১.৫.১৬ আকবর (শাসনকাল : ১৫৫৬ সাল থেকে ১৬০৬ সাল)

আকবর (শাসনকাল : ১৫৫৬ সাল থেকে ১৬০৬ সাল)

সাম্রাজ্যে অস্থিরতা ভর করতে পারে, এমনটা ভেবে হুমায়ুনের মৃত্যুসংবাদ ১৭ দিন গোপন রাখা হয়েছিল। পিতা হুমায়ুনের আকস্মিক মৃত্যুতে পুত্র আকবরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তরদি বেগ ও অন্য আমিররা দিল্লির জুমা মসজিদে আকবরের নামে খুতবা (এটি একটি আরবি শব্দ। বাংলায় অর্থ হয় ভাষণ) পড়লেন এবং হুমায়ুনের উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করলেন। বৈরাম খাঁ তৎক্ষণাৎ তাঁর রাজতিলকের ব্যবস্থা করলেন। ১৫৫৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আকবরের রাজ্যাভিষেক হয় এবং তাঁকে মোগল সম্রাট হিসাবে গ্রহণ করা হল। তাঁরতাঁর মরিয়ম-উজ জামানি, সেলিমা সুলতান বেগম, রুকিয়া সুলতান বেগম, বেগম রাজ কানয়ারি বাই, বেগম নাথি বাই, কুশমিয়া বানু। বেগম, বিবি দৌলত শাদ বেগম, রাজিয়া সুলতান বেগম সহ আরও পাঁচজন স্ত্রী ছিলেন। যে সময় জন্ম নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা আবিষ্কার হয়নি, সেই নিরিখে মাত্র আটটা– হাসান, হুসাইন, জাহাঙ্গির, দানিয়েল মির্জা, মুরাদ মির্জা, আরাম বানু বেগম, সাকার-উন-নিশা বেগম, শেহজাদি খাতুন।

ছেলেবেলা থেকে আমরা সকলেই সম্রাট আকবরকে শ্রেষ্ঠ সম্রাট’ বলে জেনে এসেছি। আকবরের পুরো নাম আবদুল ফতহ জালাল-উদ-দিন মোহাম্মদ আকবর। কীভাবে ভারতের হাজার হাজার মুসলিম শাসকদের মধ্য থেকে আকবরই একমাত্র শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠলেন? আকবরের এই শ্রেষ্ঠত্ব কতটা গ্রহণযোগ্য? ভারতে শাসক হিসাবে আওরঙ্গজেবকে যতটা ঘৃণা করা হয়, ঠিক ততটাই ধন্য ধন্য করা হয় আকবরকে নিয়ে। একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে।

হুমায়ুন-হামিদা বানুর পুত্র আকবরকে ১৫৫১ সালে গজনির শাসনকর্তা নিয়োগ করা হয় এবং এই সময় রুকিয়া বেগমের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পরে আকবরকে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা হিসাবে নিয়োগ করা হয়। আকবরের যখন রাজ্যাভিষেক হয় তখন বয়স মাত্র ১৩ বছর ৪ মাস। আকবরের অভিভাবক হিসাবে ছিলেন বৈরাম খাঁ। অভিষিক্ত হওয়ার পরপরই আকবর দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। বিনা বাধায় আকবরের সিংহাসনে অভিষেকের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার ছিল। ডাঃ আর পি ত্রিপাঠী মন্তব্য করেছেন– “আকবরই ছিলেন অপ্রাপ্তবয়স্ক রাজা, যাঁর সিংহাসনের দাবি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি।” ১৫৫৬ সালে অভিষেকের পর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়েছেন একথা মনে করার কোনো কারণ নেই। তাঁকে রীতিমতো যুদ্ধ, রক্তপাত এবং মানসিক দৃঢ়তা প্রদর্শন করে অভিভাবক বৈরাম খাঁর হাত থেকে প্রকৃত ক্ষমতা নিতে হয়েছে। যদিও বৈরামের পতনের পর আকবর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়েছেন একথাও বলা যায় না। তাঁকে বিভিন্ন বিদ্রোহী, স্বাধিকার-প্রমত্ত কর্মচারী, আফগান, উজবেগি বিদ্রোহীদের দমন করে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে হয়েছে। তবে আকবর উপলব্ধি করেছিলেন মোগল অভিজাতদের সিংহাসনের বশ্যতা বাধ্য না-করাতে পারলে প্রকৃত ক্ষমতা পাওয়া অসম্ভব। কারণ সুলতানি যুগে অভিজাত শ্রেণিকে সর্বদা সিংহাসনের সমকক্ষতা দাবি করতে দেখা যেত। আকবর আরও উপলব্ধি করতেন যে, সর্বভারতীয় জাতীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রশাসন-যন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে তাঁর নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, অভিজাতদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিলে ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঐক্য স্থাপন করার পথে বাধা আসবে।

সম্রাট আকবর ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ শাসক এবং তুখোড় বুদ্ধিধর। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন রাজপুতদের শক্তি ও সাহসিকতার সঙ্গে তাঁর এঁটে ওঠা প্রায় অসম্ভব। পূর্বসূরি মুসলমান শাসকরা যেমন রাজপুতদের খুঁচিয়েছিলেন, আকবর কিন্তু সেই পথে হাঁটলেন না। সাপ মরবে লাঠি ভাঙবে না’– এমন এক কার্যকরী কৌশল অবলম্বন করলেন। অর্থাৎ রাজপুতদের দিয়েই রাজপুতদের বিদ্রোহ দমন। রাজপুতদের অভিজাতদের আপন করে নিলেন। বহু রাজপুতকে আকবর রাজদরবারে চাকরি দিলেন। তদুপরি বিয়ে-শাদির মধ্য দিয়ে সামাজিক সম্পর্ক বেশি করে বাড়িয়ে তুললেন। সম্রাট আকবর অম্বরের কাচ্ছোরা রাজা বিহারীমলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বশ্যতা স্বীকার করেন এবং তাঁর কন্যার পাণিগ্রহণ করলেন (সামন্ততান্ত্রিক বা রাজতন্ত্রের যুগে বিয়ে একটা রাজনৈতিক কৌশল। বিয়ের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে করতলগত করা এবং নিজের শক্তি বৃদ্ধি করাই ছিল মুখ্য উদ্দ্যেশ্য। সে কারণেই সে সময়কার রাজা/সুলতানদের একের অধিক রানির উপস্থিতি লক্ষ করতে পারি। কখনো কখনো নিজেরা বিয়ে না করলেও রাজনৈতিক কৌশলটা মাথায় রেখেই পুত্র-প্রৌত্র-কন্যাদের বিয়ে দিতেন। রাজনৈতিক লাভের কথা মাথায় রেখেই পাত্র বা পাত্রী মনোনীত হত। একাধিক বিয়ের ব্যাপারে রাজা/শাসকদের যৌনকাতর ভাবার কোনো যৌক্তিকতা নেই।) বিহারীমলের পুত্র ভগবান দাস ও পৌত্র মানসিংহ আকবরের বিশ্বস্ত মনসবদার হিসাবে নিযুক্ত হন। মুসলিম অভিজাতদের একচেটিয়া ক্ষমতার বিরুদ্ধেও রাজপুতদের ব্যবহার করার নীতি আকবর পত্তন করেন।

১৫৬২ সালে তিনি মারওয়াড়ের মের্তা দুর্গ অধিকার করে রাজপুতানার দরজা খুলে ফেলেন। আকবর এবার স্বভাবতই রাজপুতানার দিকে নজর দেন। তিনি বুঝলেন, ভারতে আফগানদের তখনও পর্যন্ত স্বদেশীয় এবং মোগলদের বিদেশি মনে করত। অতএব ভারতে মোগল শক্তিকে আফগান শক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজপুত জাতির ক্ষাত্রশক্তিকে মোগলের স্বার্থে ব্যবহার করা দরকার। রাজপুতদের মিত্রতা পেলে মোগলের পক্ষে ভারতে স্থায়ী আধিপত্য স্থাপন সহজ হবে। এজন্য তিনি রাজপুত রাজারা মোগলদের বশ্যতাদানের বিনিময়ে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার এবং অন্যান্য বিপুল সুযোগসুবিধা দেন। তিনি বিহারীমলে কন্যাকে বিয়ে করেছেন শুধু তাই নয়, বিহারীমলের পুত্র ভগবান দাসের কন্যার সঙ্গে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র জাহাঙ্গিরকেও বিয়ে দেন। রাজপুত-মৈত্রী নীতি ফলপ্রসূ হয়। এর ফলে যোধপুর, জয়পুর, বঁদি তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে। রাজপুত শক্তিকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান স্তম্ভে পরিণত করার প্রচেষ্টা আরম্ভ হয়।

সাম্রাজ্যের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিভেদকামী, স্বেচ্ছাচারী শক্তিগুলির মূল উৎপাটন করে আকবর সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপনের বিরাট আয়োজনে আত্মনিয়োগ করেন। রাজপুতদের প্রত্যক্ষ শক্তি নিয়ে প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে তিনি একের পর এক গ্রাস করার নীতি নেন। এর পিছনে তাঁর উচ্চাকাঙ্খ ও সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা কাজ করেছিল। সেটাই স্বাভাবিক। শাসকদের রাজ্য বাড়ানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকবে না এটা আবার হয় নাকি! দেশের আয়তন বৃদ্ধি বা হ্রাসের উপরই শাসকদের ওজন বা সমীহ নির্ভর করত। এইভাবে আকবর সর্বপ্রথম উত্তর ও মধ্য ভারত সম্পূর্ণভাবে তাঁর অধীনে আনেন। দক্ষিণেও তিনি রাজ্য বিস্তার করেন। এরপর ১৬০১ সালে দক্ষিণে আসিরগড় দুর্গ জয় করার পর আকবর তাঁর তরবারি কোশবদ্ধ করেন।

ডাঃ এ এল শ্রীবাস্তবের মতে, তাঁর রাজত্বকালের দ্বিতীয় ভাগে আকবর মানবতাবাদী, জাতীয় নীতি গ্রহণ করে বহু সংস্কার প্রবর্তন করেন। এর ফলেই তিনি জাতীয় সম্রাটে পরিণত হন। তিনি কোনো কোনো অঞ্চলে প্রত্যক্ষ শাসন স্থাপন করলেও রাজপুতানায় রাজপুত রাজাদের বশ্যতার বিনিময়ে স্বায়ত্বশাসন দেন। বিজিত অঞ্চলে তাঁর উন্নত শাসন, বিচারব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা স্থাপন করেন। আকবর তাঁর ধর্মসহিষ্ণুতা বা সুলহ-ই-কুল নীতিদ্বারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্য ও সম্প্রীতি স্থাপন করেন। সুশাসকের নীতি এমনই হওয়া উচিত। সুশাসক কখনো বিভাজনের রাজনীতি করেন না। তিনিই বিভাজনের রাজনীতি করেন, যিনি দেশের সম্পদ লুটেপুটে খেতেই শাসক হয়েছেন। যাই হোক, হিন্দু রাজপুতদের উচ্চতম পদে নিয়োগ করে সমদর্শিতার দৃষ্টান্ত রাখেন আকবর। মোগল সাম্রাজ্যের শাসন, রাজস্ব, সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্য হিন্দু সম্প্রদায় রাজপুত নেতাদের অকুণ্ঠ সমর্থন পান। জিজিয়া ছিল অ-মুসলিমদের উপর কর। এই কর প্রমাণ করত মুসলিম রাষ্ট্রে অ-মুসলিমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। আকবর এই কর লোপ করে হিন্দুদের এবং মুসলিম প্রজাদের সঙ্গে সমান মর্যাদা দেন। সে সময় বহু হিন্দু ফারসি শিখে মোগল সরকারের চাকরি করতেন। মনসবদারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদও আকবর মানসিংহের মতো রাজপুত সেনাপতির জন্য খুলে দেন। তিনি রাজপুত ও অন্যান্য হিন্দুদের বিভিন্ন উচ্চ ও দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন। বস্তুত এই পদগুলি মুসলিম প্রশাসক বা সেনাপতিদের একচেটিয়া ছিল। তাঁর রাজসভায় টোডরমল, বীরমল, ভগবান দাস, মনসিংহ প্রমুখ প্রশাসক ও সেনাপতির স্থান হয়। শুধু আকবরই নয়, প্রায় সব মুসলমান শাসক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণগুলি হিন্দুদের দিয়ে অলংকৃত করেছেন। তার মানে এটা বলা নয় যে, তাঁরা হিন্দু সম্প্রদায়কে দয়া করতেন। তাঁরা যোগ্যতম, বিশ্বস্ত ও সাহসীদেরই রাজদরবারে রাজপদে স্থান দিতেন। সেটাই স্বাভাবিক। যোগ্যতার প্রশ্নে কোনো আপোস চলে না। হিন্দু পদাধিকারিকরাও কখনো মুসলিম শাসকদের সঙ্গে বেইমানি করেননি। পিছন থেকে ছুরিও মারেননি কেউ। শাসকদের নির্দেশ অনুযায়ী তাঁদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতেন। তবে আকবর কেন শ্রেষ্ঠ সম্রাটের মর্যাদা পেল? আকবর আর পাঁচটা শাসকদের মতো হিন্দু রাজাদের করতলগত করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের করলেও সেইদিকটা অত্যন্ত গৌণভাবে দেখা হয়েছে। মুখ্যভাবে দেখা হয়েছে আকবরের সামাজিক সংস্কার, ধর্মীয় সংস্কার এবং রাজনৈতিক সংস্কার, যা ব্যাপকভাবে মানুষকে মুগ্ধ করেছে।

হ্যাভেলের মতে, আকবর ছিলেন ভারতীয়ের মধ্যে ভারতীয়’ (Indian of Indians)। যদিও তাঁর শিরার শিকড়ে কোনো ভারতীয় রক্ত ছিল না, তবুও তিনি ভারতীয় চিত্রকলা, স্থাপত্য, সংগীত ও সাহিত্যের সমাদর করতেন। তাঁর সভায় ছিলেন বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ তানসেন, সুরসিক সমালোচক বীরবল, চিত্রকর মহেশ দাশ প্রমুখেরা। তিনি ইন্দো-মুসলিম স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সম্রাট আকবর বাদায়নির সাহায্যে রামায়ণের ফারসি অনুবাদের ব্যবস্থাও করেন। তিনি হিন্দু, জৈন পণ্ডিতদের সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করতেন। তিনি তাঁর দরবারে হোলি উৎসব, ঝরোখা দর্শন ইত্যাদি প্রথা চালু করেছিলেন। সম্রাট ভারতের ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত করে দেন। কোতোয়ালদের ক্রীতদাস কেনাবেচা বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। যুদ্ধবন্দিদের ক্রীতদাসে পরিণত করা নিষিদ্ধ করে দেন। বলা বাহুল্য, এর ফলে বহু হিন্দুবন্দি ক্রীতদাস বা দাসে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। আকবর ভারতীয় নয়, একথা বলিই-বা কী করে? পূর্বপুরুষ বাবরের সময়কাল (১৫২৬ সাল) থেকে আকবরের সময়কাল (১৬০৫ সাল) পর্যন্ত প্রায় ৮০ বছর এক টানা বসবাস করেও যদি ভারতীয় না-হয় তাহলে কে ভারতীয়? আকবরের জন্মস্থান উমরকোট (বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত), মৃত্যু হয়েছে ফতেপুর সিক্রি (বর্তমান ভারত)।

আকবরের দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছরের রাজত্বকালের ইতিহাস আমরা জানতে পারি সমসাময়িক বহু ইতিহাস-গ্রন্থ থেকে। তার মধ্যে অন্যতম আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’ ও ‘আইন-ই-আকবরি’। আবুল ফজল মধ্যকালীন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক শুধু নয়, তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিকদের একজন। তিনি ছিলেন আকবরের রাজদরবারের ঐতিহাসিক এবং সম্রাটের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অতএব অনেকের মতো আমিও মনে করি তাঁর কাজও পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। আবুল ফজলের ইতিহাস থেকে নিরপেক্ষতা আশা করা অবৈজ্ঞানিক হবে। ইতিহাসে পক্ষপাতিত্ব থাকবে না, তা হয় না? কারোর ইতিহাস কেমনভাবে রচিত হবে তা নির্ভর করে কে রচনা করছেন তার উপর। কুখ্যাতিটাও অতিরঞ্জিত হতে পারে, আবার সুখ্যাতিটাও অতিরঞ্জিত হতে পারে। যিনি ইতিহাস বিশ্লেষক, তিনি বিশ্লেষণ করে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করবেন।

আকবরকে দিল্লির সিংহাসন থেকে অপসারিত করার জন্য মোহম্মদ শাহ আদিলের সেনাপতি হিমু বিশাল সেনাদল নিয়ে আগ্রা দিকে রওনা দেন এবং অনায়াসেই আগ্রা দখল করেন। এখান থেকে তিনি দিল্লি দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন এবং দিল্লির শাসনকর্তা তার্দিবেগ তাঁকে বাধা দেন। কিন্তু তার্দিবেগ পরাজিত হয়ে পালিয়ে বাঁচেন। এর ফলে দিল্লি হিমুর অধিকারে আসে। তিনি ‘বিক্রমাদিত্য’ নাম ধারণ করে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। ১৫৫৬ সালে হিমুকে শায়েস্তা করার জন্য বৈরাম খাঁ দিল্লির পথে এগিয়ে যান। পাণিপথে উভয়ে মিলিত হন। এই যুদ্ধই পাণিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ বলে পরিচিত। এই যুদ্ধে হিমুর হস্তিবাহিনী বৈরাম খাঁয়ের বাহিনীকে প্রায় বিধ্বস্ত করে ফেলে। মোগলবাহিনী ছত্রখান হয়ে যায়। কিন্তু চোখে তীরবিদ্ধ হিমু সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে নেতৃত্বহীনতায় হিমুর বাহিনী অসহায় হয়ে পড়েন। বৈরাম খাঁ সুযোগ বুঝে আক্রমণ করে হিমুকে বন্দি করেন। এসময় বৈরাম খাঁ প্রায় ২৫০০ হাতি সহ বিপুল পরিমাণ যুদ্ধের সরঞ্জাম অধিকার করতে সক্ষম হন। এ ঘটনার পর বৈরাম খাঁ আহত হিমুকে হত্যা করে দিল্লির রাজপথে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে রাখেন। শের শাহের বংশধরদের একজন শাসক আহমদ শাহ সুর, যিনি পাঞ্জাবে সিকন্দর শাহ নাম ধারণ করে রাজত্ব করতেন। পাণিপথের যুদ্ধের আগেই উত্তর পশ্চিম সীমান্তের দিকে সিকন্দর সুরের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠান। সে সময় সিকন্দর শাহ পালিয়ে শিবালিক পর্বতে আশ্রয় নেন। পাণিপথের যুদ্ধে জয়লাভের পর বৈরাম খাঁ পুনরায় তাঁর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠান। এই সময় সিকন্দর শাহ বশ্যতা স্বীকার করে একটি জায়গির লাভ করেন। বৈরাম খাঁর শত্রুদের প্ররোচনায় ১৫৬০ সালে আকবর তাঁকে পদচ্যুত করেন এবং নিজের হাতে শাসনভার তুলে নেন। বৈরাম খাঁকে মক্কা যাওয়ার সুযোগ দেন। কিন্তু পথিমধ্যে জনৈক আফগান তাঁকে হত্যা করেন। ১৫৬১ সালে আফগান সর্দার বাজবাহাদুরকে দমন করার জন্য আদম খাঁকে পাঠান। আদম খাঁ বাজবাহাদুরকে পরাজিত করে এবং আকবরকে অবজ্ঞা করতে শুরু করেন। ফলে আকবর নিজেই আদম খাঁর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাঁকে দমন করেন। এরপর তিনি পির মোহম্মদকে মালবের শাসনকর্তা হিসাবে নিয়োগ করেন। প্রশাসক হিসাবে পির মোহম্মদ অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। তাই তাঁকে অচিরেই পরাজিত করে বাজবাহাদুর মালব দখল করেন।

সম্রাট আকবর বুঝলেন ভারতে আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে রাজপুতদের সহযোগিতা দরকার, এই বিবেচনায় তিনি রাজপুতদের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ১৫৬৪ সালে আকবর মধ্যপ্রদেশের গণ্ডোয়ানা রাজ্য দখলের জন্য আসফ খাঁকে পাঠান। এসময় গণ্ডোয়ানায় রানি দুর্গাবতী তাঁর নাবালক পুত্র বীরনারায়ণের অভিভাবক হিসাবে রাজত্ব করতেন। এই যুদ্ধে পরাজয়ের পর রানি দুর্গাবতী আত্মহত্যা করেন। ফলে এই রাজ্য আকবরের অধিকারে চলে আসে। এই বছরেই মালবের বিদ্রোহী শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ খাঁ উজবেকে দমন করার জন্য আকবর মালব অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। পথে খান্দেশ রাজ্যের শাসক মিরন মুবারকের সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ হয়। তিনি মিরন মুবারকের কন্যাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। পরে এই বিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৫৬৪ সালে তিনি হিন্দুদের উপর থেকে জিজিয়া কর তুলে নেন।

১৫৬৭ সালে সম্রাট আকবর চিতোর আক্রমণ করেন। চিতোর ছিল মেবার বা মেওয়ারের রাজধানী। মেবারের রাজা রানা উদয় সিংহ আকবরকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতেন এবং তিনি মালবের রাজা বাজবাহাদুরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তা ছাড়া গুজরাটে আক্রমণ পরিচালনার জন্য চিতোর দখল করাটাও তাঁর জরুরি ছিল। আক্রমণের শুরুতেই উদয় সিংহ পালিয়ে আশ্রয় নেন এক পার্বত্য অঞ্চলে। কিন্তু জয়মল এবং পাত্ত নামক দুইজন টানা চার মাস ব্যাপী মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে এই দুই সেনাপতিরই মৃত্যু হয়। দুর্গের ভিতরের মহিলারা অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ১৫৬৮ সালে আকবরের দখলে আসে মেবারের রাজধানী চিতোর এবং আসফ খাঁকে এখানকার শাসনকর্তা হিসাবে নিযুক্ত করেন। এরপর ১৫৬৯ সালে সম্রাট আকবর রণথোম্বর রাজ্য আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে রাজপুত রাজা সারজনহারা পরাজিত হয়ে সন্ধির প্রস্তাব দেন। সেইসঙ্গে তাঁর দুই ছেলে ভোজ ও দুদাকে মোগল দরবারে পাঠিয়ে দেন। সারজনহারাকে পরে উপহারস্বরূপ বারাণসী ও চুনারের জায়গির করা হয়। রাজত্ব খুঁইয়ে জায়গিরদারি, তাইই সই! এবার আকবর কালিঞ্জর দখলের জন্য সেনা পাঠান। না, কালিঞ্জরের রাজার সঙ্গে কোনো যুদ্ধই করতে হয়নি। একেবারে বিনা বাধাতেই কালিঞ্জর দখল করে নেন আকবর। কালিঞ্জরের রাজা আত্মসমর্পণ করেন। উপহারস্বরূপ কালিঞ্জরের রাজাকেও এলাহাবাদের কাছে জায়গির একটি দেওয়া হয়। কালিঞ্জরের রাজারও নাকের বদলে নুরুন। অপরদিকে কালিঞ্জরের শাসনভার পেলেন সেনাপতি মাজনুর খাঁ। আকবর এবার গুজরাটের দিকে দৃষ্টি ঘোরান। ১৫৭০ সাল। সে সময়ে গুজরাটের সুলতান ছিলেন তৃতীয় মুজফফর খাঁ। আকবরের বিদ্রোহী আত্মীয়স্বজন তখন গুজরাটে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তাঁরা নানাভাবে গুজরাটে অশান্তির সৃষ্টি করছিল। এমতাবস্থায় গুজরাটের শান্তির জন্য মুজফফর খাঁর মন্ত্রী ইমদাদ খাঁ আকবরের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১৫৭২ সালে আকবর তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে গুজরাটে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে পরাজিত হন মুজফফর খাঁ এবং আত্মগোপন করেন। অবশেষে মুজফফর খাঁকে আকবর বন্দি করেন। এরপর ইমদাদ খাঁ আকবরের হাতে নগরের চাবি তুলে দেন। আকবরও ইমদাদ খাঁর হাতে গুজরাটের একটি অংশের শাসনভার তুলে দেন। অপর অংশের শাসনভার দেন মির্জা আজিজ কোকার হাতে। এরপর আকবরের গন্তব্য ক্যাম্ব। ক্যাম্বে তুর্কি, সিরিয়, ইরানি ও পর্তুগিজ বণিকরা তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে বণিকদের সবরকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি সুরাট ফিরে যান। সেখানে হুমায়ুনের এক বিশ্বস্ত অনুচর হামজাবান স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে আকবর হামজাবানের রাজ্য সুরাট অবরোধ করেন। সুরাটরাজ হামজাবান আকবরকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য পর্তুগিজদের সাহায্য নেন। কিন্তু আকবরের তীব্র আক্রমণে হামজাবান এবং পর্তুগিজ গোলন্দাজ বাহিনী পরাজিত হয়। মোগলসৈন্যরা হামজাবানকে বন্দি করেন। অপরদিকে পর্তুগিজরা প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে আকবরের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আকবরও তাঁদের ক্ষমা করে দেন। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে এ সময় ভারতের পশ্চিম উপকূলে পর্তুগিজদের ব্যাপক আধিপত্য ছিল। অতএব পর্তুগিজদের চটানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়, সেটা আকবর বিলক্ষণ বুঝেছেন। এই পর্তুগিজরাই ভারত থেকে যেসব মুসলমানরা হজ করার জন্য মক্কায় যেতেন, তাঁদের উপর অত্যাচার করত। আকবর ক্ষমার খাতিরে চুক্তির দ্বারা মুসলমানদের হজে যাতায়াতে যাতে বিঘ্ন না ঘটায় তার অঙ্গীকার করিয়ে নিলেন পর্তুগিজদের কাছ থেকে। এ থেকে বোঝাই যায়, সে সময় ভারতে কেবলমাত্র আরব তুরস্ক থেকে মুসলমানরা আসত না, আসত অন্যান্য বিদেশিরাও। এসে ভারতীয়দের সাহায্যেই ভারতে ঘাঁটি গড়ত। যাই হোক, এরপর কুলিজ খাঁকে সুরাট দুর্গের অধিপতি করেন এবং খান-ই-আজমকে গুজরাটের শাসনকর্তা হিসাবে নিযুক্ত করেন। মুজফফর খাঁকে করেন মালবের শাসনকর্তা। ১৫৭৩ সালে আকবর ফতেপুর সিক্রিতে চলে আসেন। ১৫৭৪ সালে আকবর ভাকার দুর্গ দখল করেন। এই দখলের মাধ্যমেই তিনি সিন্ধুর বিশাল অংশ দখলে আনেন। ১৫৭২ সালে উদয় সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রানা প্রতাপ সিংহ পুনরায় আকবরের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। সম্রাট আকবর সেনাপতি মানসিংহ এবং আসফ খাঁর অধীনে এক বিশাল সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। ১৫৭৬ সালে হলদিঘাটে উভয় বাহিনী মুখোমুখী হয়। এই যুদ্ধে রানা প্রতাপ সিংহ পরাজিত হয় এবং পার্শ্ববর্তী এক পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করেন।

১৫৬৪ সালে বাংলাদেশের (অবিভক্ত বঙ্গ) কররানি রাজবংশের সুলতান সুলেইমান আকবরের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ফলে তখন বাংলা হল মোগলদের করদ রাজ্য। সুলেইমানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দাউদ বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সম্রাট আকবর দাউদকে দমন করার জন্য সেনাপতি টোডরমল। এবং মুনিম খাঁকে প্রেরণ করেন। ১৫৭৫ সালে তুকারই সমরক্ষেত্রে এদের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে উভয় বাহিনীই জয়লাভে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়। এরপর ১৫৭৬ সালে রাজমহল সমরক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে অবশেষে বাংলার স্বাধীন সুলতান দাউদ পরাজিত ও নিহত হন। এরপর বাংলায় মোগল শাসনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। কিন্তু বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তখনও আফগান শাসকরাই স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। এদিকে মুনিম খাঁর মৃত্যুর পর মোগল শিবিরে ভাঙন ধরে। এসময় অনেকেই মোগল শিবির ত্যাগ করে দিল্লিতে চলে যায়। ইত্যবসরে মির্জা হাকিম নামে এক ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসাবে ঘোষণা করে দেন। এইভাবে বাংলা সহ বিহার মোগল সাম্রাজ্য থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে। সম্রাট আকবর এবারও মির্জা হাকিম ও অন্যান্য বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য টোডরমল এবং মানসিংহকে পাঠিয়ে দেন। টোডরমল দমনের কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করেন। অপরদিকে মির্জা হাকিম যাতে পাল্টা আক্রমণ না করতে পারেন, সেটা প্রতিরোধের দায়িত্বে থাকলেন স্বয়ং মানসিংহ। টোডরমল আর মানসিংহের প্রচেষ্টায় বাংলা পুনরায় মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৫৭৬ সালে আকবর খান্দেশ রাজ্য আক্রমণ করলেন। খান্দেশের শাসক ছিলেন রাজা আলি খাঁ। মোগলবাহিনী খান্দেশ অবরোধ করেন। ফলে খান্দেশের পরাজিত শাসক আলি খাঁ প্রচুর অর্থ প্রদান করে মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেন। এরপর খান্দেশ মোগলদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। সম্রাট আকবর এবার কাবুলের দিকে দৃষ্টি দেন। ১৫৮১ সালে তিনি কাবুলে সামরিক অভিযান চালান এবং বিনা বাধায় কাবুল দখল করে ফেলেন। কিন্তু বাংলার স্বাধীন সুলতান মির্জা হাকিম আকবরের অধীনতা অস্বীকার করলে আকবর মির্জা হাকিমের বোনের হাতে কাবুলের শাসনভার দিয়ে দিল্লিতে ফিরে আসেন। ১৫৮৫ সালে আহম্মদনগরের মির মুর্তজা এবং অন্যান্যা অভিজাত ব্যক্তিবর্গ প্রধানমন্ত্রী সালাবৎ খাঁর বিরুদ্ধে মোগল দরবারে আর্জি পেশ করেন এবং আক্রমণ করার জন্য অনুরোধ করেন। আকবর তখন অনুরোধ রক্ষা করতে মালবের শাসনকর্তা খান-ই-আজমকে আহম্মদনগর দখল করে সেখানে বিদ্রোহী নেতাদের প্রতিষ্ঠিত করার আদেশ দেন। খান্দেশের শাসক রাজা আলি খাঁ মোগলদের অনুকূলে থাকলেও আহম্মদনগর আক্রমণের ক্ষেত্রে তিনি মোগলদের বিরোধিতা করেন এবং তাঁর রাজ্যের ভিতর দিয়ে মোগল সৈন্যের চলাচলে বাধাদান করেন। এর ফলে বাধ্য হয়ে মোগল সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

১৫৮৮ সালে আহম্মদনগরের শাসক মুর্তজা নিজাম শাহের বিরুদ্ধে কয়েকজন অভিজাত বিদ্রোহী হয়ে পড়ে এবং মুর্তজা নিজাম শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে তাঁর ভাই বারহানউদ্দিনকে সিংহাসনে বসানোর ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত বিদ্রোহীদের এহেন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়। বারহানউদ্দিন পালিয়ে মোগল দরবারে আশ্রয় নেন। আকবরও তাঁর প্রতি বিশেষ সদয় ব্যবহার করেন। আকবর বারহানউদ্দিনকে অধিনায়ক করে একটি শক্তিশালী সেনাদল পাঠান আহম্মদনগরে। সম্রাট আকবর একই সঙ্গে বারহানউদ্দিনকে যাতে সাহায্য করেন তার নির্দেশ দেন মালবের শাসনকর্তা খান-ই-আজম এবং খান্দেশের শাসক রাজা আলি খাঁকে। শেষপর্যন্ত আকবরের সেনাসাহায্যে বারহানউদ্দিন আহম্মদনগর দখল করতে সক্ষম হন। পরে অবশ্য ভোল পালটে বারহানউদ্দিন মোগলদের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসাবে ঘোষণা করে দেন।

১৫৯০ সালে আকবরের আদেশে মুলতানের মোগল শাসনকর্তা আব্দুর রহমান নিম্ন সিন্ধু এলাকা আট্টা দখল করার জন্য অভিযান চালান। আট্টার অধীশ্বর মর্জা জানিবেগ আত্মসমর্পণ করেন এবং সম্পূর্ণ সিন্ধু অঞ্চল মোগলদের অধিকারে আসে। ১৫৯১ সালে আকবর খান্দেশ, আহম্মদনগর, গোলকুণ্ডা এবং বিজাপুরের শাসকদের কাছে কর দাবি করেন। প্রথমে খান্দেশের সুলতান রাজা আলি আকবরের এই দাবি মেনে নিলেও দক্ষিণের অন্য তিন সুলতান আকবরের দাবি মানতে অস্বীকার করেন। আকবর সেই মুহূর্তে এই তিন সুলতানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলেন না। বরং বেলুচিস্তানের দিকে দৃষ্টি দেন। শুধু দৃষ্টি দিলেই তো হবে না, দখল নিতে হবে। বেলুচিস্তানের আফগান শাসকরা আকবরের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি হলেন না। ফলে ১৫৯৫ সালে আকবরের আদেশেই সেনাপতি মির মাসুম বেলুচিস্তানের সিরি দুর্গ আক্রমণ করে এবং দখল করে নেন। এই দখলের মধ্য দিয়ে গোটা বেলুচিস্তান মোগলদের অধিকারে চলে আসে। এসময় কান্দাহার রাজ্য শাসন করতেন পারস্যের শাসনকর্তা হুসেইন মির্জা। কিন্তু তাঁর সঙ্গে পারস্যের সম্রাটের সুসম্পর্ক ছিল না। এর সুযোগ নিয়ে আকবর কান্দাহার আক্রমণ করেন। এমতাবস্থায় পারস্যের শাসনকর্তা কান্দাহার দুর্গ মোগলদের হাতে তুলে দেন। এবার কান্দাহারও মোগলদের অধিকারে চলে আসে।

১৫৯৫ সালে আহম্মদনগরের শাসক বারহানউদ্দিনের মৃত্যু হয়। রীতি অনুসারে বারহানউদ্দিনের ছেলে বাহাদুর শাসক হওয়ার কথা। বিজাপুরের বারহানউদ্দিনের ভাই সুলতান দ্বিতীয় ইব্রাহিম আদিল শাহও বাহাদুরের পক্ষেই ছিলেন। সেই সূত্রে বিজাপুরের ভূতপূর্ব সুলতানের বিধবা পত্নী এবং বারহানউদ্দিনের ভগ্নী চাঁদবিবি। তিনি ইব্রাহিম আদিল শাহের নাবালককালে প্রায় ১০ বছর অভিভাবিকা হিসাবেও রাজত্ব করেছিলেন। অতএব তিনি সশরীরে আহম্মদনগরে এসে বাহাদুরের পক্ষালম্বন করেন। এমতাবস্থায় আহম্মদনগরের বিরোধীপক্ষ মোগলদের তথা আকবরের সাহায্য প্রার্থনা করেন। সেই সুযোগ নিয়ে আকবর গুজরাটের শাসক যুবরাজ মুরাদ এবং সেনাপতি আবদুর রহিম খানের নেতৃত্বে সেনা প্রেরণ করেন। অকুস্থলে পৌঁছে মোগলবাহিনী আহম্মদনগর দুর্গ অবরোধ করেন। চারদিন অবরোধ করে থাকার পরও মোগলরা এই দুর্গের পতন ঘটাতে ব্যর্থ হন। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে মীমাংসা হয়। এই মীমাংসায় বাহাদুরকে আহম্মদনগরের রাজা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং বেরার অঞ্চল মোগলদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বেরার মোগলদের হস্তগত হওয়ায় দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য সুলতানরা পতনের আশঙ্কায় দিন কাটাতে থাকেন। এই আশঙ্কা থেকে বিজাপুর, গোলকুণ্ডা এবং আহম্মদনগর মিলিতভাবে মোগলদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার উদ্যোগ নেয়। ১৫৯৭ সালে সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে মোগলদের যুদ্ধও হয়। কিন্তু সেই যুদ্ধে সম্মিলিত বাহিনীর পরাজয় হয়। পরাজয়ের পর বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে। ফলে আহম্মদনগরের চাঁদবিবি একাই মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। মোগলদের সঙ্গে সেই যুদ্ধে এঁটে উঠতে না পেরে অবশেষে চাঁদবিবি আলোচনা করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু আহম্মনগরের অভিজাতরা চাঁদবিবিকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে হত্যা করে। এই সময় মোগল শিবিরে অভ্যন্তরীণ গোলমালের কারণে আহম্মদনগর থেকে মোগলবাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ফলে আহম্মদনগরের সৈন্যরা আবার হৃতরাজ্য ফিরে পান। এদিকে রানা প্রতাপ সিংহ ১৫৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। রানা প্রতাপের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র অমর সিংহ মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৫৯৯ সালে আকবর অমর সিংহের বিরুদ্ধে মানসিংহ এবং যুবরাজ সেলিমকে প্রেরণ করেন। অমর সিংহ পরাজিত হলেন। পরাজিত হয়ে আত্মগোপনও করলেন তিনি। এ সময়ই বাংলাদেশের উসমান বিদ্রোহ শুরু করেন। আকবর এবার মানসিংহকে বাংলাদেশে প্রেরণ করেন উসমানকেও দমন করার জন্য। বস্তুত আহম্মদনগরের ঘটনায় আকবর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই অমর সিংহকে পরাজিত করে তিনি স্বয়ং ১৫৯৯ সালে আহম্মদনগর আক্রমণ করেন। আক্রমণের শুরুতেই মোগলরা দৌলতাবাদ দখল করে নেয়। ১৬০০ সালে আহম্মদনগরের একটি অংশ মোগলদের অধিকারে চলে আসে। কিন্তু এর ভিতর খান্দেশের রাজা আলি খাঁ মৃত্যু হলে তাঁর উত্তরাধিকারী মিরন বাহাদুর শাহ স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেন। এই কারণে আকবর আহম্মদনগর থেকে খাদেশে চলে আসেন এবং আসিরগড় দুর্গ অবরোধ করেন। ১৬০১ সালে আকবর আসিরগড় দুর্গটি দখল করেন। এরপর সম্রাট আকবর যুবরাজ দানিয়েলের হাতে রেবার, আহম্মদনগর ও খান্দেশের শাসনভার অর্পণ করে রাজধানীতে ফিরে আসেন। ১২৮৬ সাল পর্যন্ত ওড়িশার লোহানি রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা লোহানি বংশের আফগান শাসকরা আকবরের অধীনে ছিলেন। এই বছরে শ্রীপুরের শাসক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৫৯৩ সালে খাজা সুলায়মান লোহানির সহায়তায় কেদার রায় এবং চাঁদ রায় ভূষণা দুর্গ দখল করেন। তবে সেই যুদ্ধে চাঁদ রায়ের মৃত্যু হয়। এই অবস্থায় বাংলাকে দমন করার জন্য ১৫৯৪ সালে মানসিংহকে বাংলার সুবেদার হিসাবে পাঠানো হয়। ১৯৯৫ সালে মানসিংহের পুত্র হিম্মত সিংহের নেতৃত্বে ভূষণা দুর্গ আক্রমণ করেন এবং মোগল অধিকারে নিয়ে আসেন। এরপর তিনি ঈসা খাঁর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য তাণ্ডা থেকে রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। তিনি নতুন এই রাজধানীর নামকরণ করেন আকবরনগর। মানসিংহ প্রথমে শেরপুর মোর্চায় (বগুড়া জেলায়) শিবির স্থাপন করেন এবং সেখানে একটি মাটির দুর্গ নির্মাণ করেন। তিনি এই স্থানের নামকরণ করেন সেলিমনগর এবং বর্ষাকাল জুড়ে তিনি সেখানেই কাটাতেন। ১৯৯৬ সালে ভূষণা দুর্গ পুনর্দখলের জন্য মানসিংহ তাঁর পুত্র দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে অভিযানের জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। এই যুদ্ধে দুর্গের ভিতরে কামানের গোলা বিস্ফোরণ হওয়ার ফলে সুলায়মান লোহানি নিহত হন এবং কেদার রায় মারত্মকভাবে জখম হন। এরপর তিনি সেখান থেকে পালিয়ে ঈসা খাঁর কাছে শরণাপন্ন হন। ১৬০৩ সালে মগ মিগ হল বঙ্গদেশের একটি উপজাতি। বর্মার (বর্তমানে মায়ানমার) আরাকান জাতির মানুষ বা তাদের বংশধর, যাঁরা ১৫০০-১৭০০ সাল নাগাদ জলদস্যু বা আরাকান রাজ্যবিস্তারের উদ্দেশ্যে বঙ্গদেশের চট্টগ্রাম এবং তার আশেপাশের উপকূলবর্তী কিছু অংশে আক্রমণ চালাত ও স্থানীয় মানুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে বাটাভিয়াতে (ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধিকৃত জাকার্তা) ক্রীতদাস হিসাবে চালান করত। মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে শত্রুতার কারণে আরাকানের মগ দস্যুরা পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তৎকালীন মোগল শাসনাধীন বাংলায় অবাধ লুণ্ঠন, অপহরণ ও নির্বিচারে নারীদের উপর অত্যাচার চালাত।] জলদস্যুরা বিশাল নৌবহর নিয়ে জলপথে ঢাকা আক্রমণ করে। বিশেষ করে এরা ত্রিমোহনীতে মোগল দুর্গের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। মোগল বাহিনী তাঁদের তাড়া করলে সংঘর্ষে বহুসংখ্যক মগের মৃত্যু হয়। এই সময় মগদের সহায়তায় কেদার রায় শ্রীনগরে মোগল ঘাঁটি আক্রমণ করেন। বিক্রমপুরের অনতিদূরে দু-পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে কেদার রায় মারাত্মক জখম হলে বন্দি হন। বন্দি অবস্থায় তাঁকে রাজা মানসিংহের কাছে নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়। কেদার রায়ের মৃত্যুর পর শ্রীপুর, বিক্রমপুরের দুর্গ মুসা খাঁ নিজ অধিকারে আনেন। শেষপর্যন্ত অবশ্য মানসিংহ পুরো বাংলাকে মোগল সাম্রজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হন।

আকবরের রাজপুত-প্ৰীতি আর ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আমরা যতই গদগদ হই না-কেন, এটা পুরোপুরি না-হলেও অনেকটাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা কৌশল। সুশাসক হিসাবে এই কৌশল এবং নীতিতে আকবর সফলও হয়েছেন। মধ্যযুগে একমাত্র শের শাহ ছাড়া আকবরই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন, বিশাল হিন্দুসমাজের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া এদেশে স্থায়ী সাম্রাজ্য গঠন এবং সেই সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় ও সুসংহত করা সম্ভব নয়। তাই জাতিধর্মনির্বিশেষে ভারতবর্ষের আপামর জনসাধারণের স্বীকৃত শাসক হিসাবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন এবং পেরেছেন। এই লক্ষ্য সামনে রেখে হিন্দুদের সঙ্গে নতুন মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হতে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন। হিন্দুদের মধ্যে বিশেষ করে রাজপুতদের বেছে নেওয়ার কারণ শৌর্যে-বীর্যে তাঁরাই হিন্দুদের মধ্যে অগ্রগণ্য। এছাড়া বিচক্ষণ আকবর বুঝেছিলেন যে-কোনো মূল্যে রাজপুতদের কবজা করতে পারলে সবচেয়ে বেশি নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা যাবে, আবার খুব বেশি যুদ্ধবিগ্রহ না-করেও রক্তপাতহীন রাজপুত-ভীতি মুক্ত থাকা সম্ভব হবে। কঙ্কর সিংহ তাঁর ‘ইসলামের ভারত অভিযান’ গ্রন্থে লিখেছেন– “…মহান আকবর ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেও ইসলামের জিহাদি উদ্দীপনা ত্যাগ করতে পারেননি। চিতোর অভিযানে (১৫৬৮ সাল) ৮০০০ রাজপুত সেনা নিহত হলে দুর্গের ভিতরে আশ্রয়গ্রহণরত নিহত রাজপুতসেনাদের স্ত্রী-কন্যা ও অন্যান্য নারীদের বন্দি করে ক্রীতদাসকরণের জন্যে নির্দেশ দেন সম্রাট। খবর পেয়েই রাজপুত নারীরা নিজেদের সম্ভ্রম বাঁচাতে জহরব্রত পালন করে জ্বলন্ত অগ্নিতে আত্মাহুতি দেন। রাজপুতসেনাদের সাহায্য করার অপরাধে সেইসময় ৩০,০০০ অসামরিক কৃষক হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন মহান সম্রাট আকবর।” সম্রাট আকবরের এক সেনাপতি মালব্য প্রশাসক আবদুল্লাহ খান উজবেক গর্বিত স্বরে বলেছিলেন –“আমি পাঁচ লক্ষ নারী ও পুরুষকে বিক্রি করেছি, তারা সবাই মোহম্মদি হয়েছে। বিচারের দিন তাদের বংশধররা এক কোটিতে পরিণত হবে।”

ঐতিহাসিকরা সারা ভারত খুঁজে থেকে মাত্র দুজন মহামতিকে খুঁজে পেয়েছেন একজন ‘অহিংসার পূজারী অশোক, যিনি লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করে কলিঙ্গের মাটি রক্তে ভিজিয়েছিলেন। অশোক ‘মহামতী’ হয়েছিলেন ধর্মান্তরিত হয়ে সারা বিশ্বে বৌদ্ধধর্মের অহিংসার বাণী প্রচার করে। অশোকের ‘মহামতী’ বিষয়ে পরের কোনো অধ্যায়ে আলোচনা করা যাবে। অন্যজন ‘ধর্মনিরপেক্ষ আকবর’, মহামতি। আকবর কীভাবে মহামতি’ হলেন সেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক– (১) বারো বছরের কম বয়সি ছেলেদের ‘খ’ দেওয়া নিষিদ্ধ করেন। কেবল নিষিদ্ধ করেন তা নয়– বড়ো হওয়ার পর সে ‘খ’ দিতেও পারে, আবার নাও দিতে পারে। বাধ্যতামূলক হবে না কখনোই। (২) প্রতি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে কোরান ও হাদিস মোতাবেক স্ত্রীর সঙ্গে যৌনকর্ম করার পর এক বিশেষ নিয়মে স্নান করতে হয়। এবং তা অবশ্যই বাধ্যতামূলক। কিন্তু আকবরের নতুন ধর্মে বলা হল– যৌনকর্মের পরে স্নান নয়, স্নান করতে হবে যৌনকর্মের আগেই। (৩) ইসলাম মতে পুরুষরা সিল্ক বা রেশমের পোশাক এবং সোনা ব্যবহার করতে পারবেন না। সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। অবশ্য নারীরা সোনা এবং সিল্ক ব্যবহার করতে পারবে। আকবরের নতুন ধর্ম বলল –কেবল নারীই নয়, সিল্ক ও সোনা সকলেই ব্যবহার করতে পারবে। (৪) আকবরের নতুন ধর্মে মানুষকে বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ খেতে বলেছেন –কিন্তু গোরু, মহিষ, মেষ, উট খাওয়া এক্কেবারে নিষিদ্ধ হয়েছিল। এমনকি ইদ-উল-আজহাতেও গোরু খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। (৫) ইসলাম ধর্মে কুকুর ও শুয়োর বা শূকর নিষিদ্ধ, ঘৃণ্য। কিন্তু আকবরের নতুন ধর্মে বলা হল– কুকুর বা শুয়োর আল্লাহর কুদরত প্রকাশক, পবিত্র। (৬) ইসলাম ধর্মে আল্লাহ ছাড়া কোনো সৃষ্টির সম্মানের জন্য প্রণিপাত (সিজদা) করা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ ও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। নতুন ধর্মে আকবর তাঁর দরবারে প্রজাদের সিজদা করার জন্য আইন প্রণনয় করেন। (৭) মসজিতে একসঙ্গে নামাজ পড়া ও আজান দেওয়া বন্ধ করেছিলেন। (৮) ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী কোনো মুসলমানের মৃত্যু হলে তাঁর মৃত্যদেহকে কবর দিতে হবে। কবর দেওয়ার সময় মাথায় রাখতে হবে মৃতদেহটি যেন এমনভাবে শোয়ানো হয় যাতে মক্কার কাবা ঘরের দিকে (ভারতের উত্তর-দক্ষিণে) পা ও মাথা না থাকে। আকবরের নতুন ধর্মে নির্দেশ দিলেন– মৃতদেহের কাঁধে একটা গমের প্যাকেট বা ভারি পাথর বেঁধে জলে ফেলে দাও। অথবা কেউ যদি একান্তই কবর দিতে চায়, তাহলে ভারতের পশ্চিমদিকে কাবা ঘর –অতএব পশ্চিমদিক করেই মৃতদেহটিকে শোয়াতে হবে। (৯) প্রতিটি ইসলাম ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিকে তার মুসলমানত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ও বিচারের প্রতি প্রশ্নাতীত আস্থা রাখতে হবে। সম্রাট আকবর পুনরুত্থান ও বিচারদিবসকে অস্বীকার করতেন। (১০) মহামতি আকবর অনেকগুলি মসজিদ গুদামঘর এবং হিন্দুপ্রজাদের জন্য ক্লাবঘরে পরিবর্তন করেছিলেন। (১১) সারা বিশ্বের মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে ‘আসোলামু আলাইকুম’ অর্থাৎ আল্লাহ তোমার উপর শান্তি বর্ষণ করুক’ বলে থাকে। এটাই দস্তুর। এবং প্রত্যুত্তরে ‘ওয়া আলাই কুমস সালাম’ অর্থাৎ তোমার উপরও শান্তি বর্ষিত হোক’। মহামতি আকবর বললেন– উঁহু, সালাম নয়। বলতে হবে ‘আল্লাহু আকবর। প্রত্যুত্তরে বলতে হবে ‘জাল্লা জালালাহু’। তবে ‘আল্লাহু’ শব্দটিতে অ-মুসলমানদের আপত্তি থাকায় আকবর বললেন– মুসলমানদের জন্য আমিই স্বয়ং আল্লাহ হয়ে প্রকট হয়েছি। আল্লাহু আকবর’ মানে আকবরই আল্লাহ।

অমুসলমানরা সম্রাটের এ ব্যাখ্যায় খুশি না-হওয়ায় আল্লাহ শব্দটিকে সরিয়ে দিয়ে বললেন ‘সালাম’ বা ‘আল্লাহু’-র পরিবর্তে ‘আদাব’ শব্দটি ব্যবহার করতে হবে। (১২) ইসলামিক ‘পর্দা প্রথা’ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হল। এমনকি অ-মুসলিমদের অবগুণ্ঠন ও ওড়নার ব্যবহারও নিষিদ্ধ হল। মহামতি নির্দেশ দিলেন– বাইরে চলাফেরার সময় মাথায় কাপড়, পর্দা, উড়না, বোরখা অথবা অবগুণ্ঠিতা হওয়া চলবে না। (১৩) মুসলমানদের দাড়ি রাখা ইসলাম ধর্মে সুন্নত। এটা যে মানবে না তাকে ‘ইসলাম বিরোধী’ বলা হয়। মহামতি আকবর বললেন, দাড়ি মুণ্ডন বৈধ। এমনকি তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর দাড়ি মুণ্ডন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তিনি। পরদিন রাজদরবারে যত উচ্চপদাসীন কর্মচারী ছিলেন তাঁদের অনেকেই নিজের নিজের দাড়ি কেটে সম্রাটের পায়ের নীচে উৎসর্গ করলেন। (১৪) সম্রাট আকবর সূর্য উপাসনায় সকলকে উৎসাহ দিতেন। নিজেও সকাল, সন্ধ্যা, দুপুর, এমনকি মধ্য রাত্রিতেও সূর্যের উপাসনা করতেন।

স্মিথ বলেছেন, “দ্বীন-ই-ইলাহি ছিল আকবরের বুদ্ধিহীনতার প্রধান স্তম্ভ। সম্রাটের অহংবোধের জলন্ত উদাহরণ।” স্মিথের এই মন্তব্যের অর্থ যা দাঁড়ায় তা হল –আকবর নির্বুদ্ধিতা ও অহমিকাবশত ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে নবধর্ম প্রচার করেন। তিনি একাধারে পোপ ও সম্রাটের ভূমিকা নেন। আকবর কি সত্যিই ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন? সুশীল চৌধুরী তাঁর একটি নিবন্ধে বলেছেন– “আকবরের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ আসে– আকবর ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করেছেন এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়ে।”

গুজব! ইবাদতখানার আলোচনা সব ধর্মের মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়ার আলোচনাচক্রের পরিধি বেড়ে যায়। এমনকি ইসলাম ধর্ম ও পয়গম্বর মোহম্মদ সম্বন্ধেও নানারকমের প্রশ্ন উঠতে থাকে। এর ফলে দেশের গোঁড়া উলেমারা আকবরের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। বিভিন্ন ধর্মের শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের সমাবেশ সত্ত্বেও ইবাদতখানার আলোচনা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। সমবেত শাস্ত্রবিশারদরা মত-বিনিময়ের মাধ্যমে ন্যূনতম মতৈক্যেও পৌঁছোতে পারেনি। উলটে আলোচনাকালে তীব্র বিতর্কের সূত্রপাত হয় এবং একে অপরের ধর্মকে আক্রমণ করতে থাকায় পারস্পরিক তিক্ততা বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় ১৫৮২ সালে ইবাদতখানার ধর্ম বিষয়ে আলোচনাচক্র বন্ধ হয়ে যায়।

অবশেষে বিভিন্ন ধর্মের সার-সংকলন করে মন্দগুলোকে বাতিলের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে আকবর ১৫৮২ সালে তাঁর একেশ্বরবাদী ধর্মমত প্রচারে প্রবৃত্ত হন। অ-মুসলিমদের কাছে যা দারুণভাবে প্রশংসিত হয়, মুসলিমদের কাছে তা ছিল নিরেট ভণ্ডামি ও আবর্জনার মতো পরিত্যাজ্য বস্তু। মুসলিমদের মতে, নিরপেক্ষ ভূমিকায় ‘দ্বীন-ই-ইলাহি ছিল মহামতি আকবরের স্বধর্মে নিপাতসাধনের এক সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। আকবরের এই কোরান উপেক্ষা করা এক ভয়ানক দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিশ্চয়ই। এই নতুন পথই হল ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’, আবুল ফজল ও বায়ুনি দুজনেই একে তৌহিদ-ই-ইলাহি’ নামে অভিহিত করেছেন– যার প্রকৃত অর্থ ‘একেশ্বরবাদ’। তৌহিদ’-এর পরিবর্তে “দ্বীন’ কথাটি ব্যবহৃত হয় এর আশি বছর পরে। দ্বি-ই-ইলাহির কতগুলি নির্ধারিত রীতিনীতি ছিল। যার উল্লেখযোগ্য কিছু নীতি নিম্নরূপ –(১) এ ধর্মের কালেমা ছিল “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আকবারু খলিফাতুল্লাহ’। (২) তাঁর অনুসারীরা পরস্পর সাক্ষাৎকালে নতুন প্রথায় সম্ভাষণ করত। প্রথম ব্যক্তি বলত “আল্লাহু আকবার’, দ্বিতীয় ব্যক্তি ‘জাল্লা জালালুহু’ বলে প্রতি-উত্তর দিত। এভাবে ‘আল্লাহ’ নামের সঙ্গে আকবরের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। (৩) মদ, জুয়া, সুদ ও শূকরের মাংস হালাল করা হয়েছিল। (৪) ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজব্রত পালন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। (৫) ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ জাকাতের বিধান রহিত করা হয়েছিল। (৬) সম্রাট আকবরকে সিজদা করা ও দাড়ি মুণ্ডন বৈধ মনে করা হত। (৭) অন্য ধর্ম থেকে কেউ মুসলমান হতে পারবে না –এ মর্মে নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। (৮) আগুনকে পবিত্র মনে করা হত এবং সব ধর্মকে ধর্মীয়ভাবে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার বিধান ছিল। (৯) জেনা ও বেশ্যাবৃত্তি বৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। (১০) হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করাকে প্রজাসাধারণের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। (১১) জন্মবার্ষিকী পালন এবং বিভিন্ন উৎসবে স্বধর্মীয়দের ভোজের আমন্ত্রণ করা বাধ্যতামূলক ছিল। (১২) কসাই, জেলে প্রভৃতি তথাকথিত নিম্ন জাতের লোকদের সঙ্গে মেলামেশা পরিহার করার নির্দেশ ছিল। (১৩) মহিলাদের পর্দা করা এবং পুরুষদের খতনা করা নিষিদ্ধ ছিল। (১৪) চারটি জিনিস, যেমন –ধন, জীবন, সম্মান ও ধর্ম সম্রাটের জন্য উৎসর্গ করে এই ধর্ম গ্রহণ করতে হত।

বদায়ুনি থেকে শুরু করে ভিনসেন্ট স্মিথ পর্যন্ত অনেক ঐতিহাসিক দ্বীন-ই-ইলাহিকে আকবরের নতুন ধর্ম বলে আখ্যা দিয়েছেন, যা তিনি ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করে প্রচার শুরু করেন। এই ধর্ম একান্তভাবে যুক্তিনর্ভর –কোনো পবিত্র গ্রন্থ বা ধর্মগ্রন্থ নেই, কোনো দেবদেবী নেই, কোনো ধর্মর্যাজক নেই, কোনো উপাসনাগৃহও নেই। এই ধর্মে যোগ দিতে কেবল সম্রাটের অনুমতি লাগত। দীক্ষা গ্রহণেচ্ছু ব্যক্তিকে নতজানু হয়ে সম্রাটের পদযুগলে মাথা রাখতে হত। সম্রাট সেই ব্যক্তির মাথায় হাত দিয়ে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিতেন এবং তাঁর প্রিয় মন্ত্র ‘আল্লা হো আকবর’ বা ‘ঈশ্বর মহান’ বাক্যটি উচ্চারণ করতেন। তবে দ্বীন-ই-ইলাহির অনুসারীর সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য, আকবরের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু এবং অমাত্যরা ছাড়া কেউই এই ধর্ম গ্রহণ করতে আগ্রহ দেখাননি। অভিজাত সম্প্রদায়ের অনেক অগ্রগণ্য সদস্যই দ্বীন-ই-ইলাহি গ্রহণ করেননি। দ্বীন-ই-ইলাহির অনুসারী একমাত্র হিন্দু বীরবলই, বাকিরা সবাই মুসলমান। আকবরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ভগবান দাস, মানসিংহ, টোডরমল কিন্তু দ্বীন-ই-ইলাহি গ্রহণ করেননি। অবশ্য অনুসারী বাড়ানোর জন্য আকবর যে কোনো গা-জোয়ারি করেননি সেটা বলাই বাহুল্য। গা-জোয়ারি করলে অবশ্যই আকবরের সৃষ্ট ধর্ম আর পাঁচটা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কাতারে জায়গা করে নিতে সক্ষম হত। বায়ুনি গোঁড়া সুন্নি মুসলমান হিসাবে আকবরের ধর্মীয় সহনশীলতায় ও অবাধ উদারতার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। জেসুইট ধর্মযাজকরা আকবরকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে না-পেরে কিছুটা হতাশায় এবং তাঁর সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী সম্যক উপলব্ধি করতে না-পেরে কিছুটা ভ্রান্তিবশত আকবর ইসলাম ধর্ম বর্জন করেছিলেন এমন ধারণায় বশবর্তী হয়েছিলেন। তবে সমসাময়িক ঐতিহাসিক ও উলেমার নেতা বদায়ুনি আকবরকে ইসলাম ধর্মত্যাগী বলেই ক্ষান্ত হননি, আকবরের বিরুদ্ধে তিনি ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের প্রতি নির্যাতন ও হয়রানির বেশ কিছু অভিযোগ এনেছিলেন। জেসুইট ধর্মর্যাজকরাও বদায়ুনির সঙ্গে প্রায় একমত হয়ে ঘোষণা করেছিলেন, আকবর ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন। বস্তুত আকবর যেমন জন্মগতভাবে মুসলমান ছিলেন, মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ঠিক তেমনই মুসলমান থেকে গিয়েছিলেন। ইসলাম মতেই তাঁর মরদেহ সৎকার হয়েছিল।

যাই হোক, রক্ষণশীল মুসলমানরা আকবরের এই ধর্মনীতি মেনে নিতে পারেনি। সমসাময়িক সময়ে তো বটেই, আজও সেই মনোভাবের পরিবর্তন আসেনি। আকবর-বিরোধী মুসলমান ঐতিহাসিকরা মনে করেন –“উপমহাদেশে মুসলিম শাসকদের মধ্যে সম্রাট আকবরই ইসলামের ক্ষতি করেছেন সবচেয়ে বেশি। ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকার জন্য এই সম্রাট সভাসদদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে “দ্বীন-ই-ইলাহি’ নামে একটি নতুন ধর্ম প্রবর্তন করে ইসলামের অস্তিত্ব ও আদর্শকে বিপন্ন করেছিলেন মারাত্মকভাবে। ইতিহাসবিদরা একে তাঁর তথাকথিত উদার ধর্মবাদ বা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ‘গোঁজামিল তত্ত্ব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর এই পদক্ষেপ ভারতবর্ষে ইসলাম ও মুসলিম উম্মার অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই মুসলিম উম্মার কাছে তিনি ধিক্কার কুড়িয়ে আসছেন। রাজক্ষমতায় টিকে থাকার অন্ধ মোহ এবং ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতাই সম্রাট আকবরের ধর্মনীতি পরিবর্তনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল বলে মনে করা হয়। ধর্মে-ধর্মে বৈরিতা ও বিদ্বেষ রাজক্ষমতায় বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে –এই আশঙ্কায় আকবর শঙ্কিত ছিলেন। ধর্মগুলির পারস্পরিক ব্যবধান উঠিয়ে দিয়ে সর্ববাদী একটি ধর্মের প্রবর্তন করতে পারলে এ থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে তিনি মনে। করলেন। আকবর ইসলাম ধর্মসম্প্রদায়ের কাছে বর্জিত হলেও হিন্দু ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষরা মাথায় তুলে নাচেন। বাইরে থেকে নাচতে দেখলেও তা যে ভিতর থেকে আকবরকে গ্রহণ করেনি, তা বীরবল ছাড়া একজন হিন্দুও আকবর প্রণীত ধর্ম গ্রহণ না-করার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার থেকে নিস্তার পেতে তাঁরা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, পরে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে– কিন্তু দ্বীন-ই-ইলাহি গ্রহণ। করেনি। আকবরের সমসাময়িক এক ধর্মীয় নেতা সৈয়দ আহমদ সিরহিন্দি জাহাঙ্গিরকে এক পত্রে দাবি করেছিলেন, আকবরের রাজত্বকালে কিছু ইতিবাচক নিপীড়নের কারণে ইসলাম বিপন্ন হয়ে পড়েছিল (মাকতুবাতে ইমান রাব্বানি– সৈয়দ আহমদ সিরহিন্দি)। সৈয়দ আহমদ লিখেছিলেন– “অমুসলিমদের পাশাপাশি মুসলমানদেরও প্রকাশ্যেই তাঁদের ধর্ম পালনের শাস্তিস্বরূপ তাঁদের হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে।” ষোড়শ শতকে মোহম্মদ সাদিক রচিত ‘তবকৎ-ই-শাহজাহানী” থেকে জানা যায়– সম্রাট আকবর তাঁর রাজত্বের শেষের দিকে ইসলামের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছিলেন এবং দেশের বহু স্থান থেকে ধর্মীয় নেতাদের তলব করে তাঁর দরবারে এনে শাস্তি দেন। … তিনি হিন্দুদের অভিযোগের ভিত্তিতে ১৬০০ সালে হাজি সুলতান নামে এক রাজস্ব সংগ্রাহককে হত্যা করেন।

ঐতিহাসিক আবদুল কাদের বাদায়ুনি তাঁর এক লেখায় মন্তব্য করেছেন– “১৫৭৯ সালের পর থেকে আকবর আর মুসলমান ছিলেন না।” একটা তালিকা দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ইসলাম থেকে আকবর কত দূরে ছিলেন। তালিকাটা এরকম –(১) লাইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ ইসলামের মূলমন্ত্রের পরিবর্তে ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ আকবর খলিফাতুল্লাহ’ মুলমন্ত্র প্রবর্তন করেন। (২) দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ করেন। (৩) মেয়েদের মাথায় কাপড় দেওয়া ও পর্দাপ্রথা বিলোপ করেন। (৪) মুসলিম বালকদের খতনা (মুসলমানি) নিষিদ্ধ করেন। (৫) শুকর ও কুকুরের মাংস খাওয়া বৈধ করেন। (৬) রাজপ্রাসাদে শুকর ও কুকুর প্রতিপালনে উৎসাহ দেন। তিনি বলেন, সকালে শুকর ও কুকুর দেখা পুণ্যের কাজ। (৭) সুদ খাওয়া বৈধ করেন। (৮) মদ্যপান বৈধ করেন। (৯) কোরান মিথ্যা বলেন। (১০) কোরান ও হাদিস পাঠ নিষিদ্ধ করে দেন। (১১) ইদুল আজহায় গোরু নিষিদ্ধ করেন। (১২) আরবি ভাষাশিক্ষা গর্হিত অপরাধ হিসাবে দেখা হয়। (১৩) মাদ্রাসায় ও মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে আজান নিষিদ্ধ করা হয় ইত্যাদি। ‘আকবর’ গ্রন্থে রাহুল সাংকৃত্যায়নও লিখেছেন– “আকবর গো-হত্যা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং সেই অপরাধের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। … ‘দীন-ই-ইলাহি’ অনুগামীদের জন্য শ্মশ্রু মুণ্ডন আবশ্যক ছিল। তাঁদের জন্য শুধু গো-মাংস নয়, রসুন-পিঁয়াজও পরিত্যাজ্য ছিল।”

১৫৯৩-৯৪ সালে সম্রাট আকবর কয়েকটি আদেশ জারি করেছিল, যা ধর্মসহিষ্ণুতার পরিচায়ক। আদেশগুলি হল– (১) শৈশবে অথবা অন্য কোনোভাবে কোনো হিন্দুকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুসলমান করা হলে, যদি সে তাঁর পিতা পিতামহের ধর্মে প্রত্যাবৃত্ত হতে চায়, তাহলে তা অনুমোদনযোগ্য। (২) ধর্মের কারণে কোনো ব্যক্তির প্রতিবন্ধকতা করা যাবে না। প্রত্যেক ব্যক্তি তাঁর ইচ্ছানুসারে যে-কোনো ধর্ম অবলম্বন করতে পারে। (৩) যদি কোনো হিন্দু মহিলা কোনো মুসলমানকে ভালোবেসে মুসলমান হয়ে যায়, তাহলে তাঁকে তাঁর স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দিতে হবে। (৪) যদি কোনো অমুসলিম নিজের গির্জা, ইহুদি ধর্ম-মন্দির, দেবালয় কিংবা পারসি সমাধি নির্মাণ করতে চায়, তাহলে তাতে কেউ বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারবে না। (৫) হিন্দু যুদ্ধবন্দিদের ক্রীতদাসে পরিণত করার প্রথা বন্ধ করে দেন। (৬) হিন্দু যুদ্ধবন্দিদের বলপ্রয়োগ করে ধর্মান্তরিত করার বিরুদ্ধে তিনি সিদ্ধান্ত প্রদান করেন।

আকবরের হিন্দুপ্রীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তিনি হিন্দুদের সংস্পর্শে এসে হিন্দুধর্মের তত্ত্ব ও শাস্ত্র সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভ করেছিলেন। হিন্দু ধর্মগুরু পুরুষোত্তম আকবরকে হিন্দু ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দিয়েছিলেন। সকল ধর্মের প্রতি সমান সম্মান জানাতে হিন্দু দেবদেবী অর্থাৎ বিষ্ণু, ইন্দ্র, মহাদেবের প্রতি প্রণতি জানাতেন। সম্রাট আকবর হিন্দুদের কর্মবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর জীবনযাপনেও হিন্দু-সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ করা যেত। এমনকি তিনি রাখিবন্ধন, দীপাবলি, দশহরা উৎসবও পালন করতেন। সংস্কৃত থেকে সূর্যের ১০০০ নাম সংগ্রহ করে প্রতিভোরে সূর্যের দিকে তাকিয়ে জপ করতেন। হিন্দুদের মতো কপালে তিলক আঁকতেন। ঐতিহাসিক বাদায়ুনি লিখেছেন, আকবর হারেমে হিন্দু বেগম এবং বাইরে হিন্দু বন্ধুদের খুশি করার জন্য পিঁয়াজ-রসুন খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। সম্রাট আকবর হিন্দুবিশ্বাসেষ প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে গঙ্গাজলকে পবিত্র মনে করতেন। এখানেই শেষ নয় –বিভিন্ন প্রামাণিক গ্রন্থ থেকে জানা যাচ্ছে, তিনি হিন্দু স্ত্রীদের সঙ্গে হোম-যজ্ঞ অনুষ্ঠানেও অংশ নিতেন। এমনকি তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর হিন্দু রিচুয়াল অনুসারে মস্তক-মুণ্ডন করেছিলেন। সেই কারণেই বোধহয়। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাঁকে ‘জগৎগুরু’এবং রাম-কৃষ্ণের অবতার বলে মানতেন। হিন্দুদের সংস্কৃত মহাকাব্যগুলি অনুবাদ করান।

আকবর একজন সুন্নি মুসলমান। তিনি যখনই রাজপুতদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেন, তখন তাঁদের সঙ্গে এবং তাঁর শাসনাধীন নতুন হিন্দু অধ্যুষিত সাম্রাজ্যের অন্যান্য হিন্দু জনগোষ্ঠীর বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতেন। তিনি একাধিক উপায়ে এই লক্ষ্য অর্জন করেন। সম্রাট আকবর হিন্দু মন্দির অপবিত্রীকরণ নিষিদ্ধ করেন। ১৫৬৩ সালে তিনি যখন জানতে পারেন যে, তাঁর আধিকারিকেরা আগ্রায় চল্লিশ মাইল দূরে হিন্দুতীর্থ মথুরা (কৃষ্ণের জন্মস্থান বলে হিন্দুদের বিশ্বাস) দর্শন করার জন্য হিন্দুতীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে বিশেষ কর আদায় করছে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সাম্রাজ্যের সর্বত্র তীর্থযাত্রীদের কর আদায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এমনকি জিজিয়া করও বিলুপ্ত করেন। যদিও সম্রাট আকবর প্রত্যেক অমুসলমানকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অস্ত্রধারণে বাধ্যতামূলক আইন করেছিলেন। সুতরাং সেক্ষেত্রে জিজিয়া কর নেওয়া মোটেই চলে না। জিজিয়া কর ছিল একটি সামরিক করমাত্র। যেসব সবল সমর্থ অমুসলিম নাগরিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন না, কেবলমাত্র তাঁদেরই জিজিয়া কর দিতে হত। ভারতবর্ষের দুই-তৃতীয়াংশের অঞ্চল নিয়ে জাতিগত ও ধর্মগতভাবে বিভাজিত ১০০,০০০,০০০ প্রজার একটি শক্তিশালী আর একতাবদ্ধ সাম্রাজ্য সম্রাট আকবরের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রাণশক্তির কারণেই সৃষ্টি হয়েছিল।

বহুজাতিক দেশ এই ভারতবর্ষ। বিভিন্ন ধর্মমত এদেশে বিদ্যমান। তবে অভিজাত প্রজাদের ৯০ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তাঁদের খুশি রেখে ক্ষমতা ধরে রাখার কূটকৌশল হিসাবে সম্রাট আকবর ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে হিন্দুদের রীতি-নীতি পালন করতেন এবং সমস্ত প্রজাদেরও তা করতে বাধ্য করাতেন। রাজপুত রাজাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনের পর তিনি সূর্যমুখী’ হয়ে জানালায় মোমবাতি জ্বালাতেন, তিলক পরিধান করতেন, হিন্দু রানিদের সঙ্গে হিন্দুদের আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন এবং হিন্দুধর্মকে প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতেন। এখনকার সময় হলে আকবরকে ‘হিন্দুতোষণকারী’ বিশেষণে ভূষিত করে ক্ষমতাচ্যুত করতে ভেন্ডালিজম করত বিরোধীরা। বস্তুত আকবরের বাহ্যিক স্লোগান ছিল ধর্মের ব্যবধান ও বিদ্বেষ উঠিয়ে দিয়ে শান্তিময় এক সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন করা। এই স্লোগানে বিভ্রান্ত হয়ে কেউ কেউ ক্রমেই সরে যাচ্ছিল মৌলিক চেতনা ও বিশ্বাস থেকে। এ যে মুসলমানদের জন্য কী দুর্দিন ছিল তা ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন। এইসব মুসলিমরা মনে করেন, সম্রাট আকবর ক্ষমতার অন্ধ মোহে সব সীমা অতিক্রম করেছিলেন। একজন মুসলিম ধর্মাবলম্বী হয়ে তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান ও সুরক্ষিত ইমানের প্রাচীরকে তিনি বিধ্বস্ত করেছেন অবলীলায়।” তাই হয়তো সম্রাট আকবর হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যতটা আদর পায়, মুসলমানদের মধ্যে ঠিক ততটাই অনাদর। সম্ভবত আকবরই প্রথম এবং শেষ মুসলিম শাসক, যিনি বিধর্মী তথা হিন্দুহত্যায় তেমন একটা নৃশংসতা দেখাননি এবং ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে আগ্রহ বা গা-জোয়ারি দেখাননি। তবে আকবর যে উদারপন্থী ছিলেন তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তিনি নিজে হিন্দু রাজপুত কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন এবং তাঁর পুত্রকেও করিয়েছিলেন। সেইসব হিন্দু রমণীরা মুসলিম পরিবারে ঘরসংসার করতে গিয়ে অসন্মানিত হয়েছেন এমন কথা শোনা যায় না। বরং ঐতিহাসিকরা দাবি করেন, সেইসব রমণীদের কারোকেই ধর্মান্তরিত হতে হয়নি। তাঁরা সারা জীবন নিজ নিজ ধর্মে এবং ধর্মবিশ্বাসে অটুট ছিলেন। জাহাঙ্গির ও সাজাহান– দুই সম্রাটেরই মা ছিলেন হিন্দু। এদের কারোর ধর্মান্তরিত হতে হয়নি।

আকবরের মৃত্যুর পর পরবর্তী দুই মোগল সম্রাট তাঁর পুত্র সম্রাট সেলিম ওরফে জাহাঙ্গির (১৬০৫ থেকে ১৬২৮) এবং পৌত্র সম্রাট শাহ জাহানের (১৬২৮ থেকে ১৬৫৬) শাসনামলে ইসলামিকরণ নতুন গতি পেয়ে পুনর্জীবন লাভ করে। সুশাসক হিসাবে পিতা আকবরের যতটা সুনাম ছিল, কুপ্রভাবে পড়ে পুত্র সেলিমের দুর্নাম ছিল ঠিক ততটাই। অকালে বখে যাওয়া সেলিম পিতা সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিলেন। সেলিম বীর সিং বুন্দোলার সঙ্গে চক্রান্ত করে তাঁর সাহায্যে আবুল ফজলকে হত্যা করেন। বিপদগামী সেলিমকে সুপথে ফেরাতে আকবর চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি। শেষপর্যন্ত সেলিমা বেগমের চেষ্টার যুবরাজ সেলিম বিদ্রোহী মনোভাব ত্যাগ করেন। এছাড়া হারেমের বেগমদের ভর্ৎসনা ও তিরস্কারে সেলিম কাবু হয়ে পড়ে। ১৬০৩ সালে আগ্রায় গিয়ে সেলিম তাঁর পিতার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেন। আকবর তাঁকে ক্ষমা প্রদর্শন করেন।

হুমায়ুনের পুত্র আকবর, যিনি তাঁর সমসাময়িক শেক্সপিয়রের মতো নিজের জন্মদিনেই মৃত্যুবরণ করেন। ঠিক তেষট্টি বছর বাঁচেন, যার মধ্যে ৫০ বছর তিনি ভারতে অতিবাহিত করেন। আর এই সময়ে ৪৯ বছরই সম্রাট হিসাবে রাজত্ব করেন। তিনি ভারতবর্ষে মোগল শাসনকে ভিনদেশি দখলদারী থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী সাম্রাজ্যের কাঠামো দান করেন।

আকবরের মতো সম্রাট যে দেশে থাকে, সে দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ধর্মীয় হানাহানি হতে পারে না। আকবরের মতো শাসক পাওয়া বড়োই সৌভাগ্যের ব্যাপার। অতএব রামরাজত্ব নয়, আকবর-রাজত্বই কায়েম হোক আমাদের দেশে। আমরা আকবরের মতোই একজন পরধর্মসহিষ্ণু শাসক চাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *