১.৫.১৮ শাহজাহান (শাসনকাল : ১৬২৮ সাল থেকে ১৬৫৮ সাল)

শাহজাহান (শাসনকাল : ১৬২৮ সাল থেকে ১৬৫৮ সাল)

শাহবুদ্দিন মোহাম্মদ শাহজাহান (শাহজাহান বা শাজাহান) মোগল সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন, যিনি ১৬২৮ সাল থেকে ১৬৫৮ সাল পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছেন। শাহজাহান নামটি এসেছে ফারসি ভাষা থেকে, যার অর্থ ‘পৃথিবীর রাজা। তিনি ছিলেন বাবর, হুমায়ুন, আকবর, এবং জাহাঙ্গিরের পরে পঞ্চম মোগল সম্রাট। তাঁকে মোগল সাম্রাজ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর শাসনামলকে স্বর্ণযুগও বলা হয় এবং তাঁর সময়ে ভারতীয় সভ্যতা সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। দাদু আকবরের মতো তিনিও তাঁর সাম্রাজ্য প্রসারিত করতে আগ্রহী ছিলেন। শাহজাহানের স্ত্রীরা হলেন—আকবারাবাদি মহল, কান্দাহারি মহল, মমতাজ মহল, হাসিনা বেগম সাহেবা, মুতি বেগম সাহেবা, ফাতেহপুরি মহল সাহেবা, সরহিন্দি বেগম সাহিবা, শ্রীমতি মানভবাতি বাইজি লাল সাহেবা, লীলাবতি বাইজি লাল সাহেবা। সন্তানেরা হলেন— জাহানারা বেগম, দারাশিকো, শাহ সুজা, রওশনারা বেগম, আওরঙ্গজেব, মুরাদ বাকশ, গহুরা বেগম, হুর আল নিসা, উম্মিদ বক্স। ১৬২৭ সালে জাহাঙ্গিরের মৃত্যুর পর খুররমই নিজেকে শাহজাহান উপাধিতে ভূষিত করে সিংহাসন দখল করেন। শাহজাহান ও শাহরিয়ারের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে এক দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠেছিল।

পিতা জাহাঙ্গিরের মৃত্যুকালে শাহজাহান সে সময় দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করছিলেন। এই সুযোগে নুরজাহানের (জাহাঙ্গিরের স্ত্রী) সাহায্যে যুবরাজ শাহরিয়ার লাহোর থেকে নিজেকে ‘সম্রাট’ বলে ঘোষণা করলেন। শাহরিয়ার ছিলেন নুরজাহানের জামাই। অপরপক্ষে শাহজাহান নুরজাহানের ভাই আসফ খাঁর মেয়ে মমতাজকে বিয়ে করেছিলেন। আসফ খাঁ স্বভাবতই শাহজাহানের সিংহাসন লাভের পক্ষপাতী ছিলেন। এহেন আত্মীয়তার সূত্র ধরে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব জটিল হয়। আসফ খাঁ শাহজাহান আগ্রা পৌঁছোবার আগে পর্যন্ত সিংহাসন যাতে শূন্য না থাকে সেজন্য খুসরুর পুত্র দাওর বক্সকে সিংহাসনে স্থাপন করলেন। যুবরাজ শাহরিয়ার নুরজাহানের সাহায্যেও আসফ খাঁর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না। আসফ খাঁর কাছে তিনি পরাজিত ও ধৃত হলে তাঁর চোখ উপড়ে সিংহাসন লাভের অযোগ্য করে রাখা হল। শাহজাহান দাক্ষিণাত্য থেকে আগ্রা পৌঁছোনোর সময় মাঝপথেই আদেশ দিলেন –দিল্লির সিংহাসন দাবি করতে পারে এমন সমস্ত পুরুষকে যেন অবিলম্বে হত্যা করা হয়। আসফ খাঁ সেই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। একমাত্র দাওর বক্স পারস্য দেশে পালিয়ে প্রাণে বাঁচলেন। এইভাবে রক্তস্নানের পর শাহজাহান ১৬২৮ সালে সিংহাসনে বসলেন।

জাহাঙ্গিরের পরবর্তী সম্রাট হিসাবে শাহজাহান ছিলেন পিতার যোগ্য উত্তরাধিকারী। তাঁর শাসনকালে হিন্দু কৃষকদের অবস্থা ক্রমান্বয়ে অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছোয়। মোগল আমলে ভারত সফরকারী মানরিকের রচনার উদ্ধৃতি দিয়ে কে, এস, লিখেছেন, “কর আদায়কারী কর্মকর্তারা বিপন্ন ও দরিদ্র কৃষক ও তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের ধরে নিয়ে যেত তাঁদের বিভিন্ন বাজারে ও মেলায় বিক্রি করার জন্য।” ১৬১৩ সালে মেবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় শাহজাহানকে সেনাপ্রধান করে পাঠানো হয়। এই যুদ্ধে শাহজাহান মেবারের রাজা অমর সিংহের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। ১৬১৫ সালে অমর সিংহের সঙ্গে মোগলদের একটি সন্ধি চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুসারে অমর সিংহ ১০০০ অশ্বারোহী সৈন্য মোগল দরবারে পাঠান। ১৬১৬ সালে তিনি দাক্ষিণাত্যে অভিযান চালান। তিনি মালিক অম্বরকে পরাজিত করেন। এই সময় মালিক অম্বর বালাঘাট অঞ্চল এবং আহম্মদনগরের দুর্গ মোগলদের কাছে অর্পণ করেন। এর কিছুদিন পর মোগলবাহিনীর অরাজকতার সুযোগে মালিক অম্বর বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ফলে মালিক অম্বরের বিরুদ্ধে শাহজাহানকে পুনরায় যুদ্ধে পাঠানো হয়। এবারও মালিক অম্বর পরাজিত হন। এই যুদ্ধে মোগলবাহিনী বিজাপুর, আহম্মদনগর ও গোলকুণ্ডা অধিকার করে নেয়। এই সময় মালিক অম্বর বিপুল অঙ্কের টাকা নজরানা দিয়ে মোগলদের সঙ্গে সন্ধি করেন।

১৬২২ সালে পারস্য সৈন্য কান্দাহার অবরোধ করলে সেখানকার সেনাপ্রধান জাহাঙ্গিরের কাছে সৈন্যদল প্রার্থনা করেন। নুরজাহান কান্দাহার জয়ের জন্য শাহজাহানকে পাঠানোর ব্যবস্থা করলে শাহজাহান এই অভিযানে যেতে অস্বীকার করেন। শাহজাহান ভেবেছিলেন কান্দাহারে পাঠিয়ে নুরজাহান তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছেন। শাহজাহানের বিদ্রোহের সূত্রে মোগল বাহিনীর সঙ্গে ১৬২৩ সালে একটি যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে শাহজাহান পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে যান। এই সময় যুবরাজ পারভেজ ও সেনাপতি মহবত খাঁকে শাহজাহানের বিরুদ্ধে পাঠায় এবং শাহজাহান ওড়িশা, বিহার ও বঙ্গদেশ দখল করে নেন। কিন্তু এলাহাবাদের কাছে এক যুদ্ধে যুবরাজ পারভেজ ও সেনাপতি মহবত খাঁর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যের রওনা দেন। এই সময় তিনি মালিক অম্বরের সঙ্গে যোগ দেন। ১৬২৫ সালে মোগলবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শাহাজাহান পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন। জাহাঙ্গির বিদ্রোহী শাহজাহানকে ক্ষমা করে দেন।

সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত সর্বধর্মসহিষ্ণুতার নীতি মোটামুটিভাবে জাহাঙ্গিরের আমলেও অনুসৃত হয়েছিল। যদিও জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালের শেষভাগে হিন্দুমন্দিরাদি নির্মাণ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তথাপি তাঁর আমলে হিন্দু তথা অন্য কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার করা শাসননীতি হিসাবে গৃহীত হয়নি। বরঞ্চ জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালে ধর্মবিষয়ে উদারতার জন্যই উল্লেখযোগ্য। কিন্তু শাহজাহানের রাজত্বকালে আগের পরধর্মসহিষ্ণুতার নিয়মনীতি যেমন পরিত্যক্ত হয়েছিল, তেমনই ভবিষ্যতেও ধর্মান্ধনীতি ও পরধর্মাবলম্বীদের উপর অত্যাচারের ইঙ্গিত দিয়েছিল। আওরঙ্গজেবের আমলে সংকীর্ণ ধর্মান্ধতার পূর্ব-ছায়াপাত শাহজাহানের রাজত্বকালে পরিলক্ষিত হয়েছিল। বস্তুত আকবরের ধর্মসহিষ্ণু নীতির বিরুদ্ধে দরবারে ও এক শ্রেণির গোঁড়া লোকেদের মানুষের মনে চাপা বিক্ষোভ ছিল। জাহাঙ্গিরের আমলে আকবরের উদারনীতি থেকে বিচ্যুতি ঘটলেও মোটামুটিভাবে তিনি পিতার ধর্মসহিষ্ণুতা, সকল সম্প্রদায়ের প্রতি সমদর্শী নীতি অনুসরণ করেন। শাহজাহানের রাজত্বকালেই সর্বপ্রথম আকবরের উদারনীতির গুরুতর বিচ্যুতি ঘটে যায়। যদিও শাহজাহানকে গোঁড়ামির অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় না, কিন্তু তাঁর দরবারে মৌলবাদ ও গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। সিংহাসনে বসার পর সিজদা প্রথা রদ ও মুদ্রায় প্রথম চারজন খলিফার নামাঙ্কন শাহজাহানের মৌলবাদের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে। এই কারণে ঐতিহাসিক আবদুল হামিদ লাহোরি তাঁকে ইসলামের রক্ষক’ বলে অভিহিত করেছেন। ১৬৩২ সালে শাহজাহান হঠাৎ এক ফরমান জারি করেন। ফরমানটি হল– পিতার আমলে যেসব হিন্দু মন্দিরের নির্মাণ শুরু হয় সেগুলি ভেঙে ফেলতে হবে। আদেশ পেয়ে উৎসাহী কর্মচারীরা বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত হিন্দু মন্দির ব্যাপকভাবে ভেঙে ফেলে। তাজমহলের স্রষ্টা, প্রেমিকপ্রবর সম্রাটের আদেশে শুধু বারাণসীতেই ৭৬টি মন্দির ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তাজমহলের স্রষ্টা, প্রেমিকপ্রবর সম্রাটের আদেশে ধর্মান্তরকরণও করা হয়। তিনি সাধারণত হিন্দুদের উপর কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ না-করলেও আকবরের মতো হিন্দু ও মুসলিমদের সমান অধিকার স্বীকার করেননি। তাঁর গোঁড়ামি আওরঙ্গজেবের যুগের প্রতিক্রিয়াশীলতার পথ প্রস্তুত করে। শাহজাহান তাঁর রাজত্বের গোড়ার দিকে কিছুটা ধর্মীয় অনুদারতা দেখালেও ক্রমে ক্রমে তিনি উদার ধর্মসহিষ্ণু নীতিতে ফিরে যান। তা না-হলে তাঁর দরবারে হিন্দুরা উচ্চপদ ও ক্ষমতা ভোগ করতে পারত না। হিন্দু রাজারা তাহলে তাঁর সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য দেহের রক্ত ঢেলে দিত না।

সম্রাট শাহজাহানের পূর্বপুরুষ সম্রাট আকবর এবং জাহাঙ্গিরের বদান্যতায় হুগলির সাতগাঁও অঞ্চলে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি পেয়েছিল। পরে এরাই নানাস্থানে কুঠি নির্মাণ করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। এই সময় তাঁরা ক্রীতদাস ব্যাবসা, জলদস্যুতা, স্থানীয়দের অ-মুসলিমদের ধর্মান্তরিত করার মতো কাজ শুরু করে। এরই মধ্যে পর্তুগিজরা সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের দুইজন ক্রীতদাসীকে আটক করলে শাহজাহান পর্তুগিজদের দমনের জন্য কাসিম খাঁকে প্রেরণ করেন। প্রায় তিন মাস যুদ্ধের পর পর্তুগিজ বাহিনী সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। এই যুদ্ধে পর্তুগিজ বাহিনীর বহু সৈন্য নিহত হয়। প্রায় সাড়ে চার হাজার পর্তুগিজকে বন্দি করে আগ্রায় পাঠানো হয়। এই সময় আরও কিছু পর্তুগিজদের পথেই মৃত্যু হয়। ১৬৩৩ সালে পর্তুগিজদের ক্ষমাভিক্ষার কারণে হুগলিতে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়। বুন্দেলা নেতা জুজার সিংহ বিদ্রোহ করেন। শাহজাহান জুজার সিংহের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। এই যুদ্ধে শাহজাহান তাঁর তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেবকে নিযুক্ত করেন। ১৬৩৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর আওরঙ্গজেব প্রথম যুদ্ধ পরিচালনা করেন বুন্দেলখণ্ডে। এই যুদ্ধের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন শাহজাহান। আওরঙ্গজেব এই যুদ্ধে একটিমাত্র বাহিনী পরিচালনা করলেও জুজার সিংহ পরাজিত এবং নিহত হন।

১৬৩৬ সালে শাহজাহান তাঁর তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের খান্দেশ, বেরার, তেলেঙ্গানা ও দৌলতাবাদের শাসনকর্তা হিসাবে নিযুক্ত করেন। আওরঙ্গজেব ১৬৪৪ সাল পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই সময় আওরঙ্গজেব নাসিকের নিকটবর্তী বাগলানার শাহকে পরাস্ত করে মোগলশাসনের অধিকারে আনেন। ১৬৪৫ সালে শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে গুজরাটের প্রশাসকের দায়িত্ব দেন। এরপর ১৬৪৭ সালে তাঁকে গুজরাট থেকে বলখ অঞ্চলের প্রশাসক করে পাঠানো হয়। এখানে অবস্থিত মোগল সৈন্যদের ভেঙে পড়া মনোবলকে চাঙা করে আওরঙ্গজেব স্থানীয় জনগণ এবং উজবেকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। যুদ্ধে উজবেকরা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। উজবেকদের নেতা আবদুল আজিজ মোগলদের সঙ্গে সন্ধি করে। এছাড়া তিনি তুর্কেমেনিয়ানদের আক্রমণেরও মোকাবিলা করেন। তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং কৌশলের মাধ্যমে সাফল্য লাভ করেন। এরপর আওরঙ্গজেব মুলতান এবং সিন্ধু অঞ্চলের প্রশাসক হন। ১৬২৩ সালে সম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে যে কান্দাহার পারস্যের রাজা দখল করে নিয়েছিল। ১৬৩৮ সাল পর্যন্ত কান্দাহার পারশ্যরাজেরই অধীনে ছিল। এই বছরে শাহজাহান কান্দাহার অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগে সন্ত্রস্ত হয়ে পারস্যসম্রাটের কান্দাহার প্রশাসক আলিমর্দন খাঁ, পারস্যসম্রাটের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু পারস্যসম্রাট মনে করেছিলেন, আলিমর্দন খাঁ এইভাবে শক্তি বৃদ্ধি করে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। ফলে পারস্যসম্রাট তাঁকে সাহায্যের পরিবর্তে বন্দি করার চেষ্টা করেন। ফলে আলিমর্দন খাঁর সঙ্গে পারস্যসম্রাটের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। এই সুযোগে শাহাজাহান উৎকোচ দিয়ে আলিমর্দনকে স্বপক্ষে আনেন এবং কান্দাহার দখল করেন। এরপর আলিমর্দনকে কাশ্মীর এবং কাবুলের শাসনকর্তা নিয়োগ করা হয়। পারস্যসম্রাট দ্বিতীয় শাহ আব্বাস কান্দাহার পুনরুদ্ধারের জন্য অভিযান চালান এবং কান্দাহার অবরুদ্ধ করেন। এই সময় মোগলদের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য না-পাওয়ায় প্রায় দুই মাস অবরুদ্ধ থাকার পর মোগলবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ১৬৪৯ সালে কান্দাহার পারস্যসম্রাটের অধীন হয়। এরপর কান্দাহার উদ্ধারে শাহজাহান সাদুল্লাহ এবং আওরঙ্গজেবকে পাঠান। অতঃপর এই অভিযান ব্যর্থ হয়। ১৬৫২ সালে আওরঙ্গজেব দ্বিতীয়বার কান্দাহার অভিযান চালান। দুই মাস অবরুদ্ধ করে রাখার পর পারস্যসৈন্যদের গোলন্দাজদের দক্ষতায় মোগলবাহিনী ফিরে যায়। ১৬৫২ সালে যুবরাজ দারার নেতৃত্বে কান্দাহার দখলের জন্য তৃতীয়বার অভিযান পরিচালিত হয়। কিন্তু কয়েক মাস কান্দাহার অবরোধের পর মোগলবাহিনী ফিরে আসে। এরপর শাহজাহানের শাসনামলে কান্দাহার দখলের আর চেষ্টা করা হয়নি।

১৬৫৩ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য শাহাজাহান আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের শাসনভার অর্পণ করে। ১৬৩৬ সালের চুক্তি অনুসারে গোলকুণ্ডার সুলতান বার্ষিক কর পরিশোধ করতে অস্বীকার করায় এবং রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করায় আওরঙ্গজেব গোলকুণ্ডা আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে সাফল্য যখন প্রায় নিশ্চিত, ঠিক সেই সময় দারাশিকোর প্ররোচনায় শাহজাহান যুদ্ধবিরতির আদেশ দেন। ১৬৫৭ সালে সম্রাট শাহজাহান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় আগ্রাতে ছিলেন যুবরাজ দারাশিকো। শাহজাহানের চার সন্তানের মধ্যে সিংহাসন দখলের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। শাহজাহান সবার সামনে দারাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করেন। এই খবর পেয়ে মুরাদ, আওরঙ্গজেব এবং সুজা আলাদা আলাদাভাবে সিংহাসন দখলের জন্য প্রস্তুতি নেন। দারাশিকো রাজধানী থেকে বাংলার শাসনকর্তা সুজা, গুজরাটের শাসনকর্তা মুরাদ এবং দাক্ষিণাত্যের শাসক আওরঙ্গজেবের সঙ্গে দিল্লির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। ভলিকলে আওরঙ্গজেবের বাসভবনও বাজেয়াপ্ত করেন। অপরদিকে বিজাপুরের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের যুদ্ধের সময় আওরঙ্গজেবের কর্মচারীদের রাজধানীতে ফিরে আসার আদেশ জারি করেন। শাহজাহান সুস্থ হয়ে উঠার পরও তিনি দারার হাতে শাসনক্ষমতা রেখে দেন। ফলে বাকি তিন যুবরাজ চূড়ান্তভাবে বিদ্রোহী হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় আওরঙ্গজেব সুজা এবং মুরাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্থির করে করেন যে, এই বিরোধের সময় তিন ভাই আলাদাভাবে নয়, একত্রে একযোগে কাজ করবেন। শক্তি ভাগ হতে দেওয়া যাবে না। ইতিমধ্যে সুজা নিজেকে বাংলার নবাব ঘোষণা দিয়ে আগ্রার পথে রওনা হন। অপরদিকে মুরাদও নিজেকে গুজরাটের নবাব ঘোষণা করে অগ্রসর হন। আওরঙ্গজেব প্রকাশ্যে কোনো ঘোষণা দিলেন না, বেছে নিলেন প্রতীক্ষার পথ। লক্ষ্য পাখির চোখ। সুজার সসৈন্যে অগ্রসর হওয়ার খবর পেয়ে আওরঙ্গজেব দ্রুত নর্মদা নদী অতিক্রম করে উজ্জ্বয়িনীর কাছে মুরাদের সঙ্গে মিলিত হন। উভয়ই দারা এবং সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা করেন। জয়ের পর দুই ভাই রাজ্য সমানভাবে ভাগ করে নেবেন এমন সিদ্ধান্তও নিলেন। দারা এই খবর পেয়ে তাঁর পুত্র সুলেমানকে সুজাকে প্রতিহত করার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। বারাণসীর কাছে বাহাদুরপুর নামক অঞ্চলে উভয় বাহিনী মুখোমুখী হয়। ১৬৫৮ সালে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সুজা বাংলাদেশে ফিরে যান।

অপরদিকে মুরাদ ও আওরঙ্গজেবের বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য দারাশিকো কাশিম খাঁ এবং যশোবন্ত সিংহকে পাঠান। আওরঙ্গজেবকে দারাশিকোর বাহিনী উজ্জয়িনীর নিকটবর্তী ধর্মটি নামক স্থানে বাধা দেন। ১৬৫৮ সালের এপ্রিল মাসে উভয়বাহিনীর মধ্য যুদ্ধ হয়। দারাশিকোর বাহিনীর কাশিমা খাঁ এবং যশোবন্ত সিংহের মধ্যে মতনৈক্যের কারণে আওরঙ্গজেব যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এরপর আওরঙ্গজেব ও মুরাদের বাহিনী আগ্রার পথে অগ্রসর হন। ১৬৫৮ সালে জুন মাসের শুরুতেই উভয় বাহিনী আগ্রার আটমাইল দূরে সামুগড়ে উপস্থিত হন। এইসময় দারার অধীনে প্রায় ৫০ হাজার সৈন্য ছিল। এর সঙ্গে রাজপুত যোদ্ধারাও যোগ দিয়েছিল। ১৬৫৮ সালের ৮ জুন দারার পক্ষের খলিল-উল্লাহের বিশ্বাসঘাতকতায় আওরঙ্গজেব যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এইসময় দারাশিকো পালিয়ে পাঞ্জাবে চলে যান। আওরঙ্গজেব রাজধানী প্রবেশ করেন এবং শাহজাহানকে বন্দি করে কারাগারে পাঠান। ১৬৫৮ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে পুত্র আওরঙ্গজেব তাকে বন্দি করেন এবং বন্দি অবস্থায় ১৬৬৬ সালে আগ্রা ফোর্টের নির্জনে তাঁর মৃত্যু হয়।

না, শাহাজাহানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমার এ লেখা শেষ হতে পারে না। শাহজাহানের কথা লিখতে হলে তাঁর সৃষ্টির কথাও লিখতে হবে। তাঁর সেই অমর সৃষ্টির নাম তাজমহল। তাজমহল ভারতের উত্তরপ্রদেশে আগ্রায় অবস্থিত একটি রাজকীয় সমাধি। মোগল সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম যিনি মমতাজ মহল নামে পরিচিত, তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে এই অপূর্ব সৌধটি নির্মাণ করেন। সৌধটি নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ সালে, যা সম্পূর্ণ হয়েছিল প্রায় ১৬৫৩ সালে। তাজমহলকে মোগল স্থাপত্যশৈলীর একটি আকর্ষণীয় নিদর্শন হিসাবে মনে করা হয়, যার নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামি স্থাপত্যশিল্পের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। যদিও সাদা মার্বেলের গোম্বুজাকৃতি রাজকীয় সমাধিটিই বেশি সমাদৃত। তাজমহল আসলে সামগ্রিকভাবে একটি জটিল অখণ্ড স্থাপত্য। তাজমহল বিশ্বের অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ মনোমুগ্ধকর নিদর্শন। ভালোবাসার অবিশ্বাস্য স্মরণীয় ভাস্কর্য। ইসলামিক স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন, যা শান্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক। ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান, যিনি মুঘল আমলের সমৃদ্ধশালী সম্রাট ছিলেন, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মুমতাজ মহলের মৃত্যুতে প্রচণ্ডভাবে শোকাহত হয়ে পড়েন। মমতাজ মহল তাঁদের চতুর্দশ কন্যা সন্তান গৌহর বেগমের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাজমহলের নির্মাণ কাজ মমতাজের মৃত্যুর পর শুরু হয়। মূল সমাধিটি সম্পূর্ণ হয় ১৬৪৮ সালে এবং এর চারদিকের ইমারত এবং বাগান আরও পাঁচ বছর পরে তৈরি হয়। ১৬৬৩ সালে আগ্রা ভ্রমণ করে ফরাসি পর্যটক ফ্রান্সিস বেরনিয়ার (Frangois Bernier) লিখেছিলেন– “দুটো বিস্ময়কর সমাধির বিবরণ দিয়ে আমি চিঠিটি শেষ করব যারা আগ্রাকে দিল্লির চেয়ে শ্রেষ্ঠ করেছে। একটি নির্মাণ করেছেন সম্রাট জাহাঙ্গির তাঁর পিতা আকবরের সম্মানে এবং অন্যটি সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রীর স্মরণে তৈরি করেছেন তাজমহল, যা অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারী, স্বামী তাঁর স্ত্রীর শোকে এতই শোকার্ত যে স্ত্রী জীবনে যেমন তার সঙ্গেই ছিলেন, মরণেও তিনি তাঁর কবরের কাছেই থাকবেন।” (I shall finish this letter with a description of the two wonderful mausoleums which constitute the chief superiority of Agra over Delhi. One was erected by Jehan-guyre [sic] in honor of his father Ekbar, and Chah-Jehan raised the other to the memory of his wife Tage Mehale, that extraordinary and celebrated beauty, of whom her husband was so enamoured it is said that he was constant to her during life, and at her death was so affected as nearly to follow her to the grave.)

তাজমহল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নকশার উপর, বিশেষ করে পারস্য ও মোগল স্থাপত্য অনুসারে। নির্দিষ্ট কিছু নকশা তিমুর ও মোগল ইমারতের মতো হুবহু করা হয়েছে। যার মধ্যে তিমুরের গুর-ই-আমির, সমরখন্দে মোগল সাম্রাজ্যের পূর্বসূরী, হুমায়ুনের মাজার, ইমাদ-উদ-দৌলার মাজার এবং দিল্লিতে শাহজাহানের নিজের তৈরি দিল্লি জামে মসজিদ। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায়, মোগল ইমারত পরিমার্জনের এক নতুন স্তরে পৌঁছোয়। যেখানে পূর্ববর্তী মোগল ইমারতগুলি তৈরি হয়েছিল লাল বেলে পাথরে, শাহজাহান চালু করেছিলেন সাদা দামি মার্বেল পাথরের প্রচলন।

সমাধির উপরের মার্বেল পাথরের গম্বুজই সমাধির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এর আকার প্রায় ইমারতের ভিত্তির আকারের সমান, যা প্রায় ৩৫ মিটার। এমন উচ্চতা হওয়ার কারণ গম্বুজটি একটি ৭ মিটার উচ্চতার সিলিন্ডার আকৃতির ড্রামের উপরে বসানো। এই ধরনের আকৃতির কারণে, এই গম্বুজকে কখনো পেঁয়াজ গম্বুজ অথবা পেয়ারা গম্বুজ বলেও ডাকা হয়। গম্বুজের উপরের দিক সাজানো হয়েছে একটি পদ্মফুল দিয়ে, যা তার উচ্চতাকে আরও দৃষ্টিগোচর হয়। গম্বুজের উপরে একটি পুরোনো সম্ভবত তামা বা কাঁসার দণ্ড আছে, যাতে পারস্যদেশীয় ও হিন্দু ঐতিহ্যবাহী অলংকরণ আছে। বড় গম্বুজটির গুরুত্বের কারণ এর চার কোণায় আরও চারটি ছোটো গম্বুজ আছে। ছোটো গম্বুজগুলোও দেখতে বড়ো গম্বুজটির মতোই। এদের স্তম্ভগুলো সমাধির ভিত্তি থেকে ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। ছোটো গম্বুজগুলোতেও কাঁসা বা তামার পুরোনো দণ্ড আছে। লম্বা মোচাকার চূড়া বা গুলদাস্তা ভিত্তি দেয়ালের পাশ। দিয়ে উপরে উঠেছে এবং গম্বুজের উচ্চতায় দৃষ্টিগোচর হয়। পদ্মফুল ছোট গম্বুজ ও গুলদাস্তাতেও আছে। বড়ো গম্বুজের উপর মুকুটের মতো একটি পুরোনো মোচাকার চূড়া আছে। চূড়াটি ১৮০০ শতকের আগে স্বর্ণের নির্মিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে এটি ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি। এই চূড়াটিই পারস্যদেশীয় এবং হিন্দুদের শোভাবর্ধক উপাদানের মিলনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। চূড়ার উপরের অংশে আছে একটি চাঁদ, যা ইসলামিক উপাদান এবং চূড়ার শিং তাক করা আছে স্বর্গ বা বেহেস্তের দিকে। বড় গম্বুজের উপর চূড়ার চাঁদ এবং তাক করা শিং মিলে একটি ঐতিহ্যবাহী চিহ্নের আকার ধারণ করে, যা হিন্দু দেবতা শিবের চিহ্নের মতো।

মিনারগুলোর মূল বেদিকার কোণাগুলোতে আছে চারটি বড়ো চৌকি, যাদের প্রতিটির উচ্চতা ৪০ মিটারেরও বেশি। মিনারগুলোতেও তাজমহলের প্রতিসমতার ব্যাপারটিই লক্ষ করা যায়। চৌকিগুলো নকশা করা হয়েছে মসজিদের প্রথাগত মিনারের নকশায়, যেখানে মুয়াজ্জিন নামাজের জন্য আজান দেন। প্রতিটি মিনারেরই দুটি বারান্দা দিয়ে তিনটি সমান উচ্চতায় ভাগ করা হয়েছে। মিনারের একেবারে উপরে শেষ বারান্দা আছে, যার উপরে সমাধির ছাতাগুলোর একই রকম একটি ছাতা রয়েছে। মিনারের ছাতাগুলোতেও একই রকমের কাজ করা হয়েছে, যেমনটি করা হয়েছে পদ্মফুলের নকশা করা চূড়াতে। প্রতিটি মিনারই বেদিকার থেকে বাইরের দিকে কিঞ্চিৎ হেলানো আছে, যাতে এ মিনার কখনও ভেঙে পড়লেও যেন তা মূল সমাধির উপরে না পড়ে।

তাজমহল দেয়াল ঘেরা আগ্রা শহরের দক্ষিণ অংশের একটি জমিতে তৈরি করা হয়েছিল, সেই জমির মালিক ছিলেন মহারাজা জয় সিং। শাহজাহান তাঁকে আগ্রার মাঝখানে একটি বিশাল প্রাসাদ দেওয়ার বদলে জমিটি নেন। তাজমহলের কাজ শুরু হয় সমাধির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে। প্রায় ৩ একর জায়গাকে খনন করে তাতে আলগা মাটি ফেলা হয় নদীর ক্ষরণ কমানোর জন্য। সম্পূর্ণ এলাকাকে নদীর পাড় থেকে প্রায় ৫০ মিটার উঁচু করা সমান করা হয়। তাজমহল ৫৫ মিটার লম্বা। সমাধিটি নিজে ব্যাসে ১৮ মিটার এবং উচ্চতায় ২৪ মিটার।

সমাধি এলাকায় যেখানে জল চলে আসে সেখানে পরে কুয়া খনন করা হয়েছিল। যা পরে পাথর ফেলে ভরাট করা হয়েছিল, যা ছিল সমাধির ভিত্তিস্থাপন। বাধা বাঁশের পরিবর্তে রাজমিস্ত্রিরা তাঁদের সাধারণ ভারা বাধার নিয়মে সমাধির ভিতরে এবং বাইরে একই রকম ইটের ভারা তৈরি করেন। ভারা এত বড়ো এবং জটিল ছিল যে তা শ্রমিকদের খুলে সরাতে প্রায় বছর লাগার কথা। কথিত আছে, শাহজাহান ঘোষণা দিয়েছিলেন যে কেউ ভারার হঁট নিয়ে যেতে পারবে বিনামূল্যে এবং এক রাতের মধ্যে কৃষক, দিনমজুর, চাষিরা ভারাটি সরিয়ে নিয়েছিল। রাজ্যের হাজার হাজার গরিব কৃষক সেই ভারার হঁট খুলে নিয়ে যায় তাঁদের নিজেদের গৃহ নির্মাণের জন্যে। পনেরো কিলোমিটারের একটি ঢালু পথ তৈরি করা হয়েছিল, নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে মার্বেল পাথর ও অন্যান্য মালপত্র নেওয়ার জন্য। সমসাময়িক উৎস থেকে জানা যায়, ২০ ও ৩০টি করে ষাঁড় একসঙ্গে বেঁধে বিশেষ ধরনের গোরুর গাড়িতে করে পাথর উঠানো হত। পাথর উঠিয়ে ঠিক উচ্চতায় বসাতে কপিকল ব্যবহার করা হত। গাধা এবং ষাঁড়ের দল কপিকল নাড়াতে শক্তির জোগান দিত। ভিত্তি আর সমাধি নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় ১২ বছর। পুরো এলাকার বাকি অংশগুলো নির্মাণ করতে লেগেছিল আরও ১০ বছর। (যেহেতু চত্বর এলাকাটি কয়েকটি ভাগে নির্মিত হয়েছিল তাই তৎকালীন ইতিহাস লেখকরা নির্মাণ শেষের বিভিন্ন তারিখ উল্লেখ করেন। যেমন সমাধিটির কাজ শেষ হয়েছিল ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে, কিন্তু বাকি অংশগুলোর কাজ তখনও চলছিল।) সম্পূর্ণ তাজমহল ১৮০ ফুট উঁচু, যার প্রধান গম্বুজটি ২১৩ ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট চওড়া এবং এর চারপাশে চারটি মিনার আছে, যার প্রতিটির উচ্চতা ১৬২.৫ ফুট। পুরো কমপ্লেক্সটির আকার ১৯০২ x ১০০২ ফুট। শুধু তাজমহলটি ১৮৬ X ১৮৬ ফুট মার্বেল পাথরের উপর নির্মিত। এর প্রধান প্রবেশদ্বার ১৫১ x ১১৭ ফুট চওড়া এবং ১০০ ফুট উঁচু।

তাজমহল কোনো একজন ব্যক্তির দ্বারা নকশা করা নয়। এ ধরনের প্রকল্পে অনেক প্রতিভাধর লোকের প্রয়োজন। বিভিন্ন উৎস থেকে তাজমহল নির্মাণ কাজে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। পারস্যদেশীয় স্থপতি, ওস্তাদ ঈসা চত্বরের নকশা করার বিশেষ ভূমিকায় অনেক স্থানেই তাঁর নাম পাওয়া যায়। পারস্য দেশের (ইরান) বেনারসের ‘পুরু’; ফার্সি ভাষার এক লেখায় তাঁকে তত্ত্বাবধায়ক স্থপতি হিসাবে উল্লেখ করেছে। বড়ো গম্বুজটির নকশা করেছিলেন অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আসা ইসমাইল খান, যাকে গোলার্ধের প্রথম নকশাকারী এবং সে যুগের একজন প্রধান গম্বুজ নির্মাতা মনে করা হয়। কাজিম খান, লাহোরের বাসিন্দা, বড়ো গম্বুজের চূড়ায় যে স্বর্ণের দণ্ডটি ছিল, তিনি তা গড়েছিলেন। চিরঞ্জিলাল, একজন পাথর খোদাইকারক যিনি দিল্লি থেকে এসেছিলেন। প্রধান ভাস্কর ও মোজাইকারক হিসাবে নেওয়া হয়েছিল। পারস্যের (সিরাজ, ইরান) আমানত খান, যিনি প্রধান চারুলিপিকর (তাঁর নাম তাজমহলের প্রবেশপথের দরজায় প্রত্যায়িত করা আছে। মোহাম্মদ হানিফ রাজমিস্ত্রিদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। সিরাজ, ইরান থেকে মির আব্দুল করিম এবং মুক্কারিমাত খান, যাঁরা ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক দিকগুলো সামাল দিতেন।

তাজমহল তৈরি হয়েছে সারা এশিয়া এবং ভারত থেকে আনা বিভিন্ন উপাদান সামগ্রী দিয়ে। নির্মাণ কাজের সময় এক হাজারের বেশি হাতি ব্যবহার করা হয়েছিল নির্মাণ সামগ্রী বহন করে আনার জন্য। আলোপ্ৰবাহী অস্বচ্ছ সাদা মার্বেল পাথর আনা হয়েছিল রাজস্থান থেকে। ইয়াশব— লাল, হলুদ বা বাদামি রঙের মধ্যম মানের পাথর আনা হয়েছিল পাঞ্জাব থেকে। চিন থেকে আনা হয়েছিল ইয়াশম—কঠিন, সাদা, সবুজ পাথর, স্ফটিক টুকরো। তিব্বত থেকে বৈদূর্য সবুজ-নীলাভ (ফিরোজা) রঙের রত্ন এবং আফগানিস্তান থেকে নীলকান্তমণি আনা হয়েছিল। নীলমণি—- উজ্জ্বল নীল রত্ন এসেছিল শ্রীলঙ্কা এবং রক্তিমাভাব, খয়েরি বা সাদা রঙের মূল্যবান পাথর এসেছিল আরব থেকে। এ ছাড়া আটাশ প্রকারের মহামূল্যবান পাথর সাদা মার্বেল পাথরের উপর বসানো রয়েছে। ২০ হাজারের বেশি শ্রমিকের প্রচেষ্টায় নির্মাণ হয়েছিল এই তাজমহল। শুধু মানুষ নয়; এ মহান কীর্তির ভাগিদার ১০০০ হাতি, যারা নির্মাণের জন্য মার্বেল পাথর পরিবহনে নিয়োজিত ছিল। এই সৌধ নির্মাণে বিভিন্ন ধর্মের স্থাপত্যের অনুকরণে করা হয়। যেমন তাজের মাথার ত্রিশূলটি হিন্দুদের শিবমন্দিরের অনুকরণে, মুসলমানদের মসজিদের মতো করা হয় তাজমহলের চারটি মিনার ও মাথার গম্বুজ। তাজমহল যে জমির উপর দাঁড়িয়ে, সেই জমি ছিল অত্যন্ত নীচু। প্রচুর মাটি ফেলে সেই জমিকে যমুনা নদীর তীরের উচ্চতা থেকে প্রায় ৫০ মিটার (১৬০ ফুট) উঁচু করা হয়। ঠিক এখনকার earthquake proof বহুতলের column নির্মাণের মতোই সেখানে অনেকগুলি পাতকুয়া খোঁড়া হয় ও তারপর সেগুলি পাথর, বালি ও মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়। তাজমহলের এই ভিতটি ভূমিকম্প বা প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। ওই ভরাট-করা পাতকুয়াগুলির উপর এক বিশাল মঞ্চ তৈরি করে তার উপর সৌধের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়।

এই বিশাল কর্মযজ্ঞ খরচ কত হয়েছিল? তকালীন নির্মাণ খরচ অনুমান করা খুব কঠিন। তাজমহল নির্মাণে কত খরচ হয়েছিল তার হিসাবে কিছুটা হেরফের দেখা যায়। তাজমহল নির্মাণে তৎকালীন আনুমানিক ৩২ মিলিয়ন ভারতীয় মুদ্রা খরচ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু শ্রমিকের খরচ, নির্মাণে যে সময় লেগেছে এবং ভিন্ন অর্থনৈতিক যুগের কারণে এর মূল্য অনেক, একে অমূল্যই বলা হয়।

সমকালীন রচনা ‘দেওয়ান-ই-আফ্রিদি’ গ্রন্থের মতে কালজয়ী মর্মর সৌধ তাজমহল নির্মাণ করতে অসংখ্য গুণী শিল্পীর সাহায্য নিয়েছিলেন বাদশা। ভারতবর্ষ ছাড়াও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্থপতি ও শিল্পীদের। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, প্রাণ প্রিয়তমার স্মৃতিতে এমন একটা স্মৃতিসৌধ গড়ে তুলতে হবে, যেটি সারা বিশ্বে হয়ে থাকবে চিরস্মরণীয়। বহু প্রথিতযশা স্থপতির কাছ থেকে এল নানা ধরনের, নানা রূপের পরিকল্পনা। সবশেষে শিল্পী ইসফান দিয়ার রুমির তাজমহলের পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হল। ইন্দো-পারসিক শিল্প ধারার শ্রেষ্ঠ ফসল তাজমহল। এর প্রকৃত নকশাটি করেন পারস্যের সিরাজবাসী ওস্তাদ ঈসা। শিল্পী ঈসা ছিলেন তাজমহল নির্মাণের প্রধান স্থপতি। স্পেনদেশীয় পর্যটক ফাদার সেবাস্টিয়ান মানরিখের মতে, তাজমহলের নকশা তৈরি করেছেন জনৈক ভেনিশীয় স্থপতি জেরোনিমো ভেরেনিও। তবে তাজমহল নির্মাণের এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অনেক বিষয় নিয়েই ঐতিহাসিকদের নানা মত আছে, মতভেদও আছে নানা গ্রন্থে। সমাধিসৌধ নির্মাণে শিল্পী কারিগরদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ কাজের দায়িত্বে থাকা কিছু ব্যক্তির কথা বলি, যাঁরা বাদশার আমন্ত্রিত, তাজমহলের কাজে এসেছিল দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে। মণিমুক্তা উৎকীর্ণকারীদের মধ্যে আছেন মুলতানের চিন্তামণি (মাসিক বেতন ২৯২), বংশীধর (মাসিক বেতন ২৪৪), হীরামণি (মাসিক বেতন ২৩৪), মনোহর সিং (মাসিক বেতন ২০০), মোহনলাল (মাসিক বেতন ২০০), শিবাজীলাল (মাসিক বেতন ৩৪২), মনোহর দাস (মাসিক বেতন ২৯৫), বসহরত আলি (মাসিক বেতন ৬৩২), ভগবান দাস (মাসিক বেতন ৬৩০), ছোটেলাল (মাসিক বেতন ৬০০), দিল্লির যমুনা দাস (মাসিক বেতন ৬০০), আবু মোহম্মদ (মাসিক বেতন ৫০০), মোহম্মদ ইউসুফ খান (মাসিক বেতন ৬০০), লাহোরের মাধো রাম (মাসিক বেতন ২৫৩), মর্মুলাল (মাসিক বেতন৬৮০) প্রমুখ। তুরস্কের মহম্মদ ইসা আফাদি (মাসিক বেতন ১০০০) ছিলেন নকশা আঁকিয়ে। মোহম্মদ শরিফ সমরখন্দ (মাসিক বেতন ১০০০) ছিলেন তাজমহলের পরিকল্পক। ইসমাইল অফিউদি (মাসিক বেতন ৫০০) গম্বুজ নির্মাতা। আরবের কাদির জিমন খান (মাসিক বেতন ৮০০) সাধারণ শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। রাজমিস্ত্রিদের তত্ত্বাবধায়ক মোহম্মদ হানিফ আকবরাবাদ মোহম্মদ (১০০০) ছিলেন আগ্রাবাসী। দিল্লির রাজমিস্ত্রি আবদুল্লাহ (মাসিক বেতন ৬৭৫), মোহম্মদ সাহিব (মাসিক বেতন ৫০০), মুলতানের আবুতুবুর খান (মাসিক বেতন ৫০০), বালখের মোহম্মদ সোজ্জাক প্রমুখ। সুন্দর হস্তাক্ষরবিদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিরিয়ার রোখন খান (মাসিক বেতন ৪০০), পারস্যের ওয়াব খান (মাসিক বেতন ৬০০), মুলতানের আবদুল গফফর (মাসিক বেতন ৬০০), বাগদাদের মোহম্মদ খান (মাসিক বেতন ৫০০) এবং তুরস্কের সাত্তার খান (মাসিক বেতন ১০০০) প্রমুখ। বুখারার আরা মোহম্মদ (মাসিক বেতন ৫০০) ছিলেন বিশিষ্ট ভাস্কর। পুষ্পসজ্জক মুলতানের আমির আলি (মাসিক বেতন ৬০০), রঙিন মর্মরপ্রস্তর কাঁচ প্রভৃতির টুকরো জোড়া দিয়ে অলংকৃতকারী শিল্পী দিল্লির চিরঞ্জিলাল (মাসিক বেতন ৮৮০) এবং মুলতানের পুষ্পসজ্জা বিশেষজ্ঞ ছিলেন বলদেব দাস (মাসিক বেতন ৫৯০)। তাজ নির্মাণে এঁদের অবদান আজও মনে রাখার মতো। তাজমহলের অভ্যন্তরীণ অলংকরণ করেন মুলতান ও কনৌজের শিল্পীরা। সৌধের দেয়ালে কোরানের বাণীগুলি নিখুঁতভাবে খোদাই করেন কান্দাহারের বাসিন্দা আমানত খাঁ মিরাজি। বারোখ’ শৈলীর স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন দেখা যায় তাজমহলে। ঐতিহাসিকদের অনুমান, সমাধিসৌধের গম্বুজের কাজে প্রধান শিল্পী ছিলেন কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে আসা ইসমাইল খাঁ রুমিই। বিস্ময়কর এই সৌধ নির্মাণের জন্য এদেশের নানা প্রদেশের রাজা মহারাজা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ-প্রধানদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল সোনা, রুপো, নানান ধরনের রত্ন, পাথর ও দ্রব্যসামগ্রী। এইগুলির মধ্যে আছে সর্বোৎকৃষ্ট নীলা, পান্না, চুনি, হীরা, প্রবাল, মুক্তা, ফিরোজাসহ প্রায় ৪৩ রকমের পাথর ও রত্ন। ভারতের জয়পুর, ফতেপুর সিক্রি, গোয়ালিয়র, জব্বলপুর, জয়সলমির, হায়দ্রাবাদ, কুমায়ুন, সুরাটের মতো অসংখ্য জায়গা ছাড়াও বাগদাদ, তিব্বত, সিংহল, রাশিয়া, আরব প্রভৃতি দেশ থেকে তাজ নির্মাণের জন্য কেনা হয়েছিল পাথরগুলি।

এই সৌধ নির্মাণের কাজে জোর করে কাউকেই নিয়োগ করেননি শাহজাহান। কোনো শ্রমিককে তাঁর প্রাপ্য পারিশ্রমিকের একটি পয়সাও কম দেননি। রাজকোশ পূর্ণ থাকা সত্ত্বেও ত্রিশটি গ্রাম থেকে বাৎসরিক আদায় করা রাজস্ব ৩০ লক্ষ টাকা তিনি শুধু ব্যয় করেছেন তাজমহল নির্মাণে। এর নির্মাণ ব্যয় হয় ১,৮৪,৬৫,১৩৬ টাকা। মতভেদে পাদিশাহ নামাতে উল্লিখিত হয়েছে ৫০ লক্ষ টাকা। আবার কারও মতে ৪,১১,৪৮,৮২৬ টাকা ৭ আনা ৬ পাই। ট্যাভার্নিয়ের মতে, ২২ বছর ধরে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে এই সৌধ।

তাজমহলের নির্মাণ কাজ শেষ হতে না-হতেই শাহজাহান তাঁর পুত্র আওরঙ্গজেব দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত ও আগ্রার কেল্লায় গৃহবন্দি হন। জনশ্রুতি, জীবনের বাকি সময়টুকু শাহজাহান আগ্রার কেল্লার জানালা দিয়ে তাজমহলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই কাটাতেন। শাহজাহানের মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেব তাঁকে তাজমহলে তাঁর স্ত্রীর পাশে সমাহিত করেন। একমাত্র এ ব্যাপারটিই তাজমহলের নকশার প্রতিসমতা নষ্ট করেছে। ১৯ শতকের শেষ ভাগে তাজমহলের একটি অংশ মেরামতের অভাবে খুব খারাপভাবে নষ্ট হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের সময় ইংরেজ সৈন্যরা। তাজমহলের বিকৃতি সাধন করে এবং সরকারি কর্মচারীরা বাটালি দিয়ে তাজমহলের দেয়াল থেকে মূল্যবান ও দামি নীলকান্তমণি খুলে নেয়। ১৯ শতকের শেষদিকে লর্ড কার্জন তাজমহল পুনর্নির্মাণের একটি বড়ো প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। প্রকল্পের কাজ ১৯০৮ সালে শেষ হয়। তিনি তাজমহলের ভিতরের মঞ্চে একটি বড়ড়া বাতি (যা কায়রো মসজিদে ঝুলানো একটি বাতির অনুকরণে তৈরি করার কথা ছিল, কিন্তু তৎকালীন কারিগরেরা ঠিক হুবহু তৈরি করতে পারেনি ) বসিয়েছিলেন। তখনই বাগানের নকশা পরিবর্তন করে ইংরেজ পার্কের মতো করে গড়া হয়, যা এখনও রয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে তাজমহলের ভালোই রক্ষণাবেক্ষণ হয়। ১৯৪২ সালে যখন জার্মান বিমান। বাহিনী এবং পরে জাপানি বিমান বাহিনী দ্বারা আকাশপথে হামলা চালায় তৎকালীন সরকার তখন তাজমহল রক্ষার জন্য এর উপর একটি আচ্ছাদন তৈরি করে দিয়েছিল। ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান-বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়েও তাজমহলকে আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে বিমান চালকদের ভ্রম তৈরি করে।

প্রেম আর তাজমহল যেন সমার্থক শব্দ। সকলে তাজমহলকে প্রেমের প্রতীক বলে মানে। কোনো কোনো প্রেমিকপ্রবর তাঁর প্রেয়সীকে আজও তাজমহলের রেপ্লিকা উপহার দিয়ে থাকে। কিন্তু সত্যিই কি তাজমহল প্রেমের প্রতীক? জানতে একটু ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। যমুনার স্রোতের প্রবাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাজমহলের প্রেমের স্তুতি পৌঁছে গেছে বিশাল এই দুনিয়ার প্রত্যেকটি আনাচে কানাচে। তবুও প্রেমের উত্তাল মহাসমারোহের ভিতরেও কোথা থেকে যেন একটি কালো রঙের স্রোত খুবই ক্ষীণ আকারে বহমান। শাহজাহানের বয়স তখন ২০ বছর। একদিন আগ্রার বাজার দিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ শাহজাহানের চোখ পড়ে এক পরমাসুন্দরী মেয়ের দিকে। তাঁর নাম জানা যায় আরজুমান্দ বেগম। আরজুমান্দ বেগম নামের মেয়েটির বয়স তখন মাত্র ১৪। প্রথম দেখাতেই আরজুমান্দ বেগমকে ভালো লেগে যায় শাহজাহানের। এ ঘটনার অনেক পরে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে আরজুমান্দের সঙ্গে যুবরাজ সম্রাট শাহজাহান সঙ্গে বিয়ে হয়। আরজুমান্দ নামটি পরিবর্তন করে শাহজাহান তাঁর নাম রাখেন মমতাজ মহল। ১৬৩১ সালের জুন মাসে দাক্ষিণাত্যের বুরহানপুরে সম্রাটের ১৪ তম সন্তানকে প্রসবকালে মমতাজ মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মমতাজ মহলের মৃত্যু হয়। বলা যায়, শাহজাহান নিজে মমতাজের মৃত্যুকে ডেকে এনেছিলেন নির্বোধের মতো এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্তটি হল তিনি গর্ভবতী মমতাজকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেন। দুর্গম রাস্তা দিয়ে হাতির পিঠে বসে দীর্ঘক্ষণ চলার কারণে মমতাজের প্রসববেদনা শুরু হয়ে যায়। দীর্ঘ ৩০ ঘণ্টার সেই প্রসবব্যথা, শেষে সন্তান জন্ম দিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মমতাজ। শাহজাহান তাঁর ভুল পরে বুঝতে পেরেছিলেন। মমতাজের মৃত্যুর পর আক্ষেপ আর অনুতাপে সাতদিন সাতরাত শাহজাহান কিছু খাননি। ঘর থেকেও বের হননি। মমতাজের মৃত্যুর পর দুঃখে শোকে মুহ্যমান বাদশার সমস্ত চুল-দাড়ি অসময়েই পেকে গিয়েছিল অল্প কয়েকদিনের মধ্যে। শাহজাহান এতটা ব্যথিত হয়েছিলেন যে, সাময়িকভাবে রাজপোশাক পরিত্যাগ করেছিলেন। বন্ধ করেছিলেন রাজদরবারে যাওয়া। স্ত্রী হারানোর শোকে মুহ্যমান শাহজাহান তাঁর প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর স্মৃতির জন্য একবছর পরেই নির্মাণ শুরু করেন তাজমহল, যা ভালোবাসার এক অপরূপ নিদর্শন। এই সমাধিসৌধে কেবলমাত্র মমতাজের সমাধিই ছিল না, ছিল সমাধি শাহজাহানের অন্য স্ত্রীদের সমাধিও এবং মমতাজের প্রিয় পরিচারিকাদের একটি বড় সমাধিও আছে। তবে মমতাজের দেহরক্ষা করেন দাক্ষিণাত্যের বারহানপুরে। সেই কারণে তাঁকে সাময়িকভাবে সমাহিত করা হয় তাপ্তি নদীর তীরে জেনাবাদে। এর মাস ছয়েক পরে যুবরাজ সুজার তত্ত্বাবধানে মরদেহ তুলে এনে আবার সমাহিত করা হয় আগ্রায়, জয়পুরের রাজা মানসিংহের বাগানে।

বর্তমানে তাজমহলকে ঘিরে একশ্রেণির উগ্রবাদী হিন্দু গোষ্ঠীর অপ-রাজনীতি এবং উস্কানি দেওয়া শুরু করেছ। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের বিজেপি বিধায়ক সঙ্গীত সোম বলেছেন, “তাজমহল ভারতীয় সংস্কৃতিতে কলঙ্কের চিহ্ন। তাজমহলের নাম বদলে ‘তেজো মহল’ করার দাবি তুলেছেন বিজেপি সাংসদ তথা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা বিনয় কাটিয়ার। তার দাবি, “মন্দির ভেঙেই তাজমহল বানানো হয়েছে।” তিনি আরও বলেছেন “বিশ্বাসঘাতকরা এই তাজমহল তৈরি করেছে। তাঁর দাবি জয়পুরের রাজার জমি জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে সেই জায়গায় তৈরি হয়েছে তাজমহল। কয়েকটি গোষ্ঠী তাজমহলকে শিবমন্দির বলেও দাবি করে। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের সরকারি পর্যটন সূচি থেকে তাজমহলকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

তাজমহল কি হিন্দুদের শিবমন্দির গুঁড়িয়ে দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে? এই বিতর্ক উসকে উঠল হিন্দু ঐতিহাসিক হিসাবে খ্যাত লেখক পি এন ওক ‘তাজমহল : দ্য টু স্টোরি’ নামের বিতর্কিত বইয়ের মধ্য দিয়ে। এই গ্রন্থে তিনি দাবি করেন, ওই সৌধ আদৌ শাহজাহান স্ত্রীর স্মৃতিতে তৈরি করেননি। ওটি রাজপুত রাজা মানসিংহ উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন। এ নিয়ে কোনো প্রমাণ না মিললেও অনেক বিতর্ক হয়েছে। অনেক মামলাও হয়েছে। আদালতে। এই ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান জানতে চাইল কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন। দ্রুত স্পষ্ট অবস্থান জানাতে বলা হয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রককে। সম্প্রতি বি কে এস আর আয়ানগর নামে জনৈক ব্যক্তি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ (এএসআই)-এর কাছে তথ্য জানার অধিকার আইনে তাজমহলের প্রকৃত পরিচয় জানতে চায়। সত্যিই কি ওই সৌধের নাম তাজমহল, নাকি তেজো মহালয়া? আদৌ কি ওই সৌধ কোনো সমাধি, নাকি হিন্দু মন্দির? স্বাধীনতার পর থেকে জালি ইতিহাসবিদরা ভারতের পাঠ্যবই ভুয়ো ইতিহাসে ভরিয়ে দিয়েছে। এগুলোও সমস্ত কিছুই ইংরেজ ও কংগ্রেসের ইশারায় হয়েছে। প্রফেসর পি.এন ওক একটা রিপোর্ট দিয়েছিল নেহেরুকে। যেখানে বলা হয়েছিল তাজমহল একটা হিন্দুমন্দির, এটার গোপন কক্ষ খোলা হোক। এই প্রশ্নের প্রেক্ষিতেই কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনার শ্রীধর আচারিয়ালু কেন্দ্রের অবস্থান জানতে চেয়েছেন। ১৭ শতকে নির্মিত এই সৌধের বিস্তারিত তথ্যও জানতে চাওয়া হয়েছিল। নির্মাণ শিল্পের বিস্তারিত বিবরণ চাইলেও বন্ধ থাকা ঘরগুলি ভোলা হবে না বলে জানিয়েছিল কমিশন। এই সংক্রান্ত যত মামলা হয়েছে তার হলফনামা, তাজমহল সংক্রান্ত যাবতীয় রিপোর্ট এবং সেখানে পুরাতত্ত্ব বিভাগ কোনো খনন কার্য চালিয়েছে কি না তাও জানতে চেয়েছিল কমিশন। বলা হয়েছে পুরাতত্ত্ব বিভাগের হাতে থাকা যাবতীয় নথি ও তথ্য কমিশনে জমা দিতে হবে। নেহেরু বলেছিলেন এটা করা যাবে না। সেইসময় থেকে আজ অবধি তাজমহলের গোপন কক্ষ বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। বলা হয় যে, গোপন কক্ষকে খুলতে দেওয়া হয় না, কারণ সেখানে আজও বহু মূর্তি রয়েছে। আসলে আজকের তাজমহল, তেজো মহালয়া নামে মন্দির ছিল। যার উপরের অংশ আরবি আক্রমণকারী ও অন্যান বিদেশিদের দ্বারা নষ্ট করে গম্বুজ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বিদেশি আক্রমণকারীরা এটাকে ইসলামিক কবরস্থান প্রমাণ করার জন্য বিল্ডিংয়ের উপরে নানা আরবি শব্দ লিখেছিল, কিন্তু হিন্দু মন্দিরের চিহ্ন। আজও সেই চিহ্ন রয়ে গেছে। আজও তাজমহলে কলস, কমল, ওঁম সহ নানা হিন্দু চিহ্ন রয়েছে। আমেরিকার বিখ্যাত আর্কিটেক অধ্যাপক মারভিন মিলস তাজমহলের উপর গবেষণা করেছেন এবং এটাকে হিন্দু ইমারত বলে ঘোষণা করেছেন। মারভিন মিলসের রিপোর্ট নিউইয়র্ক টাইমসেও প্রকাশিত হয়েছিল। মারভিন মিলস তাঁর রিপোর্টে লিখেছেন তাজমহল একটা হিন্দু ইমারত, যার উপর ‘বিদেশি’ ইসলামিক জিহাদিরা আক্রমণ করে কবরস্থানের রূপ দিয়ে দিয়েছে। কোনো বস্তু, পাথর, ইমারত কতটা পুরোনো সেটা নির্ণয় করার জন্য কার্বন ডেটিং করা হয়। কার্বন ডেটিং প্রক্রিয়ায় সমস্ত রকমের পুরানো পদার্থের বয়স নির্ণয় করা সম্ভব। কার্বন ডেটিংয়ে এটা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে যে, তাজমহলের পাথর ১৩ শতাব্দীর যখন শাহাজাহান তত দূর বাবরের জন্ম হয়নি। প্রফেসর মিলস এটাও বলেছেন যে, তাজমহল দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে যে এটা ইসলামিক ইমারত নয়। কারণ ইসলামিক ইমারত মক্কার দিক দিশা করে তৈরি করা হয়। কিন্তু তাজমহলে তৈরি করা মসজিদ ওই দিশায় নেই। এছাড়াও তাজমহল যমুনা নদীর তীরে তৈরি করা হয়েছে, যাতে ভগবান শিবের অভিষেক করা যায়। “taj mahal the illumined tomb” নামক বইতে প্রফেসর মারভিন মিলসের রিপোর্ট রয়েছে। আজও যে-কোনো ভালো আর্কিটেককে তাজমহলের উপর তদন্ত করলে স্পষ্ট জানিয়ে দেবে যে, তাজমহল আতঙ্কবাদীদের দ্বারা তৈরি কোনো ইসলামিক ইমারত নয়। বরং এত একটা হিন্দু মন্দির, যেটাকে কবরস্থানে রূপান্তরিত করে দেওয়া হয়েছে।

অপরদিকে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আইনজীবী অঞ্জনী শর্মা অ্যাফিডেভিটের মাধ্যমে আদালতকে জানিয়ে দেন, তাজমহল কোনোদিন শিবমন্দির ছিল না। এটি মোগল সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের স্মৃতির উদ্দেশে গড়া সৌধ। অঞ্জনী শর্মা বলেন, তাজমহলকে শিবমন্দির প্রমাণ করার জন্য যেসব তথ্য-প্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়েছে, তার অধিকাংশই কল্পনাপ্রসূত। এর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। আর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তাজমহলের যে অংশটি বন্ধ রাখা হয়েছে, সেই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনার প্রয়োজন নেই। এসএসআই দাবি করেছে, ঐতিহাসিক পি এন ওকের লেখা একটি বই নিয়ে প্রথম তাজমহল বিষয়ক বিতর্ক শুরু হয়। ওই বইয়ে পি এন ওক দাবি করেন, তাজমহলের তলায় শিবমন্দির চাপা দেওয়া হয়েছে। ওই শিবমন্দিরের নাম ছিল ‘তেজো মহালয়া’। বইয়ের তথ্যের উপর ভিত্তি করে আগ্রার আইনজীবীরা মামলা করেন। এতে তাজমহলকে শিবমন্দির হিসাবে মানার দাবি তোলা হয়। তাজমহলের নাম ‘তেজো মহালয় হিসাবে ঘোষণা দেওয়ার আবেদন জানানো হয়। যদিও ভারতের উত্তরপ্রদেশের আগ্রা শহরের ঐতিহাসিক তাজমহল কখনো শিবমন্দির ছিল না বলে আদালতে হলফনামা পেশ করেছে দেশটির প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (এসএসআই), তা সত্ত্বেও আশঙ্কা তো থেকেই যায়। কোনদিন হয়তো বাবরি মসজিদের মতো ভেঙে পড়বে, আর নিশ্চয় আদালত বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তেজো মহালয়া গড়তে রায় দেবে!

‘রাষ্ট্রীয় বজরং দল’ নামে সংগঠনের নেত্রীরা দাবি করেছেন, কর্তৃপক্ষের নিয়ম লঙ্ঘন করে তাজমহলের ভিতরের মসজিদে নামাজ পড়া হয়েছে। তাঁর প্রতিবাদেই তাঁরা সেখানে পূজা-অর্চনা করেছেন। তাজমহলের ভিতরে যে মসজিদ আছে, আগ্রার স্থানীয় মুসলিমরা সেখানে সূচনালগ্ন থেকেই নামাজ আদায় করে আসছেন। কিন্তু সম্প্রতি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এ এস আই) বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে জুমার দিন ছাড়া তাজ মসজিদে নামাজ পড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ফলে মুসলমানদেরকে তাঁদের ধর্মীয় ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে। জুম্মাবার তাজমহল দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ থাকে। শুধু সেদিনই স্থানীয়রা সেখানে নামাজ পড়তে পারবেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। কিন্তু সেই নির্দেশ লঙ্ঘন করে সম্প্রতি বেশ কয়েকজন স্থানীয় মুসলিম তাজমহলে নামাজ আদায় করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। যদিও তা নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আগ্রার প্রভাবশালী মুসলিম নেতা মুফতি মুকাররম সেই অভিযোগ স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করেননি। তিনি দাবি করেছেন, এএসআই-এর নির্দেশটাই আসলে বেআইনি! তাঁর মতে, “আগ্রার মুসলিমরা আবহমান কাল থেকে তাজমহলে নামাজ পড়ে আসছেন। আর তা আমাদের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার!’ তাজমহলের ভিতরে নামাজ পড়া ঠেকানোর জন্য হিন্দুত্ববাদীরা বহুদিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছেন। যদিও তাদের দাবি বস্তুনিষ্ঠ ও ইতিহাস সম্মত নয়। তাজমহল একটি শিবমন্দির ছিল বলে যাঁরা দাবি করেন তাঁদের অনেকেই সেটিতে ‘তেজো মহল’ নামে অভিহিত করে থাকেন। তাজমহলের ভিতরে পূজা-অর্চনা নিয়ে আগ্রার প্রশাসন বা উত্তরপ্রদেশ সরকার এখনও কোনো মন্তব্য করেনি। এই ঘটনায় কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। উল্লেখ্য, তাজমহলে নামাজের আদায়ের লক্ষ্যে প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রবেশের পরই ২০১৩ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে তাজমহলের ভিতর মমতাজ মসজিদে শুক্রবারে জুম্মার নামাজ আদায়ের উপর বিদেশিদের ক্ষেত্রে নিযেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটি অজুহাত মাত্র। তাঁরা পরিকল্পিতভাবেই তাজমহল কমপ্লেক্সকে মুসলমানদের কাছ থেকে সরিয়ে চায়। মূলত ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদের উত্থানের কারণেই ভারতের মুসলিম, মুসলিম শাসনামলের স্থাপনা ও মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এঁরা ভারতের সমস্ত মসজিদের ভিতরে মন্দির খোঁজার চেষ্টা করে চলেছেন। ভারতের মন্দিরের নীচে কোথায় কোথায় বৌদ্ধবিহার আছে, সেটা অবশ্য খুঁজছে না কেউ। উগ্রবাদীরা মুসলিম-মুক্ত ভারত গড়ার পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই নানাবিধ ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করছে। সে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবেই ১৯৯০ সালে তাঁরা দেশের অযোধ্যায় মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবর কর্তৃক ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধুলিস্যাৎ করে দেয়। এতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। মূলত ধর্মের ছদ্মবেশে এসব উগ্রবাদী তৎপরতা চালানো হলেও এর সঙ্গে ধর্মের তেমন কোনো যোগসূত্র আছে বলে মনে হয় না। আবহমানকাল থেকেই ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে এই উপমহাদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সঙ্গেই বসবাস করে আসছে। মুসলিম শাসনামলেও উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে একশ্রেণির উচ্চাভিলাষী ভারতীয় রাজনীতিক রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্যই রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার করা শুরু করেছেন। যার ফলশ্রুতিতেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। এতে কোনো ধর্ম উপকৃত হয়নি। বরং উপকৃত হয়েছে একটি উগ্রবাদী-ধর্মান্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী। ধর্মের নামে তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে পেরেছে। সেই উচ্চাভিলাষ তাঁদের পূর্ণ হয়েছে, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে তাজমহল নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা উন্মাদনা শুরু করলেও ইতিহাস তাঁদের দাবি পক্ষে কথা বলে না। মূলত তাজমহল ভারতের আগ্রায় অবস্থিত একটি রাজকীয় সমাধি। ভারতীয় রাজনীতিতে উগ্রবাদীদের উত্থান ভারতে মুসলিম ও মুসলিম স্থাপনাগুলোকে অনিরাপদ করে তুলেছে। সে ধারাবাহিকতায় একজন ভারতীয় সাংসদ এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দাবি করছে তাজমহল ছিল একটি হিন্দু মন্দির। ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির ভিনয় কাটিয়ার দাবি করেছেন, একজন হিন্দু শাসক তাজমহল তৈরি করেছেন। ভারতের গণমাধ্যমে তাঁর এই দাবি ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। ভারতের ডানপন্থী মহল বলে পরিচিত তাঁর এই দাবি সমর্থনও করেছে। কিন্তু এই দাবির পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই। বরঞ্চ ইতিহাসবিদরা এমনকি ভারত সরকারও মনে করে, এই সৌধ ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের এক চমৎকার নিদর্শন। ভারতের সরকারিভাবে সংরক্ষিত ইতিহাস অনুযায়ী মোগল সম্রাট শাহজাহান তাজমহল তৈরি করেছিলেন তাঁর মৃত স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মরণে। তাই উগ্রবাদীদের দাবির কোনো যৌক্তিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাজমহল নিয়ে ভারত সরকারের ওয়েবসাইট উল্লেখ আছে, ইসলামি স্থাপত্যকলার সঙ্গে ভারতের স্থানীয় স্থাপত্যকলার সংমিশ্রণে গড়ে উঠা সে সময়ের স্থাপত্য রীতির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহারণ এটি। ইতিহাসবিদ রানা সাফভির মতে, “তাজমহলের ইতিহাস নতুন করে লেখার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। সেখানে যে কখনো কোনো মন্দির ছিল তার কোনো প্রমাণ নেই। তাজমহল তৈরি হওয়ার আগে সেখানে হিন্দু শাসক জয় সিংয়ের একটি প্রাসাদোপম বাড়ি ছিল। শাহজাহান এই হিন্দুশাসক জয় সিংয়ের কাছ থেকে প্রাসাদোপম বাড়িটি কিনে নেন। এ নিয়ে একটি ফরমান জারি করা হয়েছিল। সেটা এখনও আছে। এই ফরমানে দেখা যাচ্ছে মোগলরা তাঁদের বিভিন্ন চুক্তি এবং ইতিহাস রক্ষায় বেশ সচেতন ছিল।” রানা সাফভি বলেন, ডাব্লিউ ই বেগলি এবং জেড এ ডেসাহাসের লেখা একটি বইতে এসব দলিল সংকলন করা আছে। ভারতের পাঠ্যপুস্তক, বিভিন্ন সরকারি সাইট ও মোহাফেজ খানা দলিল-দস্তাবেজে তাজমহলকে ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ডানপন্থী ইতিহাসবিদ পিএন ওক মনে করেন, সম্রাট শাহজাহান এটি দখল করে সেটিকে পরে তাজমহল নাম দিয়েছেন। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দাবির অসারতা প্রমাণিত হয় একজন ফরাসি পর্যটক ফ্রান্সিস বেরনিয়ার স্মৃতিচারণমূলক একটি গ্রন্থ থেকে। ১৬৬৩ সালে আগ্রা ভ্রমণ করে ফরাসি এই পর্যটক স্মৃতিচারণ করে লেখেন– “I shall finish this letter with a description of the two wonderful mausoleums which constitute the chief superiority of Agra over Delhi. One was erected by Jehan-guyre (sic) in honor of his father Ekbar; and Chah-Jehan raised the other to the memory of his wife Tage Mehale, that extraordinary and celebrated beauty, of whom her husband was so enamoured it is said that he was constant to her during life, and at her death was so affected as nearly to follow her to the grave.”

এরপরও কি তাজমহল আর তেজো মহল বিতর্ক থামবে? থামবে কি থামবে না, সেটা বলা সত্যিই খুব মুশকিল। কিন্তু যে তাজমহল নিয়ে শাহজাহানের প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেই জল্পনাকল্পনা চলতেই থাকবে। প্রেম বলে কথা। প্রেমের প্রশ্নে আমরা মানুষরা বরাবরই দুর্বল। জনমানসে প্রেমের নিদর্শন হিসাবে তাজমহল প্রতিভাত হলেও সত্যি কি এই নির্মাণে শাহজাহানের প্রেমের সামান্যতম অংশ ছিল? অনেক ইতিহাস গবেষকের মতে সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল তৈরির পিছনে মমতাজের প্রতি প্রেমের কোনো স্পর্শই ছিল না। শাহজাহান ছিলেন স্থাপত্য নির্মাণে ব্যাপক আকুল। বলা যায় এটা তাঁর নেশায় পরিণত হয়েছিল। তাঁর ধ্যানেজ্ঞানে এমনই কামনা ছিল যে, তিনি এমন অপরূপ এক স্থাপত্য তৈরি করবেন, যা তাঁর নামকে অমর করে রাখবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। মমতাজের আগেও সম্রাট শাহজাহানের আরও একজন স্ত্রী ছিলেন এবং মমতাজকে বিয়ে করার পরও সম্রাট শাহজাহান আরও তিনটি বিয়ে করেন। এমনকি মমতাজ মারা যাওয়ার পর শাহজাহান মমতাজের নিজের ছোটো বোনকে বিয়েও করেন। যদি সত্যিই মমতাজ তাঁর প্রাণপ্রিয় হত এবং সত্যিই যদি মমতাজের প্রেমে পাগল হত, তাহলে মমতাজের মৃত্যুর পরে বৃদ্ধ বয়সে তিনি আরও একটি বিয়ের কথা ভাবতেই পারতেন না। সম্রাট শাহজাহান নিজের মেয়ে জাহানারার প্রেমকে জঘন্য উপায়ে কবর দিয়েছিলেন। জাহানারা যাঁর প্রেমে পড়েছিলেন শাহজাহান তাঁকে একেবারেই পছন্দ করেননি। কিন্তু বিদূষী জাহানারা প্রেমে অটল ছিলেন। তাঁর প্রেমিক লুকিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসত। শাহজাহান একদিন মেয়ের প্রেমিককে আটক করতে সক্ষম হন। তারপর মেয়ের চোখের সামনেই মেয়ের সেই প্রেমিককে তক্তা দিয়ে দেয়ালের সঙ্গে আটকে পেরেক গেঁথে গেঁথে খুন করেন প্রেমের তাজমহলের নির্মাতা শাহজাহান। যমুনার তীরে তখন তাজমহলের নির্মাণ কাজ চলছিল। এই শাহজাহান কখনো প্রেমিক হতে পারে। তাজমহলের নির্মাণ কাজ মমতাজের মৃত্যুর পর শুরু হয়। শাহজাহানকে তাঁর জীবনের শেষ ৮ বছর আগ্রার দুর্গেই গৃহবন্দি হয়ে কাটাতে হয়। এখান থেকেই সম্রাট শাহজাহান অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতেন তাজমহলের দিকে। এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। স্ত্রী মমতাজের পাশে তাজমহলেই শাহজাহানকে সমাহিত করা হয়।

তাজমহল নির্মাণ তো শেষ হল। এই বিখ্যাত স্থাপত্য শেষ হওয়ার পরের ঘটনা কী ঘটেছিল? ঘটনা না বলে বলা যায় অঘটনই ঘটেছিল। শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে কলহ বেধে গেল। ১৬৫৭ সালে শাহজাহান গুরুতর অসুখে অসুস্থ হলে এক পর্যায়ে গুজব রটে যে, তিনি জীবিত নেই। কিন্তু পরে তিনি জীবিত আছেন জানা গেলেও তাঁর পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হয়। আওরঙ্গজেব পিতাকে আগ্রার দুর্গে নজরবন্দি রেখে স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ করেন।

এই সৌধ সম্পর্কে কী ভাবছি তা জিজ্ঞাসা করছ তো, কিন্তু এই সৌধ সম্পর্কে সমালোচনা কীভাবে করব, তা আমি নিজেই জানি না। এর সম্পর্কে আমার অনুভূতির কথা বলতে পারি। আমার দেহের উপরে এইরকম সৌধ যদি করে দেওয়া হয় তাহলে আমি কালকেই মরতে চাই।— তাজমহল দেখার পর স্লিম্যান-পত্নীর এ মন্তব্যের কথা বিখ্যাত ঐতিহাসিক মেজর জেনারেল স্লিম্যান (Sleeman) লিখেছেন তাঁর ‘Rambles and Recollections’ গ্রন্থে।

শাহজাহানের তিয়াত্তর বছরের জীবনের ১৫৯২ থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত, মোগলদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ সময় এমন একটা সময়, যখন বাইরের জগতে দ্রুত পরিবর্তন হয়ে চলেছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রে অল্প অল্প করে স্থায়ী সীমান্ত সৃষ্টি হচ্ছে নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। শাহজাহানের জীবদ্দশাতেই ইউরোপের বলিষ্ঠ পরিবর্তন ঘটে এবং ইউরোপীয় শক্তিগুলোর ভিতরে ভারসাম্যের পরিবর্তন হয়। ৩০ বছরের যুদ্ধের পরিণতি জার্মানকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। ২০০ বছর পর প্রুশিয়ার সাম্রাজ্যের উত্থানের ফলেই কেবল এ পরিস্থিতির অবসান ঘটবে। ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী ফ্রান্স চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বকালে ক্ষমতার শিখরে আরোহণ করে। অবশ্য প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী ইংল্যান্ড এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী ছিল না। ১৬৪৯ সালে প্রথম চালর্সের বিচার ও প্রাণদণ্ড হয়। তাঁর পরিবর্তে এক নীতিবাগীশ প্রজাতন্ত্রের সৃষ্টি হয়। ১৬৬০ সাল পর্যন্ত পার্লামেন্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাকাল বজায় ছিল। ১৬০৭ সালে ইংরেজরা আমেরিকার ভার্জিনিয়ার জেমসটাউনে তাঁদের প্রথম উপনিবেশ স্থাপন করে। এ বছরই ভারত-সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে মমতাজের বাগদান সম্পন্ন হয়। ১৬৬৪ সালে ব্রিটিশরা ডাচদের কাছ থেকে নিউ আমস্টারডাম শহর অধিকার করে। এই শহরের নতুন নামকরণ হয় নিউইয়র্ক।এ ঘটনার ২ বছর আগেই শাহজাহানের মৃত্যু ঘটে গেছে। সারা পৃথিবীজুড়ে চলছে দখলদারী। স্প্যানিশরা মধ্য আর দক্ষিণ আমেরিকায় বহু বছর ধরেই আমেরিকায় কর্তৃত্ব করছিল। ১৬৫৫ সালে ইংলিশ প্রজাতন্ত্র স্পেনের কাছ থেকে জ্যামাইকা দখল করে নেয় এবং সেখান থেকে এরপর তাঁদের প্রাইভেটিয়্যার বা জলদস্যুরা স্পেনের ধনসম্পদ লুট শুরু করে। সারা বিশ্বের লুটপাট দখলের ইতিহাস শেষ করা যাবে না।

একদিকে একশো মিলিয়ন মানুষ অধ্যুষিত ভারতের একটি সাম্রাজ্যের ভাগ্য একটি রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। যে পরিবারে ভাই ভাইকে হত্যা করে, হত্যা করতে চায়। যে পরিবারে পুত্র পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করতে চায়। যে পরিবারে সম্রাজ্ঞী আর হবু সম্রাজ্ঞী একসঙ্গে পরস্পরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তে লিপ্ত থাকে। পিতা শাহজাহানের মৃত্যুর পর আরঙ্গজেব নিজেকে দিল্লির সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করেন। ১৬৫৯ সালের জুন মাসে দিল্লিতে তাঁর অভিষেক সম্পন্ন হয়। তিনি ‘আলমগির পাদশাহ গাজি’ উপাধি নেন। আওরঙ্গজেব অভিষেকের পর যথোচিত পুরস্কার ও উপঢৌকন বিতরণ করেছিলেন। রোগাক্রান্ত অবস্থায় শাহজাহান একটি উইল করে জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। মমতাজ মহলের ৪ পুত্র ছিল। দারা ছিলেন সবার বড়। তিনি নামেমাত্র পাঞ্জাবের শাসনকর্তা থাকলেও তিনি আগ্রায় অবস্থান করে রাজকর্মে পিতাকে সাহায্য করতেন। তিনি হিন্দুদের প্রতি মিত্র ভাবাপন্ন এবং শিয়াদের প্রতি উদার ছিলেন। শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুজা ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ও যোদ্ধা হলেও বাংলার আবহাওয়া তাকে আয়েশী, দুর্বল ও স্থবির করে তুলেছিল। উত্তরাধিকার সংগ্রামে শাহ সুজা ছিলেন আওরঙ্গজেবের শেষ প্রতিদ্বন্দ্বী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *