০২. মরিয়ম ওরফে মেরি

মরিয়ম ওরফে মেরি

দেব দেব দেব দেব/ রক্ত রক্ত রক্ত দেব।
বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো।

মরিয়মদের বাসার সামনের চিপা গলিতে ঝড়ের বেগে ঢোকে সর্পাকৃতির একটি মিছিল। লোকগুলোর হাতে লোহার রড, বাঁশের লাঠি, নৌকার বৈঠা, খাটের স্ট্যান্ড। হঠাৎ মিছিলের পেট চিরে হাঁপাতে হাঁপাতে দুটি ছেলে গেটের ভেতর ঢুকে পড়ে। ‘মন্টু বাড়ি চলে গেছে,’ মরিয়ম তা বলামাত্র তারা আরেক দৌড়ে ফিরে গিয়ে মিছিলের লেজটাকে ধরে। এ সময় মিছিলের অগ্রভাগে চোঙায় ঝংকার ওঠে, ‘তোমার আমার ঠিকানা,’ সঙ্গে সঙ্গে লেজে আছড়ে পড়ে ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’র কুলভাঙা ঐকতান। মরিয়ম যেন নদীতীরের নিঃসঙ্গ গাছ, মাটি ভাঙনের আবেগে থরথরিয়ে কাঁপছে। যে সংগ্রাম আর সবার স্বাধীনতার, তার জন্য বন্দিত্বের। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। অফিস-আদালত হয় কি হয় না। সে নিজে বিএ পাস দিয়ে ঘরে বসে আছে। দেশের এ পরিস্থিতিতে চাকরির খোঁজে বেরোলে লোকে পাগল ভাববে। অবশ্য চাকরিবাকরি তার বর্তমান সমস্যার সমাধানও নয়।

মরিয়মের ইচ্ছে হয়, মিছিলের ছেলে দুটিকে ডেকে কিছুটা সময়ের জন্য ঘরে বসায়। প্রেসিডেন্ট ভবনের আলোচনা কতদূর, আমরা কি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসতে পারব, না যার যা আছে তা-ই দিয়ে যুদ্ধ করে নিজেদের ন্যায্য পাওনা আদায় করতে হবে–এসব জানার জন্য নয়। সে আসলে তাদের কাছে। আবেদের খবর জানতে চায়। লোকটা কি আজ আসবে না? মরিয়মের যে তার সঙ্গে জরুরি কথা ছিল। সেসব জানানোর জন্য মানুষ তো মানুষ, পাখিদেরও এখন তার পক্ষে দূত ভাবা সম্ভব। কারণ মেরি ওরফে মরিয়মের ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত চাওয়া ছিল–আর দশটা মেয়ের মতো নানান বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তার যেন একটা নিজস্ব জীবন হয়, যাতে সময়মতো মা হয়ে স্বামীর সংসার করার নিশ্চয়তা থাকে। এদিকে সর্পাকৃতির মিছিলটা তখন গলি কাঁপিয়ে বেরিয়ে গেছে। মরিয়ম জানে, নদী-শাখানদী সব মিলে যেমন সাগরে পতিত হয়, এটিও তেমনি আর সব মিছিলের সঙ্গে পল্টন ময়দানে গিয়ে পড়বে। যদিও শুরু থেকে শেষতক কোনো মিছিলে সে কখনো ছিল না।

উনসত্তর সালে মরিয়মদের বকশীবাজার কলেজ থেকে রোজ একটা করে মিছিল বেরোত। বিক্ষুব্ধ ছাত্রীদের স্রোতের তোড়ে সেও দু-তিনবার খড়কুটোর মতো ক্লাসরুম, কলেজের মাঠ থেকে ভেসে গেছে। একবার তাদের মিছিলটা বুয়েটের সামনের রাস্তায় পৌঁছানোর পর মরিয়মের পায়ের একপাটি স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়। মিছিলটা যাবে ইডেন কলেজে। সে খালি পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে কিছুদূর। তারপর পলাশীর কাছাকাছি। আসতে সুযোগ বুঝে সটকে পড়ে। সেখানে এক মুচির কাছে স্যান্ডেল সারানোর সময়। মরিয়মের প্রথম পরিচয় এসএম হলের আবসিক ছাত্র আবেদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। সেদিন মেরি মিছিল থেকে সটকে না পড়লে, আবেদ প্রায়ই বলত, তাদের হয়তো দেখাই হতো না, তারা যে যার জায়গায় থেকে যেত। উনসত্তর থেকে একাত্তর। এখন আবেদ বলে, ‘তোমার মতো মেয়েরা যখন ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে, রোদে দাঁড়িয়ে লেফট-রাইট করছে, গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছে, তোমার মুখে খালি বিয়ে বিয়ে–জপ-তপ।’

কেন মরিয়ম বিয়ের কথা বলে–এখন তা বলতে গেলেও শুনতে চায় না আবেদ। মেয়েটিকে আবর্জনার মতো এড়িয়ে চলে সে।

সর্পিল মিছিলটা বড় রাস্তায় উঠে গেলে, মরিয়ম টিউবওয়েলের নর্দমার জলকাদা ডিঙিয়ে গলির মুখে এসে দাঁড়ায়। এখন তার ঘরে ফেরা উচিত, না আবেদের খোঁজে বেরোবে সে–তা বুঝতে না পেরে গলির মুখেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। যত দূর স্মরণ হয়, মরিয়ম সেদিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওখানেই ছিল, যতক্ষণ না সামনের দোতলা বাড়ির জানালা খুলে দুটি জ্বলজ্বলে চোখ অন্ধকারে জ্বলে ওঠে। তার পরও খানিকটা সময় সে অসাড়, যেন এক জোড়া চোখ নয়, সে আটকে গেছে বন্দুকের গোলাকার রেঞ্জে। নড়ামাত্র গুলি। মরিয়ম লোকটাকে কখনো দেখেনি, তার ওই চোখ জোড়া ছাড়া। সে যে মেয়ে নয়–তা তার আন্দাজই কেবল। কারণ মন্টুর অনুপস্থিতিতেই লোকটা তাদের বাসার দিকের জানালা খুলে ওই বন্দুক চোখে মরিয়মের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন গলিতে একটা মিছিল ঢুকল তো শাট শাট কপাট বন্ধের আওয়াজ। মন্টু বলে, লোকটা খুনের আসামি, না হয় চোর। কদিন আগে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের তালা ভেঙে ৩২৫ জন কয়েদি যে পালিয়েছে, সে হয়তো তাদেরই একজন। তবে লোকটা দালালও হতে পারে। বাড়ির মালিক হাজি সাহেব ব্রিটিশ আমলের মুসলিম লীগার। নির্বাচনের সময় আওয়ামীপন্থি ছেলেকে সপরিবারে তাড়িয়ে দেওয়ার পর মাঝখানে কয়েক মাস দোতলাটা খালি পড়ে ছিল। এখন তো দেশের নিরানব্বই শতাংশেরও বেশি মানুষ আওয়ামী লীগ করে। তাই দোতলাটা ভাড়া দিয়ে বাড়িতে শত্রু তোলেননি তিনি। মরিয়ম ভাবে, হাজি সাহেবকে একদিন বললে হয়–তার নতুন ভাড়াটে মেয়েলোকের দিকে তাকিয়ে থাকে কেন! সে লোকটার বেলাল্লাপনার শাস্তি দাবি করবে। কিন্তু হাজির বাড়ির মহিলারা তো পর্দানশিন, যদি উল্টো নসিহত শুনে তাকে বেরিয়ে আসতে হয়! এমনিতেই হাজি সাহেব মন্টুর ওপর মহা খাপ্পা। নির্বাচনের সময় সে হাজির বাড়ির চুনকামহীন খড়খড়ে দেয়ালে নৌকার চিকা মেরেছে। কিন্তু মন্টু চিকা মারুক, মেরি তো মারেনি। সে কখনো রিকশার চাকার হাওয়া ছাড়েনি, বাসে আগুন ধরায়নি, পুলিশের গায়ে ঢিল ছোড়েনি। তখন যদি হাজি বলেন, ‘তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু তুমি তো একজন কলেজছাত্রী, শিক্ষিত, সচেতন নাগরিক। আমারে ভেঙে কও দেখি, তুমি পাকিস্তানের অখণ্ডতা চাও, না ভারতের দালালি করে দেশটা ভাগ হোক–হেইডা চাও?’

এখন তো দাঁড়িপাল্লার দুদিকে নব্বই ডিগ্রি কোনাকুনি এই দুই পক্ষের অবস্থান। হাজি সাহেবদের পাল্লায় মণ মণ ওজনের বাটখারা চাপালেও মন্টুদের পাল্লার সমান। হবে না। তাই তিনি একরকম ঘরবন্দি থেকে দল ভারী করার জন্য একটা প্যাচা ধরে দোতলায় রেখে দিয়েছেন। কিন্তু এসবের মধ্যে মরিয়ম কোথায়? আজ মন্টু চলে যাওয়াতে সে পক্ষ-নিরপেক্ষও হয়ে পড়েছে। এই ভাবনাটা তাকে বিচলিত করে। বুকে কাঁপন ধরায়। এখন যে যেখানেই থাকুক, যার যা আছে, তাই নিয়েই সশস্ত্র। মরিয়ম সশস্ত্র হওয়ার জন্য গেটের পাশের বেড়ার খুঁটি ধরে টানাটানি জুড়ে দেয়। কাজটা যত সহজ ভেবেছিল, ততটা নয়। ঘুণে ধরা বাঁশ যেন মাটিতে শিকড় গেড়েছে। ভাঙবে তবু উঠে আসবে না। সে খুঁটি ওপড়ানো ছেড়ে বাড়ির ভেতর চলে যাওয়ার কথা ভাবে একবার। পরক্ষণেই অনুভব করে পিঠের ওপর বন্দুকের সেই গোলাকার চাকতি। গায়ের সমস্ত শক্তি জড়ো করে টান দিতেই যখন বাঁশটা মাঝখানে ভেঙে হাতে চলে আসে আর মাটিতে পড়তে পড়তে সে টাল সামলে উঠে দাঁড়ায়, তখন দোতলার জানালার জমাট অন্ধকার হাসির তাণ্ডবে খান খান হয়ে যায়। হাসির শব্দে বোঝা যায়, কে হাসে। হায়েনাও তো মানুষের মতো হাসে। কিংবা মানুষ হায়েনার মতো। মরিয়ম এইটুকু ভাঙা-বাঁশ দিয়ে কী করবে? দোতলার জানালা ছুঁতে গেলেও তো আস্ত একটা বাঁশ দরকার। তা বলে বাঁশের টুকরাটা ফেলে দিলে হাত একদম খালি। মরিয়মের ভয় হয়, তারপর সে শুধু নয়, তাদের এই ছোট্ট বাড়িটাও ওই জানালার দখলে চলে যাবে।

ভয়টা মরিয়মের রক্তেই ছিল।

’৬৪ সালের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এবং ’৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর হিন্দুরা যখন ঝাঁক বেঁধে ভারতে চলে যাচ্ছিল, তখন মেরি-মন্টুর আব্বা পানির দরে রায়ের বাজারের এই জায়গাটা কেনেন। শহরের জমি-জিরাতের ওপর কোনোকালেই তার তেমন লোভ ছিল না। বড় শ্যালক গোলাম মোস্তফা দেশভাগের পর থেকে হিন্দুদের জমিজমা বেচা-কিনি করে তত দিনে লাখপতি। তিনি জোতদার ভগ্নীপতিকে উপদেশ দেন–এক বছরের পাট বেচার টাকা দিয়ে শহরে যেহেতু জমি পাওয়া যায়, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তার তা করা উচিত। তা ছাড়া একমাত্র ছেলে লেখাপড়া শিখে তো হাল-বাওয়ার জন্য গায়ে পড়ে থাকবে না! তাদের আব্বা কৃষক মানুষ। মাটির সঙ্গে তার নাড়ি-বাঁধা সম্পর্ক। সেই মাটি ফলনশীল, উর্বর। শুরুতে তাই দোনামনা করছিলেন। কিন্তু কেনার পর, চারদিক থেকে দালানকোঠায় টুটি চেপে ধরা জমিটার ওপর তার মায়া পড়ে গেল। জমির প্রাক্তন মালিক ভারতে চলে গেছে। তার পরিত্যক্ত ভঁই এখন শত্ৰু-সম্পত্তি। কোর্ট-কাছারির সিংহভাগ মামলা তখন এসব জমিজমাসংক্রান্ত। বড় শ্যালকের শহুরে জারিজুরির ওপর কোনোকালেই তার তেমন আস্থা ছিল না। তাই অপরিচিত, অনুর্বর, নিষ্ফলা জমি দখলে আনার জন্য নিজ গ্রাম ফুলতলি থেকে দুজন কামলা এনে টিনের চালের দুই কামরার একটি ঘর তড়িঘড়ি বানিয়ে ফেলেন। দেয়াল ইটের গাঁথুনির, চুনকামহীন। ঘরের সামনে গাঁও-গেরামের ধাঁচে ভোলা আঙিনা, পাশে রান্নাঘর, পেছনে বাঁশঝাড়। বাকি দুই ভিটেই খালি, যেখানটায় ফুলতলি গাঁয়ে হলে গোয়ালঘর ও বৈঠকখানা উঠত। উঠানের মধ্যিখানে টিউবওয়েল, তার পাশে টিনের বেড়ার গোসলখানা। সেখানে নদীর ঘাটের অনুরূপ একটা ভারী তক্তা ফেলা হয়েছে বসে বসে গায়ে জল ঢালার, কাপড় কাঁচার জন্য। বাঁশের পাটাতনের ল্যাট্রিনটা বসেছে বাঁশঝাড়ের পাশে। এর তিন দিক চাটাই ঘিরে প্রবেশপথে চটের পর্দা টাঙানো হয়েছে। সবশেষে পুরো চার কাঠা জমি ঘিরে ফেলা হয়েছে মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে। রাস্তার দিকে মুখ করা কালো লোহার গেট। তার ওপর সাদা রং দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা–এই জমির মালিক কফিলউদ্দিন আহমেদ, সাং ফুলতলি, ডাকঘর সাহারপাড়। বহুদিন নেমপ্লেটে বাড়ির নম্বর ছিল না। বোতলপড়ার মাধ্যমে বাড়িবন্ধ করতে গাঁয়ের এক মৌলবিকে রাহা খরচ দিয়ে শহরে আনা হয়েছিল। সে বাড়ির চার কোনায় চারটি বোতল পুঁতে যায়। এভাবে ফুলতলি গাঁয়ের কফিলউদ্দিন আহমেদ জিন-ইনসানের নজর আটকিয়ে দু’কামরার আধা-শহুরে বাড়ির নিরঙ্কুশ মালিক হন। তারপর বছর খানেক বাড়িটা যে খালি পড়ে ছিল, ভাড়া দেওয়া হয়নি, তা এই কারণে যে, অপরিচিত-অনাত্মীয় লোকজন কটা টাকার বিনিময়ে প্রকারান্তরে বাড়ির মালিক হয়ে বসুক, তিনি সেটি চাননি। বাড়িটা হয়তো খালিই পড়ে থাকত, যদি-না মরিয়ম এমন একটা কাজ করে বসত, যা পরে বড় আর ভয়ংকর হবে, তা না ভেবেই।

মরিয়ম তখন খুব ছোটও নয়, বড়ও নয়, ক্লাস টেনের ছাত্রী। প্রতিবছর একদল ছাত্র দূরদূরান্ত থেকে তাদের বাড়িতে থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে আসত। এক মাইলের ভেতর থানা শহর। সেখানকার হাইস্কুলের দোতলা দালানঘরে আর প্রাইমারির টিনের ছাপরায় পরীক্ষার সেন্টার পড়ে। সেবারও তারা আসে। পরীক্ষার বিরতিতে লুঙ্গি মালকোচা দিয়ে পুকুরের মাছ ধরে আর দিনান্তে হাটে যায়। সিজনের প্রথম আম, ছোট ছোট কোয়ার কাঁঠাল, বিস্কুট, মিষ্টি নিয়ে ফেরে। খাওয়া-থাকা বাবদ গৃহকর্তাকে টাকা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না। তাই সবাই মিলে পুকুরের মাছ ঘরে তুলে, বাজারের টুকিটাকি জিনিস কিনে এনে খানিকটা পুষিয়ে দিতে চাইত। পরীক্ষার্থী একজনের প্রথম দিন থেকেই মরিয়মের পড়াশোনার দিকে নজর খুব। দু’বেলা খাওয়ার সময় ভেতর-বাড়িতে আসা-যাওয়ার পথে মরিয়মকে বলত, অঙ্কে লেটার মার্ক তুলতে হলে পাটিগণিত, জ্যামিতিতে ভালো হলে চলে না, বীজগণিতই আসল। ছেলেটা আবার তাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। নাম জসিম। জসিমুল হক। পরীক্ষার শেষ দিন জসিমুল হক মরিয়মকে সিনেমা দেখার প্রস্তাব দেয়। আব্বা বাড়ি নেই। ঢাকায় বাড়ি বানানো নিয়ে ব্যস্ত আছেন। মাকে না বলেই মরিয়ম জসিমের সঙ্গে সিনেমা দেখতে কাছের জেলাশহরে যায়। বাড়ি ফেরে তিন দিন পর। ছেলেটি ভয়ে পথ থেকেই লাপাত্তা। তারপর প্রথম প্রথম বাড়ির লোকজন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। গ্রামদেশে কলঙ্ক শিমুল তুলোর মতো বাতাসে ছড়ায়। যখন বাবা-মা বুঝলেন যে, দেদার খরচা করলেও মেয়ের এখন বিয়ে হবে না, তখন শহরের বাড়িটার কথা তাদের মনে পড়ে। মরিয়ম শহরে চলে যাক, লেখাপড়া করুক, গ্রামের লোকেরা বেশিদিন কোনো কিছু মনে রাখতে পারে না। ক’বছর বাদে তারা এসবও ভুলে যাবে, তখন মেয়ের বিয়ে দিতে কোনো সমস্যাই হবে না। বুদ্ধিটা আসলে কফিলউদ্দিন আহমেদের বড় শ্যালক গোলাম মোস্তফার। জমির দালালি করে করে মানুষের মনের অন্ধিসন্ধি তার জানা হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, তার আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল। মরিয়ম তত দিনে ম্যাট্রিক পাস করেছে ফার্স্ট ডিভিশনে, বীজগণিতের সূত্র মুখস্থ করে অঙ্কে সে লেটার মার্কও পায়। যে বাড়ি একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বানানো হয়েছিল, তার উদ্বোধনটা হয় মেয়েকে দিয়ে। মন্টু ফাউ–বড় বোনকে পাহারা দিতেই। তার ঢাকা শহরে আসা।

শহর আক্রান্ত হওয়ার আগমুহূর্তে পাখিরাও যখন নীড় ভেঙে পালাচ্ছে, সে সময় পাহারাদার মন্টুকে বাড়ি পাঠিয়ে, ঘুণে-ধরা ভাঙা বাঁশ হাতে ঘরে ঢোকে মেরি। তাদের বাড়িটা গাঁয়ের নাম-ঠিকানা আর শহরের বাড়ির আধাআধি চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফুলতলি গাঁয়ের কলঙ্ক রটানোয় ওস্তাদ লোকগুলোর চোখে ধুলা দেওয়ার জন্য গত পাঁচ বছর তাকে এখানে রাখা হয়েছে। তারপর তাদের ভুলো-মনের সুযোগ নিয়ে তার বিয়ের আয়োজন করা হবে। মরিয়ম তা জানে। যে-কেউ চৌকাঠে দাঁড়ালে তা আন্দাজ করতে পারে। বাড়িটা যেন পান্থনিবাস। এর দু’কামরায় আসবাব বলতে দুটি খাট, একখানা আলনা, পড়ার টেবিলের দু’পাশে দুটি হাতলবিহীন সস্তা কাঠের চেয়ার। আবেদ এলে চেয়ারে না-বসে সরাসরি বিছানায় উঠে যেত। মন্টুও তাতে আপত্তি করত না। প্রথম দিন থেকেই সে তার রাজনীতির চ্যালা বনে গিয়েছিল। আবেদ ভাই, আগরতলায় কি সত্যই একটা ষড়যন্ত্র হইছিল? মোনেম খান নাকি আইয়ুব খানের ভাতিজা? মন্টুর এমন সব বোকা বোকা প্রশ্নে ছাত্রনেতা আবেদ কখনো ধৈর্যচ্যুত হয়নি। বরং সে উত্তেজিত, উদ্দীপ্ত, যেন তার সামনে পল্টন ময়দানের হাজার হাজার শ্রোতা, গলাটা একলাফে আকাশে চড়ে যেত। মরিয়ম তখন ঘর-বাহির করেছে। সে শঙ্কিত একদিকে মন্টুকে নিয়ে, রাজনীতি মাথায় ঢুকে পড়াশোনা যার লাটে ওঠার জোগাড়; অন্যদিকে তার চোখ দুটি চরকির মতো ঘুরত চারপাশের বাড়ির জানালা অলিন্দে। এ বাসায় তৃতীয় ব্যক্তির আনাগোনায় লোকজনের চোখ টাটায়, কানগুলো যেন সারি সারি বন্দুকের নল, এদিকে তাক করা থাকে। তখন আবেদের সময়-অসময় আসা-যাওয়া মরিয়ম ঠেকাতে পারেনি। যদি সে হাতছাড়া হয়ে যায়! তার কাছে বন্ধক দিয়ে ফেলেছে তো নিজেকে! ফেরার পথ নেই। কতবার ফেরা যায়?

জসিমুল হক মহুয়া সিনেমা হলে ইংরেজি মুভি দেখতে দেখতে আবেগে তার হাত চেপে ধরেছিল। ওরা যে রিয়ালে, খেয়াল ছিল না। পাশের সিট থেকে গাঁয়ের একজন সিটি বাজালে তাদের আর বাড়ি ফেরার সাহস হয় না। তিন দিন পথে পথে ফেরা। জসিমের চাকরি থাকলে হাত ধরার খেসারত হিসেবে তারা কোর্টম্যারেজ করত, মেরিকে একা গায়ে ফিরতে হতো না–এই কথা জসিম ইংরেজিতে বলেছিল। তার পাণ্ডিত্যে মরিয়ম তখন মুগ্ধ। এমন গুণী ছেলে তার পনেরো-ষোলো বছরের জীবনে দ্বিতীয় আরেকটিও দেখেনি। মরিয়ম জসিমুল হকের কথা বিশ্বাস করেছিল।

বাড়ি ফেরা ছিল এই কিশোরীর স্বর্গ থেকে পতন। সেই এক বছরেই সে বড় আর বয়স্ক হয়ে ওঠে। পুরুষের প্রতি ভালোবাসা বুঝতে-না-বুঝতেই অকালে ঝরে যায়। সাধারণ বিষয়েও মনে সংশয় জাগে। শুধু বোঝে যে, বিয়ে হলো নারীজীবনের একমাত্র সফল পরিণতি, বাকি সব মিথ্যা। বিদ্বান প্রেমিক সুন্দর সুন্দর কথা বললেই কী, বিয়ে করার তো মুরদ ছিল না। এর ফলে জসিমুল হক লজ্জা-ঘেন্নার কাঁথা-প্যাঁচানো রক্তাক্ত জ্বণের পিণ্ড যেন, অচিরেই তার হৃদয় থেকে আবর্জনায় নির্বাসিত হয়। মরিয়ম ঢাকা আসে পঙ্কে সাঁতার কাটার পর পালক-ঝাড়া শুভ্র হংসিনীর মতো। উপমাটা আবেদের। কলেজ ড্রেসে মরিয়মকে প্রথম দিন দেখে তার নাকি সেরকমই মনে হয়েছিল। পরে সব শোনার পর বলেছে সে। কিন্তু মরিয়মের মনে তখন অন্য ভাবনা। জসিম ছিল সম্ভাবনাময় চারা গাছ, আর সে মনে করে আবেদ হচ্ছে আগামী সিজনে ফল দেবে, এমন এক পরিণত বৃক্ষ। সুযোগ পেলে তাতে চড়ে বসা যায়। তারপর আবেদ ফল যা ফলাবে, সব মরিয়মের। সেইমতো ‘৬৯-৭০, এই দুই বছর আবেদ স্বপ্ন দেখায়, মরিয়ম দেখে.. ’৬

তখন মিছিল-মিটিংয়েও বড় বড় প্রতিশ্রুতি। সেসব এক জায়গায় জড়ো করলে ডজন ডজন উঁচু পাহাড় হয়। পাহাড়গুলো সব বঞ্চিত মানুষের স্বপ্নের। এ দেশের মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি হরেক কিসিমের লাঞ্ছনার-বঞ্চনার শিকার হয়। এর কারণ যে অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী, দেশভাগের পর থেকে তারা তা একটু একটু করে শুনে আসছিল। এবার হাতে-কলমে বোঝাপড়া। পশ্চিম পাকিস্তানের মানচিত্র থেকে উত্থিত অজগর ভারতের বিশাল ভূখণ্ড ডিঙিয়ে এখানে যে ছোবল মারছে, সচিত্র পোস্টার দেখে তারা এর বিষযন্ত্রণা অনুভব করে। বক্তৃতাগুলো রূপকথার মতো আকর্ষণীয়। সোনার বাংলা লুণ্ঠন করে কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের রাস্তাঘাট সোনার পাতে মোড়া হচ্ছে, সে দৃশ্য শ্রোতাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পাকিস্তানটা যেন দেশ নয়, গাভি একটা। তার সামনের দুই পা পূর্বে, পেছনের দুই পা পশ্চিমে। বাঙালিরা রোজ একে ঘাস খাওয়ায়, আর দুধ দুইয়ে নেয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা। শতকরা ৬০ ভাগ রাজস্ব আয় করে পূর্ব পাকিস্তান, খরচ করতে পারে মাত্র ২৫ ভাগ। বাকিটা যায় পশ্চিম পাকিস্তানের উদরে। সেখানে মাথাপিছু আয় বেশি, জিনিসপত্রের দাম কম। ‘৭০-এর নির্বাচনী পোস্টারে বৈষম্য আর শোষণের পাই-পাই হিসাব সংখ্যাচিত্রের আকারে ছাপা হয়। মরিয়ম নিজে যেন বঞ্চিত দেশমাতৃকা আর আবেদ হচ্ছে প্রতিশ্রুতিশীল নেতা। সে মেয়েটির উদ্ধারের স্বপ্লবীজ ফুলার রোড থেকে শহিদমিনার, কার্জন হল, রমনাগ্রিনের লেকের গায়ের ঝুলন্ত রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ছড়াতে ছড়াতে যায়। আবেদের সমাজবিজ্ঞানে এমএ দেওয়া হয়ে গেছে, এখন চাকরি পেলেই বীজ থেকে গাছ হবে। ‘৭১ সালটা বারুদের গন্ধ নিয়ে আসে। মরিয়মের স্বপ্নগুলো পাখি হয়ে উড়ে যায়। এখন ডামি রাইফেল হাতে ট্রেনিং নেওয়া ছাড়া আবেদকে আর কিছু বলতে শোনা যায় না।

‘৬৬ থেকে ‘৭১-এই পাঁচ বছরে জল ঘোলা হয়েছে বিস্তর। ঘোলাজলের পাঁকে পাঁকে জটিল আবর্তও সৃষ্টি হয়েছে। মরিয়ম তখন ছিল কিশোরী। জসিমুল হক শুধু তার হাত ধরেছিল। তার জন্য গ্রাম থেকে তাকে শহরে চলে আসতে হয়। এখন আবেদ আর মরিয়মের সম্পর্ক গড়িয়েছে বিছানা পর্যন্ত। প্রথম প্রথম এসএম হল আর বুয়েটের মাঝখানের দু’সারি বড় বড় মেঘশিরীষের কারুকাজময় ছায়াতলে তারা শান্তই ছিল। পরস্পরের অংশীদারত্ব বলতে বুঝত একটা বাদাম ভেঙে একজন আরেকজনকে দিয়ে খাওয়া। ঢাকা ক্রমশ উত্তপ্ত হতে শুরু করে। আবেদের পড়াশোনা শেষ। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলে বড় সাহেবরা ভাবেন, তারা প্রভু, যে চাকরি চাইতে এসেছে সে তাদের দাস। তখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার থাবার বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবিক এক স্বাধীন দ্বীপ। সেখানে সামরিক কি বেসামরিক কোনো আইনই কার্যকর ছিল না। এমন এক ভূখণ্ডের অর্ধযুগের স্বাধীন সার্বভৌম বাসিন্দা আবেদ। ইন্টারভিউ টেবিলে বড় সাহেবের প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে তার একটা করে ঘুষি মারতে ইচ্ছে করে। তা নিবৃত্ত করতে গিয়ে সে আরো খেপে ওঠে। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়, আর নয়। মোটা হাবড়াদের সালাম ঠুকে, নতজানু হওয়া আর পোষায় না। সে লাইব্রেরি সায়েন্সে ভর্তি হয়ে স্বাধীন দ্বীপে বসবাসের মেয়াদ বর্ধিত করে। এর আগে কখনো-সখনো মিছিলে শ্লোগান দেওয়া কিংবা আইয়ুব খানের কুশপুত্তলিকা পোড়ানোর সময় পেছন থেকে তালি বাজানোর মধ্যে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল। এই পর্বে মিছিলের অগ্রভাগে সে চলে আসে। আগুনও ধরায় স্বহস্তে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্বাধীন বাসিন্দা তার ক্ষুদ্র দ্বীপটিকে নিয়ে আর সন্তুষ্ট নয়। বড় সাহেবদের যারা আবার অধিকাংশই অবাঙালি, তাদের উচ্ছেদ করে, এর সম্প্রসারণের প্রয়োজন অনুভব করে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে আবেদ। শিরীষের ছায়ায় হেঁটে হেঁটে বাদাম খাওয়ার দিন ফুরিয়েছে। কিন্তু মরিয়মকে দরকার অন্য কারণে। বীরত্বের পাশাপাশি নারী-শরীরের দখল কায়েমও তার কাছে জরুরি হয়ে পড়ে। তখন হুডতোলা রিকশায় কালো পেড়ে সাদা শাড়ির বেড়া ভেঙে ব্লাউজের তলায় আঙুল চালিয়ে বীরের উত্তেজনা প্রশমিত হচ্ছিল না। এ যেন জ্বলন্ত মশাল হাতে কোথাও আগুন না জ্বালিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়ানো। সঙ্গে আগুন আছে ঠিকই কিন্তু তা জ্বালানো যাচ্ছে না। তার জন্য, সম্পূর্ণভাবে মেয়েটিকে পাওয়ার জন্য বিছানা চাই। সবকিছু এত দ্রুত ঘটতে থাকে যে, মরিয়ম বেদিশা হয়ে পড়ে। সে নিজেও কদিন ধরে হুডতোলা রিকশায় সিক্ত হচ্ছিল। তার ভয় ছিল, প্রতিরোধ ছিল না। একদিন মন্টুর অনুপস্থিতির সুযোগে আবেদ ভরদুপুরে মরিয়মকে বিছানায় নেয়। যেখানে পা ভাঁজ করে বসে বছরাধিক সময় সে মন্টুকে রাজনীতির পাঠ দিয়েছে, মুহূর্তেই তা পাল্টে যায়। এলোপাতাড়ি ঝড়ের ভেতর মরিয়ম ভয়ে আর উত্তেজনায় কাঁপছিল। বুঝতে পারছিল না, বিয়ের আগে এসব করা ঠিক হচ্ছে কি না। তা ছাড়া মন্টু যে-কোনো সময় চলে আসতে পারে। এবার মরিয়মের ভয়, প্রতিরোধ দুটোই ছিল। প্রতিরোধের ফলেই হয়তো পুরো ব্যাপারটা যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। বিছানা রক্তে ভাসিয়ে আবেদ যেন তক্তপোশ থেকে নয়, মঞ্চ থেকে মেঝেতে পদার্পণ করে।

রক্ত ঝরার ভেতর দিয়ে আত্মসমর্পণের নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। মরিয়ম অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আবেদকে শুধু প্রেমিক ভাবা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। স্বামীই ভাবতে হচ্ছে। যদিও নিজের জন্য একটা চাকরি, বাসা, বউ, বাচ্চা–এসবের মধ্যে আবেদ আর নেই। ক্ষমতা, রাষ্ট্র, আন্দোলন নিয়ে এখন তার কারবার। কথাও বলে শুধু এসব বিষয়ে। এমনকি তাদের সংক্ষিপ্ত শয্যায় মরিয়ম যখন জোঁকের মতো তাকে আঁকড়ে ধরে, যা বাহ্যত গভীর আলিঙ্গন, তখনো।

মরিয়ম-আবেদের শরীরী সম্পর্কের তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রথম কটি সপ্তাহ আবেদ ছিল দিশাহারা। মরিয়মের কাছে এলে মন পড়ে থাকত বাইরে, আর বাইরে থাকার সময় মনটা থাকত মরিয়মের কাছে। একদিকে দেশ, আরেক দিকে নারী। দুজনেরই গা থেকে তত দিনে পোশাক সরে গেছে। কামজ্বরে ফুটছে তার সামনে দুটি নগ্ন শরীর। কোথাও যেন স্বস্তি নেই। মনহীন শরীরটাই তখন তার রাতদিনের সঙ্গী। তাই শরীরের উপস্থিতি শুধু প্রকট হয়ে ওঠে বিছানায়, রাজপথে সর্বত্র। ক্রমে মরিয়মের কাছ থেকে শরীরটা তুলে নিয়ে, মনের সঙ্গে শরীরের সমন্বয় সে ঘটায় বাইরে। যার বিস্তার ৫৬ হাজার বর্গমাইল, সম্ভাবনাও প্রচুর। সেখানে কয়েকটা শব্দের বা সংকেতের যেমন, গাঢ় সবুজের বুকে লাল টুকটুকে সূর্য, সূর্যের মাঝখানে সোনালি মানচিত্র আঁকা পতাকার, জাতীয় সংগীতের আর স্বাধীনতার কী দুর্মর আকর্ষণ! ভাগ্যের অজুহাতে নিজেদের দুর্দশাকে আর মেনে নেওয়া যায় না। অতীত ভোজবাজির মতো ধুলায় মিলিয়ে যাবে, তারপর যা হবে, সব ভবিষ্যতের জঠরে। এর মাঝখানে আছে লড়াই। এক অসম যুদ্ধ-ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীনের; ট্যাংক, কামান, রকেট, বিমান আর মেশিনগানের বিপরীতে বোমা, পটকা, লোহার রড, মলোটভ ককটেল, টু-টু বোর রাইফেল, টেটা, বল্লম আর লাঠি। ঘরোয়া হাতিয়ারগুলো বিদ্রোহীর করতলের উত্তাপে ঝলকায়। কে কাকে সামনে টানে, উত্তেজনা জোগায়–বিদ্রোহী, না তাদের হাতের অস্ত্র-অস্ত্রধারীও জানে না। উভয়ে এতটাই বেপরোয়া।

আবেদকে আর চেনা যায় না। কখনো-সখনো তার সঙ্গে মরিয়মের এখন দেখা হয়। বাকি সময় মেয়েটার কাটে এক অদ্ভুত ঘোরে। থেকে থেকে চমকে ওঠে সে। ফুলতলি গায়ে বাবা-মার কাছে ফেরার পথ নেই। তার সামনে রয়েছে বাঁচা-মরার সমতুল্য এক অগ্নিপরীক্ষা।

তখন দেশের সামনেও কঠিন পরীক্ষা। মন্টু চলে যাওয়ার সময় বলেছিল, ‘মেরিবু ঠিক আছে আমি যামু তুইও চল, সামনে যুদ্ধ।

‘যুদ্ধ তো কী? করবে তো আবেদরা।’ সেদিন মরিয়মের কথার পিঠে মন্টু আর কথা বলেনি। বোন আর দু-চারটা দিন ঢাকায় থাকতে চাচ্ছে–থাকুক। কফিলউদ্দিন। আহমেদ যখন নিতে আসবেন, তখন বাপ বাপ করে ঠিকই যাবে। তারপর বাড়ি যাওয়ার অন্যতম শর্ত হিসেবে রেডিওটা সঙ্গে নিয়ে যায় মন্টু।

আজকে ঘরে রেডিও নেই, মন্টুও নেই। অন্যদিন ঘরে-বাইরে পাল্লা দিয়ে শোরগোল চলত। এমনকি কারফিউর সময়ও সারা রাত তাদের গলির তস্যগলিতে

মিছিল। গুলি হচ্ছে জেনে, মানুষগুলো যেন আরো বেশি করে কারফিউ ভেঙে মিছিল করে গুলি খায়। এক কারফিউর রাতে ঝড়ে ঝাঁপটা খাওয়া কাকের মতো আবেদ উপস্থিত। মন্টু তো অবাক। ‘আরে আবেদ ভাই, এত রাইতে? বাইরে না কারফিউ, আসলেন ক্যামনে?’ আবেদ আর ঘরে ঢোকেনি। ‘তোমরা কেমন আছো দেখতে আসলাম।’ বলে মরিয়মের সঙ্গে দেখা না করেই বাইরে থেকে চলে যায়। আজ তো কারফিউ নেই, মন্টুও নেই। আবেদ কি আসতে পারে না? একবার এসে পড়লে আজ আর বাইরে থেকে চলে যেতে হতো না।

গেট নাড়ার শব্দ শুনে মরিয়ম বেরিয়ে আসে। বাতাসই হয়তো অথবা কানের ভুল। তার যত দূর চোখ যায়, একটা কুকুর ছাড়া, গলিটা একদম সুনসান। কুকুরটাকে হাজি সাহেবের বাসার সামনের লাইটপোস্টে বেঁধে রাখা হয়েছে পাহারা দেওয়ার জন্য। মরিয়ম ঠিক করে, বাইরে দাঁড়িয়ে আবেদের জন্য অপেক্ষা করবে। যদি সে আসে! যদি সে গেটে তালা দেখে ফিরে যায়। বাড়ির ভেতর তো মানুষ কি রেডিওরও সাড়াশব্দ নেই। মরিয়ম গেটের মুখটায় এসে দাঁড়ায়। ঠিক তখন হাজির বাড়ির দোতলার জানালাটি ফের মটমট করে খুলে যায়। এই মাঝরাত্তিরে! লোকটার সাহস দেখি বহুৎ বেড়ে গেছে। আবার গলা খাকারিও দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে। সে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়।

সেই রাত্রিরে মরিয়ম বিছানায় একবার শোয় একবার উঠে বসে। অস্বস্তিতে মশারির দড়ি খুলে দেয়। পায়ের পাতায় বাতাসের সুড়সুড়ি। পর্দাটা উড়ে উড়ে জানালায় বাড়ি খাচ্ছে। লাইটপোস্টে বাঁধা কুকুরটা থেকে থেকে কেঁদে ওঠে। দু-চার বাড়ি পর আরো একটা কাঁদে। হাজির বাড়ির সামনের দড়ি-বাঁধা কুকুর যেন নেতৃত্ব দিচ্ছে। দূরের আরো দূরের শত শত কুকুরের করুণ কান্না রাতের বাতাস কাঁপায়, আতঙ্ক ছড়ায়। ফুলতলি গ্রামে মহামারির বছর কুকুর কাঁদত। মরিয়ম শুনেছে–মানুষের শোকে নাকি কুকুর কাঁদে। এই মাসে শতাধিক মানুষ গুলি খেয়ে মারা গেছে। আরো মরবে যদি যুদ্ধ হয়। কুকুরগুলো কি মৃতদের জন্য কাঁদছে, নাকি সংকেত দিচ্ছে–যুদ্ধ বাধার পর আরো মানুষ মারা যাবে! শহরের নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে গেট খুলে যুদ্ধ এসে মরিয়মদের বাড়ির চৌকাঠে বসে। একটুখানি জিরোয়। তারপর হামা দিয়ে ঘরে ঢোকে। যুদ্ধ মরিয়মের বিছানার চারপাশে নৃত্য করে। আগামী যুদ্ধে সে কি মারা যাবে, যুদ্ধ না করেও? আবেদ মরবে, না বাঁচবে? মন্টু গ্রামে চলে গেছে। একটা যুদ্ধাতঙ্কের রাত মরিয়মকে পাথর চাপা দিয়ে চলে যায়।

পরদিন শহরে জয় বাংলা পতাকার সাজ। রাস্তার দু’পাশের বাড়িগুলোর মাথায় নতুন দেশের মানচিত্র আঁকা লাল-সবুজ পতাকা পতপত করে উড়ছে। মরিয়মের রিকশার ঘণ্টিতে একটা ছয় ইঞ্চি পতাকা সুতো দিয়ে পাটখড়ির দণ্ডে বাঁধা। টুংটাং আওয়াজের ছন্দে হেলেদুলে নাচছে। স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা যদিও মরিয়মের সংকটের দাওয়াই নয়, তবুও মনে তার অশেষ আনন্দ। সে এসএম হলের গেটে নেমে ফেরিঅলার কাছ থেকে কিনে নেয় এক টাকায় দুটি পতাকা। এই তো টাকায় কেনা পতাকা–স্বাধীনতা, রক্তপাত ছাড়াই তার হাতে চলে এসেছে! সে স্বাধীনতার ঝান্ডা উড়িয়ে আবেদের কক্ষে প্রবেশ করে।

মরিয়ম চূড়ান্ত বোঝাপড়া করতে এসএম হলে এসেছে। কিন্তু আবেদের ক্ষুব্ধ চেহারা দেখামাত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা দুটি তার হাতের মুঠোয় ভাঁজ হতে থাকে। পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়। সে তালগোল পাকিয়ে খাটের কোনায় পা ঝুলিয়ে বসে। পড়ে। আবেদ সুস্থির হয়ে তাকালেই দেখতে পেত–রাত-জাগা মেয়েটি ভীষণ অবসন্ন, ভয়ে দিশাহারা, একটুখানি আশ্রয়ের জন্য তার কাছে ছুটে এসেছে। সেদিকে তার চোখ নেই। আজ ২৩ মার্চ। পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস রূপান্তরিত হয়েছে বাঙালির প্রতিরোধ দিবসে। সকালবেলা অনেকগুলো দূতাবাসসহ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জয় বাংলার পতাকা উড়িয়ে এলেও আবেদের মনের ওপর আশঙ্কার পাহাড়। পতাকা তো একখণ্ড কাপড়, ত্যানা। ওড়ানো-নামানো দুমিনিটের ব্যাপার। এদিকে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে অসংখ্য সেনা-সামন্ত এখন ঢাকায়। জলপথে ভারী অস্ত্রশস্ত্র পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসছে। এসবের ভেতর শুধু শুধু কতগুলো দিন আলোচনার নামে সাবাড় হচ্ছে। মূল্যবান একেকটা দিন। এর দাম কে দেবে? রুমের মধ্যিখানের স্তূপ করা মশারির স্ট্যান্ড, লাঠি, রড, সুরকি, হাতবোমা বানানোর মশলার প্যাকেট–সব ধরে ধরে তার ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এ দিয়ে হবে যুদ্ধ! ৩২ নম্বরে গিয়ে শেখকে সরাসরি জিগ্যেস করা দরকার, তিনি এভাবে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে কত দিনে দেশটা স্বাধীন করবেন। নাকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খোয়াব ত্যাগ করতে পারছেন না, এত কিছুর পরও। তিনি জনগণকে বলছেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, আন্দোলন অব্যাহত রাখে। আর নিজে প্রেসিডেন্ট ভবনে বসে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে মাছ কেনার মতো দর-কষাকষি চালিয়ে যাচ্ছেন।

আবেদ আর মরিয়মের মাঝখানে বসে পা দোলাতে দোলাতে রুমমেট সুমন নাটকীয়ভাবে বলে, ‘আবেদ ভাই, নেতারা যা-ই করুক, আমাদের কিন্তু পেছন হটার উপায় নেই।’

মরিয়ম ঘরে ঢোকার আগে কোনো কথার সূত্রেই হয়তো কথাটা বলেছে সুমন। যদিও পরিস্থিতি ততক্ষণে পাল্টে গেছে। ঘরে যে তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত আরেকটি ঘোরতর সমস্যা নিয়ে, দু’রুমমেট তা গ্রাহ্যই করে না এবং করবে বলেও মনে হয় না। মরিয়ম তাই সুমনের কথার পিঠে তাড়াতাড়ি বলে, ‘আমারও পেছন হটার উপায় নেই।’

কথাটার অর্থ বোঝে একা আবেদ। তীক্ষ্ণ চোখে ঝট করে সে মরিয়মের দিকে তাকায়। সুমন ভেবেছিল, হেঁয়ালিই হচ্ছে, এ ছাড়া মেয়েটার কথার এমন কী অর্থ আছে যে, নেতার রেগে যেতে হবে? কিন্তু আবেদের জ্বলন্ত দৃষ্টি তাকেও বিদ্ধ করে। সে মানে মানে ঘর ছেড়ে বারান্দায় চলে যায়।

আবেদ তখন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘তোমার পেছন হটার উপায় নেই, কথাটার মানে কী?’

তার স্বরে চ্যালেঞ্জ ছিল, দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান ছিল। মরিয়মের গলা যেন একখণ্ড ভেজা কাঠ। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে সে বলে, ‘আবেদ, তুমি ভালো করে জানো, আমি কী বলতে চাই।’

‘না, আমি জানি না, কিছু জানতে চাই না।’ সে বসা থেকে চিৎকার করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। ‘যা বলার খোলাখুলি বলো। এসপার-ওসপার হয়ে যাক।’

মরিয়মের ভয় লাগে। তবু মনে মনে হিসাব করে বলে, ‘এসপার-ওসপার আবার কী। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। তার জন্য আমি তোমাকে দায়ী করছি না।’

‘দায়ী! কীসের জন্য দায়ী হব আমি? একহাতে তালি বাজে?’

আজকে আবেদের সঙ্গে কথা বলার জো নেই। সবকিছুর শেষ দেখতে চায় ও-মরিয়মের সঙ্গের সম্পর্কের, স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের। সে আজ মারমুখী, যুদ্ধংদেহী।

মরিয়ম ভেতরে ভেতরে রিক্ত হতে থাকে। এখান থেকে বেরিয়ে কী করবে সে। কোথায় যাবে। আবেদের সঙ্গে লতার মতো জড়িয়ে থাকার শেষ চেষ্টাস্বরূপ সে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কাঠের রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং নেওয়ারও প্রস্তাব দেয়। তাতে আগুনে যেন তেল পড়ে। তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে আবেদ। ‘যুদ্ধ! যুদ্ধ করবে তুমি? যুদ্ধ কোনো ছেলেখেলা নয়। হাসপাতালে না গিয়ে এখানে আসছ কেন?’

‘হাসপাতালে যাব না তো বলেছিই!’ মরিয়ম ডাইনির মতো গোঁ ধরে। আবেদ তাকে বাসায় যেতে বললে, ও বলে, বাসায়ও যাবে না। ওখানে একা থাকতে তার ভয় লাগে। জানালা দিয়ে লোকটা এখন খালি তাকায় না, কী যেন ইঙ্গিত করে। দোতলার লোকটার দুঃসাহস নিয়ে মরিয়ম আরো কীসব বানিয়ে বানিয়ে বলতে যাচ্ছিল, আবেদ মাঝখানে চেঁচিয়ে ওঠে, মন্টু কোথায়? ওর মাথায় বাড়ি মারতেছে না ক্যান?

‘মন্টু বাড়ি চলে গেছে। আমিই বলে-কয়ে ওরে পাঠাই দিছি। তুমি তো আজকাল মন্টুর সামনে অস্বস্তি বোধ করো!’

মরিয়মের ইঙ্গিতময় কথায় আবেদের কী যেন মনে পড়ে। সংগ্রাম-আন্দোলনের বাইরের তুচ্ছ কিছু। একেবারে বাতিল করার মতোও নয় আবার। শরীর থাকলে এর খাঁই থাকবেই। হতাশার সমুদুরে ডুবে থাকা কামনা ফের ধীরে ধীরে মাথা তোলে। সে খোলা দরজা দিয়ে বারান্দায় তাকায়। সুমন ওখানে নেই। আবেদ এগিয়ে এসে। মরিয়মের বাহু ধরে কাছে টানে। মেয়েটি অসাড়। আবেদ বিরক্ত হয়ে গম্ভীর গলায় বলে, ‘শহরের অবস্থা ভালো নয়, মেরি। তুমি দেশের বাড়ি চলে যাও।’

এ অবস্থায় দেশের বাড়ি যাবে মেরি! আবেদের কি মাথা খারাপ হয়েছে? মরিয়ম রাগ করার বদলে ছেলেটির কাছে একটুখানি দয়া ভিক্ষা চায়, ‘আবেদ, বাচ্চার কী হবে?’

আবেদ ঘরের এদিক-ওদিক দিয়াশলাই খোঁজে। কোথায় রেখেছে মনে করতে পারে না। ইন্টারভিউ দিয়ে তার একটা চাকরি পাওয়ার কথা ছিল। সেই যোগ্যতা দলে-মুছে গেছে বুটের তলায়। তাকে জুতার তলার দুর্গন্ধ শুঁকতে বলছে নাকি মেয়েটা! সে তো এখন অন্য মানুষ। সামনে নতুন দিন। দিয়াশলাই ঠুকে ঠুকে আবেদ সিগারেট ধরায়। তাতে টান দিতে দিতে মরিয়মকে জোর করে কাছে টানে।

মরিয়মের কিছুই আর বলা হলো না। একটা প্রলয়ংকরী মিছিলের ঘায়ে দুজন বিভক্ত হয়ে গেল। আবেদের হুঁশ ফিরেছে-সে তো পদানত এখনো। শত্ৰু এগিয়ে আসছে। সামনে যুদ্ধ। মারতে হবে, না-হয় মরতে হবে। মেরিটা একটা জোক। এখনো তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। যতই যন্ত্রণা হোক, রক্ত ঝরুক, জেঁকটাকে গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।

সে সময় এসএম হলের সামনের রাস্তা দিয়ে একটা মিছিল যাচ্ছিল–যার গতি ঝোড়ো হওয়ার বেগের। শ্লোগানে ছিল ধারালো শিলাবৃষ্টির তীব্রতা। শিরীষ অরণ্যের পাখিগুলো নীড় ছেড়ে উড়তে শুরু করে। আবেদ শাড়িটা গুছিয়ে পরারও সময় দেয় না। মরিয়মকে। ডানা ধরে বারান্দায় নিয়ে আসে। তার হাতে লোহার রড। সুমন দৌড়ে এসে একগাদা লাঠি পাঁজাকোলে তুলে নেয়। গুজব রটেছে মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর আলোচনা ভেঙে গেছে। ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় স্থগিত । আবেদের রুমের স্তূপীকৃত হাতিয়ার মুহূর্তেই লোপাট হয়ে যায়। ছাত্ররা হল থেকে দৌড়ে যাচ্ছে রাস্তার দিকে। মরিয়ম পদপিষ্ট হওয়ার ভয়ে অন্ধের মতো যা আঁকড়ে ধরে, তা একটা ঠান্ডা, সর্পাকৃতির লোহার রড। আবেদ কয়েক পা দৌড়ে হাত খালি দেখে পিছিয়ে আসে। মরিয়মের হাত থেকে রডটি ছিনিয়ে নিতে তার বল প্রয়োগের দরকার হয় না। তবু পেছন ফেরাটা যেন তার রাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং মরিয়মকে যে সে আর চায় না, কয়েক মুহূর্ত আগের সিদ্ধান্তটা, লোহার রড দু’হাতে চেপে ধরে ডামাডোলের ভেতর জানিয়ে দেয়। তারপর অস্ত্রটি যেন তার বাহুল্য লাগে, বা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, সে ফেলে দেয় হাত থেকে। মিছিলেও যায় না। মরিয়মকে নিয়ে জনশূন্য হোস্টেল ছেড়ে রাস্তায় আসে। মেঘশিরীষের কারুকাজময় ছায়ার নিচে রিকশার জন্য দাঁড়ায়। মিছিলটা একবুক তরঙ্গ নিয়ে সরে গেছে। এর অস্পষ্ট কলধ্বনি ভেসে আসে যেন গহিন সাগরের মাঝখান থেকে। এর পরও শিরীষগাছের পাখিরা ভয়ে নীড়ে ফেরে না। চারদিক শূন্য। কোনো পথচারী কি যানবাহনও নেই। আবেদ আর মরিয়মের পায়ে পায়ে রাস্তাটা গিয়ে পলাশীতে পড়ে। সেখানকার ফুটপাতে প্রথম দিনের সেই মুচি জুতো সেলাইয়ের সরঞ্জাম নিয়ে আজও বসে আছে। তার পাশেই একটা খালি রিকশা। মরিয়ম উনসত্তর থেকে একাত্তর, একটা আনন্দ আর বেদনাময় অধ্যায় সমাপ্ত করে রিকশায় উঠে বসে।

ঘরে ফিরে মরিয়মের কান্না কেঁদে কেঁদে বুক হালকা করার জন্য নয়। বুক পাখির পালকের মতো হালকা হলে তারপর কী? তারপরই তো যুদ্ধ। যুদ্ধ মানেই অনিশ্চয়তা। কে বাঁচে, কে মরে–ঠিক নেই। বিবদমান দু’পক্ষের আবেদ এক পক্ষ। যুদ্ধের সনাতন নিয়মানুসারে তার মারার এবং মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আধাআধি। ধরা যাক সে বাঁচল, মরল না। একটা জীবন-মরণ সংঘর্ষ বাধার আগেই তো তাদের সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। মেরি পিতাহীন সন্তানের জননী হবে। যুদ্ধ না হলেও এই তার নিয়তি। সে ঘুমের বড়ির পাতাটা এক বসায় শেষ করে দেয়। ফলত বুধ-বৃহস্পতি দু’দিন, যুদ্ধ যে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে দোরগোড়ায়, সেটি তার দেখা হয় না। সেই সময়টায় নতুন করে জন্ম নেওয়ার জন্য মেরি ওরফে মরিয়ম যেন পুনরায় জ্বণাকৃতিতে ফিরে গিয়েছিল।

.

মেরি-মন্টুর খোঁজে পরপর দু’দিন দুজন লোক পাঠিয়েছিলেন গোলাম মোস্তফা। ভাগনে-ভাগনির তথ্য-তালাশ করতে মোস্তফার না আসার কারণ নিজের কাছা সামলাতেই তিনি তখন ব্যস্ত। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা অথবা তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর–দুটোর সম্ভাবনাই তখন আধাআধি। বাঙালিরা ক্ষমতাসীন হলে হিন্দুদের ভারত থেকে এসে জমিজমা, দালানকোঠা, ভিটেবাড়ি ফেরত চাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। তা তারা চাইতেই পারে। যদিও তাদের পরিত্যক্ত ডোবাখন্দে এখন বড় বড় ইমারত, কলকারখানা, কারো-বা বাসাবাড়ি। শখের বাগানবাড়িতে মক্তব বসেছে। দাঁতব্য চিকিৎসালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলছে নাটমন্দিরের নোনাধরা দেয়ালগাত্রে। পুকুর, বসতবাড়ি, পূজামণ্ডপ সমান করে ধানপাটের চাষ হচ্ছে। গোলাম মোস্তফার হাত দিয়ে এই চব্বিশ বছরে দেশভাগের নেতাদের স্বপ্নমাফিক হিন্দুস্থান বাস্তবিকই পাকিস্তান হয়েছে। স্বপ্নদ্রষ্টারা তো স্বপ্ন দেখেই খালাস, কবরে নিদ্রা যাচ্ছেন। এখন হিসাবের পালা এসেছে যখন, কৈফিয়ত দিতে হবে এমন একজনকে, যে আদতে এ বিষয়ে কোনো স্বপ্নই দেখেনি। গোলাম মোস্তফা ‘৭০-এর নির্বাচনের সময় গা-বাঁচাতে আওয়ামী লীগে ভিড়ে যান। চড়ে বসেন নৌকায়। মনটা পড়ে থাকে তীরে, নিজের হাতে গড়া পাকিস্তানে। তিনি যার স্বপ্নদ্রষ্টা নন, একজন সাচ্চা কারিগর। তার পরও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দুটি মাস তাকে নৌকাতেই থাকতে হয়। কারণ জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের ১৬৭টিতে জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের এখতিয়ার এখন তাদেরই। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাহ্যত তা ঠিক ছিল। মার্চের পয়লা তারিখ দুপুর একটায় ইয়াহিয়া খান রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন, যা ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ইয়াহিয়ার ঘোষণা শুনে ক্রিকেট ম্যাচের দর্শকরা যখন গ্যালারি ছেড়ে মাঠে নেমে পড়ে, গোলাম মোস্তফা নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়েন পানিতে। তারপর আন্দোলন বিক্ষোভের চোটে তিনি আর তীরে উঠতে পারেননি। এ অবস্থায় বুধবার দিন ভাগনে ভাগনির কথা হঠাৎ তার মনে পড়ে। তিনি তিন ছেলেকে ডেকে তাদের খোঁজ নিতে বলেন। মেজো ছেলে হাবা সাজু, যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে মরিয়মকে ছাড়া জীবনে কাউকে শাদি করবে না, সে-ই শুধু পিতৃআজ্ঞা পালনে রাজি হয়। সাজু হাজি সাহেবের বাসা পর্যন্ত ঠিক ঠিক আসে। তারপর কুকুর দেখে পড়িমরি পালায়। মেরি-মন্টুদের বাড়ির পঞ্চাশ গজের ভেতর উল্টে পড়ে থাকা এক পাটি স্যান্ডেল এর সাক্ষী। যদিও কিল-চড় দেওয়ার সময় গোলাম মোস্তফা কথাটা গ্রাহ্যই করেননি। সাজুর দোষ এইটুকুই যে, কুকুরটা যে লাইটপোস্টের সঙ্গে এক হাত দড়িতে বাধা, বেচারা ভয়ের চোটে দিনদুপুরেও তা দেখতে পায়নি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মামা তার সহকারীকে পাঠান। রাস্তায় আসতে আসতে লোকটা শহরে আর্মি নামানোর নানা প্রকার গুজব শোনে। সৈন্যদের নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ জেনারেল টিক্কা। সে গুলি ছুঁড়ে গাছের পাতাও রাখবে না। শহরটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। এর মধ্যে শোনা গেল, গেরুয়া পোশাকের সেনারা টহল দিতে রাস্তায় নেমে পড়েছে। গোলাম মোস্তফার সহকারী ডানে-বাঁয়ে তাকায়, আগু-পিছু করে, তারপর খানিকটা এগোয়। এই করে করে পিলখানা পর্যন্ত সে আসে। তারপর ইপিআর ক্যাম্পের গেটে বালুর বস্তার গানপোস্ট দেখামাত্র সাহেবের ভাগনে-ভাগনির নাম ভুলে যায়। তখন তার জানের মায়ার সঙ্গে যুক্ত হয় চাকরি হারানোর আতঙ্ক। তবে জানে বাঁচলে মানুষের যে চাকরির অভাব হয় না, এই বিশ্বাস তাকে নির্ভয়ে গোলাম মোস্তফার সামনে নিয়ে দাঁড় করায়। আর তোতলাতে তোতলাতে বলে যে, খোকা-খুকু দু’জন অদ্য বৃহস্পতিবার বাদ জোহর দেশের বাড়ি চলে গেছে। কিন্তু কার কাছ থেকে সংবাদদাতা এ তথ্য পেল? এ প্রশ্নের জবাব দিতে সহকারী অপারগ। মামার ধমক খেয়ে লোকটা রাস্তায় যা যা গুজব শুনেছে, সেসব সবিস্তারে বয়ান করে। গোলাম মোস্তফার বিক্ষুব্ধ মনটা তখন আশকারা পাওয়া, নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়া, শেষ পর্যন্ত তাকে না-বলে বাড়ি চলে যাওয়া ভাগনে-ভাগনির ওপর থেকে সরে গুজবের সোপান বেয়ে উঠতে চায় তীরে–চব্বিশ বছরের পুরোনো পাকিস্তানে। কিন্তু সেই পথে তখনো বাধা বিস্তর। ছাত্র-জনতা তখন। বড় বড় গাছ কেটে শুমার করছিল। তা দিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। পথে-ঘাটে জলের ট্যাংক, সুয়ারেজ পাইপ টেনে এনে ফাঁকা জায়গাগুলো বুজিয়ে দেয় ইট দিয়ে। এসব জঞ্জাল সাফ করে সৈন্যদের শহরে ঢুকতে হবে।

গোলাম মোস্তফা অস্থির বোধ করছিলেন।

সে সময় স্বপ্নের ভেতর মরিয়মের শরীর থেকে রক্ত ঝরা শুরু হয়। তা ধাপে ধাপে। দুধদাঁত তোলা দিয়ে যার শুরু। থুতুর সঙ্গে জিবের নোনা স্বাদ জড়িয়ে থকথকে রক্তের দলা বাইরে আসে। সে মন্টুকে অঞ্জলি মেলে দেখায়। মন্টু নিঃশব্দে অশ্রুপাত করে। তারপর দাঁতটা ফেলার জন্য ভাইবোন হন্যে হয়ে একটা ইঁদুরের গর্ত খোঁজে। ইন্দুর ইন্দুর, আমার বোনের বিশ্রী দাঁতটা নিয়া তোমার সুন্দর দাঁতটা দেও। ইন্দুর ইন্দুর–মায়ের চোখে বিস্ময়। মেয়েটার এত তাড়াতাড়ি মাসিক হলো! পেসাবের রাস্ত য় রক্ত! শরীর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় উষ্ণতা ঝরছে। কালো, খয়েরি, গোলাপি থোক থোক রং জমাট বাঁধে পায়জামায়। এটা কী অসুখ, মা? পায়ের কাছে শীত যে কুকুরের মতো কুণ্ডলী পাকাতে শুরু করেছে! এ সময় কাপড় ভাঁজ করে তলপেটে গরম সেঁক দিতে হয়। তাতে যন্ত্রণা কমে। হারিকেনের সলতে উসকে দিতে কাঁচের চিমনির ভেতর লম্বা জিহ্বা মেলে আগুন। গনগনে উত্তাপে এক টুকরো কাপড় মায়ের হাতে নিঃশব্দে পোড়ে। রক্তের স্রোত নালা উপচে গেট পেরিয়ে রাস্তা ভাসিয়ে পল্টন ময়দানে। জমা হয়। ওখানে বিশাল জনসভা। আবেদ মঞ্চে ওঠে। শ্রোতারা করতালি দেয়। মেরি বাচ্চা প্রসব করে। অবয়বহীন, রক্তপিণ্ড, বাবাছাড়া।

তখন যে বাস্তবতা, তা যুদ্ধের। প্রচণ্ড জোরে অদূরে একটা গোলা ফাটে। জানালার শার্সি ভাঙার ঝনঝন আর্তনাদে মরিয়ম ছিটকে পড়ে মেঝেতে। তখনো সে চলাচলের শক্তিরহিত, চেতনাহীন। খাটের তলার জমাট অন্ধকার যেন কোল পেতে বসে রয়েছে। আরেকটা বোমা ফাটার সঙ্গে সঙ্গে অবয়বহীন রক্তপিণ্ড পেছনে ফেলে মরিয়ম অন্ধকারের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ঢাকা তখন জ্বলছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *