মধ্যযুগ : ভারতে মুসলিম শাসন
সিরাজ-উদ্-দৌল্লা (শাসনকাল : ১৭৫৬ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল)
মাত্র ১ বছরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা। আওরঙ্গজেবের পর ভারতের শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর সম্বন্ধে লেখার আগে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লার আলোচনাটা সেরে নেব ভেবেছিলাম। করিনি, তার কারণ তাহলে মোগল সাম্রাজ্য নিয়ে আলোচনাটার ধারাবাহিকতা রক্ষা হত না। যদিও দিল্লি দখলের অনেক আগেই ব্রিটিশরা বাংলা দখল করেছিল সিরাজ-উদ্-দৌল্লাকে পরাজিত করে। বাংলা দখলের প্রায় ১০০ বছর পর ব্রিটিশরা দিল্লির দখল নেয়। আওরঙ্গজেবের সময়কালে এবং মৃত্যুর পর শাসক হিসাবে না-হলেও যথারীতি ব্রিটিশরা ভারত ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে। তার আগে যদিও বিদেশি বণিক পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসিরা ঢুকে পড়েছিল, তা সত্ত্বেও ব্রিটিশরাই অগ্রণী। ব্রিটিশদের আধিপত্য শুরুই হয় বাংলা থেকে। সিরাজের পতনের মধ্য দিয়েই ব্রিটিশরা ভারত ভূখণ্ডে উপনিবেশ কায়েম করতে শুরু করে। তাই সিরাজ-উদ-দৌল্লার আলোচনা বাদ দেওয়া যায় না। ব্রিটিশরা ভারত ভূখণ্ডে ঢুকে যেমন আওরঙ্গজেবকে কালিমালিপ্ত করেছে, ঠিক তেমনিভাবে সিরাজ-উদ-দৌল্লাকেও কালিমালিপ্ত করেছে। সিরাজ-উদ্-দৌল্লা মানুষের মুখে মুখে সিরাজ হলেও তাঁর পুরো নাম মির্জা মোহম্মদ সিরাজ-উদ্-দৌল্লা। তাঁর পিতার নাম জৈনুদ্দিন আহমদ, মাতা আমেনা বেগম। দুই স্ত্রী উমদাতুন্নেসা (জেবুন্নিসা নামে কোনো স্ত্রী কখনোই তাঁর ছিল না) ও বেগম লুৎফুন্নেসা। সন্তান একটি, নাম উম্মে জোহরা। সিরাজ-উদ্-দৌল্লার আরও দুই ভাই ছিল– ইকরাম-উদ্-দৌল্লা ও মির্জা মেহেদি। সিরাজ ধর্ম পরিচয়ে শিয়া ইসলাম। তিনি ছিলেন একজন ধর্মনরপেক্ষ নবাব। হিন্দু-মুসলিমে কোনো পক্ষপাতিত্ব তাঁর ছিল না।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে মুসলিম শাসকদের ধর্ম-পরিচয়ে মুসলিম বলে চিহ্নিত করছি কেন? তাহলে ইংরেজদের কেন ব্রিটিশ না-বলে খ্রিস্টান শাসক বলব না? কারণ ভারতের কোনো মুসলিম শাসকই তাঁরা যে দেশ থেকে এসেছিলেন, সেই দেশের শাসক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন না। সেই দেশের হয়ে ভারতে উপনিবেশ গড়ে তোলেনি। এই দেশ থেকে উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী যে দেশ থেকে এসেছিলেন, সেই দেশে পাঠিয়ে দিতেন না। এ দেশ থেকে রাজস্ব পাঠিয়ে দিত না। যে দেশ থেকে এসেছিলেন, সেই দেশের শাসক ভারতের জন্য আইন প্রণয়ন করতেন না। মুসলিমরা যে দেশ থেকেই আসুক না কেন ভারতের যেটুকু অংশেই সাম্রাজ্য গড়ে তুলুক না-কেন, ভারতকে নিজেদের দেশ বানিয়েছেন, ভারতের সংস্কৃতিকে বরণ করেছেন, নিজেদের হিন্দুস্তানি মনে করতেন। সংস্কৃতির এনকাউন্টার করেছে। ব্রিটিশরা কোনোদিনই ভারতে স্বতন্ত্র দেশ ভাবত না। ভারতকে ভাবত বৃহত্তর ব্রিটেন হিসাবে। কায়ণ ভারত সহ যতগুলি দেশ ব্রিটিশরা উপনিবেশন স্থাপন করেছিল সবকটি দেশকেই কাল্পনিকভাবে জুড়ে দিয়ে বৃহত্তর ব্রিটেন বানিয়েছিল। ব্রিটেন অধিকৃত দেশগুলিকে ব্রিটেনে শাসকই শাসন করত, আইন প্রণয়ন করত। উপনিবেশকৃত দেশগুলিতে খবরদারি করত ব্রিটেনের শাসকরাই। ভারতের যেসব ব্রিটিশ শাসকরা ছিল, তাঁরা ব্রিটেন শাসকের নির্দেশেই কাজ করত। তাই খ্রিস্টান তাঁদের পরিচয় হয় না, পরিচয় হয় ব্রিটিশ। ব্রিটেনের অধিবাসীদেরই ব্রিটিশ বলে। খুব জোর ইংরেজ বলা যায়, ভাষাগত পরিচয়ে। শাসক হিসাবে মুসলিম আর শাসক হিসাবে ব্রিটিশদের তফাত আকাশপাতাল। মুসলিমদের ইতিহাস শাসনের ইতিহাস। ব্রিটিশদের ইতিহাস শোষণের ইতিহাস। মুসলিম শাসনকালে প্রজা-রাজার সম্পর্ক ছাড়া গোলাম-প্রভুর সম্পর্ক ছিল না। ব্রিটিশ শাসনকালে প্রজা-রাজার সম্পর্ক বিনষ্ট হয়ে গোলাম-প্রভুর সম্পর্কে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
সে যাই হোক, বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। তাই মুর্শিদকুলি খাঁকে দিয়ে শুরু করা যাক বাংলার মুসলিম শাসনের ইতিহাস। মুর্শিদকুলি খাঁ (১৭১৭-১৭২৭ সাল) বাংলার শাসক, প্রথম স্বাধীন নবাব। ভেবেছিলাম মুর্শিদকুলি খাঁকে নিয়ে কিছু আলোচনা করব না। তারপর দেখলাম মুর্শিদকুলি খাঁ ও তাঁর শাসনব্যবস্থায় এমন কিছু উপাদান আছে, যা সাধারণ মানুষের জানা প্রয়োজন। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার সহ অনেকেই মনে করেন মুর্শিদকুলি খাঁ জন্মসূত্রে ওড়িয়া ব্রাহ্মণ ছিলেন। ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি হওয়ার আগেই পারস্যের বণিক ইসফাহান তাঁকে ক্রয় করে ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত করে। ইনিই বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব। মুর্শিদকুলি খাঁর পালক পিতার হাজি শফি ইসফাহানই। প্রকৃত পিতার নাম জানা যায় না। অপর সংস্করণ মতে তিনি ছিলেন, মারাঠা জেনারেল মোহাম্মদ কুলি খানের নাতি।
তাঁর নামেই মুর্শিদাবাদ। বিভিন্ন নথিপত্র নির্দেশ করে তিনিই মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু-পরবর্তী প্রথম স্বাধীন নবাব। তাঁর উপর মোগল সাম্রাজ্যের নামমাত্র আধিপত্য ছিল, সকল ব্যাবহারিক উদ্দেশ্যেই তিনি বাংলার নবাব ছিলেন। ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে শফি ইসফাহানই মৃত্যুবরণ করলে, তিনি বেরার প্রদেশের দেওয়ান হাজি আবদুল্লাহ খোরাসানির অধীনে চাকরিতে যোগদান করেন। এই সময় দেওয়ানি কাজে দক্ষতার পরিচয় দিলে, সম্রাট আওরঙ্গজেব এই বছরের শেষের দিকে হায়দ্রাবাদের দেওয়ান পদে নিয়োগ দেন। এই সময় আওরঙ্গজেব তাঁর নামকরণ করেছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ’। এখানে যোগ্যতার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালনের সূত্রে, আওরঙ্গজেবের বিশেষ আস্থা লাভ করেন। এই সূত্রে ১৭০০ সালে আওরঙ্গজেব তাঁকে ‘করতলব খান’ উপাধি প্রদান করেন এবং দেওয়ান পদে অভিষিক্ত করে বঙ্গদেশে পাঠান। বাংলার সুবাদার আজিম-উস-শান নিজে এবং তাঁর সময়ের দেওয়ানরা রাজকার্যের পাশাপাশি বৈধ-অবৈধ বাণিজ্য ও অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে প্রচুর সম্পদের মালিক হন। এই কার্যকলাপে মুর্শিদকুলি খাঁ বাধা দেন এবং তিনি এ বিষয়ে আওরঙ্গজেবকে বিস্তারিত লিখে জানান। আওরঙ্গজেব এই সম্পদ আহরণের পথ বন্ধ করার ফলে, সুবাদারের বিপুল পরিমাণ আয় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আজিম-উস-শান রাজকোশ থেকে অর্থ গ্রহণের চেষ্টা করেন। এই বিষয়ে মুর্শিদকুলি খাঁ বাধা দিলে, আজিম-উস-শান তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেন। মুর্শিদকুলি খাঁ আওরঙ্গজেবকে জানান। ১৭০২ সালে আওরঙ্গজেব তাঁকে গঙ্গার তীরবর্তী (ভাগীরথী শাখা) মখসুদাবাদে দফতর স্থানান্তরের অনুমতি দেন। অন্যদিকে সম্রাট তাঁর দৌহিত্রকে পাটনায় প্রেরণ করেন এবং নায়েবের মাধ্যমে প্রদেশ শাসনের আদেশ দেন। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দিল্লির সিংহাসনে বসেন প্রথম বাহাদুর শাহ। এই সময় মুর্শিদকুলি খাঁকে শাস্তিস্বরূপ দাক্ষিণ্যত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৭১০ সালে তাঁকে পুনরায় বাংলার দেওয়ান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৭১২ সালে প্রথম বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর দিল্লির সিংহাসনে বসেন আজিম-উস-শান-এর পুত্র ফারুকশিয়ার। এই সময় মুর্শিদকুলি খাঁ নতুন সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সম্রাট খুশি হয়ে ১৭১৩ সালে মুর্শিদকুলিকে বাংলার দেওয়ান এবং নায়েব-সুবাদার পদ দান করেন। ১৭১৪ সালে তাঁকে ওড়িশার সুবাদার করা হয় এবং সম্রাট তাঁকে জাফর খাঁ উপাধি প্রদান করেন। ১৭১৬ সালে সম্রাট তাঁকে নাজিম পদে উন্নীত করেন। ১৭১৭ সালে তাঁকে বাংলায় এনে সুবাদার পদ দেওয়া হয়। এই সময় তিনি বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। ১৭২৭ সালের ৩০ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
আসলে মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার সুবাদার থাকাকালীন দিল্লির সম্রাটের রাজশক্তির ক্ষয়ের কারণে তিনি স্বাধীন হয়ে পড়েন। তাঁর শেষ জীবনে তিনি স্বাধীন নবাবের মতোই বাংলা শাসন করেছেন। এই কারণে তাঁকে বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৭৬৫ সালে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, দিল্লির মোগল সম্রাট শাহ আলমের কাছে বাংলা বিহার ওড়িশার দেওয়ানি প্রাপ্তির পর এই বাংলার নবাব-শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
ঐতিহাসিকদের মতে, মুর্শিদকুলি খাঁ জীবনের শেষ পর্যায়ে মসজিদ সংলগ্ন নিজের একটি সমাধি ভবন নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। নবাবের ইচ্ছানুযায়ী কাজও শুরু হয়। মসজিদটি নির্মাণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁরই এক বিশ্বস্ত সহচর ফরাস খাঁর উপর, যিনি ছিলেন একজন দক্ষ কারিগর। তিনি মাত্র দুই বছরে (১৭২৪ ২৫) এই মসজিদ নির্মাণের কাজ শেষ করেন। মসজিদ নির্মাণের কিছুদিন পরেই মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যু হয়। মসজিদের প্রবেশদ্বারের পরেই একটি সিঁড়ি আছে। এই সিঁড়ি বেয়েই মসজিদে উঠতে হয়। এই সিঁড়ির নীচেই মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি। নবাব এমন এক স্থানে সমাহিত হতে চেয়েছিলেন, যেখানে তিনি মসজিদে প্রবেশকারী পুণ্যবান মুসল্লিদের পদস্পর্শ পাবেন। মৃত্যুর পরে তাঁর ইচ্ছানুসারে কাটরা মসজিদের প্রবেশ সোপানের নীচেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। মসজিদের একটি কষ্টিপাথরের লেখা— “আরবের মোহম্মদ উভয় জগতের গৌরব, যে ব্যক্তি তার দ্বারে ধূলি লয়, তার মাথায় ধূলিবৃষ্টি হউক”। এটি একজন ধর্মভীরু নবাবেরই পরিচয় বহন করে। ধর্মভীরু নবাব শুনেই নিশ্চয় ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন, নবাব বিধর্মী হিন্দুদের নির্যাতন-নিপীড়ন করতেন, মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতেন। বিশ্বাস করুন, আমিও এমন কিছু ভেবে খুব চেষ্টা করেছি এমন কিছু খোঁজার। কিন্তু নিরাশ হতে হয়েছে। বাংলার নবাব তথা মুর্শিদকুলির উপর যত বইপত্র আমার হাতে এসেছে, কোথাও মুর্শিদকুলির নিষ্ঠুরতা বর্ণিত হয়নি। মুর্শিদকুলি খাঁর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তাঁর একমাত্র কন্যা জিন্নতউন্নিসা, কেউ বলেন আজিমুন্নেসা। তাঁর মেয়ে আজিমুন্নেসার সমাধিও একই কায়দায় নির্মিত। ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে আজিমুন্নেসার মৃত্যু হয়। জামাতা সুজাউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না। ফলে তিনি আজিমুন্নেসার পুত্র দৌহিত্র সরফরাজকে বাংলার পরবর্তী নবাব ঘোষণা করেন এবং দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে অনুমোদন আনার চেষ্টা করেন। ওদিকে সুজাউদ্দিনকে তিনি ওড়িশার ছোটো নবাব করেন। কিন্তু সুজাউদ্দিনও নিজেকে নবাব করার জন্য দিল্লিতে দূত পাঠান। দিল্লির সম্রাট সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ম অনুযায়ী সুজাউদ্দিনকেই অনুমোদন দেয়। এদিকে মুর্শিদকুলি খাঁ তো মৃত্যুসজ্জায়। সুজাউদ্দিন দিল্লির অনুমোদন পেয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হন। পথিমধ্যেই খবর পান মুর্শিদকুলি খাঁ মারা গেছেন। তাঁকে আর মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যু পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হল না। মুর্শিদাবাদ এসে তিনি নিজেকে বাংলার নবাব ঘোষণা করেন ও চেহেলসেতুন প্রাসাদের সিংহাসনে বসেন।
অন্যদিকে, দৌহিত্র সরফরাজ খাঁও মানসিকভাবে নবাব হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ফলে পিতা-পুত্রের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব বেঁধে গেল। এ দ্বন্দ্ব নিরসনে মুর্শিদকুলি খাঁর স্ত্রী নৌসেরী বানু ও মেয়ে আজিমুন্নেসা এগিয়ে এলেন। তাঁরা বোঝালেন যে, বাবার পরে তুমিই হবে নবাব। তাই অকারণ রক্তক্ষয় কোরো না। সরফরাজ পিতা সুজাউদ্দিনকেই নবাব হিসাবে মেনে নিলেন। সুজাউদ্দিন ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাব হলেন। তাঁর অন্য নাম সুজাউদ্দৌলা। সুজাউদ্দিন ও তার স্ত্রী আজিমুন্নেসার সম্পর্ক ভালো না-থাকার কারণে। সুজা ওড়িশায় ছোটো নবাব থাকাকালে আজিমুন্নেসা সেখানে যাননি। তিনি বাবার সঙ্গে মুর্শিদাবাদেই ছিলেন। সুজাউদ্দিন উচ্চুঙ্খল স্বভাবের ছিলেন। সে কারণে পিতা নবাব মুর্শিদকুলি খাঁও জামাতা সুজাউদ্দিনকে পছন্দ করতেন না। তাই তাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত না করে দোহিত্র সরফরাজকে নবাব করার জন্য মনোনীত করেন।
কথিত আছে, আজিমুন্নেসা একসময় কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তবে হেকিমের নিদান অনুযায়ী জীবন্ত মানুষের কলিজা মিশ্রিত ওষুধ খেয়ে তিনি সুস্থতা লাভ করেন। কিন্তু সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও কলিজা খাওয়ার অভ্যাসটি তিনি পরিত্যাগ করতে পারেননি। অনেকে বলেন, তিনি শিশুদের কলিজা খেতেন। বলা হয়, এর ফলে বহু নগরবাসী ও হারেমবাসীদের প্রাণনাশও করেছেন। এমনকি অসুখ সেরে যাওয়ার পরও আজিমুন্নেসা নেশাগ্রস্ত হয়ে গোপনে নিয়মিতভাবে মানবশিশুর কলিজা খেতে থাকেন। আজিমুন্নেসাকে ‘কলিজাখাকি’ বলেও অনেকে অবহিত করেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে নবাব সুজাউদ্দিন নিজের স্ত্রীকে জীবন্ত অবস্থায় কবর দেন। অনেকে বলেন, তাঁর পিতাই তাকে জীবন্ত কবর দেন। মসজিদে ওঠার সিঁড়ির নীচেই তাঁর সমাধি। জনশ্রুতি, সাধারণ মানুষের পদধূলিতে তাঁর শিশুহত্যার পাপ মোচনের জন্যই মসজিদে ওঠার সিঁড়ির নীচে তাকে সমাহিত করা হয়। আজিমুন্নেসার মৃত্যু নিয়ে আরও নানা গল্প-গুজব ও রহস্য আছে। মৃত্যুর প্রায় তিনশো বছর পরেও রহস্যের অন্তরালেই রয়ে গেলেন আজিমুন্নেসা।
আজিমুন্নেসার এই মৃত্যুকাহিনি যে বানোয়াট, তা ঘটনার বিশ্লেষণ করলেই ধরা পড়ে যায় কাহিনির অসংলগ্নতা। প্রথম অসংলগ্নতা, মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যু হয়েছে ১৭২৭ সালে, আর তাঁর মেয়ে আজিমুন্নেসার মৃত্যু হয় ১৭৩৪ সালে। অতএব তাঁর পিতা মুর্শিদকুলি খাঁই তাঁর কন্যাকে জীবন্ত কবর দিয়েছিলেন, এ গপ্পো ধোপে টেকে না। দ্বিতীয় অসংলগ্নতা, বাস্তবিক কন্যার সমাধি যেখানে পিতার সমাধিও সেখানে, অতি কাছাকাছি। কন্যাকে যদি শাস্তি দিতে বা পাপমোচনের (তাও আবার শিশুর কলিজা ভক্ষণ) কারণে, তাহলে পিতার সমাধিও সেখানে থাকবে কেন?
এছাড়া বিভিন্ন তথ্য সুত্র থেকেও জানা যায় নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ছিলেন খুবই ধার্মিক। সকালে প্রাতরাশ গ্রহণের পর থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজকীয় কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত তিনি পবিত্র কোরান স্বহস্তে কপি করে লিখতেন এবং প্রতি বছর তাঁর স্বহস্ত লিখিত কোরানের কপি মক্কা, মদিনা, নাজাফ সহ বিভিন্ন মসজিদে প্রেরণ করতেন। তাঁর সমাধির উপর দিয়ে মসুল্লিগণ নামাজের জন্য মসজিদে গেলে তাঁদের পদধুলিতে তাঁর জীবনের অনেক পাপ মোচনে সহায়ক হবে। একজন মানুষ কতটুকু নিরহংকারী হলে নিজের মৃত্যুর পর এমন পরিণতি তাঁর জীবিত অবস্থাতেই বলে যেতে পারেন, তা ভাবতেও অবাক লাগে। তাই এমন চারিত্রিক বৈশিষ্টের অধিকারী মুর্শিদকুলি খাঁ তাঁর কন্যাকে কেন জীবন্ত কবর দেওয়ার জন্য আদেশ দেবেন তা স্পষ্ট নয়। বিষয়টি নিয়ে একটু অনুসন্ধানে জানা যায় murshidabad.net নামে একটি ওয়েবসাইট ও আরও কিছু ভারতীয় ইংলিশ ওয়েব সাইটে এ ধরনের তথ্য দেখতে পাওয়া যায়, যা সেখানকার টাঙ্গাওয়ালারা পর্যটকদের কাছে বর্ণনা দেন। তবে এ বিষয়টি নিয়ে আরও একটু বেশি জানার আগ্রহ থেকে জানতে গিয়ে দেখা গেল ওয়েব সাইটগুলিতে পরস্পরবিরোধী আরও কিছু কথামালাও আছে, যা এখানে তুলে দেওয়া হল— “Myth has it that once Azim-un-nisa fell seriously ill and as per doctor’s prescription she used to take a medicine prepared from the liver of human child. This medicine was registered to her secretly, but even after she recovered from her sickness, she developed an addiction towards this medicine, resulting in killing quite a lot of children during that time. Once his father came to know about this, she was buried alive under this mosque, so that every person who visits this place will walk over her grave. But according to some historian, she died in 1730A.D. 3 years after her father’s death. Once Murshid Quli Khan came to know about the killings, he sent her to Orissa (her husband Suja-ud-dullah’s house). Later when Suja-ud-dullah became nawab of Bengal, she came back to Bengal. But Suja-ud-dullah buried his wife Azim-un-nisa alive for her act. (http://murshidabad.net/history/places-topic-places-zone-three.htm) কিছু ভারতীয় ইংলিশ ব্লগ পোস্ট ব্যতিত অন্য কোনো স্বীকৃত লিটারেচারে এই ধরনের শিশুদের কলিজা থেকে তৈরি ওষুধ সেবনের তথ্য এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুর্শিদকুলি খাঁর বিরুদ্ধে হিন্দু-বিদ্বেষ, হিন্দু-নিধন, হিন্দুদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণ করার মতো কোনো অভিযোগের দলিল পাওয়া যায়নি।
বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা। মাঝে বেশ কিছু নবাব এসেছেন আর গিয়েছেন। স্বল্প মেয়াদের নবাবির নবাবেরা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। সেইসব অনুল্লিখিত নবাবদের বিরুদ্ধেও হিন্দু-বিদ্বেষ, হিন্দু-নিধন, হিন্দুদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণ করার মতো কোনো অভিযোগের দলিল পাওয়া যায়নি। তাঁদের তেমন কোনো বিশেষত্ব না-থাকার কারণেই হয়তো ইতিহাস মনে রাখেনি।
১৬১৭ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গির ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে বাণিজ্যের অনুমতি দান করেন। ধীরে ধীরে নিজেদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ১৭১৭ সালে কোম্পানি তৎকালীন আইনসম্মত মোগল সম্রাট ফারুক শিয়রকে দিয়ে বাংলায় রাজস্বমুক্ত বাণিজ্যের দস্তক বা পারমিট আদায় করে নেয়। কিন্তু মোগল বাংলা প্রদেশের প্রকৃত শাসনকর্তা নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লা এই পারমিট ব্যবহারে বাধা দেন। ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশে ঢুকে বিভিন্ন প্রদেশের শাসকদের কাছ থেকে ব্যাবসা-বাণিজ্য করে জাঁকিয়ে বসার পারমিট জোগাড় করে নিতে সক্ষম হলেও বাংলায় এসে বেশ বেগ পেতে হল। কিন্তু ব্রিটিশরা তো হেরে গিয়ে নিজের দেশে ফিরে যেতে আসেনি!
বাংলার সিরাজপর্ব ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। সিরাজ-পতনের মধ্য দিয়েই ভারত-শাসনের খাতা খোলে ব্রিটিশরা। যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে ইংরেজরা শতাধিক বছরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সাধ্যসাধনায় ব্যবসায়ী থেকে শাসকে পরিণত হয়েছিল, ৮০০ বছর ব্যাপী প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসনের মূলোৎপাটন করে এ দেশবাসীকে গোলামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিল। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে (১৫৯৯) কতিপয় ব্যবসায়ী সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম হয়। রানি এলিজাবেথের অনুমোদনক্রমে তাঁরা ভারত সহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যাবসা শুরু করে। ১৬১২ সালে বাদশাহ জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে সনদ লাভ করে এই কোম্পানি সর্বপ্রথম সুরাট বন্দরে তাঁদের বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। প্রথম প্রথম তাঁদেরকে খুব ঘাতপ্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে চলতে হয় বলে ব্যাবসাবাণিজ্যে বেশি সুবিধা করতে পারে না। ১৬৪৪ সালে বাদশাহ শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে অবস্থানকালে তাঁর কন্যা আগুনে দগ্ধিভূত হয়। তাঁর চিকিৎসার জন্যে সুরাটের ইংরেজ-কুঠির অধ্যক্ষ কর্তৃক প্রেরিত সুদক্ষ সার্জন ডাঃ গ্যাব্রিল বাউটন তাঁকে নিরাময় করেন। তাঁর প্রতি বাদশাহ শাহজাহান অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং বাউটনের অনুরোধে ইংরেজ বণিকরা বাংলায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। ১৬৪৪ সালে তাঁরা যখন বাদশাহর ফরমানসহ বাংলায় উপস্থিত হয়, তখন বাংলা-বিহার-ওড়িশার সুবাদার ছিলেন শাহজাহানের পুত্র যুবরাজ মোহাম্মদ শাহসুজা।
কোম্পানির পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, শাহসুজার পরিবারের জনৈক সদস্যের চিকিৎসার ভার ডাঃ বাউটনের উপর অর্পিত হয় এবং এখানেও তিনি চিকিৎসায় সুনাম অর্জন করেন। অতএব শাহসুজা মাত্র ৩০০০ টাকা সালামির বিনিময়ে ব্রিটিশ বণিকদের বাংলায় অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ দান করে। বাদশাহ শাহজাহান ও তাঁর পুত্র ব্রিটিশদের প্রতি যে চরম উদারতা প্রদর্শন করেছিলেন সেই উদারতা ও অনুগ্রহ প্রদর্শনকে অকৃতজ্ঞ ব্রিটিশ বণিকগণ পরবর্তীকালে মোগল সাম্রাজ্যের ও বাংলা-বিহারের স্বাধীনতার মৃত্যু পরোয়ানা হিসাবে ব্যবহার করে। শাহসুজার ফরমানবলে ব্রিটিশ বণিকরা হুগলিতে তাঁদের বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে এবং বিহারের পাটনায় এজেন্সি স্থাপন করে। শাহসুজার পর আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মিরজুমলা বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। বিচক্ষণ মিরজুমলা ইংরেজদের গতিবিধির প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতেন। একবার পাটনা থেকে হুগলিগামী কয়েকটি মাল বোঝাই নৌকা মিরজুমলা আটক করেন। প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য হুগলির ব্রিটিশ কুঠিয়াল জনৈক মুসলিম ব্যবসায়ীর মাল বোঝাই নৌকা আটক করে পণ্যদ্রব্যাদি হস্তগত করে। তাঁর এ ঔদ্ধত্যের জন্যে মিরজুমলা হুগলির কুঠি অধিকার করার আদেশ জারি করেন। কুঠিয়াল বেগতিক দেখে আটক নৌকা ও মালপত্র মালিককে ফেরত দিয়ে মিরজুমলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। মিরজুমলার পর শায়েস্তা খাঁ বাংলার নবাব সুবাদার পদে নিযুক্ত হন। শায়েস্তা খানের জন্যে ব্রিটিশরা সর্বত্র সন্ত্রস্ত থাকত। তাঁদের ঔদ্ধত্যের জন্যে শায়েস্তা খান পূর্ববর্তী ফরমানগুলি বাতিল করে দেন। তাঁরা তাঁদের আচরণের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী হলে এবং সতোর সঙ্গে ব্যাবসা করার প্রতিশ্রুতি দিলে পূর্বতন ফরমানগুলি পুনর্বহাল করা হয়। শেষপর্যন্ত শায়েস্তা খান বাংলা ত্যাগ করেন। এরপর যথাক্রমে ফিদা খান, মোহাম্মদ আজম, ইব্রাহিম খান, আজিমুশশান, মুর্শিদকুলি খান, সুজাউদ্দিন, সরফরাজ খান, আলিবর্দি খান বাংলার সুবাদার হন।
সরফরাজ খান ছিলেন অযোগ্য ও দুর্বলচিত্ত। তাঁর সেনাপতি আলিবর্দি খানের সংগে সংঘর্ষে নিহত হন এবং আলিবর্দি খান ১৭৪১ সালে বাংলার সুবাদার হন। আলিবর্দি খানের সময় বার বার বাংলার উপর আক্রমণ চলে মারাঠি বর্গি-দস্যুদের। তাঁদের দৌরাত্ম্য থেকে দেশকে রক্ষার জন্যে তিনি কয়েকবার ব্রিটিশ ও অন্যান্য বিদেশি বণিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায়ও করেন। জলপথে আগমনকারী মারাঠি বর্গিদস্যুদের দমন করার জন্যে আলিবর্দি খান ইংরেজদের সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজনবোধ করেছিলেন। কারণ নৌ-শক্তি বলতে বাংলা শাসকের কিছুই ছিল না। পক্ষান্তরে ইংরেজদের ছিল শক্তিশালী নৌ-বহর। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ এই নৌ-বহর ব্যবহার করেই ব্রিটিশরা ভারতে প্রবেশ করেছিল। আলিবর্দির প্রধান সেনাপতি একবার ব্রিটিশদের মতো ক্রমবর্ধমান এক অশুভ শক্তিকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার পরামর্শ দেন। তদুত্তরে বৃদ্ধ আলিবর্দি বলেন— একদিকে বর্গিরা স্থলপথে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। আবার ইংরেজদের ক্ষুব্ধ করলে তাঁরা সমুদ্রপথে আগুন জ্বালাবে, যা নির্বাপিত করার ক্ষমতা বাংলার নেই। আলিবর্দির বার্ধক্য এবং পরিস্থিতির স্পর্শকাতরতার সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা জাঁকিয়ে বসে এ দেশে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠালাভের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ব্রিটিশরা যেসব মুসলিম শাসকদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে চরম বেগ পেতে হয়েছে, তাঁদেরকেই কালিমালিপ্ত করার প্রয়াস চালিয়েছে। এটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে –‘ওরা কত খারাপ ছিল, আমরা কত ভালো। ওদের হঠিয়ে দিয়ে আমরা তোমাদের কত উপকার করে দিয়েছি। ওরা শয়তান, আমরা ভগবান। তেমনই সিরাজকেও কালিমালিপ্ত করার সুযোগ তাঁরা হাতছাড়া করেনি। ব্রিটিশদের বর্ণনা থেকেই আমরা জানতে পেরেছি সিরাজ লম্পট, চরিত্রহীন এবং মিরজাফর বিশ্বাসঘাতক।
তাই কী! সিরাজ অধ্যায় ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যুগসন্ধিক্ষণ বললে অত্যুক্তি হবে না। একটু বিস্তারে যেতে পারি। উচিত-অনুচিত্যের প্রশ্ন পাঠকদের জন্য থাক। ব্রিটিশরাও সুযোগ খুঁজছিল ভারতকে কবজা করতে। খুঁজছিল দুর্বল শাসক। আর এই দুর্বল শাসক সিরাজ ছাড়া কেই-বা হতে পারে! সিংহাসনে বসতে না-বসতেই বিধ্বস্ত নবাব, ব্যতিব্যস্ত নবাব। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা মারলেই ক্ষমতা কায়েম সহজেই। আর এ কাজে অমুসলিমদের সম্পূর্ণ সহযোগিতার গ্যারান্টি পেয়ে যাবে, সেটা ইংরেজদের বুঝতে অসুবিধা হল না- ভারতের দুই সতীন : মুসলিম এবং হিন্দু তথা অমুসলিম। সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করে পারলেই ব্রিটিশরাজ কায়েম হবে। একথা অমুসলমানরাও অনুধাবন করল। অনুধাবন করল ব্রিটিশদের মাধ্যমেই ভারত থেকে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব। অন্যদিকে ব্রিটিশরাও দেখল তাঁদের একমাত্র দুর্দমনীয় প্রতিপক্ষ ফরাসিরা, ফরাসিদের উৎখাত করতে না-পারলে ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম করা যাবে না। সে সময় ব্রিটিশদের মতো ফরাসি, পোর্তুগিজরাও ভারতে ঢুকে পড়েছিল। তার উপর ফরাসিরা ধেয়ে আসছে, সহায়তা পাচ্ছে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লার। অতএব হয় ফরাসিরা, নয় ব্রিটিশরা ভারত শাসন করবে। ব্রিটিশদের সামনে দুটি যুযুধান শত্রুপক্ষ– একদিকে মুসলিম শাসক, অপরদিকে ফরাসিরা। ব্রিটিশদের বন্ধু এবং একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ সহযোগী হল হিন্দুরা। সেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের বেনিফিট পাইয়ে দিয়ে এবং সর্বোচ্চ পদের লোভ দেখিয়ে কবজা করে নিল ভারতে প্রথমে বাণিজ্য ও পরে শাসন কায়েম করার জন্য। মুসলিম শাসক ও সম্প্রদায়রা সেদিন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে প্রাণপণ লড়াই দিয়েছিল তার সিকি ভাগও যদি হিন্দু সম্প্রদায় দিত তাহলে ব্রিটিশ সহ সকল বিদেশিদের কাছা খুলে ভারত ছেড়ে পালাতে হত। ভারতীয়দের উপর এত শোষণ ও অত্যাচার করার সুযোগই পেত না ব্রিটিশরা। মা-বোনেদের সম্মান ইজ্জত ভূলুণ্ঠিত হত না। টানা ১৯০ বছর সাদা চামড়ার প্রভুদের ক্রীতদাস হয়ে থাকতে হতে হত না ভারতীয়দের।
যাই হোক, অবশেষে শিকে ছিঁড়ল ব্রিটিশদের। পেয়ে গেল ‘ঘরশত্রু বিভীষণ’-দের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা। আসলে দু-পক্ষই শুধু একটা সুযোগ খুঁজছিল। উদভ্রান্ত সিরাজের দুর্বল শাসনের সুযোগ অমুসলমানরা চাইল বাংলা থেকে খেদাতে, অপরদিকে ব্রিটিশরা চাইল অমুসলমানদের ধর্ম-বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে বন্ধুর বেশে ক্ষমতালাভের আসরে নেমে পড়া। এই লড়াইয়ে দু-পক্ষ কতটা, কীভাবে সফল হয়েছিল সেটাই দেখার।
একজন শাসককে শুধুমাত্র প্রজাবৎসল হলেই হয় না, বিপদমুক্ত সাম্রাজ্য চালাতে হলে কুটকৌশলও আয়ত্ব করতে হয়। ১৭৫৬ সালে সুদীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থাকার পর আলিবর্দি মৃত্যুবরণ করেন এবং সিরাজ-উদ্-দৌল্লা তাঁর উত্তরাধিকারী হন। সিরাজ তাঁর সিংহাসন আরোহণের পর আলিবর্দির কন্যা ঘসেটি বেগম ও আলিবর্দির ভাই সৈয়দ আহমদ খান সওলত জঙের পুত্র (পূর্ণিয়ার নায়েব নাজিম) শওকত জংয়ের সকল ষড়যন্ত্র তিনি দক্ষতার সঙ্গে বানচাল করে দেন। আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পর সিরাজ-উদ্-দৌল্লার সিংহাসন আরোহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই ঘসেটি বেগম ২০,০০০ সৈন্যকে তাঁর দলে ভিড়াতে সক্ষম হন এবং মুর্শিদাবাদ অভিমুখে রওনা হন। সিরাজ-উদ্-দৌল্লা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ঘসেটি বেগমের সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করেন ও বেগমকে রাজপ্রসাদে বন্দি করেন। অপরদিকে শওকত জং নিজেকে বাংলার সুবাদার বলে ঘোষণা করলে যুদ্ধে সিরাজ উদ্-দৌল্লা কর্তৃক নিহত হন। আসলে যেদিন থেকে আলিবর্দি খান তাঁর নাতি সিরাজকে ছোটে নবাব হিসাবে মনোনীত করেন, সেইদিন থেকে ঘসেটি পরোক্ষে আলিবর্দি খান এবং প্রত্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। কারণ আলিবর্দি খানের বোন ঘসেটি ভেবেছিলেন বাংলার সিংহাসনটা তিনিই পাওয়ার যোগ্যতম ব্যক্তি। এদিকে আলিবর্দির দৌহিত্র শওকত জংও ভাবছিলেন তিনিই বাংলার পরবর্তী নবাব হবেন। আলিবর্দি শওকত ও ঘসেটির সেই আশা ও স্বপ্নে জল ঢেলে দিয়েছিলেন। ঘসেটিও দমবার পাত্রী নন। তিনি সিরাজকে বহুবার হত্যার চক্রান্ত করেছিলেন। কখনো শওকতকে দিয়ে, কখনো আফগান সেনাদের দিয়ে। সেইসব চক্রান্ত সিরাজের দ্বিতীয় স্ত্রী লুৎফুন্নেসার (সিরাজের মা আমিনা বেগমের একজন হিন্দু পরিচারিকা বা জারিয়া। বিয়ের পর সিরাজ তাঁর নাম দেন লুৎফুন্নেসা) বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতায় ব্যর্থ হয়ে গেলেও ঘসেটি বেগম কিন্তু কোনোদিন হাল ছাড়েননি। তাঁর মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রচনা করে গেছে। শেষপর্যন্ত সফলও হয়েছে।
ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙের বিদ্রোহে নওয়াজেশ মোহাম্মদের হিন্দু দেওয়ান রাজবল্লভও ইন্ধন জোগাচ্ছিল। সিরাজ তা জানতে পেরে রাজবল্লভের কাছে হিসাবপত্র তলব করেন। ঢাকার শাসনকর্তা নওয়াজেশ মোহাম্মদের অধীনে দেওয়ান হিসাবে রাজস্ব আদায়ের ভার তাঁর উপরে ছিল। আদায়কৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছিল বলে হিসাব দিতে অপারগ হওয়ায় নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লা রাজবল্লভের ঢাকার ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আদেশ জারি করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণবল্লভ আদায়কৃত রাজস্ব ও অবৈধভাবে অর্জিত যাবতীয় ধনসম্পদ সহ গঙ্গাস্নানের ভান করে পালিয়ে গিয়ে ১৭৫৬ সালে কলকাতায় ব্রিটিশদের আশ্রয় গ্রহণ করে। সিরাজ-উদ্-দৌল্লা ধনরত্নসহ পলাতক কৃষ্ণবল্লভকে নবাবের হাতে অর্পণ করার জন্যে কলকাতায় গভর্নর মিঃ ড্রেককে আদেশ করেন। ভারতের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ধনকুবের ও রাজ্যের মধ্যে অতি প্রভাবশালী হিন্দু বণিক ‘জগৎ শেঠ’ মাহতাব চাঁদ সহ অন্যান্য বণিক ও বেনিয়াদের পরামর্শে ড্রেক সিরাজ-উদ্-দৌল্লার আদেশ পালন করতে অস্বীকার করে। তারপর অকৃতজ্ঞ ক্ষমতালিপ্স ইংরেজরা ও তাঁদের সহায়ক অ-মুসলিম প্রধানগণ সিরাজ-উদ-দৌল্লাকে ক্ষমতাচ্যুত করে চিরদিনের জন্যে মুসলিম শাসন বিলুপ্ত করার যে ষড়যন্ত্রজাল বিস্তার করে তা চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয়।
বস্তুত মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতীয় মুসলিম শাসকদের জীবনে নেমে এসেছিল চরম দুর্যোগ। নামেমাত্র একটি কেন্দ্রীয় শাসন দিল্লিতে অবশিষ্ট থাকলেও তা ছিল অত্যন্ত দুর্বল, যার সুযোগে বিভিন্ন স্থানে মুসলমান শাসকরা একপ্রকার স্বাধীনতা ভোগ করছিলেন। তাঁরা জমিদার-জায়গিরদার ও ধনিক-বণিক শ্রেণির সন্তুষ্টি সাধনের আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন। ফলে তাঁরা স্বভাবতই হীনমন্যতার শিকার হয়ে পড়েছিলেন। শত্রুকে সম্মুখ সমরে পরাজিত করার উপায় না-থাকলে তাঁর ধর্মবিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারলে তাকে সহজেই পরাজিত করা যায়। ভারতের এবং বিশেষ করে বাংলার অ-মুসলিম তথা হিন্দু সম্প্রদায় তাঁদের কয়েক শতাব্দীর পুঞ্জিভূত ক্ষোভের প্রতিশোধ এভাবেই নিয়েছে।
মুসলিম ঐতিহাসিকরা মনে করে, মুসলমানরা ইসলামের মূল উৎসকেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের আধা ধর্মান্তরিত মুসলমানসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলমানদের সঙ্গে বহু বছর বসবাস করতে করতে মূল ধর্মবিশ্বাস থেকে সরে গিয়েছিল এবং হয়ে পড়েছিল ভারতীয়। অধিকন্তু এই ভারতীয় মুসলমানরা হিন্দুদের বর্ণপ্রথা অবলম্বন করে অতীতের যে ইসলামি ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের মধ্যে তাঁদের শক্তি নিহিত ছিল তার প্রতি চরম আঘাত হানে। ফলে উনবিংশ শতাব্দীতে তাঁরা বহু ভাগে বিভক্ত, ছিন্নভিন্ন ও অধঃপতিত জাতি হিসাবে চিহ্নিত হয়। “Thus long years of association with a non-Muslim people who far outnumbered them, cut off from original home of Islam, and living with half converts from Hinduism, the Muslims had greatly deviation from the faith and had become Idianised. This deviation from the faith apart, the Indian Muslims in adopting the caste system of the Hindus, had given a disastraous bloe to the Islamic conception of brotherhood and equality in which their strength had rested in the past and presented thus in the 19th century the picture of a distrupted society, degenerated and weakened by division and sub-division to a degree, in seemed, beyond the possibility of repair. No wonder, Sir Mohammad Iqbal said, surely we have out-Hindued the Hindu himself, we are suffering and social caste system– religios caste system, sectarian and social caste system– which we have either revenged themselves on their conquerors.” (British Policy and the Muslims in Bengal– A.R. Mallick learned or inherited from the Hindus. This is one of the quiet ways on which the conquered nation)
সত্য এটাই যে, বাংলা তথা ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়সহ অন্যান্য অ-মুসলিমরা মুসলিম শাসন কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা মুসলিমদের সমূলে ধ্বংস করার জন্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নীরবে কাজ করে গেছে। প্রকট হওয়ার খুঁজছিলেন সুযোগ। তাঁদের প্রচেষ্টায় তাঁরা পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে। হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত না-করে হিন্দুভাবাপন্ন মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে তারা পুরোপুরি সাফল্য অর্জন করেছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর পঞ্চম দশকে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার পরাজয় ও বাংলার পতন কোনো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার ফল নয়। যেসব রাজনৈতিক ঘটনাপুঞ্জের ফলস্বরূপ পলাশির বিয়োগান্তক নাটকের সমাপ্তি ঘটে, তা সত্যানুসন্ধিৎসু পাঠকবর্গের অবশ্য জেনে রাখা উচিত। প্রকৃতপক্ষে মোগল সাম্রাজ্যের পতন গোটা উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের পতন ডেকে আনে। ১৭০৭ সালে সম্রাট আরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে ১৭৫৭ সালে সংঘটিত পলাশির যুদ্ধ পর্যন্ত পঞ্চাশ বছরে কমপক্ষে সাতজন দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কারও এ যোগ্যতা ছিল না যে পতনোম্মুখ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মনে করেন— কতিপয় ‘অবিবেচক ঐতিহাসিক’ আওরঙ্গজেবকে মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসের জন্যে দায়ী করেন। ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করলে এ সত্যটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ধ্বংসের বীজ বহু পূর্বেই স্বয়ং বাদশাহ আকবর কর্তৃক রোপিত হয়েছিল এবং তা ধীরে ধীরে একটি বিরাট বিশাল মহিরূহের আকার ধারণ করছিল। আওরঙ্গজেব সারাজীবন তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে সে ধ্বংসকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর উত্তরাধিকারীরা যদি তাঁদের মতো শক্তিশালী ও বিচক্ষণ হতেন, তাহলে সম্ভবত ভারতের ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হত। ঐতিহাসিক আকরাম খাঁ তাঁর ‘মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন— “আকবরের রাজত্বকালের সকল অপকর্মের পরিণাম ভোগ তাঁহার মৃত্যুর সাথেই শেষ হইয়া যায় নাই। মোগল সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁহার সকল উত্তরাধিকারীকে জীবনের যথাসর্বস্ব দিয়া এই অপকর্মের ফল ভোগ করিতে হইয়াছিল। ভারতের ১০ কোটি মুসলমান আজ পর্যন্ত আকবরের অপকর্মের দরুন ক্ষতিপূরণের অবশিষ্ট উত্তরাধিকার দায়িত্ব হইতে অব্যাহতি পায় নাই।”
বাংলার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা কলকাতায় দুর্গ নির্মাণের কাজ ব্যাপকভাবে চালাতে থাকে। বাংলার নবাব আলিবর্দি খান তখন অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং এই দুর্বলতার সুযোগে সুচতুর ইংরেজরা তাঁদের দুর্গ নির্মাণের কাজ দ্রুততার সঙ্গে করে যাচ্ছিল। আর তাঁদের এ কাজে সাহস ও উৎসাহ জোগাচ্ছিল বাংলার শেঠ ও বেনিয়া শ্রেণি। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত বাংলায় ইংরেজদের যে ব্যাবসা দানা বেঁধে উঠেছিল, তাঁরা কেউ দালাল কেউ কর্মচারী হিসাবে কাজ করে একশ্রেণির অ-মুসলিম সম্প্রদায় প্রভূত অর্থশালী ও প্রভাবশালী হয়ে পড়েছিল। উপরন্তু তাঁরা নবাব আমলে রাজস্ব প্রশাসনের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদেও অধিষ্ঠিত ছিল। সুদখোর মহাজনী ও ব্যাংক ব্যাবসার মাধ্যমেও তাঁরা অর্থনীতি ক্ষেত্রে ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁরা মুসলিম শাসন ততক্ষণই মেনে নিয়েছিল যতক্ষণ নবাব বিশ্বাস করে হিসাবকিতাব নিত না, যা খুশি তা করতে পারত। যেদিন থেকে নবাবরা কঠোরতার সঙ্গে বণিকদের লাগাম টানতে শুরু করল, সেদিন থেকে তাঁরা নবাবের বিরাগভাজন হতে শুরু করল। লক্ষ করে দেখবেন বর্তমান শাসকরাও বণিকদের তোষামোদ করে চলে, নানা সুযোগসুবিধা পাইয়ে দেয় অকাতরে। একদম চটান না বণিকদের। নবাবের ভুল সেখানেই। বণিকরাও চটে গিয়ে নবাবকে উচিত শিক্ষা দিতে ব্রিটিশদের সাহায্য-সহযোগিতা ব্যতিত গত্যন্তর ছিল না।
বণিক তথা পুঁজিপতিদের কোনো দেশ হয় না, ধর্ম হয় না, জাতি হয় না, বর্ণ হয় না। এঁরা কেবল মুনাফা বোঝে। এঁরা শাসক তথা সরকার তথা রাষ্ট্রের ছায়াতলে থেকে নানা ছদ্মবেশে জনগণকে শোষণ করে, উচ্ছেদ করে। বণিক ছাড়া রাষ্ট্র পঙ্গু, রাষ্ট্র ছাড়া বণিকেরা পঙ্গু। বণিকদের এই অসহায়তা বুঝে ছদ্মবেশী ব্রিটিশরাও এ সুবৰ্ণসুযোগ এক্কেবারেই হাতছাড়া করতে চায়নি। সিরাজের প্রশাসন ও অর্থনীতি ক্ষেত্রে অ-মুসলিম, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা অংশের এতটা প্রভাব বৃদ্ধি হয়েছিল যে, তাঁরা বাংলার নবাবদের ভাগ্যবিধাতা (Kingmakers) হয়ে গিয়েছিল। ১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলি খানের মৃত্যুর পর তাঁর পৌত্র সরফরাজ খানকে উত্তরাধিকার মনোনীত করা হলে হিন্দু প্রধানগণ বাধা দান করে। কারণ এ সিদ্ধান্ত ছিল তাঁদের স্বার্থের পরিপন্থী। তাঁরা সরফরাজ খানের পিতা সুজাউদ্দিনকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর শাসনকালে (১৭২৭ থেকে ১৭৩৯ সাল) এসব শেঠ বেনিয়ারা প্রকৃতপক্ষে ষড়যন্ত্রের প্রধান উদ্যোক্তা হয়ে পড়ে। তাঁদের দলনেতা ‘জগৎ শেঠ’ স্বরূপচাঁদ ও ‘জগৎ শেঠ’ মাহতাবচাঁদ দেশের প্রকৃত শাসক (Defactoruler) হয়ে পড়েছিল।
অনেকে মনে করেন ‘জগৎ শেঠ’ কোনো ব্যক্তির নাম। ইতিহাস বইগুলিতেও এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। যেভাবে লেখা হয়েছে তাতে জগৎ শেঠ একজন ব্যক্তি হিসাবেই পরিচিত হয়ে আছে। না, ‘জগৎ শেঠ’ মোটেই কোনো ব্যক্তির নাম নয়। এটি একটি রাজদত্ত উপাধি। শ্ৰেষ্ঠী শব্দের শব্দের অপভ্রংশ ‘শেঠ’ বৈশ্যদের উপাধি। শেঠ-বংশীয়দের আদি নিবাস রাজপুতনার মধ্যস্থ যোধপুরের নাগর নামক গ্রামে। রাজপুত থেকে এই বংশের উৎপত্তি হয়েছে। শেঠরা আগে শ্বেতম্বরীয় জৈন সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন, পরে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে।
যে সিরাজ-পতনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, তাঁর নাম ‘জগৎ শেঠ’ মাহতাবচাঁদ শাহ, সঙ্গে ভাই স্বরূপচাঁদ শাহ। ‘জগৎ শেঠ’ ফতেচাঁদের পুত্র উত্তরাধিকার সূত্রে ‘জগৎ শেঠ’ মাহতাবচাঁদ। বাংলা প্রদেশের অত্যন্ত ধনী ব্যাংকার ফতেচাঁদকে আঠারো শতকের প্রথমার্ধে ‘জগৎ শেঠ’ বা ‘বিশ্বের ব্যাংকার’ উপাধি প্রদান করা হয়। শ্ৰেষ্ঠী বা শেঠ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম পুরুষ হীরানন্দ শাহ। জগৎ শেঠ’ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হীরানন্দ সাহের জ্যেষ্ঠপুত্র মানিকচাঁদ সাহ। তিনি আঠারো শতকের প্রথম দিকে পাটনা থেকে ঢাকা আসেন এবং এখানে একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বাংলার দেওয়ান মুর্শিদকুলি খান তাঁর রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করলে, মানিকচাঁদ তাঁর সঙ্গে নতুন রাজধানীতে চলে যান। মুর্শিদাবাদে তিনি ছিলেন নবাবের খুবই প্রিয়ভাজন এবং পরে নবাবের ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদ লাভ করেন। ১৭১২ সালে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণের পর পরই সম্রাট ফররুখ সিয়ার ‘নগর শেঠ’ (নগরের ব্যাংকার) উপাধি প্রদান করে মানিকচাঁদকে সম্মানিত করেন। ১৭১৪ সালে মানিকচাঁদের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুস্পুত্র (দত্তক পুত্র) ও উত্তরাধিকারী ফতেচাঁদের নেতৃত্বে পরিবারটি বিপুল খ্যাতি অর্জন করে। ১৭২৩ সালে সম্রাট মাহমুদ শাহ ফতেচাঁদকে ‘জগৎ শেঠ’ উপাধি প্রদান করলে এই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানটি দেশে এক অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। এর সদর দফতর ছিল মুর্শিদাবাদ, ঢাকা, পাটনা ও দিল্লিসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরে। সমকালীন দলিল দস্তাবেজে জগৎ শেঠের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারবার, যেমন ঋণগ্রহণ, ঋণ পরিশোধ, সোনারুপোর ক্রয়-বিক্রয় ও অন্যান্য লেনদেনের উল্লেখ আছে। রবার্ট ওর্ম (Orme) লিখেছেন যে, এই হিন্দু ব্যবসায়ী পরিবারটি মোগল সাম্রাজ্যে সর্বাধিক ধনবান ছিল। মুর্শিদাবাদ সরকারের উপর এই পরিবার প্রধানের ছিল প্রচণ্ড প্রভাব। তিনি অধিকাংশ জমিদারের পক্ষে নিরাপত্তা জামিনদার হতেন এবং তাঁর প্রতিনিধিরা ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতেন। রাজ্যের কোথায় কী ঘটছে তা তিনি অন্যদের চেয়ে বেশি জানতেন এবং প্রতিটি জরুরি ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে তাঁদের সহায়তার প্রয়োজন হত। এঁদের প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের লেনদেনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আঠারো শতকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ব্রিটিশ সরকারের জন্য যেমন আর্থিক কর্মকাণ্ড ও দায়দায়িত্ব পালন করত, প্রতিষ্ঠানটিও বাংলার সরকারের পক্ষে অনুরূপ দায়িত্ব সম্পাদন করত। এর আয়ের উৎস ছিল বহুমুখী। এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল সরকারি রাজস্ব জমা গ্রহণকারী ও জিম্মাদার। জমিদাররা এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরকারে রাজস্ব জমা দিতেন এবং নবাবরাও তাঁদের বার্ষিক প্রদেয় অর্থ দিল্লিতে প্রেরণ করতেন। এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠান মুদ্রা তৈরি করত ‘জগৎ শেঠ’ নামেই এবং বাংলায় আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ সোনারুপো ক্রয় করত। প্রতিষ্ঠানটি বছরে প্রচুর মুনাফা করত। ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে এই শেঠের গদি থাকার বাদশাহ, নবাব, মহারাজা, রাজা, জমিদার, মহাজন ও বণিকরা এই গদি থেকে প্রয়োজনানুসারে অর্থ গ্রহণ করত। তৎকালীন সমরে হিন্দুস্তান অথবা দাক্ষিণাত্যে তাঁদের মতো অর্থশালী মহাজন বিরল ছিল।
ফতেচাঁদের পর তাঁর পৌত্র মাহতাবচাঁদ ১৭৪৪ সালে উত্তরাধিকারসূত্রে ‘জগৎ শেঠ’ উপাধি লাভ করেন। তিনি ও তাঁর সম্পর্কিত ভাই মহারাজা স্বরূপচাঁদ নবাব আলিবর্দি খানের সময়ে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। আলিবর্দির উত্তরাধিকারী সিরাজ-উদ্-দৌল্লা এই পরিবারের দুই ভাইকে শক্ত করে তোলে। সিরাজের ছিল এটা চরম হঠকারিতা। ফলে তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং পলাশির যুদ্ধের আগে ও পরে তাঁদেরকে বিপুল অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। বাংলার জনগণ বিশ্বাস করে যে, ‘জগৎ শেঠ’-দের অর্থ আর ইংরেজদের তলোয়ার মিলিত হয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের পতন ঘটিয়েছে। নবাবি আমলেও মির জাফর তাঁদের শক্তি ও প্রভাব অব্যাহত ছিল। কিন্তু তাঁরা তাঁর উত্তরাধিকারী মির কাসিমের বিরাগভাজন হন। মির কাসিম ১৭৬৩ সালে জগৎ শেঠ’ পরিবারের নেতৃস্থানীয় এই দুই ভাই মাহতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদকে হত্যার নির্দেশ দেন। এ ঘটনার পরই নবাবের কাছ থেকে ক্ষমতা কোম্পানির হাতে চলে যায়। জগৎ শেঠের বংশলতিকা –হীরানন্দের জ্যেষ্ঠপুত্র মানিকচাঁদ সাহ, মানিকচাঁদের পোষ্যপুত্র ফতেচাঁদ, ফতেচাঁদের পৌত্রদ্বয় মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ, মহাতাবচাঁদের চার পুত্র– খোসালচাঁদ, গুমরচাঁদ, গোলাপচাঁদ ও শুকলচাঁদ, স্বরূপচাঁদের তিন পুত্র– উদয়চাঁদ, অভয়চাঁদ ও মিহিরচাঁদ, খোসালচাঁদের পোষ্যপুত্র হরকচাঁদ, হরকচাঁদের দুইপুত্র– ইন্দ্রচাঁদ ও বিষণচাঁদ, ইন্দ্ৰচাঁদের পুত্র গোবিন্দ শেঠ, গোবিন্দচাঁদের দুই পুত্র– গোপালচাঁদ ও কিষণচাঁদ। শেষতম ‘জগৎ শেঠ’ এই গোপালচাঁদ। কিন্তু ‘জগৎ শেঠ’ ততদিনে ‘ভিখারি’-তে পরিণত হয়ে গেছে। ১৯১৩ সালে চরম দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে মৃত্যমুখে পতিত হয় গোপালচাঁদ। এঁদের সুবিস্তৃত বিশাল অট্টালিকাগুলি ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং ভাগীরথীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
‘জগৎ শেঠ’-দের সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ এই পরিবার বেশ কয়েক বছর কোম্পানির ব্যাংকারও ছিল। কিন্তু ১৭৭৩ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় কোষাগার স্থানান্তরিত হলে কোম্পানির ব্যাংকার হিসাবে ‘জগৎ শেঠ’ পরিবারের কার্যক্রমের অবসান ঘটে। তখনও পরিবারটির সুবিধাজনক হারে মুর্শিদাবাদে মুদ্রা প্রস্তুতের সুযোগ ছিল। কিন্তু পূর্বপুরুষদের তুলনায় তাঁদের ধনসম্পদ এত হ্রাস পেয়েছিল যে, একটা সময়ে এসে ব্রিটিশদের দেয় পেনশনের টাকায় তাঁদের দিন গুজরান করতে হত। মাহতাব চাঁদের উত্তরাধিকারীরা ছয় পুরুষ ধরে ‘জগৎ শেঠ’ উপাধি লাভ করে এসেছেন।
‘জগৎ শেঠ’-দের কথা একটু আলোচনা করে নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সিরাজ প্রসঙ্গে। এবার সিরাজের মূল প্রসঙ্গে ফিরে যেতে পারি। সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর এই ষড়যন্ত্রকারী দলটি ওড়িশার নায়েব নবাব আলিবর্দি খানকে বাংলার সিংহাসন লাভে সাহায্য করে। তাঁর আমলে প্রাসাদের অভ্যন্তরে ষড়যন্ত্র চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। খোদ সেনাপতিই সেই ষড়যন্ত্রের অংশীদার ছিল। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে বর্গি তথা মারাঠারা বার বার বাংলার উপর চড়াও হয়েছে। বাংলা তছনছ করেছে তাঁরা। বেগতিক দেখে আলিবর্দি খানও এসব প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তিনি তাঁদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেন। ফলে ‘জগৎ শেঠ’ স্বরূপচাঁদ, রাজা জানকী রায়, রায় দুর্লভ রায়, ‘জগৎ শেঠ’ মাহতাবচাঁদ, রাজা রামনারায়ণ, দেওয়ান মানিকচাঁদ (ইনি ‘জগৎ শেঠ’ মানিকচাঁদ নয়, ইনি মানিকচাঁদ বর্মন। পাঞ্জাবের ক্ষেত্রী। বর্ধমানরাজ ত্রিলোকচাঁদ মুর্শিদাবাদের নবাবদের সঙ্গে বিশস্ত ও নির্ভরযোগ্য দৃঢ় সম্পর্ক রাখতেন মানিকচাঁদের মাধ্যমেই।) প্রভৃতির নেতৃত্বে এ দলটি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে পড়ে। মুর্শিদকুলি খানের পর সম্ভ্রান্ত মুসলিম রাজকর্মচারীর সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে পেতে শূন্যের কোঠায় পৌঁছে যায়। কার্যত তাঁদেরকে যবনিকার অন্তরালে নিক্ষেপ করা হয়। অতএব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সংগে যোগসাজসের পথ প্রশস্ত হয়ে যায়।
‘জগৎশেঠ’ মাহতাবচাঁদ ও দেওয়ান মানিকচাঁদ চক্রের নেতৃত্বে বাংলার এই প্রভাবশালীদের লক্ষ্য ছিল দুটি। একটি রাজনৈতিক, অপরটি অর্থনৈতিক। বাংলার শাসন পরিবর্তন বা হস্তান্তরের দ্বারা তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থকরণ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা লাভ। পক্ষান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও তাদের ব্যাবসার প্রসার ও উন্নতিকল্পে হিন্দু রাজা-জমিদার-বণিকরা ছাড়া অন্যদের কাছেও কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না। কারণ তাঁদের ব্যাবসাবাণিজ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের গোমস্তা ও ঠিকাদারদের সাহায্য ছাড়া কিছুকেই চলতে পারত না। উপরন্তু ১৭৩৬ থেকে ১৭৪০ সাল পর্যন্ত কলকাতায় তাঁদের মূলধন বিনিয়োগে ৫২ জন স্থানীয় হিন্দু বণিকদের অংশ ছিল। কাশিমবাজারের কারখানা স্থাপনেও ২৫ জন হিন্দু বণিক অংশীদার ছিল। শুধু ঢাকার তাঁদের ১২ জন অংশীদারের মধ্যে ২ জন মুসলিমও ছিলেন।
কলকাতা ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গের সামরিক ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল স্কটের নিকট লিখিত এক পত্রে চার্লস এফ. নোবেল বলেন— হিন্দু রাজাগণ ও নাগরিকগণ মুসলিম শাসনের প্রতি অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ ছিল। এ শাসনের অবসান কীভাবে ঘটানো যায় এটাই ছিল তাদের চিন্তার কারণ, অভিলাষও। নোবেল জানান, “উমিচাঁদ আমাদের বিরাট কাজে লাগবে বলে আমি মনে করি। হিন্দু রাজা ও জনসাধারণের উপর পুরোহিত নিমু গোঁসাইয়ের যথেষ্ট প্রভাব আছে। বিরাট সংখ্যার সশস্ত্র একটি দল তাঁর একান্ত অনুগত। সন্ন্যাসী দলকেও আমরা আমাদের কাজে লাগাতে পারি। নিমু গোঁসাইয়ের দ্বারা এ কাজ হবে বলে আমার বিশ্বাস আছে”। ব্রিটিশদের ছকবাজি বুঝতে কর্নেল স্কটের এই উদ্ধৃতিটুকুই যথেষ্ঠ। হিন্দু-মুসলিমের তাস নিয়ে খেলা এঁরা শুরু থেকেই শুরু করেছিল। ভারতীয়দের দুই ভাগে ভাগ করে রাজ করে গেছে ১৯০ বছর। নিমু গোঁসাই কর্নেল স্কটকে দেশের পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর বলত ও পরামর্শ দিত। প্রয়োজন হলে ইংরেজদের সাহায্যে সে মাত্র চারদিনের মধ্যে এক হাজার সশস্ত্র লোক হাজির করতে পারত। মনে রাখতে হবে যে, হিন্দু জাতির পুনর্জাগরণ আন্দোলনের ফলে বাংলায় সন্ন্যাসী আন্দোলনের নামে একটি গোপন সশস্ত্র দলগঠন করা হয়েছিল এবং তাঁরাও মুসলিম শাসন অবসানে ব্রিটিশদের সহায়ক হয়েছিল। ভারতীয়দের উপর ব্রিটিশদের এত অত্যাচার নিপীড়ন এঁদের প্রশ্রয়েই সংঘটিত হয়েছিল, নিঃসন্দেহে। অপরদিকে ব্রিটিশদের সহায়তার রাজা জমিদার-নায়েবরাও তো প্রজাদের উপর অত্যাচার-নিপীড়নে ব্রিটিশদের চেয়ে দশ কাঠি উপরে ছিল। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল কলকাতায় দুর্গ নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করে। যেখান থেকে ব্রিটিশরা বাংলায় শোষণ নিপীড়ন চালাত, সেটা এখন ভারতীয় সেনাদের দখলে। যাই হোক, বাংলার নবাবের কাছে যে জমিদারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লাভ করে তার উপরে সার্বভৌম অধিকারও তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করে। দেশের আইনে অপরাধীরাও শাস্তি এড়ানোর জন্যে কোম্পানির জমিদারির অধীনে আশ্রয় (Shelter) লাভ করতে থাকে। ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্র, কুকর্ম ও হীন আচরণ নবাব আলিবর্দির যে জানা ছিল না সেটা কিন্তু নয়। তবে শয্যাশায়ী মরণোন্মুখ নবাবের কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। তা ছাড়া অসম লড়াইয়ে কীই বা করতে পারতেন। তাঁর ভাবী উত্তরাধিকারী সিরাজ-উদ্-দৌল্লা ইংরেজদের ষড়যন্ত্র বানচাল করতে গিয়ে তিনি তাঁদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। উল্লেখ্য, ১৭৫৬ সালে ফোর্ট উইলিয়মের গভর্নর রজার ড্রেক যখন নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লাকে কলকাতা আক্রমণে জন্য প্ররোচিত করে, তখনই ফোর্ট বা দুর্গের কার্যকারিতার পরীক্ষা হয়ে যায়। নবাব কলকাতা দখল করে দুর্গে প্রবেশ করেন এবং ১৭৫৬ সালের ১৯ জুন গভর্নর ড্রেক এবং তার সৈন্য-সামন্তকে দুর্গ থেকে ঝেটিয়ে বিদেয় করে।
অতঃপর ব্রিটিশরা ভারত তথা বাংলার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাতে শুরু করল। তাঁরা ষড়যন্ত্ৰী ঘসেটি বেগমের লালসাকে সমর্থন করে পাশে দাঁড়াল। বেগম ও তাঁর দেওয়ান রাজবল্লভ তাঁদের যাবতীয় ধনসম্পদ নিরাপদে সঞ্চিত করার জন্যে কলকাতায় কোম্পানির তত্ত্বাবধানে রাখেন। রাজবল্লভ রাজকোশের সম্পূর্ণ অর্থসম্পদ সহ তাঁর পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে কোম্পানির আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেন। কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয় দিয়ে ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে নবাবের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা শুরু হল। ঘসেটি বেগমের ২০,০০০ সৈন্যসহ সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার জন্যে উদ্বুদ্ধ করে তাঁরা রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করে। সবকিছু জানার পর সিরাজ-উদ্-দৌল্লা তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন না-করে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ঝামেলা মেটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নবাবের কোনো কথায় কর্ণপাত করতে ব্রিটিশরা প্রস্তুত ছিলেন না। জনৈক ব্রিটিশ কারখানার মালিক উইলিয়াম টুক (William Tooke) বলেন— প্রাচ্যের প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী নতুন রাজ্যভিষেকের পর বিদেশি নাগরিকরা বিভিন্ন উপঢৌকনাদিসহ নতুন বাদশাহ বা নবাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে থাকে। কিন্তু এই প্রথমবার তাঁরা এ প্রথা লঙ্ঘন করে। তিনি আরও বলেন, কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয় দান এবং তাঁকে নবাবের হাতে সমর্পণ করতে অস্বীকৃতি এটাই প্রমাণ করে যে, সিরাজ-উদ্-দৌল্লার রাজনৈতিক শত্রুর সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভীর যোগসাজস ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বাংলা সরকারের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের অনুরূপ হয়ে উঠেছিল। সিরাজ-উদ্-দৌল্লা তাঁদের সঙ্গে একটা মীমাংসায় উপনীত হওয়ার সকল প্রকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অতঃপর তিনি তাঁদেরকে দেশ থেকেই বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এ ব্যাপারে ১ জুন, ১৭৫৬ সালে হুগলির জনৈক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী খাজা ওয়াজেদকে যে পত্র দেন তা এরকম— প্রধানত তিনটি কারণে ইংরেজদেরকে এ দেশে আর থাকার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে না। (১) তাঁরা দেশের আইন লঙ্ঘন করে কলকাতায় একটি সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করেছে। (২) তাঁরা ব্যাবসায় চুক্তি ভঙ্গ করে অসদুপায় অবলম্বন করেছে এবং ব্যাবসা-কর ফাঁকি দিয়ে সরকারের প্রভূত আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছে। (৩) একজন সরকারি তহবিল আত্মসাৎকারীকে আশ্রয় দিয়ে তাঁরা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছে। স্মত, সিরাজ এখানে ‘দেশ’ বলতে সমগ্র ভারত বোঝায়নি। দেশ বলতে তাঁর অধিকারে থাকা বাংলা-বিহার-ওড়িশা ভূখণ্ডকে বুঝিয়েছে, যে অংশে তাঁর শাসন ও কর্তৃত্ব কায়েম ছিল। তখনকার সমরে শাসকের সাম্রাজ্য অংশকেই ‘দেশ’ বুঝত। ভারত নামে কোনো ‘অখণ্ড’ দেশের ধারণাই তৈরি হয়নি।
ওই বছরেই ৩ জুন সিরাজ-উদ্-দৌল্লা কাশিমবাজারে ব্রিটিশদের কারখানা দখল করে একটা মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্যে চাপ দেন। কারখানা দখলের পর তিনি উদারতা প্রদর্শন করে কারখানাটি তালাবদ্ধ করে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করেন, যাতে করে তা লুণ্ঠিত হতে না-পারে। কাশিমবাজার কারখানার সমুদয় কর্মচারীকে সিরাজ-উদ্-দৌল্লা মুক্ত করে দেন। শুধুমাত্র ওয়াটস এবং কলেটকে সঙ্গে করে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। যাত্রার পূর্বে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আসার জন্যে বার বার পত্র লেখেন। কিন্তু তারা মোটেই কর্ণপাত করেন না। উপরন্তু একটা সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার জন্যে ব্রিটিশরা সদাপ্রস্তুত থাকলেন। দাক্ষিণাত্য থেকে সামরিক সাহায্য লাভের পর তাঁদের সাহস অনেকখানি বেড়ে যায়। নবাবের কলকাতা পৌঁছোনোর এক সপ্তাহ আগেই হুগলি নদীর নিম্নভাবে অবস্থিত থানা দুর্গ এবং হুগলি ও কলকাতায় মধ্যবর্তী সুখসাগর দখলের জন্যে ড্রেক সৈন্য প্রেরণ করে। নবাব কর্তৃক প্রেরিত অগ্রবর্তী দল উভয়স্থানে ব্রিটিশদের আক্রমণ প্রতিহত করে। ১৬ জুন ৩০,০০০ সৈন্যসহ সিরাজ ফোর্ট উইলিয়ামের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হন। দু-দিন ব্যাপী যুদ্ধের পর ড্রেক তাঁর মূল সেনাবাহিনীসহ ফলতায় পালিয়ে যায়। পালানোর সুবিধার জন্যে হলওয়েলকে যুদ্ধে নিয়োজিত রাখা হয়। বলা হয়— পরদিন সেও যেন তাঁর মুষ্ঠিমেয় সৈন্যসহ ফলতায় আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু হলওয়েল নবাবের সৈন্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। হাউস অব কমন্সের সিলেক্ট কমিটির সামনে উইলিয়াম টুক যে সাক্ষ্য দান করে, তাতে বলা হয়— আত্মসমর্পণকারী ব্রিটিশসৈন্যদের প্রতি কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার করা হয়নি। রাত্রিবেলায় প্রচুর মদ্যপানের পর কিছু সংখ্যক ব্রিটিশসৈন্য হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করলে তাঁদেরকে ১৮ বাই ১৪ মাপের একটি ঘরে আবদ্ধ রাখা হয়। অবাধ্য ও দুর্বিনীত সৈন্যদের আবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যেই ঘরটি তাঁদেরই দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। ৪০ থেকে ৬০ জনকে এই ঘরে আটক করে রাখা হয়। যুদ্ধে অত্যধিক পরিশ্রান্ত হওয়ার কারণে প্রায় ২০ জন সৈন্য প্রাণত্যাগ করে।” তবে এ ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্থান করে দেওয়া হয়েছে। এ কাল্পনিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে বিজয়ী শাসকগণ ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ নামক একটি স্মৃতিস্তম্ভ কলকাতায় ডালহৌসি স্কোয়ারে স্থাপন করে। বস্তুত এই স্তম্ভটি নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার কাল্পনিক কালিমা বহন করে বিংশতি শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। উদ্দেশ্যমূলক ও নিছক বিদ্বেষমূলক প্রচারণার উৎস এ স্তম্ভটি তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৯৩৭ সালে আগেই ভেঙে দেওয়া হয়।
যাই হোক, হলওয়েল এবং অন্য তিন ব্যক্তি ছাড়া বাকি সকলের মুক্তি দেওয়া হয়। ২৪ জুন নায়েব মানিকচাঁদকে কলকাতার শাসনকার্যে নিয়োজিত করে সিরাজ-উদ্-দৌল্লা হলওয়েল ও তাঁর তিনজন সঙ্গীসহ মুর্শিদাবাদ প্রত্যাবর্তন করেন। ২৬ জুন অবশিষ্ট ব্রিটিশসৈন্যরা কলকাতা থেকে ফলতা রওনা দেন। ৩০ জুন সিরাজদ্দৌলা ফোর্ট সেন্ট জর্জের গভর্নর জর্জ পিগটকে পত্র লেখেন। সেই পত্রের মর্ম ছিল –“ইংরেজরা যদি একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় উপনীত হয় এবং রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের উচ্চাভিলাষ পরিত্যাগ করে ব্যাবসার শর্তাবলি মেনে চলার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ, তাহলে তাঁদেরকে বাংলায় ব্যাবসায় পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হবে।” সিরাজ চেয়েছিলেন ব্রিটিশদের সঙ্গে একটা ন্যায়সংগত মীমাংসায় পৌঁছোতে। কিন্তু সিরাজের প্রতিপক্ষ ব্রিটিশদের মনোভাব ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।
দাক্ষিণাত্য তথা মাদ্রাজ থেকে যে সামরিক সাহায্য চাওয়া হয়েছিল, রজার ড্রেক তার প্রতীক্ষায় দিন গুণতে থাকে। এদিকে নবাবকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে ৬ জুলাই একটা মীমাংসার জন্যে তাঁরা কথাবার্তা শুরু করে। মাদ্রাজ থেকে সামরিক সাহায্য এলেই তাঁরা পুনরায় শক্তি পরীক্ষায় লেগে যাবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রধানরা ও বণিকশ্রেণি ব্রিটিশদেরকে সবরকমভাবে উৎসাহিত করতে থাকে। বিশেষ করে খাজা ওয়াজেদের প্রধান সহকারী শিববাবু নামক জনৈক প্রভাবশালী ব্যক্তি সর্বদা ব্রিটিশদেরকে একথা বলতে থাকে যে, “নবাব সিরাজ উদ্-দৌল্লা আর তাঁদেরকে কিছুতেই ব্যাবসায় সুযোগসুবিধা দেওয়ার পাত্র নন। কলকাতায় পরাজয় বরণ করার পর কোনো মীমাংসায় উপনীত হওয়া তাঁদের জন্যে কিছুতেই সম্মানজনক নয়।” গোবিন্দরাম নামে অন্য একটি লোক সিরাজ-উদ্-দৌল্লার কলকাতা অভিযানের সময় পথে বৃক্ষ উৎপাটন করে রেখে বাধার সৃষ্টি করে ব্রিটিশদের শক্তি জুগিয়েছিল। সে ব্রিটিশদের পক্ষে গোপন তথ্য সরবরাহের কাজ শুরু করে। কলকাতায় শাসনভার যে নায়েব মানিকচাঁদের উপর অর্পিত হয়েছিল, সেও বাংলার সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা করে ফলতায় অবস্থিত ব্রিটিশদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করতে থাকে। সে নবাবের কাছে এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য পেশ করতে থাকে যে, যাতে মনে হয় ব্রিটিশরা একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আসার জন্যে প্রস্তুত। অল্প সৈন্য নিয়ে কিছু করা যাবে না চিন্তা করে মেজর কিলপ্যাট্রিক আপাতত যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে এবং মাদ্রাজ থেকে বৃহত্তর সামরিক সাহায্য ও নৌ-বহর তলব করে। ১৭৫৬ সালের ১৫ আগস্ট কিলপ্যাট্রিক নবাবকে জানায় যে, তাঁরা তাঁর অনুগ্রহপ্রার্থী। অপরদিকে ব্রিটিশদেরকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার জন্য মানিকচাঁদ, জগৎশেঠ’ মাহতাবচাঁদ ও অন্যান্য হিন্দু প্রধানদেরকে অনুরোধ করে পত্রও লেখে।
মানিকচাঁদের মিথ্যা আশ্বাসবাণীতে নবাব বিভ্রান্ত হন এবং বলেন যে, ব্রিটিশরা যুদ্ধ করতে না-চাইলে তাঁদেরকে ব্যাবসায় সবরকমের সুযোগসুবিধা দেওয়া হবে। নবাবের নৌ-শক্তি বলে প্রায় কিছুই ছিল না। বিদেশি বণিকদেরকে বাংলার ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করে দিলেও সমুদ্র উপকূল থেকে তাঁদেরকে বিতাড়িত করার ক্ষমতা নবাবের ছিল না। ব্রিটিশরা এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। সিরাজ-উদ্-দৌল্লার সামনে নতুন এক বিপদ দেখা দিল। পূর্নিয়ার শওকত জং মোগল সম্রাটের কাছ থেকে এক ফরমান লাভ করতে সমর্থ হয়, যার বলে তাঁকে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার সুবাদার হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। ব্রিটিশরা শওকতের মধ্যে সিরাজের পতন ঘটানোর অক্সিজেন পেল যেন। তাঁরা শওকত জঙের পক্ষ অবলম্বন করে তাঁর বিজয়ের আশা পোষণ করছিল। কিন্তু ৬ আগস্টের সিরাজের সঙ্গে শওকত জঙের যুদ্ধে শওকত নিহত হওয়ায় তাঁদের সে আশায় ছাই পড়ে গেল।
আগস্টের মাঝামাঝি ড্রেক এবং কিলপ্যাট্রিক কর্তৃক কলকাতার পতন সম্পর্কে লিখিত পত্রের জবাবে যথেষ্ট পরিমাণে সামরিক সাহায্য ইংল্যান্ড (তখনও আজকের ব্রিটেন যুক্তরাজ্য তৈরি হয়নি) থেকে মাদ্রাজ এসে পৌঁছে দেয়। সেপ্টেম্বরে কোম্পানির দুটি জাহাজ ‘চেস্টারফিল্ড’ ও ‘ওয়ালপোল’ মাদ্রাজ পৌঁছে যায়। অক্টোবরে ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিল রবার্ট ক্লাইভ এবং এডমিরাল ওয়াটসনের নেতৃত্বে একটি সামরিক বাহিনী বাংলায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত করে। বাংলায় পৌঁছোনোর পরপরই প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু করার জন্যে কর্নেল ক্লাইভকে নির্দেশ দেওয়া হয়। ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলের পক্ষ থেকে ঢাকা, পূর্ণিয়া এবং কটকের ডিপুটি নবাবদেরকে ক্লাইভের সঙ্গে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানিয়ে পত্র দেওয়া হয়। অপরদিকে ব্রিটিশদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে নবাবকেও পত্র দেওয়া হয়। উক্ত কাউন্সিলের গভর্নর জর্জ পিগটের পত্রে বলা হয়– “আমি একজন শক্তিশালী সর্দার পাঠাচ্ছি, যার নাম ক্লাইভ। সৈন্য ও পদাতিক বাহিনীসহ সে যাচ্ছে এবং আমার পরিবর্তে তিনিই শাসন চালাবে। আমাদের যে ক্ষতি করা হয়েছে তার সন্তোষজনক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আপনি নিশ্চয় জেনে থাকবেন যে, আমরা যুদ্ধে সর্বত্রই জয়ী হয়েছি।” ব্রিটিশরা নাকি বণিক হিসাবে আমাদের উপমহাদেশে এসেছিল! এটা কি বণিকদের নমুনা? বণিকরা সেনা মোতায়েন করে যুদ্ধ করে পরদেশে ঢুকে? আসলে বণিকের ছদ্মবেশে সমগ্র ভারত দখল নিয়ে শাসন করতেই এসেছিল। যেমনটি অন্য দেশগুলি দখল ও শাসন করেছে। উল্লিখিত এই পত্রের মর্ম পরিষ্কার যে, মীমাংসার আর কোনো পথ থাকল না। ১৫ ডিসেম্বর ক্লাইভ ফলতায় পৌঁছে যায়। “মানিকচাঁদ কোম্পানির প্রতি যে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও সাহায্য সহযোগিতা করে, তাঁর জন্যে তাঁকে ধন্যবাদ জানিও”— সেইদিনই ক্লাইভ তাঁকে পত্র লেখেন। ক্লাইভের নিরাপদে পৌঁছোনোর আনন্দ প্রকাশ করে মানিকচাঁদ সেই পত্রের জবাবও দেন। পত্রে সে জানায় যে, সে কোম্পানির সহযোগিতায় যথাসাধ্য আত্মনিয়োগ করবে। উপরন্তু গোপন তথ্য আদানপ্রদানের জন্যে সে রাধাকৃষ্ণ নামক এক ব্যক্তিকে ক্লাইভের কাছে পাঠাবেন।
২৯ ডিসেম্বর ক্লাইভের রণতরী হুগলি নদী দিয়ে অগ্রসর হয়ে বজবজ দখল করে। তার চার দিন আগে ক্লাইভ মানিকচাঁদের মাধ্যমে নবাবকে যে পত্র লেখে তাতে বলা হয় –“নবাব আমাদের যে ক্ষতি করেছেন, আমরা এসেছি তার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্যে, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে আসিনি তাঁর কাছে। আমাদের দাবি আদায়ের জন্যে আমাদের সেনাবাহিনীই যথেষ্ট।” মানিকচাঁদ পত্রটি নবাবকে দিয়েছিল কি না জানা যায়নি। দিলে নবাব নিশ্চয়ই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন। মানিকচাঁদ সবসময়ই নবাবকে বিভ্রান্তে রেখেছিল। তার ফলে বিনা বাধায় ক্লাইভ ৩১ ডিসেম্বর থানা ফোর্ট এবং ১ জানুয়ারি, ১৭৫৭ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ পুনরুদ্ধার করে। মানিকচাঁদ ইচ্ছা করলে নবাবের বিরাট সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে ব্রিটিশদের আক্রমণ সহজেই প্রতিহত করতে পারত। কিন্তু তিনি এমন কোনো চেষ্টা করেছেন বলে শুনিনি। এমনকি এইসব অঞ্চল ব্রিটিশ কর্তৃক অধিকৃত হওয়ার সংবাদটুকু পর্যন্ত সে নবাবকে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
ব্রিটিশদের হাতে ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গটি একপ্রকার তুলে দিয়ে মনিকচাঁদ হুগলি রওনা দেন এবং হুগলি ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ক্লাইভ হুগলিতে তাঁর নামে লিখিত পত্রে অনুরোধ জানার যে, পূর্বের মতো সে যেন এখানেও বন্ধুত্বের পরিচয় দেয়। দু-দিন পর হুগলি আক্রমণ করে এবং ক্লাইভ তা সহজেই হস্তগত করে। ব্রিটিশ কর্তৃক এতসব গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি অধিকৃত হওয়ার পর মানিকচাঁদ নবাবকে জানায়। যে, ব্রিটিশদের মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। হুগলি অধিকারের পর ব্রিটিশসৈন্যরা সমগ্র শহরে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের দ্বারা বিরাট সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। হুগলির পতন ও ধ্বংসলীলার সংবাদ পাওয়ামাত্র সিরাজ-উদ্-দৌল্লা বিরাট বাহিনীসহ ২০ জানুয়ারি হুগলি হাজির হন। ব্রিটিশরা তখন তড়িৎগতিতে হুগলি থেকে পালিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেয়। অনেক আলাপ-আলোচনার পর ৯ ফেব্রুয়ারি নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতিহাসে তা ‘আলিনগরের সন্ধি’ বলে প্রসিদ্ধ। এই সন্ধি অনুসারে ১৭১৭ সালের ফরমান মোতাবেক সমস্ত গ্রাম ব্রিটিশদেরকে দিতে হবে। তাঁদের পণ্যদ্রব্যাদি করমুক্ত হবে এবং তাঁরা কলকাতা অধিকতর সুরক্ষিত করতে পারবে। উপরন্তু সেখানে তাঁরা একটা নিজস্ব টাঁকশাল নির্মাণ করতে পারবে।
সিরাজ-উদ্-দৌল্লাকেও এ ধরনের অসম্মানজনক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। তার প্রথম কারণ হল মানিকচাঁদের মতো তাঁর অতি নির্ভরযোগ্য লোকদের চরম ‘বিশ্বাসঘাতকতা’। অপরদিকে ক্লাইভের কাছে এ সন্ধি ছিল একটা সামরিক প্রয়োজন মাত্র। ব্রিটিশরা একই সঙ্গে প্রয়োজনবোধ করেছিল নবাব সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করার এবং ফরাসিদেরকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করার। এই উদ্দেশ্যেই ক্লাইভ ওয়াটস এবং উমিচাঁদকে সিরাজ-উদ্-দৌল্লার কাছে পাঠিয়ে দেয় এ কথা বলার জন্যে যে, তাঁরা ফরাসি অধিকৃত শহর চন্দননগর অধিকার করতে চায় এবং তার জন্যে নবাবকে সাহায্য করতে হবে। এ ছিল তাঁদের এক বিরাট রণকৌশল। নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লা উভয় সংকটে পড়ে গেলেন। তিনি তাঁর রাজ্যমধ্যে সবসময়ই বিদেশি বণিকদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে আসছিলেন। এ নীতি কী করে ভঙ্গ করবেন। কিন্তু মুশকিল হল ব্রিটিশদের সাহায্য না-করলে তাঁরা এটাকে তাঁদের প্রতি শত্রুতা এবং ফরাসিদের প্রতি মিত্রতা পোষণের অভিযোগ করবে। শেষপর্যন্ত তিনি নিরপেক্ষ নীতিতেই অবিচল থাকার সিদ্ধান্ত করেন। সেই অনুসারে তিনি সেনাপতি নন্দকুমারকে নির্দেশ দেন— ব্রিটিশরা যদি চন্দননগর আক্রমণ করে তাহলে ফরাসিদের সাহায্য করতে হবে। অনুরূপভাবে ফরাসিরা যদি ব্রিটিশদেরকে আক্রমণ করে তাহলে ব্রিটিশদেরকে সাহায্য করতে হবে। ক্লাইভ উৎকোচ (১০,০০০ থেকে ১২,০০০ হাজার টাকা) দিয়ে নন্দকুমারকে নিজের অধীনে নিয়ে নেয়। উৎকোচ দিয়ে নবাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানকেও বশ করে ফেলে ব্রিটিশরা। এভাবে ক্লাইভ চারদিকে উৎকোচ ও বিশ্বাসঘাতকতা এমন এক জাল বিস্তার করে যে, সিরাজ-উদ-দৌল্লা কোনো বিষয়েই দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে পারেন না। উপরন্তু শেঠ, বেনিয়ারা এবং তাঁর কর্মচারীরা যাঁরা মনেপ্রাণে মুসলিম শাসনের অবসান কামনা করে আসছিল বহুদিন থেকে, তাঁরা সিরাজ-উদ্-দৌল্লাকে সর্বদা কু-পরামর্শই দিতে থাকে। বলেন, ইংরেজদেরকে কিছুতেই রুষ্ট করা চলবে না। ওদিকে বাংলা-বিহার রক্ষার উদ্দেশ্যে বিরাট সেনাবাহিনী সেদিকে পাঠানোর পরামর্শ দেয়। এভাবে ব্রিটিশদের অগ্রগতির পথ সুগম করে দেওয়া হয়।
ইতিমধ্যে ৫ মার্চ ইংল্যান্ড থেকে সৈন্যসামন্তসহ একটি নতুন জাহাজ ‘কাম্বারল্যান্ড’ কলকাতা এসে পৌঁছোয়। ৮ মার্চ ক্লাইভ চন্দননগর অবরোধ করেন। সিরাজের মন্ত্রী ও প্রভাবশালী মহারাজ রায়দুর্লভ (পুরো নাম মহেন্দ্রনারায়ণ রায়দুর্লভ) এবং মির জাফরের অধীনে একটি সেনাবাহিনী চন্দননগরের দিকে পাঠানো হয়। কিন্তু তাঁদের পৌঁছোনোর আগেই ফরাসিরা আত্মসমর্পণ করল। তাঁরা চন্দননগর ছেড়ে যেতে রাজি হয়ে যায়। এমনকি বাংলায় অবস্থিত তাঁদের সমস্ত কারখানা নবাব এবং এডমিরাল ওয়াটসনের হাতে তুলে দিয়ে যেতে রাজি হয়ে যায়। অবশেষে ক্লাইভ বাংলার ভূখণ্ড থেকে ফরাসিদের শিকড় থেকে উচ্ছেদ করার জন্যে নবাবের কাছে দাবি জানান। উপরন্তু পাটনা পর্যন্ত ফরাসিদের পিছু নেওয়ার জন্য কোম্পানির ২০০০ সৈন্য স্থলপথে অগ্রসর হওয়ার জন্যে নবাবের অনুমতি প্রার্থনা করে। খুব স্বাভাবিকভাবেই নবাব এ অন্যায় অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এতে ফরাসিদের সাহায্য করা হয়েছে বলে নবাবের প্রতি ব্রিটিশরা অভিযোগ চাপিয়ে দেয় এবং ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল কমিটি ২৩ এপ্রিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। ব্রিটিশরা আরও অভিযোগ করে যে, নবাব আলিনগরের চুক্তি ভঙ্গ করেছেন। ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে নবাবের বিরুদ্ধে পাকাঁপোক্ত ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায় সিরাজ-উদ্-দৌল্লারই ‘কাছের মানুষ’ রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ ও ‘জগৎ শেঠ’ মাহতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদদের সঙ্গে নিয়ে। তাঁদেরই পরামর্শে নবাবের ‘বখশি’ (বেতনদাতা কর্মচারী) মির জাফরকে নবাবের স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করা হয়। ব্রিটিশ ও মির জাফরের মধ্যেও সমস্ত বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। কেবল উমিচাঁদই (আগ্রার অধিবাসী হলেও বাংলায় এসে শোরা ও আফিমের ব্যাবসা করতেন। ব্রিটিশ কোম্পানিতে শোরা সরবরাহের একজন বড় ঠিকাদার ছিলেন।) একটু বেঁকে বসেন। তিনি নবাবের যাবতীয় ধনসম্পদের শতকরা পাঁচ ভাগ দাবি করে বসেন। অন্যথায় সকল ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেওয়ার হুমকিও দেন। ক্লাইভ উমিচাঁদকে খুশি করার জন্যে ওয়াটসনের জাল স্বাক্ষরসহ একটি দলিল তৈরি করে। মির জাফরের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে সে আলিনগরের চুক্তির সমস্ত শর্ত সম্পূর্ণরূপে পালন করতে বাধ্য থাকবে বলে স্বীকৃত হয়। উপরন্তু সে স্বীকৃত হয় ক্ষতিপূরণ বাবদ কোম্পানিকে দিতে হবে ১ কোটি টাকা, ইউরোপীয়ানদেরকে ৫০ লক্ষ, হিন্দু প্রধানদেরকে ২০ লক্ষ এবং আর্মেনিয়ানদেরকে ৭ লক্ষ টাকা। কলকাতা এবং তার দক্ষিণে সমস্ত অঞ্চল চিরদিনের জন্যে কোম্পানিকে ছেড়ে দিতে হবে। সুচতুর ক্লাইভ নবাবের সন্দেহ নিরসনের জন্যে চন্দননগর থেকে সৈন্যসামন্ত সরিয়ে নেয়। মির জাফর পরিকল্পিত বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্যে ক্লাইভকে অতিরিক্ত ৫২ লক্ষ টাকা পুরস্কারস্বরূপ দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। অতএব পলাশির ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ কোম্পানি মুর্শিদাবাদ দরবারে উমিচাঁদের প্রভাবকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগায়।
আহমদ শাহ আবদালির ভারত ত্যাগের পর সিরাজ-উদ্-দৌল্লা মির জাফরকে একটি সেনাবাহিনীসহ পলাশি প্রান্তরে ইংরেজদের প্রতিহত করার আদেশ করেন, যদি তাঁরা ফরাসিদের অনুসরণে উত্তরদিকে অগ্রসর হয়। ক্লাইভ সিরাজ-উদ-দৌল্লাকে জানায় যে, যেহেতু আলিনগর চুক্তি পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, সেহেতু ব্যাপারটির পর্যালোচনার জন্যে মির জাফর, জগৎ শেঠ মাহতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ, রায়দুর্লভ রায়, মির মদন এবং মোহনলালকে (মোহনলাল ছিলেন সিরাজের অন্যতম ও বিশ্বস্ত সেনাপতি। জাতিতে কাশ্মীরি হিন্দু। পলাশির যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সিরাজের পক্ষে বিশ্বস্ততার সঙ্গে ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করে। তবে মোহনলালের শেষপর্যন্ত কী হয়েছিল, তা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে।) দায়িত্ব দেওয়া হোক। কিন্তু ওদিকে সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভ মুর্শিদাবাদের দিকে তাঁর সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে দেন। পলাশির যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ২৩ জুন বর্ষাকালে। সিরাজ-উদ্-দৌল্লা পলাশির ময়দানে ব্রিটিশসৈন্যদের মুখোমুখি হন। নবাবের সৈন্য পরিচালনার ভার ছিল মিরজাফর, রায়দুর্লভ রায়দের উপর। প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তাঁরা সৈন্য পরিচালনা থেকে বিরত থাকে। এর ফলে ক্লাইভ যুদ্ধ না-করেও তাঁর জয় নিশ্চিত হয়ে যায়। ক্লাইভের সৈন্য যেখানে মাত্র ৩২০০ (ইউরোপীয়ান সৈন্য ১০০০, ভারতীয় সিপাহি ২১০০, ১০০ বন্দুকবাজ), সেখানে সিরাজের সৈন্য ৫০,০০০ (এর মধ্যে ৩৫০০০ হাজর পদাতিক সৈন্য, ১৫০০০ অশ্বারোহী। ৪৫০০০ হাজার সৈন্য ছিল মির জাফরের নেতৃত্বে এবং ৫০০০ ছিল মোহনলালের নেতৃত্ব, এই পাঁচ হাজারই যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল।)। ব্রিটিশদের ছিল ৯ টি কামান (৮ টি সিক্স পাউন্ডার ও একটি হাউইটজার) এবং সিরাজের ছিল ৫৩ টি কামান। তা সত্ত্বেও সিরাজের শোচনীয় পরাজয় হল। মির জাফর, রায়দুর্লভ ও অন্য সেনাপতিরা পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল। সুদক্ষ সৈন্য হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশদের আক্রমণ ও গুলিতে যেন আত্মহত্যা করতে থাকল। একা মোহনলাল ৫০০০ সৈন্য নিয়ে অসহায়। যখন তুমূল যুদ্ধ চলছিল তখন মির জাফর যুদ্ধ বন্ধ করতে আদেশ দেন। সিরাজের সৈন্যরা যুদ্ধে বিরতি দিলেও ব্রিটিশদের উপর্যুপরি গোলাবর্ষণে সৈন্যরা ইঁদুরের মতো মরতে থাকল। উভয়পক্ষের যুদ্ধে ব্রিটিশপক্ষের সেনার মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ২২ জন (এর মধ্যে ৬ জন ইউরোপীয় ও ১৬ জন দেশীয়, আহত ৫৩ জনের মধ্যে ১৩ জন ইউরোপীয় ও ৩৬ জন দেশীয়) এবং সিরাজের পক্ষে ৫০০ সেনা নিহত ও আহত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মির মদনের ভূমিকার কথা উল্লেখ করতেই হয়। ব্রিটিশরা যখন যুদ্ধের উদ্দেশে পলাশি মৌজার লক্ষবাগ নামে এক আমবাগানে এসে তাঁবু গাড়েন, তখন বেলা আটটার সময় হঠাৎ করে মির মদন ব্রিটিশ বাহিনীকে আক্রমণ করে। তাঁর প্রবল আক্রমণে টিকতে না-পেরে ক্লাইভ তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ে। মির মদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মির জাফর, রায়দুর্লভরা সেখানে সেনা সমাবেশ করলেও নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। তার উপর দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজের সমস্ত গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও তাঁদের সামান্য সাহায্য পেলেই ব্রিটিশদের পরাজয় ছিল অনিবার্য। যাই হোক, হতভাগ্য সিরাজ-উদ্-দৌল্লা ও তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নেসা এবং তাঁর ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে পালিয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যায় এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তরদিক অভিমুখে রওনা দেয়। তাঁর আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছোতে পারলে ফরাসি সেনাপতি মঁসিয়ে নাসের সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রাজা রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সাহায্য নিয়ে বাংলা পুনরুদ্ধার করবে। সিরাজের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। পথিমধ্যে বন্দি হন, অবশেষে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষার প্রয়াস নেন এবং মির মিরনের কাছে পথিমধ্যে সিরাজ বন্দি এবং মোহাম্মদী বেগ হত্যা করে। মির মিরন হল মির জাফরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। এভাবে পলাশির যুদ্ধে সিরাজের বেদনাদায়ক রাজনৈতিক নাটকের যবনিকাপাতের মধ্য দিয়ে ভারতে মুসলমান শাসনের অবসানের সূত্রপাত হয়। মির জাফর পুত্র মিরনের বাড়িতে বসে ষড়যন্ত্রকারীরা ১৭৫৭ সালে একটি চুক্তিনামা সম্পাদন করে। চুক্তিনামায় উল্লেখ করা হয় সিরাজকে হত্যা করে সিংহাসন ছিনিয়ে নেওয়া হবে যুদ্ধের মাধ্যমে। সে যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মির জাফর কোনো যুদ্ধ করবে না। সিরাজের পতনের পর মসনদের নবাব হবে মির জাফর। সিপাহসালার পদ দেওয়া হবে রায়দুর্লভকে। জগৎ শেঠরা পাবেন অনেক অর্থ। উমিচাঁদকে দেওয়া হবে ২০ লাখ টাকা। অন্যান্য যাঁরা আছেন তাঁদের মধ্যে ইয়ার লতিব খাঁ, নন্দকুমারকে দেওয়া হবে অন্যান্য সুযোগসুবিধা। আর ক্লাইভ পাবেন একটি গ্রামের জমিদারিসহ রাজকোশের কোটি টাকা। ব্রিটিশ বেনিয়াদের নেতা ওয়াটসন, ওয়াটস, হলওয়েলস অন্যরা পাবে নানা জাতীয় সুবিধা। মির জাফর পুত্র মিরন হবেন নবাব পুত্র। অতএব এ পরাজয় শুধু সিরাজের পরাজয় নয়, শুধু বাংলার পরাজয় নয় –এ পরাজয় সমগ্র ভারতের, ভারতবাসীর। অপরদিকে জয় কেবল ইংরেজ এবং ইংল্যান্ডের।
যাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করে নবাব সিরাজের পতন নিশ্চিত করেছিল, তাঁদের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল? আমরা একটু দেখার চেষ্টা করব –(১) মির জাফর : চার বছর তাঁকে নবাব পদে রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে দুর্নীতির জন্য দুই বছর বহিষ্কার করা হয়। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। তাঁর শরীরে অসংখ্য ঘা ও ফোঁড়া হয়ে রক্ত ও পুঁজ পড়ে দুর্গন্ধ বের হয়। এ অবস্থায় পরিবারের লোকজন তাঁকে লোকালয়হীন জঙ্গলে রেখে আসে। বাঁচানোর আশায় রাজা নন্দকুমার কিরিটেশ্বরী দেবীর পা ধোঁয়া জল ওষুধ হিসাবে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে। তবুও আরোগ্য লাভ না করে মৃত্যু জ্বালায় ধুঁকতে ধুঁকতে প্রাণ যায় মির জাফরের। (২) মির মিরন : মির জাফরের জ্যেষ্ঠ পুত্র মিরন সিরাজ-উদ্-দৌল্লাকে হত্যা থেকে শুরু করে বহু অপকর্মের নায়ক। ঐতিহাসিকরা বলেন, তিনি বজ্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। আবার কেউ কেউ বলেন জনৈক ব্রিটিশ সেনাপতি তাঁর বাড়াবাড়ি দেখে গুলি করে হত্যা করেছেন। (৩) জগৎ শেঠ’ মাহতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ : মির কাসেমের সৈন্যরা মাহতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ সহ পরিবারের সকলের শিরচ্ছেদ করে। অনেকের মতে, মাঙঘরের সামনে এটি টাওয়ারের উপর থেকে মহাতাবচাঁদকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। তা দেখে স্বরূপচাঁদও ঝাঁপ দিয়ে আত্মহনন বেছে নেয়। (৪) রায়দুর্লভ : যুদ্ধের পর কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ওই কারাগারেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। (৫) মির কাশিম : মির জাফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে মির কাশিম ক্ষমতা দখল করে। পরে ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর বিরোধের জের ধরে বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হন। এরপর তিনি পালিয়ে বেড়ায়। অজ্ঞাতনামা বিবরণ অনুসারে দিল্লিতে তাঁর করুণ মৃত্যু হয়। (৬) ঘসেটি বেগম : ঘসেটি বেগমকে মিরনের নির্দেশে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। (৭) উমিচাঁদ : যুদ্ধের পর ক্লাইভ কর্তৃক প্রতারিত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মারা যান। (৮) নন্দকুমার : বিভিন্ন অপকর্মের জন্য ব্রিটিশ কর্তৃক তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। (১) রাজবল্লভ : পদ্মায় ডুবে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। (১০) ইয়ার লতিফ খাঁ : যুদ্ধের পর হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ধারণা করা হয়, তাঁকে যুদ্ধের পর মেরে ফেলা হয়েছিল। (১১) মোহাম্মদী বেগ : সিরাজের হত্যাকারী মোহাম্মদী বেগ মাথা খারাপ অবস্থায় বিনা কারণে কুঁয়োতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। (১২) “মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় : দেশের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতার কারণে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে শাস্তি হিসাবে ব্রিটিশদের নির্দেশে নবাব মির কাশিম কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। দেশে তখন এত বিশ্বাসঘাতক ও বেইমান ছিল তা সত্ত্বেও মির জাফরকেই ‘হাইলাইট করা হয়েছে তীব্রভাবে। বিশ্বাসঘাতক আর মির জাফর এখন একটি সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে। এই নামে মুসলিম সন্তানের নাম পর্যন্ত রাখা হয় না। বাকিদের কথা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সত্যকে মটির তলায় চাপা দিয়ে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করতে ওস্তাদ ছিল ব্রিটিশরা। সেই একইরকম ওস্তাদ ব্রিটিশদের দেশীয় দালালরাও।
‘জগৎ শেঠ’ মাহতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলায় (ভারত) ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। ব্রিটিশরা কখনোই ভারতে ‘রাজা হয়ে বসতে পারত না, সেদিন যদি তাঁদের হাতে মিরজাফর-মানিকচাঁদ-উমিচাঁদ ‘জগৎশেঠ’-রায়দুর্লভদের মতো মহান ব্যক্তিরা নিজেদের সঁপে না-দিত, বাংলার সঙ্গে বেইমানি বা বিশ্বাসসঘাতকতা না-করত। আর বিশ্বাসঘাতকদের নাটের গুরু ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। কৃষ্ণচন্দ্র রায় ছিলেন একজন কূটবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি, কৌশলীও। নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লা যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, ঠিক তখনই রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ব্রিটিশদের সঙ্গে হাতে হাত মেলায়। তিনি ব্রিটিশদের প্রতি এতটাই আনুগত্য প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ‘কোম্পানি সরকার তাঁকে “মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। পলাশির যুদ্ধের আগে পর্যন্ত বাংলায় যে সাতজন হিন্দুরাজা ছিল, তাঁদের মধ্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকেই ইতিহাস মনে রেখেছে। তবে ব্রিটিশদের পক্ষে কেন যোগ দেওয়া উচিত, এটা তিনি বাকি ৬ জন হিন্দুরাজাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি তাঁদের বোঝাতে বা মনের ভিতর বিষ ঢোকাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তাঁদের হিন্দুধর্ম মুসলিম শাসকদের হাতে নিরাপদ নয়। বরং ব্রিটিশদের কাছে তাঁদের ধর্ম বেশি নিরাপদ। মির জাফরের তুলনায় ‘জগৎ শেঠ’-দের বিশ্বাসঘাতকতাও কোনো অংশেই কিছু কম ছিল না। শেঠজিদের বিশাল অর্থ সাহায্যেই ইংরেজদের এমন দুঃসাহসিক অভিযান এবং শাসনের গোড়াপত্তন। উমিচাঁদ, জগৎ শেঠদেরই ‘মাস্টার প্ল্যান’, লোভী মির জাফর ক্রীড়নকমাত্র। পিছন থেকে হিন্দুদের ‘শুভানুধ্যায়ী’র ছদ্মবেশে ক্লাইভরা কলকাঠি নাড়িয়েছে। শেঠজিরা শুধুমাত্র ইংরেজদের হাতে অর্থ দেননি, সিরাজের সৈন্যদের পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ সরবরাহ করে ভারতকে শৃঙ্খলবদ্ধ করেছে, ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। কিন্তু ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, বিশ্বাসঘাতকতার সব বিষ মির জাফরকে একা কণ্ঠে ধারণ করতে হল! একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে দেখা যায় মির জাফর বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল বাংলার নবাব সিরাজের সঙ্গে। জগৎ শেঠরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল গোটা দেশের সঙ্গে। তাই বলে লোভী মিরজাফরকে ধোয়া তুলসীপাতা বলা যায় না কিছুতেই। একজন সেনাপতি হয়ে তাঁর যে দেশ এবং নবাবকে রক্ষা করা কর্তব্য ছিল তিনি তা করেননি। এটা গহিত এবং ক্ষমাহীন অপরাধ। তাই বলে যে বা যাঁদের বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশরা ভারতের মাটিতে তূলাদণ্ডের পরিবর্তে রাজদণ্ড ধারণে সক্ষম হয়েছিল তাঁদের সকলেই নায়ক হয়ে যাবে, আর কেবল একজনই খলনায়ক হবে— এটা সত্যিই অবিচার ও পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। তবে বাকি বিশ্বাসঘাতকদের সময় ক্ষমা করেনি। যে ‘জগৎ শেঠ’ দুধকলা দিয়ে ব্রিটিশদের লালনপালন করেছিল, সেই জগৎ শেঠদ্বয়ের মৃত্যুও হয়েছিল অপঘাতে। শেষদিকে ব্রিটিশদের ভিক্ষা-সাহায্য নিয়ে শেষতম শেঠদেরকে জীবন ধারণ করতে হয়েছিল।
সিরাজের পতনের কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় –(১) বাংলার জমিদার প্রধান, ধনিক-বণিক ও বেনিয়া গোষ্ঠী দেশের পরাধীনতার বিনিময়ে হলেও মুসলিম শাসনের অবসানকল্পে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া। (২) ব্রিটিশরা প্রভাবশালী হিন্দুদের মনোভাব আন্দাজ করতে পেরে তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থ কায়েম করার জন্য হিন্দুদের পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারা।(৩) নবাবের সমস্ত দায়িত্বপূর্ণ পদে যাঁরা অধিষ্ঠিত ছিল তাঁরা প্রায় সকলেই ছিল হিন্দু এবং তাঁদের উপরই তাঁকে পুরাপুরি নির্ভর করতে হত। যাঁদের উপরে তিনি নির্ভর করতেন তাঁরাই তাঁর পতনের জন্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। (৪) পলাশির যুদ্ধকে যুদ্ধ বলা যায় না, এ ছিল যুদ্ধের নামে প্রহসন। ব্রিটিশ অপেক্ষা নবাবের সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক গুণ বেশি। নবাবের সৈন্যবাহিনী পূর্ণভাবে যুদ্ধ করলে ব্রিটিশসৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত এবং হয়তো ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। অথবা সিরাজ-উদ্-দৌল্লা যদি স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করতেন, তাহলেও তাঁকে পরাজয় বরণ করতে হত না হয়তো। (৫) যাঁদেরকে সিরাজ দেশপ্রেমিক ও তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করেছিলেন, তাঁরা যে দেশের স্বাধীনতা বিক্রয় করে তাঁদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করবে, একথা বুঝতে না-পারাটা তাঁর মারাত্মক ভুল।
বস্তুত পলাশির ময়দানে সিরাজ-উদ-দৌল্লার পরাজয়ই উন্মোচন করে দেয় ভারতের উপরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুত্বের। শুধু তাই নয়— এশিয়ার ইউরোপের কাছে, প্রাচ্যের প্রতীচ্যের কাছে। তারপর নিদেনপক্ষে ভারত উপমহাদেশের উপরে ব্রিটিশ আধিপত্য ও প্রভুত্ব চলেছিল ১৯০ বছর ধরে।
পলাশির রাজনৈতিক নাটকের পরিচালক কে বা কারা ছিল, বাংলা-বিহার তথা ভারত উপমহাদেশের গলায় ১৯০ বছরের জন্যে পরাধীনতার শৃঙ্খল কে বা কারা পরিয়ে দিয়েছেন, ইতিহাস তাদেরকে খুঁজে বের করতে ভোলেনি। অতীব ঘৃণিত ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, উৎকোচের মাধ্যমে মাথা বিক্রি এবং কাল্পনিক অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিশোধ গ্রহণের হিংস্র নীতি অবলম্বনে, যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র পরিচালনা না-করেই, ক্লাইভ ও তাঁর দল সিরাজ-উদ্-দৌল্লাকে পরাজিত ও নিহত করে এ দেশে তাঁদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় কৃতকার্য হয়েছিল। সিরাজ উদ্-দৌল্লার পতনের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে ইংরেজরা ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। ১৭৫৭ সালের পর যাঁদের বিজয় নিনাদ প্রায় ১৯০ বছর পর্যন্ত ভারত তথা এশিয়ার বিশাল ভূখণ্ডে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল এবং এ বিজয় লাভে সহায়ক শক্তি হিসাবে যাঁদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তাঁদেরই মনগড়া ইতিহাসে সিরাজ-উদ্ দৌল্লাকেই দায়ী করার চেষ্টা করা হয়েছে। এর ১০০ বছর পর বিরাট মোগল সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল। ভারতের বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন আধা-স্বাধীন শাসকরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। মারাঠাশক্তি উত্তর ও মধ্য ভারতকে গ্রাস করার পরিকল্পনা নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু আহমদ শাহ আবদালি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে (১৭৬১) তাঁদের শক্তি চূর্ণবিচূর্ণ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। বাদশাহ আকবর ভারতের দুর্ধর্ষ মুসলিম সামরিক শক্তির বিনাশ সাধন করেছিলেন। বিকল্প কোনো সামরিক শক্তি গঠিত হতে পারেনি। নৌ-শক্তি বলতে মুসলমানদের কিছুই ছিল না বললেও চলে। ব্রিটিশ বণিকরা এদেশে এসেছিল দ্বিবিধ উদ্দেশ্য নিয়ে। ব্যাবসাবাণিজ্যের নামে রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্গ নির্মাণ, নৌ-বহর স্থাপন, ইংল্যান্ড থেকে সৈন্যবাহিনীর সমাবেশ ঘটানো প্রভৃতির দ্বারা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। তাঁদের এ উদ্দেশ্য সাধনে সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছিল হিন্দু ধনিক-বণিক শ্রেণি।
বাংলায় মুর্শিদকুলি খাঁর সময় থেকেই সকল প্রশাসনক্ষেত্র থেকে মুসলমানদেরকে অপসারিত করে তথায় বাংলার হিন্দুদের জন্যে স্থান করে দেওয়া হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে তাঁর মাশুল দিতে হয়েছে কড়ায় গণ্ডায়। আলিবর্দির সময় থেকে তাঁরাই হয়ে পড়ে রাজ্যের সর্বেসর্বা। বাংলার মসনদ লাভ ছিল তাঁদেরই কৃপার উপরে একান্ত নির্ভরশীল। তাঁরাই ছিল বাংলার কিং মেকার।
সিরাজ-উদ-দৌল্লা নবাব আলিবর্দির স্থলাভিষিক্ত মনোনীত হওয়ার সময় জগৎ শেঠরা, মানিকচাঁদ, রায়দুর্লভরা প্রভৃতি এমন প্রভাবশালী এবং শক্তিশালী ছিল যে, তাঁদের বিরাগভাজন হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা সিরাজের পক্ষে ছিল অসম্ভব ব্যাপার। তাঁরা সিরাজকে কুপরামর্শ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরঞ্চ ভিতরে ভিতরে কোম্পানির সঙ্গে একাত্মতাই পোষণ করেছে। তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সিরাজের পতনের মাধ্যমে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে এদেশে ইংরেজ শাসন পত্তন হোক।
সে সময়কার প্রভাবশালী হিন্দুরা যদি দেশের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতার ভূমিকা পালন না-করত, তাহলে হয়তো বাংলার ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হত, ভারতের ইতিহাসও। মির জাফরের ভূমিকাও কম নিন্দনীয় নয়। কিন্তু পলাশি নাটকের সবচেয়ে ঘৃণিত ও অভিশপ্ত ব্যক্তি করা হয়েছে তাঁকে। মনে রাখতে হবে, কলকাতা ফোর্ট উইলিয়মের যুদ্ধে ব্রিটিশদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করার পর নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা কলকাতা শাসনের ভার অর্পণ করেন দেওয়ান মানিকচাঁদের উপর। এই ‘ছুপা রুস্তম’ মানিকচাঁদই ব্রিটিশদেরকে কলকাতা ও হুগলিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র পাকাঁপোক্ত হয় রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ ও জগৎশেঠদের পরামর্শে। এ কাজের জন্যে মির জাফর যে দোষী ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ হীন ষড়যন্ত্রে তাঁর অংশ কতটুকুই-বা ছিল? বড়োজোর এক আনা। সিংহাসনের লোভে ধান্ধাবাজদের প্ররোচনায় পা দেওয়া একজন সেনাপতির একেবারেই উচিত হয়নি। বোঝা উচিত ছিল তাঁকে কাঠের পুতুল হয়ে থাকতে হবে, নবাব তো নামকেওয়াস্তে –লোক দেখানো। দুর্ভাগ্যের এমনই পরিহাস, ইতিহাসে তাঁর চেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি আর কেউ নেই। তাই আজও সকল সময়ে বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তির নামের পূর্বে ‘মির জাফর’ শব্দটি বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়। শেঠরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল মাটির সাথে। বাংলা দখল করার জন্য জগৎ শেঠরা শুধু রবার্ট ক্লাইভকেই দিয়েছিল তখনকার দিনে ৪০ লক্ষ পাউন্ড, যার আজকের মূল্য ৪২ কোটি পাউন্ড বা ৪২০০ কোটি টাকা। স্পষ্ট করে বললে শেঠ গোষ্ঠী, উমি চাঁদরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল ব্রিটিশরা এদেশে আসার পর। নবাব হওয়ার স্বার্থে নয়, বাণিজ্যের স্বার্থে। আর মির জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা আরও অনেক আগে থেকে। মির জাফর ও ঘষেটি বেগম প্যারালালভাবে যাঁর যাঁর মতো করে ষড়যন্ত্র রচনা করছিল এবং সিরাজকে শেষ করে নবাব হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। সেই স্বপ্নপূরণ সহজ হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশদের সাহায্যে। সেই ক্ষেত্র পূর্বেই প্রস্তুত করে রেখেছিল মির জাফর। বণিক শ্রেণি বাংলা তথা দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মির জাফর বাংলার নবাব সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকা করেছে। নবাবের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশরাজ কায়েম হয়। ভারত পরাধীন হয়।
সিরাজ-উদ্-দৌল্লা বাংলা-বিহারের স্বাধীনতা বিদেশি শক্তির কাছে বিক্রি না-করার জন্যে মির জাফরসহ হিন্দু প্রধানদের কাছে যার যার আকুল আবেদন জানিয়েছিলে। কিন্তু তাঁর সকল নিবেদন আবেদন অরণ্যে রোদনে পরিণত হয়। বিশ্বাসঘাতকের দল তাঁদের বহুদিনের পুঞ্জিভূত আক্রোশের প্রতিশোধ গ্রহণ করে দেশের স্বাধীনতার বিনিময়ে। সিরাজ-উদ-দৌল্লাকে বাংলা-বিহার-ওড়িশা থেকে অপসারিত করে অন্য কাউকে বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত করা ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যে ছিল না। তাঁরা চেয়েছিল এদেশে তাঁদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। মির জাফর তাঁদের ক্রমবর্ধমান অন্যায় দাবি মিটাতে সক্ষম হয়নি বলে তাঁকেও অবশেষে সরতে হয়। অপরদিকে হিন্দু প্রধানদের কাছে একান্ত কামনার বস্তু ছিল মুসলিম শাসনের অবসান। তাঁর মানে এই নয় যে খুব হিন্দুপ্রীতি হল! হিন্দুদের মুসলিম-মুক্ত করতে তাঁরা, মানে হিন্দু রাজা-বণিকরা তাঁদের ঘুম নষ্ট করেছিল এটার ভাবার কোনো কারণ নেই। বস্তুত একশ্রেণির মানুষ মনে করেন মানিকচাঁদ-উমিচাঁদ জগৎশেঠরা এগিয়ে না এলে ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ না-করলে সিরাজের পরাজয় না-হলে ভারত ‘দার-উল ইসলাম’-এ পরিণত হত। প্রথমত বলি এই তত্ত্বটি সম্পূর্ণভাবে কষ্টকল্পনা, সুপরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তকর প্রচার। দ্বিতীয়ত একথা ভাবাই ভুল হবে যে, হিন্দু-বণিকরা হিন্দুজাতির মঙ্গলের জন্য সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত আর ব্রিটিশদের কোলে টেনে নিয়েছিলেন। মনের রাখতে হবে ব্রিটিশরা কিন্তু তখনও বণিক, শাসক নয়। অতএব সেয়ানে-সেয়ানে কোলাকুলি আর বণিকে-বণিকে আঁতাত। বণিকগোষ্ঠীগুলি বরাবরই ধান্ধাবাজ, মুনাফাখখার। বস্তুত এইসব বণিকেরা মুসলমান শাসকদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছিলেন না। অধিক মুনাফা করতে না পেরে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। মুসলমান শাসকদের নিকেশ না-করা পর্যন্ত তাই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। শাসক তো পুতুলমাত্র, শাসকদের সুতো বাঁধা থাকে বণিক-পুঁজিপতিদের হাতে। যেমন নাচাবে তেমনি নাচতে হবে। না নাচলে ছুঁড়ে ফেলে দেবে ডাস্টবিনে।
অবশেষে এসে গেল সেই সুবর্ণসুযোগটি। ব্রিটিশদের হাতের কাছে পেয়ে তাঁদের শক্তিসমষ্টিকে কাজে লাগিয়ে উদ্দেশ্যসাধন করেছিলেন। বণিকরা কখনোই সরাসরি বা প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেন না ঠিকই, কিন্তু পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ান তাঁরাই। দেশের বা রাজ্যের শাসনক্ষমতায় কে থাকবেন কে আসবেন সবেরই নিয়ন্ত্রক এই বণিকসমাজ। ব্রিটিশ কর্তৃক ১৯০ বছর ভারতে ছড়ি ঘোড়ানোর কৃতিত্বটাও কিন্তু এই বণিকসমাজের। লক্ষ করে দেখুন আজও বণিকরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। ক্ষমতার তাস বণিকদেরই হাতে। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে চুষে খেয়ে ছিবড়ে করে ২০১১ সালে তৃণমূল দলকে সরকারে এনেছে এই বণিকরাই। বাম আমলের সর্বশেষ চোষক-বণিক রতন টাটা। প্রভূত অন্যায় সুবিধা পেয়েছিল এই বণিক সম্প্রদায়। বিরোধী শক্তি হিসাবে তৃণমূল সুপ্রিমো টাটার বাড়া ভাতে ছাই দিলেন। বিচক্ষণ রতন টাটা বুঝতে পেরেছিলেন অন্য কোনো সরকার এ সুবিধা দেবে না। তাই রতন টাটা সরাসরি মাঠে নেমে বলেছিলেন– আমার শরীরে শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত সিঙ্গুরে ন্যানোর কারখানার করবই। বন্দুক দেখালেও বাংলা ছেড়ে যাব না। অনেকে ভেবেছিলেন, এটা রতন টাটার বাংলাপ্রেম। বাংলার উন্নয়নের জন্য রতন টাটা দিনরাত এক করে দিতে চায়, প্রাণপাত করতে চায়। পুরোটা যে নাটক ছিল তা বোঝা গেল শেষপর্যন্ত ন্যানো নিয়ে গুজরাটে চলে যাওয়ার পর এবং পরবর্তী সময়ে বাংলায় রতনের ভূমিকা। আবার কোনো একদিন কোনো এক বণিক সম্প্রদায়ের উত্থান হবে, সেদিন তৃণমূল সরকারকে চব্যচোষ্য খেয়ে অন্য কোনো দলকে ক্ষমতায় বসাবে। মুনাফা যেদিকে বণিকরা সেদিকে। বণিকরাই রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, বণিকদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের কোনো রাজনৈতিক দলের নেই। তাই বণিকদের খুশি করতেই সরকার সদাব্যস্ত থাকে। কারণ বণিকদের খুশি করতে পারলেই ক্ষমতা নিরঙ্কুশ থাকে। তাই রিলায়েন্সের ১ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা, বেদান্তের ১ লক্ষ ৩ কোটি টাকা, এসারের ১ লক্ষ ১ কোটি টাকা, আদানির ৯৬ হাজার ৩১ কোটি টাকা, জেইপির ৭৫ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা, জিন্দালের ৫৮ হাজার ১৭১ কোটি টাকা, ল্যানকোর ৪৭ হাজার ১০২ কোটি টাকা, জিএমআরের ৪৬ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা, ভিডিওকনের ৪৫ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা, জিভিকের ৩৩ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলিকে পরিশোধ না-করেও পার পাওয়া যায়। কিং ফিশারের মালিক মায় ধনকুবের বণিক বিজয় মালিয়া তো ব্যাংকের ৯০০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ভারত থেকে সোজা ব্রিটেনে চম্পট। এইসব জালিয়াত বণিকরা ব্রিটিশদের কোলেই আশ্রয় পায়। এরপরেও শাসকরা এইসব বণিকদের পাশেই থাকে। থাকতেই হবে।
২০২০ সালে মার্চ মাস থেকে গোটা বিশ্ব যখন করোনা-আক্রান্ত, লক ডাউনের ফলে যখন দেশের অর্থনীতির কোমর ভেঙে গেছে, যখন গরিব ক্ষুধার্ত মানুষদের কাছে খাবার পৌঁছোচ্ছে না, যখন অন্য রাজ্যে পড়ে থাকা কয়েক লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরানো যাচ্ছে না, যখন করোনা মোকাবিলা করতে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ন্যূনতম উন্নতি করা যায়নি– ঠিক সেই সময়ই কেন্দ্রের শাসক দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়া ঋণ খেলাপিদের ঋণ মকুব করে দিল। হিরে ব্যবসায়ী চোকসির ঋণ মকুব হয়েছে ৫৪৯২ কোটি টাকা, আরইআই অ্যাগ্রোর দুই ডিরেক্টর সঞ্জয় ও ঝুনঝুনওয়ালার ঋণ মকুব হল ৪৩১৪ কোটি টাকা, যোগগুরু রামদেব ও ‘বিজনেস পার্টনার’ আচার্য বালাকৃষ্ণের ঋণ মকুব হল ২২১২ কোটি টাকা, হিরে ব্যবসায়ী যতীন মেহতার ঋণ মকুব হল প্রায় ৪০৭৬ কোটি টাকা, কিংফিসারের বিজয় মালিয়ার ঋণ মকুব হল ১৯৪৩ কোটি টাকা। এইভাবে ঋণখেলাপিদের প্রায় ৬৮,০০০ কোটি টাকার ঋণ মকুব করে দেওয়া হল। ভারত করোনা মোকাবিলা করতে বিশ্ব ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ টাকা ঋণ নিয়েছে, তার ৮ গুণ বেশি পরিমাণ ঋণ মকুব করেছে ঋণখেলাপিদের। না, সাধারণ মানুষদের কোনো ঋণ ব্যাংক বা সরকার মকুব করেনি। শাসক ও বণিকদের গাঁটছড়া বহু প্রাচীন। জল বিনা যেমন মাছ বাঁচে না, ঠিক তেমনই শাসক ছাড়া বণিক বাঁচে না, বণিক ছাড়া শাসক বাঁচে না। অনুরূপ প্রাক-স্বাধীন ভারতের বণিকরা নিজের দেশের স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও মুসলিম শাসনের পরিবর্তে বিদেশি শাসনের শৃঙ্খল স্বেচ্ছায় গলায় ধারণ করতে ইতঃস্তত করেনি। ভারত মুসলিম শাসনমুক্ত হলেও ব্রিটিশের শাসনের শিকল স্বেচ্ছায় পরে নিল। বস্তুত মুসলিম শাসনকালে বণিকদের স্বার্থ যদি সুরক্ষিত থাকত এবং বণিকরা যদি চাইত তাহলে মুসলমানরা আরও পাঁচ হাজার বছর এই ভারতে রাজত্ব করত। বণিকরা চেয়েছিল বলেই ব্রিটিশরা আগে বাণিজ্য পরে ভারত শাসন করতে পেরেছিল, ১৯০ বছর। মুশকিল হল, মুসলমান শাসকরা যা করেনি ব্রিটিশরা তাইই করে বসল –যাঁর শিল যাঁর নোড়া তাঁরই দাঁতের গোড়া ভাঙতে শুরু করে দিল। ফলে দীর্ঘ ৮০০ বছরের মুসলমান শাসনে মানুষ বিদ্রোহ না-করলেও, ১৯০ বছরের ব্রিটিশ-শাসনে সশস্ত্র বিদ্রোহ চরম আকার নিল।
পলাশি যুদ্ধের পর মির জাফর প্রমুখ নামমাত্র নবাব থাকলেও সামরিক শক্তির নিয়স্তা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৭৬৫ সালের পর দেশের অর্থনীতিও সম্পূর্ণ তাঁদেরই নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে। ফলে বাংলার মুসলিম সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সর্বাপেক্ষা ও সর্বদিক দিয়ে। সিরাজ-উদ্-দৌল্লাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে উমিচাঁদ-মিরজাফরের সঙ্গে কোম্পানির যে ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার অর্থনৈতিক দাবি পূরণ করতে দিয়ে বাংলার রাজকোশ শূন্য হয়ে পড়ে। মির জাফরের ভুয়ো নবাব হিসাবে বাংলার মসনদে আরোহণ করার পর কোম্পানির দাবি উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। মিরজাফরও তাঁদেরকে প্রীত ও সন্তুষ্ট রাখতে বাধ্য হয়। রাজস্ব বিভাগ কোম্পানির পরিচালনাধীন হওয়ার পর কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার জন্যে হিন্দু ও ব্রিটিশ আদায়কারীগণ অতিমাত্রায় শোষণ নিষ্পেষণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করে কোম্পানির রাজকোশে পূর্ণ করতে থাকে। তখন থেকে ইংল্যান্ডের ব্যাংকে ও ব্যাবসা কেন্দ্রগুলিতে ভারতের সম্পদ স্থানান্তরিত হতে থাকে।
ব্রিটিশ আমলে বাংলার অর্থনীতি মানেই হল সুপরিকল্পিত শোষণের মর্মন্তুদ ইতিহাস। ঐতিহাসিকরা মোটামুটি হিসাব করে বলেছেন, ১৭৫৭ থেকে ১৭৮০ সাল পর্যন্ত মাত্র ২৩ বছরে বাংলা থেকে ইংলন্ডে চালান গেছে প্রায় ৩,৮০,০০০ পাউন্ড অর্থাৎ সমকালীন মূল্যের ৬০ কোটি টাকা। কিন্তু ১৯০০ সালের মূল্যমানের তিনশো কোটি টাকা (I.0 Miller, quoted by Misra, p.15)। মুর্শিদাবাদের খাজাঞ্চিখানা থেকে পাওয়া গেল ১৫,০০,০০০ পাউন্ডের টাকা, অবশ্য বহুমূল্য মণিমাণিক্য দিয়ে। ক্ষতিপূরণ হিসাবে ব্রিটিশ স্থলসেনা ও নৌসেনা পেল চার লক্ষ পাউন্ড, সিলেক্ট কমিটির ছয়জন সদস্য পেলেন নয় লক্ষ পাউন্ড, কাউন্সিল মেম্বাররা পেলেন প্রত্যেকে পঞ্চাশ থেকে আশি হাজার পাউন্ড এবং খোদ ক্লাইভ পেলেন ২,৩৪,০০০ পাউন্ড। তা ছাড়া ৩০ হাজার পাউন্ড বার্ষিক আয়ের জমিদারিসহ বাহশাহ প্রদত্ত উপাধি ‘সাবাত জং’। অবশ্য পলাশি বিজয়ী ক্লাইভের ভাষায় তিনি এত সংযম দেখিয়ে নিজেই আশ্চর্য। মিরকাশিম দিয়েছেন নগদ দুই লক্ষ পাউন্ড কাউন্সিলের সাহায্যের জন্যে। মিরজাফর নন্দন নিজামউদ্দৌলা দিয়েছেন ১,১৯,০০০ পাউন্ড। এছাড়া সাধারণ সৈনিক, কুঠিয়াল ইংরেজ কত লক্ষ মুদ্রা আত্মসাৎ করেছে, বলা দুঃসাধ্য। বিখ্যাত জরিপবিদ জেমস রেনেল ১৭৬৪ সালে ২২ বছর বয়সে বার্ষিক হাজার পাউন্ডে নিযুক্ত হন এবং ১৭৭৭ সালে বিলাত ফিরে যান ৩০ থেকে ৪০ হাজার পাউন্ড আত্মসাৎ করে।
সিরাজ হলেন সেই প্রথম ভারতীয়, যিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছেন, যাঁর প্রথম শহিদ হিসাবে সন্মান পাওয়ার কথা ছিল। উপরন্তু তিনি পেলেন মদ্যপ, চরিত্রহীনের তকমা। তিনি নাকি খুবই নিষ্ঠুর ছিলেন। নিষ্ঠুরতার প্রমাণ হিসাবে যে ঘটনাটি খাঁড়া করা হয়, সেটি হল অন্ধকূপ হত্যা। ২০০ জন ইংরেজকে ছোট্ট একটি অন্ধকার কক্ষে খাবার, জল ও বাতাসের অভাব ঘটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল বলে সিরাজের নামে অপবাদ দেওয়া হয়েছে। মিঃ কুক এবং হলওয়েলই এই অপবাদ প্রচার করেন। এই মিঃ হলওয়েলই মির জাফরকে সিংহাসনচ্যুত করে মিরকাশিমকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন এবং ৩,০৯,৩০০ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। মিথ্যাবাদী হলওয়েল কারণে-অকারণে প্রচুর মিথ্যা কথা বলতেন। জীবিত মানুষকেও মিথ্যায় মেরে ফেলতে পারতেন। ১৭৮৬ সালের জুন মাসে নওয়াজেস মহিষী ঘসেটি বেগম, সিরাজের মা আমিনা বেগম প্রমুখ সম্ভ্রান্ত মহিলাদের রাজকারাগারে মিরজার নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন বলে বিলেতের কর্তৃপক্ষকে এক পত্র লিখেছিলেন। হলওয়েল যখন এ কাহিনি রচনা করেছিলেন তখন সমস্ত রাজমহিলারা সশরীরে জীবিত ছিলেন। অপরদিকে সিরাজের কলকাতা আক্রমণের আগে কলকাতা দুর্গে ৬০ জন ইউরোপীয়ান ছিলেন। এই ৬০ জনের মধ্যে ১০জন বীরপুরুষ পালিয়ে গিয়েছিলেন। রইল বাকি ৫০ জন। সিরাজের হাতে মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ৫০ জনের, ২০০ নয়। ক্লাইভ কোর্ট অফ ডিরেক্টরকে যে পত্র লিখেছিলেন তাতে সিরাজকে কেন সিংহাসনচ্যুত করা হয়েছে তার বিবরণ আছে, কিন্তু অন্ধকূপ হত্যার কোনো কথাই সেখানে উল্লেখ নেই। সেই হলওয়েলের মনুমেন্ট, যা ১৯৪০ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভেঙে ফেলার দাবি করেন। অনেক অসন্তোষ সত্ত্বেও অবশেষে ব্রিটিশ রাজত্বের রাজধানী কলকাতার ওই মনুমেন্ট ব্রিটিশরাই ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয়। সখারাম গণেশ দেউস্কর তাঁর দেশের কথা গ্রন্থে লিখেছেন– “ইংরাজ ইতিহাস লেখকেরা হিন্দু ছাত্রদের হৃদয়ে মুসলমান বিদ্বেষ প্রজ্বলিত রাখার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেছেন, পরিতাপের বিষয় কোনো কোনো অদূরদর্শী হিন্দু লেখক কাব্যনাট্যকাদিতে অনর্থক মুসলমান ভ্রাতাদিগের নিন্দাবাদ করে ইংরজদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি বিষয়ে সহায়তা করতেছেন।” নিষ্ঠুরতার প্রসঙ্গে শ্রীসুধীরকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন –“সিরাজ অতিরিক্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি প্রায় নদীতে বন্যার সময় নৌকা থেকে আরোহী উলটায়ে দিয়ে বা ডুবিয়ে দিয়ে এক সঙ্গে দুই শত যুবক, যুবতী, স্ত্রী, বৃদ্ধ, শিশু সাঁতার না জেনে জলে নিমজ্জিত হওয়ার নিষ্ঠুর দৃশ্যটি উপভোগ করে আনন্দ লাভ করতেন।” আবার নবীনচন্দ্র সেন তাঁর কাব্যে বলেছেন ‘গর্ভিনীর বক্ষ বিদারণ ঘটনা। অর্থাৎ সিরাজ নাকি জীবন্ত গর্ভবতী নারীর পেট কেটে সন্তান দেখতেন। সত্যি কথা বলতে মাত্র এক বছর শাসনকালে সিরাজ এমন কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেননি, এমন কোনো ঘটনা ঘটাননি— যাতে করে সিরাজকে কলঙ্কিত করা যায়।
সিরাজ মদ্যপান করতেন এমন কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। গোলাম মুর্তাজা আহমেদ তাঁর ‘ইতিহাসের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন– “সিরাজ-উদ্-দৌল্লা অল্প বয়সে একবার মদ্যপানের কলঙ্কে কলঙ্কিত হয়েছিলেন। কিন্তু আলিবর্দি প্রাণপ্রিয় সিরাজকে ডেকে মদ আর কোনোদিন স্পর্শ না করার জন্য কোরান ছুঁয়ে শপথ করতে বলেন। তাতে সিরাজ বলেছিলেন, “নানা, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। সিরাজ জীবনে আর মদ স্পর্শ করবে না। যদি করি তাহলে আমি আপনাদের নাতি নামের কলঙ্ক। বলা বাহুল্য, সিরাজ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন সারা জীবনে।” সিরাজের বিরুদ্ধে নারীর প্রতি লোলুপতার যে মিথ্যা অপবাদটি আরোপ করা হল। তা ভিত্তিহীন, ব্রিটিশ ও তাঁদের সহায়কদের কৌশলমাত্র।
এবার দেখা যাক সিরাজের চরিত্র। সিরাজ নাকি লম্পট, দুশ্চরিত্র। আগেই বলেছি দুটি স্ত্রী— উমদাতুন্নেসা ও বেগম লুৎফুন্নেসা। উমদাতুন্নেসার সঙ্গে সিরাজের বিয়ে হয়েছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক বলতে যা বোঝায় তা কোনোদিনই গড়ে ওঠেনি উমদাতুন্নেসা আর সিরাজের মধ্যে। উমদাতুন্নেসা ছিলেন খুব লোভী মহিলা, সিরাজের ধনসম্পদের লোভ। এহেন বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেতে সিরাজ তাঁর মায়ের হিন্দু বাঁদি বা পরিচারিকা রাজকুনোয়ারের প্রেমে পড়েন এবং বিয়ে করেন। রাজকুনোয়ার বিয়ের পর লুৎফুন্নেসা। লুৎফুন্নেসার প্রেমে পাগল ছিলেন সিরাজ, মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত। লুৎফুন্নেসা বেগম সিরাজের প্রধান সহচরে পরিণত হন। পলাশি বিপর্যয়ের পর সিরাজ, স্ত্রী লুৎফুন্নেসা, তাঁদের একমাত্র কন্যা জোহরা এবং একজন অনুগত খোঁজাসহ ১৭৫৭ সালের ২৪ জুন রাতে নিভৃতে শহর ত্যাগ করেন। লুৎফুন্নেসার মৃত্যু হলে খুশবাগে সিরাজ-উদ্-দৌল্লার কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল। এই দুইজন নারী ছাড়া সিরাজের জীবনে আর কোনো নারীর কথা জানা যায় না। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিক হিরা নামের নারীর কথা বলে থাকেন, যাঁর সঙ্গে সিরাজ সম্পর্কে জড়িয়েছিল নবাব হওয়ার আগেই। তাঁরা বলেন, সিরাজের অপর স্ত্রী হিরা। হিরার নাকি সিরাজের ঔরসজাত একটি পুত্রও ছিল। পলাশির যুদ্ধের পর যখন সিরাজের সাম্রাজ্যের অবলুপ্তি ঘটে, সেই সময়ে নাকি সিরাজের এই পুত্র সন্তানের বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হয়নি মির জাফর এবং ইংরেজদের থেকে গোপন রাখার জন্য। নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লার অত্যন্ত বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন মোহনলাল। কাশ্মীরি হিন্দু কায়স্থ মোহনলালের বোন মাধবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সিরাজের। মাধবী মুর্শিদাবাদে হিরা নামেও পরিচিত ছিল। শোনা যায়, হিরা নামটা দিয়েছিলেন সিরাজ। তাঁর গর্ভেই জন্ম নেয় সিরাজের পুত্র সন্তান। তখনও পরমা সুন্দরী মাধবী ওরফে হিরার ধর্মান্তর হয়নি। একইসঙ্গে হিরাকে বিয়ের সময় নবাবের আসনে বসেননি সিরাজ। হিরার সঙ্গে সিরাজের সম্পর্কের বিষয়টি জানতেন না আলিবর্দি খাঁ। সিরাজের ধারণা ছিল এই বিয়ের বিষয়টি দাদু আলিবর্দি খাঁ জানতে পারলে ক্ষুব্ধ হবেন। আলিবর্দির ভয়ে সিরাজ নিজের পুত্রের প্রতি অত্যন্ত অমানবিক আচরণ করেন। যা খুবই অস্বাভাবিক ছিল। হিরার গর্ভে জন্মানো নিজের পুত্রকে সিরাজ একটি ঘোড়ায় বসিয়ে বেঁধে দিয়ে সেই ঘোড়াকে তীর বিদ্ধ করে ছুটিয়ে দেন। সিরাজের ধারণা ছিল, কেউ হয়তো জখম ছুটন্ত ঘোড়াকে ধরে তাঁর পুত্রকে রক্ষা করবে। ছুটন্ত ঘোড়ার খবর পেয়ে ভীত হিরা সমস্ত বিষয়টি দাদা মোহনলালকে জানান। তিনিই ছুটন্ত জখম ঘোড়াকে থামিয়ে উদ্ধার করেন সদ্য জন্মানো সিরাজ পুত্রকে। এই ঘটনায় সিরাজের উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে মোহনলাল তাঁর বোন হিরা এবং তাঁর পুত্রকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আলিবর্দি খাঁ মনে করতেন মোহনলাল মুর্শিদাবাদে না-থাকলে মারাত্মক ক্ষতি হবে আদরের নাতির। সেই কারণে তিনি মোহনলালের মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত শুনে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। সিরাজ-মোহনলাল বিরোধের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করেন এবং হিরার বিষয়টি জানতে পারেন। হিরা-সিরাজের সম্পর্কের কথা জানার পর সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হন আলিবর্দি খাঁ। মূলত ভিন্ন ধর্মের দুই ব্যক্তির বিয়ে নিয়েই সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এই বিষয়ে ইমামের সঙ্গে কথা বলেন আলিবর্দি খাঁ। ইমামের পরামর্শে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন হিরা ওরফে মাধবী। তাঁর নতুন নাম হয় আলেয়া। নবাবের প্রাসাদেই ইসলামিক রীতি মেনে আলেয়ার সঙ্গে বিয়ে হয়। শুধু আলেয়াই নয়, হিন্দু নারী লুৎফান্নেসার সঙ্গে সিরাজের বিয়েতেও আলিবর্দির প্রবল আপত্তি ছিল। সিরাজকে প্রাসাদের বাইরে ত্যাগ করেছিল। এ ঘটনাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজকে চরিত্রহীন বলা চলে? রাজা-নবাব-বাদশাদের তো একের অধিক স্ত্রী থাকতই। শুধু রাজা-নবাব-বাদশাই নয়, সাধারণ মানুষরাও একাধিক বিয়ে করত সেসময়। এই বিয়েকে কখনোই অন্যায় কর্ম মনে করত না তৎকালীন সমাজব্যবস্থা।
সিরাজের পতনের কারণ হিসাবে মির জাফরকে দায়ী করা হলেও আমি মনে করি সিরাজের পতনের কারণ সিরাজ নিজেই। শাসক হিসাবে তিনি নিঃসন্দেহে বিচক্ষণ ছিলেন না। বাইরে শত্রু দমনের পাশাপাশি ঘরের শত্রু দমন করতে ব্যর্থ। সিরাজের ভিতরে-বাইরে সর্বত্রই ঘূণ ধরে গিয়েছিল, যা চরম উদাসিনতায় সিরাজ কোনোদিনই বুঝে উঠতে পারেনি। উল্টোদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রস্তুতি ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে। তাঁরা অনেক বেশি সঙ্ঘবদ্ধ ও শক্তিশালী ছিল। মোহনলাল ছাড়া সিরাজের পাশে প্রায় কেউই ছিল। নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের যথোপযুক্ত নেওয়া উচিত ছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যার যোগ্য। কাছা-খোলা’ নবাব তা করে উঠতে পারেননি। ঘসেটি বেগম, মির জাফর, মিরন সব পরিবারের লোকজন। পরিবারের লোকজন ষড়যন্ত্র করলে বাকিরা তো ফায়দা তুলবেই। এমনিতেই তাঁর সভাসদদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক ছিল না। বণিকদের ক্ষেপিয়েছেন। তাছাড়া তাঁর জনগণকে খুশি রাখতে পারেননি। জনগণও তাঁদের অস্তিত্বের সংকট বুঝতে পারেনি। তাঁরাও সিরাজের পতন চেয়েছিল। সিরাজের পতন ইস্ট ইন্ডিয়ার কাছে না-হলেও অন্য কারোর কাছেও হতে হত। মির জাফর না-থাকলেও পতন হত।
যাই হোক সিরাজকে মদ্যপ, চরিত্রহীন, লম্পট অভিযোগে অভিযুক্ত করলেও তাঁর বিরুদ্ধে হিন্দুনিধন, হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা ও হিন্দুদের মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়ার কোনো অভিযোগ কেউ দায়ের করেননি। কেন দেয়নি এটা আমার কাছে বেশ রহস্যজনক। ব্রিটিশ শাসক ও ব্রিটিশ-প্রোষিত ঐতিহাসিকরা বোধহয় ভুলেই গিয়েছিলেন সিরাজের কাছে মার খাওয়ার কথা। বাংলার মুসলিম-বিদ্বেষীদের মুখেও সিরাজের বিরোধিতা করতে শুনিনি। ১০০ বছর পর, ১৮৮৫ সালে এসে ব্রিটিশদের মাথায় ঢুকল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভাজন ঘটাতে না-পারলে ভারতে শাসন ও শোষণ করা দুঃসাধ্য হয়ে যাবে। সিরাজ-উদ-দৌল্লাকে নিয়ে আলোচনা করতে করতেই মনে হল সে সময়কার বাংলার শাসনকর্তাদের সঙ্গেও একটু পরিচয় হওয়া দরকার। আমরা যদি ১৪০৯ সাল থেকে শুরু করি, তাহলে পেয়ে যাব গণেশ নামে এক শাসককে, হিন্দু রাজা।