বুলি আজও তোরে ভুলি নাই
আতা মিয়া উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে যখন শহরে ঢোকে, তখন দক্ষিণ সীমানা থেকে ৭/৮ মাইল দূরে পাকবাহিনী-যৌথবাহিনীর তুমুল লড়াই চলছে। পথেই পাড়াতুতো এক মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। ছেলেটা অস্ত্র খুইয়ে কোনোরকমে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসেছে। উদ্ভ্রান্ত চেহারা। দুই দিন তিন রাত একনাগাড়ে যুদ্ধ করেছে। সে বলে, পাকবাহিনী এক ইঞ্চি জমিনও ছাড়তে রাজি নয়, শস্যখেত ভরে গেছে লাশে লাশে। ওখান থেকে যুদ্ধের আওয়াজ এলেও শহরের অবস্থা স্বাভাবিক। রাস্তাঘাটে কিছু মানুষ লুটপাট নিয়ে ব্যস্ত। কারো দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। আতা মিয়াদের পাশ দিয়ে সেমাইয়ের পোটলা হাতে একজন দৌড়ে চলে যায়। অদূরে বাড়িঘরের দরজা-কপাট ভেঙে কিছু লোক ভ্যানে তুলছে। কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে রিকশাভর্তি লেপ-তোশকের ওপর পা ছড়িয়ে বসে একজন আসছিল তাদের দিকে। পাড়াতুতো ভাই বলে, ‘শালারে হ্যান্ডসআপ করায়ে পিস্তলডা নে, আমার অস্ত্রের দরকার।’ যে কথা সেই কাজ। লোকটা পিস্তল ফেলে লেপ-তোশকের রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড়ে পালাল। বুলেট নেই পিস্তলে। ‘শালা মাগনা পেয়ে তুলে নেইছে। যা-ই হোক, যুদ্ধের সোমায় হাতে লগার-ফগার কিছু থাকা ভালো।’ তারা আবার হাঁটতে শুরু করে। পথিমধ্যে শোনে যে, বোমায় পা উড়ে গেছে তাদের পরিচিত ফ্রিডম ফাইটার একজনের। তাকে আহত অবস্থায় সদর হাসপাতালে আনা হয়েছে। হাসপাতালে যাওয়ার পথে আরেক কাণ্ড। কয়েকটা পাঞ্জাবি সৈন্য কোথা থেকে রাস্তায় এসে পড়ে। পাবলিক তাদের দেখে। জয় বাংলা স্লোগান দেয়। ভয়ে পাঞ্জাবিরা চাইনিজ স্টেনগান দিয়ে ব্ল্যাংক ফায়ার। করলে পাবলিক ভাবে, পাকবাহিনী আবার এসে গেছে, তারা রাস্তার ধারের দোকানপাট ভেঙেচুরে দেয় দৌড়। আতা মিয়ারাও দাঁড়িয়ে থাকার কোনো কারণ দেখে না। দুজনের হাতেই অস্ত্র আছে, তবে গুলি সাকল্যে দুটি, তা-ও আতা মিয়ার কোমরের গামছায় বাঁধা। সে তো যুদ্ধ করবে না বলেই শত্রুমুক্ত শহরে ঢুকেছে। তাই তার প্রস্তুতিও নেই।
হাসপাতালের অবস্থা করুণ। সেখানে কোনো ডাক্তার নেই। সিভিল সার্জন যে, সে অবাঙালি, চিকিৎসা করবে কী, নিজেই প্রাণের ভয়ে পালিয়েছে। নার্সরা ছোটাছুটি করে কোনোরকমে কাজ চালাচ্ছিল। ‘তখন তো হাসপাতালে দুইশ-আড়াইশ বেড ছিল না, ডাক্তারও কম।’ আতা মিয়া মুক্তিকে বলে, ‘ধরেন আজকে যেমন নাকের ডাক্তার হয়েছে, কানের ডাক্তার হয়েছে–একটা হসপিটালে বিশ রকমের ডাক্তার, তখন তো এসব ছিল না! তা-ও সদর হসপিটালে যে কজন ছিল–পলাইছে।’
এদিকে রণাঙ্গন থেকে আহতদের এনে তোলা হচ্ছে সদর হাসপাতালে। মুক্তিযোদ্ধারা কোত্থেকে এক ডাক্তার ধরে আনে। একা কী করবে সে। যার পেটে গুলি ঢুকে আছে, তার তো জরুরি অপারেশন দরকার, অথচ তাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পানি নেই, বাতি নেই। রাতে আবার বিমান হামলার আশঙ্কায় শহর নিষ্প্রদীপ। আতা মিয়া রোগী দেখতে এসে ফেঁসে যায়। পাড়াতুতো ভাই যুদ্ধ থেকে ফিরেছে, তার বিশ্রাম দরকার, কোন ফাঁকে সে সরে পড়েছে। আতা মিয়ারও কেটে পড়ি পড়ি ভাব। হঠাৎ ঠা-ঠা করে গুলি ফাটল। বোঝা যাচ্ছে ব্ল্যাংক ফায়ার-পাকসেনারা আবার ফিরে আসলো নাকি! আতা মিয়া তখনো জানে না যে, তা বিজয়োৎসবের। সে অন্ধকার হাসপাতালের করিডোরে নেমে আসে। গুলির আওয়াজেই সম্ভবত, করিডোরের রোগীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। যারা চলতে-ফিরতে সক্ষম তারা বাইরে বেরিয়ে আসে। উল্টো দিক থেকে হনহন করে হেঁটে আসে জোর করে ধরে আনা সেই ডাক্তার। এসেই মাথায় আর হাতে ব্যান্ডেজ বাধা সামনের। রোগীটাকে বুকে জড়িয়ে একটানে মাথার ওপর তুলে ফেলে। তাকে নামিয়ে আরেকজনকে। এভাবে পাঁচজনের সময় ডাক্তার আর লোকটিকে মাথায় তোলে না। শূন্য থেকে ছেড়ে দিয়ে আতা মিয়াকে স্টেনগানসহ জাপটে ধরে, ‘মুক্তিযোদ্ধা ভাই, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমরা স্বাধীন। স্বাধীন দেশের নাগরিক।’
ডাক্তারের চিৎকার করিডোর ছেড়ে পুরুষের ওয়ার্ড পেরিয়ে বন্ধ দরজার ওপাশে। মহিলা ওয়ার্ডের একমাত্র রোগী মরিয়মের কানে পৌঁছায়। এতে তার কোনো ভাবান্তর। হয় না। ইস্পাহানি স্কুল থেকে গতকাল তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। আগের। দু’দিন মরিয়মের অবস্থা ছিল চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো। দলে দলে লোক দেখতে। আসছিল। অন্য মেয়েরা কে কোন দিকে চলে গেছে। সে একা। খাওয়া না, নাওয়া না, মানুষের ঠাট্টা-মশকরা শুনে শুনে সে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। বমি কিছুতেই বন্ধ। হচ্ছিল না। হাসপাতালে আনার পর একজন নার্স যত্ন করে গোসল করিয়ে তাকে বমির ওষুধ খাইয়ে দেয়। সেই থেকে সে ঘুমাচ্ছে।
সেদিন বিকেলে জেনারেল নিয়াজি যখন আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করছিলেন, মরিয়ম তখন ওষুধের ঘোরে প্রবেশ করে সেখানে, যেখানে শালিমার বাগ আছে আর শহরটার নাম হচ্ছে লাহোর। সে লাহোরের সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যায়, ফোয়ারার ধারে চকিতে দাঁড়ায়, সারি সারি ঝাউবীথির মনোরম শোভা উপভোগ করে। কিন্তু টাইট কামিজ আর চুড়িদার পরা, গলায় দোপাট্টা প্যাঁচানো কোনো নারীকে সেখানে দেখতে পায় না। দৃশ্যটা তাকে স্বস্তি দেয় এবং ভবিষ্যতের জন্য একটা দরজা খোলা রেখে সে ফের ঘুমিয়ে পড়ে।
আতা মিয়া ডাক্তারের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়া পেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। সে এখন বিজয়োৎসব করুক চাই না করুক, তার জন্য হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়াটা জরুরি। বাইরের অবস্থা তখন আরো হতাশাজনক। দিনের বেলা লুটপাট, পাকহানাদের ব্ল্যাংক ফায়ার–সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খুব প্রাণবন্ত ছিল। এখন একে মনে হচ্ছে একটা মরা শহর। পথচারী বলতে একা আতা মিয়া। হাঁটতে হাঁটতে সে টাউন হলের সামনে আসে। ওখানে কয়েকটা খাবার হোটেল। মিষ্টির একটি মাত্র দোকানে ভিড় লেগে আছে মানুষের। দোকানের সামনে শান্তিপূর্ণভাবে বিজয়োৎসব করার জন্য একজন রিকশায় বসে মাইকিং করছিল। উৎসবই বলে হচ্ছে না, তার আবার শান্তি-অশান্তি! একটুখানি উৎসব করার জন্য আতা মিয়ার মনটা ছটফট করে। এর আগে দু-চারটা মিষ্টি খাওয়া দরকার। পকেটে পয়সা নেই তো কী, কাঁধের স্টেনগানই যথেষ্ট। আতা মিয়া মুক্তিকে কৈফিয়ত দিয়ে বলে, ‘ওইসব দিনে মুক্তিবাহিনীরে মানুষ ফিরিই খাওয়াইছে। টেনে টেনে বাড়ি নিয়ে বিছনা পাইতে বলেছে–ভাইজান ঘুমাই পড়েন।’ তবে আতা মিয়ার সেদিন মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছা পূরণ হয় না। দোকানে পৌঁছানোর আগেই কাঁচের আলমারির তাক সব ফাঁকা। দোকানদার হাত কচলায়, ‘স্যার, ময়দা আছে, দুইডা পরোডা বানাই দিই?’ পরোটা ভাজার আগেই মাইকিং বাদ দিয়ে ফ্রিডম ফাইটার শাহজাহান সিদ্দিক রিকশা থেকে নেমে আসে। কত দিন পর দেখা, মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ, প্রথম একজন আরেকজনকে চিনতে পারেনি। কোলাকুলির পর বলে যে, ‘দোস্ত উপশহরে গন্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। এখন পরোটা খাওয়ার সময় নয়। পরে তোরে আমি গোশত-ভাত খাওয়াব-চল।
উপশহরে বাস করে বিহারিরা। আতা মিয়া আর শাহজাহান সিদ্দিক ওখানে মাইকে স্লোগান দেয়, ‘বাঙালি-বিহারি ভাই ভাই/এক থালাতে ভাত খাই। তুমি কে আমি কে/ স্বাধীন বাংলার নাগরিক।’ তাদের স্লোগান, অভয়বাণী বিহারিরা শুনছে বলে মনে হয় না, শুনলেও বুঝতে পারছে বলে মনে হয় না। তাদের দরকার নিরাপদ আশ্রয়। এদিকে রাত গম্ভীর হচ্ছে। তারা যখন শাহজাহান সিদ্দিকের ডেরায় ফিরে আসে, ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধাদের হাট বসে গেছে ওখানে। কে কার চেনা বা অচেনা, কে বড়লোক বা ঘোটলোক এসব নিয়ে চিন্তাভাবনার আপাতত দরকার নেই। সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা, সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাদের কথারও শেষ নেই। বীরত্বের কথা, দুঃখের কথা, কষ্টের কথা, আনন্দের কথা বলতে বলতে রাত কাবার। মাঝখানে দু’দুবার পাশের হোটেল মাংস-ভাত সরবরাহ করে। তারা যখন ঘুমাতে যায়, স্বাধীন দেশের প্রথম সূর্যকিরণ ততক্ষণে হামাগুড়ি দিয়ে তাদের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে।
পরদিন সন্ধ্যায় আতা মিয়া নিজেকে আবিষ্কার করে শহরের তস্যগলির শেষ মাথায় জোড়া তালগাছের পেছনে টিনের চাল আর বাঁশের বেড়ার একটা শোকার্ত বাড়ির সামনে। তালগাছ দুটি মোটা আর লম্বা হওয়া ছাড়া বহির্বাড়ির কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু অন্দরমহলের চেহারা করুণ। ফুপুর মোটাকাটা শরীরটা শুকিয়ে চেরা তক্তার মতো পাতলা হয়ে গেছে। একসময়ের তেল জবজবে কালো চুল এখন রুক্ষ আর সাদা। সুখী গৃহিণীর খোঁপা ভেঙে তা পিঠের ওপর লুটাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা ভাইপোকে দেখে ফুপু হাউমাউ করে কেঁদে উঠে কী বলেন স্পষ্ট বোঝা যায় না। ফুপাজানের শহিদ হওয়ার খবর আতা মিয়া ফুপাতো বোন দুলির কাছ থেকে তখন। শোনে। কোনো অপরাধ ছাড়াই মিলিটারিরা তালগাছের গোড়ায় তাকে গুলি করে। দুই দিন দুই রাত লাশটা জোড়া তালগাছের চিপায় পড়ে ছিল। মুসলমান মুসলমানের কবর দেবে, ফরজ কাজ, তবু ভয়ে কেউ এগিয়ে আসে না। কুকুর আর কাকের উপদ্রপে যখন পাড়ার লোকজন অস্থির, দুর্গন্ধে টেকা দায়, তখন দুলির স্বামী আমজাদ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাশের পাশেই গর্ত খোঁড়ে। দুলি পচাগলা বাপজানের শরীরটা কবরে নামাতে হাত লাগায়। তারপর কচি ঘাস-দুব্বো দিয়ে কবরটা ঢেকে দেয় রাতারাতি। মাত্র দুই মাসের পুরোনো কবর, আতা মিয়া তাই জোড়া তালগাছ পার হওয়ার সময় প্রথম দর্শনে তা শনাক্ত করতে পারেনি। কবর জিয়ারত করার সময়ও তার মনে হচ্ছিল, ফুপাজান আবদুল করিম-চল্লিশ বছর যিনি কোর্টের পেশকার ছিলেন, তিনি এখানে শায়িত আছেন তো, নাকি সে জ্যান্ত তালগাছ দুটির রুহের মাগফেরাত কামনা করছে!
‘তোর ফুপারে নিয়ে যে শোক করব, তা আমার নসিবে ছিল না রে, বাপ। তিরিশ বচ্ছর একসঙ্গে ঘর করলাম, এক চালের নিচে থাকলাম, মানুষটা চোখের সামনে গুলি খেয়ে ঘাপাতে ঘাপাতে মরি গেল, এক ফোঁটা চক্ষের পানি ফেলতি সময় পালাম না আমি! আমার বিপদের কোনো শেষ আছে?’
কথা বলতে বলতে ফুপু হঠাৎ থেমে যান। দুলি, আমজাদ আমতা আমতা করে। আতা মিয়ার টনক নড়ে, ‘বুলি কনে ফুপু আম্মা? ওরে যে দেখতে পাচ্ছিনে!’ বাড়ির চার-পাঁচ বছরের মেয়েটি এতক্ষণ হাঁ করে স্টেনগান দেখছিল, এই প্রথম তার কথা বলার সুযোগ আসে। সে স্টেনগানের ফিতা ধরে টান দেয়, ‘বুলি খালারে মিলিটারি ধরে নে গেছে, মামা।’ সঙ্গে সঙ্গে ফুপু ডুকরে কেঁদে ওঠেন, আর দুলির মেয়েটা আগ বাড়িয়ে কথা বলার জন্য মায়ের হাতে দুমদুম কিল খায়।
স্বাধীন বাংলাদেশের কোথাও কি এক ফোঁটা শান্তি নেই? কুত্তার বাচ্চারা কী করে থুয়ে গেছে দেশটার? আতা মিয়ার আর সহ্য হয় না। সে বাইরের দিকে পা বাড়াতে ফুপু খপ করে তার স্টেনগানের ফিতা ধরে ফেলেন, ‘বাজান কনে যাচ্ছিস। যাওয়ার আগে তোর ফুপুরে মাইরে থুয়ে যা।’ এখন ঠ্যালা সামলাও! পেছনে কুপির সলতেটা ফুপুর আহাজারিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আতা মিয়া নিষ্কম্প। স্থির দাঁড়িয়ে ভুতুড়ে তালগাছ দুটির দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, যুদ্ধের পরও যে আরেক যুদ্ধ, এর জোয়াল বয়ে বেড়ানোর দায় আছে কি না একজন মুক্তিযোদ্ধার। কমলগঞ্জের মর্জিনা বিবিকে সে চিনে না, দেখেওনি কোনোদিন অথচ মা মদিনা উঠোনে লাশ রেখে তার হাতে মেয়েকে সঁপে দিতে চাইলেন। তার একটা মন পড়ে আছে ওখানে। এদিকে ফুপুও তার পর নয়। দুই মাস আগে ফুপাজানকে মেরে ফুপাতো বোন বুলিকে ধরে নিয়ে গেছে মিলিটারিরা। এই বুলির সঙ্গেই একবার আতা মিয়ার বিয়ের কথা হয়েছিল। পাত্রের পড়ালেখা কম থাকায় প্রস্তাবটা টেকেনি। মানুষের জীবনে কখন যে কী হয়! এলাকা শত্রুমুক্ত হয়েছে তো চার দিন। আমজাদ হোসেন এ কয় দিন শালির জন্য কী করেছে? নাকি শ্বশুরের লাশ মাটি চাপা দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ?
এবার তার প্রশ্নের জবাব দেয় বুলির বড় বোন দুলি। মুন্নির আব্বা একা মানুষ, কী করবে। তুমি যখন আসি পড়িছো একটুখানি দেখো দিনি ঘটনাটা কী!’ ফুপু মেয়ের চেয়ে এককাঠি বাড়া। তিনি ভাইপোকে জড়িয়ে ধরে বলেন, দেশ স্বাধীন হইয়ে গেল রে বাপ, আমার মেয়ে কই? তোরা তারে এনে দে। বুকের আগুন আমি পানি ঢালি নিবাই।’ দুই মাস বুকে পাষাণ বেঁধে পড়ে থাকলেও ফুপুর আর একমুহূর্তও তর সইছে না, তিনি নিজের বুকে দুমদুম কিল বসাচ্ছেন। এদিকে আমজাদ হোসেন সোয়েটার গায় দিয়ে রেডি, শালিকে সে মুক্তিযোদ্ধা আতা মিয়ার সঙ্গে খুঁজতে যাবে।
সব শুনে শাহজাহান সিদ্দিক চার-পাঁচ জায়গার নাম দিয়ে বলে, ‘এখন কি আর খুঁজে পাবি? বেঁচে থাকলি তো এদ্দিনে নিজবাড়িই ফিরত। তবে এমনও হতি পারে লজ্জায় সে মুখ দেখাতি পারছে না। দ্যাখ তবে চেষ্টা করে।’
শাহজাহান সিদ্দিকের সঙ্গে কথা বলে আতা মিয়া আর আমজাদ হোসেন সোজা নদীর পাড়ের ভাগাড়ে চলে যায়। পরে ভাগাড়টার নাম হয় কালীতলা বধ্যভূমি। তারা প্রথম সেখানে যায়, কারণ জায়গাটা কাছে আর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা যেহেতু বুলির কম-শাহজাহান সিদ্দিক বলে দিয়েছে। সেখানে তখন শয়ে শয়ে কেরোসিনের লম্প। মানুষ আপনজনের লাশ খুঁজতে বেরিয়েছে হারিকেন দিয়ে। কত দিনের পচাগলা লাশ, বেশির ভাগই কঙ্কাল। কার লাশ কে নিয়ে যাচ্ছে। আতা মিয়াদের সঙ্গে হারিকেনও নেই। তারা ভাগাড় থেকে চলে যায় উপশহর, যেখানে বিহারিদের আবাস। বিহারিরা পাকবাহিনীর যোগসাজশে নয় মাস বাঙালি কেটে কেটে ম্যানহোল ভরেছে। এবার পাল্টাপাল্টির সময়। সেই রাতে ম্যানহোলের ঢাকনা তুলে পচাগলা যে কটা বাঙালির লাশ তোলা সম্ভব হয়, সেই খালি জায়গায় কেটে কেটে ফেলতে থাকে বিহারির লাশ। এই চলে পরদিন ভোর পর্যন্ত। সকালের দিকে সেই যে শাহজাহান সিদ্দিক বলেছিল ‘এমনও হতি পারে সে লজ্জায় বাড়ি যাতি পারছে না’ কথাটা মনে পড়তে আতা মিয়া আর আমজাদ হোসেন নয়াবাজারের বাংকারের দিকে ছোটে। সঙ্গে নেয় বুলির লজ্জা নিবারণের জন্য একখানা নাইলনের শাড়ি, যা কাঁধের স্টেনগান দেখিয়ে আতা মিয়া চকবাজারের এক আড়তদারের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে। শাড়িটা সঙ্গে নিয়ে লাভ হয়নি। বাংকারে সেদিন কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পাকবাহিনীর মাইনে পড়ে এক মুক্তিযোদ্ধার হাত-পা উড়ে গেছে। তাকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি। দ্বিতীয় দিনে মিত্রবাহিনীর সার্চ করা নয়াবাজারের বাংকারে তারা কোনোরকমে প্রবেশ করে। সেখানে হাতের চুড়ি, শাড়ি, লম্বা চুলের গোছা সব আছে, মানুষ নেই। তারপর তারা যায় আইয়ুব স্কুলে, পরে যার নাম হয় এ কে ফজলুল হক স্কুল। স্কুলে গিয়ে দেখে টুল-বেঞ্চি-ব্ল্যাকবোর্ডহীন একটা ক্লাসরুমে কয়েকটা মেয়ে মুখ ঢেকে নতুন বউয়ের মতো বসে রয়েছে।
স্কুলঘরের চারদিক থেকে কৌতূহলী মানুষ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। গেটে সশস্ত্র সান্ত্রি। মুক্তিবাহিনীর কয়েকটা ছেলে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ছেলেছোকরাদের জানালা থেকে নামানো হয় তো তারা বাউন্ডারি ওয়ালের ওপর চড়ে বসে। বা বানরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে গাছের মগডালে উঠে যায়। ইতিমধ্যে গাছ থেকে পড়ে দুটি ছেলের পা ভেঙেছে। সব শুনে একজন চেনা মুক্তিযোদ্ধা আতা মিয়াদের নির্ধারিত কক্ষে নিয়ে আসে। তারপর মুক্তিযোদ্ধার কথামতো বুলির নাম, তার আব্বার নাম বলে স্কুলের রোল-কল করার মতো তারা দুজন চারবার ডাক ছাড়ে। কিন্তু মুখঢাকা মেয়েগুলো সাড়া দেয় না। একজন শুধু শেষবার ডাকার সময় শীর্ণ একটা হাত বের করে পিঠ চুলকায়। আতা মিয়া তাকে বুলি মনে করে এগিয়ে যেতে চাইলে তাকে হাত তুলে বাধা দেয় মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটি। মুখে বলে, ‘আপনি যা ভাবিছেন তা না, গর্তে থাকি থাকি ওদের গায়ে উকুন পড়ে গেছে। হাত দিয়ে চুলকোচ্ছে তাই।’ তারপর রাইফেলের বাঁট নিয়ে নিজের গা চুলকাতে চুলকাতে মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটি হাসপাতালের বেড খালি হওয়ামাত্র তাদের ওখানে স্থানান্তর করা হবে বলে জানায়। কিন্তু আতা মিয়ার সন্দেহ দূর হয় না। সবার গায়ে গুঁড়ি গুঁড়ি উকুন থাকলে, তাদের একজন খালি পিঠ চুলকাবে কেন, যখন সে বুলির নাম ধরে ডাকছিল! ‘কিন্তু সবকিছুর একটা নিয়ম আছে,’ চেনা মুক্তিযোদ্ধা বলে। ‘কেউ নিজের মুখ দেখাতে না চাইলে আপনি জোর করে দেখতে পারেন না।’ এ ছাড়া আতা মিয়া নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা। সর্বাগ্রে তারই তো নিয়ম মানা উচিত।
এরপর তারা হাসপাতালের দিকে হাঁটতে শুরু করে। যদিও বেড খালি না হলে মেয়েগুলোকে ওখানে স্থানান্তর করা হবে না। আইয়ুব স্কুল আর সদর হাসপাতালের মধ্যিখানে টাউন হল ময়দান। ওখানে তখন এ অঞ্চলের যুদ্ধবন্দিদের নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া চলছে। জায়গাটা ঘিরে রেখেছে মিত্রবাহিনী। পাবলিক মাঠের বাইরে থেকে শ্লোগান দিচ্ছে, ‘একটা একটা সৈন্য ধরো, সকাল-বিকাল নাস্তা করো। বিচার চাই বিচার চাই, ইয়াহিয়ার বিচার চাই। বিচার চাই বিচার চাই, নরহত্যার বিচার চাই। ইয়াহিয়া-ভুট্টো, কুত্তার বাচ্চা কুত্তো।’ সেখানে আতা মিয়ার সহযোদ্ধারা মহা ব্যস্ত। তারা কোনো-না-কোনোভাবে নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ায় জড়িত হয়ে গেছে, যা বুলিকে খোঁজার চেয়ে উঁচুদরের কাজ। আতা মিয়াও তাতে শরিক হয়। এই ফাঁকে আমজাদ হোসেন তার কাছ-ছাড়া হয়ে গেলে, দুই রাত দুই দিন পর টাউন হল ময়দানের সামনে বুলিকে খোঁজাখুঁজির ইতি ঘটে।
মেয়েটা মরে গেল না বেঁচে রইল–আতা মিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা, পথে পথে ঘুরেও এর সুরাহা করতে পারল না, ফুপুকে মুখ দেখাবে কেমন করে! পরদিন কাউকে কিছু না বলে সে শহর ছেড়ে চলে আসে। যায় কমলগঞ্জ। মর্জিনা বিবির তখনো ইদ্দতকাল চলছে। এ অবস্থায় শাদি নাজায়েজ। তখন সবে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আইনকানুন ঢিলেঢালা। রাজাকারি করুক চাই না-করুক গাঁয়ের মোল্লা-মৌলবিরা পলাতক। তাই তাদের শাদিটাও নিয়ম ভঙ্গ করে হয়ে যায় নির্বিঘ্নে।
ঢাকার স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমা দিয়ে সরকারি কম্বল হাতে আতা মিয়া এ গাঁয়েই ফেরে। এখানে বৃদ্ধ আছেন কারবালার পুঁথি নিয়ে, আতা মিয়া আছে মর্জিনা বিবি, তাদের ছেলেমেয়ে আর গার্লস স্কুলের দফতরির চাকরিটা নিয়ে। এখনো আতা মিয়া ভুলতে পারে না শীর্ণ হাতের মেয়েটির কথা, যে তার ডাক শুনে পিঠ চুলকাচ্ছিল অথচ মুখ দেখাতে চায়নি। কিন্তু সে বুলি হয়ে থাকলে এত দিনে কি বাড়ি ফিরত না?
বেঁচে থাকলেই সবাই বাড়ি ফিরেছে–তা কিন্তু নয়। আতা মিয়া টাউন হল ময়দানে যুদ্ধবন্দিদের নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ায় যখন উঁচুদরের ভূমিকা রাখছিল, তখন কাছের সদর হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে কিছু মেয়ে জড়ো হয়। তারা কেউই উদ্ধারকারীদের নিজের বাড়ির ঠিকানা দেয়নি। পরদিন ঢাকাগামী ভারতীয় মিলিটারি কনভয়ের যাত্রী ছিল ওরা। সঙ্গে যুদ্ধবন্দি পাকসেনারাও ছিল। মেজর ইশতিয়াকের কপালে, হাতে কমলগঞ্জের গণপ্রতিরোধের ফলক–দগদগে কাটা ঘা। উন্মুক্ত, ব্যান্ডেজহীন। ফেরি-পারাপারের সময় পদ্মার উত্তাল তরঙ্গের দিকে তাকিয়ে মেজর আহত হাত তুলে আনমনে একটা মাছি তাড়ায়। তা দেখে ফেরির পানিবিক্রেতা ছেলেটি ভাবে, খুনি লোকটা বুঝি তাকে সালাম দিচ্ছে। সে সালামের প্রতি-উত্তরে মেজরকে গাল দেয়, ‘শালা বাইনচোত!’ কেউ কিছু বলছে না যখন, ছেলেটি বীরত্ব দেখাতে তার বাদামবিক্রেতা বন্ধুকে ডেকে আনে। এবার তাদের টার্গেট হয় মরিয়ম আর সঙ্গের মেয়েরা, যারা কেউই উদ্ধারকারীদের বাড়ির ঠিকানা দেয়নি। বাদামবিক্রেতা পানিঅলাকে বলে, ‘এই দ্যাখ দ্যাখ, মাইয়্যা গুলান মিলিটারির লগ লইছে। খানকি মাগিরা যায় কই?’
মরিয়মের মাথার ভেতর মেজর ইশতিয়াকের তাড়িয়ে দেওয়া মাছিটা ভনভন করে উড়তে থাকে। তাদের ঘিরে রেখেছে বাচ্চা বাচ্চা ফেরিঅলারা। স্বাধীন দেশে এ কেমন সংবর্ধনা! ভারতীয় সৈন্যরা এর মর্মার্থ না বুঝেই হাসছে আর যারা হাত বাড়াচ্ছে। তাদের সঙ্গে ঝুঁকে ঝুঁকে হ্যান্ডশেক করছে।
ভারতীয় মিলিটারি কনভয় ফেরি ছেড়ে নদীর ঢাল বেয়ে তীরে উঠলে মরিয়ম মনে মনে পদ্মাকে বিদায় জানায়। গোধূলির রক্ত বর্ণের আকাশকে নিঃশব্দে বলে, অন্য দেশের সন্ধ্যা কী রকম, আমি জানি না। কিন্তু নিজের দেশ আমাকে কী দিল। বাইশ বছর কি অনেক সময়? জীবন তার চেয়েও দীর্ঘ।