মা-মেয়ে টেইলারিং
এ কোন সাহসে নারী
যাতনার এই সংসার দাও পাড়ি?
আকাশ ঝরায় বিজুলির রেখা
বাতাসে তুহিন নামে
তুমি স্থির, তুমি উদ্যত থাকো বামে
আল্লার তরবারি।
[আল মাহমুদ]
আবেদ সামির যেদিন সুমনের সঙ্গে মরিয়মদের বাসায় আসে, সেদিন সে রীতিমতো প্রগল্ভ। কাউকেই কথা বলতে দিচ্ছে না। তার মতে, কফিলউদ্দিন আহমেদের নাম ঠিকানা লেখা বাড়িটা ইতিহাসের টুকরো, মূল্যবান ভগ্নাংশ। আগাপাশতলা সংরক্ষণের দাবি রাখে। এমন বাড়িতে থাকার কথা লেখক-শিল্পীদের। দুঃখের বিষয়, যারা এখানে বাস করে তারা শিল্পীমনে হলেও প্রতিভা বিকাশের তাগিদ বোধ করছে না। সুমন সাহিত্যিক বন্ধুর বাতচিতে যারপরনাই গর্বিত। ঘন-ঘন মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছে। মনোয়ারা বেগম আড়ালে ডেকে মেরিকে জিগ্যেস করেন, ‘অহ, মরিয়ম, পোলাডার মনে অয় মাথা খারাপ? ক্যামন মাইয়্যা মানষ্যের মতো চুল রাখছে! তুই যে দিনচুক্তি আসর বসাইছস, হেরা কাপড়-চোপড়ের অর্ডার দিব?’ তত দিনে তাদের রেডিমেড কাপড়ের জয়েন্ট ভেঞ্চারে লালবাত্তি জ্বলে উঠেছে। সেলাই মেশিনে মরচে পড়ার জোগাড়। সোনার ভাণ্ডও শূন্য। মনোয়ারা বেগমের মাথার ঠিক নেই। এদিকে মেয়ে। তার কথার জবাব না দিয়ে মুখ ঝামটা মেরে ফের আসরে ঢুকেছে।
মনোয়ারা বেগম বাইরে দাঁড়িয়ে আকাশ-পাতাল ভাবেন। মেয়েটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। তাকেই সংসারের হাল ধরতে হবে। তা যে-কোনো মূল্যেই হোক। তার রাগ কমতে কমতে ক্রমে ব্যবসায়িক বিবেচনায় রূপান্তরিত হয়। তিনি পেশাদার নট-নটীর মতো মেকআপ নিয়ে আসরে নামেন। এবার ঠান্ডা মাথায় ফ্লোর দখল করার পালা। অতি দ্রুত সাহিত্যের বিমূর্ততা থেকে আড়ার বিষয় দেশের পরিস্থিতির দিকে বাঁক নেয়। তিনি বলেন, ‘সৎপথে দু’পয়সা উপার্জন করে মানুষ যে চারটা ডালভাত খাবে–তার উপায় দেখি না। কী হইলো দেশটার!’ তারপর কথার পিঠে কথা চড়িয়ে মা-মেয়ের। বর্তমান বেহাল অবস্থার দিকে তার বক্তব্য আল টপকে চলে যায়। শ্রোতারা অস্বস্তি বোধ করে। তিনি উঠে গিয়ে চটকদার ডিজাইনের কয়েক সেট পোশাকের সঙ্গে সেলাই মেশিনটাও এনে বসান আসরের ঠিক মধ্যিখানে। ‘জানো তো বাবারা,’ মনোয়ারা বেগমের গলার গাম্ভীর্যে বাকি দুজন চমৎকৃত হলেও মরিয়ম বেশ উদ্বিগ্ন। তিনি থেমে থেমে বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে মুক্তিযুদ্ধের শহিদ। হে কি যুদ্ধে গেছিল এই পোড়া দেশের জন্য? এ দেশটা অহন কার–কতগুলি চোরবাটপার, মজুতদার, কালোবাজারির।’ এমন কথার শেষে জনসভায় হলে হাততালি পড়ত। মরিয়ম আর আবেদ সামির হাত গুটিয়ে বসে থাকে। সুমন উঠে গিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখে কাপড়গুলো। তাকে চিন্তামগ্ন দেখায়। ছেলেটা পরোপকারী। মা-মেয়ের বেহাল অবস্থা নিরসনের প্রথম উদ্যোগ নেয় সে-ই।
সেদিনের আসরে বসে আবেদ সামিরের সাহিত্যিক বয়ানে মা-মেয়ে টেইলারিং’ এর পোস্টার লেখা হয়। মনোয়ারা বেগম রান্নাঘরে গিয়ে ময়দা গুলে আঠা তৈরি করেন। তারা জিগাতলা, রায়েরবাজার, ট্যানারির মোড়ের দেয়ালগুলোতে, লাইটপোস্টে আর গাছে গাছে রঙিন কাগজের পোস্টার লাগিয়ে দেয়। উদ্যোগটা অভিনব। পোস্টারগুলো দৃষ্টিনন্দন। মূল্যবৃদ্ধির বাজারেও দর্শকদের নতুন কাপড় বানাতে উদ্বুদ্ধ করে। তারা রঙিন ছিট কাপড় বগলে খুঁজে বা খবরের কাগজে মুড়ে কফিলউদ্দিন আহমেদের নাম-ঠিকানা লেখা বাড়িটাতে হাজির হয়। মনোয়ারা বেগম বারান্দায় লম্বা বেঞ্চি পেতে দিয়েছেন খদ্দেরদের বসার জন্য। মরিয়ম ফিতা দিয়ে তাদের বডির মাপ নেয়, কাচির নিচে কাপড় ফেলে কচকচ করে কাটে, ববিনে সুতো ভরে, ভনভন শব্দে মেশিনের হাতল ঘোরায়। তার চারপাশে টুকরা-টাকরা রঙিন কাপড়ের পাহাড় জমে ওঠে। তাকে সুতোর জাল ঘিরে রাখে সব সময়। আর গলায় দিনরাত প্যাচানো থাকে ডোরাকাটা সাপের মতো শরীর মাপ নেওয়ার একটা গজফিতা।
মনোয়ারা বেগম টাকা নিয়ে তৈরি-পোশাক ডেলিভারি দেন। রসিদ কাটা, টাকাপয়সার হিসাবনিকাশ–সব তার হাতে। নতুন কাজ নিয়ে মা-মেয়ে দুজনেই ব্যস্ত। যত দিন মেশিনের হাতল ঘুরবে, তত দিন সংসারের চাকাও সচল থাকবে। তাদের রুটিরুজি বাঁধা পড়ে গেছে একটা মেশিনের কাছে। মনোয়ারা বেগম কাস্টমার-পড়শি যাকে যখন পান, কথাটা বলেন। কষ্টে না গর্বে, ঠিক বোঝা যায় না। তবে দিনের পর দিন কাজটা করতে করতে মরিয়ম একসময় বিগড়ে যায়। তার মনে হয়, সে তো পুনর্বাসনকেন্দ্রের কাজই এখনো করছে। জীবন থেকেই যে উদ্বাস্তু, একটা সামান্য মেশিন তার পুনর্বাসন করে কীভাবে। এ কি সম্ভব? এই যে আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ফোঁসকা পড়ে গেছে, যন্ত্রণায় শিরদাঁড়া টনটন করছে, পায়ে সারাক্ষণ ঝিঁঝি ধরে থাকে–এসব কীসের জন্য। একলা মানুষের পেট তো একটাই। তার বাইরে শরীরের আরো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে। তা ছাড়া জীবমাত্রই শুধু শরীর নয়। একটা মেশিনের ওপর সারা দিন উপুড় হয়ে পড়ে থাকা-বেঁচে থাকার নামে নিতান্তই অপচয়। তার কাপড় কাটায়, সেলাইয়ের ফোঁড়ে ঘনঘন ভুল হতে থাকে। একদিন ব্লাউজের হাতা উল্টো সেলাই করে, রঙিন টুকরা কাপড়ের পাহাড় ভেঙে, সুতোর জাল ছিঁড়ে, মেশিন ঠেলে সরিয়ে সে উঠে পড়ে অসময়ে। বারান্দার বেঞ্চি থেকে মনোয়ারা বেগম হা-হা করে ওঠেন, কাজটা ভালো হচ্ছে না মরিয়ম। এক ডজন বেলাউজের ডেলিভারির ডেট আইজ। লোকজন আইস্যা বইস্যা থাকব। রুটি-রুজি নিয়ে মশকরা চলে না, মা।’ এর জবাবে গুচ্ছের থালাবাসন রান্নাঘরের মেঝেতে সশব্দে ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় মরিয়ম।
শিরীষ অরণ্যের প্রেমিক-প্রেমিকারা এখনো ক্লাসরুমে, হয়তো লেকচার শোনার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে ঘড়ি দেখছে। নতুন মুচি রাস্তার বাঁ পাশ থেকে ডান দিকের ফুটপাতে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়লে জাঁকিয়ে বসবে। ওদিকটা এড়িয়ে আজিমপুরের দিকে চলে যায় মরিয়ম। সুমন বাসায় নেই। আবেদ সামির ব্যর্থ লেখার দলা পাকানো মুঠো মুঠো কাগজের মাঝখানে চোখ লাল করে বসে আছে। চুল উশকোখুশকো। মেজাজ রুক্ষ। দরজা খুলেই কী চাই’ বলে মরিয়মকে সম্ভাষণ জানায়। মেরিও তখন খাট্টা মেজাজে। আর যা চাই, তোমাকে নয়। সুমন কোথায়? প্রশ্নটার জবাব না শুনেই সে সুমনের ঘরের দিকে ঘটঘট করে হেঁটে যায়। তক্তপোশের নোংরা চাদরে বসতে খানিক ইতস্তত করে। এর কারণ চাদরটা নোংরা, নাকি ঘরের মালিকের অনুপস্থিতি? মরিয়মের মনে হয়, দুটোই। যুদ্ধের নয় মাস বীভৎস নোংরায় থেকে, সে তাতে অভ্যস্ত তো হয়ইনি বরং খুঁতখুঁতে স্বভাব নিয়ে ফিরেছে। তবে ঘরের মালিকের অনুপস্থিতিটা এখন তাকে একরকম স্বস্তি দেয়। কিছুটা সময় অন্তত একা থাকা যাবে। বাড়ি থেকে রাগারাগি করে এসেছে, তার মধ্যে আবেদ সামিরের এমন উকট মেজাজ, এ পুরুষগুলো নিজেদের ভাবে কী? লিখতে না পারলেও মেয়েদের দোষ? এখানে না এসে শিরীষতলার ফুটপাতে বসে থাকা কি ভালো ছিল না? কী ভালো ছিল! তেল চিটচিটে ওয়াড় একটানে খুলে উলঙ্গ বালিশটা মাথার নিচে ঠেসে দিতে দিতে সে ভাবে–স্বপ্নটপ্ন সব বোগাস। পুরোনো হলে তো আরো।
তার পরও সুমনের বিছানায় শুয়ে মরিয়ম পুরোনো দিনের একটা স্বপ্ন দেখে। মেজর ইশতিয়াক রাইফেল কাঁধে ঢাকার ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে। সিগন্যাল পোস্ট থেকে নেমে হুইসেল বাজাতে বাজাতে সে মরিয়মের দিকে লেফট-রাইট করে আসে। এখানে কেন এসেছে লোকটা! যাদের জন্য মন্টু মৃত, সে আজ পথে পথে-তার এখানে আসার দরকারটা কী? মেজরের মুখে কথার খই ফোটে। সে বলে, মায়া। কী করব, মায়া ছাড়তে পারি না! মরিয়ম মনে মনে ভাবে, মায়া না ছাই, গোলাম মোস্তফা তার গার্জিয়ান তো, তিনিই মেজর ইশতিয়াককে আনিয়েছেন। লোকটা এসেছেই যখন, তাদের এখন বিয়ে হবে। যুদ্ধের কারণে মেরির তো বিয়েই হচ্ছে না। মেজর ইশতিয়াক বিয়ের প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে লাজুক হেসে বলে, এ দেশটা আমার জন্মস্থান। মরিয়ম অবাক, জন্মস্থান? মেজর বলে, না আবার! এই দেখো আমি কী সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গাই-সহে না যাতনা, দিবস রজনী…
মরিয়ম গানের মাঝখানেই বুঝতে পারে, তাদের বিয়েটা হবে হবে করে এবারও হবে না, আজিমপুরে সুমনের বাসার ময়লা বিছানায় শুয়ে সে আসলে একটা স্বপ্ন দেখছে। গান গাইছেন দেব্রত, পাশের বাড়ির রেকর্ড প্লেয়ারে। এতখানি বুঝতে পারা সত্ত্বেও তার ঘুম ভাঙে না। স্বর্ণলতার মতো একটা স্বপ্ন তাকে কোমলভাবে জড়িয়ে রাখে। সূর্যটা পশ্চিমাকাশে। মেজর ইশতিয়াক পলাশীর মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়। তার চেহারাটা অফিস-ফেরত কেরানির মতো। হাতে ব্রিফকেস। মরিয়ম তার স্ত্রী। মেজর হাত তুলে স্ত্রীকে শিরীষ অরণ্যে যেতে বারণ করে। কেন? মরিয়ম নিষেধ মানতে একদম রাজি নয়। মেজর বলে, কারফিউ চলছে ওখানে। প্রবেশ নিষেধ। মরিয়ম যাবেই, লোকটা কিছুতেই যেতে দেবে না। প্রথম দিনের মুচি বিবাদ মিটাতে এসে বুকে গুলি খায়। না-আ-আ-স্বর্ণলতার বাঁধন ছিঁড়ে মরিয়ম এক লাফে বিছানায় উঠে বসে। দরদরিয়ে সে ঘামছে। বিকালের রোদতপ্ত বিছানা, আলনার লুঙ্গি-গেঞ্জি, স্থান সম্পর্কে তাকে বিভ্রান্ত করে। স্বপ্নটার চেয়েও এমন জায়গায় তার ঘুমিয়ে পড়াটাই যেন বিসদৃশ বেশি।
দুই রুমের মাঝখানের দরজাটা ভেজানো। তবে পাল্লা দুটির ফাঁক ইঞ্চি খানেক হবে। পাশের ঘরের চাপা কথাবার্তা এ ঘর থেকে শোনা যায়। সুমন ফিরেছে। দুই বন্ধু বাতচিত করছে, মরিয়মের মনে হয় ওকে নিয়ে। যদিও বাস্তবের চেয়ে স্বপ্নে দেখা মানুষগুলোকে তার বেশি কাছের মনে হয়, তবু পাশের কামরার ছেলে দুটিকে সে অগ্রাহ্য করতে পারে না। ইশ, কী গরম!’ কথাটা কি সুমন বলল? তাহলে এখন আবেদ সামিরের কণ্ঠ, ‘এমন গরমে মইষের মতো ঘুম!’ ‘এই না-না, আমি বাসা ছেড়ে ছাদে চলে গেছলাম। মনে হয় বাসায় কোনো ঝামেলা হইছে?’ ‘হইলেই কী, তাই বলে তুমি ছাদে চলে যাইবা?’
কথাগুলোর কোনো মাথামুণ্ডু নেই। মরিয়ম কি এখনো স্বপ্ন দেখছে? সে জোর করে শরীরটা বিছানা থেকে তুলে, শাড়ির ভাজ ঠিক করতে করতে পা টেনে টেনে ভেজানো দরজার দিকে এগোয়। সুমনের দেহের অর্ধেকটা খবরের কাগজের আড়ালে। আবেদ সামির নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। এই, তোমরা আমার দুর্নাম করতেছিলা ক্যান? মরিয়মের কথা শুনে সুমন মুখ থেকে কাগজ নামিয়ে অবাক হয়ে তাকায়। সেই সঙ্গে চেহারায় কষ্টেসৃষ্টে ফুটিয়ে তোলা প্রসন্ন ভাব, এত গরমে মানুষ ঘুমায় ক্যামনে?’ মরিয়ম গোলযোগপূর্ণ ঘুমে ভারী হয়ে যাওয়া গলায় হেসে বলে, ‘মইষের মতো ঘুম! ‘এই না না, গত রাতে গরমে টিকতে না পেরে আমি ছাদে চলে গেছলাম। মরিয়মের স্বপ্নের আবেশ মুহূর্তে ছুটে যায়। সুমন চটজলদি জানতে চায়, বাসায় কোনো ঝামেলা হইছে? স্বপ্ন এমন বাস্তবের সঙ্গে মিলে যেতে পারে, আশ্চর্য! নাকি তাকে ঘরে ঢুকতে দেখে একজন ঘুমের ভান করছে, অন্যজন আপাদমস্তক ঢেকে ফেলেছে খবরের কাগজে? কিন্তু সুমনের কথা শুনে মনে হচ্ছে, তা নয়। সে ঝা-ঝ রোদ মাথায় করে ঘরে ঢুকে দেখে, দুজন ঘুমন্ত মানুষের দখলে দুটি কামরা। নিজঘরে সে পরবাসী। সুমন হেসে হেসে কথা বললেও মরিয়মের মনে হয়, সে আবেদ সামিরের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করছে। তা করুক। মরিয়ম স্বপ্নের জালে এমন জড়িয়ে আছে যে, ছাইপাশ ভাবতেও তার ভালো লাগছে না। সুমন নাছোড়। সে হঠাৎ আবেদ জাহাঙ্গীরের কথা অপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে আনে। আবেদ শ্বশুরের ব্যবসা করতে গিয়ে। লাট খেয়ে পড়েছে। বউ বাপের বাড়ি লাহোরে বেড়াতে গিয়ে ফিরছে না। চিঠিপত্রও বন্ধ। মাথা খারাপের জোগাড় আবেদ ভাইয়ের। সুমন খোশমেজাজে বয়ান করে, ‘এখন বাকশালে যোগ দিয়ে তিনি নেতা হইতে চান। তাই অভাগা সুমনের ডাক পড়েছে অসময়ে।’
মরিয়মের মনে হয়, এসব কথা বাদ দিয়ে আবেদ সামিরের লেখাপত্র বালিশের তলা থেকে টেনে আনলে সুমন ভালো করত। তার মেজাজটা ঠিক থাকত। কিন্তু সেদিকে সুমনের আজ মন নেই। বোঝা যায়, প্রাক্তন গুরুর কাছ থেকেই ঝা-ঝা রোদে বাসায় ফিরেছে। মস্ত বড় ঢেকুর তুলে সুমন বলে, ‘আবেদ ভাই এমনভাবে ধরলেন, নইলে এই গরমে কেউ বিরানি খায়! তা-ও আবার কাচ্চি!’ মরিয়মের হঠাৎ মনে পড়ে সে দুপুরে কিছু খায়নি। আবেদ সামির কি খেয়েছে? বেচারার দিন শেষ হয়ে এল বলে। সুমন যেমন ঝড়ের গতিতে প্রাক্তন গুরুর দিকে ধাবিত হচ্ছে, প্রতিভাবান সাহিত্যিকের মাথার ওপরের ছাদটা দুদিন বাদে এমনিই সরে যাবে। হয়তো পথে বসতে হবে তাকে। কিন্তু এমন কাউকে নিয়ে ভাবছে কেন মরিয়ম, যে ঘণ্টা দুই আগে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে! নাকি পুরুষের কাছ থেকে খারাপ ব্যবহারই সে। আশা করে। যেন তারা তাকে মানুষ না ভেবে রাস্তার কুকুর ভাবে! তা না হলে সে মমতাজের মতো পাষণ্ড আর মেজর ইশতিয়াকের মতো খুনির সঙ্গে থাকল কীভাবে। মরিয়মের অস্থির অস্থির লাগে। সুমনের ঘন-ঘন ঢেকুর তোলা মুখটায় কষে একটা চড় লাগিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। রাস্তার কুকুর আসলে কে–সে, না সুমন? আয়-আয় উঁহুঁ করে ডাকলে লেজ নাড়তে নাড়তে যে বিরানি খেতে ছুটে যায়–সে মরিয়ম না, সুমনই।
সুমন আপনাতে আপনি বিভোর। হঠাৎ জিগ্যেস করে, ‘রাজনীতি করবেন?’
কত বড় আস্পর্ধা! মরিয়ম দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ‘কেন?’
‘না মানে, দর্জিগিরি বাদ দিয়ে রাজনীতিটা কেরিয়ার হিসাবে নিলে ক্ষতি কী? এখন তো রাজনীতির যুগ।’
‘নাকি আবেদ জাহাঙ্গীর ফের রাজনীতি করতে চাচ্ছে বলে আমাকেও করতে হবে?’
‘না-না, আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী। হে বিবাহিত মানুষ। আর আপনে…’
‘আমি?’
সুমন বিরক্ত হয়।
‘আর আমি?’ মরিয়মের মাথায় খুন চেপে গেছে। সে কে–আজ সুমনের কাছ থেকে জানতেই হবে। আবেদ সামির ঘুম থেকে উঠে দুজনের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। ঘরটা কখন রণক্ষেত্রে পরিণত হলো! মরিয়ম এসবের পরোয়া করে না। হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে সে একই প্রশ্ন করে বারবার। তার প্রশ্ন করা শেষ হয়, যখন সুমন বাড়ি মাথায় তুলে চিৎকার করে বলে, ‘এত সতী সাজেন ক্যান? আপনে কে–সবাই জানে। আর্মির ভুসিমাল। মুখে আবার বড় বড় কথা!’
রাস্তায় বেরিয়ে মরিয়মের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। সবাই তো ভালো মানুষের মুখোশ পরে ভালো ভালো কথা বলতে আসে। আর কত। একটা একটা মুখোশ টেনে ছিঁড়ে তবে তার শান্তি। ‘হ-হ আমি আর্মির ভুসিমাল। তাতে তোমার কোনো অসুবিধা আছে? আমি তোমার ঘরের বউ, না ছেলের মা?’ মরিয়ম হাঁটতে হাঁটতে পাগলের মতো প্রলাপ বকে। তার পেছন পেছন আসে আবেদ সামির। কী যেন সে বলতে চায়। হয়তো সুমনের হয়ে সে তার কাছে ক্ষমা চাইবে। মরিয়ম সেই সুযোগ দিতে নারাজ। এদের সব কটাকে তার চেনা আছে। সুমনও একদিন এসএম হল থেকে পলাশীর মোড় পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিয়েছিল। আর্মির ভুসিমালের প্রতি সমবেদনায় সেদিন তার চোখ ছিল ছলছল।
মরিয়ম সামনে একটা খালি রিকশা পেয়ে উঠে বসে। পেছন ফিরে তাকায় না। সামনে এগিয়ে গেলে পলাশীর মোড়। ওখানে মেজর ইশতিয়াক ব্রিফকেস হাতে দাঁড়িয়ে আছে অফিস-ফেরত কেরানির মতো। প্রথম দিনের মুচি নিবিষ্ট মনে জুতো সেলাই করছে। শিরীষ অরণ্যে আজ কারফিউ। ওদিকে যাওয়া যাবে না। এখন থেকে স্বপ্নগুলোকে হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে। কত কাছের মানুষ, অল্প সময়ে তার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। স্বপ্ন ছাড়া তাদের ফিরে পাওয়ার অন্য কোনো পথ নেই। এই পথটা খুলে না রাখলে তার জীবন ঘিরে তো খরা সৃষ্টি হবে। যা অন্ধকার কবরের একাকিত্বতুল্য। মরিয়ম রিকশাঅলাকে তাড়াতাড়ি রায়েরবাজারের দিকে চালিয়ে যেতে বলে।
মনোয়ারা বেগম নিঃশব্দে দুয়ার খুলে সরে দাঁড়ান। মরিয়ম একজন পরাজিত মানুষ–যে কয়েক ঘণ্টা আগে ঝড়ের বেগে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, সে বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে ঘরে ঢোকে। ঘরটা তবু আশ্রয়। বাইরের পৃথিবীতে যে কণ্টক বিছানো আছে, মা কি তা জানেন?
এই এক বেলায় মনোয়ারা বেগমেরও শক্তি ক্ষয় হয়ে তলায় লেগে গেছে। রঙিন কাপড়ের টুকরা-টাকরা আজ দুপুরে বস্তাবন্দি করতে করতে তার হঠাৎ মনে হয়েছিল, তিনি মেরির রোজগার খাচ্ছেন। আঙুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে মেশিন ঘুরিয়ে জীবন কাটবে মেয়ের? মেশিনের ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে দিন-মাস-বছরও তো ঘুরে যাচ্ছে। এ মহাকাল ঠেকাবে কে। মেরি নিজের পথ খুঁজে নিক, যদি কোনো পথ থাকে। তিনি কোনোভাবে তার পথে বাধা হবেন না।
মা-মেয়ে গরমে ভিজে-ওঠা বাসি ভাত নিয়ে সন্ধ্যাবাতির তলায় খেতে বসে। ঘরে কোনো শব্দ নেই। যে যার চিন্তায় মগ্ন। একটা দিন হঠাৎ করে অন্য দিনগুলো থেকে আলাদা হয়ে যায়। মনোয়ারা বেগমের আঙুল গুনে বাজারের হিসাব করা এখন বন্ধ। মা-মেয়ে টেইলারিং’-এর লাভ-লোকসান, ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি আর চিন্তিত নন। জীবন বড় প্রতারক। এর বড় হিসাবটা মানুষের দৃষ্টির আড়ালে, আঙুল গোনা ছাড়াই শেষ করে দিচ্ছে আরেকজন। আতঙ্কে মনোয়ারা বেগমের ভাত গলায় আটকে যায়। তিনি পানির গ্লাস নামিয়ে ধীরে ধীরে কোমল স্বরে মেয়েকে বলেন, আমি এক রকমের জীবন চিনি মরিয়ম। স্বামী-সন্তান। খোদা তা-ও রাখল না। তবে আমার মনে লয়, জীবন শুধু এক রকমের না। তোর সামনে সময় আছে। তুই মা খুঁইজা দেখ।
ছেলের মৃত্যু, মেয়ের ইজ্জতহানি মাকেও কি সাবালক করে দেয়? তা না হলে কার মুখে কী কথা। মহুয়া সিনেমা হলের ঘটনার পর, মেরির নামে অপবাদ রটার ফলে মায়ের জীবন বরবাদ হয়ে গিয়েছিল। তিনি সারাক্ষণ নিজের মৃত্যুকামনা করতেন। মেয়েকেও বলতেন, ‘মর মর, বিষ খাইয়্যা মর তুই। এমন কালসাপ পেটে লইছিলাম মাগো। খোদা, তোমার এ পাপী বান্দারে তুইল্যা নেও, তুইল্যা নেও।’
মনোয়ারা বেগম জীবনের জটিলতার কাছে হেরে গেছেন। শহরের রাস্তায় বৃষ্টি পড়ে পড়ে গলাপানি লেগে গেছে। তিনি অনড়। যেখানে সকালে মুখ ধুয়ে আল্লার নাম করে বসেন, সেখানেই এক বসায় দিন শেষ। মরিয়ম থেমে থেমে মেশিন ঘোরায়। মা-মেয়ে টেইলারিংয়ের রঙিন পোস্টার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেছে। বর্ষাকালে কাগজের নতুন পোস্টার লাগিয়ে ফায়দা নেই। তা ছাড়া রায়েরবাজার, ট্যানারির মোড় আর জিগাতলার পোস্টার অধ্যুষিত এলাকার লোকজন মা-মেয়ে টেইলারিংয়ের খবর জানে। তারা প্রয়োজনমতো কাপড়চোপড় বানিয়ে নিয়েও গেছে। গত তিন মাসে এই এলাকার নিম্নমধ্যবিত্তের চাহিদা শেষ। বারান্দার কাস্টমারদের বসার বেঞ্চিটা শূন্য পড়ে থাকে। পুঁজির বিকাশের নিয়মে এখন দরকার নতুন এলাকা, নতুন ভোক্তা। তার জন্য লাগবে নতুন নতুন দৃষ্টিনন্দন, আকর্ষণীয়, চটকদার সব পোস্টার। মা-মেয়ের উদ্যোগে ভাটা পড়াতে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। মরিয়ম টুকরা কাপড় জোড়া দিয়ে বাচ্চাদের নিমা, বালিশের কভার, কুশন, টিকোজি তৈরি করে। শরীরের গিঁটগুলো আলগা করে আড়মোড়া ভেঙে দরজায় এসে দাঁড়ায়। মনোয়ারা বেগম জানালার পাশে বসে আছেন তো আছেনই। বৃষ্টির দিকে তার চোখ অনির্দিষ্টকালের জন্য নিবদ্ধ। এখন কে নিয়ে যাবে তৈরি পোশাক বাজারে বেচতে?
একদিন অঝোর বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে আবেদ সামির মরিয়মদের বাসায় আসে। মনোয়ারা বেগম সুমন আর মেরির ঝগড়ার বৃত্তান্ত কিছুই জানেন না। তিনি জানালার ধার থেকে উঠে তাকে সমাদর করে বারান্দায় বসান। মরিয়ম সেলাইঘরে, টুকরা কাপড় দিয়ে বাচ্চাদের নিমা বানাচ্ছে। মনোয়ারা বেগমের চেঁচামেচিতে সে মেশিন বন্ধ করে ঘোরভাঙা চোখে তাকায়। দেইখ্যা যা মরিয়ম, কে আইছে! ওঠ-ওঠ,– শিগগির আয়।’
আজকাল সেলাই করাটা মরিয়মের খালি রুটিরুজির উপায় নয়। মেশিনের ঘূর্ণনের মধ্য দিয়ে উল্টো ঘুরতে ঘুরতে সে অতীতে চলে যায়। রঙিন জামাগুলো বিছানায় সাজাতে সাজাতে ভাবে–এইটা শোভা রানীর বাচ্চার, এইটা বিন্দুবালার, টুকির। পুনর্বাসনকেন্দ্রের যেসব বাচ্চারা প্লেনে চড়ে বিদেশ চলে গেছে, জামাকাপড় থেকে তাদেরও বঞ্চিত করে না মরিয়ম। বিছানার শেষ প্রান্তে অভিবাসী যুদ্ধশিশুদের জন্য আলাদা করে কিছু কাপড় গুছিয়ে রাখে। বাড়িতে নির্বাক মা ছাড়া আর কেউ নেই যে, তার এসব গোপন কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। তাই আজ মনোয়ারা বেগমের ডাকাডাকি কাঁচা ঘুম থেকে টেনে তোলার মতো তার মনে হয়। ওঠ-ওঠ, শিগরির আয়! দেইখ্যা যা মরিয়ম, কে আইছে!’
কে আইছে মা, মন্টু? মাগো মন্টু আইছে? মরিয়মের স্বপ্নাচ্ছন্ন মনটা নিঃশব্দে চিৎকার করে ওঠে। ছোটবেলার মতো চৌকি থেকে লাফিয়ে মেঝেতে নামে সে। এবার অবাক হওয়ার পালা মনোয়ারা বেগমের। খাড়া মরিয়ম, পরনের কাপড়টা আগে ঠিক কইর্যা ল। আবেদরে আমি বারান্দায় বসাইছি।’ আবেদ! মেরির বুকের ওপর আস্ত পাহাড় ভেঙে পড়ে। কিন্তু মায়ের তাড়া খেয়ে সে ততক্ষণে বারান্দায়। নামের পুনরাবৃত্তি তার জীবন থেকে আর গেল না। মেজর ইশতিয়াক নম্বর ওয়ান, নম্বর টু, আবেদ জাহাঙ্গীর, আবেদ সামির।
মরিয়মের দু’ভুরুর মাঝখানের গভীর ভাঁজ দেখে সামির ভড়কে যায়। সে তাড়াতাড়ি বারান্দার বেঞ্চি ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। পথেই এমন বৃষ্টি নামল!’ মনোয়ারা বেগম পেছন থেকে গলা মেলান, ‘হ বাবা, এমন পচা বিষ্টি। ঘর থাইক্যা বাইর অওনের জো নাই। তুমি আওনে আমরা বহুৎ খুশি অইছি, বাবা।
মায়ের ব্যাপার কী! ব্যবসাপাতিতে তো আর মন নেই। আবেদ সামিরকে টেনে বসাচ্ছেন কেন। তার ওপর ‘তোমরা গল্পগুজব করো’ বলে নিজে ভিজতে ভিজতে চা বানাতে চলে যান রান্নাঘরে। ওহ্, এ তাহলে মায়ের দ্বিতীয় প্রজেক্ট! মরিয়ম দীর্ঘদিনের তন্দ্রা থেকে জেগে ওঠে-স্বামী-সন্তানের বাইরে আরেক রকম জীবন আছে কি না মেয়েকে খুঁজে দেখার সুযোগ করে দিচ্ছেন মা। কোনো দিন মা-বাবার চাওয়ার সঙ্গে তার চাওয়া-পাওয়ার মিল হলো না। সে যখন আরেক রকম জীবন খোঁজায় ইস্তফা দিয়েছে, মা তখন তাকে পীড়াপীড়ি করছেন তা আবার শুরু করতে। কে আসলে ঠিক–মা, নাকি সে নিজে?
মা-মেয়ের এমন উল্টাপাল্টা আচরণে আবেদ সামির বিভ্রান্ত। তবে মরিয়মকে সে বুঝতে পারে-তার সেই দিনের রাগটা এখনো কমেনি। কমার কথাও নয়। সে যে এখন দুটি টিউশনি করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে–এ খবরে মেয়েটা নিশ্চয় খুশি হবে। তাতেও যখন মরিয়মের কোনো ভাবান্তর হয় না, সে তখন তার তৈরি পোশাকগুলো দেখতে চায়। কিন্তু বিষয়টা গোপন, আবেদ সামিরের কাটাকুটিভরা কবিতার খসড়ার চেয়েও। বাচ্চাদের নিমা তৈরি করে থরে থরে সাজানোতে মরিয়মের একার আনন্দ। সেসব প্রদর্শনী বা বিক্রির জন্য নয়। এ ক্ষেত্রে বালিশের কভার, কুশন, টিকোজি শুধু দেখানো চলে। ঘরে ঢুকেই মরিয়মের একার আনন্দসামগ্রীর দিকে প্রথম চোখ যায় আবেদ সামিরের। দেখি দেখি’ বলে একগুচ্ছ নিমা-জামা সে বিছানা থেকে টেনে নেয়। মরিয়ম থাবা মারতেই তার হাত থেকে সেসব ঝুরঝুরিয়ে পড়ে যায়। কতগুলো সেলাই করা কাপড়ই তো, গোপন করার কী আছে। কাপড়গুলো মেঝেতে পড়ে যেতে মেয়েটা এমন ফুঁপিয়ে উঠল কেন। সামিরের কৌতূহল বেড়ে যায়। নবজাতকের অনেকগুলো জামা, শিশুহীন এক বাড়ির মেঝেতে করুণভাবে পড়ে রয়েছে। দৃশ্যটা পুরুষের বাৎসল্য আর মেয়েদের মাতৃত্ব জাগানোর জন্য যথেষ্ট। মরিয়মের অপ্রস্তুত চেহারার দিকে তাকিয়ে আবেদ সামিরের এই প্রথম মনে হয়, রুক্ষ মেজাজের আড়ালে এ মেয়ের মনটা আসলে কোমল। তা সমবেদনার চেয়ে মনোযোগ দাবি করে বেশি।
মনোয়ারা বেগমের নতুন প্রজেক্ট-স্বামী-সন্তানের বাইরে মেয়ের অন্যরকম জীবন’ পরিণতির দিকে এগোয়। তবে শুকনো মাটির বুকে দাগ ফেলে কচ্ছপের খড়খড়িয়ে চলার মতো শ্লথগতিতে। আবেদ সামির সন্ধ্যার দিকে ঝোলা কাঁধে হাজির হয়। বারান্দার বেঞ্চিতে বসেই নতুন লেখা কবিতা বের করে। সারা দিনে মেরেকেটে দুজনের বেশি কাস্টমার আসে না। তা-ও বেশিরভাগ কাজ–ব্লাউজ অল্টার করার, শাড়ির ফলস লাগানোর, অসময়ে ছিঁড়ে যাওয়া কাপড়ে তালি বসানোর মতো সংস্কারমূলক। দিন থাকতেই এসব কাপড় দেয়া-নেয়ার পাট চুকে যায়। সন্ধ্যায় সাহিত্য পাঠের আসর বসে। মরিয়ম স্নান করে পরিষ্কার শাড়ি-ব্লাউজ গায় দিয়ে কবিতা শুনতে বসলেও তার মনোযোগ বেশিক্ষণ স্থির থাকে না। অনুরাধার কথা মনে পড়ে। মেয়েটা বেঁচে থাকলে হয়তো নামকরা লেখক বা কবি হতো। তার কল্পনাশক্তি ছিল প্রবল। শ্রোতার মনের গতিবিধি আবেদ সামিরের চোখ এড়িয়ে যায়। কারণ মনোযোগটা তার মরিয়মের চেয়ে নিজের দিকেই বেশি। মনোয়ারা বেগম তার জন্য ভালোমন্দ রান্না করেন। সে বড় লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে ভাত খেয়ে হাত ধুয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে যায়।
এমন জীবনের কোনো গতি নেই। যেন পানাপুকুর, কচুরিপানা ঠেলে ঠেলে এগোতে হচ্ছে। মনোয়ারা বেগমের শক্তি ফুরোনোর সঙ্গে সঙ্গে অস্থিরতাও বাড়ে। তার স্বামী মানুষটা কেমন, পাক্কা পঁয়ত্রিশ বছর একসঙ্গে ঘর করেছেন, আট মাস পেরিয়ে গেল স্ত্রী ঢাকায়, এক লাইনের একটা চিঠিও লিখলেন না! মনোয়ারা বেগমের ‘৭৫ সালে মা হব না’ চিরকুটেরও জবাব দেয়নি লোকটা। এক্কেবারে গাইয়্যা ভূত, শহরের সূক্ষ্ম ব্যাপার-স্যাপার মাথায় ঢোকে না। মনোয়ারা বেগমের স্বামীর প্রতি বিরক্তির ভাবটা মরিয়মের ওপর পড়ে। তিনি কপট রাগ দেখিয়ে বলেন, ‘ক্যামন মাইয়্যা তুই, বাপের কোনো খবর নিস না। বাপ বাঁচল না মরল–দুই কলম লিখে ডাকে দিতে তোর ইজ্জত যায়?’
মরিয়মের তাতে ইজ্জত যায় না ঠিকই, তবে সে বাপকে দুই কলম লেখেও না। সময় কাটানোর জন্য মাকে খবরের কাগজ পড়তে বলে। একদিন বড় ধরনের বিপত্তিও ঘটে তাতে। পত্রিকায় সোনার মুকুট পরা পুত্রবধূর পাশে হাস্যরত বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে মনোয়ারা বেগম বিষণ্ণ হয়ে যান। বেঁচে থাকলে মন্টুর এত দিনে বিয়ের বয়স হতো। তাদের যা সামর্থ্য তা-ই দিয়ে তিনি ছেলের বিয়ে দিতেন। মুকুট না হোক, টিকলি কি গড়িয়ে দিতে পারতেন না ছেলেবউকে! যে ঘরে ঘরে দুর্গ বানাতে বলল, যার যা আছে, তাই দিয়ে যুদ্ধ করতে বলল, তার ছেলেমেয়ের তো কিছু হলো না। কী নিষ্ঠুর! এখন নিজের ছেলে বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ এনেছে। মনোয়ারা বেগমের আহাজারি আর থামে না। থেকে থেকে শুধু বলেন, ‘এইডা কী অইলো মরিয়ম? এক যাত্রায় পৃথক ফল! কে মরলো আর কে ফল ভোগ করছে এই মুক্তিযুদ্ধের? বৃষ্টি ছাড়ক। ৩২ নম্বরে গিয়া শেখের ব্যাটা শেখেরে আমি কথাডা জিগাইয়্যা ছাড়ুম।’
মায়ের মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে–মরিয়ম ভাবে। তা না হলে এমন উদ্ভট চিন্তা করেন কীভাবে। রাজা-প্রজা কখনো এক হয়? একদিন তার নিষেধ সত্ত্বেও মনোয়ারা বেগম বৃষ্টি মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। যাচ্ছে যাক, পেছনে মরিয়ম গজগজ করে, দারোয়ানের গলাধাক্কা খেয়ে যখন ফিরে আসবে, তখন টের পাবে। এমনকি প্রেসিডেন্টের বডিগার্ডের হাতে বন্দি হওয়াও আশ্চর্যের কিছু নয়। সন্ধ্যায় আবেদ সামির মরিয়মের মুখে খুঁটিনাটি বৃত্তান্ত শোনার আগেই বলে, সে আজ বিকালে বাহাদুর শাহ পার্কে টিয়া পাখি দিয়ে ভাগ্য গণনা করাতে দেখেছে মনোয়ারা বেগমকে। লজ্জা পাবেন ভেবে, সামনে যায় নাই সে।
বাহাদুর শাহ পার্ক! সে তো বহুদূর। মা বাড়ি চিনে আসতে পারবেন তো? মরিয়মের মাথায় হাত। আবেদ সামির সাহিত্য পাঠের বদলে সেদিনের কাগজটা খুলে জোরে জোরে পড়তে শুরু করে–
সদরঘাট, বাহাদুর শাহ পার্ক, বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউ, গুলিস্তান, ফার্মগেট। ভাগ্য গণনা আর হস্তরেখার ফলক টাঙিয়ে, জীর্ণ মলাটের কিছু বই সামনে নিয়ে টিয়ে পাখি হাতে ফুটপাতে বসে পড়েছে গণকরা। হস্তরেখা ও কোষ্ঠি বিচার করে ফাড়া কাটানোর জন্য মাদুলি, কবচ, রঙিন পাথরের আংটি ধারণের পরামর্শ দেন। টিয়াপাখির মাধ্যমে ভাগ্য পরীক্ষা করা আরো সহজ। চারটা পোষমানা টিয়া পাখি সাজানো খাম থেকে একটি খাম ঠোঁট দিয়ে টেনে আনে। সেই খামের ভিতর ছাপানো অক্ষরে ভাগ্যলিপি লেখা আছে। গোলকধাঁধার এই গোলকে ভাগ্যের গোল চাকাটা গন্তব্য খুঁজে পায় না।
আবেদ সামিরের পড়া শেষ হতেই মনোয়ারা বেগম বাড়ি ফিরে আসেন। তাদের দিকে ফিরেও তাকান না। অন্য দিনের মতো ভালোমন্দ রান্না করা দূরে থাক, নিজের ঘরের দুয়ার দিয়ে শুয়ে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে সামির সটকে পড়ে। মরিয়মেরও রাতে খাওয়া হয় না। মা সেই যে বিছানা নিয়েছেন, ওঠার নাম নেই। কী হলো তার? গণক কী বলেছে যে, মা শয্যা নিলেন? নয়-ছয় ভাবতে ভাবতে মরিয়মের তন্দ্রা ভাব হয়তো খানিকটা এসেছিল। মনোয়ারা বেগম মাঝরাতে তাকে ডেকে তোলেন। আবার শুরু হচ্ছে রাতের নাটক। এখন সংলাপ যা বলবেন, তার শৈশবে দেখা কোনো যাত্রাপালার।
মরিয়মের নানার বাড়ির কাছেই ছিল বিরাট গরু-ছাগলের হাট। শীতের মৌসুমে যাত্রার পার্টি এসে তাঁবু ফেলত ওখানে। যাত্রা দেখতে দেখতে মা বলেন, আমি বালেক অইলাম। ঋতুস্রাব হওয়ার পর যাত্রাপালা দূরে থাক, ঘরের বাইরে উঁকি দেওয়ারও অনুমতি ছিল না। মনোয়ারা বেগম পর্দার ঘেরাটোপে বন্দি হলেন। সেই সঙ্গে তাঁর পাঁজরের গ্রিলে চিরতরে আটকে গেল অতীতে দেখা যাত্রাপালার অগণিত সংলাপ। বুকে কান পাতলে শোনা যায় ধুকপুক করে হৃৎপিণ্ডের তালে তালে তিনি এখনো রিহার্সেল করছেন। সময় সময় রাত গম্ভীর হলে বহুদিনের অশ্রুত সংলাপগুলো। পর্দানশিন মহিলার মতো লোকচক্ষুর আড়ালে বেরিয়ে আসে। সে সময় বাতি জ্বালানো একদম পছন্দ করেন না মনোয়ারা বেগম। আজকেও রাতের অন্ধকারে মেরির শিথানে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘মরিয়ম, আমি মা ভিখারির অধম। আমার যা আছিল, সব তোরে দিছি–সাধ্যের বাইরেই দিছি। বাকিডা তোর নিজের হাতে।’
কাপড়ের তলা থেকে দোমড়ানো-মোচড়ানো বাড়ির দলিলটা মেয়ের হাতে দিয়ে বলেন, ‘বোকামি করিস না, মা। আল্লাপাক বোকা মাইয়্যামানুষ পছন্দ করেন না। পুরুষলোকেরে মন দিলেও দলিল দিবি না। এইডা তোর। একান্তই তোর–মনে রাখিস।’
মরিয়মের ঘুম ছুটে গেছে। মা তাহলে চলে যাচ্ছেন! কোথায়? কথাবার্তায় মনে হয়, রাজা হরিশচন্দ্রের মতো ধন-দৌলত বিলিয়ে সংসারত্যাগী হবেন! রায়েরবাজারের বাড়িটা মায়ের নামে, মরিয়ম জানে। কিন্তু লিখে-পড়ে না দিয়ে শুধু দলিলটা মেয়ের হাতে দিলে কী লাভ। মা হয়তো অতীতের কোনো যাত্রাপালায় দোমড়ানো-মোচড়ানো ময়লা কাগজ হস্তান্তর করতে দেখেছেন। তবে এ নিয়ে কথা বলতেও তার ইচ্ছে করে না মাঝরাতে। মা যে চলে যাচ্ছেন, এটাই দুঃস্বপ্ন। মধ্যরাতে স্বপ্ন কি দুঃস্বপ্নই হোক, কথা বলতে গেলে গলা থেকে আওয়াজ সরে না। মেরি অস্ফুটস্বরে জড়িয়ে জড়িয়ে জিগ্যেস করে, ‘এত যে তড়পাইতাছে, যাইবা কই?’
উত্তরটা সরাসরি দিতে বোধ করি মনোয়ারা বেগমের সংকোচ হয়। তিনি ঘুরিয়েপেঁচিয়ে বলেন, ‘তোর বাপ একটা পাগল-ছাগল। এই আট মাসে ঘরদোরের কী হাল হইছে কে জানে। তোরে ছাড়া আমার তো আরো দুইডা মাইয়্যা আছে। তোর বাপ চিডির জবাব না দেইক, অদের আমি দেখভাল না করলে কে করবে, মরিয়ম?’
অহ, এই কথা? আট মাস ধরে যে মেয়েরা একবারও মায়ের খবর নিল না, তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব এখন তার! মা আসলে জাতে মাতাল তালে ঠিক। আর মনোয়ারা বেগমের মতে, মেরি হচ্ছে এক নম্বরের স্বার্থপর । যমজ দুটিকে এত দিন সে তার প্রাপ্যের ভাগীদারই শুধু ভেবেছে, নিজের ছোট বোন বলে মনে করেনি। এই বয়সে তারা স্বাবলম্বী হয় কী করে, দশ বছরের বড় বোন যেখানে গলাপানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে! রাতের অন্ধকার দুজনকে এর চেয়ে বেশি বিবেচক হতে দেয় না। মা-হীন বাড়িতে নিজের ভবিষ্যৎ দিনগুলোর কথা ভেবে মরিয়ম শিউরে ওঠে। নিপ্রদীপ ঘরে চাঁদের আলো পড়ায় মায়ের ভোলা চুল আর মুখের একপাশ আভাময়। তিনি নিস্পন্দ। মরিয়মের চোখের সামনে এই যে ভূতুড়ে কায়া কাল থেকে তা-ও থাকবে না। জনমনিষ্যিহীন বাড়িতে সে একা। মেশিন থেকে মাথা তুললে হাস্নাহেনার ঝোঁপটাই শুধু চোখে কাটার মতো বিধবে। শব্দ বলতে মেশিনের একঘেয়ে ভনভনানি, চাপকলে পানি তোলার ঘটর-ঘটর আওয়াজ। পড়শিরা কাস্টমার মারফত অচিরেই জেনে যাবে, যে বাঁশঝাড়অলা বাড়িটায় এত দিন মা-মেয়ে বাস করত, ওখানে এখন শুধু মেয়েটা থাকে। এ সেই মেয়ে, যে একাত্তরে যুদ্ধ লাগার সময় বাড়িটাতে একা ছিল।
‘প্লিজ মা, আর দুইডা দিন থাকো।’ মরিয়ম মায়ের হাত ধরে। ঠান্ডা কম্পমান হাত–মা-মেয়ে দুজনেরই। মা হাত আলগা করে গুটিয়ে নেন। মেয়ে নাছোড়, ‘মা, আমি আব্বারে লিখি! হে আইস্যা তোমারে নিয়া যাবে!’
‘আমি কি কচি খুকি, মরিয়ম? তোর বাপেরে ছাড়া বাড়ি যাইতে পারি না? বাড়ি কি হের একলার? আমার হক নাই কোনো?’
এতগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে! মরিয়ম বুঝতে পারে না, আর কীভাবে মিনতি করলে মা যাবেন না–থাকবেন। সে মায়ের ঠান্ডা হাত দুটি অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায়। মুখে বারবার বলে, ‘আর দুইডা দিন থাকো না মাপ্লিজ, থাকো না মা…।’ মনোয়ারা বেগম এলোচুল টেনে হাতখোঁপা বাঁধেন। ‘বাধা দিস না মরিয়ম, মা কারো আজীবন থাহে না, তুই একলা হইছস নিজের কপাল দোষে, আল্লার দোহাই–আমারে যাইতে দে,’ কথাগুলো বলতে বলতে নিজের ঘরে চলে যান। কী নিষ্ঠুর, কী ঔদ্ধত্য! এমন মা যার, তার কপালে দুঃখ থাকবে না তো সুখ থাকবে? বাকি রাতটা মরিয়ম মেঘের আড়ালে চাঁদের লুকোচুরি দেখতে দেখতে পার করে। তারপর আরো এক পক্ষকাল চাঁদ সাক্ষী মেনে মেয়ে সওয়াল-জবাব করে মায়ের সঙ্গে, ‘মা কারো আজীবন থাকে না–মানি। কিন্তু আমার কপালের দোষ কে খণ্ডাবে, মা? আমি যে আর একা থাকতে পারছি না!’