০১. ইসলাম এবং মুসলিম : গোড়ার কথা
“কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে/কত মানুষের ধারা/দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে/ সমুদ্রে হল হারা।/হেথায় আর্য, হেথা অনার্য/হেথায় দ্রাবিড়, চীন–শিক-হুঁন-দল পাঠান মোগল/এক দেহে হল লীন।/পশ্চিম আজি খুলিয়াছে। দ্বার,/সেথা হতে সবে আনে উপহার,/দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে/যাবে না ফিরে,/এই ভারতের মহামানবের/সাগরতীরে।/…এসো হে আর্য, এসো অনার্য,/হিন্দু মুসলমান।/এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান।/এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মন/ধরো হাত সবাকার,/এসো হে পতিত করো অপনীত/সব অপমানভার।/মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা/মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা,/সবারে-পরশে-পবিত্র করা/তীর্থনীরে।/ আজি ভারতের মহামানবের/সাগরতীরে।”
ভারতে ইসলাম তথা মুসলিমদের ইতিহাস নিয়ে লিখতে বসে মহামানব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লিখিত উদ্ধৃতিটি উল্লেখ না-করে শুরু করতে পারছিলাম না। প্রায় ৮০০ বছরের ইতিহাস তো সোজা কথা নয়। ভারতবর্ষের পরতে পরতে মুসলিমদের সুকীর্তিতে যেমন উজ্জ্বল হয়ে আছে, কুকীর্তিতেও তেমন কালিমালিপ্ত হয়ে আছে। শাসকদের চরিত্র যেমন হয়! কোনোটাই অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। আর্য-অনার্য-হিন্দু-মুসলিম-শক-হুন-ইংরাজ খ্রিস্টান যখন এক দেহে লীন হয়, তখন সেই দেশে একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের ইতিহাস লেখা সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে সেই ধর্মাবলম্বীদের শাসনকাল যদি ৮০০ বছরের বেশি হয়।
সেই ভারতের মুসলিম শাসকদের ইতিহাসের সন্ধান তো করবই, তার আগে জানা প্রয়োজন ইসলামের মূল সুর। তারও আগে জেনে নেওয়া প্রয়োজন আরব জাতি ইতিহাস। যাই হোক, সেসময় তো আরব দেশে ইহুদি, খ্রিস্টধর্মের মতো অন্যান্য সুসংগঠিত ধর্মপ্রতিষ্ঠান তো ছিলই। তবে কেন ইসলাম ধর্মের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। আরববাসীদের? ‘জাজিরাতুল আরব’ শব্দযুগলের অর্থ হল আরব উপদ্বীপ। ভারত উপমহাদেশের পশ্চিমদিকে আরবসাগরের অপর প্রান্তে আরব দেশ। আরবের উত্তরে ইরাক, জর্ডন ও সিনাই উপদ্বীপ, পূর্বে পারস্য উপসাগর ও আরবসাগর, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর এবং পশ্চিমে লোহিত সাগর, সুয়েজ খাল ও সিনাই মরুভূমি। আরব’ শব্দটির অর্থই মরুভূমি। কাহতানের পুত্রসন্তান ইয়ারেবের নামানুসারেই এদেশের নাম হয়েছে আরব। নুহের এক পুত্রের নাম ছিল সাম। এই সামের নামানুসারে অনেকে আরবকে ‘সিমেটিক’ বলেও উল্লেখ করে। হজরত মোহাম্মদের সময় ‘আরব’ বলতে কেবলমাত্র অধুনা মক্কা, মদিনা প্রদেশ, সৌদি আরব বোঝা হত।
সেসময় আরব অধিবাসীদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একদল, যাঁরা এক স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, কৃষিকার্য ও ব্যাবসাবাণিজ্য করে জীবিকা অর্জন করে তাঁদের বলা হয় ‘মেদুইন’। অপরদল, যাঁদের কোনো স্থায়ী বাসস্থান নেই, তাঁবু খাঁটিয়ে জায়গা পরিবর্তন করে জীবনযাপন করে, পশুপালন, লুঠতরাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, তাঁদের ‘যাযাবর’ বা ‘বেদুইন’ বলা হয়। এঁরা যেমন অতিথিপরায়ণ ছিলেন, তেমনই সাহসী জাতি ছিলেন। কঠিন প্রাকৃতিক আবহাওয়া তাঁদের উগ্র নিষ্ঠুর করে তোলে।
প্রাচীনকালের আফ্রিকা মহাদেশ, ভারত উপমহাদেশের মতো আরবও ছিল অন্ধকারের যুগ। আরবের এই অন্ধকারময় যুগকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা ‘অজ্ঞতার যুগ’ও বলে। এই সময় আরববাসীরা গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে নানারকমের নোংরামি, ভণ্ডামি, অত্যাচার, ব্যাভিচার, হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, নিয়তই যুদ্ধ বিগ্রহ করে ব্যস্ত থাকত। এদের না-ছিল কোনো সামাজিক বন্ধন, না-ছিল কোনো শন্তিপূর্ণ স্থিতিশীলতা। বহুবিবাহ, মদ, জুয়া, দাবা ছিল ধনী মানুষের নিত্যসঙ্গী। দাসেদের জীবন ছিল আরও দুর্বিসহ। মেলায়, হাটে দাসী বিক্রি হত পশুর মতো। নগ্ন করে নারীদের দাসহাটে বিক্রি করা হত— নারীর ন্যূনতম মর্যাদা ছিল না। কোনো নারীকে স্ত্রী হিসাবে রাখার কয়েকদিন পর ছেঁড়া জুতোর মতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হত। পুরুষরা সৎ মা, পিসিমা, মাসিমা, ভাগ্নি, দুধ-মা, সহদোরা বোনের সঙ্গেও যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হত, তাঁদের বিয়েও করত। একজন পুরুষ যেমন অসংখ্য নারীকে বিয়ে করত, তেমনই একজন নারীও অসংখ্য পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করত। পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, আভিজাত্যের দম্ভ আরব চরিত্রকে কলুষিত করে তুলেছিল।
হজরত মোহাম্মদের সময়কালে আরবে কোনো কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। আরববাসীরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। রাত পোহালে গোত্রে গোত্রে লড়াই, ঝগড়া, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ লেগেই থাকত। আইন-অনুশাসন বলতে কিছু ছিল না। জোর যাঁর মুলুক তাঁর। সামান্য ছাগল-মুরগি নিয়েও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ লেগে যেত গোত্রে গোত্রে। নিজ গোত্রের ন্যায় অন্যায় কাজের প্রতি ছিল তাঁদের চরম আনুগত্য, কিন্তু অপরের সঙ্গে ছিল ব্যাপক বৈরিতা। এই সুযোগে বিদেশিরা আরব ভূখণ্ডে ঢুকে লুঠপাট ও ভূখণ্ডের কোনো কোনো অংশ দখল করে নিত। বিচার বলতে যা ছিল তা হল ‘রক্তের বদলে রক্ত’, ‘নখের বদলে নখ’, ‘দাঁতের বদলে দাঁত’, ‘চোখের বদলে চোখ’। বিচারালয়, কারাগার কিছুই ছিল না সেসময়।
প্রাচীন যুগে আরবের ধর্মীয় অবস্থাও ছিল খুবই করুণ, শোচনীয়। সেসময় আরববাসীদের বহু সংখ্যক মানুষ মূর্তিপূজক বা পৌত্তলিক ছিল। সকলেই যে যাঁর মতো পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করত। খ্রিস্টানরা জিশুখ্রিস্ট তথা ঈসাকে আল্লাহর পুত্র হিসাবে পুজো করত। ইহুদিরা উজাইর নবির পুজো করত। লাত, মানত, ওজ্জা, হোবল সহ ৩৬০ জন এমন দেবদেবীর সন্ধান পাওয়া গেছে। কাবার মধ্যে দেবদেবী রেখে জিলহজ মাসে বিভিন্ন দাবি দাওয়াকে কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে দিয়ে নারী-পুরুষ সকলে একত্রিত হয়ে এবং নগ্ন হয়ে চারদিক ঘুরে বেড়াত। সেসময় আরবের সকলেই প্রায় অশিক্ষিত ছিল। কথিত আছে, মক্কায় সেসময় মাত্র ১৭ জন মানুষ লেখাপড়া জানত। মদিনা থেকে কয়েক মাইল দূরে নাখলা ও তায়েফের মধ্যস্থলে ওকাজ নামে এক জায়গায় প্রতি বছর জিলকিদ মাসে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ মেলা অনুষ্ঠিত হত। সেই মেলায় ঘোড়দৌড়, তিরন্দাজি, জুয়া, মদ্যপানের প্রতিযোগিতা হত। এইসব প্রতিযোগিতার হারজিতকে কেন্দ্র করে আরববাসীরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণও হতেন। এই যুদ্ধ চলতে থাকত বছরকে বছর।
আরবের শ্রেষ্ঠ বংশ কোয়ারেশ। কোয়ারেশের অর্থ বণিক। হজরত মোহাম্মদ এই কোয়ারেশ বংশেই জন্মগ্রহণ করেছেন। কাহতান ও ইসলামীয় বংশ থেকে কোয়ারেশের বংশের উৎপত্তি। হজরত মোহাম্মদ যে ধর্মপ্রচার করেন তার নামই ইসলাম। ইসলাম মানে আত্মসমর্পণ (মতান্তরে শান্তি), আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ। যাঁরা আল্লাহকে একমাত্র মেনে ধর্মপালন করেন তাঁরাই মুসলিম। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন নবি মোহাম্মদের জীবন ছিল সর্বকালের পরিপূর্ণতাপ্রাপ্ত, নিখুঁত, অভ্রান্ত, পাপ বিবর্জিত। ইনসান-ই-কামাল, আল্লাহ নিজেই তাঁকে পরিশুদ্ধ করেছেন। মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থের নাম কোরান। মুসলিমরা বিশ্বাস করেন কোরান আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া ওহির সংকলন, যা শুধুমাত্র মোহাম্মদের পক্ষেই ধারণ করা সম্ভব। ওহির প্রতিটি অক্ষর পর্যন্ত আল্লাহর নিজের সৃষ্টি (কোরানের সৃষ্টি প্রসঙ্গে আমি আমার নাস্তিকের ধর্মকথা গ্রন্থে বিস্তারিত লিখেছি। সে বিষয়ে এখানে আলোচনা করার অবকাশ নেই। আগ্রহীরা পড়ে নিতে পারেন)। কোরানের কোনো কিছু পরিবর্তনের অধিকার ও ক্ষমতা আল্লাহ কোনো বান্দাকে দেননি বলে সাধারণ মুসলিমরা বিশ্বাস করেন। যদিও বিশ্বাস আর বাস্তব এক নয়, তবুও চর্বিতচর্বন চলতেই থাকে। মূলত আরবি ভাষায় কোরান লিখিত হয়েছে। আরবি ভাষা আরবভূমির সব মানুষের মুখের ভাষা। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর ইসলামের উপর আরবের সর্বময় কর্তৃত্বের যাতে অবসান না-হয়, সেজন্য কোরানের অনুবাদককে স্বীকৃতি দিতে ইসলামি আলেমদের বেশ আপত্তি।
যাই হোক, হজরত মোহাম্মদ ছিলেন অকুতোভয় যোদ্ধা। মাত্র ২০ বছর বয়সে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ফুজ্জারের যুদ্ধে মোহাম্মদ স্বয়ং যোগদান করে দীর্ঘ ৫ বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যান। এরপর হেরা গুহায় নবুওত তথা আল্লাহর আদেশ পাওয়ার পর তাঁর নবি হওয়ার কথা শুনে প্রথমেই তাঁর হাতে হাত দিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন খাদিজা। খাদিজা মোহম্মদের প্রথমা স্ত্রী, ইনিই বিশ্বের প্রথম মুসলমান। মোহম্মদের সুখ্যাতি (!) যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন খাদিজা (খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ) মোহাম্মদকে নিজের ব্যাবসার জন্য সফরে যাওয়ার অনুরোধ জানান। এক পর্যায়ে তিনি মোহাম্মদকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন খাদিজা। বিয়ের সময় খাদিজার বয়স ছিল ৪০ আর মোহাম্মদের বয়স ছিল ২৫। খাদিজার জীবদ্দশায় তিনি আর কোনো বিয়ে করেননি (তবে অন্য এক সূত্রে জানা যায় খাদিজারও একাধিক বিয়ে ছিল মোহম্মদকে বিয়ে করার আগে )। খাদিজার গর্ভে মোহাম্মদের ছয় জন সন্তান জন্মগ্রহণ করে, যার মধ্যে চার জন মেয়ে এবং দুই জন ছেলে। তাঁদের নাম যথাক্রমে কাসিম, জয়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতিমা এবং আবদুল্লাহ। ছেলে সন্তান দুজনই শৈশবে মারা যায়। এরপর “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহহা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই) মোহাম্মদ তাঁর রসুল একথা বলে মুসলিম হন মাত্র ১০ বছরের শিশু মোহাম্মদের খুড়তুতো ভাই তালেবের ছেলে আলি ইত্যাদি। এইভাবে এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন, তিন থেকে চার, চার থেকে পাঁচ, পাঁচ থেকে ছয়, ছয় থেকে ১৬০ কোটি মুসলমান সারা বিশ্বে।
ইসলাম একটি একেশ্বরবাদী, আব্রাহামিক এবং সেমেটিক ধর্ম। কোরান, হাদিস এবং অন্যান্য কিছু ইসলামি গ্রন্থই মুসলিম সম্প্রদায়ের সব কিছু। মুসলিমরা কোরান দ্বারা পরিচালিত— যা এমন এক কিতাব বা গ্রন্থ, যা হবহু আল্লাহর বাণী এবং ইসলামের প্রধান নবি মোহাম্মদের প্রদত্ত শিক্ষা পদ্ধতি, জীবনাদর্শও এর ভিত্তি বলে মনে করেন মুসলিমরা। মুসলিমরা মনে করেন কোরান একটি সম্পূর্ণ জীবনবিধান। তাঁরা কেন সম্পূর্ণ জীবনবিধান বলেন কোরানকে আমার তেমন কিছু বোধগম্য হয় না। হয়তো আমি অ-মুসলিম বলেই বোধগম্য হয় না। তবে আমি বুঝি। সম্পূর্ণ জীবনবিধান বললে তো কোরানের আয়াতগুলিকেই শেষ সিদ্ধান্ত বলে মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে হয় পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘোরে। মেনে নিতে হয় অ-মুসলিম যেখানেই পাওয়া যাবে খুঁজে সেখানেই হত্যা করতে হবে। কোরান-পরবর্তী ১৫০০ বছরের মধ্যবর্তী যা কিছু পরিবর্তন, সভ্যতার বিকাশ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উপযোগিতা, যুগোপযোগী রাষ্ট্রীয় আইনকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কোরানের পথে থাকতে হয়। কোরানে যা উল্লেখ নেই তা কেন মুসলিমরা খাবে, পরবে, ব্যবহার করবে, সুবিধা নেবে? সেটা কি বাস্তবে সম্ভব? ইমাম, হাফিজ, মুমিন, হুজুর কারোর পক্ষেই কোরানের প্রতিটি আয়াত মেনে চলা সম্ভব নয়, সাধারণ মুসলিম তো দূরের কথা। হয়তো মুসলিমরা একথা বলে বোঝাতে চায় যে, কোরানকে বাদ দিলে ইসলাম নেই, ইসলাম না-থাকলে মুসলিমদের কোনো অস্তিত্ব নেই। মুসলমান মানেই আল্লাহ প্রেরিত কোরানের দাস, বান্দা।
এ প্রসঙ্গে আরও কয়েকটা জরুরি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। ইসলাম শুরু থেকেই তার অনুগামীদের মধ্যে এটা বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে যে, তাঁরা কেবল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যই নয়, তাঁরা একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীরও অংশ। কোরান, হাদিসগুলি খুব গভীরভাবে পাঠ করলেই তা অনুধাবন করেন। নির্দেশনার একটা বড়ো অংশই রাজনৈতিক। হজরত মোহম্মদ এর জন্য প্রশংসার যোগ্য, তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি যেমনভাবে একটি জাতিকে এক ছাতার তলার আটকে ফেলতে চরমভাবে সফল হয়েছেন, তেমনভাবে পরবর্তীকালে আর কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী পারেনি। বস্তুত আমি রাজনৈতিক গোষ্ঠী আর ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে কোনো মূলগত পার্থক্য কিছু দেখি না। মুদ্রার এপিঠ আর ও-পিঠ। ধর্মান্তর হওয়া আর রাজনৈতিক দল বদল করা একইরকমভাবে হয়। ধর্মে যেমন পরিবর্তিত ধর্মের অনুশাসন মেনে চলতে হয়, ঠিক তেমনি পরিবর্তিত রাজনৈতিক দলেরও অনুশাসন মেনে চলতে হয়। মুখে যাইই বলুক, ধর্মের ক্ষেত্রে নতুন ধর্মে এসে পুরোনো ধর্মের কথা ভুলতে পারে না, ঠিক তেমনি রাজনীতির ক্ষেত্রেও– নতুন দলে এসেও পুরোনো দলের কথা ভুলতে পারে না। ধর্মীয় অনুসরণকারীরা আগ্রাসী, পৃথিবীর সবাইকে নিজের ধর্মে সেঁধিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। তার জন্য যা যা করা সম্ভব তাই-ই করে। খুনোখুনি, রক্তারক্তি ইত্যাদি। রাজনৈতিক দলগুলিও তেমনি আগ্রাসী, সব রাজনৈতিক দলগুলিকে বিলুপ্ত করে নিজের দলে সেঁধিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। তার যা যা করণীয় রাজনৈতিক দলগুলি সব করে। খুনোখুনি, রক্তারক্তি করে। দলত্যাগ আর ধর্মত্যাগ উভয়ই এমন চলে। ইসলামের ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ সুরক্ষা কবচ আছে। ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করা যাবে না। ইসলাম ধর্মত্যাগীদের ‘মুরতাদ’ বলা হয়। ইসলাম ধর্মত্যাগী মুরতাদদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। ইসলামের এই বিধান এতটাই কঠোর যে, ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্মে চলে যাওয়াই নয়– ইসলামে থেকে আল্লাহকে গালি দিলে, মোহাম্মদকে গালি দিলে, কর্মের মাধ্যমে, ইসলামের অনুশাসনকে বর্জন করার মাধ্যমে, কোনো নোংরা জায়গায় কোরানকে নিক্ষেপ করলে, আল্লাহর বাণীকে অবমূল্যায়ন করলে, আল্লাহকে বিশ্বাস না-করলে, কোনো প্রতিমা বা সূর্য বা চন্দ্রকে সিজদাকারীদেরও মুরতাদ বলা হয়। সহিহ বুখারি ২৭৯৪ নম্বরে বলা হয়েছে– “যে ব্যক্তি ধর্ম ত্যাগ করে তাকে হত্যা করো”। সেই কারণেই ইসলাম ধর্মে ধর্মত্যাগের ঘটনা বিরল। সেই কারণে অন্য ধর্মে অনুসরণকারীরা সংখ্যায় কমলেও, ইসলাম অনুসরণকারীদের সংখ্যা বাড়ে।
শুধু ইসলাম নয়, পৃথিবীর সব ধর্মীয় অনুশাসনই রাজনৈতিকভাবে প্রয়োগ হয়েছে। রাজনৈতিক (শোষণ ও শাসন) প্রয়োজনেই ধর্মীয় অনুশাসনের সৃষ্টি। প্রাচীন যুগে ধর্মীয় নীতিই রাষ্ট্রনীতি। যেদিন থেকে সুসংঘবদ্ধ পৃথক রাষ্ট্রনীতি রচিত হল সারা বিশ্বজুড়ে, সেদিন থেকে ধর্মীয় অনুশাসন বা নীতির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেল। বর্তমানে রাষ্ট্রনীতি বা রাষ্ট্রীয় অনুশাসনই সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর। ঐশী কর্তৃক ধর্মগ্রন্থ আর রচিত হয় না। কারণ ঐশী কর্তৃক রচিত ধর্মীয় অনুশাসন একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, অন্য সম্প্রদায়ের জন্য নয়। রাষ্ট্রীয় অনুশাসন কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের জন্য নয়, সকল সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর জন্য। তাই কিছু ক্ষেত্র ছাড়া পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রীয় অনুশাসনই প্রায় এক। ধর্মীয় অনুশাসনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ‘ড্র ব্যাক’ হল একটি নিদিষ্টি অঞ্চলের কথা মাথায় রেখে রচিত হলেও সারা দেশে তা প্রয়োগ করতে চায়— জলবায়ু, আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস, সম্পদ, খ্যাদাভ্যাস, অন্যের ভাবাবেগকে তোতায়াক্কা না-করে। আর এখান থেকেই শুরু হয় বিভ্রান্তি, গোলযোগ, অশান্তি, বিদ্বেষ, বিভাজন ইত্যাদি। পৃথিবীর সর্বশেষ ধর্মীয় অনুশাসন ইসলাম। সেই ইসলাম, যা রাজনৈতিক কারণে রচিত হয়েছিল, আজ তা শুধুই আধ্যাত্মিকভাবেই টিকে আছে।
মোহাম্মদ শুধু একটি বিশেষ ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রচারক ছিলেন না, তিনি একই সঙ্গে ইসলাম অনুসারীদের রাজনৈতিক শীর্ষ ব্যক্তিত্ব। তাঁর ইসলামি চিন্তায় ‘ধর্ম’ আর ‘রাজনীতি’র মধ্যে কোনো দূরত্ব রাখেননি। বরং বলা যায়, ইসলামে ধর্ম ও রাজনীতি পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক, সম্পৃত্ত। ইসলামের অনুসারী মানুষদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও তাঁর ধর্মীয় দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবেই একজন ইসলাম অনুসারী ব্যক্তি কাজ করে। পশ্চিমী আদর্শ যাই-ই বলুক না কেন, মানুষের রাজনৈতিক আচরণের উপর তাঁর ধর্মীয় আনুগত্যের প্রভাব পড়ে।
ভারতের মুসলিম প্রসঙ্গে ইসলাম নিয়ে আলোচনা যখন করতেই হবে, তখন কোরান ও হাদিস সম্পর্কে না-জানলে, জানাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, একথা বলাই বাহুল্য। আসুন, কোরান দিয়েই শুরু করি। কারণ কোরান মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে কলিজা। মুসলিমদের বিশ্বাস কোরান সাধারণ কোনো কিতাব নয়, এটি একটি অলৌকিক ও ঐশী গ্রন্থ, যা দুষ্পরিবর্তনীয়। কোরান কি সত্যিই অলৌকিক গ্রন্থ? সত্যি না মিথ্যা, সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব কোরান গ্রন্থ থেকেই। যেহেতু এ লেখাটি একজন কোরানের অলৌকিকতায় অবিশ্বাসীর (যদিও এই গোটা বইটি প্রচলিত ও জনশ্রুত ইতিহাসের অবিশ্বাস থেকেই রচিত হচ্ছে, তাই অবিশ্বাসটা এক্ষেত্রেও) দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছে তাই আপনার যদি কোরান-বিরোধী লেখা সহ্য না-হয়, তবে অবশ্যই তা নিজ দায়িত্বে পড়বেন। পরবর্তীতে কোনো অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। সব বিষয় সকলের জন্য নয়। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি লেখাটায় এমন কোনো বাক্য ব্যবহার না করতে, যা কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়। সেটা আমার উদ্দেশ্যও নয়। আমি মনে করি কোনো ধর্মই কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। কারোর যেমন অধিকার আছে একে চরম বিশ্বাস করার, ইচ্ছেমতো ধর্ম-মাহাত্মের প্রচার করার, তেমনি অন্যজনেও অধিকার আছে এটার খণ্ডন করার।
মুসলিমরা বিশ্বাস করেন, কোরান একটি স্বয়ং আল্লাহ নবি মোহাম্মদের কাছে বিভিন্ন পদ্ধতিতে নাজিল করেছেন। প্রায় সকল মুসলমানই বিশ্বাস করেন যে, কোরান অবতরণের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো বিকৃতি ঘটেনি এবং তা লওহে মাহফুজে যেমন রয়েছে, ঠিক সেই অবস্থায় বর্তমানে রয়েছে –এসব বিশ্বাসের সমর্থনে নাকি কোরানে অজস্র আয়াত জ্বলজ্বল করছে। কোরানের অলৌকিকতা প্রমাণের দায়িত্ব কার? এই দেখুন Dr. Carl Sagan কী বলছেন –“Extraordinary claims require extraordinary evidence” ধরা যাক, ইমতিয়াজ আলির কাছে এক হাজারটি বই আছে। এবার তিনি এর মধ্য থেকে একটি বই বের করে দাবি করলেন –“এই বইটি আল্লাহ দ্বারা রচিত, আর বাদবাকি নয়শত নিরানব্বইটি মানুষের দ্বারা রচিত”। আপনি বিশ্বাসী, তাই আপনি ইমতিয়াজকে না-ই প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্ত কেউই কোনো প্রশ্ন করবে না, তা তো হয় না। একজন সংশয়বাদী অবশ্যই প্রশ্ন করবে। প্রথমেই ইমতিয়াজের কাছ থেকে জানতে চাইবেন, তিনি কীভাবে ওটা আল্লাহ প্রদত্ত বলে নিঃসংশয় হলেন? এমন প্রশ্ন করলেই পাঁচজন মুসলিমদের মতো ইমতিয়াজও উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবেন –“আপনিই বরং প্রমাণ করুন, ওটা আল্লাহ রচিত নয়”। সংশয়বাদীরা যেহেতু ঈশ্বর-দেবতা-ভগবান-আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, ধর্মে বিশ্বাস করে না– তাই সংশয়বাদীকেই এগুলো অপ্রমাণ করতে হবে। কিন্তু যা প্রমাণ করা যায়নি, তা তো এমনিতেই অগ্রহণযোগ্য, একে কি আলাদাভাবে অপ্রমাণ করা কোন্ প্রয়োজনে? যদি কেউ অলৌকিক বলে দাবি করেন এবং এর স্বপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ দেখাতে পারেন, তাহলে একে অলৌকিক বলে মেনে নিতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অনুরূপ কেউ যদি কোনো গ্রন্থের অলৌকিকতার দাবি করেন, তবে স্বভাবতই তা প্রমাণ করার দায়িত্ব সেই দাবিকারকের। প্রথমেই সেটা যে অলৌকিক নয়, এ ব্যাপারটা প্রমাণের দায়িত্ব অন্য কারও উপরে পড়ে না।
আলোকপাত করার আগে আমার অকপটে স্বীকারোক্তি –আমি আরবি ভাষা পড়তে পারি না, লিখতে পারি না। কোরানের যা কিছু তথ্য সবই বাংলা অনুবাদ থেকে সংগ্রহ করেছি। একটা নয়, কমপক্ষে ভিন্ন অনুবাদকের পাঁচটি বাংলা অনুবাদ থেকে সহায়তা নিয়েছি। এর মধ্যে বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বাংলা অনুবাদও আছে। তাই ভিন্নতার কোনো সুযোগ নেই। কোরান মূলত মক্কাবাসী এবং আশেপাশের বাসিন্দাদের জন্যই রচিত হয়েছিল। গোড়াতে তো প্রায় ভাবা অসম্ভব ছিল যে, ইসলাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে! সেই কারণেই কোরান আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে আরবিভাষীদের কথা মাথায় রেখে। কোরান যদি ভারতে নাজিল হত, তাহলে নিশ্চয়ই আরবিতে হত না। হয়তো সংস্কৃত ভাষাতেই হত। সংস্কৃত যেমন দেবতার ভাষা বা দেবভাষা নয়, আরবিও তেমন আল্লাহর ভাষা নয়। পড়ন, কোরান কী বলছে –“এভাবে আমি তোমার প্রতি আরবি ভাষায় কোরান অহী করেছি; (১) যাতে তুমি সতর্ক করতে পার মক্কাবাসীদের এবং ওর আশেপাশের বাসিন্দাকে, (২) আর সতর্ক করতে পার জমায়েত হওয়ার দিন (কিয়ামত) সম্পর্কে, যাতে কোনো সন্দেহ নেই; (৩) সেদিন একদল জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং একদল প্রবেশ করবে জাহান্নামে (৪)।” এই আশেপাশে বলতে নিশ্চয় সারা পৃথিবী বোঝায় না। তাহলে কোরানও সমগ্র মানবজাতিরও নয়।
যাই হোক, কোরান অলৌকিক কি না, সে বিষয়ে একটু দেখা যাক। বই লিখবে মানুষ, ছবি আঁকবে মানুষ, গান গাইবে মানুষ, নাচবে মানুষ, প্রযুক্তি বানাবে মানুষ— এটাই স্বাভাবিক। মানুষ ছাড়া এ পৃথিবীতে বা পৃথিবীর বাইরে অন্য কোথাও কেউই এসব করতে পারে না। শুধু ধর্মগ্রন্থই ঈশ্বর বা আল্লাহ সৃষ্টি করে থাকেন। যদি তাইই হত, যে ধর্মগ্রন্থ নিয়ে এত সমালোচনা, এত নিন্দা, এত অশান্তি, এত অবিশ্বাস– সেই ধর্মগ্রন্থকে সময়ের সঙ্গে উপযোগী করে আরও একটি প্রশ্নমুক্ত সংশোধিত অলৌকিক গ্রন্থ আকাশ থেকে ফেলতেন পরমকরুণাময় আল্লাহ বা ঈশ্বর। কোরানের মধ্য দিয়ে আল্লাহ যা চেয়েছিল, তাতেও আল্লাহ ডাহা ফেল। অন্য সমস্ত ধর্মকে বাতিল ও প্রতিস্থাপন করার জন্য ইসলাম ধর্ম প্রেরণ করেছেন, এ দাবি করে ‘আল্লাহ’ কোরানে বলেছেন –“তিনি (আল্লাহ) তাঁর প্রেরিত নবিকে (মোহম্মদ) পথনির্দেশ ও (একমাত্র) সত্য ধর্ম সহ প্রেরণ করেছেন, যাতে অন্য সকল ধর্মের উপর তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।” (কোরান ৪৮ : ২৮) পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ২০১৮ সালের জনগণনা অনুসারে ৭.৬৩২,৮১৯,৩২৫ কোটি, এর মধ্যে ইসলাম অনুসারি মাত্র ১,৫৯৮,৫১০,০০০। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ২৩%। অর্থাৎ দীর্ঘ ১৫০০ বছর পরেও আল্লাহর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়নি, এখনও ৭৭% মানুষ ইসলামের বাইরে থেকে গেছে, থাকবেও। আর জনসংখ্যার দিক দিয়ে খ্রিস্টানরা রয়ে গেল সবার উপরে। ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্যে কোরান কী বলেছে একটু দেখে নিতে পারি। ইসলাম দাবি করে যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইহুদিরা তাঁদের ধর্মশাস্ত্রকে বিকৃত ও পরিবর্তিত করেছে (কোরান ২ : ৫৯)। সুতরাং এটা বাতিল ও পরিত্যাজ্য। এ ব্যাপারে খ্রিস্ট ধর্মশাস্ত্র কিছুটা ভালো মূল্যায়ন পেয়েছে– এটা এখনও বৈধ, যদিও ইসলামের চেয়ে হীনতর। খ্রিস্টানরা তাঁদের মূল ধর্মগ্রন্থের কিছু অংশ ভুলে গেছে (কোরান ৫ : ১৪) এবং এর উপদেশ তাঁরা ভুল বুঝেছে। যেমন তাঁরা ভ্রান্তভাবে জিশুকে ঈশ্বরের পুত্র বলে মনে করেন (কোরান ৫ : ৭২, ১১২ : ২, ১৯ : ৩৪-৩৫, ৪: ১৭১)। কোরান ঘোষণা দিয়েছে– “খ্রিস্টানরা ভুলবশত জিশুকে তিন ঈশ্বরের একজন বলে গণ্য করে (কোরান ৫ : ৭৩, ৪ : ১৭১)। খ্রিস্টানরা যদিও-বা ভুলভাবে ধর্মচর্চা করে, তবুও আল্লাহ তাঁদের ধর্মকে বাতিল করেননি। তবে আশা করেছেন যে, ইসলামের দ্বারা পরিণামে তা বাতিল হয়ে যাবে (কোরান ৪৮ : ২৮)। আল্লাহ সর্বজ্ঞ নন, তাই তিনি ইহুদি আর খ্রিস্টান ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের কথা জানতেন না। তাই অন্য কোনো ধর্মের কথা কোরানে কোথাও উল্লেখ নেই। ইহুদি আর খ্রিস্টান ধর্মের কথা জানার কারণ আরব ও তাঁর আশেপাশে ইহুদি আর খ্রিস্টানদেরই আধিপত্য ছিল। কোরানে মক্কা, মদিনা পাশ্ববর্তী অঞ্চলগুলি ছাড়া আর কোনো দেশের কথা জানা যায় না, কারণ আল্লাহ সর্বজ্ঞ নন। এমনকি কোরানে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী প্রাণী ছাড়া অন্য কোনো ভূখণ্ডের প্রাণীর কথা জানা যায় না, কারণ আল্লাহ সর্বজ্ঞ নন। আল্লাহ সত্য হলে মোহাম্মদ মিথ্যা হবে, মোহম্মদ সত্য হলে আল্লাহ মিথ্যা হয়ে যাবে। তাই উভয়ই সত্য। এ যে শাঁখের করাত।
যে ধর্মগ্রন্থ পূর্ণাঙ্গই নয়, সেই ধর্মগ্রন্থ পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হয় কী করে? পূর্ণতা কোথায়? অপূর্ণতাই তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। মানুষ দ্বারা রচিত বলেই এই জুটিটা লক্ষণীয়। কোরান যদি আল্লাহর বাণীই হত, তাহলে তা অবশ্যই যুগোপযোগী হত। ১৫০০ বছর আগে থমকে থাকত না। তাহলে কোরান একটি মৌলিক কিতাব হত। খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মের সঙ্গে এত মিল থাকত না। যে আল্লাহ মাত্র সাতদিনে গোটা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করতে সক্ষম, সেই কোরান সম্পূর্ণ হাজির করতে আল্লাহর দীর্ঘ ২৩ বছর লাগল কেন, এই প্রশ্নটাও মাথায় আসা উচিত, তাই নয় কী? দীর্ঘ সময় লাগে মানুষের। কারণ মানুষ ম্যাজিক জানে না, লজিক জানে। তাই একটা অপরূপ সুন্দর তাজমহল গড়তে ২২ বছর লেগেছিল। কারণ মানুষের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে। মানুষের সেই সীমাবদ্ধতা কোরানের ছত্রে ছত্রে বিদ্যমান। কোরান নাকি পুরো ২৩ বছরে মোহাম্মদের উপর অবতীর্ণ (?) হয়েছে। কীভাবে অবতীর্ণ হয়েছে, তার বিচিত্র বিবরণ রয়েছে ইসলামে। এগুলি এতই উদ্ভট যে, একজন যুক্তিবোধসম্পন্ন মানুষের কাছে তা ‘ফেয়ারি টেল’ ব্যতীত আর কিছু মনে হওয়ার অবকাশ নেই।
বর্তমান পৃথিবীর সব ধর্মগুলোই, বিশেষ করে সিমেটিক ধর্মগুলি তাঁদের পূর্ব ধর্মগুলো থেকে কিছু কিছু অংশ নিজেদের ধর্মে অন্তর্ভুক্ত করেছে (হিন্দুধর্ম বাদে। কারণ হিন্দুধর্ম সেই অর্থে কোনো একটি ধর্মগ্রন্থকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠেনি।)। যেসব ধর্ম থেকে ধর্মীয় আচার-আচরণগুলো গ্রহণ করা হয়েছে তার অনেকগুলোই আজ মৃত। কিন্তু ইসলামের মতো এত বেশি সংকলন বোধ হয় অন্য কোনো ধর্মই করেনি। জিহাদকে বাদ দিলে ইসলামের নিজস্বতা বলে কিছুই নেই। জিহাদের কথা একমাত্র ইসলামেই বলা হয়েছে। ইসলামে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটা মৌলিক। কোরান নিজেই ইসলামে ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাবের কথা স্বীকার করে। এছাড়াও পৌত্তলিক (হিন্দু নয়, আরবীয় পৌত্তলিক), জরাস্টবাদ, সাবিয়ান এবং ইসলামপূর্ব অন্যান্য ধর্মবিশ্বাস ও শাস্ত্রীয় আচার-আচরণ ইসলাম ধর্মে ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পুরো কোরানটাই তৎকালীন আরবের এবং মোহাম্মদ যাঁদের সংস্পর্শে এসেছেন তাঁদের ধর্মগুলির একটি সংকলন বলা যায়। বাইবেল রচনাশৈলী আর কোরানের রচনাশৈলীর মধ্যে পার্থক্য নেই। বাণী কোনোটা একেবারেই অবিকৃতরূপে এবং কোনোটা আবার সামান্য পরিমার্জন-পরিবর্তিত রূপে। ইসলামের কাবাঘর থেকে শুরু করে নামাজ, রোজা, জাকাত, হজ্ব ইত্যাদি সবগুলোই তখনকার আরবের বিভিন্ন ধর্ম থেকেই সংকলিত করা। যেসব গোষ্ঠীদের কাছ থেকে এগুলি গ্রহণ করা হয়েছে, মোহাম্মদের নবুয়তির প্রথম দিককার আয়াতগুলিতে তাঁদের প্রশংসাও করা হয়েছে। কোরানই এর সাক্ষী হিসাবে রয়ে গিয়েছে।
ইসলামের আগে আরবে যেসব একেশ্বরবাদী ধর্মগুলি ছিল সেগুলি হল ইহুদি, খ্রিস্টান ও হানিফি সম্প্রদায়। এগুলির সবকটিই একেশ্বরবাদী ধর্ম। ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব ইসলামে সবচেয়ে বেশি। সম্ভবত এ দুটো ধর্মের প্রভাব মক্কার বহু-ঈশ্বরবাদীদের মাঝে একত্ববাদ প্রচারের লক্ষ্যে তাঁকে নিজস্ব নবুয়তির মিশন গ্রহণে অনুপ্রেরণা পেয়েছিল। চাচা আবু তালিবের সঙ্গে সিরিয়া যাওয়ার পথে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের সঙ্গে তাঁর পরিচিত হওয়া স্বাভাবিক। মক্কাতে আবদাইস বিন সালোম নামের এক ইহুদি রাব্বির সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, যার কাছ থেকে মোহাম্মদ ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে বেশ জ্ঞান লাভ করেন। এই ইহুদি মানুষটি পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন বলে জানা যায় এবং আবদুল্লাহ ইবনে সালাম নাম গ্রহণ করেন।
ইসলামের রোজা রাখা, খৎনা দেওয়া এবং মদিনায় হিজরতের পর জেরুজালেমমুখী হয়ে নামাজ আদায় (পরে কাবামুখী হয়) করা সহ অনেক কিছুই ইহুদিদের অনুকরণের মাধ্যমে তাঁদেরকে সন্তুষ্ট করে ইসলামে দীক্ষিত করার প্রচেষ্টা বই অন্য কিছু নয়, যা ইসলামে স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। কোরানের বেশ কিছু আয়াতও রয়েছে ইহুদিদের সমর্থনে— “এবং নিশ্চয়ই আমরা বনি ইসলাইলের সন্তানদেরকে (ইহুদিদেরকে) ধর্মগ্রন্থ (তাউরাত) এবং জ্ঞান ও দৈববাণী প্রদান করেছি, তাদেরকে যা কিছু ভালো তা দিয়েছি এবং তাদেরকে সকল জাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছি” (কোরান ৪৫ : ১৬); “এতে (তাউরাত) আল্লাহর পথ নির্দেশ ও (জ্ঞানের আলো রয়েছে” (কোরান ৫ : ৪৪); “এটা আল্লাহর আশীর্বাদ ও সঠিকপন্থীদের পথ নির্দেশক” (কোরান ৬ : ১৫৩-১৫৪)। মোহাম্মদ ইহুদিদের দাঁতব্য প্রথা জাকাত নকল করেন এবং একে ইসলামের পাঁচস্তম্ভের একটির মর্যাদা দেন। ইহুদিদের অনুকরণে শুকরের মাংসও হারাম করেন। প্রবর্তন করেন ওজু এবং ইহুদিদের সাবাথ পালনের অনুকরণে শনিবারকে (পরে শুক্রবার) সাপ্তাহিক নামাজের দিন ধার্য করেন। ইহুদি প্রথার অনুসরণে আশুরার উপবাস বা রোজা চালু করেন, যাকে পরবর্তীতে রমজান মাসের রোজা’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইহুদিদের অনুসরণে মুসলমানদের জন্য লিঙ্গের চামড়া কর্তন (খ) চালু করা হয়। এছাড়া ইসলামের পূর্বেই ইহুদিদের ব্যবহৃত ‘নবি’ শব্দটিও ব্যবহার করে নিজেকে ‘বি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং পূর্বসূরি লাখো নবিদের আখ্যান গেঁথেছেন।
ইহুদিদের ইসলামে আকৃষ্ট (ধর্মান্তরিত করতে নিজের ধর্মে এতকিছু প্রবর্তন করলেও ইহুদিদের তাঁর ধর্মে আনতে ব্যর্থ হন। ইহুদিরা নিজেরাও বিস্তার লাভ করতে পারেনি। হিন্দুধর্মের মতো ইহুদিদেরও জিহাদ নেই, সেই কারণেই হয়তো বিস্তার লাভ করতে পারেনি। পরবর্তীতে ইহুদিরা মোহাম্মদকে ‘ভণ্ড’ এবং ‘পাগল’ আখ্যা দিলে মোহাম্মদ পরবর্তী জীবনে ইহুদিদের ভালোভাবেই ঘৃণা করতেন। এমনকি, বহু ইহুদি গোত্রকে উধাও করে ফেলা হয়। এরপর নবি মোহাম্মদ ইহুদিদের প্রতি ক্ষুব্ধ হন এবং তাঁর ‘আল্লাহ’ একের পর এক ইহুদি-বিদ্বেষী আয়াত হাজির করতে থাকেন। তাঁদের নারী এবং শিশুদের যৌনদাসও বানানো হয়। অর্থাৎ প্রথমে নরমপন্থা, পরে গরমপন্থা। নবি আরব থেকে ইহুদিদের সমূলে উৎপাটন করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হন এবং তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁদের প্রায় সমূলে বিনাশ করেন। তলোয়ারের মুখে তাঁদের মোহম্মদ-সৃষ্ট ধর্মে আসতে বাধ্য করা হয়। তুচ্ছ কারণে অথবা কোনো কারণ ছাড়াই (ইসলাম গ্রহণে অনিচ্ছাকে যদি কোনো কারণ ধরা না হয়) তাঁদের সকল পুরুষদের তলোয়ারের কোপে দেহ বিচ্ছিন্ন করা হয়, নারীদের যৌনদাসী বানানো হয়, নারী ও শিশুদের দাস হিসাবে বিক্রি করা হয় অথবা নিজেদের দাস হিসাবে রেখে দেওয়া হয়। মোহম্মদ তাঁর অনুগামীদের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি আয়াত উপহার দিলেন। তারই কয়েকটা শোনাই– “…আর তাদেরকে হত্যা করো যেখানে পাও সেখানেই এবং তাদেরকে বের করে দাও সেখান থেকে যেখান থেকে তারা বের করেছে তোমাদেরকে। বস্তুত ফেতনা ফ্যাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ। আর তাদের সাথে লড়াই করো না মসজিদুল হারামের নিকটে যতক্ষণ না তারা তোমাদের সাথে সেখানে লড়াই করে। অবশ্য যদি তারা নিজেরাই তোমাদের সাথে লড়াই করে। তাহলে তাদেরকে হত্যা কর। এই হল কাফেরদের শাস্তি। আর তারা যদি বিরত থাকে, তাহলে আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু। (কোরান ২ : ১৯১)। “.খুব শীঘ্রই আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করব। কারণ, ওরা আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করে যে সম্পর্কে কোনো সনদ অবতীর্ণ করা হয়নি। আর ওদের ঠিকানা হল দোজখের আগুন। বস্তুত জালেমদের ঠিকানা অত্যন্ত নিকৃষ্ট (কোরান ৩ : ১৫১)। “তারা চায় যে, তারা যেমন কাফের, তোমরাও তেমনি কাফের হয়ে যাও, যাতে তোমরা এবং তারা সব সমান হয়ে যাও। অতএব, তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে চলে আসে। অতঃপর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে তাদেরকে পাকড়াও করো এবং যেখানে পাও হত্যা করো। তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না এবং সাহায্যকারী বানিও না (কোরান ৪ : ৮৯)। নবি’ এভাবে কাদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন? অমুসলিমদের, যাঁরা আল্লাহর অনুসারী নন –ইহুদি, খ্রিস্টান ইত্যাদি। এরাই কাফের।
এ তো গেল ইহুদিদের কথা। এবার আসি খ্রিস্টান প্রসঙ্গে। একদা অনেক দার্শনিকই মনে করতেন যে, “ইসলাম খ্রিস্টান ধর্মেরই একটি ভ্রান্ত রূপ”। রেনেসাঁর প্রথমার্ধে ইউরোপে ইসলামকে মনে করা হত –“ইসলাম একটি ভ্রষ্ট ও অস্পষ্ট দানবীয় ধর্ম”। জিশুকে উদ্দেশ্য করে কোরানে নরমপন্থায় বলা হয়েছে –“তোমাকে যারা অনুসরণ করে তাদেরকে আমি শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত অবিশ্বাসীদের চেয়ে অধিকতর মর্যাদাবান করব” (কোরান ৩ : ৫৫)। “খ্রিস্টানরা অহংকারমুক্ত ও মুসলিমদের প্রতি অত্যন্ত বন্ধু ভাবাপন্ন” (কোরান ৫ : ৮২)। এছাড়া ১৯ : ২১, ৫৭ : ২৭, ৯:১১১, ৫: ৪৬, ৩: ৩৭, ৬৬ : ১২, ৫: ৫৭, ১৯ : ২১, ২১ : ৯১, ৫: ৬৯ সহ অনেক আয়াতেই খ্রিস্টান ধর্মের গসপেল, মাতা মেরি ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশংসাবাক্য রয়েছে। কাবাঘর থেকে সমস্ত মূর্তি ধবংস করলেও জিশুকোলে মেরির প্রতিচ্ছবিটির উপর নিজের হাত রেখে নবি তা রক্ষা করেন।
কোরানে বাইবেলের সঙ্গে কিছু সাদৃশ্যপূর্ণ আয়াত দেখুন– (১) ন্যায়বানরাই পৃথিবীর অধিকারী হবে (কোরান ২১: ১০৫) (একেবারেই অবিকৃত) (২) স্বর্গের দুয়ার খুলবে না তাদের জন্য যারা আমাদেরকে মিথ্যা অপবাদ দেয়; সূচের ছিদ্রপথে উটের প্রবেশ তাদের স্বর্গ গমনের চেয়ে সহজতর হবে (কোরান ৭ : ৪০) (সূচের ছিদ্রপথের উপমা) (৩) সেদিন আমরা (আল্লাহ) আসমান জমিনকে সংকুচিত করব একটা কাগজের বেলুনাকারে (কোরান ২১: ১০৪) (কাগজের বেলুনাকার উপমা) (৪) তিন ব্যক্তি গোপনে একত্রিত হতে পারে না, কারণ ঈশ্বর সেখানে হন চতুর্থ (ব্যক্তি) (কোরান ৫৮ : ৭) (ঈশ্বরের উপস্থিতি) (৫) সমুদ্রের সব পানিও যদি কালি হত, তাও ঈশ্বরের বাণী লিপিবদ্ধ করতে অপর্যাপ্ত হত (কোরান ১৮ : ১০৯) (বাইবেল : জিশু আরও অনেক কিছুই করে গেছেন, তার সবকিছু লিখা হলে আমার ধারণা সমগ্র পৃথিবীও সে বইটি ধারণ করতে পারবে না)।
খ্রিস্টান ধর্ম থেকে এতকিছু কপি/পেস্ট করার পরও, এমনকি খ্রিস্টানদের পক্ষে তোল্লা দেওয়া আয়াত রচনা করলেও পরে নবিজি তাঁদের প্রতি খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন এবং তাঁর আল্লাহ পরবর্তীতে ইহুদি-বিদ্বেষী আয়াতের মতোই খ্রিস্টান-বিদ্বেষী আয়াত নাজিল করা শুরু করেন। মৃত্যু-পূর্ববর্তী মোহাম্মদের খ্রিস্টান-বিদ্বেষ এতই চরম পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, মৃত্যুশয্যায় কাতর মোহাম্মদ তাঁর দুই স্ত্রী উম্মে সালমা ও উম্মে হাবিবার (দুজনই একসময় সিরিয়ায় নির্বাসিত ছিলেন) মুখে আবিসিনিয়ার সুন্দর ক্যাথেড্রাল/গির্জা ও তার দেয়ালের বিস্ময়কর ছবির কথা শুনে। ক্রোধোম্মত্ত চিৎকার করে ওঠেন— “হে আল্লাহ! ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধ্বংস করো। আল্লাহর ক্রোধ তাদের উপর প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠুক। সমগ্র আরব ভূখণ্ডে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম না থাকুক।” নবির এ অন্তিম ইচ্ছা তাঁর উত্তরাধিকারীরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন, আরব ভূখণ্ড থেকে সকল খ্রিস্টান ও ইহুদির বিতাড়নের মাধ্যমে।
মোহম্মদের ধর্ম ও আল্লাহ অনুসরণকারী না-হলে তাঁর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই, তার জন্য যতটা উচ্চসীমায় অসহিষ্ণু হওয়া সম্ভব হতে হবে। আসুন, আরও কয়েকটা অসহিষ্ণু আয়াত তথা হুকুম জেনে নিই –(১)। “যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রসুলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হল তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি” (কোরান ৫: ৩৩)। (২) “যখন নির্দেশ দান করেন ফেরেশতাদিগকে তোমাদের পরওয়ারদেগার যে, আমি সাথে রয়েছি তোমাদের, সুতরাং তোমরা মুসলমানদের চিত্তসমূহকে ধীরস্থির করে রাখো। আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই গর্দানের উপর আঘাত হানো এবং তাদেরকে কাটো জোড়ায় জোড়ায়” (কোরান ৮ : ১২)। (৩) “হে ঈমানদারগণ, তোমরা যখন কাফেরদের সাথে মুখোমুখি হবে, তখন পশ্চাদপসরণ করবে না” (কোরান ৮ : ১৫)। (৪) “আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ-না ভ্রান্তি শেষ হয়ে যায়; এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারপর যদি তারা বিরত হয়ে যায়, তবে আল্লাহর তাদের কার্যকলাপ লক্ষ করেন” (কোরান ৮ : ৩৯)। (৫) “সুতরাং যদি কখনও তুমি তাদেরকে যুদ্ধে পেয়ে যাও, তবে তাদের এমন শাস্তি দাও, যেন তাদের উত্তরসূরিরা তাই দেখে পালিয়ে যায়; তাদেরও যেন শিক্ষা হয়” (কোরান ৮ : ৫৭)। (৬) আর কাফেররা যেন একা যা মনে না করে যে, তারা বেঁচে গেছে; কখনও এরা আমাকে পরিশ্রান্ত করতে পারবে না (কোরান ৮ : ৫৯)। (৭) “আর প্রস্তুত করো তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পারে নিজের শক্তি সামর্থের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে তোমরা জানো না; আল্লাহ তাদেরকে চেনেন। বস্তুত যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহর রাহে, তা তোমরা পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাবে এবং তোমাদের কোন্ হক অপূর্ণ থাকবে না” (কোরান ৮ : ৬০)। (৮) অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদের হত্যা করো যেখানে তাদের পাও, তাদের বন্দি করো এবং অবরোধ করো। আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসে থাকো। কিন্তু যদি তারা তওবা করে, নামাজ কায়েম করে, জাকাত আদায় করে, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু” (কোরান ৯ : ৫)। (৯) যুদ্ধ করো ওদের সাথে, আল্লাহ্ তোমাদের হস্তে তাদের শাস্তি দেবেন। তাদের লাঞ্ছিত করবেন, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের জয়ী করবেন এবং মুসলমানদের অন্তরসমূহ শান্ত করবেন” (কোরান ৯ : ১৪) (১০) “ইহুদিরা বলে ওজাইর আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলে মসিহ আল্লাহর পুত্র’— এ হচ্ছে তাদের মুখের কথা। এরা পূর্ববর্তী কাফেরদের মতো কথা বলে। আল্লাহ্ এদের ধ্বংস করুন, এরা কোন্ উল্টো পথে চলে যাচ্ছে” (কোরান ৯ : ৩০)।
এইসব আয়াত উল্লেখ করে অমুসলিম তথা মুসলিম-বিদ্বেষীরা মুসলিমদের বিচার করে। তাঁরা বোঝাতে চায় অ মুসলিম মানেই মুসলিমরা হত্যা করতে উদ্যত হবে কিংবা করবে। কারণ সব মুসলমানই কোরান অনুসারী। কোরানে পথে তাঁরা রাষ্ট্র গড়তে চায়। অতএব মুসলিমদের রক্তেই হত্যাকারী। অতএব পরিত্যাজ্য।
যে কোরানকে অ-মুসলিমরা হুমকি মনে করে এস্ত থাকে, সেই কোরান কি সত্যিই ত্রাসের? কোরানের ওই আয়াতগুলি গুরুত্ব কতটা? মনে রাখতে কোরানের এমন একটা সময় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, যখন গোটা আরব যুদ্ধরত। তার উপর প্রতিপক্ষরা কিছুতেই মোহম্মদকে মেনে নিতে পারত না। মোহম্মদকেও প্রচুর যুদ্ধ বা সংঘর্ষ করতে হয়েছে সে সময়। একজন সেনানায়ক হিসাবে মোহম্মদের যুদ্ধনীতিই কোরানে প্রতিফলিত হয়েছে। মোহম্মদের যুদ্ধনীতি অনুসারেই কোরান রচিত হয়েছে, নাকি কোরানের নীতি অনুসারেই মোহম্মদ যুদ্ধ করেছেন –তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলতেই পারে। একজন সেনানায়ক যুদ্ধকে যেভাবে দেখেন, প্রতিপক্ষকে যেভাবে দেখেন, কোরানের এই আয়াতগুলি সেই নির্দেশই দেয়। এই কিছুদিন আগেও সেনারা প্রতিপক্ষকে নৃশংসভাবে হত্যা করত গোটা পৃথিবীতেই। বর্তমানে বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থার চাপে চট করে সেনারা নৃশংসভাবে হত্যা করতে না পারলেও প্রতিপক্ষকে হত্যা করা বন্ধ হয়নি। কোরানের একটা বড় অংশই যুদ্ধ বিষয়ক। ১৪০০-১৫০০ বছর আগের রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হত, নতুন ধর্মপ্রবর্তকদের উপর নানারকমে অত্যাচার নেমে আসত। শুধু আরবেই নয়, আদি মধ্যযুগ থেকে মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত সারা পৃথিবী জুড়ে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে যুদ্ধ লেগেই থাকত। এটা আমরা ভারতেও দেখেছি বৌদ্ধধর্মের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নির্যাতন। সেই নির্যাতনে বৌদ্ধধর্ম ভারত ভূখণ্ড থেকে প্রায় নিশ্চিহ্নই হয়ে গেল। নিশ্চিহ্ন হওয়ার মূল কারণ বৌদ্ধধর্মের অহিংস মতবাদ। উল্টোদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ছিল সহিংস।
হজরত মোহম্মদ যে ঐতিহাসিক কাজটা করে ফেলতে পেরেছিলেন, তা বিশ্বের আর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম পারেনি। সেটা হল ইসলামের মাধ্যমে অসংখ্য নিত্য বিবাদমান আরবীয় গোষ্ঠীকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। হয় ইসলাম, নয় ইসলাম –গোড়ার দিকে দু-ভাগে ভাগ ছিল আরব জাতি। হয় ইসলাম বনাম নয় ইসলামের যুদ্ধ। ইসলামে সমর্পণ করলে ক্ষমা, অন্যথায় মৃত্যু। ধীরে ধীরে সকল আরব জাতি সমর্পণের মধ্য দিয়ে এক জাতিতে পরিণত হল। কখনও রক্তপাতে, কখনও বিনা রক্তপাতেই। আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন তিনি আরব জাতিকে এক করার উদ্দেশ্যে। সেটা হল পৌত্তলিকতা বিলুপ্ত করা। মোহম্মদ অনুভব করেছিলেন একাধিক মূর্তি ভাবনা বা পৌত্তলিকতা এক জাতিতে সফলভাবে পরিণত করার অন্তরায়। তাঁর সবচেয়ে প্রমাণ হিন্দুধর্ম। বহুত্ববাদ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বহুধা করে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। আরবে কোনো গোষ্ঠী আল-লাত দেবতার অনুসারী তো কেউ আল-উজ্জা দেবতার অনুসারী, কেউ আল-মানাত দেবতার অনুসারী তো কেউ অন্য দেবতার অনুসারী। এর ফলে জাতি ভিন্ন দেবতার বিশ্বাসে মানুষ বিভাজিত হয়ে থাকে। কীভাবে বিভাজিত থাকে একটা জাতি, তা হিন্দুজাতির দিকে তাকালেই অনুধাবন করতে পারব। হিন্দুজাতিদের অসংখ্য দেবতা বিশ্বাস থাকার জন্য এই জাতি বিভাজিতই থেকে গেল। এক জাতি হয়ে উঠতে পারল না। এক জাতি হয়ে না-ওঠার কারণ হিন্দুরা এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয় বলেই। মোহম্মদ সমস্ত মূর্তি ধ্বংস করে এক আল্লাহ ধারণা তৈরি করলেন। বললেন –“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, যার অর্থ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই, তার নেই কোনো শরিক, নেই কোনো দ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা, পরিবার, বন্ধু বান্ধব, সহকারী। তিনিই একমাত্র পালনকর্তা, মাবুদ, প্রভু, মালিক, তিনি সারা জাহানের সৃষ্টিকর্তা, আমরা তাঁরই দাসত্ব স্বীকার করি, কেবল তাঁরই আনুগত্য করি এবং তাঁরই আইন মেনে চলার চেষ্টা করি। এখানেই থেমে থাকেননি মোহম্মদ। তিনি এটাও বললেন— মহান আল্লাহ বলেন– “তোমরা তো আল্লাহকে বাদ দিয়ে মূর্তির পূজা করছ আর মিথ্যা বানাচ্ছ। নিশ্চয়ই আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদের উপাসনা করো, তারা তোমাদের জন্য রিজিক দানের কোনো ক্ষমতা রাখে না। তাই আল্লাহর নিকট রিজিক তালাশ করো, আর তাঁরই ইবাদাত করো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে” (সুরা আনকাবুত, আয়াত ১৭)। মহান আল্লাহ বলেন– “আর ইব্রাহিম বলল, দুনিয়ার জীবনে তোমাদের মধ্যে পরস্পরিক ভালোবাসার জন্যই তো তোমরা আল্লাহকে ছাড়া মূর্তিদেরকে গ্রহণ করেছ। তারপর কিয়ামতের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং পরস্পর পরস্পরকে অভিশাপ দেবে, আর তোমাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম আর তোমাদের জন্য থাকবে না কোনো সাহায্যকারী” (সুরা আনকাবুত, আয়াত ২৫)। মহান আল্লাহ বলেন –“সে ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত কে, যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা কিয়ামত দিবস পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দেবে না। আর তারা তাদের ডাক সম্বন্ধে অবহিতও নয়। যখন কিয়ামতের দিন মানুষকে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রু হয়ে দাঁড়াবে এবং তাদের উপাসনাকে অস্বীকার করবে” (সুরা আহকাফ, আয়াত ৫-৬)। মহান আল্লাহ বলেন– “আর যখন ইব্রাহিম তার পিতা আয়রকে বলেছিল, আপনি কি মূর্তিগুলোকে ইলাহ রূপে গ্রহণ করছেন? নিশ্চয়ই আমি আপনাকে ও আপনার জাতিকে স্পষ্টভাবে গোমরাহিতে নিমজ্জিত দেখছি” (সুরা আনআম, আয়াত ৭৪)। মহান আল্লাহ বলেন –“আর তুমি তাদের নিকট ইব্রাহিমের ঘটনা বর্ণনা করো, যখন সে তার পিতা ও তার কওমকে বলেছিল, তোমরা কীসের ইবাদাত করো? তারা বলল, আমরা মূর্তির পুজো করি। অতঃপর আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের পুজোয় রত থাকি”। সে বলল, “যখন তোমরা ডাকো তখন তারা কি তোমাদের সে ডাক শুনতে পায়? অথবা তারা কি তোমাদের উপকার কিংবা ক্ষতি করতে পারে?” তারা বলল, “বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের পেয়েছি তারা এরূপই করত।” ইব্রাহিম বলল, “তোমরা কি তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখেছ তোমরা যাদের পুজো করো। তোমরা এবং তোমাদের অতীত পিতৃপুরুষেরা? সকল সৃষ্টির রব ছাড়া অবশ্যই তারা আমার শত্রু” (সুরা শুআরা, আয়াত ৬৯-৭৭)। এই নিয়ম অনুসরণ করে দীর্ঘ প্রায় ১৫০০ বছর ধরে এক আল্লাহর ঘরে এলাকার সকল মুসলিম একসঙ্গে ইবাদাত করেন। এখানেই মুসলিম ঐক্য মজবুত হয়।প্রসঙ্গত বলে রাখি, মোহম্মদও গোড়ার দিকে মূর্তি পূজারী ছিলেন। তিনি সজ্ঞানে তাঁর দলবল সহ প্রায় ১০ বছর সেই ধ্বংসকৃত ৩৬০ টি মূর্তিকেই সেজদা ও মাথা নত করে নামাজ পড়েছেন।
মোহম্মদের নবি হওয়ার কথা শুনে প্রথমেই তাঁর হাতে হাত দিয়ে খাদিজা ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর মোহম্মদের ১০ বছরের বালক চাচাতো ভাই আবু তালেবের ছেলে আলি মুসলমান হন। এরপর পুত্রবৎ তায়েদ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এরা তিনজনই মোহাম্মদের অতি ঘনিষ্ঠ জন। তারপর আবু বকর সিদ্দিকি ইমান আনেন। একে একে ওসমান, তালহা, আবদুর রহমান, হজরত সাদ, আবু ওবাইদা, আবু সালম প্রমুখ ইমান আনেন। এইভাবে তিন বছর মোহম্মদ ও তাঁর সঙ্গীরা টানা তিন বছরে মাত্র ৪০ জনকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে পারলেন।
প্রাচীন আরবে রীতি ছিল কোনো বিপদ দেখা দিলে বা বিশেষ ঘোষণা দেওয়ার থাকলে সাফা মারোয়া নামে এক পাহাড়ে উঠে গোত্রের মানুষদের ডেকে জানানো হত। একদিন মোহম্মদ সেই পাহাড়ে উঠে স্বগোত্রের মানুষদের ডাক দিলেন। সেই ডাকে এলাকার সকলে পড়িমরি করে জমায়েত হল।মোহম্মদ এবার উচ্চৈঃস্বরে বললেন– “আমি যদি বলি একদল সেনা পাহাড়ের ওদিকে আমাদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে, আমার সেই কথা কি তোমরা বিশ্বাস করবে?” কোরায়েসরা (মোহম্মদের গোত্র ছিল কোরায়েস) এক বাক্যে জানিয়ে দিল– “মোহাম্মদ, তুমি কখনও মিথ্যা ও বাজে কথা বলোনি। অতএব তোমার কথা আমরা বিশ্বাস করব।” মোহাম্মদের প্রতি এই বিশ্বাস এই আস্থা তাঁকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। সকলের ভরসা মোহম্মদ তাঁদের বোঝালেন, পৌত্তলিকতার অসারতা ও আল্লাহ মহত্ত্ব। এরপর তিনি সকলকে ইসলাম তথা ন্যায় ধর্ম গ্রহণের আহ্বান করলেন। সবাই সে কথা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু একথা শুনে আবু লাহাব নামে জনৈক ব্যক্তি রেগে গিয়ে বলেছিলেন– “তোমার মরণ হোক। এ জন্যে তুমি আমাদের ডেকে এনেছ?” পরের কাহিনি আর এখানে বলার প্রয়োজন নেই। যেটা বলার তা হল, মোহম্মদ এবার জোর কদমে এবং প্রকাশ্যেই ইসলামের প্রচার করা শুরু করে দিলেন। দ্বিমতদের তরফ থেকে প্রতিরোধ আসতে থাকল। শুরু হয়ে গেল বিরোধীদের দ্বারা কোরায়েসদের উপর অত্যাচার। ভিন্নমত প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ নয়। ভিন্ন মত কোনোকালেই কেউই মেনে নেয় না। এইসব অত্যাচারের মধ্যেই মোহম্মদ রাস্তায় রাস্তায়, বিভিন্ন জনবহুল এলাকায় সভা-সমিতি করে, এমনকি বাড়ি বাড়ি ঘরে ঘরে গিয়ে ইসলামের কথা বলতে থাকলেন। এই হল ইসলাম প্রচারের শুরু। ইসলাম ধর্ম প্রচারের আগে মোহম্মদ ছিলেন আল আমিন। ঠাকুর-দেবতা তথা মূর্তিপুজোর বিরোধিতা করতে গিয়ে মোহম্মদ অচিরেই সকলের শত্রু হয়ে উঠলেন। সবাই তাঁকে ‘পাগল’ বলতে শুরু করে দিল। তাঁর উপর নির্যাতনও শুরু হয়ে যায়। মোহম্মদের উপর নির্যাতন ও বিরোধিতার মূল কারণই ছিল– (১) আরববাসীরা যুগ যুগ ধরে যে সমস্ত দেবদেবীর পুজো করত মোহম্মদ তার বিরোধিতা করতেন, যা আরববাসীরা সহজেই মেনে নিতে পারছিলেন না। (২) আরবের অসংখ্য গোত্র-গোষ্ঠী ছিল। সেই বিভিন্ন গোত্রের আভিজাত্যবোধ, কৌলিন্য ছিল ষোলা আনা। তাতে হাত পড়ল মোহম্মদের।
মোহম্মদ বললেন –“সকল মানুষ সমান। সকলের ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে থাকবে সমান অধিকার।” এ সাম্যের নিয়ম অভিজাত তথা কুলীনরা মানবেন কেন! (৩) ধর্মযাজক বা পুরোহিতদের স্বার্থে আঘাত লাগলে মোহাম্মদের বিরোধিতা করা শুরু করে। (৪) আরবদের গোত্রগত শত্রুতা ও রেষারেষি ইসলামে বিরোধিতার একটা মূল কারণ। (৫) ইহুদি, খ্রিস্টানদের সঙ্গে ইসলাম ধর্মে অনেকটা মিল থাকায় পৌত্তলিকরা ইসলামকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং বিরোধিতা করে।(৬) কোরায়েসরা মদ্যপান, ব্যাভিচার, হত্যা, লুণ্ঠন, সুদের বিরোধিতা করা ভালো চোখে দেখেনি। বাধাবন্ধনহীন জীবনে বাধা আসছে বলে ইসলামের বিরোধিতায় নেমে পড়ল তাঁরা। যদিও বাস্তবক্ষেত্রে ইসলামের প্রসার ও প্রচারে কোনো বাধাই সামনে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ ইসলামে বিরোধিতা যেমন ছিল, তার চেয়ে শতগুণ ছিল ইসলামের সমর্থক। তা ছাড়া মোহম্মদ জিরো টলারেন্সেই ইসলামকে গোটা আরবে ছড়িয়ে সক্ষম হয়েছিল তাঁর দক্ষতা ও নির্ভীকতায়। এর জন্য প্রচুর যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে। কারণ ইসলাম প্রচার ও প্রসারের কালে তাঁকে তীব্র বিরোধিতার মোকাবিলা করতে হয়েছিল।
ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কথা এলোই যখন, তখন একটু জেনে নিই মোহম্মদের অনুসারীদের কথাও। ইসলাম বা মোহম্মদের অনুসারীদের আরবিতে বলা হয় “মুসলিম’ এবং ফারসিতে বলা হয় মুসলমান’, ইংরেজিতেই সেটাই ‘মহামেডান’। ইসলাম হল সেমেটীয় ধর্ম। সেমেটীয় গোষ্ঠীর সম্ভাব্য ধাত্রী এই আরব ভূখণ্ড। এখান থেকেই সমৃদ্ধির পথে যাত্রা করা পথিকরা উত্তরকালের ইতিহাসে ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয়, ফিনিশীয় বা হিব্রু নামে পরিচিত হয়। বিশুদ্ধ সেমেটীয় চরিত্রের উৎস অনুসন্ধান করতে হবে আরবের বালুরাশিতেই। কারণ এখানেই যথাক্রমে ইহুদি, খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম ধর্মের বীজ বপন হয়। এই আরবেই প্রবর্তন হয় ইসলাম ধর্মের, যা বিশ্বের প্রায় সব জাতি এবং গোষ্ঠীর মধ্যে পল্লবিত। এই ধর্মের ছত্রছায়ায় আছে প্রায় ৪৫ কোটি অনুগামী। সমসাময়িক বিশ্বে যা প্রতি আটজনের একজন মোহাম্মদের অনুগামী।
আরবীয়রা শুধু এক বিশাল সাম্রাজ্যই গড়েননি, সৃষ্টি করেছিলেন এক উচ্চমার্গের সংস্কৃতির। নিল নদের উপত্যকা, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের তীরভূমি এবং ভূমধ্যসাগরের পূর্বতটে যে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, আরবীয়রা ছিলেন তাঁর উত্তরসূরি। গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির ধারায় পরিপুষ্ট আরবীয়রা এই সংস্কৃতির নির্যাস পৌঁছে দিয়েছিলেন মধ্যযুগের ইউরোপের বিদগ্ধজনের কাছে। দীপ্তবুদ্ধির এই পরিক্রমাই উত্তরকালের প্রতীচ্যে এনেছিল নবজাগরণের আলোকবর্তিকা। আরবীয় এবং আরবিভাষীদের অগ্রণী ভূমিকাতেই মধ্যযুগে মানবসভ্যতার বিকাশ ও বৃদ্ধি। ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের মতোই তৃতীয় এবং সর্বশেষ একেশ্বরবাদী ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা এই আরবীয়রাই। ঐতিহাসিক বিচারে ইসলাম ধর্ম এই দুই ধর্ম সঞ্জাত। তাই অন্যান্য সব ধর্মের তুলনায় ইসলামের নৈকট্য এই দুই ধর্মের। সঙ্গেই। কারণ সেমেটীয় জীবনচর্যাই এই তিন ধর্মের উৎস। ফিলিপ কে হিট্টি মনে করেন– খ্রিস্টধর্মের অল্প কয়েকটি অনুশাসনে অদলবদল ঘটালেইএক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে তা গ্রহণীয় হয়ে উঠতে পারে।
পৃথিবীর কোনো মতবাদই রক্তপাতহীন হয়নি –সে ধর্মীয় মতবাদই হোক বা রাজনৈতিক মতবাদ। ইতিহাসে এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। আরবের ইসলাম মোটেই অহিংস ছিল না, একথা বলাই বাহুল্য। কারণ সহিংস খ্রিস্টান, ইহুদি ও অন্যান্য ইসলাম-বিরোধীদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে ইসলামের সহিংসতা ছাড়া কোনো পথ খোলা ছিল না। তাই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অনুগামীদের লড়াই করতে শক্তি জোগায় ‘আল্লাহ প্রেরিত’ এরকম আয়াত– “তাদেরকে হত্যা করো যেখানে পাও সেখানেই এবং তাদেরকে বের করে দাও সেখান থেকে যেখান থেকে তারা বের করেছে তোমাদেরকে”। তাই নির্দেশ দিতে হয় –“আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই গর্দানের উপর আঘাত হানো এবং তাদেরকে কাটো জোড়ায় জোড়ায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কিছু মুখ অশিক্ষিত হুজুরা জলসাগুলিতে ওয়াজের চিৎকার করে অমুসলিমদের উদ্দেশ্যে কোরানকে উল্লেখ করে আয়াতগুলি শোনায়। তাতে ভুল বার্তা পৌঁছোয় অমুসলিমদের কাছে, মুসলিমদের কাছেও। এই সমস্ত জলসাগুলির ভিডিও অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ফলে ইসলাম ও মুসলিমরা ঘৃণার কারণ হয়ে উঠছে। অবিলম্বে এইসব জলসা, জলসার বক্তব্য নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত। এইসব জলসা বিদ্বেষ ছড়ায় নিঃসন্দেহে। অমুসলিমদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।
কোরান মারমুখী প্রতিপক্ষ ইহুদি ও খ্রিস্টানদের হত্যার হুকুম নথিভুক্ত করলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, সিন্টদের হত্যার হুকুম দেয়নি। যে পৌত্তলিকদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন, তারা আরবীয় পৌত্তলিক। এই আরবীয় পৌত্তলিকরা হিন্দু নন। মোহম্মদ নিজের হাতে প্রচুর মূর্তি ভেঙেছেন। তবে কোরান হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, সিন্টদের হত্যা করার হুকুম সরাসরি না-দিলেও মোহম্মদের মৃত্যু-পরবর্তী শাসকরা হাতে তলোয়ার নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিগ্বিজয়ে ছুটলেন আর কোরানের হুকুমকে বর্ধিত করে পৃথিবীর যত অমুসলিম আছে তাঁদের সবাইকে কাফের তালিকাভুক্ত করে নিল। ‘আল্লাহ’ তো একথা বলেই রেখেছেন– “হে নবি, কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করুন এবং মুনাফেকদের সাথে তাদের সাথে কঠোরতা অবলম্বন করুন। তাদের ঠিকানা হল দোজখ এবং তা হল নিকৃষ্ট ঠিকানা” (কোরান ৯ : ৭৩)
আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন দেবতার মূর্তি থাকলেও কাবাঘরটি মূলত মূর্তিপূজক বা পৌত্তলিকদের নিয়ন্ত্রণাধীন উপাসনাঘর হিসাবেই পরিচিত ছিল। নবুয়ত প্রাপ্তির পরপরই যেটিকে মোহাম্মদ তাঁর সৃষ্ট ‘ফ্রেন্ড-গাইড ফিলোজফার’ আল্লাহর ঘর হিসাবে দাবি করেন এবং মক্কা বিজয়ের পর এই ঘরই তাঁর উপাসনালয় হিসাবেই দখল নেন। মক্কায় বহু-ঈশ্বরবাদীদের মধ্যে বেড়ে ওঠা মোহাম্মদকে তাই পৌত্তলিকদের অনেক আচার-অনুষ্ঠানই প্রভাবিত করেছিল। হজ্ব, ওমরাহ ছিল পৌত্তলিক বহু-ঈশ্বরবাদী তীর্থযাত্রীদের ধর্মীয় আচার, যা তিনি সামান্য পরিবর্তন করে ইসলামের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেন। হজ্বের ক্ষেত্রে মোহাম্মদ শুধু এটুকু পরিবর্তন করেছেন যে, এখন কোরবানি দেওয়া হয় নিরাকার তথা বিমূর্ত আল্লাহর উদ্দেশে, যা পৌত্তলিকরা উৎসর্গ করত মূর্তিদেবদেবীর উদ্দেশ্যে। ‘আল্লাহ’ শব্দটিও কাবার প্রধান দেবী আল-লাত থেকেই নেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদ পৌত্তলিক-বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও কাবার প্রধান তিন দেবী আল-লাত, আল-উজ্জা ও আল-মানাতকে পুজোর যোগ্য বলে কোরানের আয়াত নাজিল করেছিল ৬১৬ সালে, যা পরবর্তীতে ‘শয়তানের আয়াত’ বলে বাতিল করে দেওয়া হয় এবং তা বাতিলের জন্য নতুন আয়াত আনা হয়। ইসলামের আজকের দিনে ‘আল্লাহ’ বলতে যেমন একমাত্র ঈশ্বর বোঝায়, ইসলাম সৃষ্টির আগে আরবে এমন ধারণা ছিল না। ‘আল্লাহ’ শব্দটির ইতিহাস ইসলামের চেয়ে অনেক প্রাচীন এবং বহুল প্রচলিত। আল্লাহ্ শব্দটির অর্থ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতামত পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন মোহাম্মদের বাবার নাম ছিল আবদ আল্লাহ্ ইবন আবদ আল মুত্তালিব— ‘আবদ আল্লাহ’ শব্দের অর্থ ‘আল্লাহর দাস’। প্রাক-ইসলামি খ্রিস্টান, ইহুদি ও হানাফি নামে পরিচিত একেশ্বরবাদী আরবীয়রা ‘বিসমিল্লাহ্’ শব্দটিও ব্যবহার করত। আরবের শিলালিপিগুলিতে ইসলামের আবির্ভাবের কয়েক শতাব্দীর আগেও ‘আল্লাহ’-কে সর্বোচ্চ দেবতা বা সৃষ্টিকর্তা দেবতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাপ্লাবনের কাহিনিও ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে নেওয়া, পরে এ কাহিনি নিউ টেস্টামেন্টেও পাওয়া যায়। একটু এদিক ওদিক করে কপি/পেস্ট হয়েছে কোরানেও। হিন্দুধর্মে অত বিস্তারিত না-হলেও ‘মনুমৎসকথা তেও এ কাহিনিতেও পাওয়া যায়। তবে পরবর্তীতে পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মগ্রন্থে বা উপজাতিদের মধ্যে মহাপ্লাবনের কাহিনি পাওয়া যায় বিভিন্ন আঙ্গিকে। মহাপ্লাবনের প্রকৃত সত্য নিয়ে আমি বিস্তারিত লিখেছি আমার ‘মহাপ্লাবন গ্রন্থে। আগ্রহী হলে পড়ে দেখতে পারেন।
এছাড়া জরাথ্রুস্টবাদ, মনিবাদ, নেস্টোরিয়ান ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থগুলির কাছেও কোরান ঋণী। যদিও কোরান-শেষে কোনো তথ্যসূত্র বা ঋণস্বীকার করা হয়নি। যাই হোক, সালমান ফার্সি নামে একজন জরাথ্রস্টবাদীর (যিনি প্রথমে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেন) কাছ থেকে মোহাম্মদ জরাথ্রস্টবাদ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। খন্দকের যুদ্ধে সালমান ফার্সিই পরিখা খোঁড়ার পরিকল্পনা বাতলে দিয়ে কুরাইশদের আক্রমণ থেকে মোহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদেরকে রক্ষায় সাহায্য করেন। জরাথুস্টবাদের জান্নাত ও জাহান্নামের ধারণা, শয়তানের ধারণা, পুলসিরাতের ধারণা ও মেরাজের কাহিনিগুলি ইসলামে সংযোজন করা হয়। পারস্যে প্রচলিত খ্রিস্ট, জরথ্রস্টবাদ ও বৌদ্ধদর্শনের সংমিশ্রণে সৃষ্ট ধর্ম হল মনিবাদ। এটাই ছিল মেসোপটেমিয়ার ধর্মবিশ্বাস। এই ধর্মের প্রবক্তা ও প্রচারক মনি। মনি দাবি করতেন তিনিই শেষ নবি এবং জিশু ক্রুশবিদ্ধ হননি, তার পরিবর্তে অন্য একজন ক্রুশবিদ্ধ হন। মোহাম্মদের প্রচারিত ইসলামেও এ ধারণাগুলো ভিত্তি লাভ করে। নেস্টোরিয়ানরা ছিল জিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ছবি প্রদর্শনের বিরোধী। ইসলামেও নবির ছবি তথা জীবন্ত প্রাণীর ছবি অঙ্কন নিষিদ্ধ হয়েছিল। সম্প্রতি ফ্রান্সে মোহম্মদের কার্টুন-চিত্র আঁকাকে কেন্দ্র করে খুনোখুনি হয়ে যায়। গোটা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের বহু মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এ প্রসঙ্গে আমি কিছু লিখব না। আমি বরং জারিন চৌধুরীর একটি উদ্ধৃতি কোট করি –“যার চিত্র নেই তার ব্যঙ্গ চিত্র আসে কোত্থেকে? আচ্ছা আপনাদের মনে এই প্রশ্নটা কখনো আসেনি যে, মোহাম্মদের প্রতিকৃতি নেই কেন? মোহাম্মদ কিছুই এমন প্রাগৈতিহাসিক যুগের নয়। ওই সময় প্রতিকৃতি আঁকার প্রচলন ছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। ইসলামের অনুসরণকারীরা অবশ্য বলেন যে, এই ধর্মে যেহেতু মূর্তিপুজো নিষিদ্ধ, তাই প্রতিকৃতি ইত্যাদি থাকলে মানুষ সেটা নিয়ে পুজো-অর্চনা শুরু করে দিতে পারে,যেটা ইসলামের নিরাকার আল্লাহ এই ভাবধারার পরিপন্থী। আচ্ছা এটাই যদি যুক্তি হয় তাহলে কাবাঘর প্রদক্ষিণ, স্তম্ভকে শয়তান মনে করে পাথর ছোঁড়া, আল্লাহর আরশের (আল্লাহ যেখানে অধিষ্ঠান করেন সেই আসন। যার আকার নেই তার আসন!) উল্লেখ এইসব আছে কেন? আর মূর্তি না-থাকলেও মোহাম্মদ নামক মূর্তিমানের ভাবমূর্তি পুজো করেই মুমিন বান্দা সভ্যতাকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। যাক এবার প্রসঙ্গে ফিরে আসি, প্রাণী প্রতিকৃতিতে নিয়ে এত সমস্যা কেন ইসলামে? মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠার দরুন আমি জানি জামাকাপড়ে প্রাণীর ছবি থাকলে সেই জামা পরিধান করে নামাজ পড়া যায় না। ইসলামে ছবি তোলাও নিষিদ্ধ এবং এই নিষিদ্ধের তালিকা এতই লম্বা যে, শেষপর্যন্ত যা দাঁড়ায় তা হল সহি মুমিন বান্দারা বিকৃত যৌনতা আর জিহাদ ঘোষণা করে মানুষ খুন করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু কেন? ছবি আঁকা, গান গাওয়া, নাচ করা এবং আরও সমস্ত রকমের চিত্ত বিনোদনের উপকরণের উপর নিষেধাজ্ঞা কেন? এগুলো মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এগুলো বাদ দিয়ে একটা একমুখী, অযৌক্তিক ধর্মসর্বস্ব জীবন যাপনে বাধ্য করার হেতু কি? এই যে একমাত্রিক জীবন যেখানে আল্লাহ এবং নবিকে ধ্যানজ্ঞান করে পরকালে মদ আর নারী মাংসের লোভ দেখিয়ে একটা নিকৃষ্টতম জীবনের হাতছানি দেওয়া এর পিছনে কোন্ মহত উদ্দেশ্য কাজ করছে? এই যে মডারেট মুসলিমগণ, আপনাদের বলছি ভালো ভাবো ভাবা প্র্যাকটিস করো। কারণ সবচেয়ে বেশি বিপাকে আপনারা পড়বেন। আপনারা ইসলামের ৯৯% নিয়ম না-মেনেই নিজেদের মুসলিম দাবি করেন। অথচ আপনার আগামী প্রজন্ম কিন্তু জিহাদ করতে পারবে না। কারণ তারা সহজ স্বাভাবিক মানবিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, বহুমাত্রিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। এমতাবস্থায় অ-মুসলিম বিশ্ব কিন্তু মুসলমানদের শত্রু হিসাবেই বিবেচনা করতে শুরু করেছে, আর তাদের দোষও দেওয়া যায় না। নিজের সন্তানদের তাগিদেই নিজের অবস্থান স্থির করুন। আর অন্ধ ব্যক্তিপুজো থেকে নিরস্ত হন সামনে ঘোর বিপদ আসছে কিন্তু।”
যদিও নবির ছবি তেমন আঁকাআঁকির চল না-থাকলেও জীবন্ত প্রাণীর ছবি হামেশাই এঁকে থাকেন মুসলমানরা, ব্যাপক হারে ফোটোগ্রাফও করেন। টিভিতে মুখ দেখান। জলসার ওয়াজের ভিডিও করে ইউটিউবে ছাড়েন। কোরানের কোন্ সুরার কোন্ আয়াতে এর সমর্থন আছে? সমর্থন না-থাকলে করা যাবে না, এটা কোন্ ধরনের চিন্তাভাবনা? গোটা জীবনে মুসলিম সমাজ যেভাবে জীবননির্বাহ করেন তার কত অংশ ইসলাম সমর্থিত? সম্প্রতি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে তুমূল উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। হাসান মাহমুদ লিখছেন –“দেশে এখন মূর্তি ও ভাস্কর্য নিয়ে উত্তেজনা চলছে। বিষয়টির সঙ্গে হেফাজতিরা ইসলামকে জড়িয়ে ফেলেছে। তাই চলুন আমরা সূত্র ধরে দেখি এ ব্যাপারে কোরান, হাদিস, সিরাত (ইবনে হিশাম ইবনে ইবনে ইসহাক), তারিখ আল তারারি ও অন্যান্য দলিল কী বলে।
প্রথমেই তিনটে শব্দ বুঝে নেওয়া যাক : প্রতিমা, ভাস্কর্য ও মূর্তি। প্রতিমা হল মানুষ যাঁর আরাধনা উপাসনা করে, ইহকালে-পরকালে মঙ্গল চায়, ভুলের ক্ষমা চায় ইত্যাদি। ভাস্কর্য হল মানুষসহ কোনো প্রাণী বা কোনো কিছুর মূর্তি যাকে মানুষ রাখে সম্মান দেখাতে বা সৌন্দর্য বর্ধন করতে, মানুষ যার আরাধনা বা উপাসনা করে না। এবারে অন্যান্য দলিলের দিকে তাকানো যাক, সেখানে আমরা দেখব হজরত মোহাম্মদের বাড়িতে মূর্তি ছিল তাঁর সম্মতিক্রমেই। সব দলিলের শেষে আমরা কোরানে যাব এবং দেখতে পাব আল্লাহর নির্দেশেই এক পয়গম্বরের প্রাসাদে ভাস্কর্য ছিল।
কোরানে যাওয়ার আগে প্রথমেই হাদিস ও অন্যান্য দলিল। কাবাতে রাসূল (সা.) লাত, মানাত, উজ্জা, হোবল, ওয়াদ ইত্যাদির প্রতিমা ভেঙেছিলেন, এগুলোর আরাধনা করা হত বলে। ভাস্কর্য ও মূর্তির বিপক্ষে কিছু হাদিস আছে, কিন্তু সাধারণত বিপক্ষের দলিলে আমরা ব্যক্তির নাম ও ঘটনার বিবরণ পাই না, যা পক্ষের হাদিসগুলোতে পাই। পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ। (ক) সহি বুখারি ৮ম খণ্ড হাদিস ১৫১: আয়েশা বলিয়াছেন, আমি রাসুলের (সা.) উপস্থিতিতে পুতুলগুলি লইয়া খেলিতাম এবং আমার বান্ধবীরাও আমার সহিত খেলিত। যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) আমার খেলাঘরে প্রবেশ করিতেন, তাহারা লুকাইয়া যাইত, কিন্তু রাসুল (সা.) তাহাদিগকে ডাকিয়া আমার সহিত খেলিতে বলিতেন। (খ) সহি আবু দাউদ বুক ৪১ হাদিস নং ৪৯১৪: বিশ্বাসীদের মাতা আয়েশা (রা.) বলিয়াছেন, যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) তাবুক অথবা খাইবার যুদ্ধ হইতে ফিরিলেন তখন বাতাসে তাঁহার কক্ষের সামনের পর্দা সরে গেলে তাঁহার কিছু পুতুল দেখা গেল। তিনি (রাসুল) বলিলেন, “এইগুলি কী?” তিনি বলিলেন, “আমার পুতুল।” ওইগুলির মধ্যে তিনি দেখিলেন একটি ঘোড়া যাহার ডানা কাপড় দিয়া বানানো হইয়াছে এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহা কি যাহা উহার উপর রহিয়াছে?” তিনি উত্তরে বলিলেন, “দুইটি ডানা।” তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “ডানাওয়ালা ঘোড়া?” তিনি উত্তরে বলিলেন, “আপনি কি শোনেননি যে সুলেমানের ডানাওয়ালা ঘোড়া ছিল?” তিনি বলিয়েছেন, ইহাতে আল্লাহর রাসুল (সা.) এমন অট্টহাসি হাসিলেন যে আমি উনার মাড়ির দাঁত দেখিতে পাইলাম।” (গ) সহি মুসলিম– বুক ০০৮, নং ৩৩১১: আয়েশা (রা.) বলিয়াছেন যে আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁহাকে সাত বৎসর বয়সে বিবাহ করিয়াছিলেন (যদিও অন্য রেওয়াতে আমরা পাই ছয় বছর: হাসান মাহমুদ) এবং তাঁহাকে নয় বৎসর বয়সে কনে হিসেবে তাঁহার বাসায় লইয়া যাওয়া হয়, এবং তাঁহার পুতুলগুলি তাঁহার সাথে ছিল এবং যখন তিনি দেহত্যাগ করিলেন তখন তাঁহার বয়স ছিল আঠারো। (ঘ) সহি মুসলিম– বুক ০৩১ নং ৫৯৮১: আয়েশা (রা.) বলিয়াছেন যে তিনি আল্লাহর রাসুলের (সা.) উপস্থিতিতে পুতুল লইয়া খেলিতেন এবং যখন তাঁহার সঙ্গিনীরা তাঁহার কাছে আসিত তখন তাহারা চলিয়া যাইত। কারণ তাহারা আল্লাহর রাসুলের (সা.) জন্য লজ্জা পাইত। যদিও আল্লাহর রাসুল (সা.) তাহাদিগকে তাঁহার কাছে পাঠাইয়া দিতেন।
সহি বুখারির ব্যাখ্যা শুনুন। হাদিসটার ফুটনোটে ‘ফতহুল বারি’র লেখক ইমাম ইবনে হাজার আসকালানীর উদ্ধৃতি: “পুতুল ও একই রকম ইমেজ অবৈধ কিন্তু ইহা বৈধ করা হইয়াছিল, তখন আয়েশার (রা.) জন্য। কারণ তিনি ছিলেন ছোটো বালিকা, তখনও তিনি বয়স্কা হননি।” (ফতহুল বারি, পৃষ্ঠা ১৪৩, ১৩ খণ্ড) নবি (সা.) পুতুল বৈধ করেছিলেন এটাই আসল কথা। কী কারণে করেছিলেন সেটা ইমামের জানা সম্ভব নয়। কারণ তিনি রাসুলের (সা.) ৮০০ বছর পরের হাজার মাইল দূরে মিসরের লোক, রাসুলের (সা.) সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়নি, কথাও হয়নি। ওটা তাঁর ব্যক্তিগত মত মাত্র।
এবারে আরও কিছু সংশ্লিষ্ট দলিল। তখন কাবার দেয়ালে ৩৬০টি মূর্তি (বুখারি ৩য় খণ্ড –৬৫৮) ও অনেক ছবির সঙ্গে ছিল হজরত ঈসা (আ.) ও মাতা মেরির ছবিও। উদ্ধৃতি দিচ্ছি, “রাসুল (সা.) হজরত ঈসা (আ.) ও মাতা মেরির ছবি বাদে বাকি সব ছবি মুছিয়া ফেলিতে নির্দেশ দিলেন।” (সিরাত (ইবনে হিশাম/ইবনে ইশাক-এর পৃষ্ঠা ৫৫২)
এবারে সাহাবি ও খলিফারা। দুনিয়ার প্রায় এক-চতুর্থাংশ জয় করেছিলেন মুসলিমরা। সবই অমুসলিমের দেশ এবং সেখানেও নিশ্চয়ই অনেক প্রতিমা-ভাস্কর্য ছিল, সেগুলোর তো সবই ভেঙে দেওয়ার কথা। কিন্তু সেখানেও আমরা তেমন দলিল পাই না। ৭১০ সালে হিন্দু রাজা দাহিরের দেশ সিন্ধু জয় করার পর কয়টা মূর্তি ভেঙেছিলেন। মোহম্মদ বিন কাশেম? ভাস্কর্য-মূর্তি তো দূরের কথা, কোনো প্রতিমাও ভেঙেছেন বলে জানা যায় না।
রাসুলের (সা.) অজস্র ছবি স্বচক্ষে দেখতে চাইলে ইরানে চলে যান। দেখবেন দেয়ালে ঝুলানো সুদৃশ্য কার্পেটে আছে মা আমিনার কোলে শিশু নবি (সা.), সাহাবি পরিবেষ্টিত নবিজি (সা.), আসমানে বোরাখে উপবিষ্ট নবিজি (সা.) ইত্যাদি। গুগল করলেই পেয়ে যাবেন- সবই কাল্পনিক ছবি অবশ্য –হাজার বছর ধরে আছে ওগুলো। ইরান এখন তো শিয়া দেশ, কিন্তু ৭৫০ সালে আব্বাসিরা দখল করার আগে পর্যন্ত ওটা সুন্নি উমাইয়াদের রাজত্ব ছিল।
এবারে সাম্প্রতিক কাল। ছবি তো ছবি, নবিজির (সা.) আট ফুট উঁচু, ১০০০ পাউণ্ড ওজনের মার্বেল পাথরের ভাস্কর্যও ছিল দীর্ঘ ৫৩ বছর। ১৯০২ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ২৫ নং স্ট্রিট ম্যাডিসন এভিনিউতে অবস্থিত ম্যাডিসন পার্কের মুখোমুখি নিউইয়র্ক আপিল বিভাগের কোর্ট দালানের ছাদে। ইতিহাসের আরও নয়জন আইনদাতাদের সঙ্গে নবিজির (সা.) আট ফুট উঁচু মার্বেল পাথরের ভাস্কর্যও রাখা ছিল সসম্মানে। গুগলে ‘এ স্ট্যাচু অব মুহাম্মদ’ সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন। মুসলিম সমাজ ও দেশগুলোর অনুরোধের প্রেক্ষিতে ওটা সরানো হয়েছে। এখন ইতিহাসের বাকি নয়জন আইনদাতার ভাস্কর্য রাখা আছে। কোর্টের ভিতরের দেয়ালে ওই দশজনের সঙ্গে তাঁর ভাস্কর্য এখনও আছে কি না জানি না। ওটার ছবি এখনও আছে কি না জানি না।
কোরান-রাসুল (সা.)-সাহাবি-খলিফা-সাম্প্রতিক কাল তো অনেক হল, মধ্যপ্রাচ্যের কী খবর? হাঙ্গামা করার আগে বাংলাদেশের ইমামদের ভেবে দেখা দরকার কেন মধ্যপ্রাচ্যের ইমামেরা ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে নন। সৌদি আরবেও বহু ভাস্কর্য আছে। গুগল করুন ‘স্ট্যাচু ইন মুসলিম ওয়ার্ল্ড’ কিংবা স্ট্যাচু ইন সৌদি আরব’- রাস্তার মোড়ে মোড়ে উটের, কবজি থেকে হাতের আঙুলের, মুসলিম বীরদের এবং আরও কত ভাস্কর্য। সেখানকার মওলানারা জানেন কোরান ও রাসুল (সা.) সুস্পষ্টভাবে প্রতিমাকে নিষিদ্ধ করে মূর্তি ও ভাস্কর্যকে বৈধ করেছেন। তাই তাঁরা মুসলিম বিশ্বে অজস্র মূর্তি ও ভাস্কর্যকে অস্বীকৃতি জানাননি।
এবারে কোরান। কোরানে সুস্পষ্ট বলা আছে: (ক) মূর্তিপূজা শয়তানের কাজ (মায়েদা ৯০) এবং (খ) “এই মূর্তিগুলো কী, যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ?” (আম্বিয়া ৫২)। অর্থাৎ কোরানের নিষেধ মূর্তিপুজো, উপাসনা-আরাধনা-ইবাদত সম্পর্কে। কারণ মূর্তি স্রষ্টার অংশীদার অর্থাৎ শরিক হয়ে দাঁড়ায়। এটাই মানুষকে মুশরিক বানায়। তাহলে যে মূর্তিকে আরাধনা ইবাদত করা হয় না, যে মূর্তি সৌন্দর্য বাড়ায়, সুসজ্জিত করে সে ব্যাপারে কোরান কী বলে? এখানে আমরা অবাক হয়ে দেখব কোরান সুস্পষ্ট ভাষায় ভাস্কর্যের অনুমতি দেয়। উদ্ধৃতি: “তারা সোলায়মানের (আ.) ইচ্ছানুযায়ী দূর্গ, ভাস্কর্য, হাউজসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত।” (সুরা সাবা, আয়াত ১৩) নবিজি (সা.) মূর্তি-ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে সেটা কোরানের ওই আয়াতের বিরুদ্ধে যেত, সেটা সম্ভব নয়। আরাধনা করলে সেটা হয় প্রতিমা আর না-করলে হয় ভাস্কর্য (মূর্তি)। ইসলাম প্রতিমার বিরুদ্ধে, ভাস্কর্য ও মূর্তির বিরুদ্ধে নয়।
আদি থেকে মানুষ স্রষ্টা খুঁজেছে, সূর্য-চন্দ্র থেকে শুরু করে পশু-পাখিকে, এমনকি নিজেরাই মূর্তি বানিয়ে আরাধনা করেছে। যে হজরত মুসা (আ.) মানুষকে সেই একমেবাদ্বিতীয়ম স্রষ্টার দিকে ডেকেছেন তাঁর বিশ্বাসীরা বাছুরের মূর্তির আরাধনা করেছে। যে ঈসা (আ.) মানুষকে সেই একমেবাদ্বিতীয়ম স্রষ্টার দিকে ডেকেছেন তাঁর বিশ্বাসীরা তাঁর তো বটেই, তাঁর মায়েরও (মাতা মেরি) মূর্তি বানিয়ে আরাধনা শুরু করেছে। যে গৌতম বুদ্ধ স্রষ্টার ধারণা ত্যাগ করে কর্মফলের কথা বলেছেন, তাঁর অনুসারীরা তাঁর মূর্তি বানিয়ে আরাধনা শুরু করেছে। এখানেই ইসলামের আপত্তি : ইসলাম আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক বা অংশীদার করার ঘোর বিপক্ষে। তাই হয়তো অতীত বর্তমানের কিছু ইমাম সরাসরি মূর্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, প্রতিমা ও ভাস্কর্যের পার্থক্য উপেক্ষা করছেন। ইমামেরা প্রতিমার বিরুদ্ধে বলুন অসুবিধা নেই, কিন্তু ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে সেটা কোরান-রাসুলের (সা.) বিরুদ্ধে দাঁড়ানো হয় কি না, তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন।”
হামালাত আল-আরশ– যে সমস্ত ফেরেশতা আল্লাহর আরশ ধরে রাখে। জিবরাইল— আল্লাহর দূত ও সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেশতা। কাজ, বার্তা প্রেরণ। মিকাইল— ইনি বৃষ্টি ও খাদ্য উৎপাদনের দায়িত্বপ্রাপ্ত। ইসরাফিল— এই ফেরেস্তা কিয়ামত বা বিশ্বপ্রলয় ঘোষণা করবেন। আজরাইল— ইনি মৃত্যুর ফেরেশতা ও প্রাণ হরণ করেন। সাতটি বেহেশতের ফেরেশতাগণ। হাফাজা বা তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাগণ। মুনকার ও নাকির— কবরে প্রশ্নকারী ফেরেশতাদ্বয়। দারদায়িল মালিক— জাহান্নাম বা নরক তত্ত্বাবধানকারী ফেরেশতা। রেদওয়ান— জান্নাত বা স্বর্গ তত্ত্বাবধানকারী ফেরেশতা। জাবানিয়া— জাহান্নামে দায়িত্ব পালনকারী ফেরেশতাগণ। একটু খোঁজখবর নিলেই দেখা যাবে মোহম্মদের এই ফেরেশতাদের প্রতিটি চরিত্রই মিশরীয়, গ্রিক, রোমান বা আরও পুরোনো সভ্যতাগুলোতে নানাভাবে প্রচলিত ছিল। আরবেও সেই গল্পগুলি প্রচলিত ছিল উপকথা হিসাবে। সম্ভবত মোহাম্মদ ছোটোবেলা থেকেই নানাজনের কাছে নানামুখে এইসব গল্প শুনে শুনে বেড়ে উঠেছে। যার ফলশ্রুতিতে সেই সব মূর্তিমান দেবদেবীরাই হয়ে উঠেছে মোহম্মদের বিমূর্ত ফেরেশতা। ইসলামে মূর্তি গড়া বা ছবি অঙ্কন নিষিদ্ধ না-করলে এইসব ফেরেশতাদের মূর্তি, পুজো, বোধন, বিসর্জন সবই হত।
শুধু যে হিন্দুরাই দেবদেবীর পুজো করা হয় তা নয়, অনেক সভ্যতায় এইরকম দেবদেবীর প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রিক, রোমানে প্রচুর দেবদেবীদের কথা আমরা জানি। এঁরা খুব বিখ্যাত। গ্রহ-উপগ্রহদের নামকরণ এইসব দেবদেবীদের নামেই। মোহাম্মদের সঙ্গে কৈশোরে হাজরে আসওয়াদ পাথরের স্মৃতি থাকার কারণে মোহাম্মদ এই প্যাগান পাথরটি কাবায় সংরক্ষণ করতে বলেন। যদিও ওমরের বক্তব্য থেকে জানা যায়, মোহাম্মদ যদি এই পাথরটিকে সম্মান না দিতেন, তাহলে সে পাথরটিকে কাবায় বরদাস্ত করত না। যেহেতু ইসলাম একটি আপাদমস্তক পুরুষতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক ধর্ম, তাই এই কালো পাথরটির ইতিহাসই বদলে ফেলা যেতেই পারে। অতএব সেই সময়ে উপায় ছিল দুইটি– (১) নারী দেহের উর্বরতার প্রতীক হিসাবে পূজিত কালো পাথরটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া, (২) কালো পাথরটিকে ইসলামিকরণ করা। মুসলমানরা দ্বিতীয় পথই বেছে নিল, কালো পাথরটিকে ইসলামিকরণ করেন এবং সেইসঙ্গে পাথরটিতে মাহাত্ম্য জুড়ে দিয়ে প্রচার করে দিল— এই পাথরটি আদম হাওয়ার সময় স্বর্গ থেকে নেমেছিল। স্বর্গ একটি অমীমাংসিত ও বিতর্কিত বিষয়।
এতক্ষণ পড়ার পর মুমিনরা নিশ্চয় মনে মনে আমাকে বলে ফেলেছেন– “শ্লা, কাফেরের বাচ্চা”। মুমিনগণ, বলতেই পারেন। কারণ এটাই আপনাদের বিশ্বাস। বিশ্বাস কখনোই যুক্তির পথে হাঁটে না। সেইসব মুমিনরা আরও কী বলবেন সেটাও জানি, যেমন—১) “অমুসলিম ও নাস্তিকরা কোরানের আয়াতের মর্ম বোঝে না। ভুল ব্যাখ্যা করে।”— তবে কি কোরানের আয়াতের মর্ম বুঝতে হলে খারিজি/কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে শিক্ষিত হতেই হয়? যারা জন্মের পর পরই লিখতে পড়তে শেখার আগেই কোরানের আয়াতের মর্ম সব বুঝে ফেলে।(২) “কোরানের আয়াত এমনি এমনি বোঝা যাবে না, শানে নজুল ও তফসির পড়তে হবে।”— তার মানে আল্লাহ মিথ্যা কথা বলেছে? আল্লাহ বলেছে, ‘আমি কোরান তোমাদের জন্য সহজ করে নাজিল করেছি যেন তোমরা তা বুঝতে পারো, এতই যখন সহজ করে নাজিল হয়, তবে কেন শানে নজুল আর তফসির পড়ার প্রয়োজন হবে? (৫) “আলাদা আলাদা আয়াত দিলে হবে না, আগের আয়াত এবং পরের আয়াত দিতে হবে।”— আরে ভাই, পুরো কোরান কি একসাথে নাজিল হয়েছিল? এইটুকু একটা বই লিখে শেষ করতে মোহাম্মদ তার জীবনের ২৩ বছর সময় ব্যয় করলে আমাকে একদিনে পুরো কোরান কপি/পেস্ট করতে হবে কেন? আমাকে একজন মুমিন টাইপের লোক এসে আমাকে বলছেন— “আপনি সুরা বাক্কারাহের ২৪ রুকুর ১৯০, ১৯১ নম্বর আয়াত উল্লেখ করলেন আর ১৯২ নম্বর আয়াত বাদ দিলেন কেন?” আমি বললাম –এমন কী আছে ১৯২ নম্বর আয়াতে, যা উল্লেখ করলে ১৯০ ও ১৯১ নম্বর আয়াতের অর্থ বদলে যাবে? তিনি বললেন –“১৯২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে।– যদি তারা বিরত হয়, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়”। আমি বললাম –“আমি আরবি জানি না একথা দিনের আলোর মতো সত্য। কিন্তু বাংলা ভাষা জানি না বুঝি না, একথা আপনার মনে হল কেন? ১৯২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, বিরত (নিশ্চয় যুদ্ধে) হলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন, করুণা করবেন। আর বিরত না-হলে অবশ্যই ১৯০ ও ১৯১ নম্বর আয়াত কার্যকরী হবে। ১৯২ নম্বর আয়াতটি থাকা-না-থাকায় কি এই আয়াত দুটি মিথ্যা হয়ে যায়, নাকি অর্থ বদলে যায়? আর এখানে বিরত’ মানে তো ইসলামে আত্মসমর্পণ। এরপর সবই গণিমতের মাল। তাই তো?” যুদ্ধনীতি তো এমন হতেই হয়। এতে ওজোর-আপত্তির কী আছে! এমন কোনো যুদ্ধ এ পৃথিবীতে হয়েছে নাকি, যে যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে হত্যা করা হয় না, আত্মসমর্পণ করার সুযোগ দেওয়া হয় না? এমন। কোনো যুদ্ধ হয়েছে নাকি, যে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করলে ক্ষমা করে দেওয়া হয় না? পরাজিত হয়ে ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্যসহ জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেননি ভারতীয় জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে? আর আত্মসমর্পণ না-করলে কি ভারতীয় সেনানায়ক পাকিস্তানি সেনানায়ক ও তাঁর সেনাদলকে ফুল-বেলপাতা ছড়িয়ে পুজো করতেন? তাহলে ১৯২ নম্বর আয়াতে নতুন কী বলা হল!
কোনো মুসলিম যদি কোরানকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেন, তাহলে মুসলমানদের অমুসলিমদের বিরুদ্ধে চিরকালীন যুদ্ধে রত থাকতে হয়। এর বিরোধিতা করা মানে কোরানকে অস্বীকার করা। কোরানকে অস্বীকার করা মানে তিনি মুসলিম নন –তিনি মুনাফিক, কাফের, মুর্তাদ। কোনো রাষ্ট্রের সংবিধানের সব অংশ যেমন সকলের নয়, ঠিক তেমনি কোনো ধর্মের সব অংশও যেমন সকলের জন্য নয়। একটা বড় অংশ থাকে সামরিক আইন। যা কেবল সামরিক বাহিনীর জন্যই প্রযোজ্য, সাধারণের জন্য নয়। সাধারণের জন্য তা বেআইনি, না-জায়েজ। কোরান ও হাদিসের একটা বড়ো অংশই হল যুদ্ধ বিষয়ক নির্দেশনা। যুদ্ধ রাষ্ট্রই করে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। রাষ্ট্রের কাছে যুদ্ধ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যুদ্ধ কখনোই সাধারণ মানুষ করে না। যুদ্ধ করে রাষ্ট্রনায়কের নির্দেশে সেনানায়ক ও তাঁর সেনাবাহিনী। তাই কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন কোরান ও হাদিস হল একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক গ্রন্থ। রাজনৈতিক ক্ষমতায়ণের উদ্দেশ্যেই এই গ্রন্থের অবতারণা।
ইসলাম নিয়ে বিশ্বের চিন্তাশীল বিদগ্ধজনদের আগ্রহ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ইসলাম নিয়ে চর্চা করে অনেকেই এই ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ, শিক্ষায় সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। ইসলামের বিরুদ্ধে সীমাহীন নেগেটিভ প্রোপাগান্ডার পরও বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও প্রসার হচ্ছে অপ্রতিরোধ্যভাবে। মূলত ইসলাম কথা বলে নিপীড়িত, বঞ্চিত, অসহায় মানুষেরা পক্ষে, তাই বিশ্বের কায়েমি স্বার্থবাজ শক্তি সচরাচর ইসলামের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুসলিম নামধারী কিছু মানুষের ইসলাম-বিরোধী ক্রিয়াকলাপ, আচার অনুষ্ঠান বিশ্বে ইসলামের বিপক্ষের লোকদের প্রচারের অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি, সমাজবিরোধী ক্রিয়াকর্ম, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি সহ কিছু মুসলিম নামসর্বস্ব সংগঠনের সন্ত্রাসী তৎপরতা নিঃসন্দেহে ইসলাম সম্বন্ধে মানুষের বিরূপ ধারণা জন্ম দিতে সহায়ক হচ্ছে। সাধারণ মানুষ মুসলিমদের এই অপকর্মকে ইসলাম বলে ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছে। আশার কথা হল, মুসলিম সমাজের বিভিন্ন সংগঠন এই সব অপকর্ম তথা ইসলাম-বিরোধী কাজকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। তুমুল লেখালেখি হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সংগঠন ইসলামের প্রকৃত স্বরূপটি কথা ও কাজের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে অহরহ প্রচেষ্টা করছে।
যাবতীয় অন্যায়, অবিচার থেকে মুক্তির পুর্ব শর্ত হল মানুষে মানুষে পারস্পরিক ভালোবাসা, সহানুভূতিশীল হওয়া। সে জন্য সর্বশেষ নবির পরিচয় সম্পর্কে কোরানে বলা হয়েছে –“আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত (কল্যাণ) স্বরূপ প্রেরণ করেছি। তাই তো আমরা দেখি নবির চরম শত্রুরা পর্যন্ত যখন তাঁর বিরুদ্ধে কটুবাক্য প্রয়োগ করত তিনি ধৈর্যের সঙ্গে জবাব দিয়েছেন, পাল্টা গালি তিনি দেননি, কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করেননি। এই জন্য তাঁর সম্পর্কে কোরানে বলা হয়েছে— “আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন, পক্ষান্তরে যদি আপনি রাগ ও কঠিন হৃদয়ের হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।” স্বাভাবিকভাবে আরবের বেদুইনরা ছিল কঠিন প্রকৃতির, মোহম্মদের কোমলতা মানুষ তাঁর দিকে আকৃষ্ট হয় দ্রুত। নবি বলেছেন— “খবরদার তোমরা কাহারও উপর জুলুম অত্যাচার করো না। কারও সম্পদ জোর করে নিয়ে নেওয়া বৈধ নয়। মোহাম্মদ বলেন –“যদি কোনো অমুসলিমের উপর কোনো মুসলিম নিপীড়ন চালায়, অধিকার খর্ব করে তাহলে শেষ বিচারের দিন মোহম্মদ ওই অমুসলিম নাগরিকের পক্ষে থেকে অত্যাচারী মুসলিমের বিরুদ্ধে মামলা করবেন।
কোরান প্রসঙ্গে আমার আলোচনা শেষ করব হাফেজ আব্দুল্লাহ আল মাসুদের কথা দিয়ে। ১০ বছর টানা মসজিদে ইমামতি করেছেন মুফতি মাসুদ, দীর্ঘদিন একটি কওমি মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব পালন করেছেন। আলহাজ ‘হাফেজ মাওলানা মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ তাঁর মাদ্রাসা জীবনের স্মৃতি লিখতে গিয়ে কোরান এবং ইসলামের কঠোর সমালোচনা করেছেন। যাঁরা পড়তে চান, তাঁদের জন্য এই লিংকটা দিয়ে রাখলাম https://somoyekhon.com/news/15458। পড়তে মন চাইলে পড়ে নিতে পারেন। আব্দুল্লাহ আল মাসুদ বর্তমানে ইসলাম-ত্যাগী, মুরতাদ শিরোপায় ভূষিত হয়েছেন। এই মুহূর্তের মাসুদ যে ভাবনায় অবস্থান করছেন, সেটুকুও বলে রাখি –“আমি স্বপ্ন দেখি একটি অসাম্প্রদায়িক পৃথিবীর। আমি স্বপ্ন দেখি একটি সুন্দর পৃথিবীর। এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি যেখানে মানুষকে কাফের, নাস্তিক, মুসলিম, হিন্দু, ইহুদি ইত্যাদি কারণে হত্যা করা হবে না। যেখানে সবার পরিচয় হবে মানুষ। ধর্মের পরিচয়ের চেয়ে মানুষের পরিচয় অনেক বড়ো।” ভারতের ভারতের নবম রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মার হিন্দি ভাষায় কোরান শরিফ’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। একটু পড়াই –“আমল কি কিতাব থি,/দুয়া কি কিতাব বনা দিয়া।/সমঝনে কি কিতাব থি,/পড়নে কা কিতাব বনা দিয়া।/জিন্দাওঁ কা দস্তুর থা,/মুর্দাওঁ কা মনশুর বনা দিয়া।/জো ইলম্ কি কিতাব থি/উসে লা-ইলমে কে হাথ থমা দিয়া।/তশখির-এ-কয়েনাৎ কা দর্স দেনে আয়ি থি,/সি মদ্রাসোঁ কা নিসাব বনা দিয়া।/মুর্দা কওমে কো জিন্দা করনে আয়ি থি,/মুর্দো কো বখশওয়ানে পের লগা দিয়া।/অয় মুসলমানে, ইয়ে তুম নে ক্যা কিয়া?” অর্থাৎ “আমল করার কিতাব ছিল, দোয়ার কিতাব বানিয়ে দিয়েছ।/অনুধাবন করার কিতাব ছিল,/পাঠের কিতাব বানিয়ে দিয়েছ।জীবিতদের জীবনবিধান ছিল,/মৃতদের ইশতাহার বানিয়ে দিয়েছো।/যেটা ছিল জ্ঞানের কিতাব,/মূর্খদের হাতে ছেড়ে দিয়েছ।/সৃষ্টির জ্ঞান দিতে এসেছিল এটা,/স্রেফ মাদ্রাসার পাঠ্য বানিয়ে দিয়েছ।/মৃত জাতিদের বাঁচিয়ে তুলতে এসেছিল এটা,/মৃতের জন্যে দোয়ার কাজে লাগিয়ে দিয়েছ।/হে মুসলমানেরা, এ তোমরা কী করেছো?”
কোরান প্রসঙ্গ শেষ করব ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও হিন্দি ভাষার খ্যাতিমান কবি শঙ্করদয়াল শর্মার একটি কবিতা দিয়ে। কবিতাটি পড়ে আমি বিস্মিত হয়েছি। লেখার প্রায় চার দশক পরেও এই কবিতার প্রাসঙ্গিকতা তো কমেইনি, বরং বেড়েছে বলেই মনে হয়। মুসলমানদের কী করা উচিত ছিল আর কী করেছে। তাঁর কবিতা ‘কোরান শরিফ’-এ লিখছেন— “আমল কি কিতাব থি,/ দুয়া কি কিতাব বনা দিয়া।/সমঝনে কি কিতাব থি,/পড়নে কা কিতাব বনা দিয়া।/জিন্দাওঁ কা দস্তুর থা,/মুর্দাওঁ কা মনশুর বনা দিয়া।/জো ইলম্ কি কিতাব থিউসে লা-ইলমে কে হাথ থমা দিয়া।/তশখির-এ-কয়েনাৎ কা দর্স দেনে আয়ি থি,/সি মদ্রাসোঁ কা নিসাব বনা দিয়া।/মুর্দা কওমে কো জিন্দা করনে আয়ি থি,/মুর্দেী কো বখশওয়ানে পের লগা দিয়া।/অয় মুসলমানে, ইয়ে তুম নে ক্যা কিয়া?” তায়েদুল ইসলামের বাংলা তর্জমায়– “আমল করার কিতাব ছিল,/দোয়ার কিতাব বানিয়ে দিয়েছ।/অনুধাবন করার কিতাব ছিল,/ পাঠের কিতাব বানিয়ে দিয়েছ।/জীবিতদের জীবনবিধান ছিল,/মৃতদের ইশতাহার বানিয়ে দিয়েছ।/যেটা ছিল জ্ঞানের কিতাব,/মূর্খদের হাতে ছেড়ে দিয়েছ।/সৃষ্টির জ্ঞান দিতে এসেছিল এটা,/স্রেফ মাদ্রাসার পাঠ্য বানিয়ে দিয়েছ।/মৃত জাতিদের বাঁচিয়ে তুলতে এসেছিল এটা,/মৃতের জন্যে দোয়ার কাজে লাগিয়ে দিয়েছ।/হে মুসলমানেরা, এ তোমরা কী করেছ?”
এবার আসব ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় অন্যতম প্রাণভোমরা’ হাদিস। হাদিস হল মূলত ইসলাম ধর্মের শেষ বাণীবাহক হজরত মোহাম্মদের বাণী ও জীবনাচরণ। হাদিসের উপদেশ মুসলমানদের জীবনাচরণ ও ব্যবহারবিধির অন্যতম পথনির্দেশ। হাদিসকে অনেক সময় কোরানের ব্যাখ্যা হিসেবেও অভিহিত করা হয়। আল্লামা সাখাবি মতে, হাদিস শব্দের আভিধানিক অর্থ হল কাদিম তথা অবিনশ্বরের বিপরীত আর পরিভাষায় বলা হয় নবির দিকে সম্বন্ধযুক্ত। তাই তার বক্তব্য হোক বা কর্ম বা অনুমোদন অথবা গুণ এমন কী ঘুমন্ত অবস্থায় বা জাগ্রত অবস্থায় তাঁর গতি ও স্থির সবই হাদিস। বুখারি শরিফ মতে, ইলমে হাদিস এমন বিশেষ জ্ঞান যার সাহায্যে প্রিয় নবির কথা, কাজ ও অবস্থা জানতে পারা যায়। ফিকহবিদদের কাছে হাদিস হল— আল্লাহর রাসুলের কথা ও কাজসমূহ। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও আলিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন হেড মাওলানা মুফতি সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ আমিমুল ইহসান বারকাতির মতে, হাদিস এমন একটি বিষয়, যা নবির বাণী, কর্ম ও নীরবতা এবং সাহাবায়ে কেরাম, তাবিইনদের কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতিকে বোঝায়। সোজা অর্থ হল –কথা, বাণী, সংবাদ, উপদেশ, কাহিনি, বক্তব্য, নতুন ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায় হাদিসের ছয়টি অন্যতম হাদিসগ্রন্থকে একত্রে ‘কিতাবুস সিত্তাহ’ বলে। সেই ছয়খানি হাদিস হল– সহিহ বুখারি (হাদিস সংখ্যা ৭৩৯৭), সহিহ মুসলিম (হাদিস সংখ্যা ৪০০০), জামি’আত তিরমিজি (হাদিস সংখ্যা ৩৮১২), সুনানে আবু দাউদ (হাদিস সংখ্যা ৪৮০০), সুনানে নাসাই (হাদিস সংখ্যা ৫৭৬১) এবং সুনানে ইবনে মাজাহ (হাদিস সংখ্যা ৪৩৪৯)।
মোহাম্মদের জীবদ্দশায় সাহাবিরা (যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে মোহম্মদের সাহচর্য লাভ করেছেন বা তাঁকে দেখেছেন ও তাঁর একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, অথবা জীবনে একবার তাঁকে দেখেছেন এবং ইমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে সাহাবি বলে।) তাঁর হাদিসগুলি অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে মুখস্থ করে স্মৃতিপটে রাখতেন। আবার অনেকে তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে কিছু কিছু হাদিস লিখে রাখতেন। এভাবে মোহম্মদের জীবদ্দশায় স্মৃতিপটে মুখস্থ করে রাখার সঙ্গে সঙ্গে কিছু হাদিস লিখিত আকারে লিপিবদ্ধ ছিল। হজরত আলি, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হজরত আনাস ইবনে মালিক প্রমুখ সাহাবি কিছু কিছু হাদিস লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। হজরত আবু হুরায়রা বলেন “আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ব্যতীত আর কোনো সাহাবি আমার অপেক্ষা অধিক হাদিস জানতেন না। কারন তিনি হাদিস লিখে রাখতেন, আর আমি লিখতাম না।” মোহম্মদের জীবদ্দশায় ইসলামি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক বহু কাজকর্ম লিখিতভাবে সম্পাদনা করা হত। বিভিন্ন এলাকার শাসনকর্তা, সরকারি কর্মচারী এবং জনসাধারণের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে লিখিত নির্দেশ প্রদান করা হত। তা ছাড়া রোম, পারস্য প্রভৃতি প্রতিবেশী দেশসমূহের সম্রাটদের সঙ্গে পত্র-বিনিময়, ইসলামের দাওয়াত এবং বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে চুক্তি ও সন্ধি লিখিতভাবে সম্পাদন করা হত। আর মোহম্মদের আদেশক্রমে যা লেখা হত, তা হাদিস বলে পরিচিত। মোহম্মদের ওফাতের পর বিভিন্ন কারণে হাদিস সংকলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কোরান মাজিদের সঙ্গে হাদিস মিশে যাওয়ার আশঙ্কায় কোরান পূর্ণ গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ না-হওয়া পর্যন্ত হাদিস লিপিবদ্ধ করতে কেউ সাহস পায়নি। কোরানের বাণীর সঙ্গে হাদিসের বাণী মিশে যাওয়ার আশঙ্কা! আশ্চর্য, আল্লাহ বাণীর সঙ্গে মোহম্মদের বাণীর এত মিল!! তাই বুঝি হাদিসে বাণীর ধরন আর কোরানের বাণীর ধরনে এত সাদৃশ্য। আলাদা করে বলে না-দিলে বোঝাই যাবে না, কোনটা হাদিস কোনটা কোরান। বোঝাই যায়, আশঙ্কাটা অমূলক নয়। যাই। হোক, সেই কারণেই নাকি হজরত আবু বকরের আমলে কোরান মাজিদ গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হলে সাহাবিরা হাদিস লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে আর কোনো বাধা আছে বলে অনুভব করেননি। হিজরি প্রথম শতাব্দীর শেষভাগে সাহাবি ও তাবেয়ীরা প্রয়োজন অনুসারে কিছু হাদিস লিপিবদ্ধ করেন। অতঃপর উমাইয়া খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আজিজ হাদিস সংগ্রহের জন্য মদিনার শাসনকর্তা আবু বকর বিন হাজম সহ মুসলিম-বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার শাসনকর্তা ও আলিমদের কাছে একটি ফরমান জারি করেন যে, আপনারা মহানবির হাদিসগুলি সংগ্রহ করুন। কিন্তু সাবধান! মহানবির হাদিস ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করবেন না। আর আপনার নিজ নিজ এলাকায় মজলিস প্রতিষ্ঠা করে আনুষ্ঠানিকভাবে হাদিস শিক্ষা দিতে থাকুন। কেননা, জ্ঞান গোপন থাকলে তা একদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই আদেশ জারির পর মক্কা, মদিনা, সিরিয়া, ইরাক এবং অন্যান্য অঞ্চলে হাদিস সংকলনের কাজ শুরু হয়। কথিত আছে, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ইবনে শিহাব জুহরি সর্বপ্রথম হাদিস সংগ্রহ এবং সংকলনে হাত দেন। কিন্তু তাঁর সংকলিত হাদিসগ্রন্থের বর্তমানে কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না (হাদিসের মতো গ্রন্থের কেন সন্ধান পাওয়া যায় না, সেটা রহস্যজনক বটে। সন্ধান পাওয়া যায়নি, নাকি হারায়ে খুঁজি!)। তাই শুরু হয়ে গেল ‘নতুন’ হাদিস। এরপর ইমাম ইবনে জুরাইজ মক্কায়, ইমাম মালিক মদিনায়, আবদুল্লাহ ইবনে ওয়াহাব মিশরে, আব্দুর রাজ্জাক ইয়েমেনে, আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক খুরাসানে, এবং সুফিয়ান সাওরি ও হাম্মাদ ইবনে সালমা বসরায় হাদিস সংকলনে আত্মনিয়োগ করেন। এ যুগের ইমামরা কেবল দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় হাদিসগুলি ও স্থানীয় হাদিস শিক্ষাকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত হাদিসগুলি লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের কেউই বিষয়বস্তু হিসাবে বিন্যাস করে হাদিসগুলি লিপিবদ্ধ করেননি। এ যুগে লিখিত হাদিস গ্রন্থগুলির মধ্যে ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্তা’ সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান প্রামাণ্য হাদিসগ্রন্থ। ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্থটি হাদিস সংকলনের ব্যাপারে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। এটি হাদিস অধ্যয়নে মুসলিম মনীষীদের প্রধান আকর্ষণে পরিণত হয়েছিল। অতঃপর হিজরি তৃতীয় শতাব্দীতে বিভিন্ন মনীষী মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর হাদিস সংগ্রহ করেন। মোহম্মদের জীবদ্দশায় যে হাদিসগুলি প্রধানত সাহাবিদের স্মৃতিপটে মুখস্থ ছিল, তা ধীরে ধীরে লিখিত রূপ নেয় এবং আব্বাসীয় যুগে হাদিস লিপিবদ্ধের কাজ শেষ হয়।
এই হাদিসকে আমরা যদি সত্য বলে ধরে নেই, তাহলে হাদিস যতপ্রকার, সত্যও ঠিক তত প্রকার। ইসলামি সত্য আরও বহু প্রকার। কাজেই ইসলাম বা যে-কোনো ধর্মীয় সত্যের সঙ্গে প্রকৃত সত্যের বিস্তর ফারাক। লেখালেখির সময় যে হাদিস থেকেই উদ্ধৃতি দিই-না কেন, অমনি মুমিনরা বলে দেন– এটা সহিহ হাদিস নয়, জাল হাদিস। তাহলে সহিহ হাদিস কোনটা? একেক মুমিনের কাছ থেকে একেক পরামর্শ পেয়েছি। অতএব বিভ্রান্ত হয়েছি।
জাল হাদিসকে আরবিতে ‘মওজু’ বলা হয়। বস্তুত বলা হয় এই মওজু বা জাল হাদিস হল মিথ্যা বা বানোয়াট হাদিস, যা আদৌ কোনো হাদিসই নয়। সেইসব হাদিসকে জাল হাদিস বলা হয়, যা রাসুল মোহম্মদের নাম করে রচিত হয়েছে, যা কখনোই তিনি বলেননি। এককথায় মোহম্মদের নাম ভাঙিয়ে প্রচলিত ও কথিত হাদিসকে জাল বা মওজু বা বানোয়াট বা মিথ্যা হাদিস বলা হয়। জাল হাদিস বর্ণনা বা প্রচার করার মানে বা অর্থ হল মোহম্মদের উপর মিথ্যারোপ করা। তাঁকে মিথ্যার অপবাদে দুষ্ট করা এবং তাঁর কথাকে প্রত্যাখ্যান করে সীমা লঙ্ঘন করা। যা জাহান্নামে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। এ প্রসঙ্গে অবশ্য মোহম্মদ আগেই বলে রেখেছেন— “যে ব্যক্তি আমার উপরে মিথ্যারোপ করে, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়” (সহিহ বুখারি, প্রথম খণ্ড, কিতাবুল ইলম, হাদিস নং ১০৭; সহিহ মুসলিম, প্রথম খণ্ড, কিতাবুল ঈমান)। তিনি আরও বলেছেন— “তোমরা আমার উপর মিথ্যারোপ কোরো না, নিশ্চই আমার উপর মিথ্যারোপকারী জাহান্নামে প্রবেশ করবে” (বুখারি, প্রথম খণ্ড, কিতাবুল ইলম, হাদিস নং ১০৬; মুসলিম, প্রথম খণ্ড, কিতাবুল ঈমান; ইবনু মাজাহ, হাদিস নং ২৯)। তিনি আরও বলেছেন— “যে ব্যক্তি আমার নামে এমন হাদিস বর্ণনা করে যে, তার ধারণা হয়, ওটা মিথ্যাও হতে পারে; তবে সে অন্যতম সেরা মিথ্যুক।(সহিহ মুসলিম, প্রথম খণ্ড, কিতাবুল ঈমান)।
মুমিনরা বলেন— জাল হাদিসের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও প্রচারক হচ্ছে পির ও মাজার তথা কবরপূজারী এবং শিরক ও বিদয়াতপন্থীরা। এদের কেউ নিজেদের ধর্মকে টিকাতে, কেউ-বা নিজেদের পথভ্রষ্ট বুজুর্গের বিনাপুঁজির পির ব্যাবসা জমজমাট করতে, আবার কেউ-বা বিদয়াত ব্যাবসা করে নিজেদের সংসার চালাতে এবং বিদয়াতের জিলাপির আশায় এসব জাল হাদিস প্রচার ও প্রসার করে থাকে। আল্লাহর প্রিয় নবি মোহম্মদের ‘হাদিস’ এক মুসলিম জাল লিখে ফেলছে, আর ‘পরম করুণাময় ক্ষমাশীল’ আল্লাহ এসব দেখছেন! কোরানের যে বাণী তাঁর। একমাত্র প্রিয় নবি মোহাম্মদকে দিয়েছেন, সে মোহাম্মদের বদনাম হয়ে যাচ্ছে জাল হাদিসে প্রভাবে!!
অস্ট্রেলীয় শিয়া ইমাম শেখ মোহাম্মদ তাওহিদির কিছু ভিডিও বার্তা প্রচার করেছেন। তাতে তিনি সরাসরি হাদিস সংকলন সহিহ বুখারিকে নিষিদ্ধ করার কথা বলছেন। তার মত অনুসারে, এই আধুনিক যুগে ইসলামের সমস্ত ভুল। ব্যাখ্যা, অনাচার আর জঙ্গিবাদের মূলে আছে বুখারির হাদিস সংকলন। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই সুন্নি ইমামদের ফাটতে শুরু করে দিয়েছে। আগ্রহীরা গুগল করে সত্যতা যাচাই করতে পারেন।
তবুও আশার কথা, শেষপর্যন্ত বাড়ির ভিতর থেকে কেউ একজন ইসলামের ফাঁক-ফোঁকরের মূলে হাত দিতে শুরু করেছে। হোক না সে শিয়া বা সুন্নি! তাতে কী এসে যায়, মুসলিমই তো। যদি কোনো মুসলিম সত্যিকার অর্থে কোরানকে সৃষ্টিকর্তার বাণী হিসাবে গণ্য করেন, তবে তাঁকে কোরান বাদে সকল হাদিস গ্রন্থকে অবশ্যই নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ আল্লাহ কোরানে একাধিকবার হাদিস মানতে নিষেধ করেছেন। কোরান যদি সত্যিই পরিপূর্ণ জীবনবিধান হয়, যদি বলা হয় কোরান মানুষের সমগ্র জীবনচর্যার জন্য যথেষ্ট। এর বাইরে আর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই! তাহলে সহায়িকা পুস্তকের প্রয়োজন কেন হবে? আসুন জেনে নিই— (১) “হুকুমের মালিক আল্লাহ ছাড়া আর কেহ উপাস্য নয়”(কোরান ৬:৫৭)। (২) “এটা কি (কোরান) তাদের জন্যে যথেষ্ট নয় যে, আমি আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছি, যা তাদের কাছে পাঠ করা হয়। এতে অবশ্যই বিশ্বাসী লোকদের জন্যে রহমত ও উপদেশ আছে।”(কোরান ২৯ : ৫১)। (৩) “আল্লাহ কি তাঁর বান্দার পক্ষে যথেষ্ট নন? অথচ তারা আপনাকে আল্লাহর পরিবর্তে অন্যান্য উপাস্যদের ভয় দেখায়।”(কোরান ৩৯; ৩৬)
ইসলাম অনুসারে, কোরানই হচ্ছে আল্লাহর হাদিস এবং আল্লাহ চান কোরান ছাড়া মুসলিমরা অন্য কোনো হাদিস অনুসরণ না করুক। কোরান বলছে— (১) “তারা কি প্রত্যক্ষ করেনি আকাশ ও পৃথিবীর রাজ্য সম্পর্কে এবং যা কিছু সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ তাআলা বস্তু সামগ্রী থেকে এবং এ ব্যাপারে যে, তাদের সাথে কৃত ওয়াদার সময় নিকটবর্তী হয়ে এসেছে? বস্তুত এরপর আর কোনো হাদিসের উপর ঈমান আনবে?” (৭ : ১৮৫)। (২) “এক শ্রেণির লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার উদ্দেশে অবান্তর হাদিস সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি” (৩১ : ৬)।(৩) “এগুলো আল্লাহর আয়াত, যা আমি আপনার কাছে আবৃত্তি করি যথাযথরূপে। অতএব, আল্লাহ ও তাঁর আয়াতের পর তারা কোন হাদিসে বিশ্বাস স্থাপন করবে” (৪৫ : ৬)।(৪) “যদি তারা সত্যবাদী হয়ে থাকে, তবে এর (কোরানের) অনুরূপ কোন হাদিস উপস্থিত করুক” (৫২ : ৩৪)। (৫) “এরপরে (কোরান ছাড়া) আর কোনো হাদিসে বিশ্বাস স্থাপন করবে?” (৭৭ : ৫০)।
ইসলামের ইতিহাস বলছে— খলিফা আবুবকর আল্লাহর কোরান ছাড়া মোহাম্মদের হাদিস পুড়িয়ে ফেলার আদেশ শোনার পর ঠিক করতে পারছিলেন না, কী করবেন। দীর্ঘকাল মোহাম্মদের সঙ্গে থাকার সময়ে তিনি মাত্র ৫০০ হাদিস সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু হাদিস পুড়িয়ে ফেলার আদেশ শোনার রাতে সবগুলি হাদিস না-পোড়ানো পর্যন্ত তিনি ঘুমোতে পারেননি। খলিফা ওমর ইবনে আল-খাত্তাব তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহকে তাঁরই সংগৃহীত হাদিসগুলি ধ্বংস করতে বাধ্য করেছিলেন। ওমর ইবনে আল-খাত্তাব চারজন সাহাবিকে হাদিস বলা থেকে বিরত থাকার জন্য আদেশ করেছিলেন। এরা হলেন— ইবনে মাসুদ, আবু আল-দারদা, আবু মাসুদ আল আনসারি এবং আবু দার আল-গফফারি। খলিফা ওমর ইবনে আল-খাত্তাব আবু হুরায়রাকে মিথ্যাবাদী বলেছিলেন এবং তাকে এই বলে শাসিয়েছিলেন যে, যদি আবু হুরায়রা মোহাম্মদ সম্পর্কে মিথ্যা হাদিস বলা থেকে বিরত না-হয়, তবে তাঁকে তাঁর জন্মস্থান ইয়েমেনে ফেরত পাঠাবেন। ওমরের জীবদ্দশায় আবু হুরায়রা আর কোনো হাদিস বলেননি।
চতুর্থ খলিফা আলি ইবনে আবু তালেব এক খুতবায় বলেছিলেন –“যাঁদের কাছে আল্লাহর রসুলের কোনো হাদিস আছে, আমি তাঁদেরকে অনুরোধ করব বাড়ি গিয়ে সেগুলি মুছে ফেলতে। তোমাদের আগের মানবসমাজ ধ্বংস হয়ে গেছে তাঁদের ধর্মীয় পণ্ডিতদের হাদিস অনুসরণ করার জন্য এবং প্রভুর বাণী পরিত্যাগ করার জন্য।” জাইদ ইবনে থাবিত মোহাম্মদের মৃত্যুর ৩০ বছর পর মুয়াবিয়ার দরবারে মোহাম্মদ সম্পর্কে একটি গল্প বলেছিলেন। মুয়াবিয়ার গল্পটি ভালো লাগে এবং এটি লিখে রাখার আদেশ দেন। কিন্তু তখন জাইদ বলেন— রসুল আমাদেরকে আদেশ করেছেন, তাঁর কোনো হাদিস কখনও না লিখতে। এই গল্পটি ইবনে হাম্বল সংকলনে আছে এবং এই গল্প প্রমাণ করে হাদিস লেখার উপর নিষেধাজ্ঞা মোহাম্মদ মৃত্যুর আগেও তুলে নেননি। হাদিস বিরোধিতার সবচেয়ে পুরানো দলিল পাওয়া যায় ৭৬ হিজরি (৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ) খলিফা আব্দুল মালেককে লেখা আব্দুল্লাহ ইবনে ইবাদের লেখা। চিঠিতে। সেই চিঠিতে কুফাবাসীদেরকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে কোরানকে পরিত্যাগ করে মোহাম্মদের হাদিসকে ধর্মের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করার জন্য। “তারা এমন একটি বইকে বিশ্বাস করে, যা আল্লাহর থেকে নয়, মানুষের হাত দ্বারা রচিত এবং এটাকে রসুলের বাণী বলে দাবি করে” (Michael Cook, Muslim Dogma, Cambridge University Press, Cambridge, 1981)। তবে আব্বাসীয় খেলাফত সময়কালীন ও পরবর্তীতে সেলজুক খলিফাঁদের শাসনামলে হাদিস-বিরোধীদের সকল বই ও গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে হাদিস-বিরোধী লেখা ও তথ্য এখন তেমনটা পাওয়া যায় না। তবে হাদিস-বিরোধীদের উপস্থিতি ও যুক্তি সম্পর্কে জানা যায় শরিয়া আইনের জনক ও প্রবর্তক ইমাম শাফেয়ীর বই ‘জিমা আল ইলম’ ও ‘ইবনে কুতাইবার’ লেখা থেকে। তাঁরা একথা পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন— তাঁদের সময়ে হাদিস-বিরোধিতা ছিল সর্বব্যাপী।
মুমিন তথা মুসলিম বন্ধুরা, যদি আপনারা কোরানের কথা মানেন, তবে হাদিস মানার উপায় আর থাকে কি? আর যদি হাদিস না থাকে, তবে আপনাদের লালন-পালন করা ইসলামের চেহারা কেমন দাঁড়াবে, ভেবে দেখবেন। মুসলমানদেরকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের আলাদা করার ব্যবস্থা তো সব হাদিসেই রাখা আছে। সুন্নতের কী হবে! খত্না-দাড়ি-টুপি-হিজাব আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ— সবই তো মোহম্মদের নির্দেশ, বাণী। কেন হাদিস পোড়ানোর এত আয়োজন? কোরান, নতুবা হাদিস– যে-কোনো একটিকে বিলুপ্ত করা হবে কেন? কোরান বিলুপ্ত হওয়ার প্রশ্নই উঠছে না। কারণ কোরান ইতিমধ্যেই আল্লাহ প্রেরিত বাণী হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত। উভয় গ্রন্থ কোনো সাংঘর্ষিক ব্যাপার সৃষ্টি করতে পারে কি?
হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান সব ধর্মের মধ্যেই একাধিক ধর্মীয় মতবাদে বিভাজিত হয়েছে। তৈরি হয়েছে ঘরের ভিতর পৃথক আরও অনেক ঘর। ইসলামও ব্যতিক্রম নয়। এমনিতেই ধর্মে ধর্মের বিভাজন, তা উপর একই ধর্মের শত বিভাজন। প্রতিটি ধর্মের ভিতরে থাকে অসংখ্য শাখা। সাধারণত এই শাখাগুলি হয় একটি আরেকটি থেকে অনেকখানি আলাদা। এদের মাঝে যতটুকু মিল থাকে, অনেকক্ষেত্রে অমিল থাকে তার চেয়ে বেশি। আবার প্রতিটি শাখার মাঝে রয়েছে অনেক প্রশাখা। এসব প্রশাখার মধ্যেও আছে অনেক অমিল। প্রতিটি প্রশাখা নিজ ধর্মের অন্য সকল প্রশাখা, সকল শাখা ও অন্য সকল ধর্মকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে। অনেকে বলতে ভালোবাসেন যে, ইসলামে জাত বিভাজন নেই। তাহলে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখাগুলি দেখব।
আরবে নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে মুসলিম জাতিটির সংকট শুরু হয়ে যায় মোহম্মদের মৃত্যুর পরপরই। মোহম্মদের মৃতদেহ সৎকার না-করেই মক্কার মুহাজির ও মদিনার আনসাররা সেদিনই খলিফার নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েপড়েছিল। এ থেকেই বোঝা যায় কোনো ধর্ম এবং ধর্মপ্রতিষ্ঠানই কোনোদিনই প্রশ্নহীন ছিল না। আরবে যে কারণে ইসলামের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, তার মৌলিক উদ্দেশ্যটি কখনোই বাস্তবায়িত হতে পারেনি। যেভাবেই হোক, মোহম্মদ আরবের যতটুকু সংস্কার করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরেই তা আবার আগের মতোই উল্টোপথে ঘুরে যেতে থাকে। মোহম্মদের ঘনিষ্ট মানুষগুলিই একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল। আমরা যাঁদেরকে সাহাবি বলে থাকি, মুসলিমদের কল্পলোকে তাঁরা নক্ষত্রসম’ হলেও ইসলামের ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। ইসলামের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, শীর্ষস্থানীয় সাহাবিরা মোহম্মদের মৃত্যুর কিছুকাল পরেই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি মোহম্মদের এক জীবনসঙ্গিনী হজরত আয়েশাও ক্ষমতার এই নোংরা প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েন।
মক্কার কুরাইশ বংশের হাশেমি বনাম উমাইয়া গোত্রের দ্বন্দ্ব। হাশেমি গোত্র নবি মোহম্মদের নিজস্ব গোত্র। উমাইয়া গোত্র ছিল হাশেমি গোত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী। হাশেমি গোত্রে একজন নবি মোহম্মদকে উমাইয়া গোত্রের লোকেরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তাই শুরু থেকেই হজরত মোহম্মদ আর মোহম্মদের ইসলামের প্রকাশ্য বিরোধিতায় নেমে পড়েছিলেন উমাইয়া গোষ্ঠী। উমাইয়া গোষ্ঠীর আশংকা করছিল হাশেমিরা হজরত মোহম্মদকে সামনে রেখে সমগ্র আরবের নেতৃত্ব দখলে নিতে চাইছে। স্মত, মক্কা বিজয়ের আগে পর্যন্ত উমাইয়া গোত্রের নেতৃস্থানীয় কেউই মোহম্মদের আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেননি, অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করেনি। পরে অবশ্য বাধ্য হয়েই তাঁরা মোহম্মদের আনুগত্য মেনে নেয়। কিন্তু হাশেমি গোত্রের লোকদের কাছে এই আত্মসমর্পণ তাঁদের জন্য ছিল অপমানকর। দাঁতে দাঁত চেপে তাঁরা কেবল একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সেই সুযোগটা এসেই গেল, মোহম্মদের মৃত্যুর পর।
উমাইয়াদের একটাই লক্ষ্য ছিল হাশেমিরা যেন কোনোভাবেই ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করতে না পারে। হাশেমি গোত্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের ঈর্ষা ও প্রতিশোধপরায়ণতা কাজ করেছিল তাঁদের মনের ভিতর। কারণ হজরত মোহম্মদের সুচারু নেতৃত্বে গোটা আরব জুড়ে ইতিমধ্যেই হাশেমিরা বেশ সম্মানজনক অবস্থায়। সবার মুখে কেবল মোহম্মদেরই নাম। খলিফা নির্বাচনের সময় যখন আনসার বনাম মুহাজির দ্বন্দ্ব চরমে, সেই সংকটময় সময়ে হাশেমি গোত্রেরই অগ্রাধিকার। কারণ এটা ছিল দোর্দণ্ডপ্রতাপ মোহম্মদের নিজের গোত্র। এক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে একমাত্র হজরত আলি ছিলেন হাশেমি গোত্রের। কিন্তু তিনি মোহম্মদের শোকাহত পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত ছিলেন। উমাইয়ারাও নিজেদের কারও নামও প্রস্তাব করার সাহস করেননি সেসময়। কারণ প্রথমদিকে ইসলামের বিরোধিতা করায় তাঁদের অবস্থান ছিল বিব্রতকর। উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে একজন নিরপেক্ষ গোত্রের ব্যক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কোথায় পাওয়া যাবে তেমন নিরপেক্ষ ব্যক্তি! এমন একজন নিরপেক্ষ লোক ছিলেন তাঈম গোত্রের আবু বকর। আরেকজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব বনু আ’দি গোত্রের হজরত ওমর বিন খাত্তাব, তাঁকে সমর্থন দেওয়ায় পরিস্থিতি উমাইয়াদের অনুকূলেই যায়।
হজরত আবু বকর ছিলেন ইসলামের অন্যতম আদর্শবান মানুষ। তাঁর প্রতি বিশ্বাস ছিল সন্দেহের ঊর্ধ্বে। ব্যক্তিজীবনেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত নির্লোভ। কিন্তু তাঁকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল ক্ষমতাগুধু উমাইয়া গোষ্ঠীরা। আবু বকরের মৃত্যুর পর উমাইয়া নেতৃস্থানীয়রা আরেকজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে খলিফা হিসাবে দেখতে চাইল। সেই নিরপেক্ষ লোকটি ছিলেন হজরত ওমর। তবুও হাশেমি গোত্রের কাউকে নয়। হজরত ওমরের মৃত্যুর পর খলিফা হন হজরত উসমান, যিনি ছিলেন উমাইয়া গোত্রের। ক্ষমতার পালাবদলে হাশেমিদের বঞ্চিত করে রাখাটা ভালো চোখে দেখেনি হাশেমি গোত্রের মুসলিমরা। তাঁরা ক্রমেই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠে। তাঁদের ভাবগুরু ছিল হজরত আলি। হজরত উসমান যখন আততায়ীর হাতে নিহত হলেন, তখন এর দায় চাপানো হল আলির উপর। উমাইয়া গোত্রের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা দামেস্কের আমির মুয়াবিয়া ঘোষণা করেন, উসমান হত্যার বদলা না-নেওয়া পর্যন্ত আলির আনুগত্য মানব না। এ কথা শুনে আলি মুয়াবিয়কে দামেস্কের আমির পদ থেকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নেন।
সদ্য নিহত খলিফা হজরত উসমান ছিলেন উমাইয়া গোত্রের। তাই উমাইয়া গোত্রের সমস্ত মুসলিমদের মধ্যে পুরোনো গোত্রদ্বন্দ্ব আবার জেগে ওঠে। তাঁরা হাশেমি গোত্রের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে। এদিকে হাশেমি গোত্রও দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে উমাইয়াদের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হল। আরব উপদ্বীপে রক্তপাত অবধারিত হয়ে পড়ল। হাশেমি ও উমাইয়া গোত্রের পুরোনো বংশগত দ্বন্দ্ব আলি ও মুয়াবিয়ার মাধ্যমে পুনরায় সক্রিয় হল। হজরত আয়েশা ছিলেন মুয়াবিয়ার পক্ষে। যার ফলে নেতৃস্থানীয় সাহাবিরাও পরিষ্কারভাবে দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। এই বংশগত দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে কারবালার ময়দানে। যেখানে মুয়াবিয়ার পুত্র এজিদের সৈন্যরা আলির পুত্র হোসাইন ও তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করে। কারবালায় হাশেমিদের পতনে উমাইয়া খলিফা এজিদ ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিল— হাশেমিরা চিরকালই ক্ষমতার জুয়া খেলে। ক্ষমতার জন্য তারা একজনকে নবিও বানিয়েছিল। কিন্তু হায়! আজ যখন তাঁদের পতন হল, তখন কোনো নবিও এলো না, এমনকি কোনো দৈববাণীও অবতীর্ণ হল না।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিয়া ও সুন্নি এই দুই গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে গেল। হাশেমি ও উমাইয়া গোত্রের এই বংশগত দ্বন্দ্বই মূলত আজকের শিয়া ও সুন্নি বিরোধের মূল, যে দ্বন্দ্বের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে মুসলিম জাতির আরও অসংখ্য বিরোধ, তিলে তিলে শেষ করেছে একটি আদর্শিক সংগঠনের প্রকৃত সৌন্দর্যকে। ইসলাম আজ স্বাভাবিকভাবেই বিকৃত, বিতর্কিত। মুসলিম জাতির আজকের এই অধঃপতন শুধু তাদেরই ক্ষতি করছে না, পৃথিবীকেও চরম হুমকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। মুসলিমদের মধ্যে বহু বছর ধরে ধর্মত্যাগের ঢল নেমেছে। নতুন যুগের ছেলেমেয়েদের একটা বড়ো অংশই ইসলামে থাকতে চাইছে না। এমনকি কওমি মাদ্রাসাশিক্ষায় শিক্ষিতরাও স্বধর্ম থেকে বেরিয়ে আসছে। প্রয়োজনে স্বদেশ ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। কোরান মোতাবেক ধর্মত্যাগে মৃত্যুদণ্ডও তাঁদের আটকাতে পারছে না।
শিয়া-সুন্নি বিরোধের উৎস আরও আগেই শুরু হয়েছিল বলে মনে করেন অনেকে। মোহাম্মদ জীবিত থাকার সময়ের একটি ঘটনারও রেফারেন্স টানা হয়। বিদায় হজ্জ্ব শেষে মোহাম্মদ মদিনায় ফিরে যাওয়ার পথে গাদিরে খুম নামক এক অঞ্চলে পৌঁছানোর পর সবাইকে থামতে আদেশ করে পিছিয়ে পড়া সাহাবিদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন এবং এগিয়ে যাওয়া সাহাবিদেরও ফিরে আসার জন্য খবর পাঠিয়ে দেন। সকলে একত্রিত হলে দুপুর রৌদ্রের ভিতরে একটি মঞ্চ তৈরি করেন এবং হজরত আলিকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে উঠে একটি ভাষণ দেন। ভাষণের শেষে তিনি হজরত আলির হাত উঁচু করে ধরে বলেন যে, “আমি যাঁর মওলা, অতঃপর এই আলি তাঁরই মওলা।” শিয়ারা এটিকে মোহাম্মদের ঘোষিত হজরত আলির মনোনয়ন হিসাবে দেখেন। একথা শুনে সুন্নি আলেমরা বলেন যে, এখানে ‘মওলা’ বলতে বন্ধু বোঝানো হয়েছে। কিন্তু শিয়াদের মতে এখানে মওলা’ বলতে অভিভাবক ও শাসক বোঝানো হয়েছে। এই কারণে শিয়ারা হজরত আলিকে মোহাম্মদের পরবর্তী বৈধ নেতৃত্ব হিসাবে গ্রহণ করে, মধ্যবর্তী তিন খলিফাঁকে (হজরত আবু বকর, হজরত ওমর ও হজরত উসমান) তাঁরা অনুসরণযোগ্য মনে করে না।
মওলা মানে বন্ধু— সুন্নিদের এই দাবিটি আসলে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। যৌক্তিক নয়। মাওলা শব্দের অর্থ প্রায় ৩০টি পাওয়া যায়। যেমন –প্রভু, বন্ধু, সাহায্যকারী, মনিব, দাস, চাচাতো ভাই, প্রতিনিধি, অভিভাবক, নিকটবর্তী, আত্মীয়, নেতা, গুরু, প্রতিপালক, সর্দার, প্রেমিক, প্রতিবেশী, আনুগত্য প্রাথনা, নীরবতা, ইবাদত, দণ্ডায়মান, জাহান্নাম ইত্যাদি। কোরানে মওলা শব্দের অর্থ চারটি পাওয়া গেছে– অভিভাবক (সুরা বাকারা ২৮৫), আবাসস্থল (সুরা হাদিস ১৫), বন্ধু (সুরা মোহাম্মদ ১১), সহযোগী (সুরা তাহরিম ১১)। মওলা শব্দ থেকে মাওলানা শব্দের উৎপত্তি। মোহম্মদ নিজেও স্পষ্ট করে বলেননি, মওলা শব্দটি তিনি কোন অর্থে ব্যবহার করেছেন। সেই কারণেই এত জটিলতা তৈরি হয়েছে। দুই পক্ষ দুই অর্থ বুঝে এগিয়ে গেছে। বিচার্য বিষয় হল— প্রথমত, হজরত আলি মোহাম্মদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন একদম প্রথম থেকেই। এমনকি তিনি ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম পুরুষ। শুধুমাত্র বন্ধু ঘোষণা দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে হজরত আলিকে নিয়ে মঞ্চে ওঠা– এটাকে স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। যাঁরা মওলা’ শব্দটিকে সার্বিক অর্থে গ্রহণ করেছিল, তারা স্বাভাবিকভাবেই ইমাম আলি ছাড়া চার খলিফার অন্য তিন খলিফাঁকে (হজরত আবু বকর, হজরত ওমর, হজরত উসমান) মেনে নেয়নি। মোহাম্মদকে তাঁরা যেভাবে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিকসহ সব বিষয়ে আল্লাহ কর্তৃক নিযুক্ত নেতা ও আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিল, ঠিক একইভাবে ইমাম আলিকেও তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থকে মনোনীত ধর্মীয়, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিকসহ সব বিষয়ে নেতা ও আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এখনও যাঁরা গাদিরে খুমে মোহম্মদের দেওয়া ভাষণের ‘মওলা’ শব্দটিকে সার্বিক অর্থে গ্রহণ করে, তাঁরা প্রথম তিন খলিফাঁকে অনুসরণযোগ্য মনে করে না।
সেখান থেকেই মুসলিমরা দুটি ভাগ হয়ে গেল। যাঁরা সেই যুগে ইমাম আলিকে অনুসরণ করেছিল, তাঁদেরকে অন্যরা আলির শিয়া বা আলির অনুসারী বলে উল্লেখ করত। পরবর্তীতে ইসলামি পরিভাষায় এটি ‘শিয়া’ হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। আরও পরে “শিয়ারা নবিজির সুন্নাহর প্রকৃত অনুসারী নয়” এমন দাবি থেকে নিজেদেরকে শিয়াদের থেকে আলাদা করতে সুন্নি’ শব্দটার প্রচলন ঘটে, অর্থাৎ যাঁরা নবির সুন্নাহর (নবির পথের) অনুসারী। নবির অনুসারী যাঁরা নন, তাঁরা মুসলমানও নন– এমনটাই দাবি করেন সুন্নি সম্প্রদায়ের মানুষজন। শিয়া-সুন্নি পার্থক্যটি শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং সার্বিকভাবে ধর্মীয়। বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। এখন বরং দেখি ইসলামের অন্যান্য শাখাপ্রশাখাগুলিকে।
(১) ইসলামের বৃহত্তম শাখা সুন্নি। সুন্নিরা হজরত মোহাম্মদের ঐতিহ্যের ও সম্প্রদায়ের লোক। সুন্নি’ শব্দের উৎপত্তি সুন্নাহ শব্দ থেকে, যা দ্বারা হজরত মোহাম্মদের বাণী ও কর্মকে বোঝায়। এঁরা ইসলামের সেই অংশকে প্রতিনিধিত্ব করে যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হওয়া খলিফা আবু বকরকে মেনে নিয়েছিল। সুন্নি মুসলমানদের মধ্যেও আছে অনেকগুলি উপশাখা। এদের মধ্যে প্রধান উপশাখাসমূহ আলোচনা করা যাক।
(ক) হানাফি উপশাখা : এঁদেরকে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় দক্ষিণ এশিয়ায়। এঁদের ধর্ম পালনের রীতি-নীতি সম্পর্কে আমাদের সবার কমবেশি ধারণা আছে। এখন এঁরা মোটামুটি বেরেলভি, দেওবন্দি, ইলিয়াসি জামাত, মওদুদি জামাত প্রভৃতি আকিদায় বিভক্ত হয়ে গেছে। বেরেলভি বা বালাকোটি সুন্নিরা শুরুতে ওহাবি মতবাদের অনুসারি হলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন ইসলামি ব্যক্তিত্বকে, যেমন মাওলানা সৈয়দ আহমদ বেরেলভি, মাওলানা কেরামত আলি জৌনপুরী প্রভৃতি মৌলবিকে আল্লাহর মতো আলিমুল গায়েব বা অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞানী বলে বিবেচনা করে এবং এঁদেরই আদেশ-নির্দেশের অন্ধ অনুকরণ করতে থাকে। এঁরা বিখ্যাত দার-উল-হারব’ তত্ত্বের স্রষ্টা। ‘দার-উল-হারব’ শব্দের অর্থ যে জায়গা বা দেশের সঙ্গে মুসলমানরা যুদ্ধে জড়িত বা যুদ্ধ করতে বাধ্য। ব্রিটিশশাসিত ভারত ছিল এঁদের দৃষ্টিতে ‘দার-উল-হারব। দেওবন্দিগণ ও আহলে হাদিসরা এঁদেরকে কাফের হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। এমনকি এঁদের সঙ্গে মেলামেশা করা কিংবা সৌহার্দ্য প্রকাশের বিরুদ্ধেও ফতোয়া জারি করেছে।
মাওলানা কাসেম নানতুবি আরও কয়েকজনের সহযোগিতায় ভারতের উত্তরপ্রদেশে দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসা থেকে যে ইসলামের জন্ম হয়, তা দেওবন্দি ইসলাম নামে পরিচিত। দেশের অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসা এঁদের নেতৃত্ব মেনে চলে। বাংলাদেশে কওমি বা খারজি মাদ্রাসার রমরমা খুবই। অনেকে বলেন, দেশে দেশে জঙ্গিবাদ মূলত এদের হাত ধরেই সৃষ্টি হয়েছে। ইলিয়াসি তাবলিগ জামাত চিল্লার দ্বারা প্রচারকেই ইসলামের মূল লক্ষ্য বলে মনে করে। এঁরা ছয় উশুলে আস্থা রাখে এবং বলে যে, ভালো করে দোয়া-দরুদ পাঠ, নামাজ-রোজা পালন ও বিভিন্ন এলাকার মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়াই মুসলমানদের প্রধান। ধর্মীয় কাজ। মওদুদি জামাত রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা দখলকে ভাবে তাঁদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় দায়িত্ব। এঁরা নামাজ-রোজা-হজ্জ্ব-জাকাতকে সাধারণ অনুশীলন বলে মনে করে, যা মূলত ঈমানকে মজবুত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে সহায়ক হয়। অন্যান্য অনেক সুন্নি এঁদের পিছনে নামাজ আদায় করাকে মাকরুহে তাহরিমি বলে ঘোষণা। দিয়েছে। বেরেলভি-দেওবন্দি-ইলিয়াসি জামাত ও মওদুদি জামাত প্রমুখ ইসলামের একই শাখার একই উপশাখার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এঁরা কেউ কাউকে সঠিক মনে করে না, সহ্য করতে পারে না।
(খ) শাফেয়ি উপশাখা : মূলত ফিলিস্তিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, জর্ডন, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সোমালিয়া, কুর্দিস্তানের অধিকাংশ এবং সৌদি আরব, ইয়েমেন ও মিসরের কিছু অংশের মুসলমানরা ইমাম শাফেয়ির অনুসারী। এঁরা হানাফিদের থেকে ভিন্নভাবে নামাজ-রোজা পালন করে থাকে। শাফেয়ি ও হানাফি মাজহাবের রক্তাক্ত দ্বন্দ্বে ইসলামের ইতিহাস পরিপূর্ণ। এঁদের মতে, বিয়ের সময় অভিভাবককে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে, নিজের মেয়েকেও হাত দিয়ে স্পর্শ করলে ওজু ভেঙে যাবে, দাড়ি কেটে ফেলা জায়েজ ইত্যাদি।
(গ) মালেকি উপশাখা : উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা, আরব আমিরাত, কুয়েত এবং সৌদি আরব ও মিশরের একাংশের মুসলমানরা মালেকি মাজহাব মেনে চলে। এঁরাও অন্য সবার থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের মতো করে ধর্ম-কর্ম পালন করে। এঁদের মতে, একজনের হজ্ব অন্যজন প্রক্সি দিতে পারবে না, দীর্ঘশ্বাস ফেললে নামাজ ভেঙে যাবে, কাকের মাংস খাওয়া জায়েজ, মিসওয়াক করা জায়েজ নয়, শুক্রবারে রোজা রাখতে হবে ইত্যাদি।
(ঘ) হাম্বলি উপশাখা : সৌদি আরবের অধিকাংশ মানুষ এই মাজহাবের অনুসারী। সৌদি আরব ছাড়াও কাতারের অধিকাংশ এবং সিরিয়া ও ইরাকের কিছু মুসলমানও এই মাজহাব অনুসরণ করে থাকে। অন্য শাখাগুলির মতো এঁদেরও নিজস্ব নিয়ম রয়েছে। এদের মতে, ওজু নিয়ে সামান্যতম সন্দেহ হলে বা মাংস খেলে ওজু ভেঙে যাবে, সামান্যতম রক্ত বের হলেও রোজা ভেঙে যাবে, নগদ টাকায় জাকাত দেওয়া যাবে না, এজিদ ছিল ন্যায়ের পক্ষে ও ইমাম হোসাইন ছিল অন্যায়ের পক্ষে ইত্যাদি।
হানাফি-শাফেয়ি-মালেকি ও হাম্বলি হচ্ছে ইসলামের বিখ্যাত চার মাজহাব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এঁরা নবি মোহাম্মদকে পাশ কাটিয়ে তাঁর সাহাবিদের উক্তি ও কাজ-কর্মকে শরিয় দলিল হিসাবে গ্রহণ করে। এতদসত্ত্বেও এঁদের মধ্যে প্রচুর দ্বন্দ্ব বিরাজমান। এঁদের কেউ একটি বিষয়কে ফরজ বা আবশ্যক বলে মনে করলে অন্যজন মনে করে মুস্তাহাব এবং অন্য আরেকজন মনে করে হারাম! এধরনের মিউঁচুয়ালি এক্সক্লসিভ দ্বন্দ্বের ফলে অতীতে প্রত্যেকের জন্য একই স্থানে আলাদা আলাদা মসজিদ নির্মাণ করতে হয়েছিল। এমনকি, এক মাজহাব অন্য মাজহাবে বিয়ে করা হারাম বলে ফতোয়া জারি করেছিল। এখন প্রত্যেককে সমানভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলে দ্বন্দ্ব কিছুটা কমে গেছে।
(ঙ) ওহাবি বা সালাফি উপশাখা : সৌদি রাজপরিবারের সদস্যরা ওহাবি বা সালাফি মতবাদ পালন করে থাকেন। এঁরা কোরান-হাদিস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ইসলামের প্রথম দিকের আলেমরা তথা সাহাবি, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈদের অনুসরণ করেন। এঁরা সুফিবাদের সম্পূর্ণ বিরোধী। বিশেষ করে এঁরা আল্লাহকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সহকারে সশরীরে অস্তিত্বশীল বলে মনে করে, যিনি আকাশের অনেক উপরে অবস্থান করছেন। মোহাম্মদের জন্মদিন পালন করা, তাঁর বিষয়ে কোনো স্মরণসভার আয়োজন করা কিংবা তাঁর কবর জেয়ারত করাকে এঁরা শিরক ও হারাম বলে মনে করে। মক্কা ও মদিনার সকল সাহাবির কবর ভেঙেচুরে এঁরা সমতল করে দিয়েছে। অতিরিক্ত প্রতিটি ধর্মীয় কাজকেই এঁরা ভাবে বিদ’আত। তাঁরা নবিদেরকেও নিষ্পাপ বলে মনে করে না।
(চ) আহলে হাদিস উপশাখা : আহলে হাদিস মতবাদের জন্ম ভারতীয় উপমহাদেশে। এঁরা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো মাজহাব অনুসরণ করে না। মাজহাব অনুসরণ করাকে এঁরা শিরক বা অমার্জনীয় অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে থাকে। অর্থাৎ এঁদের চোখে হানাফি-মালেকি-শাফেয়ি-হাম্বলি সম্প্রদায়রা মুশরিক। এঁরা মনে করে, যাঁরা নামাজ পড়ে না, তাঁরা কাফের এবং তাঁদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে। দেওবন্দি ও বেরেলভি আলেমরা এঁদেরকে কাফের ঘোষণা করেছে।
(ছ) জাহিরি উপশাখা : সুদান, মরক্কো ও পাকিস্তানের বেশকিছু মানুষ এই মাজহাব অনুযায়ী ধর্ম-কর্ম করে। আগে অনেক মানুষ জাহিরি উপশাখার অনুসারী ছিলেন। এখন দিনে দিনে এটি দুর্বল হয়ে পড়ছে। এঁদের সঙ্গে আহলে হাদিস মতাদর্শের অনেকটা মিল পরিলক্ষিত হয়।
(২) ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায় শিয়া। শিয়া ইসলাম অনুসরণকারীদের শিইতি বা শিয়া বলা হয়। শিয়া’ হল ঐতিহাসিক বাক্য ‘শিয়াতু আলি’-র সংক্ষিপ্ত রূপ, যার অর্থ ‘আলির অনুগামীরা’ বা ‘আলির দল। শিয়া মতবাদের মূল ভিত্তি হল আলি এবং তাঁর বংশধরেরাই হল খিলাফতের প্রধান দাবিদার। শিয়া-সুন্নির ভয়ংকর সংঘাতই মধ্যপ্রাচ্যকে এখন নরক গুলজার বানিয়ে ফেলেছে। শিয়াদের মধ্যেও রয়েছে অনেকগুলো উপশাখা। চিন্তাভাবনা ও কর্মপদ্ধতির দিক থেকে এই উপশাখাগুলোও পরস্পর থেকে আলাদা।
(ক) ইশনা আশারিয়া বা বার ইমামিয়া বা জাফরিয়া উপশাখা : ইরাক, ইরান, আজারবাইজান, লেবানন ও বাহরাইনের অধিকাংশ মানুষ ইশনা আশারিয়া বা বার ইমামিয়া বা জাফরিয়া উপশাখার অনুসারী। এছাড়া পাকিস্তান, আফগানিস্তান, কুয়েত ও আলবেনিয়ার অনেক মানুষ ইশনা আশারিয়া শিয়া। এঁদের ধারণা, মোহম্মদের মৃত্যুর পর হজরত আলি হচ্ছেন মুসলমানদের বৈধ নেতা বা ইমাম। সাহাবিরা হজরত আলিকে ইমাম না-বানিয়ে আবুবকর-ওমর-উসমানকে খলিফা বানিয়েছে, যা আল্লাহর আদেশের সরাসরি লঙ্ঘন। তাঁরা অধিকাংশ সাহাবিকে মুনাফিক মনে করে এবং খুতবায় নিয়মিত গালিগালাজ করে। তাঁরা বিশ্বাস করে বারো ইমামতে, যা মোহম্মদ থেকে শুরু করে আলির বংশধর ইমাম মাহদির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। এই ইমামদের মর্যাদা নবি-রাসুলদের চেয়ে বেশি। ইশনা আশারিয়াদের কিছু কর্মকাণ্ড বিচিত্র ধরনের। এঁরা মুতা বিবাহ বা পতিতাবৃত্তিকে জায়েজ মনে করে, তিনবারে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, হজ্জ্বের চেয়ে হজরত আলির মাজার দর্শনকে অধিক পুণ্যের বলে বিবেচনা করে। এঁদের নিজস্ব হাদিস আছে। বোখারি শরিফ, সহিহ মুসলিম প্রমুখ হাদিস গ্রন্থে এঁরা আস্থা রাখে না।
(খ) জাইদিয়া বা সপ্ত ইমামিয়া উপশাখা : ইয়েমেনের অর্ধেক মানুষ জাইদিয়া বা সপ্ত ইমামিয়া মতাদর্শের শিয়া। বহুল আলোচিত হুথিরা এঁদের মধ্যে অন্যতম। শিয়াদের মধ্যে এঁরা সবচেয়ে প্রাচীন। আগে এঁদের রমরমা অবস্থা থাকলেও ১৯৬২ সালে ইমামত লোপের পরে তাঁরা বেকায়দায় পড়ে গেছে। অনেক শতাব্দী আগে ইমাম নির্বাচনের প্রশ্নে মতানৈক্য হওয়ায় অন্য একদল শিয়া আলাদা হয়ে ইশনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে। ইশনা আশারিয়া শিয়া সম্প্রদায়েরা বিশ্বাস করে মোহাম্মদ আল বাকিরের ইমামতে এবং জাইদিয়া শিয়ারা জাইদ ইবনে আলির ইমামতে বিশ্বাস করতে শুরু করে। এঁরা ইমাম হোসাইন পর্যন্ত আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করে, তদুপরি ইমামগণের স্বর্গীয় আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করে না।
(গ) ইসমাইলিয়া উপশাখা : ইসমাইলিয়া শিয়া সম্প্রদায়রা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভারত, চিন, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপে ইসমাইলিয়াদের দেখা মেলে। এঁরা বলে থাকেন, ইসলামের সপ্তম ইমাম হচ্ছেন ইসমাইল ইবনে জাফর। অন্যদিকে জাফরিয়া শিয়ারা বলে, সপ্তম ইমাম মুসা ইবনে কাজিম। এইখান থেকেই দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে শিয়াদের এই নতুন উপশাখা যাত্রা শুরু করে। এঁদের বিশ্বাস হল, আধ্যাত্মিকতা নবি মোহাম্মদ থেকে হজরত আলি এবং তাঁর থেকে বংশানুক্রমে প্রবাহিত হতে হতে বর্তমান পর্যন্ত চলে এসেছে। এই স্বর্গীয় আধ্যাত্মিকতা এখন অবস্থান করছে তাঁদের বর্তমান ইমাম প্রিন্স করিম আগা খানের শরীরে। আগা খান তাঁদের ৪৯তম ইমাম। কোনো। পাপ বা ভুল তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। প্রতিটি ইসমাইলিয়াকে তাঁদের আয়ের বারো ভাগের এক ভাগ ইমাম আগা খানের ভাণ্ডারে প্রদান করতে হয়। অধস্তনদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থে ফুলে-ফেঁপে ওঠা এই সম্পদশালী ব্যক্তিকে প্রায়ই খবরে দেখা যায়। বর্তমানে ইসমাইলিয়া শিয়ারাও নিজারি, হাফিজি, তাইয়াবি প্রভৃতি বিভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে।
(ঘ) আলাভি বা নুসাইরি বা আনসারি উপশাখা : ক্ষমতাসীন সরকারসহ সিরিয়া এবং তুরস্কের বেশকিছু মুসলমান আলাভি শিয়া সম্প্রদায়। এঁরা মূলত ইশনা আশারিয়া থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এঁরা মনে করে, আল্লাহ অনেকবার মানুষের রূপ ধরে পৃথিবীতে আগমন করেছেন। এমনকি এঁরা বিশ্বাস করে আল্লাহ হজরত মোহাম্মদ, হজরত আলি ও সালমান ফার্সির এই পৃথিবীতে ছদ্মবেশে এসেছেন। অর্থাৎ মোহম্মদ, সালমান ফার্সি ও হজরত আলি ছিলেন মূলত আল্লাহই। তাঁরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে।
(৩) ইসলামের তৃতীয় বৃহত্তম শাখা আহমদিয়া। অনেকের কাছে এঁরা কাদিয়ানি নামে পরিচিত। প্রথমদিকে তাঁরা হানাফিদের একটি উপশাখা ছিল। পরবর্তীতে হানাফিদের চিন্তাধারা পরিত্যাগ করে এঁরা নতুন মতবাদ সৃষ্টি করে। আমাদের উপমহাদেশে অসংখ্য আহমদিয়া মুসলমান বসবাস করে। এঁরা আবার মোটামুটি দু-ভাগে বিভক্ত।
(ক) আহমদিয়া আঞ্জুমান ইশাত-ই-ইসলাম উপশাখা : আহমদিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানি। এই সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, আহমেদ কাদিয়ানি প্রতিশ্রুত মসিহ, ইমাম মাহদি ও জিশুখ্রিস্ট। তবে তিনি নবি নন। তাঁরা মনে করে, জিশুখ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ অবস্থা থেকে পালিয়ে এসে কাশ্মীরে বসবাস করতে শুরু করেন এবং এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর কবর কাশ্মীরের উজ আসাফে। এখন তিনি বেহেশতে আছেন। নতুন জিশু। যিনি এসেছেন তিনি হলেন মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি, তিনি হলেন শেষ নবি মোহাম্মদের উম্মত (জাতি বা দল)।
(খ) জামাতে আহমদিয়া :জামাতে আহমদিয়া সম্প্রদায়েরা মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানিকে একজন নবি বলে দাবি করে। মোহাম্মদকেও এঁরা নবি বলে মানে, তবে শেষ নবি হিসাবে স্বীকার করে না। এঁরা বলে, মোহাম্মদ হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ নবি। এরপরে অনেক নবি এসেছেন, যাঁরা পূর্ণাঙ্গ নবি নন। গোলাম আহমদ কাদিয়ানি হচ্ছেন এমনই একজন নবি।
(৪) ইবাদি : চতুর্থ বৃহত্তম শাখা ইবাদি। ওমান ও আফ্রিকার জাঞ্জিবার দ্বীপে এঁদের দেখা মেলে। এছাড়া আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও পূর্ব আফ্রিকায় এঁদের বসবাস রয়েছে। ধারণা করা হয়, এঁরা বিলুপ্ত হয়ে। যাওয়া খারেজিদের একটি উপশাখা। ইবাদিরা খলিফা আবু বকর ও খলিফা উমরকে সঠিক বলে মানে। তবে অনেকক্ষেত্রে খলিফা আলি ও খলিফা উসমানের বিরোধিতা করে। শিয়াদের মতো এদের নিজস্ব ধর্মীয় নেতা বা ইমাম রয়েছে। এই ইমাম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হন। এঁদের মতে, আল্লাহ কখনও দেখা দেবেন না, বিচার দিবসেও না। কোরানকে এঁরা মনুষ্য-সৃষ্ট গ্রন্থ বলে মনে করে, আল্লাহর বাণী বলে মনে করে না।
(৫) সুফিবাদ : ইসলামের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা সুফিজম। এদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা কঠিন। দেখা যায়, একেক এলাকায় একেকজন সুফি আসন গেড়ে বসেছেন। সেখানে তিনি নিজের আস্তানা তৈরি করেছেন, মানুষজনকে মুরিদ বানিয়েছেন। মুরিদদের ধর্মকর্মের সবকিছু তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। তিনি মুরিদকে যা যা করতে বলেন, যেভাবে নামাজ পড়তে বলেন, রোজা রাখতে বলেন, মুরিদরাও তাই করে। এক্ষেত্রে অনেক সুফি নিজস্ব স্বতন্ত্র নিয়ম-কানুন অনুসরণ করেন। শাহজালাল, চরমোনাই, দেওয়ানবাগী, কুতুববাগী প্রমুখ হচ্ছেন সুফিবাদের উদাহরণ। এঁদের সংখ্যা অসংখ্য। তবে এঁদেরকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে আলেভি, বেকতাশি, বোরহানিয়া, মেভলেভি, বালাভিয়া, চিশতিয়া, রিফাঈ, খালবাতি, নকশাবন্দি, নিমাতুল্লাহি, কাঁদেরিয়া, বোস্তামিয়া, সাধিলিল্লা, মাইজভান্ডারি, মোজাদ্দেদিয়া, কালান্ধারিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া ইত্যাদি।
(৬) পির : পির হল সুফিগুরু বা আধ্যাত্মিক শিক্ষকদের একটি উপাধি। তাঁদের হজরত এবং শাইখ নামেও ডাকা হয়, যা মূলত এর আরবি প্রতিশব্দ। একে প্রায় সময় ইংরেজিতে সেইন্ট (সাধু) এবং খ্রিস্টান পরিভাষা এল্ডার’ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। সুফিবাদে কোনো পিরের ভূমিকা হল তাঁর শিষ্যদের সুফি পন্থায় নির্দেশনা দেওয়া। যা অনেকসময় সহবস’ নামক সাধারণ পাঠদান ও ব্যক্তিগত দিকনির্দেশনার মাধ্যমে করা হয়। পির বলতে অপর যে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয় সেগুলো হল মুর্শিদ (শিক্ষক, নির্দেশক) ও সরকার (গুরু, প্রভু’)। আলেভি মতবাদে পিরদেরকে সরাসরি আলির উত্তরসূরী বলা হয়।
মোট কথা পিরের সংজ্ঞা হল সাধারণত যে ওলি-আল্লাহ অন্তত কোনো তরিকার প্রতিষ্ঠাতা বা খলিফা, তাঁকে পির বলে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম তরিকার নাম উয়াইসিয়া। রইসুত তাবিঈন উয়ায়েস করনিকে এর প্রতিষ্ঠাতা ধরা হয়। তাই তিনিই প্রথম পির। বুখারি শরিফ’ নামটি যেমনি ইমাম বুখারি দেননি, বরং তাঁর ভক্তরা দিয়েছেন— তেমনি ‘উয়াইসিয়া’ তরিকাও ভক্তগণ পির সাহেবের নামে নামকরণ করেছেন। মহানবি তাঁর প্রশংসাও করেছেন। যেমন উমর ফারুক বলেন –“আমি আল্লাহর রাসুলকে (সল্লাল্লাহুতা’লা ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনেছি যে, তাবেঈদের মাঝে উয়ায়েসই সেরা। তাঁর মা-ই শুধু আছেন এবং তাঁর শ্বেতী হয়েছিল। তোমরা তাঁর কাছে তোমাদের মাগফিরাতের জন্যে দোয়া করতে অনুরোধ করবে (মুসলিম)। লক্ষ্যণীয়, নবিজি তাঁর সাহাবিদের বলেছেন তাঁদের গুণাহ মাফ করাতে একজন তাবেয়ীকে অনুরোধ করতে বা তাঁর শরণাপন্ন হতে। মুকাম্মেল পিররা এমনই বিশিষ্ট হয়ে থাকেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে আরব দেশে পির নেই কেন? যত পিরসাহেব বা পিরজাদা ভারত উপমহাদেশে কেন? উত্তর : কদু খেয়ে যদি বলেন, লাউ কেন দেননি? যাহাই লাউ তাহাই কদু। পির’ শব্দ ফারসি ও ‘শায়েখ’ আরবি ভাষা। অভিধানে দুটোর অর্থ একই। সৌদিতে শায়েখের অভাব নেই। পিরেরাই যে আল্লাহর ওলি এর প্রমাণ কী? সহজ প্রমাণ হচ্ছে, মুরিদান। প্রত্যেক পিরসাহেবকে তাঁর মুরিদান আল্লাহর ওলি ভেবে থাকেন, ঠিক যেভাবে ইমাম বুখারি ও মুসলিমের ভক্তরা বুখারি ও মুসলিম শরিফাঈনকে সহিহ ভেবে থাকেন। অথচ এ দুটো গ্রন্থকে কোরান হাদিসে কোথাও সহিহ বলা হয়নি। পিরেরা যে তাঁদের মুরিদদের শাফায়াত তাঁর প্রমাণ কোরানের আছে— “মনে রেখো যারা আল্লাহর ওলি, তাঁদের না কোন ভয় ভীতি আছে, না তাঁরা চিন্তান্বিত হবে।” (ইউনুস– ৬২)।
তাহলে আওলিয়া কারা? এ প্রশ্নের উত্তরে নবিজি বলেছেন: যাঁদের দেখলে আল্লাহর কথা মনে হয়, তারাই আওলিয়া। তিনি আরও ফরমান করেন— আল্লাহ বলেন : আমার আলোচনায় যাঁদের স্মরণ করা হয় এবং যাঁদের আলোচনায় আমায় স্মরণ করা হয়, আমার বান্দাদের মাঝে ওরাই আওলিয়া। নবিজি আরও বলেন— রোজ হাশরে তাঁদের চেহারা নুরান্বিত হবে, তাঁরা নুরের ভিতরে থাকবে, আল্লাহ নুরের আসনে তাঁদের বসতে দেবেন এবং তাঁর কাছে তাঁদের উঁচু মর্তবা দেখে নবিরা ও শহিদরাও ঈর্ষান্বিত হবেন। সকল মানুষ যখন ভীত ও চিন্তিত থাকবে, তখন তাঁরা ভীত ও চিন্তিত হবেন না। এরপর তিনি আলোচ্য আয়াতে কারিমা ইউনুস– ৬২ নং তিলাওয়াৎ করলেন (তাফসিরে তাবারি, মেশকাত, আবু দাউদ, শারহে সুন্নাহ, তাফসিরে মাজহারি ইত্যাদি)। সুতরাং আল্লাহর ওলি বা হাক্কানি পিররা রোজ হাশরে নির্ভয়ে ও নিশ্চিন্তে নুরের ভিতরে নুরের আসনে বসে থেকে তাঁদের মুরিদানকে নির্বিঘ্নে শাফায়াত করতে পারবেন। পির সমালোচকদের প্রশ্ন তবে নবিজি কত নাম্বার পির? পির সমর্থকদের উত্তর নবিজি পির নন, পরোক্ষভাবে পিরের অনুমতিদাতা।
বাংলায় পিরানি বিশ্বাসের বিবর্তনে এক তাৎপর্যপূর্ণ উত্তরণ। দূরদূরান্তে ইসলামের বিস্তৃতির ফলে মুসলিম জনগণ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে আসে। এর ফলে একদিকে যেমন ইসলাম অন্য ধর্মকে প্রভাবিত করে, অন্যদিকে ইসলাম এবং মুসলিমরাও অপর ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই প্রভাবিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি প্রধানত পির বা আওলিয়া-দরবেশদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
পাঁচ পিরের বন্দনা বাংলার কোনো কোনো অঞ্চলে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলায় প্রচলিত ছিল। গৃহদেবতা হিসাবে পাঁচ পিরের বন্দনা বেদি তৈরি হত গৃহস্থের বাড়ির কোনো ঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে কাদা মাটি দিয়ে উঁচু করে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে, বিশেষ করে সমাজের নিম্নস্তরের জনগণ পাঁচ পিরের বন্দনা করত। মাটির বেদির উপর মানুষের মাথার আদলে এক খণ্ড লোহা এবং পাঁচ পিরের প্রতীকস্বরূপ পাঁচ আঙ্গুল স্থাপিত হত। পাঁচ পিরের দরগাহ নামে সোনার গাঁয়ে একটি দরগাহ আছে। তৎকালীন পূর্ব বাংলার উপকূলীয় জেলার নাবিকেরা নৌ-যাত্রার পূর্বে আপদ-বিপদ থেকে পরিত্রাণের মানসে পাঁচ পিরের সঙ্গে পির বদরকেও স্মরণ করে থাকে। পাঁচ পির বন্দনা কখন থেকে শুরু হয়, তা সঠিক করে বলা কঠিন। সোনার গাঁয়ের পাঁচ পিরের দরগাহ কখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাও জানা যায়নি। দরগাহর পাশে একটি মসজিদ আছে। কিন্তু মসজিদের গায়ে। নির্মাণের তারিখ সম্বলিত কোনো লিপি সংস্থাপিত নেই। পালাগানে পাঁচ পিরের সঙ্গে পির বদরকে যুক্ত করা হলেও, বদরকেও শনাক্ত করা যায় না। অনেক এলাকা আছে যেখানে পির বদরের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। অবশ্য পালাগানের পির বদরকে যদি চট্টগ্রাম বিজয়ের সঙ্গে জড়িত পির বদর বা বদর শাহের সঙ্গে অভিন্ন ধরা। হয়, তবে পাঁচ পিরের ধারনা চোদ্দো শতকের বলে অনুমান করা যায়। অবশ্য পরবর্তীকালেও বদরের নামের সঙ্গে পাঁচ পিরের নাম সংযুক্ত হয়ে থাকতে পারে। এই পাঁচ পির কারা তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। পাঁচ পিরের যে তালিকা বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায় তা অভিন্ন নয়, এ সকল তালিকায় স্থানীয় পিরদের নাম রয়েছে। তবে একজন ‘গাজী মিয়া’র নাম সকলের তালিকায় দেখা যায়। কিন্তু এই গাজী মিয়া কে তা সঠিক জানা যায় না। সাধারণত ধর্মযুদ্ধে মৃত্যু বরণকারীদের শহিদ এবং ধর্মযুদ্ধে বিজয়ীদের বলা হয় গাজী। গাজী উপাধি ছিল সাহসিকতা ও বীরত্বের প্রতীক। গ্রামের দরিদ্র জনগণ তাই ক্ষমতার প্রতীকরূপে পাঁচ পিরের বন্দনা করত এবং তাঁদের নিরাপদ আশ্রয় কামনা করত। (আবদুল করিম) আমাদের বাংলায় ত্বহা সিদ্দিকি, আব্বাস সিদ্দিকিদের নাম খুব শোনা যায়, যাঁরা পিরসাহেব বা পিরজাদা হিসাবে পরিচিত।
পিরদের মধ্যেও খাঁটি পির যেমন আছে, তেমনি ভেজাল পিরও আছে। খাঁটি পির চেনার উপায় কী? ‘কছুদুস সাবিল’ নামক গ্রন্থে হাকিমুল উম্মত হজরত আশরাফ আলি থানভি খাঁটি পির চেনার ১০টি উপায়ের কথা বাতলেছেন— (১) সুন্নতি লেবাস; মাথা থেকে পা পর্যন্ত লেবাস, পোশাক, ওঠাবসা পুরো সুন্নত মোতাবেক হওয়া। কামেল পিরের জন্য জরুরি। (২) কোরান-হাদিসের পর্যাপ্ত জ্ঞান : শুধু লেবাস-পোশাক কাটছাঁট হলে চলবে না, ওই পিরের মধ্যে সাহেবে জ্ঞান বা কোরান-হাদিসের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। এমন ব্যক্তির যদি পোশাক-আশাক ভালোও হয় আর পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকে, তাহলে ওই ব্যক্তি কামেল পির হওয়ার উপযুক্ত নন। (৩) আমলকারী : শুধু পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকলেই হবে না, শুধু সুন্নত থাকলেই হবে না; বরং ওই পিরের মধ্যে পর্যাপ্ত আমলও থাকতে হবে। লোকদের অনেক ওয়াজ-নসিহত করেন, কিন্তু তাঁর নিজের মধ্যে আমল নেই। নিজে তাহাজ্জুদ পড়েন না, কিন্তু মুরিদদের তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য খুব বলেন, তাহলে ওই ওয়াজের কোনো তাছির হবে না। (৪) এখলাস থাকা : তাঁর মধ্যে এখলাস থাকতে হবে। লোক দেখানোর জন্য তিনি ইবাদত করেন না, বরং তিনি আল্লাহর মুহব্বতে এখলাসের সঙ্গে আমল করেন। আমল করেন, কিন্তু এখলাস নেই, মুরিদদের দেখানোর জন্য যে শায়খ খুব নামাজ পড়েন, সে ব্যক্তি কামেল পির হতে পারেন না। তাঁর ভিতরে এখলাস থাকতে হবে। (৫) দুনিয়াবিমুখতা : তাঁর মধ্যে দুনিয়াবি লোভ থাকবে না। তিনি লোভী হবেন না, পরেরটা পেতে চেষ্টা করবেন না। বর্তমান জামানায় ভণ্ড পির তাঁদের মুরিদদের কাছে বহু কিছু প্রত্যাশা করে। হুজুরের সঙ্গে মোসাফা করতে গেলে কিছু খলিফা মুরিদদের বলে দেন যে হুজুরের সঙ্গে মোসাফা করতে হাতে হাদিয়া রাখবেন। সাহাবিরা তো মহানবির কাছে গিয়ে হাত মেলাতেন, হুজুর কী বলতেন যে মোসাফা করার জন্য হাতে হাদিয়া নিয়ে যেতে? অতএব, এই চাওয়া-পাওয়ার মোয়ামেলাত এটা কামেল পিরের আলামত না। (৬) আখলাক : তাঁর মধ্যে এমন আখলাক থাকবে, যে আখলাক দ্বারা দ্বিনের ব্যাপারে তাঁর মধ্যে শিথিলতা থাকবে না। হক কথা বলতে কাউকে ভয় করবেন না। তিনি ভাববেন না যে এই লোক আমার মুরিদ, বড়ো লোক মানুষ। সুদ-ঘুষ খায়; কিন্তু আমাকে এত হাদিয়া দেয়, তাকে কীভাবে বলব দ্বিনের ব্যাপারে। একজন হক্কানি পির প্রত্যেককে এসলাহ করবেন, দ্বিনের ব্যাপারে প্রত্যেককে শক্ত কথা বলবেন, কারো মুখের দিকে চেয়ে কথা বলবেন না। (৭) নামাজে মনোযোগী : নামাজ ও জামাতের ব্যবস্থা করবেন। জামাতের মধ্যে তিনি অলসতা করবেন না। তিনি নামাজের ব্যাপারে শক্ত থাকবেন। অনেক পির সাহেব বিনা কারণে পর্দার আড়ালে নামাজ পড়েন, এটা ঠিক নয়। আজকাল ভণ্ড পিরদের কাছে নামাজের কোনো গুরুত্বই নেই। (৮) চোখের হেফাজত : সে ব্যক্তি চলাফেরায়, ওঠাবসায় তাঁর চোখের হেফাজত করবেন। আজকাল অনেক পির মুরিদের সুন্দরী বউদের সঙ্গে দেখা দেন। বলেন, আমার ছেলের বউ। মুরিদরা পিরের রুহানি সন্তান। আল্লাহ। রুহানি সন্তানদের জন্যও পর্দা ফরজ করেছেন। (১) পর্দা করা : হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানভি বলেছেন, “তুমি তোমার পিরের মধ্যে দেখ যে, সে পর্দা মেনে চলে কি না? তুমি যাচাই করো।” (১০) কোরান তিলাওয়াত : হাকিমুল উম্মত বলেন, দেখ সে কোরান শরিফ তিলাওয়াতে উৎসাহ দেয় কি না? কী লাভ মুরিদ হয়ে, যদি অন্তত নামাজ পড়ার মতো পাঁচটি সুরা, তাশাহুদ, দরুদ শরিফ, দুয়ায়ে মাসুরা ঠিক না করেন? কামেল পিরের আলামত যে তিনি নিজে কোরান তিলাওয়াত করেন এবং কোরান তিলাওয়াতের ব্যাপারে তাগিদ দেন। বর্তমানে অনেক পির কোরান তিলাওয়াতের কোনো তাগিদই দেন না।
এগুলো ছাড়াও আরও অসংখ্য শাখা আছে ইসলামে। এঁদের মধ্যে দ্রুজ, আলেভি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আবার অসংখ্য শাখা-উপশাখা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তও হয়ে গেছে কিংবা নতুন কোনো শাখায় পরিবর্তিত হয়েছে। যাঁরা বিলুপ্ত হয়েছে তাঁদের মধ্যে খারেজি, মুরজিয়া, মুতাজিলা, মুশাব্বিয়া, জাহমিয়া, জারারিয়াহ, নাজ্জারিয়া, কালবিয়াহ ইত্যাদি অন্যতম।
উপরে উল্লিখিত শাখা-উপশাখার কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না, কেউ কাউকে ভালোবাসে না। সুন্নিদের একটি উপশাখা ফতোয়া দিয়েছে— ‘শিয়াগণ কাফের। যাঁরা তাঁদের কাফের হিসাবে স্বীকার করে না, তাঁরাও কাফের। যাঁরা তাঁদের কাফের হওয়া নিয়ে সন্দেহ করে, তাঁরাও কাফের। তবে এটা মনে রাখতে হবে, যতই মিল অমিল থাকুক না-কেন, কোরান ও হাদিস নিয়ে কোনো মতানৈক্য নেই কোনো শাখারেই।
সামান্য যে বিষয়গুলি নিয়ে মতভেদ আছে, তা অতি সামান্য। তাই শক্তিশালী মুসলিম জাতি গঠনে সামান্য মতভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করে। মাজহাব নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। কোন্ মাজহাব ভালো বা সঠিক তা নিয়ে বিভেদ— এ তর্ক ঠিক নয়। অতএব শিয়া সম্প্রদায় মুসলমান সুন্নিদের হত্যা করবে, আর সুন্নিরা শিয়া সম্প্রদায় মুসলমানকে হত্যা করবে এটা তো কোনো মাজহাবই মেনে নেয় না। বস্তুত মুসলমান মুসলমানকে হত্যা করা হারাম– সেই রকমই প্রচলিত বিশ্বাস। তবে বিশ্বাস ভাঙারও ইতিহাস আছে প্রচুর। পাকিস্তান, সিরিয়া, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে মুসলিম জঙ্গিরা তো নিরীহ মুসলমানদেরই মারছে –শিশু, বৃদ্ধ, নারী কেউই তো বাদ যাচ্ছে না! সাধারণ মুসলমানরাও সাধারণ মুসলমানদের খুন করে, ধর্ষণ করে— সবই করে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ধর্মের শাসন নিয়ে তো মন চলে না। মানুষের মন ষড়রিপু দ্বারা আক্রান্ত, সে হিন্দু না মুসলমান তাতে কিছু যায় আসে না। হারামই হোক কিংবা হালাল– প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মানুষ সব করতে পারে। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ডোন্ট কেয়ার। ৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের মুসলিম সেনা ও পাকিস্তানপন্থী মুসলিমরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৩০ লক্ষ মুসলিমদের হত্যা করেছিল।
এছাড়া সারা বিশ্বের সমগ্র মুসলমান দুটি ভাবনায় বিভক্ত বলে মনে করি। পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি একপক্ষ দার উল-ইসলাম কায়েম করতে চায় সারা বিশ্বে, অপরপক্ষ দার-উল-হারব করতে চায় সারা বিশ্বে। কারা সংখ্যালঘু, কারা সংখ্যাগুরু সে আলোচনায় যাচ্ছি না। সেই পরিসংখ্যানও আমার কাছে নেই। ১৫০০ বছর আগে মহানবির দেখিয়ে যাওয়া পথে দার-উল-ইসলামের সমর্থকরা জয়ী হতে চায়। এহেন ধর্মান্ধ মুসলমানরা খুন, ধর্ষণ আর লুট দিয়ে পৃথিবীকে দার-উল-ইসলাম বানাতে চায়। এদের নেই মেধার চর্চা, নেই জ্ঞানের চর্চা। সর্বোপরি এঁরা সময়কে বোঝে না, মানুষকে বোঝে না। উদাহরণ– আইসিস ও তাঁর সমর্থকরা। এছাড়া একশ্রেণির হাফিজ-হুজুর-মুমিনরা এ ধরনের স্বপ্ন দেখে থাকেন। দার-উল-ইসলাম’ মানে সার্বক্ষণিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ধ্বংস, খুন করে পার পাওয়া, ধর্ষককে রেহাই দেওয়া আর ধর্ষিতাকে ফাঁসি দেওয়া, যৌনতা আর সন্তান জন্ম দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো কাজে নারীর অবদান নিষিদ্ধ করা, নারীকে বস্তাবন্দি করে রাখা। এঁরা প্রকাশ্যেই বলে নারীর কাজ বাচ্চা জন্ম দেওয়া আর স্বামীর যত্ন করা। এছাড়া কোনো কাজ থাকতে পারে না। নারী চাকরি করবে না। এছাড়া পরকালমুখী হয়ে পৃথিবীর উন্নতি অগ্রগতিকে থামিয়ে দেওয়া, সবরকম সুকুমার বৃত্তির চর্চাকে নিষিদ্ধ করা, মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করা। এঁরা আনন্দ করতে পারে না, তাই আনন্দ ধংস করে। আল্লাহ আর নবি ছাড়া কাউকে ভালবাসতে পারে না, তাই মানুষের ভালোবাসায় এঁরা আস্থা পায় না। এঁরা গাইতে পারে না, নাচতে পারে না, ছবি আঁকতে পারে না, তাই সব শিল্পীদের প্রতি এঁদের ঘৃণা। নিজেদের আড়াল করে প্রাচীন কারায় বন্দি করে রাখে। ১৫০০ বছর আগের আলো-বাতাসহীন একটা কারাগারের নাম দার-উল-ইসলাম। প্রমাণ চান? মন দিয়ে শুনুন ওয়াজের জলসাগুলি। মন দিয়ে শুনুন সেখানে হাজার হাজার উপস্থিত মুসলমানদের সামনে সর্বক্ষণ উত্তেজিত হুজুর কী বলছেন।
অপরদিকে ‘দার-উল-হারব’-এর অর্থ মানবতার জয়, বিজ্ঞানের জয়, বিবেকের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, নাচ-গান-সাহিত্য-চিত্রকর্মের আনন্দ, সব মানুষকে বন্ধু করার আনন্দ, মানুষে-মানুষে ভালোবাসার আনন্দ। সেখানে যে ধর্মের নামে নৃশংসতা নেই, তা নয়। কিন্তু এই নৃশংসতাকে ঘৃণা জানায় মানুষ, আড়াল করে না। এঁদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে, এটা আশার কথা।
বেশিরভাগ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন এবং মুক্তমনা মুসলমানদের আকর্ষণও দার-উল-হারবের প্রতি। তাই প্রতিদিন হাজার হাজার মুসলমান বিধর্মী কাফেরদের দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য মরিয়া চেষ্টা করে। তবে অন্ধবিশ্বাসের কারণে এঁরা দার-উল-ইসলামের স্বপ্নকেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। তাই মনে মনে টান থাকার পরও এরা দার-উল হারবকে নিজের বলে ভাবতে পারে না। এই না-পারার ক্ষোভ থেকে তৈরি হয় ঘৃণা।
মুসলিম হোক বা অমুসলিম, মুমিন বন্ধুরা ইসলামের সমালোচককে সহ্যই করতে পারেন না। তাঁরা সেই সমালোচনাকে ইসলামোফোবিয়া’ বলে ভেবে থাকেন। তাঁদের মতে কোনোকিছুর সমালোচনা করা মানে সেটাকে ভয় পাওয়া। যদিও শিল্পসমালোচকরা শিল্পকে, সাহিত্য সমালোচকরা সাহিত্যকে ভয় করেন না। কিন্তু এসব ব্যাপার একশ্রেণির মুসলমানদের পক্ষে বোঝা শক্ত। তাঁরা শিল্পসাহিত্যের ধারেকাছেও নেই, সেসব তাঁদের কাছে হারাম। একশ্রেণির মুসলমানদের পক্ষ থেকে বরাবরই ইসলাম এবং মুসলমানের সমালোচনা কেন করা যাবে না, তার অনেকগুলি কারণ দেখানো হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুসলমানদের সঙ্গে কথা বলে যা উঠে এসেছে, তা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন।
(১) আমি আপনারই ভাই-বোন-বন্ধু হতে পারি: অতএব এই কারণে যদি আপনার সমালোচনা করার অধিকার ত্যাগ করতে হয় তাহলে ব্যাপারটা বড়োই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। খেয়াল রাখতে হবে, দুনিয়ার প্রত্যেক অপরাধীও কারো-না-কারো ভাই, বোন অথবা বন্ধু। এই কারণে খারাপকে খারাপ বলা যাবে না, এটা হাস্যকর যুক্তি। এর চেয়ে সোজাসুজি বললেই হয়— আমি মুসলিম তাই আমার দোষ ধরা চলবে না। ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোরানে অবশ্য সোজাসুজি সেই কথাই বলা আছে, এক সহিহ মুসলিম অন্য মুসলিমের দোষ গোপন করবে।
(২) আমরা মানুষ : আসলে ব্যাপারটা তাই, ইসলামের চোখে কেবল মুসলমানরাই মানুষ, বাকিরা নিকৃষ্ট জীব। বিধর্মীদের জায়গা মানুষ তো দূরের কথা, গোরুছাগলের চেয়েও নিচে। পোকামাকড়ের চেয়েও নীচে। অতএব মুসলমান অবশ্যই সমালোচনার যোগ্য নয়। একথাও অবশ্য স্পষ্ট করে কোরানে উল্লেখ আছে। অমুসলমান বা বিধর্মীদের জান্নাতে কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও, জাহান্নামে সবচেয়ে কঠিনতম জায়গা নির্দিষ্ট করা আছে।
(৩) মুসলিমদের নিরাপত্তার অধিকার আছে : অবশ্যই তা আছে! অন্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অধিকারও আছে। কিন্তু যাঁরা মুসলিম নয় তাঁদেরও সেই নিরাপত্তার অধিকার আছে। কিন্তু মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ কোরান তো সেটা স্বীকার করে না। কোরান অনুসারে কেবল সেইসব বিধর্মীর নিরাপত্তার অধিকার আছে, যাঁরা জিজিয়া কর দেবে। যাঁরা এই নিরাপত্তা কর দেয় না, তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার স্পষ্ট নির্দেশ আছে। কোরানের এই নির্দেশ মেনেই সারা পৃথিবীজুড়ে তাঁরা বিধর্মী হত্যা চলত কখনো-সখনো। অথচ তাঁদের নিরাপত্তা নাকি সামান্য সমালোচনাতেই বিপন্ন হয়ে পড়ে। পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম কিন্তু সমালোচনায় এত বিপন্ন হয়ে পড়ছে না। অবশ্য এটাও চরমভাবে সত্য, পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম নিয়ে এত সমালোচনা হয় না। সারাবিশ্বেই ইসলাম ধর্ম সমালোচিত। ইসলাম সমালোচনার হাত থেকে কিছুতেই রেহাই পাচ্ছে না। কোরান ও হাদিসই মুসলমানদের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। মডারেট মুসলমানরা এখন বোঝাতে বাধ্য হচ্ছে যে, কোরানের এটার মানে এটা নয়, ওটার মানে সেটা নয়। তবুও অমুসলমানরা বুঝতে চাইছে না। অমুসলমানরা আবার মুসলমানদের চাইতে কোরান ও হাদিসকেই বেশি মান্য করে।
(৪) মানবজাতির মধ্যে বিভাজন তৈরি করা ঠিক নয় : ১৫০০ বছর ধরেই ইসলাম শিয়া-সুন্নি দুইভাগে বিভাজিত। এঁদের মধ্যে রক্তাক্ত যুদ্ধ এখনও চালু আছে। তাই মানবজাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির সমালোচনা করতে গেলেও ইসলামের সমালোচনা সবার আগে এসে পড়বে। অমুসলিমদের বিরুদ্ধে কোরানে যে লাগাতার যুদ্ধের নির্দেশ রয়েছে, সেটা কোরান পাঠ করলেই জ্ঞানচক্ষু খুলবে। তবে সেই যুদ্ধ অযযাদ্ধাদের জন্য প্রযোজ্য নয়, পাশাপাশি এটাও মনে রাখা প্রয়োজন। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, যদি সত্যিই মুসলিম শাসক তথা যোদ্ধারা অমুসলিমদের বিরুদ্ধে লাগাতার যুদ্ধ করত, তাহলে সারাবিশ্বে একজন অমুসলিমদেরও অস্তিত্ব থাকত না। একজন প্রকৃত শাসক কখনোই এমন ভাবনা বহন করতে পারে না।
(৫) আমি মুসলিম এবং আপনারই মতো মানুষ : একদিক দিয়ে দেখলে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধদের মতো মুসলমানরাও মানুষই, অন্তত চোখে দেখে সেরকমই মনে হয়। কিন্তু সেজন্য তাঁদের দোষ ধরা চলবে না কেন? বরং যেখানে ব্যক্তিমানুষ থেকে সমগ্র মানবজাতির সবকিছুর সমালোচনা করা হয়, সেখানে ইসলাম এবং মুসলিমদেরও সমালোচনা চালু থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি একেবারে চলবে না। সমগ্র মানবজাতির সমালোচনা করা চলবে, কিন্তু ইসলাম বা মুসলিমদের সমালোচনা করা চলবে না। নবির সমালোচনা করা চলবে না। নবিকে নিয়ে ভালো ভালো কথা চর্বিতচর্বন করা যাবে, কিন্তু তাঁর মন্দদিকগুলি মোটেই উত্থাপন করা যাবে না। বানিয়ে বানিয়ে প্রশংসা করা যাবে, কিন্তু সত্য হলেও তুলে আনা যাবে না তাঁর মন্দ আচরণ। তা করলে হয় নিজেরা সমালোচকের শরীর থেকে কল্যা নামিয়ে দেবে অতর্কিতে, নয়তো ৫৭ ধারা প্রয়োগ করে জেলে ভরে দেবে।
(৬) সন্ত্রাসবাদীরা আমাদের লোক নয় : আমাদের বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? গোঁড়া মুসলিম বোঝালে অবশ্যই সন্ত্রাসবাদীরা বা উগ্রপন্থীরা আপনাদেরই লোক। আর যদি আমাদের বলতে মডারেট মুসলিম বা সেকুলার মুসলিম বোঝানো হয়, তাহলে সেটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু উগ্রপন্থীদের কাজ সহিহ ইসলামের বিরুদ্ধে নাকি পক্ষে, সেটা তো আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমেই প্রমাণিত হওয়ার কথা। তাহলে ইসলামের আলোচনায় এত আপত্তি কেন? উল্টোটাই প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে কী? বাংলাদেশে এতগুলি মুক্তমনাদের হত্যা করার পরও একজন গোঁফহীন দাড়ি-টুপি-সৌদি পোশাক-পরা মুসলমানরা বিচার চেয়ে হত্যাকারীর শাস্তির দাবিতে প্রতিবাদ মিছিল করতে দেখিনি। নাস্তিক, মুক্তমনাদের বিরুদ্ধে এঁরা সবসময়ই খড়হস্ত।
(৭) মা হিজাব পরলে দুশ্চিন্তা থাকে না : দুশ্চিন্তা এমনিতেও থাকার কারণ নেই, যদি-না আপনি মিশরের বাসিন্দা হয়ে থাকেন। যদিও হিজাব সেখানে ৯৮% মহিলারই নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। অন্যদিকে ইউরোপের মহিলারা হিজাব না-পরলেও তাঁদের পরিবার দুশ্চিন্তা করে না। বাংলাদেশে যত মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে, তার মধ্যে ৯৯% মেয়েই হিজাবি। ধর্ষকদের মধ্যে আছে হাফিজ, মৌলবি, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকরাও।
(৮) মানুষের নিজস্বতাকে মেনে নেওয়া উচিত : এসব উচিত কথা আইসিস, বোকোহারাম, আলকায়দার লোকদের শেখালেই বরং ভালো হয়। তাহলে আমাদের মতো নাস্তিকদের চাপটাও কমে, মুসলিমদের অনুভূতিও আহত হয় না। কিন্তু মোহাম্মদের কার্টুন দেখে মুসলিমরা যত বড়ো মিছিল বের করেন, আইসিস কিম্বা বোকোহারামের বিরুদ্ধে তো সেরকম দেখা যায় না। অবশ্য তেমন মিছিল করতে হলে সরাসরি ইসলাম আর কোরানের বিরুদ্ধেই করা ভালো। আইসিস বা বোকোহারাম তো কোরানের বাইপ্রোডাক্ট মাত্র।
ইসলামোফোবিয়া? কী বলছেন গবেষক মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার— ইসলাম এবং ইসলামোফোবিয়া এক কথা নয়। ইসলাম একটা অদ্ভুত ধর্ম, যা নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত ব্যাখ্যা করে চলেছি, যুদ্ধ করে চলেছি। ধর্ম হিসাবে ইসলাম আমাদেরকে যতটা পিছু টেনে ধরে, আজকের যুগে অন্য কোনও ধর্ম তা করে না (তবে আজকাল অবশ্য উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোও পিছনেই ফিরে যেতে চাইছে।)। ইসলাম ধর্ম শুধু পরিবারের উপরেই নয়, সমাজের উপরেও চাপিয়ে দেয় জগদ্দল পাথরের মতো মধ্যযুগীয় নৈতিকতা, সংস্কৃতি এবং আইন-কানুনের ভার। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির অশান্তি, সন্ত্রাসবাদ এবং পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতে সামাজিক স্তরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর অনড় সাংস্কৃতিক চর্চা মুসলমান বা ইসলামের অনুসারীদের সম্পর্কে মিশ্র অনুভুতির জন্ম দিচ্ছে ব্যাপকভাবে। পশ্চিমা বিশ্বে সামাজিকভাবে গড়ে উঠছে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে এক স্থায়ী ভীতি। ইসলাম এবং মুসলমানদের নিয়ে এই ভিত্তির সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে নানান ধরনের শব্দ বা বর্গ, তাঁরই একটি হচ্ছে ‘ইসলামোফোবিয়া’। ইসলামোফোবিয়া হচ্ছে ইসলাম সম্পর্কে এবং তার অনুসারীদের সম্পর্কে অমুসলিম জনগণের ভাবনা বিষয়ক সাম্প্রতিক একটি সামাজিক ধারণা বা প্রপঞ্চ। মুসলিম জনগোষ্ঠী যাকে মনে করে থাকে। একধরনের বৈষম্য, আর অমুসলিম জনগণ মনে করেন এই আতঙ্কের বাস্তব ভিত্তি আছে এবং আতঙ্কজনক কোনো কিছু থেকে সাবধান থাকাটা যে-কারও অধিকার।
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকভাবে উচ্চারিত, তবুও ‘ইসলামোফোবিয়া’ শব্দটি প্রায় একশ বছর আগে ফরাসি রাজনৈতিক লেখালেখিতে ব্যবহৃত হয়েছিল, অবশ্য সেই সময়কার অর্থ আর আজকের অর্থের মাঝে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়েছে। মুসলিম এবং অমুসলিম সবাই খুব ব্যবহার করছেন শব্দটি। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই শব্দটি সামাজিক কিম্বা আইনগত কোনোভাবেই এখনও সংজ্ঞায়িত হয়নি। যেভাবে বর্ণবাদ বা ‘রেসিজম’-কে আইনগতভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, ইসলামোফোবিয়াকে সেভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়নি এখনও। তাই দশজন মানুষ এই শব্দটি ব্যবহার করলে অন্তত চারটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে। আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানেরা এই শব্দটি ব্যবহার করছেন প্রধানত এটা বলতে যে– পশ্চিমা দুনিয়া মুসলিম সমাজের নামে অহেতুক আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর মাধ্যমে মুসলিম জনসাধারণের প্রতি এক ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, এটাই ইসালামোফোবিয়া!
আর মুসলিম ধর্মের নন এমন নাগরিকেরা, বিশেষত উন্নত বিশ্বে, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর অমুসলিম নাগরিকেরা বলছেন মধ্যপ্রাচ্য সহ সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের সঙ্গে বিভিন্ন ইসলামিক গোষ্ঠী বা দলগুলোর সংশ্লিষ্টতার কারণে এক ধরনের স্থায়ী ভীতি তৈরি হয়েছে, যার বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। যদিও বিভিন্ন দেশের অমুসলিম নাগরিক সমাজের অনেকেই এই ভিতির কারণে মুসলিমদের প্রতি কোনো বৈষম্যমূলক আচরণের কথা অস্বীকার করে থাকেন।
মুসলমান সমাজের এই ধারণার বিপরীতে যে প্রধান প্রশ্নগুলি উঠে আসে তা হল –(১) আসলেই কি আতঙ্কটি অহেতুক? (২) আসলেই কি সারা পৃথিবীর সন্ত্রাসবাদী ঘটনার জন্যে মুসলমান জনগোষ্ঠী দায়ী? (৩) পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী ঘটনার জন্যে মুসলমান জনগোষ্ঠী আসলে কতটুকু জড়িত? কতটুকু দায়ী? (৪)
আসলেই কি মুসলমান নাগরিকেরা বৈষম্যের শিকার শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে? আমি বিষয়টিকে একটু। খোলামেলা ভাবে দেখতে চেয়েছি, অর্থাৎ আমি কোনও পূর্ব নির্ধারিত ভাবনা নিয়ে বিষয়টিকে পর্যবেক্ষণ করিনি। সংখ্যার প্রতি আমার এক ধরনের প্রীতি আছে, তাই চেষ্টা করেছি খানিকটা পরিসংখ্যান ব্যবহার করে এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার। মুসলমানদের যুদ্ধপ্রীতি এবং ইসলাম প্রসারের ক্ষেত্রে যুদ্ধ এবং বলপ্রয়োগের ইতিহাস সবারই জানা। আরব সহ ভারতবর্ষের ইতিহাসে তার বহু নজির আছে। তবে এই আলোচনায় সেসব ইতিহাস খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক এইজন্যে যে ইসলামোফোবিয়া একটি সাম্প্রতিক ধারণা এবং মুসলমান জনগোষ্ঠীর সাম্প্রতিক ইতিহাসই এই প্রশ্নে প্রাসঙ্গিক। তাই আসুন দেখা যাক, সাম্প্রতিক ইতিহাস কী বলে–
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের সবচেয়ে বড়ো ডেটাবেসটি সংরক্ষণ করছে আমেরিকার ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যা Global Terrorism Database a GTD alica yfiforo (91016 (http://www.start.umd.edu/gtd/) I Global Terrorism Database ১৯৭০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৪২ বছরের তথ্য সংগ্রহ করছে। ইউরোপে আলাদাভাবে TWEED ডেটাবেস, যা ইউরোপের একটি প্রধান ডেটাবেস, নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয় এই ডেটাবেসটি সংরক্ষণ করছে প্রায় অর্ধ শতক ধরে এবং ইউরোপোল গত প্রায় এক দশক ধরে এই ধরনের তথ্য ও পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করছেন। এই সবকয়টি ডেটাবেস ওপেন সোর্স বা উন্মুক্ত, যে কেউ চাইলেই এই ডেটাগুলি পেতে পারেন এবং গবেষণার কাজে ব্যবহার করতে পারেন। ইউরোপোল ২০০৬ সাল থেকে নিয়মিত বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করছেন, যা TE-SAT report নামে গুগোল করলেই পাওয়া যাবে। এই সকল ডেটাবেস বা প্রকাশনাগুলি আমেরিকা বা ইউরোপের সরকার বা প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রিত প্রকাশনা, তাই এই প্রকাশনার তথ্যগুলোকে অন্তত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্ভরযোগ্য ধরে নেওয়া যেতে পারে। যদিও সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদের সংজ্ঞা নিয়ে মুসলিম বা মার্কিন-বিরোধী মহলে বিতর্ক আছে। আপাতত সংজ্ঞা বিষয়ক বিতর্ক একপাশে রেখে বরং আলোচনাটিকে এগিয়ে নেওয়া যাক।
মুসলমানদের জঙ্গি তৎপরতা বা সন্ত্রাসবাদ সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে, কোনো সন্দেহ নেই, ২০০১ সালের ৯/১১ একটা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত হয়ে আছে এবং থাকবে। নিষ্ঠুরতার, বর্বরতার একটা কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে পৃথিবীর ইতিহাসে। একথায় তো কোনো দ্বিমত নেই যে, ৯/১১ আক্রমণের সঙ্গে জড়িতরা সকলেই মুসলমান ছিলেন এবং তারপরে যে গোষ্ঠীটি এই আক্রমণের দায়িত্ব নেয়, তাঁদের সকল প্রকার ব্যাখ্যা-বক্তব্য ধর্ম অনুপ্রাণিত (Religiously motivated) ছিল। আমেরিকায় ১৯৭০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মোট ২৩৮২ টি ঘটনাকে সন্ত্রাসবাদী ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে Global Terrorism Database-এর মতে, এর মধ্যে সন্দেহাতীতভাবে ৯/১১–এর ঘটনাটি সবচাইতে ভয়াবহতম এবং বর্বরতম ঘটনা।
খানিকটা বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে ৯/১১-এর আগে বা পরে কখনোই ইউরোপে এবং উত্তর আমেরিকার সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমে মুসলিমদের ব্যাপক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় না। আগ্রহ-উদ্দীপক সত্য হচ্ছে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের গত কয়েক যুগের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের খুব ছোটো একটি অংশ হচ্ছে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ (Religious Terrorism) এবং যদি মোট সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে প্রায়শই তা ১০%–এর নীচে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে এই যে, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী ঘটনাগুলির খুব ছোটো একটা অংশ মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা সংগঠিত। আমেরিকায় এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রায় ২% এবং ইউরোপে ১%-এরও কম। আমেরিকায় দেশের মাটিতে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের একটা বড়ো অংশের সঙ্গে ইহুদি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, যার পরিমাণ প্রায় ৫%। অর্থাৎ আমেরিকায় ইহুদি ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের দ্বারা সংগঠিত ঘটনাগুলোর সংখ্যা ইসলামিক জঙ্গি ঘটনাগুলির প্রায় আড়াই গুণ। তাহলে আমেরিকা বা ইউরোপের এই সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের সঙ্গে। মূলত কারা জড়িত? আমাদের সাধারণ ধারণার সঙ্গে বাস্তব পরিসংখ্যানকে মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ইউরোপোল ২০০৬ সাল থেকে নিয়মিত রিপোর্ট প্রকাশ করছে এবং ২০০৬ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত প্রত্যেক বছরে ইউরোপের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার প্রায় প্রায় ৭০% বেশি সংগঠিত হয়েছে ‘সেপারেটিস্ট’ বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা। ফ্রান্স, স্পেন এবং ইংল্যান্ড এই তিনটি দেশে ৮০%-এর বেশি সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে, যার সবচাইতে বেশি ঘটেছে স্পেনে এবং প্রতিটি ঘটনাই স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী’-দের দ্বারা সংগঠিত। (কৃতজ্ঞতা : মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার)।
মোহম্মদের ইসলাম প্রচার নিরঙ্কুশ ও রক্তপাতহীন ছিল না মোটেই। মোহম্মদের সময়েও না, মোহম্মদের পরেও না। মোহাম্মদ মক্কায় ইসলামের প্রসারের ব্যাপারে অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েন। হতাশ হয়ে তিনি মক্কা বাদ দিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফ যান (তায়েফ গমনের তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে)। কিন্তু সেখানে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তিনি চূড়ান্ত অপমান, ক্রোধ ও উপহাসের শিকার হন। এমনকি তায়েফের লোকজন তাঁদের কিশোর তরুণদেরকে মোহাম্মদের পিছনে লেলিয়ে দেয়। তাঁরা ইট-পাথরের আঘাতে তাঁকে রক্তাক্ত করে দেয়। কিন্তু তবুও তিনি হাল ছাড়েননি, বরং সেখানেও তিনি ইসলাম প্রসারের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করতে থাকেন। কেন এমন বিরূপতা?
তার আগে জানা প্রয়োজন ইসলামের কাঠামো, ইসলামের ভিত্তি। ইসলামের ভিত্তি হল ‘পঞ্চ স্তম্ভ’– কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব ও জাকাত। এই কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব ও জাকাত– এইগুলো নিয়ে কোনো অ মুসলমানদের কোনো আগ্রহ নেই। থাকার কথাও নয়। তবে অ-মুসলমানদের কাছে দুটি আরবি শব্দ নিয়ে খুবই আতঙ্কিত— একটি হল কাফের, অপরটি জিহাদ। ইসলামও এই শব্দদুটি নিয়ে বিভ্রান্ত এবং রক্তাক্ত হয় অ মুসলিমরা। এই দুটি শব্দ কোরানে অনেক জায়গায় উল্লেখ আছে, যা অমুসলমানদের প্রতি ঘৃণা বর্ষণ করে। তাই নানা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সহ কৈফিয়ত নিয়ে মাঠে নামতে হয় তাঁদের।
কাফের : কাফের কথার সোজা অর্থ হল অবিশ্বাসী। কীসের অবিশ্বাস? আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস। অর্থাৎ তিনিই মুসলমান, যিনি আল্লাহর প্রতি অনুগত, বিশ্বাসী। বাকিরা কাফের। কোরানের সেইসব কাফেরদের কথাই উল্লেখ আছে, যাঁরা ইহুদি এবং খ্রিস্টান। কোরান-রচয়িতাদের সেসময় অন্য ধর্ম বা ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলি সম্বন্ধে কোনো উল্লেখ নেই, বোধহয় অজ্ঞানতার কারণেই। উল্লেখ না-থাকলেও সারা বিশ্বের মুসলমানরা সমস্ত অমুসলমানদেরই কাফের বলে থাকে।
কাফের হত্যাযোগ্য। কারণ কোরান সেটা পাকাপাকিভাবেই বলে গেছে। কোরানের আয়াতগুলি যেহেতু কোনোরূপ পরিবর্তন করা যায় না বলে মুসলমানদের বিশ্বাস, তাই ধরে নেওয়া যেতেই পারে সমগ্র মুসলিম জাতি এ বাণী অক্ষরে অক্ষরে পালন করার বাসনা মনের ভিতর পোষণ করে। আল্লাহর নির্দেশ কি অমান্য করা সম্ভব! পবিত্র কোরান ঘেঁটে এমন আঠারোটি আয়াত সংগ্রহ করতে পেরেছি, যেখানে কাফেরদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার হুকুম করেছেন দয়ালু আল্লাহ।
(১) আর তাদেরকে হত্যা করো যেখানে পাও সেখানেই এবং তাদেরকে বের করে দাও সেখান থেকে যেখান থেকে তারা বের করেছে তোমাদেরকে। বস্তুত ফেতনা ফ্যাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ। আর তাদের সাথে লড়াই কোরো না মসজিদুল হারামের নিকটে যতক্ষণ-না তারা তোমাদের সাথে সেখানে লড়াই করে। অবশ্য যদি তারা নিজেরাই তোমাদের সাথে লড়াই করে। তাহলে তাদেরকে হত্যা করো। এই হল কাফেরদের শাস্তি (কোরান— বাক্কারাহ : ১৯১)। (২) আর তারা যদি বিরত থাকে, তাহলে আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু (কোরান— বাক্কারাহ : ১৯২)।
(৩) আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই করো, যে পর্যন্ত-না ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর যদি তারা নিবৃত হয়ে যায় তাহলে কারো প্রতি কোনো জবরদস্তি নেই, কিন্তু যারা জালেম (কোরান–বাকারাহ : ১৯৩)।
(৪) অতএব যারা কাফের হয়েছে, তাদেরকে আমি কঠিন শাস্তি দেব দুনিয়াতে এবং আখেরাতে তাদের কোন সাহায্যকারী নেই (কোরান— ইমরান : ৫৬)।
(৫) খুব শীঘ্রই আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করব। কারণ, ওরা আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করে যে সম্পর্কে কোনো সনদ অবতীর্ণ করা হয়নি। আর ওদের ঠিকানা হল দোজখের আগুন। বস্তুত জালেমদের ঠিকানা অত্যন্ত নিকৃষ্ট (কোরান— ইমরান : ১৫১)।
(৬) তারা চায় যে, তারা যেমন কাফের, তোমরাও তেমনি কাফের হয়ে যাও, যাতে তোমরা এবং তারা সব সমান হয়ে যাও। অতএব, তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে চলে আসে। অতঃপর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে তাদেরকে পাকড়াও করো এবং যেখানে পাও হত্যা করো। তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কোরো না এবং সাহায্যকারী বানিও না (কোরান— নিসা : ৮৯)।
(৭) যখন নির্দেশ দান করেন ফেরেশতাদিগকে তোমাদের পরওয়ারদেগার যে, আমি সাথে রয়েছি তোমাদের, সুতরাং তোমরা মুসলমানদের চিত্তসমূহকে ধীরস্থির করে রাখো। আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই গর্দানের উপর আঘাত হানো এবং তাদেরকে কাটো জোড়ায় জোড়ায় (কোরান— আনফাল : ১২)।
(৮) হে ঈমানদারগণ, তোমরা যখন কাফেরদের সাথে মুখোমুখী হবে, তখন পশ্চাদপসরণ করবে না (কোরান— আনফাল : ১৫)।
(৯) আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ-না ভ্রান্তি শেষ হয়ে যায়; এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারপর যদি তারা বিরত হয়ে যায়, তবে আল্লাহ্ তাদের কার্যকলাপ লক্ষ করেন (কোরান— আনফাল : ৩৯)।
(১০) সুতরাং যদি কখনো তুমি তাদেরকে যুদ্ধে পেয়ে যাও, তবে তাদের এমন শাস্তি দাও, যেন তাদের উত্তরসূরিরা তাই দেখে পালিয়ে যায়; তাদেরও যেন শিক্ষা হয় (কোরান— আনফাল : ৫৭)।
(১১) আর কাফেররা যেন একা যা মনে না করে যে, তারা বেঁচে গেছে; কখনও এরা আমাকে পরিশ্রান্ত করতে পারবে না (কোরান— আনফাল : ৫৯)।
(১২) আর প্রস্তুত করো তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পারো নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে তোমরা জান না; আল্লাহ তাদেরকে চেনেন। বস্তুত যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহর পথে, তা তোমরা পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাবে এবং তোমাদের কোনো হক অপূর্ণ থাকবে না (কোরান— আনফাল : ৬০)।
(১৩) অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদের হত্যা করো যেখানে তাদের পাও, তাদের বন্দি করো এবং অবরোধ করো। আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসে থাক। কিন্তু যদি তারা তওবা করে, নামাজ কায়েম করে, জাকাত আদায় করে, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (কোরান— তাওবা : ৫)।
(১৪) ইহুদিরা বলে ওজাইর আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলে মসিহ আল্লাহর পুত্র। এ হচ্ছে তাদের মুখের কথা। এরা পূর্ববর্তী কাফেরদের মতো কথা বলে। আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন, এরা কোন উল্টো পথে চলে যাচ্ছে (কোরান— তাওবা : ৩০)।
(১৫) হে নবি, কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করুন এবং মুনাফেকদের সাথে তাদের সাথে কঠোরতা অবলম্বন করুন। তাদের ঠিকানা হল দোজখ এবং তা হল নিকৃষ্ট ঠিকানা (কোরান— তাওবা : ৭৩)
(১৬) হে ঈমানদারগণ, তোমাদের নিকটবর্তী কাফেরদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও এবং তারা তোমাদের মধ্যে কঠোরতা অনুভব করুক আর জেনে রাখ, আল্লাহ মুত্তাকিদের সাথে রয়েছেন (কোরান— তাওবা : ১২৩)।
(১৭) অতঃপর যখন তোমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের গর্দার মারো, অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত করো তখন তাদেরকে শক্ত করে বেঁধে ফেল। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ করো, না হয় তাদের নিকট হতে মুক্তিপণ লও। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে যে পর্যন্ত না শত্রুপক্ষ অস্ত্র সমর্পণ করবে! একথা শুনলে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের কতককে কতকের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। যারা আল্লাহর পথে শহিদ হয়, আল্লাহ কখনোই তাদের কর্ম বিনষ্ট করবেন না (কোরান— মুহাম্মদ : ৪)।
(১৮) মোহাম্মদ আল্লাহ্ রসুল এবং তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সেজদারত দেখবেন। তাদের মুখমণ্ডলে রয়েছে সেজদার চিহ্ন। তওরাতে তাদের অবস্থা এরূপ এবং ইঞ্জিলে তাদের অবস্থা যেমন একটি চারা গাছ যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অতঃপর তা শক্ত ও মজবুত হয় এবং কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে চাষিকে আনন্দে অভিভুত করে— যাতে আল্লাহ্ তাদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন (কোরান— মুহাম্মদ : ২৯)।
(১৯) হে নবি! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জেহাদ করুন এবং তাদের প্রতি কঠোর হোন। তাদের ঠিকানা জাহান্নাম। সেটা কতই না নিকৃষ্ট স্থান (কোরান— তাহরিম : ৯)।
আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ তাঁর ‘Why are they Kafir why are’ গ্রন্থে কাফের কারা সে বিষয়ে বিস্তারিত যা বলেছেন, সেটা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিষয়টা তাহলে আর-একটু পরিষ্কার হবে— (১) যে ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কাউকে নবি মানে। (২) যে ব্যক্তি নিজেকে নবি বলে দাবি করে। (৩) যে ব্যক্তি নবুওয়তকে ‘ইকতিসাবি’ বলে দাবি করে। নবুওয়ত মানে নবিত্ব, মোহম্মদের নবিত্ব। (৪) যে ব্যক্তি নিজের কাছে ওহি আসে বলে দাবি করে। (৫) যে ব্যক্তি কোরানের আয়াত ও হাদিসের নসকে তাদের প্রকাশ্য ও মুজমা আলাইহি অর্থ থেকে সরিয়ে দেয়। (৬) যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাফের বলে না। (৭) যে ব্যক্তি মুখে উচ্চারণ করে এমন কথা বলে, যার দ্বারা উম্মতের গোমরাহী কিংবা সাহাবায়ে কেরামের প্রতি কুফরির অপবাদ আরোপিত হয়। (৮) যে মুসলমান এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয়, যা নির্দিষ্টভাবে কুফরের প্রতীক। (৯) কুফরি কথা বলনেওয়ালার সমর্থনকারী ও প্রশংসাকারী। (১০) যে ইচ্ছাকৃত কুফরি কথা বলে। (১১) কুফরি কথা উচ্চারণকারী। (১২) কুফরি কথা হাসি-তামাশা ক্রীড়ার ছলে বললেও সেই বক্তা কাফের। (১৩) যে ব্যক্তি ওহি, নবুওয়ত, সশরীরে হাশর, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদির ব্যাপারে আহলে ইসলামের ন্যায় প্রবক্তা না হবে, সেও কাফের। (১৪) যে ব্যক্তি আম্বিয়ারে কেরাম মাসুম তথা নিষ্পাপ হওয়ার প্রবক্তা নয়, সে কাফের। (১৫) শরিয়তের অকাট্য হারামগুলিকে যে ব্যক্তি নিজের জন্য হালাল মনে করে, সে কাফের। (১৬) যিনি মূর্তিকে সেজদা করে, তিনি কাফের।
অর্থাৎ কাফের শুধু অমুসলমান বা বিধর্মীরাই নয়, মুসলমানরাও কখনো কথার দ্বারা কাফের আবার কখনো কাজের দ্বারা। কুফরকে আবশ্যককারী সুরত হচ্ছে এই যে, মানুষ এমন কোনো শরয়ী বিষয়কে অস্বীকার করবে, যা মুজমা আলাইহি এবং যার ব্যাপারে স্পষ্ট নস বিদ্যমান। চাই তার আকিদাও তাই হোক কিংবা তা না হোক; বরং শুধু গোঁয়ার্তুমি অথবা উপহাসস্বরূপ অস্বীকার করে থাকুক –তাতে কোনো কোনো পার্থক্য হয় না। সর্বাবস্থায় সেই ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে। কাফের, তাই হত্যা করো। আল্লাহ কাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন? কাফেরদের হত্যার দায়িত্ব কাকে দিয়েছে আল্লাহ? নবিকে, নবি ছাড়া এ দায়িত্ব কারোকে আল্লাহ দেননি। নবি সেই দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, আল্লাহ দয়ালু। আল্লাহ কি হত্যাকারীদের খুব পছন্দ করে, যাঁরা কাফের হত্যা করে? এই হত্যার প্রকৃত নির্দেশক কে? নবি, না আল্লাহ? ‘পরম করুণাময় আল্লাহ কখনো এ ধরনের নির্দেশ দিতে পারে? সংশয় থাকলে বলবেন।
মুমিনরা বলেন, নবি মোহম্মদ মূর্খ নিরক্ষর ছিলেন। তাঁর পক্ষে কোরান রচনা সম্ভব নয়। তাঁরা আল্লাহকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে, কোরানকে প্রামাণ্য করতে গিয়ে নবিকেই অবলীলায় মূর্খ ‘নিরক্ষর’ বলতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু আমি মনে করি না নবি হজরত মোহম্মদ মূর্খ ছিল। বরং তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ, অদম্য সাহসী, দক্ষ যোদ্ধা, অপরিসীম আত্মবিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। আর ছিল নেতৃত্ব দেওয়ার সীমাহীন ক্ষমতা, যা প্রায় সম্মোহনী পর্যায়ের ছিল। জেনে রাখুন, খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ছিলেন মোহাম্মদের প্রথমা স্ত্রী। তিনি কে ছিলেন? তিনি ছিলেন সেই সময়কার মক্কার অন্যতম ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। নিজ যোগ্যতায় অনেক বড়ো ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে তাঁকে আমেরাত কুরাইশ বা কুরাইশদের রাজকন্যা নামেও ডাকা হত। ব্যবসার কাজে তিনি মোহাম্মদকে নিয়োগ করেন। মুখ দেখে নয়। মনে রাখতে হবে, তখনও মোহাম্মদ নবুয়ত বা নবিত্ব লাভ করেননি। তাঁর ব্যাবসা দেখাশোনা এবং ব্যাবসায় কর্মচারীদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তিই ছিলেন মোহাম্মদ। সেই ব্যাবসায় হিসেবনিকেশের কাজ ছিল, অন্য শহর এবং অন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার বিষয় ছিল। প্রশ্ন জাগে, এরকম একজন ‘অশিক্ষিত’ ‘নিরক্ষর’ ব্যক্তিকে খাদিজা কেন নিজের এত বড়ো ব্যাবসার প্রধান হিসাবে নিযুক্ত করবেন? উনার মতো একজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী এত বোকা হবেন তা ধরে নেওয়া মুশকিলের ব্যাপার। কোনো প্রথিতযশা নিয়োগকর্তা কোনো মূর্খকে নিয়োগ করবেন এমন একটা দায়িত্বপূর্ণ কাজে? আবার তাঁকে বিয়েও করে ফেললেন, যে কিনা তাঁর থেকে ১৫ বছরের ছোটো ছিল। অর্থাৎ খাদিজার বয়স যখন চল্লিশ, তখন মোহম্মদের বয়স মাত্র পঁচিশ। অবশ্য খাদিজার এটা প্রথম বিবাহ নয়, মোহম্মদ পঞ্চম স্বামী। পূর্বের স্বামীরা যথাক্রমে আতিক বিন আবিদ, আল-মাখজুমি, আবু হালা ইবন জারারাহ, আত-তামিমি প্রমুখ।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে ইসকারের ‘সিরাত আল রসুল’ বই থেকে পাওয়া যায়, একবার মুসাইলিমা আল হাবিব নিজেকে নবি দাবি করে চিঠি লেখে মোহাম্মদকে— “From Musaylima the apostle of God to Muhammad the apostle of God. Peace upon you. I have been made partner with you in authority. To us belongs half the land and to Quraysh half, but Quraysh are a hostile people..” প্রত্যুত্তরে মোহাম্মদ লেখেন –“From Muhammad the apostle of God to Musaylima the liar. Peace be upon him who follows the guidance. The earth is God’s. He lets whom He will of His creatures (to) inherit it and the result is to the pious…” সেইসঙ্গে হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় মোহাম্মদ নিজেই সন্ধির কাগজটি পরিমার্জনা করেন বলেও একটি সহি হাদিস পাওয়া যায়। সহিহ বুখারি (তাওহিদ) অধ্যায় : ৫৩/ বিবাদ মীমাংসা, হাদিস নম্বর : ২৬৯৮ বারা’ ইবনু ‘আজিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হুদায়বিয়াতে (মক্কাবাসীদের সঙ্গে) সন্ধি করার সময় ‘আলি (রাঃ) উভয় পক্ষের মাঝে এক চুক্তিপত্র লিখলেন। তিনি লিখলেন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। মুশরিকরা বলল, “মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ লিখবে না। আপনি রাসুল হলে আপনার সঙ্গে লড়াই করতাম না?’ তখন তিনি আলিকে বললেন, ‘ওটা মুছে দাও। আলি (রাঃ) বললেন, আমি তা মুছব না এবং তখন আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজ হাতে তা মুছে দিলেন। ইবনু আববাস (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর অসুখ যখন বৃদ্ধি পেল তখন তিনি বললেন— ‘আমার নিকট লেখার জিনিস নিয়ে এসো, আমি তোমাদের এমন কিছু লিখে দেব যাতে পরে তোমরা আর পথভ্রষ্ট হবে না। “উমার (রাযি.) বললেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রোগ-যন্ত্রণা প্রবল হয়ে গেছে (এমতাবস্থায় কিছু বলতে বা লিখতে তাঁর কষ্ট হবে)। আর আমাদের নিকট তো আল্লাহর কিতাব আছে, যা আমাদের জন্য যথেষ্ট। এতে সাহাবিগণের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিল এবং শোরগোল বেড়ে গেল। তখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা আমার কাছ থেকে উঠে যাও। আমার নিকট ঝগড়া-বিবাদ করা অনুচিত। এ পর্যন্ত বর্ণনা করে ইবনু আববাস (রাযি.) (যেখানে বসে হাদিস বর্ণনা করছিলেন সেখান থেকে) এ কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন যে, “হায় বিপদ, সাংঘাতিক বিপদ! আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর লেখনীর মধ্যে যা বাধ সেধেছে।’ (৩০৫৩, ৩১৬৮, ৪৪৩১, ৪৪৩২, ৫৬৬৯, ৭৩৬৬ দ্রষ্টব্য) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১১২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১১৫) হাদিস নম্বর ৩৬০৮– “নাসর ইবন আলি (রহঃ) … মুত্তালিব ইবন আবদিল্লাহ ইবন হানতাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন— একদা জায়দ ইবন ছাবিত (রা:) মু’আবিয়া (রা:)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে একটি একটি হাদিস সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন। তখন মু’আবিয়া (রা:) জনৈক ব্যক্তিকে সে হাদিসটি লিখে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। এ দেখে জায়দ (রা:) বলেন— রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম আমাদের এরূপ নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমরা যেন তাঁর কোনো হাদিস লিপিবদ্ধ না করি। আর যা কিছু লেখা হয়েছিল, তিনি তার সবই মুছে দেন।” নবি মোহম্মদ মূর্খ ও নিরক্ষর হলে কিছুতেই ২৩ বছরের নবুয়্যত জীবন টিকে থাকতে পারত না। তারপর ১৫০০ বছর পরেও স্বমহিমায় টিকে আছে।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নিই মোহাম্মদ মূর্খ ছিলেন, নিরক্ষর ছিলেন, তার মানে এই নয় যে তিনি জ্ঞানী ছিলেন না। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কোনো পুথিগত বিদ্যা ও প্রথাগত ছিল না। তা সত্ত্বেও তাঁর জ্ঞান সমুদ্রের মতো গভীর, আকাশের মতো সীমাহীন। তিনি ছিলেন দার্শনিক। তাঁর কথামৃতগুলি পাঠ করলেই তা অনুধাবন করা সম্ভব। তিনি যদি মোহাম্মদের মতো ভাবতেন, তাহলে তিনি কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুগতদের সঙ্গে নিয়ে ‘কোর কমিটি’ করে কোরানের মত একখানি অনুশাসন সংবলিত কিতাবও লিখে ফেলতে পারতেন।
জিহাদ : ইসলাম ধর্মে জিহাদ খুব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ইসলামি আন্দোলনের সূচনাতেই ‘বাতিল’ সমাজের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। প্রচলিত সমাজের চিন্তাধারা ও আকিদা-বিশ্বাস জাহেলিয়াতেরই প্রভাবাধীন থাকে। জাহেলিয়াতের ভিত্তিতেই ওই সমাজব্যবস্থার কাঠামো গড়ে ওঠে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় জাহেলিয়াত সমাজের উপর সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত থাকে। পার্থিব উপকরণ ও বিভ্রান্তিকর কর্মসূচি অবলম্বন করে মানুষকে জাহলি সমাজের প্রতি অনুগত থাকার জন্য বাধ্য করে। আর ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর পরিবর্তে মানুষেরই কাছে মাথা নত করে বাস করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এর ফলে ইসলামি আন্দোলন পরিচালনার জন্য জাহেলিয়াতের প্রতিষ্ঠিত শক্তির তুলনায় সমপরিমাণ উপায়-উপকরণ অপরিহার্য হয়ে পড়ল। প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সাধনের জন্য পার্থিব শক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে জিহাদ পরিচালনা করে। জিহাদ কথার বাংলা অর্থ সংগ্রাম। তা সংগ্রাম কাদের সঙ্গে? সংগ্রাম তাঁদের সঙ্গে, যাঁরা ইসলামের প্রতিপক্ষ। মোহম্মদের রাজনৈতিক ভাবনায় আরবে একজনও ইসলাম-বিরোধী থাকতে পারবে না। থাকবে কেবল ইসলামি একনায়কতন্ত্র। জাহেলিয়াত আরবে ইসলামি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেই জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে, যতক্ষণ-না শেষ জাহেলিয়াত শক্তি অবশিষ্ট থাকবে, ততক্ষণ জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে এবং মোহম্মদ প্রণীত আল্লাহর পথে এবং ইসলামের ছত্রতলে আসবে। সেইসময়ে ইসলামের শিকার শুধুমাত্র জাহেলিয়াতের প্যাগান ধৰ্মই নয়, ইহুদি-খ্রিস্টানরাও শিকার হল। ভিন্ন ধর্মানুভূতি ও ধর্মভাবনাকে জিহাদের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়ে ইসলামের জয়যাত্রা সূচিত হল।
একশ্রেণির মুমিন, যাঁরা ইসলামি জিহাদের আলোচনা করেন এবং জিহাদের সমর্থনে কোরানের আয়াত উদ্ধৃত করে থাকেন, তাঁরা এই বিষয়টির গভীরে মনোযোগ প্রদান করেন না। বরং তাঁরা ইসলামি আন্দোলনকে যেসব স্তর অতিক্রম করে অগ্রসর হতে হয়, সেই স্তরগুলিও বুঝে উঠতে পারে না। অতি স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলনের কোন্ স্তরে কোন্ কোরানি আয়াত কী তাৎপর্য নিয়ে ‘অবতীর্ণ হয়েছিল, তাও উপলব্ধি করতে পারে না। তাঁরা তাই অস্পষ্ট ধারণা নিয়ে জিহাদের আলোচনায় প্রবৃত্ত হন এবং আন্দোলনের বিভিন্ন স্তরগুলি জগাখিচুড়ি বানিয়ে জিহাদের আসল রূপ বিকৃতি করে ফেলেন।
তবে ‘Jehad’ গ্রন্থে সাইয়েদ কুতুব শহিদ লিখেছেন –“দুর্বল ও পরাজিত মনোভাবাপন্ন লেখকরা ইসলামি জিহাদ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে যখন তাঁদের দৃষ্টভঙ্গি অনুসারে ইসলামের দেহ থেকে জিহাদের ‘কলঙ্ক’ মোচনের প্রয়াস পান, তখন তাঁরা দুটো বিষয়কে অযথা মিশ্রিত করে ফেলেন— প্রথম বিষয়টি হচ্ছে জোরজবরদস্তি ইসলাম গ্রহণ করতে কোনো বাধ্য না করা। পবিত্র কোরানে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা (দ্বীন গ্রহণে কোনো জবরদস্তি নেই) ঘোষণার ভিতর দিয়ে স্পষ্ট ভাষায়ই এরূপ নির্দেশ দিয়েছেন। দ্বিতীয় হচ্ছে, ইসলাম ওই সমস্ত রাজনৈতিক ও পার্থিব শক্তির মূলোচ্ছেদ করার নির্দেশ দেয়, যেসব শক্তি মানুষ ও আল্লার মধ্যে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় এবং আল্লার দাসত্ব গ্রহণে মানুষকে বাধা প্রদান করে নিজেদের গোলাম বানিয়ে নেয়। এ দুটো মূলনীতি সম্পূর্ণ পৃথক। … দুর্বল মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা পরাজয় বরণকারী পরাভূত চিন্তাধারার দরুন এই উভয় বিষয়কে মিশ্রিত করে ইসলামি জিহাদকে ‘আত্মরক্ষামূলক’ যুদ্ধ হিসাবে আখ্যায়িত করতে চায়। অথচ ইসলামি জিহাদ হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির লড়াই। আধুনিক যুগে প্রচলিত যুদ্ধবিগ্রহের সঙ্গে তার কোনো সামঞ্জস্য নেই। যুদ্ধের শর্তাবলি অথবা বাহ্যিক আকৃতি-প্রকৃতি কোনো ক্ষেত্রেই ইসলামি জিহাদের সঙ্গে বর্তমানকালের যুদ্ধ তুলনাই হতে পারে না।” অর্থাৎ আইসিস, আল কায়দার মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি আল্লাহর নামে যে যুদ্ধ করে, তা আল্লাহ পথে নয়। এঁরা আল্লাহর নামে ‘আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে সমগ্র মুসলিম সমাজকে বিপথে চালিত করে। আশার কথা সেই কাজে তাঁরা চরমভাবে ব্যর্থ।
অপরদিকে ইসলাম পণ্ডিতরা যা বলে থাকেন, সেটাও ভাবার বিষয়। তাঁরা বলেন– দ্বীনে-হক একটি বিশ্বব্যাপী বিপ্লবী ঘোষণা। মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে এমনকি নিজের প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকেও মুক্তিদানই এই ঘোষণার সারকথা। আল্লাহর একক সার্বভৌমত্ব যে আকার ও যে ধরনেরই হোক না-কেন, তার বিরুদ্ধে পরিপূর্ণ বিদ্রোহ ঘোষণার নামই ইসলাম। মানুষের উপর মানুষের শাসন ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে খোদায়ী শক্তিরই দাবি। অর্থাৎ যে সমাজব্যবস্থায় সকল বিষয়ে চূড়ান্ত মীমাংসাকারী কর্তৃত্ব মানুষেরই হাতে, যেখানে মানুষই মানুষের জন্যে চূড়ান্তভাবে আদেশ-নিষেধ জারি করার ক্ষমতা ভোগ করবে, সে সমাজে কিছু সংখ্যক লোক অবৈধভাবে খোদায়ী ক্ষমতাই দাবি করে থাকে। যাঁরা তাঁদের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয় তাঁরা কোরানের পরিভাষায় ‘আল্লাহ ছাড়া অপরাপর রব’ গ্রহণ করে থাকে। তাহলে একমাত্র আল্লার সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব ঘোষণার অর্থ দাঁড়ায়, যাঁরা অবৈধভাবে খোদায়ী শক্তি ভোগ করছে তাঁদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে পুনরায় আল্লারই হাতে অর্পণ করা এবং যারা মনগড়া আইন বিধান রচনা করে মানুষের উপর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তাঁদের উচ্ছেদ সাধন। কারণ তাঁরা নিজেদেরকে খোদার আসনে বসিয়ে মানবসমাজকে তাঁদের দাসে পরিণত করেছিল। মোদ্দা কথা, আল্লাহর প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করার অর্থই হচ্ছে মানুষের উপর মানুষের সকল প্রকার শাসনাধিকার ও শাসনক্ষমতার অবসান ঘটিয়ে সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা ও প্রতিপালক প্রভুর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ হুজুর-মুমিনরা মানুষের প্রণীত আইন দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে স্বীকার করে না। তাঁরা স্বপ্ন দেখেন আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে। আল্লাহর শাসন মানে কোরানের শাসন। কোরানের শাসন মানে মোহম্মদীয় শাসন। গোটা পৃথিবীতে মোহম্মদীয় শাসন চলবে? পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষ সুড়সুড় করে মোহম্মদীয়কে শাসনকে মেনে নেবে? আর বাকি ধর্মীয় মতাদর্শ কী গাঙের জলে ভেসে এসেছে নাকি?
বলা হয়, জিহাদ অস্বীকার করলে তাঁর আর মুসলমান থাকা যায় না। অতএব যিনি মুসলমান নন, তিনি তো কাফেরই– অ-মুসলমান। জিহাদ প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য ফরজ। “জিহাদ ফি আবিল আল্লাহ”– জিহাদ হল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করা। মডারেট মুসলমানরা বলছেন, নিজের সঙ্গে নিজের সংগ্রাম –জিহাদ। অনেকে মনে করেন, জিহাদ হল ইসলামকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যুদ্ধ। তাই জিহাদের কোনো বিকল্প নেই। জিহাদের মাধ্যমেই সকলকে মুসলিম বানানো এবং সমগ্র বিশ্বকে ইসলামী রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলার প্রয়াস জারি থাকল নাকি? এখন প্রশ্ন হল কাদের বিরুদ্ধে ইসলামিরা জিহাদ করবে? (১) যাঁরা মুসলমানদের সঙ্গে বিরোধিতা করবে, (২) যাঁরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উপাসনা করবে? (৩) নিজের সঙ্গে নিজের সংগ্রাম। কেন এই জিহাদ কেয়ামত অর্থাৎ শেষ প্রলয় পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে? কারণ জিহাদ হল হজ, ওমরাহ হজ, নফল নামাজ, রোজা ইত্যাদির চাইতেও মহত্তর।
ইসলামের জগতে সর্বোচ্চ পণ্ডিত ইমাম গাজ্জালি। জিহাদ প্রসঙ্গে তিনি বলছেন –“প্রত্যেক মুসলমানকে বছরে বছরে অন্তত একবার অবশ্যই জিহাদে যেতে হবে।… দুর্গের ভিতরে যদি নারী ও শিশুরাও থাকে তবুও তাদের বিরুদ্ধে ভারী পাথর বা তীর নিক্ষেপের যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে, তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে কিংবা ডুবিয়ে মারা যেতে পারে।”(এম. এ. খান— জিহাদ) কোরান বলছে– “যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও আল্লাহর রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। কখনো সীমা লঙ্ঘন কোরো না। আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের একেবারেই পছন্দ করেন না।” (সুরা বাকারা ২: ১৯০) “তাদের যেখানেই পাও সেখানেই হত্যা করো, তারা যেখান থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে তোমরাও তাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দাও। ফেত্না হত্যার চেয়ে জঘন্য। তোমরা আক্রান্ত না-হলে কাবাঘরের কাছে যুদ্ধ কোরো না। তবে তারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করলে তোমরা তাদের হত্যা করবে। এটাই কাফেরদের পুরস্কার।”(সুরা বাকারা ২: ১৯১) “তবে তারা বিরত থাকলে আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সুরা বাকারা ২: ১৯২) “ফেত্না দূর এবং আল্লাহর ধর্ম কায়েম না-পর্যন্ত তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তারা বিরত হলে জালেম ছাড়া কাউকে আক্রমণ কোরো না।”(সুরা বাকারা ২: ১৯৩) এই জিহাদের বিষয়ে একটি ফুটনোটও উল্লেখ আছে। সেই ৩২ নম্বর ফুটনোটে বলা হয়েছে –মুসলমানের মুসলমান রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশে কাফের ও মুনাফেকদের বিরুদ্ধে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধই জিহাদ (৯ : ৭৩, ৬৬ : ৯১)। জিহাদেও নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও দুর্বল যারা যুদ্ধরত নয় বা যুদ্ধ করার উপযুক্ত নয়, তাদের হত্যা করা নিষিদ্ধ। ফসল হানি ও গাছপালা ধ্বংস করাও নিষিদ্ধ।(অনুবাদ : এ কে এম আশরাফুল ইসলাম)।
এম. এ. খানের ‘জিহাদ’ গ্রন্থের ভূমিকা অংশে প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিক লিখেছেন –“ইসলামের প্রাণশক্তির উৎস হচ্ছে জিহাদ। এ জিহাদের মাধ্যমে মদিনা থেকে তাঁর বিজয়ী রূপে আত্মপ্রকাশ, প্রসার এবং প্রতিষ্ঠা। জিহাদের তাৎপর্য বাস্তবে হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্মের নামে যুদ্ধ এবং আরব আধিপত্য ও সামাজ্যের সম্প্রসারণ। জিহাদের মাধ্যমে ইসলামি আরব রাষ্ট্রের প্রসারের সঙ্গে ঘটেছে ধর্মের নামে পাইকারিভাবে পরের সম্পদ ও সম্পত্তি। লুণ্ঠন ও আত্মসাৎকরণ, নারী ধর্ষণ, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরকে কাফের’ বা ‘সত্য প্রত্যাখ্যানকারী’ আখ্যায়িত করে আক্রমণ ও পরাজিত করে বন্দি ও দাসকরণ। এভাবে ইসলামে ধর্মের নামে জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, আরব সাম্রাজ্যবাদ এবং দাস ব্যবস্থার যে ঐতিহ্য বা উত্তরাধিকার গড়ে উঠেছে।” শুধু শামসুজ্জোহাই নয়, ‘আমি কেন মুসলিম নই’ গ্রন্থের লেখক ইবনে ওয়ারাক লিখেছেন– “আগামী দশকগুলোতে ইসলামি জিহাদ খুব সম্ভবত ক্রমান্বয়ে জোরদার ও উগ্রতর হয়ে উঠবে, যা মানবজাতির জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে, বিশেষত অমুসলিম ও পশ্চিমা বিশ্বের জন্য।” ‘Now they call me infidel’ গ্রন্থের লেখিকা ননি দারবিশ (Nonie Darwish) বলেন –“জিহাদ হল ইসলামের প্রধান মতবাদ, যার প্রতিষ্ঠা সম্ভব কেবলই অ-মুসলিম, এমনকি মুসলিমদেরও। মানবিক অধিকার পদদলিত করার বিনিময়ে।” ভয়ংকর ব্যাপার!
কোরানের আয়াতগুলি নাকি আল্লাহ নাজিল করেছেন। নাজিল করেছেন শুধুমাত্র মক্কার কাবা শরিফ দখল করা এবং পৌত্তলিকদের উৎখাত করে ইসলাম ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। জিহাদ হল আল্লাহর পথে যুদ্ধ তথা সংগ্রাম। জিহাদ হল অবিশ্বাসীদের প্রতি ঘৃণা এবং তাঁদের সমূলে ধ্বংস করা। অবিশ্বাসীরা যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে না-চায় তবে তাদের সেই ধর্মে সামিল করার জন্য যে সংগ্রাম সেটাই জিহাদ। “পৃথিবীতে কোনো অবিশ্বাসী। গৃহবাসীকে তুমি অব্যাহতি দিও না।”(সুরা নুহ ৭১: ২৬) “কারণ ওরা অপবিত্র, অংশীদারীরা তো অপবিত্র।” (সুরা তওবা ৯ : ২৮) “ওরা শুধু অপবিত্রই নয়, অবিশ্বাসীরা হল নিকৃষ্ট জীব, নিশ্চয় আল্লাহর কাছে নিকৃষ্ট জীব তারাই যারা অবিশ্বাস করেও বিশ্বাস আনে না।” অতএব আল্লাহর কাছে পবিত্রতার একমাত্র মানদণ্ড হল ‘সত্যধর্ম ইসলামে ধর্মান্তকরণ। অর্থাৎ হিটলার, স্তালিন প্রমুখদের মতো মোহম্মদও একাই বিশ্ব শাসন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এটা একটা অবশ্যই স্পর্ধা! কারণ এইসব ‘অবিশ্বাসী’ ‘অপবিত্র’ জীবদের আল্লাহর দুনিয়ায় নেই। অবিশ্বাসী অপবিত্র জীবদের ধর্মান্তরিত করে কিংবা হত্যা করে দোজখে পাঠানোর দায়িত্ব পেলেন আরবদেশের ইসলামিরা। বস্তুত জিহাদ হল আল্লাহর বাধ্যতামূলক নির্দেশ, যা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ মুসলমানদের নেই। যে-কোনো মূল্যে অবিশ্বাসীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে পারলে জান্নাতবাসী হওয়া নিশ্চিত।(সুরা তওবা ৯ : ১১১) মোহম্মদের সারাজীবনের সংগ্রাম ছিল পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে, যাদের শেষপর্যন্ত তিনি উৎখাত করেছেন। শুধু পৌত্তলিক কাফের নয়, মুশরিক ইহুদি-নাসারাদের তিনি ক্ষমা করেননি। আমি মনে করি, এমন সুরা কখনোই আল্লাহ পাঠাতে পারেন না, সত্যিই যদি আল্লাহ পরমকরুণাময় হন। এইসব কুৎসিত ও মানবতাবিরোধী সুরা নিশ্চয় কোনো অসৎ ব্যক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংযোজন করেছেন।
ইসলাম প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কিছু ভ্রান্তপথিক জিহাদকে সঙ্গে রেখে ধর্মটাকেই সহিংস এবং বিধর্মী সংহারিতে ঠেলে দিয়েছে। কোরানে জিহাদ বিষয়ে প্রায় ২০০টি আয়াতে কোথাও কোনো অহিংসার বাণী নেই। সেই কারণেই মোহম্মদও জিহাদের মাধ্যমেই সহিংসতার মাধ্যমে তিনি ইসলামকে বিজয়ীর ধর্মে রূপ দিয়েছেন এবং নতুন নতুন দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইতিহাস বলছে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েনি কোনো দেশেই। ইসলাম প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছে সম্পূর্ণভাবে সহিংসার পথে। ইসলাম ধর্ম সর্বগ্রাসী, সামরিক বিজয় ও বিধর্মী সংহার ইসলামের প্রধান লক্ষ্য। ইতিহাস অথবা ইতিহাসের ইতিহাস– সর্বত্রই সেই সংহারের পদচিহ্ন পাওয়া যায়। সপ্তম শতক থেকেই ইসলামের এই রূপ ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেছে। গীতাতে দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ করে ধর্ম সংস্থানের ও অধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে প্রবল প্ররোচনার নানারূপ সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা সম্ভব হলেও তার প্রত্যক্ষ বা স্পষ্ট বক্তব্যের অনুরূপ কাফেরদের ধ্বংস করার জন্যে কোরানে জেহাদের আহ্বান পরিলক্ষিত হয় এবং জেহাদেরও নানারূপ সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা অনেকে করেছেন। কিন্তু সব রকমের সূক্ষ্ম ও স্থূল ব্যাখ্যা সত্ত্বেও জেহাদ কখনোই আগ্রাসন বা ধর্মপ্রসারের জন্যে সশস্ত্র শক্তি প্রয়োগ নয়, তা আসলে ঈশ্বরের পথে সংগ্রাম –একেবারে সেই অর্থেই সংগ্রাম যে অর্থে যুধিষ্ঠির কৌরবদের বিপক্ষে কিংবা গান্ধিজির ব্রিটিশদের বিপক্ষে লড়াই করা।
জেহাদ আর ক্রুসেড সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের লড়াই। প্রাচীন ভারতে দিগ্বিজয়ের আদর্শের মধ্যে অথবা অশ্বমেধ যজ্ঞাদির সঙ্গে জড়িত রাষ্ট্রনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের যে লিপ্সা আছে জেহাদের মধ্যে সেটুকুও নেই। ব্রাসেলসে ১৯ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সালে ইস্ট-ওয়েস্ট ইনস্টিটিউট আয়োজিত একটি সন্ত্রাসবিরোধী সন্মেলনে বক্তারা দাবি করেন –আল কায়েদার সহিংসতা থেকে ‘জিহাদ’ শব্দটিকে আলাদা করে দিতে হবে। কারণ অধিকাংশ মুসলিমের মতে ‘জিহাদ’ মানে আধ্যাত্মিক একটা সংগ্রাম। অপশক্তির দ্বারা ‘জিহাদ’ শব্দটি আরও ছিনতাই হোক, সেটা তারা চান না। সন্মেলনে এক ইরাকি পণ্ডিত শেখ মোহাম্মদ আলি বলেন– “নিজ আত্মার ভিতরের সকল অশুভ প্রবণতার বিরুদ্ধে সংগ্রামই হল জিহাদ, ইসলামে কোনো জিহাদি সন্ত্রাসবাদ নেই।” জিহাদ দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা বিস্তার অথবা জীবনে অত্যন্ত ইতিবাচক কিছু করার জন্য সংগ্রাম হতে পারে– এই কথার উপর জোর দিয়ে পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব আর্মি স্টাফের প্রাক্তন চেয়ারম্যান জেনারেল এহসান উল হক বলেন– ‘সন্ত্রাসবাদীদের জিহাদি বলে আখ্যায়িত করা হল ইসলামের উপলব্ধির ঘাটতির প্রতিফলন’ অথবা দুর্ভাগ্যবশত ‘একটি ইচ্ছাকৃত অপব্যবহার। ২০০২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি প্রদান অনুষ্ঠানে হার্ভার্ড ইসলামিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট জায়েদ ইয়াসিন My American Jihad’ শিরোনামে এক বক্তৃতায় বলেন– “জিহাদের সত্য ও বিশুদ্ধ। রূপ, যা সকল মুসলিম কামনা করে, তা হল নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে হলেও যা সঠিক, যা ন্যায়সংগত, তা-ই করা। নিজস্ব নৈতিক আচরণের জন্য এটা একটি ব্যক্তিগত সংগ্রাম।”
কিন্তু বাস্তবে কিন্তু উলটো প্রতিফলনই দেখা যায়। সাধারণ মানুষ তত্ত্বের অত অন্তর্নিহিত মানে বোঝে না, মানুষ যা দেখে যা শোনে তাই-ই মানে। তাই পুথির তত্ত্বকথা ছেড়ে ইতিহাস ভূগোল অনুসরণ করে। জিহাদের অহিংস ও মঙ্গলময় ধারণার বিরুদ্ধে আল কায়দা সহ অন্যান্য জঙ্গি তথা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী মায় মৌলবাদী ইসলামি দলগুলি। উল্লসিত চিত্তে দাবি করে যে– অবিশ্বাসীদের, বিশেষ করে পশ্চিমা ও পশ্চিমা-ঘেঁষা মিত্র ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং সরকারের বিরুদ্ধে তাদের পরিচালিত সহিংস কর্মকাণ্ডই হল জিহাদ। ইসলাম ধর্ম সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, মুসলিমরা সর্বোৎকৃষ্ট জাতি’– এই ধারণা এবং মানসিকতা কখনোই পৃথিবীতে শান্তি আনতে পারে না। অর্থাৎ আমার বাবাই শ্ৰেষ্ঠ আর পৃথিবীর সব বাবারা নিকৃষ্ট– অতএব সব বাবাদের হত্যা করো। পৃথিবীর সব বাবাদের হত্যা করলে নিজের ‘সর্বোৎকৃষ্ট’ বাবা বেঁচে থাকবে কি? দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তখনই, যখন আইসিস, বোকা হারাম, আল কায়দা ইত্যাদি মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো নিজেদেরকে ‘জিহাদি’ বলে ঘোষণা করে, তাঁদের কর্মকাণ্ডকে ‘জিহাদ’ বলে। তখন মুসলমানদের যে-কোনো সাধারণ সংগ্রাম বা আন্দোলনকেই অ-মুসলমানরা ‘জিহাদি’ ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম এত আলোচিত সমালোচিত হয় না, যতটা ইসলামের বিরুদ্ধে হয়। কেন হয়? অন্য ধর্মের কথা ছাড়ুন, আজ ইসলামের বিরোধিতা করছে ইসলামিরাই। বহু মুসলিম ধর্মত্যাগ করছে। ইসলাম ত্যাগ করে অন্য ধর্মে না-এলেও নাস্তিক বা মুক্তমনা হয়ে যাচ্ছে। ইসলামের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার করছে সোসাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে। এমনই কয়েকজন মুক্তমনাদের নাম উল্লেখ রাখি, যাঁরা সোসাল মিডিয়া এবং ইউটিউবের দৌলতে বেশ প্রসিদ্ধ– মুফাঁসিল ইসলাম, হাফেজ মাওলানা মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, আসিফ মহিউদ্দিন (প্রাক্তন মুমিন), মুহম্মদ আব্দুল কাইয়ুম, আসাদ নুর সহ এরকম অসংখ্য বিদ্রোহী মুসলিম।
ইসলামের সমালোচনা শুরু হয়েছে এই ধর্মের আবির্ভাবের সময়কাল (সপ্তম শতাব্দী) থেকেই। প্রাথমিকভাবে লিখিত সমালোচনা খ্রিস্টনদের কাছ থেকে এসেছিল, নবম শতকের আগে। অনেকেই ইসলামকে একটি উগ্র উৎপথ (যে-কোনো ধর্ম বিষয়ে প্রচলিত মতের বিরুদ্ধ বিশ্বাস) বলে মনে করেছিলেন। পরে মুসলিম বিশ্ব নিজেই এর সমালোচনা ভোগ করেছিল। পশ্চিম সমাজে ইসলাম ধর্মটির সমালোচনা পুনরায় জেগে ওঠে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পরে এবং একবিংশ শতাব্দীর অন্যান্য উগ্র ইসলামি হামলার কারণে (অন্যান্য দেশগুলোতে)।
ইসলাম ধর্মের সমালোচনাগুলির মধ্যে রয়েছে মোহম্মাদের জীবনের নৈতিকতা, ইসলাম অনুযায়ী শেষ নবি, তার বাইরের এবং ব্যক্তিগত জীবন দুটোই। এছাড়া কোরান যেটি ইসলাম অনুযায়ী ঐশ্বরিক বাণী এটির প্রকৃততা এবং নৈতিকতাও উঠে আসে সমালোচনায়। আফ্রিকা এবং ভারতের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে মুসলমানেরা ওই অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে তাঁদের ধর্ম প্রচার এবং প্রসারের মাধ্যমে। অন্যান্য সমালোচনার বিষয়গুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল ইসলাম এবং ইসলামবাদী রাষ্ট্রগুলির দৃষ্টিতে মানবাধিকার যেমন– নারীদের চাকরি করার অধিকার, সমকামীদের অধিকার, ধর্ম সমালোচনা বা ত্যাগের অধিকার এবং রাষ্ট্রে বসবাসরত অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মানুষদের অধিকার প্রদানে ইসলামের ভূমিকা।
আগেই বলেছি, সবচেয়ে আগের লব্ধ সমালোচনা পাওয়া যায় খ্রিস্টানদের লেখায়, যাঁরা ইসলামের প্রথমদিককার খলিফাঁদের শাসনাধীন হয়ে পড়েছিলেন। এমনি একজন খ্রিস্টান ব্যক্তি ছিলেন সিরিয়ার জন অব দামাস্কাস (জীবনকাল ৬৭৬– ৭৪৯ সাল), এই জন অব দামাস্কাস ইসলাম এবং আরবি ভাষা সম্পর্কে খুব ভালো জানতেন। তাঁর লেখা বই ‘The Fount of Wisdom’-এর দ্বিতীয় অধ্যায় ‘কনসার্নিং হেরেসিস’-এ তিনি খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে পৰ্বাকারে বর্ণনা দেন। জন দাবি করেন একজন আরিয়ান (খ্রিস্টান ধর্মগুরু আরিয়াসের অনুসারী) সন্ন্যাস (যাকে তিনি বহিরা বলেননি) মোহাম্মদকে প্রভাবিত করে এবং ইসলামি মতবাদগুলি বাইবেল থেকে নেওয়া। জন ইসলামের আব্রাহামীয় পূর্বপুরুষতার দাবি নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেন এবং ব্যাখ্যা দেন যে, আরবদেরকে নাকি একসময় সারাসিন’ বলা হত। কারণ তাঁরা নাকি ‘সারাহ’ (হিব্রু বাইবেল অনুযায়ী আব্রাহামের সৎ বোন এবং পত্নী) শূন্য ছিল। তাঁদেরকে নাকি ‘হাগারেন্স’ বলা হত, কারণ তাঁরা নাকি দাসী মেয়ে ‘হাগার’ (বুক অব জেনেসিস অনুযায়ী আব্রাহামের পত্নীর ব্যক্তিগত ভৃত্য যাকে আব্রাহামের সন্তান প্রসবের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং সে আব্রাহামের পুত্র ইসমাইলকে জন্ম দেয়)-এর বংশধর ছিল।
অন্যান্য পূর্ব-ইসলাম সমালোচক (গুরুত্বপূর্ণ) হলেন— আবু ঈসা আল-ওয়ারাক, নবম শতকের একজন পণ্ডিত এবং ইসলামের সমালোচক। ইবন-আল-রাওয়ান্দি, নবম শতাব্দীর একজন নাস্তিক ছিলেন, যিনি ইসলাম ত্যাগ করেছিলেন এবং ধর্মটিকে সমালোচনাও করেছিলেন সাধারণভাবে। আল-মারি, একাদশ শতকের আরবীয় কবি এবং ইসলামের সমালোচক, এছাড়া ইনি অন্যান্য ধর্মেরও সমালোচনা করেছিলেন। ইনি মাংসাশী প্রাণী ভক্ষণবিরোধী এবং প্রথাবিরোধী হিসাবেও পরিচিত ছিলেন। ইসলামি খেলাফতের প্রারম্ভিক শতকগুলোতে ইসলামি আইন তাঁদের অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদেরকে স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করতে দিত, এর মধ্যে ছিল ইসলাম এবং ধর্মীয় কর্তৃত্বের সমালোচনা করার অধিকার এবং নির্ভয়ে এসব করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল— কোনো সাজা দেওয়া হবে না এরূপ শর্তে। এর কারণে ইসলামি সমাজ থেকেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমালোচক এবং ধর্মত্যাগী মানুষ বের হয়ে আসে। দশম এবং এগারো শতাব্দীতে সিরিয়াতে আল-মারি নামে এক অন্ধ কবি বাস করতেন। তিনি তার একটি কবিতার জন্য সুপরিচিত হয়ে ওঠেন যেটি পরিব্যাপ্ত দুখঃবাদ’ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
সৈয়দ কামরান মির্জা তাঁর ‘Quran is the Primary manual of Islamic Terrorism’ নিবন্ধে লিখেছেন— By now any sane human being of 21st century should realize that the religion of Islam is the main source of Islamic terrorism happening today around the world. But sadly, majority of gullible people (Muslim and non-Muslims) tend to ask questions: Does the Islam have anything to do with Terrorism? More precisely-does the Quran anyway responsible for Islamic terrorism, or Islamic suicide bombings? Some hypocritical western educated so called moderate Muslims now started to blame Hadiths (only) for Islamic terrorism/suicide bombings etc. and they are hypocritically claiming that Quran is totally innocent of this crime. These neo-islamists also claim that for all these Islamic suicide bombings and Islamic terrorism-it is the Sunnah (Ahadiths or traditions left by the Prophet Muhammad) which should be blamed, and not the Holy Quran. In this faulty or erroneous line of thinking they got their illusionary vision that, if hadiths could be dump then Islam will be very peaceful and innocent.
Background story : Islam is a cultic (brotherhood or ummatic) religion by nature. The very theme of Islam is: Allah is the sole creator of everything on heaven and Earth and Muslims are His only legitimate and righteous people. Remaining all other people (Jews, Christians, Hindus etc.) are simply infidels and hated by Allah. A Muslim is a person who gets his/her life’s inspiration primarily from the Quran and secondarily from the Hadiths (the Sunna). The devout Muslims believe that life’s all solutions are contained in the Holy Quran and every good Muslim does believe by his heart that the Quran is the immutable divine words of Allah, infallible unchangeable-eterna- 1 book of Allah, and they must follow this (Quran) word by word without any question. Following this line of thinking the Muslims believe that anyone who does not agree with them is kaffir and enemy of Islam; hence enemy of Allah. A Muslim must oppose his/her enemy and kill him/her by any means whenever the opportunity arises.
Historically, Muslims in Arabia always considered their political enemies/rivals as the kaffirs (filthy, unclean, non-believers and deserves death) and always wanted to eliminate them by force. They have also considered it a blessed or holy thing to kill their enemy (kaffirs) which will please Allah and consequently they will be rewarded in this life and hereafter. If we study early Islamic history (the reigns of most Islamic caliphs) we can readily learn that there had been always bloody disputes amongst various Muslim political groups in which tens of thousands of people were slaughtered in the name of their religion. In these political disputes always one group was calling other group kaffirs or enemy of Allah. They tried to justify killing their rivals by Islamic dictums. Even today, the same patterns of religious sectarian killings are going on in Iraq, Pakistan, Afghanistan and many other Islamic nations and these are glaring examples of my above claims. As always, each party calls them the party of Allah and opposite party is theparty of kaffirs who should be killed. In these sectarian killings Muslims always get their inspiration primarily from the Quranic dictums supported by Hadiths. They never get inspiration from anything which is not in the Quran; or they never kill anybody having being inspired only from hadiths. Because Muslims always consider Quran as the nucleus of their Faith and inspiration and hadiths are used only to support Quranic dictums.
Islamic terrorists do kill people by their Islamic fanatical zeal which is the prime source of motivation in their killing spree. And these inspirations always come from Holy Quran. Now, question is: dose the Quran contain such verses which can easily inspire/incite devout Muslims to kill people with impunity? Answer is there are plenty of such inciting or inspiring Quranic verses which can turn any simple/innocent minded devout Muslims into a killing monster. In fact, Quran is replete with such horrifically inciting dictums throughout the pages of Quran. Holy Quran repeatedly promised terrestrial handsome rewards for those who can kill kaffirs (enemy of Allah and His messenger) and dreadful punishing hellfire for those who refuse to kill kaffirs. Quran also incite followers to sacrifice their lives in order to kill kaffirs in exchange of much better and lucrative after life. In this line just one Quranic verse (9:111) is most attractive to those jihadis who desperately egger to achieve heavenly rearward of 72 virgins.” (https://www.speakingtree.in/blog/quran-is-the-primary-manual-of-islamic-terrorism-syed kamran-mirza)
ইসলাম-সমালোচক আসিফ মহিউদ্দিন ‘ছহি মুসলিম’ মুমিনদের কাছ থেকে অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। সেগুলি সবাইকে শেয়ার করেছেন। আমি অবিকৃত অবস্থায় তুলে ধরলাম –(১) ইহা ছহি ইসলাম নহে।(২) ঐগুলা ইহুদি নাসারাদের ষড়যন্ত্র, ইহুদি নাসারা মালাউনরা মুমিন মুসলমানের লোহার মতো শক্ত ঈমান দেইখ্যা হিংসায়। ইসলাম নিয়া মিথ্যা অপপ্রচারে লিপ্ত। (৩) গুটিকয় মৌলবাদীর (সৌদি, পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান, আল কায়েদা আইসিস বোকোহারাম এরা সবাই গুটিকয় মুসলিম!) জন্য ইসলামকে দোষারোপ করবেন না। কোনো ধর্মই খারাপ কিছু করতে বলে না। আসলে সব দোষ মানুষের। মানুষই ধর্মকে খারাপভাবে ব্যবহার করছে। ফলে ধর্মের দুর্নাম হচ্ছে। (৪) (এরপরে হাদিস দেখালে) ঐগুলা দুর্বল হাদিস। (হাদিস তিন প্রকার, দুর্বল, সবল এবং হাস্যকর) (৫) (এরপরে কোরানের আয়াত দেখালে) অনুবাদে ভুল আছে, আপনি আরবি জানেন? আর এক-দুই লাইন নিয়ে এসে পুরো কোরান কি বুঝবেন? এ সম্পর্কে জানতে হলে পুরো কোরান পড়ন।(৬) (বিশিষ্ট অনুবাদকদের অনুবাদ দেখালে) আপনি কিছু না জেনেই কথা বলেন। আপনার সাথে তর্ক করা বৃথা। আপনাদের দিলে মোহর আটা তাই চোখ থাকতেও আপনারা অন্ধ!! আল্লা আপনার মঙ্গল করুক। যতক্ষণ-গুয়ের-ল্যাদা-থেকে-সুগন্ধ-না-পাওয়া-যায় ততক্ষণ-গন্ধ-শুকিতেই-থাকুন যুক্তি। (৭) আপনার কথা শুনে হাসি পেয়ে গেল। হা হা হা। আপনাকে আরও অনেক পড়ালেখা করতে হবে। ইসলাম সম্পর্কে ভালোভাবে না-জেনেই ইসলামের সমালোচনা করা ঠিক না। ইসলামকে জানার জন্য কোরান-হাদিস পড়ুন। বুঝতে সমস্যা হলে বারবার পড়ুন। যতক্ষণ সবকিছু না বুঝছেন ততক্ষণ পড়তেই থাকুন। ইসলাম সম্পর্কে খণ্ডিত জ্ঞান দিয়ে ইসলাম বোঝা যাবে না। এত কম পড়লখা নিয়ে আপনি নিজেকে নাস্তিক দাবি করেন? শুনুন মশাই, ভালো নাস্তিকেরা কখনই ধর্মকে আক্রমন করে না, মানষের বিশ্বাসকে আঘাত করে না। (৮) আপনি শুধু ইসলাম নিয়েই কেন লেখেন? পৃথিবীতে কি আর কোনো ধর্ম নাই? এত সমস্যা থাকতে ইসলাম নিয়েই কেন আপনাদের এত মাথা ব্যথা বুঝি না। এই যে দেশের যানজট, বিদ্যুৎ সমস্যা, এগুলো নিয়েও লিখুন। (৯) আপনার পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হবে, সেই সময়ের সমাজব্যবস্থা আর এই সময়ের সমাজব্যবস্থা এক নয়। কী বললেন? ইসলাম সর্বকালের জীবনাদর্শ হলে সময়ের পরিপ্রেক্ষিত কোথা থেকে আসছে? (১০)। এসব প্রশ্নের উত্তর আল্লাই ভালো জানেন। আসুন এসব নিয়ে কথা বলে বৃথা সময় নষ্ট না করে অন্য কাজ করি, তার আগে চলুন নামাজটা সেরে আসি। (১১) ইসলাম হল পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। পারলে কোরানের একটা আয়াত ভুল প্রমাণ করে দেখান! সেরেফ আলোচিত হওয়ার জন্য, সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় এইসব আজেবাজে কথা বলছেন আপনি। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। (এই মন্তব্যের সাথে সাথে ইনবক্সে মেসেজ দিল— কুত্তার বাচ্চা! তোর মায় তোরে ডাস্টবিনে জন্ম দিছে। তুই ফের নবিজিরে নিয়া একটা কথা বললে তোমার মায়ের জায়গামতো তোরে হান্দায়া দিমো। হনুমান আজাদগিরি ছুটায়া দিমো, নকির পো!) (১২) কোরান-হাদিসে বিশ্বাসী মুসলমান বাদে দুনিয়ার সব শালা ইসলামবিদ্বেষী। আপনি নিশ্চয়ই মালাউন, মুসলিম নাম নিয়া ইসলামের নামে মিথ্যা কথা ছড়াচ্ছেন। সব ইহুদি নাসারাদের চক্রান্ত, এই সব লিখে ইহুদি নাসারাদের থেকে কত পান? আপনার ধুতি ঠিক আছে তো? তা দাদা, কলকাতায় ইলিশের কেজি কত? মোসাদ কেজিবি আর আমেরিকা এই লেখার জন্য কত দিল? মুসলিম আইডি নিয়ে হিন্দু শালারা ইসলামের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা ছড়ায়! অন্য ধর্মের হয়ে ইসলাম নিয়ে কথা বলার অধিকার পান কোথা থেকে? (১৩) দেখুন ভাই, ভালো নাস্তিক কখনও ধর্মকে আঘাত করে না। ভালো নাস্তিক হওয়ার চেষ্টা করুন এবং আমাদের প্রাচীন ব্যবসার পেটে লাথি মারবেন না। ধর্ম বেচে দুটো পয়সা জোটে, আর ধর্মের কথা শুনিয়ে ভালো মানুষ সেজে ধুমায়া দুর্নীতি করলেও সবাই ভালো বলে। আর আপনি সেই ব্যবসাতেই বাম হাত ঢুকাইয়া দিলেন! দেখেন না, ভালো নাস্তিকরা আমাদের কিছুই বলে না। যত আকামই করি না কেন, তাঁরা পিঠ চাপড়ে দেয়। (১৪) কোরানের একটা-দুটা লাইন নিয়ে কথা বলেন, তার আগের-পরের লাইনগুলো পড়েন, তারপর বলেন। না হলে ভুলই বলে যাবেন। কোরান ১০০% বিজ্ঞানসম্মত। আপনি বিজ্ঞানের যা জানেন, তার সবই কোরানে আছে। আপনি বোঝেন না দেখে বুঝতে পারেন না। কোরান আল্লাহর বাণী। তাই এটা ভুল হতেই পারে না। আপনি কতটুক আরবি জানেন যে, কোরানের অর্থে ভুল ধরেন? (১৫) পৃথিবীতে এক একজন মুসলিমের কাছে ইসলাম এক এক রকম। সব যে এক হবে তা নয়। তাই সহি ইসলাম জানতে চাইলে মোহম্মদের জীবনদর্শন দেখুন। (মুহম্মদ নিয়ে কোনো কথা বললে) কোন্ সাহসে আমাদের নবিকে নিয়ে কথা বললেন? তোর মায়েরে ****** (আপত্তিকর শব্দ সেন্সর করা হল) (১৬) আপনি আসলে সত্যিকারের নাস্তিক না। সত্যিকারের নাস্তিক হলে হিন্দুধর্ম নিয়ে কথা বলতেন না। আগে তো ভালোই লিখতেন, হঠাৎ আপনার কী হল? মুসলিমদের থেকে নিশ্চয়ই এটা লেখার জন্য টাকা পাচ্ছেন তাই না? (১৭) কোরানের মতো একটা গ্রন্থ আগে লিখে দেখান। তারপর ইসলামের সমালোচনা করেন। পারবেন জীবনে কোরানের মতো একটা সুরা লিখে দেখাতে? আপনি তো ভালো আপনার বাপ, তার বাপ, তার বাপ এরকম চোদ্দোপুরুষ মিলেও পারবেন না। পৃথিবীর কেউ পারবে না। (সুরা লিখে দেখালে –“মশাই, নকল না করে মৌলিক কিছু লিখুন না। এটা তো কোরানের নকল হয়ে গেল। মৌলিক কিছু লিখে দেখালে –‘এটা কোরানের মতো হল কই? এর সাথে কি কোরানের তুলনা হল? কোরানের মতো মৌলিক সুরা লিখে দেখালে –শালা তোর এত্ত বড় সাহস, তুই কোরান বিকৃত করস, তোর। ঠিকানা দে *ঙ্গের পো, তোরে *ত্তা দিয়া যদি না *দাইছি তাইলে আমি এক বাপের পোলা না।) (১৮)। ‘কিরপোলা, তর বাসার ঠিকানা দে। কসম খোদার, বাসায় আইসা কোপায়া যামু।
একথা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই যে, ভুল ধারণাবশতই হোক বা না-ই হোক, সহিংস ইসলামি দলগুলি ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি তুলে ‘আল্লাহর রাহে যুদ্ধ’-এর অকাট্য বিশ্বাসে ভবিষ্যতে নারী-শিশুসহ নিরীহ মানুষের উপর সহিংসতা ও সন্ত্রাস অব্যাহত থাকবে। এই কারণে জীবন ও সমাজ ভোগ করবে অবর্ণনীয় ক্ষতি ও ধবংসযজ্ঞ। ক্ষতি হচ্ছে ইসলামের, সমগ্র মুসলিম সমাজকে এক প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে –শান্তিকামী মানুষ কৈফিয়ত চাইছে। জঙ্গি-জিহাদে মোহম্মদের জীবন ও কাজকর্মও আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি। মোহাম্মদের কর্মকাণ্ড ও যুদ্ধাভিযানই কি তাহলে জিহাদের বীজ বপন!
মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর মদিনায় স্থায়ীভাবে বসবাসকালীন জীবনের শেষ দশ বছরে স্বয়ং নবি বা নবির অঙ্গুলি হেলনে ৭০ থেকে ১০০টি ব্যর্থ অথবা সফল আক্রমণ তথা লুণ্ঠন অভিযান মায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতিহাস রচিত হয়ে আছে। জিহাদকে প্রাধান্য দিয়ে পৃথিবীকে আল্লাহর বান্দা করা ইসলাম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আয়োজন করেছেন। যে যুদ্ধগুলির মধ্যে ১৭ থেকে ২৯টি মোহম্মদ নিজেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। এম. এ. খান তাঁর ‘জিহাদ’ গ্রন্থে ওয়াদ্দানের যুদ্ধ (৬২৩ সাল), সাফওয়ানের যুদ্ধ (৬২৩ সাল), দুল আসিরের যুদ্ধ (৬২৩ সাল), নাখলার যুদ্ধ (৬২৪ সাল), বদরের যুদ্ধ (৬২৪ সাল), বানু সালিমের যুদ্ধ (৬২৪ সাল), ঈদ-উল-ফিতর ও জাকাত-উল-ফিতরের যুদ্ধ (৬২৪ সাল), বানু কাইনুকার যুদ্ধ (৬২৪ সাল), সাউইকের যুদ্ধ (৬২৪ সাল), ঘাতফানের যুদ্ধ (৬২৪ সাল), বাহরানের যুদ্ধ (৬২৪ সাল), ওহুদের যুদ্ধ (৬২৫ সাল), হুমরা-উল-আসাদের যুদ্ধ (৬২৫ সাল), বানু নাদিরের যুদ্ধ (৬২৫ সাল), ধাতুর-রিকার যুদ্ধ (৬২৫ সাল), বাদরু-উখরার যুদ্ধ (৬২৬ সাল), দুমাতুল-জান্দালের যুদ্ধ (৬২৬ সাল), বানু মুসতালাক নিকাহর যুদ্ধ (৬২৬ সাল), খন্দকের যুদ্ধ (৬২৭ সাল), আহজাবের যুদ্ধ (৬২৭ সাল), বানু কোরাইজার যুদ্ধ (৬২৭ সাল), বানু লাহিয়ানের যুদ্ধ (৬২৭ সাল), ঘাইবার যুদ্ধ (৬২৭ সাল), খাইবারের যুদ্ধ (৬২৭ সাল), হুদাইবিয়া অভিযান (৬২৮ সাল), মক্কা বিজয় (৬৩০ সাল), হুনসিনের যুদ্ধ (৬৩০ সাল), তাবুকের যুদ্ধ (৬৩০ সাল) ইত্যাদির উল্লেখ আছে।
জিহাদের ‘ভুল’ প্রয়োগে মোহাম্মদের যুদ্ধাভিযানও কি কালিমালিপ্ত হয়ে গেল? হজরত মোহম্মদ কেন এই যুদ্ধগুলি করেছিলেন? তিনি নবি, তাঁর ধর্মমত তিনি প্রচার করতেই পারেন। সবাই করেছে। একটা ধর্মপ্রচার করতে গিয়ে এত হত্যা! এত হত্যা কেন? এত রক্তপাত কেন? কারণ— (১) নিজস্ব ধর্মমত অন্যের ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া, (২) অন্যের শাসনাঞ্চল দখল করে নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করা এবং (৩) অন্যের ধনসম্পদ লুঠ করে নেওয়া, যা ‘গণিমতের মাল হিসাবে জায়েজ করা হয়েছে। এই যুদ্ধগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিলে পাঠকগণ শিহরিত হবেন। ভাববেন ‘জিহাদ’ কী জিনিস! আগ্রহীদের এম. এ. খানের ‘জিহাদ’ বইটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করব। এছাড়া মাওলানা আকবর শাহ খান নজিববাদীর তিন খণ্ডে ইসলামের ইতিহাস’ গ্রন্থখানি পড়ে দেখতে পারেন। এ প্রসঙ্গে একটা কথা ঐতিহাসিক সত্য যে ইসলাম, খ্রিস্টান এবং হিন্দু এই তিনটি ধর্মপ্রতিষ্ঠানই কমবেশি রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ধর্মের বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। হজরত মোহম্মদই একমাত্র ‘রক্তপিপাসু’ ধর্মপ্রচারক নন। হিন্দুরাও যথেষ্ট রক্তপাত ঘটিয়েছে ধর্মপ্রচারে, অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপর চড়াও হয়েছে, উপাসনা গৃহ গুঁড়িয়ে দিয়েছে। পার্থক্য এইটুকুই– হিন্দুবাদীরা তাঁদের রক্তক্ষয়ী ধর্মীয় কার্যকলাপ ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল। আদি শঙ্করাচার্য কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত চষে দিয়েছিলেন। প্রতিপক্ষ ধর্মানুসারীরা ছিলেন মূলত বৌদ্ধ। কিন্তু হিন্দু ধর্মগ্রন্থে সেটা জায়েজ হয়নি। কিন্ত হজরত মোহম্মদ তাঁর রক্তক্ষয়ী ধর্মপ্রচার আরবের মধ্যে সীমাবদ্ধ। রাখেননি। তিনি পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে তাঁর সৃষ্ট ধর্মছত্রে বশ্যতা স্বীকার করিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাপত্র করে রেখেছেন। তিনি যেটুকু পেরেছিলেন করেছিলেন, তারপর মোহম্মদের সেই রক্তমাখা তলোয়ার খলিফারা হাতে তুলে নিয়ে দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। মোহম্মদের ধর্মীয় প্রতিপক্ষ ছিল পৃথিবীর সমস্ত অমুসলিম, অর্থাৎ যাঁরা আল্লাহর অনুসারী নয়। যাঁরা হজরত মোহম্মদ সম্পর্কে আরও বেশি জানতে আগ্রহী, তাঁরা মোহম্মদের মৃত্যু কয়েক বছর পর রচিত এই গ্রন্থগুলি পড়ে দেখতে পারেন— Walter Emil Kaegi, Jr., “Initial Byzantine Reactions to the Arab Conquest”, Church History, Vol. 38, No. 2 (Jun., 1969), p. 139–49, p. 139–42, quoting from Doctrina Jacobi nuper baptizati 86–87 From Writings, by St John of Damascus, The Fathers of the Church, vol. 37 (Washington, DC: Catholic University of America Press, 1958), pp. 153-60. Posted 26 March 2006 to The Othordox Christian Information Center –St. John of Damascus’s Critique of Islam Critique of Islam St. John of Damascus, From Writings, by St John of Damascus, The Fathers of the Church, vol. 37 (Washington, DC: Catholic University of America Press, 1958), pp. 153-60. Posted 26 March 2006 on the Orthodox Information Center website. Cited by Powers, David Stephan. 2009. Muḥammad is not the Father of any of your Men: the Making of the Last Prophet. USA: University of Pennsylvania Press, p. 29. Sbaihat, Ahlam (2015), “Stereotypes associated with real prototypes of the prophet of Islam’s name till the 19th century”. Jordan Journal of Modern Languages and Literature Vol. 7, No. 1, 2015, p. 25. http
৬৩২ সালে মোহম্মদের অকালমৃত্যুর তাঁরই প্রতিষ্ঠিত মদিনাকেন্দ্রিক ইসলামি রাষ্ট্রের শাসক হন খলিফারা। চারজন পরপর খলিফা ছিলেন রসুলের ‘সাহাবি’। প্রথম দুজন তাঁর শ্বশুর এবং শেষের দুজন জামাতা। এই চারজন খলিফাঁকেই খোলাফায়ে রাশেদিন। ইসলামকে সুরক্ষিত এবং বিশ্ব দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে তাঁরা মোহাম্মদের নীতি ও আদর্শকে অনুসরণ করেন। এই চারজন খলিফা মোহাম্মদের সেই উত্তরাধিকার সার্থকভাবে রক্ষা করেছেন। ইসলামের হিফাজত ও প্রসারে তাঁরা সশস্ত্র ও সহিংস জিহাদ পরিচালনা করেছিলেন। এই মহামান্য খলিফারা ৬৩২ সাল থেকে ৬৬১ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে একের পর এক দেশ আক্রমণ করেছেন এবং অমুসলমানদের ইসলামে বাধ্য করেছেন। এই ২৯ বছর হল খলিফাঁদের শাসনকাল, ইসলামের ‘স্বর্ণযুগ। এই জিহাদি অভিযানে অমুসলমান সাধারণ মানুষদের হত্যা করা হত, শিশু পুত্রদের এবং মহিলাদের বন্দি করে ধর্ষণ ও দাস করা হত, লুণ্ঠন করা হত ধনসম্পদ। যুদ্ধে বিজয়লব্ধ সব গণিমতের মালেই পরিণত হল। শুরুতেই ইসলামের প্রচার ও প্রসার মোহাম্মদের শান্তির ললিত বাণীর নিয়ে অগ্রসর হয়নি, হয়েছে সহিংসা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। বিশ্বের কোনায় কোনায় ইসলাম বিজয়ী হয়েছে তরবারির রক্তে। শুধু ইসলামের বিজয় নয়, সেই সাম্রাজ্য বাড়ানোর চকচকে চোখ। গোটা পৃথিবীকে নিজের দখলে নেওয়ার উদগ্র বাসনা ছিল সে সময়কার ইসলামি শাসক সেনানায়কদের, যাঁর অনেকটাই সফল হয়েছিলেন চেঙ্গিস খাঁ আর তৈমুর লঙ্গ। যদিও এঁরা দুজনেই মঙ্গোলিয়ান, আরবীয়ান নয়।
গোড়ার দিকে আরববাসী খ্রিস্টান, ইহুদিদের সঙ্গে সহাবস্থান থাকলেও অতি দ্রুত অচিরেই ভোল বদলে তাঁদের আরবভূমি থেকে বিতাড়ন করা হল। কারণ নবির সেটাই ছিল ‘আখরি খোয়াইশ’। কারণ ওরা কাফের। সুরা বাকারার ৬২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে– “নিঃসন্দেহে যারা মুসলিম হয়েছে এবং যারা ইহুদি, নাসারা ও সাবেইন, যারা ইমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও কেয়ামত দিবসের প্রতি, সৎ কাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে। আর তাদের কোনো ভয়ভীতি নেই, তারা দুঃখিতও হবে না।” হুজরাত ১৪ নম্বরেও উল্লেখ আছে –“আরবরা বলে আমরা ইমান এনেছি অর্থাৎ মুমিন হয়েছি, বলুন– তোমরা ইমান আনেনি, বরং বলো, আমরা বশ্যতা স্বীকার করেছি, মুসলিম হয়েছি। এখনও তোমাদের অন্তরে ইমান জন্মেনি।”) ব্যতীত সব অমুসলমানই ‘কাফের’। কোরানে ইহুদি, নাসারা ইত্যাদি ধর্মাবলম্বীদের কাফের’ বলেছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখদের কথা কাফের’ হিসাবে উল্লেখ নেই। তাঁরা এইসব ধর্মের কথা জানতেনও না। প্রতিপক্ষও নয়। তাই কাফেরের তালিকা থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈনরা বাদ পড়ল। কোরান-হাদিসে বাদ পড়লেও অশিক্ষিত মুসলমানরাও হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈনদের কাফের হিসাবেই দেখে (বাংলাদেশে তো এই কাফেররাই মালাউন)।
[ফুটনোট : বাংলা ভাষার গোটা বিশেক অভিধান ঘেটে মালাউন’ শব্দটি পাওয়া গেছে মাত্র তিনটি অভিধানে। বলা বাহুল্য, এর সবগুলো অভিধানই বাংলাদেশ থেকে, আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত। আমার জানা মতে, বাংলা ভাষার প্রথম দিকের কোনো অভিধান থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত পশ্চিমবাংলা থেকে প্রকাশিত কোনো বাংলা ভাষার অভিধানেই মালাউন’ শব্দটি নেই। বাংলাদেশের কিছু মানুষের মুখে মালাউন’ শব্দটির ব্যবহার দ্রুতহারে বাড়তে থাকে। এর আগেও শব্দটির ব্যবহার ছিল, তবে তা ছিল অনুল্লেখযোগ্য, কিন্তু যথাযথ। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের কবিতায় এবং আধুনিক যুগের কারো কারো সাহিত্যকর্মে মালাউন’ শব্দটি লক্ষ করা যায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বেশিরভাগ উর্দুভাষী পাকিস্তানি হিন্দু শব্দের পরিবর্তে মালাউন’ শব্দটি ব্যবহার করতে থাকে। এই অপব্যবহারের ব্যাপকতা চোখে পড়ে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। সে সময় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাঁদের এদেশীয় সহযোগীরা ব্যাপকভাবে মালাউন’ শব্দটি ব্যবহার করতে থাকে। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর কোনো সদস্য হিন্দুদেরকে কখনো ‘হিন্দু’ সম্বোধন করেছে এমন উদাহরণ বিরল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা মুক্তিবাহিনীর সদস্য এবং তাদের ভাষায় মালাউন’দের খোঁজ করত, হিন্দুদেরকে নয়। “মালাউন’ শব্দটি এরা বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টানদের প্রতি নয়; শুধু হিন্দুদের প্রতি ব্যাঙ্গার্থে বা তুচ্ছার্থে বা চরম ঘৃণা প্রকাশার্থে ব্যবহার করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে মননে পাকিস্তানি কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষ হিন্দুদেরকে শুধু মালাউন’-ই নয়; আরও ঘৃণার্থে মালাউন’ শব্দটিকে তাঁদের মানসিকতার মতো বিকৃত করে মালোয়ান’ এবং কোথাও তীব্রতম ঘৃণা ও ঈর্ষার প্রকাশ ঘটিয়ে ‘মালোয়ান’ শব্দকে সংক্ষিপ্ত করে মালু শব্দটি চালু করেছে, যা একজন সামান্যতম হৃদয়বান ও ব্যক্তিত্ববান মানুষকে ব্যথিত না করে পারে না। মালাউন’ শব্দটির অর্থ নিরূপণে অভিধানের শরণাপন্ন হওয়া যাক। প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক, পণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’-এ মালাউন’ শব্দটির প্রথম অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘বিধর্মী’ এবং দ্বিতীয় অর্থ ‘অভিশপ্ত’। কাজী রফিকুল হক সম্পাদিত বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষায় আরবি ফারসি তুর্কি হিন্দি উর্দু শব্দের অভিধান’ গ্রন্থে মালাউন’ শব্দটিকে প্রথমত ‘মালউন’ বানানে দেওয়া হয়েছে, যার আরবি উচ্চারণ নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ম’ঊন’ এবং শব্দটির প্রথম অর্থ দেওয়া হয়েছে “অভিশপ্ত; ‘বিতাড়িত’ এবং দ্বিতীয় অর্থ দেওয়া হয়েছে শয়তান’। আর ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক এবং শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমি ব্যাবহারিক বাংলা অভিধান’ গ্রন্থে মালাউন’ শব্দটির প্রথম অর্থ দেওয়া হয়েছে লানতপ্রাপ্ত অভিশপ্ত; বিতাড়িত; কাফের (উদ্ধৃতি: অনাচারে কার সরদার মুসলিম অভিমানে ছাড়িয়ে গেল চিরতরে মালাউনকে— শাহাদাত হোসেন), দ্বিতীয় অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘শয়তান’, আর তৃতীয় অর্থ দেওয়া হয়েছে মুসলমান কর্তৃক ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোককে দেওয়া গালিবিশেষ। এই অভিধানের অন্যত্র ‘মালাউন’ শব্দের ‘লানতপ্রাপ্ত অর্থে লানত’ বা ‘লাৎ’ আরবি শব্দটির দুটি অর্থ দেওয়া আছে। প্রথমটি অভিশাপ’ (উদ্ধৃতি হাজার লানত যে এমন কাজ করে— সৈয়দ হামজা)। দ্বিতীয় অর্থ ‘অপমান’, ‘লাঞ্ছনা’; ‘ভর্ৎসনা। তৃতীয় অর্থ শাস্তি’ (উদ্ধৃতি: সে সবেরে লাহানতি দিবেক আল্লায়— সৈয়দ সুলতান)। অর্থাৎ অভিধানের আলোকে ‘মালাউন’ শব্দটির অর্থ ডক্টর মুহম্মদ শহিদুল্লাহকৃত অর্থ “বিধর্মী’-র মধ্যেই আজ আর সীমাবদ্ধ নেই। আজ অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীকে না-বুঝিয়ে ‘মালাউন’ শব্দটির অর্থ সংকুচিত করে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিবিশিষ্ট কিছু মানুষ শুধু হিন্দুদেরকেই মালাউন’ নামে অভিহিত করছে। বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের এক মাননীয় সাংসদকেও মালাউন’ শব্দটা ব্যবহার করতে শুনেছি। শব্দটির অর্থ যদি ‘বিধর্মী’ অর্থাৎ অন্য ধর্মাবলম্বীকে বোঝাত তাহলেও কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে ইসলাম ধর্মাবলম্বী ব্যতীত অন্য কোনো ধর্মাশ্রয়ীকে নয়; সুনির্দিষ্টভাবে তারা মালাউন’ শব্দ দিয়ে শুধু হিন্দুদেরকেই বোঝাচ্ছে। ডক্টর মুহম্মদ শহিদুল্লাহ মালাউন’ শব্দটির প্রথম অর্থ ‘বিধর্মী জানালেও দ্বিতীয় অর্থ দিয়েছেন অভিশপ্ত’। উল্লেখ্য, শহিদুল্লাহ ব্যতীত আর কোনো অভিধানকার শব্দটির অর্থ “বিধর্মী’ বলেননি। অন্যদের অভিধানে যে অর্থটি গুরুত্ব পেয়েছে সেটি হচ্ছে অভিশপ্ত এবং বিড়িত। তাহলে কি ওইসব সাম্প্রদায়িকমনস্ক ব্যক্তির কথায় ধরে নেব বাংলাদেশের হিন্দুরা অভিশপ্ত এবং বিতাড়িত? অভিশপ্ত হলে কখন, কোথায়, কীভাবে, কার দ্বারা অভিশপ্ত হল; আর বিতাড়িত হলে কোন্ জায়গা থেকে, কখন তাঁদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। বাংলাদেশের হিন্দুরা কি নীচ মনোভাবাপন্ন ওইসব ব্যক্তি কর্তৃক অভিশাপগ্রস্ত হল এবং এই হিন্দুরা কি নিজ বাসভূম থেকে বিতাড়িত হল? … সুতরাং “অভিশপ্ত’ বা ‘বিতাড়িত’-র মতো নিকৃষ্ট অর্থে হিন্দুদেরকে নয়; বরং ওই সাম্প্রদায়িক মনোভাবদুষ্ট সংকীর্ণ মানুষদেরকেই উল্টো মালাউন’ অভিধায় চিহ্নিত করা যেতে পারে। কাজী রফিকুল হকের অভিধানে মালাউন’ শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে আরবি শব্দ ‘শয়তান’, যার অর্থ আল্লাহদ্রোহী ফেরেশতা, পাপাত্মা, অতিশয় দুবৃত্ত, বদমায়েশ ইত্যাদি। তবে কি বাংলাদেশের হিন্দুরা আজ ওই মানুষদের কাছে এসব নেতিবাচক বিশেষণের উপযুক্ত? নিশ্চয়ই নয়। আর ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের অভিধানে ‘মালাউন’ শব্দের আর-একটি উল্লেখযোগ্য অর্থ দেওয়া হয়েছে : কাফের (আরবি শব্দ কাফির), যার অর্থ সত্য প্রত্যাখ্যানকারী, ইসলামধর্ম অস্বীকারকারী, ইসলাম-বিরোধী ইত্যাদি। … হিন্দুধর্মের আধুনিক ব্যাখ্যাকারী, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণদেবের উদ্ধৃতি দিয়ে এ কথাটি আরও চমৎকারভাবে বলেছেন এভাবে : ‘যত মত, তত পথ। … হিন্দু শুধু অন্যের ধর্মকে শুধু স্বীকারই করে না, বিশ্বাসও করে। তাই হিন্দুদেরকে কোনোভাবেই ‘মালাউন’ বলা যায় না।… কোনো সংস্কৃতিবান, সুশিক্ষিত, অসাম্প্রদায়িক, মুক্ত চেতনার ধারক, আধুনিক মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই মালাউন’ শব্দের অপপ্রয়োগ শুধু অসম্ভবই নয়; অভাবনীয়ও বটে। ~~ ড. নিমাই মণ্ডল]
হিন্দুরা তো খুবই ঘৃণ্য, কারণ ওরা মুর্তিপুজো করে, নাচ গান করে। ইসলামি পরিভাষায় ‘কাফের’ বলা হয় যে আল্লাহ পাক ও তার নবিদেরকে অস্বীকার করে। তাই বাংলায় ‘নাস্তিক’ শব্দও আরবি কাফের বা কাফির। সেই কারণেই বোধহয় মুসলমানরা নাস্তিকদের খুবই ঘৃণা করে, ধড় থেকে কল্যা কেটে বিচ্ছিন্ন করে। আমার ‘নাস্তিক পরিচয় পেতেই আমাকে এক মুসলিম বন্ধু ফিরদৌসি কালাম বিশ্বাস বিনা কৈফিয়তে ‘1 hate atheist’ বলে প্রত্যাখ্যান করল। না, সব মুসলমান নাস্তিকদের ঘৃণা করে না, প্রচুর মুসলমান আছেন যাঁরা প্রকৃত নাস্তিক। নাস্তিকদের তাঁরা শ্রদ্ধা করে। আর মুশরিক হল সেই, যে আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক বা অংশীদার করে। তাই হিন্দুদেরকে ‘মুশরিক’ও বলা হয়। কোনো মুসলিমও যদি তাঁদের নবি বা পির দরবেশদেরকে আল্লাহর গুণাবলিতে গুণান্বিত বলে বিশ্বাস করে, তবে সেও মুশরিক হিসাবে পরিগণিত হয়। কাফের এবং মুশরিক উভয় শ্রেণির জন্য ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোরানে চির জাহান্নামের শাস্তির উল্লেখ আছে।
জাহান্নামে কাফেরদের শাস্তি কী? “এই দুইদল (মুসলমান ও অমুসলমান), এঁরা তাঁদের প্রতিপালক সম্বন্ধে বিতর্ক করে, যাঁরা কাফের তাঁদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে আগুনের পোশাক; তাঁদের মাথার উপর ফুটন্ত জল ঢেলে দেওয়া হবে, যাতে তাঁদের চামড়া এবং ওদের পেটে যা আছে তা গলে যাবে, এবং ওদের জন্য থাকবে লোহার। হাতুড়ি। যখনই ওরা (কাফের) যন্ত্রণাকাতর হয়ে জাহান্নাম থেকে বের হতে চাইবে, তখনই তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে ওতে, ওদেরকে বলা হবে, আস্বাদ করো দহন যন্ত্রণা।” (কোরান ২২ : ১৯-২২) “আমি সীমা লঙ্ঘনকারীদের জন্য অগ্নি প্রস্তুত রেখেছি, যার বেষ্টনী ওদের পরিবেষ্টন করে থাকবে। ওরা জল চাইলে ওদের দেওয়া হবে গলিত ধাতু সদৃশ পানীয়, যা ওদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে, কী ভীষণ সে পানীয়, আর কি নিকৃষ্ট তাঁদের অগ্নিময় আরামের স্থান।” (কোরান ১৮ : ২৯) “আল্লাহ সত্য প্রত্যাখানকারীদের অভিশপ্ত করেছেন এবং তাঁদের জন্য জলন্ত অগ্নি প্রস্তুত রেখেছেন, যেখানে ওরা স্থায়ী হবে এবং ওরা কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। যেদিন অগ্নিতে ওদের মুখমণ্ডল উলটেপালটে দগ্ধ করা হবে, সেদিন ওরা বলবে— হায় আমরা যদি আল্লাহ ও রসুলকে মান্য করতাম!” (কোরান ৩৩ : ৬৪-৬৬) “আমি মানুষকে পথের বিধান দিয়েছি, হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে, না-হয় সে কৃতজ্ঞ হবে। আমি অকৃতজ্ঞদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি শৃঙ্খল, বেড়ি, লেলিহান অগ্নি।” (কোরান ৭৬ : ৩-৪) ‘অকৃতজ্ঞ বলতে বোঝাচ্ছে, যারা কোরানের পথ স্বীকার করে না, অর্থাৎ অমুসলমানরা। “যাঁরা আমার আয়াতে অবিশ্বাস করে তাঁদের আগুনে দগ্ধ করবই। যখনই তাঁদের চর্ম দগ্ধ হবে, তখনই ওই স্থানে নতুন চর্ম সৃষ্টি করব, যাতে তাঁরা শাস্তি ভোগ করে। নিশ্চয় আল্লাহ, পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (কোরান ৪ : ৫৬) “সীমা লঙ্ঘনকারীদের জন্য আছে। নিকৃষ্ট পরিণাম জাহান্নম, সেখানে ওরা (অমুসলমান) প্রবেশ করবে! এই সীমা লঙ্ঘনকারীদের জন্য। সুতরাং ওরা আস্বাদন করুক ফুটন্ত জল ও পুঁজ। এছাড়া আছে আরও এরকম বিভিন্ন ধরনের শাস্তি।” (কোরান ৩৮; ৫৫-৫৮)
“যাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাঁদের অপদস্থ করা হবে, তাঁদের পূর্ববর্তীদের মতো। আমি সুস্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ করেছি; অবিশ্বাসদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।” (কোরান ৫৮ : ৩৫) “অবিশ্বাসীরা যেন কিছুতেই মনে না করে যে আমি তাদের মঙ্গলের জন্য কাল বিলম্বিত করি, আমি কাল বিলম্বিত করি যাতে তাঁদের পাপ বৃদ্ধি পায় এবং তাঁদের জন্য আছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি” (কোরান ৩:১৭৮) “তোমরা তাঁদের (অমুসলমানদের) সঙ্গে যুদ্ধ করবে। তোমাদের হাতে আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন, ওদের লাঞ্ছিত করবেন, ওদের বিরুদ্ধে তোমাদের বিজয়ী করবেন ও তোমাদের (মুসলমানদের) চিত্ত প্রশান্ত করবেন।” (কোরান : ১৪)
আল্লাহ যাঁদের এত ঘৃণা করেছে ইসলামিরা কেন তাঁদেরকে চুমো খেতে যাবে! এইসব আয়াতে কোরান স্পষ্ট করে। বলে দিয়েছেন যে, এই পৃথিবীতেই আল্লাহ মুসলমানদের হাতে অ-মুসলমানদের শাস্তি দেবেন ও লাঞ্ছিত করবেন। এর ফলেই কোনো কোনো মুসলমানদের কাছে অ-মুসলমানদের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার করাটা ধর্মীয় অধিকার ও কর্তব্য হয়ে গেল। আল্লাহর সৃষ্ট মুসলিম ছাড়া সকলেই কাফের, তাঁদের এ দুনিয়াতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। কাফের হত্যার যোগ্য। হত্যার পর কাফেরদের যাতে দোজখ দর্শন হয়, সেই প্রার্থনাও করা হয়। যে আয়াতগুলিতে আল্লাহর বদনাম হয়, জাতির প্রতির ঘৃণার উদ্রেক হয়— এমন ধর্মগ্রন্থ আল্লাহ দিয়েছেন!
অনেক ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, মোহম্মদ যুদ্ধবৃত্তির অনুসরণে পরবর্তী খলিফারা যুদ্ধে রক্ত ঝরিয়েছেন ‘আল্লাহর পথে। যাই হোক, এরপর কিছু যুদ্ধবাজ আরবীয় মানুষ দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়েন গণিমতের মাল ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার নেশায়। কোরান নির্দেশিত পথে এক শ্রেণির যুদ্ধবাজ আরবজাতি দেশ দখলে বেরিয়ে পড়লেন। শুধু দেশ জয়ই নয়, দুনিয়ার সবাইকে মুসলমানে পরিণত করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁরা ছড়িয়ে পড়ল। সেদিন যুদ্ধবাজ আরবি যাযাবরেরা স্বপ্ন দেখেছিল সমগ্র দুনিয়াতে ‘একটাই আল্লাহ, একটাই ধর্ম, একটাই রাষ্ট্রের। ধর্মের দোহাই পেড়ে রক্তপিপাসু যুদ্ধবাজরা ‘এক হাতে শাস্ত্র অন্য হাতে অস্ত্র নিয়ে এবং ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে পড়লেন দিগ্বিজয়ে। অবশ্য যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো পথও খোলা ছিল না তৎকালীন সময়ে।
জন্ম থেকে অন্ধ ব্যক্তি ‘র দ্বারা প্রকৃতির সৌন্দর্য যেমন অবলোকন সম্ভব নয় – জন্ম থেকে বধীর ব্যক্তি ‘র দ্বারা নৈ-স্বর্গীক শ্রুতী ও উপলব্ধি সম্ভব নয়।
মনের কলুষতা ঝেড়ে ফেলুন – আর – নিন্দুকের মত – ধরা কে সরা আখ্যা দিয়ে – মন গড়া কথা কথা বলা বন্ধ করুন। অন্তরের অহমিকা আগে পরিত্যাগ করুন।
চামড়ার মুখ দিয়ে ভক ভকিয়ে যাওয়াটাই যদি বিশাল কিছু হতো – তবে – রাস্তার কুকুর গুলো – সর্ব শ্রেষ্ঠ হয়ে যেত।
কোনো বিষয়ে জ্ঞানী সাজার আগে সেই বিষয়ে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করুন – এবং ঐ বিষয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তি ‘র নিকট হতে যে কোন সন্দেহ নিরশন করুন।
ভাসা ভাসা জ্ঞান এ ভেসে বেড়িয়ে – মন গড়া বুলি আওড়াবেন না। সকলকে অপব্যাখ্যার ভেলায় না ভাসিয়ে – সত্যকে জানুন। আর সত্য জানতে আপনার মন না চাইলে সেটা আপনার মর্জি। কিন্তু মিথ্যা দ্বারা অন্যদের মন কে কলুষিত করবেন না।
– ধন্যবাদ
চন্দনমো শিক্কা কি লিখছে এইসব ছাইপাশ