২.৮ শেষ পাতে শেষ পাতা

শেষ পাতে শেষ পাতা

ভারতভাগের পূর্বপ্রস্তুতি, ভারতভাগ এবং ভারতভাগের পর থেকে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে এক নিদারুণ অবনতি হয়ে গেছে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল হিন্দু-মুসলমানের এই পরস্পরের ঘৃণার সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়ে ভালোবাসার সম্পর্ক, আস্থার সম্পর্ক, বিশ্বাসের সম্পর্ক হবে? না, হবে না। কোনো সম্ভাবনাই নেই। কারণ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠুক এটা আমরা কেউই চাই না। সেই সদিচ্ছাও নেই। কারণ যে ইতিহাস পড়ে আমরা বড়ো হই সেই ইতিহাসেই আছে গলদ, আছে সাম্প্রদায়িকতার বীজ, মিথ্যাচর্চা। রোমিলা থাপার, ডঃ হরবংশ মুখিয়া, বিপানচন্দ্র, সুমিত সরকার, সুরজিৎ দাশগুপ্তদের নিরপেক্ষ ইতিহাস পড়ানো হয় না। পড়ানো হয় স্যার যদুনাথ সরকার। আরএসএসের ঘনিষ্ট রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো ঐতিহাসিক আর ইংরেজ ঐতিহাসিকদের রচিত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইতিহাস। সেই অতিরঞ্জিত ইতিহাসই দিনের পর দিন বছরের পর বছর কপি-পেস্ট করে লিখে চলেছেন পাঠ্যবইয়ের ইতিহাস-লেখকরা। আর আমাদের ছেলেমেয়েরা সেই মিথ্যাচর্চা করে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সাম্প্রদায়িকতার বিষ এখন রক্তের ভিতর। ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র যথার্থই লিখেছেন– “… গত একশো বছর সাম্প্রদায়িকতা প্রসারের জন্য ভারতে ইতিহাস শিক্ষা অনেকটাই দায়ী। প্রকৃতপক্ষে একটুও অত্যুক্তি না-করেই বলা চলে যে, ঐতিহাসিকদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিই বরাবর ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক মতবাদকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে এসেছে।… সাম্প্রদায়িকতার মূলে বরাবরই থেকেছে গত একশো বছরের ইতিহাসের ধারা সম্বন্ধে একটি মিথ্যা চেতনা। পরে আমরা দেখাব যে, সমসাময়িক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চাপে ঐতিহাসিকরা এটিকে অতীতের অমৃত (অসত্য) ব্যাখ্যা হিসাবে ব্যবহার করেছেন। … আশ্চর্যের বিষয় হল যে, যেসব ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও আমলাবর্গ ইতিহাস চর্চায় ‘হিন্দু মুসলমান’ তত্ত্বটির গোড়াপত্তন ও লালন করেছেন, তাঁরাই আবার বর্ণ এবং জাতিকে (বাঙালি জাতি, পাঞ্জাবি জাতি, মারাঠা জাতি ইত্যাদি) ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির মূল নীতি হিসাবে দেখিয়েছে।… তাঁরা অতীতের মাহাত্মকীর্তন শুরু করলেন।… এইভাবে ধীরে ধীরে উপকথা তৈরি হল যার প্রত্যেকটি সুস্থ ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করে তুলল।..সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে ইতিহাসের অপব্যবহার সংশোধন করার জন্যে আন্তরিক চেষ্টা করতে গেলে আমাদের এইসব উপকথাগুলিকেও ধ্বংস করতে হবে। … আশ্চর্যের বিষয়, এদের কেউই ব্রিটিশ শাসনকে খ্রিস্টান শাসন বলে অভিহিত করেন না। অথচ মোগল শাসনে যে কয়জন সরকারি কর্মচারী মুসলমান ছিলেন এই আমলের তুলনায় তার চেয়ে ঢের বেশি সংখ্যক কর্মচারী খ্রিস্টান ছিলেন। আসলে সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিকরা মারাঠা রাজপুত এমনকি রণজিৎ সিংহের শাসনাধীনে পাঞ্জাবের ও রাজ্যগুলির ‘হিন্দুত্ব’ প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক তথ্যের যথেচ্ছ অপব্যবহার করেছেন।”

এই বিষ ঝাড়ার ওঝা কোথায়? এই বিষ যাঁরা চাইলেই ঝাড়তে পারতেন, তাঁরা তো ওই ব্রিটিশরাই। কিন্তু ব্রিটিশরা তার উল্টো কাজটা করে গেছেন তাঁদের ভারতীয় সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে। কারণ ভারতের সংখ্যাগুরুরা তাঁদের সাদা চামড়ার বন্ধুদের ঈশ্বরের মতো মান্য করতেন। মান্য করার মতোই জাতি বটে! কারণ এই ব্রিটিশরাই যে আকবর-অশোকদের মহামতি বানিয়েছে, আওরঙ্গজেবদের ভিলেন বানিয়েছে। সেই অশোক মহামতি, যে অশোক সিংহাসন আরোহণ করে পরবর্তী ৮ বছর তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ বাদে সমগ্র ভারত উপমহাদেশ করায়ত্ত করেন। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো সাম্রাজ্য ছিল অশোকের। ধারণা করা হয়, এত বড়ো সাম্রাজ্যের অধিকারী আর কোনো সম্রাট ছিলেন না সে আমলে। করায়ত্ত বিনা রক্তপাতে হয়নি। যুদ্ধ ছাড়া অন্য সাম্রাজ্য দখল করে নিজের সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটানো সম্ভব নয়। সেই যুদ্ধের হত্যালীলার বিবরণ কেউ পাঠ্যবইয়ে নথিভুক্ত করেনি। কিন্তু তাঁর রাজত্বকালের অষ্টম বর্ষে কলিঙ্গ যুদ্ধে যে হত্যালীলা চালিয়েছিলেন, তা নথিভুক্ত আছে। সেই ভয়াবহ কলিঙ্গ যুদ্ধে প্রায় ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) সাধারণ মানুষ নিহত হয় এবং ১,৫০,০০০ (দেড় লক্ষ) মানুষ নির্বাসিত হন। (Chandragupta Maurya and His Times’– Radhakumud Mookerji, “The Edicts of King Ashoka’– Ven. S. Dhammika) Progei 43 দেয়, বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল সেই কলিঙ্গের যুদ্ধ। কলিঙ্গ সাম্রাজ্য নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পুরো শক্তি প্রয়োগ করেও হেরে যায় অশোকের নৃশংসতার কাছে। কলিঙ্গ জয় শেষে অশোক ঠিক করেন রাজ্যটির ক্ষয়ক্ষতি দেখতে যাবেন। যে রাজ্যে তাঁকে নির্বাসিত করা হয়েছিল, সে রাজ্যকে যেন আর খুঁজে পেলেন না অশোক। সমগ্ৰ কলিঙ্গ যেন ধূলোর সঙ্গে মিশে গেছে। ঘর-বাড়ি সব পুড়ে ছারখার, গোটা ময়দান জুড়ে শুধু মানুষের লাশ, লাশের কারণে পা ফেলা যাচ্ছে না। বলা হয় যে, অশোক প্রথমবারের মতো যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের ক্ষয়ক্ষতি সরাসরি নিজ চোখে দেখেছিলেন। শুধু অশোক বলে নয়, সেই সময়ের সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী শাসকরাই এভাবেই সাম্রাজ্য বিস্তার করত। যে এ পথে যেত না, সে বিলুপ্ত হয়ে যেত। ইতিহাসে এরকম অহিংস নীতির শাসক বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অহিংস শাসক তাঁর প্রজাদের সুরক্ষা দিতে পারে না। যেমন বৈষ্ণব রাজা লক্ষ্মণ সেন। বখতিয়ার খিলজির সঙ্গে লড়াই না-দিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। প্রজারাও এমন রাজাকে পছন্দ করে না।

২৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিন্দুসারের মৃত্যু হলে উত্তরাধিকারের প্রশ্নে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বিন্দুসার তাঁর অপর পুত্র সুসীমকে উত্তরাধিকারী হিসাবে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুসীমকে উগ্র ও অহংকারী চরিত্রের মানুষ হিসাবে বিবেচনা করে বিন্দুসারের মন্ত্রীরা অশোককে সমর্থন করেন। রাধাগুপ্ত নামক এক মন্ত্রী অশোকের সিংহাসনলাভের পক্ষে প্রধান সহায়ক হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। অশোক শঠতার আশ্রয় নিয়ে করে সুসীমকে একটি জ্বলন্ত কয়লা ভর্তি গর্তে ফেলে দিয়ে হত্যা করেন। দীপবংশ ও মহাবংশ গ্রন্থানুসারে, বীতাশোক নামক একজন ভাইকে ছেড়ে অশোক বাকি ৯৯ জন ভাইকেই হত্যা করেন। এই ঘটনার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পিতার মৃত্যুর তিন বছর পরে অশোক মৌর্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজত্বের প্রথম আট বছরের পর মানুষের কাছে নিজেকে নৃশংসতার আদর্শ হিসাবে গড়ে তুললেন তিনি। ক্ষ্যাপা হায়েনার মতো মৌর্য সাম্রাজ্য বাড়াতে থাকলেন অশোক। বৌদ্ধ গ্রন্থানুসারে, অশোক প্রথম জীবনে একজন বদমেজাজি ও ক্রুর প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি বন্দিদের উপর শারীরিক অত্যাচার করার জন্য একটি কক্ষ নির্মাণ করিয়েছিলেন। তার ক্রুর স্বভাবের জন্য তাকে ‘চণ্ড অশোক’ নামে অভিহিত করা হত।

সম্রাট অশোকের বৌদ্ধভারত (২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে থেকে ২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

[সম্রাট অশোকের বৌদ্ধভারত (২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে থেকে ২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)।

এই বৌদ্ধভারত হিন্দুভারত হল কীভাবে?]

অধ্যাপক চার্লস ড্রেকেমেয়ার অবশ্য বৌদ্ধ প্রবাদগুলিকে অতিশয়োক্তি হিসাবে বিবেচনা করেছেন। তাঁর মতে, কোপণ স্বভাবের অশোক যে বৌদ্ধধর্মে প্রভাবিত হয়ে একজন ধার্মিক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন, সেই বৌদ্ধধর্মকে সুমহান হিসাবে দেখানোর উদ্দেশ্যে এই সমস্ত কাহিনির জন্ম দেওয়া হয়েছিল। অশোকের ত্রয়োদশ শিলালিপিতে বর্ণিত হয়েছে যে, কলিঙ্গের যুদ্ধে প্রচুর মানুষের মৃত্যু ও তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের অপরিসীম কষ্ট লক্ষ্য করে অশোক দুঃখে ও অনুশোচনায় দগ্ধ হন। এই ভয়ানক যুদ্ধের কুফল লক্ষ করে যুদ্ধপ্রিয় অশোক একজন শান্তিকামী ও প্রজাদরদি সম্রাট এবং বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় শুধুমাত্র মৌর্য সাম্রাজ্য নয়, এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়। তাঁর পুত্র মহিন্দ ও কন্যা সংঘমিত্রা সিংহলে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। অশোকাবদান’ গ্রন্থানুসারে, বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পরেও অশোক হিংসা ত্যাগ করেননি। তিনি পুণ্ড্রবর্ধন অঞ্চলে বসবাসকারী সমস্ত আজীবিক সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যার নির্দেশ দেন, যার ফলে প্রায় ১৮,০০০ মানুষ নিহত হন। (The Ajivikas’— Beni Madhab Barua) এছাড়া জৈন ধর্মাবলম্বীদের তিনি হত্যা করেন বলেও কথিত আছে। বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার আগে অশোক কোন্ ধর্মাবলম্বী ছিলেন? যেহেতু সে সময় হিন্দু বলে কোনো ধর্ম-ধারণা তৈরি হয়নি, তাই অশোক বৌদ্ধ হওয়ার আগে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন এ-কথা বলা যায় না। তবে ‘অশোকাবদান’ গ্রন্থানুসারে, অশোক দ্বিতীয় মৌর্য সম্রাট বিন্দুসার ও তার দাসী চম্পা শহরের আজীবিক (আজীবিক ধর্ম একটি প্রাচীন ধর্ম। ছোটো ছোটো গোষ্ঠী হিসাবে এই ধর্ম অনেক আগে থেকেই গাঙ্গেয় মধ্য অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। মকখালি গোসলা এঁদের একত্রিত করে একটা ধর্মীয় গোষ্ঠীতে পরিণত করেন। তিনি গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক ছিলেন) দার্শনিক মতবাদে বিশ্বাসী ব্রাহ্মণ বংশের নারী সুভদ্ৰাঙ্গীর পুত্র ছিলেন। অশোকের জন্মস্থান পাটলিপুত্র (বর্তমানে বিহারের পাটনা)। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ভারত উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ অংশকে একক রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন। তামিল ও কলিঙ্গ ব্যতীত উপমহাদেশের প্রায় পুরোটাই নিজ সাম্রাজ্য করে নেন চন্দ্রগুপ্ত। অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্তও ছিলেন প্রচণ্ড নৃশংস শাসক। আর তাঁর পৌত্র হলেন সম্রাট অশোক, ক্ষমতায় এসেই অশোক সেই তামিল আর কলিঙ্গকেও সাম্রাজ্যের বাইরে থাকতে দেননি। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ভারত উপমহাদেশে এসেছিলেন খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে। তিনি জানান, অশোকের রাজত্বের প্রায় ৯০০ বছর পরও উপমহাদেশের মানুষ অশোকের জেলখানার নৃশংসতার কথা মনে রেখেছিল। রাজধানীর উত্তরে নির্মিত সেই জেলখানা পরিচিতি ছিল ‘অশোকের নরক’ নামে। সম্রাট অশোকের আদেশ ছিল এমন— “জেলখানার কয়েদিদের যেন কাল্পনিক ও অকল্পনীয় সব রকমের অত্যাচারের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কোনো বন্দি যাতে জীবিত বের হতে না-পারে সেই নরক থেকে!”

এহেন অশোক ‘মহামতি’! অনুশোচনায় সাত খুন মাফ, ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে গেলেন? কে করলেন এমন নির্ণয়! তবে একটা বিষয় মানতেই হয়, যুদ্ধে বিজয়প্রাপ্তির পর অশোক নিজের নৃশংসতায় নিজেই যেন শিহরিত হয়ে পড়েন। এত দিন পর তাঁর নজর পড়ে নিজের নৃশংস শাসনব্যবস্থার প্রতি। পূর্বের কৃতকর্মগুলোর জন্য অনুতপ্ত হলেন। প্রায়শ্চিত্ত করার উদ্দেশ্যে তাঁর সাম্রাজ্যে নতুন বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন করেন অশোক। রাতারাতি শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ উল্টে ফেললেন তিনি। কলিঙ্গ যুদ্ধের আগের আট বছরে অশোক যা যা অন্যায় করেছিলেন, সবকিছু যেন উল্টো দিক থেকে আবার শুরু করলেন তিনি। সকল বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হল তাঁর হুকুমে, তাঁদের সম্পত্তিও ফিরিয়ে দেওয়া হল যথাযথরূপে। পুরো সাম্রাজ্যে শান্তি আনয়নের জন্য ইতিহাসখ্যাত এক ফরমান জারি করেন সম্রাট অশোক। জারি করেই ক্ষান্ত হননি তিনি, একই সঙ্গে তাঁর রাজপরিষদের সকল কর্মকর্তাদের হুকুম দেন, যেন পুরো সাম্রাজ্যের স্থানে স্থানে পাথরের স্তম্ভ নির্মাণ করে তাতে অহিংসা নীতি সংবলিত ফরমানটি খোদাই করে দেওয়া হয়। এই স্তম্ভগুলোই ‘অশোকস্তম্ভ’ নামে পরিচিত। সেই সঙ্গে অশোক এটাও বলেন, খোদাই করার সময় যেন প্রতিটি অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে সহজ সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা হয়। এই ফরমান জারির সঙ্গে সঙ্গে অশোক ধর্মীয় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর রাজসভাসদদের আদেশ দেন, সাম্রাজ্যের সকল দরিদ্র আর বয়স্কদের বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য।

সাম্রাজ্যের জায়গায় জায়গায় যেন মানুষ এবং প্রাণীদের জন্য চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করা হয়। রাতারাতি রাজ্যের চেহারা বদলে যেতে শুরু করে। আইন করে একে একে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের বাধ্যতা, গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধানত দৃষ্টি, জাত-কুল-ধর্ম নির্বিচারে সকলের প্রতি সহমর্মিতা, রাজ্যের সর্বস্থানে পথিকদের জন্য ফলদায়ক ও ছায়াদায়ক বৃক্ষরোপণ, কূপ খনন সবকিছুরই বাস্তবায়ন করতে শুরু করেন সম্রাট অশোক। অশোকের ফতোয়া বা ফরমানকৃত ১৪টি নীতি হল— (১) কোনো জীবন্ত প্রাণীকে হত্যা করা যাবে না, ঈশ্বরের। উদ্দেশ্যেও বলিদান নিষিদ্ধ। (২) পুরো সাম্রাজ্য জুড়ে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে পশুদের জন্যও চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করা হবে। (৩) প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সন্ন্যাসীদের একবার করে পুরো সাম্রাজ্য ভ্রমণে বেরোতে হবে, সেসময় তাঁরা সাম্রাজ্যের জনসাধারণকে বৌদ্ধধর্মের নীতিতে দীক্ষিত করবেন। (৪) সন্ন্যাসী, পুরোহিত আর নিজ পিতা মাতার প্রতি সবাইকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। (৫) বন্দিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ বজায় রাখতে হবে। (৬) যে কোনো খবর সকলের আগে সম্রাট অশোকের কাছে পৌঁছোতে হবে, তিনি যত ব্যস্তই থাকুন না-কেন।(৭) ধর্মবিশ্বাসকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হল।(৮) প্রয়োজন হলে সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণ কিংবা অভাবগ্রস্তকে সাহায্যের মনোভাব রাখতে হবে। (৯) ধর্মের প্রতি সহনশীলতা ও শিক্ষাগুরুর প্রতি সদাচরণকে বিয়ে কিংবা অন্য যে-কোনো পালা-পার্বণের চেয়ে অধিক সম্মানের বলে বিবেচিত করা হবে। (১০) মানুষ যদি ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা না রাখে, তাহলে খ্যাতি কিংবা গৌরব মূল্যহীন। (১১) কাউকে দেওয়া ধর্মীয় শিক্ষা হবে তাঁর প্রতি সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। (১২) পূর্ণ ভক্তির সঙ্গে কেউ যদি তার ধর্ম পালন করে এবং একইসঙ্গে অন্যের কাছে প্রমাণ করতে চায় তাঁর ধর্মের প্রাধান্য, সে যেন নিজ ধর্মেরই অপমান সাধন করে। (১৩) জোর করে কোনো কিছু জয় করার চেয়ে ধর্ম দ্বারা জয় করা উত্তম। (১৪) এই ১৪টি নীতি এখানে লিখে রাখা হল, শুধু পড়ার জন্য নয়, মানুষ যেন তা পড়ে সে অনুযায়ী জীবন ধারণ করতে পারে সেজন্যও। অশোক ছিলেন প্রথম শাসনকর্তা যিনি কিনা সমগ্র ভারত উপমহাদেশকে এক সাম্রাজ্যের ছায়াতলে নিয়ে এসেছিলেন। একই সাথে তিনি ছিলেন ইতিহাসের প্রথম বৌদ্ধ শাসনকর্তা। তিনি প্রায় ৪০ বছরের মতো সাম্রাজ্য শাসন করেন। তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছরের মাথায় মৌর্য সাম্রাজ্য প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে আসে। কারণ ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ যখন দেখল, তাঁদের প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠানগুলো বাতিল হতে চলেছে, তখন তাঁরা এই নীতি পছন্দ করল না। যেহেতু অশোকের সাম্রাজ্যে প্রাণী হত্যাকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল, তাই ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাঁদের স্রষ্টার প্রতি বলি দিতে পারছিলেন না। শিকারি আর জেলেরাও ক্ষুব্ধ ছিল, কেন-না এ আইন তাঁদের উপরেও বর্তায়। এরপর যা হওয়ার ছিল তাই-ই হল। বৌদ্ধধর্মের বিনাশ করতে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা উঠে-পড়ে লাগল এবং দারুণ ‘ঐতিহাসিকভাবে সফল হল।

অশোকের রাজত্বের নবম বছরে কলিঙ্গ যুদ্ধ হয়। সত্যি কি তিনি কলিঙ্গ যুদ্ধের শেষে দয়া নদীর তীরে লক্ষ মানুষের রক্তস্রোত দেখে শোকে বিহ্বল হয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন? এরকম হলে অবশ্য বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রচারে সুবিধা হয়, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার নয়। অশোক বুদ্ধের বাণী শুনে ‘অতি দুষ্ট’ থেকে ‘অতি শিষ্ট হয়েছেন– এই চিত্রকল্প বৌদ্ধধর্ম প্রচারে ও প্রসারে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে নিশ্চয়। তবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক এই আবেগের অতিশোয়াক্তি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

স্মর্তব্য, সেই সময়কার ভারত উপমহাদেশে একাধিক দর্শন দানা বাঁধছে শুরু করেছে। সেগুলির মধ্যে অনেকগুলিই হল ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরোধী, নিদেনপক্ষে ভিন্ন মতাবলম্বী। ধর্ম বিরোধিতা সেই সময়ে মধ্য যুগের মতো ছিল না। একই পরিবারে বিভিন্ন মতাবলম্বী সদস্য অবস্থান করত। ধর্ম পরিবর্তন বা বলা যেতে পারে জীবনদর্শনের পরিবর্তন ব্যক্তি মানুষকে চূড়ান্ত আঘাত করত না। সেই ধরনের বিদ্বেষের বিষ ঢোকানোর মতো মানসিকতা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি। ভিন্ন ধর্মীয়দের সহাবস্থান আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সত্যিই ঈর্ষণীয়। তার মানে এই নয় যে, এই ধর্মমত ও দর্শনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ ছিল না। ছিল, কিন্তু সঙ্গে ছিল এই দর্শনগুলোর বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক আন্দোলন। এই গতিশীলতার প্রভাব তাই শুধু ধর্মবিশ্বাসে নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরেও পড়েছিল।

রোমিলা থাপার তাঁর ‘অশোক ও মৌর্যদের পতন’ গ্রন্থে লিখেছেন, তাঁর রাজত্বের কোনো একটি সময়কে তাঁর ধর্মান্তরণের নিখুঁত মুহূর্ত হিসাবে উল্লেখ করার অর্থ, আসলে যা ঘটেছিল সে সম্পর্কে অত্যুক্তি করা। হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে কিছু বিরোধিতা ছিল। কিন্তু সাক্ষ্য প্রমাণ বুঝিয়ে দেয় যে, এই সময়ে ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধিতা এত তীব্র ছিল না যে, নতুন ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে পুরোনো সমস্ত বিশ্বাসকে অস্বীকার করার প্রয়োজন।

অশোকের প্রথম স্ত্রী ছিলেন দেবী ছিলেন বুদ্ধ অনুরক্ত। তখন থেকেই বিদিশা বৌদ্ধধর্মের এক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীকালে দেবীর উদ্যোগে বিদিশার বিহার নির্মিত হয়েছিল। অনেকে মনে করেন অশোকের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পিছনে দেবীর ভূমিকা আছে। অশোকের সিংহাসন আরোহণ মসৃণ ছিল না। সিংহলীয় ইতিবৃত্ত মহাবংশে বলা হয়েছে ৯৯ জন ভাইকে হত্যা করে তিনি সিংহাসনারূঢ় হয়েছেন। আবার তারানাথের বিবরণ অনুযায়ী অশোক তাঁর ছয়জন ভাইয়ের মৃত্যু ঘটান। এবিষয়ে সন্দেহ নেই যে, বিন্দুসারের মৃত্যুর পরে প্রাসাদ অভ্যুত্থান হয়েছিল। তাই পিতার মৃত্যুর পরে দীর্ঘ চার বছর লেগেছিল অশোকের নিরঙ্কুশভাবে সিংহাসনের অধিকারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। ভ্রাতৃ হত্যা, পিতার আদেশ অনুসরণ না করা ইত্যাদি মোটেই বৌদ্ধ অনুশাসনুযায়ী নয়।

সম্ভাবনাময় অশোকের সামনে ছিল পূর্ববর্তী রাজবংশের উদাহরণ। পিতৃঘাতক অজাতশত্রু। দরবারী অমাত্যবর্গের সহায়তা তিনি পেয়েছেন। ভ্রাতৃহত্যা করে তিনি সিংহাসনে বসেছেন। দ্বন্দ্ব ছিল বলেই সিংহাসনে বসার আগের জীবন নিয়ে অশোকের শিলালেখে নৈঃশব্দ বিরাজ করছে। পরবর্তীকালে একবার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি তার ভাইয়ের পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করেছেন। শক্তিধর অশোকের সিংহাসন দখল, কলিঙ্গ যুদ্ধ ইত্যাদিকে এই পটভূমিকায় দেখা প্রয়োজন। কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে ত্রয়োদশ শিলালেখতে লিখিত বয়ান— “যখন তিনি (অশোক) ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র, রাজা পিয়দসি, আট বছর অতিবাহিত করলেন, তখন কলিঙ্গ জয় হল। এতে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার লোক গৃহহীন হয়, এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয় এবং তারও কয়েক গুণ বেশী মানুষ ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর যখন কলিঙ্গ তাঁর রাজ্যভুক্ত হয়, তখন ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র ঐকান্তিকতার সঙ্গে ‘ধম্ম’ পালন করেন, তাঁর একমাত্র কাম্য হয়, ধম্ম প্রচার।”

অশোকই প্রথম এবং শাসক, যিনি তাঁর নৃশংস শাসনব্যবস্থা বদলে দিয়ে এক আদর্শ জনকল্যাণমুখী শাসন ও বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন, যা ভারতের পরবর্তী কোনো শাসকই অনুসরণ করেননি। চারটি সিংহ একে অপরের পিঠ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এমন একটি ভাস্কর্য নির্মাণে তদারকি করেছিলেন অশোক; যা স্থাপিত হয় মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানীতে। বর্তমানে ভাস্কর্যটি সারনাথ জাদুঘরে রয়েছে। এই ভাস্কর্যটিই হল বর্তমান ভারতের জাতীয় প্রতীক। মজার বিষয় হল –আমাদের জাতীয় প্রতীক অশোকস্তম্ভ, যা এক বৌদ্ধশাসকের সৃষ্টি করা, সেই বৌদ্ধধর্ম যা ভারতে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। সেই অশোকস্তম্ভ, যা অহিংসার প্রতীক। অশোকচক্র, যা ভারতের জাতীয় পতাকায় ব্যবহৃত হয়, যা ১২ বিপরীত ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে মোট ২৪টি প্রকাশ করে। বাস্তবিক ভারতীয় শাসকরা এই এই প্রতীকগুলির অমর্যাদা করে চলেছে প্রতিনিয়ত স্বাধীনতা পরবর্তী ৭৩ বছর। ভারতে আজ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত হিংসায় বাতাবরণ। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে জরাজীর্ণ এই দেশ। আজকের দেশে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে হিংসা ছড়িয়ে দাঙ্গা সংঘটিত করে তখত-এ তাউসে উপবিষ্ট হন বিশেষ একটি রাজনৈতিক দল। এই আমাদের অশোকের ধর্মীয় অনুশাসনের দেশ!

 ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এইচ এম ইলিয়ট (Henry Miers Elliot) তাঁর “The History of India, as Told by Its Own Historians’ গ্রন্থের ভূমিকায় যা লিখেছেন তাতেই অনুমেয় বইয়ের ভিতর কী ভয়ংকর ‘বারুদ উনি মজুত রেখেছেন। ভূমিকায় ইলিয়ট লিখছেন– মুসলিমরা হিন্দুদের হত্যা করত, শোভাযাত্রা ও প্রার্থনায় বাধা সৃষ্টি করত, শুদ্ধিকরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করত, পবিত্র মূর্তির অঙ্গচ্ছেদ করত, মন্দিরগুলিকে গুঁড়িয়ে দিত, জোর করে হিন্দুদের মুসলমান করে নিত। তারা হিন্দুদের পাইকারিভাবে হত্যা ও নারীধর্ষণ করত। … তুলনামূলকভাবে ইংরেজদের শাসন মৃদু এবং সাম্যবাদী। তার ফলে ভারতের হিন্দু প্রজারা ইংরেজদের শাসনকালে পাচ্ছে বিশাল সুযোগসুবিধা। এ ইতিহাস চাড়িয়ে গেল গোটা ভারতে। দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্কের মধ্যে পচন শুরু হল। ইংরেজরা তো রইলই, এর সঙ্গে যুক্ত হলেন গোলওয়ালকরের মতো সুমহান ‘ভারতপ্রেমীরা’! গোলওয়ালকার তাঁর ‘We or Our Nationhood Defined’ গ্রন্থে বললেন– “প্রাচীন হিন্দুজাতিই হিন্দুস্তানে বর্তমান এবং বর্তমান থাকা উচিত; হিন্দুজাতি ছাড়া আর কিছুই নয়।… এতদিন পর্যন্ত, যেভাবেই হোক, যেহেতু তাঁরা (মুসলিম ও অন্যান্য অহিন্দুরা) তাঁদের জাতিগত ধর্মগত ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য বজায় রেখেছে, তাঁরা বিদেশি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। … বিদেশিদের সামনে কেবল দুটি পথ খোলা আছে, হয় দেশীয় জাতির সঙ্গে মিশে যাওয়া এবং তার সংস্কৃতিকে গ্রহণ করা, নয়তো দেশীয় জাতির সদিচ্ছার উপর বেঁচে থাকা। … হয় তাঁদের আর বিদেশি হয়ে থাকা চলবে না, নয় তাঁদের হিন্দু জাতির কাছে পুরোপুরি। বশ্যতা স্বীকার করে এদেশে থাকতে হবে, কোনো কিছুই দাবি করা চলবে না, কোনো অধিকার রাখা চলবে না, পক্ষপাতমূলক ব্যবহার তো দূরে থাক, নাগরিকত্ব পর্যন্ত নয়। এই দেশে হিন্দুরাই প্রকৃত জাতি এবং মুসলিম ও অন্যান্যরা দেশদ্রোহী যদি নাও হয় অন্ততপক্ষে জাতিবহির্ভূত।” ভারতীয় গোলওয়ালকরদের লড়াইটা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কোনোদিনই ছিল না। ভারতীয় গোলওয়ালকরদের লড়াইটা ছিল ভারতীয়দের বিরুদ্ধেই, ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে এবং যেসব হিন্দুরা ওদের ভাবনার সঙ্গে সহমত পোষণ করে না তাঁদের বিরুদ্ধে। ওরা সবাইকেই দেশদ্রোহীর ট্যাগ লাগায়। ওদের মতে, ওদের মতো ব্রাহ্মণ্যবাদীরাই ভারতের একমাত্র দেশপ্রেমী’। একমাত্র ব্রাহ্মণ্যবাদীরাই ভারতের নাগরিক।

ঘাড়ের উপর আতঙ্ক আর সংশয় নিঃশ্বাস ফেলে সবসময়। অথচ পরিস্থিতি তো এত কঠিন অবস্থায় কি পৌঁছোতে পারত, যদি ভুলভাল অসত্য ইতিহাস রচনা ও তাঁর প্রচার এবং প্রসারের মুখ বন্ধ করে দেওয়া যেত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। ওইসব সাংঘাতিক মিথ্যাবৃত্তি তথাকথিত ইতিহাসের প্রচার নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল। যে বিবরণের ইতিহাস নেই, সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই সেই ইতিহাস প্রচার করা গর্হিত অন্যায় তো বটে। শত শত বছর ধরে হাজার হাজার গোয়েবলস মুসলিমদের দিয়ে কোটি কোটি হিন্দুদের রক্ত ঝরিয়ে ফেলেছেন ‘ইতিহাস’ গ্রন্থে। নীচের স্তরে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চস্তরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও অধ্যাপকেরা ইতিহাসের অপবাদটা ঘুচিয়ে ফেলতে পারতেন ইতিহাসমনস্কতায়। তাঁরা যদি এই বৌদ্ধিক দায়িত্বটা নিতেন তাহলে হয়তো আমরা অন্য এক সুন্দর ভারতবর্ষ পেতে পারতাম। আজ হয়তো সাম্প্রদায়িক অসৌজন্যের মুখোমুখি হতে হত না।

পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে, যা দেখি তার সবটা সত্য নয়, যা জানি তার সবটা সত্য নয়। সত্যের পিছনেও অন্য সত্য, যা চতুরতার সঙ্গে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। আসুন, কয়েকটা ঘটনার উল্লেখ করি। ধরুন, কমিউনিস্ট পার্টি হল শ্রমিক কৃষকের পার্টি, সর্বহারা পার্টি, তাই তো? কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিতে দেখবেন শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষে বসে আছে জ্যোতি বসু মতো এলিট লোকজন। কৃষক সংগঠনের নেতৃত্বে যাদবপুরের প্রফেসর যাকে ধান গাছে তক্তা হয় কি না জিজ্ঞেস করলে মাথা চুলকাবে। ওদের পার্টির তাত্ত্বিক নেতৃত্বে আছে প্রফেসর থেকে শুরু করে পুঁজিবাদী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এগজিকিউটিভ। আবার ধরুন, পুরুষতান্ত্রিকতা। স্বাভাবিকভাবে শুনলেই মনে হবে এটা বোধহয় ‘বাই দা পুরুষ ফর দা পুরুষ’। আদতে কি তাই? পণের দায়ে একটা মেয়ের গারে কেরোসিন ঢেলে দেশলাই ঠুকে দেওয়ার মূল কাজটা কিন্তু করে ননদ, শাশুড়ি, জা, এঁরাই। স্বামী শ্বশুর দেওর ভাসুর এঁরা ব্যাক আপ দেয়। ব্রিটিশরা যখন ভারত শাসন করত, তখন কি ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রে শুধু ইংরেজই ছিল? তা তো নয়। বরং পুলিশ, সেনাবাহিনী, ও প্রশাসনের বেশিরভাগ পদেই ভারতীয়রা চাকরি করত। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন ব্রিটিশ আমলের একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর। এরকম অসংখ্য পদাধিকারীর নাম বলা যায়। ব্রিটিশদের নির্দেশিত সমস্ত অন্যায় এইসব ভারতীয়দের দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল। বিপ্লবীদের ধরিয়ে দেওয়ার কাজটিও ভারতীয়রাই করত। “বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে শতগুণ”। অতএব ব্রিটিশ শাসনকালে যত-না ব্রিটিশরা অত্যাচার করেছিল ভারতীয় জমিদার এলিট শ্রেণির লোকেরা। মোদ্দা কথা ব্রিটিশদের প্রসাদ পাওয়া ব্যক্তিরাই সাধারণ মানুষদের উপর শোষণ নিপীড়ন চালিয়ে গেছে। হিটলার ইহুদি গণহত্যা করেছিল বলে ইতিহাসে কুখ্যাত। কিন্তু এটা কি জানেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদি বন্দিদের গুলি করা, হত্যা করা, কবর দেওয়ার ম্যানুয়াল কাজগুলো করত গেস্টাপো নিয়োজিত বিশেষ ইহুদি ‘কাঁপো’ বাহিনী? তেমনি বিজেপি দলেও সব জাত ধর্মের প্রতিনিধিত্ব আছে। কিন্তু প্রতিনিধিত্ব থাকাটা কোনো ব্যাপার নয়। বিজেপি সংখ্যালঘুবিদ্বেষী রাজনৈতিক দল হলেও সে মুসলিম, দলিত সব ধরনের মানুষ আছে। আমাদের দেশে ধান্দাবাজ ও সুবিধাবাদী লোকের অভাব তো কালেই ছিল না। বিজেপির মূল উদ্দেশ্যই হল পুরুষতান্ত্রিক, মনুবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী, হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র ও সমাজ সৃষ্টি করা। এই কাজে ওঁরা হিন্দু তো বটেই, দরকারে মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, দলিত, মহিলা, আদিবাসী সবার সাহায্য ও সহযোগিতা নেবে ও নিচ্ছে। যাঁরা এই কাজে ওদের সাহায্য করছে তাঁরা বোঝাই যাচ্ছে আসলে নিজের শ্রেণির পক্ষে নয়, বরং টাকা, ক্ষমতা বা সুবিধার বিনিময়ে নিজেদের আইডেন্টিটিকে কাজে লাগাচ্ছে। দীর্ঘ ৮০০ বছরে মুসলিম শাসনেও প্রচুর অভিজাত হিন্দু, হিন্দু সেনা, হিন্দু সেনানায়ক, হিন্দু পদাধিকারীদের দ্বারাই হিন্দু হত্যা, মন্দির ধ্বংস সংঘটিত হয়েছে।

তদুপরি আমাদের আরও ভাবা দরকার– মোগল আমলে মুসলিম শাসনের সময় সারা ভারতবর্ষে চাকরি, ব্যাবসা, রাজনীতি সবক্ষেত্রেই মুসলমানদের স্থান ছিল শীর্ষে। কিন্তু সিপাহি বিপ্লবের পর থেকেই উন্নতির আলো নিভে যেতে শুরু করল। মুসলিমরা ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়ল। প্রান্তিক হয়ে পড়ল কিছুটা নিজেদের গোঁয়ার্তুমির জন্যেও, তবে অনেকটাই ষড়যন্ত্র। আরবি, ফারসি ভাষা থেকে সরে এসে ইংরেজি ভাষাকে গ্রহণ না-করাতেই অনেক যোজন দূর পিছিয়ে পড়ল মুসলমান সমাজ। সেই ঘাটতি আজও মুসলমান সমাজ কাটিয়ে উঠতে পারেনি, শিক্ষায়-দীক্ষায় অন্ততপক্ষে হিন্দুদের সমকক্ষ হতে পারেনি। এমনকি মুসলিমরা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদেরও টপকাতে পারেনি। বাংলাদেশের হিন্দুরা সরকারি বড়ো বড়ো পদ অলংকৃত করে রেখেছে। সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে নতুন গতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য হল –১৯৯১ সালে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই মোট নথিভুক্ত চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৫,৫৫,৯৫২ জন, যার মধ্যে মুসলিম ৭,৩১,৩৫৭ জন (অর্থাৎ ১৩.১৬ শতাংশ)। অর্থাৎ মুসলিমদের জনসংখ্যার হারের তুলনায় অন্তত ১০ শতাংশ কম। এই ফল কেন? মুসলিমদের দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব? নাকি চাকরি পাওয়ার আশা নেই বলে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে পা মাড়ায় না? বস্তুত এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার যে হিসাব তা মুসলিমদের পক্ষে আদৌ আশাব্যঞ্জক নয়। ওই বছরই চাকরির জন্য এক্সচেঞ্জ থেকে নাম পাঠানো হয়েছিল মোট ২,৪৯,৭৬৯ জনের, যার মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০,৪৫৮ জন। নথিভুক্তি থেকে মনোনয়নের পর্যায়ে শতকরা হার আরও নেমে হয়েছে ৪.১৯ শতাংশ। শেষপর্যন্ত যাঁরা চাকরি পেলেন তাঁদের সংখ্যা ১৪,৪৬৫ জনের, এর মধ্যে মুসলিম ৭১৭ জন। তবে মুসলিমদের এই পিছিয়ে পড়ার ব্যাপারে একটা ইতিহাস আছে। এ ইতিহাস আগেও আলোচনা করেছি। বস্তুত ভারত ব্রিটিশ কর্তৃক পরাধীনতার পর ব্রিটিশ-প্রণীত আধুনিক শিক্ষার প্রতি চরম অনীহা দেখিয়েছে মুসলিমরা। বাংলা ভাষা ‘বিদাত’ এবং ইংরেজি ভাষা ‘হারাম’ –এই ফতোয়া জারি হয়েছিল মুসলিম সমাজে। এর ফলে মুসলিমরা যতটা পিছনে পড়ে গেল, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি হিন্দু সহ অন্যান্য অ-মুসলমানরা এগিয়ে গেল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে। তা ছাড়া দেশভাগের পর শিক্ষিত মুসলমান সমাজের একটা বড়ো অংশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায়। সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানই আজকের বাংলাদেশ। বহু বছর যাঁরা অভিমান নিয়ে যাঁরা পথ চলেছে তাঁরা দেশের মূলস্রোতের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিল না। আজও কি খাপ খাওয়াতে পারল? না-পারার কারণও হয়তো সেই ধর্ম, ধর্মীয় বিভাজন এবং একে অপরের থেকে যোজন যোজন দূরত্ব।

মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে আজ যাঁরা নানা মুখরোচক কথা বলছেন তাঁরা কি একবারও ভেবেছেন মুসলিম সম্প্রদায় এ মুহূর্তে গোটা দেশে কোন্ পর্যায়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার আবর্তে পড়ে রয়েছে? বিশ্লেষণ করে দেখব। তার আগে অবশ্যই মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপারটা পরিষ্কার করে নিতে পারি। মাদ্রাসা সম্বন্ধে অ মুসলিমদের তেমন কোনো ধারণা নেই বললেই চলে। তাঁরা মনে করে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করা মুসলিম মানেই ধর্মান্ধ, সন্ত্রাসী। মাদ্রাসা’ বহুবচনে আরবি ‘দারসুন’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘পাঠ’। মাদ্রাসা মূলত মুসলিমদের অধ্যয়ন-গবেষণার প্রতিষ্ঠান। সাধারণ অর্থে মাদ্রাসা হচ্ছে আরবি ভাষা ও ইসলামি বিষয়ে অধ্যয়নের প্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসার প্রাথমিক স্তর মক্তব, নুরানি বা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা নামে অভিহিত। ফোরকানিয়া শব্দের মূল ‘ফুরকান, যার অর্থ বিশিষ্ট। মিথ্যা থেকে সত্যকে সুস্পষ্টভাবে পৃথক করে বলে পবিত্র কোরানের আর-এক নাম আল ফুরকান। প্রাথমিক স্তরের যেসব মাদ্রাসায় কোরান পাঠ ও আবৃত্তি শেখানো হয় সেগুলিকে বলা হয় সে কোরান। সাধারণত স্থানীয় কোনো মসজিদেই আশেপাশের পরিবারের ছোটোদের প্রাথমিক পর্যায়ের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিনরাই সাধারণত এর শিক্ষক বা উস্তাদ হন। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত মাদ্রাসার প্রকরণগুলো হল— ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, দাখিল মাদ্রাসা, আলিম মাদ্রাসা, ফাজিল মাদ্রাসা, কামিল মাদ্রাসা, হাফিজিয়া মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা। মাদ্রাসা শুধুমাত্র কোরান পড়ানো হয় না। অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ও পড়ানো হয়। সুলতানি আমলে মাদ্রাসার পাঠক্রমে ছিল আরবি, নাহু (বাগবিধি), সরফ (রূপতত্ত্ব), বালাগাত (অলংকারশাস্ত্র), মানতিক (যুক্তিবিদ্যা), কালাম (জ্ঞানতত্ত্ব), তাসাউফ (অতীন্দ্রিয়বাদ), সাহিত্য, ফিকহ (আইনশাস্ত্র), এবং দর্শন। ব্রিটিশ শাসনামলে এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা একটি নতুন মোড় নেয়। মাদ্রাসাগুলির নামে মোগল সরকারের বরাদ্দকৃত লাখেরাজ জমি বাজেয়াপ্ত করে। ফলে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অনেক মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলার গভর্নর লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮০ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারের জন্য কিছুসংখ্যক মুসলিম আইন। অফিসার তৈরি করা। তবে সরকারের সমর্থন ও অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মাদ্রাসা শিক্ষার বিকাশ গতিরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বাংলার অধিকাংশ মাদ্রাসা দরসে নিজামির আদলে শিক্ষাদান পরিচালনা করে। এই ব্যবস্থা ১৯৭০ দশক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। দরসে নিজামি পাঠক্রম অনুযায়ী একজন ছাত্রকে ১৭/১৮ বছর বয়সেই আরবি ও ফারসি ভাষায় লিখিত নির্বাচিত ৯৯টি গ্রন্থের অন্তত একটি পড়ার ও অনুধাবনের যোগ্যতা অর্জন করতে হত। ধর্মীয় পাঠ্যক্রম ছাড়া এই পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল ইউনানি চিকিৎসা বিদ্যা, কুটির শিল্প ও কারিগরি প্রশিক্ষণ। মুসলিমদের ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে ঔপনিবেশিক শাসকবর্গ ১৮৯০-এর দশকে নতুন ধরনের মাদ্রাসা চালু করে। নিউ স্কিম মাদ্রাসা’ নামে অভিহিত এসব মাদ্রাসায় পাঠক্রমে সকল ইসলামি বিষয়ের সঙ্গে ইংরেজি ভাষাকেও বাধ্যতামূলক করা হয়। সকল নিউ স্কিম মাদ্রাসাকে সরকারি সাহায্যভুক্ত করা হয়। জুনিয়র ও সিনিয়র নামে দু-ধরনের নিউ স্কিম মাদ্রাসা প্রবর্তিত হয়। জুনিয়র মাদ্রাসায় পড়ানো হত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আর সিনিয়র মাদ্রাসা ছিল মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য। সরকারি চাকুরি পেতে আগ্রহী মুসলিম শিক্ষার্থীরা নিউ স্কিম মাদ্রাসায় পড়তে বিশেষ আগ্রহী ছিল।

সবচেয়ে আলোচিত মাদ্রাসা হল কওমি মাদ্রাসা বা খারিজি মাদ্রাসা। অনেক মুসলিমরাই এই শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে থাকে। এইসব মাদ্রাসাগুলো নিয়ে প্রচুর অভিযোগও আছে। কওমি মাদ্রাসায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বিশ্বাস করেন, তাঁদের অর্জিত শিক্ষা ইহকালের জন্য নয়, পরকালের জন্য। তাঁদের কর্মজী তাই ধর্মীয় শিক্ষা, ধর্মপ্রচার ও ধর্মীয় আচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই ধরনের প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ কোরানভিত্তিক। অর্থাৎ ১৫০০ বছর আগের কোরানের সমাজ ও আইনি ব্যবস্থাই এখানকার ছাত্রছাত্রীরা ২০২১ সালেও ধ্রুব সত্য বলে মনে করে। অনেক কিছুই সত্য হতে পারে, কিন্তু সব তো সত্য হতে পারে না। এঁরা ১৫০০ বছর আগের সমাজ ও আইনি ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখে এবং সেটা প্রচার করেন। এঁদের শিক্ষাশেষে কেরিয়ার বলতে বেশিরভাগই মসজিদে সামান্য বেতন ধর্মীয় শিক্ষাদান, যা ওঁরা নিজেরা শিখেছেন।

২০১১ সালের এক গবেষণা (গবেষক অধ্যাপক আবুল বারকাত) প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারাদেশে (বাংলাদেশ) কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ৩৯ হাজার ৬১২। এসব মাদ্রাসায় বিভিন্ন স্তরে পড়াশোনা করছে ৫২ লাখ ৪৭ হাজার ৬৬০ জন্য শিক্ষার্থী। এই বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর কর্মজীবন যেহেতু ধর্মভিত্তিক পেশার মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষার্থীদের তুলনায় তাঁদের চাকরিক্ষেত্র অনেকটাই সংকীর্ণ। আর তাঁদের চাকরিক্ষেত্র সীমিত হওয়ার পিছনের মূল কারণ মূলধারার চাকরির জন্য যেসব মৌলিক দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলো শেখানো হয় না কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের। তবে মাদ্রাসা শিক্ষায় দ্বিতীয় ধারা অর্থাৎ আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ধর্মভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি মূল ধারার শিক্ষাব্যবস্থার কিছু কিছু বিষয় পড়ানো হয়। ফলে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের তুলনায় আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের চাকরির ক্ষেত্র খানিকটা বিস্তৃত। তবে তা মূলধারার শিক্ষার্থীদের সমান নয়। সরকার অনুমোদিত আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার, এর মধ্যে ছয়টি মাদ্রাসা সরকারি। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪০ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড নির্দেশিত ও অনুমোদিত পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি অনুসরণ করে থাকে এসব মাদ্রাসা। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীর সংখ্যায় এগিয়ে থাকা কওমি মাদ্রাসাগুলো নিজস্ব পাঠ্যসূচি অনুসরণ হয়ে থাকে। এদের পাঠ্যপুস্তকও নিজস্ব। এগুলোর সরকারি স্বীকৃতি নেই। এসব মাদ্রাসায় বিভিন্ন ডিগ্রির মধ্যে ‘দাওরায়ে হাদিস’ ছাড়া অন্য কোনো ডিগ্রিরও সরকারি স্বীকৃতি নেই। স্নাতকোত্তর সমমান ‘দাওরায়ে হাদিসে’র সরকারি স্বীকৃতিও মিলেছে সম্প্রতি। এর আগে, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক পর্যায়ে আলিয়া মাদ্রাসা বা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় স্থানান্তরিত হয়ে আসতে পারত, যেন চাকরির বাজারে তাঁরা সুযোগ পায়।

তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষা চালুর হওয়ায় পঞ্চম শ্রেণির পর থেকে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের আলিয়া মাদ্রাসা বা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল কাদির বলছেন, “কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি সময়োপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। বেসরকারিভাবে পরিচালিত এসব মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ তাঁদের পাঠ্যসূচিতে সংস্কার চায়নি অথবা নিজেদের পাঠ্যসূচিতে সরকারের হস্তক্ষেপ চায়নি বলেই এই সংস্কার হয়নি।” অধ্যাপক কাদির বলেন, “এর ফলে বছরের পর বছর ধরে এই শিক্ষাব্যবস্থায় কেউ হাত দিতে পারেনি এবং এর স্বীকৃতি মেলেনি।” কওমি শিক্ষার্থীদের চাকরির ক্ষেত্র সীমিত। কওমি মাদ্রাসাগুলোর দর্শনের লক্ষ্য পরকাল। তাঁদের কোরান ও হাদিস সম্পর্কে বিস্তারিত পড়াশোনা করতে হয়, যেন তাঁরা এই শিক্ষা দিয়ে ধর্মীয় বিধান মেনে জীবনযাপন করতে পারে এবং পরকালে জান্নাতবাসী হয়। তাঁরা পৃথিবীর বুকে খুব সহজ-সরল জীবনযাপনে বিশ্বাসী। ফলে পৃথিবীতে সাধারণ জীবনযাপনের জন্য যে শিক্ষা ও দক্ষতা প্রয়োজন, সেগুলো কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থায় অবহেলিত।

গাজীপুরের মুন্সিপাড়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার অধ্যক্ষ মওলানা রফিকুল আলম বলেন, “কওমি মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ আলাদা। যাঁরা আল্লাহর কাজ করতে চায়, তাঁরা মাদ্রাসায় পড়তে আসে।” পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার নিয়ম-কানুন কিংবা কোরান শরিফ পড়তে জানা নেই যাঁদের, তাঁদের বাড়িতে গিয়ে এসব বিষয় শেখানোর মাধ্যমে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন বলে জানান তিনি। একসময় কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন আব্দুল্লাহ। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বলেন, “তাঁরা (কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা) ইসলামের সেবা করতে চায় এবং ইসলামি পন্থায় জীবনযাপন করতে চায়। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে তাঁরা মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন, ধর্মপ্রচারের কাজ করেন অথবা বিভিন্ন মসজিদে নামাজ পড়িয়ে থাকেন।” কওমি মাদ্রাসায় থাকাকালে সেখানকার খুব অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীই আলিয়া মাদ্রাসায় যেতে চাইত বলে জানান তিনি। জানা গেছে, কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষ করে খুব অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীই উচ্চশিক্ষার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গিয়ে থাকেন। তাঁদের কেউ কেউ সেসব দেশেই থেকে যান, কেউ কেউ ফিরে আসেন দেশে। আব্দুল্লাহ বলেন, “কওমি মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এ ধরনের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা খুবই কম। কারণ কওমিতে পড়ালেখা খুব কঠিন। ফলে পূর্ণাঙ্গ আলেম হওয়াটা সহজ নয়। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বড়ো একটি অংশই মাধ্যমিক স্তর শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে।”

কওমি শিক্ষার্থীদের জীবিকা নির্বাহ হয় কীভাবে? কওমি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, কওমি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন মসজিদে ইমাম, মুয়াজ্জিম বা খাদেম হিসাবে কিংবা বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসাবে কাজ করার উদাহরণই বেশি। তবে ধর্মভিত্তিক এসব কাজে বেতন-ভাতা অত্যন্ত কম হওয়ায় তাঁদের অনেকেই আর্থিক নিশ্চয়তার জন্য ছোটোখাটো ব্যাবসা করে থাকেন। যেমন, একজন ইমামের কাজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ানো এবং মুয়াজ্জিনের কাজ পাঁচ ওয়াক্তের নামাজের সময় আজান দেওয়া। কেবল পেশাগত নয়, ধর্মীয় দায়িত্বশীলতা থেকেও তাঁরা এসব করে থাকেন। মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয় মূলত মসজিদের তহবিল থেকে, যা সংগৃহীত হয় স্থানীয় ধার্মিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দান থেকে।

শহর এলাকায় মসজিদের ইমাম ও খতিবের মাসিক সম্মানী সাধারণত ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে হয়। এসব এলাকায় একজন মুয়াজ্জিনের সম্মানী মাসে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা, খাদেমের জন্য সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে, মসজিদের তহবিলে অল্প টাকা থাকে বলে গ্রাম এলাকায় ইমাম-মুয়াজ্জিনের সম্মানী আরও কম হয়ে থাকে। কোননা কোনো গ্রামে ইমামকে মাসে এক হাজার টাকাও দেওয়া হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও আবার কেবল গ্রামবাসীর দেওয়া ধান-চাল দিয়েই সম্মানী দেওয়া হয় ইমাম-মুয়াজ্জিনকে। অবশ্য তাঁদের মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে তিন বেলা খাবার দেওয়া হয়। আর মসজিদেই তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। শহরাঞ্চলে বড়ো বড়ো মসজিদে জুমার নামাজ পড়িয়ে চার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি আয়ের সুযোগ থাকে খতিবদের জন্য। ফলে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের দৈনন্দিন খরচ মেটানোর জন্য কোরান শিক্ষা দেওয়া, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল বা ওয়াজ মাহফিল পরিচালনার কাজ করে থাকেন।

মওলানা রফিকুল আলম বলেন, “ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থাকায় তাঁরা কোনোমতে চলতে পারেন। তা ছাড়া ইহলৌকিক জীবনে তাঁদের খুব একটা আগ্রহও নেই।” ইহলোকের জীবনে আগ্রহ না-থাকা কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ধর্ষণে প্রবৃত্ত হয়, সেটা বড্ড ভাবায়। মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ প্রচুর। এমনকি, মসজিদের ইমাম, মৌলানাদের বিরুদ্ধেও এ ধরনের অভিযোগ উঠে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জহিরুল ইসলাম বলেন, “ইমামরা মাদ্রাসা ও মসজিদে মহানবির সুন্নত পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। ফলে তাঁরা বেতন-ভাতা বাড়ানোর বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ নন। কেউ কেউ লজ্জার খাতিরেও এসব নিয়ে কোনও কথা বলেন না।” আলিয়া মাদ্রাসায় সুযোগ কিছুটা উন্মুক্ত। আলিয়া মাদ্রাসাগুলোর ডিগ্রি মূলধারার সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার সমতুল্য। তা সত্ত্বেও মূলধারার চাকরিগুলোতে ঢোকার ক্ষেত্রে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরও সমস্যার মুখে পড়তে হয়। এইচএসসি সমমান আলিম ডিগ্রি অর্জনের পরই যেন আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা জাতীয় জনবলে যুক্ত হতে পারে, সেই পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তবে মাদ্রাসা থেকে মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিশেষায়িত শিক্ষায় পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখনও অনেক কম। আগে দাখিল ও আলিম স্তরে শিক্ষার্থীদের ১০০ নম্বরের বাংলা ও ১০০ নম্বরের ইংরেজি পড়তে হত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিবেচনায় দুই বিষয়েই এখন তাদের ২০০ নম্বর করে পড়তে হয় দাখিল ও আলিম স্তরে।

তবে ঢাবি শিক্ষক জহিরুল ইসলাম বলছেন, ইংরেজি-বাংলায় নম্বর বাড়লেও তাঁদের সার্বিক পাঠ্যক্রমে তেমন কোনো সংস্কার হয়নি। বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলো থেকে একসময় হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির মতো বিখ্যাত নেতা এবং মোহাম্মদ খুদরত-ই-খুদার মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানী বেরিয়ে এসেছে। সেই মাদ্রাসাগুলো এখন আর ভালো শিক্ষার্থী তৈরি করতে পারছে না। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এখন আর ইসলামি শিক্ষায় নিজেদের কর্মজীবন গড়তে মনোযোগী নয়। আলিম পাস করার পর অনেক শিক্ষার্থীই এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সাধারণ শিক্ষার ধারায় চলে আসে। তবে তাঁদের বড়ো একটি অংশ আবার আরবি বা ইসলাম শিক্ষার মতো বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ধর্মীয় আচার তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে বড়ো ভূমিকা রাখে। আবার মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মূলধারায় চাকরি ক্ষেত্রে ঢোকা অনেকের মধ্যেই সেই ধর্মীয় আচার থেকে দূরে সরে আসার ঘটনাও জানা যায়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় এখন আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বেশ ভালো করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও এখন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা মাদ্রাসা থেকে এসেছেন। আবার মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁরা আলেম হতে চান, তাঁরা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হন এবং ধর্মমনস্ক সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে উঠে আসেন তাঁরা।

অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য আরবি, কোরান, দাওয়া ও হাদিস বা ফিকাহর মতো বিষয় রয়েছে। এসব বিষয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী ডিগ্রি পাচ্ছেন। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের চাকরি ক্ষেত্র প্রসঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম সায়েফ উল্যা বলেন, সরকারি কর্ম কমিশনসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় তাঁদের শিক্ষার্থীরা ভালো করছেন। তিনি বলেন, “বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমাদের অনেক শিক্ষার্থী প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডারে যোগ দিয়েছে। আমরা এখন বিজ্ঞানে জোর দিচ্ছি, যা আইটি খাতেও বিশেষজ্ঞ জনবল তৈরিতে সহায়তা করছে।” মাওলানা রফিকুল আলম বলেন, “ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই আমাদের সমাজের অনেক মানুষ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে চান। এছাড়া, বেফাঁক নিজ অনুসারীদের কমিউনিটিগুলোতে বেশি করে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করে। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ইসলামকে প্রমোট করা এবং বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা।” মাদ্রাসা জনপ্রিয় হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাওলানা রফিকুল আলম বলেন, “মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যয়ভার সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার চেয়ে কম। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় থাকা-খাওয়ার সুবিধা দেওয়া হয়, যা সাধারণ স্কুল কলেজে থাকে না। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হল, কওমি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের জন্য রাষ্ট্রের সহায়তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করে এবং সরকারি অনুদানের উপর নির্ভর করতে চায় না। অধ্যাপক আবুল বারাকাতের বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, কওমি মাদ্রাসার অর্থের উৎস প্রধানত দুটি। একটি অভ্যন্তরীণ, অপরটি বিদেশি। স্বচ্ছল ব্যক্তিরা মাদ্রাসার ফান্ডে জাকাত, ফিতরা এবং সাদকার টাকা অনুদান হিসাবে দেন। এছাড়া ওয়াকফ সম্পত্তি, গ্রাম এলাকায় ফসল চাষ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি আদায়ও মাদ্রাসার ফান্ডের উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। মানুষ কোরবানির পশুর চামড়াও মাদ্রাসাগুলোতে দান করেন। অধ্যাপক আবুল বারাকাত বলেন, “অধিকাংশ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ফান্ডের উৎস সম্পর্কে মুখ খুলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। কওমি মাদ্রাসাগুলো বিভিন্ন নামে ফান্ড সংগ্রহ করে। বিশেষ করে সাধারণ ফান্ড, লিল্লাহ ফান্ড (গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য), বই কেনার ফান্ড, অবকাঠামো নির্মাণ ফান্ড ইত্যাদি। (সোহেল মামুন ও আসিফ ইসলাম শাওন)। বাংলাদেশ হল, এবার একটু ভারতে খোঁজ নিতে পারি মুসলিম জনসংখ্যার ঠিক কত শতাংশ মাদ্রাসায় শিক্ষা নেয় এবং কী কারণে। যেসব মুসলিম ছেলেপুলেরা ধারে-কাছে অন্য কোনো শিক্ষাব্যবস্থা পায় না, এমন গ্রামগঞ্জ এ ভারতে অভাব নেই। খোঁজ নিলে দেখা যাবে শুধু মুসলমান ছেলেপুলেরাই নয়, হিন্দু বা অন্য অ মুসলমান সন্তানসন্ততিরাও সেখানে পড়াশোনা করছে যথাযথ স্কুলের অভাবে। অনেক অ-মুসলমানরা মনে করেন বা মনে করানো হয় যে মাদ্রাসায় কেবলই কোরান-হাদিস পড়ানো হয় আর বিধর্মীদের ঘৃণা করতে শেখায় এবং জঙ্গি বানায়। প্রথমত, ধর্মীয় মাদ্রাসাগুলিতে অবশ্যই কোরান-হাদিস পড়ানো হয়। কিন্তু সরকার অনুমোদিত মাদ্রাসায় আরবি ভাষাশিক্ষার উপর জোর দেওয়া হলেও হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় সিলেবাস মাধ্যমিকের মতোই। এইসব মাদ্রাসাগুলিতে শুধু যে মুসলিম শিক্ষকরাই পড়ান তা কিন্তু নয়, হিন্দু শিক্ষকরাও পড়ান। দ্বিতীয়ত, বিধর্মীদের ঘৃণা করার জন্য কোনো মাদ্রাসার প্রয়োজন নেই, বাড়ির আত্মীয়-পরিজনরাই যথেষ্ট। সেটা কেবল মুসলিমদের দিকে তাক করলে হবে কেন, হিন্দুদের আত্মীয়-পরিজনরাও এ ব্যাপারে যথেষ্ট সক্রিয়। বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা করতে করতেই তো আমরা বেড়ে উঠি, বড়ো হই। শিক্ষা যথাযথ হলে একটা সুন্দর-সুষ্ঠু সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি, আর সুশিক্ষার অভাব হলে সমাজে বিষ ছড়াই, রক্ত ঝরাই। তৃতীয়ত, জঙ্গি মাদ্রাসায় তৈরি হয় এমন কাঠ-তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। হতে পারে জঙ্গিপনা করতে জঙ্গিরা কোনো ধর্মীয় মাদ্রাসায় শেলটার নিতে পারে। তা ছাড়া বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা ওইসব মাদ্রাসায় জঙ্গি বানাতে পাঠাচ্ছে, এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। সেখানে তো শুধু ছেলেরা পড়ে না, মেয়েরাও পড়ে। মূলত গ্রামের বেশিরভাগ গরিব অনাথ ছেলেমেয়েরাই এইসব মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। এইসব শিক্ষালয়ে। যেহেতু আরবি ভাষা শেখানো হয়, তাই বাবা-মায়েরা ছেলেদের পাশাপাশি কন্যাসন্তানটিকেও পাঠান। মেয়েরা আরবি জানলে তার বিয়ের বাজারে বেশ কদর হয়। ছেলেদেরও ফায়দা আছে, আছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক তাগিদ। পড়াশোনার শেখার পর মুসলিমদের যেহেতু চাকরির কোনো গ্যারান্টি নেই, সেইহেতু মসজিদে নামাজ পড়ানোর জন্য অনেকক্ষেত্রে বৈতনিক ইমামের প্রয়োজন মেটায়। যৎসামান্য, তবু গ্রামীণ জীবনে এটাই কম কীসের! পয়সা বা রোজগার কম ঠিকই, কিন্তু এ-পেশায় সন্মানও অনেক। গ্রামের মানুষদের আধ্যাত্মিক ভাবনার প্রয়োজন মেটায় এঁরাই। জন্ম থেকে মৃত্যু সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠানে মৌলবির চাহিদাও এরাই মেটায়। এক-আধজন অবশ্য এসব মাদ্রাসাতেও পড়ানোর চাকরি পেরে যায়, আবার কেউ কেউ নিজের বাড়িতে মক্তব খুলে শিশুদের কোরান শিক্ষা দিয়ে রোজগার করে। এছাড়া মুসলিম সমাজে দাড়ি-টুপি পরিহিত মুসলিমরা সাধারণ মুসলিমদের কাছে অত্যন্ত সন্মানের, সবাই সেই ব্যক্তিকে সমীহ করে। ফলে ভারতের মতো ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সমাজে প্রকৃত ভারতীয় হিসাবে প্রতিষ্ঠা না-পেয়ে অনেকে বাধ্য হয়ে ধর্মের শরণাপন্ন হয়ে ‘প্রকৃত মুসলিম হয়ে উঠতে চায়। যদিও মুসলিম সমাজের খুব সামান্য অংশই মাদ্রাসায় পড়তে যায়, তবে তা দিয়ে গোটা মুসলিম সমাজকে মেপে নিয়ে তাঁদের সম্পর্কে সাধারণ ধারণা করাটা ঠিক হয় না।

চাকরির বাজারে মুসলমানদের উপস্থিতি কতটুকু। নামকাওয়াস্তে। গৌতম রায়ের একটি বিবৃতিই এখানে সরাসরি উল্লেখ করা যাক –“অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমান সম্প্রদায়জাত মানুষ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে যে বঞ্চনার শিকার তার অপরাধের দায় আমাদের প্রত্যেক দেশবাসীর, এই অর্থনৈতিক বঞ্চনাই তাঁদের মধ্যেকার সামাজিক পরিবর্তনের অন্তরায়। এই সমস্যাটির প্রতি কারও বিশেষ নজর নেই। অথচ সবাই-ই দেখতে ব্যস্ত মুসলিম সমাজের অনগ্রসরতা। কোন্ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট একজন মুসলিম সম্প্রদায়জাত মানুষ সামাজিক নিগ্রহের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ধর্মীয় কোটরে গিয়ে নিজের অস্তিত্বকে খোঁজার চেষ্টা করে তা কেউ ভেবে দেখেছেন? মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে আজ যাঁরা নানা কথা বলছেন তাঁরা একবারও ভেবেছেন মুসলিম সম্প্রদায় আজ গোটা দেশে কোন পর্যায়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনার আবর্তে পড়ে রয়েছে? একদা কংগ্রেস আমলে উত্তরপ্রদেশে সরকারি চাকরিতে মুসলিম নিয়োগ বন্ধ ছিল। তৎকালীন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (উত্তরপ্রদেশের) রাজ্য বিধানসভায় এই তথ্য স্বীকার করেছেন, প্রাক্তন প্রতিরক্ষা রাষ্ট্রমন্ত্রী মহাবীর ত্যাগী সংসদে স্বীকার করেছিলেন, স্বাধীনতার পর রেল, যোগাযোগ, পুলিশ ও প্রতিরক্ষা বিভাগে মুসলিমদের অনুপাত ৩২ শতাংশ নেমে দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশ। সর্দার প্যাটেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন সার্কুলার জারি করেছিলেন, প্রশাসনের মূল এবং নিয়ন্ত্রক ক্ষেত্রগুলিতে যেন মুসলিমদের প্রবেশ না-ঘটে।…অথচ ১৯৭১ সালে তালুকদার কমিশন বলছে, সেইসময় রাজ্যে ক্যাডারদের ২৬৪ জন আইএএস অফিসারের মধ্যে মাত্র ২ জন মুসলমান সম্প্রদায়জাত। গোপাল সিং কমিটির বক্তব্য হল– অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের প্রথম শ্রেণির অফিসারের মধ্যে ১ জনও মুসলিম নেই। ১৯৯৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে ২২ শতাংশ মুসলিম থাকলেও তার মাত্র ২ শতাংশের বেশি মানুষকে চাকরি দেওয়া যায়নি। ১৯৫৬-৫৭ সালে তৎকালীন বিরোধী নেতা জ্যোতি বসুর সমালোচনার চাপে পড়ে ডঃ বিধানচন্দ্র রায় ২ শতাংশ মুসলিমকে চাকরি দিয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে চাকরি পায় ৯,১৩৮ জন। তার মধ্যে মুসলিম ৩৭১ জন, অর্থাৎ ৪.০৬ শতাংশ। ১৯৮৭ সালে ১০,২৫৩ জন, মুসলিম ২১৪ জন, ২.০৯ শতাংশ। ১৯৮৮ সালে ১২,২৯৮ জন, ৪০৯ জন মুসলিম, ৩.৩৩ শতাংশ। ১৯৮৯ সালে ৯,৯৮৪ জন, মুসলিম ৩৮৬ জন, ৩.৮৭ শতাংশ। ১৯৯০ সালে ৯,৪৯৪ জন, মুসলিম ৪৩৯ জন, ৪.৬২ শতাংশ। ১৯৯১ সালে ৯,৮৪৯ জন, মুসলিম ৪৪৫ জন, ৪.৫১ শতাংশ। ১৯৯২ সালে ৭,৩১৮ জন, মুসলিম ২৯২ জন, ৩.৯৫ শতাংশ। ১৯৯৩ সালে ৫,৬৭৫ জন, মুসলিম ৩১৪ জন, ৩.৭৭ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য হল, এই সময়কালে যতজন মুসলিম সম্প্রদায়জাত মানুষ চাকরি পেয়েছেন তার মধ্যে ২.৩১ শতাংশ নিযুক্ত হয়েছে পর্যটন দপ্তরে, ২.৪১ শতাংশ তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরে, ৩ শতাংশ মৎস্য দপ্তরে, খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরে অফিসার পদে ২.০৮ শতাংশ, এই বিভাগের সাধারণ পদে ৪.৭০ শতাংশ, পরিবহন দপ্তরে ৫.৫৭ শতাংশ। ১৯৯৫ সালে বর্ধমান জেলায় প্রাথমিক স্কুলে ৪ হাজার শিক্ষক নিযুক্ত হয়, তার মধ্যে ১১ জন মুসলমান, ১৯৯৬ সালে মুর্শিদাবাদ জেলায় নিযুক্ত ৬৪০ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ৪০ জন মুসলমান।” সারা ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে মুসলিমদের অংশগ্রহণ বিষয়ে সাচার কমিটির রিপোর্ট বলছে –(১) অন্ধ্রপ্রদেশে (জনসংখ্যা ৯.২ শতাংশ) ৮.৮ শতাংশ, (২) আসাম (জনসংখ্যা ৩০.৯ শতাংশ) ১১.২ শতাংশ, (৩) উত্তরপ্রদেশ (জনসংখ্যা ১৮.৫ শতাংশ) ৫.১ শতাংশ, (৪) কর্ণাটক (জনসংখ্যা ১২.২ শতাংশ) ৮.৫ শতাংশ, (৫) কেরল (জনসংখ্যা ২৪.৭ শতাংশ) ১০.৪ শতাংশ, (৬) গুজরাট (জনসংখ্যা ৯.১ শতাংশ) ৫.৪ শতাংশ, (৭) ঝাড়খণ্ড (জনসংখ্যা ১৩.৮ শতাংশ) ৬.৭ শতাংশ, (৮) তামিলনাড়ু (জনসংখ্যা ৫.৬ শতাংশ) ৩.২ শতাংশ, (৯) দিল্লি (জনসংখ্যা ১১.৭ শতাংশ) ৩.২ শতাংশ, (১০) পশ্চিমবঙ্গ (জনসংখ্যা ২৫.২ শতাংশ) ২.১ শতাংশ, (১১) বিহার (জনসংখ্যা ১৬.৫ শতাংশ) ৭.৬ শতাংশ, (১২) মহারাষ্ট্র (জনসংখ্যা ১০.৬ শতাংশ) ৪.৪ শতাংশ ইত্যাদি। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরিতে (ভারতীয় রেল) মুসলিমদের পদভিত্তিক সাচার কমিশনের খতিয়ান– উচ্চপদে হিন্দু ৯২.৮ শতাংশ (মুসলিম ৩ শতাংশ), অধস্তন হিন্দু ৮৮.৬ শতাংশ (মুসলিম ৫ শতাংশ), গ্রুপ এ হিন্দু ৯৩.৮ শতাংশ (মুসলিম ২.৫ শতাংশ), গ্রুপ বি হিন্দু ৯১.৫ শতাংশ (মুসলিম ৩.৪ শতাংশ), গ্রুপ সি হিন্দু ৮৮.৫ (মুসলিম ৪.৯ শতাংশ), গ্রুপ ডি হিন্দু ৮৮.৭ (মুসলিম ৫ শতাংশ)। জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীতে উচ্চপদে হিন্দু ৮৭.৫ শতাংশ (মুসলিম ৩.৬ শতাংশ), অধস্তন হিন্দু ৮৮.৭ শতাংশ (মুসলিম ৪.৬ শতাংশ), গ্রুপ এ হিন্দু ৮৬ শতাংশ (মুসলিম ৩.১ শতাংশ), গ্রুপ বি হিন্দু ৮৮.২ শতাংশ (মুসলিম ৩.৯ শতাংশ), গ্রুপ সি হিন্দু ৮৮.৭ (মুসলিম ৪.৬ শতাংশ), গ্রুপ ডি হিন্দু ৮৯.৩ (মুসলিম ৪.৩ শতাংশ)। ভারতে দলিতদের অবস্থা তো মুসলিমদের চেয়েও খারাপ। ভারতের মূলস্রোতে এদের তুলে আনতে বর্ণহিন্দুরা ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য ব্যর্থ হয়েছে বলাটা ব্যাকরণগতভাবে ভুল বলা হল, সদ্দিচ্ছাটাও ছিল না, নেই। একা খাব, একা পরব মানসিকতা কাজ করছে। গোলওয়ালকরের নীতিতেই দেশ চলছে, বর্ণহিন্দু ছাড়া বাকিদের “পুরোপুরি বশ্যতা স্বীকার করে এদেশে থাকতে হবে, কোনো কিছুই দাবি করা চলবে না, কোনো অধিকার রাখা চলবে না, পক্ষপাতমূলক ব্যবহার তো দূরে থাক, নাগরিকত্ব পর্যন্ত নয়।”

তফসিলি জাতি এবং তফসিলি জনজাতিদের চাকরি বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংরক্ষণ থাকলেও মুসলিমদের ওরকম কোনো সংরক্ষণ নেই। ভারতীয় সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে– চাকরি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ চলবে না। যে সংরক্ষণগুলি চালু আছে সেই সংরক্ষণের প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িয়ে আছে। আছে মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট ও হাই কোর্টের অভিমত। বস্তুত সংবিধান রচনার শুরু থেকেই প্রশ্ন ওঠে রাজ্য সরকারগুলি শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ করতে পারবে কি না? তৎকালীন মাদ্রাজ সরকার মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির ব্যাপারে একটি আদেশ জারি করেছিল –প্রতি ১৪টি আসনের মধ্যে ৬ জন অব্রাহ্মণ হিন্দু, ২ জন ব্রাহ্মণ হিন্দু, ২ জন অনুন্নত হিন্দু, ২ জন হরিজন, ১ জন ভারতীয় খ্রিস্টান এবং ১ জন মুসলিম। সুপ্রিমকোর্ট মাদ্রাজ সরকারের এই হুকুমনামা সংবিধানের ২৯(২) ধারার বিরোধী বলে বাতিল করে দেয়। সেই সময় অনুন্নত শ্রেণি, অর্থাৎ তফসিলি জাতি বা উপজাতিদের উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা রাজ্য সরকারকে দেওয়া হয়। সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে –ধর্মের ভিত্তিতে চাকরিতে সংরক্ষণ করা যাবে না।

ভীমরাও রামজি আম্বেডকর লিখেছিলেন— মুসলিম বিশ্ব হল, “হিন্দু সমাজের চেয়েও অনেকাংশে সামাজিক দুর্ভোগে ভরা”। সমালোচনা করে তিনি বলেন, “মুসলিমরা তাঁদের সাম্প্রদায়িক প্রথাকে (Sectarian Caste System) ভ্রাতৃত্বের শ্রুতিমধুর (Euphemisms) মোড়ক দ্বারা আবৃত করেছে।” তিনি আরও বলেন, “মুসলিমদের মধ্যে আজরাল শ্রেণির (Azral class) প্রতি বৈষম্যতা, যাঁরা ‘পদানত’ (Degraded) হিসাবে স্বীকৃত”। এর সঙ্গে মুসলিম সমাজে পীড়াদায়ক পর্দা প্রথার মাধ্যমে নারীদের উৎপীড়নেরও (Oppression) সমালোচনা করেন। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে অভিযোগ করেন যে, “পর্দাপ্রথা হিন্দুদের মধ্যে চৰ্চিত হলেও মুসলিমরা ধর্মের মাধ্যমে তা অনুমোদন করে নেন। তাঁর মতে, “ইসলামের প্রতি তাঁদের ধর্মোম্মত্ততা (fanaticism) এতটাই উপরে উঠে যে, আক্ষরিক অর্থে ইসলামের বাণী তাঁদের সমাজকে করেছে খুব দৃঢ় এবং অপরিবর্তনীয়।” তিনি আরও লেখেন যে, “অন্য দেশের মুসলিমদের মতো যেমন তুরস্কের মতো ভারতীয় মুসলিমরাও নিজেদের সমাজকে পুনর্গঠনে ব্যর্থ হয়েছে।”

কেবল মুসলমানই তো নয়, ভারতে অন্যান্য সংখ্যালঘুদের অবস্থাও তথৈবচ। সংখ্যাগুরুদের চাপে সংখ্যালঘু দলিতদের জিভ বেরিয়ে যাচ্ছে। এই চাপ থেকে মুক্তি পেতে দলিতরা হামেশাই ধর্মান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। কেউ বৌদ্ধ হচ্ছেন, কেউ খ্রিস্টান হচ্ছেন, কেউ-বা মুসলিম হয়ে যাচ্ছেন– প্রতিদিন। সব ধর্মের সংখ্যাগুরুরাই সংখ্যালঘুদের দাসানুদাস মনে করে, কীটাণুকীট মনে করে। সংখ্যাগুরুরা মনে করেন তাঁরাই সকলের পরমেশ্বর, ভাগ্যবিধাতা। সংখ্যাগুরুরা মনে করে তাঁরা যা বলবে সংখ্যালঘুরা তাই-ই মাথা পেতে মেনে নেবে। অন্যায় ধরিয়ে দিতে পারবে না, বিদ্রোহ করতে পারবে না, প্রতিবাদ করতে পারবে না –করলেই ‘দেশদ্রোহী’ র সার্টিফিকেট হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। কী ভারত, কী বাংলাদেশ, কী পাকিস্তান, কী জার্মান, কী মায়ানমার –সব দেশেই একই চিত্র। দেশ-ধর্ম-জাতি-নির্বিশেষে সংখ্যাগুরুরা বড়ই বজ্জাত। একা থাকব, একা খাবো, একা পরবো মন-মানসিকতা এদের– বাকি সব দূর হাঁটো। ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যাগুরুদের প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক সুকুমারী ভট্টাচার্যের বিবৃতি প্রণিধানযোগ্য –“ভারতবর্ষে হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপন করতে গেলে অহিন্দুকে হয় ধর্মান্তরিত করতে হয়, নয়তো তাঁদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সম্পত্তি লুঠ করতে হয় এবং ফাউ হিসাবে তাঁদের কিশোরী যুবতী-প্রৌঢ়া নারীদের গণধর্ষণ করতে হয়। হিন্দুশাস্ত্রেই বলে, শূদ্রা স্লেচ্ছ রমণীকে ধর্ষণ করা অশাস্ত্রীয় নয় এবং তাঁদের ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করাও অন্যায় নয়। কাজেই এক হিসাবে এঁরা শাস্ত্রসম্মত আচরণই করছে। হিন্দুশাস্ত্র একাধিকবার উচ্চারণ করে নারীর সম্বন্ধে বলেছে, “তস্যাঃ পণ্যসধর্মত্বাৎ’, নারী পণ্যসদৃশ, অতএব ভোগ্যবস্তু। কাজেই বিধর্মী নারীও ভোগ্যবস্তু। ধর্ষণই যথেষ্ট নয় সঘীদের পক্ষে। সেটা নিকট আত্মীয়দের সামনে হওয়া চাই। শিশুহত্যাও মার দৃষ্টিগোচরে করা চাই। অঙ্গচ্ছেদও আত্মীয়দের দেখতে হবে।…তাই উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুসলিম নিধন, তাঁদের সম্পত্তি লুঠ, বাড়িতে আগুন লাগানো ও তাদের নারীদের ধর্ষণ করা চলছে এবং এসবই ঘটেছে খ্রিস্টানদের উপরেও। এই দুই প্রধান বিধর্মী শত্রুকে ক্রমে ক্রমে নিশ্চিহ্ন করতে পারলে, বাকিদের ঘুষ দিয়ে, ধর্মান্তরণ করে বা পায়ের তলায় পিষে হিন্দুরাষ্ট্র গড়া যাবে।…হিন্দুর আছে মহাভারতের মতো মহাকাব্য যেখানে পিতামহ ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে অত্যন্ত চরম এক কথা বলেন, একটি গোপন কথা তোমাকে বলি, যুধিষ্ঠির, মানুষের চেয়ে বড়ো কিছুই নেই। মুসলিম মানুষ নয়? তার চেয়ে বড়ো হিন্দুরাষ্ট্র এদের কাছে, তাই অক্লেশে এতদিন ধরে এত নৃশংসভাবে মুসলিম বলি চলে।” গুজরাটের গোধরা কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতেই লেখিকার এই বয়ান। ভাবায় বইকি!

“সংখ্যালঘুরা ভারতে নিরাপদ থাকিতে পারেন কীভাবে? না, সংখ্যাগুরুর শুভেচ্ছার উপর নির্ভর করিয়া।… অর্ধশতাব্দীরও বেশি কাল ধরিয়া ধর্মনিরপেক্ষতাকে সাংবিধানিক আদর্শ হিসাবে অনুশীলন করিয়া ভারতের সংখ্যালঘুদের যে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আইনের শাসন বা রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের উপর নয়, নির্ভর করিতে হইবে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িক সংগঠনের দয়া ও করুণার উপর,… ধর্মনিরপেক্ষতার সাইনবোর্ড টাঙাইয়া তলে তলে ভারতীয় রাষ্ট্র এই কালপর্বে সাম্প্রদায়িক শাসননীতিরই সাধনা করিয়াছে।”– অভীক সরকার, আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক। হায় রে, যে দেশে মনে আর মননে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বারুদ জমে ওঠে সে দেশে সংখ্যালঘুরা ভালো থাকে কী করে! অতএব হিন্দু ধর্ম ও মুসলমান ধর্মের নাম করে যাঁরা ক্ষতিকারক সাম্প্রদায়িকতা লালন করার পক্ষপাতী তাঁদের বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীদের ঘৃণা থাকাটাই স্বাভাবিক।

ভারতে যুযুধান পক্ষ যে কেবলই হিন্দু-মুসলমান, তা কিন্তু নয়। বৰ্ণহিন্দুর সঙ্গে বর্ণহিন্দু, বর্ণহিন্দুর সঙ্গে দলিত হিন্দুর, সুন্নি মুসলমানের সঙ্গে শিয়া মুসলমানের, শিয়া মুসলমানের সঙ্গে শিয়া মুসলমানের, সুন্নি মুসলমানের সঙ্গে সুন্নি মুসলমান, সরকার পাড়ার সঙ্গে মণ্ডল পাড়ার –সংঘর্ষ সর্বত্র। পার্থক্য একটাই –হিন্দু-মুসলমানের সংঘর্ষ হলে সেটা দাঙ্গা, অন্য ক্ষেত্রে সেটা মামুলি ঝামেলা। আর দাঙ্গা মানে লকলকে আগুন, গুজবের বাতাস পেয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়িয়ে পড়ে সেই ধ্বংসলীলায়। গুজরাট দাঙ্গা প্রসঙ্গে তপন মিত্র লিখেছেন– “সংখ্যায় হামলাবাজরা কয়েকশো বা কয়েক হাজার নয়, প্রায় বারো লক্ষ। যথেষ্ট সংখ্যায় মেয়েও আছে তাঁদের মধ্যে। পুলিশ-প্রশাসনে সাহায্য হামলার দিকে। খোলাখুলি। যে পুলিশ লুট, খুন থামাতে গেছে, সেই ২৭ জন বদলি হয়েছে। …কিন্তু আমার ভারী ভয় জেগেছে। জীবনে কখনও এত ভয় পাইনি। বহু শতাব্দী আগের পাথর ফলক থেকে জানি যে, এক হিন্দু রাজার বাহিনী ৬৪,০০০ বৌদ্ধকে কোতল করেছিল একদিনে। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধি হত্যার পর দিল্লিতে ৩০০০ শিখ খুন হয়েছিল কয়েক হাজার উন্মত্ত হিন্দু হামলাবাজদের হাতে, মাত্র তিনদিনে। ১৯৯২ এবং ১৯৯৩ সালের উত্তরপ্রদেশ দাঙ্গায় হিন্দু ও মুসলমান মরেছিল ৩০০০, ৮/১০ দিনে। কিন্তু ৫০ দিন ধরে ১২ লক্ষ হামলাবাজ খুন-লুট-দাহ করেই চলেছে। এমন কখনও হয়নি এদেশে।” গুজরাট দাঙ্গা প্রসঙ্গে দেবেশ রায়ের বক্তব্যও অনুধাবনযোগ্য –“গত পঁয়ত্রিশ বছরে ভারতে যতগুলি দাঙ্গা হয়েছে তার প্রত্যেকটিই মুসলমানদের বিরুদ্ধে। এর কোনো জায়গাতেই মুসলমানরা আত্মরক্ষার সুযোগ পায়নি। আর এর প্রতিটি জায়গাতেই রাজ্য সরকার নিজের উদাসীনতা দিয়ে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার সময় দিয়েছে ও নিজের নীরব হুকুমে স্থানীয় পুলিশকে পর্যন্ত ব্যারাকে বসে থাকতে বাধ্য করেছে। … এই দাঙ্গায় মুসলমানেরা প্রাণে মরেছে বেশি, আশ্রয় হারিয়েছে বেশি, জীবিকা হারিয়েছে বেশি। এমন কোনো দাঙ্গা হয়নি যে দাঙ্গায় মোট খুনের ৭০ শতাংশ মুসলমান নয়। বাবরি মসজিদের পরের দাঙ্গাগুলিতে এই অনুপাত ৯০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে।” (ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায় –গোলাম আহমাদ মোর্তজা)।

দাঙ্গার ইতিহাস এবং সেই দাঙ্গা ক্ষয়ক্ষতি, কারা খুন করেছিল, কারা খুন হয়েছিল সবই এখানে উল্লেখ করা যায়। আমার প্রবন্ধটি দাঙ্গার ইতিহাস নয়, ভারতের মুসলমান। তাই মুসলমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা জরুরি। যাই হোক, দাঙ্গা লাগিয়ে যাঁরা লক্ষ লক্ষ মানুষদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। কোনো দেশে হয় না। কারোর শাস্তি হয়েছে বলে আমি অন্তত শুনিনি। কার বা কাদের অঙ্গুলি হেলনে দাঙ্গার হত্যাকারীদের শাস্তি হয় না, সেটা ভাবা দরকার। তাহলে কি দাঙ্গা চলছে, চলবে! হত্যা চলছে, চলবে! সারা বছর ভারতবর্ষে প্রচুর দাঙ্গা সংঘটিত হয়। কটা সংবাদ খবরের কাগজে আসে? কটা খবর চ্যানেলে দেখানো হয়? আজব এক সেন্সরে সব সংবাদ চেপে যাওয়া হয়। সংবাদ চাপা গেলেও সত্যকে চেপে রাখা যায় না। নথি থেকে যায় মহাফেজখানায়। ১৯৫০ থেকে ১৯৬৩ সালে পর্যন্ত দাঙ্গার পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম। নথি কথা বলে ওঠে– ১৯৬৮ সালে দাঙ্গা হয়েছে ৩৪৬টি, ১৯৬৯ সালে ৫১৯টি দাঙ্গা হয়েছিল, ১৯৭০ সালে ৫২১টি, ১৯৭১ সালে ৩২১টি, ১৯৭২ সালে ২৪০টি, ১৯৭৩ সালে সালে ২৪২টি, ১৯৭৪ সালে ২৪৮টি, ১৯৭৫ সালে ২০৪টি, ১৯৭৬ সালে ১৬৯টি, ১৯৭৭ সালে ১৮৮টি, ১৯৭৮ সালে ২১৯টি, ১৯৭৯ সালে ৩০৪টি, ১৯৮০ সালে ৪২৭টি, ১৯৮১ সালে ৩১৯টি, ১৯৮২ সালে ৪৭৪টি দাঙ্গা হয়েছিল। এর মধ্যে ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কত মানুষ মারা গেছে বা আহত হয়েছে তার পূর্ণ তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। সরকারি হিসাবে যেটা পাওয়া গেছে, তা হল, ওই কয়টি বছরে প্রচারিত দাঙ্গার সংখ্যা ৪৮৪২টি এবং ১৮ হাজার ৮৪২ জন ভাগ্যহীন ভারতবাসী এই দাঙ্গার শিকার হয়েছিল। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দাঙ্গা হয়েছিল ১৪০০ বার এবং এ সময়ের দাঙ্গার শিকার হয়েছেন ২১ হাজার ৬০০ জন দুর্ভাগা ভারতবাসী। ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৮৯ সালগুলিতে দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, বিহার, গুজরাট, জম্মু ও কাশ্মীর সর্বত্রই কমবেশি দাঙ্গা হয়েছিল। ১৯৯০ সালে হায়দরাবাদে টানা ২১ ধরে দাঙ্গা হয়েছিল। মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ৬৩২, বেসরকারি হিসাবে প্রায় ১৯০০ জন। ১৯৯১ সালে ১৪০৭টি দাঙ্গায় ৭৮৭৫ জন ভারতবাসী বলি হয়েছিল।(সূত্র : কমিউনাল রায়টস ইন ইন্ডিয়া, মিট দ্য চ্যালেঞ্জ ইউনাইটেডলি– সংকলিত রিপোর্ট, ১৯৮৭, দিল্লি এবং মুসলিম ইন্ডিয়া পত্রিকা, ১৯৯১ জুলাই, দিল্লি)

এক জাতি অন্য জাতিকে হত্যা করবে, এক ধর্ম অন্য ধর্মকে খাটো করে দেখবে ঘৃণা করবে অবাঞ্ছিত মন্তব্য করবে– কতদিন চলবে এভাবে! ‘আমি গর্বিত, আমি হিন্দু’, ‘আমি গর্বিত, আমি মুসলমান’ –এইসব শ্লোগানের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সন্ত্রাস আর দাঙ্গার রস। ধর্ম আগে, না দেশ আগে? দেশ মানে কি শুধুই মাটি, নাকি মানুষ? যতদিন-না একটি দেশের সমস্ত মানুষ সমস্ত জাতি সমস্ত শ্রেণি আলোকিত হবে, নিরাপত্তা পাবে, স্থিতিশীলতার গ্যারান্টি পাবে— ততদিন পর্যন্ত একটি রাষ্ট্র কোনো উন্নতি সাধন করতে পারে না। চাই সমান অধিকার। দয়া নয়, অনুকম্পা নয়– কোলে টেনে নিতে হবে যোগ্যতায়, শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণ রেখেছে। কী হবে সেই সংরক্ষণ দিয়ে যে সংরক্ষণ মর্যাদা দেয় না, অচ্ছুত করে রাখে! ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য চাই চাকরি বা কর্মসংস্থান এবং বাসস্থান। মুসলিমদের শিক্ষাদীক্ষা ও দক্ষতা যথেষ্ট নেই একথা সবটা নাহলেও কিছুটা সত্যি। কিন্তু যেসব মুসলিমদের যথাযথ যোগ্যতা ও দক্ষতা আছে তাঁরা উপযুক্ত চাকরি পায়? না, পায় না। পায় না মুসলিম বলেই। সরকারি ক্ষেত্রে শতকরা দুই/চার শতাংশ চাকরি জুটলেও বেসরকারি ক্ষেত্রে আরও ভয়ানক অবস্থা। চাকরি তো দূরের কথা, মুসলিম না-হয়েও ‘অচ্ছুত’ চুনি কোটালরা শিক্ষায় অধিকার পায় না এ দেশে, আত্মহত্যা করে বাঁচতে হয়। বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মুসলিমদের প্রবেশাধিকারই নেই। আমি দেখেছি, আমার অফিসে কর্মী নিয়োগের জন্য ইন্টারভিউয়ের দিন একজন মুসলিম মেয়ে ইন্টারভিউ দিয়েছিল। তুখোড় মেয়ে– যোগ্যতায় এবং দক্ষতায়। মুসলিম বলেই তাঁকে বাতিল করা হয়েছিল। বস্তুত আমার অফিস কঠোরভাবে মুসলিম বর্জিত। চাকরিটা হয়নি। এই বৈষম্য সর্বত্র, কমবেশি।

এ তো গেল চাকরি। এবার যদি বাসস্থানের দিকটা দেখি সেখানেও একই অবস্থা। গ্রাম বা মফসসল থেকে বহু ছেলেমেয়ে কলকাতা আসে পড়াশোনা করতে। সেক্ষেত্রে কলকাতায় থেকেই পড়াশোনাটা করতে হয়।এক্ষেত্রে হিন্দুদের ক্ষেত্রে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেলেও মুসলিমদের ক্ষেত্রে থাকার ঘর পাওয়া খুব দুষ্কর। মুসলিম বলে কেউ ঘর ভাড়া দিতে চায় না। হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে পিজি বা মেসে পড়াশোনা করছেন এমন দৃশ্য অতি বিরল। যেসব মেসে বা পিজিতে মুসলিম ছেলেমেয়েরা থাকার সুযোগ পায় তাঁরা সকলে সাধারণত মুসলিমই হয়ে থাকে। এমন বাড়ি বিরল যাঁরা মুসলমানদের ঘর দেন থাকতে। গরিব ঘরের মুসলিম মেয়ে/বউরা শহরে আসে লোকের বাড়িতে কাজ করতে। অবশ্য মুসলিম নামে তাঁরা কাজ পাবেন না কোনো হিন্দুর বাড়িতে, তাই নাম ভাঁড়িয়ে হিন্দুনাম নিয়ে কাজ জোটায় অনেকে। যাঁরা ব্যতিক্রম’ প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা ভাগ্যবান। আমারও কিছু প্রত্যক্ষ হয়েছে। আমিও দেখেছি হিন্দু মালিকের হোটেলে মুসলিম ম্যানেজার। হিন্দুদের বিরিয়ানির দোকানের কারিগর তো বেশিরভাগই মুসলিম। রাজমিস্ত্রি ও তাঁর সহযোগীরা কাজ করে তাঁরা তো অনেকে মুসলিম। ফি রোববার যে দোকান থেকে প্রতি রবিবার খাসির মাংস কেনে হিন্দুরা, সেই মাংস বিক্রেতারা তো বেশিরভাগই মুসলিমই। তাঁদের বয়কট করার ডাক দিয়েছিল এক হিন্দুত্ববাদী ভক্ত।

যতই সদিচ্ছা থাকুক, সংখ্যাগুরুদের পক্ষে সংখ্যালঘুদের অবস্থান-পরিস্থিতি-মানসিকতা উপলব্ধি করা শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভব। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলিমরা যেমন সংখ্যালঘু হিন্দুদের অসহায়তা উপলব্ধি করতে পারে না, ঠিক তেমনই ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুরাও সংখ্যালঘু মুসলিম তদুপরি দলিতদের অসহায়তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। এর কারণ ঘৃণা। ঘৃণার পাহাড়ে আমরা বসে আছি, সব্বাই। দলিতদের প্রতি বর্ণহিন্দুর ঘৃণা, হিন্দুদের প্রতি মুসলমানদের ঘৃণা, মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের ঘৃণা। জাতির প্রতি ঘৃণা, পরধর্মে ঘৃণা। ঘৃণা থেকে বেড়েছে দূরত্ব, দূরত্ব থেকে বেড়েছে অজ্ঞানতা। জ্ঞান নেই, তাই আস্থা নেই। আস্থা নেই, তাই অনেক কথাই না-বলা থেকে যায়। যে-কোনো মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা হল পারস্পরিক আস্থা। আস্থা বা সমব্যাথী খুঁজতে খুঁজতেই সংঘবদ্ধতায় জোট বাঁধতে থাকে সংখ্যালঘু মানুষ।

আমরা ভুলে যাই— কোনো মুসলিম যদি কোনো একজন হিন্দুর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে তাহলে সব রাগ গিয়ে পড়ে সমস্ত মুসলিম জাতির উপর, তেমনই কোনো হিন্দু যদি কোনো একজন মুসলিমের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে সেক্ষেত্রেও সব রাগ গিয়ে পড়ে সমস্ত হিন্দু জাতির উপর। তখন মানবধর্ম পরিহার করে বন্যধর্ম গ্রহণ করে ফেলে পৃথিবীর একমাত্র সভ্য এবং উন্নত জীব। চরম হঠকারিতায় ভুলে যাই সংযমই পুরস্কৃত করে, অসংযমে মৃত্যু। কেন আমরা নিভৃতে কিংবা প্রকাশ্যে অন্য ধর্ম বা অন্য ধর্মের লোকজনদের গালমন্দ করব অকারণে– সে প্রশ্নটাও নিজের কাছে নিজেকে করতে হবে। ভাবুন তো, যে মানুষটিকে এক্কেবারে কট্টর সাম্প্রদায়িক বলেই জানি, সেই মানুষই তো ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে বন্ধু বা সহকর্মী ভিন্ন ধর্মের হলেও কী সখ্যতা, কী ঈর্ষণীয় মেলামেশা। ভিন্নধর্মী হলেও চেনাজানার জন্য একে অপরের সঙ্গে সহজভাবে মিশতে কোনো বাধা নেই, তাই সাম্প্রদায়িকতাও নেই। সাম্প্রদায়িকতা আসলে নৈর্ব্যক্তিক, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির পরিচয়ই বন্ধনে আস্থা জোগায়। ধর্ম যাঁর যাঁর, ভালোবাসা হোক সবার। হিন্দু ছেলে মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করুক, মুসলিম ছেলে হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করুক। ধর্মান্তরিত হতে না চাইলে হবে না। একই ছাদের নীচে যাঁর যাঁর ধর্ম পালন করুক না। ক্ষতি কী? সোমা এক মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করে জারা সোমা হয়েছে। সোমার ঠাকুরঘরে আল্লাহ-ভগবানের সহাবস্থান। রেডিও জকি, উপস্থাপক, সঞ্চালক মীর আফসার আলির স্ত্রী সোমা ভট্টাচার্য। তাঁর ঘরেও আল্লাহ ভগবানের সহাবস্থান। আন্তধর্ম বিয়ে পারিবারিক বন্ধন গড়ে তোলে। সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে। একে অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিক। গোঁড়ামি অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে। ধর্মীয় গোঁড়ামি মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা বাড়ায়। একে অপরের ধর্মকে জানতে হবে, শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। শ্রদ্ধার বিনিময়ে শ্রদ্ধা আসে, ঘৃণার বিনিময়ে ঘৃণা। এটা বুঝতে হবে– সাম্প্রদায়িকতার উর্বর ক্ষেত্ৰই হল পরিচয়হীনতা, অজ্ঞানতা। বহুদিন অব্যবহারে স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে জাতি, তাই সঙ্গমের আগেই শীঘ্রপতন! এটা জাতি ও ধর্মের দুর্বলতা, এ দুর্বলতা থেকে সকলকেই বেরিয়ে আসতে হবে। যে চরম সুখ থেকে মানুষ প্রতিদিন বঞ্চিত হয়, তাতে তো শেষপর্যন্ত মানুষেরই ক্ষতি হচ্ছে।

হিন্দুরা থাকবে হিন্দুদের পাড়ায়, মুসলিমরা থাকবে মুসলিমদের পাড়ায়, ভট্টাচার্যরা থাকবে ভট্টাচার্য পাড়ায়, মণ্ডলরা থাকবে মণ্ডল পাড়ায়, দত্তরা থাকবে দত্ত পাড়ায়, বিশ্বাসরা থাকবে বিশ্বাস পাড়ায়, নমঃশূদ্ররা থাকবে নমঃশূদ্র পাড়ায়, ব্রাহ্মণরা থাকবে ব্রাহ্মণ পাড়ায়, মুচি থাকবে মুচিপাড়ায়, মেথর থাকবে মেথর পাড়ায়। এখানেই শেষ নয়, মুসলিম সমাজেও বিভেদ-বিভাজন কিছু কম নেই। সৈয়দ, শেখ, মোগল, পাঠান –এই চতুর্বগীয় বর্ণভেদ ইসলামে সাম্যের বাণী সত্ত্বেও মুসলিম সমাজে বিভক্ত করে রেখেছে। সৈয়দ, শেখ, মোগল, পাঠানদের মধ্যেও বিভাজন। যেমন মিরাটের সৈয়দ, হায়দরাবাদের সৈয়দ, লখনউয়ের সৈয়দ, লাহোরের সৈয়দ, করাচির সৈয়দ সবাই সমমানের নয়। নীচুতলাতেও একই চিত্র। মোমিন, আনসারি, কুরেশি, মনসুরি, ইদ্রিসি এদের পৃথক শিবির। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের নিজেদের মধ্যেও যে বহু অন্তর্বিরোধ থাকে সেটা ভুলে তাঁদের সবাইকে একরূপ জনগোষ্ঠী মনে করে স্কুল বিভাজন অহেতুক বিবাদে মশগুল আছে। এরপরেও ঐক্য চাইব? শান্তি চাইব? সম্প্রীতি চাইব?

হ্যাঁ, এর মধ্যেও ঐক্য চাইব, শান্তি চাইব, সম্প্রীতি চাইব। যতটা পারি তা বিদ্যমান রাখার চেষ্টা করব। “নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান/বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান/ দেখিয়া ভারতে মহাজাতির উত্থান জনগণ মানিবে বিস্ময়, জগজন মানিবে বিস্ময়/তেত্রিশ কোটি মোরা নহি কভু ক্ষীণ, হতে পারি দীন, তবু নহি মোরা হীন/ভারতে জনম, পুনঃ আসিবে সুদিন—” কবি অতুলপ্রসাদ সেনের চোখে দেখা ভারত প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। আরও কিছু ছোটোখাটো সমস্যা রয়েছে আমাদের মধ্যে, যেগুলো আমরা পালন করি। যেমন ভাষার কথাই ধরি। আজও পশ্চিমবাংলার হিন্দুদের চোখে মুসলিম বাঙালি নয়। মুসলিম শুধুই মুসলিম, বাঙালি কেবল হিন্দু। আমরা বাঙালি ওরা মুসলিম– এমনই শুনি অনেক হিন্দু বাঙালিদের মুখে। ইসলামি নামধারীদের মানুষদের সঙ্গে কথা বললেই হিন্দু বাঙালিরা হিন্দিতে কথা বলে ফেলে। আজকাল দৈনিকে ‘শিকড়ের খোঁজে ঘরে ফিরুক বাঙালি মুসলিম’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন সোহরাব হোসেন। শিকড়ের সন্ধান করতে গিয়ে বলেছেন –“বাঙালির সংস্কৃতি, বাঙালির ঐতিহ্য, বাঙালির মানসিকতা, বাংলা ভাষা ও বাংলা ভূখণ্ডের প্রতি আন্তরিক প্রেম।” তিনি চান ইসলাম ও ইসলামি সমাজের প্রভাবে যে আলাদা পরিভাষা গড়ে উঠেছে বাঙালি মুসলিম সমাজে, সেগুলিকে সরিয়ে রাখতে হবে। কারণ আলাদা শব্দ দূরত্ব বাড়ায়। মোদ্দা কথা, হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বাঙালিরা ইসলাম ধর্মে এসে ধর্মত্যাগের পাশাপাশি বাংলাভাষাও ত্যাগ করেছে এই ভেবে যে, বাঙালি হিন্দুদের বাংলা ভাষা আসলে হিন্দু সংস্কৃতি। কিন্তু হিন্দু সংস্কৃতির ‘পানি’ বলতে তাঁদের করতে অসুবিধা হয় না। যদিও বাঙালি হিন্দুরা ‘জল’ বলে। পানি ও জল দুটো শব্দই সংস্কৃত থেকে আগত। আবার হিন্দিভাষী ভারতীয় হিন্দু-মুসলিম উভয়ই ‘পানি’ বলে। মুসলিম সন্তানদের বেশিরভাগই ইসলামি তথা আরবি নাম হলেও বহু মুসলিমের নাম বাংলা ভাষতেই হয়। সেটি হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করার ফসল কি না জানি না। আমার পরিচিত অনেক মুসলিম বন্ধুর নাম বাংলা ভাষায়। কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের সকলের নাম বাংলা ভাষায়– কৃষ্ণ মোহাম্মদ, কাজী সব্যসাচী, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধ ইত্যাদি। কবির ছোটো পুত্রবধূর নাম কল্যাণী কাজী (কাজী অনিরুদ্ধের স্ত্রী)। কাজী অনিরুদ্ধের তিন সন্তান –অনির্বাণ, অরিন্দম, অনিন্দিতা। অনির্বাণের স্ত্রী সোমা মুখার্জি। তাঁদের দুই সন্তান –অংকন ও ঐশ্বর্য। অরিন্দমের স্ত্রী সুপর্ণা ভৌমিক। তাঁদের দুই সন্তানের নাম –অভিল্লা ও অনুরাগ। সব্যসাচীর স্ত্রীর নাম উমা কাজী। সব্যসাচীর তিন সন্তানের নাম –খিলখিল কাজী, মিষ্টি কাজী, বাবুল কাজী। কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারে সকলের নাম তথাকথিত হিন্দু সংস্কতি’-র বাংলা নাম হলেও তাঁকে কেউ হিন্দু কবি বলে না, মুসলিম কবিই বলে। বাঙালি হিন্দুর নাম বাংলা ভাষায়, তামিল হিন্দুর নাম তামিল ভাষায়, তেলুগু হিন্দুর নাম তেলুগু ভাষায় হলেও সমগ্র পৃথিবীর মুসলিমদের নাম একই ভাষায়, আরবি ভাষা। যেমন ইংরেজি ভাষা ভারতীয় ভাষা নয়, তেমনি আরবি ভাষাও ভারতীয় ভাষা নয়। গোল বেধেছে এখানেও।

সুদীপ্ত তাঁর এক স্যুটেড-বুটেড বন্ধুকে নিয়ে বাড়িতে এলেন। মাকে বলল, মা আমার বন্ধু জাভেদ। মা ছেলেটিকে বলল, “তুমি মুসলিম? দেখে তো একদম মুসলিম মনেই হয় না তোমাকে! জাভেদের কৌতূহল প্রশ্ন— কেন কাকিমা মুসলিমদের কি আলাদা দেখতে?” “ও মা তুমি বাঙালি? বাংলা বলতে পারো!”– সুদীপ্তর মা বিস্ময়াভূত হলেন। এটা শুধু সুদীপ্তর মায়ের কথা নয়, এমন প্রশ্ন বেশিরভাগ হিন্দুদের মনে উঠে। তাঁরা মনে করে মুসলিম মানে গোঁফহীন দাঁড়িওয়াল মাথায় বিশেষ টুপি-পরা কেউ। তাঁরা লম্বা পঞ্জাবি পরে আর গোঁড়ালির উপর প্যান্ট বা পাজামা পরে। আচ্ছা, হিন্দু বলতে কি লাল বা গেরুয়া রঙের কৌপিন বা বস্ত্র কোনো ব্যক্তি, যাঁর কপালে তিলক মাথায় জটাওয়ালা মানুষদের বোঝায়? প্যান্ট-শার্ট, টি-শার্ট, গেঞ্জি, মাথায় জটাহীন, কলাপে তিলকহীন মানুষ কি হিন্দু নয়? এই ধরনের গড়পড়তা মানসিকতা দূর করা প্রয়োজন। এত অজ্ঞানতা কেন থাকে? অজ্ঞানতা দূরত্ব বাড়ায়। একে অপরের ধর্মীয় আচার-আচরণ বিষয়েও যথেষ্ট অজ্ঞানতা রয়েছে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে। অবশ্য এতে দোষ দেওয়া যায় না। যাঁদের নিজ ধর্ম সম্বন্ধেই সম্যক ধারণা নেই, তাঁরা অন্য ধর্ম বিষয়ে আগ্রহ থাকবে, এটা আশা করাই অন্যায়। জানার আগ্রহ জন্মায় শ্রদ্ধা থেকে। সেই শ্রদ্ধারই বড় অভাব পরিলক্ষিত হয়। আমার ধর্ম শ্রেষ্ট ধর্ম, বাকি সব নিকৃষ্ট’ –এই ধরনের চেতনা কখনো সম্পর্ক মধুর করতে দেয় না। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ রুখতে হলে সম্পীতির বাতাবরণ তৈরি করতে এই ধরনের ভাবনা থেকে দ্রুত মুক্ত হতে হবে।

হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক ভালো করার উপায় বাতলেছে বিভিন্ন লেখক-সাহিত্যিকরা। কিন্তু সব সমস্যার সমাধান আটকে ধর্ম-পরিচয়ে। পরিচয় সংকটে মানুষ। সে আগে মুসলিম, না আগে ভারতীয়? সে আগে বাঙালি, না আগে মুসলিম? অনুরূপ সে আগে হিন্দু, না আগে ভারতীয়? সে আগে বাঙালি, না আগে হিন্দু? কেন সবাই মানুষ হতে পারে না? অনেকেই হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতির জন্য ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ এবং দেশভাগের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী দাঙ্গাকেই দায়ী করে থাকে। এমন সিদ্ধান্ত ইতিহাসের সরলীকরণ বলা যায়। কোনো সম্পর্কই তো রাতারাতি নষ্ট হয়ে যেতে পারে না। যদিও সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ছেচল্লিশর দাঙ্গা গ্রন্থে লিখেছেন– “কবে কোন বাদশা মন্দির ভেঙেছিলেন কি ভাঙেননি, সে দূরের ইতিহাসটা আজ খুব প্রাসঙ্গিক নয় একজন কাছে। কিন্তু যে-স্মৃতি সে কিছুতেই ভুলতে পারে না, তা হল দাঙ্গা।” আমি বলব, দাঙ্গাটাও তো এমনি এমনি হয়নি। সেদিনের দাঙ্গা ছিল বহু বছর ধরে লালনপালন করে রাখা সেই বিষবৃক্ষ, যা পূর্ব-স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী ফল পরিপক্ক লাভ করেছিল। তাও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। ছেচল্লিশের দাঙ্গার পিছনে রাজনৈতিক নেতারাই সম্পূর্ণ দায়ী ছিলেন। উপরতলা থেকে নীচুতলার নেতারা সেই দাঙ্গার মহানায়ক, সাধারণ মানুষ তাঁদের স্বপ্নের বীভৎস শিকার। এর শুরু মহাবিদ্রোহের পর থেকেই। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশদের শাসন কায়েম করতে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করেছে। ভারতীয়দের হিন্দু-মুসলিমে পৃথক করে তারপর দুটি ডোমিনিয়ন সৃষ্টি করে তবেই ব্রিটিশদের স্বপ্ন পূরণ করেছে। ছেচল্লিশের দাঙ্গা বড়ো প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, যে পটভূমিতে বোঝানো যায় দেশভাগ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। এই দেশভাগে কারা লাভবান হয়েছিল? উপরতলার নেতারা এবং দেশের পুঁজিপতিরা লাভবান হয়েছিল। সাধারণ হিন্দুরা লাভবান হয়েনি, সাধারণ মুসলিমরাও লাভবান হয়েনি। এই হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিড়ম্বনায় হাজার হাজার শিখদেরও বীভৎসতার শিকার হতে হয়েছিল দেশভাগের ফলে।

ব্রিটিশরা যে কম্মটি করে রেখে গিয়েছিল, সেই কম্মের মশাল হাতে নিয়ে চলেছেন স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক নেতারাও। হিন্দু-মুসলিমের সম্পর্ক নষ্ট করে দাঙ্গা বাধিয়ে নেতারা ক্ষমতায় টিকে আছে। হিন্দু-মুসলিমের তাস সব রাজনৈতিক দলই কমবেশি খেলে। উত্তরসূরি হিন্দু বা মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ে কোনো দায় নেই ইতিহাসের পাপ বহন করার। যদি পাপ থাকে, সেই পাপ স্খলন করতে সাধারণ হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়কেই এগিয়ে আসতে হবে। ব্রিটেনের ব্রিটিশরাও পাপস্থলন করতে চাইছে। তাঁরা স্বজাতিদের ভুলতে চাইছে। সেই স্বজাতি, যে স্বজাতি দেশে দেশে উপনিবেশিক অত্যাচার করেছিল সাধারণ মানুষের উপর। সেইসব উপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের মূর্তি তাঁরা প্রকাশ্যে স্থাপন করতে দেয় না, তাঁদের ঘৃণা করে। ভ্যাটিকানের পোপ পাপস্খলন করেছেন, জাপানের মানুষ পাপস্খলন করেছেন। ওরা যেভাবে পেরেছে, ঠিক সেইভাবে ভারতের হিন্দু-মুসলিমদেরও পারতে হবে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির খপ্পরে পড়বেন না। রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না। রাজনীতিকরা রাজনীতি করে ক্ষমতায় থেকে রাজার হালে থাকার স্বার্থে। তাঁরা ডাঁই করা উঁচু লাশের উপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতা ভোগ করতে চায়। সেই লাশগুলো অবশ্যই গরিবদের হতে হবে, তা সে হিন্দু হোক বা মুসলিম। ক্ষমতা মানে কোটি কোটি টাকার বিছানায় নিশ্চিন্তে ঘুমোনো। এর সঙ্গে গাড়ি, বাড়ি, নারী তো আছেই। সাধারণ মানুষ এটা যতদিন বুঝবেন না, ততদিন সাম্প্রদায়িক অশান্তির শিকার হতে থাকবেন। বাংলায় মুসলমানের আটশো বছর বছর গ্রন্থের লেখক জাহিরুল হাসানের মতে– “দেশভাগের আগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে দশ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে মুসলমানদের মধ্যে ঔদ্ধত্য এসে গিয়েছিল এবং ব্রিটিশের কাছে হেরে গিয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতা থেকে বাইরে থাকার পর পুনর্বার ক্ষমতার স্বাদ পেয়েও বেসামাল হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। এ কথা মুসলমানকে যেমন স্বীকার করতে হবে, তেমনি বাঙালি হিন্দু তাঁদের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের জোরে কীভাবে মুসলমানকে ব্রিটিশ আসার শুরু থেকেই উপেক্ষা করেছিলেন, সে-কথাও কাউকে না কাউকে স্বীকার করতেই হবে। দাঙ্গার আগে ও পরে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের আচরণে অনেক গলদ ছিল। দল বেঁধে প্রায়শ্চিত্ত করারও কোনো প্রয়োজন নেই। যে-কেউ নির্মল হৃদয়ে তা করতে পারেন।”

১৯২৯ সালে লিখিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্ধৃতি দিয়ে ছেদ টানি –“পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র- সে হচ্ছে খৃস্টান আর মুসলমান-ধর্ম। তারা নিজের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত। এইজন্যে তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার অন্য কোনো উপায় নেই। হিন্দুর ধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচারমূলক হওয়াতে তার বেড়া আরও কঠিন। মুসলমানধর্ম স্বীকার করে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিশয় সংকীর্ণ। আহারে ব্যবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখ্যান করে না, হিন্দু সেখানেও সতর্ক। তাই খিলাফৎ উপলক্ষ্যে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারে নি। আচার হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধের সেতু, সেইখানেই পদে পদে হিন্দু নিজের বেড়া তুলে রেখেছে। আমি যখন প্রথম আমার জমিদারি কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম তখন দেখেছিলুম, কাছারিতে মুসলমান প্রজাকে বসতে দিতে হলে জাজিমের এক প্রান্ত তুলে দিয়ে সেইখানে তাকে স্থান দেওয়া হত। অন্য আচার-অবলম্বীদের অশুচি বলে গণ্য করার মতো মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের এমন ভীষণ বাধা আর কিছু নেই। ভারতবর্ষের এমনি কপাল যে, এখানে হিন্দু মুসলমানের মতো দুই জাত একত্র হয়েছে; ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল। এক পক্ষের যে দিকে দ্বার খোলা, অন্য পক্ষের সে দিকে দ্বার রুদ্ধ। এরা কী করে মিলবে। এক সময়ে ভারতবর্ষে গ্রিক পারসিক শক নানা জাতির অবাধ সমাগম ও সম্মিলন ছিল। কিন্তু মনে রেখো, সে ‘হিন্দু-যুগের পূর্ববর্তী কালে। হিন্দুযুগ হচ্ছে একটা প্রতিক্রিয়ার যুগ- এই যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে সচেষ্টভাবে পাকা করে গাঁথা হয়েছিল। দুর্লঙ্ঘ্য আচারের প্রাকার তুলে এ কে দুষ্প্রবেশ্য করে তোলা হয়েছিল। একটা কথা মনে ছিল না, কোনো প্রাণবান জিনিসকে একেবারে আটঘাট বন্ধ করে সামলাতে গেলে তাকে মেরে ফেলা হয়। যাই হোক, মোট কথা হচ্ছে, বিশেষ এক সময়ে বৌদ্ধযুগের পরে রাজপুত প্রভৃতি বিদেশীয় জাতিকে দলে টেনে বিশেষ অধ্যবসায়ে নিজেদেরকে পরকীয় সংস্রব ও প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করবার জন্যেই আধুনিক হিন্দুধর্মকে ভারতবাসী প্রকাণ্ড একটা বেড়ার মতো করেই গড়ে তুলেছিল- এর প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ এবং প্রত্যাখ্যান। সকলপ্রকার মিলনের পক্ষে এমন সুনিপুণ কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কোথাও সৃষ্টি হয় নি। এই বাধা কেবল হিন্দু মুসলমানে তা নয়। তোমার আমার মতো মানুষ যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই, আমরাও পৃথক, বাধাগ্রস্ত। সমস্যা তো এই, কিন্তু সমাধান কোথায়। মনের পরিবর্তনে, যুগের পরিবর্তনে। য়ুরোপ সত্যসাধনা ও জ্ঞানের ব্যাপ্তির ভিতর দিয়ে যেমন করে মধ্যযুগের ভিতর দিয়ে আধুনিক যুগে এসে পৌঁচেছে হিন্দুকে মুসলমানকেও তেমনি গণ্ডির বাইরে যাত্রা করতে হবে। ধর্মকে কবরের মতো তৈরি করে তারই মধ্যে সমগ্র জাতিকে ভূতকালের মধ্যে সর্বতোভাবে নিহিত করে রাখলে উন্নতির পথে চলবার উপায় নেই, কারো সঙ্গে কারো মেলবার উপায় নেই। আমাদের মানসপ্রকৃতির মধ্যে যে অবরোধ রয়েছে তাকে ঘোচাতে না পারলে আমরা কোনোরকমের স্বাধীনতাই পাব না। শিক্ষার দ্বারা, সাধনার দ্বারা সেই মূলের পরিবর্তন ঘটাতে হবে- ডানার চেয়ে খাঁচা বড়ো এই সংস্কারটাকেই বদলে ফেলতে হবে। তারপরে আমাদের কল্যাণ হতে পারবে। হিন্দু মুসলমানের মিলন যুগপরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে।”

ভারতের ১৩০ কোটি মানুষ সকলেই দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। সবসময়। দেশদ্রোহী যে আমাদের দেশে নেই, তা নয়। অবশ্যই আছে। সেই দেশদ্রোহীদের আমরা কমবেশি চিনি। দেশপ্রেমিকদেরও চিনি। দুর্নীতির পাঁকে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা রাজনীতিকরাই ঠিক করে দেবে নাকি কে ‘দেশপ্রেমিক’, কে ‘দেশদ্রোহী’? কোনো সন্ত্রাসী-নেতা বলে দেবে না কে রামজাদে’, কে ‘হামারজাদে’? দেশ মানে একতাল ভূখণ্ড নয়, দেশ মানে শুধু মাটি-নদী-পাহাড় নয়। দেশ মানে দেশের সমগ্র মানুষ– হিন্দু, মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, বাঙালি, মারাঠি, গুজরাটি, তামিল, অসমীয়া সকলের ভারত। সকলেই এ দেশের মালিক। সবার সমান অধিকার। দেশপ্রেম মানে মানুষের প্রতি প্রেম। কে ‘বন্দেমাতরম’ বলবে, কে বলবে না –কে ‘জয় শ্রীরাম’ বলবে, কে বলবে না –কে ‘নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর’ বলবে, কে বলবে না, সেটা মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, জবরদস্তির উপর নয়। জবরদস্তি কখনো প্রেমের জন্ম দেয় না, হিংসার জন্ম দেয়। চৈতন্য, বিবেকানন্দের দেশে প্রেম ছাড়া কিছুই বিলোবার নেই।

অনেককে বলতে শুনেছি যে, “মুসলিমরা খুবই গোষ্ঠীপ্রিয়। তাঁরা সর্বদা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকে। চেনা পরিভাষায় যেটাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ তকমা লাগানো হয়। এ বিষয়ে একটাই কথা বলার– পৃথিবীর সব দেশেই সংখ্যালঘুরা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েই থাকেন বা থাকতে পছন্দ করেন। তাঁর একটাই বড় কারণ, সেটা হল, সংখ্যাগুরুদের তরফ থেকে আক্রমণ এলে দলবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করা। এমন ভাবনা নিরাপত্তাহীনতা থেকে আসে। সংখ্যালঘুদের এই নিরাপত্তাহীনতার জন্য সংখ্যাগুরুরাই দায়ী। সংখ্যাগুরুদেরই ব্যর্থতা, কারণ তাঁরা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু নয় কিন্তু জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু যাঁরা, তাঁরাও গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকেন। কারণ একই, নিরাপত্তাহীনতা। এ তো গেল একটা দিক। আর-একটা দিক হল, একজন মুসলিমই এ-কথা ভালোভাবেই জানেন, একজন মুসলিম হওয়ার সুবাদে অন্য মুসলিমদের কাছ থেকে অতিরিক্ত সুবিধা আশা করে না। কখনোই আশা করে না। বরং বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, একজন মুসলিম একজন হিন্দুকে সম্মান মর্যাদা দেন, একজন মুসলিম তা দেন না। একমাত্র দাঙ্গার আতঙ্কেই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই মুসলিমরা যূথবদ্ধ হয়ে থাকেন। বলা যায় থাকতে বাধ্য হন। দাঙ্গা ধনবান-নির্ধন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, প্রগতিশীল, মৌলবাদী কারোকেই ছাড় দেয় না। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন দুর্বল শ্রেণির মানুষরাই– কী হিন্দু, কী মুসলিম।

আমরা ভারতীয় সিনেমা-সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখেছি, সেখানে মুসলিমরা প্রায় অনুপস্থিত। দেখে-পড়ে মনে হয় যেন ভারত মুসলিম বর্জিত একটি দেশ। হিন্দুদের রচিত সাহিত্যে মুসলিম চরিত্র দেখাই যায় না। সিনেমায় যে দু-একটি মুসলিম চরিত্র পাওয়া যায়, তা নিতান্তই গৌণ চরিত্রে। না থাকলেও সিনেমার কিছু যায় আসে না। সিনেমার মুসলিমরা তেমন একটা ভালো মুসলিমও নয়। তাও আবার সেই মুসলিম টুপিওয়ালা, কাঁধে ত্রিকোণ করে পিঠে নামানো তোয়ালে, গোঁফশূন্য বড় দাড়ি, পরনে লুঙ্গি এবং চোখে সুর্মা। এ দৃশ্য কি সমগ্র মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করে? অথচ খ্রিস্টান চরিত্রগুলি কী মহান করে দেখানো হয়, যেন সাক্ষাৎ দেবদূত তাঁরা। সিস্টার’, ‘ফাদার’, ‘মাদার’, ‘শ্যামসাহেব’ সিনেমাগুলির কথা মনে করুন। শিল্প-সাহিত্য-মিডিয়া সর্বত্র মুসলিমদের অত্যন্ত খাটো করে দেখান তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা।

শেষবেলায় একটা কথাই বলতে চাই –সংখ্যালঘু রসাতলে গেলে সংখ্যাগুরুরা শেষপর্যন্ত পার পেতে পারে না। চিন্তা বদলাতে হবে, পৃথিবী এমনিতেই বদলে যাবে। কাজেই কে, কী খাবে কী পরবে তাতে নাক না গলিয়ে, নিজে কী খাবেন সেই চিন্তা করুন। ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। এটা ভুলে যাওয়া মানে সংবিধানকে অবমাননা করা। কারোর মানা বা না-মানায় কারার কিছু যায় আসে না। দুর্ভাগ্যের বিষয় এ দেশে যতটা-না ধর্মনিরপেক্ষতার অনুশীলন হয়েছে, তার চেয়ে শতগুণ বেশি সাম্প্রদায়িক হিংসার অনুশীলন হয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান কোনো দৃষ্টান্ত নয় –ভারতই ভারতের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠুক। ভারত কারোকে অনুসরণ করবে না, ভারত কারোকে অনুকরণ করবে না –ভারতকে অন্যেরা অনুসরণ করুক, অনুকরণ করুক। তবেই “ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে/ধর্মে মহান হবে, কর্মে মহান হবে/নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতন এ পূরবে”।

.

সাহায্যকারী গ্রন্থ ও পত্রিকাসমূহ

(১) ভারতকোষ— বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ (২) Gloom and Bloom: The Case of Jagannatha Temples in Midnapore District— K.S. Behera (5) The Cult of Jagannātha— Kanhu Charan Mishra (৪) ইতিহাস ও সংস্কৃতি— শ্রী শ্যামাপদ ভৌমিক (৫) মেদিনীপুরের ইতিহাস— কমল চৌধুরী সম্পাদিত (৬) হিন্দু-মুসলমান বিরোধ– কাজী আবদুল ওদুদ (৭) সিরাজউদ্দৌলার পতন— ডঃ মোহর আলি, (৮) মানবাধিকার ও দলিত– দেবী চ্যাটার্জি, (৯) বাংলার সমাজে ইসলাম সূচনা পর্ব –অতীশ দাশগুপ্ত, (১০) মুসলিম সমাজ কয়েকটি প্রাসঙ্গিক আলোচনা –মইনুল হাসান, (১১) তিন প্রসঙ্গ মৌলবাদ সন্ত্রাসবাদ জাতপাত– শ্যামল চক্রবর্তী, (১২) হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক– সম্পাদনা : হোসেনুর রহমান, (১৩) ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায় –গোলাম আহমেদ মোর্তজা, (১৪) ইতিহাসের ইতিহাস— গোলাম আহমেদ মোর্তজা, (১৫) বাজেয়াপ্ত ইতিহাস— গোলাম আহমেদ মোর্তজা, (১৬) চেপে রাখা ইতিহাস— গোলাম আহমেদ মোর্তজা, (১৭) ভারতজনের ইতিহাস– বিনয় ঘোষ, (১৮) ভারতবর্ষের ইতিহাস –রোমিলা থাপার, (১৯) ভারতবর্ষ ও ইসলাম– সুরজিৎ দাশগুপ্ত, (২০) সাম্প্রদায়িকতাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি– প্রণব চট্টোপাধ্যায়, (২১) অনীক (অক্টোবর নভেম্বর ২০০৫), (২২) ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান –এম. এন. রায় (অনুবাদ : আবদুল হাই) (২৩) মনীষা মঞ্জুষা— ড. মোহম্মদ এনামুল হক (২৪) Islam and Indian culture– Dr. B. N. Pandey (২৫) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ— শিবনাথ শাস্ত্রী (২৬) সিপাহী বিপ্লব, বেগম হজরত মহল ও নেটিভদের বিশ্বাসঘাতকতা— মোহাম্মদ সিদ্দিক (২৭) ভারতের মুসলমান ও স্বাধীনতা আন্দোলন— মোহাম্মদ ইনাম-উল-হক (২৮) সিপাহী বিপ্লব-স্বাধীনতা সংগ্রামের টার্নিং পয়েন্ট— মোহাম্মদ আবদুল গফুর (২৯) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ও পরাধীন মুসলমান ১৭৫৭-১৮৫৭ : অতঃপর স্বাধীনতার সংগ্রাম— এমরান জাহান (৩০) ভারতের জাতীয়তাবাদী বৈপ্লবিক সংগ্রাম— সুপ্রকাশ রায় (৩১) উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও বাংলা ভাগ –নুরুল কবীর (৩২) www.sanataninews.com (৩৩) ভারতীয় ঐতিহ্য ও গান্ধিবাদী অহিংসা– ডঃ রাধেশ্যাম ব্রহ্মচারী (৩৪) বেঙ্গল ডিভাইডেড : হিন্দু কমুনালিজম অ্যান্ড পার্টিশন : ১৯৩২-১৯৪৫— জয়া চ্যাটার্জি (৩৫) ১৯৫০ : রক্তরঞ্জিত ঢাকা বরিশাল এবং– ডঃ দীনেশচন্দ্র সিংহ (৩৬) আধুনিক ভারত : ১৮৮৫ ১৯৪৭– সুমিত সরকার (৩৭) দেশবিভাগ : ফিরে দেখা –আহমদ রফিক (৩৮) নোয়াখালির গণহত্যা– শান্তনু সিংহ (৩৯) পাক-ভারতের রূপকথা –প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী (৪০) বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস –আব্বাস আলি খান (৪১) মহাত্মা গান্ধী কেন মহাত্মা নন– মনোজ দাশ (৪২) শ্যামাপ্রসাদ : বঙ্গবিভাগ ও পশ্চিমবঙ্গ –ডঃ দীনেশচন্দ্র সিংহ (৪৩) উদ্বাস্তু –হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় (৪৪) জিন্না : পাকিস্তান নতুন ভাবনা– শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (৪৫) বাংলায় মুসলমানের আটশো বছর –জাহিরুল হাসান (৪৬) দ্বিখণ্ডিতা মাতা, ধর্ষিতা ভগিনী– রবীন্দ্রনাথ দত্ত (৪৭) সংস্কৃতির সংকট– বদরুদ্দিন ওমর (৪৮) বাংলা ভাগ হল –আবু জাফর (৪৯) ইসলামী শান্তি ও বিধর্মী সংহার– নুসরাত জাহান আয়েশা সিদ্দিকা (জয়শ্রী আচার্য) (৫০) পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক– পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ (৫১) বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি— বদরুদ্দিন উমর (৫২) ইতিহাসের দিকে ফিরে : ছেচল্লিশের দাঙ্গা– সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (৫৩) বাংলায় হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক– নজরুল ইসলাম (৫৪) দেশভাগের ইতিহাস– একটি বিনির্মাণ প্রয়াস– অসিত রায় (৫৫) ভারতের ইতিহাসকথা (দ্বিতীয় খণ্ড)– ডঃ কিরণচন্দ্র চৌধুরী (৫৬) ভারত ইতিহাস পরিক্রমা– শ্রী প্রভাংশু মাইতি (৫৭) ভারতবর্ষের ইতিহাস– গোপালচন্দ্র সিনহা (৫৮) ইসলামের ভারত অভিযান– কঙ্কর সিংহ (৫৯) ইসলামের ইতিহাস– এ টি এম রফিকুল হাসান ও এম আবুল বাসার (৬০) আধুনিক ভারত ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ– বিপানচন্দ্র (৬১) টিপু সুলতান– মোহিবুল হাসান (৬২) তারিখ-ই-ফিরোজশাহি (জিয়াউদ্দিন বারানি) (৬৩) তারিখ-ই-আলাই (আমির খসরু) (৬৪) A Comprehensive History of India: The Delhi Sultanat (A.D. 1206-1526), ed. by Mohammad Habib and Khaliq Ahmad Nizami (৬৫) ইতিহাসের ইতিহাস- গোলাম আহমেদ মোর্তজা (৬৬) ভারতবর্ষের ইতিহাস— কোকা আন্তোনোভা, গ্রিগোরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি (৬৭) বিশ্বসভ্যতা- এ. কে. এম. শাহনাওয়াজ (৬৮) The Crusades : The Flame of Islam– Harold Lamb (অনুবাদ : শওকত হোসেন) (৬৯) ক্রুসেডের ইতিবৃত্ত –আশকার ইবনে শাইখ (৭০) বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রুসেড– মাওলানা ইসমাঈল রায়হান (৭১) হিন্দু ধর্ম ও ভারতীয় হিন্দু সমাজ— এ. জি. বেলস্কি (রাশিয়ার গবেষক) (৭২) বিষয় সাম্প্রদায়িকতা : ফিরে দেখা— সুজিত সেন (সম্পাদিত) (৭৩) জাতীয়তাবাদী জিন্নাহ— মৃণালকান্তি চট্টোপাধ্যায় (৭৪) জিন্না ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা— যশোবন্ত সিংহ (৭৫) কলকাতা ও নোয়াখালি দাঙ্গা– সংকলক অর্জুন গোস্বামী (৭৬) পরাধীন ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা– গৌতম রায় (৭৭) আরএসএস ও বর্তমান ভারত– গৌতম রায় (৭৮) ভারত ও বিশ্বের ইতিহাস– জীবন মুখোপাধ্যায় ও ড. সুভাষ বিশ্বাস (৭৯) দেশবিভাগ : পশ্চাৎ ও নেপথ্য কাহিনী –ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (৮০) বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলমানচর্চা– আমিনুল ইসলাম (৮১) দেশভাগ দেশত্যাগ– সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (৮২) বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা– সত্যেন সেন (৮৩) উপমহাদেশে ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের সূচনায় উলামায়ে কেরাম– আবদুল মান্নান তালিব (৮৪) ভারতীয় সমাজ-পদ্ধতি— ডাঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *