২.১.৪ টিপু সুলতান (শাসনকাল : ১৭৮২ সাল থেকে ১৭৯৯ সাল)

টিপু সুলতান (শাসনকাল : ১৭৮২ সাল থেকে ১৭৯৯ সাল)

সম্প্রতি আরএসএসের (ওরফে বিজেপি) পক্ষ থেকে হঠাৎ টিপু সুলতানকে নিয়ে হঠাৎ পড়েছে দেখলাম। বর্তমানে কর্নাটকে বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পা বলেছেন, “টিপু জন্মজয়ন্তী আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্কুল পাঠ্যবইতে যা আছে টিপু সুলতানের সম্বন্ধে, সেগুলোও সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছি আমরা। সিদ্ধান্ত নেওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা।” কোডাগু জেলা থেকে নির্বাচিত বিধানসভা সদস্য বিজেপির। এ. রঞ্জন বলেছেন –“টিপু সুলতানকে যেভাবে গৌরবান্বিত করা হয় স্কুলের পাঠ্য বইগুলিতে, তা বন্ধ করা উচিত। টিপু সুলতান হিন্দুদের উপরে সাংঘাতিক অত্যাচার করতেন।” টিপু সুলতানের উপরে বহুদিন ধরে গবেষণা করেছেন মহিশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সেবাস্টিয়ান জোসেফ। তিনি বলেন, “টিপু সুলতানকে ভারতীয় ইতিহাসের একজন ‘খলনায়ক’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। টিপু সুলতানকে নিয়ে যা বলা হচ্ছে, সেগুলো রাজনৈতিক কথাবার্তা। টিপু সুলতানকে একজন খলনায়ক করে তোলার এই প্রচেষ্টাটা কয়েক বছর ধরেই শুরু হয়েছে।” মি. যোসেফ বর্তমানে ‘নলওয়াঢ়ি কৃষ্ণারাজা ওয়াদিয়ার চেয়ার’-এর ভিসিটিং প্রফেসর।

এই প্রথম নয়, এর আগেও কর্নাটকে সরকারিভাবে যে টিপু জয়ন্তী পালিত হত, তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিজেপির আমলে। বিজেপি এবং হিন্দু পুনরুত্থানবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস মনে করে টিপু সুলতান কুর্গ, মালাবার সহ নানা এলাকায় কয়েক লক্ষ হিন্দুকে মেরে ফেলেছিলেন এবং বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছিলেন।

আরএসএসের মতাদর্শে বিশ্বাস করে, এমন একটি সংগঠন, ইতিহাস সংকলন সমিতির পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং ইতিহাসের অধ্যাপক রবিরঞ্জন সেন বলছিলেন, “বাস্তবে যা করেছেন টিপু সুলতান– সবটাই থাকা উচিত। তিনি যেমন ধর্মীয় নিপীড়ন চালিয়েছেন, তেমনই বলপূর্বক ধর্মান্তকরণও করিয়েছেন। এগুলো ঐতিহাসিক সত্য। আমাদের মতে তাঁর যদি কিছু অবদান থেকে থাকে সেগুলোর সঙ্গেই নেতিবাচক দিকগুলোও থাকা দরকার।”

টিপু সুলতান যে হিন্দুদের উপরে নিপীড়ন চালিয়েছিলেন বা লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে মেরে ফেলেছিলেন বলে আরএসএস যা দাবি করে, তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন অধ্যাপক জোসেফ। তিনি বলেছেন– “টিপু সুলতানকে নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, তাতে এরকম তথ্য বিশেষ পাওয়া যায় না যে, তিনি নির্দিষ্টভাবে হিন্দুদের উপরেই অত্যাচার করেছিলেন। কুর্গ বা মালাবার উপকূলে যুদ্ধ নিঃসন্দেহে হয়েছিল সেখানকার হিন্দু শাসকদের সঙ্গে এবং সেই যুদ্ধে অনেক হিন্দুর যে প্রাণ গিয়েছিল, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সেটাকে একটা ধর্মীয় অত্যাচার বলা ভুল। মহাভারতের কাহিনিতে তো যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, তাঁরাও হিন্দুই ছিলেন। আবার মারাঠারা যখন মহিশুর দখল করতে এসেছিলেন, তখন তাঁরাও অতি পবিত্র হিন্দুতীর্থ শৃঙ্গেরি মঠ ধ্বংস করে দিয়েছিল, এমনকী বিগ্রহটিও ধ্বংস করে দেয় তাঁরা। শৃঙ্গেরি মঠ পুনর্নির্মাণে অর্থ দিয়েছিলেন টিপু সুলতান। এগুলোকে তো ধর্মীয় নিপীড়ন বলা যায় না। টিপু সুলতান যখন ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতেন, রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে শাসন চালাতেন একজন হিন্দু, তাঁর নাম পুন্নাইয়া। আবার মালাবার দখল করার সময়েও টিপুর সেনাপতি ছিলেন শ্রীনিবাস রাও, তিনিও হিন্দু। টিপুর পরেই যাঁর হাতে সব ক্ষমতা, সেই পুন্নাইয়া, কুর্গে হিন্দুদের উপরে অত্যাচার করতে দিয়েছেন, এটা কি যুক্তিগ্রাহ্য অথবা হিন্দু হয়েও শ্রীনিবাস রাও মালাবারে হিন্দুদের ধর্মান্তকরণ করানোতে মদত দিয়েছিলেন, সেটা কি মেনে নেওয়া যায়?”

আরএসএসের মতো ‘হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আর বিজেপির মতো রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ইতিহাস জানতে হলে সমস্ত ঐতিহাসিকদের ছুটি নিতে হয়। সবচেয়ে বড়ো কথা আরএসএস ও বিজেপি তো আর ইতিহাসের অথরিটি নয়। আমার কাছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষক ও সত্যসন্ধানী ঐতিহাসিকদের মতামতই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।

টিপু সুলতান (পুরো নাম ফতেহ আলি সাহাব টিপু) ছিলেন ব্রিটিশ শাসিত ভারতের মহিশূর (বর্তমানে মাইসোর) রাজ্যের শাসনকর্তা। তিনি একজন বীর যোদ্ধা ছিলেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি বীরত্ব সহকারে যুদ্ধ করেন। ভারতের স্বাধীনতাকামিতার জন্য ভারতের বীরপুত্র বলা হয়। তিনি বিশ্বের প্রথম রকেট আর্টিলারি এবং বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করেছিল। তিনি তাঁর শাসনকালে বেশ কয়েকটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা উদ্ভাবন চালু। করেছিলেন। একটি নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা এবং ক্যালেন্ডার সহ পাশাপাশি একটি নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, যা মহিশুরের রেশম শিল্পের বিকাশের সূচনা করেছিল। সুলতানের ৪ জন স্ত্রী, ১৫ জন পুত্র এবং কমপক্ষে ৮ জন কন্যা সন্তান ছিল। কন্যাদের পরিচিতি অজানাই থেকে গেছে।

টিপু সুলতানের পিতা হায়দার আলি মহিশূর রাজ্যের সেনাপতি ছিলেন। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তাঁর মিত্র ছিল এবং ইঙ্গ-মহিশূর যুদ্ধে সাহায্য করেছিল। শ্রীরঙ্গপত্তনম গ্রামে কাবেরী নদীর একটি ব-দ্বীপে নির্মিত একটি দুর্গ থেকে রাজ্য শাসন করতেন (বর্তমানে শ্রীরঙ্গপত্তনম গ্রাম দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের মান্ডিয়া জেলার অন্তর্গত)। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে নিহত হন। টিপুর এক সেনাপতি মির সাদিক বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলান। পরে তাঁর পরিবারের লোকজনকে ভেলোরের দুর্গে বন্দি করে রাখে ব্রিটিশ শাসকরা।

টিপু সুলতানকে ডাকা হত শের-ই-মহিশূর (মহিশূরের বাঘ), উপাধিটা অবশ্য ব্রিটিশদেরই দেওয়া। তার এই বাঘ (শের) হয়ে ওঠার পিছনে অনেকগুলো বিষয় সম্পর্কিত ছিল। মূল কারণ ছিল তাঁর অসাধারণ ক্ষীপ্রতা, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা আর কৌশলপূর্ণ রাজ্য পরিচালনা। পিতা হায়দার ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে টিপু নামে এক ফকিরের আর্শীবাদে এক পুত্রসন্তান লাভ করেন এবং আনন্দচিত্তে ওই ফকিরের নামেই ছেলের নাম রাখেন টিপু। মহিশূরের স্থানীয় ভাষায় (কানাড়ি ভাষা) টিপু শব্দের অর্থ হল বাঘ। হয়তো তাঁকে ‘শের-ই-মহিশূর’ ডাকার পিছনে এটাও একটা কারণ ছিল। আশ্চর্যজনকভাবে ছোটোবেলা থেকেই টিপু সুলতান বাঘের গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। পিতা হায়দার আলিই তাঁকে বাঘের গল্প শোনাতেন। কিশোর বয়সে টিপু সুলতান বাঘ পুষতে শুরু করেন। বাঘ নিয়ে তাঁর অবশেসনের শেষ ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর তিনি যখন সিংহাসনে আরোহণ করলেন, তখন পিতার পুরোনো সিংহাসনটি তিনি ঠিক পছন্দ করলেন না। তাই তিনি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ কারিগর দিয়ে কাঠের ফ্রেমের উপর সোনার পাত বসিয়ে তাঁর উপর মণিমুক্তা ও রত্নখচিত একটি সিংহাসন বানিয়ে নিলেন, যাকে বরং ব্যাঘ্রাসনই (Tiger throne) বলা যায়। কারণ আট কোণা ওই আসনটির ঠিক মাঝখানে ছিল একটি বাঘের মূর্তি। ৮ ফুট চওড়া আসনটির রেলিঙের মাথায় বসানো ছিল সম্পূর্ণ সোনার তৈরি দশটি বাঘের মাথা, আর উপরে উঠার জন্য ছিল দু-ধারে রুপোর তৈরি সিঁড়ি। আর পুরো ব্যাঘ্রাসনটাই ছিল বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা। তাঁর ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের হাতলগুলিও ছিল বাঘের প্রতিকৃতি। টিপু সুলতানের রাষ্ট্রের প্রতীক ছিল বাঘ। এই বাঘ ছিল তাঁর কাছে অনুপ্রেরণার মতো। তাঁর সমস্ত পরিধেয় পোশাক ছিল হলুদ-কালো রঙে ছাপানো আর বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা। তিনি যে তলোয়ার ব্যবহার করতেন, তার গায়েও ছিল ডোরা দাগ এবং হাতলে ছিল খোদাই করা বাঘের মূর্তি। তাঁর ব্যবহৃত রুমালও ছিল বাঘের মতো ডোরাকাটা। তাঁর রাজ্যের সমস্ত সৈনিকের পোশাকে থাকত বাঘের ছবি। সৈন্যদের ব্যবহার্ব তলোয়ার, বল্লম, বন্দুকগুলোর নল, কুঁদো, হ্যাঁমারেও আঁকা থাকত বিভিন্ন আকারের বাঘের প্রতিরূপ কিংবা মূর্তি। এমনকি তিনি তাঁর রাজ্যের প্রধান প্রধান সড়কের পাশে, বাড়ির মালিকদেরকে বাড়ির দেয়ালে বাঘের ছবি আঁকার নির্দেশ জারি করেছিলেন। তখনও তাঁর বাঘ পোষার বাতিক যায়নি এবং রাজবাড়িতে বেশ কয়েকটি পোষা বাঘ ছিল। তার কয়েকটি আবার তাঁর ঘরের দরজার সামনে বাঁধা থাকত। তাঁর রাজ্যের পতাকায় কানাড়ি ভাষায় লেখা ছিল ‘বাঘই ঈশ্বর’। ঘটনাক্রমে ১৭৯৩ সালে হেক্টর মুনরোর একমাত্র পুত্র সুন্দরবনের সাগরদ্বীপে বাঘ শিকার করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়। এই সংবাদ পেয়ে টিপু সুলতানের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। তিনি এই ধারণা কাজে লাগিয়ে একটি বিচিত্র খেলনা বানিয়েছিলেন, যা সারা দুনিয়ায় ‘টিপু’স টাইগার’ (Tipu’s Tiger) নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। ফরাসি যন্ত্রকুশলীদের দ্বারা নির্মিত প্রমাণ আকারের এই খেলনাটিতে ‘ক্লকওয়ার্ক সিস্টেম ব্যবহৃত হয়েছিল। খেলনায় দম দিয়ে ছেড়ে দিলে এর সঙ্গে লাগনো একটি অর্গান পাইপ থেকে রক্ত হিম করা বাঘের প্রচণ্ড গর্জন শোনা যায়, আর এক ব্রিটিশের প্রচণ্ড গোঙানির আওয়াজ বের হত। পুরো খেলনাটি ছিল এরকম— একজন ব্রিটিশ একটি বাঘের থাবার মধ্যে অসহায়ভাবে পড়ে গোঙাচ্ছে, আর একটা বাঘ প্রচণ্ড আওয়াজ করে সেই ব্রিটিশের বুকের উপর চেপে গলা কামড়ে ধরছে। তখন সেই ব্রিটিশ তাঁর হাত উঠিয়ে চেষ্টা করত এদিক-ওদিক বাঘের মাথাটি সরিয়ে দিতে। তখন ভিতরকার অর্গান থেকে বেরিয়ে আসত মহিশূর সুলতানের প্রিয় গজলের সুর। টিপু’স টাইগার’ বানানোর পিছনে একদিকে যেমন ছিল তাঁর ব্রিটিশদের প্রতি উত্মা, তেমনি অন্যদিকে ছিল প্রচণ্ড ব্যাঘ্রপ্রীতি। সময় পেলেই তিনি বাঘটিতে দম দিতেন। কখনো-কখনো রাতের পর রাত একই জিনিস দেখে গায়ের জ্বালা মেটাতেন। তিনি সিংহাসনে বসে মাঝে মাঝেই বলতেন –“ভেড়া বা শিয়ালের মতো দুশো বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দু দিন বেঁচে থাকাও ভাল”।

টিপু সুলতানের উপদেষ্টা হিসাবে ছিলেন পণ্ডিত পুন্নাইয়া। টিপু সুলতান সামরিক তালিম নেন সরদার গাজী খানের কাছ থেকে। গাজী খাঁ হায়দার আলির সেনাবিভাগের শ্রেষ্ঠ অসিচালক ছিলেন। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনাপতি হেক্টর মুনরোর ও তাঁর বাহিনীর কাছে দ্বিতীয় মহিশূর যুদ্ধে টিপু ও তাঁর পিতা হায়দার মারাত্মক নাজেহাল হন এবং টিপুর রাজ্যে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়, নিহত হয় অনেক সৈন্য। এমনিতেই তিনি প্রচণ্ড ব্রিটিশ বিরোধী ছিলেন, তদুপরি এই পরাজয়ে তিনি আরও বেশি তেজদীপ্ত হয়ে ওঠেন।

“যদি তোমরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো, তবে কাপড় পরার অধিকার পাবে”– এই উক্তি টিপু সুলতানের। এই উক্তিটি শুনে নিশ্চয় মনে হতে পারে টিপু সুলতান বোধহয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করাচ্ছেন। বিষয়টি কিন্তু মোটেই তা নয়। একটু খুলেই বলি।

হিন্দু নারীদের প্রতি টিপু সুলতানের এই আহ্বানের পিছনে আছে এক ন্যক্কারজনক সামাজিক প্রথার ইতিহাস। আজ থেকে কয়েকশ বছর আগে ভারতের কেরালা অঙ্গরাজ্যে হিন্দু নারীদের মধ্যে এক ধরনের ট্যাক্স বা কর প্রচলিত ছিল। করটির স্থানীয় ভাষায় নাম মুলাককারাম (mulakkaram) বা স্তনকর (breast tax)। স্তনকর বা ব্রেস্ট ট্যাক্স বা মুলাককারাম বিষয়টি কী? ওই সময় নিয়ম ছিল শুধু ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কোনো হিন্দু নারী তাঁর স্তনকে ঢেকে রাখতে পারবে না, অর্থাৎ নারীর ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ অনাবৃত থাকবে। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ শ্রেণির হিন্দু নারীরাই তাঁদের স্তনকে একটুকরো সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারত। বাকি হিন্দু শ্রেণির নারীদেরকে সর্বদা স্তন উন্মুক্ত করে রাখতে হত। যদি কোনো নারী তাঁর স্তনকে কাপড় দ্বারা আবৃত করতে চাইত, তবে তাঁকে স্তনের আকারের (Size) উপর নির্ভর করে ট্যাক্স বা কর দিতে হত। এই করকেই বলা হয় স্তনকর বা ব্রেস্টট্যাক্স।

১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে নাঙ্গেলি (Nangeli) নামে এক অ-ব্রাহ্মণ নারী ব্রাহ্মণদের তৈরি নিয়ম ভেঙে তাঁর স্তনকে আবৃত করে। যখন গ্রামের ট্যাক্স কালেকটরের চোখে পড়ে যায় স্তন আবৃত করা নাঙ্গেলিকে, তখন ট্যাক্স কালেকটর নাঙ্গেলির কাছে মুলাককারাম (স্তনকর) চাইতে আসে। তখন নালেঙ্গি তা দিতে অস্বীকার করে এবং তাঁর নিজের দুটি স্তনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে পাতা দিয়ে মুড়ে ট্যাক্স কালেকটরকে দিয়ে দেয়। কাটা স্তন দেখে ট্যাক্স কালেকটর হতভম্ব হয়ে যায়। স্তন কেটে ফেলার কিছুক্ষণ পরেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য নাঙ্গেলির মৃত্যু হয়। স্ত্রীর মৃত্যুশোকে নালেঙ্গির স্বামীও সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনার পর থেকেই স্তনকর রদ হয়। তবে স্তনকর রদ হলেও দক্ষিণ ভারতে নারীদের স্তন আবৃত করার জন্য বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে। এমনকি বিষয়টি নিয়ে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা পর্যন্ত করতে হয়েছে অব্রাহ্মণ নারীদের। উনিশ শতাব্দীর মাঝে এসে যখন কিছু হিন্দু নারী তাঁদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার দাবি করে, তখন হিন্দু পুরোহিতরা স্পষ্ট করে বলে দেয়, নিচু বর্ণের নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করা ধর্ম-বিরোধী। বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৯ সালে দক্ষিণ ভারতে একটি দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার আদায় করা। এই দাঙ্গা কাপড়ের দাঙ্গা’ হিসেবেও পরিচিত। ওই সময় টিপু সুলতান হিন্দুদের বর্ণপ্রথার এই অন্যায় রীতিকে মোটেও পছন্দ করেননি। তিনি চেয়েছেন এই নগ্নতা বন্ধ হোক। তাই তিনি হিন্দু নারীদের আহবান করেছিলেন- “যদি তোমরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো, তবে কাপড় পরার অধিকার পাবে।” এছাড়া তো আর কোনো উপায় ছিল না সুলতানের সামনে। ওইসব অ-ব্রাহ্মণ হিন্দু নারীরা হিন্দু ধর্মে থাকলে কিছুতেই স্তন ঢাকতে পারত না। কিন্তু তাঁরা মনেপ্রাণে তাঁদের স্তন ঢাকতে চাইছে যে-কোনো মূল্যে। এক্ষেত্রে সেইসব নারীদের কাছে ধর্মত্যাগ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। আর সেই আশ্বাস যদি স্বয়ং সুলতানের কাছ থেকে আসে তাহলে তো কথাই নেই। অতএব টিপু সুলতানের আহ্বানে হাজার হাজার অ-ব্রাহ্মণ হিন্দু নারী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এ সম্পর্কে ইতিহাসবিদ সুরজিৎ দাসগুপ্তও লিখেছেন— “ওই সময় হিন্দু নিম্নবর্ণের লোকদের উর্ধাঙ্গ অনাবৃত রাখতে হত। সে সময় ভারতবর্ষের কেরালাতে অমুক হিন্দু নারী ইসলাম গ্রহণ করেছে এটা বলার প্রয়োজন ছিল না, বলতে হত শুধু ‘কুপপায়ামিডুক’ শব্দখানা। এ শব্দখানার অর্থ ‘গায়ে জামা চড়িয়েছে।” ( ভারতবর্ষ ও ইসলাম– সুরজিৎ দাসগুপ্ত, পৃষ্ঠা— ১৩০-১৩১)।

টিপু সুলতান ছিলেন ব্রিটিশদের ত্রাস। টিপু সুলতান ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে যেসব হাতিয়ার ব্যবহার করেছেন তা ছিল অত্যন্ত আধুনিক মানের এবং ব্যতিক্রমী। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথম রকেট প্রযুক্তি ব্যবহার করেন টিপু। সেই যুদ্ধের একটি চিত্র নাসার মেরিল্যান্ড অফিসে সংরক্ষিত আছে। টিপু সুলতানের চেয়ে একাগ্রচিত্তে আর কেউ মহিশূর রাজ্যকে ব্রিটিশ মুক্ত করতে মরিয়া লড়াই করেনি। নিদ্রায়-জাগরণে তাঁর হৃদয়ে সবসময় কাজ করত কীভাবে ব্রিটিশ শাসন-আগ্রাসন থেকে দেশকে (মহিশূর) বাঁচাবে। ব্রিটিশরা টিপুকে কেমন ভয় করে চলত তার প্রমাণ মেলে রিচার্ড ওয়েলেসলির কথায়। রিচার্ড ওয়েলেসলি ছিলেন ভারতে ক্রমসম্প্রসারণশীল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পরিচালক। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ মে মহিশূরের বাঘ’ টিপু সুলতানের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেয়ে তিনি বলেন— “গোটা ভারতবর্ষই এখন আমাদের”। এ কথা শুনেই বোঝা যায়, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণে সবচেয়ে বড়ো বাধাগুলোর মধ্যে একটি ছিল টিপু সুলতান। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে টিপুর নাম ছিল এক বিভীষিকা। ইউরোপে তখন নেপোলিয়নের জয়জয়কার। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ভয় ছিল, টিপু সুলতান নেপোলিয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতকে ব্রিটিশমুক্ত করবেন। আশঙ্কা একেবারে অমূলকও নয়। অটোমান এবং ফরাসি সাম্রাজ্যের প্রধানদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেনও টিপু সুলতান।

কিন্তু ইদানিংকালে ভারতীয়দের মধ্যে টিপুকে নিয়ে কিছু ইতিহাস বিকৃতি ছড়ানো হচ্ছে। এটা শুরু হয়েছে বছর তিনেক আগে। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে দেশটির কর্ণাটক রাজ্য একটি প্যারেড বের করা হয়, যাতে একদম সম্মুখভাগে ছিল তরবারি হাতে টিপুর একটি চলমান ভাস্কর্য। প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতীয় জাতীয়তার প্রতীক হিসাবে টিপুকে গ্রহণ করা যেতে পারে কি না, তাই নিয়েই উত্তপ্ত আলোচনা শুরু হয় টুইটারে। বিরুদ্ধ বক্তাদের যুক্তি টিপুর আমলে হাজার হাজার হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করে এবং ভারতের হিন্দুদের সংখ্যা এতে অনেক হ্রাস যায়। টিপুর অত্যাচারের স্বীকার হয়ে সাধারণ হিন্দুরা বাধ্য হয়ে ধর্মান্তরিত হয়। কিন্তু ঘটনা সত্যতা কতটুকু?

ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে, অর্থাৎ টিপু সুলতানের মৃত্যুর পরপরই অনেকগুলো লোকসংগীত ও শোকগাথা রচিত হয়, যা কালের ধারাবাহিকতায় এখনও জনপ্রিয়। কর্ণাটকের লোকসাহিত্যের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ব্রিটিশবিরোধী হাতেগোনা কিছু গোত্রপতি ছাড়া আর কোনো সম্রাটকে নিয়ে কর্ণাটকে শোকগাথা রচিত হয়নি। আর এই শোকগাথা বা ‘লাভানা’-গুলোর জনপ্রিয়তাই এই নেতার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়। শুধু টিপু সুলতানই নয়, তাঁর পিতা হায়দার আলিও ছিল স্থানীয় রাজা ও জনগণের কাছে ত্রাণকর্তা।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে টিপু ধার্মিক মুসলিম ছিলেন। নিয়মিত প্রার্থনা করতেন এবং এবং তাঁর এলাকার মসজিদগুলোর উপর বিশেষ নজরদারি ছিল। মূলধারার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনামতে টিপু সুলতানের শাসনব্যবস্থা ছিল সহনশীল। তাঁর শাসনকালে তিনি ১৫৬ টি হিন্দুমন্দিরে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ দিতেন। বরাদ্দ পাওয়া এরকম এক বিখ্যাত মন্দির হল শ্রীরঙ্গপত্তনমের রঙ্গন অষ্টমী মন্দির। অন্যদিকে অনেকে তাঁকে মনে করেন তিনি এক ধর্মান্ধ মুসলিম যে হিন্দু ও খ্রিস্টানদের উপর গণহত্যা চালিয়েছে।

তিনি বেশ কিছু সম্প্রদায়ের উপর অবরোধ আরোপ করেছিলেন। তাঁর এ অবরোধ আরোপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল কোরোগের হিন্দুরা, ম্যাঙ্গালোরের খ্রিস্টানরা, মালাবারের নাইর, মালাবারের মাফিলা মুসলিম, মহাদেবী মুসলিম, সোহানুর এবং নিজামবাদ জেলার নবাব। এই হত্যা যুদ্ধকেন্দ্রীক, অবশ্যই রাজনৈতিক –কখনো ধর্মীয় কারণে নয়। প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতীয় জাতীয়তার প্রতীক হিসাবে টিপুকে গ্রহণ করা যেতে পারে কি না, তাই নিয়েই উত্তপ্ত আলোচনা শুরু হয় টুইটারে। সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, ২০০ বছরেরও বেশি সময় আগে মারা যাওয়া এই ব্যক্তিকে নিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজার টুইট হয়েছে। টুইটগুলোর বেশিরভাগেই টিপুকে ‘বীর’ এবং দেশপ্রেমিক’ আখ্যা দেওয়া হলেও এমন টুইটও কম নয় যেখানে তাঁকে স্রেফ ‘বর্বর” এবং “খুনী’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। টিপু সুলতান : দ্য টায়রান্ট অব মহিশুর’ নামের ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা সন্দীপ বালাকৃষ্ণা টিপুভক্তিকে ‘ইতিহাসের একটি খোলাখুলি বিকৃতি’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। সন্দীপ এবং অন্যান্য টিপু-সমালোচকদের দাবি, টিপু গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছেন, হিন্দুদের মন্দির, খ্রিস্টানদের চার্চ ধ্বংস করেছেন, অন্তত ১০,০০০ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছেন। বলা হয়ে থাকে, কর্ণাটকের কোদাভা সম্প্রদায়ের হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে টিপু বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দিকে চাপের মুখে ইসলামে দীক্ষিত করেন। এছাড়া মালাবার ও কালিকূট আক্রমণেও এমন ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটে বলে টিপু বিরোধীরা দাবি করে থাকে।

টিপুকে ভারতের স্বাধীনতার রক্ষাকারী বীর’ হিসাবে যেসব ইতিহাসবিদেরা দাবি করেন, তাঁরা এই সমালোচনাগুলোকে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের প্রচারণা হিসাবেই আখ্যা দিয়েছেন। ভারতের বিকল্পধারার অনলাইন জার্নাল কাউন্টার কারেন্টস’-এর লেখক সুভাষ গাতাদি টিপুর বিরুদ্ধে আনা ধর্মান্তরের অভিযোগকে ইতিহাসের বিকৃতি উল্লেখ করে জানান, ১৯২৮ সালে ভারতের এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক বি.এন. পাণ্ডের কাছে তাঁর ছাত্ররা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর একটি লেখা নিয়ে আসেন, যেখানে বলা ছিল টিপুর ধর্মান্তরের চাপের মুখে ৩০০০ ব্রাহ্মণ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। ছাত্রদের আগ্রহের কারণে তথ্যের সূত্র চেয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে চিঠি পাঠান বি.এন পাণ্ডে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। উত্তরে জানান, তিনি মহিশুর গ্যাজেটিয়ার পত্রিকাতে এই তথ্য পেয়েছেন। পরবর্তীতে মহিশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক শ্রীকান্তিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তথ্যগুলোকে মিথ্যা বলে বি.এন.পাণ্ডেকে জানান। আর পুরো ঘটনাটা ‘সাম্রাজ্যবাদের সেবায় ইতিহাস’ নামে ১৯৭৭ সালে রাজ্যসভায় দেওয়া একটি ভাষণে উল্লেখ করেন বি.এন পান্ডে। কাউন্টার কারেন্টস’ এ প্রকাশিত এই লেখায় সুভাষ গাতাদি আরো দাবি করেন, কর্ণাটকের উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী সংঘ পরিবারই এ টিপু বিদ্বেষের মূল হোতা। ভারতের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক বিভেদ যতই জোরালো হচ্ছে, ততই জোরালো হচ্ছে টিপু বিদ্বেষ। কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী দল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ও সত্তরের দশকে টিপু সুলতানের নামে এক জীবনী প্রকাশ করে, যেখানে তাঁর নামে কোনো ধরনের নিপীড়নের অভিযোগ আনা হয়নি। টিপু ইস্যুতে আরএসএসের অবস্থান এখন প্রায় উল্টো।

প্রথম ব্রিটিশ-মহিশূরী যুদ্ধ হয় ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে। এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়েছিল নিজাম ও মারাঠারা। কিন্তু হায়দার এই গাঁটছড়া ভেঙে দিতে সক্ষম হন। কীভাবে? প্রথমে তিনি মারাঠাদের আলাদা করে ডেকে নিয়ে তাঁদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেন। তারপর চেষ্টা করে নিজামকে দলে টানতে। সেই কাজ সমাধা করতে টিপুকে পাঠানো হয় ব্যাঙ্গালোর থেকে ৩৭ মাইল দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমে চেন্নাপত্তনাতে। সঙ্গে উপঢৌকন স্বরূপ। পাঁচটি হাতি, দশটি সুদৃশ্য ঘোড়া, নগদ টাকা ও মণিমুক্তা ইত্যাদিও পাঠানো হয়। বিচক্ষণ টিপু আলাপ আলোচনা মাধ্যমে নিজামকে নিজের পক্ষে আনেন এবং হায়দারের পক্ষে যোগ দিয়ে ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করতে রাজি করায়। পরবর্তী যুদ্ধের বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। ১৭৬৯ সালে টিপু তাঁর পিতার পাশাপাশি থেকে যুদ্ধ করে যান। এ সময় একেবারে মাদ্রাজের প্রবেশদ্বারে এসে সন্ধির শর্ত মেনে নিতে ব্রিটিশদের বাধ্য করেন।

১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় দ্বিতীয় ব্রিটিশ-মহিশূরের যুদ্ধ। হায়দার আলি ৯০,০০০ সৈন্যসহ চাঙ্গামাগিরিবক্সের ভিতর দিয়ে কর্ণাটকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁর এক পুত্র করিমকে পাঠিয়ে দেন পৰ্তোনভো আক্রমণ করতে। আর টিপুকে পাঠিয়ে দেন আরকটে। এ সময় হায়দারের মৃত্যু হয়। তিনি কার্বাল রোগে ভুগছিলেন। টিপু যখন পিতার শেষকৃত্য করছিলেন, তখন পিতা হায়দারের পাগড়ির ভিতর এক টুকরো কাগজ দেখতে পান। যাতে লেখা ছিল টিপু যেন ব্রিটিশদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করে। তবে মিশ্যোর মতে, হায়দার টিপুকে উপদেশ দিয়েছিল ফরাসিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে চলতে। কারণ ব্রিটিশরা ভারতের সবচেয়ে জোরাল শক্তি। একমাত্র ফরাসিদের সাহায্যেই ব্রিটিশদের ভারত থেকে সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব। আসল ঘটনা হল হায়দার মৃত্যুর আগে তাঁর সেক্রেটারিকে ডেকে পাঠিয়ে টিপুকে লিখিত আদেশ করেন যে, মালাবার সম্পত্তি রক্ষার যথাযোগ্য ব্যবস্থা করে তিনি যেন তাড়াতাড়ি তাঁর কাছে চলে আসে। মৃত্যুর সময় তাঁর সেবায় উপস্থিত ছিল পুন্নাইয়া, কৃষ্ণরাও, শ্যামাইয়া, মোহম্মদ আলি, গাজী খাঁ প্রমুখ। হায়দারের মৃত্যুর পর তাঁর মুখ্য কর্মচারীরা ঠিক করেন যে, কোনো বিদ্রোহের যাতে না ঘটে সেজন্য টিপুর আসা পর্যন্ত মৃত্যুর সংবাদ গোপন রাখা হবে। টিপু ফিরলে শ্রীরঙ্গপত্তনমে মৃত পিতাকে নিয়ে গিয়ে টিপু তৈরি করলেন জমকালো সমাধি মন্দির, সেখানেই কবরস্থ করা হয়। এত সাবধানতা সত্ত্বেও হায়দারের মৃত্যুর সংবাদ ফাঁস হয়ে যায়।

তখন মাদ্রাজে সশস্ত্র ব্রিটিশরা সমাবেশ ঘটিয়েছিল। হায়দারের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ল তাঁরা। গভর্নর ঘোষণা করল –“আমরা এ অবস্থায় যতটা সুবিধা করে নিতে পারি তা অবশ্যই নেব।” কুট লেখেন– “হায়দার আলির মৃত্যুর মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা থেকে ভারতে আমাদের সাধারণ স্বার্থের কতটা সুরাহাই-না হতে পারে। প্রাচ্যদেশে আমাদের মাতৃভূমির স্থায়ী ও নিরুপদ্রব মালিকানা প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেল।” কিন্তু না, হায়দারের মৃত্যুর কোনো সুযোগ ও সুবিধাই ব্রিটিশরা শেষপর্যন্ত নিতে পারেনি। ব্রিটিশরা আশা করেছিল সিংহাসন নিয়ে দুই ভাই টিপু ও করিমের মধ্যে বিদ্রোহ হবে, লড়াই হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। যাই হোক এর মধ্যে অনেক যুদ্ধ-টুদ্ধও হয়েছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে টিপুর। স্টুয়ার্টের পরাজয়ও হল। মেথুরের অনন্তপুর এবং অনৌর আক্রমণের সময় ব্রিটিশরা যথেচ্ছ নৃশংস অত্যাচার করেছিল। অনন্তপুরের হত্যাকাণ্ড এমনি নির্বিচারে চলেছিল যে সমস্ত অসামরিক বাসিন্দাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল। তাঁদের মৃতদেহ দুর্গমধ্যস্থ পুষ্করিণীতে নিক্ষেপ করা হয়। মহিলারাও পর্যন্ত বাদ যায়নি। বন্দুকের সঙ্গিনে আহত ও রক্তাক্ত মহিলাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০। মহিলাদের শরীর থেকে সমস্ত অলংকার খুলে নিয়েছিল ব্রিটিশের সাধারণ সেনারা।

দ্বিতীয় ব্রিটিশ-মহিশূর যুদ্ধে ফরাসিরা টিপুকে সাহায্য করেছিল। হায়দায়ের মৃত্যুর পর কর্ণাটকে টিপুর পক্ষে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছিল ফরাসিরা। ব্রিটিশ-মহিশূরী যুদ্ধে ফরাসিদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ভারতের ফরাসিরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হায়দারকে সাহায্য করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল। যদিও ১৭৮০ সালে হায়দার যখন কর্ণাটক আক্রমণ করেছিল এবং যুদ্ধ করেছিল, তখন মালপত্র সরবরাহ ছাড়া তেমন কিছুই করেনি। কারণ সে সময়, ১৭৭৮ সাল থেকে ফরাসিরা নিজেরাই পৃথকভাবে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিল। কিন্তু পরে ফ্রান্স দ্যুশম্যাঁর নেতৃত্বে ২৫০০ জন নিয়ে ভারতে এসে পৌঁছোয় ফরাসি উপনিবেশগুলি পুনরুদ্ধার করতে এবং তা সম্মিলিতভাবে ভারতীয় রাজা ও মুখ্যনেতা হায়দারকে সাহায্য করে। দুশম্যাঁর পর নেতৃত্বের দায়িত্ব পান মারকুইস দ্য ঝুসি। ঝুসি বিশাল একটি সৈন্যদল নিয়ে ভারতে ঢুকছেন শুনে হায়দার আত্মহারা। কিন্তু শীঘ্রই মোহমুক্তি ঘটে। পরে নানা শর্তাবলিতে ফরাসিদের রাজি করানো হয়েছিল। হায়দারের অসহায়তা বুঝে ফরাসিরা নানরকম দাবি-দাওয়া আদায় করে নিয়েছিল। ফরাসিরাও নানারকম চতুরতার আশ্রয় নিয়েছিল। যাই হোক, অবশেষে হায়দার দ্যুশম্যাঁকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বললে দুশম্যাঁ তা করতে অস্বীকার করে। কারণ তিনি ঝুসি ও পূর্বাঞ্চলের ফরাসি উপনিবেশের গভর্নর জেনারেল ভিঙ্কোমত দ্য সুইলাক কর্তৃক হুকুম পেয়েছিলেন বড়ো রকমের কোনো যুদ্ধ করার আগে কোনোরকম ঝুঁকি না নিতে, যতক্ষণ না ফ্রান্স থেকে যথেষ্ট সংখ্যক সেনা ভারতে পৌঁছোয়। কারণ যুদ্ধে পরাজয় ঘটলে ফরাসি জাতির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। কিন্তু ফরাসি ও হায়দারের মিলিত সৈন্যসংখ্যা ও সাজসরঞ্জাম উভয়ই ব্রিটিশদের চেয়ে অনেক উৎকৃষ্ট ছিল। ব্রিটিশ কুটকে সহজেই পরাস্ত করা যেত। অতএব যুদ্ধে অস্বীকৃত হয়ে দুশম্যাঁ মস্ত একটা ভুল করেছিলেন, এটা তাঁর বিচক্ষণতার অভাব। তা ছাড়া ফরাসি গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে মালে বলেছিলেন –“দ্যুশম্যাঁ ছিলেন একজন নাবিক, সৈন্য নন। তিনি জলে বা স্থলে কোনো বিভাগেই সুদক্ষ ছিলেন না। তিনি দেহে ও মনে উভয়তেই দুর্বল ছিলেন। একটা ভীষণ দায়িত্ব-ভীতি তাঁর, একান্ত শ্রমকাতর দেহ-মনের উপর চেপে বসেছিল।”

১৭৭৮ সালে দ্যুশম্যাঁর মৃত্যু হলে দায়িত্ব নিয়ে আসেন কোঁত দ্য ফিজ। কিন্তু হায়দারের সঙ্গে সম্পর্ক জমে ওঠেনি। দ্য লোনে বলেন –“দ্যুশম্যাঁর মৃত্যু হয়ে রাষ্ট্রের যেমন কোনো ক্ষতি হয়নি, ঠিক তেমনি ফিজ এসেও রাষ্ট্রের কোনো লাভ হয়নি। ফিজ লোক হিসাবে ভালো হলেও নির্দিষ্ট কাজের পক্ষে সে অযোগ্য। এর ফলে হায়দার অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফরাসিদের সঙ্গে সব সম্পর্কে ছেদ টানতে মনস্থির করেন। এমন সময় দ্য লোনে ও স্যু হায়দারকে আশ্বস্ত করে বলেন, ঝুসির নেতৃত্বে ফ্রান্স থেকে একটা বড়ো সৈন্যদল শীঘ্রই আসছে। হায়দারও আশা করেছিলেন ব্যুসির আগমনের পর তিনি ব্রিটিশদের পরাজিত করতে পারবেন।

ঝুসি এলেন তিন মাস পর। দ্যুশম্যাঁর মতো বুসির নিয়োগও ভুল ছিল। ৬২ বছরের বৃদ্ধ ঝুসি তখন দেহ-মনে দুর্বল, আত্মবিশ্বাস শূন্য, কর্মোদ্যম ও উচ্চাভিলাষ কিছু নেই। ঝুসির কর্মকুশলতা তো ছিলই না, উপরন্তু জাতির স্বার্থে তাঁর মনোভাব প্রগতিশীলও ছিল না। ঝুসির সঙ্গে টিপুর মনকষাকষিও শুরু হয়ে যায়। ফরাসিরা পরবর্তীতে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও টিপুর সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও ফায়দা কিছু হয়নি। পিতা হায়দায় আলির সময়কাল থেকেই যখন টিপু সুলতান’ হিসাবে অভিষিক্ত পর্যন্ত হয়নি, তখন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত টিপু নিরন্তর নিরলস ব্রিটিশদের দেশ থেকে সমূলে উৎপাটন করতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। দীর্ঘ যুদ্ধে প্রচুর সাধারণ নর-নারী হতাহতও হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করতে গিয়ে ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষদেরও রেহাই দেয়নি। যে-কোনো মূল্যে টিপুকে হত্যা করে ভারত দখলকে সম্পূর্ণ করতেই হবে। যদিও এত হত্যায় বিচলিত হয়ে টিপু কর্নালিসের কাছে শান্তির জন্য ব্যগ্র হয়ে পড়েন এবং একটি পত্রও পাঠান, কিন্তু কর্নওয়ালিস সেই আবেদনে সাড়া দেননি। কারণ কর্নওয়ালিস শান্তি চাননি কোনোদিন। তিনি যুদ্ধই চান। যুদ্ধটা এমনিতেই ব্রিটিশদের অতি প্রিয় বিষয়। প্রায় গোটা বিশ্বে উপনিবেশ গড়ে দেশগুলির দখল নিয়েছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেই। তাঁদের কাছে যুদ্ধ মানেই মুনাফা। অতএব যুদ্ধে টিপুকে ধ্বংস করে নিরঙ্কুশ ভারতের দখল নিতেই হবে। তাই তিনি এক কঠিন শর্ত আরোপ করে দিল, যা টিপু সুলতানের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। টিপুর বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করত মারাঠারা, পেশোয়াররা। ব্রিটিশরা বলতে গেলে মারাঠাদের বলেই বলীয়ান। কর্নওয়ালিস টিপুকে জানিয়েছিলেন নিজাম ও মারাঠাদের সঙ্গে আলোচনা করেই টিপুকে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন। এদিকে আবার কর্নওয়ালিসের অভিযানের নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর ব্রিটিশ শক্তির প্রগতিতে মারাঠারা খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। মারাঠারা চেয়েছিল টিপুর শক্তি হ্রাস হোক, কিন্তু একেবারে ধ্বংস নয়। কর্নওয়ালিস টিপুর সঙ্গে যুদ্ধ সমাপ্তিতে রাজি না-হলেও নিজাম ও মারাঠারা টিপু সুলতানের সঙ্গে পৃথক সন্ধি করতেও প্রস্তুত ছিল। এমতাবস্থায় কর্নওয়ালিস টিপুর আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি হলেন এবং একটু অবস্থা ভালো হতেই গভর্নর জেনারেলের মত বদলে যায় এবং টিপুর সঙ্গে মীমাংসার শর্ত কঠিনতর করে দেয়। কর্মপ্রণালীগত ও আত্মসম্মানের একটা ছোটো কথার উপর জেদ ধরে টিপু সুলতান একটা মস্ত ভুল করে ফেলল, যে ভুলের জন্য তিনি কর্নওয়ালিসের পাতা ফাঁদে পড়ে গেলেন। কর্নওয়ালিস তো চেয়েইছিলেন আলোচনা বাতিল করতে। শ্রীরঙ্গপত্তনম থেকে ব্রিটিশদের শোচনীয়ভাবে পরাজয় ও পলায়নের পর টিপু নিজেকে বিপদমুক্ত ও অধিকতর শক্তিশালী মনে করেছিলেন। কর্নওয়ালিস যখন আবার শ্রীরঙ্গপত্তনম আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, টিপু আবারও শান্তির কথা আলোচনা চালানোর জন্য তাঁর কাছে আইনজীবী পাঠাতে চান বলে জানালেন। নিজাম ও পেশোয়াকেও এ বিষয়ে তিনি অবগত করেন। মোট কথা এটা পরিষ্কার যে টিপু আর যুদ্ধ চাইছেন না কোনোভাবেই। কর্নওয়ালিসও জানালেন শান্তি স্থাপনে রাজি। তবে টিপুকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং তাঁর কাছে বন্দি থাকা ব্রিটিশ সেনাদের মুক্তি দিতে হবে। টিপু এ যাবৎ যুদ্ধ বিরতির জন্য কর্নওয়ালিসের প্রায় সমস্ত শর্ত অগ্রাহ্য করেছিলেন। কারণ সেই সমস্ত শর্ত তিনি ন্যায়সংগত মনে করেনি। তিনি মিত্রপক্ষের সঙ্গে পৃথক পৃথক আলোচনা করে তাঁদের জোট ভাঙতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রেও তিনি সফল হননি। উল্টে মিত্রপক্ষের প্রতিনিধিরা তিনটি প্রস্তাব দেয় টিপুকে। এক, যুদ্ধের খরচ বাবদ ৮ কোটি টাকা তাঁকে দিতে হবে। দুই, বার্ষিক ৩ কোটি টাকা রাজস্বের ভূমিভাগ হস্তান্তর করতে হবে। তিন, প্রথম শর্ত দুটি গৃহীত হলে তাঁর দুটি ছেলেকে তাঁদের কাছে জামিন রাখতে হবে। শর্তগুলি পূরণ না-হলে কর্নওয়ালিস ও তাঁর সঙ্গীরা পুনরায় যুদ্ধ শুরু করবেন বলে হুমকিও দেন। টিপু জানায় তাঁর রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ ও ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা দিতে পারবেন। টিপুর শর্তপূরণ ব্রিটিশদের কাছে গ্রহণযোগ্য হল না। সর্বশেষ প্রস্তাব এলো মহিশূর রাজ্যের অর্ধেক ও ৩ কোটি টাকা দেবে। টিপুর উকিলরা টাকার পরিমাণ খুব বেশি মনে করলেন। তারপর দরকষাকষি করে ৩০ লক্ষে নামিয়ে আনা হয়। মুশির উল মুলকের মত ছিল টিপুর জন্য শুধুমাত্র ১ কোটি টাকা আয়ের রাজ্য ভাগ থাকবে রাজ্যের অবশিষ্টাংশ থাকবে মিত্রপক্ষে। অবশ্য সেগুলি পরে প্রত্যাহার হয়।

অসংখ্যবার আলোচনা আর প্রস্তাবের পর তুমূল দরকষাকষির শেষে এই সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় এবং যুদ্ধ বিরতি হয়। প্রাথমিক সন্ধির ধারাগুলি এরূপ– (১) যুদ্ধের আগে টিপুর দখলে যে রাজ্যগুলি ছিল তার অর্ধেক মিত্রপক্ষকে হস্তান্তর করতে হবে। এই রাজ্যাংশগুলি মিত্রপক্ষীয়দের রাজ্য সংলগ্ন ও তাঁদের নির্বাচন মতো হবে। (২) সোনার মোহর, পেগোডা বা সোনা রুপোর খণ্ডে টিপু সুলতান তিন কোটি ত্রিশ লক্ষ টাকা দেবেন। এক কোটি ষাট লাখ টাকা তখনি দিতে হবে, বাকিটা তিন কিস্তিতে, প্রতি কিস্তি চার মাসের অনধিক। (৩) হায়দার আলির সময় থেকে চার পক্ষের সমস্ত যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দিতে হব। (৪) টিপু সুলতানের জ্যেষ্ঠ তিন ছেলের দুজনকে যথারীতি সন্ধিশর্ত পালনের জন্য জামিন হিসাবে দিতে হবে।

ব্রিটিশ সহ দেশীয় শত্রুদের একটা জোরালো জোটের বিরুদ্ধে শরীরে শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত লড়াই তথা যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল টিপু সুলতান। লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছিল দীর্ঘ টানা দুই বছর ধরে। প্রকৃত বীরের মতো লড়াইয়ের মুখোমুখি কোনো ভারতীয় কাছ থেকে ব্রিটিশদের হতে হয়নি। এটা দাও, ওটা দাও’ বলে টিপুর কাছ থেকে সবকিছুই প্রায় কেড়ে নিয়েছিল। ব্রিটিশরা বুঝেছিলেন টিপুর ধ্বংস করা বাঞ্ছনীয়। না-হলে ব্রিটিশদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব কিছুতেই প্রমাণ করা যেত না। যেনতেনপ্রকারেণ সেটা করতেই হবে। টিপুর দেশীয় শত্রুরা তাঁর সমূলে বিনাশ না-চাইলেও ব্রিটিশদের চাইতেই হবে। যুদ্ধ অতি দ্রুত শেষ করাও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ইংল্যান্ড থেকে প্রতি চিঠিতেই ডিরেক্টররা কর্নওয়ালিসকে তাড়া দিচ্ছিল শক্তি স্থাপন করতে। কারণ যুদ্ধের জন্য বহু ব্যয় ও কোম্পানির ব্যাবসাবাণিজ্যে প্রভূত ক্ষতিও হচ্ছিল। টিপুর সঙ্গে যুদ্ধটা যদি আরও এক বছর চালিয়ে যেতে হত তাহলে কোম্পানির পক্ষে তা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন হত। বঙ্গদেশের সমস্ত ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানও দেউলিয়া হয়ে যেত। টিপুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে ব্রিটিশরা প্রায় নিঃস্ব হয়ে যেতে বসেছিল। যাই হোক, কর্নওয়ালিস দাক্ষিণাত্যে আসার পরেই টিপুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। কর্নওয়ালিসের সঙ্গে ছিল গভর্নর জেনারেলের পদমর্যাদা ও বৃহৎ ও সুসজ্জিত সেনাবাহিনী। সেইসঙ্গে মারাঠারাও আরও শক্তিশালী ও সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। তবে একথা সত্য, টিপুর বিরুদ্ধে মারাঠারা যদি ব্রিটিশদের সক্রিয় সঙ্গ না দিত কিছুতেই টিপুর পরাজয় হত না। যুদ্ধে যখন থেকে মারাঠারা ও নিজাম আরও সক্রিয় হতে শুরু করে, তখন থেকেই টিপুর হার শুরু হয়।

১৭৯৯ সালে কর্নেল রিড ও ব্রাউনের নেতৃত্বে শ্রীরঙ্গপত্তনমে আসে এক বিরাট সেনাদল। টিপু যখন যথাসম্ভব চেষ্টা করেছিলেন ওয়েলেসলির সঙ্গে বোঝাঁপড়ায় আসতে। বিফল হলেন তখন, যখন জানতে পারলেন চারদিক থেকে ব্রিটিশসেনারা তাঁকে ঘিরে ফেলেছে। তিনি প্রতিরোধের জন্য চেষ্টাও করেন। টিপুর রাজপ্রাসাদ ছাড়াও দুর্গ প্রাকার ও রক্ষাব্যবস্থার সমস্ত অংশ ব্রিটিশ কর্তৃক অধিকৃত হয়ে যায়। ব্রিটিশরা শ্রীরঙ্গপত্তনমে আসা পর্যন্ত টিপু দুর্গ প্রাকারে তাঁবু ফেলে থাকতেন। এখান থেকেই শত্রুর গতিবিধি অনুযায়ী স্থান বদল করতেন। প্রথমে তিনি দক্ষিণ প্রান্তে তাঁবু খাটান, তারপর তিনি যান পশ্চিম দিকে এবং সর্বশেষে ব্রিটিশরা প্রথম গোলাবর্ষণ আরম্ভ করলে উত্তর প্রান্তে একটি পাথরের ক্ষুদ্র চৌলট্রি’-তে। এখানেই তিনি খেতেন, শুতেন এবং এখান থেকেই দুর্গ রক্ষার জন্য অফিসারদের নির্দেশ দিতেন। ৪ মে ঘোড়ায় চড়ে প্রাচীরের ভগ্নস্থান পরিদর্শন ও মেরামতের নির্দেশ দিয়ে স্নানের জন্য প্রাসাদে যান। সেদিন ভোরে হিন্দু ও মুসলিম উভয় জ্যোতিষই সুলতানকে সতর্ক করে দিলেন যে, আজকের দিনটা তাঁর জন্যে অশুভ। তিনি যেন বিকাল পর্যন্ত সেনা পরিবৃত হয়ে থাকেন এবং অমঙ্গল দূর করার জন্য দান-খয়রাত করেন। জ্যোতিষীদের নির্দেশমতো সুলতান প্রচুর দান খয়রাতও করেন। এরপর তিনি চৌলট্রিতে ফিরে এসে খাবার চেয়ে পাঠান। এসময় ব্রিটিশরা দুর্গ-প্রাকার আক্রমণ করে। তাঁর সেনাদল যখন সম্পূর্ণরূপে মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল তখন তিনি ঘোড়ায় চড়ে জলকপাটের নিকটস্থ যোদ্ধাদের নির্গমন পথে উপস্থিত হন। কিন্তু কপাটটি বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, যাতে কেউ পালাতে না পারে। যখন সুলতান কপাট খোলার আদেশ দেন তখন তা মান্য করা হয়নি। সুলতান তখন অন্তঃদুর্গের প্রবেশপথের দিকে যান। তিনি ইতিমধ্যেই আহত হয়ে পড়েছিলেন এবং প্রবেশপথে পৌঁছোনোর পূর্বেই দ্বিতীয়বার আহত হন। ব্রিটিশরা ভিতরে-বাইরে দিকের প্রাকার থেকে মারাত্মক গোলাবর্ষণ করেছিল। প্রবেশদ্বার অতিক্রম করতে গিয়ে টিপু তৃতীয়বার আহত হয়। তাঁর বাঁ-দিকের বুক গুলিবিদ্ধ হয়, সেইসঙ্গে তাঁর ঘোড়াও গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। টিপুর অনুচরেরা তাঁকে নিয়ে যেতে পালকি এনেছিল। কিন্তু অকুস্থলে হাজারে হাজারে মৃতদেহ পড়ে থাকায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। টিপুর পার্শ্বচর রেজা খাঁ তাঁকে শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে পরামর্শ দেয়। কিন্ত টিপু বন্দি হওয়ার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় মনে করেছিলেন। এই সময় মহিশূরীরা অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে চারদিক থেকে ছুটোছুটি করে পালাতে শুরু করে। এসময় ব্রিটিশরা তাঁদের নির্দয়ভাবে হত্যা করে। প্রবেশদ্বারে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। দুর্গ-প্রাকারগুলি দখলে আসার পর রাজপ্রাসাদ অধিকার করা সাব্যস্ত হল। সুলতানের পুত্ররা ব্রিটিশদের হাতে বন্দি হল। এবার ব্রিটিশদের কাজ হল টিপু সুলতানকে খুঁজে বের করা। ওরা ভেবেছিল সে কোথাও লুকিয়ে আছে। চতুর্দিকে রাশি রাশি মৃতদেহ পড়ে আছে। দুর্গের উত্তরদিকের একটা দ্বারে মিলল টিপুর পালকির সন্ধান। পালকির নিচে মিলল রেজা খাঁর মারাত্মকভাবে আহত দেহ। রেজা খাঁই দেখিয়ে দিল টিপু যেখানে শায়িত। তখনও টিপুর শরীর গরম ছিল। নাড়ি টিপে তবেই মৃত বলে নিশ্চিত হয়। তাঁর দেহে চারটি আঘাত পাওয়া যায়। তিনটি শরীরের ভিতর, একটি কপালের পাশে।

টিপুকে পরাজিত করার পর কর্নওয়ালিস ডানডাসকে উচ্ছ্বসিতভাবে লিখেছিলেন–”আমরা অবশেষে ভারতের যুদ্ধ সুষ্ঠুভাবে শেষ করলাম এবং আমার মনে হয় যে-কোনো বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকের আশানুরূপ লাভজনক। আমরা শত্রুকে খর্ব করেছি, মিত্রদেরও অতিমাত্রায় বাড়তে দেয়নি।”

টিপু সুলতান আর পাঁচটা ভারতীয় শাসকদের মতোই স্বৈরাচারী ছিল। মোদ্দা কথা, গোটা পৃথিবীতেই সেসময় গণতান্ত্রিক শাসক অতি বিরল বিষয় ছিল। বেশিরভাগই একনায়কতান্ত্রিক শাসক ছিল। একনায়কতান্ত্রিক বা স্বৈরচারী হয়েও পঞ্চাশ/ষাট বছর রাজত্ব করতে পারত বংশপরম্পরায়। শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে মুখ্য সামরিক ও অসামরিক বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরামর্শ চাইতেন। শেষ সিদ্ধান্ত সর্বদা শাসকেরই হত। রাজ্যের বিধান, বিচার ও শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নিয়ন্তা ছিলেন শাসকই। তিনি নিজেই নিজের প্রধান সেনাপতি। যুদ্ধকালে তিনিই স্বয়ং মূল সেনাদল পরিচালনা করেন। বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাঠানো সেনাপতিরা তাঁরই নির্দেশমতো কাজ করত। টিপু সুলতানও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। টিপু সুলতানের ক্ষমতার উপর কোনো শাসনতান্ত্রিক বাধা ছিল না। তার মানে এই নয় যে তিনি একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন শাসক ছিলেন। বরং তিনি মনে করতেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবেই প্রজাদের উপর তাঁর এই দুর্লভ অভিভাবকত্ব। এই বিশ্বাসেই প্রজাকল্যাণের জন্য কোনো চেষ্টার ত্রুটি রাখতেন না। মেকেঞ্জির ভাষায় –“প্রতিবেশি যে-কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে অতুলনীয় যে পার্থিব সম্পদের অধিকারী তিনি ছিলেন মিতব্যয়িতার সঙ্গে তার সদ্ব্যবহার করে সুষ্ঠু শাসননীতির অনুসরণে টিপু সমগ্র শাসনব্যবস্থাকে উজ্জীবিত করেছিলেন .. কঠোর ও আদর্শ শাস্তি দ্বারা মধ্যবর্তী দালালদের প্রতারণা বন্ধ করে সুলতান তাঁর অসাধু সমাহর্তাদের উৎপীড়ন থেকে হিন্দুগরিষ্ঠ রায়তদের রক্ষা করতেন।”

টিপু সুলতানের সমাজ-সংস্কারকের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কয়েকটা উল্লেখ করা যায় –(১) তাঁর সাম্রাজ্যে মদ ও অন্যান্য মাদক দ্রব্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। (২) গণিকাবৃত্তি ও গৃহকাজে দাসীশ্রেণির মেয়েদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছিলেন। (৩) মালাবার ও কুর্গে একই মহিলাদের বহুপতি গ্রহণ প্রথা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। (৪) মালাবারের কোনো কোনো অংশে মহিলাদের উধ্বাঙ্গ অনাবৃত থাকত। সুলতান আদেশ দিলেন কোনো মহিলা নগ্ন শরীরে বাড়ির বাইরে আসতে পারবে না। (৫) মহিশূর শহরে কালীমন্দিরে নরবলি হত। সুলতান সেই প্রথা বিলুপ্ত করে দেন ইত্যাদি।

টিপু সুলতানের শাসনব্যবস্থাকে বলা হত ‘সরকার-ই-খুদাদাদ’, অর্থাৎ ঈশ্বর প্রদত্ত সরকার। তবে শারিয়া আইন শুধুমাত্র মুসলিম প্রজাদের জন্য ছিল। হিন্দু সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পৃথক আইন। পৃথক আইন বলতে সেইসব ধর্মীয় সম্প্রদায়দের প্রচলিত নিজস্ব আইন। সুলতান কখনোই তাতে হস্তক্ষেপ করতেন না। প্রত্যেকের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল। ঐতিহাসিক মানরো ১৭৯০ সালের ১৭ জানুয়ারি তাঁর পিতাকে লিখছেন –“মহিশূর গভর্নমেন্ট পৃথিবীর একটি সেরা সার্বভৌম ও অনাড়ম্বর রাজতন্ত্র। সেখানে উচ্চকুলের দুরহংকার প্রশ্রয় পায় না, স্বাধীন রাজা ও জমিদাররা অধীন কিংবা লুপ্ত হয়েছে, নিরপেক্ষ ন্যায়বিচার প্রযোজ্য হচ্ছে, বিশাল ও সুশৃঙ্খল এক সেনাবাহিনী প্রস্তুত হয়ে আছে, প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ শাসন বিভাগ অজ্ঞাত অখ্যাত স্তর থেকে গড়ে তোলা কর্মীর হাতে ন্যস্ত আছে– সব কিছু মিলে গভর্নমেন্টকে জুগিয়ে দিচ্ছে ভারতে অতুলনীয় এক প্রাণশক্তি।” ঐতিহাসিক স্নার টিপু সুলতানের মহিশূর প্রসঙ্গে লিখেছেন –“এক অজ্ঞাত দেশের মধ্য দিয়ে ভ্রমণকালে যদি দেখে যে দেশ কৃষিকর্মে উত্তম, শ্রমশীল লোকে ভরপুর, আর যদি দেখে যে, নতুন নতুন নগরের পত্তন ও বাণিজ্যের প্রসারণ হচ্ছে, শহরের সংখ্যা বেড়ে চলেছে এবং সবকিছুই সুসমৃদ্ধ থেকে একটা পরিতৃপ্তির সূচনা করছে, তবে স্বভাবতই সে সিদ্ধান্ত করবে যে, সে দেশের গভর্নমেন্ট জনগণের মনঃপূত। এই হল টিপুর দেশের ছবি, আর এই হল এর গভর্নমেন্ট সম্বন্ধে আমাদের অভিমত।”

টিপু সুলতানের সাম্রাজ্যে মুদ্রার নাম ছিল পেপোডা। প্রতি শহরে একজন কাজী ও একজন পণ্ডিত থাকত, যাঁরা যথাক্রমে মুসলিম ও হিন্দু অপরাধীদের বিচার করতেন। এসব আদালতে বিচারে সন্তুষ্ট না-হলে শ্রীরঙ্গপত্তনমে উচ্চতর আদালতে পুনর্বিচারের প্রার্থনা করা যেত। যেখানে বসত একজন মুসলিম বিচারক ও একজন হিন্দু বিচারক। উচ্চ আদালতের বিচারে সন্তুষ্ট না-হলে সর্বোচ্চ আপিল আদালত, যেখানে স্বয়ং টিপু সুলতান বিচার করতেন। হিন্দু-মুসলিম ধর্মনির্বিশেষে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। রাষ্ট্রদ্রোহী ও খুনীদের ফাঁসিকাঠে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও আরও কিছু শাস্তির বিধান দেওয়া হত। যেমন অপরাধীর হাত-পা বেঁধে হাতির পায়ের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটানো হত। কখনো-কখনো চোর, আইন ভঙ্গকারী বা দেশদ্রোহীদের কান, নাক, হাত ও পা কেটে দেওয়া হত। অবাধ্যতা ও শিথিলতার অপরাধে সরকারি কেরানিদের বেত মারার নিয়ম ছিল।

সুলতানের সময়ে কর্ষিত জমির পরিমাণ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। কারণ কৃষকদের সুলভে জমি দেওয়া হয়েছিল। পতিত জমি প্রথম বছর বিনা খাজায়, দ্বিতীয় বছর প্রচলিত হারের এক-চতুর্থাংশ এবং পরবর্তী বছরগুলিতে সাধারণ হারে খাজনা দিতে হত। দশ বছরের অনাবাদী জমি প্রথম বছর ছিল বিনা খাজনায়। দ্বিতীয় বছর খাজনা হত প্রচলিত হারের এক-চতুর্থাংশ, তৃতীয় বছর অর্ধেক এবং চতুর্থ বছর পূর্ণহারে।

রাসব্রুক উইলিয়ামস সম্পাদিত ‘Great Men of India’ গ্রন্থে ডেডওয়েল ‘Tipu Sultan’ শিরোনামাঙ্কিত প্রবন্ধে লিখেছেন–”বস্তুত তাঁর জীবনবৃত্তান্ত যুক্তিসংগতভাবে বিচার করলে দেখা যায় যে, তিনি গতানুগতিকভাবে অত্যাচারী শাসক ছিলেন না। তিনি ছিলেন কর্মঠ, উদ্যোগী মানুষ, যাঁর চারদিকে সম্প্রতির একটা নতুন জাগরণ তৈরি হয়েছিল, যে শক্তি তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং কিছুটা তাঁর উপলব্ধিরও অতীত।” (পৃ: ২১৭) এই পরিচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, টিপু ধর্মান্ধ ছিলেন না। তিনি তাঁর রাজকার্যে হিন্দুদের উচ্চপদে উন্নীত করেছিলেন। ধর্মাচরণে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তাঁর পিতা হায়দার আলিও তাঁর রাজ্যে হিন্দুদের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেছিলেন। টিপু সুলতানও পিতার নীতিই অনুসরণ করতেন। টিপুর সাম্রাজ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিই হিন্দুদের দখলে ছিল। পুন্নাইয়া ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ট পণ্ডিত। কৃষ্ণরাও কোষাধ্যক্ষ, শামাইয়া আয়েঙ্গ ছিলেন ডাক ও পুলিশের মন্ত্রী। রঙ্গ আয়েঙ্গার ও নরসিংহ রাও শ্রীরঙ্গপত্তনমে উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। শ্রীনিবাস রাও ও আপ্পাজী রাম সুলতানের পরম বিশ্বাসভাজন ছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ কুটনীতিক দৌত্যে পাঠানো হত। সুলতানের প্রধান পেশকার ছিলেন হিন্দু, নাম সুবা রাও। নরসইয়া ছিলেন মুনশি। নাগাপ্পায়া নামের জনৈক ব্রাহ্মণ কুর্গের ফৌজদার হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। সেনাদলেও হিন্দুরা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। তালিকা দীর্ঘ। সব উল্লেখে বাহুল্যতা প্রকাশ পাবে।

১৯১৫ সালে রঘুনাথরাও পট্টবর্ধনের নেতৃত্বে মারাঠা অশ্বারোহী শ্রীঙ্গেরী মঠ আক্রমণ করে। এ তথ্য জানা যায় ১৯১৬ সালে মহিশূরের তৎকালীন ডিরেক্টর অব আর্কিওলজি রাওবাহাদুর কে নরসিমহাচারের একগোছা চিঠি থেকে। চিঠিগুলি শ্রীঙ্গেরী মন্দির থেকে পাওয়া গেছে, যেগুলি মঠাধ্যক্ষকে টিপু সুলতানের চিঠি। এই চিঠিগুলি থেকে টিপুর ধর্মগত নীতি বিষয়ে অনেকটা ধারণা পাওয়া যায়। সেই চিঠিগুলি থেকে জানা যায়, মারাঠা অশ্বারোহীরা শ্রীঙ্গেরী মঠের ব্রাহ্মণ সহ বহু মানুষকে হতাহত করে। মঠের সমস্ত মূল্যবান সম্পত্তি লুণ্ঠন করে দেবী সারদার মূর্তি সরিয়ে ফেলে দেয়। মঠের স্বামীজি মঠ ত্যাগ করে করালা এলাকায় বাস করতে বাধ্য হন। এ সংবাদ সুলতান টিপুর কানে পৌঁছে যায়। সঙ্গে সঙ্গে টিপু বেদনুরের আসফকে আদেশ দেন তিনি যেন দেবী সারদার পুনঃস্থাপনের জন্য স্বামীজিকে ২০০ রাহাতি নগদ এবং ২০০ রাহাতি মূল্যের খাদ্যশস্য পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। মূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা হল। পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিন সুলতানও আমন্ত্রিত হল। স্বামীজি সুলতানকে প্রসাদ ও শাল দিয়ে অভিবাদন দিলেন। প্রতিদানে সুলতান দিলেন দেবী সারদার জন্য পোশাক এবং স্বামীজির এক জোড়া শাল। একবার উদ্যোক্তারা ‘সহস্র চণ্ডীজপ’ করবে তার খরচ চেয়ে সুলতানকে জানান। সুলতান খরচের বিস্তারিত ফর্দ প্রাপ্তি স্বীকার করে জানিয়ে দেন এই উৎসব দেশের কল্যাণ ও শত্রুর নিধন কামনায় উদযাপিত জেনে খুশি। তিনি আরও জানিয়ে দেন সংশ্লিষ্ট অফিসারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শ্রীঙ্গেরী গিয়ে উৎসবের প্রয়োজনীয় সবকিছুর জোগান দেবে। উপরন্তু স্বামীজিকে ‘জগৎগুরু’ সম্বোধন করে অনুরোধ করেন প্রত্যহ ১০০০ ব্রাহ্মণদের ভোজন করান এবং দক্ষিণা দিন। সুলতানের যদি ধর্মীয় গোঁড়ামি থাকত, তাহলে একজন হিন্দু যাজককে ‘জগৎগুরু’ সম্বোধন করতেন না কিংবা দেবীমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ধর্মোৎসবের জন্য স্বামীজিকে সাহায্য করতেন না। তিনি যদি ধর্মান্ধই হত, তাহলে স্বামীজিকে কখনোই বলতেন না –“আপনি জগৎগুরু। জগতের কল্যাণে ও মানুষের শান্তির জন্য আপনি সর্বদাই তপস্যায় রত। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন আমাদের যেন সম্পদ বৃদ্ধি হয়, আপনার মতো দেবলোকের যেখানে বসতি সেখানেই প্রচুর শস্য, পর্যাপ্ত বৃদ্ধি এবং প্রভূত সমৃদ্ধি।”

টিপু সুলতানের সঙ্গে শ্রীঙ্গেরী মঠের স্বামীজির সঙ্গে শুধু যে ভালো সম্পর্ক ছিল তা নয়। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের অন্যান্য মন্দিরের সঙ্গেও নিয়ম করে যোগাযোগ রাখতেন। যেমন লক্ষ্মীকান্ত মন্দিরে রুপোর ৪ টি বাটি, ১ টি থালা ও ১ টি পিকদানি দিয়েছিলেন। পিকদানিতে উত্তীর্ণ ফলক থেকেই জানা যায় টিপু সুলতানের প্রদত্ত উপহারের কথা। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরেই সুলতান ১২ টি হাতি এবং ১৭৮৬ সালে একটি নাকাড়া দান করেছিলেন। নানজাগুড়ের শ্রীকান্তেশ্বর মন্দিরের তলদেশে যে পাঁচপ্রকার মূল্যবান পাথর ও মণিমুক্তো খচিত পাত্র পাওয়া যায়, সেটা টিপু সুলতানেরই দান করা। শ্রীরঙ্গপত্তনমের রঙ্গনাথ মন্দির মধ্যস্থ সাতটি রুপোর বাটি ও একটি রুপোর কর্পূরদানির উপর খোদিত লিপি প্রকাশ করে সুলতানের দানের কথা। নানজানগুডের নানজানাদীশ্বর মন্দিরে একটি সবুজবর্ণের মণির লিঙ্গ আছে, যেটার নাম ‘পাছছা লিঙ্গ’ বা ‘পাদশা লিঙ্গ’। এটি টিপুর আদেশেই স্থাপিত হয়েছে। পাদশা’ টিপু সুলতানকেই বলা হত। তাঁর নামেই এই লিঙ্গ প্রতিকৃতি। পুষ্পগিরি মঠের স্বামী থঙ্গাপলি ও গোল্লাপলিকে গ্রামের রাজস্ব ভোগ করার জন্য অনুমতি দিয়েছিল। শ্রীরঙ্গপত্তনম দুর্গে রাজপ্রাসাদের প্রায় ১০০ গজ পশ্চিমে শ্রীরঙ্গনাথের জমকালো মন্দির ছিল। সেখানে সকাল সন্ধে ঘণ্টা-কাঁসর বাজত, পুরোহিতদের স্তোত্রপাঠ শোনা যেত। সুলতান কোনোদিন কখনো নিষেধ করেছেন বলে কোনো তথ্য পাইনি। দুর্গের মধ্যে, প্রাসাদের কাছে নরসিংহ ও গঙ্গাধরেশ্বর নামে দুটি বড়ো মন্দির ছিল, তাঁর সাম্রাজ্যের ভিতর এরকম হাজার হাজার মন্দির ছিল, সেইসব মন্দিরে আগত হিন্দুদের ভজনপূজনে বাধা দিয়েছেন, এমন নথি-নজিরও খুঁজে পাইনি।

টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি নাকি তাঁর রাজ্যের বহু মন্দির ও ব্রাহ্মণদের জমি মাত্রাধিক্যভাবে বেদখল নিয়েছিল। কোন্ জমি বেদখল করেছিল? অবশ্যই অননুমোদিত জমি। অননুমোদিত জমি সরকার নিয়ে নেয়, এ আর নতুন কথা কী! আজও নেয়। ভবিষ্যতেও নেবে। আজকাল অবশ্য ধর্মের সুড়সুড়ানির জন্য অননুমদিত জমি দখল করে মন্দির-মসজিদ গড়ে উঠলেও সরকার চোখ বন্ধ করে থাকেন। পাছে ভোটে টান পড়ে! কিন্তু সেসময় ওসব ধান্দাবাজি ছিল না। তাই অননুমোদিত জমিতে কিছু নির্মাণ গড়ে উঠলে সুলতান বাদশারা বিনা দ্বিধায় সরকারের জিম্মায় নিয়ে নিতে পারত। টিপুও তেমনই জমি বেদখল করেছিল। উল্টোদিকে টিপু বহু জমি মন্দিরের জন্য দানও করেছিলেন। শুধু মন্দির নয়, তিনি ব্রাহ্মণদেরও জমি দান করতেন। কয়েকটা বলি। গেঞ্জিকটার অঞ্জনের স্বামী মন্দিরে পুজো করার জন্য রামচর নামে এক ব্যক্তিকে কুড়াপা জেলার কোথানুথালা গ্রাম প্রদান করেন। কমলাপুর তালুকের বহু ব্রাহ্মণকে জমি দান করেছিলেন সুলতানই। ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ হরিপা নামে এক ব্রাহ্মণকে মঞ্জরাবাদ তালুকের একটি ‘ইনাম’ দান করেন। টিপু সুলতান মন্দির ও ব্রাহ্মণদের জন্য তুঙ্গভদ্রার তীরবর্তী ভূমি দান করেন। ব্রাহ্মণ পরিব্রাজকদের খাদ্য-খাবারের জন্য তিনি নির্দিষ্ট করে দিতেন। সুলতান বড়মহলের আমিলদার হরদেশাইয়াকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সমস্ত দান নেওয়ার জন্য। তবে ‘দেবদায়’ ও ‘ব্রাহ্মণদায়’ (মন্দির ও ব্রাহ্মণদের প্রদত্ত দান) ছাড়া। বাড়ির গৃহিণীরা হাড়িতে ভাত ফুটেছে কি না তা দেখার জন্য হাড়ির সমস্ত ভাত টিপে দেখেন না। একটি বা দুটি ভাত টিপেই সে বুঝতে পারে।

এবার আসি ধর্মান্তরের বিষয়ে। টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে মস্ত বড়ো অভিযোগ তিনি হিন্দুদের ধরে ধরে ধর্মান্তরিত করেছেন। বলা হয় কুর্গ ও মালাবারের হিন্দুদের জোর করে মুসলিম বানিয়েছে। তাঁর দেশে এত জায়গায় এত হিন্দু থাকতে কেবল কুর্গ ও মালাবার কেন? ইসলামে জোর করে ধর্মান্তরকরণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও কিছু ক্ষেত্রে টিপু সুলতান ধর্মান্তরকরণের ভয় দেখিয়েছেন। কারণ টিপুর কাছে। ধর্মান্তরকরণও এক ধরনের শাস্তি বলে বিবেচিত হত। টিপুর যুদ্ধের ইতিহাস পড়লে জানা যায় এই কুর্গ ও মালাবারের জাতিরা বারবার বিদ্রোহ করেছিল সুলতানের বিরুদ্ধে। বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। কাসঞ্চির কাছে। লেখা একটা চিঠিতে টিপু সুলতান লিখেছিলেন –“ছ-বার তাঁরা বিদ্রোহ করেছিল। ছ-বারই আমি তাঁদের ক্ষমা করি। তারপর অফিসার পাঠিয়ে ওদের ধর্মান্তরকরণের ভয় দেখানোর চেষ্টা হয়েছিল।” টিপু মনে করেছিলেন এ ধরনের ভীত ও আদর্শ শাস্তি দেখানোর পর বশে আনতে পারবে। অতএব এটা ছিল তাঁর রাজনৈতিক পদক্ষেপ, ধর্মগত নয়।

অনেক বিদ্রোহীরা পরবর্তীতে সুলতানকে খুশি করতেও ধর্মান্তরিত হয়েছে। এই আশায় যে, তাঁরা এমনিভাবে তাঁদের উপর প্রভাব হারিয়ে আর তেমন ভয়ের পাত্র থাকবে না। রামচন্দ্ররাও ‘পুঙ্গানুরির মতে— পুরুষ, মহিলা ও শিশু মিলিয়ে ৫০০ জন ধর্মান্তরিত হয়। ঐতিহাসিক মুর কুর্গে টিপুর ধর্মগত কারণে নিগ্রহ বিষয়ে কিছু লেখেননি। টিপু ব্যাপকভাবে হিন্দুদের ধর্মান্তরণ করিয়েছেন, আর যাঁরা মুসলিম হতে চায়নি তাঁদের হত্যা করা হয়েছে— এর সমর্থনে কোনো যথাযথ দলিল পাওয়া যায়নি। এমন সব অতিরঞ্জিত বর্ণনা পাওয়া গেছে যাতে প্রচুর তথ্যগত ত্রুটি আছে। তা ছাড়া টিপুর চরিত্রবৈশিষ্ট্যের সঙ্গেও এই অভিযোগগুলি খাপ খায় না। ১৭৯৪ সালেই মুর লিখেছেন– “কয়েক বছর যাবৎ মৃদু স্বভাব ব্যক্তিরা টিপুর নাম ও চরিত্র নিয়ে ঘৃণা প্রকাশে ইচ্ছুক হয়ে আমাদের ভাষা তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন উপযুক্ত বাক্য সন্ধানে। জঘন্য শব্দের ভাণ্ডারে নিঃশেষিত হয়েছে এবং সত্য সত্যই অনেকে দুঃখ করেছেন যে, টিপুর স্মৃতিকে যথাযোগ্যভাবে কলঙ্ক কালিমায় লিপ্ত করে রূপ দিতে পেরে এমন সুষম শব্দ-সম্পদ সরবরাহে ইংরেজি ভাষা সমৃদ্ধ নয়।” টিপুর মৃত্যুর পর বিটসন, কার্ক পেট্রিক ও উইলকস একে অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গেছেন সুলতানের কলঙ্ক রটানোর ক্ষেত্রে, আর তাঁদের বিবৃতি ব্রিটিশ ও ভারতীয় উভয় ঐতিহাসিকরাই চোখ বুজে গ্রহণ করেছে। কেন চোখ বুজে গ্রহণ করল? সেই প্রশ্নের উত্তরে একটু পরে আসছি। তার আগে দেখে নিই টিপুর বিরুদ্ধে কারা কারা কী বলে প্রশান্তি লাভ করেছে। কার্ক পেট্রিক টিপু সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন –“পরমত অসহিষ্ণু ধর্মান্ধ বা প্রচণ্ড ধর্মোন্মাদ”। উইলকস History of Mysore’ গ্রন্থে জোর করে ধর্মান্তকরণ ও দলে দলে সুন্নতকরণ, মন্দির ধ্বংস ও তৎসংলগ্ন জমি বাজেয়াপ্তকরণের কাহিনি বর্ণনা করেছেন এবং সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, টিপু ছিলেন একজন অসহিষ্ণু ধর্মান্ধ ব্যক্তি’ ও ‘যে-যুগে ধর্মগত কারণে নিপীড়নের ইতিহাস একটা কাহিনিমাত্র, তখন তার চূড়ান্ত বিভীষিকার সৃজন করেছিলেন। আওরঙ্গজেব ছাড়া খুব কম ভারতীয় নৃপতিই টিপু সুলতানের মতো অপবাদ ও মিথ্যাচারে অভিযুক্ত হয়েছেন।

লড়াকু বীর শাসক টিপু সুলতানের ভাগ্যে এত অপবাদ জুটে গেল কেন, তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হওয়ারই কথা নয়। ব্রিটিশরা টিপু সুলতান সম্বন্ধে প্রতিকূল ধারণা রাখত। খুব ভয়ে ভীত থাকত সর্বদা। তাঁরা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি দুর্ধর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে ভারতে সম্পূর্ণ দখলদারি সম্পন্ন হবে। এটা তো ঐতিহাসিকভাবে সত্য, সেসময় ভারত উপমহাদেশে রাজা, মহারাজা, সুলতান, নবাব শাসিত অসংখ্য ছোটোবড়ো ‘দেশ’ ছিল। টিপু ও সিরাজের মতো প্রতিরোধ্য শাসক ছাড়া কোনো অঞ্চল দখল নিতে ব্রিটিশদের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। বেশিরভাগ রাজা, মহারাজা, সুলতান, নবাবরা ব্রিটিশ কোম্পানির থেকে সামন্তরাজ হতে পেরেই খুশি ছিলেন। দেশপ্রেম বলে কোনো অনুভূতিই তাঁদের স্পর্শ করতে পারেনি। তাই পরাশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে দিয়েছিলেন নির্বিবাদে। যে সুলতানের জন্য তাঁদের এত শক্তিক্ষয়, এত অৰ্থক্ষয়, এত লোকক্ষয়, তাঁকে কালিমালিপ্ত না-করলে হয়! তা ছাড়া যেসব ব্যক্তিরা নৃশংসতার অভিযোগ তুলেছিল তাঁর কাছে পরাস্ত এবং ক্রুব্ধ ব্যক্তিরা। তাঁরা টিপুর বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে তাঁবেদার হয়েছে ফায়দার লোভে। টিপু কত খারাপ লোক ছিল আর আপনারা কত ভালো! টিপু যদি সত্যিই এত খারাপ লোক হত, তাহলে মহিশূরের জনগণ আজও তাঁকে মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করত না। সন্দেহ নেই, টিপু সুলতান যদি ব্রিটিশদের সঙ্গে সামন্তরাজা হয়ে থাকতে রাজি হয়ে যেতেন তাহলে তিনি আমৃত্যুকাল অক্ষত থাকতে পারতেন। দাসত্ব স্বীকার করা তাঁর মতো আত্মসম্ভ্রম বোধসম্পন্ন, স্বাধীনচেতা মানুষ দেশরক্ষায় তিনি জীবন দেবেন, এ আর নতুন কথা কী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *