ভবিষ্যতের জল্পনা-কল্পনা
শ্যামলীর মুক্ত হওয়ার দিন অনুরাধা সারা রাত ঘুমাতে পারে না। মরিয়ম স্বপ্নের ভেতর অচেনা এক শহরের রাস্তা দিয়ে নগ্ন দেহে হেঁটে যায়। শোভা রানী দেখে, সে বিমল দাসের সঙ্গে গাড়িতে ঘুরছে। তাদের নিজস্ব গাড়ি–সাদা রঙের। বর্ণনাটা শোনার পর মরিয়ম বলে, শোভা রানীর স্বপ্নের গাড়িটার নাম ফক্সওয়াগন।
সেদিন ছিল ২৫ অক্টোবর ১৯৭১, সোমবার, টাইম ম্যাগাজিনের চাঞ্চল্যকর খবর-ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ৫৬৩ জন মেয়ের প্রত্যেকেই গর্ভবতী। তাদের গর্ভপাতের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। খবরটা বড় শ্যালক গোলাম মোস্তফার মুখে শোনার পর কফিলউদ্দিন আহমেদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তিনি মগবাজারের বাসার ড্রয়িংরুমের সোফা ছেড়ে কপালে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়েন। সেখান থেকে গোলাম মোস্তফার পা দুটির দূরত্ব মাত্র এক হাত। ফুলতলি থেকে এক দিনের পথ পাঁচ দিনে পাড়ি দিয়ে কফিলউদ্দিন আহমেদ গতকাল ঢাকা পৌঁছেছেন। উদ্দেশ্য, বয়সে আর সম্পর্কে ছোট হলেও শ্যালকের হাতে-পায়ে ধরে যদি মেয়েটাকে মুক্ত করা যায়। কিন্তু গোলাম মোস্তফা যত বার না-না করে মাথা নাড়েন, ততবার তার পদযুগল দোল খায় ডানে-বাঁয়ে। মুখে কিছু বলেন না। ফুলতলি, বল্লবপুর, নবীনগর, কোমলকান্দিসহ আশপাশের আট-দশ মৌজায় যার এত দাপট, ঢাকায় সে মশা মাছিরও অধম, এ কি বিশ্বাস করার মতো, না এ বিশ্বাস করা যায়? এমন কথায় গোলাম মোস্তফার মুখে হাসি ফোটে, দুলাভাই যে আমারে কী ভাবেন, তা কেবল আপনের খোদায় জানে।’ তবে শ্যালক-দুলাভাই দুজনেরই ধারণা, যে মেয়ে ঢাকা থেকে নিখোঁজ, সে যদি মরে গিয়ে না থাকে তো ওই সেনানিবাসেই আছে। সেখানে থাকার অর্থ তাদের অবিবাহিত মেয়েটা এখন গর্ভবতী এবং তার গর্ভপাতের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
ঢাকার সেনানিবাসে না থাকলেও মরিয়ম, অনুরাধা, শোভা রানী–এক কম্বলের নিচে এখন এই যে তিনজন, তিনজনই গর্ভবতী। এর মধ্যে গর্ভপাতের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে শোভা রানীর। তবে কফিলউদ্দিন আহমেদ বা গোলাম মোস্তফার মতো সে এ নিয়ে মোটেও ভাবিত নয়। সে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে গর্ভের সন্তানের নড়াচড়া তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। ‘মেরি দিদি, অনুরাধা দিদি তোমাগের হাত দুটি ইখানে থোও। বাচ্চাডা যে কি লাখোন লাথোয়, ভাষায় বুঝাতে পারি না। আমার স্বামীও খুব রাগী ছেল।’
শোভা রানীর আধো আধো আদুরে কথা অনুরাধার কানে ঢোকে না। সে আজ অন্যমনস্ক। কোথাও একটা গোলমাল হয়ে গেছে। কত মেয়ে রোগে-শোকে অত্যাচারে-গুলিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে! অমরত্বের চেয়ে বেঁচে থাকাটা অনুরাধার হঠাৎ দামি মনে হয়। আনা ফ্রাংকের ডায়েরি এত দিন যার প্রেরণা ছিল, সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে অন্য দৃষ্টান্ত। শ্যামলীর বাঁচার উপায়টা শর্টকাট-হাতেনাতে ফল পাওয়া যায়। এমন সুযোগ কি তাদের জীবনে আসবে? সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। গোলাগুলির আওয়াজ শুনে বোঝা যায়, যুদ্ধটা এখন আর একতরফা হচ্ছে না। অচিরেই দেশ স্বাধীন হবে। শোভা রানীর পেটের ওপর অনুরাধার নিরাসক্ত হাত। উত্তেজিত হয়ে সে বলে, ‘খুব শিগগির বড় একটা যুদ্ধ হবে। ভারত আগায় আসতেছে।’
বিছানায় নড়ে ওঠে শোভা রানীর শরীরটা। মরিয়ম শিশুর মতো প্রশ্ন করে, ‘অনুরাধা, কী করে তুমি বুঝলে?’
‘বুঝলাম? কারণ পানি শুকায়ে পথঘাট এখন ভেসে উঠছে। ভারতের প্রস্তুতিও প্রায় শেষ। ট্যাংক আর ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতে ভারতীয় সৈন্যদের কোনো অসুবিধাই হবে না। জনগণও সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।’
অনুরাধার কথা শুনতে শুনতে মরিয়মের বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। ‘স্বাধীনতাটা যে আকাশ থেকে পড়বে না, তার জন্য ট্যাংক-কামান-বিমান নিয়ে তুমুল একটা যুদ্ধ হবে,’ মুক্তিকে সে উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘আমাদের মাথায় এই চিন্তাটা আসেনি। আমরা মিলিটারির অত্যাচার-অবিচার সামলাতেই তখন ব্যস্ত। তুমি ভাবো একবার তোমার মাথার ওপর যুদ্ধবিমান মৌমাছির মতো গুনগুন করে উড়ছে আর তুমি আটকা পড়ে রইছো একটা তালাবন্ধ ঘরে!’
দৃশ্যটা সত্যি ইঁদুরের গর্তে পড়ে মরার মতো করুণ। ‘কিন্তু এত মেয়ে চোখের সামনে মারা যাচ্ছে, ভাবেন নাই যে, আপনিও মারা যেতে পারেন?’ মুক্তির প্রশ্নের জবাবে মরিয়ম বলে, ‘ভেবেছি, তবে আর যা-ই হোক এইভাবে না। আটকাবস্থায় অসহায়ের মতো না। তা ছাড়া নিজের পক্ষের বোমার আঘাতে আমরা কেউ তখন মরতে চাইনি।’
পক্ষ-বিপক্ষ তখনো একটা বড় ব্যাপার-যুদ্ধবন্দি মেয়েদের কাছে। স্বাধীনতার পর বিভাজনরেখাটা মুছে গিয়ে সবাই বিপক্ষে চলে যায়। অনুরাধার এ ভবিষ্যদ্বাণীটা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মাসাধিককাল আগের কথা। আসল যুদ্ধটা যে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত করবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাশে থেকে সহযোগিতা দেবে, তখনই মরিয়ম জানতে পারে। কারণ পাঁচ মাস হতে চলেছে সে বন্দি। তখন যে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ব্রাসেলস থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার পথে, তা তার জানার কথা নয়। তিনি এক দেশ থেকে আরেক দেশে উড়ে যাচ্ছেন আর দরবার করছেন। বক্তব্য এবার পরিষ্কার। ব্রাসেলসের সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্নে ভারত। আর পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতার কোনো ভিত্তি নেই। অর্থাৎ-পাক-ভারত যুদ্ধ আসন্ন। দেশ স্বাধীন হতে চলেছে।
মরিয়ম আগাম বোমাতঙ্কে দিশাহারা। অনুরাধা বিরক্ত হয়ে বলে, ‘ধরো, বোমার আঘাতে তুমি মরলা না, বেঁচে থাকলা, দেশ স্বাধীন হইল। তখন কী করবা তুমি? কই যাইবা?’
‘আমি যামু শ্বশুরের ভিটায়।’ কথার মাঝখানে শোভা রানী ঢুকে পড়ে। ঘৃণা অত্যাচার-অনাহার সত্ত্বেও তার গর্ভের সন্তান মাচাংয়ের কুমড়োর মতো বাড়ছে। পাকিস্তানিদের হিন্দু নিশ্চিহ্নকরণ অভিযানের এ এক ব্যর্থতার দিক। সৈন্যরা স্বামীকে হত্যা করে স্ত্রীর পেটে সন্তান দিয়েছে। স্বাধীন দেশে শোভা রানী পুত্রসন্তানের জননী হবে। পোড়া ভিটায় আবার ঘর উঠবে, শঙ্খ বাজবে, ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে, ফুল-পাতা সাজিয়ে দেব-দেবীর অর্চনা হবে। গোবর লেপা আঙিনায় হামাগুড়ি দেবে হিন্দুর ভবিষ্যৎ বংশধর। তাদের নির্বংশ করার যে প্রক্রিয়া অপারেশন সার্চলাইটের রাত থেকেই পাকিস্তানিরা জারি রেখেছিল, পুরো নয় মাস লুঙ্গি তুলে খতনাহীন পুরুষাঙ্গের লোকগুলোকে আলাদা লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরেছে, সেই রক্তবীজ থেকে জন্ম নেবে শোভা রানীর গর্ভজাত সন্তান। পিতা ছাড়া, তবে পরিচয়হীন নয়।
শোভা রানী যখন ভবিষ্যৎ ভাবনায় বুঁদ হয়ে আছে, মরিয়ম তখন ফুলতলি গাঁয়ে ঢুকে এসএম হলের শিরীষ অরণ্যের তল দিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে। সব কটা আশ্রয়ই সে যুদ্ধের আগে হারিয়েছে। তারপর ২৭ মার্চ থেকে তার যে উদ্বাস্তুর আর বন্দির জীবন, এর ভাগীদার দেশের লাখ লাখ মানুষ। নিজের পুরোনো সমস্যাগুলো সেই ডামাডোলে হারিয়ে যায়। কিন্তু তখনকার মতো এখনো সে অন্তঃসত্ত্বা। এ অবস্থায় যদি দেশ স্বাধীন হয়, কোথায় ফিরবে? কার কাছে? অনুরাধার কথা তখনো শেষ হয় নাই। সে বলে, ‘তুমি ভাবছো স্বাধীন দেশের মানুষ মালা দিয়া আমাদের বরণ করবে? না মেরি, পৃথিবীর ইতিহাসে এমনটা কখনো ঘটে নাই। যুদ্ধ শেষে পুরুষেরা হয় বীর, মেয়েরা হয় কলঙ্কিনী।’
কী অলুক্ষুনে কথা! শাস্ত্রে যা বলা নেই মেয়েটা দেখি তা-ই বলছে! শোভা রানী বিরক্ত হয়। ভগবানের অশেষ কৃপায় তার পেটে সন্তান এসেছে। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সেই সন্তান এখন লকলকিয়ে বাড়ছে। তা না হলে বাজা-বিধবার দুর্নাম নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে হতো। শ্বশুরের ভিটেয় বাতি জ্বালানোরও কেউ থাকত না। পুত্র-সন্তানের জন্য কত দুঃখী নারীর দেবতার শরণাপন্ন হওয়ার কথা শাস্ত্রে বলা আছে! যে নিয়মে সত্যবতী, কুন্তী সতী, শোভা রানীও সেই নিয়মে সতী। অনুরাধার হাতটা পেটের ওপর থেকে আলগোছে সরিয়ে দেয় সে।
কিন্তু অনুরাধার কথায় মরিয়মের ভয় বাড়ে। বহু বছর আগে জসিমুল হক শুধু তার হাত ধরেছিল। তাতেই যদি অপরাধ হয়, এখন তবে কী? দিনের পর দিন তাকে যারা ধর্ষণ করছে, তাদের নাম কী, বাড়ি কোথায়, বংশ কেমন, লেখাপড়া কর, বিবাহিত না অবিবাহিত কিছুই তো সে জানে না। মুখগুলোও প্রত্যেকের একই রকম, আচার-ব্যবহারেও কোনো ফারাক নেই। তাই তারা একশ’, পঞ্চাশ, বিশ–কতগুলো। সংখ্যা। এর মধ্যে কেবল লাল সোফায় বসা সেই আর্মি অফিসারের চেহারা তার মনে আছে, যার নাম ইশতিয়াক। লোকটি নিজের দুর্ভাগ্যের কথা তাকে বলতে চেয়েছিল, যদিও মাতাল অবস্থায়।
‘মাতাল তো খালি মদ খেয়ে হয় না,’ অনুরাধা বলে, ‘যুদ্ধটাই পুরুষের সবচেয়ে বড় মাতলামি।’
‘তা হতে পারে।’
‘তাইলে ভয় পাইছিলা ক্যান সেইদিন? লোকটার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত ছিল তোমার। দেখতে–কী বলে?’
‘ওর কথা শুনে আমার লাভ?’
‘তোমার লাভ মানে? লোকটার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের আখের গোছাতে!’
‘তা কি বাস্তবিকই সম্ভব যুদ্ধের দিনে? যে আবার তোমার শত্রু?’
‘শ্যামলীকে তোমার কী মনে হয়?’
‘আমার মনে হয় বিশ্বাসঘাতক।’
‘বিশ্বাসঘাতকতা কার প্রতি?’
‘নিজের দেশের প্রতি।’
‘কোন দেশ? যে দেশ তোমার ওপর শত্রুর নির্যাতনকে নির্যাতন বলে দেখবে না, দেখবে নিজের বেইজ্জতি হিসেবে, তারপর হয় আমাদের লুকিয়ে ফেলবে, না-হয় বেশ্যালয়ের দিকে ঠেলে দেবে–সেই দেশের প্রতি?’
অনুরাধার কথাগুলো মরিয়মের হৃৎপিণ্ডে বঁড়শির মতো গেঁথে যায়। যন্ত্রণায় ছটফট করে সে। জীবন যদি এমন হয়, এর শেষ কোথায়? অনুরাধা তখনো আপন মনে কথা ভাজছে। তারপর বলে, ‘মেরি, তুমি যদি মেজর ইশতিয়াকের সঙ্গে পাকিস্তান যাও, তা বিশ্বাসঘাতকতা হবে না।’
‘কী হবে?’
অনুরাধার জবাব, ‘তা হবে প্রতিশোধ।’