১.৫.০৭ গিয়াসুদ্দিন বলবন (শাসনকাল : ১২৬৬ সাল থেকে ১২৮৭ সাল)

গিয়াসুদ্দিন বলবন (শাসনকাল : ১২৬৬ সাল থেকে ১২৮৭ সাল)

ইলতুৎমিসের পর যথাক্রমে রুকন-উদ-দিন ফিরোজ শাহ, রাজিয়া, মুইজুদ্দিন বাহারাম শাহ, আলাউদ্দিন মাসুদ শাহ, নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ প্রমুখেরা সুলতান হন। এরপর সুলতান হন উলুগ খান (গিয়াসুদ্দিন) বলবন। তিনি প্রথমে নাসিরউদ্দিন মাহমুদের উজির ছিলেন। সিংহাসনে আরোহণ করার পরে গিয়াসউদ্দিন বলবন এক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীদের অপদার্থতার ফলে সুলতানি শাসনের ভিত যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল। দিল্লির কোশাগার প্রায় শূন্য হয়ে যায়। অপরদিকে আমির-ওমরাহদের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মোঙ্গল আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিলে দিল্লি সুলতানির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়। এই পরিস্থিতিতে গিয়াসউদ্দিন বলবন শক্ত হাতে হাল ধরেন ও একজন দক্ষ শাসকের পরিচয় দেন। এই পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার মতো যোগ্যতা গিয়াসউদ্দিন বলবনের ছিল।

তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী এবং শত্রুদের একদম ক্ষমা করতেন না। মোঙ্গল আক্রমণের ফলে মধ্য এশিয়া থেকে নতুন তুর্কি সেনাদের আসা বন্ধ হলে তুর্কি সেনাদলে উচ্চ কর্মচারী ও সাধারণ সেনার সংখ্যা হ্রাস পায়। বলবন হিন্দুস্থানী মুসলমান ও রাজপুতদের একদম বিশ্বাস করতেন না। কোনো ভারতীয় ভূমিপুত্রকে সেনাদলে নিয়োগ করতেন না। ফলে ক্রমে ক্রমে তাঁর বাহিনী দুর্বল হতে থাকে। সরকারি পদে তুর্কি নিয়োগের ব্যাপারে গোয়ার্তুমি করলে ভারতীয় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর ফলে বিরাদরি আন্দোলন ব্যাহত হয়। এসময় নিম্নবর্ণের হিন্দুরা অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। একেই বলেই বিরাদরি আন্দোলন। বলবন ধর্মন্তরিত হিন্দুস্থানী নব্য মুসলমানদের ঘৃণা করায় এই আন্দোলনে ভাটা পড়ে।

মুক্তমনা ব্লগে আবুল কাশেম লিখেছেন– “১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে রনথোম্বর আক্রমণ করে বলবন বহু ক্রীতদাস কবজা করেন এবং ১২৫৯ খ্রিস্টাব্দে হরিয়ানা আক্রমণে বহুসংখ্যক নারী-শিশুকে ক্রীতদাস বানান। বলবন কাস্পিল্য, পাতিয়ালি ও ভোজপুরে দু-বার করে আক্রমণ করেন এবং প্রতিবার বিপুল সংখ্যক নারী-শিশুকে ক্রীতদাস বানান। কাটিহারে আট বছরের ঊর্ধ্ব-বয়সি বিধর্মীদেরকে পাইকারি হারে হত্যার পর তাঁদের নারী ও শিশুদের তিনি আটক করে নিয়ে আসেন, লিখেছেন ফেরিশতা। ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে বলবন রনথোম্বর, মেওয়াত ও সিউয়ালিক আক্রমণ করে তাঁর যোদ্ধাদেরকে লক্ষ করে ঘোষণা দেন— যাঁরা একজন জীবিত বন্দিকে আনবে, তাঁরা পাবে দুই তাজ্জ (রৌপ্য মুদ্রা), আর বিধর্মীদের ছিন্নমস্তক আনলে পাবে এক তাত্থা। ফেরিশতা লিখেছেন : অচিরেই তার সমীপে তিন থেকে চারশো জীবিত বন্দি ও ছিন্নমস্তক এনে হাজির করা হয়। সুলতান নাসিরুদ্দিনের (মৃত্যু ১২৬৬) অধীনে সেনানায়ক হিসেবে কাজ করার সময় বলবন বিধর্মীদের বিরুদ্ধে বহু হামলা পরিচালনা করেন। কিন্তু কী পরিমাণ বন্দি তিনি কজা করেছিলেন, তা লিখিত হয়নি। তবে তিনি যে কী বিপুল পরিমাণ ক্রীতদাস সংগ্রহ করেছিলেন তা অনুমান করা যাবে এ ঘটনা থেকে যে, সুলতান নাসিরুদ্দিন লেখক মিনহাজ সিরাজকে তার খোরাসানবাসী ভগ্নির জন্য চল্লিশ জন ক্রীতদাসকে উপহার দিয়েছিলেন। ..পূর্ববর্তী সুলতানের সেনাপতি থাকাকালীন বলবন বিধর্মীদের বিরুদ্ধে বহু যুদ্ধ পরিচালনায় অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দেন। ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ক্ষমতা গ্রহণ করার পর তার প্রথম কর্তব্য হয়ে পড়ে হাজার হাজার অবাধ্য হিন্দু বিদ্রোহী বা মুয়াত্তিকে নির্মূল করা। সে অভিযানে তিনি ‘বিদ্রোহীদের গ্রামগুলো ধ্বংস, পুরুষদেরকে হত্যা এবং নারী ও শিশুদেরকে বন্দি করার নির্দেশ দেন।” এধরনের 164 M. A. Khan shou Betals 98 ‘Islamic Jihad : A Legacy of Forced Conversion, Imperialism and slavery’-এও বিস্তারিত উল্লেখ আছে।

বলবন নিজ ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করায় জন্য রাজ্যে আইন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের জন্য সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। তিনি অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যের দায়িত্ব যোগ্য হাতে অর্পণ করে সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। তারপর তিনি দিল্লি ও দোয়াব অঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনের জন্য মেওয়াটি দস্যুদের দমন করেন। পুনরায় যাতে শান্তি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে না-পারে, তার জন্য তিনি গোয়ালিয়রে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। দোয়া অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য তিনি কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেন ও জালালির দুর্গটি মেরামত করেন। বলবন তাঁর স্বৈরতন্ত্রী শাসনব্যবস্থাকে কায়েম করতে একটি শক্তিশালী রাজতান্ত্রিক আদর্শ ও তত্ত্ব গড়ে তুলেছিলেন। দিল্লি সুলতানির মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তিনি বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পারসিক শাসকদের অনুকরণে তিনি তাঁর রাজসভা গড়ে তোলেন। পারসিক আদব কায়দা ও প্রথা চালু করে তিনি জনগণের সম্ভমও আদায় করে নেন। তিনি রাজসভায় সবসময় সুসজ্জিত হয়ে ও অনুচরবর্গ দ্বারা বেষ্ঠিত হয়ে প্রবেশ করতেন। রাজ্যের সমস্ত উচ্চ পদের দরজা সাধারণ লোকের কাছে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাইরের চাকচিক্য দিয়ে লোকের মন ভুলিয়ে এইভাবে তিনি তাঁদের মধ্যে ভীত সন্ত্রস্ত ভাব জাগিয়ে তোলেন। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শাসনব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে মোঙ্গল আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য গিয়াসউদ্দিন বলবন দৃষ্টি দেন। তিনি লাহোরের দুর্গটি পুনরায় নির্মাণ করার আদেশ দেন। দীর্ঘদিন ধরে সুলতানের আত্মীয় শের খান যোগ্যতার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন করছিলেন। বলবন তাঁকে সন্দেহবশত হত্যা করেন বলে বরনি অভিযোগ করেন। এই হত্যাকাণ্ড বলবনের রাজনৈতিক অদুরদর্শিতার পরিচায়ক। তবে শের খানের হত্যার ফলে মোঙ্গলরা ভারত আক্রমণ করতে প্রলুব্ধ হয়। তখন সুলতান জ্যৈষ্ঠ পুত্র মোহম্মদকে সুলতানের শাসক নিযুক্ত করেন। তাঁর প্রচেষ্ঠায় সাময়িকভাবে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত হয়। কিন্তু মোঙ্গলরা আবার আক্রমণ করলে মোহম্মদ প্রাণ হারান। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন এই পুত্রশোকে শেষপর্যন্ত মারা যান।

বলবনের শাসননীতি কেমন ছিল? একনজরে দেখে নেব– (১) যে অবস্থার মধ্যে বলবন দিল্লির সিংহাসনে আরোহন করেন, সেসময় তিনি বাধ্য হয়ে কিছু কঠোর নীতি গ্রহণ করতে হয়। সিংহাসনে আরোহণের পর অসীম সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে বলবন চরম প্রতিক্রিয়াশীল চল্লিশচক্র’ বিলুপ্ত করেন। (২) তিনি একদিকে অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা, অন্যদিকে সীমান্তে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে নিজের দুই পুত্রকে মোতায়েন করেন।(৩) দিল্লির সন্নিহিত অঞ্চলে তিনি মেওয়াটি দস্যুদের কঠোর ভাবে দমন করে রাজধানীর নিরাপত্তা বজায় রাখেন। (৪) বাদাউনের নিকটবর্তী অঞ্চলের রাজপুত দুর্গগুলি ধ্বংস করেন এবং রাজপুত জমিদারদের সম্ভাব্য বিদ্রোহ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে সেখানে আফগান সৈন্য মোতায়েন করেন। (৫) পরবর্তীকালে বাংলার শাসনকর্তা তুঘরিল খাঁর বিদ্রোহ দমন করে বলবন নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে সমর্থ হন। (৬) অভিজাতদের গতিবিধির উপর লক্ষ রাখার জন্য তাঁর আমলে অসংখ্য গুপ্তচর নিয়োগ করা হত। (৭) তিনি অমুসলিমদের হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করার ব্রতী হলেও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়।

যাই হোক, যে দৃঢ়তার সঙ্গে গিয়াসউদ্দিন বলবন দিল্লির সুলতানিকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেন, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি সারাজীবনই অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকার ফলে সাম্রাজ্য বিস্তারের সুযোগ পাননি। স্বৈরতন্ত্রী শাসনকে তিনি দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করতে পারেননি। সন্দেহ ও অবিশ্বাস তাঁর বিচারবুদ্ধিকে মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল। সামরিক দক্ষতার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন তিনি রাখতে পারেননি। কিন্তু এই সমস্ত ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও বলবনের কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায় না। তিনি দিল্লি সুলতানির স্থায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সুলতানের চারটি প্রধান কর্তব্য। সেগুলি হল— (১) ধর্ম ও শরিয়তের অনুশাসন মেনে চলা, (২) অন্যায় কাজকর্ম বন্ধ করা, (৩) ধার্মিক ব্যক্তিকে সরকারি কর্মে নিয়োগ করা এবং (৪) ন্যায় বিচার করা। তিনি বলতেন— “রাষ্ট্রের গৌরব নির্ভর করে এমন এক শাসন ব্যবস্থার উপরে, যা জনগণকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করে তোলে।” দিল্লির বিখ্যাত সুলতান এবং উপমহাদেশে ভারতের প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাট সুলতান। গিয়াসউদ্দিন বলবন শাহ। গিয়াসউদ্দিন বলবনের প্রতাপকে বলা যায় ‘বাঘ আর গোরু এক ঘাটে জল খেত। সুলতান বলবন ছিলেন সে যুগের বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী শাসকদের অন্যতম।

বলবন ১২৬৬ থেকে ১২৮৬ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শাসন করেছেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ খান মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। আরেকপুত্র নাসিরউদ্দিন বুগরা খান বাংলার শাসক হিসাবে থাকা পছন্দ করতেন। তাই বলবন তাঁর পৌত্র কায়খসরুকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। তবে তাঁর মৃত্যুর পর অভিজাত ব্যক্তিরা কায়কোবাদকে সুলতান মনোনীত করে। ১৯৮৭ সালে গিয়াসউদ্দিন বলবনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই দাস বংশের পতন শুরু হয়।

1 Comment
Collapse Comments
গোলাম ছরোয়ার হোসেন October 21, 2023 at 7:04 am

মৃত্যু ১৯৮৭ সালে? নাকি ১২৮৭ সালে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *