জীবনের শেষ কোথায়
দুই বছর দীর্ঘ সময়–একটা কেস স্টাডির জন্য তো অবশ্যই। মরিয়ম যে একাত্তরের বীরাঙ্গনা, এর কোনো লিখিত তথ্য-প্রমাণ ছিল না। এ ব্যাপারে আগে থেকেই বীরাঙ্গনা অফিস দেউলিয়া। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর নতুন শাসকদলের উত্থান ঘটে। যে দেশে ক্ষমতার লড়াই মুখ্য, সে দেশে মহৎ কাজ সরল গতিতে চলতে পারে না। এদিকে দুর্গম পথের যাত্রী চিরকালই দুর্লভ। প্রাক্তন সমাজকর্মীরা পাততাড়ি গুটালেও এ থেকে মুক্তি পান না। ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চসহ বছরের আরো কয়েকটা দিন টিভির ক্যামেরার সামনে তাদের বসতে হয়। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও দেন কেউ কেউ খবরের কাগজে। তরুণেরা তাঁদের কথা অভিসন্দর্ভে কোড করে। কিন্তু মুক্তির হাত শূন্য–দেখা হওয়া মাত্র দৌলতদিয়ার রাধারানী বাইন মাছের মতো পিছলে বেরিয়ে গেছে। বেতনভুক সমাজকর্মী বেবি এসব দৃশ্যের বাইরে থাকলেও কিছু স্মৃতি সে টেবিলের কাঁচের ঢাকনার নিচে সংরক্ষণ করেছিল। সেই সুবাদে হয়তো মরিয়মের ঠিকানাটা তার মনে থাকে। পরে যা চলে আসে মুক্তির হাতে। সেখানে মরিয়ম আছে আবার নেই। কারণ তার পেছন পেছন নয় মাসের যুদ্ধের কাহিনি পদ্মা পার হয়ে চলে গেছে বহু দূর। মুক্তিকে সেই পথ ধরে এগোতে হচ্ছিল। নতুন অনুসন্ধানে দেখা গেল, যে রমিজ শেখ যুদ্ধের তৃতীয় মাসে পাকিস্তান জিন্দাবাদ আর জয় বাংলা স্লোগান দুটি আলাদা করতে পারেনি, সে একজন মৃত দেশপ্রেমিক। নতুনগাঁয়ের জৈতুন বিবি ফোকলা মুখে কথা কয়ে ওঠেন। মরিয়মের চাঁদপানা মুখ এখনো তার মনে আছে। তবে আশি বছরের বৃদ্ধা মনে করেন, মেয়েটি বড় অলক্ষুনে। তার শরীরের গন্ধ শুঁকে নতুনগাঁয়ে মিলিটারি এসেছিল। মন্টুর কবর পাকা করার মানত ছিল মরিয়মের। হানাদার বাহিনীর গাড়ির হেডলাইটের ওপর পতঙ্গের মতো মন্টুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছে মুক্তিযোদ্ধাদের গাইড, ভূমিহীন কৃষক আমিনুল। সে জানায়, যার লাশই পাওয়া যায়নি, তার কবর আসবে কোত্থেকে। বৃষ্টি আর বন্যায় তিরিশ বছরের ভাঙা কবর উদ্বাহু মুক্তিযোদ্ধা মজিবরের। কমলগঞ্জের ঘরজামাই আতা মিয়া, যে একের পর এক ব্যর্থ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে, অথচ এ নিয়ে কখনো দুঃখ করেনি, সে মেজর ইশতিয়াককে শনাক্ত করার একমাত্র দাবিদার। মেজর ইশতিয়াক তালাবন্ধ ঘরে। মরিয়মকে আটকে রেখে পালাতে গিয়ে গ্রামবাসীর ক্রোধানলে পড়ে এবং মরতে মরতে বেঁচে যায়। মরিয়মের উদ্ধারকারী মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল, যে পর্যায়ক্রমে যুদ্ধ আর মদে মাতাল, মরিয়মের শত্রু লাঞ্ছিত, দুর্গন্ধময় শরীরটা আজও তার মনে ঘৃণার উদ্রেক ঘটায়। এফডিসির সাইড একট্রেস বকুল বেগম, যার সঙ্গে মরিয়মের দেখাই হয়নি, হবেও না হয়তো কোনোদিন, বীরাঙ্গনা অফিস’ অধ্যায়ে যে হঠাৎ হাজির হয় আবার চলেও যায়, যাকে বাস্তবের চেয়ে সিনেমার চরিত্র বলেই বেশি মনে হয়, তার ব্যাপারে মরিয়মের কোনো আগ্রহই নেই। মেরি ওরফে মরিয়মের মুখে খালি এক কথা, মুক্তি, অনুরাধার সঙ্গে আমার একটা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করো। তোমার অফিস তো কত জনকে খুঁজে বের করেছে। দেখো না চেষ্টা করে–পারো কি না!’
‘কেন?’
‘ওর কাছে একটা কথা জানতে চাই আমি। আরেকটা ভবিষ্যদ্বাণী।’
‘কী সেটা?’
‘আমার জীবনের শেষ কোথায়, আমি জানতে চাই।’
দুই বছর পর হঠাৎ করে মুক্তির তখন দৌলতদিয়ার রাধারানীর কথা মনে পড়ে। যে হাত না দেখেই অন্যের ভবিষ্যৎ বলতে পারত, নিজের পরমায়ুও বলেছিল–একশ বছর, মরিয়মের জীবনের শেষ কোথায়, এমন এক ভবিষ্যৎ বক্তারই তো তা জানার কথা। মুক্তি দ্বিতীয় দফায় দৌলতদিয়া যাওয়ার কথা ভাবে। মরিয়ম বলে, ‘যেতে চাচ্ছ। যাও। আমি গণকফনকে বিশ্বাস করি না। আমার মা করত।’
না করুক বিশ্বাস মরিয়ম। রাধারানীর সঙ্গে মুক্তির অন্য কাজ আছে। তার সাক্ষাৎকারটা নিশ্চয় ব্যতিক্রমধর্মী হবে। টুকির উচ্চাকাঙ্ক্ষায় মুক্তিকেও পেয়ে বসেছে। আরো জবানবন্দি তার চাই যুদ্ধাপরাধের বিচারের আয়োজন করতে, যা তাদের গবেষণা প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য বা গৌল।
দৌলতদিয়ার মুক্তিকে দেখে হায় হায় করে ওঠে এনজিওকর্মী, ‘এত দেরিতে আইছেন, রাধারানী মইর্যা গেছে।’
বলে কী! ‘কীভাবে মরল?’
‘হার্টফেইল করছিল।’
মুক্তিও মনে হয় বিশ্বাস করেছিল, রাধারানীর একশ বছর পরমায়ু। কিন্তু এনজিওকর্মী তা বিশ্বাস করে না। সে বলে, ‘ধুর ধুর, শিক্ষিত মানুষ, কী কন, পাগল ছাগলের মতো কথাবার্তা।’ এদিকে কুসুমকলি রাধারানীর একশ বছর পরমায়ুতে এখনো অটল। ‘রাধারানী মরলো ক্যামনে’ মুক্তি জানতে চাইলে সে বলে, ‘মদের মইধ্যে বিষ মিশাইয়া দিছিল। নইলে অত সহজে মরণ হয় রাধারানীর! ওর একশ বছর পরমায়ু ছেল।’
‘কে করল কাজটা?’
পতিতালয়ে শত্রুর অভাব! ভালোবাসাবাসির পীঠস্থান বেশ্যাপল্লি। সংসারে প্রেমের ভাটা পড়লে পুরুষমানুষ ভালোবাসা খুঁজতে আসে এখানে। সঙ্গে নিয়ে আসে হিংসা-বিদ্বেষ-সন্ত্রাস। এই ‘এক বচ্চরে, জানেন, কয়জন বেশ্যা খুন অইছে এই পতিতালয়ে? জোছনা, পিরিয়বালা…’ কুসুমকলি একদিকে আঙুলের গিঁট গোনে আরেক দিকে মৃত বেশ্যাদের নাম স্মরণ করার চেষ্টা করে। এই ফাঁকে এনজিওকর্মী বলে, ‘মোট পাঁচজন।’
‘তুমি রাধারানীরে বাদ দিয়া গুনছো!’ এনজিওকর্মীর ওপর রেগে টং কুসুমকলি। একজন মনে করে, রাধারানী খুন হয়েছে, আরেকজনের দৃঢ় বিশ্বাস–এ স্বাভাবিক মৃত্যু। দুজনের মাঝখানে পড়ে গেছে মুক্তি। তার মধ্যস্থতা আবশ্যক—‘রাধারানী যে খুন অইছে আপনে শিওর?’ কুসুমকলি ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘শিউর শিউর একশবার শিউর। হাজারবার শিউর।’
রাধারানীর মৃত্যুর চার দিন আগে দৌলতদিয়ায় দুজন মাঝবয়সি খদ্দের আসে। এসেই পাশাপাশি দুটি ঘরে ঢুকে পড়ে। এদের দেখলে মনে হয় যমজ, আসলে আজরাইল-রাধারানীর জান কবজ করতে এসেছিল। তারা বেরিয়ে যাওয়ার সময় রাধারানী মাতাল অবস্থায় তাদের সামনে পড়ে যায়। তখন যমজ বা আজরাইল একজন বলে, ‘এই তুমি অনুরাধা না? বি কে সরকারের মাইয়্যা! যে লোয়ার কোর্টের উকিল ছিল।’
মুক্তির বুক কেঁপে ওঠে। ওদিকে তখন রাধারানীর নেশা ছুটে গেছে। সে বলে, ‘না, আপনেরা ভুল করতাছেন, আমি রাধারানী। বাপের নাম খেদমত আলি। হে চৌকিদার ছিল। বর্তমানে মৃত।’ এক নিঃশ্বাসে কথা কটা বলে রাধারানী ঘরে ঢুকে খিল তুলে দেয়। সে সময় রাধারানীর জন্য কলাপাতায় শুঁটকি মাছের চচ্চড়ি নিয়ে আসছিল কুসুমকলি। গলির মুখে যমজ দুজনের সঙ্গে দেখা। তারা তখন বলাবলি করছিল, ‘অনুরাধা সরকার পাড়ায় আইয়্যা রাধারানী অইছে। হের ত্যাজ দ্যাকছো? আবার মদও খায়!’ কুসুমকলি আগামাথা কিছু না বুঝে শুঁটকির চচ্চড়ি হাতে রাধারানীর দুয়ারে ধাক্কা দেয়। অহ্ রাধে, ‘অহ্ রানী, দুয়ার খোল দিনি! তোর চাট বানাই আনছি।’ রাধারানী দুয়ার খোলে না। পাশের ঘর থেকে দুজন বেশ্যা তখন বেরিয়ে আসে। তাদের যমজ সোয়ামিরা যে হাটে হাঁড়ি ভেঙে গেছে, কুসুমকলি তখন তা। সবিস্তারে জানতে পারে। রাধারানীর মারা যাওয়ার দিন বিকালে যমজরা ফিরে আসে। হাতে বিলাতি মদের বোতল। এবার তারা বেশ্যা দুটির ডাকাডাকি অগ্রাহ্য করে সরাসরি রাধারানীর ঘরের দিকে চলে যায়। তারপর ঘরের মধ্যে খুব চিল্লাফাল্লা হয়। যমজরা চলে যাওয়ার পর সেই রাতেই রাধারানী হার্টফেল করে।
মরিয়ম বিশ্বাস করে না। অনুরাধাকে এ তিরিশ বছর সে মৃতই ধরে নিয়েছিল। মৃত্যুসংবাদটা তাই নতুন কিছু নয়। কিন্তু কেউ কি নিজের ভবিষ্যদ্বাণী ফলানোর জন্য জোর করে রান্ডি হয়? মুখে বলে, ‘ওর মতো শিক্ষিত মেয়ে বীরাঙ্গনা বলে বেশ্যা হয়ে যাবে? ওর কি ভাত-কাপড়ের অভাব ছিল?’
‘কিন্তু সে বেশ্যা হয়ে গেছিল তো।’ মুক্তি জোর দিয়ে এই কথা বললে মরিয়ম মাথা নাড়ে, ‘না না, তুমি ভুল করছো।‘ তারপর ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে অনুরাধার চোখে চশমা ছিল কি না জানতে চায়। মুক্তি বলে, ‘ছিল। তবে ডাঁটিভাঙা। পাটের দড়ি দিয়া মাথার চুলের সঙ্গে বেঁধে রাখছিল।’ মরিয়ম তাতেও ভড়কায় না। যে অনুরাধা একদিন অনুসন্ধানকারী দলের কথা বলত, যারা ওর হাড়গোড়, ছেঁড়া কাপড়চোপড়, চুলের গোছা নির্যাতন শিবির থেকে উদ্ধার করবে, তাকে ভুলে যেতে দেবে না, অমর করে রাখবে, যুদ্ধের তিরিশ বছর পর মারা গিয়েও সে স্বাধীন বাংলাদেশে গোর পেল না, তার মৃত দেহটা ভাসিয়ে দেওয়া হলো পদ্মায়–এ কাহিনি শোনার পরও মরিয়ম একইভাবে মাথা নাড়ে। ‘না না, তুমি মেয়ে নিজেরে কী ভাবো? নিজে তুমি দেশ-দশের ওপর রাগ করে বেশ্যা হইবা? বা এমন কেউ বেশ্যা হবে, যার ভাত-কাপড়ের অভাব নাই, যে শিক্ষিত? তোমার ভুল হতে পারে না! এক নামে। দুনিয়ায় বহুৎ মানুষ থাকে। এই বেশ্যা অন্য কেউ।’
মুক্তি মুখ ফুটে বলে না যে, এই মেরি ওরফে মরিয়মও একদিন বেশ্যা হওয়ার চিন্তা করেছিল, মমতাজের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার সময়, যদিও সে শিক্ষিত, তার ভাত-কাপড়ের অভাব ছিল না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তা-ভাবনাও কেমন বদলে যায়।
তাদের কথাবার্তার মাঝখানে টুকির মোরগ-মুরগি উঠান থেকে বারান্দায় লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। অনুরাধার মৃত্যুসংবাদে যেন মানুষ নয়, কতগুলো অবোধ প্রাণী এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। সন্ধ্যালোকে এ বাড়িটার রং ধূসর, বিস্মৃতকালের প্রাসাদের মতো মলিন, বিবর্ণ। মরিয়ম গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। টুকি দেশের বাড়ি গেছে আজ চার দিন। দিন শেষে মোরগ-মুরগিদের আধার খাইয়ে খোয়াড়ে তোলার কাজটা এখন তাকে করতে হবে।
বহু বছর পর টুকি বাড়ি গেছে একটুখানি জমি ক্রয় করতে। তার পরিকল্পনা–নিজের জায়গায় পুষ্করিণী খুঁড়ে কয়টা মাছ ছাড়বে, পুকুরের তিন পাড়ে গাছ লাগাবে, আরেক পাড়ে হাঁস-মুরগির খামার। এ ছাড়া দামে বনলে নিজের কবরের জায়গা খরিদ করে টুকির এবার ঢাকায় ফেরার ইচ্ছা। স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় তাকে গ্রাম থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। নিজের বাবা-মাও চায়নি সমাজে কলঙ্কিনী হয়ে এ মেয়ে বেঁচে থাকুক। মানুষের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রথম টুকির বাবা বঁটিতে শান দেয়। তবে নিজের হাতে মেয়েকে খুন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরের বার মা বদনায় বিষ গুলে তার গালের ভেতর ঢেলে দিয়েছিল। মায়ের রাতদিন এক কথা, ‘তোরে বাঁচায় রাইখ্যে কিনো লাভ নাই। তুই মর!’ টুকি যখন মরো মরো, তখন ওর চাচি নাকের কাছে ঘেঁড়া জুতো ধরে, আর চাচাতো বোন যায় দায়ের আগায় করে মানুষের বিষ্ঠা তুলে আনতে। জুতোর গন্ধে আর গু খেয়ে বমি করে পেটের বিষ বের করে দিয়েছিল টুকি বেগম। তাকে হাসপাতালে নিতে হলে পথেই মারা পড়ত। সেই চাচি আর চাচাতো বোন দুদিন পর তাকে রওনা করে দেয় ঢাকার পথে।
বর্তমানে টুকির বাপ-মা দুজনেই বিগত। সে ভেবেছিল, আজ ছাব্বিশ বছর পর বাড়ি যাচ্ছে, লোকজন তাকে চিনতে পারবে না অথবা চিনলেও বীরাঙ্গনার সম্মান দেবে। কিন্তু সেখানে তার অভিজ্ঞতাটা হয় তিক্ত। ‘আরে টুকি বেগম, তুই পাড়া থেইক্যে কবে আলি?’ বাড়ির সীমানায় ঢোকার মুখে একজন তাকে গায়ে পড়ে জিগ্যেস করে। টুকি কিছু বোঝার আগে অন্য জন জবাব দেয়, বয়স হয়েছে তো, পাড়ার থে রিটায়ার করছে। গ্রামের লোকেরা তার কাছে জমির দাম হাঁকলো ডবল আর টাকা নিয়েও কবরের জায়গা বেচতে রাজি হলো না। জমি ও কবরের জায়গা কিনতে ব্যর্থ হয়ে টুকি ঢাকা ফিরে এসেছে।
টুকির ভাগ্যটাই খারাপ। জীবনে একটা গণ-আদালত চাইল–হলো না। আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ চাইল, তারও সম্ভাবনা নেই। বাকি জীবন গৃহস্থ হয়ে কাটাতে চেয়েও সে ব্যর্থ হলো। মরলে যে কবরে শোবে, নগদ টাকা দিয়েও সে তা কিনতে পারল না। ঢাকা ফিরে টুকি বেগম সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে। মরিয়ম দশবার জিগ্যেস করলে, একবার জবাব দেয়, কখনো দেয়ও না। কী মুশকিল! মরিয়ম নিজেকে সামলাবে না টুকিকে দেখবে? অনুরাধার বিষয়টা তাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। জীবন নাটক-সিনেমার চেয়েও আজব। সে বিশ্বাস করবে কি করবে না? বিশ্বাস করলে নিজে সে দাঁড়াবে কোথায়? যে দেশে বীরাঙ্গনা মরলে কবর পায় না, সে দেশে হবে যুদ্ধাপরাধের বিচার! দুই বছর ধরে মুক্তিকে জবানবন্দি রেকর্ড করতে দেওয়াটাই তার ভুল হয়েছে।
এসব চিন্তা যার মাথায় আসে, তার রেগে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। মরিয়ম দেখে, সে রেগে যাচ্ছে, তবে টুকির ওপর।
অবশেষে টুকি একদিন মুখ খোলে–
‘বেশ্যা না হয়েও বেশ্যা হয়ে গেলাম। কী সার্থকতা আমার জীবনের! আজীবন কুমারী থাইক্যে কী লাভ হলো।’
‘কে কুমারী?’
‘কেন আমি! তুমি তো দু-দুটি বিয়ে করেছ। আমি করিছি?’
‘কিন্তু তোমার না একটা বাচ্চা হইছিল মিলিটারি ক্যাম্পে?’
‘হইয়েছিল তো কী? তখন কি আমার স্বামী আছিল, না মন থাকি আমি চাচ্ছিলাম যে, আমার একটা বাচ্ছা হোক? এ তো অত্যাচারের ফসল।’
চাক বা না চাক, বাচ্চা হওয়ার পর কেউ যে কুমারী থাকে না–এ কথাটা মরিয়ম বোঝাতে গেলে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়ে যায়। কথাবার্তা বন্ধ। মুক্তি বাড়ি গেলে, টুকি আঙুল তুলে বন্ধ ঘর দেখায়, ‘খিল দিয়া পড়ি রইছে। দুয়ারে বাড়ি মারা নিষেধ।’ কী ব্যাপার? মরিয়ম কি অনুরাধার জন্য শোক পালন করছে? মহিলা মারা গেছে এখনো চল্লিশ দিন পুরো হয়নি। এত্তেকাফে বইছে মনে লয়, টুকি বলে। এই বেলা আল্লার বন্দিগি না করলে করবে কবে! সময় তো শ্যাষ। কিন্তু পরের বার মুক্তি গিয়ে শোনে, মরিয়ম দৌলতদিয়া গেছে এবং সেখানে সে প্রায়ই যায়, অনুরাধার ছোট মেয়েটার জন্য জামাকাপড়, কলম-পেনসিল, বইখাতা নিয়ে। তাতে বিশেষ লাভ হচ্ছে না। অনুরাধার মেয়ে নয় বছরের চম্পাবতাঁকে ব্যবসায় নামিয়ে দিয়েছে কুসুমকলি। চম্পাবতী তাতে অমত করেনি। সে এখন হাসি মুখে গরু মোটাতাজাকরণের ইঞ্জেকশন নিচ্ছে।
টুকিও এক-দুইবার দৌলতদিয়া গেছে মরিয়মের সঙ্গে। জায়গাটা তার পছন্দ হয়নি, ‘এমুন জায়গায় সুখ আছে তয় শান্তি নাই। এত হইচই, যেন বছরচুক্তি মেলা বসাইছে।’ ব্রথেলে ঢুকেই তার পালাই পালাই ভাব। এদিকে মরিয়মের ইশারা পেয়ে কুসুমকলি টুকিকে বলে, ‘বুইন, তুমারে আমি একটা কমিডি দেখাই, মনে ফুর্তি লাগবে তোমার।’
ঘরের মাঝখান থেকে ট্রাংক, চেয়ার, টেবিলফ্যান সরিয়ে মঞ্চ তৈরি হয়। কুসুমকলি পরনের শাড়ি কোমরে প্যাঁচ দেয় শক্ত করে। এ তার একক অভিনয়, নৃত্যগীত সহযোগে–
এক ধনী রাজা থাকে, রাজার দুটি স্ত্রী থাকে, রাজা বৃদ্ধ। বড় স্ত্রী থুয়ে, নাতি নাতনি রাইখ্যাও সে আবার বিয়া করে। আমার রূপ দেখে সে পাগল হয়া যায়। পাগল হয়া সে আমারে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি গরিবের মেয়ে থাকি, একটা ঝিয়ের মেয়ে থাকি। ধন-সম্পদের লোভে আমার মা ওই বুড়া রাজার সাথে আমারে বিয়া দেয়। আমার বাবা থাকে না। বুড়ার নাতি থাকে চন্দন কুমার। দাদু তো বুড়া মানুষ, আমি চ্যাংড়া মানুষ, দাদুর বউ হইয়্যা আমি তার নাতির সাথে প্রেম করি। গোপনে গোপনে প্রেম করি। এক রাইতে আমি বাগানে চলে যাই। বুড়া ঘরে আইস্যা পায় না আমারে। না পায়া হরিকল আর লাঠি নিয়া খুঁজতে খুঁজতে দেখে যে, আমারে পাওয়া গেছে। স্টেজে তখন একটা টেবিল থাকে। টেবিলের নিচে পর্দা থাকে। তখন চন্দন যায়া টেবিলের নিচে পলায়। বুড়া কচ্ছে কী, তুমি এখানে রয়েছ গিন্নি, আমি খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাচ্ছি। আমি বুড়া রাজাকে ল্যাং মেরে ফেলায় দিয়ে একটা গান ধরি–আমি তুমার ভাত খামু না। তুমার বাড়ি আর যামু না। তোমার সংসারেতে খাইট্টা মলাম বুড়া, তুমি পরনেতে, হায় হায় পরনেতে, ও পরনেতে ভালো একখান রঙিন শাড়িও দিলা না। তুমার বাড়ি আর যামু না।
তখন বুড়ার মনে আবার সাধ জাগে, বুড়া রাজা তখন কয়–এবার আমি চাকরি পামু, ও সোন্দরি তোমায় নিয়া যামু গো, কত সাজনকাজন, হায় হায় সাজনকাজন, কত সাজনকাজন আলতা দিমু কেন তুমি যাইবা না…
তোমার বাড়ি আর যামু না।
বুড়া যাইয়া আসনে বসে। আরেক চেয়ারে বসি আমি। বসার পর বুড়া রাজা ওই টেবিলের নিচ দিয়া পা ঢুকায় দেয়। ঢুকাই দিয়া বলছে যে, আচ্ছা গিন্নি ও ছোট গিন্নি! ওই টেবিলের নিচে লড়ে কী? আমি কই, ওহো লড়ে কী! ওহ্ মনে পড়ছে। বাড়ির পাশ দিয়া চাল কুমোড় যাইতে লাগছিল গো। পাকা চাল কুমোড় তাই টাকা দিয়া কিনে রাখছি। তো বলছে চালকুমড়ো লড়ছে কেন? আমি বলছি, তুমি পাও দিয়া লড়াচ্ছো, একটার গায়ে একটা ধাক্কা খাচ্ছে, তারি জন্য লড়ছে। তখন বুড়া আঙুল ঢুকায় দেয় চন্দন কুমারের শরীলে। ও গিন্নি নরম কেন? আমি বলছি, তালি বোধ হয় একটায় পচন ধরেছে।
চন্দন কুমার তকন পিছ দিয়া বার হইয়্যা দৌড়ে পালায়।
কাহিনিটা টুকির পছন্দ হয়। কুসুমকলি মহিলাটাও খারাপ না। তবে বেলা পড়ে গেছে। তাদের ঢাকা ফেরা দরকার।
পরের বার দৌলতদিয়া যাওয়ার সময় ফেরিতে ওঠার আগে মরিয়ম টুকিকে নিয়ে চলে যায় অন্যদিকে। সেখানে গিয়ে মাঝিমাল্লার সঙ্গে সে মুলামুলি করে। কত বড় সাহস নৌকায় করে পদ্মা পারাপার! মরিয়ম মুখ টিপে হাসে-কেন যুদ্ধের বছর তো বরিশালগামী ধানকাটার মজুরদের নৌকায় করে সে পদ্মা পার হয়েছিল। কিন্তু তখন। ছিল যুদ্ধের সময়। ফেরি চলাচল বন্ধ। মিলিটারি যাতে ব্যবহার করতে না পারে আইডব্ৰুটি-এর মোটরযানগুলো ঘাট থেকে আগেভাগে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এখন পারাপারের লঞ্চ-ফেরি থাকতে নৌকা ভাড়া করে কোথায় যেতে চায় মরিয়ম? টুকিকে সে ভেঙে কিছু বলে না। পীড়াপীড়ি করতে বলে, ‘মাঝিমাল্লার আয়-ব্যয়ের হিসাব নিচ্ছিলাম।’ কেন? ‘এম্নি এম্নি।’
মুক্তি অফিসে খোঁজ নিতে গিয়ে শোনে, সেখানে মরিয়ম অনেকদিন যায় না। একটা হাতে লেখা পদত্যাগপত্র দাখিল করে এসেছে বহুদিন আগে। তা গৃহীত হয়েছে। কি হয়নি, খোঁজ নিতেও সে আর যাচ্ছে না ওদিকে।
আরেক দিন মরিয়মের বাড়ি গিয়ে মুক্তি দেখে, টুকি এটা-সেটা গোছগাছ করছে। তাকে দেখেই মিটিমিটি হাসে, ‘আপনে বসে খানিক বিশ্রাম করেন, মেরি আফা দুলুদিয়ায়।’ কখন ফিরবে, টুকি জানে না। মুক্তি বসে আছে। টুকির হাতে প্রচুর কাজ। একসময় উঠে গিয়ে টুকিকে সে জাল পেতে মুরগি ধরায় সাহায্য করে। হাতে হাতে তারা মোরগ-মুরগির পায়ে দড়ি পরাচ্ছে। মুক্তি কেমন ধন্ধে পড়ে যায়। জোড়ায় জোড়ায় মোরগ-মুরগির পায়ে দড়ি পরাচ্ছে কেন টুকি বেগম, ওর কি পুরোনো বাতিকটা ফিরে এসেছে? ফেরিঅলার কাছে লুকিয়ে লুকিয়ে মুরগি বেচে দিচ্ছে? টুকি আবার মিটিমিটি হাসে, ‘মেরি আফা কইল কাজটা করে রাখতি–তাই করছি।’ গোঁয়ারের হদ্দ যে টুকি, মরিয়ম বলেছে বলে কাজ করে যাবে, কথাটা ঠিক বিশ্বাস করার মতো না। মুক্তির জেরার মুখে বলবে না বলবে না করেও টুকি কয়েকটা কথা বলে ফেলে। মাল টানার জন্য সওয়ারি নাও ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, তাই মেরি আফা অফিস থেকে টাকা তুলে নতুন একখানা নৌকার বায়না করতে গেছে আরিচায়। মুক্তি চমকে ওঠে-মরিয়মের স্বপ্নেও তো বারবার দেখা দেয় একটা নতুন নৌকা, যা পাল উড়িয়ে তাকে পারাপার করছে। কিন্তু মোরগ-মুরগির পা বাঁধার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী? ‘সম্পর্ক নেই মানে?’ টুকি অবাক আর বিরক্ত হয়, ‘আমরা চলি গেলে এ বেচইন দুনিয়ায় মোরগ-মুরগি ক’খান পড়ে থাইকবে?’
‘মোরগ-মুরগি সঙ্গে নিচ্ছেন, আমারে নিবেন না?’ মুক্তি মশকরা করে। টুকি সিরিয়াস-তার মেরি আফা একমাত্র বলতে পারবে, তার জীবনকাহিনি যে লিখছে, তাকে সঙ্গে নিতে চায় কি না। তবে কথা হলো, কাছের মানুষ হলেই যে সঙ্গে নেওয়া যাবে, এমন কোনো কথা নেই। মহা প্লাবন শুরু হয়ে গেল, হজরত নুহ (আ.) খোদার অবাধ্য পুত্রকে নৌকায় তুলতে পারলেন না। তার ওপর খোদাতালার কড়া নির্দেশ ছিল–তোলার রহমানির রাহিম বলেছিলেন, দেখো রে নুহ নবি, তোমার পাপ পুত্রের জন্য ফের সুপারিশ করছ কি তোমার নবুওয়াতি চলে যাবে।
টুকির ভাবগতিকে মনে হয়, এই পাপীতাপীর দুনিয়ায় একমুহূর্তও মন টিকছে না তার। যতটুকু না পারলে নয় ততটুকুই সঙ্গে নিচ্ছে। ব্যাপারটা আর হেঁয়ালি মনে হয় না মুক্তির। কিন্তু এরা যাচ্ছে কোথায়? খাওয়া-পরার তো অভাব নেই যে, দৌলতদিয়া চলে যেতে হবে। তার পরও গেল না-হয়, কিন্তু বয়স যাদের পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে, তারা বেশ্যাপল্লি গিয়ে কী করবে। টুকিকে এসব প্রশ্ন করা নিরর্থক। সে হয়তো ভালো করে জানেও না, তাদের এ যাত্রাপথের শুরু বা শেষ কোথায়।
মরিয়মের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না মাসাধিক কাল হয়ে গেল। সে মুক্তিকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। মুক্তি ঘরে ফিরে ভাবে, যে একটা উদ্দেশ্যহীন জীবনের লগি তিরিশ বছর টেনেছে, সে কি এর শেষ দেখার জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠবে যে, একটা ডেডবডির পেছনে নৌকা নিয়ে ধাওয়া করবে? এ পাগল ছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে? অথবা মালসামান নৌকায় তুলে মরিয়ম আর টুকির দৌলতদিয়া চলে যাওয়া যে অসম্ভব নয়, কুসুমকলি তাদের সাহায্য করতে পারে–তা-ও তার বিশ্বাস হয় না। সে ভাবনা দুটিকে শুধু চোখ ঠারে আর অন্য চিন্তা করে–অভিযোগকারী ছাড়া যুদ্ধাপরাধের বিচারসভা ঠিকভাবে চলতে পারে না, তা প্রতীকী হোক আর আসলই হোক। মরিয়মকে আরো কয়েকটা দিন তার দরকার ।
মুক্তি তখনো জানে না যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার দূরে থাক, কাহিনিটাও অসমাপ্ত রেখে মরিয়ম একদিন চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে, আর সে অর্থাৎ মুক্তি, যে পাঠকদের আস্থা অর্জনের জন্য সাক্ষাৎকার গ্রহণের শুরু থেকেই সচেষ্ট ছিল, কখনো কখনো অসহায়ের মতো হাল ছেড়ে দিলেও নানান জনের কথা কেটেকুটে জোড়াতালি দিয়ে শেষতক বাস্তবের কাছাকাছি থেকেছে, তার একদিন সান্ত্বনা পেতে হবে, এমন একটি নৌভ্রমণের গল্প ফেঁদে, যা হবে তার নিজেরই তৈরি। মরিয়ম ও টুকি নিরুদ্দেশ হওয়ার বছর ছয়েক পর, রায়েরবাজারের বাড়ির জায়গায় চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি ওঠে। তাতে পাশাপাশি একজোড়া কালো গেট। সাং ফুলতলি, ডাকঘর সাহারপাড় ঠিকানাসহ কফিলউদ্দিন আহমেদের নাম মুছে লেখা হয়েছে রত্না ও ছন্দা-আলাদাভাবে দুটি গেটে যমজ দু’বোনের নাম। মেরি ওরফে মরিয়ম কোথাও নেই। ছিল যে, তারও কোনো সাক্ষীসাবুদ আর থাকল না। তার পরও লেখাটি হয়তো পাঠক বিশ্বাস করত, যদি এ কাহিনি এক অলীক নৌযাত্রায় শেষ না হয়ে, হতো দুনিয়ার জমিনের ওপর।