হুমায়ুন (শাসনকাল : ১৫৩০ সাল থেকে ১৫৫৬ সাল)
বাবরের জীবিতকালেই হুমায়ুন বিভিন্ন যুদ্ধে গেলেও পাকাপাকিভাবে ১৫৩০ সালে হুমায়ুন দ্বিতীয় মোগল সম্রাট হিসাবে অধিষ্ঠিত হন বাবরের মৃত্যুর পর। তবে সম্রাট বাবরের মৃত্যু হলে সেই সংবাদটি গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কারণ মোগল সাম্রাজ্যের এই শোকময় অবস্থায় শত্রুরা অবশ্যই এর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করত। তা ছাড়া বাবরের সামনে দরবারের সবাই হুমায়ুনকে নতুন সম্রাট হিসাবে মেনে নিলেও দরবারে এমন অনেক আমিরই ছিলেন, যাঁরা হুমায়ুনকে বৈধ সম্রাট হিসাবে বিবেচনা করতেন না। সম্রাটের মৃত্যু এই মূহুর্তে প্রকাশ পেলে তাঁরা ঝামেলা করার চেষ্টা করবেই। কিন্তু বাধ সাধলেন বাবরের এক হিন্দুস্তানীয় আমির। তিনি এই সংবাদ গোপন না করে ভিন্নভাবে পরিবেশন করার পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেন, এভাবে অসুস্থ সম্রাটের কোনো খবরই জনগণের সামনে না প্রকাশ করলে তাতে বিভ্রান্তি আরও বাড়বে। আর সম্রাটের মৃত্যু গুজব হিসাবে ঠিকই ছড়িয়ে যাবে। তাতে গোটা সাম্রাজ্যে লুটপাট শুরু হয়ে যাবে। তিনি অনুরোধ করলেন, এই শোকের সময় মোগল পরিবারের সামান্য ভুলও হিন্দুস্তানের পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। তাঁর পরামর্শেই ঘোষকের দল গোটা রাজ্যে ঘোষণা করলেন সম্রাট অসুস্থ থাকায় স্বেচ্ছায় রাজকার্য থেকে অব্যহতি নিয়ে নিজের পুত্র হুমায়ুনকে মোগল সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসিয়েছেন। এই ঘোষণা শোনার পর জনগণ আশ্বস্ত হল যে, তাঁদের সম্রাট জীবিত আছেন এবং নিজ পুত্রের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে অবসর গ্রহণ করেছেন। সম্রাটের মৃত্যুর পর তাৎক্ষণিক হুমকির মোকাবিলার প্রস্তুতি গ্রহণ করে পরবর্তীতে সম্রাটের মৃত্যু সংবাদ সাম্রাজ্যে প্রকাশ করা হয়।
কিন্তু ৯ বছর পর, ১৫৩৯ সালের ২৬ জুন শের শাহ সুরির কাছে পরাজিত হয়ে মোগল সম্রাট হুমায়ুন হিন্দুস্তানের কর্তৃত্ব হারান। হিন্দুস্তানে সাময়িক ছেদ পড়ে মোগল শাসনামলের। বাবর যে সাম্রাজ্য স্থাপন করেন তা স্থায়ী হয়নি। হুমায়ুনের আমলে তা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। যদি আকবর পুনরায় রাজ্য জয় ও শাসনব্যবস্থা গঠন না করতেন তবে ভারত ইতিহাসে মোগল বিজয় উপাখ্যানে (Episode) পরিণত হত। আকবরের কৃতিত্ব খাটো না করেও ভারতে মোগল সাম্রাজ্য স্থাপয়িতা হিসাবে বাবরের কৃতিত্ব উল্লেখ্য। বাবর যদি মোগল শক্তিকে ভারতমুখী না করতেন, তবে তা মধ্য এশিয়ায় সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য তাতার জাতির অন্তযুদ্ধে ক্ষয় হয়ে যেত। তিনিই ভারতের পুরোনো মানচিত্রকে পালটে নতুনভাবে গঠন করে।
হুমায়ুন কথাটির অর্থ ভাগ্যবান হলেও তিনি সার্থকনামা ছিলেন না। তিনি উদারচিত্ত, আমোদপ্রিয়, সংস্কৃতিবান লোক ছিলেন সত্য– কিন্তু রাজ্যরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বিচক্ষণতা, দৃঢ়তা ও ধৈর্য কোনোটাই ছিল না। হুমায়ুন আমোদপ্রমোদে বহু সময় নষ্ট করেছেন। এর ফলে পশ্চিম ভারতে গুজরাটের বাহাদুর শাহ অত্যন্ত শক্তিশালী রাজপুতানা অধিকারের উদ্যোগ করেন। এদিকে তখন পূর্ব ভারতে শের শাহ বাংলা জয় করে বিহার ও বাংলার অধিপতি হিসাবে প্রভূত ক্ষমতা বাড়িয়ে ফেলেন। পশ্চিমে বাহাদুর শাহ ও পূর্বে শের শাহ— উভয়ের সাঁড়াশির দুই বাহুর চাপে হুমায়ুন হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেও শেষপর্যন্ত –(১) বাহাদুর শাহ যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে পালিয়ে গেলে তাঁর ক্ষমতাকে চূড়ান্ত ধ্বংস না করে তিনি ফিরে আসেন এবং (২) শের শাহের শক্তিবৃদ্ধি হতে থাকলে তিনি গোড়ায় তা অগ্রাহ্য করে। বস্তুত বাবরের সাংগঠনিক দুর্বলতা মোগল সাম্রাজ্যকে আগেই দুর্বল করলেও হুমায়ুনের দুর্বল নীতি সেই পতন ত্বরান্বিত করে।
বাবরের পুত্রসন্তানদের মধ্যে দিল্লির সিংহাসন পুনরাধিকার পর্যন্ত একমাত্র হুমায়ুনই জীবিত ছিলেন। হুমায়ুনের সিংহাসন আরোহণের সময় পর্যন্ত বাবরের পুত্রদের মাত্র চারজন বেঁচেছিলেন। এই চারজনের মধ্যে হুমায়ুনই বড়ো। হুমায়ুনের অন্যান্য ভাইয়েরা হলেন যথাক্রমে কামরান, আসকারি এবং হিন্দাল। ভাই বটে, কিন্তু কেউই সহোদর ছিলেন না। অর্থাৎ হুমায়ুনের মা আলাদা, কামরান ও আসকারার মা অন্য এবং হিন্দালের মাও আলাদা। তবে হুমায়ুনের এক সহোদরা বোন ছিলেন, তাঁর নাম গুলবদন। গুলবদন হুমায়ুনের জীবনীগ্রন্থ ‘হুমায়ুননামা’-র রচয়িতা।
বিমাতৃক ভাই হলেও হুমায়ুনকে নিষ্কণ্টক শাসক হতে দেয়নি। হুমায়ুনকে সবচেয়ে বেশি ক্লেশ দিয়েছেন কামরান আর আসকারি। হিন্দাল অবশ্য শেষদিকে হুমায়ুনের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে শহিদ হন। হিন্দালের হত্যাকারীই ছিল কামরান, কামরানের আকস্মিক ও কাপুরুষোচিত আক্রমণেই হিন্দোলের মৃত্যু হয়। বস্তুত কামরানের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের কারণেই হুমায়ুন ও মোগল পরিবারের পতন ডেকে আনেন। আকসারির পতনও একই কারণে।
বাবর তাঁর বিজিত স্বপ্নের ‘হিন্দুস্তান সাম্রাজ্যকে সুব্যবস্থিত করে যেতে পারেননি। সাম্রাজ্যের অধিকার তাঁর পুত্র হুমায়ুনকে সঁপে দিলেও দুর্ভাগ্য ও বিড়ম্বনা হুমায়ুনের নিত্যসঙ্গী হওয়ায় সেই অব্যবস্থিত সাম্রাজ্যকে সুব্যবস্থিত করার আগেই হুমায়ুনের হাতছাড়া হয়ে যায়। তিনি হয়ে যান শরণার্থী সম্রাট এবং হিন্দুস্তানের পথে পথে তাঁকে সহায় সম্বলহীন হয়ে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ইরানের শাহের কাছে গিয়ে আশ্রয় ও সাহায্য নিতে হয়। শাহের সাহায্যে তিনি পুনরায় হিন্দুস্তান জয় করে মোগল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করে দিল্লির সিংহাসনে আসীন হন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হতে না হতেই এবং সাম্রাজ্যকে সুব্যবস্থিত আগেই অকালে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর চরিত্রে দোষগুণের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ছিল, যা তাঁকে একদিকে হিন্দুস্তানের বাদশাহ, অন্যদিকে নির্বাসিত বাদশাহ রূপে ইরানের বাদশাহের অনুগ্রহের পাত্র বানিয়ে দেয়। একসময় যিনি দিল্লির সম্রাট ছিলেন, যাঁর সামনে রাজা ও নবাবরা অবনত মস্তক হতেন, আর সেই হুমায়ুন বাদশাহ রাজস্থানের মরুভূমিতে নির্ধন অসহায় হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি সকল অবস্থাতেই খুশি থাকতেন। কোনো দুঃখ-দুর্দশায় তিনি নিরাশ হতেন না। এমনকি জয় পরাজয়েও বিহ্বল হতেন না। তবে হুমায়ুনের যা কিছু সৌভাগ্যপ্রাপ্তি, তার জন্য সম্পূর্ণ অবদান বৈরাম খাঁয়ের। ইতিহাসে এমন বিশ্বস্ত, বিচক্ষণ এবং আত্মনিবেদন প্রাণের বন্ধু এ জগতে দুর্লভ। বৈরাম খাঁর মতো বন্ধু হুমায়ুনের পাশে না-থাকলে তাঁর পক্ষে মোগল সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধার কখনোই সম্ভব হত না। না-হলে হুমায়ুন বেশ কয়েকবার রাজকার্য ত্যাগ করে ফকিরজীবন গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বৈরাম খাঁই সে পথ থেকে হুমায়ুনকে ফিরিয়ে আনেন। আর-একজন মানুষেরও চরম সাহচর্য পেয়েছিলেন, তিনি হলেন হামিদাবানু বেগম। ইনি হুমায়ুনের স্ত্রী। হুমায়ুনের ২৫ বছরের রাজত্বকালের দীর্ঘ ১৫ বছরই বিদেশে কেটেছে।
এই যে ১৫ বছর তাঁকে বিদেশে কাটাতে হয়েছিল, ঠিক এই সময়ের মধ্যেই শের শাহ সুরির সুর বংশের উত্থান হলেও তিনিই সুর বংশের ধ্বংসাবশেষের উপর মোগল সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দিলেন। হুমায়ুনের মৃত্যু হয় ১৫৫৬ সালের ২৬ জানুয়ারি। হুমায়ুন তাঁর গ্রন্থাগারের ছাদের উপরে উঠেছিলেন। সেখান থেকে যে সমস্ত মানুষ মসজিদে সমবেত হয়েছিলেন তিনি তাঁদের অভিবাদন করলেন। সেখানকার কিছু প্রশাসনিক কাজ সেরে হুমায়ুন যে সময়ে ছাদ থেকে নীচে নামছিলেন, সেসময় মিসকিন নামে এক মোয়াজ্জিন মসজিদে আজান দিলেন। তখন তাঁর পা নামার সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে। আজানের আওয়াজ কানে এলেই হুমায়ুন তৎক্ষণাৎ হাঁটু গেড়ে অবনত হতেন। সে তিনি যে অবস্থাতেই থাকুন-না কেন। শীতকাল ছিল বলে তাঁর পরনে ছিল লম্বা পোস্তিন বা লবাদা। সেই পোস্তিন পায়ের নীচে চেপে গেলে হুমায়ুনের হাতের ছড়িটি দূরে ছিটকে পড়ে যায়। একই সঙ্গে হুমায়ুনও পড়ে যান। এমন আঘাত লাগল সেখান থেকে রক্ত বেরতে থাকল। তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। এ অবস্থায় তাঁকে রাজমহলের ভিতর আনা হল। চিকিৎসায় জ্ঞান ফিরলেও পুনরায় অজ্ঞান হয়ে গেলেন। এ অবস্থায় তাঁকে তাঁর পুত্র আকবরের কাছে পাঞ্জাবে পাঠানো হয়। সামান্য এই আঘাতেই হুমায়ুনের মৃত্যু হল। বাইরে থেকে আঘাতটা সামান্য মনে হলেও ভিতর থেকে নিশ্চয় ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মৃত্যুর পর হুমায়ুনের মৃতদেহ দিল্লিতে দাফন করা হয়। হেমুর দিল্লি অধিকার করার সময় তাঁর মৃতদেহ সেখান থেকে তুলে সেরহিন্দ নিয়ে গিয়ে অস্থায়ীভাবে পুনরায় দাফন করা হয়। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর মোগলদের দিল্লি অধিকার করার পর হুমায়ুনের মৃতদেহ পুনরায় দীনপনাহয় নিয়ে আসা হয়। এরপর হুমায়ুনের স্ত্রী হামিদাবানু বেগমের নির্দেশে সেখানেই হুমায়ুনের মকবরা বানানো হয় এবং সেখানেই তাঁর মৃতদেহ শেষবারের মতো দাফন করা হয়। এমন দুর্ভাগা শাসক বোধহয় এ পৃথিবীতে খুব কমই আছে, যাঁর মৃতদেদেহ মাটির নীচ থেকে বারবার তুলে বারবার দাফন করা হয়েছে।
হুমায়ুনের মতো ভাগ্যহীনা সম্রাট এ পৃথিবীতে অতি বিরল। পিতার কাছ থেকে বৃহৎ সাম্রাজ্য লাভ করেছিলেন বটে, একই সঙ্গে তাঁর মূর্খামি আর প্রতিকূল পরিস্থিতি তাঁকে পথে বসিয়ে ছেড়েছে। তাঁর ৪৮ বছরের জীবনে কেবলমাত্র ১০ বছরই (প্রথম পর্যায়ে ৯ বছর সাড়ে চার মাস এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬ মাস) তিনি তিনি হিন্দুস্তানের সিংহাসনে বসে শাসন করতে সমর্থ হন এবং তা সম্পন্ন হয়েছে নানা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। ফলে এই ১০ বছরে তিনি হিন্দুস্তানের কোনো স্থায়ী শাসন, গুরুত্বপূর্ণ সৌধ বা কোনো প্রতিষ্ঠান রেখে যেতে পারেননি। ২০ বছর টানা কামরানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই তাঁর অতিবাহিত হয়ে গেছে। এমনকি নির্বাসনকালের পুরো সময়টাতেও কামরানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কেমন ছিল মোগল সম্রাট হুমায়ুনের শাসন? বাবরের আলোচনায় বাবরের একটি চিঠির কথা উল্লেখ করেছিলাম, যা পুত্র হুমায়ুনের উদ্দেশে লেখা হয়েছিল। হুমায়ুন পিতার সেই নির্দেশ ও উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন।
একটু দেখা যাক হুমায়ুনের শাসন। হুমায়ুনের শাসনব্যবস্থা ছিল একনায়কতান্ত্রিক। তবে তিনি মনে করতেন সম্রাট হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তিনি মনে করতেন ঈশ্বর যেমন জাত-ধর্ম-উঁচু-নীচু-ক্ষুদ্র-বৃহৎ ভেদাভেদ না করে সবাইকে সমান চোখে দেখেন, শাসকও ঠিক তেমন চোখেই প্রজাদেরকে দেখে থাকেন। হুমায়ুন ললাট-লিখন ও জ্যোতিষে বিশ্বাসী ছিলেন। এতটাই তিথিনক্ষত্র মানতেন যে, বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ বিশেষ রঙের পোশাক পরতেন ও মুকুট ধারণ করতেন। যেমন– শনিবারে কালো, রবিবারে পীত, সোমবারে শ্বেত, মঙ্গলবারে রক্তিম, বুধবারে ধূসর (নীলা বা রেশমি বর্ণের) এবং শুক্রবারে শ্বেতবর্ণ। তিনি এক আনন্দমঙ্গলের কালীন নির্মাণ করন। এটি ছিল গোলাকার এবং তা ছিল তাত্ত্বিক গ্রহনক্ষত্রের পথের অনুরূপে বিভাজিত। সেইমতো রং ব্যবহার হত। হুমায়ুন একটি বড়ো তাঁবু নির্মাণ করেছিলেন। এটি আকাশের বারোটি রাশিচক্রের ভিত্তিতে বারোটি কক্ষে বিভক্ত ছিল। তবে তিনি ছিলেন ক্ষমাশীল শাসক। হুমায়ুনের সিংহাসন আরোহণের সময় তাঁর পিতৃসূত্রে পাওয়া এক বিশাল সাম্রাজ্য লাভ করেছিলেন, যা ছিল অক্সাস নদী থেকে গঙ্গা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। শাসক হিসাবে হুমায়ুনও সাম্রাজ্য বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। মালব ও গুজরাট নিজের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করলেও পরে হাতছাড়া হয়ে যায়। এমনকি বাংলা, বিহার, দিল্লি থেকেও তিনি বহিষ্কৃত হন। বেশ কিছুদিন তাঁর অধীনে এক বিঘেত ভূমিও ছিল না। সাম্রাজ্যের কিছুটা তিনি পুনরুদ্ধার করতে পারলেও পাঞ্জাব, দিল্লি, বিহার এবং দোয়াবের অধিকাংশ অঞ্চল আফগানদেরই অধীনে থেকে গিয়েছিল মৃত্যুকাল পর্যন্ত। হুমায়ুনের মধ্যে প্রশাসকীয় যোগ্যতা ছিল না। হয়তো সময় না পাওয়ার জন্যই সেই যোগ্যতা অর্জন করে উঠতে পারেননি। আবুল ফজলের রচনা থেকে জানতে পারি, হুমায়ুন কয়েকটি স্থানে শাসনকেন্দ্র স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তিনি দিল্লি, আগ্রা, জৌনপুর, মা, লাহোর, কনৌজ ইত্যাদি স্থানে যোগ্য এবং অভিজ্ঞ আমিরদের নিযুক্ত করে ওই সমস্ত স্থানে একটি করে বাহিনী রাখতে চেয়েছিলেন। নিজের জন্য ১২ হাজারের বেশি অশ্বারোহী রাখতে চাননি। সেই ইচ্ছা তাঁর পূরণ হয়নি অকালমৃত্যুর কারণে। তাঁর রাজত্বের প্রথম যুগে উজির (প্রধানমন্ত্রী) ছিলেন আমির ওয়াইস মোহম্মদ। পরে অবশ্য এক হিন্দু বেগ (বেগ শব্দটির অর্থ গোত্রপতি বা গোত্রপ্রধান) হুমায়ুনের আস্থাভাজন হয়েছিলেন। হুমায়ুন তাঁকে ‘আমিরুল উমরা’ উপাধি এবং সোনার কুর্সি উপহার দিয়েছিলেন। উজির সৈনিক ও রাজ্যের সমস্ত বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। উজির কেবল শাসনকার্যের দায়িত্বেই থাকতেন না, সেনানায়কও হতেন, যুদ্ধেও অশংগ্রহণ করতেন। হুমায়ুন আমির ও রাজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছিলেন –(১) আহলে দৌলত, (২) আহলে সআদত এবং (৩) আহলে মুরাদ। আহলে দৌলত ভাগে সেই সমস্ত ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যাঁরা বুদ্ধি বীরত্ব-কুশলতার সঙ্গে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতেন এবং সাম্রাজ্য বিকাশ ও বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করতেন। এই ভাগে মূলত সম্রাটের আত্মীয়স্বজন, আমির, উজির এবং সৈনিকদেরই রাখা হত। এরা যে সকলেই মুসলিম ছিলেন না, প্রচুর হিন্দুরাও থাকত। হুমায়ুনের আহলে দৌলতে প্রধান অধিকারী ছিলেন ‘শুজাউদ্দিন আমির হিন্দু বেগ। এই হিন্দু বাবরেরও বিশিষ্ট আমির ছিলেন। হুমায়ুনের আমলে ইনি জৌনপুরের গভর্নর ছিলেন। আহলে সআদতেও শায়খ, সৈয়দ, কাজী পদগুলিতে মুসলিমের পূর্ণ অধিকার থাকলেও সেইসঙ্গে সঙ্গে হিন্দুরাও অলংকৃত করে রাখত দার্শনিক, কবি ও পণ্ডিত পদগুলি। এই ব্যক্তিরা নিজেদের জ্ঞান ও আদর্শ বিনিময়ের মাধ্যমে রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধি করতেন। হুমায়ুন এক চলমান বাজার প্রচলন করেছিলেন, যেটাকে বলা হত নৌকাবাজার। যেখানে পথিমধ্যে প্রত্যেক নাগরিক তাঁদের পানাহার, বস্ত্র, যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম ইত্যাদি পাওয়া যেত। প্রচলন করেছিলেন নৌকা উদ্যান, চলমান পুল, এমনকি চলমান রাজপ্রাসাদও। পিতা বাবরের মতো হুমায়ুনও ছিলেন প্রচণ্ড বইপ্রেমী। বইতৃষ্ণা মেটানোর জন্য একটি গ্রন্থাগারও তৈরি করেছিলেন। গ্রন্থাগারটি ছিল গ্রানাইট ও লাল পাথরে নির্মিত একটি দ্বিতল ভবন। এই গ্রন্থাগারের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েই হুমায়ুন মৃত্যু হয়েছিল। হুমায়ুনের ইমারত নির্মাণে খুব আগ্রহ ছিল। সময় ও সুযোগ পেলেই তিনি ইমারত নির্মাণের আদেশ দিতেন। তিনি ইরান থেকে আনা কলাতত্ত্বের সঙ্গে ভারতীয় কলাতত্ত্বের মিশ্রণে মোগল-কলার সৃষ্টি করেছিলেন। হুমায়ুনের মকবরা থেকে মোগল আমলের বাস্তুকলার বাস্তবিক ইতিহাস শুরু হয়। মোগল কলাতত্ত্ব মানেই ইরানীয় প্রভাব। ইরানি প্রভাব থাকলেও তা হয়ে উঠল সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় মোগল কলাতত্ত্বের ইমারত। হুমায়ুনের নির্মিত মকবরার নীচের ভূমিগৃহের মোগল পরিবার সম্পর্কিত বহু কবর আছে। তবে কোনো শিলালিপি না-থাকায় কোনটা কার কবর বোঝা দুঃসাধ্য। শাহজাহানের পুত্র দারাশিকোর প্রাণদণ্ডের পর কোনো সংস্কারকর্ম ব্যতীতই এই মকবরায় কবর দেওয়া হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর কয়েকজন মোগল মৃত রাজপুত্র ও মৃত সম্রাটদেরও এখানেই কবর দেওয়া হয়।
‘Glimpses of World History’ পণ্ডিত নেহেরু লিখেছেন– “চেঙ্গিস খাঁ ও তৈমুর লঙের বংশধর বাবর তাঁর পূর্বপুরুষদের মহানুভবতা ও সামরিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। মার্জিত ও সংস্কৃতি অনুরাগী বাবর ছিলেন এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর মধ্যে কোনো সংকীর্ণতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। তিনি ছিলেন কবি, বিদ্যোৎসাহী ও শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক।”
আমরা মোগল সম্রাট হুমায়নের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পাই হিন্দি ঐতিহাসবিদ ডক্টর হরিশঙ্কর শ্রীবাস্তব রচিত ‘মোগল সম্রাট হুমায়ুন’ গ্রন্থ থেকে। তিনি হুমায়ুন সম্পৃক্ত যত ফারসি ভাষার গ্রন্থ আছে, সবই অবলোকন করেছেন। এমনকি ইংরেজি ভাষার যত গ্রন্থ আছে, তার সবই অত্যন্ত গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছেন। ডক্টর তারাচাঁদ ওই গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছেন– “হুমায়ুন তৈমুরী বংশের এক বিচিত্র রত্ন ছিলেন। ওই বংশে অদ্ভুত সব বিভূতিরা জন্ম নিয়েছেন, যাঁদের ধারাবাহিকতা তৈমুর থেকে নিয়ে আওরঙ্গজেব– দশ-বারো পুরুষ অবধি চলতে থাকে। এমন রাজবংশ জগতে অতি দুর্লভ, যে বংশে এমন ওজস্বী নায়কদের আবির্ভাব ঘটেছে। হুমায়ুন এই সুদীর্ঘ সোনালি শৃঙ্খলে এক অমূল্য সংযোজন ছিলেন। তাঁর চরিত্রে দোষে-গুণের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ছিল, যা তাঁকে একদিকে হিন্দুস্তানের বাদশাহ, অন্যদিকে নির্বাসিত বাদশাহ রূপে ইরানের বাদশাহের অনুগ্রহের পাত্র বানিয়ে দেয়। এক সময় যিনি দিল্লির সম্রাট ছিলেন, যাঁর সামনে রাজা ও নবাবগণ অবনতমস্তক হতেন, আর সেই হুমায়ুন বাদশাহ রাজস্থানের মরুভূমিতে নির্ধন, অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন। তা সত্ত্বেও তিনি সকল অবস্থাতেই খুশি ছিলেন, দুঃখ-দুর্দশায় তিনি হতাশ হতেন না, আবার জয়-পরাজয়ে বিহ্বল হতেন না।”
বাবরের সৈন্যদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দেশের লোক তথা নানা জাতি, নানা বর্ণ, নানা ধর্মের কারণে সেনাদের মধ্যে পূর্ণ ঐক্য ছিল না। বাবর যেমন সৈন্যদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করতে পারেনি, তেমনি হুমায়ুনও ভিন্ন ভিন্ন জাতি গোষ্ঠী সেনাদের এক সূত্রে বাঁধতে পারেনি। সেই যোগ্যতা হুমায়ুনেরও ছিল না। হুমায়ুন বাবরের সঙ্গে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বটে, কিন্তু কোনোদিনই যুদ্ধকলায় নিপুণতা প্রদর্শন করতে পারেননি। মোগল সাম্রাজ্য সেসময় সবেমাত্র স্থাপিত হয়েছে। তা ছাড়া ভারতে তখনও পর্যন্ত মোগলদের বিদেশি বলে মনে করত। তবে হুমায়ুনই প্রথম সেনা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। অত্যন্ত শক্তিশালী করে তুলেছিলেন তাঁর তোপখানা। তাঁর প্রায় ১০,০০০ বিদেশি সৈন্য ছিল। নিজ সাম্রাজ্যের হিন্দুদের প্রতিও তাঁর খুব ভালো ব্যবহার ছিল। তিনি হিন্দুদের পুরস্কৃত করতেন বিভিন্ন সময়ে। হিন্দুদের উচ্চ ও বিশ্বাসযোগ্য স্থানে নিয়োগ করতেন? এমনকি তিনি কোল, ভীলদের সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করতেন। হুমায়ুন তাঁর দরবারের নাম রাখেন ‘শৃঙ্গার মণ্ডপ। তাঁর হাতিদের নামকরণ করেন সব সংস্কৃতে। তিনি তাঁর উদারনীতি ও সুশাসনের জন্য অত্যধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন।
হুমায়ুনের অকালমৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র আকবর তাঁর সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হলেন। বাবর থেকে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ পর্যন্ত দীর্ঘ আড়াইশো বছরের গৌরবময় মোগল ইতিহাস। আকবরের আলোচনায় পরে আসব। তার আগে শের শাহের কথা বলতেই হয়।