২২. ফেরা

ফেরা

রিকশা থেকে মরিয়মের একা নেমে আসাটা মনোয়ারা বেগম রান্নাঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। চুলার আগুনের তাপে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। হঠাৎ হাতের খুন্তিটা মাটিতে পড়ে যায়। মরিয়ম উঠানে দাঁড়িয়ে ডাইনির মতো হাসে। মা বিচলিত। সারা দিন এক হাতে চোখ মুছে আরেক হাতে রান্না করেছেন। শেষবার মেরি যখন বাড়ি আসে, সঙ্গে মন্টু ছিল। এবার নিজের নয়, পরের ছেলের আসার কথা। সে জামাই তো। তাই ভালো-মন্দ রাঁধছিলেন। সে-ও আসবে বলে এল না। ঘরের বেড়ায় ঠেস দিয়ে খুন্তিটা মাটি থেকে তুলতে তুলতে তিনি মেয়েকে শুধান, ‘জামাই কই, মরিয়ম? তুই একলা আইলি যে বড়! মেরি তৈরিই ছিল। তার বাড়ি ফেরার ছাড়পত্র মমতাজের জন্য। কিন্তু লোকটা আসেনি। আসবেও না কোনো দিন। দু’দিন আগে-পরে সবাই যা জানতে পারবে, আজ নিজের মাকেও তা বলা যায় না। রত্না-ছন্দা দুই আমন্ত্রণকারী, ছুটে এসে রিকশা থেকে সুটকেস নামায়। মরিয়ম তাদের শেষবার দেখেছে হাফ প্যান্ট পরা, খালি গায়। এখন ব্যালবটম পায়জামা, খাটো কামিজ আর চুলে ঝুঁটি বেঁধে তারা জানতে চাচ্ছে, ‘দুলাভাই কই, মেরিবু? কী ব্যাপার, গরিবের বাড়ি অপছন্দ নাকি সাহেবের?

যমজ কিশোরীরা টেক্কা দিয়ে মরিয়মের সামনে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করছে। শহর তো দূরস্থ, একটা পাকা সড়ক থেকেও তাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল বিশাল এক জলাভূমি। হালের মেলবন্ধন-ভুখা মানুষের তৈরি মাটির রাস্তা। সেই সুবাদে ব্যালবটম, খাটো কামিজের চলতি ফ্যাশন। বাড়তি সাজসজ্জা মায়ের পেটের এমন এক বোনের আগমন উপলক্ষে, যে তাদের অচেনা। দেখা-সাক্ষাৎও হয়নি বিশেষ। যমজদের বুঝ হওয়ার আগেই মরিয়ম ঢাকায় নির্বাসিত। তারা বড় হয়েছে অচেনা বড় বোনের ভালোমন্দ কাহিনি শুনতে শুনতে। মা : বইনের স্বভাব পাইছ! কথায় কথায় রাগ করো! বায়না ধরো! বড় চাচি : ওড়না বুহে থায় না, ইক্কিরে মেরির স্বভাব। খেলার সঙ্গীরা : ঘর পালানির বইন, অহ, ঘর পালানির বইন। মিলিটারি তোর দুলাভাই, যাইবি কই পাকিস্তান (কোরাস)। নোয়াখালী থেকে আগত স্কুলের মৌলবি স্যার : তোর বইনের লাহান অইলি না কিল্লাই? হেতি সব কেলাসে ফার্স্ট অইতো! গ্রামের লোকজন : যমইক্কারা ঘোমটা ছাড়া ইস্কুলে যায়। বইনের লাহান দুনিয়া এক করব।

অবশ্য মরিয়মের বিয়ের খবর রাষ্ট্র হওয়ার পর, গত ছয় মাসে গাছের পাতাও বাতাসে নড়া বন্ধ। মা থেকে থেকে শুধু বড় মেয়ের শিশুকালের গল্প বলেন। কবে দাঁত পড়ে দাঁত উঠল। গোসল করাতে নিলে দু’হাতে খালি পানি ছানত, খালি পানি ছানত। হাসলে ছোট থাকতেই গালে টোল পড়ে তার বড় মেয়ের। হায় আল্লা, শাশুড়িআম্মা তো পাগল ছিলেন! কোলে বসিয়ে ঠাট্টা করতেন–অহ্, কফি! তোর মাইয়্যার দি। হাসলে গালোত টোল পড়ে! বড় অইলে ছিনাল অইব। আব্বা হাসতেন। যমজেরা বড় বোনের রূপ-গুণের ছিটেফোঁটাও যে পায়নি, এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর দুঃখ আর ধরে না। এখন উপায়? যার জন্য এত আয়োজন-আদিখ্যেতা, সেই জামাইতো এল না!

মরিয়ম যমজদের ছেড়ে রান্নাঘরে দৌড়ে যায়, মা, মাগো। আমি আইছি। ইশ, কত দিন পরে মা! তোমার জামাই ব্যস্ত মানুষ। খালি কাজ আর কাজ। একদম সময় পায় না। মনোয়ারা বেগমের শরীরটা যেন গাছের খোড়ল থেকে সদ্য পড়া পাখির ছানা। তিরতির করে কাঁপে। তার কম্পন থামাতে শিশুর মতো মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মরিয়ম।

কফিলউদ্দিন আহমেদ দূর থেকেই দেখেছেন, সুন্দরীর জলার ওপর দিয়ে মেরি রিকশা করে আসছে। সঙ্গে জামাই নেই। তিনি কাছারিঘরের বারান্দায় আর দাঁড়িয়ে না থেকে নিঃশব্দে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। মা-মেয়ের টুকরা-টাকরা কথাবার্তা আর কান্নাকাটির পর মরিয়ম ঘরে ঢোকে। সব শুনেও না-শোনার ভান করে আব্বা অবেলায় শুয়ে আছেন বিছানায়। তবে তার পায়ের পাতা জোড়া লুঙ্গির বাইরে, নাঙা। মেরি পা ছুঁয়ে সালাম করতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসেন। মেয়ে খাটের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। পিতা পালঙ্কে আসীন। দুজনেরই চোখ জানালাপথে বাইরে–দূরে। যুদ্ধের দমকা হাওয়ায় তাদের জীবন ওলট-পালট হয়ে গেছে। কারো মুখে কথা নেই। তারা বাইরে তাকিয়ে গোধূলির ম্লান আলোয় কী যেন খোঁজে। সন্তানদের সঙ্গে কফিলউদ্দিন আহমেদের সম্পর্কটা অদ্ভুত। ভালো সময়ও কে কী নিয়ে কথা বলবে বুঝতে পারে না। রত্না হারিকেন হাতে ঘরে ঢুকতে নীরবতায় ছেদ পড়ে। ‘রাত না অইতে বাত্তি কা?’ আব্বা তেড়ে ওঠেন, নিবা নিবা! কেরোসিনের যা দাম! এরপর মাগরিবের আজান, পড়ার আগ পর্যন্ত তিনি মরিয়মের সঙ্গে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, শেখ সাহেব যে একজন অযোগ্য শাসক এ নিয়ে কথা বলে, মাথায় টুপি চড়িয়ে মসজিদে চলে যান।

যুদ্ধ নিয়ে পরিবারের পাঁচজন প্রাণী কেউ কথা বলে না। গাঁয়ের লোকেরা মরিয়মকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে বাড়ি চলে যায়। কয়েকজন আবার উঠানের মধ্যিখানে হাঁটু ভেঙে ঠায় বসে থাকে। মনোয়ারা বেগম বাসি বা টাটকা যে-কোনো খাবার সাধলেই নিঃশব্দে মাথা দোলায়। মরিয়মের ব্লাউজের কাট, শাড়ি পরার শহুরে ঢং, হাঁটাচলা, পরিষ্কার হাত-পা এসবই আপাতত তাদের কৌতূহলের বিষয়। কাপড়ের নিচের মিলিটারির অত্যাচার-খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখেও ঠিক আন্দাজ করা যায় না। তবে কলঙ্কের খবর–যা রটে তা বটেই।

মনোয়ারা বেগম সময়-অসময় কান্নাকাটি করেন। সবাই মনে করে, মেরিকে দেখে তার মন্টুর কথা মনে পড়ছে। কিন্তু ওই নাম এ বাড়িতে কখনো উচ্চারিত হয় না। গ্রামের টিনের দোচালা প্রাইমারি স্কুলটার নাম এখন শহিদ সাইফুদ্দিন আহমেদ ফুলতলি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মুখের জবান থেকে সরে সে জায়গা নিয়েছে এক টুকরা টিনের সাইনবোর্ডে। উপমন্ত্রী জিপে করে এসে তা উদ্বোধন করে গেছেন। সঙ্গে আসা মুজিব কোট পরা সদরের লোকগুলো মন্টুকে বাদ দিয়ে উপমন্ত্রীর নামে আসা যাওয়ার সারাটা পথ শ্লোগান দেয়। কফিলউদ্দিন আহমেদ রেগে টং। শহিদের পিতার নাম ডেকে কিছু বলতে বলা হলে মঞ্চে উঠে তিনি কাঁপতে থাকেন। সদরের অচেনা লোকগুলো ভাবে পুত্রশোক। স্বয়ং চিফ গেস্ট চেয়ার ছেড়ে উঠে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দেন। তখন খই ফোঁটার মতো কতগুলো হাততালি পড়ে। মাঝখানে শ্লোগানের যা ধুয়া ওঠে, সব উপমন্ত্রী আর বঙ্গবন্ধুর নামে। রত্না-ছন্দা হারমোনিয়াম বাজিয়ে দেশাত্মবোধক গান গায়–আমায় গেঁথে দেওনা মাগো, একটা পলাশ ফুলের মালা/ আমি জনম জনম রাখব ধরে ভাই হারানোর জ্বালা। গানটা পুরো গাওয়া হয় না। তারই শোকে কোকিল ডাকে, ফোটে বনের ফুল পর্যন্ত গেয়ে দু’বোন ওড়নায় মুখ চেপে মঞ্চ থেকে নেমে আসে। প্রতিবার রিহার্সেলেও তারা এইটুকুই গাইতে পেরেছে। স্টেজে বসে রুমালে চোখ মোছেন উপমন্ত্রী। কালো মুজিব কোট পরা পেঙ্গুইনের মতো লোকগুলো স্তম্ভিত। তারা বিলম্বে হলেও নেতার দেখাদেখি পকেট থেকে রুমাল বের করে। চোখে পানি নেই শুধু কফিলউদ্দিন আহমেদের। তিনি বাড়ি ফিরে দাদার আমলের উঁচু খাটে সটান শুয়ে পড়েন। টানা দু’দিন খাওয়াদাওয়া দূরে থাক, এক ফোঁটা পানি স্পর্শ করানো গেল না তাকে দিয়ে। মনোয়ারা বেগম চিন্তিত। কাছে গেলে স্বামী মুখ ঘুরিয়ে রাখেন। রাগ কমার পর কথা বলতে শুরু করেন থেমে থেমে। মরিয়মের মা, দেশটা রাজাকারে ছাইয়্যা গেল। মানুষ আর মানুষ নাই। সরকার যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করছে, কারে জিগাইয়্যা করছে? তোমার-আমার পারমিশন নিছিল শেখ মুজিব? মনোয়ারা বেগম ফ্যালফ্যাল করে স্বামীর মুখের দিকে তাকান। খবরের কাগজের সঙ্গে তার সম্বন্ধ নেই। ‘ইসব কী কন, কে কারে জিগ্যাইব, রাজা প্রজারে জিগায় কখনো? পাগল-ছাগলের কথাবার্তা!’ কফিলউদ্দিন আহমেদ চেতে আগুন, ‘তোমার মাথা আর আমার মুণ্ডুরে কই। অশিক্ষিত মাইয়্যা মানুষ!’

মরিয়ম একদিন স্কুল ছুটির পর রত্না-ছন্দার সঙ্গে মন্টুর নাম লেখা সাইনবোর্ডটি দেখতে যায়। স্কুলমাঠের ঘাসে বসে যমজ দু’বোন মেরিকে বলে, ‘তাদের আব্বা স্কুলের উন্নতির জন্য এখন মাসে মাসে টাকা দেন।’ মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলেন, ‘পোলাপানরে পড়ালেখা করাও গো। এইডা পুণ্যের কাজ। আখেরাতে ফল পাইবা।’ আখেরাতের চেয়ে তাদের দরকার ইহকালের সুখ-সুবিধার। বাপের সঙ্গে কামলা দিলে হাতে হাতে নগদ টাকা আসে। পরকালের ভাবনাচিন্তার সময় কোথায়। পুত্রহীন লোকটার কথা কেউ শোনে, কেউ শোনে না। আব্বার পীড়াপীড়িতে বয়স্করাও কিছু দিন খড়ের ব্যানা জ্বালিয়ে নাইট স্কুলে গেছে। আব্বা সরাসরি তদারক করতেন। নাইট স্কুলে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থাও করেছিলেন একটা হ্যাঁজাকবাতি কিনে দিয়ে। কিন্তু ছাত্রদের পান-জর্দা খাওয়া জিব সব মোটা মোটা। মাথায়ও পড়া ঢোকে না। ঢুকলেও অদৃশ্য ছিদ্রপথে বেরিয়ে যায়। জিগ্যেস করলে মস্ত বড় হাই তোলে। কেউ কেউ হ্যাজাকের শোঁ-শোঁ গর্জনে নাক ডাকিয়ে ঘুমায়। স্যারের অবস্থা শোচনীয়। বেত নিয়ে বসেও ছাত্রদের মারতে পারেন না। সবাই তার বাবার বয়সি। স্যার ছিলেন অবৈতনিক। তিনি হাল ছেড়ে দিলেন।

রত্না-ছন্দা, তারা যার সুনাম কি দুর্নাম কোনোটারই সমকক্ষ নয়, এমন বোনের সঙ্গে কথা বলে বলে অন্তরঙ্গ হতে চায়। মরিয়ম ধরা দেয় না। তার মনোযোগ অন্যত্র । সে খেয়াল করে, কফিলউদ্দিন আহমেদ মমতাজের চিঠির জন্য রোজ একবার করে সদরে যান। আরো ক্লান্ত আরো অবনমিত হয়ে বাড়ি ফেরেন। বাড়ির কেউ কিছু মুখ ফুটে বলার আগে মরিয়মের ঢাকা চলে যাওয়া উচিত। সেই দিনটা বেশি দূর নয়। কিন্তু ঢাকা গিয়ে উঠবে কোথায়–পুনর্বাসনকেন্দ্রে নাকি বেশ্যাপাড়ায়?

চিন্তায় মরিয়মের রাতে ঘুম হয় না। খালি দুঃস্বপ্ন দেখে। কে যেন তার বুকের ওপর বসে হৃৎপিণ্ডটা চাপছে। লোকটার মুখ দেখা যায় না। চোখ দুটি বিড়ালের চোখের মতো জ্বলজ্বল করে। বুক থেকে গলার কাছে চলে আসে দুটি লোমশ হাত। আঙুলগুলো তামার আংটার মতো। গলা টিপে মারার চেষ্টা করছে। মরিয়ম চিৎকার করে–গলায় গরু জবাই দেওয়ার গোঁ-গোঁ আওয়াজ। কফিলউদ্দিন আহমেদ যখন কুড়াল দিয়ে দরজা ভাঙছেন, তখনো সে সমানে চিৎকার করছে। মনোয়ারা বেগম হারিকেন ধরে আছেন। রত্না-ছন্দা হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিছানার ওপর। মরিয়মের নাক দিয়ে মুখ দিয়ে গাঁজলা বের হয়। চোখ দুটি মরা মাছের মতো ওল্টানো, মণি দেখা যায় না এমন।

মাঝরাতে ডাক্তার ডাকাও সমস্যা। পরদিন এক কান থেকে দশ কান হবে। কফিলউদ্দিন আহমেদ নিজের ঘুমের ওষুধ মেয়েকে খেতে দেন। দিনের বেলা একই চিকিৎসা চলে। এদিকে মরিয়মের গায়ে একশ চার ডিগ্রি জ্বর। রাতের বেলা ঝাড়ফুঁক আর পানিপড়া দিতে একজন দরবেশ আসেন। বড় চাচি তহুরা বেগম নিজেও তুকতাক জানেন কিছু। দরবেশ বিদায় নিলে তিনি রোগীর শুশ্রূষায় নেমে যান। দোয়া পড়ে পড়ে রোগীর জ্বরতপ্ত শরীরে ফুঁ দিচ্ছেন। অন্যদিকে ঘন-ঘন কপালের জলপট্টি বদলাতে হচ্ছে। লোমশ দুটি হাত কুপির আলোয় কেঁপে কেঁপে গলার ওপর দিয়ে কপালে উঠে যায়। মরিয়ম খপ করে ভিজা ত্যানাসহ হাতটা ধরে ফেলে। একদিকে চাচি চিল্লাচ্ছেন, আরেক দিকে মরিয়ম। রোগীর কথা অস্পষ্ট। তবে বোঝা যায়, জীবন গেলেও সে হাত ছাড়বে না। চাচির মুখটা কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। তিনি ছাড়া পাওয়া মাত্র ঘর ছেড়ে দৌড়ে পালান। রত্না-ছন্দা পেছনে মুখ টিপে হাসে–কি, শাস্তিটা কেমন হলো? বুক থেকে ওড়না সরে গেলে কিছু বলতে আসুক, তারা বড় বোনকে লেলিয়ে দেবে। মেয়ে দুটির শরীরে মায়াদয়ার বালাই নেই। বয়সটাই হয়তো এমন।

মরিয়মের জ্বর নেমে গেছে। তখনো দুর্বলতা কাটেনি। ভোরবেলায় বাজ পড়ার শব্দে তন্দ্রা ভাঙে। সকাল থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। ওর ইচ্ছার সঙ্গে সায় দিয়ে সমস্ত দিন একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ে। রাতে, তারপর দিন, তারপর দিন। লাগাতার বৃষ্টি। মহাপ্লাবন আসন্ন। পৃথিবী ভেসে যাক। নুহ নবি ডিঙা নিয়ে হাজির হলেও মরিয়ম ডাঙা ছাড়বে না। সবার সঙ্গে ভেসে যাওয়ার এ সুবর্ণ সুযোগ। কফিলউদ্দিন আহমেদের সদরে যাওয়া বন্ধ। জামাইয়ের চিঠি না আসার দুঃখ নেই। পিয়নও তো রক্তমাংসের মানুষ। বৃষ্টি থামার আগ পর্যন্ত না-পাঠানো চিঠিগুলো ডাকবাক্সেই নিরাপদে থাকুক। মরিয়ম বহুদিনের অনিদ্রা আর জ্বরের পর রাতদিন ঘুমাচ্ছে। বৃষ্টি আর ঘুম। ঘুম আর বৃষ্টি। তার ঘুমন্ত চেতনায় বৃষ্টি হোসপাইপ দিয়ে আশীর্বাদ বর্ষণ করে।

মনোয়ারা বেগমের ধাক্কাধাক্কিতে মরিয়ম একদিন সত্যি সত্যি জেগে ওঠে। মাঝখানে কত দিন কত রাত চলে গেছে হিসাব নেই। মাথার কাছের জানালা খুলে দিয়ে মা খুশিমনে মেয়েকে সুন্দরীর জলাটা দেখান। বন্যার পানিতে তা এখন সমুদুর। রাস্তার চিহ্নমাত্র নেই। ‘মরিয়ম, জামাই কেমুন বোকা মানুষ, দ্যাখ।’ মা হাসতে হাসতে বলেন, ‘খরা থাকতে আইলো না। দুনিয়া অহন ভাইস্যা যাচ্ছে, আইবো ক্যামনে?’ রত্না-ছন্দা বৃষ্টির পানিতে বই-খাতা ভিজিয়ে বাড়ি ফিরেছে। স্কুল পর্যন্ত যেতে পারেনি। তারাও খুশি, ‘মেরিবু কী মজা! দুলাভাই পানি না কমলে আসতে পারবে না। তোমারও ঢাকা যাওয়া বন্ধ। কফিলউদ্দিন আহমেদ মৃদু হেসে দলে যোগ দেন। মেরি ছাড়া বাকি সবাই এখন বিশ্বাস করে, জামাই ঢাকা থেকে আসতে পারছে না, কারণ ফুলতলি গাঁয়ে আসার সব কটা রাস্তাই জলে নিমজ্জিত। এ তাদের তৈরি বিশ্বাস। যে বিশ্বাসের জোরে মৃত্যুর বছর খানেক পরও মন্টু তাদের মাঝে বেঁচে ছিল।

কফিলউদ্দিনের ভিটেবাড়িটা সাগরের বুকে জাহাজের মতো ভাসছে। জলের সীমাহীন বিস্তার তাই অক্লেশে দেখা যায়। আউশ ধান খোসার ভেতর দুগ্ধাবস্থায় তলিয়ে গেছে। দুর্ভিক্ষ আসন্ন। এটা ভাববার বিষয় এই পরিবারেরও। কফিলউদ্দিন আহমেদ যুদ্ধের পর ঘরে কিছু গচ্ছিত রাখা পারত পছন্দ করেন না। তাতেও তার হিসাব আছে। মানুষ সঞ্চয় করে পুত্রসন্তানের জন্য। কন্যারা আজ বাদে কাল চলে যাবে অন্যের বাড়ি। তার দান-খয়রাত তাই মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন ঘরে সম্বল বলতে মাটির এক মটকা চাল, গোবর লেপা বাঁশের ছোট ছোট ডুলিতে আগামী মৌসুমের কয়েক পদের বীজধান। মনোয়ারা বেগম বড় মেয়ের সঙ্গে উৎকণ্ঠা ভাগাভাগি করতে চান। কারণ স্বামীকে এসব বলে ফায়দা নেই। মানুষটা মন্টুর নিখোঁজ হওয়ার পর দিন-দুনিয়া থেকে আলগা হয়ে গেছে। যে জায়গাজমির ভার কফিলউদ্দিন আহমেদ আর বইতে পারছেন না, তা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ায় তাকে খুশি খুশি দেখায়। একদিন জাহাজের ডেকের মতো বসতবাড়ির কিনারায় দাঁড়িয়ে মেরিকে তিনি তর্জনী তুলে নিজের জমিজমার সীমানা দেখান। পানির নিচের সম্পত্তির হিসাব। ব্যাপারটা পাগলামি। সে ভয়ে ভয়ে আব্বার হাতের স্খলিত চামড়ার ভাঁজ লক্ষ করে। উদ্যত অঙ্গুলি বাতের রোগীর মতো কাঁপছে। সব আমার! অপরাজেয় নাবিকের জলদগম্ভীর কণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করেন। সাগরের ঢেউ আরো উত্তাল হয়। দীর্ঘ সামুদ্রিক ভ্রমণের পর বৃদ্ধ নাবিক জাহাজভর্তি মণিমুক্তা হারিয়ে যেন। স্বদেশে ফিরছে। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যু।

সেই রাতে মা চুপিচুপি বিছানা ছেড়ে উঠে আসেন। ‘মরিয়ম উঠ-উঠ। কী মরার মতো ঘুম মাইয়্যার! আমার যে কেয়ামত অইয়্যা গেল মা। আমি আর পারছি না।’ মনোয়ারা বেগম মেয়ের সামনে বসে খনখনে গলায় কথা বলেন। পাশের ঘরে ছোট মেয়ে দুটি ঘুমাচ্ছে। পাতলা মশারির মতো চারপাশ আবছা অন্ধকার। মা সতর্কতার সঙ্গে এদিক-ওদিক তাকান। ‘তোর বাপ বাঁচবে না, মা।’ মায়ের গলার স্বর খাদে নামে, ‘পুত পুত করে লোকটা শেষ অইয়্যা গেল। আমি চাই–হে আবার শাদি কইর‍্যা পোলার বাপ হউক।’ মেরি চমকে উঠে বাধা দেয়, ‘না, আম্মা না, এসব কী বলেন, ঘুমাতে যান তো!’ মা থামেন না। ‘আমারে বলতে দে। কথার মাঝখানে হামলাইয়া পড়স ক্যা? আমার অ্যাম্নেও শেষ, ওমেও শেষ। বিয়া করতে চাইলে আমি হ্যাঁরে বাধা দিব না, মরিয়ম।‘’ মেঘভরা আকাশটা আরো ভারী হয়ে তাদের মাথার ওপর নেমে আসে। বজ্রনিনাদে তোলপাড় হয়।’ সব নিরানন্দ, বিস্বাদ। মা-মেয়ে মুখোমুখি। মনোয়ারা বেগমের কথা শেষ হয় না। ‘তুই না কইলে কী, আমি মা, আমি তোর কষ্ট জানি। কপাল একবার ভাঙলে মা গো, আর জোড়া লয় না। কান্দিস না, মরিয়ম। পানি নামলে পর তুই চইল্যা যা। ঢাকার বাড়ি দখল নে। তোর বাপ জাগা-জমি শ্যাষ কইর‍্যা তই কবরে যাইব।’

সকালে মায়ের দিকে তাকিয়ে মরিয়মের মনে হয়, গত রাতের কথাগুলো ছিল তার প্রলাপ। তিনি কলাপাতা মাথায় দিয়ে তুমুল বৃষ্টিতে এঘর-ওঘর করছেন। তার হাঁকডাক বর্ষণের একঘেয়ে শব্দ ছাপিয়ে কানে বেঁধে। ভেজা পাটখড়ি আর চ্যালাকাঠ দিয়ে রান্না করেন দিনের অর্ধেক সময়। চুলায় লম্বা ফুঁ দিয়ে, মরিয়ম ভাবে, তিনি আসলে দমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে চাচ্ছেন। এ বাড়িতে রত্না-ছন্দা ছাড়া তারা তিনজনই একপ্রকার মৃত। জীবিত মানুষের চরিত্রে জনসমক্ষে অভিনয় করছে। কিন্তু অভিনয়ই তোক আর বাস্তবই হোক বেঁচে থাকলে মানুষের খেতে হয়। বীজধানের ডুলি একে একে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। অগত্যা কামলা ছেলে দুটি বুকে কলসি বেঁধে পানির তল থেকে ধানের ছড়া তুলে আনে। মুগুর দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে শিষ থেকে ধান ছাড়ায়। মেরি আর মনোয়ারা বেগম অপুষ্ট ধান টিনের পাত্রে ছড়িয়ে দিয়ে চুলার ওপর নেড়েচেড়ে গরম করে। তারপর মুষল দিয়ে পাড় দিতে দিতে একসময় এ থেকে চাল না, খুদ বেরোয়। তাই দিয়ে থকথকে জাউভাত, সারা দিনের খাবার। প্রত্যেক বেলায়। তাতে ভাগ বসায় গলাপানি ভেঙে হেঁচোড়-পেঁচোড় করে আসা গায়ের দু-চারজন অনাহারী মানুষ। এ প্রক্রিয়ায় আহারের সংস্থান করতে চ্যালাকাঠ, পাটখড়ি ফুরিয়ে গেলে মা-মেয়ে রান্নাঘরের খুঁটি উপড়ে ফেলে, চালের ছন টেনে টেনে চুলায় দেয়। ধান ভানার বড় ঢেঁকিটাও তাদের কুঠারাঘাত থেকে রেহাই পায় না। এভাবে আগুন জ্বেলে, মাথার ওপরের ঠাই আর নিত্য ব্যবহার্য জিনিস ধ্বংস করে, বীজের ধান চাল করে ভাত রাঁধতে রাঁধতে দুজন নারী একে অন্যের খুব কাছে চলে আসে। তাদের চাওয়াগুলোও এক। বাঁচার উপায়ও অভিন্ন। যা অনিবার্য, যা রোধ করা যাবে না, তা আগলে রেখে কী লাভ। মরিয়মের মনে হয়, যুদ্ধের পর সে এই প্রথম একজন যথার্থ বন্ধু পেল। যার অবস্থা তারই মতো। দুজনের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। হাত পেতে কারো কাছে কিছু চাওয়াটাই বিড়ম্বনা, মিথ্যা আশ্বাস আরো ভয়ংকর–মা হাতে-কলমে মেয়েকে এই শিক্ষা দিচ্ছেন।

পেছনে পলিমাটি রেখে বন্যার পানি তরতরিয়ে নেমে গেছে। সেই নরম মাটির ওপর নিঃশব্দে পা ফেলে আসে দুর্ভিক্ষ। ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ তোবড়ানো বাটি আর মাটির সানকি হাতে খিদার ঘোরে অন্ধের মতো ঘুরছে। কফিলউদ্দিনের ভিটেয় সারা দিন তাদের আনাগোনা। ভাত চাই, ফ্যান চাই কলরব। একজনের পাতে ফ্যান-ভাত দিতে-না-দিতে মানুষ আর কুকুরে কামড়াকামড়ি বেধে যায়। কফিলউদ্দিন আহমেদ বগলে ছাতা নিয়ে হয় সদরে যান খবরের কাগজ পড়তে, না হয় বাড়ি বসে স্বাধীনতার শাপান্ত করেন। তার ছেলে আস্ত একটা গাধা। এমন স্বাধীনতার জন্য কেউ জীবন দেয়! পঞ্চাশ সনের দুর্ভিক্ষের কথা ভেবে, তার চোখ দুটি জ্বালা করে। সেই বছর তার পাগল মা ছেলেকে শামুক-গুগলি তোলার জন্য অঠাই পানিতে নামিয়ে দিয়েছিলেন। মৃত্যুর সঙ্গে সেই তার প্রথম সাক্ষাৎ। ডুবতে ডুবতে খালি হাতে ভেসে উঠলে মা তীর থেকে মাথায় লাঠির বাড়ি মারতেন। এক জীবনে দু-দুটি দুর্ভিক্ষ! একটা করল ব্রিটিশ সরকার আর অন্যটা ডেকে আনল চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। গরিব নিরন্নের ওপর ধনী রাষ্ট্রের কী নির্মম জুলুম! এদিকে মনোয়ারা বেগমের পাগল পাগল ভাব। স্বামী-সন্তান নিয়ে খেতে বসলে কঙ্কালসার হাতগুলো জানালা-দরজায় নিঃশব্দে সানকি বাড়িয়ে দেয়। তাদের চোখ মৃত। পেটের খাঁচা ডেবে পিঠের চামড়ার সঙ্গে মিশে গেছে। মুখে রা করার শক্তি নেই। রাতের বেলায় উঠানে-বারান্দায় এমনভাবে পড়ে থাকে যে, ভয়ে পা ফেলা যায় না।

এমন এক রাতে বাড়িভর্তি মানুষের ভেতর মনোয়ারা বেগম আবার চুপিচুপি বিছানা ছেড়ে উঠে আসেন। মেরি জেগেই ছিল। মায়ের হাতের ধাক্কায় উঠে বসে। ‘তুই এহানে আর থাকিস না মা। কালই চইল্যা যা।’

‘কেন মা?’

‘কথা বাড়াইস না মরিয়ম। নে ধর।’ মেরির দিকে এগিয়ে দেওয়া তার হাতের পুটলিটা অন্ধকারে ঝনঝনিয়ে ওঠে। ওজনে ভারী। মনোয়ারা বেগমের সব স্বর্ণালংকার এখানে। মেয়ে অবাক হওয়ারও সময় পায় না। মা প্রসঙ্গান্তরে চলে যান। ‘তোর বিয়েটা যে হাচা বিয়া না, আমি আগেই বুঝছি। এসব পাতানো খেলা। তোর বাপ। খবর শুইন্যা নাচ্ছে। আমার কথা কানে তোলে নাই। হায় রে, অভাইগ্যা মানুষ!’

যে স্বর্ণালংকার মন্টুর স্ত্রীর প্রাপ্য ছিল, রত্না-ছন্দার বিয়ের যৌতুক হতে পারত, সেগুলো এখন মরিয়মের বেঁচে থাকার পুঁজি। মনোয়ারা বেগম পুটলিটা মেয়ের হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘সাবধানে খরচ করবি। ছোট দুইডারে বঞ্চিত করে আমি তোরে দিলাম। তাতে কোনো দুঃখ নাই। অরা অগো মতো বাঁচব।’

তাদের বাঁচার সম্ভাবনা যে মোলোআনা, মায়ের মতো মেরিও তা বুঝতে পারে। মেয়ে দুটি বাঁচাল হলেও হিসেবি। মহুয়া হলে সিনেমা দেখার বদলে তারা সিনেমার কাগজ কিনে নায়ক-নায়িকার কেচ্ছা ঘরে বসে মুখস্থ করে। এদের চটকদার ছবি কেটে পড়ার ঘর সাজায়। বন্যা, দুর্ভিক্ষ, বাপের পাগলামি, মায়ের ধ্বংসযজ্ঞ, বড় বোনের দুর্ভাগ্য তাদের বিচলিত করে না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দুজনের মুখে কোনো প্রকার বাগাড়ম্বর নেই। একমাত্র ভাই যুদ্ধে শহিদ হবে–তারা যেন আগে থেকেই জানত। বড় বোনের অতীতের পথের খোদলগুলো তারা বাঁচিয়ে চলে। যতই ভঙ্গুর হোক পথ পথই। সেই পথে অঙ্কে লেটার মার্ক পাওয়ার মাইলফলক আছে। বীজগণিতের সূত্র মুখস্থ করার জন্য জসিমুল হকের অনুপ্রেরণার তাই তাদের দরকার হবে না। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পড়ার জন্য বিয়ে না-হওয়ার মতো কলঙ্কেরও তাদের প্রয়োজন নেই। বোন বিএ। তারা বিএ পাস করবে, এটাই স্বাভাবিক। মানুষ ভুল করলে, সেই ভুল শুধরাতে গিয়ে আরেকটা ভুল করে। তাদের জীবনে জসিমুল হক থাকছে না যখন, আবেদের মতো সুযোগসন্ধানী পুরুষও আসবে না। আর যুদ্ধ তো বছর বছর হয় না! প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর দ্বিতীয়টির মাঝখানে নয় নয় করেও সতেরো বছরের ফারাক ছিল।

যমজরা কোনোভাবে বড়বোনের মুখাপেক্ষী নয়। তারা তাকে কাছে টানার মতো দূরে ঠেলে দেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা রাখে। মরিয়ম চলে আসার দিন রিকশায় সুটকেস টেনে তোলা নিয়ে দু’বোনের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা হলো না। তারা ঘরের পাল্লা ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকল। তত দিনে দুজনই জেনে গেছে, বড় বোন দেউলিয়া, বিয়েটা তার ভেঙে গেছে। মরিয়মের জীবনের পরবর্তী অধ্যায় কারো কাছে দৃষ্টান্ত হতে পারে না। বোনের একের পর এক ব্যর্থতা তারা মনে রাখবে, কখনো সেসব নাগালে আসতে দেবে না। রত্না-ছন্দা দূরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে মরিয়মকে বিদায় জানায়।

কফিলউদ্দিন আহমেদ বানের পানি নেমে যাওয়ার পর থেকে বেশিরভাগ সময় সদরে কাটান। বাজারের চায়ের দোকানগুলো তার উপুড় করা ট্র্যাকের পয়সায় এত বড় দুর্ভিক্ষ সত্ত্বেও টিকে আছে। তিনি দফায় দফায় সেখানে জমি বেচা-কেনার পার্টির সঙ্গে দরদস্তুর করতে বসেন। কাপের পর কাপ ধূমায়িত চা ওড়ে। সঙ্গে নিমকি, গরম গরম জিলিপি। মেয়ের স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে শুনে বাড়িতে সেই যে মৌব্রত নিয়েছেন, মেরি চলে আসার দিনও তা ভাঙেনি। সকাল সকাল রঙচটা কালো ছাতাখানি বগলদাবা করে তিনি আজকেও সদরে গেছেন।

মনোয়ারা বেগম আগে থেকে কিছু জানান না দিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে মরিয়মের সঙ্গী হলেন। তাতে বাড়ির আধমরা আশ্রিতরা শুধু বিপদের গন্ধ পেল। অন্নদাত্রী বাড়ি নেই তো ফ্যানও নেই। যমজ মেয়ে দুটি তামাশা দেখা ছাড়া তাদের। কোনো কাজেই লাগে না। তারা ঝটপট যার যার থালা-বাটি গুছিয়ে নেয়। মা-মেয়ের খোলা ভ্যানের পেছনে লম্বা এক ভুখা মিছিল। যেন মনোয়ারা বেগম নেতৃত্ব দিচ্ছেন আর মিছিলটা যাচ্ছে রাজধানী অবরোধ করতে। তাদের পেছনে পড়ে থাকে একজোড়া। হতভম্ব মেয়ে আর তিনটা টিনের ঘর। কাঁচা ঘরগুলো ভেঙেচুরে চুলোয় দিয়ে মা-মেয়ে নিশ্চিহ্ন করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *