উনবিংশ পরিচ্ছেদ
ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।
ঐন্দ্রিলার বিয়েটা একরকম হঠাৎই ঠিক হয়ে গেল। শ্যামার জ্বর উপলক্ষে ঐন্দ্রিলা পদ্মগ্রামে এসেছিল দিন সাতেকের জন্যে। আর আড়গোড়ের মাধব ঘোষাল শিবপুর থেকে ফিরছিলেন হাঁটাপথে। ঐ সময়ে দেখা। দুপুর রোদে অতখানি পথ হেঁটে এসে তৃষ্ণা পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। আর পিপাসা-বোধ প্রবল হওয়াতে যে তাঁর অক্ষয়বাবুর বাড়ির কথাটা মনে পড়বে এতোই বা আশ্চর্য হবার কি আছে? মাধব ঘোষাল আর অক্ষয়বাবু আগে একই অফিসে কাজ করতেন। তারপর এখানকার অফিসটা নতুন খুলতে মাধব ঘোষাল এসে ঢুকলেন, অক্ষয়বাবু আর এলেন না। কারণ তখনই তাঁর আর বড়বাবুর মধ্যে দুটি মাত্র বাবুর ব্যবধান ছিল।
সেই থেকেই অক্ষয়বাবুর সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি। তবু আসা-যাওয়া আছে– ক্রিয়া- কর্ম উপলক্ষে ত বটেই, এমনিও দু-একবার এসেছেন। বাড়িটা তাঁর মনে ছিল। অচেনা লোকের বাড়ি জল চেয়ে খাওয়ার চেয়ে চেনা লোকের বাড়ি গিয়ে ওঠাই ভাল। চাই কি যদি রাঁধুনী বামুন থাকে ত দুটি ভাত পাওয়াও বিচিত্র নয়। যেখানে গিয়েছিলেন সেখানে একটু দেরি হয়ে গেছে। এতটা দেরি হবে ভাবেন নি। এখনও আড়গোড়ে পাকা আড়াই ক্রোশ রাস্তা। ক্লান্ত ও অভুক্ত অবস্থায় হাঁটতে বেলা গড়িয়ে যাবে। অনেক ভেবেচিন্তে মাধববাবু অক্ষয়বাবুর বাড়ির পথই ধরলেন।
চেনা হ’লেও গত পাঁচ-ছ বছর এ পথে আসেন নি মাধব ঘোষাল। পথটা ঠিক করতে না পেরে ঈষৎ বেঁকে খিড়কীর দিকের বাগানে ঢুকে পড়লেন। আর করমচা গাছের ঝোঁপটা ছাড়াতেই তাঁর নজরে পড়ল ঐ অপরূপ দৃশ্য।
নির্জন পুকুর-ঘাটের বাঁধানো পৈটেতে বসে আছে একটি বছর দশ-এগারোর মেয়ে। পরণে একটা ছোট খয়েরী রঙের শাড়ি, তাতে ওর উজ্জ্বল গৌরবর্ণ যেন আরও খুলেছে। একমাথা কালো চুল। চোখ দুটি খুবই ডাগর কিন্তু বেমানান নয়, চোখের পাতা এত দীর্ঘ যে ওর নিটোল সুগৌর গাল দুটি অনেকখানি পর্যন্ত তার ছায়া পড়েছে— এখান থেকেই সে ছায়া বোঝা যায়। নাকটা তেমন টিকোলো নয় কিন্তু তাতেই যেন আরও ভাল দেখাচ্ছে। বিস্ফারিত আয়ত চোখে ও অমন ফুটফুটে গৌর বর্ণ
দেখাচ্ছে। বিশ্ব টিকোলো নাক হয়ত তেমন মানাত না। পাশেই একরাশ বাসন রয়েছে জলে ভেজানো,
বোধ করি বাসন ক-খানা মাজতেই সে এসেছে, কিন্তু আপাতত সে রকম কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। পা দুটি জলে ডুবিয়ে বসে বসে অন্যমনস্ক ভাবে এক হাতে একটা ডাঁসা পেয়ারা খাচ্ছে মেয়েটি, আর এক হাতে অলস ভাবে একটা শুকনো আমড়া- পাতা নাড়াচাড়া করছে। এত স্থির হয়ে বসে আছে যে হাত নড়লেও পা নড়ছে না– ফলে পুকুরের জলে ঈষৎ কাঁপন মাত্র আছে, আর আছে তে-চোকো মাছের সূক্ষ্ম নিশ্বাসের বুদ্বুদ। তাতে পুকুরের কালো জলে এমন কোন তরঙ্গ ওঠে না যে ছবিটা নষ্ট হবে। বড় বিলিতী আমড়া গাছটার ফাঁক দিয়ে আধোছায়া-মাখা রোদ এসে পড়েছে ওর মুখেচোখে সেই ছবি সবটাই প্রতিবিম্বিত হয়েছে পুকুরের স্থির জলের আয়নায়। স্তদ্ধ দ্বিপ্রহরে বাতাস নেই কোথাও, গাছের পাতা কখনও কখনও কাঁপছে মাত্র, তাতে যেটুকু আলোর খেলা চলে– সেটুকুর ছবিও ধরা পড়ছে পুকুরের ছায়াতে।
অপূর্ব সে ছবি। মাধব ঘোষাল কবি নন– মাইকেল আর হেম বাঁড় য্যের নাম হয়ত শুনেছেন– কিন্তু তাঁদের কাব্য-কালিমার এতটুকু ছোঁয়া লাগে নি মনে। তবু তিনি চোখ ফেরাতে পারলেন না। নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন সে ছবি।
I
পেয়ারা খেতে খেতে মেয়েটি একসময় পেয়ারাসুদ্ধ হাত নামিয়ে চুপ ক’রে কি ভাবতে লাগল। তাতে আরও সুন্দর হয়ে উঠল ছবিটি। মাধব ঘোষালও তৃষ্ণা ভুলে দাঁড়িয়ে রইলেন। জীবনে যার কখনও প্রকৃতির দিকে সৌন্দর্যের দিকে তাকাবার অবসর হয় না– প্রকৃতি তার ওপর এমনি করেই শোধ নেন, এক-একটি দুর্বল মুহূর্তে অকস্মাৎ বিস্মিত, স্তম্ভিত করে দেন কর্মব্যস্ত বিষয়ী মানুষকে। তার চোখে ও মনে বুলিয়ে দেন মায়ার তুলি। মাধব ঘোষালও এই মুহূর্তে শুধু যে তাঁর পিপাসার কথা ভুললেন তাই নয়– ভুলে গেছেন তাঁর জরুরী মকদ্দমার কথা, ভুলে গেলেন যে তাঁর বুড়ো ফজলী আমের গাছটা (গত চার বছর একটাও ফল দেয় নি বউল পর্যন্ত আসে না– কি লাভ ও গাছ রেখে?) আজ কিনতে আসবে– কথা আছে; তার দরদস্তুর করা দরকার, বায়নার টাকাটাও যদি গিন্নীর আঁচলে আটক পড়ে ত বেহাত হয়ে যাবে; ভুলে গেলেন যে পগার-ধারের বাঁশঝাড়টা নিয়ে গত ছ মাস যাবৎ মল্লিকদের সঙ্গে যে বিবাদ চলেছে, আজই তার আপস হবার কথা। মধ্যস্থ রিদয় (হৃদয়) বাবুর সঙ্গে দুপুরেই একটু গোপন আলাপ সেরে নিতে পারলে মীমাংসাটা তাঁর দিকে ঘেঁষেই হতে পারে। তিনি সব কিছু ভুলে চেয়ে রইলেন এই ছবির দিকে– এবং বুঝতে পারলেন না যে দেবশিল্পীর আঁকা এক অপরূপ ছবি দেখে তিনি সৌন্দর্য-মুগ্ধ হয়ে এমন করে তাকিয়ে আছেন। বুঝতে পারলে নিজের এই কবিসুলভ দুর্বলতায় লজ্জিত হতেন কিনা কে বলতে পারে!
কতক্ষণ তিনি এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং থাকতেন কে জানে, হঠাৎ সেই মেয়েটি চোখ পড়ল ওঁর দিকে এবং কচি মিষ্টি গলায় অত্যন্ত পাকা ও কটু ভঙ্গীতে বলে উঠল সে, ‘কে রে অলপেয়ে মিনসে, চোখের মাথা খেয়ে চেয়ে আছে অমন করে? নিজের ঘরে গিয়ে চেয়ে থাকতে পারে না?
স্বপ্নভঙ্গ হ’ল বৈকি!
কলকাতার কাছেই_e
২০৯
তবু মাধব ঘোষালের তখনও মোহ কাটে নি সম্পূর্ণ। তিনি দু পা এগিয়ে এসে মিষ্টি ক’রেই বললেন ‘খুকী মা– অক্ষয়বাবুর বাড়ি কি এইটে? আমি তাঁকেই খুঁজছি!’
‘খুকী মা’ কিন্তু কিছুমাত্র নরম হল না তাতে। তেমনি ঝাঁজের সঙ্গেই বললে, ‘আমি তাঁকেই খুজছি! তা তাঁর কি সদর বাড়ি নেই? ও ধারের পথ ছেড়ে খিড়কীর বাগানে এসে আমন ক’রে দাঁড়িয়ে না থাকলে চলে না!’
‘কার সঙ্গে অমন ক’রে ঝগড়া কচ্ছিস লা খেদি?’
মঙ্গলা ঠাকরুন ভাত খেয়ে উঠে আঁচাতে আসছিলেন, কাছাকাছি আসতেই তাঁর নজর পড়ল মাধববাবুর দিকে, তাড়াতাড়ি টানাটানি করে মাথায় কাপড়টা দিতে দিতে ফিসফিসিয়ে বললেন ‘ওমা, এ যে আমাদের মাধববাবু!… তুই ওর সঙ্গে অমন গাছ কোমর বেঁধে ঝগড়া করছিলি?’
মাধব বুঝি ওঁর মামাতো জ্যাঠশ্বশুরের নাম।
এতক্ষণে ঐন্দ্রিলাও একটু অপ্রস্তুত হয়েছে। তাড়াতাড়ি সে জল থেকে উঠে এসে ওপরের চাতালে দাঁড়াল। মনে পড়ে গেল যে সত্যিই কাপড়খানা তার গাছকোমর ক’রে বাঁধা। অপ্রতিভ ভাবে কোমরের বাঁধনটা খুলতে খুলতে বলল, ‘ওমা- আমি যে—- আমি ভাবলুম কে না কে একটা মিসে—–
আর একটু এগিয়ে এসে মাধব ঘোষাল প্রশ্ন করলেন, ‘বৌ-ঠাকরুন, অক্ষয় বাড়ি আছে?’
বেশ শ্রুতিগোচর ভাবেই মঙ্গলা উত্তর দিলেন, ‘বল্ না খেঁদি– ঐ বাইরের রোয়াকে বসে তামাক খাচ্ছেন!’
আর কথা না বাড়িয়ে মাধব ঘোষাল এগিয়ে গেলেন।
দুই
তবু তখনও মেয়েটি সম্বন্ধে কোন আশাই পোষণ করে নি মাধববাবু। কায়স্থর ঘরের মেয়ে– ভাল লেগেছে এই পর্যন্ত, তার সঙ্গে কোন সম্বন্ধ স্থাপন করা সম্ভব তা কল্পনাও করেন নি।
কিন্তু প্রাথমিক কুশল-বিনিময়ের পরই প্রথম প্রশ্ন করলেন তিনি ওর সম্বন্ধেই, ‘হ্যাঁ হে অক্ষয়, পুকুর-ঘাটে দিব্যি ফুটফটে একটি মেয়ে দেখলুম, কে হে? তোমার কেউ ভাগ্নী কি নাতনী–’
খোঁচাটুকু নীরবে হজম ক’রে অক্ষয় হাতের হুঁকো নামিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ফুটফুটে মেয়ে? আমার পুকুর-ঘাটে? সে আবার কি?’
তখন মোটামুটি একটা বর্ণনা দিলেন মাধব ঘোষাল; উঠলেন, ‘ও হো হো– আর বলতে হবে না। ও হ্যাঁ
এসে আছে বটে ক-দিন। ও ত এখানে থাকে না, ওর
‘বামুন মেয়ের মেয়ে? সে কে, তোমার রাঁধুনী?’
২১০-
শুনতে শুনতেই অক্ষয় বলে
বামুন মেয়ের মেজ মেয়েটা কথাটা মনেই ছিল না!’ ག ་༢། །
―
‘না না তার চেয়ে একটু উঁচু। আমাদের নিত্যসেবা করার জন্যে একঘর বামুন এনে বসানো হয়েছিল। তা সে বেটা ত চামারের অগ্রগণ্য– কোথায় নেশা-ভাঙ ক’রে পড়ে থাকে। ঐ মেয়েটির দাদাই এখন পূজোপাট সব করে।’
‘ও পুজুরী বামুন? তা কি গোত্তর ওদের?
‘কেন হে? ছেলের বিয়ে দেবে নাকি, গাঁই-গোত্তর সব খবর নিচ্ছ?’
‘দিতেও ত পারি। মেয়েটি দেখতে বেশ।’
আবারও হুঁকো নামালেন অক্ষয়। একটু চুপ করে থেকে বললেন, তোমাদের ত বাস গোত্তর? গোত্তরে আটকাবে না– তবে দেবে ওর সঙ্গে ছেলের বিয়ে? বাপটা বড় ছোট, বড় নীচ। আর ছেলেমেয়েগুলো– অবিশ্যি অভাবের সংসার ব’লেই– বড় চোর। আমার বাগানে ফল-ফুলুরি হবার যো নেই। লুকিয়ে লুকিয়ে চুরি করে আর বেচে আসে। মেয়েটাও বড় বাঁচাল, ঝগড়াটি। তবে হ্যাঁ ওর মা বেশ ভদ্ৰ
বংশের মেয়ে বলেই মনে হয়। লেখাপড়াও জানেন একেবারে দুর্লভ।’
‘তাহলে এমন পাত্তরের হাতে পড়ল কি ক’রে?’
আমাদের এদিক ঘরে যা
তখন নাকি ওদের অবস্থা বেশ ভাল ছিল। ঘরবাড়ি জমি-জমা– সম্পত্তি ছিল বিস্তর। গুরুবংশ ওরা। সব খুঁইয়েছে এরা দু’ভাই। বামুনের ঘরের গরু হ’লে যা হয়- একেবারে নিরেট মুখ্য ত!
জলখাবার ইতিমধ্যে এসে পৌঁচেছে। তা ছাড়াও
চোখে চোখে মঙ্গলার সঙ্গে
অক্ষবাবুর কথাবার্তা হয়ে গেছে। অর্থাৎ ভাতের ব্যবস্থা হয় না? মঙ্গলা ঘাড় নেড়ে জানিয়েছেন যে সে কথা তিনি ভেবেছেন– হবে।
বামুন-মেয়ের দুদিন জ্বর। মঙ্গলাদের হেঁশেলে ভাত হবে না। লুচি ভেজে দেওয়া যায়– ঘরে ময়দা আছে। কিন্তু এই দুপুরে লুচি?
তাছাড়া ওদের কথার টুকরো দু-একটা মঙ্গলার কানে এসে পৌঁচেছে। মতলব গেছে মাথায়। আনন্দে উত্তেজনায় তাঁর চোখে জ্বলে উঠেছে আগুন। এই শ্রেণীর ষড়যন্ত্রে মঙ্গলার বড় উৎসাহ।
উনি হাঁপাতে হাঁপাতে শ্যামার কাছে গিছে উপস্থিত হলেন। খাওয়া-দাওয়া সেরে সবে সে মেঝেতে আঁচলটা বিছিয়ে শুয়েছে।
‘বানি বাম্নি—শীগির ওঠ! দে দিকি পাতার উনুনে একগাল আলা-চাল চড়িয়ে। দুটো আলুভাতে দিয়ে ভাতটা চাপিয়ে দে– আমার হেঁশেলে আ-সড়ি ডাল- চস্তড়ি আছে, এনে দিচ্ছি। আর একটু দুধ দিই– তাতেই হয়ে যাবে। নে-নে–হাঁ করে শুয়ে থাকিস নি, ওঠ।’
তা ত উঠছি। কিন্তু মা, আমার হেঁশেলে খাবে– বামুন বুঝি?’
‘ওলো হ্যাঁ। নেকী! বামুন বামুন–তোদের পালটি ঘর! ঘোষাল বামুন– তবে বামুন ত? তোরাই বা কি এমন নৈকুষ্যি কুলীন? পূজুরী বামুন আবার বামুন! নে নে তাকিয়ে থাকিস নি অমন জড়-ভরত হয়ে। ওর বড় ছেলের বে এখনও হয়নি
རྣ བ ཁ འབད
রাত হয়ে
২১১
বোধ হয়। হ’লেও আরো দুটো বাকী। সব রেল অফিসে কাজ করে। তো মেয়ে খেঁদিকে দেখেছে– দেখে পছন্দও হয়েছে। সেই জন্যেই ত তোর খপ্পরে গুনে ফেলেছি। দ্যাখ যদি খেলিয়ে তুলতে পারিস! আমার হেঁশেল থেকে ত ভাত দিতে পারবো না– বামুন-ঠাকরুনের জ্বর- আমাদের ছোঁয়া নেপায় হয়েছে। এ এক রকম শাপে বর হ’ল, কী বলিস!’
মঙ্গলা ভারি খুশী হয়ে উঠেছেন ততক্ষণে। এ এক রকম খেলা। বৈচিত্র্যহীন জীবনে বর্ণাঢ্য বিচিত্রতা। তিনি নিজেই বিপুল দেহ নেড়ে যতটা পারেন সাহায্য করেন। পাতা এগিয়ে দেন উনুনে গোছা গোছা ক’রে।
শ্যামাও ইঙ্গিতটা বুঝে ফেলেছে বৈকি।
শুধু আলুভাতেই নয়– কদিন আগে হেম সিধে পেয়েছিল কোথায়, তাতে একটু গাওয়া ঘি পাওয়া গিয়েছিল, পাঁপরও ছিল দুখানা। এ খাবার এদেশে দুর্লভ বলে সযত্নে তুলে রেখেছিল শ্যামা, জামাই আসার অপেক্ষায়। ডাল আর একথাল চস্তড়ি মঙ্গলা এনে দিয়েছিলেন ওঁদের হেশেল থেকে; শ্যামা তাড়াতাড়ি করে দিলে বড়িভাজা, পাঁপরভাজা বড়ির ঝাল। গরম ভাতে গাওয়া ঘি ঢেলে দিয়ে সযত্নে ঠাঁই করে খেতে দিলে শ্যামা। ইতিমধ্যে মঙ্গলা ঠাকরুন ঐন্দ্রিলাকে একটু সাজিয়ে-গুজিয়ে দিয়েছেন। মাধব ঘোষালের সামনে শ্যামা বেরোবে না– যা দরকার হবে ঐন্দ্রিলাই দেবে।
এদের রান্নাঘরের দাওয়ায় খেতে বসে একটু অবাকই হয়ে গেলেন মাধব ঘোষাল। বাটির মত ছোট করে ভাত বাড়া, তার ওপর ছোট একটি বাটিতে গাওয়া ঘি– ভাতের চূড়োর ওপর বসানো, ভাতে ভাজা তরকারি নিখুঁত পরিপাটির সঙ্গে সাজানো– থালারই এক কোণে গোল ক’রে কলা-পাতা কেটে তাতে নুন-লেবু, সবটার ভেতরই যেন একটা নাগরিক পারিপাট্য।
পরিতৃপ্তির সঙ্গেই খেলেন। ক্ষুধার অন্ন বলেই নয়, আয়োজনও ভাল। মঙ্গলা একটু দুধ এনে দিয়েছিলেন। সেই দুধের বাটিতে একটা পাকা কলা ও গুড় দিয়ে ঐন্দ্রিলা এনে পাতার কাছে নামিয়ে রেখে প্রশ্ন করলে, ‘আর দুটি ভাত এনে দিই আপনাকে?’
তার সেই ‘সবিনয়’ ভঙ্গিমা, শুভ্র গৌর গন্ডে লজ্জারক্ত লালিমা– সবটা জড়িয়ে বড় ভাল লাগল মাধববাবুর। তিনি বললেন, ‘তা আনো মা। খুব দুটিখানি!’
তারপর ভাত খাওয়া শেষ হলে আঁচিয়ে উঠে পান নেবার সময় ওর গালটি তুলে ধরে মাধববাবু প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি আমাদের বাড়ি যাবে মা-লক্ষ্মী?’
সপ্রতিভ ঐন্দ্রিলা তৎক্ষনাৎ জবাব দিলে, ‘কেন যাবো না? আপনি বললেই যাবো! কিন্তু আপনিও আবার আসবেন– মা বলে দিলেন। আজ খাওয়ার বড় কষ্ট হ’ল, আর একদিন খবর দিয়ে আসবেন। কেমন?’
একটু মুচকি হেসে মাধব বললেন, ‘আসব বৈ কি। ঘন-ঘনই আসব হয়ত।’
অক্ষয়বাবুর ঘরে গিয়ে বসে কিছুক্ষণ নীরবে তামাক খেয়ে মাধববাবু বললেন, ‘আমি মন স্থির করেই ফেললাম। তুমি ভাই ওর মার কাছে কথাটা পাড়ো!’
‘কার সঙ্গে?’
‘আমার বড়ো ছেলে– হরিনাথ। তার ত এখনো বিয়ে হয় নি।
‘তার বয়স কত হ’ল? মানাবে? এর বড় জোর দশ।’
‘বয়স ওর একটু বেশীই হয়েছে। ঠিক মনে নেই আমার, তবে তেইশ-চব্বিশের কম না। হয়ত পঁচিশ হতে পারে, তা আর কি হবে! লোকে ত দোজবরে ওর চেয়ে বেশী বয়সে বিয়ে করছে। ন দশ বছরের মেয়ে! আমাদের পাড়ার গোকুল মুখুজ্জে চল্লিশ বছর বয়সে যে সাত বছরের মেয়ে বিয়ে ক’রে বসল! না– না–তাতে আটকাবে না।’
অক্ষয় বললেন, ‘কিন্তু পয়সাকড়ি চুঁ-টু– তা বলে দিচ্ছি! শুধু ভাত মুখে উঠবে ত? বৌঠানের?’
হ্যাঁ, উনি একটু গোলমাল করবেন বটে। তবে আমি মন স্থির করে ফেলেছি। আমি ত এই, তায় আমার পরিবার একেবারে আবলুস — ছেলেমেয়েরা হয়েছে, চাওয়া যায় না। আমি ভাই একটু পনটাই বদলাতে চাই।’
তারপরে, যেন, মানসচক্ষে গৃহিণীর উগ্র মূর্তিটা একবার দেখে নিয়েই, কণ্ঠস্বরে জোর দিয়ে বললেন, ‘কি আর হবে– না হয় মাগী দশবাই-চন্ডী হয়ে খানিক নাচবে ধেই ধেই ক’রে! আর ত কিছু করতে পারবে না! তুমি দ্যাখো কথাটা পেড়ে।
হুঁকো নামিয়ে রেখে মাধব ঘোষাল আবার আড়গোড়ের পথ ধরলেন।
তিন
জোর বরাত বটে তোর মেয়ের; পাত্তর
মঙ্গলা ছুটতে ছুটতে এসে খবরটা দিলেন। ‘দাঁড়া-হরির নুট দে লো বাম্নি! হ্যাঁ পক্ষ নিজে থেকে সেধে কথা পাড়ে এমন ত কখনও শুনি নি। ইস্ আবার নিজেই স্বীকার হয়ে গেল যে পয়সার কামড় করবে না!
–
আনন্দের প্রথম আলোড়নটা থেমে যেতে শ্যামা ছেলের খবর নিতে লাগল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। মঙ্গলা জানেন না কিছুই। অক্ষয়বাবুকে বার বার জিজ্ঞাসা ক’রে আসতে হ’ল। অক্ষয়বাবুও বিশেষ কিছু জানেন না। শুধু জানেন যে, ওদের ঢের বিষয়সম্পত্তি আছে। জমি থেকে বছরের খোরাকী ধানটা উঠে যায়। চার ভাই ছেলেরা এইটি বড়। ইংরেজী ইস্কুলেও নাকি পড়েছিল ক-বছর। রেল অফিসে কাজ করে। সব দিক দিয়েই সুপাত্র। দোষের মধ্যে বয়স একটু বেশী আর রং নাকি কুচকুচে কালো।
কালো! বয়স বেশী জন্যে ভাবি না মা– কিন্তু মেয়ের আমার ত দেখেছেন কালোতে কি ঘেন্না! শেষে জামাইয়ের সামনে বাঁকা বাঁকা কথা বলবে না ত?’
‘ওলো থাম্ দিকি। অমন কত ঘেন্না দেখলুম! রাখ। সব ঠিক হয়ে যাবে। পুরুষের আবার রূপ নিয়ে ব্যাখ্যানা! নে, কলকাতায় চিঠি
তার মা-মাগীর কাছ
থেকে কিছু বাগাতে পারিস কিনা!’
কলকাতায় চিঠি
–
২১৩
শ্যামা সেই উপদেশই শোনে। রাত্রে পিদিমের আলোতে বসে দীর্ঘ পত্র লেখে উমাকে। মার শরীর খারাপ– তাছাড়া তিনি আজকাল যেন কি রকম উদাসীন হয়ে পড়েছেন! যা করবে উমাই।
পাত্রের মোটামুটি বিবরণ দিয়ে, সেদিনের ঘটনাটা আনুপূর্বিক বিবৃত করে শ্যামা শেষ অনুচ্ছেদে লিখলে।
এমন অযাচিত ভাবে পাত্রপক্ষ আসিয়া পড়ায় এবং নিজ হইতে প্রস্তাব করায় ঘটনাকে প্রজাপতির নির্বন্ধ বলিয়াই বোধ হইতেছে। এ প্রস্তাবে আপত্তি করাও কিছু দেখিতেছি না। আমার মত ভিখারীর মেয়ের আর ইহা অপেক্ষা ভাল সম্বন্ধ কি হইতে পারে? আশা করি তুমি বা মা-ও এ পাত্র অপছন্দ করিবে না। একমাত্র যা পাত্রের গায়ের রং শ্যামবর্ণ। তা সব কি আর মনের মাত হয়? তবে শুনিতেছি স্বাস্থ্য খুব
ভাল!
এক্ষণে কথা হইতেছে, এ মেয়ে তোমারই। তোমার অমতে কিছু হইতে পারে না। তোমার নিকট হইতে কথা না পাইলে আমি কোন চেষ্টা করিব না। মার শরীর খারাপ- আমার ইচ্ছা বিবাহ কলিকাতার বাড়ি হইতেই দিই। তাহা না হইলে মা কোন নাতি-নাতনীর বিবাহই দেখিতে পাইবেন না। আশা করি ইহাতে তোমার কোন আপত্তি হইবে না।’
অনেক মুন্সিয়ানা করে চিঠিটা লিখলে শ্যামা। দেনা-পাওয়ার কথা এক-বার ও উল্লেখ করলে না। কলকাতার বাড়িতে বিয়ে দিলে সবই ওদের ঘাড়ে পড়বে– তখন কি আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারবে! শ্যামা খামখানা মুড়তে মুড়তে আপন মনেই হেসে উঠল।
চিঠিটা পড়ে উমাও হাসল অনেকক্ষণ ধরে। শ্যামার চালাকি কি আজও সে ধরতে পারবে না– শ্যামা এতই বোকা ভাবে নাকি ওকে? আশ্চর্য!
রাসমণিও চিঠিখানা পড়লেন। ঐন্দ্রিলার ওপর এই ক’বছরে ওঁরও একটা মায়া পড়ে গিয়েছে। মুখে স্বীকার না করলেও মনে স্বীকার করতে বাধ্য তিনি
সেদিন আর কিছু বললেন না। পরের দিন উমা যখন এসে প্রশ্ন করলে, তাহলে ছোড়দিকে কী লিখব মা?’ তখন একটু চুপ ক’রে থেকে বললেন, আমি পঞ্চাশটা টাকা দেব, আর আমার কানের কেরাপাত জোড়া। তবে ওসব ঝঞ্ঝাট এখানে হবে না, তাই লিখে দাও।’
উমা এই প্রস্তাব জানিয়ে নিজেরটাও জুড়ে দিলে। তার হাতে নিজস্ব পনরো ষোল টাকা আছে, ভাল শাড়ি যেন সেই টাকায় একটা কিনে দেয় হেম। মার শরীর খারাপ, তিনি যেতে পারবেন না। এখানে ত বিয়ে দেওয়া অসম্ভব। চেঁচামেচি গোলমাল রাসমণি একদম সহ্য করতে পারেন না। সুতরাং তাদের বাদ দিয়েই যেন শ্যামা মেয়ের বিয়ের আয়োজন করে। বরং যদি মেয়ে-জামাই একদিন আসে ত খুব ভাল হয়– যথাসাধ্য আদর-যত্ন সে করবে। আর তাহলে রাসমণিও নাতজামাই দেখতে পাবেন।
218
শ্যামা এই কঠিন চিঠির জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে আশা করেছিল ঢের–তার কিছুই পেলে না। তবে পড়ে-পাওয়া চোদ্দআনাই লাভ! মঙ্গলা কিছু ধার দেবেন, হেমও তার যজমান বাড়ি চেয়ে-চিন্তে কিছু আনতে পারবে। হয়েই যাবে একরকম ক’রে।
কিছু দিতে পারবে না বলেও একেবারে অব্যাহতি পায় নি শ্যামা। শাশুড়ী বেঁচে আছেন, খুব বেশী কষাকষি করতে গেলে হয়ত বিগড়ে যাবেন। শ্বশুরও তখন পিছিয়ে যাবেন হয়ত। একশ এক টাকা নগদ। আট গাছা চুড়ি। জামাইয়ের আংটি চেলির জোড় দান ত আছেই। সব জড়িয়ে অনেক পড়ে যাবে।
কিন্তু উপায় কি?
শ্যামা একবার শেষ চেষ্টা করে দেখলে।
ঐন্দ্রিলার বিয়ের কথার পর কলকাতা চলে এসেছিল, আশীর্বাদ উপলক্ষে নিয়ে যেতে হবে। শ্যামা নিজে নিতে এল ওকে। কলকাতা থেকে কিছু বাজার করে নিয়ে যাবে হেম, সেই সঙ্গেই ওরা ফিরবে।
হেঁটেই এল শ্যামা। বরাবরই তাই আসে। সঙ্গে কোলের ছেলে কান্তটাকে কাঁঠে করেই হাঁটতে হয়েছে। কিন্তু উপায় কি?
উমা মৃদু অনুযোগ করলে, ‘এত কান্ড ক’রে তোমার আসবার দরকার কি ছিল ছোড়দি!
‘এ ত আমিই রে। বিয়ের আগে তোদের সঙ্গে একবার দেখা করব না তাই বলে ‘ পথশ্রম কাটিয়ে আহারাদি করে শ্যামা মার কাছে গিয়ে বসল। রাসমণি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন একেবারে। সেদিন জ্বরটা ছিল না, তবু শুয়েই ছিলেন। বিছানারই এক পাশে বসে খানিকক্ষণ নিঃশব্দে পায়ে হাত বুলোবার পর শ্যামা বললে, ‘মা, আপনাকে যদি একখানা গাড়ি করে নিয়ে যাই এখান থেকে—- সোজা! আপনি যেতে পরবেন না? খেঁদির বিয়েটা দেখতেন!’
রাসমণি চোখ বুজে শুয়ে ছিলেন, সেই ভাবেই রইলেন। সংক্ষেপে শুধু বললেন ‘না।’
‘কেন মা?’ শ্যামা আবার প্রশ্ন করে।
‘ইচ্ছে নেই!’ সংক্ষিপ্ত উত্তর।
একটু পরে চোখ খুলে বললেন, ‘জামাই-বাড়ি আমি যাবো না–তা ত ভাল করেই জানো মা, আমার শরীরও বইবে না। সেজন্যে তুমি আসোও নি! মতলবটা কি খুলে বলো দিকি? তুমি আমার পেটে হয়েছ মা, আমি তোমার পেটে হই নি। আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না!’
নেই।
শ্যামা একটু ক্ষুণ্নই হ’ল। সবটাই কি সত্যি-সত্যিই তার স্বার্থ।
হয়ত উমাই দিনরাত ওঁকে বোঝায় যে ছোড়দির শুধু স্বার্থ ছাড়া অন্য কোন চিন্তা
বেশ একটা আহত ভাবই দেখাতে পারত শ্যামা, বক্তব্যটা মুহূর্ত-কয়েকের মধ্যেই মনে মনে গুছিয়ে এনেছিল কিন্তু সব মাটি ক’রে দিল হাতভাগা মেয়েটা। এখানে
২১৫-
আসবার আগে মঙ্গলার সঙ্গে শ্যামার কথাবার্তা সে কিছু কিছু শুনেছিল। সে কুট্ করে বলে বসল, ‘মা কেন এসেছে জানেন দিদিমা, দানের বাসনগুলো বাগাতে! যদি পাওয়া যায়?’
‘তুই ছোট মুখে বড় কথা বলিস কেন বল ত– সব তাইতে! যা, সুমুখ থেকে বেরিয়ে যা বলছি। হতচ্ছাড়ী বাঁদরী মেয়ে কোথাকার! আমি ওর ইয়ার!
তারপর একটু থেমে ওপাশে দেওয়ালটার দিকে চেয়ে বললে, ‘সত্যি কথাই ত, চেয়ে-চিন্তে ভিক্ষে করেই যখন আমাকে বিয়ে দিতে হবে তখন আর চক্ষুলজ্জা করলে চলবে কেন?… বাসন কখানা যদি দিতে পারেন তা সত্যিই উদ্গার হয়!’
রাসমণি আবার সংক্ষেপে বললেন, ‘সে এখন হবে না বাছা।’
শ্যামার ধৈর্যের বাঁধ এবার ভাঙল, বললে, আপনার এক সিন্দুক বোঝাই বাসন, আমি কি তা থেকে দুখানা পেতে পারি না? ‘আমারও ত ভাগ একটা আছে!’
রাসমণি এবার পূর্ণদৃষ্টিতে চাইলেন ওর দিকে। কঠিন কন্ঠে বললেন, ‘আমি বেঁচে থাকতে কিসের ভাগ লা তোর? তাছাড়া আমি এখন কদিন বাঁচব তার ঠিক কি! হয়ত এরপর ঐ বাসন বেচেই খেতে হবে! মানুষের জীবনমরণ কি বলা যায় কিছু? না, ও আমি এখন হাতছাড়া করতে পারব না।
শ্যামা মাকে চিনত। ওঁর এ কণ্ঠস্বরের পর আর কিছু বলতে সাহস হ’ল না। ক্ষুণ্ণ মনেই নগদ পঞ্চাশটা টাকা আর কেরাপাত জোড়া আঁচলে বাঁধলে। কেবল অব্যাহতি পেলে না উমা। শুধু পনরোটা টাকা দেওয়া চলল না। টুকিটাকি দু-একটা জিনিস কিনে দিতে হল– ছাত্রীদের বাড়ি থেকে আরও দুচার টাকা আগাম চেয়ে এনে দিতে হল।
ঐন্দ্রিলা আশা করেছিল যে উমা শেষ অবধি যেতে রাজী হবে। উমাকে এই ক’বছরে সে একটু ভালই বেসেছিল। যাবার সময় বললে, তুমি সত্যিই যাবে না নাকি ছোট মাসি? ওমা, তবে কি হবে!’
শ্যামাও বললে, ‘চল না রে উমি, তোরই ত মেয়ের বিয়ে।’
উমা মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বললে, ‘আমার ছায়া যেন কোন বিয়েতে না পড়ে ছোড়দি– এ ত আপনার জন! অতি বড় শত্রু ও বিয়ের সময় যেন আমার মুখ না দেখে।’
শ্যামা ঠিক এ উত্তরটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এর পর কোন অনুরোধ করতে তারও মুখে বাধল। নীরবে নতমুখে খানিকটা দাঁড়িয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেমে গেল।
কী হ’ল ঐন্দ্রিলা তা বুঝল না কিন্তু উমার কন্ঠস্বরে অকারণেই তারও বুকটা উদ্বেল হয়ে দুই চোখে জল ভরে এল। মাসির সব কথা বোঝার মত বয়স তার হয় নি, সবটা শোনেও নি সে। শুধু এইটুকু বুঝলে যে এমন একটা শোচনীয় ব্যর্থতার ইতিহাস আছে
-এই বাইরের হাসিখুশি প্রতিদিনকার আচরণের আড়ালে- যার এক ভগ্নাংশও কোন মেয়ের জীবন থেকে সুখ-সৌভাগ্য হরণ করার পক্ষে যথেষ্ট। তাই মাসি তার দুর্ভাগ্যের ছায়া পর্যন্ত ফেলতে চায় না ওর বিবাহে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে নিজের ভাবী জীবন সম্বন্ধে কেমন এক ধরনের নাম-না জানা আশঙ্কা অনুভব করতে লাগল সে নিজের অজ্ঞাতেই। অতটা সে বুঝল না– শুধু মনটা ভারী হয়ে রইল অনেকক্ষণ পর্যন্ত।
চার
বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই শ্যামা একদিন মেয়ে জমাই নিয়ে এসে হাজির হ’ল। মহার বিয়ের পর এঁরা অভয়কে নিমন্ত্রণ করাতে দু-একদিন এসেছিল বটে কিন্তু সে একাই এসেছিল– এমন ঘটা ক’রে মেয়ে জামাই নিয়ে শ্যামা কখনও আসে নি। হঠাৎ এতখানি মনোযোগের কারণটা বুঝতে না পেরে উমা অনেক কিছুই আন্দাজ করতে চেষ্টা করে।
শ্যামার অবশ্য একটা কৈফিয়ত তৈরিই ছিল, ‘মায়ের যে অবস্থা দেখে গেলুম, খেঁদির বর যে দেখাতে পারব এ আশা আর ছিল না। তাড়াতাড়ি তাই হুড়তে পুড়তে ছুঁড়তে ছুটে এলুম। তা জামাইয়ের আবার ছুটি হবে তবে ত! রবিবারের সঙ্গে আর একটা দিন ছুটি পড়ল এবার, তাই আর দেরি করলুম না।’
ঐন্দ্রিলার বরের দিকে তাকিয়ে উমা স্তম্ভিত হয়ে গেল।
এ যে শ্যামা-শিবের উল্টোটা! যে মেয়ে কালো হাঁড়িতে খেতে চাইত না, কালো মাছ পাতে দিলে উঠে চলে যেত– তার এ কি বর হ’ল?
কুচকুচ্ েকালো হরিনাথ। এত কালো যে চোখমুখ অন্ধকারে বোঝা কঠিন।
কিন্তু স্বাস্থ্যবান ছেলে। তেমনি বিনীত ও ভদ্র। কথা বলতেও জানে অভয়ের মত গম্ভীর স্বল্পভাষী নয়। বেশ হাশি-খুশি স্বভাবের। খানিক কথাবার্তা বলবার পর উমার ভালই লাগল জামাইকে।
শ্যামাও বার বার বলতে লাগল, ‘এই-ই বলতে গেলে তোমার আসল শাশুড়ী বাবা, আমি ত মেয়ে পেটে ধরেই খালাস!’
ওর এই অতিশয়োক্তিতে লজ্জা করে উমার। এসব কথার সঙ্গে যে কৌতূহল জড়িয়ে থাকা স্বভাবিক– কেন উমা বাপের বাড়ি থাকে, কেন ঐন্দ্রিলার বিবাহে যায় নি– সে কথা উঠেছে কিনা হরিনাথ কিছু শুনেছে কিনা কে জানে! যদি সব শুনে থাকে ত কি লজ্জা!
ছি-ছি! স্বামী যাকে গ্রহণ করলে না, সে স্ত্রীর কোন ভদ্র সমাজেই বুঝি মুখ দেখানো উচিত নয়।
কিন্তু হরিনাথের কথা থেকে কিছুই বোঝ যায় না। সে সহজভাবেই এটা ওটা গল্প ক’রে যায়। রাসমণির সঙ্গে দু-একটা রসিকতার চেষ্টাও করে। তবে রাসমণির সহজ গাম্ভীর্যে ও নিস্পৃহ নিরাসক্তিতে ধাক্কা খেয়ে সে রসিকতা জমতে পায় না। অবশ্য রাসমণিও ভাল লাগে হরিনাথেকে। তিনি সামনে বসি ওরে ওয়ান। মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন।
ওদের ঘরবাড়ি পরিবার সম্বন্ধে দু-একটা প্রশ্ন করেন রাসমণি। হরিনাথও বেশ খুঁটিয়ে সব জানায়। বহুক্ষণ ধরে বসে গল্প করে।
বিরাট একান্নবর্তী সংসার ছিল ওদের। এই সবে ওর বাবা ও কাকারা পৃথক হয়েছেন। তবে মামলা-মকদ্দমা কিছু হতে দেন নি বাবা। তিনটি সমান ভাগ করে কাকাদের বলেছেন এক একটা ভাগ বেছে নিতে। যে ভাগটা বেছেছে সেইটিই উনি নিয়েছেন। তাতে ঠকেন নি মাধব ঘোষাল বরং কিছু যেন জিতেছেনই। সকলেই রেলে চাকরি করে। কেবল ছোট ভাইটা স্কুলে পড়ছে। জমি-জমা যা আছে তাতে বছরের ভাত হয়ে যায়। গরু বাছুর আছে। ছাগলও ছিল– গুরুদের এসে বারণ করেছেন, পূর্বধর্ম বিনাশপ্রাপ্ত হয় ছাগলনাদি মাড়ালে– তাই বাবা বিলিয়ে দিয়েছেন বাধ্য হয়ে। মোটামুটি ওদের সুখের সংসার। এক বুড়ী ঠাকুমা আছেন, বাপের পিসি– তা তিনিও মানুষ ভাল। আপন মনেই বকেন। তবে ঝগড়াঝাঁটি বিশেষ করেন না।
অনর্গল বকে যায় হরিনাথ।
–
ওর বিয়েতে কি কম বাগড়া পড়েছিল? বিয়ে হয়ত বন্ধই হয়ে যেত। বিয়ের ঠিক দুটি দিন আগে ওর এক ভাই বিপিন আসছিল শিবপুর থেকে–পথে এক পুলিস- হঙ্গামে জড়িয়ে পড়ে। কতকগুলো স্বদেশী ছেলে আসছিল সেই পথে– ওকে পেয়ে ওর সঙ্গে সেধে গল্প করতে শুরু করে। বিপিন অত জানত না। হঠাৎ পুলিস ঘেরাও করে। তিন দফা চার্জ তাদের নামে– ডাকাতি, নরহত্যা, আরও একটা কি। সেই কথা শুনে বাড়িতে ত কান্নাকাটি। ওর বাবা ছুটলেন তখনই হাওড়ায়– ভাগ্যিস ওর সঙ্গে বিয়ের বাজার ছিল, আর ডাকাতির দিন সে অফিসে ছিল, সাহেব নিজে লিখে দিলেন, তাই কোনমতে ঘুষ-ঘাষ দিয়ে মাধববাবু ছাড়িয়ে আনতে পেরেছিলেন। তাও ত্রিশ ঘন্টা হাজতবাস করতে হয়েছিল। বিপিন ছাড়া না পেলে হয়ত এ বিয়েই হত না। ওর মা ছেলেদের বড্ড ভালবাসেন কি না–
এমনি কত কথা বলে যায় হরিনাথ। শ্রান্ত অর্ধনিমীলিত চোখ দুটি মেলে শোনেন রাসমণি। পৃথিবী থেকে একটা পা বাড়িয়ে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন তিনি এখন এ সব কথা যেন শিশুকণ্ঠের কাকলি বলে মনে হয়। তবুও মিষ্টি লাগে শুনতে। নবীন জীবন এদের, আশা আকাঙ্ক্ষা আসক্তিতে ভরপুর। আহা বেঁচে থাক, ভোগ করুক জীবনটা! তাঁর রক্ত আছে বলেই ভয় হয়। তাঁর দুখ ও দুর্ভাগ্যের ছোঁয়া না লাগে ওদের জীবনে। প্রসারিত জীবনপত্র ওদের সহজ ও ছায়া-শীতল হোক—- কাঁটা যা কিছু তাঁদের মা-মেয়ের ভাগ্যেই যেন শেষ হয়ে যায়।
বল্!
-স্তিমিত চোখে স্নেহ ও আশীর্বাদ উপচে পড়ে রাসমণির।
মৃত্যু-
ঐন্দ্রিলাকে নির্জনে পেয়ে প্রশ্ন করে
পাঁচ
য়েছে ত? ঠিক করে
আশার বই
ঐন্দ্রিলার শুভ্র গাল দুটিতে কে যেন মুঠো করে আবির ছড়িয়ে দেয়। মাথা হেট হয়ে আসে লজ্জায়। তবু পাকা বুড়ীর মতই উত্তর দেয়, ‘ওমা, তা না হয়ে আর উপায় আছে! মেয়েমানুষের বর আবার পচন্দ অপচন্দ কি বলো? এত একজন্মের কথা নয় কিংবা কাপড়-জামাও নয় যে অপচন্দ হ’ল আর ছেড়ে দিলুম! এ যে জন্মান্তরের সম্বন্ধ গো।’
উমার মুখটাও রাঙা হয়ে ওঠে নিমেষে।
―
জন্মান্তরের সম্বন্ধ– ঠিকই ত! কিন্তু জন্ম-জন্মই কি তাকে এই অভিশাপের বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়েছে আর হবে? ঐ স্ত্রীলোকটাও কি জন্ম জন্ম ধরে তার স্বামীকে অনুসরণ করছে? নাকি ওরই সম্পর্কটা জন্ম-জন্মের– নেহাত কোন অভিশাপে এবার নিচু ঘরে এসে জন্মেছে কিন্তু ঐকান্তিক আগ্রহ ও প্রেমে স্বামীকে টেনে এনেছে নিচে!….. তাহলে উমার সম্পর্কটা কি ছিল?
অবোধ্য কতকগুলো প্রশ্ন মনের মধ্যে নিমেষে জেগে নিমেষেই মিলিয়ে যায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি-হাসি মুখেই প্রশ্ন করে উমা, ‘তবে যে বড় কালোকে ঘেন্না করতিস! কত বিচক্ষণা করতিস কালো জিনিস নিয়ে। কইমাছ মাগুরমাছ খেতিস না। এখন এত কালো সহ্য করছিস কি করে?’
>
হাত-পা নেড়ে ঐন্দ্রিলা বলে, ‘সে কেলঙ্কারের কথা আরি বলো না ছোট মাসি। কালো শুনেছিলুম এই পজ্জন্ত, বে’র সময় ত আর চেয়ে দেখতে পারি নি ভাল করে। ভয়ে লজ্জায় যেন চোখ বুজে আসছিল, চোখ মেলে চাইব কি। শুভদৃষ্টির সময় একবার চোখ চেয়েছিলুম কিন্তু সত্যি বলছি। মাসি সে সময় ভাল করে কিচ্ছু নজরে পড়ে নি। হারিকেন লন্ঠনের আলোতে ঝাপসা ঝাপসা কী যেন একটা, সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। পরে দিন কুসুমডিঙের সময় ত আগাগোড়া ঘাড় হেট করে বসে। মা শিখিয়ে দিয়েছিল, খবরদার মাথা তুলবি নি, তাহলে লোকে বলবে বৌটা বেহায়া। একেবারে ফূলশয্যের রাত্তিরে সময় মিলল। কিন্তু আমি ত সেয়ানা আছি, জানি সবাই আড়ি পাতবে, আমি বিছানায় শুয়েই বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলূম। ও হরি, ভান ভান– রাতও ত ঢের হয়ে গিছল– আমি সত্যি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।’
এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে, বোধ হয় দম নেবার জন্যেই থামল ঐন্দ্রিলা। কিন্তু থামলে উমার চলে না। ঐ বালিকার আনন্দের নেশা লেগেছে তার মনে। সে সাগ্রহে বললে, ‘তারপর?’
*
‘তারপর–আদ্দেক রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেছে, আপনিই কি ক’রে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে চেয়ে দেখি– মাগো মা, বললে বিশ্বাস করবে না ছোট মাসি– ঠিক মনে হল একটা বুনো মোষ শুয়ে আছে আমার পাশে। আমার এমন ভয় হল— আমি একেবারে ডুকরে কেঁদে উঠেছি। লোকটা কিন্তু খুব চালাক, বুঝলে সেই শব্দে ওরও ঘুম ভেঙে উঠেই এক লাফে মেঝেতে
গেছে, আর ও না– উঠেই বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। নেমে, ঘরে যে পিদিম জ্বলছিল সেটা নিভিয়ে দিয়ে ফিরে এসে আমার হাত দুটো ধরে বললে, ‘ভয় কি– আমাকে দেখে কি তোমার ভয় করছে? আমি ত বাঘ-ভালুক নই।
= ২১৯
দ্যাখো–এখন ত আর ভয় করছে না!’
‘তখন? তুই কি বললি?’ রুদ্ধ নিঃশ্বাসে প্রশ্ন করে উমা।
‘আমার তখন অন্য ভয় হয়েছে। আমি বললুম, ‘তুমি যে আলোটা বড় ফস করে নিবিয়ে দিলে, অলুক্ষুণ হবে না? ফুলশয্যের রাত্তিরে আলো যে নিবুতে নেই!’… ও লোকটা তখন আমায় খুব আদর-টাদর করে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললে, রাত আর কোথায়? ভোর হতে বেশি দেরি নেই। তা বলো ত আবার জ্বেলে দিই। মোদ্দা আমাকে দেখে ভয় পাবে না ত? আমি তখন–’
লজ্জায় রাঙা হয়ে এইখানেই থেমে গেল ঐন্দ্রিলা। উমাও প্রশ্ন করলে না। একটুখানি চুপ করে থেকে শুধু বললে, ‘তা জামাইটি বাপু বেশ, আমার ত খুব পছন্দ হয়েছে– কী বলিস!’
আবার উৎসাহে যেন সোজা হয়ে ওঠে ঐন্দ্রিলা, ‘সে কথা একশবার। লোকটা খুব ভাল মাসি, এত ভাল যে বাইরে থেকে দেখে তার কিছুই বোঝা যায় না। ওর আবার বাসাই খাবার অব্যেস আছে জানো, ত আমি বলেছিলুম, ওসব ছাইভস্ম খাও কেন– মুখে যে বিচ্ছিরি গন্ধ হয়! তা সেই দিন থেকে রাত্তিরে খাওয়ার পর মোটে খায় না। পাছে মুখে গন্ধ হয়! এদান্তে আবার আমার মায়া হয়– বলি, তা বাপু খাও না, তোমার যখন এত দিনের অব্যেস! তাও খায় না, বলে– আমার অব্যেসটা বড় কথা না তোমার কষ্টটা বড় কথা?’
উমার বুকের কাছে কি একটা নিঃশ্বাস আটকে যায়!
আস্তে আস্তে সে বলে, ‘তা তুই ঘর করতে কবে যাবি? এক বছর পর?’
এদিক-ওদিক চেয়ে চুপিচুপি উমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে ঐন্দ্রিলা, ‘মা তাই বলছে। আমার কিন্তু বাপু তা পছন্দ নয়। আমি ওকে শিখিয়ে দিয়েছি জোর করতে। ও জেদ করলে মা আর রাখতে পারবে না। ‘ধুলো পায়ে দিন’ ত করাই আছে। দিদির বেলা হয়েছিল, কায়েত দিদি বললে এবারও করিয়ে রাখতে। আসল কথা কি জানো মাসি– আগে ভাবতুম বুঝি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে একদিনও থাকতে পারব না, কিন্তু এখন হয়েছে ঠিক উলটো, ওকে ছেড়ে এক দন্ড এখন আর থাকতে ইচ্ছে করে না। বড্ড মন কেমন করে!’
উমার ম্লান মুখেও কৌতুকের হাসি ফুটে ওঠে, ‘ও-টা আবার কে রে?’
হাসি চাপতে চাপতে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে ঐন্দ্রিলা উত্তর দেয়,
আবার? ঐ বুনো মোষটা!’
শ্যামাও খুঁজে বেড়ায় কখন উমাকে একটু নির্জনে, পাওয়া যাবে!
কে
‘হ্যাঁ রে উমি, একটা কথা ভাবছি কাল থেকে। মা ত শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন, তোর ত চার-পাঁচ ঘন্টা বইরে কাজ– একটা ত কাউকে হাত-নুড়কুৎ রাখতে হয়! তা আমি বলি কি কালই না হয় হেমের সঙ্গে তরুটাকে পাঠিয়ে দিই? কী বলিস?’
দুটি হাত জোড় করে উমা বলে, ‘ঐটি তুমি মাপ করো ছোড়দি। আর না। ভগবান যা দেন নি তা জোর করে পেতে চাই না। ঐন্দ্রিলা যখন যায় তখন সাতরাত ঘুমোতে
পারি ন
না, শখ আমার মিটে গেছে।’
অপ্রসন্ন মুখে শ্যামা বলে, ‘মার অসুখ বলেই বলা– নইলে আর কি বল! লেখাপড়া শিখবে এ আশা আর আমি করি না। খেঁদিটা তো কতই শিখলে! আপনার লোককে কি আর পড়ানো যায়? মাইনে দিলে তবে চাড় হয়!’
উমা উত্তর দিতে গিয়েও সামলে নেয়। সহজ কণ্ঠেই বলে, ‘মার জন্যে ভাবতে হবে না। দিদি ত দুপুরে এসে থাকেই মনে করছি এবার জোর করেই দিদির বাসা উঠিয়ে ওদের এখানে এনে রাখব।’
দিদি এবং গোবিন্দ।
মা কবে মারা যাবেন শ্যামা হয়ত খবরও পাবে না। হয়ত বা মরবার আগেই মার কি খেয়াল হবে, যা কিছু আছে ওদের মধ্যে ভাগ করে দেবেন। বলা ত যায় না। মরবার মুখে মতিচ্ছন্ন, কথাতেই আছে! মার যে একেবারে কিছু নেই– তা নয়। তাহলে এ ঠাট বজায় থাকত না।
আরও একবার চেষ্টা করে দেখে সে, ‘তা দিদি এলেও ত তার সুবিধে হত। হাতের কাছে–’
উমা চুপ ক’রে থাকে।
‘দিদি এলে না হয় জিজ্ঞেস করি!’ কতকটা আপন মনেই বলে শ্যামা।
‘দোহাই তোমার ছোড়দি। আমাকে অব্যাহতি দাও– তোমার পায়ে পড়ি। এসব জ্বালা আর আমার সহ্য হয় না।’
‘জানি নে বাছা। আপনার লোক অসহ্য হয়– পর ভাল। কালে কালে কতই শুনব? তুমি যে কেন আমার ছেলেমেয়েকে সহ্য করতে পারো না। তাও বুঝি না! ওরা তোমার কি করলে?’
রাগ করেই সেখানে থেকে উঠে যায় শ্যামা।
উমা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সেখানে।
হয়ত এতটা না বললেও হত। কিন্তু সত্যিই, সে-ও আর পারে না।