২৫. ও আমার দরদি…

ও আমার দরদি..

অমাবস্যার এক ঘুটঘুঁটে অন্ধকার রাতে আবেদ সামির দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। তাদের কচ্ছপ গতির সম্পর্ক অতি দ্রুত রূপান্তরিত হয় খরগোশ-রেসে। নারী জানতে চায় না, পুরুষ এত দিন ডুব দিয়েছিল কোথায়–কী তার বৃত্তান্ত। তবু পুরুষটির মুখ থেকে সে স্বগতোক্তি শোনে–কাব্যের পথ বড় পিছল। তাতে বিস্তর সাধনা লাগে। ঘাটে, আঘাটে গমন সাধকের জন্য জরুরি। সামির প্রথম দু’রাত বিশ টাকার বিনিময়ে এক বেশ্যার শরীরের ভাঁজ খোলা শুধু দূরে বসে দেখেছে। তৃতীয় রাতে স্পর্শ অবশ্যম্ভাবী জেনে টাকা না দিয়ে পালিয়ে আসে। পেছনের বীভৎস গালাগাল দুদিন আগের ঘটনা হলেও, এখন তা মনে পড়াতে সে মরিয়মের পাশে বসে কানে হাত চাপা দেয়। তারপর হয়তো প্রশ্ন করা যেত, সে এখানে কেন? এ ঘাট, না আঘাট? কাব্যসাধনার বাহন এবার তাহলে মরিয়ম!

মরিয়ম অন্ধকারে চোখ রেখে শুধু শুনে যায়, প্রশ্ন করে না। অভিজ্ঞতা থেকে জানে, স্বামী-সন্তানের বাইরে অন্যরকম যে জীবন, যাতে মনোয়ারা বেগমেরও সায় আছে, সেখানে এসব প্রশ্ন করা বৃথা আর জবাবগুলো হয় প্রতারণায় ভরা। তাতে বিড়ম্বনা বাড়ে বৈ কমে না। সম্পর্কের শুরুর দিকে কাস্টমারের বেঞ্চিতে বসে সন্ধ্যায় সাহিত্যপাঠের যে সাজানো আসর, তা ছিল দুজন নরনারীর একসঙ্গে সময় কাটানোর অজুহাত। তাতে শরীরের দেনা-পাওনার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল। মা চলে যাওয়ার পর তারা বেঞ্চি ছেড়ে বিছানায় উঠে আসে। চার বছর দীর্ঘ সময়, নশ্বর শরীরের জন্য তো অবশ্যই। যুদ্ধের পর এই প্রথম মরিয়মের শরীর ও মন তৈরি হয়েছে। আপাতত মন বাদ দিয়ে শরীর শরীরের পাওনা শোধ করে।

আবেদ সামির অনভিজ্ঞ পুরুষ। তার আচরণ বেতাল, বেখাপ্পা হলেও মমতাজ বা পাকিস্তানি সৈন্যদের মতো মুখে ‘হুইস্কির গন্ধ নিয়ে সে আসে না। যে গন্ধটা পিস্তল ছাড়াই মরিয়মকে আগাম সারেন্ডার করতে বাধ্য করত। মমতাজ এ নিয়ে খুশি ছিল না। তার মতে, যে আগ বাড়িয়ে আত্মসমর্পণ করে, হাত ধরলেই যার শরীরের ভাঁজ খুলে যায়–সে বেশ্যা। মমতাজের পরিচিত বেশ্যাদের মতো আচরণ করায় অল্প ক’দিনেই মরিয়মের বিয়েটা ভেঙে যায়। এখন আবেদ সামির বিছানায় লম্বা হয়ে কাতর গলায় বলে, ‘মেরি আমারে শিখাও, আমি শিখতে চাই।’

যুদ্ধের চার বছর পর মরা মাছের চোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছে। এ দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। মরিয়ম দেখছে–ছেলেটি যৌনতার পাঠ নিতে চায় এমন এক নারীর কাছে, যে দিনের পর দিন ধর্ষিত হয়েছে। সে এজন্য একজন পেশাদার বেশ্যার কাছে যেতে পারত। গিয়েছিল। তবে জায়গাটা নোংরা, অস্বাস্থ্যকর। পুলিশ রেইডের ভয় আছে। বাজে রোগ-ব্যারামেও আক্রান্ত হতে পারে। তাই ওখানে না গিয়ে আবেদ সামির মরিয়মের বাসায় এসেছে। পকেটে ওই বিশ টাকা। যা দিয়ে বাসায় ঢোকার আগে কেনে। খাবারদাবার বা মরিয়মের জন্য সস্তা প্রসাধন। মা-মেয়ে টেইলারিংয়ের ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। আবেদ সামির প্যাকেট খুলে যখন বলে, দুপুরে খাওয়ার সময় পাই নাই, আসো মেরি দুজনে মিলে খাই’ মরিয়ম তখন হাত ধুয়ে খেতে বসে যায়। তা ছাড়া সাবান, পাউডার, কেশতেল যে দেয় আর যে নেয়, সত্যটা তারা দুজনে প্রকাশ্যেই গোপন করে।

এসব নিয়ে মরিয়ম আজকাল ভাবে না। যা নিয়ে ভাবে, তার কূলকিনারা পায় না। স্বামী-সন্তানের বাইরের অন্যরকম জীবনটা একা মরিয়মের। আবেদ সামির এখানে শুধু লেফট-রাইট করছে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার পাতার সামর্থ্য হলেই সে পালাবে। এ সময়টা তখন হবে অতীত অভিজ্ঞতা–যা তার সাহিত্যের জন্য একান্ত জরুরি। কথা হলো, অভিজ্ঞতা অর্জন কত দিন ধরে চলবে। তা কি গলায় প্যাচানো গজফিতাটা দিয়ে মাপা সম্ভব? কিছু একটা করতে হয় বলে মরিয়ম একদিন তা করার চেষ্টা করে। তাতে আবেদ সামির রেগে আগুন, ‘তোমাদের মেয়েদের এ এক দোষ। ভালোবাসাকেও তোমরা ফিতা দিয়ে মাপতে চাও।

‘ওহ্, এ তাইলে ভালোবাসা?’

‘ভালোবাসাই তো!’

‘খাবারের প্যাকেট আর তেল-সাবান-পাউডার?’

‘গিফট।’

গিফট হোক আর যা হোক অভাবের সংসারে এসবের দরকার আছে। মরিয়ম হতাশ হয়ে বলে, এসব কথা বাদ দেও এখন।

আবেদ সামির সঙ্গে সঙ্গে বাদ দিলেও মরিয়মই দেয় না। সুখ যদি তার কপালে–ই থাকে, নিজে সে অন্যের সুখের উপলক্ষ হবে কেন, সামান্য কয়েকটা জিনিসের বিনিময়ে? সে আসলে ধূপ না, চ্যালা কাঠ। আগুনে সশব্দে জ্বলে আর গলগলিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। স্বল্প মূল্যে সুখ বিলানো এমন মেয়ের কাজ নয়। ধোঁয়ার ভেতর হেঁচে-কেশে যে যত দিন থাকতে পারবে–থাকবে, না হয় চলে যাবে। কেউ তো চিরদিন থাকার জন্য তার কাছে আসে না। নিজের মা-ই থাকল না, অন্যকে দোষ দিয়ে কী লাভ।

মাস খানেক হয় মনোয়ারা বেগম চলে গেছেন। যাওয়ার সময় মেয়েকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিতেও দেননি। মরিয়ম, আমি কি কচি খুকি যে তুই আমারে আউগাইয়া দিবি? বাসায় থাক, মা। কাস্টমার আইয়্যা ফিরা যাইব।’ মরিয়ম দাঁড়িয়ে থাকে কলতলার আধখান ইটের ওপর। ডান হাত কাপড় মেলার দড়িটা খামচে ধরা। বাঁ হাতে আঁচলের খুঁট তুলে চোখ মোছে সে। তখন মন্টুর মতো এলোমেলো ইটের ওপর পা ফেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যান মা। মন্টুর সামনে ভয়াল যুদ্ধ ছিল। সে আর ফেরেনি। মা কি ফিরবেন?

রোজ সকালে বারান্দার বেঞ্চিতে বসে মরিয়ম ভাবে, মা তো ফিরে গিয়ে কোনো । চিঠিপত্র দিল না, সে বরং আজ লিখবে। তুমি আমারে মুক্তি দিয়ে গেছ মা। আমি ভালো আছি। তারপর কি আবেদ সামিরের কথা লিখবে চিঠিতে? ছেলেটা এখনো তার শয্যায়, আরাম করে ঘুমাচ্ছে। সে রাতে থেকে গেলে মরিয়মের খুব টেনশন হয়। নতুন কাপড় নিয়ে কোনো অধৈর্য কাস্টমার যদি সকালবেলায় বাসি মুখে চলে আসে, তাকে গেট দিয়ে কিছুতেই ঢুকতে দেওয়া যাবে না। দরকার পড়লে সেখানে দাঁড় করিয়ে গজফিতা দিয়ে মরিয়ম তার বডির মাপ নেবে। রসিদ কেটে বিদায় করে দেবে ওখান থেকেই। সেইমতো গলায় ফিতা পেঁচিয়ে, খাতাপত্র, চক-পেনসিল হাতে নিয়ে মরিয়ম অন্ধকার থাকতেই বারান্দার বেঞ্চিতে গিয়ে বসে। কাঠের বেঞ্চিটা আরামের না হলেও স্বস্তিদায়ক। মাকে চিঠি লেখা থেকে শুরু করে সারা জীবনের যাবতীয় অসমাপ্ত কাজ ওখানে বসেই মনে মনে শেষ করে সে। তাতে হয়তো তার পরিশ্রম হয়। গজফিতাটা ফাঁসির দড়ির মতো গলায় পেঁচিয়ে সেখানে সে ঘুমিয়ে পড়ে। তার কোলে খাতার পাতাগুলো ভোরের মৃদুমন্দ হাওয়ায় ক্যালেন্ডারের মতো উল্টে যায়।

সময় কত দ্রুত চলে যাচ্ছে। ভালো-মন্দ মিলিয়ে দেখতে দেখতে চারটা বছর চলে গেল। সরফরাজ বিয়ে করেছে। তার মেয়ের বয়স ছয় মাস পেরিয়ে দুদিন পর সাতে পড়বে। মন্টু যেখানে ছিল সেখানেই তার বয়স বাড়ে না। বিয়েশাদিরও ব্যাপার নেই। গতকাল ঢাকা এসে শরিফ ভাইয়ের সঙ্গে সরফরাজ দেখা করতে গিয়েছিল। মন্টুর কবর পাকা করার কথা তিনিই তুললেন। তারপর কথায় কথায় জানালেন যে, আগামী বিজয় দিবসে সহযোদ্ধারা যে যেখানেই থাকুক, ঢাকায় তাদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান হবে। স্যুভেনিরের কাজটা এখন থেকে শুরু করা দরকার। তার জন্য মন্টুর একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি চাই। দায়িত্বটা পড়েছে সরফরাজের ওপর। যদিও বিজয় দিবসের আরো পাঁচ মাস বাকি, সে বাড়ি ফেরার পথে সকাল সকাল কফিলউদ্দিন আহমেদের বাসার সামনে দুরু দুরু বুকে মন্টুর ছবির জন্য হাজির হয়। গতবার সরফরাজ আশা করেছিল, মন্টুর মেরিবু দরজা খুলে দেবেন। তিনি তখন ছিলেন না। সস্ত্রীক কফিলউদ্দিন সাহেবকে ছেলের মৃত্যুসংবাদ জানাতে হয়েছিল। আজ মন্টুর বাবা-মাকে যখন সে আশা করছে, তখন গেট খুলে আলুথালু বেশে এক দজ্জাল প্রকৃতির মহিলা তার সামনে দাঁড়ায়।

মরিয়মের কাস্টমাররা সব মহিলা। পুরুষ হলেও দাড়ি-গোঁফ গজাতে কয়েক বছর বাকি এমন সব বালক, যারা ইজের সেলাই করাতে মায়ের হাত ধরে আসে। অথবা ফুলপ্যান্ট পরার শখ, বয়স হয়নি বলে বাবা-মা কিনে দিচ্ছে না, বাবার ওল্ড ফ্যাশনের খাকি প্যান্ট নিয়ে এসে বলে, কাইট্টা ছোড কইরা দেন, আর কোমর সরু করে ইলাস্টিক বসাইবেন। তারাও মায়ের সঙ্গেই আসে। একে তো মা ছাড়া, তার ওপর প্রাপ্তবয়স্ক একজন পুরুষ সকাল না হতেই দোরগড়ায়, মন্টুর নাম বারবার। উচ্চারণ করার পরও লোকটার কথা বুঝতে মরিয়মের সময় লাগে। যখন বোঝে, তখন তার মনে পড়ে, আবেদ সামির মশারির নিচে। লোকটাকে বাড়ির ভেতর নেওয়া যাবে না। এ অবস্থায় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে মন্টুর ছবি যে ফুলতলি থেকে আনাতে মাস খানেক সময় লাগবে, কারণ জানেন তো, আমাদের আর কোনো ভাই নাই, আব্বার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না এসব কথা ঘরের দিকে এক চোখ রেখে মরিয়ম গড়গড়িয়ে বলে যায়। সরফরাজ অবাক হয়ে কিছু শোনে কিছু শোনে না। তার সামনে দর্জির ডিজাইনের খাতাটা বাড়িয়ে দেওয়া হলে, সে তাতে কী ভেবে মন্টুর শেষ যুদ্ধক্ষেত্রের নাম লিখে দেয়, যেখানে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা সাইফুদ্দিন আহমেদের কবর। কবরটা যে গেল বছরের বন্যায় ভেঙেচুরে ডেবে গেছে, এর সংস্কার দরকার-এ কথাটা এক নিঃশ্বাসে এলোমেলোভাবে বলে সে। কারণ সরফরাজের মনে হয়, তার কথাবার্তার প্রতি মহিলার বিশেষ মনোযোগ নেই। তারপর মাস খানেক পর তাকে আসতে বলা হলে, সে গেটের বাইরে থেকেই বিদায় নেয়। তাদের দুজনের কারোর তখন জানার কথা নয় যে, মন্টুর ছবিটার আর কোনোদিন দরকার হবে না। কারণ আর মাত্র দশ দিন পর ১৫ আগস্ট, সেদিনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী বিজয় দিবসের স্যুভেনির প্রকাশ শরিফ ভাইয়ের হাতছাড়া হয়ে যাবে।

সরফরাজের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে মরিয়মের হঠাৎ মনে পড়ে, লোকটা মন্টুর সহযোদ্ধা, তার কাছ থেকে অনেক কথা শোনার ছিল। কীভাবে তার ভাই মারা গেল, মরার আগে কী বলে গেছে, মন্টুর শেষ ইচ্ছাই-বা কী ছিল, তার কবরটা পাকা। করা যায় কীভাবে–মরিয়ম খালি পায়ে খানিকটা পথ দৌড়ে যায়। অ্যাই-অ্যাই, শোনেন-শোনেন কয়েকবার ডেকে বুঝতে পারে, লোকটার নামও সে জানে না। ঠিকানা কি রেখেছে? রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাতার পাতা উল্টেপাল্টে ঘটি হাতার ব্লাউজের ডিজাইনের নিচে লেখা কয়েকটা শব্দ সে উদ্ধার করে-গ্রাম মধ্যমতলা, পোস্টঅফিস চান্দেরহাট। অদূরে লেখা-মন্টুর শেষ যুদ্ধস্থল। পাশে আছে লোকটার নাম সরফরাজ হোসেন। ঠিকানা কোথাও নেই। গলির বাকে হারিয়ে গেছে সরফরাজ হোসেন। মন্টুর। খবর এর বেশি জানা গেল না। চার বছর পর এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে যার জন্য, সে তখনো মশারির নিচে নিদ্রা যাচ্ছে।

ঘরের ভেতর আবেদ সামিরের ঘুমানোর দৃশ্যটা উঠোন থেকেই মরিয়মের আজ উকট, খাপছাড়া লাগে। কার বুকভাঙা কষ্টের বিনিময়ে কে সুখের নিদ্রা যায়! ছেলেটা তো তার ভালোমন্দের অংশীদার নয়! চায়ের কেটলি চুলা থেকে নামাতে গিয়ে ন্যাকড়ায় আগুন ধরে গেলে মরিয়ম ভাবে, জ্বলন্ত ন্যাকড়াটা ছুঁড়ে দেবে নাকি মশারির ওপর! তাহলে একবারেই সবকিছুর ফয়সালা হয়ে যায়। কয়েক দিন পর চা খেতে খেতে আবেদ সামিরকে মশারিতে আগুন ধরানোর কথাটা বলে সে। শোনামাত্র ছেলেটা তো ভয়ে দিশেহারা। এ অবস্থায় সামনে দেখে একজন অপ্রকৃতিস্থ নারী, যে হাসতে হাসতে তাকে পুড়িয়েও মারতে পারে। কবি হওয়ার জন্য এই অভিজ্ঞতাটার তার দরকার নেই। অর্ধভুক্ত চায়ের কাপ রেখে আবেদ সামির সেই যে প্যান্ট পরে ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে গেল, তার আর দেখা নেই।

ন্যাকড়ার আগুনে মশারি পোড়ানোর দৃশ্যটা সমস্ত দিন ধরে মরিয়মকে আমোদ দেয়। সে একা ফিকফিক করে হাসে। তাকে দেখলে যে-কেউ তখন ভাবতে পারত, সে একজন ষড়যন্ত্রকারী-অদ্য রজনী শেষ হওয়ার পূর্বে রাস্তায় যারা ট্যাংক নামাবে, দেশের রাষ্ট্রনায়ক সপরিবারে যাদের হাতে খুন হবেন, মরিয়ম তাদের একজন। পার্থক্য শুধু ঘটনাস্থলে সে সরাসরি উপস্থিত থাকবে না, তার হাতে আর্মির ওয়ারলেস নেই, গত এক সপ্তাহ সে ঘরের বাইরে একবারও যায়নি, সর্বোপরি এই ঘাতকদলে বীরাঙ্গনা দূরে থাক, কোনো নারীই ছিল না।

ভোরের দিকে গোলাগুলির শব্দে মরিয়মের ঘুম ভাঙে। শব্দটা মনে হয় পিলখানার বিডিআর ক্যাম্প থেকে আসছে। পরক্ষণে মনে হয় গোলাগুলি চলছে বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায়। এ যেন আরেকটা ২৫ মার্চ রাত। আচমকাই যেন সে সাড়ে চার বছর পেছনে চলে গেছে। সামনে শিরীষ অরণ্য। অদূরের ফুটপাতে প্রথম দিনের সেই মুচি, অপারেশন সার্চলাইটের আগুনে পুড়ে যে ছাই হয়ে গেছে। সময়ের এ পেছন-দৌড় মরিয়মের অসহ্য লাগে। সে বিছানা ছেড়ে সেলাইঘরে যায়, সুইচ টিপে বাতি জ্বালায়, মেশিন সামনে নিয়ে একমনে ধ্যানে বসে। এখন সে যে হাতলটা ঘোরাবে, সেটি তাকে বড়জোর পুনর্বাসনকেন্দ্র অব্দি দাবড়িয়ে নিয়ে যাবে, এর পেছনে, অর্থাৎ–যুদ্ধ পর্যন্ত। কিছুতেই নয়।

মরিয়ম তখনো সেলাইঘরে। একজন কাস্টমার এসে যখন ভোররাতের হত্যাযজ্ঞের খবর দেয়, তার চলন্ত সেলাই মেশিনটা আপনা হতে বন্ধ হয়ে যায়। ঘরে পিনপতন নীরবতা। মন্টু চলে যাওয়ার সময় সেই যে বগলে করে রেডিওটা নিয়ে গিয়েছিল, আর কেনা হয়নি। পাশের বাড়িতে এখন রেডিও বাজছে। মরিয়ম হামাগুড়ি দিয়ে তক্তপোশের গা-লাগা জানালাটা খুলে দেয়–’আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’

‘মেজর ডালিমটা কে?’ সংবাদদাতাকে বসতে না বলেই মরিয়ম প্রশ্নটা করে। কাস্টমার মেয়েটা হাসপাতালের একজন নার্স। নাইট ডিউটি সেরে ফেরার পথে ট্যাংক দেখে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবরটা পথচারীর মুখ থেকেই তার শোনা। এর বেশি কিছু জানে না। মরিয়ম আপনমনে বলে, ‘মেজর যখন, আর্মিটার্মি কেউ হবে।’

‘সব্বোনাশ, আস্তে কন!’

‘কেন, কী হইছে?

‘ওরা সাঙ্ঘাতিক! শুনলে পরে ট্যাংক নিয়া চইল্যা আসবে।’ মেয়েটার ট্যাংক-বিভীষিকা এখনো যায় নাই। ঢাকা মেডিক্যাল থেকে নিউমার্কেট হয়ে এটুকু পথ, তার মধ্যে তিনটা ট্যাংক সে নাক উঁচিয়ে রাস্তায় ঘুরতে দেখেছে। একেকটার চেহারা কী! হাতির মতো লম্বা গুঁড়তোলা। ‘মেরি আপা, আবার দেইখ্যেন একটা যুদ্ধ লাগবে।’ যুদ্ধ লাগলে কে কোথায় চলে যায়, মানুষের নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা থাকে না। এটি তাদের মাত্র সাড়ে চার বছর আগের অভিজ্ঞতা। মেয়েটি তাই দুদিন আগে বানাতে দেয়া ব্লাউজের কাপড় ফেরত নিতে এসেছে। মরিয়ম জানালা বন্ধ করে, কালো কাপড়ে মেশিনের শরীরটা আগাপাশতলা ঢেকে দেয়। দৃশ্যটা উদ্ভট। কিন্তু সংবাদদাতার এসব তাকিয়ে দেখার সময় নেই। তাকে না-বানানো ব্লাউজ নিয়ে এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে হবে। কারণ শহরে আজ কারফিউ।

যে লোকটা গতরাতে সপরিবারে নিহত হয়েছে, তার সারা জীবনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মরিয়ম যেন অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। নিজেকে সে যদি ভাবতে পারত একটা কাপড়ের বা কাঠের পুতুল, সে ক্ষেত্রে লোকটা পুতুলমাস্টার।

পুতুল তোমার জনম কী রূপ যে জানে।
আলোকলতায় বাইন্ধা সুতায় সে টানে।

[সেলীম আল দীন]

গত পাঁচ বছরে পুতুলমাস্টারের প্রতিটা সুতোর টান মরিয়ম তীব্রভাবে অনুভব করেছে। বারবার সুতো ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেও নিস্তার পায়নি। এই যে সিঙ্গার সেলাই মেশিন, পুনর্বাসনকেন্দ্রের মেয়েদের হাত দিয়ে ঘোরে, তা এখনো মরিয়মের রুটিরুজির উপায়। মনোয়ারা বেগমের সোনার গয়না বিক্রি করে সেলাই মেশিন খরিদ করা, আবেদ সামির আর সুমনের ‘মা-মেয়ে টেইলারিং’ নামকরণ, জিগাতলা-রায়েরবাজার ট্যানারির মোড়ে পোস্টারিং–সবকিছু নেপথ্যে থেকে পুতুলমাস্টারের কারসাজি। এখন তার গুলিবিদ্ধ নিস্পন্দ শরীরটা যখন সিঁড়ির ওপর কাত হয়ে পড়ে রয়েছে, সেলাই মেশিনের গুনগুনানিও সেই সঙ্গে থেমে গেছে। মরিয়ম আজ পুতুলমাস্টারের হাত দুটি থেকে চিরদিনের মতো মুক্তি পেল। যদিও লোকটাকে জীবনে সে একবারই মাত্র দেখেছে। মরিয়ম তখন নিউ ইস্কাটন রোডের পুনর্বাসনকেন্দ্রে। বঙ্গবন্ধু পরিদর্শনে আসবেন, মেয়েদের তাই রিহার্সেল করানো হচ্ছে, ও আমার দরদি/ আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না। গোঁফের তলায় মুচকি হেসে এগিয়ে যান তিনি। গানটা থেমে গেল মাঝপথে। সারা দিনের মহড়া ভুলে মেয়েরা ততক্ষণে সুরহীন, ছত্রভঙ্গ। তিনি তাদের বিশৃঙ্খল চাকের ভেতর আটকে গেলেন। অদূরে দাঁড়িয়ে মরিয়ম শুধু দেখেছিল, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা একজন লম্বা মানুষ, যার বুকের বেশ নিচে, নাভির প্রায় কাছাকাছি একটি বিপন্ন মেয়ের ঊর্ধ্বমুখী মুখ। মেয়েটির চোখ দিয়ে। দরদরিয়ে পানি পড়ছে। তার ভবিষ্যৎ কী–সে জানে না। তিনি সবার উদ্দেশে হাত তুলে বললেন, ‘তোরা আমার মা। তোরা বীরাঙ্গনা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *