১.৫.০৮ আলাউদ্দিন খিলজি (শাসনকাল : ১২৯৬ সাল থেকে ১৩১৬ সাল)

আলাউদ্দিন খিলজি (শাসনকাল : ১২৯৬ সাল থেকে ১৩১৬ সাল)

বাংলার বীরভূমের সন্তান আলাউদ্দিন খিলজির বিরুদ্ধে মোটা দাগের অভিযোগ বর্ণিত হয়েছে ব্রিটিশ-প্রোষিত ঐতিহাসিকদের গ্রন্থগুলিতে। খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিনের পিতা জালালউদ্দিন খিলজির শাসনকালে বিধর্মীদের উপর ইসলামিদের খবরদারি আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর আমলেই হিন্দু বিদ্রোহীদের দমন ও সুলতানের সীমানা সম্প্রসারণের জন্য নির্মম অভিযান শুরু করা হয়। আমির খসরু লিখেছেন– “সুলতান জালালউদ্দিন হিন্দু দেবালয় ধ্বংস, বিপুল লুণ্ঠন এবং বন্দি সংগ্রহের মাধ্যমে ‘স্বর্গের নরক’ সৃষ্টি করেন। পরে আলাউদ্দিন খলজিও বিধর্মীদের ক্রীতদাসকরণের ক্ষেত্রে সব সুলতানদের ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। ১২৯৯ সালে গুজরাটে এক বড়ো ধরনের অভিযান চালিয়ে সেখানকার সমস্ত বড়ো বড়ো শহর ও নগর ধ্বংস করেছিলেন।” ঐতিহাসিক ইসামি ও বারানির বিবরণ থেকে জানা যায় –“যে বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত সামগ্রী এবং প্রচুর বন্দি সংগ্রহ করেছিলেন তাদের মধ্যে ২০ হাজার যুবতী নারী ছিল। ১৩০৩ সালে সালে আলাউদ্দিন চিতোর আক্রমণ করলে ৩০ হাজার হিন্দু নাগরিক হত্যা করে। এই চিতোর আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাজপুত রাণা রতন সিংহের সুন্দরী রানি পদ্মিনীকে অপহরণ করে নিজের হারেমে আনা। যুদ্ধে রাণা রতনের পরাজয় হয় এবং বন্দি হন। রাজার পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে নারীর সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদে সহচরীদের সঙ্গে নিয়ে রানি পদ্মিনী আগুনে আত্মাহুতি দেন।” আলাউদ্দিন সম্পর্কে আমির খসরু আরও বলেছেন –“তুর্কিরা তাঁদের খেয়ালখুশি মতো যে কোনো হিন্দুকে ধরত, বেচত এবং কিনত। ঐতিহাসিক আফিক ও বারানি লিখেছেন– “ক্রীতদাসকরণ এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল যে, আলাউদ্দিনের ব্যক্তিগত কাজের জন্য ৫০ হাজার বালক নিয়োজিত ছিল এবং তাঁর প্রাসাদে ৭০ হাজার ক্রীতদাস কাজ করত।”

অস্ট্রেলিয়া নিবাসী মুক্তমনা লেখক আবুল কাশেম তাঁর আলাউদ্দিন প্রসঙ্গে ইসলামে বর্বরতা’ নিবন্ধে লিখেছেন– “সুলতানের ক্ষমতা এ সময় এতই ব্যাপক ছিল যে, কারও সাহস ছিল না উচ্চবাচ্য করার’। বহু হিন্দু বিদ্রোহ দমনের জন্য অভিযান চালানোর পাশাপাশি তিনি বিধর্মী অঞ্চলগুলোকে মুসলিম নিয়ন্ত্রণে আনার উদগ্র আকাঙ্ক্ষায়ও বহু অভিযান চালান সেসব অঞ্চলে। এসব অভিযানে তিনি বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত দ্রব্য কবজা করেন, যার মধ্যে ছিল ক্রীতদাস। কিন্তু সে সম্পর্কে লিখিত দলিল খুব কম। সম্ভবত এর কারণ হল— ক্রীতদাসকরণ ও লুণ্ঠন এসময় একেবারে সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে সমসাময়িককালের লেখকদের রেখে যাওয়া সামান্য কিছু প্রামাণ্য দলিল বিবেচনা করলে সে সময়ে ক্রীতদাসকরণের পরিসর সম্পর্কে সাধারণ ধারণা পাওয়া যাবে। খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জালালুদ্দিন খিলজির শাসনকালে (১২৯০-৯৬) হিন্দু বিদ্রোহীদের দমন ও সুলতানাতের সীমানা সম্প্রসারণের নিমিত্তে নির্মম ও নিষ্ঠুর অভিযান শুরু করা হয়। তিনি কাটিহার, রণথোম্বর, জেইন, মালোয়া ও গোয়ালিয়রে অভিযান চালান। রণথোম্বর ও জেইন অভিযানে তিনি মন্দিরসমূহ বিধ্বস্ত এবং বিপুল লুণ্ঠন ও বন্দি সংগ্রহের মাধ্যমে একটা স্বর্গের নরক’ সৃষ্টি করেন, লিখেছেন আমির খসরু। আমির খসরু আরও লিখেছেন— মালোয়া অভিযান থেকে বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠন দ্রব্য (যার মধ্যে সর্বদা থাকত ক্রীতদাস) দিল্লিতে আনা হয়। পরবর্তী সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি (শাসনকাল ১২৯৬-১৩১৬) ক্রীতদাসকরণের ক্ষেত্রে আগের সব সুলতানকে ছাড়িয়ে যান। তিনি ১২৯৯ সালে গুজরাটে এক বড়ো ধরনের অভিযান চালিয়ে সবগুলো বড়ো বড়ো শহর ও নগর, যেমন নাহারওয়ালা, আসাভাল, ভানমানথালি, সুরাট, ক্যামবে ও সোমনাথ তছনছ করেন। মুসলিম ইতিহাসবিদ ইসামি ও বারানি জানান— তিনি এ অভিযানে বিপুল পরিমাণে লুষ্ঠিত মালামাল ও উভয় লিঙ্গের ব্যাপক সংখ্যক বন্দি সংগ্রহ করেন। ওয়াসাফের তথ্য অনুযায়ী, মুসলিম বাহিনী বিপুলসংখ্যক সুন্দরী তরুণীকে বন্দি করে, যার সংখ্যা ছিল প্রায় ২০,০০০ এবং সে সঙ্গে উভয় লিঙ্গের শিশুদেরকেও বন্দি করে নিয়ে যায়। ১৩০১ সালে রণথোম্বর ও ১৩০৩ সালে চিতোর আক্রমণ করা হয়। চিতোর আক্রমণে ৩০,০০০ লোককে হত্যা করা হয়েছিল এবং প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মুসলিমরা পরাজিতদের নারী-শিশুকে ক্রীতদাস করে। এ সময় কিছু রাজপুত নারী জহর বরণ করে আত্মহত্যা করে। ১৩০৫ থেকে ১৩১১ সালের মধ্যে মালোয়া, সেভানা ও জালোর অভিযান করে বিপুল সংখ্যক লোককে বন্দি করা হয়। সুলতান আলাউদ্দিন তাঁর রাজস্থান অভিযানেও বহু ক্রীতদাস আটক করেন। আলাউদ্দিনের রাজত্বকালে ক্রীতদাস ধরা যেন শিশুখেলার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমির খসরু লিখেছেন– “তুর্কিরা তাঁদের খেয়াল খুশিমতো যে-কোনো হিন্দুকে ধরতে, কিনতে বা বিক্রি করতে পারত।” ক্রীতদাসকরণ এতটাই ব্যাপক ছিল যে, সুলতান তাঁর ব্যক্তিগত কাজের জন্য ৫০,০০০ হাজার দাস-বালক নিয়োজিত ছিল এবং তার প্রাসাদে ৭০,০০০ ক্রীতদাস কাজ করত”, জানান আফিফ ও বারানি। বারানি সাক্ষ্য দেন– “সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির রাজত্বকালে দিল্লির দাস-বাজারে নতুন নতুন দলে অবিরাম বন্দিদের আনা হত।”

অতিরঞ্জিত গল্পগাছা থেকে বেরিয়ে আমরা প্রকৃত আলাউদ্দিনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। আলাউদ্দিন খিলজির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো অভিযোগ হল হিন্দুরমণী পদ্মিনী বা পদ্মাবতী হরণ। সেই পদ্মাবতীর চরিত্র নিয়ে সিনেমাকে কেন্দ্র করে গোটা ভারতবর্ষে তো ধুন্ধুমার কাণ্ড! ভারতে ৮০০ বছর আগেকার চিতোরের রানি পদ্মিনীর জীবন নিয়ে তৈরি বলিউড ছবি ‘পদ্মাবতী’-কে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তুমুল প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে। রাজপুতানার ইতিহাস বলে, দিল্লির শাসক আলাউদ্দিন খিলজির কবল থেকে রক্ষা পেতে রানি পদ্মিনী ১৬,০০০ নারীকে নিয়ে চিতায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন— কিন্তু পদ্মাবতী সিনেমায় তাঁর সেই মর্যাদা ও আত্মত্যাগকে খাটো করা হয়েছে বলে বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য ছিল। রাজপুত করণি সেনা নামে যে সংগঠন এর আগে ছবির শুটিংয়েও বাধা দিয়েছিল, তাঁদের প্রতিষ্ঠাতা লোকেন্দ্র সিং কালভি জানিয়েছিলেন, “যে-কোনোভাবে এই ছবির মুক্তি রুখতে চাই আমরা। ইতিহাসকে বিকৃত করার যে-কোনো চেষ্টা আমরা আটকাব, আমরা বেঁচে থাকতে আমাদের মেয়ে বোনদের অমর্যাদা কিছুতেই হতে দেব না।” এই সিনেমাটি নিয়ে প্রধান আপত্তি হল, সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সঙ্গে রানি পদ্মিনীর মুখোমুখি কখনও দেখাই হয়নি— অথচ ছবিতে নাকি তাঁদের মধ্যে একটি স্বপ্নদৃশ্য রাখা হয়েছে। এই মুভির পরিচালক সঞ্জয়লীলা বনশালির বক্তব্য ছিল– “ভুল বোঝাবুঝির প্রধান কারণটাই হল এই তথাকথিত স্বপ্নদৃশ্য– অথচ আমি বারবার বলেছি, লিখিত প্রমাণও দিয়েছি যে এমন কোনও দৃশ্য ছবিতেই নেই। বিশ্বাস করুন, ছবিটা আমি খুব দায়িত্ববোধ নিয়ে বানিয়েছি, রাজপুতদের মান-মর্যাদার দিকে দৃষ্টিও দিয়েছি।”

চিতোরের রাজা মহারাজা সংগ্রাম সিংয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় এবং ফলে চিতোরের রানি হিসাবে গণ্য হন। দিল্লি দখলের লক্ষ্যে মহারাজা সংগ্রাম সিংয়ের নেতৃত্বে হিন্দুদের সম্মিলিত বাহিনীর সঙ্গে সম্রাট বাবরের যুদ্ধ হয় ১৫২৭ সালে, যা খানুয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই খানুয়ার যুদ্ধে হিন্দুদের সম্মিলিত বাহিনী পরাজয় বরণ করে এবং মহারাজা সংগ্রাম সিং ভীষণভাবে আহত হন। ১৫২৮ সালে আহত মহারাজা সংগ্রাম সিং মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর, রানি কর্ণাবতী তার বড় ছেলের হয়ে ক্ষমতার ভার নেন এবং বেশ কয়েক বছর রাজ্য পরিচালনা করেন। ১৫৩৫ সালে বাহদুর শাহ মেয়র আক্রমণ করলে রানি কর্ণাবতী ও দুর্গের অন্যান্য নারীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেন এবং বিষ পানে আত্মহত্যা করেন। আবার এটাও প্রচলিত আছে যে, রানি কর্ণাবতী ও দুর্গের অন্যান্য নারীরা বারুদভর্তি ঘরে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহুতি দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, রানি কর্ণাবতীর ছেলে বিক্রমাদিত্যর সঙ্গে ১৫৩২ সালে বাহাদুর শাহর যুদ্ধ হয়, যেখানে বিক্রমাদিত্য শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। তাই ১৫৩৫ সালে যখন বাহাদুর শাহর সঙ্গে দ্বিতীয় যুদ্ধে চিতোরের বাহিনী পুনরায় শোচনীয় পরাজয় বরণ করে, তখন রানি কর্ণাবতী ও দুর্গের অন্যান্য নারীরা আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। বস্তুত প্রায় সব বিখ্যাত ইতিহাসবিদ স্বীকার করেছেন যে, সর্বপ্রথম ১৫৪০ সালে মালিক মোহম্মদ জায়াসির লিখিত ‘পদ্মাবত’ নামক একটি মহাকাব্যে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়। এর আগে ইতিহাসে কোথাও এ বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত মালিক মোহম্মদ জায়াসি রানি কর্ণাবতীর ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে এই মহাকাব্যটি রচনা করেন। পদ্মাবত মহাকাব্যে বর্ণিত রানি পদ্মাবতীর সঙ্গে রানি কর্ণাবতীর অনেক মিল রয়েছে। তাঁদের দুইজনের স্বামীর রাজ্যও ছিল চিতোর। অধ্যাপক রাম পুনিয়ানি বলেন যে, পদ্মাবত মহাকাব্য পরবর্তীতে ভারতে বহুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং লোককাহিনি হিসাবে মর্যাদা পায়। ইতিহাসবিদ ইফরান হাবিব, হারবান মুখিয়া, দেবদত্ত প্রমুখ পরিষ্কারভাবে মত প্রকাশ করেন যে, রানি পদ্মাবতী একটি কাল্পনিক চরিত্র।

দুজনের স্বামী যুদ্ধে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। দু’জনই আগুনে (বা রানি কর্ণাবতী বিষপানে) আত্নহত্যা করেন। জহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক আদিত্য মুখোপাধ্যায় বলেন যে, তৎকালীন ইতিহাসে রানি পদ্মাবতীর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তিনি রানি পদ্মাবতাঁকে মালিক মোহম্মদ জায়াসির কাল্পনিক সৃষ্টি হিসাবে গণ্য করেন। আলাউদ্দিন খলজির মৃত্যু ২০০ বছর পর কবি জায়সি রচিত ‘পদুমাবৎ’ তৈরি একটা চরিত্র মাত্র এই ‘পদ্মাবতী’। আর এর ১০০ বছর পর রচিত বৌদ্ধ রাজার অমাত্য মাগন ঠাকুরের নির্দেশে আলাওলের পদ্মাবতীও একই। সেই সময়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমির খসরু ‘পদ্মাবতীর’ উল্লেখ করেননি। ষোলো শতকের ইতিহাসবিদ ফারিশতা প্রমুখ মুসলমান ঐতিহাসিকদের কেউই এই কল্পিত ‘হিন্দুরমণী’র অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয় না। নির্ভরযোগ্য হিন্দু ঐতিহাসিক দলিল থেকেও সেরকম কিছুর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।

তবে সঞ্জয়লীলা বনসালি এ ছবিতে আলাউদ্দিনকে ভয়ংকর, নির্দয়, নিষ্ঠুরভাবে দেখিয়ে প্রচলিত ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে কোনোরূপ কার্পণ্য করেননি। সুলতানকে দেখানো হয়েছে মাদকাসক্ত এবং উভকামী যৌনতাতাড়িত জালিম, অত্যাচারী রূপে। অর্থাৎ মানবীয় মন্দ গুণের এমন কোনও কিছুই বাদ রাখা হয়নি, যাতে সুলতানকে ঘৃণিতভাবে উপস্থাপনের বাকি থাকে। ইতিহাসবিদ রানা সাফভি বলেন যে, মুভিতে আলাউদ্দিনকে নিষ্ঠুর ও বর্বর হিসাবে দেখানো হয়েছে, যাতে করে মুভির নায়ক রানা সিং-কে একজন বিনম্র ও বুদ্ধিমান শাসক হিসাবে উপস্থাপন করা যায়। তিনিও মুভিতে খিলজিকে ভুলভাবে দেখানো হয়েছে বলে স্বীকার করেন। শান্তনু ডেভিড বলেন যে, খিলজি নিষ্ঠুর হলেও এমন ধরনের শাসক ছিলেন না, যে কিনা শুধুমাত্র একজন নারীর জন্য একটি রাজ্য আক্রমণ করে বসবেন। আন্না এমএম তাঁর মুভি রিভিউতে উল্লেখ করেন যে, হিন্দুদের খুশি করার জন্য বনশালি মুভিতে রাজপুতদের উচ্চাসন এবং খিলজিকে নিচ হিসাবে উপস্থাপন করেছেন।

১২৯৬ সালে আলাউদ্দিন খলজি দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। বস্তুত ভারতব্যাপী সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রথম পথপ্রদর্শনই আলাউদ্দিন খিলজির সর্বপ্রধান কীর্তি। একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিজেতা হিসেবে তিনি ১২৯৬ সালে ইলখানি রাজ্যের শিয়া শাসক গাঁজান মাহমুদকে পরাজিত করে সিন্ধ দখল করেন। ১২৯৯ সালে চাগতাই খান দুয়া খানকে পরাজিত করে পাঞ্জাব নিজের দখলে নেন। ১৩০১ সালে রণথম্বোর, ১৩০৩ সালে চিতোর, ১৩০৫ সালে। মান্দু সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির পদানত হয়। রাজা রায় রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মালিক কাফুর। তবে পরবর্তীতে রাজা রায়চন্দ্রকে ‘রায় রায়হান’ খেতাব দিয়ে পুনরায় তাকে রাজ্য চালনার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে গুজরাটও তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। ১৩০৯ সালে রাজা রায় রামচন্দ্রের সহায়তায় মালিক কাফুরের নেতৃত্বে বারাঙ্গল জয় করা হয়। মৌর্য সম্রাট অশোকের পর তাকেই একমাত্র সম্রাট হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যিনি গোটা হিন্দুস্তানকে এক সুতোয় গাঁথতে পেরেছিলেন। তিনি এত বেশি পরিমাণ শহর আর নগর জয় করেছিলেন যে, তাঁকে সিকান্দার সানি বা দ্বিতীয় আলেকজান্ডার উপাধিও দেওয়া হয়েছিল।

আলাউদ্দিন খিলজির শাসনব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল –(১) দাক্ষিণাত্যকে ভারত তথা ভারত উপমহাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে একত্রিত করা। মনে রাখতে হবে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে দাক্ষিণাত্য সবসময়েই আলাদা ছিল। সাংস্কৃতিকভাবে, ভাষাগতভাবে এবং ভৌগোলিকভাবেও পৃথক ছিল। তবে গৌড় শাসনামলে দাক্ষিণাত্যের শেষ সীমানা কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত গৌড় শাসন পৌঁছোতে পেরেছিল। এরপর আর কোনো শাসকই দাক্ষিণাত্য শাসন করতে পারেননি। দাক্ষিণাত্য জয় করতে পারলেও তিনি দাক্ষিণাত্যকে সরাসরি নিজ শাসনে না-নিয়ে আগের রাজাদেরই নিজের অধীনে নিয়োগ দেন। “তারিক-ই-আলাই’-এর বর্ণনানুযায়ী, এসব রাজারা সুলতান আলাউদ্দিন খিলজিকে নিয়মিত জিজিয়া আর খাজনা আদায় করে নিজ নিজ সিংহাসন অধিকারে রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন। (২) আলাই মিনার, পুরাতন দিল্লির কুতুব মিনার কমপ্লেক্সে মিনারটি অবস্থিত। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির দাক্ষিণাত্য বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে এই মিনারটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। এর নির্মাণ শুরুর সময়কালটি সঠিকভাবে জানা না-গেলেও ধারণা করা হয়, ১৩০০ সালের দিকে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৩১৬ সালে সুলতানের মৃত্যুর সময় মিনারটির মাত্র একতলা সম্পন্ন হয়। (৩) গোটা সাম্রাজ্যে তিনি মদপান নিষিদ্ধ করেন। এমনকি মদ উৎপাদনেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তাঁর সময়ে ভারতে ব্যভিচার আর ‘বিকৃত যৌনাচার সমকামিতা নিষিদ্ধ করা হয়। (৪) একজন সুলতানের সুষ্ঠুভাবে শাসন করার জন্য প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের বিভিন্ন গোপন তথ্যের। আর এসব তথ্য সংগ্রহ করার জন্য গোটা রাজ্যজুড়ে তিনি অসংখ্য গুপ্তচর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছিলেন। এই গুপ্তচরেরা রাজ্যে সুলতানের চোখ-কান হিসাবে কাজ করত। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থেকে শুরু করে অতি তুচ্ছ তথ্যও মুহূর্তেই সুলতানের কাছে পৌঁছে যেত। (৫) ভারতের ইতিহাসে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির পূর্বে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্দিষ্ট কোনো বেতন পেতেন না। বরং তাদের জমির জায়গির দান করা হত। তিনি এই জায়গির ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে সেনাবাহিনীর সদস্যদের নির্দিষ্ট বেতন দেওয়ার রীতি শুরু করেন। তাঁর সময়ে একজন অশ্বারোহী সৈন্যের বেতন ছিল প্রায় ২৩৮ তঙ্কা (স্বর্ণমুদ্রা)। (৬) আলাউদ্দিন খিলজির সময়ে সাম্রাজ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিল ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। এই ব্যবস্থায় নিত্যব্যবহার্য প্রতিটি পণ্যের মূল্যই রাষ্ট্র থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হত। শুধু নির্ধারণ করে দিয়েই তিনি তাঁর দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নেননি। বরং তাঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানা হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করে গুপ্তচররা নিয়মিত সুলতানকে রিপোর্ট করত। গুপ্তচররা ঘুরে ঘুরে বাজার পর্যবেক্ষণ করতেন। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বাজারমূল্য বেশি হলে বিক্রেতাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হত। সেই সময়েও ব্যবসায়ীদের ওজনে কম দেওয়ার প্রবণতা ছিল। তবে এর জন্যও ছিল কঠোর শাস্তির বিধান। ওজনে কম দিয়ে কোনো ব্যবসায়ী ধরা পড়লে যতটুকু ওজন কম দেওয়া হয়েছে, ঠিক ততটুকু মাংস তাঁর শরীর থেকে কেটে নেওয়া হত। ফলে ধীরে ধীরে ওজনে কম দেওয়ার মতো জঘন্য এই মানসিকতা থেকে ব্যবসায়ীরা সরে আসে। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানি বলেন, সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এতটাই কঠোর ছিল যে, দুর্যোগের সময়ও বাজারমূল্য ওঠানামা করত না। তবে দুর্যোগ কিংবা অন্য কোনো কারণে বাজারে পণ্য সরবরাহ হ্রাস পেলে যাতে পণ্যমূল্য ওঠানামা না করে, সেজন্য রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গুদামে পণ্য মজুদ রাখা হত। সরবরাহ কমে গেলে গুদাম থেকে পণ্য সরবরাহ করে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা হত। (৭) দ্রব্যমূল্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও, প্রশাসনের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যে ঘুষের রীতি প্রচলিত ছিল, তা সুলতান আলাউদ্দিন খলজি কঠোর হাতে নির্মূল করেন। (৮) আমির-ওমরাহ ও বিত্তবানদের মধ্যে প্রচলিত দুর্নীতির তিনি মূলোৎপাটন করেছিলেন। সুদৃঢ় ও কঠোর ব্যবস্থা দ্বারা তিনি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে এনেছিলেন। (৯) প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস তাঁর শাসনামলের বিরাট সাফল্য। তিনি রাজস্ব আদায়কারী খুত, মুকাদ্দাম ও চৌধুরীদের অত্যাচার থেকে প্রজাদের রক্ষা করেছিলেন। (১০) ভূমি জরিপ ব্যবস্থা ভারতবর্ষে মুসলিম শাসক হিসাবে তিনিই সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন। রাষ্ট্রের কাজের জন্য অশ্বকে চিহ্নিত করার প্রথা প্রবর্তন করে তিনি সামরিক বাহিনীতে প্রচলিত দুর্নীতি দমন করেন। (১১) শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শিল্পের পৃষ্টপোষক হিসেবে আলাউদ্দিন খলজি ভারতীয় ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। মুসলিম ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ‘ভারতের তোতা পাখি’ বলে খ্যাত কবি আমির খসরু ছিলেন আলাউদ্দিন খলজির রাজ দরবারের সবচেয়ে খ্যাতিমান কবি।

আলাউদ্দিনের ব্যক্তিগত চারিত্রিক কলঙ্কের কথা ছাড়া শাসনগত যোগ্যতা ও কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ধর্ম সম্বন্ধে বেপরোয়া মনোভাব, স্বার্থপরতা, পাপপ্রবণতা, কূটনীতির নামে প্রতারণার সূক্ষ্ম কৌশল তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করেছিল ঠিকই, সেই কারণেই আলাউদ্দিন খলজির এহেন ধর্মদ্রোহিতাই পরবর্তী সময় তাঁর উত্তরাধিকারীদের অনুপযুক্ততা ও মালিক কাফুরের ক্ষমতা লাভের ফলে খিলজি বংশের পতনের অন্যতম কারণ।

আলাউদ্দিনের হিন্দুনির্যাতন প্রসঙ্গে ডাঃ ঈশ্বরীপ্রসাদ লিখেছেন– “আলাউদ্দিন হিন্দুদের অত্যাচার-উৎপীড়ন করেছিলেন বলে যে তথ্যটি প্রচারিত তা সত্য নয়।” মুরল্যান্ড এবং প্রফেসর হাবিব লিখেছেন– “রাবণী যেখানে ‘হিন্দু’ শব্দ ব্যবহার করেছেন তাঁর উদ্দেশ্য হল যুত, মুকাদদাম, চৌধুরী ইত্যাদি। এরা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। সুতরাং রাজনীতির প্রয়োজনে তাঁদের শক্তিহীন করার প্রয়োজন ছিল।” অর্থাৎ যুত, মুকাদদাম, চৌধুরীকে এবং হিন্দুদের তিনি ধর্মের কারণে নিধন করেননি। ডাঃ ত্রিপাঠী লিখেছেন– “তিনি মুসলমানদেরও ছাড়েননি। অতএব হিন্দুদের কীভাবে ছাড়া সম্ভব?” আলাউদ্দিনের ২০ বছর শাসনকালে বিভিন্ন সময়ে মোঙ্গলরা লুটপাটের উদ্দেশ্যে হিন্দুস্তানে অভিযান চালায়। শুধুমাত্র ১২৯৬-১৩০৮ সালে মধ্যেই এই বর্বর মোঙ্গলরা মোট ১৬ বার ভারত তথা হিন্দুস্তানে অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু প্রতিবারই তাঁরা হিন্দুস্তানের সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির হাতে পরাজিত হয়ে ফেরত যায়। ভারতের প্রতি আলাউদ্দিন খিলজির অন্যতম একটি অবদান হচ্ছে, তিনি মঙ্গোল আক্রমণের হুমকি থেকে হিন্দুস্তানকে রক্ষা করেছিলেন। ১২৯৭ সালে জলন্ধরে সুলতানের বাহিনীর মুখোমুখি হয় একটি মোঙ্গল বাহিনী। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি জাফর খান তাঁদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। মোঙ্গলরা এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পুনরায় হামলা চালিয়ে দিল্লির শিরি দুর্গটি দখল করে নেয়। জাফর খান তাঁদের পরাজিত করে শিরি দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন। সেই সঙ্গে ২০০০ মোঙ্গল-যোদ্ধাকে বন্দি করে নিয়ে আসা হয়। শিরি দুর্গটির প্রকৃত নাম ছিল দার-উল-খিলাফত। একবার এই দুর্গে প্রায় ৮০০০ মোঙ্গল সৈন্যের শিরচ্ছেদ করা হয়, যার ফলে দুর্গটির নামই হয়ে যায় ‘শিরি’। ১২৯৯ সালে মোঙ্গলরা পুনরায় দুয়া খানের পুত্র কুতলুগ খাজার নেতৃত্বে প্রায় ২ লাখ সৈন্য নিয়ে হিন্দুস্তানে অভিযান চালায়। তাঁরা আবারও শিরি দুর্গটি দখল করে নেয়। শিরি দুর্গের দখল নিয়ে তাঁরা দিল্লির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মোঙ্গলদের আক্রমণের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তাঁরা আক্রমণের সময় লুটপাট করতে করতে আসে। কিন্তু আলাউদ্দিন খলজি লক্ষ করলেন এবার আর তাঁরা লুটপাট না-করে সরাসরি দিল্লির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অর্থাৎ এবার চূড়ান্ত একটি লড়াই হতে যাচ্ছে, কারণ আক্রমণের লক্ষ্য এবার খোদ দিল্লিই। জাফর খানকে প্রধান সেনাপতি হিসাবে নিয়োগ দিয়ে আলাউদ্দিন খলজি মোঙ্গলদের বাঁধা দিতে এগিয়ে আসেন। দুর্ধর্ষ জাফর খানের হাতে মোঙ্গলরা আরও একবার পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করে পিছু হটতে থাকে। তবে এই যুদ্ধে সেনাপতি জাফর খান নিহত হন। আলাউদ্দিন যখন চিতোর দুর্গ অবরোধে ব্যস্ত ছিলেন, মোঙ্গলরা আরেকবার হিন্দুস্তানে আক্রমণ চালায়। তবে এবার মোঙ্গল সেনাবাহিনীর আকার তুলনামূলকভাবে অনেক ছোটো ছিল। তবে এই আক্রমণের ফলে সুলতান বেশ বিপর্যয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তাই এরপর তিনি সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নিরাপত্তার জোরদার করার জন্য আরও বেশ কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেন। উন্নত অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন করেন। তবে এরপরও আলি বেগ ও তারতাক খানের নেতৃত্বে মোঙ্গলরা আক্রমণ চালিয়ে পাঞ্জাব দখলে নিয়ে নেয়। অনেকটা প্রথানুযায়ীই তাঁদের আবারও পরাজিত করে দিল্লির সেনাবাহিনী পাঞ্জাবের দখল নিয়ে নেয়। অন্যদিকে, ১৩০৬ সালে কাবাক খান আর ১৩০৮ সালে ইকবালের নেতৃত্বে মোঙ্গলরা পুনরায় আক্রমণ চালালে মোঙ্গলদের পুরো সেনাবাহিনীই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ১৩০৬ সাল থেকে দিল্লি সেনাবাহিনী একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। এসময় থেকে চেষ্টা করা হত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একজন মোঙ্গল সেনাও যেন জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে। কারণ এই পলাতক যোদ্ধারাই আবার পরবর্তী অভিযানগুলোতে অংশগ্রহণ করত। আর যুদ্ধে যাঁরা বন্দি হত, তাঁদের সোজা হাতির পায়ের নিচে ফেলে পিষ্ট করা হত। সুলতান আলাউদ্দিন মোঙ্গলদের এত কঠোরভাবে দমন করেন যে, এই ১৬টি যুদ্ধে প্রায় ৩ লাখ মঙ্গোল সেনা তাঁর হাতে নিহত হয়। ১৩০৮ সালের পর মোঙ্গলরা ভুলেও আর হিন্দুস্তানের দিকে তাঁদের বিষাক্ত দৃষ্টিতে তাকাতে সাহস করেনি। তাঁরা হিন্দুস্তানের সুলতান আলাউদ্দিন খলজিকে এতটাই ভয় পেত যে, তারিক-ই-ফিরোজশাহির বর্ণনানুযায়ী, সুলতানের সেনাপতি মালিক গাজী প্রতি শীতকালে মোঙ্গল সীমান্তে গিয়ে তাঁদের যুদ্ধের জন্য আহবান করতেন। কিন্তু মঙ্গোলরা কখনোই আর হিন্দুস্তান অভিমুখে এগিয়ে আসার ধৃষ্টতা দেখায়নি!

আলাউদ্দিন কি সমকামী ছিলেন? আলাউদ্দিনের সমকামিতা নিয়ে কতিপয় ঐতিহাসিকরা বেশ মুখর। বলা হয় মালিক কাফুর ছিলেন আলাউদ্দিনের সমকাম যৌনসঙ্গী। এহেন তথ্য প্রথম জানা যায় ইতিহাস ঘটনাপঞ্জী লেখক জিয়াউদ্দিন বারানির লেখা ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’ গ্রন্থে। জিয়াউদ্দিন বারানির লেখার উপর ভিত্তি করে ভারতীয় গবেষক রুথ ভানিতা এবং সেলিম কিদাই মত প্রকাশ করেন যে, আলাউদ্দিন খলজি উভয়কামী ছিল। অবশ্য ভারতীয় অধ্যাপক-গবেষক-লেখক আব্রাহাম এরালি এই মতকে মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করে বলেন— জিয়াউদ্দিন বারানি সম্ভবত একজন অ-তুর্কি এবং হিন্দু ঘরে জন্ম নেওয়ার জন্য মালিক কাফুরের বিপক্ষে অত্যন্ত সমালোচনামুখর ছিলেন। প্রথম দিকে মালিক কাফুর ছিলেন একজন হিন্দু বালক, যাকে ১২৯৯ সালে গুজরাট বিজয় করার পর দাস হিসাবে নিয়ে আসা হয়। মালিক কাফুর একজন সুদর্শন বালক এবং বিচক্ষণ বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি মুসলিম হন এবং সুলতানের প্রচণ্ড বিশ্বাসভাজন হন। সুলতানের সেনাপতি হিসাবে তিনি সফলভাবে অনেকগুলো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বিজয় লাভ করেন। ভারতীয় ইতিহাসবিদ বেনারসী প্রসাদ সাক্সেনা মত প্রকাশ করেন যে, আলাউদ্দিন খিলজি ও মালিক কাফুরের মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক ছিল, তাকে ‘সমকাম হিসাবে গণ্য করা ভুল হবে। তিনি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন যে, আলাউদ্দিন খিলজির চরিত্রে সমকামিতার কোনো গুণ ছিল না। যেহেতু মালিক কাফুরের পরিবার বা নিকটজন বলে কেউ ছিল না, তাই আলাউদ্দিন খিলজি তাঁকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন। এই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়েই মালিক কাফুর আলাউদ্দিন খিলজিকে হত্যা করেন এবং পরোক্ষভাবে ক্ষমতা দখল করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *