একটি আদর্শ জাদুঘর
কফিলউদ্দিন আহমেদের ঢাকা আসার বিলম্বের কারণ সাত-পাঁচ ভাবনা। মেয়েকে গাঁয়ে আনা ঠিক হবে না, বীরাঙ্গনা অফিসে রাখাও সমীচীন নয়, রায়েরবাজারের বাড়িটা শুনেছেন বাসযোগ্য নেই, তাহলে কোথায়? তিনি তার চিরকালের উপদেষ্টা গোলাম মোস্তফার শরণাপন্ন হন। যদিও চতুর শ্যালকের অবস্থা আর আগের মতো নেই। বিজয়ের আট সপ্তাহের মাথায় পত্রিকার হিসাবমতে চার হাজার দালাল গ্রেফতার হয়েছে। এদিকে গোলাম মোস্তফাঁকে মুক্তিযোদ্ধারা একবার ধরে, একবার ছাড়ে। সহায়-সম্পদ বেহাত হওয়ার জোগাড়। ঢাকার তিনটা বাড়ির দুটোই এখন মুক্তিযোদ্ধা নামদারদের দখলে। পুত্র-কন্যা এদিক-ওদিক পাঠিয়ে দিয়ে, মগবাজারের তিন কামরার বাসায় তিনি ঘাপটি মেরে আছেন। এই অবস্থায় কফিলউদ্দিন আহমেদের চিঠি হাতে আসে, ‘ভাই মোস্তফা, আমার নিদানকালের বন্ধু। তুমি জানো হয়তো, আমার বেয়াড়া মেয়েটা এখন পুনর্বাসনকেন্দ্রে। এরে নিয়া কী করি, কই যাই?’
বীরাঙ্গনা জাতির গর্ব। তাদের নিয়ে আজকাল খুব নাচানাচি হচ্ছে। কেবল দেশের লোকই নাচছে না, বিদেশিরাও নাচছে। মুক্তিযোদ্ধা ভাগনেটা আজ বেঁচে থাকলে গোলাম মোস্তফার এই দুরবস্থা হতো না। স্বাধীনের চার মাস পরও সে যখন ফিরল না, আর কি ফিরবে? গোষ্ঠীতে একজন মুক্তিযোদ্ধা থাকলে আজকাল পুলসেরাতও পার হওয়া যায়। তিন-তিনটা বেজন্মার পিতা হয়েছেন তিনি। একটাও যদি কোনো কাজে লাগে। যুদ্ধের নয়টা মাস, বিছানায় শুয়ে-বসে ছাড়পোকার ডিমে তা দিয়ে বংশ বিস্তার ঘটিয়েছে শুধু। ফাঁকে ফাঁকে তাস নিয়ে বাজি। পাকিস্তান হারবে না ভারত জিতবে। যেন ক্রিকেট ম্যাচ। তাদের একজনও যদি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিত বা যুদ্ধে শহিদ হতো, তাহলে তো তিনি আজ বীর বিক্রম (বিবি) কি বীর প্রতীক। (বিপি) মুক্তিযোদ্ধার ভাগ্যবান পিতা। তার সম্পত্তি দখল নেয়, এমন বুকের পাটা কার। যা হোক বাকি আছে ভাগনিটা, সে একজন বীরাঙ্গনা, জাতির গর্ব। গোলাম মোস্তফা মনে মনে ফন্দি এঁটে কফিলউদ্দিন আহমেদকে লিখেন, ‘দুলাভাই, আপনার নসিবটাই মন্দ। কোন পাপে খোদা নাখোশ হলেন কে জানে। সব তার মর্জি। আমরা তার আজ্ঞাবহ মাত্র। তবে মুশকিল যিনি দেন, আসানও তিনি করেন। বুবুসহ অতিসত্বর ঢাকা চলে আসেন। যত খারাপ অবস্থায়ই থাকি না কেন, আপনার পুত্র কন্যার জন্য এই অধমের দ্বার অবারিত। ইতি আপনার স্নেহের গোলাম মোস্তফা।’
চিঠিটা ভাঁজ করে তোরঙ্গে রেখে কফিলউদ্দিন আহমেদ তৈরি হতে বলেন স্ত্রীকে। কী ব্যাপার কী বৃত্তান্ত, মনোয়ারা বেগম কিছুই জানেন না। শ্যালক-দুলাভাইয়ের চিঠি চালাচালি তার কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। তিনি ভাবলেন, মন্টুর কোনো খবর, যা খারাপই। ভালো কিছু হলে ছেলে নিজেই বাড়ি আসত। মন্টু, তার জলজ্যান্ত ছেলেটা, গত এক বছর খালি স্বপ্নে দেখা দিয়েছে। ঘুম ভাঙার পর নাই, কোথাও নাই। তার। চোখের সমুদ্রে দিনমান ডুবে থেকে রাতের অন্ধকারে দূরতম সাগরের মাঝখানে ভেসে ওঠে। হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতরায়। তাকে ছোঁয়া যায় না। তার নির্দিষ্ট কোনো আকারও। নেই। একেক দিন একেক রকম। গর্ভে থাকার সময়টার মতন। এভাবে স্বপ্নের মধ্য দিয়ে, বিশ বছর পর, মন্টু যেন মাতৃগর্ভে ফিরে আসে।
মন্টু পেটে আসার পর মনোয়ারা বেগম মনেপ্রাণে চাইতেন, ছেলে হোক। ছেলেই যেন হয় খোদা। দু-দুটো মরা ছেলে জন্ম দেওয়ার পর বিয়ের দশ বছরের মাথায় মেরি হলো। মেয়েটা স্বাস্থ্যবতী, হাস্যোজ্জ্বল। কিন্তু কেউ খুশি হলো না তাতে। এর চেয়ে মৃত পুত্রের জননী হওয়া যেন গর্বের–সকলের এমনই মনোভাব। অনেক তাবিজ-কবচ আর পিরের থানে শিরনি দেওয়ার পর মন্টু এল। বংশের একমাত্র ছেলে। মাটিতে রাখলে পিঁপড়ে খাবে, পানিতে নিলে সাপে কাটবে, এমন তুলুতুলু করে মানুষ। করেছেন। মেরির একগুঁয়েমির পাশে ছেলে হয়েও সে নম্র-শান্ত। খেতে না পেলে যে কাঁদত না, যা করতে বলা হতো তা-ই করত, সেই ছেলের বুকে এত আগুন ছিল? সে যুদ্ধে চলে গেল নিজের মাকে না বলে! ছেলের হারিয়ে যাওয়ার চেয়ে তার বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণাটাই যেন প্রবল। শরীরের একটি অঙ্গ যেন প্রতারণা করল বাকি শরীরটার সঙ্গে। মনোয়ারা বেগম ডুকরে কেঁদে ওঠেন।
এ দৃশ্য কফিলউদ্দিন আহমেদের আর সহ্য হয় না। যুদ্ধের পুরো সময়টায় পাকসেনার ভয়ে পুত্রকে আর সমাজের ভয়ে মেয়েকে আড়াল করতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে দেয়াল উঠে গেছে। এর পলেস্তারা এখন খসে পড়ছে। মুখব্যাদান করছে। কুৎসিত ইটের গাঁথুনি। কী হবে তাদের? বাকি জীবন কাটাবেন কী করে? খোদার হাতে এমন কিছু কী দেওয়ার আছে, যা থেকে তারা এর পরও বাঁচার খোরাক পাবেন? একমাত্র ছেলেটা নেই। মেয়ের এভাবে থাকার চেয়ে না-থাকাটাই ভালো ছিল। কিন্তু তাকে ফেলতেও তো পারছেন না। কফিলউদ্দিন আহমেদ বাবা। তিনি আর সব। বাবাদের মতো বিশ্বাস করেন, সন্তানদের দুনিয়ার মুখ দেখিয়েছেন এই অঙ্গীকারে যে, সর্বশক্তি দিয়ে, শেষ সামর্থ খরচ করে তিনি তাদের রক্ষা করবেন। এত বড় যুদ্ধ। কত অসহায় তিনি। পারলেন না ছেলেমেয়েকে বাঁচাতে।
যে মানুষকে কোনো দিন কাঁদতে দেখা যায় না, সে যে কাঁদতে জানে, মানুষ তা ভুলে যায়। তার হো-হো শব্দে বুকফাটা চিৎকারটা তাই ঠাট্টার মতো শোনায়। মনোয়ারা বেগম প্রথম বুঝতে না-পেরে চমকে ওঠেন। দুজনের মাঝখানের দেয়ালটা যেন ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। পাথরসদৃশ একজন মানুষ, স্ত্রীর লুকিয়ে কান্নাও গত এক বছর যার অনুমোদন পায়নি, চোখের সামনে তাকে ভেঙেচুরে মাটি-কাদায় মিশে যেতে দেখছেন মনোয়ারা বেগম। হায় বাপ! এমন নিষ্ঠুর কেউ কি দুনিয়ায় আছে, যে সন্তানের মরা মুখ দেখার আগে নিজের মরণ চায় না? তার স্বামী আসলে তো একটা জিন্দা লাশ। মিলিটারির ভয়ে এতদিন বাঁচার ভান করে ছিলেন। মনোয়ারা বেগমের একার গোপন কান্না আর গোপন থাকে না, দুজনের কণ্ঠ চিরে তা জনসমক্ষে বেরিয়ে আসে।
দরজার পাল্লা ধরে হিক্কা তুলে কাঁদছে ছোট দুটি যমজ মেয়ে রত্না আর ছন্দা। চোখের জল আর হাতের কাদায় তাদের কচি গাল দুটি মাখামাখি। ফুলতলি গ্রাম ভেঙে পড়েছে বাড়ির উঠোনে। এক ঝাক কাক কা কা করে উড়ে আসে সুন্দরীর জলার ওপর দিয়ে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেখতে দেখতে আজ চার মাস হয়ে গেল। এলাকার কে বাঁচল, কে মারা গেল–এর হিসাব-নিকাশ শেষ। যুদ্ধের নয় মাস মিলিটারির ভয়ে গোপন রাখা হলেও মন্টুর ঘটনাটা এখন প্রকাশ্য। খবরের কাগজে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়ে তা জানান দেওয়া হয়ে গেছে। মেরি একা রহস্যময় পর্দার আড়ালে। তা বলে গাঁয়ের লোকের অজানা কিছু নেই। তারা শুধু এত দিনের গুজবটার সত্যতা যাচাই করতে উঠানে জড়ো হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর যৌথ শোকপ্রকাশের মধ্য দিয়ে তারা তা জেনেও গেছে। কফিলউদ্দিন আহমেদ যখন সস্ত্রীক ঢাকা রওনা করেন, গোপনীয়তার আব্রু হারিয়ে তখন পথের ভিখিরির অবস্থা তার। নিঃস্ব, সম্মানহীন। এই অবস্থায় তিনি সুন্দরীর জলা অতিক্রম করেন, ভিড় ঠেলে বাসে চড়েন, ভাঙা ব্রিজের নিচ দিয়ে খেয়া পার হন, তারপর খানিকটা রিকশা, ফেরি পারাপার, আবারও বাস, অবশেষে ঢাকা। সেখানে আছে গোলাম মোস্তফা, তার নিদানকালের বন্ধু, যে তাকে খোয়ানো সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারে।
গোলাম মোস্তফা তার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন।
মগবাজারের বাড়িতে যদিও আগের সেই জেল্লা নাই, জানালার পর্দা ঘেঁড়া, টেবিলের কাপড় ও বালিশের ওয়াড়ে ময়লা জমে মাটি মাটি; রসুইঘরের চুলায় রেশনের দুর্গন্ধময় চাল ফুটছে, তবু গোলাম মোস্তফা সদাহাস্যময় চেহারাটা নিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানান। মনোয়ারা বেগম মায়ের পেটের ভাইকে জড়িয়ে কেঁদেকেটে একশেষ। মামার কথায় ছেলেমেয়ে দুটিকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন শহরে। কখনো দুর্ভাগ্যের জন্য নিজের কপালের দোষ দিচ্ছেন, পরক্ষণে গোলাম মোস্তফাঁকে দায়ী করছেন। কফিলউদ্দিনের হাবভাব কিন্তু ভিন্ন। তিনি যেন মাতৃজঠরের নিরাপত্তায় প্রবেশ করেছেন। এমন একজন অবিচল মানুষই আজ তার দরকার, যে তার সামনে দাঁড়িয়ে এবং শত অভিযোগ-বিড়ম্বনায়ও যে চুল পরিমাণ টলছে না। তবে লোকটার পূর্বের কর্মোদ্যম আর তৎপরতায় যেন কিঞ্চিৎ ভাটা পড়েছে। বাড়ি থেকে সারা দিনে একবারও তাকে বেরোতে দেখা যায় না। বন্ধুবান্ধব থেকেও নেই। খবরের কাগজের অক্ষরগুলোই এখন তার দিকনির্দেশক। টাল টাল কাগজের তলা থেকে কফিলউদ্দিন আহমেদকে দেখানোর জন্য কয়েকটা পাতা তিনি টেনে বাইরে আনেন। মেরির মতো মেয়েদের চিকিৎসা আর পুনর্বাসনের জন্য বিদেশ থেকে টাকা আর মানুষ আসছে। মেয়েগুলো সুস্থ হওয়ার পর কাজ শিখবে। অর্থের অভাব নেই। তাদের চাকরি দেওয়া হবে। চাইলে কেউ কেউ ব্যবসা ফেঁদেও বসতে পারে। কিন্তু এসব কি জীবনের সব? বিয়ের দিকটা ভাবা দরকার। এ নিয়ে এমনকি সরকারও ভাবছে। বিয়ের বিজ্ঞাপন পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। গোলাম মোস্তফা নিউজপ্রিন্টের পাতাটা ভগ্নীপতির সামনে মেলে ধরে বলেন, ‘দুলাভাই, এই দেখেন।’
কফিলউদ্দিন আহমেদ ভিরমি খেলেন। সরকারের এত প্রশংসা যে, শ্যালক আবার দলবদল করল নাকি? তিনি গোলাম মোস্তফাঁকে দেখবেন, না কাগজের দিকে তাকাবেন। যেহেতু মেয়েটা তার এবং এ নিয়েই কথা হচ্ছে, তিনি কাগজে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু গোলাম মোস্তফা মনে করছেন, বীরাঙ্গনাদের যারা বিয়ে করতে আসছে তারা সৎ নয়, এখানে তাদের স্বার্থ আছে। সরকার যতই বাহবা দিক, তাদের দেশপ্রেমিক বলুক, তারা আসলে দেশপ্রেম থেকে আসে না বিয়ে করতে। সবার যেমনই হোক, মেরেকেটে একটা পরিবার আছে, সমাজ আছে। সমাজ চুপ থাকবে না। থাকলেও কত দিন। ওস্তাদের মার শেষ রাতে। যুদ্ধের শোকতাপ ফুরোনোর আগেই সমাজের বাকস্ফুরণ ঘটবে। ‘এ ছাড়া দুলাভাই!’ বড় বোন বা স্ত্রী আশপাশে আছে কি না একবার দেখে নিয়ে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আপনে পুরুষ, আমিও পুরুষ। আপনে ওদের বিয়ে করবেন, না আমি করব? কফিলউদ্দিন আহমেদকে। অপ্রস্তুত আর দুঃখিত হতে দেখে ঠা-ঠা করে হেসে উঠলেন তিনি। গলা থেকে চি-চি করে একটা চিকন আওয়াজও বেরোল। একা দ্বৈতকণ্ঠে হাসতে হাসতে গোলাম। মোস্তফা বড় বোনের স্বামীকে বললেন, ‘গতকাল দুলাভাই, সাজুকে কাগজটা দেখিয়ে কচ্ছিলাম–কি রে বিয়া করবি? অমনি ছেলের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।’
কফিলউদ্দিন আহমেদের মুখটাও শ্যালকের কথা শুনে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কত আশা করে ঢাকা এসেছেন। মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য তো আসেননি। বাড়ি নিয়ে কী করবেন? ঘরের খুঁটি দেবেন? ওর একটা সুব্যবস্থার জন্যই স্বামী-স্ত্রীর ঢাকা আসা। বীরাঙ্গনা বিয়ে করতে হাবা সাজুরও যদি অরুচি, অন্যরা কী করবে?
গোলাম মোস্তফা এরকমই চাইছিলেন আর এভাবে। কফিলউদ্দিন আহমেদকে অকূল দরিয়ায় ঠেলে দিয়ে, মেরির সঙ্গে সাজুর বিয়ের টোপ বঁড়শিতে গেঁথে তিনি পানিতে ফেললেন। দুলাভাইয়ের এখন টোপ না-গিলে তীরে ওঠার জো নেই। বীরাঙ্গনা যে বিয়ে করে, রাষ্ট্রীয়ভাবে সে যদি দেশপ্রেমিক হয়, তার বাপ কি রাজাকার? সে-ও দেশপ্রেমিকই। তবে মুখে বললেন, এ বিয়েতে গোলাম মোস্তফার কোনো খাই নেই, কোনো ডিমান্ড নেই। সরকার ঘোষিত সেলাই মেশিন, সংসারের হাঁড়িপাতিল, বাসনকোশন কিছুই তার চাই না। বর্তমানে বেহাল অবস্থায় পড়েছেন তো কী, এখনো মেরিকে দশটা সেলাই মেশিন কিনে দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন। রহমানের রাহিমের অশেষ কৃপা যে, সাজু ছোটবেলা থেকে মেরিকে ভালোবাসে। হোক না বোকা-হাবা, ভালোবাসার খামতি নেই। বিয়েতে তার আপত্তি থাকবে না।
কফিলউদ্দিন আহমেদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে–একটা লালা-ঝরা মুখ, বেকুব চেহারা, ঘিলুহীন মাথা। তার বিএ পাস মেয়েটার বিয়ে এই অমানুষটার সঙ্গে! অন্য সময় হলে এক থাপ্পড়ে শালার বড় মুখ ভোঁতা করে দিতেন। খোদা তাকে মেরে রেখেছে। ছেলেটা বেঁচে থাকলে দু’দিন আগে হোক পরে হোক এর শোধ তিনি তুলতেনই। কিন্তু আজ ভবিষ্যৎ বলেও তার কিছু নেই। মেয়েটাও কপালপোড়া। তাকে নিয়ে তিনি কী করবেন? ফুলতলি গায়ে ফিরবেন কোন মুখে? ভয়টা তার ওখানেই। শ্যালকের পীড়াপীড়িতে একসময় শ্রান্ত হয়ে বললেন, ‘তোমার বুবুর সঙ্গে কথা কয়ে দেখি। মেয়েটা তো তারও–নাকি?’
বাহ্ বাহ্, ভূতের মুখে রাম নাম। কস্মিনকালে কফিলউদ্দিন আহমেদ স্ত্রীর মত নিয়েছেন কি না সন্দেহ। কখন আবার বলে বসেন, মায়ের সঙ্গে মেয়েরও মত লাগবে। দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে জেনানারাও স্বাধীন, কোন কিতাবে লেখা আছে। রোজ তিন চারটা পত্রিকা তো গোলাম মোস্তফা একাই নাড়াচাড়া করেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। এই যে দফায় দফায় মিলিটারির জারজ বাচ্চা পাঠানো হচ্ছে বিদেশে, তা কি মায়েদের মত নিয়ে? হোক না বীরাঙ্গনা, মা তো। কোন মা বুক খালি করে চিরতরে দুধের সন্তান বিদেশ পাঠায়! আসলে স্ত্রীর মত নেওয়ার মতো কাঁচা লোক কফিলউদ্দিন নন। পাত্র হিসেবে সাজুর নাম গালে উঠছে না, তাই ছুতো খুঁজছেন। সময় নিচ্ছেন। যদি দৈবক্রমে বড় ঘরের পাত্র জুটে যায়! বাইরে সহজ-সরল, ভেতরে জিলিপির প্যাঁচ, নিজের এই ভগ্নীপতিকে তিনি ভালোমতোই চেনেন। তবে কথা হলো, শুভ কাজে বিলম্ব করতে নেই। তাই গোলাম মোস্তফা বললেন, ‘বুবুরে রাজি করানোর ভার আমার। ভাইপোটা তো তারও নাকি?’
এ শুধু কথার মারপ্যাঁচ নয়। বাস্তবটা অত্যন্ত কঠিন। বিশেষত সেই বাবা-মার জন্য, যাদের একমাত্র ছেলে নিখোঁজ আর মেয়ে বীরাঙ্গনা। এ সমস্ত কথা, একটা ময়লা বালিশ আর চোখের জল মনোয়ারা বেগম রাত জেগে স্বামীর সঙ্গে ভাগাভাগি করেন। বহুদিন পর মানুষটা আজ তার শোকের প্রকাশ্য অংশীদার। একসঙ্গে কাঁদছেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন, কথা বলছেন। এ ছাড়া পাশের ঘরে মায়ের পেটের ভাই ঘুমাচ্ছে। তার নাক ডাকার আওয়াজটাও কেমন স্বস্তিদায়ক। মনোয়ারা বেগম ভাবছিলেন, জীবন অসহ্য কষ্টের হলেও দুনিয়ায় তিনি একা দুঃখী নন। একই ছাদের নিচে আজ রাতে তার স্বামী আছেন, ভাই আছে। পরদিন হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে দেখতে পাবেন। শোক-তাপের মধ্যেও হাতে কিছু-না-কিছু থাকেই মানুষের-একটি ক্রন্দনের রাত, বালিশ আর বেদনা ভাগাভাগির রাত, প্রতীক্ষার রাত, নিঘুম রাত। এর মাত্র মাস তিনেক পর মনোয়ারা বেগমের মনে হবে, এই রাতটা তার জীবনে কোনোদিন আসেনি। এসে থাকলেও, এ ছিল স্বপ্ন। স্বামী, ভাই, নিজের বলে কেউ কোনোদিন তার ছিল না। একমাত্র সত্য যা, তিনি পুত্রহীন। আরেকটা ছেলের জন্ম দেওয়ার তার ক্ষমতা নেই।
পরদিন সকাল থেকে অঘটনগুলো ঘটতে শুরু করে। বোনের বীরাঙ্গনা অফিসে মেয়েমানুষ দেখলেই লোকজন সন্দেহ করে। সে যে-কোনো বয়সের হোক না-কেন, ভাবে বীরাঙ্গনা। অগত্যা কফিলউদ্দিন আহমেদ একাই গেলেন। গোলাম মোস্তফা থাকলেন আড়ালে, সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে এক পান দোকানদারের টঙের পেছনে। তবে ঘুড়ির লাটাই তার হাতে। সেখান থেকেই তিনি সুতো টানছিলেন আর ছাড়ছিলেন। প্রথমবার তিন নম্বর রোডের মাথায় কফিলউদ্দিন আহমেদকে একা ফিরতে দেখে তার মাথায় আগুন ধরে যায়। বাবা মেয়ে আনতে গেছে, শ্বশুরবাড়ি নাকি। যে তারা মেয়ে দেবে না, আটকে রাখবে? তারপর মেরির মাথা বিগড়ে যাওয়ার খবরটাও তাকে টলাতে পারে না। ভগ্নীপতিকে বললেন, বংশে পাগল থাকলে যুদ্ধের কী দোষ। এই অবস্থায় ডাক্তাররাই-বা কী করবে। যা করার মেয়ের বাপ-মা করবে। কফিলউদ্দিন আহমেদ দ্বিতীয়বার ফিরে এসে যখন জানালেন, মেরিকে সপ্তাহ খানেক পর রিলিজ দেওয়া হবে, তখন গোলাম মোস্তফার বুদ্ধির থলে শূন্য হয়ে গেল। এখন। খানিকটা সময় নিরিবিলি চিন্তা করা দরকার। রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে তা সম্ভব নয়। কখন কে দেখে ফেলে। হিন্দুরা দলে দলে ভারত থেকে ফিরে আসছে। যুদ্ধের সময় ঢাকায় গোলাম মোস্তফার কর্মকাণ্ড শূন্য। যা করেছেন গাঁয়ে। এই যেমন ঘরবাড়ি লুটপাট করে, ভয় দেখিয়ে পাকিস্তান থেকে হিন্দুদের ছাঁ-পোনাসহ হিন্দুস্থানে চলে যেতে বাধ্য করা। কারণ ভয়টা তার হিন্দুদের চেয়ে তাদের জমিজমা নিয়েই বেশি। ঝাড়ে-বংশে মালাওন খেদাতে না-পারলে নিজে তিনি বিপদমুক্ত হচ্ছিলেন না। অন্যদিকে নয় মাস মুসলমানদের কাঠি দিয়েও ছুঁয়ে দেখেননি তিনি। দু-চারজনকে বরং কৌশলে গুলির মুখ থেকে বাঁচিয়েছেন। সেই সুবাদে একদল মুক্তিযোদ্ধা তাকে বন্দি করলে আরেক দল এসে ছেড়ে দেয়। এই খেলাই গত চার মাস ধরে চলছে। তার পরও বিপদ কখনো বলে-কয়ে আসে না। তাই কফিলউদ্দিন আহমেদ রায়েরবাজারের বাসা থেকে এক পাক ঘুরে আসতে চাইলে, তিনি তাকে একা রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যান।
বাসার সামনের রাস্তা ধরে কফিলউদ্দিন আহমেদ বারবার টহল দিচ্ছেন, অথচ নিজের বাড়ি চিনতে পারছেন না। যে বাঁশঝাড়টা নিশানা হতে পারত, তা উধাও। কালো গেটের গায়ে সাদা রঙে লেখা ঠিকানাটা নেই। উঠোনের টিউবওয়েলের মাথা ভাঙা। চারপাশের মুলিবাঁশের বেড়া মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সন্তান আর জমি–এই যার সারা জীবনের অর্জন, এসব চলে গেলে আর কী থাকে মানুষের! গাঁয়ে বসেই শহরের বাসার হালহকিকত লোকমুখে তিনি শুনেছিলেন। তবে এসে যে বাড়িটা খুঁজে পাবেন না, তা গায়েব হয়ে যাবে-ভাবতে পারেননি। নিজের কপালের গাল-মন্দ করতে করতে যখন ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছেন, তখন পাশের বাড়ি থেকে একজন রাস্তায় নেমে আসে। লোকটা সুহৃদ। কফিলউদ্দিন আহমেদকে চেনে বাড়ি করার সময় থেকে। তারপর বহুদিন দেখা হয়নি। তবে যুদ্ধ মানুষের চেহারা-ছবি এমন বদলে দিয়েছে যে, আপনজনকেও আজকাল অচেনা লাগে। ঘরদোরের কথা না-হয় বাদই দেওয়া গেল। কফিলউদ্দিন আহমেদকে লোকটা বাড়ির দোর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। মাইনের ভয়ে নিজে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। স্বয়ং বাড়ির মালিকেরও তখন আর সাহস হয় না ভেতরে ঢোকার। তিনিও পড়শির পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
বাড়িটা বলতে গেলে যুদ্ধের পুরো সময় আর্মির প্রমোদখানা ছিল। তখনই মুক্তিফৌজের ভয়ে বাঁশঝাড় নির্মূল করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় লেখা ঠিকানাটা মুছে এর জায়গায় টাঙানো হয় নতুন সাইনবোর্ড, তাতে উর্দুতে লেখা–হারেম। এসব হাজি সাহেবের অসামান্য কীর্তি। তবে পড়শি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ যে, আশপাশের লোকজনের জানমাল তিনি রক্ষা করেছেন। কিন্তু আমার জানমালের যে ক্ষতি করল-কফিলউদ্দিন আহমেদ চটে গেলেন। সবাই যদি এভাবে রাজাকারদের সাফাই গায়, সরকার যতই দালাল-রাজাকার পাকড়াও করুক, বিচারটা হবে কীভাবে। অপরাধ প্রমাণ করতে সাক্ষী তো লাগে, নাকি? পড়শি কফিলউদ্দিন আহমেদের প্রতি সহানুভূতিশীল, তবে তার ক্ষতির ব্যাপারে একমত নয়। কারণ হাজি সাহেব বাঁশঝাড় কেটে সাফ করে অন্যায় কিছু করেননি। শহরে ঝোঁপজঙ্গল থাকাটাই বেমানান। কফিলউদ্দিন আহমেদ এবার লজ্জায় অপোবদন, অজায়গায় একটা বাঁশঝাড় জন্ম দিয়ে তিনি যেন রাজাকারির চেয়েও বড় অপরাধ করে ফেলেছেন। পড়শির আগ্রহ তাতে বেড়ে যায়। সে বলে, সেই সঙ্গে হাজির খরচায় তার খাট্টা পায়খানাটা যে তখন পাকা হয়ে গেল, এই হিসাবটাও ধরা দরকার। চলে যাওয়ার আগে বাড়ির ভিটায় মাইন পুঁতে গেছে মিলিটারি। আর টিউবওয়েলের মাথা গায়েব হয়েছে স্বাধীনতার সময়। এরপর এখানে তৈরি হয় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। তারা উর্দুতে লেখা সাইনবোর্ড টেনে নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। মিলিটারিরা দরজা-জানালার পাল্লা ভেঙে বিরানি পাকিয়েছিল। কাঠের চেয়ার টেবিল আলনা খাট আর টিনের চাল খুলে দিনদুপুরে লোক লাগিয়ে নিয়ে গেছে। হাজির এক সাগরেদ। আর রাতের বেলা বই-খাতা, হাঁড়িপাতিল সের দরে বিক্রির জন্য তুলে নেয় এক ছিঁচকে চোর। মাইন ফেটে একজন মুক্তিযোদ্ধার পা উড়ে গেল। সেই পা হাসপাতালে যাওয়ার পর কেটে বাদ দিয়েছিল এক বিদেশি ডাক্তার। পাতকুয়োটা বুজিয়ে ফেলা হয়েছে যুদ্ধের পর, কারণ মেয়েদের মাথার চুল আর হাড়গোড়ে তা ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় সৈন্যরা মাইন উদ্ধার করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
পড়শি ক্লান্ত হয়ে থামে। আর কফিলউদ্দিন আহমেদ হতবুদ্ধি হয়ে। ভাবেন–বাড়িটার কে কখন কী ক্ষতি করেছে, এভাবে দশবার বললেও তার মাথায় ঢুকবে না। তার সামনে দণ্ডায়মান কঙ্কাল-একটা বাড়ির, একটা দেশের । একাত্তরের ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষমতার পালাবদলের যা জবরদস্ত সাক্ষী হতে পারে। এমনকি হতে পারে একটি আদর্শ জাদুঘর। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বিদেশি পর্যটক, মফস্বলের কৌতূহলী মানুষ আর প্রেমিক-প্রেমিকার দর্শনীয় স্থান। স্বল্পমূল্যের টিকিটের বিনিময়ে তারা যে ফটক পেরিয়ে জাদুঘরে প্রবেশ করবে, এর গায়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড লটকানো থাকবে। তাতে লেখা–এই বাড়ির মালিক কফিলউদ্দিন আহমেদ, সাং ফুলতলি, ডাকঘর সাহারপাড়। তিনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বছর জনৈক হিন্দু ধর্মাবলম্বী নিখিল চন্দ্র সাহার পাঁচ কাঠা জমি জলের দরে খরিদ করেন, গায়ের অনুরূপ একটি বাটি এখানে নির্মাণ করেন। তাতে মন্টু নামদার পুত্র এবং মেরি নাম্নী এক কন্যা বসবাস করত। তারা উভয়েই ছিল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে মন্টু শহিদ হয় আর মেরি প্রকারান্তরে মরিয়ম হয় বীরাঙ্গনা। বাড়িটা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর হাতবদল হয়ে ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে গৃহকর্তা কফিলউদ্দিন আহমেদের হস্তগত হয়। তারপর যে অবস্থায় বাড়িটা তিনি হস্তান্তর করেছেন, কোনোরূপ পরিবর্তন বা বিকৃতি ব্যতিরেকে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তদাবস্থায় তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছে।
মরিয়মই প্রথম দর্শক, যে বাড়িটিতে প্রবেশ করে, তবে ঘোরের মধ্যে। সে কালো গেট দিয়ে ঢুকে এলোমেলো ইটের ওপর পা ফেলে কর্দমাক্ত জায়গাটা পেরিয়ে যায়। কল চেপে পেট পুরে পানি খায়। খানিকটা বাঁশঝাড়ের ছায়ায় জিরিয়ে, মন্টুর রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যায় নিজের ঘরে। তারপর শুয়ে পড়ে সেই বিছানায়, যেখান থেকে ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ ভাঙার পর মহল্লার লোকজনের সঙ্গে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। বহুদিন পর আজ নিজের ঘরে, নিজের শয্যায়। বালিশে মাথা রাখতেই এক রাজ্যের ঘুম তাকে গ্রাস করে।
গত দুদিন মগবাজারের বাসায় এমন হয়েছে যে, মরিয়ম ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুমাতে পারেনি। পাশের ঘরে দফায় দফায় গোলাম মোস্তফার সঙ্গে কফিলউদ্দিন আহমেদের বৈঠক বসছে আর রাগারাগি, চিল্লাচিল্লির মধ্য দিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। বিষয়টা কী-মরিয়ম জানে না। তাকে জানানোও হয়নি। তবে ঘুমের ঘোরে সে বুঝে যে, একটা ষড়যন্ত্র চলছে, যা পুরোনো। তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হবে। নওশা সেজে যে আসে, সে আর কেউ নয়–সাজু। সে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলে মনোয়ারা বেগম তাকে আবার শুইয়ে দেন বিছানায়। পানির গ্লাস হাতে ছুটে আসেন গোলাম মোস্তফার স্বল্পবাক স্ত্রী জ্বলেখা বিবি। শেষবার মরিয়মের শরীরে অসুর ভর করে। সে বিছানা থেকে উঠেই মনোয়ারা বেগমকে ধাক্কা মেরে, জ্বলেখা বিবির হাতের গ্লাস উল্টে দিয়ে, দুয়ার খুলে বেরিয়ে যায়। কফিলউদ্দিন আহমেদ চিৎকার করে, রায়েরবাজারের বাসায় যে মাইন পোঁতা আছে, সেই ভয় দেখান মেয়েকে। তাতে কাজ হয় না। অগত্যা আরেকটা রিকশায় লাফিয়ে উঠে মেয়ের পেছন পেছন তিনি ছোটেন।
বাড়িটা দেখলেই কফিলউদ্দিন আহমেদের মনে আধ্যাত্মিক ভাব জেগে ওঠে। এ তো শূন্যের মধ্যে বসতবাড়ি। তার জীবনের অনুরূপ। কপাটবিহীন দরজা-জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়, বাতাস নির্বিঘ্নে চলাচল করে। পাখিরা উড়ে বেড়ায়। মাথার ওপর রোদ-বৃষ্টি সরাসরি কিরণ ও পানি দেয়। মগবাজার থেকে রায়েরবাজার রিকশায় এটুকু পথ আসতেই মরিয়মের শক্তি বা তেজ নিঃশেষ হয়ে গেছে। কফিলউদ্দিন আহমেদ পৌঁছে দেখেন, খোলা ছাদের নিচে, খালি মেঝেতে কুঁকড়ে-মুকড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে সে। মেয়েটা কি তার শেষমেশ পাগল হয়ে গেল? যে বাড়ির ছাদ নেই, দুয়ার নেই, ফটক নেই, বাউন্ডারি ওয়াল নেই, সেখানে পাগল ছাড়া কেউ এমন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে?
একদিকে মেয়ে, আরেক দিকে শ্যালক-দুজনেই স্বজন, দুজনেই তার শত্রু। মাঝখানে পড়ে গলায় দড়ি দেওয়ার উপক্রম হয়েছে তার। মেয়েটার চোখের দিকে আজকাল আর তাকানো যায় না। যতক্ষণ চেতন থাকে, লাটিমের মতো চোখের তারা দুটি ঘোরে, না-হয় জ্বলতে থাকে ধকধক করে। যেন একখণ্ড কাঠ কি কাগজের টুকরা কাছে ধরলেই দপ করে আগুন জ্বলে উঠবে। অবিকল কফিলউদ্দিন আহমেদের আম্মাজানের চোখ। বছরের দু-তিনটা মাস ছাড়া বাকি সময় তিনি পাগল থাকতেন। তখন দুনিয়াদারির বিরুদ্ধে তার অজস্র অভিযোগ। কফিলউদ্দিন আহমেদের নানাজান সেই কোন কালে মেয়েকে যে গাজির গীত শুনতে যেতে দেননি, তা নিয়ে তিনি আস্ত এক দুপুর নিজের বাপকে গালমন্দ করতেন। বাকি দিনটা কাটত মৃত শাশুড়ির পিণ্ডি চটকাতে চটকাতে। কারণ গাঁয়ে যেইবার খুনের আসামি ধরতে গুর্খা সৈন্য আসে, সেইবার জ্যৈষ্ঠ মাসে তাকে বাপেরবাড়ি যেতে দেওয়া হয়নি। তবে উচিত শাস্তি হয়েছে। যে, গুর্খারা আসামি না-পেয়ে গাঁয়ের বাড়ি বাড়ি ঢুকে চাল-ডাল সব এক করে রেখে গেলে এর পরের ছয় মাস গোটা গ্রাম শুধু খিচুড়ি খেয়ে কাটায়। পঞ্চাশ সনের দুর্ভিক্ষের বছর একদিন বাড়ির সবাই ভাত খেয়ে তার জন্য যে ফ্যান রেখে দিয়েছিল, সেই দুঃখ কফিলউদ্দিন আহমেদের আম্মাজানের বছরের নয় মাসের কোনো একদিন ঠিক মনে পড়ে যেত। সেদিন তিনি উপোস থাকতেন। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা হাতে-পায়ে ধরেও তাকে ভাত খাওয়াতে পারত না। স্বামী এক চোখ কানা, নিরীহ মানুষ। কলাপাতার শয্যায় গুটিবসন্ত তাকে ফেলে গেলেও একটা চোখ নিয়ে নেয়। অন্য চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ কমে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় স্ত্রীর পাগলামি সহ্য করা ছাড়া কফিলউদ্দিন আহমেদের আব্বাজান সলিমুদ্দিনের আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু মেরিকে সহ্য করবে কে, এক সাজু ছাড়া?
কফিলউদ্দিন আহমেদের এই বিয়েতে যে অমত নেই, তা যেন গোলাম মোস্তফার বিশ্বাস হতে চায় না। মেয়েটা ওষুধের ঘোরে থাকতে থাকতে মৌলবি ডেকে বিয়েটা তিনি পড়িয়ে ফেলতে চান। তারপর শামিয়ানা টাঙিয়ে মাইক বাজিয়ে উৎসব হবে। প্রধান অতিথি সস্ত্রীক বঙ্গবন্ধু। তিনি ব্যস্ততার কারণে আসতে না পারলে, বেগম মুজিব ঠিকই আসবেন। বীরাঙ্গনা-বিবাহের তিনি সবচেয়ে বড় উদ্যোক্তা। এভাবে মরা হাতিও। যে লাখ টাকা, গোলাম মোস্তফা দেশবাসীকে তা জানিয়ে ছাড়বেন। কাগজে ছবি ছাপা হবে–আরেকটি বীরাঙ্গনা-বিবাহ। কন্যা সম্প্রদান করছেন স্বয়ং বেগম মুজিব। পাত্র সাজেদ মোস্তফা ওরফে সাজু, পিতা গোলাম মোস্তফা আর পাত্রী হচ্ছেন বীরাঙ্গনা মোসাম্মৎ মরিয়ম বেগম, পিতা কফিলউদ্দিন আহমেদ। এই শেষের বাক্যটায়
কফিলউদ্দিন আহমেদের অসুবিধা আছে। কাগজে ছবি ছাপিয়ে ঢাকঢোল পিটানোতেও তার ঘোর আপত্তি। এখনো যেসব লোক মরিয়মের ঘটনা জানে না, গোলাম মোস্তফা এসব করে তাদের জানিয়ে ছাড়বে। তিনি তাতে রাজি নন। শ্যালকও নিজের কথা থেকে এক চুল নড়বে না। পাশের ঘরে মেয়েটা ঘুমাবে কী, এ নিয়ে তো বাড়িতে মহা শোরগোল।
পরিস্থিতি এমন যে কারো সঙ্গে কারো মতের মিল হচ্ছে না, কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। তবে বাইরে বাইরে সবাই একটা আপোসের ভাব বজায় রেখে চলে। কারণ গোলাম মোস্তফার পাকিস্তানের দালাল থেকে রাতারাতি দেশপ্রেমিক হওয়া দরকার। এতে করে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া বাড়ি দুটির পুনর্দখলও সম্ভব। আর কফিলউদ্দিন আহমেদ কন্যাদায়গ্রস্ত অবস্থা থেকে আশু মুক্তি চান। সেই মতো ঠিক হয়, মেরির ওষুধের ঘোর কাটার পর বিয়ের আয়োজন করা হবে। পত্রিকায় বিয়ের খবর যাবে, তবে ছবি ছাপা হবে না। এ নিয়ে মগবাজারের বাড়িতে সভা-সমিতি বন্ধ থাকবে। হইহট্টগোল করা থেকে উভয় পক্ষ কিছুদিন অন্তত বিরত থাকবেন।
আপাতশান্তিপূর্ণ এমন এক পরিবেশে রায়েরবাজার থেকে মগবাজারের বাসায় এনে দরজায় শিকল দিয়ে মেরিকে কয়েক দিন রাখা হয়। কিন্তু গোলাম মোস্তফাঁকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, বিশেষত ছবি ছাপানোর ব্যাপারে। এ ছাড়া কাগজে বিয়ের খবর প্রকাশ হওয়াই তো যথেষ্ট। মানুষ নাম-ঠিকানা জেনে ঠিকই চেহারা বের করে ফেলবে। কফিলউদ্দিন আহমেদ তাতে গররাজি। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারছেন না। বিয়েশাদি দর-কষাকষির ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে লুকোছাপার দরকার পড়েই, যা গোলাম মোস্তফার আশ্রয়ে থেকে সম্ভব নয়। তাই তিনি নিজের দিকটা শক্ত রাখার জন্য রায়েরবাজারের ভাঙা বাড়ি মেরামতে তড়িঘড়ি হাত দেন।
মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। এদিক দিয়ে গোলাম মোস্তফা কফিলউদ্দিন আহমেদের চেয়ে সঠিক ছিলেন। মরিয়মের ওষুধের ঘোর কাটার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের যাবতীয় পরিকল্পনা-প্রস্তুতি মাঠে মারা যায়। অন্ধ পিতা যে কারণে স্ত্রীকে পোষ মানাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, চোখ থাকা সত্ত্বেও সেই একই কারণে পুত্র তার কন্যাকে বাগে আনতে পারেননি। কারণ নারী দুটি ছিল সত্যিকারের পাগল।