১৩. মহাশ্বেতার বিয়ে

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।

সত্যি-সত্যিই যে মহাশ্বেতার এখানেই বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে তা শ্যামা কখনও ভাবে নি এমন কি যখন দিন পর্যন্ত স্থির হয়ে গেল তখনও যেন তার বিশ্বাস হ’তে চায় না কথাটা। তা মঙ্গলা করেছেনও ঢের তিনি একরকম জোর ক’রেই ছেলের মাকে চেপে ধরে এ সম্বন্ধে রাজী করিয়েছেন। একান্ন টাকা নগদ, চেলির জোড়, তিনখানা নমস্কারী, দানের বাসন আর দু’গাছা সোনাবাঁধানো পেটি, এই দিতে হবে। বাসন কিছু কিছু মঙ্গলা নিজের ঘর থেকে বার ক’রে দিলেন ঝালাই পালিশ ক’রে নেওয়া হ’ল। নগদ টাকাটা রাসমণি পাঠালেন। কমলা এত দুঃখের মধ্যেও পাঁচটা টাকা নগদ আর একখানা পার্সী শাড়ী পাঠিয়েছে। উমা ইদানীং ক্রুশ বুনে খুঞ্চিপোশ করে বিক্রি করে

তার হাতেও দু’চার টাকা জমেছে, সে তা থেকে পাঠিয়েছে পাঁচ টাকা। আর এধার- ওধার ক’রে কিছু চেয়ে-চিন্তে আনলে শ্যামা। একরকম ভিক্ষে ক’রেই। বাকী কিছু ধার হ’ল। মঙ্গলাই ধার দিলেন। কথা রইল মাসে মাসে দু-এক টাকা ক’রে শ্যামা শোধ

করবে মঙ্গলা সুদ নেবেন না।

শ্যামা পুরোনো ঠিকানায় বড় জায়ের নামেও একখানা চিঠি দিয়েছিল কিন্তু কোন উত্তর এল না। তবে আর একটা দিক থেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে কিন্তু এসে গেল। না এলে শ্যামা বিব্রত হ’ত কারণ বরযাত্রী আসবে ত্রিশ জন এ তাঁরা বলেই দিয়েছিলেন, ওটা কিছুতেই কমানো গেল না। বরদের নিকট-আত্মীয়ই নাকি ওর চেয়ে বেশি। এখানেও দু-একজনকে না বললে চলবে না। সরকারদের বাড়িতেই ছেলেবুড়ো নিয়ে বাইশ জন। পাড়াতেও আছে। মঙ্গলা অবশ্যই বারণ করেছিলেন এত হাঙ্গামা করতে কিন্তু শ্যামার তাতে মন ওঠেনি। এই প্রথম সন্তানের বিয়ে ওর, এই প্রথম কাজ ওর নিজের জীবনে ও সংসারে। যে রকম দেখে ও অভ্যস্ত বাল্যকাল থেকে, ঠিক সেরকম হবে না তা ত সে নিজেও জানে কিন্তু তাই বলে একেবারে সব কিছু বাদ,

সে সম্ভব নয়!

তাছাড়া মরুভূমে ওয়েসিস্ দেখা গেছে, তৃষ্ণার্ত পথিকের মন হয়ে উঠেছে দুরাশা- চঞ্চল। এখনই কত কি স্বপ্ন দেখেছে ওর কল্পনা –কত কি সুদুর ও অসম্ভব স্বপ্ন। মনে তাই জোরও এসেছে ঋণ করতে যেন আজ আর ভয় নেই। মনে মনে কোথায় এ আশ্বাস ওর জেগেছে যে, এ দেনা শোধ হয়ে যাবেই।

তবু হয়ত শেষে সামলানো যেত না

যদি না একত্রিশটা টাকা ভগবান প্রায়

ছপ্পড় ফুঁড়ে দিতেন! মঙ্গলা বললেন, ‘মেয়েরই পয় বামুন মা। মেয়ে আয়-পয় ফলাবে বলেই মনে হচ্ছে।’

কি ক’রে যে টাকাটা এল

তা আজও যেন শ্যামার ধারণার অতীত। অত সাহসই যে কে ওকে দিয়েছিল! সত্যিই বোধ হয় ভগবানের হাত।

বিয়ের ঠিক তিনদিন আগে নরেন এসে পড়ল কোথা থেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে। হাতে কচুপাতায় জড়ানো খানিকটা হরিণের মাংস আর সের দুই ময়দা।

একেবারে

‘ভাল ক’রে প্যাজ দিয়ে রাঁধ দিকি মাংসটা। চাটি খড় দিয়ে আগে সেদ্ধ ক’রে জলটা ফেলে দিস্— নইলে মেটে গন্ধ ছাড়বে, খেতে পারবি না!

তারপরই ওর চোখে ধরা পড়ল আয়োজনটা।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলে, ‘এ সব ব্যাপার কি? হ্যাঁ? এত সব চক্‌চকে বাসন, নতুন চৌকি, বরণডালা . বলি মতলবটা কিসের? কার বে?’

শ্যামা হাত থেকে মাংসটা নিয়ে রান্নাঘরে রেখে ঘটি ক’রে জল এনে দাঁড়িয়েছিল, ‘হাতটা আগে ধুয়ে নাও দিকি, বিয়ের খবর পরে নিলেও চলবে।’

নরেনের সুর সপ্তমে চড়ে গেল, ‘না, পরে নেবো না আমি। ওসব চালাকি চলবে না, বল্ শীগগির কার বে নইলে অনথ করব!’

‘বিয়ে আবার কার? তোমার মেয়ের?’

‘য়্যা! অদ্ভুত একটা সুর বার করে নরেন গলা দিয়ে, ‘আমার মেয়ের বিয়ে! আমি জানলুম না

আমার মেয়ের বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেল। দেওয়াচ্ছি আমি বিয়ে, ভাল ক’রে দেওয়াব! ঐ এক পাত্তরে তোদের মা-বেটি দু’জনকে পার করব এই বলে রাখছি। দেখে নিস!’

সে কি আস্ফালন ওর! যেন ধেই ধেই করে নাচতে লাগল সারা উটোনটা ময়! তবু শ্যামার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে নি। সে বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করলে, ‘দ্যাখো মিছিমিছি ছোটলোক্‌মি করো না বলে দিচ্ছি। তুমি কি বাড়িতে থাকো, না আমাদের খবর রাখো? তোমাকে বিয়ের কথা জানাবো কি, আমরা ক’দিন অন্তর খাই সে খবরটা জানবার চেষ্টা করেছ কখনও?’

>

‘থাম্ হারামজাদী, ওসব লম্বা লম্বা বাত রাখ্! আমার মেয়ের বে আমি দোব না, দোব না! বলে পাঠা তাদের এখুনি যে ওসব চলবে না। তারপরও যদি বিয়ে করতে আসে ত এই নাদ্‌না রইল, সব কটার মাথা যদি না ফাটিয়ে দিই ত আমার নাম নেই!’

চেঁচামেচিতে কখন অক্ষয়বাবু এসে পেছনে দাঁড়িয়েছেন ওরা কেউ টের পায় নি। তিনি এইবার একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘কিন্তু তাতে জেল হবে যে –চাই কি কেউ খুন হ’লে ফাঁসিও হতে পারে।’

জেল হয় খেটে নেব। তাতে কি, ও আমার অভ্যেস আছে। জেলকে ভয় করি নে। মোদ্দা মেয়ের বে আমি দিতে দোব না। দেখি কেমন ক’রে দ্যায় উ! মেয়ের বে দিয়ে উনি নিশ্চিন্ত হবেন! আমি বেঁচে থাকতে সেটি হচ্ছে না!’

308

অহেতুক একটা আক্রোশ যেন ওর কণ্ঠে।

অকস্মাৎ বোধ হয় ভগবানই বুকে দুর্জয় সাহস এনে দিলেন। শ্যামা মাথার কাপড়টা আর একটু টেনে দিয়ে অক্ষয়বাবুকে উদ্দেশ্য করে বললে, ‘আপনি একটু আসুন ত বাবা আমার সঙ্গে, আমি থানায় যাবো।’

থানা শব্দটা শোনাবার সঙ্গে সঙ্গেই বেলুন যেন চুপসে গেল। ‘উঃ! তবে ত ভয়ে আমি একেবারে কেঁচো হয়ে যাবো।

গিয়ে কি বলবি তাই শুনি!’

যা না থানায়, থানায়

কথাগুলো বলে, কিন্তু কণ্ঠস্বরে যে আর জোর নেই তা উপস্থিত সকল- কার কাছেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আর ওর সেই জোরের অভাবটাই যেন শ্যামার মনে অভূতপূর্ব একটা জোর এনে দেয়। কোথা থেকে যেন কথাগুলোও কে যুগিয়ে দেয় ওর মুখে, সে বেশ শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলে, ‘বলব যে তুমি রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে জুয়া খেল, আমি তা জেনে পুলিসে খবর দেব বলেছিলুম তাই তুমি চেঁচামেচি মারধোর করছ। কনস্টেবল্ চাইব তোমাকে বেঁধে নিয়ে যাবার জন্যে

এবার সত্যিই জোঁকের মুখে নুন পড়ল। মুখ কালি ক’রে একরকম ক্ষীণ কণ্ঠেই নরেন বললে, ‘যা না –বলগে যা না! বললেই অমনি তারা বিশ্বাস করছে কি না। সাক্ষী চাই নে, প্রমাণ চাই নে, কিছু না! এ যেন শ্বশুরবাড়ি!

তারপর গলা আরও নামিয়ে এনে বলে, ‘বেশ ত দিগে যা না তোর মেয়ের বে! আমার কি? আমি ত তোর ভালয় জন্যেই বলছি। বলি কে না কে ঠকিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে যাবে! তুই ত বুঝিস্ ছাই মেয়ে-মানুষ দশহাত কাপড়ে কাছা আঁটতে পারে না

বুদ্ধি ত একতিল ঘটে নেই! শুধু নাচতেই জানিস্।’

অক্ষয়বাবু এবার একটু তিরস্কারের ভঙ্গীতেই বললেন, মেয়ের আমার যদি বুদ্ধি না থাকত তাহ’লে কি আর তুমি বাঁচতে ঠাকুর, না এই সংসারটাই বজায় থাকত!… ও যা বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করেছে, তা তোমার ইহ-জীবনে জুটত না। নাও, আর বেশি গোল ক’রো না। চুপচাপ শুয়ে পড়ো গে। হ্যাঁ, আর দেখো, যেন মেয়ের দানের বাসনগুলো চুরি ক’রে বেচে দিয়ে এসো না! তাহ’লে কিন্তু মেয়ে যাক না যাক আমিই থানায় যাবো।’

সত্যি-সত্যিই চাদরটা খুলে আলনায় রেখে গজগজ করে বকতে বকতে গিয়ে নরেন বিছানায় শুয়ে পড়ল।

পরের দিন দুপুরবেলা ভাত চাপিয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে টাকার কথাটাই ভাবছে শ্যামা, পিকীর সেজ মেয়েটা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললে, ‘জানো বামুন মাসি, বামুন মেসোর কাছে অনেক টাকা আছে, অ-নে-ক টাকা! ‘

তুই কি ক’রে জানলি?’ শ্যামার চোখ-দুটো যেন লোভে আগ্রহে জ্বলে ওঠে।

‘এই যে এখন পুকুরে নাইতে নেমেছিল না! নেয়ে উঠে ভিজে কাপড়ের সঙ্গে

কোমর থেকে একটা গেঁজে খুলে কতকগুলো টাকা বার করে

রেখে গেঁজেটা শুকুতে দিয়েছে। আর বসে বসে তাই পাহারা

রপাড়ে ঘাসের ওপর

১৩৫

তবু যেন বিশ্বাস হয় না কথাটা। শ্যামা ঈষৎ সন্দিগ্ধ সুরে প্রশ্ন করে, ‘কি ক’রে জানলি সেটা গেঁজে? তুই গেঁজে কাকে বলে জানিস?’

‘হু লম্বা সুরে টেনে বলে কালীতারা, ‘গেঁজে জানি নি! দাদু কোথাও টাকা নিয়ে যেতে হ’লেই ত গেঁজেতে ক’রে নিয়ে যায়!’

শ্যামা ওর গাল টিপে আদর ক’রে বলে, ‘বড় ভাল খবর দিয়েছিস মা!’

‘আমায় বেশি ক’রে আনন্দনাড়ু খাওয়াবে!’ উৎসুক আগ্রহে প্রশ্ন করে কালী।’

‘নিশ্চয়। যত খেতে পারিস্!’

তখন আর উচ্চবাচ্য করলে না শ্যামা। বিকেলের দিকে যখন বিয়ের নানা যোগাড় উপলক্ষে মঙ্গলা এসে বাইরের রকে জাঁকিয়ে বসেছেন, শ্যামা সোজাসুজি গিয়ে নরেনকে বললে, ‘কৈ, কুড়িটা টাকা দাও ত, আমি আর কিছুতেই পেরে উঠছি না। ময়দা ঘি এখন ওসব বাকী, তবু ত মাছ মা কাল পুকুর থেকে ধরিয়ে দেবেন বলেছেন।’

‘টাকা! টাকা আমি কোথায় পাবো! এক পয়সা নেই আমার কাছে।

আরে ঘি কি হবে, তেলেভাজা লুচিই ত বেশ! কিংবা ভাত খাওয়াগে যা। বামুনবাড়ি তাতে দোষ নেই। পূজুরী বামুনের মেয়ের বিয়ে তাতে আবার লুচি!’

এখানে তেলেভাজা লুচি খাওয়ানোর

শ্যামা বললে, ‘এ তোমার গুপ্তিপাড়া নয় রেওয়াজ নেই। ভাত ত খাবেই না। দুপুরে বৌভাতের যজ্ঞি হ’লে চলত। বিয়েতে ভাত খাওয়াতে গেলে নিন্দে হবে। আর শুধু ত বিয়ের রাতই নয়– ফুলশয্যে পাঠানো আছে, দশটা টাকার কম কি ফুলশয্যে পাঠানো হবে!’

‘তবে মরগে যা! আমি কি জানি, নবাবী করতে হয় নিজের কোমরের বল বুঝে করবি!’

‘কোমরের বল বুঝেই ত করছি। যা কিছু ত আমি করছি, আর করছেন মা। তুমি যে জন্মদাতা পিতে বলে চেঁচাও তা তুমি কি করলে তাই শুনি! মেয়ে তোমার নয়?’

‘মেয়ে আমার তা হয়েছে কি! আমি ত আর বিয়ে দিতে যাই নি! আমার যখন ক্ষ্যামতা হ’ত আমি বিয়ে দিতুম! তুই কি আমার মত নিয়ে বিয়ে ঠিক করিছিলি?’

‘বেশ ত– তা যেমন করি নি তোমার ভরসায় ত ছিলুমও না। এসে পড়েছ, টাকাও আছে, তাই চাইছি। সংসারটা ত তোমার, সংসার-খরচ বলেই না হয় কিছু দিলে।’

‘আমি

আমার কাছে টাকা!’ যেন আকাশ থেকে পড়ে নরেন। উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় একেবারে, ‘আমি কোথায় টাকা পাবো? মাইরি, মা কালীর দিব্যি বলছি, আমার কাছে এক পয়সাও নেই।’

বাইরে থেকে মঙ্গলাও কতকটা স্বগতোক্তি করলেন, ‘তুই আর টাকা চাইবার লোক পেলি নে বামুন মেয়ে! ওর কাছে আবার টাকা!

কিন্তু শ্যামার মুখ ততক্ষণে কঠিন হয়ে হয়ে এসেছে, সে এক পা কাছে এগিয়ে গিয়ে বললে, ‘দ্যাখো, জেনেশুনে মিছিমিছি দিব্যিগুলো গেলো না বলে দিলুম। টাকা আমার চাই-ই— ভাল চাও ত দাও, নইলে তোমারই একদিন কি আমারই একদিন!’

‘মিছিমিছি!’ আরও আকাশ থেকে পড়ে যেন নরেন, ‘এ যদি মিছে হয় কি বলিছি, তোর ঐ ছেলের দিব্যি, বলছি হাতে আমার এক পয়সাও নেই! বলিস্ ত ছেলের

মাথায় হাত দিয়ে

་་་་

১৩৬

‘ফের?’

বলেই শ্যামা ওর কোমরে কোঁচার যে কাপড়টা সযত্বে জড়ানো বাঁধা ছিল তাতে এক হ্যাঁচকা টান মেরে গেঁজেটা টেনে বার করলে। হয়ত ভাল ক’রে মুখবন্ধ ছিল না বা আর কিছু গেঁজেটায় টান দিতেই ঝন্‌ঝন্ ক’রে টাকাগুলো ছড়িয়ে পড়ে গেল

মেঝেতে।

সত্যিই যে ওর কাছে অতগুলো টাকা আছে তা শ্যামা আশা করে নি। সে মুহূর্তকয়েক যেন সেই রজতমুদ্রা বর্ষণের শব্দের মধ্যে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু সে যথার্থই কয়েক মুহূর্ত মাত্র, তারপরেই ক্রোধে দিগ্বিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে, যতটা শক্তি ওর হাতে ছিল তার সবটা প্রয়োগ ক’রে মারলে এক চড় নরেনের গালে। বহুদিনের বহু সঞ্চিত ক্ষোভ, স্বামীর অমানুষিক আচরণের জন্য সমস্ত তিক্ততা ওর অন্তরে যা জমেছিল এতকাল তা যেন ঐ চড়ের শক্তি ও প্রেরণা যোগাল ওকে নিজের অজ্ঞাতসারে, সম্পূর্ণ অতির্কিতে। এ ঘটনার পূর্বমূহূর্তেও এ ছিল ওর ধারণার অতীত, পরেও বহুক্ষণ পর্যন্ত রইল তা বিশ্বাসের বাইরে। জ্যেষ্ঠ এবং একমাত্র পুত্রসন্তানের নামে, মিথ্যা দিব্যি গালাতেই ওর এতকালের সঞ্চিত চিত্তক্ষোভের বারুদে অগ্নিসংযোগ হয়ে গেল। এ বোধহয় পৃথিবীর সমস্ত মায়েরই সহ্যের বাইরে।

যাই হোক চড় মেরেও দু’তিন মুহূর্ত ব্যাপারটা মনের মধ্যে ধারণা ক’রে নিতে দেরি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারপরই শ্যামা মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে টাকাগুলো কুড়িয়ে নিতে শুরু করলে। মোট যতটা পাওয়া গেল একত্রিশটা টাকা। অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে দেখলে আরও, তক্তোপোশের নিচে, বাক্সের পাশে

একত্রিশ টাকা একসঙ্গে পাওয়াই ওর কাছে অবিশ্বাস্য!

আর পাওয়া গেল না।

নরেন কিন্তু বেশি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটায়। সত্যিই যে শ্যামা কোনদিন ওর গায়ে হাত তুলবে এ সে কল্পনাও করতে পারে নি। ওর কেমন একটা ভয় হয়ে গেল নইলে তখনও হয়ত কাড়াকাড়ি করে কয়েকটা টাকা বাঁচানো চলত। কিন্তু সে চেষ্টাও সে করলে না তেমনি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে, শ্যামা মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে টাকাগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে তুলে নিলে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে মঙ্গলার সামনে এসে বসে পড়ে কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললে, ‘দেখলেন! দেখলেন হারামজাদীর কান্ডটা দেখলেন? আমার গালে পাঁচ আঙুলের দাগ পড়ে গেছে একেবারে। জ্বালা করছে আমার গালটা।’

মঙ্গলা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘তোমার যা কেলেঙ্কার ঠাকুর, আর ব’লো না! নিজের মেয়ের বে কুড়িটা টাকা চেয়েছিল, সহমানে দিয়ে দিলেই হ’ত তা নয় আবার ছেলেটার নাম ক’রে মিথ্যে দিব্যি গালা! গলায় দড়িও জোটে না! দড়ি না জোটে ঐ পৈতেগাছটা ত আছে, আর আমি কলসী দিচ্ছি, গলায় বেঁধে পুকুরে গিয়ে ওলো গে।… লজ্জা করে না আবার নাকে কাঁদতে! বেশ করেছে মেরেছে। আমরা হ’লে অমন ভাতারের পাতে আকার ছাই বেড়ে দিতুম।’

টাকার শোকে সেদিন নরেন রাত্রে খেলে না পরের দিন যেন কতকটা প্রতিশোধ নেবার অভিপ্রায়েই আবার ডুব মারলে বাড়ি থেকে। শ্যামা যতটা সম্ভব চোখে

১৩৭

চোখে রেখেছিল বলে আর কিছু নিতে পারে নি, শুধু একখানা কোরা কাপড় কি ক’রে চাদরের মধ্যে লুকিয়ে নিয়েছিল ওরা কেউ টের পায়নি। খোঁজ ক’রে যখন পাওয়া গেল না তখন সকলেই ব্যাপারটা অনুমান করলে। মঙ্গলা সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘তা বাপু একত্রিশটা টাকার বদলে না হয় গেলই একখানা তের আনা দামের বিলিতি কাপড়! আর সত্যি, ওরও ত কিছু চাই!’

দুই

মহাশ্বেতার কাছে সবটাই পুতুল খেলা। বরং যে দারিদ্র্যের মধ্যে, যে একান্ত অভাবের মধ্যে সে মানুষ হয়েছে সে অভিজ্ঞতার কাছে এই সত্যিকারের বিয়ের উদ্যোগ-আয়োজন যেন রূপকথার রাজ্যের মতই অবিশ্বাস্য এবং স্বপ্নের দেশেরই সূচনা বহন করে ওর মনের মধ্যে। শ্বশুরবাড়ি হয়ত ততটা খারাপ জায়গা নয়, ওকে ক্ষ্যাপাবার জন্যে পিঁকীরা যেমন বর্ণনা করে! আর বর, সেই-বা না জানি কেমন! সত্যিই কি রাজপুত্তুরের মত হবে সে? কিন্তু তাই বা ঠিক কি রকম? মঙ্গলার এক বুড়ী ননদ কোন কোন দিন সরকারবাড়ির ছেলেমেয়েদের নিয়ে রূপকথার গল্প বলতে বসত– মহাশ্বেতাও বহুদিন গিয়ে বসেছে সে দলে। রূপকথার রাজপুত্র, কেবলই সে রাক্ষস মেরে রাজকন্যাদের উদ্ধার করে তারই একটা ধারণা করবার চেষ্টা করত মনের মধ্যে। জিজ্ঞাসাও করত এক-একবার, ‘হ্যাঁ দিমা

রাজপুত্তুর কেমন?’ বুড়ী

চোখ বড় বড় করে বলত, ‘ওমা তা জানিস্ না? এই ফরসা রং তোর মার মত পটোল-চেরা চোখ’ টিকোলো নাক, কাত্তিকের মত ফুরফুরে গোঁফ এই ঠাকরুণ পিতিমের কাত্তিক ঠাকুরের মত আর কি কতকটা! ব’লে শেষকরতেন। দুর্গা তাঁর শাশুড়ীর নাম। তাই ঠাকরুণ বলতেন। এমন কি সকালে উঠে রোজই বলতেন, ঠাকরুণ দুর্গাতিনাশিনী মা গো!’

মহাশ্বেতা কার্তিককে ভাববার চেষ্টা করে ওর বর। ভাল লাগে না। ও কি খেলাঘরের পুতুলের মত ছোট্ট একরত্তি –বাবরি চুল! না, অমনই যদি রাজপুত্তুর হয় ত চাই নে ওর রাজপুত্তুরের মত বর! অবশ্য রাজপুত্তুরের মত কেন হবে ওর বর এ প্রশ্নটা একবারও মনে জাগে না। সেই প্রথম দিন সরকার দিদ্‌মা ওর মাকে বলেছিলেন, রাজপুত্তুরের মত ছেলে– সেই কথাটাই ওর মনে বাসা বেঁধেছে বোধ হয়।

অবশেষে বিয়ের দিন এল।

বর এসে পৌঁছতেই বরের উত্তরীয় চেয়ে এনে পিঁড়ির ওপর পেতে ওকে বসিয়ে দিলে সবাই। পিঁকী চোখ রাঙিয়ে বললে, ‘খবরদার, এক পা নড়বি নি এখান থেকে, উঠতে নেই! একেবারে সাতপাক ঘোরাতে নিয়ে যাবে পিঁড়িসুদ্দু!’

কিন্তু মহাশ্বেতা বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলে না। সরকারদের বৈঠক-খানা ঘরে বর এসে বসেছে মেয়েরা সব গেছে ভিড় ক’রে দেখতে আড়াল থেকে। ওর কাছে কেউ নেই যে ঘরে ও বসেছিল সে ঘরে আছে শুধু গুটি-দুই ঘুমন্ত শিশু। কৌতূহলে স্থির থাকতে না পেরে একসময় এদিক-ও দিক চেয়ে মহাশ্বেতাও বরের উত্তরীয়খানা

১৩৮

কুড়িয়ে বুকে ক’রে নিয়ে ছুটল যথাসম্ভব নিঃশব্দ গতিতে। যেদিক দিয়ে সবাই দেখছে বাইরে দিয়ে যাবার ত উপায়ই নেই –থৈ থৈ করছে

সেদিক দিয়ে গেলে চলবে না

_

পুরুষ। দ্রুত ভেবে নিলে সে ছুটতে ছুটতেই –ওপাশে পিঁকীদের ঘরের দিকে একটা সেখান থেকে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ এখানে

ছোট জানলা আছে ঘুলঘুলির মত

ভিড় সত্যিই কম, একটা-দুটো ছোট ছেলে, তাদের ঠেলেঠুলে সরিয়ে মহাশ্বেতা উঁকি মেরে দেখলে। সবটা না হোক পাশটা দেখা যাবে। হ্যাঁ, লম্বাচওড়া জোয়ান বটে,

রংটাও খুব ফরসা, কিন্তু ওমা, এ কি এক গাল কালো আর ঘন দাড়ি যে! গোঁফদাড়িতে মুখখানা একেবারে

। এ আবার কি!

মহাশ্বেতা ক্ষুণ্ণ হয় একটু। অবাকও হয়। জ্ঞান হবার পর যে তিনচারটে বিয়ে ও পাড়ায় দেখেছে, তার কোন বরই ত এমন দাড়ি নিয়ে বিয়ে করতে আসে নি! প্রতিমার কার্তিকের মত যে নয় তাতে ও খুশী বটে, তা বলে এমনি চোয়াড় হবে! অক্ষয়বাবুর অফিসের যে ভোজপুরী দারোয়ান আসে তার কতকটা এমনি দাড়ি আছে। তবু দাড়ি দুদিকে ভাঁজ করা, কেমন কানের সঙ্গে বাঁধা –এমন জংলী দাড়ি ত নয়!

দেখছে অবাক হয়েই দেখছে মহাশ্বেতা

ধরলে। চমকে চেয়ে দেখে পিঁকী।

তার

পেছন থেকে কে এসে কান

পৈ পৈ ক’রে না বারণ করে এলুম! সেই অলুক্ষুণে কাণ্ড করা হ’ল! উঠতে নেই একে পিঁড়ি থেকে তায় শুভদৃষ্টির আগে বর দেখা! একরত্তি মেয়ে ভেতরে ভেতরে পেকে উঠেছ! আর তর সইছে না দুটো ঘণ্টা! বর দেখা হচ্ছে লুকিয়ে লুকিয়ে!’

চাপা গলায় গজরাতে থাকে সে। শ্যামা ত ছুটে এসে একটা চড় ই কষিয়ে দিলে। মঙ্গলা হাঁ হাঁ ক’রে উঠলেন, ‘করিস্ কি, করিস্ কি, আজকের দিনে!’

শ্যামা বললে, ‘দেখুন দিকি, শুভদৃষ্টির আগেই বর দেখে নিলে, যদি ভালমন্দ কিছু হয়? যত সব অলুক্ষণে কাণ্ড!’

‘ওলো শুভদৃষ্টি ত আর হয় নি। বর ত অন্য দিকে চেয়ে ছিল। নে, আর মনখারাপ করিস নি।’

অপমানে আর অভিমানে মহাশ্বেতার চোখে জল এসে গিয়েছিল। তাই সত্যি যখন শুভদৃষ্টির সময় এল তখন সে চোখ বুজে বসে রইল জোর ক’রে। অনুরোধ, অনুনয়, ধমক

কিছুতেই আর চোখ খুলতে পারে না। শেষকালে অক্ষয়বাবু এসে আদর ক’রে মুখখানা তুলে ধরে যখন বললেন, ‘একবার চোখ চাও ত দিদি, এ-ই, বা! বেশ হয়েছে। দেখো ভালো ক’রে!’ তখন কোনমতে এক লহমার জন্যে চোখ খুলেই আবার বুজে নিলে। তাতে শুধু ওর চোখে পড়ল, ঈষৎ পিঙ্গল একজোড়া চোখের গভীর স্থির দৃষ্টি।

ওর যেন কেমন ভয় করতে লাগল।

তিন

ওমা এ কি ছিরির শ্বশুরবাড়ি! পালকি থেকে নেমে মাথা হেঁট ক’রে থাকলেও, আড়ে এক ঝলক দেখে নিয়েছে মহাশ্বেতা। বিরাট ঝুপসী বাগান, উঠোনে প্রকান্ড একটা

১৩৯

কাঁঠাল গাছ সেই দিনের আলোতেই যেন অন্ধকার ক’রে রেখেছে আর তার মধ্যে জরাজীর্ণ স্যাঁতসেঁতে একটি নিচু নিচু পুরোনো ঘর। এই নাকি একটিই ঘর। পাশেও একটা ঘর আছে,তার ছাদের খানিকটা ভেঙে পড়ে গেছে, সেখানে আবার গোলপাতা দেওয়া ছাউনি খানিকটা। যত দুঃখেই পদ্মগ্রামে থাক্ ওরা, ভাল পাকা ঘরে থাকে, পোতা উঁচু ঘর, খটখট্ করছে শুকনো। এইখানে থাকতে হবে ওকে, সা-রা-জী-ব-ন!

শাশুড়ী অবশ্য মন্দ মানুষ নন। ছোটখাটো একরত্তি মানুষটি। ঠাণ্ডা ঠান্ডা কথাবার্তা। কোলে ক’রেই নামালেন পালকি থেকে। বরণের পরে ঘরে এনে বসিয়ে বললেন, ‘পুরোনো বাড়ি দেখে ঘেন্না ক’রো না মা এ তোমার শ্বশুরের ভিটে। তোমার পয়ে এইখানেই একদিন রাজ অট্টালিকা উঠবে দেখে নিও।’

কুশণ্ডিকার হাঙ্গামা চুকল বেলা তিনটে নাগাদ। ক্ষুধাতৃষ্ণায় মহাশ্বেতা তখন নেতিয়ে পড়েছে। তবু একটা জিনিস এরই মধ্যে সে লক্ষ্য করেছে যে, কুশন্ডিকার শেষের দিকে সে প্রায় টলে টলে পড়ে যাচ্ছিল কিন্তু যতবারই মাথা ঘুরেছে ততবারই বর আগে থেকে যেন বুঝে নিয়ে কোনমতে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে ওকে টেকনো দিয়ে সামলে নিয়েছে। খুব লক্ষ্য আছে কিন্তু লোকটার।

জলখাবার এল দুটো নারকেল নাড়ু আর দুখানা জিলিপি। কে তাই দেখে তাড়াতাড়ি গিয়ে একটু আখের গুড় গুলে শরবৎ ক’রে দিলে। কিন্তু তা-ই তখন অমৃত মহাশ্বেতার কাছে। কনেকে যে প্রায় কিছুই খেতে নেই, একটু শুধু ভেঙে মুখে দিতে হয় তা তখন সে ভুলেই গেছে।

জল খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে বসতে আশেপাশে যারা ভিড় ক’রে ঘিরে ছিল তাদেরও দেখবার সুযোগ পেলে মহাশ্বেতা। মানুষগুলোও যেন কি রকম কি রকম এখানকার। জ্ঞান হয়ে পর্যন্ত মহাশ্বেতার জগৎ দুটি বাড়িতে সীমাবদ্ধ। এক কলকাতায় দিদিমার বাড়ি, আর এক পদ্মগ্রামে সরকার বাড়ি। দিদিমার বাড়ির যে দুটি-তিনটি মানুষ তাদের শিক্ষাদীক্ষা সভ্যতার পরিমাণ বোঝার মত বয়স ওর হয় নি বটে কিন্তু সবটার ছাপ পড়েছে ওর মনে ঠিকই। সরকার বাড়িরও চালচলনে বিশেষত বেশভূষায় কলকাতার ছোঁয়া আছে। কিন্তু এখানকার মানুষগুলো যেন সে-সব থেকে একেবারে আলাদা। যেমন মলিন ও দীন পোশাক, তেমনি কথাবার্তার ধরন। পুরুষদের হাঁটুর ওপর কাপড়, খালি পা, কাঁধে হয় একটা গামছা নয়ত কতদিনের ছেঁড়া পুরোনো কোট। ওর দুটি দেবর এবং দুটি ননদ। বড় ননদটির বিয়ে হয়েছে বারো তের বছরের মেয়ে, প্রকান্ড একটা নথ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে মুরুব্বীর মত। তবু তারই একটু ফরসা কাপড় চোপড়, দেওর দুটির একটি বছর এগারো, একটি পাঁচ-কারও গায়েই জামা নেই। এই বিয়েবাড়িতেও তারা খাটো খাটো ময়লা ধুতি পরে খালি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর তেমনি কি পাকা পাকা কথাবার্তা! মহাশ্বেতার মন বিরূপ হয়ে ওঠে

I

বরটাও যেন কেমন কেমন। যতক্ষণ চেলির জোড় ছিল ততক্ষণ এক রকম। ব্যস্, এখনই একটা মোটা চটের মত কোরা কাপড় পরে প্রকান্ড প্রকান্ড কাঠের গুঁড়ি চেলা করতে লেগে গেছে। কাল যজ্ঞি হবে তারই কাঠ। তবু কি ভাগ্যি একেবারে খালিগায়ে নেই একটা ফতুয়া আছে গায়ে।

380

কিন্তু লোকটার খুব রং বাপু যাই বলো। মনে মনে স্বীকার করে মহাশ্বেতা। ওর চাইতে অনেক বেশি ফরসা। পরিশ্রমে কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। আর মুখখানা হয়ে উঠেছে লাল মহাশ্বেতার মনে হ’ল ঘাম নয়, সকালে যে দুধে-আলতায় দাঁড়িয়েছিল, সেই দুধে-আলতাই ওর মুখে কে ছড়িয়ে দিয়েছে। অত দাড়ি যদি না থাকত ত বেশ হ’ত!

শ্যামা ফুলশয্যার তত্ত্ব পাঠিয়েছিল ভালই। সবাই সুখ্যাতি করতে লাগল।

দশ টাকার বেশি খরচ হয় নি বটে কিন্তু নিজের কায়িক পরিশ্রমে অনেক পুষিয়ে দিয়েছে সে। দু থালা চন্দ্রপুলি, এক থালা ক্ষীরের ছাঁচ–আর এক থালায় জলখাবারের কচুরি, সিঙাড়া, সন্দেশ, পাণ্ডুয়া সব নিজে করেছে শ্যামা। জামাইয়ের ধুতি-চাদর, মেয়ের লালপাড় শাড়ি, ফুলের থালা, মালাচন্দন, ক্ষীর-মুড়কির বাটি কিছুই ভুল হয় নি। মায় একটি ছোট ডালায় অল্প একটু ঘি-ময়দা, সামান্য আনাজ চিনি মিছরি পর্যন্ত সাজিয়ে দিয়েছে। সকলেই স্বীকার করলে এ গ্রামে এমন ফুলশয্যার তত্ত্ব, আর কখনও আসে নি।

বৌভাতের যজ্ঞি দুপুরেই মিটে গিয়েছিল–। যজ্ঞি ত কত

‘ভেতো যজ্ঞি’ ভাত, ডাল, ছ্যাঁচড়া, মাছের ঝোল, অম্বল শেষ পাতে দই জিলিপি। মহাশ্বেতার চোখে জল এসে গিয়েছিল অত ভাল ক’রে বিয়ে হল তার, আর বৌভাতে এই খাওয়া! তেমনি অবশ্য নিমন্ত্রিতরাও মুখদেখানি পাওয়া গেল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিকি আর দুয়ানি কেবল কে এক এদের আত্মীয় . কলকাতার লোক, সে-ই যা গোটা একটা টাকা দিয়ে গেল। আর হেম এসেছিল কন্যাপক্ষের হয়ে নিমন্ত্রণ রাখতে, সে দিয়ে গেল একটা আধুলি রাজবাড়ির সরকার একটি ছোট ছেলে সঙ্গে ক’রে এসে নিমন্ত্রণ রেখে গেলেন তিনি দিলেন সব চেয়ে বেশি পাঁচ-পাঁচটা টাকা।

তবু সব গুণে-গেঁথে মন্দ দাঁড়াল না। মহাশ্বেতার সামনেই শাশুড়ী গুণে বাক্সতে তুললেন, সাতাশ টাকা প্ৰায়।

বৌভাতের ঝঞ্ঝাট সকাল ক’রে মিটে গিয়েছিল বলেই ফুলশয্যাও সকাল ক’রে হ’ল। মেয়েরা সকলেই ক্লান্ত, জা-দেইজীরা বাড়ি যাবার জন্য ব্যস্ত কোনমতে অনুষ্ঠান সেরে সকলেই চলে গেলেন। মহাশ্বেতাও বাঁচল, সারাদিন কাঠের পুতুলের মত কনে সেজে বসে থেকে আর অবেলায় ভাত খেয়ে তার দু’চোখের পাতাতে টান ধরেছে, সে তখন একটু ঘুমোতে পারলে বাঁচে।

কিন্তু সত্যি-সত্যিই যখন মেয়েরা অনুষ্ঠান শেষ ক’রে ওদের শুয়েই রেখে বেরিয়ে গেল তখন আর যেন কিছুতেই ওর ঘুম এল না।

সেই একমাত্র পাকা ঘরখানিতেই ওদের ফুলশয্যার আয়োজন হয়েছে। পুরোনো কাঁঠাল তক্তপোশে পাতলা বিছানা। খানকতক ছেঁড়া কাঁথার ওপর বোধ হয় একটা সাদা চাদর পাতা। টিম টিম ক’রে রেড়ির তেলের পিদিম জ্বলছে এক পাশে, বাতাসে তার শিখাটা কাঁপছে আর সেই সঙ্গে কাঁপছে পূবদিকের দেওয়ালে ভাঙা তোরঙ্গটার ছায়া। পুরোনো ছাদের কড়ি-বরগায় আলকাতরা মাখানো, দেওয়ালে চুনবালি নেই

অনেক জায়গাতেই। কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গন্ধ। তবু মহাশ্বেতা একপাশ ফিরে সেই ঘরেরই খুঁটিনাটি দেখতে লাগল চেয়ে চেয়ে। ঘুমে চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে এসেছে, ব্যথা করছে দুটো চোখ–তবু যেন ঘুম আসে না। পাশে যে মানুষটা শুয়ে আছে, তার সম্বন্ধে কৌতূহলই যেন সব চেয়ে উগ্র। ভয় হচ্ছে খুব শুয়ে শুয়েই বেশ টের পাচ্ছে পা-দুটো কাঁপছে সামান্য সামান্য। হাতের মুটোয় ঘাম। ভয় অথচ কৌতূহলেরও যেন সীমা নেই।

ঘরের বাইরে খখস্ শব্দ বোধ হয় কেউ আড়ি পেতেছে। তা পাতুক। কি লাভ আড়ি পেতে তা বোঝে না মহাশ্বেতা। ওর শুধু হাসি পায়। হেসেই ফেলত যদি না

ঐ লোকটা ঠিক পেছনে গায়ের কাছে শুয়ে থাকত।

একটু উসখুস করতেই বর লোকটি ওর কানের কাছে মুখ এন খুব কোমল, খুব সম্মেহ কণ্ঠে বললে, ‘কি, ঘুম পাচ্ছে না? একটু জল খাবে?’

সাগ্রহে ঘাড় নাড়ে মহাশ্বেতা। সত্যিই ত, তেষ্টাই ত ওর পেয়েছে বুঝতে পেরেছে ত!

লোকটা ঠিক

বর যথাসম্ভব নিঃশব্দে উঠে পেতলের একটা চুমকি ঘটিতে ক’রে জল এনে দিলে। মহাশ্বেতা উঠে বসে জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল।

তারপর কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। বাইরের খস্থসানি একটু থামতে বর ওকে টেনে খানিকটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বললে, ‘ঘুম না হয় ত একটু গল্প করো না।’

চুপিচুপি যে বরের সঙ্গে কথা কইতে হয় তা কেউ না বললেও মহাশ্বেতা কেমন ক’রে বুঝেছে। সে ফিসফিস ক’রেই বললে, ‘কি গল্প করব?’

‘যা খুশি।’

একটু পরে মহাশ্বেতা বললে, ‘তুমি দাড়ি কামাও না কেন? সরকার দাদুদের বাড়ি, আমাদের পাড়ায় সবাই ত দাড়ি কামায়। বুড়ো হলে তবে দাড়ি রাখে।

বর বললে, ‘খরচে কুলোয় না।’

‘খরচা হয় নাকি দাড়ি কামাতে?’

‘হ্যাঁ, এক পয়সা ক’রে নেয় নাপিত। মাসে দু আনা।’

‘ভারি ত খরচ!’ ঠোঁট উলটে বলে মহাশ্বেতা।

1

বর একটু গম্ভীরভাবে বলে, ‘আমি মাইনে পাই মোটে উনিশ টাকা। পাঁচটি লোক খেতে, বোনের বিয়ে দিয়েছি। তুমি এলে, ছ’জন হল। এ আয়ে কি কুলোয়? বাড়িঘর তুলতে হবে ত? আর দাড়ি রাখলেই বা মন্দ কি?’

কেন?

‘না, মন্দ আর কি!’ মুরুব্বীর মত বলে মহাশ্বেতা।

খানিক পরে হঠাৎ সে-ই আবার প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, চোর কেমন দেখতে হয়?’ তা ত জানি নি। মানুষের মতই দেখতে হয় বোধ হয়।

একটু অপ্রতিভ হয়ে মহাশ্বেতা বলে, ‘না, ঐ যে মালার চোপড় আছে কিনা দেখে শুতে –চোরে না নিয়ে যায়

তা হঠাৎ চোরের কথা

লেন, বাইরে কাপড়- আসে বুঝি এখানে?’

‘না। আমাদের কীই বা আছে যে চোরে নিয়ে যাবে!’

তারপর আর কি প্রসঙ্গ তুলবে ভেবে পায় না মহাশ্বেতা। ও লোকটাও ত কিছু কিছু বললে পারে! নিজে বেশ চুপ ক’রে শুয়ে আছে।… যত দায় যেন মহাশ্বেতারই। ‘গল্প করো না!’ বা-রে! বেশ লোক ত!

অনেক ভেবে-চিন্তে একসময়ে মহাশ্বেতা প্রশ্ন ক’রে বসে, ‘তোমাদের বাড়িতে পুঁই

গাছ আছে?’

একটু হেসে বর বললেন, ‘আছে। কেন? তুমি বুঝি পুঁই খুব ভালবাস?’

কিন্তু ততক্ষণে বাইরে উচ্চ হাসির রোল উঠেছে। বোঝা গেল আড়ি পাতবার লোক তখনও অপেক্ষা করছিল, কেউ শুতে যায় নি। মহাশ্বেতা আরও বুঝতে পারলে যে সে বিষম বোকার মত একটা কিছু কথা বলে ফেলেছে। তাই সে যৎপরোনাস্তি অপ্রস্তুত হয়ে ওপাশ ফিরে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইল বরের কথার উত্তর দিলে না।

পিদিমের শিখাটা কাঁপছে আর তার সঙ্গে কাঁপছে উপরি উপরি রাখা দুটো তোরঙ্গের ছায়া পূর্বদিকের দেওয়ালে। একটি চোখ ঈষৎ ফাঁক ক’রে সেই দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল মহাশ্বেতা।

-১৪৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *