যোদ্ধা
‘কেয়া, ডর লাগতা হ্যায়?’
‘না স্যার, নেহি।’ বুক টান করে মেজর শর্মার প্রশ্নের জবাব দেয় মন্টু। মেজর এগিয়ে যান ফল ইন-এ দাঁড়ানো পরবর্তী যোদ্ধার দিকে। আজ তাদের প্রথম অপারেশনের দিন। শত্রুর দখলকৃত স্বদেশে তারা ঢুকবে এলএমজি, গ্রেনেড, রাইফেল হাতে। ছেলেদের চেকআপ শেষ করে মেজর এবার বক্তৃতা দিচ্ছেন। মন্টু বুক থেকে পুরো বাতাস বেরিয়ে যেতে দেয় না। প্রাণপণে ধরে রাখে। যাতে মি. শর্মা বক্তৃতা দিতে দিতে অনেকগুলো ছেলের মাঝখানে তার ফোলানো বুকটা দেখতে পান। আর এ কাজে মন্টুর অনেকখানি মনোযোগও ব্যয় হয়। মেজর যোদ্ধাদের তখন তাতাচ্ছেন। মন্টু বুকে দম আটকে মেজরের কথাগুলো মনে মনে মাতৃভাষায় উচ্চারণ করে-বাচ্চারা, মনে হিম্মত রাখো, সাহস রাখো। যুদ্ধ ছাড়া দেশ স্বাধীন করা যায় না। শত্রু তোমাদের জন্মভূমি নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। তোমাদের মানুষদের মারছে। কুকুর-বিড়ালের মতো। তোমাদের মা-বোনদের ইজ্জত লুঠ করছে।
মন্টুর পশমহীন মসৃণ বুকটাতে ভূমিকম্পের কাঁপন। অতি কষ্টের আটকে রাখা বায়ু বুক তোলপাড় করে গলায় ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যায়। মার্চ মাসের পর এপ্রিল চলে গেছে, মেরিবুর খবর নেই। মা মাঝরাত্তিরে উঠে ঘর-বাহির করেন। বাড়িতে কান্নাকাটি নিষেধ। আব্বা সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ‘ঢাকায় এখন একটা কুত্তাবিলাইও নাই।’ শহর থেকে পালিয়ে আসা লোকদের কাছে এসব কথা শুনে গাঁয়ের মানুষ জানতে চায়, ‘মেরি কই? হে কি বাড়ি আইছে, না ঢাকায় রইছে?’ মা অনেক দিন ‘মেয়্যেটা আমার ছোডু ভাইয়ের বাসায়, দোয়া কইরেন গো, বড় আদরের মেয়ে আমার,’ বলে বলে চালিয়েছেন। তখন তারাও বলত ‘দোয়া করি মা গো, আল্লাহ্ যান সহি সালামতে রাহে আপনের মাইয়্যাডারে।’ গোলাম মোস্তফার সপরিবারে গায়ে আসার পর জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায়। মায়েরও গায়ের লোকদের বলার মতো কিছু থাকে না, লুকিয়ে কান্নাকাটি করা ছাড়া। মেয়েটা চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল–বড়। আদরের মেয়ে গো আমার।
‘তোমরা প্রতিশোধ নাও,’ মন্টু শোনে মেজর শর্মার উত্তেজিত স্বর। এখন বক্তৃতা প্রায় শেষ পর্যায়ে। তিনি বলছেন, ‘ডোন্ট বি অ্যাফরেড। হামলোক তুমহারা সাথ হ্যায়। তুমকো মদদ করে গা। অল শর্টস অব হেলপ। দেখো, একদিন না একদিন তুমহারা দেশ স্বাধীন হোগা। ইয়ে হোনে চাইয়্যে। গুডলাক সান। জয় বাংলা।’
সেই রাতে বর্ডার পেরিয়ে মন্টুদের দল রাজাকার ধরার অভিযান চালায়। রাজাকারকে বাড়ি না পেয়ে তার টাটু ঘোড়াটা ক্যাম্পে নিয়ে আসে। এর পিঠে চড়ে লোকটা ধানের মৌসুমে ভিক্ষা করতে বেরোত। ফেরার সময় তারা পাঁচটা গ্রেনেডের চারটাই ভিক্ষুকের খালি উঠোনে ছোড়ে। যার একটাই শুধু ফাটে বিকট শব্দে। তারা ছুটছে, সঙ্গে ঘোড়াটাও। দেশের মাটিতে ক্ষণকাল তিষ্টানোরও সাহস নেই তাদের। তাড়াহুড়োয় গ্রেনেডের পিন খুলতেও ভুলে গিয়েছিল। ভারতের সীমানায় ঢুকে তবে তারা দৌড়ানো থামায়। ভাবে, তারা চোর, ঘোড়া চোর। আর চোরের মতোই হয়েছে তাদের প্রথম দিনের অপারেশন।
‘অ্যাই করে হবে যুইদ্ধ, দেশ স্বাধীন হইব এইভাবে?’ তিরস্কারটা করেন স্বয়ং প্লাটুন কমান্ডার। একই প্রশ্ন অপারেশনে যাওয়া ছেলেদেরও। তবে তারা এজন্য খুশি যে, জানটা হাতে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরতে পেরেছে। একজনও খোয়া যায়নি। নিজের দেশ যে এত ভীতিকর–জানা ছিল না। ভারতের প্রশিক্ষণ-শিবিরে থাকার সময় শুধু ভেবেছে, কবে মশা আর জোঁকের কামড় থেকে রেহাই পাবে, আধপেটা খেয়ে শারীরিক কসরতের দিন ফুরাবে কবে, কখন স্বদেশে ঢুকবে একজন পরিপূর্ণ যোদ্ধার মতো অস্ত্র হাতে। এর মধ্যে তাদের গায়ের চামড়া পুড়ে তামাবর্ণ ধারণ করেছে, পেশিতে নীল শিরার নকশা ফুটেছে আর মুখ ঘিরে আছে না-কাটা দাড়ি-গোঁফের বিশৃঙ্খল জঙ্গল। পরিবর্তিত অবয়বের তলায় মনটাও ক্রমে বদলে যাচ্ছিল। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কারো এক মুহূর্ত তর সইছিল না।
প্রথমে তারা হতাশ হয় অস্ত্রের স্বল্পতা দেখে। পাকবাহিনীর আছে ট্যাংক, মেশিনগান আরো সব অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। এসবের বিরুদ্ধে রাইফেল, স্টেনগান, গ্রেনেড দিয়ে কত দিনে তারা দেশটা স্বাধীন করবে? তারপর সামান্য গ্রেনেড ব্যবহার করতে না পেরে ভীষণ দমে যায়। প্রতিশোধের আগুনটাও কখন যেন নিভে ছাই হয়ে গেছে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র এসব হতাশা, নৈরাজ্য বরদাস্ত করে না। তোমাকে মারতে বা মরতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। প্লাটুন কমান্ডারের এ রকম কড়া কথা শুনে একেক সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাদের পালাতে ইচ্ছা করে। পুরোনো দিনগুলো পেছনে টানে শার্টের আস্তিন ধরে। সেখানে ছিল পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করার মতো ক্লান্তিকর জীবন। কখনো কখনো প্রেমপত্র লিখে নাস্তানাবুদও তারা হয়েছে। প্রতারণা আর প্রত্যাখ্যানের ভুক্তভোগী দলের কম-বেশি সবাই। তখন আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো পথ দেখতে পায়নি। যুদ্ধের তোপের মুখে পুরোনো কষ্টগুলো বাতাসে উবে যায় । একঘেয়ে অতীতটা হয়ে ওঠে নানা বর্ণে উজ্জ্বল, স্বপ্নের মতো স্পর্শাতীত।
তত দিনে পুরোদমে বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। বেছে বেছে বৃষ্টির রাতগুলোতে অপারেশনের সময় ধার্য করা হয়। তারা গামছায় গ্রেনেড পেঁচিয়ে কোমরে বাঁধে, গায়ে চড়ায় অন্ধকারে মিশে যাওয়ার মতো গাঢ় রঙের শার্ট, কাঁধে ঝোলায় স্টেনগান বা রাইফেল, পরনের লুঙ্গিটা ভাঁজ করে হাঁটুর ওপর তুলে কোমরে গিঁট দেয়, তারপর একটুকরো পলিথিনে মাথা মুড়িয়ে খালি পায়ে বেরিয়ে পড়ে ক্যাম্প থেকে। শত্রুবাহিনী জোঁকের মতো সঁতসেঁতে বাংকারের গায়ে লেপ্টে আছে। গর্ত ছেড়ে বেরোনোর হিম্মত নেই। এই সুযোগে মন্টুরা অবরুদ্ধ স্বদেশের পথে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে চলে। যদিও তারা আসল শত্রুর মুখোমুখি তখনো হয়নি, বুঝতেও পারছে না স্বাধীনতা কত দূর, তবুও প্রতিটি পদক্ষেপে মাড়িয়ে যাওয়া জল-কাদা-ঘাস তাদের মনে হয় নিজেদের অর্জন। এমনকি বর্ষার মেঘ থইথই আকাশ, বাংলার আকাশটায়ও যেন শুধু তাদেরই অংশীদার আর ঘুটঘুঁটে অন্ধকার রাত তাদের একার সঙ্গী। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রমের সময় জীবনের মায়া ত্যাগ করার বিনিময়ে এসব তারা অর্জন করেছে। মৃত্যুতেও যা হাতছাড়া হওয়ার নয়। অস্ত্রের চেয়ে এই দখলদারি মনোভাবের শক্তি প্রবল। তা তাদের শহিদি প্রেরণা জোগায়, শত্রু খতমে উদ্বুদ্ধ করে।
সমস্যা হলো, অপারেশনের রাতে বেশিরভাগ সময় টার্গেট বাড়ি থাকে না। কী করে যেন আগেভাগে খবর পেয়ে পালিয়ে যায়। তবে মন্টুরা সেসব বাড়ি থেকে খালি হাতে কখনো ফেরে না। গরুটা, ছাগলটা দড়ি ধরে গোয়াল থেকে বের করে আনে। সেই সঙ্গে সংসারের টুকিটাকি জিনিস দিয়ে উঠোনে বসে বোঁচকা বানায়। যুদ্ধের ময়দানে এসব জিনিস কী কাজে দেবে জানে না, তবে লোভে পড়ে বা দালালদের শায়েস্তা করার জন্যই হয়তো মালসামান লুট করে। বা খালি হাতে ফেরার মধ্যে পরাজয়ের যে গ্লানি থাকে, লুটপাটের উত্তেজনায় সেটা চাপা পড়ে যায়।
ফেরার সময় প্রতিবার এক দুর্বোধ্য ভয় মন্টুকে তাড়া করে। তার সামনে যেন রাতের সেই রহস্যময় জলাভূমি, যা পেরিয়ে আর কোনোদিন বাড়ি ফেরা হবে না। সে দু’কলাম করে মার্চ করা মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝখানে অনবরত জায়গা বদলায়। লুটের মালামালের আড়ালে লুকোতে চায়। তারপর একসময় দেখে, সে সবার পেছনে। পেছনটা শূন্য, সামনে অন্ধকার। সেখানে কয়েকটা আলোর ফুটকি। তখন মুখ থেকে। গোঁ-গোঁ আওয়াজ নিঃসৃত হয়–সহযোদ্ধারা যার নাম দিয়েছে ভয়সংগীত। তার এই ভয় জয় করার জন্য দলনেতা যেদিন দালাল খতম করার হুকুম দেন, সেদিনও ফেরার পথে সে একই কাজ করে।
দলনেতা শরিফ ভাইয়ের নির্দেশ পেয়ে গর্বিত পায়ে এগিয়ে যায় মন্টু। এমন একটা গুরুদায়িত্ব জীবনে এই প্রথম, যা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও নয়। স্কুলে পড়ার সময় বোনের সঙ্গে যে শহরে চলে আসতে হয়েছিল, তাতে জোরজবরদস্তি ছিলই। কেউ একবার জিগ্যেসও করেনি, ‘কি রে মন্টু, শহরে যাবি, না গ্রামে থাকাটা তোর পছন্দ?’ শহরে মন্টুর অবস্থা দাঁড়ায় গাছের খোড়ল থেকে ছিটকে পড়া চোখ-না-ফোঁটা পাখির ছানার মতো, যারা একদিন তার হাতের তালুতে তিরতিরিয়ে কাঁপত। কত রাত সে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে! ওখানে মন্টু ছিল বোনের হাতের ক্রীড়নকতার ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাস। শেষমেশ সে যখন মিছিল-মিটিংয়ের উত্তপ্ত নগরীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল, প্রথমবারের মতো ভাবতে পেরেছিল এটি তার নিজের শহর, তখনই মরিয়ম তাকে জোর করে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। তার বড় হওয়াটা পরিবারের কেউ কখনো গ্রাহ্যই করেনি। এমনকি বাইরের লোকেরাও। এখানে সে যে একজন ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, সঙ্গের ছেলেরা তাকে একফোঁটাও দাম দেয় না। অবসর সময়ে ‘ডওরা মন্টু, রাইতে হিসি করে বিছানা ভিজায় দিস না কইলাম’ বলে বলে উত্ত্যক্ত করে। কেবল কমান্ডার শরিফ ভাই তাকে আজ যথার্থ সম্মান দিলেন। হাতে স্টেনগান দিয়ে বললেন, ‘কি রে, পারবি?’
পারব শরিফ ভাই, পারব–মাথা নেড়ে অস্ত্রটা হাতে নেয় মন্টু। তার মাত্র তিন গজ দূরে কয়েকটা আলোর ফুটকি–জ্বলছে-নিবছে। ভাই রে মন্টু, ভয় পাস না, এগুলো আলেয়ার আলো। সংসারে এদের অস্তিত্ব নাই রে ভাই। এরা মায়ার জালে জড়িয়ে পথিককে দিগভ্রান্ত করে, ভুল পথে টেনে নিয়ে হত্যা করে। এক-দুই-তিন শরিফ ভাইয়ের কণ্ঠস্বর যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসে। তিনি যেন অন্য কারো গলায় অর্ডার দেন, ‘মন্টু রেডি? ফায়ার ওপেন কর। বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যু।’ ঠা-ঠা-ঠা মন্টুর স্টেনগানের মুখ থেকে এক ঝলক আগুন বেরিয়ে যায় অট্টহাসি দিয়ে। আর উড়ে গিয়ে বিদ্ধ করে গাছে বাঁধা লোকটির বক্ষদেশ, কণ্ঠা, দাড়ি। নিমেষে দশাসই লোকটা পাখির ছানার মতো ছটফটিয়ে নিঃসাড় হয়ে গেল। এর আগে পানি খেতে চেয়েছিল পাখির মতোই চঞ্চু ফাঁক করে। সেই রাতের নায়ক মন্টু। শরিফ ভাই নিজ হাতে দিয়াশলাই জ্বেলে চারমিনার ধরিয়ে দেন। ফেরার পথে পিঠ চাপড়িয়ে বলেন, পিছিয়ে না পড়ে পাশাপাশি হাঁটতে। খানিকটা এগিয়ে ফের লুকোচুরি খেলা শুরু করে মন্টু। তারপর যথারীতি গোঁ-গোঁ ভয়সংগীত।
মুখে যে যা-ই বলুক, দলের সবাই যে সাহসীতা নয়। বিষয়টা ধরা পড়ে ভারত থেকে ক্যাম্প গুটিয়ে আসার দিন। এর আগে তারা ছিল অনুপ্রবেশকারী, আরেক দেশের বর্ডার ক্রস করে চটজলদি আক্রমণ চালিয়ে রাতের অন্ধকারে ফিরে গেছে। যুদ্ধের ভাষায় একে বলে-ইনফিলট্রেশন। কাজটা বেআইনি। যত দিন না ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ বাধানো হচ্ছে, ভারত তত দিন পাকিস্তানের ভূখণ্ডে যুদ্ধ করার জন্য লোক পাঠাতে পারে না। এ ছাড়া মন্টুদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে দেশের মধ্যে ঢুকে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করার জন্য। এর ফলাফল হাতে-নাতে পাওয়া যাবে না ঠিকই, তবে নানান রকম নাশকতামূলক কাজ করে শত্রুকে ব্যস্ত রাখার নামও যুদ্ধ। এতে করে শত্রুসৈন্যের কাজে বিঘ্ন ঘটবে। তারা বিরক্ত হবে। ভয় পাবে। পরিশ্রান্ত হয়ে পড়বে। মেজর শর্মার দীর্ঘ বক্তৃতায় ছেলেরা খুশি হতে পারে না। ভারতের এই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ কৌশলে তাদের ঘোর আপত্তি। তাহলে দেশটা স্বাধীন হবে কবে? মেজরের পক্ষে এর জবাবে কিছু ভেঙে বলা সম্ভব নয়, তা স্টেট সিক্রেট। তিনি ছেলেগুলোর ওপর বিরক্ত হন। এরা দেখা যাচ্ছে, দিনদুনিয়ার কোনো খবরই রাখে না! রাতের বেলা দু-চারটা দালাল খতম করে ভারতে বসে স্বপ্ন দেখে দেশ স্বাধীন করার! তিনি তাদের দুই ব্যান্ডের রেডিও কেনার পরামর্শ দিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে যান। পেছনে তার আদেশটা বহাল থাকে।
রেডিও কেনা হয়, তবে তা শোনার সময় বা ইচ্ছা কারো নেই। দিন থাকতেই পাততাড়ি গোটাতে হবে। সন্ধান করতে হবে নিরাপদ আশ্রয়ের। দুটি মিলিটারি ট্রাক বর্ডারের কাছাকাছি স্থানে মালসামানসহ মন্টুদের নামিয়ে দিলে তাদের অবস্থা দাঁড়ায় শরণার্থীদের মতন। পার্থক্য শুধু শরণার্থীরা যাচ্ছে ভারতে, তারা উল্টো ঢুকছে শত্রু আক্রান্ত ভূখণ্ডে। দৃশ্যটা সত্যিই বিরল। তা দেখতে আশপাশের দু’চার গায়ের লোক ছুটতে ছুটতে আসে। যেন সার্কাস পার্টি গ্রামে ঢুকেছে। ছোট ছোট ছেলেরা সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া। তাড়া করলে খিলখিলিয়ে হেসে পালিয়ে যায়, পরক্ষণে বন্দুকের ধাতব নলগুলো ছুঁয়ে দেখার জন্য পা টিপে টিপে ফিরে আসে। ভিক্ষুকের ঘোড়াটা সঙ্গে থাকলে একজন ভাবে, তারা নাজেহাল হতো কম। ঘোড়া আভিজাত্যের প্রতীক, এমনকি তা ভিক্ষুকের হলেও। ক্যাম্প গোটানোর সময় একজন প্রস্তাবটা দিয়েছিল। তার যুক্তি ছিল, যুদ্ধে ঘোড়সওয়ার বাহিনী থাকে না! আমরাও একে যুদ্ধের কাজে লাগাতে পারি। তত দিনে কয়েকজন ছেলে অশ্ব চালোনায় সুদক্ষ হয়ে উঠেছে। শরিফ ভাই রাজি হলেন না। উল্টো ঝাড়া এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিলেন-তোমাদের বোঝা দরকার, গেরিলা যুদ্ধ সম্মুখ-সমর নয়। তা করতে হয় নিঃশব্দে, শত্রুকে নিজের উপস্থিতি জানান না দিয়ে। তার জন্য খালি পায়ে জল-কাদা পাড়াতে পাড়াতে আমাদের আঙুলের চিপায় সাদা সাদা ঘা হয়ে গেল, পায়ের তলাটা চালনির মতো ঝাঁঝরা করে ফেলল পানিপোকারা। সহযোদ্ধা মজিবর গুলিবিদ্ধ হলো শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গ্রেনেড ছোঁড়ার সময়…
শরিফ ভাইয়ের এ এক দোষ, সব সময় বক্তৃতা শেষ করেন মজিবরকে দিয়ে। মজিবর তাদের বীরত্ব না ভুলের প্রতীক? এখন বোঁচকা-বাচকি নিয়ে দেশে ঢুকতে গেলে মজিবরের কবরের পাশ দিয়েই তাদের যেতে হবে। কেউ তাতে রাজি হয় না। দেশে ফেরার অন্য কোনো পথও নেই। তাই তারা কৌতূহলী জনতার মাঝখানে। গুটিসুটি বসে রাতের জন্য অপেক্ষা করে। রাত নামার পর অন্ধকারের আড়াল নিয়ে ভীতিকর জায়গাটা পেরিয়ে যাবে, যেখানে দলের প্রথম ক্যাজুয়ালটি শহিদ মুক্তিযোদ্ধা। মজিবর চিরনিদ্রায় শায়িত।
দুজন ছেলেসহ মজিবরকে মধ্যমগ্রামে পাঠানো হয়েছিল অস্থায়ী আর্মি ক্যাম্প রেকি করতে। সময়টা দুপুর-বিকালের মাঝামাঝি। পরিষ্কার-ঝকঝকে দিন। তার মধ্যে দু-তিনটা গ্রেনেড অবস্থা বুঝে ফাটাবে। সেই মতো স্টেনগান বাগিয়ে, মাথা নিচু করে, কোমর বেঁকিয়ে শত্রুর আস্তানার পঞ্চাশ গজের ভেতর ঢুকে পড়ার পর সেন্ট্রি টের পেয়ে গেলে শুরু হয় বৃষ্টির মতো অঝোর গুলিবর্ষণ। বাকি দুজন পাটখেতের আড়াল নিয়ে পালিয়ে আসে। মজিবর পজিশন নিয়ে স্টেনগানের ট্রিগারে চাপ দেয়। দু’বারের ব্রাশেই ম্যাগাজিন শূন্য। তখন পাটখেতের ভেতর দিয়ে না পালিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে গ্রেনেডের পিন খোলে। তারপর বর্শা নিক্ষেপকারীর মতো সামনে কয়েক পা দৌড়ে গ্রেনেড ছোড়ে এবং সে অবস্থায় গুলি খেয়ে স্থির হয়ে যায়। আশপাশের গাঁয়ের লোক গোলাগুলির শব্দে তখন পালাচ্ছিল। হঠাৎ গোধূলির আলোয় একজন মুক্তিযোদ্ধার উত্তোলিত হাত এবং দৌড়ের ভঙ্গিতে শূন্যে ঝুলে থাকার দৃশ্যটি তাদের নিশ্চল করে দেয়। আরেক দফা গুলিবর্ষণের আগ পর্যন্ত তারা যার যার জায়গায় দাঁড়িয়েই থাকে।
যুদ্ধের উনত্রিশ বছর পর মুক্তির কাছে মধ্যমগ্রামবাসী অভিযোগ করে বলে যে, স্বাধীনতার ভাস্কর্যগুলি ঠিকভাবে তৈরি হচ্ছে না শহরে। তারা মুক্তির কাছে এমন একটা পাথরে খোদাই মুক্তিযোদ্ধার বায়না ধরে, যে উদ্বাহু, শূন্যে স্থির, বাংলার মাটিতে যার খাই নেই। ‘কেন?’ মুক্তির প্রশ্ন শুনে তারা খানিক ভাবে। এরপর বলে, বাস্তবে এমন একজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধা তারা দেখেছে, যার স্মৃতি পাটগাছ বড় হয়ে মাথা ছাড়িয়ে গেলে তাদের মনে পড়ে। কারণ সে তো যুদ্ধ না করে পাটখেতে লুকোতে পারত। সেটা সে করেনি। কারণ সে মানুষ না, ফেরেশতা ছিল। আর চাওয়া-পাওয়ার হিসাবটা হলো মানুষের। মানুষ মরলেও দাবি ছাড়ে না। গাঁয়ের এক শহিদের মাকে দেখিয়ে তারা মুক্তিকে শেষের বাক্যটি বলে। তিনি অশীতিপর বৃদ্ধা, সোমত্ত ছেলে যুদ্ধে হারিয়ে উনত্রিশ বছর ভিক্ষা করে খাচ্ছেন। বাংলার মাটিতে তার ছেলের যে দাবি, তা সে ছেড়ে যায়নি। ছেলের হয়ে তিনি তা বহন করছেন। কবরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই বোঝা তাকে বইতে হবে।
জীবিত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মধ্যমগ্রামবাসীর গর্ব নেই। একসময় অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেও সমাজের আর দশজনের মতোই এখন। সবার মতো তাদেরও বয়স বেড়েছে। ছেলেমেয়ের বাবা হয়েছে, কেউ-বা নাতি-নাতনির দাদা-নানা। যুদ্ধের পর পর তাদের যে জেল্লা আর দাপট ছিল, দেখে মনে হতো এ গাঁয়ের ছেলে হলেও তারা যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করেছে, তারা গ্রামের গৌরব, বীর মুক্তিযোদ্ধা–এখন আর ওসব কিছু মনে হয় না। চোখের সামনে তাদের উত্থান-পতন দুই-ই দেখেছে। গ্রামবাসী। তখন দু-একজন চাল-গম-কম্বলের ডিলারি করে বিস্তর কামিয়েছিল। যে পথে টাকা এল, সেই পথেই গেল। ভোগ করতে পারল না। তবে রিলিফের সিমেন্টে তৈরি থানা কমান্ডারের দালানবাড়িটা এখনো অক্ষত আছে। সরকার বদলের সঙ্গে দলবদল করে করে সে এখন দু-দুটি কোল্ড স্টোরেজ আর পেট্রোলপাম্পের মালিক। গায়ে থাকে না। নির্বাচনের আগে শহর থেকে নেমে আসে ভোট চাইতে। একেকবার একেক মার্কা। অন্যদের বেলায় সরকার বদল হয় তো বাড়িতে পুলিশ এসে তাদের ধরে নিয়ে যায়–মারে-কাটে। লাঞ্ছনার শেষ নেই। অবশ্য এমনিতেই দু-চারটা খুনখারাবির মামলা-মোকদ্দমা লেগেই থাকে। জেল খাটা, কোর্ট-কাছারি করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। গ্রামবাসী মুক্তিকে বলে, আরো আগে তার গায়ে আসা উচিত ছিল। কারণ এখন কে মুক্তিযোদ্ধা, কে রাজাকার বলা মুশকিল। একেকটা সরকার ক্ষমতায় এসে যাচাই-বাছাই করে। তখন এমনও হয়, যে ছিল রাজাকার সে হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধা আর যে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা ছিল, তার নাম কলমের খোঁচায় তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেল। সবকিছু এখন তালগোল পাকিয়ে গেছে। এ অবস্থায় মাথাটা পরিষ্কার আছে কেবল ভূমিহীন কৃষক আমিনুলের।
‘উহু হু-হু, হেই বছরডায় যে কী বিষ্টি!’ আমিনুল ইসলাম মুক্তিকে বলে, ‘আন্ধার রাইত, হাতের তালু দিহা যায় না, এমুন। ওরা আমাগো ঘরের পিছ দিয়া ছপছপ কইরা হাইট্যা যায়, আমরা ঘর থিক্যা টের পাই। পুকি দিয়াও দেহি, কথা কওনের সাহস হয় না।’ একদিন আমিনুল সাহস করে জানালা দিয়ে টর্চ মারে। আর যায়। কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে হ্যান্ডসআপ করিয়ে টেনে-হেঁচড়ে বাইরে আনে। একজন মারে তো আরেকজন বাধে। সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি জরুরি অপারেশন ছিল। আমিনুলকে সঙ্গে নিয়ে তারা ধানখেত, বিল-বাওড় পেরিয়ে যায় আরেক গ্রামে। সেদিন থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে আমিনুলের ওঠা-বসা, বন্ধুত্ব। তার কাছ থেকে মুক্তি জানতে পারে, মধ্যমগ্রামে যার কবর, সে মন্টু নয়, তার নাম মজিবর, উদ্বাহু সেই মুক্তিযোদ্ধা। মজিবরের কবর খুঁড়েছে সে নিজে। দলনেতা শরিফ ভাই মন্টুর শেষ অপারেশনের আগেই পায়ে গুলি লেগে বেহুশ অবস্থায় হাইডআউটে পড়েছিলেন। তিনি আর যুদ্ধ করতে পারেননি। পরে তার পাওটাই কেটে বাদ দিতে হয়। আর মন্টুর মৃত্যুসংবাদ বয়ে নিয়ে গেছে যে মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটি, নাম সরফরাজ হোসেন, তাকে সে সময় ভারত পাঠানো হয় অস্ত্র বা রসদ আনার জন্য। ‘৭৫ সালের আগস্ট মাসে মরিয়ম সরফরাজের কাছ থেকে মন্টুর কবরসংক্রান্ত ভুল তথ্যই পেয়েছে।
উদ্বাহু মুক্তিযোদ্ধা মজিবরের মৃত্যুর দিনটা আমিনুলের স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন ছিল বুধবার, হাটের দিন। আচমকা গোলাগুলি শুনে আমিনুল ভেবেছিল, আর্মি বুঝি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে গ্রামে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু পাল্টা আওয়াজ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে আমিনুলের তত দিনে মর্টারের শেল ফাটার শব্দ, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের থেমে থেমে ব্রাশফায়ার আর রাইফেলের সিঙ্গল শট–আলাদা করে চেনা হয়ে গেছে। আর তো বিলম্ব চলে না। চটজলদি বাড়ির বগলের সবচেয়ে উঁচু সুপারিগাছটায় উঠে পড়ে সে।
গোলাগুলির শব্দটা ততক্ষণে থেমে গেছে। কিন্তু মানুষের দৌড়ঝাঁপের খামতি নেই। আমিনুল ওপর থেকে ধোঁয়ার ছোট্ট একটা কুণ্ডলী দেখে ইউপি অফিসের চাতালটায়। বাপরে, দিনদুপুরে শত্রুর আস্তানায় মুক্তিফৌজের আক্রমণ! যা হোক, ভিমরুলের চাকে ঢিল মারা হয়ে গেছে। এখন কামড়ানোর আগে পালাতে হবে। সেও গাছ থেকে নেমে পলায়নপর মানুষের কাফেলায় ভিড়ে যায়।
সন্ধ্যায় সাত রাজাকারসহ চার আর্মির পাততাড়ি গুটানোর খবর পেয়ে আমিনুল হাঁটা দেয় ক্যাম্পের দিকে। পথে থাকতেই একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুসংবাদ কানে আসে। সে যে মৃত্যুর পরও দণ্ডায়মান, উদ্বাহু ছিল সেসময় পথচারীরা তা বলাবলি করছিল। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখে, লাল গামছায় ঢাকা একটি সাধারণ মৃতদেহ। মাথার কাছে কুপি জ্বলছে আর লাশটা ঘিরে বসে আছে সাত-আটজন সহযোদ্ধা। শোকে মোহ্যমান। সংবিৎ ফেরার পর ভারতের ভূখণ্ডে তাদের বেসক্যাম্পে সৈনিকের মর্যাদায় তাকে গোর দেওয়ার প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু ওপারের কর্তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাতে তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। অতীত বিদ্বেষ আবার ফিরে আসে। তারা বলে, দুদিন আগেও ভারত তাদের শত্রু ছিল, এখন মিত্র, কারণ তারা যুদ্ধ করছে ভারতের শত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আমিনুলের গা ছমছম করে। ভয় পেয়ে সাত রাজাকারসহ চার আর্মি ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেছে ঠিকই, তবে যে-কোনো সময় ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফিরতে পারে। শত্রুর দখলকৃত ভূখণ্ডে বসে বসে শোক করা বা রাগ দেখানো ঠিক হচ্ছে না। যে গেছে, গেছে। বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপত্তার দিকটা ভাবতে হবে। সে নিজ উদ্যোগে কোদাল হাতে পোর খুঁড়তে শুরু করে। ঠিক সে সময় সহযোদ্ধাদের বেষ্টনী ছেড়ে মন্টু এগিয়ে আসে। চাক-চাক মাটির ওপর দাঁড়িয়ে সে গোরখোদকের। কাছে একটা সিগারেট চায়। আমিনুল কানের গোঁজ থেকে বিড়ি বের করে তার হাতে দিলে সে বলে, জীবনে এই প্রথম কবর খোঁড়া দেখছে। গোরখোদক তাতে অবাক হয়, কোদাল চালাতে চালাতে জিগ্যেস করে, কী কও মিয়া, হাছাই? মন্টু মাটি কাটার ছপছপ শব্দ শোনে, উঁকি দিয়ে অন্ধকার গর্ত দেখে ভয়ে পিছিয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে, মানুষকে এভাবে গর্তে পোরাটা তার ভাল্লাগে না। কেমন দমবন্ধকর অনুভূতি হয়। অন্ধকারে আমিনুল ছেলেটার মুখ দেখতে পায় না। তবে বোঝে যে, সে ভয় পেয়েছে। আর ভয় তাড়ানোর জন্যই হয়তো আমিনুলকে না-দিয়ে বিড়িটা একাই সাবাড় করে দিয়েছে। ‘খোদার কী কুদরত,’ মুক্তিকে যুদ্ধের উনত্রিশ বছর পর আমিনুল বলে, ‘ছেলেডা কবরে গেল না। খানেরা লাশ গায়েব করে দিল ওর।’
মন্টুদের দলটা জঙ্গল ঘেরা একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে ঘাঁটি গাড়ার পর আমিনুল ইসলাম ঘরবাড়ি ছেড়ে তাদের সঙ্গে থাকতে চলে আসে। কারণ তাকে তখন উত্ত্যক্ত করছিল স্থানীয় রাজাকার বাহিনী। মিলিটারিরও ধরি ধরি ভাব। গ্রামে ঢুকে তারা জনে জনে জিগ্যেস করে, মুক্তিফৌজ কাঁহা হায়, মুক্তিফৌজ কাঁহা হায়। এরপর বাড়ি থাকা যায়? সব শুনে দলনেতা শরিফ ভাই বললেন, ‘আমিনুল, তুমি আমাগো লগে থাকতে চাও ভালো কথা, কিন্তু অস্ত্র ট্রেনিং তো লাগবে। তাইলে পর শত্রুর বিরুদ্ধে ফাইট দিতে পারবা।’ শরিফ ভাই কোমল মনের মানুষ হলেও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। তিনি সকাল-সন্ধ্যা আউরপাড়া স্কুলমাঠে আমিনুলকে নিজের হাতে ট্রেনিং করাতে লাগলেন। অস্ত্রের মধ্যে থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর গ্রেনেড। গ্রেনেড চার্জ করতে বললেই আমিনুলের বুকটা কেমন ধড়ফড় করত। তাই থ্রি নট থ্রি রাইফেলটাই সে ব্যবহার করত বেশি।
মন্টুর ছিল স্টেনগান। এই নিয়েই সে অপারেশনে গেছে। আমিনুল ইসলাম গেছে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে। তখন একসঙ্গে তাদের খাওয়া-বসা-শোয়া। অবসরমতো তাস পিটিয়েছেও একসঙ্গে। ‘তয় ছেলেডা বড় ডওরা আছিল, ঘুমের মধ্যে খালি কাইন্দা কাইন্দা উঠত।’ আমিনুল দুঃখ করে বলে, ‘হেরে আমি মায়ের পেডের ভাইয়ের মতো জানতাম। বয়সে ছোড়ু আছিল তো! ছেলেডার মনে কী দুঃখু আছিল রে মা, আমারেও কোনোদিন ভাইঙ্গা কয় নাই। দুঃখু কার ছিল না? হক্কলতে বাড়িঘর, বাপ-মা থুইয়্যা যুইদ্ধে গেছে। কারো বাপ শহিদ, বইনের খোঁজ নাই, বউরে মিলিটারি ধইরা নিছে।’
সে সময় ভয়কাতুরে স্বভাবের জন্য দলে মন্টুর খুব দুর্নাম। নিজে ভয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকি ছেলেদেরও সে বিভ্রান্ত করত। তার জন্য পুরো দল দু-দুবার পথ হারিয়ে বিপদে পড়ে। রাতের অপারেশনে বেরিয়ে অন্যে যা দেখে না, সে তাই দেখে, অন্যে যা শোনে না, সে তাই শোনে। তার এই দেখাটা, এই শোনাটা ছিল সংক্রামক। একবার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলে, দলনেতা শরিফ ভাইও তা বিশ্বাস করে ফেলতেন। তখন পথ বদলানোর হিড়িক পড়ে যেত। এই করে করে একবার তারা পাক আর্মির অ্যামবুশের ভেতর পড়ে যায়। গেরিলা যোদ্ধাদের আর যা হোক পালানোর কায়দাটা ভালোই রপ্ত থাকে। সেই রাতে খালবিল সাঁতরে, গোলাবারুদ ভিজিয়ে, পরনের লুঙ্গি ফেলে কোনোক্রমে পালিয়ে আসে ক্যাম্পে। ক্ষতিটা হয় ভয়ংকর। অস্ত্রশস্ত্র শুকোতে, নিজেদের চাঙ্গা হতে তিন থেকে চার দিন লেগে যায়। ফলে দুটি জরুরি অপারেশন বাতিল করতে হয়। এর সাজাস্বরূপ লঙ্গরখানার কাজে ঢোকানো হয়েছিল মন্টুকে। যা ছিল তার জন্য অপমানজনক। কারণ এমন না যে, সে যুদ্ধ করতে চায় না। খুব চায়। কয়েকটা অপারেশনে দুর্ধর্ষ ভূমিকা রেখেছে। এভাবে তাকে বঞ্চিত করাটা অন্যায়। সে হাঙ্গার স্ট্রাইক করে। শরিফ ভাইয়ের দয়ার শরীর। তার জায়গায় আর কেউ হলে, যুদ্ধের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে মন্টুর কোর্টমার্শাল হয়ে যেতে পারত। তিনি শুধু তাকে শপথ করান। সে যদি অন্ধকারে আলোর ফুটকি দেখে, ভূতের কানাকানি শোনে, তবু কাউকে মুখ ফুটে বলবে না। তা গোপন রাখবে। মন্টু আরেক ধাপ এগিয়ে যায়, দলনেতার বদান্যতায় মুগ্ধ হয়ে বলে, সে যদি এসব দেখেও, বা শোনেও নিজে তা বিশ্বাস করবে না। শেষের শপথ বাক্যটা মন্টুর জীবনে কাল হয়েছিল।
হেঁসেল থেকে বেরিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছে মন্টু। রাজায় রাজায় যুদ্ধ নয়, গেরিলা যুদ্ধ। তাই কেউ বাদ্য বাজায়নি, শিঙা ফোঁকেনি, বাজি পোড়ায়নি। এই যুদ্ধের বাহ্যিক আড়ম্বর নেই, লোকের পিলে চমকে দেওয়ার মতো শান-শওকত নেই। হাতি নেই, ঘোড়া নেই। তবে মন্টুর মনে দামামা বাজছে, অসম্ভব কিছু করে দেখানোর উত্তেজনায় সে এগিয়ে যাচ্ছে সবার আগে-আগে। এমন পাগলের লাহান করতাছো ক্যান, মিয়া? আমিনুল তার স্টেনগানের ফিতা টেনে ধরে বলে, ‘এত সাহস কিন্তু ভালো না।’ মন্টু তার কথা আমলে নেয় না। আগের মতোই আচরণ করে। কী হয়েছে আজ মন্টুর, হা ভাতের মতো এমন করছে কেন সে? তারা চলেছে বিপজ্জনক এক অপারেশনে। সামনে যে লোহার রেলিং, কাঠের পাটাতনের বারো পিলারের ব্রিজ, এর মুখটায় রাজাকার ক্যাম্প। রাজাকারদের খেদিয়ে ব্রিজ দখলে আনতে হবে। তারপর হাতে সময় থাকলে ব্রিজ ওড়ানোর কাজ। এ অপারেশনে শরিফ ভাই নেই। তিনি পায়ে গুলি লেগে হাইডআউটে পড়ে রয়েছেন। তার অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে দলের সেকেন্ডম্যান মতিন পাটোয়ারি। লোকটা দুর্ধর্ষ আর গোঁয়ার। আজকের অপারেশনের শেষ কোথায় খোদা মালুম।
আমিনুলের ডিউটি পড়ে খালের দক্ষিণ পাড়ে। ওইখানে কয়েকটা হিজলগাছ। ফুলের ঝুরি নামিয়েছে। হিজলগাছের আড়ালে পজিশন নিয়ে ফায়ার করতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আমিনুল বলে, ‘পানি তো, পানির জন্যি আগুনি যায় না। গাছ ছাড়লে গায়ে গুলি আইসা লাগে। আমি গাছ ছাড়ি নাই। গাছের সাইডে দাঁড়াইয়্যা খালি গুলি করছি। আমার ডাইন সাইডে আমার পিছনে আমার বামে আমার সামনে অনেকে ফায়ারিং করতাছে। তহন কে বাঁশি দিল, মানে যুইদ্ধ শেষ, রাজাকার বাহিনী ভাইগ্যা গেছে। আমরা জাহুর দিয়া, জয় বাংলা স্লোগান দিয়া আগুই গেলাম।
অপারেশন সাকসেসফুল। তখন মাঝরাত। ভোর হতে আরো তিন-চার ঘণ্টা বাকি। এর মধ্যে কাঠের ব্রিজ ভাঙা শুরু হলো। মন্টু আর মিলন পোদ্দার নামে আরেকজনকে পজিশনে রাখা হয়েছে ব্রিজের ওপারে পাকা সড়কের দিকে মুখ করে। সবার নিরাপত্তার বিষয়টি তারা দেখবে। তারপর দলের বাকি ছেলেদের ডাঙায় রেখে মতিন ভাই চারজন যোদ্ধা নিয়ে খালের গলাপানিতে নেমে গেলেন। খালে আমিনুলও আছে। তারা পিলারের গায়ে সবে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়েছে, তখনই মন্টুর সঙ্গের ছেলেটি–মিলন পোদ্দার যার নাম, সে নদীর ধু-ধু চড়া দিয়ে দুজন সৈন্যকে হেঁটে আসতে দেখে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় পানিতে ডুবসাঁতার আর ডাঙায় ছোটাছুটি। সহযোদ্ধারা পালালেও মন্টু নড়ে না। চোখের ভুল বুঝতে পেরে মিলন আগের জায়গায় ফিরে আসে। পজিশন নিয়ে বলে, ‘আমি ভয় পাইছিলাম মন্টু, তুমি ভয় পাও নাই?’ মন্টু তার কথার জবাব দেয় না। সে তখনো চর বরাবর স্টেনগানের নিশানা করে শার্দুলের মতো মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছে, যা ব্যতিক্রম শুধু নয়, অস্বাভাবিকও।
তারপর যার যার কাজে লেগে যায় সবাই। সেফটি ফিউজের মাথায় আগুন ধরানো হয়েছে। কাঠের ব্রিজের পাটাতন জ্বলছে ফরফর শব্দ করে। এর আগে ওপার থেকে উইথ ড্র করা হয়েছে মন্টু-মিলনদের। এখন পালানোর সময়। ঠিক তখন উল্টোদিক থেকে একটি তির্যক আলোকরেখা তিরবেগে ছুটে আসে। সবাই দৌড়াচ্ছে, পালাচ্ছে। মন্টু কোথায়? বিস্ফোরণের আর সামান্য বাকি। আর গাড়িটাও দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমিনুল ঘাড় ফিরিয়ে সেদিন যা দেখেছিল, তা আজও তার অবিশ্বাস্য মনে হয়। সে ঘটনাস্থলের তখন এতটা কাছাকাছি, তীব্র আলোর ঝলকানি আর বিকট শব্দে ব্রিজটা যখন ভেঙে পড়ে তখন উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। আর অনুভব করে, বুকের নিচের মাটি ধাক্কা দিয়ে তাকে আসমানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অবশ্য বিস্ফোরণের আগে ঘাড় ফিরিয়ে আমিনুল যা দেখেছিল, সেই দৃশ্যটার তুলনায় এ কিছুই নয়। তখন মন্টুর গায়ে ছিল স্যান্ডো গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি, কাঁধে স্টেনগান। সেফটি ফিউজের ম্লান আলোয় তার ভুতুড়ে ছায়াটা প্রথম ব্রিজের কিনারায় উদয় হয়। তারপর সে জ্বলন্ত ব্রিজ ডিঙিয়ে নদীর ওপারের ঝোঁপঝাড় পার হয়ে আর্মির জিপের হেডলাইটের ওপর পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তখন মন্টুর স্টেনগানের নিশানা ছিল না।