উদ্ধার পর্ব
তালা ভেঙে মরিয়মকে যারা উদ্ধার করে, অকুস্থলে পৌঁছাতে তাদের আরো চার দিন বাকি। পাকিস্তানি ট্যাংক আর যৌথ বাহিনীর ট্যাংক তখন সামনাসামনি মোকাবিলা করছে। ট্যাংকের ওপর গোলমতন ফাঁকা জায়গায় গ্রেনেড চার্জ করছে মুক্তিবাহিনী। প্রথমটা ছুঁড়ে দেওয়ার পর যখন বাস্ট হলো, ‘হা-হা-হা’ মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম হাসতে হাসতে মুক্তিকে বলে, ‘তখন খুব আনন্দ পালাম।’ তারপর দুপাশে মাথা নাড়ে, ‘এ বলা যায় না তো–এ ছিল স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ।’ সেদিনের ট্যাংক ফাইটে তাদের ছয় থেকে সাতজন ছেলে মারা যায়। পরেরটা বাস্ট হলো কি না, কাজটা চুরি চুরি করে করা হচ্ছে বলে রফিকুল বলতে পারবে না। তবে দ্বিতীয় দিনে তারা অনেক দূর অ্যাডভান্স করে। তৃতীয় দিনে তারা আরো অ্যাডভান্স করে। কমান্ডিং অফিসার শুধু অর্ডার দিয়ে যাচ্ছেন–অ্যাডভান্স। গুলির বৃষ্টিতে তারা ঢুকে পড়েছে। জীবনের পরোয়া নেই। তখন মুক্তিযযাদ্ধাদের কাছে রিপোর্ট এল, ‘পাকবাহিনী ভাইগ্যা যাচ্ছে। ওরা পালাচ্ছে। এদিকে ফায়ার চলছে। পেছনে আর্টিলারি। আর্টিলারি সেল নিক্ষেপ করে যথারীতি অপারেশন পার্টিকে কাভার দিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা অ্যাডভান্স করছে। চারপাশের গ্রাম দেখতে পাচ্ছে তারা। আশপাশের গ্রামের মানুষ গরুগাড়ি করে, পায়ে হেঁটে সরে যাচ্ছে। তাদের আগে আগে পাঞ্জাবিরাও যাচ্ছে। পালাচ্ছে।
চতুর্থ দিন সকালবেলা একটা খোলা জিপে করে রফিকুল ইসলামরা শহরে ঢোকে। তাদের জিপের এক সাইডে ফিট করা মেশিনগান, অন্য সাইডে এলএমজি। শহর একবারে ফাঁকা। পাকিস্তানি সৈন্যরা আগেই পালিয়েছে। কোনো লোকজনও নেই। রাস্তার কুকুরগুলো পাগলের মতো এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধাদের জয় বাংলা ধ্বনি আর ব্ল্যাংক ফায়ার চারদিক থেকে শুরু হয়ে গেছে। রফিকুলদের গাড়িটা চালাচ্ছিল সিক্সথ বেঙ্গলের একটি ছেলে। নাম স্বপন। পাশের সিটে আর পেছনে স্টেনগান হাতে ওরা পাঁচজন। একজন হলো রুস্তম আলি, যাকে ’৭৩ সালে মহররমের আশুরার দিন কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তি গুলি করে হত্যা করে। সে জাসদের গণবাহিনী করত। আরেকজন ছিল কালো হ্যাংলা মতন, নাম সিরাজ। কমিশনার সাহেবের মেয়ে সে বিয়ে করেছে। এখন কন্ট্রাকটরি করে। পরের জন সুধীর, শহিদ সুধীর পাল, পরদিন নারকেলবাড়িয়ার যুদ্ধে সুধীর শহিদ হয়। এখন জেলখানার দিকে যেতে যে সাদা একতলা বাড়িটা, এর মালিক আগে স্টেশনমাস্টার ছিল, পরে ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে কাজ করত, তার মেজো ছেলে, কোনো এক ব্যাংকের এখন ডিরেক্টর, সে ছিল রফিকুলদের দলের চতুর্থ ব্যক্তি। আর রফিকুল নিজে হচ্ছে একজন প্রাক্তন ব্যবসায়ী। ব্যবসায় লাল বাত্তি জ্বলে উঠলে রাস্তার ওপরের দোকান বেচে দিয়ে, দোকানের পেছনের নামায় একটা ছাপরা মতন ঘর বেঁধে থাকে। তার কথামতো, এখন মদ না খেলে রাতে ঘুম হয় না।
পাঁচজনের দলটা একটা ভোলা জিপ নিয়ে সেদিন বন্দি মানুষদের উদ্ধারে নেমে পড়ে। তারা জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে প্রথম জেলখানার দিকে যায়। জেলের তালা ভেঙে ছোটে ক্যান্টনমেন্টের দিকে। মরিয়ম বলে, ‘সকাল থেকে খালি কানে আসতেছে জয় বাংলা স্লোগান। সারা দিনই জয় বাংলা স্লোগান শুনছি। গোলাগুলির শব্দও দূর থেকে ভেসে আসছে।
মেজর ইশতিয়াক চলে যাওয়ার দিন থেকে মরিয়ম না-খাওয়া। এই চার দিনে এক বেলাও খাবার জোটেনি। বাথরুমের কল ছেড়ে দু’দিন শুধু পানি খেয়েছে। তারপর কলেও পানি নেই। পানি-বাতি সব বন্ধ। জিব দিয়ে ঠোঁট চাটতে গেলে জিব। জড়িয়ে আসে। খিদা-তৃষ্ণার বোধটা ধীরে ধীরে শরীর থেকে চলে যাচ্ছিল। এই বুঝি শেষ, না-খেয়ে মরতে হবে। এই অবস্থায় জয় বাংলা স্লোগানটা আরো নিকটে এলে, মরিয়ম বলে, ‘তখন যে কী অনুভূতি হচ্ছিল তা ভাষায় বোঝাতে পারব না। আরে আল্লা, আমরা তাইলে বেঁচে গেছি, বোমার আঘাতে বা না-খেয়ে আমাদের আর মরতে হবে না!’ শরীরে তখন অসুর ভর করে। ‘ও বাবা, ও ভাই’ চিৎকার করে করে মরিয়ম তখন দরজায় লাথি মারছে। বাইরে থেকেও চিৎকার আসে, ‘ও মা, ও বুইন আমরা আসছি, আমরা আসছি। মা-মা, এই যে আমরা আসছি, এই যে আমরা আসছি।’
আঁচলে চোখ মোছে মরিয়ম, ‘কান্না পায় কথাগুলো মনে পড়লে। এত বছর পর কান পাতলে আজও শুনি মা-মা চিৎকার করে ওরা আসছে।’ মরিয়ম যে কোনোদিন জীবিত সন্তানের মা হতে পারল না, দূর থেকে ভেসে আসা ওই মা-মা চিৎকারটা ওর কষ্ট এখন আরো বাড়িয়ে দেয়। তখন কত আশা ছিল, মেজর ইশতিয়াক পালিয়ে গেছে–যাক, দেশ স্বাধীন হয়েছে, মুক্তিবাহিনী এগিয়ে আসছে তাদের উদ্ধার করতে।
‘আমরা তো পাগলের মতো একটার পর একটা তালা ভেঙে আগুই যাচ্ছি।’ রফিকুল বলে, ‘কতগুলি বিদগুটে চেহারার মেয়েছেলে পিলপিল করে বেরিয়ে আসলো। সারা গায়ে ঘা। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়েছে। শরীরে এক ফোঁটা গোশত নেই। একেকটা কঙ্কাল। তখন ওদের মানুষ বুইলে মনে হতো না। হাফম্যাড। কাপড় বলতে এদের যা ছিল, এ তো ভাষায় বলা যাবে না! এরা মনে হয় যোনিদ্বারটা শুধু ঢাইক্যা রাখছিল।’
কিন্তু সিল্ক শাড়ি? খোঁপায় লাল গোলাপ? দেয়ালে তৈলচিত্র? মেঝেতে হারমোনিয়াম-তবলা? কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে। রফিকুল যাদের তালা ভাঙার পর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেখেছে, তারা অন্য কেউ, সেখানে মরিয়ম ছিল না। মুক্তি তার সন্দেহের কথা জানালে একটানে হাঁটুর ওপর শাড়ি তুলে ডান পায়ের ক্ষতস্থান দেখায় মরিয়ম। ‘দেখতে চাও? আরো দেখাই,’ বলে যখন সে ব্লাউজ খুলতে যাচ্ছিল, মুক্তি বাধা দেয়। ‘তোমাকে যে বলেছে মিথ্যা বলেছে,’ মরিয়ম রাগে কাঁপতে থাকে। ‘ওরা তখন আমাদের দ্যাখবে কেন? নজর তো অন্যদিকে। আমরা হলাম গিয়ে বাসি, মিলিটারি আমাদের ইজ্জত মারছে। গায়ে খোঁচা খোঁচা দাগ। রক্ত, গন্ধ। আমাদের এরা চিনবে কেন?’ রেগে হড়হড় করে একসঙ্গে এতগুলো কথা বললেও সিল্ক শাড়ি, লাল গোলাপ, তৈলচিত্র, হারমোনিয়াম-তবলা নিয়ে একটি কথাও আর বলে না মরিয়ম। রফিকুলকে দেখানোর জন্য তার কাছে ছবি চাইলে হালের একটা পাসপোর্ট সাইজের সাদাকালো ছবি দিয়ে মুক্তিকে বিদায় করে। বাইশ বছরের তরুণীকে যে দেখেছে, সে বায়ান্নতে তোলা ছবি দেখে তাকে চিনতে পারবে?
হারিকেনের ঘোলা আলোয় সাদা-কালো ছবিটা চোখের সামনে মেলে ধরে রফিকুল। ‘এহ্ হে, এ তো বুড়ি! আমরা যাদের তালা ভেঙে বের করে দেছিলাম, ওরা সব মোলো-সতেরো বচ্ছরের ছুঁড়ি ছেল। তয় ঘিন্না লাগত ওদের দেখলে।’
‘আপনেও তো বুড়া।’ বলে মুক্তি ছবিটা ফিরিয়ে নিতে হাত বাড়ায়। রফিকুল তার হাত সরিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে ছবিটা। একদিন আবেগের বশে তালা ভেঙে যাদের বের করেছিল, তারা কোথায় গেল, কী করল, বেঁচে আছে না মরে গেছে, মাঝখানে এতগুলো বছর, কোনো দিন খোঁজ নেওয়া হলো না। সে নিজেও একজন মেয়েটি বলল, ‘বুড়া’। লিভার পচে গেছে। আজ আছে কাল নেই। রফিকুলের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে অনেকগুলো মুখের ভেতর একটা মুখ। যার গালের মাঝখানে একটা আঁচিল ছিল গোলাপি রঙের, সাদা-কালো ছবিতে যদিও বোঝা যাচ্ছে না, এ কি সেই? মুক্তি সায় দিতে লোকটা হে-হে করে হাসতে থাকে। ‘গালে আঁচিল একটা মেয়ে বেরুইয়ে পানি খাতি চাইল। আমরা পানি দেলাম। বাড়ি কোথায় বলল না। খালি কইল, ঢাকাত থ্যে বাড়ি যাচ্ছিল, পথে ধরা পড়ছে। তখন এ খুব রোগা ছিল। এখন দেখি গায়ে গোশত হয়েছে–হে-হে-হে।’
‘পরনে কী শাড়ি ছিল? সিল্ক শাড়ি?’
‘শাড়ি-টাড়ি কিছু ছিল না। ও-ওই রহমই। হাফম্যাড। পরে, অনেক বছর পরেও রাতে ঘুম ভাঙলে ওই চেহারা কয়ডা মনের পর্দায় ভেসে উঠত।’
‘ঘরের মধ্যে কি হারমোনিয়াম-তবলা বা দেয়ালে পেইন্টিং ছিল?’
‘কে কয়? যে ব্যারাকে এদের আটক রাখছিল, তা একটা নোংরা-ময়লা ঘর। নয় মাস ঝাড় পড়ে নাই। এর মধ্যে হাফম্যাড–পাগলের মতো মেয়েটা বইসে ছেল।’
‘তো আপনি প্রথম তাদের হাসপাতালে নিলেন, না সামনের ইস্পাহানি স্কুলে?’
‘হাসপাতালে কারে নেয়া হচ্ছে, কারে নেয়া হচ্ছে না…’
‘ইস্কুল ঘরে?’
‘ইস্কুল ঘরে কারে নেয়া হচ্ছে, কারে নেয়া হচ্ছে না…’
রফিকুলের গ্লাস খালি। কথায় বিরতি দিয়ে কাজের ছেলের কাছে সে ইনিয়ে বিনিয়ে আরেকটু মদ চায়। তারপর ফের শুরু হয় কথাবার্তা, ‘কথা হইল গে ওই সময় সৈনিকের দুটো মন থাকে। একটা মন থাকে মানুষরে উদ্ধার করার জন্য, আরেকটা মন থাকে শত্রুরে মারার জন্য। মানুষ তো খালি মদ খেয়ে মাতাল হয় না! যারা জীবন্ত মানুষ গুলি করে মারে, ওরাও মাতাল।’
গ্লাসের তলানিটুকু গলায় ঢেলে রফিকুল বলে, ‘আমি যত পুড়ি ততই আমার ভালো লাগে। হা-হা-হা।’
পাকিস্তানি মিলিটারি তখন পালাচ্ছে। যুদ্ধ তখনো শেষ হয়নি। রফিকুলরা শুধু তালা ভেঙে দিয়েছে। হাসপাতালে কাকে নেয়া হচ্ছে, কাকে নেয়া হচ্ছে না, ইস্কুল ঘরে কাকে নেয়া হচ্ছে, কাকে নেওয়া হচ্ছে না–সেসব দেখা তাদের কাজ না। যুদ্ধ করার জন্য মাতালের মতো অবস্থা তখন তাদের। এ সময়ে কমান্ডারের নির্দেশ আসে–অ্যাডভান্স! সামনে বাড়ো!