বাবর (শাসনকাল : ১৪৯৪ সাল থেকে ১৫৩০ সাল)
ভারতের প্রথম মোঘল সম্রাট মোঙ্গলজাত বাবর (চুঘতাই ভাষায় ‘বাবুর’), পুরো নাম মির্জা জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ জালালউদ্দিন বাবর। বাবরের স্ত্রীরা হলেন –আয়েশা সুলতান বেগম, বিবি মুবারিকা ইউসুফযায়, দিলদার বেগম, গুলনার আগাচেহ, গুলরুখ বেগম, মাহাম বেগম, মাসুমাহ বেগম, নারাগুল আগাচেহ, সাদিয়া আফাঁক। তাঁর সন্তানসন্ততিরা হলেন –মির্জা হুমায়ুন, কামরান মির্জা, আসকারি মির্জা, হিন্দাল মির্জা, বারবুল মির্জা, ফারুক মির্জা, সুলতান আহমেদ মির্জা, আলোয়ার মির্জা এবং কন্যারা হলেন গুলবদন বেগম, মেহেরজান বেগম, ঈশান বেগম, গুলগাদার বেগম, গুলরঙ বেগম, গুলচেহারা বেগম। বাবর ভারত উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট। তিনি তৈমুর লঙের সরাসরি বংশধর এবং মাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। তিনি মির্জা ওমর শেখ মির্জার পুত্র, এবং তৈমুরী শাসক আবু সৈয়দ মির্জা প্রপৌত্র। বাবর জন্মেছিলেন ১৪৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, ফরঘান প্রদেশের (বর্তমানে উজবেকিস্তান নামে পরিচিত) আন্দিজান শহরে। তিনি ফরঘান প্রদেশের শাসনকর্তা ওমর মির্জার বড়ো পুত্র ছিলেন। মোঙ্গলদের থেকে উদ্ভূত বারলাস উপজাতিতে বেড়ে উঠলেও বাবরের জাতিতে তুর্কি ও পারস্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ছিল। বাবরের মাতৃভাষা ছিল চুঘতাই, যা তাঁর কাছে তুর্কি ভাষা নামে পরিচিত ছিল। বাবর একজন মোঙ্গলীয় (ফারসিতে মোগল বা মুঘল) হয়েও মধ্য এশিয়ার তুর্কি এবং ইরানিদের কাছ থেকে ব্যাপক সহযোগিতা লাভ করেছিলেন এবং তাঁর সৈন্যবাহিনীতে পারসি, পাঠান, আরবীয় মানুষ ছিলেন। এছাড়াও তাঁর সৈন্যবাহিনীতে কুইজিলবাস যোদ্ধাদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
পিতা ওমর শেখ মির্জার অকালমৃত্যুতে ফরগানা শাসনের গুরু দায়িত্ব বাবরের কাঁধে চেপে বসে। শিশু বাবরের বয়স তখন মাত্র ১২, সালটা ১৪৯৪। বাবর যে যুগের মানুষ সে যুগে নিজরাজ্য রক্ষা করা খুব সহজ কাজ ছিল না। বিশেষ করে বাবর যে অঞ্চলের রাজা বা শাসক ছিলেন, সেই মধ্য এশিয়ায় তো কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। সেই মধ্য এশিয়ায় অসংখ্য রাজ্য বা দেশ, তার অসংখ্য রাজা। সকলেই চেঙ্গিস খাঁ ও তৈমুর লঙের বংশধর মনে করতেন। ফলে সকল রাজার চোখে দিগ্বিজয়ের নেশা। অতএব প্রতি মুহূর্তেই রাজ্যের সীমানা, স্থিতি এবং রাজার ভাগ্য সরু সুতোয় ঝুলে থাকত। কখন কোন্ রাজার ভবলীলা সাঙ্গ হবে তা কেউ জানত না। দেশ বা রাজ্যগুলি বারবার আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণের কখনো আকারে ছোটো হয়ে যেত, কখনো বড়ো হয়ে যেত। কখনো-বা গোটা দেশটাই ভ্যানিশ হয়ে যেত। সেইসঙ্গে প্রজাদেরও ভাগ্য বদলে যেত।
বাবরের ঠাকুরদা আবু সৈয়দ মির্জা বংশীয় রীতি অনুসারে তাঁর চার ছেলের মধ্যে আপন রাজ্য ভাগ করে দিয়ে গেলেন। সেই ভাগে বাবরের পিতার ভাগ্যে পড়ল একটি ছোট্ট রাজ্য ফরঘান। বাবররা চার ভাই ছিলেন বটে, কিন্তু চার ভাই-ই এক মায়ের সন্তান ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন মায়ের সন্তান। বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জারও ছিল রাজ্য বিস্তারের নেশা। শুধু নেশা থাকলেই তো হবে না, সেইসঙ্গে যথেষ্ট সামর্থ্য থাকাও জরুরি। অন্যের ফলে কামড় বসাতে হলে নিজের দাঁতের মজবুতিটাও বুঝে নেওয়ার দরকার। সেটা না-বুঝেই বাবরের পিতা পড়শি রাজ্যগুলির সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে এলাকাগুলি দখল করতে ছুটলেন। শক্তি সামর্থ্য না-থাকার ফলে রাজ্য বিস্তার তো দূরের কথা, উল্টে নিজের রাজ্যই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হতে থাকল। তাঁর রাজ্যের একটা বড়ো অংশই চলে গেল তাঁরই শ্বশুর ইউনুস খানের কবজায়। শ্বশুরের সেনাবাহিনীর হাতে ব্যাপক মার খেলেন বাবরের পিতা। যুদ্ধনীতি অনুসারে বন্দিও হলেন তিনি। শিকলে বেঁধে মোঙ্গল-প্রধান তথা শ্বশুর ইউনুস খানের কাছে হাজির করা হল বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জাকে। জামাইকে দেখে তো শ্বশুরমশাই হতভম্ব। তিনি নিজেই উঠে এসে জামাইয়ের বাঁধন খুলে দিলেন এবং নানাবিধ উপহারাদি দিয়ে ফরঘানে পাঠিয়ে দিলেন। সঙ্গে ইউনুস খান নিজে ফরঘানায় এলেন এবং জামাইয়ের সঙ্গে প্রায় দুই মাস অতিবাহিত করলেন।
যাই হোক, ইউনুস খানের মৃত্যুর পর তাঁর রাজ্য মুঘলিস্তান দুই ছেলে মাহমুদ খান ও আহমেদ খানের মধ্যে ভাগ হল। বড়ো ছেলে মাহমুদ খানই হলেন মোঙ্গল-প্রধান। এদিকে বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জা এত মার খেয়েও শিক্ষা হয়নি। তাঁর বড়ো ভাই সুলতান আহমদ মির্জা ও বড়ো শ্যালক মোঙ্গল-প্রধান মাহমুদ খানের সঙ্গে বিবাদ বাধাতে গেলেন। মাহমুদ মির্জা কেবল আহমেদ মির্জার শ্যালকই ছিলেন না, তাঁরা মৈত্রী সূত্রে আবদ্ধও হয়েছিলেন। সেই মিত্রতা আরও দৃঢ় করতে আহমদ মির্জার মেয়ের সঙ্গে মাহমুদ মির্জার বিয়েও দেওয়া হয়েছিল। এই বিয়ে প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে রাজতন্ত্রে নিজের রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখতে এবং রাজ্যের রাজাদের সঙ্গে জোট বাঁধতে নিজেদের মধ্যে বিয়েপ্রথা ছিল একটা সহজতম পথ। তাই প্রয়োজনে একাধিক বিয়ে করতে হত। এটাকে বলা যায় ‘রাজনৈতিক বিবাহ।
বাবরের পিতার কার্যকলাপে আহমদ মির্জা ও মাহমুদ খান দুজনেই ক্রুব্ধ হলেন। বাবরের পিতাকে চিরকালের মতো রাজ্যক্ষুধা মিটিয়ে দিতে তাঁরা দৃঢ়সংকল্প হলেন। আহমদ মির্জা ও মাহমুদ খান ফরঘানার দু-দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ করলেন। এই আক্রমণে ফরঘান রাজ্য ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। এই বিপর্যস্ত অবস্থাতে বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জা ক্ষান্ত হলেন না। ধন-সম্পদ-রাজ্য-জীবন বাজি ধরে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। ফরঘানার রাজধানী অন্দিজানের শাসনভার শিশু বাবরের হাতে অর্পণ করে যুদ্ধে রওনা দিলেন। বাবরকে সাহায্য করার জন্য রেখে গেলেন কয়েকজন বেগ বা আমিরকে। ভাগ্য সহায় না-থাকলে যা হয়! বাবরের পিতা উমর শেখ মির্জার মৃত্যু হল ভগ্নপ চাপা পড়ে। অখসি দুর্গ রক্ষা করতে গিয়ে দুর্গের ভিতর কবুতরখানা বাড়িটি অকস্মাৎ ধসে পড়ে উমর শেখের ঘাড়ে। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তাঁর অকালমৃত্যু হয়।
এ সংবাদ শুনে শিশু বাবরের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কীভাবে সে রাজ্য রক্ষা করবে? শোকে চোখের জল ফেলবার অবকাশ নেই তাঁর। শিশু রাজার কাছে এখন তাঁর অস্তিত্ব রক্ষাই বিরাট প্রশ্নের মুখে। যে-কোনো মুহূর্তেই শত্রুর অস্ত্রে শিশু বাবরের শরীর ফালাফালা হয়ে যেতে পারে। শেরিম তঘাই পরামর্শ দিলেন –‘রাজধানী অন্দিজান ত্যাগ করে আউজকিন্টের রওনা দিন এবং সেখানকার পাহাড়ি এলাকায় গা-ঢাকা দিয়ে থাকুন। পরে সময়-সুযোগ বুঝে বড়ো মামা সুলতান মাহমুদ বা ছোটো মামা আহমদ খান যাঁর সঙ্গে খুশি চলে যাবেন। এ খবর জানাজানি হতেই রাজপরিবারের ওস্তাগর (দর্জি) খাজা মোহম্মদ ছুটলেন শিশু বাবরকে ফিরিয়ে আনতে। সফলও হলেন তিনি। দুর্গে ফিরিয়ে আনলেন শিশু বাবরকে। উপস্থিত বেগেরা সমগ্র পরিস্থিতি খুঁটিনাটি বিচার করে সিদ্ধান্ত নিলেন, শত্রুপক্ষের কাছে কোনোমতেই মাথা নত করা হবে না। এরপর শিশু বাবরকে প্রচুর যুদ্ধ করতে হয়েছিল। সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য নয়। শত্রুপক্ষের আক্রমণকে প্রতিহত করতেই তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। সেই শত্রুপক্ষের মধ্যে বাবরের আত্মীয়রাই ছিল। যেমন তাঁর বড়ো মামা সুলতান মাহমুদ বা ছোটো মামা আহমদ খান প্রমুখ। সকলের চোখেই দিগ্বিজয়ের নেশা। পররাজ্য গ্রাসের দিকে নজর। আর শিশু বাবরের ফরঘান রাজ্য তো সকলের দৃষ্টিতে অনাথ। বাবর সহ পিতৃহীন তিন নাবালক শিশু যাঁর উত্তরাধিকারী। তার উপর তাঁরা আবার এক মায়ের পেটের ভাই নয়। বালক রাজাকে থিতু হয়ে বসতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। সুলতান আহমদ মির্জা ও মোঙ্গল-প্রধান মাহমুদ খান ঝাঁপিয়ে পড়লেন ফরঘানে। এর ফলে অন্য রাজ্যের আক্রমণে বাবরের রাজ্য ফরঘান ক্রমশই ছোটো হয়ে যাচ্ছে। তবে দুই শক্তিধর রাজার শক্ত হাতের মুঠোর ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরে বালক বাবর তাঁর সৈন্যদের মনোবল বেড়ে গেল। একসময় শত্রুমুক্ত হয়ে বালকরাজা বাবর ও তাঁর বেগেরা এবার নিজরাজ্যের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তৎপর হলেন। নজর দিলেন প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিকে। একথা বলে রাখা জরুরি যে, মুসলিম শাসকদের মাতামহীরা ছিলেন প্রবল ক্ষমতাধর, বিচক্ষণ। সিরাজের পাশে যেমন ছিলেন তাঁর নানিজান, তেমনি বালক বাবরের পাশেও পাচ্ছি মাতামহী অইসান দৌলত বেগমকে। অতি বুদ্ধিমতী ছিলেন এই মহিলা। রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতা তো আসলে তাঁর হাতেই ছিল। তাঁর নির্দেশ-উপদেশ মতোই রাজ্য পরিচালিত হত।
বাবরের কাকা উপর্যুপরি তাঁকে সিংহাসন চ্যুত করার চেষ্টা করছিলেন। অন্যন্য বহিঃশত্রুতা তো ছিলই। একসময় সে বাবরকে ক্ষমতাচ্যুত করতেও সফল হয়। ফলে জীবনের বেশকিছু সময় তাঁকে আশ্রয়হীন এবং যাযাবর থাকতে হয় কিশোর বাবরকে। এই সময়টুকুতে তাঁর সঙ্গে কেবল তাঁর বন্ধু ও চাষিদেরই যোগাযোগ ছিল। ১৪৯৭ সালে বাবর সমরকন্দের উজবেক শহর আক্রমণ করেন। সাত মাস পর সেই শহর দখল করতে সমর্থ হন। কিন্তু ফরঘনায় কিছু নোবেলদের বিদ্রোহের কারণে তাঁকে স্থানটি হারাতে হয়। ফরঘনা পুনরুদ্ধারের জন্য অগ্রসর হলে তাঁর বাহিনীর লোকজন তাঁকে ফেলে চলে যায়। ফলে তাঁকে সমরকন্দ ও ফরগানা উভয় অঞ্চলই হারাতে হয়। ১৫০১ সালে বাবর পুনরায় সমরকন্দের দখল নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। তবে বাবর পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ মোহাম্মদ শেবানি খানের কাছে বিশ্রীভাবে পরাজিত হন। তবে তিনি তাঁর কয়েকজন অনুগামীদের নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
বাবর বুঝলেন এভাবে হয় না। এভাবে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। তাঁর সেনাবাহিনীকে প্রচণ্ড শক্তিশালী করে তুলতে হবে। তিনি একটি শক্তিশালী সৈন্যদল গঠনে মনযোগী হন। বিশেষ করে সেই সেনাদলে প্রধানত তাজিক ও বাদা শানদেরকে তাঁর দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৫০৪ সালে বরফাবৃত অঞ্চল হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করেন এবং কাবুল (বর্তমানে আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্ত, রাজধানী) দখল করেন। এই দখলের মধ্যে দিয়ে তিনি একটি নতুন ধনী ও সমৃদ্ধ রাজ্য লাভ করে নিলেন। অনুকূলে ঘুরে যায় বাবরের ভাগ্য এবং তিনি ‘বাদশাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। এর মধ্যে তিনি এই রাজ্যকে প্রাচুর্যমণ্ডিত করে তোলেন। হেরাতের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের আধিক্য তাঁকে চমৎকৃত করে। ঘনিয়ে আসা একটি বিদ্রোহ তাঁকে হেরাত থেকে কাবুল আসতে বাধ্য করে। তিনি এই পরিস্থিতিও সামলে নেন। তবে দুই বছর পর একটি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর তাঁর কিছু শীর্ষস্থানীয় নেতা তাঁকে কাবুল থেকে তাড়িয়ে দেন। বাবর কিছু সঙ্গী সহ সেই মুহূর্তে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেলেও পুনরায় তিনি শহরে ফিরে এসে কাবুল দখল করেন। বিদ্রোহীদের তিনি তাঁর অধীনে আনতে সক্ষম হন। অপরদিকে বাবর যাঁর কাছে বিশ্রীভাবে পরাজিত হয়েছিলেন সেই মোহাম্মদ শেবানি খান ১৫১০ সালে পার্সিয়ার শাসনকর্তা ইসমাঈল সাকাভিদের কাছে নিহত হন। বাবর সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন। তাঁর পূর্বপুরুষের রাজ্য তিমুরিদ পুনঃরুদ্ধার করতে চেষ্টা করেন এবং বছর কয়েক বাদে বাবর শাহ ইসমাঈলের সঙ্গে মধ্য এশিয়া দখলের জন্য মিলিত হন। বাবর সাকাভিদকে তাঁর রাজ্যে সার্বভৌম রাজা হিসাবে পরিচালনা করার অনুমতি দেন। শাহ ইসমাঈল বাবর ও তাঁর বোন খানজাদার মধ্যে পুনর্মিলন ঘটান। খানজাদাকে শেবানি খান বন্দি করে জোরপূর্বক বিয়ে করেছিলেন। ইসমাঈল বাবরকে অনেক ধনসম্পদ এবং রসদ সরবরাহ করেছিলেন। প্রতিদানে বাবর শাহ ইসমাঈলকে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করেন। ১৫১১ সালে প্রায় দশ বছর পরে বাবর সমরকন্দে পুনরায় প্রবেশ করতে সমর্থ হন। আবারও জনগণ তাঁদের মুক্তিদাতাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আট মাস পরে বাবর পুনরায় উজবেক জয় করতে সক্ষম হন।
বাবরের এবারের লক্ষ্য ভারত ভূখণ্ড। শৈশবকাল থেকে লড়াই করতে করতে শত্রুর মোকাবিলা করতে করতে বাবরের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস প্রবলতর হয়েছে। এদিকে পশ্চিমদিক থেকে উজবেকদের আক্রমণের ভয়ও ছিল তাঁর। বলা যায় আত্মরক্ষার জন্যেই তাঁকে ভারতের দিকে মনোনিবেশ করতে হয়। বিশেষ করে আইয়ুদিয়ার রাজ্য এবং পেনিনসুলার মালায়া।
তিনি কাবুলের পশ্চিমদিক থেকে আক্রমণ চালানোর একটি রণকৌশল ঠিক করেন ভারত দখলের জন্য। পূর্বেই কান্দাহার অবরোধ করে দিয়েছিলেন। প্রায় তিন বছর পর কান্দাহার ও এর পৌরদুর্গ বেদখল হয়েছিল এবং এছাড়াও অন্যান্য ছোটোখাটো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই খণ্ডযুদ্ধগুলো বাবরকে সফল হওয়ার সুযোগ করে দেয়। পাঞ্জাবে প্রবেশের সময় বাবরের রাজদূত লঙ্গর খান নিয়াজি বাবরকে পরামর্শ দেন জানজুয়ার রাজপুত্রকে এই অভিযানে সম্পৃক্ত করার জন্য, তাঁদের এই দিল্লি জয়ের অভিযান বেশ পরিচিত লাভ করে। বাবর তাঁর প্রধান ব্যক্তি মালিক আসাদ এবং রাজা সংগ খানের কাছে তাঁর রাজ্যে ঐতিহ্যগত শাসনের সুফল এবং তাঁর পূর্বপুরুষের সহযোগিতার কথা তাঁদের কাছে উল্লেখ করেন। বাবর শত্রুদের পরাজিত করে তাঁদের নিজের দলে ভিড়ান। ১৫২১ সালে গাখারসে তাঁর মিত্রদের একত্রিত করেন। বাবর তাঁদের প্রত্যেককে সেনাপ্রধান হাসান রানা সঙ্গকে পরাজিত করেন, এটিও তার ভারত দখলের অন্তর্ভুক্ত। ইসমাঈলের বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয় অটোম্যান রাজার বিরুদ্ধে চালদ্রিরান যুদ্ধে। এই যুদ্ধে ‘ম্যাচলক মাস্কেট’ নামক এক ধরনের নতুন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। বাবর এবং ইসমাঈল দুজনেই প্রযুক্তির উন্নয়ন উপলব্ধি করেন এবং বাবর তার বাহিনীকে ম্যাচলক যন্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতে একজন অটোম্যান উস্তাদ আলিকে তাঁর বাহিনীতে আমন্ত্রণ জানান। উস্তাদ আলিকুলি খান তখন ম্যাচলক মানব নামে পরিচিত ছিলেন। এই অস্ত্রগুলো স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের হাতে দেওয়া হয় শত্রুদের মোকাবিলা করার জন্য। ভারতের পথে অগ্রসর হওয়ার সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলোর সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধের সময় এটি ব্যবহার করা হয় শুধুমাত্র শত্রুদের অবস্থান এবং কৌশল পরীক্ষা করার জন্য। বাবর কোনো অঞ্চল জয়ের পর স্থানীয়দের খুশি করার চেষ্টা করতেন। স্থানীয় মানুষরা তাঁর উপর যাতে বিরাগভাজন হয়ে না পড়েন সেজন্য স্থানীয় সংস্কৃতি পালনের পাশাপাশি বিধবা ও অনাথদের সাহায্য করতেন।
ইব্রাহিম লোদি তাঁর রাজ্যের কাছে খুবই অপ্রিয় মানুষ ছিলেন, এমনকি তাঁর নিজস্ব নোবেলদের কাছেও বিরাগভাজন ছিলেন। বাবর প্রায় ১২০০০ সৈন্য সংগ্রহ করেন এবং লোদির আফগান নোবেলদেরকে তাঁর শামিল হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। এই সৈন্যসংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কেননা তাঁরা অগ্রসর হওয়ার সময় স্থানীয় অনেকেই তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছিল। ১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিলে ইব্রাহিম লোদিও প্রায় এক লক্ষ সৈন্য এবং ১০০টি হাতি সহ বাবরের দিকে অগ্রসর হন। তখন বাবরের সৈন্যসংখ্যা লোদির অর্ধেকেরও কম ছিল, যা সর্বসাকুল্যে প্রায় ২৫০০০-এর মতো। সংঘটিত এই যুদ্ধটি পানিপথের প্রথম যুদ্ধ নামে খ্যাত। এটাই বাবর ও লোদির মধ্যে প্রধান সংঘাত। আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরা করা ‘ম্যাচলক মাস্কেট বাবরের সৈন্যদলে থাকার কারণে এই যুদ্ধে ইবরাহিম লোদি নিহত হন এবং তাঁর সৈন্যবাহিনীদের পরাজিত করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বাবর আর কালবিলম্ব না-করে দ্রুত দিল্লি এবং আগ্রা উভয়ের দখল নেন। ওইদিনই বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ুনকে আগ্রা যাওয়ার আদেশ দেন জাতীয় ধনসম্পদ লুটপাটের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। হুমায়ুন সেখানে গোয়ালিয়রের রাজাকে পেয়ে যান। সেই রাজার সঙ্গে যুদ্ধ সংঘঠিত হয় এবং রাজা যুদ্ধে নিহত হন। রাজার পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তা নিশ্চয়তা লাভের আশায় হুমায়ুনকে একটি বড়ো হিরে দেন। এই হিরেটিই জগদ্বিখ্যাত কোহিনুর। কোহিনুর শব্দের অর্থ আলোর পর্বত।
বিজয়ের তৃতীয় দিন বাবর দিল্লি পৌঁছোন। পরে তিনি আগ্রার দিকে অগ্রসর হন ছেলে হুমায়ুনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। দিল্লি ও আগ্রা দখলের পর বাবর মেবারের রাজপুতরাজ রানা সংগের দুশ্চিন্তায় বিনিদ্র রজনী কাটাতে লাগলেন। বাবরের অভিযানের আগে রাজপুতের জমিদারেরা সালতানাতের কিছু জাতি জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা বাবরের নতুন রাজ্যের দক্ষিণ পশ্চিমের একটি অঞ্চল সরাসরি শাসন করত, যা রাজপুতানা’ নামে পরিচিত ছিল। এটি কোনো একতাবদ্ধ রাজ্য ছিল না। বলা যায়, এটি ছিল রানা সংগের অধীনস্থ কিছু রাজ্যের সমষ্টি।
বাবর আক্রমণকারীই হোন অথবা বিজয়ী— বাবর সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কাছে খুব বেশি তথ্য নেই। ইতিহাসবিদ হরবংশ মুখিয়ার কথায়, “সংস্কৃতি, সাহসিকতা আর সেনা পরিচালনার ক্ষেত্রে বাবর নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যদি বাবর ভারতে না আসতেন, তাহলে এই দেশের সংস্কৃতি হয়তো এতটা বিচিত্র হওয়ার সুযোগ পেত না।” ভাষা, সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য, পোশাক অথবা খাবার-দাবার— প্রতিটা বিষয়েই মোগলদের অবদান অনস্বীকার্য বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ মুখিয়া। হরবংশ মুখিয়ার মতে, বাবরের চিন্তাধারায় কখনও হার না মানার একটা মানসিকতা ছিল। শারীরিক দিক থেকে সম্রাট বাবর ভীষণ শক্তপোক্ত গড়নের মানুষ ছিলেন। কথিত আছে, তিনি তাঁর দুই কাঁধে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিয়ে দৌড়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যেতে পারতেন। এছাড়া একটানা ৩০ ঘণ্টা সাঁতার কাটতে পারতেন তিনি। একজন সফল শাসক তথা যোদ্ধার যেমনটা হওয়া উচিত। তাঁর হৃদয়ে সমরখন্দ দখলের স্বপ্ন ছিল। তিনবার দখল করেছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁকে। যদি তিনি সমরখন্দ দখলে সফল হতেন, আর সেখানকার রাজা হিসাবেই থেকে যেতেন, তাহলে হয়তো কাবুল বা ভারত দখল করে রাজত্ব করার কথা তিনি ভাবতেনও না। তা ছাড়া উজবেকদের ভয়ও বাবরের ভারতে আসার অন্যতম কারণ।
তুর্কি ভাষায় কবিতা লিখতেন বাবর। বাবরনামায় ব্যবহৃত বেশ কিছু শব্দ এখন ভারতে প্রতিদিনের ভাষার অঙ্গ হয়ে গেছে। যেমন ‘ময়দান’ শব্দটা তাঁর জীবনীতেই প্রথমবার দেখা যায়। সেভাবেই অনেক তুর্কি আর ফারসি শব্দ ভারতীয়দের মুখের ভাষায় ঢুকে গেছে। ইতিহাসবিদ মুখিয়ার মতে যুদ্ধ, সাম্রাজ্য পরিচালনার মধ্যেও নিজের পরিবারের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন বাবর। ১৫২৯ সালে ঘাঘরার যুদ্ধে আফগানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় মোগল সাম্রাজ্যকে হিন্দুস্তানে পাকাঁপোক্ত একটি অবস্থান গড়ে দিল। যদিও খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের পরাজয়ের পর মোগল সাম্রাজ্যের সমস্ত শক্রশক্তিই মাটিতে মিশে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরেও হিন্দুস্তানের পূর্বাঞ্চলে আফগানরা বেশ শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছিল। অবশেষে নতুন আফগান অধিপতি ইব্রাহিম লোদির ভাই সুলতান মাহমুদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মোগল সাম্রাজ্যের জন্য শেষ এই হুমকিটিও নির্মূল হয়ে গেল। ঘাঘড়ার যুদ্ধের বেশ কয়েকমাস আগেই, ১৫২৭ সালের ১৬ মার্চ খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের পরাজিত করে সম্রাট বাবর নিজের পরিবারের জন্য হিন্দুস্তানকে নিরাপদ ভাবতে শুরু করেন।
২২ ডিসেম্বর, ১৫৩০ সাল। আগ্রার পুরোনো দুর্গ। নিজের শারীরিক দুর্বল অবস্থা নিয়েই সম্রাট বাবর রাজদরবারে তাঁর সিংহাসনে গিয়ে বসলেন। পরিবার আর সভাসদের সবাই অনুরোধ করছিলেন যা বলার তা নিজের ব্যক্তিগত কক্ষ থেকেই ঘোষণা করতে। কিন্তু সম্রাট বাবর চাইছিলেন যা বলার তা এই সিংহাসন থেকেই বলবেন। অসুস্থ সম্রাট সিংহাসনে বসে আছেন। দরবার আর পরিবারের লোকেরা উৎসুক দৃষ্টিতে সম্রাটের দিকে চেয়ে আছেন। সম্রাট বাবর কিছু বলতে শুরু করলেন। তবে তাঁর কণ্ঠ শুনে বোঝা যাচ্ছিল কথা বলতে সম্রাটের বেশ কষ্ট হচ্ছিল। তারপরও তিনি বলতে লাগলেন –“আল্লাহর কৃপায় ও আপনাদের সমর্থনে আমি আমার জীবনে সব কিছুই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। পৃথিবীতে আমার সব ইচ্ছাই পূরণ হয়েছে। তবে আমি সুস্থ অবস্থায় নিজের সব কাজ সম্পন্ন করতে পারলাম না। আজ আপনাদের সামনে আমি নিজের শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করছি। আমার পরে আমি মোঘল সিংহাসনে হুমায়ুনকে বসিয়ে যেতে চাই। আমি আশা করব, আমার প্রতি আপনারা যেমন অনুগত ছিলেন, বাদশাহ হিসাবে আপনারা হুমায়ুনের প্রতিও ঠিক তেমনই অনুগত থাকবেন। তাঁর সমস্ত কাজকে সমর্থন জানাবেন। আমি আশা করছি, মহান আল্লাহর দয়ায় হুমায়ুন সফলভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে।” এরপর সম্রাট বাবর হুমায়ুনের দিকে তাকিয়ে দুর্বল কণ্ঠে বললেন –“হুমায়ুন আমি তোমাকে, তোমার ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন ও তোমার প্রজাদের আল্লাহর হাতে সমর্পণ করে যাচ্ছি।”
সম্রাট বাবর চাইলেই পারতেন নিজের ব্যক্তিগত কক্ষে সবাইকে ডেকে নিজের শেষ ইচ্ছার কথা বলে যেতে। কিন্তু তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের কোনো সুযোগ দিতে রাজি ছিলেন না। তিনি জানতেন, তাঁর মৃত্যুর পর হুমায়ুনকে সিংহাসনে বসতে বাধা দেওয়া হবে। তাই জীবিতকালেই সকলের সামনেই আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি হুমায়ুনকে সিংহাসনের বৈধ দাবিদার স্বীকৃতি দিয়ে দিলেন। তিনি ভালো করেই জানতেন, চার বছর আগে ইব্রাহিম লোদির মায়ের দেওয়া বিষের ফলে তিনি যখন শয্যাশায়ী ছিলেন, তখন এই দরবারের একাংশ হুমায়ুনের পরিবর্তে তাঁর ভগ্নিপতি মেহেদি খাজাকে সিংহাসনে প্রায় বসিয়ে ফেলার আয়োজন করে ফেলেছিল। সম্রাট বাবর হয়তো এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটি জানতেনই না, কিন্তু মেহেদি খাজার বোকামিতে বিষয়টি ধরা পড়ে যায়। হুমায়ুনের পরামর্শে মেহেদি খাজাকে নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। একইসঙ্গে তাঁর জন্য দরবারের কারোর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বাবরের দরবারে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। সেইবার বাবর বেঁচে গেলেও বিষের প্রভাব তাঁর শরীরে থেকে গিয়েছিল। খুব ধীরে ধীরে হলেও বিষাক্রান্তের ফলে শরীরের ভিতর থেকে দুর্বল হচ্ছিলেন তিনি। এমনিতেই হিন্দুস্তানের আবহাওয়াও বাবরকে কম ভোগায়নি। সব মিলিয়ে হিন্দুস্তানে আসার পর থেকেই বাবর বিভিন্ন মানসিক আর শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন।
পুত্র হুমায়ুনের প্রতি তাঁর গভীর পিতৃস্নেহ ছিল। হুমায়ুনকে তিনি তাঁর অন্য যে-কোনো পুত্র থেকে বেশি ভালোবাসতেন। গোটা হিন্দুস্তান অভিযানের সময় বাবরকে সঙ্গ দিয়েছিলেন তাঁর এই পুত্র। তাই বাবর আর হুমায়ুনের মাঝে একটি বিশেষ আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়েছিল, যা বাবরের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বজায় ছিল। ইতিহাসবিদ মুখিয়া লিখেছেন, হুমায়ুনের একবার কঠিন অসুখ হয়েছিল, সেই সময়ে বাবর ছেলের শরীর ছুঁয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে। প্রার্থনা করেছিলেন যে, “হে আল্লাহ, যদি একজনের প্রাণ নিয়ে আরেকজনের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে পুত্রের প্রাণের বিনিময়ে আমার নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে আমি প্রস্তুত।” মুখিয়া বলেন, “হুমায়ুন সে যাত্রা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন বটে, কিন্তু ওই ঘটনার কিছুদিন পরেই বাবর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তারপরেই তাঁর মৃত্যু হয় ২৬ ডিসেম্বর, ১৫৩০ সাল।” ১২ বছর বয়স থেকে ৪৭ বছর বয়সে মৃত্যু পর্যন্ত টানা যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মোহম্মদ বাবর। সম্রাট বাবর মৃত্যুর পূর্বেই তাঁকে কাবুলে সমাহিত করার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ীই মৃত্যুর পর মোগল এই বীরকে যমুনার আড়াই কিলোমিটার পূর্বে আরামবাগের চারবাগে সমাহিত করা হয়। এখানেই একটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। যমুনার পূর্বদিকে তৎকালীন সময়ে প্রচুর বাগান ছিল, যা হিন্দুস্তানের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য থেকে বেশ ব্যতিক্রম ছিল। ঠিক এ কারণেই হিন্দুস্তানের অধিবাসীরা তখন এই স্থানটিকে কাবুল বলত। বাবর তাঁর ইচ্ছাপত্রতে এই কাবুলের কথাই বলেছেন। আর সম্রাট হুমায়ুনও পিতার ইচ্ছাটির কথা জানতেন। তাই সম্রাট বাবরকে যমুনার পূর্ব তীরেই সমাহিত করা হয়েছিল। কিন্তু শের শাহের শাসনামলে বাবরেরই এক স্ত্রী বেগা বেগম বাবরের দেহাবশেষ আফগানিস্তানের কাবুলে বাবরের আর এক সৃষ্টি ‘বাগ-ই-বাবুর’-এ স্থানান্তর করেন। বেগা বেগমের এই সিদ্ধান্তের কারণ আজও অস্পষ্ট! বাদশাহ বাবরের আদেশে ১৫২৮ সালে কাবুলে এই বাগানটি নির্মাণ করা হয়েছিল। মোগলদের সবসময়ই বাগানের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল। মোগলরা যেখানেই সীমানা বিস্তার করতে পেরেছিলেন, এখানেই তৈরি করেছেন বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর বাগান। কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, হুমায়ুন সে সময় ক্ষমতায় থাকলে নিজের পিতার সমধি কখনোই আফগানিস্তানের কাবুলে স্থানান্তর করা হত না। বাবর সারাজীবন তাঁর ভালোবাসার হিন্দুস্তানের মাটিতেই। শুয়ে থাকতে পারতেন। হিন্দুস্তান বাবরের কাছে অপছন্দের হলেও তিনি নিজের ভাগ্য মেনে নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, তাঁর ভবিষ্যৎ বংশধররা ঠিকই একদিন হিন্দুস্তানকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেবে। আর তাঁরা হিন্দুস্তানকে মন থেকেই আপন করে নেবে। বাবরের ধারণা কোনো অংশেই ভুল প্রমাণিত হয়নি। বাবরের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঠিকই হিন্দুস্তানকে ভালোবেসে শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিলেন। নিজেদের মনমতো নানা রঙে তাঁরা হিন্দুস্তানকে সাজিয়ে তুলেছিলেন। আজও হিন্দুস্তানের পথে প্রান্তরে তাঁদের ভালোবাসার সেসবের ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। তবে বাবর একবারেই হিন্দুস্তানকে পছন্দ করতে পারেননি। পছন্দ করতে পারেননি মূলত জলবায়ু ও আবহাওয়ার কারণে। বাবর লিখেছেন –“হিন্দুস্তানে কোনো মজা নেই। লোকগুলোর কোনো সৌন্দর্য নেই … এদের শিল্পকলা, হাতের কাজে কোনো সুসংগতি, সামঞ্জস্য নেই.. এখানে বরফ পাওয়া যায় না… কোথাও স্নানাগার নেই।” উত্তর-পশ্চিম ভারতের বর্ষাকাল বাবরের পছন্দ ছিল বটে। তবে ভ্যাপসা ভাবটা একদম পছন্দের ছিল না। যে বাবরনামার জন্য বাবর সর্বাধিক স্মরণীয়, সেই বাবরনামায় ১৫২৮ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই পাঁচ মাসের বিবরণ পাওয়া যায় না। ওই অংশটা হারিয়ে গেছে। কীভাবে হারাল তা রহস্যাবৃত। অনেকে বলেন, ওই সময়কালে বাবর অযোধ্যায় ছিলেন এবং নির্মাণ হয় বাবরি মসজিদ। বাবরনামা থেকে ওই সময়ের পৃষ্ঠাগুলি হারিয়ে যাওয়ায় রামমন্দির ধ্বংস করে মসজিদ গড়েছিল, নাকি মসজিদস্থলে কোনো মন্দির ছিলই না, তা জানার কোনো উপায় নেই। বাবরি মসজিদ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব।
মৃত্যুর পূর্বে সম্রাট বাবর তাঁর পুত্রের জন্য ফারসিতে ‘ওয়াসিয়াতনামা-ই-মাখফি’ বা ‘গোপন উইল’ শিরোনামে একটি গোপন নির্দেশনামা রেখে যান। এই উইলটি ভারতের ভুপালের হামিদা লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ছিল। নানলাল সি মেহতা (তিনি এনসি মেহতা নামেই বেশি জনপ্রিয়)। সাহাদত হোসেন খানের ‘মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়’ শীর্ষক গ্রন্থটির সৌজন্যে উইলটির বাংলা অনুবাদ উৎসুক পাঠকদের জন্য উল্লেখ করা হল –“সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য। নাসরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুনের নিকট জহির উদ-দিন মোহাম্মদ বাবর বাদশাহ গাজির গোপন উইল। আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন। সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতার জন্য আমি তোমার নিকট এই নির্দেশাবলি রেখে যাচ্ছি। আমার প্রিয় পুত্র, হিন্দুস্তান একটি বৈচিত্রপূর্ণ দেশ। মহান আল্লাহর কাছে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, তিনি হিন্দুস্তানকে আমার সাম্রাজ্য হিসাবে দান করেছেন। তোমাকে সকল ধর্মীয় গোঁড়ামির উর্ধ্বে উঠে প্রত্যেক ধর্মের মূলনীতি অনুযায়ী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে, বিশেষ করে হিন্দুস্তানে গোরু জবাই থেকে বিরত থাকতে হবে। গোরু জবাই থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে এ দেশের মানুষের মন জয় করে নেওয়ার একমাত্র উপায়। এই কাজটি করলে সাম্রাজ্যের হিন্দুপ্রজারা তোমার অনুগত থাকবে। রাজকীয় নিয়ন্ত্রণের আওতাভুক্ত প্রতিটি সম্প্রদায়ের মন্দির ও উপাসনালয় ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে, যেন তুমি তোমার প্রজাদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারো। এর ফলে প্রজারাও তোমাকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে। উদারতার সাহায্যে এই দেশে ইসলামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তরবারির সাহায্যে নয়। শিয়া ও সুন্নিদের মতপার্থক্যকে আমল দেবে না। শিয়া ও সুন্নিদের মতপার্থক্য হল ইসলামের ভিতর দিকের একটি দুর্বলতা। চারটি মূলনীতিতে সকল ধর্মের প্রজাদের এক কাতারে নিয়ে আসবে। হজরত তাইমূর সাহিব-কিরানির শিক্ষা স্মরণ রাখবে, যাতে শাসনকাজে তুমি পরিপক্কতা অর্জন করতে পারো। কখনো ভাইদের বিরোধিতা করবে না, যদিও এর প্রয়োজন দেখা দেয়। (প্রথম জমাদিউল আউয়াল, ৯৩৫ হিজরি, ১১ জানুয়ারি, ১৫২৯ সাল)”
আমরা বাবর সম্পর্কে যেটুকু জানতে পারি তা বাবর রচিত ‘বাবরনামা’ থেকেই। এছাড়া ওঁর কনিষ্ঠা কন্যা গুলবদন বেগমের স্মৃতিকথা ‘হুমায়ুননামা’ থেকেও কিছু জানতে পাই। এছাড়া যেসব সূত্র থেকে বাবর সম্পর্কে জানতে পারি তার বেশিরভাগই অতিরঞ্জিত এবং বিদ্বেষে ঠাসা। বাবরনামাই ইসলামীয় সাহিত্যের প্রথম আত্মজীবনী। আত্মজীবনী হলেও বাবর এই রচনাকে ইতিহাস হিসাবেই দেখতেন এবং তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিলেন যে, বিবরণে তিনি যৎপরনাস্তি সৎ ও নিরপেক্ষ থাকবেন। বাবরনামায় সম্রাট বাবর লিখেছেন– “আমি এত সব লিখেছি কোনো অনুযোগ করার জন্য নয়। আমি কেবল সত্যটা তুলে ধরেছি। নিজের প্রশংসা করার জন্যেও এসব লিখিনি। যা যা ঘটেছে ঠিক ঠিক সেই বিবরণই দিয়েছি। যেহেতু এই ইতিহাসে শুধু সত্যটুকুই লিখব মনস্থ করেছিলাম এবং সত্যের বাইরে কিছু ছোঁব না, তাই বাবা বা ভাইয়ের যা ভালো এবং যা মন্দ দেখেছি তার সবই উল্লেখ করেছি। সেইসঙ্গে আত্মীয় বা অপরিচিতের সমস্ত গুণ ও দোষের কথা বলেছি। পাঠক যেন আমায় ক্ষমা করেন। এই রচনা পাঠ হলে শ্রোতা যেন দোষ না ধরেন।” এইভাবে বাবরনামায় বাবরের মুখোমুখি করায় আমাদের। একজন সামরিক যোদ্ধা হিসাবে বাবর নিঃসন্দেহে বর্বর খুনে ছিলেন এবং অবশ্যই কবি ও পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন।
মহাপণ্ডিত রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন রচিত ‘মধ্য এশিয়া কা ইতিহাস’ নামে গ্রন্থে যা লিখেছেন, তা এখানে উল্লেখ করা অত্যুক্তি হবে মনে করি না। তিনি লিখেছেন– বাবর বাদশাহ তাঁর আপন দেশে চুঘতাই ভাষায় একজন শ্রেষ্ঠ ও সাহিত্যিক হিসাবেই পরিচিত। তাঁর রচনা সে দেশের নীচু শ্রেণি থেকে উঁচু শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। তাঁর লেখা গদ্য পদ্য ইত্যাদি রচনা সব শ্রেণিতে অবশ্যপাঠ্য। বলা বাহুল্য, ওদেশের মানুষের কাছে সাহিত্যিক পরিচয়ের বাইরে সাম্রাজ্য বিজেতা বাবরের পরিচয় অতি নগণ্য এবং গৌণ। সংগত কারণেই ভারতের ইতিহাসে বাবরের সাহিত্যিক পরিচয় কেউ জানে না বললেই চলে চলে। এখানে সাম্রাজ্য বিজেতা ও মোগল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবেই আলোচিত হয়। ভয়াল, ভয়ংকর এক বিদেশি সাম্রাজবাদীর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশ্ব-ইতিহাসে বাবরের মতো প্রতিভাধর ব্যক্তির দৃষ্টান্ত বিরল, যিনি এক হাতে তলোয়ার ও অন্য হাতে কলম নিয়ে বিশ্বজয়ের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। তলোয়ার দিয়ে তিনি বিশ্বজয় করতে তেমন সমর্থ না-হলেও কিছু ভূখণ্ড তো শাসন করেছিলেনই। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, তিনি তাঁর কলমাস্ত্র দিয়ে বিশ্বমানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন।
তবে মোগল সাম্রাজ্য নিঃসন্দেহে বিশাল ছিল। কিন্তু সেই সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ছিল অপূর্ণ। বাবর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, যোগ্য ব্যক্তিদের দূরবর্তী পরগনাগুলিতে পাঠিয়ে শাসনব্যবস্থা কায়েম করার অবসর তিনি পাননি। তা ছাড়া বাবরের শাসকীয় যোগ্যতাও তেমন ছিল না। অতি দ্রুত তিনি সাম্রাজ্যের আয়তন বাড়িয়েছিলেন একথা যেমন সত্য, তেমনি তাঁর সাম্রাজ্যের শাসনশৃঙ্খলা ছিল শিথিল। প্রান্তিক কেন্দ্রগুলোতে দিওয়ান এবং তার নীচের স্তরে কোতওয়াল ও শিকদার ছিলেন রাজ্যের প্রধান প্রশাসক। দূরের সাম্রাজ্যগুলিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। বাবর এর জন্য কোনো চেষ্টাও করেননি। শুধুমাত্র সামরিক শক্তির উপর শাসন নির্ভরশীল ছিল। জনসাধারণের মধ্যে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার বিশেষ কোনো প্রভাবই ছিল না। মোগল সাম্রাজ্যের সুবিধা অসুবিধা মূল সমাজের নিম্নস্তর পর্যন্ত পৌঁছোতে সক্ষম হয়নি। তা ছাড়া জনসাধারণও মোগলদের দেশীয় ভাবত না, ভাবত বিদেশি। ফলে কখনো-সখনো তাঁরা বিদ্রোহ করত। মোগল সাম্রাজ্যের প্রথম পাঁচ বছর তো যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল। আর্থিক অবস্থাও ছিল শোচনীয়। বাবর ধনসম্পদের প্রচুর অপব্যবহার করতেন। তাঁর দানপ্রিয়তার কারণেও আর্থিক দূরবস্থা আরও প্রকট হয়ে পড়ে। বাবরের সৈন্যদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দেশের লোক ছিল, যেমন –চুঘতাই, মোগল, ইরানি, তুরানি, আফগানি ও ভারতীয়। নানা জাতি, নানা বর্ণ, নানা ধর্মের কারণে সেনাদের মধ্যে পূর্ণ ঐক্য ছিল না। সেনা সংগঠনগুলি ছিল মূলত গোত্রপতিনির্ভর। মোগল সংস্কৃতি বলতে যা বুঝি বাবর তা কোনোদিনই প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।
বাবরের কথা লিখলে ‘বাবর-ই-মসজিদ’ নিয়ে তো লিখতেই হয়। বাবর-ই-মসজিদ, যা ১৯৯২ সালে করসেবক কর্তৃক ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। দাবি— বাবর রাম মন্দির ভেঙে এই মসজিদটি গড়ে তুলেছিলেন। দাবিদার— রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক (আরএসএস), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং ভারতীয় জনতা পার্টি। বাবরি মসজিদ রামমন্দির বিতর্কের প্রথম এবং প্রধান সূত্র হল –যেহেতু সম্রাট বাবর সংশ্লিষ্ট স্থানে ত্রেতাযুগে নির্মিত রামমন্দির ধ্বংস করে ১৫২৮ সালে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, সেহেতু বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে সেই স্থলে রামমন্দিরই নির্মাণ করা হবে। এই দাবি কতটা সঠিক বা বেঠিক সেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে।
বাবর রামমন্দির ধ্বংস করেছেন এই অভিযোগে দাগিয়ে দিলে বাবরকে হিন্দুধর্ম বিদ্বেষী হিসাবে চিহ্নিত করতে সহজ হয়। কিন্তু ইতিহাসের বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে জানা যাচ্ছে, বাবর পরধর্মবিদ্বেষী ছিলেন এমন কোনো নথি বা ইতিহাসে প্রমাণ মেলে না। ইতিহাসবিদ ডঃ ত্রিপাঠীর কথা স্মর্তব্য। তিনি লিখেছেন –“সম্রাট বাবর অমুসলিমদের প্রতি ধর্মসহিষ্ণু ছিলেন। তাঁর শাসনব্যবস্থায় ধর্মের কোনো প্রভাব ছিল না। অধ্যাপক পি মাইতি তাঁর ‘ইতিহাস পরিক্রমা’ গ্রন্থে তার প্রমাণ আছে।” ডঃ অমলেন্দু দে তাঁর ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ গ্রন্থে লিখেছেন– “আঃ কুদ্স গাঙ্গোহি নামে একজন মুসলিম ধর্মগুরু সম্রাট বাবরকে পত্র লিখে শরিয়তি শাসন পরিচালনার উপদেশ দেন। বাবর তাঁর উপদেশ অগ্রাহ্য করেন। তিনি হিন্দু প্রজাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করার পূর্ণ অধিকার। দেন এবং হিন্দুদের সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে নিযুক্ত করেন।”
এহেন সম্রাটের বিরুদ্ধে রামমন্দির ধ্বংসের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে মনে করি। কেন ভিত্তিহীন বলে মনে করি? বলা হয় ১৫২৮ সালে বাবর রামমন্দির ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। দেখা যাচ্ছে, তুলসীদাস তাঁর ‘রামচরিতমানস’ রচনা করেছিলেন ১৫৭২ সালে, অর্থাৎ মসজিদ নির্মাণের ৪৪ বছর পর। তুলসী ছিলেন একজন একনিষ্ঠ রামভক্ত সাধক। তিনি তাঁর রচনায় ম্লেচ্ছ যবনদের প্রভাব, মুসলিম রাজশক্তির উত্থান সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ চেপে রাখেননি। যদি মুসলিম সম্রাট বাবর রামমন্দির ধ্বংস করতেন, নিশ্চয় তারও উল্লেখ তিনি করতেন। তুলসীদাস ‘রামচরিতমানস’ রচনা করেছিলেন কাশী নগরীতে বসে। কাশী থেকে অযোধ্যার দূরত্ব সামান্য। সেখানে গোটা একটা রামমন্দির ধ্বংস করে দিল এক মুসলমান শাসক, আর সেই খবর তুসলীদাসের কানে পৌঁছোবে না?
তাহলে হঠাৎ কী এমন হল বাবর রামমন্দির ধ্বংস করে নিজের নামে মসজিদ গড়ে ফেলার অভিযোগে অভিযুক্ত হল? ১৫২৮ সাল থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না, কোনো তথ্য লিপিবদ্ধ করলেন না। হঠাৎ ১৯২১ সালে প্রথম মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণের অপবাদ দেওয়া শুরু হয়। শ্রীমতী বেভারিজ নামে। এক অনুবাদিকা বাবরের ‘বাবরনামা’ ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন। বাবর তাঁর বাবরনামা’ চুঘতাই তুর্কি ভাষায় রচনা করেছিলেন। ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, ভালো কথা। এ কাজ মোটেই দোষের নয়। কিন্তু উদ্দেশ্য তাঁর মহৎ ছিল না। আর তাই বেভ্যারিজ একটা মনগড়া কাহিনি লিখে ফেললেন সংযোজিত পরিশিষ্টে। সংযোজিত পরিশিষ্টে তিনি লিখলেন –১৫২৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫২৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, প্রায় এক বছরের মধ্যে বাবরের নির্দেশে মির বাকি নামক জনৈক ব্যক্তির নেতৃত্বে মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদ নির্মাণ করার কথা উল্লেখ থাকলেও মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়া হয়েছে এমন কোনো কথাই উল্লেখ নেই সেখানে। মন্দিরের ভাঙার কথা তিনি নিজে উল্লেখ না-করলেও ফৈজিবাদ গেজেটিয়ার থেকে একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরেন। জনৈক মিঃ এইচ আর নেভিল তাঁর গেজেটিয়ারে কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই লিখেছেন– “একটি মন্দির ধ্বংস করা হয় এবং মসজিদ নির্মাণ হয়। অবশ্য সেই মন্দির রামমন্দির কি না, সেটা উল্লেখ করেননি। তাহলে রামমন্দিরের ব্যাপারটা এল কোথা থেকে? শিল্পীর পরিচয় ও সময়কাল উল্লেখ ছাড়াই একটি তৈলচিত্র পাওয়া যায়, সেই চিত্রে দেখানো হয়েছে।– বাবরের সৈন্যরা রামমন্দির ধ্বংস করছে এবং হিন্দুনিধন করছে। চিত্রের পরিচয়লিপিতে বলা হয়েছে, “বাবরের সৈন্যরা অযোধ্যার রামমন্দির আক্রমণকালে ৭৫,০০০ হিন্দুকে হত্যা করে ও তাঁদের রক্ত দালানের মসলায় মেখে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করে।” ভয়ংকর অভিযোগ। ৭৫,০০০ হিন্দু হত্যা! তখনকার একটা নগরে জনসংখ্যা কত ছিল? সেই জনসংখ্যার ৭৫ হাজার মানুষ মেরে ফেললে তো নগর জনশূন্য হয়ে যাওয়ার কথা। এমন ঘটনা কোনো নিষ্ঠুরতম শাসক করতে পারে? গল্প বলার একটা সীমা থাকে। বোঝাই যায় এগুলো ব্রিটিশ কর্তৃক সুপরিকল্পিত অতিরঞ্জিত কল্পকথা, যা অনেকে ইতিহাস ভেবে ভুল করেন।
তাহলে আর একটু গভীরে যাওয়া যাক। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিক পর্যন্ত বাবরি মসজিদ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। উচ্চবাচ্য নয়, এবার বাবরি মসজিদকে ঘিরে রীতিমতো খুনোখুনি হয়ে গেল ১৮৫৩ সাল থেকে ১৮৫৫ সালের মধ্যে। ১৮১৬ সালে অযোধ্যার বেগমের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে ব্রিটিশরা অযোধ্যার রাজস্ব আদায় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পায়।কিন্তু মুসলমান নাগরিকরা ব্রিটিশদের এলাকা ছাড়া করে রাজ্যের বাইরে বের করে দেয়। সেই অপমান ব্রিটিশরা কোনোদিন ভুলতে পারেনি। ব্রিটিশের জাত সেই অপমানের বদলা নিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের খেপিয়ে তোলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। শুরু হল বাবর নির্মিত মসজিদকে নিয়ে। কোনো প্রমাণ সূত্র ছাড়াই বাবর রামমন্দির গুঁড়িয়ে দিয়ে মসজিদ গড়েছে প্রচার শুরু করে দিল। ১৮৩৮ সালের মন্টেগোমারি মার্টিন তাঁর এক সার্ভে রিপোর্টে নির্দেশ দেন এই গল্পটি প্রচার করতে। তিনি সেই রিপোর্টে লিখলেন –“জনশ্রুতি আছে যে, অযোধ্যার রামমন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়। তবে আমি একথা বিশ্বাস করি না।” বুঝুন চালাকিটা। শুরু করলেন ‘জনশ্রুতি’ শব্দটা ব্যবহার করে, কারণ জনশ্রুতির কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। আর শেষ করলেন— “তবে আমি একথা বিশ্বাস করি না” ধরি মাছ না ছুঁই পানি, এমন বিবৃতিতে সাপ তো মরলই লাঠিটাও ভাঙল না। মানুষ জনশ্রুতি’ আর ‘তবে আমি একথা বিশ্বাস করি না’ কথাগুলি ভেবে দেখল না, মনেও রাখল না। কেবল মনে রাখল– “অযোধ্যার রামমন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়”। বাতাসে আগুনের ছড়িয়ে গেল। ধর্মে সুড়সুড়ি শরীরের এক জায়গায় দিলে সারা শরীরই কেঁপে ওঠে। শুধু শরীরই নয়, সারা ভারত উপমহাদেশ কেঁপে উঠল। কারণ এই জনশ্রুতির ভুয়ো গল্পই হয়ে উঠল ‘ইতিহাস’। এই রিপোর্টই পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ঢুকিয়ে দিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার। আর এটাই প্রতিষ্ঠিত হল ‘অযোধ্যার রামমন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ নির্মিত হওয়ার’ নির্ভরযোগ্য ‘রেফারেন্স’।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্দেশ্য ছিল অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা। অতএব পথ একটাই, ধর্মীয় উসকানি। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুপ্রজাদের খেপিয়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করল ব্রিটিশরা। কর্নেল উইলিয়ম স্নিমার ও জেমস আউট্রামের হাতে এই সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর দায়িত্ব পড়ল। তাঁরা সুচারুভাবে সেই দায়িত্ব পালন করল। কাজও হল মোক্ষম। হিন্দুরা এই প্রথম মসজিদে মন্দিরের দাবি তুলল। সোজা বাংলায় বলা যায়, হিন্দুদেরকে দিয়েই এই দাবি তোলানো হল বা তুলতে প্ররোচনা দেওয়া হল। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষ দাঙ্গার শিকার হল। শুরু হল সংঘর্ষ। বাবরি মসজিদকে ঘিরে শুরু হল প্রথম রক্তপাত। এখানেই শেষ নয়। এলো গোদের উপর বিষফোঁড়া। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ফৈজাবাদের ব্রিটিশ সেটেলমেন্ট অফিসার পি কার্নেগি আর-একটা নথি বানিয়ে ফেললেন, বললেন –“অযোধ্যা যেহেতু রামের জন্মভূমি, অতএব সেখানে নিশ্চয়ই একটা রামমন্দির থেকে থাকবে এবং আমার মনে হয় সম্রাট বাবরের নির্দেশেই ওই মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে।” এমন ভিত্তিহীন কথা আদালতে পেশ করা যায় না। আদালত ছুঁড়ে ফেলে দেবে ডাস্টবিনে। যদি’, ‘কিন্তু’, ‘হয়তো নিশ্চয়ই’ শব্দগুলি বিচার্য হয় না। তবুও একে সাদা চামড়ার ব্রিটিশ, তায় সেটেলমেন্ট অফিসার– সে কি মিথ্যা বা ভুল বলবেন? অতএব ওনার স্বরচিত তথ্যই হল নথি, পাকাঁপোক্ত দলিল। অথচ বাস্তবে— প্রথমত, হিন্দুদের কোনো ধর্মগ্রন্থে অযোধ্যার রামমন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, রামভক্ত তুলসীদাসী রামচরিতমানসেও অযোধ্যার রামমন্দিরের উল্লেখ নেই। তৃতীয়ত, ৪০০ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘বিষ্ণুস্মৃতি’ গ্রন্থে হিন্দুদের যে তীর্থস্থানের তালিকা পাওয়া যায়, সেখানেও অযোধ্যার কোনো রামমন্দিরের উল্লেখ নেই। চতুর্থত, হিন্দুদের তীর্থস্থান সংবলিত ‘তীর্থ চিন্তামণি’ পুস্তকেও অযোধ্যার কোনো রামমন্দিরের উল্লেখ নেই। পুস্তকটি রচিত হয় ১৪২০ খ্রিস্টাব্দে। পঞ্চমত, ফাহিয়েন, হিউয়েন সাঙ, ইবনে বতুতা প্রমুখ ব্যক্তিদের রচিত ভারতভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থগুলিতেও অযোধ্যার কোনো উল্লেখ নেই। অর্থাৎ যেখানে বাবরি মসজিদটি ছিল, সেখানে কোনো রামমন্দির ছিল, এমন কোনো নির্ভরযোগ্য/অ-নির্ভরযোগ্য কোনো দলিল বা তথ্য বা সূত্রই পাওয়া যায়নি। ষষ্ঠত, শিবাজী প্রায় সারাজীবন মুসলিম সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। সেই শিবাজী কখনো মুসলিমদের বিরুদ্ধে এক কলম লেখেননি। এমনকি বাবর রাম মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছেন, এমন কথাও কোথাও লেখেননি। সপ্তমত, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ফৈজবাদে দাঁড়িয়ে মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাবর রামমন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছেন, একথা কখনো বলেননি। অষ্টমত, স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি শিকাগো গিয়ে দুর্ধর্ষ ভাষণ দিয়ে সমস্ত হিন্দুজাতিকে গৌরবান্বিত করেছিলেন। তিনি ২০০টি গ্রন্থ লিখেছিলেন। তাঁর কোনো গ্রন্থে সম্রাট বাবর রাম মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছেন, একথা কখনো লেখেননি। নবমত, মহাত্মা গান্ধি, যিনি মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রামনাম জপেছিলেন, তিনিও প্রচুর গ্রন্থ লিখেছিলেন, তাঁর কোনো গ্রন্থে বাবর রাম মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছেন, একথা কোথাও লেখেননি। কখন মানুষ আবার নতুন করে জানল যে, বাবর। রামমন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছিলেন? যখন ভারতীয় জনতা পার্টির ক্ষমতায় আসার প্রয়োজন হল। অত্যন্ত মুনসিয়ানার গোয়েবলসের কায়দায় প্রচার করা শুরু হল– যেখানে বাবরি মসজিদ, সেখানে পূর্বে রামমন্দির ছিল। ‘হিন্দুবিদ্বেষী’ সম্রাট বাবর সেই মন্দিরকে গুঁড়িয়ে দিয়ে মসজিদ বানিয়েছিল। ঘটনা পরম্পরা থেকে জানতে পাওয়া যায়—
১৯৪৯ সালের একেবারে শেষদিকে বাবরি মসজিদের ভিতর হঠাৎ করে অলৌকিকভাবে এক রাম ও সীতার মূর্তি পাওয়া গেল। প্রত্যক্ষ গণ্ডগোল শুরু হল সেইদিন থেকেই। অলৌকিক বললাম বটে, কিন্তু অলৌকিক বলে কিছু হয়। না, সবই লৌকিক। ১৫২৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তো কোনো মূর্তি ছিল না। তা ছাড়া মসজিদে মূর্তি থাকার কথাও নয়। কারণ ইসলামে মূর্তি নিষিদ্ধ। তাহলে বাবরি মসজিদের ভিতর কীভাবে এলো সেই রামসীতার যুগলমূর্তি? ১৯৪৯ সালের ২ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় তৎকালীন জেলাশাসক কে ডি নায়ার উত্তরপ্রদেশের তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ রাজ্যের মুখ্য সচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে এক বেতারবার্তায় জানান –২২ ডিসেম্বর রাতে যখন মসজিদ জনশূন্য ছিল, কয়েকজন হিন্দু তখন মসজিদে মূর্তি রেখে গেছে। রাতে যে ১৫ জন পুলিশ পাহারায় ছিল তাঁরা এই কাজে বাধা দেয়নি।”
রাতের অন্ধকারে নির্জন মসজিদের মধ্যে মূর্তি রেখে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ ডিসেম্বর অযোধ্যা থানায় এফআইআরও করা হয়। এখন প্রশ্ন হল, মসজিদের ভিতর মূর্তিটা রাখল কে? এলেতেলি কেউ নন, তিনি একজন জেলাশাসক, ফৈজাবাদের জেলাশাসক কে ডি নায়ার। তিনিই চুপিসারে রাতের অন্ধকারে মসজিদের ভিতর মূর্তি রেখে আসেন। ঘটনাটি অবশ্য পরে জানাজানি হয়ে যায়, গোপন রাখা যায়নি। অথচ এই জেলাশাসকই উপরোক্ত বেতারবার্তা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যথাক্রমে মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে। এই কর্মকাণ্ডে জেলাশাসক মূল পাণ্ডা হলেও মূল কাজটি করার জন্য বেছে নিয়েছিল দিগম্বর আখড়ার এক তরুণ মহন্ত, নাম পরমহংস রামচন্দ্র দাস। রামচন্দ্র দাসই মসজিদের ভিতর ঢুকে রামসীতার মূর্তি রাখার কাজটি সারেন। পাহারায় থাকা জনৈক পুলিশ অফিসার মাতাপ্রসাদ নির্দেশমতোই মাহাত্ম প্রচার করে দেন। তিনি বলেন, “আকাশপথে আলোর ঝর্ণাধারায় নেমে আসে রামলালার মূর্তি এবং মসজিদের ছাদ ভেদ করে ভিতরে ঢুকে পড়ে।”
মহন্ত পরমহংস রামচন্দ্র দাসের প্রকৃত নাম ছিল চন্দ্ৰেশ্বর ত্রিপাঠী। আদিবাড়ি বিহারের ছাপড়া জেলার সিংখিপুর গ্রাম। অযোধ্যায় রামজন্মভূমি আন্দোলনের প্রথম ও অবিসংবাদিত নেতা। ২০০৩ সালের ৩০ জুলাই ৯৩ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী সহ সরকারে পদস্থ ব্যক্তিরা। উপস্থিত থাকবেন নাই-বা কেন! মসজিদের ভিতর মূর্তি ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো অসাধ্য কাজটি সাধন করেছেন, তিনি তো সমগ্র হিন্দুসমাজের উদ্ধারকর্তা বটে! দাবি করা হল বাবরি মসজিদের নীচে রামমন্দির আছে। এই সূত্র ধরেই তো বাবরি মসজিদ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
মহামান্য এলাহাবাদ হাই কোর্টের লখনউ বেঞ্চের নির্দেশে বাবরি মসজিদের নীচে খননকার্য চালিয়ে আদালত নিযুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিকরা যে রিপোর্টটি এলাহাবাদ হাই কোর্টের লখনউ বেঞ্চের বিচারপতিদের তুলে দিয়েছিলেন, সেখানে বলা হয়েছে মসজিদের ঠিক নীচেই এবং ৫০ মিটার নীচে মন্দিরের একটা কাঠামোর উপস্থিতির কথা। বলা হয়েছে, ওই মন্দিরের কাঠামোটিতে ১০০০ সাল থেকে ১৫২৮ সাল, অর্থাৎ মসজিদ নির্মাণকাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মন্দিরের নির্মাণকাজ চলার প্রমাণ মিলেছে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলেছেন, মাটি খুঁড়ে যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে, তা হল– পাথর, নকশা করা ইট, মিথুন মূর্তি, পাতার নকশা, কালো পাথরের ভাঙা আটকোণ বিশিষ্ট স্তম্ভ, পদ্মফুলের মোটিভ, জলের ফোয়ারা এবং কমপক্ষে ৫০টি পিলার। মন্দিরে যে কাঠামোটি পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছে, সেটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বায় ১৫০ ফুটের বেশি এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্থে প্রায় ১০০ ফুটের মতো। ওই কাঠামোটির কেন্দ্রবিন্দুতে ঠিক উপরেই ছিল মূল মসজিদটি। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে– যেসব কাঠামোর নিদর্শন পাওয়া গেছে, সেগুলির চরিত্র ও ব্যবহার সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এই ব্যাপারে ধারণাকে সঠিক বলে প্রতিষ্ঠিত করার মতো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
২০০৩ সালের ১৮ জুন দৈনিক গণশক্তি সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, ১৭ জুন দেশের রাজধানী নতুন দিল্লিতে এক ভিড় ঠাসা সাংবাদিক সম্মেলনে প্রথিতযশা প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকরা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন –“মন্দির নয়, বাবরি মসজিদের নির্মাণের আগে ওখানে আর-একটি মসজিদ ছিল।”
১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে ২২৪ জন সদস্য নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এল কংগ্রেস, যে সরকার গঠিত হল তার প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও। অপরদিকে ২৪ জুন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হলেন বিজেপির কল্যাণ সিং। মুখ্যমন্ত্রী হয়েই তিনি চললেন অযোধ্যায়, বাবরি মসজিদে। রামলালার দর্শন করে পুজো দিলেন। কল্যাণ সিংয়ের মন্ত্রীসভায় একজন মুসলিম মন্ত্রী ছিলেন ইজাজ রিজভি। তিনি কল্যাণ সিংয়ের সঙ্গী ছিলেন। তিনিও ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিলেন। এর পর কয়েক মাস ধরে কিছু নাটকও চলল। এলো ১৯৯২ সাল। সংঘ পরিবার ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় করসেবার ডাক দিল। সংঘ পরিবারের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ রামভক্ত করসেবকরা অযোধ্যায় জমায়েত হল। তার আগের দিন ৫ ডিসেম্বর উত্তরপ্রদেশের লখনউ শহরে এক বিশাল সভার আয়োজন করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ি, লালকৃষ্ণ আডবানী, কল্যাণ সিং, মুরলীমনোহর যোশি, অশোক সিংহল প্রমুখ। শুরু হল গরম গরম বক্তৃতা। বাজপেয়ি বললেন, যত টিলা আছে সব সমান করে দিতে হবে। তোড়জোড় শুরু হল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের। সব জল্পনাকল্পনার অবসান হল ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। ধুলোয় মিশে গেল সাড়ে ৪০০ বছরের প্রাচীন বাবরি মসজিদ। একই সঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেল ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রাচীর। ধর্ষিত হল দেশের ঐতিহ্য আর সম্প্রীতির বাতাবরণ।
একজন মুসলিম শাসককে কলঙ্কিত করা খুবই সহজ। কারণ প্রমাণ করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বাবরও কলঙ্কিত হলেন। ভারত কলঙ্কিত হল। ৬ ডিসেম্বর ‘কালাদিবস’ হিসাবে চিহ্নিত হল, যা প্রতি বছর উদযাপন করা হয়।
দুই প্রত্নতাত্ত্বিক সুপ্রিয়া ভার্মা ও জয় মেনন এএসআইকে খননের পূর্বে প্রাক্কলিত ধারণার ধারণ করার এবং খননকালে নৈতিক কোড এবং পদ্ধতির লঙ্ঘন করার অভিযোগ করেন। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ভার্মা, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান মেনন আদালতে বলেন, খননে এএসআইয়ের উপসংহারকে সমর্থন করে এমন কোনো রসদ পাওয়া যায়নি। ২০১০ সালে তাঁরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সাপ্তাহিক একটি কাগজ প্রকাশ করেছিল, প্রমাণ সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতি এবং তার ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৬ তম বার্ষিকী উপলক্ষে ভার্মা ২০০৩ সালে পাওয়া প্রমাণের তিনটি মূল অংশ সম্পর্কে হাফপস্ট (HuffPost) ভারতকে কথা বলেছিলেন, কেন তিনি মনে করেন যে, এএসআই তার উপসংহার তৈরি করার জন্য বাধ্য হয়ে পড়েছিল এবং বি আর মণির নেতৃত্বাধীন খননকার্যের সময় পদ্ধতিগত ব্যর্থতা অনুভব করেছিল। পরে মণি, যিনি পরে এলাহাবাদ হাই কোর্টের আদেশে প্রতিস্থাপিত হন। ২০১৬ সালে মোদি সরকার ন্যাশনাল মিউজিয়ামের মহাপরিচালক হিসাবে মণিকে নিয়োগ দেন। কী ছিল সেই প্রশ্নোত্তর পর্ব? মূল ভাষায় হুবহু এখানে উল্লেখ করলাম সেই সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব —
Q. Is there any archeological evidence that the Babri Masjid was built over a temple devoted to Ram?
Ans. No, there is nothing. Even today, there is no archeological evidence that there was a temple under the Babri Masjid.
Q. What is the evidence on the basis of which the ASI is saying there was a temple?
Ans. There are three things. What the ASI has excavated is not evidence there was a temple underneath the mosque. One is this western wall, the second are these 50 pillar bases and third are architectural fragments. The western wall is a feature of a mosque. It is a wall in front of which you say namaaz. It is not the feature of a temple. Temple has a very different plan. Underneath the Babri Masjid, there are actually older mosques.
Now, as far as these pillar bases are concerned, these are completely fabricated and we filed many complaints to the court about it. Our argument is that if you look at what they are claiming to be pillar bases, these are pieces of broken bricks and they have mud inside them. There is no way a pillar can even stand on it, it is so unstable. It’s a completely political issue. They wanted that report to say there are pillar bases and it said there are pillar bases.
Q. What about the architectural fragments?
Ans. The third piece of evidence is these architectural fragments. They say there are some 400 500 fragments, which are pieces of architectural buildings. Of these, they say 12 are the most important. Of these 12, none of these were found during the excavation. These were recovered from the debris lying above the lime floor of the masjid. There is this one particular sculpture, which is closest to some kind of image, which they called a ‘divine couple.’ But even that is just one man and a woman and is half-broken. There is nothing else. A temple, a stone temple supposedly this is a stone temple-has much more sculptured material than what they have found.
Q. Can this sculpture not be dated?
Ans. The stone cannot be dated. What you date in archeology is the deposit, the layer in which the particular artefact has been found. In that also, you can date organic material. So, for example, a bone or a shell or charcoal. The ASI have got some dates. But this sculptured piece has not even come from a stratified deposit.
Q. It could have come from anywhere?
Ans. It could have come from anywhere. There is no way of dating it. In other words, there is no evidence for a temple.
Q. Can you date the pillar bases?
Ans. You can date those floor levels. They clearly belong, in my opinion, to the period from the 12th to the 15th century at different levels.
Q. Does the ASI date the temple it claims was under the mosque?
Ans. No. They don’t say that. They just say there was a temple underneath. That’s all. They give it no precise date.
Q. Doesn’t the report say the temple is from the 10th century?
Ans. On the one hand, they are claiming a massive temple with more than 50 pillar bases, but they are also saying that there is a circular shrine under these pillar bases, which is much smaller in size, about three to four meters in diameter, which they claim belong to the 10 century. But I have examined walls next to the circular structure, and the information mentioned in the site notebook of that particular trench, which mentions these walls belong to the Gupta period. And that is why this circular structure would also belong to the Gupta period around 4th-6th century AD.
Q. How many excavations have there been in Ayodhya?
Ans. There is Alexander Cunningham who is the first Director General of the ASI, who, in 1861 62, does some kind of survey around Ayodhya region, and he mentions three mounds. And of these three mounds, two have some kind of Buddhist Stupa and one of them has a Vihara. He also said that there are oral traditions that say that three temples were destroyed, but in his account, there is no mention of a temple being destroyed on the site of the Babri Masjid.
That is the first time that archeologically some kind of survey had been carried out. Now, in terms of excavations, the story begins in 1969-70. The first excavation is carried out by the Department of Archaeology, Banaras Hindu University. They did not really conduct the excavations close to the Babri Masjid, but in the near vicinity. The only report that we have is in what we call IARs, which is the Indian Archeology Review published by the ASI, every year. It is not a very detailed report. There is a one-page description of what they found. They say it looks like it was inhabited in what we call the early historic period, which is about 6th century BC to 6th century AD. And they say that there is some medieval occupation, but they don’t really get into the details. That’s the end. Then, what happens is from about 1975 to about 1980, there is a project by B.B. Lal.
Q. Who is B.B. Lal?
Ans. BB Lal was also the director general of ASI and he took early retirement in 1972 and joined the Archeology Department of the Jiwaji University in Gwalior. And from there he went as a fellow to the Institute of Advanced Studies in Shimla. And he came up with this project on the archeology of Ramayana. He also had a project on the archeology of Mahabharata. As part of the archeology of Ramayana, he excavated Ayodhya and a couple of other sites, which have been mentioned in Ramayana. He carried out excavations for a period of five years but a report is only available for two years in the IAR. He pretty much substantiates what is mentioned by the BHU. That there are occupations in the early historic period and there is some sign of desertion and you also find some floors from the medieval period. That’s all there is.
Then it is only in 1988, by which time the VHP has picked up this whole issue of temples having been demolished at three sites-Ayodhya, Mathura and Varanasi-and in 1988, B.B. Lal takes a photograph of pillar bases, which he says was taken and excavated at Ayodhya between 1975 and 1978, and publishes it in Manthan, which is the RSS (Rashtriya Swayamsevak Sangh) presented the photograph at the World Archeological Congress in Croatia, saying that if excavations are to be carried then they will find evidence of a temple.
Q. What does the photograph show?
Ans. The photographs are what he calls pillar bases, which are pieces of bricks put together in a half-squarish, half rectangular, half circular forms. There are three pillar bases that he marks out in that photograph.
Q. Where does he find the pillar bases?
Ans. This excavation was carried out near the wall of the Babri Masjid.
Q. What happened after Lal’s photo?
Ans. Then, the BJP picks up the Ayodhya movement and it becomes a political movement. In 1992, the mosque is demolished and they have paved the way for excavations. The title suit, that case of who owns the land, is carrying on in the Lucknow Bench of the Allahabad High Court. Once NDA comes to power, which is in 1999, the court orders that now possibly we should excavate. In 2002, they would order the ASI, the government body, to carry out a Ground Penetrating Radar (GPR) survey. Certain signals are sent through a machine and if there are structures underneath the mound then it bounces back. On the basis of that report, the court ordered excavation be carried out. In March 2003, the excavations began and they ended in August. Then, they submitted the report.
Q. How did you get involved?
Ans. Once the excavations began, there were a lot of apprehensions because the ASI comes directly under the Ministry of Culture. And also, because archeology as a discipline is fairly technical. At that point, the Sunni Waqf Board people thought that they should have an archaeologist who would be present and point out in case there are any procedures that are not followed the way it should be in terms of methods and recording. They contacted Irfan Habib, who is a professor of medieval history at Aligarh Muslim University, and he contacted us.
I, and I think I can speak for my colleague Jaya Menon, we were both quite keen. We both wanted to know what exists under the mosque. It is not as though we had any kind of bias either way. We went with an open mind. For us, it was an academic issue. We knew that we probably would never be able to get the chance unless we go there ourselves. It was at the cost of our professional careers as well. As an archaeologist, if I have to excavate any site, I have to get permission from ASI. So, if you antagonise the ASI, chances are that you are not going to get a permit, and that is why very few archaeologists were willing to even go
Q. You went as observers because the Sunni Waqf Board were petitioners in the title suit?
Ans. Just to note whether correct procedures were being followed or not. The NDA was in power. There was fear that the data would be manipulated. There was even fear that outside material would be planted over there. In fact, some of us also thought they would try and do it if they don’t find evidence for a temple. They might bring material from outside, some idol, some image, and put it there.
Q. Did you face any kind of backlash?
Ans. We were lucky that they lost the elections, and we went on to excavate two sites (not connected to the Ayodhya dispute). Today, if I apply, I’m not certain whether I will get permission.
Q. What does the ASI say in the report?
Ans. If you read the entire report, there is no mention of any temple. It is a standard report. You have a chapter on the trenches, you have a chapter of chronology, you have a chapter on different structures, you have a chapter on pottery. What is missing is a chapter on bones and human skeletal remains. That is what they also found but they never published it.
What you will also find is that the names of the people who wrote those chapters is mentioned. But in the conclusion, there is no name mentioned. And in the conclusion, in the last paragraph of the report, they say that given the evidence of this western wall, and pillar bases, and some architectural fragments, there was a temple underneath the Babri Masjid. It is literally written in three lines. Otherwise, nowhere in the discussion, is there any talk of a temple being found. With the same evidence, we have interpreted that there were actually two or three phases of smaller mosques underneath the Babri Masjid.
Q. In your expert opinion, as of today, there was no temple under the Babri Masjid? What was under it?
Ans. There was no temple under the Babri Masjid. What there was, if you go beyond the 12th century and you come down to the levels of the 4th to 6th century, i.e. the Gupta period, there seems to be a Buddhist stupa. So, there was Buddhist occupation here, and that is something even Alexander Cunningham has said. Outside the Babri Masjid, there are several other archeological mounds which seem to be sites of Buddhist stupas as well as monasteries. There was clearly a Buddhist community here, in the period, roughly from the 2nd century BC to 6th century AD. To us, it looks like this was then abandoned and reoccupied sometime around the 11th-12th century and possibly because there was a Muslim settlement that came up. And they had a small mosque, which was expanded as the community increased, in size and finally a much larger mosque was built by Babar in 1528.
Q. So, there is no evidence of this narrative that Babar’s general Mir Baqi knocked down a temple to build a mosque?
Ans. There is no evidence but there is oral tradition that starts coming up in the late 19th century and it is recorded in a colonial period gazetteer. Even when Alexander Cunningham, he goes in 1861-62, he is traveling around and he does record oral traditions. He does not mention a temple being underneath the Babri Masjid. He talks about three temples, there is oral tradition of three temples being destroyed, but these are not underneath the Babri Masjid. They are some other temples in Ayodhya.
Q. What impact did the report have on the title suit?
Ans. The bench comprised of three judges, two Hindus and one Muslim. The Muslim judge, S.U. Khan, clearly did not go into the archeological evidence. There was a strong viewpoint that this is a title suit and it does not matter who lived here before the present occupants. It is immaterial. And many of us also felt that they should have never dragged in history and archeology into a title suit. They should have just gone by what was the status when the first suit was filed in 1950. But the other two judges, D.V. Sharma and Sudhir Agarwal, much more Sudhir Agarwal, he did say that the ASI is saying a temple was there under the mosque and therefore we have to accept what the ASI is saying because they are the experts.
Q. A generic temple?
Ans. Yes. Some generic temple. They don’t get into whether it was a Ram Temple and they don’t date it.
Q. In the EPW report, you write about being concerned about certain procedures?
Ans. Yes. They are claiming that this is the site of Ram Temple, which is a Vaishnav temple, where generally, you would not expect to find any bones because of this vegetarianism etcetera, but when they started excavating, they started finding a lot of bones, animal bones. How do you explain finding animal bones in a Vaishnav temple? They clearly did not want that recorded. So, we noticed that the labour they had hired were just throwing the bones away. The other thing they were also doing, there is a certain pottery, ceramic type, which is known as glazed ware, which is generally associated with Muslim communities. They were finding a lot of this glazed ware. Those again were being thrown. So, we made a complaint, and they had to be recorded. You would not expect glazed ware in a Vaishnav temple. Procedurally, there was violation of an ethical code.
Q. Did the ASI date the bones?
Ans. No, they did not.
Q. Would it help to have a foreign team of archaeologists excavate the site?
Ans. As far as foreign archeologists are concerned, they know it is a political issue and they would not want to get entangled in it. If they wish to do any other archeological work in India, they would not want that to be jeopardised. And it is a political issue, it is clear to everyone.
Q. Isn’t six months very short for this kind of excavation?
Ans. As far as the ASI, and the archeologists of the ASI are concerned, they really are now no longer considered to have any kind of expertise. They haven’t kept up to date with the latest methods, the recent theoretical developments, and they really just see it as more as an administrative job than as an academic discipline.
(Source : https://www.huffingtonpost.in/2018/12/04/there-is-no-evidence-of-a-temple-under-the babri-masjid-asi-lied-to-the-country-say)
এই লেখাটা যখন প্রস্তুত করছি তখন ভাবছিলাম বাবরি মসজিদের নীচে মন্দির ছিল কি ছিল না সেই সিদ্ধান্ত। অমীমাংসিতই থেকে যাবে? ভাবছিলাম, সুপ্রিমকোর্ট কি মন্দির নির্মাণের অনুমোদন দেবে? ভাবছিলাম, যাঁরা বলেছিলেন মসজিদের নীচে মন্দির না-মিললে বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণ করে দেবেন, তাঁরা কী ভাবছেন? পারবেন পুনর্নির্মাণ করে দিতে? ৪০০ বছরের প্রাচীনত্ব এবং ঐতিহ্য কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
না, প্রশ্ন নিরুত্তর থাকল না। অবশেষে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ৫ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চ এক ঐতিহাসিক রায়ে জানিয়ে দিলেন– ২.৭৭ একরের বিতর্কিত জমিটি রামলালার মন্দির নির্মাণের জন্য তিন মাসের মধ্যে একটি ট্রাস্ট গঠন করতে হবে। ওই ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানেই থাকবে বিতর্কিত মূল জমি। কীভাবে, কোন্ পদ্ধতিতে মন্দির তৈরি হবে, তারও পরিকল্পনা করবে ট্রাস্ট এবং মসজিদ নির্মাণের জন্য অন্য কোথাও ৫ একরের একটি জায়গা দিতে হবে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে। কীসের ভিত্তিতে ভারতের সর্বোচ্চ আদলতের এই রায়? সুপ্রিম কোর্ট তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আদালত এটা মানতে অস্বীকার করেছেন যে, মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট স্বীকার করেছেন, সেখানে বাবরি মসজিদ ছিল, সেখানে নামাজ আদায় হত। তবে সেখানে হিন্দুও পুজোর জন্য যেত। সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, নামাজের ধারাবাহিকতা বন্ধ হওয়ার দ্বারা মসজিদের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায় না। আদালত মসজিদের নিচে কোনো অবকাঠামোর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তবে এ কথাও বলেছেন, “আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে বিভাগ বলেনি মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট মূলত হিন্দুদের আস্থা-বিশ্বাসকে তার রায়ের ভিত্তি বানিয়েছেন।
আদালতের বক্তব্য— হিন্দুদের বিশ্বাস, ভগবান রামের জন্ম ‘গর্ভগৃহে’ হয়েছিল। একবার যদি আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে আদালতকে বিষয়টি থেকে দূরে থাকা উচিত। আর সাংবিধানিক ব্যবস্থাপনার অধীনে গঠিত আদালতকে ভক্তদের আস্থা ও বিশ্বাসের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। অথচ আদালত এ মামলার শুনানির আগে স্পষ্ট করেছিলেন যে, “তাঁরা কোনো আস্থা বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়, বরং মালিকানার অধিকারের ভিত্তিতে এ মামলার রায় দেবেন।” আদালতের এই রায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেটি, যেখানে তাঁরা বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে এক ‘অপরাধমূলক বে-আইনি কর্ম’ বলে অভিহিত করেছেন। পাশাপাশি এ কথাও মেনে নিয়েছেন যে, সেকুলার ভারতের আইনের ভিত্তি হল বিশ্বাস। বাবরি মসজিদ ধ্বংস ষড়যন্ত্র মামলার তদন্তকারী বিচারপতি মনমোহন সিং লিবরাহানও তাঁর প্রতিবেদনে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করাকে একটি ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে উল্লেখ্য করেছিলেন। উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টে বাবরি মসজিদের মামলার শুনানি শুরু হলে বিচারপতি লিবরাহান এ বিষয়ে জোর দেন যে, সুপ্রিম কোর্টকে মালিকানা অধিকারের মামলায় রায় দেওয়ার আগে বাবরি মসজিদ ধ্বংস ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি করা উচিত, কেননা এ মামলা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এই রায় যে সকলকেই সন্তুষ্ট করতে পেরেছে, সেকথা বলা যায় না। সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি লেখা প্রকাশ করে। সেখানে প্রাক্তন বিচারপতি বলছেন– “এই রায়টা কীসের ভিত্তিতে দেওয়া হল, সবটা ঠিক বুঝতে পারছি না। সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সেই আদালত একটা রায় দিলে তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাচ্ছি না। চারশো-পাঁচশো বছর ধরে একটা মসজিদ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মসজিদকে আজ থেকে ২৭ বছর আগে ভেঙে দেওয়া হল বর্বরদের মতো আক্রমণ চালিয়ে। আর আজ দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলল, ওখানে এ বার মন্দির হবে। সাংবিধানিক নৈতিকতা বলে তো একটা বিষয় রয়েছে! এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়, যাতে দেশের সংবিধানের উপর থেকে কারও ভরসা উঠে যায়। আজ অযোধ্যার ক্ষেত্রে যে রায় হল, সেই রায়কে হাতিয়ার করে ভবিষ্যতে এই রকম কাণ্ড আরও ঘটানো হবে না, সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেন? শুধু অযোধ্যায় নয়, মথুরা এবং কাশীতেও একই ঘটনা ঘটবে –একথা আগেই বলা হত। যাঁরা গুন্ডামি করে বাবরি মসজিদ ভেঙেছিলেন, তাঁরাই বলতেন। এখন আবার সেই কথা বলা শুরু হচ্ছে। যদি সত্যিই মথুরা বা কাশীতে কোনো অঘটন ঘটানো হয় এবং তার পরে মামলা-মোকদ্দমা শুরু হয়, তা হলে কী হবে? সেখানেও তো এই রায়কেই তুলে ধরে দাবি করা হবে যে, মন্দিরের পক্ষেই রায় দিতে হবে বা বিশ্বাসের পক্ষেই রায় দিতে হবে। অযোধ্যা মামলা এর আগেও সুপ্রিম কোর্টে উঠেছে। তখনই আদালত স্বীকার করে নিয়েছিল যে, বিতর্কিত জমিতে মসজিদ ছিল। যেখানে বছরের পর বছর ধরে নামাজ পড়া হচ্ছে, সেই স্থানকে মসজিদ হিসেবে মান্যতা দেওয়া উচিত, এ কথা আদালত মেনে নিয়েছিল। তা হলে আজ এই নির্দেশ এল কীভাবে? যেখানে একটা মসজিদ ছিল বলে সুপ্রিম কোর্ট নিজেই মেনেছে, সেখানে আজ মন্দির বানানোর নির্দেশ সেই সুপ্রিম কোর্টই দিচ্ছে কোন যুক্তিতে? ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক জরিপে (এএসআই) জানিয়েছিল, ওই মসজিদের তলায় একটি প্রাচীনতর কাঠামোর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সেই প্রাচীনতর কাঠামো যে মন্দিরই ছিল, এমন কোনো প্রমাণ তো মেলেনি। সুপ্রিম কোর্ট নিজেও মেনে নিয়েছে যে, পুরাতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে কোনোভাবেই প্রমাণ হচ্ছে না যে, একটা মন্দিরকে ভেঙে ওখানে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। তা হলে কীসের ভিত্তিতে আজ মন্দির তৈরির নির্দেশ? বিশ্বাসের ভিত্তিতে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলল, অনেক হিন্দুর বিশ্বাস যে, ওখানে রামের জন্ম হয়েছিল। বিশ্বাস বা আস্থার মর্যাদা রাখতে ওই বিতর্কিত জমি রামলালা বিরাজমানের নামে দিয়ে দেওয়া হল। এটা কি আদৌ যুক্তিযুক্ত হল? রামচন্দ্র আদৌ ছিলেন কি না, কোথায় জন্মেছিলেন, সে সবের কোনো প্রামাণ্য নথি কি রয়েছে? নেই। রাম শুধু মহাকাব্যে রয়েছেন। সেই সূত্রে অনেক মানুষের মনে একটা বিশ্বাসও রয়েছে। কিন্তু সেই বিশ্বাসের বলে একটা মসজিদের জমি মন্দিরের নামে হয়ে যেতে পারে না। কালকে যদি আমি বলি, আপনার বাড়ির নীচে আমার একটা বাড়ি রয়েছে, এটা আমার বিশ্বাস, তা হলে কি আপনার বাড়িটা ভেঙে জমিটা আমাকে দিয়ে দেওয়া হবে? ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করা তো আদালতের কাজ নয়। আদালত সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় অকাট্য প্রমাণ এবং প্রামাণ্য নথিপত্রের ভিত্তিতে। বাবরি মসজিদ যেখানে ছিল, সেই জমিতে মন্দির তৈরির নির্দেশ সুপ্রিম কোর্ট কোন্ অকাট্য প্রমাণ ও প্রামাণ্য নথির ভিত্তিতে দিল, সেটা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়েছে। বাবরি মসজিদ যে ওখানে ছিল, পাঁচ শতাব্দী ধরে ছিল, সে আমরা সবাই জানি। বাবরি মসজিদ যে গুণ্ডামি করে ভেঙে দেওয়া হল, সেটাও আমরা দেখেছি। এমনকি সুপ্রিম কোর্ট রায়েও এটাও মেনে নিয়েছে যে, অন্যায়ভাবে মসজিদটা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৫২৮ সালের আগে ওখানে রামমন্দির ছিল কি না, আমরা কেউ কি নিশ্চিতভাবে জানি? রাম মন্দির ভেঙেই বাবরি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল, এমন কোনো অকাট্য প্রমাণ কি কেউ দাখিল করতে পেরেছিলেন? পারেননি। তা সত্ত্বেও যে নির্দেশটা শীর্ষ আদালত থেকে এল, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক নয় কি?”
সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির কথার উত্তর কি পাওয়া গেল ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সংসদ সদস্য মনসুখ ওয়াসওয়ারের মন্তব্যে? কী বলছেন মনসুখ ওয়াসওয়ার? বলছেন– “স্বাধীনতার আগে থেকে অযোধ্যা আন্দোলন চলছে। মনে রাখবেন, এখন বিজেপি সরকারে আছে বলেই সুপ্রিম কোর্ট থেকে আমাদের অনুকূলে রায় পাওয়া গেছে।” বাবরি মসজিদ রায় প্রকাশের আগে খড়াপুরের সংসদ সদস্য দিলীপ ঘোষও একই দাবি করেছিলেন। তিনি বলেছেন –“সরকার আমাদের, তাই রায়ও আমাদের দিকেই যাবে।”
সে যাই হোক, দুই ধর্মের কর্তাব্যক্তিরা কী বললেন, সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক— রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভগবত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “অযোধ্যা ইস্যুতে আমরা সুপ্রিম কোর্টের রায়কে সাধুবাদ জানাই। এই রায়কে কারও জয় বা কারও পরাজয় হিসাবে দেখাটা ভুল হবে। অতীতের বিভেদ ভুলে রামমন্দির নির্মাণে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।” শিবসেনার প্রধান উদ্ধব ঠাকরে বলেছেন, “আজকের দিন ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।” আদালতের রায় মেনে দ্রুত রামমন্দির প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিতে এক বিবৃতিতে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। এ তো গেল হিন্দু সংগঠনগুলির বক্তব্য। মুসলিম সংগঠনগুলির বক্তব্য কী? আজমির শরিফের দেওয়ান সৈয়দ জয়নুল আবেদিনও এ রায় সবাইকে মেনে নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এটা কারও জয়-পরাজয়ের বিষয় নয়। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে নেওয়া উচিত। যা হয়েছে, দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে আমাদের এই বিরোধের এখানেই সমাপ্তি টানা উচিত।” শিয়া নেতা মওলানা কালবে জাওয়াদ বলেছেন, “এখনও রিভিউ পিটিশনের সুযোগ থাকলেও বেশিরভাগ মুসলিম এই রায় মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে নিয়েছি। আমি মনে করি এই বিষয়টির এখানেই সমাপ্তি ঘটা উচিত।” সুন্নি কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান জাফর আহমাদ ফারুকিও আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন এবং একে চ্যালেঞ্জ করার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন। দিল্লি জামে মসজিদের শাহি ইমাম সৈয়দ আহমেদ বুখারি এ নিয়ে আর জল ঘোলা–করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “ভারতের মুসলিমরা শান্তি চায়। “হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে চলা বিরোধ এখানেই শেষ হওয়া উচিত।” অবশ্য অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (মিম)-এর প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি জানিয়েছেন, মামলার রায়ে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। সুপ্রিম কোর্টকে সর্বোচ্চ আদালত বলে মানলেও তিনি মনে করেন সুপ্রিম কোর্টও সবসময় ‘নির্ভুল’ নয়। ভারতীয় গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, “সংবিধানে আমাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস। রয়েছে, আমরা আমাদের অধিকারের জন্য লড়াই করছি। দান হিসাবে পাঁচ একর জমি আমাদের দরকার নেই। আমাদের এই পাঁচ একর জমি প্রত্যাখ্যান করা উচিত।”
অযোধ্যা রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ ঘটনাক্রম ও মামলার গতি-প্রকৃতি একনজরে ফিরে দেখা : ১৫২৮ : মোগল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মির বাকি বাবরি মসজিদ তৈরি করলেন। ১৮৮৫ : ফৈজাবাদ জেলা আদালতে বাবরি মসজিদের বাইরে চাঁদোয়া টাঙানোর আবেদন জানালেন মহান্ত রঘুবর দাস। আদালতে আবেদন নাকচ হয়ে যায়। ১৯৪৯ : বিতর্কিত ধাঁচার মূল গম্বুজের মধ্যে রাতের অন্ধকারে গোপনে বসিয়ে দেওয়া হল রামলালার মূর্তি। ১৯৫০ : রামলালার মূর্তিগুলির পুজোর অধিকারের আবেদন জানিয়ে ফৈজাবাদ জেলা আদালতে আবেদন করলেন গোপাল শিমলা বিশারদ। ১৯৫০ : মূর্তি রেখে দেওয়ার এবং পুজো চালিয়ে যাওয়ার জন্য মামলা করলেন পরমহংস। রামচন্দ্র দাস। ১৯৫৯ : ওই স্থানের অধিকার চেয়ে মামলা করল নির্মোহী আখড়া। ১৯৬১; একই দাবি জানিয়ে মামলা করল সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড। ১৯৮৬, ১ ফেব্রুয়ারি : স্থানীয় আদালত সরকারকে নির্দেশ দেয়, হিন্দু তীর্থযাত্রীদের প্রবেশাধিকার দিতে। সে সময়ে রাজীব গান্ধী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। অযোধ্যা রামজন্মভূমির রামলালা বিরাজমনের নিকট বন্ধু তথা এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি দেবকীনন্দন আগরওয়ালের মাধ্যমে মামলা দায়ের করে। ১৯৮৯, ১৪ অগাস্ট : এলাহাবাদ হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়, বিতর্কিত স্থানে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে। ১৯৯০, ২৫ ডিসেম্বর : বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি গুজরাটের সোমনাথ থেকে রথযাত্রা শুরু করেন। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ : অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমোহন জোশিদের মতো বিজেপি নেতাদের উসকানিতে করসেবকরা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়। ১৯৯৩, ৩ এপ্রিল : অযোধ্যার জমি অধিগ্রহণ করার জন্য বিতর্কিত এলাকার অধিগ্রহণ আইন পাস হয়। এলাহাবাদ হাইকোর্টে এই আইনের বিভিন্ন বিষয়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রিট পিটিশন জমা পড়ে। সংবিধানের ১৩৯-এ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে ওই রিট পিটিশন বদলি করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট, যা এখনও হাইকোর্টে বিচারাধীন। ১৯৯৪, ২৪ এপ্রিল : সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক ইসমাইল ফারুকি মামলায় রায়ে জানায়, মসজিদ ইসলামের অন্তর্গত ছিল না। ২০০২ এপ্রিল : বিতর্কিত স্থলের মালিকানা নিয়ে হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। ২০০৩, ১৩ মার্চ : সুপ্রিম কোর্ট বলে, অধিগৃহীত জমিতে কোনো রকমের ধর্মীয় কার্যকলাপ চলবে না। ১৪ মার্চ : সুপ্রিম কোর্ট বলে, এলাহাবাদ হাইকোর্টে দেওয়ানি মামলার নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অন্তর্বর্তী আদেশ কার্যকর থাকবে। ২০১০, ৩০ সেপ্টেম্বর : এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেয়, বিতর্কিত জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং রামলালার মধ্যে সমবণ্টন করে দেওয়া হোক। এই রায়ে তিন বিচারপতি সহমত পোষণ করেননি। ২-১ ভিত্তিতে রায়দান হয়। ২০১১, ৯ মে : অযোধ্যা জমি বিতর্কে হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৬, ২৬ ফেব্রুয়ারি : বিতর্কিত স্থানে রাম মন্দির তৈরির অনুমতি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। ২০১৭, ২১ মার্চ : প্রধান বিচারপতি জেএস খেহর যুযুধান পক্ষগুলিকে আদালতের বাইরে সমঝোতার প্রস্তাব দেন। ৭ আগস্ট : এলাহাবাদ হাইকোর্টের ১৯৯৪ সালের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে করা আবেদনের শুনানির জন্য তিন বিচারপতির বেঞ্চ গঠন করে সুপ্রিম কোর্ট।৮ আগস্ট : উত্তরপ্রদেশের শিয়া সেন্ট্রাল বোর্ড সুপ্রিম কোর্টে জানায়, বিতর্কিত স্থান থেকে কিছুটা দূরে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মসজিদ বানানো যেতে পারে। ১১ সেপ্টেম্বর : সুপ্রিম কোর্ট এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নির্দেশ দেয়, বিতর্কিত জমির ব্যাপারে সদর্থক মধ্যস্থতার জন্য দুজন অতিরিক্ত জেলা বিচারককে ১০ দিনের মধ্যে মনোনয়ন করতে হবে। ২০ নভেম্বর : উত্তরপ্রদেশের শিয়া সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড সুপ্রিম কোর্টকে বলে, অযোধ্যায় মন্দির ও লখনউয়ে মসজিদ বানানো যেতে পারে। ১ ডিসেম্বর : এলাহাবাদ হাইকোর্টে ২০১০ সালের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আবেদন করেন ৩২ জন নাগরিক অধিকার রক্ষা কর্মী। ২০১৮, ৮ ফেব্রুয়ারি : সুপ্রিম কোর্টে সমস্ত দেওয়ানি মামলার আবেদনের শুনানি শুরু হয়। ১৪ মার্চ : সুব্রহ্মণ্যম স্বামী সহ সকল অন্তবর্তী আবেদন (যারা এই মামলার পক্ষ হতে চেয়েছিল) নাকচ করে সুপ্রিম কোর্ট। ১৯৯৪, ৬ এপ্রিল : সালের রায়ে যে পর্যবেক্ষণ ছিল তা বৃহত্তর বেঞ্চে পুনর্বিবেচনা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানালেন রাজীব ধাওয়ান। ২০ জুলাই : সুপ্রিম কোর্ট রায়দান স্থগিত রাখল। ২৭ সেপ্টেম্বর : পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চে মামলা নিয়ে যেতে অস্বীকার করল সুপ্রিম কোর্ট। জানানো হল, ২৯ অক্টোবর থেকে মামলায় শুনানি হবে নবগঠিত তিন বিচারপতির বেঞ্চে। ২৯ অক্টোবর : সুপ্রিম কোর্ট জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে যথাযথ বেঞ্চে মামলার শুনানি স্থির করল, ওই বেঞ্চই শুনানির দিন ধার্য করবে। ২৪ ডিসেম্বর : সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত নিল, এ সম্পর্কিত সমস্ত আবেদনের শুনানি হবে ৪ জানুয়ারি থেকে। ২০১৯, ৪ জানুয়ারি : সুপ্রিম কোর্ট জানায়, তাঁদের তৈরি করা যথোপযুক্ত বেঞ্চ মামলায় শুনানির তারিখ ১০ জানুয়ারি স্থির করবে। ৮ জানুয়ারি : সুপ্রিম কোর্ট পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ ঘোষণা করে। শীর্ষে রাখা হয় প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈকে। এ ছাড়া বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন এস এ বোবদে, এনভি রামানা, ইউইউ ললিত এবং ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। ১০ জানুয়ারি : বিচারপতি ইউইউ ললিত নিজেকে মামলা থেকে সরিয়ে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে বলেন— ২৯ জানুয়ারি নতুন বেঞ্চের সামনে মামলার শুনানি শুরু করতে। ২৫ জানুয়ারি : সুপ্রিম কোর্ট পাঁচ সদস্যের নতুন সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করে। নতুন বেঞ্চের সদস্যরা হলেন বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, বিচারপতি এসএ বোবদে, ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, অশোক ভূষণ এবং এস এ নাজির। ২৯ জানুয়ারি : কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টে বিতর্কিত অংশ বাদ দিয়ে বাকি ৬৭ একর জমি তাদের আদত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেবার আবেদন জানায়। ২০ ফেব্রুয়ারি : সুপ্রিম কোর্ট জানায়, মামলার শুনানি শুরু হবে ২৬ জানুয়ারি থেকে। ২৬ ফেব্রুয়ারি : সুপ্রিম কোর্ট মধ্যস্থতার কথা বলে, আদালত নিযুক্ত মধ্যস্থতাকারীদের কাজে লাগানো হবে কি না সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ৫ মার্চ দিন স্থির হয়। ৬ মার্চ : জমি বিতর্ক মধ্যস্থতার মাধ্যমে মীমাংসা করা হবে কিনা সে সম্পর্কিত রায় দান মুলতুবি রাখে সুপ্রিম কোর্ট। ৯ এপ্রিল : নির্মোহী আখড়া কেন্দ্রের জমি ফেরানোর আবেদনের বিরোধিতা করে। ৯ মে : তিন সদস্যের মধ্যস্থতাকারী কমিটি সুপ্রিম কোর্টে তাদের অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা দেয়। ১৮ জুলাই : সুপ্রিম কোর্ট মধ্যস্থতা চালিয়ে যেতে বলে, ১ আগস্ট রিপোর্ট জমা দেওয়ার দিন ধার্য হয়। ১ আগস্ট : মধ্যস্থতা সংক্রান্ত রিপোর্ট বন্ধ খামে সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়ে। ৬ আগস্ট : সুপ্রিম কোর্ট জমি মামলায় দৈনিক ভিত্তিতে শুনানির কথা জানায়। ১৬ অক্টোবর : সুপ্রিম কোর্টে শুনানি শেষ হয়, রায়দান মুলতুবি রাখা হয়। ২০১৯, ৯ নভেম্বর : অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম রায় ঘোষণা সকাল সাড়ে দশটায়।
সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান প্রধান বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলি বাবরি রায় বেরনোর এক বছর ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্টত বলেন –“মন্দির তৈরির যে রায় সুপ্রিম কোর্ট দিল, আমার পক্ষে তা মেনে নেওয়া শক্ত। ওই জমি ৩০০ বছর আগের। তার মালিকানা কি এখন সুপ্রিম কোর্ট ঠিক করবে? কীভাবে ভোলা সম্ভব যে তার উপর এতবছর ধরে একটা মসজিদ ছিল? সংবিধান আসার পরও সেটা ছিল। সেটাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তো সুপ্রিম কোর্টের। সংবিধানের আগে কী ছিল সেটাকে রক্ষা করার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের নয়। কারণ তখন গণতান্ত্রিক ভারত ছিল না। তাই সংবিধান আসার আগে কোথায় মন্দির ছিল, কোথায় মসজিদ ছিল, কোথায় বৌদ্ধপ ছিল তার বিচার করতে বসলে তো অনেক মন্দির, মসজিদই ভাঙা পড়বে। আমি বিচারক হলে বাবরি মসজিদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার রায় দিতাম।”
বাবরি রায় কি ন্যায় বিচার, না পক্ষপাতিত্ব?– সে বিচার পাঠকদের জন্য ভোলা থাক। পাঠকরা বিচক্ষণতার সঙ্গে মূল্যায়ন করবেন।