অন্তর্বাস, শাড়ি ও সতীত্ব
ঘটনাটা একটা ক্লুয়ের কাজ করে, যুদ্ধের আটাশ বছর পর। পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্পে মরিয়মের পরনে যে শুধু অন্তর্বাস ছিল, আর কোনো বস্ত্র ছিল না, তা মুক্তির জন্য একটা জরুরি তথ্য। কারণ সে এ প্রথম বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে মরিয়মের সামান্য হলেও একটা মিল খুঁজে পেয়েছে। যা তার রিপোর্টিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে সাহায্য করবে। ‘৭১ সালে পাকসেনারা বন্দি নারীদের গা থেকে শাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে লুঙ্গি বা ত্যানা পরিয়ে দিয়েছিল–আর্মির এ আচরণেরও নানান ব্যাখ্যা আছে। যেমন নতুনগাঁওয়ের জৈতুন বিবি মুক্তিকে বলেন, ‘যিখান থিকে পাকসেনারা এয়েছিল, অইভেনের বিডিরা শুইনছি শাড়ি পরত না, মুসলমানি লম্বা কুর্তা গরে দিত। শাড়ি হচ্ছে গে হিন্দুর পোশাক।’ কলেজছাত্র শাহরুকের বক্তব্য হচ্ছে ‘শাড়ি হচ্ছে বাঙালি রমণীকুলের ভূষণ। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য। ওইদিকে পাকিদের ছিল চরম বাঙালিবিদ্বেষ। তারা বাঙালি নারীর বসন-ভূষণ-শাড়ি-ফাড়ি আর বাংলাদেশের পতাকা একসাথ করে পুইড়ে দেছিল যুদ্ধের বছর। আরেকটা কারণ, যা নানান জনের লেখাপত্রে রয়েছে, তা হলো, কিছু মেয়ে সতীত্ব হারানোর পর সেনানিবাস, সেনাক্যাম্পে শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। সৈন্যরা তাই পরনের শাড়ি খুলে নিয়ে তাদের আত্মহত্যার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। এসব সত্য-মিথ্যা। যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত বিষয়টি বাঙালির লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শাড়ি এবং সতীত্ব-হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যের যে ধারা, যা নারীর মাধ্যমে বাহিত এবং লালিত হয়ে আসছিল, যুদ্ধের বছর এ দুটিকে একসঙ্গে খোয়াতে হয়। জাতিগতভাবে বীরাঙ্গনা বিসর্জনের অন্যতম কারণ হিসেবে মুক্তি রিপোর্টিতে তা সংক্ষেপে উল্লেখ করে।
তারপর মরিয়মের কাহিনি বেশ খানিকটা জটিলতাবর্জিত, ঝরঝরে। আর দশটা বীরাঙ্গনার থেকে কোনোভাবে পৃথক করা যায় না। এ ছাড়া রমিজ শেখের আগমনের পর গোটা কাহিনিটা যেমন লেজে-গোবরে হয়ে উঠেছিল, তারও সমাপ্তি ঘটে এই পর্বে। ভাগ্য ভালো যে, লোকটা পাকিস্তানি সৈন্যের গুলিতে মরেছে, মুক্তিযোদ্ধারা তাকে মারেনি। এর ব্যত্যয় হলে, মুক্তি বুঝতে পারে না, সে কীভাবে এর ব্যাখ্যা দিত। যুদ্ধের তিন মাসের মাথায় যে জয় বাংলা আর পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান দুটির মর্ম আলাদা করে উপলব্ধি করতে পারেনি, তার মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল পাকিস্তানি আর্মি এবং মুক্তিবাহিনীর হাতে ফিফটি-ফিফটি। তারপর তো মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা নামে একজনের একাত্তরের স্মৃতিকথা পড়ে জানা গেল যে, রমিজ শেখ মৃত্যুর আগে দেশপ্রেমিক বনে গিয়েছিল, যদিও মস্তিষ্ক বিকৃতির কারণে। পুল ভাঙতে গিয়ে স্টেনগানসহ জনাব শামসুদ্দোহা ধরা পড়েন রাজাকারদের হাতে। রাজাকার কমান্ডার অস্ত্রটা হাতিয়ে তাকে মার্শাল ল কোর্টে প্রডিউস করে। শামসুদ্দোহা বাঙালি হলেও একজন মোহাজের, সাতচল্লিশের দেশভাগের পর ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বাবা মার সঙ্গে পালিয়ে আসেন। তারপর থেকে উক্ত রাজাকার কমান্ডারের পরিবার তাদের পেছনে লেগে আছে। ‘ইয়ে লোক হামকো ফাস আয়াথা জমিজমা লেনেকে লিয়ে স্যার’-–এরকম এক সাজানো কাহিনি বারংবার উর্দুতে বয়ান করে, তিনি মার্শাল ল কোর্ট, এফআইও (ফিল্ড ইনটেলিজেন্স অফিস), এমপির (মিলিটারি পুলিশ) মতো সব কটি মৃত্যুফাঁদ উতরে অক্টোবর মাসে জেলখানায় গিয়ে পড়েন। সেখান থেকে মুক্তিযযাদ্ধারা জেলের তালা ভেঙে দিলে বেরিয়ে আসেন ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১।
মে মাসের শেষ দিকে জনাব শামসুদ্দোহা ধরা পড়ার পর বেশ কিছুদিন রমিজ শেখের সঙ্গে মল্লিকপুর থানার লকআপে ছিলেন। এই অদ্ভুত মানুষটাকে কাছ থেকে দেখা তার। স্মৃতিকথায় তিনি প্রশ্নসমেত একটি জরুরি বিষয় উত্থাপন করেন, যা রমিজ শেখের পক্ষে যায়। শামসুদ্দোহা লিখেছেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত টর্চারের ফলে রমিজ শেখের পাগল হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তা না হলে এক সাধারণ প্রজা নিজেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ভাবতে যাবে কেন?’ এ ছাড়া সাক্ষাৎকারে মরিয়মও সবিস্তারে বর্ণনা করেছে, কীভাবে লোকটা আলেয়া-আলেয়া বলে চিৎকার করতে করতে সিপাহিদের বন্দুকের নল দু’হাতে সরিয়ে ওর দিকে দৌড়ে আসছিল। পাগল ছাড়া, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনে এরকম ছুটে আসার সাহস কোনো স্বাভাবিক মানুষের হবে?
পিঠে গুলি লাগার পর রমিজ শেখের দৌড়ানোর গতি হঠাৎ বেড়ে যায়। কারণ পায়ের দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ায় তার দৌড়টা আর ঠ্যাং-বাঁধা মোরগের মতো থাকেনি, বাঘের তাড়া খাওয়া হরিণের লাফে রূপান্তরিত হয়। মরিয়ম মুক্তিকে বলে, লোকটি যেন মুখ থুবড়ে মাটিতে না পড়ার ধনুকভাঙা পণ করেছিল। প্লেন ওড়ার আগে যেমন ধীরে ধীরে স্পিড তুলে রানওয়েতে দৌড়ায়, সে খানিকক্ষণ তা-ই করল স্কুলমাঠের চারদিকে। শেষ সময়টায় তার পা দুটি মাটি ছোঁয়নি। মুখেও প্লেনের ইঞ্জিনের গোঁ-গোঁ আওয়াজ। মরার আগে লোকটা পাকিস্তানি সৈন্যদের খুব শাসিয়ে গিয়েছিল। তবে তখন সে কী বলছিল, মরিয়ম শুনতে পায়নি। কারণ অনেকগুলো বন্দুকের নল একসঙ্গে গর্জে উঠলে কানে তালা লাগার উপক্রম হয় আর মাঠটা ঘন কালো ধোঁয়ায় ভরে যায়। তাই রমিজ শেখের শেষযাত্রা উড়ে না দৌড়ে সমাপ্ত হয়েছে, মরিয়ম তা বলতে পারবে না।
ভয়ে, উৎকণ্ঠায় মরিয়মের তখন হিস্টিরিয়া রোগীর অবস্থা। সাক্ষাৎকারে সে মুক্তিকে বলে, ওর দিকে লোকটার দৌড়ে আসাটাই বিচলিত করে বেশি। শুধু ব্রেসিয়ার আর এক চিলতে ত্যানা পরনে থাকায়, জানালার পাশ থেকে সে প্রথম সরে এলেও পরে বিষয়টা তার মনে থাকেনি। কারণ তখন পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ, কল্পনাতীত। ‘ত্যানা পরায়ে রাখল বা ধর্ষণ করল,’ মরিয়ম মুক্তিকে বলে, ‘তা শুধু না। প্রত্যেকটা বুটের লাথি, বেয়নেটের খোঁচা কি সিগারেটের ছ্যাকা–আমার কাছে সমান ভয়াবহ। একটাও নরমাল না। একটার থেকে আরেকটা কম না। মিলিটারি দিনে-রাতে ক’বার ধর্ষণ করেছে, লোকে খালি এর হিসাব জানতে চায়। অন্য সব নির্যাতন তারা নির্যাতন মনে করে না।’
রমিজ শেখের মৃত্যুতে মরিয়ম শোকার্ত হয়েছিল যুদ্ধের বহু বছর পর। যখন সে বুঝতে পারে, তার শত্রু-লাঞ্ছিত দেহটা স্বাধীন বাংলাদেশের পুরুষেরা একইভাবে ব্যবহার করবে, কোনোদিন তারা তাকে আপন ভাববে না, তখন এই ভেবে সে সান্ত্বনা পেত যে, পৃথিবীতে অন্তত একজন পুরুষ তার দিকে ছুটে আসতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তখন রমিজ শেখের এই অদৃশ্য ভূমিকার কথা মরিয়মের বোঝার কথা নয়। তারা দুজনই তখন বন্দি। কেউ কারো উপকারেই লাগছে না।
‘আমার ভাগ্যটাই খারাপ,’ মরিয়ম বলে। তা না হলে নিজের বাড়ি যেখান থেকে মাত্র এক দিনের পথ, এমন এক গায়ে সে ধরা পড়ে! দূরত্বটা নির্ণয় করা হয়েছিল ফুপু সাহার বানুর শ্বশুরবাড়ি যাওয়া-আসার সময় হিসাব করে। যুদ্ধের তিরিশ বছর আগে সাহার বানুর বিয়ে হয় নতুনগাওয়ের পার্শ্ববর্তী গ্রাম রাধানগর। তখন ইংরেজ আমল। পথে-ঘাটে ডাকাতের উপদ্রব। তাই কফিলউদ্দিনের মরহুম আব্বাজান সলিমুদ্দিন সূর্য ওঠার আগে পরিচিত বেহারার পালকিতে মেয়েকে উঠিয়ে দিতেন। ‘উঁহুম না উঁহুম না’ করে তারা মুন্সিবাড়ির দরজায় পৌঁছে যেত বাদ-আসর, সূর্য যখন পশ্চিমাকাশে ডুবো ডুবো করছে। বেহারারা হাঁটে না, দৌড়ায়। সেই হিসেবে পায়ে হেঁটে মরিয়মের বাড়ি পৌঁছাতে বড়জোর রাত দশটা বাজবে। ছয় পাহারাদারসহ রমিজ শেখের নিখোঁজ হওয়ার পরদিন সে রওনাও করেছিল। কিন্তু যুদ্ধের দিন, পথঘাট নিরাপদ নয়, একা একজন মেয়ের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করাটা নতুনগাঁওয়ের মুরুব্বিরা অনুমোদন করেননি। তখন মিলিটারির গাড়ি পাগলের মতো পাকা সড়কে ছুটোছুটি করছে। পুলের গোড়ায় রাজাকার, মুজাহিদদের প্রহরা। গ্রামে গ্রামে চেকপোস্ট। অবস্থার উন্নতির জন্য মুরুব্বিরা তাকে আরো কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে বলে নিখোঁজ গ্রামবাসীর জন্য সাফা খতম পড়াতে মসজিদে চলে যায়। দ্বিতীয় দিনে ছয় ছয়টা লাশ-মৃত পাহারাদারদের। বাড়ি বাড়ি কারবালার মাতম। তারপর তো লাশ দাফন কাফন করতে-না-করতে গায়ে মিলিটারি চলে আসে।
‘মেয়েটা যেন ডাইক্যে আইনলো খান সেনাদের,’ জৈতুন বিবি বললেন। কারণ যুদ্ধ তখন তিন মাসে পড়েছে। মিলিটারিরা ধারেকাছের গ্রাম-বন্দর তছনছ করলেও নতুনগাঁওয়ে তখনো তাদের আঁচড় পড়েনি। মরিয়ম আসতে-না-আসতে একটার পর একটা অঘটন ঘটতে শুরু করে। অথচ চৌধুরীবাড়িতে শহরের একটা মেয়ে এসেছে শুনে, যুদ্ধের ডামাঢোলেও জৈতুন বিবি সেই রাতেই খাল পেরিয়ে তাকে দেখতে যান। শহরের মেয়ে হলে কী, দেখতে-শুনতে কেমন নরম-শরম। চাঁদপানা মুখ। কথাও বলে আস্তেধীরে। তিনি মেয়েটার মান-ইজ্জত যেন ঠিক থাকে, খানেদের হাতে যেন নষ্ট না হয়, এর জন্য দোয়া পড়তে পড়তে সেদিন বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। তারপর তো বিপদ এসে পড়ল তার নিজের ওপর। ছয় পাহারাদারের একজন ছিল জৈতুন বিবির সতিনের বড় ছেলে। কোলে-পিঠে করে ছেলেটাকে তিনি মানুষ করেছেন। ছেলেটা কবরে যাওয়ার সময় তার শরীরের অর্ধেকটা যেন সঙ্গে নিয়ে গেল। তাই খানেরা আসছে শুনেও জৈতুন বিবি আর তার সতিন বাড়ি ছেড়ে নড়েননি। ঘরের পেছনের করমচার ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলেন। খানেরা তখন ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা দিয়ে পঙ্গপালের মতো ধেয়ে আসছে। এই তাদের দেখা গেল দর্জিবাড়ির কাছে, চোখের পলকে হিন্দুপাড়ার বড় বড় পানের বরজ, ফলবাগান আর বাঁশঝাড়ের ভেতর। তখন তাদের কালো কালো পাছা ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তারপর দাউদাউ আগুন জ্বলে উঠল। তারা পেট্রোল ঢেলে হিন্দুদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছিল। হিন্দুবাড়ি যাওয়ার পথে হানাদাররা লুটপাট করার জন্য গাঁয়ের লোকদের ঘর-বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। জৈতুন বিবি আর তার সতিন করমচার ঝোঁপের আড়ালে থেকে লুটের মালসামান নিয়ে লোকজনের ছোটাছুটি দেখেছেন। তারপরই পটপট করে কয়েকটা গুলির শব্দ। সেদিন মঠের পেছনের জঙ্গল থেকে ধরে এনে বলাই সাধুকে দুজন শিষ্যসহ পাকসেনারা এক কাতারে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। বলাই সাধু অবস্থা বেগতিক দেখে শিষ্যসমেত পালাতে চেয়েছিলেন। অথচ ভারতে চলে যাওয়ার সময় ভাই-ভাতিজারা তাকে সঙ্গে নিতে চাইলে এক গাল হেসে বলেছিলেন, তোরা যেতি চাচ্ছিস-যা, আমারে নিয়ে অযথা টানাহেঁচড়া করছিস কেন? আমি একেশ্বরে বিশ্বাসী, খানেরা আমারে মারবে না। তারপর পাকসেনারা গায়ের ভেতর বেশিক্ষণ থাকেনি। দিনদুপুরে মানুষ মেরে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খানিক বাদে একই পথ দিয়ে ফিরে যায়। যাওয়ার সময়, করমচার ঝোঁপ থেকেই জৈতুন বিবি দেখেছেন, চৌধুরীবাড়ির কাজের মেয়ে টুকি, যোগেন বাইন্যার বড় বেটি বিন্দুবালাসহ মরিয়মকে ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে।
কে দেখল, কে দেখল না, মরিয়মের সেদিকে তখন খেয়াল নেই। সে তখন অনুভূতিশূন্য, চোখে অন্ধকার দেখছে। বাড়িতে মিলিটারি ঢুকে পড়লে চৌধুরীবাড়ির বউ-ঝিরা দেউড়িঘরের খিল তুলে দিয়ে কুলহু আল্লাহ সুরা বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করে। বন্ধ ঘরে বাচ্চারা চিল্লাচ্ছে। মুখে কাপড় চাপা দিয়েও তাদের থামানো যাচ্ছে না। হিন্দুবাড়িতে মানুষ মেরে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খানেরা তখন উন্মাদ। তাদের এক লাথিতে দরজার পাল্লা দুটির কবজি খুলে যায়। ঘরে মেয়ে আর শিশু। পুরুষেরা পালিয়েছে। মেয়েদের বেরিয়ে আসতে বললে তারা চিৎকার-চেঁচামেচি করে ঘরের চিপায়-চাপায় লুকোয়। মিলিটারির ভাষা বোঝে না। বাচ্চাগুলো ততক্ষণে কান্নাকাটি বন্ধ করে দিয়েছে। মিলিটারির বন্দুকের বাড়ি খেয়ে আরেক দফা চিৎকার করতে করতে মেয়েরা যখন বেরিয়ে আসে, তখনো কয়েকজন জোরে জোরে কুলহু আল্লাহ সুরাটা পড়ছিল। মরিয়মের পরনে ছিল সালোয়ার-কামিজ আর সুতির ওড়না। ওড়নাটা দিয়ে সে মুখের ওপর লম্বা করে ঘোমটা টেনে দিয়েছিল। কিন্তু ঘর থেকে বেরোনোর সময় মেয়েদের ধাক্কাধাক্কিতে ঘোমটা খসে তার চাঁদপনা মুখটা বেরিয়ে পড়ে। সে দেখে উঠোনে পাঁচ-ছজন মিলিটারি। তারা ঠায় দাঁড়ানো, অপারেশনে নেই। হয়তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অর্ডার করছিল। আবার ঘোমটা টানার আগে একজনের চোখ পড়ে মরিয়মের ওপর। লোকটা চিতাবাঘের মতো লাফ দেয়। তারপর যে কী হয়ে গেল। আমার, মরিয়ম বলে, ‘কিছু বুঝতে পারছিলাম না। অনুভব করতে পারছিলাম না। আর্মির হাতে ধরা পড়ে গেলাম! এরা কি আমাকে মেরে ফেলবে? শরীরে কোনো সেন্স ছিল না।’
এ অবস্থায় কীভাবে দুই ক্রোশ পথ পায়ে হেঁটে মল্লিকপুর সদরে এসেছে, মরিয়ম জানে না। অথচ গাঁও-গেরাম যখন, পথের বাঁকে বাঁকে নিশ্চয় মানুষের ঘরবাড়ি ছিল, দু-চারটা খাল-বিলও তাকে পেরোতে হয়েছে, খেত-খামারে তখন ছিল হাঁটুসমান পাটের গাছ, ধানের চারা–অথচ এসবের কিছুই সে দেখতে পায়নি। শহরের পিচের রাস্তায় ওঠার পর পায়ের তলায় গরম সেঁকা লাগতে প্রথম বোঝে যে, পায়ে স্যান্ডেল নেই। তখন সাঁড়াশির মতো তার বাহু খামচে ধরা কয়েকটা আঙুল চোখে পড়ে। ওপরে তাকাতে একজোড়া লালচে মোটা গোঁফ। সিঁড়ি ভেঙে যখন দোতলায় ওঠে তখনো মোচঅলাটা তার বাহু খামচে ধরেছিল। ঘরের ভেতর ফেলে দেওয়ার সময় হাতটা ছেড়ে দেয়। মরিয়ম উড়ে গিয়ে পড়ে ভাঙা বেঞ্চির ওপর।
: বেঞ্চি আসলো কোত্থেকে?
: এটা ছিল স্কুলঘর, আমাকে প্রথম যেখানে রেখেছিল।
: ঘরে ফ্যান ছিল?
: ছিল? না না ছিল না। নাকি ছিল? তখনকার সময়ে স্কুলঘরে ফ্যান চলত?
: প্লিজ, একটু মনে করার চেষ্টা করেন।
: না, মনে পড়ছে না। তবে ফ্যান না থাকলেও হুকটুক ছিল বোধ হয়। কেন?
: আপনার গায়ে কি ওড়না ছিল? সুতির ওড়নাটা?
: হ্যাঁ ওড়না ছিল।
: ওড়না ছিল?
: ছিল। কামিজ ছিল পরনে। ওড়না তো থাকবেই। তখন তো এরকম কামিজ ছিল না। আরেকটু টাইট আর খাটো মতন।
: খাবারের কথা কি মনে আছে? কী ধরনের খাবার খেতেন?
: ডাল দিত, ভাত দিত মনে হয়, কয়েক দিন গোশত দিছিল–এই এক-দুই পিস, ছোট ছোট।
: রুটি?
: হ্যাঁ হ্যাঁ রুটিই দিছে বেশি। তবে ইনফেকশন তো শরীরের এসব জায়গায়। জ্বর থাকত সব সময়। খাওয়ায় রুচি ছিল না।
: পানি খাওয়ার গ্লাসটাস দিছিল?
: মেয়েটা যে কী বলে, আবার পানির গ্লাস! স্কুলের জমাদার বড় একটা মাটির সানকি আর এক বদনি পানি দিয়ে যেত দু’দিন পরপর। সেই পানিতে খাওয়া চলত। পেসাব-পায়খানার পর পরিষ্কারের কাজও সেই পানিতে। ঘরে বাথরুম টাথরুম ছিল না। স্কুল ঘর তো। একদম পেছনে ছাত্রদের জন্য কয়েকটা টাট্টি–খাট্টা পায়খানা। কীভাবে যে দিন কাটাইছি! গোসল করতে পারিনি এক দিনও।
: গন্ধ লাগত না? নিজের শরীরের দুর্গন্ধ?
: লাগত। কাপড়চোপড়ে রক্ত, এর গন্ধ আছে না আলাদা একটা? পরিস্থিতি বাধ্য করেছে এভাবে থাকতে। উপায় নেই তো। এগুলো কি কাউকে বুঝায়ে বলা যায়? এর কোনো ভাষা আছে? কোন ভাষায় বলব?
: কিন্তু সত্যি সত্যি বলেন তো ঘরে ফ্যান ছিল কি না, ফ্যান না থাকলে সিলিংয়ে হুক ছিল কি না।
: হুকটুক থাকলেও থাকতে পারে। কে এত খেয়াল করেছে। নিজের জ্বালায় বাঁচিনে তখন।
: আশ্চর্য সিলিংয়ে হুক ছিল, গায়ে সুতির ওড়না ছিল!
: এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?
: এ পরিস্থিতিতে অনেক মেয়ে তো আত্মহত্যা করেছে তখন।
: অহ্! আমি কিন্তু আত্মহত্যার কথা ভাবতাম না। বাঁচার কথা ভাবতাম। আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছি যুদ্ধের পর। আরেকটা কথা মনে পড়েছে–ঘরে একটা জানালা ছিল। এক পাশের পাট ভাঙা। তাই দিয়েই রমিজ শেখকে দৌড়ে আসতে দেখেছিলাম।
: তখন আপনার পরনে সালোয়ার-কামিজ আর ওই ওড়নাটা ছিল?
: না, ছিল না। টাইনে-টুইনে ছিঁড়ে ফেলাই দিছিল মিলিটারিরা। জমাদার বর্জ নেওয়ার সময় দলা পাকিয়ে সেই যে নিল, এগুলো আর ফেরত পেলাম না। তাই রমিজ শেখকে দৌড়ে আসতে দেখে প্রথম সরে গেছিলাম জানালার পাশ থেকে।
: আপনার পরনে তখন কিছু ছিল না?
: ছিল। ব্রেসিয়ার আর এক টুকরা ছিঁড়া ত্যানা।
মুক্তি হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। লম্বা-চওড়া সুতির ওড়নাটা বই-পুস্তকের লিখিত তথ্যের সঙ্গে কিছুতেই খাপ খাচ্ছিল না। বিশেষত যার ঘরে ফ্যান না থাকলেও গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সিলিং থেকে ঝুলে পড়ার মতো হুক লাগানো ছিল, তার তো সতীত্ব খোয়ানোর পর আত্মহত্যা করার কথা। এ অবস্থায় স্কুলের জমাদার কাপড়চোপড় তুলে নিয়ে মরিয়মকে শুধু আত্মহত্যা করার দায় থেকেই রেহাই দেয়নি, মুক্তিকেও যারপরনাই স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু চৌধুরীবাড়ির কাজের মেয়ে টুকি আর যোগেন বাইন্যার বড় বেটি বিন্দুবালা-তাদের পরনে তখন কী ছিল? মরিয়মের দ্ব্যর্থবোধক জবাব, শাড়ি ছিল মনে হয়, গ্রামের মেয়েরা শাড়িই পরত তখন, সঙ্গে সায়া, ব্লাউজ। কাজের মেয়ে টুকির পরনে খালি একটা শাড়িই ছিল বোধ হয়। পরে মুক্তিকে এই একই কথা অন্যভাবে বলে টুকি, ‘আমারে ব্লাউজ-পেটিকোট কিনে দিব কিডা? একখান শাড়িই ছিল পরনে। ছাপা শাড়ি। খিদিরপুর হাট থিকা আব্বা কিনা দেছিল ঈদের সোমায়। আমার বয়স অইছে, এ পর্যন্ত আমি কইতে পারি না এক দিনও সালোয়ার-কামিজ পরছি কি না।’
তখন তাদের ধরে এনে কোথায় রেখেছে, কী করেছে মরিয়ম জানে না। চিৎকার শুনেছে শুধু। কে কোথায় কাঁদছে? পাশের রুম, না তার পরের রুম? স্কুলবাড়িতে তো রুমের কমতি নেই! যুদ্ধের আগে সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত ক্লাস চলত একসঙ্গে। কান্নাকাটির শব্দে আন্দাজ করত যে, কাছাকাছি আরো কয়েকটি মেয়ে আছে। তাদের মধ্যে টুকি, বিন্দুবালার থাকাটা অসম্ভব নয়।
মল্লিকপুর থেকে মরিয়ম যেদিন চালান হয়, তখন রাত না দিন, মেয়ে দুটি সঙ্গে আছে কি নেই, তারা শাড়ি পরেছে কি পরেনি, বোঝার উপায় ছিল না। কারণ ঘর থেকে চোখ বেঁধে তাদের বাইরে আনা হয়। সেখানে অন্ধ প্যাঁচার মতো তারা দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মিলিটারিরা পাছায় লাথি মেরে মেরে তাদের গাড়িতে তোলে। ‘নিচা হো যাও, নিচা হো যাও’ অর্ডারটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন স্টার্ট হয়ে যায়। গাড়িটা যে একটা ট্রাক এবং এর খোলা পিঠে ওরা যে উবু হয়ে বসে আছে, তা বুঝতে পারে গায়ের ওপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়লে। মরিয়মের কানের কাছে টুকির মতো একজনের মুখ, ‘এ দি খোলা টেরাক! শরমে বাঁচিনে, রাস্তার মানুষ আমাগের দেইখ্যে ফেইল্লো, ছি!’
ট্রাক যাচ্ছে উঁচু-নিচু এবড়োখেবড়ো পথ ধরে। অনেকক্ষণ শুধু ইঞ্জিনের ঘর্গর আওয়াজ। একসময় তা ছাপিয়ে জনতার হর্ষধ্বনি ভেসে আসে। এরা কারা–এই যুদ্ধের দিনে উল্লাস করে? মরিয়ম হাত দিয়ে মুখ ঢাকে। অন্তর্বাস পরা শরীরটা ট্রাকের এক কোনায় লেপ্টে থাকে মার-খাওয়া জন্তুর মতো। আর সে অন্ধ চোখে দেখে-মহুয়া সিনেমা হলের সামনে দিয়ে অন্তর্বাস পরা অবস্থায় খোলা ট্রাকে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেদিনের সিনেমা হলের দর্শকদের একজন জসিমুল হক। মরিয়মের প্রথম প্রেমিক, যার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে তিন দিনের মধ্যে প্রণয় এবং বিচ্ছেদ। সে হয়তো হল-ভাঙা দর্শকদের সঙ্গে বিশাল হোর্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছিল, ট্রাক ভর্তি ন্যাংটা মেয়ে দেখে সিটি বাজিয়েছে। এমন দৃশ্য তো ব্ল্যাকে টিকিট কেটে ‘কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ইংরেজি মুভিতেও সচরাচর দেখা যায় না। ওই সময়ের কথা মনে পড়তে মরিয়মের কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ফোটে। লজ্জায় মাথাটা নুয়ে পড়ে। আর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় পায়ের আঙুলের চিপায়। যুদ্ধের দিনে সিনেমা হলে তো কারোর যাওয়ার কথা নয়। ভাবনাটা যেন আকাশ থেকে হঠাৎ উড়ে পড়ল। মরিয়ম মাথা তুলে মুক্তির দিকে সরাসরি তাকায়, তা না হলে, সামনে মৃত্যু না কী–কিছুই তো জানতাম না তখন, তা আসলো কোত্থেকে!’ তারপর তাদের লজ্জা নিবারণের জন্যই বোধ হয় বৃষ্টিটা আরো জোরে তেড়ে আসে। সে এমন মুষলধারে বৃষ্টি, যেন দুনিয়া ভাসিয়ে নেবে। গাড়িটা ব্রেক কষে থেমে যায়। লোকগুলো নেমে তাদের দিকে ছুঁড়ে দেয় বিশাল বিশাল বাদুড়ের ডানার মতো ত্রিপল। আসলে চোখ বাঁধা থাকায় এমন মনে হইছিল,’ মরিয়ম মৃদু হেসে বলে। তারা প্রত্যেকেই ভেবেছিল, যার যার বাড়ির কাছ দিয়ে ট্রাকে করে যাচ্ছে। যারা শিস দিচ্ছে বা তালি বাজাচ্ছে, তারা তাদের চেনা লোক, কারো কারো প্রাক্তন প্রেমিক। তবে তাদের সেদিনের এ চিন্ত টা ছিল অন্ধের যষ্টির মতো, যা দিয়ে তারা তাদের ভবিষৎকে ছুঁয়েছিল, যেখানে ক্রমে জমা হচ্ছিল আপন-পরনির্বিশেষে সকলের টিটকারি আর ধিক্কার। পরে শত শত ত্রিপল দিয়েও এ থেকে তাদের আড়াল করা যাবে না।
এ চলার যেন শেষ নেই। পথ নয় গোলকধাঁধা–সুন্দরীর জলার মতন। আর মন্টুও আছে সঙ্গে। চোখ-বাঁধা অবস্থায় ত্রিপলের নিচে বসে মেরির মনে হয়, যেন অনন্তকাল ধরে তারা ভাই-বোন নিজেদের বাড়ি ফেরার পথ খুঁজছে। কিন্তু জলাভূমির গোলকধাঁধায় কিছুতেই পথের হদিশ পাচ্ছে না। মন্টুটা আগের মতোই বোকা–এই যুদ্ধের দিনেও। সুন্দরীর জলার রহস্য ভেদ করে যে কখনও প্রাপ্তবয়স্কে উত্তীর্ণ হবে না। শৈশবের প্রশ্নগুলোর মীমাংসা না হতেই এই কিশোরের জীবনে যুদ্ধ চলে আসে। যুদ্ধে যায় সে।