ঢাকা ত্যাগ
২৬ মার্চ সকাল। কারফিউ চলছে। হাজি সাহেবের বাড়ির সামনের লাইটপোস্টে দড়ি বাধা কুকুরটা যে মরে পড়ে আছে, আশপাশের বাড়ির লোকজন তা শুধু জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে, ভয়ে ঘর থেকে বেরোয় না কেউ। তখনো এদিক-ওদিক ফুটফাট গুলির আওয়াজ, বাতাসে পোড়া দুর্গন্ধ। ধারেকাছে নিশ্চয় ঘাপটি মেরে আছে ঘাতক। তা না হলে কুকুরটা মরল কীভাবে? পাড়ার প্রথম শহিদ পাহারাদার কুকুর একদিন একরাত রাস্তায় পড়ে রইল। সকালবেলায় একটা সাদা বিড়াল গুটি গুটি পায়ে মরদেহটা একচক্কর ঘুরে যায়। খানিক পর ডাক্তারের বাড়ির গলাছোলা মুরগিটা এক ঝাঁক ছানাপোনা নিয়ে এর লেজ থেকে মাথা পর্যন্ত ঠোকরায়, ঘাড় তুলে কুড়কুড়িয়ে বাচ্চাদের কী যেন বলে, তারপর জোরে কোথাও বোমা ফাটতে গম্ভীর চালে হেঁটে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। দুপুরবেলা ডাক্তার সাহেব সাহস করে রাস্তায় নেমে শনাক্ত করেন–কুকুরটা গুলি খায় নাই, হার্টফেল করেছে। তখন ছাদে উঠে পাড়ার ছেলেরা স্বাধীন বাংলার পতাকা নামিয়ে ফেলে ঝটপট। মরা কুকুর ডিঙিয়ে কেউ কেউ ত্রস্তপায়ে এবাড়ি-ওবাড়ি যায়। কে বাঁচে কে মরে, তাদের হয়তো জরুরি কথা আছে প্রতিবেশীকে শেষবার বলার মতো।
২৫ মার্চ রাতে মহল্লার লোকেরা খাটের তলায়, টেবিলের নিচে, দেয়ালের আড়ালে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বেঁচেছে, এখন অদৃষ্টে কী আছে, কে জানে। যে কুকুরটা গত দু’দিন করুণ সুরে বিলাপ করে তাদের আগাম বিপদসংকেত জানাচ্ছিল, তার নেতৃত্বের অভাবে শহরের বাদবাকি কুকুরগুলোও চুপ। টেলিফোন বিকল। রেডিওতে সামরিক আইন অধ্যাদেশের মুহূর্মুহূ প্রচার, বিরতিতে যন্ত্রসংগীত, পুনঃপুন ঘোষিত হচ্ছে-রাস্তায় বের হলেই গুলি। নানা রকম আশঙ্কায় দিনটা শেষ হয়। রাতে ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ শুনে চোখে সবাই অন্ধকার দেখে।
সেই আঁধারে গা-ঢাকা দিয়ে হাজির বাড়ির দোতলার লোকটা নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে এক দৌড়ে রাস্তা পার হয়। লোহার গেট বেয়ে উঠে লাফিয়ে পড়ে উঠানে। কোনো শব্দ হয় না। মাটি টিউবওয়েলের জলে ভিজে কর্দমাক্ত। উঠানের বিক্ষিপ্ত ইটের সারি সে সন্তর্পণে পেরিয়ে যায়। খোলা জানালা দিয়ে লাফিয়ে ঘরে ঢোকে। অন্ধকারে প্রথম কিছুই ঠাহর হয় না। নাকে দুর্গন্ধ। রক্তপিণ্ডে পা পিছলে কয়েক গজ সামনে চলে যায়-অন্ধকারে বোঝা মুশকিল ভেজা আঠালো জিনিসটা কী। সে ডান দিকে তাকায়–কিছু নেই। বাঁয়ে তাকায়–খাট শূন্য। গেল কোথায় মেয়েটা? সে দম আটকে রেখে কান খাড়া করে। খাটের তলায় হালকা গুঞ্জন। যেন একটা বেখেয়ালি মাছি মাকড়সার জালে আটকে পড়েছে। লোকটা উবু হয়-খাটের নিচে মরিয়ম, যাকে ২৫ মার্চ রাত উড়িয়ে নিয়ে ফেলেছে ওখানে। মরে যে যায়নি, নাকের কাছে আঙুল ধরে কিংবা বুকে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করে না। সে মেয়েটিকে খাটের নিচ থেকে টেনে বাইরে আনে। ঘরের মেঝে ভর্তি কাঁচের টুকরো আর ভেজা-আঠালো অদ্ভুত জিনিসটা। সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে এখন এমন উত্তেজিত যে, নিঃশব্দে চলাফেরার কথাও ভুলে যায়। তবে দরজাটা সে খোলে না। হয়তো ভাঙা জানালাটা দিয়েই তার চলাচলের সুবিধা। সে টিউবওয়েল চেপে মগভর্তি পানি নিয়ে এই পথেই আসা-যাওয়া করে। মরিয়মের সারা গা ভিজে জবজবে। তবু জ্ঞান ফেরে না। কতক্ষণ ধরে বেহুশরাত ১২টার আগে নিশ্চয়ই নয়, গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর খাটের তলায় নিজে থেকেই ঢুকেছে যখন। লোকটা আঙুল গুনে হিসাব করে, চব্বিশ ঘণ্টা পার হতে এখনো দুই আঙুল বাকি। সে অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে রান্নাঘরে যায়। ওখানে দিয়াশলাই, মোম, কেরোসিনের কুপি সব রাখা আছে। চুলার কাছের কাঠের তাকে হলুদ, লবণ, গুড়ো মশলার পাশে শুকনো মরিচের কৌটা। কৌটাটা হাতে তুলে নেওয়ার সময় লোকটাকে মিটিমিটি হাসতে দেখা যায়। সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল আলোর গতিতে একটা হারানো স্মৃতি তার ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে-বউয়ের দাঁতকপাটি লেগে গেছে। দু’দিন যায়, তিন দিন যায়, খোলে না। ওঝা আসে বাড়িতে। মাটির মালশার তুষের আগুনে লাল টুকটুকে মরিচ পোড়ানো হয়। বউ হেঁচে-কেশে রক্ত জবার মতো চোখের পাপড়ি খোলে, যা তিন দিন আগে দু’পাটি দাঁতের সঙ্গে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর বাপের বাড়ি চলে যায়। সেখান থেকে জোরজবরদস্তি আনতে গিয়েই খুনখারাবির ঘটনাটা ঘটে।
মরিয়ম চোখ খোলে–দুটি ঘুমন্ত রক্তজবা পাপড়ি ছড়ায়। ঘরভর্তি ধোঁয়া, মরিচ পোড়ার তাণ্ডব। এই লঙ্কাকাণ্ডের ভেতর কাকে যেন সে দু’হাতে ধোঁয়া ঠেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে। বোতল পোঁতা বাড়িটা তাকে ভরসা দেয় না। আবার জিনপরির ভয়ে সে চেতনাও হারায় না। সুন্দরীর জলা এখান থেকে বহুদূর। ভূত-পেতনির জায়গা নিয়েছে মানুষ–শহর আক্রান্ত হয়েছে যেসব মানুষের হাতে। অদূরের গোলাগুলির আওয়াজ তাকে জানিয়ে দিতে পারত, এখনো যুদ্ধ চলছে এবং বাড়িতে সে একা। সে ভাবতে পারত, তার একটা অতীত ছিল, যা থেকে এখন সে বিযুক্ত। এমনকি আবেদের সঙ্গের সম্পর্কের গিঁটগুলোও যে যুদ্ধ লাগার ঠিক আগমুহূর্তে ছিঁড়ে গেছে, তা ভেবে সে দুঃখ পেতে পারত। মরিয়মের এসব কিছুই হয় না। সে তলপেটে সামান্য ব্যথা অনুভব করে, তার পরও বোঝে না যে, আপদ নিজে থেকে বিদায় হয়েছে। মরিয়ম শুধু অচেনা লোকটাকে ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে পানির গেলাস হাতে ফিরে আসতে দেখে। লোকটা তাকে বিছানায় শোয়ায়, মাথার পেছনে হাত রেখে চুমুক দিয়ে দিয়ে জল খেতে সাহায্য করে। তারপর গায়ের ওপর ধীরেসুস্থে চাদর টেনে দিয়ে। বেরিয়ে যায়। এসব হয়তো কোনো সিনেমার দৃশ্য। ঘর খালি হতে আরামে চোখ। বোজে মরিয়ম।
‘গাড়ি-ঘোড়া চলতাছে’ বলে দরজায় ঘা দিয়েই চলে যায়। সে গেট টপকে এসেছিল হাজির চোখে ধুলা দিয়ে। ঢাকা ছেড়ে লোকজন চলে যেতে শুরু করেছে। সকাল থেকে দুপুর কারফিউ-মুক্ত। ঘরের জিনিসপত্র যে যতটুকু পারে বোঁচকা বানিয়ে পিঠে, কাঁধে, হাতে তুলে নেয়। দরজায় তালা পড়ে। কোনো দিন যদি ফিরে আসতে পারে, ঘরদোর, জিনিসপত্র ফেরত পাওয়ার আশা নেই। এই মুহূর্তে জীবনটাই সবচেয়ে দামি। মরিয়মও দুর্বল শরীরে ঘরছাড়া মানুষের কাফেলায় ভিড়ে যায়। তাকে চোখে চোখে রেখে বিশাল এক বোঁচকা মাথায় হাঁটছে গত রাতের লোকটা। বোঁচকায় হাজি সাহেবের মালসামান। হাজির খাস চাকর দড়ি ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মরা কুকুরটাকে। সকারের জন্য নয়, তাকে নাপাক জন্তুটাকে এলাকার বাইরে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাজি সাহেব। তিনি মরিয়মকে আচমকা জিগ্যেস করেন, ‘তোমার ভাই মন্টু না ঝন্টু-হে কই?’ মন্টু গ্রামের বাড়ি গেছে শুনে বিড়বিড়িয়ে মনে হলো বদদোয়া দিলেন। মেরিকে কিছু বললেন না।
হাজি সাহেবের নেতৃত্বে পনেরো-কুড়ি জনের দলটা যখন নৌকা করে বুড়িগঙ্গা পার হয়, তখন কয়েকটা শবদেহ তাদের পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। এদের চলায় জীবিতদের মতো তাড়া নেই। ছোট ছোট ঢেউয়ের দোলায় ভাসছে। কোথাও আটকে পড়ছে জলজ গুল্মে, আবর্জনায়। এ দৃশ্য দূর আকাশ থেকে দুরবিন-চোখে দেখছে। একদল শকুন। তখনো এদের পাখা টানটান, ধারালো নখ গুটানো। অপেক্ষাকৃত নিচ দিয়ে ওড়াউড়ি করছে কতগুলো মাংসলোভী কাক।
বেলা চড়ে গেছে। সামনে উত্তপ্ত বালুচর। মরিয়মদের দলটা যাচ্ছে কেরানীগঞ্জের দিকে। সেখানে মহল্লার আওয়ামী লীগের সংগ্রাম কমিটির সেক্রেটারির মৃত স্ত্রীর বাবার বাড়ি। হাজি সাহেব বিয়েতে ঘটকালি করেছিলেন। সংগ্রাম কমিটির সেক্রেটারি এখনো রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শহরের অফিসঘরটা আগলাতে ব্যস্ত। সেক্রেটারির। অনুপস্থিতিতে হাজি সাহেব পাড়ার এক দঙ্গল লোক নিয়ে যাচ্ছেন নিজের ঘটকালি করা অন্যের শ্বশুরবাড়ি, যে বর্তমানে তার বিরোধীপক্ষও বটে। তবে সব বাঙালিই আপাতত একদিকে। তিনিও মহল্লার পুরোনো লিডার। তাই বিপদের দিনে তার ওপর ভরসা রেখে সবাই যাচ্ছে।
সংগ্রাম কমিটির সেক্রেটারির শ্বশুরবাড়িতে প্রথম রাতেই উদ্বাস্তুদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই বেঁধে গেল। গৃহকর্তা শৌখিন মানুষ। একটা তিন ব্যান্ডের পুরোনো পাই রেডিও চালিয়ে যুদ্ধের আগে অনুরোধের আসরের গান শুনতেন। যন্ত্রটা এখন এজমালি সম্পত্তি। যে হাতের কাছে পায়, সে-ই নব ঘোরায়। রাতে নব ঘোরাতে ঘোরাতে ধরা পড়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। উত্তেজনায় শ্রোতাদের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম যখন, হাজি সাহেবের বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়ে। স্বাধীনতার ঘোষণাপাঠ আরম্ভ হয়ে গেছে–আই, মেজর জিয়া, অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান…। যুদ্ধটা যে একতরফা হবে না, এখন তা স্পষ্ট। কে এই মেজর জিয়া? হাজি সাহেব নিজেই-বা কার দলে? পাকসৈন্যরা বাছবিচারহীন বাঙালি খতম করছে বলে জানের ভয়ে সপরিবারে তাকেও ঢাকা ছেড়ে পালাতে হয়েছে। ভেবেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতে সক্ষম হবে মিলিটারি। পাকিস্তান পাকিস্তানের জায়গায় থেকে যাবে। এখন এদিক থেকেও যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়! আজন্মের শত্রু ভারত তো ওত পেতেই আছে ঘোলাজলে মাছ শিকারের জন্য। হাজি সাহেবের অবস্থা এখন বাঘের ঘরে ঘোগের ছা। নিজে এসে ধরা দিয়েছেন।
উদ্বাস্তুরা শহরের শিক্ষিত মানুষ, সবজান্তা। ঢাকার পতন হলেও সারা দেশে যে দাবানলের মতো যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে, কেরানীগঞ্জ বসে ঠিক ঠিক তা বলে দিচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বন্দি না পলাতক-রাতদিন কানে রেডিও লাগিয়ে তা আন্দাজ করতে পারছে না। লোকগুলো আসলে চোখ থাকতে অন্ধ। কান থাকতে বধির। হাজি সাহেব ভয়ে ভয়ে উচ্চারণ করেন, ‘শেখেরে মনে হয় বন্দি করে আননোন ডেস্টিনেশনে নিয়া যাওয়া অইছে।’ কেউ তার কথার প্রতিবাদ করে না। বিষয়টা অস্বস্তিকর। মাথা না থাকলে ধড় দিয়ে কী হবে? ২৭-২৮ মার্চ দুই দিন হাজি সাহেব সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললেন। মনের মতো খবর শোনার জন্য লুকিয়ে-চুরিয়ে রেডিও পাকিস্তান ধরবার উপায় নেই। ২৯ তারিখ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র টিক্কা খানের নিহত হওয়ার গুজব নিউজ আকারে পরিবেশন করে। গৃহকর্তা খুশি হয়ে রাতে ফিস্টের আয়োজন করলেন। হাজি সাহেব দেখলেন, বিপদ ঘাড়ের ওপর। ব্রিটিশ আমল থেকে। তিনি রাজনীতি করছেন। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা দেখেছেন। বাঙালি মুসলমানদের পাকিস্তান চাইতে এবং এখন তা ভাঙতে দেখছেন। বুঝতে পারছিলেন, আড্ডার পরিবেশ বেশি দিন ঠিক থাকবে না। শ্রোতারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে এবং রক্ত। ঝরবে, যা থেকে তিনি নিজেও বাদ যাবেন না। ২৯ মার্চ রাতে বৃষ্টি হয়। হাজি সাহেব বললেন, আগুন নেভাতে অসময়ে আল্লাহতালার এই অমোঘ বর্ষণ। পোড়া শহর আবার চাঙ্গা হবে–মহা প্লাবনের পর পৃথিবী সুজলা-সুফলা হওয়ার কথা আল্লাহর কালাম পাকে যেমন বলা আছে। ভোরবেলা বর্ষণসিক্ত মাটির ওপর দিয়ে সপরিবারে। তিনি ঢাকা ফিরে গেলেন। সঙ্গে নিলেন দোতলার বাসিন্দাকে। যার নাম এখন দলের সবাই জানে রমিজ শেখ। সে দুর্দিনের আশ্রয়দাতা হাজি সাহেবের ডান হাত। কৃতজ্ঞতাবশত বা বাধ্য হয়ে গেলেও রমিজ শেখের মনটা পড়ে থাকল কেরানীগঞ্জে, যেখানে মরিয়ম রয়েছে। যাকে সে মরিচ পুড়িয়ে ধোয়া দিয়ে বাঁচিয়েছে। ফলে মেয়েটার জানের ওপর তার হক আছেই। তা ছাড়া কাউকে মেরে ফেললে যদি শাস্তি পেতে হয়, বাঁচালে এর সুফল ভোগ করবে না কেন মানুষ? যুক্তিটা রমিজ শেখ মাথায় করে নিয়ে যায়।
দলের বাকি লোকজন রাতের বর্ষণে খোদার লীলাখেলার আলামত কিছু দেখতে পায় না। গোলাগুলি থামারও কোনো লক্ষণ নেই। স্বাভাবিকভাবে তারা নিজের নিজের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে পায়ে হেঁটে যাত্রা করে। নিখরচায় ছোট ছোট খেয়া পারাপার হয়। ধানখেতের আইল ধরে হাঁটে। খায়-ঘুমায় অচেনা লোকের বাড়ি। দিনের বেলায় গ্রামবাসী ডাব কেটে, চিড়ে-গুড়, সেদ্ধ ডিম নিয়ে মাঠে, গাছতলে আপ্যায়ন করে। তারা দেখে, ধনী হোক গরিব হোক শহরের লোকগুলো জান নিয়ে পিঁপড়ার মতো পিলপিলিয়ে পালিয়ে আসছে। সাধ্যে যা কুলায়, তাদের সাহায্য করাই কর্তব্য। এদিকে যার যার গন্তব্য অনুযায়ী পথ ভাগ হয়ে যাচ্ছে। চলতে চলতে বদলে যাচ্ছে দলের লোকজন। উত্তরবঙ্গ থেকে বরিশালে ধান কাটতে যাচ্ছিল কয়েকজন খেতমজুর। তাদের নৌকায় করে মরিয়ম যখন উত্তাল পদ্মা পার হয়, তখন দলের লোক সব তার অপরিচিত। সে ভাত খাচ্ছে নৌকার এক মাল্লার মাটির সানকিতে-পোড়া মরিচ-লবণ মেখে পান্তাভাত। পদ্মায় জেলে-নৌকা বিস্তর, মাছও উঠছে, তখনো মানুষের মৃতদেহ নদীর মাছের খাদ্য তালিকাভুক্ত হয়নি আর মানুষও খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেয়নি নদীর মাছ। কিন্তু পয়সার অভাবে মাল্লা-মজুররা মাছ কিনতে পারছে না। মরিয়মের গাল বেয়ে দু’ফোঁটা নোনা পানি পান্তাভাতে ঝরে পড়ে।