২১. পার্কের বিকল্প ঘর, ঘাসের বিকল্প তোশক

পার্কের বিকল্প ঘর, ঘাসের বিকল্প তোশক

পুত্রসন্তানের জন্য বাড়ি তৈরি হলেও এর প্রথম বাসিন্দা মরিয়ম। কোনো-না কোনোভাবে তার হক থেকেই যায়। যদিও সে এখন ঘরছাড়া, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ক্রমাগত ঠিকানা বদলে চলেছে। তবে যুদ্ধের সময়ের মতো দল বেঁধে নয়। একা একা। রিনাদের বাসা, পুনর্বাসনকেন্দ্র, তারপর নিউ ইস্কাটন রোডের বাড়ি হয়ে সে এখন কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে। তার মতো আরো ক’জন বীরাঙ্গনা আছে এখানে। তাদের চাকরিস্থল ভিন্ন ভিন্ন। যে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এই মেয়েরা ধর্ষিত হলো, চাকরি করা ছাড়া সেই দেশের পুনর্গঠন কাজে কি লুটপাটের মধ্যে তারা নেই। তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিপ্লবী মনোভাব নিয়ে চোরাচালান প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন’ ডাকে সাড়া দেয়নি। কলকারখানা রাষ্ট্রীয়করণে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। ঘন ঘন পাটের গুদামে অগ্নিসংযোগ বা আগুন নেভানো কোনোটাই করছে না। খুন-ছিনতাই-রাহাজানি সংঘটনে বা এর প্রতিরোধে তারা কখনো এগিয়ে আসেনি। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন, নতুন নতুন আইন তৈরির সময় তারা হাত গুটিয়ে বসে রইল। ‘দালাল আইন ১৯৭২’-এর ফাঁকফোকর নিয়ে মাথা ঘামায়নি। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা চুপ করে শুনল। রক্ষীবাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে তারা একবারও নিন্দা জানায়নি। সর্বহারাদের শ্রেণিশত্রু খতম অভিযানেও শরিক হলো না। ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল অ্যাক্ট, ১৯৭৩’ পাস হওয়ার পর আইনমন্ত্রীকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানায়নি। যদিও অ্যাক্টের ২(ক) ধারায় ‘ধর্ষণ’কে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতিকে যখন জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়, তখনো এ নিয়ে তারা উচ্চবাচ্য করেনি। তারা বাকশালে যোগ দেয়নি। আসলে তারা একটা লড়াইয়ের মধ্যে ছিল। এজেন্ডা তাদের একটাই–বীরাঙ্গনার সামাজিক পুর্নবাসন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে, যৌতুকের প্রলোভন দেখিয়ে সরকার যে কাজে ব্যর্থ হয়েছে, তারা তা সমাধা করতে অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

কর্মজীবী মেয়েদের হোস্টেলের পাশে জাতীয় নাট্যশালা, অদূরে রমনা পার্ক। আশপাশের রাস্তাগুলো সন্ধ্যার পর নির্জন। লাইটপোস্টের আর গাছগাছালির আলো আঁধারে মরিয়মরা ভালো কাপড়চোপড় পরে ঘুরে বেড়ায়। কাগজের ঠোঙা থেকে চানাচুর, ঝালমুড়ি বের করে ভাগাভাগি করে খায়। টাকা নষ্ট করে টিকিট কিনে নাটক দেখতে যায় না। আলোর নিচে বসে পড়া বা দাঁড়িয়ে থাকা থেকেও বিরত থাকে। তারা কেবল একের পর এক অন্ধকার নির্জন রাস্তায় পাক খেয়ে খেয়ে অন্ধের মতো ঘোরে।

সন্ধ্যার পর রমনা পার্কে বেশ্যার শরীর বেচাকিনির হাট। ওখান থেকে একদল খদ্দের দলচ্যুত হয়ে একদিন বেরিয়ে পড়ে। ঘাসের ওপর দিনের পর দিন বেশ্যাগমন একঘেয়ে, ক্লান্তিকর। তার ওপর পুলিশের উৎপাত। তারা হাঁটতে হাঁটতে নির্জন রাস্তায় প্রবেশ করে, যেখানে মরিয়মরা সেজেগুজে আগে থেকেই ঘোরাঘুরি করছিল। মেয়েরা চানাচুর-ঝালমুড়ির ঠোঙাগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। পুরুষদের হাত ধরে নাট্যশালায় ঢোকে। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে পাশাপাশি দুটি চেয়ারে একজন বীরাঙ্গনা আর রমনা পার্কের একজন প্রাক্তন খদ্দের–তারা জোড়ায় জোড়ায় ঝালমুড়ি চানাচুর খায়, নাটক দেখে। যাদের উচ্চমার্গের নাট্যকলা বুঝতে অসুবিধা, তারা জোড় বেঁধে চলে যায় বলাকা, নাজ বা মধুমিতায়। সিনেমাহলগুলোতে বধূ মাতা কন্যা, কাঁচের স্বর্গ, জীবন সঙ্গীত দ্বিতীয় সপ্তাহেও হাউসফুল। তুলনায় গোপালভাঁড় ছবিটা পাত পায় কম। বাঙালি আসলে হাসতে ভুলে গেছে। রমনা পার্কের প্রাক্তন খদ্দেরদের কেউ কেউ ভাড়ামি দেখতে চাইলে মেয়েরা তাতে বাদ সাধে। বলে, ‘গোপালভাড় নামটা শুনলেই খালি হাসি পায়। লোকটা জানি কেমন!’ এসব কথার কথা। আসলে রঙ্গ-তামাশা দেখার জন্য তারা এই জোড় বাঁধেনি। একঘেয়েমি কাটানো বা রুচি বদলের মতো বিলাসিতাও তাদের নেই। দেশ বা জাতি যে সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ, যাকে বলে বীরাঙ্গনার সামাজিক পুনর্বাসন–সেই গুরুদায়িত্ব এখন তাদের কাঁধে। যে সকল নেতা-নেত্রী বলে বেড়াচ্ছিলেন, ‘এত বড় একটা দুর্যোগ আমরা তো ওভারকাম করেছি,’ তাদের আত্মতৃপ্তির ফাটল দিয়ে মরিয়মরা রাস্তায় এসে পড়েছে। যা করার এখন নিজেদেরই মেরে-কেটে করতে হবে। এ ব্যাপারে পত্রিকাগুলো সহায়ক ভূমিকা নেয়। তারা চুলে মুখ ঢাকা এক বীরাঙ্গনার ছবি অনবরত কাগজে ছাপিয়ে আগে থেকেই তাদের অবয়বশূন্য করে রেখেছিল। আর সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে স্লোগান দেওয়া বা প্রেস কনফারেন্স করা থেকে বিরত থাকায় বরাবরই তারা কণ্ঠহীন। ফলে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ তো বটেই দিনের আলোতেও কেউ তাদের শনাক্ত করতে পারে না। তারা একরাশ ঘন কালো চুলের আড়াল নিয়ে, চানাচুর-ঝালমুড়ি খেতে খেতে, নাটক বা সিনেমা দেখতে দেখতে জাতীয় সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যায়।

মমতাজ নামটা মরিয়ম এযাবৎ ভেবেছে মেয়েদের। তবে সে পুরুষই। পরিচয় পর্বে লোকটা সদর্পে জানায়, রমনা পার্কের বেশ্যাদের সে একজন প্রাক্তন খদ্দের। পেশায় ব্যবসায়ী। অস্ত্রহাতে যুদ্ধ না করলেও মনেপ্রাণে একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেই সুবাদে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জোগাড় হয়ে গেছে। তাই দিয়ে ব্যবসার লাইসেন্সও জুটেছে। কাজটা যে রিলিফের চাল, গম, কম্বল কালোবাজারে কিনে খোলা বাজারে বিক্রির, মরিয়ম পরে তা জানতে পারবে। আপাতত হবু বর ঘাসের শয্যা ছেড়ে ঘরের নিরাপদ বিছানায় ফিরতে চায়। মরিয়মেরও ঘরে ফেরা দরকার। প্রথম ঘর, তারপর সমাজ–বিয়ের মাধ্যমে বীরাঙ্গনার সামাজিক পুনর্বাসন।

নাটক-সিনেমা দেখতে দেখতে, ঝালমুড়ি-চানাচুর চিবোনোর এক ফাঁকে মমতাজ একদিন তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। মরিয়ম তাতে মিউজিক্যাল চেয়ারে ত্বরিত বসে পড়ার রেফারির বাঁশির সংকেত শোনে। আর বিয়েটাও হয়ে যায় সামনের খালি চেয়ারে ঝপ করে বসে পড়ার মতো। বীরাঙ্গনা, অ-বীরাঙ্গনা মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলই। তার ওপর খেলার নিয়মানুযায়ী একটা চেয়ার কম। তবে ভয়টা তার অন্যত্র। শিরীষ অরণ্যের ছত্রচ্ছায়ার বাদাম-পর্বে আবেদও বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। বিছানায় যাওয়ার পর দিনক্ষণ পেছাতে পেছাতে একসময় প্রস্তাবটা নাই হয়ে যায়। একই ভুল মানুষ দুইবার করতে পারে না, যার আবার নয় মাসের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সে হোস্টেল-বান্ধবীদের পরামর্শ বাতিল করে দিয়ে, বীরাঙ্গনার মুখের ওপর থেকে নেকাব সরানোর মতো কেশগুচ্ছ সরিয়ে নেয়। মমতাজ উদার পুরুষ। বীরাঙ্গনাকে জীবনসাথিরূপে পেলে, সে বলে, তার পুরুষজনমই সার্থক। এত দিন পর সে এমন একটা কাজ করতে যাচ্ছে, যা দশটা মুক্তিযুদ্ধের সমান গৌরবের। সেলাই মেশিন, হড়িকুড়ি কিছুই চাই না। শামিয়ানা টাঙিয়ে মাইক বাজানোরও দরকার নেই। পত্রিকায় সচিত্র-সংবাদ না-ছাপিয়ে বীরাঙ্গনার বিয়ে হবে। মরিয়ম সব জানিয়ে বাবা-মাকে একই খামে আলাদা দুটি চিঠি পাঠায়।

ছুঁচোর লাথি খাওয়া হাতি শেষ পর্যন্ত গর্ত থেকে উঠে দাঁড়াল। তাদের বীরাঙ্গনা কন্যার লালা-ঝরা, জড়বুদ্ধির অমানুষের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে না। পাত্র রীতিমতো অবস্থাসম্পন্ন, উদার, লেখাপড়া জানা। কফিলউদ্দিন আহমেদ সেদিনের ডাকেই সুখবরটা গোলাম মোস্তফাঁকে জানিয়ে দেন। মরিয়ম নয় মাসের যুদ্ধ, অগণিত লাশ, ভাঙা ব্রিজ ও কালভার্ট, পোড়া ঘরবাড়ি আর দোকানপাট পেছনে ফেলে, একটা মৃত্যুর পর, চব্বিশ বছর বয়সে নতুন জীবনে প্রবেশ করে।

নবদম্পতির সংসার শুরু হয় এক অবাঙালি পরিবারের পরিত্যক্ত বাড়িতে। এর। দরজা-জানালা, স্যানেটারি ও ইলেকট্রিক ফিটিংস মমতাজ দখল নেওয়ার আগে উধাও হয়ে গেছে। আসবাবপত্র সরানো হয়েছে নিশ্চয় তারও আগে। সে দেদার টাকা খরচ করে বাড়িটা মেরামত করে। অদৃশ্য মালিককে টেক্কা দিয়ে কেনে অট্টালিকার সঙ্গে মানানসই দামি আসবাব আর ঘর সাজানোর জিনিসপত্র। তারপর আনে বউ। ঘর পার্কের বিকল্প আর বিছানাটা বিকল্প ঘাসের শয্যার।

ফুলতলি গাঁয়ের পর মরিয়মের প্রতিটা আবাস কোনো-না-কোনোভাবে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের। তারা রাজনৈতিক উদ্বাস্তু। একেকবার একেকটা নতুন দেশের জন্মের সঙ্গে ভিটেছাড়া হয়েছে। ঘটনাচক্রে মরিয়ম ভোগদখলকারী। সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে (বিয়ের শর্ত ছিল) অন্যের ঘরবাড়ি নিজের মতো করে সাজায়। বিছানায় জাজিম পাতে। ওপরে তুলোভরা নরম তোশক বিছায়। তোশকের আবরণে পুনর্বাসনকেন্দ্রের অসমাপ্ত ফুল-পাতা রঙিন সুতোয় নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তোলে। বালিশের ওয়াড়ে ভালোবাসার দরদি পদ্য লেখে। এ ছত্রগুলো তার যৌবনের সূচনায় ফুলতলি গায়ে থাকতে মালার মতো গাঁথা হয়েছিল। তারপর আবেদের প্রতারণায় আর যুদ্ধের টানাটানিতে ছিঁড়ে গেলেও বিয়ের নাম শুনে অমরসংগীতের মতো বেজে উঠেছে। বিয়ে বিয়েই–যার-তার সঙ্গে হলেও স্বস্তিকর। বিয়ের ছত্রচ্ছায়ায় দুপুরগুলো মরিয়মের একার। সে এর অতুল বৈভব, সীমাহীন নিরাপত্তা উপভোগ করে। তবে তা মাত্র কয়েক দিন। তারপর সে আর একা থাকে না। নির্জন দুপুরগুলোতে মন্টু, অনুরাধা আর তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো দফায় দফায় অতিথি হয়ে আসে। মরিয়মের সাজানো সংসার ঘুরেফিরে দেখে, সূচিকর্মের তারিফ করে, দু-চারটা আজগুবি উপদেশও দেয়। মন্টু বলে, ‘কী হলো মেরিবু, তুমি না বীরাঙ্গনা! তোমার ছাদের অ্যান্টেনায় বাংলাদেশের পতাকা কই?’ অনুরাধা উঠতে-বসতে বাড়িটার খুঁত ধরে। তর্জনী উল্টিয়ে ঠোকা মারে কংক্রিটের দেয়ালে আর পালিশ করা সেগুনকাঠের দরজায়। তার ভবিষ্যদ্বাণী, বাড়িটা কাঁচের স্বর্গ। ‘দেখো মেরি, ঘুমের মধ্যে খান খান হয়ে ভেঙে পড়বে।’ শোভা রানী খিলখিলিয়ে হাসে, ‘ট্যাকা-ট্যাকা–দুনিয়ায় শুধা টাকার খেলা।’ মেজর ইশতিয়াক চোরের মতো বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে চলে যায়। ঘরে ঢোকার তার সাহস হয় না। রমিজ শেখ বাহুল্য, তার অস্তিত্ব না থাকলেই যেন। ভালো ছিল। যদিও ঝক ঝক গুলি কচুরিপানার মতো দু’হাতে ঠেলে মরিয়মের দিকে সে সাঁতরে আসছিল। তারপর আর পারেনি, সেখান থেকেই উড়াল দেয় শূন্যে। আলো-বাতাসের বানডাকা দুপুরেও মরিয়মের নতুন সংসারে একাত্তরের হলঘরের গুমোট ভাব। দরজা-জানালা খুলে দিলে হারানো দিনের মানুষেরা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। একে একে দখল নেয় বিছানা, চেয়ার, সোফা, কার্পেট, দরজার চৌকাঠ-সব।

মমতাজ সন্ধ্যায় ফিরে এলে মরিয়ম অভিযোগ করে, দুপুরে একা একা তার সময় কাটে না। ঘর গোছানোর কাজ শেষ। এখন সে কী করবে। বাসায় চাকরবাকর থাকলেও কথা ছিল। এটা-সেটা বলে, কাজের ফরমাশ দিয়ে সময় কাটানো যেত। মমতাজের কাজের লোক রাখতে আপত্তির কারণ, মরিয়ম যে বীরাঙ্গনা তারা তা জানার পর দুপুরে আর ঘরে থাকবে না। মহল্লার ঘরে ঘরে হানা দেবে। এ বাড়ির চাকর থেকে আরেক বাড়ির চাকর। এক কান থেকে দশ কান। ওই আমগাছঅলা বাড়ির বিবিসাবরে মিলিটারিরা বেইজ্জত করছে। হেই দুঃখে রাইত অইলেই সাহেবডায় বোতল খুইল্যা বসে। এসব রটনার পর বাড়িটা আর বাড়ি থাকবে না, সকাল-বিকাল দর্শনার্থীদের ভিড়ের ঠেলায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হয়ে যাবে। তাহলে কি মরিয়ম চাকরিতে ফিরে যাবে? তাতেও বর রাজি নয়। অফিসে তার পরিচয় একজন স্টাফের চেয়েও বীরাঙ্গনার। পিয়ন থেকে বস সবাই তা জানে। বর্তমানে ঘরে স্বামী আছে কি নেই, গ্রাহ্যও করবে না। উল্টো ফাউ খেতে চাইবে, ‘খানেদের দেহ দিতে পারলে, আমরা কী অপরাধ করছি, আমাদের একটু-আধটু দিলেই হয়!’ বাকি থাকে মরিয়মের শ্বশুরকুলের আত্মীয়স্বজন। যারা গ্রামে থাকে বলে মমতাজ দাবি করে, এত বড় বাড়ি, তারা স্বচ্ছন্দে এখানে এসে থাকতে পারেন। ‘তা পারেন।’ মমতাজ রাগ গোপন করে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘তবে কথা হচ্ছে কি, সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। শাশুড়ি-ননদে চুল ধইরা হ্যাঁচকা টান মারলে ভালো লাগবে? বলে যদি একাত্তরের খানকি মাগি–তখন!’

সব কথার শেষ কথা–খানকি মাগি নয়, বীরাঙ্গনা। মমতাজ নিজে বলে না। অদৃশ্য মানুষদের ছুতোয় সে তার ‘আসল’ পরিচয়টা বারবার শুনিয়ে দেয়। এ ছাড়া যুদ্ধ নিয়ে কথা নেই। সে নয় মাস কোথায় ছিল? রমনা পার্কে? রমনার কালীমন্দিরটা ভাঙা হলো যখন, তখন কোথায় ছিল। নাকি ওখানেও ছিল না! এই লোকের অতীত। কী, ভবিষ্যৎ কোথায়। এখন দু’হাতে টাকা কামাচ্ছে আর উড়াচ্ছে। মরিয়ম কেন। তাকে বিয়ে করল? বীরাঙ্গনার সামাজিক পুনর্বাসনের জন্য? নাকি সে বাচ্চা চায় বলে? পাকিস্তান আর্মির নয়, বাঙালির বাচ্চা। মমতাজ বলে, ‘এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা কীসের। সবে তো বিয়া অইলো। জীবনটা আগে উপভোগ করি, তারপর দেখা যাবে।’

উপভোগের বিষয়টা আরো বিভ্রান্তিকর। মমতাজ তাকে জাপটে ধরলে, মরা মাছের মতো মরিয়মের চোখ দুটি বেরিয়ে আসে। আগেভাগে শরীর খুলে যায়। জোরে জোরে দম নিতে শুরু করে। ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো হৃৎপিণ্ডটা বেদম লাফায়। প্রথম প্রথম মমতাজের বিষয়টা অস্বাভাবিক লাগেনি। কারণ পার্কের বেশ্যারাও এক হাতে টাকা নেয়, আরেক হাতে পোশাক ফাঁক করে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। আদর-সোহাগ সেখানে অবান্তর। পুলিশ অকুস্থলে পৌঁছোনোর আগেই যত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয়, ততই উভয়ের জন্য মঙ্গল। কিন্তু ঘর পার্কের বিকল্প আর বিছানাটা বিকল্প ঘাসশয্যার। তবে স্ত্রী কেন বেশ্যার মতো আচরণ করে? স্বামীর সঙ্গে যখন-তখন শোয়ায় না’ নেই। কার্যত সে অংশও নেয় না। পুরোটা সময় পিস্তলের মুখে যেন সারেন্ডার করে পড়ে থাকে। এ অবস্থায় স্ত্রীকে সক্রিয় করার তাগিদে মমতাজ দিনে দিনে রূপ নেয় ধর্ষকের–চার বছর আগেকার পাকিস্তান আর্মির।

মরিয়মের একাত্তরের ক্ষতে মমতাজ দাঁত বসায়, মুখ দিয়ে অনবরত খিস্তি-খেউড় করে। মদ মমতাজ আগেও খেত। টাকা হওয়ার পর বেশি বেশি খাচ্ছে। একদিন মাতাল অবস্থায় এক বোতল হুইস্কি উপুড় করে ঢেলে দেয় স্ত্রীর যৌনাঙ্গে। পরদিন আহত স্ত্রীকে বিছানায় ফেলে কাজে যেতে তার ভয় হয়। মেয়েটি পালিয়ে যেতে পারে। যদি না-ও পালায়, পাড়াপড়শি কেউ এ অবস্থায় দেখে ফেললে থানা-পুলিশ করবে। এসব ঝুটঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য তখন সে যা করে, তা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান আর্মি মরিয়মদের সঙ্গে করেছে। মমতাজ জানালার কপাট পেরেক ঠুকে বন্ধ করে, দরজায় তালা লাগিয়ে, চাবি নিয়ে চলে যায়। কিন্তু মরিয়মকে উদ্ধার করতে খোলা জিপ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আর আসে না। দূর থেকে মা মা চিৎকারটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বারবার ফিরে আসে, চলেও যায় দূর থেকে দূরে। বহু আগে নিয়াজির আত্মসমর্পণের পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। মিত্রবাহিনী বিজয়ীর বেশে ফিরে গেছে নিজের দেশে। দিল্লি চুক্তি অনুসারে পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের প্রত্যাগমনও শেষ। অভিযুক্ত জেনারেলরা ভারতে কয়েদ খেটে চলে গেছে ভাঙা পাকিস্তানে। একটা দেশ কতবার স্বাধীন হবে?

তবে এসব দিনে মমতাজ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। আতঙ্কই তাকে বেশি সময় বাইরে থাকতে দেয় না। ঘরে ফিরে কাপড়চোপড় না ছেড়েই স্ত্রীর শুশ্রূষায় লেগে যায়। হাতে-পায়ে ধরে মাফ চায়, কান্নাকাটি করে। এ বিষয়টা নতুন-যা পাকিস্তান আর্মি করত না। মরিয়ম সঙ্গে সঙ্গে মাফ করে দিয়ে ভাবে, ক্ষমার মধ্য দিয়ে তাদের বিবাহিত জীবন নতুন করে শুরু হবে। তা না হলে আবারও কর্মজীবী হোস্টেল-বিকাল-সন্ধ্যায় ঝালমুড়ি-চানাচুর খাওয়া, আলো-আঁধারে রাস্তায় পায়চারি করা, নাটক-সিনেমা দেখতে দেখতে আবার একটা ভঙ্গুর বিয়ের প্রস্তাব। তার সঙ্গের বহু মেয়ের এখনো সামাজিক পুনর্বাসন বাকি। প্রতিদ্বন্দ্বী এখনো আছেই। তার ওপর খেলার নিয়মানুযায়ী একটা চেয়ার কম। মরিয়ম সেই ঝুঁকি দ্বিতীয়বার নিতে চায় না। কয়েকটা দিন মমতাজের সঙ্গে তার ভালো কাটে। বর শাড়ি, চুড়ি, ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে কাজ থেকে ফেরে। সিল্ক শাড়ি কিনলেও কখনো লাল গোলাপ আনে না। গজল শোনার, আবৃত্তি করার অভ্যাসও তার নেই। তবু মেজর ইশতিয়াকের কথা মরিয়মের মনে পড়ে না। সম্পর্ক ভালো থাকার কয়েকটা দিন মমতাজ স্ত্রীকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যায়। দীপ জ্বেলে যাই বা হারানো সুর। হল ভাঙার পর উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক মেজাজে তারা রিকশায় ওঠে। মমতাজ শিস বাজায়–এই রাত তোমার আমার/ শুধুই দুজনার। রাতে মরিয়মের কোলে মাথা রেখে, স্টুডিওর ব্যাকড্রপের শিউলিগাছ থেকে বিছানায় টুপটাপ কাগজের ফুল পড়ার সে স্বপ্ন দেখে। ডাগর নয়না সুচিত্রা সেন কোল পেতে দিয়েছে। নিজে সে কখনো বসন্ত চৌধুরী কখনো উত্তমকুমার। মোহিনীর কণ্ঠে ঝরে, তুমি যে আমার দিশা অতল অন্ধকারে…। মরিয়ম নির্বাক। পীড়াপীড়ি করলে অর্থহীন আওয়াজ করে। শিউলি ফুলের বদলে মুখের ওপর চোখের পানি টুপটাপ ঝরে পড়লে মমতাজের স্বপ্নটা ছুটে পালায়। সামনে ড্রিম লাইটের আলোয় ঠিকরে বেরিয়ে আসা একজোড়া মরা মাছের চোখ। মোহিনীর মাথাটা পেছনে হেলানো। হলরুমের কড়িবর্গার কম্পন মরা চোখে ঝড় তোলে। সেই ঝড়ে দেয়ালগুলো কাপে ঠকঠকিয়ে। ছাদটা সরে সরে যায়। তখন মমতাজের মাথার ঠিক থাকে না। যার যুদ্ধের কোনো স্মৃতি নেই, গল্প নেই, সে একের পর এক পাকিস্তানি আর্মির মতো আচরণ করতে থাকে।

মরিয়ম নিজেকে ধিক্কার দেয়–হাঁদারাম! বিয়ে কী এখনো জানে না। লোকটাকে যদি পার্কেই ফিরে যেতে হয়, সে ঘরে বউ রাখবে কেন। মরিয়ম চিন্তা করে দেখে, ভালোবাসাহীন শরীরী সম্পর্ক একপ্রকার ধর্ষণই, পুরুষটি স্বামী হলেও। এখন প্রশ্ন হচ্ছে–ভালোবাসার অর্থ কী। সংগম আর ধর্ষণের ফারাক কতখানি। মমতাজ হলঘরের লোকগুলোর মতো মদের গন্ধ নিয়ে বারে বারে আসে। তার হুইস্কির গন্ধটাও উকট। বন্দিজীবনের স্মৃতি-জাগানিয়া। মরিয়ম তাকে মদ খেতে বারণ করলে মমতাজ বলে মদ জিনিসটা খারাপ–সে জানে। বেশ্যা আরো খারাপ। মরিয়ম তার কাছে একজন বেশ্যা। তবে ভদ্র, শিক্ষিত আর মার্জিত রুচির। এ ছাড়া সে পার্কে থাকে না, ঘরে ঘুমায়।

বিবেচনাটা অতি সংকীর্ণ। ঘর না হয় পার্ক, পার্ক না হয় ঘর।

অনুরাধার ভবিষ্যদ্বাণী দেরিতে হলেও ফলতে শুরু করে। এখন মরিয়ম কেন বেশ্যার আসন আলোকিত করে একজন পুরুষের ঘর করবে? তাতে সুবিধা কী? সুবিধা এই যে, সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যায় রেশন নিয়ে তাকে বাড়ি ফিরতে হয় না। কাপড়-চোপড়ের কষ্ট নেই। বাড়িতে বন্দি থাকতেও সে অভ্যস্ত। তা একাত্তরের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের এক্সটেনশন। যুদ্ধটা টুকরো টুকরো হয়ে তার জীবনে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ধর্ষণ-নির্যাতন কারো ওপর জীবনভর চলতে পারে না। তাহলে কি সে ঠাই বদলাবে? পুনর্বাসনকেন্দ্রে কতবার ফেরা যায়! সেখানে যেতে না চাইলে বা জায়গা না পেলে বাকি থাকে যা, তা বেশ্যালয়। সে জায়গাটা দেখতে কী রকম? সেখানে মেয়েরা একবার ঢুকলে আর বেরোতে পারে না। কবরের মতো স্থায়ী এমন এক ঠিকানাই হয়তো তার দরকার।

নির্জন দুপুরগুলোতে একটা অবয়বহীন বেশ্যালয় যখন মরিয়মের পায়ে পায়ে নাছোড়বান্দার মতো ঘোরে, দালালের মতো প্ররোচিত করে, তখন রত্না-ছন্দার যুগলবন্দি চিঠি আসে ফুলতলি গ্রাম থেকে। চিঠিতে স্বামীসহ মরিয়মকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বি. দ্র. কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় সুন্দরীর জলার ওপর কাঁচা সড়কের নির্মাণকাজ সমাপ্ত। দুলাভাইকে পায়ে হেঁটে শ্বশুরালয়ে আসতে হবে না। ঢাকার বাস থেকে নেমে ভ্যান বা সাইকেল রিকশায় তারা বাড়ির উঠান পর্যন্ত নির্বিঘ্নে পৌঁছে যাবে। তবে বর্ষাকালে ভুখা মানুষের গমের লোভে তৈরি মাটির রাস্তাটার কী দশা হবে কেউ জানে না। তাই মেরি যেন অতিসত্বর স্বামীসহ একবার বেড়িয়ে যায়। চিঠিটা যমজ বোনদের হাত দিয়ে লেখা হলেও মরিয়ম জানে, তাতে বাবা-মায়ের সায় আছে। যে মেয়ে স্বেচ্ছায় ঘরত্যাগী, তাকে তারা স্বহস্তে চিঠি লিখে নিজেদের ছোট করেননি। মরিয়ম নড়েচড়ে বসে। মমতাজের সঙ্গে সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটেছে। বর্তমানে পাকাপাকিভাবে স্ত্রীর জায়গায় বেশ্যা আর ঘরের জায়গায় পার্ক। এই অবস্থায় বেশ্যা হওয়ার চিন্তা স্থগিত রেখে বাবা-মায়ের কাছে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয় সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *