২.০ জবাবদিহি (দ্বিতীয় খণ্ড)

ভারতে ইসলাম ভারতীয় মুসলিম (দ্বিতীয় খণ্ড : ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পরবর্তী ) – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

উৎসর্গ

আমার বাল্যবন্ধু শঙ্করকে

যে আমাকে গ্রন্থাগার চিনিয়েছিল, যে আমাকে ফি রবিবার মফসসল থেকে কলকাতায় এনে অলিগলি চিনিয়েছিল

.

সূচিমুখ

জবাবদিহি

মধ্যযুগ : ভারতে মুসলিম শাসন

  • সিরাজ-উদ্-দৌল্লা
  • রাজা গণেশ
  • আলাউদ্দিন খিলজি
  • টিপু সুলতান

প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ : বিশ্বজুড়েই যুদ্ধাভিযান এবং রক্তধারা

ব্রিটিশরাজ : বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে

ভারতে ব্রিটিশ শাসন : হিন্দু ও মুসলিম

খণ্ডিত ভারত : হিন্দু, মুসলিম, ব্রিটিশ, কংগ্রেস

মুসলিম : যত দোষ নন্দ ঘোষ

বিশ্ব তথা ভারতে মুসলিমদের অবদান

শেষ পাতে শেষ পাতা

.

জবাবদিহি

কোনটা ইতিহাস আর কোনটা গল্পগাছা আর কোনটা ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রয়োজনে নির্মাণ করা ইতিহাস, সব গুলিয়ে দেওয়ার নিরন্তর প্রয়াস চলছে গত ২৬৩ (ব্রিটিশদের ১৯০ এবং স্বাধীন ভারতের ৭৩ বছর) বছর ধরে। স্বকল্পিত ইতিহাসকে ‘খাঁটি ইতিহাস বলে চালানোর চেষ্টা চলছে। ইতিহাস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জ্ঞানের ঘাটতিকে মূলধন করে শাসককুল ক্ষমতায় টিকে থাকে। আজব দেশ আমার –যাঁর যেখানে থাকার কথা তিনি সেখানে নেই, যাঁর যেখানে থাকার কথা নয় তিনি সেখানে জ্বলজ্বল করছেন। অর্থাৎ যাঁর বসার কথা রুপোর সিংহাসনে, তিনি বসে আছেন সোনার সিংহাসনে। যাঁর বসার কথা সোনার সিংহাসনে, তিনি বসে আছেন রুপোর সিংহাসনে। এ গ্রন্থখানি লিখতে লিখতে আমার সেই কথাই বারবার মনে হয়েছে।

ইতিহাসের অনেক দিক, অনেক মুখ। যত মুখ তত মত। একই ইতিহাস কমিউনিস্টদের চোখে একরকম, গান্ধিবাদীদের চোখে অন্যরকম৷ আবার উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চোখে একরকম, উগ্র ইসলামিদের চোখে একরকম। নির্মোহী হিন্দুদের চোখে একরকম, নির্মোহী ইসলামিদের চোখে অন্য রকম। আবার নাস্তিকদের চোখে অন্যরকম। মোটকথা, ইতিহাস লেখার সময়ে সকলই নিরপেক্ষ থাকতে পেরেছেন একথা হলফ করে বলা যায় না। প্রত্যেকই তাঁদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাসকে দেখেছেন এবং বর্ণনা করেছেন। কোনো কোনো লেখকের লেখা পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছি, আবার কোনো কোনো লেখকের ইতিহাস পাঠ করে মনে হয়েছে– লেখকের কলমে এত বিষ! বিষ থাকবে না কেন? যে দেশে ব্রিটিশদের মতো কালীয়ানাগের প্রবেশ ঘটে, সে দেশ যমুনার জলের মতো বিষময় হবেই। তাই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগিনী নিবেদিতা তাঁর ‘অ্যাগ্রেসিভ হিন্দুইজম’ গ্রন্থে মনে করিয়ে দিয়েছেন– “নতুন দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া প্রাচীন ভারতবর্ষকে জানিতে হইবে। ইংরাজের লেখা ইতিহাস অধ্যয়ন করিলে চলিবে না।”

কোনো কোনো লেখক ‘ঐতিহাসিক’ নাম ধারণ করে ইতিহাস চর্চা করেন। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই যে, আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ঐতিহাসিক। অর্থাৎ এমন মানুষ নেই যাঁর সময় সম্বন্ধে বোধ নেই। এমন মানুষ নেই যাঁর ঐতিহাসিক কার্য-কায়ণ ধারার কোনো ধারণা নেই। ঐতিহাসিক কার্য-কারণের ধারণা, চিন্তার ফল, যার মূলে থাকে অভিজ্ঞতা এবং পড়াশোনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “বিশেষজ্ঞরা যা বলেন তাই যে বেদবাক্য আমি বলি নে। কিন্তু সুবিধা এই যে বেদবাক্যের ছন্দে তাঁরা কথা বলেন না। প্রকাশ্য সভায় তাঁরা আমাদের বুদ্ধিকে আহ্বান করে। আমাদের ধারণার সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মত কি সবসময়ই মিলে যেতে হবে? যদি না মেলে, তবে কেন নয়? এইসব জিজ্ঞাসার উত্তর আমাদের জানতে হবে। যেহেতু অজান্তে আমার প্রত্যেকেই ঐতিহাসিক।

ভারতে সুলতানি যুগ ও মোগল যুগ মিলে মধ্যযুগ বলা হয়। মধ্যযুগে ইতিহাস গ্রন্থের অভাব নেই। সেজন্য। মধ্যযুগে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান অপেক্ষা সাহিত্যিক উপাদান বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক উপাদান দুই ধরনের –(১) সাহিত্যিক উপাদান (The Literary Elements) ও (২) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান (Archaeological Evidence)

সাহিত্যিক উপাদান আবার দুই ধরনের –(১) সমসাময়িক ইতিহাস গ্রন্থ— ঐতিহাসিক গ্রন্থের মধ্যে মিনহাজ উস-সিরাজের ‘তবাক-ই-নাসিরি’ জিয়াউদ্দিন বরানির ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি’ সামসউদ্দিন সিরাজ আফিকের ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি’ প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমির খসরু, ইসামি প্রভৃতি ঐতিহাসিকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সিকান্দার-বিন-ই-রসিদি’ গোলাম হুসেন সালিম রচিত “রিয়াজ-উস-সালাতিন ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে প্রাদেশিক ইতিহাস জানা যায়। এইসব গ্রন্থ থেকে তৎকালীন সমাজ, অর্থনীতি ও ধর্মজীবন সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায় এবং (২) বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ— সুলতানি আমলের পর্যটকদের মধ্যে ইবন বতুতার নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁর বিবরণ থেকে সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বহু তথ্য পাওয়া যায়। অন্যান্য পর্যটকদের মধ্যে মার্কো পোলো, নিকলো কন্টি, আবদুর রজ্জাক, নুনিজ পায়েজ প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এরপর আসে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। সুলতানি আমলের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতত্ত্বের গুরুত্ব কিছুটা কম হলেও কোনো কোনো অঞ্চলের যেমন বাংলা, বাহমনি, গুজরাটি ইত্যাদির ইতিহাস রচনায় লিপি বিশেষ ভাবে সাহায্য করে। ইলতুৎমিস, বলবন, আলাউদ্দিন খলজি এবং বিশেষভাবে মোহম্মদ বিন তুঘলকের মুদ্রা থেকেও বহু তথ্য পাওয়া যায়। স্থাপত্য, ভাস্কর্য, শিল্পকলা সুলতানি আমলে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতার পরিচায়ক। মোগলযুগের ঐতিহাসিক উপাদান মূলত ইতিহাস গ্রন্থ, আর এই যুগের ইতিহাস গ্রন্থগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়— (১) সরকারি আনুকুল্য ও উদ্যোগে রচিত ইতিহাস : আকবরের সভাসদ আবুল ফজল রচিত ‘আকবর নামা’ ও ‘আইন-ই-আকবরি’ এই শ্রেণিতে পড়ে। (২) নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক রচনা : নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের মধ্যে খাজা নিজামউদ্দিন আহমদ, বদাউনি, ফেরিস্তা, আবদুল, হামিদ লাহোরি, কাফি খান প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (৩) আত্মজীবনীমূলক রচনা : জীবনীমূলক রচনায় মধ্যে বাবরের ‘তুজুক-ই-বাবরি জাহাঙ্গিরের ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি’ ও গুলবদন বেগমের ‘হুমায়ুননামা’ উল্লেখযোগ্য। বৈদেশিক পর্যটকদের মধ্যে রালফ ফিচ, বার্নিয়ের, ট্যাভারনিয়ে, মানুচি, স্যার টমাস রো প্রভৃতির বিবরণ থেকে ইতিহাস রচনার মূল্যবান উপাদান সংগৃহিত হয়।

গবেষক ই এইচ কার তাঁর ‘what is History?’ গ্রন্থে বলেছেন –“চূড়ান্ত ইতিহাস এই প্রজন্মে আমরা পাব না। কিন্তু প্রথাগত ইতিহাসকে বাতিল করতে পারব, আর এখন যেহেতু সব তথ্যই আয়ত্তের মধ্যে ও প্রত্যেক সমস্যারই সমাধান করা যায়, ফলে পথ থেকে পথান্তরে যাওয়ার যে পর্যায়ে আমরা পৌঁছেছি তা দেখাতে পারব।”

চূড়ান্ত ইতিহাস রচনার প্রসঙ্গে অধ্যাপক স্যার জর্জ ক্লার্ক তাঁর ‘The New Cambridge Modern Hisory গ্রন্থে লিখেছেন –“পরবর্তী প্রজন্মের ঐতিহাসিকরা এই ধরনের কোনো সম্ভাবনার প্রত্যাশা করেন না। তাঁরা আশা করেন, তাঁদের লেখা বারবারই অতিক্রান্ত হবে, তাঁরা মনে করেন, অতীতের জ্ঞান এসে পৌঁছেছে এক বা একাধিক মানবমনের মধ্যে দিয়ে ও তাঁদের মাধ্যমে ‘সংসাধিত হয়েছে। ফলে জ্ঞান এমন কোনো মৌল ও নৈর্ব্যক্তিক পরমাণু দিয়ে গঠিত হতে পারে না, যা একেবারেই অপরিবর্তনীয়। … এই বিষয়ের সন্ধান মনে হয় অন্তহীন এবং কিছু অধীর পণ্ডিত আশ্রয় নেন সংশয়বাদের, বা অন্তত এই ধরনের মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন যে, যেহেতু ইতিহাসের সবরকম বিচারের সঙ্গেই ব্যক্তি ও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি জড়িত, তার যে-কোনো একটি অপরটির মতোই সমান ভালো আর ‘বিষয়নিষ্ঠ’, ঐতিহাসিক সত্য বলে কিছু নেই।”

খোদ অতীত বা তার সম্পর্কে ঐতিহাসিক খোদ চিন্তা, এর কোনোটাই ইতিহাসের দর্শনের বিবেচ্য নয়। বরং তার আলোচ্য হল, পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত অবস্থায় এই দুটি বিষয়। এই সুর থেকেই প্রতিফলিত হয় ‘ইতিহাস’ শব্দটির প্রচলিত দুটি অর্থ– ঐতিহাসিক যে অনুসন্ধান করেন এবং অতীতের যে বিভিন্ন ঘটনার সারি নিয়ে তিনি অনুসন্ধান করেন। ঐতিহাসিকরা যে ইতিহাসের চর্চা করেন তা মৃত নয়। তার বদলে এক অর্থে ওই অতীত এখনও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে। শুধু বেঁচে থাকলেই হবে না, জাগিয়ে রাখতে হবে। বহু অতীত ঘুমিয়ে আছে, বরং বলা ভালো তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তাঁকে জাগিয়ে তোলাটাই একজন সৎ ঐতিহাসিকের কাজ। অতীতের ক্রিয়া কিন্তু মৃত, অর্থাৎ ঐতিহাসিকের কাছে তা অর্থহীন, যতক্ষণ-না তিনি তার পিছনে যে চিন্তা করছে তাকে বুঝতে পারেন। অতএব সব ইতিহাসই চিন্তার ইতিহাস, আর ইতিহাস মানে ঐতিহাসিকের মনে সেই চিন্তার পুনঃরূপায়ণ, যে ইতিহাস তিনি চর্চা করছেন। ঐতিহাসিকের মনে অতীতের পুনর্গঠন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এটি স্বয়ং কোনো প্রক্রিয়া নয় এবং শুধু তথ্যের পুনরাবৃত্তি করে এটি গড়ে ওঠেনি। তার পরিবর্তে পুনর্গঠনের বা পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করে তথ্যের নির্বাচন ও ব্যাখ্যান। এর ফলেই সেগুলো পরিণত হয় ঐতিহাসিক তথ্যে। ইতিহাসের তথ্য কখনোই আমাদের কাছে ‘বিশুদ্ধ’ রূপে আসে না। কায়ণ ইতিহাসের তথ্য বিশুদ্ধ অবস্থায় থাকে না, থাকতে পারে না। তারা সবসময়েই নথিকারের মনের মধ্যে দিয়ে প্রতিসারিত হয়। অর্থাৎ, আমরা যখন কোনো ইতিহাসের বই বেছে নিই তখন তার ভিতরকার তথ্যই আমাদের প্রথম বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়, যে ঐতিহাসিক সেটি লিখেছিলেন। তিনিই আমাদের কাছে বিবেচ্য। অধ্যাপক ওকশটের মতে– “ইতিহাস হল ঐতিহাসিকের অভিজ্ঞতা। ঐতিহাসিক ছাড়া আর কেউই তৈরি করেন না, ইতিহাস তৈরি করার একমাত্র উপায় সেটি লিখে ফেলা।”

আমি সেই কাজটিই করেছি। লিখে ফেলেছি। কিন্তু আমি ইতিহাসবিদ নই, আবার পেটুয়াও নই। ইতিহাস লেখার জন্য কেউ আমাকে ‘বরাত’ দেননি, দেবেও না। আমার ইতিহাসচর্চা আমারই তাগিদে। ঘুমিয়ে থাকা অতীতকে ঘুম থেকে টেনে তুলেছি মাত্র। ঐতিহাসিক হিসাবে নয়, একজন সামাজিক মানুষ হিসাবে দায় ও দায়িত্ববোধ থেকে এই গ্রন্থের অবতারণা। কেউ আমাকে ইসলাম-বিদ্বেষী বলতে পারেন, কেউ আমাকে হিন্দু বিদ্বেষীও বলতে বলতে পারে, কেউ কেউ যে সেকু-মাকু বলবে না এমন গ্যারান্টিও দেওয়া যায় না। তবে আমি হিন্দুরও নই, মুসলমানদেরও নই। আমি শুধু মানুষের পক্ষে। সেকুও নই, মাকুও নই। আমার মতাদর্শেই আমি।

কোনো বামপন্থীকে বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের ইতিহাস লিখতে বলা হল। তিনি লিখবেন ৩৪ বছর ভালো ভালো কাজগুলি। প্রয়োজনে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ভুল তথ্যও দেবেন৷ আবার একজন তৃণমূলি লেখক যদি ওই একই ইতিহাস লেখে তাহলে তিনি বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের কুকীর্তি, গণহত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতি, স্বজনপোষণের ইতিহাস লিখবেন, প্রচুর মিথ্যাচারও করবেন। আর আমাকে যদি বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের ইতিহাস লিখতে বলা হয়, তাহলে আমি যেমন মরিচঝাঁপি লিখব তেমনই অপারেশন বর্গাও লিখব, বিজন সেতুতে আনন্দমার্গীদের হত্যা-প্রসঙ্গ লিখব, তেমনই হলদিয়া পেট্রোকেম নিয়েও লিখব, অনিতা ধাওয়ানের ধর্ষণ প্রসঙ্গ যখন আসবে তখন ‘নন্দন’ প্রসঙ্গ থাকবে না? বস্তুত প্রকৃত ইতিহাস লেখার লেখক পাওয়া খুব দুষ্কর। আমাদের মতো মানুষ যাঁরা কোনো গোষ্ঠীর তাবেদারি করি না, তাঁরা নির্মোহ ইতিহাস লেখার চেষ্টা করি মাত্র। ধুলো ঝেড়ে না-বলা ইতিহাসকে বের করে আনার চেষ্টা করি। কারোকে খুশি করার জন্য এ গ্রন্থ লেখা হয়নি। যদি কারোর আঁতে ঘা লাগে তাহলে অশিক্ষিত, দুমুখ বলে ক্ষমাঘৃণা করতে পারেন আমাকে। ভারতের মুসলিমদের নিয়ে ইতিহাস মুসলিম ঐতিহাসিকরা একরকম লিখেছেন, হিন্দু ঐতিহাসিকরা আর-একরকম লিখেছেন, আবার ব্রিটিশরা আর-একরকম লিখেছেন। আমি কেবল সম্পর্কের উন্নতি চেয়েছি।

এ গ্রন্থের প্রতিটি অক্ষরই যে আমার কলম থেকে বেরিয়েছে, এ দাবি আমি করি না। খুব স্পর্শকাতর বিষয়। বিষয় মুসলমান। আমি পণ্ডিত নই, ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু ছাত্র মাত্র। প্রকৃত ইতিহাসকে খুঁজে বের করা খুব সহজ কাজ নয়। তবুও হাল ছাড়িনি। পরতে পরতে ধাক্কা, পরতে পরতে অনাস্বাদিত আবিষ্কার। এই গ্রন্থের বিষয় নির্বাচন করার সময় মনে হয়েছিল একটা লম্বা সময়কাল নিয়ে আলোচনা করতে হবে, যা এক খণ্ডে এক মলাটে ধরানো সম্ভব নয়। তাই দুটি খণ্ডে বইটি প্রকাশ করতে হল। প্রথম খণ্ডটি পাঠকসমাজের প্রভূত সমাদর লাভ করেছে, প্রথম খণ্ডটির মতো দ্বিতীয় খণ্ডটিও সমানভাবে সমাদর লাভ করবে, এই প্রত্যাশা রইল।

এ লেখাটি একটি ওয়েবম্যাগে মিডিয়াতে মোট বত্রিশটি পর্বে প্রকাশিত হয়েছিল। পেয়েছি সরাসরি ফিডব্যাক। উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। আবার উগ্র হিন্দুবাদীরা বলেছেন মুসলমানদের দালাল’, গোঁড়া মুসলিমদের কেউ কেউ আবার মুসলিমদের বিষয়ে না-লিখে অন্য বিষয়ে লিখুন’ বলে হুমকি দিয়েছে। প্রতি পদে পদে অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে ছিল ওয়েবম্যাগের পাঠকরা, পরামর্শ দিয়েছেন, শুধরে দিয়েছেন অনেক জায়গায়। প্রেরণা দিয়েছেন, বইটি ছাপার অক্ষরে প্রকাশের জন্য উপযুপরি তাগাদা দিয়েছেন। সেই তাগদার ফল এই বই, যেটি এখন আপনার হাতে। বলে রাখতে চাই, যিনি ছিদ্রান্বেষী তিনি অন্যের ছিদ্র খুঁজতে চান খুঁজুন। যাঁর যেটা কাজ! তবে অন্যের ছিদ্র খোঁজার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ছিদ্রটাও যদি খুঁজে নেওয়া যায় তাহলে কোনো সংঘাতই থাকবে না। অপরের ছিদ্র নিয়ে লিখতে লিখতে তাই নিজের ছিদ্রও দেখে নিলাম। কারোর লজ্জা লাগলে আড়াল নেবেন। না-হলে ইতিহাস কান মুলে দেবে, নাকখত দেওয়াবে।

ইতিহাসে যা লেখা হয় তার সবটাই যেমন সত্য নয় সবসময়, তেমনই যা ইতিহাসে পাওয়া না তা সবসময় মিথ্যা হবে এমন কথাও বলা যায় না। আমাদের দেশে অনেক সময়ে মিথ্যা ইতিহাসকে সত্যতার আবরণে প্রচার করা হয়ে থাকে। দেশের সম্মুখে আজ সবচেয়ে বড়ড়া বিপদ এই মিথ্যা ইতিহাসের প্রাবল্য। মিথ্যা ইতিহাসের সাহায্যে সমগ্র জাতিকে তথা হিন্দু মুসলমানকে কোন্ দুর্গতির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে তার কোনো কিনারা পাওয়া সম্ভব নয়। দেশকে ও সমাজকে পুনরায় জাগিয়ে তুলতে হলে সত্য ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সকল প্রকার প্রয়াসের প্রয়োজন। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারলে যে মিথ্যা সভ্যতা ও সংস্কৃতি তৈরি হবে একদিন না একদিন তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বাধ্য। তখন সমগ্র সমাজ এক বিরাট শূন্যতার গহ্বরে পড়ে হাবুডুবু খাবে। দেশকে সমাজকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য এখন সর্বত্র চাই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অবিরাম পদক্ষেপ। একজন সাধারণ সত্যানুসন্ধানী হিসাবে সত্যপ্রতিষ্ঠার এই পদক্ষেপে আমি যদি সামান্য কিছু সাহায্য করতে পারি, তাহলে আমার এ পরিশ্রম সার্থক হবে।

—অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *