণের উপায় উপকরণও শ্রমশক্তির উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপায় উপকরণের অন্তর্ভুক্ত হয়; যাতে করে পণ্য-মালিকদের এই বিশিষ্ট বংশটি বাজারে তার আবির্ভাবকে অবিচ্ছিন্ন রাখতে সক্ষম হয়।

যাতে করে সে শিল্পের একটি বিশেষ শাখায় দক্ষতা ও নৈপুণ্য অর্জন করতে পারে এবং বিশেষ ধরনের শ্রমশক্তি হয়ে উঠতে পারে তার জন্য মানুষের দেহযন্ত্রটিকে অভিযোজিত করে নিতে হয় আর তার জন্য আবশ্যক হয় বিশেষ ধরনের শিক্ষার বা প্রশিক্ষনের; তাতে অম্লাধিক পরিমাণ পণ্যাদির অঙ্কে তার সমমূল্য-পরিমাণ ব্যয়ের প্রয়োজন হয়। এই শিক্ষাজনিত ব্যয় (মামুলি শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে যা অতি সামান্য ) শ্রমশক্তি-উৎপাদনের মোট ব্যয়ে পুরোপুরি অন্তভুক্ত হয়।

শ্রমশক্তির মূল্য পর্যবসিত হয় জীবনসাধণের উপায়-উপকরণের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে। সুতরাং এই উপায়-উপকরণের মূল্য পরিবর্তন কিংবা সেগুলির উৎপাদনে ব্যয়তিব্য শ্রমের পরিমাণ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমশক্তির মূল্যও পরিবর্তীত হয়।

খাদ্য ও ইন্ধনের মতো কতকগুলি জীবনধারণের উপকরণ প্রত্যহই পরিভুক্ত হয়। সুতরাং প্রত্যহই এগুলির সরবরাহের সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। কাপড়-চোপড়, আসবাবপত্র ইত্যাদির মতো উপকরণগুলি অবশ্য দীর্ঘতর কাল টেকে; সুতরাং নির্দিষ্ট সময়কাল অন্তর অন্তর সেগুলির বদলি-সংস্থানের ব্যবস্থা করলেই চলে। কোন জিনিস কিনতে হয় তথা দামের বদলে নিতে হয় রোজই, কোন জিনিস সপ্তাহে সপ্তাহে, কোনটা তিন মাসে একবার ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যেভাবেই এই ব্যয়গুলি সারা বছর জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হোক না কেন, সেগুলির একটি দিনের সঙ্গে আরেকটি দিনকে হিসেবে ধরে গড় আয়ের দ্বারা পরিশোধ্য হওয়া চাই। শ্রমশক্তি উৎপাদনের জন্য প্রত্যহ প্রয়োজনীয় পণ্যসম্ভারের মোট যদি হয় ক, সপ্তাহে প্রয়োজনীয় পণ্যসম্ভারের মোট যদি হয় খ, এবং ত্রৈমাসিক প্রয়োজনীয় পণ্যসম্ভারের মোট যদি হয় গ ইত্যাদি ইত্যাদি, তা হলে এই পণ্যদ্রব্যাদির ভয়=৩৬৫ক+৫১খ+ ৪গ ইত্যাদি।। ধরা যাক, গড় দিবসের ৩৬৫। জন্য প্রয়োজনীয় এই পণ্যসম্ভারে বিধৃত আছে ৬ ঘণ্টা সমাজিক শ্রম; তা হলে শ্রমশক্তিতে প্রতিদিন অন্তর্ভুক্ত হয় অর্ধদিনের গড় সামাজিক শ্রম; অন্য ভাবে বলা যায় যে শ্রমশক্তির প্রাত্যহিক উৎপাদনের জন্য চাই অর্ধদিনের শ্রম। এই পরিমাণ শ্রমই হচ্ছে এক দিনের শ্রমশক্তির মূল্য বা প্রত্যহ পুনরুৎপাদিত শ্রমশক্তির মূল্য। যদি অর্ধদিনের গড় সমাজিক শ্রম বিধৃত হয় তিনটি শিলিং-এ, তা হলে এক দিনের শ্রমশক্তির মূল্য অনুরূপ দাম-এ। সুতরাং যদি এই শ্রমশক্তির মালিক রোজ তিন শিলিং হারে তার শ্রমশক্তিকে বিক্রয় করার জন্য হাজির করে তা হলে তার বিক্রয় মূল্য হয় তার দামের সমান; এবং আমরা যা ধরে নিয়েছি তদনুসারে, আমদের বন্ধু ‘শ্ৰীটাকাভার থলিয়ালা’, যে তার তিন শিলিংকে মূলধনের রূপান্তরিত করতে উন্মুখ, সে এই মূল্য প্রদান করে।

শ্রমশক্তির মূল্যের নিম্নতম মাত্রা নির্ধারিত হয় সেই সব পণ্যদ্রব্যর মূল্যের দ্বারা, যে সবের প্রাত্যহিক সরবরাহ ছাড়া শ্রমিক তার প্রাণশক্তি নবীকৃত করতে পারে না; অন্য ভাবে বলা যায় যে শ্রমশক্তির মূল্যের নিম্নতম মাত্রা নির্ধারিত হয় সেই সব জীবনধারণী উপায়-উপকরনের দ্বারা, যেগুলি দৈহিক দিক থেকে অপরিহার্য। শ্ৰম-শক্তির দাম যদি এই নিম্নতম মাত্রায় পড়ে যায়, তা হলে পড়ে যায় তার মূল্যেরও নীচে, কেননা এই পরিস্থিতিতে শ্রমশক্তিকে ভরণপোষণ ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে কেবল এক পঙ্গু অবস্থায়। কিন্তু প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্যই নির্ধারিত হয় সেই পরিমাণ শ্রমসময়ের দ্বারা, যা তার স্বাভাবিক গুণমানে কর্মক্ষম রাখবার পক্ষে আবশ্যক।

এ কথা বলা যে, শ্রমশক্তির মূল্যের এই পদ্ধতিতে নির্ধারণ হচ্ছে একটা পাশবিক পদ্ধতি, একটা সস্তা ভাবাবেগের প্রাকাশমাত্র, কেননা এই পদ্ধতিটিই ঘটনার প্রকৃতি দ্বারাই ব্যবস্থিত; কিংবা রসি’র সঙ্গে সুর মিলিয়ে হাহাকার করে এ কথা বলাও একটা সস্তা ভাবাবেগের প্রকাশমাত্র যে, “উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলাকালীন শ্রমিকদের জীবনধারণী উপায়-উপকরণ থেকে আমরা যে বিয়োজন করি, সেই একই সময়ে শ্রমের ক্ষমতাকে (Puissance de travail) উপলব্ধি করা হচ্ছে একটি মায়ামূর্তিকে ( etre de raison) উপলব্ধি করা। আমরা যখন শ্রম বা শ্রম ক্ষমতার কথা বলি, তখন সেই সঙ্গেই আমরা বলি শ্রমিকের এবং তার জীবনধারণী উপায়-উপকরণের কথা শ্রমিকের এবং তার মজুরির কথা।[৯] যখন আমরা শ্রম ক্ষমতার কথা বলি, আমরা তখন শ্রমের কথা বলি না, যেমন যখন আমরা পপরিপাকের কথা বলি তখন আমরা পরিপাকের ক্ষমতার কথা বলি না। পরিপাক প্রক্রিয়ায় একটি সুস্থ পাকস্থলী ছাড়াও আরো কিছু প্রয়োজন হয়। যখন আমরা শ্ৰম-ক্ষমতার কথা বলি তখন আমরা জীবনধারনের আবশ্যিক উপায়-উপকরণ থেকে বিয়োজন করি না। উটো, ঐ উপায়-উপকরণের মূল্যই প্রকাশিত হয় শ্রম-ক্ষমতার মূল্যের মধ্যে। যদি তার শ্রম-ক্ষমতা অবিক্রীত থাকে, তা হলে শ্রমিক তা থেকে কোনো সুবিধা পায় না; বরং সে অনুভব করবে যে এটা হচ্ছে প্রকৃতি-আরোপিত একট। নিষ্ঠ, আবশ্যিকতা যে, এই ক্ষমতার দরুন ব্যয় করতে হয়েছে জীবনধারণী উপায় উপকরণের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ এবং এই ক্ষমতার পুনরুৎপাদনের দরুন এই ব্যয় ক্রমাগত করেই যেতে হবে। তখন সে সিম দি’র সঙ্গে একমত হবে যে ‘শ্রমের ক্ষমতা কিছুই না যদি তা বিক্রয় না হয়।'[১০]

পণ্য হিসেবে শ্রমশক্তির বিশিষ্ট প্রকৃতির একটি ফলশ্রুতি এই যে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে চুক্তি হয়ে যাবার পরে তার ব্যবহার-মূল্য সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রেতার হাতে চলে যায় না। অন্যান্য প্রত্যেকটি পণ্যের মতই এরও মূল্য সঞ্চলনে যাবার আগেই স্থিরীকৃত হয়ে যায়, কেননা সামাজিক শ্রমের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ এর উপর ব্যায়িত হয়েছে। কিন্তু এর ব্যবহার-মূল্য বিধৃত হয় পরবর্তীকালে এর শক্তির অনুশীলনে। শ্রমশক্তির পরকীকরণ এবং ক্রেতা কর্তৃক বাস্তবে তার প্রয়োগীকরণ, ব্যবহার-মূল্য হিসেবে এর নিয়োজন-একটি সময়গত ব্যবধানের দ্বারা পৃথগীকৃত। কিন্তু যে-সমস্ত ক্ষেত্রে একটি পণ্যের ব্যবহার-মূল্যের বিক্রয়ের দ্বারা আনুষ্ঠানিক পরকী করণ তার ক্রেতার হাতে বাস্তবে হস্তান্তরণের সঙ্গে যুগপৎ সংঘটিত হয় না, সে ক্ষেত্রে ক্রেতাব অর্থ সচরাচর পরিপ্রদানের উপায় হিসেবে কাজ করে।[১১] যেসব দেশে পুজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতির রাজত্ব, তাদের প্রত্যেকটিতেই প্রচলিত প্রথা, এই যে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত সময়কাল জুড়ে শ্রমশক্তি প্রযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত, যেমন সপ্তাহ অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত, শ্রমশক্তির জন্য কিছু না ব্যয় করা। সুতরাং সকল ক্ষেত্রেই শ্রমশক্তির ব্যবহার-মূল্যে পুজিবাদীকে আগাম দেওয়া হয় : দাম। পাবার আগেই শ্রমিক তা মালিককে ভোগ করতে দেয়, সর্বত্রই সে পুজিবাদীকে ঋণ দেয়। এই ঋণদান যে কোন অলীক কল্পনা মাত্র নয় তা দেখা যায় যখন কখনো কখনো পুজিবাদী মালিকটি দেউলিয়া হয়ে যায় এবং শ্রমিকদের মজুরি মারা যায়।[১২] কেবল তাই নয়, আরো দীর্ঘস্থায়ী ফলাফলের মধ্যেও তা দেখা যায়।[১৩] যাই হোক, অর্থ ক্রয়ের উপায় হিসাবেই কাজ করুক আর প্রদানের উপায় হিসেবেই কাজ করুক, তার দরুণ পণ্যদ্রব্যাদির বিনিময়ের প্রকৃতিতে কোন অদলবদল হয় না। এম শক্তির দাম চুক্তির দ্বারা স্থিরীকৃত, যদিও বাড়ির ভাড়ার মতো পরবর্তী সময়ের আগে তা আদায় করা যায় না। শ্রমশক্তি বিক্রয় করে দেওয়া হয়, যদিও তার বাবদে যা পাওনা তা পাওয়া যায় পরে। সুতরাং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলির সম্পর্ক সঠিক ভাবে বুঝতে হলে, সাময়িক ভাবে ধরে নেওয়া সুবিধাজনক যে, প্রত্যেকটি বিক্রয় উপলক্ষেই শ্রমশক্তির মালিক সঙ্গে সঙ্গেই চুক্তিগত হারে তার প্রাপ্য দাম পেয়ে যাচ্ছে।

আমরা এখন জানি যে শ্রমশক্তি নামধেয় স্ববিশিষ্ট পণ্যটির মালিককে ঐ পণ্যের ক্রেতাব্যক্তিটি যে মূল্য দেয় তা কিভাবে নির্ধারিত হয়। বিনিময়ে ক্রেতা যে ব্যবহার মূল্য পায়, তা আত্মপ্রকাশ করে কেবল বাস্তব ব্যবহারে শ্রমশক্তির পরিভোগ-কালে এই উদ্দেশ্যে যা কিছু প্রয়োজন সেই সবই, যেমন কাচামাল, মালিক বাজার থেকে ক্রয় করে, এবং সেসব কিছুর জন্য পূর্ণ মূল্য দিয়ে থাকে। শ্রমশক্তির পরিভোগ একই সময়ে পণ্যদ্রব্য এবং উদ্ব-মূল্যের উৎপাদন। যেমন অন্য প্রত্যেকটি পণ্যের ক্ষেত্রে তেমন শ্রমশক্তির ক্ষেত্রেও পরিভোগ সম্পূর্ণায়িত হয় বাজারে সীমানার বাইরে তথা সঞ্চলনের পরিধির বাইরে। অত:পর ঐ টাকাভর থলিওয়ালা এবং শ্রমশক্তির অধিকারীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা কিছু কালের জন্য গোলমেলে পরিধির বাইরে চলে যাই, যে পরিধিতে সব কিছুই ঘটে প্রকাশ্যে সকল লোকের চোখের সামনে। এদের দুজনেরই সঙ্গে আমরা চলে যাই উৎপাদনের প্রচ্ছন্ন আবাসে, যার চৌকাঠের উপরে কড়া সুরে নির্দেশ রয়েছে, ‘বিনা কাজে প্রবেশ নিষেধ। সেখানে আমরা দেখতে পাব কিভাবে মূলধন উৎপাদন করে এবং কেবল তা-ই নয়, আরো দেখতে পাব কিভাবে মূলধন উৎপাদিত হয়। সর্বশেষে আমরা সকলে জেনে নেব মুনাফা সংগ্রহের গোপন রহস্যটি।

এই যে পরিধি আমরা পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছি, যে পরিধিটির মধ্যে শ্রমশক্তির বিক্রয় এবং ক্রয় সংঘটিত হয়, সেই পরিধিটির বাস্তবিক পক্ষে কিন্তু মানুষের সহজাত অধিকারসমূহের নন্দন কানন’। একমাত্র সেখানেই রাজত্ব করে স্বাধীনতা, সমতা, সম্পত্তি এবং বেন্থাম। স্বাধীনতা, কেননা কোন পণ্যের, ধরা যাক শ্রমশক্তির, ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই এখানে কেবল তাদের নিজ নিজ স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। স্বাধীন কর্তৃত্ববলে তারা চুক্তিবদ্ধ হয় এবং যে চুক্তিটিতে তারা আবদ্ধ হয়, সেটি তাদের দুজনের অভিন্ন ইচ্ছার আইনগত অভিব্যক্তিরই রূপ। সমতা, কেননা যেমন একজন পণ্যদ্রব্যাদির সরল স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে ঠিক তেমনি এখানেও তারা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কে প্রবেশ করে, এবং তারা সমার্ঘ সামগ্রীর সঙ্গে সমার্ঘ সামগ্রীর বিনিময় করে সম্পত্তি, কেননা প্রত্যেকেই লেনদেন করে যা তার নিজস্ব কেবল তা-ই। একমাত্র যে-শক্তিটি তাদের দুজনকে একত্রিত করে, পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে, তা হচ্ছে স্বার্থপরতা, দুজনেরই লাভ ও ব্যক্তিগত স্বার্থ। প্রত্যেকেই ভাবে নিজের কথা, অন্যেরটা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না এবং যেহেতু তারা এরূপ করে, ঠিক সেহেতুই তারা সব কিছুই করে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত এক বিশ্ববিধান অনুসারে কিংবা বিশ্ববুদ্ধিমান এক বিধাতার তত্ত্বাবধানে; তারা কাজ করে পরস্পরের সুবিধার জন্য, সাধারণ কল্যাণের জন্য, সকলের স্বার্থের জন্য।

সরল সঞ্চলনের তথা পণ্যবিনিময়ের এই যে পরিধি, যা থেকে স্বাধীন বাণিজ্যের ধ্বজাধারী” আহরণ করে তার ধ্যানধারণা ও মতামত, আহরণ করে মূলধন ও মজুরির উপরে প্রতিষ্ঠিত এক সমাজের বিচার-বিশ্লেষণে তার মানদণ্ড, এই পরিধিটি পরিত্যাগ করলে, আমাদের মনে হয়, আমরা আমাদের নাটকীয় চরিত্রটির শারীরবৃত্তে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারি। আমাদের নাটকীয় চরিত্রটি আগে ছিল মহাজন, এখন সে সামনে এসে দাড়ায় একজন পুজিবাদী হিসেবে, তার পেছনে আসে শ্রমশক্তির স্বত্বাধিকারী তথা শ্রমিক। একজন রাশভারি চালে চাপা পড়ে হাসে, ব্যবসা করতে চনমন করে; অন্যজন আসে এস্ত পায়ে, দ্বিধাগ্রস্ত মনে কেউ যদি তার নিজের চামড়া নিয়ে আসে বাজারে কিন্তু বিনিময়ে প্রত্যাশা করে না কিছুই এক চাবুকের মার খাওয়া ছাড়া, ঠিক তার মতো–সংকুচিত ও দ্বিধাগ্রস্ত।

————

১. “অর্থের আকারে……মূলধন কোন মুনাফা উৎপাদন করে না” ( রিকার্ডো, … পলিটিক্যাল ইকোনমি পৃঃ ২৬৭)

২. চিরায়ত পুরাতথ্যের বিশ্বকোষগুলিতে আমরা এই ধরনের উদ্ভট উক্তি লক্ষ্য করি : “স্বাধীন শ্রমিক এবং ক্রেডিট প্রথা না থাকলেও প্রাচীন জগতে মূলধন কিন্তু পরিপূর্ণভাবে বিকশিত ছিল। মমসেন-ও তার ‘রোমের ইতিহাস’-এ এ ধরনের ভুলের পরে ভুল করেছেন।

৩. এই কারণেই বিভিন্ন দেশের আইনই শ্রম-চুক্তির ক্ষেত্রে একটি সর্বোচ্চ সীম। বেঁধে দেয়। যেখানে স্বাধীন শ্রমই রেওয়াজ, সেখানেই আইন চুক্তি ছেদ করার বিবিধ পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। কতকগুলি রাষ্ট্রে, বিশেষ করে মেক্সিকোতে ( আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পূর্বে, যে-ভূখণ্ডগুলি মেক্সিকো থেকে নেওয়া হয়েছিল, সেইগুলিতেও এবং কুসা কর্তৃক সংঘটিত বিপ্লব অবধি ড্যানুবিয়ার প্রদেশগুলিতেও) ‘পিওনেজ’-এর আকারে ক্রীতদাস-প্রথা প্রচ্ছন্ন ছিল। শ্রমের সাহায্যে পরিশোধ্য এই শর্তে অগ্রিম দিয়ে কেবল ব্যক্তি-শ্রমিককে নয়, তার পরিবারকেও বংশানুক্রমিক ভাবে কার্যতঃ অগ্রিম-দাতার ও তার পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত করা হত। জুয়াবেজ এই ‘পিওনেজ’-প্রথার অবসাদ ঘটান। তথাকথিত সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ান আবার এক অধ্যাদেশ জারি করে এই প্রথাকে প্রতিষ্ঠিত করেন, যে-অধ্যাদেশটিতে ওয়াশিংটনের প্রতিনিধি-সভা’-য় মেক্সিকোতে ক্রীতদাস-প্রথার পুনঃপ্রতিষ্ঠা বলে সঠিক ভাবেই নিন্দা করা হয়। আমার বিশেষ বিশেষ্ণ দৈহিক ও মানসিক শক্তি ও সক্ষমতাগুলির ব্যবহারকে আমি সীমিত সময়ের জন্য অন্যের হাতে তুলে দিতে পারি; কেননা এই নিয়ন্ত্রণের ফলে সেগুলির উপরে সমগ্র ভাবে আমি থেকে পরকীকৃত একটি চরিত্রের ছাপ পড়ে যায়। কিন্তু আমার সমস্ত শ্রম-সময় এবং আমার সমগ্র কাজের পরকীকরণের আমি স্বয়ং সত্তাটিকেই, অর্থাৎ, আমার সার্বিক সক্রিয়তা ও বাস্তবতাকেই, আমার ব্যক্তি সত্তাকেই রূপান্তরিত করি অপরের post feco y (Hegel, “Philosophie des Rechts.” Berlin, 1840, p. 104 ($)

৪. সুতরাং পুজিতন্ত্রের যুগের বৈশিষ্ট্য এই যে শ্রমিকের নিজের চোখেও শ্রম শক্তি পণ্যের রূপ ধারণ করে; এই শ্রমশক্তিই তার পণ্য এবং স্বভাবতই তা হয় মজুরি প্রম। পক্ষান্তরে, কেবল সেই মুহূর্ত থেকেই শ্রমের ফল সার্বজনীনভাবে পরিণত হয় পণ্যে।

৫. “কোন মানুষের মূল্য বা অর্থ হচ্ছে তার দাম—অর্থাৎ যা তার শক্তি ব্যবহারের জন্য দেওয়া হবে।” (টমাস হবস, লেভিয়াথান, পৃঃ ৭৬)

৫. ভূমি-দানের তদারককারী হিসেবে রোমের ‘ভিলিকাস’ “কর্মবিযুক্ত দাসদের থেকে স্বল্পতর পারিশ্রমিক পেত, কারণ তার কাজ ছিল লঘুতর।” (Jh. Mommesen, Rom Geschichte, 1856, p. 810)

৬. দ্রষ্টব্য: ধনটন, ওভার পপুলেশন অ্যাণ্ড ইটস রেমিডি’, লণ্ডন ১৮ ৪৬।

৭. পেটি (Petty)।

৮. শুষের স্বাভাবিক দাম … গঠিত হয় সেই সব আবশ্যিক ও আরামিক দ্রব্যসামগ্রীর দ্বারা, যেগুলি সংশ্লিষ্ট দেশের জলবায়ুতে এবং প্রচলিত আচার-আচরণে শ্রমিকদের ভরণপোষণের জন্য এবং যাতে করে বাজারে শ্রমের সরবরাহ অক্ষুন্ন থাকে সেইহেতু তার পরিবার পরিপোষণের জন্য আবশ্যক হয়। (আর. টরেন্স, “অ্যান এসে অন দি এক্সটানাল কর্ন ট্রেড,” ১৪১৫, পৃ: ৬২)। এম কথাটিকে এখানে ভুল করে শ্রমশক্তি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।

৯. Rossi, “Cours d’Econ. Polit” Bruzelles, 1842. p. 370.

১০. Sismondi : ‘Nouv. Princ. etc.’ t. I. p. 112

১১. শ্রম সমাপ্ত হবার পরেই শ্রমের প্রাপ্য দেওয়া হয়।” (An Inquiry into those Principles Respecting the Nature of Demand.” &c., p. 104 ) Le credit commercial a du commencer au moment ou l’ouvrier, premier artisan de la production, a pu, au moyen de ses economies, attendre le salaire de son travail jusqu’a la fin de la semaine, de la quinzaine, du mois, du trtmestre, &c.” (Ch. Ganilh : “Des Systemes d’Econ. Polit.” 2eme edit. Paris, 1821, t. II, p. 150)

১২. Louvrier prete son industrie,” কিন্তু স্টর্চ সকৌতুকে এই মন্তব্যটি জুড়ে দেন, “কিন্তু তিনি কোনো ঝুঁকিই নেননা। কেবলমাত্র “de perdre son salaire……. l’ouvriers ne transmet rien de materiel.” (Storch : “Cours d’Econ. Polit.” Petersbourg, 1815, t. II., p. 37)

১৩. যেমন, লণ্ডনে দু’ধরনের রুটি তৈরীকারক আছেন-“পুরে দামী’, যারা পূর্ণ মূল্যে রুটি বিক্রি করে এবং কম দামী”, যারা তার কমে তা বিক্রি। মোট ক্ষটি প্রস্তুতকারকদের মধ্যে কম-দামী’আই চার ভাগের তিন ভাগ। কম-দামীরা সকলেই বিক্রি করে ফটকিরি সাবান, ছাই, চক, ডারবিশায়ারের পাথর চুর্ণ ও মেশানর উপযোগী ও অনুপযোগী ভোজাল-মেশানো রুটি। ১৮৫৫ সালের কমিটি কাছে জন গর্ডন বর্ণনা করেছেন যে ভেজাল মেশানর ফলে যে গরিব মানুষরা তা খায়, যারা মাত্র দু পাউণ্ড রুটিতে জীবন ধারণ করে, তারা চার ভাগের এক ভাগ পুষ্টিকর উপাদানও পায় না। তার উপরে, স্বাস্থ্যের উপর ভেজালের প্রতিক্রিয়া তো রয়েছেই। এই ভেজাল মেশানর ফল ত্রিমেনজর বর্ণনা করেছেন শ্রমিকদের বেশির ভাগ যদিও জানে এবং কখনই ফটকিরি ও পাথর চুর্ণকে তাদের ক্রয়ের মধ্যে গ্রহণ করতে চায় না তবুও যেহেতু সপ্তাহ না পার হলে তারা মজুরি পায় না যেহেতু বাধ্য হয়েই গরিব মানুষেরা এই ভেজাল রুটি কিনে থাকে। ইংল্যাণ্ডের, বিশেষ করে স্কটল্যাণ্ডের অনেক কৃষি-অঞ্চলে মজুরি দেওয়া হয় ১৪ দিন পর পর, কোথাও কোথাও আবার গোটা মাসের শেষে। “এই সময়ের জন্য মালিকরা তাদের দোকান থেকে বাকিতে বেশি দামে জিনিস নিতে শ্রমিকদের বাধ্য করে।” সপ্তাহ শেষের আগে তারা মজুরী পায় না বলে সপ্তাহের মধ্যে তাদের পরিবারবর্গ যে রুটি গ্রহণ করে তার দাম সপ্তাহ শেষ না হলে তারা পরিশোধ করতে পারে না। সাক্ষীর এই সাক্ষ্যের সঙ্গে টরমনহের যুক্ত করেন, “এটা সর্বজনবিদিত যে ঐসব ভেজালমিশ্রিত রুটি এমনি করে বিশেষভাবে বিক্রয়ের জন্য তৈরী হয়। এখনও বহু ইংরেজ ও স্কচ কৃষিজেলায় মজুরি দেওয়া হয় পক্ষ হিসেবে, মাসিক হিসেবেও। মজুরী পাওয়ার এই দীর্ঘ ব্যবধানের জন্য কৃষকরা ধারে ক্রয় করতে বাধ্য হয়……”এজন্য তাকে অবশ্যই বেশী দাম দিতে হয় এবং বস্তুতপক্ষে তাকে যে দোকানে ধারে দেয় তার কাছে বাঁধাধরা থাকতে হয়। উদাহরণস্বরূপ উইলটের হরনিংহামের কথা বলা যায় যেখানে মাসিক মজুরীর ব্যবস্থা আছে। এখানে কোন প্রতি ১০ পেন্স দরের ময়দা ধারে কেনার জন্য শ্রমিকদের দিতে হয় ২ শিং ৪ পেন্স (জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রিভিকাউন্সিলের মেডিকেল অফিসারের “যষ্ঠ রিপোর্ট ১৮৬৪ পৃ ২৬৪)। পেসলীর ব্লক মুদ্ৰক এবং কিলমারনক ধর্মঘটের ফলে মাসিক মজুরির পরিবর্তে পাখি মজুরি দিতে বাধ্য হয় (কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট, . অক্টোবর ১৮৫৩ পৃ ৩০)। কিন্তু পথে শ্রমিক ঐ প্রাপ্ত অর্থ ধনী আমানতকারীর কাছে পুনরায় জমা দিতে বাধ্য হয়। বহু ইংরেজ কয়লাখনির এই প্রচলিত পদ্ধতি আমরা তুলে ধরতে পারি—যেখানে মাস শেষ হওয়ার আগে শ্রমিক কোন মজুরি পায় না, এই সময়ে ধনিকের কাছ থেকে সে টাকা ধার নেয় কখনও কখনও দ্রব্যের মাধ্যমে—যার মূল্য তাকে দিতে হয় বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। (পণ্য বিনিময় পদ্ধতি) মাসে একবার মজুরীদান স্থানীয় মালিকদের একটা সাধারণ অভ্যাস। এরা তাদের শ্রমিকদের অগ্রিম দেয় প্রতি দু সপ্তাহ শেষে। ঐ নগদ অর্থ দিতে হয় দোকানে (অর্থাৎ মালিকের মজুৱীর পৰিবৰ্তে খাবারের দোকানে)। শ্রমিকেরা একদিকে যা নেয় অন্যদিকে তাই দিয়ে দেয়। (শিত নিয়োগ কমিশন, তৃতীয় বিপোর্ট লণ্ডন, ১৮৬৪ পৃঃ ৩৪)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *