২.৭ বিশ্ব তথা ভারতে মুসলিমদের অবদান

বিশ্ব তথা ভারতে মুসলিমদের অবদান

উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা প্রায়শই বলে থাকে ভারত তথা গোটা বিশ্বে মুসলিমদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে বা অন্য কোনো কিছুতেই তাঁদের কোনো অবদান নেই। কারণ মুসলিমরা গোঁড়া। কোরান ছাড়া কিছু বোঝে না। কোরানের বাইরে কিছু মানেন না। কোরানের পথই মুসলিমদের পথ। কোরান তাঁরা শুধু মাদ্রাসায় ধর্মশিক্ষা নেয়, আর এক-একটা জঙ্গি তৈরি হয়! ইহুদি, খ্রিস্টান আর হিন্দুরাই নাকি সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিরোমণি। সত্যিই তো, জ্ঞান-বিজ্ঞানে কোথাও তো মুসলিমদের নাম দেখি না! তাই কি? একটু তত্ত্বতালাশ করা যাক। দেখি কোথাকার জল কতদূর গড়ায়।

শতাব্দী প্রাচীন গ্রিকদের চেয়েও আরবদের জ্ঞানবুদ্ধি অনেক তাড়াতাড়ি নাটকীয়ভাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরিচিত হতে থাকল বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মীয় আচরণের সঙ্গে। ব্যাপকভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার আচরণের মিশ্রণ ঘটতে থাকল। শিক্ষা নিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের। চিনাদের কাছ থেকে তাঁরা কাগজ তৈরি শিখল এবং তাঁর ফলে বই ছাপাও শুরু করল। মুসলিমরা যে দেশে এসেছে আর শাসন করেছে, মুসলিম পণ্ডিতরা সেখানকার প্রাচীন সাহিত্য ও ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ করে নিয়েছিল আরবি ও ফারসি ভাষায়। চিনের পশ্চিমের সমগ্র পৃথিবীর মননশক্তির উজ্জীবন ও প্রাচীন ধারণার পরিবর্তে নতুন চিন্তাধারার বিকাশের প্রচুর ফুরণ ঘটেছিল। তাঁরা ভারত উপমহাদেশের গণিতবিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্রের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছিল। বদলে যাচ্ছিল ইসলাম ধর্মের চিন্তন ও মনন। মুসলিম শাসকরা ইসলামের শাসন আর রাষ্ট্রীয় শাসনকে পৃথক করল। মুসলিম শাসকরা কখনোই ইসলাম শাসনকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়নি। এ প্রসঙ্গে ‘Outline of History’ গ্রন্থে এইচ জি ওয়েলস লিখেছেন– “কোরান স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সম্ভাব্য একমাত্র পুস্তক, এই আদি অসহিষ্ণু বিশ্বাস খুব অল্পদিনের মধ্যে পরিত্যক্ত হল।”

আরব বিজেতাদের পথ অনুসরণ করে সর্বত্রই শিক্ষার জাগরণ হতে থাকল। অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে সমগ্র আরব জগতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। নবম শতাব্দীতে স্পেনের করডোবা বিদ্যালয়ের পণ্ডিতরা কায়রো, বোখারা ও সমরখন্দের পণ্ডিতদের সঙ্গে পত্রালাপ করেন। ইহুদি চিন্তাধারা আরবদের সঙ্গে সহজেই মিশে যায়। কিছুকালের মধ্যেই এই সেমিটিক জাতি একত্রে আরবি ভাষার মাধ্যমে কাজ করতে থাকে। আরবি ভাষী জগতে বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী স্বপ্রতিষ্ঠিত ছিল। এয়োদশ শতাব্দীতে এসে তাঁরা বিশেষ সাফল্যের সঙ্গে গবেষণা করছিল। গণিত, চিকিৎসা ও পদার্থবিদ্যায় প্রচুর গবেষণামূলক কাজও হয়। কঠিন রোমান সংখ্যার পরিবর্তে আজকের ব্যবহৃত আরবি সংখ্যার প্রচলন ও শূন্য (০) চিহ্নটিরও প্রবর্তন হল। গণিত শাখার ‘অ্যালজেব্রা’ নামটিই তো আরবি। ‘কেমিস্ট্রি’ শব্দটিও। আলগল, অলদেবারান ও বুটস প্রভৃতি তারাদের নামও মহাকাশে আরবীয় বিজ্ঞানের কথা মনে করিয়ে দেয়। আরবে পরীক্ষামূলক রাসায়নিকদের ‘অ্যালকেমিস্ট’ বলা হত। তবে রাসায়নিক পরীক্ষার ফলাফল যথাসম্ভব গোপন রাখার প্রয়াসে অত্যন্ত বর্বরোচিত ছিল। আরব অ্যালকেমিস্টদের ধীর-স্থির পরীক্ষানিরীক্ষার হাওয়া খ্রিস্টান সমাজেও পৌঁছে গেল এবং শেষ অ্যালকেমিস্টরা প্রথম পরীক্ষামূলক দার্শনিকে রূপান্তরিত হয়ে গেল। আরববাসীরা বহু মূল্যবান ধাতুবিদ্যার নানা প্রক্রিয়ারও সন্ধান পায়। সংকর ধাতু ও রঞ্জক, পাতন, সুরাসার ও নির্যাস, লেন্স প্রভৃতি আবিষ্কার করে। আরও দুটি আবিষ্কারে কথাও তাঁরা ভেবেছিল –একটি পরশপাথর বা স্পর্শমণি, যা দিয়ে একটি ধাতুকে অপর ধাতুতে পরিবর্তিত করা যায় এবং এইভাবে কৃত্রিম সোনার উপর কর্তৃত্ব করবে। অপরটি হল মৃতসঞ্জীবনী সুধা, যে বস্তু জরা-বার্ধক্যকে নির্মূল করে চিরযৌবনের অধিকারী করবে মানুষকে।

মুসলিম সম্প্রদায়ের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মপালন, সাহিত্যচর্চা, বিজ্ঞানসাধনা, রাজনীতি, সংগ্রামের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে চরম উদাসীনতা লক্ষ করা যায় অ-মুসলিমদের মধ্যে। তাঁরা জানতে আগ্রহীও নয়। ফলে অজ্ঞানতার কারণে বিদ্বেষ ছাড়া সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠতে পারেনি। জানার শেষ নেই। তবুও জানতে হবে নবম দশম শতাব্দীতে আরবদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল, তা অনেক পণ্ডিতদের মতে— সেরকম আর পরে দেখা যায়নি। অষ্টম-নবম থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইসলামীয় বিশ্ব ছিল পথিকৃৎ। আর বিজ্ঞান চর্চার উপর ভর করেই পরবর্তীকালে ইউরোপে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জোয়ার এসেছিল। বিশেষ করে বলতে হয় জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্র উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে মুসলিম সম্প্রদায়। এমনকি সপ্তদশ শতক ইতালি ও ফ্রান্সের চিকিৎসকরা ইবন সিনার (ইউরোপ সমাজে যিনি আভিসেনা নামেই পরিচিত) কাছে ‘ক্যানন অফ মেডিসিন অধ্যয়ন করে চিকিৎসাশাস্ত্র শিখেছেন। আল বিরুনির নাম আমরা ভারতের ভ্রমণ বিষয়ক লেখার সূত্রেই জানি। যেটা জানি না, তা হল আল বিরুনি একজন একাধারে গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, ভূবিদ্যাবিদ। আল বিরুনিও আরও উল্লেখযোগ্য কীর্তি স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা আছে, তা হল –তিনি পৃথিবীর পরিধি মেপেছেন, নানা শহরের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করেছেন, দামি রত্নপাথরের গ্রন্থ লিখেছেন, এমনকি তুলনামূলক ধর্ম নিয়েও কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন রসায়ন ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেও পারদর্শী। অধিকন্তু ঐতিহাসিক, পঞ্জিকাবিদ, দার্শনিক এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ববিদ ও ধর্মতত্ত্বের নিরপেক্ষ বিশ্লেষক। স্বাধীন চিন্তা, মুক্তবুদ্ধি, সাহসিকতা, নির্ভীক সমালোচক ও সঠিক মতামতের জন্য যুগশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত। হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর শেষার্ধ ও পঞ্চম শতাব্দীর প্রথমার্ধকে আল-বেরুনির কাল বলে উল্লেখ করা হয়। তিনিই সর্বপ্রথম প্রাচ্যের জ্ঞানবিজ্ঞান, বিশেষ করে ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি মুসলিম মনীষীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। অধ্যাপক মাপা বলেন, “আল বিরুনি শুধু মুসলিম বিশ্বেরই নন, বরং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের একজন।

ওমর খৈয়ামের নাম হয়তো অনেকেই শুনেছেন। শুনেছেন তিনি একজন প্রখ্যাত শায়র, তিনি শায়রি লিখতেন। কিন্তু যেটা আমরা অনেকেই জানি না, তা হল, তিনি একজন মস্ত বড়ড়া গণিতজ্ঞ। তাঁর বীজগণিতের গুরুত্বপূর্ণ “Treatise on Demonstration of Problems of Algebra” গ্রন্থে তিনি ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধানের একটি পদ্ধতি বর্ণনা করেন। এই পদ্ধতিতে একটি পরাবৃত্তকে বৃত্তের ছেদক বানিয়ে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করা হয়। ইসলামি বর্ষপঞ্জি সংস্কারেও তাঁর অবদান রয়েছে। তাঁর কাব্য-প্রতিভার আড়ালে তাঁর গাণিতিক ও দার্শনিক ভূমিকা অনেকখানি ঢাকা পড়েছে। ধারণা করা হয় রনে দেকার্তের আগে তিনি বিশ্লেষণী জ্যামিতি আবিষ্কার করেন। তিনি স্বাধীনভাবে গণিতের দ্বিপদী উপপাদ্য আবিষ্কার করেন। বীজগণিতে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান তিনিই প্রথম করেন। বহুমুখী প্রতিভার দৃষ্টান্ত দিতে বলা হলে বিশ্বসাহিত্য কিংবা ইতিহাসে যাঁদের নাম উপেক্ষা করা কঠিন, ওমর খৈয়াম তাঁদের মধ্যে অন্যতম ও শীর্ষস্থানীয়। আর-একজন প্রখ্যাত মানুষের নাম মনে পড়ছে। তাঁর নাম আল-রাজি। আল-রাজি একাধারে প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী, অ্যালকেমিস্ট, কেমিস্ট এবং বিরাট মাপের দার্শনিক।

দাঁড়ি-টুপিওয়ালা দেখলেই যাঁদের সন্ত্রাসবাদী বলে মনে হয়, তাঁদের জন্য তালিকা দিই। দীর্ঘ তালিকা। তবুও উল্লেখ করি। প্রথমেই দেখব মুসলিম জ্যোতির্বিদদের তালিকা— সিন্দ ইবন আলি (অষ্টম শতাব্দী), আলি কুশজি, (চতুর্দশ শতাব্দী), আহমদ খানি (ষোড়শ-সপ্তদশ), ইব্রাহিম আল ফাজারি (সপ্তদশ), মোহাম্মাদ আল ফাজারি (সপ্তম-অষ্টম), আল খাওয়ারিজমি, গণিতবিদ (সপ্তম-অষ্টম), আবু মাশার আল-বালখি (সপ্তম-অষ্টম), আল-ফারগানি (অষ্টম-নবম), বনু মুসা (নবম), আবু হানিফা আল-দিনাওয়ারি (অষ্টম-নবম), আল-মাজরিতি (দশম-একাদশ), আল বাত্তানি (অষ্টম-নবম), আল ফারাবি (অষ্টম-নবম), আব্দ আল-রহমান আল সুফি (নবম), আবু সাঈদ জ্বরজানি (নবম), কুশয়ার ইবনে লাব্বান (নবম-দশম), আবু জাফর আল-খাজিন (নবম), আল মাহানি (অষ্টম শতক), ইবন ইউনুস (নবম-দশম), হাসান ইবন আল-হাইসাম (নবম-দশম), ওমর খৈয়াম (দশম-একাদশ), আল মারওয়াজি (নবম), আল-নাইরিজি (অষ্টম-নবম), আল-সাগানি (নবম), আল ফারগানি (নবম), আবু নাসর মনসুর (নবম-দশম), আবু সাহল আল-কুহি (দশম), আবু মাহমুদ আল খুজান্দি (নবম দশম), আবু আল-ওয়াফা আল-বুজজানি (নবম), ইবন ইউনুস (নবম-দশম), আল বিরুনি (নবম-দশম), ইবন সিনা (নবম-দশম), আবু ইসাক ইব্রাহিম আল-জারকালি (দশম), আল-খাজিনি, নাসির আল-দিন তুসি (দ্বাদশ), কুতুব আল-দিন আল-শিরাজি (দ্বাদশ-ত্রয়োদশ), শামস আল-দিন আল সমারকান্দি (দ্বাদশ-ত্রয়োদশ), ইবনে আল শাতির (ত্রয়োদশ), শামস আল-দিন আবু আব্দুল্লাহ আল-খলিজি (এয়োদশ), জামশেদ আল-কাশি (ত্রয়োদশ-চতুর্দশ), উলুগ বেগ (ত্রয়োদশ-চতুর্দশ), তাকি আল-দিনা মুহাম্মদ ইবনে মারুফ (পঞ্চদশ), আহমদ নাহভান্দি (অষ্টম-নবম), হ্যাঁলি অ্যাবনেগেল (দশম-একাদশ), আবোলফাঁদল হারাউই (দশম), মুয়ায়দুল-দিন আল-উর্দি (দ্বাদশ) প্রমুখ।

আসুন, এবার দেখে নেওয়া যাক কিছু মুসলিম জীববিজ্ঞানী, নিউরোলজিস্ট ও মনোবিজ্ঞানীদের তালিকা— আজিজ সানজার (নোবেল পুরস্কার জয়ী প্রথম মুসলিম), আহমদ রেজা দেফর (১৯৪৮, ইরানি ফার্মাসসালজিস্ট), ইবনে শিরিন (৬৫৪-৭২৮), আল-কিন্দি (সাইকোথেরাপি ও সংগীত থেরাপিতে অগ্রদূত), আলি ইবন সাহল রান আল-তাবারি, (মনস্তাত্ত্বিক, ক্লিনিকাল সাইকিয়াট্রিক এবং ক্লিনিকাল সাইকোলজির অগ্রদূত), আহমেদ ইবনে সাহল আল-বাখি (মানসিক স্বাস্থ্য, জ্ঞানীয় মনোবিজ্ঞান, জ্ঞানীয় থেরাপি, সাইকোফিজিওলজি এবং সাইকোসোমেটিক ঔষধের অগ্রগামী), আল ফারাবি (সামাজিক মনোবিজ্ঞান এবং চেতনার অগ্রদূত), আলি ইবন আব্বাস আল-মাজুসি (হালি আব্বাস) (নিউরো-অ্যানোটমির অগ্রদূত, নিউরো বায়োলজি এবং নিউরো-ফিজিওলজি), আবুল কাসিম আল জাহরাউয়ি (নিউরো-সার্জারির অগ্রদূত), হাসান ইবনে আল-হাইসাম (নিরক্ষীয় মনোবিজ্ঞান, সাইকোফিজিক্স), ইবনে সিনা (নিউরো-সাইকাট্রি, চিন্তা পরীক্ষা, আত্ম-সচেতনতা এবং আত্ম-উপলব্ধির অগ্রদূত), ইবনে জহর (স্নায়ুবিজ্ঞান ও নিউরো-ফার্মাকোলজির অগ্রদূত), ইবনে রুশদ (পারকিনসন রোগের অগ্রদূত), ইবনে তুফায়েল (তবুল রাসা এবং প্রকৃতি বনাম পুষ্টিকরের অগ্রদূত), সৈয়দ জিয়াউর রহমান (পরিবেশ ফার্মাকোভিলেজেন্সর অগ্রদূত), মোহাম্মদ সামির হোসেন (তত্ত্ববিদ, লেখক এবং মুসলিম বিজ্ঞানী) প্রমুখ।

মুসলিম রসায়নবিদ ও আলকেমিস্টদের তালিকা— খালিদ ইবনে ইয়াজিদ (৭০৪), জাফর আল-সাদিক (৭০২ ৭৬৫), জাবির ইবন হাইয়ান (সপ্তম-অষ্টম শতকের রসায়নের জনক), আব্বাস ইবনে ফিরনাস (৮১০-৮৮৭), আল-কিন্দি (৮০১-৮৭৩), আল-মার্জিতি (১০০৭-১০০৮), ইবনে মিসকওয়াহ (৯৩২-১০৩০), আল বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮), ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭), আল-খাজিনি (১১১৫-১১৩০), নাসির আল-দিন তুসি (১২০১ ১২৭৪), ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬), সালিমুজ্জামান সিদ্দিকি (১৮৯৭-১৯৯৪), আল খোয়ারিজমি (৭৮০ ৮৫০), আহমেদ এইচ জেইয়েল (১৯৪৬-২০১৬), (মিশরীয় রসায়নবিদ এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে রসায়নে নোবেল পুরস্কার), আব্বাস শাফেঈ (১৯৩৭-২০১৬), মোস্তফা এল সাঈদ (ঊনবিংশ শতাব্দী), আবদুল কাদের খান (ঊনবিংশ শতাব্দী), আতাউর রহমান, ওমর এম ইয়াহি (উনবিংশ শতাব্দী), সারা আকবর প্রমুখ।

মুসলিম ভূগোল ও ভূতত্ত্ববিদদের তালিকা— আল-মাসুদি, ‘আরবের হেরোডোটাস’ (ঐতিহাসিক ভূগোলরের অগ্রদূত), আল-কিন্দি, (পরিবেশ বিজ্ঞানের অগ্রদূত), ইবনে আল জাজার, আল-তামিমি, আল-মাসিহি, আলি ইবন রিদওয়ান, আল-ইদ্রিসি, আহমেদ ইবনে ফাঁদলান, আব্দ আল-লতিফ আল-বাগদাদি, ইবনে রুশদ, ইবনে আন নাফিস, ইবনে জুবায়ের, ইবনে বতুতা, ইবনে খালদুন, পিরি রেইস, ইভিলিয়া শেলেবি প্রমুখ।

মুসলিম গণিতবিদদের তালিকা— মাসাতোশি গুন্ডুজ ইকদা (১৩২৬ টোকিও), কাহিট আরএফ, আলি কুশজি, আল হজজ ইবনে ইউসুফ ইবনে মাতার, খালিদ খালিদ ইবনে ইয়াজিদ, আল খাওয়ারিজমি (বীজগণিত এবং অ্যালগরিদমের জনক), আবদুল হামিদ ইবনে তুর্ক, আবু আল হাসান ইবনে আলি কালাসদি (সিম্বলিক অ্যালজেব্রার অগ্রদূত), আবু কমিল শুজা ইবনে আসলাম, আল-আব্বাস ইবনে সাইদ আল-জাওয়ারি, আল কিন্দি, আল-মাহানি, আহমদ ইবনে ইউসুফ, আল-মাজারি, আল বাত্তানি, আল ফারাবি, আল-নায়রিজি, আবু জাফর আল-খাজিন, আবু এল-হাসান আল-উঁকিলিদিসি, আল-সাঘানি, আবু সাহল আল-কুহি, আবু মাহমুদ আল-খুজান্দি, আবু আল-ওয়াফা আল-বুজজনি, ইবনে সাহল, আল-সিজি, ইবনে ইউনুস, আবু নাসর মনসুর, কুশিয়র ইবনে লাব্বান, আল কারজি, হাসান ইবনে আল-হাইসাম, ইবনে তাহির আল-বাগদাদি, আল-নাসাউ, আল-জয়য়ানি, আবু ইশক ইব্রাহিম আল-জারকালি, আল-মুয়াতমান ইবনে হুদ, আল-খাজনি, ইবনে বাজাহা, আল-গাঁজালি, আল-মারাকাকুশি, আল-সামওয়াল, হুনাইন্ ইবনে ইসহাক, ইবনে আল-বান্না, ইবনে আল-শাতের, জাফর ইবন মোহাম্মদ আবু মাশার আল-বালখি, জামশেদ আল-কাশি, কামাল আল-দিন আল ফারাসি, মুয়াই আল-দিন আল-মাগরিবি, নাসির আল-দিনা আল-তুসি (ত্রয়োদশ শতাব্দীর ফারসি গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক), কানি জাদ আল-রুমি, কুতবি আল-দিন আল-শিরাজি, শামস আল-দিন আল-সমারকান্দি, তাকি-আল-দিনা মোহাম্মদ ইবনে মারুফ প্রমুখ।

মুসলিম দার্শনিকদের তালিকা— আল-কিন্দি, ইবনে রুশদ, আল-রাজি, আল ফারাবি, ইবনে সিনা, ইবনে আরাবি, রুমি, জামি, ইবনে খালদুন, মির দামাদ, নাসির আল দিন তুসি, কুয়াসিম কাসাম, আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল প্রমুখ।

মুসলিম পদার্থবিদদের তালিকা— মিমার সিনান (চতুর্দশ-পঞ্চদশ), জাফর আল-সাদিক (অষ্টম শতাব্দী), আব্বাস ইবনে ফিরনাস (নবম শতাব্দী), আল-সাঘানি (নবম শতাব্দী), আবু সাহল আল-কুহি (দশম শতক), ইবনে সাহল (দশম শতাব্দী), ইবনে ইউনুস (দশম শতাব্দী), আল কারাজি (দশম শতাব্দী), হাসান ইবনে আল হাইসাম (একাদশ শতাব্দীর ইরাকি বিজ্ঞানী, অপটিক্সের জনক ও পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যাএবং প্রথম বিজ্ঞানী’ বিবেচনা করা হয়), আল বিরুনি, (একাদশ শতাব্দী, পরীক্ষামূলক বলবিদ্যার অগ্রগামী), ইবনে সিনা, (একাদশ শতাব্দী), আল-খাজিনি (দ্বাদশ শতাব্দী), ইবনে বাজাহা (দ্বাদশ শতাব্দী), হিবাতুল্লাহ আবু-বারাকাত আল-বাগদাদি (দ্বাদশ শতাব্দী), ইবনে রুশদ (দ্বাদশ শতাব্দীর আন্দালুসিয়ার গণিতজ্ঞ, দার্শনিক ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ), আল জাজারি (ত্রয়োদশ শতাব্দীর সিভিল ইঞ্জিনিয়ার), নাসির আল-দিন তুসি (ত্রয়োদশ শতাব্দী), কুতুব আল-দিন আল-শিরাজি (ত্রয়োদশ শতাব্দীর), কামাল আল-দিন আল ফারাসি (ত্রয়োদশ শতাব্দী), ইবনে আল-শাতের (চতুর্দশ শতাব্দী), তাকি-আল-মোহাম্মদ ইবনে মাওরুফ (সপ্তদশ শতাব্দী), হিজারফেন আহমেট সেলিবি (সপ্তদশ শতাব্দী), লাগারি হাসান সেলিবি (সপ্তদশ শতাব্দী), সাক ডিন মহোমেট (অষ্টাদশ শতাব্দী), আব্দুস সালাম (বিশ শতকের পাকিস্তানি পদার্থবিজ্ঞানী, ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী), ফজলুর খান (বিশ শতকের বাংলাদেশি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার), মাহমুদ হেসবি (বিশ শতকের ইরানি পদার্থবিদ), আলি জাওয়ান, (বিশ শতাব্দীর আই আর অ্যানিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী), বিজে হাবিবি (বিংশ শতাব্দীর ইন্দোনেশিয়ান মহাকাশ প্রকৌশলী ও সভাপতি), আব্দুল কালাম (ভারতীয় আণবিক প্রকৌশলী, পরমাণু বিজ্ঞানী এবং ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি), মেহরান কারদার (ইরানি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী), মুনির নঈফ (ফিলিস্তিনি-আমেরিকান কণা পদার্থবিজ্ঞানী), আব্দুল কাদির খান (পাকিস্তানি ধাতববিদ এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানী), রিয়াজউদ্দিন (পাকিস্তানি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী), শহিদ হোসেন বোখারি (পাকিস্তানি গবেষক সমান্তরাল এবং বিতরিত কম্পিউটিং), সুলতান বাঁশিরউদ্দিন মাহমুদ (পাকিস্তানি পরমাণু প্রকৌশলী এবং পারমাণবিক পদার্থবিদ), আলি মুশারাফা (মিশরীয় পরমাণু পদার্থবিজ্ঞানী), সামিরা মুসা (মিশরীয় পরমাণু পদার্থবিদ), মুনির আহমেদ খান (পাকিস্তানি পরমাণু বিজ্ঞানী), কেরিম কেরিমো (সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা, প্রথম মানব স্পেসফ্লাইট ভস্টক ১ এর পিছনের একজন প্রধান স্থপতি এবং প্রথম স্পেস স্টেশনের প্রধান স্থপতি), ফারুক এলবাজ (নাসা বিজ্ঞানী প্রথম চন্দ্র অবতরণের সঙ্গে অ্যাপোলো প্রোগ্রামে জড়িত ছিলেন), কামরুন ভাফ (ইরানি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ এবং স্ট্রিং থিওরিস্ট) প্রমুখ।

মুসলিম চিকিৎসক-গবেষকদের তালিকা— আল-কিন্দি (ফার্মাকোলজির অগ্রদূত), আব্বাস ইবনে ফিরনাস (অষ্টম-নবম শতাব্দী), আলি ইবনে সাহল রাব্বান আল-তাবারি (চিকিৎসা বিশ্বকোশের অগ্রদূত), আহমেদ ইবনে সাহল আল-বালখি, ইসহাক বিন আলি আল রাহবি ( অষ্টম-নবম শতকের পিয়ার রিভিউ এবং মেডিক্যাল পিয়ার রিভিউয়ের অগ্রদূত), আল-রাজি (একজন রসায়নবিদ), আলি ইবনে আব্বাস আল-মাজুসি (নবম-দশম শতাব্দীর ধাত্রীবিদ্যা এবং পেরিনেটোলজির অগ্রদূত), আবুল কাসিম আল জাহরাউয়ি (আধুনিক সার্জারি এবং নিউরোসার্জারির জনক, ক্রনিটোমি, হেমাটোলজি, ও ডেন্টাল সার্জারি), হাসান ইবনে আল-হাইসাম (চোখের অস্ত্রোপচার, চাক্ষুষ ব্যবস্থা এবং চাক্ষুষ উপলব্ধির অগ্রগামী), ইবনে সিনা (আধুনিক ঔষধের জনক, ইউনানি ঔষধের প্রতিষ্ঠাতা, পরীক্ষামূলক ওষুধ, প্রমাণভিত্তিক ঔষধ, ফার্মাসিউটিকাল বিজ্ঞান, ক্লিনিকাল ফার্মাকোলজির অগ্রদূত, অ্যারোমাথেরাপি, পলসোলজি এবং স্ফগমোলজি এবং একজন দার্শনিক), ইবনে জুহর (আভেনজোয়ার) (পরীক্ষামূলক সার্জারির জনক এবং পরীক্ষামূলক শারীরবৃত্তীয়, পরীক্ষামূলক শারীরবৃত্তীয় মানুষের ব্যবচ্ছেদ অটোপসের অগ্রদূত এবং ট্র্যাচোটিমি), মোহাম্মদ সামির হোসেন (একজন তাত্ত্বিক লেখক এবং অন্যতম মুসলমান বিজ্ঞানী, মৃত্যুর উদ্বেগ (মনোবিজ্ঞান) গবেষণা, ইবনে নাফিস (রিসার্চুটরি ফিজিওলজির জনক, পরীক্ষামূলক শারীরস্থান পরিচলনের অগ্রগামী এবং নাফিসিয়ান শারীরস্থান, শারীরবৃত্তের প্রতিষ্ঠাতা, পালসোলজি এবং স্পাইগমোলজি), মোহাম্মদ বি ইউনুস (আধুনিক ফাইব্রোমালজিয়া দর্শনের জনক), শেখ মুজাফফর শুকর (মহাশূন্যে জৈবপদার্থ গবেষণার অগ্রদূত) প্রমুখ।

মুসলিম অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের তালিকা— ইবনে সিনা (চিকিৎসক ও অর্থনীতিবিদ), ইবনে মিসকাওয়াহ (অর্থনীতিবিদ), আল গাজ্জালি (অর্থনীতিবিদ), আল মাওয়ারদি (অর্থনীতিবিদ), ইবনে নাফিজ (সমাজবিজ্ঞানী), ইবনে তাইমিয়া (অর্থনীতিবিদ), ইবনে খালদুন (সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ), আল মাকরিজি (অর্থনীতিবিদ), আখতার হামিদ খান (পাকিস্তানি সমাজবিজ্ঞানী; ক্ষুদ্রঋণের অগ্রদূত), মোহাম্মদ ইউনুস (নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ, মাইক্রোফিন্যান্সের অগ্রদূত), শাহ আব্দুল হান্নান (দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামী ব্যাংকের অগ্রদূত), মাহবুব উল হক (পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ) পমুখ।

মুসলিম রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের তালিকা— শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলোভী, তকিউদ্দিন আল নাভানি, সাইয়েদ কুতুব, মোহাম্মদ বাকির আল সদর, আবুল আলা মওদুদি, হাসান আল তুরাবি, হাসান আল বান্না, মোহাম্মাদ হাসনাইন হাইকল, এম এ মুক্তোর খান, রশিদ আল ঘানুশি, আলা আদ দিন ইবনে ইউসুফ, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ।

মুসলিম সাহিত্যিকদের তালিকা –কাজী নজরুল ইসলাম, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, ছফা আহমেদ, জাফর ইকবাল, কাজী আবদুল ওদুদ, সৈয়দ মুজতবা সিরাজ, শেখ ওয়াজেদ আলি, ইমমাদুল হক মিলন, হোসেনুর রহমান, গুলজার প্রমুখ।

মুসলিম সংগীতশিল্পীদের তালিকা– কে মল্লিক, সাবিনা ইয়াসমিন, আবদুল জব্বর, এন্ড্রো কিশোর, নুসরত ফতেহ আলি, আনদান স্বামী, মোহম্মদ রফি, সাবির কুমার, তালাত আজিজ, তালাত মামুদ, মেহেদি হাসান, ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান, ওস্তাদ আমজাদ আলি খান, আলি আকবর খাঁ, আয়ান আলি খান, ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি, ওস্তাদ তানিম হায়াত খান রাজিত, রওশন আরা বেগম, ওস্তাদ সিরাজ আলি খান, সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ ইউসুফ খান, ওস্তাদ শাহাদাৎ হোসেন খান, এ আর রহমান, গোলাম আলি, রশিদ খান, আব্বাসউদ্দিন আহমেদ, ফিরোজা বেগম, বেগম আখতার প্রমুখ।

মুসলিমদের চিত্রশিল্পী ও ভাস্করদের তালিকা– আবুল কাসেম, মকবুল ফিদা হোসেন, জয়নাল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, মেহের বানু খানম, আবদুল্লাহ-আল-সাইদ প্রমুখ।

আল খাওয়ারিজমি (৭৮০-৮৫০) মধ্যযুগীয় মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। তিনি ছিলেন একাধারে গণিতজ্ঞ, ভূগোলবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তাঁর পুরো নাম আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি। খাওয়ারিজমি রচিত গ্রন্থ আল জাবর ওয়াল মুকাবলা’-তে তিনি রৈখিক এবং দ্বিঘাত সমীকরণের প্রথম পদ্ধতিগত সমাধান উপস্থাপন করেন। বীজগণিতে তাঁর প্রধান সাফল্য ছিল বর্গের সাহায্যে দ্বিঘাত সমীকরণের সমধান। এর জন্য তিনি জ্যামতিক প্রমাণ প্রদান করেন। সর্বপ্রথম তিনিই বীজগণিতকে স্বাধীন শাখা হিসাবে তুলে ধরেন এবং সমীকরণ সমাধানের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন, তাই খাওয়ারিজমিকে বীজগণিতের জনক বা প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। অ্যালজেবরা (বীজগণিত) শব্দটিই এসেছে তাঁর ‘আল জিবর ওয়াল মুকাবিলা’ গ্রন্থের শিরোনাম থেকে। তাঁর নামটি guarismo (স্পেনীয়) এবং algarismo (পোর্তুগিজ) দুইটিরই উৎস, দুইটি শব্দের অর্থ অঙ্ক। দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে পাটিগণিতের উপর তাঁর বই ‘Algorithmo de Numero Indorum’-এর বর্ণনাকৃত ভারতীয় সংখ্যা এর উপর ভিত্তি করে পশ্চিমা বিশ্ব দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি চালু করে। ১৯৪৫ সালে রবার্ট অব চেস্টার কর্তৃক অনুবাদকৃত ‘আল জিবর ওয়াল মুকাবিলা’ বইটি ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণিতের প্রধান বই হিসাবে পড়ানো হত। এছাড়াও তাঁর অন্যতম একটি বিখ্যাত কাজ হচ্ছে, টলেমির ‘Geography’-র বইটি সংশোধন করা। তিনি এই বইয়ে বিভিন্ন শহর এবং এলাকার অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ তালিকাভুক্ত করেন। তিনি আরও কিছু জ্যোতির্বিদ্যা টেবিল প্রস্তুত। করেন এবং বর্ষপঞ্জি, সূর্যঘড়ি, অ্যাস্ট্রোল্যাব নিয়ে কাজ করেন।

সিন্দ ইবনে আলি মুসা ছিলেন সিন্দের একজন প্রখ্যাত মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী, অনুবাদক, গণিতবিদ ও প্রকৌশলী। তাঁর বাবা ছিলেন মানসুরা, সিন্ধু প্রদেশের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সিন্দ ইবনে আলি উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদ গিয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত জিজ আল সিন্দ হিন্দ অনুবাদ ও সম্পাদনার জন্য তিনি পরিচিতি লাভ করেন। একজন গণিতবিদ হিসাবে সিন্দ ইবনে আলি আল খাওয়ারিজমির সহকর্মী ছিলেন এবং ইয়াকুব ইবনে তারিকের সঙ্গে মিলে পৃথিবীর ব্যাস নির্ণয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। সিন্দ ইবনে আলি একজন ভালো প্রকৌশলীও ছিলেন। একবার বনু মুসা গোত্রের দুইজনকে বড়ো খাল খননের দায়িত্ব দেওয়া হয়। খাল খননের কাজে ত্রুটি দেখা দেয়। খাল খননের গভীরতার পরিমাপ ঠিক না-হওয়ায় জল সৈন্যদের কাছে পৌঁছোতে পারছিল না। খবরটি খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলকে রাগান্বিত করে তোলে। সিন্দ ইবনে আলি খনন তত্ত্বের বিষয়টির সুন্দর সমাধান দিয়ে তাঁদের। শাস্তির হাত থেকে বাঁচান।

মোহাম্মদ ইবনে জাবির ইবনে সিনান আল রাক্কি আল হারানি আস সাবি আল-বাত্তানি ছিলেন একজন আরব জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ। তিনি অনেকগুলি ত্রিকোণমিতির সম্পর্কেরও উদ্ভাবক এবং তাঁর রচিত এবং কিতাবুল আজ-জিজ থেকে কোপারনিকাস সহ অনেক মধ্যযুগীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা উদ্ধৃতি প্রদান করতেন। আল ফারাবির পুরো নাম আবু নসর মোহম্মদ বিন মোহম্মদ আল ফারাবি। একজন প্রখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ও বিজ্ঞানী। এছাড়াও তিনি একজন মহাবিশ্বতত্ত্ববিদ, যুক্তিবিদ এবং সুরকার ছিলেন। পদার্থবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রভৃতিতে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। পদার্থবিজ্ঞানে তিনিই শূন্যতা’-র অবস্থান প্রমাণ করেছিলেন। আল ফারাবি দর্শন ছাড়াও যুক্তিবিদ্যা ও সঙ্গীতে মতো জ্ঞানের বিস্তর শাখায় অবদান রাখেন। আল মদিনা আল ফাজিলা’ বা ‘আদর্শনগর’ তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ। “কিতাব আল মুসিকি আল কবির’ বা ‘সঙ্গীতের মহান গ্রন্থ তাঁর আর-একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। প্লেটো ও এরিস্টটলের দর্শনের উপর তিনি বিস্তর আলোচনা করেছেন। প্লেটোর রিপাবলিকের মতো তিনিও একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন তাঁর ‘আল মদিনা আল ফাজিলা’ বা ‘আদর্শনগর’ গ্রন্থে। তিনি স্রষ্টার সর্বাধিপত্য স্বীকারের পাশাপাশি সৃষ্টিকেও শাশ্বত বলে মনে করতেন। তিনি কোনো চরম মত পোষণ করতেন না এবং চিন্তার ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী মতকে প্রায়শই একসঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেছেন। আল মদিনা আল ফাজিলা’ বা ‘আদর্শনগর’ তাঁর রাষ্ট্রনায়কের একনায়ক বৈশিষ্ট্য প্রকট। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের প্রধান রাষ্ট্রের সর্বৈব ক্ষমতা পোষণ করবেন এবং অন্য সবাই তাঁর বাধ্য থাকবেন। নাগরিকদের ক্ষমতায়ও থাকবে শ্রেণি বিভাজন, যেখানে কোনো শ্রেণি তাঁর উপরের শ্রেণির আদেশ মান্য করবে ও নিচের শ্রেণির উপর আদেশ জারি করবে। তৎকালীন বহুধা বিভক্ত সামন্ততান্ত্রিক সমাজকে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর আওতায় আনতে এই রাষ্ট্রদর্শন প্রভাব বিস্তার করে এবং সময়ের বিচারে এরূপ ভাবধারা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আদর্শ রাষ্ট্রকে তিনি অসম্ভব উল্লেখ করলেও এটি অর্জনের জন্য মানুষের চিরন্তন প্রচেষ্টাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেন।

আলি আল-হাসান ইবনে আলি-হাসান ইবন আল হাইসাম পশ্চিমা বিশ্বে তিনি ‘আল-হাইজেন’ নামে সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন একাধারে আরব বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক। ইবন আল হাইসামের উল্লেখযোগ্য অবদান অপটিক্স বা আলোকবিদ্যার মূলনীতি, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, আবহাওয়াবিজ্ঞান, চাক্ষুষ বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক নীতি। তিনি সর্বপ্রথম ক্যামেরার মূলনীতি আবিষ্কার করেন, যার উপর ভর করে আজকের আধুনিক ক্যামেরা, স্যাটেলাইট ইত্যাদি। তিনি কায়রোয় ফাতেমীয় খলিফার দরবারে জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন। গ্রন্থ রচনা, চুক্তি সম্পাদনা এবং দরবারের অভিজাত সদস্যদের গৃহশিক্ষক হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করেন। নাসির আল দিন তুসি অথবা নাসির আল দিন আল তুসি পারস্যের একজন দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী। তিনি মুসলিম বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম একজন। উলুগ বেগ মির্জা মোহাম্মদ তারেঘ বিন শাহরুখ ছিলেন তৈমুরী বংশীয় সুলতান এবং একজন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ। উলুগ বেগ যার অর্থ করা যেতে পারে মহান শাসক। জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত গণিতের নানা বিভাগে যেমন ত্রিকোণমিতি (trigonometry) বা গোলকীয় জ্যামিতি (spherical geometry) তাঁর অবদানের জন্য তিনি বিখ্যাত। তিনি মহান মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্টাতা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবরের প্রেপিতামহ। উলুগ বেগ ইসলামীয় সভ্যতার প্রাচীনতম মানমন্দিরের একটি নির্মাণ করান। ১৪৪৯ সালে উলুগ বেগের হত্যার পরে মানমন্দিরটি ধ্বংস করে ফেলা হয়। এর আগে নাসির আল-দিন তুসি (১২০১-১২৭৪) ইরানের মারাঘে শহরে ১২৫৮ সালে হুলাগু খানের (১২১৭-১২৬৫) অর্থানুকূল্যে একটি মানমন্দির নির্মাণ করান। উলুগ বেগের। মানমন্দিরটির পরিকল্পনায় এবং যন্ত্রপাতির সন্নিবেশে তুসির মানমন্দিরটির প্রভাব পড়ে।

কম্পিউটারের যে-কোনো প্ল্যাটফমে বাংলা হরফে টাইপ করার সুবিধা এনে দিয়ে বাংলাদেশের মেহদি হাসান খান এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন। আজ গোটা বিশ্বের বাঙালি অভ্র ফন্টকে ব্যবহার নিজের মাতৃভাষায় লেখার আনন্দ উপভোগ করছেন, তাও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। অভ্র আবিষ্কারের আগে যেসব বাংলা ফন্ট দিয়ে বাংলা লেখা হত, তা ছিল বেশ চড়া মূল্যের। সবাই ব্যবহার করতে পারত না বলে বাংলিশে (ami tomake valobasi) লিখত, এ ভাষায় যাঁরা লিখত তাঁদের মুরাদ টাকলা’ বলা হত। মেহদি হাসান খান একজন বাংলাদেশি ডাক্তার ও প্রোগ্রামার। তিনি ২০০৩ সালে ইউনিকোড ও এএনএসআই সমর্থিত বাংলা লেখার বিনামূল্যের ও মুক্ত সফটওয়্যার অভ্র কি-বোর্ড তৈরি করেন। মেহদি তাঁর প্রথম বাংলা ফন্ট ইউনিবিজয় ডট নেট ফ্রেমওয়ার্ক ও ভিজুয়াল বেসিক উপর লেখেন। পরে তিনি অভ্র কি-বোর্ড ব্যবহারকারীদের সুবিধার্তে ডট নেট ফ্রেমওয়ার্ক ছাড়াই লেখেন। অভ্র সম্পূর্ণভাবে ইউনিকোড উপযোগী, যা ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম দ্বারা ২০০৩ সালে ১৪ জুন স্বীকৃত হয়। তিনি তাঁর সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ওমিক্রনল্যাব প্রতিষ্ঠা করেন। অভ্র কি-বোর্ড প্রথম উন্মুক্ত করা হয় ২০০৩ সালে ২৬ মার্চ। ওমিক্রনল্যাব থেকে অভ্র উন্মুক্ত করা হয় ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ১৫ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে অভ্র ব্যবহার করা হয়। আমি নিজেও একেবারে প্রথম থেকেই অভ্র ফন্ট ব্যবহার করেই ওয়ার্ডে লিখছি।

পঞ্চম শতক থেকে পঞ্চদশ শতক ছিল ইউরোপের মধ্যযুগ। এই সময়টাকেই বলা হয় ‘অন্ধকারময় যুগ। ইউরোপে যখন অন্ধকার যুগ, তখন অন্যত্র বিভিন্ন অংশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের আবিষ্কার হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই সভ্যতার বিকাশ ঘটছে সর্বত্র। বিশেষ করে আরব অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। ভারতেও গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা হয়েছে। আরবে যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা চলছে, ইউরোপে তখন জ্ঞানচর্চা বলতে বাইবেল বা ধর্মতত্ত্ব। এই সময়ের ইউরোপে পাদ্রি ছাড়া কারোর অক্ষরজ্ঞান ছিল না। ইসলামীয় সাম্রাজ্য থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান আরোহণ করে তার উপরই গড়ে উঠেছে রেনেসাঁস। নির্মিত হয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানের বনিয়াদ। ইসলামীয় সাম্রাজ্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা থেকে লাভবান হয়েছে ইউরোপ। ইসলামের আগমনের পর মধ্য এশিয়া থেকে উত্তর আফ্রিকা এবং ইউরোপের স্পেনে রীতিমতো বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ চলেছিল।

ইতিহাস বলছে মধ্যযুগে ইউরোপ থেকে গ্রিসের জ্ঞান-বিজ্ঞান একবারে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তখন আরবরা বইগুলো অনুবাদ করে রেখেছিল। পঞ্চদশ শতকে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পর সেখান থেকে পণ্ডিতরা বস্তা বস্তা বই ইউরোপে পাচার করে দেয়। ভাবটা এমন যেন এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্পদ ইউরোপেরই, যা আরবদের কাছে গচ্ছিত ছিল। আরবরা শুধু গ্রিসের পণ্ডিতদের বই-ই নয়, অন্যান্য দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বইও অনুবাদ করেছেন। এর ফলে তাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছেন। শুধু অনুবাদ নয়, বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নততম জ্ঞান-বিজ্ঞানকে তাঁরা আত্মস্থ করেছেন। আর এই বিদ্যার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তাঁরা বিজ্ঞানকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। গড়ে তুলেছেন উন্নততর বিজ্ঞান, গণিত এবং বিজ্ঞানের নানা নতুন ধারার উদ্ভাবক আরবরাই। অষ্টম শতক থেকে চতুর্দশ শতকের শেষপর্যন্ত আরবি বিজ্ঞান ছিল সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত বিজ্ঞান। পাশ্চাত্য ও চিনের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ঐতিহাসিক জর্জ সার্টন বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে একটি আকর গ্রন্থ লেখেন। কয়েক খণ্ডে লিখিত এই বইটিতে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বিজ্ঞানের ইতিহাস লিখেছেন। প্রতি ৫০ বছর নিয়ে এই বইয়ের একটি করে অধ্যায়, আর এই অধ্যায়গুলির নাম দেওয়া হয়েছে সে সময়ের সবচেয়ে বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিকদের নামে। এই বইয়ে ৭৫০-৮০০ অর্ধশতকের শিরোনাম জাবির ইবন হায়থাম, ৮০০-৮৫০ অর্ধশতকের গণিতজ্ঞ আল খাওয়ারিজমির নামে, ৮৫০-৯০০ এই অর্ধশতকে আল রাজির নামে, ৯০০-৯৫০ অর্ধশতকে প্রধান বিজ্ঞানী আল মাসুদির নামে, ৯৫০-১০০০ অর্ধশতকে আবু ওয়াফার নামে, ১০০০-১০৫০ অর্ধশতক বিজ্ঞানী আল বিরুনির নামে, একাদশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধটির বিজ্ঞানী ওমর খৈয়ামের নামে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, ৭৫০ থেকে ১১০০ এই ৩৫০ বছর আলো করে আছে শুধুমাত্র আরবি-ইসলামীয় সভ্যতার বিজ্ঞানীরা। প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন, আরবি ভাষার ব্যবহার শুধু মুসলিমরাই করতেন না, আরবের খ্রিস্টান, ইহুদি, ইরানি ও অন্যরাও এই ভাষা ব্যবহার করতেন জ্ঞানচর্চায়। মুসলিমদের বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে যাঁরা আরও বিস্তারিত যাঁরা জানতে চান, তাঁরা অবশ্যই সুমিতা দাসের অন্য এক রেনেসাঁস’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন।

এবার ভারতের মুসলিমদের অবদানের অন্য প্রসঙ্গে আসি। ইসলামি সুফিতত্ত্ব আর হিন্দুভক্তির স্রোত সমন্বিত হয় এক শক্তিশালী প্রবাহে, যা প্রাচীন ঊষর অঞ্চলকে উর্বর করে তোলে। বদলে দেয় দেশের আদল। ইসলামের আচারনিষ্ঠ কঠোরতা ও ভীতিপ্রদ অজ্ঞেয়তাকে সমৃদ্ধ পরিপূর্ণতায় রূপ-প্রাচুর্যে তাঁদের অন্তর্লীন একত্বের অন্তদৃষ্টিসঞ্জাত বোধে হিন্দুধর্মের সঙ্গে সমন্বিত করার প্রয়াস আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হলেও, ভারতের এই প্রাণশক্তি বলে সে সাফল্য অর্জিত হয়। আর গড়ে তোলে সেইসব স্থাপত্যসৌধ ও চিত্রাঙ্কন, সংগীত ও কাব্য আর প্রেমপ্রাণিত ধর্ম, যেগুলি হল মধ্যযুগের ভারত ইতিহাসের উত্তরাধিকার।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের পরিবেশনা হয় মূলত দু-ভাবে, কণ্ঠে ও বাদ্যযন্ত্রে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের এককভাবে পরিবেশনকারী যন্ত্রসমূহ হচ্ছে সরোদ, সেতার, সুরবাহার, বীণা, সারেঙ্গী, বাঁশী, বেহালা, সন্তুর, তবলা, মৃদঙ্গ। এছাড়াও সহায়ক যন্ত্রসমূহ হচ্ছে তানপুরা, এস্রাজ, পাখখায়াজ ইত্যাদি। হিন্দুস্থানি উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রচলন মূলত উত্তর ভারতে এবং কর্ণাটকী উচ্চাঙ্গ সংগীত মূলত দক্ষিণ ভারতে দেখা যায়।

 ভারতের সংগীত জগতে মুসলিমদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। হিন্দুদের বিয়েবাড়ি অথবা অন্যান্য অনুষ্ঠানে অথবা পুজোৎসবে যাঁর সানাই না-বাজলে সব আলুনি হয়ে যাবে, তাঁর নাম ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান। ভারতের উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সংগীত জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম বিসমিল্লাহ খান। তিনি ছিলেন বারাণসীর বিশ্বনাথ মন্দিরের সানাইবাদক। বিসমিল্লাহ খান ১৯৩৭ সালে কলকাতায় অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে সানাই বাজিয়ে ভারতীয় সংগীতের মূলমঞ্চে সানাইকে নিয়ে আসেন। ১৯৫০ সালে ২৬ জানুয়ারি দিল্লির লালকেল্লায় অনুষ্ঠিত ভারতে প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে বিসমিল্লাহ খান তাঁর অন্তরের মাধুরী ঢেলে রাগ কাফি বাজিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন ভারতবাসীকে। বিসমিল্লাহ খান ২০০১ সালে ভারতের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘ভারতরত্ন’ লাভ করেন। ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান ভারতের তানসেন অ্যাওয়ার্ড, পদ্মভূষণ খেতাব ও সংগীত নাটক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন। হিন্দু, মুসলমানসহ সব সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান শুরু হয় তাঁর সানাই দিয়ে। বাদ্যযন্ত্রটিকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য উচ্চতায়। তাঁর সানাই ভারতের ঐক্যের প্রতীক। আমজাদ আলি খান ভারতীয় মার্গসংগীতের আকাশে এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। সরোদ তথা শাস্ত্রীয় সংগীতে তাঁর অনবদ্য সৃজন আবিশ্বের সংগীতপ্রেমীকে অনুভূতির গভীর আলোয় নিয়ে যায় লহমায়। ১৯৬০-এর দশক থেকে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে সংগীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন। ২০০১ সালে তাঁকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণে ভূষিত করা হয়। ১৯৮৯ সালে আমজাদ আলি খান সংগীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ভারত সরকার তাঁকে ১৯৭৫ সালে পদ্মশ্রী, ১৯৯১ সালে পদ্মভূষণ ও ২০০১ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। ২০০৪ সালে তিনি লাভ করেন ফুকুওকা এশীয় সংস্কৃতি পুরস্কার। ১৯৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ম্যাসাচুসেটস ২০ এপ্রিল তারিখটিকে আমজাদ আলি খান দিবস ঘোষণা করেছিল। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হস্টন, টেক্সাস, ন্যাশভিলে, টেনেসি তাঁকে সাম্মানিক নাগরিকত্ব প্রদান করে। ২০০৭ সালে টুলসা, ওকলাহামাও তাঁকে সাম্মানিক নাগরিকত্ব দেয়।

কোনো কোনো গবেষক মনে করেন— মুসলিমরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতে সভ্যতা, শিক্ষা, শিল্প তথা সামগ্রিক উন্নতি সাধন করেন। বহু পৌত্তলিক রাজা মুসলিমদের উদারতা ও শিক্ষা দেখে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। মুসলিমদের আবির্ভাবের কারণে ভারতবর্ষের বহু অত্যাচারী ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকের জুলুম-নির্যাতন থেকে বেঁচে যায় পৌত্তলিকরা। একথার সমর্থন মেলে স্বামী বিবেকানন্দের ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থের ১১৫ পৃষ্ঠায়— “দেখা যাবে ইসলাম যেথায় গিয়েছে, সেথায়ই আদিম নিবাসীদের রক্ষা করেছে। সেসব জাত সেথায় বর্তমান। তাদের ভাষা, জাতীয়ত্ব আজও বর্তমান।” ডক্টর তেজ বাহাদুর সাও বলেছেন– “হিন্দুদিগকে রক্ষা করিবার একমাত্র উপায় ইসলাম ধর্মের কতিপয় মূলনীতি— আল্লাহর একত্ববাদ ও মানবের বিশ্বজনীনত্ব।” প্রখ্যাত লেখক মোহম্মদ সোহেল ইব্রাহিম মনে করেন –“১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ১৯০ বছর ধরে ব্রিটিশরা যে শাসন করেছে এর পিছনে উদ্দেশ্যই ছিল ভারতবর্ষ থেকে লুটপাট করে তাঁদের দেশ উন্নত করা। আর করেছেও তাই। কিন্তু শতশত বছর মুসলিমরা ভারত শাসন করেছেন কেবল ইসলাম দর্শন কায়েম করার জন্য। মুসলিমদের কারণেই ভারতে আজ হিন্দুরা দেশত্ববোধ, জাতিত্ববোধ শিখেছে। আর এখন কিনা এই ভারতকে তাঁরা হিন্দুদের তীর্থস্থান বলে দাবি করে। পৃথিবীতে একটাই হিন্দু রাষ্ট্র আছে, আর তা হচ্ছে নেপাল। এছাড়া হিন্দু দেশ বা জাতি বলতে পৃথিবীর কোথাও কোনো অস্তিত্ব নেই।” এই তো বছর কয়েক বছর আগে কোনো এক ঘটনা-প্রসঙ্গে দিল্লির ইমাম বলেছিলেন– “ভারত ছেড়ে যাব কেন? এই ভারতকে তো আমরাই সাজিয়েছি।”

সত্যিই কি ভারতবর্ষ মুসলিমরা সাজিয়ে দিয়েছে? “খুন-লুঠপাট’ করা জাতির পক্ষে এটা কীভাবে সম্ভব হল? ভারতে যখন হর্ষবর্ধন রাজত্ব করছিলেন, তখন আরবে হজরত উমর খলিফার পদে অধিষ্ঠিত। স্মরণে রাখা প্রয়োজন, হর্ষবর্ধনই (মৃত্যু ৬৪৮ সাল) ভারতের শেষ বৌদ্ধসম্রাট। তাঁর মৃত্যুর পর ভারত অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মুসলিম জাতি ৭০০ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে ভারতে প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মুসলিম জাতি ছাড়া ভারতে আর কোনো সম্প্রদায় এই উন্নতির উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেনি। আচার্য প্রফুল্ল রায় বলেছেন, “প্রশান্ত মহাসাগর হতে আরম্ভ করে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত সমস্ত মানবজাতিকে উদারনীতির একসূত্রে আবদ্ধ করে ইসলাম পার্থিব উন্নতির চরম উৎকর্ষ লাভ করেছে।”

হজরত উমরের খিলাফতকালেই (৬৩৪-৬৪৪ সাল) মুসলিম রাজ্য বিস্তৃতির সুবর্ণযুগ। ভারতীয় উপকূলভাগ কয়েকবার মুসলিম কর্তৃক আক্রান্ত হয় বলে আল-বলাজুরির ‘নগরী বিজয়’ (ফতুহু-ল-বুলদান) নামক ইতিহাসে লিখিত আছে। এই সমস্ত আক্রমণ ছিল সাময়িক, অর্থাৎ আরবদের কোনো স্থায়ী ফললাভ হয়নি। ৬৬৪ সালে আরব সেনাপতি আল-মোহল্লব কর্তৃক স্থলপথে মুলতান বিজয়ও একটি অনুরূপ ঘটনা।

অতঃপর আগেই বলেছি ৭১১ সালে মোহম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধবিজয় ভারতের ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। নানা কারণে তাঁর সিন্ধু অধিকার একটি স্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা। সিন্ধুদেশে মুসলিম রাজত্ব বেশিদিন টিকল না ঠিকই, কিন্তু এর পর থেকে ভারতের সঙ্গে আরব জাতির ব্যাবসাবাণিজ্যের সম্বন্ধ একরকমভাবে পাকাঁপোক্ত হল। খ্রিস্টীয় অষ্টম, নবম, দশম ও একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে এই সম্পর্ক অবিচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকল। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে— ভারতের সঙ্গে ইউরোপ ও আফ্রিকার বাণিজ্য এই সময়ে আরবি মুসলমানদের মধ্যস্থতাতেই সম্ভব হয়েছিল। কেরল, সুরাট, কালিকট প্রভৃতি সমুদ্রতীরবর্তী বন্দরমালা, মালদ্বীপ, লক্ষদ্বীপ ও সরদ্বীপ প্রকৃতি ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং লাহোর, মুলতান, কাবুল প্রভৃতি ভারতীয় ও ভারত প্রভাবিত নগরগুলি এই সময়ে গড়ে উঠে এবং বহির্জগতের নিকট পরিচিত হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, শুধুমাত্র ব্যবসাবাণিজ্যের জন্যই এই সমস্ত স্থানের খ্যাতি জগন্ময় ছড়িয়ে পড়ে।

ভারতীয় সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে, তা একটু দেখা যাক— (১) ভারতীয় সংস্কৃতি পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্য স্থানগুলির (যেমন— মিশর, ব্যাবিলন, উর, কালদিয়া, ফিনিসিয়া প্রভৃতি) সংস্কৃতি হইতে খুব অল্প প্রাচীন না-হলেও, স্মরণাতীতকাল থেকে ভারতবর্ষ নিকটবর্তী ব্ৰহ্মদেশ (বর্তমানে মায়ানমার), মালয়, শ্যাম (বর্তমানে থাইল্যান্ড), শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি কতিপয় এশীয় অঞ্চল ব্যতীত সভ্য জগতের জন্য কোনো অংশের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত ছিল না। কালক্রমে ভারতের সঙ্গে এই সমস্ত অঞ্চলের যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভারতের সঙ্গে আরবি মুসলিমদের সংশ্রবকালে ভারত একরূপ একক ও নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছিল। সে যুগে ভারতবাসী মনে করতেন, তাঁদের এই নিঃসঙ্গ জীবনই পরিপূর্ণ জীবন। এই আত্মতৃপ্ত ও আত্মসমাহিত জীবনের ফাঁকে যে অপরিপূর্ণতা বিরাজ করছিল, তা তখনও ভারতবাসীর কাছে প্রকট হয়ে ধরা পড়েনি। ভারতবর্ষে আরবি মুসলিমদের আগমনে ভারতীয় সংস্কৃতির দুর্বলতা ভারতবাসীর কাছে প্রকট হয়ে উঠে। মুসলিম-সংস্কৃতিকে সামনে উপস্থিত দেখে তার সঙ্গে তুলনামূলক সমালোচনায় ভারতীয় মনমানস এই সময় থেকেই আপন সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট ও স্বাভাবিকভাবেই সজাগ হয়ে উঠতে থাকে (২) আরবি মুসলিমদের আগমনেই ভারতের সঙ্গে বহির্জগতের প্রকৃত যোগাযোগ সংস্থাপিত হয় এবং ভারতের নিঃসঙ্গতা ভেঙে পড়তে থাকে। প্রাচীনকাল থেকে অমূল্য ও অফুরন্ত প্রাকৃতিক ও শ্রমজাত সম্পদের অধিকারী হলেও আপন নিঃসঙ্গতার জন্য এই সমস্ত সম্পদের বিষয় ভারতের অধিবাসীরা বিশেষভাবে অবহিত ছিল না। আরব বণিকেরাই ভারতের এই সম্পদ একদিকে স্বয়ং ভারতের কাছে এবং অন্যদিকে ইউরোপ ও আফ্রিকার কাছে পরিচিত করিয়ে দেন। এই সমস্ত বাণিজ্য-সম্পদের জন্যই ভারতের খ্যাতি প্রাচীন পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে। এইভাবে পৃথিবীর কাছে ভারতের পরিচয় এবং পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে জগতে তার প্রতিষ্ঠা ভারতীয় সংস্কৃতিতে আরবি মুসলিমদেরই এক অপূর্ব অবদান। (৩) বহির্বাণিজ্য সম্বন্ধে প্রাচীন ভারতের কোনো ধারণাই ছিল না। অন্তর্বাণিজ্য সম্বন্ধে ভারত আগে থেকেই অবগত ছিল। ভারতীয় প্রদেশগুলিতে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য চলত বটে, কিন্তু এর দ্বারা ভারতের আর্থিক সম্পদ বৃদ্ধির আয়োজন করা হয়নি। বাণিজ্য সম্বন্ধে প্রাচীন ভারতীয় ধারণা ব্যক্তিগত ধন বৃদ্ধির ধারণা— জাতি ও রাষ্ট্রগত ধনাগমের ধারণা নয়। “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীস্তদর্পং কৃষিকর্মণি।/তর্দধং রাজসোয়াং ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ। অর্থাৎ বাণিজ্যে গৃহস্থের সৌভাগ্য অর্থাৎ বাণিজ্য দ্বারা পর্যাপ্ত অর্থাগম হয়, কৃষিকর্মের দ্বারা তার অর্ধেক পাওয়া যায়, রাজসেবা বা চাকরি দ্বারা তারও অর্ধেক পাওয়া যায়, কিন্তু ভিক্ষায় কিছুমাত্র লাভ হয় না। এই শ্লোকটিতে চাকরি (রাজসেবা) এবং ভিক্ষা— এই দুইটিই ব্যক্তিগত, কেন-না সমষ্টিগতভাবেই ভিক্ষা ও চাকরি করা চলে না। আপাতদৃষ্টিতে বাণিজ্য ও কৃষিকার্য দ্বারা সমষ্টিগত অর্থ প্রকাশ পায় বলে মনে হলেও অর্থের দিক থেকে চাকরি ও ভিক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় এই দুটিও যে ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল, তা বেশ ভালভাবেই বোঝা যাচ্ছে। আরবি মুসলিমদের আগমনে ভারত বহির্বাণিজ্য সম্বন্ধে সর্বপ্রথম জ্ঞান লাভ করে— এই জ্ঞান ধীরে ধীরে কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করে অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারত সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে। কালক্রমে এই উন্নতি ভারতের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় উন্নতিতে পরিণত হয়। ভারত অর্থনৈতিক দিক থেকে যেমন লাভবান হল, অন্য একদিক থেকে তেমন ক্ষতিগ্রস্তও হল। কারণ এই সময় থেকেই ভারতের প্রতি বহির্জগতের লোলুপ দৃষ্টি পড়ল।(৪) ভারতে ব্রাহ্মণ্যধর্ম সহ অন্যান্য ধর্মসমূহের পাশাপাশি ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা হতে থাকল। যাঁরা বলেন বা মনে করেন যে, ভারতে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম ধর্মও এদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মন্দির ভেঙে মসজিদ উঠেছে, তাঁদের গভীর। ঐতিহাসিক জ্ঞানের প্রশংসার সহিত বিভ্রান্ত দৃষ্টির যশোগাথাও ঘোষণা করতে হয়। ভারতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ইতিহাস শান্তি প্রবর্তনেরই ইতিহাস। এই ইতিহাস নররক্তে কলঙ্কিত নয়। প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের অন্তর্নিহিত গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস, নিশ্চিত ভরসা, আত্মত্যাগ ও প্রবল প্রেরণাই এই যুগে ভারতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রথম ও প্রধান কারণ। পরবর্তী যুগের মুসলিম রাজ্য পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামের ভিত্তিকে সম্প্রসারিত ও সুদৃঢ় করে দিয়েছে মাত্র (মনীষা মঞ্জুষা— ড. মোহম্মদ এনামুল হক)।

৬৪৮ সালে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর ভারতে কোনো হিন্দু বা বৌদ্ধ শাসক একচ্ছত্র রাজত্ব করতে পারেননি। এই সময়ে ভারত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডরাজ্যে বিভক্ত হয়ে গেল। বশ্যতায় আর পরাজয়ে আত্মঘাতী হলেন ভারতের অজস্র দেশীয় রাজারা! তখনকার ভারতীয় সংস্কৃতির মূল উৎস এক হলেও ভারতের রাষ্ট্রীয় বিভিন্নতা সাংস্কৃতিক বিভিন্নতায় রূপান্তরিত হতে থাকে। এই কারণেই আজও মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ এবং বাঙালি ব্রাহ্মণে, কিংবা মাদ্রাজি হিন্দু এবং মৈথিল হিন্দুতে বিস্তর প্রভেদ। এই কারণেই মনুসংহিতা’ ভারতের সর্বত্র হিন্দুদের মধ্যে একমাত্র ধর্মীয় বিধানরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সমর্থ হয়নি। এই কারণে যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতারও অনুরূপ অবস্থা। এই কারণেই ভারতের হিন্দুদের মধ্যে দেশে দেশে নতুন শাস্ত্র, নতুন বিধান এবং নতুন আচার-বিচার প্রচলিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, প্রাচীনকালে অসংখ্য স্বাধীন দেশ নিয়ে গঠিত ছিল ভারত উপমহাদেশ। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে যখন ভারত ব্রিটেনের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে তখনও ভারতের দেশীয় রাজ্যের সংখ্যা ছিল ৫৬৫।

মুসলিমরা এদেশে প্রবেশের আগে পর্যন্ত একজন ভারতবাসীও কল্পনা করতে পারত না যে, কেন্দ্রীয়ভাবে এক রাজার শাসনে শাসিত হবে সমগ্র উপমহাদেশ। তেমনই ভাবতে পারত না, এক রাজার শাসনে শাসিত হয়ে ভারত কখনো এক রাজ্যের স্বপ্ন দেখবে। ভারতীয় হিন্দুরা কখনো উপলব্ধি করেছেন যে, তাঁরা এই দেশের অধিবাসী এবং একই ধর্মের অনুসারী? মুসলিম আমলে ভারতে রাজনৈতিক একত্ব ও একচ্ছত্রত্ব, ভারতীয়। সাংস্কৃতিক একত্বকে এবং ভারতীয় রাষ্ট্রের একচ্ছত্ৰত্বকে সুদৃঢ় করে তুলেছিল। ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে ভারতীয় জাতীয়তাবোধ বলতে যা বোঝায়, তাকে সুষুপ্ত অবস্থা থেকে জাগ্রত করেছে। এই সময়ে রাষ্ট্রীয় জীবনের সীমাবদ্ধতার সঙ্গে মানসিক সংকীর্ণতাও ভারতীয় অধিবাসীদের মনে ক্রমশ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। তাঁদের এই মানসিক সংকীর্ণতাও কালক্রমে এক-একটি সংস্কারে এবং পরে সেই সংস্কারগুলি। একত্রিত হয়ে ধর্মের ধারণায় পরিণত হতে থাকে। জাতপাতের নিম্নতম স্তরের মানুষগুলির দুঃখ-দুর্দশায় তৎকালীন ভারতীয় সমাজের দেহ কণ্টকিত, জর্জরিত ও বিষাক্ত হয়ে উঠতে থাকল। উচ্চবর্ণ কর্তৃক অস্পৃশ্যের নিপীড়নের আর্তনাদে ভারতের আকাশ-বাতাস মুখর হয়ে উঠেছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদ-প্রপীড়িত ভারত মানবতার এই অপমান রঙ্গমঞ্চের অভিনয়ের মতো সোল্লাসে উপভোগ করছিল। অবশ্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের এই ধারাবাহিক অত্যাচারে রাজ-রাজড়াদের কোনো ভূমিকা ছিল না। এই সময় মুসলিমরা ইসলামের সাম্যের বাণী নিয়ে মানবতার জয়গান গেয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তাঁদের এই বাণীকে দরবেশ ও মুসলিম সাধকেরা আপন জীবনে রূপদান এবং শাসক সম্প্রদায় রাষ্ট্রীয় জীবনে গ্রহণ করে প্রবল থেকে প্রবলতর করে তুললেন। ভারতের অধিবাসীরা দরবেশদের কাছ থেকে প্রথম শুনল— মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। শিক্ষা দীক্ষা, ব্যাবসাবাণিজ্য, ক্ষমতা, রাজপদ ও জীবন-জীবিকা মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করে উত্তম কিংবা অধম করে তুলতে পারে না। সকল মানুষ এক ঈশ্বরের সৃষ্টি, এক ঈশ্বর স্বয়ম্ভ ইচ্ছাময় ও অনন্ত-শক্তির আধার, তাঁরই ইচ্ছা ও ইঙ্গিতেই সমস্ত সৃষ্টি হয়েছে, হচ্ছে এবং হবেও।

 প্রাচীন ভারতের অধিবাসীরা সনাতন চিন্তাধারায় মুসলিমরা বিপ্লব আনতে সমর্থ হয়। ভারতে তেত্রিশ কোটি দেব-দেবতার অনুধ্যানে, ইসলামের ‘তৌহিদ’ নিদারুণ আঘাত হানল। ভারতের উচ্চবর্ণ-প্রপীড়িত অন্ত্যজ জাতিগুলি মুসলিমদেরকে মুক্তিদাতারূপে বরণ করতে লাগল। ভারতের অধিবাসীদের দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে লাগল। ভারতে ইসলাম ধর্ম উত্তরোত্তর সম্প্রসারিত হতে শুরু করল এবং ভারতীয় সনাতন ধর্মের পাশাপাশি অর্বাচীন ইসলাম ধর্ম সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। মুসলিম আমলে ভারতে ভক্তিবাদ প্রবল হয়। গীতার ভক্তিযোগের প্রতি ভারতীয় সনাতনীদের বিশেষ প্রবণতাও পরিলক্ষিত হয়। খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে দাক্ষিণাত্যে রামানুজ কর্তৃক বৈষ্ণব মত প্রচার এবং চতুর্দশ শতাব্দীর রামানন্দ কর্তৃক ‘রামাৎ বৈষ্ণব’-বাদ ঘোষণা, ভারতে ভক্তিবাদের জয় প্রকাশ করেছে। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াবার জন্য বৈষ্ণববাদ প্রচারের আবশ্যকতা অস্বীকার করার উপায় নেই। অতএব ভারতের পরবর্তী ভক্তিবাদ মুসলিম সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ বলে অস্বীকৃত হলেও পরোক্ষ অবদান বলে স্বীকার না-করে উপায় নেই। ভারতে মুসলিম সংস্কৃতি ও ইসলাম ধর্ম প্রচারে সুফিদের দান অপরিসীম। ভারতের সাধু-সন্ন্যাসীরা পতঞ্জল মুনির যোগসাধনা। নিয়ে সুফিসাধকের মোকাবিলা করেছিলেন। ফলে মুসলিম সুফিদের হিন্দুশিষ্য এবং হিন্দু-সন্ন্যাসীর মুসলিম চেলা দেখতে পাওয়া যায়। সাধনার ক্ষেত্রে এইরূপ ভাবের বিনিময়ে ভারতীয় সংস্কৃতি সেই বিশিষ্ট রূপ গ্রহণ করে থাকে। মধ্যযুগীয় ভারতেই কবীর (১৩৯৮-১৪৪৮), নানক (১৪৬৯-১৫৩৯), দাদু (১৫৪৪-১৬০৩) ও চৈতন্যদেবের (১৪৮৪-১৫৩৩) মতো ধর্ম ও সমাজসংস্কারকের জন্ম সম্ভবপর হয়েছিল। এঁদের আবির্ভাবে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব, এমন কি এদের জীবনেও ঐসলামিক প্রভাব দেদীপ্যমান। এঁদের সকলেই একেশ্বরবাদিতায় প্রবুদ্ধ এবং মানুষে-মানুষে, ধর্মে-ধর্মে ভিন্নতর বাঁধ ভেঙে দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।

ভারতের রাষ্ট্রীয় একাত্ববোধ মুসলিমদের আমলেই জেগে উঠেছিল। এই রাষ্ট্রীয় একতাবোধ ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও ধীরে ধীরে রূপ গ্রহণ করছিল। এ প্রসঙ্গে এখানে উর্দু ভাষার উদ্ভবের কথা উল্লেখ করা যায়। একদিকে রাষ্ট্রীয় একাত্ববোধ এবং অন্যদিকে শাসক ও শাসিতের মধ্যে ভাব বিনিময়ের আবশ্যকতার মৌলিক উপলব্ধি থেকে এই মিষ্টি ভাষার উদ্ভব ঘটে। মনে রাখতে হবে, এই নতুন ভাষার সৃষ্টি এই ভারতেই ঘটেছে, আরবে নয়। এটি একটি ভারতীয় ভাষা।

উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ভাষা পরস্পর এতই ভিন্নতা যে, এক ভাষাভাষীর মানুষকে অন্য ভাষাভাষীর মানুষকে বোঝার উপায় নেই। এই বিভিন্নতা মধ্য যুগীয় বিভিন্নতা নয়। ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার বহু আগেই উত্তর ভারতীয় প্রদেশিক ভাষা পরস্পর বিভিন্ন হয়ে রূপ পরিবর্তন করেছিল। রাষ্ট্রীয় বিভিন্নতাই সবার আগে মনে পড়ে, কেননা প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা যখন প্রাকৃতে বিবর্তিত হল তখন সৌরসেনি, মাগধি, উদীচ্য, প্রাচ্য প্রাকৃতরূপেই আখ্যা লাভ করল। মুসলিম রাজত্বের শুরুতেই উত্তর ভারতীয় এক প্রদেশ অন্য প্রদেশকে বুঝত না বা বুঝতে পারত না। মুসলিম আমলে প্রায় সমগ্র ভারত ক্রমে ক্রমে এক শাসনাধীন হল। ভারতের নানা প্রদেশের লোক মুসলিম রাজধানী দিল্লি ও আগ্রায় সমবেত হতে বাধ্য হল। এছাড়া এই দুই স্থানে বোখারা, সমরকন্দ, তুর্কিস্তান, কুর্দিস্তান, ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, মিশর, বাগদাদ, বসরা প্রভৃতি স্থানের বহু মানুষ ভারতের কেন্দ্রস্থলে সমবেত হয়েছিল। মুসলিম শাসনকালের গোড়ার দিকে কেবল বিদেশীয় মুসলিম মধ্যে ভারতে তুর্কি ভাষা ও সংস্কৃতি প্রবল ছিল বটে, কিন্তু তা বেশিদিন কায়েম করতে পারেনি। বস্তুত ভারতে ফারসি ভাষাই রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত হয়েছিল সেসময় এবং ইরানি সংস্কৃতিই মুসলিমদের মধ্যে। জোরকদমে চলেছে।

মোদ্দা কথা, মুসলিম আমলে গোড়ার দিকে ভারতীয় কিংবা অ-ভারতীয় কারও মধ্যে পরস্পর ভাবের আদানপ্রদানের জন্য কোনো সাধারণ ভাষা ছিল না। এই অভাবটি মুসলিমদের শিবির-জীবনেই সর্বাধিক অনুভূত হয়। ভারতে খ্রিস্টীয় দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুসলিম জীবন শিবির-জীবনরূপেই অধিক সময় কেটেছে। এই শিবির-জীবনে ভারতীয়দের সঙ্গে মুসলিমদের যোগাযোগ রক্ষা করা একান্তই আবশ্যক হয়ে পড়ে। ভারতীয় ও অ-ভারতীয় উভয় শ্রেণির লোক এই ব্রজভাষাকে কেন্দ্র করে একটি ‘খিচুড়ি’ ভাষার সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়। এই ভাষার পদবিন্যাসপদ্ধতি হিন্দি হলেও যেভাবে এতে আরবি, ফারসি, তুর্কি প্রভৃতি ভাষার শব্দ ও রীতিনীতি গৃহীত হতে লাগল, তাতে অনতিবিলম্বেই এটা এক নতুন রূপ গ্রহণ করে বসল। ব্রজভাষা’ তথা পশ্চিমা হিন্দির আধারে ঢেলে যে নতুন ভাষার রূপ দেওয়া হল, তার নাম হল উর্দু। উর্দু তুর্কি শব্দ, এর অর্থ ‘শিবির’ বা ‘তাঁবু। ক্রমে ক্রমে দেখা গেল এই ভাষার সাহায্য শুধু ব্রজমণ্ডলে নয়, উত্তর ভারতের প্রায়। সর্বত্রই নিত্য কাজ-কারবার চলতে লাগল। এই হিসাবে এ ভাষা মুসলিম আমলেই ভারতের সর্বজনীন ভাষার। রূপ গ্রহণ করল। এই ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় দেশরূপে ভারতীয় ধারণাকে ঘনীভূত করে তোলার পক্ষেও উর্দু ভাষার দান অনস্বীকার্য।

ভারতে মুসলিম রাজত্ব যতই সুদৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকল, ভারতীয় জীবনে মুসলমান সংস্কৃতির ছাপ ততই সম্প্রসারিত হচ্ছিল। আহার-বিহার, আচার-ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে আরম্ভ করে ভারতীয় সমাজজীবনের প্রতিটি স্তরে মুসলিম-সংস্কৃতির প্রভাব ও অনুকরণ সভ্যতার নিদর্শনরূপে গৃহীত হতে থাকল। এই সময়ে ভারতীয় সংগীত ও চিত্রকলায়ও যুগান্তরকারী পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। ললিতকলা হিসাবে সংগীত ও চিত্রকলা ইসলামে নিন্দিত তো নয়ই, বরং ইসলামের ইতিহাসে তা চিরদিন শিল্প হিসাবে উৎসাহিত হয়েছে। ভারতে মুসলিম আমলে মুসলিম শিল্পীরা যে শুধুমাত্র সংগীতচর্চা করেছেন তা নয়, ব্যাপক চিত্রকলা চর্চাও করেছেন। তাঁদের চিত্রকলা চর্চার রীতি, মোটামুটিভাবে ইরানি রীতি— যা ভারতীয় রীতি থেকে স্বতন্ত্র। ভারতের চিত্রকলাজগতে মুসলিমদের এই রীতি ভারতীয় রীতির সঙ্গে সন্মিলিত হয়ে ‘মোগলাই রীতি’ নামে একটি স্বতন্ত্র ধারার ভারতীয় অঙ্কনশিল্পের জন্মদান করেছে। রাজপুত চিত্রশিল্পেও মুসলিম ঘরানার চিত্রশিল্পের ছাপ বিদ্যমান। তাঁদের সংগীতবিদ্যা ও যন্ত্রভাবনা ভারতীয় এই অংশের সংস্রবে এসে ক্রমশ নতুন রূপ গ্রহণ করে। ফলে ভৈরব, মেঘমল্লার, গান্ধার প্রভৃতি ভারতীয় রাগরাগিণীর সঙ্গে মুসলিমদের গজল, কাওয়ালি, দাদরা, খেয়াল প্রভৃতি মিশে গেল। ঢাক, ঢোল, বীণা, মুরলি প্রভৃতি ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র জগতে মুসলিমদের তবলা, রবার, সেতার, নাকারা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রও স্থায়ী জায়গা করে নিল। ক্রমে ক্রমে জৌনপুরী, আশাবরী, ঠুমরি, টপ্পা প্রভৃতি নানা মিশ্র রাগিণীর উদ্ভবে ভারতীয় সংগীতে যুগান্তরকারী ঘরানার সৃষ্টি হল। মুসলিমরা ভারতীয় সংস্কৃতিকে ক্ষেত্রবিশেষে জোরালো, স্থান বিশেষে পরিপুষ্ট এবং পাত্রবিশেষে গরিষ্ঠ ও মহীয়ান করে দিয়েছেন। জানা যায় মিশর, ইরান, তুরান, তুর্কিস্তান প্রভৃতি দেশে মুসলিম সংস্কৃতি দেশীয় সংস্কৃতিকে একেবারেই গ্রাস করে ফেলেছে, কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। বরং উভয় সংস্কৃতির আদান-প্রদান ঘটেছে, মিশ্রণ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। অতএব বলা যায়, ভারতে বর্তমান সংস্কৃতি কোনো জাতির বিশেষের একার দান নয়, এটি প্রাচীন ভারতীয় এবং মধ্যযুগীয় মুসলিম সংস্কৃতির সংমিশ্রণেই প্রস্তুত একটি যৌগিক সংস্কৃতি। এমনকি মুসলিম শাসকদের তৈরি স্থাপত্য ও সৌধগুলির মধ্যেও রয়েছে ভারতীয় ও ইসলামিক বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ।

 একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে গজনির সুলতান মামুদ, মোহাম্মদ ঘুরি ও দিল্লির প্রথম স্বাধীন সুলতান। কুতুবউদ্দিন আইবক উত্তর ভারতের আজমির ও দিল্লি জয় করে বিজিত রাজ্যে প্রথম ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন। সুলতানি শাসনকালের আগে হিন্দুশিক্ষা মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মণদের হাতে কুক্ষিগত ছিল। হিন্দুসমাজের মধ্যে বর্ণভেদের কারণে নিচুশ্রেণির হিন্দুদের শিক্ষার কোনো অধিকার ছিল না। তৎকালীন ব্রাহ্মণ শিক্ষকরা নিচুবর্ণের হিন্দুদের শিক্ষা দিতে কখনো রাজি হত না। অধিকার ছিল না, নিয়মও ছিল না। অধিকার না-থাকার কারণে শিক্ষা ব্রাহ্মণ ছাড়া নীচুবর্ণের মানুষরা শাস্ত্র শিখতে পারত না। এমতাবস্থায় মুসলিম সুলতানরা ইসলামের নীতি অনুসরণ করে নিচুবর্ণের হিন্দুসমাজের জন্যেও শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সুলতানি আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভারতের প্রত্যেকটি নাগরিক, হিন্দু-মুসলমান, নারী-পুরুষনির্বিশেষে সমান সুযোগ ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। শাস্ত্রের ভাষা সংস্কৃত ছিল বলে সাধারণ হিন্দু নাগরিকরা একেবারেই পড়তে পারত না। তাই মুসলিমরা সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসিতে অনুবাদ করে স্কুল ও মক্তবে হিন্দু ছাত্রদের সংস্কৃত পড়ার বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। ভারতের শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে মুসলিম শাসকদের এই অবদান অনস্বীকার্য। সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবক ছিলেন একজন জ্ঞানী-গুণী ও শিক্ষিত ব্যক্তি। আরবি ও ফারসি ভাষার একজন সুপণ্ডিত ছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবক। ভারতবর্ষে ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে তার অবদান ছিল অপরিসীম। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি নিজে বিদ্বান না-হলেও বিদ্যোৎসাহী ও বিদ্যানুরাগী ছিলেন। শিক্ষা ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের তিনি ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে আলাউদ্দিন খিলজি ভারতীয় ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। মুসলিম ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ভারতীয় ‘তোতাপাখি’ বলে খ্যাত কবি আমির খসরু ছিলেন আলাউদ্দিন খিলজির রাজদরবারের সবচেয়ে খ্যাতিমান কবি। শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়া ছিলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানতাপস। তিনি শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে সম্রাট আওরঙ্গজেবের অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলার মুসলিম শাসকেরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। বাংলা ভাষার বিস্তারে মুসলিম শাসকদের রয়েছে ব্যাপক অবদান। ভারতীয় উপমহাদেশে মক্তব, মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার করেছিলেন মুসলিম শাসকরা।

মুসলিমরা ভারতে আসার আগে এবং বেশ কিছু পরেও ভারতের উচ্চবর্গীয় মহিলা ছাড়া বাকি মহিলাদের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত থাকত। সাধারণ মেয়েরা একটি সেলাইবিহীন পোশাক পরতেন, যে পোশাকটির নাম শাড়ি। না ব্লাউজ পরার চল ছিল, না সায়া বা পেটিকোট পরার চল ছিল। অভিজাত মহিলারা উর্ধাঙ্গ আবৃত করতে পারলেও নীচুশ্রেণির মহিলাদের ঊধ্বাঙ্গ আবৃত করার অধিকার ছিল না। এ প্রসঙ্গে নাঙ্গেলি ও কাপড় আন্দোলন’-এর কথা স্মত। মুসলিম শাসনে ইসলামের আশ্রয়ে অস্পৃশ্যরা যখন ধর্মান্তরিত হতে চাইছিল, তেমনই পাশাপাশি ভারতীয় নারীরাও দিক পরিবর্তনের কথা ভাবছিল। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ। নারী আন্দোলন নিয়ে ভারতের বাইরে দারুণভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেন এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন, লুক্রেশিয়া মটো, সুশান বি অ্যান্টনি, লুসি স্টোন, অ্যাঞ্জেলিনা এম গ্রিম, সারা এম গ্রিম। অপরদিকে সেই রেশ আছড়ে পড়ল ভারতেও। ভারতের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী সেদিন জেগে উঠেছিল নিজ অধিকার নিয়ে। শুরু হয়েছিল বিদ্রোহ।

ভারতের কেরলে প্রতি বছর নারী দিবসে শ্রদ্ধাভরে নাঙ্গেলিকে স্মরণ করা হয়, আজও। নিম্নবর্ণের নারীর আত্মমর্যাদা আদায়ের সংগ্রামে আজও নাঙ্গেলি সে রাজ্যে এক এবং অনন্য সৈনিক। নিজের জীবন দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিম্নবর্ণের নারীর সম্মান। যদিও ভারতের নারীরা বুকের উপর কিছুই পরত না, অথবা পরলেও ওড়না পরত বা আঁচল দিত, নয়তো কেউ কেউ ফুল দিয়ে বক্ষবন্ধনী ব্যবহার করত। যে কাপড় পরত সেই কাপড়ে কোনো সেলাই ছিল না। হিন্দুদের মধ্যে সায়াহীন ব্লাউজহীন সেলাইবিহীন কাপড় পয়ার চল ছিল। সেসময় সেলাই করা কাপড়কে ‘অপবিত্র’ বলে ভাবা হত। পরবর্তীতে ধুতি থেকে ধীরে ধীরে শাড়ি এসেছে, শাড়ির নাম তখন শাড়ি ছিল না, ছিল ‘সাত্তিকা’। সংস্কৃত শব্দ ‘সাত্তিকা থেকে এলো সাতি, সাতি থেকে সাড়ি, সাড়ি থেকে সাড়ি, সাড়ি থেকে শাড়ি। উড়িশায় মাছের লেজের স্টাইল’ এলো সতেরো শতকে। মাছের লেজের স্টাইল’ এরকম— দুটো পাকে ধুতি দিয়ে পেঁচিয়ে মাছের লেজের মতো কাঁধ থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া। লেজটাই আঁচল। ধুতিটাই ধীরে ধীরে এভাবে মেয়েদের শাড়িতে রূপান্তরিত হয়। ব্রিটিশরা আসার পর ব্লাউজ পেটিকোট পরা শুরু হয়েছে। মুসলিমরা ঘাগড়া নিয়ে এসেছিল। সেই ঘাগড়া দেখেই পেটিকোট সেলাইয়ের শুরু। সরাসরি না-হলেও ভারতীয় মেয়েদের পোশাক-বিবর্তনে মুসলিমদের ভূমিকা রয়েছে। মুসলিম সমাজে পর্দানসীন ব্যবস্থাও হিন্দু নারীদের মধ্যে তীব্র প্রভাব ফেলেছিল। বোরখা ও হিজাবের অনুসরণে এলো মুখ-ঢাকা ঘোমটা। লম্বা লম্বা ঘোমটা। সেই ঘোমটায় মুখ দেখাই যেত না। লম্বা লম্বা ঘোমটাওয়ালা মহিলাদের বলা হত ‘কলাবউ’। আজ শহরাঞ্চলে ঘোমটা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেলেও ভারতের সমস্ত প্রদেশের গ্রামাঞ্চলগুলিতে আজও ব্যাপক লম্বা লম্বা ঘোমটার চল বহমান। জানালা-দরজায় সংযোজিত হল পর্দার ব্যবস্থা।

ভারতের মুসলিমরাও হিন্দুদের প্রচুর বিবাহরীতি গ্রহণ করেছেন। তা ছাড়া ইসলামি আইন-বিরোধী বেশ কিছু আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণ করেন। যেমন– বিবাহহাপযোগী আত্মীয়তার মান নির্ধারণ, উপজাতীয় ও বর্ণভেদভিত্তিক সগোত্র ও অসবর্ণের সীমা নির্ণয় এবং বিবাহ চুক্তি সংক্রান্ত অনুষ্ঠান পালন। এমনকি অনেক হিন্দু ও মুসলমান উৎসব নিরপেক্ষ আড়ম্বরের পালিত হত। রাখীবন্ধনে সম্ভ্রান্ত হিন্দু ব্রাহ্মণরা সম্রাটের হাতে রাখী বেঁধে দিতেন। দেওয়ালি উপলক্ষে প্রাসাদে জুয়াখেলা চলত এবং যথাযথভাবে শিবরাত্রি পালিত হত। যদিও মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলিম বিবাহ বিরল ছিল, কিন্তু শাসক পরিবারে তা ভালোভাবেই মেনে নিয়েছিল। কাশ্মীরে হিন্দু-মুসলিম বিবাহ তো দীর্ঘদিনের। দক্ষিণের বাহমনি রাজারা হিন্দু পরিবারের সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাজউদ্দিন ফিরোজ বিজয়নগরের দেবরায় ও খেলার নরসিংহ রাওয়ের কন্যাকে বিবাহ করেন। নবম বাহমনি সম্রাট আহমেদ শাহওয়ালি সোঙ্গেদের রাজকন্যাদের বিবাহ করেন। বিজাপুরের সুলতান ইউসুফ আদিল শাহ মুকুন্দরাও নামক জনৈক ব্রাহ্মণের কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। আকবর, জাহাঙ্গির, ফররুখশিয়র সুকোহ, সিপির সুকোহ হিন্দু রাজকন্যাকে পত্নীত্বে বরণ করে। এরকম অসংখ্য ঘটনা উল্লেখ করা যায়। তবে প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, হিন্দুরা জাতপাতের বিধিনিষেধে এত উচ্চে অবস্থান করতেন যে, কোনো মুসলিম নারীকে প্রাসাদের অন্তঃপুরের পবিত্র ঠাঁই দিতে পারতেন না। তবুও হিন্দুরা মুসলমান কন্যাকে বিবাহ করছেন। এমন দৃষ্টান্ত অপরিজ্ঞাত ছিল না।

ভারতে পৌঁছোনোর আগেই সুফিতত্ত্ব বেদান্তের মূল বৈশিষ্ট্য আত্মসাৎ করে। যেমন– পরম অদ্বৈতদর্শন। ভারতে অদ্বৈত হয়ে ওঠে মুসলিম ওয়াদত-আল-ওজুদ। মনে রাখতে হবে দীর্ঘ সময় ভারতে মুসলিম শাসন চললেও কখনোই শরিয়তি শাসন লাগু করেননি কোনো শাসকই। উপরন্তু, যেমন মোহাম্মদ বিন কাশিম ভারতীয় ব্রাহ্মণদের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন এবং পূর্ব-বৈশিষ্ট্য বহাল রাখার জন্য আদেশও জারি করেছিলেন। বিদ্বেষ ও হিংসা থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রত্যেককেই এক একটি পদে নিয়োজিত করেছিলেন। মধ্যযুগে ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান মুসলমান হলেও রাষ্ট্র কিন্তু ইসলামিক ছিল না। রাষ্ট্র কখনোই পবিত্র ধর্মশাস্ত্রের কোরান, হাদিস বা সুন্নি ব্যবহার শাস্ত্রের চার মজহাবের বিধিবদ্ধ বিধান অননুসরণ করেননি। মধ্যযুগের ভারত রাষ্ট্রকে দিব্যতান্ত্রিক বলা ভুল হবে। কেননা মুসলমান ধর্মতত্ত্ববিদদের নির্দেশাধীনে রাষ্ট্রের কাজকর্ম পরিচালিত হয়নি। বস্তুত ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর থেকে ভারতের প্রায় প্রত্যেক মুসলিম শাসক শরিয়তি শাসন পরিচালনায় তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করেন এবং তার অসম্ভাব্যতার ইঙ্গিত দেন। অধ্যাপক এম হাব্বি বলেন –অধিকাংশ বিদেশি বংশোদ্ভূত মুসলিম বাদশাহ প্রায় ৭০০ বছর ধরে ভারতের সিংহাসনে সমাসীন ছিলেন। কিন্তু তাঁরা তা করতে পেরেছিলেন এই কারণে যে, তাঁদের সিংহাসনারোহণ মুসলিম শাসনের সিংহাসনারোহণ ছিল না। তা না-হয়ে যদি অন্য কিছু হত, তাহলে এক পুরুষও তাঁরা টিকতে পারতেন না।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের কোনো ভূমিকা ছিল? সন্দেহাতীতভাবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের ভূমিকা অবশ্যই ছিল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইটা প্রথমে মুসলিমরাই করেছিল। হিন্দুরা নয়। ঘুরিয়ে বললে ব্রিটিশরা ভারতে ঢুকে প্রথমেই যে সম্প্রদায় থেকে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল, সেই সম্প্রদায়ের নাম মুসলিম। একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, দীর্ঘ ৭০০/৮০০ বছর ধরে ভারতবর্ষের শাসকজাতি মুসলমানরা অতি সহজেই ব্রিটিশদের ‘দাসানুদাস’ হতে রাজি হননি। তাই তাঁরা ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার অনেক থেকেই সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ইংরেজ শাসকদেরকে উৎখাত করার সংকল্পে সক্রিয় ছিলেন সমগ্র ভারত জুড়ে। মুসলিমরাই ব্রিটিশদের মধ্যে একটা ভীতির সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিল শুরু থেকেই। উত্তরপ্রদেশের মওলানা আহমদুল্লাহ, জাফর থানেশ্বরী ও মওলানা ফজলে হক খায়রাবাদি, দক্ষিণাত্যের হায়দার আলি ও তাঁর সুযোগ্য পুত্র টিপু সুলতান, বাংলার আলেম পির মজনু শাহ, তদানীন্তন আসাম প্রদেশের সিলেটের সৈয়দ হাদি ও মাহদি, বালাকোটের শহিদ সায়েদ আহমদ শহিদ, দক্ষিণ বাংলার হাফিজ নিসার আলি তিতুমির ও পরবর্তীতে হাজি শরিয়তুল্লাহ ও তাঁর বংশের পির মুহসিনউদ্দিন দুদু মিয়া, বাদশা মিয়া, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মওলানা নুর মোহাম্মদ নিজামপুরী— শেষের দিকে শায়খুলহিন্দ মাহমুদউল হাসান ও তাঁর শিষ্য মওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি প্রভৃতি নামগুলি ভুলে গেলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। আরও ছিলেন গোটা ভারতের হাজার হাজার আলেম ও পির তথা ধর্মীয় নেতাগণ। এই ‘মওলানা’ শব্দটির বাইরের কেউ সমাজের নেতৃত্ব দিতে পারেন, এটা ছিল ভারতবর্ষের মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা ও কল্পনার অতীত। এই সংগ্রাম ব্রিটিশ আমলের প্রায় শেষ দিন পর্যন্তই ছিল। তাই ১৯২০ সালে দেওবন্দ দার-উল উলুমের সদরুল মুদাররিসিন সায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদউল হাসানের আশীর্বাদধন্য আলি-ভ্রাতৃদ্বয় রামপুর রাজ্যের মোহাম্মদ আলি জওহর ও শওকত আলি যখন ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম সফল গণ-আন্দোলন খিলাফত আন্দোলনের নেতৃত্বে হাত বাড়ালেন, তাঁদেরকেও দেশবাসী মওলানা’ বললেন। সিরাজগঞ্জের জননেতা কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজি আলেম না-হলেও মওলানা’ খেতাবে স্বীকৃত হলেন। পরবর্তীতে ভাসানচরের কৃষক আন্দোলনের নেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানি ও উল্লাপাড়ার সলংগা আন্দোলন খ্যাত আবদুর রশিদ তর্কবাগীশও ওই রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসাবে ‘মওলানা’ বলেই নন্দিত হলেন। যদিও প্রকৃতপক্ষে এঁদের কেউই মাদ্রাসা শিক্ষিত প্রথাগত মওলানা’ ছিলেন না। মওলানা’ না-হয়ে কেউ ‘নেতা’ বলে মুসলিম সমাজে স্বীকৃত হওয়ার রেওয়াজ ছিল না সেসময়ে। তাই ওইসব জাতীয় পর্যায়ের আন্দোলনকারী নেতারাও বঙ্গীয় মুসলিম লিগের সভাপতি মওলানা আকরাম খাঁ, মওলানা আবদুল্লাহেল কাফি, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রতিষ্ঠাতা কেন্দ্রীয় নেতাদের অন্যতম মওলানা মুনিরউজ্জামান ইসলামাবাদি ও মওলানা মাদানির মতো জাঁদরেল আলেম নেতাদের পাশাপাশি তাঁদের নামও মুসলিমসমাজে মওলানারূপে উচ্চারিত হতে থাকল।

যাই হোক, পক্ষান্তরে আলেম সমাজের নেতৃত্বে ভারতবর্ষের মুসলিম সমাজ রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পূর্ব বাংলা থেকে দীর্ঘ ১৫০০ মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশে অবস্থিত মুজাহিদ আন্দোলনের ‘সিতানা’ কেন্দ্রে বাংলার দামাল ছেলেরা অবিরত পাড়ি জমাচ্ছিল লড়াইয়ের জন্য। বলা বাহুল্য, এঁদের অধিকাংশই ছিলেন দিনি মাদ্রাসা পড়ুয়া তালেবুল ইলম। তাঁদের চোখে-মুখে ছিল ব্রিটিশদের কবজা থেকে স্বাধীনতা-সূর্য ছিনিয়ে আনার দৃপ্ত শপথ। মওলানা আকরাম খাঁর পিতা মওলানা আবদুল বারি, মওলানা সামসুল হক ফরিদপুরির পিতামহ মুনসি আবদুল্লাহ, নোয়াখালির মওলানা ইমামউদ্দিন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড মিরসারইয়ের পূর্বে উল্লিখিত মওলানা নুর মোহাম্মদ নিজামপুরি, নোয়াখালির মওলানা ইমামউদ্দিন প্রমুখ বালাকোটের সংগ্রামের ময়দানে নেমে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন।

এছাড়াও ভারত উপমহাদেশে ৮০০ বছরের ইতিহাসে মুসলিমদের গৌরবদীপ্ত অবদান আছে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকাঁচার ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনধারায় মুসলিমদের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। উপমহাদেশের জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্রমবিকাশ ধারায় মুসলিমদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে তাঁদের নজিরবিহীন বলিদান ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও মুসলিম-বিদ্বেষীরা প্রচার করে থাকে মুসলিমরা আগ্রাসী, লুটেরা, হত্যাকারী ইত্যাদি। কিন্তু এ অভিযোগ যে কাল্পনিক ও সংকীর্ণ মানসিকতা প্রণোদিত, সেটা দেখাই এই অধ্যায়ের উদ্দেশ্য।

প্রায় হাজার বছর ধরে মুসলিম শাসকরা গোটা উপমহাদেশ শাসন করল নিরঙ্কুশভাবে। একটা প্রতিবাদী, বিদ্রোহী, সংগ্রামী হিন্দুনেতাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি এই দীর্ঘ সময়ে। কারণ সেই মুসলিম শাসনকালেও অভিজাত শ্রেণির প্রভুরা তখন মধুপানে মত্ত হয়ে বিলাস-ব্যসনে ডুবে আছেন। তখনও তাঁরা নিশ্চিন্ত মনে সুখস্বপ্ন দেখছিলেন। মুসলিম দরবারে সিংহাসন আলো করে বসেছিলেন তাঁরা। মুসলিম শাসকদের হয়ে হিন্দু সেনাপতিরা লুঠপাটের রাজত্ব কায়েম করছিলেন, মন্দির ভাঙতেও তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করেননি। ঠিক যেভাবে ব্রিটিশ শাসনকালেও এইসব এলিট জমিদার শ্রেণির লোকেরা সাধারণ মানুষদের উপর শোষণ আর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে গেছে। ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল মুসলিম উলেমা সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেই। প্রথম প্রতিবাদ তুললেন সেইসময়ের বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ। শাহ ওয়ালিউল্লাহের দুটি স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল –(১) তিনি ইসলাম ধর্মকে পরবর্তীকালের নানারূপ কুসংস্কার ও আচার বিচারের জাল থেকে মুক্ত করে হজরত মোহম্মদের প্রবর্তিত ধর্মের প্রাথমিক বিশুদ্ধতায় নিয়ে যাওয়া এবং (২) ব্রিটিশদের ভারত অধিকারের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনের যে সমস্ত সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে, শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে তার সমাধানের পথ খুঁজে নিতে হবে। তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ভারতকে ‘দার-উল-হরব’, অর্থাৎ ‘যুদ্ধরত দেশ’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই ফতোয়ার মধ্য দিয়ে সমগ্র মুসলিমদের এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, ভারতের কোনায় কোনায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এটা মুসলিমদের ধর্মীয় কর্তব্য। এই ফতোয়ার মাধ্যমেই সমস্ত মুসলিমদের নির্দেশ দেওয়া হল যে, তাঁরা হয় জেহাদ ঘোষণা করে ভারতকে বিজেতা খ্রিস্টানদের হাত থেকে মুক্ত করুক, নচেৎ ভারত ত্যাগ করে যে-কোনো স্বাধীন মুসলিম দেশে চলে যাক। শুধু দেশত্যাগ করলেই হবে না, বাইরে শক্তি সংগ্রহ করে স্বদেশে ফিরে এসে খ্রিস্টানদের কবল থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করতে হবে এবং দেশকে ‘দার-উল-ইসলাম’, অর্থাৎ শান্তির রাজ্যে পরিণত করতে হবে। সেই নির্দেশ মান্য করে উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদ খান দীর্ঘ অর্ধ শতক ব্যাপী খ্রিস্টান ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক বর্ণিত এই ‘ওয়াহাবি’ দল উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলকে ঘাঁটি করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করেছিলেন। তাঁরা সেইসময় থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে দীর্ঘদিন ব্যাপী বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাঁচিয়ে রেখেছিল। মুসলিমদের হাত থেকে বাদশাহী শাসনক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল এই ব্রিটিশরাই। অতএব আঘাতটা মুসলিমদের বুকেই বেশি বাজবে। এটা খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। যদি হিন্দু শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করে ব্রিটিশরা ক্ষমতা দখল করত, তাহলে প্রতিক্রিয়া একইরকম হত। মূলত ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই বিদেশি ও বিধর্মীদের শাসন অসহনীয় বলে তাঁদের কাছে মনে হয়েছিল। যে-কোনো ধর্মই হোক, ধর্মীয় জীবন থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারে না। ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে একথা আরও বেশি করে প্রযোজ্য। ব্রিটিশদের মুসলিমরা দুটি আপত্তিকর বিষয় হিসাবে দেখেছে। এক বিদেশি। দুই খ্রিস্টান। খ্রিস্টান মানে অতীতকালের বৈরিতা। হিন্দুদের ক্ষেত্রে সেটা হল উল্টো। হিন্দুরা ব্রিটিশদের ভাবতে থাকলেন ইংরেজ বা ব্রিটিশ হিসাবে, কখনোই খ্রিস্টান হিসাবে নয়। তাই হাজার বছরের মুসলিম শাসন হয়, আর ১৯০ বছরের ব্রিটিশ বা ইংরেজ শাসন হয়। টানা দেড়শো বছর ধরে মুসলিমরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছে এককভাবে। হিন্দুরা লড়াইয়ের ময়দানে নামলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এসে, যখন ব্রিটিশরা মুসলিমদের ছেড়ে হিন্দুদেরও পিঠের চামড়া গুটিয়ে নুন দিতে শুরু করে দিল। সঙ্গে চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক বিভেদের বীজ রোপণের কাজও শুরু হয়ে গেল। যতদিন পর্যন্ত ব্রিটিশরা মুসলিমদের চামড়া গোটাচ্ছিল, ততদিন পর্যন্ত তাঁরা চুপ ছিল। কারণ তাঁরা মনে মনে চাইছিল ব্রিটিশরাই মুসলিমদের নিকেশ করে দিক। মুসলিম নিকেশ হলেই ব্রিটিশ খেদিয়ে আমরাই ভারত শাসন করব। অতএব এ কাজে ব্রিটিশদের সাহায্য করা উচিত। সেটাই করেছিল। বর্তমান রাজ্যে সিপিএমরাও সেইরকম ভাবছে। আমরা তো পারব না। বিজেপিকে দিয়ে তৃণমূলের নিকেশ করিয়ে তারপর আমরাই ক্ষমতায় ফিরব। যেদিন থেকে নিজেদের পিঠে আগুনের ছেঁকা লাগল, তখন শয়ে শয়ে বিপ্লবী বেরিয়ে এলো দেশের আনাচে-কানাচে। ব্রিটিশ শাসনের শেষ ৫০ বছর ভয়ানক অস্থিরতায় কাটল। রক্তপাত, রক্তপাত আর রক্তপাত।

যাই হোক, বিস্মৃতপ্রায় এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর কথা মনে পড়ে গেল। ভুলে গিয়েছিলাম, কারণ ভারতের ইতিহাসবিদরা মনে রাখতে দেয়নি। সেই ব্যক্তির নাম বদরুদ্দিন তায়াবজি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে গঠন হওয়ার শুরুর দিকে যে কজন হাতে-গোনা নেতৃস্থানীয় মুসলিমদের দেখা মেলে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম নেতা বদরুদ্দিন তায়াবজি। যে সমস্ত মুসলিম নেতা ও কর্মী জাতীয়তাবাদী নীতিকে ভিত্তি করে কংগ্রেসে যোগ দিতেন, নিজেদের সম্প্রদায় থেকেই বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হত। বদরুদ্দিনকেও সেইরকম বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু বদরুদ্দিন বীরের মতো সেইসব বিরোধিতার মোকাবিলা করেছিলেন। বদরুদ্দিন থেকে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ– স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের স্বাধীনতা ইতিহাস অকথিত রয়ে গেছে। বদরুদ্দিন তায়াবজি পেশায় ছিলেন বোম্বাইয়ের একজন খ্যাতনামা ব্যারিস্টার। যাঁরা বলেন মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে মুসলিমরা সন্ত্রাসবাদী হয়, তাঁদের বলি বদরুদ্দিন তায়াবজিও একজন মাদ্রাসার ছাত্র, কিন্তু খ্যাতিমান ব্যারিস্টার। তাঁর গোটা রাজনৈতিক জীবনে তিনি সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক কোনো বিবৃতি দিয়েছেন বলে কোনো তথ্য কোথাও পাইনি। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ভাইসরয় লর্ড লিটন কর্তৃক ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’ ঘোষণার পর থেকেই তিনি জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’ হল দেশীয় সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রণীত একটি বহুল বিতর্কিত আইন। লর্ড লিটন মনে করতেন, অধিকাংশ দেশীয় সংবাদপত্রের সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্রিটিশরাজের পতন ঘটানো। যে সমস্ত সংবাদপত্র ব্রিটিশ সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল, সেগুলি হল– সোমপ্রকাশ, সুলভ সমাচার, হালিশহর পত্রিকা, অমৃতবাজার পত্রিকা, ভারতমিহির, ঢাকা প্রকাশ, সাধারণী ও ভারত সংস্কারক। প্রণীত আইনে সংবাদপত্র প্রকাশের আগে বিষয়বস্তুর সমস্ত প্রুফ-শিট পুলিশের কাছে পেশ করার বিধান রাখা হয়। কোন্ ধরনের সংবাদ রাজদ্রোহের আওতায় পড়ে তা পুলিশই ঠিক করে দিত, আদালত নয়। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে যখন সারা দেশে ইলবার্ট বিল নিয়ে বিতর্ক বাধল। তখন তিনি এই বিলেন তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ইলবার্ট বিল হল আইনসচিব স্যার কোর্টনি ইলবার্ট প্রণীত একটি আইন। এই বিলে বলা হয়েছিল ভারতীয় জজদের একমাত্র ইউরোপীয়, ব্রিটিশ প্রজা ছাড়া বাকি ভারতীয় প্রজা বা নাগরিকদের বিচার অধিকার থাকবে। ইতিপূর্বে কৃষ্ণাঙ্গ জজদের শ্বেতাঙ্গদের করার কোনো অধিকার ছিল না। এই বিলটি উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই সমগ্র অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায় এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে।

আমরা সিপাহি বিদ্রোহের কেবলমাত্র মঙ্গল পাণ্ডের নামই মনে রেখেছি। তেমন করে আর কারোর নাম মনে রাখিনি। যদিও মঙ্গল পাণ্ডে ছিলেন সিপাহি বিদ্রোহের প্রথম শহিদ, তার মানে তো এই নয় যে, হাজার হাজার যে সংগ্রামীরা দেশের জন্য প্রাণ বলিদান দিলেন তাঁদের ভুলে যেতে হবে? ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম লড়াই মহাবিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে যাঁরা সামিল হয়েছিলেন এবং প্রাণ বলিদান করেছিলেন, তাঁদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যাক –আজিমুল্লাহ খান, ফৈজাবাদের মৌলবি আহম্মদ শাহ, অযোধ্যার বেগম হজরত মহল, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই, পাটনার পির আলি, কুনওয়ার সিং, তাঁতিয়া টোপি, শাহজাদার ফিরোজ শাহ, ইঞ্জিনিয়ার মোহম্মদ আলি খাঁ, নাজিম মোহম্মদ হাসান, শঙ্করপুরের বেণী মাধো প্রমুখ। এঁদের মধ্যে দুজনের নামই আমার ছোটোবেলার ইতিহাস বইয়ে পড়েছি। বাকিরা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। এঁদের মধ্যে ফৈজাবাদের মৌলবি আহম্মদ শাহের নাম বিশেষভাবে মনে রাখা উচিত ছিল। মৌলবি আহম্মদ শাহ অকুতোভয় সর্বজনগ্রাহ্য একজন সংগ্রামী নেতা। হতাশায় ভেঙে পড়া মানুষকে কীভাবে নতুন আশায় ও উৎসাহে উদ্দীপিত করে তুলতে হয়, সে মন্ত্র তাঁর বিলক্ষণ জানা ছিল। তিনি নিঃস্ব ফকিরের বেশে গ্রামে গ্রামে। শহরে শহরে প্রদেশে প্রদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিদ্রোহের বাণী প্রচার করার জন্য। অদ্ভূত তাঁর আকর্ষণী শক্তি ছিল। তিনি যেখানেই সভা করতে যেতেন সেখানেই শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ দলে দলে এসে ভীড় করে দাঁড়াত। অ-বোলা মানুষের মুখে কথা ফোঁটাতে পারতেন। তাঁকে দেখামাত্রই দুর্বল মানুষও সবল হয়ে উঠত। সারা দেশ জুড়ে কোম্পানির অত্যাচার ও লুণ্ঠনের প্রতিবাদে তিনি সিংহের মতো হুংকার দিয়ে বলতেন –এ জুলুমবাজ ফিরিঙ্গিরাজ খতম করো।” শুধু হুংকার নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে লেখনীর অবিরাম অগ্নিবর্ষণ চলত। তাঁর লেখা বৈপ্লবিক ইস্তাহারে গোটা অযোধ্যা প্রদেশ ছেয়ে গিয়েছিল। একসময় তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ এলে গ্রেফতার করতে সেনাদল পাঠানো হল। বিচারে ফাঁসির আদেশ হল। মৌলবি আহম্মদ শাহ ফৈজাবাদের কারগারের অন্ধকারে বসে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুণতে থাকলেন।

ফৈজাবাদের মানুষ তাঁদের প্রিয় নেতার উপর এহেন হামলা নিঃশব্দে মাথা পেতে নিল না। সারা দেশে আগুন জ্বলল। সিপাই ও নগরবাসী একসঙ্গে রুখে দাঁড়াল। ব্রিটিশ অফিসাররা সিপাইদের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য প্যারেড ময়দানে জমায়েত হওয়ার হুকুম দিলেন। সিপাহিরা সে কথা গ্রাহ্য করল না। বুক ফুলিয়ে তাঁরা প্রকাশ্যে ঘোষণা করল, এখন থেকে দেশি অফিসার ছাড়া কারোর কথা মানবে না। সর্দার দলীপ সিং ব্রিটিশ অফিসারদের আটক করার হুকুম দিলেন। শহর বিদ্রোহীদের অধিকারে এসে গেল। জনসাধারণ ও সিপাহিরা জয়ধ্বনি করে জেলের দরজা ভেঙে তাঁদের প্রিয় নেতা আহম্মদ শাহকে বের করে নিয়ে আসে।

সৈয়দ আহমেদের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম মূলত স্বাধীনতার সংগ্রাম হলেও তা ইসলামের ধর্মীয় বিধানের মোড়কে এমনভাবে মোড়া ছিল যে, হিন্দুদের মধ্যে কারোর ইচ্ছা থাকলেও যোগদান করতে পারেনি। কাঁধে কাঁধ মেলাতে পারেনি। ফলে সৈয়দ আহমদের সংগ্রাম একান্তই মুসলিমদের সংগ্রাম ছিল। সংগ্রামরত সকলেই ছিলেন মুসলমান। শুধুমাত্র মুসলিমদের সংগ্রাম বলে তাকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা যাবে না? কোন্ যুক্তিতে এমন নির্ণয় করা যায়? ঐতিহাসিক সত্যেন সেনের অভিমত হল– “…কেবলমাত্র এই কারণেই এই। সংগ্রামকে স্বাধীনতা সংগ্রাম নয় বলে কেউ যদি আপত্তি তোলেন, তবে এই যুক্তিকে কোনোমতে গ্রাহ্য করা যায়। না। একমাত্র হিন্দুদের সংগ্রামের ফলে স্বাধীনতা লাভ যদি সম্ভবপর হত, তাহলে আমরা বিনা দ্বিধায় তাকেও স্বাধীনতা সংগ্রাম আখ্যাই দিতাম। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ হিন্দু-মুসলিমের মিলিত সংগ্রাম হলেও এ বিষয়ে সবাই একমত যে, এই বিদ্রোহে মুসলিমদেরই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ফলে বিদ্রোহ যখন ভেঙে পড়ল, তখন মুসলিমদের উপর ব্রিটিশদের আক্রমণ নগ্নমূর্তিতে নেমে এলো।” মহাবিদ্রোহের পর থেকেই ব্রিটিশদের রাজনৈতিক কৌশল প্রস্তুত হল। শুরু হল মুসলিম বিদ্বেষ এবং হিন্দু তোষণ। তা জারি ছিল ভারতভাগ পর্যন্ত।

ভারতের কোনায় কোনায় ব্রিটিশ বণিক শক্তি সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী ধারালো দাঁত-নখ বিস্তার করে ক্রমশ যখন কেন্দ্রবিন্দু দিল্লির দিকে হানা দিচ্ছিল, তখন সেখানে নামকাওয়াস্তে মোগল বাদশাহ ছিলেন বয়োবৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফর। সমগ্র ভারতে ক্রমবর্ধমান খ্রিস্টান আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি ও সামর্থ্য তখন এই ক্ষয়িষ্ণু মোগল শাসকের ছিল না। বাহাদুর শাহ মনে মনে ব্রিটিশদেরদের প্রতি যতই ক্ষোভ পোষণ করুন না-কেন, বাস্তবে তিনি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য কোনো চেষ্টাই করেননি বা করা তাঁর পক্ষে সম্ভবও হয়নি। কিন্তু ঘটনাচক্রের এক পর্যায়ে এই বাদশাহকেই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের নেতৃত্ব দান করতে এবং সে কারণে চরম দণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। বাহাদুর শাহ জাফরের প্রতি বিদ্রোহের পূর্ব থেকেই ধূর্ত ব্রিটিশদের কুনজর ছিল। দিল্লির এই প্রায় ক্ষমতাহীন শাসকের দিকে লক্ষ রেখেই ব্রিটিশরা বিদ্রোহের আগেই নির্দেশ জারি করেছিল যে, বাহাদুর শাহের পর আর কোনো মুসলিম সম্রাট থাকবেন না এই ভারতে এবং সম্রাট না-থাকার কারণে মোগল বংশের কেউই লালকেল্লায় বসবাস করতে পারবেন না। তাঁদেরকে বসবাস করতে হবে শহরের মেহেরালি নামের এক মহল্লায়, যেখানে সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে সাধারণ সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থাকতে হবে। বিদেশি দখলদারদের এমন নির্দেশ শুধুমাত্র মোগল বংশকেই নয়, সমগ্র দেশবাসীকেও প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। কারণ সেদিন এই মোগল সম্রাটই ছিলেন সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সর্বশেষ প্রতীক। তাঁকে সামনে রেখেই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহী স্বাধীনতাকামীরা বিশেষত মুসলিম-বিদ্রোহীরা স্বদেশের হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সর্বশেষ সশস্ত্র লড়াইয়ের সূত্রপাত করেন। মুক্তির মিছিলে সক্রিয় হয়েছিলেন ভারতের শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ও বেগম জিনাত মহল, অযোধ্যার ক্ষমতাচ্যুত নবাব সৈয়দ ওয়াজেদ আলি শাহ ও বেগম হজরত মহল, ঝাঁন্সির রানি লক্ষ্মীবাঈ, মারাঠা নেতা তাঁতিয়া তোপি, নানা সাহেব এবং রায়বেরেলির মুজাহিদ নেতা মাওলানা আহমদুল্লাহ। মহাবিদ্রোহের সামনের সারির নেতাদের মধ্যে একমাত্র মাওলানা আহমদুল্লাহই (সিংহাসন, ভাতা বা কোন ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা হারানোর কারণে নয়)। তিনি সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার এবং বিদেশি দখলদার-সাম্রাজ্যবাদী বিতাড়নের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভাগ্যবিড়ম্বিত মুসলিম সম্প্রদায় অমানিশার ঘোর অন্ধকার থেকে উত্তরণের প্রয়াসে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে দেশের আজাদি পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই আন্দোলন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। সিপাহি থেকে শুরু হলেও এই মহাবিদ্রোহ সর্বসাধারণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল। মহাবিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতে ব্রিটিশ শক্তিকে উৎখাত করে ভারতীয়দের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। এই এক সংগ্রামেই ২৭,০০০ মুসলিম প্রাণ বলিদান দিয়েছিল ফাঁসির। দড়িতে। তাঁদের ইতিহাস কেউ মনে রাখেনি। যেমন কেউ মনে রাখেনি শের আলি আফ্রিদিদের মতো বীরদের বলিদানের কথা। শের আলি আফ্রিদি এক ব্রিটিশ গুপ্তচরকে হত্যা করে আন্দামানের সেলুলার জেলে নির্বাসিত হন। পরে বন্দি অবস্থায় ছুরি দিয়ে জেল পরিদর্শনে আসা বড়োলাট মেয়োকে হত্যা করেন। আমার মনে হয় পরাধীন ভারতে বন্দি স্বাধীনতা সংগ্রামী দ্বারা এই রকম সফল আক্রমনের ঘটনা বিরল। বড়োলাট পদমর্যাদার কোনো ব্রিটিশ হত্যাও মনে হয় দ্বিতীয় আর-একটি হয়নি। ১৮৭৩ সালে শের আলির ফাঁসি হয়। ফাঁসির মঞ্চেও তিনি বীরের মতোই দৃঢ় ছিলেন। এই সেলুলার জেলে সাভারকরও বন্দি ছিলেন কয়েক বছর। জেলে ভিতর সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া তো বহু দূরের কথা, তিনি জেল-জীবনের কষ্ট সহ্য করতে না-পেরে ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে লিখিত আর্জি জানান এবং আর কোনোদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবেন না বলে মুচলেকা দেন। ভাবতে অবাক লাগে, সেই সেলুলার জেলের নাম শের আলি আফ্রিদির নামে না-হয়ে সাভারকরের নামে করার প্রস্তাব উঠেছে। সে সময় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে ভারত ভূখণ্ডের অংশ বলে মনে করা হত না। ওটা ছিল বিদেশ। রাজবন্দিদের আন্দামানে পাঠিয়ে তাঁদের মনোবল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়াই ছিল ব্রিটিশদের মূল উদ্দেশ্য। ব্রিটিশরা শের আলি আফ্রিদিদের মনোবল ভাঙতে সফল না-হলেও সাভারকরদের মনোবল ভাঙতে চূড়ান্তভাবে সফল হয়েছিল। সাভারকররা তারপরে আর কোনোদিন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। যে লক্ষ লক্ষ কথা তিনি বলেছিলেন, তার সবটাই মুসলিমদের বিরুদ্ধে। এর ফলে ব্রিটিশরাও বুঝে গেল ভারতের সংখ্যাগুরুদের কাছে ব্রিটিশরা শত্রু নয় মোটেই, বরং চরম শত্রু হল সংখ্যালঘু মুসলিম।

সেই কারণে ভারতের ইতিহাস লেখা হল বটে, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও লেখা হল, কিন্তু সেই ইতিহাসে স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের বলিদান দেওয়ার কথা প্রায় নেই বললেই চলে। অর্থাৎ তোমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে শরিক নও, অতএব ভারতেরও শরিক হতে পারে না। অর্থাৎ তোমরা ভারতের কেউ নও। তোমরা ভারত ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাও। যে ব্রিটিশদের সঙ্গে সাভারকরদের প্রেম-পিরিত জমে ক্ষীর হয়েছিল, সেই তাঁদের নিয়ন্ত্রিত ইতিহাসে কি মুসলিম বিপ্লবীদের উল্লেখ থাকতে পারে? তাই ক্ষুদিরামের ইতিহাস স্কুল কলেজে পড়ানো হলেও শের আলি আফ্রিদির ইতিহাস নয়। এই কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে ক্ষুদিরাম। কিন্তু শের আলি নামে এক মুসলিম যুবক কিংসফোর্ডকেই হত্যা করে।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য শুধু অসহযোগ আন্দোলন নয়, বরং সশস্ত্র সংগ্রামেরও যে প্রয়োজন ছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভারতের ইতিহাসের পাতায় সশস্ত্র বিপ্লবী হিসাবে যাঁদের নাম সহজেই চোখে পড়ে তাঁরা হলেন সুভাষচন্দ্র বসু, মাস্টারদা সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ভগৎ সিং প্রমুখ। নিঃসন্দেহে তাঁদের আত্মত্যাগ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনমনীয় মনোভাবের কারণে তাঁরা সকল প্রজন্মের পর প্রজন্ম অনুপ্রেরণার পাত্র। কিন্তু ঐতিহাসিকরা মুসলিম বীর সেনানীদের নাম নিতে কৃপণতা করলেও ব্রিটিশদের জুলুমের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের হাতেখড়ি যে মুসলিম বীরদের হাতেই হয়েছিল তা ইতিহাসই সাক্ষী দেয়। কেউ স্বীকার করুক বা না-করুক, এই অধ্যায়ে সেই বীর যোদ্ধা ও শহিদদের মধ্য থেকে এমন। কয়েকজনের নাম ও বীরত্বের কাহিনি সংক্ষেপে তুলে ধরব, যাঁরা পক্ষপাতহীন ইতিহাসের পাতায় ও বিবেকবান নিরপেক্ষ মানুষের স্মৃতির খাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ও থাকবেন।

ইংরেজ আমলের অরাজক পরিস্থিতি যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল, ঠিক তখন (১৭০৩– ১৭৬৪ সাল) তৎকালীন মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থভূমি দিল্লিতে আবির্ভূত হলেন শাহ্ ওয়লিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি। ব্রিটিশদের দুঃশাসন, জুলুম এবং একই সঙ্গে ধর্মীয় কুসংস্কার ও বিদেশি অপসংস্কৃতি থেকে মুক্তি দানের লক্ষ্যে সমাজ-সংস্কারক হিসাবে আবির্ভূত হয়ে তিনি নিজের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে ভারতবর্ষ তথা এই বাংলার মানুষকে নবজাগরণের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যাঁরা জীবন বাজি রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথমে যাঁর নাম না-নিলেই নয়, তিনি হলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আহমদ বেরলভি। এ আন্দোলনকে ‘ওয়াহাবি আন্দোলন’ নামেই সবাই জানে। সৈয়দ আহমদ বেরলভির কাছে দিক্ষিত ও অনুপ্রাণিত আর-একজন বিপ্লবী সেনানীর নাম মির নিসার আলি, যাঁকে তিতুমির নামে সবাই জানে। ব্রিটিশ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে বাংলার শহিদ তিতুমির ১৮৩১ সালে চব্বিশ পরগনার নারিকেলবেড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে সহযোদ্ধা সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এবং আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তা ভারতবর্ষের তৎকালীন সকল বিপ্লবীদের প্রেরণা জুগিয়েছিল।

একই অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে দুর্বল চাষিদের উপর নীলকরদের জুলুম ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ফরিদপুরের হাজি শরিয়তুল্লাহ ও তাঁর পুত্র মহসিনউদ্দিন দুদু মিয়া দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। যা ফারাজিয়া আন্দোলন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১১ সালের পর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মুসলিম ও হিন্দু ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। একদিকে মওলানা মোহাম্মদ আলি ও মওলানা শওকত আলি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জনগণকে জাগিয়ে তোলেন এবং আপন আবাসভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য যে আন্দোলন গড়ে তুলেন তা ‘খেলাফত আন্দোলন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। অপরদিকে সুদূর উত্তর-পশ্চিমের পার্বত্য অঞ্চলে পশতুন নেতা আব্দুল গাফফার খানের নেতৃত্বে গঠিত দল ‘খোদা-ই খিদমদগার’ (আল্লাহর দাস)-এর ছত্রছায়ায় এবং সমতল এলাকায় মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন, যা ব্রিটিশদের বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। স্বদেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি নতুন ধারায় রাজনৈতিক চেতনার জন্ম দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া এই ক্ষণজন্মা মানুষটি বুঝতে পেরেছিলেন যে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করতে হলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বিকল্প নেই। তাই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মতাদর্শকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অসহযোগ আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। আসামের ভাসানচরে নির্যাতিত বাঙালি কৃষকদের পাশে থেকে তিনি এক বিশাল প্রতিবাদী সমাবেশ করায় কৃষকরা ভালোবেসে তাঁকে ‘ভাসানচরের মওলানা’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। পরবর্তীতে তিনি মওলানা ভাসানি’ নামে পরিচিতি লাভ করেন।

স্বশস্ত্র বিপ্লবীদের একের পর এক প্রতিরোধের মুখে ব্রিটিশ সরকার যখন নাস্তানাবুদ প্রায়। এই সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লব পরিচালনা এবং অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ জোগাড় করার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়। তাই ১৯২৫ সালের ৯ মার্চ স্টেশন মাস্টার সাহজানপুর থেকে লখনউ গার্ডভ্যানে টাকার বস্তা নিয়ে যাচ্ছে, এই খবর পেয়ে হাইকমান্ডের নির্দেশে আশফাকুল্লাহ ও তাঁর সঙ্গীরা তা ছিনিয়ে নেয়। কাকরি গ্রামের কাছে এই লুটের ঘটনাটি সংঘটিত হয় বলে ব্রিটিশ সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে ‘কাকরি ডাকাতি’ নামে মামলা করে। প্রথমত আশফাকুল্লাহ পালাতে পারলেও বেশ কয়েকমাস পর তাঁরই এক পরিচিতজনের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তিনি ধরা পড়েন এবং ১৯২৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর তাঁর ফাঁসি হয়। ছয় ফুট লম্বা এই মানবসিংহ হাসতে হাসতে শহিদ হন শুধু দেশপ্রেমের জন্য। ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল মুসলিমদের একত্ববাদের মূলমন্ত্র “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”। সেই সময় এ উপমহাদেশের শিক্ষা বিস্তারে ও বিজ্ঞান, কলা, ধর্ম ও সমকালীন জ্ঞানচর্চার জগতে যুগান্তকারী বিপ্লব সাধনের সঙ্গে যাঁদের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাঁরা হলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নওয়াব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলি প্রমুখ। তাঁরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারকের ভুমিকাও পালন করেন।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ এবং ১৮৫৭ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পর্যন্ত যেসব মুসলিম বিপ্লবী নেতানেত্রীদের জেল দীপান্তর ও ফাঁসি হয়েছে, তাঁদের নাম স্কুল কলেজের পাঠ্য ইতিহাস বইয়ে পুরোপুরি গোপন রাখা হয়েছে। যদি এই গোপন অপকর্মটি না-করত তাহলে কোনো অ-মুসলিম ভারতবাসী “মুসলমানদের ভারত ছাড়তে বা মুসলমানরা বিদেশি” বলার সাহসটুকু পেত না।

একথা যদিও নির্ঘাত সত্য, তবুও অনেক দালাল ঐতিহাসিক এড়িয়ে গিয়েছেন যে, মুসলিম বিপ্লবীদের শুধু জেল ফাঁসি হয়নি, অনেকক্ষেত্রেই তাঁদের জরিমানা হয়েছে এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কেড়ে নিলাম করে ব্রিটিশরা অর্থ জোগাড় করেছে। যদিও ব্রিটিশ শাসনে যত রাস্তাঘাট, ব্রিজ, রেলপথ, টেলি ও ডাকব্যাবস্থা ইত্যাদি হয়েছে তার বেশির ভাগ খরচ মুসলিম সমাজ থেকেই প্রাপ্ত। জমি, সম্পত্তি যেমন কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং সরকারী বেসরকারি চাকরি থেকে তাঁদের কেমন করে বঞ্চিত করা হয়েছে সে তথ্য বিস্তারিত জানতে উইলিয়াম হান্টারের ‘Indian Musalmans’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল, অর্থাৎ ১৯০ বছরের সুদীর্ঘ মুসলিম আন্দোলনের জেলখাটা ও রক্ত দেওয়া কেমন করে বেমালুম নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হল সেটা ভয়াবহ বিস্ময়কর ব্যাপার। কলকাতা সিটি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান এবং রবীন্দ্রভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাষক, যিনি নিজে একজন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সংগ্রামী ছিলেন, তিনি শ্রীশান্তিময় রায়। শ্রীশান্তিময় রায় লিখেছেন– “স্কুল কলেজের শিক্ষকদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘ভারতীয় মুসলমানদের ভূমিকা’ বিষয়ে বিরাট অজ্ঞতা দেখি। আমাদের সমগ্র প্রজন্মই খ্যাতনামা ব্যক্তিদের লেখা ডাহা মিথ্যা ও ভুল ইতিহাস পাঠ করে বড়ো হয়েছে। মিথ্যা ইতিহাস রচনা একটি প্রাচীন শিল্পকলা, যা আজও বহু প্রতিভা সম্পন্ন ব্যক্তি প্রয়োগ করে থাকেন।” শ্রীশান্তিময় রায়ের লেখা ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রাম ও মুসলিম অবদান’ গ্রন্থটিতে পণ্ডিত শ্রী পি সি যোশীর ভূমিকা অংশে লিখেছেন– “সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সাধারণ সংগ্রামে কিছু হিন্দু ইতিহাসবিদদের মুসলমানদের অবদান উপেক্ষা করা বা তার ভুল ব্যাখ্যা শান্তিময় রায়কে বিচলিত করে, সত্য উঘাটনে অনুপ্রাণিত করে। .. আসলে ব্রিটিশরাই তাঁদের দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য তাদের ওয়াহাবি বলত, যেমন তাঁরা পরবর্তীকালে সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে বলত।” প্রসঙ্গত বলে রাখি যে, ‘ওয়াহাবি’ শব্দ বিপ্লবীদের উপহাস ও বিদ্রুপাত্মক শব্দ। হাজি শরিয়তুল্লাহ ও তাঁর পুত্র মোহম্মদ মহসিন দুই উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, যাঁরা ব্রিটিশ বিতাড়নে বা সংগঠন পরিচালনায় ঘরের শান্তি ও আরামকে নির্বাসন দিয়ে কষ্টের পথে চলতে চলতে মৃত্যকে বরণ করে নিয়েছিলেন। ৮০,০০০ সমর্থক নিয়ে যিনি সগৌরবে বিপ্লব পরিচালনা করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, তিনি বিপ্লবী মোহম্মদ মহসিন (দুদু মিয়া)। ঐতিহাসিক শান্তিময় রায় লিখেছেন– “তিনি সাফল্যের সঙ্গে দেশি হাতিয়ারে সজ্জিত এক সামরিক বাহিনী গড়ে তোলেন।”

‘Indian Musalmans’ গ্রন্থে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন— “মুসলিম বিপ্লবীদের লড়াই ভারতের আদিমতম এবং সব থেকে দীর্ঘস্থায়ী ও অধিক ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইগুলির মধ্য অন্যতম।” “মুসলিম পরিচালিত বিপ্লবগুলিকে দালাল ঐতিহাসিকরা ইংরেজদের ইঙ্গিতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বলে চালাতে চেয়েছে। কারণ হংরেজদের পদলেহি জমিদার, তাঁদের সমর্থক ও সংরক্ষকদের ওই বিপ্লবীরা আক্রমণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সুতরাং জমিদার, রাজা, মহারাজা ও বাবুসমাজ এটাকে হিন্দুর বিরুদ্ধে মুসলমানদের লড়াই বলে চালাতে চেয়েছিলেন।”(বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ— অমলেন্দু দে) তবে উইলিয়াম হান্টার মুসলিমদের এই সংগ্রামকে নিছক স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসাবে দেখেননি, দেখিয়েছেন ধর্মান্ধ মুসলিমদের ধর্মীয় আন্দোলন হিসাবে। অবশ্য শুধু ব্রিটিশ শাসক নয়, পৃথিবীর শাসকই তাঁর শাসনকালের কোনো বিদ্রোহকেই ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ সিলমোহর দেন না। আমরা দেখেছি স্বাধীন ভারতের শাসকরাও কোনো স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকে ‘জঙ্গি’ বা ‘সন্ত্রাসবাদী’ সিলমোহর দিয়ে থাকে। এর ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠদেরও সমর্থন পাওয়া যায় এবং আন্দোলনকারীদের হত্যা করে আন্দোলন দমন করাও সম্ভব হয়। কেউ প্রতিবাদ করে না সংঘটিত এই রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের। নির্বিঘ্নেই বিনাশ করে ফেলা যায়। উদাহরণ দিলাম না। নিরপেক্ষভাবে বিচার করে ঘটনাগুলির পুনর্মূল্যায়ন করুন। বুঝে নিন। গোড়ার দিকে মুসলিমদের তুমুল সংগ্রামকে ‘ধর্মীয় জেহাদ’ বলে যেমন খাটো করে দেখানো হয়েছে সংখ্যাগুরুদের কাছে, তেমনি পরবর্তীকালে হিন্দু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে সিলমোহর দিয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ শাসকরা। আর এসব ব্যাপারে মিডিয়াও দারুণ সফলভাবে রাষ্ট্রের সঙ্গে থাকে। যদিও হিন্দুরাও ধর্মকে সামনে রেখেই স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’-ই তার হাতেগরম জলন্ত প্রমাণ।

‘Indian Musalmans’ গ্রন্থে উইলিয়াম হান্টার বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কী ধারণা পোষণ করেছেন, একটু দেখে নেওয়া যাক– “মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা অপেক্ষাকৃত অধিক ধর্মান্ধ তাঁরা এইভাবে রাজদ্রোহিতামূলক প্রকাশ্য তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। আর এই বিদ্রোহের প্রতি নিজেদের কর্তব্য সম্পর্কে প্রকাশ্যেই শলা-পরামর্শ করছে গোটা মুসলিম সম্প্রদায়। বিগত ৯ মাস যাবৎ প্রধান প্রধান সংবাদপত্রগুলোর পৃষ্ঠাগুলি ভর্তি হয়েছে রানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে মুসলিমদের কর্তব্য সম্পর্কিত আলোচনায়। উত্তর ভারতের মুসলিম আইনজীবী ব্যক্তিদের সমষ্টিগত অভিমত সর্বপ্রথম প্রচারিত হয় একটি ফতোয়ারূপে। এরপরেই বাংলার মুসলিমরা এই বিষয়টি সম্পর্কে এক প্রচারপত্র বিতরণ করে। এমনকি ভারতের বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র যে শিয়া সম্প্রদায় তাঁরাও এই প্রচার অভিযান থেকে বিরত থাকতে পারেনি। মুসলিমদের মধ্যে যাঁরা অপেক্ষাকৃত রাজানুগত তাঁরা এই প্রচার অভিযান থেকে বিরত থাকতে পারেনি। মুসলিমদের মধ্যে যাঁরা অপেক্ষাকৃত কম রাজানুগত তাঁরা এই রাজদ্রোহ থেকে নিবৃত্ত থাকলে আখেরাত নষ্ট হবে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য যেভাবে গলদঘর্ম হয়ে চেষ্টা করছিল, তা দেখে ইঙ্গ ভারতীয় সংবাদপত্রগুলি কয়েক মাস হাসি সংবরণ করতে পারেনি। কিন্তু মুসলিম আইনজীবী পণ্ডিতদের সার্বিক ফতোয়া জারির পর আমাদের দেশবাসী নিশ্চিতরূপে উপলব্ধি করেন যে, বিষয়টা একদিকে যেমন গুরুতর, তেমনই অপরদিকে নিতান্তই হাস্যকর। মুসলিমদের প্রণীত ও প্রচারিত যাবতীয় প্রচারপত্রাদি থেকে একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ভারত সাম্রাজ্য এক বিপদসংকুল অবস্থা অতিক্রম করছে। বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রত্যেকটি মানুষ বর্তমান অবস্থায় অবশ্যই উপলব্ধি করবেন যে, মুসলিমদের মধ্যে যাঁরা অপেক্ষাকৃত অধিক বেপরোয়া, তাঁরা বহু বছর যাবৎ প্রকাশ্যে রাজদ্রোহিতায় লিপ্ত আছে। পক্ষান্তরে সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের চিন্তাধারা সর্বকালের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক প্রশ্নে আলোড়িত হচ্ছে। মুসলিম আইনে বিদ্রোহকে আনুষ্ঠানিক ও প্রকাশ্যভাবে অবশ্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কোনো-না-কোনোভাবে যেন প্রত্যেকটি মুসলিমদের প্রতি নির্দেশ জারি হয়েছে বিদ্রোহের প্রশ্নে তাঁর সিদ্ধান্ত ঘোষণার করার।” হান্টার মুসলিমদের বিদ্রোহে যতই ধর্মকে সম্পৃক্ত করুক না-কেন, তাঁর লেখাতে এটা স্পষ্ট হয় যে, মুসলিমদের লাগাতার অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামে ব্রিটিশদের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। হান্টার সাহেব মুসলিমদের সংগ্রামের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। হান্টারের বিবরণ থেকেই জানা যায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের অবদান ও প্রভাব কতখানি ছিল, যা অন্যান্য ঐতিহাসিকরা সযত্নেই এড়িয়ে গেছেন।

বিপ্লবী মজনু শাহ সম্বন্ধে যামিনীমোহন ঘোষ এবং উইলিয়াম হান্টারের লেখা গ্রন্থ থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। স্বাধীনতা আন্দোলনে মজনু শাহ শহিদ হওয়ার পরেও তাঁর দলের অন্যান্য যে নেতারা সেই সংগ্রাম বহুদিন পর্যন্ত চালিয়েছেন তাঁদের নাম মোহম্মদ শাহ, পেরাগুল শাহ, মুসা শাহ, মতিউল্লাহ শাহ, নিগাহ শাহ, বুদু শাহ, চেরাগ আলি শাহ, ইমাম শাহ প্রমুখ। এঁরা ব্রিটিশ ম্যাকেঞ্জির আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীকে সাময়িক পরাজিত করেছিলেন ১৭৬৯ সালে। এই সংগ্রামের নেতৃত্বে ছিলেন মজনু শাহ। ১৭৭১ সালে লেফটেন্যান্ট টেলর পরিচালিত ব্রিটিশ বাহিনীকে মজনু শাহের দল পরাজিত করে। ১৭৭৬ সালে ১৪ নভেম্বরে লেফটেন্যান্ট রবার্টসন ও তাঁর সুদক্ষ বাহিনীকেও ভীষণভাবে পরাজিত করে মজনু শাহ বাহিনী এবং রবার্টসন ওইসময় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন। দশ বছর পরে ১৭৮৬ সালে ২৯ নভেম্বর লেফটেন্যান্ট ব্রোম্যানের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে মজনু শাহ বাহিনীর প্রচুর লড়াই হয়। উভয় পক্ষই আহত ও নিহত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকের মতে, ব্রিটিশরা পলিসি প্রয়োগ করে কিছু সন্ন্যাসীকে বিপ্লবী ফকির দলে ঢুকিয়ে দেয়। সেই হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলিম ফকিরদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়ে যায়। ব্রিটিশদের নিয়োগ করা সন্ন্যাসীর মাধ্যমে ফকির বাহিনীর গোপন ঘাঁটি ও গোপন বিষয়ের খবর পেয়ে যায়। তারপরে মজনু বাহিনীকে ব্রিটিশরা পরাজিত ও ধ্বংস করে দেয়।

দুঃসাহসী বিপ্লবী দুই ভাই সাদুল্লাহ খান ও হাবিবুল্লাহ নিজেদের ছোট্ট বাহিনীর ব্রিটিশদের কোমর ভেঙে দিয়েছিল। শুধু ব্রিটিশ নয়, ব্রিটিশদের দেশীয় দালাল জাঠ ও মারাঠাদেরও কোমর ভেঙে দিয়েছিল। বহু ব্রিটিশ সৈন্য তাঁদের হাতে মৃত্যু হয়। অবশেষে দুই ভাই বন্দি হন। ক্যাপ্টেন উইলসন ক্রোধ সামলাতে না-পেরে লাফিয়ে সাদুল্লাহ খানের দাড়ি ধরে জোরসে ঝাঁকুনি দিয়ে দিল। এ সময় হাবিবুল্লাহ খান ক্যাপ্টেনের পেটে কষিয়ে লাথি মারেন। লাথি খেয়ে ক্যাপ্টেন সেখানেই উল্টে পড়ে গেলেন এবং কোঁকাতে থাকলেন। এহেন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লেফটেন্যান্ট হাইন সৈন্যদের হুকুম দিলেন ওঁদের ফাঁসিতে ঝোলাতে। সৈন্যরা তড়িঘড়ি দুই ভাইকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিল।

পরবর্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল প্রকৃত অর্থে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত ও সম্মিলিত সংগ্রাম। ভারতবর্ষ দেশপ্রেম, ঐক্য ও সংহতি, উৎসাহ ও উদ্দীপনা, আবেদ ও উত্তাপের এমন প্রাণপূর্ণ দৃশ্য আর কখনো দেখা যায়নি। তবে শুরু থেকে অনেকটা সময় নেতৃত্বের অগ্রণী ভূমিকায় মুসলিমদেরই পাল্লা ভারী ছিল। এসময় অধিকাংশ আন্দোলনের নেতা ও সেনা অধিনায়ক ছিলেন মুসলিম। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, সে সময় শিখ ও কোনো কোনো প্রদেশের নবাবরা এ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। বরং ব্রিটিশরাই তাঁদেরকে বিদ্রোহ দমনের কাজে ব্যবহার করত। মুসলিম বীর বিপ্লবী আজিমুল্লাহ খান, জেনারেল বখত খান, খান বাহাদুর খান, মাওলানা আহমদুল্লাহ, মাওলানা লিয়াকত আলি, হজরত মহল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মৌলভী আহমদুল্লাহ শাহ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে হোমজ লিখছেন –“মৌলভী আহমদুল্লাহ শাহ ছিলেন উত্তর ভারতে ব্রিটিশদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু।” পণ্ডিত চন্দ্রলাল লিখছেন– “এ-কথা সন্দেহাতীত যে, পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীনতা সংগ্রামের শহিদদের মধ্যে ১৮৫৭ সালের মৌলভী আহমদুল্লাহ শাহের নাম চির গৌরবান্বিত ও প্রোজ্জ্বল করে রাখবে।” মালেসন লিখেছেন– “মৌলভী আহমদুল্লাহ এক বড়ো বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব ছিলেন, বিদ্রোহের সময় সেনাপতি রূপে তিনি দক্ষতা ও কৃতিত্বের অপূর্ব স্বাক্ষর রেখেছেন।” এই বীর বিপ্লবী আহমদুল্লাহের সঙ্গে কতজন ভারতীয় পরিচিত হয়েছেন?

নির্মম গণহত্যায় ব্রিটিশদের মূল টার্গেট ছিল মূলত মুসলিমরাই। কারণ বহু ব্রিটিশরা মনে করত যে, মূলত ইসলামি জিহাদ এবং মুসলিমরাই এই বিদ্রোহের নায়ক। ব্রিটিশ লেখক হেনরি মিডের বক্তব্য– “This rebellion, in its present phase, cannot be called a sepoy Mutiny. It did begin with the sepoys, but soon its true nature was revealed. It was an Islamic revolt.” জনৈক সমসাময়িক ঐতিহাসিক মুসলিমদের সংগ্রাম বিষয়ে লেখেন– “প্রতিটি ইংরেজদের অভ্যাসই হয়ে গিয়েছিল যে, তাঁরা প্রত্যেক মুসলিমকেই বিদ্রোহী মনে করত। প্রত্যেক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করত সে হিন্দু না মুসলিম। উত্তরে মুসলিম শুবলেই গুলি চালাত।”

স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে মুসলিমদেরই। দেশের জন্য বলিদানে মুসলিমদেরই পাল্লা ভারী। ব্রিটিশদের শাসনের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ ও লেখকরা ভাবতে থাকে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের জন্য মূলত মুসলিমরাই দায়ী। ব্রিটিশরা ভারতের মুসলিমদেরকে ভিলেন বানিয়ে ছেড়েছে। বুঝিয়ে দিতে পেরেছে ভারতের মুসলিম হিন্দুদের শত্রু, ভারতের শত্রু। ভারত উপমহাদেশের মুসলিমরা আজও সেই মাশুল গুনে চলেছে। বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য দুটি উদ্ধৃতি তুলে এই অধ্যায় শেষ করব। ১৮৫৭ সালের ২১ জুন ফিল্ড লর্ড রবাটস তাঁর মাকে লিখেছেন– “মৃত্যুদণ্ডের সবচেয়ে কার্যকর ও সুন্দর ব্যবস্থা হল কামানের গোলায় উড়িয়ে দেওয়া। এই দৃশ্য বড়ো বীভৎস হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা সতর্কতার সঙ্গে কাজ চালাতে পারছি না। আমাদের উদ্দেশ্য, বদমায়েস মুসলিমদের একথা বুঝিয়ে দেওয়া যে, ঈশ্বরের সাহায্যে ইংরেজরা এখনও হিন্দুস্তানের অধিপতি থাকবে।” শুরু এখান থেকেই। হেনরি হেমিল্টন থমাস, যিনি তৎকালীন বাংলার একজন বড়ো সিভিল কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি ১৮৫৮ সালে ‘Late Rebellion in India and our Future Policy’ গ্রন্থে মুলিমদের প্রতি ব্রিটিশদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করেছে। লিখেছেন– “আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের মূল নায়ক ও প্রবক্তা হিন্দু ছিল না। এখন আমি একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করব যে, এ বিদ্রোহ ছিল মুসলিমদের চক্রান্তের ফল। হিন্দুরা নিজেদের ইচ্ছা ও উপকরণ পর্যন্ত সীমিত থাকলে এমন কোনো চক্রান্তে তাঁরা অংশগ্রহণ করতে পারত না এবং করতেও চাইত না। মুসলিমরা প্রথম খলিফার সময়কাল থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত দাম্ভিক, অসহিষ্ণু ও অত্যাচারী হিসাবেই নিজেদের পরিচয় দিয়ে আসছে। সর্বদা তাঁদের লক্ষ্য এটাই থাকে যে, যে-করেই হোক ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং খ্রিস্টানদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব জিইয়ে রাখতে হবে। মুসলিমরা কখনো ভিন্ন ধর্মানুসারী সরকারের ভালো প্রজা হতে পারে না। কেননা কোরানের নির্দেশমালার উপস্থিতিতে এই সহাবস্থান সম্ভব নয়।”

ভারতের মুসলিমদের সর্বনাশের শুরু এখান থেকেই। বিপন্নতার শুরুও এখানে থেকেই। হিন্দু-খ্রিস্টান সাঁড়াশি নির্যাতনে মুসলিমরা একপ্রকার কোণঠাসা হয়ে পড়ল। ক্রমশ নিজভূমে পরবাসী হতে থাকল অবিশ্বাস আর ঘৃণার বাতাবরণে। শুরু হল মুসলিমদের জব্দ করার প্রক্রিয়া। ১৯১৮ সালে রাওলাট রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাতে মুসলিমদেরই বিশেষভাবে টার্গেট করে বিদ্রোহের জন্য দায়ী করা হয়। ব্রিটিশ প্রশাসকের উচ্চপদস্থ অফিসার ও কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, মুসলিমদেরকে প্রশাসন-যন্ত্রের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি থেকে পৃথক রাখতে হবে। তাঁদের জীবিকার উৎস বন্ধ করে দিতে হবে। ১৮৬৯ সালের ১৪ জুলাই কলকাতার একটি সংবাদপত্র ‘দূরবিন’-এ যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল, তার মূল বিষয়বস্তু ছিল এরকম –“Recently, when several vacancies occurred in the office of the Sunderbans Commissioner, that official in advertising them in the Government Gazette, atated that the appointment would be given to none but Hindus.” Commenting on the above complaint, the author goes on to say : “….. the Muslims have now sunk so low that, even when qualified for Government employment, they are studiously kept out of it by government notification. Nobody takes any notice of their helpless condition, and the higher authorities do not deign even to acknowledge their existence.”

১৮৫৭ সাল থেকে মুসলিমদের ব্রাত্য করতে করতে ১৯০১ সালে এসে এক আদমসুমারিতে দেখা যাচ্ছে বাংলায় ৫০.৫২ শতাংশ সরকারি পদে যেখানে বর্ণহিন্দুরা অধিষ্ঠিত ছিলেন, সেখানে মুসলিমদের ভাগে মাত্র ৬.৪৫ শতাংশ। এর কারণ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি ব্রিটিশদের চরম শোষণ ও বঞ্চনা তো ছিলই, সেইসঙ্গে মুসলিমদেরও চাকুরি উপযুক্ত হয়ে ওঠার ব্যাপারে উদাসীনতা ছিল। চাকরি করার মানসিকতা তো তৈরি করতে হবে। তার উপর ব্রিটিশদের কাছে। ব্রিটিশ তথা ইংরেজরা যখন এদেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে উঠেছিলেন তখন শাসনক্ষমতায় মূলত ছিল মুসলিম শাসকরা। মুসলিমদের একটা বড়ো অংশ মনে করত ইংরেজরা এদেশে প্রবেশ করার তাঁদের স্বর্ণযুগ নষ্ট হয়েছে। মুসলমানরা ইংরেজদের স্পর্শ থেকে বহু যোজন দূরে সরে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকল। মূলস্রোত থেকে অনেক অনেক দূরে। অতএব ইংরেজ শাসনের প্রথম পর্বে হিন্দুদের চাইতে মুসলমানরাই ইংরাজদের কোপানলে পড়ে বেশি। মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষা বর্জন করল। ইংরেজি পড়া হারাম’ বলে এক অংশের মৌলবিরা ফতোয়া জারি করেছিলেন। এমনও প্রচার করা হয়েছিল যে, ইংরেজি শিখলে ধর্ম থেকে পতিত হবে। ফলে ইংরেজ শাসনের শুরুতেই মুসলমান সমাজ পিছিয়ে পড়ল। ১৮৩৭ সালে বড়লাট লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে ইংরেজি আধুনিক শিক্ষার সূচনার মাধ্যমে সেই ধারাবাহিকতায় ভাঙনের বা ভাটার সূচনা হয়। আধুনিক ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে যেমন বৃহত্তর ভারতবর্ষের মুসলিম সভ্যতার। পতনের বীজ রোপণ করা হয়, তেমনই জাতিধর্মনির্বিশেষে ভারতীয়দের হীনমন্যতার সূত্রপাতও হয় এই নবপ্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। মুসলমানরা ভারতের মূলস্রোত থেকে আর কীভাবে ছিটকে পড়ল? ব্রিটিশরাও চিন্তা করল বাজেয়াপ্ত করতে হবে ওয়াকফকৃত সম্পদ এবং জমিজমাগুলো যার সাহায্যে পরিচালিত হয় তাঁদের মাদ্রাসা ও প্রতিষ্ঠানগুলি। এর পরিবর্তে এমন বিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করতে হবে যেখান থেকে মুসলিমরা উপকৃত হতে না পারে। তবে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতের মুসলিমদের যে ছন্নছাড়া অবস্থা হয়েছিল তা থেকে তাঁদের উদ্ধার করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব আবদুল লতিফ এবং সৈয়দ আমির আলি। নবাব আবদুল লতিফ এবং সৈয়দ আমির আলি দুজনেই বঙ্গবাসী হলেও বাঙালি ছিলেন না। এঁরা ছিলেন আশরাফ মুসলিম, পারিবারিক ভাষা ছিল উর্দু। এই উর্দুভাষী মুসলিমরা সম্প্রদায়ের মাথা হলেও গরিব মুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অনেক দূরের।

তাঁবেদার, খেতাবলোভী, মোসাহেব, তৈলমর্দনকারী বণিক ও ধনিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাদা চামড়ার ব্রিটিশ শাসকদের প্রথম ১০০ বছর (১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭) রসে-ঘিয়ে ভালোই চলছিল। এই মধুচন্দ্রিমা যাপনে বাধ সেধেছিল মুসলিমরা। মহাবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে সোজা পাকা ধানে মই দিয়ে দিল। ব্রিটিশরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল মুসলিমদের হামলায়। বস্তুত মুসলিমরা কোনোদিনই কখনোই পশ্চিমা তথা ব্রিটিশদের পছন্দ করত না, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ঘৃণা করতেন। যদিও ব্রিটিশদের প্রতি মুসলিমদের এই ঘৃণার জন্য চরম মূল্যও চোকাতে হয়েছিল।

যাই হোক, একতরফাভাবে বিদ্রোহ করতে করতে একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ক্রমে ক্রমে মুসলমান এবং মুসলমান নেতারাও বুঝতে পারলেন ব্রিটিশদের সঙ্গে বিরোধিতা করে নিজেদের উন্নতি করা যাবে না। অতএব এবার ইংরেজদের সঙ্গে গলাগলি বাড়িয়ে হিন্দুদের সঙ্গে গালাগালির সম্পর্ক জমে ঘন হতে থাকল। মৌলানা কেরামত আলি এবং আবদুল লতিফের যৌথ উদ্যোগে দানা বেধে উঠল মুসলিমদের ইংরেজ-প্রেম। কেরামত আলি ঘোষণা দিলেন –ব্রিটিশ শাসন বা রাজত্ব মুসলিমদের কাছে আর শত্রুর দেশ’ নয় –ইসলামের দেশ। শুরু হল কেরামত আলির ধর্মীয় সংস্কার। কোরান প্রয়োগ করে বাংলার সংস্কৃতির শেষ করে দিল। যে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে নবান্ন উৎসব পালন করত, মুসলিম প্রাচীনপন্থীদের তরফ থেকে বলা হল—এটা পালন করা হারাম। হিন্দুদের পুজোপার্বণে মুসলমানদের যে সোৎসাহ অংশগ্রহণ ছিল, তাতে লক্ষণীয়ভাবে ভাটা পড়তে থাকল। মুসলমান বিবাহ ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ-গান-বাজনার ব্যবস্থা করত, বন্ধ হয়ে গেল। যাত্রাগানের আসর নিষিদ্ধ হল। এমনকি নিজেদের পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কেও মুসলিমরা হিন্দুদের থেকে ফারাক বাড়াতে থাকল। মুসলিমরা ধুতি পরত, এবার ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি পরা শুরু করল, কেউ কেউ গোড়ালির উপর পর্যন্ত ঝুলের পাজামা পরতে শুরু করে দিল। বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবি-ফারসি আমদানি করে এক ধরনের ভাষা-সংস্কৃতির উদ্ভাবন হল। বাঙালি মুসলিম নিজেদের দৈনন্দিন সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনকে কার্যত পালটে দিল। এক আশ্চর্য মিথ্যা স্বাতন্ত্রবোধ এর পিছনে কাজ করতে শুরু করে দিল।

অবশেষে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের উত্থানের অনেক বছর পর মুসলিমরা জেগে ওঠার চেষ্টা করে পাল্টা সংগঠন তৈরি করে। সেই সংগঠনের নামে মুসলিম লিগ। সমগ্র উপমহাদেশে মুসলিমদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক হয়ে পড়ল উর্দুভাষী মুসলিমরা। মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠার পিছনে ছিল এই উর্দুভাষী মুসলিমরাই। নেতৃত্বে ছিলেন এলিট ঢাকার নবাব পরিবার। এঁরা ছিলেন মূলত কাশ্মীরি মুসলিম। ব্রিটিশদের বদান্যতায় পাওয়া নবাব উপাধিধারী। সে সময় বাংলার মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একাংশ প্যান ইসলামিক মোহে মশগুল হয়ে পড়লেন। এই প্রবণতা দেখা যায় ১৮৮২ সালে জামালউদ্দিন আফগানির সফরের পর থেকেই। জামালউদ্দিন ছিলেন আফগানিস্তানের বাসিন্দা। তিনি একবার কলকাতাতেও এসেছিল সভা করতে। কিন্তু বাংলার প্রধান মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাঁকে সভা করতে দেয়নি। কারন জামালউদ্দিন ছিলেন ব্রিটিশদের কাছে বিপজ্জনক ব্যক্তি। বাংলার মুসলিমরা পাছে রাজরোষে পড়ে যায়, সেই কারণেই সভা করাতে আপত্তি। জামালউদ্দিন কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেও প্যান ইসলামিকের ভূত অনেকদিন ধরেই বাংলার মুসলিমদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল।

অবশেষে ভারত উপমহাদেশের সমগ্র মুসলিমদের মঙ্গল ও উন্নতির ধোঁয়া তুলে মুসলিমদের এলিট গোষ্ঠী মুসলিমদের জন্য আলাদা দেশ চাইলেন। হয়তো উপকৃত হয়েছিল সেই ভূখণ্ড, যে ভূখণ্ডে মুসলিমরা আগেই থেকে বসবাস করত। তাঁরা প্রায় হিন্দু-শিখ মুক্ত একটা দেশ পেয়েছিল। কিন্তু সেই ভূখণ্ডের বাইরে ভারতের মূল ভূখণ্ডের মুসলিমদের কতটা উপকার হল, সে-কথা বলাই বাহুল্য, ক্ষমতায় লালসায় তাঁদের চরম সংকটে ফেলে ফেলে দিল। ভারতের মুসলিমরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল। জিন্নাহ পাকিস্তান পেয়ে কতটা তৃপ্তি (১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান পেলেন, আর ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যক্ষ্মারোগে মারা গেলেন। স্বপ্নের দেশে মাত্র ১ বছরের সুলতান চলে যাওয়ার আগে তিনি যে কত বড়ড়া ভুল করেছিলেন, তা। নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন) পেরেছিলেন জানি না, এই ‘পাকিস্তান’ যে ভারতের মুসলিমদের দফারফা করে দিল, সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

ঐতিহাসিক সত্যেন সেন লিখছেন –“ সত্য কথা বলতে গেলে বিনা বাধায় মোগল সাম্রাজ্য থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের খাসতালুকে পরিণত হয়ে গেল। বহুকাল আগে থেকেই ভারতের অপরিমিত ধনসম্পদের সত্য ও কল্পিত কাহিনি সারা বিশ্বময় প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল। তার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ইউরোপীয় জলদস্যু ও বণিকের দল একের পর ছুটে আসছিল এবং তাঁদের পরাস্পরের হানাহানির ফলে সমুদ্রের জল ও স্থলভূমি রক্তরাঙা হয়ে উঠেছিল– অবশেষে তার চূড়ান্ত অবসান ঘটল। ভাগ্যের নির্দেশে যাঁরা আগে এসেছিল তাঁরা পিছনে পড়ে গেল। আর ভাগ্যলক্ষ্মী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কণ্ঠে তাঁর জয়মালা পরিয়ে দিলেন।… যাঁরা ঘুমিয়ে ছিল, তাঁরা জেগে উঠল। যাঁরা বসে ছিল তাঁরা উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিন্তু এই পর্যন্তই। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো শক্তি তাঁদের ছিল কি? হয়তো তা ছিল, কিন্তু এই উন্নততর মারণাস্ত্রে সু-সজ্জিত শক্তির বিরুদ্ধে কে তাঁদের সংগঠিত করবে, কে তাঁদের নেতৃত্ব দেবে? তাঁদের নেতৃস্থানীয় অভিজাত শ্রেণির প্রভুরা তখন মধুপানে মত্ত হয়ে বিলাস-ব্যসনে ডুবে গেলেন। কে জানে হয়তো তখনও তাঁরা নিশ্চিন্ত মনে সুখস্বপ্ন দেখছিলেন –দিল্লি অনেক দূর।”

মুসলিমরা কি সত্যিই দেশভাগ চেয়েছিল? না, ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয় না। জিন্নাহর পাকিস্তান চাওয়াটাকে যদি মুসলিমদের দেশভাগ চাওয়া বোঝায়, তা হলে সেটা ঐতিহাসিকভাবে ভুল। বস্তুত ভারত নামে কোনো দেশ ছিল না, ছিল ভারত নামে এক উপমহাদেশ। সেই উপমহাদেশের পূর্বের ও পশ্চিমে অবস্থিত দুটি প্রদেশকে ভাগ করা হয়েছিল। সে সময় জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া’ ও ‘জমিয়ত উলামা-ই-হিন্দ’-এর মতো বিভিন্ন মুসলিম প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের প্রথম সারির নেতারা ভারতভাগ চাননি। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন স্বনামধন্য মুসলিম নেতাদের কথা উল্লেখ করতে পারি। যেমন– মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, খান আবদুল গফফর খান, হসরত মোহানি, আব্দুল কাইয়ুম খান, ড. জাকির হোসেন, গোলাম হুসেন হিদায়তুল্লাহ, মোহম্মদ আবদুর রহিমান, মৌলানা হুসেন আহমদ মাদানি, সৈয়দ মোহাম্মদ সারফুদ্দিন কাদরি প্রমুখ। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে মুসলিম নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নাম। তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং পাণ্ডিত্য কংগ্রেস নেতৃত্বকে অনেক জোর দিয়েছিল। মুসলিগের দ্বিজাতিতত্ত্বের তীব্র বিরোধী ছিলেন বলে উন্নাসিক জিন্নাহ কালামকে কংগ্রেসের ‘শো-পিস’ বলতেন। জাতপাতের উর্ধ্বে উঠে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “আমি একজন ভারতীয় হিসাবে গর্বিত। আমি নিজেকে অবিভক্ত ভারতের একটি অংশ বলে মনে করি। এই দেশের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হতে পেরে আমি খুশি। নতুন ভারত গড়ে তুলতে যেসব বিশেষ উপাদানের প্রয়োজন তার মধ্যে আমিও একটি উপাদান। আমি কোনোভাবেই পৃথক রাষ্ট্রের দাবিকে সমর্থন করি না।” খান আবদুল গফফর খান ছিলেন ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অবিসংবাদিত মুসলিম নেতা। ইনিও এক অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখতেন। জিন্নাহ ভারতভাগের দাবি তুললে খান আবদুল গফফর খান তার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। বস্তুত জাতীয় কংগ্রেস ভারতবিভাগে সম্মতি প্রদান করলে তিনি খুবই হতাশ হয়ে পড়েন। মেনে নিতে পারেননি। এ বিষয়ে নিজের আক্ষেপকে আড়াল না-করে জাতীয় কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন –“তোমরা আমাদের নেকড়ের মুখে ছুঁড়ে দিলে।” স্বাধীনতা সংগ্রামী মৌলানা হসরত মোহানি ১৯২১ সালে তাঁর রচিত ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ মন্ত্রে পরাধীন ভারতের বিপ্লবীরা দীক্ষিত হয়েছিলেন। জয়হিন্দ’ শ্লোগানের স্রষ্টাও যে একজন মুসলিম, নাম তাঁর আবিদ হাসান। আবিদ হাসান আজাদ হিন্দ ফৌজে সুভাষচন্দ্র বসুর সহযোদ্ধা। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের মতে, মোহানি ভারত-পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিবাদ করেন। মোহানিই প্রথম সেই ব্যক্তি, যিনি ১৯২১ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের বার্ষিক অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার (আজাদ-ই-কামিল) দাবি তোলেন। আব্দুল কাইয়ুম খান আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি ও লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে শিক্ষাজীবন। পেশায় আইনজীবী। ১৯৩৪ সালে জাতীয় কংগ্রেসে যোগদানের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ড. শামসুল ইসলাম তাঁর ‘Muslim against Partition of India’ গ্রন্থে লিখেছেন– ভারতবিভাগের আগে আব্দুল কাইয়ুম খান ঘোষণা করেছিলেন নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও তিনি উত্তর পশ্চিম সীমান্ত তথা ভারতের অখণ্ডতাকে রক্ষা করবেন। স্বাধীন ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি ড. জাকির হোসেন গান্ধির অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী এই মহান নেতা ভারতবিভাগের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। গোলাম হুসেন হিদায়তুল্লাহ ১৯২৬ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি পান। ১৯৩৩ সালে তিনি মর্যাদাপূর্ণ ‘নাইট কম্যান্ডার’ পদে নিযুক্ত হন। ব্রিটিশ শাসনকালেই তিনি সিন্ধু প্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন। হুসেন হিদায়তুল্লাহ ভারতবিভাগ সিদ্ধান্তের চরম বিরোধিতা করেছিলেন। মোহম্মদ আবদুর রহিমান ১৯২১ সালের দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের উদ্ধার করে তিনি নায়কোচিত ভূমিকা পালন করেন। তিনি বেশ কয়েকবার কারারুদ্ধও হন। মহাত্মা গান্ধির অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী আবদুর রহিমান মুসলিম লিগের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পৃথক রাষ্ট্রের দাবির বিরুদ্ধে বহু মুসলিমকে একজোট করেছিলেন। মৌলানা হুসেন আহমদ মাদানি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। মুসলিমদের একটি বিশাল অংশের উপর মাদানির প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। শুধুমাত্র জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজন –এই তত্ত্বে মাদানি বিশ্বাসী ছিলেন না। কংগ্রেস ভারতবিভাগকে সমর্থন জানালে মাদানি এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বিস্মৃতিপ্রায় নায়ক সৈয়দ মোহাম্মদ সারফুদ্দিন কাদরি। ১৯৩০ সালে গান্ধিজির লবণ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কাদরির বিপ্লবী জীবনে প্রবেশ। মহাত্মা গান্ধির অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রত্যেকটিতে যোগদান করেন এবং গান্ধিজির সঙ্গে কারারুদ্ধ হন। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা গড়ে তোলেন। (রাজা নকভি, কলম, ২ আগস্ট ২০১৮) একজনের কথা আর-একটু বিস্তারিত উল্লেখ না-করলে ইতিহাসের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। তিনি হলেন খান আবদুল গফফর খান। তৎকালীন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বিশৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধে মহাত্মা গান্ধির অহিংস নীতি প্রচার ও ধারণ করার জন্য তাকে সীমান্ত গান্ধি উপাধি দেওয়া হয় বলা হয়। তিনি সর্বদাই মহাত্মা গান্ধির অহিংস নীতির একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। খান আব্দুল গফফর খানের নেতৃত্বে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আইন অমান্য আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। ১৯১৯ সালে তিনি রাওলাট বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন এবং ১৯২৩ সালে সীমান্ত প্রদেশে খিলাফৎ আন্দোলন সংগঠিত করেন। কংগ্রেসের নীতি অনুসরণ করে তিনি উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ‘খোদা-ই-খিদমদগার’ নামে একটি দল গঠন করেন। খোদা-ই-খিদমতগার’-এর অর্থ হল ঈশ্বরের সেবক। এই দলের অনুগামীদের পোশাক লাল ছিল বলে একে ‘লালকুর্তা’ও বলা হত। খান আবদুল গফফর খানের নেতৃত্বে খোদা-ই-খিদমার অসহযোগ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ১৯৩১ সালে এই দল কংগ্রেসে যোগদান করে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সহ দেশের অন্যান্য অংশে আইন অমান্য আন্দোলনের ক্রমবিস্তার এবং গতিবেগ ব্রিটিশ সরকারের গভীর চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। নিষ্ঠুর অত্যাচার ও নির্যাতন সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার জাতীয়তাবাদীদের কণ্ঠরোধ করতে পারেনি।

১৯২৯ সালের নভেম্বরে খান ‘খোদা-ই-খিদমতগার’ (সার্ভেন্টস অব গড) নামে আন্দোলনটির সফলতা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের টনক নড়ায়। তাঁরা গফফর খান ও তাঁর সহযোগীদের কঠোর হাতে দমন করে। বস্তুত ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের দমন করতে ব্রিটিশ রাজ যেসব শাস্তি দিয়েছে, তার মধ্যে নির্মমতম শাস্তি দেওয়া হয়েছে এই গফফর খান ও তাঁর সঙ্গীদের। নিজের উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া, ব্রিটিশদের সদা দমনমূলক নিষ্ঠুর আচরণ, গোঁড়া মোল্লাদের নির্যাতন এবং পাখতুন সমাজে নিজেদের মধ্যে তীব্র হিংসা ও প্রতিশোধের প্রাচীন সংস্কৃতি লক্ষ্য করে গফফর খান আবার বুঝতে পারলেন, এই সমাজকে ওঠাতে হলে এখানকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে ব্যাপক শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজন। তাঁর নির্মিত উৎঞ্জিয়া স্কুলের সাফল্য দেখে প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন লোকজন তাঁকে সমাজসংস্কারের ব্যাপারে আহ্বান জানায়। ১৯১৫ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে পুরো খাইবার পাখতুনখাওয়ার ৫০০টি গ্রাম ঘুরে পশতুনদের মধ্যে একটি জাগরণ তোলেন। এই কাজে তাঁর এত উত্তেজনা ও পরিশ্রম দেখে লোকে গফফর খানকে ‘বাদশা (বাচা) খান’ বলা শুরু করে, যার মানে হল তিনি সব ট্রাইবাল বা উপজাতি প্রধানদের রাজা। খানসাহেব নিজেও একজন ‘সেকুলার মুসলিম ছিলেন। সাধারণভাবে ধর্ম নিয়ে এবং মুসলমানদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে ভাগাভাগিতে তিনি বিশ্বাস করতেন না। একসময় একটি স্বাধীন ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারত’ দেখার ফর্মুলা গফফর খানের মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। এ লক্ষ্যেই তিনি খুদাই খিদমতগার’ (ঈশ্বরের দাস) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। যেটা সাধারণভাবে ‘সুখ পশ’ (রেড শার্ট) বলে অধিক পরিচিত ছিল। তিনি এই লাল শার্ট বাহিনী গান্ধির সত্যাগ্রহের মডেলে তৈরি করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় এক লাখ সদস্য ছিল। তিনি তাঁদের বলেছিলেন, “আমি তোমাদের এমন একটি অস্ত্র দেব, যার নাম সততা ও ধৈর্য। পৃথিবীর কোনো শক্তিই তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না।”

ব্রিটিশ রাজের হাতে এই সংগঠনের সদস্যদের উপর নিঠুর নির্যাতন চালানো ও মৃত্যু হলেও খানের এই কৌশল অনেকটাই সফল হয়েছিল। গফফর খানের ভাই ড. খান আবদুল জাব্বার খান এই সংগঠনের রাজনৈতিক বিভাগ পরিচালনা করেন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি এই ফ্রন্টিয়ার প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৩০ সালের ২৩ এপ্রিল গান্ধিজির লবণ সত্যাগ্রহ কালে গফফর খানকে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় ‘খোদা-ই-খিদমতগার থেকে একদল জনতা পেশোয়ারের কিসসা খাওয়ানি বাজারে প্রতিবাদ করতে জমায়েত হয়। ব্রিটিশ সৈন্য দল এই নিরস্ত্র জনতার উপর বেপরোয়াভাবে মেশিনগানের গুলি চালালে ২০০ থেকে ২৫০ লাল কুর্তিওয়ালা কর্মী নিহত হয়। চন্দ্র সিং গাড়োয়ালের নেতৃত্বে দুই প্লাটুন গাড়োয়াল রাইফেল রেজিমেন্টও সেখানে গিয়েছিল। তাঁরা নিরীহ এই জনতার উপর গুলি চালাতে অস্বীকার করলে তাঁদের কোর্ট মার্শাল করে কঠিন শাস্তি, এমনকি জেল পর্যন্ত দেওয়া হয়।

১৯৩১ সালে তাঁকে জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণের আহ্বান জানানো হলে তিনি তা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “আমি একজন সাধারণ সৈনিক মাত্র এবং আমি ও খোদা-ই-খিদমতগার’ কেবল আপনাদের সেবায় নিযুক্ত থাকব। তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন বহুদিন। একবার পার্টির যুদ্ধনীতির (ওয়ার পলিসি) সঙ্গে একমত না হয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে পার্টি ওয়ার পলিসি’ সংশোধন করে নিলে তিনি আবার পার্টিতে ফিরে আসেন। তিনি নারী অধিকারেরও একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন।

গফফর খান ভারতবিভাগের তীব্র বিরোধী ছিলেন। কিছু কিছু রাজনীতিবিদ তাঁকে মুসলিম-বিরোধী বলে অভিহিত করেন। ১৯৪৬ সালে মারধর করে তাঁর শরীর এমনভাবে জখম করে দেওয়া হয় যে, তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ২১ জুন দেশ ভাগের মাত্র ৭ সপ্তাহ আগে বায়ুতে গফফর খান, ‘খুদাই খিদমতগার’-এর সদস্যরা, প্রাদেশিক সভার সদস্যগণ, মিরজালি খান ও উপজাতি প্রধানদের নিয়ে একটি ‘লয়া জিরগা (জনসমাবেশ) বসে। বাম্বু রেজুলিউশনে স্থির হয়, ব্রিটিশ টেরিটোরির সব পাখতুন এলাকা নিয়ে ‘পাখতুনিস্তান’ নামে সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি এলাকা তাঁদের দেওয়া হোক। তাঁরা ইন্ডিয়া বা পাকিস্তান কারও সঙ্গে যেতে চায় না। কিন্তু ব্রিটিশ রাজ এই দাবি মানতে অস্বীকার করে। জাতীয় কংগ্রেসও ‘ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান’ ও গান্ধির দেওয়া জিন্নাহকে ‘প্রধানমন্ত্রী পদের প্রস্তাবও মানতে রাজি হয় না। এভাবে দেশভাগ ঠেকাবার শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়। সে জন্য গফফর খান মনে করেন, ভারত ও পাকিস্তান উভয় মিলেই তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তিনি মর্মাহত হয়ে তাঁর পূর্বের কংগ্রেস পার্টির সদস্যদের ও গান্ধিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তোমরা আমাদের নেকড়ের সামনে ছুঁড়ে দিলে।” যেহেতু দেশভাগ ঠেকানো করা গেল না, অতএব ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানের মধ্যে চলে যায়। সেখানে তিনি সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও তাঁকে নানাভাবে সন্দেহ করা হয়। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি গৃহবন্দীসহ নানা শাস্তির মধ্যে ছিলেন। এরপর বহুবার তাঁকে কারাগার ও গৃহে অন্তরীণ করে রাখা হয়। ১৯৮৮ সালে গফফর খান গৃহবন্দি অবস্থাতেই পেশোয়ারে মারা যান।

এই অধ্যায় শেষ করব একজন মুসলিম দাতার কথা বলে। নিজাম মির উসমান আলি খান, ১৯১১ সালে তিনি ‘নিজাম’ হন এবং ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি হায়দ্রাবাদের (এখনকার মহারাষ্ট্র, অন্ধপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও কর্ণাটক মিলিয়ে ছিল তখনকার হায়দ্রাবাদ ছিল) নিজাম বা শাসক ছিলেন। আপনার মনে হতে পারে, যাই বলুন ৭ টি স্ত্রী, ৩৪ টি সন্তান এবং অগণিত রক্ষিতা নিয়ে জীবন কাটানো নিজাম আদৌ সুবিধের লোক ছিলেন না। তদুপরি ভারত বিরোধী ছিলেন। কেউ কেউ তাঁকে হিন্দু বিদ্বেষী একজন কট্টর মুসলিম শাসক ও শোষক হিসাবে দেখিয়েছেন। কিন্তু তিনি ধর্মের ভিত্তিতে সদ্য তৈরি হওয়া পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর সাম্রাজ্যকে যুক্ত করেননি। তবে এটুকুতেই মির উসমান আলিকে চেনা যাবে না। জানতে হবে তিনি তাঁর স্বদেশভূমি ভারতের জন্য কী করে গেছেন। অনেকের অপছন্দের নিজাম বাহাদুর ভারতের জন্য যেটা করে গেছেন, তা আজ পর্যন্ত কেউ করতে পারেননি। ভবিষ্যতেও পারবেনও না। তখন ১৯৬৫ সাল, ভারতকে চোখ রাঙাচ্ছে চিন। সঙ্গে পেয়েছে দোসর পাকিস্তানকে। দেশকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচাতে ভারত তৈরি করল জাতীয় নিরাপত্তা তহবিল। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী হায়দরাবাদে গেলেন। নিজামকে অনুরোধ করলেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা তহবিলে নিজামকে কিছু দান করার জন্য। কিপটে’ নিজাম সব শুনে মিটি মিটি হাসতে হাসতে নিজের সেক্রেটারিকে ডাকলেন। একটা কাগজে উর্দুতে কী একটা লিখে দিলেন। সেক্রেটারি কাগজটা তুলে চমকে উঠেই নিজেকে সামলে নিলেন। ভারতের নিরাপত্তা তহবিলে নিজাম ওসমান আলি ডোনেশন দিলেন। চমকে গেল বিশ্ব। দিলেন পাঁচ টন সোনা। এর সঙ্গে নগদে দিলেন ৭৫ লক্ষ টাকা। সে সময়ে ৭৫ লক্ষ টাকা সংখ্যার মূল্যমানটা নেহাত কম নয়। ১৯৬৫ সালে নিজামের দেওয়া পাঁচ টন সোনা এখনও পর্যন্ত ভারতের জাতীয় কোশাগারে দান হিসাবে দেওয়া সবচেয়ে বড়ো অর্থরাশি। এত টাটা, বিড়লা, আম্বানি, আদানি, মিত্তাল এলেন-গেলেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি তো বটেই, কোনো প্রতিষ্ঠানও এত পরিমাণ সম্পদ দেশের সুরক্ষা খাতে দান করার বুকের পাটা দেখাতে পারেননি।

ভারতের প্রচলিত ইতিহাসের কোথাও সে দেশের এক মুসলিম নারী সুরাইয়া বদরুদ্দিন তায়াবজির নাম পাওয়া যায় না। ভারতের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসেবে সর্বত্র যে নামটি পাওয়া যায় সেটি হল পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া। কিন্তু তিনি কী বাস্তবে ভারতের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার? বর্তমানে ভারতের যে জাতীয় পতাকাটি পতপত করে ওড়ে সেটির ডিজাইনার পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া নয়। এটির প্রকৃত ডিজাইনার এক মুসলিম নারী সুরাইয়া বদরুদ্দিন তায়াবজি। কী, বিশ্বাস করতে বা মেনে নিতে বুকে শূলবেদনা হচ্ছে? বিশ্বাসের উপর তো জবরদোস্তি চলে না। তার চেয়ে বরং দেখা যাক ভারতের জাতীয় পতাকার ইতিহাস। তালেগোলে যে ইতিহাসটা আমরা ভুলে গেছি বা মনে রাখতে চাইনি।

ভারতের জাতীয় পতাকা হল কেন্দ্রে ২৪টি দণ্ডযুক্ত নীল ‘অশোকচক্র’ সহ গেরুয়া, সাদা ও সবুজ আনুভূমিক আয়তাকার ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা। ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই গণপরিষদের একটি অধিবেশনে এই পতাকার বর্তমান রূপটি ভারত অধিরাজ্যের সরকারি পতাকা হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তীকালে এটি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকার মর্যাদা লাভ করে। এ পতাকার কেন্দ্রে আছে অশোকচক্র, যা সম্রাট অশোক নির্মিত সিংহশীর্ষযুক্ত অশোকস্তম্ভ থেকে নেওয়া। ভারত প্রায় বৌদ্ধশূন্য হলেও ভারতের প্রথম বৌদ্ধসম্রাট অশোককে আমরা জাতীয় মর্যাদায় গ্রহণ করেছি বটে, কিন্তু আত্মীকরণ করিনি। যাই হোক, সম্রাট অশোক হিন্দু-মুসলিম সবার কাছেই শ্রদ্ধেয় হওয়ায় এ অশোকচক্র গৃহীত হয় সবার কাছে। মজার বিষয় হল, সম্রাট অশোক হিন্দু-মুসলিম সবার নিকটই শ্রদ্ধেয় হলে অশোকচক্র সেই মুসলিম সম্প্রদায়কে মর্যাদা দিতে পারেনি। সেই অশোকের দেশে মুসলিমদের পাকিস্তানে বিতারণ করে দিতে চায় সংখ্যাগুরুরা, উৎখাত করতে চায়। যাক গে সে কথা, আসল বিষয়ে আসি। কিন্তু পতাকার কীভাবে এলো এই চক্রটি? খনন-ক্রিয়ায় বেরিয়ে আসে সেই মুসলিম নারীর নাম— সুরাইয়া বদরুদ্দিন তায়াবজি।

ভারতের পতাকার তিনটি বর্ণ। আর এই ত্রিবর্ণের পতাকা দুটি স্থানে উত্তোলনের খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি ছিল কলকাতায় এবং অন্যটি জার্মানিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেড এনসাইন ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধিরূপে সর্বাধিক গুরুত্ব অর্জন করেছিল। ১৯৪৫-৪৭ সময়পর্বে জাতিসংঘে এই পতাকাটিই ভারতের পতাকা হিসাবে ব্যবহৃত হত। উভয় পতাকারই ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনার ছিলেন। ১৯০৬ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার পার্সিগান স্কোয়ারে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী এক সভায় প্রথম ভারতের ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলিত হয়। অপরদিকে ১৯০৭ সালে ২২ জুলাই জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে ভিখাজি কামা অন্য একটি ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করেন। ভিখাজি কামা, সাভারকর ও শ্যামজি কৃষ্ণ বর্মা একযোগে এই পতাকাটির নকশা অঙ্কন করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে বার্লিন কমিটিতে ভারতীয় বিপ্লবীরা এই পতাকাটি গ্রহণ করেন।

ভারতের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত নাম পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া। বলা হয়, তিনিই ভারতের জাতীয় পতাকাটির ডিজাইন করেছেন। ১৯১৬ সালে অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপত্তনম শহরের নিকটস্থ ভাটলাপেনামারু গ্রামের বাসিন্দা পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া একটি সাধারণ জাতীয় পতাকার রূপদানের চেষ্টা করেন। মহাত্মা গান্ধির ইচ্ছানুসারে একটি নতুন পতাকার নকশা করা হয়। এই ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার তিনটি রং— সংখ্যালঘু ধর্মসম্প্রদায়, মুসলমান ও হিন্দুদের প্রতীক। তিনটি ডোরা জুড়ে খচিত ছিল চরকার ছবি। অবশ্য ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কখনোই এটিকে সরকারি পতাকা হিসাবে গ্রহণ করেনি। কেন মেনে নেননি তা অনুমেয়।

ভারতের পতাকায় নানা ধর্মীয় প্রতীক সংযোজনে আরও বহু ধর্ম ও গোত্র তাঁদের প্রতীক সংযোজনের দাবি করতে থাকে। এছাড়া পতাকার এই সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি অনেকের মনেই অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সর্বভারতীয় সংস্কৃত কংগ্রেস হিন্দুধর্মের প্রতীক রূপে গেরুয়া রং ও বিষ্ণুর গদার চিত্র পতাকায় সংযোজনের প্রস্তাব দেয়। এই বছরই ‘হিন্দু যোগী ও সন্ন্যাসী এবং মুসলিম ফকির ও দরবেশদের মধ্যে প্রচলিত ত্যাগের প্রতীক’ গেরু বা গিরিমাটি রং পতাকায় যোগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। শিখে সম্প্রদায় দাবি তোলে, হয় তাঁদের ধর্মের প্রতিনিধিরূপে হলুদ রং পতাকায় রাখতে হবে, নয়তো পতাকায় কোনো ধর্মীয় প্রতীকতত্ত্বই থাকবে না, বাদ দিতে হবে।

ভারতের স্বাধীনতার কয়েকদিন আগে জাতীয় পতাকার বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য গণপরিষদ স্থাপিত হয়। গণপরিষদ রাজেন্দ্র প্রসাদের নেতৃত্বে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সদস্যরা ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, সরোজিনী নাইডু, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, কে এম মুন্সি ও বি আর আম্বেদকর। পতাকা কমিটি গঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ২৩ জুন। তিন সপ্তাহ পর তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পতাকাটিই উপযুক্ত সংস্কারের পর সব দল ও সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণীয় করে তুলে জাতীয় পতাকা হিসাবে গৃহীত হবে। পরে এমন প্রস্তাবও গৃহীত হয় যে, ভারতের জাতীয় পতাকার কোনো সাম্প্রদায়িক গুরুত্ব থাকবে না। সে সময়েই চরকার পরিবর্তে সারনাথ স্তম্ভ থেকে অশোকচক্রটি গৃহীত হয় পতাকায়। যদিও এই অশোকচক্রটি বৌদ্ধশাসক ও বৌদ্ধধর্মের প্রতীকই হল। হয়তো জেনেবুঝেই হল। কারণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তখন ভারতের ধর্মীয় যুযুধান পক্ষ নয়। অপরদিকে হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মীয় সম্প্রদায় ভয়ানক যুযুধান পক্ষ। আমরা দেখব ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট স্বাধীন ভারতে প্রথমবার যে পতাকাটি উত্তোলিত হয় এবং আজও উত্তোলিত হয়, তার কথা। কিন্তু কোথা থেকে এল এই চক্রটি? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না।

অন্য পতাকাগুলিতে ভারতের জাতীয় পতাকার মাঝে কোনো চক্র ছিল না। কিন্তু এ চক্রের আইডিয়াটি কার মাথা থেকে আসে এ বিষয়টি ইতিহাসে পাওয়া যায় না। পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার পতাকার যেই ডিজাইনটা করেছিলেন, তার কেন্দ্রে ছিল একটি চরকা, চক্র নয়। তাহলে পতাকায় ব্যবহৃত চক্রটি সংযোজনের চিন্তাটি কার মাথা থেকে এসেছিল? এ বিষয়ে ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ লিখেছেন, চরকা পছন্দ করা হয়েছিল কারণ এটি ধর্ম ও আইনের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে চরকার বদলে অশোকচক্রকে গ্রহণ করার ব্যাপারটি নেহরু স্বাগত জানান। তিনি পতাকায় চরকার বদলে ধর্মচক্র সংযোজনের বিষয়টিকে বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ বলে মনে করেন। তবে গান্ধি বিষয়টি প্রথমে পছন্দ না-করলেও পরে মেনে নেন। কিন্তু সে চক্র পতাকায় কে তুলে ধরলেন? এ বিষয়ে উত্তর মেলে এক ব্রিটিশ ইতিহাসবিদের লেখনিতে।

সুরাইয়া তায়াবজির তৈরি করা ভারতের জাতীয় পতাকাটি প্রথম গৃহীত হয় ১৭ জুলাই ১৯৪৭ সালে। ভারতীয় কোনো ইতিহাসবিদদের লেখায় সুরাইয়ার তৈরি করা পতাকাটির বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ট্রেলোর রয়েল (Trevor Royle)-এর বইতে সুরাইয়ার নাম পাওয়া যায়। তাঁর লেখা ‘The Last Days of the Raj’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভারতীয় জাতীয় পতাকাটির ডিজাইনার বদরুদ্দিন তায়াবজির স্ত্রী সুরাইয়া তায়াবজি। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ লিখেছেন— “ভারতের ইতিহাসের মাঝে চলমান এ ধরনের বিতর্কের মাঝে আর-একটি হল জাতীয় পতাকার ডিজাইন একজন মুসলিমের করা। বাস্তবে তিন রঙের পতাকাতে ছিল একটি চরকা, যা গান্ধি তাঁর দলের চিহ্ন হিসাবে ব্যবহার করতেন। তায়াবজি মনে করেন এটি ভুল বিষয় উপস্থাপন করবে। এরপর বহু চাপের পর গান্ধি এ চক্রটি পতাকায় নিতে রাজি হন। কারণ সম্রাট অশোেক হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের নিকটই সম্মানিত ছিলেন। পতাকাটি নেহরুর গাড়িতে ওড়ে সেই রাতে, যা বিশেষভাবে তৈরি হয়েছিল তায়াবজির স্ত্রীর হাতে।”

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ সুরাইয়ার কথা লিখে গেলেও তা ভারতীয় ইতিহাসে মনে রাখেনি। ভারতীয় বিভিন্ন দলিলপত্র ও পাঠ্য বইতে সর্বদা জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসাবে পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার নামই পাওয়া যায়। সুরাইয়া বদরুদ্দিন তায়াবজি সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। জানা যায়, সুরাইয়ার স্বামী ছিলেন বদরুদ্দিন ফাইজ তায়াবজি। তিনি একজন ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) অফিসার হিসাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে কর্মরত ছিলেন। সে সময়েই ভারতের জাতীয় পতাকার ডিজাইন করেন তাঁর স্ত্রী। এরপর নেহরুর কাছে পতাকাটি নিয়ে গেলে তিনি তা পছন্দ করেন এবং তাঁর গাড়িতে লাগিয়ে নেন। এরপর এই পতাকাটিই গৃহীত হয় ভারতের জাতীয় পতাকা হিসাবে। এক ভারতীয় মুসলিম নারীর অবদান আমরা বেমালুম ভুলে গেলাম!

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের আগে পর্যন্ত ভারতের স্কুল, কলেজের পাঠ্যপুস্তকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যক্ষেত্রে মুসলিমদের অনেক ভূমিকা ও উপস্থিতি পরিলক্ষিত হত। ধীরে ধীরে সিলেবাস বদল হতে হতে, বিশেষত ইতিহাস বারবার পুনর্লিখিত হওয়ার ফলে ভারতের নানা ক্ষেত্রে মুসলিমদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদানের কথা একরকম ধামাচাপা পড়ে গেল। এর ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে তা অজানা আর চোখে না-পড়ার ফলে বয়স্কদের কাছেও সেসব স্মৃতিও আর বেঁচে নেই। ভারতের স্বাধীনতা-পূর্ব, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভারতের মুসলিমদেরও যে অনেক মূল্যবান অবদান ছিল এবং আছে, সে সম্পর্কে পাঠকদের জানাতে এই অধ্যায়টি লেখার প্রয়োজন হল। সংক্ষেপে যতটুকু উল্লেখ করা সম্ভব হল, ততটুকুই জানাতে সক্ষম হলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *