০৩. ব্রিটিশরাজ : বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে
এখন আমরা এসে গেলাম উপনিবেশিক যুগে। গোটা বিশ্বে ফরাসি, পোর্তুগিজ, ডাচ, ওলন্দাজ প্রভৃতি উপনিবেশ শক্তি দেশে দেশে উপনিবেশ গড়ে তুললেও আমার আলোচ্য বিষয় শুধুমাত্র ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি। ফরাসি, পোর্তুগিজরা ভারত উপমহাদেশে ক্ষুদ্র কিছু অংশে উপনিবেশ করলেও ব্রিটিশরা প্রায় সমগ্র ভারত উপমহাদেশে উপনিবেশ ঘটিয়ে শাসন করেছে টানা ১৯০ বছর। তার আগে আমরা একটু জেনে নিতে পারি উপনিবেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়।
উপনিবেশ (Colony) বলতে বোঝায় একটি স্থান বা এলাকা, অন্য কোনো দেশ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রধান নগর হিসাবে দেশটি উপনিবেশের বৈধ দখলদার। একটি দেশের যখন অনেকগুলো উপনিবেশ থাকে তখন মূল দেশটি সাম্রাজ্য হিসাবে পরিচিত হয়। বিশ্বের প্রাচীনতম উপনিবেশ পুয়ের্তো রিকো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়েছে। উপনিবেশে অবশ্যই অনেক লোকসংখ্যা থাকতে হবে। বিশ্বে একসময় অনেক উপনিবেশ ছিল যা বর্তমানে স্বাধীন দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। অধিকাংশ দেশই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ন্ত্রিত ছিল। বর্তমানে সেই সমস্ত দেশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশের সদস্য। Colony শব্দটি লাতিন শব্দ কলোনিয়া থেকে উদ্ভূত। প্রাচীন গ্রিসে উপনিবেশের নিয়ন্ত্রককে মেট্রোপোলিশ বা প্রধান নগর বলা হত। একটি উপনিবেশকে প্রায়শই নির্দিষ্ট কোনো-না-কোনো দেশ কর্তৃক শাসন করা হত কিংবা উপনিবেশটি নিজেই স্বাধীনভাবে পরিচালিত হত। পুতুল রাজ্য বা নিয়ন্ত্রিত রাজ্যরূপে উপনিবেশের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্ব করার কোনো স্বাধীন স্বত্ত্বা বা অধিকার নেই। এর শীর্ষ পর্যায়ের প্রশাসন ব্যবস্থা প্রধান নগর বা রাজধানী থেকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে।
আধুনিক যুগের উপনিবেশগুলি হল –(১) ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত অ্যাঙ্গোলা কয়েক শতক ধরে পোর্তুগালের উপনিবেশ ছিল। (২) ব্রিটিশ অনুসন্ধানকারী ও নাবিক জেমস কুক ১৭৭০ সালে অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে পদার্পণ করে একে ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে দাবি করেন। (৩) ব্রাজিল ১৮২২ সালে স্বাধীনতার পূর্বে কয়েক শতাব্দী পর্তুগালের উপনিবেশ ছিল। (৪) কানাডা প্রথমে ফ্রান্স ও পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনাধীন উপনিবেশ ছিল। (৫) ১৮৪১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত হংকং ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। ম্যাকাও পোর্তুগিজ উপনিবেশরূপে ১৫৫৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে ছিল। উভয় উপনিবেশই পরবর্তীতে চিনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলে পরিণত হয়। (৬) ষোড়শ শতকের শুরুতে আধুনিক ভারতের অংশবিশেষ পর্তুগালের নিয়ন্ত্রণে ছিল, যা সমষ্টিগতভাবে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পোর্তুগিজ ইন্ডিয়া নামে পরিচিতি ছিল। ১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যবর্তীকালীন সময়ে যুক্তরাজ্য সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হত। (৭) ১৬০০ থেকে ১৯৪৫/১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া ডাচ উপনিবেশ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এর পূর্বে ১৫২১ সাল থেকে স্পেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল বর্তমান স্বাধীন দেশটি। (৮) ফিলিপাইন ১৫২১ থেকে ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত স্পেনের এবং ১৮৯৮ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানের সামরিক বাহিনী উপনিবেশটির নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেছিল।
এখন কি উপনিবেশ ধারণা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে? একদমই না। আজও উপনিবেশ বহাল তবিয়তে আছে। যেমন— (১) রিও ডি ওয়ো / পশ্চিম সাহারা মরক্কোর অনেক উপনিবেশের একটি হিসাবে পরিগণিত। পাশাপাশি আফ্রিকা মহাদেশের সর্বশেষ উপনিবেশরূপে পরিচিত এটি। (২) চিলির বিশেষ অঙ্গরাজ্য হিসাবে ইস্টার আইল্যান্ডের নাগরিকেরা চিলির নাগরিকত্ব প্রাপ্তির পূর্ণ দাবিদার। (৩) ফ্রান্সের অনেকগুলো উপনিবেশ আছে। এর মধ্যে ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া, সেন্ট বার্থলেমাই, সেন্ট মার্টিন, সেন্ট পিয়েরে অ্যান্ড মিকুইলন, ওয়ালিস এন্ড ফুতুনা, নিউ ক্যালিদোনিয়া অন্যতম। (৪) যুক্তরাজ্যের উপনিবেশগুলো হল— ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, জিব্রাল্টার এবং ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ। (৫) যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ হিসাবে আমেরিকান সামোয়া, পুয়ের্তো রিকো, গুয়াম, নর্দান মারিয়ানা আইল্যান্ড, ইউনাইটেড স্টেটস ভার্জিন আইল্যান্ড আছে।
উপনিবেশ কেবল আধুনিক যুগের বিষয় নয়, উপনিবেশ প্রাচীনকাল থেকেই উদ্ভব হয়েছে। যেমন– (১) আলেকজান্দ্রিয়া, দুরেস, মার্সেইল গ্রিক উপনিবেশ হিসেবে গঠিত হয়। (২) কার্থেজ ফোনিসিয়ান উপনিবেশ ছিল। (৩) সাইরেন গ্রিসের থেরার উপনিবেশ ছিল। (৪) কোলন রোমান উপনিবেশ ছিল। কোলন নামটি লাতিন ভাষা কলোনিয়া থেকেই সৃষ্ট। উপনিবেশবাদের ক্রিয়াকলাপের দীর্ঘ ইতিহাস আছে, যা মিশরীয়, ফিনিশিয়ান, গ্রিক এবং রোমানদের দ্বারা শুরু হয়েছে। ফিনিসিয়ানরা একটি উদ্যোগী সামুদ্রিক বাণিজ্য সংস্কৃতি চালু করে, যা ভূমধ্যসাগর খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ সাল থেকে ৩০০ অব্দ পর্যন্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে গ্রিক এবং পারস্যদের উপনিবেশ স্থাপনের ধারাকে অব্যাহতভাবে চালু রাখে। তারপর রোমানরা ভূমধ্যসাগর, উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়া জুড়ে উপনিবেশ স্থাপন শুরু করে। নবম শতাব্দীতে ভেনিসিয়ান, জেনোভেস এবং আমালফিয়ানদের মতো রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য এবং অন্য ভূখণ্ডগুলিতে ধনীদের আক্রমণ করে উপনিবেশ স্থাপনের একটি নতুন প্রতিযোগিতার ঢেউ শুরু হয়েছিল। ভেনিসের ডালমাটিয়া বিজয়ের মধ্য দিয়ে এ যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের তিনটি অক্টাভের অধিগ্রহণের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ১২০৪ সালের চতুর্থ ক্রসেডের সমাপ্তিতে সর্বাধিক পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
উপনিবেশ থেকে উপনিবেশবাদ। উপনিবেশবাদ হল রাজনৈতিক ক্ষমতা দ্বারা এক অঞ্চল থেকে আর-একটি অঞ্চল প্রতিষ্ঠা ও উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণ, সম্প্রসারণ এবং শোষণ। উপনিবেশ শব্দটি এমন একটি শব্দ, যা ঔপনিবেশিক শক্তি এবং উপনিবেশের মধ্যে অসম সম্পর্ক এবং প্রায়ই ঔপনিবেশিকদের এবং আদিবাসী মধ্যে অসম সম্পর্ক বর্ণনা করতে ব্যবহার করা হয়। উপনিবেশবাদ হল এক দেশের জনবসতি প্রতিষ্ঠা এবং অন্য অঞ্চলে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নীতি আরোপের চেষ্টা।
কলিন্স ইংরেজি অভিধান উপনিবেশবাদকে ‘দুর্বল মানুষ বা অঞ্চলগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটি শক্তির নীতি এবং অনুশীলন’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ওয়েবস্টার এনসাইক্লোপিডিক ডিকশনারি উপনিবেশবাদকে অন্য জাতির বা অঞ্চলগুলির উপর কর্তৃত্ব প্রসারিত বা বজায় রাখতে চায় এমন একটি দেশের সিস্টেম বা নীতি’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। মেরিয়াম-ওয়েবস্টার চারটি সংজ্ঞা দেয়, যার মধ্যে রয়েছে একটি উপনিবেশের কিছু বৈশিষ্ট্যযুক্ত এবং একটি নির্ভরশীল অঞ্চল বা লোকের উপর একটি শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ’। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোসফি ‘উপপনিবেশবাদ’ শব্দটি দ্বারা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকা ও এশিয়ায় ইউরোপীয় বসতি স্থাপন এবং বিশ্বের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া বর্ণনা করতে ব্যবহার করেছে। এটি উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেছে এবং বলেছে দুটি ব্যবস্থার মধ্যে ধারাবাহিকভাবে পার্থক্য করার অসুবিধা দেখে এই প্রবেশিকাটি উপনিবেশবাদকে একটি বিস্তৃত ধারণা হিসাবে ব্যবহার করে, যা ষোড়শ থেকে বিংশ শতাব্দীর অবধি শেষ হওয়া ইউরোপীয় রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রকল্পকে বোঝায়, যা ১৯৬০-এর দশকের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে শেষ হয়। উপনিবেশবাদ একটি আদিবাসী (বা জোর করে নিয়ে আসা) সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং বিদেশি হানাদার সংখ্যালঘুদের মধ্যে একটি সম্পর্ক। উপনিবেশিক মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন মৌলিক সিদ্ধান্তগুলি উপনিবেশিক শাসকরা তাঁদের স্বার্থের জন্য তা তৈরি করে এবং প্রয়োগ করা হয়, যেগুলি প্রায়শই একটি দূরবর্তী মহানগরীতে স্থাপন করা হয়। উপনিবেশকারীরা উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সাংস্কৃতিক সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁদের নিজস্ব শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁদের শাসনের নির্ধারিত আদেশ জোর করে মানতে বাধ্য করে।
বস্তুত ১৭০০ এবং ১৮০০-এর দশকে, ইউরোপের ধনী, শক্তিশালী দেশ (যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন এবং নেদারল্যান্ডস) আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া এবং ক্যারিবিয়ানের মহাদেশের উপনিবেশ স্থাপন করে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সময় ছিল, যোড়শ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যে যখন বিভিন্ন ইউরোপিয়ান ক্ষমতা দ্বারা এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকা এর মধ্যে অনেকগুলো উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থনীতি ব্যয় প্রতিদ্বন্দ্বী অবকাঠামো প্রণয়ন জোরদার করার জন্য প্রথমে দেশগুলো একটি বাণিজ্যবাদ নীতি অনুসরণ করে, ফলে উপনিবেশগুলো শুধুমাত্র মাতৃদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য অনুমোদিত ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর। মধ্যবর্তী সময়ে শক্তিশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বাণিজ্যবাদ নীতি ও তার অন্তর্ভুক্ত সকল নিষেধাজ্ঞা অপসারণ ও চালু নীতির প্রণয়ন করেন এবং এর পরিবর্তে মুক্ত বাণিজ্য প্রণয়ন করে।
গোটা বিশ্বে যে উপনিবেশগুলি ঘটেছে সেই উপনিবেশগুলির রূপরেখা কি একই ধরনের? একদমই না। উপনিবেশেরও অনেকগুলি ধরন আছে, যেমন –(১) বসতি উপনিবেশবাদ, (২) শোষণমূলক উপনিবেশবাদ, (৩) প্রতিনিধিমূলক উপনিবেশবাদ এবং (৪) অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ। একটু ব্যাখ্যা করে নিলে বুঝতে পারবেন ভারতে ব্রিটিশরা ঠিক কোন্ ধরনের উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। বসতি উপনিবেশ : বসতি উপনিবেশ বৃহত্তর পর্যায়ে অভিবাসন জড়িত, যা প্রায়শই ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণে অনুপ্রাণিত হয়। এটি আসলে জনসংখ্যা প্রতিস্থাপনের জন্য চেষ্টা করে। এখানে, বসতি স্থাপন ও কৃষিকাজ করার উদ্দেশ্যে প্রচুর সংখ্যক লোক কলোনিতে পাড়ি জমান। শোষণমূলক উপনিবেশ : শোষণমূলক উপনিবেশ হল উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণের বা স্থানীয় জনগণের শ্রমকে ব্যহারের দিকে মনোনিবেশ করে, সাধারণত যা হয় উপনিবেশের কেন্দ্রের সুবিধার জন্য। প্রতিনিধিমূলক উপনিবেশ : প্রতিনিধিমূলক উপনিবেশ হল সেটাই— একটি বসতি স্থাপন প্রকল্প, যা উপনিবেশিক শক্তি দ্বারা সমর্থিত, যেখানে বেশিরভাগ বসতিস্থাপনকারীরা ক্ষমতাসীন উপনিবেশিকদের একই জাতিগত গোষ্ঠী থেকে আসে না। অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ : অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলগুলির মধ্যে অসম কাঠামোগত শক্তির ধারণা। শোষণের উৎস রাষ্ট্রের মধ্য থেকেই আসে। মোটামুটি ১৮০০ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত গোটা বিশ্বে উপনিবেশ জারি ছিল। মুসলিম দেশগুলির তুলনায় অতীতে দুর্বল থাকা খ্রিস্টান দেশগুলি কেন আধুনিক সময়ে এতগুলি ভূখণ্ডে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে এবং এমনকি একসময় বিজয়ী অটোমান সেনাবাহিনীকেও পরাস্ত করতে শুরু করে? কারণ তাঁদের আইন-কানুন কারণেই উদ্ভাবিত হয়েছে? [Rational basis for the Politics of Nations— Ibrahim Muteferrika (1731)]
আধুনিক উপনিবেশবাদ শুরু হয়েছিল পোর্তুগিজ যুবরাজ হেনরি আবিষ্কারের যুগ শুরু করার মাধ্যমে। স্পেন এবং তারপর পোর্তুগাল সমুদ্র ভ্রমণ দিয়ে আমেরিকার মুখোমুখি হয় এবং নতুন বাণিজ্য পোস্ট তৈরি বা বিশাল জমি অধিকরণ করে। কিছু লোকের মতে, এটি মহাসাগর জুড়ে উপনিবেশগুলির নির্মাণ যা উপনিবেশবাদকে সম্প্রসারণবাদের ধারণা থেকে পৃথক করে। এই নতুন ভূখণ্ডগুলি স্পেনীয় সাম্রাজ্য এবং পোর্তুগিজ সাম্রাজ্যের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হত। সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসি উপনিবেশিক সাম্রাজ্য এবং ডাচ সাম্রাজ্যের সৃষ্টি এবং পাশাপাশি ইংলিশ উপনিবেশিক সাম্রাজ্য সৃষ্টি হয়, যা পরে ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্য’ নামে পরিচিতি পায়। এই শতাব্দী। ডেনিশ উপনিবেশিক সাম্রাজ্য এবং কিছু সুইডিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠাও দেখেছিল। স্বাধীনতার প্রথম ঢেউ শুরু হয়েছিল আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধ (১৭৭৫-১৭৮৩) দ্বারা, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এক নতুন পর্ব শুরু করে। স্পেনীয় সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় আমেরিকান অঞ্চলে লাতিন আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধগুলির মাধ্যমে। তবে এই সময়ের পরে অনেকগুলি নতুন উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা মধ্যে উল্লেখযোগ্য জার্মান উপনিবেশিক সাম্রাজ্য এবং বেলজিয়াম উপনিবেশিক সাম্রাজ্য। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, অনেক ইউরোপীয় শক্তি আফ্রিকার বিভাজন বা কলোনিয়ান আফ্রিকার সূচনার সাথে জড়িত ছিল।
মোটামুটি ষোড়শ শতক থেকেই ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্থানে নিজ নিজ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তবে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি নয়া সাম্রাজ্যবাদী বা ‘নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদী’ নীতি গ্রহণ করে তা পূর্ববর্তী যুগের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী নীতির চেয়ে অনেক তীব্র ও সক্রিয় ছিল। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপনে অগ্রসর হয়। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা। উপনিবেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করার মাধ্যমে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি প্রকৃতপক্ষে উপনিবেশে নিজেদের সামগ্রিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করত। রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফলে উপনিবেশের ফলে উপনিবেশের অর্থনৈতিক, সামরিক, সামাজিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহজেই নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।
উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ কি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ? সাম্রাজ্যবাদ হল পররাজ্যের উপর অধিকার বিস্তারের নীতি। এটিকে প্রায় নঞর্থকভাবে বিবেচনা করা হয়, যেহেতু এতে স্থানীয় জনগণকে শোষণের মাধ্যমে অল্প আয়াসে ধনী হওয়ার উদ্দেশ্য থাকে। আধুনিককালে এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয় যে, উপনিবেশবাদ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের বহিঃপ্রকাশ এবং পরেরটি ছাড়া তার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। বিদ্যমান বৈধ উপনিবেশ ছাড়া অনানুষ্ঠানিক সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয়।
বিগত উনিশ শতকে পুঁজিবাদ বিকাশলাভ করে এবং দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে সারা পৃথিবী দখল করে ফেলে। পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তার যন্ত্রণাকর দ্বন্দগুলো ক্রমশ বেশি করে প্রকট ও তীব্র হয়ে ওঠে। ওই সময়ে পুঁজিবাদী বিকাশের অগ্রভাগে ছিল শিল্পপুঁজি। এই জন্য ওই যুগকে শিল্পপুঁজির বা শিল্পপুঁজিবাদের যুগ বলা হয়। শিল্প পুঁজিবাদের মৌলিক দ্বন্দ্বগুলির বৃদ্ধি ও বিকাশের ফলে পুঁজিবাদের বিকাশে এক নতুন পর্যায় দেখা দিল, যার নাম সাম্রাজ্যবাদ। পুঁজিবাদের বিকাশে এক নতুন ও উচ্চতর পর্যায়রূপে বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই সাম্রাজ্যবাদ দেখা দেয়। পুঁজিবাদের সমস্ত মৌলিক দ্বন্দ্বগুলো সাম্রাজ্যবাদে তীব্র হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদ হল মরণোন্মুখ পুঁজিবাদ। সাম্রাজ্যবাদে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা সমাজের আরও বিকাশের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
১৮৭০ সালের পর সাম্রাজ্যবাদের বিস্ফোরণের জন্য পণ্ডিতেরা নানাবিধ কারণ দেখান। ব্রিটিশ অর্থনৈতিক তাত্ত্বিক জেএ হবসন সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। হবসন বলেন যে, নব্য সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে কোনো উচ্চতর লক্ষ্য ছিল না। অর্থনৈতিক লক্ষ্যই ছিল এই নব্য উপনিবেশবাদের মূল। হবসনের মতে, এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিবাদীরা মুনাফা ভোগ করে বহু মূলধন জমা করে। এর ফলে মূলধনের পাহাড় জমে যায়। এই মূলধন উপনিবেশে বিনিয়োগ করে আরও মুনাফা বৃদ্ধির জন্য পুঁজিপতিরা তাঁদের নিজ দেশের সরকারকে উপনিবেশ দখলে বাধ্য করে। উপনিবেশের নতুন শিল্পে মূলধন লগ্নি করে পুঁজিপতি শ্রেণি মুনাফার পাহাড় জমায়। উপনিবেশের কাঁচামাল ও বাজারকে একচেটিয়া দখল করে তাঁরা ফুলে ফেঁপে ওঠে। সুতরাং নব্য সাম্রাজ্যবাদের মূল অর্থনৈতিক শিকড় ছিল উপনিবেশে লগ্নির জন্য বাড়তি মূলধনের চাপ। অর্থাৎ বাড়তি মূলধনের চাপই সাম্রাজ্য বা উপনিবেশ দখলের মূল কারণ। বিখ্যাত সাম্যবাদী নেতা ম্লাদিমির লেনিন, তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ নামক গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাকে আরও বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, পুঁজিবাদের ভিতরেই সাম্রাজ্যবাদের বীজ নিহিত আছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর বৈদেশিক নীতি পুঁজিবাদের স্বার্থেই পরিচালিত হয়। অধিক মুনাফার আশায় শিল্প-মালিকরা দেশের লোকের প্রয়োজন অপেক্ষা বাড়তি পণ্য উৎপাদন করে। এই বাড়তি পণ্য বিক্রয় ও সস্তায় কাঁচামাল পাওয়ার জন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র উপনিবেশ দখল করে। বিশ্বে উপনিবেশের সংখ্যা সীমিত। পুঁজিবাদী দেশগুলো উপনিবেশ দখলের চেষ্টা করার বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধ আরম্ভ হয়। যুদ্ধ হল পুঁজিবাদী অর্থনীতির চূড়ান্ত পরিণতি। লেনিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসাবে বিভিন্ন পুঁজিবাদী শক্তির উপনিবেশ দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে দায়ী করেন। সাম্রাজ্যবাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ তিনি চালিয়ে যান আরও অনেক রচনায়। বিপুল বাস্তব তথ্য আর তাত্ত্বিক মালমসলার সার্বিকীকরণ করে তিনি অতি গুরুত্বপূর্ণ এই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে আসেন যে, সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিবাদের বিকাশ অসমান এবং উল্লম্ফনধর্মী। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিজয় লাভ করতে পারে প্রথমে অল্প কয়েকটি, এমনকি পৃথক একটি পুঁজিবাদী দেশেও। বিশ্ব-বৈপ্লবিক আন্দোলনের কাছে এ সিদ্ধান্তের গুরুত্ব অসাধারণ বিপুল।
সাম্রাজ্যবাদ প্রতিদ্বন্দ্বী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের এবং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের তীব্রতা ভয়ংকরভাবে বৃদ্ধি করে এবং এর পরিণতিতেই দেখা দেয় যুদ্ধ। বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই সাম্রাজ্যবাদীরা পৃথিবীকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার কাজ সমাপ্ত করেছিল। পৃথিবী অশেষ নয়, আর মানুষ তখনও মহাকাশে পাড়ি জমায়নি। তাই প্রসারের নতুন ক্ষেত্র আর দেখা গেলো না, কাজেই পৃথিবী পুনঃবণ্টনের সংগ্রামের প্রশ্নটিই সামনে এসে দাঁড়াল। নিজেদের মধ্যে দেশ ও বাজার নিয়ে কাড়াকাড়ি ছাড়া বৃহৎ শক্তিগুলোর আর কোনো উপায় থাকল না। তাই দেখা দিল প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদের যুগে বরাবরই কোনো কোনো সাম্রাজ্য চেষ্টা করতে থাকবে অপরকে জব্দ করে নিজেদের সুবিধামতো পৃথিবী নতুনভাবে ভাগ করে নিতে। বিশ্বযুদ্ধ বা মহাযুদ্ধ তাই অনিবার্য এবং এ যুদ্ধ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। প্রথম মহাযুদ্ধে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যুদ্ধের এইরূপই দেখা যায়।
ভারত সহ বিভিন্ন দেশে যে মুসলিম শাসন চলেছিল, তাতে কি মুসলিম শাসকদের উপনিবেশবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী বলা যায়? না, বলা যায় না। কারণ মুসলিম শাসকই কোনো দেশের সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে অপর দেশে প্রবেশ করেনি। কোনো মুসলিম শাসক কোনো অঞ্চল বা ভূখণ্ড বা দেশ ধনসম্পদ রাজস্ব নিয়ে নিজের দেশকে সমৃদ্ধ করেনি। কোনো মুসলিম শাসকই অধিকৃত দেশে এসে উৎপাদনের জন্য নাগরিকদের উপর অকথ্য অত্যাচার করেনি। ব্রিটিশরা যেমন ভারতকে ব্রিটেনের অংশ করে নিয়েছিল। কোনো মুসলিম শাসকই কোনো ভূখণ্ডকেই তাঁর ফেলে আসা দেশের অংশ ভাবেনি। ব্রিটিশ বা ফরাসিদের মতো ফ্রান্স বা ব্রিটেনের আইনপ্রণেতাদের আইন দ্বারা উপনিবেশ দেশকে শাসন করত, মুসলিম শাসক অন্য দেশে এসেছে এবং নিজেদের তৈরি আইন দ্বারা তাঁর রাজ্য পরিচালনা করতেন। ব্রিটিশ, ফ্রান্স, পোর্তুগিজ, ডাচরা বিভিন্ন দেশ দখল করে নিজেদের দেশকে সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে। মুসলিম শাসকরা এসেছে নিজেদের ভাগ্যান্বেষণে, যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই সমৃদ্ধ করেছেন।
মুসলিমরা ভারতে এসে উপনিবেশ ঘটায়নি। কোনো কলোনী গড়ে তোলেনি। তবে পরিবর্তন ঘটিয়েছে তা হল ধর্মীয় আচরণ, পোশাক-আশাক, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি। যে দেশেই মুসলিমরা এসেছে সে দেশেই ভাষা, পোশাক, সংস্কৃতির বদল ঘটিয়েছে, যাকে বলা হয় আরবীয় সংস্কৃতি। নিউ এজ ইসলাম’ ফাউন্ডিং এডিটর সুলতান শাহীন বলেন— ১৯৩২ থেকে ১৯৫০ সময় অবধি নামাজেও তুর্কি ভাষায় আদায় করা হত। কিন্তু মুসলমানদের মন-মগজে আরবির মর্যাদা এমন গভীর ছিল যে, এই ফয়সালা কার্যকরী হতে পারেনি এবং ১৯৫০ যখন এই পার্টি নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা হারাল তখন এই ব্যবস্থাকে বাতিল ঘোষণা করা হল। ইস্তাম্বুলের এক মসজিদে ১৯ মার্চ ১৯২৬ তারিখে প্রথম যেদিন তুর্কি ভাষায় আজান দেওয়া হল, সেদিন রমজান মাসের প্রথম জুমার দিন ছিল ইমাম কামালউদ্দিন আফিন্দি নামাজের ইমামতি করছিলেন। তিনি লক্ষ করলেন অধিকাংশ মানুষই নামাজ সম্পন্ন না-করেই নামাজ ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন। স্থানীয় ভাষায় নামাজের সমস্যা তখনই প্রকাশ্যে এল, যখন ইসলাম আরব সীমানা ছাড়িয়ে শাসানি সাম্রাজ্যে প্রবেশ করল। সপ্তম শতাব্দীর অর্ধ ভাগে যখন ইসলাম ইরানের মধ্যে ফুলে-ফেঁপে বড়ো হচ্ছিল তখন পারস্যের জনগণ তাঁদের নিজস্ব ভাষায় নামাজ আদায় করার দাবি তুলল। এ এক শুভ সূচনা এবং কোরানের নির্দেশ এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পূর্ণও বটে যে, নামাজ সেই ভাষায় আদায় করা হোক যা লোকেরা বুঝতে পারে। কোরান বলে আল্লাহর পয়গম্বর দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে নিয়োজিত করা হয়েছে যাঁরা তাঁদের স্থানীয় ভাষায় আল্লাহর পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন আল্লাহ কোরানে আরবকে বিশেষ ক্ষমতাধর হিসাবে কোনো মর্যাদা দান করেননি। এর উপরে ফকিহদেরও মতবাদ সেরকমই ইমাম মালিক বিন আনাস ইমাম মোহাম্মদ শাফি ইমাম আহমদ বিন হাম্বল এবং সমস্ত আরবরা এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করেছেন।
ভাষার চাপের দুটি কারণ আছে— (১) স্থানীয় সংস্কৃতির উপর গর্ব (২) খোদার সঙ্গে নৈকট্য লাভের ইচ্ছা। কোরআন মজিদে কেবল আল্লাহই নয়, বরং তার শেষ নবি মোহাম্মদ ও তাঁর শেষ ভাষণে পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, অন্যের উপর আরবদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আরবি ভাষার ব্যবহারকারী আরবরা না কেবল অন্যের উপর নিজেদের ভাষা চালাবার চেষ্টা করেছে বরং তাঁদের পোশাক-পরিচ্ছদ শিল্প-সংস্কৃতি কৃষ্টি-কালচার ইত্যাদিও অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যার ফলে ভারতবর্ষের কিছু ওলামা নিজেকে আরব রুহানি ব্যক্তিত্বের গোলাম, এমনকি আরবদের কুকুর বলাতেও গর্ব অনুভব করতেন।
সুলতান শাহীন প্রশ্ন করেছেন, তাহলে কী এর অর্থ এটাই যে ইসলামের নিজস্ব কোনো এলাকাভিত্তিক রং-রূপ নেই? না, বরং ভারতীয় ইসলামের বৈশিষ্ট্য এমন যার সঙ্গে আরব সংস্কৃতির তুলনা করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের জাতপাতের ব্যবস্থা আমাদের এখানে পণপ্রথার রীতিনীতি বিবাহিতা মহিলাদের টিপ সিঁদুর পরার রীতি ওলামা একেরাম ভারতীয় ইসলামের এই মিশ্রণ খতম করার যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন। স্যার রফিউদ্দিন কোরানের অনুবাদে এবাদতের বিকল্প যে শব্দচয়ন করেছেন তা হল পুজো, যা হিন্দু রীতিনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অষ্টাদশ শতাব্দীতে আঞ্চলিক শব্দ ‘পুজো’ এবং আরবি শব্দ ‘এবাদাত’ দুটি একে অপরের পরিপূরক ছিল। কিন্তু মাত্র এক শতাব্দী পরে মুসলিমদের পরিস্থিতি মজবুত হতে শুরু করল। তখন থেকে আরবি শব্দের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠল। ইসলামি ঐক্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচারের জন্য দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো আন্দোলন তবলিগ জমাত ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে একজন দেওবন্দ আলেমে দ্বিন মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি আরম্ভ করেছিলেন। কেননা তাঁর মনে হয়েছিল আমাদের মুসলমানেরা মিশ্র সংস্কৃতির সঙ্গে ভালোভাবেই মিশে আছে। সৌদি পেট্রো-ডলারের মাধ্যমে এই তবলিগি আন্দোলনকে সাহায্য করা হয়েছিল। এখন পরিচিত মুসলমান একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বিদায়কালে ‘খোদা হাফেজ’-এর পরিবর্তে ‘আল্লা হাফেজ’ বলার প্রচলন চালু হয়েছে। এখন কোনো মুসলিম মহিলাকে বোরখা পরিহিতা বা কোনো মুসলিম পুরুষকে চোগাচাপকান পরিহিত অবস্থায় দেখা কোনো বিশেষ ব্যাপার নয়। পশ্চিম এশিয়ায় এ ধরনের পোশাক উপযোগী যেখানে সূর্যতাপ প্রখর রৌদ্র ধুলিঝড় ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষা করে। কিন্তু কলকাতা, জাকার্তা, লন্ডন, প্যারিস অথবা বোস্টনে এই পোশাকের কী প্রয়োজন। এটা এক পতনশীল মুসলিম মন-মানসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
অন্য ধর্ম আঞ্চলিক ভাষায় ঢলে পড়া সহজ হয়নি, কিছু বিশেষ পবিত্রতা নিজেই কিছু ভাষায় সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। যেমন বৈদিক সংস্কৃতি হিন্দু ভাইদের নিকট এ পবিত্র, ইবরানী ইহুদিদের জন্য লাতিন পবিত্র এবং ইউনানি ভাষায় বাইবেলকে সংরক্ষিত রাখার জন্য ক্রিশ্চান জগতের মরণপণ প্রচেষ্টা চলেছিল। কেননা শক্তিশালী চার্চ তার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। অবশেষে বাইবেলকে তার নিজের ভাষায় পেশ করে দেওয়াই হল। ভারতীয় উলামা হজরতগণ এই পবিত্র গ্রন্থের উর্দু বা ইংরেজি অনুবাদকে কোরান হিসাবে মানতে অস্বীকার করেন, মসজিদেও কোরানের অনুবাদ রাখতে আপত্তি ওঠে। কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকায় এরকম করা হয়, আসলে এখন বেশিরভাগ ইসলামি বইয়ের অনুবাদ ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজপ্রাপ্য। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক ভাষায় আজান ও নামাজের কখনো কোনো দাবি বা ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়নি। তবুও মুসলমানরা যে ভাষায় নামাজ আদায় করছেন সেই ভাষা যদি তারা বুঝতে না পারেন তাহলে কীভাবে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারবেন? হয়তো তুর্কির আলোচনা আমাদের মন-মগজের জানালা খুলে দেবে।”
উপনিবেশ কোটি কোটি মানুষকে দাস বা ক্রীতদাসে পরিণত করেছিল। জাহাজ ভর্তি করে মানুষকে ক্রীতদাস রূপে এক দেশ থেকে অন্য দেশে উদয়াস্ত শ্রমের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হত। বহু পূর্ব থেকেই আফ্রিকান দাসত্বের অস্তিত্ব ছিল, ইউরোপীয়দের আবিষ্কার হিসাবে এটি একটি উপযোগী মাধ্যম তৈরি হল একটি সস্তা শ্রমশক্তির জন্য উপনিবেশ।
১৬১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র পৌঁছোয় আফ্রিকান দাসদের প্রথম চালান। দাসত্ব ঠেকাতে পূর্বসূরীদের অনেকেই যুদ্ধ করতেন। মাঝে মাঝে জয় পেতেন, কিন্তু হেরেও যেতেন। আর হেরে যাওয়া মানে আজীবন দাসত্ব। যুক্তরাষ্ট্রে দাস বিক্রির আগে থেকেই পশ্চিম আফ্রিকায় এই বাণিজ্যের প্রচলন ছিল। পনেরো শতকের শেষের দিকে জাহাজে করে নিজ দেশে দাস নিয়ে যেত পোর্তুগিজরা। ইউরোপীয় দখলদারিত্বের পর আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল হয়ে ওঠে দাস রপ্তানির মূল কেন্দ্র। দাস ব্যাবসার জন্য ইউরোপের ক্ষমতাশালীরা অস্ত্র, টেক্সটাইল বা অ্যালকোহলের জাতীয় পণ্যগুলো আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে নিয়ে আসত। আফ্রিকা থেকে জাহাজগুলো ছুটত আমেরিকার পথে। সেখানে চা, কফি বা সুতির মতো লোভনীয় কাঁচামালের বিপরীতে ক্রীতদাসদের বিনিময় করা হত। সেই পণ্যগুলো পাঠানো হত ইউরোপে। এই পুরো সিস্টেমটিকে বলা হত ত্রিভুজাকার বাণিজ্য। ক্রীতদাসদের নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার যাত্রা ছিল খুবই অমানবিক। দাসবাহী জাহাজগুলোর শেষ সেন্টিমিটার জায়গাটিও ছাড় দেওয়া হত না। আক্ষরিক অর্থে একে অপরের উপরে সারিবদ্ধভাবে রাখা হত দাসদের। লাশ রাখার মতো রাখা হত দাসদের। শিকলে বেঁধে রাখা হত হাত-পা। দেওয়া হত না পর্যাপ্ত খাদ্যখাবার। জল পর্যন্ত নয়। ক্রীতদাসদের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে তাঁদের জাহাজ থেকে ফেলে মেরে ফেলা হত। নতুন বিশ্বে ক্রীতদাসদের সুতো আর আখ চাষে বাধ্য করা হত। জমির মালিক লাভবান হতেন, আর ক্রীতদাস গরিবই থেকে যেতেন। তাঁদের জীবনযাপনও ছিল মানবেতর প্রাণীদের থেকেও নিকৃষ্ট। শহরের দিকে তাঁদেরকে দিয়ে পণ্য উঠা-নামানোর কাজ করানো হত, গৃহস্থালি কাজে যাঁরা নিযুক্ত হত, তাঁদের চলতে হত মালিকের কথামতো। অনেককে শিল্প-কারখানার কাজেও লাগান হত। অনেক দাসের জন্য সহিংসতা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। শেকল আর লোহা দিয়ে তাঁদের চিহ্নিত করা হত। কেউ আপত্তি করলেই বেত্রাঘাত, চরম শাস্তি। ক্রীতদাসরা কোনো সম্পর্কে জড়াবে কি না সেই সিদ্ধান্তও নিত তাঁদের মালিকরা। দাসদের কোনো অধিকার ছিল না। ট্রান্স-অ্যাটলান্টিক দাস ব্যবসার সুবর্ণ সময় ছিল আঠেরো শতকে। আফ্রিকান দুই-তৃতীয়াংশ দাসকে নিয়ে যায় আমেরিকা। নোঙ্গর তুলে চলে যেত দাসবাহী জাহাজ। কতজন আফ্রিকান দাসত্ব বরণ করেছিলেন তার প্রকৃত সংখ্যা নেই। অনুমান করা হয় সংখ্যাটি অন্তত চার কোটি। আজকের ঘানা উপকূলে গ্রো ফ্রেড্রিশবুর্গ উপনিবেশ ছিল ব্র্যান্ডেনবুর্গের ইলেক্টর ফ্রেডরিখ ভিলহেলমের। দাস ব্যবসায়ের সময় ঘানাকে ‘সোনালি উপকূল’ বলা হত। সেখান থেকে ব্র্যান্ডেনবুর্গাররা ত্রিভুজাকার বাণিজ্যে অংশ নিত।
দাসপ্রথার ইতিহাস অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্কৃতি, জাতি এবং ধর্মজুড়ে বিস্তৃত। অবশ্য দাসদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং বৈধ অবস্থান বিভিন্ন সমাজে এবং বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ছিল। আদিম সমাজে দাসপ্রথার প্রচলন বিরল ছিল। কারণ এই প্রথা সামাজিক শ্রেণিবিভাগের কারণে তৈরি হয়। দাসপ্রথার অস্তিত্ব মেসোপটেমিয়াতে প্রায় ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বে প্রথম পাওয়া যায়। অন্ধকার যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত ইউরোপে অধিকাংশ এলাকাতেই দাসপ্রথা পাওয়া যেত। ইউরোপে বাইজেন্টাইন-উসমানিদের যুদ্ধ এবং উসমানিদের যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে আনেক খ্রিস্টানও দাসে পরিণত হয়। ওলন্দাজ, ফরাসি, স্পেনিশ, পোর্তুগিজ, ব্রিটিশ, আরব এবং কিছু পশ্চিম আফ্রিকান রাজ্যের লোকেরা আটলান্টিক দাস বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। ডেভিড ফোর্সথি লেখেন, “উনিশ শতকের শুরুর দিকে আনুমানিক প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষই দাসপ্রথার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।” ইউরোপের মধ্যে সর্বপ্রথম ১৪১৬ সালে রাগুসা নামক দেশ দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে। আধুনিক যুগে নরওয়ে এবং ডেনমার্ক সর্বপ্রথম ১৮০২ সালে দাস বাণিজ্য বন্ধ করে।
বস্তুত দাসপ্রথা একটি অনুমোদিত সামাজিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় বাজারে মানুষের আনুষ্ঠানিক বেচা-কেনা চলত এবং ক্রীত ব্যক্তি ক্রেতার ব্যক্তিগত সম্পত্তি রূপে কাজ করতে বাধ্য থাকত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রায় সব শাসনব্যবস্থাতেই দাস প্রথার প্রচলন ছিল। গবাদিপশুর মতো মানুষেরও বেচা-কেনা চলত। অন্যান্য প্রায় সকল দেশের মতো আমাদের বঙ্গদেশেও প্রাচীনকাল থেকেও দাসপ্রথা প্রচলিত হয়ে আসছিল। এ প্রথা সব ধর্মেই স্বীকৃতি ছিল। মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেন যে, পাটলিপত্রের রাজার নিরাপত্তার দায়িত্ব ক্রীতদাসীদের উপর ন্যস্ত ছিল। সব ধর্মীয় পুস্তকেই ক্রীত দাসদাসীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
দাসপ্রথার উপর প্রাপ্ত নথিপত্রে প্রমাণ মেলে যে, বনেদি সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো ও গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে এ প্রথা সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিল। বাজারে মুক্ত শ্রমিক পাওয়া দুষ্কর থাকায় সমাজের শক্তিশালী শ্রেণি তাঁদের উৎপাদন ও প্রাধান্য অব্যাহত রাখতে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর শ্রেণির লোককে দাসে রূপান্তর করত। অভিজাত শাসকশ্রেণি, তাঁদের পারিবারিক ও অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক পদমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার তাগিদে, সুবৃহৎ কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন অনুভব করে। গণপূর্ত কাজ, যেমন সরকারি ভবন, বাঁধ, সেতু, সড়ক ও প্রধান পথের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাষ্ট্রের এক বিশাল শ্রমশক্তির প্রয়োজন ছিল। বিশাল বিশাল অট্টালিকা, সৌধ নির্মাণেও দাসদের কাজে লাগান হত। সৈন্য চলাচল ও তাঁদের রসদ সরবরাহের জন্যও শ্রমশক্তির প্রয়োজন ছিল। দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ ও শ্রেণিভেদ প্রথা যাঁদেরকে গুরুত্বহীন করে তুলেছিল প্রধানত তাঁরাই দাসপ্রথার বলি হত। অভাবগ্রস্ত, নিঃস্ব, অনাথ ও বিধবাদের অনেকেরই শেষ গন্তব্য ছিল ক্রীতদাস বাজার। দাস বাজারের অনেক ঠগ ও অপরাধী বিক্রি করার জন্য শিশুদের অপহরণ করত। আইনত ও প্রথাগতভাবে, ক্রীতদাস-দাসীরা ও তাঁদের সন্তান-সন্ততিরা তাঁদের মালিকের সম্পত্তি রূপে পরিগণিত হত। ক্রীতদাস-দাসী হস্তান্তরযোগ্য পণ্য ছিল। তাই, অনেক মালিক তাঁদের উদ্বৃত্ত বা অপ্রয়োজনীয় দাস-দাসীদের বাজারে বিক্রি করে দিত। দাস-দাসীদের আমদানি ও রপ্তানি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ খাত ছিল।
বাংলার সুলতানরা আফ্রিকা, তুরস্ক, পারস্য ও চিনদেশ থেকে দাস-দাসী আমদানি করতেন বলে জানা যায়। এ ধরনের কিছু ক্রীতদাসকে মুক্তি দেওয়ার পর মন্ত্রী, প্রশাসক, এমন কি সেনাপতির পদে উন্নীত করা হয়েছিল। পনেরো শতকের শেষদিকে আবিসিনীয় বংশোদ্ভূত দাসগণ স্বল্পকালের জন্য বাংলায় তাঁদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থাও কায়েম করেছিল। বাংলার বাজারে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তও ‘হাবশি’ ও ‘কাফ্রি’ নামে পরিচিত আফ্রিকান ক্রীতদাস-দাসী আমদানি করা হত। বাংলায় সাধারণত ধনী সম্ভ্রান্ত মুসলিমগণ ও ইউরোপীয় বণিকগণ কঠোর পরিশ্রমী ও কর্তব্যনিষ্ঠ বলে খ্যাত হাবশিদেরকে দাস হিসাবে রাখত। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য পরিবহন ও কারখানা প্রহরার জন্য নিয়মিত শ্রমিকের বিকল্প হিসাবে ক্রীতদাসদের নিয়োগ করত। ইউরোপীয় অধিবাসীদের মধ্যে ক্রীতদাস রাখার এমনই রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল যে, স্যার উইলিয়ম জোনসের মতো একজন মানবতাবাদী, আইনজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তিরও চারজন ক্রীতদাস ছিল। ক্রীতদাসদের মধ্যে সবচেয়ে দামি হাবশি দাস, যাঁরা খানসামা, পাঁচক (বাবুর্চি), গায়ক, নাপিত, গৃহ প্রহরী ইত্যাদি হিসাবে তাঁদের প্রভুদের সেবায় নিয়োজিত হত।
সিরাজের সিংহাসনচ্যুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত থেকে মুসলমান শাসনের চিরতরে অবসান হলেও, পরবর্তী ১৯০ বছর ভারত হয়ে গেল ব্রিটিশ-ভারত। ব্রিটিশ উপনিবেশের শিকল হাতে-পায়ে-শরীরে জড়িয়ে নিল ভারত উপমহাদেশ। দাসত্বের শৃঙ্খল। সমাজের উঁচু স্তরের মানুষদের সঙ্গে ব্রিটিশদের কী দহরম মহরম! তাঁরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বেশ চলেছিল পরবর্তী সময়গুলোতে। ভারতের মুসলমানরা আরবি-ফারসি ত্যাগ করে ইংরেজি গ্রহণ করতে চাইলেন না। গ্রহণ করলেন না পাশ্চাত্য শিক্ষা। ব্রিটিশ-ভারতের ব্রিটিশ কোম্পানিগুলিতে চাকরিও প্রত্যাখ্যান করলেন। অপরদিকে ব্রিটিশরা এক সময়ে প্রায় সমস্ত উপমহাদেশ তাঁদের শাসনের আওতায় নিয়ে এল। ছলে-বলে-কৌশলে, যেখানে যে ওষুধ প্রয়োজন। সেইসঙ্গে দেশের শেঠ-রাজা-জমিদারদের-ধনিক-বণিকদের অকাতরে বিলানো চলল ‘রাজা’, ‘প্রিন্স’, ‘চৌধুরী, ‘রায়চৌধুরী ইত্যাদি খেতাব। সাদা চামড়ার ঘনিষ্ঠতা পেতে ভারতের উচ্চবিত্তরা তখন উদগ্রীব। আনুগত্যে নুয়ে পড়েছিল। এইসব রাজা-জমিদারদের কল্যাণে দেশের সমস্ত ভূখণ্ড ব্রিটিশদের কাছে বিক্রি হয়ে গেল মোটা টাকার বিনিময়ে। হাজার হাজার একর জমি ব্রিটিশদের কজায় চলে গেল। দালালদের আনুগত্যে ভারতের ‘শুভানুধ্যায়ী’ সাদা চামড়াগুলো হাতে তুলে নিল ভারত-শাসনের রাজদণ্ড। ভারত রাজা, সুলতান শূন্য হয়ে ধীরে ধীরে গভর্নরে পরিপূর্ণ হল।
১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভ নেতৃত্বাধীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘বাহিনী’ নবাবের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে। এই ঘটনা ছিল ব্রিটিশদের ভারত অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো অঞ্চল জয়ের মাধ্যমে প্রথম রাজনৈতিক প্রাধান্য স্থাপনের ঘটনা। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্লাইভকে বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করে। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধের পর কোম্পানি মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা শাসনের রাষ্ট্রীয় অধিকার অর্জন করে। ফলে কোম্পানির নিয়মতান্ত্রিক শাসনের সূত্রপাত ঘটে। এক শতাব্দীকালের মধ্যেই তারা ভারত থেকে মোগল সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ অবলুপ্ত করে দেশে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করে।
ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিষ্ঠুর শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম যে আন্দোলনটি সংগঠিত হয় সেটি ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ নামে পরিচিত, ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ। এক বছর নৈরাজ্যের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীর বদলে ব্রিটিশ সৈন্য নিয়োগ করে ব্রিটিশরা বিদ্রোহীদের দমন করতে সক্ষম হন। সর্বশেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে ব্ৰহ্মদেশে নির্বাসিত করা হয় এবং তাঁর সন্তানদের শিরোচ্ছেদ করে মোগল বংশকে নির্মূল করা হয়। এরপর ব্রিটিশ রাজশক্তি সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে স্বহস্তে তুলে নেয়। সে সময় যুক্তরাজ্য ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রানি ছিলেন। আলেকজান্দ্রিনা ভিক্টোরিয়া। ১৮৭৬ সালে সালের ১ মে তিনি ‘ভারত সম্রাজ্ঞী’ উপাধি ধারণ ছিলেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের সদস্যরা ‘ভারত সম্রাজ্ঞী মহারানিকে ফুলচন্দন সহযোগে পুজো করে। ব্রিটিশ সরকার কোম্পানি অধিকৃত ভারতের সকল অঞ্চল নিজের উপনিবেশ হিসেবে শাসন করতে থাকে। অবশিষ্ট অঞ্চলগুলি শাসিত হতে থাকে দেশীয় রাজ্যগুলির শাসনকর্তাদের মাধ্যমে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বলতে শুধুমাত্র ব্রিটিশদেরই বোঝানো হয় না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বলতে যেমন ‘ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ বোঝায়, তেমনই ‘ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অথবা ‘ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ও বোঝায়। ভারত উপমহাদেশে শেষ উপনিবেশ ব্রিটিশরা করলেও ফরাসি, ওলন্দাজ বা ডাচ, ডেনিস বা ডেনমার্ক, পোর্তুগিজরাও উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ওলন্দাজ-ভারত (১৬০৫-১৮২৫) বলতে ভারতে উপমহাদেশে ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’-র বসতি ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোকে বোঝায়। এটি শুধু ভৌগোলিক সংজ্ঞা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ডাচ-ভারত কখনো রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি। তা ছাড়া ডাচ ভারত, ডাচ সিংহল, ডাচ করমন্ডল গভর্নরেট, ডাচ মালাবার কমান্ডমেন্ট ও ওলন্দাজ বাংলা ও ডাচ সুরাট ডিরেক্টরেটে বিভক্ত ছিল। ডাচ-ইন্ডিজ আর ডাচ-ভারত এক নয়। ডাচ-ইন্ডিজ দ্বারা ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ (বর্তমান– ইন্দোনেশিয়া) ও ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিজ (বর্তমান সুরিনাম ও প্রাক্তন নেদারল্যান্ড এন্টিলেস) বোঝায়। ডেনিশ ভারত (১৬২০-১৮৬৯) বলতে ভারতে ডেনমার্কের সাবেক কলোনিগুলিতে বোঝায়। ভারতে ২২৫ বছর যাবৎ ডেনমার্কের ঔপনিবেশিক সম্পত্তি ছিল। বর্তমান তামিলনাড়ুর থারাঙ্গামবাড়ি, বাংলার শ্রীরামপুর এবং আন্দামান। ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সামরিক বা বাণিজ্যিক দিক থেকে হুমকি না হওয়ায় ভারতে ডেনিশদের উপস্থিতি অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিগুলোর কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্যান্য স্থানের মতো ভারতের ডেনিশ বণিকরা সাধারণত পোর্তুগাল, নেদারল্যান্ড ও ব্রিটেনের মতো বাণিজ্যিক রুটগুলোর উপর একচেটিয়া আধিপত্য করতে সক্ষম হননি। ব্রিটিশ শাসন চলাকালীন বা ব্রিটিশ উচ্ছেদের পরেও অন্য দেশের উপনিবেশ ভারতে ছিল। যেমন –গোয়া। ১৯৬১ সালে গোয়া পোর্তুগিজ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৪ সালে পুদুচেরি (পণ্ডিচেরি) ফরাসি উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়।
বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের ঔপনিবেশিক অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হন এবং বৃহৎ দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুবিধা আদায় করেন ও নিরপেক্ষ পতাকার অধীনে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রস্তাব করেন। এ কারণে ১৮৪৫ সাল পর্যন্ত তাঁদের অবস্থান সহ্য করা হয়। এসময় পরাজিত ফ্রান্সের সঙ্গে তাঁদের মৈত্রীর কারণে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে তাঁদের উপনিবেশগুলো ছেড়ে দিতে হয়। ফরাসি ভারত (১৭৬৯-১৯৫৪) হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশে ফরাসিদের ঔপনিবেশিকতার দরুন দখলকৃত এলাকা। ভারতবর্ষের পণ্ডিচেরী (পুদুচেরি), কারাইকাল, ইয়ানায়ন (বর্তমান ইয়ানাম), মালাবার উপকূলের মাহে এবং বাংলাতে চন্দননগর এলাকা ফরাসি-ভারত এলাকা নামে পরিচিতি ছিল।
ষোলো শতকের শুরুতে ফরাসিরা ভারতবর্ষে আসার চেষ্টা করে। প্রথম ফ্রাংকোর সময়ে দুটো বাণিজ্যিক জাহাজ ভারতবর্ষে আগমনের চেষ্টা করে। ১৬০৪ সালে সম্রাট চতুর্থ হেনরি সর্বপ্রথম ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের অনুমতি দেয়। ১৬১৫ সালের পর ফ্রান্স থেকে আগত দুটো জাহাজ ভারতবর্ষে সমুদ্র সীমায় নোঙ্গর করে। পরবর্তীতে একটি জাহাজ ফ্রান্সে প্রত্যাবর্তন। ১৬৫৮ সালে পরিব্রাজক ও চিকিৎসক ফ্রাঙ্কোস বের্নিয়ার মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬৪২ সালে কার্ডিনাল রিচেলিউর পৃষ্টপোষকতাতে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ‘লা কোম্পাজিন ফ্রস্যে দেস ইন্ডিস অরিএন্টালেস’ গঠিত হয়। ১৬৬৮ সালে সুরাটে ফরাসি কোম্পানির প্রথম জাহাজ অবতরণ করে। ১৬৭২ সালে সেইন্ট টমাস চন্দননগর থেকে ওলন্দাজদের বিতাড়িত করেন। ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধে বাংলার নবাবকে ফরাসি জেনারেল মশিয়ে ডুধে সহায়তা করেন। যুদ্ধে নবাবের পরাজয় হলে ব্রিটিশরা বাংলাতে স্থাপিত ফরাসিদের বাণিজ্য কুঠিসমূহ দখল করে নেয়। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারত স্বাধীনতা লাভ করলে ফরাসি শাসিত এলাকাগুলিতে ফরাসি কর্তৃত্ব বজায় থাকে। সুরাট, মছলিপত্তনম, কজহিকোদে এলাকা ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে ভারতীয়দের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৪৮ সালে ভারত সরকার ও ফ্রান্সের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যেখানে ফরাসি শাসনাধীন এলাকাতে গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়, যার মাধ্যমে ওই এলাকার অধিবাসীরা সিদ্ধান্ত নেবে তাঁরা কাদের সঙ্গে থাকবে।
চন্দননগরের শাসনভার ভারতীয়দের হাতে ১৯৫০ সালের ২ মে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৫৫ সালে চন্দননগর পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৫৪ সালে ১ নভেম্বর পুদুচেরি, ইয়ানায়ন, মাহে ও কারাইকাল ভারত প্রজাতন্ত্রের কাছে হস্তান্তরিত হয়। ১৯৬২ সালে ফরাসি সরকার স্বাধীন ভারতের স্বীকৃতি দিলে ভারত থেকে ফরাসি ঔপনিবেশিকতার অবসান হয়। ১৬৬৮ সাল থেকে ১৬৯৯ সাল পর্যন্ত ভারতে নিযুক্ত ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধানকে কমিশনার নামে ডাকা হত। ১৬৯৯ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত নিযুক্ত শাসনকর্তাকে ‘গর্ভনর জেনারেল’ নামে সম্ভাষিত করা হত। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত শাসক প্রতিনিধিকে পুনরায় কমিশনার নামে ডাকা হত।
পোর্তুগিজ-ভারত (১৫০৫-১৯৬১) হল ভারতবর্ষে পোর্তুগাল ঔপনিবেশকতার দরুন দখলকৃত স্থানসমূহ নিয়ে গড়ে উঠা এলাকা। ইংরেজিতে পোর্তুগিজ শাসনাধীন এই এলাকার নাম হল ‘পোর্তুগিজ ভাইসরয়াল্টি অব ইন্ডিয়া’। পোর্তুগিজ ভাষাতে এই এলাকার নাম হচ্ছে ‘ভাইস-রেইনো দ্য ইন্ডিয়া পোর্তুগিজ’ পরবর্তীতে এই এলাকার নাম সরাসরি পোর্তুগিজ স্টেট অব ইন্ডিয়া’ নামকরণ করা হয়। ১৪৯৮ সালে ভারতবর্ষে পোর্তুগিজরা আসে। ১৪৯৮ সালে পোর্তুগিজ জলদস্যু তথা নাবিক ভাস্কো ডা গামার নেতৃত্বে পোর্তুগিজ জাহাজ বহর কালিকটের (বর্তমান কোজিকোড়ে) কাপ্পাড় এলাকাতে অবতরণ করে। ১৫০৫ সালে পোর্তুগিজ ভারতে সাম্রাজ্য গঠন করে। পোর্তুগিজ শাসকদের ‘ভাইসরয়’ উপাধিতে ডাকা হত। ভারতবর্ষে নিযুক্ত প্রথম ভাইসরয়ের নাম ফ্রান্সিসকো দ্য আলমেইদা। ভারতবর্ষে পোর্তুগিজ শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কোচি। ১৭৫২ সাল পর্যন্ত ভারত মহাসাগরের সমস্ত পোর্তুগিজ অভিযান এই কোচি থেকেই পরিচালিত হত। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে গেলেও ফরাসি, পোর্তুগিজদের উপনিবেশ থেকে যায়। অর্থাৎ ব্রিটিশ উপনিবেশ শেষ হলেও অন্য উপনিবেশগুলি ভারতে বহাল তবিয়তেই ছিল। পোর্তুগিজ ছিটমহল হিসাবে গোয়াসহ বেশকিছু এলাকা ভারত ভূখণ্ডে থেকে যায়। ১৯৫৪ সালে ভারত গোয়া সহ আরও কয়েকটি জায়গা পুনরুদ্ধার করে নেয়। ডিসেম্বর ১৯৬১ সালের মধ্যে সকল পোর্তুগিজ এলাকা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনে চলে আসে। ১৯৭৫ সালে পোর্তুগিজ সরকার ভারতবর্ষ থেকে তাঁদের দাবি অধিকার সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে নেয়।
‘কাসা দা ইন্ডিয়া’ নামে একটি পোর্তুগিজ সংগঠন ছিল, যা ষোড়শ শতাব্দীতে পোর্তুগিজ সাম্রাজ্যের পূর্ণবিকাশের সময় সমস্ত বিদেশি অঞ্চল পরিচালনা করত। বৈদেশিক বাণিজ্যের সমস্ত দিক পরিচালনার জন্য এটি ছিল কেন্দ্রীয় শক্তি। পোর্তুগালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে এটি একটি ফিটিরিয়া (ফ্যাক্টরি, ট্রেডিং পোস্ট)-এর মতোও কাজ করত। এটি লিসবনের টেরিবো দো পাকো স্কোয়ারের (আধুনিক প্রাকো ডো কমেরসিও) রাজকীয় প্রাসাদ— রিবেরা প্রাসাদে অবস্থিত। কাসা দ্য ইন্ডিয়া’-র অগ্রদূত আফ্রিকান উপকূলের পোর্তুগিজদের অনুসন্ধানে নতুন বাণিজ্য সুযোগ পরিচালনা করতে শুরু করেন। ১৪৯৭-৯৯ সালে ভাস্কো দা গামা দ্বারা ভারতের একটি সমুদ্র রুট আবিষ্কারের সঙ্গে মশলা ব্যাবসার রাজকীয় ব্যাবসায়িক একটি নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপ হয়ে ওঠে এবং পুরোনো কাসা নামকরণ করা হয়েছিল ‘সাসা দ্য ইন্ডিয়া ই দ্য গিনে’ (প্রথম লিখিত রেফারেন্স) ১৫০১ সালে।
পাশাপাশি শুরু হয়ে গেল কোম্পানি শাসন। ভারতে কোম্পানি শাসন বলতে বোঝায় ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে বাংলার নবাব কোম্পানির হাতে পরাজিত হলে কার্যত এই শাসনের সূচনা ঘটে। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি বাংলা ও বিহারের দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার লাভ করে। ১৭৭২ সালে কোম্পানি কলকাতায় রাজধানী স্থাপন করে এবং প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে নিযুক্ত করে প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত এই শাসন স্থায়ী হয়েছিল। ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের পর ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন বলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব স্বহস্তে তুলে নেয় এবং দেশে নতুন ব্রিটিশ রাজ প্রবর্তিত হয়।
ব্রিটিশরা প্রথমে অনুপ্রবেশ করেছিল বাংলায় এবং ধীরে ধীরে তাঁরা দিল্লিনগরী দখল করে মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে দিয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক কাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ভিত্তিমূলে আঘাত পড়ার ফলে সামাজিক কাঠামোও নড়বড়ে হয়ে পড়ে। বলা যায়, ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশে পূর্বতন মুসলিম সামন্তদের স্বার্থ প্রচণ্ড ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। সে কারণেই ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ব্রিটিশদের অন্তরে বরণ করে নিয়েছিল। দীর্ঘ ১৯০ বছর ধরে ব্রিটিশদের শাসনতন্ত্রে থেকে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছিল এবং বহু বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা হিন্দুরা হৃত জমি ফিরে পেল। নিজেদের ক্ষমতার না-হলেও বিদেশিদের প্রত্যক্ষ সাহায্য নিয়ে ভারতকে মুসলিম শাসন থেকে মুক্ত করেছে। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে ভারত ভেঙে মুসলিমদের একটা গোটা রাষ্ট্র উপহার দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি।
যাই হোক, এত বছর পরেও অনেক মুসলিমদের কণ্ঠে আক্ষেপের সুর শোনা যায়। আজও বনেদি পরিবারের মুসলিমরা দুঃখ করে বলে– ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধ থেকেই তাঁদের পূর্বপুরুষদের পতন হয়েছিল। সেটা অবশ্য স্পষ্টতই বোঝা যায়, যখন দেখি ব্রিটেনের মহারানি ভিক্টোরিয়ার নামে সৌধটি কলকাতায় কেন্দ্রস্থলে মাহাত্ম নিয়ে ঝকঝক করে দাঁড়িয়ে আছে, আর মুর্শিদাবাদের নবাবদের সৌধ-প্রাসাদগুলি চরম অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতা দখল করার পর থেকেই মোগল সাম্রাজ্যের নবাব-জমিদার এবং আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ধনী থেকে শুরু করে মুসলিমদের যত সুযোগসুবিধা ছিল, তার সব কিছুর অস্তিত্ব বিপন্ন হতে থাকল। অপরদিকে ব্রিটিশদের মধ্যস্থতায় সেই সুযোগসুবিধাগুলিই পেয়ে গেল হিন্দু সম্প্রদায়। এইভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাগ্যে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটে গেল। হিন্দুরা ভাবতে শুরু করে দিল –“এবার আমাদের হুকুমতের পালা। অর্ধনারীশ্বর ঘুরে শুয়েছেন।”
ব্রিটিশদের ভারত-বিজয়ের ফলে মুসলিম শাসকদের কমপক্ষে তিনটি ক্ষেত্রে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল– (১) ব্রিটিশরা বাংলা থেকে শুরু করে সাম্রাজ্যের সর্বত্র নতুন একটি সামন্তহীন সামন্ত শ্রেণি সৃষ্টি করেছিল। এই শ্রেণিটির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁরা ব্রিটিশ উপমহাদেশের অভিজাত গোষ্ঠীর মতো করে ব্রিটিশদের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য দেখাত। অভিজাত-কৃষকদের নতুন একটি জাত এটি, যাঁদের কাজ জমির খাজনা আদায় করা। এছাড়া প্রজাদের জমির প্রাথমিক মালিকানাস্বত্ত্বও এঁদের দেওয়া হল। এই সুবিধাভোগী শ্রেণিটির কাজ ছিল পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আত্মস্থ করা এবং যাঁরা তাঁদের সৃষ্টিকর্তা সেই ব্রিটিশদের কাছে আনুগত্য প্রদর্শন করা। এরাই ভারতের জমিদার শ্রেণি, প্রজাদের উপর তাঁদের অত্যাচারের কাহিনি নিয়ে একটা গ্রন্থ লিখে ফেলা যায়।
ব্রিটিশরা ভারতে আসার আগেও জমিদার গোষ্ঠী ছিল। তবে তাঁরা ছিল এক ধরনের সাধারণ কৃষক। যাঁদের কাজ ছিল রাষ্ট্রের হয়ে জমির খাজনা আদায় করা। ব্রিটিশরা এসে সেই জমিদারী ব্যবস্থাকে সংগঠিত করল। তথাকথিত জমিদারেরা আগে ছিল করণিক-আমলা, ব্রিটিশদের আশীর্বাদে হলেন ‘প্রকৃত জমিদার’। ব্রিটিশদের শাসনে জমিদার হওয়ার জন্য যেসব গুন থাকার দরকার ছিল, তা রইস হিন্দুদের ছিল, তার কোনোটাই ছিল না রইস মুসলিমদের। তা ছাড়া মুসলিম সামন্তরা মোটেই ব্রিটিশদের প্রতি নমনীয় ছিলেন না। তাঁরা ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রতি কোনোরূপ আনুগত্য দেখাতে প্রস্তুত ছিলেন না। যাই হোক, এরপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমির সর্বময় মালিকানা চলে যায় ব্রিটিশ-সৃষ্ট জমিদারদের হাতে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ধনী জমিদারের বিশাল একটি শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁরা সার্বক্ষণিকভাবে ব্রিটিশরাজের প্রতি অনুগত। সাধারণ জনগণের উপর এরা যেমন অত্যাচার করত, তেমনই ভয়ে-ভক্তিতে তাঁদের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণও ছিল। যদি কখনও কোথাও কোনো বিদ্রোহ-গণ্ডগোল হত, তখন এই জমিদারই ব্রিটিশদের হয়ে রুখে দিত। এ ব্যাপারে মুসলিম সামন্তরা পিছিয়ে পড়ল। তাঁদের জায়গায় হিন্দু উচ্চ বর্ণের লোকেরা নতুন জমিদার হিসাবে নিয়োগ পেল। মুসলিমরা জমিহীন হয়ে পড়ল। এই আনন্দে হিন্দু জমিদাররা ব্রিটিশ শাসনের শেষদিন পর্যন্ত ঋণ শোধ করেছিল ব্রিটিশদের। ব্রিটিশরাও রাজার জাত, বেইমান নয়! হিন্দুদের ‘ইচ্ছাপূরণ দেবতা’ ব্রিটিশরা পাকিস্তান উপহার দিয়েছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এটাই শ্রেষ্ট সৃষ্টিকর্ম। হিন্দু-মুসলিমদের সম্পর্ক পূর্বে ভালো ছিল, একথা বলা যায় না। কিন্তু সম্পর্কের এই টানাপোড়েনকে তাঁরা আরও নষ্ট করেছে। জমি আগেই ছিল, ব্রিটিশরা সেই জমি খুঁড়ে খনি বের করে কয়লার কালি ছড়িয়ে দিল। মজার বিষয় হল, যে হিন্দু জমিদাররা ব্রিটিশদের প্রতি চিরস্থায়ীভাবে কৃতজ্ঞ ছিল, সেই হিন্দুরাই হঠাৎ করে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল গঠন করে বসল।
১৬০০ সালে ‘দ্য কোম্পানি অফ মার্চেন্টস অফ লন্ডন ট্রেডিং ইনটু দি ইস্ট ইন্ডিজ’ নামে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬১২ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গির পশ্চিম উপকূলের সুরাট বন্দরে কোম্পানিকে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করেন। ১৬৪০ সালে বিজয়নগর সম্রাটের কাছ থেকে অনুরূপ একটি অনুমতি আদায় করে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল মাদ্রাজে কোম্পানি দ্বিতীয় বাণিজ্যকুঠিটি স্থাপন করে। সুরাটের অদূরে বোম্বাই দ্বীপটি আগেই পোর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল। দ্বিতীয় চার্লসের সঙ্গে ক্যাথারিন অফ ব্র্যাগাঞ্জার বিবাহের যৌতুকস্বরূপ দ্বীপটি ইংল্যান্ডের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ১৬৬৮ সালে কোম্পানি দ্বীপটি ইজারা নেয়। দুই দশক পরে কোম্পানি পূর্ব উপকূলেও আধিপত্য বিস্তারে প্রয়াসী হয়। গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে কলকাতায় তাঁরা একটি বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। এই সময় পোর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি ও ডেনিশ বণিকেরা নিজ নিজ কোম্পানি স্থাপন করে এই অঞ্চলে ব্যবসাবাণিজ্য চালাচ্ছিল। এখানে ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্যের সূত্রপাত ঘটে খুবই সাদামাটাভাবে। তাই এইসময় ভারতীয় উপমহাদেশে এদের ভবিষ্যৎ একাধিপত্যের বিষয়টি আগে থেকে আন্দাজ করা সম্ভবপর হয়নি।
কোম্পানি ভারতের সামান্য কয়েকটি অঞ্চলে প্রকৃত শাসকের ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। বণিকের ছদ্মবেশে বাণিজ্য করলেও সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়দের সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহও শুরু করে দিল ব্রিটিশরা। যুদ্ধ-বিগ্রহ রাজা-সম্রাটদের কাজ, বণিকদের নয়। এইসব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহই আভাস দেয় ব্রিটিশরা যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে ভারতীয় শাসকদের পরাজিত করে রাজদণ্ড হাতে তুলে নেবে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ক্লাইভের বিজয়ের পরই এই সমস্ত অঞ্চল সরকারিভাবে তাঁদের স্বাধীনতা হারায়। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বিহারে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ করার পর কোম্পানির ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়। সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ান বা রাজস্ব আদায়কারী ঘোষণা করতে বাধ্য হন। এইভাবে কোম্পানি নিম্ন গাঙ্গেয় উপত্যকার অধিকাংশ অঞ্চলে প্রকৃত শাসনকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। একইভাবে কোম্পানি বোম্বাই ও মাদ্রাজকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও রাজ্যবিস্তারে মনোনিবেশ করে। ইঙ্গ-মহিশূর যুদ্ধ (১৭৬৬-৯৯) ও ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের (১৭৭২-১৮১৮) পর শতদ্রু নদীর দক্ষিণে ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে কোম্পানির শাসন কায়েম হয়।
কোম্পানির ক্ষমতাবৃদ্ধির দুটি পৃথক ধারা লক্ষিত হয়। প্রথমত, দেশীয় রাজ্যগুলিকে গ্রাস করে সেখানে প্রত্যক্ষ শাসন প্রবর্তন করে এককভাবে ব্রিটিশ-ভারতের অধীনে আনা হয়। এইভাবে অধিগৃহীত অঞ্চলগুলি হল ১৮০১ সালে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ (রোহিখণ্ড, গোরখপুর ও দোয়াব অঞ্চল নিয়ে গঠিত), ১৮০৩ সালে দিল্লি ও ১৮৪৩ সালে সিন্ধ। ১৮৪৯ সালে ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও কাশ্মীর অধিগৃহীত হয়। তবে ১৮৫০ সালে অমৃতসরের চুক্তি অনুযায়ী জম্মুর ডোগরা রাজবংশের কাছে কাশ্মীর বিক্রি করে দেওয়া হয়। এইভাবে কাশ্মীর একটি দেশীয় রাজ্যে পরিণত হয়। ১৮৫৪ সালে বেরার ও দু-বছর বাদে অযোধ্যা অধিগৃহীত হয়। ক্ষমতা বৃদ্ধির দ্বিতীয় পন্থাটি ছিল ভারতীয় শাসকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া। এই সকল শাসকেরা সীমিত আঞ্চলিক স্বশাসনের বিনিময়ে কোম্পানির আধিপত্য মেনে নিয়েছিল। কোম্পানিকে যেহেতু আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হত, সেহেতু শাসনকার্য চালানোর জন্য এটিকে রাজনৈতিক আলম্ব তৈরি করতে হয়। কোম্পানি শাসনের প্রথম ৭৫ বছর এই ধরনের সমর্থন আসে দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে সাবসিডারি অ্যালায়েন্সের থেকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এই অঞ্চলগুলি ভারতের এক-তৃতীয়াংশ নিয়ে প্রসারিত ছিল। নিজের অঞ্চল রক্ষা করতে সক্ষম কোনো দেশীয় রাজা যখন এই ধরনের জোটে আগ্রহী হতেন, তখন কোম্পানি পরোক্ষ শাসনের সুলভ পদ্ধতি হিসাবে তাঁকে স্বাগত জানাত। কারণ এর ফলে প্রত্যক্ষ প্রশাসনের অর্থনৈতিক ব্যয়বরাদ্দ বা বিদেশি প্রজা পালনের রাজনৈতিক খরচাপাতি কোম্পানিকে বহন করতে হত না। পরিবর্তে কোম্পানিও এই সকল অধীনস্থ রাজ্যের প্রতিরক্ষার দিকটি দেখত এবং শাসকদের সনাতন পন্থায় সম্মান প্রদর্শন করত। হিন্দু মহারাজা ও মুসলমান নবাবদের দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে এই সহকারী শক্তিজোট তৈরি হয়েছিল। এই সব দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— কোচিন (১৭৯১), জয়পুর (১৭৯৪), ত্রিবাঙ্কুর (১৭৯৫), হায়দ্রাবাদ (১৭৯৮), মহিশূর (১৭৯৯), কিস-শতদ্রু পার্বত্য রাজ্যসমূহ (১৮১৫), সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া এজেন্সি (১৮১৯), কচ্ছ ও গুজরাট গাইকওয়াড় অঞ্চলসমূহ (১৮১৯), রাজপুতানা (১৮১৮) ও ভাওয়ালপুর (১৮৩৩) ইত্যাদি।
দেশীয় রাজ্য বলতে বোঝায় ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত মৌখিকভাবে সার্বভৌম রাজ্য। ব্রিটিশরা সরাসরি এসব রাজ্য শাসন করত না। এসব রাজ্য ব্রিটিশ আধিপত্য মেনে নিয়ে স্থানীয় শাসকের অধীনে পরিচালিত হত। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় সরকারিভাবে ৫৬৫টি দেশীয় রাজ্য গোটা ভারত উপমহাদেশজুড়ে ছিল। এগুলোর মধ্যে মাত্র ২১টির বাস্তবিক সরকার ছিল, যার মধ্যে চারটি ছিল বৃহত্তম। এগুলো হল হায়দ্রাবাদ, মহিশূর, বরোদা এবং জম্মু ও কাশ্মীর। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সালে মধ্যে এসব রাজ্য নবগঠিত স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। একীভূত প্রক্রিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ ছিল। কেবল জুনাগড়, জম্মু ও কাশ্মীর এবং হায়দ্রাবাদের ক্ষেত্রেই কেবল ব্যতিক্রম হয়। সমস্ত রাজাদের এরপর পেনশন দেওয়া হয়। প্রায় দুইশতের মতো রাজ্যের মোট এলাকা ২৫ বর্গ কিলোমিটারেরও (১০ বর্গ মাইল) কম ছিল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ সালের মধ্যে বেশ কিছু রাজ্য পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। তার মধ্যে কিছু ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত স্বায়ত্বশাসন ধরে রাখে।
কোম্পানির শাসনকালে কোম্পানি অসংখ্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত করে। কোটি কোটি সামরিক ও অসামরিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। কোম্পানি আমলে কিছু ঘটনা, যেমন— ওয়ারেন হেস্টিংসের সময়ে (২০ অক্টোবর, ১৭৭৩ থেকে ১ ফেব্রুয়ারি, ১৭৮৫) ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৭৬৯-৭৩), রোহিলা যুদ্ধ (১৭৭৩-৭৪), প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৭৭৩-৮৩), চালিসা মন্বন্তর (১৭৮৩-৮৪), দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহিশূর যুদ্ধ (১৭৮০-৮৪)। চার্লস কর্নওয়ালিসের সময়ে (১২ সেপ্টেম্বর, ১৭৮৬ থেকে ২৮ অক্টোবর, ১৭৯৩) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, তৃতীয় ইঙ্গ-মহিশূর যুদ্ধ (১৭৮৯-৯২), দোজি বরা মন্বন্তর (১৭৯১-৯২)। জন শোরের সময়ে (২৮ অক্টোবর, ১৭৯৩ থেকে মার্চ ১৭৯৮) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর্মি’ পুনর্গঠিত হয় এবং এর ব্যয়সংকোচ করা হয়। রিচার্ড ওয়েলেসলির সময়ে (১৮ মে, ১৭৯৮ থেকে ৩০ জুলাই, ১৮০৫) চতুর্থ ইঙ্গ-মহিশূর যুদ্ধ (১৭৯৮-৯৯), অযোধ্যার নবাব গোরখপুর ও বেরিলি বিভাগ; এলাহাবাদ, ফতেহপুর, কানপুর, এটাওয়া, মণিপুরী, এটাহ জেলা; মির্জাপুরের অংশবিশেষ; এবং কুমায়ুনের ‘তরাই’ প্রত্যর্পণ করেন (প্রত্যর্পিত প্রদেশ’, ১৮০১), দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৮০৩-০৫), দোয়াবের অবশিষ্টাংশ ও আগ্রা বিভাগ, বুন্দেলখণ্ডের অংশবিশেষ মারাঠা সাম্রাজ্য থেকে অধিগৃহীত হয় (১৮০৫), প্রত্যর্পিত ও বিজিত প্রদেশসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮০৫)। চার্লস কর্নওয়ালিসের (দ্বিতীয়বার) সময়ে (৩০ জুলাই, ১৮০৫ থেকে ৫ অক্টোবর, ১৮০৫) ব্যয়বহুল যুদ্ধাভিযানের পর কোম্পানিতে আর্থিক চাপ ও শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টায় কর্নওয়ালিসকে পুনর্বহাল করা হয়। কিন্তু তিনি গাজিপুরে মারা যান। জর্জ হিলারিও বার্লোর (অস্থায়ী) সময়ে (১০ অক্টোবর, ১৮০৫ থেকে ৩১ জুলাই, ১৮০৭) ভেলোর বিদ্রোহ (১০ জুলাই, ১৮০৬)। লর্ড মিন্টোর সময়ে (৩১ জুলাই, ১৮০৭ থেকে ৪ অক্টোবর, ১৮১৩) জাভা আক্রমণ ও মরিশাস দখল। মাকুইস অফ হেস্টিংসের সময়ে (৪ অক্টোবর, ১৮১৩ থেকে ৯ জানুয়ারি, ১৮২৩) ১৮১৪ সালে ইঙ্গ-নেপাল যুদ্ধ; কুমায়ুন, গাড়ওয়াল ও পূর্ব সিক্কিম বা সিকিম অধিগ্রহণ, তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৮১৭-১৮১৮), রাজপুতানা রাজ্যসমূহ ব্রিটিশ আধিপত্য স্বীকার করে নেয় (১৮১৭)। লর্ড আমহাস্টের সময়ে (১ আগস্ট, ১৮২৩ থেকে ১৩ মার্চ, ১৮২৮)।
প্রথম ইঙ্গ-ব্ৰহ্ম যুদ্ধ (১৮২৩-২৬), আসাম, মণিপুর এবং ব্রহ্মদেশের থেকে আরাকান ও টেনাসেরিম অধিগ্রহণ। উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সময়ে (৪ জুলাই, ১৮২৮ থেকে ২০ মার্চ, ১৮৩৫) সতীদাহ প্রথা, ব্রিটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় উপনিবেশে সতীদাহ প্রথা রদ (১৮২৯), ঠগি দমন (১৮২৬-৩৫), মহিশূর রাজ্য ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনস্থ হয় (১৮৩১-১৮৮১), কুর্গ অধিগৃহীত হয় (১৮৩৪)। লর্ড অকল্যান্ডের সময়ে (৪ মার্চ, ১৮৩৬ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪২) উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮৩৬), ১৮৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে আগ্রা মন্বন্তর, প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ (১৮৩৯-১৮৪২), এলফিনস্টোন বাহিনী গণহত্যা (১৮৪২)। লর্ড এলেনবরোর সময়ে (২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪২ থেকে জুন, ১৮৪৪) প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ (১৮৩৯-১৮৪২), সিন্ধ অধিগ্রহণ (১৮৪৩), ব্রিটিশ-ভারতে দাসপ্রথা বিলোপ (১৮৪৩)। হেনরি হার্ডিঞ্জের সময়ে (২৩ জুলাই, ১৮৪৪ থেকে ১২ জানুয়ারি, ১৮৪৮) প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ (১৮৪৫-৪৬) লাহোর চুক্তি (১৮৪৬) অনুযায়ী, শিখেরা জলন্ধর দোয়াব, হাজারা ও কাশ্মীর ব্রিটিশদের প্রত্যর্পণ করে। অমৃতসর চুক্তি (১৮৪৬) অনুযায়ী, কাশ্মীর জম্মুর রাজা গুলাব সিংকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। মাকুইস অফ ডালহৌসির সময়ে (১২ জানুয়ারি, ১৮৪৮ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৬) দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ (১৮৪৮-৪৯) পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ অধিগ্রহণ (১৮৪৯), ভারতীয় রেলের নির্মাণকার্যের সূচনা (১৮৫০), ভারতে প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপন (১৮৫১), দ্বিতীয় ইঙ্গ-ব্ৰহ্ম যুদ্ধ (১৮৫২-৫৩), নিম্ন ব্ৰহ্মদেশ অধিগ্রহণ গঙ্গা খাল চালু (১৮৫৪), স্বত্ববিলোপ নীতি অনুযায়ী, সাতারা, নাগপুর ও ঝাঁসি অধিগ্রহণ। বেরার ও অযোধ্যা অধিগ্রহণ। চার্লস ক্যানিংয়ের সময়ে (২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৬ থেকে ১ নভেম্বর, ১৮৫৮) বিধবাবিবাহ আইন (২৫ জুলাই, ১৮৫৬), প্রথম আধুনিক ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রতিষ্ঠা (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর, ১৮৫৭), ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ (১০ মে, ১৮৫৭-২০ জুন, ১৮৫৮), ‘ভারত শাসন আইন, ১৮৫৮’ মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন বিলোপ হল।
আগেই বলেছি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের পর ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন বলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব স্বহস্তে তুলে নেয় এবং দেশে নতুন ‘ব্রিটিশ রাজ’ প্রবর্তিত হয়। কোম্পানির শাসন হিসাবে সব ঠিকঠাকই চলছিল, গোল বাধল এই মহাবিদ্রোহে। এই মহাবিদ্রোহেই ব্রিটিশ খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করল ভারতে দুটি ধর্মীয় শক্তি– একটি মুসলিম ধর্মীয় শক্তি, অপরটি হিন্দু ধর্মীয় শক্তি। মুসলিম ধর্মীয় শক্তি সংখ্যালঘু এবং হিন্দু ধর্মীয় শক্তি সংখ্যাগুরু। এই ভিন্ন শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিরঙ্কুশ ভারত শাসন করা সম্ভব। ভারতীয় হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে কোন্দল বাধিয়ে জিইয়ে রাখতে পারলেই কেল্লা ফতে। তার জন্য চাই রাষ্ট্রীয় শক্তি। ভারত শাসনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল ব্রিটেনের মহারানি ভিক্টোরিয়া। ভারত পরাধীন হল, ভারত হল ব্রিটেনের অধীন।
আসুন, এবার একটু দেখে নেওয়া যাক সেই যুগসন্ধিক্ষণ মহাবিদ্রোহ কেন হয়েছিল? কীভাবেই-বা ব্রিটিশরা আবিষ্কার করল ভারতে হিন্দু-মুসলিমের সখ্যতার ফাঁকি? ১৮৫৭ সালে যে মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল তার প্রচলিত নাম সিপাহি বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহ মোটেও নিছক সিপাহি বিদ্রোহ ছিল না। বিদ্রোহ সিপাহিদের মধ্যেও সীমাবদ্ধ ছিল না। বৃহৎ সমাজে এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল। তাই ঐতিহাসিকেরা বলেন, স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ’। আর এটা হঠাৎ করে সংঘটিত হয়নি। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিগত ১০০ বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিল ভারতের মানুষ। কোম্পানির আর্থিক শোষণ, একচেটিয়া ভূমিরাজস্ব নীতি, আইন ও প্রশাসন ব্যবস্থা, ভারতীয়দের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের ঘৃণা ও বর্ণবিদ্বেষ, নানা আছিলা ও একের পর এক দেশীয় রাজ্যগ্রাস ছিল এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের মূল কারণ। আর সিপাহিদের বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কারণ ছিল সেনাবাহিনীতে তাঁদের দুরবস্থা। তার উপর এনফিল্ড রাইফেল প্রবর্তনের মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মনাশ করার প্রচেষ্টার গুজব তাঁদের আরও বেশি তাতিয়ে দেয়। তাতে ইন্ধন জোগায় খ্রিস্টান মিশনারিদের খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কর্মসুচি।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বা কারণ হিসাবে এগুলোর ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মাত্রাগুলো অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। যেমন –(১) ব্রিটিশদের অভিপ্রায় পূর্বতন রাজা এবং ওমরাহদের বংশ ধ্বংস করা। (২) ব্রিটিশরা ভারতের সমস্ত ধর্মের গ্রন্থসমূহ ধ্বংস করছে। (৩) তারা দেশীয় রাজন্যবর্গের ভূমি-অধিকার অস্বীকার করছে। (৪) ভারতীয় নারীদের বিয়ের মাধ্যমে ব্রিটিশরা ভারতে স্বতন্ত্র একটি জাতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। (৫) দেশীয় সিপাহীদের তাঁরা বিশেষ আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয় না। (৬) ব্রিটিশরা দেশীয় সিপাহিদের কাছে অস্ত্র হস্তান্তরে অনিচ্ছুক। (৭) ব্রিটিশদের সঙ্গে একত্রে খাওয়া-দাওয়া, উঠা-বসা তথা সাংস্কৃতিক আনুগত্যের সম্পর্ক স্থাপন না-করলে তাঁরা দেশীয়দের চাকুরি দেয় না। (৮) ব্রিটিশরা মৌলভি ও ব্রাহ্মণদের ধর্ম প্রচারে বাধা দিচ্ছে। (৯) ভারতীয়দের ব্রিটিশ আইনে বিচার করা হচ্ছে। (১০) খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মান্তকরণের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। (১১) ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি ব্রিটিশরা অবজ্ঞা দেখাচ্ছে। (১২) ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিমদের ধর্মান্তরকরণের কাজে কোম্পানি অনুমতি দিয়েছে। (১৩) বহু ভাষাভাষী মানুষের ঘাড়ে জোর করে ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস ইত্যাদি।
ব্রিটিশ গবেষক-লেখকেরা অবশ্য অন্যবিধ বিষয়াবলিকে যুদ্ধের কারণ হিসাবে তুলে ধরেছেন। ১৮৫৭ সালের যুদ্ধাবস্থার বিশ্লেষক-গবেষক মন্টগোমারি মার্টিনের মতে– (১) অত্যাচারী ও শোষণমূলক ভূমিনীতি। (২) অদক্ষ প্রশাসন ও বিচার। (৩) সরকারি চাকুরি থেকে ভারতীয়দের বর্জন নীতি। (৪) ব্রিটিশদের দেশীয় ভাষার অবজ্ঞা এবং দেশীয়দের প্রতি হীন ও অবজ্ঞামূলক মনোভাব। (৫) শিক্ষানীতি, ধর্মীয় সংস্কার ও মিশনারিদের কার্যকলাপ। (৬) জাতিভেদ প্রথা। (৭) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ। (৮) ক্রটিপূর্ণ মুদ্রানীতি। (৯) আফিমের একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার। (১০) জনহিতকর কার্যে কোম্পানির অবজ্ঞা। (১১) ব্রিটিশদের কর্মোদ্যমের অভাব। (১২) দেশীয় রাজ্য সংযোজন নীতি। (১৩) হিন্দু উত্তরাধিকারী আইনের বিরুদ্ধাচরণ। (১৪) সাতারা, নাগপুর, কর্ণাট, ঝাঁন্সি, তাঞ্জোর ও অযোধ্যা ইত্যাদি দেশীয় রাজ্যের উপস্থিতির বিলোপ সাধন। (১৫) বাংলার সৈন্যের সার্বিক অবস্থা, শিথিল আইন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সামরিক কর্মচারীদের প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ, বেসামরিক নিয়োগ, স্বল্প সংখ্যক ইউরোপীয় সৈন্যের ভারতে উপস্থিতি, সিপাহিদের ষড়যন্ত্র এবং (১৬) পারস্য ও রাশিয়ার বৈদেশিক ষড়যন্ত্র।
ভারতকে স্বাধীন করতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যতগুলি সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে এই বিদ্রোহই ছিল সম্ভবত সবচেয়ে বর্ণময় ঘটনা। তবে এই সংগ্রাম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র অভ্যুত্থান নয়। এর আগে একাধিক বার একাধিক অঞ্চলে সংগঠিত বা অসংগঠিতভাবে নানা ছোটোখাটো কৃষক, আদিবাসী ও সেনাবিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল। তার মধ্যে মিরাটের বিদ্রোহ ও তারপর দিল্লি দখলই প্রথম সারা উত্তর ভারতব্যাপী সিপাহি বিদ্রোহের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। ১৮৫৭ সালের এক গ্রীষ্মে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ল পশ্চিম ও মধ্য ভারতেও। কেবলমাত্র দক্ষিণ ভারত বিদ্রোহের উত্তেজনা থেকে মুক্ত থাকে। পাঞ্জাব ও বাংলায় খুব সামান্য প্রভাবিত হয়। সেই সময় কোম্পানির ২,৩২,২২৪ জন দেশি সিপাহির অর্ধাংশই বিদ্রোহের পথে পা বাড়িয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল বটে। কিন্তু এই যুদ্ধই প্রথম ভারতকে বিদেশি শাসনের কবলমুক্ত করার প্রেরণা দেয়। মানুষের এই বিদ্রোহের একটি ইতিবাচক দিক ছিল দিল্লি দখল করে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ‘শাহেনশাহ্-এ-হিন্দুস্তান’ বা ভারতসম্রাট’ ঘোষণা করা। এর মাধ্যমে বহুধাবিদীর্ণ ভারতকে পুনরায় একসূত্রে বাঁধার একটা প্রচেষ্টা দেখা যায়, পরবর্তীকালে ভারত যে একটি পূর্ণাঙ্গ জাতিরাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, তার বীজ নিহিত ছিল এই প্রয়াসের মধ্যেই।
শুরু হয় ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ব্যারাকপুরে। মঙ্গল পাণ্ডে নামে এক সুঠাম যুবক ৩৪ নং রেজিমেন্টের এক সিপাহি কুচকাওয়াজের সময় দুই ব্রিটিশ অফিসারকে হত্যার মধ্য দিয়ে। উপস্থিত অন্যান্য ভারতীয় সিপাহিরা মঙ্গল পাণ্ডেকে গ্রেফতার করতে অস্বীকার করে। পরে অবশ্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। কিন্তু এই খবর ছড়িয়ে পড়ামাত্র লখনউ, আম্বালা, বেরহামপুর ও মিরাটের ক্যান্টনমেন্টগুলিতে জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের আগুন। সেই বছরই ১০ মে তারিখে মিরাটের সিপাহিরা এনফিল্ড রাইফেলের বিতর্কিত টোটা (গোরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানো টোটা, যা মুখ দিয়ে ছিঁড়তে হবে বলে গুজব) স্পর্শ করতে অস্বীকার করে। একদল বহিরাগতের সাহায্যে সিপাহিরা আক্রমণ করে ব্রিটিশদের। তাঁদের মুখে স্লোগান ছিল মারো ফিরঙ্গি কো’। তাঁরা জেল ভেঙে বন্দিদের মুক্ত করে আনে। নারীপুরুষ নির্বিশেষে ইউরোপীয়দের হত্যা করে তাঁদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তারপর অগ্রসর হয় দিল্লির পথে। পরদিন সকালে দিল্লির পথে সেই সিপাহিদের দেখে স্থানীয় সিপাহিরাও বিদ্রোহে যোগ দেয়। বক্ত খানের নেতৃত্বে তাঁরা দখল করে নেয় ভারতের এই শতাব্দীপ্রাচীন রাজধানী। অশীতিপর মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারত সম্রাট’ বলে ঘোষণা করে।
দিল্লি দখলের একমাসের মধ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে কানপুর, লখনউ, বারাণসী, এলাহাবাদ, বরেলি, জগদীশপুর ও ঝাঁসিতে। অবশ্য এই সব অঞ্চলে সামরিক নেতার অভাবে সিপাহিরা ভারতীয় সমাজের স্থানীয় নেতৃবর্গের অধীনেই বিদ্রোহ করে। কানপুরের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন শেষ পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের দত্তক পুত্র নানাসাহেব ও তাঁর বিশ্বস্ত সেনানায়ক তাঁতিয়া টোপি। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই, লখনউতে বেগম হজরত মহল ও প্রাক্তন নবাবের উপদেষ্টা আহমদউল্লাহ ও বরেলিতে খান বাহাদুর খান নেতৃত্ব দেন। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নেতারা হলেন অযোধ্যার আহমেদউল্লাহ, জগদীশপুরের রাও সিং, আজিমুল্লাহ খান ও কানওয়ার সিং এবং ফিরোজাবাদের ফিরোজ শাহ ও মৌলবি আহমেদ শাহ।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঘৃণা সব ধর্মাবলম্বীদের এক করে দিয়েছিল। যদিও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা এঁদের ছিল না। অতীতের ভারতীয় রাজতন্ত্রকেই এঁরা মনে করেছিলেন শ্রেষ্ঠতম। অতঃপর নেতৃত্ব ও সমন্বয়ের অভাবই বিদ্রোহকে ব্যর্থতার পথে ঠেলে দিয়েছিল। বিদ্রোহের উপর সবচেয়ে বড়ো আঘাতটি নেমে আসে। ১৮৫৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। এই দিন ব্রিটিশ বাহিনী দিল্লি পুনর্দখল করে সম্রাট বাহাদুর শাহকে কারারুদ্ধ করে। এরপর একের পর এক কেন্দ্রে বিদ্রোহীদের পরাজয় ঘটতে থাকে। ১৮৫৮ সালের ১৭ জুন রানি লক্ষ্মীবাই পিঠের পিছনে নিজের দুধের বাচ্চাকে বেঁধে নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে রণক্ষেত্রেই। প্রাণ দেন। রানি লক্ষ্মীবাইয়ের মৃত্যুর পর পাছে ব্রিটিশ শাসকদের রোষানলে পড়ে যায় সেই ভয়ে কোনো হিন্দু রাজা তাঁর শেষকৃত্য করতে এগিয়ে আসেননি। কিন্তু এগিয়ে এসেছিলেন নবাব আলি বাহাদুর। তিনি হিন্দুরীতি অনুসরণ করে রানির শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন (নবাব আলি বাহাদুর ছিলেন পাতানো ভাই। রানি প্রতি বছর নবাবের হাতে রাখি বেঁধে দিতেন। এই ঐতিহ্য আজও ঝাঁসি ও বিথুর সহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে প্রচলিত আছে। প্রতি বছর হিন্দু বোনেরা মুসলিম ভাইদের হাতে রাখি বেঁধে থাকেন)। ১৮৫৮ সালের মে মাসে কানোয়ার সিং ব্রিটিশদের হাত এড়িয়ে পালাতে গিয়ে মারা পড়েন। নানাসাহেব যুদ্ধ চালিয়ে যান। শেষে ১৮৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে নতুন করে শক্তিসঞ্চয়ের আশা নিয়ে পালিয়ে যান নেপালে। তাঁতিয়া টোপি ১৮৫৯ সালের মে মাস পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও শেষে এক সহকর্মীর বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়েন এবং প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। শুধুমাত্র সিপাহি যোদ্ধাদের পরাজয়ই নয়, বিদ্রোহের ব্যর্থতার পিছনে অন্যান্য কারণ। হিসাবে চিহ্নিত করা হয় সিন্ধিয়া, হেলকর ও নিজামের মতো রাজন্যবর্গের বিদ্রোহে যোগদান না করা এবং সিপাহিদের সঙ্গে স্থানীয় কৃষক, জমিদার ও অন্যান্য শ্রেণির মানুষের সমন্বয়ের অভাবও ছিল।
মহাবিদ্রোহের সামনের সারির নেতাদের মধ্যে একমাত্র মাওলানা আহমদুল্লাহই (সিংহাসন, ভাতা বা কোনো ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা হারানোর কারণে নয়) সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার এবং বিদেশি দখলদার সাম্রাজ্যবাদী বিতাড়নের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৮৩১ সালে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভির শাহাদাঁতের পর তাঁর এই সুযোগ্য শিষ্যই পাটনায় একটি কেন্দ্র স্থাপন করে স্বাধীনতার বাণী সর্বত্র পৌঁছে দিতে স্বাধীনতাকামী মুজাহিদ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। মূলত তিনিই ছিলেন স্বাধীনতাকামী-মুজাহিদ বাহিনী এবং মহাবিদ্রোহের অন্যান্য সহযোগী শক্তিসমূহের (সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ও বেগম জিনাত মহল, নবাব সৈয়দ ওয়াজেদ আলি শাহ ও বেগম হজরত মহল, রানি লক্ষ্মীবাঈ, তাঁতিয়া টোপি, নানা সাহেব প্রমুখ) মধ্যে প্রধান যোগসূত্র।
১৮৫৭ সালে মহাযুদ্ধের পিছনে যে যথেষ্ট পরিমাণ কারণ বিদ্যমান ছিল এবং এটি যে কেবল বিচ্ছিন্ন ষড়যন্ত্র বা ক্ষমতা দখলের মুসলিম চক্রান্ত ছিল এটা কখনোই বলা যায় না, সেটা বিভিন্ন লেখকের বিশ্লেষণগুলি তুলনা করা হলেই অনুধাবন করা যায়। ইংরেজ লেখকের পাশাপাশি এদেশীয় লেখকদের মতামত লক্ষ করলেও একই চিত্র উদ্ভাসিত হয় যে, এটি একটি মুসলিম নেতৃত্বাধীন সর্বভারতীয় জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল এবং সিপাহি ও জনতার সম্মিলনে সর্বাত্মক যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলিমদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের কারণে মুসলিম মানেই বিদ্রোহী বলে ব্রিটিশরা উল্লেখ করেছেন। বিশিষ্ট ব্রিটিশ গবেষক ও ঐতিহাসিক পি হার্ডলি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Muslims of British India’s গ্রন্থে লিখেছেন— “For most British observers in 1857 a Muslim meant a rebel.” ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলিমদের ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করে আর-এক ব্রিটিশ ঐতিহাসিকও অভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি লিখেছেন— “The first sparks of disaffection it was generally agreed, were kindled among the Hindu sepoys who feared an attack upon their caste. But the Muslims then fanned the flames of discontent and placed themselves at the head of movement, for they saw in these religious grievances the stepping stone to political power. In the British view it was Muslim intrigue and Muslim leadership that converted a sepoy mutiny into a political conspiracy, aimed at the extinction of the British Raj.” (বাংলা তর্জমায়— সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, ধর্মের উপর আঘাতের ভয়ে হিন্দুসৈন্যরা অসন্তোষের প্রথম শিখাঁটি জ্বালিয়েছিল। কিন্তু মুসলিমরা সেই অসন্তোষের অগ্নিশিখাকে উস্কে দেয় এবং নিজেদেরকে আন্দোলনের শীর্ষ স্থানে নিয়ে যায়। তাঁরা এই ধর্মীয় আঘাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতায় যাওয়ার প্রথম সিঁড়িটি দেখতে পায়। ব্রিটিশদের মতে, এটা ছিল মুসলিমদের ষড়যন্ত্র ও নেতৃত্ব, যা একটি সামান্য সিপাহি বিদ্রোহকে ব্রিটিশ শাসনের অবসানকামী রাজনৈতিক চক্রান্তে রূপান্তরিত করে।)
তবে এই বিদ্রোহের একটি ইতিবাচক দিকই অবশ্য উল্লেখ্যনীয়! মহাবিদ্রোহ আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমানের ভেদ অনেকটাই ঘুচিয়ে দিয়েছিল। হিন্দু ও মুসলমান সিপাহিরা একযোগে বিদ্রোহে অংশ নেয় এবং একবাক্যে বাহাদুর শাহকে সম্রাট হিসাবে মেনে নেয়। তা ছাড়া, এই বিদ্রোহীরাই প্রথম সার্থকভাবে আমাদের মনে ব্রিটিশ বিরোধিতার বীজ রোপণ করতে সক্ষম হয়।
উপসংহারে সিপাহি বিদ্রোহের মূল্যায়ন একটু দেখে নেওয়া যাক। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ইতিহাসে সিপাহি বিদ্রোহ, মহাবিদ্রোহ বা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রভৃতি বিভিন্ন নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ যুক্তি সহকারে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সিপাহি বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতামত বিশ্লেষণ করলে যে দৃষ্টিকোণগুলি সামনে আসে। বেশকিছু ঐতিহাসিক ও চিন্তাশীল ব্যক্তিরা মনে করেন যে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ছিল নিছক সিপাহিদের বিদ্রোহ। রবার্টস, জন কে, জন সিলি এবং দাদাভাই নওরোজি, রাজনারায়ণ বসু, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ আহমেদ খান প্রমুখ এই মতের সমর্থক। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার ‘History of Freedom Movement in India’ গ্রন্থে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। কিশোরী চাঁদ মিত্র বলেছেন “এই বিদ্রোহ ছিল একান্তভাবেই সিপাহিদের অভূখান। এতে গণ আন্দোলনের কোনো উপাদান ছিল না।” যুক্তি– (১) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ সিপাহিদের জন্য এবং সিপাহিদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল। (২) দেশীয় রাজশক্তির অধিকাংশই হয় এই বিদ্রোহে নিরপেক্ষ ছিল নতুবা সিপাহিদের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। (৩) শিক্ষিত ও সাধারণ মানুষ এই বিদ্রোহ থেকে দূরে ছিল। (৪) বিদ্রোহীদের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, পরিকল্পনা বা সংগঠন ছিল না। (৫) ঐক্য বা বোঝাঁপড়া কেবলমাত্র সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। (৬) সিপাহিদের সঙ্গে বিদ্রোহী নেতাদের তেমন যোগাযোগ ছিল না। (৭) বিদ্রোহের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও নেতাদের মধ্যে লক্ষ্য ও আদর্শের ফারাক ছিল। জাতীয় স্বার্থে বিদ্রোহ পরিচালিত হয়নি। ডা. রমেশচন্দ্র মজুমদার ও সুরেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেননি। কারণ— (১) তাঁদের মতে, ভারতের কিছু অঞ্চলে এই বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ ছিল; কাজেই এই সংগ্রামকে সারা ভারতের সংগ্রাম বলা যায় না। (২) এই বিদ্রোহ ছিল সিপাহিদের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ, যা জাতীয় বিদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে না। (৩) অধিকাংশ সামন্তরাজ ও জমিদার ইংরেজ কোম্পানির প্রতি অনুগত ছিল এবং বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল। (৪) বিদ্রোহীরা সকলের স্বাধীনতা লাভের জন্য নয়, বরং পৃথক পৃথক উদ্দেশ্য সিদ্ধির লক্ষ্যে বিদ্রোহ করেছিল। (৫) শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজও সমসাময়িক বাংলার পত্রপত্রিকাগুলিও বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল। (৬) তখন বিদ্রোহীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের চেতনা ছিল না, অর্থাৎ সেই সময় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়নি।
বস্তুত এই বিদ্রোহ সিপাহিরা শুরু করলেও অচিরেই বিভিন্ন স্থানের অসামরিক ব্যক্তিবর্গ এতে যোগ দিয়েছিল। বিদ্রোহীরা সিংহাসনচ্যুত শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবোধের সঙ্গে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মিশে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। সেদিক থেকে সিপাহি বিদ্রোহে প্রায় সমগ্র ভারতবাসী ব্রিটিশ শোষণ থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য যোগ দিয়েছিল। তাই একে জাতীয় বিদ্রোহ বলাই যুক্তিযুক্ত। একে শুধু সিপাহি বিদ্রোহ বলে গোষ্ঠীস্বার্থ বলে চিহ্নিত করা আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিনায়ক দামোদর সাভারকার তার Indian War of Independence গ্রন্থের সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে উল্লেখ করেছেন। এই বিদ্রোহকে নিছক ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ হিসাবে আখ্যায়িত করা যুক্তিসংগত নয়। অনেকেই সিপাহি বিদ্রোহকে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলতে অধিক পছন্দ করেন। ঐতিহাসিক হোমস, ডাফ, ম্যালেসন, জে.বি, নর্টন, আউট্রাম এবং ডিসরেলি এই বিদ্রোহকে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলেছেন। সমাজতন্ত্রবাদের জনক কার্ল মার্কসও একে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলেই উল্লেখ করেছেন। পক্ষে যুক্তি— (১) ইংরেজ কোম্পানির দীর্ঘকালের শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ ছিল ভারতবর্ষের বুকে জনগণের জ্বলন্ত প্রতিবাদ। (২) বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে চেয়েছিল। (৩) ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ সমগ্র ভারতে না-হলেও এমনকি এর কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য না-থাকলেও অধিকাংশ ভারতীয়ই মনেপ্রাণে ইংরেজদের বিতাড়ন চেয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক একসঙ্গে লড়াই করেছিলেন এবং দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট করেছিলেন। (৪) ইংরেজ-বিরোধী এত ব্যাপক আন্দোলন ভারতে আর হয়নি। তাই গতানুগতিক বিচার না-করে এই অভ্যুত্থানকে স্বাধীনতার সংগ্রাম বলাই যুক্তিযুক্ত।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পিছনে ধর্মীয় কারণ দর্শালে এই মহান বিদ্রোহের প্রকৃত মূল্যায়নে ঘাটতি থেকে যায়। প্রকৃত অর্থে এই মহাবিদ্রোহ ছিল শাসক ব্রিটিশ আর দেশীয় ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে একটি সংগঠিত লড়াইয়ের বার্তা। এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুধুমাত্র ভারতের ইতিহাসেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, স্থান করে নিয়েছিল বিশ্ব ইতিহাসে। মহাবিদ্রোহ সার্বিক সাফল্য লাভ না করলেও ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের আমূল সংস্কার এবং ১৮৬১ সালে পুলিশ আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা লক্ষ করা যায়। নেতাজি সুভাষ বসু বলেছেন ‘প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’। মনে রাখতে হবে তৎকালীন সময়ে ভারতবর্ষে স্বাধীনতা বলতে আজ আমরা যা বুঝি তার ধারণা মানুষের ছিল না। ব্রিটিশ বিরোধী ভাবনায় হিন্দু-মুসলিম মিলে কোনো ধর্মের কথা না ভেবেই লড়াই করেছিল। কার্ল মার্ক্স এটিকে সর্বপ্রথম প্রথম ভারতীয় মহাবিদ্রোহ’ আখ্যা দেন। তাঁর লেখা ‘ভারতীয় ইতিহাসের কালপঞ্জী’ বইটি পড়লে বোঝা যায়। সাল-তারিখ দেখলে সেটাই প্রথম বলে মনে করায়। কার্ল মার্ক্স ‘ভারতীয় বিদ্রোহ, ভারতীয় প্রশ্ন প্রবন্ধে লিখেছেন–সিপাহিরা ছিল খণ্ডমাত্র এবং মূলত কৃষকেরা ছিল ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের প্রধান চালিকাশক্তি। মার্ক্সের মতে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ছিল ভারতের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম’। সিপাহিরা ছিল মূলত উত্তর ভারতের কৃষিজীবী মানুষ। নতুন ভূমি রাজস্বব্যবস্থা উত্তর ভারতে যে গ্রামীণ অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল, ১৮৫৭ সালের গণবিদ্রোহে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। বিদ্রোহের শুরুটা হয়েছিল সেনাবাহিনীর ছাউনিতে, সিপাহিদের অনেকগুলি অভাব অভিযোগকে কেন্দ্র করে। কিন্তু সমগ্র ভারতে সাধারণ মানুষ এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন।
কিন্তু হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক এত ইতিবাচক হলে তো চলবে না! অতএব ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে হবে। লড়াই বাধিয়ে দিতে হবে একে অপরের সঙ্গে। আবার কবে হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না, তার কোনো গ্যারান্টি আছে নাকি! টিপুর মোকাবিলা করতে গিয়ে ব্রিটিশদের শরীর দিয়ে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। সিপাহি বিদ্রোহেও কম বেগ পেতে হল না। এই বিদ্রোহে ২৫ লাখ মুসলিম হত্যা করেও নিশ্চিন্তে ঘুমোনো যাচ্ছে না। হিন্দুদের ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে কজা করা গেলেও মুসলিমদের কজা করা সহজ হচ্ছে না। বিচক্ষণ ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছে মুসলিমরাই ব্রিটিশদের প্রধান প্রতিপক্ষ। এঁদের হত্যা করেও শান্ত করা যাবে না। অতএব অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন ঘটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।
বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, ব্রিটিশ কর্তৃক উপমহাদেশের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত প্রায় শতবর্ষব্যাপী সময়কালে মুসলিমদের উপনিবেশবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেক্ষাপটটিকে ব্রিটিশ গবেষকরা ঘৃণ্যভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং শত সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় যে প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৮৫৭ সালে সমগ্র ভারতব্যাপী সূচিত হয়েছিল, তাঁকেও মুসলিম নেতৃত্বে পরিচালিত ‘ব্রিটিশ শাসনের অবসানকামী রাজনৈতিক চক্রান্ত’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। মুসলিমরা নেতৃত্বে ছিলেন এটা ঠিক। কারণ, ব্রিটিশ শাসনকে চ্যালেঞ্জ করার মতো নেতৃত্ব, এলিট শ্রেণি ও সামরিক সক্ষমতা সেই আমলের ভারতে অন্য কোনো সম্প্রদায়ের ছিল না। কিন্তু এটা তো কোনোভাবেই কেবল ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত ছিল না। ছিল জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম। ১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রামের ঘটনাবলিকে বিকৃত করা এবং মুসলিমদের স্বাধীনতাকামী-জাতীয়তাবাদী-বৈপ্লবিক আন্দোলনকে ‘ক্ষমতা দখলের বিচ্ছিন্ন চক্রান্ত বা ‘ওয়াহাবি ষড়যন্ত্র ইত্যাদি ক্ষুদ্র ও ভ্রষ্ট চরিত্রে প্রতিপন্ন করার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ এবং তাঁদের বশংবদ, বিশেষ করে, বাঙালি মধ্যবিত্ত-বুদ্ধিজীবী শ্রেণির হিন্দু সম্প্রদায়ের লেখক-গবেষকদের তৎপরতা।
স্যার উইলিয়ম মূর ১৮৫৮-১৮৬১ সালে ‘Life of Mohammed’ এবং ১৮৯১ সালে ‘The Caliphate, its Rise, Decline and Fall’ নামের দুটি বড়ো মাপের গ্রন্থ রচনা করেন এবং যাঁর প্রধান লক্ষ্যই ছিল এই মিথ। বা উপকথাকে প্রতিষ্ঠা করা যে, ইসলাম এক হাতে তরবারি আর অন্য হাতে কোরান নিয়ে বিশ্ব দখল করেছে। মূরের উদ্দেশ্যকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আর-এক বিশিষ্ট ব্রিটিশ পণ্ডিত পি. হার্ডি লেখেন— “whose (books) helped to foster the myth of the Muslim as always armed with the sword in one hand and the Qur’an in the other.” ১৮৫৭ সালের অক্টোবর মাসে যুদ্ধের মধ্যে মূর তাঁর ভাইকে এক চিঠিতে লেখেন— “The Musulmans, while they thought their cause had a fair chance of final success have frequently compromised themselves by flagrantly traitorous acts. At Allygurh, for instance, the Musulmans were for a considerable time dominant; they forcibly converted many Hindoos; they defied our Government in the most insolent manner; all the ancient feelings of warring for the Faith, reminding one of the days of the first Caliphs, were resuscitated.”
ব্রিটিশদের সৃষ্ট ইতিহাস বিকৃতির ধারা এবং মুসলিমদের চরিত্র হননের কাজটি অতি দ্রুত তৎকালীন ভারতের রাজধানী কলকাতার হিন্দু বুদ্ধিজীবী সমাজ সোৎসাহে শুরু করে। মুসলিমদের ওয়াহাবি, বিপ্লবী, সন্ত্রাসী, মধ্যযুগীয়, অনাধুনিক ইত্যাদি কুৎসার মাধ্যমে চিত্রিত করা হতে থাকে। আজও ইতিহাস বিকৃতির এহেন ধারা আমাদের পারিপার্শ্বে অব্যাহত আছে। ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব ও প্রেরণায় মুসলিমদের অগ্রণী ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সত্য। অথচ ব্রিটিশ ও উপনিবেশবাদ বিরোধী মুসলিম আন্দোলন ও সংগ্রামের অসংখ্য বিচ্ছিন্ন ধারা ১৮৫৭ সালে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিল বহিরাগত-দখলদারদের ক্ষমতায় ভিত্তি।
ব্রিটিশবিরোধী প্রচারপত্র বিলির অপরাধে সংগ্রামের অগ্রণী নেতা মওলানা আহমদউল্লাহকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহিদ করা হয়। আটক ও শহিদ হওয়ার পূর্ব-পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলনকে তিনি বেগবান করে গেছেন এবং ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে মাদ্রাজে যে বক্তৃতা করেন, তাকে সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদবিরোধী স্বাধীনতা ঘোষণার ঐতিহাসিক দলিল বলা যায়— “দেশবাসী, আপনারা জেগে উঠুন। ফিরিঙ্গি কাফেরদের উৎখাত করতে আপনারা সংঘবদ্ধ হোন। এই কাফেররা ন্যায়কে পদদলিত করছে, আমাদের স্বরাজ্যে তাঁরা লুণ্ঠন। করছে। এই কাফেরদের অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য আমাদেরকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সে সংগ্রাম হবে স্বাধীনতা ও ন্যায়ের জন্য জিহাদ।” স্বাধীনতা আন্দোলনের এমন অসংখ্য নেতা ভারতবাসীকে ইংরেজ বিতাড়নের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন এবং স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সশস্ত্র যুদ্ধে নেতৃত্ব দান করেন। দিল্লির মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরও স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী নায়কদের সংগ্রামী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে এক ঘোষণাপত্র প্রচার করেন এবং “বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানান।” স্যার জেমস আউটরামের মতে, “বিপ্লবী মুসলিমরাই ছিলেন এই বিদ্রোহের মূল
‘Indian Mutiny’ গ্রন্থে চার্লস বল লেখেন— “বেসামরিক ও সামরিক আদালতের হুকুমে যাঁদেরকে গুলি করে মারা হয় বা যাঁদেরকে কামানের গোলায় উড়িয়ে দেওয়া হয় বা ফাঁসিতে হত্যা করা হয়, তাঁদের সংখ্যা ভয়ংকরভাবে বেশি। যুদ্ধশেষে ব্রিটিশরা একটি ব্যাপক গণহত্যা চালায়। কমপক্ষে ৩০,০০০ মুক্তিকামী সিপাহি এবং ৫০,০০০ স্বাধীনতাকামীকে হত্যা করা হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিরোধ-যুদ্ধে শহিদ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভির রক্তাক্ত কাটা-তাজা মাথা ভারতবাসীকে দিয়ে গেছে। ১৮৫৭ সালে বীর বিপ্লবী মৌলভি আহমদউল্লাহ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসম সাহসিকতায় লড়াই করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামনে এক জ্বলন্ত আতঙ্কে পরিণত করেন। এ কারণেই ব্রিটিশ সরকার তাঁকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরে দেওয়ার জন্য তৎকালীন ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। অর্থের লোভে এবং ব্রিটিশ প্রভুদের খুশি করার জন্য পোয়াইনের রাজা জগন্নাথ বিশ্বাসঘাতকতায় নিদর্শন রেখে তাঁকে প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানিয়ে গুলি করে হত্যা করে এবং তাঁর ছিন্ন মস্তক ব্রিটিশপ্রভুদের উপহার হিসাবে প্রদান করে। এক নিষ্ঠুর ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আহমদউল্লাহর ছিন্ন মস্তক প্রকাশ্য স্থানে দু-দিন ঝুলিয়ে রেখে জনসাধারণের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের জন্য প্রদর্শনী করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পঙ্গা নিতে সাহস না পায়। ব্রিটিশ প্রভু বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কারস্বরূপ রাজা জগন্নাথকে তৎকালীন মূল্যমানে ৬৫,০০০ টাকা নগদ পুরস্কার এবং জমিদারি দান করে।
‘সিপাহি যুদ্ধ ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে রতনলাল চক্রবর্তী লিখেছেন— “প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম অন্যান্য জনগণ সিপাহি যুদ্ধের সময় ছিল নিষ্ক্রিয়। ভারতের অন্যান্য কতিপয় অঞ্চলের মতো ভূস্বামী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি কোম্পানিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করে, অবশ্য এই সহযোগিতার মূলে ছিল শ্রেণি স্বার্থ আদায়।” ব্রিটিশদের সহযোগীরূপে ভূস্বামী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলে লেখক যাঁদেরকে যুদ্ধের সময় নিষ্ক্রিয় বলেছেন, তাঁরা ১৭৯৩ সালে কোম্পানি-প্রবর্তিত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’-এর সুবিধাভোগী নব্য হিন্দু জমিদার শ্রেণি এবং ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সনদ প্রাপ্ত কলকাতাকেন্দ্রীক হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি। লেখক অবশ্য শ্রেণিস্বার্থ আদায়ের জন্য হিন্দু জমিদার ও মধ্যবিত্তদের আনুগত্যকে চিহ্নিত করলেও তাঁদের সম্প্রদায়গত চারিত্রিক অবস্থানটিকে নিরূপণ করেননি। তবে শিবনাথ শাস্ত্রী রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে কোনোরূপ রাখঢাক না-করেই লিখেছেন— “১৮৫৭ সালে মহারানি প্রজাদিগকে অভয়দান করিয়া ভারতসাম্রাজ্য নিজহস্তে লইলেন; কলিকাতা শহর আলোকমালাতে মণ্ডিত হইল; চারিদিকে আনন্দধ্বনি উঠিল। কিন্তু সিপাহি বিদ্রোহের উত্তেজনার মধ্যে বঙ্গদেশে ও সমাজে এক মহোপকার সাধিত হইল; এক নবশক্তির সূচনা হইল; এক নব আকাক্ষা জাতীয় জীবনে জাগিল।..বিদ্রোহজনিত উত্তেজনাকালে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ নামক সাপ্তাহিক ইংরাজি কাগজ এক মহোপকার সাধন করিল। পেট্রিয়ট সারগর্ভ সুযুক্তিপূর্ণ তেজস্বিনী ভাষাতে কর্তৃপক্ষের মনে এই সংস্কার দৃঢ়রূপে মুদ্রিত করিবার প্রয়াস পাইলেন যে, সিপাহি-বিদ্রোহ কেবল কু-সংস্কারাপন্ন সিপাহিগণের কার্য মাত্র, দেশের প্রজাবর্গের তাহার সহিত যোগ নাই। প্রজাকুল ইংরাজ গবর্নমেন্টের প্রতি কৃতজ্ঞ ও অনুরক্ত এবং তাহাদের রাজভক্তি অবিচল রহিয়াছে। পেট্রিয়টের চেষ্টাতে লর্ড ক্যানিংয়ের মনেও এই বিশ্বাস দৃঢ় ছিল; সেজন্য এদেশীয়দিগের প্রতি কঠিন শাসন বিস্তার করিবার জন্য ইংরাজগণ যে কিছু পরামর্শ দিতে লাগিলেন, ক্যানিং তাহার প্রতি কর্ণপাত করিলেন না। পূর্বেই বলিয়াছি সেই কারণে তাঁহার স্বদেশিগণ তাঁহার ‘Clemency Canning বা দয়াময়ী ক্যানিং নাম দিল। এমনকি তাঁহাকে দেশে ফিরাইয়া লইবার জন্য লন্ডনের প্রভুদিগকে অনেকে পরামর্শ দিতে লাগিলেন। পার্লিয়ামেন্টেও সেকথা উঠিয়াছিল; কিন্তু ক্যানিংয়ের বন্ধুগণ পেট্রিয়টের উক্তিসকল উদ্ধৃত করিয়া দেখাইলেন যে, এদেশবাসীগণ ক্যানিংয়ের প্রতি কীরূপ অনুরক্ত এবং ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের প্রতি কিরূপ কৃতজ্ঞ।..সকলে উত্তেজনাতে পড়িয়া স্থিরবুদ্ধি হারাইয়াছিল, কেবল পেট্রিয়ট হারায় নাই; এজন্য রাজপুরুষগণের নিকট ইহার আদর বাড়িয়া গেল। এরূপ শুনিয়াছি পেট্রিয়ট বাহির হইবার দিন লর্ড ক্যানিং-এর ভৃত্য আসিয়া পেট্রিয়ট আফিসে বসিয়া থাকিত, প্রথম কয়েকখানি কাগজ মুদ্রিত হইলেই লইয়া যাইত। হিন্দু পেট্রিয়টের এই প্রভাব দেখিয়া দেশের শিক্ষিত ব্যক্তিগণ পুলকিত হইয়া উঠিলেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ এবং রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী প্রভৃতি নব্যবঙ্গের নেতৃগণ হরিশের পৃষ্ঠপোষক হইয়া তাঁহাকে উৎসাহ দিতে লাগিল।”
১৮৫৭ সালের মহাসংগ্রামের বিরুদ্ধে হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইংরেজানুগ মনোভাবকে বিশ্লেষণ করে সুপ্রকাশ রায় ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন— “ইহারা (হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি) প্রথম হইতেই ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতার মোহে আত্মহারা হইয়া ইংরেজদেরও ভারত জয়কে ‘ভগবানের মঙ্গল বিধান’ বলিয়া বরণ করিয়া লইয়াছিল। সুতরাং মহাবিদ্রোহে ইংরেজদের পরাজয় তাহারা কল্পনাও করিতে পারিত না। সমসাময়িককালে শহুরে মধ্যশ্রেণি বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সরকারকে সাহায্য না করিলেও অনেকেই মহাবিদ্রোহের নিন্দায় মুখর হইয়া উঠিয়াছিলেন, এমনকি স্বাধীনতার অগ্রদূত বলিয়া কথিত কবি ঈশ্বর গুপ্ত যিনি ‘বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া স্বদেশের কুকুর পূজা করিব’ বলিয়া আস্ফালন করিতেন, তিনিও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য নানা সাহেব, ঝাঁন্সির রানি ও অন্যান্যদের প্রতি কুৎসিত কটাক্ষ করিয়া গাত্রদাহ নিবারণ করিয়াছিলেন এবং ইংরেজ ভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছিলেন।”
‘সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সংবাদ ভাস্কর’ পত্রিকায় লিখলেন –“হে পাঠক, সকলে উদ্বাহু হইয়া ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া জয়ধ্বনি করিতে করিতে নৃত্য কর। আমাদের প্রধান সেনাপতি সক্ষমরূপে দিল্লি প্রবেশ করিয়াছেন। পাঠকগণ জয় জয় বলিয়া নৃত্য কর। হিন্দু প্রজাসকল দেবালয়ে পূজা দাও। আমাদের রাজ্যেশ্বর শত্রুজয়ী হইলেন।” কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখলেন –“যুবনের যত বংশ এবারে হবে ধ্বংস/সাজিয়াছে কোম্পানির। সেনা/গোরু জরু লবে কেড়ে, চাপ দেড়ে যত নেড়ে/এই বেলা সামাল সামাল।” তিনি আরও একটু অগ্রসর হয়ে লিখলেন –“চিরকাল হয় যেন বৃটিশের জয়/বৃটিশের রাজলক্ষ্মী স্থির যেন রয়/এমন সুখের রাজ্য আর নাহি হয়/শাস্ত্রমতে এই রাজ্য রামরাজ্য কয়।” ঈশ্বর গুপ্ত একটি জনপ্রিয় শ্লোগান পর্যন্ত তৎকালে ইংরেজানুগ এবং বিপ্লব-বিরোধী জনমত গঠনের লক্ষ্যে প্রচার করেন : “ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয়/মুক্ত মুখে বল সবে বৃটিশের জয়।” তাঁর সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ সে সময় সম্পূর্ণভাবে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির। পক্ষে এবং সংগ্রামী-স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের বিরুদ্ধে সুতীব্রভাবে সংবাদ এবং সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশ করতে থাকে। এমনই একটি সংখ্যায় পত্রিকাটিতে লেখা হয়–”অবোধ যবনেরা উপস্থিত বিদ্রোহ সময়ে গভর্নমেন্টের সাহায্যার্থে কোন প্রকার সদানুষ্ঠান না-করাতে তাহাদিগের রাজভক্তি সম্পূর্ণ বিপরীতরূপ রহিয়াছে এবং বিজ্ঞ লোকেরা তাহাদিগকে নিতান্ত অকৃতজ্ঞও জানিয়াছেন।”
ভারতের হিন্দুসম্প্রদায়ের এরূপ আচরণ ব্রিটিশদের নজর এড়ায়নি। এই সংবাদ ব্রিটিশদের কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল। ব্রিটিশরা বুঝেছিল এদেশে বিশ্বাসঘাতক’ ‘বিভীষণ’-দের অভাব নেই। ভবিষ্যতেও অভাব হবে না। এমন দেশই তো শাসন করে লুটেপুটে খেতে মজা আসে। অতএব এই মহাবিদ্রোহের একটি তাৎক্ষণিক ফল হিসাবে পেলাম ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন’। পলাশির যুদ্ধের পর থেকে ভারত কার্যত শাসিত হত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা। পলাশি যুদ্ধের প্রায় ১০০ বছর পর এই আইনবলে ব্রিটিশ সরকার কোম্পানির হাত থেকে কেড়ে নিল সেই ক্ষমতা। এবার সরাসরি সরকারি শাসন। ব্রিটিশ-ভারত নির্মাণের খাতা খুলে গেল। ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর রানি ভিক্টোরিয়া একটি সনদ জারি করে ভারতীয়দের ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসনে আনলেন। ব্রিটেনের অধিকৃত ভূখণ্ডে পর্যবসিত হতে থাকল ভারত। দেশে একজন ভাইসরয় বা রাজ-প্রতিনিধি নিযুক্ত হলেন। ব্রিটিশ সরকার যে মহাবিদ্রোহের কারণগুলি থেকে যথেষ্ট শিক্ষা গ্রহণ করেছিল, তা স্পষ্ট হয়ে গেল রানির এই ঘোষণাপত্রেই। ভিক্টোরিয়া সমস্ত দেশীয় রাজাকে পুত্রসন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার নিষিদ্ধ করে দিলেন। উল্লেখ্য, এই অধিকার কেড়ে নেওয়ায় একাধিক দেশীয় রাজ্যের রাজন্যবর্গ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। এছাড়া দেশীয় রাজন্যবর্গের সঙ্গে ব্রিটিশদের সাক্ষরিত সকল চুক্তিকে মর্যাদা দেওয়া হল। শুধু তাই নয়, মহাবিদ্রোহের পিছনে ধর্মীয় উত্তেজনার কারণটি বিচার করে, ব্রিটিশ রাজশক্তি ঘোষণা করে দিলেন, এর পর থেকে ব্রিটিশরা ভারতের ধর্মীয় ব্যাপারে নাক গলাবেন না। ভারতীয়দের ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকবে। কেউ কেউ রানির এই ঘোষণাপত্রকে বলেন ভারতীয় স্বাধীনতার ম্যাগনা কার্টা’। ১৮৭৬ সালে ভিক্টোরিয়াকে ‘Empress of India’ বা ‘ভারতের সম্রাজ্ঞী’ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।
১৮৫৮ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ভারতে ব্রিটিশ শাসন মোটামুটি দৃঢ়ভাবেই বলবৎ ছিল। সেযুগে মনে হত, ভারতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশদের শাসন কয়েক শতাব্দীকালব্যাপী স্থায়ী হতে চলেছে। কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের বিদ্রোহ তো চলছিলই ১০০ বছর ধরে। যেমন– কৃষক বিদ্রোহ, আবাক্কা রানির বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, নৃ-তাত্ত্বিক বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, তিতুমিরের বিদ্রোহ, ওয়াহাবি আন্দোলন, ফরাজি আন্দোলন, সন্দীপ বিদ্রোহ, রংপুর বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, পাইক বিদ্রোহ, পলিগার বিদ্রোহ, মোপলা বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, চুয়ার বিদ্রোহ ইত্যাদি। এইসব বিদ্রোহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দমনপীড়ন করে সামলে নিয়েছিল। কিন্তু ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ব্রিটিশদের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিল।
১৮৫৮ থেকে ভারতের সমাজে নানারকম পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছিল। নানাবিধ সামাজিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে মানুষগুলোরও বদল ঘটছিল। এই সময়ের মধ্যে কোনো বিদ্রোহ সংগঠিত হয়নি, সে কথা বলা যায় না। কিন্তু সেই বিদ্রোহ ব্রিটিশপ্রেমী ভারতীয়দের অনুপ্রেরণায় ব্রিটিশ শাসকরা কঠোর আইনের মাধ্যমে দমন-পীড়নে স্তব্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। এ সময় মুসলিম সম্প্রদায় ব্রিটিশদের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হলেও হিন্দু সম্প্রদায় ততোধিক ব্রিটিশদের সঙ্গে ঘনিষ্টতা অর্জন করে ফেলল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে এই শাসনের নানা দিকই ভারতে একটি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। তার স্ফুরণ ঘটে ১৯০৫ সালে। আর তা থেকে ভারতবাসীর স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে তীব্রতর।
ভারতে যে সময় ব্রিটিশ শাসন চলছে গোটা বিশ্বে নানা পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। সেই পরিবর্তনের ঢেউ ভারতেও আছড়ে পড়ল। ১৮৭০ সালের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও উগ্র জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রতিটি জাতিই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর ফলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য শুরু হয়ে যায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রতিটি জাতির মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও বিরোধ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ইউরোপেও যুদ্ধের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলিতে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা চালাতে থাকে। এছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের সম্মান, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হয়।
উপনিবেশের আরও একটি বড় কারণ ছিল অর্থনৈতিক। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ইংল্যান্ডে এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটলে ইউরোপের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায়। শিল্পোন্নত দেশগুলির কলকারখানায় বিপুল পরিমাণে পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হতে থাকে। নিজ দেশের চাহিদা মেটানোর পর উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রির সুযোগ ইউরোপে ছিল না। কারণ ইউরোপের প্রায় সব দেশই শিল্পোন্নত ছিল এবং প্রতিটি দেশেই চাহিদা অতিরিক্ত পণ্য উদ্বৃত্ত হত। এসব উদ্বৃত্ত পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অনুন্নত দেশের বাজার দখলের চেষ্টা চালাতে সশস্ত্র হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং উপনিবেশের প্রসার ঘটায়।
শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলির কলকারখানায় অল্প সময়ে প্রচুর পরিমাণ শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন শুরু হলে সেসব কারখানায় নিয়মিত প্রচুর পরিমাণ কাঁচামালের প্রয়োজন হয়। কারখানাগুলিতে এই বিপুল পরিমাণ কাঁচামালের জোগান নিজ দেশ থেকে সম্ভব হত না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাইরে থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে ইউরোপের শিল্পকারখানাগুলিতে উৎপাদনের কাজ সফল করতে হয়। কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি সুকৌশলে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের রাজনেতিক ক্ষমতা দখল করে।
এছাড়া উপনিবেশের আরও একটি কারণ হল সুলভে শ্রমিক সংগ্রহ। শিল্পোৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং ইউরোপের কলকারখানাগুলিতে কায়িক শ্রমদানের জন্য সস্তায় প্রচুর সংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। ইউরোপের বাইরে বিভিন্ন অনগ্রসর দেশে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় না-করলে জোর করে করানো হত। প্রকৃষ্ট উদাহরণ ভারতে নীলচাষ। ভারত উপমহাদেশের মাটি নীলচাষের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় ব্রিটিশ নীলকররা এই চাষে প্রচুর বিনিয়োগ করে। উনিশ শতকের শেষের দিকে নীলচাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না-হওয়ায় চাষিরা ধান ও পাট চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ব্রিটিশ নীলকরেরা অকথ্য অত্যাচার ও নিপীড়নের মাধ্যমে নীলচাষে বাধ্য করত। এই নীলচাষ ভারতের কল্যাণে জন্য হত না। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের অভূতপূর্ব। উন্নতি সাধিত হয় এবং সেই কাপড় রং করার জন্য নীলের চাহিদা শতগুণ বেড়ে গিয়েছিল। সেই চাহিদা মেটাতেই চাষিদের উপর ভয়ানক নির্যাতন করত। বাংলাদেশের ২০ লক্ষ ৪০ হাজার বিঘা জমিতে ১২ লক্ষ ৮০ হাজার মণ নীল উৎপন্ন হত। বাংলায় ১১৬টি কোম্পানি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ৬২৮টি সদর কুঠির অধীনে সর্বমোট ৭৪৫২টি নীলকুঠি ছিল (ব্যক্তিগত ও দেশীয় জমিদার-মহাজনদের কুঠি বাদে)। নীলচাষে কর্মরত ছিল ১ কোটি ১২ লক্ষ ৩৬ হাজার কৃষক এবং নীলকুঠিগুলোতে নিযুক্ত কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৪৮২ জন। ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূলধনের শতকরা ৭৩ ভাগ নীলের কারবারে লগ্নিকৃত ছিল। সে সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোনো পণ্য নীলের মতো এত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেনি। নীলের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যবঙ্গের উৎকৃষ্ট নীলের ব্যাবসা করে রাতারাতি ধনী হওয়ার কাহিনি সকল ধনিক ও বণিক সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করে এবং ক্রমশ ফরাসি, ডাচ, পোর্তুগিজ, দিনেমার প্রভৃতি দেশের ধনিক গোষ্ঠীও দলে দলে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়।
নীল চাষের প্রসার দেখে বাংলার শীর্ষস্থানীয় মুৎসুদ্দি, নব প্রতিষ্ঠিত জমিদার গোষ্ঠী ও উদীয়মান শহুরে শ্রেণি নীলকরদের সুযোগ-সুবিধা ও নীলচাষের প্রসারের জন্য দাবি জানাতে থাকে। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ সরকারের সুনজরে থাকা। এঁদের মধ্যে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায় অন্যতম। তাঁরা ১৮২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার টাউন হলে এক সভা করেন এবং নীল চাষ প্রসারের দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে সুপারিশ পাঠান। পার্লামেন্ট তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দাস মালিক ও দাস পরিচালনাকারীদের বাংলায় এনে নীলচাষের তদারকিতে নিয়োজিত করে। এছাড়া ব্যাপক নীল চাষের কারণে বিহার ও ওড়িশা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা আগ্রা ও অযোধ্যাও দখল করে। এ ঘটনায় আরও স্পষ্ট হয় ব্রিটিশপুজোয় ভারতীয় এলিট শ্রেণিদের কতটা ভূমিকা ছিল। এমনি এমনি তাঁরা উপাধি পেত না। কারণ সাদা চামড়া দেখে এলিট তথা বণিক শ্রেণিরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সাদা চামড়াওয়ালাদের তাঁরা ‘উদ্ধারকর্তা ঈশ্বর’ ভেবে নিয়েছিল। সাদা চামড়ার ব্রিটিশরাও মনে করত এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত মানুষদের প্রতি কিছু দায়বদ্ধতা আছে। তথাকথিত এই দায়বদ্ধতা সাদা চামড়ার দায়বদ্ধতা’(white man’s burden) নামে পরিচিত। প্রখ্যাত সাদা চামড়ার ফরাসি লেখক জুলি ফেরি বলেন যে, অনুন্নত জাতিগুলিকে সভ্য করে তোলা উন্নত জাতিগুলির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আজও এক শ্রেণির ভারতীয় মনে করে ব্রিটিশরা ভারতে না-এলে আমরা সভ্য হতাম না। আজও তাঁরা মনে করে ব্রিটিশ শাসনই ভালো ছিল। তাঁরা চায় ব্রিটিশরা আবার ভারত শাসন করুক। ব্রিটিশপ্রেম আজও ভারতীয়দের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁরা ভুলে গেছে ব্রিটিশরা ভারতে মাটিতে যা যা করেছে তার সবকটি ইংল্যান্ডের স্বার্থে, ভারতের স্বার্থে নয়। ভারতকে চুষে ইংল্যান্ডকে সমৃদ্ধ করেছিল। অনিচ্ছায় আমাদের সামান্য কিছু হলেও ইউরোপীয় দেশগুলি। শতগুণে সমৃদ্ধ হয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার রক্ত চুষে।
ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে ব্রিটিশরাজ দ্বারা সরাসরি ভারত প্রশাসন এবং শিল্পবিপ্লবজনিত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে ভারত এবং গ্রেট ব্রিটেনের অর্থনীতি একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে পড়ে। বাস্তবিকভাবে ভারতে পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার মুখ্য পরিবর্তনগুলি সিপাহি বিদ্রোহের আগেই শুরু হয়েছিল, যা ব্রিটিশরাজের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সাধারণভাবে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। লর্ড ডালহৌসি প্রযুক্তিগত পরিবর্তন গ্রহণ করেছিলেন, যা তখন গ্রেট ব্রিটেনে খুবই দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হচ্ছিল। এর ফলে ভারতেও খুব তাড়াতাড়ি বিভিন্ন প্রযুক্তির উন্নয়ন শুরু হয়। রেলপথ, সড়ক, খাল এবং সেতুগুলি খুব দ্রুতগতিতে নির্মিত হতে থাকে এবং টেলিগ্রাফ যোগাযোগও খুব তাড়াতাড়ি গড়ে ওঠে। এগুলির মাধ্যমে কাঁচামাল, যেমন তুলো ভারতের ভিতরের বিভিন্ন দূরবর্তী জায়গা থেকে আরও দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন বন্দর যেমন বোম্বেতে পরিবহন করে নিয়ে আসা সম্ভব হয় ইংল্যান্ডে রপ্তানির জন্য। একই দক্ষতার সঙ্গে ইংল্যান্ডে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী পরিবহন করে ভারতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় সেখানকার বর্ধনশীল বাজারে বিক্রির জন্য। যদিও ইংল্যান্ডে পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য বাজারের ঝুঁকি ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীরাই বহন করতেন। কিন্তু ভারতে তা বহন করতেন করদাতারাই, যাঁরা ছিলেন মূলত কৃষক এবং কৃষি শ্রমিকেরা। যা শেষে দাঁড়ায় ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড। এই সমস্ত খরচের পরেও খুব কম দক্ষ শ্রমিক ভারতে তৈরি হয়। ১৯২০ সাল নাগাদ ভারতীয় রেল নির্মাণের পরের ৬০ বছরের ইতিহাসে রেলওয়ের কেবল দশ শতাংশ উচ্চপদ ভারতীয়দের দখলে ছিল। আসুন, এবার একটু দেখে নিই ব্রিটিশরা ভারতের কতটা উপকার করেছিল অর্থনীতির দিক থেকে। আর মোগল আমলের অর্থনীতি কেমন ছিল তার তুলনামূলক আলোচনা করা যাক।
একথা ঠিকই প্রযুক্তিগত দ্রুততা ভারতে কৃষি অর্থনীতিকেও পরিবর্তন আসে। ঊনবিংশ শতকের শেষ দশক নাগাদ কিছু কাঁচামালের বড়ো অংশ যার মধ্যে তুলো ছাড়াও কিছু খাদ্যশস্য ছিল, দূরবর্তী বাজারগুলিতে রপ্তানি হতে থাকে। ফলস্বরূপ, অনেক ক্ষুদ্র কৃষক যাঁরা এর উপর নির্ভরশীল ছিল তাঁরা বাজারগুলির অস্থিরতার কারণে জমি, গবাদি পশু, কৃষি উপকরণ ইত্যাদি ঋণদাতা মহাজনদের কাছে হারাতে থাকে। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে বড়ো আকারের দুর্ভিক্ষের বৃদ্ধি দেখা যেতে থাকে। যদিও ভারতীয় উপমহাদেশে দুর্ভিক্ষ নতুন কিছু ছিল না। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষগুলির প্রভাব খুবই গুরুতর ছিল, যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যেতে থাকে। ব্রিটিশ এবং ভারতীয় অনেক সমালোচকরা এই দুর্ভিক্ষের দায়ভার চাপান উপনিবেশ শাসকদের উপর।
১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সাল। দীর্ঘ সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে ভারতবর্ষে অরাজকতা চালিয়েছিল ব্রিটেন। যদিও গ্রেট ব্রিটেনের পক্ষ থেকে বরাবরই ভারতীয় উপমহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন তাঁদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি হত বলে দাবি করে। অবশ্য সেই দাবি তোলা হয় ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর। তাঁরা দাবি করে, ভারতবর্ষ থেকে তাঁদের কোনো আর্থিক সুবিধা হত না। উলটে ভারত উপমহাদেশ তাঁদের খরচের একটি খাত হিসেবেই ছিল। ব্রিটেনের এমন বক্তব্য থেকে মনে হয় যেন ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশের মানুষের প্রতি টানা ১৯০ বছর অনুগ্রহ করেছিল। কিন্তু কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে অর্থনীতিবিদ ঊষা পট্টনায়েকের প্রকাশিত গবেষণা ওই মিথের হাঁড়ি ভেঙে যায়। গবেষণায় কর এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত দুই শতাধিক নথি থেকে জানা যায়, ব্রিটিশরা ভারত রাজত্বের ১৯০ বছরে প্রায় ৪৫ লাখ কোটি ডলার চুরি করে নিয়েছিল। যা বর্তমানে ব্রিটেনের মোট জিডিপির ১৭ গুণ। প্রকাশিত এসব নথি থেকে জানা যায়, বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই ব্রিটিশরা এমন লুটতরাজ চালাতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রথমদিকে তাঁরা ভারতের উৎপাদকদের কাছ থেকে রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে পণ্য কিনত। কিন্তু ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরো উপমহাদেশ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর পাল্টে যায় সব। তাঁরা ভারতবাসীর কাছ থেকে কর নিত, আবার সেই করের টাকা দিয়ে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের কাছ থেকে পণ্য কিনত। ফলে তাঁরা আসলে ভারতবাসীদের কাছ থেকে ফ্রিতেই পণ্য নিত। এটি বড় আকারের চুরি হলেও যেহেতু কর আদায়কারী এবং পণ্যক্রয়কারী গ্রুপ ভিন্ন ভিন্ন ছিল, তাই কেউ বিষয়টি ধরতে পারেনি। চুরি করা এসব পণ্য ব্রিটেনে ব্যবহৃত হত। তবে বেশিরভাগ পণ্যই পুনঃরপ্তানি করা হত অন্যত্র। ১৮৪৭ সালে ব্রিটেনের রাজা ভারতবর্ষের দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁরা কর ও বাণিজ্যের নতুন একটি পদ্ধতি চালু করে। তাতে বলা হল, ভারত থেকে আমদানি করতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শেষপর্যন্ত লন্ডনেই লেনদেন শেষ করতে হবে। কারণ আমদানিকারক দেশ বা প্রতিষ্ঠানকে দায় শোধ করতে হত বিলের মাধ্যমে, যা কেবল ব্রিটিশরাজাই ইস্যু করতেন। লন্ডন থেকে সোনা বা রুপোর বিনিময়ে তা কিনতে হত। আমদানিকারকরা ভারতে সেই কাউন্সিল বিল দিয়েই পণ্য কিনত। ভারতীয়রা যখন সেই বিল নগদ করতে চাইত তখন তাঁদের নগদ করে দেওয়া হত করের রুপি দিয়েই, যা তাঁদের কাছ থেকেই কর আকারে নেওয়া হয়েছিল। ফলে তাঁদের কোনো অর্থ দেওয়া হত না। ব্রিটেনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, ভারত ব্রিটেনের কাছে দায়বদ্ধ ছিল। কিন্তু ঘটনা ছিল তার উলটো। ভারতবর্ষ থেকে এভাবে অর্থ লন্ডনে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণেই ভারতীয়রা ব্রিটেন থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এ অপ্রয়োজনীয় ঋণ দিতে পেরে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী হয়। ভারতবর্ষ থেকে নেওয়া এসব অর্থ তারা বিভিন্ন আক্রমণ, অভিযান, শত্রুপক্ষকে ঠেকানোর কাজেও ব্যবহার করত।
ব্রিটিশরা অবশ্যই এই উপমহাদেশ শাসন করেছে। কিন্তু এই কথার পিছনে লুকিয়ে আছে অন্য ভয়ংকর ইতিহাস। অনেকের মতে, ব্রিটিশ সরকার নয় বরং একটি বিপজ্জনক ও নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান আঠেরো শতকের শেষদিকে ভারতকে শাসন করা শুরু করে। এই কোম্পানির সদর দফতর ছিল লন্ডনে এবং ভারতে এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন গভর্নর লর্ড ক্লাইভ। ১০০ বছরের শাসনকালের ইতিহাসে সদর দফতরে মাত্র ৩৫ জন স্থায়ী কর্মচারী নিয়ে এত বড়ো একটি কোম্পানি পরিচালনা করার দরুন এই কোম্পানি কর্পোরেট দক্ষতার রোল মডেল হিসাবে বিবেচিত হয়। মাত্র ৩৫ জন কর্মচারী যেভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে নিজস্ব মিলিটারি বাহিনী তৈরি করা থেকে শুরু করে সেখানকার বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুটতরাজ ও আয়ত্ত করে সেটা কর্পোরেট দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। কর্পোরেট জুলুমের সবচেয়ে বড়ড়া দৃষ্টান্ত হিসেবেই বিবেচিত হয় এটি।
বঙ্গদেশ থেকে লুট হওয়া সম্পদের অনেক বড়ড়া একটা অংশ গিয়েছিল লর্ড ক্লাইভের পকেটে। ক্লাইভ যখন ব্রিটেন ফেরত যান তখন তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল তৎকালীন বাজারমূল্যে প্রায় ২৩৪,০০০ ইউরো সমমানের। এর মাধ্যমে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। পলাশির যুদ্ধে ব্রিটিশরা জয়ী হয়েছিল মিলিটারি পরাক্রম দিয়ে নয়, বরং বিশ্বাসঘাতকতা, জাল চুক্তি এবং ঘুষখোর ব্যাংকারদের (শেঠ) সাহায্যে। এই যুদ্ধে জয়লাভের পর নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার রাজকোশাগার থেকে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন ইউরো ব্রিটেনে পাচার করা হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোশাগারে। বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ইউরো যায় কোম্পানির কোশাগারে এবং ২৩ মিলিয়ন ক্লাইভের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে। প্রায় সব ধনসম্পদ ১০০টি নৌকায় ভরে কোম্পানির কলকাতার প্রধান কার্যালয় ফোর্ট উইলিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়।
সমসাময়িক ঐতিহাসিক রজতকান্ত রায় বলেন, অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতি ছিল মোগল আমলের গতানুগতিক অর্থনীতির উপর লুঠতরাজ ও বিপর্যয়। এই সময়ে খাদ্য ও অর্থের মজুতকে নিঃশেষিত করা হয় এবং উচ্চ কর চাপানো হয়। এর ফলে ১৭৭০ সালে দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়, যার কারণে বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হয়। অপরপক্ষে ঐতিহাসিক নিয়াল ফারগুসন বলেন, ব্রিটিশ শাসনামলে গ্রামীণ অর্থনীতির কর-পরবর্তী মোট আয় ২৭ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৪ শতাংশে পরিণত হয় (এই গ্রামীণ অর্থনীতির সেক্টরটি ভারতবর্ষের সমগ্র জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশের প্রতিনিধিত্ব করে)। এছাড়া ফারগুসন বলেন, ভারতবর্ষের পরিকাঠামোভিত্তিক, কৃষিভিতিক ও শিল্পভিতিক উন্নয়নের জন্য ব্রিটিশরা ১৮৮০-এর দশক পর্যন্ত ২৭০ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করে, যা ইংরেজদের দেশের বাইরে মোট বিনিয়োগের এক পঞ্চমাংশ ছিল। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত এই বিনিয়োগের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারে। তিনি এও বলেন, ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের সেচ জমির পরিমাণ আটগুণ বৃদ্ধি করে, মোগলদের সময়ে এই জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ৫ শতাংশ।
পি. জে. মার্শাল বলেন, ব্রিটিশ শাসনে গতানুগতিক অর্থনীতি থেকে হঠাৎ করে কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল আঞ্চলিক শাসকদের হাতে। উন্নয়নের সাধারণ শর্তগুলো অনুসারেই অষ্টাদশ শতকের শেষ দিক পর্যন্ত অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিল। ব্যতিক্রম হিসাবে কেবল দুর্ভিক্ষের হার বেড়ে যায়, যার কারণ ছিল উচ্চ জন্মহার। মার্শাল উল্লেখ করেন, ব্রিটিশরা স্থানীয় কর প্রশাসকদের দ্বারা রাজস্ব আদায় করত এবং তাঁরা করের ক্ষেত্রে মোগলদের স্থির করা হারই বহাল রেখেছিল। মার্শাল এও বলেন, ব্রিটিশরা প্রাথমিকভাবে ভারতীয় সম্ভ্রান্তদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক আচরণের ভিত্তিতে স্থানীয়-নিয়ন্ত্রণের দ্বারা অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা করেছিল।
ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের বস্ত্রশিল্পের ও বস্ত্রের রপ্তানির পতনের লম্বা ইতিহাসের সূচনা পরিলক্ষিত হয়। ঊনবিংশ শতকের খুব পরিচিত একটি কিংবদন্তি হচ্ছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় শত শত তাঁতির হাত কেটে দেয়, তাতে ভারতবর্ষের দেশীয় তাঁতশিল্প ধ্বংস করে, ব্রিটিশ বস্ত্র আমদানি করা হয় (কেউ বলেন ঢাকার তাঁতিদের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দেওয়া হয়েছিল)। যাই হোক, এই কাহিনির উদ্ভব ঘটে উইলিয়াম বোল্টের ১৭৭২ সালের ইতিহাস থেকে, যখন তিনি অভিযোগ করে বলেন, অনেক রেশম তাঁতি তাঁদের বাজে কর্ম পরিস্থিতির প্রতিবাদে নিজেদের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে ফেলেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক বলেন, ভারতবর্ষে শিল্পায়নের অভাবের কারণ হচ্ছে, ভারতবর্ষ তখনও মূলত কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল, যে-কানো কৃষকদের মজুরি অনেক কম ছিল। এদিকে ব্রিটেনে মজুরি উচ্চ ছিল, তাই তুলো থেকে সুতো উৎপাদকরা শ্রম বাঁচানোর জন্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ক্রয়ের ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে সমর্থ হন। আর এই মজুরির মাত্রা ভারতে কম হওয়ায় উৎপাদকরা প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ না-করে আরও বেশি শ্রমিক নিয়োগ করে পণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে চান। আবার অনেক ঐতিহাসিকই এই যুক্তির সমালোচনা করেছেন। যেমন, প্রসন্ন পার্থসারথি উপার্জন উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রকৃতি মজুরির হিসাব দেখিয়ে বলেন, বাংলা ও মহিশূরে মজুরির পরিমাণ ব্রিটেনের চেয়ে বেশি ছিল। বাংলা ও মহিশূরের বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকেরা যে পরিমাণ মজুরি পেতে, একই পরিমাণ মজুরির জন্য ব্রিটেনের শ্রমিকদের বেশি সময় ধরে কাজ করতে হত। অর্থনৈতিক ঐতিহাসিক ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন, ইরফান হাবিব, পারসিভাল স্পিয়ার এবং অশোক দেশাইয়ের দেওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণ অনুসারে সপ্তদশ শতকের মোগল ভারতের মাথাপিছু কৃষি উৎপাদন এবং ভোগের মান ছিল সপ্তদশ শতকের ইউরোপ এবং বিংশ শতকের প্রথম দিকের ব্রিটিশ ভারতের তুলনায় বেশি।
বাণিজ্যে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ এবং সস্তা ম্যানচেস্টারের সূতীবস্ত্রের রপ্তানিকেও ভারতবর্ষের অবশিল্পায়নের উল্লেখযোগ্য নিয়ামক হিসাবে উল্লেখ করা হয়, যদিও উনিশ শতক পর্যন্ত ব্রিটিশ বস্ত্রের তুলনায় ভারতীয় বস্ত্রের মূল্য কম ছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা বলেন, ভারতবর্ষে উপনিবেশ স্থাপনই ছিল ভারতবর্ষের অবশিল্পায়ন এবং ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লবের প্রধান কারণ। ব্রিটিশ উপনিবেশীকরণের কারণে ভারতে ব্রিটিশ পণ্যের বিশাল বাজার উন্মুক্ত হয়ে যায়, যেখানে যে-কোনো ব্রিটিশ পণ্য কোনোরকম শুল্ক ও মাশুল ছাড়াই বিক্রয় করা যায়। অন্যদিকে স্থানীয় ভারতীয় উৎপাদকদের উপর উচ্চহারের করের বোঝা ছিল। ব্রিটেনের সংরক্ষণবাদী নীতিমালাও এর একটি কারণ ছিল। যেমন, ভারতীয় বস্ত্র সেখানে যাতে বিক্রি না-হতে পারে সেজন্য নিষেধাজ্ঞা ও উচ্চহারে শুল্ক চাপানো হয়। এদিকে বস্ত্রশিল্পের কাঁচামাল (তুলো) কোনোরকম শুল্ক ছাড়াই ভারত থেকে আমদানি করে ম্যানচেস্টারের ব্রিটিশ বস্ত্ৰকলে দেওয়া হত। ব্রিটিশ অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে তাঁরা ভারতের বিশাল বাজার ও কাঁচামাল তুলোর উপর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশ উৎপাদকদের জন্য ভারত একই সঙ্গে কাঁচামাল তুলোর একটি উল্লেখযোগ্য সরবরাহকারী এবং ব্রিটিশ উৎপাদিত পণ্যের বিশাল বন্দিবাজারে পরিণত হয়।
ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এঙ্গাস মেডিসন অনুসারে, ১৭০০ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ভারতের ভাগ ছিল ২৪.৪ শতাংশ। ১৭৫০ সালে সেটা গিয়ে পৌঁছায় ৪.২ শতাংশে। ভারতের মাথাপিছু আয় (পিপিপি) মোগল সাম্রাজ্যে স্থির ছিল। এবং ব্রিটিশ শাসনকাল শুরু হওয়ার আগে হ্রাস পেতে শুরু করে। বৈশ্বিক শিল্প পণ্যের মধ্যে ভারতের ভাগ ১৭৫০ সালে ২৫ শতাংশ ছিল। সেটা ১৭৯০ সালে গিয়ে ঠেকে ২ শতাংশে। এদিকে ১৭০০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাজ্যের ভাগ ছিল ২.৯ শতাংশ, ১৮৭০ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৯ শতাংশে। ব্রিটেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ বস্ত্র উৎপাদনকারী হিসাবে ঊনবিংশ শতকে ব্রিটেন ভারতকে প্রতিস্থাপন করে। মোগল ভারতে ষোড়শ শতকের শেষের দিকে যে মাথাপিছু আয় ছিল তা বিংশ শতকের ব্রিটিশ ভারতের মাথাপিচু আয়ের চেয়ে বেশি ছিল। মোগল অর্থনীতিতে সেকেন্ডারি সেক্টরের শতকরা হার ছিল ১৮.২ শতাংশ, সেটা বিংশ। শতকের ব্রিটিশ ভারতে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১১.২ শতাংশে। নগরায়নের ক্ষেত্রেও মোগল ভারতই এগিয়েছিল। ১৬০০ সালে ভারতের নগর কেন্দ্রগুলোতে ভারতের সর্বমোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষ বসবাস করত, এই শতকরা হার ১৯ শতকের ব্রিটিশ ভারতে নগরে বসবাসকারী জনসংখ্যার শতকরা হারের তুলনায় বেশি ছিল।
আধুনিক অর্থনৈতিক ঐতিহাসিকদের অনেকেই ভারতের অর্থনীতির বেদনাদায়ক অবস্থার জন্য উপনিবেশী শাসনকে দায়ী করেন। ভারত উপনিবেশে পরিণত হওয়ায় ভারতীয় শিল্পে বিনিয়োগ সীমিত হয়ে যায়। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে অবশিল্পায়ন হয়, তাতে ভারতবর্ষের আঞ্চলিক উৎপাদনমূলক শিল্পগুলি প্রচণ্ড হ্রাস পায়। ব্রিটিশরাজের অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে হস্তশিল্প ও তাঁত খাত প্রচণ্ড হ্রাস পেতে থাকে। সেইসঙ্গে চাহিদা এবং চাকরিও কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে তাঁত থেকে তৈরি হওয়া সুতোর পরিমাণ ছিল ১৮৫০ সালে ৪১৯ মিলিয়ন পাউন্ড, সেটা ১৯০০ সালে কমে গিয়ে দাঁড়াল ২৪০ মিলিয়ন পাউন্ডে।
১৮৫৮ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ভারতে ব্রিটিশ শাসন মোটামুটি দৃঢ়ভাবেই বলবৎ ছিল। সেযুগে মনে হত, ভারতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশদের শাসন কয়েক শতাব্দীকালব্যাপী স্থায়ী হতে চলেছে। কিন্তু চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই ধীরে ধীরে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটতে থাকল। ব্রিটিশশাসকদের অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতের একাংশ রুখে দাঁড়ালো। এই বিদ্রোহ উঠে এসেছিল মূলত কৃষক, শ্রমিক, জনজাতিদের মধ্য থেকেই।
জাতীয়তাবাদ বলতে যে আবেগ বা ধারণা বোঝায় এদেশে ব্রিটিশদের আগমনের আগে সেই আবেগ বা অনুভূতি তেমনভাবে প্রকট হয়নি। তখন ভারতবর্ষ অসংখ্য খণ্ড রাজ্যের সমষ্টি ছিল। ব্রিটিশরা এদেশে এসে সেই খণ্ড খণ্ড রাজ্যগুলিকে একই পতাকার তলায় নিয়ে এসে পরোক্ষভাবে এই দেশকে রাজনৈতিক দিক দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ রূপ পরিগ্রহ করেছিল। এছাড়া এর মূলে ছিল ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রেক্ষিত। ইউরোপে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ধারণার উন্মেষ ঘটেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলি যেমন ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম, ইটালি ও জার্মানির ঐক্য আন্দোলন প্রভৃতির মাধ্যমে এই জাতীয়তাবাদ সুষ্ঠু রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের বাণী— স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি টমাস জেফারসনের মানবাধিকারের ঘোষণা ভারতীয়দের আবেগকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। উনিশ শতকে ভারতীয় দেশীয় রাজ্যগুলি একই শাসনাধীনে আসার পর এদেশে ব্রিটিশ শাসনের বজ্রমুষ্টি যতই দৃঢ় হতে থাকে, ততই তার কুটিল রূপ ভারতীয়দের চোখ খুলে দেয়। ভারতীয়রা ধীরে ধীরে দেশবাসী হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব ও গুরুত্ব অনুভব করে। উনিশ শতক থেকে ভারতে এই জাতীয়তাবাদী ধারণার উন্মেষ ঘটেছিল। এভাবেই বলা যায় উনিশ শতকের এই জাতীয়তাবাদী চেতনার মূলে ছিল ইউরোপীয় চেতনার প্রেক্ষিত।
এদেশে ইংরেজ শাসন প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন হয়। রাজা রামমোহন রায়, হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও, ডেভিড হেয়ার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন প্রমুখ ভারতীয় ও ব্রিটিশ মনীষীগণ এদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। আর এই ইংরেজি শিক্ষার সুবাদে ভারতীয়রা পাশ্চাত্য জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়। এর সঙ্গে ভারতীয়রা ইউরোপের জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার সঙ্গে পরিচিত হন এবং নিজেরাও জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত হন। ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের সঙ্গে ভারতীয়রা ইউরোপের চিন্তানায়কদের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে। ইংরেজি শিক্ষার সূত্রে ভারতীয়রা মিল, বেন্থাম, স্টুয়ার্ট, ভলটেয়ার, রুশো, ম্যাৎসিনি, গ্যারিবল্ডি, কার্লমার্কস প্রভৃতি পাশ্চাত্য দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের প্রগতিশীল চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসেন। ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম, ইটালি ও জার্মানির ঐক্য আন্দোলন প্রভৃতি ভারতীয়দের নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। ক্রমশ ভারতীয়দের একাংশ উপলব্ধি করেন যে তাঁরাও একটি জাতি ও জাতি হিসাবে তাঁদেরও স্বাধীন সত্তা আছে এবং সেই স্বাধীনতাকে কেউ হরণ করতে পারে না। আর যদি তা কেউ করে থেকে মুক্তি পাওয়ার অধিকার সব জাতিরই আছে। উনবিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষার শিক্ষিত প্রথম ভারতীয় রাজা রামমোহন রায় ভারতীয়দের মধ্যে এই নব জাগরণের উন্মেষ ঘটান। জাতীয়তাবাদী ধারণার প্রথম উন্মেষ ঘটে বাংলায়, বাংলা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপলব্ধিতে। পরে তা সারা ভারতে পরিব্যাপ্ত হয়। তারপর একটা সময়ে এসে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ভেঙে দু-টুকরো হয়ে যায় –হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদ।
ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। তবে ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ব্রিটিশরা ‘সন্ত্রাসবাদী’ (Terrorist) হিসাবেই ট্রিটমেন্ট করত। রেকর্ডে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পরিচয়ে “Terrorist পরিচয়টিই খোদাই করা আছে। ব্রিটিশদের ভারতীয় দালালদের মধ্যেও এরূপ চেতনা কাজ করত। যেমন এখন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-প্রতিবাদ করলেই ‘আরবান নকশাল’, ‘মাওবাদী’, ‘জঙ্গি’, ‘সন্ত্রাসবাদী’, ‘খালিস্তানি’, ‘দেশদ্রোহী’ ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে। ১৯৩২ সালে স্যার চার্লস টেগার্ট সিএসআই, সি আইই, এমভিও ও লন্ডনের রয়্যাল এম্পায়ার সোসাইটির আমন্ত্রণে ‘Terrorism in India’ শিরোনামে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই বক্তৃতার বাংলা অনুবাদ গ্রন্থাকারে পাওয়া যায়। স্যার টেগার্ট ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসে ১৯০১ সালে যোগ দেন এবং প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে ৩০ বছর এই বাহিনীতে ছিলেন। শেষ আট বছর তিনি কলকাতার পুলিশ কমিশনার ছিলেন। এরপর তিনি ‘Secretary of State’s Indian Council-এর সদস্য ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলেন তাঁদের সন্ত্রাসবাদী’ হিসাবেই নাম নথিভুক্ত করা হত। সশস্ত্র সংগ্রামীদের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ-ভারতের গোয়েন্দা রিপোর্টে কী বলা হয়েছে একবার দেখে নেয়া যাক– “Terrorism as distinct from other revolutionary methods, such as Communism or the Ghadr Movement, may be said to denote the commission of outrages of a comparatively individual in nature. That is to say the terrorist holds the belief that Indian independence can best be brought about by a series of revolutionary outrages calculated to instil fear into the British official classes and to drive them out of Indian. He commits other outrages for the purpose of arms, for the making of Bombs and for the maintenance of his party, hoping that the masses will be drawn to his support either by fear or admiration.”
ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে স্বদেশি আন্দোলন একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাব রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাবনার জগতে প্রসারিত হয়েছিল। ভ্যালেন্টাইন কাইরল ও ভার্নে লোভেট ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় দেখিয়েছেন ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আগে ভারতে জাতির পরিবর্তে ছিল পরস্পর বিবদমান খণ্ডিত অসংখ্য প্রদেশ বা সাম্রাজ্য শক্তি। ভারত উপমহাদেশের সমস্ত খণ্ডিত অংশকে একসূত্রে বেঁধে ব্রিটিশরা উপমহাদেশে একক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। হরিদাস মুখোপাধ্যায় ও উমা মুখোপাধ্যায় জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চায় প্রেক্ষিতে ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলিতে উপেক্ষা করে জাতীয় স্বার্থ সমন্বিত সমপ্রকৃতির জাতির অস্তিত্বের ধারণা উপস্থাপিত করেন। ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতে জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় বলে দাবি করেন। অপরদিকে অনিল শীল, রজত রায় প্রমুখ কেমব্রিজ ঘরানার ঐতিহাসিকরা ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলেন এবং দেখান যে, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজের উঁচুতলার মানুষের ব্রিটিশ বিরোধিতার উৎস ছিল নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ, দেশপ্রেম নয়। প্রায় একই সুরে ঐতিহাসিক রজনী পাম দত্ত বলেছেন, বুর্জোয়া নেতৃত্ব জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিচালনা করত। আশির দশকে রণজিত গুহ বলেন, জাতীয়তাবাদের ইতিহাস চর্চায় দীর্ঘদিন ধরে উচ্চবর্গ প্রাধান্য পেয়েছে এবং নিন্মবর্গের অবদানকে তুচ্ছ করা হয়েছে। এই ‘সাবল্টার্ন’ ঘরানাই দাবি করে, নিন্মবর্গের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামই হল প্রকৃত জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদে হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মুসলিম জাতীয়তাবাদ ছিল না। হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মুসলিম জাতীয়তাবাদ উচ্চকোটিরই মস্তিষ্কপ্রসূত। যদি ভারতীয় জাতীয়তাবাদ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংগ্রামরত হত, তাহলে কখনোই দেশভাগের মধ্য দিয়ে ভারতকে ব্রিটিশমুক্ত করতে হত না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা গোটা বিশ্বে যেভাবে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে পযুদস্ত হয়েছিল, সে সময় আপোস না-করে সংগ্রামের মাত্রা আর-একটু বাড়ালে ব্রিটিশরা পালানোর পথ খুঁজে পেত না। তার বদলে ভারতীয়রা হিন্দু-মুসলিম দুইভাগে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে আচকাআচকি করতে শুরু দিলাম। ব্রিটিশ তাড়াতে গিয়ে দেশ থেকে মুসলিম তাড়ানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বিয়াল্লিশের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের পরে আর কোনো বিপ্লবীর সক্রিয়তা তেমনভাবে লক্ষ করা যায় না। ভারতের ভবিষ্যতের দায়িত্ব দাঙ্গাবাজদের হাতে চলে গেল।