১৩. লাল গোলাপ, সিল্ক শাড়ি ও ধবধবে সাদা বিছানা

লাল গোলাপ, সিল্ক শাড়ি ও ধবধবে সাদা বিছানা

তখন পাকসেনারা সারাক্ষণ মুক্তিফৌজের ভূত দেখছে। সঙ্গে ভারতীয় আক্রমণের ভয়। প্রহরা আরো কড়াকড়ি হয়েছিল। শ্যামলী চলে যাওয়ার পরের সপ্তাহে হলরুমের সদর দরজায় একটা গ্রেনেড ফাটে। তাতে হত হয় দ্বাররক্ষী। জমাদারনি ঘটনাস্থলে অনুপস্থিত ছিল, সেটাই তার অপরাধ। বন্ধ ঘরে ধোঁয়া ঢুকে পড়ায় মেয়েরা বেদম কাশছিল। সুতরাং তারাও সন্দেহের তালিকাভুক্ত হলো। সেটা এ কারণে, নাকি জেরার মুখে জমাদারনি তাদের যে ক’জনের নাম জানত বলে দিয়েছে, মরিয়ম আজও জানে না। ঘটনার দিন তাদের টেনে-হেঁচড়ে হলঘরের বাইরে আনা হয়। ‘সব শালি কো মার ঢালো, বাদ মে…’ মরিয়ম আর কিছু শুনতে পায়নি। তার পরের দৃশ্যগুলো মাঝখানে মাঝখানে ছেঁড়া, দাগ-পড়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া ফিল্মের রিলের মতো।

চলন্ত গাড়ির পেছনের সিটে চিত হয়ে পড়ে আছে মরিয়ম। মাথার আধখানা ঝুলছে সিটের বাইরে। এ অবস্থায় উরুর মাঝখানে রাইফেলের বাটের গুঁতো, দু’বগলে দুটি পুরুষাঙ্গের বিরামহীন ঘষাঘষি এবং ঠোঁটের দু’দিক টেনে ধরে একটি দুর্গন্ধময় পুরুষাঙ্গ মুখে ঢোকানোর প্রাণপণ চেষ্টা চলছে। গাড়িটা কোথাও থামছে না। চলতে চলতে একসময় এবড়োখেবড়ো রাস্তায় পড়ে। তাতে রাইফেলের বাঁটসহ পুরুষাঙ্গ দুটি পথভ্রষ্ট হয়, বগলের মাঝখানে ছন্দপতন ঘটে। তাতে লোকগুলো বিরক্ত হয়। মসৃণ রাস্তায় ওঠার পর, পুরো কাজটা ফের প্রথম থেকে শুরু করতে হয়। তার আগে বগল দুটি নিজেদের মধ্যে বদলাবদলি করে নিয়েছে দুজন। আর রাইফেলের বাঁট ফেলে পেছনের লোকটা সামনে চলে আসে, দুর্গন্ধময় পুরুষাঙ্গ মুখ বেজার করে চলে যায়। পেছনে। বিরতিতে ধুলা ওড়ে। গাড়িতে ঢুকে পড়ে শীতের দুপুরের ঝিলমিলে সোনালি রোদ্দুর।

পরের দৃশ্যে একজন মহিলা রক্ত-বীর্যের শুকনো দাগগুলো মুছিয়ে তাকে একটা আনকোরা কাপড় পরায়। মরিয়ম কাত হয়ে নেতিয়ে পড়তে ষন্ডামার্কা এক লোক তার লটপট শরীরটা উপুড় করে কাঁধে ঝুলিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা দেয়। তার পরের দৃশ্যে খোয়া ছড়ানো পথের দু’ধারে টবে বসানো সারি সারি ওল্টানো পাতাবাহারের গাছ। কাছেই চুনকাম করা একটি দোতলা বাড়ি, যার পেছনে বিকালের সূর্য পেন্ডুলামের মতো ডানে-বাঁয়ে দোল খাচ্ছে।

যে চেয়ারটায় মরিয়ম এখন বসে আছে, এর হাতলের সঙ্গে তার হাত দুটি শক্ত করে পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা। সামনে একটা ঝোলা মুখ ঠোঁটে কলম চেপে ক্রমাগত তার দিকে ধোঁয়া ছাড়ছে। মরিয়ম কেশে উঠতে লোকটি পেট ফাটিয়ে হাসল। ‘নাউ টেল মি, হোয়াট ডু ইউ থিং অ্যাবাউড সভূরেন্টি। অ্যান্ড হাউ ডু ইউ এক্সপ্লেইন দ্য কনসেপ্ট অব ফ্রিডম। সঙ্গে সঙ্গে নেপথ্যকারীর কণ্ঠে বাংলা তর্জমা, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? স্বাধীনতা শব্দটিকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করো।’ ধোঁয়ার ফাঁকে ঝোলা মুখ ফের আবির্ভূত হয়, ‘ডু ইউ বিলিভ ইন টু ন্যাশন থিওরি? টেল মি, হোয়াট দ্য ফিউচার অব পাকিস্তান?’ অদৃশ্য লোকটি—’তুমি কি দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করো? পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ কী–আমাকে বলো।’

‘হ্যাভ ইউ সিন শেখ মুজিব? ডোন্ট ইউ থিং দ্যাট দ্য সিক্স-পয়েন্ট ডিমান্ড প্রেসড বাই মুজিব ইজ ভায়োলেশন অব আর্টিকেল সিক্সটিন অব দ্য মার্শাল ল প্রোক্লেমেশন? অ্যান্ড দ্যাট বাসটার্ড শুড বি হাঙ্গড ফর দ্যাট?’

‘তুমি শেখ মুজিবকে দেখেছ? তার ছয় দফা প্রচারণা, তুমি কি মনে করো না, সামরিক আইনের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদের চূড়ান্ত লঙ্ঘন? এবং তার জন্য জারজটার ফাঁসি হওয়া উচিত?’

মরার আগে মনে হয় কলমা পড়ানো হচ্ছে। মরিয়ম ঢুকে পড়েছে সুন্দরীর জলার গোলকধাঁধায়। বেরোনোর পথ কই! সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকির আলো, ঝোলা মুখটা তার ঠিক মধ্যিখানে, ‘উল্লু টর্চ বন্ধ করো!’ নেপথ্যের লোকটি ধমকে ওঠে, ‘বাতি নেভা উল্লুক!’ টেবিলের ওপাশ থেকে ঝোলা মুখের লোকটা এবার কচ্ছপের মতো গলা তোলে, ‘ডিড ইউ কিল হাবিলদার তাজ খান? ইফ ইউ ডিড নট, টেল মি হু আর দ্য কিলারস। তর্জমাকারী ফিসফিস করে, ‘তুমি কি হাবিলদার তাজ খানকে হত্যা করেছ?’ পরক্ষণে গলাটা তার সপ্তমে চড়ে যায়, ‘যদি না করে থাকো, বলো কে করেছে।’

ঝোলা মুখ দু’কাঁধের মাঝখানে গলাটা ঢুকিয়ে চেয়ারে হেলান দেয়, ‘নাউ উই আর ভেরি মাচ সিওর দ্যাট ইউ আর এ মিসক্রিয়েন্ট। ইফ ইউ অ্যাডমিট দ্যাট, ইউ উইল বি ফ্রি।’ স্খলিত গলায় তর্জমাকারী, ‘তুমি যে একজন দুষ্কৃতকারী, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত? তা যদি নিজের মুখে স্বীকার করো, তোমাকে মুক্তি দেওয়া হবে।’

তারপর অন্ধকারে খানিক চেয়ার টানাটানি। এদিক-ওদিক খুটখাট আওয়াজ। ‘আচ্ছা ইন্টারভিউ থা।’ তর্জমাকারী খুশিতে বাগ বাগ, ‘সাক্ষাৎকারটা খুব ভালো হয়েছে। চেয়ারের হাতল থেকে মরিয়মের হাত দুটি খসিয়ে স্ট্রেচারে ধরাধরি করে শোয়ানো হয়েছে। মুখের ওপর ঝোলা মুখটা ধীরে ধীরে নেমে আসে, বহৎ আচ্ছি লাড়কি হো তুম।’ বিব্রত কণ্ঠে দ্রুত তর্জমা, ‘খুব ভালো মেয়ে তুমি।’

‘গুডনাইট।’

‘শুভরাত্রি।’

সাদা ধবধবে বিছানায় একটা লাল গোলাপ। পাশে জারুল ফুলের রঙের ভাঁজ করা সিল্ক শাড়ি। একটা দুই লিটার আন্দাজের স্যালাইন বোতল খাটের স্ট্যান্ড থেকে ঝুলছে। মরিয়ম পাশ ফিরতে হাতে তারের টান লাগে। তবে কম্বলের নিচে পা দুটি মুক্ত। দেশ কি স্বাধীন হয়েছে? অনুরাধা কোথায়? তাদের না পাকিস্তান চলে যাওয়ার কথা! হাউ ডু ইউ ফিল?’ হঠাৎ ঝোলা মুখটা তার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়তে মরিয়ম আরো একটা সাক্ষাৎকারের জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু এবার আর অদৃশ্য তর্জমাকারীর কণ্ঠ শোনা যায় না। এ এক নতুন উপদ্রব। তবু আগের চেয়ে ভালো। হলরুমের নোংরা কম্বল-শয্যা থেকে ক্যাম্প খাট, সাদা নিপাট-পরিচ্ছন্ন বিছানা, শিয়রে লাল গোলাপ, সিল্ক শাড়ি। তার মানে সব জায়গাতেই পদোন্নতির ব্যবস্থা আছে–সেটি বন্দিশিবির আর সময়টা ১৯৭১ সাল হলেও!

 ‘আর ইউ ওকে?’ মরিয়ম বালিশের ওপর ভারী মাথাটা এদিক-ওদিক করে এবং এই প্রথম শোনে যে, সে নিজের মুখে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে–‘ইয়েস।’ লোকটা মেজর ইশতিয়াকের মতো খুশি হয়। তার সংক্ষিপ্ত ইংরেজি ভাষ্য শুনে নাকি তাকে সুস্থ হয়ে উঠতে দেখে-মরিয়ম জানে না। তার শীর্ণ হাতটা কোলে তুলে বিছানায় বসার পর, ঝোলা মুখ রূপান্তরিত হয় মেজর ইশতিয়াকের ঢুলুঢুলু মাতাল চেহারায়। মরিয়মের মনে পড়ে, সার্কিট হাউসের সেই মাতালটার থাপ্পড়, যার ধাক্কায় সে উড়তে উড়তে রেলিংয়ের গায়ে পাতার মতো সেঁটে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও অনুরাধার উপদেশ স্মরণ করে সে জানতে চায়, আর ইউ মেজর ইশতিয়াক? তার প্রশ্ন শুনে লোকটা যেন বিদ্যুতের শক্ খেয়েছে, ঝপ করে হাতটা ছেড়ে দেয়। চেঁচিয়ে বলে, ‘নো নো, হাউ ডু ইউ নো হিম?’ এর জবাব মরিয়ম কেন দেবে? যুদ্ধের দিনে বাঙালি মেয়ের সঙ্গে পাকিস্তানি আর্মির কীভাবে সাক্ষাৎ-পরিচয় ঘটে–প্রশ্নকর্তারই তো তা ভালো জানার কথা। মেজর ইশতিয়াকের নামটাই শুধু তার মনে ছিল। এ ছাড়া ইউনিফরম পরা প্রত্যেকটা লোকই এক। ততক্ষণে লোকটার চেহারা পাল্টে আগের মতো ঝুলে পড়েছে। মিনিটে মিনিটে চেহারার পরিবর্তন–মরিয়মের মাথা ঘুরে ওঠে।

‘হাউ ডিড ইউ নো হিম?’ লোকটা তো নাছোড়বান্দা! মরিয়ম সরাসরি প্রশ্নের জবাব দেয় না, ঘুরিয়ে বলে, ‘হি ওয়াজ কাইন্ড টু মি।’ দেখা যাক কোথাকার জল। কোথায় গড়ায়। চোখের কোণ দিয়ে সে তার ভাবান্তর লক্ষ্য করে। কিন্তু এ কি চোখের ভুল, নাকি লোকটা আশ্চর্য ক্ষমতা রাখে চেহারা পাল্টে ফেলার! ঝোলা মুখ ক্রমে মেজর ইশতিয়াকে রূপান্তর হতে হতে মরিয়ম শুনতে পায় বলছে, ‘হি ওয়াজ কিন্ড ডে বিফোর ইয়াসটারডে।

কী আশ্চর্য! ওরাও বিলক্ষণ খুন হয়? মরিয়মের না তার সঙ্গে পাকিস্তান চলে যাওয়ার কথা–অনুরাধা বলেছিল!

নিজের লোকজনের হতাহতের খবর শত্রুপক্ষকে জানানো বোধ হয় যুদ্ধের নিয়মবহির্ভূত। ঝোলা মুখ নিজে নিয়মভঙ্গ করে, চোখের পলকে মরিয়মের ওপর খেপে ওঠে। বিছানা ছেড়ে সামরিক কায়দায় দাঁড়িয়ে বলে, ‘ডোন্ট ট্রাই টু মুভ। স্টিল ইউ আর সাসপেক্টেড। ইউ হ্যাভ টু অ্যামার-হুঁ আর দি কিলারস অব দ্যাট হাবিলদার।’

লোকটা গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। লাল গোলাপ আর সিল্ক শাড়িটা পড়ে থাকে বিছানায়। হয়তো তুলে নিতে ভুলে গেছে। শত্রুর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের আখের গোছানো কি সোজা কথা? শ্যামলী যা পেরেছে, অনুরাধা নিজে তা পারবে? কখনো তো বড় বড় কথা বলার বাইরে সাহসী কিছু করে দেখাতে পারল না। মেজর ইশতিয়াকের চেহারা, নাকি ঝোলা মুখটা নিয়ে লোকটা আবার আবির্ভূত হয়, কে জানে।

‘শি ইজ সিক নাউ।’ গলাটা পরিচিত মনে হলেও ঘুমের ভান করে মরিয়ম মরার মতো পড়ে থাকে। নতুন ফন্দি এঁটে আর কাজ নেই। চুপচাপ থাকাই ভালো। ‘তা ছাড়া আমি মনে করি, সে সুযোগ পেলেই মুক্তিবাহিনীতে চলে যাবে।’ অপরিচিত কণ্ঠ—’লেটস সি।’

এভাবে লাল গোলাপ, সিল্ক শাড়ি ও ধবধবে সাদা বিছানা মরিয়মের অধিকারে চলে আসে। যে ঘরে তাকে রাখা হয়েছে, এর যাবতীয় জিনিসপত্রও এখন তার। ছুঁয়ে দেখলে বারণ করার কেউ নেই। স্বর্গধামের মতো ফেলে যাওয়া কোনো পরিবারের সয়-সম্পত্তি হয়তো এসব। বা হালের কোনো বিনোদন কেন্দ্র। টাল টাল খালি মদের বোতল আর দেয়ালে লালচে লিপস্টিকের মতো রক্তের দাগ এমন সাক্ষ্যই দেয়। এ ছাড়া কফির কৌটা, আচারের বয়াম, চিনির ডিব্বার তলায় সবকিছু একটু-আধটু লেগে রয়েছে। মরিয়ম আঙুল দিয়ে টক টক আমের আচার মুখে পোরে। এখনো তিতকুটে বিস্বাদ হয়ে যায়নি। সরষে ফোড়নের ঝাঁঝটা নাকে সুড়সুড়ি দেয়। হেঁচে-কেশে ওপরে তাকাতেই তার চোখে পড়ে সারি সারি ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ। পোশাকে-চেহারায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে লোকগুলো অবাঙালি। ভারতের আক্রমণের ভয়েই হয়তো পাকিস্তান চলে গেছে। গলায় আচারের টুকরো মাকড়সার জাল বুনতে শুরু করলে সে হড়হড় করে বমি করে মেঝের কার্পেট নষ্ট করে দেয়। সেখানে একটা তার-ছেঁড়া তানপুরা ঘিরে শোকে মোহমান খান কতক তবলা। এর পাশের দেয়ালে লটকানো তৈলচিত্রগুলো অশেষ পীড়াদায়ক। যদিও নর্তকীদের স্থির অঙ্গ-বিভঙ্গ থেকে চোখ সরিয়ে নিলে তালাবন্ধ বিশাল ঘরটা মরিয়মের একার মনে হয়। চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো সে চাইলে খাঁচায় পায়চারি করতে পারে। দেয়াল আয়নার নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে কথা বলায়, হাই তোলায়, এমনকি ভেংচি কাটায় এখানে তার অপার স্বাধীনতা রয়েছে।

ঝোলা মুখের লোকটা নিজের নাম বলে মেজর ইশতিয়াক। তার কথামতো সে দ্বিতীয়। প্রাক্তন যুদ্ধে মারা গেছে। সে এখন ঝোলা মুখ বাইরে রেখে মৃত মেজর ইশতিয়াকের মাতাল চেহারাটা নিয়ে ঘরে ঢোকে। আর প্রাক্তনের মতোই বলে, ‘আই হ্যাভ টু টক টু ইউ। ইফ আই কান্ট, সাচ এ ব্লাডি ওয়ার, আই উইল ডাই।’

দোজখেও এক কণা বেহেশত থাকে। উল্টো করে বললে, বেহেশতের চারদিকে তখন দোজখের দাউদাউ আগুন। দ্বিতীয় মেজর ইশতিয়াক বারুদগন্ধময় পোশাক ছেড়ে, রক্তমাখা হাত মুছে বেহেশতের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। বন্ধ ঘরের তালা খুলতেই তার নাকের পাটা ফুলে ওঠে। সে চোখ বুজে বুকে টেনে নেয় অজানা স্বর্গের সৌরভ।

চূর্ণ অলক থেকে এক পরী
মৃগনাভির এ গন্ধ ছড়ায়;
না, অরণ্যের হরিণ নয় সে
মানুষ দেখে যে বিষম ডরায়।
[কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনূদিত—হাফিজ]

মরিয়ম দরজা খোলার মধুময় ছন্দে দু’কদম পিছিয়ে আসে–এ প্রস্তুতি-পর্ব। তারপর বেহেশত আর দোজখের মাঝখানের দুয়ার বন্ধ হতে যতখানি সময়, তারপরই শিকারের ওপর চোখ বুজে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারি। স্বর্গারোহণেও কালবিলম্ব হয় না। বাইরের গোলাগুলি আর বিকট আওয়াজ, যা মানুষকে সন্ত্রস্ত করে, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, তা তাদের স্বর্গসম্ভোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি না-করে আরোহণের মেয়াদ দীর্ঘতর করে। দুজনের মাঝখানের ফাঁকগুলো কানায় কানায় ভরে যায়।

পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর সামনে যে বৈরী পৃথিবী, সেখানে মরিয়ম আর মেজর ইশতিয়াক একে অন্যের দুশমন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। প্রকারান্তরে একজন আরেকজনকে মারতেই চায় স্বর্গারোহণের সময়টুকু বাদ দিয়ে।

তবু লাল গোলাপ আসে, মদ সহযোগে ওমর খৈয়াম, হাফিজ পাঠ হয়। বুলবুলকণ্ঠী নূরজাহান বন্ধ ঘরে মায়াজাল বুনে চলেন। প্রেম রসসিক্ত ঘন হয়। ভালোবাসা আর মদিরায় যুদ্ধের প্রহরগুলো যুদ্ধের নিয়মের বাইরে চলে যায়।

মরিয়ম হুঁশ হারিয়ে ফেলেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে করে ভারতীয়রা যে এগিয়ে আসছে, তারপর বড় একটা যুদ্ধ হবে-অনুরাধার কথাগুলো সে বেমালুম ভুলে যায়। সে রাত-দিন এমন এক খোয়াবে বাস করে, যা ভাঙা না-ভাঙা সমান। তবে ভালো হয়, যদি বাকি জীবন এর মধ্যে থাকা যায়। ঝোলা মুখের মেজর তাকে রূপকথার দেশ আর এক রাজপুত্রের গল্প শোনায়। পঞ্চ নদের দেশ পাঞ্জাব-সুজলা-সুফলা। মোগল সম্রাটদের গড়া লাহোরকে খালি শহর বললে ভুল বলা হবে। ফুলবাগিচা, সুরম্য অট্টালিকার এক আশ্চর্য নগরী লাহোর। এর পাশ দিয়ে স্বচ্ছ জলের যে নহর বইছে, তার দু’ধার বৃক্ষশোভিত। অজানা ফুলের ঘ্রাণ পথিকের মন মাতোয়ারা করে। মরিয়ম পাঠ্যবইয়ে শালিমার বাগের ছবি দেখেছে। এর সারি সারি ঝাউবীথির পাশে যে ফোয়ারা, তার কোল ঘেঁষে টাইট কামিজ, চুড়িদার পরা মেয়েরা পায়রার মতো ঘুরে বেড়ায়। মাথার তালু ঘিরে এক ফালি দোপাট্টা সোহাগ করে গলা জড়িয়ে রাখে। তবে নিউজপ্রিন্টের ছাপার সাদা-কালো মুখগুলো স্পষ্ট হয় না। এসব অস্পষ্ট চেহারার একজন মরিয়মের মনে হয়-মেজর ইশতিয়াকের স্ত্রী। মেজর বলে, সেই মেয়েটি এখন ফুলবাগিচা-বেষ্টিত এক সুরম্য অট্টালিকায় বাস করে, যেখানে একদা এক সুখী রাজপুত্র তার স্বামী ছিল। যুদ্ধ লাগার পর স্বামীটিকে চলে যেতে হয় বাংলামুলুকে। সেখানে সম্মোহনী চোখ আর কালো কেশরাশির বিরল প্রজাতির নারীদের বাস। তারা জাদুকরী। তাদের মোহিনী রূপ সেই কোন কালে মেজর ইশতিয়াকের পূর্বপুরুষদের বশ করেছিল, সেই লোকগুলো পশ্চিম ভারতের রুখুশুকু, লাবণ্যহীন নারীদের কাছে আর ফিরে আসেনি। সেখানেই থেকে গিয়েছিল। স্বামী হারানোর বেদনা এ মহিলারা ভুলতে পারেনি, বংশপরম্পরায় আজও তা বয়ে বেড়াচ্ছে।

মেজর ইশতিয়াকের বুকপকেট থেকে বেরিয়ে আসে গোলাপি লিপস্টিক রঞ্জিত ঠোঁট, সরু আঁকা জ্বর এক ভয়ার্ত নারী। চিঠিতে যে বারংবার স্বামীকে চরিত্র ঠিক রাখার কসম খাওয়ায় আর অনবরত ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। খান্দান রক্ষার্থে সে আত্মঘাতিনীও হতে পারে, যদি জানে যে, তার খসম জাদুটোনার খপ্পরে পড়ে কালো কালো বাঙালি নারীর শাড়ির আঁচল ধরা হয়ে গেছে এবং ঠিকমতো যুদ্ধ করছে না। মেজরের স্ত্রী জর্জেটের স্বচ্ছ ওড়নার ফাঁক দিয়ে বারো শ’ মাইল দূর থেকে ঘৃণা আর অবিশ্বাস নিয়ে মরিয়মের দিকে তাকায়। জাদুকরীর তাতে ভাবান্তর হয় না। সে তখনো এসব হিসাব-নিকাশের বাইরে। তা ছাড়া মানুষের জীবনই যেখানে মিথ্যা, সেখানে একটা ফটোর মূল্য কী। কিন্তু ছবিটাকে উপলক্ষ করে কদিন পর প্রেমিক-প্রেমিকার মনে ভাটার টান লাগে। জোয়ারের ঢেউগুলো বিষাক্ত শৈবালের মতো তাদের শুকনো বেলাভূমিতে আছড়ে ফেলে ক্রমে দূরে সরে যায়। কী আশ্চর্য! মরিয়মের হঠাৎ হুঁশ ফেরে, খুনি-ধর্ষক লোকটাকে নিয়ে গত কয়েকটা দিন সে মাতোয়ারা ছিল! যার বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানও রয়েছে! যে তাকে বিশ্বাস করে না পর্যন্ত! তালাবন্ধ ঘরে রাতদিন আটকে রেখেছে। লাল গোলাপ, সিল্ক শাড়ি, গজল–সব মেকি আর প্রেমটা হচ্ছে চাতুরী। সত্য যে, লোকটা তাকে ভালোবাসে না, সে তার জন্ম-জন্মান্তরের শত্রু।

এদিকে মেজর ইশতিয়াক মনে করে বাঙালিরা মানুষ না–প্যাট, পোষ্য, বিড়াল স্বভাবের। আশপাশে মিউমিউ ডাক ছাড়বে। কোলে বসে চোখ বুজে দোল খাবে। কিন্তু সুযোগ পেলে আঁচড়টা-খামচিটা দিতে ভুল করবে না। মেজরের দুঃখ যে, ইংরেজদের মতো তারা সঠিকভাবে দেশটা শাসন করতে পারেনি। তাই দুই শ বছরের জায়গায় চব্বিশ না পেরোতেই দুর্ভোগের একশেষ। আত্মসমালোচনাটা মেজর ইশতিয়াক এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই করে। তাই বন্ধুমহলে উদারনৈতিক হিসেবে তার খুব নামডাক। মরিয়মকে একদিন ‘আর ইউ হিন্দু অলসো?’ মেজর ইশতিয়াক দুম করে প্রশ্নটা করে বসে। এ প্রশ্নের কী জবাব দেওয়া যায়? হিন্দু বললে মেজর তাকে মেরে ফেলবে? মলিনা গুপ্তের স্বামী, শ্বশুর, ভাশুর, আর শোভা রানীর স্বামীর মতো?

মরিয়ম মুসলমান শুনেও মেজর ইশতিয়াকের রাগ পড়ে না। বাঙালি মুসলমান আবার মুসলমান নাকি! হিন্দুরা তাদের কাফের বানিয়ে ফেলেছে। মুসলমান ভ্রাতৃত্বের মাঝখানে সুকৌশলে ছুরি চালিয়ে দু’ফালি করে দিল শালার মালাউনরা। ব্লাডি ওয়ারের একটা ভালো দিক মেজর মনে করে, তারা হিন্দুদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিলম্বে হলেও নিশ্চিহ্ন করতে পেরেছে। বাকিগুলো এখন ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পে কলেরায় ধুকে ধুকে মরছে। ওই নরক থেকে কাফেরগণের আর ফিরতে হবে না।

এদিকটা বাদ দিলে সত্য যা–মেজর ইশতিয়াকের যুদ্ধ করতে আর ভালো লাগে না। সে ক্লান্ত। শত্রুপক্ষের সৈন্যদলের সঙ্গে লড়াই করলে জয়-পরাজয় থাকে। কিন্তু নিরস্ত্র সিভিলিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আর ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করা, তার মনে হয় একই ব্যাপার। এর শুরু আছে, শেষ নেই।

অবশেষে আসল যুদ্ধটা ঘোষণা দিয়ে শুরু হলো। জন্মাবধি একে অপরের শত্রু–পাকিস্তান আর হিন্দুস্তান আবারও পরস্পরের মুখোমুখি। এবার কাশ্মীর বা রান অফ কাঁচ নয়-বাংলা। পশ্চিম সীমান্তে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার খেলা যখন চলছে, পূর্বে যুদ্ধটা ঝড়ের আকার ধারণ করে। ঝটিকা ঝড়, যার মেয়াদ মাত্র বারো দিন। জেনারেল ব্যাঘ ওরফে নিয়াজির তখত টলে ওঠে, গর্জন থেমে যায়, ভূগর্ভস্থ কক্ষে অস্থির পদচারণা শুরু হয়। সেখানে নিরাপদবোধ করার কোনো কারণ ছিল না। কেননা দেয়ালের মানচিত্রের তিরচিহ্নগুলো একই সঙ্গে নির্দেশ করছে পাকিস্তানিদের পশ্চাদপসরণ আর ভারতীয়দের অগ্রযাত্রা। টেলিফোন, বেতারযন্ত্র মারফত একের পর এক তার অধস্তনদের পথ হারানোর, আত্মসমপর্ণের, ডুবে মরার খবর আসছে। অথচ পশ্চিম অর্থাৎ কেন্দ্র নির্বিকার।

মেজর ইশতিয়াকরা শক্ৰবেষ্টিত। এই অবস্থায় ভূগর্ভস্থ কক্ষ থেকে ইস্টার্ন কমান্ডের নির্দেশ আসে-শতকরা পঁচাত্তর ভাগ কেজুয়্যালটির আগে ডিফেনসিভ পজিশন ছেড়ে কেউ পালাতে পারবে না। নির্দেশটা মৃত্যুর পরোয়ানা। ভূগর্ভস্থ নির্দেশটিকে মেজর ইশতিয়াক বিচার করে বাস্তবতার নিরিখে। শত্রু জল, স্থল, অন্তরীক্ষ–সর্বত্র বিরাজমান। এ অবস্থায় যুদ্ধ নিরর্থক, পালানো কাপুরুষতা। তারপর বাকি থাকে মৃত্যু। ‘মুজে মাফ কর্‌ দো’ বলে ভারতীয়দের বোমাবর্ষণের মধ্যে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। মরিয়ম হতভম্ব। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শোনে দরজায় তালা লাগানোর ঝনঝন আওয়াজ। ‘এই, এই কী হচ্ছে? প্লিজ লেট মি ফ্রি, আই বেগ ইউ!’ সে দৌড়ে যায় দোর পর্যন্ত। বাইরে থেকে তখন জবাব আসে, ‘অর্ডার নেই।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *